৫ আগস্ট ধারা ৩৭০ ও ৩৫এ প্রত্যাহার করে কেন্দ্রের মোদী সরকার। তারপর থেকে কার্যত কাশ্মীরীয়ৎ দ্বি-খন্ডিত, কাশ্মীরী জনজীবন অবরুদ্ধ, বন্দী। বহির্জগতের সাথে তার সংযোগ স্থাপনের সূত্রগুলি বন্ধ বা চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রিত থাকছে।মানুষের স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। আত্মীয়তার যোগাযোগও রাখা যাচ্ছে না। এক চরম সেনা নিয়ন্ত্রিত দিন কাটাচ্ছে কাশ্মীরের সমাজজীবন।
এসব তথ্য ইতিমধ্যেই বেসরকারী কিছু কিছু প্রত্যক্ষদর্শী দল, ব্যক্তিবিশেষ, সংবাদ সংগ্রহকারী, ভাষ্যকার সূত্রে প্রকাশ্যে জানাজানি হতে শুরু করেছে। তবে যা যা অবহিত হওয়া গেছে তা দৃশ্যমান তথ্যাবলী মাত্র। মোদী-অমিত শাহদের কেন্দ্রীয় সরকার থেকে শুরু করে বিজেপি-আরএসএস এবং তাদের পেয়ারের কর্পোরেট মিডিয়া উন্মোচিত হচ্ছে, তবু ঢং দেখিয়ে চলছে, লাগাতার মিথ্যাচার করে চলছে। ‘কাশ্মীরের নাকি ভালো হচ্ছে’, ‘স্বস্তি-শান্তি আসছে’! ভিন্ন স্বর তুললেই সেনার সাঁড়াসি আক্রমণ। এহেন নির্মম-নিষ্ঠুর সারসত্যের কথাকাহিনী আরও একবার উঠে এল এক সংখ্যাবহুল কাশ্মীর তথ্যানুসন্ধানী পরিদর্শনকারী দলের রিপোর্টে। ঐ দলটি সফর করে ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে ৪ অক্টোবর, উপত্যকার ৫টি জেলা জুড়ে। দলে ছিলেন নারী-পুরুষ সমন্বয়ে সমাজের বিভিন্ন পেশাজীবী বিশিষ্টজন। যেমন, মানবাধিকার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ আইনজীবী মিহির দেশাই, লারা জেসানী, বীণা গৌড়া, ক্লিফটন ডি রোজারিও, আরতি মুন্দকুর ও সারঙ্গা উগালমুগলে; মনোবিদ অমিত সেন, ট্রেড ইউনিয়ন নেতা গৌতম মোদী ও বেঙ্গালুরু ভিত্তিক সমাজকর্মী নাগরি বাবাইয়া, রামদাস রাও ও স্বাতী শেষাদ্রি। তথ্যানুসন্ধানী দলটি দিল্লীতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে তাদের রিপোর্ট প্রকাশ করে। রিপোর্টের মূল মূল কথা হল, উপত্যকার জেলাগুলিতে কার্যত গোটা বিচারব্যবস্থা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে, চলছে ব্যাপক দমনপীড়ন অত্যাচার, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মানসিক ভীতি সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ার শিকার।
অত্যাচারের ধরনগুলি রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। ছেলেমেয়েদের ধরে এনে গোপনাঙ্গে ইলেকট্রিক শক দেওয়া ও জঘন্যভাবে যৌন নিগ্রহ করা হচ্ছে এবং এইসমস্ত অত্যাচার সহ্য করতে না পারার আর্তনাদ রেকর্ড করে মাইক বাজিয়ে শোনানো হচ্ছে। অবস্থা এমনই বিপজ্জনক যে, অত্যাচারিতরা তথ্যপ্রমাণ হিসেবে ভয়ে নাম-পরিচয় উল্লেখ করতে চাইছে না। রিপোর্টে বলা হয়েছে, “সোপিয়ান জেলার একটি গ্রামে সেনার হাতে এক তথাকথিত জঙ্গীর ভাইয়ের নৃশংসভাবে অত্যাচারিত হওয়ার খবর বিবিসি-তে প্রচারিত হওয়ার পর সশস্ত্র সেনারা আবার এসে তাকে ‘মিডিয়ায় বলার এত সাহস কি করে হয়?’ হুমকি দিয়ে ভয়ঙ্কর অত্যাচার করে।” সত্যি বলতে কী, এইসমস্ত অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে মানুষজন যে আইন আদালতের দ্বারস্থ হবে তার উপায় নেই। বাস্তবিকই সেটা হয়ে দাঁড়িয়েছে অসম্ভব।
রিপোর্টে উল্লেখ, “তাঁরা (হাইকোর্টের আইনজীবীরা) আমাদের বললেন, যখন যোগাযোগ বন্ধ, অবরুদ্ধ হয় পড়া, আন্দোলনে নিষেধাজ্ঞা জারী ইত্যাদি কারণে গোটা বিচারপ্রক্রিয়াই অকার্যকর প্রতিপন্ন হচ্ছে তখন আইনজীবীরা ধারা ৩৭০ খারিজ, যোগাযোগ অবরুদ্ধতা, অনবরত রাষ্ট্রীয় দমনপীড়ন ও বার এসোসিয়েশনের আইনজীবীদের তথা গণ্যমান্য সদস্যদের গ্রেপ্তারি জনিত মামলা বা সমস্ত রকমের দৈনন্দিন আদালতি কাজ বয়কট করে চলছেন।”
