১৯ সেপ্টেম্বর থেকে কয়েকদিন ধরেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এবিভিপি-র লোকজন ঘৃণা ও বিদ্বেষের রাজনীতি প্রচারের তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছিল। এদিন দুপুর থেকেই পরিস্থিতি যথেষ্ট উত্তপ্ত ছিল।এই সময় সশস্ত্র পুলিশ নিয়ে মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে। ছাত্র-ছাত্রীরা দূরে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন ক্যাম্পাসে ঘৃণা-বিদ্বেষের রাজনীতির প্রচার করা চলবে না। এই সময় মন্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন। পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে। মন্ত্রী প্রবরের সশস্ত্র দেহরক্ষীর রিভলবার ও ম্যাগাজিন মাটিতে পড়ে যায়। ছাত্রছাত্রীরা আপত্তি জানায় “স্বাগত জানাতে’’ রিভলবার নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে কেন মন্ত্রী প্রবেশ করেছেন। দলীয় রাজনৈতিক কার্যক্রমে, তাও আবার নবাগত ছাত্র-ছাত্রীদের ফ্রেশার্স ওয়েলকাম। মন্ত্রীর সঙ্গে থাকা সাঙ্গপাঙ্গরা ছাত্র-ছাত্রীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পায়ের তলায় জমি তৈরি করতে পরিকল্পিতভাবেই এই হাঙ্গামা ও গুন্ডামি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা মন্ত্রীর নিঃশর্তক্ষমা চাওয়ার দাবি করে। দলমত নির্বিশেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত ছাত্র-ছাত্রী এই বিক্ষোভ কর্মসূচীতে সামিল হন। উপাচার্য জানিয়ে দিয়েছেন ক্যাম্পাসে পুলিশ ঢোকানোর আগে উনি পদত্যাগ করতে রাজি। আমরা সংঘ পরিবারের এই গুন্ডামির বিরুদ্ধে ছাত্র-ছাত্রীদের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদকে স্বাগত জানাই।
পরের দিন রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান রাজ্যপাল শ্রীযুক্ত জগদীপ ধনখড় সমস্ত নজির ভেঙে “আইন শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব’’ নিতে সরাসরি পৌঁছে গেলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। উপাচার্য তাঁকে আমন্ত্রণ জানাননি। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বারবার অসম্মতি প্রকাশ করেছেন। তথাপি তিনি সেখানে পৌঁছে যান এবং পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলেন। যে মন্ত্রী ও সাংসদ প্রকাশ্য রাস্তায় উপাচার্যকে গালিগালাজ করছে, জল আনার জন্য নির্দেশ দিচ্ছে এবং ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে অশালীন ও অভব্য আচরণ করছে তাকেই উদ্ধার করতে এসেছিলেন স্বয়ং রাজ্যপাল। পশ্চিমবাংলার রাজনীতিতে এ বড় বিরল ঘটনা। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেই ফ্যাসিস্ট হামলা শুরু হয়েছে তাই নয়, সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতিনীতির উপরও হামলা শুরু হয়েছে। আমরা রাজ্যপালের এই ভূমিকার জন্য “প্রশংসাসূচক’ কোনো শব্দ ব্যবহার করতে রাজি নই, বরং তাঁর এই আচরণের ব্যাখ্যা রাজ্যবাসীর কাছে পরিস্কার করা দরকার। শুধু মন্ত্রীপ্রবরই উপাচার্যকে অসম্মান করেছেন তাই নয়, স্বয়ং রাজ্যপাল প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে উপাচার্যকে পদত্যাগের কথা শুনিয়ে দিলেন। এটা আরও বড় অসম্মান। বিজেপির রাজত্বে শিল্প প্রতিষ্ঠানে যেভাবে “হায়ার এন্ড ফায়ার’ নীতি