“একুশের বিধানসভা নির্বাচনে আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল বিজেপি যেন আসাম, ত্রিপুরার পর পশ্চিমবঙ্গেও ক্ষমতায় আসতে না পারে। তাদের ক্ষমতা দখলের মরিয়া প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করতে আমরা বলেছিলাম “নো ভোট টু বিজেপি”, বিজেপি’কে একটিও ভোট নয়।
একুশের নির্বাচনে বাংলার মানুষ বিজেপি’র ক্ষমতা দখলের আগ্রাসী অভিযানকে ব্যর্থ করে দেয়। তৃতীয়বার ক্ষমতায় চলে আসে তৃণমূল কংগ্রেস। সরকারের তৃতীয় দফার প্রথম বছর অতিক্রান্ত। এই একবছরের অভিজ্ঞতা একুশের গণরায়ের ধারাবাহিক অপমানের অভিজ্ঞতা। এই অপশাসনের বিরুদ্ধে আমাদের আহ্বান “নো লাইসেন্স টু টিএমসি”, তৃণমূল সরকারকে একটুও ছাড় নয়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ও অধিকারের দাবিতে রাজ্যব্যাপী জনগণের সমস্ত আন্দোলনে আমরা জনগণের সঙ্গে আছি।
বিজেপি ক্ষমতা দখল করতে না পারলেও বিধানসভায় প্রধান বিরোধী দলের আসনে আজ বিজেপি। বিরোধী শক্তির এই স্বীকৃতিকে কাজে লাগিয়ে সংঘ বাহিনী এরাজ্যে তাদের সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী অভিযানকে তীব্র করে তুলতে সচেষ্ট। রাজ্যে বিরোধী রাজনীতির পরিসরে বিজেপি’কে দুর্বল করে বামপন্থীদের প্রধান শক্তি হিসেবে উঠে আসতে হবে। বালিগঞ্জ উপনির্বাচনের বিজেপি’কে তৃতীয় স্থানে ঠেলে দিয়ে বামপন্থী প্রার্থী দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছেন। এটাই যেন গোটা রাজ্যের ছবি হয়ে উঠতে পারে সেই চ্যালেঞ্জ বামপন্থীদের গ্রহণ করতে হবে।
বামপন্থী ঐক্য বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রূপে সামনে এসেছে। চৌত্রিশ বছর ক্ষমতায় থাকার সুবাদে বামফ্রন্টের পরিচিতি সরকার কেন্দ্রিক হয়ে পড়েছিল। আজ বিরোধী রাজনীতিতে ভিন্নতর বামপন্থী ঐক্য প্রয়োজন। বামফ্রন্টের অন্তর্ভুক্ত দল ও বামফ্রন্টের বাইরে থাকা বামপন্থী শক্তিকে ধারাবাহিকভাবে একযোগে আন্দোলন করতে হলে ঐক্যের আলাদা পরিবেশ ও কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। আমরা সেই লক্ষ্যে চেষ্টা চালাব। জাতীয় স্তরে পাঁচটি বামপন্থী দল ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচী নিয়ে চলেছে। রাজ্যেও বিভিন্ন প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ বামপন্থী উদ্যোগ ও আন্দোলন চাই।”
- দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, সাধারণ সম্পাদক, সিপিআই (এম-এল) লিবারেশন
সুপ্রীম কোর্ট অন্তর্বর্তী আদেশ দিয়েছে রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের ব্যবহার আপাতত বন্ধ রাখা হোক। কেন্দ্রের মোদী সরকার সময় চেয়েছে ‘আইনটির অপব্যবহার’ রোধে ‘পুনর্বিবেচনা’ করে দেখবে বলে। এখনই আশ্বস্ত হওয়ার কিছু নেই। কারণ মোদী জমানা ছল-বল-কৌশলে যেমন নৃশংস তেমনি ধুরন্ধর। কেন্দ্র কি করবে তা সময়ের ধারায় জানা যাবে। তবে, বোঝা যাচ্ছে চাপের মুখে পড়েছে। সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতির প্রশ্নবাণের মুখে কেন্দ্রের কৌসূলীর ঠ্যাটামী দাঁড়ায়নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের সংশ্লিষ্ট সচিবেরও প্রতিক্রিয়া ধরা পড়ে একইরকম। অনতিবিলম্বে অবস্থান বোঝা গেল কিঞ্চিৎ রক্ষণাত্মক। স্বাধীনতা আন্দোলনে হিন্দুত্ববাদীরা ছিল না, তবু ‘ছিল’ বলে ইতিহাসের বিকৃতকরণে উঠেপড়ে লেগেছে, স্বাধীনতার পঁচাত্তর উপলক্ষে ‘অমৃতউৎসবে’ মাতোয়ারা হতে হচ্ছে, এই অবস্থায় ঔপনিবেশিক আমলের নিপীড়ক আইন আজও কেন চলবে প্রশ্ন উঠছে। বল এখন মোদী সরকার আর বিজেপির কোর্টে।
দেড় শতাধিক বছরের একটা দমন আইন। চালু করেছিল ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী শাসকেরা। মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতা আন্দোলনকে গুঁড়িয়ে দিতে। ব্রিটেনেও এর প্রবর্তন করা হয়। তবে মূল নিশানায় ছিল উপনিবেশ ভারত। আইনের শাসনের নামে দমনরাজ চালানোর অপরাধ শুধু ব্রিটিশ শাসকরা করেনি। পরবর্তীতে স্বাধীন ভারতের সংবিধানে পরাধীন ভারতের রাষ্ট্রদ্রোহ আইনটি অক্ষত করে রাখা হয়। ঔপনিবেশিক আমলের আরও পাঁচ রকমের দমন আইনও বজায় রাখা হয়। ১২৪এ ধারাটি ইতিহাস বলছে, ষাটের দশকের গোড়ায় একবার মামলার গেড়োয় পড়লেও ছাড় পেয়ে যায়। চোখ বুজে থাকে আইনসভা-বিচারসভা। আমলাতন্ত্রও। সে ছিল কংগ্রেসের নেহরু-গুলজারিলাল আমল। তারপর আর এনিয়ে বিশেষ হৈচৈ হয়নি। গত শতকের ষাট-সত্তর দশক ছিল নিরন্তর আন্দোলনের ঝড়ের, তার মোকাবিলায় ইন্দিরা-সিদ্ধার্থ ঘরানার শাসকশ্রেণী নামিয়েছিল বিভিন্ন দমন আইন। তখন লাগু করা হোত ১২০বি ও ১২১এ অর্থাৎ ‘রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও যুদ্ধঘোষণা’র মতো মারাত্মক ধারা। তবে সীমিত সংখ্যায়। আর তখনও পুরোদস্তুর দানবীয় রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের প্রয়োগ শুরু হয়নি। এটা চালু করে দেওয়া হয় একুশ শতকের দেশ শাসনে রাজ্য শাসনে। রাজ্যে রাজ্যে শাসকের রং নির্বিশেষে ‘পোকা’-’মোকা’-’আফস্পা’ ইত্যাদি — নানা নিবর্তন আইন লাগু হতে থাকে। কেন্দ্রে ইউপিএ আমল নিয়ে আসে ইউএপিএ। সেই প্রক্রিয়ায় সিডিশন অ্যাক্ট চাপিয়েও দমন শুরু করে দেওয়া হয়।
২০১০ থেকে ২০২২ — এক দশকাধিক সময়কালে উপরোক্ত দুটি সবচেয়ে মারাত্মক জনবিরোধী আইনের ব্যবহার একইভাবে চলেনি। তারতম্য থেকেছে। ইউপিএ আমলের তুলনায় মোদী আমলে বহুগুণ ব্যাপক বাড়িয়ে তোলা হয়েছে। এনসিআরবি'র রিপোর্ট বলছে, রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে এপর্যন্ত মামলার ৬৫ শতাংশই মোদী আমলে। যে সর্বোচ্চ পাঁচটি রাজ্য এই আইনের যথেচ্ছে ব্যবহারে অভিযুক্ত, তার চারটিতেই বিজেপি সরকারের শাসন। পয়লা নম্বরে রয়েছে যোগী সরকার শাসিত উত্তরপ্রদেশ। আইনটি কোথায় না ব্যবহার হয়েছে! টার্গেট করা হয়েছে ছাত্র আন্দোলন, মানবাধিকার আন্দোলন, মজদুর আন্দোলন, এনআরসি-সিএএ বিরোধী আন্দোলন, সমান নাগরিকত্বের জন্য আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, পরিবেশ আন্দোলন, সীমান্ত সেনা সন্ত্রাসবাদ ও যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলন, জাতিসত্তার আন্দোলনকে। কাদের না নিশানায় ফেলা হয়েছে! জনআন্দোলনের সক্রিয় কর্মী, সক্রিয় সমাজকর্মী, জনমুখী সাংবাদিক, মিডিয়া কর্মী, যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানকর্মী, ইতিহাসবিদ, নাট্যকর্মী, গায়ক, লেখক, কলমচি, দলিত, আদিবাসী, সংখ্যালঘু ও বিরোধীপক্ষের লোকজনকে। সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রায় সর্বাংশেই চলে আসছে রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে হামলা। বিনাবিচারে কারাগারের অন্তরালে অন্তহীন বন্দী করে রাখার নিগ্রহ, উৎপীড়ন। এমনকি আবালবৃদ্ধবনিতা হলেও, স্বাভাবিক চলাফেরা করতে অসমর্থ হলেও, প্রাণের স্পন্দন থেমে গেলেও, মুক্তি মেলেনা। কি আশ্চর্য! আইনটি শীর্ষ আদালতের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর লেগে গেল! সংবিধান ও গণতন্ত্রের পক্ষে লজ্জ্বারই কথা। কিন্তু ফ্যাসিস্ট হিন্দুত্ববাদী সমাজপতি ও শাসকদের কোনও শরম নেই। ওরা চালাচ্ছে সংবিধান বহির্ভূত জবরদস্তি ও সংবিধানের চূড়ান্ত জনবিরোধী ধারার সমন্বয়ে সাঁড়াসী আক্রমণ। এইসব চালিয়ে ওরা ভয়ের রাজত্ব টিকিয়ে রাখতে চায়।
তবু মানুষের চোখ-কান খুলছে, মানুষ চিন্তা করছে, ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, রুখে দাঁড়াচ্ছে। তীব্রতম ব্যাপকতম অত্যাচার আর ভীতি সন্ত্রাস সীমা ছাড়ানোয় প্রতিক্রিয়ায় মানুষের ভয়ভীতিও কাটছে। জীবন-জীবিকার অধিকার চলে যাওয়ার বিপদ তাড়িত হয়ে মানুষের ভয় ভাঙছে। অস্তিত্ব রক্ষার আওয়াজ উঠছে — মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের অধিকার রক্ষার্থে রাষ্ট্রদ্রোহ আইনটি সংবিধান, সমাজ ও রাষ্ট্রদেহ থেকে বাদ দিতে হবে। ‘অপব্যবহার পুনর্বিচারের’ বাহানা আবার কী! আইনটিকে পুরো বাতিল করতে হবে। শুধু রাষ্ট্রদ্রোহ আইন কেন, ইউএপিএ, আফস্পা ইত্যাদি জনবিরোধী কানুনী উপাঙ্গগুলোকে নির্মূল করতে হবে। জনগণের এই দাবি, কণ্ঠনাদ সরাসরি বিজেপি গরিষ্ঠের সংসদে, মোদী সরকারের খাসমহলে গ্রাহ্য হওয়ার নয়, কিন্তু শীর্ষ আাদালতে তার সামান্যতম হলেও প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। এই দ্যোতনা ওই দাবি আদায়ের রাস্তার লড়াইকে শক্তি যোগাবে।
শ্রীলঙ্কার জনগণ রাজাপক্ষ সরকার ও তার অপশাসনের বিরুদ্ধে গত মার্চ, ২০২২ থেকে লাগাতার প্রতিবাদে উঠে দাঁড়িয়েছেন। অর্থনৈতিক অব্যবস্থা থেকেই প্রতিবাদ জ্বলে ওঠে, কারণ এই বিশৃঙ্খলায় খাদ্য ও জ্বালানির দাম আকাশ ছুঁয়েছে, জ্বালানী সংকট তৈরি হয়েছে এবং অনির্দিষ্টকাল ধরে বিদ্যুৎ বিভ্রাট চলেছে, জ্বালানির লাইনে দাঁড়িয়ে বয়স্ক মানুষরা প্রাণ হারিয়ে লুটিয়ে পড়েন।
কিন্তু এই প্রতিবাদ দ্রুতই এক সর্বাত্মক অভ্যুত্থানের চেহারা নেয় — রাজাপক্ষ ভাইদের নেতৃত্বাধীন সরকারকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার দাবিতে। এই ভাইয়েরা, গোটাবায়া এবং মাহিন্দা দ্বীপরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। সরকারের প্রকাশ্য স্বজনপোষণ জনতার রোষকে আরও বাড়িয়ে তোলে। আমাদের লেখার সময় পর্যন্ত, প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দাকে পদত্যাগ করতে হয়েছে, যে লোকটির হাত তামিল-গণহত্যার রক্তে রাঙানো — যে তামিলরা আত্ম নির্ধারণের লড়াই লড়ছিলেন; আর তার ভাই প্রতিবাদীদের ঠাণ্ডা করার জন্য দেখামাত্র গুলির নির্দেশ জারি করেছে।
বিদ্রোহী তামিলদের ‘জয় করার’ দরুণ ‘বলিষ্ঠ নেতা’ হয়ে ওঠার ভাবমূর্তির জোরে রাজাপক্ষ ভাইয়েরা ক্ষমতায় এসেছিল। তখন তামিল জনগণের প্রতি ধারাবাহিক নির্যাতনের সঙ্গে মিশেছে ইসলাম-ভীতির রাজনীতি (হালাল-মাংসে ও হিজাবে নিষেধাজ্ঞা, আরএসএস ও বিজেপি ভারতে যার প্রতিধ্বনি তুলেছে, তারসঙ্গে জুড়েছে ঘৃণা ছড়ানো বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের মদত) এবং মুসলিম ও খ্রিস্টানধর্মের সংখ্যালঘু জনগণের বিরুদ্ধে হিংসা। এই অভ্যুত্থান সম্পর্কে ভারতীয়দের জন্য যেটা সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ সেটি হল — জাতিগত ও ধর্মীয় বিভাজনের বেড়া ভেঙে শ্রীলঙ্কার জনগণের একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়া। শ্রীলঙ্কার জনগণ সেই বিপর্যয়টা উপলব্ধি করতে পেরেছেন যেটা রাজাপক্ষ সরকার হিংসাশ্রয়ী রাজনীতির আবরণে অনেক কসরৎ করে তাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছিল।
মোদী-সৃষ্ট বিপর্যয় ভারতবর্ষকে ইতিমধ্যেই গ্রাস করেছে; আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, বিগত অর্ধ শতকের ভয়ঙ্করতম বেকারত্ব, তার সঙ্গে মোদী সরকার ও বিজেপি-শাসিত রাজ্য সরকারগুলির ঘৃণা-ভাষণ ও বিদ্বেষমূলক নীতির ক্রমাগত হট্টরোল (যা মগজ বিষিয়ে তুলতে বদ্ধপরিকর)। এসব কিছুই শ্রীলঙ্কাকে মনে করিয়ে দেয়। কৃষকদের প্রতিবাদ, বিহার ও উত্তর প্রদেশে বেকার যুবকদের প্রতিবাদ — এগুলো সবই সেই প্রবল আলোড়ন আর অস্থিরতার ইঙ্গিত যা শুধু মুসলিম-বিরোধী আর খ্রিস্টান-বিরোধী হিংসা দিয়ে বিজেপি সামাল দিতে পারবে না।
ভারতে সঙ্ঘ-পোষিত ঘৃণার কারবারিরা মুসলিম সংখ্যালঘুদের গণহত্যার হুমকি দিয়েই চলেছে; আর মুসলিম ও খ্রিস্টান ধর্মের প্রতিদিন হিন্দু আধিপত্যকামীদের হাতে বাষ্ট্র-পোষিত হিংসার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। শ্রীলঙ্কা প্রকৃতপক্ষে এক গৃহযুদ্ধের সাক্ষী থেকেছে যা শেষ হয়েছে তামিল-গণহত্যা দিয়ে। তখন থেকে শ্রীলঙ্কার শাসকরা শুধু যে মানবতার বিরুদ্ধে তাদের অপরাধের সমস্ত দায় এড়িয়ে চলেছে তাই-ই নয়, রাজনৈতিক ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে গণহত্যাকে পুঁজি করারও চেষ্টা করেছে। এবং তারা অন্যান্য সংখ্যালঘু-মুসলিম ও খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে নয়া নয়া ঘৃণার ঢেউকে ইন্ধন যোগানোর, এমনকি এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলিকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেওয়ারও চেষ্টা চালিয়ে গেছে। তামিল ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং সিংহল-আধিপত্যকামী জাতীয়তাবাদের বাগাড়ম্বর অনিষ্পন্নই থেকে গেল; আর সেখান থেকেই উন্মোচিত হল যে নিপীড়িতদের ‘পরাজয়’ অনিবার্যভাবেই ডেকে আনে সকলের পরাজয়। শ্রীলঙ্কার জনগণের থেকে ভারতীয়দের এই শিক্ষাটিও নিতে হবে।
ভীষণ দমনপীড়নের মুখেও গভীর সংকল্পবদ্ধ শ্রীলঙ্কার জনগণের অভ্যুত্থান ভারতীয়দের কাছে গভীর অনুপ্রেরণাদায়ক। প্রতিবাদী শ্রীলঙ্কার জনগণের জয় হোক! তাদের দৃষ্টান্ত ভারত এবং দক্ষিণ এশিয়ার সমস্ত দেশকে ঘৃণার রাজনীতি ও কর্পোরেট নয়া-উদারবাদী লুন্ঠণকে প্রত্যাখ্যান করতে এবং জনগণের অধিকার দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করতে অনুপ্রাণিত করুক!
- এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ১৬ মে ২০২২
১৩ মে কবি সুকান্তের ৭৬তম মৃত্যু দিবস। তাঁর প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করে রক্তপতাকা উত্তোলন করলেন নকশালবাড়ি কৃষক অভ্যুত্থানের কিংবদন্তিদের অন্যতম সিরিল এক্কা। শুরু হয়ে গেল সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের ১২তম পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্মেলন কল্পনা দত্ত-বটুকেশ্বর দত্ত নগরে (মহানগরী কলকাতাকে মহান এই দুই স্বাধীনতা সংগ্রামীর নামে চিহ্নিত করা হয়)। সম্মেলনস্থান মৌলালী যুবকেন্দ্র’কে উৎসর্গ করা হয় শহীদ আনিস খানের স্মৃতিতে। সম্মেলন পরিচালনায় গঠন করা হয় দশ সদস্যের সভাপতিমণ্ডলী। সেইসঙ্গে পাঁচ সদস্যের সহায়ক সঞ্চালকমন্ডলী। তেভাগা আন্দোলনের ৭৫তম বর্ষে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে কৃষিমজুর, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক, চা ও পাট শিল্প সমেত সংগঠিত ও অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক, দলিত-আদিবাসী-সংখ্যালঘু ও সমাজের অনগ্রসর অংশ থেকে উঠে আসা মহিলা ও পুরুষ প্রতিনিধি সহ উপস্থিত ছিলেন ছাত্র-যুব ও বুদ্ধিজীবীরা। এক কথায় আনিস খান সভাগৃহ হয়ে উঠেছিল সংগ্রামী বাংলারই যেন এক ক্ষুদ্র প্রতিরূপ। নবীন ও প্রবীণ — উভয় প্রজন্মের অভিজ্ঞতার আদান প্রদান, সমালোচনা-আত্মসমালোচনার মাধ্যমে ৩ দিনের এই সম্মেলন প্রাণচঞ্চল ও বলিষ্ঠ প্রত্যয়ের এক অনবদ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সত্যি বলতে কী, ‘কোম্পানিরাজ’ কায়েম করার লক্ষ্যে আরএসএস-বিজেপি’র উন্মাদনা সৃষ্টি এবং তৃণমূল কংগ্রেসের দুর্নীতি ও অপশাসনে যখন মানুষ অতীষ্ঠ তখন জনগণের রুটি-রুজি-গণতন্ত্রের বুনিয়াদী দাবিগুলিকে প্রবলভাবে সামনে আনার জন্য যে শৃঙ্খলাবদ্ধ, বিপ্লবী বামপন্থী শক্তির জাগরণ প্রয়োজন তারই নবতর সূচনা ঘটিয়েছে এই সম্মেলন।
সভাগৃহের সুবিমল সেনগুপ্ত মঞ্চে প্রকাশ্য অধিবেশনের শুরুতে পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের শিল্পীরা কবি সুকান্তের লেখা গান দিয়ে (বন্ধু তোমার ছাড়ো উদ্বেগ, সুতীক্ষ্ণ করো চিত্ত) আরম্ভ করে তেভাগার গান (হেই সামালো), নকশালবাড়ির অগ্নিবিষাণ (ও নকশাল, নকশাল, নকশালবাড়ির মা), সাম্প্রদায়িক বিভেদের বিরুদ্ধে বজ্র নিনাদ (রাম রহিমের বাঁচার লড়াই) ও আন্তর্জাতিক সর্বহার ঐক্যের (পিট সিগারের ‘ভোরের আগে যেন ঘোর আঁধার’) গান শুনিয়েছেন। ২০২১ সালে প্রয়াত প্রখ্যাত নাট্যকার বাদল সরকারকে শ্রদ্ধাবনতচিত্তে স্মরণ করা হয়। এরপর প্রকাশ্য অধিবেশনে পার্টির সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য যে বক্তব্য রাখেন তা ইতিমধ্যেই সমস্ত সংবাদ মাধ্যমে কমবেশি প্রকাশিত হয়েছে (তাঁর ভাষণ এই সংখ্যায় আলাদভাবে রয়েছে)। সেই বক্তব্যের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে অন্যতম কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক সুচেতা দে বক্তব্য রাখেন। দিল্লীর জাহাঙ্গীরপুরি, শাহিনবাগ প্রভৃতি এলাকায় বুলডোজারের সামনে বামপন্থীদের প্রতিরোধ গড়ার উদাহরণ টেনে তিনি জেএনইউ-এ ঠিকা কর্মীদের আন্দোলনে তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতার কথাও তুলে ধরেন। দিল্লী পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে তাঁর প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা সত্বেও সেখানে লড়াই জারি আছে এবং ঠিকা কর্মীরা ব্যারিকেড ভেঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকে তাঁদের জোরদার অবস্থান বিক্ষোভ চালিয়ে গেছেন। সুচেতা দিল্লীতে ছাঁটাই স্বাস্থ্যকর্মী (সরকারি হাসপাতালগুলিতে কোভিডকালে নিযুক্ত এই কর্মীরা অক্লান্ত পরিষেবা দিয়েছেন) ও পুর নিগমের সাফাই কর্মীদের বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের কথা তুলে ধরেন।
সুচেতার বক্তব্যের পর বিদায়ী রাজ্য কমিটির সম্পাদক অভিজিত মজুমদার রাজনৈতিক-সাংগঠনিক খসড়া প্রতিবেদন (আসলে যা গত চার বছরের কাজের রিপোর্ট) পেশ করেন। প্রতিবেদনকে ঘিরে শুরু হয় বিতর্ক, আলোচনা ও সমালোচনা। উঠে আসে নানা পরামর্শ, বিভিন্ন প্রস্তাব। মোট ৮০ জন প্রতিনিধি এই আলোচনায় অংশ গ্রহণ করেন। প্রকৃত অর্থে ১৪-১৫ মে, দুই দিন প্রতিনিধিদের তীক্ষ্ম, টানটান বক্তব্যই ছিল সম্মেলনের আসল প্রাপ্তি। তাঁদের বক্তব্যে যেমন ছিল একদিকে বিদায়ী রাজ্য কমিটির দুর্বলতাগুলিকে চিহ্নিত করে কঠোর সমালোচনা, পার্টি শিক্ষা ও অনুশীলনে দুর্বলতাগুলিকে তীরবিদ্ধ করা, তেমনি ছিল আন্দোলনের ময়দান থেকে উঠে আসা অভিজ্ঞতার জীবন্ত ও বিচিত্র সংকলন। এরই ধারায় বিষ্ণুপুরের ছাত্র ও যুব কর্মীরা (এক তরুণী সমেত) ছাত্র আন্দোলনের পাশাপাশি কীভাবে মেহনতী গরিব মানুষদের আন্দোলনে সামিল হয়েছেন তার ইতিবৃত্ত পেশ করেন। তাঁরা বলেন, ভগৎ সিং-আম্বেদকার-নেতাজীর মতো স্বাধীনতা সংগ্রামী ও মনস্বীদের জন্মদিন পালনে বিভিন্ন ক্লাব সংগঠনকে সামিল করা, প্রতিরোধের সিনেমা প্রদর্শন, ফ্রি কোচিং ক্যাম্প চালানো — প্রথম প্রথম সবই হয়েছে পার্টির পতাকা ছাড়াই। আর এখন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্র রক্ষায় বিভিন্ন কর্মসূচিতে পার্টির ঝান্ডা তুলে ধরা যাচ্ছে সহজে ও অত্যন্ত জোরের সাথে। উঠে আসে, এই মফঃস্বল শহরে এক পুরকর্মীর মুখ থেকে তাঁদের সংগঠিত হওয়া ও দাবি আদায়ের কঠিন লড়ায়ের কথা। একেবারে অন্য স্বাদের অভিজ্ঞতার কথা শোনা গেল হাওড়ার উলুবেড়িয়া অঞ্চলের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের রক্ষণশীল পরিবার থেকে আসা এক মহিলা প্রতিনিধির মুখে। তিনি সগর্বে জানান, পর্দার অবগুণ্ঠন সরিয়ে, মধ্যবয়সে তিনি সকলের সঙ্গে প্রকাশ্যে একাসনে বসার অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছেন। তিনি আরও উল্লেখ করেন, এই রূপান্তরের জন্য তিনি আমৃত্যু পার্টির কাছে ঋণী ও বিশ্বস্ত থাকবেন। একই ভাবে, মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের সংখ্যালঘু পরিবার থেকে উঠে আসা আর এক মহিলা প্রতিনিধি শোনালেন তাঁর গণ্ডী ভেঙ্গে এগিয়ে চলার কথা। কীভাবে পারিবারিক বাধা টপকে বিড়ি শ্রমিক মহিলাদের সংগঠিত করে প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছেন তার কাহিনী শোনান তিনি। পূর্ব বর্ধমানের এক প্রতিনিধি শিক্ষক রাজ্যে নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতির প্রতিবাদে ‘যুব ছাত্র অধিকার মঞ্চের’ পতাকাতলে চাকরিপ্রার্থী, উত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীদের দীর্ঘ আন্দোলনের কাহিনী তুলে ধরেন। তিনি জানান, এই মঞ্চকে পরিচালনার ক্ষেত্রে পার্টি পরিচালিত যুব সংগঠন আরওয়াইএ’র বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। পার্টিকে এই আন্দোলনের সপক্ষে আরো দৃঢ়ভাবে দাঁড়ানোর জন্য তিনি আবেদন জানান। প্রতিনিধিদের মুখ থেকে উঠে এসেছে এলাকাস্তরে তৃণমূলের সন্রাস ও দুর্নীতিকে রুখে দেওয়ার কথা। নদীয়ার এক মহিলা প্রতিনিধি কিভাবে তিনি ‘একশো দিনের কাজে’ ভুয়ো মাস্টাররোল প্রত্যাহারে তৃণমূলের মাতব্বরদের বাধ্য করেছেন এবং নতুন করে কাজ আদায়ের ক্ষেত্রে এলাকার জনগণকে সামিল করে আন্দোলন চালিয়েছেন তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। পূর্ব বর্ধমানের এক যুব কমরেড বলেন, ‘লক্ষীর ভান্ডার প্রকল্প’কে তাচ্ছিল্য না করে তাঁরা এই প্রকল্পে উপভোক্তাদের মাসে দু’হাজার টাকা ভাতা দেওয়ার জন্য প্রচার চালিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। জনগণের প্রতিটি সমস্যার সমাধানে তাঁদের পাশে থাকায় তাঁদের মজবুত গণভিত্তি গড়ে উঠেছে। তাঁদের বিক্ষোভ কর্মসূচীগুলি রাজ্যের শাসক দলের বিরুদ্ধে গণক্ষোভ গঠনে বিশেষ ফল দেয়। কখনো কখনো সিপিআই(এমএল)-এর ঠ্যালা সামলাতে টিএমসি ব্লক জমায়েত ডাকতে বাধ্য হয়। উত্তরবঙ্গসহ বিভিন্ন জেলার একাধিক প্রতিনিধি মাইক্রোফিনান্স ঋণ থেকে, ঋণদাতা কোম্পানিগুলির জুলুম হতে বাঁচাতে ‘ঋণমুক্তি কমিটির’ ইতিবাচক ভূমিকার কথা তুলে ধরেন। তাঁরা বলেন, এই ঋণফাঁদ থেকে গ্রামের মহিলারা এখনও মুক্ত নন এবং ‘ঋণমুক্তি কমিটিকে’ আরও সক্রিয় হতে হবে। হুগলীর এক আদিবাসী প্রতিনিধি, আদিবাসীদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষায় তাঁদের উদ্যোগের কথা বলার পাশাপাশি আদিবাসীদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ও আজও টিকে থাকা কিছু অন্ধবিশ্বাসকে দূর করার জন্য তাঁদের প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করেন। কলকাতার এক তরুণ অধ্যাপিকা সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে গিগ শ্রমিকদের সংগঠিত করার সম্ভাবনাময় আশার বার্তা শোনান। অনেক প্রতিনিধির মুখে কাজের বাজারে অনিশ্চয়তা ও শ্রমিকদের উদ্বেগের কথা উঠে আসে। দার্জিলিং’এর দু’জন প্রতিনিধির মুখে উঠে আসে নির্মাণ শ্রমিকদের সমস্যার কথা। একই সাথে তাঁরা নদী থেকে পাথর তুলে গরিব মেহনতিরা এতদিন যে জীবিকা নির্বাহ করতেন তার সামনে ‘জেসিবি’ মালিক ও ঠিকাদারদের খাড়া করা বিপদের কথা তুলে ধরেন। দার্জিলিং জেলার আর এক প্রতিনিধি, বাস্তু ও কৃষিজমি প্রোমোটারদের হাতে চলৃ যাওয়া রুখতে ‘কাওয়াখালি-পোড়াঝার জমি রক্ষা কমিটি’র আন্দোলন ও তিস্তা প্রকল্পে অব্যবহৃত জমি কৃষকদের ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে আন্দোলনের বার্তা শোনান। বলা বাহুল্য, সম্মেলনে অধিকাংশ প্রতিনিধিই এসেছিলেন গ্রামাঞ্চল থেকে। স্বভাবতই সার্বিক কৃষি সঙ্কট ও তা মোকাবিলার কথা অনেক প্রতিনিধির বক্তব্যে উঠে আসে। কৃষি ক্রমশ অলাভজনক হয়ে ওঠায় অনুপস্থিত জমির মালিক ও ধনী চাষিরা এখন লীজ বা চুক্তি চাষের দিকে ঝুঁকছেন। ‘জমির কাগজ’ না থাকায় গরিব লিজ বা চুক্তি চাষিদের সমস্ত ধকল সহ্য করতে হচ্ছে। তাঁদের স্বার্থ রক্ষায় এক প্রতিনিধি বলেন, “লিজ চাষীদের পরিচয়পত্র দিতে হবে। বীজ, সার, কৃষিযন্ত্র ইত্যাদি সুলভে সরবরাহের জন্য ব্লকে ব্লকে একাধিক ন্যয্যমূল্যে কৃষি ভান্ডার খোলার দাবি তুলতে হবে।” খাদ্যশস্যের বদলে অন্যান্য নগদ অর্থকরী ফসল চাষের ফলে কৃষিক্ষেত্রে যে ভারসাম্যহীনতা দেখা যাচ্ছে তা নিয়ে সমীক্ষা চালানোর গুরুত্বও প্রতিনিধিদের মুখে উঠে আসে। তবে জমির লড়াই আজও যে প্রাসঙ্গিক, খাস জমি উদ্ধারের দাবিতে আজও যে লড়াই গড়ে তোলা যায় তা স্মরণ করিয়ে দেন পূর্ব বর্ধমানের এক প্রতিনিধি।
