অবশেষে পশ্চিমবাংলার সরকার ‘এক দেশ এক রেশন কার্ড’ ব্যবস্থা চালু করবে বলে সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশ মেনে নিয়েছে। এতদিন এই ব্যাপারে আপত্তির যে কারণ দেখিয়ে এসেছে তার কোনো যুক্তি ছিল না। এরাজ্যে রেশনে কেন্দ্রের চেয়ে রাজ্য সরকারের সরবরাহ করা খাদ্যশস্যের মান ভালো, ‘এক দেশ এক রেশন কার্ড’ হলে ভিন্ রাজ্য থেকে আসা পরিযায়ী শ্রমিকরা তাতে ভাগ বসাবে, ফলে ভাঁড়ারে টান পড়বে, সেই কারণে আপত্তি! প্রথমত, এটা ন্যক্কারজনক সংকীর্ণতার অবস্থান। দ্বিতীয়ত প্রকৃত বাস্তবতা হল, এরাজ্য থেকে মেহনতি অংশ যে সংখ্যায় দেশের অন্যত্র পরিযায়ী হয় তার চেয়ে বাইরে থেকে এখানে পরিযায়ী হয়ে আসা সংখ্যা অনেক কম। এবং রাজ্য সরকারের দাবি মতো এখানে ১০ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ যদি রেশনের আওতায় থাকে, তবে তাতে তুলনায় অনেক কম পরিযায়ী হয়ে আসা মানুষেরা ভাঁড়ারে কি করে টান পড়ার কারণ হবে! এসব আসলে বাহানা! অগত্যা রাজ্য সরকার দেশব্যাপী এক কার্ডের প্রয়োজনীয়তা দেরীতে মানলেও এটা সুলক্ষণ।
কেন্দ্রীয় সরকারও যে সহজে এই পদক্ষেপ করেছে তাও নয়। টানা অতিমারী পরিস্থিতিতে জনগণের জ্বলন্ত দাবিগুলো দুঃসহ বঞ্চনার শিকার হয়ে চলেছে। তা নিয়ে যথেষ্ট সোরগোল ওঠার পর কেন্দ্রের টনক নড়েছে কেবল রেশন বিষয়ে। সেটাও অবশেষে সুপ্রীম কোর্টের চাপ খেয়ে। জরুরি প্রথম তিনটি দাবি হল, বিনা মূল্যে রেশন, হাতে নগদ অর্থের যোগান এবং বিনা মূল্যে ভ্যাকসিন। কেন্দ্র কেবল রেশনে কিছু সুলভে সরবরাহের ব্যবস্থা চালু করেছে, ভ্যাকসিন নিয়ে বৈষম্য চালিয়ে যদিও বা বিনা মূল্যে দেওয়ার দাবি মেনে নিয়েছে, তবু চালিয়ে যাচ্ছে নানা টালবাহানা। যত পারা যায় রাজ্যগুলোর ওপর দায় চাপানো এবং বেসরকারি হাসপাতাল ও টিকা উৎপাদন সংস্থাগুলোকে মুনাফা লোটার সুযোগ করে দেওয়া। নগদ অর্থ যোগানোর নাম করছে না। এইসবই হচ্ছে কেন্দ্রের মতলব।
রাজ্য সরকার ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছে “দুয়ারে রেশন” - ‘দুয়ারে ত্রাণ’ কর্মসূচী, কিছু কিছু শুরু করেছে। বলছে সর্বত্র করতে সময় লাগবে। তা সেসব না হয় দেখতে হবে। রেশন গ্রহিতাদের নতুন করে যোগবিয়োগ করে তথ্যভান্ডার তৈরি করা, খাদ্যশস্যের সংগ্রহভান্ডার গড়ে তোলা, বিলিবন্টণের পরিকাঠামো ঢেলে সাজানো, এসবের প্রস্তুতিতেও সরকার সময় চাইছে, কিন্তু গয়ংগচ্ছ রীতি চলবে না, রেশন দেওয়া স্থগিত না রেখে সবই করতে হবে যুদ্ধকালীন উপায়ে।
সমস্যা জমেছে আরও। পাঁচ মাস যাবত রাজ্যের অঙ্গনওয়াড়ি উপভোক্তাদের অধিকাংশের খাদ্য সামগ্রী মেলেনি। বন্ধ ছিল বিলিবন্টণ গত ফেব্রুয়ারি থেকে। রাজ্য সরকারের বক্তব্য হল, এ কয়মাস কেন্দ্র কিছুই পাঠায়নি, গত বছরেও উপভোক্তাদের সংখ্যাবৃদ্ধির তুলনায় কেন্দ্রের সরবরাহ কোটায় ঘাটতি ছিল, এবার উপর্যুপরি বেড়েছে ঘাটতি। তবে দেরীতে হলেও চলতি অর্থবর্ষের প্রথম তিন মাসের কোটা এসেছে। যদিও এতে মোট কোটার বরাদ্দ কেন্দ্র এখনও বাড়ায়নি।
অন্যদিকে, কেন্দ্রের মোদী সরকার হুঁশিয়ার! কথায় ও কাজে বিপরীত আচরণ করলে চলবে না। কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যকার যুক্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের দায়দায়িত্বকে নিছক বিজেপি ও টিএমসি -- দুই শাসকদলের গোয়ার্তুমির সংঘাতে পরিণত করা চলবে না। মোদী সদ্য পুনরায় ঘোষণা করেছেন, দেশের গরিব ৮০ কোটি রেশন গ্রহিতাদের জন্য ‘প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনা’ আগামী নভেম্বর পর্যন্ত থাকবে। এই খাতে মাথা পিছু প্রতি মাসে বিনা মূল্যে ৫ কেজি করে খাদ্যশস্য দেওয়া হবে। এটা খাদ্য সুরক্ষা আইনে মাথা পিছু প্রতি মাসে ভর্তুকিতে যে ৫ কেজি করে খাদ্যশস্য দেওয়া হয় তার অতিরিক্ত কোটা। কেন্দ্র গত বছর এপ্রিল মাস নাগাদ এই প্রকল্প চালু করলেও অঘোষিতভাবে নভেম্বর থেকে বন্ধ রেখে দিয়েছিল। তার ব্যাখ্যা আজও দেয়নি। পাঁচ রাজ্যে নির্বাচনের ফলাফলে বিজেপির বিরুদ্ধে গনগনে আঁচ লক্ষ্য করে অন্ন যোজনার পুনঃপ্রবর্তন করল। সামনে রয়েছে উত্তরপ্রদেশের নির্বাচন। দুর্ভাবনা তো থাকবেই। কিন্তু গুদামজাত চাল নিয়ে ‘প্রতিশ্রুতির রাজনীতি’র চালবাজি করা থেকে বিরত থাকুক। অতিমারীর বছরে দেশের ১৮টি রাজ্যের ৮৮টি জেলা ও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলগুলোর এক সমীক্ষা বলছে, রেশনকার্ড থাকা নাগরিকদের ৯৪ শতাংশই রেশন নিয়েছেন। এটা বুঝিয়ে দেয় ব্যাপকতম নাগরিক ভারত রেশন ব্যবস্থার ওপর কেমন নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। তবু এখনও বহু দেশবাসীকে এই নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে। শাসকের রংবাজিতে প্রতারিত হয় মানুষ। অথচ কেন্দ্রীয় সরকারি সূত্র বলছে, এফসিআই গুদামে এখন মজুদ চাল-গমের পরিমাণ ৯০০ লক্ষ টন, যা দিয়ে মোট চাহিদার দ্বিগুণেরও বেশি পূরণ করা যায়। সুতরাং গণবন্টণ নিয়ে কোনও গদ্দারি যেন না করা হয়।
প্রত্যাশা মতোই , প্রধানমন্ত্রীকে তার সমস্ত ক্যাবিনেট সহযোগী এবং এনডিএ মুখ্যমন্ত্রীরা, ১৮-৪৪ বছরের সকলকে বিনামূল্যে টিকা দেওয়ার বিলম্বিত ঘোষণার জন্য ধন্য ধন্য করে চলেছেন। আর সাধারণ জনমত সরকারের স্বেচ্ছাচারী অযৌক্তিক টিকা-নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অভিযোগের জন্য শীর্ষ আদালতকে ধন্যবাদ জানিয়েছে, কারণ এর জন্যই এক সপ্তাহের মধ্যে সরকার নীতি সংশোধনে বাধ্য হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী মোদী তার আধ ঘন্টার ভাষণে মূলত তিনটি সুনির্দিষ্ট ঘোষণা করেছেন : (১) কেন্দ্রীয় সরকার ১৮-৪৪ বছরের সকলের বিনামূল্যে টিকা পাওয়া সুনিশ্চিত করতে, টিকা সংগ্রহ করবে এবং রাজ্য সরকারগুলিকে সরবরাহ করবে, (২) বেসরকারি হাসপাতালগুলি টিকার প্রতিটি ডোজ-এর মূল্য ছাড়াও পরিষেবা ফী বাবদ সর্বোচ্চ ১৫০ টাকা ধার্য করতে পারবে, (৩) আগামী দীপাবলি পর্যন্ত দরিদ্রদের বিনামূল্যে খাদ্যশস্য সরবরাহ অব্যাহত থাকবে।
কিন্তু মোদীর যা চিরাচরিত অভ্যাস! তিনি প্রবচন আউড়ে ধর্মোপদেশ দেওয়ার নিজস্ব ঢংয়ে এই ঘোষণাগুলিকে ভাষণে পরিণত করে ফেললেন। এবং যথারীতি নির্দিষ্ট বিষয়গুলি, তার মহিমাকীর্তনের দুরূহ বিমূর্ত বাকচাতুর্যের আড়ালেই থেকে গেল। বিষয়টা নির্দিষ্টভাবে কোভিড ভ্যাকসিন নিয়ে, অথচ তার ভাষণের বেশিরভাগটা জুড়ে তিনি সাধারণভাবে ভ্যাকসিন নিয়ে কথা বলে গেলেন। যখন কোভিড মৃত্যুর প্রসঙ্গ আসে, এই সরকার তখন শতাংশের হিসেবে কথা বলে; আর টিকার ডোজ-এর প্রশ্নে, একেবারে নির্দিষ্ট সংখ্যায় হিসেব দেয়। গত পাঁচমাসের টিকাকরণ প্রক্রিয়ায় যে জনসংখ্যার ৪%-কেও টিকা দিয়ে উঠতে পারা যায়নি, সেই সত্যিটা আড়াল করতেই এই কৌশল-চাতুরী!
ভারতের ভ্যাকসিন সরবরাহকে নির্দিষ্টভাবে ভাগ করার ক্ষেত্রে সরকারের ভুল সূত্র কিছু অনাবশ্যক জটিলতা তৈরি করেছিল। মোদীর ৭ জুনের ভাষণে সেগুলোকে বাদ দিলেও এই বক্তব্য একটি যুক্তিসঙ্গত টিকা নীতির স্পষ্ট প্রকাশ এবং তার উৎসাহী রূপায়ণ নিয়ে কোনও আত্মবিশ্বাস জাগাতে পারেনি।
আমরা এখনও জানি না, কেন গুজরাট তামিলনাড়ুর চেয়ে বেশি টিকা পাচ্ছে এবং কীসের ভিত্তিতে রাজ্যগুলির মধ্যে টিকা বণ্টন করা হচ্ছে। ন্যূনতম সম্ভাব্য সময়ের মধ্যে সর্বাধিক মানুষকে টিকা দেওয়াই যদি ‘ভাবনা’ হয়, তাহলে বাস্তব সরবরাহের উপর গুরুত্ব দিতে হবে, ডিজিটাল পদ্ধতিতে নথিভুক্ত চাহিদার উপরে নয়। ভারতে বাধ্যতামূলক ডিজিটাল নথিভুক্তি এখনও ব্যাপক ও স্বচ্ছ গণ সরবরাহকে সহজতর ও ত্বরান্বিত করতে যত না কাজে লাগে তার চেয়ে অনেক বেশি কাজে লাগে ‘বাদ দেওয়ার মাধ্যম’ হিসেবে। এই সময়ের জরুরি প্রয়োজন -- দ্রুত সর্বজনীন টিকাকরণ সুনিশ্চিত করার জন্য জোরদার প্রচার; কিন্তু মোদীর ভাষণ এই অভিমুখে পথনির্দেশের ক্ষেত্রে আমাদের কোন ভরসা জোগাতে পারেনি।
আগামী দীপাবলি পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনা চালু রাখার প্রতিশ্রুতিটি আরেকটি জাঁক করে বলা কথা। কিন্তু আসলে এতে কী পাওয়া যাচ্ছে? প্রতি মাসে জনপ্রতি ৫ কেজি চাল বা গম, সঙ্গে এক কেজি করে ছোলা (যেটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেওয়াই হয় না)। ব্যস! খাদ্য সুরক্ষা আর সর্বজনীন গণবন্টনের গোটা বিষয়টাকে এই নামমাত্র ন্যূনতমে এনে দাঁড় করানো আমরা কি মেনে নিতে পারি? ডাল, ভোজ্য তেল, মশলা এবং ন্যূনতম আয় সহায়তা -- কিছুই নেই। গ্রামীণ দরিদ্র জনসাধারণকে শুধুমাত্র পিএমজিকেএওয়াই-এর এই নামমাত্র ছিটেফোঁটার ভরসায় বেঁচে থাকতে হবে?
মোদীর ‘ভ্যাকসিন ডিগবাজি’ আমাদের বলছে, সরকার আর প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ এবং পুঞ্জীভূত গণক্রোধের চাপকে উপেক্ষা করার অবস্থানে নেই। আসুন, আমরা কৃষি আইন ও নতুন শ্রম কোড বাতিল করা, সরকারি সম্পত্তি বেচা বন্ধ করা, দ্রুত গণটিকাকরণ এবং শ্রমজীবী জনতার জন্য ন্যূনতম আয় ও খাদ্য সহায়তা সুনিশ্চিত করার জন্য সরকারের উপর ক্রমান্বয়ে চাপ বাড়িয়ে যাই!
