৫ জুলাই রাষ্ট্রের নির্মম ষড়যন্ত্রের হাতে খুন হয়েছেন ফাদার স্ট্যান স্বামী। গৌরী লঙ্কেশ, মহাভির নারেওয়াল থেকে ফাদার স্ট্যান স্বামী সবাই নানা রূপে গেরুয়া মতাবলম্বী হত্যাকান্ডের শিকার। যারা নিহত হচ্ছেন তাদের আদর্শ — অধিকার বুঝে নেওয়ার, মানুষের জল জঙ্গল জমিন বুঝে নেওয়ার আদর্শ। জাতীয় নিরাপত্তা আইনে একজন চুরাশি বছরের লড়াকু ব্যক্তিত্ব, যার কোনও রকম কোনও অপরাধ রাষ্ট্র প্রমাণ করতে পারেনি, তাকে তিলে তিলে খুন করা হল। চশমা পরতে না দেওয়া, ন্যূনতম চিকিৎসা না দেওয়া, তরল খাবার খাওয়ার স্ট্রটুকুও না দেওয়া, কোনও প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও চারবার জামিনের আবেদন অগ্রাহ্য করা সহ খুনের প্রত্যেকটি পদক্ষেপ আমাদের মনে আছে, আমরা ভুলিনি। বরং ঐ চশমার আড়ালে জ্বলে থাকা স্পর্ধাকে খুঁজে নিয়ে রাস্তায় নেমেছে অসংখ্য গণসংগঠন, মানুষ।
সারা দেশ, রাজ্যের মতো একুশের ডাক, সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি, অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস এ্যাসোসিয়েশন, পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদ, এপিডিআর, পিউসিএল, পিডিএসএফ, জয় ভীম ইন্ডিয়া নেটওয়ার্ক, যাদবপুর কমিউন, অরিজিত মিত্র স্মারক কমিটি সহ আরও কয়েকটি সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে ফাদার স্ট্যান স্বামীর এই পরিকল্পনা মাফিক হেফাজতে হত্যার বিরুদ্ধে গত ১০ জুলাই বিকাল থেকে এক চলমান প্রচার ও ধারাবাহিক পথসভার আয়োজন করা হয়েছিল। বাঘাযতীন হাসপাতাল মোড়ে দীর্ঘক্ষণ ব্যাপী প্রতিবাদী সভা চলে। উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী ডাক্তার বিনায়ক সেন। নানান সংগঠনের সুসজ্জিত প্ল্যকার্ড ও পোস্টারে গোটা অনুষ্ঠানটি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। বক্তব্য রাখেন তমাল চক্রবর্তী, বর্ণালী মুখার্জী, আইসার অত্রি, সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির পক্ষে সম্প্রীতি, জয় ভীমের পক্ষে শরদিন্দু উদ্দীপন, দেবাশীষ চক্রবর্তী। প্রত্যেক বক্তার বক্তব্যেই উঠে আসে শোকস্তব্ধ ক্ষোভ। দিনের পর দিন সামাজিক কর্মীদের প্রতি ইউএপিএ’র মতো বীভৎস ঔপনিবেশিক আমলের আইন ব্যবহার করে কিভাবে পরিকল্পিতভাবে আঘাত নামানো হচ্ছে, খুন করা হচ্ছে, কিভাবে রাজনৈতিক বন্দীদের উপর দিনের পর দিন অকথ্য নির্যাতন চলছে থেকে রাজ্যেও রাজনৈতিক বন্দীদের বেহাল দশা সংক্রান্ত জ্বলন্ত তথ্যাদি ও দাবি সমূহ। এরপর মিছিল শুরু হয়। কমরেড শান্তনুর “এই তপ্ত অশ্রু দিক শক্তি” গান দিয়ে সভা শুরু হয়। শেষ হয় নীতীশ রায়-এর গান দিয়ে। গোটা অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন চন্দ্রাস্মিতা। মিছিল চলাকালীন কয়েকটি স্থানে ছোট ছোট সভায় কয়েকজন বক্তা বক্তব্য রাখেন। ফাদার স্ট্যান স্বামীই সেই মানুষ যিনি লাগাতার আদিবাসী ও মুলবাসী যুবকদের নির্বিচারে ‘আরবান নকশাল’ বলে তকমা দিয়ে জেলে পচিয়ে রাখার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছেন, আওয়াজ তুলেছেন অরণ্য আইন, আদিবাসীদের অধিকার সহ একাধিক প্রশ্নে। সেই লড়াইকে এভাবে শেষ করা যাবে না — মিছিলের অগণিত মানুষ আবারও যেন সেই বার্তাই দিলেন বারংবার।
পশ্চিমবাংলার গণরায়ে বিজেপি পরাজিত হয়েছে, তবে বাম-কংগ্রেস-শূন্য বিধানসভায় গেরুয়া পরিসর পেয়েছে বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যায়। নির্বাচনে হেরে গেলেও ঘরে-বাইরে, তার কর্মীদের ও মানুষের মধ্যে প্রভাব ধরে রাখতে মরীয়া। তাই তুলে ধরছে “অতীতের চেয়ে জনপ্রতিনিধিত্ব পঁচিশ গুণ বৃদ্ধি” হওয়ার ঘটনা। বিধানসভায় শুরু থেকেই বিরোধী দলের ভূমিকার সূচনা করল প্রতিবাদ, পদত্যাগ, ওয়াক আউট করে। তৃণমূল ভেঙ্গে বিজেপির বপু বাড়ানোর কারিগর নেতার বিজেপি’র টিকিটে জেতার পরে ঘটনাক্রমে পুনরায় তাঁর পুরানো দল তৃণমূলে ফিরে যাওয়া, তাঁর বিরুদ্ধে দলত্যাগ আইনে ব্যবস্থা নিতে অনুমোদন না দিয়ে স্পিকারের দিক থেকে সভাঘরে তাঁর বসার আসন গেরুয়া দলের সারিতেই রাখা, তৃণমূলের তরফে ওই নেতাকে পুরস্কৃত করতে পিএসি’র চেয়ারম্যান করে দেওয়া, বিজেপি এসব রেয়াত করতে নারাজ। সেটা বুঝিয়ে দিতে বিধানসভার নবগঠিত সবকটি স্ট্যান্ডিং কমিটি থেকে পদত্যাগ করেছেন দলের নির্বাচিত বিধায়করা। উদ্দেশ্য হল, ‘সংঘাতের জন্য হাজির’ — এই বার্তা দেওয়া।
বিজেপির এবারের বাংলার নির্বাচনী বাজিগুলো বহলাংশে ব্যুমেরাং হয়েছে। দলের ভেতরে চলছে এখন হরেক রকমের অন্তর্দ্বন্দ্ব, বিস্তর অন্তর্কলহ। দিল্লীর কেন্দ্রীয় নেতাদের হাতে নির্বাচনী অভিযান পরিচালনার ক্ষমতা চরম কুক্ষিগত হওয়া, তৃণমূল ছেড়ে আসা নেতাদের অতিরিক্ত মাথায় তোলা, দলের পুরানো কার্যকর্তা ও সংঘ শিক্ষণ-প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত নেতাদের তেমন জনপরিচিতি গড়ে না ওঠা দুরবস্থা, নির্বাচনে তাদের দায়দায়িত্ব বা টিকিট প্রদানে গুরুত্ব ছাঁটা, প্রাক্তন তৃণমূলী মোড়লদের নিয়ে বেশি মাতামাতি, এইসব প্রতিক্রিয়া নিয়ে ঘর জেরবার হচ্ছে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে। বিজেপি এবার ১৪৯টি আসনে প্রার্থী করেছিল অন্যান্য দল থেকে আসা, প্রধানত তৃণমূল থেকে যোগদান করা ‘কেউকেটা’দের। অন্যদিকে যে ৭৭টি আসন বিজেপির দখলে এসেছে তার ৬৮ জন বিধায়ক দলের আদি অংশের, বলাবাহুল্য, আরএসএস অনুগত। তবে এই জেতাদের মধ্যে দলের প্রথম সারির আদি রাজ্য নেতাদের একজনও নেই। ফলাফলের এই চেহারা এবং ‘মুকুলাংশের’ তৃণমূলে ফেরার প্রবণতা বিজেপির হাতে ধরিয়ে দিয়েছে তৃণমূল ভাঙিয়ে চমকপ্রদ দ্রুত ফায়দা লোটার অসারতা। বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা নির্বাচন যেভাবে করা হল তা নিয়েও দলের ভেতরে দলবাজি থাকবে। বহিরঙ্গে যতই সদাশয় ‘অটুট’ ভাব দেখানো হোক যা করা হয়েছে তা একান্তই বাধ্য হয়ে। কারণ সংঘ পরিবারের প্রতি আনুগত্যের দীর্ঘ পটভূমি থাকা ছাড়া বিজেপির প্রধান প্রধান পদে স্থান সচরাচর হয় না।
বিজেপি বাংলার নির্বাচনে পরাজিত হয়েছে শুধু নয়, এরফলে বাকি ভারতে তার দম্ভ আগ্রাসন ঘা খেয়েছে, উপরন্তু লাগাতার অন্তর্দ্বন্দ্বের জ্বলুনিতে জ্বলছে। ফলে যেরকম শক্তিমত্তায় আগ্রাসী হয়ে চলছিল তাকে এখন ধাক্কা সামাল দিতে হচ্ছে। তবে তার মানে এই নয় যে এই বেসামাল অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ানোর হাল ছেড়ে দিয়েছে। বরং চেষ্টা করছে ক্রমশ ঘুরে দাঁড়ানোর।
তারজন্য সবচেয়ে জোর দেওয়ার ইস্যু পাকিয়েছে নির্বাচন পরবর্তী তৃণমূলের সন্ত্রাসকে। রাজ্যপাল আর কেন্দ্র তার বিশেষ দুই হাতিয়ার। দলের প্রতিনিধিবর্গ ও বিধায়কবর্গের রাজ্যপালের কাছে ঘনঘন হত্যে দেওয়া, রাজ্যপালের অনবরত গণতন্ত্র ‘গেল গেল’ রব তোলা, প্রচলিত সংখ্যাগত বিধিনিষেধের নিয়ম ভেঙে রাজভবনে বিজেপি বিধায়কপালকে স্বাগত জানানো — এসব চলছেই। সেইসঙ্গে কেন্দ্রে মন্ত্রীসভা রদবদলের যে পদক্ষেপ করা হল তাতেও বাংলার জন্য পরবর্তী নিশানার সংকেত খুব স্পষ্ট। বাংলার দুজন মন্ত্রীকে বিদায় দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়েছে নতুন চারজনকে। বিশেষ বিশেষ উদ্দেশ্য হল, উত্তরে জনজাতি ভোট, দক্ষিণ জঙ্গলমহল সংলগ্ন আদিবাসী ভোট, বাংলাদেশ সীমান্ত অঞ্চলে মতুয়া ভোট।
এপ্রসঙ্গে বিচার করা হয়েছে ২০১৯’র লোকসভা নির্বাচনে বিধানসভা ভিত্তিক এগিয়ে থাকা আসনগুলির মধ্যে ২০২১’র বিধানসভা নির্বাচনে জয়ের আসনগুলিকে। অগ্রাধিকার দেওয়া হল সেইমতো অঞ্চলভিত্তিক মন্ত্রীসভায় অন্তর্ভুক্তিকরণে। বিজেপি জিতেছে উত্তরবঙ্গে ৫৪টির মধ্যে ৩০টি আসনে, আর দক্ষিণবঙ্গে ২৪০টির মধ্যে ৪৭টি আসনে। সবচেয়ে ঘনীভূত জয় এসেছে উত্তরের আট জেলায়। আর দক্ষিণবঙ্গে জিতেছে বিশেষত জঙ্গলমহল সমেত বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী জেলাগুলির কেন্দ্রগুলিতে। তাই এই অঞ্চল সমূহকে ভিত্তি করে নতুন করে বিস্তারের ঘুঁটি সাজাতে চাইছে। প্রচারের মালমশলাও বানাচ্ছে।
সর্বোচ্চ স্থান দেওয়া হয়েছে সন্ত্রাসের ইস্যুকে। তার সাথে জোড়া হচ্ছে দুরকম পরিকল্পনা। একদিকে ‘হিন্দুত্বের’ ভাবধারাকে বাংলার ইতিহাস-কৃষ্টি-সংস্কৃতি-মূল্যবোধ মাথায় রেখে ‘বাংলার বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন’ করে তোলা, বিগত নির্বাচনী প্রচারে বাংলার জাতীয়তাবাদের পরম্পরাকে ‘খন্ড জাতীয়তাবাদ’ বলে উড়িয়ে দেওয়ার অবস্থান পাল্টে নেওয়া, বাংলার জাতীয়তাবাদী ঐতিহ্যের সাথে বিজেপির জাতিয়তাবাদের ছদ্ম সংযোগ স্থাপনে প্রয়াসী হওয়া; অন্যদিকে পুরো বাংলার দখল যখন এযাত্রা এল না তখন যেসব অঞ্চল আসন লাভের নিরীখে নিবিড় দখলে এসেছে সেক্ষেত্রে তলায় তলায় কেন্দ্র নিয়ন্ত্রিত ‘বঙ্গভঙ্গ’র রব তোলা বাজিয়ে দেখা — এসব ছক কষাও হচ্ছে। নতুন করে উস্কে দেওয়া হচ্ছে যা আদতে ‘ইস্যু’ হওয়ার নয়, সেই ধর্মভিত্তিক নাগরিকত্ব প্রদানের ইস্যুকে। বলা হচ্ছে, যেহেতু বিজেপি ক্ষমতায় আসতে পারেনি, এসেছে তৃণমূল, তাই সিএএ রূপায়ণ নির্ভর করছে মমতা সরকারের ওপর। এর সাথে নির্বিচারে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে বিদ্বেষের বিষ মাখানো আরও কিছু বিষয়কে। তদন্তের পরোয়া না করে বা তদন্তকে প্রভাবিত করতে কিছু ঘটনাকে পুঁজি করে রটিয়ে দেওয়া হচ্ছে অনেককিছু। প্রচার করা হচ্ছে বাংলা হল মুসলিম সন্ত্রাসবাদীদের আঁতুরঘর, ঘাঁটি, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে সন্ত্রাসবাদী অনুপ্রবেশের আন্তর্জাতিক করিডোর!!!
