বিস্তীর্ণ সময় ধরে ঢিলেমির পরে অবশেষে সরকার বিএসএনএল ও এমটিএনএল-এর পুনরুজ্জীবনের প্রকল্পকে ছাড়পত্র দিয়েছে। কিছুদিন আগেও শোনা যাচ্ছিল যে, অর্থমন্ত্রক বিএসএনএল-এর কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পেশ করা অনুরূপ প্রস্তাবকে নাকচ করে বিএসএনএল ও এমটিএনএল-কে বন্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে চলেছে। সেই খবরের পরে সারা দেশ জুড়েই বিভিন্ন স্তরে বিরোধিতা দেখা যায়। শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকার আপাতত ঢোক গিলতে বাধ্য হয়ে একটি পুনরুজ্জীবন প্রকল্পে রাজি হতে বাধ্য হয়েছে। ২৩ অক্টোবর মন্ত্রীসভার বৈঠকে বিএসএনএল-এমটিএনএল-এর পুনর্গঠন ও সংস্কার প্রকল্প ঘোষিত হওয়ার পরেই বিএসএনএল কর্তৃপক্ষ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও যোগাযোগ মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদকে বিস্তর ধন্যবাদ জানিয়েছেন এই দুর্দিনে বিএসএনএল-এর পাশে দাঁড়িয়ে সহযোগিতা করার জন্য। গত কয়েক বছর ধরে বিএসএনএল-কে ক্রমাগত দুর্বল করে একটি নবরত্ন সংস্থাকে ঝাপ বন্ধ করার দোরগোড়ায় নিয়ে গিয়েছিুল যারা তারাই আজ সংস্থাকে বাঁচানোর গৌরব অর্জন করছে। দেশে সর্বক্ষেত্রে মিথ্যার বিপণন ও ধাপ্পাবাজির রাজনীতি এমন অবস্থাই তৈরি করেছে।
যে বিএসএনএল ও এমটিএনএল-এর সংযুক্তির প্রকল্প গত ২৩ অক্টোবরের মন্ত্রীসভার বৈঠকে অনুমোদিত হয়েছে তা দুবছর আগে সংসদীয় কমিটি সুপারিশ করেছিল। দুবছর ধরে সেই সুপারিশকে ফেলে রাখার মধ্য দিয়ে দুটি সংস্থাকেই ক্রমাগত রুগ্ন করে তোলা হয়েছে। একইভাবে সেই ২০১২ সাল থেকে ভারতে চালু হয়ে যাওয়া ৪জি স্পেকট্রাম নেওয়া থেকে বিএসএনএল-এমটিএনএল-কে বিরত রাখার পর এতদিনে কেন্দ্রীয় সরকারের বোধোদয় হয়েছে যে ৪জি ব্যতিরেকে ওই দুই রাষ্ট্রায়ত্ব টেলিকম সংস্থার পক্ষে অন্য তিনটি বেসরকারি টেলিকম সংস্থার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা অসম্ভব। কিন্তু বিগত অর্ধ দশক ধরেই সংস্থার কর্মী সংগঠনগুলি ৪জি-র দাবি করে আসছিল। ফলে বিএসএনএল-এমটিএনএল-কে জীবিত রাখার তেমন কোনো আকাঙ্খা এই সরকারের আছে বলে মনে হচ্ছে না। বরং সাময়িক স্বস্তি দেওয়ার ভান করে পরবর্তিতে সংস্থা দুটিকে লাটে তোলার ভাবনাই আছে বলে মনে হচ্ছে।
যে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, যতদূর জানা যাচ্ছে, তাতে কেন্দ্রীয় সরকারের তেমন কোনো অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে না। ৪জি স্পেকট্রামের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হবে। যে টাকা আদতে সরকারের কাছেই যেত সেই টাকা দেওয়ার অর্থ স্পেকট্রামের জন্য টাকা না নেওয়া। ফলে কোনো টাকা সরকারের পকেট থেকে যাবে না। তবে জিএসটি বাবদ যে টাকা পাওনা তার অর্ধেক যেহেতু রাজ্যগুলির পাওনা তা হয়তো দিতে হবে, যার পরিমাণ হাজার দেড়েক কোটি টাকা। এছাড়া পুনরুজ্জীবনের জন্য বিএসএনএল ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণপত্র ছাড়বে যার জামিনদার থাকবে কেন্দ্রীয় সরকার। এক্ষেত্রেও সরকারের কোনো অর্থ ব্যয় নেই। বাকি অর্থ, ৩৮ হাজার কোটি টাকা আসবে সংস্থার সম্পত্তি বিক্রি করে।