এম এল আপডেট, সম্পাদকীয় খণ্ড - ২৪, সংখ্যা - ২৪ ( ৮ - ১৪ জুন ২০২১)
* কোভিড বিধি মেনে গণপরিবহন অবিলম্বে চালু কর।
* যুদ্ধকালীন তৎপরতায় টিকাদান কর্মসূচি চালু কর। টিকার যোগান সুনিশ্চিত না করে কর্মস্থলে বা অন্যত্র প্রবেশের ক্ষেত্রে টিকাকে বাধ্যতামূলক করা যাবে না।
* আধার সংযোগের নামে দুয়ারে রেশন প্রকল্প থেকে কাউকে বঞ্চিত করা চলবে না।
১৫ জুন এক প্রেস বিবৃতিতে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির পক্ষে সম্পাদক পার্থ ঘোষ বলেন, ১৪ জুন রাজ্য সরকার বিধিনিষেধের (লক ডাউনের) সময় সীমা ১ জুলাই পর্যন্ত বর্ধিত করেছে। যদিও দু’দফায় চলা মোট তিরিশ দিনের কড়া বিধিনিষেধ এবার কিছুটা শিথিল করার কথা জানিয়েছেন রাজ্য সরকার। সরকারি, বেসরকারি অফিস খোলার কথাও এতে বলা হয়েছে। বলা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের আর্থিক কর্মকাণ্ডতে কিছু কিছু ছাড়ের কথাও।
কিন্তু আমরা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করেছি, গণপরিবহণ সম্পূর্ণ বন্ধ রাখা হয়েছে। এর ফলে যারা ব্যবসা বা কর্মস্থলে যাওয়া আসার জন্য ট্রেন, বাস, লঞ্চ-এর মতো গণপরিবহণের ওপর নির্ভরশীল তাদের জন্য কার্যত লকডাউন চলবে। রাজ্য সরকারের এই সিদ্ধান্তকে সাধারণ মানুষ রুটি-রুজির ওপর প্রত্যক্ষ আঘাত হিসেবেই দেখছেন। লকডাউনে কাজ হারা মানুষদের জন্য মাসিক ৭৫০০ টাকা অনুদানের দাবিটিও এখনো মান্যতা দেয়নি সরকার।
আমরা লক্ষ্য করেছি জীবিকা বাঁচানোর মরীয়া চেষ্টায় যে সামান্য কয়েকটি স্টাফ স্পেশ্যাল ট্রেন চলছে, তাতে অসংখ্য মানুষ কোনোক্রমে স্থান করে নিতে চাইছেন। প্রবল ভিড় করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিকেই কার্যত আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। খবরে প্রকাশ যে রেল কর্তৃপক্ষও রাজ্য সরকারের কাছে লোকাল ট্রেন বাড়ানোর জন্য আবেদন জানিয়েছে। অন্যথায় যে কোনো সময় বড় ধরনের উত্তেজনা তৈরি হতে পারে।
এই পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকারের কাছে আমাদের দাবি
( ১৭ জুন প্রচারিত প্রেস বিবৃতি)
সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা এবং এআইকেএসসিসি-র পক্ষ থেকে আগামী ২৬ জুন দেশব্যাপী “কৃষি বাঁচাও-গণতন্ত্র বাঁচাও” দিবস পালনের আহ্বান এই রাজ্যে যথাযথ গুরুত্ব সহকারে সংগঠিত করা হবে। এই দিন দিল্লীর ঐতিহাসিক কিষাণ আন্দোলনের গৌরবময় সাত মাস পূর্তি। এছাড়া ২৬ জুন ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়, যা কোনোদিনই ভোলা যাবে না। এই দিনটি ভারতে স্বৈরাচারী কংগ্রেসী শাসনে কূখ্যাত জরুরি অবস্থা জারী করার ৪৬তম বর্ষ পূর্তির। বর্তমানে দেশে এক অঘোষিত জরুরি অবস্থার পরিস্থিতি চলছে। বিজেপি সরকার সাংবিধানিক গণতন্ত্রকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করছে, যে কোনও প্রতিবাদ-আন্দোলনের উপর দমন-পীড়ন কালাকানুন জারী করা হচ্ছে। একে মোকাবিলা করে দিল্লীর বুকে কৃষক আন্দোলন সহ জনগণের বেশ কিছু লড়াই এগিয়ে চলেছে। এছাড়াও লক্ষণীয় যে ২৬ জুন কিংবদন্তী কৃষক নেতা স্বামী সহজানন্দ সরস্বতীর মৃত্যুবার্ষিকী।
২৬ জুন দেশের বিভিন্ন রাজ্যের রাজভবনগুলিতে ধর্না অবস্থানের কর্মসূচী কলকাতায়ও সংগঠিত করা হবে। এই দিন রাজভবনের পূর্ব গেটে (সিধু কানু ডহরের সামনের দিকে) কোভিড বিধি মেনে এআইকেএসসিসি-র অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন সংগঠনের ১০০ জন সংখ্যক কর্মী ও নেতৃত্ব সমাবেশিত হবেন, সকাল ১১টায় স্লোগান প্ল্যাকার্ড সহকারে বিক্ষোভ প্রদর্শন শুরু করা হবে।
এই দিন রাজ্যের বিভিন্ন জেলা সদর ও ব্লকগুলিতে (সম্ভব হলে কেন্দ্রীয় সরকারের দপ্তরের সামনে) যৌথভাবে বিক্ষোভ/ অবস্থান কর্মসূচি সংগঠিত করা হবে।
কৃষক আন্দোলনের সাথে একাত্ম হওয়া এবং দেশব্যাপী বিক্ষোভে সামিল হওয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন, কর্মচারি ইউনিয়ন, নাগরিক সংগঠন, গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সংগঠন, ব্যবসায়ী সমিতি, মহিলা সংগঠন, ছাত্র ও যুব সংগঠন এবং অন্যান্য সকল প্রগতিশীল প্রতিষ্ঠান এবং নাগরিকদের কাছে ২৬ জুনের কর্মসূচিতে যোগদানের আবেদন জানানো হবে।
স্লোগান :
১) কৃষি বাঁচাও, গণতন্ত্র বাঁচাও!
২) কৃষকদের ন্যায্য দাবির সমর্থনে সমস্ত মানুষ এক হও!
৩) নয়া কালা কৃষি আইন বাতিল কর!
৪) দেশের কৃষি ও কৃষকদের কর্পোরেটদের গোলামে পরিণত করা চলবে না!
৫) কোম্পানিরাজ হঠাও, দেশ বাঁচাও!
৬) কৃষকের স্বাধীনতা রক্ষায় সমস্ত মানুষ এক হও!
৭) ফসলের ন্যূনতম সংগ্রহমূল্য গ্যারান্টি আইন চালু কর!
৮) কৃষি পণ্যের সরকারি সংগ্রহ তুলে দিয়ে রেশন ব্যবস্থাকে বিলোপ করার চক্রান্তের বিরুদ্ধে এক হও!
৯) সার বীজ বিদ্যুৎ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধিকারী মোদী সরকার দূর হঠো!
১০) চুক্তি চাষের মধ্য দিয়ে দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে ধ্বংস করা চলবে না!
১১) অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন তুলে দিয়ে কালোবাজারি মজুতদারিকে বৈধ করা হচ্ছে কেন মোদী সরকার জবাব দাও!
১২) বিদ্যুৎ বিল ২০২০ বাতিল কর!
১৩) দিল্লীর বুকে কৃষক আন্দোলনের পাশে সমস্ত মানুষ এক হোন!
১৪) শ্রম আইন তুলে দিয়ে শ্রমিকদের অধিকার হরণ করা চলবে না, নয়া শ্রম কোড বাতিল কর!
১৫) সমস্ত মানুষকে সময়সীমা বেঁধে বিনামূল্যে করোনা টিকাকরণ করতে হবে।
১৬) গ্রামস্তর পর্যন্ত স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিতে কোভিড পরীক্ষা ও চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত করতে হবে।
এছাড়া জেলা ও ব্লকস্তরের কর্মসূচিতে কৃষকের ফসলের ন্যায্য দাম, বিশেষতঃ ধানের সরকারি সংগ্রহর দাবি সহ সার-বীজ-বিদ্যুৎ মাশুল বৃদ্ধির বিষয়গুলিও তুলে ধরা হবে।
সুন্দরবন বাঁচাও এবং প্রতিবছর বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলা এবং এ সম্পর্কে রাজ্য জুড়ে প্রচার সংগঠিত করা হবে।
অমল হালদার (আহ্বায়ক)
কার্তিক পাল (সচিব)
রাজ্যের তৃণমূল সরকার “কৃষক বন্ধু’ প্রকল্পে চাষিদের বছরে পাঁচ হাজারের বদলে দশ হাজার টাকার খয়রাতি সাহায্য ঘোষণা করেছে। কিন্তু চাষির আয় “তিন গুণ’ করার সরকারি প্রতিশ্রুতি আদৌ রূপায়িত হচ্ছে না। চাষিরা ফসলের ন্যায্য দাম না পেয়ে অভাবী বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। যেমন গ্রামাঞ্চলে এক কুইন্টাল ধান বিক্রি হচ্ছে ১১০০-১২০০ টাকায়, অথচ সরকারি দর ১৮৬৫ টাকা (আরও ৭০ টাকা বেড়েছে যা আগামী মরশুম থেকে কার্যকরী হবে), অর্থাৎ চাষিদের লোকসান কুইন্টাল পিছু ৬০০-৬৫০ টাকারও বেশি। বিপরীতে সার, বীজ, বিদ্যুৎ-র দাম অর্থাৎ চাষের খরচের বিপুল বৃদ্ধি হয়ে চলেছে। তাহলে চাষিদের হাতে রইলো কি? দেশব্যাপী চাষিদের যে দাবি আজ স্বীকৃতি পেয়েছে তা হলো উৎপাদিত ফসল উৎপাদন খরচের দেড়গুণ দামে কিনতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকার ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণে কারচুপি করে চাষিদের ঠকাচ্ছে। যথা ধানের কুইন্টাল পিছু ন্যূনতম সহায়ক মূল্য হওয়া উচিত ২৩৫০ টাকা, অথচ কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করেছে ১৮৬৫ টাকা! অপরদিকে রাজ্য সরকার ফসল কেনার কোনও পরিকাঠামো গড়ে না তুলে চাষিদের অভাবী বিক্রির পথে ঠেলে দিচ্ছে। ফলে চাষিরা বিপুল লোকসানে ব্যবসায়ীদের কাছে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকারের খয়রাতি সাহায্য সেই লোকসানকে আদৌ পূরণ করছে না। তাই আওয়াজ উঠেছে যৎসামান্য দান খয়রাতি নয়, ফসলের প্রকৃত সংগ্রহ মূল্য গ্যারান্টি করো, কম দামে ভর্তুকি দিয়ে সার বীজ বিদ্যুৎ সরবরাহ করো। দিল্লীর চলমান কৃষক আন্দোলনে এটা অন্যতম প্রধান দাবি।
এ রাজ্যে এক একরের ঊর্ধ্বে জমির মালিক কৃষকদের ১০ শতাংশেরও কম, যারা কৃষক বন্ধু প্রকল্পে ১০ হাজার টাকা পাবে। বাস্তবে অকৃষক জমির মালিকদের বড় অংশ এই টাকা পাবে। অথচ সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্ষুদ্র প্রান্তিক চাষিরা পাবে বছরে যৎসামান্য চার হাজার টাকা। এ রাজ্যের লক্ষ লক্ষ ভাগচাষি, অনথিভুক্ত চুক্তি চাষিরা সম্পূর্ণ বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে। সর্বোপরি গ্রামের কৃষি ও অন্যান্য মজুররা কোনরকম সরকারি সহায়তাই পাচ্ছে না। এই লকডাউনের কর্মহীন পরিস্থিতিতে ১০০ দিনের প্রকল্প বন্ধ। তাই সারা ভারত কিষাণ মহাসভা দাবি জানাচ্ছে ন্যায্য দরে সমস্ত ফসলের সরকারি ক্রয় নিশ্চিত করো। ধান কেনার জন্য টাকা বরাদ্দ করো, গ্রামে দুয়ারে দুয়ারে ধান কেনার ব্যবস্থা করো, নথিভুক্ত অনথিভুক্ত ভাগ চাষিদের সরকারি প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। সমস্ত জবকার্ডধারী গ্রামীণ মজুরদের ৫০ দিনের মজুরী নগদে দিতে হবে। জবকার্ডধারীরা বা গ্রামীণ শ্রমিকরা ‘৫০ দিন কাজ করেছেন’ ধরে নিয়ে সেই মজুরি লকডাউন পরিস্থিতিতে আশু ত্রাণ হিসাবে প্রদান করতে হবে। এই মর্মে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে চিঠি পাঠাচ্ছে সারা ভারত কিষাণ মহাসভা।
ধন্যবাদান্তে,
অন্নদা প্রসাদ ভট্টাচার্য, রাজ্য সভাপতি এবং
জয়তু দেশমুখ, রাজ্য সম্পাদক, সারা ভারত কিষাণ মহাসভা
গত ১১ জুন আমাদের জেলার প্রান্তিক পাথরপ্রতিমা ব্লক, হেরম্বগোপালপুর অঞ্চলের কুয়েমুড়ি গ্রামে ইয়াসে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সাথে একাত্ব হতে গিয়েছিলাম।
ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কতটা ক্ষতি হয়েছে তা অনুবীক্ষন যন্ত্র দিয়ে মেপে দেখতে কেন্দ্রের আমলা-মন্ত্রীরা লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে পরিদর্শনে বেরিয়েছেন। তাদের পরিমাপ কবে শেষ হবে এবং কবে আমরা আমাদের ন্যায্য পাওনা পাবো, তা নিয়ে দীর্ঘ টানাপোড়েন চলবে। জনগণের তদারকি বন্ধ করে, দুর্নীতি বন্ধ করতে আমলা নির্ভর ব্যবস্থা ক্ষতিপূরণে কতগুলো পরিবারেরর হিসাব যথার্থ এবং দ্রুত করতে পারবে জানা নেই।
বাংলা বাঁচাতে বাংলার মানুষ প্রথমেই বিজেপি’র মতো ভয়ঙ্কর ভাইরাসকে বাংলা দখলের স্বপ্নকে চুরমার করেছে। দ্বিতীয়ত করোনার হাত থেকে বাংলাকে বাঁচাতে, করোনায় লক্ষ লক্ষ মানুষ মারার কেন্দ্রের টিকাকরন ভুল নীতির বিরোধীতা করার সাথে সাথে নানা রং-এর কোভিড ভলেন্টিয়াররা রুগী বাঁচাতে মরণপন লড়াই চালাচ্ছে। একইভাবে রেশন ছাড়া কেন্দ্র-রাজ্য সরকারের অনুপস্থিতিতে বিপর্যস্ত মানুষগুলোকে পুনরায় উঠে দাঁড়াতে নানা ব্যক্তি, বেসরকারী প্রতিষ্ঠান তাদের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছেন।
অনেকের মতো আমরাও সিন্ধুতে বিন্দুর মতো ২০০ পরিবারের জন্য চিড়ে, মুড়ি, বাতাসা, বিস্কুট, চানাচুর, সাবান, দেশলাই, মাস্ক, সানিটারি ন্যাপকিন ও বড় মশারি নিয়ে গ্রামের বাড়িতে রওনা দিয়েছিলাম।
কমরেড চারু মজুমদারের আহ্বান “জনগনের স্বার্থই, পার্টির স্বার্থ” ও গ্রামে চলো ডাককে বাস্তবায়িত করতে আইসা ও আরওয়াইএ সাথীরা বিগত কয়েকদিন যুদ্ধকালীন উৎসাহ নিয়ে অর্থ ও সামগ্রী সংগ্রহে মানুষের কাছে পৌছেছে। ছাত্ররা যখন পুঁথিগত জ্ঞানের কেন্দ্র থেকে পৃথিবীর পাঠশালায় পৌছে কুয়েমুড়ি গ্রামের কৃষক ও মেহনতিদের হাতে সামগ্রী তুলে দিয়ে তাদের হাতে হাত মেলায় তখন তারা নিজেরাই ধন্য হয়।
পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের রাজ্য সম্পাদক গণকবিয়াল নিতিশ রায়, নাট্টকার অরিন্দম সেনগুপ্ত ও অধ্যাপক নিত্যানন্দ ঘোষ এবং আরো দুজন সামগ্রী নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের মধ্যে উপস্থিত থেকে তাদের অধিকার নিয়ে লিফলেট বিলি করেন।
ইয়াস ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের অধিকার ও প্রয়োজন নিয়ে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলা কমিটি প্রথম থেকে সচেতন ছিল। তাই (১) ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের আশু ও স্থায়ী সমস্যা সমাধানে একগুচ্ছ দাবিসনদ মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর নিকট পেশ করা হয়েছে। (২) অধিকারের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে আগাম ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় থেকে যুবদের সংগঠিত করার উদ্যোগ নেন (যাদের সাহায্যেই সুষ্টভাবে সামগ্রী এলাকার জনগণদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। জেলা পার্টির অন্যতম সদস্য নব কুমার বিশ্বাস ও জয়দেব নস্কর। (৩) সামগ্রী নিয়ে মানুষের মধ্যে সরাসরি চলে যাওয়া।
আগামী কয়েকদিন পর সামগ্রী নিয়ে অন্যস্থানে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে। একই সাথে এই অঞ্চলের মানুষের অধিকারের আন্দোলন গড়ে তোলার প্রস্তুতি চলুক।
