বিহারে সিপিআই(এম-এল)-এর প্রতিষ্ঠাতা নেতা কমরেড রাম নরেশ রামের নবম প্রয়াণ বার্ষিকীতে সারা বিহারেই ২৬ অক্টোবর তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এই উপলক্ষে পাটনায় রাজ্য সদর কার্যালয়ে একটি স্মরণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেদিনের সভায় তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করে পলিটব্যুরো সদস্য কমরেড রামজি রাই বলেন, কমরেড রাম নরেশ রাম ছিলেন এক অঙ্গীকারবদ্ধ যোদ্ধা যিনি শ্রমিক, কৃষক, নিপীড়িত ও বঞ্চিত জনগণের মুক্তির জন্য সারা জীবন ব্যায় করেন। ঐ সভায় আরো উপস্থিত ছিলেন ব্রিজ বিহারি পাণ্ডে, আর এন ঠাকুর, রাজ্য কমিটির সদস্য রণবিজয় কুমার ও প্রকাশ কুমার, লোকযুদ্ধ পত্রিকার এক সম্পাদক সন্ত লাল, বিভা গুপ্ত, ও অন্যান্য বরিষ্ঠ নেতা। সভা পরিচালনা করেন কমরেড রাজারাম। রাজ্য সদর কার্যালয় ছাড়াও স্মরণ সভা সংগঠিত হয় ভোজপুর, আরোয়াল, জাহানাবাদ, গয়া, পাটনা গ্ৰামীণ, সিওয়ান, নওয়াদা, নালন্দা এবং অন্যান্য স্থানে।
বিহারে দলিত, ভূমিহীন, দরিদ্রদের বিপ্লবী আন্দোলনের নির্মাতা কমরেড রাম নরেশ রাম সিপিআই(এম-এল)-এর পলিটব্যুরো সদস্য এবং ১৯৯৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত বিহার বিধানসভায় পার্টির বিধায়ক গোষ্ঠীর নেতা ছিলেন। তিনি পারশজি নামেই সবার কাছে পরিচিত ছিলেন এবং ১৯৬৭ সালে তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে তাঁকে এবং বিহারে সিপিআই(এম-এল)এর আর এক প্রতিষ্ঠাতা জগদীশ মাস্টারকে সামন্ততান্ত্রিক হিংসার মুখে পড়তে হয়। নিপীড়িত দলিত ভূমিহীন মজুরদের মুক্তি এবং শোষণের অবসানের লক্ষ্যে বিপ্লবী বাম আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে তাঁরা ভোজপুরে সিপিআই(এম-এল)-কে গড়ে তুললেন।
কমরেড রাম নরেশ রাম ১৯২৪ সালে ভোজপুরের সাহাবাদ জেলার সাহার ব্লকের একোয়ারি গ্ৰামে জন্মগ্রহণ করেন। যুব বয়সে তিনি ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশ নেন, তেলেঙ্গানা কৃষক আন্দোলনের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন, সিপিআই-এ যোগ দেন এবং ক্যানাল থেকে নেওয়া সেচের জলের দাম বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলনে কৃষকদের নেতৃত্ব দেন। এরপর তিনি সিপিএম-এ যোগ দেন, ১৯৬৫ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনে অংশ নিয়ে একোয়ারি পঞ্চায়েতের মুখিয়া আসনে জয়লাভ করেন। সিপিএম থেকে ১৯৬৭ সালে বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে সামন্ততান্ত্রিক শক্তিগুলো হিংসা চালায়। এরপর তিনি ও জগদীশ মাস্টার সিপিআই(এম-এল) গড়ে তোলেন এবং বিপ্লবী কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ১৯৮০-র দশকে তাঁর উপর বিহার রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব অর্পিত হয়। বিহারে বিহার রাজ্য কিষাণ সভা গড়ে তোলেন রাম নরেশ রাম, স্বাধীনতা সংগ্ৰামী এবং জনগণের কবিয়াল রামাকান্ত দ্বিবেদী ‘রামতা’ এবং অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।
বিহার বিধানসভার ১৯৯৫ সালের নির্বাচনে সিপিআই(এম-এল) প্রার্থী হিসাবে সাহার কেন্দ্রীয় থেকে রাম নরেশ রাম-এর বিজয় সামন্ততান্ত্রিক শক্তিগুলোর সন্ত্রাসবাদের বাহিনী রণবীর সেনার রোষ আকর্ষণ করে। কারণ, দলিতদের ভোট দিয়ে সিপিআই(এম-এল) প্রার্থীকে জেতানোটা সামন্ততান্ত্রিক ‘সম্মানের’ কাছে এক চ্যলেঞ্জ হিসেবেই দেখা হয়েছিল।
বিধায়ক হিসাবে রাম নরেশ রাম-এর ভূমিকা সমস্ত কমিউনিস্ট আইন প্রণেতার কাছেই মডেল হয়ে থাকবে। তিনি দানবীয় আইন, সন্ত্রাসবাদী সংগঠন রণবীর সেনাকে দেওয়া মদতের বিরুদ্ধে বিধানসভার ভিতরে ও বাইরে তীব্র লড়াই চালান, দুর্নীতির অবসানের লক্ষ্যে সরকারি কাজের তদারকিও করেন। বিধায়ক হিসাবে তিনি সেচ সম্পদের উন্নতি ঘটাতে যথাসাধ্য চেষ্টা চালান এবং সর্বদাই সার্বিক ভূমিসংস্কার এবং কৃষিশ্রমিক, ভাগচাষি, ক্ষুদ্র ও মধ্য কৃষকদের অধিকারের পক্ষে দাঁড়ান। বিধায়ক হওয়ার পর তিনি ১৯৪২-এর আন্দোলনে শহীদ হওয়া কৃষকদের মর্যাদায় ভূষিত করতে এক অনুপম স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণ করেন। কৃষক বিদ্রোহ এবং তাদের সংগ্ৰামের প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধা ছিল।
কমরেড রাম নরেশ রাম ছিলেন স্বাধীন ভারতের সহজানন্দ সরস্বতী — উভয়েই সমাজের সবচেয়ে নিপীড়িত অংশের মধ্যে রাজনৈতিক ও সামন্ততন্ত্র-বিরোধী আত্মঘোষণার বিপ্লবী স্ফুলিঙ্গ জাগিয়ে তোলেন।
কমরেড রাম নরেশ রাম যে সংগ্ৰাম গড়ে তোলেন তারই ফলশ্রুতিতে বিহারের দলিত-পশ্চাদপদ গ্ৰামীণ দরিদ্ররা স্বাধীনতার পরবর্তী পর্যায়ে সেই প্রথম ভোট দেওয়ার বুনিয়াদি গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জন করে। তারা যেমন কমিউনিস্ট প্রতিনিধি নির্বাচিত করে সংসদ এবং বিধানসভায় পাঠায়, সেরকমই পঞ্চায়েতগুলিতেও শক্তির ভারসাম্যে পরিবর্তন নিয়ে আসে।