বাঁকুড়ার ওন্দায় কিষাণ মহাসভার ব্লক সম্মেলন

বাঁকুড়া জেলার ওন্দা ব্লকের উর্বর কৃষি এলাকা থেকে বড়জোড়ার দিকে এবং সোনামুখী পর্য্যন্ত বিস্তৃত যে বনাঞ্চল তার একপ্রান্তে, কৃষি অঞ্চলের লাগোয়া এলাকায়, প্রায় চার শতাধিক আদিবাসী তপশিলি সম্প্রদায়ের মানুষ দীর্ঘ কয়েক প্রজন্ম ধরে গড়ে তুলেছেন নিজেদের বসতি। গ্রামের নাম খেমুয়া। অঞ্চল কোষ্ঠিয়া। এই এলাকার মানুষকে মাঝে মধ্যেই বুনো হাতির হামলা মোকাবিলা করতে হয়। তা সত্বেও অনেকেই ছোট ছোট উর্বরা খন্ডভূমিতে অসম্ভব শ্রম দিয়ে চাষাবাদের পত্তন করেছেন। এর বাইরে পশুপালন আর ‘মুনিষ’ খেটেই তারা দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে দিন গুজরান করে চলেছেন। এই এলাকায় একদিকে বন দপ্তরের সহযোগিতায় ঠিকাদারের দল অন্যদিকে শাসকদলের পক্ষপুটে থাকা “বন কমিটি”-র নামে গ্রামীণ কায়েমী স্বার্থান্বেষী চক্র যখন নানা কৌশলে বনের গাছ কেটে লুঠের কারবার চালিয়ে যাচ্ছে, তখন এই আদিবাসী মানুষেরা নিজ বসতির পার্শবর্তী বনভূমিকে ধারাবাহিক ভাবে রক্ষা করে চলেছেন। কৃষিকাজের স্বাধীন পেশায় রয়েছে এদের চরম আগ্রহ। এই মানুষগুলিকে বনাঞ্চলের জমিতে বাস্তু ও কৃষিকাজের জমির আইনী স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য তৈরি হয়েছিল বনাঞ্চল আইন ২০০৬। কিন্তু সেক্ষেত্রে জমির পাট্টার জন্য জমা হওয়া হাজার হাজার আবেদনপত্র বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। অথচ সম্প্রতি বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানিকে বনাঞ্চলের লাগোয়া জমি লিজে দেওয়া হচ্ছে। এইভাবে, কার্যত বনাধিকার আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানো হচ্ছে।

bankura dist conf

 

সম্প্রতি এদের বাসস্থানের এলাকার মধ্যে গভীর গর্ত খনন করে উচ্ছেদের পরিকল্পনা করেছে স্থানীয় বনদপ্তর। এর বিরুদ্ধে ঐ এলাকার সমস্ত মানুষেরা এক হয়ে কিষাণ সভার পতাকাতলে জোট বেঁধেছেন। জেলা শাসকের দপ্তরে বিক্ষোভ ডেপুটেশন সংগঠিত করেছেন। আগামী দিনে উচ্ছেদের চক্রান্তের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার লক্ষ্যে তাঁরা মিলিত হয়েছিলেন এআইকেএম ওন্দা ব্লক কৃষক সম্মেলনে। সেখানে বন দপ্তর ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কয়েকটি আশু কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়। গত ২২ অক্টোবর নিকুঞ্জপুর স্কুল মোড়ে আয়োজিত এই সম্মেলনে পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন গ্রামের শতাধিক কৃষক প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। শুরুতে লাল পতাকা উত্তোলন করেন এলাকার কৃষক সংগঠক আদিত্য ধবল। নদীয়ার প্রয়াত কৃষক নেতা কমরেড বিমান বিশ্বাস সহ গণ আন্দোলনের সমস্ত শহীদদের স্মৃতিতে নীরবতা পালন করা হয়। এরপর সম্মেলনে জমির অধিকারের বিভিন্ন দাবীর পাশাপাশি কৃষি সংকট থেকে উঠে আসা নানা দাবি সামনে আসে। যথা, ফসলের ন্যায্য দাম থেকে চাষিরা লাগাতার বঞ্চিত হয়ে চলেছে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার লম্বা চওড়া প্রতিশ্রুতি দিয়েও ফসলের দেড়গুণ দাম দিচ্ছে না, ফড়ে দালালরা সরকারী দরের সুবিধা লুঠে নিচ্ছে, চিরাচরিত ভাবেই যেন চাষিরা অভাবী বিক্রির দুর্দশার মধ্যে থেকেই যাচ্ছে। কৃষি ক্ষেত্রে সার-বীজ-কীটনাশকের দাম, বিদ্যুতের মাশুল দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে। সমবায় সমিতিগুলিকে অকার্য্যকর করে রাখা হয়েছে, ভাগে-ঠিকা চুক্তিতে যারা চাষাবাদ করছেন তাদের জন্য কোনো সরকারী সুবিধা নেই, ইত্যাদি।