কিশোর সরকার
গেছিলাম ইয়াস পীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়াতে দঃ ২৪ পরগণার পাথরপ্রতিমা ব্লকের হেরম্বগোপালপুর পঞ্চায়েত অন্তর্গত কুয়েমুড়ি গ্রামে। বাখরাহাট থেকে যাত্রা শুরু। যাওয়ার পথে দাঁড়ানো হল রায়দীঘি বিধানসভা অন্তর্গত শঙ্কর রোড অঞ্চলে। যেখানে আগে থেকেই ত্রাণ সামগ্রীর একটা অংশ গোছগাছ করতে গিয়েছিলেন জেলা কমিটির দুজন নেতৃত্ব, কমরেড নবকুমার বিশ্বাস এবং কমরেড জয়দেব নস্কর। তারুণ্যে ভরা ১০ জন যুবকের তৎপরতায় যেখানে ত্রাণসামগ্রীর গোছগাছ সম্পন্ন হয়েছে আগের দিনই। আলাপচারিতা চলল, সাথে করে খবর পাওয়া গেল এই এলাকাতেই ৭০ দশকের এক কমরেডের বসবাস। কমরেড শঙ্কর মন্ডল। অল্প সময়তেই পৌঁছে গেলাম তার কাছে। বয়স্ক কমরেড নবযৌবনকে হাতের কাছে পেয়ে আপ্লুত। কথাবার্তা চলল, পেলাম পাশে থাকার বার্তা। আলাপচারিতার পর পুনরায় যাত্রা শুরু হেরম্বগোপালপুরের দিকে। রায়দীঘি পেরিয়ে নদীর বুকচিরে গড়ে ওঠা এলাকার সবচেয়ে বড় ফ্লাইওভার টপকে কিছুটা গিয়ে গ্রামে প্রবেশ। ত্রাণকার্য শুরু হল এলাকার যুবকদের উদ্যোগেই। আমরা ছাত্র-যুবরা কথা বলা শুরু করলাম গ্রামের বাসিন্দাদের সাথে।
মূলত চাষ-বাস, ক্ষেতমজুরি, সমুদ্রে মাছ ধরা (ট্রলারে), মাছ চাষ, গরু, ছাগল পালন এগুলোই জীবিকা এলাকার মানুষের। বছরে দুটো চাষ হয়, ১) বরো, ২) আমন। এক বিঘা জমিতে গড়ে ১২ বস্তা (১৮ মন) মতো ধান হয়। ধান ছাড়া উচ্ছে, করোলা এবং টমেটো চাষের কথা জানা গেল, এছাড়া মাছ চাষ প্রায় সব পুকুরেই হয়। ইয়াসের ফলে সমুদ্রের নোনা জল ঢুকে পুকুরের মাছ পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত। জলের তলায় এখনো যে জলাজমি রয়েছে তাতে আগামী ২ বছর কোনোরকম ফসল হবেনা একথাও জানা গেল। গ্রামগুলোর কিছু লোক কলকাতায় কাজ করে বিভিন্ন অসংগঠিত শ্রমিকের, কেউ বা পরিযায়ী শ্রমিক, তবে এ সংখ্যা কম। দুটি এলাকা এখনো জলের তলায় আছে, সেসব অঞ্চলে ঘরবাড়ি, পশু, মাছ, ধানের তলা সব ক্ষতিগ্রস্ত। এলাকার লোক নিজেদের তৎপরতায় জল নিকাশ বাঁধ মেরামতের কাজ করছেন। প্রশাসনের কথা জিজ্ঞাস করলে জানা গেল “কারোর ভরসায় বসে থাকলে কি আর বাঁচা যাবে ভাই, আমরাই এগুলো করি, পরে টাকাপয়সা ওরা ব্যবস্থা করে দেয়, যদিও না করে দেয় তাতে আর কি করব, আমাদের তো বাঁচতে হবে।” একশ দিনের কাজ নিয়ে একটা ক্ষোভ রয়েছে। একশ দিনের কাজে দূর্নীতি, মজুরি দেওয়ার সময় মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের উপদ্রব, যাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিলেন গ্রামীণ মহিলারা। এলাকার মানুষের সাথে কথা বলে বোঝা গেল প্রশাসনের কাছে দাবি পুনর্বাসন দিতে হবে, মজবুত নদীবাঁধ বানাতে হবে, অরণ্য ধ্বংস করা চলবে না, ম্যানগ্রোভের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে, মজবুত রাস্তাঘাট বানাতে হবে, বেকারত্ব কমানোর পরিকল্পনা করতে হবে। নদীবাঁধ নির্মাণে সরকারী ব্যর্থতা, দুর্নীতির বিষয়গুলো নিয়েও কথাবার্তা হল।
পুরানো ইতিহাস সম্বন্ধে খোঁজ নিয়ে দেখা গেল আগে এসব অঞ্চলে এক একটা জোতের মালিক এক এক জন ছিল, পরে নকশালবাড়ি আন্দোলনের ফলে জমি কৃষকের হাতে আসে। এখন জোতের মালিক কেউ নেই, মোটামুটি কৃষকের হাতেই জমি আছে। পূর্বে যারা মালিক ছিল তাদের বেশিরভাগটাই এখন কলকাতার বাসিন্দা, কারো বা এখানে খুব সামান্য জমিজমা রয়েছে, কিন্তু তারা গ্রামে আর কেউ আসে না।
এরপর ফেরার পালা। ফেরার পথেও প্রবীণ কমরেড শঙ্কর মন্ডলের সাথে পুনরায় দেখা করে নিলাম। বললাম কমরেড নতুন করে সংগঠন এই অঞ্চলে গড়ে তুলব, আপনাকে পাশে দরকার। পাশে থাকার অঙ্গীকার করলেন, নবীন প্রবীণের মেলবন্ধনে নকশালবাড়ির ধারা এভাবেই সারা জেলায় স্থাপন করার স্বপ্ন বুকে নিয়ে ফিরলাম নিজ এলাকায়।
- শুভদীপ পাল
সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের যাদবপুর-ঢাকুরিয়া লোকাল কমিটি ও ‘বোকাবুড়ো’র পক্ষ থেকে ‘বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরীক্ষা শিবির’ সংগঠিত হল ‘ইয়াস’ বিধ্বস্ত মৈপীঠ এলাকায়। পূর্ব গুড়গুড়িয়া গ্রামে এই স্বাস্থ্য শিবিরে শতাধিক গ্রামবাসী স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান। চিকিৎসক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ডাঃ শান্তসবুজ দাস ও ডাঃ দেবাশীষ মুখার্জি। এছাড়াও বোকাবুড়ো’র স্বেচ্ছাসেবকরা চিকিৎসকদের সাহায্য করেন। স্বাস্থ্য পরীক্ষার সাথে প্রয়োজনীয় ওষুধ দেওয়া হয়। পূর্ব গুড়গুড়িয়া গ্রামের ২০০টি পরিবারের হাতে ৫ লিটারের জলের বোতল, ছোটদের কেক-বিস্কুট, যৌথ রান্নাঘরের জন্য চাল, ডাল, আলু গ্রামবাসীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। ‘ইয়াস’ বিধ্বস্ত সুন্দরবনের মানুষের পাশে আছি আমরা।
করোনা মহামারীর ২য় ঢেউ, অঘোষিত লকডাউন ও ‘ইয়াস’ সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত অসহায় মানুষের সমস্যা সমাধানে সিপিআই(এম-এল) লিবারেশনের পূর্ব বর্ধমান জেলা কমিটির পক্ষ থেকে ৭ জুন নিম্নলিখিত দাবিতে জেলাশাসক ও বিডিও দপ্তরে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। মূল দাবি ছিল,
১) সমস্ত গ্রাম পঞ্চায়েতে কোভিড কেয়ার সেন্টার তৈরি করা বা গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে বিনামুল্যে টিকা দেওয়া, স্ক্রিনিং, কোয়ারেন্টেন ও এম্বুল্যান্সের ব্যবস্থা করতে হবে। ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে অক্সিজেন-সমৃদ্ধ শয্যা ও উপযুক্ত ডাক্তারদের মাধ্যমে চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকতে হবে। সমস্ত হাসপাতালে আইসিইউ বেডের ব্যবস্থা করতে হবে।
২) গ্রামীণ গরিবদের অবিলম্বে লাগাতার এমজিএনআরইজিএ প্রকল্পে কাজ দিতে হবে পরিযায়ী শ্রমিক সহ সমস্ত কাজ হারানো মেহনতিদের কাজ দিতে হবে। মহামারী চলাকালীন প্রতিটি জবকার্ড ধারী গরিব মানুষের পরিবারকে ৫০টি শ্রম দিবসের মজুরি অনুদান হিসেবে দিতে হবে।
৩) সমস্ত রেশন কার্ডধারী সহ ক্ষুদ্র ও মাঝারী কৃষকদের মাসিক ৩৫ কেজি চাল/গম/আটা ও মাসিক ৫,০০০ টাকা বিশেষ সহায়তা করতে হবে।
৪) ‘ইয়াস’ সহ বিগত কালবৈশাখীর ঝড়-বৃষ্টির ফলে বরো মরসুমের ধান, তিল ও অন্যান্য রবি ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। সরকারি বিধিনিষেধের ফলে যানবাহন সংকটের জন্য ধান ও অন্যান্য ফসলের বাজার পাচ্ছে না তাই গ্রামে গ্রামে ধান ক্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। আগামী ফসল উৎপাদনের জন্য বীজ সার সরবরাহ করতে হবে।
৫) কৃষক ও গরিব মেহনতিদের সমস্ত ঋণ মকুব করতে হবে। স্বনির্ভর গোষ্ঠীসহ মাইক্রোফিনান্স সংস্থার ঋণ মকুব করতে হবে। কিস্তির টাকা আদায় স্থগিত রাখতে হবে। কিস্তির টাকার জন্য জুলুম বন্ধ করতে হবে।
শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি, যোগ্য শিক্ষক পদে চাকুরী প্রার্থীদের বঞ্চিত করার বিরুদ্ধে ও শূন্য পদে দ্রুত শিক্ষক নিয়োগের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরেই আর ওয়াইএর নেতৃত্বে আন্দোলন চলছে শিক্ষক প্রার্থীরা দীর্ঘদিন অনশন করছেন। মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি ও কার্যকর হচ্ছে না। বেকার যুবকরা অনেক কষ্ট করে ঋণগ্রস্ত মা-বাবার অর্থ ব্যয় করে লেখা পড়া শিখে যোগ্যতা অর্জন করেও বেকারত্বের জ্বালায় আত্মহত্যা করতে হচ্ছে। দালাল, শাসক পার্টির দান্ধাবাজ নেতাদের দ্বারা প্রতারিত হচ্ছে। কিন্ত শিক্ষক নিয়োগ আজ ও কোর্টের অজুহাত, নেতাদের ভাষণ প্রতিশ্রুতির মধ্যেই আটকে আছে। তাই করোনার পরিস্থিতিতে অঘোষিত লকডাউন এর মধ্যেই ব্যাপক সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসা নতুন সরকারের কাছে আর ওয়াইএ দাবি করছে –
• শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির নিরপেক্ষ তদন্ত হোক ।
• অসদউপায়ে নিযুক্ত শিক্ষকদের বরখাস্ত করতে হবে এবং যোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগ করতে হবে।
• শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতা ও নিয়মিত টেট, এসএসসি ও অন্যান্য নিয়োগ পরীক্ষা কার্যকর করতে হবে ।
• শিক্ষান্তে কাজের অধিকারকে সুনিশ্চিত করতে হবে ।
এই সমস্ত দাবিতে ১০ জুন পূর্ব বর্ধমান জেলার পুর্বস্থলী ২নং ব্লকের ফলেয়া স্টেশন বাজারে, বাররপাড়া গ্রামে, মন্তেশ্বর ব্লকের মুরুলিয়া গ্রাম, কুলুট-এ প্রতিবাদ সংগঠিত হয়।
“বড্ড বেশি মানুষ গেছে বানের জলে ভেসে” -- হ্যাঁ করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে মোদী সরকারের চরম অবহেলা তাচ্ছিল্য অপদার্থতায় আমাদের হাজার হাজার সহনাগরিক হারিয়ে গেছেন। সম্মানজনক শেষ বিদায়ও জানানো যায় নি তাদের। সেই প্রতিটি মানুষকে স্মরণে রাখার, প্রতিটি মৃত্যুর হিসেব রাখার শপথ ধ্বনিত হল মোমের স্নিগ্ধ আলোয় গানে কবিতায় শ্রদ্ধা-স্মরণে।
সন্ধ্যার ছায়া ঘনিয়ে আসা আঙিনায় সারিবদ্ধ মোমের আলো। পরিবার পরিজন ও পড়শিদের সামিল করেছেন সমিতির সদস্যা। কোথাও স্কুলছাত্রীর উদ্যোগে সামিল হয়েছে পল্লী। কোথাও তরুণ-তরুণী গভীর গাঢ়-গলায় গানে কবিতায় উগরে দিলেন হৃদয়ের ব্যথা ক্ষোভ ক্রোধ। সেই অনুভূতি ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে, পড়বে গ্রাম গ্রামান্তরে নাগরিক পরিসরে, শহরের আনাচে কানাচে। অনেক অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছে নাগরিক সমাজ। তাদের অনেকের হৃদয়ে আজ স্বজন হারানোর গভীর ক্ষত। তাদের সহমর্মী মুখ, ব্যথাভরা চোখে স্বজন হারানোর বেদনা আর তীব্র প্রতিবাদ একাকার। সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির কেন্দ্রীয় আহ্বানে সাড়া দিয়ে রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে 'প্রিয়জন স্মরণ' অনুষ্ঠিত হয়।
হুগলি জেলার বিভিন্ন ব্লকে সমিতির সংগঠকদের পরিকল্পিত উদ্যোগে বৈঁচি, পোলবা, বলাগড় গুপ্তিপাড়া, ধনিয়াখালি বাগনান, পাণ্ডুয়ার ভোটগ্রাম, কোন্নগরে এই অনুষ্ঠানে বহু সাধারণ মহিলা অংশ নিয়েছেন। উত্তর ২৪ পরগনার অশোকনগরে সমিতির উদ্যোগে নাগরিক সমাজ সামিল হয় এই অনুষ্ঠানে। বেলঘরিয়ায় আইসা'র সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে মহিলা সমিতি আয়োজিত অনুষ্ঠানে অনেক সাধারণ মানুষ অংশ নেন। হাওড়া জেলার বালি বাগনান আমতা ও পাঁচলায় সমিতির উদ্যোগে সাধারণ মহিলাদের নিয়ে অনুষ্ঠান হয়। বালি গ্রামাঞ্চল সমবায় পল্লী মোড়ে সমিতি গণসংস্কৃতি পরিষদের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে শ্রদ্ধা স্মরণে সামিল হয়। আশাকর্মীরাও শোক জ্ঞাপন করেন পৃথক অনুষ্ঠানে। কলকাতায় সমিতির উদ্যোগে যাদবপুর গরফা মোড়ে এবং বাঘাযতীন আই ব্লকে এই অনুষ্ঠানে অনেক সাধারণ মানুষও সামিল হন। বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরেও সমিতির উদ্যোগে ‘প্রিয়জন স্মরণ’ অনুষ্ঠান পালিত হয়। দক্ষিণ ২৪ পরগনার বজবজ নিশ্চিতপুর পঞ্চায়েতের মালিকপাড়া ও বৈষ্ণবপাড়া গ্রামে সমিতির স্থানীয় নেতৃত্বের উদ্যোগে শ্রদ্ধা-স্মরণ অনুষ্ঠানে সাধারণ মহিলা ও ছাত্রীরা সামিল হন। সমিতির পোড় খাওয়া প্রবীণা নেত্রী কমরেড মীনা পাল দিনটিকে স্মরণে রেখে সতেজ ঋজু কণ্ঠে সুকান্ত ভট্টাচার্যের 'ছাড়পত্র' কবিতাটি আবৃত্তি করেন। শোক আর প্রতিবাদের এই অনুষ্ঠান স্থির অকম্প শিখায় নাগরিক সমাজে দেদীপ্যমান থাকবে।
-- জয়ন্তী দাশগুপ্ত
দক্ষিণ ২৪ পরগণা
কোভিড মহামারী, লকডাউন সহ বিভিন্ন ঘটনায় আমাদের ছেড়ে যাওয়া প্রিয়জনদের স্মৃতিতে দেশজুড়ে শোক ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের কর্মসূচির অঙ্গ হিসাবে দঃ ২৪ পরগণার জেলা অফিস, পূজালী, বজবজ গ্রামাঞ্চল সহ বিভিন্ন এলাকায় শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হয়। দঃ ২৪ পরগণা জেলা অফিসে জেলা সম্পাদক কমরেড কিশোর সরকারের নেতৃত্বে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হয়। উপস্থিত ছিলেন সেখ সাবির, লক্ষীকান্ত অধিকারী সহ আরো অনেকে। বজবজ গ্রামাঞ্চলে দেবযানী গোস্বামীর নেতৃত্বে কর্মসূচি পালিত হয়।
আমরা ভুলবো না। প্রত্যেক মৃত্যুর হিসেব রাখবো। সব শোক ভাগ করে নেবো।
হাওড়া
