আলফ্রেড নোবেলের স্মৃতিতে অর্থনীতি বিদ্যায় স্বেরিয়া রিক্সবাঙ্ক পুরস্কার, যা ‘অর্থনীতির নোবেল’ নামে পরিচিত, এবছর ভারতের মিডিয়া ও সাধারণ মানুষের মাঝে বেশ হইচই ফেলেছে। কারণ এই পুরস্কার যে তিনজন মিলে পেয়েছেন তার মধ্যে একজন, আমেরিকান অর্থনীতিবিদ অভিজিত বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, ভারতীয় বংশোদ্ভুত। তিনি কলকাতার প্রখ্যাত প্রেসিডেন্সি কলেজ (বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে গ্রাজুয়েশন করেছেন আর নয়া দিল্লীর জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে করেছেন মাস্টার্স ডিগ্রি। প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনীদের মধ্যে অমর্ত্য সেনের পর দ্বিতীয়বার কেউ বিশ্বের এই সেরা পুরস্কারটি পেলেন। যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিকে ২০১৪ সাল থেকে মোদি সরকারের লাগাতার সর্বনাশা আক্রমণ আর কুৎসা সইতে হয়েছে সেই জেএনইউ-এর দিক থেকে দেখলে এ ধরনের পুরস্কার এক আশ্বাস বার্তা। তাছাড়া আরেকটি বিষয়ও খেয়াল রাখা দরকার যে ১৯৮০র দশকের গোড়ার দিকে অভিজিত ব্যানার্জি একজন ছাত্র-আন্দোলনকারী হিসেবে কর্তৃপক্ষ-বিরোধী সহিংসতার দায়ে কুখ্যাত তিহার জেলে সপ্তাহ দুয়েক বন্দী ছিলেন।
ভারতে বহু মানুষ যে এই পুরস্কারে উচ্ছ্বসিত আনন্দ প্রকাশ করছেন তার আরও প্রত্যক্ষ ও অবশ্যম্ভাবী কারণ আছে। ভারত বর্তমানে এক তীব্র অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। জিডিপি বৃদ্ধির হার বা অন্যান্য প্রায় সমস্ত অর্থনৈতিক মাপকাঠিই পাক খেয়ে নামছে নীচের দিকে। একমাত্র যে জিনিসটা কেবলই বেড়ে চলেছে তা হল বেকারত্ব আর সাধারণ ও গরিব মানুষের আর্থিক দুর্দশা। যে দিশায় দীর্ঘকালীন নীতিসমূহ নেওয়া হয়েছে তা যেমন এই আর্থিক মন্দার পেছনে কারণ হিসেবে কাজ করেছে তেমনি আর এক কারণ হল মোদি সরকারের নোটবন্দী বা অবিবেচক আধখেচড়া জিএসটির অবাস্তব যাচ্ছেতাই পদক্ষেপগুলি। যখন এই অর্থনৈতিক ধ্বংস-সাধন প্রকাশ্যে এসে গেল তখন সরকার হাবিজাবি কথা বলে তথ্য পরিসংখ্যানকে নাকচ করতে আর সংকটকে অস্বীকার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। অর্থমন্ত্রী ঘাঁটা যুক্তি দিতে শুরু করলেন। যেমন, গাড়ি বিক্রি কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে দায়ী করলেন “নয়া সহস্রাব্দের মানসিকতা”-কে যা নাকি নিজে গাড়ি কেনার থেকে ওলা উবের চড়াকেই বেশি পছন্দ করে। আইনমন্ত্রী শোনালেন বলিউডের রিলিজ হওয়া ফিল্মগুলির “বক্স অফিসে রেকর্ড” মুনাফার কথা। একদিকে তীব্র অর্থনৈতিক মন্দা অন্যদিকে ক্ষমতাসীনদের তরফে এইসব ধাপ্পাবাজি মিথ্যাচার। এই প্রেক্ষাপটে, মোদি সরকারের এইসব অবাস্তব অর্থনৈতিক নীতি ও পরিসংখ্যানগত প্রতারণার বিরুদ্ধে সমালোচনা করেছেন এরকম একজন ভারতীয় বংশোদ্ভুত ব্যক্তির অর্থনীতিতে নোবেল পাওয়াটা অনেক ভারতীয়র কাছেই এক আনন্দ ও বিষ্ময়ের খবর হিসেবে হাজির হয়।
