কোনো কোনো আন্দোলন কীভাবে মৃদু নিম্নচাপ থেকে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়ে রাজনৈতিক বিন্যাস পাল্টে দিতে পারে তা প্রত্যক্ষ করেছিল এই পশ্চিমবঙ্গ দেড় দশক আগে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে জোর করে কৃষিজমি দখলের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠা কৃষকদের সমবেত প্রতিরোধে, সমাজের অন্য বর্গের লোকেরা বাধ্য হয়েছিল তার পাশে দাঁড়াতে। গত ১১ বছর ধরে তৃণমূল ক়ংগ্রেস সারা রাজ্যে গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে বিধানসভা হয়ে লোকসভা পর্যন্ত, জোর করে লোভ দেখিয়ে গাঁজা কেসের ভয় দেখিয়ে পুলিশ লেলিয়ে নিজেদের নিরঙ্কুশ করে তুলেছে; তোলাবাজি, সিণ্ডিকেটরাজ, দুর্নীতি, ঘুষকে প্রসারিত করেছে নির্মাণ, ব্যবসা, নিয়োগ, আবাস যোজনা, লক্ষী ভান্ডার, বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা সর্বত্র। কলেজের ছাত্রনেতা থেকে শিক্ষামন্ত্রী পর্যন্ত সকলেই ভেবেছিলেন এমনভাবেই দিন কেটে যাবে। কিন্তু শিক্ষক পদে কর্মপ্রার্থী যুবকরা সমাজের অন্যতম প্রকৃত শিক্ষক হয়ে নিয়োগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে এমন এক আন্দোলন গড়ে তুললেন যে তা ওই ‘সর্বশক্তিমান’ তৃণমূল কংগ্রসের ভিতকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যে আন্দোলন ছিল চারাগাছ আজ তা মহীরূহে পরিণত হয়ে সমাজের বহু গণতন্ত্রপ্রিয় নাগরিকের কাছে আশার আলো দেখাচ্ছে।
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে তৎকালীন আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয়। স্বচ্ছ নিয়োগ সংক্রান্ত কোনো প্রতিশ্রুতি পালিত না হওয়ার কারণে প্রায় সাড়ে পাঁচশ দিন ধরে ক্রমান্বয়ে অবস্থান করছে সহস্রাধিক বঞ্চিত নিয়োগপ্রার্থী। আন্দোলনকারীরা একদিকে যথাবিহিত নিয়োগের দাবিতে অবস্থান অনশন করছে, অন্যদিকে বেআইনি নিয়োগের বিরুদ্ধে আদালতে গিয়েছে। আদালতের নির্দেশে বেশ কিছু বেআইনিভাবে নিযুক্ত শিক্ষকের চাকরি গিয়েছে। পরিবর্তে চাকরি পেয়েছে তালিকায় থাকা দুজন।
শিক্ষক নিয়োগের বিধিনিষেধ, যা মূলত এনসিইআরটি (জাতীয় শিক্ষা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ পর্ষদ) দ্বারা প্রণীত, তার মধ্যেই যথেষ্ট গলদ রয়েছে। শিক্ষা প্রশিক্ষণের সরকারী প্রতিষ্ঠান অত্যন্ত কম রয়েছে, কিন্তু বিদ্যালয়ে শিক্ষক হতে গেলে মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের জন্য বিএড ও প্রাথমিকের জন্য ডিএড উত্তীর্ণ হওয়া আবশ্যিক করা হয়েছে। ফলে ব্যাঙের ছাতার মতো শিক্ষা প্রশিক্ষণের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গজিয়ে উঠেছে, মুনাফা করা হচ্ছে ট্রাস্টের নামে। ওই প্রতিষ্ঠানগুলি পাঠরত ছাত্রীছাত্রদের শিক্ষকতায় নিয়োগের জন্য প্রভাব বিস্তার করছে, উৎকোচের বিনিময়ে, যে অর্থ ছাত্রদের কাছ থেকেই আদায় করা হচ্ছে। শিক্ষা প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন থেকেই টাকার খেলা শুরু হচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রতিক কালে শিক্ষক নিয়োগের যে পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে সেটিই জানিয়ে দিচ্ছে যে নিয়োগে অনিয়ম হয়েছে ও অস্বচ্ছভাবে নিয়োগের বন্দোবস্ত করে টাকার বিনিময়ে নিয়োগের উপায় করে দেওয়া হয়েছে। সাধারণভাবে নিয়োগের পরীক্ষা দেওয়ার পরে ফলাফল ঘোষিত হবে ও প্রত্যেক পরীক্ষার্থী তার প্রাপ্ত নম্বর ও তালিকার ক্রমিক সংখ্যা জানতে পারবেন। এটাই স্বচ্ছতা। ২০১৬ সালে ডিসেম্বর মাসে হওয়া স্কুল সার্ভিস কমিশনের নবম-দশম ও একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীতে শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষার পরীক্ষার্থীদের তেমন কোনো ফল প্রকাশিত হয়নি। প্রথমে কাগজপত্র (ডকুমেন্টস) যাচাই করার জন্য একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়, যেখানে পরীক্ষার্থী অনলাইনে নিজের দরখাস্ত সংক্রান্ত কিছু তথ্য দিয়ে জানতে পারেন যে তিনি ওই ডকুমেন্টস যাচাইযোগ্যতা অতিক্রম করেছেন কিনা। অন্য কে বা কার অতিক্রম করেছেন তা জানা যায় না। প্রথম পর্যায়ের যাচাই সম্পূর্ণ হওয়ার পরে একইভাবে দ্বিতীয় পর্যায়, সেটির পরে তৃতীয় পর্যায়ের যাচাই সংক্রান্ত তথ্য একইভাবে পাওয়া যায়।
যাচাই পর্বের পরে নিয়োগের চূড়ান্ত ফল প্রকাশের সময়েও কোনো তালিকা প্রকাশিত হয় না। যাচাই করা পরীক্ষার্থীরা নিজেদের দরখাস্ত সংক্রান্ত তথ্য দিয়ে জানতে পারেন যে তিনি প্যানেলে বা অপেক্ষমান তালিকায় আছেন কিনা। ১৯ জন পরীক্ষার্থী আদালতে মামলা করলে মাননীয় বিচারপতি শেখর ববি সরাফ তালিকা প্রকাশের নির্দেশ দেন। তালিকা প্রকাশ করা হয়, নির্বাচিতদের ও অপেক্ষমানদের প্যানেল। ওই তালিকাতেও কোনো প্রাপ্ত নম্বরের অস্তিত্ব থাকে না। বহুক্ষেত্রে একই নাম প্যানেলের তিন চার স্থানে থাকে; যেমন, কোনো মহিলা পরীক্ষার্থীর নাম সাধারণ মহিলা, সাধারণ মহিলা ও পুরুষ, তফশিলী জাতি মহিলা এবং তফশিলী জাতি মহিলা ও পুরুষ এই চারটি স্থানেই হয়তো থেকেছে। ফলে তাঁকে নিয়োগের পরে তিনটি স্থান খালি থেকেছে। সেই নিয়োগের জন্য আবার অপেক্ষমানদের থেকে তালিকা প্রকাশ পাওয়ার পরে নতুন অপেক্ষমান তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। এমনও হয়েছে যে নতুন তালিকায় পুরোনো অপেক্ষমানদের টপকে আগে অপেক্ষমান তালিকায় না থাকা প্রার্থীর নামও চলে এসেছে। অমনটাই হয়েছিল মন্ত্রী পরেশ অধিকারীর মেয়ে অঙ্কিতা অধিকারীর ক্ষেত্রে। তাঁর চাকরি গিয়েছে। অন্য আরেকজন প্রার্থী ইনসান আলিরও চাকরি গিয়েছে। কিন্তু যেটা ঘটেছে তা অদ্ভুত। ইনসান আলি ওবিসি শ্রেণীতে একজনকে টপকে চাকরি পেয়েছিলেন। তাই তাঁর চাকরি গেছে। কিন্তু তাঁর মোট প্রাপ্ত নম্বর সাধারণ শ্রেণীতে নিয়োজিত শেষ নম্বরের থেকে বেশি। ফলে তিনি সেই চাকরি পাওযার যোগ্য। এখানে যে মোট প্রাপ্ত নম্বরের কথা বলা হচ্ছে তা জানা গিয়েছে আদালতের নির্দেশে সমস্ত এমপ্যানেলড ও অপেক্ষমান প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশের পরে। ওই তালিকা প্রকাশের পরেও কতজন বেআইনি ভাবে নিযুক্ত তা জানা যাচ্ছে না, কারণ কারা প্যানেলের বাইরে থেকে নিযুক্ত হয়েছেন তা খোঁজা সমস্যাজনক। আন্দোলনরত প্রার্থীরা বিভিন্ন সূত্র থেকে বা আরটিআইএর মাধ্যমে বিদ্যালয় থেকে নবনিযুক্তদের নাম জানতে ও প্রকাশিত প্যানেলের সঙ্গে মিলিয়ে প্যানেল বহির্ভুত বা ক্রম টপকানোদের চিহ্নিত করতে পারছেন। প্রাপ্ত নম্বরযুক্ত তালিকা প্রকাশের পরে দেখা যায় অনেকে শিক্ষাগত যোগ্যতার ও পরীক্ষার মাপকাঠিতে প্রথম পর্যায়ে ডাক পাওয়া প্রার্থীর থেকে বেশি নম্বর থাকা সত্বেও সেই পর্যায়ে যাচাইএর জন্য ডাক পাননি। কয়েকটি ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে প্রার্থী আরটিআই করে নিজের প্রাপ্ত নম্বর যেটা জেনেছিলেন (সাক্ষাতকারে বা পরীক্ষায়) তার থেকে প্রকাশিত তালিকায় প্রাপ্ত নম্বর পৃথক। ফলে পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়াটিই প্রশ্নের সম্মুখীন।
এই যে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে হইচই তা পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া সরকারি স্তরে সমস্ত নিয়োগের সামনেই এক বিরাট প্রশ্নচিহ্ন দাঁড় করিয়েছে। প্রশ্নটা যতটা না যোগ্য বা অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগের তার থেকে অনেক বেশি অসৎ, নিয়োগের শুরুতেই দুর্নীতিগ্রস্ত শিক্ষকের; আরো বড় প্রশ্ন শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বাঙ্গীণ দুর্নীতির। গ্রাম-ব্লক-মহকুমা-জেলা-শহর-কলকাতা জুড়ে দুর্নীতির এই বৃহৎ শৃঙ্খল সাজিয়ে তুলে নিয়োগে উৎকোচ থেকে সমস্ত সরকারি প্রকল্পের ক্ষেত্রে তোলাবাজির নরক তৈরি করেছে শাসক দলের গুন্ডাবাহিনী।
বড় প্রশ্ন হচ্ছে আন্দোলনরত প্রার্থীদের যথাবিহিত চাকরির। একদিকে বেআইনিভাবে নিযুক্ত প্যানেল বহির্ভুত বা প্যানেল টপকানো প্রার্থীদের খুঁজে বের করে তাদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে হবে; এবং দুর্নীতি উৎকোচের সঙ্গে যুক্ত সমস্ত তৃণমূল ও বেশ কিছু তৃণমূল থেকে বিজেপিতে রূপান্তরিত নেতাদের উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে। অপরদিকে যেহেতু পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়াটিই চরম অস্বচ্ছ, তাই সমস্ত আন্দোলনরত অপেক্ষমান প্রার্থীদের নিয়োগ করতেই হবে। তার জন্য অতিরিক্ত শিক্ষক পদ তৈরি করতে হবে। পশ্চিমবঙ্গে বিদ্যালয়স্তরে শিক্ষাকে উপযুক্ত মানে পৌঁছতে গেলে বহু শিক্ষকের পদ সৃষ্টি করা অবশ্য প্রয়োজনীয়। তাই, গত ২০১৬ থেকে প্রতীক্ষায় থাকা, গত ২০১৮ সাল থেকে আদালতে মামলা করা, ধর্মতলায়, বিধাননগরের বিকাশ ভবনে বা সেন্ট্রাল পার্কের সামনে অনশন অবস্থান করা যথাবিহিত প্যানেলে থাকা সমস্ত প্রার্থীদের চাকরি দেওয়া রাজ্য সরকারের অবশ্য কর্তব্য।
সাধারণভাবে আন্দোলনের ফলে নিয়োজিত প্রার্থীদের অনেকেই মনে করবেন যে ওই নিয়োগের জন্য আন্দোলনের ভূমিকা নগণ্য, কিন্তু সেইসব নবনিযুক্ত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মনে রাখতে হবে যদি এই ধারাবাহিক আন্দোলন না হোত তাহলে টেবিলের তলায় লেনদেনের মাধ্যমেই চাকরি নিয়ম হয়ে দাঁড়াতো। ভবিষ্যতের সরকারি পদে বিধিসম্মত নিয়োগের ক্ষেত্রেও শিক্ষক পদপ্রার্থীদের আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আন্দোলনরত শিক্ষকপদ প্রার্থীদের এই লেগে পড়ে থাকা অধ্যবসায়কে কুর্ণিশ জানাতেই হবে।
– অমিত দাশগুপ্ত
‘সত্য সংবাদ পরিবেশন জরুরি। আর সেই সংবাদ তাঁর বিরুদ্ধে হলেও তিনি মনে কিছু করবেন না। কিন্তু সম্মানহানি যেন না করা হয়।’ বলতে চাইলেন, বিচার যেন নিরপেক্ষ হয়, এক পক্ষের না হয়। প্রসঙ্গত আরও বললেন – ’মিডিয়া ট্রায়াল যেন না হয়।’ এই কথাগুলো হাইকোর্টের বিচারপতিদের সাথে এক সভামঞ্চে দাঁড়িয়ে বলতে শোনা গেল রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে।
এই বিপদ অতি বাস্তব ক্রমবর্ধমান যে, কেন্দ্রের মোদী সরকার ন্যায় বিচারের সবকিছুকে বিধ্বস্ত করার অভিযান চালাচ্ছে। বিরোধী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও উদ্যোগ থেকে শুরু করে বিরোধী দল পরিচালিত সরকারকে সন্ত্রস্ত, দমন ও কোণঠাসা করতে উন্মত্ত অভিযানে নেমেছে। তার জন্য তুলছে ছদ্মবেশী আহ্বান, প্রতারণাপূর্ণ শ্লোগান, আর আগ্রাসী উন্মাদনা; আর কিছু তকমা লাগিয়ে দিয়ে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ-ইডি-সিবিআইকে স্বেচ্ছাচারীভাবে ব্যবহার করছে, বিচারব্যবস্থাকেও পক্ষপাতমূলক ভাবে প্রভাবিত করে চলছে। ন্যায়ের ভারতশাসন চলছে না, তাকে প্রতিস্থাপিত করে চলছে অন্যায় – অঘোষিত ফ্যাসিবাদী শাসন। যার মাথায় আরএসএস-বিজেপি চক্র, আর মুখ মোদী।