প্রিয়জনের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ১৩ জুন রবিবার বালি গ্রামাঞ্চলে সমবায় পল্লী মোড়ে সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি ও পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদ যৌথ ভাবে “প্রিয়জন স্মরণ” কর্মসূচি পালন করা হয়। সভার শুরুতে মাল্যদান করেন প্রবীণ কমরেড অরুণ গুহ, পার্থ সারথি মিত্র, অরুণ পাল কমঃ দেবাশিস চ্যাটার্জি। সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির পক্ষে সুষমা মুখার্জী, ছায়া মাখাল পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের পক্ষে আশিস রায় চৌধুরী, অমিতাভ দে এবং বিপ্লবী যুব অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে প্রদীপ মাখাল, অয়নান্ত গুহ, দিগন্ত গুহ সহ আরও অনেকে। সভায় আজকের ভয়ংকর পরিস্থিতি সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন অরুণ গুহ ও মাধব মুখার্জী। অঙ্গীকার করা হয় বিপর্যস্ত মানুষের পাশে থাকার। নীরবতা পালন ও মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রিয়জনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে স্মরণ কর্মসূচির সমাপ্তি ঘোষণা করা ।
- অঙ্কিত
গত দেড় বছরে মোদী সরকারের ভ্রান্ত স্বাস্থ্যনীতির জেরে মুখ থুবড়ে পড়া চিকিৎসা ব্যাবস্থার কবলে পরে প্রয়াত হয়েছেন, হয়ে চলেছেন আমাদের সহ নাগরিক সহযোদ্ধারা। মোদী একদিকে দেশের মানুষদের আত্মনির্ভর হতে বলছেন। অন্যদিকে আত্মনির্ভর চিকিৎসা পরিকাঠামোর বেআব্রু ছবি দিন-প্রতিদিন চোখে আসছে। কখনো গঙ্গায় মৃতদেহের মিছিল, কখনো অক্সিজেনের অভাবে রুগী ধুঁকছে। হাসপাতালগুলোতে শুধুই স্বজন হারানোর আর্তনাদ। আমরা সমস্ত না পাওয়াগুলোকে, শোককে মনে রাখার জন্য কোভিড মহামারীতে হারিয়ে ফেলা আত্মজনের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর সংকল্পে একুশের ডাকে সাড়া দিয়ে রাজ্যের অন্যান্য জায়গার সাথে সাথে ১৩ জুন রবিবার শিলিগুড়ি হাসপাতাল সংলগ্ন শিলিগুড়ি ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশনের সামনে মোমবাতি জ্বালিয়ে গানে, কবিতায় কথায় স্বজন হারানোর শোক ভাগ করে নিলাম উপস্থিত সহনাগরিকদের সাথে। হাতে ধরা পোস্টারে দাবি জানানো হলো সকলের জন্য, ফ্রি ভ্যাকসিন, সর্বজনীন স্বাস্থ্যনীতি তৈরি করা সহ বেসরকারি চিকিৎসা ব্যাবস্থার লাগামহীন খরচের রাশ টানতে সরকারকে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। উপস্থিত ছিলেন অভিজিৎ মজুমদার, ডাঃ অতনু রায়, ডাঃ সুধীন দাস, গৌতম চক্রবর্তী, প্রলয় চতুর্বেদী, মুক্তি সরকার, সাগর চতুর্বেদী, লক্ষ্মী দাস মোজাম্মেল হক, দীনবন্ধু দাস প্রমুখ। অপু চতুর্বেদীকে মনে রেখে মীরা চতুর্বেদীর লেখা কবিতা সহ স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন গৌতম চক্রবর্তী, মুক্তি সরকার।
একই দিনে শিলিগুড়ি শক্তিগড়েও এলাকার সহমর্মী মানুষেরা গানে কবিতায় স্মরণ করেন প্রয়াত সহনাগরিকের, সহযোদ্ধাদের। সমবেত গানে গলা মেলান সুশান্ত ঘোষ, মধুবন্তী বসু, সর্বানী দাশগুপ্ত। কবিতা পাঠ করেন সুশান্ত ঘোষ। মোমবাতি জ্বালিয়ে শ্রদ্ধা অর্পণ করা হয় সকলের প্রতি। শোকের বিহ্বলতাকে কাটিয়ে উঠে ক্রোধের আগুনকে সম্বল করে জনবিরোধী সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সবকিছু মনে রাখা হবে -- সবকিছু -- এই শপথেই কর্মসূচি শেষ হয়। উপস্থিত ছিলেন এলাকার সহ নাগরিক সুশান্ত ঘোষ, সর্বানী দাশগুপ্ত, মধুবন্তী বসু, রজত বর্মণ, সোমা সেনগুপ্ত, মিলি ভট্টাচার্য, রমা সাহা, টুলু সাহা, রাজা সরকার, শাশ্বতী সেনগুপ্ত প্রমুখ।
দু’জায়গাতেই সহমর্মী মানুষদের উপস্থিতি ছিলো উল্লেখযোগ্য।
স্বচ্ছ বৈষম্যহীন ভ্যাকসিন নীতিসহ বিনামূল্যে দ্রুত সার্বজনীন টিকাকরণ, সমস্তরকম পরিষেবা সহ হাসপাতাল, উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র, শ্রমজীবী গরিব মানুষকে বিনামূল্যে চাল গম ডাল তেল চিনি সাবান স্যানিটারি ন্যাপকিন সরবরাহ, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে মুনাফাবাজি বন্ধ করা, জাতীয় উৎপাদনের (GDP) ১০ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করা, আশাকর্মীদের পিপিই ও নিরাপত্তা এবং স্কীম ওয়ার্কারদের লকডাউন ভাতা, লকডাউনে বিপর্যস্ত মানুষের সমস্ত রকম ঋণ মকুব করা, অতিমারিতে কাজ হারানো শ্রমজীবী মহিলাদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্নিযোগের দায়িত্ব নেওয়া, অতিমারি থেকে ভারতবাসীকে বাঁচাতে ব্যর্থ প্রধানমন্ত্রী ও স্বাস্থ্য মন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে বিভিন্ন অঞ্চলে মহিলারা বিক্ষোভ কর্মসূচিতে সামিল হন।
উত্তর ২৪ পরগনার অশোকনগরের গোলবাজার, হুগলির বলাগড়, ধনিয়াখালি বাগনান, পাণ্ডুয়ার ইলছোবা ও ভোটগ্রামে, বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে এবং কলকাতায় নেত্রী সংগঠক ও কর্মীরা প্ল্যাকার্ড ব্যানার নিয়ে শ্লোগান ও ভাষণের মাধ্যমে সমিতির দাবিগুলি তুলে ধরেন। দরিদ্র আদিবাসী মহিলারাও দাবিতে সরব হন।
১০ জুন সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির আহ্বানে দেশ জুড়ে দাবি দিবস পালনের অংশ হিসেবেই পূর্ব বর্ধমান জেলার কালনা ২নং ব্লকের আগ্রাদহ, বর্ধমান শহর ও শক্তিগড়ে দাবি দিবস পালন হয়। দাবি ছিল – করোনা মহামারী মোকাবিলায় ব্যর্থ মোদী সরকারের পদত্যাগ চাই। অবিলম্বে প্রতিটি মানুষের বিনামুল্যে ভ্যাকসিন দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ১৩ জুন করোনা মহামারীতে মৃত মানুষের ও করোনা যুদ্ধে নিহত শহীদদের স্মরণে মোমবাতি জ্বালিয়ে পূর্ব বর্ধমান জেলার মন্তেশ্বর ব্লকের কুলুট গ্রামে বর্ধমান সদর ২নং ব্লক এর খাড়গ্রাম, শক্তিগড় ও বর্ধমান শহরে স্মরণ করা হয়।
১৩ জুন করোনা মহামারীতে মৃত মানুষের ও করোনা যুদ্ধে নিহত শহীদদের স্মরণে মোমবাতি জ্বালিয়ে পূর্ব বর্ধমান জেলার মন্তেশ্বর ব্লকের কুলুট গ্রামে বর্ধমান সদর ২নং ব্লক এর খাড়গ্রাম, শক্তিগড় ও বর্ধমান শহরে স্মরণ করা হয়।
বজবজ গ্ৰামাঞ্চলে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন ও আইআরলার নেতৃত্বে কাজের অঞ্চলজুড়ে ২০০ দিনের কাজ, ৬০০ টাকা মজুরি, বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেওয়া রেশনে ৩৫ কেজি খাদ্যশষ্য প্রদান করা সহ বিভিন্ন দাবিতে অবস্থান সংগঠিত হয়। গত ২রা জুন হালদারপাড়া, ৩ জুন বৈষ্ণবপাড়া, ৯ জুন সিংপাড়া, ১৪ জুন আদকপাড়া অঞ্চলে অবস্থান কর্মসূচী সংগঠিত হয়। প্রতিটি অবস্থানে আন্দোলনের সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দেন আইআরলা জাতীয় কাউন্সিল সদস্যা ও পার্টির জেলা নেত্রী দেবযানী গোস্বামী, বজবজ গ্রাম লোকাল কমিটির অন্যতম সংগঠক শ্যামসুন্দর গোস্বামী, বজবজ গ্রাম লোকাল কমিটির সম্পাদক ইন্দ্রজিৎ দত্ত।
যে কোনো আইনের মতোই ধর্ষণ আইনের সংশোধন, সংস্কার ও উন্নতিকরণে আদৌ কোনো লাভ হয় না, যদি না ঠিক মতো সেই আইন প্রয়োগ করা যায়। আর এই প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিচারব্যবস্থার সদিচ্ছার গুরুত্ব অপরিসীম। ২০১২ সালে দিল্লির বাসে ধর্ষণ বা তথাকথিত ‘নির্ভয়া কেস'-কে ঘিরে যে নাগরিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তা ধর্ষণ আইনের সংস্কারের জন্য ভার্মা কমিটি গঠন করতে তৎকালীন সরকারকে বাধ্য করেছিল। বেশ কিছু আধুনিক পরিবর্তন এসেছিল ধর্ষণ আইনে। কিন্তু সেই আইন কীভাবে প্রযুক্ত হচ্ছে? এখানে সচেতনতা ও সদিচ্ছার প্রশ্ন বারবার উঠছে, কারণ কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, বিচারব্যবস্থার ধারক-বাহকরাই আদালতকে সনাতন পিতৃতান্ত্রিক পক্ষপাত বজায় রাখতে সাহায্য করছেন।
ধর্ষণের কেস-এ অভিযুক্তকে বাঁচাতে গিয়ে প্রতিপক্ষের উকিল, এমনকি বিচারকও, কী কী বলতে পারবেন আর কী কী বলতে পারবেন না, এবং যা যা বলতে পারবেন না, তা বললেই বা তাঁরা কোনো সাজা পাবেন কিনা, তার রূপরেখা কোথাও নেই। তরুণ তেজপাল সংক্রান্ত রায়টি শুধু এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ নয় যে তা ধর্ষণে অভিযুক্ত তেজপালকে খালাস করল। বরং তা এ কারণেও চিন্তার উদ্রেক করছে যে আজ অবধি ভারতে ঘটা ধর্ষণ-আইনের যাবতীয় সংস্কারকে তা অগ্রাহ্য করল। আবারও একবার প্রমাণ হল, কেন মেয়েরা ধর্ষণের পর ‘ডিউ প্রসেস'-এ আস্থা রাখতে চেয়েও ব্যর্থ হয়। তেজপালের সময়ে ‘মিটু’ ছিল না। পরে কেন ‘মিটু আন্দোলন’ প্রয়োজন হয়েছে, তা আবারও একবার দেখাল এই কেসের রায়৷
গোয়ার এক সেশন কোর্ট ২১ মে তারিখে তহেলকা ম্যাগাজিনের এককালের মুখ্য সম্পাদক তরুণ তেজপালকে ধর্ষণ ও অন্যান্য অভিযোগ থেকে মুক্তি দিল। তেজপালকে ৩৭৬/২/চ ও ৩৭৬/২/ট ধারায় অভিযুক্ত করা হয়েছিল, যা একদিকে পরিচিত ও বিশ্বস্ত, এবং অন্যদিকে ঊর্ধ্বতন ও ক্ষমতাশালী ব্যক্তির দ্বারা কারও ধর্ষণের জন্য প্রয়োগার্থে ভারতীয় আইনের দুটি ধারা। সঙ্গে ছিল ৩৫৪, ৩৫৪ক, ৩৫৪খ, ৩৪১, ৩৪২ ধারাও। ২০১৩ সালের ধর্ষণ আইনের সংস্কারের পর অন্যতম হাই-প্রোফাইল কেস ছিল এই ‘স্টেট ভার্সাস তরুণজিত তেজপাল’ কেস, যার নিষ্পত্তি হল অতিরিক্ত সেশন জাজ ক্ষমা এম যোশির হাতে।
নিষ্পত্তি বলতে, দীর্ঘ আট বছর পর অভিযুক্ত ধর্ষণের অপরাধ থেকে মুক্তি পেল। একটি ‘ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট’-এর আট বছর লাগল এই রায় দিতে যে ‘ধর্ষণ হয়নি'! কোর্টের বাইরে বেরিয়ে অভিযুক্ত এমনভাবে নিজের প্রেস রিলিজ পেশ করলেন, যেন আগে থেকেই জানতেন, মুক্তি পেতে চলেছেন। কনিষ্ঠ কন্যাই পিতার হয়ে বিবৃতিটি পড়ে দিল, যেখানে পিতা জানান, ‘মিথ্যা অভিযোগে’ তাঁর পুরো পরিবার আট বছর কী কষ্টেই না কাটালো! ধর্ষকের স্ত্রী কন্যা তাঁর ‘পাশে থেকে’ ঠিক কী প্রমাণ করতে চান যুগে যুগে? ভেবে দেখুন, বহুগামিতা নাকি আধুনিক, কারণ তা প্রাচীনপন্থী পরিবার প্রথার বিরুদ্ধে যায়। তাহলে বারবার পরিবারের ‘সলিডারিটি', স্ত্রী-কন্যাদের সমর্থনই বা কেন দরকার হয় এই তেজপাল বা ফারুকি বা ক্লিন্টনদের, ক্লিনচিট পাওয়ার জন্য?
তরুণ তেজপাল ছিলেন মুক্তচিন্তক বাম মহলে বন্দিত সেলিব্রিটি সাংবাদিক৷ তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল অধস্তন সাংবাদিককে লিফটে ধর্ষণের। সেটা ২০১৩ সাল এবং নির্ভয়া-উত্তর সময়ে যোনিপথে জোর করে আঙুল সঞ্চালনা বা জোর করে ওরাল সেক্সকেও ধর্ষণ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। সেই সময়ে বলা হয়েছিল, এসব তেজপালের ‘তহেলকা’-র সাহসী সব স্টিং অপারেশনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের ফল। অভিযোগ ছিল বিজেপির বিরুদ্ধে, কারণ এর আগে এনডিএ আমলে ‘তহেলকা’-র ‘অপারেশন ওয়েস্ট এন্ড’ প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জর্জ ফার্নান্ডেজ সহ অনেকের পর্দা ফাঁস করেছিল। গোয়া পুলিশ সুয়ো মোটু করেছিল বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী মনোহর পানিক্করের নির্দেশে৷ তাই এমন ভাব করছিল প্রগ্রেসিভ মহল, যেন পুরো ন্যারেটিভটাই তহেলকা ও বিজেপিময়৷ যেন সেখানে ধর্ষিতার কোনো বক্তব্য মান্য নয়। মেয়েটির সঙ্গে ঘটনার পর যে ইমেইল চালাচালি হয়েছিল তরুণ তেজপাল ও তহেলকার আরেক কর্ণধার সোমা চৌধুরির, তা ‘লিক’ হওয়াতেই গোয়া পুলিশ কেস করে৷ সেই সব ইমেইল কিন্তু বলে, ঘটনা ঘটেছিল৷ মেয়েটির মতে, সম্মতি ছিল না। তরুণ তেজপালের কথায়, তিনি বুঝতে পারেননি যে সম্মতি ছিল না। ঘটনাটি ২০১৩ সালের নভেম্বরে পরপর দুদিন ঘটে, যখন বিরাট পাঁচ তারা হোটেলে ‘তহেলকা’ ‘থিংক ফেস্টিভ্যাল’ নামক এলাহি বৌদ্ধিক অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিল।
আমাদের বুদ্ধিজীবী সাংবাদিকদের চিন্তনের জন্যও কেন পাঁচতারা হোটেল আর কর্পোরেট লগ্নি লাগে, কীভাবে কর্পোরেট টাকায় ‘প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার’ আইকন তৈরি হয়, সেসব প্রশ্ন তোলা থাক। এই প্রশ্নও তোলা থাক যে কেন ‘মুক্তচিন্তক’ বা ‘প্রগতিশীল’ পুরুষ যৌন নির্যাতনে অভিযুক্ত হলে তার পাশে অন্য সব প্রগতিশীলরা দাঁড়িয়ে পড়েন। ধর্ষক কি শুধু রাম সিং-এর মতো অশিক্ষিত বস্তিবাসীই করে? ধর্ষকের অপরায়ন আমাদের ধর্ষণের সমস্যার প্রতি আসলে অন্ধই করে রাখে।
আপাতত মেয়েটির কথায় ফেরা যাক। গোয়া সরকারের তৎপরতা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হোক বা না হোক, ধর্ষণের সংজ্ঞানুযায়ী কনসেন্টের অভাব থাকলে ঘটনাটি ধর্ষণই। আর অভিযোগকারিণী বারবার কনসেন্টের অভাবের কথাই বলেছিলেন। তিনি ঘটনার দিনই একাধিক জনকে ঘটনাটি জানিয়েছিলেন, যার মধ্যে তেজপালের বড় মেয়ে ছিল, ছিল সহকর্মীরা। তারপর তিনি সোমা চৌধুরীকে চিঠি লেখেন। তরুণ তেজপালও ক্ষমা চেয়ে চিঠি লেখেন অভিযোগকারিণীকে। তারপরেও আদালত বলল, তেজপাল সম্পূর্ণ নির্দোষ। কীভাবে? তার ব্যাখায় আদালত ৫২৭ পাতার এক রায় উপস্থাপন করে যা অভিযোগকারিণীর চরিত্রহনন, তাঁর পূর্ব-সম্পর্ক ও তাঁর নারীবাদী হওয়ার সম্ভাবনার বিশ্লেষণে ঠাসা৷ প্রশ্ন উঠবে, অভিযোগকারিণীর চরিত্রহনন বা তাঁর পূর্ব-সম্পর্ক নিয়ে কাটাছেঁড়া এর আগেও বহুবার আদালতে হয়েছে; কিন্তু নারীবাদ নিয়ে বিশ্লেষণ আবার কেন?
