আজকের দেশব্রতী : ২৪ ডিসেম্বর ২০২০ (অনলাইন সংখ্যা)
ondddaaahhhh

আগামী ২৭ ডিসেম্বর সর্বনাশা কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে কৃষকদের ‘দিল্লি চলো’ অভিযানের এক মাস পূর্ণ হতে চলেছে। ব্যারিকেড – লাঠি – কাঁদানে গ্যাস – জল কামান সমস্ত বাধা অতিক্রম করে দেশের রাজধানীর বুকে গত এক মাস যাবত চলছে পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম বড় কৃষক আন্দোলন। প্রবল ঠাণ্ডার মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার ও গোদি মিডিয়ার সব আক্রমণ, ষড়যন্ত্র, বাধা, প্রলোভন, মিথ্যা প্রচারের মোকাবিলা করে পূর্ণ উদ্যমে সাহসী লড়াইয়ের এক অনন্য নজির সৃষ্টি করেছেন দেশের অন্নদাতারা। পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান, উত্তরাখণ্ড, উত্তরপ্রদেশ সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কৃষকরা এই মুহূর্তে দিল্লি – হরিয়ানার সিঙ্ঘু ও তিকরি বর্ডার, দিল্লি – উত্তরপ্রদেশের গাজীপুর বর্ডার, হরিয়ানা-রাজাস্থানের শাহাজাহানপুর বর্ডারে সমস্ত প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে শান্তিপূর্ণ অবস্থান চালাচ্ছেন। ইতিমধ্যেই ৩৪ জন কৃষক এই আন্দোলন চলাকালীন শহীদের মৃত্যু বরন করেছেন। দেশের কৃষিকে আম্বানি আদানির কর্পোরেটরাজের গ্রাস থেকে বাঁচাতে, কৃষি আইন ও বিদ্যুৎ সংশোধন বিল ২০২০ বাতিল না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন থেকে এক পা পিছু হটবেন না সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তাঁরা। সারা দেশের সমস্ত বাম গণতান্ত্রিক দল, বিভিন্ন ছাত্র যুব শ্রমিক মহিলা সংস্কৃতিক গনসংগঠনগুলিও এই লড়াইয়ে সক্রিয় সমর্থন জানিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে। ৮ ডিসেম্বর দেশ জুড়ে কৃষি আইন বাতিলের দাবিকে সামনে রেখে ঐতিহাসিক ভারত ধর্মঘট হয়েছে। যে কর্পোরেটদের সুবিধা করে দিতে মোদী সরকার এই আইন এনেছে, আন্দোলনস্থল থেকে সংযুক্ত কিষান মোর্চা ও সারা ভারত কৃষক সংঘর্ষ সমন্বয় কমিটি দেশবাসীর কাছে সেই আম্বানি আদানির সমস্ত পণ্য বয়কট করার আহবান জানিয়েছে। ১৪ ডিসেম্বর সারা দেশের রিলায়েন্স, আম্বানি, আদানির বিপণির সামনে চলেছে বিক্ষোভ, ব্যাপক হারে জিও সিম বয়কট চলছে এর সাথেই। ২৩ ডিসেম্বর কৃষকদের ডাকে সারা দিয়ে দেশের মানুষ অনশনে সামিল হয়েছেন। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কৃষকরা দিল্লির বুকে পৌঁছে যাচ্ছেন, নয়া উদ্যমে ক্রমেই জোরদার হচ্ছে  আন্দোলন। শিশু থেকে মহিলা, কিশোর থেকে বৃদ্ধ বিভিন্ন বয়সের আন্দোলনকারীদের প্রতিবাদের ধরনেও রয়েছে অভিনবত্ব। বক্তব্য, স্লোগান, গান, কবিতা, গ্রাফিতি, ওয়াল আর্টের পাশেই ছাত্র সংগঠন AISA-র উদ্যোগে চালু হয়েছে ‘শহীদ ভগত সিং’ লাইব্রেরী। সিপিআই(এমএল)-এর চিকিৎসক কমরেডদের সহযোগিতায় চলছে মেডিকেল ক্যাম্প।

