বিজেপি-আরএসএসের সরকারকে ঘিরে কৃষকদের আন্দোলন তীব্র চেহারা নিচ্ছে। দিল্লীর দরজায় কৃষকদের অবস্থান চল্লিশ দিন পেরিয়ে গেছে। লক্ষ লক্ষ কৃষক সেখানে সংঘর্ষ ও নির্মাণের এক নয়া ইতিহাস তৈরি করছেন। ইতিমধ্যেই প্রাণ দিয়েছেন ষাট জন কৃষক। আদানি-আম্বানি কোম্পানীরাজের বিরুদ্ধে আন্দোলনের বর্ষামুখ শানিত করেছে কৃষকেরা। সরকার এখন পর্যন্ত আটবার বৈঠক করেও কোন সুরাহার পথ দেখাতে পারে নি। বারবার আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার জন্য ‘সারা ভারত কিসান মহাসভা’ সরকারকে দায়ি করে জানিয়েছে যে সরকার একদিকে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার কথা বলছে আবার অন্যদিকে তাদের মন্ত্রীরা বিপরীত মন্তব্য করে চলেছে । নীতিন গডকরির সাম্প্রতিক মন্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে কর্পোরেটদের কাছে আরও কম দামে ফসল বিক্রি করতে কৃষকদের বাধ্য করা এবং কর্পোরেটদের ইচ্ছেমত চাষ করতে বাধ্য করার উদ্দেশ্যেই কৃষি আইনগুলি এনেছে বিজেপি সরকার। গত ৪ জানুয়ারী এআইকেএম-এর জাতীয় সাধারণ সম্পাদক রাজারাম সিং টিকরি সীমান্তের কৃষক জমায়েতে তাঁর বক্তব্যে কথাগুলি তুলে ধরেন। পশ্চিমবঙ্গ এআইকেএম নেতা কৃষ্ণ প্রামাণিক টিকরি সীমান্তে কৃষকদের মাঝে আছেন। কৃষকদের ওপর লাঠিচার্জকে তীব্র ভাষায় ধিক্কার জানান তাঁরা। আন্দোলনকারী কৃষক সংগঠনগুলি বিজেপি ও এনডিএ শরিকদের বয়কট করার ইঙ্গিত দিয়েছে এবং ৬-২০ জানুয়ারী পর্যন্ত ‘জন জাগরণ অভিযান’ চালিয়ে ২৩ জানুয়ারী ‘আজাদ হিন্দ কিসান দিবস’ পালন করার আহ্বান জানিয়েছে। কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ মঞ্চ থেকে আগামী ২৬ জানুয়ারী সাধারণতন্ত্র দিবসে দিল্লীতে প্রবেশ করে লালকেল্লা চত্বরে ট্রাক্টর চালিয়ে প্যারেড করার ঘোষণা দিয়েছে। ৭ জানুয়ারী তার মহড়া হিসেবে এক হাজার ট্রাক্টর রেলি করছে হরিয়ানা বর্ডারে। দিল্লী ঘিরে এই কর্মসূচীর সংহতিতে সারা দেশে লাগাতার কর্মসূচী চলবে। কৃষক সংঘর্ষ সমন্বয় সমিতির পশ্চিমবঙ্গ শাখার পক্ষ থেকে অমল হালদার ও কার্তিক পাল এক প্রেস বিবৃতিতে বাংলায় নিন্মলিখিত কর্মসূচী ঘোষণা করেছেন।
দিল্লীর চলমান কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে ‘অন্নদাতাদের সংহতিতে বাংলা’ এই আহ্বানে আগামী ৯ জানুয়ারী থেকে কলকাতায় এআইকেএসসিসি’র উদ্যোগে এক লাগাতার সংহতি অবস্থান কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এই কর্মসূচিতে ছাত্র-যুব-মহিলা-শ্রমিক সহ সমাজের সর্বস্তরের গণতান্ত্রিক শক্তিকে অংশগ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। কর্মসূচির সম্ভাব্য স্থান ধর্মতলা চত্বর। ৬ জানুয়ারী এআইকেএসসিসি’র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য শাখার বৈঠক থেকে আরও যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তা হল :
এছাড়া কেন্দ্রীয় কর্মসূচীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১৩ জানুয়ারী সর্বত্র কৃষি বিলের কপি জ্বালানো এবং ১৮ জানুয়ারী মহিলা কিষাণ দিবস পালন করা হবে।
ইতিমধ্যে রাজ্যের জেলায় জেলায় কৃষক জাঠা, অবস্থান, মিছিল, সভা প্রভৃতির মাধ্যমে কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করা হচ্ছে। জনবিরোধী কেন্দ্রীয় কৃষি আইনকে প্রতিহত করার উপযোগী রাজ্য আইন প্রণয়নের দাবি এআইকেএসসিসি রাজ্য সরকারের কাছে তুলে ধরছে। সাথে সাথে রাজ্য সরকারের কাছে এআইকেএসসিসি’র দাবি, অবিলম্বে আলু সহ অন্যান্য কৃযি পণ্যের সরকারী দর ঘোষণা ও গ্রামে গ্রামে ক্যাম্প করে আলু সংগ্রহ করার ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রশ্নঃ সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক পদে রয়েছেন আপনি। যে দল সর্বদা জনজাতি, উপজাতি, আদিবাসী তথা পিছিয়ে পড়া মানুষের পাশে থেকেছে। ইদানিং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পশ্চিমবঙ্গ সফরে দেখা যাচ্ছে কখনও তিনি আদিবাসী, কখনও নমঃশূদ্র আবার কখনও বাউল পরিবারে মধ্যাহ্ন ভোজ সারছেন। অথচ তারপরেই সেই পরিবারের সদস্যরা আক্ষেপ করছেন তাঁদের কথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শুনলেন না। এই বিষয়টাকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
উত্তরঃ বিজেপি’র জনজাতিপ্রেম পুরোপুরি প্রচারকেন্দ্রিক ও ভোটসর্বস্ব। বিজেপি সরকারের অর্থনীতি দেশের সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদ আদানি আম্বানিদের হাতে তুলে দিচ্ছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি দেশের আদিবাসী জনগণের। অর্থনৈতিক আগ্রাসনের পাশাপাশি ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রশ্নেও বিজেপি অত্যন্ত আগ্রাসী। দলিত ও আদিবাসী জনগণ এবং তথাকথিত প্রান্তবাসী মানুষ ও তাদের সংস্কৃতি সমান সম্মানের অধিকারী। ক্ষমতাশালীদের লোকদেখানো বদান্যতা নয়, সাংবিধানিক অধিকার ও পারস্পরিক স্বীকৃতি ও সম্মানটাই আসল কথা।
প্রশ্নঃ এই প্রসঙ্গে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই। আপনার মনে হয় মানুষকে জাত-পাতে, সম্প্রদায়ে বিভক্ত করে ফায়দা তুলতে চায় রাজনৈতিক দলগুলি?
উত্তরঃ আমি বলব শাসন ক্ষমতায় থাকা অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই মানুষকে বিভক্ত রাখতে চায়। মানুষ যখন ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেদের দাবি তুলে ধরে তখন সরকারেরা আর পালাবার পথ পায় না। এই সময়ের কৃষক আন্দোলন তা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিচ্ছে।
প্রশ্নঃ ভুমি সংস্কার নিয়ে আপনার মতামত শুনেছি। সিঙ্গুরের মাটি থেকে টাটা চলে যাওয়া। বুদ্ধবাবুর স্বপ্নভঙ্গ। বাংলায় সরকার বদল। এরপর বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী এই জমিতে সর্ষে ছড়ালেন। এখন আবার বলছেন সিঙ্গুরে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক হবে। প্রায় ১০ বছর হয়ে গেল সিঙ্গুরের মানুষ কিছুই তো পেল না। না হল চাষ, না হল শিল্প। এরপর ওই জমিতে ইন্ডাস্ট্রি তৈরি হতে ৩ থেকে ৪ বছর সময় লেগে যাব। গোটা বিষয়টায় আপনার মতামত কি?
উত্তরঃ সিঙ্গুরের মানুষের সঙ্গে আলাপ আলোচনা না করে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে শিল্পের নামে জোর করে জমি নিয়ে নেওয়াটা একটা বিরাট বড় ভুল ছিল। সেই জমিকে কৃষিযোগ্য করে ফেরত দেওয়ার কথা ছিল। তা হয়নি। বিশ্বাসঘাতকতা অব্যাহত। এখন সে জমিতে কী হতে পারে এ ব্যাপারেও শুধু বিশেষজ্ঞদের রায় নয় ওখানকার মানুষের ইচ্ছেকে মূল্য দিতে হবে। আমার তো মনে হয় কৃষি বা শিল্প যাই হোক তাতে যদি সমবায় ভিত্তিতে সাধারণ স্থানীয় মানুষের অধিকার সুনিশ্চিত করা যায় সেটাই হবে সবচেয়ে কাজের কথা।
প্রশ্নঃ টানা ৩০ দিনের মাথায় পড়ল কৃষকদের আন্দোলন। সেই আন্দোলনকে একাধিক তকমা দিয়ে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা চলছে। অথচ যত সময় যাচ্ছে আন্দোলন আকারে বাড়ছে। ৩৩ জন আন্দোলনরত কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। আপনি এবং আপনার দল কি দাবি করছেন?
উত্তরঃ কৃষকদের দাবিই আমাদের দাবি। কৃষকের নাম করে কোম্পানি রাজের স্বার্থে আইন তৈরি করা এবং কৃষিকে কোম্পানি মালিকের হাতে তুলে দেওয়া কৃষকের উপর বিরাট বড় আঘাত ও অপমান। এই আইন প্রত্যাহার করতে হবে। এর পাশাপাশি কৃষকদের অগ্রণী অংশ গণতন্ত্রের অন্য অনেক দাবিতেও সোচ্চার। যেমন রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির দাবি। সংবাদ মাধ্যমের উপর কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ ও রাষ্ট্রের দখলের ফলে মিডিয়ার যে অগণতান্ত্রিক চরিত্র তৈরি হয়েছে তার অবসান ঘটানো। শুধু কৃষি নয়, গোটা অর্থব্যবস্হাকেই কর্পোরেট দখল মুক্ত করা। আমরা এই সমস্ত প্রশ্নেই কৃষকের সঙ্গে রয়েছি।
প্রশ্নঃ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বললেন ‘প্রধানমন্ত্রী কিসান সম্মান নিধি’ প্রকল্প থেকে বাংলার কৃষকরা বঞ্চিত হচ্ছে। রাজ্য বিজেপি’র নেতৃত্ব বলছেন কেন্দ্রের নাম বদল করে প্রকল্প চালাচ্ছে মুখ্যমন্ত্রী। সেখানেও ‘কাটমানি’র অভিযোগ তুলছেন। একটা বিরাট অংশের কৃষকরা বঞ্চিত হচ্ছেন সরকারী প্রকল্প থেকে। কি বলবেন এবিষয়ে?
উত্তরঃ কৃষকেরা এই মুহূর্তে দুটি দাবি সবচেয়ে বেশি জোরের সঙ্গে তুলে ধরেছেন। ঋণমুক্তি ও ফসলের ন্যায্য দাম। কৃষি উন্নয়নের জন্য উপযুক্ত কাঠামো গড়ে তোলাটাও সরকারের প্রাথমিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সরকার এই কাজগুলো করলে ভোটের আগে সম্মানের নামে ঢাকঢোল বাজিয়ে কৃষকের হাতে কিছু সামান্য অর্থ তুলে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। কৃষকরা ভিক্ষা বা ঘুষ চাইছেন না, তাঁদের দাবি ন্যায্য অধিকার।
প্রশ্নঃ বিহারের নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে আপনি বলেছিলেন নির্বাচনের ধাঁচ বদলাচ্ছে। এখন মানুষ বেকারত্বের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিচ্ছে। প্রতিশ্রুতির তালিকায় চাকরি প্রথম স্থানে প্রাধান্য পাচ্ছে। মানুষ সেটাকে মেনেও নিচ্ছে। শুধুমাত্র বাংলা নয়, সারা দেশে বেকারত্ব একটি বিরাট সমস্যা। তাহলে বাংলার নির্বাচনে বামেরা এই বিষয়টিকে নির্বাচনী ইস্তেহারে প্রাধান্য দেবে?
উত্তরঃ বেকারত্ব বাংলার যুবসমাজের জন্যও বিরাট বড় প্রশ্ন। শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্যের প্রশ্নও কম বড় নয়। আমার তো মনে হয় বাংলার বামপন্থীরা অবশ্যই এবারের নির্বাচনে এসব প্রশ্নে বিশেষ জোর দেবে।
প্রশ্নঃ নির্বাচনে বামেদের ব্যাপক জয়ের পরেও বিহারে অল্পের জন্য আপনারা সরকার গঠন করতে পারলেন না। এর কারণ কি ছিল?
উত্তরঃ বামেদের জয়টা সত্যিই যদি অতটা ব্যাপক হতো তাহলে সরকার গঠন হয়ে যেত। আসলে আমরা যদি আরও কিছু আসনে লড়তাম তাহলে হয়তো ছবিটা অন্যরকম হতো। কংগ্রেসের দুর্বলতা এবং আরজেডির রাজনৈতিক-সামাজিক সীমাবদ্ধতা অবশ্যই সামগ্রিক ফলাফলকে প্রভাবিত করেছে। কিন্তু আমার মনে হয় সবার আগে আমাদের বামপন্থীদের আরও বেশি সংগঠন, আন্দোলন ও আদর্শগত প্রভাব বিস্তারে মনোযোগী হতে হবে।
প্রশ্নঃ এর কারণ কি কংগ্রেস ছিল? যদিও বিহার এবং বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাস এক নয়। তবুও এই মুহূর্তে সারা দেশে কংগ্রেসের যা অবস্থা, তাতে আপনারা জোট করে ভুল করবেন না তো?
উত্তরঃ জোট দিয়ে দুর্বলতা ঢাকা যায় না। বাংলায় বামপন্থীদের কাছে নিজস্ব শক্তিবৃদ্ধি ও হৃত রাজনৈতিক জমি পুনরুদ্ধার এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
প্রশ্নঃ গত কয়েক বছরে তৃণমূল এবং বিজেপিকে একই শ্লোগান দিতে শুনেছি ‘৩৪ বছরের বাম অপশাসন’। আপনার মনে হয় গত দশ বছরে তৃণমূলের শাসনকালে মানুষ তা ভুলতে পেরেছে। এবারের নির্বাচনে বামেরা হারানো জমি ফিরে পাবে?
উত্তরঃ অবশ্যই তৃণমূলের অপশাসনের প্রশ্ন সামনে আসায় অন্য অনেক প্রশ্ন প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। কিন্তু এই লাভটা বিজেপি সবচেয়ে বেশি ঘরে তুলছে। বিজেপি’কে আড়ালে থাকতে দেওয়াটা বিরাট ভুল। তৃণমূলের অপশাসনের অভিজ্ঞতা লোকের হয়ে গেছে, বিজেপি সম্পর্কে যদি ঠেকে শেখার আগেই ত্রিপুরা, আসাম, বিহার, উত্তরপ্রদেশ বা গোটা দেশে বিজেপি শাসনকে দেখে বাংলার মানুষ শিখতে পারে সেটাই হবে বাংলার বামপন্থীদের আসল সাফল্য। নাহলে তৃণমূলের অপশাসন বা ভাঙনে বামপন্থীদের উৎসাহিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।
প্রশ্নঃ এখন রাজ্যজুড়ে দলবদলের হিড়িক পড়েছে। যারা আগে এক থালায় ভাত খেতেন, তাঁরাই এখন থালা ভেঙে অন্যের সঙ্গে পাত পেড়ে খাচ্ছেন। দলবদলের মানে তো মানুষের সঙ্গে বঞ্চনা করা। এবিষয়ে আপনার কি মতামত?
উত্তরঃ বিশেষ করে কোনো একটি দলের হয়ে ভোটে জেতার পর দলবদল করাটা আমি অনৈতিক মনে করি। সেক্ষেত্রে আগে পদত্যাগ করে জনগণের কাছে ফিরে যাওয়া উচিত। তবে বিজেপি জবরদখলকারীদের পার্টি। ইতিহাস, ভূগোল, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি সর্বত্রই লুটপাট করে রাজত্ব করাটাই ওদের রীতি। অন্য দল ভেঙে, ইতিহাসের বিভিন্ন প্রতীকদের বিকৃত করে নিজেদের দল বাড়ানো ও প্রচার চালানোটাই ওদের কাজ।
প্রশ্নঃ আপনার মতে বাংলায় বামেদের মূল প্রতিপক্ষ কে? তৃণমূল, নাকি বিজেপি?