এইখানে পশ্চাদপদরণের এক নতুন নিদর্শন রায়টি স্থাপন করেছে। রায়টি পড়ে বোঝা যাচ্ছে না, কাঠগড়ায় কে ছিল -- তেজপাল, না ফেমিনিজম?
ধর্ষিতা যদি ঠিক ‘বেচারা’ না হন, যদি ধর্ষণের আইনি সংজ্ঞা জানেন, ২০১৩ সালে ভার্মা কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ধর্ষণ আইনের অ্যামেনডমেন্ট জানেন, যদি তাঁর বন্ধুবৃত্তও সচেতন হয়, যদি তাঁর কিছু কাজ থাকে নারীর উপর ঘটা হিংসা নিয়ে (কিছু বইপত্তর বা লেখালেখি) এবং যদি তাঁর পরিচয় থাকে এমন কিছু উকিলের সঙ্গে যাঁরা নিজেদের নারীবাদী বলে চিহ্নিত করেন বা যৌন নির্যাতনের কেস লড়েন, তাহলে কি সেই ধর্ষিতা কোনো অসহায় ধর্ষিতা-র চেয়ে তাড়াতাড়ি সুবিচার পাবেন? না। বরং এই রায় দেখালো, উল্টোটা সম্ভব। সেক্ষেত্রে পুরো ধর্ষণটাই আদালতের চোখে হয়ে যেতে পারে এক ‘ফেমিনিস্ট ষড়যন্ত্র’।
যেকোনো ধর্ষণের ক্ষেত্রেই আদালতের সামনে দুটি প্রশ্ন থাকে : (১) অভিযোগকারিণী সঙ্গে অভিযুক্তর কোনো যৌন ক্রিয়া হয়েছিল কিনা। (২) হয়ে থাকলে অভিযোগকারিনীর সম্মতি ছিল কিনা। উক্ত মামলার ক্ষেত্রে আদালত কীভাবে এই প্রশ্নগুলির সম্মুখীন হল ও কী সিদ্ধান্তে পৌঁছাল, তা দেখা যাক।
রায়টি প্রথম প্রশ্নের উত্তরে খুব শীঘ্রই বলে দিচ্ছে যে লিফটে কোনো যৌনতা ঘটেনি। অভিযোগকারিণী মিথ্যা কথা বলছিলেন। বিচারক এও বলতে পারতেন যে সত্য প্রমাণ করার পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। তার পরিবর্তে, বারবার দৃঢ়ভাবে দাবি করা হল যে অভিযোগকারিণী মিথ্যাবাদী।
খুব তাড়াতাড়ি, ৫২৭ পাতার মধ্যে ২৩তম অনুচ্ছেদেই, আদালত স্পষ্টভাবে পর্যবেক্ষণ করছে যে ‘বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় ঘটনাসমূহের বিকৃতি ঘটানোর বা ঘটনা সংযোজন হওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে।’ পরবর্তী ৫০০ পৃষ্ঠায়, আদালত ধর্ষণের নয়, বরং সেই ‘চক্রান্তের’ তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে এবং ক্ষুদ্র কিছু অসঙ্গতি পেলেও ভুক্তভোগীকে সটান মিথ্যাবাদী বলছে।
যাই হোক, রায়টি তো বলল লিফটে কোনো যৌনতা হয়নি। বরং এক ধরনের মদ্যপ ‘ব্যান্টার’ হয়েছিল, যেখানে অভিযোগকারিণীই আগের বছরের তহেলকা আয়োজিত উৎসবে ভিআইপি অতিথির সাথে তাঁর যৌন মিলনের কিছু গল্প বলেছিলেন তার বস্-কে। এবং সেই প্রসঙ্গেই তেজপাল পরে অভিযোগকারিণীকে একটি মেসেজ করেন, যাতে লেখা ছিল ‘fingertips’। (অর্থাৎ তেজপাল নিজে মেয়েটির শরীরে আঙুল প্রবেশ করাননি। মেয়েটির দ্বারা বর্ণিত ঘটনারই রেফারেন্স ছিল তাঁর পাঠানো মেসেজে। এই মেসেজ এসেছিল ধর্ষণের রাতেই, যা মেয়েটি আদালতকে দেখিয়েছিল।)
কেন অভিযোগকারিণী মিথ্যা বললেন? উত্তরে আদালত বলছে, কারণ ‘তিনি নারীবাদীদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করছেন’। কী সেই ষড়, তা স্পষ্ট নয়। আদালত আরও বলে, অভিযোগকারিণী ভেবেছিলেন যে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ করলে তিনি ধর্ষণ নিয়ে একটি বই লেখার জন্য অনুদান পেয়ে যাবেন। বই-এর গ্রান্ট পেতে তিনি চাকরি খোওয়ালেন ও বসের বিরুদ্ধে মামলা করলেন, এটা বড়ই বাড়াবাড়ি কল্পনা নয়?
আদালত এও বলছে, গোয়া পুলিশের সঙ্গে আঁতাত করে রাজনৈতিক কারণে অভিযুক্তকে ফাঁসিয়েছেন অভিযোগকারিণী। অথচ পরে এক জায়গায় আদালত এই প্রশ্নও তুলছে যে, হাথরাসের ঘটনার পর অভিযোগকারিণী ইন্সটাগ্রামে কেন পোস্ট দিয়েছেন? এমন পোস্ট, যা প্রমাণ করে যে তিনি নারীবাদী! অতএব, নিজের ধর্ষণ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্যে অতিরঞ্জন থাকতে পারে, কারণ নারীবাদীরা এরকম বাড়াবাড়ি করে। এই হাথরাসের ঘটনার বিরোধিতা মানে কিন্তু বিজেপি-বিরোধিতাও। তাহলে বিজেপির হয়ে কাজ করছেন ধর্ষিতা না বিজেপির বিরুদ্ধে? তা বোঝা গেল না।
এছাড়া আছে আরও নানা যুক্তি। তিনি বসের থেকে ধমক খেয়ে তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিশোধপরায়ণ হয়েছিলেন, তাঁর রাশিয়ান প্রেমিক ছিল ইত্যাদি -- যার মধ্যে কোনোটিই ধর্ষণকে অপ্রমাণ করে না৷ তবু তাদের ৫০০ পাতা জুড়ে এখানে ওখানে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সুযুক্তির অভাবে।
এবার প্রশ্ন হল, কোনো যৌন ক্রিয়া না ঘটা সত্ত্বেও আসামী তার কর্মচারীর কাছে ক্ষমা চেয়ে দুটি ইমেইল এবং একটি তাহেলকার ম্যানেজিং এডিটরের কাছে একটি ইমেইল কেন লিখলেন? এই চিঠিগুলোয় তিনি ক্ষমা-টমা চেয়েছিলেন। আদালত সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, অভিযুক্ত এই ক্ষমা চেয়েছিলেন (ক) তাহেলকার ম্যানেজিং এডিটরের জোরাজুরিতে এবং (খ) সেখানে এমন কিছু লেখা নেই যাকে ‘যৌন নির্যাতনের স্বীকারোক্তি’ বলা যায়। অভিযুক্তর এই চিঠিগুলিতে কিন্তু লিফ্টের অভ্যন্তরে যে কিছু ঘটেছিল, তা অস্বীকার করা হয়নি। ব্যবস্থাপনা সম্পাদককে লেখা অভিযুক্তের চিঠির শিরোনামই হল ‘প্রায়শ্চিত্ত’। তিনি এডিটরের পদ থেকে ইস্তফা দিতে চেয়েছিলেন কারণ তিনি ‘ভুল’ করে ফেলেছেন।
সত্যি যদি কোনো যৌনতা না ঘটে থাকে, তবে তো ‘সম্মতি’-র প্রশ্নই নেই। কিন্তু ওই চিঠিগুলির প্রসঙ্গে আদালতকে বারবার ‘সম্মতি’-র প্রসঙ্গে ফিরতে হয়েছে। আর তখনই আদালতের পক্ষপাত নগ্ন হয়েছে।
রায়টিতে বলা হয়েছে যে অভিযোগকারিণীর ইমেইল পেয়ে তহেলকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ক্ষুব্ধ হয়ে অভিযুক্তর থেকে ব্যাখ্যা চান। তিনি বলেছিলেন যে, তিনি অভিযোগকারিণীর সঙ্গে কেবল একটি ‘ক্ষণস্থায়ী সম্মতিযুক্ত যৌন এনকাউন্টার’ করেছেন। রায়েই এই ভাষা আছে, যা নাকি তেজপাল ইমেইলে বলেছেন। অথচ এর আগে রায় সেটিকে ‘মদ্যপ ব্যান্টার’ বলছিল, যেখানে অভিযোগকারিণীই মূলত তার যৌন অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছিল! তাহলে বিষয়টা ‘এনকাউন্টার’ না ‘ব্যান্টার'? দুটো শব্দের মানে তো আলাদা! যৌন ‘এনকাউন্টার’ বলতে অবশ্যই যৌন ক্রিয়া বোঝায়। তাহলে কি যৌন ক্রিয়া হয়েছিল? সেক্ষেত্রে সম্মতির প্রসঙ্গ ফিরতে বাধ্য।
এইবার দেখা গেল, অভিযুক্ত দাবি করছেন যে উক্ত ‘এনকাউন্টার’ সম্মতিক্রমে হয়েছিল যদিও অভিযোগকারিণী বলছেন যে সম্মতি ছিল না। এদিকে, ক্ষমা প্রার্থনার ইমেইলে অভিযুক্ত স্বীকার করে নিয়েছিল, ‘দু’বার আপনার সাথে যৌন সম্পর্ক (‘লিয়াঁসো’) করার চেষ্টা করা আমার ভুল ছিল ... আপনার স্পষ্ট অনীহা থাকা সত্ত্বেও এবং আপনি এটা স্পষ্ট করা সত্ত্বেও যে আপনি আমার কাছ থেকে এ জাতীয় মনোযোগ চাননি …’ ইত্যাদি।
এর পরেও আদালত বলছে, স্পষ্টত ‘সেক্সুয়াল ভায়োলেন্স’, ‘সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট’ ‘রেপ’ কথাগুলি এই ইমেইলে না থাকায় নাকি কিছুই প্রমাণ হল না। আদালতের দাবি হল, অপরাধী ‘লিয়াঁসো’ বললে চলবে না। অপরাধী আইনি ভাষা ব্যবহার করে ক্ষমা চাইবে বা স্বীকারোক্তি দেবে -- তবে তাকে আদালত ‘স্বীকারোক্তি’ বলে মানবে। এমন অলীক দাবি আদালত কক্ষে আগে শোনা গেছে কি?
আমরা আরও জানতে পারি, যৌনতা চলার সময় মেয়েটি মনে করিয়েছিল ‘আপনি আমার বস্’, আর বস্ বলেছিলেন ‘দ্যাট মেকস ইট ইভন সিম্পলার’। চিঠিতে তিনি স্বীকার করেছেন যে যদিও এমনটাই তিনি বলেছেন, তবু কিছু পরে সেই কথা প্রত্যাহার করে বলেছিলেন যে, বস্ হওয়ার কারণে জোর খাটানো যায় না। একে রায়টি অভিযুক্তের ‘মহত্ত্ব’ বলে উল্লেখ করেছে এবং, বলা বাহুল্য, এত কিছুর পরেও আদালত বুঝতে পারছে না যে যৌন নির্যাতন হয়েছিল।
এরপর বিচারক বোধহয় সবচেয়ে সমস্যাজনক কথাটি বলেন। ‘যদি তাঁর (অভিযোগকারিনীর) বিবরণ অনুসারে হামলা হত, তবে স্বভাবতই তাঁর অসম্মতির কথা, আপসেট হওয়ার কথা অভিযুক্ত বুঝতে পারতেন। কিন্তু তিনি তেমন কিছুই বুঝতে পারেননি বলছেন।’ অর্থাৎ অভিযুক্তের প্রতিটি কথা বিশ্বাস করা হচ্ছে। অভিযোগকারিণীর প্রতিটি কথা মিথ্যা বলেই ধরা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, বক্তব্যটি মূলগতভাবে সমস্যাজনক। কারণ ধর্ষক অসম্মতি বুঝতে অক্ষম বলেই সে ধর্ষক। যে অনুমতির তোয়াক্কা করে না, সেই তো ধর্ষক! খোদ আদালত যখন বলে, ‘অভিযুক্ত অসম্মতি বুঝতে পারেননি মানে নিশ্চয় অসম্মতি ছিল না’, তখন বিস্ময়ের সীমা থাকে না৷ এই যুক্তিতে তো পৃথিবীর সব ধর্ষকই খালাস পেতে পারে!
প্রথম হামলার রাতেই অভিযোগকারিণী তাঁর তিন সহকর্মীকে লাঞ্ছিত হওয়ার কথা বলেছিলেন। তিনজনই আদালতে এই বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। চতুর্থ একজন, যাকে তিনি সামান্য পরে ঘটনাটি বলেছিলেন, তিনিও সাক্ষ্য দেন। কিন্তু প্রথম দু’জনের সাক্ষ্য গণ্য করা হয় না এই অজুহাতে যে তারা অভিযোগকারিণীর নয়, তাঁর স্বামীর বন্ধু। তৃতীয় সাক্ষ্যটিও বরখাস্ত করা হয়, কারণ অভিযোগকারিণীর প্রতি এই সাক্ষীর নাকি ভালো-লাগা ছিল। চতুর্থ সাক্ষ্য খারিজ হয়েছে কারণ অভিযোগকারিণী তাকে ধর্ষণের গ্রাফিক বিবরণ দেয়নি। অভিযোগকারিণীর বর এবং মায়ের বয়ানও অবিশ্বস্ত বলে বিবেচিত হয়েছে আদালতের দ্বারা।
তবে রায়টি অন্য একজন পুরুষ সাক্ষীর সাক্ষ্যের উপর বিশেষ আস্থা রেখেছে। তিনি অভিযোগকারিণীর প্রাক্তন প্রেমিক। তাঁর সাক্ষ্যর ভিত্তিতেই যাবতীয় স্লাট-শেমিং-এর ন্যারেটিভ গড়ে ওঠে। তিনি বলেন যে নিশ্চয় তেজপালকে লিফটে ওঠার আগে বা পরে কোনো রগরগে গল্প অভিযোগকারিণী শুনিয়ে থাকবেন, কারণ যৌন গল্প বলতে অভিযোগকারিণী ভালোবাসেন। প্রাক্তন প্রেমিকের বয়ানের প্রতি আদালতের এই মোহ প্রণিধানযোগ্য।
এই রায়ে বারবারই এসেছে নারীর চরিত্র ও তাঁর পূর্ব-সম্পর্কের প্রসঙ্গ। অথচ ২০১৩ সালের আইন সংস্কারের সময় ভার্মা কমিটি এভিডেন্স অ্যাক্টেও কিছু বদল এনেছিল। ৫৩ক সেকশন ঢোকানো হয়েছিল, যেখানে বলা হয়েছিল ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে, যখন অভিযোগকারিণীর ‘কনসেন্ট’ ছিল কিনা, তা নিয়ে তর্ক হবে, তখন অভিযোগকারিণীর পূর্ব সম্পর্কের কথা আনা যাবে না। এভিডেন্স অ্যাক্টের সেকশন ১৪৬-এও বলা হয় যে অভিযোগকারিণীর চরিত্র বা পূর্ব সম্পর্ক টানা যাবে না। এমনকি আরও দশ বছর আগে ১৫৫-৪ ধারা বাদ দিয়ে বলা হয়েছিল, অভিযুক্ত অভিযোগকারিণীকে চরিত্রহীন বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করতে পারবেন না।
অথচ বর্তমান রায়ে বলা হল, ‘এই ধারাগুলি (১৪৬, ৫৩ক) এক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, কারণ উইটনেসরা সাক্ষ্য দিচ্ছে কী কী ঘটনা ঘটে থাকতে পারে, সে বিষয়ে। এখানে কনসেন্টের প্রসঙ্গ আসছেই না।’ বর্তমান লেখক এ কথার মর্মোদ্ধার করতে পারেননি। কিন্তু এই সূত্রে আলোচনা হল, আগের বছরের ‘থিঙ্ক ফেস্টিভ্যালে’ অভিযোগকারিণীর সঙ্গে কোনো ভিআইপি গেস্টের ভাবসাব হয়েছিল, তিনি কোন কোন ফিল্মস্টারকে চেনেন, কোন ক্রিকেটারের সঙ্গে তাঁর কেমন সখ্য; অভিযোগকারিণীকে জিজ্ঞাসা করা হল, সিগারেট বা মদ্যপান বা বহুগামিতা নিয়ে তাঁর কী মত। এই সবই নাকি ধর্ষণের দিন কী ঘটেছিল, তা বুঝতে আদালতকে সাহায্য করবে!
