“বামপন্থায় বিশ্বাসী একজন মানুষ কিংবা বিপ্লবী আদর্শে অগ্রণী কোনো নেতাকে পরিস্থিতির সমস্ত দিকগুলো ভালো করে জানতে হয় – বুঝতে হয়, নিজেকে সমৃদ্ধ করতে হয়। কোনো একটা ঘটনাকে বাস্তবসন্মত ও বৈজ্ঞানিকভাবে বিশ্লেষণ করতে হয়। সেটা না হলে বিশ্বাস বা আদর্শের কোনো মূল্য থাকে না। বিমান বিশ্বাসের মধ্যে ছিল সেই বিশেষ গুণাবলী। তিনি গরিবের মাটির দাওয়ায় বসে তাঁদের কথা শুনতেন, দেশ দুনিয়ার রাজনীতির শিক্ষা দিতেন। আমাকে বলতেন, লেখার মধ্য দিয়ে সেসব তুলে ধরতে। তাঁর আদর্শ বেঁচে থাকবে, এগিয়ে যাবে সামনের দিকে।” মাটির গন্ধ মাখা লেখনীতে গ্রামবাংলার অন্তরের কথা যার গল্প উপন্যাসের মর্মবস্তু, বাংলা সাহিত্য-জগতে প্রতিষ্ঠিত নতুন ধারার লেখক আনসারউদ্দিন এভাবেই তাঁর অনুভবকে তুলে ধরলেন। শ্রদ্ধা জানালেন নদীয়ার জলঙ্গী নদীর পার্শ্ববর্তী গ্রাম গ্রামান্তরে তাঁর প্রতিবেশী এবং মানুষের জীবন-যুদ্ধের ভরসাস্থল সংগ্রামী নেতা বিমান বিশ্বাসকে।
গত ৩ নভেম্বর কৃষ্ণনগরে অনুষ্ঠিত স্মরণসভায় দ্বিজেন্দ্র মঞ্চ ছিলো পরিপূর্ণ। কমরেড বিমান বিশ্বাসের দীর্ঘ কয়েক দশকের সংগ্রামী জীবনের সহযোদ্ধারা, ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে থাকা গ্রামের কমরেডরা অন্তরের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা জানাতে এসেছিলেন প্রায় সকলেই। সভার শুরুতে মাল্যদান, নীরবতা পালন ও শোকবার্তা পাঠের পর ‘৭৪ সালে নদীয়া জেলায় পার্টি পুনর্গঠনের সংগ্রামী ইতিহাস তুলে ধরেন সেই সময়কাল থেকে তাঁর সহকর্মী পার্টির জেলা সম্পাদক সুবিমল সেনগুপ্ত। তিনি বলেন “নদীয়া জেলায় কৃষকদের মধ্যে নকশালবাড়ির রাজনীতি নিয়ে যাওয়ার কঠোর কঠিন কাজ সারাজীবন ধরে করে গেছেন বিমান বিশ্বাস।’’ নদীয়া পার্টির “ত্রয়ী” বলে কথিত প্রয়াত সুবোধ মজুমদার-বিমান এবং ধনা — জেলার ঘনিষ্ঠতম এই তিন শীর্ষনেতা যারা ’৭০-এর শেষ ভাগে জেলের বন্দিজীবন থেকে ফিরে আসার পর বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলকেই নিজেদের ঠিকানা বানিয়ে ফেলেছিলেন। তাদের অন্যতম, বিমান বিশ্বাসের বন্ধু তথা সহকর্মী ধনা বা ধনঞ্জয় গাঙ্গুলি বললেন, চার-পাঁচটি ব্লকের বিরাট এলাকায় এমন কোনো গ্রাম নেই যেখানে বিমানের যাতায়াত ছিলো না। আজ ফ্যাসিবাদী শক্তি যে মারাত্মক হামলা নামিয়ে এনেছে তাকে একক ব্যাক্তি হিসাবে নয়, সম্মিলিত ভাবেই মোকাবিলা করতে হবে। জীবনের শেষ প্রান্তে অনেক ব্যাথা বেদনা বুকে নিয়েও পার্টির কমরেডদের প্রতি বিমানের প্রবল আস্থা দেখেছি। তাঁর অনুপস্থিতিতে আমাদের বিভিন্ন দায় দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।
সেই দায়দায়িত্ব গ্রহণে আজকের সময়ের ডাকে নিজেদেরকে নতুন করে উৎসর্গ করার আহ্বান জানালেন পার্টির রাজ্য সম্পাদক পার্থ ঘোষ। তিনি বলেন, একমাত্র এভাবেই আমরা বিমানদার প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জানাতে পারবো। সমাজটাকে পাল্টে দেওয়ার লক্ষ্যে-গরিবের জমি-ন্যায্য মজুরি-মর্যাদার অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্যই বিমানদা ঘরবাড়ি— সব কিছু ত্যাগ করেছিলেন। আজকের