এই সংবেদনশীল পরিস্থিতিতেও গঙ্গাবক্ষে প্রমোদ ভ্রমণ ও রাজে রাজ্যে বিধায়ক সাংসদ কেনা বেচা করতে ব্যস্ত দেশের প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী। একবারের জন্যও আন্দোলন স্থলে গিয়ে কৃষকদের সাথে কথা বলার সময় তাঁদের হয়নি। এই পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলনের এক মাস পূর্তিতে আগামী ২৭ ডিসেম্বর নরেন্দ্র মোদীর ‘মন কি বাত’ চলাকালীন দেশ জুড়ে ‘থালি বাজাও’ কর্মসূচীর ঘোষণা করা হয়েছে সংযুক্ত কিষান মোরচার পক্ষ থেকে। মার্চ মাসে কোভিড অতিমারী ছড়াতে শুরু করার প্রথম দিকে মোদী সরকার অপরিকল্পিত লকডাউন, থালি বাজাও আর প্রদীপ জ্বালাও এর ঘোষণা মনে আছে দেশবাসীর। বধির কেন্দ্র সরকারের কাছে নিজেদের ন্যায্য দাবি পৌঁছে দিতে সেই ‘থালি বাজাও’ কেই প্রতিবাদের এক অভিনব হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছেন কৃষকেরা। আসুন অন্নদাতাদের পাশে দাঁড়াই। এ লড়াই বাঁচার লড়াই, এ লড়াই জিততে হবে।

ccccapaaa

গত ২০ ডিসেম্বর, ২০২০-তে বাঙালী জনজীবন এক নতুনতর দৃশ্য প্রত্যক্ষ করলো। ভারত সরকারের প্রধান মহামাত্য পরিদর্শন করলেন রবীন্দ্রনাথের অমর কীর্তি বিশ্বভারতী। মেদিনীপুরে শুভেন্দু-বিজয় পর্ব শেষ করেই ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ আসন্ন বঙ্গবিজয় সম্পূর্ণ করার তাগিদে পা রাখলেন বিশ্বভারতীতে। চারিদিকে, ‘উপরে অমিত শাহ মুখ্য, নীচে রবীন্দ্রনাথ গৌন’ পোস্টারে ভরিয়ে দেয়া হল। গুজরাট-উত্তরপ্রদেশ-দিল্লী দাঙ্গার মন্ত্রণাদাতা, বাঙলাকে ১৯৪৭-এর পর এনআরসি করে আবার উদ্বাস্তু করার চক্রান্তের মহানায়ক, আদানি-আম্বানি কোম্পানিরাজের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মহামাত্য অমিত শাহ বীরদর্পে প্রবেশ করলেন “যত্র বিশ্ব ভবত্যেক নীড়ম” অর্থাৎ “যেখানে বিশ্ব হবে এক নীড়” সেই রবীন্দ্র সৃষ্ট বিশ্বভ্রাতৃত্বর মহা আলয়ে। এই উল্টোপুরাণের যাত্রাপথে ফুল ছড়ানোর লোকের অভাব ঘটেনি, কারণ বিশ্বভারতীর এখনকার উপাচার্য নিজেই অমিত শাহর গুরুদেব, হিন্দুরাজ্য স্থাপনের উদগাতা দামোদর বিনায়ক সাভারকারের গুণগ্রাহী, একজন গেরুয়াধারী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক। অমিত শাহ, নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি এখন বাংলার আসন্ন নির্বাচনে বঙ্গ-বিজয়ের ছক কষছে। সেই কারণেই বাংলার বহুধা বিচিত্র মননকে ছদ্ম-তুষ্টিবিধানের জন্য ‘মন কি বাতে’তে নরেন্দ্র মোদী অদ্ভুতুড়ে বাংলায় রবীন্দ্র কবিতা পড়ছেন, বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নাড্ডা রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কিছুই অবগত নন তবু তাকে বলতে হচ্ছে ‘শান্তিনিকেতন রবীন্দ্রনাথের জন্মভূমি’; অমিত শাহকেও আসতে হচ্ছে শান্তিনিকেতনে, বলতে হচ্ছে ‘ছুটি পেলে সাতদিন রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে সময় কাটাবেন’ (সূত্র-আনন্দবাজার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২০)। কি গান শুনবেন উনি? “বহে নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারা”? দিল্লির উপকণ্ঠে কৃষকেরা এই ভয়ংকর শীতে চার সপ্তাহের উপর বসে আছে অন্যায্য কৃষি বিল বাতিলের দাবিতে। নয় নয় করে ৩০ এর অধিক কৃষক, আন্দোলন করতে গিয়ে প্রবাসে শহীদ হয়েছেন কঠিন সরকারী উদাসীনতায়। তোমাদের একটুও তাপ উত্তাপ নেই। বরঞ্চ শান্তিপূর্ণ আন্দোলনরত কৃষকদের নামে সরকারের তরফ থেকে নিরন্তর কুৎসা রটাচ্ছ। খাদ্যের যোগানদার অন্নদাতাদের বলছ ‘গদ্দার’। নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য ভেক ধরেছো হে দাঙ্গাবাজ বৈষ্ণব! রবীন্দ্র গানের সুপ্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্য প্রসূত ‘বসুধেব কুটুম্বকম’ কিংবা ‘আনন্দধেব খল্বিমানি ভূতানি জয়ন্তী’ সদৃশ অনুভূতিবোধ তোমাদের জন্য নয়। “বিবিধের মাঝে মিলন মহান”-এর যে মহাস্বপ্ন রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন, তোমরা আজ সেই অনন্ত প্রাণ সত্ত্বাকে ভাঙতে উদ্যত। তোমরা এখন ব্যস্ত বাংলায় তোমাদের ছাপ মারা ভন্ড কৃষক, বাসুদেব দাস বাউলদের মতো সত্যি বাউলধর্ম ভুলে যাওয়া শিল্পীদের ঘরে ভাত খেয়ে মেকি আউল-বাউল-কৃষক প্রেম দেখাতে। আজ কৃষক হত্যার রক্ত হাতে নিয়ে তোমরা বিরোধী দলের তথাকথিত কৃষক(!) নেতাকে ভাঙ্গিয়ে আগামী বাংলা বিজয়ের মোচ্ছব করছ। এক দিক থেকে ভালোই হোলো। নন্দীগ্রামের সরল কৃষক জনগণ আজ বুঝতে পারবে এই ভন্ড রংবেরং-এর ক্ষমতালোভী নায়করা, আর তার দিল্লির প্রভুরা কোনোদিনই তাদের বন্ধু ছিল না। ওদিকে শান্তিনিকেতনে বহিস্থ জনগণের অর্থাৎ ‘শোনপাংশু’দের প্রবেশ রোখার জন্য উঠছে অভ্রভেদী প্রাচীর। কবিগুরুর আদর্শকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে নতুন করে নয়া হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শে গড়ে উঠছে ‘অচলায়তন’। আজকের ‘মহাপঞ্চক’রা ছাত্রাবাসের দরজায় দরজায় বসাচ্ছে পাহারা। অমিত শাহর পরিদর্শন পর্বেই তা স্পষ্ট দেখা গেল। উত্তর-দক্ষিণের সমস্ত জানলা বন্ধ করে দিয়ে শান্তিনিকেতনের আকাশে বাতাসে আজ রবীন্দ্র গান চাপা পড়ে গেছে “ওঁ তট তট তোতয় তোতয় স্ফট স্ফট স্ফোটয় স্ফোটয় ঘুণ ঘুণ ঘুণপায় ঘুণপায় স্বর বসত্ত্বানি”র অচলায়তন-সদৃশ অদ্ভূত মন্ত্রে।

