অবিলম্বে নিয়োগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে, দুই মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও পরেশ অধিকারীর পদত্যাগের দাবিতে এবং এসএসসি প্যানেলভুক্ত সমস্ত চাকরি-প্রার্থীদের দ্রুত নিয়োগের দাবিতে, আইসা-আরওয়াইএ-আইপোয়া’র উদ্যোগে ২৩ মে মৌলালি মোড়ে সংক্ষিপ্ত পথসভা হয়। বক্তব্য রাখেন আইসা থেকে নিলাশিস বসু, আরওয়াইএ থেকে মেহবুব মন্ডল, আইপোয়া থেকে চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরী। এছাড়া, ছাত্র-যুব অধিকার মঞ্চের পক্ষ থেকে বলেন রাকিবুর শেখ। সভা শেষে মিছিল করে রাস্তা অবরোধ করা হয়।
এসএসসি’র এই আন্দোলন আজকের নয়। ২০১৬ সাল থেকে এই আন্দোলন চলছে। বিকাশ ভবন, আচার্য সদন, নবান্ন অভিযান কর্মসূচি নিয়ে আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যায় আন্দোলনকারীরা। ২০১৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে কলকাতার প্রেস ক্লাবের সামনে চাকরি প্রার্থীরা অবস্থানে বসে এবং ফুটপাতের ধারে বসে ২৯ দিন ধরে অনশন চালায়। বারংবার মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে অবস্থান তুলে নিতে বলা হয় সরকারের পক্ষ থেকে। কোভিড পরিস্থিতিতে অবস্থান করার অনুমতি না পাওয়ায় সেন্ট্রাল পার্কের সামনে ১৮৭ দিনের অবস্থান চালায়। এরপর একদিন ঝড়-জলের রাতে পুলিশ এসে অবস্থান মঞ্চ ভেঙে দেয়। এই ঘটনার প্রতিবাদে আন্দোলনকারীরা নাকতলা, হাজরা মোড়, কলেজ স্ট্রীট, শ্যামবাজার, মৌলালি, ধর্মতলায় ৪৮ ঘন্টার জন্য নগর অনশন করে। সবশেষে হাইকোর্টের অনুমতি নিয়ে ২০২১ সালের ৮ অক্টোবর থেকে গান্ধীমূর্তির পাদদেশে যোগ্য প্রার্থীরা অবস্থানে বসেন। আজ প্রায় ২২০ দিন অতিক্রান্ত হয়ে যাবার পরেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনও সুরাহা হয়নি। অন্যদিকে তৃণমূলের একের পর এক দুর্নীতির খবর আমাদের সকলের কাছেই প্রায় কমবেশি এসে পৌঁছেছে। আন্দোলনকারীদের স্পষ্ট দাবি, দুর্নীতি-নিয়োগ নয়, প্যানেলভুক্তদের অবিলম্বে নিয়োগ করতে হবে। নিয়োগে লাগামছাড়া দুর্নীতির বিরুদ্ধে পথে নেমেছে হাজার হাজার মানুষ। আগামীদিনে, আন্দোলনকারীদের দাবি-দাওয়া সম্পূর্ণ পূরণ না হলে এই আন্দোলন চলবে৷ আশা রাখা যায়, শেষপর্যন্ত এই দীর্ঘ আন্দোলনের সাথে থাকা ভবিষ্যতের শিক্ষক-শিক্ষিকারা দালালির বদলে রাজপথকেই বেছে নেবেন।
- ত্রিয়াশা
২৫ মে ১৯৬৭, ঐতিহাসিক নকশালবাড়ি গণঅভ্যুত্থানের সূচনাকাল, ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে বিপ্লবী দিশা প্রদানের ঊষাকাল। ৫৫টি বছর পার করে উদযাপিত হল সেই নকশালবাড়ি দিবস। তরাইয়ের নকশালবাড়ির বেঙ্গাইজোত থেকে জঙ্গলমহলের হীরবাঁধ, কলকাতার কলেজ স্ট্রীট থেকে গঙ্গার দু'পাড়ের শিল্পাঞ্চল — রাজ্যের প্রায় সমস্ত জেলায় সমগ্র পার্টি সংগঠনকে সামিল করে উদযাপিত হল নকশালবাড়ি দিবস। পার্টির রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার ছিলেন নকশালবাড়িতে। কলকাতায় পার্টির রাজ্য অফিস চত্বরে কর্মসূচিতে ছিলেন সিনিয়র নেতৃস্থানীয় কার্তিক পাল। শহীদ বেদীতে মাল্যদান, শহীদ বেদী স্থাপন, মিছিল, আলোচনাসভা, পথসভা ইত্যাদি নানারূপে দিবসের অঙ্গীকার নেওয়া হয়, জনগণের স্বার্থে সংগ্রামের জন্য সংগঠিত হতে বার্তা দেওয়া হয়। সেইসাথে কিছু বিশেষ উদ্যোগ নজর কাড়ে। যেমন, বারাসাতে সত্তর দশকের শহীদদের স্মৃতিফলক প্রতিষ্ঠার অভিনব সূচনা-সভা করলেন শহরের সংগ্রামী অনুগামীরা, এখনও পর্যন্ত ৩২ জন শহীদের নাম পাওয়া গেছে যারা এই শহরেরই। বলাবাহুল্য, বারাসত গণহত্যার (আড়িয়াদহ-দক্ষিণেশ্বরের বিপ্লবী শহীদদের) স্মৃতিস্তম্ভ দু'দশকেরও বেশি আগে নির্মীত হয়। নকশালবাড়ি দিবসে অন্যদিকে হুগলির নবগ্রামের সত্তর দশকে গণহত্যার শহীদদের স্মরণ করা হয়। নকশালবাড়ি দিবসের আহ্বান অক্ষয় হয়ে থাকবে — শহীদের স্বপ্ন হবে নাকো ব্যর্থ। নকশালবাড়ি লাল সেলাম।
এতোদিন প্রায় সমস্ত বেসরকারি সামাজিক অর্থনৈতিক সমীক্ষা সুপারিশ করে এসেছে — সর্বজনীন মানবিক মৌলিক আয়ের সংস্থান করতেই হবে। এটা জীবন-জীবিকার অধিকারের প্রশ্নে ভীষণভাবেই প্রয়োজন। বিশেষ করে অতিমারী-উত্তর বিশ্ব পরিস্থিতিতে এটা বাঁচা-মরার শর্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু এবিষয়ে মোদী সরকার এতটুকু আগ্রহ দেখায়নি, বরং ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ-উপেক্ষা-বঞ্চনা-কারসাজি-ছলনা-প্রতারণা করে আসছে। তবে এখন মোদী-ঘরের ভেতর থেকে বেরোচ্ছে বে-সুরের তাল-মিল। অন্যকথায়, শোনা যাচ্ছে বাইরের সমালোচনা ও প্রতিকারের উপায় বাৎলানো সুপারিশের সমস্বর। মুখ খুলতে হচ্ছে মোদী-কেন্দ্রের গঠন করা 'অর্থনৈতিক উপদেষ্টামন্ডলী’র চেয়ারম্যান বিবেক রায়'দের। গুরুগাঁও ভিত্তিক এক সংস্থার তৈরি সমীক্ষার বলছে ‘ভারতরাষ্ট্রে তীব্র হচ্ছে অসমতা’। ওই রিপোর্ট চিহ্নিত করেছে, শ্রমে অংশগ্রহণ করতে পারার প্রশ্নে গ্রাম ও শহরের মধ্যে ব্যবধান ক্রমেই বাড়ছে। আর, সুপারিশ করেছে প্রতিকারের কিছু উপায়ের। রিপোর্ট উল্লেখ করেছে, যে অসমতার রেখাচিত্র ধরা পড়েছে তা কিছুতেই সর্বাঙ্গীন হতে পারে না। কারণ, প্রাসঙ্গিক সরকারের তথ্যাগারে পর্যাপ্ত তথ্য পাওয়া যায় না। বিশেষত, পর্যায়ক্রমিক শ্রমে অংশগ্রহণের হার, তার তুলনামূলক চিত্র, ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধির অনুপাতে সর্বজনীন ন্যূনতম ভোগব্যয় হ্রাসের হার, সেসবের তুলনীয় পর্যবেক্ষণ, উল্লেখ, বিবৃতি, বিশ্লেষণ কোনটাই সুসংবদ্ধ পাওয়া যায় না। এ বিষয়ে জাতীয় নমুনা সমীক্ষা ২০১১-১২-র পর থেকে আর তেমন করাই হয়নি। বিগত এক দশক যাবত একই তথ্যপরিসংখ্যান বহু ব্যবহারে পুরানো সেকেলে হয়ে গেছে। তবু পরবর্তীতে বিক্ষিপ্ত যা তথ্যসমূহ মেলে তাতেই মিলছে অসাম্য বৃদ্ধির ছবি। আজকের ভারতে বেকারি বৃদ্ধির ছবিটা অতীতের সমস্ত রেকর্ড ছাপিয়ে গেছে। কর্মহীনতার স্থিতিস্ফীতির এহেন সময়ে স্বাভাবিকভাবেই শ্রমে অংশগ্রহণের সুযোগ যৎসামান্য। তার ৯০ শতাংশই কেবল অপ্রচলিত অসংগঠিত ক্ষেত্রে, যেখানে ন্যূনতম সংবেদনশীল বা সম্মানজনক আয়ের সামাজিক সুরক্ষা নেই। অতিমারীর ঘা খাওয়া বিশ্ব অর্থাবস্থায় আইএমএফ তিনটি ভয়াবহ বৃদ্ধির পরিঘটনা চিহ্নিত করেছে — বেকারি, দারিদ্র, অর্থনৈতিক অসমতা। ২০১৯-২০-র পর্যায়ক্রমিক শ্রমে অংশগ্রহণ ও ভোগব্যয়ের নিম্নগামী হার অনুধাবন করে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টামন্ডলীর চেয়ারম্যানের টানা উপসংহার মূলত অনুরূপ। সেইসঙ্গে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। যেমন, এমএনআরইজিএ প্রকল্প রূপায়ণে জোর দেওয়া, নিঃশর্তে কাজের চাহিদা ও নিশ্চয়তা পূরণ, যাতে উদ্বৃত্ত শ্রমশক্তির হাতে কাজ ও কাজের বিনিময়ে মজুরি তুলে দেওয়া যায়, সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যয় বৃদ্ধি করা, যাতে দারিদ্র কমানোর অবস্থা তৈরি হতে পারে, এপ্রশ্নে গ্রাম ও শহরের সুযোগের ব্যবধান কমানোয় তীব্রতা ও ব্যাপকতা বাড়ানো। সর্বজনীন বুনিয়াদি আয়ের ব্যাপারে আরও কয়েকটি বাধ্যতা মানতেই হবে। যেমন, সময়ের মজুরি সময়েই মিটিয়ে দিতে হবে, পরে এককালীন দিয়ে দেওয়ার নামে ফেলে রাখা যাবে না, মজুরি দিতে হবে জনে জনে ব্যক্তিগতভাবে, মজুরি দিতে হবে নগদে, কোনও ভাউচারে নয়, কোনও শর্তের বিনিময়ে নয় — মেটাতে হবে নিঃশর্তে, পর্যায়ক্রমে মূল্যবৃদ্ধি পরিমাপ করে সঙ্গত করতে হবে মজুরি মান।
এরকম এক গুরুতর বিষয় নিয়ে মোদী সরকারের বিশেষ কোন হেলদোল নেই। অথচ বেকারি আর মূল্যবৃদ্ধির চাপে গরিব নিম্নবিত্ত জনগণ ক্রমশ নিঃস্ব থেকে নিঃস্ব হচ্ছে। অতএব মাঠে নেমে রাস্তায় নেমে আন্দোলনের মধ্য দিয়েই অধিকার আদায় করার উপায় করে নিতে হবে।
(জম্মুর দুর্গানগরের বাড়িতে স্ত্রী, সাত বছরের মেয়ে ও মা-বাবাকে রেখে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ কর্মসংস্থান প্রকল্পে কাশ্মীর উপত্যকার বডগামে সরকারি কর্মী হিসাবে কাজ করতে গিয়েছিলেন কাশ্মীরী পণ্ডিত রাহুল ভাট। গত ১২ মে জঙ্গিরা তাঁর অফিসে ঢুকে রাহুল ভাটকে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ড পণ্ডিতদের নিরাপত্তাহীনতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এই প্রকল্পে কাজ করা আর এক কাশ্মীরী পণ্ডিত অজয় কল জানিয়েছেন, “উপত্যকায় আমরা নিরাপদ বোধ করছিনা। জঙ্গিরা বারবারই আমাদের হিংসার লক্ষ্যবস্তু করছে। কেন্দ্রের মোদী নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার আমাদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে।” উপত্যকাকে নিরাপত্তা বাহিনীতে ভরিয়ে দিলেও পরিস্থিতি যে একেবারেই স্বাভাবিক নয়, এই হত্যাকাণ্ড তার জ্বলন্ত প্রমাণ। পণ্ডিতদের মধ্যে এই ধারণা ক্রমেই আরও বেশি করে দানা বাঁধছে যে, মোদী সরকার ও বিজেপি তাঁদের বলির পাঁঠা করছে, নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধিতে ও ভোট কুড়োতে কাজে লাগাচ্ছে তাঁদের অসহায় পরিস্থিতিকে। তাঁদের উপলব্ধিতে এই ধারণা জোরালো হচ্ছে যে, ৩৭০ ধারা বাতিল ও ‘কাশ্মীর ফাইলস’ সিনেমা কাশ্মীরের পরিস্থিতির সঙ্গে পণ্ডিতদের অবস্থাকেও আরও বিপন্ন করে তুলেছে। পণ্ডিতরা পথে নেমে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন, পুলিশের লাঠি ও কাঁদানে গ্যাসের মুখেও পড়ছেন। রাহুল ভাটের হত্যার পরদিন তাঁর শেষকৃত্যে হাজির হওয়ার সময় জম্মু ও কাশ্মীরের বিজেপি প্রধান রবীন্দ্র রায়না, প্রাক্তন উপ-মুখ্যমন্ত্রী কবীন্দ্র গুপ্ত ও অন্যান্য বিজেপি নেতাদের ক্ষুব্ধ ও রুষ্ট পণ্ডিতদের প্রতিবাদের মুখে পড়তে হয়। তবে, শুধু রাস্তাতেই নয়, সামাজিক মাধ্যমেও ক্ষোভ ধ্বনিত হচ্ছে। “মোদী হায় হায়, অমিত শাহ হায় হায়, বিজেপি হায় হায়” শ্লোগান নিয়ে ভিডিও সমাজ মাধ্যমে ঘুরছে। পণ্ডিতরা জানাচ্ছেন, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ কর্মসংস্থান প্রকল্পে আবেদন করার সময় তাঁদের এই মর্মে একটা বণ্ডে স্বাক্ষর করতে হচ্ছিল যে, তাঁরা কাশ্মীরেই থাকবেন। এখন তাঁরা বলছেন, ঐ বণ্ড বাতিল করতে হবে, কাশ্মীর থেকে বদলি করে জম্মুতে তাঁদের পোস্টিং দিতে হবে। সমবেত প্রতিবাদের দৃষ্টান্ত রেখে ৩৫০ জনেরও বেশি কাশ্মীরী পণ্ডিত প্রশাসনের কাছে গণইস্তফাপত্র পাঠিয়েছেন। রাহুল ভাটের হত্যা মোদী সরকার এবং জম্মু ও কাশ্মীরের প্রশাসনের এক কলঙ্ক রূপেই চিহ্নিত হয়ে থাকবে। রাহুল ভাটের হত্যাকাণ্ডে সিপিআই(এমএল) কেন্দ্রীয় কমিটির বিবৃতির ভাষান্তর পড়ুন নিচে। – সম্পাদকমন্ডলী)
বডগামে জঙ্গিদের হাতে কাশ্মীরী পণ্ডিত সম্প্রদায়ের সরকারি কর্মচারী রাহুল ভাটের হত্যা সন্ত্রাসবাদের এক ঘৃণ্য কাপুরুষোচিত কাজ যেটাকে কঠোরতম ভাষায় ধিক্কার জানাতে হবে। বিভেদকে আরও উসকিয়ে তোলার জন্য এটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে চালিত এক হত্যাকাণ্ড।
যে মোদী সরকার ২০১৯ সাল থেকে অগণতান্ত্রিক পথে জম্মু ও কাশ্মীরে শাসন চালিয়ে যাচ্ছে, কাশ্মীরী পণ্ডিতদের বিক্ষোভ মিছিলে তাদের কাঁদানে গ্যাস প্রয়োগ ও লাঠি চালানোর ঘটনাকেও ধিক্কার জানাতে হবে। কাশ্মীরের মুসলিম জনগণই হোক আর কাশ্মীরী পণ্ডিতরাই হোন, তাদের প্রতিবাদ জানানো ও মত প্রকাশের অধিকারকে মোদী সরকার যে দমন করে সেটা নিয়ে প্রশ্নের কোনো অবকাশ থাকতে পারে না। ১৩ মে’র শোক ও প্রতিবাদ মিছিলে বহু সংখ্যক কাশ্মীরি পণ্ডিত ও কাশ্মীরের মুসলমান জনগণ অংশ নেন। বিরোধী পক্ষের নেতারা বডগামে গিয়ে সংহতি জানাতে গেলে তাদের আটকানো হয়।
বিজেপি ও আরএসএস কাশ্মীরী পণ্ডিতদের যন্ত্রণাকে হাতিয়ে নিয়ে অবশিষ্ট ভারতে সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা ছড়ায় এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর পক্ষে যুক্তি দেয়। কিন্তু, প্রতিটি স্তরে গোটা রাষ্ট্রযন্ত্র এবং নিরাপত্তা বাহিনী তাদের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে থাকলেও তারা জম্মু ও কাশ্মীরে কাশ্মীরী পণ্ডিত বা অন্যান্য নাগরিকদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা দিতে চরম ব্যর্থ হয়েছে। তাদের মুখপাত্ররা বিরোধী দলগুলোর দিকে আঙুল তুললেও নিজেদের দায়বদ্ধতা ও ব্যর্থতার স্বীকারে অপারগ।
