একটি ধর্মঘট ও বেশ কিছু সম্ভাবনা

মোটর সাইকেল আরোহী তিন রঙা ঝাণ্ডা লাগিয়ে তীব্র গতিতে ছুটে চলেছে। অনেকেই নিজের গাড়ির কাচে ইংরেজিতে লিখে রেখেছে আর্মি। শরীরের ভাষায় যুদ্ধ জয়ের ইঙ্গিত, মাঝে মাঝে শ্লোগান উঠছে জয় শ্রীরাম। কেউ প্রশ্ন করতে সাহস পাচ্ছে না, সীতা রাম কেন জয় শ্রীরাম হয়ে গেল! কাশ্মীরে ৩৭০ ও ৩৫ক ধারা বাতিল, ‘পাকিস্তানকে টাইট দিয়েছে’, ‘চিনকে বুঝে নেবে’, ‘ট্রাম্পের সাথে গলাগলি’ সে এক সাংঘাতিক দেশপ্রেমের হাওয়া! বেশির ভাগ মানুষ এই হাওয়ায় ভেসে চলেছে। কিন্তু হঠাৎ করে তাল কেটে দিলেন প্রতিরক্ষা শিল্পের শ্রমিকরা। তারা মোদী সরকার-২-কে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন একমাস লাগাতার ধর্মঘটের নোটিশ জারি করে। এই শিল্পের শ্রমিক কর্মচারীরা তুলনামূলকভাবে অন্যান্য শিল্প শ্রমিক থেকে বেতন, কাজের স্থায়িত্ব ও সামাজিক সুরক্ষার বিষয়ে কিছুটা এগিয়ে ছিলেন। তাও কেন ধর্মঘট? সরকারের ঘুম ছুটে গেল।

ধর্মঘটীদের সাথে সরকার চুক্তি করতে বাধ্য হল। কর্পোরেটায়ন করা থেকে সরকার সাময়িকভাবে পিছু হঠলো। ৬ দিনের মাথায় ইউনিয়ন ধর্মঘট স্থগিতের কথা ঘোষণা করে দিল। সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হল ধর্মঘট স্থগিত হল, কিন্তু আন্দোলন চলবে। শ্রমিকদের কোন বিশ্রাম নেই। পরের ধাপে সংগ্রামের জন্য ধর্মঘটের পর্যালোচনা করতে তারা মিটিং-এ বসেছেন।

ফ্লোরের শ্রমিক নেতা ও কর্মীদের আলোচনা

শ্রমিকদের নিজেদের আলোচনা থেকে কিছু বিষয় উঠে এলো। এক মাসের লাগাতার ধর্মঘট হবে কিনা সন্দেহ ছিল। আগেও বিভিন্ন ঘটনায় শ্রমিকদের ধর্মঘট বিমুখতা দেখা গিয়েছে। ধর্মঘট যদি মাঝরাস্তায় ভেঙে যায় তাহলে বেশ কিছু দিনের জন্য আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে। কর্পোরেটায়নের বিরুদ্ধে লড়াইও বিরাট ধাক্কা খাবে।  ইউনিয়নগুলোর মধ্যকার ঐক্য ও ধর্মঘটের প্রস্তুতিও খুব ভালো করে গড়ে ওঠেনি। শ্রমিকদের মধ্যে ধর্মীয় বিভাজনের প্রাধান্য আছে। কেন্দ্রীয় সরকার এসমা জারি করবে বলে হুমকি দিয়ে রেখেছে। ফলে শ্রমিকদের মধ্যে ভয়ের আবহ তৈরি হয়েছিল। এই রকম এক কঠিন এবং অনিশ্চয়তার বাতাবরণের মধ্যে, ধর্মঘটের পক্ষে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। তারা আরও বলছেন যদি দেখা যায় ধর্মঘটে বেশিরভাগ শ্রমিক সামিল হচ্ছেন না, তাহলে আমরাও আর ঝুঁকি নেব না। এতো ‘যদি’ ‘কিন্তু’র মধ্যেও ধর্মঘটে অংশ নেওয়া ছাড়া শ্রমিকদের কাছে বিকল্প কোন রাস্তা খোলা ছিল না। কারণ কেন্দ্রীয় সকারের সিদ্ধান্তগুলি  তাদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দিয়েছে। তারা ধর্মঘটে যেতে বাধ্য হয়েছেন।

kosipur babubazar

ধর্মঘট শুরু ও প্রতিক্রিয়া

১৯ আগস্ট সকাল ৬ টা, শ্রমিকরা গেটে উপস্থিত। তারা ফ্যাক্টরিতে কাজে ঢুকলেন না। ৯৬% শ্রমিক স্বত:স্ফূর্তভাবে ধর্মঘটে সামিল হয়ে গেলেন। এরপর শ্রমিকদের আর কিছু বলতে হয়নি। তারা নিজেদের ভুমিকা পালন করতে থাকেন। শ্রমিকশ্রেণীর এটাই বোধহয় বৈশিষ্ট্য যখন তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন, তা কার্যকরী করার জন্য উদ্যোগও নিতে থাকেন। ইউনিয়নগুলোর যৌথ বা একক কর্মসূচিতে শ্রমিকদের অংশগ্রহণ ক্রমশ বাড়তে থাকে। কালা দিবস পালনের দিন কাজের সময় কারখানায় সব শ্রমিক কালো ব্যাজ পরেন। ফ্যাক্টরির ক্যান্টিন থেকে বিভিন্ন জায়গায় কালো বেলুন ঝুলিয়ে দিয়ে শ্রমিকরা প্রতিবাদে সামিল হলেন। সে এক অভিনব সৃজনশীল সংগ্রামী প্রচার আন্দোলন।

ধর্মঘটের দিন যত এগিয়ে আসে ইউনিয়নগুলির ঐক্য এক ঐতিহাসিক চেহারা নেয়। যার নিদর্শন, ধর্মঘটে অংশ নেওয়া এবং প্রত্যাহারের সময় কোনো ধরনের বিভাজন শ্রমিকদের মধ্যে হয়নি। সুনির্দিষ্টভাবে এই ধর্মঘটে শ্রমিকরা আত্মগত ধারণা থেকেও বেরিয়ে এসে যৌথ আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে নিয়েছেন।

srtike defence

ধমর্ঘট সফল হওয়ার প্রধান কারণ কি ছিল

ধর্মঘট সফল হওয়ার অনেকগুলি কারণের মধ্যে ‘নতুন পেনশন প্রকল্প’ অন্যতম ছিল। নতুন পেনশন প্রকল্পের বিরুদ্ধে ২৩-২৫ ফেব্রুয়ারি শ্রমিকরা ৭২ ঘন্টা ধর্মঘট পালন করেন।

কী আছে ২০০৪ সালে নতুন পেনশন প্রকল্পে? ২০০৪ সালের ১ জানুয়ারির আগে যারা চাকরিতে নিযুক্ত হয়েছেন তারা যেভাবে পেনশন পেয়ে থাকেন — একজন কর্মী শেষ যে বেতন পেয়ে অবসর নিলেন, সেই বেতনের বেসিকের ৫০ শতাংশ পেনশন হিসাবে পান। পেনশনের এই টাকার পরিমাণ নির্ধরিত থাকে। এর সাথে যেভাবে ডিএ বা পে-কমিশনের বৃদ্ধি ঘটবে সেই অনুযায়ী পেনশন বাড়তে থাকে। পেনশন ফান্ডে কর্মীদের কোনো দায়ভার থাকে না, সবটা নিয়োগ কর্তা বহন করে।

