কমরেড চারু মজুমদারের রাজনৈতিক জীবনপ্রবাহের সমগ্র সময়কাল থেকে আজকের বিশ্ব ও ভারতীয় পরিস্থিতি একেবারেই আলাদা। কমরেড চারু মজুমদার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে। তারপর পঞ্চাশের দশকের ঊষাকালে মহান তেভাগা আন্দোলনে তাঁর সাহসী প্রত্যয়ী আলোড়নকারী সংগঠকের ভূমিকা, এবং তারপর ঐতিহাসিক নকশালবাড়ি বিপ্লবী অভ্যুত্থানে ও তার ভিত্তিতে ভারতের নতুন বিপ্লবী পার্টি সিপিআই (এমএল) গঠনে ও বিপ্লবী সংগ্রামে ঝড়ের গতিতে নেতৃত্ব দেওয়া, তার প্রথম পর্বে ধাক্কা নেমে আাসার পরে গ্রেপ্তার এবং দিনকয়েকের মধ্যে শত্রুর হেফাজতে হত্যার শিকার হওয়া – এই হল অতি সংক্ষেপে কমরেড চারু মজুমদারের রাজনৈতিক কর্মজীবন ও শহীদত্বের রূপরেখা।
আজকের ভারতীয় পরিস্থিতির কোনও পূর্বনজির কখনও ছিল না। আজকের ভারতে শাসনক্ষমতায় কায়েম হয়েছে কর্পোরেট পুঁজির ও হিন্দুত্বের সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদ।
কমিউনিস্ট আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে এক বিপ্লব সংগঠিত করার স্বপ্ন নিয়ে কমরেড চারু মজুমদার আত্মোৎসর্গ করেছিলেন আজাদী, মুক্তি ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে, জনপ্রিয় ভাষায় “জনগণের রাজ” কায়েমের সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যে। আর, এই মহতী উদ্দেশ্য পূরণের স্বার্থে কমরেড চারু মজুমদার শত্রুশাসকের হেফাজতে শহীদের মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁর এই জীবনচরিত ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে, বৃহত্তর গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ও দেশপ্রেম বোধের বিষয়ে এক অনন্য নজির হয়ে রয়েছে।
তাঁর আত্মোৎসর্গের অর্ধশতক সময়ান্তরে আজকের এই বিশেষ সন্ধিক্ষণে কমরেড চারু মজুমদারের বিভিন্ন সময়ে তুলে ধরা কিছু কালোত্তীর্ণ শিক্ষাকে আসুন, পাথেয় করা যাক।
বুর্জোয়া জাতিয়তাবাদ
“যে প্রশ্ন আজ আমাদের সামনে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হল বুর্জোয়া জাতিয়তাবাদ। এই জাতিয়তাবাদ অত্যন্ত সংকীর্ণ এবং এই সংকীর্ণতাবাদই আজ শাসকশ্রেণীর সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। ... জাতীয় ঐক্য ইত্যাদি আওয়াজ তুলে এরা একচেটিয়া পুঁজির শোষণকে অব্যাহত রাখতে চায়। আমাদের মনে রাখতে হবে যে ভারতে ঐক্যবোধ জেগেছে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের জন্য। ... ... প্রত্যেকটি জাতিসত্ত্বার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার স্বীকার করা মার্কসবাদীদের অবশ্যই কর্তব্য। ভারতের সাম্রাজ্যবাদ, সামন্ততন্ত্র ও বড় পুঁজিপতিদের সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়েই নতুন ঐক্যের চেতনা আসবে এবং বিপ্লবের স্বার্থেই ভারতবর্ষকে এক রাখার দরকার হবে। সেই ঐক্যই হবে দৃঢ় ঐক্য। এই জাতিসত্ত্বার চেতনা থেকেই হিন্দীভাষা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে সংগ্রাম হয়েছে দক্ষিণ ভারতে। এবং ৬০জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছে ‘৬৫ সালেই। সুতরাং এই সংগ্রামের তাৎপর্যকে ছোট করে দেখলে শ্রমিকশ্রেণী ব্যাপক জনতার সংগ্রাম থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করবে। শ্রমিকশ্রেণীর স্বার্থেই এইসব জাতিসত্ত্বার বিকাশের চেষ্টাকে সমর্থন করতে হবে।”
কৃষক আন্দোলন
“কৃষকশ্রেণী বর্তমান বিপ্লবের স্তরে শ্রমিকশ্রেণীর মিত্র এবং এই কৃষকশ্রেণী ভারতের গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সর্ববৃহৎ শক্তি। এবং এইকথা মনে রেখেই আমাদের কৃষকশ্রেণীর আন্দোলনে এগোতে হবে। কিন্তু কৃষকরা সকলেই এক শ্রেণীতে পড়ে না। ... চারটি শ্রেণী আছে। এবং আছে গ্রামের কারিগর শ্রেণী। অবস্থা অনুযায়ী তাদের চেতনা ও কর্মশক্তির মধ্যেও পার্থক্য রয়েছে, তাই মার্কসবাদীদের সর্বদাই চেষ্টা করতে হবে সমগ্র কৃষক আন্দোলনের ওপর দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষকের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। ..... সমগ্র কৃষক আন্দোলনের ওপর দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষকের নেতৃত্ব যত প্রতিষ্ঠিত করতে পারব, কৃষক আন্দোলন তত জঙ্গী রূপ নেবে। মনে রাখতে হবে, ব্যাপক কৃষকশ্রেণীর ওপর ভিত্তি করে যে কোনো সংগ্রামী কৌশলই গ্রহণ করা হোক, সেটা কোনোমতেই হঠকারিতা হতে পারে না।..... মনে রাখতে হবে, কৃষকের কোনো মৌলিক দাবির আন্দোলন শান্তিপূর্ণ পথে হবে না।.... কিন্তু একথার অর্থ এই নয় যে আমরা কোনো আইনগত আন্দোলনের সুযোগ নেব না বা আইনের সুবিধা নেব না, বরং কৃষক সমিতির কাজ হবে প্রধানত আইনগত সুবিধা আদায় ও আইনের পরিবর্তনের আন্দোলন চালিয়েই যাওয়া।”
-- ( ৪ নং দলিল : আধুনিক সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যান)
“ভারতবর্ষ বিরাট দেশ এবং কৃষক বহু শ্রেণীতে বিভক্ত। কাজেই রাজনৈতিক চেতনার মান সব এলাকার বা সব শ্রেণীর মধ্যে একই স্তরে থাকতে পারে না, তাই আংশিক দাবির ভিত্তিতে কৃষকের গণআন্দোলনের সুযোগ ও সম্ভাবনা সব সময়ে থাকবে এবং কমিউনিস্টদের সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার সব সময়েই করতে হবে।..... আমাদের কৌশলের মূল কথা হল ব্যাপক কৃষকশ্রেণীর জমায়েত হচ্ছে কিনা এবং আমাদের মূল লক্ষ্য হবে কৃষকের শ্রেণীচেতনা বাড়ল কিনা....। আংশিক দাবির ভিত্তিতে আন্দোলন শ্রেণীসংগ্রামকে তীব্র করে তুলবে। ব্যাপক জনতার মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়াবে, কৃষক জনতা ত্যাগ স্বীকারে উদ্বুদ্ধ হবে, সংগ্রাম ছড়িয়ে পড়বে নতুন নতুন এলাকায়। আংশিক দাবির আন্দোলনের ধরন যেকোনো রূপে হতে পারে, কিন্তু কমিউনিস্টরা সবসময় উন্নত ধরনের সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তা কৃষক সাধারণের মধ্যে প্রচার করবে।”
(৮ নং দলিল : সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেই কৃষক সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে)
ছাত্র-যুবদের ভূমিকা
“দু’শো বছরের পরাধীন ও শোষিত ভারতবর্ষে ছাত্র ও যুবকরাই হচ্ছে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ব্যাপক জনগণকে অশিক্ষিত ও অন্ধ করে রেখেছে। তাই বিপ্লবী আন্দোলনে এই শিক্ষিত সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। ছাত্র-যুবরা শুধু শিক্ষিত নয়, তাদের আছে বিরাট উৎসাহ, ত্যাগ স্বীকারের শক্তি এবং যে কোনো অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা।..... তাঁরা শিক্ষিত, তাই দেশের অশিক্ষিত মানুষের কাছে চিন্তাধারার শিক্ষা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব তাদের সবচেয়ে বেশি।
ভারতবর্ষের জাতীয় আন্দোলনের প্রতিটি স্তরে বাংলার যুব ও ছাত্ররা অসীম ত্যাগ স্বীকার করেছেন, গ্রামে গ্রামে স্বাধীনতার বাণী পৌঁছে দিয়েছেন, পুলিশের দমননীতির মোকাবিলা করেছেন, .... সর্বক্ষণের রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে কাজ করেছেন। আজকের এই নতুন যুগে ... বাংলার সেই বিপ্লবী ছাত্র যুবকরা তাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বভার কাঁধে তুলে নেবেন এবং শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যে...... রাজনীতি প্রচারের কাজে নামবেন।
(দেশব্রতী, ২১ আগস্ট ১৯৬৯)
প্রকৃত কমিউনিস্ট
শোষকশ্রেণীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারাটাই কমিউনিস্ট হওয়ার একমাত্র মাপকাঠি নয়। কে প্রকৃত কমিউনিস্ট? যিনি জনগণের জন্য আত্মত্যাগ করতে পারেন। আর এই আত্মত্যাগ কোনো বিনিময়ের প্রত্যাশা করে নয়। দুটো পথ – হয় আত্মত্যাগ, নয় আত্মস্বার্থ। মাঝামাঝি কোন রাস্তা নেই।..... জনগণের সেবা করা ছাড়া জনগণকে ভালোবাসা যায় না। জনগণের সেবা করা যায় একমাত্র আত্মত্যাগ করেই। প্রকৃত কমিউনিস্ট হতে গেলে এই আত্মত্যাগ আয়ত্ব করতে হবে। জনগণের সেবা করা মানে জনগণের স্বার্থে, বিপ্লবের স্বার্থে বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করা। এর মধ্য দিয়েই জনগণের মধ্যে মিশে যাওয়া ঘটবে।..... এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই বিপ্লবী রূপান্তরসাধন হয়। তাই বিপ্লব মানে শুধু বৈষয়িক লাভ নয়। বিপ্লব মানে রূপান্তর – উপলব্ধির, আদর্শের, চিন্তাধারার রূপান্তর।.... বিপ্লব মানে চেতনার আমূল রূপান্তর। কী সেই চেতনা? জনগণের সেবা করার চেতনা, আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ হওয়ার চেতনা, জনগণকে ভালোবাসার চেতনা। বিপ্লব মানেই এই রূপান্তর – কী সমাজের, কী ব্যক্তির।”
(প্রকৃত কমিউনিস্ট হওয়ার তাৎপর্যকি? দেশব্রতী, ১২ মার্চ ১৯৬৯)
শ্রমিক আন্দোলন
যে কোনো স্থানে বা যে কোনো সংগঠনের শ্রমিকদের উপর হামলা হলে তাঁদের সমর্থনে যাতে বিক্ষোভ আন্দোলন বা অন্য ধরণের আন্দোলন সংগঠিত হয়, সেদিকে আমাদের বিশেষ নজর দিতে হবে। কোন নেতারা ঐসব শ্রমিকদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন অথবা আক্রান্ত শ্রমিকরা কোন পার্টির অনুগত – এসব প্রশ্ন অবান্তর।...
শ্রমিকরা যে পার্টির প্রভাবেই থাকুন না কেন, দাসত্বের জ্বালা ও অপমান বোধ তাঁদের মধ্যে থাকেই। কারণ শ্রমিকরা সবকিছু সৃষ্টি করেন নিজ হাতে, আর তাঁর উপর মাতব্বরী করে মালিক ও আমলারা। তাঁর মধ্যে ইজ্জতবোধ যদি জাগিয়ে তোলা যায় বিপ্লবী রাজনীতি প্রচারের মধ্য দিয়ে, তাহলে অর্থনীতিবাদের জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা তাঁদের পক্ষে সহজ হবে। তাঁরা তখন আগুন হয়ে উঠবেন, দুঃসাহসী হয়ে উঠবেন, মালিকশ্রেণীর ত্রাস হয়ে উঠবেন।”
(শ্রমিকদের মধ্যে পার্টির কাজ, দেশব্রতী, ১২ মার্চ ১৯৭০)
যুক্তমোর্চা ও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন
“আমাদের কর্তব্য হচ্ছে ব্যাপক মূল জনগণের মধ্যে পার্টি গঠন করার কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং লড়াইয়ের ভিত্তিতে জনগণের ব্যাপকতম অংশের সাথে যুক্তমোর্চা প্রতিষ্ঠা করা।..... এমনকি যারা এক সময়ে আমাদের প্রতি শত্রুতা করেছে বিশেষ পরিস্থিতিতে তারাও আমাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হতে এগিয়ে আসবে। এইসব শক্তির সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মতো মনের প্রসারতা রাখতে হবে। মনের প্রসারতা কমিউনিস্টদের গুণ। জনগণের স্বার্থই আজ ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের দাবি জানাচ্ছে। জনগণের স্বার্থই পার্টির স্বার্থ।”
(জনগণের স্বার্থই পার্টির স্বার্থ, ৯ জুন, ১৯৭২)
আনিস খানের মৃত্যুরহস্যের যে রিপোর্ট রাজ্যের বিশেষ তদন্তকারী সংস্থা (সিট) পেশ করেছে তা আশ্বস্ত করার পরিবর্তেবেশকিছু গুরুতর অসঙ্গতি ও প্রশ্নের জবাব চাইতে বাধ্য করছে। উচ্চ আদালতের আদেশে নিযুক্ত সিটের তদন্ত রিপোর্টের বিস্তারিত অপ্রকাশিত। তবে যতটুকু যা সংবাদ জগতে প্রকাশ হয়েছে তার ভিত্তিতে কিছু কথা তুলতেই হয়। সিট একশো পৃষ্ঠার দীর্ঘরিপোর্ট পেশ করেছে। কিন্তু তার মূল মূল বক্তব্যের একটির সাথে অপরটির সাযুজ্য নেই। অভিযুক্ত করার ফৌজধারী ধরন খতিয়ে দেখা দিয়ে পর্যবেক্ষণ শুরু করা যায়। আনিসের বাড়ি গভীর রাতে হানা দেওয়ার দায়ে সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশের পাঁচজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তাতে আছেন থানার ওসি, একজন এএসআই, হোমগার্ড, দুই সিভিক পুলিশ। কিন্তু হোমগার্ড ও সিভিক পুলিশদুজনের তুলনায় ওসি ও এএসআইয়ের বিরুদ্ধে ধারা লাগু করা হয়েছে কম। আর যা সব ধারা লাগু করা হয়েছে তাতে দৃষ্টান্তমূলক কঠিন শাস্তির সংস্থান নেই, বরং সাক্ষ্যপ্রমাণ লোপাট করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে, তা কাজে লাগিয়ে অভিযুক্তরা বেকসুর খালাস পেয়ে যেতে পারে। বলা হয়েছে, অভিযান চালানো হয়েছিল পরিকল্পনা করেই, কিন্তু কোন লিখিত নির্দেশ ছিলনা। অর্থাৎ পুলিশ কোন তথ্যপ্রমাণ রাখতে চায়নি, বেআইনি অভিযান চালায়। সেইমতো অভিযোগ আনা হয়েছে কি? যাকে ধরতে এতো উঠেপড়ে লাগা তার দোষটা কী ছিল? তিনি তো কোন ‘ফেরার’ ‘সন্ত্রাসবাদী’ ছিলেন না, নির্দোষ ছিলেন। হ্যাঁ, পাঁচ রকমের প্রতিবাদে লড়াকু ছিলেন। তাহলে তাঁকে ধরতে পুলিশী হানার দরকার হয়েছিল কেন? গভীর রাতে পুলিশী হানার পরিকল্পনা করা হয়েছিল কেন? পরোয়ানা ইস্যু না করে, বাড়িতে ঢোকার আগে প্রতিবেশিদের না জানিয়ে, কোনও সাক্ষীসাবুদ না করিয়ে অভিযান চালানোর গোপন উদ্দেশ্য কি ছিল? বাড়িতে জবরদস্তি ঢুকে যেরকম মারমুখী তান্ডব চালানো হয় তাতে কি সিটের এটা দাবি করা সাজে যে, আনিসের মৃত্যুর জন্য দায়ি পুলিশের ‘গাফিলতি’ মাত্র! সিট বলেছে, পুলিশ খুন করতে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়নি, আনিস ধেয়ে আসা পুলিশের ভয়ে তেতলা থেকে লাফ দিয়ে পালাতে গিয়ে নিচে পড়ে মারা যান! তবে এই মন্তব্য অবশ্য করেছে যে, প্রচন্ড রক্তাক্ত ও প্রায় নিথর হয়ে থাকা আনিসকে বাঁচানোর কোনও চেষ্টা পুলিশ করেনি — তাই আনিসের মৃত্যুর পেছনে খুন নয়, পুলিশের ‘গাফিলতি’কেই দায়ি করেছে সিট। এখন তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া যায় ‘গাফিলতি’ই কারণ, তবু প্রশ্ন হল, এই গাফিলতি ইচ্ছাকৃত না অনিচ্ছাকৃত? ‘অনিচ্ছাকৃত’ বললে গোটা পুলিশী অপারেশনের গুরুতর ধরণকে লঘু করে দেখা হয়। আর, ‘ইচ্ছাকৃত’ সাব্যস্ত করলে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া বা ভীতসন্ত্রস্ত করে মরণঝাঁপ দিতে বাধ্য করার সন্দেহ নাকচ করে দেওয়া যায়না। তাছাড়া সিট যদিও অভিযুক্ত করেছে ‘ষড়যন্ত্রমূলক অপরাধের’ ধারায়, তবে এটাও নিঃসংশয় করতে পারেনি যে কোন বিশেষ ষড়যন্ত্রমূলক উদ্দেশ্য কাজ করেছে? ক্ষমতার প্রাবল্যে মত্ত পুলিশ অনেক সময় স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অনেক অতি অপরাধ করে থাকে। তবে আনিস মৃত্যুকান্ড যেভাবে ঘটেছে সেটা স্রেফ একান্তই থানার পুলিশের বাড়াবাড়ির ফল বলে মেনে নেওয়া মুশকিল। ধৃত সিভিক পুলিশ ও হোমগার্ডরা প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন — তাঁদের পরিকল্পনা করে ফাঁসানো হয়েছে। এই দাবির সারবত্তা সিট খুঁজে দেখেছে? নাকি অবান্তর মনে করেছে! স্থানীয় থানা ও শাসকদল টিএমসি’র কোনও গোপন আঁতাত, আরও ওপরতলার যোগসাজশ ছিল কিনা — সেসব অনুসন্ধান আদৌ করা হয়েছে? আনিস মৃত্যুকান্ডের অস্বাভাবিকতার পেছনে নিশ্চিত প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য ঘটনাবহুল গরম হাওয়া ছিল। বামপন্থায় বিশ্বাসী এই ছাত্রনেতা সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সংগ্রাম-সমাবেশে সবসময় থাকতেন নির্ভীক। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজ্য সরকারের প্রচ্ছন্ন মদতে কর্পোরেট অনুপ্রবেশ কিংবা তাঁদের গ্রামীণ বসবাসের এলাকায় টিএমসি’র দাপটের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কারণে তিনি চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলেন কিনা। তাঁর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ খুঁজে পেতে হলে উপরোক্ত সামগ্রিক প্রেক্ষিতে তদন্ত করা প্রয়োজন। ফেসবুকে কিছু তথাকথিত মন্তব্যের জেরে পুলিশী হানার সাফাই গাওয়া স্রেফ এক অজুহাত মাত্র। এবিষয়ে সিটের বক্তব্য অস্পষ্ট।
এরাজ্যে প্রায় কোনো ক্ষেত্রেই সঙ্গত গণতন্ত্র ও ন্যায় মেলে না। প্রায়শই অভিযোগ ওঠে, আইনের শাসন নয় — চলছে শাসকের ‘আইন’, তার নির্দিষ্ট রূপ হল শাসক তৃণমূলের দলতন্ত্র-দমনতন্ত্র, এককথায় — অপশাসন। এই উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয় পুলিশ ও তদন্তকারী সংস্থাকে, প্রশাসনকে, প্রভাবিত করার অপচেষ্টা চলে আদালতের বিচারব্যবস্থাকেও। বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি গ্রাহ্য হয় না। এই পরিস্থিতিতে, তাই আনিসের মৃত্যুরহস্যের কিনারা করতে সিটের তদন্ত রিপোর্ট প্রশ্নাতীত গণ্য হতে পারে না।
৯ জুলাই, ২০২২ দিনটি শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে লেখা থাকবে এক চরম অর্থনৈতিক সঙ্কট ও বিস্ফোরক জনরোষের মুখে এক অত্যাচারী শাসকের দেশ ছেড়ে পালানোর দিন হিসেবে। হাজার হাজার সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রপতির প্রাসাদ দখল করে নেয়। তারা রাষ্ট্রপতি ভবনের সুইমিং পুল থেকে রান্নাঘর, বেডরুম থেকে মিউজিক হল মায় পুরো ভবনটাই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। এইসব ছবি আর ভিডিও ভাইরাল হয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। গোতাবায়া রাজাপক্ষে সিংহাসন বাঁচাতে খুব চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংঘে সর্বদলীয় অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের চেষ্টা করছেন।
শ্রীলঙ্কার ভবিষ্যত কী হতে চলেছে তা এই মুহূর্তে বলা খুব কঠিন। আমরা কেবল আশা করতে পারি যে, দ্বীপ রাষ্ট্রটি দ্রুত এই অর্থনৈতিক সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে, এবং আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর কাছে দাবি করতে পারি যে পূর্বতন সরকারের বৈদেশিক ঋণের বোঝা থেকে শ্রীলঙ্কাকে মুক্তি দিয়ে দেশটির জনগণের পাশে দাঁড়ানো হোক। শ্রীলঙ্কার মানুষের প্রতি আমরা এই শুভকামনা ব্যক্ত করি যে, একটি স্থিতিশীল গণতন্ত্রে উত্তরণ ঘটুক যেখানে বর্তমান বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির জন্যে জন্য দায়ী নীতিগুলির পরিবর্তন হবে এবং শ্রীলঙ্কার সাধারণ জনগণের চাহিদা ও অধিকারকে সমস্ত পরিকল্পনার কেন্দ্রে রেখে এক নতুন অভিমুখে তাঁরা এগিয়ে যাবেন। শ্রীলঙ্কার সামাজিক বিন্যাস বৈচিত্র্যময়, কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের রাজনীতিতে সিংহলী বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদের এক নগ্ন নির্লজ্জ তীব্র আগ্রাসী প্রাধান্য দেখা গেছে। শ্রীলঙ্কায় গণতন্ত্র ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে গেলে এই আগ্রাসী অরাজক জাতিয়তাবাদ থেকে সরে এসে সকলকে নিয়ে সকলের জন্য এক বহুত্ববাদী পরিবেশ গড়ে তোলা অপরিহার্য কর্তব্য।
শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতি অবশ্যই জটপাকানো এবং বিশৃঙ্খল, ভবিষ্যতও হয়তো অনিশ্চিত, কিন্তু শ্রীলঙ্কা কীভাবে কী কী কারণে এই সঙ্কটে গিয়ে পড়ল সেদিকে আমাদের নজর দেওয়া দরকার। শ্রীলঙ্কা সম্পর্কে ভারতের বেশিরভাগ সংবাদ মাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমের বেশিরভাগ মন্তব্যেই বর্তমান বিপর্যয়ের জন্য রাজাপক্ষে পরিবার এবং তাদের ‘পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি’কে দায়ি করেছে। শ্রীলঙ্কার জনগণের ক্ষোভও ফেটে পড়েছে মূলত এই রাজাপক্ষে পরিবারের ওপর। এটাও ঘটনা যে, আগের যের কোনো শাসক বংশই রাজাপক্ষের মতো এতো শক্তিশালী এবং এতটা প্রকট রূপে স্বজনপোষক ও লুণ্ঠনকারী ছিল না। শুরুর দিকে, যখন মাহিন্দা রাষ্ট্রপতি ছিলেন, তখন গোতাবায়া ছিল তাঁর প্রতিরক্ষা সচিব। এবং তখনই দুই ভাই মিলে এলটিটিই-কে চূর্ণ করতে একটি বিষাক্ত যুদ্ধের অবতারণা করেছিলেন। তাঁদের ছোট ভাই বাসিল ছিলেন অর্থনৈতিক উন্নয়ন মন্ত্রকের দায়িত্বে এবং বড় ভাই চমল তখন স্পিকার। একটা কথা চালু আছে যে, তখন চল্লিশ জনের মতো রাজাপক্ষে পদবীধারী কোনো না কোনো সরকারি দফতর থেকে সমগ্র শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। মাহিন্দা ২০১৫ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে হেরে গেলেও গোতাবায়া ২০১৯ সালে রাষ্ট্রপতি হয়ে যান এবং মাহিন্দাকে তাঁর প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন।
চরম ক্ষমতার সাথে এসেছে চরম দুর্নীতি, চূড়ান্ত অব্যবস্থা আর স্বৈরতান্ত্রিক শাসন। দ্রুত হারে বৃদ্ধির নামে, ২০১৯ সালের শেষে রাজাপক্ষে সরকার ধনীদের জন্য ব্যাপক হারে কর ছাড় দেয় এবং ভ্যাট ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮ শতাংশে নামিয়ে আনে, পাশাপাশি আরো বেশ কয়েকটি কর বাতিল করে। কর প্রদানকারী নাগরিকের সংখ্যা ২০২০ সালের শুরুর দিকে প্রায় ১৫ লক্ষ থেকে কমে ২০২১ সালে ৫ লক্ষেরও নিচে নেমে যায়। এছাড়া কোভিড অতিমারীর কারণে শ্রীলংকার পর্যটন শিল্প এবং প্রবাসী শ্রীলঙ্কানদের রেমিট্যান্স বাবদ পাঠানো অর্থথেকে শ্রীলঙ্কার আয় হ্রাস পায়। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার ৮৮০ কোটি ডলার থেকে নেমে আসে ২৫০ কোটি ডলারে। অতিমারী কিছুটা কমতে না কমতেই আবার ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের ফলে অত্যাবশকীয় আমদানির সরবরাহ শৃঙ্খল সাংঘাতিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দ্রুতই শ্রীলঙ্কা গগনচুম্বী দ্রব্যমূল্য এবং খাদ্য, জ্বালানি ও ওষুধের তীব্র সংকটের মধ্যে পড়ে। গণ বিক্ষোভ শুরু হয়, গোতাবায়া ২ এপ্রিল একটি সার্বজনীন জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে এবং এর তিন মাসের মধ্যে শ্রীলঙ্কা অভূতপূর্ব এক গণ-অভ্যুত্থানের মুখোমুখী হয়।
এখন প্রশ্ন হল রাজাপক্ষেরা কীভাবে এত শক্তিশালী হয়ে উঠলেন এবং কী করে এত দীর্ঘ সময় ধরে এই স্বেচ্ছাচারী অপশাসন চালিয়ে গেলেন? এখানেই আমাদের শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক পরিস্থিতি ফিরে দেখা দরকার। নৃশংস সেনা অভিযান চালিয়ে এলটিটিইকে নিশ্চিহ্ন করার পর, রাজাপক্ষেরা নিজেদের শ্রীলঙ্কার ত্রাণকর্তা হিসেবে তুলে ধরেন। মাহিন্দা রাজাপক্ষেকে একজন পৌরাণিক নায়ক, একজন অবতার হিসেবে জনগণের কাছে তুলে ধরা হয়। সরকারি নিয়ন্ত্রণকে সুসংবদ্ধ ও দৃঢ় করতে, নবগঠিত সিংহলী বৌদ্ধ জঙ্গি সংগঠন বোদু বালা সেনাকে নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে তাদের হাতে যথেচ্ছ ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়। এলটিটিই ধ্বংস হওয়ার সাথে সাথে, শ্রীলঙ্কার মুসলমানরা আগ্রাসী সিংহলী বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদের আক্রমণের পরবর্তী লক্ষ্যবস্তু হয়ে যায়। গত দুই দশকে শ্রীলঙ্কায় ঘটে যাওয়া ঘটনাক্রম এবং তার গতিপথকে ভারতীয় রাজনীতির গতিপথের প্রতিবিম্ব মনে হবে।
মাহিন্দা রাজাপক্ষে অধিকতম দুইমেয়াদ পাল্টে দিয়ে রাষ্ট্রপতি পদের মেয়াদ আরো বৃদ্ধির জন্যে সংবিধান সংশোধন করে আরো ক্ষমতা কুক্ষিগত করার প্রচেষ্টা করতেই মানুষের মনে বিপদঘন্টা বেজে ওঠে এবং ২০১৫ সালের নির্বাচনে তিনি পরাজিত হন। কিন্তু ২০১৯ সালে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ঠিক আগে যখন একটি শক্তিশালী সরকারের দাবিতে দেশজুড়ে বিতর্ক চলছে তখন, ইস্টার বোমা হামলা আবার রাজাপক্ষদের ক্ষমতার অলিন্দে ফিরিয়ে আনে। যেহেতু বিরোধীরা ইতিমধ্যেই রাষ্ট্রপতি পদের পুরোনো নিয়ম ‘দুই-মেয়াদ’কে আবার ফিরিয়ে এনেছে তাই মাহিন্দা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেননি। তখন তাঁর ভাই গোতাবায়া, যিনি তখন পর্যন্ত প্রধানত সামরিক ভূমিকা পালন করে আসছিলেন, রাষ্ট্রপতি হওয়ার জন্য তার আমেরিকান নাগরিকত্ব ত্যাগ করেন।
তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং অব্যবস্থা এই অতি প্রবল শ্রীলঙ্কা সরকারকে এক আগ্রাসী সিংহলী বৌদ্ধ জাতীয়তাদের তরঙ্গ শীর্ষথেকে এমন এক নির্বোধ সত্তায় নামিয়ে এনেছে যার বোঝা শ্রীলঙ্কা আর বইতে পারছে না। জনগণের এই বিস্ফোরক ক্ষোভের পটভূমি তৈরী করেছে নির্লজ্জ স্বজনপোষণ, স্বৈরাচারী শাসন এবং পুরোদস্তুর অর্থনৈতিক অব্যবস্থা যেগুলো রাজাপক্ষের শাসনের বৈশিষ্ট্য। এগুলো ততক্ষণ কোনো সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়নি যতক্ষণ পর্যন্ত না সমগ্র সংকট এমন পর্যায়ে গেছে যে, জনগণ বৌদ্ধআধিপত্যবাদী সিংহলী জাতীয়তাবাদের ফাঁপা উন্মাদনা থেকে নিজেদের মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে।
নির্দিষ্টভাবে এখানেই শ্রীলঙ্কার কাছ থেকে ভারতের শিক্ষা নেওয়া উচিত। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের মতো মাপকাঠিতে ভারত শ্রীলঙ্কার থেকে অনেক খারাপ অবস্থায় থাকলেও বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার বা বুনিয়াদী অর্থনৈতিক শক্তির পরিপ্রেক্ষিতে ভারত তুলনামূলকভাবে অনেক শক্তিশালী। তবু, ভারতীয় অর্থনীতিও কিন্তু মোদির শাসনের বছরগুলিতে একই ধরনের অব্যবস্থা এবং স্বৈরাচারী পদক্ষেপের শিকার হয়ে চলেছে অর্থনীতির ভিত নাড়িয়ে দেওয়া নোটবন্দী এবং অপরিপক্ক জিএসটি নীতি থেকে শুরু করে রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্রগুলির ধবংসসাধন এবং কিছু বাছাই হাতে সরকারি সম্পদ হস্তান্তর ইত্যাদির মাধ্যমে। আকাশছোঁয়া দ্রব্যমূল্য, সর্বকালের সর্বোচ্চ বেকারত্বর সাথে আন্তর্জাতিক মুদ্রা-বাজারে রুপির মূল্য সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। তা সত্বেও অর্থনীতি এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার বিষয়ে আলোচনা প্রায় নেই, সমগ্র নজর থাকে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের প্রচার এবং ভারতীয় গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে ধ্বংস করার প্রচেষ্টার দিকে।
আমাদের ভুলে যাওয়া চলবে না যে মাত্র দুই বছর আগে শ্রীলঙ্কার মানব উন্নয়ন সূচক ছিল ১৮৯টি দেশের মধ্যে ৭১; যেখানে ভারত ছিল ১৩১তম স্থানে৷ শ্রীলঙ্কার ঘটনা সমগ্র বিশ্বের সরকারগুলির জন্য এই হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে, স্যাঙাতি পুঁজি ও কর্পোরেট লুণ্ঠনকে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও স্বৈরাচারী শাসনের মাধ্যমে আড়াল করে চিরকাল শাসন চালিয়ে যাওয়া যায় না।
এম এল আপডেট, সম্পাদকীয় ১২-১৮ জুলাই ২০২২
নদীয়ার রিপোর্ট