সময়ে অর্জিত মৌলিক অধিকারগুলিকে নতুন করে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। যথা নাগরিকত্বের অধিকার প্রমাণে হাজারো কাগজপত্র যোগাড় করতে মানুষকে নানারকম কার্ডের জন্য লাইনে ব্যস্ত রাখা হচ্ছে, অপর দিকে লক্ষ লক্ষ মানুষের কাজ চলে যাচ্ছে, বিগত ৬ বছরে সেই সংখ্যা ৯০ লক্ষ! কলকারখানা-সরকারী ক্ষেত্র বিক্রি হয়ে যাচ্ছে, রান্নার গ্যাস থেকে শুরু করে সমস্ত জিনিসের দাম বাড়ছে। আর ওরা বলে চলেছে, বেছে বেছে সংখ্যালঘুদের নাকি এদেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। আর কয়েকদিন পরেই অযোধ্যার রায় ঘোষণা হবে। সেই সময় সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা দিয়ে ওরা বলেছিল বাবরি মসজিদ ভাঙ্গবে না। কিন্তু তারপর যে ভেঙ্গে দিলো তার জন্য সেই অপরাধীদের শাস্তি হলো না কেন? আগে সেই জবাব ওদের দিতে হবে।
বিমানদার চলে যাওয়ার জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থার জটিলতা একটা অন্যতম কারণ। রোগের জটিলতাও অপর একটি কারণ হিসাবে ছিলো। এজন্য একটা খেদ বা দুঃখ আমাদের রয়েছে, ভবিষ্যতে এ থেকে শিক্ষা নিতে হবে। পার্টির পলিটব্যুরো সদস্য কার্তিক পাল বলেন, কৃষক সংগ্রামের পৃষ্ঠভূমি থেকে বিমান উঠে এসেছিলো। পরবর্তীতে কমরেড জালাল অপর এক বাম দল থেকে আমাদের মধ্যে এসেছিলো, সে শহীদদের মৃত্যু বরণ করেছিলো। তাঁদের নেতৃত্বে বিস্তীর্ণ একটা এলাকা জুড়ে কৃষকের প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে উঠেছিলো, যা কিনা সাম্প্রদায়িক শক্তির চক্রান্তকেও রুখে দিতে সক্ষম হয়েছিল। এই কৃষক আন্দোলনের প্রধান সংগঠক ছিলো বিমান। ঐ এলাকায় আমাদের এমন একটা পরিচিতি গড়ে উঠেছিলো যেখানে জনগণের শত্রুরা, এমনকি পুলিশও ঢুকতে সাহস পেতো না। এই যে দৃষ্টান্ত বিমান রেখে গেছে তাকে হাতিয়ার করেই আজকের দিনে ফ্যাসিবাদকে মোকাবিলার পথে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। স্মরণ সভায় বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এম) জেলা কমিটির সদস্য ও আইনজীবী সামসুল মোল্লা। তিনি আজকের পরিস্থিতিতে ঐক্যবদ্ধ বাম প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদী হামলাকে মোকাবিলার কথা তুলে ধরেন। বিমান বিশ্বাসের লড়াকু ভূমিকা কিভাবে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রতিহত করে মানুষের মধ্যে আশা ভরসা সৃষ্টি করেছিলো অতীতের সেই উদাহরণ সামনে রেখে আজকের দিনেও এগিয়ে যাওয়ার কথা বলেন।
বক্তব্য রাখেন সিপিআই দলের নদীয়া জেলা নেতা অমল মজুমদার, এসইউসিআই(সি) দলের জেলা নেতা জয়দীপ চৌধুরী। মাল্যদান করেন কোটনিস স্মৃতি রক্ষা কমিটির মনতোষ মুখার্জি, বিশিষ্ট নাগরিক অমিত ঘোষ প্রমূখ। বক্তব্য রাখেন দেশব্রতী পত্রিকার সম্পাদক অনিমেষ চক্রবর্তী। তিনি বলেন, মানুষকে সংগঠিত করে ক্ষুদ্র শক্তি নিয়েও বড় বড় গণউদ্যোগ গড়ে তোলা যায়, তার গুরুত্ব অপরিসীম, বিমানদা হাতে কলমে সেই শিক্ষা দিয়ে গেছে। মানুষের উপর ভরসা রাখা, তাঁদের চেতনা বাড়িয়ে যাওয়া, সংগঠিত করা — এই যে কমিউনিস্ট গুণাবলী এ থেকে প্রেরণা নিয়েই নদীয়ার