আসল কথা নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহদের চিন্তা চেতনায় হিন্দুত্ববাদী ভারতবর্ষর সাথে রবীন্দ্রনাথের ভারতবর্ষের ধারণার কোনো মিল নেই, অমিল সর্বব্যাপী। তাদের গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ নয়, তাদের গুরুদেব মাধবরাও সদাশিবরাও গোলয়ালকর; আরএসএস-এর দ্বিতীয় সরসংঘচালক। জাতিরাষ্ট্র সম্পর্কে তার ধারণাই মোদী-অমিত শাহর বিজেপি আজকের ভারতে ছলেবলে কৌশলে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। গোলওয়ালকর বলেছিলেন হিন্দুত্বের সঙ্গে যা কিছু সম্পর্কিত, একমাত্র সেটাই জাতীয়। যারা হৃদয় দিয়ে হিন্দু জাতির উন্নতির কথা ভাবে, তারাই কেবল দেশপ্রেমী। বাকিরা হয় বিশ্বাসঘাতক নয় শত্রু।আজকের বিজেপি চালিত ভারতবর্ষে এই ধারণারই প্রায়োগিক রূপ দেখা যায় অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে; উচ্চ ন্যায়ালয়কে কাজে লাগিয়ে, সাংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষতাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শণ করে রামমন্দির নির্মানে; গোরক্ষার নামে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রবহির্ভূত সন্ত্রাসের বাতাবরণে; লাভ জিহাদের কাল্পনিক জিগির তুলে সংখ্যালঘু দমনের কূটকৌশলে, ইত্যাদি ইত্যাদি।