বিজেপি হাইকমান্ড এভাবেই নতুন করে থাবা বাড়ানোর ছক কষছে। এজন্যে তাদের জাতীয় স্তরের ‘বঙ্গাল’ ভারপ্রাপ্ত মন্ডলীর অদল-বদল ঘটাতে শুরু করে দিয়েছে। একইসাথে আরএসএস’ও হাত লাগিয়েছে বাংলার দায়-দায়িত্ব পুনর্বিন্যাসের কাজে। আসছে সংঘ নেতাদের এমন এক টিম যার নেতৃত্বে রয়েছেন নব্বইয়ের দশকের দ্বিতীয় ভাগে বাংলায় ‘বিশেষ প্রচারক’ হিসেবে পোড় খাওয়া এক নেতা। এই পদক্ষেপ করা হয়েছে অতি সম্প্রতি সংঘ নেতৃমন্ডলীর চিত্রকূটের পাঁচ দিনব্যাপী সভা থেকে।
পশ্চিমবাংলায় সামনে হওয়ার কথা বেশ কয়েকটি বিধানসভা উপনির্বাচন। তারপরে পৌরসভা নির্বাচন। ২০২৩-এ পঞ্চায়েত নির্বাচন, ২০২৪-এ লোকসভা নির্বাচন। স্বভাবতই বিজেপি বিপদ বাড়বে বৈ কমবে না।
এর মোকাবিলায় তাই এতটুকু শিথিলতা দেখানো চলবে না।
সংসদের বাদল অধিবেশনের আগে মোদী সরকার মন্ত্রীসভার বড় রকম রদবদল কার্যকর করল। তার আগে বেশ কিছু মন্ত্রী, পরিবর্তনের স্বার্থে ইস্তফা দিলেন, কারও কারও দায়িত্ব অদলবদল হল বা গুরুত্ব বাড়ানো-কমানো হল, কেউ কেউ আবার একেবারে আনকোরা — এই প্রথম মন্ত্রীত্বে ‘অভিষেক’ হল। মোদীর স্ব-ঘোষিত নীতিবাক্য — ‘ন্যূনতম প্রশাসন অধিকতম শাসন’ দ্রুত একেবারে উল্টোমুখে ঘুরে হয়ে গেল ‘গোদা প্রশাসন, অশ্বডিম্ব শাসন’!
এই বিরাট তৎপরতার তাৎপর্য কী? গুরুত্বপূর্ণ যেসব দপ্তর এই রদবদলে নাড়া খেয়েছে, সেগুলো অতিমারী পরিস্থিতিতে কড়া সমালোচনার মুখে পড়েছিল। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শ্রম, পরিবেশ, তথ্য ও সম্প্রচার এই সব গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকের সব ক’টিরই মাথায় বদল ঘটেছে। নিঃসন্দেহে, সরকার এর মধ্যে দিয়ে এই বার্তাই তুলে ধরতে চাইছে যে তার কাজ কর্মের উন্নতি ঘটাতে সে বদ্ধপরিকর। যেসব মন্ত্রী ভালো কাজ করতে পারেননি তাদের সরতে হয়েছে — এই সরকারি প্রচারই বিভিন্ন মহলে গুঞ্জরিত হচ্ছে।
এই মেগা রদবদল একটা প্রশ্নকে প্রকট করে তুলেছে। অতিমারী পরিস্থিতিতে এতগুলো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রক যদি কাজে ব্যর্থ হয়ে থাকে, তাহলে গোটা সরকারটাই ব্যর্থ হয়েছে বলা যাবে না কেন? সরকারের এই ব্যর্থতার জন্য প্রধানমন্ত্রী এবং তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী কেন মুখ্যত দায়ী হবেন না? ইঞ্জিনই যখন অচল, তখন কয়েকটি বগি পাল্টে আর কী উপকার হবে? নতুন নতুন বলির পাঁঠা খোঁজাটা স্পষ্টতই এর উত্তর নয়!
কোভিড১৯-এর দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় মোদী সরকারের পর্বতপ্রমাণ অব্যবস্থা ও বিশৃঙ্খলাজনিত ব্যর্থতা এবং পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনে বিজেপি’র প্রচণ্ড থাপ্পড় খাওয়া — বিভিন্ন রাজ্যে বিজেপি’র অন্দরে মতবিরোধকে ক্রমশ বাড়িয়ে তুলছে। মন্ত্রীসভার এই পরিবর্তন আসলে সেই সংকটকে সামাল দেওয়ার চেষ্টা। নির্বাচনমুখী উত্তর প্রদেশ পেল সাত সাতজন মন্ত্রী। নির্বাচন-উত্তর পশ্চিমবঙ্গ, যেখানে বিজেপি জনতার রায়কে বানচাল করে দিতে এবং রাজ্য সরকারকে অতিষ্ঠ করে তুলতে আদা-জল খেয়ে লেগেছে, সেখান থেকে এলেন একধিক মন্ত্রী, যাদের মধ্যে একজন আবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ’র ডেপুটি। অন্যান্য মন্ত্রীদের অনেকেই অন্য রাজ্যগুলি থেকে একই ধরনের ‘বিবেচনা’ থেকেই নির্বাচিত হয়েছেন।
বিজেপি’র রাজনৈতিক চরিত্রের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই, নতুন মন্ত্রীদের অনেকেই নানা গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত। অনেকেই তাদের দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্যের জন্য কুখ্যাত। এই নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রীই অ্যালোপ্যাথি সম্পর্কে তাচ্ছিল্যসূচক চপল মন্তব্য করেছিলেন। মন্ত্রী বাছাইয়ে সবচেয়ে নির্লজ্জতা প্রকাশ পেল অনুরাগ ঠাকুরের ক্ষেত্রে — ইনি সেই বিজেপি নেতা যাকে দিল্লী নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশন প্রচার থেকে বিরত করেছিল তার আগুন-লাগানো হুঙ্কার ‘গোলী মারো’র জন্য। এই হুঙ্কার গত বছর ফেব্রুয়ারিতে দিল্লীতে সত্যিই হিংস্র তাণ্ডব জ্বালিয়ে তুলেছিল যা কয়েক ডজন মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল। ভারতে যদি সত্যিই আইনের শাসন বহাল থাকতো, তাহলে অনুরাগ ঠাকুরের এখন জেলের ভিতর থাকা উচিত ছিল। পরিবর্তে তাকে তথা ও সম্প্রচার মন্ত্রকের ক্যাবিনেট মন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছে।
মন্ত্রীসভার রদবদল চিত্রনাট্যের সবচেয়ে ষড়যন্ত্রমূলক এবং বিস্ফোরক অংশটি হল — অমিত শাহ’র সহযোগিতার জন্য এক নতুন মন্ত্রক সৃষ্টি যার মাথায় থাকবেন তিনিই। কৃষি ও সমবায় ভারতীয় সংবিধানের সপ্তম তফসিল অনুযায়ী রাজ্যের বিষয়। গতবছর মোদী সরকার কৃষিকে কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্দেশ্যে রাজ্যগুলির যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিসরে অনুপ্রবেশ করে তিনটি আইন পাশ করে, যে আইন বাতিলের দাবিতে গণবিক্ষোভ জ্বলে ওঠে এবং এক শক্তিশালী আন্দোলন জারি রয়েছে। এবার সরকার অমিত শাহ’র অধীনে নতুন সমবায় মন্ত্রক তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোকে আরেক বার লঙ্ঘনের ইঙ্গিত দিল।
এই পদক্ষেপ গভীর আশঙ্কাময় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বার্তা বহন করছে। সমবায় ক্ষেত্র গ্রামীণ অর্থনীতির এক শক্তিশালী অংশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে, বিশেষ করে বিপণন ও ব্যাঙ্কিং-এর ক্ষেত্রে। অনেক রাজ্যেই ডেয়ারি, চিনি/আখ সমবায়, সুতা কাটা ও বস্ত্র বয়ন এবং এই ধরণের যৌথ দরকষাকষি সংস্থাগুলি গ্রামীণ অর্থনীতির চালিকাশক্তি। সমবায় ব্যাঙ্কগুলি কৃষকদের ও গ্রামীণ উৎপাদকদের অন্যান্য ক্ষেত্রগুলিতে ঋণ সরবরাহের প্রধান উৎস। মোদী সরকার ইতিমধ্যেই কৃষি এবং ব্যাঙ্কিং, উভয় ক্ষেত্রকে কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্দেশ্যে দুটি ক্ষেত্রেই বড় ধরনের সংস্কারে হাত দিয়েছে। কেন্দ্রীয় সমবায় মন্ত্রক তৈরি করা আসলে সেই অভিমুখে আরও একটি পদক্ষেপ।
সমবায় ক্ষেত্রগুলি বিভিন্ন রাজ্যের সামাজিক-রাজনৈতিক সক্রিয় শক্তিগুলির মধ্যে এক মুখ্য ভূমিকা পালন করে। বিজেপি ক্রমশ গোটা কৃষক সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে। অন্যদিকে রাজ্যগুলির যুক্তরাষ্ট্রীয় অধিকার রক্ষার উদ্দেশ্যে অ-বিজেপি শাসনে থাকা রাজ্যগুলি ক্রমশ ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। এই দুটি বিষয়কে মোকাবিলার উদ্দেশ্যে, উপরের ক্ষেত্রগুলিতে বৃহত্তর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে, বিজেপি’র বিভিন্ন রাজ্যে নিজেদের পাওয়ার লবি তৈরির উদ্দেশ্য নগ্ন হয়ে পড়েছে। দীর্ঘকালীন কৃষি সংকট এবং প্রলম্বিত অতিমারি এবং লকডাউন পরিস্থিতিতে অর্থনীতির বিপর্যয় ও ধ্বসের কারণে অনেক জায়গাতেই গ্রামীণ সমবায়গুলি খুব সংকটজনক অবস্থায় আছে। এই সংকট এবং কর্পোরেট আগ্রাসনের চাপের মোকাবিলার জন্য চাই ব্যাপকতর অংশগ্রহণ, গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও সরকারি সহায়তা। অন্যদিকে মোদী সরকার এই সংকটে সমবায়ক্ষেত্রের দখল নেওয়া এবং এটিকে কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণে আনা তথা আরও বেশি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনের বিজেপি’র ছককে কাজে লাগানোর আরেকটা সুযোগ খুঁজছে।
- এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়
এআইকেএসসিসি’র ডাকে ৮ জুলাই দেশজুড়ে প্রতিবাদ দিবসের অংশ হিসেবে পুর্ব বর্ধমান জেলায় বিভিন্ন কর্মসূচি পালন হয়।
মোদী সরকারের জনবিরোধী নীতির ফলে প্রতিনিয়ত পেট্রোল ডিজেল রান্নার গ্যাসের মুল্যবৃদ্ধি হয়ে চলেছে। ফলে সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়ে সাধারণ মানুষের নাগালের বাহিরে চলে যাচ্ছে। অথচ কেন্দ্রের সরকার উদাসীন। তাদের ট্যাক্স বসানোর ফলেই এই অস্বাভাবিক মুল্যবৃদ্ধি। কেন্দ্রের কৃষক বিরোধী আইন, শ্রমিক বিরোধী শ্রমআইন, বিদ্যুৎ বিল ও কর্পোরেট স্বার্থ রক্ষার জন্য দেশে বিলগ্নীকরণ নীতির বিরুদ্ধে দেশজুড়ে আন্দোলন সংগঠিত হচ্ছে। দিল্লীর সীমান্তে আন্দোলনরত কৃষক সংগঠনগুলোর নেতৃত্বাধীন এআইকেএসসিসি’র পক্ষ থেকে তাই পেট্রোল, ডিজেল ও গ্যাসের মুল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে দেশজুড়ে ৮ জুলাই প্রতিবাদ দিবস পালন করার কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল।
৮ জুলাই জেলার কালনা ২নং ব্লকের আগ্রাদহ বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন রাস্তার উপর এআইকেএম, আয়ারলা এবং আরওয়াইএ’র পক্ষ থেকে মিছিল প্রতিবাদসভা ও মোদীর কুশপুতুল দাহ করা হয়। শ্লোগান ছিল পেট্রোল-ডিজেলের ও গ্যাসের প্রতিনিয়ত মুল্যবৃদ্ধি কার স্বার্থে কেন্দ্রীয় সরকার জবাব দাও। তিনটি কৃষক বিরোধী আইন বাতিল করতে হবে। সমস্ত গরিব মানুষকে বছরে ২০০ দিন কাজ ও ৬০০ টাকা মজুরি দিতে হবে। সমস্ত মানুষের বিনা খরচে গ্রামে গ্রামে ভ্যাকসিন দেওয়ার ব্যাবস্থা করতে হবে। লকডাউনে কাজ হারানো লোকদের মাসিক ৭,৫০০ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। বক্তব্য রাখেন রফিকুল ইসলাম।
এছাড়া প্রতিবাদসভা সংগঠিত হয় পুর্বস্থলী ১নং ব্লকের নাদনঘাট পঞ্চায়েতের ইসলামপুর গ্রামে।
সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির পক্ষ থেকে ১১ জুলাই কালনা ২নং ব্লকের আগ্রাদহ গ্রামে পেট্রোল, ডিজেল ও গ্যাসের মুল্যবৃদ্ধি ও ফাদার স্ট্যান স্বামীর কারাগারে হত্যার বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকারকে ধিক্কার জানিয়ে প্রতিবাদ সভা সংগঠিত হয়। দাবি ওঠে ইউএপিএ সহ সমস্ত কালা কানুন বাতিল বাতিল করতে হবে। সর্বজনীন ভ্যাকসিন দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। করোনায় প্রয়াতদের পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। সভা শেষে স্বজন হারানোদের স্মরণে মোমবাতি জ্বালিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। কর্মসূচির নেতৃত্ব দেন মহিলা সমিতির জেলা সম্পাদীকা সুমি মজুমদার ও আয়ারলার জেলা কমিটির সদস্যা চিন্তামণি মুর্মু।
মন্তেশ্বর ব্লকের কুলুট গ্রামে ও বর্ধমান শহরে স্বজন হারানো স্মরণে অনুষ্ঠান হয়।