গণ সংযোগ অভিযানে গ্রামের বহুসংখ্যক মানুষই আন্তরিকভাবে জানালেন, এই এলাকায় বিকল্প আর কেউ নেই। তোমরা সোজা হয়ে দাঁড়াও। সামনে থেকে প্রতিবাদ কর। আমরা তোমাদের পাশে আছি। সংখ্যালঘু প্রধান এই এলাকা পার্টির দীর্ঘদিনের কাজের অঞ্চল। ধুবুলিয়া ব্লকের সোনাতলা পাত্রদহ গ্রামে গণসংযোগে এভাবেই শোনা গেল মানুষের আশা প্রত্যাশার কথা। নতুন করে এ সত্যটাও উঠে এল জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে অগ্রণী শক্তির ভূমিকা সর্বদাই নির্ধারক। ঘরে ঘরে গিয়ে মানুষের সুখ দুঃখের কথা জানা বোঝা, কমরেড চারু মজুমদার যাকে বলতেন “একাত্ম হওয়া” – কাজের এই ধারা মানুষের মধ্যে আমাদের সংগঠনের প্রতি ভরসা যোগায়। খানিকটা দুর্বল হয়ে পড়া গণসংযোগ নতুন করে গড়ে তোলার মাধ্যমে স্থানীয় কর্মীরা আত্মবিশ্বাস ফিরে পায়। প্রায় ১০/ ১২ দিন ধরে এই এলাকার ৬ টি গ্রামসংসদে গণসংযোগ অভিযানে প্রায় ৫ হাজার সদস্য সংগ্রহ করা হয়েছে। পার্শ্ববর্তী আরও দুটি গ্রামে হয়েছে ১ হাজার সদস্য। মোট ৪টি টিম এই কাজে অংশ নিয়েছে। পাশাপাশি কিছু আন্দোলনমুখী উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। ১০০ দিনের কাজ করে টাকা পায়নি এমন মানুষের নামের তালিকা তৈরি করা, আবাস যোজনার দুর্নীতি অনিয়মের নির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহ করা, এলাকার রাস্তা ড্রেন প্রভৃতি নির্মাণে অত্যন্ত নিম্নমানের কাজ হয়েছে – সে সব কিছুর তথ্য প্রমান সংগ্রহ করা। এ সমস্ত প্রশ্নগুলি নিয়ে শাসকের মুখোমুখি দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। গৃহীত হয়েছে পঞ্চায়েতে বিক্ষোভ ডেপুটেশনের পরিকল্পনা। তৃণমূলের রাজত্বে পঞ্চায়েতগুলিকে প্রায় অচল করে দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় শাসকদলের মাতব্বরদের বাড়িগুলিই এখন পঞ্চায়েত হয়ে উঠেছে। এই চুড়ান্ত অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনগণকে সমাবেশিত করার উদ্যোগ শুরু হয়েছে। ১০০ দিনের কাজে বরাদ্দ কমিয়ে দিয়ে, নিয়ম বিধি পাল্টে দিয়ে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার একে তুলে দিতে চাইছে। কাজের সীমিত অধিকারটুকুও কেড়ে নিতে চাইছে। কৃষিকে তুলে দিচ্ছে কর্পোরেটদের হাতে। এসবের বিরুদ্ধেও প্রচার করা চলছে।
গণসংযোগ অভিযানে ব্যাপক মানুষ প্রধানত শাসক তৃণমূলের দুর্নীতি, দলবাজি, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি আর সীমাহীন বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রবল ক্ষোভ বিক্ষোভের কথা জানালেন। সদস্য সংগ্রহের প্রক্রিয়ায় উঠে এলো কৃষক ও গ্রামীণ গরিব জনগণের তীব্র সংকটের বাস্তব চিত্র। অথচ এ কথা বহুল প্রচারিত যে এই রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে তৃণমূলের নানাবিধ সংস্কার ও সন্ত্রাসের কারনে বর্তমানে বিরোধী শক্তির নাকি কোন জায়গা নেই! ব্যাপক জনগণ তৃণমূল আর বিজেপির দ্বারা দ্বিমেরুকৃত হয়ে পড়ছে, অনেকেই সরকারি সুযোগ সুবিধা হারানোর আশংকায় প্রকাশ্যে বিরোধীপক্ষের সাথে থাকতে চাইছেন না। এভাবে শাসকের সপক্ষে সরকারি মিথ্যাচার প্রকৃত সত্যকে আড়াল করে বারংবার নানাবিধ কায়দায় চটকদারী প্রচার, কিছুটা আবেগ, অনুভূতি, ব্যক্তিগত বিশ্বাস প্রভৃতিকে আশ্রয় করে একটা জনমত তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু গণসংযোগ অভিযানে গ্রামের ঘরে ঘরে গিয়ে সম্পূর্ণভিন্ন অভিজ্ঞতা পাওয়া গেল। দেখা গেল “তথ্য থেকে সত্য” অনুসন্ধান প্রক্রিয়া শাসকের সেই মিথ্যাচারকে উন্মোচিত করে দিতে সক্ষম। লক্ষীর ভান্ডার, কৃষক বন্ধু, স্বাস্থ্যসাথী ইত্যাদি সীমিত কয়েকটি প্রকল্পের যৎসামান্য সহায়তা কৃষকের বঞ্চনা অপ্রাপ্তিকে আর চাপা দিয়ে রাখতে পারছে না।
নাকাশীপাড়া ও চাপড়া ব্লকের তিনটি গ্রামে ৪দিন ধরে সদস্য সংগ্রহ অভিযান সংগঠিত হয়েছে৷ সেখানে উঠে এসেছে কৃষকের জীবন্ত সমস্যাগুলি। এই সময়কালে আকাশে বৃষ্টি নেই, জলের অভাবে যখন পাট ভেজানোর সমস্যায় কৃষকরা হাহাকার করছে, তখন একটি গ্রামে ৫/৬ বিঘা জুড়ে একটা সরকারি খাসের জলা জায়গায় সরকারি রিভার পাম্পের জল দিয়ে পাট ভেজানোর জন্য তৃণমূলের কয়েকজন মাতব্বর পঞ্চায়েতের অনুমোদন সাপেক্ষে বিঘা প্রতি ৪০০/৫০০ টাকা করে নিচ্ছে। এমনিতেই চাষের খরচ বেড়ে গেছে, গতবার এই সময় ১০:২৬ সারের দাম ছিল ২৭ টাকা কেজি, এবার বেড়ে হয়েছে ৪২ টাকা কেজি, ইউরিয়া সাত টাকা কেজি, এবার দশ টাকা কেজি। আগে ৫০ কেজির বস্তা ছিল এখন সেটা ৪৫ কেজির বস্তা হয়ে গেছে, অর্থাৎ ঘুরপথে দাম বাড়ানো হয়েছে। সব মিলিয়ে ফসলের ন্যায্য দাম থেকে চাষিরা চরম বঞ্চিত৷ ধানের সরকারি দর থেকে প্রতি কুইন্টালে চাষিদের লোকসান গড়ে ৮০০ টাকা। পাটের সরকারি সংগ্রহ লাটে তুলে দেওয়া হয়েছে। মোদী সরকার সঠিকভাবে এমএসপি নির্ধারণ করছে না। সব্জিচাষেও চাষিরা লাভ পায় না। প্রচন্ড মাত্রায় পারিবারিক শ্রম দিয়ে কোনোক্রমে তাঁদের চাষের খরচা তুলতে হয়। শ্রমের ন্যায্য দামটুকুও ওঠে না। অথচ চাষির আয় দ্বিগুণ বা তিনগুণ বৃদ্ধির কল্পকথা তথা সরকারি প্রচারের ঢাক পেটানো চলছে।
নাকাশীপাড়ার দোগাছি অঞ্চলে দেখা গেল কৃষকের মনে জমে রয়েছে চাপা ক্ষোভ। এক সময় সিপিআই(এমএল) দলের পক্ষ থেকে এই জলা জায়গায় দখল করে বিনা পয়সায় কৃষকের পাট ভেজানোর ব্যবস্থা করেছিল, সকলের অধিকার ছিল। কৃষকরা বলছে আপনারা মুখ খুলুন, আপনাদের নেতৃত্বে আমরা পঞ্চায়েত, বিডিও দপ্তরে যেতে প্রস্তুত। সংগঠনের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে আপনাদের দাবি নিয়ে ব্লক দপ্তরে যাওয়া হবে। এছাড়াও উঠে এলো, আবাস যোজনায় আগাম টাকা নিয়েও ঘর না পাওয়ার কথা, ১০০ দিনের কাজে পুকুর সংস্কার না করে ফলক লাগিয়ে টাকা তছরুপের ঘটনা। সেচের জন্য জলঙ্গী নদীর রিভার পাম্পের সেচের অনিয়ম ও দুর্নীতির কথা।
- জয়তু দেশমুখ
গত ১৪ জুলাই সিপিআই(এম-এল) লিবারেশন এবং পশ্চিমবঙ্গ খেতমজুর সমিতি যৌথ ভাবে বাঁকুড়া ১ নং ব্লকের বিডিও দপ্তরে গণ ডেপুটেশন সংগঠিত করে। শতাধিক খেতমজুর মিছিল করে বিডিও অফিসে আসে। আজ তিন-চার মাস হলো গ্রামীণ কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্পে কাজ করেও মজুরি পাননি গ্রামীণ শ্রমিকেরা। অথচ এই বকেয়া মজুরি নিয়ে টিএমসি ও বিজেপি কেন্দ্র বনাম রাজ্যের পারস্পরিক দোষারোপের খেলা খেলছে। মাঝখান থেকে গ্রামীণ শ্রমিকদের প্রাপ্য মজুরির প্রশ্নটাই আড়াল হয়ে যাচ্ছে। বকেয়া মজুরি না পেয়ে অনেকেই ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। তাই মিছিল থেকে আওয়াজ উঠল “কেন্দ্র-রাজ্য বুঝি না, কাজ করেছি মজুরি দাও”। উপরন্ত, আচুড়ী অঞ্চলের দেবিপুর মৌজায় ২৫টি ভুমিহীন তফশিলভুক্ত জাতির (বাউরি) পরিবার দীর্ঘদিন ধরে বংশানুক্রমিক ভাবে বনের জমিতে চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করার পরও সম্প্রতি বনদপ্তর তাঁদের উচ্ছেদের নোটিশ দিয়ে জমি থেকে উচ্ছেদ করার চেষ্টা করছে। তার বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ জানানো হয়। অবিলম্বে পুয়াবাগান থেকে দুবরাজী যাওয়ার রাস্তা সংস্কার করার দাবি যুক্ত হয়। এই রাস্তাটি বর্তমানে চলাচলের অযোগ্য হয়ে গেছে অথচ এই রাস্তাটি বাঁকুড়া শহরের এই দিকের অনেকগুলো গ্রামের একমাত্র যোগাযোগের রাস্তা। পুরো কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেন পশ্চিমবঙ্গ খেতমজুর সমিতির জেলার দায়িত্বশীল সোমনাথ বাস্কে ও সিপিআইএমএল’র স্থানীয় নেতা দীনবন্ধু মাল। ডেপুটেশনের শেষে সিপিআইএমএল লিবারেশন জেলা সম্পাদক বাবলু ব্যানার্জি বলেন, আগামী ১৪ দিনের মধ্যে বকেয়া মজুরি না পেলে ব্লকের সমস্ত জবকার্ডধারীদের নিয়ে পুয়াবাগান মোড়ে বাঁকুড়া-খাতড়া মেন রোড অবরোধ করে রাখার কর্মসূচি নেওয়া হবে।
সারাভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতির আসন্ন সর্বভারতীয় সম্মেলনকে ধরে রাজ্য জুড়ে গ্রামে গ্রামে প্রচরাভিযান চলছে, এই অভিযানে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের সর্বস্তরের নেতা কর্মীরাও সামিল হয়েছেন বিভিন্ন গ্রামীণ এলাকায়। বাগনান ১নং ব্লকের হারোপ এলাকায় গণসংযোগ করে আজ ফেরার পথে দুপুর ২,৩০ নাগাদ হারোপ পান বাজারে অটো ধরার জন্য দাঁড়িয়েছিলেন পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য ও এ আই এস এ’ রাজ্য সভাপতি নীলাশিস বসু। সেইসময় হেলমেট পরিহিত তিনজন দুষ্কৃতি এসে তাঁকে হুমকি দেয়। প্রাণে মারার হুমকিও দেওয়া হয়। অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে বলা হয় এটাই শেষ ওয়ার্নিং। টিভিতে বসে, ঘরে বসে যা খুশি কর, রাস্তায় নয় – ইত্যাদি বলে হুমকি দেওয়া হয়। পার্টির রাজ্য সম্পাদক কমরেড অভিজিত মজুমদার এক প্রেস বিবৃতিতে এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন।
গত ১৬ জুলাই কলকাতার বিএমপিইউ হলে সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি ‘আইপোয়া’র রাজ্য কাউন্সিল বৈঠক হয়। শুরুতে আইপোয়ার সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদিকা মিনা তিওয়ারী ও পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সম্পাদিকা ইন্দ্রাণী দত্ত মেয়েদের অধিকারের প্রশ্নে ফ্যাসিবাদের বিপদ প্রসঙ্গে শিক্ষামূলক বক্তব্য রাখেন।
বহুত্ববাদের সংস্কৃতির যে ইতিহাস ভারতের বিরাজমান সেখানে হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী কীভাবে মনুবাদী সংস্কৃতি চাপিয়ে দিচ্ছে সেই নিয়ে সভার শুরুতে আলোকপাত করেন ইন্দ্রাণী দত্ত। তিনি ফ্যাসিবাদের পিতৃতান্ত্রিক ও ব্রাহ্মণ্যবাদী দীর্ঘ ধারাবাহিক ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা করেন। ভারতে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের ধারক ও বাহক আরএসএস’এর আদর্শহিসাবে মনু-সংহিতার প্রচারের তথ্য তুলে ধরেন। মনু-সংহিতায় নারীকে তুলনা করা হয়েছে কুকুরের সাথে। নারীর স্বায়ত্ততা ও স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রনের মধ্যে রাখা মনুর বচনের মধ্যে অন্যতম। মনুর চোখে, সমাজে নারীর ভূমিকা সন্তান প্রতিপালন ও পরিবারের দেখাশোনা করাতেই সীমিত ছিল। এহেন মনুর আজ্ঞা মেনেই আজও আরএসএস’এর বক্তব্যে ও ভাবধারায় ফুটে ওঠে নারী-বিদ্বেষ। যখন আমরা দেখি, আন্ত-ধর্মীয়, আন্ত-জাতি বিয়ে বা সম্পর্কের অপরাধীকরণ করে লাভ-জিহাদের প্রচার নামায় আরএসএস ও বিজেপি। মেয়েরা কাকে ভালোবাসবে, কার সাথে থাকবে, কীভাবে বাঁচবে সবই আরএসএস ঠিক করে দিতে চায়। কাঠুয়া থেকে হাথরস — গণধর্ষকদের রক্ষা করতে বিজেপি সরকারের নির্দেশে ঝাঁপিয়ে পড়ে পুলিশ ও প্রশাসনিক শক্তি। হাথরসে বিজেপির ঘনিষ্ঠ উচ্চবর্ণ গণধর্ষকদের বিরুদ্ধে কলম ধরার জন্য সন্ত্রাসবাদী তকমা দিয়ে জেলে ভরা হয় সাংবাদিক সিদ্দিকী কাপ্পানকে। কাঠুয়ার ঘটনায় আট বছরের একটি শিশু কন্যাকে গণধর্ষন ও খুনের ঘটনায় বিজেপির সমর্থক সরকারপক্ষের উকিলরা ধর্ষকদের পক্ষে মিছিল করে। ক্ষমতায় আসার পরে পরেই নারীবাদী পড়াশোনার কেন্দ্রগুলি বন্ধ করে দিয়ে গৃহকর্মের পাঠ্যক্রম চালু করেছে বিজেপি। সাম্প্রতিক সময় কর্ণাটকে মুসলিম মেয়েদের হিজাব পরাকে কেন্দ্র করে, হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলিকে তোল্লাই দিয়ে মুসলিম মেয়েদের শিক্ষার অধিকার কেড়ে নিতে উঠে পড়ে লাগে বিজেপি।
মিনা তিওয়ারী তাঁর বক্তব্যে তুলে ধরেন বর্তমান ভারতে আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে মেয়েদের বাস্তব পরিস্থিতি ও অধিকারের প্রশ্নগুলি। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৪৬টা দেশের মধ্যে লিঙ্গ-বিভেদের নির্দেশিকা অনুযায়ী ভারত ১৩৫ নম্বর স্থানে আছে। দেশের সরকার ভারতে লিঙ্গ-বিভেদের এই দুর্দশা নিয়ে কোনোরকম মুখ খুলছেনা। অন্যদিকে জন-সংখ্যার নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে মেয়েদের সামাজিক সুরক্ষার প্রশ্নে পরোক্ষভাবে মুসলিম সম্প্রদায়কে নিশানা করছে। আজকের ভারতের মেয়েরা যে মুখ্য বৈষম্যের মুখোমুখি হচ্ছে তারমধ্যে অন্যতম স্বাস্থ্য, শিক্ষা আর কাজের বেহাল অবস্থা। এই বৈষম্যগুলির সাথে ধর্মের কোনো যোগ নেই, কিন্তু মুখ্য সমস্যাগুলির থেকে নজর সরিয়ে বারবার ধর্ম-বিদ্বেষকে উসকে দিয়ে নিজেদের জনবিরোধী নীতি চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি রিপোর্ট ২০২২ অনুযায়ী, ভারতের মেয়েরা মোট শ্রম উপার্জনের মাত্র ১৮ শতাংশ ভাগ পান। ভারতের গরিব মানুষেরা দেশের জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ। অথচ দেশের সম্পদের ৫৭ শতাংশ সম্পদ দেশের ১০ শতাংশ শীর্ষস্থানীয় ধনীর হাতে। ২২ শতাংশ সম্পদের মালিকানা দেশের ১ শতাংশ শীর্ষস্থানীয় ধনীর হাতে। সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকায় গড়া জাতীয় সম্পদ যেমন রেলপথ, বিমানপথ ইত্যাদি আম্বানি-আদানিদের কাছে বেচে দিচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার। পুঁজিপতিরা ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা ধার নিয়ে ভারতের জাতীয় সম্পদ কিনছে। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের টাকায় বানানো সম্পদ তাদেরই ব্যাংকে জমানো টাকা নিয়ে কেনা হচ্ছে। মোদী সরকারের প্রতিটি আর্থিক নীতি গরিব-বিরোধী। অন্যদিকে রাজনৈতিক ফ্রন্টে তারা এক দেশ এক আইনের জুমলা জারি করার চেষ্টা করে মানুষের অধিকার আন্দোলনের আইনি সুরক্ষাকে দমন করতে চাইছে। সংসদে প্রতিবাদের ভাষা ব্যবহার করাকে অসংসদীয় বলে জারি করা হচ্ছে। রাজনৈতিক, সামাজিক কর্মী থেকে সাংবাদিক, যেই এই সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খুলছে তাকেই ভরা হচ্ছে জেলে। ভারতের প্রতীকের চিহ্নের চেহারা বদলে হিংসাকে বলবৎ করার চেষ্টা চলছে। ভারতের বিভিন্নতার ইতিহাস বদলে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের এজেন্ডা অনুযায়ী গড়া হচ্ছে ভারতের ইতিহাস। আজ মেয়েদের স্বায়ত্ব ও স্বাধীনতার প্রশ্ন কেন্দ্রের ফ্যাসিবাদী ও জনবিরোধী সরকারের হাতে চুড়ান্ত বিপন্ন। এরআগে আমরা দেখেছি, এই সরকারের বিরুদ্ধে সরব মেয়েদের রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে কারারুদ্ধ করতে। সুল্লি, বুল্লি ডিলের মাধ্যমে মুসলিম মেয়েদের যৌন-সামগ্রী হিসাবে বেচাকেনা হতে দেখা গেছে। এমনকি হিন্দুধর্মের বিভিন্নতাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে গেলেও সামাজিক মাধ্যমে ধর্ষণ, খুনের হুমকির মুখে পড়ছে মেয়েরা, যেমন সাম্প্রতিক সময় লীনা মেকমেলাইকে ‘কালী’ নিয়ে একটা তথ্যচিত্র বানাতে গিয়ে ন্যক্কারজনক হামলার মুখে পরতে হল।