কিছু কিছু সংবাদ মাধ্যমে বলা হচ্ছে, সিসিটিভি ফুটেজ ‘ধ্বংস’ করা হয়েছে। অথচ ভালোভাবে রায় পড়লে বোঝা যায়, সরকারকে সব ফুটেজই দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আটবছর সরকারি গুদামে থাকাকালীন হোটেলের দোতলার ফুটেজ নষ্ট হয়ে গেছে। তার দায় অভিযোগকারিণীর নয়, সরকারের। বরং এই সব ফুটেজের প্রতিলিপি অভিযুক্ত ও তার উকিলকেও দেওয়া হয়েছিল। আদালত চাইলে তাদের কাছেই তা আবার চেয়ে পাঠাতে পারত। আদালত তা করেনি। এই প্রসঙ্গে আরও মনে পড়ল, লিফট থেকে বের হওয়ার সময় অভিযুক্তকে মুখ মুছতে ও অভিযোগকারিণীকে চুল ও পোষাক ঠিক করতে দেখা গিয়েছিল নাকি সিসিটিভি ফুটেজ-এ। ওরাল সেক্সের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও অভিযুক্তকে প্রশ্ন করা হল না, তিনি মুখ কেন মুছছিলেন৷ অন্তত রায়ে তেমন কোনো প্রশ্নোত্তরের উল্লেখ নেই। কিন্তু অভিযোগকারিণীকে প্রশ্ন করা হল, তিনি দিনে কতবার চুল ঠিক করেন!
মুক্তিপ্রাপ্ত তেজপাল যখন কন্যা মারফত প্রেস বিবৃতি দিচ্ছিলেন কোর্টের বাইরে, সেই অনামী অভিযোগকারিণী তখন ভিড়ে হয়ত মিশে যাচ্ছিলেন, যিনি ছিল ভুক্তভোগী, যিনি নিজেকে ধর্ষিতা ‘মনে করেছিলেন’। অভিযুক্তর নাকি আটটি বছর ‘নষ্ট হল’, আর অভিযোগকারিণীর?
কিন্তু শুধু ভুক্তভোগীর প্রতি সহানুভূতিতে নয়, এই রায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন কাম্য আরও বৃহত্তর কারণে। ৫২৭ পাতার এই বিশাল-বপু রায়টির যুক্তি, ভাষা ও প্রোপাগ্যান্ডা -- সবই ২০১৩ সালের ধর্ষণ আইন সংস্কারের সম্পূর্ণ বিপরীতে দাঁড়িয়ে। তা নারীর যৌন ও শারীরিক স্বায়ত্তশাসন এবং গোপনীয়তার দাবি লঙ্ঘন করে। তা বলে, ‘এ কথা চূড়ান্ত অবিশ্বাস্য যে আইন-কানুন সম্পর্কে সচেতন, বুদ্ধিমান, সজাগ এবং শারীরিকভাবে সবল (যোগ প্রশিক্ষক) এক মহিলাকে অভিযুক্ত দেওয়ালে ঠেসে ধরলেন আর সে ধাক্কা দিল না …’। রায়টির পাতায় পাতায় নির্যাতিত নারীর প্রতি এই অবিশ্বাস তো আছেই, সেই সঙ্গে তাঁর রাজনীতির বিরুদ্ধে, বিশেষভাবে তাঁর নারীবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে, রায়টি খড়্গহস্ত।
নারীবাদীর অভিযোগ ষড়যন্ত্রমূলক, তার সাক্ষ্য মিথ্যা, তার উদ্দেশ্য অনৈতিক -- এই রায় স্পষ্টভাবে এই সব বার্তা বহন করেছে। তাহলে ভারতীয় আইন কি নারীবাদ বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করছে পরোক্ষে?
এই নারীবাদ-বিরোধী প্রবণতার বিরুদ্ধে লড়াই জরুরি। কারণ নারীবাদ-ই সেই ডিস্কোর্স যা ধর্ষিতা বা যেকোনো নির্যাতিতার জন্য সুবিচার নিশ্চিত করার পাঠ দেয়। তেজপাল সংক্রান্ত এই রায় যদি শেষ পর্যন্ত স্বীকৃতি পায়, তবে তা যৌন নির্যাতনের ভবিষৎ মামলাগুলির ক্ষেত্রেই শুধু বিপজ্জনক নজির স্থাপন করবে না, বরং রাষ্ট্রীয় নারীবাদ-বিরোধিতারও এক চরম উদাহরণ খাড়া করবে।
-- শতাব্দী দাশ
আজ থেকে দু’তিন বছর আগেও ‘আইটি সেল’ শুনলেই যে কোনও বিবেকবান মানুষের শিরদাঁড়া দিয়ে এক হিমশীতল তরঙ্গ খেলে যেত। এই সেল থেকে নরমে গরমে উৎপাদিত বার্তা-বিশ্লেষণ-মিথ্যাচার এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, মনে হোত আমরা বুঝি এক গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছি। সমাজের ওপর শ্যেনদৃষ্টিতে কেউ যেন এমনভাবে তাকিয়ে রয়েছে, সামান্য এদিক-ওদিক হলেই ‘দেশদ্রোহী’ অথবা ‘আরবান নকশাল’এর তকমা পড়ে যাবে গায়ের ওপর। সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে তখন যেন একতরফা ‘হিন্দুরাজ’।
এই দখলদারি একদিনে শুরু হয়নি। ২০১৪ সালের আগে থেকেই এর সলতে পাকানো শুরু। ক্যাডার-ভিত্তিক একটি অনুশাসিত দল পরিকল্পনামাফিক এগোতে থাকে দিল্লীর ক্ষমতা দখলের দিকে। সে ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যবিন্দু শুধুমাত্র দিল্লীর মসনদই ছিল না, দেশ জুড়ে এক কঠিন-সহিংস মতাদর্শগত ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য জারিরও সুগঠিত অভিসার ছিল। আর সেযাত্রায় অনেকাংশেই ফাঁকা মাঠে গোল দিতে দিতেই এগিয়েছে তারা। কারণ, প্রধান বিরোধী দল হিসেবে নেতৃত্বহীন ও দিশেহারা কংগ্রেসের যে করুণ অবস্থা ছিল, তাতে নেহাতই আত্মসমর্পণ করে দেওয়া ছাড়া তাদের আর কোনও উপায়ও ছিল না। অবশ্য, কোনও কোনও রাজ্যে কংগ্রেসের স্থানীয় নেতৃত্বের জোরে কিছুটা ঠেকা দেওয়া গিয়েছিল, তবুও পরে সেসব বহু জায়গাও তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে।
এই সার্বিক দখলদারির অভিযানে সোশ্যাল মিডিয়ায় তথাকথিত সেই ‘আইটি সেল’এর ভূমিকা ছিল অবিসংবাদিত। এটা সত্যি দেখার মতো যে, চরম দক্ষিণপন্থী ও ধর্মীয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন একটি সামাজিক-রাজনৈতিক অস্তিত্ব হয়েও আরএসএস-বিজেপি সোশ্যাল মিডিয়ার শক্তি ও কার্যকারিতাকে পুরোমাত্রায় অনুধাবন করে তাকে নিজ উদ্দেশ্য পূরণে ব্যবহার করে নিতে সক্ষম হয়। অথচ, তথাকথিত প্রগতিশীলেরা এক্ষেত্রে তখনও কয়েক যোজন পিছিয়ে।
আজ অবশ্য সেই সমীকরণটা পালটে গেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় পালটা ঝড় উঠেছে। ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, ট্যুইটার, হোয়াটসআপ’এ এখন মৌলবাদ বিরোধী স্বর প্রবল শক্তিশালী। ইউটিউবার’রা মাঠে-ঘাটে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে নির্দ্বিধায় সত্যকে তুলে ধরছেন। তাদের অনুগামী ও দর্শক সংখ্যা যে কোনও মেইনস্ট্রিম মিডিয়াকে লজ্জায় ফেলে দেবে। যে সমস্ত মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছিলেন, ‘আইটি সেল’এর প্রচারে মোহিত হয়েছিলেন, তাঁরা এখন কঠোর বাস্তবতাকে বুঝতে পারছেন। অতএব, গত সাত বছরে আরএসএস-বিজেপি’র বিভাজন ও ঘৃণার রাজনীতির বিরুদ্ধে আজ এই মুহূর্তে এতটাই সোরগোল উঠেছে যে এখন বরং তাদেরই নড়েচড়ে বসার পালা। ইউটিউবে আপলোডেড প্রধানমন্ত্রীর ‘মন কি বাত’এ ‘লাইক’এর থেকে ‘ডিসলাইক’এর সংখ্যা বহুল পরিমাণে বেশি হয়ে পড়ছে। ট্যুইটারে ‘রিজাইন মোদী’ হ্যাশট্যাগ দারুণভাবে ট্রেন্ড করছে, কৃষক আন্দোলনের রোজকার খবর শেয়ার হতে হতে সোশ্যাল মিডিয়াকে ছেয়ে ফেলেছে, সম্বিত পাত্রের ফেক পোস্টের ওপর ‘ম্যানিপুলেটেড মিডিয়া’ ট্যাগ পড়ে যাচ্ছে। সবটা মিলিয়ে, ‘আইটি সেল’ এখন সোশ্যাল মিডিয়ার সর্বত্রই রীতিমতো কোণঠাসা। এবং তার জের নির্বাচনী ফলাফলেও পড়ছে। পশ্চিমবাংলাতেই যে শুধু তারা বেজায় হেরেছে তাই নয়, উত্তরপ্রদেশের পঞ্চায়েত নির্বাচনেও ভরাডুবি ও উত্তরোত্তর দলীয় কোন্দল তাদের রাতের ঘুম কেড়ে নিচ্ছে।
এবার তাই ক্ষিপ্ত হয়ে তাদের পালটা প্রত্যাঘাতের পালা। যে সোশ্যাল মিডিয়া এতদিন ছিল তাদের প্রিয়তম দোসর, বিচরণের একচেটিয়া আয়েস-ভূমি, এখন তারাই হয়ে উঠেছে চক্ষুশূল। ফেসবুকের প্রাক্তন আঞ্চলিক অধিকর্তা আঁখি দাস সেদিনও মোদীর দলের সঙ্গে তাদের সখ্যের কথা সগর্বে জানিয়েছিলেন। কিন্তু, ‘কাহারও সমান নাহি যায়’। এখন সেসব সুখের দিন গিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় বেইজ্জত হয়ে তারা এখন সোশ্যাল মিডিয়াগুলির বিরুদ্ধেই একপ্রকার যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।
ঘটনার শুরু ট্যুইটারকে দিয়ে। যেখানে সম্বিত পাত্র একটি ফেক টুলকিট প্রকাশ করে কংগ্রেসের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে ট্যুইট করেছিলেন। তা ট্যুইটার কর্তৃপক্ষের নজরে আসতেই তারা ব্যাপারটি অনুসন্ধান করে যখন নিশ্চিত হয় যে টুলকিটটি ফেক, তখন সম্বিত পাত্রের ট্যুইটের ওপর ‘ম্যানিপুলেটেড মিডিয়া’ বলে একটি ছাপ্পা মেরে দেয়। ব্যস, তাতেই চটে লাল ‘আইটি সেল’। তারা ট্যুইটারের কাছে দরবার করে ওই ছাপ্পাটি তুলে নেওয়ার জন্য। কিন্তু প্রমাণিত একটি প্রতারণাপূর্ণ ট্যুইট থেকে সে ট্যাগ ট্যুইটার কেন সরাবে? তাহলে তো সেই ট্যুইটের মিথ্যাচারিতাকে স্বীকার করে নেওয়া হয়! ট্যুইটার কর্তৃপক্ষ রাজী না হওয়ায় দিল্লীর পুলিশ গিয়ে ট্যুইটারের ভারতীয় অফিসে রেইড করে ও কর্মচারীদের ভয় দেখায়। তবুও ট্যুইটার তাদের সিদ্ধান্তে অটল থাকায় কেন্দ্রের সরকার নানারকম আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার হুমকি দেখায়।
এর আগেই সরকারের তরফে জানানো হয় যে, কোনও ‘আপত্তিকর’ পোস্টের দায় শুধুমাত্র প্রেরকের ওপর থাকবে না, তা সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের ওপরেও এসে বর্তাবে। অর্থাৎ, সরকার যদি মনে করে কোনও পোস্ট বা মেসেজ ‘দেশ ও দশের পক্ষে হানিকর’, তাহলে সেই মোতাবেক সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশ পাওয়ার ৭২ ঘন্টার মধ্যে সেই পোস্ট সরিয়ে দিতে হবে এবং শুধুমাত্র তাই নয়, তারজন্য সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের নির্দিষ্ট অফিসার দায়ী হবেন এবং সেই পোস্টের উৎস কে, তাও জানাতে হবে। উল্লেখ্য, গত ফেব্রুয়ারিতে ‘ইনফরমেশন টেকনোলজি (ইন্টারমিডিয়ারি গাইডলাইন্স অ্যান্ড মিডিয়া এথিকস কোড) রুলস’ জারি করে কেন্দ্রীয় সরকার প্রত্যকেটি প্ল্যাটফর্মকে তিনজন করে অফিসার নিয়োগ করতে বলেছে, যারা যে কোনও নিয়মনীতি লঙ্ঘিত হলে তারজন্য সরাসরি দায়ী থাকবে। মেসেজের উৎস জানানোর নির্দেশের বিরুদ্ধে হোয়াটসআপ দিল্লী আদালতে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে। কারণ, তাদের প্ল্যাটফর্ম হল ‘এন্ড টু এন্ড এনক্রিপশন’এর ভিত্তিতে এমন ভাবে গ্রথিত যে তারা নিজেরাও ব্যবহারকারীদের দ্বারা প্রেরিত মেসেজগুলি উন্মুক্ত করে পড়তে পারে না। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার্থে তারা সেই প্রযুক্তিগত আঙ্গিকেই তাদের প্ল্যাটফর্মকে নির্মাণ করেছে। এই এনক্রিপশন তারা স্বভাবতই ভাঙতে পারবে না, কারণ, এই ভিত্তির ওপরেই তাদের বাণিজ্যের আন্তর্জাতিক চরিত্র দাঁড়িয়ে আছে। এই নির্মাণ-কৌশলকে ভাঙলে তাদের বাণিজ্যের মৌলিক অবস্থানটিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অবশ্য, তাই বলে এমন ভাবার কোনও কারণ নেই যে সোশ্যাল মিডিয়াগুলি সুবোধ বালকের মতো আচরণ করে। অনেক সময় তারাও ব্যবহারকারীদের তথ্য বাজারে বিক্রি করে অন্যায় মুনাফা সংগ্রহ করতে পিছপা হয়না। এ ব্যাতিরেকেও, গ্রাহক বা ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা ব্যক্তির গণতান্ত্রিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্টের নয় সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ এক ঐতিহাসিক রায়ে জানিয়েছিল - সংবিধানের ২১ ধারা মোতাবেক গোপনীয়তার অধিকার এক মৌলিক অধিকার।
দেখা যাচ্ছে, জনমতে পর্যুদস্ত হয়ে মরীয়া বিজেপিকুল এখন উঠে পড়ে লেগেছে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিরুদ্ধ মতকে শায়েস্তা করতে। তথ্যমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ জানিয়েছেন, গোপনীয়তার অধিকারকেও ‘যুক্তিযুক্ত নিয়ন্ত্রণ’এর অধীনে থাকতে হবে। অর্থাৎ, মানুষের যাবতীয় ব্যক্তিগত প্রয়াস বা চলন গেরুয়া ‘যুক্তি’র অধীনে থাকবে। এ এক ভয়ঙ্কর মনোভাব। আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি, যে কোনও সরকারি বিরুদ্ধ মত প্রকাশকেই তারা ‘দেশদ্রোহ’ বলে দেগে দিতে কুন্ঠা বোধ করে না। লক্ষদ্বীপ নিয়ে চিত্র পরিচালক আইশা সুলতানা একটি মতামত প্রকাশ করায় তাঁর বিরুদ্ধে লাগু হয়েছে দেশদ্রোহী আইন। এইসব আক্রমণের বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোড়ন তো উঠেছেই, বিভিন্ন গণসংগঠনও প্রতিবাদে সামিল হয়েছে। যেমন, ডিজিটাল স্বাধীনতা নিয়ে সোচ্চার ‘অ্যাকসেস নাও’ সহ ১৪টি সংগঠন (যেমন, ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স’, ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’, ‘আর্টিকেল ১৯’ প্রভৃতি) কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এক আবেদনে সোশ্যাল মিডিয়া সম্পর্কিত অসাংবিধানিক নতুন বিধিগুলিকে বাতিল করতে বলেছে। তাদের মতে, এই বিধিগুলি আর কিছুই নয়, বিরোধী মতকে দমন করার এক কৌশল বিশেষ। এখন দেখার, চারিদিক থেকে নানাবিধ চাপে পড়ে সরকার পিছু হঠে কিনা। কিন্তু বিষয়টা অত মসৃণ নয় বলেই অনুমান। ফ্যাসিবাদীরা অত সহজে জমি ছেড়ে দেবে বলে মনে হয় না।
-- অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