রবীন্দ্রনাথের ধারণা এই দৃষ্টিভঙ্গী থেকে অনেক দূরে। “ভারতবর্ষের প্রধান সার্থকতা কী, এ কথার স্পষ্ট উত্তর যদি কেহ জিজ্ঞাসা করেন সে উত্তর আছে; ভারতবর্ষের ইতিহাস সেই উত্তরকেই সমর্থন করিবে। ভারতবর্ষের চিরদিনই একমাত্র চেষ্টা দেখিতেছি প্রভেদের মধ্যে ঐক্যস্থাপন করা, নানা পথকে একই লক্ষ্যের অভিমুখীন করিয়া দেওয়া এবং বহুর মধ্যে এককে নিঃসংশয়রূপে অন্তরতররূপে উপলব্ধি করা- বাহিরে যে সকল পার্থক্য প্রতীয়মান হয় তাহাকে নষ্ট না করিয়া তাঁহার ভিতরকার নিগূঢ় যোগকে অধিকার করা” [ভারতবর্ষের ইতিহাস-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]। “হেথায় আর্য, হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড় চীন-/শক-হুন-দল পাঠান মোগল এক দেহে হল লীন”-এর যে উদার ধারণা ভারত আত্মার অন্তর থেকে অন্বেষণ করে  রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবন ব্যাপী সাধনায় অর্জন করেছিলেন বিজেপি-আরএসএস-মোদী-অমিত শাহরা আজ সেই উপলব্ধিকে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে একজাতি-এক ধর্ম-হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান ভাবনা দিয়ে শুধুমাত্র মনুস্মৃতি আশ্রিত এক সংকীর্ণ ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারত গড়তে চাইছেন যেখানে ভারতবর্ষের মুসলমান পরিত্যাজ্য, দলিত মানুষ অন্ত্যজ, এমনকি নারী সমুদায়ও এক পিছরে বর্গের প্রজাতি,অস্যার্থে ‘নরকের দ্বার’। অমিত শাহ মনে রেখো তোমাদের এই মনুবাদী প্রকল্প বাংলায় ঠাঁই পাবে না। এ বাংলা চৈতন্যের, এ বাংলা মঙ্গলকাব্যের, এ বাংলা রামমোহন, বিদ্যাসাগর, ইয়ংবেঙ্গল, মধুসূদন, ক্ষুদিরাম, বাঘাযতীন, মাষ্টারদা, প্রীতিলতা, তেভাগা, খাদ্য আন্দোলন ও নকশাল বাড়ির বাংলা। আজকের ভারতের ক্রমঘনায়মান সভ্যতার সংকট সন্ধিক্ষণে – “এই কথা আজ বলে যাব, প্রবল প্রতাপশালীরও ক্ষমতা মদমত্ততা আত্মভরিতা যে নিরাপদ নয় তারই প্রমাণ হবার দিন আজ সম্মুখে উপস্থিত হয়েছে; নিশ্চিত এ সত্য প্রমাণিত হবে যে –

অধর্মেনৈধতে তাবৎ ততো ভদ্রাণি পশ্যতি।
ততঃ সপত্নান জয়তি সমূলস্তূ বিনশ্যতি”।
[সভ্যতার সংকট –রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]

- সিতাংশু চক্রবর্ত্তী     

cccararlove

২০২০ সালের উত্তর প্রদেশের বেআইনি ‘ধর্ম পরিবর্তন বিরোধী রায়’, যাকে মহিলাদের ‘লাভ জিহাদ’ থেকে রক্ষা করার পন্থা হিসেবে দাবি করা হচ্ছে, তা আসলে মহিলাদের স্বাধিকার ও ইচ্ছার ওপর এক ভয়ানক আক্রমণ। এই রায় এবং অনুরূপ আরও বেশ কিছু রায় যা উত্তরাখণ্ডে রয়েছে এবং অন্যান্য বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতেও আসতে চলেছে, সেগুলি হিন্দু মহিলাদেরকে হিন্দু সম্প্রদায়ের নিছক সম্পত্তি হিসেবে দেখে, স্বাধিকারসম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে নয়।

এই রায়ের সাহায্যে উত্তর প্রদেশ পুলিশ একের পর এক যেসমস্ত কেস ফাইল করেছে, তার প্রত্যেকটিতে দেখা যায় কিভাবে সংঘী গুণ্ডা আর পুলিশের আঁতাতে হিন্দু মহিলাদেরকে তাদের মুসলিম সাথিদের থেকে বলপূর্বক আলাদা রাখা হয়েছে। প্রায় সব ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, এই মহিলারা স্বেচ্ছায় এই সাথীদের ভালোবেসেছেন এবং বিয়ে করেছেন, কিন্তু তাঁদের পরিবার এই সংঘী গুণ্ডাদের প্ররোচনায় মামলাগুলি রুজু করেছে। একটি ঘটনায় দেখা গেছে, পাত্রপাত্রী উভয় পক্ষের পরিবারের অনুমতি থাকা সত্ত্বেও এই গুণ্ডা-পুলিশের মেলবন্ধনে একটি বিয়ের অনুষ্ঠান বলপূর্বক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