বিজেপি সরকার শান্তি ও সুরক্ষা জোগাতে ব্যর্থ হওয়ায় বহু সংখ্যক কাশ্মীরী পণ্ডিত সরকারি চাকরি থেকে গণইস্তফা দিয়েছেন। নোট বাতিল এবং ৩৭০ ধারার বিলোপ সন্ত্রাসবাদকে নির্মূল করবে বলে যে দাবি মোদী করেছিলেন তা মিথ্যা বলে প্রতিপন্ন হয়েছে — আর এর বিপরীতে আমরা দেখছি, দীর্ঘকাল নিষ্ক্রিয় থাকার পর জঙ্গি সক্রিয়তা এক নতুন জীবন পেয়েছে।
ঘটনা হল, কাশ্মীরের অনেক মুসলিম জনগণও জঙ্গি হিংসার বলি হয়েছেন। কাশ্মীরের মুসলিম জনগণ এবং কাশ্মীরী পণ্ডিতরা উভয়েই জঙ্গি হিংসার শিকার হয়েছেন এবং রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর হাতে হেফাজতে তাঁদের ওপর অত্যাচার চালানো হয়েছে ও তাঁদের হত্যা করা হয়েছে। এদের একের ন্যায়বিচারকে অপরের ন্যায়বিচারের বিরুদ্ধে খাড়া করা যাবেনা। জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণ এবং দেশের অন্যান্য অংশের গণতন্ত্র-প্রেমী জনগণকে শান্তি ও ন্যায়ের পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়াতে হবে। সাম্প্রদায়িকীকরণকে বাড়িয়ে তোলা এবং ঘৃণাকে উসকিয়ে তোলার গোটা অপচেষ্টাকে দৃঢ়ভাবে পরাস্ত করতে হবে।
পোড়াঝাড়-কাওয়াখালি ভূমিরক্ষা কমিটি ও তিস্তা-মহানন্দা প্রকল্পের ক্ষতিগ্রস্ত ভূমিরক্ষা কমিটির আহ্বানে ২৩ মে সহস্রাধিক মানুষের এক মিছিল ‘উত্তরকন্যা’ অভিযান করে। জমিহারাদের সমস্যা সমাধান, অনিচ্ছুক কৃষকদের জমি ফেরত, বর্গাদারদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ সহ বিভিন্ন দাবিতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের এই মিছিলকে তিনবাত্তি মোড়ে পুলিশ আটকায়। ব্যাপক ধস্তাধস্তির পর মিছিলের মানুষেরা জাতীয় সড়কের উপর বসে পড়েন। অবরোধ স্থান থেকে ৭ জনের প্রতিনিধি দল উত্তরবঙ্গ ডিভিশনাল কমিশনারের কাছে স্মারকলিপি পেশ করে। প্রতিনিধি দলে ছিলেন এআইসিসিটিইউ’র পক্ষে বাসুদেব বসু, সিটু’র গৌতম ঘোষ, নকশালবাড়ি-মাটিগাড়ার প্রাক্তন বিধায়ক শংকর মালাকার, এআইকেএমএস’এর পক্ষে অমল রায় প্রমুখ। বিস্তারিত আলোচনায় জানানো হয় অবিলম্বে সরকার ক্ষতিগ্রস্ত কমিটির সাথে বৈঠক না করলে ‘উৎসধারা’ আবাসন প্রকল্পের কাজ আটকে দেওয়া হবে। আধিকারিক দ্রুত বিষয়টির সমাধানের জন্য উদ্যোগ নেবেন বলে জানান। অপেক্ষারত মিছিলের মানুষরা পার্শ্ববর্তী মাঠে জমায়েত হন। সেখানে বক্তব্য রাখেন নকশালবাড়ি আন্দোলনের প্রবীন যোদ্ধা শান্তি মুন্ডা, সারা ভারত কিষাণ মহাসভার পক্ষে পবিত্র সিংহ, নেত্রী ও মানবাধিকার কর্মী মুক্তি সরকার, মহানন্দা প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্ত কমিটির সম্পাদক কৃষ্ণপদ সিংহ, বাসুদেব বসু, গৌতম ঘোষ, অমল রায়, ডঃ এ কে মিত্তল, শম্ভু সিং প্রমুখ। মিছিলে ছিলেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের দার্জিলিং জেলা নেতা মোজাম্মেল হক, শরৎ সিংহ, পৈসাঞ্জু সিংহ, সুমন্তী এক্কা, জলপাইগুড়ি জেলা নেতা শ্যামল ভৌমিক প্রমুখ।
২৩ মে মিড-ডে-মিল রন্ধনকর্মীদের ডিএম ডেপুটেশন হয় হুগলী জেলায়। প্রখর রোদ, ট্রেন গন্ডগোল, সমস্ত বাধা উপেক্ষা করে ধনিয়াখালি, পোলবা, দাদপুর, পান্ডুয়া থেকে কর্মীরা সমাবেশিত হয়েছিলেন চুঁচুড়া ঘড়ির মোড়ে। সেখান থেকে পোষ্টার ব্যানার সহ মিছিল করে ডিএম দপ্তরে যাওয়া হয়। সেখানে কর্মীরা ঘন্টা খানেক অবস্থান করেন। দাবি তোলেন, মজুরি বৃদ্ধি করতে হবে, সরকারি কর্মচারীর স্বীকৃতি ও পরিচয়পত্র, ১০ মাস নয়, ১২ মাসের ভাতা দিতে হবে, দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতিপূরণ, উৎসবকালীন বোনাস দিতে হবে, ভবিষ্যত সুরক্ষা প্রকল্প ভুক্ত করতে হবে, কর্তৃপক্ষের ইচ্ছামত ছাঁটাইয়ের হুমকি বন্ধ করতে হবে, সরকার ঘোষিত প্রশিক্ষণ বাবদ প্রত্যেককে ৫০০ টাকা ও সার্টিফিকেট অবিলম্বে দিতে হবে, ছাত্র-ছাত্রীদের মিড-ডে-মিলে দৈনিক ১০ টাকা বরাদ্দ বাড়াতে হবে। এছাড়া দুর্নীতিগ্রস্ত প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীকে অবিলম্বে মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগের দাবিও তোলা হয়।
আধিকারিক অনেকটা সময় দিয়ে প্রতিনিধিদের কাছ থেকে সবকিছু শোনেন। এবং তখনই তাঁদের আটকে থাকা প্রাপ্য টাকা সহ আরও কিছু সমস্যা সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মচারীকে ডেকে পাঠান এবং তা দ্রুত কার্যকরি করতে নির্দেশ দেন। ৭-৮ জুন রন্ধনকর্মীদের কলকাতায় অবস্থান কর্মসূচির কথা শুনে তাকে স্বাগত জানান। প্রতিনিধিদলে ছিলেন ধনিয়াখালির ঝর্ণা মালিক, পোলবার সবিতা পাকিরা, পান্ডুয়ার ছবি টুডু ও ইউনিয়নের জেলা সভানেত্রী চৈতালি সেন। গণডেপুটেশন বেশ উৎসাহব্যঞ্জক ছিল। রন্ধনকর্মীরা সিদ্ধান্ত নেন, কলকাতার অবস্থান কর্মসূচি সফল করতে তাঁরা সর্বাত্মক উদ্যোগ নেবেন ।
এই দিনই ডিএম দপ্তরে বেশ কিছু মহিলা ধর্ণায় বসে ছিলেন। জমায়েত দেখে বক্তব্য শুনে তাঁরা এসে বললেন, “আমরাও অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, ২০১০ সালে আমাদের নাম তালিকাভুক্ত হয়েছে, কিন্তু এখনো নিয়োগপত্র পাইনি”, তাঁরা আরও বলেন, “আমাদের জন্য কিছু করুন”। তাঁদের ৭ জুন কলকাতায় আসতে আবেদন জানানো হয় যাতে কথা বলা যায়।
অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে, স্থানীয়, ব্লক ও জেলাস্তরে আন্দোলনের ধারাবাহিকতা রাখতে পারলে সংগঠনের যেমন বিস্তার ঘটে তেমনি সদস্যদের আস্থা ও আত্মবিশ্বাস বাড়ে।
২৩ মে কলকাতায় শ্রমিক ভবনে ২৭ দফা দাবি সনদের সমর্থনে চটশিল্পের ২১টি শ্রমিক সংগঠনের রাজ্য কনভেনশন অনুষ্ঠিত হল। প্রথম বক্তা ‘বেঙ্গল চটকল মজদুর ফোরাম’এর রাজ্য সম্পাদক মাজহার খান বলেন, মিলগুলোতে কর্তৃপক্ষের মদতে গুন্ডারাজ চলছে। চটকল শ্রমিকদের নামমাত্র দৈনিক মজুরিতে কাজ করিয়ে নিচ্ছে, শ্রমিকদের কোনোরকম সামাজিক সুরক্ষা দেওয়া হচ্ছে না। ন্যায্য দাবিতে আন্দোলন করলে শ্রমিকদের গেট বাহার করে দেয়। এমনকি মিলে পুলিশ পিকেটও বসানো হয়। মিলের ভিতরে মালিকপক্ষ ‘বাউন্সার’ বা ভাড়াটে গুন্ডাবাহিনী আমদানি করেছে। যখন তখন শ্রমিকদের দৈহিক এবং মানসিক নির্যাতন করা হচ্ছে। প্রতিটি প্রান্তে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। শ্রমিকদের উপর মিল কর্তৃপক্ষ ২৪ ঘন্টা নজরদারি চালাচ্ছে। যে ২১টি ইউনিয়নের ডাকে কনভেনশন হল তারমধ্যে রয়েছে এআইসিসিটিইউ, সিআইটিইউ, আইএনটিইউসি, এআইটিইউসি, টিইউসিসি, ইউটিইউসি, এআইইউটিইউসি ও অন্যান্য ইউনিয়ন।
কনভেনশনে শ্রমিক নেতৃত্বের পাশাপাশি বক্তব্য রাখেন সাধারণ শ্রমিকরাও। শুরুতে প্রস্তাব পেশ করেন সিআইটিইউ রাজ্য সম্পাদক অনাদি সাহু। তিনি বলেন, কাঁচামাল অর্থাৎ কাঁচা পাটের অভাব দেখিয়ে ১৪টি চটকল বন্ধ। এরফলে ৫০ হাজারের কাছে শ্রমিক কর্মহীন। কিন্তু রাজ্যে এবার যথেষ্ট পরিমাণে কাঁচাপাটের উৎপাদন হয়েছে। আসলে একশ্রেণীর পাট ব্যবসায়ী এবং মিল মালিকের চক্রান্তে কাঁচামালের কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করা হয়েছে। এরফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ শ্রমিকরা। এর পাশাপাশি মজুরির প্রশ্নেও শ্রমিকদের সঙ্গে বঞ্চনা করা হচ্ছে।
কনভেনশন সভাপতিমণ্ডলীতে ছিলেন অতনু চক্রবর্তী, দীপক দাশগুপ্ত, গণেশ সরকার, দেবাশীষ দত্ত, অমল সেন, দেবদাস চ্যাটার্জী, রামসুরত গিরি, সঞ্জয় রায়, রামনারায়ণ ঝা ও দীপক সাহা।
কনভেনশন থেকে আগামী দিনে পেশ করা দাবি সনদের ভিত্তিতে আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। হাওড়া-হুগলি, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণায় জেলা ভিত্তিক কনভেনশন করে একপ্রস্থ কর্মসূচি নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কনভেনশনে শ্রমিকদের উপস্থিতি ভালোই ছিল।
কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন সাম্প্রদায়িক কর্পোরেট ফ্যাসিবাদী সরকার দেশের সামনে এক চরম বিপর্যয় ডেকে এনেছে। প্রতিদিন নিত্যনতুন কূটকৌশলে হিন্দুত্ববাদী কর্মসূচিকে তথা ঘৃণা ও বিদ্বেষের রাজনীতিকে সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে। দেশের সংবিধানকে ভেতর থেকে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে, এমনকি বিচার বিভাগের ভূমিকা প্রশ্নচিহ্নের মুখে! অপরদিকে কর্পোরেট লুন্ঠনকে লাগাতার তীব্রতর করে তোলার ফলশ্রুতিতে সৃষ্ট আর্থিক সংকটের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের ঘাড়ে। মূল্যবৃদ্ধি, বেকারী সর্বোচ্চ রেকর্ডে পৌঁছেছে। ফ্যাসিবাদের এই সর্বব্যাপী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বামপন্থার এক আক্রমাত্মক অভিযান আজ সময়ের দাবি। এই প্রেক্ষাপটে ৫টি বামপন্থী দল মূল্যবৃদ্ধি ও বেকারত্বের বিরুদ্ধে ২৫-৩১ মে এক সপ্তাহব্যাপী সর্বভারতীয় প্রচার অভিযানের আহ্বান জানিয়েছে, সিপিআই(এমএল) লিবারেশন যার অন্যতম অংশীদার। অন্য দলগুলির মধ্যে রয়েছে সিপিআই(এম), সিপিআই, আরএসপি এবং ফরওয়ার্ড ব্লক। এই প্রচারাভিযান অবশ্যই বুলডোজার রাজ এবং সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ (জ্ঞানবাপী, তাজমহল, কুতব মিনার, মান্ডা এবং আরও কয়েকটি ক্ষেত্রে) উভয়ের বিরুদ্ধেই পরিচালিত হবে। প্রচার অভিযানকে এক রাজনৈতিক অভিযান হিসাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। মূল্যবৃদ্ধি ও বেকারত্বর প্রশ্নে যে দাবিগুলি নির্দিষ্ট হয়েছে তা হল — পেট্রোল, ডিজেল, রান্নার গ্যাসের দাম কমাতে হবে, আয়কর যারা দেন না তাদের সকলকে রেশন থেকে চাল-ডাল-ভোজ্য তেল ও নগদ ৭,৫০০ টাকা দিতে হবে, ১০০ দিনের কাজে বরাদ্দ বাড়াতে হবে, শহরাঞ্চলে ১০০ দিনের কাজ চালু করতে হবে, কেন্দ্রীয় সরকারকে বেকার ভাতা দেওয়ার আইন করতে হবে। দেশ এবং রাজ্যে সমস্ত শূন্য পদে সুষ্ঠু নিয়োগ পদ্ধতি মেনে দ্রুত নিয়োগ করতে হবে।
এরাজ্যে ৫টি বামপন্থী দল ছাড়াও অন্যান্য বাম ও সহযোগী দলসমূহের আহ্বানে এই শিরোনামে প্রচার অভিযান সংগঠিত হবে। পারস্পরিক সমতা ও মতামত বিনিময়ের মধ্য দিয়ে সর্বস্তরে ঐকমত্য গড়ে তুলে যৌথ কার্যক্রম এগিয়ে যাবে। রাজ্যস্তরে এক বৈঠকের মধ্য দিয়ে এই বোঝাপড়া গড়ে উঠেছে। প্রচারের সূচনাপর্বে একেবারে নীচুতলায়, হাটে-বাজারে, গঞ্জে বা পুরসভা এলাকায় বিকেন্দ্রীভূতভাবে নিবিড় প্রচার অভিযান চালানো হবে।
২৫ মে ছিল বিকেন্দ্রীভূতভাবে পথসভা করার দিন। ২৬ মে ছিল বাজার-হাটগুলিতে প্রচার। ২৭ মে ছিল ব্লকে প্রচার। ২৮ মে মহকুমা স্তরে প্রচার। ২৯ মে রবিবার জেলা শহরে সমাবেশ। ৩০ মে সর্বত্র মশাল মিছিল। পরিশেষে ৩১ মে জেলাগুলোতে অবস্থান/বিক্ষোভ মিছিল ইত্যাদি। একইসাথে কলকাতায় বিকাল ৩টে থেকে সন্ধ্যে ৬টা পর্যন্ত কেন্দ্রীয় অবস্থান। এই কর্মসূচিতে পার্শ্ববর্তী জেলাগুলির শহরের কর্মীদের অংশগ্রহণ করতে হবে। জেলাগুলি বৈঠকের মাধ্যমে নিজেদের সুবিধা ও বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী কর্মসূচির পরিবর্তন করতে পারে।
বামপন্থী নেতৃবৃন্দ আরও যে রাজনৈতিক বোঝাপড়ায় পৌঁছায় হয় তা হল কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণের বর্শামুখ রেখে এরাজ্যের পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধেও আমাদের সোচ্চার হতে হবে। বেকারত্বের প্রশ্নে এরাজ্যে শূন্যপদে নিয়োগ বন্ধ করে রাখা, নিয়োগে চরম অস্বচ্ছতা, সরকার-প্রশাসন ও শাসকদলের যোগসাজসে উচ্চপর্যায়ে দুর্নীতি, ব্যাপক হারে ঠিকাচুক্তির ভিত্তিতে অমর্যাদাকর নিয়োগ প্রভৃতি জ্বলন্ত বিষয়গুলি প্রচারে তুলে ধরা হবে। এরাজ্যে সরকারি মদতে চলা সিন্ডিকেট রাজ, ক্রমবর্ধমান মজুতদারী, কালোবাজারি, আলু সহ কৃষি ও অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে ওঠার মতো বিষয়গুলিও প্রচারে তুলে ধরা হবে।