চালু হয়েছে, এবার তা উপাচার্যের উপরও প্রয়োগের দিন এসে গেছে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৫০০০ ছাত্রছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত চত্বর পরিক্রমা করে শ্লোগান তোলে; শিক্ষা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর ফ্যাসিস্ট হামলাকে প্রতিহত করুন। গতকাল বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ছাত্র ইউনিয়ন অফিস তছনছ করা, সুভাষ চন্দ্র বসু এবং চে গুয়েভারার ছবিকে কালিমালিপ্ত করা এবং আগুন ধরিয়ে দিয়ে যে তান্ডব এবিভিপি-র গুন্ডারা সংগঠিত করেছে তার উপযুক্ত বিচার চাই। মিছিল বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর পরিক্রমা করে যাদবপুর থানায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করে অপরাধীদের শাস্তির দাবি জানায় এবং তারপর শান্তিপূর্ণভাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ফিরে আসে। আমরা ছাত্রছাত্রীদের এই দৃপ্ত প্রতিবাদকে অভিনন্দন জানাই। এই ঐক্যকে আরও মজবুত করা এবং ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার স্বার্থে আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাবে এই প্রত্যয় আমাদের আছে।
এদিকে বিজেপি-আরএসএসের রাজনৈতিক নেতা নামধারী ব্যক্তিবর্গ যে ভাষায় ছাত্রছাত্রীদের হুমকি দিয়ে চলেছেন, আমরা তার তীব্র নিন্দা করি এবং রাজ্য প্রশাসনকে এর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
আরএসএস ও বিজেপি নেতা নেত্রীদের ভাষা, ভাষণ, অঙ্গভঙ্গি, আচার আচরণ সম্পর্কে দেশ ও রাজ্যের মানুষ কমবেশি ওয়াকিবহাল। অমিত শাহ, যোগী আদিত্যনাথ থেকে দিলীপ ঘোষ “অপরাধ জগতের” ভাষায় কথা বলতে অভ্যস্ত। হিংসা, বিদ্বেষ ও বিভাজনের রাজনীতি প্রচারের সঙ্গে “অপরাধ জগতের’’ শব্দাবলীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। কিন্তু এখানেই বিষয়টা থেমে নেই। একের পর এক বিজেপি সাংসদ, বিধায়ক, মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ধর্ষণ, বলাৎকার, নারী নিগ্রহের অভিযোগ উঠছে। আন্দোলনের চাপে কেউ কেউ শেষপর্যন্ত গ্রেফতারও হচ্ছে। স্বামী চিন্ময়ানন্দ অতি সাম্প্রতিক উদাহরণ। যে সংস্কৃতি ও মনোজগতে এরা “মানুষ’’ হন, তার সঙ্গে এর গভীর সম্পর্ক আছে। ফ্যাসিস্ট ব্যক্তিবর্গের জীবন নিয়ে যারা চর্চা করেন, তাঁরা এতে আলোকপাত করতে পারবেন।
সবাইকে প্রায় ছাড়িয়ে গেলেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি, আর এস এসের হাতে গড়া, দিলীপ ঘোষ। গত কয়েকদিন ধরেই, বিশেষত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীদের প্রতিবাদ বিক্ষোভের পর থেকে, এই ফ্যাসিস্ট রাজনীতিক একের পর উত্তেজক ভাষণ দিয়ে চলেছেন। কখনও “সার্জিক্যাল স্ট্রাইক” করে ছাত্র ছাত্রীদের “উচিত” শিক্ষা দেবার কথা বলছেন, কখনও হাত-পা ভাঙার হুমকি দিচ্ছেন। ফ্যাসিস্ট উন্মাদরা এ ভাষাতেই কথা বলতে অভ্যস্ত।
অত্যন্ত ন্যক্কারজনক ঘটনা হল, সাংবাদিক বৈঠকে দিলীপ ঘোষ যাদবপুরের ছাত্রীদের প্রতি যে কুৎসিত মন্তব্য করেছেন, তা বাংলার নারী সমাজের প্রতি চরম অপমান। সিপিআই(এমএল) লিবারেশন তীব্র ভাষায় এর নিন্দা করছে ও ধিক্কার জানাচ্ছে। অবিলম্বে এই কুৎসিত নারী-বিদ্বেষী ও ফ্যাসিস্ট মন্তব্যের জন্য দিলীপ ঘোষকে রাজ্যবাসীর কাছে নিঃশর্তে ক্ষমা চাইতে হবে।