বৈঠকের সভাপতিমন্ডলী তুলে ধরেন রাজ্যের পরিস্থিতি। এই মোদী সরকারের বিরোধিতা করে এই রাজ্যে ক্ষমতায় আসা তৃণমূল সরকার ‘লক্ষীর ভান্ডার’এর ভাতা’র ব্যবস্থা করেই মেয়েদের জীবিকা ও অর্থের প্রয়োজনের প্রশ্নে দায় সেরেছে। একের পর এক ধর্ষণের ঘটনাকে ‘ছোটো ঘটনা’ বলে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে তৃণমূল সরকার। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের ঋণমুক্তি কমিটির মহিলারা নিজেদের জীবিকার দাবিতে কলকাতায় জমায়েত হলে, তৃণমূল সরকারের অকথ্য পুলিশী আক্রমণের মুখে পড়তে হয় তাদের। সবচেয়ে বেশি মেয়েদের ভোট পেয়ে ক্ষমতায় এলেও মেয়েদের সুরক্ষা, স্বাস্থ্য ও জীবিকার দাবিগুলিকে দমিয়ে রাখতে চাইছে তৃণমূল সরকার।
রাজ্য নেত্রী চৈতালি সেন অঞ্চলে অঞ্চলে জন সংযোগ বাড়ানোর কথা বলেন। সভাপতিমন্ডলীতে ছিলেন আইপোয়া’র রাজ্য নেতৃত্ব — চৈতালী সেন, কল্যাণী গোস্বামী, কাজল দত্ত, মলিনা বক্সী ও মিতালী বিশ্বাস। আগামী ১০ ডিসেম্বর কলকাতায় আইপোয়া রাজ্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। সেই উপলক্ষে অঞ্চলে অঞ্চলে প্রস্তুতি এবং জেলায় জেলায় সম্মেলন সম্পন্ন করার লক্ষ্যে এবং শিক্ষাশিবিরের বিষয় নিয়ে বিভিন্ন প্রতিনিধিরা বক্তব্য রাখেন। হুগলী জেলা থেকে শিপ্রা ঘোষ, সুদীপ্তা, রুমা আহেরী, ময়না মুর্মু, পূর্ব বর্ধমান থেকে সুমি মজুমদার, উত্তর ২৪ পরগণা থেকে অর্চনা ঘটক, পশ্চিম বর্ধমান থেকে সন্ধ্যা দাস, দক্ষিণ ২৪ পরগণা থেকে কাজল দত্ত, হাওড়া থেকে সুষমা মুখার্জী, সবিতা, মুর্শিদাবাদ থেকে গুলশন বেগম, কলকাতা থেকে মমতা ঘোষ ও সম্প্রীতি মুখার্জী বক্তব্য রাখেন। এই মুহূর্তে ফ্যাসিবাদের বিপদ, মহিলাদের অধিকারের উপর যে হামলা নেমে আসছে — এই বিষয়ে জেলায় জেলায় শিক্ষণ শিবির এবং জন সংযোগ গড়ে তোলার কথা উঠে আসে বিভিন্নজনের বক্তব্যে৷ আদিবাসী নেত্রী ও সংগঠক, ময়না মুর্মু তুলে ধরেন আদিবাসী সংস্কৃতি ও দেবতার ধারণাকে কীভাবে বিজেপি হিন্দুত্বকরণ করার চেষ্টা করছে। তিনি আরো বলেন, দীর্ঘ সময় আদিবাসী ও বাঙালী হিন্দুরা আদিবাসীদের মানুষ হিসাবে মনে করত না। আদিবাসীদের ছোঁয়া থেকে বাঁচতে অস্পৃশ্যতা অভ্যাস করত উচ্চবর্ণের হিন্দু বাঙালী। আজ ধর্মনিয়ে চারদিকে দাঙ্গা বাধানোর চক্রান্তের কথা মনে করিয়ে ময়না মুর্মু আরও বলেন, ধর্ম আর দেবতাকে বিশ্বাস করা নিয়ে আমাদের দেশে বিভিন্ন অভ্যাস ও সংস্কৃতি রয়েছে। এই বিভিন্নতাকে হাতিয়ার করেই ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। ঋণ-মুক্তি আন্দোলনের নেত্রী ও আইসিডিএস কর্মী রুমা আহেরী তুলে ধরেন, করোনা পরবর্তী সময় গ্রামের মেয়েদের কর্ম-সংস্থানের দুর্দশার কথা। মিড-ডে-মিল, আশা, অঙ্গনওয়ারী কর্মীরা কোনোরকম সুরক্ষা ছাড়া, অত্যন্ত কম মজুরিতে সরকারের কাজ করছেন, কিন্তু এখনো অবধি তারা ন্যায্য মজুরি বা সরকারি শ্রমিকের স্বীকৃতি পাচ্ছেন না। সম্প্রতি, কর্মসংস্থানের দাবিতে কলকাতায় জমায়েত হওয়া মিছিলের উপর পুলিশী আক্রমণের কথা উল্লেখ করে রুমা বলেন, আমার সাথে গ্রাম থেকে আরো অনেক মিড-ডে-মিল কর্মী, ঋণমুক্তি আন্দোলনের সাথীরা এসেছিল। ন্যায্য কাজের আর মজুরির দাবি চাইলে আমাদের উপর এলোপাথারি লাঠি, মারধর চলেছে। আমরা কেউ ভয় পাচ্ছি না। বরং, আমাদের জেদ আরো বেড়ে গেছে যে আমাদের নিজেদের অধিকার ছিনিয়ে আনবোই। প্রতিনিধিদের বক্তব্যে, পরিচারিকাদের কাজকে আরো সংগঠিত রূপ দেওয়ার ও সোশ্যাল মিডিয়াকে নিজেদের আন্দোলনের জন্য ব্যবহার করার গুরুত্ব নিয়েও আলোচনা হয়। এআইসিসিটিইউ নেত্রী মীনা পাল নারী শ্রমিক ও মহিলা হিসাবে দ্বৈত নিপীড়নের বিরুদ্ধে মহিলা ও শ্রমিক ফ্রন্টের সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে কাজ করার কথা বলেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে মেয়েদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরি ও সামাজিক সুরক্ষার দাবিতে জনবিরোধী প্রতিটি আইন ও অপচেষ্টার বিরুদ্ধে নিজেদের দেশজুড়ে সংগঠিত করতে হবে — এই বার্তা দিয়ে সভার বক্তব্য শেষ হয়।
প্রশ্নটা হল, কে কাকে ভয় পাচ্ছে?
ভারতীয় রাজনীতি ও অর্থনীতি এক যুগ সন্ধিক্ষণের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আগামীদিনে কী আমরা এক ধর্মবেষ্টিত, মৌলবাদী, স্বৈরাচারী ও অতি-গরিব রাষ্ট্রের আঙিনায় প্রবেশ করব, নাকি আমাদের সংবিধান প্রদত্ত অধিকারগুলিতে বলীয়ান হয়ে এক সুখী-সমৃদ্ধ ভারতবর্ষ গড়ার লড়াইতে এগিয়ে যেতে পারব? আজ এই মুহূর্তে এই মৌলিক প্রশ্নটির দোরগোড়ায় এসে আমরা হাজির হয়েছি। আগামী দেড়-দু’বছর এক ভয়ঙ্কর আবহের মধ্য দিয়ে আমাদের হয়তো পার হতে হবে। অন্তত ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন অবধি এক আশঙ্কার মেঘ আমাদের তাড়া করে বেড়াবে। কারণ, নির্বাচনী যুদ্ধে আপাত সুবিধাজনক জায়গায় থাকা দিল্লীর কেন্দ্রীয় শাসক এখন আস্তিন গুটোচ্ছে মরণকামড় দেওয়ার জন্য। প্রশ্নটা তাই, ওরা কি ভয় পেয়েছে? ওদের মনেও কি সমান আশঙ্কা?
আমরা জানি, আতঙ্কিত শাসক নিজের ছায়াকেও ভয় পায়। তাই রাতারাতি শাসকের ভোলবদল। কেউ কিছু বোঝার আগেই সিংহকে হিংস্র দাঁত বের করিয়ে সাজিয়ে আনা হল নতুন সংসদ ভবনের টঙে বসানোর জন্য। বলা হল, এইই নাকি নতুন ‘অশোকস্তম্ভ’। পুরনো অশোকস্তম্ভের গরিমা ও তাৎপর্য অবলীলায় ফেলে দেওয়া হল ধুলোর স্তূপে। প্রধানমন্ত্রী আর পুরুতমশাই ছাড়া (ফটোগ্রাফার তো থাকবেই!) কেউই সেই নতুন সিংহের ধারেকাছে ভিড়তে পারলেন না; এমনকি রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত নয়। হয়তো বা, গণৎকারের গণনা-নির্ভর ছিল সমস্ত প্রক্রিয়াটা; যেভাবে আমরা হীরক রাজাকে দেখেছি রাজজ্যোতিষীর পরামর্শে মূর্তি উন্মোচনের দিনক্ষণ ঠিক করতে। সেই রাজজ্যোতিষীই আবার, রাজ্যে গ্রহ-নক্ষত্রের সুঅবস্থান কতদিন থাকবে হীরক রাজার যে প্রশ্নে চটজলদি উত্তর দেন, ‘যতদিন ততদিন’। এই ভেল্কি-উত্তরে হীরক রাজা খুশি হয়েছিলেন, কিন্তু দিল্লীর রাজজ্যোতিষী দিল্লীশ্বরকে কী বলেছেন তা কেউ জানি না। তবে, সামান্য কিছুটা অনুমান করতে পারি যে রাজা ভয় পেয়েছেন। কারণ, তিনি কিছুটা অসংলগ্ন হয়ে পড়েছেন।
সম্রাট অশোক বা সম্রাট সাজাহানের মতো তিনিও চান এক অমূল্য কীর্তি রেখে যেতে। তাই, সেন্ট্রাল ভিস্তা। কিন্তু, অশোকস্তম্ভের ভোল বদলে তাকে নতুন সংসদ ভবনের মাথায় স্থাপিত করে যে শৌর্যের বার্তা তিনি দিতে চাইছেন, তা হিংস্র। আর এরই পাশাপাশি এমন সব পদক্ষেপ তিনি নিচ্ছেন যা তাঁর আতঙ্ককে আরও প্রকট করছে।
প্রথমত, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে নিজেদের পদপ্রার্থীর বিজয়কে সুনিশ্চিত করতে তিনি ও তাঁর দল রকেট লঞ্চারটি ছুঁড়লেন মহারাষ্ট্রে এমন একটি লক্ষ্যে যা ছিল একপ্রকার অব্যর্থ। কারণ, ১৯৮৯ সাল থেকে হিন্দুবাদী দোসর শিবসেনা যে আদতে বিজেপি’র ঘরানারই একটি দল তা উপযুক্ত সময়ে আবারও উন্মোচিত করাটা ছিল উভয় দলের কাছেই একটি ছোটখাটো চ্যালেঞ্জ। সে সমস্যা তারা উভয়েই অতিক্রম করেছে। শিবসেনা ফিরে গেছে বিজেপির বাহুডোরে, উদ্ধব ঠাকরে অথবা সঞ্জয় রাউতের ফিরে আসাটা এখন সময়ের খানিক অপেক্ষা মাত্র। কিন্তু এই খেলাতেও অর্থ উচ্চৈস্বরে কথা বলেছে। এমন নয় যে, বিনা অর্থ ও ক্ষমতার জোরে সুরাত থেকে গুয়াহাটি হয়ে গোয়া থেকে মুম্বাইয়ে শিন্ডে বাহিনীর প্রত্যাবর্তন। ইলেক্টোরাল বন্ডের রহস্য ও পিএম কেয়ার্সফান্ডের বিনা-অডিটের বেহিসেব যে ভারতীয় রাজনীতির গতিপথকে আরও কলুষিত ও নির্মম করে চলেছে ও করবে, তা বলাই বাহুল্য। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিজেপির পদপ্রার্থীকে জিতিয়ে আনাটাকে ষোলআনা সুনিশ্চিত করতেই যে এই পদক্ষেপ, তা নিয়ে আর কোনও সংশয়ের অবকাশ নেই। কারণ, শিবসেনাকে পাশে না পেলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে এনডিএ জোটের মোট ভোট ছিল ৪৮ শতাংশের আশেপাশে। আর এই সন্দেহও অমূলক নয় যে যশবন্ত সিনহা অতীতে বিজেপির একজন প্রভাবশালী নেতা থাকার কারণে, হতে পারে, বাজপেয়ীপন্থী অথবা মোদী বিরোধী কিছু বিজেপি ভোট সন্তর্পণে যশবন্তের পক্ষে পড়ে গেল।
দ্বিতীয়ত, আমরা দেখলাম, গুজরাট দাঙ্গা নিয়ে মামলা করার ‘অপরাধে’ তিস্তা শীতলবাদ সহ আরও কয়েকজনকে পুলিশ গ্রেফতার করল। পাশাপাশি, ‘অল্ট নিউজ’এর কর্ণধার মহম্মদ জুবেইরকে পুলিশ বিনা দোষে আটক করল। বলা হল, জুবেইর’এর করা ট্যুইটে কোনও এক ব্যক্তি নাকি আহত হয়েছেন। অথচ সেই ব্যক্তির আসল পরিচয় এখনও জানা যায়নি। কারণ, ‘তিনি’ একটি ট্যুইট করে বিষয়টি জানিয়েছিলেন বটে কিন্তু জুবেইর গ্রেফতার হতেই সেই ট্যুইটার অ্যাকাউন্ট’টিও উধাও। অর্থাৎ, সম্পূর্ণ একটি ভুয়ো (উদ্দেশ্যপ্রণোদিত) ট্যুইটের ওপর ভিত্তি করে পুলিশ জুবেইরকে গ্রেফতার করল। তার ওপর জুবেইর যে ফিল্ম ক্লিপটি তাঁর ২০১৮ সালের ‘বিতর্কিত’ ট্যুইটে জুড়েছিলেন সেটি হৃষিকেশ মুখার্জির একটি জনপ্রিয় ফিল্ম থেকে নেওয়া।
এইসব হাস্যকর অথচ নৃশংস স্বৈরাচারী পদক্ষেপ শুধু এখানেই থেমে থাকল না, হিমাংশু কুমার, মেধা পাটেকরের মতো গান্ধীবাদী নেতাদের ওপরেও নেমে এল। হিমাংশু কুমারকে ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা করা হল এবং মেধাজীর বিরুদ্ধে হল এফআইআর। আর এই সামগ্রিক রাজনৈতিক উদ্যোগে বিচারব্যবস্থার একাংশ শাসকের সঙ্গে জুড়ে গিয়ে দেশে তৈরি করল এক ভয়ঙ্কর দুরবস্থা। কোনও কথা বলা, লেখা এমনকি শোনা হয়ে দাঁড়াল গর্হিত অপরাধ।
আর সেই সূত্র ধরেই, তৃতীয়ত, আমরা পেলাম এক গুচ্ছ শব্দমালা যা নাকি অসংসদীয়, অব্যবহারযোগ্য। সেগুলিকে সংসদের আলোচনায় ব্যবহার করা যাবেনা; যদি কেউ করেন তাহলে একমাত্র স্পিকারের আদেশেই তা গৃহীত হবে বা হবেনা। ব্যাপারটা কেমন? কারও কোনও কার্যকলাপে কেউ যদি লজ্জিত বোধ করেন, তাহলে তা বলা যাবেনা, কারণ, ‘লজ্জিত’ শব্দটি সংসদের স্পিকার অথবা সেক্রেটারিয়েটের মতে ‘অসংসদীয়’। এমনকি কেউ যদি মনে করেন কোনও তথ্য বা ঘটনা যা পেশ করা হচ্ছে তা অসত্য, তাহলে সে কথাটিও বলা যাবেনা কারণ ‘অসত্য’ শব্দটিও ‘অসংসদীয়’। এই নিদানকে পাগলের প্রলাপ নাকি শব্দসন্ত্রাস — কী বললে যথাযথ হবে তা নিয়ে সম্ভবত মনোবিদরাও হিমশিম খাচ্ছেন।
চতুর্থত, শুধু এটুকুতেও নয়। জোর গলায় তিনি জনসভায় বলছেন, জনতাকে ‘রেউড়ি’ খাইয়ে ভোট আদায়ের চেষ্টার বিরুদ্ধে সকলকে সজাগ হতে। অর্থাৎ, যারা জনকল্যাণের রাজনীতি করছেন, তাঁদের কার্যকলাপকেও তিনি দেগে দিচ্ছেন। একের পর এক সরকারি সংস্থার বেসরকারিকরণ, সরকারকে সম্পূর্ণভাবে গুটি কয়েক শিল্পপতিদের হাতের তালুতে বন্দী করে আনা, টাকার মূল্যের রেকর্ড পতন, এলপিজি, পেট্রল, ডিজেল, কেরোসিনের মূল্যকে আকাশছোঁয়া করা, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামকে সাধারণের নাগালের বাইরে নিয়ে যাওয়া — এই যখন একটি সরকারের মূল নীতি, তখন স্বভাবতই জনকল্যাণের রাজনীতি তাঁদের কাছে ‘রেউড়ি’ বিলির মতো লাগবে। কিন্তু সমস্যা হল, জনকল্যাণের রাজনীতির বিরুদ্ধে ভয়ের পরিবেশ কিন্তু মাঠ ছাড়া যাবে না তিনি যে জনমত গড়ে তুলতে চাইছেন তা সফল হলে দেশে নেমে আসবে এক ভয়ঙ্কর অরাজকতা ও দারিদ্র্য। তাই পথ একটাই — পেশির জোর ও হিন্দুত্বের মিথ্যাচার। তা দিয়ে যদি তাঁরা দেশ পরিচালনার রাশ নিজেদের হাতে রাখতে পারে, তাহলে আগামী দিন যে কী ভয়াবহ, আশাকরি আন্দাজ করা যাচ্ছে।
পঞ্চমত, সংসদে এবারের বাদল অধিবেশনে পেশ হতে চলেছে প্রেস অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন অফ পিরিওডিকালস বিল, ২০২২ যা মুদ্রণ ও ডিজিটাল মাধ্যমের ওপর নতুন করে একপ্রস্থ বিধিনিষেধ আরোপ করে মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আরও এক কোপ মারতে চলেছে। সেই ২০১২ সাল থেকে, আগে মাঠে নেমে, বিজেপি’র আইটি সেল এতদিন সোশ্যাল মিডিয়া ও ডিজিটাল ভুবনের চত্বরে একচেটিয়া আধিপত্য করে এসেছে। এখন সে দিন গিয়েছে। বহু মানুষ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে এসে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় নানাবিধ কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে মৌলবাদী চিন্তার বিরুদ্ধে এক বিরুদ্ধ স্রোত গড়ে তুলেছেন। কেন্দ্রীয় শাসক এই স্রোতকে ভয় পাচ্ছে। তাই তার কন্ঠরোধ করার চেষ্টা। ‘অল্ট নিউজ’এর মতো আরও বহু স্বাধীন পোর্টালের মাজা ভেঙে দিতে তারা এখন আসরে।
ষষ্ঠত, এই বাদল অধিবেশনেই ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের বিল আনতেও মোদী বেপরোয়া। এইভাবে প্রায় সমস্ত রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রগুলিকে বেচে দিয়ে ভারতীয় জনতার যে অর্থনৈতিক রক্ষাকবচ (যা ২০০৮ সালের বিশ্ব মন্দা থেকে আমাদের দেশের সাধারণজনকে অনেকটা রক্ষা করেছিল) এতদিন আমাদের মাথার ওপর ছিল, তার সলিল সমাধি হতে চলেছে। মানুষ এবার যাবে কোথায়?