এই বার্তা তুলে ধরে গত ২২ মে ভারত পথিক রাজা রামমোহন রায়ের জন্মের ২৫০তম বর্ষপূর্তিতে হুগলি জেলার খানাকুল ১নং ব্লকের রাধানগর গ্রামে (জন্ম ভিটা) ও পার্শ্ববর্তী রঘুনাথপুর গ্রামে (সামাজিক অনুশাসনের বিরুদ্ধে যাওয়ায় পরিবার থেকে ত্যাজ্যপুত্র হয়ে নির্মীত বসতবাড়ি) গিয়ে তাঁকে শ্রদ্ধা জানায় সিপিআই(এমএল) লিবারেশন, ছাত্র সংগঠন আইসা, পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদ, সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি ও বিপ্লবী যুব অ্যাসোসিয়েশন। সঙ্গে ছিলেন নৈহাটির অগ্নিবীণা সাংস্কৃতিক সংস্থার শিল্পীরা। সতীদাহ প্রথায় নিজের বৌদির নির্মম পরিণতি দেখে রামমোহন নিজেদের পারিবারিক শ্মশানের যে স্থানে দাঁড়িয়ে এই বর্বর প্রথা বন্ধের সংকল্প করেন সেই বেদী ও সংলগ্ন মূর্তিতে মাল্যদান করে কোরাস গানে বসতবাড়ি এলাকায় সংক্ষিপ্ত পদযাত্রা করেন সংগঠনগুলোর সদস্যরা। সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন আইসার রাজ্য সভাপতি নিলাশিস বসু। সঙ্গীত পরিবেশন করেন নীতিশ রায়, সরিৎ চক্রবর্তী, মাধব মুখার্জী প্রমুখ। কর্মসূচি সঞ্চালনা করেন পার্টির হুগলি জেলা কমিটির সদস্য সৌরভ রায়। উপস্থিত ছিলেন সুব্রত সেনগুপ্ত, দেবব্রত ভক্ত, প্রবীর হালদার, ভিয়েত ব্যানার্জী, প্রদীপ সরকার, দুর্গা রায়, কৃষ্ণা পাল, সুষমা মুখার্জী, অতনু, রণজয়, বর্ষা, সঙ্কেত, শুভ সহ অন্যান্যরা। সকলের সমবেত কন্ঠস্বরে মুখরিত হয়ে ওঠে রামমোহনের আম্রকুঞ্জ। সঙ্গীত স্রষ্ঠা রামমোহনকে পরিচয় করান সুব্রত সেনগুপ্ত।
এছাড়াও এদিন পার্টির ব্যান্ডেল-চুঁচুড়া অঞ্চলের কর্মীরাও তাঁদের এলাকায় ভারত পথিককে শ্রদ্ধা জানান। চুঁচুড়া হসপিটাল রোডে রামমোহন রায়ের মূর্তিতে মাল্যদান করেন সুদর্শন বসু, কল্যাণ সেন, সনৎ রায়চৌধুরী সহ অন্যান্য কমরেডরা। বক্তারা বলেন, দেশের ধর্মনিরপেক্ষতা ও আধুনিকতাকে ধবংসকারী শক্তির বিরুদ্ধে রামমোহন রায় আমাদের প্রেরণা! রামমোহন রায়ের আধুনিকতাকে এগিয়ে নিয়ে চলা ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার শ্নোগান ওঠে।
কলকাতায় যথাযোগ্য শ্রদ্ধা ও মর্যাদার সাথে পালন করা হয় ভারত পথিক রামমোহন রায়’এর সার্ধ দ্বিশততম জন্মবার্ষিকী। ২২ মে দুপুরে, কলকাতা জেলা পার্টি কমিটি, আইপোয়া, আইসা’র পক্ষ থেকে রামমোহন রায় সরণিস্থিত রামমোহন রায়ের বাসগৃহে তাঁর আবক্ষমূর্তিতে মাল্যদান করা হয়। মাল্যদান করার পর তাঁর অবদান নিয়ে দু’চার কথা বলেন বাসুদেব বোস, অতনু চক্রবর্তী, চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরী ও ইন্দ্রানী দত্ত।
২২ মে ২০২২ একদিকে ভারত যখন আধুনিক ভারত গঠনের লক্ষ্যে প্রথম এবং সর্বশ্রেষ্ঠ প্রচারকদের অন্যতম রামমোহন রায়ের ২৫০তম জন্মবার্ষিকী পালন করছে, অন্যদিকে আমরা তখন ইতিহাসের এক নিষ্ঠুর পরিহাসের মুখোমুখি হয়েছি। ক্ষমতাসীন শাসক একটা গণহিংসা সংঘটনের লক্ষ্যে প্রায় তিন শতাব্দী আগে ভারত শাসনকারী মুঘল রাজবংশের সময়ের কিছু ভুলকে হাতিয়ার করে এবং ইতিহাসের মনগড়া বিকৃতি ঘটিয়ে ২১ শতকের ভারতকে ব্যাপক সহিংস প্রতিশোধ নিতে উস্কে চলেছে। একদিকে আগ্ৰাসী ঔপনিবেশিক শাসন অন্যদিকে ভারতের অভ্যন্তরীণ সামাজিক ও মতাদর্শগত প্রতিরোধের মুখে আধুনিক ভারতের রূপকল্পকে জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে রামমোহন এবং তাঁর সমসাময়িক সংস্কারকদের যে লড়াই করতে হয়েছিল তার প্রকৃত তাৎপর্য উপলব্ধি করতে এই বিতর্কিত বিরোধাভাস আমাদের সাহায্য করবে।
পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে পরাজিত করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা দখল এবং সমগ্র ভারতবর্ষের উপর তার নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় “বণিকের মানদণ্ড শাসকের রাজদণ্ডে পরিণত হয়”। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সমগ্র ভারত দখলের পনের বছর পর অর্থাৎ ১৭৭২ সালে রামমোহনের জন্ম হয়। তাঁর জীবনের প্রথম চল্লিশ বছরে, রামমোহন সমস্ত প্রধান ধর্মের ধর্মগ্রন্থ এবং প্রধান গ্রন্থগুলি আয়ত্ত করেন, প্রায়শই সেগুলির মূল ভাষার রচনা তিনি পড়তেন কারণ তিনি ছিলেন বহু ভাষাবিদ। সংস্কৃত, আরবি, ফারসি তৎসহ ইংরেজী, ল্যাটিন এবং গ্রীক এইরকম বহু ভাষার ওপর তার অসাধারণ কর্তৃত্ব ছিল। তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজস্ব আধিকারিকের চাকরি করতেন, চাকরি ছেড়ে দিয়ে ১৮১৫ সালে কলকাতায় থিতু হন এবং লেখালেখি ও সংগঠনের কাজে মনোনিবেশ করেন।
সতীদাহ প্রথার বিলোপের জন্য রামমোহনের যে ঐতিহাসিক অবদান, তারজন্যে তাঁকে সবচেয়ে বেশি স্মরণ করা হয়, এই সতীদাহ প্রথা আসলে তথাকথিত ‘স্বেচ্ছামৃত্যু’র নামে হিন্দু বিধবাদের আত্মহননে বাধ্য করা যা প্রকৃতপক্ষে তাদের স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবা স্ত্রীকে ধর্মীয় অনুশাসনের নামে পুড়িয়ে মারা ছাড়া আর কিছুই নয়। তৎকালীন সময়ে বহুবিবাহও একটি স্বাভাবিক প্রথা ছিল, এর অর্থ যুগপৎ একাধিক নারীর সামাজিক বঞ্চনা। রামমোহন তাঁর নিজের পরিবারে এইরকম ঘটনা প্রথম হতে দেখেন, যখন তাঁর বৌদি এই ঘৃণ্য প্রথার শিকার হন। তিনি এই প্রথার বিলোপের জন্যে প্রাথমিকভাবে এই উদ্দেশেই তাঁর নিজের প্রকাশিত বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা সংবাদ কৌমুদীর পাতায় তেজস্বী, বলদীপ্ত এবং প্রত্যয়ী একাধিক নিবন্ধের মাধ্যমে প্রচার চালাতে থাকেন, এই প্রচার অবশেষে ১৮২৯ সালে গভর্নর জেনারেল উইলিয়াম বেন্টিঙ্ককে সতীদাহ প্রথাকে নিষিদ্ধ করতে বাধ্য করে।
সতীদাহ প্রথার বিলুপ্তি ছিল হিন্দু মহিলাদের অধিকারের সমর্থনে প্রথম ঐতিহাসিক আইনি পদক্ষেপ, যার গুরুত্বকে শুধুমাত্র বিদ্যাসাগর কর্তৃক পদক্ষেপের ফলে প্রবর্তিত ১৮৫৬ সালের বিধবা বিবাহ আইন এবং আম্বেদকর ও নেহরুর নেতৃত্বে ১৯৫২ ও ১৯৫৬ সালে হিন্দু কোড বিলের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। ঘটনা হলো যে সতীদাহ নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার প্রায় একশো ষাট বছর পর ১৯৮৭ সালে রাজস্থানের রূপ কানওয়ার সতী মামলা এবং সতীদাহের সমর্থনে আরএসএস-বিজেপি’র আক্রমণাত্মক প্রচার অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে আবার একটি সতীদাহ প্রথা বিরোধী আইনের প্রয়োজন হয়েছিল। এই ঘটনা রামমোহনের প্রচারের ঐতিহাসিক তাৎপর্য প্রমান করছে। রামমোহনের কাছে সতীদাহ প্রথা বিরোধী অভিযান ছিল যুক্তিবাদ ও আধুনিকতার যে বৃহত্তর প্রগতিশীল এজেন্ডা তারই একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ যা তাঁকে একজন ধর্মীয় ও সমাজ সংস্কারক, শিক্ষাবিদ এবং সাংবাদিক হিসাবে তুলে ধরেছিল। তিনি মহিলাদের জন্য সম্পত্তির উত্তরাধিকারের দাবিও উত্থাপন করেন — যেখানে ১৮৭০ সাল পর্যন্ত ইংল্যান্ডের নারীরা তাদের বিবাহ পরবর্তী পিতামাতার উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারেনি সেই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতবর্ষে নারীর সম্পত্তির উত্তরাধিকারের দাবি এক বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। অবশেষে হিন্দুধর্মকে বর্ণভেদ প্রথা থেকে মুক্ত করতে এবং একে একেশ্বরবাদী ধর্ম বিশ্বাসে সংস্কারের লক্ষ্যে তিনি হিন্দুধর্ম থেকে দূরে সরে গিয়ে একটি সার্বজনীন ধর্মের ধারণার অবতারণা করেন এবং ব্রাহ্মসভা ও ব্রাহ্মসমাজের ভিত্তি স্থাপন করেন।
সামাজিক সংস্কার, আধুনিক শিক্ষা এবং ন্যায়বিচারের জন্য ব্রিটিশ প্রশাসনের সাথে জড়িত থাকার পাশাপাশি রামমোহন তার সমসাময়িক মুঘল সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারীদের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখেছিলেন। উনিশতম মুঘল সম্রাট আকবর শাহ দ্বিতীয় যিনি ১৮০৬ সালের নভেম্বর থেকে ১৮৩৭ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মুঘল সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন তিনি রামমোহনকে ‘রাজা’ উপাধিতে ভূষিত করেন, এই উপাধি তাঁর নামের সুপরিচিত সম্মানসূচক বিশেষণ হয়ে উঠেছে। মুঘল সম্রাটের একজন দূত হিসেবে রামমোহন ১৮৩০ সালে ব্রিটেনে যান, সেখানে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এর তিন বছর পর তিনি সেখানে প্রয়াত হন।
ভারতের স্বাধীনতার ধারণাটি তার জীবদ্দশায় উত্থাপিত না হলেও রামমোহন ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের মুক্তির ধারণা দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং উনিশ শতকের প্রথম পাদে স্পেনীয় ঔপনিবেশিকতা থেকে দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলির স্বাধীনতা অর্জনে অত্যন্ত উচ্ছ্বসিত বোধ করেছিলেন।
রামমোহনের মৃত্যুর দুই দশক পরে, ভারতে স্বাধীনতার দাবিতে সুনির্দিষ্ট একটি জাতীয় জাগরণের সূচনা হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিক থেকে ধারাবাহিক আদিবাসী বিদ্রোহের পর, ১৮৫৭ সালের মে মাসে আমাদের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা হয়, তখনই আজিমুল্লা খান লিখেছিলেন সেই চির-অনুপ্রেরণাময় সঙ্গীত ‘হাম হ্যায় ইসকে মালিক, হিন্দুস্তান হামারা’, বিদ্রোহে গর্জে উঠেছিল উত্তর ভারতের এক বিশাল অংশের মানুষ। ঔপনিবেশিক শাসনের ভয়াবহতা হিন্দু ও মুসলমানের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের অভূতপূর্ব বীরত্বের কাহিনী রচনা করেছিল। একটাই ছাতার তলায় দাঁড়িয়ে এই সংগ্রাম ছিল রানী লক্ষ্মীবাই ও বেগম হজরত মহল, কুনওয়ার সিং ও মৌলভি আহমাদুল্লাহ শাহ ফৈজাবাদীর মিলিত উত্তরাধিকার, যা ভারতের পরবর্তী দীর্ঘস্থায়ী স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিত্তি স্থাপন করেছিল।
১৯তম মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর শাহের দূত হিসেবে রামমোহন ব্রিটেনে মারা যান। ১৮৫৭ সালের যোদ্ধারা আকবর শাহের পুত্র এবং শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে বিদ্রোহের নেতা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। ১৮৬২ সালের ৮ নভেম্বর বাহাদুর শাহ জাফর রেঙ্গুনে নির্বাসনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
মুঘল রাজবংশের বিরোধিতা করে একবিংশ শতাব্দীর ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে সংজ্ঞায়িত করার সংঘ-বিজেপি’র অপচেষ্টার বিপরীতে যদি দেখি, অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মুক্ত ও আধুনিক ভারতের লক্ষ্যে ব্রিটিশ বিরোধী লড়াইয়ে মুঘল সম্রাটদের মিত্র হিসেবে, এমনকি নেতা হিসাবে মেনে নিতেও কোনো সমস্যা ছিল না।
রামমোহন রায় হয়ত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের হাত থেকে ভারতকে মুক্ত করার কোনো সুস্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেননি, কিন্তু তিনি দেশীয় সম্পদ এবং উদ্বৃত্ত সম্পদ দেশের বাইরে পাচারের ঔপনিবেশিক লুঠের বিরুদ্ধে বিতর্ক শুরু করেছিলেন। রামমোহনের মতো, আধুনিক ভারতের সমস্ত স্বপ্নদ্রষ্টা এবং নির্মাতা যারা সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কারের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাগত অগ্রগতির জন্য লড়াই করেছিলেন তাঁদের ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নায়ক হিসাবে আমাদের দেখতে হবে। বাংলার রামমোহন এবং বিদ্যাসাগর থেকে শুরু করে মহারাষ্ট্রের জ্যোতিবা এবং সাবিত্রীবাই ফুলে এবং ফাতিমা শেখ পর্যন্ত, উনিশ শতকে আমাদের ভারতীয় জাগরণের একটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ উত্তরাধিকার রয়েছে। তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিতে ছিল সাম্প্রদায়িকতা, ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতন্ত্র, কুসংস্কার এবং শোষণ উৎপীড়ন থেকে মুক্ত একটি বৈচিত্র্যময়, বহুত্ববাদী এবং গণতান্ত্রিক ভারতের স্বপ্ন, যেখানে যুক্তি ও সম্প্রীতি হবে মর্যাদাপূর্ণ মানব উন্নয়নের স্তম্ভ। আজ যারা দেশের বর্তমানকে ধ্বংস করতে, ভবিষ্যৎকে পঙ্গু করতে অতীতের উত্থাপন করছে ভারতের সেই অনুপ্রেরণাময় উত্তরাধিকার এবং দৃষ্টিভঙ্গি আমাদেরকে সেই অশুভ শক্তিকে প্রত্যাখ্যান করতে সাহায্য করবে।