অভিজিৎ বিনায়ক ব্যানার্জি ও তাঁর সহকর্মী এস্থার দুফ্লো ও মিশেল ক্রেমার স্বেরিয়া রিক্সবাঙ্ক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন বিশ্ব দারিদ্র নিরাময়ের চ্যালেঞ্জে তাঁদের পরীক্ষামূলক অ্যাপ্রোচের জন্য। আজকের বিশ্বপুঁজি হল ডিজিটাল ইন্ধনে চলা লগ্নি পুঁজির বিপুলায়তন এক মত্ত হস্তি স্বরূপ যা দুনিয়া জুড়ে প্রকৃতি-পরিবেশ ও শ্রমজীবি জনতাকে তছনছ করছে, মানব সমাজে গভীর অর্থনেতিক অসাম্য ও দুঃখ দুর্দশা তৈরি করছে। দারিদ্র অথবা দরিদ্র মানুষ সম্পর্কে যে কোনও উল্লেখকেই তাই আজকের দিনে এক জরুরি সতর্কবাণী বলে মনে হয় এবং সাধারণভাবে তাকে স্বাগত জানানো হয়। মার্ক্সবাদী অর্থনীতি চর্চার বিভিন্ন ঘরানার বাইরেও আমরা কল্যাণমুখী অর্থনীতিবিদ বা উন্নয়ন অর্থনীতিবিদদের পাই যারা বাজার-মৌলবাদের বিরুদ্ধে কথা বলেন এবং ক্রমবর্ধমান হারে কর ব্যবস্থা প্রচলন বা অন্যান্য পদক্ষেপের মাধ্যমে উপার্জন পুনর্বণ্টন করে অর্থনৈতিক অসাম্য হ্রাস ও দারিদ্র দূরীকরণের জন্য বিভিন্ন নীতি ও পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলে থাকেন। ব্যানার্জী ও দুফ্লো, যাঁরা “পুওর ইকনমিকস : এ ৠাডিক্যাল রিথিঙ্কিং অব দ্যা ওয়ে টু ফাইট গ্লোবাল পোভার্টি” বইটি লিখে ২০১১ সাল থেকেই বিখ্যাত হয়ে গেছেন, উন্নয়ন অর্থনীতির এই চলতি ঘরানার মধ্যেও পড়েন না। তাঁরা ‘রেন্ডামাইজড কন্ট্রোলড ট্রায়াল’ (বা এলোপাতাড়িভাবে বেছে নিয়ে নিয়ন্ত্রিত পরখ) পদ্ধতি ব্যবহার করার জন্য ও তাঁদের ‘পোভার্টি অ্যাকশন ল্যাব’-এ অতিক্ষুদ্র স্তরে প্রকল্প পরিকল্পনা(মাইক্রো-লেভেল স্কিম) করার জন্য সম্মানিত হয়েছেন। তাঁরা দাবি করেছেন যে তাঁদের এই পদ্ধতি গরিব মানুষের অভ্যাস ও পছন্দকে প্রভাবিত করার মাধ্যমে দারিদ্র সমস্যা সমাধানে আরও ভালো ফল এনে দেবে।
অন্য কথায় বললে দারিদ্র সমস্যা অনুধাবনের ক্ষেত্রে তাঁদের বোধ বা দারিদ্র দূরীকরণে তাঁদের উদ্ভাবিত পদ্ধতি বাস্তবের সামাজিক-অর্থনৈতিক কাঠামো বা দীর্ঘস্থায়ী নীতিসমূহের বৃহত্তর প্রেক্ষাপট সম্পর্কে কিছুই বলে না। নির্দিষ্ট কোনও এলাকায় নির্দিষ্ট কিছু উন্নতি ঘটানোর লক্ষ্যে হস্তক্ষেপের মাইক্রো-লেভেল ছকই তাঁদের প্রায় সমগ্র কাজের ফোকাস। গরিব মানুষকেই দারিদ্রের জন্য দায়ী সাব্যস্ত করা হয়েছে এবং গরিব মানুষের অভ্যাস ও পছন্দে বদল এনেই সেই দারিদ্র থেকে মুক্তির উপায় খোঁজা হয়েছে। বিশ্ব পুঁজিবাদের হোতারা এই ধরনের অ্যাপ্রোচকে ‘সংশোধনক্ষম পদ্ধতি’ হিসেবে সুবিধাজনক মনে করতে পারে, কিন্তু ভারতের মতো একটি গভীর দারিদ্র পীড়িত দেশে যেখানে শ্রেণী-লিঙ্গ-জাতের কাঠামোগত নিপীড়ন চক্র ও সরকারী নীতি