উত্তরঃ অবশ্যই বিজেপি। প্রশ্নাতীতভাবে। আজকের বিজেপি মানে এক অভূতপূর্ব সামাজিক, আর্থিক ও রাজনৈতিক বিপর্যয়। তার সাথে আজ ভারতবর্ষের অন্য কোনো দলের তুলনা চলে না। ভারতবর্ষে শাসক শ্রেণীর অনেক দল আছে। দক্ষিণপন্থী বা পুঁজিবাদ সমর্থক দলের সংখ্যা অনেক। কিন্তু বিজেপি অন্য পাঁচটি দলের মতো নয়, বিজেপি মানে বস্তুত একদলীয় শাসন, গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ কন্ঠরোধ।
সৌরভ গাঙ্গুলি, ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেট অধিনায়ক, বাঙালির নয়নের মনি, অতর্কিতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তাঁর জীবন হতে পারত সংশয়াচ্ছন্ন, কিন্তু সেদিকে গড়ায়নি। গৃহীত ব্যবস্থাক্রমে তিনি সংকটমুক্ত হয়েছেন। বিদ্যুৎগতিতে চলে গিয়েছিলেন কলকাতার সবচেয়ে অভিজাত এক সর্বাধুনিক হাসপাতালে। চিকিৎসাক্ষেত্রের ভাষায় তিনি পৌঁছে যেতে পেরেছিলেন ‘গোল্ডেন আওয়ার’-এর মধ্যে, অর্থাৎ যে সময়ের মধ্যে চিকিৎসা পেলে বিপদ কেটে যাওয়ার সুযোগ বেশি।
এই দেশে, এই রাজ্যে, এহেন ‘সোনালি সময়ে’র মধ্যে চিকিৎসা পরিষেবা পাওয়া যায় মূলত পুরানো-নতুন নামী-দামী সব বেসরকারী হাসপাতালে। তবে ব্যবস্থাটা ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল’ পলিসির। সরকারী বড় বড় হাসপাতালেও কিছু অনুরূপ পরিকাঠামো রয়েছে, কিন্তু গরিব, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত রোগীর ভীড় লেগে থাকে প্রচণ্ড, লাইন পেতে অতীষ্ট হয় জীবন। ব্যবধানটা ভীষণ মাত্রায়। ফলে পুঞ্জীভূত হয়েই চলছিল দাবিটা। রাজ্য সরকারকে কিছু একটা করতেই হোত স্বাস্থ্যবিমা ধরনের। অনেক দেরীতে হলেও তা প্রথমে শুরু হয়েছিল ২০১৬ সালে। প্রকল্পের নাম ‘স্বাস্থ্য সাথী’। কিন্তু ২০২০’র অতিমারী পরিস্থিতিতে চিকিৎসা পরিষেবা পেতে সাধারণ মানুষের অশেষ দূর্ভোগ পোহানো, বিশেষত বেসরকারী হাসপাতালগুলোর অর্থচোষা ব্যবস্থা; সরকারী বড় বড় হাসপাতালগুলোর বা জেলা ‘সুপার স্পেশ্যালিটি’ হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত পরিকাঠামোর অভাব উন্মোচিত হয়েছে প্রকটভাবেই। সব মিলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পরিচিত করালো সার্বিক সংকটকে, যার জন্য মূল দায়ি বেসরকারী হাসপাতাল ব্যবস্থা। তারা অসহায় মানুষকে আগেও অর্থের চাপ দিয়ে শুষে ছিবড়ে করে ছাড়তো, দরজা দেখিয়ে দিত, এমনকি শবদেহ আটকে রেখে বিল আাদায়ের বিভৎসতা দেখিয়েছে। অতিমারী পরিস্থিতিতেও এসব শয়তানি করেছে। এই দুরবস্থাকে কোনো-না-কোনো মাত্রায় নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। আর জনসাধারণকে একটু স্বস্তির পরিষেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করা ভীষণ প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। তাই ‘স্বাস্থ্য সাথী’ প্রকল্প উপভোক্তাবর্গের ব্যাপক সম্প্রসারণ করতেই হোত। রাজ্য সরকার সেটা আর দেরী না করে সম্প্রসারিত করে প্রাথমিকভাবে পরিচয় দিয়েছে সুমতির। সামনে বিধানসভা নির্বাচন। ইতিমধ্যে মোদীর কেন্দ্র নামিয়েছে ‘আয়ুস্মান ভারত’! বিজেপি তাই নিয়ে খুব ঢাকঢোল পেটাচ্ছে। রাজ্য সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আয়ুস্মানের বোঝা না টানার। যুক্তি হল, আর্থিক দায় কেন্দ্র-রাজ্য উভয়ের হলেও প্রকল্পের নাম কিনছে কেন্দ্রীয় সরকার। তাই মমতা সরকার চলতে চায় পাঁচ লক্ষ টাকা মূল্যের এবং মহিলাদের নামে চালু প্রকল্প ‘স্বাস্থ্য সাথী’ নিয়ে। এই কার্ডের বিনিময়ে রাজ্যের ভেতরে ও বাইরে শয়ে শয়ে বেসরকারী হাসপাতাল/নার্সিং হোমে চিকিৎসা মিলবে, কেউ ফেরাতে পারে না, নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এমনই। নয় কোটি মানুষ ধর্তব্য-এর আওতায়। এপর্যন্ত আবেদন জমার সংখ্যা সত্তর লক্ষাভিমুখী, আবেদন মঞ্জুরের ভাগ আশি শতাংশ, হাতে কার্ড পেয়েছেন কুড়ি শতাংশ, বাকিদের দেওয়া হচ্ছে ‘ইউনিক’ রেজিস্ট্রেশান নাম্বার ‘ইউআরএন’। একে জনপ্রিয় করতে নাম লিখিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী নিজেও।
কিন্তু শুরুতেই প্রশ্ন উঠছে বেসরকারী হাসপাতালগুলোতে এর গ্রাহ্যতা নিয়ে। কমলি কিস্কু, রূপালি মাহালি, মর্জিনা বিবি, রীতা সর্দার, নমিতা দাসরা এর উপযোগিতা কার্যত কি পাবেন? কিভাবে নিশ্চিত হবেন? এই প্রশ্নগুলোর জরুরী প্রত্যুত্তর চাই। কারণ ইতিমধ্যেই ঘটতে শুরু করেছে নিদারুণ সব ঘটনা। ভাঙরের গরিব শাকিলা বিবি গুরুতর হৃদরোগের জরুরী চিকিৎসার জন্য ‘স্বাস্থ্য সাথী’ কার্ড নিয়ে হন্যে হয়ে ঘুরেছেন। তাঁকে এক নামী বেসরকারী হাসপাতাল ফিরিয়ে দেয় কার্ডে চিকিৎসা মিলবে না বলে। তারপর দুটো বড় সরকারী হাসপাতালেও মেলেনি প্রত্যাশিত পরিষেবা। পুলিশ-প্রশাসনে অভিযোগ করতে হয়েছে, সংবাদ জগতে খবর হয়েছে, তারপর স্বাস্থ্যদপ্তরের হস্তক্ষেপে তিনি ভর্তি হতে পেরেছেন এক বেসরকারী হাসপাতালে। অন্য একটি কেস। মুর্শিদাবাদের নওদায় বছর বাইশের অন্তঃসত্ত্বা জুলেখা বিবির পরিবার কার্ড নিয়ে পরিষবা চাইতে গিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়। তারপরে বাড়ির রোগিকে বাঁচাতে বাড়ির গরু বিক্রি করতে বাধ্য হয়। পুলিশ-প্রশাসন করতে গেলে ঘনিয়ে আসত রোগীর ঘোর বিপদ।
এহেন নির্দয় দুঃসাহস বেসরকারী চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান দেখাতে পারছে কি করে? সংগঠিত প্রতিবন্ধকতায় নেমেছে তাদের প্রতিনিধি সংস্থা এএইচআই (এসোসিয়েশন অব হসপিটালস্ অব ইস্টার্ণ ইন্ডিয়া)। সংস্থার বক্তব্য হল, কেস প্রতি বিল চার্জ ও বিমাবাবদ বরাদ্দের পরিমাণ নিয়ে রয়েছে বিরোধ। সংস্থার বক্তব্যে আছে রকমফের ‘বিকল্প’ ও দাবি। যদি পাঁচ শতাংশের বেশি কেস করতে না হয় তাহলে বাকি পঁচানব্বই শতাংশের হসপিটাল রেট চার্ট অনুযায়ী বিল আদায়ের টাকা থেকে কার্ডধারীদের ক্রস সাবসিডির টাকা ম্যানেজ করা যাবে। কিন্তু কার্ডধারীদের ভীড় যদি বাড়তেই থাকে তবে সেটা বহন করা সম্ভব নয়। সেটা সম্ভব হতে পারে সরকার যদি কেস প্রতি যা বরাদ্দ করেছে তার গড়ে ছয় থেকে আট গুণ অর্থবরাদ্দ বাড়ায়। এ বিরোধের নিস্পত্তি করতে তৃতীয় কোনো কমিটি গঠন হোক। যাই হোক, নৃশংস স্বাস্থ্য বাজারের চাপ এবং সরকারের বরাদ্দ-সঙ্গতির মধ্যেকার চাপে গোড়াতেই পিষ্ট হতে শুরু করেছে প্রকল্পটি। বাজারি অন্যায় অযৌক্তিক চাপের কাছে নতি স্বীকার না করে অবিলম্বে এর যুদ্ধকালীন সমাধান দিতে হবে সরকারকেই। এক্ষেত্রে আইনি সংস্থান ও রুলস্ যা যা আছে কার্যকরি করা হোক, সেসব বিষয়ে তলিয়ে খতিয়ে দেখা এবং নির্দেশাবলীতে আবশ্যিক আরও পরিবর্তন প্রয়োজন হলে পদক্ষেপ করা হোক। সাফ কথা, নিছক ভোটকুড়ানোর অছিলায় ‘দুয়ারে সরকার’ কসরত প্রদর্শন করলে চলবে না। কাজের কাজগুলো করতে হবে। আমজনতাকেও নামতে হবে কার্ডের প্রাপ্য আদায়ে, গড়ে তুলতে হবে সংগঠিত চাপ।
বিক্ষোভরত কৃষক এবং মোদী সরকারের মধ্যে সপ্তম পর্যায়ের আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে। যে কৃষকরা বজ্র-বিদ্যুৎ সহ ঝড়-বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে তীব্র ঠান্ডার মধ্যে দিল্লীর সীমানায় অবস্থান করছেন, তাঁরা সরকারকে সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন কৃষক-বিরোধী তিনটে আইনের পুরোপুরি বাতিল ছাড়া কোনো কিছুকেই তাঁরা মেনে নেবেন না। এই তিনটে আইনকে প্রত্যাহার করে নিতে মোদী সরকার কিন্তু অনমনীয় মনোভাব দেখিয়ে চলেছে।
শুধুমাত্র ধনী কৃষকরাই, এবং তাও আবার পাঞ্জাবের কৃষকরাই বিরোধী পক্ষের প্ররোচনায় বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন — এই গালগল্পটাকে চালানো সরকারের পক্ষে ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে। দিল্লীর সীমানায় পাঞ্জাব ও হরিয়ানার কৃষকদের সঙ্গে বিক্ষোভে যোগ দিয়েছেন রাজস্থান, উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ড এবং তামিলনাড়ুর কৃষকরা। বিহারে হাজার-হাজার ক্ষুদ্র ও মধ্য কৃষক এবং কৃষি শ্রমিকরা কৃষি আইনগুলো বাতিলের দাবিতে সরকারের প্রশাসনিক সদর দপ্তরে অভিযান সংগঠিত করেছেন। এটাও অত্যন্ত সুস্পষ্ট যে, কৃষকদের পিছনে সাধারণ ভারতবাসীর সমর্থন ও সংহতিও রয়েছে।
নৈতিক এবং রাজনৈতিক উভয় দিক থেকেই কিন্তু কৃষকদেরই প্রাধান্য রয়েছে। যে ঘটনাটা এই বিষয়টাকে প্রতিষ্ঠিত করছে তা হল — কৃষক আন্দোলন চলাকালীন নিহত কৃষকদের স্মৃতিতে কৃষকরা যখন দু-মিনিট নীরবতা পালন করছিলেন, সে সময় সেখানে উপস্থিত কৃষক প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাক্ষাৎকারী মন্ত্রীরাও তাতে যোগ দেন। এই প্রতীকী অভিব্যক্তি প্রকাশে মন্ত্রীদের বাধ্য ক’রে কৃষকরা বিজেপির এই প্রচারটাকে ভোঁতা করে দিতে পেরেছেন যে, কৃষকদের আন্দোলনটা অবৈধ এবং তাদের মধ্যে রয়েছে শুধু “দেশদ্রোহী” ও “খালিস্তানি সন্ত্রাসবাদীরা”।
ইতিমধ্যে, প্রথম সারির এক সংবাদপত্রে দেওয়া তাঁর সাক্ষাৎকারে মোদী মন্ত্রীসভার বরিষ্ঠ সদস্য এবং বিজেপি নেতা নীতিন গডকড়ি এমন কিছু মন্তব্য করেছেন যা এই কৃষি আইনগুলোর পিছনে থাকা সরকারের অভিপ্রায় সম্পর্কে কৃষকদের আশঙ্কাকেই উন্মোচিত করে দেয়।
গডকড়ি কোনো রাখঢাক না করেই জানিয়ে দিয়েছেন যে, এই নতুন কৃষি আইনগুলো প্রবর্তন করা হয়েছে ভারতীয় কৃষির সমস্যার “মূল কারণগুলোকে” শোধরানোর জন্য, তাঁর কথায় যেগুলো হল : “উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য”; আর খাদ্যশস্যর জন্য যে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য সরকার দেয় তা অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারের দামের চেয়ে বেশি হওয়া। গডকড়ির কথাগুলো আক্ষরিকভাবে হল, “আমাদের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য আন্তর্জাতিক এবং বাজারের দামের চেয়ে বেশি, আর সমস্যাটা সেখানেই। আমি গত বারো বছর ধরে ইথানলের কথা বলে আসছি। কিন্তু খাদ্যশস্যকে রূপান্তরিত করার (জ্বালানিতে) অনুমতি দেওয়া হয়নি। মূল সমস্যাটা হল উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য এবং ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের পরিমাণ বাজারের দামের চেয়ে বেশি হওয়া।”
গডকড়ির সাক্ষাৎকার সরকারের এই দাবিকে নির্ভেজাল মিথ্যা বলে প্রতিপন্ন করছে যে, নতুন আইনগুলো শুধু ন্যূনতম সহায়ক মূল্যকেই রক্ষা করবে না, কৃষকদের খোলা বাজারে কোম্পানিগুলোর কাছে এমন দামে খাদ্যশস্য বিক্রির “স্বাধীনতা” দেবে যা ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের চেয়ে বেশি। কৃষকরা ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের দাবি করেন কেননা তাঁরা জানেন, বাজারের দাম কম হওয়ার দিকেই যাবে; আর ন্যূনতম সহায়ক মূল্য না থাকলে তাঁরা উৎপাদনের খরচের চেয়ে কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হবেন। সরকার কিন্তু ন্যূনতম সহায়ক মূল্যকে একটা সমস্যা রূপেই দেখছে, আর নতুন আইনগুলোকে এই উদ্দেশ্যেই প্রবর্তন করেছে যাতে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারে অনেক কম দামে খাদ্যশস্য বিক্রি ছাড়া কৃষকদের কাছে অন্য কোনো উপায় না থাকে।
গডকড়ির সাক্ষাৎকার থেকে এটাও পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, সরকার নতুন কৃষি আইনগুলোকে এনেছে যাতে তথাকথিত “উদ্বৃত্ত” খাদ্যশস্যগুলোকে গণবন্টন ব্যবস্থা এবং দরিদ্রদের জন্য রেশন ব্যবস্থা থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়াটাকে সহজতর করা যায়। প্রকট সত্যিটা হল ভারতের “উদ্বৃত্ত” খাদ্যশস্য গোডাউনগুলোতে যখন পচে তখন বিশ্ব খাদ্য সূচকে ১০৭টা দেশের মধ্যে ভারতের স্থান হয় ৯৪ নম্বরে, প্রতিবেশি বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং নেপালেরও পিছনে। খাদ্যশস্য “উদ্বৃত্ত” হয় কারণ, সরকার সর্বজনীন গণবন্টন ব্যবস্থার বদলে “নিয়ন্ত্রিত লক্ষ্যমাত্রা ভিত্তিক” গণবন্টন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে যা ভারতের দরিদ্র জনগণের এক বড় অংশকে বঞ্চিত ও অভুক্ত করে রাখছে। অনাহারকেই মূল সমস্যা বলে চিহ্নিত না করে মোদী সরকার এখন দাবি করছে যে, গোডাউনগুলোতে উপছে পড়া উদ্বৃত্তই হল মূল সমস্যা, এবং খাদ্যশস্যকে জৈব জ্বালানিতে রূপান্তরিত করার বিধান দিচ্ছে। নতুন আইনগুলোর মধ্যে চুক্তি ভিত্তিক চাষকে সর্বব্যাপী করার উদ্দেশ্য রয়েছে, এবং অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে তা এই পরিবর্তনে মদত যোগাবে। এইভাবে খাদ্যশস্যের জন্য আমরা অন্যান্য দেশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ব, ফলে দরিদ্রদের খাদ্যের নিরাপত্তাহীনতাও বৃদ্ধি পাবে।
গডকড়ি খোলসা করে যা বলেননি তা হল — মোদী সরকার ন্যূনতম সহায়ক মূল্যকে তুলে দিতে চাইছে, কৃষকদের এমন অবস্থায় ফেলতে চাইছে যাতে তারা অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারে নির্ধারিত দামে খাদ্যশস্য বিক্রি করতে বাধ্য হয়, এবং আরও চাইছে খাদ্যশস্য সংগ্ৰহ ব্যবস্থা এবং গণ বন্টন ব্যবস্থাকে তুলে দিতে। এ সবই তারা করতে চাইছে ভারতীয় কৃষকদের সরকারী সহায়তাকে হ্রাস করার বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার হুকুমকে তামিল করতে।
সরকারের ভাঁওতা ভারতীয় কৃষকদের কাছে দিবালোকের মতোই স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে, এবং তিনটে আইনকে ঝাড়েমূলে বাতিল করার দাবিতে তাঁরা অবিচল রয়েছেন।
তাঁরা ঘোষণা করেছেন, নিজেদের দাবিকে জোরের সাথে তুলে ধরতে তাঁরা ২৬ জানুয়ারী প্রজাতন্ত্র দিবসে ট্রাক্টরে করে রাজধানী দিল্লী অভিযান করবেন। কৃষক আন্দোলনের সামনের সারিতে থাকা কৃষকরা লড়াই করছেন ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের রক্ষায়, তাঁরা শুধু কৃষকদের অধিকারের দাবিতেই সোচ্চার হচ্ছেন না, তাঁরা সমস্ত নাগরিকের প্রতিবাদের অধিকারকে, খাদ্য নিরাপত্তা ও খাদ্য রেশনের অধিকারকে, এবং কোম্পানি রাজ-এর হাত থেকে দেশের স্বাধীনতাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরছেন। অতীব গুরুত্বপূর্ণ এই লড়াইয়ে ভারতের জনগণ কৃষকদের পাশেই রয়েছেন।
(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ৫ জানুয়ারী ২০২১)
মোদী জমানায় দিন-মজুরদের আত্মঘাতী হওয়ার হার অনেক বেড়ে গেছে। কিছুদিন আগে প্রকাশিত ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো, ২০১৯’র তথ্য জানাচ্ছে প্রতি বছর সমাজের এই বিপন্ন শ্রেণিটির আত্মঘাতী হওয়ার প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই পরিসংখ্যানের মধ্যে কিন্তু বর্তমান মন্থর আর্থিক শ্লোডাউন এবং লকডাউন পর্বে নেমে আসা বিপর্যয়ের তথ্য ধরা নেই।
এনসিআরবি’র তথ্য দেখাচ্ছে, ২০১৯ সালে যতজন ভারতে আত্মঘাতী হয়েছেন, তার মধ্যে দিনমজুরদের হার ২৩.৪ শতাংশ। আত্মঘাতী হওয়ার মধ্যে চতুর্থতম ব্যক্তিই হলেন দিনমজুর। ২০১৪ সালে এই মৃত্যুর হার ছিল ১২ শতাংশ, ২০১৯-এ যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩.৪ শতাংশ। এই রিপোর্ট আরও জানিয়েছে, এই তথ্যের মধ্যে নেই সেই সমস্ত পরিযায়ী দিন মজুরদের সংখ্যা কারণ সরকারের কাছে এই তথ্য তাদের নেই।