১০ জুলাই আরওয়াইএ’র পক্ষ থেকে কালনা ২নং ব্লকের কর্মী বৈঠক অনুষ্ঠিত হল। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন আরওয়াইএ’র রাজ্য নেতা সজল দে ও জেলা নেতা সমীর বসাক। বৈঠক থেকে কমিটি নির্বাচিত হয়, সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন সরিফুল সেখ। আলোচনা হয় সংগঠনকে শক্তিশালী করা এবং পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যা ও তাদের কাজের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া সম্পর্কে।
ইউএপিএ’র মতো নারকীয় আইনকে হাতিয়ার করেছে ফ্যাসিস্ট বিজেপি-আরএসএস পরিচালিত সরকার। মানবাধিকার কর্মী ও আদিবাসী জন-অধিকার কর্মী ফাদার স্ট্যান স্বামীকে সুপরিকল্পিতভাবে তিলে তিলে হত্যা করা হয়েছে এই দানবীয় আইন দুটিকে ব্যবহার করে। এই রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ১৩ জুলাই বাঁশদ্রোনী ব্রিজ সংলগ্ন স্থানে এক প্রতিবাদসভা অনুষ্ঠিত হয় সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের স্থানীয় শাখার উদ্যোগে। তবে পার্টির বাইরের অনেক মানুষ এই সভায় উপস্থিত ছিলেন। ফাদার স্ট্যান স্বামীর শহীদবেদীতে মাল্যদান এবং তাঁর স্মৃতিতে নিরবতা পালন করা হয়। সভা পরিচালনা করেন উজ্জ্বল সরকার। শান্তনু ভট্টাচার্যের গণসঙ্গীতের মধ্য দিয়ে সভা শুরু হয়। বক্তব্য রাখেন সোমনাথ গুহ, অতনু চক্রবর্তী, চন্দ্রস্মিতা চৌধুরী, তমাল চক্রবর্তী, বাসুদেব বসু, বিপ্লব দে। ইউএপিএ’র মতো দানবীয় আইন প্রত্যাহার, এই দানবীয় আইনে বন্দীদের অবিলম্বে মুক্তি এবং ফ্যাসিস্ট বিজেপি আরএসএস-এর বিরোধী কণ্ঠস্বরকে বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, দেশ বিক্রির নীল নকশা ছিঁড়ে ফেলার লক্ষ্যে, ফ্যাসি বিরোধী আন্দোলন জোরদার করার ডাক দেওয়া হয়।
এসকেএমের ডাকা ২২ জুলাই সংসদ চত্বরে প্রতিবাদে অংশ নেওয়ার জন্য দেশের ২২টি রাজ্য থেকে প্রতিবাদকারীদের দল আসছে
হরিয়ানা বিজেপি সরকারের নির্দেশে সিরসা পুলিশ কর্তৃক কৃষকদের গ্রেপ্তার এবং তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করার নিন্দা করছে এসকেএম
বাব্বু মান, অমিতোজ মান এবং গুল পানাগ এবং অন্যান্য জনপ্রিয় জনপ্রিয় পাঞ্জাবী শিল্পীরা সিংঘু সীমান্তে কৃষকদের জন্য অনুষ্ঠান করেছেন; কৃষক আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছেন এবং কৃষক আন্দোলনের প্রতি সমর্থন ও সংহতির জানানোর জন্য নাগরিকদের কাছে আবেদন জানিয়েছেন
২২ জুলাই থেকে ১৩ আগস্ট পর্যন্ত সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার পক্ষ থেকে সংসদের অভ্যন্তরে প্রতিবাদ করার আহ্বান সারা দেশ থেকে প্রবল এবং উৎসাহব্যাঞ্জক সাড়া পেয়েছে। এটা নিশ্চিত হয়ে গেছে যে পাঞ্জাব ও হরিয়ানা ছাড়াও তামিলনাড়ু, কেরল, কর্ণাটক, অন্ধ্র, তেলেঙ্গানা, ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, মণিপুর, ছত্তিসগড়, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, বিহার, ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশ ও রাজস্থান থেকে বড় বড় প্রতিনিধি দল এই প্রতিবাদে অংশ নেবে। ২৬ জুলাই ও ৯ আগস্ট মহিলা কৃষকদের বিশেষ মার্চ সংগঠিত করার কর্মসূচিতে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলি সহ সারা দেশ থেকে বিপুল সংখ্যায় মহিলা কৃষক এবং নেত্রীদের অংশগ্রহণ করতে দেখা যাবে। নিজেদের আওয়াজ তুলে ধরতে এবং দাবি জানাতে সারা দেশ থেকে আগত কৃষকদের সুশৃঙ্খল সংসদ মার্চ সংসদ সদস্যরা দেখতে পাবেন।
কৃষক বালকর সিং, নিকা সিং, দলজিৎ এবং মনদীপকে ফাগগু গ্রাম থেকে মিথ্যা অভিযোগ সাজিয়ে সিরসা পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে এবং এবং তাদের উপর দুর্ভাগ্যজনক ভাবে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনার বিরুদ্ধে নিন্দা জানাচ্ছে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি স্বাধীনোত্তর ভারতে রাষ্ট্রদ্রোহের মতো ঔপনিবেশিক যুগের দমনমূলক আইনের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করে মত প্রকাশ করার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশের এই পদক্ষেপ আরও নিন্দনীয়। বিজেপি সরকারের নির্দেশে, হরিয়ানা পুলিশ গুরুতর অবৈধ এবং অসাংবিধানিক কাজ করছে, এর তীব্র নিন্দা করছে এসকেএম। গ্রেপ্তার হওয়া সমস্ত কৃষককে এসকেএম সম্পূর্ণ আইনি সহায়তা দেবে এবং ক্ষয়ক্ষতির জন্য উপযুক্ত ত্রাণ এবং বিজেপি সরকারের শাস্তির বিষয় নিয়ে সুপ্রীম কোর্টেও যাওয়া হতে পারে। দেখা যাচ্ছে যে হরিয়ানার বিজেপি সরকার শান্তিপূর্ণ কৃষক আন্দোলনের ওপর আক্রমণ চালানো এবং দ্বন্দ্ব ও সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করার জন্য নাছোড়ান্দা মনোভাব নিয়েছে। এসকেএম দৃঢ়তার সাথে এ জাতীয় সমস্ত প্রচেষ্টা প্রতিরোধ করবে এবং কৃষকদের দাবি না মানা পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ অব্যাহত রাখবে।
সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা জনপ্রিয় পাঞ্জাবী শিল্পী বাব্বু মান, অমিতোজ মান, গুল পানাগ এবং অন্যান্য যারা আজ সিংহু সীমান্তে কৃষক এবং স্থানীয় মানুষের জন্য অনুষ্ঠান পরিবেশন করেছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে। শিল্পীরা কৃষক আন্দোলনে তাদের সম্পূর্ণ সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন এবং সবাইকে কৃষকদের সমর্থনে দাঁড়ানোর এবং কৃষক আন্দোলনের প্রতি তাদের সমর্থন ও সংহতি জানানোর আবেদন করেছেন। এটি লক্ষণীয় যে, দেশের সর্বস্তরের মানুষ কৃষকদের সমর্থনে এগিয়ে আসছেন এবং দুর্ভাগ্যজনক এই যে প্রধানমন্ত্রী মোদির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার কৃষকদের প্রতি ন্যায়বিচার করতে এবং জাতির খাদ্য সুরক্ষার যোদ্ধা কৃষকদের পাশে দাঁড়াতে পারছে না।
ভারতবর্ষের শ্রমজীবী ও গরিব মানুষদের জীবন ও জীবিকায় ধারাবাহিক লকডাউন চূড়ান্ত ভোগান্তি ডেকে এনেছে। বর্তমান অতিমারীকে সামলাতে ও মানুষের প্রাণ বাঁচাতে সরকার ব্যর্থ। তার পাশাপাশি দেশের বৃহত্তর জনগণের জীবিকা, খাদ্য-সুরক্ষা ও স্বাস্থ্যবিধির দিকে নজর না দিয়ে অপরিকল্পিত লকডাউন লাগু করা হচ্ছে বারংবার। সমাজের বিভিন্ন অংশে এই ধারাবাহিক লকডাউনের প্রভাব ভিন্নতর। লকডাউন লাগু করার প্রক্রিয়া অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়িয়েছে এবং অনেক বেশি মানুষকে দারিদ্র্য সীমার নিচে ঠেলে দিয়েছে। উপরন্তু, জনসংখ্যার দলিত ও প্রান্তিক শ্রেণির মানুষের জন্য অধিকতর অমানবিক হয়ে উঠেছে এই লকডাউন। লকডাউনকে ঢাল করে মুসলিম মানুষদের নিশানা বানানোর দৃষ্টান্ত বেড়েছে। এবং সমাজে নারীর অবস্থানকে সামগ্রিকভাবে পিছনে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এই প্রতিবেদনটির আলোচনা এগোবে নারীর কর্মসংস্থান ও স্বায়ত্ততার নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর ভিত্তি করে।
আমাদের পিতৃতান্ত্রিক ও পুরুষপ্রধান সমাজের একটি রূঢ় বাস্তব লিঙ্গ বৈষম্য এবং নারী ও অন্যান্য নিপীড়িত লিঙ্গের মানুষদের প্রান্তিকীকরণ। নারীকে অধীনে রাখা সামাজিক অনুশীলন যেটিকে বর্তমান শাসন ব্যবস্থা অনেক বেশি শক্তিশালী করে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে। মোদী পরিচালিত বিজেপি সরকার বিভিন্ন আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে নারীর উপর নির্ধারিত মনুবাদী নিয়ম-কানুন চাপিয়ে দিতে ব্যস্ত। ঐতিহাসিকভাবে, নারীকে দমিয়ে রাখার অন্যতম অস্ত্রগুলি হল তার শ্রমের স্বীকৃতি না দেওয়া, অর্থনৈতিক উপার্জনের সমান সুযোগ থেকে বঞ্চিত রাখা, গার্হস্থ্যের পরিধির মধ্যে তার চলাফেরাকে সীমিত করে দেওয়া এবং নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারের উপর আক্রমণ নামিয়ে আনা। নারীর উপর দমনের সবকটি অস্ত্রকেই তীব্রতর করে তুলেছে লকডাউন।
লকডাউনে বাড়তে থাকা বাড়ির-কাজ ও হিংসা
সর্বগ্রাসী অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সাথে পরিবারের সদস্যদের বাড়িতে থাকার মোট সময় বেড়ে যাওয়ার দরুন, পরিবারের ক্ষমতার চেনা ছকগুলি নারীদের উপর গৃহ-কাজের বোঝা বাড়িয়েছে। বিভিন্ন রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, সারা বিশ্ব ও ভারত জুড়ে নারীর উপর গৃহ-হিংসা ও হেনস্থা নানাভাবে বেড়ে চলেছে।
বাড়িতে থাকার সময় বাড়ার জন্য গৃহ-শ্রম ও পরিজনদের যত্নের কাজের ভারও বেড়েছে। পরিবারে নারীর সমাজ-নির্দিষ্ট লিঙ্গ-ভিত্তিক ভূমিকার দরুন লকডাউনে বেড়ে যাওয়া গৃহ-শ্রমের ভার অসমভাবে নারীর কাঁধেই চেপে বসেছে। ২০২০’র লকডাউনের উপর সিএমআইই’র তথ্যানুযায়ী, লকডাউনের আগের সময়ের তুলনায় বর্তমানে পুরুষদের গৃহ-শ্রমের জন্য বরাদ্দ গড় সময় বেড়েছে। কিন্তু অবৈতনিক গৃহ-শ্রমে নারীর বরাদ্দ গড় সময় পুরুষদের অনুপাতে অনেকটাই বেশি। দৈনিক ০.৫ থেকে ৪ ঘন্টা বাড়ির কাজে সময় দেওয়া পুরুষের শতকরা হার যেমন লকডাউনে বেড়েছে, তেমনই লকডাউনে বাড়ির কাজে ০ ঘন্টা দেওয়া পুরুষের শতকরা হারও বেড়েছে। গৃহস্থালিকে সচল রাখার জন্য কাজ না করে উপায় নেই নারীর, অন্যদিকে পুরুষদের সামাজিক অবস্থানের কারণে তারা চাইলেই উপেক্ষা করতে পারেন গৃহশ্রমের দায়ভার/দায়বদ্ধতা। মহিলাদের উপর বাড়তি গৃহ-শ্রমের বোঝাকে বুঝতে হবে বেকারত্বের লিঙ্গ-ভিত্তিক তাৎপর্য ও লকডাউনে মহিলাদের ক্ষয়িষ্ণু অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্যের নিরিখে।
জীবিকা ও বাড়তে থাকা লিঙ্গ-ভিত্তিক ফারাক
নারীর উপর লকডাউনের প্রভাব নির্দিষ্টভাবে আলোচনা করার আগে মনে রাখতে হবে, বিশেষত ২০১৪ সাল থেকে ভারত ধারাবাহিকভাবে বেকারত্ব ও লিঙ্গ-গত বিভেদের বৃদ্ধির মুখোমুখি হচ্ছে। পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভের তথ্য থেকে জানা যায় গত ৪৫ বছরে ভারতে বেকারত্বের হার শীর্ষে পৌঁছেছে ২০১৭ সালে। পিএলএফএস-এর তথ্য দেখায় যে, ১৫ বছরের ঊর্ধ্বে ৭১ শতাংশ পুরুষ ভারতের কর্মক্ষেত্রের অংশ, অন্যদিকে মাত্র ২৩ শতাংশ নারী কর্মক্ষেত্রে যুক্ত।