পক্ষান্তরে, এরাজ্যেও যে ন্যায়ের প্রশ্নে ভন্ডামী সহ এক ধরনের দমন-নিয়ন্ত্রণের রাজ চলছে এটাও নির্মম বাস্তব। টিএমসি আমলে কিছু জরুরি অস্থায়ী উপশমের প্রকল্প চালু হয়েছে বটে, তা সত্ত্বেও মমতা সরকারকে ‘জনকল্যাণকর’ বা ‘স্বস্তিকর’ সরকার হিসেবে গণ্য করার উপায় নেই। কারণ তার আশু অনুদান প্রকল্পের পরিচিতিকে ছাপিয়ে গেছে দুর্নীতি আর সন্ত্রাসের অপশাসন। মুখ্যমন্ত্রী আজ তাঁর নিজের ও সহ মন্ত্রী-নেতাদের সম্মানহানি না করার আবেদন করছে, হুঙ্কারও দিচ্ছেন! কিন্তু টিএমসি আমলের গোড়া থেকেই দুর্নীতিতে জড়ানোর অভিযোগ উঠে আসছে! সারদা ছোপ খাওয়া যে ঘোষমশাই আজ তৃণমূলের অন্যতম মুখপাত্র, তাঁকে একসময়ে ‘যত দোষী’ দাগিয়ে সাময়িক বরখাস্ত করে গারদ পোরা হয়েছিল, বন্দীদশা থেকে তিনি অভিযোগের আঙ্গুল তুলছিলেন সারদার দুর্নীতি থেকে সবচেয়ে সুবিধাভোগীর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই অভিযোগকারীকে আবার পরবর্তী পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গোপন বোঝাপড়ায় দলের মুখপাত্রের পদে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে, আর তিনিও বেশ সন্ধি মেনে চলছেন! কিন্তু তা বলে কি ঘোষবাবুর বা মুখ্যমন্ত্রীর সম্মান উদ্ধার হয়ে গেছে? না। বরং দলের দুর্নীতিগ্রস্ত পরিচিতি আরও বহুবিচিত্রতায় বহুগুণ বেড়েছে! শিক্ষাক্ষেত্রে কোটি কোটি টাকার নিয়োগ-দুর্নীতি তার এক চূড়ান্ত অমনবিক নিষ্ঠুর নিদর্শন। তৃণমূল দল ও সরকারের কখনই সততা-নৈতিকতা দেখানোর সাহস হয়নি নিজেদের পরিচ্ছন্ন প্রমাণ দিতে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কোনও তদন্ত কমিশন বসানোর। বরং এরকম যেকোনো অভিযোগ ও দাবিকে ‘চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র’ বলে নস্যাৎ ও দমন করার রাস্তা নেওয়া হয়েছে। এই পরিণতি আজ উপরন্তু খাল কেটে উচ্চ আদালতের তত্ত্বাবধানে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলোর দুর্নীতি তদন্ত অভিযান ডেকে নিয়ে এসেছে। আর এই ছুতোয় কেন্দ্রের মোদী সরকার ও বিজেপি মিলে বাংলার বুকে আবার গেরুয়া ক্ষমতার রাজনীতির বাজার গরম করার সুযোগ পাচ্ছে।
বাংলায় দুর্নীতির সাথে বেলাগাম হয়েছে শাসকের সন্ত্রাস। রাজনৈতিক ও সরকারি সন্ত্রাস। ক্ষমতায় আসার গোড়া থেকেই কোনও বিরোধিতাকে সহ্য না করার ধমকি দেওয়া শুরু হয়। তারপর ক্রমশ ভূয়ো এনকাউন্টার, ইউএপিএ-র বেড়ী পরানো, পাইকারীহারে গ্রেপ্তার, বিনাবিচারে বন্দী করে রাখা, সাপের মাথায় লাঠি মারার মতো হুঙ্কার দেওয়া, রাতের অন্ধকারে বাড়িতে পুলিশী হানা, হেফাজতে তুলে নিয়ে এসে থার্ডডিগ্রী অত্যাচার, বন্দী অবস্থায় বিনা চিকিৎসায় তিলে তিলে হত্যা করা, থানায় ডেপুটেশন দিতে গেলে ধরে বেঁধে রাতভর আটকে রেখে মার, হেফাজতে নারীর শারীরিক-মানসিক নিগ্রহ, ধর্ষণ, কখনও পুলিশী অত্যাচার চলে উত্তরপ্রদেশ মডেলে, চলে মিথ্যা সাজানো মামলার হেনস্থা-হয়রানি, রেখে দেওয়া হয়েছে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম সময়কালের মামলাও, চালানো হয় ভোট সন্ত্রাস, বিরোধীপক্ষকে মনোনয়ন বা ভোট দিতে না দেওয়া, পুলিশ-প্রশাসন ঘেরা সভামঞ্চ থেকে শোনানো হয় বিরোধিতার দুঃসাহসকে বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার নিদান, চলে ভোট লুঠ, শাসক ক্ষমতার পেশীশক্তিতে সব ক্ষমতার দখল নেওয়া, পঞ্চায়েতী সন্ত্রাস, সহজে অনুমোদন মেলে না শান্তিপূর্ণ সভা-মিছিলের, রয়েছে ক্যাম্পাস সন্ত্রাস, ট্রেড ইউনিয়ন সন্ত্রাস – সন্ত্রাসের প্রায় সমস্ত প্রকরণ চলে আসছে তৃণমূল শাসনে। এমনকি বিরোধী বামপক্ষের লোকেদের থিয়েটার-সিনেমা মঞ্চস্থ করার প্রেক্ষাগৃহ পর্যন্ত মেলে না, ব্রাত্য করে রাখা হয়। তৃণমূলী রাজনৈতিক গুন্ডামী-সন্ত্রাস চালানোর আজকের হাতিয়ার হল ‘অনুব্রত মডেল’। বিরোধিতাকে দমন করতে চলে আইনের শাসনের বদলে শাসকের আইন, শাসকের ট্রায়াল। সুতরাং কোন মুখে তৃণমূল নিজের কলঙ্কিত মুখ ঢাকবে!
মহারাষ্ট্রের পাশাপাশি ঝাড়খণ্ডও দীর্ঘদিন ধরে মোদী-শাহর ছলে বলে কৌশলে সরকার ফেলে ক্ষমতা দখলের নিশানায় আছে। পশ্চিমবঙ্গে তিনজন কংগ্রেস বিধায়ককে নগদ টাকার গাড়িসহ আটক করা বিজেপির এই শয়তানি ছককে প্রকাশ্যে এনে ফেলে। এখন মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন এবং তার ভাই বসন্ত সোরেনের বিরুদ্ধে বিজেপির আনা লাভজনক সংস্থায় থেকে নির্বাচিত হওয়ার অভিযোগকে হাতিয়ার করে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকার বিষয়ে রাজ্যপাল মুখে কুলুপ এঁটে থাকায় প্রতি দিনই বিষয়গুলি আরও ঘোলাটে হচ্ছে। তাজ্জব ব্যাপার হল, রাজ্যপাল নীরব কিন্তু বিজেপি নেতারা ইসিআই রায় নিয়ে বিবৃতি জারি করছে আর এদিকে বিধায়ক কেনাবেচার ব্যাপক জল্পনা-কল্পনার মধ্যে দিয়ে ঝাড়খণ্ডকে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
রঘুবর দাস সরকার ১৫ নভেম্বর ২০০০-এ ঝাড়খণ্ড রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর থেকে ঝাড়খণ্ডের সবচেয়ে অ-জনপ্রিয় সরকার ছিল। সরকারের নীতি এবং শাসনের ধরনে আদিবাসী বিরোধী ঝাঁঝ উচ্চকিত মাত্রায় ছিল এবং আদিবাসীরা তা হাড়ে হাড়ে বুঝেছিল আর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ঝড়ের বেগে বিজয়ি হওয়ার মাত্র ছয় মাসের মধ্যে বিধানসভা নির্বাচনে আদিবাসীরা সরকারটাকে অপসারিত করেছিল। এখন ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি রাজ্যে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করতে মরিয়া। বিহারের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বিকাশ বিজেপির হতাশা বাড়িয়ে দিয়েছে এবং তারা সেখানেও সিবিআই এবং ইডির অভিযান চালিয়ে নতুন সরকারকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সরকার ফেলে দেওয়া, বিরোধী দলগুলিকে লক্ষ্যবস্তু করে কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলিকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা এবং বিরোধী সরকারগুলিকে বদনাম ও অস্থিতিশীল করা এবং অ্যাক্টিভিস্টদের বানোয়াট মামলায় জড়িয়ে কঠোর আইনের অধীনে কারাগারে পাঠানো — এসবই দেশের আন্দোলনকারী বিরোধী ও রাজনৈতিক বিরোধীদের মোকাবিলা ও দমন করার জন্য সঙ্ঘ-বিজেপির পুরানো কৌশল। এই পদ্ধতিগত আগ্রাসন ভারতীয় সাধারণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় ভারসাম্যকে ক্ষুণ্ন করছে। আর এই পদ্ধতিগত আগ্রাসনের বলেই বিজেপি নিজেকে আগামী চল্লিশ বছর ধরে ভারতে টিকে থাকার ও শাসন করার অধিকারি একমাত্র রাজনৈতিক দল হিসেবে ঘোষণা করছে।
গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে হলে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার এই আগ্রাসী অভিযানকে সমস্ত উপায়ে রুখে দিতে হবে। বিহার রাজনৈতিক শক্তির পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে উপযুক্ত প্রত্যুত্তর দিয়েছে যা বিজেপিকে বিচ্ছিন্ন ও ক্ষমতা থেকে অপসারিত করেছে। ঝাড়খণ্ডকেও বিজেপির ক্ষমতা হাইজ্যাক করার মরিয়া খেলার পরিকল্পনা ব্যর্থ করতে হবে। হেমন্ত এবং বসন্ত সোরেনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া প্রতিক্রিয়া গোপন রেখে রাজ্যপাল ঝাড়খণ্ডে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাকে আরও গভীর করতে সহযোগিতা করেছেন। এটা দেখে দুঃখ হয় যে জেএমএম এবং কংগ্রেসের বিধায়কদেরকে বিজেপির কেনাবেচার শিকার হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে হচ্ছে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জেএমএম বিজেপিকে সমর্থন দিয়েছিল শুধুমাত্র ঝাড়খণ্ডে তাদের সরকারকে লক্ষ্যবস্তু বানাতে দেখে। এবারে বিজেপি যাতে ঝাড়খণ্ডে তাদের মহারাষ্ট্র মডেলের পুনরাবৃত্তি করতে না পারে তা দেখার দায়িত্ব ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী ও অন্যান্য সংগ্রামী শক্তির ওপর বর্তায়। সিপিআই(এমএল) ঝাড়খণ্ডে বিধানসভার ভিতরে এবং বাইরে বিজেপিকে সাহসের সাথে প্রতিহত করে চলবে।
এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ৩০ আগস্ট ২০২২
ঝাড়খণ্ডের দুমকা জেলার ১৯ বছর বয়সী মেয়ে অঙ্কিতা সিং-এর নৃশংস হত্যাকাণ্ড অত্যন্ত মর্মান্তিক। পুলিশ অভিযুক্ত শাহরুখ হুসেনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। সিপিআই(এমএল) অঙ্কিতা হত্যার নিন্দা জানিয়ে অভিযুক্তদের কঠোর শাস্তি এবং অবহেলাকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে। সঙ্ঘ এবং বিজেপি এই ইস্যুটিকে সাম্প্রদায়িক মোচড় দিয়ে মেরুকরণের চেষ্টা করছে, “লাভ জিহাদ” এর প্রচার করছে। বাস্তবে এটি একটি লিঙ্গভিত্তিক হিংসা। পুরুষের দ্বারা এইভাবে মেয়েদের তাড়া করে প্রেমে বাধ্য করার হিংস্রতা খুবই কমন ব্যাপার। বিজেপি ও সংঘ পরিবারের এই ‘লাভ জিহাদ’ জিগির আসলে নারীর ওপর এই ধরনের পুরুষ আধিপত্যবাদী হিংসাকে প্রতিহত করার সমস্ত লড়াইকেই নাকচ করে দেয়, এবং তারা কেবল রাজনৈতিক স্বার্থে বিষয়টিকে সাম্প্রদায়িক চেহারা দিতেই ব্যস্ত।
অন্যদিকে আরেকটি ঘটনায়, আদিবাসী মেয়েকে অত্যাচার করলেন বিজেপির বর্ষীয়ান নেতা। অঙ্কিতার হত্যার ক্ষেত্রে বিজেপি যখন ঝাড়খণ্ডে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের চেষ্টা করছে ঠিক তখনই একজন আদিবাসী মেয়ে সুনিতা একজন প্রবীণ বিজেপি নেতা তথা বিজেপির জাতীয় ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য দ্বারা নির্মমভাবে নির্যাতিত হয়ে হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে। বিজেপি নেত্রী সীমা পাত্রের বাড়িতে গৃহকর্মী হিসাবে কাজ করার সময় তার ওপর কেমন অত্যাচার চলে তা প্রকাশ্যে এসেছে এক ভিডিওতে। সেখানে সুনিতা বর্ণনা করেছেন কীভাবে তাকে সীমা গরম তাওয়া এবং রড দিয়ে মারধর করেছিল এবং এমনকি অমানবিকভাবে মেঝের প্রস্রাব চাটতে বাধ্য করেছিল। তার দাঁতও ভেঙে দেওয়া হয়েছে। সুনীতা অভিযোগ দায়ের করা সত্ত্বেও পুলিশ এখনও সীমা পাত্রকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। সিপিআই(এমএল) সুনিতার বিরুদ্ধে সহিংসতার সাথে জড়িত সীমা পাত্র এবং অন্য সকলকে অবিলম্বে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছে।
সম্প্রতি আয়কর তল্লাশির নামে বেনজির এক বর্বর হামলা চালানো হয়েছে কলকাতা টিভি’র সাংবাদিক-কর্মীদের ওপর। কলকাতা টিভি’র অফিসে টানা ৮০ ঘণ্টা তল্লাশি, নিউজরুমে সংবাদ সম্প্রচারে বাধা দেওয়া, জোর করে সিসিটিভি পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া, নথিপত্র তছনছ করা, সাংবাদিক-কর্মীদের মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া, তাদের অফিসে আটকে রেখে বাড়িতে পরিজনদের খবর না দিতে দেওয়া, মহিলা কর্মীদের ভয় দেখানো, শিশুপুত্র নিয়ে একা থাকা মহিলা সাংবাদিকের বাড়িতে ভোর রাতে হানা এবং ৬০ ঘণ্টা জেঁকে বসে থেকে বাড়িঘর লণ্ডভণ্ড করা, জেরার নামে সম্প্রচার সম্পর্কেতথ্য জেনে নেওয়ার চেষ্টা (যা সম্পূর্ণ অনধিকার চর্চা), তার পরিজনের বাড়িতে একে-৪৭ ধারী জওয়ানদের পাঁচিল টপকে দরজা ভেঙে ঢোকা, চ্যানেল সম্পাদকের অনুপস্থিতিতে তার অসুস্থ বৃদ্ধ বৃদ্ধা আত্মীয়দের হেনস্থা ও ৮০ ঘণ্টা ঘরে আটকে রেখে চরম অভব্যতা করা — এসবের আসল উদ্দেশ্য যে হয়রান করা ও ভালোরকম সন্ত্রস্ত করা তা খুব স্পষ্ট। এমনকি একা ঘরে অসুস্থ শয্যাশায়ী বাবার পাশেও সাংবাদিককে যেতে দেওয়া হয়নি যেমন, অসুস্থ স্ত্রীকে ভিনরাজ্যের হাসপাতালে একা ফেলে রেখে আধিকারিককে কলকাতায় টেনে আনা হয়েছে।