এই শঙ্কা যে শুধু আম-আদমির, তাই নয়। এ শঙ্কা কেন্দ্রীয় শাসকেরও। কারণ, তারা জানে, এমনতর অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে দেশ কেমন অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠতে পারে। আর সেই জন্যই তারা হাতিয়ার করেছে ধর্মের রাজনীতিকে। একদিকে পেশিশক্তির জোর, অন্যদিকে ধর্মের আফিম — এই দুইয়ের যোগে কেন্দ্রীয় শাসক নেমেছে এক মারণঘাতী খেলায়। কিন্তু সে খেলায় অনেক ঝুঁকি আছে। দু’তরফেই (শাসক-বিরোধী)। তবে ধর্মের রাজনীতি দিয়ে যেহেতু অনেক সহজে কাজ হাসিল করা যায়, তাই বিজেপি রয়েছে এক সুবিধাজনক অবস্থায়। আমাদের দেশের মানুষ অতীতে নানাবিধ সংকটপূর্ণ পরিস্থিতি দেখেছেন, তার মোকাবিলা করেছেন। নানা কারণে কিছু সময়ের জন্য মানুষ হয়তো টাল খেয়ে যান (মূল ধারার বিরোধীরাও কম দায়ী নয়), কিন্তু শেষ বিচারে, ২০২৪’র আগে যে বিপর্যয়কর রাজনীতির আগুন আরও লেলিহান করে তুলতে বিজেপি মরীয়া, তা নিশ্চিত ব্যর্থ হবে বলেই আমার ধারণা।
- অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
এ যেন মরার উপর খাঁড়ার ঘা।
আকাশচুম্বী বেকারি, যে কাজগুলো ছিল তা ক্রমে ক্রমে লুপ্ত হয়ে যাওয়া, নতুন কাজ সৃষ্টি না হওয়া – এমনই এক বিবর্ণ, আতঙ্কজনক কাজের বাজার এবার বয়ে নিয়ে এলো ব্যাপক কর্মী ছাঁটাইয়ের বার্তা।
দেশের ইউনিকর্ণস্টার্টআপগুলো গত ছ’মাসে ১১ হাজার কর্মীকে ছাঁটাই করেছে। এবছরের মধ্যে আরও ৬০ হাজার কর্মী কাজ হারাতে চলেছেন। দেশের ২৫টি স্টার্ট আপ এবছর জানুয়ারি মাস থেকে ১১,৭১৫ কর্মীকে ছাঁটাই করেছে। ওলা- ব্লিনকিট-উনাকাডেমি-ভেডান্টু-কারস্২৪- মোবাইল প্রিমিয়ারলিগ’এর মতো ইউনিকর্ণ স্টার্টআপগুলো এই কর্মীমেধ যজ্ঞে সামিল। ব্লিনকিটকে অধিগ্রহণ করার পরই এই মার্চমাসে জোমাটো কোপ বসাল ১,৬০০ কর্মীর উপর। বাইজুস্ও ইতিমধ্যে বহু কর্মীর কাজ কেড়েছে।
কী এই স্টার্ট আপ? কোন লক্ষ্যেই বা সরকার এইগুলো তৈরি করে?
এই ইউনিকর্ণস্টার্ট আপ হল ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ভ্যালুয়েশনের, কিন্তু স্টক মার্কেটে যা নথিভুক্ত হয় না। আর স্টার্টআপ ইন্ডিয়া হল ভারত সরকারের প্রকল্প, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও সম্পদ সৃষ্টির গালভরা উদ্দেশ্যেই যা নাকি তৈরি হয়। গবেষণার মাধ্যমে নানা প্রকল্পের উদ্ভাবন বৃদ্ধি ও সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যেই প্রকল্পটি চালু হয়। কেন্দ্রীয় সরকার এই স্টার্টআপগুলোকে অনেক সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। খুব সহজে রেজিষ্ট্রেশন, সুলভে ব্যাঙ্ক ঋণ, তিন বছরের জন্য কর ছাড়, শ্রম কানুন মুক্ত – এরকম অগাধ সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে এই স্টার্ট আপগুলোকে।
এই প্রসঙ্গেই মনে পড়ে মোদীর ২৯ মে’র ‘মন কি বাত’এর বক্তৃতার কথা। ওইদিন তিনি এই সমস্ত স্টার্ট আপ’এর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলেন, “এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, প্রতিটা ভারতবাসীর কাছে এই স্টার্ট আপগুলো বিরাট গর্বের বিষয়”। এমন সময় তিনি এই কথাগুলো বলছেন যখন এই সংস্থাগুলোতে ব্যাপক ছাঁটাইয়ের ঢল নেমেছে। মোদী উক্ত ভাষণে বলেন, “কয়েকদিন আগে আমাদের দেশ একটা মাইলফলক ছুঁয়েছে। এটা আমাদের সকলকে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি আমাদের মধ্যে ভারতের সক্ষমতা সম্পর্কেবিরাট এক আত্মবিশ্বাস নতুন করে তৈরি করে দেয়।” তিনি আরও জানান ওই মাসের ৫ তারিখে ভারতে স্টার্ট আপ ইউনিকর্ণের সংখ্যা সেঞ্চুরিতে পৌঁছেছে।
নির্লজ্জ বেহায়া বললেও কম বলা হয়। এমন সময় তিনি এই কথাগুলো জাতির উদ্দেশ্যে বললেন যখন নানা সুযোগ সুবিধা প্রাপ্ত স্টার্ট আপগুলো ছাঁটাইয়ের খড়্গ নিয়ে নেমে পড়েছে, আর, দেশের প্রধানমন্ত্রী ওই স্টার্ট আপগুলোকেই ‘বিরাট গর্বে’র প্রতীক হিসাবে তুলে ধরেন। কিন্তু কোন আর্থিক অনটনের কারণে নয়, অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যেই শুরু হয়েছে এই ছাঁটাই অভিযান। ‘মন কি বাত’ ভাষণে মোদী নিজেই বলেছেন, “দেশের এই সমস্ত ইউনিকর্ণগুলোর মুল্য ৩৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ২৬ লক্ষ কোটি টাকা। যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা অন্যান্য অনেকের তুলনায় এই সংস্থাগুলোর গড় বৃদ্ধি অনেক বেশি। এমনকি ঘোর কোভিডের দুঃসময়েও এগুলো ব্যাপক সম্পদ ও মূল্য সৃষ্টি করেছে।” কর্মসংস্থানের ঘোষিত লক্ষ্যে এই স্টার্ট আপগুলো কতটা পূরণ করতে পারল, সে ব্যাপারে টুঁ শব্দটি তিনি করলেন না।
আমজনতার করের টাকায় সরকারি সুযোগ সুবিধা পাওয়ার দৌলতে ফুলে ফেঁপে ওঠা এই স্টার্ট আপ ইউনিকর্ণগুলো এবার নিজের আখের বুঝে নিচ্ছে চরম সামাজিক মূল্য দিয়ে। আর সরকার চোখ কান বন্ধ করে রেখেছে। নির্বিচারে এই ছাঁটাইয়ের বিরুদ্ধে আজ পর্যন্ত কোনো ভূমিকাই সরকারের তরফ থেকে নিতে দেখা গেল না।
স্ট্যাগফ্লেশনের মুখে ভারত
প্রখ্যাত অর্থশাস্ত্রী কৌশিক বসুর থেকেই শুরু করা যাক। তিনি একটা টুইটে দেখিয়েছেন যে, পৃথিবীতে বেকারত্বের প্রশ্নে ভারতের স্থান পঞ্চম ধাপে। পাকিস্তান বা বাংলাদেশ এমনকি শ্রীলঙ্কাও ভারতের উপরে রয়েছে। ভারতের উপরে যে চারটি দেশ রয়েছে, সেগুলো হল – আলজেরিয়া, ব্রাজিল, তুরস্ক ও ইয়েমেন। তাঁর মতে, ভারত এখন স্ট্যাগফ্লেশন’এর মুখে দাঁড়িয়ে। এটা এমনই এক অর্থনৈতিক অবস্থা যখন মূল্যবৃদ্ধি এবং বেকারত্ব দুয়েরই হার অস্বাভাবিক উঁচু থাকে এবং অর্থনৈতিক বৃদ্ধি বা জিডিপি বৃদ্ধির হার ও চাহিদা একটা স্তরে এসে থমকে যায়। অর্থাৎ, ইনফ্লেশন ইন প্রাইসেস এবং স্ট্যাগনেশন ইন ডিমান্ড।
বর্তমান ভারতে বৃহত্তম আর্থিক সমস্যা হল বেকারি ও মূল্যস্ফীতি। সেন্টার ফর মনিটারিং অফ ইন্ডিয়ান ইকনমি (সিএমআইই)’র প্রকাশিত জুন মাসের রিপোর্ট বিরাট উদ্বেগ বহন করে নিয়ে এলো। ওই রিপোর্ট অনুযায়ী, শুধুমাত্র জুন মাসে ১.৩০ কোটি কাজ খোয়া গেল! জুন মাসে দেশে বেকারির হার বেড়ে হয়েছে ৭.৮০ শতাংশ, মে মাসে যা ছিল ৭.১২ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বিরাটভাবে বেড়ে যাওয়াই এর মূল কারণ। এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জুন মাসে বেকার হয়েছেন ৩০ লক্ষ। বিরাট সংখ্যক মানুষ কাজের বাজার ছেড়েই পালিয়েছে। কাজ খুঁজতে মানুষের সংখ্যা বা লেবার ফোর্স এক কোটি কমেছে। জুনে কাজ হারিয়েছেন ২৫ লক্ষ চাকুরিজীবী। অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মহীনতা বেশি।
১৮ মাসে ১০ লক্ষ কর্মসংস্থানের মোদীর ঘোষণা – কতটা বাস্তব
প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, আগামী ১৮ মাসের মধ্যে ১০ লক্ষ মানুষকে সরকারি দপ্তরে নিয়োগ করবেন। এই লক্ষ্য পূরণে কেন্দ্রীয় কোষাগার থেকে দিতে হবে বছরে ৫৪,০০০ কোটি টাকা। এরমধ্যে ৯০ শতাংশ বা তার বেশি কাজগুলো যে সমস্ত শূন্যপদ বা নতুন করে নিয়োগ না করায় উদ্ভুত, তা রয়েছে গ্রুপ-সি বর্গে – ক্লার্ক, পিয়ন, অর্ধদক্ষ বর্গগুলোতে। গ্রুপ-সি – এই নতুন পদগুলোতে নিয়োগের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের গ্যাঁটের কড়ি খরচ হবে প্রতি মাসে ৪০,০০০ কোটি টাকা। সরকারের পক্ষে আগামী ১৮ মাসের মধ্যে এই পরিমাণ নিয়োগ সম্ভবপর কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
সরকারি তথ্য বলছে, ১ মার্চ ২০২০ পর্যন্ত ৭৭ মন্ত্রকে ৮.৭২ লক্ষ শূন্যপদ রয়েছে। এরমধ্যে মাত্র ৫টি মন্ত্রক – প্রতিরক্ষা (অসামরিক), রেল, স্বরাষ্ট্র, ডাক ও রাজস্ব – শূন্যপদের সংখ্যা ৯০ শতাংশ। ৩০ মার্চ ২০২০তে লোকসভায় জিতেন্দ্র সিং, পার্সোনাল, পাবলিক গ্রিভান্স, পেনশন’এর কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী লিখিত বক্তব্য পেশ করে জানান, ৭৭টি মন্ত্রকে ১ মার্চ ২০২০ পর্যন্ত অনুমোদিত কর্মীসংখ্যা ৪০.০৪ লক্ষ থাকলেও বাস্তবে রয়েছে ৩১.৩২ লক্ষ নিয়মিত কর্মী সংখ্যা। উক্ত মন্ত্রকগুলোর মধ্যে সর্বাধিক ২.৪৭ লক্ষ শূন্যপদ পড়ে রয়েছে প্রতিরক্ষায় (অসামরিক), তারপর রেল (২.৩৭ লক্ষ), স্বরাষ্ট্র (১.২৮ লক্ষ), ডাক (৯০,০৫০) এবং রাজস্ব বিভাগে (৭৬,৩২৭)। মোট ৮.৭২ লক্ষ শূন্যপদের মধ্যে ৭.৫৬ লক্ষ শূন্যপদই গ্রুপ সি’র মধ্যে রয়েছে। ৬ষ্ঠ বেতন কমিশনের সুপারিশের পর গ্রুপ-ডি পদগুলো গ্রুপ-সি’র সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয়।
মোদীর উক্ত ঘোষণা এমন সময় করা হল, যখন শহুরে যুবকদের বেকারির হার ২০ শতাংশের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছিল, কোভিড লাখে লাখে মানুষকে চরম বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে। বিগত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে শূন্য পদের সংখ্যা হুহু করে বাড়লেও নতুন নিয়োগ হয়নি। কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী জিতেন্দ্র সিং, স্টাফ সিলেকশন কমিশন ও ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশন যে সমস্ত তথ্য দেন তাতে দেখা যাচ্ছে যথাক্রমে ১,৮৫,৭৩৪ ও ২৭,৭৬৪ পদে নতুন নিয়োগের জন্য বিজ্ঞাপন দিলেও ২০১৭-১৮ এবং ২০২১- ২২’র মধ্যে নিয়োগ হয় যথাক্রমে ১,৭৪,৭৪৪ ও ২৪, ৮৩৬ জন। অর্থাৎ, যত পদের জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে, তত সংখ্যক পদে শেষ পর্যন্ত নিয়োগ হচ্ছে না। এ বড় বিচিত্র খেলা!
