পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভায় প্রস্তাব পাস হয় যে এরাজ্যে এনআরসি করা হবে না। বিজেপি বাদে সবকটি রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধভাবে এই প্রস্তাব পাস করে। এই প্রস্তাব রাজ্য বিধানসভায় সংখ্যাগুরু অংশের রাজনৈতিক অভিমতকে প্রকাশ করে। কিন্তু এই প্রস্তাব মেনে এরাজ্যে এনআরসি করা থেকে বিরত থাকার কোনও আইনী বাধ্যবাধকতা কেন্দ্রীয় সরকারের নেই। কারণ প্রস্তাব পাস হওয়া আর আইন পাস হওয়া এক কথা নয়। কেন্দ্রীয় সরকার এনআরসি করছে কেন্দ্রীয় আইনের আওতায়।
দ্বিতীয়বার মোদি সরকার আসার পর দেশের রাষ্ট্রপতি তাঁর প্রথম প্রথানুগ ভাষণে জাতির উদ্দেশ্যে জানিয়ে দিয়েছেন যে তাঁর সরকার সারা দেশে এনআরসি লাগু করবে এবং তা করা হবে প্রায়োরিটি বেসিসে। যে রাজ্যগুলিতে অনুপ্রবেশের সমস্যা আছে সেখানে আগে করা হবে ও তারপর ধাপে ধাপে অন্যত্র। বলাই বাহুল্য বাংলা ও উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিই ফার্স্ট ‘প্রায়োরিটি’, অথবা বলা চলে প্রথম টার্গেট। পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বহুবার বহুভাবে জানিয়েছেন যে অবিলম্বে সারা দেশে এনআরসির প্রক্রিয়া চালু হবে। সম্প্রতি আরএসএস প্রধান — যিনি বেআইনীভাবে কার্যত দেশের প্রায় সমস্ত নীতিকেই নিয়ন্ত্রিত করছেন — জানিয়েছেন যে সারা দেশে এনআরসি লাগু করা হবে। সুতরাং পশ্চিমবাংলায় যে এনআরসির প্রক্রিয়া শুরু হতে চলেছে তা নিয়ে কোনও সংশয় নাই।
রাজ্য বিধানসভায় পাস হওয়া এনআরসি-বিরোধী প্রস্তাব রাজ্যের সাধারণ মানুষকে নিশ্চয় খানিকটা আশ্বস্ত করেছে। রাজ্যের শাসকদল তথা মুখ্যমন্ত্রী উচ্চস্বরে বলছেন যে এরাজ্যে তাঁরা এনআরসি করতে দেবেন না। কোনও কোনও দলের নেতা নাটকীয় ভঙ্গীমায় বলছেন যে এনআরসি লাগু করতে চাইলে তাঁদের লাশের ওপর দিয়েই তা করতে পারবে কেন্দ্রীয় সরকার। কেউ জনসভায় হুমকি দিয়ে বলছেন যে ডিটেনশন ক্যাম্প হলে তা গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে। এসবই নিশ্চয় উদ্বিগ্ন জনগণকে বিভিন্নভাবে আশ্বস্ত করছে, রুখে দাঁড়ানোর নৈতিক সাহস তৈরি করছে। কিন্তু এনআরসি লাগু করার যে প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই ঘোষিত হয়ে গেছে, কি পদ্ধতিতে কীভাবে হবে ‘এনআরআইসি’ তার নিয়ম কানুন আগেভাগেই তৈরি করে রাখা আছে এবং সেই অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকারি গেজেট নির্দেশিকা জারি হয়ে গেছে সে সম্পর্কে নীরব থেকে কি বিজেপি-আরএসএসের গেমপ্ল্যানের বিরুদ্ধে এক পা-ও এগনো যাবে? অন্ধ সেজে থাকলেই কি আসন্ন প্রলয় বন্ধ হয়ে যাবে? এই প্রশ্ন উঠছে কারণ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী প্রায় প্রতিদিনই মানুষকে বলছেন যে ‘এনপিআর’ নিয়ে মিথ্যা আতঙ্কিত হবেন না, এনপিআরের সাথে এনআরসি-র কোনও সম্পর্ক নেই। অথচ একটু খোঁজ খবর রাখলেই জানা যায় যে কেন্দ্রীয় এনআরসি তৈরির প্রথম ধাপ হিসেবেই আগামী ১ এপ্রিল থেকে শুরু করে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ‘এনপিআর’-এর কাজ শেষ করার নোটিশ জারি হয়ে গেছে গত ৩১ জুলাই ২০১৯।