দু’দিন ধরে প্রতিনিধিদের বক্তব্য শোনার পর বিদায়ী রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার তাঁর ‘সম্ভাষণে’ সমস্ত গঠনমূলক প্রস্তাব-পরামর্শ গ্রহণ করে, প্রতিনিধিদের উত্থাপিত রাজ্য সংগঠনের কিছু দুর্বলতাকে স্বীকার করে খসড়া প্রতিবেদন অনুমোদন করার আবেদন জানান। সংযোজনী, সংশোধনীসহ খসড়া প্রতিবেদন সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
সবশেষে কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক ধীরেন্দ্র ঝা’র তত্ত্বাবধানে আগামী রাজ্য কমিটি গঠনের গুরুত্বপূর্ণ কাজটি পরিচালিত হয়। বিদায়ী রাজ্য কমিটি ৬১ জনের রাজ্য কমিটির যে প্রস্তাব রাখে সম্মেলন তা অনুমোদন করে। ৬১ জন রাজ্য সদস্যের তালিকা সম্মেলনে রাখা হয়। কোন বিকল্প নাম না আসায়, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নতুন রাজ্য কমিটি নির্বাচিত হয়। অভিজিৎ মজুমদার রাজ্য সম্পাদক পদে পুননির্বাচিত হন। এরপর সম্মেলনকে উদ্দেশ্য করে বক্তব্য রাখেন ধীরেন্দ্র ঝা। সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য আরও একবার সম্মেলনকে সম্বোধিত করেন। সম্বোধিত করেন বর্ষীয়ান পলিটব্যুরো সদস্য স্বদেশ ভট্টাচার্য। সবশেষে সম্মেলন থেকে মূল্যবৃদ্ধি রোধ, সরকারি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতিকে রুখে দেওয়া ইত্যাদি কয়েকদফা প্রস্তাব গৃহীত হয়। তিনদিন ধরে মূলত যে ছাত্র-যুব স্বেচ্ছাসেবী সাথীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে সম্মেলন সফল সম্ভব হয়েছে তাদের মঞ্চে আহ্বান জানিয়ে গোটা সম্মেলন কক্ষ প্রবল করতালিতে সম্বর্ধনা জানায়। আগামী দিনে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন সংগ্রামী বাংলার মুখ ও লড়াইয়ের নিশান হয়ে উঠবে — এই প্রত্যয় ঘোষণা করে আন্তর্জাতিক সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে সম্মেলনের সফল পরিসমাপ্তি ঘটে।
১) আকাশ ছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি দেশবাসীকে গভীর সংকটে নিক্ষিপ্ত করেছে। রান্নার গ্যাসের দাম হাজার টাকা ছুঁয়েছে। গত আট বছরে মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছে। সীমাহীন বেকারত্ব, ক্রমহ্রাসমান ক্রয় ক্ষমতা, গভীর খাদের মুখে দেশের অর্থনীতি — এর বিরুদ্ধে দেশের ৫টি বামপন্থী দল ২৫-৩১ মে মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই রাজ্যেও মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে কর্মসূচিকে সর্বাত্মকভাবে সফল করার প্রস্তাব এই সম্মেলন সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করছে।
২) ক) তৃণমূল সরকারের শাসনকালে জনগণের উপর নানান দিক থেকে হামলা নেমে এসেছে। দেউচা-পাঁচামীতে পরিবেশ বিরোধী, জনবিরোধী এই প্রকল্পকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এই সরকার বদ্ধপরিকর। ইতিমধ্যে আরএসএস চলমান প্রতিবাদী আন্দোলনে অনুপ্রবেশ করার যে অপচেষ্টা চালায়, তা স্থানীয় অধিবাসী প্রত্যাখ্যান করেছে। এই সম্মেলন এই প্রকল্পকে বাতিল করার প্রস্তাব গ্রহণ করছে।
খ) গোটা রাজ্যজুড়ে নারী নির্যাতন চরম সীমায় পৌঁছেছে। কিশোরী-নাবালিকাদের ধর্ষণ, পুড়িয়ে হত্যা, আর প্রায় প্রতিটি ঘটনার সাথে তৃণমূলের কোন না কোন স্তরে নেতা-পুলিশ প্রশাসনের যোগসাজশ আজ দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। সম্মেলন এই নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা করার পাশাপাশি প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে তোলার ডাক দিচ্ছে।
গ) প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের নেতা আনিস খান হত্যার বিরুদ্ধে রাজ্যের ছাত্র-যুব সমাজের এক প্রতিবাদী উত্থান আমরা লক্ষ্য করেছি। যত দিন যাচ্ছে, ততই স্পষ্ট হচ্ছে, এই হত্যাকান্ডের নেপথ্যে তৃণমূল নেতা ও পুলিশ প্রশাসনের গভীর সংযোগ। এখন পর্যন্ত প্রকৃত দোষীদের গ্রেপ্তার করা হল না। এই সম্মেলন দাবি জানাচ্ছে, আনিস হত্যার সঙ্গে জড়িত হত্যাকারীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
৪) এসএসসি’র কর্মপ্রত্যাশীদের ধারাবাহিক আন্দোলন এতোদিন পর রাজ্য সরকারের টনক কিছুটা নড়িয়েছে। তাঁদের দাবি পূরণের জন্য আবার কিছু বস্তাপচা আশ্বাস, কিছু ঘোষণা, ইত্যাদি এই আন্দোলনে জল ঢেলে দেওয়ার লক্ষ্যেই পরিচালিত। এই সম্মেলন দাবি জানাচ্ছে, এসএসসি কান্ডে উচ্চস্তরে যে বিরাট দুর্নীতি হয়েছে, তা উন্মোচিত হোক, সমস্ত শূন্যপদ পূরণ করতে হবে। তালিকা অনুযায়ী সকলকে নিয়োগ করতে হবে।
৫) বুলডোজারের যে দমনমূলক ফ্যাসিস্ট রাজনীতি বিজেপি সরকার এখন কার্যকর করছে, তার বিরুদ্ধে দিল্লীর বুকে আমাদের পার্টি ও বাম পার্টির নেতৃবৃন্দ যে হিম্মত দেখিয়েছেন তা সারা দেশের গণতান্ত্রিক মানুষের নজর কেড়েছে। আমাদের পার্টি এই বুলডোজার রাজনীতির বিরুদ্ধে মে মাস জুড়ে প্রতিবাদী বিক্ষোভ কর্মসূচির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সম্মেলন এই কর্মসূচী কার্যকরি করার এবং এই বুলডোজার রাজনীতির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার প্রস্তাব গ্রহণ করছে।
কেন্দ্রীয় কমিটির পর্যবেক্ষক ধীরেন্দ্র ঝা
কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে পর্যবেক্ষক পার্টির পলিটব্যুরো সদস্য ধীরেন্দ্র ঝা সম্মেলনের অন্তিম পর্বে বলেন, সম্মেলন জীবন্ত ও গণতান্ত্রিক হয়েছে। পার্টির সাধারণ সম্পাদক যেমন বলেছেন, আমিও সেরকমই বলতে চাই যে স্বাধীনতার ৭৫ বছরে অমৃতমন্থনের নামে বিষ উঠছে। স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবীদের যে সাহস ছিল, সেই সাহস নিয়ে আমাদের লড়তে হবে। যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য অস্ত যায়না বলে তাদের গর্ব ছিল, সেই গর্ব ছেড়ে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের লড়াইয়ের কাছে পিছু হেঁটে তাদের শাসন ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল। সেই রকম সাহস নিয়েই আজকে লড়তে হবে বিজেপি’র ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে।
পাঁচ-সাত বছর আগে যখন সিপিআই, সিপিএম’এর সঙ্গে যৌথ আন্দোলনে আমরা যেতাম, তখন সিপিএম আমাদের বিহারের দল বলে খানিক তুচ্ছতাচ্ছিল্য করত। এখন পরিস্থিতি বদলেছে ও গোটা দেশে আমাদের পরিচিতি সম্মান বেড়েছে।
পাঞ্জাব ও বাংলা স্বাধীনতা আন্দোলনের দুই প্রধান কেন্দ্র ছিল। পাঞ্জাবে বিরাট আন্দোলন আমরা দেখলাম, বাংলাতেও তা হোক।
বাংলায় আদিবাসীদের মধ্যে থেকে, মহিলাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাজের সাড়া দেখা যাচ্ছে। এ আরো প্রসারিত হোক। গ্রামীণ সংঘর্ষকে বাড়িয়ে আমাদের ফ্যাসিবাদের মোকাবিলা করতে হবে। জমির অধিকারসহ নানা অধিকারকে নিয়ে যে আন্দোলন হত, সেরকম নানা অধিকার আন্দোলনকে আরো শক্তিশালী করতে হবে।
১৯-২০ নভেম্বর ২০২২ আয়ারলার জাতীয় সম্মেলন বাংলায় হবে। জবকার্ড, স্টাইপেন্ড সহ নানা সুবিধা পাওয়ার জন্য এখানে ঘুষ দিতে হচ্ছে। এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইকে শক্তিশালী করতে হবে। ঘরে ঘরে গিয়ে, গ্রাম, মহল্লায় গিয়ে সদস্য সংগ্রহ ও সম্মেলনের প্রচার করতে হবে।
পলিটব্যুরো সদস্য স্বদেশ ভট্টাচার্য
সংক্ষিপ্ত ভাষণে বর্ষীয়ান পলিটব্যুরো সদস্য স্বদেশ ভট্টাচার্য সফল সম্মেলনের জন্য সকলকে বিপ্লবী অভিনন্দন জানিয়ে বলেন যে এই সম্মেলন গণ্ডী ভাঙার দিকে দিশা দিয়েছে বলে মনে হয়েছে।
ছাত্রদের বলব গণ্ডী ভাঙতে হলে বড় করে ভাবতে হবে। আইসা’র আগামী সম্মেলন হোক দশহাজার কেন, তারও অনেক বেশিজনকে সদস্য করে। বাংলায় লক্ষ লক্ষ ছাত্র রয়েছে। তাদের মধ্যে যত বেশি জনকে সম্ভব আইসা’র প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসুন।
এই রাজ্য সম্মেলন থেকে বেরিয়ে পার্টি কংগ্রেসের প্রস্তুতির বড় কাজ ও পাশাপাশি অন্যান্য কাজে আমাদের নিয়োজিত হতে হবে। ফ্যাসিবাদকে প্রতিরোধ করার ব্যবহারিক ও বৈচারিক দিকগুলিকে আরো দৃঢ়ভাবে আয়ত্ত করতে হবে। ফ্যাসিবাদকে প্রতিরোধ করার শক্তিকে বাড়াতে হবে। প্রতিরোধের শক্তিকে বাড়াতে হলে গ্রামের মানুষকে সংগঠনবদ্ধ করার কাজে বিশেষ জোর দিতে হবে। আয়ারলার আসন্ন সম্মেলনকে সফল করতে হবে। এটা শুধু গ্রামীণ ও কৃষিমজুর সংগঠনের ওপর ছাড়লে হবেনা, গোটা পার্টিকে এই কাজে নামতে হবে। সমস্ত গ্রামীণ মেহনতি মানুষকে এখানে যুক্ত করার আহ্বান নিয়ে তাদের কাছে যেতে হবে। রাজ্য ও জেলাকমিটির নেতা ছাড়াও ব্রাঞ্চস্তর অবধি পার্টিকে নিয়ে যেতে হবে এই কাজে।
(সম্মেলনে আগত প্রতিনিধি, পর্যবেক্ষক, অতিথি ও সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিদের সামনে পার্টির সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের বক্তব্য)
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের রেশ ধরে দীপঙ্কর বলেন, স্বাধীনতা আন্দোলন, তেভাগা, তেলেঙ্গানা, নকশালবাড়ি আন্দোলনের সময় তৈরি হওয়া গান কবিতাগুলি সেই সময়পর্বর কথা মনে করিয়ে দেয়। এই গৌরবময় আন্দোলনমুখর সৃজনশীল সমাজের ছবিটাই আমরা চাই। কিন্ত এই ছবিটা গত কয়েক বছরে প্রতিদিন বদলে যাচ্ছে। বিজেপি-আরএসএস এখন ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতার প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গকেই প্রায় দখল করে ফেলেছে। একমাত্র সুপ্রিম কোর্টের কিছু অংশ এখনো তাদের হাতের বাইরে। সে কারণেই দিল্লীর কনস্টিটিউশন ক্লাবে কালীসেনা বলে এক সংগঠনের জনৈক নেতা বললেন, তাঁদের চূড়ান্ত লড়াই এখন সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে। মোদী সরকার যা করছে তার বাইরেও যুবকদের আহ্বান জানানো হল স্বাধীনভাবে হিন্দু ভারত প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে যেতে।