দারিদ্রকে নিরন্তর পুনরুৎপাদনের মাধ্যমে জনতাকে আরও বঞ্চিত লাঞ্ছিত দরিদ্র করে তোলে সেখানে তাঁদের এই অ্যাপ্রোচ আদৌ কোনও কাজে আসতে পারে না। তবে কর্পোরেট ধান্ধাবাজি ও উন্নাসিক উচ্ছৃঙ্খল ধনকুবেরদের সাথে মোদী জমানা এতটাই গভীর পিরিতিতে লিপ্ত যে ভারতের দারিদ্র নিয়ে চর্চায় যুক্ত থাকা এক অর্থনীতিবিদের এই সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রাপ্তিকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না সঙ্ঘ পরিবার। কর্ণাটকের বিজেপি এমপি অনন্তকুমার হেগড়ের টুইটার প্রতিক্রিয়া সবচেয়ে স্পষ্টভাবে এই মানসিকতাকে প্রকাশ করেছে : “যে মানুষটি আমাদের দেশে কর বৃদ্ধি করার ও মুদ্রাস্ফীতি ঘটানোর সুপারিশ করেছে ... তাঁকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে ও পুরস্কৃত করা হয়েছে”।
যদিও অভিজিত ব্যানার্জি কোনও অমর্ত্য সেন নন, তা সে অর্থনীতির আইডিয়ার নিরিখেই হোক বা রাজনৈতিক বিশ্লেষণের নিরিখে (২০১৭-র মে মাসে ‘দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ পত্রিকায় ব্যক্ত করা তাঁর মতামতে তিনি অবাক করার মতো রাজনৈতিক বালখিল্যতা প্রকাশ করেছিলেন ‘আমাদের সর্বোচ্চ আবেগ’-এর কাছে মোদীর আবেদন তুলে ধরে এবং পুরনো আরএসএস ও পুরনো বিজেপির জন্য স্মৃতিমেদুর ভাব জাগিয়ে), তথাপি সংঘ-বিজেপি প্রতিষ্ঠান তাঁর মধ্যে সম্ভবত আরেকজন অ্যান্টি-ন্যাশনাল বুদ্ধিজীবীকে আবিষ্কার করেছে, বিশেষত নোটবন্দী বিষয়ে তাঁর বিরূপ মন্তব্য ও ২০১৯ নির্বাচনে কংগ্রেসের ইস্তেহারে ঘোষিত সার্বজনীন ন্যুনতম উপার্জন প্রকল্প বা NYAY পরিকল্পনায় তাঁর তথাকথিত যোগ থাকার কারণে। এবং, যেখানে নোবেল লরিয়েটরাই এরকম অবজ্ঞা পাচ্ছেন সেখানে একথা সহজেই বোঝা যায় যে সুধা ভরদ্বাজের মতো ব্যক্তি যখন ভারতের উচ্ছিন্ন নিঃসহায় গ্রামীণ গরিব মানুষদের সাথে আরও গভীর সম্পর্কে জড়াতে আমেরিকার নাগরিকত্ব ত্যাগ করে ভারতে চলে আসেন তখন তাঁকে কেন ‘আর্বান নকশাল’ তকমা দেওয়া হয় আর বিগত এক বছরের বেশি সময় যাবৎ জেলে পুরে রাখা হয়। ইতিমধ্যে বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ১১৭টি দেশের মধ্যে ভারত ১০২ নম্বরের অতলস্পর্শী নিম্নতায় নেমে গেছে, অনাহার মৃত্যু থামার কোনও লক্ষণ নেই, উত্তর প্রদেশের স্কুলে শিশুদের মিড-ডে-মিল হিসেবে নুন-রুটি বা হলুদ গোলা জল দিয়ে ভাত খাওয়ানো হচ্ছে, এন্সেফেলাইটিস বা অন্যান্য প্রতিরোধযোগ্য মহামারিতে সরকারি হাসপাতালেই মারা যাচ্ছে অসংখ্য শিশু, খোলা জায়গায় পায়খানা করার শাস্তি হিসেবে দলিত শিশুদের পিটিয়ে মেরে দেওয়া হচ্ছে। ভারতে দারিদ্র দূরীকরণের লড়াই তাই গণতন্ত্র, মর্যাদা ও সামাজিক রূপান্তরের লড়াই ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না।
(এম এল আপডেট সম্পাদকীয় ১৫ অক্টোবর ২০১৯)