দেখা যাচ্ছে, বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে কৃষি ও অ-কৃষি ক্ষেত্রে শ্রমের চাহিদা কমে যাচ্ছে। জেএনইউ’র ইনফর্মাল সেক্টর ও লেবার স্টাডিস এর সহকারী অধ্যাপক অনমিত্র রায়চৌধুরী জানিয়েছেন “একদিকে অর্থনীতির মন্থরতার কারণে কর্মসংস্থান কমেছে বিরাট ভাবে, অন্যদিকে বেড়েছে শ্রমের জোগান। এর ফলে দৈনিক মজুরির উপর অনেক চাপ পড়ছে, আর হ্রাসপ্রাপ্ত হচ্ছে মজুরির হার।” তিনি আরও বলেছেন, “২০১৪-১৫তে খরার জন্য পরিস্থিতি আরো ঘোরালো হয়ে ওঠে। তার জন্য শ্রমিকেরা কৃষি থেকে অ-কৃষিক্ষেত্রে সরে যাচ্ছে আর তার প্রভাব পড়ছে মজুরি ও কাজের জোগানের উপর। ২০১১ থেকে ২০১৭র মধ্যে ক্যাজুয়াল শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি কমে অর্ধেক হয়ে যায়। এটা অ-কৃষি ক্ষেত্রের আরেকটা সংকটকেই দেখিয়ে দেয়।
এনসিআরবি’র তথ্য থেকে উঠে আসছে, সবচেয়ে দরিদ্র অংশের মধ্যেই আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি, যারা বছরে এক লাখের কম উপার্জন করে। ২০১৯ সালে মোট আত্মঘাতী ১ লক্ষ ৩৯ হাজার ১২৩ জনের মধ্যে ৯২ হাজার ৮৩ জন (অর্থাৎ ৬৬.২ শতাংশ)-র বার্ষিক আয় এক লক্ষ টাকারও কম। আর, যারা আত্মঘাতী হয়েছেন তাদের মধ্যে ২৯.৬ শতাংশ, অর্থাৎ ৪১ হাজার ১৯৭ জনের বাৎসরিক আয় এক লক্ষ থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা।
বেশিরভাগ ভারতীয় শ্রমিকরা নির্দিষ্ট কোনো চুক্তি বা কন্ট্রাক্ট ছাড়াই কাজ করেন, জানালো বিশ্ব ব্যাঙ্ক। বিশ্ব ব্যাঙ্ক আরও জানালো, ভারতে মাত্র ২৪ শতাংশ শ্রমিক কোন না কোন ধরনের চুক্তি বা কন্ট্রাক্ট-এর ভিত্তিতে কাজ করেন, যাদের রয়েছে নির্দিষ্ট আয়। আর, বিপুল ৭৬ শতাংশ শ্রমিকরাই ইনফর্মাল ভিত্তিতে কর্মরত, যাদের নেই কোনো ধরনের কাজের ও মজুরির নিশ্চয়তা, সামাজিক সুরক্ষা যেখানে মরীচিকা মাত্র। কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রক জানিয়েছে, তাদের কেন্দ্রীয় ডেটাবেস অনুযায়ী ১.০৪ কোটি পরিযায়ী শ্রমিক নিজ নিজ রাজ্য বা এলাকায় ফিরে গেছেন আর এক্ষেত্রে উত্তর প্রদেশের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি – ৩২.৪ লক্ষ। আর এই সুবিপুল অংশটাই কাজ করেন কোনো ধরনের লিখিত কন্ট্রাক্ট ছাড়াই। বিশ্ব ব্যাঙ্কের হিসাব অনুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৯৩.৮ শতাংশ শ্রমিক কোনো না কোনো কন্ট্রাক্টের ভিত্তিতে কাজ করেন। জার্মানি, ফ্রান্স ও চীনে এই সংখ্যাটা হলো যথাক্রমে ৯০.২ শতাংশ, ৮৮.৪ শতাংশ এবং ৫৩.৫ শতাংশ।
বৃহৎ অর্থনৈতিক দেশগুলোর মধ্যে ভারতেই অনথিভুক্ত শ্রমিকদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। আর, এনসিআরবি তথ্য দেখিয়েছে জনসংখ্যার এই বিপুল অংশটাই সবচেয়ে বেশি বিপন্ন, প্যান্ডেমিক যাদের জীবনকে ছাড়খার করে দিল।
(সুত্র - টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০)
- অতনু চক্রবর্তী
যদিও এ রাজ্যের নির্বাচনের এখনও চার-পাঁচ মাস দেরি, তবুও দেখা যাচ্ছে, গোদি মিডিয়া এই সময় থেকেই একটা হিড়িক তুলে দিয়েছে। এর পেছনে সেনশনাল খবর পরিবেশন করে টিআরপি তোলার বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য তো আছেই, কিন্তু আরও একটি বড় উদ্দেশ্য কাজ করছে বলে বেশ মালুম হচ্ছে। তা হল, পালা পরিবর্তনের একটা হুজুক তুলে দেওয়া, যার পেছনে তাদেরও কিছু স্বার্থসিদ্ধি করার ব্যাপার আছে। দেশজুড়ে যখন গোদি মিডিয়াকে হাতিয়ার করে বিজেপি’র রথ বেলাগাম ছুটতে চাইছে তখন এরাজ্যেও তাকে ছোটাতে এই ধরনের কারসাজি বেশ ফল দেবে বলে তাদের বিশ্বাস।
এই মুহূর্তে নির্দ্বিধায় বলা যায়, পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে ঠিক কী হতে চলেছে, সে কথা বলার সময় এখনও আসেনি। কারণ, ঘটনাবলীকে মিডিয়া যেভাবে দেখাতে চাইছে সেভাবে সব কিছু এগোচ্ছে না।
প্রথমেই ধরা যাক দলবদলের কথা। তৃণমূলের এক ঝাঁক গুরুত্বপূর্ণ নেতা-কর্মীকে দলে এনে বিজেপি যদি মনে করে থাকে যে তাদের পশ্চিমবঙ্গে জয় প্রায় সারা হয়ে গিয়েছে, তাহলে তারা মূর্খের স্বর্গে বাস করছে। কোনও রাজ্যে, এমনকি এখানেও, কতিপয় নেতার চালচলনের ওপর জনতার রায় নির্ভর করে না। কারণ, দেখা গেছে, সংসদীয় গণতন্ত্রের নানা স্তরের বিবিধ নির্বাচনে জনতা বেশ বুঝেশুনেই ভোট দেন। হতে পারে, কখনও তারা উগ্র রক্ষণশীল শক্তিকেও নির্বাচিত করেন। কিন্তু তার কারণ হিসেবে দেখা যাবে, বিপক্ষের যে দল ক্ষমতায় ছিল বা আসতে চায়, তাদের কার্যকলাপে এমন সব জনবিরোধী ও ক্ষতিকর প্রয়াস রয়েছে বা ছিল, তা জনগণ প্রত্যাখ্যান করতে চাইছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভার্সাই চুক্তিতে নিঃস্ব জার্মানির ছিন্নমূল অবস্থা দেখেই না জার্মানির জনগণ হিটলারের দলকে নির্বাচনে জিতিয়েছিলেন। সেভাবেই ফ্যাসিবাদী শক্তি জনতার ক্রোধ ও হতাশাকে হাতিয়ার করে নিতে পারে বা নেয়। আমাদের দেশেও অনুরূপ ঘটনা গত কয়েক বছরে ঘটেছে। কিন্তু তার জন্য ইউপিএ সরকারের আমলে জল-জঙ্গল-জমি দখল করার কর্পোরেট আগ্রাসন ও চরমতম দুর্নীতি কম দায়ী ছিল না।
এই দ্বান্দ্বিক বাস্তবতার ওপর দাঁড়িয়েই আমাদের এই সময়ের কঠিন পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করতে হবে। একথা অনস্বীকার্য যে, গত দশ বছরে এ রাজ্যে স্বাধীন মত প্রকাশ ও দলের কর্মসূচী পালন করতে গিয়ে বিরোধীদের শাসকের বহু আক্রমণের মুখোমুখি হতে হয়েছে। এমনকি তার আগের জমানাতে তো সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের মতো ঘটনাও ঘটেছে যা কৃষকদের ওপর শাসক পক্ষের গুলি চালানো ও গণহত্যার স্মারক হয়ে রয়েছে। এই সমস্ত ঘটনার স্মৃতি এলাকাবাসী ও রাজ্যের মানুষের মধ্যে প্রবলভাবে রয়েছে। ফলত, এই রাজ্যের পরিপ্রেক্ষিতে (বামফ্রন্ট ও তৃণমূলের শাসন প্রত্যক্ষ করার পর) বিজেপিকে খুব নতুন ও সজীব কোনও শক্তি হিসেবে কারও কারও মনে হতে পারে, যাকে একবার সুযোগ দেওয়ার কথা দুর্বল চিত্তের মানুষের হৃদয়ে সুড়সুড়িও দিচ্ছে। আর সেই সম্ভাবনা থেকেই বিজেপি কোমর বেঁধে দোর্দণ্ডপ্রতাপে সময়ের বহু আগে থেকেই অর্থ ও ক্ষমতার বাহুবল নিয়ে পরিকল্পিতভাবে নির্বাচনের ময়দানে নেমে পড়েছে। তারা একটা সোরগোল তোলার চেষ্টা করছে যে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ তৃণমূল তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ছে, অতএব, বিজেপির ক্ষমতায় আরোহন এখন সময়ের অপেক্ষা মাত্র। আর এই তাণ্ডবে তাদের পূর্ণ মদত দিচ্ছে গোদি মিডিয়া।
কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি বইছে সম্পূর্ণ অন্য খাতে। আরএসএস-বিজেপি’র এজেন্ডার মূল প্রতিপাদ্যই হল, গুটি কয়েক কর্পোরেট সহায়তায় গোটা মুসলমান সমাজকে এক ঐতিহাসিক-কাল্পনিক প্রতিপক্ষ বানিয়ে তথাকথিত হিন্দু সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে তাদের ভোট নিয়ে ক্ষমতায় আসা। এতে তারা বেশ কিছু রাজ্যে সফলও হয়েছে। আর সেই কারণেই তাদের নির্বাচনী প্রচারের ইস্যু হয় – রামমন্দির, সিএএ, এনআরসি, ইস্লামোফোবিয়া, পাকিস্তান, কাশ্মীর, অনুপ্রবেশ, দেশদ্রোহিতা ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে এই পর্যন্ত যা দেখা যাচ্ছে, শত হাইপ ও দলবদল সত্ত্বেও হিন্দুত্ববাদী এই এজেন্ডাগুলোকে তারা এখনও সামনে এনে ফেলতে পারেনি। এমনকি তারা সিএএ চালু করা নিয়েও দ্বিধান্বিত, যে কারণে আইন পাশ হলেও তার নিয়মাবলী দেড় বছরেও করে উঠতে পারেনি।
আশার কথা, এই এজেন্ডা নির্মাণের পৃষ্ঠভূমিতেই বিজেপি আপাতত হেরে বসে আছে। তারা বরং দুর্নীতি, কাটমানি, বেকারত্ব – এইসব নিয়েই সোচ্চার। এরা যত এইসব এজেন্ডা নিয়ে বাধ্যত ব্যস্ত হয়ে পড়বে, ততই তাদের মাটির তলার জমি নরম হবে, সে যতই বড় বড় নেতাদের তারা অর্থ ও ভয় দেখিয়ে ভাঙিয়ে নিয়ে যাক না কেন। কারণ, এই ধরনের এজেন্ডায় নিবদ্ধ হলে তাদের যে ইউএসপি – হিন্দুত্ববাদী প্রচার – তা দুর্বল হবে। আর সে প্রচার দুর্বল হওয়া মানে তাদের আর পাঁচটা পার্টির মতোই দেখতে লাগবে। আলাদা করে নিজ বৈশিষ্ট্যে আলোকিত হতে সমস্যা হবে। অনেকে ইতিমধ্যে বলতে শুরু করেছেন, তৃণমূলের নেতা-কর্মী ভাঙিয়ে বিজেপি আরেকটা তৃণমূল (টিম বি) তৈরি করছে!
বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন মানুষদের বাস্তবতার এই জায়গা থেকেই শুরু করতে হবে যে, নির্বাচন আসতে অনেকটা দেরি থাকলেও বিজেপি অন্তত প্রথম রাউন্ডে তাদের নিজস্ব এজেন্ডা থেকে বিচ্যুত হয়েছে। তারা আপাতত খেলছে বিরোধী দলের এজেন্ডা বা টার্মস’এ। এই পরিস্থিতি আরও সুযোগ করে দিচ্ছে এমন এক গণএজেন্ডা নির্মাণের যার তোড়ে এই ফ্যাসিবাদী শক্তি বিভাজনের রাজনীতির সওয়াল করে ক্ষমতাধারী হওয়ার কোনও সুযোগই পাবে না। তাই যদু-মধু জোটের থেকেও এই মুহূর্তে দরকার মানুষের জীবন-জীবিকার আধুনিক রূপরেখার ওপর ভিত্তি করে এক জনমুখি গণএজেন্ডা তৈরি করা যা হিন্দু সমাজের মধ্যকার বৈষম্যকেও স্বীকার করে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সমস্ত শ্রমজীবী মানুষের বেঁচেবর্তে থাকার সম্মুখে যে অবরোধ, তার বিপক্ষে এক প্রতিরোধের বর্ম গড়ে তুলতে পারে। এই প্রয়াসই হতে পারে উগ্র ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের বিপক্ষে এক মোক্ষম জবাব ও লড়াই। অন্তত একটি সবল প্রথম ধাপ যা পরের লড়াইগুলিতে পুষ্টি ও সক্ষমতা জোগাবে। বিহারের সাম্প্রতিক নির্বাচন থেকে এ বিষয়ে অনেক কিছু শেখার আছে।
- অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
ভারতে সমান নাগরিকত্বের ব্যাপক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল ২০১৯-এর শেষ এবং ২০২০’র শুরুতে। সেই আন্দোলনের বিরুদ্ধে বিজেপি-আরএসএস-এর প্রতিক্রিয়া ছিল দিল্লী দাঙ্গা। পুলিশ প্রশাসনকে বসিয়ে রেখে বিজেপি-আরএসএস-এর ক্যাডার লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল মুসলমান মহল্লার ওপর। দিল্লীর জনতাকে বোঝানো হয় যে এনআরসি-বিরোধী আন্দোলন হচ্ছে হিন্দুবিরোধী ষড়যন্ত্র, হিন্দুদের মুসলমানরা মারছে।
এই দিল্লী দাঙ্গার কাণ্ডারী দিল্লীর বিজেপি নেতা কপিল শর্মা। সে একের পর এক উসকানি মূলক বক্তৃতা দিয়েছিল তা মানুষের কাছে অজানা নয়। কিন্তু দিল্লী পুলিশ যখন তাদের তদন্ত শুরু করে তারা দেখাতে চায় যে এনআরসি-সিএএ বিরোধী আন্দোলনের নেতারাই ষড়যন্ত্র করে এই দাঙ্গা করিয়েছে। একের পর এক বিজেপি-বিরোধী নাগরিক সমাজের নেতাদের জেলে পোড়া হয়। এ যেন ভীমা-কোড়েগাঁও ঘটনা এবং তদন্তের পুনরাবৃত্তি৷
এরকম বিভিন্ন দাঙ্গার ষড়যন্ত্রে অভিযুক্ত নেতাদের আইনজীবী ছিলেন মেহমুদ প্রচা৷ গত ২৪ ডিসেম্বর তার অফিসে দিল্লী পুলিশের স্পেশাল সেল তল্লাশি চালায়। ১৫ ঘণ্টা ধরে তল্লাশি চলে৷ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ যে সে নোটারি অনুমোদিত কাগজে জাল সই করিয়েছে এবং দিল্লী দাঙ্গা কেসে একজন ব্যক্তিকে ভুল সাক্ষ্য দিতে জোর করেছে।
এই তল্লাশির ফলস্বরূপ প্রচার সাথে তার ক্লায়েন্ট দের যা যা কথোপকথন হয়েছিল তা পুলিশের হাতে চলে গেল। ভারতীয় আইন ব্যবস্থার ভিত্তি হল উকিল-ক্লায়েন্টের ভেতর কথোকথন সম্পূর্ণ গোপনীয় থাকবে। এই ক্ষেত্রে সেই ভিত্তিতেই আঘাত হানা হল। উকিলদের এক অংশের দাবি যে সরকার বিরোধী পক্ষের উকিলদের অফিসে তল্লাশি করার অর্থ হল দেশে আর আইনের শাসন নেই। সরকার যেই সময় বিরোধী নেতাদের জেলে ঢোকাচ্ছে, সেই একই সময় উকিলদের অধিকারের ওপর এই হামলা বোঝায় যে দেশে আইনি ব্যবস্থার হাল শোচনীয়। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল যে একজন জাজ এই তল্লাশির অনুমতি পুলিশকে দিয়েছে।
এই ওয়ারেন্টে যদিও বিশেষ কিছু কাগজের তল্লাশি নেওয়ার অনুমতি ছিল। কিন্তু দিল্লী পুলিশ প্রচার কম্পিউটারের সমস্ত নথির তল্লাশি চালিয়েছে যা বেআইনি।
- প্রত্যুষ নন্দী
২০২০’র সেপ্টেম্বরে মোদী সরকার নিচে বর্ণিত এই তিনটি নয়া কৃষি আইন নিয়ে আসে।
অত্যাবশ্যকীয় পণ্য (সংশোধনী) অধ্যাদেশ, ২০২০’র মাধ্যমে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য অর্থাৎ দানাশস্য (চাল/গম), ডাল জাতীয় শস্য, আলু, পেঁয়াজ, ভোজ্য তেল ও তৈলবীজ মজুতের ওপর বিধিনিষেধ তুলে নেয়।
কৃষকদের উৎপাদিত দ্রব্যের ব্যবসা ও বাণিজ্য (প্রচার ও সহায়তা) অধ্যাদেশ ২০২০’র দ্বারা এপিএমসি বাজারের (মান্ডি) চৌহদ্দির বাইরে কৃষকদের উৎপাদিত দ্রব্যের ব্যবসার উপরে জারি থাকা বিধিনিষেধকে সরিয়ে দিয়েছে। এটি এপিএমসি অঞ্চলের বাইরে চলা ব্যবসার উপর কোনো বাজার ফি, সেস বা শুল্ক আরোপ করতে রাজ্য সরকারগুলিকে নিবৃত্ত করছে।
কৃষকদের (ক্ষমতায়ন ও সুরক্ষা) ফসলের দাম সংক্রান্ত চুক্তি ও কৃষি পরিষেবা অধ্যাদেশ, ২০২০ কৃষক ও কর্পোরেশনগুলির মধ্যে চুক্তিভিত্তিক চাষের একটি রূপরেখা প্রবর্তন করে। এতে উৎপাদিত ফসলের মূল্য নির্দিষ্টকরণের কোনো পদ্ধতি থাকছে না।
ভারতবর্ষের কৃষকেরা এই আইনের বিরোধিতা করছেন। তাঁদের বিরোধিতার জায়গাগুলি হল, এই আইন ভারতীয় কৃষিক্ষেত্রের সমগ্র চেহারা পাল্টে দেবে। কৃষকদেরকে কোম্পানি/কর্পোরেশনের করুণার পাত্র করে সরকার সমস্ত দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়ে নেবে। কৃষিক্ষেত্রে কোম্পানিরাজ প্রতিষ্ঠা করে কৃষকদের সমূহ ক্ষতির দিকে ঠেলে দেওয়া এই আইনগুলো কোভিড১৯ পরিস্থিতিতে মোদী সরকারের অত্যন্ত চালাকিতে কোনো কৃষক সংগঠনের পরামর্শ ও পার্লামেন্টে কোনো প্রকার ভোটাভুটি ছাড়াই বলপূর্বক পাশ করানো হয়। প্রধানমন্ত্রীর কথা মতো সরকার “সংকটকে সুযোগে পরিণত করে” কোভিড পরিস্থিতির সদ্ব্যবহার করে গণতন্ত্রকে বিকৃত করতে এবং কৃষকদের উপর কৃষক বিরোধী এই আইন চাপিয়ে ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ও এপিএমসির (মান্ডি) বিদ্যমান কাঠামোটি ভেঙে দিতে উদ্যত হল এবং বেসরকারী সংস্থাগুলিকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য মজুত করে একচেটিয়াকরণ ও বাজার নিয়ন্ত্রণের অনুমোদন দিলো।
কৃষকরা ফসলের উৎপাদন খরচের দেড়গুণ গ্যারান্টিযুক্ত ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) ও কিষাণ মাণ্ডিগুলোর সম্প্রসারণ ও উন্নতি ঘটিয়ে সরকার কর্তৃক ফসল কেনার দাবিতে আন্দোলন করছেন। পরিবর্তে, সরকার কৃষকদের এমএসপি প্রদানের দায় ঝেড়ে ফেলছে এবং মান্ডি ব্যবস্থা ধ্বংসের পথ সুগম করছে। ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে দুর্বল করে এই আইন রাজ্য সরকারগুলিকে কৃষকদের সুরক্ষা দেওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে যা ঘটনাক্রমে শেষ পর্যন্ত কৃষকদেরকে জমি থেকে উচ্ছেদ করে কার্যত তাঁদেরকে কোম্পানিগুলোর কৃষি-ব্যবসার অনৈতিক দাস বানাবে।
এই আইনের আওতায় কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের কোনও আধিকারিকের দ্বারা করা কোনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোনও নাগরিককে আদালতে যেতে বাধা দিয়ে কোম্পানিরাজ চাপায়! অর্থাৎ নাগরিকরা দুর্নীতিগ্রস্ত ও কৃষক ও নাগরিক স্বার্থ অবহেলা করে কর্পোরেটদের সুবিধা করে দেওয়া কোনও সরকারী অফিসারের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার চাইতে পারবেন না, কারণ অভিযুক্ত অফিসার দাবি করতে পারেন যে তিনি কৃষি আইন কার্যকর করার ‘মহৎ উদ্দেশ্যে’ কাজ করেছিলেন! এটি মূলত জরুরি অবস্থা চাপানো এবং কোম্পানি ও সরকারের দুর্নীতিগ্রস্ত আঁতাতের সুরক্ষা ও প্রচারের সামিল।
তবে নতুন আইন কি কৃষকদের পছন্দমতো স্বাধীনতা এবং এপিএমসি একচেটিয়াপনা থেকে নিষ্কৃতি দেবে না? এই প্রতিযোগিতা কি তাদের ফসলের উন্নত বাজারদর আনবে না?