শেষ কয়েক বছরে কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণের বিষয়ে লিঙ্গভিত্তিক পার্থক্যের দিকে নজর দিলে কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্যের প্রকৃতিটি বিশদে বোঝা যাবে। কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণের হার বোঝায় একটি দেশের জনসখ্যার কত শতাংশ কর্মক্ষম ও কর্মক্ষেত্রে যোগ দিতে আগ্রহী। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে ২০০৪-০৫ ও ২০১৭-১৮’র মধ্যে শিক্ষায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে লিঙ্গ-ভিত্তিক ফারাক কমেছে, অন্যদিকে কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণে এই ফারাক বেড়েছে। নারীর কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণের হার ২০০৬এ ৩৪ শতাংশ থেকে ২০২০তে ২৪.৮ শতাংশে নেমে গেছে (বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ৬ মার্চ ২০২০ থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী)। কাজের সহজলভ্যতার ক্ষেত্রে বাড়তে থাকা লিঙ্গভিত্তিক পার্থক্য থেকে স্পষ্ট কীভাবে নারীদের উপর সামাজিক নিয়ম ও অবৈতনিক গৃহ-কাজের বোঝা চাপানো হচ্ছে। বর্তমান সময়েও এই পরিসংখ্যান বিস্ময়কর নয়, কারণ, দেশ চালাচ্ছে এমন একটি রাজনৈতিক দল যাদের আদর্শই হল নারীকে বাড়ির চৌহদ্দিতে বন্দী রাখা। আমরা বারংবার বিজেপির বহু নেতা, মন্ত্রীকে নারীদের উদ্দেশে অবমাননাকর মন্তব্য ছুঁড়ে দিতে বা নারীকে দমিয়ে রাখার আদর্শ ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে দেখেছি। কেন্দ্রের মসনদে বসে থাকা দলটির রক্ষণশীল, প্রতিক্রিয়াশীল মনুবাদী আদর্শের প্রভাব আমরা প্রত্যক্ষ করছি অর্থনৈতিক উপার্জনের সুযোগে নারীর অংশগ্রহণের ক্রমাগত ক্ষয়ের মধ্য দিয়ে।
চাকরি ক্ষেত্রে তথৈবচ অবস্থার মাঝেই দেশে প্রথম লকডাউনের আগমনে ভেসে গিয়েছিল লক্ষ লক্ষ ভারতীয়র জীবিকা। আজিম প্রেমজী ইউনিভার্সিটির ‘কর্মক্ষম ভারত ২০২১’ রিপোর্টের সিএমআইই-সিপিএইচএস তথ্য থেকে জানা যায় যে ২০২০’র এপ্রিল-মে মাসের লকডাউনে ১০ কোটি ভারতবাসী জীবিকা হারিয়েছে। ২০২০’র শেষের দিকে লকডাউন শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও, অন্তত ১ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষ জীবিকা ফিরে পাননি।
মহিলাদের চাকরি হারানোর পরিসংখ্যান পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি ভয়াবহ। কোভিড-১৯ লকডাউনের উপর আজিম প্রেমজী ইউনিভার্সিটির ‘কর্মক্ষম ভারত ২০২১’ রিপোর্ট অনুযায়ী, ৬১ শতাংশ পুরুষের জীবিকায় লকডাউনের কোনো প্রভাব পড়েনি, অথচ মহিলাদের জন্য এই পরিসংখ্যানটি মাত্র ১৯ শতাংশ। লকডাউনের পর ৭ শতাংশ পুরুষ নিজের জীবিকা পুনরুদ্ধার করতে পারেনি, যেখানে ৪৭ শতাংশ মহিলার পক্ষে নিজের কাজে ফিরে যাওয়া সম্ভব হয়েনি। এরথেকে স্পষ্ট যে বেকারত্বের কোপ মূলত মহিলাদের ঘাড়ে এসে পড়েছে।
লকডাউনের ফলে নারীর উপর চাপানো অসম শ্রম-ভারের জন্য নারীর শ্রমকে মূল্য না দেওয়া লিঙ্গ-ভিত্তিক সামাজিক ভূমিকার স্পষ্ট অবদান রয়েছে। আসুন আরো বিশদে বোঝা যাক বিষয়টি।
কোভিডে সামনের সারির কর্মীদের মধ্যে বৃহত্তর অংশ মহিলারাই, যেমন আশা, অঙ্গনওয়ারী, এএনএম, মিড-ডে-মিল কর্মী, রন্ধন কর্মী, নার্স, রেশন ও জরুরি চিকিৎসা সামগ্রী বিতরণের দায়িত্ব-প্রাপ্ত স্কুল টিচার প্রমুখ। বর্তমানে সবচেয়ে জরুরি কাজে যুক্ত থাকার জন্য কোভিডে সংক্রমণের ঝুঁকি এদের ক্ষেত্রেই সবচেয়ে বেশি। কিন্তু শ্রমিক হিসাবে ন্যূনতম আইনি স্বীকৃতিটুকু এরা পান না। এই স্কিম-ওয়ার্কারা বাধ্য হন অত্যন্ত কম ভাতায় (সাম্মানিকে) কাজ করতে। শ্রমমর্যাদা, ন্যায্য-মজুরি বা সামাজিক সুরক্ষার কোনোটিই প্রাপ্য হয়না সামনের সারিতে কর্মরত নারীদের জন্য। প্রকল্প-কর্মীদের শ্রমের এই নির্মম অস্বীকৃতির জন্য মূলত দায়ি লিঙ্গ-বৈষম্য। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার আকাঙ্ক্ষায়, এই কর্মক্ষেত্রগুলিতে যুক্ত হয়ে মেয়েরা অতিরিক্ত ঝুঁকি নেন, কিন্তু কাজের জায়গাতেও তাদের শ্রম অস্বীকৃত থেকে যায়।
জরুরি কাজ ছাড়াও, হোটেল, হসপিটালিটির ব্যবসা, পাইকারি, রিটেলিং-এর কাজ ও ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রির শ্রমিকদের এক বড় অংশ মেয়েরা। বিশ্বজুড়ে, কোভিডের ধাক্কায় সবচেয়ে বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে এই ইন্ডাস্ট্রিগুলিই।
বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক ঝুঁকির ক্ষেত্রে লকডাউনের লিঙ্গ-ভিত্তিক প্রভাব দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। ভারতের মতো একটি দেশে, যেখানে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে লিঙ্গগত ফারাক সবচেয়ে বেশি, সেখানে নারীর উপর লকডাউনের অসম বোঝা একটি রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা হওয়া উচিত। যতদিন না সরকার ও সরকারি নীতি-প্রণয়নকারীরা নারী ও প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষদের উপর লকডাউনের এই প্রভাবকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হচ্ছে, ততদিন লকডাউনের প্রভাব থেকে সেরে ওঠার যে কোনো চেষ্টাই বৃথা। বর্তমানের রাজনৈতিক নিয়তি স্বরূপ কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলটির নারীকে সম-নাগরিক হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার ন্যূনতম উদ্দেশ্যটুকু নেই। এদের শাসনকালেই, মেয়েদের স্বাধীনতা, শিক্ষা ও কাজের উপর আক্রমণ তীব্রতর হয়েছে। এই আক্রমণকে চিহ্নিত করা ও নারীর সম-অধিকারের লক্ষ্যে লড়াইকে তীব্রতর করা বর্তমানের শ্রমিক ও নারী আন্দোলনের আশু দায়িত্ব। নিজেদের উপর নেমে আসা অন্যায়ের বিরুদ্ধে স্কিম ওয়ার্কারদের দৃপ্ত ও সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ, আজকের শ্রমিক আন্দোলনের অনুপ্রেরণা। শ্রমিক-বিরোধী শ্রম-কোড, অসংগঠিত শ্রমক্ষেত্রের সবিস্তার ও শ্রমক্ষেত্রে বাড়তে থাকা লিঙ্গ-বৈষম্যের বিরুদ্ধে তীব্রতর সংগ্রাম গড়ে তোলা আজকের প্রয়োজন ও সময়ের দাবি।
- সুচেতা দে
(ভাষান্তর: সম্প্রীতি মুখার্জি, ওয়ার্কার্স রেজিস্ট্যান্স, জুলাই ২০২১ থেকে)
বারবারই উত্তর প্রদেশ চলে আসে খবরের শিরোনামে। অপরাধমূলক কাজকর্ম, নানা বিতর্কিত পদক্ষেপের জন্য উৎকট হিন্দুত্বের পোস্টার বয় যোগী আদিত্যনাথ দমনের এক সাক্ষাৎ প্রতিমূর্তি।
সামনে বিধানসভা নির্বাচন। আর, নানা সংকটে জর্জরিত আদিত্যনাথ নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে, নতুন মেরুকরণের লক্ষ্যে এখন থেকে সলতে পাকানো শুরু করে দিলেন। বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসে যোগী ঘোষণা করলেন জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের নতুন এক পলিসি। উত্তর প্রদেশ রাজ্য আইন কমিশনকে দিয়ে তৈরি করানো হয়েছে এক খসড়া। বিধানসভায় যা অনুমোদন করানোর তোড়জোড় শুরু হয়েছে।
আর, যা নিয়ে আবার দানা বেঁধে উঠেছে দেশজুড়ে নতুন বিতর্ক।
নতুন এই নীতির লক্ষ নাকি নিছক জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নয়। বরং “বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে জনসংখ্যার এক ভারসাম্য বজায় রাখার” উদ্দেশ্যেই তা তৈরি হয়েছে। এই প্রস্তাবিত নতুন নীতিতে ‘পুরস্কার’ ও ‘শাস্তি’ — উভয়েরই সংস্থান রয়েছে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের দুই সন্তানের নীতিকে কেউ লঙ্ঘন করলে তিনি স্থানীয় সংস্থার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না, সরকারি দপ্তরে কর্মরত ব্যক্তিরা এক্ষেত্রে পদন্নোতি থেকে বঞ্চিত হবেন এমনকি পাবেননা সরকারি ভর্তুকিও। অর্থাৎ, একজন নাগরিকের কিছু কিছু মৌলিক অধিকার থেকেও তাঁরা বঞ্চিত হবেন। আর, যারা তা অনুসরণ করবেন, তাঁরা সরকারি চাকুরে হলে পাবেন দু’টো বাড়তি ইনক্রিমেন্ট, মাতৃত্ব বা পিতৃত্বকালীন ১২ মাসের সবেতন ছুটি, জাতীয় পেনশন প্রকল্পে নিয়োগকর্তার দেয় অনুদানের ৩ শতাংশ বৃদ্ধি, ইত্যাদি। আর, যারা সরকারি চাকুরে নন, তাঁদের জলকরের উপর ছাড় দেওয়া হবে, গৃহঋণ ও আবাসন প্রকল্পে পাওয়া যাবে বিশেষ সুবিধা।
আমাদের দেশ, বা উত্তরপ্রদেশ কি বিরাট এক জনসংখ্যাগত বিস্ফোরণের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে? ২০১৯’র আর্থিক সমীক্ষা জানাচ্ছে যে দেশে জন্মহার কমছে। বর্তমানে যে জনসংখ্যা রয়েছে, তা ধরে রাখতে জন্মহার যত হওয়া দরকার, আমাদের রাজ্য সহ ন’টি রাজ্যে ওই হার তার থেকে কম। উত্তরপ্রদেশেও জন্মহার কমেছে। আগামী দু’দশকের মধ্যে দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ০.৫ শতাংশে নেমে আসবে। জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা বা ন্যাশনাল ফামিলি হেলথ সার্ভে ও সেন্সাস-এর তথ্য থেকে এটা স্পষ্ট যে বেশির ভাগ রাজ্য ও সামগ্রিক ভাবে দেশে জন্মহার কমছে — ১৯৯৪ সালে যা ছিল ৩.৪ তা ২০১৫-তে নেমে এসেছে ২.২-তে। হিন্দুত্ববাদী বিদ্বেষমূলক প্রচারের বিপরীতে সরকারি সমস্ত সমীক্ষায় এটাই প্রমাণিত যে সমস্ত ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ভেতরেই জন্মহার দ্রুতই কমছে, হিন্দুদের তুলনায় মুসলমানদের মধ্যে তা কমছে আরও দ্রুত হারে। এমনকি সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য উত্তরপ্রদেশেও, গত একদশকের মধ্যে, রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে কোনো নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ ছাড়াই জন্মহার বেশ কমেছে।
দক্ষিণ ভারতে জন্মহার নিয়ন্ত্রণের সাফল্যের নেপথ্যে রয়েছে তুলনামূলক আর্থিক বৃদ্ধি। তারসাথে হাতে হাত মিলিয়ে মহিলাদের স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও বেশ কিছু সামাজিক সুযোগ সুবিধা ভালোই কাজ করেছে। এজন্য রাজ্য সরকারগুলোর পক্ষ থেকে কোনো শাস্তিমুলক পদক্ষেপের প্রয়োজন হয়নি। বার বার দেখা গেছে, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে যে কোনো শাস্তিমূলক পদক্ষেপে গরিব, প্রান্তিক মানুষদেরই আরও বেশি মাশুল দিতে হয়েছে। এটাও প্রমাণিত, আর্থিক ও সামাজিক স্তর নির্বিশেষে মহিলাদের বেছে নেওয়ার বা নিজেদের মতামত প্রকাশ করার পুরো অধিকার থাকলে তা জন্মহার নিয়ন্ত্রণে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এটাই আজ সর্বজনগ্রাহ্য নীতি হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আরেক বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী, অসমের হিমন্ত বিশ্বশর্মা বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প পাওয়ার শর্ত হিসাবে দুই সন্তানের নীতি প্রয়োগ করেছেন। বলাই বাহুল্য, এই নীতি স্পষ্টতই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লক্ষ্যেই পরিচালিত।
যে রাজ্যটি কোভিড অতিমারীতে ছাড়খার, মৃত্যুর মিছিল ও মর্মান্তিক আখ্যান গোটা দেশকে আলোড়িত করে, যেখানে মৃতেরা পায়না সম্মান ও মর্যাদা, গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া হয় শত শত লাশ, এই অসহনীয় ট্রাজিক উপাখ্যানের থেকে নজর ঘুরিয়ে আবার সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের অভিমুখে যোগী শুরু করেছে তার যাত্রা। নির্বাচনী ফায়দা তোলার সংকীর্ণ লক্ষ্যে। নির্বাচন জেতার জন্য নাগরিকদের যে আরও কত মাশুল দিতে হবে কে জানে!!