- দীপঙ্কর ভট্টাচার্য
পশ্চিমবাংলার শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগ দুর্নীতির বিচার চলাকালীন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বলছেন যে, তাঁর প্রত্যাশা, মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় (বর্তমানে শিল্পমন্ত্রী হলেও যিনি এরআগে শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন) হয় নিজেই মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করবেন, আর তা না হলে মুখ্যমন্ত্রী বা রাজ্যপালের হস্তক্ষেপে যেন তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়। স্কুল সার্ভিস কমিশনের (এসএসসি) অফিসে নিয়োগ সম্পর্কিত সংরক্ষিত নথি নষ্ট করা হতে পারে, এই আশঙ্কায় বিচারপতির নির্দেশে এসএসসি’র ভবন বুধবার ১৮ মে মাঝরাত থেকে পাহারা দিচ্ছে কেন্দ্রীয় আধা সামরিক বাহিনী সিআরপিএফ। এসএসসি’র সচিব পরদিন তাঁর অফিসে ঢুকতে গেলে বাধা পেয়ে তাঁকে ফিরে আসতে হয়। ডেটা রুম বা তথ্য সংরক্ষণের কক্ষ সিল করে দিচ্ছে সিআরপিএফ। বিচারপতির নির্দেশে শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরেশ অধিকারীর মেয়ে অঙ্কিতা অধিকারীকে শুধু শিক্ষিকা পদ থেকে অপসারিত করলে ও পাওয়া সমস্ত বেতন ফেরত দিলেই চলবেনা, যে স্কুলে কাজ করতেন, তিনি বা তাঁর কোনো আত্মীয় সেই স্কুলের গণ্ডি মাড়াতে পারবেন না। নিয়োগ দুর্নীতিকে কেন্দ্র করে যে তদন্ত ও বিচার চলছে, এগুলো সেখান থেকে উঠে আসা তিনটে খণ্ডচিত্র মাত্র। চূড়ান্ত অমর্যাদাকর, কলঙ্কজনক, লাঞ্ছনাময় এই নির্দেশগুলো আদালত থেকে ঠিকরে গিয়ে বিঁধছে তৃণমূল দল ও সরকারের গায়ে। শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগ দুর্নীতি এখন এতটাই খোলসা হয়ে সামনে এসেছে যে এই অবমাননাগুলোকে মুখ বুজে হজম করা ছাড়া মমতা ব্যানার্জীদের কাছে আর কোনো বিকল্প থাকছে না।
কলকাতা হাইকোর্টের হরিশ ট্যান্ডন ও রবীন্দ্রনাথ সামন্তর ডিভিসন বেঞ্চ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মী নিয়োগে দুর্নীতির তদন্তের ভার দেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি রঞ্জিতকুমার বাগের নেতৃত্বাধীন কমিটির ওপর। সেই কমিটি গত ১২ মে আদালতের কাছে তাদের রিপোর্ট পেশ করেছে এবং সেই রিপোর্টে দুর্নীতির স্বরূপ ও ছক অত্যন্ত নৈপুণ্যের সঙ্গে বিধৃত হয়েছে। রিপোর্ট জানিয়েছে, অসৎ পথে নিয়োগের জন্য একটা নকশা বানানো হয়েছিল আর তার কেন্দ্রে ছিল একটা কমিটি যেটা তৈরি হয়েছিল পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নির্দেশে। এই কমিটির সদস্যরা ছিলেন এসএসসি’র পূর্বতন উপদেষ্টা শান্তিপ্রসাদ সিংহ, পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ওএসডি (অফিসার অন স্পেশ্যাল ডিউটি) প্রবীর কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ও পার্সোনাল সেক্রেটারি সুকান্ত আচার্য, স্কুল এডুকেশন ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি ডাইরেক্টর অলোক কুমার সরকার ও ঐ ডিপার্টমেন্টের ল অফিসার তাপস পাঁজা। এর নাম দেওয়া হয়েছিল উপদেষ্টা কমিটি এবং তা গঠনের উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে বলা হয়েছিল, স্কুল সার্ভিস কমিশনের কাজে “তদারকি করা, নিয়মিত নজরদারি চালানো এবং তাকে পরিচালিত করা”। ঐ কমিটি কেমন করে মেধা তালিকায় নাম না থাকা এবং পিছনের দিকে থাকা প্রার্থীদের তালিকার ওপরে তুলে নিয়ে এসেছিল, সে কথায় আসার আগে সংক্ষেপে শিক্ষা ক্ষেত্রে নিয়োগ পদ্ধতিটা বুঝে নেওয়া যাক। এসএসসি পরীক্ষা গ্ৰহণ করে (লিখিত এবং পার্সোনালিটি টেস্ট উভয়ই) মেধা তালিকা তৈরি করে। সেই মেধা তালিকার ভিত্তিতে তারা নিয়োগের সুপারিশ পাঠায় এবং মধ্যশিক্ষা পর্ষদ সুপারিশগুলো নিয়ে নিয়োগপত্র দেয়, যার ভিত্তিতে সফল প্রার্থীরা নিয়োজিত হন। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের গড়া উপদেষ্টা কমিটি যেটাকে তাদের কৌশলের প্রধান অঙ্গ করেছিল তা হল আরটিআই বা তথ্যের অধিকার আইন। এই আইনের আশ্রয় নিয়ে অসফল বা পিছনের দিকে থাকা প্রার্থীদের উত্তরপত্র বা ওএমআর শিটের পুনর্মূল্যায়নের আবেদন করতে বলা হত। এবং উত্তরপত্র বার করে তাতে নম্বর বাড়িয়ে আবেদনকারীদের মেধা তালিকার ওপরের দিকে নিয়ে আসা হত। আর এই কাজটা সাঙ্গ হবার পর অপরাধের চিহ্ন নিশ্চিহ্ন করতে উত্তরপত্রগুলোকে পুড়িয়ে বা অন্য উপায়ে নষ্ট করা হত। বাগ কমিটির অন্যতম সদস্য অরুণাভ ব্যানার্জী জানিয়েছেন, “মূলত, আরটিআই’কে কিছু প্রার্থীর নম্বর বাড়ানোর অস্ত্র হিসাবে কাজে লাগানো হয়েছিল, এবং সেটা হয়ে যাওয়ার পর তাঁরা ওএমআর শিটগুলো নষ্ট করে দিতেন”। তদন্ত করতে গিয়ে বাগ কমিটির সদস্যরা নিয়োজিত কিছু প্রার্থীর সঙ্গে কথাও বলেন। আর সেই আলোচনার ভিত্তিতে অরুণাভ ব্যানার্জীর উপলব্ধি হল, “কিছু প্রার্থী বারবারই বলেছেন যে তাঁরা কত নম্বর পেয়েছেন সেটা তাঁরা জানতেন না। কিন্তু তাঁরা কমিটির কর্তাদের পরামর্শ অনুযায়ী ওএমআর শিটের পুনর্মূল্যায়নের ভিত্তিতে লিখিত পরীক্ষার নম্বর বাড়িয়ে মেধা তালিকায় স্থান ওপরের দিকে আনার জন্য আবেদন করতেন।” এসএসসি’র বিধিতে পুনর্মূল্যায়নের কোনো কথাই নেই এবং গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়া এভাবে চালানো হয়েছে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে এক অবৈধ কমিটির মাধ্যমে। এছাড়া, যারা পরীক্ষাতেই বসেনি, তাদের নামও কোনো যাদুবলে মেধা তালিকায় সফলদের মধ্যে ঢুকে পড়ত। বাগ কমিটির রিপোর্টে জানানো হয়েছে, তৃতীয় শ্রেণীতে অবৈধ পথে নিয়োগের সংখ্যাটা ৩৮১, যারমধ্যে ২২২ জনের নাম কোনো তালিকাতেই ছিল না। আর চতুর্থ শ্রেণীর ক্ষেত্রে ঐ ধারায় নিয়োগ হয়েছে ৬০৯ জন।
শিক্ষক নিয়োগে কতজনের ক্ষেত্রে ভ্রষ্টাচারের পথ অনুসৃত হয়েছিল সে তথ্য পাওয়া না গেলেও কিছু নিদর্শন কিন্তু সামনে এসেছে। যোগ্যতা অর্জন না করেও নিয়োজিত হওয়ার জন্য শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরেশ অধিকারীর মেয়ে অঙ্কিতা অধিকারীর বরখাস্ত হওয়ার কথা শুরুতেই উল্লিখিত হয়েছে। সুমনা লায়েক এবং নাসরিন খাতুন যোগ্যতা অর্জন করে মেধা তালিকায় স্থান পেলেও চাকরি পাননি, এবং এই বঞ্চনার বিরুদ্ধে তাঁরা হাইকোর্টের শরণাপন্ন হন। প্যানেলভুক্ত না হয়েও মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন স্কুলে ছ’জন গণিত শিক্ষক নিয়োজিত হন। বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় তাঁদের নিযুক্তিকে বাতিল করার নির্দেশ দেন।
এরআগে উল্লিখিত হয়েছে যে, নিয়োগের জন্য এসএসসি’র সুপারিশ এবং তার ভিত্তিতে মধ্যশিক্ষা পর্ষদের দেওয়া নিয়োগপত্র দরকার। সেটা কিভাবে হত? এই ব্যাপারে প্রভাবশালী ভূমিকা ছিল উপদেষ্টা কমিটির শান্তিপ্রসাদ সিংহ’র। তিনি এসএসসি’র প্রোগ্ৰাম অফিসার সমরজিৎ আচার্যকে দিয়ে ভুয়ো সুপারিশপত্র ছাপাতেন। সেইসব সুপারিশপত্র যেত মধ্যশিক্ষা পর্ষদের পূর্বতন সভাপতি কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে যিনি তাঁর টেকনিক্যাল অফিসার রাজেশ লায়েককে দিয়ে নিয়োগপত্র তৈরি করাতেন এবং সেগুলো আবার পাঠাতেন শান্তিপ্রসাদ সিংহ’র কাছে। বাগ কমিটির রিপোর্টে নিয়োগ দুর্নীতিতে জড়িত বলে ১১ জন এসএসসি অধিকর্তার নাম রয়েছে। এইভাবে দেখা যাচ্ছে, এসএসসি ঘোষিতভাবে স্বশাসিত সংস্থা হলেও সেটা ছিল শুধু নামে। তা কব্জা হয়ে গিয়েছিল পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বানানো উপদেষ্টা কমিটির হাতে যারা শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগকে পরিণত করেছিল বাঁহাতি রোজগারের কদর্য কারবারে।
টাকা ফেললে পশ্চিমবাংলার শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগ দুর্লভ না হওয়ার খবর রাজ্যের চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং বিভিন্ন জেলাতে এই নিয়োগের এজেন্ট হিসাবে কাজ করছিল তৃণমূলের নেতারা ও দল ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা। কোন পদের দর কত ছিল, সে খবরও সংবাদপত্রে বেরিয়েছে। প্রাথমিকে নিয়োগের দর ছিল ১২-১৩ লক্ষ, উচ্চ প্রাথমিকে ১৮ লক্ষ, নবম-দশমে ১৬ থেকে ২৫ লক্ষ, তৃতীয় শ্রেণীর কর্মী হিসাবে নিয়োগের জন্য ১২ লক্ষ এবং চতুর্থ শ্রেণীর কর্মী হওয়ার জন্য ১০ লক্ষ। শিক্ষা ক্ষেত্রে নিয়োগের নামে লক্ষ-লক্ষ টাকা তুলে সাধারণ মানুষদের প্রতারিত করার জন্য তেহট্ট থেকে গ্ৰেপ্তার হয়েছেন প্রবীর কয়াল। পুলিশী জেরায় সেই টাকা তিনি ‘দাদা’ তেহট্টের তৃণমূল বিধায়ক তাপস সাহাকে দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন। তাপস সাহা প্রবীর কয়ালের এই বিবৃতিকে ‘মিথ্যা কথা’ বলে নিজেকে নির্দোষ বলে চালাতে চাইলেও সেই অস্বীকার বেশি ভরসা জাগায় না। একইভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রচুর টাকা তোলার দুর্নীতি মামলায় গ্ৰেপ্তার হয়েছেন পূর্ব বর্ধমানের মঙ্গলকোটের ঝিলু-২ পঞ্চায়েতের তৃণমূল উপপ্রধান শেখ হেকমত আলি। কোলাঘাটের অতনু গুছাইত টাকার বিনিময়ে শিক্ষাক্ষেত্রে বেশ কয়েকজনকে চাকরিতে ঢুকিয়েছেন বলে খবর বেরিয়েছে এবং অনেকে টাকা দিয়ে প্রতারিত হওয়ায় এখন টাকা ফেরতের দাবি জানাচ্ছেন। নিজেকে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ বলে দাবি করা অতনু গুছাইত এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বলে খবর। আবার ২০১১ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত যিনি তৃণমূলের মন্ত্রী ছিলেন সেই উপেন বিশ্বাসের সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট জানিয়েছে, উত্তর ২৪ পরগণার বাগদার জনৈক ‘রঞ্জন’ লক্ষ-লক্ষ টাকার বিনিময়ে বেশ কিছু নিয়োগ ঘটাতে পারতেন। উপদেষ্টা কমিটির মাধ্যমে নিয়োগের ক্ষেত্রে যে লেনদেন হত, তার হিসাবের খাতা থাকত বলেও কেউ-কেউ জানিয়েছেন। বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের আশঙ্কা, এই নিয়োগ দুর্নীতিতে অন্তত ৫০০ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। কেউ যদি বলেন যে, দলের ওপর তলায় এটা একেবারেই অজানা ছিল, সেকথা বিশ্বাস করতে গেলে যুক্তি বোধ সবকিছুকে তুলে রাখতে হয়।
শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগ দুর্নীতির কাঁটায় বিদ্ধ হয়ে মমতা ব্যানার্জী কখনও বলছেন — কুকর্মকারীদের মানুষ ঘৃণা করে, আর “আমিও তাদের ভালোবাসি না”। আজ যদি পার্থ চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে তাঁর বিরাগ বোধ হয়, তবে আমাদের মনে না পড়ে পারেনা যে, একসময় তিনি টিএমসি’র দু’নম্বর নেতা ছিলেন, দলে মমতার পরই ছিল তাঁর স্থান। মমতা ব্যানার্জী কখনও আবার বলছেন, “বিজেপি কয়েকটা কেন্দ্রীয় সরকারি এজেন্সিকে দিয়ে দেশে তুঘলকি কাণ্ড চালাচ্ছে। আমাকে ভোটে হারাতে পারেনি বলেই এরা এখন প্রতিশোধ নিচ্ছে।” তিনি একবার নিয়োগ দুর্নীতিতে দলের নেতারা যুক্ত থাকায় তাঁর ক্ষোভ দেখাচ্ছেন, আবার সেটাকে ভিত্তিহীন ব্যাপার — শুধুই প্রতিশোধের আখ্যান বলে দেখানোর চেষ্টা। শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগকে কেন্দ্র করে যে সমস্ত তথ্যপ্রমাণ সামনে এসেছে, সেগুলো অকাট্য বলেই প্রতিপন্ন হচ্ছে এবং মমতা ব্যানার্জী কেন, কারুর পক্ষেই সেগুলোর অস্বীকার করা সম্ভব নয়। নিজেদের দিকে ধেয়ে আসা সমালোচনাকে আটকাতে তৃণমূল কংগ্রেসের কোনো মুখপাত্র আবার মধ্যপ্রদেশের ভ্যাপম কেলেঙ্কারির কথা তুলছেন। ভ্যাপম বিজেপি শাসিত মধ্যপ্রদেশে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ এবং ডাক্তারি পড়ার প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়াকে কেন্দ্র করে বিরাট আকারের কেলেঙ্কারি যাতে দুর্নীতির পরিমাণ শতশত কোটি টাকা ছিল, তার সঙ্গে যুক্ত বহু সাক্ষীর সন্দেহজনক মৃত্যু ঘটেছিল এবং এমনকি মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহানের নামও কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছিল। কিন্তু সেই দুর্নীতি থেকে শিবরাজ সিং চৌহানের পার পেয়ে যাওয়া এবং সেখানে বিজেপি’কে আদালতের কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়তে না হওয়াটা পশ্চিমবাংলার শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগ দুর্নীতির লঘু হয়ে পড়ার কারণ হতে পারে না। বিজেপি এই দুর্নীতি থেকে ফায়দা তোলার চেষ্টা করলে তার সেই প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করতে হবে। এরই সাথে দুর্নীতি ও তৃণমূলের একাকার হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটাকে নিয়েও প্রচার অভিযান নামাতে হবে। তৃণমূল পশ্চিমবাংলায় ক্ষমতায় আসার পরপরই একগুচ্ছ চিটফান্ড দুর্নীতির উন্মোচন ঘটেছিল যাতে নিঃস্ব হতে হয়েছিল সাধারণ মানুষদেরই, আর মমতা ব্যানার্জী তাঁর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন “যা গেছে তা যাক” বলে। আজ কয়লা পাচার কাণ্ডে সিবিআই’এর মুখোমুখি হতে হচ্ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো অভিষেক বন্দোপাধ্যায় ও তাঁর স্ত্রী রুজিরাকে। কয়লা পাচার দুর্নীতিতে আরও জড়িত রয়েছে তৃণমূল নেতা বিনয় মিশ্র ও তার ভাই বিকাশ মিশ্র। অনেক দিন এড়িয়ে চলার পর অনুব্রত মণ্ডলও সিবিআই’এর কাছে হাজির হতে বাধ্য হলেন। কলকাতা পুরসভার প্রাক্তন তৃণমূল মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় এবং তৃণমূল ঘনিষ্ঠ শিল্পী শুভাপ্রসন্ন সিবিআই তদন্তের মুখে। এছাড়া, সিন্ডিকেট তোলাবাজিতে জড়িয়ে আছেন তৃণমূলের ছোট-বড় অনেক নেতাই। শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগে কেলেঙ্কারির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছিলেন বঞ্চিত শিক্ষক প্রার্থীরা। তাঁদের আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগ কেলেঙ্কারি আজ বিপুল মাত্রায় উন্মোচিত। শিক্ষক প্রার্থীদের এই আন্দোলনকে অভিনন্দন জানিয়ে বামেদেরই এই কাণ্ডকে ধরে তৃণমূলের দুর্নীতিতে আকণ্ঠ ডুবে থাকার স্বরূপের উন্মোচন ঘটাতে হবে। ২০১৯’র লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি’র কাছে ১৮টা আসন হারিয়ে মমতা ব্যানার্জী ‘কাটমানি’ ফেরত অভিযান শুরু করেছিলেন। শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগ দুর্নীতিতে ডুবে রয়েছে তৃণমূল — এই আখ্যান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মমতা ব্যানার্জী কি ঐ ধরনের কোনো উদ্যোগের পথে আবার যাবেন? তা যদি হয়, সেটার প্রহসনে পরিণত হওয়া নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকতে পারে না।
- জয়দীপ মিত্র
২০১৫ সাল থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী বঙ্গ বিশ্ব বাণিজ্য শীর্ষ সম্মেলন (বেঙ্গল গ্লোবাল বিজিনেস সামিট বা বিজিবিএস) শুরু করেছেন। ২০১৫ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত টানা ৫টি বিজিবিএস’এর পরে মাঝে কোভিডের জন্য দু’বছর স্থগিত থাকার পরে গত এপ্রিলের ২০-২১ তারিখে ষষ্ঠটি অনুষ্ঠিত হল নিউটাউনে বিশ্ব বাংলা কনভেনশন সেন্টারে। ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের কিছু আগে পঞ্চম বিজিবিএস’এ মুখ্য আকর্ষণ ছিলেন মুকেশ আম্বানি, আর এবার ষষ্ঠটিতে শিরোমণি হিসেবে উপস্থিত হলেন গৌতম আদানি। ভারতে শাসক দল বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিরা সাধারণত বিজেপি’র দোসর হিসেবে আম্বানি-আদানির নাম একসাথেই উচ্চারণ করে থাকে। যদিও মমতা ব্যানার্জীর মুখে সাধারণত তাদের বিজেপি’র সাথে একসাথে জড়িয়ে বিরোধিতা দেখা যায় না। তবুও পরপর দু’দুটি বিজিবিএস’কে ‘মহিমান্বিত’ করলেন বিজেপি’র দোসর পুঁজির দুই মালিক। ২০১৯’র সম্মেলনে মুকেশ আম্বানি পশ্চিমবঙ্গে ১০ হাজার কোটি টাকার নতুন বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এবছরের সম্মেলনে গৌতম আদানি সম পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করবেন বলে কথা দিয়েছেন। তবে কথাই তো আছে, ‘কেউ কথা রাখেনি’। প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র বলেছেন যে ২০১৫ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত সম্মেলনগুলিতে প্রতিশ্রুত সাড়ে ৯ লক্ষ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রকল্পের ৫০ শতাংশের বেশি কার্যকরী হয়ে গেছে ও ২০১৯ সালের প্রতিশ্রুত ২৮৪ লক্ষ কোটি টাকার মধ্যে ৭২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প কার্যকরী হচ্ছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের আভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ও শিল্প সহায়তাকারী দফতরের কাগজপত্র অনুযায়ী ২০১৫ থেকে ২০১৯’র মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে ৩৭ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছে যারমধ্যে ১৬ হাজার কোটি টাকা কার্যকরী হয়েছে। গত দু’বছরের অতিমারির মধ্যে তা বেড়ে প্রায় সাড়ে ৫ লক্ষ কোটি টাকা অর্থাৎ প্রায় ৩৫ গুণ হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। ফলে ২০১৯ সালে আম্বানির দেওয়া কথার ১০ হাজার কোটির বিনিয়োগ কোথায় গেল জানতে ইচ্ছে করে।
যাক গিয়ে সেসব পুরোনো কথা (যদিও পুরানো সে দিনের কথা ভোলা কি আর যায়), এবারের বিজিবিএস’এর মুখ্য শিল্পপতি আদানির কথায় আসা যাক। উনি দুটি কথা বলেছেন। প্রথমে বলেছেন, তাঁর কোম্পানিগুলি আগামী দশ বছরে পশ্চিমবঙ্গে ১০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে ও তাতে ২৫,০০০ মানুষের কাজ জুটবে। দ্বিতীয়টি বলেছেন পশ্চিমবঙ্গে বিজিবিএস শেষ হওয়ার একদিন বাদে ইন্ডিয়ান ইকোনোমিক কনক্লেভে। সেখানে বলেছেন ২০৫০ সালের মধ্যে ভারতে কোনো অভুক্ত থাকবে না ও দেশের জিডিপি ৩০ লক্ষ কোটি মার্কিন ডলারে পৌঁছবে। ভারতের তথা এশিয়ার এক নম্বর সম্পদশালী ব্যক্তি যা বলেছেন তাকে অমান্য করে কার সাধ্যি। তেমনটা হলে চাই কি তিনি গুজরাটের আদালতে মানহানির মামলা করে দেবেন। সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে ১২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের (ভারতীয় টাকায় ৯.৫ লক্ষ কোটি) মালিকের মান একটুও হানি হলে তার খেসারত তো কয়েক হাজার কোটি টাকা হবেই। অতিমারির সময়কালে ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে আদানির সম্পদ বেড়েছে প্রায় ৪৮ বিলিয়ন ডলার (৩ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকা)। ওই সময়কালে ভারতের জিডিপি একই স্তরে রয়ে গেছে। ভারতে দারিদ্রও বেড়েছে, ২০ কোটির বেশি মানুষ দারিদ্র সীমার নীচে নেমে গেছে। বোঝাই যাচ্ছে কাকে বলে কারুর পৌষমাস কারুর সর্বনাশ। এও বোঝা যাচ্ছে আত্মনির্ভর ভারত তথা রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্র বেসরকারিকরণের লাভের গুড় কারা খাচ্ছে, কারা দোসর মোদীজীর।
পুঁজির মালিকদের এদেশে অতিধনী হওয়ার মধ্যে একটা প্যাটার্ন দেখা যায়। তাঁরা প্রথমে বিভিন্ন অনীতিনিষ্ঠ উপায়ে কিছুটা ধনবান হন, তারপরে সেই ধন ব্যবহার করে ক্ষমতার অলিন্দে থাকা কোনো রাজনীতিবিদদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশের অর্থনৈতিক নীতি, বাণিজ্য নীতি বিষয়ে আগাম জানতে পারেন যাকে ব্যবসায়ীর ভাষায় বলে ‘ইনসাইডার স্টোরি’ এবং সেই অনুযায়ী ফাটকা লেনদেন করেন, বা অর্থ লগ্নি করেন। ধীরুভাই আম্বানির উত্থান নিয়ে ‘পলিয়েস্টার প্রিন্স’ বলে একটি বই আছে। একবার অতিধনীর কাতারে পৌঁছে গেলে আগে দুর্নীতি কারচুপি করা শিল্পপতি ‘দেশপ্রেমিক’ হয়ে যান। ‘দেশই প্রথম’ গোছের শ্লোগান জামার বুকে লাগিয়ে নেন। তাঁর পরবর্তী প্রজন্ম তো একদম ঝকঝকে বিদ্বান, বুদ্ধিমান উদ্যোগী শিল্পপতি হয়ে ওঠেন, সরকারগুলিও তাঁদের কাছে নতজানু হয়ে পড়েন প্রকাশ্যে। রাষ্ট্রায়ত্ব শিল্পগুলিকে বেচে দেওয়া হয় জলের দরে। সম্প্রতি টাটার কাছে এয়ার ইন্ডিয়া বিক্রি, দু’দশক আগে অনিল আগরওয়ালের বেদান্তের কাছে ভারত এ্যালুমিনিয়াম, ইন্ডিয়া জিঙ্ক, বাইলাডিলা মাইনস বিক্রি এসবই সেই দোসর পুঁজির নিদর্শন।
গৌতম আদানির সঙ্গে সরকারগুলির খাতির বন্ধুত্ব কেমন সেটা একটু খুঁজে দেখা যেতে পারে। কোন সুবাদে কলেজ ড্রপ আউট একজন ছোট ব্যবসায়ী দেশজুড়ে, এমনকি দেশের বাইরেও কয়লা খনি কিনতে পারে, দেশের বড় বড় বিমান বন্দর কব্জা করতে পারে, ১০-১২টা সমুদ্র বন্দরকে নিজের মালিকানায় আনতে পারে, একদিকে কয়লা খনি ও তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিক হয়েও অপরদিকে পরিবেশ বান্ধব শক্তিক্ষেত্রে বিপুল সম্পদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, সর্বোপরি দেশ ও জাতির অন্যতম নায়কের মতো দেশের দারিদ্র ও ক্ষুধা দূরীকরণের ভবিষ্যৎ এজেন্ডা মায় দেশকে ৩০ ট্রিলিয়ন জিডিপি’তে পৌঁছানোর টার্গেট বছর নির্দিষ্ট করতে পারেন। কেবল কি গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন মোদীর হয়ে গুজরাটে শিল্প সম্মেলন সংগঠিত করা বা ২০১৪’র নির্বাচনী প্রচারের নরেন মোদীকে বিমানের বন্দোবস্ত করে দেওয়ার মধ্য দিয়েই এই উত্থান না অন্য সরকারগুলির সঙ্গেও বোঝাপড়া রয়েছে! যেমন এরাজ্যে মমতা সরকারের সঙ্গে আপাতভাবে তা দেখা যাচ্ছে। নাকি আদানির সঙ্গে সখ্যতার মধ্য দিয়ে মমতা মোদীর কাছে বার্তা পৌঁছাতে চাইছেন! এসব জটিল ও গোপন কথা অবশ্যই ঝানু সাংবাদিকরা বিবেচনা করবেন। আমরা কেবল উত্থানের প্রক্রিয়াকে একটু খুঁটিয়ে দেখতে চেষ্টা করতে পারি।
আদানি গোষ্ঠির মোট কেনাবেচার পরিমাণ প্রায় ১.৫০ লক্ষ কোটি টাকা, বাজারী মূলধন সাড়ে ১৬ লক্ষ কোটি টাকা, সামগ্রিক মুনাফার পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকার আশেপাশে। মোট ঋণের পরিমাণ ১.৫০ লক্ষ কোটি টাকার মতো। এই ঋণের অনেকটা বিদেশ থেকে নেওয়া, অনেকটা দেশের মধ্যেও, শেয়ার ও সম্পত্তি বন্ধক দিয়ে ব্যাঙ্ক ঋণ। এগুলির অনেকটাই বৃত্তাকার ধরণে ঘুরছে, সম্পর্কিত লেনদেনের মধ্য দিয়ে। বিষয়টি জটিল। একটু সহজ ভাবে বললে এমনটি। ক কোম্পানী খ কোম্পানীর কিছু শেয়ারের মালিক, তারা সেই শেয়ার বন্ধক দিয়ে ঋণ নিল। তারা আবার সেই টাকা দিয়ে গ কোম্পানীকে ঋণ দিল বা গ’এর শেয়ারে বিনিয়োগ করল। যদিও গ কোম্পানী ও ক কোম্পানী একই ধরনের ব্যবসায় নেই। এবং ক, খ, গ সবকটি কোম্পানীই একই গোষ্ঠি, এক্ষেত্রে আদানি গোষ্ঠির অন্তর্ভুক্ত। ‘দ্য স্ক্রোল’ এব্যাপারে একটি প্রতিবেদনও তৈরি করেছিল। ফলে বাজার থেকে অর্থ ও ঋণ সংগ্রহের ক্ষেত্রে আদানি গোষ্ঠির স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সিবিআই আদানি এন্টারপ্রাইজের ম্যানেজিং ডিরেক্টর রাজেশ আদানিকে ৮০ লক্ষ টাকা কর ফাঁকির জন্য গ্রেফতার করেছিল। ২০১৭ সালে ভারতীয় কাস্টমস অভিযোগ করে যে আদানি গোষ্ঠি কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য করমুক্ত স্থানের আদানি পরিবারের দুবাই’এর খোলস (শেল) কোম্পানিকে ব্যবহার করছে। ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকা ওইরূপ ২৩৫ মিলিয়ন ডলার বা ১,৮০০ কোটি টাকা সরানোর একটি খবর প্রস্তুত করে। ২০১৪ সালে ভারত সরকারের রাজস্ব গোয়েন্দা বিভাগ দক্ষিণ কোরিয়া থেকে দুবাই হয়ে মরিসাসের একটি সংস্থায় অর্থ পাঠানোর একটি জটিল বন্দোবস্তকে খুঁজে বের করে। ওই সংস্থাটির মালিক গৌতম আদানির বড় ভাই বিনোদ শান্তিলাল আদানি।
কয়লা খনি ও বিদ্যুতে আদানি
ঝাড়খন্ডের রাঁচি থেকে ৩৮০ কিমি দূরত্বে মালি সমেত ১০টি গ্রামের ৫১৯ একর জমি আদানি পাওয়ারের হাতে তুলে দেয় ওখানকার তৎকালীন বিজেপি সরকার। গোড্ডায় ১,৬০০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ যাবে বাংলাদেশে। মোদীজী আদানির ব্যক্তিগত বিমানে চড়েই বাংলাদেশ যান, সঙ্গে নিয়ে যান শিল্পপতিদের প্রতিনিধি হিসেবে গৌতম আদানিকে। ওই সময়েই বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহের চুক্তি হয়। তার আগে আগস্ট মাসেই ওই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কেন্দ্রীয় অনুমোদন দিয়ে দেওয়া হয়। এরপরে ২০১৬ সালে জমি চায় আদানি, ২০০০ একর। ২০১৭ সালের মার্চ মাসে ঝাড়খন্ডের সরকার আদানির জন্য ৫১৯ একর আদিবাসীদের এবং তপশিলি সম্প্রদায়ের জমি অধিগ্রহন করে আদানিকে হস্তান্তর করে।