সরকার দাবি করছে যে, নতুন আইনের বলে নাকি কৃষকরা নিয়ন্ত্রিত এপিএমসি বাজারের বাইরে এমএসপির চেয়ে বেশি দাম পেতে পারে; এবং যদি তা না করে তবে তারা নিয়ন্ত্রিত এপিএমসি মার্কেটে এমএসপিতে তাদের পণ্যগুলি বিক্রি করতে পারে।
ঘটনাপ্রবাহ এই দাবিকে মিথ্যা প্রমাণ করছে।
বেশিরভাগ ফসল যা সরকার কর্তৃক সংগ্রহ করা হয় না, তা ইতিমধ্যে খোলা বাজারে বিক্রি হয়েছে এবং স্বভাবতই বাজারগুলি এমএসপির তুলনায় চাষীদের জন্য কম দাম নিয়ে আসে।
মাত্র ৩৬ শতাংশ কৃষকের উৎপাদিত শস্য মান্ডিতে এবং বাকি সবার ফসলের গন্তব্য হয় বাইরের বেসরকারী বাণিজ্যে।
সরকার ২৩টি ফসলের জন্য এমএসপি ঘোষণা করেছিল কিন্তু এপিএমসি বাজারগুলিতে স্থির এমএসপি মূল্যে সরকার প্রধানত কেবল ধান ও গম (এবং কিছু তুলা, সয়াবিন, ডাল, সরিষা) সংগ্রহ করেছে।
২৩টি পণ্যের বাজারমূল্য সাধারণত ঘোষিত এমএসপি’র চেয়ে অনেক কম থাকে। সুতরাং, সরকার যে পণ্য ক্রয় করে না সেসব কৃষকদের কম দামে বিক্রি করা ছাড়া উপায় নেই। উদাহরণস্বরূপ, ভুট্টার জন্য এমএসপি – কুইন্টাল প্রতি ১,৮৫০ টাকা, কিন্তু এটা কৃষকদের কাছে বাজার মূল্যে বিক্রি ছাড়া আর কোনও বিকল্প নেই, ফলে তারা প্রতি কুইন্টাল ৮০০ থেকে ১০০০ টাকার মধ্যে বিক্রি করতে বাধ্য হন।
ভারতের কোথাও কৃষকরা এপিএমসি’র বাইরে ফসল বিক্রি করার স্বাধীনতা চেয়েছিলেন বলে দাবি করছেন না (এই স্বাধীনতা আগেও ছিল)! বাজারগুলি কৃষকদের ন্যায্য মূল্য দিতে ব্যর্থ হচ্ছিল এবং সেই কারণেই তারা এমএসপিতে সমস্ত ফসলের সরকারী সংগ্রহের দাবি জানিয়েছিলেন যা উৎপাদন ব্যয়ের দেড়গুণ [সি২ এর উপর ৫০% মুনাফা (সি২ খরচায় জমি ভাড়াসহ অন্যান্য খরচ অন্তর্ভুক্ত)]। পরিবর্তে, সরকার এমনকি বিদ্যমান এমএসপি ও এপিএমসি মান্ডিগুলিও কেড়ে নিচ্ছে!
তদুপরি, ভারতের ৮০ শতাংশেরও বেশি কৃষক ২ হেক্টরের চেয়ে কম জমির মালিক। এই ক্ষুদ্র কৃষকরা ফসল সংরক্ষণ বা পরিবহনের জন্য পরিকাঠামোগত সামর্থ্য রাখতে পারেন না (যদি সরকার ফসল সংগ্রহ না করে) তাই তাঁরা শস্য নষ্ট হওয়ার আগেই তা বিক্রি করার চাপে থাকেন। কেবলমাত্র ফসল কাটার পরে তা বিক্রি করেই তাঁরা তাঁদের ঋণ পরিশোধ করতে ও পরবর্তী চাষের প্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতে পারেন। এত কঠোর সময়সীমার মধ্যে তাঁরা ফসল বিক্রি করতে নিকটস্থ মান্ডিতে যান। যদি কোনও মান্ডি ও এমএসপির বন্দোবস্ত না থাকে তবে কৃষকরা তাঁদের দোরগোড়ায় এসে কিনতে পারে এমন কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে বিক্রি করতে বাধ্য হবেন।
সুতরাং, কর্পোরেশনগুলিতে কৃষকদের ফসল বিক্রয় করার ‘স্বাধীনতা’ দেওয়া থেকে দূরস্ত বরং এই আইনগুলি কৃষকদের কর্পোরেটদের করুণার মুখাপেক্ষী করে তুলবে
(লিবারেশন, জানুয়ারী ২০২১ সংখ্যায় প্রকাশিত প্রচ্ছদ নিবন্ধের একটি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ)
৩ জানুয়ারী ২০২১ ছিল সাবিত্রীবাই ফুলের ১৯০তম জন্মবার্ষিকী। ভারতে নারীশিক্ষা ও জাতবিরোধী লড়াইয়ের অগ্রদূত সাবিত্রীবাই। দেশজুড়ে মেয়েরা ঐদিন প্রতিবাদী জমায়েত সংগঠিত করে ভালোবাসা-বিরোধী ও কৃষক-বিরোধী আইনগুলি প্রত্যাহারের দাবিতে। উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটক সহ বিভিন্ন রাজ্যের বিজেপি সরকারগুলি কোথাও ইতিমধ্যেই আইন এনেছে বা আইন আনার প্রকৃয়া শুরু করেছে ধর্ম-পরিচিতির গণ্ডির বাইরে ভালোবাসা ও বিবাহকে নিষিদ্ধ করতে। এই আইনগুলি নাৎসি জার্মানির ‘রক্তের বিশুদ্ধতা’ আইনের অনুকরণে লাগু হচ্ছে এবং এগুলি নারীস্বাধীনতার ওপর এবং মুসলমান নারী-পুরুষের সমমর্যাদা ও সমানাধিকারের ওপর হিংস্র আক্রমণ। সারা দেশে কৃষকেরা তিনটি কৃষক-বিরোধী আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে। ভালোবাসা-বিরোধী ও কৃষক-বিরোধী এই আইনগুলি ভারতের সংবিধানের ওপর আক্রমণ।
৩ জানুয়ারী থেকে ৯ জানুয়ারী সাবিত্রীবাই ও তার সহযোদ্ধা তথা সহশিক্ষিকা ফতিমা শেখের স্মরণে ব্রাহ্মণ্যবাদ, পিতৃতন্ত্র ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সারাভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি (সাভাপ্রমস) অভিযানের ডাক দেয়। বিজেপি ও আরএসএস আজ সাবিত্রী-ফতিমার বন্ধুত্ব, ঐক্য ও প্রগতিশীল মূল্যবোধের ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সাবিত্রী ও ফতিমা তাঁদের দুঃসাহসিক জীবন ও সংগ্রামে যে অধিকার অর্জন করেছিল তা রক্ষা করতে শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছে সাভাপ্রমস।
বিহারের সবকটি জেলায় এবং পাটনা শহরের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিবাদসভা সংগঠিত হয় যেখানে বালিকা ও মহিলারা জমায়েত হয় ও সাবিত্রী-ফতিমার স্মরণে গ্রন্থাগার গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বারানসী শহরে সাভাপ্রমসের কর্মীরা গভমেন্ট গার্লস স্কুলের ছাত্রীদের সাথে এক আলোচনার আয়োজন করে তাদের ব্রাহ্মণ্যবাদ, পিতৃতন্ত্র ও সাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কে বোধ গড়ে তোলার জন্য চর্চা চালায়। রাজস্থানের উদয়পুরে সাভাপ্রমসের নেতৃত্বে অনুরূপ শপথ নেওয়া হয়।
৩ জানুয়ারী ছিল সংবিধানসভার অন্যতম সদস্য জয়পাল সিং মুণ্ডারও জন্মবার্ষিকী, যিনি দলিত আদিবাসী ও মহিলাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিশেষ সোচ্চার ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে আইসা ও সাভাপ্রমস একযোগে প্রতিবাদ সভা সংগঠিত করে। সিপিআই(এমএল) বাঁকুড়া জেলা কমিটির সদস্য ফারহান হোসেন খান, আইসা নেতা বিল্টু ক্ষেত্রপাল ও ক্লাস সেভেনের ছাত্রী আসপিয়া খাতুন সাবিত্রীবাই ও ফতিমার জীবন ও সংগ্রাম ও জয়পাল সিং মুণ্ডার কথা তুলে ধরে সেই সংগ্রাম এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন।
কলকাতায় ৬ জানুয়ারী যাদবপুরের মন্ডলপাড়া ও ঢাকুরিয়ার গাঙ্গুলিপুকুরে দুটি আলোচনা সভা হয়। মণ্ডলপাড়ায় কমরেড মমতা ঘোষের নেতৃত্বে আলোচনা চলে। সাবিত্রীবাই ফুলে ও ফতিমা শেখের বিপ্লবী ঐতিহ্যো ও আদর্শের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে মূখ্য বক্তা ছিলেন কল্যাণী ঠাকুর চাড়াল। তিনি বলেন, ভারতের ইতিহাস চর্চা সাধারণত উচ্চবর্গের মনীষীদের নিয়েই সীমিত থাকে, বাবসাহেব আম্বেদকার বা হারচাঁদ গুরুচাঁদ বা জোতিরাও ফুলে সাবিত্রীবাই ফুলেদের কী ভুমিকা ছিল ভারতের ইতিহাসে তা নিয়ে চর্চা করা দরকার। তিনি দলিতদের নিপীড়নের ইতিহাস তুলে ধরেন। ভীমা কোরেগাঁওয়ের কথা বললেন। এই বাংলাতেও যে নীচু জাতের মানুষদের ছায়া মারান হত না এইসব কথা বলতে গিয়ে তিনি তার নিজের পারিবারিক অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। ভাষার মধ্যে লুকিয়ে থাকা জাতিহিংসার কথা বলেন এবং সাবিত্রীবাই ফুলের জীবন ও সংগ্রামের কথা তুলে ধারেন। সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির রাজ্য সম্পাদিকা ইন্দ্রাণী দত্ত সহ অন্যান্য বক্তারা সাবিত্রী-ফতিমার ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের ঐতিহ্য রক্ষার আহ্বান রাখেন ও ভালোবাসা-বিরোধী আইন ও কৃষক-বিরোধী আইনগুলি প্রত্যাহারের দাবি তোলেন।
হাথরাসের ক্ষত এখনও দগদগে। তিন মাসের মধ্যেই, উত্তর প্রদেশের বদায়ুঁ জেলার উঘৈতি গ্রামে মাঝবয়সী এক অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীকে গত রবিবার সন্ধ্যায় নারকীয় হিংস্রতায় গণধর্ষণ ও খুন করা হয়েছে। মহিলা রোজকার মতো গ্রামের মন্দিরে পুজো দিতে গিয়ে আর ফেরেননি। পরে বাড়ির কাছে তার রক্তাক্ত সংজ্ঞাহীন দেহ মেল। হাসপাতালে নিয়ে গেলেও তাকে বাঁচানো যায়নি। পরিবারের অভিযোগ, উঘৈতি থানার স্টেশন অফিসার এই ঘটনায় কোনো গুরুত্ব দেননি এবং চরম পুলিশি গাফিলতিতে মৃত্যুর ১৮ ঘন্টা পর দেহ ময়নাতদন্তে যায়। প্রশাসন সূত্রে খবর, ময়নাতদন্তের রিপোর্টে জানা গেছে, গণধর্ষণের পর যৌনাঙ্গে লোহার রড ঢুকিয়ে নির্যাতন করায় অবিরাম রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু ঘটেছে। শুধু তাই-ই নয়, বুকে ভারি পাথরের আঘাতে তার পাঁজরের হাড় ভেঙেছে। এক পায়ের হাড়ও ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এই ঘটনায় মন্দিরের পুরোহিত ও তার দুই সঙ্গীর বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও হত্যার মামলা দায়ের হয়েছে। দুই অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হলেও মূল অভিযুক্ত পুরোহিত বাবা মোহান্ত সত্যনারায়ণ এখনও পলাতক। কর্তব্যে গাফিলতির জন্য স্টেশন অফিসার রাবেন্দ্রপ্রতাপ সিং-কে সাসপেণ্ড করা হয়েছে।
উত্তর প্রদেশ সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি (সাভাপ্রমস)-এর রাজ্য সভানেত্রী কৃষ্ণা অধিকারী এবং রাজ্য সম্পাদিকা কুসুম বর্মার এক যৌথ বিবৃতিতে এই মর্মন্তুদ ঘটনায় গভীর দুঃখ প্রকাশ করে পরিবারকে সমবেদনা জানানো হয়েছে ও পাশে থাকার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনের অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টার বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ জানিয়ে অবিলম্বে দোষীদের গ্রেফতার করে কঠিনতম শাস্তি দাবি করা হয়েছে। একই সঙ্গে বার বার এইসব ন্যক্কারজনক ঘটনার জন্য আইন শৃঙ্খলার চরম অবনতিকে দায়ী করে যোগী সরকারের পদত্যাগের দাবি জানানো হয়েছে। বিবৃতিতে আগামী ৯ জানুয়ারী রাজ্য জুড়ে উপরি উক্ত দাবিতে সর্বত্র বিক্ষোভ প্রদর্শনের আহ্বান রাখা হয়েছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ‘সন্ন্যাসী’ মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ, যিনি হিন্দু মেয়েদের ধর্মান্তর ও ‘সম্ভ্রম’ রক্ষার্থে তথাকথিত লাভ জিহাদের বিরুদ্ধে ‘অবৈধ ধর্মান্তর প্রতিরোধ আইন’ এনে শুধু ক্ষান্ত হননি, মুসলিম যুবকদের ‘রাম নাম সত্য হ্যায়’-এর হুমকিও দিয়ে রেখেছেন, তার প্রশাসন একের পর এক উচ্চ বর্ণের হিন্দুর দ্বারা দলিত কন্যা, দরিদ্র মহিলাদের গণধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় অপরাধীদের আড়াল করে চলেছে। কেন যে তিনি বলেন ‘শূদ্র নারী অচ্ছুত, কিন্তু তার যোনি পবিত্র’ এবং ‘মুসলিম মেয়েদের কবর থেকে তুলে ধর্ষণ করা উচিত’ — তা অত্যন্ত পরিষ্কার। তিনি বর্ণবিদ্বেষী তো বটেই, তিনি আদ্যন্ত নারী বিদ্বেষী; তার রাজ্যের মাথায় তাই নারী নির্যাতনে একনম্বরের শিরোপা। তিনিই হলেন বিজেপি তথা আরএসএস-এর ‘মডেল’ মুখ্যমন্ত্রী!