সপ্তম বেতন কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী জানা যায়, কেন্দ্রীয় সরকারি দপ্তরগুলোতে ১৯৯৪ সালে মোট অনুমোদিত ৪১.৭৬ লক্ষ পদ সংকুচিত হয়ে নেমে আসে ৩৮.৫ লক্ষে। আর, ২০২১’র বাজেট রিপোর্টথেকে জানা যায়, কেন্দ্রীয় দপ্তরে মোট পদের সংখ্যা ৩৪.৫ লক্ষ। ২০০৬ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকার গড়ে প্রতি বছরে এক লাখের সামান্য বেশি নিয়োগ করে। এই সমস্ত তথ্য থেকে এটা স্পষ্ট যে সরকারি দপ্তরগুলোর নতুন নিয়োগের ক্ষমতা ক্রমেই হ্রাসপ্রাপ্ত হচ্ছে, সমগ্র শ্রমশক্তির একটা ছোট্ট অংশই কোনক্রমে ঠাঁই পাচ্ছে সরকারি দপ্তরে। একথা বেতন কমিশনও স্বীকার করে বলেছে, “কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার এখন বড়জোর নিজের অবস্থানকে এক প্রান্তিক জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে”।
ক্রম প্রসারমান পরিষেবামূলক ক্ষেত্র বা সার্ভিস সেক্টর অত্যন্ত স্বল্প পরিমানে কর্মী নিয়োগ করে থাকে। তাও আবার সেই কর্মীর চরিত্র হচ্ছে দক্ষ। এদিকে, পড়ে থাকলো গিগ অর্থনীতি, যেখানে অদক্ষ শ্রমশক্তি কাজ খুঁজে পাচ্ছে। কিন্তু প্রতিবছর কাজের বাজারে যে বিপুল সংখ্যক মানুষ প্রবেশ করছে, তাদের স্থান দিতে পারবেনা এই গিগ প্ল্যাটফর্ম। গ্রামাঞ্চলের উদ্বৃত্ত শ্রমশক্তিকে জায়গা করে দিতে এমন কোনো উৎপাদন শিল্প এখন আর সেইভাবে দেখা যাচ্ছে না। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের হাত ধরে যে ডিজিটাল প্রযুক্তি আজ উৎপাদন শিল্পে ক্রমেই আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করেছে, তা ব্যাপক ভাবে কর্মী সংকোচন করছে, এই প্রতিবেদনের শুরুতেই আমরা দেখিয়েছি, স্টার্ট আপ শিল্পগুলো কী বিরাট বহরের ছাঁটাই শুরু করেছে।
ভারতে বেকারত্বের ছবি দিনের পর দিন ভয়ংকর হয়ে উঠছে। মাত্র ২০ শতাংশ মানুষ বেতনভুক, ৫০ শতাংশের বেশি মানুষ স্বনিযুক্ত, আর বাকি অংশটি দৈনিক মজুরের কাজ করেন। সিএমআইই’এর তথ্য থেকে আরও উঠে আসছে প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠীর মাসিক আয় ১৫,০০০ টাকা। এরকম এক গভীর সংকটময় কাজের বাজারে যে পরিবার একজন রোজগেরের উপর নির্ভরশীল (যে সংখ্যাটা ৬৮ শতাংশ), অতিমারীর সময়ে সেই কাজটাও চলে গেলে কী নিদারুণ সংকটে পড়বে তা সহজেই অনুমেয়। দেশজুড়েই এখন বাড়ছে দারিদ্র, অপুষ্টি ও অনাহার।
ভারতের সামনে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ হল বেকারি। কিন্তু, এ সম্পর্কে রাষ্ট্রনেতারা বিন্দুমাত্র ভাবিত নয়। অগ্নিপথ প্রকল্পকে ঘিরে যে নজিরবিহীন যুব উত্থান দেশবাসী প্রত্যক্ষ করলেন তা আদতে কর্মসংস্থানের বিরাট সংকটকেই দেখিয়ে দেয়। আরও সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থগুলোর আরও প্রসার ঘটিয়ে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা, সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়াতে অর্থবহ কর্মসংস্থানে সরকারের প্রধান ভূমিকা নেওয়া – অতিমারির থেকে শিক্ষা নিয়ে অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করেতে বরেন্য অর্থনীতিবিদদের এই সমস্ত সুপরামর্শকে হেলায় উড়িয়ে দিয়ে মোদী দেশটাকে জাহান্নমে পাঠানোর সংকল্প নিয়েছে।
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)
- অতনু চক্রবর্তী
মোদী এক নতুন চমক দিলেন গত ১০ জুলাই। গুজরাটের সুরাটে প্রাকৃতিক উপায়ে চাষের উপযোগিতা নিয়ে সওয়াল করলেন। বললেন, প্রতিটি পঞ্চায়েত পিছু পঁচাত্তর জন চাষিকে সমবেত করে এই প্রক্রিয়া শুরু হোক। মোদীর বক্তব্য শোনানোর মাধ্যম ছিল ভিডিও কনফারেন্স। তার কি প্রতিক্রিয়া হয়েছে সেখবর অবশ্য সংবাদ জগতে মেলেনি। মোদীজী মোদ্দা বলেন, ‘মাতৃভূমি’র সেবায় প্রাকৃতিক উপায়ে চাষাবাদ ফিরিয়ে আনলে আখেরে মাটির উর্বরা রক্ষা ও খরচে সাশ্রয় হওয়ার লাভ আছে। কর্পোরেটের ‘পোস্টার বয়’-বুড়োর মুখে একী মন্ত্রণার কথা! কিন্তু ভারতীয় কৃষিকে তো প্রাক-মোদী জমানার দীর্ঘ পর্ব পর্যন্ত জমিদারী পথে পুঁজিবাদী বিকাশের প্রক্রিয়ায়, তারপর মোদী জমানায় সরাসরি কর্পোরেট হানায় সর্বনাশা সংকটগ্রস্ত করে ফেলা হয়েছে। এর প্রতিক্রিয়ায় কৃষকের লাগাতার সংগ্রাম, আত্মহত্যা, গণপ্রতিরোধ সবই ঘটে আসছে। এই সেদিন পর্যন্ত সংঘটিত হয়েছে বছরব্যাপী কৃষক আন্দোলন। কৃষকদের দাবি পূরণের কথা দিয়েও কথা রাখেনি মোদী সরকার। উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে বিজেপিকে উতরোতে ‘প্রতিশ্রুতি’র ছলনা করেছিল। তারপরেই ওদের স্বরূপ আবার যে কে সেই। কৃষিতে, জল-জমি- জঙ্গলে অবাধ কর্পোরেট হানাকে মদত যোগানোর নীতি যেমন ছিল তেমনই চলছে। তবু প্রাকৃতিক উপায়ে চাষাবাদে উপকারিতার গল্প শোনাতে হচ্ছে কেন? যে উপায়ের কেন্দ্রে রাখা হচ্ছে ‘গোমাতা’কে কেন? কেন বলতে হচ্ছে ‘গোরু’র হাল দেওয়া থেকে শুরু করে মল-মূত্র সহযোগে জৈবসারে চাষ করলে মাটি ও চাষি-মানুষের সুরক্ষা হয়! এভাবে চাষ যে গরিব ও প্রান্তিক চাষিরা একেবারেই করেন না তা নয়। কিন্তু কর্পোরেট পুঁজি নিয়ন্ত্রিত কৃষি সরঞ্জাম ব্যবহারে পাঁচ দশকের ওপর বাধ্য করার পরম্পরায় প্রাকৃতিক উপায়ে চাষবাসকে রীতিমত প্রান্তিক করে দেওয়া হয়েছে। এখন আবার মোদীর মুখে ওল্টানো গল্প কেন! কারণ, সামনে রয়েছে গুজরাট নির্বাচন। হিন্দুত্বের মেরুকরণের পুনরুত্থানের নতুন চাবিকাঠি চাই। গুজরাট গণহত্যার দায় থেকে আদালতের শংসাপত্র মিলেছে। কিন্তু সেটা যথেষ্ট মনে করা যাচ্ছে না। তাই নতুন তাস খেলতে চাইছেন মোদী, বিজেপির মহামহিম। সেই তাস ভাবা হচ্ছে গোরুকে, যা চেলে ‘আশায় মরে চাষা’র ‘সমব্যাথী’ও সাজা যাবে, হিন্দুত্বের মেরুকরণের ভোটেরও জিগির তোলা সম্ভব।
যাঁরা ক্রিকেট খেলা ভালবাসেন তাঁরা নিশ্চয়ই ‘নজফগড়ের নবাব’, বীরেন্দ্র সেহবাগ সম্পর্কে অবহিত আছেন। তিনি যখন ব্যাট করতেন তাঁর চার-ছক্কার ফুলঝুরিতে সচিন তেন্ডুলকারের ধ্রুপদী ব্যাটিংও ম্লান হয়ে যেত। সমস্যা হচ্ছে সেহবাগের ভক্তরা তাঁকে আদর করে আর ঐ নামে ডাকতে পারবেন না কারণ দিল্লীর বিজেপি সভাপতি আদেশ গুপ্ত নিদান দিয়েছেন নজফগড় নামটা পাল্টিয়ে ফেলতে হবে কারণ ওটা দাসত্বের প্রতীক। শুধু নজফগড় নয় দিল্লী সন্নিহিত চল্লিশটি তথাকথিত মোঘল আমলের বা মুসলিম নাম পরিবর্তনের জন্য তিনি মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে চিঠি লিখেছেন। তাঁর যুক্তি এই নামগুলি পরাধীনতার স্মৃতি বহন করে যা আমাদের আত্মমর্যাদার পরিপন্থী।
মোঘল সম্রাট শাহ আলম (২)-এর সেনাপতি মির্জা নজফ খান রাজধানী দিল্লীর নিরাপত্তা সুরক্ষিত করার জন্য নগরের সীমান্তে একটি গড় বা দুর্গ গড়ে তুলেছিলেন। সেই থেকে জায়গাটির নাম হয়ে যায় নজফগড়। আদেশ গুপ্তর ইতিহাসের জ্ঞান নেহাতই সীমিত। তিনি জানেন না নজফ খান ১৭৬৪ সালে মীরকাশিমের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বক্সারের যুদ্ধে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। তিনি দেশদ্রোহী তো ননই, তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামী! দিল্লী শহরে নজফ খানের নামে জায়গা থাকবে না তো কি আদেশ গুপ্তর পূর্বসুরীদের নামে থাকবে যাঁরা ব্রিটিশদের কাছে মুচলেকা লিখে দিয়েছিলেন?
নজফগড় ছাড়া চল্লিশটি নামের মধ্যে আছে হৌজ খাস, হুমায়ুনপুর, মাসুদপুর, সাহিবাবাদ, ইউসুফ সরাই, শেখ সরাই ইত্যাদি। ‘হৌজ’ উর্দু শব্দ যার অর্থঝিল, খাস’এর অর্থ রাজকীয় বা শাহি। আগেকার দিনে রাজারাজড়ারা এরকম বড় জলাশয় খনন করতো যাতে ক্লান্ত পথিকদের পানীয় জলের অভাব না হয়। হৌজ খাস সেরকমই একটি ঐতিহাসিক জলাশয়, সেটা নিয়ে এতো আপত্তি কিসের? এটি এখন রাজধানীর একটি আপ-মার্কেট অঞ্চল যেখানে আছে অত্যাধুনিক মল, রেস্তোঁরা, বিভিন্ন দূতাবাস, কিন্তু জায়গাটির মূল আকর্ষণ এখনো এই প্রাচীন ঝিল।
জলাশয়ের মতো যাতায়াত পথে সরাই স্থাপন করা ছিল সেকালের রাজারাজড়া, আমিরওমরাহদের আরেকটি জনহিতকর কাজ। মনে রাখতে হবে আমরা এমন একটা সময়ের কথা বলছি যখন আধুনিক যানবাহনের কোনও অস্তিত্বই ছিলনা। অধিকাংশ মানুষই পদব্রজে সফর করতেন; অভিজাত শ্রেণী পালকি, অশ্ব চালিত শকট বা হাতি, উটের পিঠে চড়ে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যেতেন। পরিব্রাজক, ব্যাপারি, তীর্থযাত্রী ও নানা কাজে বিভিন্ন সফরকারি মানুষের কাছে এই সরাইগুলি ছিল মরুভূমিতে মরুদ্যান পাওয়ার মতো। বিভিন্ন বিদেশী পর্যটকরা এই সরাইব্যবস্থা সম্পর্কেতাঁদের ভ্রমণবৃত্তান্তে বিস্তারিত লিখে গেছেন। সপ্তদশ শতাব্দীর ভিনিসিয় পর্যটক নিকোলাই মনুচ্চির মতে হিন্দুস্থানের এই সরাই বা মুসাফিরখানাগুলি ইউরোপের পান্থশালাগুলির সমতুল্য। তিনি লিখছেন, ইট, পাথর দিয়ে তৈরি এই সরাইগুলো প্রায় দুর্গের মতো, প্রতিটির প্রবেশদ্বার অত্যন্ত শক্তিশালী, দূর্ভেদ্য। একজন সর্দার এর দায়িত্বে থাকেন। এখানে খালি মুসাফিরদের জায়গা দেওয়া হয় এবং ৮০০-১০০০ লোক অনায়াসে থাকতে পারেন, এছাড়া ঘোড়া, উট, শকট তো আছেই। পুরুষ মহিলাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা। দোকানপাট আছে যেখানে দৈনন্দিন ব্যবহারের সামগ্রী পাওয়া যায়, বিলাসদ্রব্যও বিক্রি হয়। বিনোদনের ঢালাও ব্যবস্থা। ঠিক সকাল ছ’টায় ফটক খোলা হয়। তার আগে সর্দার বারবার উচ্চকন্ঠে সবাইকে নিজের জিনিস দেখে নেওয়ার জন্য সতর্ক করেন।
অতীতের এই ঐতিহ্যশালী সরাইগুলি নিয়ে গেরুয়াবাদীদের আপত্তি! এগুলো নাকি দাসত্বের প্রতীক! সরাই শব্দটিতেই এদের গাত্রদাহ হয় কারণ এটি উর্দু শব্দ। এদিকে আদেশ গুপ্ত মুখ্যমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে গোলামী, আজাদী এসব উর্দু শব্দ ব্যবহার করেছেন। উর্দু আদ্যোপান্ত একটি ভারতীয় ভাষা, এঁরা জবরদস্তি এটাকে একটা বিশেষ ধর্মের ভাষা বানিয়ে দিয়েছে এবং আমাদের দেশীয় ভাষাকে পাকিস্তানের হাতে সমর্পণ করেছে। এতো ঐতিহ্যশালী একটা নাম মোঘলসরাই সেটাকে পালটে দীনদয়াল উপাধ্যায় স্টেশন করে দেওয়া হল। এতো বড় একটা নাম উচ্চারণ করতে ঠোকর খেতে হয়! ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের সময় মোঘলসরাই বিদ্রোহীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ কেন্দ্র ছিল। এই গুপ্ত ঘাঁটিতে তাঁরা গোপনে দেখা করতেন, খবর আদানপ্রদান করতেন। যেসব নারীরা ব্রিটিশদের অধীনে বাধ্যতামূলক দেহ ব্যবসায় নিযুক্ত ছিলেন, তাঁরা এই সরাইয়ে বিদ্রোহীদের সাথে দেখা করে শত্রুপক্ষের খবর পাচার করতেন। আজকে জায়গার নাম উপাধ্যায়ের নামে করে দিলেই কি এই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস মুছে দেওয়া যাবে?