২০০৪ সালে ১ জানুয়ারি থেকে যারা চাকুরিতে নিযুক্ত হয়েছেন তাদের নতুন পেনশন প্রকল্পে অংশ নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এই পেনশন প্রকল্পে কর্মীদের নিজেদের আর্থিক দায় নিতে হবে। এই আর্থিক দায় বন্টন হবে কর্মীদের প্রতিমাসে বেসিক ও ডিএ যুক্ত করে যে অর্থ দাঁড়াবে তার ১০ শতাংশ দিতে হবে এবং নিয়োগ কর্তা দেবেন ১৪ শতাংশ। এই টাকা মিউচ্যুয়াল ফান্ডে লগ্নি করা হবে। এইভাবে পেনশনকে বাজারের সাথে যুক্ত করে দেওয়া হল। অর্থাৎ পেনশন আর নির্ধারিত নয়। অবসরের পর জমা অর্থের  ৬০ শতাংশ গ্রাহক তুলতে পারবেন, বাকি ৪০ শতাংশ নিয়োগ কর্তার কাছে জমা থাকবে। পেনশন হিসেব হবে এই ৪০ শতাংশের উপর। যেহেতু বাজারে লগ্নি করা হবে তাই পেনশন সব সময় বাড়া ও কমার মধ্যে থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকারের নতুন পেনশন প্রকল্প শেষ বয়সে ব্যাপক সংখ্যক শ্রমিককে চরম অনিশ্চয়তায় ঠেলে দিল। অর্থাৎ পেনশনে সরকারের কোনো আর দায় থাকলো না। পেনশন প্রকল্প খাতে লগ্নির দায় নেবেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিই, সরকার নয়। মৃত্যুর পর গ্রাহকের নমিনি পুরো অর্থ তুলতে পারবে। প্রকল্প নিয়ন্ত্রণে গড়া হয়েছে পেনশন ফান্ড রেগুলেটরি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (পিএফআরডিএ)-র মতো বিশেষ সংস্থা।

পেনশন তহবিল পরিচালনা করার জন্য ৭টি সংস্থাকে ফান্ড ম্যানেজার হিসাবে নিয়োগ করা হয়েছে। সেগুলি হল: এসবিআই পেনশন ফান্ড, এলআইসি পেনশন ফান্ড, ইউটিআই রিটায়ারমেন্ট সলিউশন্স, আইসিআইসিআই প্রুডেন্সিয়াল পেনশন ফান্ড, আইডিএফসি পেনশন ফান্ড, কোটাক মহীন্দ্রা পেনশন ফান্ড এবং রিলায়্যান্স ক্যাপিটাল পেনশন ফান্ড। এই সাতটি সংস্থার থেকে গ্রাহক ফান্ড ম্যানেজার বেছে নিতে পারেন। এই প্রকল্পের বিশেষত্ব-শেয়ার এবং ঋণপত্রের বাজার ভিত্তিক এই প্রকল্পে পেনশনের পরিমাণ নির্দিষ্ট করা থাকবে না। প্রকল্পের আয় বাড়লে বাড়বে পেনশনের পরিমাণ। পেনশন নিয়ে তরুণ শ্রমিকদের ন্যায্য ক্ষোভ ধর্মঘটে চালিকা শক্তি হিসাবে কাজ করেছে বলেই মনে হয়

।শ্রমিকদের আলোচনা শুনছিলাম। কোনো নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা নয়, ছোট ছোট কথার মাঝে তাদের উৎপাদন সংগ্রাম ও শ্রেণি সংগ্রামের সমৃদ্ধ কথা-কাহিনী।  সংগঠকরা ঠিকভাবে সূত্রায়ন করার ব্যাপারে সহযোগিতা করলে অনেক সম্ভাবনাময় কর্মী ও নেতা এই সব কারখানা থেকে গড়ে উঠবেন। আনুষ্ঠানিকতার বাইরে এই ধরনের ছোট সভায় অনেক কিছুই জানা গেল।

defence NN B

 

খণ্ড-26
সংখ্যা-28