অবৈধ ধর্মান্তর প্রতিরোধ আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে এবং এটির মাধ্যমে যে উত্তর প্রদেশ সরকার ঘৃণা, হিংসা ও গণ-উন্মাদনা ছড়াচ্ছে সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে আইনজীবী বিশাল ঠাকরে এবং সমাজকর্মী তিস্তা শেতলবাদ সুপ্রিম কোর্টে আইনটি স্থগিত করার আবেদন জানিয়েছিলেন। কিন্তু প্রধান বিচারপতি এস এ বোবড়ের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ আপাতত সেই আবেদন রাখেনি তবে উত্তর প্রদেশ ও উত্তরাখণ্ড সরকারকে এবং কেন্দ্রকেও এই বিষয়ে তাদের বক্তব্য জানানোর জন্য নোটিস ইস্যু করেছে। চার সপ্তাহ পর ফের শুনানি। তারপরই বোঝা যাবে সংবিধান-বিরোধী এই আইন আইনি পথে আদৌ বাতিল হবে কি না, রাস্তার আন্দোলন অবশ্য্য চলবে।
- জয়ন্তী দাশগুপ্ত
প্লেটো বলেছিলেন – প্রেমের পরশে প্রত্যেকে কবি হয়ে ওঠে! দুটি মানুষের মধ্যে পরস্পরের প্রতি মুগ্ধতা, বিশ্বাস, মর্যাদায় অভিষিক্ত ‘প্রেম’ ঊষর জীবনের ধূসরতা মুছে, জীবনকে করে তুলতে পারে এক রম্য উপত্যকা! বিশ্ব সাহিত্যের কালজয়ী সৃষ্টির পাতায় পাতায় এমন হর-হামেশা ঘটেছে।কিন্তু ‘প্রেমের’ এই অমোঘ মানবিক শক্তিতে ওরা বিশ্বাস করে না, ওদের ভরসা, ঘৃণা আর বিদ্বেষের বিধ্বংসী দানবীয়তায়। তাই প্রেমের সঙ্গে অনায়াসে ওরা জুড়ে দিতে পারে ঘৃণাকে। ওরা মানে বিজেপি এবং সঙ্ঘ পরিবার। প্রায় এক দশক আগে তাদের আমদানি করা এক শব্দবন্ধ ‘লাভ জিহাদ’ যার গৈরিক ভাষ্য হল – ‘প্রেমের অছিলায় ধর্মান্তরকরণ’। হিন্দু নারী এবং মুসলিম পুরুষের প্রেমজ বিবাহের পিছনে তারা খুঁজে পেয়েছে ইসলামের সংগঠিত উদ্যোগে ধর্মান্তরকরণের গূঢ় অভিসন্ধি! মানবাধিকার ও মহিলা সংগঠনগুলির মতে ‘লাভ জিহাদ’ আসলে ইসলাম-বিদ্বেষের এক তত্ত্ব। তার সঙ্গে, নারীর অধিকারের উপর পিতৃতান্ত্রিক কর্তৃত্ব চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র।
উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, হরিয়ানা ও কর্ণাটকের বিজেপি সরকার ‘লাভ জিহাদ’-এর বিরুদ্ধে আইন আনার হুমকি দিয়েছে। তার প্রস্তুতিও চলছে। যোগী সরকার ইতিমধ্যেই এক অর্ডিন্যান্স জারি করেছে ‘উত্তরপ্রদেশ বিধিবিরুদ্ধ ধর্ম পরিবর্তন প্রতিষেধ অধ্যাদেশ’। আন্তঃধর্ম বিয়ের ক্ষেত্রে ধর্ম পরিবর্তন করলে দশ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। কিন্তু হঠাৎ তাদের এই রণহুঙ্কার কেন? এই অভিযোগের বাস্তব ভিত্তি আদৌ আছে কি? এই অর্ডিন্যান্স তথা আইন আদৌ বৈধ?
সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির সম্পাদক বামপন্থী নেত্রী কবিতা কৃষ্ণান মনে করেন, ‘লাভ জিহাদ’ হিন্দুত্ববাদীদের মনগড়া একটি ধারণা। হিন্দুত্ববাদীরা বিয়ের ক্ষেত্রে নারীর পছন্দ-অপছন্দ এবং সম্মতির প্রতি কোনো শ্রদ্ধা দেখায় না। বামপন্থী নেত্রী বৃন্দা কারাত লাভ-জিহাদ বিরোধী এই অধ্যাদেশের সঙ্গে ১৯৩৪ সালে নাৎসী জার্মানিতে হিটলারের আনা ইহুদি-বিরোধী আইনের তুলনা করেছেন, যে আইনে ইহুদিদের সঙ্গে আর্য বংশোদ্ভূতদের বিয়ে ও যৌন সম্পর্ক নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। মুসলিম সমাজকে সন্ত্রস্ত রাখা, ধর্মীয় মেরুকরণের মাধ্যমে হিন্দুভোট আকর্ষণ করা, নারীর স্বাধিকার, স্বায়ত্ততার দাবিকে নাকচ করা এবং সবচেয়ে জরুরি বিষয় হল, আরও দ্রুত ‘এক জাতি এক রাষ্ট্র’ – ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ গঠনের পথে এগিয়ে যাওয়া যার সংবিধান হবে মনুস্মৃতিনির্ভর। সম্ভবত এই উদ্দেশ্যেই এই রণহুঙ্কার। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানিয়েছে, ভারতে ‘লাভ জিহাদ’-এর ঘটনা কাল্পনিক।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জি কিষাণ রেড্ডি, কেরালার কংগ্রেস নেতা বেণি বেথনানের এক প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছেন, এই শব্দবন্ধ ‘লাভ জিহাদ’কে আইনে সংজ্ঞায়িত করা নেই। কোনো কেন্দ্রীয় সংস্থাই লাভ জিহাদের কোনো কেস দায়ের করেনি। ছত্তিশগড়ের মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বাঘেলার মতে, সমাজকে সাম্প্রদায়িক করে তুলতেই ‘লাভ জিহাদ’-এর মতো পদক্ষেপ আমদানি করা হয়েছে। রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী গেহলট বলেছেন, দেশে সাম্প্রদায়িক সদ্ভাব নষ্ট করতে এবং দেশের মধ্যে বিভাজন আনতেই এই পদক্ষেপ। ভালোবাসায় জিহাদের স্থান নেই। বিবাহ মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতার বিষয়। এই বিষয়ে আইন আনা সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক এবং এই আইন কোনো আদালতে গ্রাহ্য হওয়ার কথা নয়।
অল ইন্ডিয়া ল’ইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলির ‘লাভ জিহাদ’ অর্থাৎ আন্তঃধর্ম বিবাহের বিরুদ্ধে আইন আনার হুমকিকে ধিক্কার জানিয়েছে। এই সংগঠন মনে করে, সরকারের এই সাম্প্রদায়িক বিভাজনের তত্ত্বকে পরিহার করে বরং তথাকথিত ‘সম্মানরক্ষা’র নামে যে ভিন্ন জাত ও সম্প্রদায়ের মধ্যে বিয়ের ক্ষেত্রে দম্পতিদের বেপরোয়াভাবে হত্যা করা হচ্ছে ,তাদের বিরুদ্ধে হিংসার আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে সেইসব অপরাধের বিরুদ্ধে আইন বলবৎ করা উচিত যেটা ‘শক্তিবাহিনী বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া এবং অন্যান্য’ (AIR ২০১৮ SC ১৬০১) মামলায় সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিল। এই সংগঠনের মতে ভিন্ন ধর্মে বিবাহকে ঐ সাম্প্রদায়িক শব্দে চিহ্নিত করে সংবিধানের ১৪, ২১ এবং ২৫ নং ধারাকে লঙ্ঘন করা হয়েছে। এই ধারাগুলি একজন ব্যক্তি মানুষের সমানাধিকারের, মর্যাদার সঙ্গে বাঁচার, স্বাধীন ধর্মাচরণের, নিজের পছন্দমতো কাউকে ভালোবাসার এবং বিয়ে করার অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। সুতরাং ঐ গেরুয়া ভাষ্য সরাসরি দেশের সংবিধান এবং ব্যক্তিস্বাধীনতাকে আঘাত করেছে। সংগঠন আরও উল্লেখ করেছে, ‘শাফিন জাহান বনাম অশোকান কেএম এবং অন্যান্য’ [(২০১৮) ১৬ এস সিসি ৩৬৮] মামলার রায়, সাধারণ্যে যা ‘হাদিয়া রায়’ বলে পরিচিত সেই রায়ে বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড় পরিষ্কার বলেছেন “পোশাক এবং খাদ্য, মত এবং মতাদর্শ, ভালোবাসা এবং যৌথজীবনের মতো বিষয়গুলি ব্যক্তিগত পরিচয়ের মূল অভিব্যক্তিগুলির মধ্যে পড়ে – আমাদের জীবনসঙ্গী নির্ধারণে সমাজের কোনো ভূমিকা নেই।” এআইএলএজে বিজেপি’র ঐ সাম্প্রদায়িক পদক্ষেপের বিরোধিতায় ‘আনিস হামিদ বনাম কেরালা রাজ্য’ মামলায় কেরালা হাইকোর্টের রায়কেও তুলে ধরেছে : “রাজ্যে প্রত্যেকটি আন্তঃধর্ম বিবাহকে হয় লাভ জিহাদ নয় ঘর ওয়াপসি বলে উত্তেজনা সৃষ্টির সাম্প্রতিক প্রবণতায় আমরা গভীর মর্মাহত। দেশের কয়েকটি অঞ্চল থেকে দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দেওয়ার মতো খবর আসছে যে যেসব তরুণ তরুণী ভিন্ন জাতে-ধর্মে বিয়ে করছে তাদের হয় হিংসার হুমকি দেওয়া হচ্ছে অথবা তাদের উপর হিংসার ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। আমরা মনে করি, এই হিংসা বা হুমকি বা হেনস্থার যেকোনো ঘটনা সম্পূর্ণভাবে অবৈধ এবং যারা এসব করছে তাদের কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত। এটা স্বাধীন এবং গণতান্ত্রিক দেশ আর কোনো মানুষ, নারী অথবা পুরুষ, প্রাপ্তবয়স্ক হলে তার যাকে পছন্দ তাকেই বিয়ে করতে পারে।”
বিচারালয়ের আরও মন্তব্য – এইসব হত্যায় ‘সম্মানের’ কোনো প্রশ্নই নেই, যা আছে তা হল সামন্ততান্ত্রিক নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা। এই ব্যাপারে কোর্টের নির্দেশ ও সুপারিশগুলি মানার ক্ষেত্রে সরকার চূড়ান্ত ব্যর্থ বলেই সংগঠনটি মনে করে। বস্তুত, ভালোবাসার জন্য জাতি, ধর্ম ও লিঙ্গের সীমানা পেরিয়ে এইসব প্রেমিকযুগল প্রচলিত সমাজ কাঠামোর অনমনীয়তার জগদ্দল পাথরটাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন এবং আমাদের গোটা সমাজের জন্য পরিসরকে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। অর্থাৎ তথাকথিত ‘লাভ জিহাদ’-এর কোনো বাস্তব বা আইনগত ভিত্তি নেই। আর তার বিরুদ্ধে আনা আইন সংবিধান-বিরোধী।
এবার নারীর প্রতি ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্বের ধ্বজাধারীদের অবস্থানের প্রতি একটু দৃষ্টিপাত করা যাক।
মনুস্মৃতি শাসিত ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতান্ত্রিক সমাজের কাছে নারীর ‘প্রেম’ প্রার্থিত নয়। নারী অল্পবুদ্ধি, চপলমতি, অশুচি, নরকের দ্বার; তাই তারজন্য শিক্ষা সম্পত্তির অধিকার, রাজনৈতিক মতপ্রকাশের অধিকার নয়! তার প্রাণরসটুকু নিংড়ে নাও সংসার প্রতিপালনে, পরিজনের পরিচর্যায়! প্রয়োজনে তার মেধা, লাবণ্য, সৌন্দর্যটুকু শুষে নাও, ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রিক স্বার্থের চরিতার্থতায়। কিন্তু তার জন্য মর্যাদা, বিশ্বাস, অধিকার – নৈব নৈব চ!
পিতৃতন্ত্র সব সময়েই নারীর উপর অনৈতিক কর্তৃত্ব চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। প্রাচীনা পৃথিবী হাজার হাজার বছরের সূর্যপ্রদক্ষিণে তারই সাক্ষী থেকেছে যুগে যুগে – নানা দেশে, নানা ধর্মে, নানা সমাজে। তাই ইভকে শাস্তি পেতে হয়, সীতাকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়, দ্রৌপদীকে প্রেমিক অর্জুন ছাড়াও আরও চারজনের শয্যাসঙ্গিনী হতে হয়, পাশাখেলায় বাজি থাকতে হয় ও ‘রক্ষক’ পাঁচ ‘স্বামী’র চোখের সামনেই চরম লাঞ্ছিতা হতে হয়, খনার জিভ কাটা যায়, জোয়ান অব আর্ককে প্রকাশ্য বিচারসভায় পুড়ে মরতে হয় – তালিকা অনেক অনেক দীর্ঘ হতে পারে। থাক।
অষ্টমবর্ষীয়ার সঙ্গে অষ্টআশির বৃদ্ধের বিয়ে দিয়ে কৌলীন্য রক্ষা, স্বামীর চিতায় স্ত্রীকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা ইত্যাদি কুৎসিত ধর্মীয় অনুশাসন তথা সামাজিক বিধানের বিলুপ্তির জন্য ভারতীয় নারী সমাজ রামমোহন, বিদ্যাসাগরের কাছে চিরঋণী। ভগিনী নিবেদিতা, বেগম রোকেয়া, জ্যোতি রাও ফুলে, সাবিত্রী বাঈ ফুলে, বেথুনের মত অজস্র সমাজ সংস্কারক, চিন্তাবিদ, শিক্ষাবিদের কাছেও তাদের আজকের অবস্থানের জন্য তারা অশেষ ঋণী। অনেক কঠোর সংগ্রামের মধ্য দিয়েই নারী আন্দোলন সমৃদ্ধ হয়েছে, পরিণত হয়েছে। নারীর সমানাধিকার সংবিধান-স্বীকৃত হয়েছে। আর এই জন্য তারা বাবা সাহেব ভীমরাও আম্বেদকরের কাছে চিরকৃতজ্ঞ। বাবা সাহেব দেখেছিলেন, মনুবাদী হিন্দু সমাজ নারী ও শূদ্রদের প্রতি কতটা নির্মম, নিষ্ঠুর এবং ক্রূর! নারীকে আর্থিকভাবে সবল না করলে তাদের এই হীন অবস্থা থেকে মুক্তি আদৌ সম্ভব নয়। এজন্য হিন্দু সমাজের সংস্কার দরকার। আর সেই উদ্দেশ্যে তিনি ‘হিন্দু কোড বিল’ প্রণয়ন করেন। অনেক জলঘোলার পর ১৯৫১-তে, স্বাধীনতার পর প্রথম আইনমন্ত্রী হিসেবে তা সংসদে পেশ করেন প্রধানমন্ত্রী নেহরুর সমর্থন ও সহযোগিতায়। এই বিলে হিন্দু নারীর বিবাহবিচ্ছেদ ও খোরপোষের অধিকার, স্বামীর ও পৈতৃক সম্পত্তির অধিকার, হিন্দু পুরুষের বহুবিবাহ রদের কথা বলা হয়। কিন্তু আরএসএস-সহ হিন্দু মৌলবাদীদের সংসদের ভিতরে ও বাইরে তীব্র বিরোধিতায় সে বিল পাস করা তো দূরের কথা, প্রত্যাহার করে নিতে হয়। ক্ষোভে, দুঃখে, অপমানে বাবা সাহেব মন্ত্রীপদে ইস্তফা দেন। পরে ১৯৫৬ থেকে চারটি পর্যায়ে বিলটি আইন হিসেবে পাস হয়। নারীর সংবিধান-প্রদত্ত সেই অধিকারগুলিই হরণ করে বিজেপি-আরএসএস আবার তাদের কয়েকশো বছর আগেকার পুরোনো অবস্থানে ঠেলে দিতে মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে। এ সম্পর্কে সারা ভারত মহিলা সমিতির অভিমত তথা প্রতিবাদ প্রণিধানযোগ্য। এই সংগঠন খুব বলিষ্ঠভাবে জানিয়েছে, আম্বেদকরের সংবিধানে বিশ্বাসী ভারতে এই আইনের (তথাকথিত লাভ জিহাদ বিরোধী আইন) কোনো ঠাঁই নেই ।
অ্যাপোয়া মনে করে, সারা ভারতবর্ষে লাভ-জিহাদের কোনো অস্তিত্বই নেই। বরং দেশের তরুণ সম্প্রদায় প্রেমের ক্ষেত্রে জাত-ধর্মের বেড়া ডিঙিয়ে যে নিজেদের স্বাধীন অবস্থানকে সাহসের সঙ্গে তুলে ধরছেন, গোটা দেশের স্বার্থে তাকে স্বাগত জানানো উচিত। কারণ ঐ মারাত্মক আইনের মাধ্যমে ভালোবাসার বিরুদ্ধে পিতৃতান্ত্রিক হিংসাতাড়িত তথাকথিত ‘সম্মানরক্ষা’র অপরাধের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হচ্ছে।