কলকাতা টিভি’র ‘চতুর্থ স্তম্ভ’ অনুষ্ঠানটি তাঁর নির্ভীক, বলিষ্ঠ উপস্থাপনার জন্য বিশেষ জনপ্রিয়। বিজেপি-আরএসএস তথা কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্ত অনাচার, ভ্রষ্টাচার, অর্থনৈতিক লুণ্ঠন ও রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক নির্লজ্জ আগ্রাসনকে ‘চতুর্থ স্তম্ভ’ দিনের পর দিন উন্মোচিত করেছে। বাংলার মানুষকে ফ্যাসিবাদের নখ-দাঁতকে চিনতে সাহায্য করেছে। একুশের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির ভরাডুবির পিছনে অনুষ্ঠানটির ভূমিকা অনস্বীকার্য। আর দক্ষ, সাহসী উপস্থাপনার জন্য মূল উপস্থাপক তথা কলকাতা টিভি’র মুখ্য সঞ্চালক সুচন্দ্রিমা যেমন ফ্যাসিবাদ বিরোধিতায় এক পরিচিত ‘মুখ’ হয়ে উঠেছেন, তেমনই তার নিশানাও হয়ে উঠেছেন। আর সেজন্যই তাঁকে আটকে রেখে ‘চতুর্থ স্তম্ভ’ অনুষ্ঠান বন্ধ রেখে, সন্ত্রাস সৃষ্টি করে আক্রোশ মেটানো হয়েছে।
আমরা কলকাতা টিভি’র ওপর এই হিংস্র তাণ্ডবকে ধিক্কার জানাচ্ছি। নির্ভীক নিরপেক্ষ যে কোন সংবাদ মাধ্যমের ওপর যে কোনও হামলার বিরোধিতা করি, কারণ সংবাদ মাধ্যম হল গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ।
বিপ্লবী যুব অ্যাসোসিয়েশন ও আইসার পক্ষ থেকে ৩০ শে আগস্ট হুগলির চন্দননগরে স্বাধীনতা সংগ্রামের শহিদ বিপ্লবী কানাইলাল দত্তের ১৩৫তম জন্ম জয়ন্তী উদযাপন করা হয় যথাযোগ্য মর্যাদায়। কানাইলাল বিদ্যামন্দির (ফরাসি বিভাগ) এর সামনে স্থাপিত মূর্তির সামনে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানানো হয়। শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন কানাইলাল বিদ্যামন্দিরের পড়ুয়া ও শিক্ষকেরাও। কানাইলালের মূর্তির অনতিদূরে চট্টগ্রামের সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী ও পরে চন্দননগরে ২ সেপ্টেম্বর চার্লস টেগার্ট-এর হাতে নিহত বিপ্লবী মাখনলাল (জীবন) ঘোষালের মূর্তিতে মাল্যদান করা হয়।
দেশের বৃহত্তম সরকারি চাকরির ক্ষেত্র ভারতীয় রেলকে বেসরকারীকরণের মোদী সরকারের ধারাবাহিক অপচেষ্টার বিরুদ্ধে ১৫ দিন ধরে চলা প্রচার অভিযানের সমাপ্তিতে গত ২৯ আগস্ট হাওড়ার উলুবেড়িয়া স্টেশনে এক প্রতিবাদী সমাবেশ সংগঠিত করে এআইসিহিটিইউ অনুমোদিত সাউথ ইস্টার্ন রেলওয়ে মজদুর ইউনিয়ন। সভায় ঠিকা ও স্থায়ী দুই বর্গের শ্রমিকদের উপস্থিতি ছিল ভালো মাত্রায়।
বক্তব্য রাখেন রেলওয়ে শ্রমিক ইউনিয়নের জনপ্রি়য় নেতা এন এন ব্যানার্জী, অপু ঘোষ, সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের হাওড়া জেলা সম্পাদক দেবব্রত ভক্ত ও অন্যান্য নেতৃত্ব।
‘বেসরকারীকরণ থেকে আজাদী’ — এই শ্লোগান সামনে রেখে বিজেপি সরকারকে নিশানা করেন বক্তারা। শেষে ডিআরএম খড়গপুর দপ্তরে স্মারকলিপি পেশ করা হয়।
বিগত এক বছরের উপর সময় ধরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় চুক্তিবদ্ধ কর্মচারী ইউনিয়নের নেতৃত্বে চলছে দুই ক্যাম্পাসের বিভিন্ন কোম্পানি ও কনট্রাক্টরের অধীন চুক্তিবদ্ধ কর্মীদের আন্দোলন। ন্যায্য বেতন, ইপিএফ ও ইএসআই, বোনাস চালু করা ও নিয়মিতকরণ, সবেতন ছুটি, মাতৃত্বকালীন ছুটি সহ অন্যান্য গণতান্ত্রিক দাবি নিয়ে বিগত এপ্রিল মাস থেকে বারংবার কর্তৃপক্ষের কাছে ডেপুটেশন দিলেও কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে শুধু মৌখিক আশ্বাসই পাওয়া গেছে, অবস্থার কোনও পরিবর্তন হয়নি।
এমতো পরিস্থিতিতে ইউনিয়নের তরফ থেকে এক সাধারণ সভার ডাক দেওয়া হলে সেখানে উপস্থিত হন দুই ক্যাম্পাসেরই কর্মীরা এবং সাধারণ সভার সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে মিছিল করে পৌছানো হয় অরবিন্দ ভবনে, দাবি একটাই — অবিলম্বে সমস্ত সমস্যার সমাধান করতে হবে লিখিত নোটিশ জারি করার মাধ্যমে।
অরবিন্দ ভবন পৌঁছানোর পরে লক্ষ্য করা গেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সহ-উপাচার্য বা রেজিস্ট্রার কেউ উপস্থিত নেই। রয়েছেন শুধু ফিন্যান্স অফিসার। বিগত দিনেও পরিস্থিতি ছিল ঠিক একই রকম। বাধ্য হয়েই ফোন করা হয় সহ-উপাচার্যকে, ফিন্যান্স অফিসার ও সহউপাচার্যের সামনেই পড়া হয় ডেপুটেশন। প্রথমে কর্তৃপক্ষ আবারও সেই মৌখিক আশ্বাস দিয়েই ফিরিয়ে দেওয়ার রাস্তায় ছিলেন, কিন্তু কর্মচারীরা নিজেদের দাবিতে অনড় রয়েছে দেখে তারা কথা বলতে বাধ্য হন। প্রায় তিন-চার ঘণ্টা কথাবার্তা চালানোর পর তারা জানান চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পরে জানানো হবে।
আবেদন করা হয়েছে যে, উপাচার্য, সহউপাচার্য ও রেজিস্ট্রারের উপস্থিতিতে নোটিশ বের করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় কর্মচারিরা অনির্দিষ্টকালীন অবস্থানে বসতে বাধ্য হবো। ডেপুটেশন দাবিপত্রে বলা হয় –
বিগত এক বছরের লাগাতার আন্দোলনের প্রাথমিক সাফল
দীর্ঘ আলোচনার পর শেষ অবধি ইউনিয়নের কয়েকটি দাবি কর্তৃপক্ষ প্রাথমিকভাবে মানতে বাধ্য হয়েছে।
- রিপোর্ট ও ছবি ইউনিয়নের ফেসবুক পাতা থেকে
গ্রামীণ ভারতের মেহনতিদের; বিশেষত কৃষিশ্রমিকদের আজকের মূল সংকট বছরভর কাজ পাওয়া নিয়ে। বাজারদর সাপেক্ষে মজুরির নিয়মিত ও যথাযথ বৃদ্ধি না থাকার কারণেও আজ জীবন-জীবিকা বিপন্ন। বাড়ছে ঋণগ্রস্ততা, আত্মহত্যার প্রবণতা!
২১ শতকের শুরুতে গ্রামীণ কাজের মূল ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছে ১০০ দিনের সরকারি প্রকল্প। অথচ ২০১৪-তে ক্ষমতায় বসেই মোদী সরকার নানান অজুহাতে, ধীর মতলবে বন্ধ করতে চাইছে ১০০ দিনের প্রকল্প। এরাজ্যের সরকারি দলের পঞ্চায়েত স্তরের কর্তাদের ১০০ দিনের প্রকল্প সংশ্লিষ্ট দুর্নীতিকে হাতিয়ার করে গত ডিসেম্বর থেকেই প্রকল্পে টাকা পাঠানো আটকেছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। মমতা কেন্দ্রকে দোষ দিয়েই দায়-দায়িত্ব সারতে চাইছেন।
এই পরিস্থিতিতে বিপন্ন, ঋণগ্রস্ত গ্রামীণ শ্রমিকদের নিয়ে গত ৮ জুন চুঁচুড়া জেলা সদরে সফল বিক্ষোভ-ডেপুটেশন কর্মসূচি সংগঠিত করে সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতি। পরবর্তীতে চলে গণসংযোগ সহ সদস্য সংগ্রহ অভিযান। জেলার আয়ারলা নেতৃত্বের অধিকাংশই আন্তরিক প্রচেষ্টায় নিজেদের জনসংযোগে যুক্ত করেছেন। আছেন অন্যান্য সংগঠকরাও।
এআইএআরএলএ’র হুগলি জেলা নেতৃত্ব এবছরের মে মাসের বৈঠক থেকে স্থির করে প্রথম পর্বে তিন মাসের গণসংযোগ ও সদস্য সংগ্রহ অভিযান শেষে অগস্ট মাসে সংগঠিত হবে ৭ম জেলা সম্মেলন। স্থির হয়, গণসংযোগ ও গণআন্দোলনের মধ্য দিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। এই দিশাতে গত ২৮ আগস্ট বলাগড় ব্লকের কামারপাড়া গণমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় জেলা সম্মেলন। সময়টা অনুকূল ছিল না। চাষের কাজ ছাড়াও ভারী বর্ষণ বাধা হয়ে ওঠে। ঐদিন সকাল থেকেই ধনেখালি, পোলবা, পাণ্ডুয়া ব্লকে চলতে থাকে বৃষ্টি। সাংগঠনিক বিস্তারকে মাথায় রেখে সম্মেলনের জন্য নির্বাচিত হয়েছিল বলাগড় ব্লকের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল, কামারপাড়া। লাগাতার গণসংযোগ ও আন্দোলনমুখিনতা প্রতিকূলতা অতিক্রমে সহায়তা করে। জেলায় কাজের চারটি মূল ব্লক — পোলবা দাদপুর, বলাগড়, ধনেখালি, পাণ্ডুয়া থেকে ট্রাকে চেপে সংগঠিতভাবে উপস্থিত হন প্রতিনিধিরা। এছাড়াও জাঙ্গিপাড়া ও মগরা ব্লক থেকেও প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। ভালো সংখ্যায় উপস্থিত ছিলেন পোলবার সারাংপুরের আন্দোলনকারীরা, সাথী অঞ্জলি মুর্মু, কাকলি সরেন, মিনু মুর্মুদের নেতৃত্বে। সাথী শৈলেন মাজির নেতৃত্বে উপস্থিত ছিলেন ধনেখালি ব্লকের সংগঠকরা। পাণ্ডুয়ার ইলছোবা থেকে উপস্থিত ছিলেন ঐ গ্রামে সম্প্রতি সংগঠিত সফল মজুরি বৃদ্ধি আন্দোলনের সংগঠকরা সাথী বিনয় দাসের নেতৃত্বে। বলাগড় ব্লকের বিভিন্ন গ্রামে আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চের আন্দোলনে পা মেলানো বিভিন্ন গ্রামের সাথীরা এখন যুক্ত হচ্ছেন কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতিতে জেলা নেতা সেখ আনারুলের নেতৃত্বে। এসেছিলেন তাঁরাও। বলাগড়ের ঋণমুক্তি আন্দোলনের পঙ্কজ বিশ্বাস, জাঙ্গিপাড়ার ঋণমুক্তি আন্দোলন সংগঠক সুজাতা রায়, বিকাশ রায় সহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন সম্মেলনে।
ওপরের ছবি নতুন জেলা কমিটির
মূল শ্লোগান ছিল, গরিব বিরোধী বুলডোজার রাজনীতি রুখে দাও। পতাকা উত্তোলন করেন বর্ষীয়ান সংগঠক সাথী দুলাল লোহার। মাল্যদান করেন রাজ্য পর্যবেক্ষক ও সমিতির রাজ্য সভাপতি সজল পাল সহ নেতৃবৃন্দ।
মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে, কাজ ও ন্যায্য মজুরির দাবিতে সোচ্চার হন বিভিন্ন বক্তা। উঠে আসে জেলার মাটিতে দাঁড়িয়ে বর্গা উচ্ছেদ বিরোধী আন্দোলন, জবকার্ডের দাবিতে আন্দোলন, শৌচাগারের দাবিতে আন্দোলন, মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন, ঋণমুক্তি আন্দোলন, আদিবাসী অধিকার আন্দোলন, বকেয়া মজুরি ও কাজের দাবিতে আন্দোলন, বাস্তুপাট্টার আন্দোলন প্রসঙ্গ। সজল পাল তাঁর বক্তব্যে এই আন্দোলনগুলি আরও বড় আকারে সংগঠিত করার আহ্বান জানান।
এআইকেএম জেলা সম্পাদক মুকুল কুমার মনে করিয়ে দেন মোদীর রাজত্বকালে দলিত ছাত্র হত্যা এবং বিলকিস বানো পরিঘটনায় অপরাধীদের কিভাবে বিজেপি ছেড়ে দিয়েছে, সেই প্রসঙ্গ। বক্তব্য রাখেন প্রদীপ সরকার, সৌরভ রায় এবং শোভা ব্যানার্জী।
সভা পরিচালনা করেন সাথী শৈলেন মাজি, আনারুল সেখ, গোপাল রায়, পাগান মুর্মু, সুকুরমনি মাণ্ডি, বিনয় দাস, মিনু মাণ্ডিকে নিয়ে গঠিত সভাপতিমন্ডলী। সম্মেলন শেষে ২৩ জনের জেলা কমিটি ও ১১ জনের কার্যকরী কমিটি গঠিত হয়। পুনরায় জেলা সম্পাদক নির্বাচিত হন নিরঞ্জন বাগ।
আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৫০ হাজার সদস্য সংগ্রহ ও ১৪-১৫ নভেম্বর জেলার চন্দননগর রবীন্দ্র ভবনে অনুষ্ঠিত হতে চলা জাতীয় সম্মেলন সফলভাবে সম্পন্ন করার শপথগ্রহণ করেন নতুন কমিটি সহ উপস্থিত প্রতিনিধিরা।
সম্মেলন সফল করতে আগের দিন থেকেই হাজির ছিলেন আইসা জেলা সংগঠক সাথী তুষার দাস সহ ইলছোবার আইসা সাথীরা। কামারপাড়ার সংগঠক সাথী পঙ্কজ টুডু ও তাঁর সাথীরা, মহীপালপুরের সংগঠকদের অক্লান্ত পরিশ্রমে সফল হয় সম্মেলন।