‘ইসলাম সে আজাদি’র স্বপ্নকে আরএসএস ২০২৫ সালে তাদের শতবর্ষের সময়ের মধ্যেই পূর্ণ করতে চায়। সেই লক্ষ্যেই আমাদের গণতন্ত্র ও ইতিহাসের ওপর তারা সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। এটাও তাদের এক ধরনের সার্জিক্যাল স্ট্রাইক।
২০২১’র নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ সহ কয়েক জায়গায় নির্বাচনী ধাক্কা, সিএএ-এনআরসি বিরোধী আন্দোলন ও ব্যাপক কৃষক আন্দোলনের চাপে বিজেপি’কে খানিকটা পিছু হটতে হয়েছিল। কিন্তু ২০২২এ উত্তরপ্রদেশ সহ চার রাজ্যের নির্বাচনে জেতার পরে আবার তারা পুরোদমে তাদের অ্যাজেন্ডা পূরণে নেমে পড়েছে। জাহাঙ্গীরপুরী, শাহিনবাগ সহ নানা জায়গায় বুলডোজার নামছে এবং বিশেষ করে মুসলিমদের টার্গেট করা হচ্ছে। রামনবমীর মতো উৎসবের সময় দাঙ্গার পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে।
নির্বাচনী পরাজয়ের পর বাংলার রাজনীতিতে বিজেপি কিছুটা হতোদ্যম হয়ে পড়লেও আরএসএস পূর্ণমাত্রায় তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এখানে বিজেপি’র বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের পক্ষে যে রায় দিলেন এবং যার সুফল মূলত তৃণমূলের ঘরে গেল, তাকে ব্যবহার করে রাজ্যের শাসক দল অপশাসন ও সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে। এটা যত বাড়বে তত বিজেপি’র সুবিধে করে দেবে। এই জায়গা থেকেই এখানে বিরোধী শক্তি হিসেবে বামেদের উঠে আসা দরকার। কিন্তু পুরনো চেহারায় বামেরা ফিরতে পারবেনা। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৭’র অপশাসনের পর যেমন কংগ্রেস এই রাজ্যে দীর্ঘদিন আর জমি খুঁজে পায়নি, তেমনি যে প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে এখানে বামফ্রন্টের পতন হল তাতে তাকেই পুরনো চেহারায় মানুষ ফিরিয়ে আনতে চাইছেন না। এখানে নতুন ধরনের বামপন্থার বিকাশ দরকার। একদিকে বিজেপি’র দেশজোড়া বিপদ ও অন্যদিকে রাজ্যে তৃণমূলের অপশাসনের বিরুদ্ধে এখানে বামেদের একসঙ্গে লড়তে হবে। রূপসী বাংলার বুকে উপোসী বাংলার লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
এই লড়াইয়ের প্রধান দিকগুলোর মধ্যে আছে কৃষকের ন্যূনতম মজুরির প্রশ্ন, রয়েছে স্থায়ী ও সম্মানজনক কাজের দাবিতে এবং নিয়োগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন সহ নানা বিষয়। কিছু পুরনো বুনিয়াদী লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে নতুন কিছু লড়াই। পরিবেশ নিয়ে আন্দোলন ও ভাবনাচিন্তা তার অন্যতম।
বিজেপি ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনিকে যদি রণধ্বনিতে পরিণত করে সাফল্য পেতে পারে, তাহলে আমাদের হাতে আছে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’এর মতো জনপ্রিয় শ্লোগান, যা স্বাধীনতা আন্দোলনের জঠর থেকে উঠে আসা। স্বাধীনতা আন্দোলন শুধু ব্রিটিশ বিরোধী লড়াইই করেনি, তার মধ্যে থেকে এমন কিছু অধিকার আন্দোলনের জন্ম নিয়েছে যেগুলি আমাদের চলমান লড়াইয়ের হাতিয়ার। ১৯২০-তে শ্রমিক অধিকারের জন্য আইএনটিইউসি’র প্রতিষ্ঠা বা ১৯৩৬-এ কিষাণ মহাসভার আন্দোলনে জমিদারী উচ্ছেদের দাবি উঠে আসার কথা আমরা মনে করতে পারি। সেই ১৯৩৬-এ প্রস্তুত হয়েছিল আম্বেদকরের এক বক্তৃতার বয়ান, যা পরে ছাপা হয়। অ্যানিহিলেশন অব কাস্ট শুধু অস্পৃশ্যতা দূরীকরণের মধ্যেই আটকে না থেকে জাতপাত ব্যবস্থাটাকেই শেষ করার দাবি তুলল। দেশের মালিক যে জনগণ ১৮৫৭ সালে মহাবিদ্রোহের সময় তৈরি গানে এই কথা এসেছিল, আর স্বাধীনতা আন্দোলনের শুরু থেকে সংবিধান পর্যন্ত সার্বভৌমত্বের কথাটা উজ্জ্বল হয়ে থাকল।
এই সমস্ত অর্জনগুলিকে বিপরীতদিকে ঘুরিয়ে দিতে চায় আরএসএস-বিজেপি। ১৯২৫এ কমিউনিস্টরা যেমন পার্টি প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ উদযাপন করবে তেমনি সেটা আরএসএস প্রতিষ্ঠারও শতবর্ষ। ভারতের চেহারা কেমন হবে তা নিয়ে এই দুই শক্তির লড়াই রয়েছে এবং থাকবে। এই লড়াই সংসদের ভেতরে ও বাইরে সর্বত্র করতে হবে। ২০২৪’র লোকসভা নির্বাচন একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। বিজেপি বিরোধী সমস্ত শক্তির একটা মহাজোট এই নির্বাচনে দরকার। কিন্তু সেটা শুধু পাটিগণিতের ব্যাপার নয়। আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যে থেকেই এই জোট মজবুত ও শক্তিশালী হতে পারে।
আন্দোলন সংগ্রামের সাফল্য ও প্রসারের জন্য ভয়কে জয় করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ইউরোপে যখন ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াই হচ্ছে তখন কমিউনিস্টরা বলেছিল ফ্যাসিবাদ ভয়ের রাজত্ব কায়েম করতে চায়। এটা এখনকার ফ্যাসিবাদীরাও চায়। সাহস, দৃঢ়তা ও সাংগঠনিক শক্তি নিয়ে এই ভয় ও সন্ত্রাসের রাজত্বের মোকাবিলা করেই সামনে এগোতে হবে।
প্রকাশ্য অধিবেশনে উপরোক্ত বক্তব্য রাখা ছাড়াও সম্মেলনের শেষ দিনে প্রতিনিধি সম্মেলন ও বিদায়ী রাজ্য সম্পাদকের জবাবী ভাষণের পর প্রতিনিধিদের সামনে বক্তব্য রাখতে উঠে সাধারণ সম্পাদক আরো কিছু কথা বলেন। সেখানে সাংগঠনিক কিছু বিষয়ের কথাবার্তা ছাড়াও একুশের নির্বাচন, সিপিআই(এম)-এর সঙ্গে বিতর্ক ও বামেদের যুক্ত কার্যকলাপ প্রসঙ্গে তিনি আলোচনা করেন। তিনি বলেন, একুশের পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন গোটা দেশের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিজেপি পশ্চিমবঙ্গ দখল করে নিতে পারে — এমন সম্ভাবনা যথেষ্ট ছিল। আজকের বিজেপি’র মতো একটি পার্টির সঙ্গে গোটা দেশের অন্য কোনও পার্টির যে তুলনা হতেই পারেনা, এটা অনেকে বুঝতে পারছিলেন না। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি’র বিপদ বাড়ছিল কিন্তু এই নিয়ে চেতনা বাড়ছিল না। আমরা এখানে এই কাজটা করতে চেয়েছিলাম। বিহারে আমাদের সাফল্যের কারণে আমাদের ওপর নজর বাড়ে এবং এই বিতর্ক তীব্র হয়।
বামপন্থীরা পুরনো চেহারায় আর ফিরবে না। বামেদের ফিরতে হবে প্রতিটি ইঞ্চিতে লড়াই করে, নতুন চেহারা ও শক্তি নিয়ে। যেভাবে আমরা বিহারে লড়াই করছি, এখানেও সেটা করতে হবে। বিজেপি ও তৃণমূল দুই শক্তির সঙ্গে লড়াই কীভাবে একইসঙ্গে করা হবে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। বিহারের অভিজ্ঞতা এক্ষেত্রে আমাদের সাহায্য করতে পারে।
বিজেপি’র দেশব্যাপী উত্থানের পর্যায়ে ১৯৯০ থেকে ২০০৫ বিহারে আরজেডি সরকার ক্ষমতায় ছিল। প্রথম দিকে দলিত গরীবের মানসম্মান ও ক্ষমতায়নের কথা হলেও পরবর্তী পর্যায়ে দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন ও অপশাসনের অভিযোগে এই সরকার ক্ষমতা হারায়। এই দীর্ঘ পর্যায়ে গণহত্যা, ধারাবাহিক রাজনৈতিক সন্ত্রাস ও রাষ্ট্রের নিপীড়নের মাধ্যমে আমাদের পার্টিকে শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা হয়। তবুও আমরা বিজেপি’র বিপদকে কখনও কম করে দেখিনি, আরজেডি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য কখনও বিজেপি’কে এক ইঞ্চি জমিও ছেড়ে দিইনি। বাংলার মাটিতেও একইভাবে বিজেপি’র বিপদ এবং তৃণমূলের অপশাসনের বিরুদ্ধে আমাদের একযোগে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। এখানে কোন সহজ সরল শর্টকাটের প্রশ্ন নেই।
সাহস, বিশ্বাস, সংগঠনের শক্তি — সব মিলিয়েই বিপ্লবী বামপন্থাকে এগিয়ে যেতে হবে।
সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের দ্বাদশ রাজ্য-সম্মেলনে ২১টি জেলা থেকে নির্বাচিত ও মনোনীত ৪০০ জন প্রতিনিধি ও পর্যবেক্ষকের মধ্যে আমন্ত্রিত ছিলেন ৮৬ জন মহিলা, উপস্থিত হয়েছিলেন ৭২ জন। মহিলা প্রতিনিধিদের অগ্রভাগে ছিলেন ক্ষেতমজুর, গরিব চাষি, বিড়ি-শ্রমিক, জন-মজুররা। এই প্রতিটি পেশায় যুক্ত শ্রমজীবী মানুষদের কথা ভাবলেই সাধারণ জ্ঞানে চোখে ভাসে পুরুষদের ছবি। অথচ, রাজ্য-সম্মেলনের ছবিটা ছিল বেশ অন্যরকম। রাজ্য-সম্মেলনে আগত পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা শ্রমজীবী মেয়েদের লড়াইগুলো ঠিক কীরকম? আসুন জেনে নিই তাদের কয়েকজনের মুখ থেকে।
হাওড়ার শিরীনা শেখ বললেন, “বিজেপি গরুর জন্য অনেক কিছু করছে কিন্তু মানুষের জন্য কিছু করছে না”। শিরীনা বলছিলেন, বিজেপি’র দৌলতে দেশজোড়া মূল্যবৃদ্ধি আর বেকারত্বের মধ্যে আমাদের রাজ্য সরকারের দুর্নীতি কিভাবে মানুষকে নাজেহাল করে রেখেছে। আমি তো পর্দানসীন ঘরের মেয়ে, যদি এখানে আসতে পারি, তবে দেশের ঘরে ঘরে মেয়েরা আছে। তাদের দাঁড়াতে হবে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে।
পুর্ব বর্ধমানের কালনা জেলায় সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির সংগঠক সুমির কথায়, লক্ষীর ভান্ডারের ৫০০ টাকা দিয়ে মেয়েদের মুখ বন্ধ রাখতে পারছেনা বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। ১০০ দিনের কাজ মুলতুবি রেখেছে সরকার। সমকাজে সমমজুরির জন্য আমরা অক্লান্তভাবে দাবি জানিয়ে যাচ্ছি। সমাজের চোখরাঙানী, নীতি-পুলিশি আর পিতৃতান্ত্রিক পরিবেশের সাথে মোকাবিলা করেই পড়াশোনা, কাজ বা কাজের দাবি তুলছে সুমির এলাকার মেয়েরা। তাঁর কথায়, “মমতা ব্যানার্জীকে বাংলার মানুষ ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনলো যাতে বিজেপি’র সাম্প্রদায়িক ও জনবিরোধী রাজনীতির কবলে আমরা না পড়ি। মেয়েরাই তো মুখ্যমন্ত্রীকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনলো কারণ আমরা বিজেপি’র বিপদ আর তাদের পিতৃতান্ত্রিক চেহারা বুঝতে পেরেছিলাম।” সম্প্রতি, হাঁসখালির গণধর্ষনের ঘটনায় সুমির এলাকার মেয়েদের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর গ্রহণযোগ্যতা কমে গেছে। তারা প্রশ্ন করছে, “আপনি যদি মেয়েদের নিয়ে এতই ভাবেন তবে মেয়েদের উপর নির্যাতন বাড়ছে কীভাবে? আর নির্যাতিতাদের পাশে দাঁড়ানোর বদলে বিরূপ মন্তব্য করছেন কেন?”
দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল মুর্শিদাবাদের কৃষক টুলুবালা দাসের সাথে। টুলুবালার মতে, কৃষক আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিয়ে আজকের শাসকদের বিরুদ্ধে আমাদের একত্রিত হতে হবে। ১৯৯৪ সালে জমির বর্গার জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে টুলুবালা সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের সংস্পর্শে আসেন। ক্ষেতমজুর পরিবারের মেয়ে টুলুবালা ছোটো থেকে অনাহার আর দারিদ্র্য খুব কাছ থেকে দেখেছেন। কোনোরকমে সঞ্চয় করে বিঘাখানেক জমি কিনে কৃষিকাজ শুরু করেন। এখন নিজের জমিতে চাষ করে শস্য সব্জি ফলান আর হাটে বিক্রী করে সংসার চালান। রাজ্য-সম্মেলনের তিন দিন বিভিন্ন রাজনৈতিক আলোচোনা আর কর্মকান্ডের মধ্যে টুলুবালার মন পড়ে আছে তার গ্রামের বিঘাখানেক জমিতে। নিজের জমির সাথে সম্পর্কের কথা বলতে গিয়ে চোখ চিকচিক করে ওঠে প্রত্যয়ী টুলুবালার। বলেন, চাষের সাথে আমার জীবন চলে। জমির সাথে আমার আত্মার যোগ। শুধু আমি নয়, আমাদের গ্রামের ৩০০ ঘর কৃষক নিজেরা শস্য ফলিয়ে হাটে বিক্রী করে। সার, বীজের দাম বেড়ে যাওয়ায় টুলুবালা বাড়িতে সার তৈরী করতে শুরু করেছেন। কিন্ত প্রতিবেশী কৃষকদের মধ্যে অনেকেই মহাজনের থেকে চড়া সুদে সার, বীজ কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। নিজের এলাকায় শাসক দলের অত্যাচার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে টুলুবালা বললেন, “ঝুঁকির মধ্যেই আমাদের অধিকারের লড়াই করি সততার সাথে। তাই আমরা ভয় পাইনা। আমরা জানি, হয় মরব নয় মারব।”
নদীয়া জেলার অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক বেলা নন্দী জনমজুরি আর ১০০ দিনের কাজ করে পেট চালান। দীর্ঘদিন ঘরে বকেয়া মজুরি আর স্থায়ী কাজের দাবিতে আন্দোলন চালাচ্ছেন বেলা। বলছেন, গ্রামের মহিলা শ্রমিকদের কাজ থেকে বঞ্চিত করে সরকারি কাজের তহবিল তছরুপ আর দুর্নীতি চালাচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেসের সদস্যরা। সরকারি নিয়মকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বাইরের গ্রাম থেকে লোক নিয়ে এসে ন্যায্য মজুরির অনেক কম টাকায় ১০০ দিনের কাজ করাচ্ছিল তৃণমূলের নেতারা। মাটি কাটার ট্র্যাক্টরের সামনে একাই দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন বেলা। আটকে দিয়েছিলেন তৃণমূলের দুর্নীতির রাজ। বলেছিলেন, “বাইরের পুরুষদের নিয়ে এসে মহিলাদের কাজ কেড়ে নিতে দেবো না। আমরা শ্রমজীবী মানুষ, খেটে খাবো। জোচ্চুরি মেনে নেবো না।” বেলার সাহস দেখে এগিয়ে এসেছিলো তার সহকর্মীরা। ৬ মাসের বকেয়া মজুরির দাবি আদায় করতে বেলার নেতৃত্বে পঞ্চায়েতে তালা লাগিয়ে দিয়েছিল অসংগঠিত ক্ষেত্রের মহিলা জন-মজুররা। বেলাকে পর্যবেক্ষক পদের লোভ দেখিয়ে ১০০ দিনের কাজের কমিটিতে ঢোকানোর চেষ্টা করেছিল শাসক দল, চেয়েছিল বেলাকে তাদের দুর্নীতিতে সামিল করতে। পদ আর ক্ষমতার সুযোগ ছুঁড়ে ফেলে বেলা তুলে নিয়েছেন মাটি কাটার কোদাল। রাজ্য সম্মেলনের মঞ্চে দাঁড়িয়ে বেলা নন্দী বললেন, “আমি মাটি কাটি, মাটি কেটে পেট চালাব। কিন্তু দুর্নীতি আর অন্যায়ের সাথে কখনো আপস করবনা”। নদীয়া জেলায় সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির নেত্রী সালেয়া খাতুনের কথায়, “দেশব্যাপী শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যাংক, বিমা, পরিবহন সহ সরকারি ক্ষেত্রগুলির বেসরকারিকরণের কোপ পড়ছে মেয়েদের উপর। মেয়েদের পড়াশোনা আর চাকরিতে সুযোগ তৈরী করার কথা যদি সরকার না ভাবে তাহলে ভাবে কে? ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’এর আড়ালে মেয়েদের পুড়িয়ে মারছে বিজেপির সরকার। কে কার সাথে থাকবে, কী খাবে, কোথায় যাবে সবই ঠিক করে দিতে চাইছে বিজেপি’র নেতা মন্ত্রীরা। এদেরকে আটকাতে ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলন দরকার।”
শিলিগুড়ির চা-বাগানের শ্রমিক নেতা মামনি বর্মন আর ময়নাগুড়ির তিলক অধিকারী রাজ্য সম্মেলনে আগত প্রতিনিধিদের কাছে তুলে ধরলেন চা-বাগানের শ্রমিকদের বঞ্চনা আর দুর্দশার করুণ ছবি। উত্তর-বঙ্গের চা বাগানে উৎপন্ন চা দিয়ে শৌখিন শহুরে মানুষেরা আসর সাজায়। অথচ, চা-বাগানের শ্রমিকদের দুর্দশা নিয়ে কতজন ওয়াকিবহল। তিলক বলছিলেন, জিনিষপত্রের দাম আকাশছোঁয়া। এর মাঝে রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের ফলে চা-পাতার বাজারি মূল্য পড়তির দিকে। যারা নিজের জমিতে চা চাষ করেন, তাদের চা বিক্রি করে হাতে কিছুই থাকছেনা। এমতাবস্থায়, অন্যের বাগানে কাজ করা চা-শ্রমিকদের অবস্থা দুঃসহ। ন্যায্য মজুরির দাবিতে মামনি-তিলকরা মিটিং, মিছিল করে শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। চা-বাগানের শ্রমিক, শ্রমিক আন্দোলনের নেত্রী, আদিবাসী সংঘর্ষ মোর্চার অন্যতম সংগঠক সুমন্তি এক্কার কথায়, “আমরা লড়াই ছাড়ছিনা। অন্যের জমিতে দিনরাত খেটে হাতে আসেনা পেট চালাবার মতো টাকা। আমাদের জমির পাট্টা চাই। যতদিন না জমির পাট্টা পাচ্ছি আমরা লড়াই চালিয়ে যাব।”
হুগলীর ধনিয়াখালিতে ঋণ-মুক্তি নিয়ে আন্দোলন চালানো রুমা আহেরী শ্রাবণী মালিকরা তুলে ধরলেন ঋণমুক্তির নিয়ে তাদের দৃপ্ত সংগ্রামের কাহিনী। মানুষের দারিদ্র আর অসহায়তার সুযোগ নিয়ে মাইক্রোফিনান্স কোম্পানী (ক্ষুদ্র-ঋণ প্রকল্প সংস্থা) চড়া সুদে ঋণ দিয়ে গেছে। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মাধ্যমে গ্রামের মেয়েদের স্বনির্ভর করার দুয়ো দেখিয়ে মেয়েদের ঋণ নিতে উৎসাহিত করেছিলো কেন্দ্র ও রাজ্য-সরকার। মাত্র চার মাসের অপরিকল্পিত লকডাউনের ফলস্বরূপ ব্যবসাগুলি ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়ে। চক্রবৃদ্ধি হারে সুদের বোঝা চাপে গ্রাম ও মফস্বলের মেয়েদের উপর। চুড়ান্ত অমানবিক মাইক্রোফিনান্স কোম্পানিদের ক্রমাগত হুমকি ও চাপের মুখে সরকারের থেকে কোনো সাহায্য না পেয়ে এলাকায় গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলেন রুমা, শ্রাবণীরা। লাগাতার পঞ্চায়েত, ব্লক, জেলা অফিস ঘেরাও চলে ঋণ-মকুবের দাবিকে ঘিরে। দেশজুড়ে চলা ঋণমুক্তি আন্দোলনকে স্থানীয় স্তরে ছড়িয়ে দিতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন এই মেয়েরা। আন্দোলনের প্রভাবে ঋণ আদায় মুলতুবি থাকলেও চড়া সুদের বোঝা কমাতে কোনো ভূমিকা নেয়নি কেন্দ্রীয় সরকার। রাজ্য সম্মেলনের শেষে শ্রাবণী শ্লোগান দিলেন, “তেভাগা, তেলেঙ্গানা, নকশালবাড়ি লাল সেলাম।”
শ্রাবণী, সালেয়া, বেলা, টুলুবালা, শিরিনার মতো মেয়েরা আজ সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের লড়াইয়ের অগ্রভাগে। অতীতের সংগ্রাম থেকে শিক্ষা নিয়ে আজকের খেটে খাওয়া মেহনতী মানুষের বেঁচে থাকার লড়াইয়ের নয়া সমীকরণ তৈরি করছেন এরা। দেশব্যাপী ফ্যাসিবাদের আগ্রাসন আর দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলির অপশাসনের বিরুদ্ধে মাথা নত না করে, সাহস আর শক্তির মিশেলে উজ্জ্বল বাংলার শ্রমজীবী মেয়েরা।
- সম্প্রীতি মুখার্জী ও সৌমী জানা
১৬ মে সিপিআই(এমএল) রাজ্য অফিসে সংবাদ কর্মীদের সাথে মিলিত হয়ে সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন—
২৫ মে রাজ্যজুড়ে আমরা নকশালবাড়ি দিবস উদযাপন করবো। ১৯৬৭ সালের ২৫মে সমাজ বদলের লক্ষ্যে কৃষক ও মেহনতি-নিপীড়িত জনগণের যে অভ্যুত্থান শুরু হয়েছিল তাকে আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করব।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি আরও বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বদল হল দিন কয়েক আগে। ক্ষমতায় আসার পর ত্রিপুরাজুড়ে ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস কায়েম করে বিপ্লব দেব একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করার চেষ্টা চালিয়েছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিপ্লব দেব গদী রক্ষা করতে পারলেন না। ২০২৩-এ নির্বাচনের ভরাডুবির আশঙ্কা থেকেই বিপ্লব দেবকে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে নিল বিজেপি। ত্রিপুরার বুকে জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনকে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
উক্ত সংবাদ কর্মী সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন পার্টির ১৩-১৫ মে রাজ্য সম্মেলনে নির্বাচিত রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার সহ পলিটব্যুরোর দুই সদস্য কার্তিক পাল ও পার্থ ঘোষ।
সংঘ ব্রিগেড জ্ঞানবাপী মসজিদ নিয়ে একটা গন্ডগোল পাকিয়ে বাবরি কাণ্ডের পুনরাবৃত্তির পরিকল্পনা করছে, যা উপাসনাস্থল আইন, ১৯৯১’র সুস্পষ্ট লঙ্ঘণ। এই আইন ১৫ আগস্ট ১৯৪৭এ সমস্ত ধর্মীয় উপাসনাস্থলের যে আইনি মর্যাদা ছিল তা নিশ্চিত করে।
এই ষড়যন্ত্র সুপ্রিম কোর্টের অযোধ্যা রায়ের মর্মবস্তুকেও লঙ্ঘণ করে, যে রায় রামমন্দির তৈরির দাবিকে বাস্তবায়িত করতে চেয়ে মসজিদ ধ্বংসের ঘটনাকে একটি গুরুতর অপরাধমূলক সক্রিয়তা হিসেবে নির্ণয় দেয়, পাশাপাশি এই প্রত্যাশায় যে এই রায় অন্য বিতর্কিত দাবিগুলিরও অবসান ঘটাবে৷
সংঘ ব্রিগেড বারবার একই উগ্র আক্রমণাত্মক শ্লোগান ‘অযোধ্যা স্রিফ এক ঝাঁকি হ্যায়, কাশী-মথুরা বাকি হ্যায়’ এর মাধ্যমে তাদের ধংসাত্বক কর্মকাণ্ড সংঘটিত করছে। সুতরাং সুপ্রিম কোর্টকে নিজেই এগিয়ে আসতে হবে এবং এই ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করতে হবে। সমস্ত শান্তিপ্রিয় ভারতীয়দের ঐক্যবদ্ধভাবে বিজেপি’র জ্ঞানবাপী অভিযানের বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে রুখে দাঁড়াতে হবে।
ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধি-নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের আকাশছোঁয়া দাম, অর্থনীতির ভয়াবহ বিশৃঙ্খল অবস্থা এবং সিংহভাগ ভারতীয় তাদের চাকরি, জীবিকা, বাসস্থান এবং জীবনের অন্যান্য মৌলিক প্রয়োজনীয়তা নিয়ে রীতিমতো আশঙ্কিত। মোদী সরকার এই সঙ্কটের কোনও সমাধান দিতে ব্যর্থ, জনগণের দুর্দশা উপশমে কোনও ত্রাণ দিতে অনিচ্ছুক, এরা শুধু পারে সঙ্কটকালে সুযোগের সদ্ব্যবহার করে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের কাটা ঘায়ে আরও নুনের ছিটে দিতে।
বৈচিত্র্য এবং সম্প্রীতি হল ভারতবর্ষের দুই স্তম্ভ যার ওপর দাঁড়িয়ে ঐক্যবদ্ধ ও দৃঢ়ভাবে ভারতবর্ষ যে কোনো ঝড়ের মোকাবিলা করতে সক্ষম। এই বুনিয়াদি ভিত্তিগুলির উপর আক্রমণ শুধুমাত্র মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অধিকার এবং ঐতিহ্যের উপর আঘাত নয়, পাশাপাশি ভারতবর্ষের মিলিত ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার এবং বলিষ্ঠ চেতনার উপর সরাসরি আক্রমণ।
- দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, সাধারণ সম্পাদক
সিপিআই(এমএল) লিবারেশন