অন্তর্ধর্মীয় দম্পতিদের আক্রমণকারী এই অশ্লীলভাষী গুণ্ডাদলের সাহসবৃদ্ধির অন্যতম কারণ, তাদের মত এক ব্যক্তিই উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী। উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী এই রায় আনার সময়েই হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন, “যারা লাভ জিহাদ করছে তারা যেন নিজেদের শেষ যাত্রার জন্য তৈরী থাকে”। এই রায়ের প্রথম শিকার মোরাদাবাদের এক কমবয়সী অন্তর্ধর্মীয় দম্পতির অনাগত সন্তান। একজন অন্তঃসত্ত্বা মহিলাকে তার স্বামীর থেকে বলপুর্বক আলাদা করে একটি “আশ্রয়স্থান”-এ রাখা হয় এবং সরকারি হাসপাতালে জোর করে তাঁর গর্ভপাত করানো হয়। তাঁর জীবন, তাঁর স্বাস্থ্য এবং ভবিষ্যতে তার সন্তানধারণের ক্ষমতাকে সংশয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে সেই ডাক্তাররা, যারা তাঁর ইউটেরাসের সংক্রমণ আটকানোর জন্য প্রয়োজনীয় আয়ন্টিবায়োটিকগুলি দেয়নি।

মোরাদাবাদের ঘটনা আইনের “অপপ্রয়োগের” ঘটনামাত্র নয়। এই আইন তৈরি করাই হয়েছে প্রাপ্তবয়স্ক মহিলাদের ইচ্ছাকে বাতিল ও অগ্রাহ্য করার জন্য কারণ এই আইনানুসারে মহিলার পরিবার মহিলাটির ইচ্ছা ব্যতিরেকেই অভিযোগ দায়ের করতে পারে।

উত্তর প্রদেশের এই রায় মনুস্মৃতির অন্তর্বর্ণ বিবাহের নিষিদ্ধকরণ, নাৎসি জার্মানির আন্ত-জাতীয় বিবাহের অপরাধীকরণ এবং আমেরিকা ও দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবিদ্বেষের দ্বারা অনুপ্রাণিত।

বহু মানুষ এলাহাবাদ হাই কোর্টে ভালোবাসা-বিরোধী এই রায়ের বিপক্ষে আপীল করেছেন এবং আমরা অবশ্যই আশাবাদী যে শেষ পর্যন্ত এই রায়কে খারিজ করা সম্ভব হবে। সাম্প্রতিককালে বহু আদালতই প্রাপ্তবয়স্ক মহিলাদের নিজের পছন্দমতো ভালোবাসা ও বিয়ের অধিকারের সপক্ষে রায় দিয়েছে। কিন্তু বারংবার এই অধিকারের স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য কোর্টের দ্বারস্থ হওয়ার প্রয়োজনই প্রমাণ করে দেয়, সাম্প্রতিককালে এই মৌলিক অধিকারের অবস্থা কতটা ভঙ্গুর।  ভালোবাসা-বিরোধী এই আইনগুলি কাজে লাগিয়ে ভারতবর্ষের ক্ষমতাসীন দল ইতিমধ্যেই ভঙ্গুর এই অধিকারের শ্বাসরোধ করার চেষ্টা করে চলেছে।

বিজেপি এমন ভারত তৈরি করতে চায় যা ভালোবাসাকে ঘৃণা করে ও ঘৃণাকে ভালোবাসে। ভারতের মানুষের লড়াই ঠিক করবে বিজেপি এটা চালিয়ে যেতে পারবে কিনা। প্রত্যেক দম্পতির ভালোবাসার অধিকারের সপক্ষে উঠে দাঁড়াতে হবে আমাদের, ঘৃণা ও ভেদাভেদের বিপক্ষে। ভালোবাসা-বিরোধী এই আইনগুলিকে পদে পদে অস্বীকার করতে হবে, প্রতিহত করতে হবে এবং দাবি করতে হবে যাতে তারা খারিজ হয় এবং তালাবন্দি হয়ে পড়ে থাকে চিরকালের জন্য। বিশেষ বিবাহ আইনেও পরিবর্তনের দাবি করতে হবে যাতে এই আইনের যে জায়গাগুলি পিতৃতান্ত্রিক আগ্রাসনকে সুবিধা করে দেয় বা দম্পতির বিয়ে করার নিজস্ব অধিকারে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের সুযোগ দেয় সেইসব জায়গাগুলি পরিবর্তন ঘটে।  