এরপর আদানি সংস্থা তাদের অবস্থান বারে বারে পাল্টাতে থাকে। যেমন, কোম্পানি যখন পরিবেশ সংক্রান্ত ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেছিল, তখন তারা বলেছিল যে তারা এই প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় জল সংগ্রহ করবে গোড্ডা’র সন্নিকটের চির নদী থেকে। পরে বলে যে তাদের অতিরিক্ত জল লাগবে, সেই জল তারা নেবে সংলগ্ন জেলা সাহেবগঞ্জের গঙ্গা থেকে; তারজন্য অতিরিক্ত ৪৬০ একর জমি লাগবে। কয়লা আনার জন্য তাদের রেল লাইন পাততে ৭৫ একর জমি লাগবে, এবং এই কাজটি আদানির হয়ে ভারতীয় রেলকেই করে দিতে হবে।
২০১৭’র মার্চ’এ ঝাড়খন্ড সরকার নোটিশ দিয়ে বলে যে আদানির এই প্রকল্প ‘জনস্বার্থে’ হচ্ছে, অতএব জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া পুনরায় চালু হবে। দেশের আইন অনুসারে রপ্তানির জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে, যে রাজ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হচ্ছে, সেই রাজ্যকে উৎপাদিত বিদ্যুতের ২৫ শতাংশ দেওয়া বাধ্যতামূলক। ঝাড়খন্ড সরকার ও আদানির কোম্পানির মধ্যে একটি চুক্তি হয়, যেখানে ঝাড়খন্ড সরকার মেনে নেয় যে আদানির কোম্পানী ‘অন্য সূত্র’ থেকে ঝাড়খড রাজ্যকে ২৫ শতাংশ বিদ্যুৎ দেওয়ার চেষ্টা করবে। আদানির কাছ থেকে এই বিদ্যুৎ ঝাড়খন্ড সরকারকে বাজারের দামের চেয়ে বেশি দামে কিনতে হবে; এই মর্মে রাজ্য সরকার তার আইন পরিবর্তিত করে নিয়েছে। এরফলে আদানির কোম্পানীর বছরে অতিরিক্ত ৭ হাজার ৪১০ কোটি টাকার বাড়তি মুনাফা হবে।
এই প্রকল্পের ক্ষেত্রে ‘জনশুনানী’র সময়ে পুলিশ আচমকা কাঁদানে গ্যাস ফাটিয়ে সবাইকে হটিয়ে দেয় এবং ঘোষণা করে যে গণশুনানি শেষ, গ্রামবাসীরা ‘স্বেচ্ছায়’ এই প্রকল্পে সায় দিয়েছে। এই মিটিং’এর নোটিশে বলা হয়েছিল যে গ্রামবাসীরা যেন এই মিটিং’এ উপস্থিত থেকে এই প্রকল্পে সায় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও স্থানীয় গ্রামসভা সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা এই প্রকল্পের বিরোধী, কেননা এখানে আদিবাসীরা তাদের বাসস্থান ও জমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছে। এই ‘গণশুনানী’র পর গোড্ডা জেলার কালেক্টার ঘোষণা করেন এই প্রকল্পে একজনও উচ্ছেদ হচ্ছেন না। ২০২০’র কোভিডকালে এসে দেখা যায় যে আদানি গোষ্ঠীর মূল উদ্দেশ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন নয়, তারা ঐ জমি এবং জলের দখল অন্যভাবে ব্যবহার করতে চায়, যাকে এমনকি ঝাড়খন্ড সরকারের পক্ষেও ‘জনস্বার্থ’ বলে ঘোষণা করা মুশকিল।
অস্ট্রেলিয়ার কয়লার সমস্যার কথা বলে আদানি গোষ্ঠী মোদী সরকারের কাছ থেকে অন্যায্য উপায়ে নতুন ‘কোল ব্লক’গুলির বেশ কয়েকটা এখনই হাতিয়ে নিয়েছে। মোদী সরকার কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলিকে চাপ দিয়ে আদানি গোষ্ঠীকে বিপুল পরিমাণ ঋণ পাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। সেই ঋণ এখন ক্রমাগত খেলাপি হয়ে চলেছে, অচিরেই হয়তো সেই ঋণ মকুব করা হবে। যে চৈনিক প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে আদানি গোষ্ঠী এই কেন্দ্রের পরিকল্পনা করেছিল, সেই প্রযুক্তি দূষণের দায়ে এখন সারা পৃথিবীতে প্রত্যাখ্যাত।
দেউচা-পাঁচামীতে খোলামুখ কয়লাখনির জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উঠেপড়ে লেগেছেন। মনে হয়, আদানিও সেটিকে পাখির চোখ করেছেন। তবে ছত্তিশগড়ে অনুরূপ কয়লাখনি যা বিগত বিজেপি সরকার ২০১১ সালে আদানিদের দিয়েছিল তার অভিজ্ঞতা ভয়াবহ। অরণ্যের একেবারে ধার ঘেঁষে বেসরকারি দুটি খোলামুখ খনির কাজ শুরু হয়। এরফলে প্রতিবেশের পক্ষে খুব গুরুত্বপূর্ণ অরণ্য একেবারে ধংস হয়ে যায়, জলের উৎসের বারোটা বাজে, ধোঁয়া, ধূলো, তাপ এবং শব্দ দূষণে পুরো অঞ্চলটির অপূরণীয় ও অপ্রত্যাহারযোগ্য ক্ষতি হয়। হাতিদের বাসস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তারা অনেক আগ্রাসী হয়ে ওঠে এবং মানুষের সঙ্গে তাদের অনভিপ্রেত সংঘাত বাধে। এরসঙ্গে যোগ করতে হবে হাজার হাজার বৃক্ষ-নিধন, যারা অনেকেই প্রায় শতাব্দী-প্রাচীন।
(ক্রমশ)
- অমিত দাশগুপ্ত
(ঋণ স্বীকারঃ শুভাশীষ মুখার্জি; পরিবেশ-প্রতিবেশ ধ্বংস ও দোসর-পুঁজি)
শ্রীলঙ্কা পুড়ছে। এক ক্ষমতালোভী শাসকের অবিবেচক সিদ্ধান্তের জেরে আজ গোটা শ্রীলঙ্কা বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে। আমাদের দেশেও আগুন। এ আগুন কখন বিস্ফোরণের রূপ নেবে তা বলা দুষ্কর। কিন্তু আমরাও যে আজ এক চরম দুর্বিপাকে নিমজ্জিত তা রেখেঢেকে বলার আর কোনও উপায় নেই।
জিনিসপত্রের দাম আকাশ স্পর্শ করেছে। গত আট বছরে আমরা সর্বাধিক মূল্যবৃদ্ধির হার অর্জন করেছি (৭.৭৯ শতাংশ)। পেট্রোপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। মুদ্রাস্ফীতি রুখতে সরকার গমের ওপর রফতানি-নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। ডলারের দাম বাড়তে বাড়তে ৮০’র ঘর ছুঁইছুঁই। শেয়ার বাজারে লাগাতার পতন হয়েই চলেছে। অর্থনৈতিক বিপর্যস্ততায় দেশের অবস্থা শোচনীয়।
কেন এমন হল? আমরা কি এক চরমতম বিপর্যয়ের দিকে এগোচ্ছি?
আমাদের অবস্থা যে ক্রমেই সঙ্গীন হয়ে উঠছে তা কেন্দ্রের শাসক বিজেপি’র ইদানীং আচরণেও বেশ স্পষ্ট। ‘অচ্ছে দিন’এর নানারকম গল্পগাথা শুনিয়ে তারা যে এতদিন জনতার এক বড় অংশকে বিমোহিত করে রেখেছিল, তার ঘোর কাটার পালা এখন। গত আট বছরের শাসনকালে জনতার এক বৃহৎ অংশ নানা মায়ামোহে তাদের বহুতর ‘বেনিফিট অফ ডাউট’ দিয়ে এসেছে। রাতারাতি বিমুদ্রাকরণের আঘাত, আচম্বিতে জিএসটি প্রবর্তন, জ্বালানি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যের ক্রম-উর্ধ্বগতি, লাভজনক রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রগুলিকে জলের দরে বিকিয়ে দেওয়া, জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলির বরাদ্দ কমিয়ে আনা, সাধারণ মানুষের জীবনযাপনকে শেয়ার বাজার, মিউচুয়াল ফান্ড ও ভাগ্যের হাতে সঁপে দেওয়া এবং ক্ষণে ক্ষণে লকডাউন ঘোষণা করে ও কোভিড মোকাবিলায় থালা-বাসন বাজিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনহানি ঘটিয়ে আজ খাদের কিনারে এনে দেশকে তারা দাঁড় করিয়েছে। বার বার মানুষ প্রশ্ন করছেন, আমরা কি শ্রীলঙ্কার মতো এক জাতীয় বিস্ফোরণের মুখে এসে দাঁড়িয়েছি?
এই দুর্দমনীয় সংকটের আভাস শাসকেরাও পেয়েছে। তাই, আবারও শুরু হয়েছে তাদের মায়ামোহের জাল বিছানো। তারা উন্মাদের মতো, তাজমহল, কুতুব মিনার, জ্ঞানবাপী এবং যেখানে যত ইসলামিক স্থাপত্য আছে সেগুলির উচ্ছেদ অথবা নতুন নামকরণের দাবি তুলে হিন্দুয়ানা আরোপের এক বিস্তৃত রাজনীতির সূচনা করতে চাইছে। এর উদ্দেশ্য আর কিছুই নয়, অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত দেশের মানুষকে যদি আবারও বিদ্বেষ ও হানাহানির পরিসরে ঠেলে দেওয়া যায়, তাহলে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের সমস্যা-উদ্ভুত সম্মিলিত ক্ষোভকে ধর্মে-ধর্মে বিভাজিত করে নিজেদের শাসন ক্ষমতাকে জিইয়ে রাখতে তারা আবারও সক্ষম হতে পারে। তাদের রাজনীতির ভিত্তিভূমিও তাই।
এটা বাস্তব যে, রুশ-ইউক্রন যুদ্ধের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে এবং প্রায় সর্বত্র মুদ্রাস্ফীতি ব্যাপকতর হয়েছে। কিন্তু এই যুদ্ধ পরিস্থিতিতেও রাশিয়ার সঙ্গে ভারত এক বোঝাপড়ার সম্পর্ক বজায় রাখার ফলে সেখান থেকে আমদানিকৃত অপরিশোধিত তেল কিন্তু অনেক সস্তায় আনতে পারছে। তাহলে তার প্রতিফলন জ্বালানির মূল্যে মিলছেনা কেন? আজকের আধুনিক রাষ্ট্রে এটাই কি কাম্য ছিলনা যে, দেশের শাসক আপামর জনসাধারণ, বিশেষত গরিব ও অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল জনসমাজকে সামাজিক সুরক্ষার রক্ষাকবচ দিয়ে তাদের সক্ষমতাকে অটুট রাখবে। কিন্তু আমাদের দেশের কেন্দ্রীয় সরকার একেবারে উল্টো পথে হেঁটে চলেছে। তারা এই আন্তর্জাতিক সংকটকে বরং হাতিয়ার করে জনতাকে আরও দুর্ভোগে ফেলতে প্রয়াসী হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, নির্বাচনের সময়ে (যেমন সম্প্রতি পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন) তারা জ্বালানির মূল্য সহ অন্যান্য বহু কিছুকে ঠেকা দিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আবারও পুরনো রূপে ফিরে এসেছে। তাদের অর্থনৈতিক নিদানটাই হল, জোগানের দিকটায় সুবিধা প্রদান করা। যেমন, তারা নানা ধরনের ঋণ প্রকল্প ঘোষণা করছে, বড় বড় পরিকাঠামো নির্মাণে প্রভূত ব্যয় করছে কিন্তু চাহিদার দিকটি, অর্থাৎ, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর কার্যক্রমটিকে চূড়ান্তভাবে অবহেলা করে চলেছে। কোভিডের সময়ে তারা বিনামুল্যে রেশন দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল বটে — শুধুমাত্র সেইটুকুতে জরুরি কিছু সমস্যার খানিক সমাধানও হতে পারে — কিন্তু তা কখনই পিছিয়ে পড়া মানুষদের দীর্ঘস্থায়ী সক্ষমতা বাড়াতে পারেনা। আর ঠিক সেই কারণেই দেশের মানুষ আজ এক নিদারুণ সংকটের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। উপরন্তু, যে মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগের প্রলোভন দেখিয়ে সরকার ও ব্যাঙ্ক’এর তরফে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষজনদের প্ররোচিত করা হচ্ছিল, এখন শেয়ার বাজারে ধস নামার ফলে সে বিনিয়োগও বিফলে গিয়েছে। তবুও রক্ষে, বেশ কিছু রাজ্যের আঞ্চলিক দলগুলির সরকার নিজ নিজ রাজ্যে নানাবিধ জনকল্যাণমূলক কার্যক্রম নেওয়ার ফলে এই সংকট এখনও তীব্র বিস্ফোরণের আকার নেয়নি।
অথচ গত এপ্রিল মাসে রেকর্ড পরিমাণ জিএসটি আদায় হয়েছে (১.৬৮ লক্ষ কোটি টাকা)। রফতানিও এই সময়ে যথেষ্ট বেড়েছে। সে ক্ষেত্রে সরকারের তো উচিত ছিল, সংকটের সময় কোষাগারের সোয়াস্তিকে সাধারণ মানুষের আস্থার জায়গা করে তোলা। অর্থাৎ, জ্বালানিতে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়ানো, উচ্চহারের কর ছাঁটাই করা। কিন্তু বুঝতে হবে, এই সরকারের উদ্দেশ্যটাই ভীষণ রকম ভাবে কর্পোরেট ও বৃহৎ পুঁজিমুখি। কোষাগারের বাড়তি অর্থ দিয়ে তারা কর্পোরেট স্বার্থে বড় বড় পরিকাঠামো গড়ে তুলবে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কোটি কোটি টাকা আয়ে ব্যবসারত ‘কাশ্মীরি ফাইলস’ ছবিটিকে করমুক্ত করবে, যা কিছু সরকারি সম্পত্তি ও সম্পদ সেগুলিকে ‘অ্যাসেট মনেটাইজেশন’এর নামে কর্পোরেটপতিদের হাতে তুলে দেবে, বিনিময়ে কোটি কোটি টাকার নামবিহীন ‘ইলেক্টরাল বন্ড’এ শাসক দলের কোষাগার ফুলে-ফেঁপে উঠবে যাতে অন্য কোনও দল ধারেভারে তাদের টক্কর না দিতে পারে; জনকল্যাণের অর্থে তারা বোঝাবে ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান করা — এইভাবে এক অলীক অর্থনৈতিক কুযাত্রায় সওয়ার হয়ে তারা দারিদ্রকে আরও সম্প্রসারিত করে চলেছে মাত্র। অথচ, বড় বড় কোম্পানির মুনাফা বৃদ্ধিতে কোনও ছেদ নেই, ব্যাঙ্কগুলিও ভালই লাভালাভের মুখ দেখছে। কিন্তু কীসের বিনিময়ে? দেশের আপামর জনসাধারণের কর্মচ্যুতি ও গড় আয় কমার বিনিময়ে। এ এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। গত ৮ মে অবধি দেশে বেকারত্বের হার ছিল ৮ শতাংশের ওপরে। যদিও এই হার কখনও কখনও কিছুটা কমে আসে বা তার সঠিক মূল্যায়ন করা যায়না, কারণ, বর্তমানের গিগ অর্থনীতির জমানায় কর্মসংস্থান ও কর্মচ্যুতির মধ্যে এক অবিশ্বাস্য ওঠানামা থাকে। এখানে কারও কাজ স্থায়ী নয়, আবার দীর্ঘ সময় ধরে বহুজনে বেকারও বসে থাকেনা। দেখতে হবে, একটা সময় ধরে (অন্তত টানা দুই কি তিন বছর) আয়ের গড়পড়তা হিসেবটা কোথায় দাঁড়াচ্ছে। এই তথ্যানুসন্ধান থেকেই সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের স্পষ্ট ছবিটি প্রতীয়মান হবে। কিন্তু এমনতর তথ্য সংগ্রহ কেউ করেছেন বলে তেমন ভাবে জানা নেই।