গত ১১ মে, ইজরায়েলি দখলদার বাহিনী বিশিষ্ট প্রবীণ প্যালেস্তিনীয় সাংবাদিক শিরীন আবু আকলে’কে সুপরিকল্পিত ভাবে নিশানা করে খুন করে। ঠাণ্ডা মাথায় নৃশংস হত্যার ঘটনাটি ঘটানো হয় অধিকৃত ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক’এর জেনিন উদ্বাস্তু শিবিরে। শিরীন জেনিনে গিয়েছিলেন আল জাজিরা অ্যারাবিক’এর একজন সাংবাদিক হিসেবে ইজরায়েলি দখলদার বাহিনীর হামলার খবর করতে।
সংবাদমাধ্যমের সদস্য হিসাবে নিজেদের স্পষ্ট পরিচয় দেওয়া সত্ত্বেও শিরীন ও আরেক সাংবাদিক আলি আল-সামৌদিকে গুলি করা হয়। তারা বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরে ছিলেন, মাথায় ছিল ‘প্রেস’ লেখা হেলমেট। আলি কোনক্রমে প্রাণে বেঁচে যান, কিন্তু শিরীনকে কানের কাছে দেহের অরক্ষিত অংশে গুলি করা হয়।
শিরীন ইজরায়েলি অপরাধের দুঃসাহসিক কভারেজ করে প্যালেস্টাইনে অত্যন্ত জনপ্রিয় এক বিশিষ্ট নাম হয়ে উঠেছিলেন। জেনিন হয়ে উঠেছিল তাঁর প্রিয় শহর, তাঁর সাংবাদিক জীবনের সঙ্গেও অনেকটা জড়িয়ে গিয়েছিল জনপদটি। ২০০২-এ এখানে ইজরায়েলি আগ্রাসন নিয়ে তিনি বিস্তারিত ভাবে কভার করেছিলেন, যা নিয়ে তিনি পরে লিখেছিলেন “জেনিন আমার সাংবাদিক জীবনে, এমনকি আমার ব্যক্তিগত জীবনেও কোন এক ক্ষণস্থায়ী ‘স্টোরি’ নয়। এই সেই শহর যা আমার সাহস, আত্মবিশ্বাস, মনোবল বাড়িয়ে দেয়। আমাকে উড়ানে এগিয়ে দেয়! এখানে প্যালেস্টাইনের শৌর্য মূর্ত হয়ে আছে যা কখনও কেঁপে ওঠে, নিম্নমুখী হয়, কিন্তু আবার সমস্ত প্রত্যাশাকে ছাপিয়ে তার স্বপ্নকে ছুঁতে দুঃসাহসের ডানা মেলে অক্লান্ত উড়ানে এগিয়ে চলে।”
শিরীনের হত্যা, প্রতিদিন ইজরায়েলি দখলদার বাহিনী প্যালেস্তিনীয়দের বিরুদ্ধে কীভাবে যুদ্ধাপরাধ করে চলেছে তারই এক রূঢ় বাস্তবতাকে সামনে এনেছে। দি ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব জার্নালিস্টস (আইএফজে) এবং প্যালেস্টিনিয়ান জার্নালিস্টস সিন্ডিকেট (পিজেএস)-এর মত আন্তর্জাতিক সাংবাদিক সংগঠনগুলি প্যালেস্তিনীয় সাংবাদিকদের ধারাবাহিক ভাবে নিশানা করার জন্য ইজরায়েলের বিরুদ্ধে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের করার ঠিক পরেই তাঁকে খুন করা হল। এরআগে ২০১৮ সালে, ‘গ্রেট মার্চ অব রিটার্ন’ প্রতিবাদ বিক্ষোভের সময় সাংবাদিকের স্পষ্ট পরিচিতি সত্ত্বেও আহমেদ আবু হুসেইন এবং ইয়াসের মোর্তাজা নামে দুই সাংবাদিককে গুলি করে হত্যা করা হয়।
সিপিআই (এম-এল) ইজরায়েলি দখলদার বাহিনীর দ্বারা সাংবাদিক শিরীন আবু আকলে’র এই জঘন্য নৃশংস হত্যাকে তীব্র ধিক্কার জানিয়েছে। একই সাথে প্যালেস্টাইনের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি পুনর্বার তার দৃঢ় সংহতি জানিয়েছে।
- (লিবারেশন, মে ২০২২ থেকে)
সম্প্রতি দুর্গাপুর পৌরসভা দুর্গাপুর এলাকার লেনিনের নামাঙ্কিত একটি রাস্তার নাম পরিবর্তন করে লতা মঙ্গেশকরের নামকরণ করার সিদ্ধান্ত গ্ৰহণ করেছে। এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে জেলার ছয় বামপন্থী দল একটি যৌথমঞ্চ গড়ে তুলে রাস্তায় নেমেছে। এই মঞ্চের আহ্বানে দুর্গাপুর পৌরসভার সামনে একটি গনকনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। এই কনভেনশনে সিপিআই(এম), সিপিআই, সিপিআই(এমএল) লিবারেশন, এসইউসিআই, আরএসপি এবং ফরওয়ার্ড ব্লক যোগদান করে। এই কনভেনশনে আমাদের পাটির পক্ষে বক্তব্য রাখেন সোমনাথ চ্যাটাজী।
শান্তিপুরের সত্তর দশকের চার কমিউনিস্ট বিপ্লবী অজয় ভট্টাচার্য, কালাচাঁদ দালাল, মধুসূদন চ্যাটার্জী ও শম্ভু সরকারের শহীদত্বের ৫০তম স্মরণ অনুষ্ঠান হল গত ৫ মে শহরের বন্ধু সভাঘরে। শহীদ পরিবারের সদস্যরা সহ অভ্যাগত বন্ধু সাথীজন শহীদ বেদী ও আবক্ষ মূর্তিতে মাল্যদান-পুষ্পার্ঘ্য অপর্ণ সহ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ১৯৭২ সালের ৩ মে স্থানীয় আমবাগান অঞ্চলে পুলিশ-সিআরপি’র ঘেরাওয়ে নকশালবাড়ি আন্দোলনের অনুগামী উপরোক্ত চার কমিউনিস্ট বিপ্লবীকে হত্যা করা হয়। সেটা ছিল কুখ্যাত ইন্দিরা-সিদ্ধার্থ রায়ের সন্ত্রাসের রাজত্ব যখন বিপ্লবী কমিউনিস্ট ও বামপন্থী কর্মীদের নিত্য খুন করা হোত। এখন দেশে চলছে বিজেপি’র ফ্যাসিস্ট রাজ, আর রাজ্যে তৃণমূলের অপশাসন। বিপরীতে গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের লড়াই, বামপন্থার লড়াই থেমে নেই। এই সময় ও পরিস্থিতি বরং দাবি রাখে, লড়াইকে বাম দিশায় আরও তীব্র, আরও ব্যাপক করে তোলার। শহীদ স্মরণে মূলত অনুরূপ বক্তব্য রাখলেন অধ্যাপক বিপ্লব দাশগুপ্ত, অধ্যাপক তপন মজুমদার, সাংবাদিক রথীন পালচৌধুরী, সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের নেতৃদ্বয় জীবন কবিরাজ ও বিজয় সাহা। গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন নীতীশ রায়। একক অভিনয় করেন ‘সৃজক’ সংস্থার নিরূপম সেন, কবিতা পাঠ করেন সৃষ্টি সরকার। সভাপতিত্ব করেন মহাদেব সাধুখাঁ। স্থানীয় মানুষজনের আন্তরিক অংশগ্রহণই সবচেয়ে বড় পাওয়া।
‘চুপ করে থাকা যখন শব্দহীন পাপ
তখন গর্জন করার সময়’
- আসুন আমরা সমবেত হই -
এই আহ্বান সামনে রেখে বর্তমান সময়ে দেশব্যাপী কট্টর সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদের আক্রমণ, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও মানবাধিকার লঙ্ঘণের বিরুদ্ধে সাহিত্য সংস্কৃতির বিভিন্ন আঙ্গিকের সৃজনশীল শিল্পমাধ্যম নিয়ে প্রতিবাদী প্রতিরোধী সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে; এছাড়া পরিবেশ রক্ষা, জাতপাত ও কুসংস্কার বিরোধী আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত থাকতে গত ৮ মে বারাসাত তিতুমির মঞ্চে আহূত কনভেনশনে গঠিত হলো এক নতুন ও বৃহত্তর ‘প্রতিবাদী সাহিত্য সংস্কৃতি মঞ্চ’। এই কনভেনশন আহ্বান করে ‘সম্প্রীতি মনন’ পত্রিকা। কনভেনশনে অংশগ্রহণ করেছিলেন মূলত কলকাতা, উত্তর ২৪ পরগণা, দক্ষিণ ২৪ পরগণা, নদীয়া, হুগলি জেলার কবি সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী, সংস্কৃতির বিভিন্ন আঙ্গিকের সৃজনশীল ব্যক্তিবর্গ ও মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মীরা। অংশগ্রহণ করেন শতাধিক প্রতিনিধি।
কনভেনশন শুরু হয় গণগায়ক বাবুনি (অনুপ) মজুমদারের গণসঙ্গীতের মধ্য দিয়ে। তারপর সম্প্রীতি মনন’এর পক্ষ থেকে আহ্বান পত্র পাঠ করেন অমিত দাশগুপ্ত। কনভেনশনের উদ্দেশ্য, লক্ষ্য তথা এই সময়ে একটি প্রতিবাদী মঞ্চ গঠনের প্রয়োজনীয়তা সম্যকভাবে ব্যাখ্যা করেন কবি সব্যসাচী দেব। তিনি বলেন, ব্যক্তিগতভাবে আমরা লেখালেখি ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক মাধ্যমে আগ্রাসী সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও মানবাধিকার লঙ্ঘণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই পারি, কিন্তু যখন আমাদের উপর আক্রমণ নেমে আসবে তখন সমবেতভাবে তার মোকাবিলা করতে হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে সেই সম্ভবতাকে মাথায় রেখে একটি প্রতিবাদী মঞ্চে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতেই হবে।
পরিস্থিতি পর্যালোচনা মধ্য দিয়ে মঞ্চ গঠনের প্রয়োজনীয়তার পক্ষে বক্তব্য রাখেন লেখক কণিষ্ক চৌধুরী, লেখক কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর, লেখক অশোক মুখোপাধ্যায়, নাট্য ব্যক্তিত্ব দেবাশিস চক্রবর্তী, কবি মৃদুল দাশগুপ্ত ও সাংস্কৃতিক কর্মী শোভনা নাথ। প্রায় কুড়ি-পঁচিশ জন মঞ্চ গঠনের প্রয়োজনীয়তার পক্ষে কিছু প্রস্তাবসহ বক্তব্য রাখার পর মঞ্চ গঠনের জন্য সভার মতামত আহ্বান করা হয় ও নাম প্রস্তাব করা হয় ‘প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক মঞ্চ’। ধ্বনিভোটে মঞ্চ গঠন ও নাম গৃহীত হয়। কমিটি গঠনের জন্য দীপক মিত্র উপদেষ্টামণ্ডলী ও কার্যকরী কমিটি সদস্যদের নাম প্রস্তাব করেন এবং সবই সভা কর্তৃক গৃহীত হয়। সভাপতি হয়েছেন কবি সব্যসাচী দেব, কার্যকরী সভাপতি অমিত দাশগুপ্ত ও সম্পাদক দীপক মিত্র। উপদেষ্টামন্ডলীতে রয়েছেন বিপুল চক্রবর্তী, কণিষ্ক চৌধুরী, মৃদুল দাশগুপ্ত, অশোক মুখোপাধ্যায় ও কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর; সহসভাপতি পদে নাট্যকার দেবাশীষ চক্রবর্তী, লেখক শান্তনু ভট্টাচার্য ও ডাঃ দেবাশীষ মুখার্জী; যুগ্মসম্পাদক পদে কবি অমিতাভ সরকার, নাট্য সম্পাদক প্রশান্ত গাঙ্গুলি ও লেখক সুমন সেনগুপ্ত। কনভেনশনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেন সংহিতা বন্দ্যোপাধ্যায়, শান্তনু ভট্টাচার্য ও দীপক চক্রবর্তী; আবৃত্তি পাঠ করে শোনান শোভনা নাথ।
ঘোষিত লক্ষ্যে বলা হয়েছে, এই মঞ্চ একটি ষান্মাসিক বুলেটিন/পত্রিকা প্রকাশ করবে। রাজ্যের বিভিন্ন রাজ্যস্তরীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠন ও পরিবেশ রক্ষা সংগঠনের সাথে যৌথ কর্মসূচিতে সামিল হবে।
সমগ্র কর্মসূচি সঞ্চালনা করেন অমিতাভ সরকার।
নির্বাচন ক্ষেত্রের পুনর্বিন্যাস কমিশনের রিপোর্ট :
দেশের অন্যান্য অংশের সঙ্গে জম্মু ও কাশ্মীর বিধানসভাও নির্বাচন ক্ষেত্রগুলোর পুনর্বিন্যাস ২০২৬ সাল পর্যন্ত স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সেই সিদ্ধান্তকে খারিজ করে ঐ অঞ্চলের জন্য ডিলিমিটেশন কমিশন বা নির্বাচন ক্ষেত্রগুলোর পুনর্বিন্যাস কমিশন গঠন হয়েছিল ২০২০ সালের ৬ মার্চ, জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্য মর্যাদা হরণ ও ৩৭০ ধারা বিলোপের প্রায় সাড়েসাত মাস পর। কমিশন নিজেকে স্বাধীন সংস্থা বলে দাবি করেছিল। যার অর্থ, গণতন্ত্রকে অগ্ৰাধিকারে রেখে, নির্বাচনী প্রতিনিধিত্বের বিষয়ে অঞ্চলের জনগণের সমান অধিকার ও সুযোগকে সুরক্ষিত করেই নির্বাচন ক্ষেত্রগুলোর পুনর্বিন্যাস ঘটানো বা নতুন সীমা নির্ধারণ। কিন্তু কমিশন গত ৫ মার্চ কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে যে চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশ করে তাতে স্বাধীনতার বদলে তাদের বশংবদতারই এক নিদর্শন ধরা পড়ল, ৩৭০ ধারা বাতিলের পিছনে যে অভিসন্ধি কাজ করেছিল, কমিশনের রিপোর্টে মূর্ত হল তারই ধারাবাহিকতা। চূড়ান্ত রিপোর্ট জমা করার আগে কমিশন দু’দফা খসড়া রিপোর্ট পেশ করেছিল। ওই রিপোর্ট পেশ করা পর্বেই অভিযোগ উঠেছিল — কমিশনের কাজের ধারা রাজ্য মর্যাদা হারানো কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলটাতে নির্বাচন ক্ষেত্রে বিজেপি’র সুবিধা লাভের লক্ষ্যেই চালিত হচ্ছে। রিপোর্টের মূল প্রস্তাবগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে আজকের দেশব্রতীর ২০ জানুয়ারি ২০২২ সংখ্যায় কমিশনের কাজের এক সমালোচনামূলক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশ হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে, কমিশন বিধানসভা আসন বৃদ্ধির যে প্রস্তাব করেছে, কিছু আসনের পুনর্বিন্যাসের প্রস্তাব যে ধারায় করা হয়েছে তাতে একদিকে জম্মু শাখার তথা হিন্দু-গরিষ্ঠ ক্ষেত্রের প্রভাব সম্প্রসারণের সুযোগ করে দেওয়া, অন্যদিকে উপত্যকার তথা কাশ্মীরের প্রভাব হ্রাস করার নকশা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিশনের নেতৃত্বে ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি রঞ্জনা প্রকাশ দেশাই, অপর দুই সদস্যের একজন হলেন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার সুশীল চন্দ্র ও অপরজন জম্মু ও কাশ্মীরের নির্বাচন কমিশনার কে কে শর্মা। এছাড়া, জম্মু ও কাশ্মীরের পাঁচ সাংসদও (ন্যাশনাল কনফারেন্সের তিন ও বিজেপি’র দুই) কমিশনের সহযোগী সদস্য ছিলেন। কমিশন জানিয়েছে, জম্মু ও কাশ্মীরের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, বিশিষ্ট নাগরিকগণ, সুশীল সমাজের গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার পরই তাঁরা রিপোর্ট তৈরি করেছেন। কিন্তু রিপোর্ট এক নজরে দেখে মনে হয়, বিজেপি’র নেতৃবৃন্দ ছাড়া অন্যান্য দলের মতামত কমিশনের কাছে খুব একটা গ্ৰহণযোগ্য বলে মনে হয়নি। খুব স্বাভাবিকভাবেই, বিজেপি ছাড়া কাশ্মীরের বড়-ছোটো সব দলই কমিশনের রিপোর্টকে প্রত্যাখ্যান করেছে।