তারা আরও বলেছেন, মনুবাদী পিতৃতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আম্বেদকর যে হিন্দু কোড বিল এনেছিলেন, যা ভারতীয় নারীর স্বাধীনতা ও সমানাধিকারের আইনী রক্ষাকবচ – তাকে ছিনিয়ে নেওয়ার বিজেপি-চক্রান্তই হল ‘লাভ জিহাদ’। মুসলিম যুবকদের থেকে নয়, বিজেপি’র থেকেই আজ হিন্দু নারীর বিপদ যারা ‘হিন্দু’র নাম করে রাজনীতি করছে! যে কোনো ধর্মের নামে যারা শাসন চালায় তারা নারী-অধিকারের শত্রু – ইতিহাস তার সাক্ষী। নিকিতা তোমর, প্রিয়দর্শিনী মাট্টু বা হিন্দু যুবকদের দ্বারা বিহারে গুলনাজের হত্যা কখনই প্রেম যুদ্ধ নয়, বরং পিতৃতান্ত্রিক হিংসার ভয়াল ছবি। এই মেয়েরা কেউ হত্যাকারীদের ভালোবাসেনি। ভালোবাসায় কোনো জিহাদ বা যুদ্ধ থাকতে পারে না! এই মহিলা সংগঠন মনে করে, প্রেম ও বিয়ের ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্ক যে কোনো নারী-পুরুষের স্বেচ্ছায় ধর্ম পরিবর্তনের অধিকার আছে। ভিন্ন ধর্মের বিয়ের ক্ষেত্রে ‘বিশেষ বিবাহ আইন ১৯৫৪’র সংস্থান আছে কিন্তু তাতে এক মাসের নোটিশের প্রয়োজন যে অপেক্ষা নোটিশদাতাদের জন্য যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ। সেই জন্যেই হয়তো ভিন্ন ধর্মের বিয়ের ক্ষেত্রে ধর্মান্তরকরণের প্রয়োজন হয়। অ্যাপোয়া চায় বিশেষ বিবাহ আইনে এক মাসের বিজ্ঞপ্তির বিষয়টি বাতিল করা হোক।
উত্তরপ্রদেশের যোগী সরকারের গণ ধর্মান্তরকরণের বিরুদ্ধে অধ্যাদেশটি শুধু সংখ্যালঘুদের জন্যই নয়, দরিদ্র দলিত সম্প্রদায়ের তরুণ ও মহিলাদের জন্যও বিপজ্জনক। সংবিধানের উপর এই বর্বর আক্রমণের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধের পথে হাঁটতে হবে আসন্ন বিপদের কথা মাথায় রেখে।
- জয়ন্তী দাশগুপ্ত
ঘুমটা বোধহয় ভেঙেছে, কিন্তু দুঃস্বপ্নের ঘোরটা এখনও কাটেনি। জন্তুটা কী ধরনের তাও বোঝা যায়নি। এমনকি সে এখন জন্তুটার পেটের ভেতরে না বাইরে তাও বুঝে উঠতে পারেনি। জল খেয়েও তার অস্বস্তি গেল না, তাই মাঝরাতেই সে তার বন্ধুকে ফোন করলো।
বন্ধু বললো, “চিন্তা করিস না। এই অদেখা জন্তুটা আমাদের চারপাশের দূষিত হাওয়ার মতো। এর মধ্যেই নিঃশ্বাস নিতে যেমন আমরা অভ্যস্ত হয়ে যাই, তেমনই জন্তুটার শরীরের মধ্যেই তুই অভ্যস্ত হয়ে যাবি।”
আসলে ফ্যাসিবাদ আসে দূষিত হাওয়ার মতোই। সে যে কত ক্ষতি করতে পারে তার খানিকটা আভাস হয়তো প্রথম প্রথম পাওয়া যায় কিন্তু ততদিনে শেষের দিন গোনা শুরু হয়ে গিয়েছে – আমরা তখন ফ্যাসিবাদ নামক জন্তুর পেটে। তাই কিছু আগে থেকেই ফ্যাসিবাদের লক্ষণগুলি চিনে নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ।
দার্শনিক প্লেটো বলেছিলেন, বাস্তবে কোন কিছুই নিখুঁত নয়। একটা নিখুঁত বৃত্ত কিংবা নিখুঁত গণতন্ত্র কোনোটাই বাস্তবে দেখা যায় না। কিন্তু তেমনই বইতে পড়া ফ্যাসিবাদও নিখুঁত আকারে আসে না। কিন্তু আমরা যদি প্রস্তুত থাকি তবে তার কিছু কিছু লক্ষণ দেখে আগে থেকে আন্দাজ করা যায় যে ফ্যাসিবাদী শক্তি থাবা গেড়ে বসতে চলেছে। যেমন বইতে পড়া নিখুঁত গণতন্ত্র বাস্তবে দেখা যায় না, ঠিক তেমনই, যে ফ্যাসিবাদ বাস্তবে আসে তা কোনো বইতে পড়া নিখুঁত তাত্ত্বিক ধারণাগুলির সঙ্গে পুরোপুরি মেলে না।
তাই আগে থেকেই চিনে নেওয়া দরকার ফ্যাসিবাদের সেই রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক লক্ষণগুলি এবং তাদের পরস্পরের সম্পর্ক।
‘শত্রু’র বিরুদ্ধে দেশরক্ষার রাজনৈতিক হুঙ্কার সম্ভবত ফ্যাসিবাদের সবথেকে বড় লক্ষণ। উগ্র জাতীয়তাবাদকে সামনে রেখে রাষ্ট্রের শক্তি প্রদর্শন-এর এক অতি পরিচিত বৈশিষ্ট্য। শত্রুর বিরুদ্ধে দেশরক্ষার বাহানা ফ্যাসিবাদের পক্ষে বিশেষভাবে সুবিধাজনক হয় যদি ঘরে বাইরে একই শত্রু আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, এটা লোকেদের পাখিপড়া করে বুঝিয়ে দেওয়া যায়। ফ্যাসিবাদের প্রধান চালিকাশক্তি যে গণউন্মাদনা তা জোরদার করতে দেশের ভেতরেও দেশরক্ষার নামে যত ইচ্ছা দমননীতি চালানো যায় আর বাইরের শত্রুর বিরুদ্ধে একটা ‘যুদ্ধং দেহি’ মার্কা উগ্র জাতীয়তাবাদ প্রদর্শন করাও যায় – এ যেন এক ঢিলে দুই পাখি মারা! লোকেরা অন্ধভাবে নেতাকে অনুসরণ করতে শুরু করে কারণ তাদের বোঝানো হয় যে একটা যুদ্ধের মতো পরস্থিতির উদ্ভব হয়েছে; আর এখনই না হলেও হতেই বা কতক্ষণ! গণতান্ত্রিক আন্দোলন থিতিয়ে দেওয়ার এ এক চমৎকার উপায়। ছোটখাটো বিষয় নিয়ে বিতর্ক-বিবাদের সময় যে এটা নয়, তাও লোকেরা মেনে নেয়। বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি, নাগরিকত্বের অধিকার নিয়ে আন্দোলন, পরিবেশ দূষণ বা বিপুল ব্যাঙ্ক জালিয়াতির মতো ছোটখাটো সমস্যা সমাধানের পথ খোঁজার কাজ ভবিষ্যতের জন্য মুলতুবি রেখে এখন প্রয়োজন নেতার অন্ধ অনুসরণ। হয়তো যুদ্ধ এখনই হবে না, কিন্তু দেশকে তো প্রস্তুত থাকতেই হবে! সরকার বিশেষভাবে যুদ্ধে শহীদ হওয়া সেনাদের বীরত্বের কথা অবিমিশ্র শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে বলেন। এই সময় ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে উত্তেজিত হওয়া সরকারের মতে দেশদ্রোহ। তার বদলে শহীদদের বীরত্বে আর দেশভক্তিতে অভিভূত হওয়া দেশপ্রেমের মাপকাঠি হয়ে পড়ে।
যখন রাষ্ট্রের কাছে রাজনীতি মানে প্রবল জাতীয়তাবাদ, যখন সে ঘরে-বাইরের শত্রুদের বিরুদ্ধে দেশের সুরক্ষার নামে যুদ্ধ-পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে ব্যস্ত আর দাবি করে যে ঘরে-বাইরের শত্রুর বিরুদ্ধে দেশপ্রেম দেখানো দেশের মানুষের প্রধান কর্তব্য, তখন বুঝতে হবে যে রাষ্ট্র ফ্যাসিবাদের রাস্তায় হাঁটছে। আর এই ফ্যাসিবাদী প্রবণতা আরও দ্রুত ছড়িয়ে দেওয়া যায় যদি ধর্মীয়, জাতিগতভাবে বা ভিন্ন সংস্কৃতির সংখ্যালঘুদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করতে পারা যায়। ফ্যাসিবাদ বেড়ে ওঠার জন্য দরকার এসবের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যারা জাতীয় ঐক্য সম্বন্ধে অন্য মত পোষণ করেন তাদের রাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা। দরকার হলে লেলিয়ে দেওয়া বুলডগের মতো কিছু নিরূপায় লোকের লিঞ্চিং, যা সরকার নীরব দর্শকের হয়ে দেখবে।
প্রাচীন লোকাচার, সব আধুনিকতা-বিরোধী ধর্মানুষ্ঠান আর কিংবদন্তির লোককথাই হল দেশের গৌরবময় অতীত, সেটাই সত্যিকারের ইতিহাস – এমন একটা ধারনাকে প্রতিষ্ঠিত করা, ফ্যাসিবাদ জোরদার করার জন্য বিশেষভাবে দরকার। কিন্তু এর থেকে এক ধরনের সামাজিক অসঙ্গতি ক্রমশই প্রকট হয়ে ওঠে কারণ ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রশক্তির বিস্তার আধুনিক সামরিক প্রযুক্তি ও ডিজিটাল যুগের প্রচারযন্ত্র ছাড়া সম্ভব নয়। কিন্তু তার সঙ্গে জাতি-ধর্ম-লিঙ্গ-গোষ্ঠীভিত্তিক আধুনিকতা বিরোধী চেষ্টা মেলানো সহজ নয়। আর এই অস্বস্তিজনক সহাবস্থানই ফ্যাসিবাদকে ঠিকভাবে চিনিয়ে দেয়। যতই এই অসঙ্গতি প্রকট হয় ফ্যাসিবাদের ধোঁকাবাজি চেহারাটা ততই যেন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেমন ধরুন একজন সাধারণ মানুষের ধাঁধা লাগাই স্বাভাবিক যখন সে কোনো রাজনৈতিক নেতার কোনো অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্রকে ফুল-মালা দিয়ে পুজো করার ছবি দেখে অথবা শোনে আর এক নেতা একদল নামকরা বৈজ্ঞানিকদের বোঝাচ্ছেন যে গণেশের মাথায় হাতির মুখ লাগানো আসলে আমাদের প্রাচীন শল্যচিকিৎসার অসম্ভব উন্নতির ‘ঐতিহাসিক’ সাবুদ। সাধারণ মানুষ এসব দেখে শুনে প্রাচীন স্বর্ণযুগের কল্পনার সঙ্গে ধর্ম নামক আফিমের মিশ্রনের মাদকতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। শুরু হয় ফ্যাসিবাদী আদর্শের জয়যাত্রা।
এই আদর্শ লোকের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে আধুনিক গণমাধ্যমগুলি এক বিরাট ভূমিকা নেয়। একদিকে ভূয়ো খবর তৈরি করা হয়, অন্যদিকে খবরকে ঝাড়াই বাছাই করে ও দরকার মতো কেটে ছেঁটে বদলিয়ে দিয়ে উগ্র জাতীয়তাবাদ ছড়ানোর কাজ অবাধে চলে। যে খবরে জাতীয়তাবাদের উগ্রতা কমে যায়, যেমন বেকারত্ব, কৃষকের দূর্দশা, ধর্মের ভিত্তিতে হত্যা, দলিত মেয়েদের ধর্ষণ ইত্যাদিকে যথাসম্ভব আড়ালে রাখা হয়, যেন সেগুলি তুচ্ছ খবর।
সাধারণত দুভাবে ভুয়ো খবরকে ছড়িয়ে দেওয়া হয় – একদিকে দরকার মতো খবর ‘ম্যানুফ্যাকচার’ করা হয় আর অন্যদিকে ‘অস্বস্তিজনক’ খবর ছড়িয়ে পড়াকে আটকে রাখা হয়। উইনস্টন চার্চিলের কথা প্রসঙ্গে অল্ডাস হাক্সলের তীর্যক মন্তব্য মনে করা যেতে পারে, “এর আগে কখনো এত কম লোক এত বেশি মানুষকে প্রভাবিত করতে পারেনি”; (ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড রিভিজিটেড, লন্ডন, ভিন্টেজ বুকস, ১৯৯৪, পৃ: ২৭)। কিন্তু এর পরেও যেটুকু বিরোধী মত অবশিষ্ট থাকে তাকে খতম করার জন্য চলে রাষ্ট্রশক্তির দমনমূলক আইনের ব্যবহার। সব বিরোধী কাজ বা ভাবনাকে জাতীয়তাবাদের বিরোধী বলে চিহ্নিত করে ফ্যাসিবাদী উগ্র জাতীয়তাবাদকে আরো প্রবল করে তোলা হয়।
অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্যগুলি ততই ক্রমশ প্রকট হতে থাকে যত বেশি করে রাষ্ট্রশক্তির সাহায্যে একটা জরুরি অবস্থার মতো ছদ্ম আবহাওয়া তৈরি হয়। সেই আবহাওয়ায় বিচারব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা, গণমাধ্যম এবং সংবিধান অনুসারে স্বয়ংশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলিকে ছলে-বলে-কৌশল যতটা সম্ভব সরকারের দিকে নিয়ে আসা যায়। কিন্তু ছলে-বলে-কৌশলে সবকিছুকে প্রভাবিত করার এই চেষ্টার মধ্যে জোরদার থাকে টাকার খেলা। তার ফলে ফ্যাসিবাদ অনিবার্যভাবে এক অর্থনৈতিক অসঙ্গতির মুখোমুখি হয়। যদি বেশি করে কর বসানো হয়, তাহলে তার জনপ্রিয় চেহারাটা ধাক্কা খায়। কর যদি শুধু ধনী ব্যবসায়ীদের ওপরে চাপানো হয় তাহলে তারা সরকারের বিরুদ্ধে যেতে পারে। তাই সরকারের আসল মুখ হয় ধনী ব্যবসায়ীদের সাহায্য করা আর মুখোশ হয় গরিবদের উদ্দেশ্যে সহানুভূতি ও প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দেওয়া আর তার সঙ্গে টুকটাক কিছু সাহায্য করা। বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলিকে আরও বড় করতে সরকার সস্তায় ‘জল-জঙ্গল-জমিনের’ অধিকার পাইয়ে দেয়, লোভনীয় কিছু আইন চালু করে – যাতে মুক্ত বাজারের নামে তারা কৃষকদের কাঁচামাল সম্পূর্ণ কব্জা করতে পারে অথবা ব্যবসাকে উৎসাহ দেবার নামে শ্রমিকদের সব রকম সুরক্ষামূলক আইন থেকে বঞ্চিত করতে পারে। অন্যদিকে বড় ব্যবসায়ীর লক্ষ্য, সব রকমের ব্যবসাকে দখল করে, আরও বড় হওয়া। তাই বড় ব্যবসায়ীরাও চায় শাসকের একচ্ছত্র ক্ষমতা। যার ওপরে নির্ভর করে দরকার হলে অসংখ্য গরিব মানুষের দারিদ্র্য আরও বাড়িয়ে দিয়ে নিজেদের ধন-সম্পদ বৃদ্ধি। তাই ফ্যাসিবাদ কৃষি বা শিল্পের ছোট ব্যবসায়িক পরিমন্ডলে স্বচ্ছন্দ নয়, বরং মুক্ত বাজারের নামে, এক শক্তিশালী সরকারের সাহায্যে, মুক্ত বাজারের আসল নিয়মগুলি নিজেদের সুবিধা মতো তৈরি করে নেয়। তার বিনিময়ে অবশ্য বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ফ্যাসিবাদী শাসককে আরও শক্তিশালী ও একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী করে তোলে। এইভাবেই ফ্যাসিবাদে এদের মধ্যে এক গভীর পারস্পরিক নির্ভরতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
সেই অবস্থায় শাসক, তার একচ্ছত্র ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে, বিপুল গণবিক্ষোভকেও জনবিরোধী হিসেবে দাগিয়ে দেয়। স্বদেশপ্রেম বা জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে বাইরের শত্রুর ষড়যন্ত্র এমন প্রচার চালিয়ে আরও সহজে তাদের ওপর দমন পীড়নের কাজ চালায়।
তত্ত্ব দিয়ে ফ্যাসিবাদ নামক জন্তুটির আকার এইসব অপরিহার্য রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্যগুলি দিয়ে বোঝা যেতে পারে কিন্তু এক অর্থে তা বিভ্রান্তিকর কারণ তত্ত্ব অপরিবর্তনশীল কিন্তু তত্ত্বের ব্যবহার তো হয় কোনো এক ঐতিহাসিক অবস্থায়; সেই অবস্থা কিভাবে বদলাবে তার নানা সম্ভাবনা থাকে। যেমন ছোট বীজের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে বিশাল মহীরুহ হওয়ার অথবা ছোট চারা হয়েই মরে যাওয়ার সম্ভাবনা। শুধু তত্ত্ব দিয়ে এই পরিবর্তনের নানা সম্ভাবনা বোঝা যায় না; ঠিক যেমন শুধু ব্যাকরণ দিয়ে একটা গোটা ভাষাকে বোঝার চেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। আসলে তো ভাষা এক জীবন্ত সম্ভাবনার মতো। তেমনই নানা রকম সম্ভাবনা নানা অবস্থায় ফ্যাসিবাদের রকমভেদ হিসেবে দেখা যায়।