“বার এসোসিয়েশন ছয় জন আইনজীবীকে নির্দিষ্ট করে দায়বদ্ধ করেছে যাঁরা জন নিরাপত্তা আইনে (পিএসএ) আটক করার আদেশের বৈধতার চ্যালেঞ্জ সংক্রান্ত মামলা, হেবিয়াস কর্পাস পিটিশন বা আটক ব্যক্তিদের সঙ্গে তাদের পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাৎকারের আবেদন সংক্রান্ত জরুরী কেসগুলি দেখবেন।”
হেবিয়াস কর্পাসের বিষয়গুলি হল যেখানে বেআইনিভাবে আটকে রাখা হয়েছে। পিএসএ-তে গ্রেপ্তার করা মানেই দীর্ঘ সময় যাবত বিনা বিচারে বন্দী করে রাখা। রিপোর্টে প্রকাশ, “আমাদের জানানো হয়েছে, ৫ আগস্টের আগে পর্যন্ত জমে থাকা হেবিয়াস কর্পাসের মামলার সংখ্যা ছিল ২০০, এখন সংখ্যাটা ছাপিয়ে গেছে ৬০০-র বেশি। ৫ আগস্ট ’১৯ থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর ’১৯-এর মধ্যে হেবিয়াস কর্পাস পিটিশন ফাইল হয়েছে ৩৩০টি।” তারপরে পিটিশন গড়িয়েছে অক্টোবর মাসেও।
“অগণিত মানুষকে বেআইনিভাবে আটকে রাখা হয়েছে, এক মাত্র সরকার ছাড়া আর কারও জানা সম্ভব নয় ঠিক কত সংখ্যায় বন্দী করে রাখা হয়েছে। তারা (কাশ্মীরী অধিবাসীরা) বললেন, বন্দীদের সংখ্যাটা আনুমানিক ১৩০০০-এর বেশি। বন্দীদের পরিবারের সদস্যরা ভয়ে তটস্থ, তাদের আশঙ্কা এই বেআইনি গ্রেপ্তারী নিয়ে তারা যদি কোথাও অভিযোগ জানায়, অথবা আদালতে হেবিয়াস কর্পাসের আবেদন করে কিংবা অন্য কোনোভাবে সহায়তা চায়, তাহলে পিএসএ-র ফাঁসে ফাটকে পুরে দেবে আর তা থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব হবে।
পুলিশ এইভাবে আটক করার বিরুদ্ধে কোনো এফআইআর নথিভুক্ত করছে না, এব্যাপারে কোনো নথি রাখা হচ্ছে না। “থানায় অভিযোগের কোনোরকম নথি না থাকায় এমনকি এফআ আর না হতে পারার কারণে লোকেরা কোনও এমনকি বাচ্চাদের জন্যও জামিনের আবেদন করতে পারছেন না। জনগণ আইনের সুযোগ নিতে পারছেন না। ইউএপিএ কোর্ট রয়েছে শ্রীনগরে, উপযুক্ত যানবাহন ব্যবস্থা না থাকার ফলে রাজ্যের অন্যান্য জেলা শ্রীনগর যাতায়াত করা সম্ভবপর নয়।
রিপোর্টে কাশ্মীরী জনগণের মানসিক স্বাস্থ্যের যে অবনতি ঘটছে তার উল্লেখ রয়েছে। এ ব্যাপারে পরিদর্শনকারী দলে থাকা মনোবিদ স্থানীয় মনোচিকিৎসক ও সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের সাথে সাক্ষাৎ কথাবার্তা বলে যা বুঝেছেন সে সবই উল্লেখ করা হয়েছে।
“দুটি জেলার শিশু ও বয়ঃসন্ধির কিশোর-কিশোরীরা প্রাথমিক পর্যায়ের মানসিক চিকিৎসার জন্য আসছেন যেখানে সেনা হিংসা চরমে পৌঁছেছে এবং রাতের অন্ধকারে চলছে সেনা হানা। একই রিপোর্ট পাওয়া গেছে তথ্যানুসন্ধানী দলটির অন্যান্য সদস্যদের বিভিন্ন সংগৃহীত তথ্য থেকে, জানা গেছে সেনা সন্ত্রাস যুব সম্প্রদায় ও তাদের পরিবারবর্গের মধ্যে ভয়ে সন্ত্রস্ত হওয়ার এক পরিবেশ তৈরি করেছে।
“তারা ভয়ভীতি, প্রচন্ড শঙ্কা, আক্রান্ত হওয়ার আতঙ্ক, অবসাদগ্রস্ততা, বিচ্ছিন্নতার উপসর্গ, মানসিক আঘাতপ্রাপ্ত উপসর্গ, আত্মহত্যার প্রবণতা ও ব্যাপক অসন্তোষ ফেটে পড়ার অভিজ্ঞতাগুলির পারস্পরিক সমান অংশীদার হচ্ছেন। ... সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, মানসিক অবসাদে আক্রান্ত হওয়া সংখ্যাটা লক্ষ্যণীয় মাত্রায় বেড়ে গেছে, জনগণের প্রায় ৭০ শতাংশ এর শিকার।”
“একজন প্রবীণ মনোবিদ এই পরিস্থিতি প্রসঙ্গে বলেছেন এখন যা চলছে তা এককথায় একটানা এমন এক মানসিক অস্থিরতা যেখানে সবাই সবকিছুকে অবিশ্বাস করছে, কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না।
“রিপোর্ট পাওয়া গেছে যুব ও অল্পবয়সীদের ওপর অত্যাচার ও নিগ্রহ চালানোর চরম প্রভাব পড়ার। মানসিক চাপ সহ্য করতে না পারার প্রতিক্রিয়া ও মানসিক আঘাতজনিত বিশৃঙ্খলা থেকে। দুটি আত্মহত্যার ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। আর শোনা গেছে যুবকরা সব বাড়ি থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে এই ভয়ে যে রাষ্ট্রশক্তি তাদের ধরে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার করবে।”
(দি টেলিগ্রাফ, ১ নভেম্বর ’১৯)