প্রথমে বিধানসভার আসন সংখ্যা বৃদ্ধির প্রস্তাবের কথাই ধরা যাক। রাজ্য মর্যাদা থাকা অবস্থায় জম্মু ও কাশ্মীর বিধানসভার আসন সংখ্যা ছিল ১১১, যারমধ্যে ২৪টি নির্দিষ্ট ছিল পাক অধিকৃত কাশ্মীর অঞ্চলের জন্য এবং সেগুলিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুযোগ কখনও ছিল না এবং তা হয়ওনি। বাকি ৮৭টি আসনের মধ্যে ৪টি নির্দিষ্ট ছিল লাদাখের জন্য, জম্মু শাখার জন্য ৩৭টি এবং উপত্যকা তথা কাশ্মীরের জন্য ৪৬টি। জম্মুর তুলনায় কাশ্মীরের আসন সংখ্যা যে ৯টি বেশি ছিল তা কাশ্মীরের জনসংখ্যা বেশি থাকার ভিত্তিতেই। কমিশন প্রস্তাব করেছে জম্মু শাখার আসন সংখ্যা বাড়ানো হবে ৬টা, তা ৩৭ থেকে বেড়ে হবে ৪৩। আর, কশ্মীর শাখার আসন সংখ্যা বাড়বে মাত্র ১টা, ৪৬ থেকে বেড়ে তা হবে ৪৭। কমিশন জানিয়েছে, ২০১১’র জনগণনার ওপর ভিত্তি করেই তাঁরা তাঁদের প্রস্তাব সমূহ তৈরি করেছেন। ২০১১’র জনগণনা অনুসারে উপত্যকার জনসংখ্যা ছিল ৬৮.৮৮ লক্ষ, আর জম্মুর জনসংখ্যা ছিল ৫৩.৫১ লক্ষ। জম্মুর তুলনায় কাশ্মীরের জনসংখ্যা ১৫ লক্ষের বেশি হলেও কাশ্মীরের তুলনায় জম্মুর আসন ৫টি বেশি বাড়ানোর প্রস্তাব করা হল। এইভাবে, দুই শাখার মধ্যেকার আসনের ব্যবধান ৯ থেকে কমিয়ে ৪এ নিয়ে আসার মধ্যে আইনসভায় উপত্যকার তুলনায় জম্মুর প্রতিনিধিত্বকে আরও জোরালো করে তোলার পরিকল্পনা প্রশ্নহীন ভাবে পরিস্ফুট। জনসংখ্যাকে গুরুত্বহীন করে তোলাটা প্রতিনিধিত্বকে সংকীর্ণ করার নামান্তর, এটা গণতন্ত্রের প্রতি অবহেলা ছাড়া অন্য কিছু হতে পারেনা। জম্মু শাখার কিছু জেলার আসনের পুনর্বিন্যাস এমনভাবে করা হয়েছে, কিছু অংশ বাদ দিয়ে এবং কিছু নতুন এলাকা যুক্ত করে ক্ষেত্রের সীমা এমনভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে যাতে আসনগুলিতে হিন্দু নির্বাচকমণ্ডলী গরিষ্ঠ হয়। যেমন, কিস্টোয়ার ও ডোডা জেলার আসনগুলোর কথা। এই দুই জেলায় আসন সংখ্যা আগে ছিল দুটো করে, নতুন প্রস্তাবে একটা করে বাড়িয়ে তিনটে করে করা হয়েছে। দুটো জেলাতেই আগের দুটো আসনেই মুসলিম ভোটার ছিল বেশি, এখন তিনটের মধ্যে দুটোতে হিন্দু ভোটার বেশি হবে। চেনাব উপত্যকার আসনগুলোকে কিভাবে হিন্দু গরিষ্ঠতাবিশিষ্ট করে তোলা হয়েছে, সে কথা জানাতে গিয়ে এলাকার পিডিপি নেতা ফিরদৌস তক বলেছেন, চেনাব উপত্যকার (যার মধ্যে রয়েছে ডোডা, রামবান ও কিস্টোয়ার জেলা) আসন সংখ্যা ৬ থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৮। কিন্তু, “আগে ছটার মধ্যে পাঁচটা ছিল মুসলিম গরিষ্ঠ; এখন আটটার মধ্যে পাঁচটাই হবে হিন্দু গরিষ্ঠ”।
জম্মুর আসনের নতুন বিন্যাসের সঙ্গে কাশ্মীরের তুলনা করা যাক। উপরে উল্লিখিত জম্মুর কিস্টোয়ার জেলার জনসংখ্যা হল ২,৩১,০৩৭ (২০১১’র জনগণনা অনুসারে)। তার আসন সংখ্যা ২ থেকে বাড়িয়ে ৩ করা হয়েছে। আর, কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলার জনসংখ্যা এর প্রায় সাড়ে চার গুণ, ১০ লক্ষ ৭ হাজার। কিন্তু এই জেলার আসন সংখ্যা বাড়ানোর গুরুত্ব কমিশন তার বিবেচনায় আনতে পারেনি।
কাশ্মীরের অনন্তনাগ লোকসভা কেন্দ্রের নতুন সীমা নির্ধারণের মধ্যেও বিজেপি’র সুবিধা করে দেওয়ার ইঙ্গিত সুস্পষ্ট। আগে জম্মু লোকসভা কেন্দ্রের অধীনে থাকা পুঞ্চ জেলা ও রাজৌরি জেলার দুই-তৃতীয়াংশকে অনন্তনাগ লোকসভা কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত করার প্রস্তাব হয়েছে। নতুন লোকসভা কেন্দ্রের নাম হবে অনন্তনাগ-রাজৌরি। প্রস্তাবিত এলাকার এক অংশের সঙ্গে অন্য অংশের দূরত্ব কয়েকশ কিলোমিটার হলেও এবং ভৌগলিক সংলগ্নতা না থাকলেও এই ধরনের সীমা নির্ধারণ কমিশনের কাছে অস্বাভাবিক বলে মনে হয়নি, সাধারণের কাছে এর যৌক্তিকতা যদিও ভেবে ওঠা মুশকিল। আসলে, পুঞ্চ ও রাজৌরি জেলার যে অংশকে অনন্তনাগ কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে সেখানে গুজ্জর ও বাকেরওয়াল জনজাতিরই সংখ্যাধিক্য। নতুন প্রস্তাবিত ক্ষেত্রের ২৬.২০ জনগণের মধ্যে এই গুজ্জর ও বাকেরওয়ালরাই হবেন ঐ জনসংখ্যার প্রায় ১৯ শতাংশ। এরা প্রকৃতিতে যাযাবর এবং ধর্মে মুসলিম হলেও কাশ্মীরি জাতিসত্ত্বার অন্তর্গত নয়। জনজাতি হওয়ায় এদের বসবাসের ৬টা বিধানসভা কেন্দ্র সংরক্ষিত করার প্রস্তাব হয়েছে। আর এই লোকসভা কেন্দ্রের ১৮টা বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে (জম্মু ও কাশ্মীরের পাঁচটা লোকসভা কেন্দ্রের প্রত্যেকটাতেই ১৮টা করে বিধানসভা ক্ষেত্র থাকবে) এই ৬টা সংরক্ষিত ক্ষেত্রও থাকবে। বিজেপি’র আশা, গুজ্জর ও বাকরেওয়ালদের প্রভাবিত করে শুধু ওই সংরক্ষিত বিধানসভা ক্ষেত্রগুলোই নয়, অনন্তনাগ-রাজৌরি লোকসভা কেন্দ্রের ফলাফলকেও তাদের দিকে ঝোঁকাতে পারবে।
জম্মু ও কাশ্মীরের আয়তনে জম্মুর ভাগ ৬২ এবং কাশ্মীরের ভাগ ৩৮ শতাংশ হলেও দুই শাখা মিলিয়ে মোট জনসংখ্যায় জম্মুর ভাগ হল ৪৩.৭২ শতাংশ এবং কাশ্মীরের ভাগ ৫৬.২৮ শতাংশ। জনসংখ্যার এই গরিষ্ঠতা সত্ত্বেও ডিলিমিটেশন কমিশনের প্রস্তাবিত আসন সংখ্যা কাশ্মীরের নির্বাচনী প্রতিনিধিত্বকে আরও প্রতিকূল করেই তুলবে। বিধানসভা আসনের মোট সংখ্যায় জম্মুর ভাগ ৪৪.৫০ শতাংশ থেকে বেড়ে হবে ৪৭.৭৭ শতাংশ, আর কাশ্মীরের অংশ ৫৫.৪০ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়াবে ৫২.২২ শতাংশে। জম্মুতে হিন্দু গরিষ্ঠ নির্বাচনী ক্ষেত্রের সংখ্যা ২৫ থেকে বেড়ে হবে ৩৩, আর মুসলিম গরিষ্ঠতার আসন ১৩ থেকে কমে হবে ১০টা। ২০১৪’র নির্বাচনে বিজেপি বিধানসভায় বিজয়ী হয়েছিল ২৫টা আসনে যার সবগুলোই এসেছিল জম্মু শাখা থেকে। এবার তাদের লক্ষ্য জম্মু থেকে বিজয়ী আসনের সংখ্যাকে আরও ১০ থেকে ১৩টি বাড়ানো, যারমধ্যে যথেষ্ট গুরুত্ব লাভ করছে সংরক্ষিত আসনগুলো (সংরক্ষিত আসনের মোট প্রস্তাব হল ১৬টা, জনজাতিদের জন্য ৯টা এবং তপশিলি জাতিদের জন্য ৭টা)। আর শুধুমাত্র জম্মু শাখা থেকে জয়লাভ করা আসনগুলোর ওপর ভিত্তি করেই তারা জম্মু ও কাশ্মীরে শাসন কায়েম করা, কোনও হিন্দু নেতাকে মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসানোর দুরভিসন্ধি লালন করে চলেছে।
এইভাবে, কাশ্মীর উপত্যকার একটা আসনেও বিজয়ী না হয়েও উপত্যকাকে, ভারতের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলকে শাসন করার বিজেপি’র অভিপ্রায়ে ডিলিমিটেশন কমিশনের কাঁধ যেন বিজেপি’র কাঁধের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। কমিশন যদিও বলেছে যে, নির্বাচনী ক্ষেত্রগুলোর পুনর্বিন্যাসে শুধু জনসংখ্যা নয়, ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য-সংযোগ পরিস্থিতি-জনসংযোগের সুবিধা-এলাকার সংলগ্নতার মতো বিষয়গুলোও তাদের বিচার্য হয়েছে, এসত্ত্বেও তাদের বিচারের ভিত্তির অযৌক্তিকতা এবং বিজেপি’র প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের মনোভাব কিছুতেই আড়াল করা যাচ্ছে না। পিডিপি নেত্রী মেহবুবা মুফতি যথার্থই বলেছেন, “ডিলিমিটেশন কমিশন বিজেপি’রই শাখা হয়ে উঠেছে এবং জনসংখ্যার মানদণ্ড উপেক্ষা করে বিজেপি যেমন চায় সেরকম কাজই করেছে। আমরা কমিশনকে বিশ্বাস করিনা। এদের সুপারিশগুলো ৩৭০ ধারাকে বাতিল করা এবং জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণের ক্ষমতাকে খর্ব করার সঙ্গে যুক্ত।” যে আইনের বলে ৩৭০ ধারা বাতিল করা হয়েছিল, ২০১৯ সালের সেই রিঅর্গানাইজেশন অ্যাক্ট বা পুনর্গঠন আইনের বৈধতা সুপ্রিম কোর্টে বিবেচনাধীন রয়েছে। ডিলিমিটেশন কমিশনের গঠনকেও অবৈধ আখ্যা দিয়ে সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছে। এই দুই বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায় যাই হোক না কেন, ডিলিমিটেশন কমিশন আর পাঁচটা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের মতো বিজেপি’র মোসাহেব বলেই যেন নিজেকে জাহির করল। কমিশন নিজেদের স্বাধীন সংস্থা বলে দাবি করলেও তার পুনর্বিন্যাসের প্রস্তাবগুলোয় জম্মু শাখার পর্যাপ্ত সুবিধা লাভ ও কাশ্মীরি জনগণের প্রতিনিধিত্ব ও ক্ষমতা হ্রাসের সম্ভাবনায় কমিশনের রিপোর্টকে শুধু নিকৃষ্ট নথি বলেই থেমে থাকা যাচ্ছেনা, তা ভারত জুড়ে চলা মুসলিম বৈরিতা ও সংখ্যাগুরুবাদী আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চলমান অভিযানের সহচর বলেই প্রতিপন্ন হচ্ছে।
- জয়দীপ মিত্র
সুসংবাদ! বুলডোজার রাজনীতির বাজারে এরকম সুসংবাদ মরুভূমিতে জল পাওয়ার মতো! গত ৩০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও হাইকোর্টের প্রধান বিচারকদের একটি সভায় দেশের ৩,৫০,০০০ বিচারাধীন বন্দীদের সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এঁরা অনেকেই গরীব ও সাধারণ ঘরের মানুষ তাই এঁদের বিষয়টা আমাদের সহানুভুতির সাথে দেখা উচিত, তিনি বলেন। একজন বিচারকের অধীনে জেলাস্তরে কমিটি করে এঁদের জামিনের আবেদন খতিয়ে দেখার তিনি নির্দেশ দেন। এছাড়াও তিনি আদালতে স্থানীয় ভাষা ব্যবহারের ওপর জোর দেন।
বেশি দিন নয়, সভার মাত্র তিন দিন পরেই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের অসাড়তা প্রমাণ হয়ে যায়। ভীমা কোরেগাঁও মামলায় অভিযুক্ত ভারভারা রাও, অরুণ ফেরেরা ও ভার্নন গঞ্জালভেস বোম্বে হাইকোর্টে আবেদন করেন, নির্ধারিত সময়ে পুলিশ চার্জশীট না দিতে পারার জন্য তাঁদের জামিন যেন না আটকায়। আদালত তাঁদের আবেদন নাকচ করে দেয়; অথচ এই একই যুক্তিতে প্রখ্যাত আইনজীবী ও সমাজকর্মী সুধা ভরদ্বাজকে কিন্তু জামিন দেওয়া হয়েছিল। এই মামলায় এখনো ১৪ জন বিনাবিচারে গ্রেপ্তার আছেন। তাঁরা ২০১৮’র ৬ জুন থেকে ২০২০’র ২৮ জুলাইয়ের মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন। কম্পিউটার হ্যাক করে, ভুয়ো নথিপত্র তাতে প্রতিস্থাপন করে, সম্পূর্ণ মনগড়া অভিযোগে তাঁদের বছরের পর বছর গ্রেপ্তার করে রাখা হয়েছে। বারবার তাঁদের জামিনের আবেদন নাকচ হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী যাঁদের জামিন দেওয়ার কথা বলেছেন তাঁদের মধ্যে এই বরেণ্য অধ্যাপক, গবেষক, সমাজকর্মীরা আছেন তো?