আন্তঃবর্ণ দম্পতিদের ওপর হিন্দু আধিপত্যবাদী গুণ্ডাদের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধেও একজোট হতে হবে। আমাদের দাবি করতে হবে যেকোনো সরকারী কর্মচারী যদি এই গুণ্ডাদের দালাল হিসেবে কাজ করে বা আগামী কোনো বিয়ের ব্যাপারে এই গুণ্ডাদলগুলিকে খবরের জোগান দেয়, তাহলে তাকে চাকরি থেকে বহিষ্কার করা হবে এবং তার বিরূদ্ধে মামলা করা হবে। ধর্ম পরিবর্তনের অধিকার বিরুদ্ধ সব আইনকে খারিজ করার দাবি করতে হবে। মহিলারা কাকে বিয়ে করবেন তা ঠিক করার অধিকার হবে শুধুমাত্র তার নিজের এবং নিপীড়িত সম্প্রদায়গুলিকে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকে নিজেদের ধর্মাচরণ বেছে নেওয়ার অধিকার দিতে হবে।

সিএএ, ভালোবাসা-বিরোধী  কানুন, তিনটি কৃষি-কানুন,  শ্রম-কোড কানুন এই সবক’টির আসল উদ্দেশ্য বহু কষ্টার্জিত সাংবিধানিক অধিকার ও স্বাধীনতার শ্বাসরোধ এবং স্বৈরাচারী কর্পোরেটমুখী হিন্দুরাষ্ট্রের কাঠামো তৈরি করা যেখানে মজদুর, কৃষক, মহিলা, দলিত ও অল্পসংখ্যকেরা সবাই পরাধীন বস্তুমাত্র হয়ে থাকবে, স্বাধীন অধিকারসম্পন্ন নাগরিক হয়ে নয়। সংবিধানবিরোধী এই আইনগুলির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে আমাদের। লড়তে হবে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সাম্য এবং ভারতের প্রতিটি মানুষের স্বাধীনতার জন্য।

hooppp

হাওড়া

বালি : ১৮ ডিসেম্বর সকালে বালি শান্তিরাম রাস্তায় সংকল্পসভা আয়োজিত হয়। লাল পতাকা উত্তোলন করে ও বিনোদ মিশ্রের প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করে শুরু হয় সভা। সভায় কেন্দ্রীয় কৃষি আইনের বিরুদ্ধ বৃহৎ গণআন্দোলন গড়ে তোলার ডাক দিয়ে বক্তব্য রাখেন নীলাশিস বসু। বিকাল ৬টায় বালি পার্টি অফিসে পার্টির পৌরাঞ্চলের সদস্যদের নিয়ে সংকল্পসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভার শুরুতে বিনোদ মিশ্রের প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করে শ্রদ্ধা জানান আইসা ও পার্টির সদস্যরা। এই সভায় কেন্দ্র ও রাজ্য কমিটির সার্কুলার পাঠ ও প্রাঞ্জল আলোচনা হয়। সন্ধ্যায় বালি গ্রামাঞ্চলে দূর্গাপুরে সংকল্পসভার আয়োজন হয়। গ্রামাঞ্চলের সদস্যদের উপস্থিতিতে এই সভা সংগঠিত হয়।

আড়ুপাড়া : সকালে কামারডাঙা অফিসে পার্টি সদস্য ও শ্রমজীবী মহিলাদের উপস্থিতিতে পতাকা উত্তোলন করে বিনোদ মিশ্রকে শ্রদ্ধা জানান। বিকালে জেলা সম্পাদকের উপস্থিতিতে সংকল্প সভায় আলোচনা ও কেন্দ্র কমিটি/রাজ্য কমিটির সার্কুলার পাঠ হয়।

বাগনান : সকালে বাঙালপুরে পার্টি ও আয়ারলার থেকে সংকল্পসভা অনুষ্ঠিত হয়। ছিলেন হাওড়া জেলা কমীটির সদস্য নবীন সামন্ত সহ স্থানীয় কর্মী সাথীরা। সভা থেকে দিল্লীর কৃষকদের প্রতি সংহতি জানিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখা হয়।