গত ২৮ আগস্ট, ২০২২ যাদবপুরের প্রতাপগড় স্কুলে সম্পন্ন হল সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির অস্টম কলকাতা জেলা সম্মেলন। শহিদদের উদ্দ্যেশ্যে মাল্যদান ও নীরবতা পালনের মধ্য দিয়ে সম্মেলনের সূচনা হয়। সভাপতিমন্ডলীতে ছিলেন কবিতা চৌধুরী, স্নিগ্ধা বসু ও ছবি দাস। আইপোয়ার রাজ্য কমিটির পক্ষ থেকে পর্যবেক্ষক হিসাবে উপস্থিত ছিলেন কাজল দত্ত। গণ-সংস্কৃতি পরিষদের পক্ষ থেকে কমরেড নীতিশ রায় গান করেন ও বক্তব্য রাখেন। এআইসিসিটিইউএর পক্ষ থেকে কমরেড সুশান বক্তব্য রাখেন। বিদায়ী সভাপতি ইন্দ্রাণী দত্ত সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির ইতিহাস ও বর্তমানে ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে, দুর্নীতি-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, শিক্ষা, কাজ ও সমানাধিকারের লক্ষ্যে রাজনৈতিক কর্মসূচির বিষয় মনে করান। খসড়া পাঠের মধ্য দিয়ে সম্মেলনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। খসড়ার উপর মত প্রকাশ করেন সম্মেলনে আগত সাধারণ সদস্যরা। সংগঠনের মধ্যে নারীর অধিকার ও লিঙ্গ-সাম্য প্রসঙ্গে সমকালীন নারীবাদী আন্দোলন নিয়ে পড়াশোনা ও চর্চা চালানোর গুরুত্বের কথা তুলে ধরেন সৌমী জানা। নির্মাণ শ্রমিক শিখা তুলে ধরেন গ্যাস ও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ ও বিশেষত মেয়েদের হয়রানীর কথা। মোদী সরকার যে মানুষকে ধোঁকা দিয়ে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষপত্রের দাম বাড়িয়ে চলছে অন্যদিকে পুরুষশাসিত সমাজ-ব্যবস্থাকে ধুয়ো দিয়ে মেয়েদের ঘর বন্দী করার পরিকল্পনা চালাচ্ছে তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার কথা বলেন কমরেড শিখা। গৃহ-শ্রমিক রাণী হালদার ও শুক্লা হালদারের কথায় উঠে আসে গৃহ-শ্রমিকদের নিত্যদিনের দুর্দশা, অন্যায্য মজুরি কাঠামো ও কর্মক্ষেত্রে নিয়মিত হয়রানির বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা ও সংঘবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা। মোদী-রাজে মেয়েদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাসস্থানের উপর নেমে এসেছে কঠোর আক্রমণ। এই আক্রমণের সবচেয়ে বেশি শিকার হয়েছেন গরিব ও প্রান্তিক মেয়েরা। কখনো মুসলিম মেয়েদের শিক্ষাক্ষেত্রে ঢোকার উপর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে, কখনো গরিব ও প্রতিবাদী মেয়েদের ঘরবাড়ির উপর বুলডোজার চালিয়ে বা জেলে বন্দী করে অত্যাচার চালাচ্ছে বিজেপির সরকারগুলি। নারীর স্বাধীনতা ও বেঁচে থাকার উপর সামগ্রিক এই আক্রমণকে রুখতে আইপোয়ার সংগঠনকে আরো মজবুত করার কথা বলেন সম্প্রীতি। রুপান্তরকামী নারীর লড়াইকে আইপোয়ার রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে সম্পৃক্তভাবে যুক্ত করার গুরুত্বের কথাও বলেন সম্প্রীতি। পর্যবেক্ষক কাজল দত্ত বলেন, মেয়েদের ঘরের ভিতর ও বাহির – দ্বি-মুখী লড়াইয়ের কথা। সমাজের পশ্চাৎগামী মানসিকতার বিরুদ্ধে নিজের স্বাধীনতার লক্ষে মেয়েদের লড়াই করতে এগিয়ে আসার জন্য উৎসাহিত করতে হবে। জবাবী ভাষণে, বিদায়ী জেলা সম্পাদিকা মমতা ঘোষ, সম্মেলনে আলোচিত বিষয়গুলির প্রয়োজনীয়তাকে চিহ্নিত করে আগামীতে সমিতির কর্মসূচিকে গড়ে তোলার আহ্বান রাখেন। নতুন জেলা কমিটি নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে জেলা সম্মেলন সম্পন্ন হয়। নব্য জেলা কমিটির সদস্যরা কমরেড চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরীকে সম্পাদক পদে ও কমরেড মমতা ঘোষকে সভাপতি পদে নির্বাচিত করে।
গত ২৭ আগস্ট বিপ্লবী যুব অ্যাসোসিয়েনের মুর্শিদাবাদ জেলা ৫ম সম্মেলন সম্পন্ন হয়। সম্মেলন থেকে ১৭ জনের জেলা কমিটি গঠিত হয়। সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন মনভোলা চৌধুরী ও সভাপতি সঙ্গীত দাস। সভায় উপস্থিত ছিলেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশন রাজ্য কমিটির সদস্য বাসুদেব বসু, রাজিব রায়, রণজয় সেনগুপ্ত সহ অন্যান্য কমরেডগণ।
গত ২৭ আগস্ট কলকাতায় মহাবোধি সোসাইটি সভাঘরে অনুষ্ঠিত হল পরিবেশ অধিকার গণকনভেনশন। পরিবেশ সংকটের রাজনৈতিক প্রশ্নে সংগঠিত এই গণকনভেনশনে উপস্থিত ছিলেন এরাজ্যের বিভিন্ন ছোট বড় প্রতিরোধ ও আন্দোলনের প্রতিনিধিরা। এসেছিলেন ঝাড়খণ্ডের গোড্ডায় আদানি কোম্পানির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে চলা আন্দোলনের প্রতিনিধিরা। বিভিন্ন গণসংগঠন, বিশেষত ছাত্রছাত্রী এবং চিত্রশিল্পী ও গানের দলের স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণে সভাঘর উপছে পড়েছিল। কনভেনশন শুরু হওয়ার আগে সভাঘরের সামনের রাস্তায় বাণীপুর বেসিক থেকে আসা স্কুলছাত্র সপ্তকের হিপহপ, সঞ্জয়ের গান, শুভঙ্করের কবিতা এবং রকি, অচিন্ত্য ও আরজুর সঙ্গতে এক জোরালো পারফরম্যান্স এলাকার মানুষকে সচকিত করে। সভাঘরে সঙ্গীত পরিবেশন করে অগ্নিঋক, গাছেদের জন্য গানের দল, স্কুল ছাত্রছাত্রীদের টিম ‘অন্য রকম’ এবং জৈব কৃষক নিতাই মাল। সভাঘরে সাজানো ছিল দেওচা-পাচামির আন্দোলনে তন্ময়ের তোলা একগুছ স্থিরচিত্র এবং লাবণী জঙ্গির বিভিন্ন পেইন্টিং। আমন্ত্রিত বক্তা হিসেবে ছিলেন অর্থনীতিবিদ তথা গণআন্দোলন চিন্তক শুভেন্দু দাশগুপ্ত, তরুণ নদী বিশেষজ্ঞ সুপ্রতিম কর্মকার ও গণ আন্দোলনের কর্মী আশিষ কুসুম ঘোষ। সমগ্র কনভেনশন সঞ্চালনা করেন মোহিত রণদীপ ও মধুরিমা বক্সী।
দেওচা-পাচামির বৃহৎ কয়লাখনি প্রকল্পের পরিবেশ বিপর্যয়ের দিক নিয়ে চর্চা ও বিরোধিতা গড়ে তোলার তাগিদ থেকে গত জানুয়ারি মাসে বেশ কিছু রাজনৈতিক কর্মী ‘পরিবেশ অধিকার আন্দোলন’ নামে একটি সমন্বয় গড়ে তুলে প্রচারান্দোলন শুরু করে। কলকাতায় পথসভা, মিছিল, পদযাত্রা সংগঠিত করা ও একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে দেওচা-পাচামি প্রকল্পের বিপর্যয়ের বিষয়ে মানুষকে অবগত করার চেষ্টা করা হয়। এবং শেষে রাজ্যের বিভিন্ন আন্দোলনগুলির সাথে যোগাযোগ গড়ে তুলে পরস্পরের বিষয়ে জানা, বিভিন্ন সরকারি পলিসি বিষয়ে আলোচনা ও পরিবেশ অধিকার আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি করার লক্ষ্যে এই গণকনভেনশন সংগঠিত করা হল। কনভেনশনে স্বাগত ভাষণ দেওয়ার সময় এই সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরেন শুভপ্রতীম রায়চৌধুরি। এর পর আলোচনার জন্য খসড়া প্রতিবেদন পেশ করেন মলয় তেওয়ারি। জলবায়ু পরিবর্তন, প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য নাশ এবং দূষণ ও বর্জ্য-জঞ্জাল — এই ত্রিমুখী পরিবেশ সংকটের নানা দিক এবং বিভিন্ন আন্দোলনগুলির সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ও পরিবেশধ্বংসী বিভিন্ন সরকারি নীতি তুলে ধরা হয়। পুঁজিবাদী উন্নয়নের মডেলকে পরিবেশ সংকটের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং সমস্ত ক্ষেত্রেই স্থানীয় জনগোষ্ঠি-নির্ভর ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন-পরিকল্পনাকে বিকল্প হিসেবে তুলে ধরা হয়। ইতিমধ্যেই বিভিন্নভাবে যে পরিবেশের যে ক্ষতি হয়ে গেছে তার মেরামতি ও পরিবেশ সংকটজাত উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের সার্বিক নীতি এবং পরিবেশধ্বংসী প্রকল্প থেকে সরে আসাকে মূল দিশা হিসেবে তুলে ধরা হয়।
দেওচা-পাচামির খনি-বিরোধী আন্দোলনের সংগঠন ‘বীরভূম জমি জীবন জীবীকা ও প্রকৃতি বাঁচাও মহাসভার’ পক্ষ থেকে বুধি হাঁসদা স্পষ্ট জানান যে তাঁরা কোনও শর্তেই কয়লাখনি চাইছেন না। পাথর খাদানের বায়ু দূষণের প্রসঙ্গ টেনে বলেন যে, কলকাতা ও বর্ধমানের বাবুরা খাদান থেকে মুনাফা লোটে, কিন্তু পাথর গুঁড়োর ধুলোটা খায় গ্রামের আদিবাসী মানুষেরা। মহাসভার আরেক নেতা রতন হেম্ব্রমও উপস্থিত ছিলেন। ঝাড়খণ্ডের গোড্ডা থেকে এসেছিলেন সুভাষ হেম্ব্রম ও মেরি নিশা হাঁসদা। তাঁরা আদানি কোম্পানির তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরুদ্ধে তাঁদের লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা তুলে ধরলেন। এখান থেকে আদানিরা বিদ্যুৎ বেচবে বাংলাদেশে। তার জন্য ফারাক্কার গ্রামবাসীদের মাথার ওপর দিয়ে হাই টেনশন তার নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, আম ও লিচু বাগান কাটা হচ্ছে জোর করে। পুরুলিয়ার আযোদিয়া পাহাড়ে ধ্বংস হতে চলেছে বিপুল পরিমাণ অরণ্য। এই পাহাড়টি যে বাংলার আদিবাসী সান্তাড় সমাজের চিরাচরিত পবিত্র স্থান হিসেবে সান্তাড় সমাজের দ্বারা ব্যবহৃত ও রক্ষিত হয়ে আসছে সেই দিকও বিবেচনায় আনছে না সরকার। আস্ত এক পাহাড় তিলাবনি, যা পর্যটন ও গ্রামবাসীদের নিসর্গ ও বনসৃজনের সাথে জড়িত তাকে পাথর ব্যবসায়িদের স্বার্থে বেচে দেওয়া হয়েছে। এইসব প্রতিরোধ আন্দোলনের কথা উঠে আসে ফারাক্কার জোবায়ের আলি ও তিলাবনি সংহতির সঞ্জয় দাসের বক্তব্যে। সুন্দরবন বাঁচাও কমিটির দীর্ঘদিনের কর্মী ডঃ মদন চন্দ্র করণ বিস্তারিতভাবে সুন্দরবনের বাস্তব সমস্যা তুলে ধরেন, নব ঘোষিত সুন্দরবন জেলা আসলে সুন্দরবনের জনগোষ্ঠির ঐক্যকে ভাগ করবে বলে অভিমত প্রকাশ করেন তিনি। বস্তুত জলবায়ু সংকটের আশু বিপর্যয়ের মুখে সুন্দরবন অঞ্চল ও তার ওপর নির্ভরশীল মানুষেরাই আছেন বলে গণকনভেনশনের প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়েছে।
কনভেনশনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিল বিভিন্ন নদী বাঁচাও, খাল বাঁচাও ও জলাভূমি বাঁচাও আন্দোলনের কর্মীরা। জলঙ্গী নদী সমাজের দেবাঞ্জন বাগচি ও নদী বাঁচাও জীবন বাঁচাও আন্দোলনের কল্লোল রায় সমগ্র বিষয়টি তুলে ধরেন। নদী মানে জীববৈচিত্র্য, জীবিকা, সংস্কৃতি, উর্বর পলি, জল সুরক্ষা, আবহাওয়া ভারসাম্য, সহ বহু কিছু। সমস্তটা নিয়ে যে নদী, তাকে শুধু জলের জন্য বাঁধ দিয়ে প্রাণহীণ করে তোলা হচ্ছে। নদী-নির্ভর, নদী পাড়ের মানুষের জীবন-জীবিকায় নেমে আসছে নানা বিপদ। নদী বাঁচাতে হলে নদীতে বাধা সৃষ্টিকারী সমস্ত ছোট-বড় বাঁধ-বাঁধাল তৈরি বন্ধ করতে হবে; নদী নির্ভর মৎস্যজীবীদের স্বাধীন জীবিকা বাঁচিয়ে রাখতে নদীতে পর্যাপ্ত নির্মল জল সুনিশ্চিত করতে হবে; মৃত ও মৃতপ্রায় নদীগুলিকে বাঁচাতে সার্বিক ভূমিরূপ ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করতে হবে। দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় আত্রেয়ী নদীতে চেক ড্যাম তৈরি অবিলম্বে বন্ধ করে নদীকে পুরোন রূপে ফিরিয়ে দিতে হবে। মৎস্যজীবীদের জীবিকা সুরক্ষা করতে মাথাভাঙা-চূর্ণি নদীতে দূষণ রোধে আন্তর্জাতিক আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কেন্দ্রীয় নদী সংযুক্তি প্রকল্প আমাদের নদীব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ বদলে দিতে চায়। এই প্রকল্প কোটি কোটি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে তাদের নদীগুলিকে কর্পোরেটদের স্বার্থে কেড়ে নেওয়া ছাড়া আর কিছু নয়। কেন্দ্রীয় এই প্রকল্পের ফলে নদী-মোহনায় জলপ্রবাহ অত্যন্ত কমে যাওয়ায় জোয়ারের নোনাজল আরও বহুদূর উঠে এসে নানারকম বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।
চড়িয়াল খাল পুনরুদ্ধারের আহ্বান নিয়ে বক্তব্য রাখেন রাজীব দত্ত। বেআইনি নির্মাণে মৃতপ্রায় এই খাল সংস্কার করে আবার আগের অবস্থায় ফেরৎ দিতে হবে। রাজাপুর খাল বাঁচাও আন্দোলনের পক্ষে মুজিবর রহমান বলেন, রাজাপুর খাল হাওড়া জেলার অন্যতম জীবনরেখা, যার ওপর প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ নির্ভরশীল। এর সাথে যুক্ত কানা দামোদর ও তাদের সাথে যুক্ত অসংখ্য ছোট খাল ও নালা আজ বিপন্ন। হাওড়ার সাঁকরাইলে অম্বুজা সিমেন্ট কারখানার দূষণে অনেকগুলি গ্রামের জীবন ও জীবিকা চরম ক্ষতিগ্রস্ত। গ্রিন ট্রাইব্যুনাল ক্ষতিয়ে দেখে দূষণের বাস্তবতা ক্ষতির সম্ভাব্য পরিমাণ নির্দিষ্ট হওয়া সত্বেও কেউ ক্ষতিপূরণ পাননি বলে জানান লক্ষ্মীকান্ত আড়ি।
কনভেনশনের প্রস্তাবনায় এরাজ্যে বনাধিকার আইনের প্রয়োগ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ২০০৬ সালে বনাধিকার আইন পাস হওয়ার পর জঙ্গলমহল নামে পরিচিত পশ্চিমাঞ্চলে আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার বদলে উল্টে কর্পোরেটদের হাতে জঙ্গলের জমি তুলে দেওয়া এবং পুলিশ প্রশাসনের সাথে আদিবাসীদের এক রক্তক্ষয়ী সংঘাতের চিত্র সামনে আসে, পরিশেষে কেন্দ্র-রাজ্য যৌথ বাহিনীর স্থায়ি সন্ত্রাস কায়েম হয় এবং বর্তমান সরকারও বনভূমির ওপর আদিবাসীদের প্রাপ্য ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত মালিকানার আবেদনগুলি হয় খারিজ করে দিয়েছে অথবা ঝুলিয়ে রেখেছে। উত্তরবঙ্গ বনজন শ্রমজীবী মঞ্চের পক্ষ থেকে স্বরূপ সাহা বলেন যে তাঁরা বনাধিকার আইন নিয়ে আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন এবং কিছু অধিকার আদায় করতে পেরেছেন।