স্থানের নাম পরিবর্তন এখন সংক্রামক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আওরাঙ্গাবাদের নাম হয়ে গেল শম্ভাজীনগর, ওসমানাবাদ হয়ে গেল ধরাশিব। প্রথমটি দক্ষিণ ভারতে আওরঙ্গজেবের রাজধানী ছিল। হিন্দুত্ববাদীদের রচিত ভারতবর্ষের নয়া ইতিহাসের প্রধান খলনায়ক হচ্ছে আওরঙ্গজেব, যিনি নাকিহিন্দুদের ওপর প্রবল অত্যাচার করেছেন, ধর্মান্তকরণে উৎসাহ দিয়েছেন, বহু মন্দির ভেঙে মসজিদ তৈরি করেছেন। এটা যদি সত্যি ধরেও নেওয়া যায় তাহলে তো সম্রাট অশোকের নাম সব জায়গা থেকে মুছে দিতে হয়, কারণ কলিঙ্গ যুদ্ধে লক্ষাধিক মানুষ হত্যা করে তিনি দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বৃহৎ গণহত্যা সংঘটিত করেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেশের মানুষ তাঁকে ইতিহাসের সর্বোত্তম নৃপতি হিসাবে অধিষ্ঠিত করেছেন। অতীতে আওরঙ্গজেব কী কুকর্ম করেছিলেন সেটার দায়ভাগ তো আজকে মুসলিমদের ওপর বর্তাতে পারে না। ইতিহাসকে প্রতিহিংসার আতস কাঁচে দেখার পরিণাম ভয়ঙ্কর, সমাজকে তা চিরন্তর নৈরাজ্য, হানাহানিতে নিমজ্জিত করতে পারে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর অন্যতম সেরা বই জাহানারা ইমাম লিখিত ‘একাত্তরের দিনগুলি’। সেখানে খানসেনারা কীভাবে ‘ঢাকাকে জাতে ওঠানোর’ জন্য রাস্তার নাম বদলানোর চেষ্টা করেছিলো তার একটা বর্ণনা আছে। আজকের কাগজে লম্বা ফিরিস্তি বেরিয়েছে। লালমোহন পোদ্দার লেন হয়েছে আবদুল করিম গজনভি স্ট্রিট। শাঁখারিবাজার লেন হয়েছে গুলবদন স্ট্রিট, নবীন চাঁদ গোস্বামী রোড হয়েছে বখতিয়ার খিলজি রোড, কালীচরণ সাহা রোড হয়েছে গাজি সালাউদ্দিন রোড, এস কে দাস রোড হয়েছে সিরাজউদ্দিন রোড… খানিক পড়ার পর হয়রান হতে হয়। এত নাম পড়া যায়না।… উঃ! একশো পঞ্চাশটা রাস্তার নাম বদলেছে, তাও শেষে লেখা আছে অসমাপ্ত…। ঘৃণা, বিদ্বেষকারী শাসকদের মধ্যে কী অদ্ভুত মিল! অত্যাচারী শাসক প্রত্যেক দেশেই নিজেদের স্বার্থে ইতিহাস বিকৃত করার চেষ্টা করে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পালটা আক্রমণে খানসেনারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল। সেখানে লড়াই ছিল বহিরাগত বিজাতীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। এদিকে প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে এখানের সংগ্রাম আরও জটিল ও দুরূহ।
- সোমনাথ গুহ
মোদী সরকারের চালু করা ইলেক্টোরাল বণ্ড প্রকল্প সচল হওয়ার পর থেকেই বিরোধিতার মুখে পড়ে। এই প্রকল্প বাতিলের আর্জি জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জমা হয়, এবং কোন দল নির্বাচনী প্রকল্পের মাধ্যমে কত টাকা পেয়েছে তা জানিয়ে সুপ্রিম কোর্ট মুখবন্ধ খামে নির্বাচন কমিশনকে রিপোর্ট দিতে বলে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন দলের কাছে চিঠি পাঠায় এবং ২০২০ সালে ১০৫টা মুখবন্ধ খাম সুপ্রিম কোর্টের কাছে জমা দেয়। সম্প্রতি রিপোটার্স কালেক্টিভ সংস্থার তথ্য সন্ধানি সাংবাদিকরা ঐ ১০৫টা দলকে খুঁজে বার করে এবং নির্বাচন কমিশনের কাছে তারা কি তথ্য দিয়েছে সে সম্পর্কে অবগত হয়। ফলে সুপ্রিম কোর্টের কাছে জমা পড়া মুখবন্ধ খামের মধ্যে কী তথ্য রয়েছে তা জানা সম্ভব হয়। সেই তথ্য সম্পর্কে আলোচনার আগে ইলেক্টোরাল বা নির্বাচনী বণ্ড প্রকল্প কী অতি সম্পর্কেতা বিধৃত করা যাক।
নির্বাচনী বণ্ড প্রকল্প অনুসারে কোনো কোম্পানি বা কোনো ব্যক্তি পছন্দের রাজনৈতিক দল যত ইচ্ছে টাকা দিতে পারবে এবং সেই দাতার পরিচয় গোপন থাকবে, কেউ জানতে পারবে না। ২০১৭র আগের প্রথা থেকে এর ফারাক এই যে, আগে কোনো কোম্পানি কোনো দলকে টাকা দিলে তা তাদের ব্যালান্স শিটে নথিবদ্ধ করতে হত এবং জনগণও জানতে পারত কোন দল ঐ কোম্পানির কাছ থেকে কত টাকা পেয়েছে। কিন্তু ২০১৭-র পর জনগণের আর জানারঅধিকার রইল না – আদানি-আম্বানি-টাটা ও অন্যান্য বিপুল পুঁজির অধিকারীরা বিজেপি ও অন্যান্য দলকে কত টাকা দিয়েছে, এবং সেই টাকার সঙ্গে তাদের প্রাপ্ত ব্যবসায়িক সুবিধার কোনো যোগ আছে কী না।
রিপোটার্স কালেক্টিভের তদন্ত থেকে জানা গেছে, যে ১০৫টা দলের তথ্য সুপ্রিম কোর্টের কাছে নির্বাচন কমিশন জমা দেয়, তার মধ্যে ছিল ৭টা জাতীয় দল, ৩টে জাতীয় দলের রাজ্য শাখা, ২০টা নথিবদ্ধ স্বীকৃত রাজ্য দল এবং ৭৫টা নথিবদ্ধ হলেও অস্বীকৃত দল (যাদের মধ্যে ‘হাম আউর আপ পার্টি’, ‘আসলি দেশি পার্টি’, ‘সবসে বড়া পার্টি’র মতো দলের নাম রয়েছে)। নির্বাচন কমিশন এই ১০৫ দলের রিপোর্ট জমা দেওয়ার পর ধারণা বুঝিবা হল এই যে, যত নির্বাচনী বণ্ড বিক্রি হয়েছে তা ১০৫টা দলের মধ্যেই ভাগ হয়েছে এবং বণ্ড প্রকল্প অত অগণতান্ত্রিক নয়। বাস্তবে কিন্তু দেখা গেল, মাত্র ১৭টা দল নির্বাচনী বণ্ড মারফত টাকা পেয়েছে, আর যাদের সঙ্গে বণ্ডের টাকার কোনো যোগ ছিল না, তাদের রিপোর্টও নির্বাচন কমিশন জমা দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের কাছে। যারা এসবিআই-এর কাছ থেকে বণ্ড কিনেছে, তাদের সিংহ ভাগের আনুকূল্য কোন দল পেয়েছে? রিপোটার্স কালেক্টিভের শ্রী গিরিশ জালিহাল তাঁদের বিবৃতিতে জানিয়েছেন, “যে তিন আর্থিক বছরের বিশ্লেষণ আমরা করেছি তার থেকে দেখা যাচ্ছে, ইলেক্টোরাল বণ্ডের মাধ্যমে প্রদত্ত সমস্ত অর্থের বিপুল পরিমাণ, একেবারে ৬৭.৮ শতাংশ পেয়েছে বিজেপি – ঐ তিন বছরে বিক্রি হওয়া মোট ৬২০১ কোটির মধ্যে ৪২১৫ কোটি।”
রিপোটার্স কালেক্টিভ তাদের রিপোর্টে আরও জানিয়েছে – দাতাদের পরিচিতি সবার কাছেই গোপন থাকে, শাসক দল ছাড়া। যেহেতু এসবিআই এই বণ্ড বিক্রি করে এবং তার মাধ্যমেই টাকা রাজনৈতিক দলের তহবিলে যায়, এবং কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রকই যেহেতু এসবিআইকে নিয়ন্ত্রণ করে, তাই কেন্দ্র সরকার ও শাসক দলের পক্ষে দাতাদের পরিচয় জানা সম্ভব হয়। কাজেই, শাসক দল বাদে অন্য কোনো দল অধিক অর্থ পেলে সহজেই তা কেন্দ্র সরকারের নজরে চলে আসে। এবং সেই দলের মদত দাতাকে বুঝে ওঠা কেন্দ্র সরকারের পক্ষে দুরূহ হয় না।
নরেন্দ্র মোদীরা এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছিলেন– এর লক্ষ্য হল “ভারতে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অর্থ প্রদান ব্যবস্থাকে পরিশুদ্ধ করা।” নরেন্দ্র মোদীদের গ্ৰহণ করা এক একটা পদক্ষেপের পিছনে ঘোষিত লক্ষ্যের ফলের বিপরীতটা যেমন বাস্তবে ঘটে (নোট বন্দির ঘোষিত লক্ষ্য কালো টাকা ধ্বংসের কথা স্মরণ করুন), বণ্ড প্রকল্পের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অর্থের দৌরাত্ম্যকে নিয়ন্ত্রিত করার পরিবর্তে নির্বাচনী বণ্ড প্রকল্প রাজনৈতিক দলের কাছে কালো ও হিসাব বহির্ভূত টাকার গমনকে অবাধ করে তুলল, বণ্ড প্রকল্পের কল্যাণে শাসক দলের তহবিল উপচিয়ে উঠল।
এই প্রকল্পের পরিকল্পনার পিছনে গূঢ় অভিপ্রায় যে ছিল, এত দিনে তা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ আর নেই। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি ফিনান্স বিল হিসাবে এই প্রকল্পকে পাশ করান এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ও নির্বাচন কমিশন এই প্রকল্প রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অর্থ প্রদান প্রক্রিয়াকে অস্বচ্ছ করবে বলে তার বিরোধিতা করলেও সেই বিরোধিতাকে অবজ্ঞা করা হয়। সরকার এ নিয়ে সংসদে এমনকি মিথ্যাচারও করে। তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ নাদিমূল হক সংসদে জানতে চেয়েছিলেন, নির্বাচন কমিশন এই প্রকল্প সম্পর্কে কোনো আপত্তি জানিয়েছে কিনা। অর্থ দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী পন রাধাকৃষ্ণাণ তখন বলেছিলেন, “ইলেক্টোরাল বিয়ারার বণ্ড সম্পর্কে কোনো উদ্বেগ নির্বাচন কমিশন সরকারের কাছে জানায়নি।” অথচ, নির্বাচন কমিশন ২০১৭ সালের মে মাসে কেন্দ্রীয় সরকারের আইন ও বিচার মন্ত্রীর কাছে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিল, অর্থ প্রদানে স্বচ্ছতার কথা বিবেচনা করলে এই বণ্ড প্রকল্প হল একটা পশ্চাৎমুখী পদক্ষেপ। নির্বাচন কমিশন ২০১৯-এর মার্চ মাসে এই প্রকল্প প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্টে আর্জিও জানায়। তার কাছে জমা পড়া মুখবন্ধ খামগুলো খুলে দেখার অবসর সুপ্রিম কোর্ট আজ পর্যন্ত পেল না। আর বিজেপির তহবিলও ফুলে কলা গাছ কেন, বট-অশ্বথ হয়ে উঠতে থাকল। এই প্রকল্পকে বাতিল করতে হবে, কেননা, কোন কোম্পানি কোন দলকে কত টাকা দিল তা জানার অধিকার সাধারণ জনগণের আছে, এবং সেই অধিকার দিতে হবে।
- লিবারেশন জুলাই ২০২২ থেকে
নতুন সংসদ ভবনের নির্মাণ এখনও সম্পূর্ণ হয়নি, এবছরের শেষ নাগাদ হবে বলে প্রত্যাশা। কিন্তু তার আগেই নির্মীয়মাণ ভবনের ছাদে বসে গেল নতুন জাতীয় প্রতীক, যার উদ্বোধন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী করলেন গত ১১ জুলাই। এটাই ‘নতুন’ ভারতের দস্তুর — এই ভারতের আকাঙ্খিত রূপ কেমন হবে, তাকে বিজ্ঞাপিত করতে সম্ভাব্য সমস্ত মাধ্যমের ব্যবহারেই মোদী জমানা উন্মুখ। সেই রূপের প্রকাশ নিয়েই বাধল তীব্র গোল। সারনাথের মাটি খুঁড়ে পাওয়া সিংহ মূর্তি-সহ অশোক স্তম্ভের যে শীর্ষকে জাতীয় প্রতীক করা হয়েছিল, নতুন প্রতীকের সিংহগুলো সারনাথের সিংহগুলো থেকে রূপে বেশ কিছুটা ভিন্ন হয়ে যেন চলতি জমানারই দ্যোতক হয়ে উঠল।
জাতীয় প্রতীকে রয়েছে চারটে সিংহ — ডাইনে, বাঁয়ে, সামনে ও তার বিপরীতে মুখ করা। সিংহর সঙ্গে হাতি, ঘোড়া ও অন্য কিছু জন্তুও প্রতীকের অঙ্গ। মূল যে জাতীয় প্রতীককে ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি গ্ৰহণ করা হয়েছিল, সেই প্রতীকের সিংহগুলো রাষ্ট্রের একটা ভাবমূর্তিকে মূর্ত করত। পশুরাজের রাজসিকতার সঙ্গে শৌর্য, প্রশান্তি ও মহিমাও সেই মূর্তিগুলোতে ধরা পড়ত। মূর্তিগুলো রাষ্ট্রের ক্ষমতা, আত্মবিশ্বাস ও শান্তিকামিতাকেও প্রতিফলিত করত। কিন্তু নতুন প্রতীকের সিংহগুলোর বুক ফুলে রয়েছে (ছাতি হয়ত ৫৬ ইঞ্চি বা তার বেশি), পায়ের স্ফীত পেশি তাদের প্রতাপ জাহির করছে, মুখের হাঁ অনেক বড় হয়ে রাগে গর্জনরত ভঙ্গিকে প্রকট করছে, আর মুখগহ্বরের ধারালো দাঁতগুলো সৃষ্টি করছে আতঙ্কের এক বাতাবরণ, বুঝিবা শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্যত। জাতীয় প্রতীককে তেমন বড় আকারে নির্মাণ করার কথা স্বাধীন রাষ্ট্রের গোড়ার দিককার শাসকরা ভাবতে পারেননি, আর তাই লম্বায় তা ছিল ১.৬ মিটার। চলতি জমানার ধরন-ধারণের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নতুন প্রতীকের উচ্চতা করা হয়েছে প্রথম প্রতীকের চার গুণেরও বেশি, একেবারে ৬.৫ মিটার। ফলে ব্রোঞ্জের তৈরি প্রতীকের ওজন বেড়েছে অনেক — প্রতীককে ধরে রাখার সাড়ে-ছয় টনের ইস্পাতের কাঠামো সহ প্রতীকের ওজন দাঁড়িয়েছে একেবারে ১৬ টন। এই বিশাল আয়তন ও ওজনের করতে গিয়ে খরচও বেড়েছে অনেক, প্রাথমিক আনুমানিক ব্যয় ৯৭৫ কোটি টাকা ছাড়িয়ে পৌঁছেছে ১,২৫০ কোটিতে। তবে মূল প্রতীক থেকে নতুন প্রতীকের বিচ্যুতি আপাতদৃষ্টিতে যথেষ্ট প্রকট হলেও মোদী সরকারের মন্ত্রীরা বলছেন যে, নতুন প্রতীকে কোনো বিকৃতি সাধন করা হয়নি, তা মূল প্রতীকেরই ‘অবিকল প্রতিরূপ’। এই অস্বীকৃতির ভিত্তি কতটা যথার্থ এবং তা জাহির করা হচ্ছেটাই বা কেন? মূল প্রতীক এবং নতুন প্রতীককে পাশাপাশি রেখে অনেক ছবিই সামনে এসেছে, এবং মূল প্রতীকের সিংহগুলোর পাশে নতুন প্রতীকের সিংহগুলো অনেক হিংস্র রূপেই প্রতিভাত হচ্ছে। কাজেই নতুন প্রতীকের উদ্ভাবকদের পরিকল্পনায় মূল প্রতীক থেকে সরে আসার অভিপ্রায় যে ছিল, মোদী মন্ত্রীসভার মন্ত্রী ও বিজেপি নেতাদের হাজারো অস্বীকৃতিও তাকে আড়াল করতে পারবেনা। এখন প্রশ্ন হল, নতুন প্রতীকে সিংহদের হিংস্র রূপে রূপান্তরণ কি মোদী সরকারের পরামর্শেই হয়েছিল? যাঁরা প্রতীকের নকশা বানিয়েছেন ও তার নির্মাণ করেছেন, এতটা পরিবর্তআন সাধনের স্বাধিকার ভোগ করা সেই কলাকুশলীদের পক্ষে আদৌ সম্ভব ছিল বলে মনে হয় না।
ইতিহাসবিদ, নৃতত্ত্ববিদ ও পর্যবেক্ষকরা বলছেন — নতুন প্রতীকের সিংহগুলো আসলে বর্তমান শাসক জমানার বৈশিষ্ট্যেরই প্রতিনিধি। নরেন্দ্র মোদী জমানা ২০১৪ সালে চালু হওয়ার পর থেকে ঘৃণা, বিদ্বেষ, হিংসা সমাজে বিপুল বিস্তার লাভ করেছে। অন্যদিকে, সরকারের বিরোধীদের জেলে পোরা এবং প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষতাকে নির্মূল করে বিরোধী পক্ষের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়ার মধ্যে ত্রাসসঞ্চারী প্রশাসনিক রীতিরও উন্মেষ ঘটানো হয়েছে। এই জমানার হাতে নির্মিত জাতীয় প্রতীকের সিংহ তাই সংযম ও শান্তির দ্যোতক হতে পারেনা, তার প্রকাশ ঘটছে এই জমানার ভাবভঙ্গিতেই। মনস্তত্ববিদ আশীষ নন্দী যথার্থই বলেছেন, “এই সিংহগুলো শুধুমাত্র সিংহ নয়। নরখাদকও বটে। এ এক দ্বিতীয় ভারতীয় প্রজাতন্ত্র ও বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রকৃত প্রতীক। আমি আমাদের বর্তমান শাসকদের অভিনন্দন জানাই এত উদার মানসিকতার জন্য, এতখানি স্বীকারোক্তি করার জন্য।” নতুন প্রতীকের সিংহগুলোর মুখমণ্ডলের অভিব্যক্তি নিয়ে বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি, সাংসদরা মূল প্রতীক থেকে বিচ্যুতির জন্য সরকারের সমালোচনা করেছেন, অনৈতিক বলেছেন। এই সমালোচনাকে খণ্ডন করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রী হরদীপ সিং পুরী বলেছেন, কোনো মূর্তির মধ্যে সৌন্দর্য আছে কিনা তা নির্ধারণ করবে যিনি মূর্তিদেখছেন তাঁর চোখ। এইভাবে মূর্তির মুখ শান্ত না ক্রোধান্বিত, তাও ধরা পড়বে নির্দিষ্ট দর্শকের দেখার ঢঙেই। অর্থাৎ, নতুন প্রতীকে বিকৃতি খুঁজে পেলে দোষ তাঁরই, যিনি মূর্তিদেখছেন। কথায় বলে না, যারে দেখতে নারি, তার চলন বাঁকা! বিজেপিও প্রতীক নিয়ে যাবতীয় সমালোচনার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে আক্রমণের বিরোধীদের ‘ষড়যন্ত্র’ই দেখতে পাচ্ছে। তবে, নতুন প্রতীক নিয়ে আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণের সমালোচনার জবাবে মোক্ষম মন্তব্যটা করেছেন ‘কাশ্মীর ফাইলস’ চলচ্চিত্রের নির্মাতা বিবেক অগ্নিহোত্রী। নতুন প্রতীকের সমালোচনায় প্রশান্ত ভূষণ বলেছিলেন — এই নতুন জাতীয় প্রতীক গান্ধী থেকে গডসেতে ক্রমবিকাশেরই পরিণাম। “দংষ্ট্রা বার করা রাগী সিংহ; এটা হল মোদীর নতুন ভারত”। এর জবাবে বিবেক অগ্নিহোত্রী বললেন, “শহুরে নকশালরা একটা দন্তহীন মূক সিংহকেই চায় যাতে তারা সেটাকে পোষ্য হিসাবে ব্যবহার করতে পারে।” একেবারে যথার্থ বলেছেন অগ্নিহোত্রী মহাশয়, সিংহপুরুষ রাষ্ট্র নায়ককে দোর্দণ্ড প্রতাপেরই অধিকারী হতে হবে, বিরোধী ও দেশদ্রোহী নিষ্পেষণে যিনি হবেন ষোলো আনা নির্মম! সারনাথের সিংহ ছিল ‘ওদের’, সেটা ‘আমাদের’ হতে পারে না। সারনাথ ছিল উত্তরপ্রদেশের বেনারস জেলায়। সেই রাজ্যেই এখন উদ্ভব ঘটেছে এক তেজস্বী সিংহের, যাঁর আগ্ৰাসী বুলডোজারের গুঁতোয় গুঁড়িয়ে যাচ্ছে সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি। নতুন প্রতীকের সিংহকে এরকমই হতে হবে। কিংবা হতে হবে গির অরণ্যের সিংহদের মতো, গুজরাটের যে অরণ্যের সিংহদের আগ্ৰাসী ধরন-ধারণ নিরীক্ষণ করে শাসনের কেতা রপ্ত করেছেন দেশের প্রশাসনিক প্রধান!