কিংবা দিল্লী ‘দাঙ্গা’য় গ্রেপ্তার হওয়া উজ্জ্বল যুবক যুবতীরা? ২৮ আগস্ট আবার উমর খালেদের জামিনের আবেদন মুলতুবি হয়ে গেল। এবার নিয়ে যে কতোবার, কতো বিচিত্র কারণে তাঁর আবেদন খারিজ হয়েছে তার কোনও হিসাব নেই। এবার বিচারপতি জিজ্ঞাসা করেছেন, প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে জুমলা শব্দটা ব্যবহার করা কি ঠিক? এটা করে তিনি নাকি বাক স্বাধীনতার লক্ষণরেখা অতিক্রম করেছেন! মাননীয় বিচারপতি ‘ক্রান্তিকারি’, ‘ইনকিলাব’ ইত্যাদি শব্দের অর্থও জানতে চেয়েছেন! কী বিড়ম্বনা! খালেদের আইনজীবী ত্রিদিব পাইস বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন, এই শব্দগুলোর ব্যবহার যদি ঠিক নাও হয়ে থাকে তবুও তারজন্য কাউকে কি ৫৮৩ দিন ইউএপিএ’র অধীনে বন্দী রাখা যায়! প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই বিচারাধীন বন্দীর মধ্যে উমর, গুলফিশা, শার্জিল ইমাম ইত্যাদিদের অন্তর্ভুক্ত করেননি।
তাহলে কারা আছেন তাঁর উল্লেখিত ঐ ৩,৫০,০০০ বন্দীদের মধ্যে? এদের মধ্যে রয়েছেন হতদরিদ্র, আদিবাসী, জনজাতি, দলিত মানুষ; এঁদের মুক্তি ত্বরান্বিত হবে? ঘটনা হচ্ছে, এঁদের মুক্তির জন্য যাঁরাই সরব হয়েছেন তাঁদেরকেই তো রাষ্ট্র ‘আর্বান নকশাল’ নাম দিয়ে বছরের পর বছর বিনাবিচারে জেলবন্দী করে রেখেছে। প্রয়াত ফাদার স্ট্যানস্বামী ২০১৫ সালে ঝাড়খণ্ড, ছত্তিসগড়, ওডিশা রাজ্যে ভুয়ো অভিযোগে হাজারো বন্দীদের মুক্তির জন্য ‘পারসিকিউটেড প্রিজনার্স সলিডারিটি কমিটি’ (পিপিএসসি) গঠন করেন। ভীমা কোরেগাঁও মামলায় আরেকজন অভিযুক্ত সুধা ভরদ্বাজ যিনি সম্প্রতি জামিনে ছাড়া পেয়েছেন তিনিও এই সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন। পিপিএসসি সংগঠনটিকে এনআইএ ‘মাওবাদী’ বলে তকমা মেরে দেয় এবং ফাদার ও সুধা ভরদ্বাজকে ‘মাওবাদী’ আখ্যা দিয়ে গ্রেপ্তার করে।
অথচ ওনারা দুজনেই দীর্ঘদিন ধরে ঝাড়খণ্ড ও ছত্তিসগড়ে সাধারণ মানুষকে পুলিশী হেনস্থা থেকে বাঁচানোর জন্য কাজ করেছেন। ফাদার স্ট্যানস্বামী গ্রেপ্তার হওয়ার আগে অবধি ভুয়ো অভিযোগে বন্দী মানুষদের নাম নথিভুক্ত করেছেন। তাঁর হিসাবে ৩,০০০ আদিবাসী, ২,০০০ দলিত ভুয়ো অভিযোগে রাজ্যের জেলে বছরের পর বছর হাজতবাস করছেন। এঁদের প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য তিনি হাইকোর্টে পিআইএল করেন। আদালত প্রতিটি জেল থেকে তথ্য চেয়ে পাঠায়; ব্যস ঐ পর্যন্তই। ফাদার ১০২ জন বিচারাধীন ‘নকশাল’ বন্দীদের সাথে কথা বলেছেন। বলছেন এঁদের মধ্যে ৯৭ শতাংশ নিরীহ এবং তাঁরা এতো হতদরিদ্র যে তাঁদের পক্ষে সঠিক বিচার পাওয়া অসম্ভব।
ছত্তিসগড়ে কংগ্রেস সরকার গঠিত হওয়ার পর মানুষের অন্যতম দাবি ছিল, বন্দী মুক্তি। বিজেপি শাসনের দীর্ঘ দেড় দশকে প্রায় ৬,০০০ গ্রামবাসীকে সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দিয়ে, বিভিন্ন ভুয়ো মামলায় ফাঁসিয়ে বিনাবিচারে কারারুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। এঁদের মুক্তির জন্য সোনি সোরি, হিড়মে মার্কম এবং অন্যান্য কর্মীরা ‘জেলবন্দী রিহাই মঞ্চ’ গঠন করেন। মুখ্যমন্ত্রী বাঘেল অবসরপ্রাপ্ত বিচারক এ কে পট্টনায়েকের অধীনে একটি কমিটি করেন যাঁরা বিভিন্ন কেস যাচাই করে তাঁদের মুক্তির জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করবেন। তিনি এও বলেন যে ‘মঞ্চ’ জেল বন্দীদের তালিকা তৈরি করতে এই কমিটিকে সাহায্য করবে। সেই মতো হিড়মে মার্কম অঞ্চলের গ্রামে গ্রামে ঘুরে বন্দীদের তালিকা প্রস্তুত করা শুরু করেন। কিন্তু বছর গড়িয়ে যায় কমিটির কাজ আর এগোয় না। ২০২০’র ১৭ সেপ্টেম্বর ‘মঞ্চ’ বন্দীমুক্তির দাবিতে দান্তেওয়াড়ায় একটি বড় জমায়েতের ডাক দেয়। অরবিন্দ নেতম, ভূতপূর্ব কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আদিবাসীদের দাবি সমর্থন করেন। তিনি বলেন, অনেকেই যাঁরা জেলে তাঁরা যুবক এবং তাঁদের পরিবারের একমাত্র রোজগেরে মানুষ। কংগ্রেস ৩০০ জনকে মুক্তি দেয়। সোনি এঁদের মুক্তিকে স্বাগত জানান। সাথে সাথে এটাও জানান যে, এঁদেরকে অন্য অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ‘নকশাল’ অভিযোগে নয়। ২০২১’র ৯ মার্চ মার্কম আন্তর্জাতিক মহিলা দিবস উদযাপনের জন্য মহিলাদের একটি সমাবেশ করেন। সেখানে তাঁরা বন্দীমুক্তির দাবিও উত্থাপন করেন। আধা সামরিক বাহিনী এই সমাবেশ ভেঙে দেয়, মার্কমকে গ্রেপ্তার করে এবং তাঁকে ইউএপিএ আইনে অভিযুক্ত করে। হিড়মে মার্কম গ্রেপ্তার হওয়ার ফলে কারাবন্দীদের তালিকা প্রস্তুত করার প্রক্রিয়া ব্যহত হয়। এখন সরকার এই ‘মঞ্চ’কেই ‘মাওবাদী’ স্ট্যাম্প মারা শুরু করে দিয়েছে। সংগঠনের সম্পাদক সুজিত কর্মাকে চূড়ান্ত হেনস্থা করা হচ্ছে। পুলিশ খোলাখুলি বলছে হিড়মে মার্কম আর কোনও দিনও জেলের বাইরে আসতে পারবেন না, তাঁকে একটার পর একটা কেসে অভিযুক্ত করা হবে। অদম্য সোনি সোরির ওপরেও সরকারের চাপ অব্যাহত। ভিমা কোরেগাঁও মামলাতেও তাঁর ওপর পুলিশের কড়া নজর।
তাই ৩,৫০,০০০ বিচারাধীনদের জামিন দেওয়া একটা কথার কথা মাত্র, আদপে আরও একটি জুমলা।
- সোমনাথ গুহ
দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মহিলাই শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার। একথা জানিয়েছে জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা-৫ এর রিপোর্ট। তবে দেশে মহিলাদের বিরুদ্ধে গার্হস্থ্য হিংসার পরিমাণ সামান্য কমেছে। শতকরা হিসেবে তা ৩১.২ শতাংশ থেকে কমে ২৯.৩ শতাংশ হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ১৮ থেকে ৪৯ বছর বয়সি মহিলাদের ৩০ শতাংশই ১৫ বছরের পর থেকে শারীরিক হিংসার শিকার। ৬ শতাংশ মহিলা কোনও না কোনও সময় যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে ওই রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী মনসুখ মাণ্ডবিয়া রিপোর্টটি প্রকাশ করেছেন।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার মাত্র ১৪ শতাংশ মহিলা বিষয়টি নিয়ে সরব হন। ১৮ থেকে ৪৯ বছরের বিবাহিত মহিলাদের মধ্যে ৩২ শতাংশ তাঁদের সঙ্গীর কাছ থেকে শারীরিক, যৌন বা মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। সঙ্গীর হাতে নির্যাতনের মধ্যে সব চেয়ে বেশি (২৮ শতাংশ) ঘটে শারীরিক হেনস্থার ঘটনা। তারপরে যথাক্রমে মানসিক অত্যাচার ও যৌন নির্যাতনের শিকার হন বিবাহিত মহিলারা।
মহিলাদের উপরে গার্হস্থ্য হিংসার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে (৪৮ শতাংশ) কর্নাটকে। তার পরেই রয়েছে বিহার, তেলঙ্গানা, মণিপুর এবং তামিলনাড়ুর নাম। সবচেয়ে কম লক্ষদ্বীপে এই হার মাত্র ২.১ শতাংশ। শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে মহিলাদের উপরে শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা বেশি। শহরে যখন এই হার ২৪ শতাংশ তখন গ্রামাঞ্চলে এই হার ৩২ শতাংশ। নিজের এবং সঙ্গীর শিক্ষাদীক্ষা এবং আর্থিক সঙ্গতি যত বাড়ে, এই হার তত কমে বলে দেখা গিয়েছে সমীক্ষায়। এই সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, স্কুলে যাননি এমন মহিলাদের ৪০ শতাংশই শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। অন্যদিকে স্কুলের পঠনপাঠন শেষ করেছেন, এমন মহিলাদের ১৮ শতাংশ ওই ঘটনার সম্মুখীন হন। দরিদ্রতম মহিলাদের ৩৯ শতাংশ এবং ধনীতমদের ১৭ শতাংশ মহিলা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। মহিলাদের উপরে শারীরিক নির্যাতনের ঘটনায় ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রেই স্বামীরা একাজ করে থাকেন।
পুরুষদের ক্ষেত্রেও শিক্ষা এবং আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয় মহিলাদের উপরে অত্যাচারের বিষয়টি। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, স্কুলের গণ্ডি পেরোনো ২১ শতাংশ পুরুষ যেখানে স্ত্রীর উপরে শারীরিক, যৌন বা মানসিক নির্যাতন করেন, সেখানে স্কুলের গণ্ডি না টপকানো বা অশিক্ষিত পুরুষদের মধ্যে ৪৩ শতাংশ একাজ করে থাকেন। এরসঙ্গে যুক্ত হয় মদ্যপানের বিষয়টিও। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, স্বামীর মদ্যপানের হার যত বাড়ে, স্ত্রীর উপরে যৌন বা মানসিক নির্যাতনও তত বাড়ে। নির্যাতিতা মহিলাদের ৭০ শতাংশই মত্ত স্বামীর হাতে যৌন বা শারীরিক হেনস্থার শিকার হন। অন্যদিকে স্বামী মদ্যপায়ী না হলেও ২৩ শতাংশ মহিলা এই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন। রিপোর্টে দেখা গিয়েছে, ১৮-১৯ বছরের মহিলাদের তুলনায় ৪০-৪৯ বছরের মহিলারা বেশি হিংসার সম্মুখীন হন।
- আনন্দবাজার পত্রিকা, ৯ মে ২০২২
নতুন বছরের পাঁচমাস হয়ে গেল। নতুন আর্থিক বছরেরও একমাস। এই সময়ের মধ্যে রাজ্যের বেশ কিছু জেলায় একশো দিনের কাজ বাবদ বরাদ্দ আসেনি দিল্লীর কাছ থেকে। ফলে বহুক্ষেত্রেই মজুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছে শ্রমিকদের। এই তালিকায় রয়েছে জলপাইগুড়ি, বাঁকুড়া, হাওড়ার মতো কয়েকটি জেলা। কেন এই অবস্থা? প্রশাসনের একটি সূত্রের খবর, চলতি আর্থিক বছরে গ্রামীণ এলাকায় কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্পে কেন্দ্র কোনও বরাদ্দ পাঠায়নি। এই প্রকল্পে গোটা রাজ্যে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা বকেয়া আছে বলে রাজ্য পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতর সূত্রে খবর।
প্রশাসনিক সূত্রে জানা গিয়েছে, এই মজুরি বাবদ জলপাইগুড়ি জেলায় বকেয়া ৮৫ কোটি টাকা। বাঁকুড়ায় বাকি ৩৪ কোটি টাকা, হাওড়ায় প্রায় ১০০ কোটি। তিন জেলাতেই গত ডিসেম্বর ২০২১ থেকে মজুরি দেওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে। একশো দিনের কাজে জলপাইগুড়ি অন্যতম অগ্রগণ্য জেলা। করোনাকালে পরিযায়ী শ্রমিকরা রাজ্যে ফিরে এলে তাঁদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে মূলত একশো দিনের কাজের উপরেই ভরসা করেছিল রাজ্য প্রশাসন। এখন সেখানেই যদি মজুরি বন্ধের ফলে কাজ স্তব্ধ হয়ে যায়, তা হলে এই বিপুল পরিমাণ লোকের কর্মসংস্থান হবে কী ভাবে, উঠেছে সেই প্রশ্নও।
প্রশাসন সূত্রে বলা হচ্ছে, কেন্দ্রীয় এই প্রকল্পের বরাদ্দ দিল্লী থেকে সরাসরি জেলার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে চলে আসে। গত পাঁচমাস ধরে সেই টাকা আসেনি। সম্প্রতি একশো দিনের কাজ দেখতে পরপর কয়েকটি কেন্দ্রীয় দল রাজ্যে এসেছিল। তারা বেশ কয়েকটি জেলায় ঘুরে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছিল। জলপাইগুড়ি জেলাতেও কয়েকটি কাজ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল তারা। বিজেপি’র ২০ জন সাংসদের একটি দলও লিখিত ভাবে দিল্লীর কাছে একশো দিনের কাজে দুর্নীতির অভিযোগ করেছিল।
প্রশ্ন উঠেছে, একশো দিনের প্রকল্পে বরাদ্দ বন্ধের পিছনে কি দুর্নীতির অভিযোগই মূল কারণ?
অভিযোগকারী সাংসদদের মধ্যে জলপাইগুড়ির বিজেপি সাংসদ বলেন, “কেন্দ্রীয় দল পরিদর্শনে এসে যে গরমিল দেখেছিল, তার ভিত্তিতে কোনও পদক্ষেপ হওয়াটা স্বাভাবিক।” কেন্দ্রের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী তথা বাঁকুড়ার বিজেপি সাংসদ সম্প্রতি দাবি করেন, রাজ্য একশো দিনের কাজের ‘ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট’ কেন্দ্রের কাছে ঠিক সময়ে জমা দিতে পারছে না এবং এই প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে। তাই শ্রমিকদের মজুরি সময়মতো আসছে না।
তৃণমূল অবশ্য বল বিজেপি’র দিকেই ঠেলে দিতে চাইছে। তৃণমূলের অভিযোগ, রাজ্যে বিজেপি ভোটে হারের জ্বালা এখনও ভোলেনি। তাই এখন সাধারণ মানুষকে ভোগাতে চাইছে।
এই তরজায় বিপাকে পড়েছেন একশো দিনের প্রকল্পের উপরে নির্ভরশীলেরা। তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা চলছে জেলা প্রশাসনস্তরে। জলপাইগুড়ি জেলার প্রকল্প আধিকারিক বলেন, “আমরা বাসিন্দাদের বোঝানোর চেষ্টা করছি যে, সরকারি মজুরির টাকা সকলেই পাবেন, হয়তো দেরি হচ্ছে। আশায় রয়েছি দ্রুত বকেয়া টাকা পাব।”
- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১২ মে ২০২২
আমাদের পার্টির পুনর্গঠনের স্থপতিদের অন্যতম নেতা তথা বিহারের ভোজপুরের প্রাক্তন জেলা সম্পাদক কমরেড অরূপ সেনগুপ্ত (দীনা জী) ১৫ এপ্রিল রাতে নাইটিঙ্গেল হাসপাতালে প্রয়াত হয়েছেন। মৃত্যুকালে ওঁর বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর।
মধ্যবর্তী একটা বিচ্ছিন্নতার পর্যায়ের পরে কিছুদিন আগে রাজ্য পার্টি কমিটির তরফ থেকে ওঁকে আর ওঁর স্ত্রী কমরেড কৃষ্ণা সেনগুপ্তকে তাঁদের বর্তমান বাসস্থান হুগলির কোন্নগরের গভর্নমেন্ট হাউজিংয়ে গিয়ে পার্টির বিহার রাজ্য সম্পাদক কুণালজী, পলিটব্যুরো সদস্য অমরজী ও কার্তিক পালের উপস্থিতিতে পুনরায় পার্টি সদস্যপদ প্রদান করা হয়। কমরেড অরূপ দুরারোগ্য কিডনির ক্যান্সারে শেষ কয়েক বছর যাবৎ অসুস্থ ছিলেন এবং শেষের দিকে মাল্টি অর্গ্যান ফেইলিওর হয়ে বারংবার হাসপাতাল-বাড়ি-হাসপাতাল এই চক্রে তাঁর জীবন কাটছিল। অবশেষে তাঁর জীবনদীপ নিভে যায়। পরের দিন সকালে কোন্নগর যাওয়ার পথে তাঁর মরদেহ পার্টির রাজ্য অফিসে নিয়ে আসা হলে সেখানে কার্তিক পাল, পার্থ ঘোষ, অভিজিৎ মজুমদার, তরুণ সরকার প্রমুখ পার্টির পক্ষ থেকে অন্তিম শ্রদ্ধাসহ বিদায় জানান। তাঁর মরদেহ কোন্নগরে পৌঁছালে সেখানে পার্টির জেলা সম্পাদক প্রবীর হালদার সহ সমস্ত স্তরের নেতা-কর্মীরা শ্রদ্ধা জানান। স্থানীয় পার্টি কমিটির অফিসে পার্টির পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়।
কমরেড অরূপ সেনগুপ্ত আদতে ষাটের দশকে বোকারো তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে চাকরি করতেন। সেখান থেকেই পার্টির সংস্পর্শে আসা। তারপর এক দীর্ঘ সময় যাবত তিনি পার্টির ভোজপুর জেলা সম্পাদক হিসাবে কাজ করেছেন। সংগঠন গড়ে তোলার প্রশ্নে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সুদক্ষ ও সাবলীল। পার্টি কর্মী ও সমর্থক জনগণের সাথে খুবই একাত্ম হয়ে কাজ করার কারিগর ছিলেন। তারপরে জীবনের গতিপথের আঁকবাঁকে বিহারের পরে পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপুর-আসানসোল অঞ্চলে বেশ কিছুকাল সংগঠনের কাজ করতে থাকেন। মাঝে এক সময় অপ্রত্যাশিতভাবে পার্টি যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। যখন আবার খোাঁজখবর পাওয়া গেল তখন তিনি জটিল কালান্তক কর্কট রোগে আক্রান্ত। অবশেষে চলে গেলেন চিরঘুমের দেশে। তাঁর জীবনসঙ্গী, ছেলে, মেয়ে ও অন্যান্য পরিজনদের গভীর শোকের আমরা অংশীদার। কমরেড অরূপ সেনগুপ্ত লাল সেলাম।
= 0 =