একদিকে ৪জি স্পেকট্রাম, অপরদিকে স্বেচ্ছাবসর প্রকল্পের মাধ্যমে কর্মী ছাটাই — এই দুই পদ্ধতিতে বিএসএনএল-কে লাভজনক করে তোলা হবে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। এমনিতেই বিএসএনএল-এর কর্মীসংখ্যা ৪ লক্ষ থেকে কমতে কমতে ১ লক্ষ ৬০ হাজারে দাঁড়িয়েছে। এর পরেও স্বেচ্ছাবসরের দ্বারা কর্মী সংখ্যাকে অন্তত এক তৃতীয়াংশ কমানোর কথা শোনা যাচ্ছে। যদিও বলা হচ্ছে যে, কোনো কর্মীকেই জোর করা হবে না এবং স্বেচ্ছাবসরের প্যাকেজকে এমন আকর্ষণীয় করা হবে যে বহু কর্মীই তার দ্বারা আকৃষ্ট হবে, কিন্তু অভিজ্ঞতা অন্য কথাই বলছে। সর্বোপরি বিএসএনএল-এর মতো সংস্থাগুলি যদি ক্রমাগত কর্মী সঙ্কোচন করতে থাকে তাহলে কর্মসংস্থানের উপরে যে নেতিবাচক প্রভাব পরে তা পরবর্তিতে বিএসএনএল-কেই দুর্বল করে তোলে। উপরন্তু যদি বিএসএনএল-এমটিএনএল-এর কর্মী সঙ্কোচন করা যায় তাহলে সংস্থাগুলিকে বিক্রি করা সহজ হবে ও সংস্থাগুলি তাদের জমি বাড়ির জন্য আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে। মনে রাখা দরকার বর্তমান বাজার দরে বিএসএনএল-এর সম্পত্তির মূল্য ৩ লক্ষ কোটি টাকা। তাই রিলায়েন্সের মতো পকেট ভারি সংস্থা ওই সংস্থাকে আত্মস্থ করার জন্য উৎসুক থাকবে।
বিএসএনএল-এমটিএনএল-কে ৪জি-র অনুমোদন না দিয়ে তাদের ক্রমাগত দুর্বল করে তোলার ক্ষেত্রে সরকারের অভিসন্ধি ছিল। গত কয়েক বছরে ভারতের টেলিকম ক্ষেত্রটি প্রায় একচেটিয়ায় পরিণত হওয়ার দিকে এগোচ্ছে। মোবাইল ফোনের ক্ষেত্রে মাত্র ৪টি সংস্থা অবশিষ্ট আছে। যেখানে একসময়ে প্রায় ১ ডজন সংস্থা ছিল। যেদিকে এগোচ্ছে তাতে বেসরকারি ক্ষেত্রে অচিরেই সংস্থার সংখ্যা কমে ২টি বা ১টিতেও পরিণত হতে পারে। বিএসএনএল-কেও যদি অনুরূপ একটি বেসরকারি সংস্থার কাছে তুলে দেওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা যায় তাহলে প্রধানমন্ত্রীর নিজ রাজ্যের সংস্থাটি ভারতীয় টেলিযোগাযোগ দুনিয়ায় একছত্র অধিপতি হয়ে উঠতে পারে। তেমন কোনো ‘সদিচ্ছা’ প্রধানমন্ত্রীর না থাকলে মন্ত্রীসভা কেন এতদিন পরে ৪জি-র অনুমোদন দিল, যখন ৫জি স্পেকট্রামের জন্য নিলাম হওয়ার রব উঠেছে, গত জুনেই যে নিলাম হওয়ার কথা ছিল।
যে বিএসএনএল-এর লোকসান নিয়ে এত আলোচনা করা হচ্ছে, সেই বিএসএনএল ২০০১- ০২ থেকে ২০০৮-০৯ পর্যন্ত, ৮ বছর টানা মুনাফা করেছে, সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা কর দেওয়ার পরেও যার পরিমাণ ছিল ৪৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। যদি নগদ মুনাফার কথা ধরা যায় তাহলে সেই পরিমাণ ছিল ১ লক্ষ ২৩ হাজার কোটি টাকা। পরবর্তিতে ২০০৯-১০ থেকে ২০১৩-১৪ পর্যন্ত ৫ বছরে লোকসান হতে থাকলেও, মোট লোকসানের পরিমাণ ছিল ৩২ হাজার কোটি টাকা, যেখানে নগদ মুনাফা ছিল ১০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু মোদি সরকারের ৫ বছরে মোট লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকা ও নগদ লোকসানের পরিমাণ সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকায়। গত আর্থিক বছরে, অর্থাৎ ২০১৮-১৯ সালে লোকসানের পরিমাণ সর্বোচ্চ ১৪ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
রিলায়েন্স জিও ব্যবসা শুরু করার পরে ২০১৬-১৭ সাল থেকে টেলি যোগাযোগ থেকে আয় কমতে শুরু করেছে। ২০১৬-১৭-র ২৮ হাজার কোটি টাকা থেকে ২০১৭-১৮ সালে ওই আয় দাঁড়িয়েছিল ২৩ হাজার কোটি টাকায়, ২০১৮-১৯-এ তা কমে হয়েছে ১৯ হাজার কোটি টাকা। ফলে বিএসএনএল-এর সর্বনাশে কার পৌষমাস তা বোঝাই যাচ্ছে। তাই বিএসএনএল-এর যে পুনরুজ্জীবন প্রকল্প তার উপরে খুব আস্থা রাখা যাচ্ছে না। দায়হীন এক প্রকল্পের মধ্য দিয়ে বিএসএনএল-কে অক্ষম দেখিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্রগুলিকে অযোগ্য হিসেবে প্রতিপন্ন করার মতলব থাকা অসম্ভব নয় বরং সেটিই ধুরন্ধরদের পরিকল্পনা হতে পারে। তাই বিএসএনএল-এর কর্মীদের সচেতন থাকতে হবে।