মধ্যহাওড়া : মধ্য হাওড়ার হালদারপাড়া শহীদবেদীতে সকালে সংকল্প দিবসের কর্মসূচী হয়। উপস্থিত ছিলেন জেলা সম্পাদক দেবব্রত ভক্ত, রতন দত্ত সহ স্থানীয় নেতৃত্ব। বিকালে মধ্য হাওড়ায় লোকালে সংকল্পসভা হয় কর্মী বৈঠকের মধ্যে দিয়ে। উপস্থিত ছিলেন রাজ্য নেতা পার্থ ব্যানার্জী।

24p

দক্ষিণ ২৪ পরগণা

পার্টির জেলা অফিসে সকালে স্মরণ অনুষ্ঠান হয়। রক্তপতাকা উত্তোলন করেন জেলা নেতা লক্ষীকান্ত অধিকারী। শহীদ বেদীতে মাল্যদান করেন জেলা সম্পাদক কিশোর সরকার, বজবজ শহর লোকাল কমিটির সম্পাদক অঞ্জন ঘোষ, যুব নেতা সেখ সাবির, চলার পথের পক্ষে দেবাশীষ মিত্র সহ আরো অনেকে। বিকালে জেলা সম্পাদকের নেতৃত্বে সংকল্প দিবসের আহ্বান অধ্যায়ন করা হয়।

বজবজ গ্রামে গ্রাম লোকাল কমিটির নেতৃত্বে সকালে কমরেডকে স্মরণ করা হয়। উপস্থিত ছিলেন জেলা নেত্রী দেবযানী গোস্বামী, যুব নেতা আশুতোষ মালিক, ছাত্র নেতা দীপ মালিক সহ আরো অনেকে। বিকালে বজবজ গ্রাম লোকাল কমিটির সম্পাদক ইন্দ্রজিৎ দত্তের নেতৃত্বে সংকল্প দিবসের আহ্বান অধ্যায়ন করা হয়।

বাখরাহাটে পার্টির লোকাল কমিটির অফিসে কমরেডকে স্মরণ করা হয়। মাল্যদান করেন লোকাল কমিটির সদস্য সুনীত ধাড়া, পুস্পার্ঘ্য অর্পন করেন জেলা নেতা দিলীপ পাল, শুভদীপ পাল, লোকাল সম্পাদক নিখিলেশ পাল, পূর্ণিমা হালদার, সন্দীপ ধাড়া, নুরুদ্দিন সহ আরো অনেকে। পরবর্তীতে সংকল্প দিবসের আহ্বান পাঠ করা হয়।

পূজালী পৌরসভার ১০নং এবং ১১নং ওয়ার্ডে জেলা নেত্রী কাজল দত্ত এবং অঞ্জনা মালের নেতৃত্বে সংকল্প দিবসের আহ্বান অধ্যয়ন করেন কমরেডরা।

পূর্ব বর্ধমান

পুর্বস্থলী ২নং ব্লকের ফলেয়া অফিসে কমরেড বিনোদ মিশ্রের ২২তম মৃত্যু বার্ষিকীতে সংকল্প দিবস পালন করা হয়। প্রথমেই শহীদ বেদী ও কমরেড বিনোদ মিশ্রের পতিকৃতিতে মাল্যদান করা হয় এবং শহীদ স্মরণে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। তারপর অফিসে ২৫ জন কমরেডের উপস্থিতিতে কেন্দ্রীয় কমিটির ১৮ ডিসেম্বরের আহ্বান পাঠ করা হয় এবং রাজ্য কমিটির সার্কুলার পাঠ করে আলোচনা ও মত বিনিময় করা হয়।

মন্তেশ্বর থানার কুলুট গ্রামের পার্টি অফিসে কমরেড বিনোদ মিশ্রের ২২তম মৃত্যু বার্ষিকীতে সংকল্প দিবস পালন করা হয়। কমরেড বিনোদ মিশ্রের ফটোতে মাল্যদান ও এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। রাজ্য কমিটির সদস্য আনসারুল আমন মন্ডলের নেতৃত্বে কর্মীদের নিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির ১৮ ডিসেম্বরের আহ্বান অধ্যয়ন ও আলোচনার মাধ্যমে সংকল্প নেওয়া হয়।

নাদনঘাট থানার ইসলামপুর গ্রামের কমরেডরা কেন্দ্রীয় কমিটির ১৮ই ডিসেম্বরের আহ্বান পাঠ ও আলোচনার মাধ্যমেই কমরেড বিনোদ মিশ্রের ২২তম মৃত্যু বার্ষিকীতে সংকল্প দিবস পালন করে।