- জয়দীপ মিত্র
কিছুদিন আগেই হৈচৈ শুরু হয়েছিল উচ্চ মাধ্যমিক অকৃতকার্য ছাত্রী ‘আমব্রেলা’ বানান জানেনা, অনুরূপ ছাত্র এইচএস’এর সম্পূর্ণ কথাটা কী বলতে পারেনি বলে। সম্প্রতি বিহারে একজন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সহজ ইংরেজি জানেননা, এরাজ্যে একজন প্রাথমিক শিক্ষককে অভিভাবকরা বিয়োগ অঙ্ক করতে দিয়েছিলেন, তিনি পারেননি। ফলে সব মিলিয়ে শিক্ষার হাল যে খারাপ তা জানা গিয়েছে। ওদিকে শিক্ষার অধিকার আইনে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সকলকেই পরবর্তিশ্রেণিতে উত্তীর্ণ করার নীতির ফলেই দেশে শিক্ষা গোল্লায় গিয়েছে এতো অতি চর্চিত ব্যাখ্যান। এরাজ্যে প্রাথমিকে ইংরেজি তুলে দেওয়ার ফলও নাকি বিষময় হয়েছে। এরাজ্যে তো শিক্ষক নিয়োগে অবারিত দুর্নীতির কথা শোনা যাচ্ছে। আলোচনাও চলছে যে ওই নিয়োগ দুর্নীতির ফলেই শিক্ষা গোল্লায় যাচ্ছে। কিন্তু যে ছাত্রীছাত্র এখন আমব্রেলা বানান বা এইচএস’এর পুরো কথা জানে না তারা তো ২০১৬-১৭-১৮ সালের নিয়োগ দুর্নীতির আগে নিযুক্ত শিক্ষকদের কাছেই পড়াশোনা করেছে। তাহলে নীতিনিষ্ঠ নিয়োগ পদ্ধতিতে নিযুক্ত শিক্ষকেরাও যথাযথ শেখাতে পারেননি। সব মিলিয়ে শিক্ষার পরিস্থিতি সঙ্কটাপন্ন, অন্তত এরাজ্যে, তা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই, দ্বিমত রয়েছে কবে থেকে শিক্ষায় এই পতন শুরু হয়েছে তা নিয়ে। তেমন কোনো পরিসংখ্যান ব্যবহার না করে কয়েকটি টুকরো টুকরো নিবন্ধে চেষ্টা করা হবে শিক্ষার সমস্যাকে ধরতে ও সমাধানের দিকে ইঙ্গিত করতে।
যারা শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত তাদের একটা আক্ষেপ বা ছুতো রয়েছে যে, যারা পাঠগ্রহণ করতে আসে তাদের অনেকেই নির্দিষ্ট শ্রেণিতে পঠনের উপযুক্ত নয়। তাই তাদের শেখানো যায় না। যেহেতু অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ‘নো ডিটেনশন’, এবং আগের শ্রেণিতে তারা শেখার ‘অযোগ্য’ তাই প্রায় কিছু না শিখেই তারা অষ্টম শ্রেণিতে উঠে যায়। তারপরে অনুর্ত্তীর্ণ হয়ে পড়া ছেড়ে দেয়, বা বিদ্যালয়ের আভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে পরবর্তী শ্রেণিগুলিতে উঠে যায়, মাধ্যমিক পরীক্ষা পর্যন্ত। যাঁরা প্রথম শ্রেণি থেকে ফেল চালু করার পক্ষে তাঁরা কয়েকটি খুঁটিনাটি বিষয় ভুলে যান। প্রথমত, প্রথম শ্রেণিতে তো কোনো ছাত্ররই কিছু না শিখে এসে একদম নতুন করে শুরু করার কথা, তাহলে তারা কেন সেই প্রথম শ্রেণি বা শুরুর শ্রেণিতে কিছু শিখল না বা যথাযথ শিখল না? ওই শুরুতে না শেখার দায় কার? অবশ্যই সে দায় ছাত্রীছাত্র বা তার অভিভাবকদের হতে পারেনা। কোনো দায়বদ্ধ সমাজেই বিদ্যালয়ের শিক্ষাকে বাড়িতে নিতে দেওয়া হয়না। বিদ্যালয়ের শিক্ষা বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষেই সম্পূর্ণ করা দস্তুর। ওই শিক্ষা সমাপনের জন্য যতটা সময় প্রয়োজন ততক্ষণ বিদ্যালয়ে শিক্ষাদান করা হবে, এবং অন্যদিকে সেই শিক্ষাদানের সময় সাপেক্ষে পাঠক্রম তৈরি হবে। যদি তেমনটা হত এরাজ্যে ও দেশে তাহলে প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ওঠা ছাত্রীছাত্ররা যথাযথ শিখেই উঠত। এভাবেই এগোত বিষয়টি। ফলে ফেল করানো বিষয়টি আসলে শিক্ষা ব্যবস্থার যাঁরা চালক, পাঠক্রম নির্মাতা, বিদ্যালয়ের শিক্ষাদানের সময় ও শ্রেণিতে ছাত্রীছাত্র সংখ্যা নির্ধারণকারী ও শিক্ষক তাদের অদক্ষতা প্রসূত ভাবনা থেকে আসে। তার থেকেই ‘সমালোচনা’ করা হয় ‘শিক্ষা গ্রহণ অযোগ্য’ ‘ফার্স্টজেনারেশন লার্নার’দের। শোনা যায়, বাবা মা নিরক্ষর বা অশিক্ষিত তাই বাড়িতে কিছু শেখে না, ফলে কিছুই পারে না। ছাত্রীছাত্রদের যে বাড়িতে শেখার কথা নয়, বিদ্যালয়েই শেখার কথা সেটা খেয়াল থাকেনা। অন্যদিকে বিদ্যালয়ে শেখা সম্পূর্ণ হয় না বলে বাড়িতে পড়ানো বা প্রাইভেট ট্যুইশন শুরু হয়। প্রকারান্তরে শিক্ষার বেসরকারিকরণ ঘটে।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি ছাত্রীছাত্রদের ফেল করানোর পক্ষে থাকা শিক্ষা ব্যবস্থার নিয়ামক সমালোচকদের মাথায় থাকে না যে, যদি বিপুল সংখ্যক ছাত্রীছাত্র ফেল করত, না শেখার ফলে, তাহলে বিদ্যালয়গুলির শ্রেণিকক্ষে একধরণের ব্যাপক স্থান বৈষম্য সৃষ্টি হত। মনে রাখা দরকার, প্রথম শ্রেণিতে অনেকে অকৃতকার্য হলে পরবর্তী বছরে দ্বিতীয় শ্রেণি অনেকটাই ফাঁকা থাকবে ও প্রথম শ্রেণিতে স্থান সঙ্কুলান হবে না। তাই বিদ্যালয় ব্যবস্থাকে সুষ্ঠভাবে চালাতে গেলে অনুর্ত্তীর্ণ রাখা কেবল ব্যতিক্রম হিসেবে থাকতে পারে।
দেশে বা রাজ্যে শিক্ষক নিয়োগ, নিয়োগে বৈষম্য, কত শতাংশ বিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষায় পাশ করল, আইআইটি’র প্রবেশিকা পরীক্ষায় কোন রাজ্য থেকে কে প্রথম হল, কতজন উত্তীর্ণ হল, আইআইএম বা আইআইটির ছাত্রীছাত্ররা কত উচ্চ বেতনের চাকুরি পেল এসব নিয়ে যত আলোচনা প্রচার মাধ্যমে দেখতে পাওয়া যায় তার বিন্দুমাত্রও শিক্ষার গুণগত মান বিষয়ে আলাপ আলোচনায় দেখা যায় না। ‘প্রথম’য়ের মত দু’একটি অসরকারি সংস্থা বিদ্যালয় শিক্ষার হাল নিয়ে সমীক্ষা করে, কিন্তু কীভাবে ধনী নির্ধন নির্বিশেষে সকল শিশুর জন্য সমমান ও গুণমানযুক্ত বিদ্যালয়স্তরের শিক্ষার বন্দোবস্ত করা যেতে পারে তা নিয়ে কোনো গভীর আলোচনা সরকারিস্তরে চোখে পড়ে না। যেধরণের নতুন নতুন শিক্ষানীতিই আসুক না কেন গ্রামের শিশু ও শহরের শিশুদের মধ্যে, ধনী পরিবারের শিশু ও গরিব পরিবারের শিশুদের মধ্যে, ইংরেজি মাধ্যম ও মাতৃভাষার মাধ্যমে শিশুদের মধ্যে, সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয়ের ছাত্রীছাত্রদের মধ্যে বিপুল পার্থক্যকে মিটিয়ে দেওয়ার কোনো অন্তর্বস্তুই তাতে থাকে না। শিক্ষক সংগঠনগুলিও মূলত তাঁদের পেশাগত দাবিদাওয়া নিয়েই ব্যস্ত থাকেন, বিদ্যালয়স্তরের শিক্ষাকে সুসংহত ও পরিপূর্ণ করে তোলার কোনো আন্তরিক এজেন্ডা সেখানে থাকে না। ফলে ছাত্রীছাত্রদের শিক্ষার গুণগত ফারাক ক্রমাগত বাড়তে থাকে, শ্রেণি বিভক্ত সমাজে বিভাজনটিও পোক্ত হয়।
- অমিত দাশগুপ্ত
ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় সরকার। কিছু ধান তারা কেনে। আর বেশিটাই কেনে রাজ্য সরকার। কেন্দ্রীয় সরকার বলতে চায় তারা বছর বছর ধানের সহায়ক মূল্য বাড়াচ্ছেন। গত দশ বছরে কুইন্টাল পিছু তা প্রায় ৭০০ টাকা বেড়েছে। রাজ্য সরকার প্রচার করে ২০১১ সালে সরকারের লক্ষ্য ছিল ২০ লক্ষ টন ধান কেনার, সেটা বেড়ে ২০২১ সালে হয়েছে ৫২ লক্ষ টন।
কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের এত ‘কৃষকবন্ধু’ অবস্থানের প্রচারের পরেও বাংলার লক্ষ লক্ষ ধানচাষির অভাব অভিযোগ এত তীব্র কেন? কেন তারা বলছেন বিক্রির সময় ন্যূনতম সহায়ক মূল্য তারা পাচ্ছেন না?
চাষিদের বক্তব্য সরকার যত বেশি ধান কেনে, তত বেশি পকেট আসলে ভরে ফড়েদের। সাধারণ গরীব প্রান্তিক বা ছোট চাষির লাভ হয় না। সরকারি কড়াকড়ি যে লোক দেখানো, ৭০ শতাংশ বা অনেক জায়গায় তার চেয়েও বেশি পরিমাণ ধান ফড়েরাই যে সরকারকে সরবরাহ করে — তা গ্রামের মাটিতে এক প্রতিষ্ঠিত বাস্তব। সরকারি ঘোষণা ও প্রচারের আড়ালে এই ছবি কেন(?) তার উত্তরে চাষিরা বলেন যে কবে ধান কেনা হবে সেই খবর চাষিরা পান না। আগাম খবর যায় পঞ্চায়েত ও শাসক দলের মাথাদের কাছে। ধর্ণা দিয়ে চাষি মান্ডি বা চালকল থেকে ধান বিক্রির টোকেন পেলেও তার দিন পায় অনেক পরে। শিবিরে ধান বিক্রি করতে নিয়ে গিয়েও অনেক সময় গাড়িভাড়া গচ্চা দিয়ে ধান নিয়ে ফিরে আসতে হয়। চালকল ধান কিনলেও কুইন্টাল পিছু ছয়-সাত কিলো প্রায়ই বাদ দিয়ে দেয়। প্রায় ষাট-সত্তর কিলো ধানের দাম হারাতে হয় ছোটো চাষিকে।
ছোটো চাষির মূল সমস্যা ধান বিক্রি করার জন্য অপেক্ষা করার সুযোগ তার নেই। ঘরে ধান কিছুদিন রেখে দেওয়া, তারপর আরো অনেকদিন অ্যাকাউন্টে সরকারি টাকা ঢোকার অপেক্ষায় বসে থাকার সুযোগ তাদের নেই। অন্তত দশ বারো বিঘের মালিক যারা, একেবারে তিরিশপঁয়ত্রিশ কুইন্টাল ধান বিক্রি করতে পারেন — তারাই ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের সুবিধেটা নিতে পারেন। দুই আড়াই বিঘের চাষিরা ধান দ্রুত বিক্রি করে আলু চাষে নেমে পড়েন, আলু বিক্রি করেই আবার নামেন ধান চাষে। এই চক্রের বাইরে তাঁরা বেরোতে পারেন না।
যে ফড়েরা লাভের গুড় খেয়ে যান, কম দামে চাষির থেকে অভাবী ফসল কিনে পরে বেশি দামে সরকার বা চালকল মালিককে বেচে দেন, তারা গ্রামের রাজনীতি অর্থনীতির বাইরের কেউ নন। এরা মূলত বড় চাষি, চালকল মালিকের এজেন্ট, সার বীজের ডিলার, কোল্ড স্টোরেজের মালিক বা বড় ব্যবসায়ী। চাষির ধান এইসব ফড়ে ব্যবসায়ীরা আগেই কম দামে কিনে রাখে, পরে বেশি দামে বেচে দেয়। কিছুটা পুঁজি বা জমানো টাকা আছে বলে তারা এইভাবে চাষির পরিশ্রমের ফসল থেকে লাভের গুড়টা খেয়ে যেতে পারে।
চালকল মালিক আর খাদ্য দফতরের কর্মীদের মিলিত দুর্নীতির জন্য বহু ধান কেনা হয় কেবল খাতায় কলমে। ধান অডিট করার কোনও ব্যবস্থা আজও বাংলায় চালু হয়নি। প্রতিটা ব্লকে কৃষক মান্ডি করে আদতে চাষির কোনও লাভ হয়নি। গ্রামে গিয়ে চাষির ঘর থেকে ধান কেনার ব্যবস্থা হলে চাষি প্রকৃতপক্ষে লাভবান হতে পারেন। এইগুলো হয় না, কারণ গ্রামীণ রাজনীতির ক্ষমতাবান অংশটিকে খুশি রেখেই শাসক দলের রাজনীতি চলে। ফড়ে রাজ নির্মূলের লড়াইটা বামপন্থীরা যদি সাহসের সঙ্গে লড়তে পারেন, তাহলে তাদের সংগঠন ও জনসমর্থনে আবার জোয়ার আসতে পারে।
- সৌভিক ঘোষাল