conf aikm

 

সম্মেলনে উপস্থিত সিপিআই(এমএল) বাঁকুড়া জেলা সম্পাদক বাবলু ব্যানার্জী বলেন, “দেশের আর্থিক মন্দার সমাধানের পথ কৃষকের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির মধ্যে রয়েছে, মোদী সরকার সেই পথে না গিয়ে কর্পোরেটদের কোটি কোটি টাকা কর ছাড় দিচ্ছে, তাঁদের উপঢৌকন দিচ্ছে। এখন আর্থিক মন্দা, কৃষি সংকট এসব কিছু থেকে মানুষের নজর ঘোরাতে এনআরসি ও নাগরিকত্ব আইনের ধুয়ো তুলে কৃষকদের মধ্যে বিভাজনের রাজনীতি করছে”। এআইকেএমের রাজ্য কমিটি সদস্য সুধীর মুর্মু বলেন আাদিবাসী, কৃষিজীবী সহ সমগ্র কৃষক সমাজকে আজকের দিনে জমির অধিকারের দাবীতে নতুন করে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে নামতে হবে। রাজ্য এআইকেএম সম্পাদক জয়তু দেশমুখ বলেন, “কৃষক সন্মান”, “কৃষক বন্ধু” এই সব গালভরা প্রকল্পের নামে কৃষকদের ধোঁকা দেওয়া হচ্ছে, হরণ করা হচ্ছে কৃষকের ফসলের দাম, শস্য বীমা, ক্ষতিপূরণের ন্যায্য অধিকারগুলিকে। এছাড়াও, বক্তব্য রাখেন ছাত্র নেতা ফারহান হোসেন খান প্রমূখ। বিভিন্ন দাবিগুলি নিয়ে ঐক্যবদ্ধ কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে সম্মেলনে আলাপ আলোচনা হয়। কৃষিমজুরদের বিভিন্ন দাবিগুলিও সামনে আসে। যথা, ১০০ দিনের কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়া, আবাস নিয়ে দুর্নীতি দলবাজি, রেশন ব্যবস্থার সাথে আধার সংযোগ, আঙ্গুলের টিপছাপ যুক্ত করে কার্যত গণবন্টন ব্যবস্থা থেকে গরিব মানুষকে বাদ দিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত প্রভৃতি। এসমস্ত প্রশ্নে গ্রামে গ্রামে কৃষক ও কৃষি মজুরদের যুক্তভাবে আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে সম্মেলন সিদ্ধান্ত নেয়। কৃষক আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানাতে ওন্দার পার্শ্ববর্তী ব্লক শহর বিষ্ণুপুর থেকে সম্মেলনে এসেছিলেন ছাত্র সংগঠন আইসার ছাত্ররা। সম্মেলনের শেষে নিকুঞ্জপুর অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রাম পরিক্রমা করে দীর্ঘ মিছিল ছাত্রদের স্লোগানে সচকিত হয়ে ওঠে। সম্মেলন থেকে ২৩ জনের ব্লক কমিটি গঠিত হয়, ওন্দার কৃষক নেতা বৈদ্যনাথ চীনা ব্লক কিষাণ সভার সম্পাদক হিসাবে নির্বাচিত হন। সবশেষে স্কুল মোড়ে এক পথসভা আয়োজিত হয়। এনআরসি সহ বিভিন্ন কৃষি প্রশ্নে নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন।

খণ্ড-26
সংখ্যা-34