- অতনু চক্রবর্তী
ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা যে মোদী সরকারের আমলে উত্তরোত্তর খারাপ হচ্ছে তা অনুভব করার জন্য অর্থনীতিবিদ হওয়ার কোনো দরকার নেই। আমজনতা তা রোজ বুঝতে পারেছে। তবে রামধাক্কার চোটে তা আমাদের মস্তিষ্কের কোষে যথাবিহিত আঘাত করছে কিনা সেটাই বিবেচ্য। ২০২০-২১ অর্থবর্ষের প্রথম ত্রৈমাসিকের চরম ঋণাত্মক বৃদ্ধিকে বাদ দিলে বা তার পরের দুটি ত্রৈমাসিকের ঋণাত্মক ও প্রায় শূন্য বৃদ্ধিকে ধর্তব্যে না এনেও জিডিপি বৃদ্ধির হার ২০২০-২১’র শেষ ত্রৈমাসিকে ১.৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। যা ২০১৮-১৯’র শেষ ত্রৈমাসিকে ৭.১ শতাংশ ছিল। ২০২০-২১’র মাথাপিছু আয় ৯৯,৬৯৪ টাকায় নেমে এসেছে যা ২০১৭-১৮ সালে ১,০০,২৬৮ টাকা ছিল। আদতে ভারতের মাথাপিছু আয় এখন ২০১৬-১৭ সালের স্তরে পৌঁছেছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী জনসাধারণের সঞ্চয়ও কমছে। ফলে অর্থনীতিতে সর্বব্যাপী অনিশ্চয়তা। যেকোনো বৃদ্ধিকেই প্রবল ঢাকঢোল বাজিয়ে অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানো বলে প্রমাণ করতে সরকার বদ্ধ পরিকর। সম্প্রতি প্রকাশিত মে, ২০২১’র পরিকাঠামো ক্ষেত্রের উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও অনুরূপ প্রচেষ্টা দেখা গেল। গত ২০২০ সালের মে মাসের তুলনায় এবছরের মে মাসে ১৬.৮ শতাংশ বৃদ্ধি ঘটেছে। সরকার তা নিয়ে উল্লসিত। কিন্তু সরকার বলছে না যে গত বছরের মে মাসে ওই ক্ষেত্রের হ্রাস ঘটেছিল ২১.৪ শতাংশ। ফলে ২০১৯ সালের মে মাসের তুলনায় ২০২১ সালের মে মাসের পরিকাঠামো ক্ষেত্রের উৎপাদন কমেছে ৮.২ শতাংশ। অর্থাৎ ২০১৯ সালের মে মাসে যদি ওই পরিকাঠামোক্ষেত্রের উৎপাদন হত ১০০ টাকা, তাহলে ২০২১ সালের মে মাসে উৎপাদন হয়েছে ৯১ টাকা ৮০ পয়সা। ২ বছর বাদে পরিকাঠামো শিল্পগুলিতে উৎপাদনের এই বিপুল হ্রাসকে উন্নতি বলেনা। বলে চরম অবনতি। একে উন্নতি বলে দেখানোর প্রচেষ্টাই আসলে মোদী সরকারের মিথ্যাচারের দর্শন।
সাম্প্রতিক অন্যান্য সমীক্ষাও দেশের অর্থনীতির বেহাল অবস্থার দিকে ইঙ্গিত করছে। গত বছরের আগস্ট মাস থেকে দেশের দ্রব্য প্রস্তুতকারী ক্ষেত্রের (ম্যানুফ্যকচারিং ক্ষেত্র) কাজকর্ম বাড়ছিল। অর্থাৎ, গত বছরে ২৪ মার্চ থেকে শুরু করা মানুষমারা লকডাউনের পরে ম্যানুফ্যকচারিং ক্ষেত্র ধীরে হলেও উৎপাদন বাড়াচ্ছিল। কিন্তু সেই গতি দেশের ওই ক্ষেত্রটি হারাতে শুরু করেছে। ম্যানুফ্যকচারিং ক্ষেত্রের বৃদ্ধি বা হ্রাসের সূচক মাপা হয় মরশুমের জন্য আইএইচএস মার্কিট ইন্ডিয়া ম্যানুফ্যকচারিং পারচেজিং ম্যানেজারস ইন্ডেকস (পিএমআই) দ্বারা। ওই সূচকের (পিএমআই) মান ৫০ পেরোলে বৃদ্ধি বোঝায়, ৫০’এর কম হলে হ্রাস। গত মে মাসে তার মান ছিল ৫০.৮। জুন মাসে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪৮.১। গত বছরের আগস্ট মাস থেকে শুরু করে ১০ মাসের যে বৃদ্ধি তা জুন মাসে হ্রাসে পরিণত হয়েছে। ওই সমীক্ষা অনুসারে কারখানার অর্ডারে, উৎপাদনে, রফতানিতে, ক্রয়ের পরিমাণে সঙ্কোচন পুনরায় দেখা যাচ্ছে। তাছাড়াও ব্যবসার ক্ষেত্রে নৈরাশ্যব্যঞ্জক পরিস্থিতিতে কর্ম সঙ্কোচন ক্রমাগত চলছে। কোভিড-১৯ জনিত নিষেধাজ্ঞা ভারতীয় পণ্যের আন্তর্জাতিক চাহিদাকেও কমিয়ে দিয়েছে, ফলে ১০ মাসে এই প্রথম রফতানির অর্ডারে হ্রাস পরিলক্ষিত হয়েছে। অপরদিকে সমস্ত কাঁচা মালের দাম বেড়েছে, বেড়েছে পরিবহণ খরচ, যার ফলে উৎপাদিত পণ্যের দামও বাড়ছে। সমীক্ষা অনুসারে সবথেকে উৎপাদন কমেছে মূলধনী দ্রব্যের ক্ষেত্রে, কাজও কমেছে ওই ক্ষেত্রটিতে।
এই পরিস্থিতি থেকে বেরোনোর জন্য মোদী সরকারের কোনো আন্তরিক প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। যদিও গরিব ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের উপরেই সর্বাধিক ধাক্কা লেগেছে তবুও তাদের হাতে নগদ দিয়ে ক্রয়ক্ষমতা বাড়নোর বদলে যোগানের দিকের অর্থনীতিতেই মোদী সরকারের জোর দেওয়া চলছে।
চলতি আর্থিক বছরে কেন্দ্র সরকার সাকুল্যে ৫০ হাজার কোটি টাকা অতিমারির জন্য অতিরিক্ত বাজেট বরাদ্দ করছে, যার মধ্যে রয়েছে সারে বর্ধিত ভরতুকি ও নভেম্বর মাস পর্যন্ত দরিদ্রদের জন্য বিনামূল্যে খাদ্যশস্য প্রদান। অর্থনীতিকে চাঙা করতে গেলে সরাসরি সাহায্য দরকার একথা সরকার মানতেই চাইছে না। কেবল যোগানের দিক থেকেই সমস্যা সমাধান করতে চাইছে। গত বছরেও সকল অর্থনীতিবিদরা চাহিদা বাড়ানোর জন্য দরিদ্র ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের হাতে সরাসরি নগদ পৌঁছানোর কথা বলেছিল। কিন্তু সরকার যে ২০ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজ তৈরি করেছিল তাতে ওই ঋণ-নিশ্চয়তা এবং সংস্থাগুলিকে নগদ পাওয়ার ক্ষেত্রে সুবিধে প্রদানের রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বন্দোবস্তের কথা ছিল। কিন্তু তারফলে অর্থনীতি চাঙা হয়নি। ২০২০-২১এ মোট মূলধন গঠন ও ব্যক্তিগত ভোগ ব্যয় উভয়ই বিপুল পরিমাণে কমেছে। দ্বিতীয় ঢেউ-এর সময়েও সরকার একই পদ্ধতি অনুসরণ করছে। ফলও একই রকম হবে।
অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ৬.২৮ লক্ষ কোটি টাকার অর্থনৈতিক উজ্জীবনের প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন যার মাধ্যমে অর্থনীতির ধুঁকতে থাকা ক্ষেত্রগুলি ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিলে সরকার গ্যারান্টর হিসেবে দাঁড়াবে। ইতিমধ্যে অতিমারীর জন্য সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত ভ্রমণশিল্পের মালিকরা জানিয়েছে যে এমনিতেই তাদের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ, ওদিকে বেড়াতে আসার কোনো নিশ্চয়তা অদূর ভবিষ্যতে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে ঋণ নিয়ে কোনো লাভ হবে না। ভ্রমণ ব্যবস্থাপক, হোটেল ও রেস্তোরা মালিকরা ওই ঋণের গ্যারান্টিতে কোনো সুরাহা খুঁজে পাচ্ছে না কেননা, ঋণ শোধ দেওয়ার জন্য দরকার আয়। ওই প্যাকেজেই ৫ লক্ষ বিদেশী পর্যটক ভিসায় ফি ছাড় দেওয়া হলেও তাতে যতদিন ভ্যাকসিনেশন না হবে ততদিন বিদেশীরা বেড়াতে আসবে বলে মনে করছেনা পর্যটকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলি। ওদিকে সামগ্রিক টিকাকরণের ভগ্নাংশ পরিমাণ সম্পূর্ণ হওয়ায় পর্যটক আগমনের ক্ষেত্রে কোনো আশার বাণী নেই। পর্যটন, রেস্তোরা, হোটেল ও পরিবহণ যেহেতু শ্রমনিবিড় ক্ষেত্র, তাই এখানে বিপুল পরমাণ মানুষ নিয়োজিত থাকে। দ্রুত গণ-টিকাকরণের দ্বারাই এই ক্ষেত্রকে চাঙা করা যেতে পারে। তা না হলে ঋণের গ্যারান্টি গোড়া কেটে আগায় জল দেওয়া হবে। সিএমআইই তথ্য অনুসারে অতিমারীর দ্বিতীয় ঢেউ’এ ৯৭ শতাংশ শ্রমিকের উপার্জনে ক্ষতি হয়েছে, যুবকদের মধ্যে বেকারির হার এপ্রিল-মে মাসে ২৮ শতাংশে পৌঁছেছে। ঋণ-নিশ্চয়তা প্রকল্প এক্ষেত্রে কোনো উদ্দীপক প্রভাব ফেলতে পারবে না।
ফারজানা আফ্রিদি, অমৃতা ধীলন ও সঞ্চারি রায় একটি সমীক্ষা করেছেন দিল্লীতে অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকদের উপরে। প্রায় ৩,০০০ মানুষের উপরে গত ২০২০ সালে লকডাউনের সময়ে দুটি পর্যায়ে, একটি প্রথম পর্যায়ে ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত যখন কঠিনতম লকডাউন চলছিল তখন ও দ্বিতীয় পর্যায়ে যখন লকডাউন কিছুটা শিথিল হয়েছিল ২০ এপ্রিল থেকে ৩ মে পর্যন্ত সমীক্ষাটি করেছিলেন। এরপরে লকডাউন উঠে যাওয়ার পরে আগস্ট থেকে অক্টোবর, ২০২০ পর্যন্ত, এবং সম্প্রতি এপ্রিল ২০২১ থেকে জুন ২০২১ পর্যন্ত, যখন স্থানীয় স্তরে লকডাউন চলেছে, তখন পুনরায় ওই মানুষদেরই মধ্যে সমীক্ষাটি করা হয়।
পুরুষ মানুষের ক্ষেত্রে অতিমারীর প্রথম পর্যায়ে কাজে নিযুক্ত কর্মীর সংখ্যা ৯১ শতাংশ থেকে কমে ৬৫ শতাংশে নেমে এসেছিল। তা আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পেয়ে ৭৭ শতাংশে পৌঁছেছিল, কিন্তু গোড়াতে থাকা ৯১ শতাংশে ফেরত যায়নি। ফলে বলা যায় যে কোভিড স্থায়ীভাবেই প্রায় ১৪ শতাংশ পুরুষের কাজ কেড়ে নিয়েছিল। দ্বিতীয় পর্যায়ে নুতন করে কাজ হারিয়েছে পুরুষেরা। কাজে নিযুক্ত মানুষের পরিমাণ ৬০ শতাংশে নেমে এসেছিল। ফলে কোভিড পূর্ববর্তী সময়ে নিযুক্ত ৯১ শতাংশ পুরুষের এক-তৃতীয়াংশের বেশি কোভিডের দ্বিতীয় পর্যায়ে কর্মহীন অবস্থায় রয়েছে। কোভিডের প্রথম পর্যায়ের পরে বেতনভোগী চাকুরিজীবীরা স্বনিযুক্ত বা অনিয়মিত শ্রমজীবীদের তুলনায় অধিক অনুপাতে কাজ ফিরে পেয়েছিল। ৮১ শতাংশ বেতনভোগী, ৭৮ শতাংশ স্বনিযুক্ত ও ৭৫ শতাংশ অনিয়মিত শ্রমজীবী মানুষ কাজ ফিরে পেয়েছিল। কোভিডের দ্বিতীয় পর্যায়ে ২৪ শতাংশ অনিয়মিত ক্যাজুয়াল কর্মী, ১৮ শতাংশ স্বনিযুক্ত ও ১৪ শতাংশ বেতনভোগী কর্মচারী কাজ খুঁইয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে যে যত গরিব বা যার জীবন যত অনিশ্চিত তিনি তত বেশি কষ্টে নিমজ্জিত হচ্ছেন।
আয় এবং চাহিদার উপরে গত কয়েক বছরের ধাক্কার প্রভাব যথেষ্টই। আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমীক্ষা জানাচ্ছে যে, ২৩ কোটি মানুষ নতুন করে দারিদ্রসীমার নীচে নেমেছে। পাশাপাশি পিউ রিসার্চের সমীক্ষাও বলছে যে বিশ্বে যত মানুষ মধ্য আয় থেকে নিম্ন আয়ের স্তরে নেমেছে তার ৫৭ শতাংশ ভারতের জনতা। অর্থমন্ত্রীর দ্বিতীয় ঢেউ-এর প্যাকেজেও সেই মানুষগুলির জন্য কোনো সুরাহা নেই। ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের মোদী-খোয়াব এখন ভারতের জনগণের দুঃস্বপ্নে পরিণত হওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। মোদীর এক দশকের শাসনকাল দেশের বুকে অন্যতম নিকৃষ্ট অর্থনৈতিক দশক হতে চলেছে, যেখানে অর্থনৈতিক বন্ধ্যা, বেকারি, মুদ্রাস্ফীতি, সঞ্চয়, আয়, বিনিয়োগ সমস্ত ক্ষেত্রে ব্যর্থতাই দেখা যাবে।
- অমিত দাশগুপ্ত
ইয়াস সাইক্লোনে পশ্চিমবঙ্গের উপকূলবর্তী অঞ্চল ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর রাজ্য সরকার ‘দুয়ারে ত্রাণ’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল। প্রচার করা হয়েছিল যে আমফান ঘূর্ণিঝড়ের পরে ক্ষতিপূরণের নামে যে অরাজকতা এবং লুটপাট চালানো হয়েছিল এবার তা হবে না। এবার নাকি ‘নিখুঁত যাচাই-ব্যবস্থা’র মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ বণ্টন হবে। সেই ক্ষতিপূরণের প্রাথমিক তথ্য আজ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। কতটা নিখুঁতভাবে চলছে ইয়াস ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতিপূরণ বণ্টন?
ঘূর্ণিঝড়ের পর মুখ্যমন্ত্রী হিসেব দিয়েছিলেন ২.২১ হেক্টর চাষের জমি ক্ষতিগ্রস্ত, ৩ লক্ষ বাড়িঘর ভেঙেছে। ক্ষতির পরিমাণ ২০ হাজার কোটি টাকা। এদিকে ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তির সরকারি তথ্য বলছে, ১৬.৮ লক্ষ আবেদনকারীকে চাষের জমি নষ্ট হওয়ার কারণে ২৪০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ কৃষকরা মাথাপিছু পেয়েছেন ১,৪২৮ টাকা মাত্র!
আর সর্বসাকুল্যে ২.২১ হেক্টর চাষের জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকলে ১৬.৮ লক্ষ কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার মানে ১ বিঘা জমি প্রতি মাত্র একজন করে কৃষককে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। এরথেকে স্পষ্ট যে ভাগচাষিরা কোনো ক্ষতিপূরণ পায়নি, শুধু জমির মালিকরাই পেয়েছে। তদুপরি, জমিতে ফসল নষ্ট হয়ে থাকলে প্রতি বিঘায় চাষের ক্ষতির পরিমাণ ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকার কম নয়। জমিতে নোনা জল ঢুকে থাকলে সেটা বার করে জমি চাষযোগ্য করতে আরও ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা খরচ হবে, আবার ফসল ফলাতে এক বছর বা তারও বেশি সময় লাগতে পারে। এতদসত্ত্বেও মাথাপিছু ক্ষতিপূরণ মাত্র ১,৪২৮ টাকা। এটা কি মেনে নেওয়া যায়?