বিজেপি মানেই যে নিরবচ্ছিন্ন নিপীড়ন, অন্তহীন অশান্তি তা ভারতের জনগণ তাঁদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় হাড়ে-হাড়ে টের পাচ্ছেন। বিজেপির কাছে যা কিছু অসংগত মনে হয়, তার ভোল পাল্টানোর লক্ষ্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে তারা কুণ্ঠিত হয় না। বিজেপির কাছে এখন অসংগত বলে গণ্য হচ্ছে ভারত মহাসাগরের মাত্র ৬৮০০০ জনসংখ্যার দ্বীপপুঞ্জ লক্ষদ্বীপের বৈশিষ্ট্য সমূহ। ফলে, বিজেপির রোষানলে বিদ্ধ হতে হচ্ছে এই দ্বীপপুঞ্জকে। দ্বীপপুঞ্জের বিজেপি প্রশাসক প্রফুল্ল খোড়া পটৈলের সৌজন্যে দেশদ্রোহ আইনের থাবা মূল ভূখণ্ড থেকে এবার সম্প্রসারিত হল লক্ষদ্বীপে। দ্বীপপুঞ্জের একমাত্র অপরাধ সেখানকার জনসংখ্যার সংখ্যাধিকই, প্রায় ৯৬ শতাংশই হল মুসলমান। তাদের শায়েস্তা করতে দ্বীপপুঞ্জের প্রশাসক করে উড়িয়ে আনা হয়েছে গুজরাটের এক বিজেপি রাজনীতিবিদকে। এ জন্য বরাবরের প্রথাকে, কেবল আমলাদেরই দ্বীপপুঞ্জের প্রশাসক করার প্রচলিত রীতিকে বিজেপি অবলীলায় পাল্টে দিয়েছে। প্রশাসক রূপী সেই বিজেপি রাজনীতিবিদ দ্বীপপুঞ্জে নেমেই প্রয়োগ করতে লাগলেন আর এস এস-এর এজেণ্ডাকে। নামালেন বিতর্কিত প্রাণী সংরক্ষণ আইনের খসড়া, যার পিছনে রয়েছে গোমাংস নিষিদ্ধকরণের কুটিল লক্ষ্য। স্কুলের ছাত্রদের খাবার থেকে আমিষ বাদ দেওয়ার ফরমান জারি হল। আরও বিধান দেওয়া হল – যে অভিভাবকদের দুটির বেশি সন্তান, তাঁরা গ্ৰাম পঞ্চায়েত নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। দ্বীপপুঞ্জের জনগণের আর্থিক নিরাপত্তাকে বিপর্যস্ত করতে বিভিন্ন অফিসে কর্মরত ঠিকা কর্মী, মিড-ডে মিল রন্ধন কর্মী, শারীরশিক্ষার শিক্ষকদের ছাঁটাই করা হল। দ্বীপপুঞ্জের জনগণের গুরুত্বপূর্ণ জীবিকা মাছ ধরার ওপর কোপ পড়ল। আর দ্বীপপুঞ্জে অপরাধ একরকম অনুপস্থিত হলেও অপছন্দের লোকদের বিনা বিচারে আটক করতে চালু করা হল গুণ্ডা দমন আইন। নিজের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করতে প্রফুল্ল খোড়া পটেল শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবা, মৎস চাষ, পশুপালনের মতো দপ্তরগুলোকে পঞ্চায়েতের হাত থেকে নিয়ে এলেন নিজের কব্জায়। এরই পাশাপাশি জানিয়ে দেওয়া হল যে, প্রশাসক-বিরোধী মতামত প্রকাশ করলে তাকে সহ্য করা হবে না।
সম্প্রতি দ্বীপপুঞ্জের প্রথম চিত্র পরিচালক আয়েশা সুলতানার বিরুদ্ধে দ্বীপপুঞ্জের রাজধানী কোভারত্তি থানায় দেশদ্রোহের অভিযোগে এফআইআর দায়ের হয়েছে। এবং তার কারণ, টিভির একটি চ্যানেলে বিতর্কে অংশ নিয়ে আয়েশা প্রশাসক প্রফুল্ল খোড়া পটেলকে একটি জৈব অস্ত্রের সঙ্গে তুলনা করেন। সেই আলোচনায় আয়েশা সুলতানা বলেন, “লক্ষদ্বীপে একটিও কোভিড সংক্রমণ ছিল না। এখন রোজ একশ করে রোগী বাড়ছে। ওঁরা জৈব অস্ত্র প্রয়োগ করেছেন। আমি স্পষ্ট বলতে পারি, করোনা শূন্য একটা জায়গায় জৈব অস্ত্র প্রয়োগ করেছে কেন্দ্রীয় সরকার।” আয়েশার এই মন্তব্যের পিছনে যুক্তি হল – নতুন প্রশাসক আসার আগে (প্রফুল্ল খোড়া পটেল দ্বীপপুঞ্জের প্রশাসকের ভার নেন ২০২০-র ডিসেম্বরের গোড়ায়) লক্ষদ্বীপে কোভিড আক্রমণের কোনো ঘটনা ছিল না। কিন্তু এখন দ্বীপপুঞ্জে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৮৭০০ এবং কোভিডে মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৪০ জনের। কোভিড সংক্রমণের বাড়বাড়ন্তের জন্য প্রশাসকের একটি পদক্ষেপই দায়ী বলে দ্বীপপুঞ্জের জনগণ মনে করেন। তাঁরা জানিয়েছেন, এই প্রশাসক আসার আগে মূল ভূখণ্ড থেকে কেউ দ্বীপপুঞ্জে গেলে তার ১৪ দিন কোয়রান্টিনে থাকাটা বাধ্যতামূলক ছিল এবং তা দ্বীপপুঞ্জে কোভিড সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রিত করেছিল। নতুন প্রশাসক সেই নিয়ন্ত্রণবিধি তুলে দিয়ে শুধু সংক্রমণ না থাকার নেগেটিভ রিপোর্টকেই দ্বীপপুঞ্জে ঢোকার ও অবাধ বিচরণের ছাড়পত্র করে তোলেন। এবং এটাই দ্বীপপুঞ্জে কোভিড ছড়ানোর কারণ বলে তাঁরা মনে করেন। আয়েশা সুলতানা দ্বীপপুঞ্জের জনগণের এই অভিমতকেই ব্যক্ত করেছেন মাত্র।
কিন্তু আয়েশা সুলতানার ঐ মন্তব্যে বিজেপি দেশদ্রোহের নিদর্শন খুঁজে পেল। দ্বীপপুঞ্জের বিজেপি সভাপতি আব্দুল কাদের হাজি বললেন, আয়েশা তাঁর মন্তব্যে কেন্দ্রীয় সরকারকেই জৈব অস্ত্র বলে বুঝিয়েছেন এবং ঐ মন্তব্য “কেন্দ্রীয় সরকারের দেশপ্রেমিক ভাবমূর্তিকে কালিমালিপ্ত করেছে।” ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪এ ধারায় দেশদ্রোহ এবং ১৫৩বি ধারায় জাতীয় সংহতি বিরোধী সক্রিয়তার অভিযোগ এনে তাঁর বিরুদ্ধে এফ আই আর দায়ের হল কাভেরত্তি থানায়। থানার পুলিশ আয়েশা সুলতানাকে ২০ জুন তাদের কাছে হাজির হয়ে তার মন্তব্যের ব্যাখ্যা দিতে বলেছে। আয়েশার আশঙ্কা ঐ দিন তাঁকে গ্ৰেপ্তার করা হতে পারে এবং গ্ৰেপ্তারি এড়াতে তিনি কেরল হাইকোর্টে আগাম জামিনের আবেদন জানিয়েছেন।
তবে, আয়েশা সুলতানাকেই যে প্রথম এই প্রশাসকের রোষের মুখে পড়তে হল তা কিন্তু নয়। এর আগে দ্বীপপুঞ্জের কংগ্ৰেস সভাপতি এম আই আট্টাকইয়া এবং দুই সিপিআই(এম) নেতা পি পি রহিম ও আস্কার আলিকেও মামলার চোখরাঙানি ভোগ করতে হয়েছে, আর তার অছিলা হয়ে উঠেছিল একটা হোর্ডিং। সেই হোর্ডিংয়ে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের (সিএএ) বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে লেখা ছিল – “ভারত নরেন্দ্র মোদীর বাবার সম্পত্তি নয়।” এই তিন জনই হলেন লক্ষদ্বীপের সংবিধান সুরক্ষা সমিতির নেতা। সেই হোর্ডিং-এর নীচে কে বা কারা সংবিধান সুরক্ষা সমিতির নাম লিখে দিয়েছিল। হোর্ডিং এক বছর ধরে টাঙানো থাকলেও প্রফুল্ল খোড়া পটেল দ্বীপপুঞ্জে যাওয়ার পরই হোর্ডিং চর্চার বিষয় হয়ে ওঠে এবং হোর্ডিংকে কেন্দ্র করে মামলার পদক্ষেপ সক্রিয় হয়। দ্বীপপুঞ্জে অরাজকতা সৃষ্টিই যে প্রফুল্ল খোড়া পটৈলের একমাত্র এজেণ্ডা, হোর্ডিংয়ে উল্লিখিত মন্তব্যকে ছুতো করে কংগ্রেস ও সিপিআই(এম) নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের সেটাই দেখিয়ে দেয়।
আয়েশা সুলতানার বিরুদ্ধে এফ আই আর কিন্তু দ্বীপপুঞ্জে যথেষ্ট ক্ষোভ ও প্রতিবাদেরও জন্ম দিয়েছে। একের পর এক বিজেপি নেতা ও কর্মী স্বৈরাচারী প্রশাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বিজেপি থেকে পদত্যাগ করেছেন, যাদের মধ্যে দ্বীপপুঞ্জে বিজেপির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হামিদ মাল্লিপুঝাও রয়েছেন। বিজেপি সভাপতি আব্দুল কাদের হাজিকে লেখা চিঠিতে তাঁরা বলেছেন, “লক্ষদ্বীপের বিজেপি সম্পূর্ণ রূপে অবহিত যে, বর্তমান প্রশাসক পটেলের কাজ কতটা জনবিরোধী, গণতন্ত্র-বিরোধী এবং জনগণের দুর্ভোগের কারণ হচ্ছে।” অর্থাৎ, তাঁরা বলছেন যে, বিজেপি যদি জনস্বার্থ বিরোধী প্রশাসকের পাশে থাকে তবে সেই সংগঠনকে তাঁরা নিজেদের সংগঠন বলে মনে করতে পারেন না। চিঠিতে তাঁরা এটাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, লক্ষদ্বীপের জনগণের সঙ্গে হাত মিলিয়ে প্রশাসকের জনবিরোধী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তাঁদের প্রতিবাদ জারি থাকবে। লক্ষদ্বীপের জনগণ কালো পোশাক পরে ও বাড়িতে কালো পতাকা তুলে প্রফুল্ল খোড়া পটৈলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে ১৪ জুন কালা দিবস পালন করেন। তাঁরা প্ল্যাকার্ড ও ব্যানার তুলে ধরেন যাতে লেখা ছিল – “প্রফুল্ল খোড়া পটেলকে ফিরিয়ে নাও” এবং “প্রফুল্ল খোড়া পটেল ফিরে যাও।”
এফআইআর কিন্তু আয়েশা সুলতানাকে একটুও দমিয়ে দিতে পারেনি। এফআইআর-এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে আয়েশা বলেছেন, “অবাধে মত প্রকাশের জন্য যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়েছে তাতে লেশমাত্র ভয় হচ্ছে না। এর বিপরীতে, দেশদ্রোহের অভিযোগ নিয়ে আমি একটুও উদ্বিগ্ন হব না এবং ওরা আমার মুখ বন্ধ করতে পারবে না।” তিনি লক্ষদ্বীপের জনগণের সঙ্গে কালা দিবস পালনে অংশ নিয়েছেন এবং তাঁর ফেসবুক পোস্টে মন্তব্য করেছেন, “লক্ষদ্বীপের জনগণ ফ্যাসিবাদকে আর বরদাস্ত করবেন না। আমরা স্বৈরাচারী নীতিগুলোর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবো, এবং লক্ষদ্বীপের ওপর চালানো অবরোধকে কাটিয়ে উঠব।” একটা ছোটো দ্বীপপুঞ্জের এক ব্যক্তিত্ব যখন মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে ও স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে এইভাবে রুখে দাঁড়ানোর কথা বলেন, তখন তা আমাদের আশ্বস্ত করে। লক্ষদ্বীপকে আর একটা কাশ্মীরে পরিণত করার বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখার দ্বীপপুঞ্জের জনগণের অঙ্গীকার আমাদের অবশ্যই ভরসা যোগায়।
-- জয়দীপ মিত্র
সিপিআই(এমএল)-এর সংগ্রামী নেতা ও প্রাক্তন পলিটব্যুরো সদস্য, ভূতপূর্ব বিহার রাজ্য সম্পাদক কমরেড রামরতন শর্মা গত ৬ জুন পাটনায় ইন্দিরা গান্ধী হার্ট ইন্সটিটিউটে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।
এই মর্মান্তিক ঘটনার জন্য প্রত্যক্ষত দায়ী বিহার জেলা হাসপাতালগুলির গাফিলতি এবং স্বাস্থ্য পরিষেবা পরিকাঠামোর বেহাল অবস্থা। কমরেড অসুস্থ বোধ করলে তাঁকে জেলা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে তাঁর একটা ইসিজি পর্যন্ত করা হয়নি। চিকিৎসকরা তাঁকে পাটনায় স্থানান্তরিত করার পর মাঝরাতে ইসিজি করার পর বোঝা যায়, সকালেই তিনি হৃদরোগে গুরুতর আক্রান্ত হয়েছিলেন। এরপর পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু হয়, কিন্তু বৃথাই। চরম মূল্যবান সময় অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ায়, তাঁকে আর বাঁচানো যায়নি।
কমরেড রামযতন শর্মা ছিলেন সত্তরের দশকের সেই বিপ্লবী যোদ্ধাদের একজন, যাঁদের গোটা জীবনটাই কেটেছে পার্টি গঠন, গ্রামীণ বিহারে মার্কসবাদী শিক্ষাকে ছড়িয়ে দেওয়া এবং পার্টির তরুণ সদস্যদের দৃঢ়সংকল্প পার্টিকর্মী ও সংগঠক হিসাবে গড়ে তোলার কাজে।
আগামী মাসে তাঁর ৭৯ বছর পূর্ণ হত। জীবনের পাঁচটি দশক তিনি সর্বক্ষণের পার্টি সংগঠক হিসাবে অতিবাহিত করেছেন, বহু উত্থান-পতন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেও শক্ত হাতে সংগঠনের হাল ধরে থেকেছেন, কখনও নিরুৎসাহ বা হতোদ্যম তো হনইনি, বরং অক্লান্ত প্রয়াসে অদম্য চেতনায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে কমরেডদের মনোবল যুগিয়েছেন। এখন দায়িত্ব সেই তরুণ প্রজন্মের হাতে যাদের কাছে কমরেড রামযতন শর্মা এক অনন্য পথপ্রদর্শক শিক্ষক।
সত্তরের দশকে নকশালবাড়ি আন্দোলন এবং গ্রামীণ বিহারে শুরু হওয়া গরিব-দলিত শ্রেণীর রাজনৈতিক-সামাজিক আন্দোলনে অনুপ্রাণিত হয়ে কমরেড রামযতন সরকারি চাকরি ছেড়ে আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। আশির দশকে তৎকালীন মধ্য বিহারে বিপ্লবী কৃষক আন্দোলনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। শুধু বিহারেই নয়, দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও পার্টি প্রতিষ্ঠায় তিনি অবদান রেখেছেন। তিনি ঝাড়খণ্ড, উত্তর প্রদেশ এবং বিশেষ করে বিহারে নব্বইয়ের দশকে দীর্ঘ সময় রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ছত্তিশগড়ে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্বশীল ছিলেন। কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্বেও ছিলেন। দীর্ঘদিন তিনি পার্টি মুখপত্র সমকালীন লোকযুদ্ধ সম্পাদনা করেছেন। পার্টির শিক্ষা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত ছিলেন। ছাত্র ও তরুণ সমাজকে বিপ্লবী মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ করা ও রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে তাদের গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর অনন্য ভূমিকা কখনও ভোলা যাবে না।
কমরেড রামরতন শর্মার প্রয়াণে গভীর শোক জ্ঞাপন করেন পার্টির সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, পার্টির বর্ষীয়ান নেতা স্বদেশ ভট্টাচার্য সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং গণসংগঠনের নেতৃত্বও অন্তিম শ্রদ্ধা জানান। মৃত্যু সংবাদ পাওয়া মাত্র সমস্ত পার্টি অফিসে পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়।
৭ জুন তাঁর শেষ যাত্রায় পা মিলিয়েছিলেন শোকার্ত কয়েকশো নেতা কর্মী সংগঠক। পাটনার দিঘা ঘাটে তাঁরা সজল চোখে কমরেডকে শেষ বিদায় জানান।
কমরেড শর্মাজী! আপনার ভালোবাসার পার্টি আপনার শিক্ষা ও ব্রতকে এগিয়ে নিয়ে যাবে!
মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছরে প্রয়াত হলেন সিপিআই(এমএল) রেড স্টার দলের পলিটব্যুরো সদস্য ও এরাজ্যের ভাঙর গণআন্দোলনের অন্যতম সংগঠক শর্মিষ্ঠা চৌধুরী।
গত শতকের নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে শর্মিষ্ঠা দর্শন নিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তে আসেন এবং সেখানেই সংগ্রামী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশুনো করেন তিনি ও টেলিগ্রাফ কাগজে সাংবাদিক হিসেবে যোগ দেন।
তবে কিছুদিন সাংবাদিকতা করার পরেই তিনি পেশাগত জীবন পরিত্যাগ করে কমিউনিস্ট বিপ্লবী আন্দোলনের সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে শ্রমিকদের মধ্যে কাজ শুরু করেন। মূলত খড়দহের লুমটেক্স জুটমিলের শ্রমিকদের আন্দোলন সংগঠনে তিনি সেই পর্বে সক্রিয় ছিলেন।
পরবর্তীকালে ভাঙরে পাওয়ার গ্রিডের বিরুদ্ধে যে শক্তিশালী গণআন্দোলন শুরু হয় তাঁর অন্যতম সংগঠক ও নেত্রী ছিলেন তিনি। এই আন্দোলনের সূত্রে তাঁকে বেশ কিছুদিন কারাবাসও করতে হয়। রাজ্যের মানুষের কাছে এই সময় পরিচিত রাজনৈতিক মুখ হয়ে ওঠেন তিনি। বিজেপিকে পরাস্ত করার জন্য সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনের আগে যে “নো ভোট টু বিজেপি” প্রচার আন্দোলন তৈরি হয়, সেখানেও ছিল তাঁর সক্রিয় ভূমিকা।
ছাত্র আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, নারী আন্দোলনের মতো নানা ক্ষেত্রে সাফল্যের সাথে কাজ করার বিরল দক্ষতা দেখিয়েছেন শর্মিষ্ঠা। একদিকে তিনি যেমন ছিলেন শক্তিশালী সংগঠক, অন্যদিকে তাঁর লেখনিও ছিল চমৎকার। নারী আন্দোলন ও কমিউনিস্ট আন্দোলনের নানা ব্যবহারিক ও তাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে তিনি নিয়মিত লেখালেখি করতেন।
শর্মিষ্ঠা গত কয়েকমাস ধরেই অসুস্থ ছিলেন। কিছুদিন আগে তিনি কোভিডেও আক্রান্ত হন। এরপরই হৃদযন্ত্র সহ নানা শারীরিক সমস্যা প্রবল হয়ে ওঠে। এসএসকেএম হাসপাতালের চিকিৎসকরা অনেক চেষ্টা করেও শেষপর্যন্ত তাঁকে বাঁচাতে ব্যর্থ হন।
শর্মিষ্ঠার মৃত্যুর খবর পাবার পরই সিপিআই(এমএল) লিবারেশান সহ বিভিন্ন বাম ও গণতান্ত্রিক মহলের সাথীরা পৌঁছে যান হাসপাতালে। পরদিন এসএসকেএম হাসপাতালেই চিকিৎসা বিজ্ঞানের স্বার্থে তাঁর দেহ দান করার আগে যে সংক্ষিপ্ত শ্রদ্ধাজ্ঞাপণ অনুষ্ঠান হয় তাতে লিবারেশানের পলিটব্যুরো সদস্য কার্তিক পাল সহ অন্যান্য কমরেডরা উপস্থিত ছিলেন। পার্টির সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য শর্মিষ্ঠার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেন ও শর্মিষ্ঠার আন্দোলন, সংগ্রাম ও জীবনের সাথী অলীক চক্রবর্তী সহ তাঁর পরিবার বন্ধু কমরেডদের প্রতি সহমর্মিতা ব্যক্ত করেন। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক পার্থ ঘোষ টেলিফোনে অলীক চক্রবর্তীর সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলে তাঁর শোক ও সমবেদনা ব্যক্ত করেন।
শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর অকাল মৃত্যুতে বাংলার বাম ও কমিউনিস্ট আন্দোলন বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হল। আন্দোলন সংগ্রামের সাথীদের স্মৃতিতে শর্মিষ্ঠা অম্লান থাকবেন।
কমরেড শর্মিষ্ঠা চৌধুরী লাল সেলাম।
বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত একাত্তর বছর বয়সে প্রয়াত হলেন। তাঁর অভিনয় জীবনের সূত্রপাত বালিকা বয়সেই। যখন তাঁর বয়েস মাত্র সাত বছর, সেই সময়েই তিনি কারাগার নাটকে কীর্তিমান চরিত্রে অভিনয় করেন। সেই সময়ে স্বাতীলেখার পিতা রামদাস হালদার পরিবার নিয়ে থাকতেন এলাহাবাদে। সেখানেই ১৯৫০ সালে তাঁর জন্ম। ১৯৫৭-তে সাত বছর বয়সে অভিনয় জীবন শুরু করে তার পরের পনেরো বছর এলাহাবাদের নানা মঞ্চে তিনি নানা বাংলা, হিন্দি ও ইংরেজি নাটকে অভিনয় করেন। পড়াশুনো করেন স্নাতকোত্তর স্তর পর্যন্ত। এলাহাবাদ পর্বে স্বাতীলেখার অভিনীত নাটকগুলির মধ্যে রয়েছে কারাগার, নূরজাহান, মিলিয়নেয়ারস, মিড সামারস নাইট ড্রিম, ওথেলো, অ্যাজ ইউ লাইক ইট, মার্চেন্ট অব ভেনিস, বিজিবডি, দ্যা ব্যারেটস অব উইমপোল স্ট্রিট, নেফা কি এক সাম, কাঞ্জনরঙ্গ, খনা প্রভৃতি।
অভিনয়ের পাশাপাশি স্বাতীলেখা দক্ষ হয়ে ওঠেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সঙ্গীতে। বিশেষভাবে শেখেন বেহালা ও পিয়ানো। লন্ডনের ট্রিনিটি কলেজ থেকে পাশ্চাত্য মার্গসঙ্গীতে ডিপ্লোমা রয়েছে তাঁর। ১৯৭২ সালে তিনি তাঁর প্রথম স্বামী অধীপ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে চলে আসেন কোলকাতায়। এই বিবাহ সম্পর্ক স্থায়ী না হলেও নাট্যমঞ্চের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অব্যাহত থাকে। ‘কলকাতার ইলেকট্রা’ নাটকে স্বাতীলেখার অভিনয় দেখে মুগ্ধ হন নান্দীকারের অন্যতম সংগঠক রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত। তাঁর আহ্বানে স্বাতীলেখা নান্দীকারে যোগ দেন ১৯৮৭ সালে। রুদ্রপ্রসাদের সঙ্গে তাঁর বিবাহও হয়।
১৯৮৭ থেকে ২০২১ - নান্দীকার নাট্যগোষ্ঠীর সঙ্গে স্বাতীলেখা দীর্ঘ চৌত্রিশ বছর যুক্ত ছিলেন। এখানে তিনি অসংখ্য নাটকে অভিনয়ের পাশাপাশি নাট্য প্রযোজনার নানা ধরনের কাজ করেছেন। পোশাক পরিকল্পনা, নির্দেশনা, আবহসঙ্গীত রচনা ছাড়াও বেশ কিছু নাটকের অনুবাদও তিনি করেছিলেন। তার অনূদিত নাটকের মধ্যে আছে আকিরা কুরোসাওয়ার রসোমন অবলম্বনে মাননীয় বিচারকমণ্ডলী, টুয়েলভ অ্যাংরি মেন অবলম্বনে এক থেকে বারো (এর সহ অনুবাদক ছিলেন রুদ্রপ্রসাদ), মুনশি প্রেমচাঁদ অবলম্বনে বড়দা। তবে একের পর এক নাটকে তাঁর অসামান্য অভিনয়ই তাঁকে বাংলার সাংস্কৃতিক মহলে সুপরিচিত ও বিখ্যাত করে তুলেছে। নান্দীকারে স্বাতীলেখা সেনগুপ্তের অভিনীত নাটকগুলির মধ্যে আছে নটী বিনোদিনী, ফুটবল, খড়ির গণ্ডি, আন্তিগোনে, যখন একা, নাট্যকারের সন্ধানে ছটি চরিত্র, মুদ্রারাক্ষস, ব্যতিক্রম, মাননীয় বিচারকমণ্ডলী, হনন মেরু, নীলা, শঙ্খপুরের সুকন্যা, শেষ সাক্ষাৎকার, ফেরিওয়ালার মৃত্যু, গোত্রহীন, বেষটের খোঁজে, এই শহর এই সময়, পাতা ঝরে যায়, নগরকীর্তিন, সোজন বাদিয়ার ঘাট প্রভৃতি। শানু রায়চৌধুরী নাটকে তিনি একক অভিনয়ে দর্শকদের মাতিয়ে রাখেন।
নান্দীকার ছাড়াও অন্যান্য দলের কিছু নাটকে স্বাতীলেখা অভিনয় করেছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে থিয়েটার ওয়ার্কশপের শোয়াইক গেল যুদ্ধে, কলকাতা নাট্যকেন্দ্রর গ্যালিলেওর জীবন, সায়কের সাঁঝবেলা ইত্যাদি। রঙ রূপ প্রযোজিত খুঁজে নাও নাটকটির পরিচালক ছিলেন তিনি।
স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত মূলত থিয়েটার জগতেরই মানুষ। তবে তাঁর অভিনয় জীবনের আরেকটি দিক তাঁর সিনেমায় অভিনয়। সত্যজিৎ রায়ের ঘরে বাইরে তে বিমলার ভূমিকায় তিনি অভিনয় করেন। এর বহুদিন পরে জীবন সায়াহ্নে এসে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বেলাশেষে সিনেমায় আরেকবার তাঁকে ফিল্ম অভিনয়ে দর্শক দেখতে পান।
১৯৯৬-তে তিনি পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমির শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত নির্দেশকের পুরস্কার পান। ১৯৯৭ তে পান শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার। নাটকের সূত্রে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন রাজ্য ছাড়াও তিনি গেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ইংল্যান্ড, কানাডা, নরওয়েতে। থিয়েটারের সঙ্গে সমাজকে যুক্ত করার দৃষ্টিকোণ থেকে স্বাতীলেখা ধারাবাহিকভাবে অনেক কাজ করেছেন। বিদ্যালয় স্তরের ছাত্রছাত্রীদের নাটকে আগ্রহী করে তোলার উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি লিখেছেন “থিয়েটার গেমস ফর স্কুল চিলড্রেন” নামের এক সাড়া জাগানো বই। নান্দীকারের থিয়েটার ইন এডুকেশন প্রকল্পের সহ নির্দেশক ছিলেন স্বাতীলেখা। পশ্চিমবঙ্গের নানা জেলায় স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি নিয়মিত থিয়েটার ওয়ার্কশপ করেছেন। পথশিশু, বস্তিবাসী, দৃষ্টিহীন মানুষজন বা যৌনকর্মীদের জন্যও অভিনয় শিবির আয়োজন করেছেন।
-- সৌভিক ঘোষাল
নাম মানসিন হেমরম। জন্ম ১৯৪৫ সালে। উড়িষ্যার ময়ূরভঞ্জ জেলা থেকে হরিণঘাটা ফার্মে কাজের জন্য আসেন। কাজের ফাঁকে শিকার করতে করতে শ্রীকৃষ্ণপুরে বাবুদের কথায় জঙ্গল সাফ করে অনাবাদি জমি আবাদি করে বাবুদের হাতে তুলে দেওয়ার সময়েই অধিকারের লড়াইয়ে সামিল হয়ে যান। ঠিক সেই সময় নকশালবাড়ির কৃষক বিদ্রোহের আঁচ পড়ে শ্রীকৃষ্ণপুরে। কমরেড চিত্তরঞ্জন ভট্টাচার্য, কমরেড প্রবীর মিত্রের নেতৃত্বে লুকু গুইপাই (ওরফে লুকু সর্দার), শ্যাম টুডু, ফতুরাম মান্ডি’দের সঙ্গে মানসিন হেমরম ও আরও অনেকে বিপ্লবী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এবং সিপিআই(এমএল)-এ যোগ দেন। আন্দোলনের শুরুর দিকে কমরেড লুকু গুইপাই শহীদ হলেন জমিদারদের গুন্ডাবাহিনীর হাতে। পরবর্তী সময়ে পার্টির অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে কিছুদিন কারাবাস করতে হয় কমরেড মানসিনকে। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আবার লড়াই শুরু। জমির পাট্টার দাবি, মজুরি বৃদ্ধির দাবি, রেশন কার্ডের দাবিতে নতুন করে আন্দোলন শুরু হল। সত্তর দশকের শেষভাগে পার্টি পুনর্গঠন শুরুর সময় পশ্চিমবঙ্গ কৃষক সমিতির কাজ যখন শুরু হল, শ্রীকৃষ্ণপুর অঞ্চল থেকে দুই শতাধিক মানুষ কমরেড মানসিন হেমরমদের সঙ্গে বাঁকুড়া জেলার সমাবেশে অংশ নেন। পরবর্তী সময়ে কলকাতা সহ রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় পার্টি কর্মসূচিতে কমরেডের সক্রিয় অংশগ্রহণ থেকেছে। আন্দোলনের বহু ঘাত-প্রতিঘাতে তিনি পার্টির প্রতি অবিচল থেকেছেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পার্টির প্রতি বিশ্বাসে তাঁর কোনো খাদ ছিল না। কমরেড মানসিন পার্টির আদর্শের প্রতি আস্থা ও ভরসা রেখে পরবর্তী প্রজন্মকে পার্টিতে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা রেখে গেছেন। কিছুদিন আগে তিনি প্রয়াত হয়েছেন। কমরেডের শেষযাত্রায় পার্টির নবীন সদস্যদের হাতে রক্তিম পতাকায় বিদায় জানানো হয়। কমরেড মানসিন চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। কমরেড মানসিন হেমরম লাল সেলাম।
- অনুপ মজুমদার