একেকটি বড় গাছ আমাদের বাস্তুতন্ত্রের একেকটা খুঁটি। যশোর রোড গাছ বাঁচাও আন্দোলনের পক্ষে তাঁদের দীর্ঘ লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা বলেন অরিন্দম। সম্প্রতি তারকেশ্বর চকদীঘি রাস্তা সম্প্রসারণ প্রকল্পেও বিপুল বৃক্ষচ্ছেদ যজ্ঞ চলছে। এর বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনের পক্ষ থেকে বলেন কল্যাণ আদক। বড় বড় গাছগুলিকে টিকিয়ে রেখেই রাস্তা চওড়া করার বিকল্প পরিকল্পনা রচনা করতে হবে যা বাস্তবে সম্ভব। উত্তরপাড়া গণ উদ্যোগের রূপম চট্টোপাধ্যায় ও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতির তাপস চক্রবর্তী আরও কিছু দিক তুলে ধরেন। গণবিজ্ঞান সমন্বয় মঞ্চের প্রদীপ বসু টেকনলজি কেন্দ্রীকতার বিরুদ্ধে সচেতন করে দেন। মৃণাল জানা কনভেনশনের দাবিসনদ পেশ করেন।
শুভেন্দু দাশগুপ্ত তাঁর বক্তব্যের মাধ্যমে নজর কেন্দ্রীভূত করতে বলেন গ্রামসভা, পেশা আইন ও তটভূমি সুরক্ষা আইনের ওপর। আইনগুলি সম্পর্কে সর্বস্তরে সচেতনতা গড়ে তোলার কথা বলেন তিনি। সুপ্রতিম কর্মকার মূল জোর দেন স্থানীয় জনগোষ্ঠির চিরাচরিত জ্ঞানভাণ্ডারের ওপর। বিভিন্ন প্রবাদ প্রবচন, ছড়া ও এক চিলতে গল্প উল্লেখ করে অত্যন্ত সহজ সরলভাবে তিনি এই গুরুত্বপূর্ণ দিকটির গুরুত্ব তুলে ধরেন। আশিষ কুসুম ঘোষ বলেন, এই কনভেনশনে পরিবেশ এক অধিকার হিসেবে উঠে এল। নির্দিষ্ট কিছু বিন্দুতে নজর কেন্দ্রীভূত করে আগামিতে এগোতে হবে। সমস্ত বক্তব্যের শেষে তাপস দাস সমাপ্তি ভাষণ দেন। উপস্থিত সকলে হাততালি দিয়ে সমস্ত সংজোযন সহ কনভেনশনের প্রস্তাবনা ও দাবিপত্র গ্রহণ করে। আগামিতে নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে ওয়ার্কশপ ও অন্যান্য কর্মসূচি নেওয়া হবে।
বিহারের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে, সরকারি অমৃত মহোৎসবের সমান্তরালে বিহারের জনগণ ‘উঠো এ মেরে দেশ’এর সাংস্কৃতিক প্রচার শুরু করলেন।
দেশের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্ণ করার নামে, কেন্দ্রীয় সরকার, ‘অমৃত মহোৎসব’ কর্মসূচির অজুহাতে, আবারও ‘হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণ’এর সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের এজেন্ডা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা করছে। যার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতার রাজনীতির বিপজ্জনক পরিকল্পনা ও প্রতিশোধ নিতে তাদের পক্ষ থেকে স্থানে স্থানে বহু কর্মসূচি পালন করছে।
বিহারের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিহারের জনগণের দ্বারা সরকারি অমৃত মহোৎসবের সমান্তরালে ‘উঠো এ মেরে দেশ’এর নিপরীতে সাংস্কৃতিক প্রচার সময়ের প্রেক্ষাপটে একটি কার্যকরী উদ্যোগ। যার মধ্য দিয়ে বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসার বিরুদ্ধে অভিন্ন-সংস্কৃতির ঐতিহ্য, শান্তি ও ঐক্যের বার্তা নিয়ে গণশিল্পীরা ‘সাংস্কৃতিক যাত্রা’ করেন। যার মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে জনসাধারণের সাথে সম্পৃক্ত সক্রিয় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে বিগত কয়েক বছরের স্থবিরতা ভাঙারও চেষ্টা করা হয়েছে।
১৫ আগস্ট গণআন্দোলনের ভূমি ভোজপুরের জেলা সদর দফতর আরায় ১৮৫৭ সালের বীর কুনওয়ার সিং এবং শহীদ ভগত সিং’এর স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে সাংস্কৃতিকযাত্রা শুরু হয়। প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা এবং সিপিআই(এমএল) পলিটব্যুরোর সদস্য স্বদেশ ভট্টাচার্য তেরঙ্গা তুলে যাত্রার সূচনা করেন। এ উপলক্ষে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, ব্রিটিশদের সমর্থনকারী, ক্ষমাপ্রার্থী এবং স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতাকারীদের উত্তরসূরীদের ‘অমৃত মহোৎসব’ অভিযানের বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন করার জন্য এধরনের সাংস্কৃতিক প্রচার খুবই প্রয়োজন। যাত্রার প্রথম অনুষ্ঠান হয় আরা সংলগ্ন আগিয়ানো এলাকার পওয়ানা বাজারে লোকগান ও পথনাট্য পরিবেশনার মধ্য দিয়ে। উপস্থিত দর্শকদের উদ্দেশে জনসংস্কৃতি মঞ্চের বিহারের সভাপতি ও প্রবীণ সাহিত্যিক জিতেন্দ্র কুমার ভোজপুরের সংগ্রামের গৌরবময় ঐতিহ্য নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, এখানকার মাটিতে রয়েছে অভিন্ন সংস্কৃতি ও অভিন্ন ঐতিহ্যের সুদৃঢ় ঐতিহ্য। বীর কুনওয়ার সিং যখন গোটা শাহাবাদ অঞ্চল থেকে ব্রিটিশদের বিতাড়িত করে কয়েকদিনের জন্য তাদের হাত থেকে মুক্ত করেছিলেন, তখন তৎকালীন স্থানীয় প্রশাসক সাধারণ ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। একই দিনে আরার জয়প্রকাশ মেমোরিয়াল কমপ্লেক্সে স্থানীয় লেখক-শিল্পীদের আয়োজনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শিল্পীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করা হয়। প্রগতিশীল লেখক সংঘের বিহার সভাপতি এবং জনপথ পত্রিকার সম্পাদক সহ বেশ কয়েকজন প্রবীণ সাহিত্যিক, অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করার সময়, দেশে ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ বাড়ানোর উপর জোর দেন। এই উপলক্ষে তরুণ কবি অর্চনা প্রতিজ্ঞা সহ অনেক লেখক তাদের কবিতা আবৃত্তি করেন।
পাটনা জেলার ফুলওয়ারী শরিফে সাংস্কৃতিক যাত্রার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান উস্থাপন করা হয়। যেখানে অতীতে, বিজেপির নির্দেশে, ‘আতঙ্ক্ কি ফুলওয়ারি, সন্ত্রাস কি পাঠশালা’র মতো সম্বোধন দিয়ে মিডিয়ার দ্বারা ফুলওয়ারি শরীফকে হেয় করা হয়েছিল। এখানে সন্ত্রাসী ষড়যন্ত্রের গুজব ছড়িয়ে এনআইএ’র মাধ্যমে অনেক নিরপরাধ মুসলমানকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে সমগ্র এলাকার মানুষকে সাম্প্রদায়িক আতঙ্কে থাকতে বাধ্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ইসোপুর মহল্লা সহ অনেক বড় মুসলিম এলাকায়, সেখানকার বাসিন্দাদের সহায়তায় আয়োজিত যাত্রার সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর উপস্থাপনা দেখতে বিপুল সংখ্যক মানুষ ভিড় করেন।
বিজেপির সাম্প্রদায়িক ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করার জন্য জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে দলের নেতৃত্বদানকারী প্রবীণ কর্মী জনাব গালিব বলেন, প্রতিটি দফায় সত্য কথা বলাই শিল্পীর ধর্ম।
একই দিনে রাজধানী পাটনার কারগিল চক ও আঞ্জুমান ইসলামিয়া হল কমপ্লেক্সেও রাস্তার উপস্থাপনা অনুষ্ঠিত হয়।
যাত্রার তৃতীয় অংশ হয়েছিল বেগুসরাইয়ে। যেখানে আন্দোলনরত গ্রাম নওলা ও বালিয়া ছাড়াও শহরের দিনকর কলাভবনের প্রধান ফটকে পথসভা অনুষ্ঠিত হয়। এসময় স্থানীয় চিত্রশিল্পীদের কবিতার পোস্টার প্রদর্শিত হয়। সমস্ত ইভেন্টে, সিপিআই(এমএল) সহ অন্যান্য বাম দলের নেতারা এই যাত্রাকে স্বাগত জানিয়েছেন, সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে বিহারে চলমান সংগ্রামের উপর আন্ডারলাইন করেছেন এবং বলেছেন যে বিহারের রাজনীতি একটি নতুন পথ দেখাচ্ছে।
১৮ আগস্ট সাংস্কৃতিক যাত্রা মিথিলাঞ্চল হয়ে সমস্তিপুরে পৌঁছায়। সমস্তিপুরে, এআইএসএ’র ছাত্ররা যাত্রার উপস্থাপনায় সক্রিয় অংশগ্রহণ দেখিয়েছিল এবং স্থানীয় সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরাও অংশগ্রহণ করেছিলেন।
১৯ আগস্ট দারভাঙ্গা গ্রামে বাবা নাগার্জুনের স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দেওয়ার পরে, মিথিলাঞ্চলের আরও অনেক শহীদের স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে একটি প্রস্তাব নেওয়া হয়।
দারভাঙ্গায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে জনসংস্কৃতি মঞ্চের প্রবীণ সাহিত্যিক সুরেন্দ্র সুমন এবং অন্যান্য অনেক বরিষ্ঠ সাহিত্যিক এবং বাম দলগুলির নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন। শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে যাত্রাদল তাদের উপস্থাপনা করে।
সাংস্কৃতিক যাত্রার সমাপ্তি কর্মসূচি মধুবনী জেলায় ২০ আগস্ট রাখা হয়েছিল। যেখানে অনেক গ্রাম-শহরে সাংস্কৃতিক পরিবেশনার মধ্য দিয়ে যাত্রা সমাপ্ত হয়।
পুরো যাত্রা চলাকালীন, দলটির শিল্পীদের অনেক জায়গায় মালা পরিয়ে এবং অঙ্গবস্ত্র দিয়ে সম্মানিত করা হয়। শহরের অনুষ্ঠানে ছাত্রযুবকদের উপস্থিতি বেশি থাকলেও গ্রামাঞ্চলে রাতের অনুষ্ঠানে কৃষক, শিশু ও নারীদের ভালো উপস্থিতি দেখা গেছে।
সাংস্কৃতিক যাত্রায় গণআন্দোলনের জনপ্রিয় লোকশিল্পী নির্মোহীজী, নির্মল নয়ন, প্রমোদ যাদব ছাড়াও তরুণ গণসঙ্গীত শিল্পী রাজু রঞ্জন এবং পুনীত পাঠককে মানুষ খুব পছন্দ করেছিল। এর পাশাপাশি মহিলা দল ‘কোরাস’এর গানও বেশ প্রশংসিত হয়।
সারা যাত্রায় জনকবি রামতাজীর “হামনি দেশওয়া কে নয়া রাছাভিয়া হ্যায় জা... , মিলাল কায়সান আজাদি জাহান পানি না মিল...” গানটি খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এছাড়াও ফয়েজ, গোরখ পান্ডে, মহেশ্বর ও বিজেন্দ্র অনিলের জনপ্রিয় গান পরিবেশন করা হয়। যাত্রার শিল্পীদের সম্মিলিতভাবে রচিত হোলি টারজের গান — “ই রাজা কে রাজ আলবেলা হো ভাইয়া…” খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। ‘রংনায়ক বেগুসরাই’এর নাট্যকর্মীদের পরিবেশিত নাট্যশিল্পী দীপক সিনহার লেখা পথনাটক ‘উঠো আমার দেশ’এর মনোমুগ্ধকর পরিবেশনা সর্বত্র দর্শকদের আকৃষ্ট করে।
সামগ্রিকভাবে, জনসংস্কৃতি মঞ্চের বিহার শাখার সমন্বয়ে আয়োজিত ‘সাংস্কৃতিক যাত্রা’ এবং প্রাণবন্ত সাংস্কৃতিক উপস্থাপনা আবারও সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়ায় দর্শকদের মনে নতুন সতেজতা পূর্ণ করার কাজ করেছে। মানুষের মধ্যে প্রাণবন্ত সংলাপে, যাকে দেশ ও সমাজের জ্বলন্ত সমস্যা নিয়ে সাংস্কৃতিক জগতে বিরাজমান নীরবতা ভাঙার শুভ সূচনা বলা যেতে পারে।
মনে রাখতে হবে বিহারের মাটিতে লেখককবি-শিল্পী ও কর্মী বুদ্ধিজীবীদের সরাসরি রাজনৈতিক-সামাজিক সমস্যা নিয়ে জনগণের মধ্যে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের এক দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। বলা হয় বাবা নাগার্জুন এবং ফণীশ্বর নাথ রেণুর মতো সাহিত্যিকরাও সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে রাজপথে আওয়াজ তুলেছিলেন।
পরবর্তী সময়ে ক্ষমতা-রাজনীতির অর্থায়নে সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত সংস্কৃতির স্রোতে প্রভাব বিস্তার করে গণমুখী সংস্কৃতিকে বাম রাজনীতির প্রচারক হওয়ার জুমলা বানানো হয়। শিল্পীদের স্বল্পতা ও সম্পদহীনতার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে ‘জাফরান সাংস্কৃতিক ধারা’ অগণিত সাংস্কৃতিক চক্র ও শিল্পীদের সামাজিক উদ্বেগ থেকে বিচ্ছিন্ন করে অধিকাংশ মানুষকে তাদের এজেন্ডা প্রচারে পরিণত করেছে।
জনসংস্কৃতি মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত সংস্কৃতিকর্মীরা বলছেন, বর্তমান রাজনীতি থেকে শুরু করে সংস্কৃতি পর্যন্ত বিপর্যস্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ‘আর্ট ফর লাইফ অ্যান্ড চেঞ্জ’ পূর্ণ শক্তিতে প্রতিষ্ঠিত হওয়া খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে।