‘দুয়ারে ত্রাণ’ কর্মসূচিতে চাষের ক্ষতিপূরণের নামে যেটা হয়েছে সেটা একরকম প্রহসন। এছাড়াও ৫ লক্ষ আবেদনে মাত্র ১.৮ লক্ষকে ঘরবাড়ি ভাঙা এবং অন্যান্য ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে। বাকি আবেদন বাতিল। সরকারের বক্তব্য মোট ক্ষতিপূরণের পরিমাণ হবে ৪০০ কোটি টাকা মাত্র। অথচ মুখ্যমন্ত্রী নিজে প্রধানমন্ত্রীকে ২৯ মে ২০২১ জানিয়েছিলেন যে ২০ হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
২০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতির জন্য ৪০০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ — এই হচ্ছে ‘দুয়ারে ত্রাণ’ কর্মসূচির স্বরূপ। আসলে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার দুজনেই কৃষক এবং গরিব মানুষের জীবন-জীবিকা নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে।
- প্রসেনজিৎ বসু
বিচারবিভাগীয় হেফাজতে থাকাকালীন গত ৫ জুলাই মুম্বাইয়ের এক হাসপাতালে ফাদার স্ট্যান স্বামীর মৃত্যু একই সাথে তীব্র শোক এবং ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে এটাকে মৃত্যু বলা হলেও দেশে-বিদেশে স্ট্যান স্বামীর মৃত্যু রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে চালিত হত্যা বলেই গণ্য হয়েছে। গ্ৰেপ্তারের পর তাঁরসঙ্গে যে বর্বোরচিত ও হৃদয়হীন আচরণ করা হয়েছে তা বর্তমান শাসককুলের মার্কামারা বৈশিষ্ট্যেরই পরিচায়ক। পার্কিনসন রোগে ভোগা নড়াচড়ায় অক্ষম ও অশক্ত ৮৪ বছরের বৃদ্ধের জামিনের আবেদনের বারবার বিরোধিতা করতে সরকারি পক্ষ তথা এনআইএ একটুও কুণ্ঠিত হয়নি। কম্পিত করজোড়ে বিচারপতিদের কাছে তিনি জামিনের আবেদন জানালেও বিচারপতিরা তাঁর মতো হীনবল মানুষকেও রাষ্ট্রের পক্ষে বিপজ্জনক বিবেচনা করে জামিন দিতে অস্বীকার করেছেন। বর্তমান শাসকদের চোখে তাঁর অপরাধ ছিল এই যে, তিনি পাঁচ দশক ধরে নিপীড়িত আদিবাসীদের পাশে থেকে তাদের অধিকার সচেতন করে তোলায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। এনআইএ’র হাতে গ্ৰেপ্তার হওয়ার ঠিক আগে একটা ভিডিওতে তিনি বলেছিলেন, “আমরা সবাই জানি কিভাবে বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, লেখক, কবি ইত্যাদিদের জেলে পোরা হয়েছে, কারণ, তাঁরা তাঁদের বিরোধিতা প্রকাশ করেছেন অথবা ভারতের শাসক শক্তিদের সম্পর্কে প্রশ্ন তুলছেন। আমরা এই প্রক্রিয়ার অংশ। আমি এক দিক থেকে খুশি যে এই প্রক্রিয়ার অংশ হতে পেরেছি। আমি নীরব দর্শক নই, বিপরীতে এই খেলার অংশ, এবং এরজন্য যে মূল্যই হোক তা দিতে আমি রাজি।” আর নিজের জীবন দিয়ে কি ভয়ঙ্কর মূল্যই না তাঁকে দিতে হল। তিলে-তিলে তাঁর মৃত্যুকে ঘনিয়ে তোলা হল, এবং যে অস্ত্র প্রয়োগ করে তাঁকে ‘শহুরে নকশাল’এর তকমা দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে মাওবাদী যোগ এবং দেশ জুড়ে অশান্তি ও হিংসা উস্কিয়ে তোলার অভিযোগ আনা হল তা এক দানবীয় আইন-বেআইনি কার্যকলাপ নিরোধক আইন যা ইউএপিএ বলেই সমধিক পরিচিত। স্ট্যান স্বামীর মৃত্যুর সঙ্গে ইউএপিএ বাতিলের দাবি তাই জোরালো হয়ে সামনে এসেছে।
যে কোনো বিরোধিতার দমনে মোদী সরকার একটা শর্টকাট বা সোজা সমীকরণকে বেছে নিয়েছে। সেটা হল, সরকার বা বিজেপি-আরএসএস বিরোধিতা মানেই সন্ত্রাসবাদী বা দেশদ্রোহী কার্যকলাপ। এরই ভিত্তিতে সরকারের বিরোধিতাকারী, জন আন্দোলনের সংগঠকদের বিরুদ্ধে ইউএপিএ’তে অভিযোগ এনে জেলে পোরা হয়েছে এবং ইউএপিএ আইনকে সংশোধন করে জামিন লাভকে একরকম অসম্ভব করে তোলা হয়েছে। ইউএপিএ’র অস্ত্রে সমাজ আন্দোলনের, রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মীদের মাসের পর মাস, বছরের পর বছর জেলে আটকে রেখে যেমন প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা হয়েছে, তেমনি সরকারের অন্যান্য সমালোচক ও সমাজ আন্দোলনের কর্মীদের কাছে বার্তাও পাঠানো হয়েছে যে, সরকারের বেঁধে দেওয়া গণ্ডি ছাড়ালে তাদেরও জেলে পচতে হবে।
ইউএপিএ আইন তৈরি হয়েছিল ১৯৬৭ সালে। শুরুতে এই আইন তৈরির উদ্দেশ্য ছিল বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপকে রোধ করা এবং ‘ভারতের সংহতি ও সার্বভৌমত্বের সুরক্ষা’। এরপর বেশ কয়েকবারই এই আইন সংশোধন হয় এবং সর্বশেষ সংশোধনীটি আনা হয় ২০১৯ সালে। এই সংশোধনীর পর আইনটার রূপ ভয়ঙ্কর ধরনের দানবীয় হয়ে উঠেছে। শুরুতে আইনের লক্ষ্যবস্তু ছিল সংগঠন, সরকারের চোখে কোনো সংগঠনের কার্যকলাপ বিপজ্জনক ঠেকলে তাকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ তকমা দিয়ে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হত। কিন্তু ২০১৯’র সংশোধনের পর আইনের ধারা ৩৫ বলে যে কোনো ব্যক্তিকেই ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে দেগে দেওয়া সম্ভব। এই আইন অনুসারে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের সংজ্ঞা হল — কোনো ব্যক্তির কোনো কার্যকলাপ কোনো ব্যক্তির মৃত্যু ঘটালে বা তাকে আহত করলে বা ঘটানোর সম্ভাবনা থাকলে, কেউ কোনো সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি বা ধ্বংসসাধন করলে, অথবা কোনো ব্যক্তিকে আটকে রাখলে বা তাকে অপহরণ করলে সেই কার্যকলাপকে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ বলে গণ্য করা হবে। তদন্তে নিয়োজিত অফিসারের যদি ‘বিশ্বাস করার কারণ থাকে’ যে কোনো ব্যক্তি উপরে উল্লিখিত কোনো কাজ করেছেন তবে তিনি ঐ ব্যক্তিকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে ঘোষণা করতে পারবেন। আইনে ‘হুমকি দেওয়ার সম্ভাবনা’, ‘জনগণকে সন্ত্রস্ত করে তোলার সম্ভাবনা’, ‘বিশ্বাস করার কারণ থাকার’ মতো কথাগুলোর ব্যবহার তদন্তকারীদের এমন ক্ষমতা দিয়েছে যার বলে যে কোনো ব্যক্তিকে অনায়াসেই ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে ঘোষণা করে গ্ৰেপ্তার করা তাঁদের পক্ষে অসুবিধার নয়।
এই আইনে জামিন লাভের সম্ভাবনাকে সুদূরপরাহত করা হয়েছে। আইনের ধারা ৪৩ডি(৫) বলছে, আদালত যদি কেস ডায়েরি পড়ে অথবা ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৭৩ ধারা অনুসারে তৈরি রিপোর্ট অধ্যয়ন করে মনে করে যে, ঐ ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগকে আপাতদৃষ্টিতে বিশ্বাস করার যুক্তিসম্মত কারণ আছে, তবে ঐ ব্যক্তি জামিনে মুক্তি পাবেন না। এই ৪৩ডি(৫) ধারাকেই অসাংবিধানিক বলে স্ট্যান স্বামী আদালতে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন। ইউএপিএ আইন ন্যাচারাল জাস্টিস বা স্বাভাবিক ন্যায়েরও বিরোধী। আইনশাস্ত্র বলে, কেউ অপরাধী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত তাকে নিরপরাধ বলে ধরে নিতে হবে। কিন্তু ইউএপিএ আইনে ব্যাপারটা উল্টো — অভিযুক্তকেই প্রমাণ করতে হবে যে সে নিরপরাধ, আর যতক্ষণ না তা করা যাচ্ছে ততক্ষণ তাকে অপরাধী বলে সন্দেহ করে চলা হবে।
মোদী জমানায় ইউএপিএ’র অধীনে মামলার কেমন বাড়বাড়ন্ত ঘটছে তা বোঝার জন্য কিছু পরিসংখ্যানের দিকে তাকানো যাক। ইউএপিএ’তে মামলার সংখ্যা ২০১৭ সালে যেখানে ছিল ৯০১, সেই সংখ্যা ২০১৮ সালে বেড়ে হয় ১,১৮২ এবং ২০১৯ সালে সেই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ১,২২৬। এছাড়া, ২০১৯ সালে অপরাধী সাব্যস্ত হওয়ার হার ছিল মাত্র ২৯ শতাংশ। সে বছর ইউএপিএ’র অধীনে ১৭৩টা মামলার বিচার শুরু হয় এবং বিচার প্রক্রিয়া শেষ হয় ১১৩টার, যার মধ্যে দোষী সাব্যস্ত করা যায় মাত্র ৩৩টা ক্ষেত্রে। অর্থাৎ, ইউএপিএ’তে ব্যাপক সংখ্যাধিক ক্ষেত্রেই অভিযুক্ত ও গ্ৰেপ্তার হওয়া মানুষের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ছিল ভিত্তিহীন। নিরপরাধ হওয়া সত্ত্বেও শাসকদের রোষ আকর্ষণ করে তাদের শুধু কারা যন্ত্রণাই ভোগ করতে হয়নি, জীবনের বেশ কয়েকটা মূল্যবান বছর অনর্থক নষ্ট হয়ে গেছে এবং হয়ে চলেছে। ভীমা কোরেগাঁও/এলগার পরিষদ মামলায় বন্দী ১৪ জন বিশিষ্ট নাগরিক (গ্ৰেপ্তার করা হয়েছিল ১৬ জনকে, ভারভারা রাওয়ের জামিনে মুক্তি এবং স্ট্যান স্বামীর মৃত্যুর পর এখন আটক ব্যক্তির সংখ্যা ১৪) যন্ত্রণায় দগ্ধ হতে-হতে উপলব্ধি করছেন তাঁদের জীবনের মূল্যবান বছরগুলো কিভাবে হারিয়ে যাচ্ছে। কেউ বলতেই পারেন সন্ত্রাবাদের মোকাবিলায় ইউএপিএ’র মতো আইনের দরকার আছে, কিন্তু নরেন্দ্র মোদী জমানায় তার অপব্যবহার হচ্ছে। সত্যিই কি তাই? অরুন্ধতি রায় কি বলছেন শোনা যাক, “কেউ যদি বলেন ইউএপিএ’র অপব্যবহার করা হচ্ছে, তাহলে তাঁরা ভুল বলছেন। এই আইনটা প্রণয়য়ন করা হয়েছে এই ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য”।
ইউএপিএ’তে জামিনের আবেদন যে লাগাতার নাকচ হয়ে চলে তার গুরুত্বপূর্ণ এক কারণ হল এই আইনে জামিন সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের ব্যাখ্যা। ওয়াতালি মামলায় সুপ্রিম কোর্ট ২০১৯ সালে যে রায় দেয় তা ইউএপিএ’তে জামিন পাওয়ার পথে এক প্রতিবন্ধক হয়ে রয়েছে। জাহুর আহমদ শাহ ওয়াতালি ছিলেন কাশ্মীরের এক ব্যবসায়ী। তিনি সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে অর্থ যুগিয়েছেন বলে এনআইএ তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে তাঁকে গ্ৰেপ্তার করে। দিল্লী হাইকোর্টে তাঁর জামিনের শুনানি হয় এবং হাইকোর্ট তাঁর জামিন মঞ্জুর করে। হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে এনআইএ সুপ্রিম কোর্টে যায়। সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি এ এম খানউইলকার দিল্লী হাইকোর্টের জামিন মঞ্জুরির রায়কে খারিজ করে দিয়ে বলেন, “এই স্তরে (জামিনের আবেদনের শুনানির সময়) সাক্ষ্যপ্রমাণগুলোকে বিশদভাবে খুঁটিয়ে দেখা বা সেগুলোর কাটাছেঁড়া করার দরকার নেই। আদালতের কাছে এটুকুই প্রত্যাশিত যে তাঁরা উল্লিখিত অপরাধ সংঘটনে অভিযুক্তর জড়িত থাকার সম্ভাব্যতা বা এর বিপরীতটা সম্পর্কে সিদ্ধান্তের উল্লেখ করবেন। যে রায়টি নিয়ে (দিল্লী হাইকোর্টের) প্রশ্ন তোলা হয়েছে সেটি বিশ্লেষণ করে আমাদের মনে হয়েছে যে হাইকোর্ট সাক্ষ্যপ্রমাণগুলোর দোষগুণ ও ত্রুটি বিচারে প্রয়াসী হয়েছে।” এরথেকে এটাই বেরিয়ে আসছে যে, জামিনের শুনানির সময় অভিযোগের সারবত্তা নিয়ে বিচার করার দরকার নেই এবং সরকারপক্ষের উকিলের অভিমতের ওপর গুরুত্ব দেওয়াটকেও জরুরি করে তোলা হয়েছে। আর এরকমটা হলে জামিন মিলবে কি করে। বিচারপতি খানউইলকারের এই রায়ের পর থেকেই হাইকোর্টের বিচারপতিরা ইউএপিএ মামলায় জামিন মঞ্জুরি থেকে হাত গুটিয়ে রাখেন।
অথচ, সুপ্রিম কোর্টের এই রায় তাদেরই আগের নেওয়া অবস্থানের বিরোধী। ১৯৭৭ সালে স্টেট অব রাজস্থান, জয়পুর বনাম বালচাঁদ বালিয়া মামলায় সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, ‘জামিন’ হবে নিয়ম এবং ‘জেল’ হবে ব্যতিক্রম। ইউএপিএ’র ক্ষেত্রে জেলই নিয়ম হয়ে উঠেছে, জামিন হয়ে গেছে ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত। যখন সরকারের সমালোচকদের ধরে-ধরে ইউএপিএ’তে অভিযুক্ত করে জেলে পোরা হচ্ছে তখন সুপ্রিম কোর্টই তাদের ২০১৮ সালের এক রায়ে বলেছে, “বিরোধী মত প্রকাশ হল গণতন্ত্রের সেফটি ভালভ”। তবে, ইউএপিএ’তে ব্যাপক সংখ্যক গ্ৰেপ্তারির পিছনে শাসকদের কোন অভিপ্রায় কাজ করছে আদালত তাকে নির্দিষ্ট করেনি এমন নয়। ভীমা কোরেগাঁও/এলগার পরিষদ মামলায় জামিনের শুনানিতে সংখ্যালঘিষ্ঠ মত প্রদানকারী বিচারপতি চন্দ্রচূড় বলেছিলেন, গ্ৰেপ্তারিগুলোর পিছনে মূল কারণ হল, “বিরোধী মতের কণ্ঠরোধ করা … এদের প্রত্যেকের বিররুদ্ধেই মামলা দায়ের করা হয়েছে কারণ তাঁরা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার ব্যক্তিদের রক্ষায় এগিয়ে এসেছেন।” সম্প্রতি দিল্লী দাঙ্গায় অভিযুক্ত আসিফ ইকবাল তানহা, দেবাঙ্গনা কলিতা এবং নাতাশা নারোয়ালের জামিন মঞ্জুর করতে গিয়ে দিল্লী হাইকোর্টও বলেছে, “আমরা বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমাদের কাছে এটা মনে হয়েছে যে, বিরোধী মতকে দমনের ব্যগ্ৰতায় এবং পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যেতে পারে এই হতাশজনক চিন্তা থেকে রাষ্ট্র সংবিধান প্রতিশ্রুত ‘প্রতিবাদ করার অধিকার’ এবং ‘সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ’এর মধ্যে ভেদরেখাকে মুছে দিয়েছে। এই ধরনের মুছে দেওয়াটা যদি প্রবণতা হয়ে দাঁড়ায় তবে গণতন্ত্র বিপন্ন হয়ে পড়বে।” দিল্লী হাইকোর্টের রায়ে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ এবং সন্ত্রাসবাদকে একাকার করে তোলার রাষ্ট্রের সীমাহীন স্পৃহাকে যেভাবে নির্দেশিত করা এবং গণতন্ত্রের বিপন্নতাকে চিহ্নিত করা হয়েছে তা শুধু আজকের বাস্তবের প্রতিফলনই নয়, তা সবার কাছে এক চেতাবনি রূপেও হাজির হচ্ছে।
মোদী জমানায় গণতন্ত্র আজ তীব্র সংকোচনের আবর্তে। মানবাধিকারের প্রতিটি ক্ষেত্র আক্রমণের মুখে। খাওয়া, পরিধান থেকে ধর্ম — সবই নির্দেশিত করতে চাইছে ফ্যাসিস্ত বাহিনী। বুদ্ধিজীবীদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে; সরকারের সমালোচনা থেকে দূরে থাকার নির্দেশই শুধু সাংবাদিকদের দেওয়া হচ্ছে না, তাদের বিরুদ্ধে ইউএপিএ’তে মামলা হচ্ছে এবং তাঁরা আক্রমণের শিকারও হচ্ছেন; আইনজীবীদের চোখ রাঙিয়ে সরকার বিরোধী মামলা থেকে সরে দাঁড়াতে বলা হচ্ছে; মানবাধিকার রক্ষকদের জেলে পোরা হচ্ছে; বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতার ইতি ঘটিয়ে বিচাপতিদের কাছে সরকারপন্থী হওয়ার সংকেত পাঠানো হচ্ছে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার আন্তর্জাতিক স্তরের নজরদারি সংস্থা রিপোটার্স স্যান্স ফ্রন্টিয়ার্স-এর চোখেও নরেন্দ্র মোদী সংবাদপত্রের স্বাধীনতার এক ‘প্রিডেটর’, স্বাধীনতাকে জাহান্নমে পাঠানোই যাঁর লক্ষ্য। গণতন্ত্রের এই অন্তর্জলি যাত্রায় সরকারের কাছে বড় অস্ত্র হয়ে উঠেছে ‘ইউএপিএ’ ও ‘দেশদ্রোহ’ আইন। এই দুই আইনকে বিদায় জানানোর সময় তাই সমুপস্থিত। আজ আমাদের শ্লোগান হোক — ‘ইউএপিএ’ এবং ‘দেশদ্রোহ’ আইন বাতিল কর!