ইতিমধ্যে ব্যাঙ্কের দেয় ঋণে সুদের হার বাড়ায় তা সার্বিক ভাবে বিনিয়োগের ওপর আঘাত হানবে। কর্মসংস্থানে আরও ভাটা আসবে। বাজারে টাকার জোগান কমবে — যদিও এরফলে মুদ্রাস্ফীতি মোটেই হ্রাস পাবে না, কারণ, এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির মুখ্য কারণ জ্বালানির মূল্যের ঊর্ধ্বগতি যার রাশ সম্পূর্ণত সরকারের হাতে। বহু ঢাকঢোল পিটিয়ে ‘উজালা’ স্কিমে এলপিজি সংযোগ আজ করুণ ও হাস্যকর জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। আমরা জানি, এই স্কিমে বিনা পয়সায় এলপিজি’র সংযোগ পাওয়া গেলেও প্রতি মাসে ১০২৯ টাকা দিয়ে সিলিন্ডার কেনার সামর্থ্য প্রায় কারওরই নেই। তার ওপর কেরোসিনও অগ্নিমূল্য। ফলে, সেই পুরনো ঘুঁটে-কয়লা-কাঠের ব্যবস্থাতেই ফিরে যাচ্ছেন আপামর গরিব ও নিম্নবিত্ত জনসাধারণ।
প্রশ্ন হল, এই পরিস্থিতি থেকে নিস্তার পাওয়া যাবে কীভাবে? আমরা ক্রমেই এক অতল খাদের অতি কিনারে এসে দাঁড়িয়েছি।
- অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
পিপলস কমিশন অন পাবলিক সেক্টর অ্যান্ড পাবলিক সার্ভিসেস (পিসিপিএসপিএস) নরেন্দ্র মোদী সরকারকে ৪ মে ২০২২ ‘কলঙ্কজনক’ লাইফ ইন্স্যুরেন্স অফ কর্পোরেশন (এলআইসি) প্রাথমিক পাবলিক অফার (আইপিও) বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে বলেছে, এরফলে “লোকসান হবে ৫০,০০০ কোটি টাকারও বেশি”।
কমিশন, যারমধ্যে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, আইনবিদ, প্রশাসক, ট্রেড ইউনিয়নিস্ট এবং সামাজিক কর্মী অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন, এই বিষয়গুলি নিয়ে নীতি-নির্ধারণের প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে এবং যারা সরকারী অর্থায়ন, বিনিয়োগ এবং বেসরকারিকরণের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে, তাদের সাথে আলোচনা করেই এই সিদ্ধান্তে এসেছে।
প্রকাশিত একটি প্রেস বিবৃতিতে পিসিপিএসপিএস — যারমধ্যে আছেন কেরেলার প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী টমাস আইজ্যাক, বিদ্যুৎ ও অর্থনৈতিক বিষয়ক মন্ত্রকের প্রাক্তন সচিব ইএএস সরমা এবং পূর্ববর্তী পরিকল্পনা কমিশনের প্রাক্তন সদস্য এসপি শুক্লা — অভিযোগ করেছে যে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রক, “গভীর ডিসকাউন্ট’এ শেয়ার অফার করে বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগকারীদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করছে। এটি একটি কেলেঙ্কারি থেকে কম কিছু নয়। সম্ভবত, ভারতে বেসরকারীকরণের ইতিহাসে এটি সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি।”
পিসিপিএসপিএস বলেছে, “আইপিও শুধুমাত্র রাজকোষের হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি করবেনা, এটি এলআইসি’র লক্ষ লক্ষ পলিসি হোল্ডারদের অর্থ বেদখল করবে, যারা এই অনন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে”।
বিনিয়োগকারীদের জন্য ‘গভীর ছাড়’ দেওয়ার কারণে সরকার কীভাবে ২৬,১৮৯ কোটি টাকা হারাবে তা ব্যাখ্যা করে কমিশন বলেছে যে, ড্রাফ্ট রেড হেরিং প্রসপেক্টাস (DRHP) ফেব্রুয়ারিতে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অফ ইন্ডিয়া (SEBI)-এর কাছে এলআইসি’র এমবেডেড ভ্যালু (ইভি) ৫.৪০ লক্ষ কোটি টাকা দাখিল করেছে। এটি বোঝায় যে, ৬৩২.৫ কোটি শেয়ারের প্রতিটির মূল্য হবে কমপক্ষে ৮৫৩ টাকা।
পিসিপিএসপিএস’র মতে, যেহেতু “একটি জীবনবীমা কোম্পানির প্রকৃত মূল্য অনুমান করার ক্ষেত্রে ইভি’র মূল্য সীমিত, এবং শিল্পে এলআইসি অনেক ছোট প্রাইভেট পিয়ারদের অনুশীলনের সাথে সঙ্গতি রাখে, এটি প্রত্যাশিত ছিল যে অন্তত, এই প্রাইভেট পিয়ারদের দ্বারা ব্যবহৃত গুণিতক ফ্যাক্টর এলআইসি ইস্যুতে মূল্য নির্ধারণে গৃহীত হবে”।
পিসিপিএসপিএস জানিয়েছে, দু’মাস আগে শেয়ারের মূল্য নির্ধারণে ২.৫ অথবা ৪.০ এরমধ্যে একটি গুণিতক ফ্যাক্টর ব্যবহার করা হবে বলে আশা করা হয়েছিল। ২৬ এপ্রিল ২০২২ এলআইসি দ্বারা দায়ের করা ডিআরএইচপি উল্লেখ করেছে যে, ইস্যুটির দাম হবে শেয়ার প্রতি ৯০৪ থেকে ৯৪৯ টাকা। এটি বোঝায় যে গুণিতক ফ্যাক্টরটি মাত্র ১.১১, যা ন্যায়সঙ্গত তার চেয়ে অনেক কম।
খুচরা বিনিয়োগকারী, কর্মচারী এবং পলিসি হোল্ডারদের ডিসকাউন্টে শেয়ার অফার করা হচ্ছে। খুচরা বিনিয়োগকারী এবং কর্মচারীদের শেয়ার প্রতি ৯০৪ টাকা এবং পলিসি হোল্ডারদের শেয়ার প্রতি ৮৮৯ টাকা দিতে হবে, যা থেকে সরকারি কোষাগারের একটি বিশাল ক্ষতি হবে।
কমিশন দাবি করেছে যে যদি ২.৫’র একটি গুণিতক ফ্যাক্টর ব্যবহার করা হয়, তাহলে ইস্যু মূল্য হত ২,১৩২ টাকা প্রতি শেয়ার। এই ছাড়ের ফলে, ৩.৫ শতাংশ শেয়ার বিক্রির করে সরকার ২৬,১৮৯ কোটি টাকা লোকসান করছে।
যেহেতু এলআইসি তার যেকোনো প্রাইভেট পিয়ারের চেয়ে অনেক বড়, তাই ২.৫’র বেশি একটি গুণিতক ফ্যাক্টর ন্যায়সঙ্গত, যা ৫৩,৭৯৫ কোটি টাকার ব্যাপক লোকসান করছে, পিসিপিএসপিএস দাবি করেছে।
- নিউজ ক্লিক, ২ মে ২০২২
খরচের বকেয়া টাকা মিলছেনা। ফলে, তালিকা মিলিয়ে ডিম, আনাজ কিনতে পারছে না রাজ্যের বেশ কিছু জেলার অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলি। জ্বালানি কিনতেও খুবই সমস্যা হচ্ছে। অগত্যা অনেক কেন্দ্র বন্ধ রাখা হয়েছে। ফলে, পুষ্টিকর খাবার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিশু, অন্তঃসত্ত্বা ও প্রসূতিরা।
করোনাকালে দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল রাজ্যের সব অঙ্গনওয়াড়ি। চাল-ডাল দেওয়া হলেও কোপ পড়ছিল রান্না করা খাবারে পুষ্টিতে। এবারও সেই পুষ্টিই বাদ পড়ছে বহু জেলার অঙ্গনওয়াড়িতে। জলপাইগুড়ির ৩,৯৩৬টি অঙ্গনওয়াড়ির মধ্যে গতমাসের খাবারের খরচের বিল না মেলায় বন্ধ বা অনিয়মিত হয়ে পড়েছে অন্তত ৭০টি কেন্দ্র। উত্তর দিনাজপুরের ৩,৭৮৭টি অঙ্গনওয়াড়ির মধ্যে প্রায় ৯০টি গত শনিবার থেকে বন্ধ। গত দু’মাসের বরাদ্দ পাননি পূর্ব বর্ধমানের অঙ্গনওয়াড়ির কর্মীরাও। জামালপুর ব্লকের ৫৩৪টি অঙ্গনওয়াড়ি তাই শনিবার খাবার দেওয়া বন্ধ রাখে। কেন্দ্রগুলির দরজায় কাগজে সাঁটানো ছিল — “গত দু’মাস ধরে নিজেদের পয়সায় সেন্টার চালানোর পরেও আনাজ, জ্বালানি ও ডিমের টাকা না পাওয়ায় বিডিও, সিডিপিও’কে জানিয়ে সারা জামালপুর ব্লকে রান্না বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল”। দফতর সূত্রে খবর, শুধু জামালপুর ব্লকেই গত দু’মাসে ৪২ লক্ষ টাকা বকেয়া রয়েছে।
মুর্শিদাবাদেও এক একটি অঙ্গনওয়াড়ির ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা বকেয়া। ধার করে বা নিজেদের টাকায় আনাজ, ডিম ও জ্বালানি কেনা আর সম্ভব হচ্ছে না। কর্মীরা জানাচ্ছেন, শিশুদের ডিম ও আনাজের জন্য মাথাপিছু দিনে তাঁরা হাতে পান ৫.৩৬ টাকা। গর্ভবতী ও প্রসূতিদের জন্য মেলে ৬.৩৫ টাকা। খিচুড়ির দিন শিশুদের জন্যে ৬.২০ টাকা আর মায়েদের জন্য ৭.৪১ টাকা পাওয়া যায়। এর বাইরে, জ্বালানি ও মশলা কেনার জন্য গড়ে ২১ টাকা পাওয়া যায়। নির্দেশ মতো সোম, বুধ ও শুক্রবার ভাত, আলু-ডিমের ঝোল, মঙ্গল-বৃহস্পতি, শনিবার দেওয়া হয় ডিমসেদ্ধ, খিচুড়ি, সয়াবিন ও আনাজ। ডিম, আনাজ, সয়াবিন বাজার থেকে কিনতে হয়। তার উপর বকেয়া টাকা মিলছে না। তাতেই সঙ্কট বেড়েছে।
- আনন্দবাজার পত্রিকা, ৯ মে ২০২২
অদ্ভুত শোনাচ্ছে? পরিবার ও সমাজ অহরহ বলে থাকে ‘মা হওয়া কী মুখের কথা!’ মাকে সন্তানের জন্য অনেক কিছু ত্যাগ করতে হয়। কিন্তু সাজা?
সম্প্রতি প্রকাশিত ১৮৯টি দেশের থেকে সংগৃহীত তথ্যের বিশ্লেষণ জানাচ্ছে অতিমারীর মধ্যে গোটা পৃথিবী জুড়ে লক্ষ লক্ষ মহিলা ‘মাতৃত্বের সাজার’ মুখোমুখি হয়েছেন! অর্থাৎ কাজ হারিয়েছেন! অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন খুইয়েছেন — স্রেফ শিশু সন্তানের ‘মা’ হওয়ার জন্য! কখনও কর্তৃপক্ষই তাকে কাজের অনুপযোগী মনে করে ছাঁটাই করেছে, কখনও পারিবারিক কাজের চাপে ‘মা’ নিজেই কাজ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। পুরুষের তুলনায় মহিলাদের এই পারিবারিক দায়বদ্ধতার চাপ বরাবরই অনেকটা বেশি ছিল, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে। কিন্তু অতিমারীর করাল গ্রাসে সেই বাধ্যবাধকতা আরও অনেক প্রকট হয়ে উঠল।
‘ইউএন উইমেন’ এবং ‘আইএলও’ এক যৌথ সমীক্ষা চালায় ২৫ থেকে ৫৪ বছর বয়সী বাবা-মাকে নিয়ে যাদের অনূর্ধ ৬ বছরের অন্তত একটি সন্তান আছে এবং যাদের শ্রমের বাজারে সক্রিয় অংশগ্রহণ আছে। একা মা বা একা বাবারাও আছেন এই সমীক্ষায় সমান গুরুত্ব নিয়ে।
অতিমারীর আগেও ২৫ থেকে ৫৪ বছর বয়সী অনূর্ধ ৬ বছরের এক সন্তানের মায়েদের শ্রমের বাজারে অংশগ্রহণ ছিল ৫৫ শতাংশ যা মহিলাদের সামগ্রিক অংশগ্রহণের (৬২ শতাংশ) থেকে কম এবং বাবাদের অংশগ্রহণ (৯৭.১ শতাংশ) থেকে অনেকটাই কম।
উপরের তথ্যগুলি, শ্রমের বাজারে নারী ও পুরুষের অসম অংশগ্রহণের জন্য শিশু পরিচর্যা ও গার্হস্থ্য দায় দায়িত্বের অসম বিভাজন দায়ী তা নিশ্চিত করে। এই অসম অংশগ্রহণ অন্যান্য ক্ষেত্র, যেমন সামাজিক সুরক্ষা ও সম বেতন, মজুরি বৃদ্ধি এবং ম্যানেজমেন্ট ও নেতৃত্বকারী অবস্থানে যাওয়ার আশু ও দীর্ঘ মেয়াদি সুযোগ, হিংসা ও হেনস্থার সহজ শিকার হওয়া — এসব প্রশ্নে প্রভাব ফেলে, বলাই বাহুল্য।
২০২০তে বাইরের এবং ঘরের কাজ দক্ষ হাতে সামলানোর চাপের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল স্কুল বন্ধ থাকা এবং মহিলা-প্রধান কাজের ক্ষেত্রগুলিতে ব্যাপক কর্মচ্যুতি। ফলে তখন শ্রম বাজারে আরও কম মহিলা অংশ নিতে পেরেছেন। ২০২০তে ২৫ থেকে ৫৪ বছর বয়সী যেসব নারীর জীবনসঙ্গী ও শিশুসন্তান আছে তাদের মধ্যে ১,১৩০ লক্ষ শ্রমবাজার থেকে ছিটকে গিয়েছিলেন। সংখ্যাটা সত্যিই বিস্মিত করে, কারণ ঐ সময়ে তাদের পুরুষ সঙ্গীদের কাজ হারানোর সংখ্যা ছিল ১৩০ লক্ষ (কোভিড১৯ পূর্ব সময়ে যা ছিল ৮০ লক্ষ)।
কোভিড১৯ পূর্ববর্তী সময়ে সঙ্গী ও শিশুসন্তানসহ মহিলাদের শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ ধীর কিন্তু স্থির গতিতে বাড়ছিল। সেই গতি নাটকীয়ভাবে বিপরীতমুখী হল অতিমারীতে।
অতিমারিতে অর্থনীতির পতনে পুরুষরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, কিন্তু মহিলাদের ক্ষেত্রে আপেক্ষিক পতন আরও বেশি ছিল। শিশুসন্তানের মায়েরা যারা শ্রমশক্তিতে ছিলেন তাদের অংশগ্রহণ ২০১৯’র তুলনায় ২০২০তে ১.৮ শতাংশ কমেছে যা বাবাদের কর্মচ্যুতির হারের (১ শতাংশ) প্রায় দ্বিগুণ।
বিশেষ করে লাতিন আমেরিকায় ও ক্যারিবিয়ান’এ মহিলাদের অংশগ্রহণের হার ২০১৯এ ৫৬ শতাংশ থেকে কমে ২০২০তে দাঁড়ায় ৫১.৫ শতাংশ (অর্থাৎ হ্রাসের হার ৪.৯ শতাংশ অথচ পুরুষদের ক্ষেত্রে হ্রাসের হার ছিল ২.৭ শতাংশ)।
অবশ্য বিভিন্ন অঞ্চলে জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি, কাজের ব্যবস্থায় নমনীয়তা, অন্যান্য সুযোগ সুবিধা যেমন ছুটির সুলভতা ইত্যাদির উপর শ্রমবাজার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার হার খানিকটা নির্ভর করে এবং অঞ্চলভেদে সেই হার বিভিন্ন হতে পারে। পারিবারিক পরিচর্যার চাপে অনেকে শ্রমশক্তি থেকে নিজেকে পুরোপুরি বা আংশিকভাবে সরিয়ে নিতে বাধ্য হন। মহিলাদের স্বল্পকালীন ও দীর্ঘকালীন আয় নিরাপত্তার উপর শ্রমবাজার থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার প্রভাব আগামী দিনে বোঝা যাবে। সামগ্রিকভাবে মহিলাদের ও তাদের কাজের জগতের উপর অতিমারির এই প্রভাবের ভীষণতা ধরা পড়বে বেশ কয়েক বছর পরে।
ভারতে কর্মরত মহিলাদের উপর অতিমারির ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। কারণ মহিলা শ্রমশক্তির বেশিরভাগটাই অসংগঠিত ক্ষেত্রে — কৃষি, ছোট কারখানায়, কুটির শিল্পে, গৃহপরিচারিকার কাজ ইত্যাদিতে নিযুক্ত।