করোনা মহামারীর ছোবলে বিগত দু’বছর নির্মাণ শ্রমিক সহ সমগ্র অসংগঠিত শ্রমিকদের জীবনে নেমে এসেছিল ভয়ঙ্কর অভিঘাত। তারসাথে সাম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টি করে দাঙ্গা লাগানো, আকাশছোঁয়া, মূল্যবৃদ্ধি ও কাজের বাজার কমে আসায় শ্রমজীবী মানুষের জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে। কেন্দ্রীয় সরকার ৪টি শ্রমকোড এনে শ্রমিকদের সমস্ত অধিকার কেড়ে নিতে উদ্যত।
এমতাবস্থায় নির্মাণ শ্রমিকদের প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কোনও দৃষ্টি নেই। ফলে তাদের সামাজিক সুরক্ষা বাতাসে মিলিয়ে গেছে। শুধু আপনি কিভাবে মরেছেন সেই অনুযায়ী অনুদানের পরিমাণ ঠিক হবে। আর অবসর হলে পেনশন। তাও আদায় করতে জুতোর শুকতলা শুকিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ হতাশ হয়ে যাতায়াত বন্ধ করে দিচ্ছে। দাবিবিহীন হয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু নির্মাণ শ্রমিকরা প্রশ্ন তুলছে ১৯৯৬ সালে নির্মাণ শ্রমিকদের জন্য রচিত কেন্দ্রীয় আইনবলে শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য নির্মিত ক্ষেত্র থেকে ১ শতাংশ সেস আদায় করে তহবিল গঠন করা এবং সেখান থেকে নির্মাণ শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা দেওয়া এবং ৫ শতাংশ দপ্তরের খরচে ব্যবহার করা। সমস্ত সামাজিক সুরক্ষা বন্ধ করে কেবলমাত্র মৃত্যু ও অবসরে অর্থ ব্যয় করছেন। তাহলে সেস থেকে আদায়কৃত হাজার হাজার কোটি টাকা কোথায় যাচ্ছে? তা শ্রমিকদের কাছে পরিষ্কার নয়। সরকারের মনোভাব এমন যে বাংলায় নতুন করে আর নির্মাণ শ্রমিক তৈরি হচ্ছে না অথবা সব নথিভুক্ত হয়ে গেছে। সরকারি দপ্তরের আধিকারিকরা একবার বড় বড় নির্মাণ স্থলগুলো পরিদর্শন করে আসুন তাহলে দেখতে পাবেন কত নির্মাণ শ্রমিক আজও অনথিভুক্ত হয়ে আছে। আর যারা নথিভুক্ত হয়ে আছেন তাদের মধ্যে অনকেই নানা কারণে সময়মতো পুনর্নবীকরণ না করতে পারায় বাতিল হয়ে যাচ্ছেন। এরকম অসংখ্য উদাহরণ আছে।
আর কাগজ খুললেই চোখে পড়ে কোনো না কোনো নির্মাণ শ্রমিক কর্মরত অবস্থায় মারা গেলেন। সর্বভারতীয় যেকোন রির্পোটে চোখ বুলোলে দেখতে পাবেন সবচেয়ে বেশি কর্মরত অবস্থায় দুর্ঘটনায় মারা যায় এই শিল্পে। কিন্তু নির্মাণ কর্তৃপক্ষের শাস্তিদানের ছবি প্রায় দেখাই যায় না। মজুরির ক্ষেত্রেও সবচেয়ে বেশি বঞ্চনা। সরকারি ন্যূনতম মজুরি এ-জোন, বি-জোন হিসেবে ভাগ করা হয়েছে। এ-জোনে একজন দক্ষ শ্রমিক ৪২৭ টাকা, বি-জোনে ৩৯৮ টাকা দৈনিক মজুরি। অদক্ষ শ্রমিকের অবস্থা অনুমেয়। আজকের দিনে বাজারদর অনুযায়ী ক্যালকুলেশন করলে দক্ষ শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি দাড়ায় ১,০০০ টাকা। কিন্তু তা থেকে অনেক কম মজুরি ঘোষণা করেছে সরকার। নির্মাণ শ্রমিকদের বঞ্চনা এক সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমস্যা সমাধানের পথ হিসেবে ব্যপক প্রচার করা, সংগঠিত করা, বড় ধরনের সমাবেশ করে সরকারের কাছে গণডেপুটেশন দেওয়া দরকার। আওয়াজ উঠুক –
- কিশোর সরকার
গত ১৭ আগস্ট জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্য নির্বাচনী অফিসার হৃদেশ কুমার সিং সাংবাদিকদের সামনে বললেন — যাঁরা নানান কাজে এখন জম্মু ও কাশ্মীরে বাস করছেন, অন্য রাজ্যের বাসিন্দা হলেও কাশ্মীরে নিয়োজিত রয়েছেন, তাঁরা জম্মু ও কাশ্মীরের ভোটার তালিকায় নাম তুলে সেখানে ভোট দিতে পারবেন। কমিশনের কথায়, “ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য ডোমিসাইল সার্টিফিকেট লাগবে না। জম্মু ও কাশ্মীরে কর্মরত সশস্ত্র বাহিনীর জওয়ানরাও ভোটার তালিকায় নাম লেখাতে পারবেন। এছাড়া, বাইরে থেকে আসা চাকরিজীবী, পড়ুয়ারাও ভোট দিতে পারবেন।” ভোটার তালিকায় বহিরাগতদের অন্তর্ভুক্তির এই সিদ্ধান্ত কাশ্মীরের জনগণের কাছে, কাশ্মীরের প্রধান দলগুলোর কাছে পিছনের দরজা দিয়ে জম্মু ও কাশ্মীরের নির্বাচনকে প্রভাবিত করা এবং কাশ্মীরের জনগণের রাজনৈতিক অধিকার হরণের নকশা বলেই প্রতিভাত হল। ফলে, কাশ্মীরে এর বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ উঠল। এর মোকাবিলায় জম্মু ও কাশ্মীর প্রশাসন স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোতে বিজ্ঞাপন দিয়ে জানালো “এটা কায়েমি স্বার্থের দ্বারা বাস্তব তথ্যের ভ্রান্তিজনক উপস্থাপনা। ভোটার তালিকার এই পরিমার্জনা জম্মু ও কাশ্মীর কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের বর্তমান বাসিন্দাদের নিয়েই হবে এবং ভোটার সংখ্যার বৃদ্ধি তাদের নিয়েই হবে যাদের বয়স ২০২২’র ১ অক্টোবর বা তার আগে ১৮ বছর হবে।” বয়স ১৮ বছর হলে ভোটার তালিকায় নাম তোলাটা সমস্ত রাজ্য ও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের নিয়ম এবং জম্মু ও কাশ্মীর তার ব্যতিক্রম হতে পারে না। কিন্তু প্রশ্ন হল, জম্মু ও কাশ্মীরে কর্মরত বহিরাগতরাও ভোটার রূপে ভোটার তালিকায় নাম তুলতে পারবেন বলে মুখ্য নির্বাচনী অফিসার যা বললেন, প্রশাসনের দেওয়া বিজ্ঞাপনে কি তাকে নাকোচ করা হল? যাবতীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্টগুলোকে কায়েমি স্বার্থের হাতে ‘গুজব ছড়ানো’ বলে অভিহিত করা হলেও তার সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট অস্বীকৃতি কিন্তু সরকারি বিজ্ঞাপনে ধরা পড়ল না। জম্মু ও কাশ্মীরের ‘বর্তমান বাসিন্দারাই’ তালিকায় স্থান পাবেন বলে যা বলা হল, সেই বাসিন্দারা যে কাশ্মীরের স্থায়ী বাসিন্দা, বিজ্ঞাপন তাকে সংশয়হীন করল না। বিপরীতে, জম্মু ও কাশ্মীর প্রশাসনের ঐ বিজ্ঞাপনের মধ্যেই যে বিভ্রান্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্য ছিল তার আভাস মিলল কয়েক দিন পর প্রকাশিত আর একটা সংবাদে। ঐ সংবাদ জানালো, ভোটার তালিকায় নাম ছিল এমন যে সমস্ত হিন্দু-শিখ পরিবার ৯০’র দশকে উপত্যকা ছেড়েছিলেন, তাঁরাও জম্মু ও কাশ্মীরের আসন্ন নির্বাচনে ভোট দিতে পারবেন। এই বিষয়ে আনন্দবাজার পত্রিকায় ২৫ আগস্ট প্রকাশিত এক রিপোর্টের অংশবিশেষ প্রাসঙ্গিক বলে এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে, “বিজেপির দাবি ১৯৯০ সালে নথিভুক্ত রয়েছেন এমন ৬২ হাজার পরিবার উপত্যকা ছেড়েছিলেন। আজ তাঁদের জনসংখ্যা ২.২০ লক্ষ। তাঁদের মধ্যে ১.৮০ লক্ষের বয়স ১৮’র বেশি। এদের মধ্যে যাঁরা নিজেদের শরণার্থী এলাকার ভোটার কার্ড ছেড়ে কাশ্মীরে নিজেদের অতীত ঠিকানায় ভোটার তালিকায় নাম তোলার আবেদন জানাবেন, তাঁরাই ভোটার হিসাবে গণ্য হবেন। কমিশন জানিয়েছে, ওই ভোটাররা যেখানে রয়েছেন, সেখানেই একাধিক ভোট কেন্দ্র তৈরি করা হবে। দিল্লীতে যেমন জম্মু-কাশ্মীর ভবন, কাপাসেরা, শালিমার গার্ডেন এলাকায় ভোটকেন্দ্র গড়া হবে।”
জম্মু ও কাশ্মীরের নির্বাচনে বিজেপির সুবিধালাভের লক্ষ্যে আর একটা কৌশলের অবলম্বন এরআগে আমরা দেখেছি। ডিলিমিটেশন কমিশনকে দিয়ে জম্মু ও কাশ্মীরের বিধানসভা ক্ষেত্রগুলোর পুনর্বিন্যাস ঘটানো হল। দেখা গেল, ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে (তারপর কোনো জনগণনা আর হয়নি) জম্মু অঞ্চলের জনসংখ্যা (৫৩,৫০,৮১১, তৎকালীন রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ৪২.৮৯ শতাংশ) কাশ্মীর উপত্যকার জনসংখ্যার (৬৮,৮৮,৪৭৫, মোট জনসংখ্যার ৫৪.৯৩ শতাংশ) তুলনায় যথেষ্ট কম হলেও ডিলিমিটেশন কমিশন জম্মুর আসন সংখ্যাকে ৩৭ থেকে ৬টা বাড়িয়ে করল ৪৩, আর কাশ্মীর উপত্যকার আসন সংখ্যা মাত্র ১টা বেড়ে ৪৬ থেকে ৪৭ হল। জম্মুতে হিন্দু জনসংখ্যার প্রাধান্য, এবং সেখানে বিজেপির প্রভাবই অন্যদলের চেয়ে বেশি। জম্মু ও কাশ্মীর বিধানসভার ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি যে ২৫টা আসন পেয়েছিল তার সবকটাই এসেছিল জম্মু অঞ্চল থেকে। অতএব, জম্মু অঞ্চলে আসন বেশি বাড়লে সেগুলো বিজেপির ঝুলিতে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ডিলিমিটেশন কমিশনের সদস্যরা সেটা জানতেন না তা নয়, আর তাই জনসংখ্যার বিচারকে গুরুত্বহীন করে ডিলিমিটেশন কমিশন এই লক্ষ্যেই নিজেদের চালিত করল। কাশ্মীর উপত্যকার তুলনায় জম্মুর আসন সংখ্যাকে ছ’গুণ বাড়ানো এবং এখন আবার বহিরাগতদের জম্মু ও কাশ্মীরের ভোটার তালিকায় নাম ঢোকানোর দুরভিসন্ধি একটা বিষয়কেই প্রতিপন্ন করছে — জম্মু ও কাশ্মীরের বিধানসভা নির্বাচনে বিজয় হাসিলের জন্য সেখানকার নির্বাচকমণ্ডলীর ওপর আস্থা বিজেপির এবং নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহদের নেই। আজ সিবিআই, ইডি ও আয়কর দপ্তরের মতো ডিলিমিটেশন কমিশন এবং নির্বাচন কমিশনও নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহদের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে বিজেপির আধিপত্য প্রতিষ্ঠা এবং বিরোধী পক্ষকে কোণঠাসা করার লক্ষ্যেই কাজ করছে। জম্মু ও কাশ্মীর নিয়ে দুই কমিশনের সিদ্ধান্তের সমালোচনায় পিডিপি নেত্রী মেহবুবা মুফতি বলেছেন, “নির্বাচনে রিগিং করা হয় কখনও নির্বাচন চলার সময়, কখনও তার পরে, যেমনটা আমরা মহারাষ্ট্র সহ কয়েকটা রাজ্যে দেখেছি। ইডির মতো সংস্থাগুলোকে এই ধরনের রিগিং’এর কাজে লাগানো হচ্ছে।” জম্মু ও কাশ্মীরের ক্ষেত্রে ডিলিমিটেশন কমিশন ও নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তগুলো কারচুপি তথা রিগিং’এরই নামান্তর।
পিডিপি-বিজেপি জোট সরকারের ওপর থেকে বিজেপি ২০১৮’র ১৯ জুন সমর্থন প্রত্যাহার করে নেওয়ায় চার বছরেরও বেশি সময় ধরে জম্মু ও কাশ্মীরে কোনো নির্বাচিত সরকার নেই। এরপর এল ২০১৯’র ৫ আগস্টের সেই বিপর্যয়কর দিন, যেদিন জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্য মর্যাদা হরণ করে তাকে দুটো কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ করা হল, ৩৭০ ও ৩৫এ ধারা বাতিলের মধ্যে দিয়ে কাশ্মীরের বিশেষ ব্যবস্থা ও অধিকারগুলোর বিলোপ ঘটানো হল। এছাড়া, জম্মু ও কাশ্মীরের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ চরিত্রকে পাল্টানোটাও বিজেপির কাছে এক গুরুত্বের এজেন্ডা। এখানে কখন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তার কোনো স্থিরতা নেই। আবার, নির্বাচন হলেই জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্য মর্যাদা ফিরে পাওয়ার নিশ্চয়তাও নেই। এসবের বিরুদ্ধে দৃঢ় ঐক্যবদ্ধ লড়াইটাই যে জরুরি তার উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু তার সংকেত কোথায়? সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বিরোধী ঐক্যের চেহারা যেমন, জম্মু ও কাশ্মীরের প্রধান দলগুলোর ক্ষেত্রেও বিষয়টা একই রকম বলে দেখা যাচ্ছে। গুলাম নবি আজাদ কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করে কাশ্মীরে নতুন দল গড়ার কথা বলেছেন। সেই দল নির্বাচনে লড়লে বিরোধী ভোট ভাগ হয়ে বিজেপিরই সুবিধা হবে। পাঁচটা দলের যে গুপকর জোট কাশ্মীরের বিরুদ্ধে সংঘটিত সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে এবং নির্বাচনে বিজেপির বিরুদ্ধে একজোট হয়ে লড়ার কথা বলেছিল, তাদের ঐক্যও এখন নড়বড় করছে। ন্যাশনাল কনফারেন্স সভাপতি ওমর আবদুল্লা গুপকর জোট ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া এবং আসন্ন নির্বাচনে ৯০টা আসনে এককভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা বললেন। পরে অবশ্য তাঁর বাবা ফারুক আবদুল্লা বললেন যে, ঐ জোট কখনই গুটিয়ে যাবে না। আমাদের দেশের নেতারা আর কবে ফ্যাসিবাদের বিপদকে যথাযথ মাত্রায় অনুধাবন করে সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধে নিজেদের সমর্পিত করবেন?
