দ্বিতীয় দফায় মোদী-শাহ সরকারের তিন মাস অতিক্রম করার মাথাতেই ঝুলি থেকে বিড়াল বেরিয়ে পড়ল। সরকার যতই মনে করুক না কেন যে, তিন তালাক ও কাশ্মীর নিয়ে জনগণ সরকারের জয়ধ্বনি তুলবে এবং অন্য সবকিছু ভুলে যাবে, বাস্তবে সারা দেশের আরও বেশি বেশি মানুষ আজ অর্থনৈতিক মন্দার বিপর্যয়কর ফলাফল নিয়েই চর্চা করছেন। দেরীতে হলেও মন্দা নিয়ে অর্থমন্ত্রীর স্বীকৃতি এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্কের উদ্বৃত্ত থেকে ১৭৬০০০ কোটি টাকারও বেশি পরিমাণ অর্থ সরকারী কোষাগারে যাওয়া – তীব্র অর্থনৈতিক সংকট সম্পর্কে জনগণের উদ্বেগের যথার্থতাই সমর্থন করছে।
সরকার ও বেসরকারী কর্পোরেশনগুলির কাছে মন্দার অর্থ ধনীদের জন্য বেল আউট প্যাকেজের আর গরিবদের জন্য আরও কষ্ট স্বীকার; সরকারী ক্ষেত্রগুলির বেসরকারীকরণ আর শ্রমিকদের অধিকারে কাটছাট। শ্রমজীবী জনগণকে তাই আরও বেশি সজাগ হতে হবে এবং নিজেদের অধিকার ও স্বার্থকে রক্ষা করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতে হবে। ২০ থেকে ২৪ আগস্ট পর্যন্ত টানা ৫ দিন ধরে অস্ত্র কারখানার শ্রমিকদের ধর্মঘট ভারতের শ্রমিক আন্দোলনে এক মাইলস্টোন হিসাবে রয়ে যাবে। ১০০ শতাংশ প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের জন্য প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রকে খুলে দিতে এবং একটি কর্পোরেশনের অধীনে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত উৎপাদনকে পুনর্গঠিত করতে সরকারী পদক্ষেপ স্পষ্টতই এই রণনৈতিক ক্ষেত্রের বেসরকারীকরণের স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে। ভারত ইতিমধ্যেই বিশ্বের বৃহত্তম অস্ত্র আমদানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে; এখন প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ এবং কর্পোরেটকরণ/বেসরকারীকরণের মধ্য দিয়ে বিশ্বের যুদ্ধ অর্থনীতি ও সামরিক-শিল্পীর প্রকল্পের সঙ্গে ভারতের একাত্মীকরণকে আরও গতি দেবে। এই প্রেক্ষাপটে সরকারের অশুভ পরিকল্পনার বিরুদ্ধে অস্ত্র কারখানার শ্রমিকদের এক মাসব্যাপী ধর্মঘটের ঘোষণা এক বড় ব্যাপার।
শ্রমিকদের মধ্যকার গভীর অসন্তোষ এবং তাদের লড়াকু মেজাজ বিজেপিপন্থী মজদুর সংঘ সহ সমস্ত ফেডারেশনকে ধর্মঘটে যুক্ত হতে বাধ্য করে। সরকারের সঙ্গে ফেডারেশনগুলোর চুক্তি সম্পাদনের পরে ৫ দিন ধরে চলা এই ধর্মঘট প্রত্যাহৃত হয় এবং এই ধর্মঘটে ৪১টি অস্ত্র কারখানা ও সংশ্লিষ্ট অফিসগুলোর শ্রমিক-কর্মচারিদের প্রায় সমস্তটাই অংশগ্রহণ করে। একই ধরনের কর্পোরেটকরণ ও বেসরকারীকরণের মুখোমুখি হয়ে রেলের উৎপাদন ইউনিটের শ্রমিকেরা অস্ত্র কারখানার শ্রমিকদের প্রতি সংহতিতে এক দিনের অনশন ধর্মঘট করেন। ফিনান্সিয়াল ক্ষেত্রের শ্রমিক-কর্মচারিরা এবং কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলোর কর্মীরা এই ঐতিহাসিক ধর্মঘটে প্রতিরক্ষা শ্রমিকদের পাশে থাকেন। প্রতিরক্ষা শ্রমিকদের তোলা সমস্ত দাবি সরকার খতিয়ে দেখতে সম্মত হলে ধর্মঘটের ৫ দিন পর ফেডারেশনগুলো ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নেওয়া যথাযথ মনে করে। দাবিগুলো মীমাংসার জন্য আপাতত রেখে দেওয়া হলেও মোদী সরকারের বেসরকারীকরণ পদক্ষেপকে প্রতিরোধ করতে শ্রমিকশ্রেণী তাদের প্রস্তুতি ও সংকল্পকে স্পষ্টভাবেই প্রদর্শন করেছে।