বুকে কৃষক সংগ্রাম নতুন করে নতুন পরিস্থিতিতে গড়ে তুলতে হবে। ’৭৯ সালে সাম্প্রদায়িক শক্তির হামলার মুখে সংখ্যালঘু মানুষকে নিরাপত্তা দিতে সাহসের সাথে যে উদ্যোগ বিমানের নেতৃত্বে শুরু হয় ক্রমশ সেটাই বড় এলাকায় বিশাল গণ প্রতিরোধের সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে জেলা স্তরে তাকে উন্নীত করা এবং রাজনৈতিকভাবে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে চ্যালেঞ্জ জানানো সম্ভব হয়। বিমানের দুর্জয় সাহস, মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা, আদর্শের প্রতি দৃঢ়তা থেকে শিক্ষা নিতে হবে।
পার্টির রাজ্য কমিটি সদস্য নবেন্দু দাশগুপ্ত বলেন, অত্যন্ত সাহসী, নির্ভীক, ঝুঁকি নিয়ে বিমান কাজ করতেন। নদীয়ায় আমরা বহু কমরেডকে হারিয়েছি, তাতে বিন্দুমাত্র দমে না গিয়ে গরিব মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি চেষ্টা করে গেছেন। তা সে জমির অধিকার প্রতিষ্ঠা হোক বা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে শ্রমজীবী মানুষকে রক্ষা করার প্রশ্ন হোক। আজকে সে দায়িত্ব আমাদের পালন করতে হবে। রাজ্য কমিটি সদস্য কল্যাণ গোস্বামী বলেন, গোটা রাজ্যে নদীয়া জেলা নিয়ে আমাদের একটা পরিচিতি গড়ে উঠেছে। সেই জেলায় পার্টি গঠনের একজন স্থপতি ছিলেন বিমান বিশ্বাস। ‘‘মাছ ও জলের মধ্যেকার সম্পর্ক’’ নিয়ে আমরা অনেক কিছুই শুনেছি। বাস্তবে বিমানের সাথে জনগণের সম্পর্ক ছিলো ঠিক তেমনই। আজকের পরিস্থিতিতে ফ্যাসিবাদী হামলার মুখে সেই কমিউনিস্ট গুণাবলী থেকে শিক্ষা নেওয়া অত্যন্ত জরুরী। রাজ্য কমিটি সদস্য জয়তু দেশমুখ বলেন, হাসপাতালের রোগশয্যায় বিমান দা “নকশালবাড়ি লাল সেলাম” শ্লোগানে গোটা ওয়ার্ডকে সচকিত করে তুলেছিলেন। এভাবে জীবনের অন্তিম পর্যায়েও নিজের আদর্শকে উর্ধ্বে তুলে ধরেছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে যেভাবে কৃষক আন্দোলনের কয়েকটি শক্তিশালী এলাকা গড়ে উঠেছিলো তেমনই আজও কৃষক ও গ্রামীণ গরিবদের প্রতিরোধের কিছু অঞ্চল গড়ে তুলতে হবে। তার উপর ভিত্তি করেই অতীতের মতো আজও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক ঐক্য বা রাজনৈতিক সংগ্রাম আমরা গড়ে তুলতে সক্ষম হবো।
নদীয়া জেলার অন্যতম পার্টি নেতা কাজল দত্তগুপ্ত বলেন, বিমানদা অসম্ভব বলিষ্ঠ ও সাহসী নেতা ছিলেন, যুবশক্তির কাছে ছিলেন অনুপ্রেরণা। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে উঠে আসা বিশিষ্ট কমিউনিস্ট সংগঠক, যিনি রাজনৈতিক পুলিশকে মোকাবিলা করার দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। নদীয়া জেলা কমিটি সদস্য অমল তরফদার বলেন, গরিব মানুষের সাথে একাত্মতা, কষ্টসাধ্য কাজের ধারা যেটা বিমানদার গুণাবলী ছিলো তা থেকে আমাদের শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। এছাড়াও বক্তব্য রাখেন রাজ্য এবং জেলা নেতা কৃষ্ণ প্রামানিক, জেলা নেতা বিজয় সাহা, দিলীপ মজুমদার, ধুবুলিয়া ব্লকের নপাড়া লোকাল কমিটির নেতা ঠান্ডু সেখ। শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন বাবুনি মজুমদার।