ভারতে অতিমারীর আগে থেকেই শ্রমবাজারে মহিলাদের অংশগ্রহণ কমছিল। বিশ্বব্যাঙ্কের তথ্য অনুযায়ী শ্রমবাজারে মহিলাদের অংশগ্রহণের হার ২০০৫এ ২৬ শতাংশ থেকে কমতে কমতে ২০১৯এ পৌঁছায় ২০.৩ শতাংশে।
২০২০তে কড়া লকডাউনের সময়ে এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকে এই হার ছিল ১৫.৫ শতাংশ, জুলাই-সেপ্টেম্বর ত্রৈমাসিকে ১৬.১ শতাংশ; এই সময়ে মহিলাদের বেকারত্বের হার ছিল ১৫.৮ শতাংশ, পুরুষদের ১২.৬ শতাংশ।
সিএমআইই’র সমীক্ষায় অতি সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে বিগত পাঁচ বছরে প্রায় এক কোটি পঁচিশ লক্ষ ভারতীয় মহিলা কাজ হারিয়েছেন। এই বিপুল কর্মচ্যুতির অন্যতম কারণ পারিবারিক পরিচর্যা ও গৃহস্থালির দায়িত্ব সামলানোর অনিবার্যতা। শিশু সন্তানের পরিচর্যার দায় মূলত মায়ের। কর্মস্থলে নিরাপত্তা ও স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব, সমকাজে পুরুষের তুলনায় কম মজুরি, সমাজের মান্ধাতা আমলের পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি (‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’ ইত্যাদি), শিক্ষা-স্বাস্থ্য-পুষ্টি-কাজের সুযোগ ইত্যাদির মতো প্রযুক্তি শিক্ষা ও ইন্টারনেট পরিষেবার সুলভতার প্রশ্নেও বৈষম্য এমনিতেই নারীর কাজে ঢোকা এবং টিঁকে থাকার ক্ষেত্রে এক বড় অন্তরায়। শিশু সন্তানের মায়ের ক্ষেত্রে সমস্যাটা আরও তীব্র ও জটিল।
২০২২এ এসেও পরিস্থিতিটা একই রকম। মহিলারা সেই একই চাপে আছেন। করোনা-ভাইরাসের নিত্যনতুন প্রজাতির সংক্রমণের ভয়ে স্কুল এবং আনুষঙ্গিক পরিচর্যা, পুষ্টি ও স্বাস্থ্য পরিষেবা অনেক সময়েই ঘন ঘন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বা অমিল হয়ে যাচ্ছে। ফলে মহিলারা সেই একইভাবে পিষ্ট হচ্ছেন। আর এই পেষণ তাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে বিপর্যস্ত করে তুলছে। ইউএন উইমেন’এর রাপিড জেন্ডার অ্যাসেসমেন্ট শীর্ষক সমীক্ষায় ধরা পড়েছে — সমীক্ষাভুক্ত ৩৩টি দেশের মধ্যে ২২টি দেশেই পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের মানসিক স্বাস্থ্য ও অনুভূতির জগতে বিপর্যয়ের সম্ভাবনা অনেক বেড়ে গেছে। আর যে মহিলারা বিনা পারিশ্রমিকে পরিচর্যা ও গৃহস্থালির দায়িত্ব সামলাতে বাধ্য হচ্ছেন তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিপর্যয় ঘটছে, যে মহিলাদের তা করতে হচ্ছে না তার তুলনায় ১.৬ গুণ বেশি।
তাহলে? হাতের কাজ কেড়ে নিয়ে, কিংবা কাজের অঙ্গন ছাড়তে বাধ্য করে, শুধু শিশু সন্তানের মা হওয়ার কারণে আর্থিক স্বাবলম্বন কেড়ে নিয়ে ‘নারী-স্বাধীনতা’র কথা আওড়ানো ‘পাগলের প্রলাপ’ মাত্র নয়, ঘোর অন্যায়।
নারীকে তার কাজের জগতে ফিরিয়ে এনে তার শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য সরকারকে এক সার্বিক পরিকল্পনা নিতে হবে।
চাই উৎকৃষ্টমানের কিন্তু সুলভ শিশুপালন, শিক্ষা ও মিড-ডে-মিল পরিষেবা, চাই পর্যাপ্ত সংখ্যক সচেতন ছুটি। চাই সুষ্ঠু কাজের পরিবেশ যেখানে হিংসা, নারীবিদ্বেষ ও হেনস্থার শিকার হতে হবে না। চাই লিঙ্গ বৈষম্য মুক্ত সমাজ-দৃষ্টিভঙ্গি। মহিলাদের কাজে ঢোকা, টিঁকে থাকা এবং শ্রমশক্তি হিসেবে শক্তিশালী হয়ে ওঠার পথে সমস্ত আইনি অবরোধকে সরাতে হবে। মহিলাদের পরিচালনা ও নেতৃত্বকারী অবস্থানে নিয়ে আসতে হবে। সকলের জন্য সম্মানজনক কাজের দাবিতে শ্রম আইন লাগু করতে হবে।
কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখছি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রায় প্রতিটি পদক্ষেপ নারীবিদ্বেষপূর্ণ। রাজ্য সরকার নারীর ক্ষমতায়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বললেও দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা, অপশাসনে সেসব সদিচ্ছার সমাধি ঘটেছে। তাই মহিলাদের প্রতিটি পদক্ষেপে লড়াই করে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে নিজের অধিকার।
(সূত্র: ওভার টু মিলিয়ন মমস্ লেফ্ট দ্য লেবার ফোর্স ইন ২০২০, অ্যাকর্ডিং টু নিউ গ্লোবাল এস্টিমেটস্)
ঘুরে এলাম নিয়ামগিরি থেকে। দেখে এলাম নিয়ামগিরির পালিত পুত্রদের। দেখলাম বেদান্ত খনি কোম্পানিকে উৎখাত করতে চাওয়া নিয়ামগিরি কিভাবে পরম মমতায় বুকে টেনে নিয়েছে বাংলার অবহেলিত, অনাদৃত, দুই সন্তানকে। তাঁদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে খাদ্য স্বাধীনতার লড়াই গড়ে তুলেছে নিয়ামগিরির অন্য সন্তানেরাও।
ছোটখাটো এক দেশীয় ধানের চাষি হিসেবে বসুধা খামারে হাজির হয়েছিলাম দেশীয় প্রজাতির ধান সংরক্ষণের প্রাণপুরুষ দেবল দেব মহাশয়ের কাছে। আমার হাতে থাকা দুই প্রকার দেশী ধান প্রজাতি কলমকাঠি ও দেরাদুন গন্ধেশ্বরীর বিশুদ্ধতা নিয়ে সংশয় তৈরি হওয়ায় এই যাত্রা। আগামী বছরগুলোতে গাঁওতা খামারকে ক্রমে ক্রমে মানভূম অঞ্চলের পুরোনো ধানগুলোর একটা সংরক্ষণ ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য রসদ সংগ্রহও এই যাত্রার আর এক উদ্দেশ্য ছিল। জানা গেল কিভাবে পদে পদে অসহযোগিতায় নিজের কর্মক্ষেত্র উড়িষ্যার রায়গড়ায় স্থানান্তরিত করতে হয়েছে। জানলাম আদিবাসীদের জাহের থানের বহু বছরের পুরনো অনেক গাছ ফরেষ্ট ডিপার্টমেন্ট কেটে নেওয়ার বিরোধিতা করায় ঐ ডিপার্টমেন্ট তাঁকে ও দেবদুলালবাবুকে কাঠ চুরির কেসে ফাঁসিয়েছে। ধান ও পরিবেশের বিষয়ে গবেষণায় আন্তর্জাতিক স্তরের একাধিক গবেষণা পত্র থাকা এক বৈজ্ঞানিক ও তাঁর সহকারীকে এখনও নিয়মিত কোর্টে হাজিরা দিতে হয়। তৎকালীন বাম সরকার বা অধুনা তৃণমূল সরকার কেউই কোনো উদ্যোগ নেয়নি এ বিষয়ে। মিডিয়াও কোনো ষ্টোরি করেনি। বাংলার প্রতি একরাশ অভিমান নিয়ে জানালেন বিগত এগারো বছরে বাংলা থেকে যাওয়া আমি দ্বিতীয় চাষি যে বসুধা থেকে ধান বীজ আনতে গেছে।
অথচ একই সময়কালে অন্যান্য রাজ্য থেকে বহু চাষি ওনার থেকে ধান বীজ নিয়ে গেছেন এবং দায়িত্বের সঙ্গে সংরক্ষণ করছেন।
দেখলাম দেবলবাবুর তিন মানুষের বাহিনী কি অক্লান্ত পরিশ্রম করে বীজতলা থেকে পেকে যাওয়া প্রতি ধাপে প্রতি প্রজাতির ধানের ছাপান্ন রকম বৈশিষ্ট্য নজরে রেখে প্রায় চোদ্দশো প্রজাতির ধান সংরক্ষণ করছেন। সংরক্ষণের ধান বীজ ব্যাঙ্কে বিনা পারিশ্রমিকে ই-সংরক্ষণ করছেন স্থানীয় গ্রামের মানুষজন। কৃষি দফতরের আধিকারিকদের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে আধুনিক ধান প্রজাতির থেকে দেশী প্রজাতি বহুরূপীর বেশি ফলন দেখিয়েছেন আর এক প্রতিবেশি গ্রামের চাষি। দেবলবাবুর সাহচর্যে মিলেট সংরক্ষণের এক ক্ষেত্র গড়ে তুলেছেন আরো এক প্রতিবেশি।
সরকারি বেসরকারি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সাহায্য না নেওয়া, বসুধা পরিবারের সংসার চলে কৃচ্ছসাধন করেই। প্রায় দু’বিঘা জমির এই খামারের বেশিরভাগই আমন, আউস আর বোরো ধানের সংরক্ষণের কাজে ব্যবহার হয়। বাকি অংশে থাকার জন্য কাঁচা ইটের কুঁড়েঘর। কিচেন গার্ডেন, বড় গাছপালা, বুনোগাছ এইসব। নিয়ামগিরির আশীর্বাদে চব্বিশ ঘণ্টা ঝর্ণার জল পাইপ দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বণ্টনের ব্যবস্থা আছে। আলো জ্বলে সোলার সিস্টেমে। জিরো কার্বন ফুটপ্রিন্ট যাপনে বদ্ধপরিকর দেবলবাবুর পরিকল্পিত ড্রাই টয়লেট ব্যবহারের সুযোগ পাওয়া গেল।
কৃচ্ছসাধনে চলা এই প্রতিষ্ঠানের আন্তরিকতা বহুদিন মনে থাকবে।
সন্ধ্যায় ছ’রকমের দেশী ধানের বীজ আনা হল বীজ ব্যাঙ্ক থেকে। দেবলবাবু বার বার শপথ করালেন আগামী পঞ্চাশ বছর এই প্রজাতিগুলো বিশুদ্ধভাবে সংরক্ষণ করার দায়িত্ব নিতে। আমার মতো নভিসের দূর্বলতাকে মাথায় রেখে ছাপান্ন রকমের বদলে সাত আট রকমের বৈশিষ্ট্য নজরে রাখতে বললেন।
এ বিষয়ে সচিত্র ক্লাসও নিলেন। হাতে কলমে দু’একটা বৈশিষ্ট্য দেখালেন।
এই কটা ব্যাপারও আমার মতো অমনোযোগী ছাত্রের মাথায় তালগোল পাকিয়ে গেল। দেবদুলালবাবুকে সে কথা জানাতে তিনি বরাভয় দিলেন। জানালেন ফোন করে এবং সশরীরে আমাদের গাঁওতা খামারে এসে সমস্যা মেটাবেন।
আলাপ হলো গোলাপদির সঙ্গে। পেশায় শিক্ষিকা এই দিদি আগামীতে বসুধাতেই ডেরা গাড়বেন ঠিক করেছেন। আলাপ হলো দেবদুলালবাবুর পুত্র ও তার বন্ধুর সঙ্গে। এরা তথ্য প্রযুক্তির চাকচিক্যের যাপন ত্যাগ করে বসুধার আগামী দিনের সৈনিক হিসেবে গড়ে উঠছে।
পরদিন দুপুরে বেরিয়ে আসার সময় বসুধার ফাণ্ডে কিছু অর্থ দিতে গেলে দেবলবাবুর ভ্রু কুঁচকে গেল। জানতে চাইলেন ধানের দাম দিচ্ছি কিনা? বীজ বিনিময় যোগ্য, বিক্রয়যোগ্য নয়। এই আদর্শে ওনারা বিশ্বাসী। ওনার কাছে বীজ নিয়ে কেউ কেউ বীজের ব্যবসা করছেন বলে অভিযোগ করলেন। এখান থেকে বীজ পাওয়ার নিয়ম হল কোনো দেশী ধানের বীজ এক কেজি জমা দিয়ে আকাঙ্খিত বীজ নেওয়া যাবে। দেশী ধানের বীজ না থাকলে পরের বছর চাষ করে বীজ ফেরত দিতে হবে। দূরত্বের সমস্যা হলে যে যার নিজের এলাকার কোনো আগ্রহী চাষিকে ঐ বীজ দেবেন।
তিনজনের শক্তিতে কোনো রকমে ধান বীজ সংরক্ষণের কাজ চালিয়ে গেলেও পরিবেশ বান্ধব যাপনের অনেক দরকারি গবেষণার কাজ স্থগিত হয়ে আছে জানা গেল। মূলত অর্থবলের অভাবে। প্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক সহায়তা না নিলেও ব্যক্তিগত আর্থিক সহায়তা ওখানে নেওয়া হয়। তারজন্য ব্রীহির ওয়েবসাইটে গিয়ে, কিভাবে অর্থ সাহায্য করা যায় দেখে নিতে পারেন। বিনোদন ভ্রমণে আগ্রহী মানুষজনকে ওনারা বসুধায় যেতে উৎসাহিত করেন না। কোন ধরণের মানুষজন ওখানে স্বাগত তা ওঁদের ওয়েবসাইটে দেওয়া আছে।
- (ফেসবুকে কুণাল কেশরীর দেওয়াল থেকে)
ঝাড়গ্রাম জেলার গোপীবল্লভপুর ব্লকের চুনঘাটি গ্রামের আদিবাসী কমরেড রামেশ্বর হেমব্রম গত ১৮ মে আকস্মিকভাবে সানস্ট্রোকে প্রয়াত হয়েছেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৫১ বছর। তিনি রেখে গেছেন চার ছেলে, তিন মেয়ে এবং তাঁর জীবনসঙ্গীকে। তিনি গরিব কৃষক পরিবারের সন্তান ছিলেন। ওঁর সমগ্র পরিবার নকশালবাড়ির রাজনীতির সাথে যুক্ত। দাদার হাত ধরে অনেক কম বয়সেই ১৯৮৫ সাল নাগাদ তাঁর এই বিপ্লবী রাজনীতিতে হাতেখড়ি। সেইসময় থেকেই আদিবাসী সহ গরিব মানুষদের সংগঠিত করার কাজ করে আসছিলেন। সিপিআই(এমএল) লিবারেশনে যুক্ত হওয়ার আসানসোল কনভেনশনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেইসময় যে সহযোদ্ধাদের সরাসরি পার্টি সদস্য পদ দেওয়া হয় কমরেড রামেশ্বর ছিলেন তাঁদের অন্যতম। ঝাড়গ্রাম জেলায় অত্যন্ত উৎসাহের সাথে অংশগ্রহণ করে লিডিং টিমের সদস্য মনোনীত হয়ে আরও একবার গোপীবল্লভপুরে নতুন করে আদিবাসী তথা কৃষক আন্দোলন সংগঠিত করার মুখেই প্রয়াত হলেন। তাঁর মৃত্যুতে ঝাড়গ্রাম জেলার সাথে সাথে গোটা রাজ্যের আদিবাসীদের অধিকার আন্দোলন তথা কৃষক আন্দোলনের বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল। ঝাড়গ্রাম জেলা তথা সমগ্র পাটি তাঁর পরিবারের গভীর শোকের সমান অংশীদার এবং সমবেদনা জানানোর সাথে সাথে আন্দোলন ও সংগঠনকে শক্তিশালী করে তোলার পথে অবিচল থাকার শপথ নিচ্ছে। কমরেড রামেশ্বর হেমব্রম লাল সেলাম।
রিষড়া জয়শ্রী কারখানার অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক ও ঐ কারখানার এআইসিসিটিইউ ইউনিয়নের প্রাক্তন সম্পাদক এবং সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের রিষড়া শাখার সদস্য গত ১৪ মে তাঁর বিহারের দেওঘরিয়া জেলার বাড়িতে প্রয়াত হন। তিনি রিষড়ার বাড়ি থেকে ৬ মাস আগে বিহারে গিয়েছিলেন। স্নায়ুর সমস্যা থাকায় পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পান। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। গ্রাম থেকে হাসপাতাল অনেকটা দূরে থাকায় যাবার পথেই তিনি প্রয়াত হন। মৃত্যুকালে তিনি তাঁর স্ত্রী ও সাবালিকা দুই কন্যাকে রেখে যান। কমরেড রামপীরিতজীর রিষড়ার বাড়িতে পার্টি ও ট্রেড ইউনিয়নের বহু বৈঠক হয়েছে।
বহু যুদ্ধের সৈনিক কমরেড রামপীরিত সিং লাল সেলাম।