ফ্যাসিবাদের আলোচনায় এর গুরুত্ব এই কারণেই, যে কোনো ঐতিহাসিক অবস্থায় এই রাজনৈতিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক লক্ষণগুলি কিভাবে দেখা দেবে তা সময় ও প্রসঙ্গের সঙ্গে সঙ্গেই বদলাবে। যেমন ধরা যাক, এমন একটা সমাজ যা একটু প্রাচীনপন্থী, এবং ঐতিহ্যকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়। এই অবস্থায়, সব নাগরিকই কি সত্যিই এই ঐতিহ্যে বিশ্বাস করেন নাকি কিছু নাগরিক সব সময়ে থাকবেন যাদের নিজেদের ঐতিহ্য এই প্রধান ঐতিহ্যের সঙ্গে মেলে না। এই কথাটি ওঠে, কারণ ঠিক এই প্রশ্নটাই তোলা হয়। আমাদের প্রধান ঐতিহ্য আর ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে অন্য ঐতিহ্য যেমন কিছু সংখ্যালঘু মানুষের ঐতিহ্য মেলে না – এই বলে ভেদাভেদের বীজ পোঁতা হয় আর তার থেকেই তৈরি করার চেষ্টা হয়, আগে যা বলা হয়েছিল, সেই এক যুদ্ধের মতো কাল্পনিক পরিস্থিতি। খেলা শুরু হয় একটা সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ‘আমাদের কেউ নয়’ বলে শুরু করে কিন্তু কোন পরিচয়ের ভিত্তিতে তাদের বিচ্ছিন্ন করা হবে, তা নির্ভর করে একটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক অবস্থায় দাঁড়িয়ে, যেমন কোথাও ধর্ম, কোথাও চামড়ার রঙ, কোথাও কে উদ্বাস্তু হয়ে এল ইত্যাদি। যে খেলার শুরু এই ভেদাভেদ তৈরি করার থেকে, সে খেলার মধ্যভাগে ভেদাভেদকে ঘৃণা ও হিংসায় বদলে সেই বিশেষ গোষ্ঠীকে লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়। সরকার অনেক সময় বলেন ঐ সংখ্যালঘু গোষ্ঠী বেশি বেশি সুবিধা পাচ্ছে যা সংখ্যাগুরুর স্বার্থকে আঘাত করছে। এমন সব প্রচারের মধ্য দিয়ে ঘৃণার মাত্রাকে বাড়িয়ে দেওয়া হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে মার্ক্সের বলে যাওয়া ‘সুবিধাভোগী শ্রেণির’ ধারণাকে বদলে তাকে এক ধর্মীয় রূপ দেওয়া হয়।
সেই সঙ্গে চলে ফ্যাসিবাদের তৈরি মিথ্যা শোষণকারী চিহ্নিত করা সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণা সরকার অনুগত গণমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া। থেকে থেকেই সংগঠিত হত্যা, দাঙ্গা বা পিটিয়ে মারার ঘটনা দিয়ে ‘জাতিগত শুদ্ধতার’ ধারণাকে আরও জোরদার করা। সেই সঙ্গেই, জাতীয় সংস্কৃতির গরিমার জন্য, এক সম্পূর্ণ ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র দরকার – এই বলে প্রচার চলে এবং এই সব ঘটনাকে তুচ্ছ বলে উপেক্ষা করে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এইভাবে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র সমস্ত পার্থক্যকে মুছে দিয়ে প্রতিশ্রুতি দেয় এক অলীক অতীতের স্বর্ণযুগে দেশকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার।
আমরা হয়তো ফ্যাসিবাদের শেষ পর্যায়ের খেলার মাঝামাঝি কোথাও, যেখানে তৈরি হচ্ছে মাস্তানদের মতো এক অন্য ধরনের সম্মান পাওয়ার ধারণা। রাষ্ট্র যেন হুঙ্কার দিচ্ছে – কিছু দেখে না, শোনে না, বলে না এমন নাগরিকেরই থাকবে শুধু বেঁচে থাকার অধিকার।
- অমিত ভাদুড়ি
(দ্যা টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধটি অনুবাদ করেছেন প্রতীপ কুমার দত্ত)
(বিশিষ্ট লেখক ও প্রাবন্ধিক আকর প্যাটেল গত ৩০ ডিসেম্বর ১৯২০ ‘দ্য ওয়্যার’ চ্যানেলে করণ থাপারকে এক সাক্ষাৎকারে ‘হিন্দুত্ব-হিন্দুরাষ্ট্র’ সংক্রান্ত বহু কথা বলেন। এখানে তার কিছু সংক্ষিপ্তসার প্রকাশ করা হল।)
হিন্দুত্ব-হিন্দুরাষ্ট্রের প্রথমত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হল, ভারতীয় সংখ্যালঘুদের, বিশেষ করে মুসলিমদের বিতাড়ন করা, উচ্ছেদ করা। মোদী প্রথমে ১৩ বছর যাবৎ গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ও ৭ বছর ধরে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এই মুসলিম বিরোধী ক্রোধান্ধতাকে মদত দিয়ে এসেছেন। বিজেপি বা তার পূর্বসূরী জনসঙ্ঘের কখনই অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ধ্যানধারণার বিষয়ে কোনও অবিচল অবস্থান থাকেনি, একমাত্র লাগাতার দাবি থেকেছে মুসলিমরা সমস্ত অধিকার ছাড়ুক। ওরা মসজিদ ছেড়ে দিক, মুসলিম ব্যক্তিগত আইন থেকে বিরত থাকুক, কাশ্মীরের ওপর স্বায়ত্ততার অধিকার চলবে না, হিন্দু মেয়েদের বিয়ে করা চলবে না, গোমাংস খাওয়া বন্ধ করতে হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি।
হিন্দুরাষ্ট্রের কাছে অ-হিন্দু সংখ্যালঘুরা কেবল উচ্ছেদের সম্প্রদায়। তা যে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের সম্প্রদায় হিসাবে খুব ভালো কিছু করার তাও নয়, সেদিকে তাকানোরই নয়, শুধু একটাই লক্ষ্য, অ-হিন্দুদের কি করে সর্বনাশ করা যায়, তাড়ানো যায়, অথর্ব করে রাখা যায়, সেসবই। ২০২০ সাল পর্যন্ত তথ্য দেখুন।
দেশে মুসলিম জনসংখ্যা যেখানে মোট ২০ কোটির বেশি সে তুলনায় ২৮টি রাজ্যে কোনো মুসলিম মুখ্যমন্ত্রী নেই, ১৫টি রাজ্যে কোনও মুসলিম মন্ত্রী নেই, ১০টি রাজ্যে মাত্র একজন করে মন্ত্রী আছেন। তাও সাধারণত মন্ত্রী করা হয়েছে কেবল সংখ্যালঘু বিষয়ক বিভাগে।
বিজেপি খুব মুসলিম তোষণের অবান্তর অভিযোগ তোলে, এটা প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ মুসলিমদের মোট জনসংখ্যা অনুপাতে জনজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের প্রতিনিধিত্ব পড়ে রয়েছে অনেক তলায়। যেমন, লোকসভায় মুসলিম প্রতিনিধির আসন ন্যূনতম যেখানে থাকা উচিত, সেখানে তাদের জনপ্রতিনিধির সংখ্যা মাত্র ২৭। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারী কর্মচারি মিলিয়ে মুসলিমদের অস্তিত্ব মাত্র ৪.৯ শতাংশ, আধা সামরিক বাহিনীতে অংশ ৪.৬ শতাংশ, আইএএস-আইপিএস ৩.২ শতাংশ, আর সেনাবাহিনীতে সংখ্যাল্পতা সবচেয়ে পক্ষপাতদুষ্ট, ১ শতাংশেরও নীচে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এবং রাষ্ট্রীয় নীতির অনুসরণে — উভয় দিক থেকে মুসলিম উচ্ছেদ অভিযান হাসিল করা হয়। ‘র’, ‘আর এ ডব্লিউ’, ‘রিসার্চ এ্যান্ড অ্যানালিটিক্যাল উইংস্’ — ভারতের সর্বোচ্চ স্তরের গোয়েন্দা গবেষণাগারে কোনোকালেই কোনও মুসলিম নিয়োগ পাননি, এখন তো আরোই থাকার কথা নয়, নেই।
মোদীর আমলে গুজরাটে লাগু হয়েছিল ‘গুজরাট উপদ্রুত এলাকা আইন,’ আজও বলবৎ রয়েছে। ঐ আইনের মোদ্দা বিষয় হল, গুজরাটের যেসব এলাকা সরকারের নির্দেশে ‘উপদ্রুত’ তালিকাভুক্ত, সেখানে মুসলিমরা জমি-বাড়ি বেচা-কেনা-ভাড়া দেওয়া-নেওয়া যেখানে বা যা ইচ্ছে তাইই করতে পারে না। সবকিছুই করতে হয় কঠোর পুলিশী-প্রশাসনিক ফরমান অনুসারে। নির্মম বাস্তবতা হল, গুজরাটে মুসলিমদের “ঘেটো” (ঘিঞ্জী মহল্লা) জীবনে থাকতে হয়। সবসময় তাড়িয়ে চলে ন্যক্কারজনক নজরদারী। ভোগ করতে হয় ঘৃণা-বিদ্বেষের জ্বলন।
দেশের বিচারব্যবস্থাও মুসলিম বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গী থেকে মুক্ত নয়। সর্বস্তরেই বিচারালয়ে এর বহুরকম ভুরি ভুরি তথ্যপ্রমাণ মেলে। সুপ্রীম কোর্টেও তো একই আচরণের পরিচয় পাওয়া যায়। রায়দানের ক্ষেত্রে ‘বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা অন্যায় অপরাধ হয়েছে’ ভর্ৎসনা করেও সংশ্লিষ্ট জমির ওপর সেই মসজিদ ধ্বংসকারীদের গাজোয়ারী অধিকার ফলানোর ওপর শীলমোহর দিয়ে দেওয়া হল! কাশ্মীরে সংবিধানের ৩৭০ ধারা মোতাবেক বিশেষ মর্যাদা ভিত্তিক স্বাধিকার সংক্রান্ত মামলার কিংবা সিএএ বাতিলের আপীল সংক্রান্ত অত্যন্ত জরুরি সংবেদনশীল মামলার শুনানির দিন নেপথ্য রহস্যপূর্ণ অজ্ঞাত কারণে মাসের পর মাস গড়ায়, শুনানি পরিত্যক্ত হয়ে থাকে।
এইসব হল দৃশ্যমান খন্ডপ্রস্তর মাত্র। মুসলিম নির্যাতন, নিপীড়ন, বিতাড়ন, উচ্ছেদ ও অধীনস্তকরণের প্রণালী লক্ষ্যবিশেষ।
সময় থাকতে আমরা অনেক কিছুর মর্ম বুঝি না। পরে যখন অনেক মূল্য দিয়ে বুঝি তখন অনেক দেরি হয়ে যায়। আমার মা অনেক ছড়া জানতেন। বিভিন্ন ঘটনায় অবলীলায় প্রাসঙ্গিক ছড়া বলতেন, গ্রাম্যকথার ডালি ঢেলে দিতেন। তখন কি আর ভেবেছিলাম এসব উত্তরকালে আমার/আমাদের কাজে লাগতে পারে! মায়ের অবর্তমানে সেইসব কথা এখন খুব মনে হয়। মায়ের মুখে একবার শুনেছিলাম:
অভদ্রা বর্ষাকাল
হরিণ চাটে বাঘের গাল
শোনরে হরিণ তোরে কই
কালগুণে আমি সবই সই।
আজ রবীন্দ্রনাথের মতো একজন দাড়ি রাখছেন, তাঁর সাকরেদরা বিশ্বভারতীকে রবীন্দ্রনাথের জন্মস্থান বলছেন, রবীন্দ্রনাথের মেজদাকে বড়দা বানাচ্ছেন, মেজবৌদির নাম ভুল বলছেন – এরকম আরও কত কি! ভোট বড় বালাই। পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন আসন্ন। বাংলা বিজয় তাঁদের স্বপ্নের তুঙ্গসীমায় এখন বিরাজ করছে। ইতিমধ্যেই তাঁরা আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে ১৬০’র অধিক আসন প্রায় পেয়ে গিয়েছেন! আরও ৪০টি তো পেতেই হবে, কেননা শাহি মশলার প্রচার তো কার্যীভূত করতে হবে।
এখন তাঁরা আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন বাঙালি আদব কায়দা নকল করতে, গায়ে চাদর জড়াতে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গুজরাটের কত নিবিড় সম্পর্ক ছিল তা প্রমাণে প্রাণপাত করে চলেছেন এঁরা। আমাদের দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক স্বপ্ন ‘আত্মনির্ভর ভারত’ নাকি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৃষ্টিভঙ্গির-ই অনুসারী! বিস্ময়ের সীমানাটা আদতে পলকা নয়, তবে এইসব কথাবার্তা শুনে তা অচিরেই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে। কিছুতেই তাকে ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না! তবু তিনি থামছেন না। পরম বিজ্ঞের মতো তিনি বলেই চলেছেন যে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে নাকি ‘বেদ থেকে বিবেকানন্দ’ সবই পাওয়া যায়! অর্থাৎ একের ভিতর সব! অন্যদিকে বিশ্বভারতীর উপাচার্য তো খোদ হিন্দুত্ববাদীদের গুড বুকে অবস্থান করছেন। তিন তো আবার বলেই দিয়েছেন যে রবীন্দ্রনাথ তো এখানে ‘বহিরাগত’! (সুত্রঃ ফ্রন্টিয়ার, ২ জানুয়ারী ২০২১) মোদীজি তাঁর বাংলা-বিজয়ের রাজনীতিক প্রচারে রবীন্দ্রভক্তির প্রাচুর্যের নমুনা রাখলেও খোদ উপাচার্যের তরফে রবীন্দ্রনাথকে ‘বহিরাগত’ বলে আখ্যা দেওয়ার প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়েছেন!
বাস্তবিক হিন্দুভারতের স্বপ্নদর্শী আরএসএস-এর সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ত প্রকল্পের মানস প্রতিমা বিজেপি’র এভাবে আসন্ন ‘বর্ষাকালে’ অর্থাৎ নির্বাচনের প্রাক্কালে রবীন্দ্র শরণ নিয়ে বাঙালির মন জয়ের লক্ষ্যে বাঘের এভাবে হরিণের ‘গাল’ চেটে দেওয়ার সময়ও সে তার ক্ষুধার্ত লাল চোখের হিংস্রতা কিন্তু গোপন থাকতে পারছে না। সাধারণ্যে তা প্রকাশ পেয়েই যাচ্ছে। সে যখন বিড়বিড় করে বলছে: ‘শোনরে হরিণ তোরে কই/কালগুণে আমি সবই সই’ – তখন তার দাঁত কিড়মিড় করার শব্দ তো আদতে অশ্রুত থাকছে না!
বিজেপি’র নেতা-নেত্রীরা এখন তো আকছার বাঙালি কবিদের শরণ নিচ্ছেন, রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও বঙ্কিমচন্দ্র, অরবিন্দ ঘোষেরও নাম নিচ্ছেন। তবে নাম নিচ্ছেন না বিদ্যাসাগরের, মধুসূদন-নজরুল-সুকান্ত-মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়দের। কারণ তাতে তাঁদের সমস্যা কমবে না বই বাড়বে। এঁদের একসময়ের ডাকসাইটে নেতা (যিনি আবার এখন নেতৃত্বলাভের লক্ষ্যে বিজেপির আনাচে-কানাচে ঘুরঘুর করছেন) তো রবীন্দ্রনাথ, সুকান্ত ভট্টাচার্য এবং নজরুল ইসলামের সংস্কৃতিকে ‘রসুন সংস্কৃতি’ বলে আখ্যা দিয়ে বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি তাঁদের প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গির স্বরূপ উন্মোচন করেছিলেন। এখন আসন্ন নির্বাচনের মুখে এসে বিজেপি তবে কি তাদের পাপস্খালনের কৌশল গ্রহণ করতে চাইছে? তাও খণ্ডিতভাবে? মধুসূদন-সুকান্ত-নজরুল তথা ‘রসুন’ বর্জন করে?
বিজেপি’র শিরোভূষণ নরেন্দ্র মোদী সম্প্রতি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে তাঁর এবং তাঁর দলের বাঙালি-প্রীতির নিদর্শন রাখতে গিয়ে জানিয়েছেন যে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে ভক্তি আন্দোলন থেকে কালীসাধক রামকৃষ্ণ দেবের চিন্তার পরিচয়ও অপ্রাপ্য নয়! তিনি অবলীলায় রবীন্দ্রনাথের ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’ আউড়ে গিয়েছেন! অর্থাৎ তাঁদের ডাক যে বাঙালিরা শুনতে চাইছেন না তিনি কি তা সম্যক উপলব্ধি করতে পারছেন? তাই কি তিনি ভিন্ন প্রেক্ষিতে, ভিন্ন আবহে তাঁর শেখা বুলি আউড়ে গেলেন! তিনি ব্রিটিশ ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামে নিবেদিতপ্রাণ ক্ষুদিরাম, বীণা দাশ, প্রফুল্ল চাকি, প্রীতিলতাদের নাম করে তাঁদের আদর্শের কথা স্মরণ করতে চেয়েছেন। অথচ একই সময়ে তিনি বিস্মৃত হয়েছেন যে এদেশে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁদের পূর্বসূরিদের কারও কোনও সদর্থক ভূমিকা ছিলো না, তাঁদের পূর্বসূরিরা এই স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ তো করেননি, পরন্তু তাঁরা ব্রিটিশ রাজশক্তির সঙ্গে সহযোগিতা করে দেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন। আজ তাঁরা নিছক নির্বাচনে সাফল্য লাভের লক্ষ্যে, বাঙালি-প্রীতির নমুনা রাখতে স্বাধীনতা সংগ্রামে শহিদ হওয়া জনাকয়েক বাঙালি বিপ্লবীর নাম নিয়েছেন! এতই যদি তাঁর বাঙালি-প্রীতি তাহলে আন্দামানের কুখ্যাত সেলুলার জেলের নামকরণ কেন বিশ্বাসঘাতক সাভারকরের নামে হলো? এর জবাব তো তাঁকে দিতে হবে। শুধু তাই নয়, দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান ছিল এমন কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম করতে গিয়ে তিনি তো খোদ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামটাই বিস্মৃত হয়েছেন!