কেন্দ্রীয় স্বরাস্ট্রমন্ত্রকের পক্ষ থেকে ৩১ জুলাই ২০১৯ ‘রেজিস্ট্রার জেনেরাল অব সিটিজেন্স রেজিস্টার’ শ্রী বিবেক যোশির জারি করা নির্দেশিকা ঘোষণা করেছে যে “সিটিজেন্স (রেজিস্ট্রেশন অব সিটিজেন্স অ্যান্ড ইস্যু অব ন্যাশনাল আইডেন্টিটি কার্ডস) রুলস ২০০৩”-এর ৩নং নিয়মের (৪)নং উপ-নিয়ম মোতাবেক ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টার গঠনের জন্য ২০২০ সালের এপ্রিল মাসের প্রথম দিন থেকে শুরু করে সেপ্টেম্বরের ৩০ তারিখের মধ্যে বাড়ি বাড়ি গিয়ে অধিবাসীদের সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করে লোকাল রেজিস্টারের কাজ সম্পূর্ণ করা হবে আসাম বাদে দেশের বাকি সর্বত্র।
একথা স্পষ্ট যে এনপিআর-এর কাজ শুরু হচ্ছে নাগরিকত্ব আইনের আওতায়, সেন্সাস আইনের আওতায় নয়। সেন্সাস বা জনগণনা প্রতি দশ বছর পরপর হয়। ২০২১ সালে পরবর্তী জনগণনা সম্পুর্ণ হবে। জনগণনায় প্রাপ্ত ব্যক্তি-তথ্য সম্পূর্ণ গোপনে সুরক্ষিত থাকে। সাধারণভাবে দেশের আর্থসামাজিক-জনবিন্যাসগত সামগ্রিক পরিসংখ্যান তৈরি করাই জনগণনার উদ্দেশ্য, কোনওরকম ব্যক্তি পরিচিতির বিষয় বা নামের তালিকার প্রশ্ন সেখানে নাই। সুতরাং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উক্ত নির্দেশনামার ‘এনপিআর’-কে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন জনগণনার নিরীহ কর্মকান্ড হিসেবে তুলে ধরে মুখ্যমন্ত্রীর নিরন্তর বিজ্ঞাপন আসলে জনসাধারণের প্রতি মিথ্যাচার।
“সিটিজেন্স (রেজিস্ট্রেশন অব সিটিজেন্স অ্যান্ড ইস্যু অব ন্যাশনাল আইডেন্টিটি কার্ডস) রুলস ২০০৩”-এর ৩নং নিয়মের (৪)নং উপ-নিয়মে এনআরআইসি-র লক্ষ্যে প্রত্যেক পরিবার ও ব্যক্তির নাগরিকত্বের যথার্থ অবস্থা সহ নির্দিষ্ট কিছু তথ্য সংগ্রহের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে বাড়ি-বাড়ি গিয়ে পরিগণনা চালানোর কথা বলা আছে। বস্তুত কীভাবে এনআরআইসি তৈরি করা হবে তা ২০০৩ সালের এই ‘সিটিজেন্স রুলস’-এ ১৮টি নিয়ম ও তার ভেতরকার উপ-নিয়মগুলিতে বর্ণনা করা আছে। খুব সংক্ষেপে বললে এনআরআইসি ও ন্যাশনাল আইডেন্টিটি কার্ড হবে চারটি ধাপে। প্রথমে এনপিআর, দ্বিতীয় ধাপে সেই পপুলেশন রেজিস্টারের মধ্যে সন্দেহজনক (ডি বা ডাউটফুল) চিহ্নিতকরণ ও শুনানির মাধ্যমে তার যাচাই, তৃতীয় ধাপে — চুড়ান্ত যাচাইয়ে নিজেকে প্রমাণ করতে না পারা ব্যক্তিদের নাম এনপিআর থেকে বাদ দিয়ে — এনআরআইসি প্রকাশ, সর্বশেষ ধাপে সেই চূড়ান্ত নাগরিক তালিকায় (এনআরআইসি) নাম থাকা ব্যক্তিদের জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান। বাড়ি বাড়ি গিয়ে কোন কাগজপত্র দেখা হবে বা “সন্দেহজনক” চিহ্নিত করা হবে কিসের ভিত্তিতে তা বলা নাই রুলসে। “লোকাল রেজিস্ট্রার”-এর মাধ্যমে এই রেজিস্ট্রেশন শুরু হবে। লোকাল রেজিস্ট্রার হবেন গ্রাম বা ওয়ার্ড স্তরে নিযুক্ত ব্যক্তি। রাজ্য সরকার কর্তৃক তিনি নিযুক্ত হবেন, কিন্তু তাঁর সাথে এক বা একাধিক সহকারী থাকবেন যারা নিযুক্ত হবেন কেন্দ্রীয় রেজিস্ট্রার জেনেরাল দ্বারা। এঁরা লোকাল রেজিস্টার তৈরি করবেন এবং “সন্দেহজনক নাগরিক” চিহ্নিত করবেন। এনপিআর-এ সন্দেহজনক নামের পাশে মন্তব্য লিখে দেবেন। এনপিআর-এর এই লোকাল রেজিস্ট্রার সাবডিভিশনাল স্তরে প্রকাশ করা হবে। সন্দেহজনক হিসেবে চিহ্নিতরা দুটো শুনানির চান্স পাবে নিজেদের প্রমাণ করার জন্য — প্রথমে সাবডিভিশনাল রেজিস্ট্রার ও তারপর ডিস্ট্রিক্ট রেজিস্ট্রারের সামনে। এই সমস্ত নথির ভিত্তিতে রেজিস্ট্রার জেনেরাল অর্থাৎ কেন্দ্রীয়ীয় মহানিবন্ধক চূড়ান্ত করবেন কে নাগরিক কে নয়। সন্দেহজনক চিহ্নিত করা হবে কিসের ভিত্তিতে বা কোনো কাগজপত্র দিয়ে নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে হবে তা এই নিয়মাবলীতে দেওয়া নেই। বিভিন্ন স্তরের রেজিস্ট্রারদের ইচ্ছের কাছে তা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। লোকাল রেজিস্ট্রাররা চাইলে তার এলাকার যে কোনও ব্যক্তির কাছ থেকে অন্য ব্যক্তি সম্পর্কে যে কোনও তথ্য জানতে চাইতে পারেন এবং তা ব্যবহার করতে পারেন। সমস্ত স্তরের রেজিস্ট্রাররা তার ঊর্ধতন রেজিস্ট্রারের অধীনস্ত হিসেবে কাজ করবে। সমগ্র প্রক্রিয়ার সময় মাঝে মাঝে কেন্দ্রীয় সরকার রেজিস্ট্রারদের গাইড করবে।
তাহলে পপুলেশন রেজিস্টারে নামের পাশেই “ডি” ছাপ্পা লেগে যাবে। এনপিআর>এনআরআইসি>ন্যাশনাল-আইডি পর্যন্ত এই কার্যক্রম সম্পন্ন হতে পারে রাজ্য প্রশাসনের মেশিনারির মাধ্যমেই। http://home.wb.gov. in/ থেকে জানা যাচ্ছে যে সরকার ইতিমধ্যেই একটি “এনপিআর সেল” গঠন করেছে। এখানে একটি বাক্যই লেখা আছে : The National Population Register Cell deal with all issues related to citizen registration within the state of West Bengal and coordinates all Aadhaar related matters with the UIDAI.
রাজ্য সরকার আইনত এই প্রক্রিয়ায় অসহযোগিতা করতে পারে কি না তা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু এনপিআর যে এনআরআইসি-র প্রথম ধাপ — এই সত্যকে চেপে দেওয়ার অপচেষ্টা রাজ্যবাসীর সাথে প্রতারণা। কোন রাজনৈতিক স্বার্থে টিএমসি ও তার সুপ্রিমো এই প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছে তা অবশ্য অন্য আলোচনার বিষয়।