এই দুই আইনে আটক সমাজ ও রাজনৈতিক আন্দোলনের কর্মীদের মুক্তি দিতে হবে!
-- জয়দীপ মিত্র
গত ৮ জুলাই ২০২১, বিকেল পাঁচটা নাগাদ বাংলাদেশের রূপগঞ্জের কর্ণগোপ এলাকায় হাসেম ফুডের ছয়তলা এক কারখানা ভবনে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট ২০ ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে পরদিন দুপুরে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এরপর ভবনের চতুর্থ তলা থেকে ৪৯ জন শ্রমিকের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। এর আগেই, আগুন লাগার পর ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে তিনজনের মৃত্যু হয়েছিল। ফায়ার সার্ভিসের আধিকারিকেরা জানিয়েছেন যে ওই কারখানায় প্লাস্টিক, ফয়েল, কাগজ, রেজিন, ঘি, প্রক্রিয়াজাত করা পণ্য ও নানা কেমিক্যালসহ প্রচুর দাহ্য পদার্থ ছিল। একারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে তাঁদের বেগ পেতে হয়।
জুস, ক্যান্ডি, বিস্কুট, লাচ্ছা সেমাইসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য তৈরি হোতো হাসেম ফুডস লিমিটেডের কারখানায়। প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক দিয়ে চলত তাদের কাজ। কর্মরত শিশু-কিশোর, শ্রমিক-জনতা পেটের আগুন জুড়ানোর জন্য মাত্র সপ্তাহখানেক আগে, ১ জুলাই ২০২১ রাস্তায় আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেছিলেন। দু’মাস ধরে তাঁদের বেতন ও ওভারটাইমের টাকা পরিশোধ করছিল না মালিকপক্ষ। বাড়িভাড়া ও মুদিদোকানের বকেয়া পরিশোধ করতে না পেরে বাধ্য হয়ে তাঁরা রাস্তায় নেমেছিলেন। সপ্তাহ না ঘুরতেই তাঁরা শিকার হলেন কারখানার রহস্যময় আগুনের।
১ জুলাই বিক্ষোভের খবর পেয়ে কাঁচপুর ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ ও ভুলতা ফাঁড়ি পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি ‘নিয়ন্ত্রণে’ এনেছিল। গলা উঁচু করে জানিয়ে গিয়েছিল, ‘মালিকপক্ষের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। ৫ জুলাই শ্রমিকদের দুই মাসের বকেয়া ওভারটাইমের টাকা দিয়ে দেওয়া হবে। বাকিটা ঈদের আগে পরিশোধ করে দেওয়া হবে। কোম্পানির অ্যাডমিন ইনচার্জ ইঞ্জিনিয়ার সালাউদ্দিনও সংবাদমাধ্যমকে একই কথা বলেছিলেন। বলা বাহুল্য, কেউ কথা রাখেনি। পেটের আগুনে জ্বলতে জ্বলতে কারখানার আগুনে পুড়ে কয়লা হলেন তাঁরা।
অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতা ব্যক্ত করে এক উদ্ধারকর্মী কাঁদতে কাঁদতে জানান, চেনা যায় না কে নারী কে পুরুষ, কোনটা মাথা, কোনটা হাত। মৃতদেহগুলো আগুনে পুড়ে এমন অবস্থা হয়েছে যে নারী, পুরুষ কিংবা পরিচয় — কারও পক্ষে কোনো কিছুই চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। বিক্ষুব্ধরা বলছেন, চারতলার ‘দরজা বন্ধ’ না থাকলে এত মৃত্যু হোত না। পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, পাঁচ-ছয়তলায় কোনো লাশ মেলেনি। কিন্তু এটাকে অনেকেই বানানো কথা বলে মনে করেছেন। যেমন ঢাকা থেকে ছুটে যাওয়া সাংবাদিক ফারুক ওয়াসিফ। তাঁর মতে ‘এটা অসম্ভব’। নিচের সিঁড়ি আগুনে বন্ধ হওয়ায় সবাই ওপরে উঠে গিয়েছিল। ছাদের তালা খোলা না বন্ধ ছিল, জানা নেই। পাঁচ-ছয়তলায় অনেকের আটকা পড়ার কথা। তাঁদের লাশ কোথায় গেল? একটা হাজিরা খাতা পড়ে ছিল, পৃষ্ঠাগুলো ছেঁড়া।
তালা মারার অভিযোগ নিয়ে মালিকপক্ষ বিবিসিসহ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছে, “এটি মিথ্যা কথা, এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন”। প্রশ্ন উঠেছে তাহলে সত্য কোনটা? নাছোড়বান্দা এক তরুণ সাংবাদিক জানতে চান, তালা দেওয়া না থাকলে এতগুলো মৃতদেহ এক জায়গায় পাওয়া গেল কীভাবে? মালিকপক্ষের উত্তর, “যখন নিচতলায় আগুনটা ধরেছে, তখন সবাই আতঙ্কে ওপরে চলে গেছে”। তাই লোকগুলো পুড়ে কয়লা হয়েছে একসঙ্গে।
তাজরীন, রানা কি হা–মীম অথবা নরসিংদীর তোয়ালে কারখানা কিংবা গাজীপুরের চান্দনায় গরিব অ্যান্ড গরিব সোয়েটার কারখানা — বাংলাদেশ এরকম ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা একের পর এক দেখেই চলেছে। কিন্তু এই সমস্ত ঘটনাগুলি থেকে কোনও শিক্ষা নেওয়া হয়না। খরচ বাড়া ও মুনাফা কমার ভয়ে সুরক্ষা ব্যবস্থার দিকে মালিকপক্ষ বিন্দুমাত্র নজর দেয় না। পুলিশ প্রশাসনও এইসব দিনের পর দিন উপেক্ষা করে। গরীব মানুষ ভাত কাপড়ের টানে বাধ্য হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিপদজনক পরিস্থিতিতে দিনের পর দিন সামান্য মজুরিতে কাজ করে যেতে বাধ্য হন। অগ্নিকাণ্ড ঘটলে সুরক্ষা ব্যবস্থার অভাবে পুড়ে কাঠকয়লা হয়ে যাওয়াই তাদের নিয়তি। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নতি ও শিল্পবিকাশের যে ছবি বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়, তার ভেতরের মারাত্মক চেহারাটা এই সমস্ত ঘটনা থেকে বেরিয়ে আসে।
আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যে শিশু কিশোর কিশোরীদের কাজ করানো হত, নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় তা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। কিন্তু এই হতভাগ্য শিশু কিশোরদের সম্পূর্ণ তালিকা পাওয়াও বোধহয় সম্ভব হবে না কোনোদিনই। অপেক্ষমাণ অভিভাবক আর প্রাণে বেঁচে যাওয়া সহকর্মীদের কাছ থেকে যেসব নাবালক-নাবালিকার নাম পাওয়া গেছে, সেটাই এখন একমাত্র তালিকা। শান্তা (১২), মুন্না (১৪), শাহানা (১৫), নাজমুল (১৫), রিপন (১৭), তাকিয়া (১৪), হিমু (১৬), সুফিয়া (৩০), আমেনা (১৭), মাহমুদ (১৫), তাসলিমা (১৭), কম্পা (১৬) ছাড়াও আরও যে অনেক শিশু ছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাছাড়া যাদের বয়স ১৯-১৮ বলা হচ্ছে, যেমন শেফালি (২০), ইসমাইল (১৮), অমৃতা (১৯) — তাঁদের প্রকৃত বয়স নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তাঁদের সহকর্মীরা।
বাংলাদেশের প্রচলিত আইন শিশুদের কারখানা বা শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শ্রমিক হিসেবে নিয়োগকে অনুমোদন করে না। আইনে বলা হয়েছে, “কোনো পেশায় বা প্রতিষ্ঠানে কোনো শিশুকে নিয়োগ করা যাবেনা বা কাজ করতে দেওয়া যাবেনা”। তবে শিশু আইনে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সবাইকে শিশু বলা হলেও বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ অনুসারে ১৪ বছর বয়স পূর্ণ করেনি, এমন ব্যক্তিকেই ‘শিশু’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। তবে কি ১৪ বছর পার হলেই সবাই প্রাপ্তবয়স্ক? না, তা নয়। শ্রম আইন প্রাপ্তবয়স্কের সুযোগ থেকে এই বয়সী মানুষদের বঞ্চিত রেখে তাঁদের কাছ থেকে সস্তা শ্রম কেনার একটা ব্যবস্থা করেছে। শ্রম আইন বলছে, “চৌদ্দ বৎসর বয়স পূর্ণ করিয়াছেন কিন্তু আঠারো বৎসর বয়স পূর্ণ করেন নাই, এমন কোনো ব্যক্তিকে ‘কিশোর’ হিসেবে গণ্য করা হইবে।” এদের কারখানায় শর্ত সাপেক্ষে নিয়োগ দেওয়া যাবে। কী সেই শর্ত?
