হায়দ্রাবাদের সাথে ‘ডেকান’ শব্দটা জড়িয়ে আছে, যার অর্থ সিঁড়ি। দাক্ষিণাত্যের সিঁড়িতে অনেকদিনের প্রচেষ্টার পর সোচ্চার আত্মঘোষণা করে পা রেখেছে অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন (আইসা)। রোহিথ ভেমুলার ক্যাম্পাস হায়দ্রাবাদ সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটিতে সাম্প্রতিক ছাত্র সংসদ নির্বাচনে বিপ্লবী বাম ছাত্র রাজনীতির মুখ হিসাবে প্রথমবারেই অল্প কিছু আসনে প্রার্থী দিয়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে আইসা। সেই শহর এবার শুনলো রাজপথে শ্লোগান — “আ গ্যায়া হ্যায় আইসা, ছা গ্যায়া হ্যায় আইসা ... নকশালবাড়ি লাল সালাম”।
ব্যাপারটা অত সহজে হয়নি, মিছিল হওয়ার কথা ছিল সম্মেলনের প্রথম দিন অর্থাৎ ৯ নভেম্বর সকালেই, কিন্তু আগাম বার্তা দেওয়া সত্ত্বেও শেষ মুহূর্তে বাধ সাধে তেলেঙ্গানা প্রশাসন — একসাথে চার-পাঁচজনকেও রাস্তায় হাঁটতে দেবে না তারা, প্রতিনিধিদের থাকার জায়গাটাকে আগের রাত থেকে ঘিরে রাখে পুলিশ। লাগাতার বাদানুবাদের পর দ্বিতীয়দিন অর্থাৎ ১০ নভেম্বর সকালে মিছিলের অনুমতি দিতে বাধ্য হয় প্রশাসন। লাল পতাকা, ফেস্টুন, ব্যানার, পেইন্টিংয়ে সেজে উঠেছিল হায়দ্রাবাদের সুন্দরাইয়া বিজ্ঞানন কেন্দ্রম। শহীদ স্মরণের পরে ৯ নভেম্বর বেলা ১১ টায় শুরু হয় প্রকাশ্য অধিবেশন। ঘড়ির কাঁটায় কয়েক মিনিট আগেই সুপ্রিম কোর্ট ঘোষণা করেছে অযোধ্যা মামলার রায়। ঘটনার পরিবর্তে বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে দেওয়া আদালতের বিচারপ্রক্রিয়ার ও সাংবিধানিক মাপকাঠির স্ববিরোধী এই রায় এবং বহুত্ববাদী ঐতিহ্যকে ধ্বংসকারী গেরুয়া ফ্যাসিবাদকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সমালোচনায় বিঁধলেন সম্মেলনে আগত অতিথি ও পর্যবেক্ষকরা — সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পলিটব্যুরো সদস্যা কবিতা কৃষ্ণণ, এসএফআইয়ের দীপ্সিতা ধর, এআইএসএফ-এর দীনেশ ও এআইডিএসও-র পি তেজা প্রমুখ। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন সিপিআই(এমএল) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তিরুপতি গোমাঙ্গ ও তেলেঙ্গানার দায়িত্বশীল এন মূর্তি। সঞ্চালনায় ছিলেন আইসার বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক সন্দীপ সৌরভ।
এরপর সারা দেশ থেকে আগত প্রায় তিনশো প্রতিনিধির উপস্থিতিতে শুরু হয় সম্মেলনের মূল পর্ব অর্থাৎ প্রতিনিধি অধিবেশন। আট সদস্যের সভাপতিমণ্ডলী এই পর্ব পরিচালনা করেন। বিদায়ী কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের তরফ থেকে খসড়া প্রতিবেদন পেশ করেন সভাপতি সুচেতা দে। এরপর প্রথমদিনের বাকি সময় ও দ্বিতীয় দিনের মধ্যাহ্ন পর্যন্ত শতাধিক প্রতিনিধি আলোচনায় নিজ মাতৃভাষা অথবা হিন্দি ও ইংরাজি মাধ্যমে অংশ নেন। উঠে আসে অন্ধ্র, উড়িষ্যা, তামিলনাড়ু, কার্বি আংলং, হরিয়ানা, পাঞ্জাব, উত্তরাখণ্ড সহ বিভিন্ন রাজ্যে আইসার নবগঠিত সাংগঠনিক কাজ ও ব্যবস্থাপনার উৎসাহব্যঞ্জক রিপোর্ট। মহারাষ্ট্র, কেরল সহ অন্য কয়েকটি রাজ্যের নিত্যনতুন যোগসূত্র ও প্রচেষ্টার কথা এবং বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, দিল্লী, উত্তরপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, অসম সহ কয়েকটি তুলনামূলক পুরানো ও সংগঠিত কাজের রাজ্যের কার্যকলাপের বিশ্লেষণ, সমালোচনা, পরামর্শ। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গুরুতর বিতর্কও চর্চিত হয়। পশ্চিমবঙ্গ থেকে মোট প্রতিনিধি ছিলেন ৩৪ জন কমরেড, ১৫ জন আলোচনায় মতামত রাখেন। আলোচনা পর্বের মাঝে মাঝে বিভিন্ন রাজ্যের কমরেডরা তাঁদের ভাষায় জনপ্রিয় দিনবদলের গান ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিবেশন করছিলেন, এই রাজ্যের বর্ষা বড়াল, রুদ্রপ্রভাকর দাস ও অণ্বেষা তাঁদের গানে গোটা হল মুখরিত করেন। দ্বিতীয় দিন সকালে কাচিগুড়া থেকে সম্মেলন কেন্দ্র পর্যন্ত রাজপথ মুখরিত হয় লালে লাল ছাত্রছাত্রী মিছিলে, বিভিন্ন প্রদেশের বিভিন্ন ভাষার জোরালো শ্লোগান বিজেপি আর তার দোসর ক্ষমতাসীন তেলেঙ্গানা রাষ্ট্রীয় সমিতিকে বুঝিয়ে দেয় একাধিপত্যের চোখে চোখ রেখে কিভাবে বৈচিত্র্যের মাঝে স্বপ্নের ঐক্য গড়া যায় — শ্রমিক-কৃষক-শিক্ষার্থী ঐক্য। খসড়া প্রতিবেদন আলোচনা শেষে জবাবী ভাষণ দেন বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক সন্দীপ।
এরপর গঠিত হল ১১৭ সদস্যের আইসার নবনির্বাচিত জাতীয় পরিষদ ও ৫৭ সদস্যের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদ এবং ১৫ সদস্যের অফিস বিয়ারার টিম। পশ্চিমবঙ্গ থেকে ৬ জন কার্যনির্বাহী পরিষদ (ই.সি) সহ মোট ১৩ জন কমরেড জাতীয় পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হলেন — অণ্বেষা রায়, অঙ্কিত মজুমদার (ই সি), অভিজিত সরকার, অমিতাভ বিশ্বাস, ঐশিক সাহা, চন্দ্রনারায়ণ ব্যানার্জী/গুড্ডু, নিলাশিস বসু (অফিস বিয়ারার), ফারহান হোসেন খান (ই সি), শুভাশীষ দাস, শুভ্রদীপ অধিকারী, সৌমেন্দু মিত্র (ই সি), সৌরভ রায় (ই সি) ও স্বর্ণেন্দু মিত্র (অফিস বিয়ারার)। সাধারণ সম্পাদক হিসাবে সন্দীপ সৌরভ পুনর্নির্বাচিত ও জাতীয় সভাপতি হিসাবে এন সাই বালাজী নবনির্বাচিত হলেন। সাতজন যুগ্ম সম্পাদক ও ছয়জন সহ সভাপতি নির্বাচিত হলেন। সাতজনের অন্যতম যুগ্ম সম্পাদক হিসাবে নির্বাচিত হয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সভাপতি নিলাশিস ও সম্পাদক স্বর্ণেন্দু। এই সামগ্রিক কমিটিকে গোটা হাউস হাততালি ও শ্লোগান দিয়ে অভিনন্দন জানায়। এরপর নতুন কমিটির সাধারণ সম্পাদক সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন ও সভাপতি আগামী ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের কলঙ্কিত দিনে দেশজুড়ে বাবরি ধ্বংসকারীদের শাস্তির দাবিতে ও জাতীয় ঐক্য ও সংহতি রক্ষার্থে এবং আগামী ৮ জানুয়ারী দেশব্যাপী শ্রমিক ধর্মঘটে ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণের প্রস্তাব সহ আইসার কর্মসূচীর আহ্বান রাখেন। ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করে ভগৎ সিং, আম্বেদকরের পথে জনগণের ভারত গড়ার শপথে ‘উই শ্যাল ওভারকাম’ সমবেত সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে সম্মেলন সফলভাবে শেষ হয়।