- জয়দীপ মিত্র
সম্প্রতি মহিলাদের এক আলোচনা সভায় এই প্রতিবেদকের থাকার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে বিভিন্ন পেশাজীবী এবং বিভিন্নভাবে জীবন সংগ্রামে লড়তে থাকা মহিলাদের সাথে পরিচয় হয়। আমি তার মধ্যে থেকে দু’একটি অভিজ্ঞতা তুলে ধরছি। আমার ব্যক্তিগত একটি অভিজ্ঞতাও সকলের সাথে ভাগ করে নিতে চাই।
একজন মহিলা বলেন, তিনি পরিচারিকার কাজ করেন। তাঁর নিজের সংসারে দুই ছেলেমেয়ে এবং নিজের মা বাবাকেও দেখতে হয়। স্বামী অন্য একজন মহিলাকে বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছেন। তাঁর আয়ের সবটাই চলে যায় পরিবারের খরচ চালাতে। নিজের কথা ভাবার সময় নেই। হাড়ভাঙা খাটুনির পর বিশ্রামটুকুও জোটে না। তিনি চান তাঁর বাচ্চারা যেন সুস্থ জীবন পায়। তিনি এই আলোচনা সভায় ছুটে এসেছিলেন কিছু পাওয়ার আশায়।
এবার আসি অন্য আর এক মহিলার অভিজ্ঞতায়। তাঁর স্বামী বেশ কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। এই মহিলা দোকান করে সংসার চালান। নিজের মায়ের কথা বলতে গিয়ে বলেন, আজ এতগুলো বছর পর তাঁর মা একা। কেন? কারণ ছেলেরা তাঁকে দেখে না। তাঁর নিজের ফিজিক্স নিয়ে অনার্স গ্র্যাজুয়েট হওয়া ছেলের প্রশ্ন, কেন সে তার অন্য বন্ধুদের মতো সুবিধা পায় না? কেন সে ইঞ্জিনিয়ায়িং পড়তে পারলো না? সেই নিয়ে সে মাকেই দোষারোপ করে। ছেলে এখন অবসাদগ্রস্ত। বিয়ের আগে হোক বা পরে, মেয়েদের নিজের মতো করে বাঁচার সুযোগ কোথায়? তাদের স্বাধীনতা কোথায়? শুধু সংসারের দায় কাঁধে নিয়ে চলতে চলতে এক সময় জীবন ফুরিয়ে যায়। তবে এই মহিলাটি বলেন, “স্বাধীনতা মানেই স্বেচ্ছাচারিতা নয়”। কথাটা খুব দামী মনে হয়েছিল। সেই কথার রেশ টেনেই বলি, এই আলোচনা সভায় বেশ কিছু প্রশ্ন উঠে এসেছিল। লিঙ্গ, পোশাক, মেয়েদের নিজস্ব জীবন-যাপন ইত্যাদি প্রসঙ্গে।
আলোচনা প্রসঙ্গে একজনের মন্তব্য, একজন রূপান্তরকামী নারী নাকি ‘হিজড়ে’ অর্থাৎ আন্তঃকামী সম্প্রদায়ের মানুষরা সমগোত্রীয়। কিন্তু আসলে তা নয়। রূপান্তরকামী নারী সবসময় নিজেকে একজন মহিলা হিসেবেই পরিচয় দিতে চান, কিন্তু ‘হিজড়ে’ মানুষরা নিজেদের একটি আলাদা তৃতীয় সম্প্রদায় তৈরি করতে চান। এছাড়া তাদের মধ্যে আরও বেশ কিছু পার্থক্য আছে। সেগুলো নিয়ে পরে আলোচনা করা যেতে পারে। এবার আসি একটি অন্য প্রশ্নে। ধূমপান কিন্তু পুরুষ নারী উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর। কারণ এতে দুজনেরই প্রজনন ক্ষমতা কমে যায়। ফুসফুস তো ক্ষতিগ্রস্ত হয়ই। পোশাকের প্রশ্নও উঠেছিল। যদিও পোশাকের কোনো লিঙ্গ হয় না, তাও পুরুষ হোক বা নারী সকলের পোশাকই ভদ্রস্থ, মার্জিত ও রুচিশীল হওয়া প্রয়োজন। যদিও এব্যাপারে নিজের পছন্দ শেষ কথা এবং মনে রাখতে হবে পোশাক নিজের ব্যক্তিত্বকে তুলে ধরে।
এবার আসি নিজের একটি অভিজ্ঞতার কথায়। সকলেরই কাজের বিনিময়ে উপযুক্ত মূল্য বা পারিশ্রমিক পাওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু আজ একজন সেলিব্রিটির সোশ্যাল মিডিয়া টিমের সদস্য হিসেবে কাজ করেও আমি বা আমরা আমাদের স্যালারি বা বেতন পাই না। কাজ বা শ্রমের মূল্য থেকে আমরা বঞ্চিত। তিনি একজন নামজাদা মানুষ হওয়ার সুবাদে কেন কিছু তরুণ-তরুণীর শ্রমকে এইভাবে শোষণ করবেন? আমাদের ভদ্রতার সুযোগ নিয়ে?
- অবন্তী
ঔপনিবেশিক আমলে পরিবেশ আইনগুলি মূলত তৈরি হয়েছিল বেশি রাজস্ব অর্জন ও উচ্চশ্রেণির স্বার্থরক্ষার দিকে মাথায় রেখে। স্বাধীনতার পরেও প্রথমদিকে এই আইনগুলির খুব একটা বদল হয়নি। বিষয়টি বদলাতে শুরু করল ১৯৭২ সালের স্টকহোম কনফারেন্সের পর। এই কনফারেন্স পরিবেশ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার দিকে সরকার ও জনগণের দৃষ্টিকোণ বদলের চেষ্টা করে। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সেই ১৯৭২এ তৈরি করলেন ন্যাশানাল কাউন্সিল ফর এনভায়রনমেন্টাল পলিসি অ্যান্ড প্ল্যানিং। ১৯৭২ সালেই এলো ওয়াইল্ড লাইফ প্রোটেকশ্যান অ্যাক্ট। তৈরি হল চারটি নতুন সংস্থা — জাতীয় ও রাজ্যর বন্যপ্রাণী সংক্রান্ত পরামর্শদাতা পর্ষদ, জাতীয় চিড়িয়াখানা পর্ষদ, বন্যপ্রাণ সংক্রান্ত অপরাধ নিয়ন্ত্রক পর্ষদ, জাতীয় ব্যাঘ্র সংরক্ষণ পর্ষদ।
সরকারের দিক থেকে যেমন কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হল, তেমনি গণআন্দোলনের মধ্যেও ঢুকে পড়ল পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি। ১৯৭৩ সালে সুন্দরলাল বহুগুণার নেতৃত্বে শুরু হল বিখ্যাত চিপকো আন্দোলন। উত্তরাখণ্ডের চামোলি ও তেহরি গাড়োয়াল জেলায় মহিলারা গাছ কাটা রুখতে দল বেঁধে এগিয়ে এলেন ও নানা কর্মসূচি গ্রহণ করলেন। ১৯৭৪ সালে এল জলদূষণ প্রতিরোধ আইন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৮’র মধ্যে চারবার তা সংশোধিত হল। ১৯৭৮ সালে কেরালায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কুন্ঠিপুজা নদীর ওপর বাঁধ তৈরির কথা এলে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হল। সাইলেন্ট ভ্যালি নামে এক বনাঞ্চলকে বাঁচানোই ছিল এই আন্দোলনের মূল দাবি।
১৯৮০ সালে তৈরি হল বনাঞ্চল সংরক্ষণ আইন।
১৯৮১ সালে এল বায়ুদূষণ প্রতিরোধী আইন।
১৯৮৫ সালে রাজীব গান্ধী যখন প্রধানমন্ত্রী তখন দ্য ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর এনভায়রনমেন্টাল পলিসি অ্যান্ড প্ল্যানিংকে একটি পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রকে রূপান্তর করা হল। তৈরি হল পরিবেশ ও বন মন্ত্রক।
১৯৮৫ সালে মেধা পাটেকর ও বাবা আমতের নেতৃত্বে শুরু হল নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন। এই আন্দোলন নর্মদা নদীর ওপর বাঁধ তৈরির বিরোধিতা করে শুরু হলেও ক্রমশ বড় বাঁধের ক্ষতিকর দিক নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন তৈরি করতে ও ভাবনায় বদল আনতে সহায়তা করল।
১৯৮৫ সালেই ঘটল ভূপাল গ্যাস দুর্ঘটনা। ১৯৮৬ সালে সরকার তৈরি করল পরিবেশ সংরক্ষণ আইন। ১৯৮৮ সালে তৈরি হল জাতীয় বননীতি। ১৯৮৯ সালে এল ক্ষতিকর বর্জ পদার্থ সম্পর্কিত আইন।
১৯৯০’র দশকে ভাগীরথী নদীর ওপর তেহরি বাঁধ নির্মাণের সময় ব্যাপক মানুষের উচ্ছেদের বিরুদ্ধে শুরু হল আন্দোলন।
১৯৯১ সালে সমুদ্র তটভূমি রক্ষা সংক্রান্ত আইন এলো।
১৯৯২ সালে হয়েছিল রিও সামিট। তার নিদানগুলি মাথায় রেখে ১৯৯৫ সালে তৈরি হল ন্যাশানাল এনভায়রনমেন্ট ট্রাইব্যুনাল আইন। এই আইনের লক্ষ্য হল পরিবেশের কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের আইনী ও প্রশাসনিক সহযোগিতা প্রদান।
১৯৯৮ সালে বায়োমেডিক্যাল বর্জ প্রক্রিয়াকরণ সংক্রান্ত নিয়মনীতি এল।
১৯৯৮ সালেই এল জাতীয় চিড়িয়াখানা নীতি।
১৯৯৯ সালে শহরাঞ্চলে কারখানা তৈরির নিয়মনীতি তৈরি হল।
২০০০ সালে পৌর অঞ্চলের কঠিন বর্জ পদার্থ (সলিড ওয়েস্ট) সংক্রান্ত আইন এল। এই বছরেই এল শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত নীতিমালা। এই বছরে ওজন স্তরের সংরক্ষণ বিষয়ক নিয়মনীতিও চালু করা হল।
২০০১ সালে শক্তি সংরক্ষণ নীতি এল।
২০০২ সালে এল বায়োলজিক্যাল ডাইভার্সিটি অ্যাক্ট।
২০০৩ সালে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে কিছু সংশোধন করে এই সংক্রান্ত অপরাধে শাস্তি আরো বাড়ানো হল। ২০০৬ সালে আরেকবার এর সংশোধন করে শাস্তি আরো কঠোর করা হল। ২০০৬ সালে এল জনজাতি (সিডিউলড ট্রাইব) ও অন্যান্য বনবাসীদের অধিকার রক্ষার জন্য বিশেষ আইন।
২০১০ সালে এল ন্যাশানাল গ্রীন ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট। ২০১১ সালে এল ইলেকট্রনিক বর্জ সংক্রান্ত নিয়মনীতি।
২০১৪ সালে পরিবেশ ও বন মন্ত্রককে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত মন্ত্রকে রূপান্তর করা হল। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি সংযুক্ত করে বিশ্ব উষ্ণায়ন ও পরিবেশ সংক্রান্ত সমস্যাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হল।
২০১৬ সালে বনভূমির জমিকে ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে অন্যান্য কাজে ব্যবহারের অধিকার দিয়ে পূর্ববর্তী আইনকে খানিকটা লঘু করা হল, যা পরিবেশ ও জনজাতি, বনবাসী মানুষদের জন্য বিপদজনক।
২০১৬ সালে প্লাস্টিক বর্জ সংক্রান্ত নিয়মনীতি এল। এই বছরেই বাড়ির রঙে লেড ব্যবহার সংক্রান্ত নিয়মে নিয়ন্ত্রণ আনা হল। পৌর অঞ্চলের কঠিন বর্জ পদার্থ (সলিড ওয়েস্ট) সংক্রান্ত আইনকে পৌর অঞ্চলের বাইরে সার্বিক করে তোলা হল এই বছরেই।
২০১৭ সালে এল জলাভূমি সংরক্ষণ সংক্রান্ত নিয়মনীতি।
২০২২ সালে এল বনভূমি সংরক্ষণ সংক্রান্ত নতুন নীতি। ১৯৮০ সালের নীতিমালায় বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হল।
- সৌভিক ঘোষাল
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর এগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্ট (আইএফএডি), জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ), জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক যৌথভাবে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে কিছু তথ্য।
২০২১ সালে ৮২.৮ কোটি মানুষ অনাহারের কবলে। তার আগের বছরের থেকে ৪.৬ কোটি বেশি এবং ২০১৯’র থেকে ১৫ কোটি বেশি।
২০১৫ সাল থেকে তুলনামূলকভাবে অপরিবর্তিত থাকার পর ২০২০ সালে ক্ষুধায় আক্রান্ত মানুষের অনুপাত লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে এবং ২০২১ সালে বিশ্ব জনসংখ্যার ৯.৮ শতাংশ অনাহারক্লিষ্ট। এটি ২০১৯এ ছিল ৮ শতাংশ এবং ২০২০তে ৯.৩ শতাংশ।
২০২১ সালে বিশ্বের প্রায় ২৩০ কোটি মানুষ (২৯.৩ শতাংশ) মাঝারি বা গুরুতরভাবে খাদ্য নিরাপত্তাহীন অবস্থায় ছিল। এই সংখ্যা কোভিড১৯ মহামারীর প্রাদুর্ভাবের আগের তুলনায় ৩৫ কোটি বেশি। প্রায় ৯২.৪ কোটি মানুষ (বিশ্বের জনসংখ্যার ১১.৭ শতাংশ) গুরুতর মাত্রায় খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন হয়েছে, যা দু’বছরে ২০.৭ কোটি বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২১ সালে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় লিঙ্গ ব্যবধান বাড়তে থাকে। বিশ্বের ৩১.৯ শতাংশ নারী মাঝারি বা মারাত্মক মাত্রায় খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ছিল, পুরুষদের ক্ষেত্রে তা ছিল ২৭.৬ শতাংশ। ৪ শতাংশের বেশি পয়েন্টের ব্যবধান, ২০২০ সালে এই ব্যবধান ছিল ৩ শতাংশ পয়েন্ট।
প্রায় ৩১ কোটি মানুষ ২০২০ সালে স্বাস্থ্যকর খাদ্য পায়নি। ২০১৯ সালের তুলনায় ১১.২ কোটি বেশি, কোভিড১৯ মহামারী ও তার মোকাবিলায় নেওয়া পদক্ষেপগুলির কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে এটা হয়েছে।
পাঁচ বছরের কম বয়সী আনুমানিক ৪.৫ কোটি শিশু অপুষ্টির সবচেয়ে মারাত্মক রূপ ‘অবক্ষয়ে’ ভুগছিল। যা শিশুদের মৃত্যুর ঝুঁকি ১২ গুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়। অধিকন্তু, পাঁচ বছরের কম বয়সী ১৪.৯ কোটি শিশুর খাদ্যে প্রয়োজনীয় পুষ্টির দীর্ঘস্থায়ী অভাবের কারণে তাদের বৃদ্ধি ও বিকাশ থেমে গেছে। এবং তার উল্টোদিকে ৩.৯ কোটি শিশু ওভারওয়েট।
কেবল বুকের দুধ খাওয়ানোর মাত্রা বাড়ছে। ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী ছয় মাসের কম বয়সী প্রায় ৪৪ শতাংশ শিশুকে কেবলমাত্র বুকের দুধ খাওয়ানো হচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে তা ৫০ শতাংশ করার লক্ষ্য আছে। অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়, প্রতি তিনজনের মধ্যে দুজন শিশুকে তাদের বৃদ্ধি ও পূর্ণ সম্ভাবনা বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম বৈচিত্র্যপূর্ণ খাদ্য খাওয়ানো হয় না।
গোটা বিশ্বজুড়ে খাদ্য সংকট ক্রমেই ভয়াবহ রূপ নিতে যাচ্ছে। অন্যদিকে, দিনের পর দিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে খাদ্য পণ্যের দাম। সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে তা ক্রমেই চলে যাচ্ছে, তৈরি হচ্ছে দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি। এই মূল্যবৃদ্ধি বিশ্ব খাদ্যবাজারে ফাটকাবাজিকে যেমন উৎসাহিত করছে, তেমনিই হাতে গোনা কয়েকটি খাদ্যপণ্য সরবরাহকারী কোম্পানি বিপুল মুনাফা আদায় করে নিল এই কয়েকমাসে।
বিশ্বের চারটি বৃহত্তম খাদ্য সরবরাহকারী সংস্থা বিগত কয়েক দশক ধরে বিশ্ব খাদ্য-বাজারটিকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। নিজেদের পকেটে পুড়েছে বিপুল মুনাফা। ২০২৪’র মধ্যে জোগানকে ছাপিয়ে যাবে চাহিদা, আর সেই আবহে আরও বেশি মুনাফা কামানোর রাস্তা তৈরি হচ্ছে।
রাষ্ট্রসংঘের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন’এর রিপোর্ট অনুযায়ী, এবছরেই খাদ্যশস্যের দাম কুড়ি শতাংশের বেশি ইতিমধ্যেই ছাড়িয়ে গেছে। প্রায় ৩৪.৫ কোটি মানুষ চরম খাদ্য সংকটের কবলে! যা, কোভিডকালকেও ছাপিয়ে গেছে। কোভিডকালে খাদ্য সংকটের কবলে পড়েন ১৩.৫ কোটি মানুষ।
চারটে কোম্পানি এই আন্তর্জাতিক খাদ্য বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করছে — আর্চার ড্যানিয়েলস্ মিডল্যান্ড কোম্পানি, বাঞ্জ, কার্গিল ও ড্রেফাস — সংক্ষেপে এবিসিডি। এরাই বিশ্বের ৭০-৯০ শতাংশ খাদ্যশস্যের বাজারকে কব্জা করে রেখেছে। এনার্জি বা শক্তির বাজারের তুলনায় খাদ্যপণ্যের বাজার অনেক বেশি কেন্দ্রীভূত ও অস্বচ্ছ নিয়ম পদ্ধতিতে চলে। এখানে ফাটকাবাজির মাধ্যমে বিপুল মুনাফা কামানোর অনেক রাস্তাই খোলা রয়েছে। এবছরের জুন মাসে আন্তর্জাতিক খাদ্য পণ্যের দাম গতবছরের তুলনায় বেড়েছে ১৩ শতাংশ হারে!