২০১৫ খ্রিস্টাব্দের ১৮ নভেম্বর মধ্যপ্রদেশের সাগর-এ আরএসএস-প্রধান মোহন ভাগবত জানিয়েছিলেন যে তাঁরা ভারতকে এক হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করতে চান কেননা হিন্দুধর্ম বিপরীতের মধ্যে ঐক্যে বিশ্বাস করে, আর একথা নাকি নোবেল পুরষ্কার বিজেতা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই বলে গিয়েছিলেন! তিনি তাঁর বক্তৃতার সমর্থনে রবীন্দ্রনাথের ‘স্বদেশী সমাজ’ শীর্ষক প্রবন্ধের কথা উল্লেখ করেছিলেন। (সুত্রঃ https://www.ndtv.com/india-news/rss-chief-invokes-tagore-appeals-for-hindu-rashtra-729070)
‘স্বদেশী সমাজ’ বিষয়ক রবীন্দ্রনাথের গোটা তিনেক লেখার সন্ধান পাওয়া যায়। প্রথমটি ‘স্বদেশী সমাজ’ শিরোনামে লেখা হয় ১৩১১ বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাসে। এরপর “স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধের ‘পরিশিষ্ট’ শিরোনামে আরও একটি লেখার সন্ধান পাওয়া যায় যা লেখা হয়েছিল পূর্বোক্ত প্রবন্ধের ঠিক পরের মাসে অর্থাৎ আশ্বিনে। এরপর ‘স্বদেশী সমাজ’-এর ‘সংবিধান’ রচিত হয়। তাছাড়া ১৩১১ বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাসে ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধ পাঠের দুটি সভাও অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সেই সভায় হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, বিপিনচন্দ্র পাল, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এই সমস্ত লেখাগুলি একত্র করে রবীন্দ্রনাথের ‘স্বদেশী সমাজ’ পুলিনবিহারী সেনের সম্পাদনায় বিশ্বভারতীর তত্ত্বাবধানে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৬৯ বঙ্গাব্দের পৌষ মাসে (অর্থাৎ ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাস নাগাদ)। ভাগবতোক্ত হিন্দুরাষ্ট্রের কথা রবীন্দ্রনাথ কোথায় বলে গিয়েছেন তা ওঁরাই জানেন।
১৩৩৬ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ মাসে এই গ্রন্থের সূচনায় ‘মর্মকথা’ প্রসঙ্গে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই বলেছিলেন: “স্বদেশী সমাজে …আমি বলেছিলুম ইংরেজ আমাদের রাজা এই কথাটা নিয়ে বকাবকি করে সময় নষ্ট না করে সেবার দ্বারা, ত্যাগের দ্বারা নিজের দেশকে নিজে সত্যভাবে অধিকার কররার চেষ্টা সর্বাগ্রে করতে হবে। দেশের সমস্ত বুদ্ধিশক্তি এবং কর্মশক্তিকে সঙ্ঘবদ্ধ আকারে কেমন করে দেশে বিস্তীর্ণ করা যেতে পারে, স্বদেশী সমাজে আমি তারই আদর্শ ব্যাখ্যা করেছিলুম।”
এর মধ্যে হিন্দুরাষ্ট্রের কথা কোথায় তা দুর্বোধ্য। এছাড়া এই ‘মর্মকথা’র শুরুতেই রবীন্দ্রনাথ দেশের ‘সরকারবাহাদুর’কে একটা ‘অমানবিক প্রভাব’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন। স্বভাবতই ভাগবত যে রবীন্দ্রনাথকে হিন্দুরাষ্ট্রের প্রবক্তা হিসেবে আখ্যাত করে তাঁকে তাঁদের হীন রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করার প্রয়াস পেয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁদেরই শংসিত ‘স্বদেশী সমাজ’-এর প্রারম্ভ কথায় দেশের সরকার সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছেন, সেই সরকার বাহাদুরের প্রয়াসকে ‘অমানবিক’ আখ্যা দিয়েছিলেন। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের ‘স্বদেশী সমাজ’ আদতে কোনও রাজনৈতিক প্রকল্প ছিল না, এখানে যেমন ব্রিটিশ-বিরোধিতার স্পষ্টতা নেই, তেমনই নেই তাঁর বক্তব্যের সুঠাম শরীরি কাঠামো। তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতেই তিনি যেসব কথা তাঁর ‘স্বদেশী সমাজে’ বলেছেন তার মধ্যে হিন্দুত্ব এবং হিন্দুরাষ্ট্রের কথা একান্তই অনুপস্থিত।
মোদী-ভাগবতরা তো রবীন্দ্রনাথকে তাঁদের কাঙ্ক্ষিত হিন্দুত্ববাদের প্রবক্তা হিসেবেই প্রতিপন্ন করায় অপপ্রয়াস পেয়ে চলেছেন! এভাবেই দেশের মানুষকে নিরন্তর বিভ্রান্ত করে রাজনৈতিক সুবিধা অর্জনের রাজনীতি করে থাকেন। তাঁরা বিস্মৃত হয়েছেন যে রবীন্দ্রনাথের কাছে জাতিয়তাবাদ এবং দেশপ্রেমের চাইতে মানবতাবাদকেই অধিকতর গুরুত্ব দিতেন। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি লিখেছিলেন: “দেশপ্রেম আমাদের অন্তিম আশ্রয় হতে পারে না। আমার অন্তিম আশ্রয় হচ্ছে মানবতাবাদ। আমি যদিন জীবিত আছি ততদিন অন্তত মানবতাবাদের বিনিময়ে দেশপ্রেমকে অনুমোদন দেবো না।”(সুত্রঃ ফ্রন্টিয়ার, ২ জানুয়ারী ২০২১) – অথচ মোদী-ভাগবতরা হলেন মানবতার চরম শত্রু। তাঁরা যে দর্শনের প্রভাবে প্রভাবিত সেই ফ্যাসিবাদ তো মানবাত্মার চরমতম শত্রু।
এর দু’বছর পর ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে এই মোহন ভাগবত পুনরায় পশ্চিমবঙ্গে তাঁদের রাজনীতির গ্রহণযোগ্যতার লক্ষ্যে আবারও রবীন্দ্রনাথকে তাঁদের হিন্দুত্বের ‘আইকন’ হিসেবে প্রচার করার অপপ্রয়াস পেয়েছিলেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের পূর্বোক্ত প্রবন্ধের কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন যে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন হিন্দু এবং মুসলিমরা নিজেদের মধ্যে চিরকাল এভাবে লড়াই করে চলতে পারবে না, একটা মধ্যপথই এই সংঘর্ষের ইতি টানতে সক্ষম, আর এই মধ্যপথই হচ্ছে হিন্দুত্বের পথ! (সুত্রঃ Catchnews, ৫ অক্টোবর ২০১৭) – এভাবেই ভাগবত রবীন্দ্রনাথকে নিজেদের ফ্যাসিস্ত রাজনীতির সপক্ষকরণের অপপ্রয়াস পেয়ে যাচ্ছেন বেশ কয়েক বছর ধরেই।
মাইকেল মধুসূদন দত্তকে বাঙালি হিসেবে সম্মান দিতে একান্তই পরাম্মুখ এই হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্তরা। আগামী নির্বাচনের মুখে বাঙালি-প্রীতির প্রদর্শনী খুললেও তারা ভুলেও মাইকেল মধুসূদন দত্তের নাম নেন না। প্রখ্যাত বাঙালি কবি মধুসূদন দত্তকে তাঁরা ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যা দিয়ে থাকেন, কারণ তাঁর লেখা ‘হিন্দুবিরোধী’! তাঁর লেখায় রামচন্দ্রকে অপমান করা হয়েছে! মাইকেলের ‘আমি রাম এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদের ঘৃণা করি’ এই উক্তির মধ্যে বিজেপিওআলারা রাম এবং হনুমান সহ তাঁর সাগরেদের ঘেন্না করেন বলে তো তাদের হিন্দুত্ববাদী আইকন-কেই নস্যাৎ করে দিয়েছেন! তাঁর মেঘনাদবধ কাব্যে প্রমীলার মুখ দিয়ে বলা উক্তি: “আমি কি ডরাই সখি ভিখারী রাঘবে?” তো বিজেপি-আরএসএস-এর হিন্দুত্ববাদের প্রতিপক্ষতাই করে! স্বভাবতই তাদের বাঙালি বন্দনার প্রদর্শনীতে মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্থান হয় না! বাঙালি লেখকদের মধ্যে তাদের প্রিয় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে নোবেল দেওয়া হয়নি বলে তাদের আক্ষেপ! এই ছদ্ম বাঙালিপ্রেম দেখাতে গিয়ে তাঁরা বিস্মৃত হয়েছেন যে বঙ্কিমের জীবনকালে নোবেল পুরষ্কারের প্রবর্তন হয়নি! আর স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এঁদের নিকট ‘চরিত্রহীন, লম্পট এবং হিন্দু-বিরোধী বিদেশিদের এজেন্ট’ আর এঁকেই কিনা নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হয়েছিল! (সুত্রঃ The Wire, ৪ এপ্রিল ২০১৭) আরএসএস-এর অন্যতম প্রচারক দীননাথ বাত্রা তো সরাসরি রবীন্দ্রচিন্তার বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি রবীন্দ্রচিন্তার মধ্যে জাতীয়তাবাদের বিরোধিতার (অবশ্যই বিজেপি’র হিন্দুত্ববাদী জাতিয়তাবাদ) সন্ধান পেয়েছিলেন, পেয়েছিলেন ধর্ম আর মানবতাবাদের মধ্যে বিভেদরেখা টানার প্রয়াস। আর এখন আবার সেই রবীন্দ্রনাথকে আঁকড়ে ধরে সেই হিন্দুত্ববাদিরাই এখন তাদের বাঙালি-প্রীতি দেখাতে অতি তৎপর হয়েছে আগামী নির্বাচনে সাফল্যলাভের লক্ষ্যেই। আসলে ইতালির ফ্যাসিস্ত নায়ক বেনিতো মুসোলিনি এবং তাঁর পোষিত বুদ্ধিজীবীদের স্তাবকতায় রবীন্দ্রনাথকে সাময়িকভাবে হলেও তাঁরা বিভ্রান্ত করতে এবং তাঁর নিকট থেকে ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে শংসাপত্র আদায় করে বিশ্ববাসীর নিকট সেই বার্তা প্রদান করে বিভ্রম নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। রমাঁ রলাঁর অক্লান্ত প্রয়াসে অবশ্য রবীন্দ্রনাথ অবশেষে ফ্যাসিস্তদের সম্পর্কে মোহমুক্ত হয়েছিলেন এবং ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামের গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন। এখনও আমাদের দেশের হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্তদের প্রতিনিধিরা মুসোলিনির অনুশীলিত প্রক্রিয়ায় বাঙালি-প্রীতি প্রদর্শন করতে এসে সেই রবীন্দ্রনাথকেই হাতিয়ার করতে চাইছে। তারা বিভিন্নভাবে রবীন্দ্র-স্তাবকতার মাধ্যমে বাঙালির মন জয় করে আসন্ন নির্বাচনে ফয়দা তুলতে চাইছে। ‘হিন্দুবিরোধী বিদেশিদের এজেন্ট’ অর্থাৎ দালাল রবীন্দ্রনাথ এখন হঠাৎ করে তাদের নিকট বড়ো দেশপ্রেমিক হয়ে উঠেছেন! এভাবেই তারা বাংলার ময়দানে প্রবেশের ছাড়পত্র আদায়ের চেষ্টা করছে। বাংলা এবং বাঙালি-প্রীতির সঘন নিদর্শনের প্রদর্শনীর দোকান খুলে বসেছে।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’র নিখিলের কথাগুলো তো সারা বাংলাময় ধ্বনি থেকে প্রতিধ্বনিত হয়ে চলেছে: “দেশকে দেবতা বলিয়ে যখন তোমরা অন্যায়কে কর্তব্য, অধর্মকে পুণ্য বলে চালাতে চাও তখন আমার হৃদয়ে লাগে বলেই আমি স্থির থাকতে পারিনে।”
একদিকে দেশপ্রেমকেই ‘দেবতা’ বলে প্রচার করা আর অন্যদিকে অন্যায় এবং অধর্মকে প্রয়োজনীয় অনুশীলন হিসেবে কার্যকরী করা একসঙ্গে কী করে চলতে পারে?
একদিকে কৃষকপ্রেমের বিজ্ঞাপন আর অন্যদিকে কৃষকস্বার্থ-বিরোধী আইন প্রণয়ন করে তাকে কার্যীভূত করার মধ্যে দিয়ে কর্পোরেটের ফুলে ফেঁপে ওঠার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ন্যায্য কৃষক বিদ্রোহকে ‘রাজনৈতিক’ মদতপুষ্ট, দেশবিরোধী নকশাল-মাওবাদী-খলিস্তানপন্থীদের পরিকল্পিত চক্রান্ত বলে আখ্যাদানের মতো ‘অধর্মকে পুণ্য বলে চালাতে’ চাওয়ার অপপ্রয়াস এবং আসন্ন নির্বাচনে বাংলাজয়ের লক্ষ্যে ছদ্ম বাঙালি-প্রীতির নিদর্শনের প্রদর্শনী কি একসঙ্গে চলতে পারে? ষাটেরও অধিক সংখ্যক কৃষক এই প্রবল শীতের মধ্যে প্রকাশ্য রাস্তায় নেয়ে আন্দোলন করতে গিয়ে শহিদ হয়েছেন। কতখানি অমানবিক, মানবতার শত্রু হলে এরকম একটা সংবেদনশীল ব্যাপারেও চরম উদাসীন থাকা সম্ভব তা এই মোদী-ভাগবতদের না দেখলে বোঝা যায় না।
আজ থেকে আশি বছর আগে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন যে তাঁর বিশ্বভারতী হচ্ছে একটা বিশাল জাহাজ, যে জাহাজ বয়ে নিয়ে চলেছে তাঁর সারা জীবনের সেরা মূল্যবান সম্পদ সমূহ। আর আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সেই বিশ্বভারতীর আচার্য হয়ে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতার চিন্তাভাবনা সম্পর্কে অনবহিত থেকে এক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপরাজনীতির অনুশীলন করে চলেছেন। এর চাইতে লজ্জার আর কী হতে পারে!
তাঁর ‘স্বদেশী সমাজ’-এই রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন: “… এই সময়েই বাঙালিকে নিয়ত স্মরণ করাইয়া দেওয়া দরকার যে, ঘর ও বাহিরের যে স্বাভাবিক সম্বন্ধ, তাহা যেন একেবারে উলটাপালটা হইয়া না যায়। … শিক্ষা করিব বাহিরে, প্রয়োগ করিব ঘরে।”
সারা দেশ জুড়ে আরএসএস-বিজেপি কী অন্যায় করে চলেছে নিত্য অহর্নিশ তার নমুনা আমরা নেতিবাচক ‘শিক্ষা’ হিসেবে যেমন গ্রহণ করবো এবং তেমনই আসন্ন নির্বাচনে এই হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্তদের ছদ্ম বাঙালিপ্রেম দেখিয়ে বাংলা দখলের প্রতিরোধে সেই নেতিবাচক শিক্ষার বিরোধিতাই ‘ঘরে’ প্রয়োগ করে দেখাবো। এই প্রচারবার্তাকেই আজ জনদরবারে সামনে নিয়ে আসা প্রয়োজন।
- অশোক চট্টোপাধ্যায়
৩ জানুয়ারী সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের ২৪তম বালি-বেলুড় লোকাল সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো বালি আশুতোষ গ্রন্থাগার তরুণ সংঘে। সম্মেলনের প্রথম পর্বে শহীদদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জানিয়ে রক্ত পতাকা উত্তোলন করেন এলাকার বর্ষীয়ান কমরেড মোহন হালদার। হাওড়া জেলা কমিটির পক্ষ থেকে পর্যবেক্ষক কমরেড পার্থ ব্যানার্জি, জেলা সম্পাদক কমরেড দেবব্রত ভক্ত সহ অন্যান্য নেতৃত্ব এবং গণসংগঠনের পক্ষ থেকে শহীদ বেদিতে মাল্যদান করে শ্রদ্ধা জানানো হয়। ২৪তম বালি-বেলুড় লোকাল সম্মেলনে, এলাকায় দীর্ঘদিনের পার্টি সদস্য প্রয়াত কমরেড সরোজাক্ষ মজুমদারের নামে মঞ্চ এবং নগরের নামকরণ করা হয়েছিল দিল্লির বুকে আন্দোলনরত কৃষক শহীদ স্মরণ নামে। স্মরণ করা হয় সাবিত্রীবাই ফুলেকেও। সম্মেলনে পার্টির প্রবীণ সদস্য এবং কর্মীদের সাথেই ছাত্র-যুবদের উপস্থিতি ছিল লক্ষ্য করার মতো। সমগ্র সম্মেলনটি পরিচালনা করেন কমরেড মোহন হালদার কমরেড রঘুপতি গাঙ্গুলী এবং কমরেড তপন ঘোষ। উদ্বোধনী সংগীত পরিবেশন করেন কমরেড অমিতাভ ব্যানার্জি। সম্মেলনের শুরুতে সম্মেলন কক্ষে বিগত এক বছরে আমরা যাদের হারিয়েছি সেই সমস্ত প্রয়াত সাথীদের স্মৃতিতে শোক প্রস্তাব পেশ করা হয়।
সভায় বিদায়ী বালি পৌরাঞ্চল প্রস্তুতি কমিটির পক্ষ থেকে প্রস্তাবিত খসড়া দলিল পেশ করেন কমরেড অঙ্কিত মজুমদার। এর পরবর্তীতে সম্মেলনকে সম্মোধন করে বক্তব্য রাখেন জেলা পর্যবেক্ষক তথা পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য কমরেড পার্থ ব্যানার্জি। কমরেড পর্যবেক্ষকের পরে পার্টির হাওড়া জেলা সম্পাদক দেবব্রত ভক্ত তার সুচিন্তিত বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি ও আমাদের কর্তব্য কথা স্মরণ করিয়ে দেন। খসড়া দলিলের ওপরে মোট ১০ জন বক্তব্য রাখেন যার মধ্যে পার্টি দীর্ঘদিনের প্রবীণ সদস্য কমরেড গোপাল বেরা, কমরেড ধনঞ্জয় দাস সহ ছাত্রদের অংশগ্রহণ ছিল লক্ষণীয়।
বিদায়ী প্রস্তুতি কমিটির পক্ষ থেকে জবাবী ভাষণে কমরেড অঙ্কিত মজুমদার সমস্ত পরামর্শকে দলিলের অন্তর্ভুক্ত করে নেন।
সর্বসম্মতভাবে মোট ১০ জনের নতুন লোকাল কমিটি নির্বাচিত হয় যার সম্পাদক হিসাবে নতুন কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে কমরেড নিলাশিস বসুকে নির্বাচিত করে।
মিড-ডে-মিল কর্মীদের উদ্যোগে এবং অ্যাপোয়া, এআইসিসিটিইউ, সংযোগ সাংস্কৃতিক সংস্থার মিলিত সহযোগিতায় চলমান কৃষক আন্দোলনের সংহতিতে এক প্রতিবাদ কর্মসূচি নেওয়া হয় বাঘাযতীন মোড়ে, ৩১ ডিসেম্বর। কর্মসূচির শেষে মিছিল ও শ্লোগানের মাধ্যমে মোদীর কুশপুতুল পোড়ানো হয়। এই কর্মসূচিতে উপস্থিত ছিলেন এআইসিসিটিইউ’র তরুণ সরকার, শীলা দে সরকার, মিড-ডে-মিলের সংগঠক মমতা ঘোষ, অধ্যাপক নিত্যানন্দ ঘোষ, পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের পক্ষ থেকে নীতিশ রায়, সাভাপ্রমসের পক্ষ থেকে চন্দ্রাস্মিতা, স্বপ্না, স্নিগ্ধা বসু। উপস্থিত ছিলেন বীরেন ব্যানার্জি, স্বরূপ ও সিপিআই(এমএল) বাঘাযতীন ব্রাঞ্চের শুভ, শংকর ও আরো অনেকে।
বারাসাতের দীর্ঘ দিনের পার্টি দরদী কমরেড দীপু দত্ত গত ১৩ ডিসেম্বর কালান্তক কোভিডে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হন। আইপিএফ-এর আহ্বানে দিল্লীর বোট ক্লাব ময়দানে ‘দাম বাঁধো কাজ দাও’ মিছিলে যোগদানের মধ্য দিয়ে কমরেড দীপু পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন। সারা জীবনে অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের মিছিলে দীপু হাঁটেননি। অত্যন্ত দারিদ্র্যের মধ্যে থেকেও কোনোদিন অসততার আশ্রয় নেননি দীপু। বারাসাত বুক স্টলে দীপুর ভুমিকা অনবদ্য। এবারেও ব্যতিক্রম হয়নি। ৩ জানুয়ারী স্থানীয় পার্টির উদ্যোগে দীপুর পরিবারের সকল সদস্য এবং প্রতিবেশিদের নিয়ে এক স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় দীপুর সাহস, পরিশ্রমি মানসিকতা এবং দায়িত্ববোধের বিষয়ে আলোচনা হয়। স্মরণসভা পরিচালনা করেন বারাসাত পার্টির দায়িত্বশীল কমরেড দিলিপ দত্ত। দীপুর স্ত্রী মিড-ডে-মিল কর্মী। ওদের একটি ছেলে আছে।
সমাপ্ত