প্রতিরক্ষা শিল্পের শ্রমিকদের ধর্মঘটকে ঐতিহাসিক করে তুলেছে যে বিষয়টি তা হল বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং গভীরতর হওয়া অর্থনৈতিক মন্দা। দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে মোদী-শাহ সরকার প্রথমদিন থেকেই জনগণ ও সংসদের উপর বুলডোজার চালাচ্ছে। এই সর্বাত্মক হামলার চরম পরিণতি হিসাবে এল ৩৭০ ধারা বিলোপের এবং জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যকে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভেঙ্গে দেওয়ার হতবুদ্ধিকর ঘোষণা। সংঘ-বিজেপি বাহিনী এই হামলা নিয়ে রাস্তাতে উৎসবে নেমেছে আর সংসদের ভিতরে বিরোধী পক্ষ স্পষ্টতই বিভাজিত ও মনোবলহীন। এই পরিপ্রেক্ষিতে সংগঠিত শ্রমিকশ্রেণী ও জনগণের বিরোধিতাকে সামনে তুলে আনতে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রের ধর্মঘট বিরাট তাৎপর্য বহন করছে।
জাতীয়তাবাদ নিয়ে বাগাড়ম্বরতার তেলে মোদী-মেশিন চলে থাকে আর প্রতিটি ক্ষেত্রেই সরকারের বিরোধিতাকে ‘জাতীয়তাবাদ বিরোধী’ আখ্যা দেওয়া হয় ও চুপ করিয়ে দেওয়া হয়। পরিহাসের ব্যাপার এই যে রাজনীতিতে চলছে জাতীয়তাবাদের বন্দনা করার জন্য আহ্বান আর অর্থনীতিতে চলছে জাতীয়করণ ও রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক যুদ্ধ চালনা।
সংঘ-বিজেপির প্রচারে ভারতের এ যাবৎ সবচেয়ে শক্তিশালী প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মোদীকে তুলে ধরা হচ্ছে, যিনি নাকি ভারতকে শক্তিমত্তার নতুন উচ্চতায় তুলেছেন। কিন্তু অর্থনীতির একটু গভীরে তাকালে বোঝা যায় যে ভারত খুবই বিপদসংকূল অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে -- টাকার দাম করছে, অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ও রপ্তানি হ্রাস পাচ্ছে আর বেকারত্ব বাড়ছে। এদিকে সামাজিক ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতা ও জাতপাতগত নিপীড়ন আমাদের সমাজের বুননকে ছিন্নছিন্ন করে দিচ্ছে এবং ক্রমান্বয়ে আরও কেন্দ্রীভূত হয়ে ওঠা রাষ্ট্র ও তার সবদিক থেকেই আধিপত্য কায়েমের এ্যাজেন্ডা আমাদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে পদদলিত করছে।
এই সন্ধিক্ষণে কেবলমাত্র জনগণের এক শক্তিশালী প্রতিরোধই পারে ভারতকে রক্ষা করতে এবং রবিদাসের মন্দির ভেঙ্গে দেওয়ার বিরুদ্ধে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদকে প্রভাবশালী প্রচারমাধ্যমগুলো যতই ব্ল্যাক আউটের চেষ্টা করুক না কেন প্রতিরক্ষা শিল্পের শ্রমিকদের ধর্মঘট, কাশ্মীরের পাশে দাঁড়ানো দেশজোড়া জনগণের সংহতি, স্বাধীনতাপ্রিয় ও গণতন্ত্রপ্রিয় জনগণ নিশ্চিতভাবেই লড়াই জারি রাখবে।
(এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ২৭ আগস্ট ২০১৯)