কার্গিল’এর মুনাফা (এবছরের ৩১ মে পর্যন্ত) বেড়েছে ২৩ শতাংশ — ১৬৫ বিলিয়ন ডলার কামিয়ে সে রেকর্ড করেছে। আর, আর্চার ড্যানিয়েলস্ মিডল্যান্ড কোং এবছরের দ্বিতীয় অর্ধে যা লাভ করেছে, তা এখন পর্যন্ত তার ইতিহাসে সর্বোচ্চ! এবছরের দ্বিতীয় অর্ধে বাঞ্জ’এর মুনাফা বেড়েছে ১৭ শতাংশ, ড্রেফাস’এর মুনাফা ২০২১-এ তার আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে ৮০ শতাংশেরও বেশি।
ইতিমধ্যে অক্সফাম’এর মতো আরও কিছু সংস্থা এই সমস্ত খাদ্য সরবরাহকারী সংস্থাগুলোর উপর কর বসানোর প্রস্তাব রেখেছে। প্রস্তাব আসছে, সংশ্লিষ্ট সরকারগুলো খাদ্যশস্যের দামের উপর একটা নির্দিষ্ট সীমা বেঁধে দিক। এই কতিপয় সংস্থাগুলো বীজ-সার-আন্তর্জাতিক বাজার নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে গোটা ব্যবস্থারই আজ নিয়ন্ত্রক।
কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়ানোর এই ফাটকাবাজির পাশাপাশি রয়েছে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ, প্রতিকূল ভূ- প্রাকৃতিক পরিবেশ, যা খাদ্য উৎপাদনেও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।
আমাদের দেশেও গাঙ্গেয় উপত্যকা জুড়েই বৃষ্টির অভাবে কৃষি সংকট দুয়ারে কড়া নাড়ছে। কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রকের হিসাব অনুযায়ী আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় ৪৪ লক্ষ হেক্টর জমিতে ধান চাষ হয়নি, মোট চাষের এলাকা গতবছরের চেয়ে কমেছে ১২ শতাংশ।
বিপুল সংখ্যক ভারতবাসীকে অনাহারে অর্ধাহারে অপুষ্ঠিতে রেখে পালিত হচ্ছে ‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসব!’ গতমাসে রাষ্ট্রসংঘের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন’এর (এফএও) রিপোর্টবেআব্রু করল বিশ্বজোড়া খাদ্য-সংকটের ভয়াবহ দিক, চরম বৈষম্যের নির্মম বাস্তবতা। এই রিপোর্ট অনুযায়ী, ৯৭ কোটি ভারতীয় বা দেশের ৭১ শতাংশ জনসংখ্যা আজ এমনই এক পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে যে তাঁদের পুষ্টিকর খাদ্য কেনার আর্থিক ক্ষমতা নেই — এশিয়ায় এই সংখ্যাটি হল ৪৩.৫ শতাংশ আর আফ্রিকায় ৮০ শতাংশ। ওই রিপোর্ট জানিয়েছে, ভারতে দৈনিক মাথাপিছু পুষ্টিকর খাদ্য কেনার মূল্য ২৩৫ টাকা, যার অর্থ হল চার-পাঁচজনের পরিবারের জন্য তা হবে মাসে ৭,৬০০ টাকা।
এফসিআই’এর গুদামে উপচে পড়া খাদ্য নষ্ট হচ্ছে। এদিকে, আমাদের দেশের বিরাট সংখ্যক মানুষ খাদ্যশস্য কেনার নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছেন, খাদ্যশস্যের মূল্যবৃদ্ধির ফাঁসে ছটফট করছেন।
এই না হলে স্বাধীনতার অমৃতকাল!!
- অতনু চক্রবর্তী
মহাসাগর তো বরাবর পৃথিবীর সব দেশের সাধারণ সম্পদ হিসেবেই গণ্য হয়ে এসেছে। আমাদের অক্সিজেনের অর্ধেক অংশ সাগর থেকে আসে। পৃথিবীর প্রায় চল্লিশ শতাংশ মানুষ সমুদ্র ও উপকূলের ওপর নির্ভর করে জীবন-জীবিকা চালায়। দুনিয়ার উপকূল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই জনগোষ্ঠিগুলির হাত থেকে সমুদ্রকে কেড়ে নিচ্ছে বৃহৎ পুঁজির গ্রাস। বিপুল পরিমাণ ভর্তুকিপ্রাপ্ত মৎস্যশিকার কোম্পানিগুলি মাছের সংখ্যায় বিরাট হ্রাস ঘটাচ্ছে; বহুজাতিক তেল কোম্পানিগুলি সমুদ্রতল এবং প্রবালদ্বীপ ধ্বংস করছে; গভীর সমুদ্রে খনিকাজ জীববৈচিত্র্য মুছে দিচ্ছে।
১৯৪৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম একতরফাভাবে মহীসোপানের এবং তার চারপাশের দূর-সমুদ্রের মালিকানা দাবি করে। এরপর থেকে সর্বসাধারণের নীলসাগর ব্যক্তিগত সম্পত্তি হয়ে উঠতে শুরু করে। ১৯৮২ সালে জাতিসংঘের সমুদ্র আইন বিষয়ক কনভেনশন কোনও দেশের উপকূলরেখা থেকে ২০০ নটিকাল মাইল দূরসমদ্র পর্যন্ত সেই দেশের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এরপর সামুদ্রিক অর্থনীতির সমস্ত ক্ষেত্রটাই দ্রুত ও সুব্যবস্থিতভাবে ব্যাক্তিমালিকানা ও লগ্নিপুঁজির আওতায় চলে যেতে থাকে। সাত সমুদ্র হয়ে ওঠে লুটেরা পুঁজির নয়া ক্ষেত্র। ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক অর্থনৈতিক বৃদ্ধি, দারিদ্র দূরীকরণ ও পরিবেশগত উন্নতি — এই তিনটি দিকের এক জগাখিচুড়ি মিশ্রণকে ‘ব্লু গ্রোথ স্ট্র্যাটেজি’ নামে হাজির করে লগ্নিপুঁজির মুনাফার এক নতুন লোভনীয় ক্ষেত্র খুলে দেয়। মহাসাগর পুঁজির গ্রাসে পড়ে।
ভারতে সমুদ্রতট সুরক্ষার লক্ষ্যে যে আইন ছিল তাকে উল্টে দিয়ে ২০১৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকার নতুন নির্দেশিকা জারি করে। উপকূলকে সর্ব অর্থে বিপর্যস্ত করে বিভিন্ন ধরনের বৃহৎ নির্মাণের ছাড়পত্র দেওয়া হয়। সমুদ্রের ওপর নির্ভরশীল সাধারণ শ্রমজীবী মানুষেরই একমাত্র আবেগ, আগ্রহ ও বৌদ্ধিক ক্ষমতা আছে উপকূলের পরিবেশকে সুস্থ রেখে সাগরের সম্পদকে টেকসইভাবে ব্যবহার করার। ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীরাই জলসম্পদের সবচেয়ে নির্ভরশীল ও স্বাভাবিক রক্ষাকর্তা।
গত ২৭ আগস্ট বাঁশদ্রোণীর পীরপুকুর রোড অঞ্চলে অমিত দাস নামে এক তরুণ, অনলাইন ফুড (জোম্যাটো) ডেলিভারি বয় দীর্ঘ ৩ মাস চাকরি না থাকার অবসাদে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। বৃদ্ধ মা-বাবার কাছে অন্ধের যষ্টির মতোই ছিল সে। পাড়ার ভালো ছেলে বলে নাম ডাকও ছিল তার। কিন্তু হঠাৎ করে চাকরি চলে যাওয়ায় সে ধীরে ধীরে অবসাদ গ্রস্ত হতে শুরু করে। মা রীনা দাস পরিচারিকার কাজ করেন, এবং অসুস্থ বাবা (অনল দাস) লাইনের বাইরে মাঝে মাঝে রিকশা চালান।
মঙ্গলবার এআইসিসিটিইউ-র তরফ থেকে এক প্রতিনিধিদল (স্বপন রায় চৌধুরী, শীলা দে সরকার, অনুপ চ্যাটার্জী, গণেশ পুষ্টি, শ্রীকান্ত ঘোষ, রবীন চৌধুরী) অমিতের বাড়িতে যান তাঁর মা বাবার পাশে দাঁড়াতে এবং প্রকৃত ঘটনাটি জানতে।
অমিত সংসারে প্রতিদিন প্রায় ২০০-৩০০ টাকা করে দিত, রোজগার মোটামুটি ছিল। কিন্তু চাকরি চলে যাওয়া এবং নতুন চাকরি না পাওয়া তাকে এই ভয়ানক সিদ্ধান্তের দিকে ঠেলে দিয়েছে। কিন্তু এর দায় কার?
এআইসিসিটিইউ-র তরফ থেকে জানানো হয় তারা জোম্যাটোতে অন্যান্য কর্মীদের সঙ্গে দেখা করবেন এবং জোম্যাটোকে অফিসিয়ালি চিঠি পাঠাবেন। সেখানে গিয়ে আরও একটি ছেলের আত্মহত্যার খোঁজ পাওয়া যায়। সেই ছেলেটি লটারির ব্যবসা করতো। কিন্তু ব্যবসায় লাভ না হওয়ায় এবং তার সংসার না চালাতে পারায় অবশেষে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। অমিতের সাথে একই দিনে এই ছেলেটিও আত্মহত্যা করে।
- অবন্তী
গত ২৮ আগস্ট বিএমপিইইউ হলে কমরেড রবি মুখোপাধ্যায়ের স্মরণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন শ্যামল গুহ, অতনু চক্রবর্তী ও নিত্যানন্দ ঘোষ। স্মরণ শুরু হয় গণশিল্পী নীতীশ রায়ের গান দিয়ে। প্রথম বক্তা (রবিদার পুত্র) সন্দীপ মুখোপাধ্যায় অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় কমরেড হিসেবে, লড়াকু এক মানুষ হিসেবে, নেতা হিসেবে তার বাবার পরিচয় তুলে ধরেন, যিনি অতি সহজ ভাষায় বামপন্থার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। লেনিনের উক্তি মাথায় রেখেই বলতেন, “এই রাজনীতি বল, বিতর্ক বল, সব জীবন থেকেই শিখেছি। জীবনের কাছে যান কমরেড।” আবার যখন শেষ বয়সে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়, সিপিআই(এমএল) লিবারেশন করা কেন, তিনি বলেন, “লিবারেশন প্লাটফর্ম তৈরি করে দিচ্ছে যেখানে বহু বর্ণের বহু মনের বামপন্থীদের আসার একটা সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। কমিউনিস্ট নেতৃত্ব দেওয়ার সম্ভাবনা এই পার্টির মধ্যে আছে বলে এই পার্টিটাকে আঁকড়ে ধরা।”
এই বক্তব্যের পর মুকুল কুমারের শ্রদ্ধাঞ্জলি পাঠ করে শোনান অতনু চক্রবর্তী। মুকুলের কথায়, যখনই কেউ তাকে জিজ্ঞেস করতেন, কমিউনিস্ট কাকে বলে, উনি সোজা বলতেন কমরেড রবি মুখার্জীকে দেখলেই বুঝবেন কমিউনিস্ট কেমন হয়। শান্তনু ঘোষ বলেন, রবি বাবু শেষ বয়স অবধি একনিষ্ঠ কমিউনিস্ট ছিলেন। তাঁর সংস্কারমুক্ত মন আর তীক্ষ্ণ স্মৃতিশক্তি ছিল। আরও অনেকে রবি মুখোপাধ্যায়ের সাহচর্যের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। অনিমেষ চক্রবর্তী, রাকেশ (বেণু ঘটক), সাধন চক্রবর্তী, সৌমেন মুখোপাধ্যায়, আহাব মন্ডল, শ্যামল গুহ, বাসুদেব বোস প্রমুখ। জিআইসি-র সৌমেন মুখোপাধ্যায় অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক ভাষায় প্রিয় কমরেড রবিদার নেতৃত্বে শ্রমিক-কর্মচারি ইউনিয়ন ও আন্দোলন গড়ে তোলার কথা বলেন। আহাব মণ্ডল একটি গান গেয়ে শোনান। সাধন চক্রবর্তী বলেন, রবিদার নেতৃত্বে নানান বাধা পেরিয়ে তাঁরা ইউনিয়ন ফ্রন্ট গড়ে তুলেছিলেন। বর্ষীয়ান অশক্ত হয়ে পড়া শ্যামল গুহ তাঁর অগ্রজ বন্ধুস্থানীয় কমরেডের স্মৃতিচারণ করে বলেন, রবিদা বলতেন মানুষের সাথে মিশতে পারার গুণটা থাকা দরকার। পরিবেশ তৈরি করতে হয়। মারা যাওয়ার প্রায় আড়াই বছর আগেও রবিদা তাঁকে দেশব্রতী পৌঁছে দিতেন। তিনি বলতেন, একটি পত্রিকা সংগঠনের কাজ করে। কথা বলা, আলোচনা করার সাহস দরকার।
সবশেষে বাসুদেব বোস বলেন, ঝড়-জল যাইই হোক রবিদা সবার আগে ইউনিয়ন অফিসে এসে বসতেন। তিনি পার্টির দ্বিতীয় সাধারণ সম্পাদক শহীদ জহর দত্তের বাবা সত্যব্রত দত্তকে একটা সময় রক্ষা করেন। এগুলো হয়তো কোথাও ছাপা হয় না, আলোচনাও হয় না, এগুলো রয়ে যায় স্মৃতির পাতায়। এইভাবেই কমরেড রবি মুখোপাধ্যায়ের মতো মানুষরা আমাদের মনে ও হৃদয়ে চিরকালের মতো স্থান করে নেন।
প্রয়াত হলেন প্রবীণ সিপিআই(এমএল) সদস্য কমরেড সাধনা সেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। তিনি ছিলেন উত্তর ২৪ পরগণা জেলার অশোকনগর অঞ্চলে মিড-ডে-মিল প্রকল্পের রন্ধন কর্মীদের মজুরি, মর্যাদা ও অধিকারের আন্দোলনের অগ্রণী যোদ্ধা ও সংগঠক। একজন রন্ধন কর্মী হিসাবে তিনি এলাকা থেকে জেলা বিভিন্ন প্রান্তে গিয়ে লড়াইয়ের বার্তা পৌঁছে দিতেন। ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়েও শোক সংবাদ প্রতিটি সভায় হাজির হতেন। ধাপে ধাপে একজন কমিউনিস্ট কর্মী হিসাবে অশোকনগর ও জেলার প্রতিটি কর্মসূচিতে অংশ নিতেন। মহিলা আন্দোলনেও ছিল তার সমান ভূমিকা। তিনি দীর্ঘ অসুস্থতায় শয্যাশায়ী থেকে গত ২৯ আগস্ট প্রয়াত হন। তিনি পুত্র, কন্যা, নাতি, নাতনি সহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। পার্টি তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছে।
কমরেড সাধনা সেন লাল সেলাম।
== 00 ==