শ্রম আইন ২০০৬ অনুসারে কিশোর শ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রে রেজিস্টার্ড চিকিৎসক কর্তৃক কিশোরকে প্রদত্ত সক্ষমতা প্রত্যয়নপত্র মালিকের হেফাজতে থাকতে হবে। কাজের নির্দিষ্ট সময় উল্লেখ করে কিশোরের কর্ম-ঘণ্টা সম্পর্কে একটি নোটিশ প্রদর্শন করতে হবে।
তারপরও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার চাপেই হোক আর মুখরক্ষার জন্যই হোক, বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, প্রজ্ঞাপন (এসআরও নং ৬৫-আইন/২০১৩) জারির মাধ্যমে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজের একটা তালিকা তৈরি করে জানিয়ে দিয়েছিল সবাইকে। সেই তালিকায় যে ৩৮টি কাজে শিশু-কিশোরদের নিয়োগ না করার কথা বলা হয়েছিল, তার অন্তত চারটি লঙ্ঘন করার প্রমাণ মিলেছে এই কারখানায়। ৮ জুলাই যখন আগুন লাগে, তখন কিশোরদের জন্য নির্ধারিত পাঁচ কর্ম-ঘণ্টা যে অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এই অগ্নিকাণ্ড আবার সেই পুরোনো ক্ষতের দগদগে ঘাগুলো উন্মোচন করে দিয়েছে। নজরে আসছে নিয়মবহির্ভূত নির্মাণ, পরিদর্শন নেই, সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর উদাসীনতা ও প্রাতিষ্ঠানিক অব্যবস্থাপনা। একটি দুর্ঘটনা ঘটলে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো পরস্পরের সঙ্গে কুশল বিনিময় করে, অন্যথায় সহজে একত্র হয় না। সমন্বিত কোনো পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেনা। দুর্ঘটনার পর কয়েকটি কমিটি হয়। তারা কিছু সুপারিশ করে। কিন্তু সেসব সুপারিশ আদৌ বাস্তবায়িত হলো কিনা, এর ওপর কোনো নজরদারি থাকে না।
বাংলাদেশের যত্রতত্র ফায়ার সার্ভিস আর কারখানা পরিদর্শনের অনুমোদন ছাড়াই গড়ে উঠছে কলকারখানা, সম্প্রসারিত হচ্ছে তাদের বহুতল ভবন। এধরনের অব্যবস্থাপনার কারণেই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বেড়ে চলেছে। কেউ জানেনা কে নিশ্চিত করবে অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে বিল্ডিং কোড মেনে নির্মাণের ব্যাপারে কার কতটা নজরদারি দরকার! ফায়ার সার্ভিসের অনুমোদন ছাড়া কোনো ভবনের কার্যক্রম শুরু করতে দেওয়া ঠিক হবে কি না? তাছাড়া কে কীভাবে নিশ্চিত করবে কলকারখানার জন্য উন্নত বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার ও নিয়মিত মেরামত করার কাজ, পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রাখা ও কৃত্রিম জলাধার, ড্রামভর্তি জল সংরক্ষণ, প্রশস্ত সিঁড়ি ও বিকল্প জরুরি বহির্গমনের পথ রাখা, কর্মকালীন গেট বন্ধ না করা – সে সবও অনিশ্চিত!
অনেক দেশের মতো একসময় বাংলাদেশেও মোহিনী মিল, কেরু কোম্পানি, চিত্তরঞ্জন বস্ত্র মিল, এমনকি আদমজীতেও শ্রমিক ও ব্যবস্থাপনা যৌথ নিরাপত্তা কমিটি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এসব কাজ করত। নিশ্চিত করত শ্রমিকদের আর কারখানার নিরাপত্তা। দেখত সিঁড়িঘরে বা যত্রতত্র মালামাল না রেখে আলাদা গুদামে সংরক্ষণ হচ্ছে কিনা, নিরাপত্তা প্রহরীর জন্য বিশেষ জরুরি টেলিফোন ব্যবস্থাসহ বিদ্যুৎ বিভাগ ও ফায়ার সার্ভিসের টেলিফোন নম্বর শ্রমিকেরা জানেন কিনা। কারখানায় প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা সহ শ্রমিকদের অগ্নিনির্বাপণের প্রশিক্ষণ প্রদানের কাজ হচ্ছে কিনা।
আসলে আইন মানার সংস্কৃতি আর জবাবদিহি না থাকলে মানুষ মরবে, শিশুদের লাশের হিসাব মিলবে না, এ আর নতুন কী!
(সূত্র: বিভিন্ন সংবাদপত্রের রিপোর্ট)
ত্রিপুরায় ডেল্টা ও ডেল্টা প্লাস করোনা ভেরিয়েশন নিয়ে, টিকা নিয়ে, মৃত্যু নিয়ে তথ্য গোপন করে ব্যর্থতাকে ঢাকার চেষ্টা করছে। অবিলম্বে গণসংক্রমণ এলাকা চিহ্নিত করে সর্বাধিক পরীক্ষা ও টিকাদান যুদ্ধকালীন তৎপরতার সাথে সম্পন্ন করতে হবে। এই দাবি তুলেছে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন।
রাজ্যে বিপদজনক ডেল্টা বা ডেল্টা প্লাস করোনা প্রজাতির সংক্রমণ নিয়ে গত ১৩ জুলাই সিকিম সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে বিশেষ কোন পদক্ষেপ গ্রহণের কথা শোনা যায়নি। গতানুগতিক সাধারণ পদক্ষেপ গ্রহণের কথাই বলা হয়েছে। আর দোষ চাপানো হয়েছে জনগণের কাঁধে। দেশে ৭৩টি জেলায় সংক্রমণের হার সর্বোচ্চ। তারমধ্যে ৪৬ শতাংশ ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয়, অরুণাচল প্রদেশ, মণিপুর ও সিকিমে। ত্রিপুরায় সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের নীচে নামছেনা। আগরতলা পুর এলাকায় তা গড়ে ১০ শতাংশ। শুধু জুন মাসে মৃত্যু হয় ১৬৩ জনের। ১২ জুলাই পর্যন্ত রাজ্যে মোট মৃত্যু হয়েছে ৭১৪ জনের। এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ভাইরাস বিশেষজ্ঞরা বলছেন এটা তৃতীয় ঢেউয়ের শুরুয়াত। ডেল্টা ও ডেল্টা প্লাস দুটোই ভয়ঙ্কর সংক্রামক ও ধ্বংসকারী। করোনা তার আলফা ভেরিয়েশন থেকে জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়ে ডেল্টা ও ডেল্টা প্লাসে উন্নীত হয়েছে। সঙ্গে আছে কাপ্পা প্রজাতি। আর এর সংক্রমণ ত্রিপুরায় ছড়িয়ে পড়েছে ছয় জেলায়। এই সংক্রমণ আটকাতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে সরকার। অথচ এখনো এরজন্য বিশেষ কোনো পদক্ষেপ নেই। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন ডেল্টা ও ডেল্টা প্লাস সংক্রমণ মনিটরিংয়ের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের। রাজ্য সরকার তা অনুসরণ করবে। আজ প্রধানমন্ত্রীও কোনও দায়বদ্ধতা প্রকাশ করেননি।
কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারের এই উদাসীনতা দেখে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন গভীর চিন্তা ও উদ্বেগ প্রকাশ করছে। আমাদের দাবি –
(১) রাজ্যে অবিলম্বে বিশেষ ব্যবস্থা হিসাবে গণসংক্রমণের এলাকা চিহ্নিত করে এলাকাগুলিকে ঘেরাও করে কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং সহ যুদ্ধকালীন তৎপরতার সাথে সর্বাধিক পরীক্ষার ব্যবস্থা করার দাবি করছে। যাতে যে কোনো প্রকারে এর উৎস খুঁজে বের করা এবং সংক্রমণকে আটকানো যায়। সংক্রমণের হারকে টেনে নীচে নামানো যায়। এরসাথে সর্বাধিক টিকাদান করার নিশ্চয়তা দিতে হবে। কারণ জুলাই মাসে পরীক্ষা ও টিকাদান দুটোই মারাত্মকভাবে কমেছে। জুনে গড়ে দৈনিক পরীক্ষা ছিল ১৫ হাজার। জুলাই মাসে পরীক্ষা ৪ হাজারের কম আর দৈনিক টিকাদান জুলাই মাসে ১০ হাজারের কম। জুন মাসে তা অনেক বেশি ছিল। ৮৪ দিন পার হয়েছে এমন তিন লক্ষ মানুষকে দ্বিতীয় ডোজ দিতে হবে। অথচ জুলাই মাসের প্রাথম ১১ দিনে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হয়েছে মাত্র ৫৪,২০৯ জনকে। দ্বিতীয় ডোজ পাচ্ছেন না মানুষ। ১৮-৪৪ বয়সের গ্রুপে ৬ লক্ষের বেশি মানুষ এখনো প্রথম ডোজ পাননি। যেখানে ডেল্টা বা ডেল্টা প্লাস প্রজাতির সংক্রমণ ঘটে গেছে।
(২) এখনই পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ করতে হবে। তাদের প্রশিক্ষিত করতে হবে। স্বাস্থ্য দপ্তরের প্রাথমিক ইউনিট পর্যন্ত পরিকাঠামো ঢেলে সাজাতে হবে। কারণ গ্রামে ও প্রত্যন্ত এডিসি এলাকায় সংক্রমণ ও মৃত্যু ছড়িয়ে পড়েছে।
(৩) ভেরিয়েশন বিতর্কে বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীর মুখ লুকানোর চেষ্টা ও দায়সারা মনোভাব স্পষ্টভাবে চিহ্নিত হয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীরও কোনো দায়বদ্ধতা নেই।
(৪) টিকা নিয়ে, কোভিডে মৃত্যু নিয়ে, মৃত্যুর শংসাপত্র নিয়ে উচ্চ আদালতে ত্রিপুরা সরকারের তথ্য গোপন করার প্রয়াস প্রমাণিত হয়েছে। কাজেই সরকার তথ্য গোপন করে তার ব্যর্থতাকে ঢাকতে পারবেনা। বরং সাহসের সাথে সঠিক তথ্য প্রকাশ করলে দায়বদ্ধতার প্রকাশ ঘটে।
(৫) কোভিডে মৃতদের পরিবারকে সুপ্রিম কোর্টের আদেশানুসারে দশ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। পোস্ট কোভিড মৃতদের এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
(৬) রেশনে মাথাপিছু দশ কেজি করে চাল, ডাল, ভোজ্য তেল, মশালা দিতে হবে। ভর্তুকি প্রত্যাহার করে মূল্যবৃদ্ধি করা চলবে না।
(৭) রেগা ও টুয়েপ প্রকল্পে মাসে ১৭ দিন করে কাজ ও দৈনিক মজুরি বাড়িয়ে ৩৪০ টাকা করতে হবে।
(৮) আয়কর আওতাভুক্ত নয় এমন পরিবারকে আগামী ছ’মাস প্রতি মাসে ৭,৫০০ টাকা নগদ সহায়তা করতে হবে।
১০ জুলাই সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের শিলিগুড়ি শক্তিগড় ব্রাঞ্চ কমিটির পক্ষ থেকে প্রয়াত সদস্য রেণু দাস এবং সমাজকর্মী, পরিবেশ আন্দোলনের অগ্রণী যোদ্ধা স্ট্যান স্বামীর স্মরণসভা করা হয়। উপস্থিত ছিলেন জেলা সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার, মোজাম্মেল হক, নেমু সিংহ, গৌতম চক্রবর্তী, পৈষানজু সিংহ সহ ব্রাঞ্চ কমিটির সদস্যরা। বিগত ছ’বছর ধরে রেণু দাস শক্তিগড় ব্রাঞ্চ কমিটির সাথে যুক্ত ছিলেন। মূলত শ্রমজীবী মানুষের প্রতিনিধিত্ব করা রেণুদি বিভিন্ন সময়ে ব্রাঞ্চ এবং জেলা স্তরের বিভিন্ন কর্মসূচিতে উৎসাহের সঙ্গে সামিল হয়েছেন। স্থানীয় সংগঠনকে কিভাবে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, সেই কথা তিনি সবসময় বলতেন। তাঁর সেই ভাবনার কথা, মানুষ হিসেবে রেণু দাস কেমন ছিলেন সেইসব কথা ভাগ করে নেন উপস্থিত ব্রাঞ্চ সদস্যা গঙ্গা রায়, ভাগ্য মন্ডল, রুবী সেনগুপ্ত প্রমুখ। বক্তব্য রাখেন জেলা সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার। তিনি বলেন, রেণু দাসরা কিভাবে খুব ছোট পরিসর থেকে উঠে আসলেও সকলকে নিয়ে চলার, ভাবার শক্তিটুকু জড়ো করেন মনের মধ্যে এবং আমৃত্যু সেই বিশ্বাসে অবিচল থাকেন। এছাড়াও ফাদার স্ট্যান স্বামীর পরিকল্পিত রাষ্ট্রীয় হত্যার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, সব গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষকে একত্রিত করে ফ্যাসিস্ট সাম্প্রদায়িক সরকারের বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই আমাদের চালিয়ে যেতে হবে। এছাড়াও বক্তব্য রাখেন শিলিগুড়ি লোকাল কমিটির সম্পাদক মোজাম্মেল হক। স্মরণসভা পরিচালনা করেন শাশ্বতী সেনগুপ্ত। শেষে গৌতম চক্রবর্তীর সঙ্গে ‘কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক’ সঙ্গীতে গলা মেলান উপস্থিত সকলে। স্মরণসভা শেষে লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত কুড়িটি পরিবারের হাতে দ্বিতীয় দফায় রেশন তুলে দেওয়া হয়।
“কোভিডকালে প্রয়াতদের আমরা ভুলব না, প্রতিটি কোভিড মৃত্যুর হিসাব থাকবে” কর্মসূচী গত একমাস ধরে বিভিন্ন রাজ্যে পালন করে চলেছে আইপোয়া। এরই ধারাবাহিকতায় ১১ জুলাই সারাদেশে এই কর্মসূচী পালিত হয়। তবে শ্রদ্ধায় ও স্মরণের সঙ্গে এবার মোদী সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দাবিও তোলা হয়, যেমন কোভিড-কালে প্রয়াত প্রতিটি পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, অবিলম্বে সমস্ত নাগরিককে বিনামূল্যে টিকা দিতে হবে, জনগণের করের টাকায় সংসদ ভবন উন্নয়ন নয়, স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর উন্নয়ন কর।
ইতিমধ্যে ৫ জুলাই ফাদার স্ট্যান স্বামীর হেফাজতে হত্যার ঘটনা ঘটে। স্ট্যান স্বামী শহীদ হয়েছেন আদিবাসীদের অধিকারের জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে। তাই গত ১১ জুলাই হুগলির পোলবা ব্লকের আদিবাসী অঞ্চল বরুনান পাড়ায় স্ট্যান স্বামীকে স্মরণ করে এক প্রতিবাদসভা করা হয়। সভাস্থল পোস্টারে ব্যানারে সজ্জিত ছিল। সভার শুরুতে চৈতালি সেন স্ট্যান স্বামীর আন্দোলন ও ফ্যাসিষ্ট মোদী সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। তারপর উপস্থিত সকলে ফুল দিয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে স্ট্যান স্বামীকে শ্রদ্ধা জানান। ফাদারের হত্যাকারী মোদী-অমিত শাহের কুশপুতুল পড়ানোর সময়ে উপস্থিত মহিলারা স্বতঃফুর্তভাবে নিজেদের সমবেত ক্ষোভ ও ক্রোধ উগড়ে দেন।
সভার উদ্যোক্তা ছিলেন পার্বতী মুর্মু, চন্দনা বাস্কে, সাজনী সরেন, রায়মণি মুর্মু। এছাড়া উপস্থিত ছিলেন অর্পিতা রায়, রুমা আহিরী, তনুশ্রী দে, দুর্গা রায় সহ আরো অনেকে।
বলাগড় ব্লকের গুপ্তিপাড়ায় সমিতির সভানেত্রী শোভা ব্যানার্জির নেতৃত্বে এবং পাণ্ডুয়া ব্লকের ভোটগ্রামে আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চের নেত্রী সরস্বতী বেসরার পরিচালনায় এই কর্মসূচী পালিত হয়।