মেমারী ১নং ব্লকের নিমো অফিসে সলিল দত্তের নেতৃত্বে ১৮ ডিসেম্বর উদযাপন করা হল ১৮ ডিসেম্বরের আহ্বান পাঠ ও আলোচনা করে।

১৯ ডিসেম্বর শ্রীকান্ত রানার নেতৃত্বে করন্দা গ্রামের কমরেডদের উপস্থিতিতে কমরেড বিনোদ মিশ্রের মৃত্যু দিবস পালন ও ১৮ ডিসেম্বরের আহ্বান নিয়ে আলোচনা করা হয়।

dha

 

এছাড়া কলকাতায় রাজ্য পার্টি অফিস, শহিদনগর পার্টি অফিস, বাঘাযতীন মোড়, বেহালায় কালীতলায় অফিসে সকালে সংকল্প গ্রহণ অনুষ্ঠান হয়। বিকেলে কালিতলায় প্রকাশ্য সভা সংগঠিত হয় এবং বেহালায় সন্ধ্যে ৬টায় মিছিল এলাকা পরিক্রম করে। নদীয়া, হুগলি, উত্তর ২৪ পরগণা সহ শিলিগুড়ি ও অন্যান্য জেলা ও লোকাল  অফিসকে কেন্দ্র করে সংকল্প সভা পালিত হয়। সর্বক্ষেত্রেই চলমান কৃষক আন্দোলনকে সংহতি জানানো হয়।

asss

দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার অন্তর্গত রাজপুর-সোনারপুর মিউনিসিপ্যালিটির চিন্তামনি কর বার্ডস স্যাঙচুয়ারিতে বার জন অস্থায়ী কর্মচারিকে গত দশই ডিসেম্বর থেকে ছাঁটাই-এর প্রতিবাদে কর্মীরা গেটে পিকেটিং ও অবস্থান কর্মসূচী অনির্দিষ্টকালের জন্য চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের দাবি, বকেয়া এগারো মাসের বেতন, কাজে পুনর্বহাল এবং স্থায়ীকরণ। মিলন বিশ্বাস, দীপঙ্কর সর্দার, গোপাল নস্কর, তন্ময় কুমীর প্রভৃতি কর্মীদের বক্তব্য, কোনো ছুটি ছাড়া এতদিন তাঁরা কাজ করেছেন এমনকি কোভিড পরিস্থিতিতেও। অন্যান্যদের কাজেও ব্যবহার করা হত তাঁদের। এই পরিস্থিতিতে তাঁরা কাজ হারিয়ে কোথায় যাবেন? এআইসিসিটিইউ-এর পক্ষে এই কর্মীদের পাশে থেকে লড়াই চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সমস্ত সরকারী জায়গায় জানানো হয়েছে।

kkkkdde

পূর্ব বর্ধমান

২০ ডিসেম্বর সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের মেমারী ১নং ব্লক লোকাল কমিটির উদ্যোগে নিমো অফিসের সামনে দিল্লীর কৃষক আন্দোলনের প্রয়াত কৃষক শহীদদের স্মরণে শ্রদ্ধাঞ্জাপন অনুষ্ঠান সংগঠিত করা হয়। শহীদ কৃষকদের ছবির ব্যানার ও শহীদ বেদী তৈরি করে মাল্যদান ও এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। শহীদ স্মরণে শ্লোগান ও কৃষি আইন বাতিল করার দাবি তোলা হয়। বক্তব্য রাখেন রাজ্য কমিটির সদস্য আনসারুল আমন মন্ডল। উপস্থিত ছিলেন জেলা সম্পাদক সহ জেলা কমিটির সদস্য ও লোকাল কমরেডরা।

২১ ডিসেম্বর পুর্বস্থলী ২নং ব্লকের ফলেয়া সব্জির পাইকারী বাজারে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পুর্বস্থলী-কাটোয়া এরিয়া কমিটি, এআইকেএম ও আয়ারলার উদ্যোগে দিল্লীতে নয়া কৃষি আইন বাতিলের সংগ্রামে প্রয়াত কৃষকদের স্মরণে মোমবাতি জ্বালিয়ে শহীদ বেদীর সামনে শহীদদের ফটোর ব্যানার রেখে মাল্যদান করে শ্রদ্ধাঞ্জাপন ও সভা করা হয়। সভা শেষে কৃষকদের মৃত্যুর জন্য দায়ী নরেন্দ্র মোদীর কুশপুতুল দাহ করা হয়। এই কর্মসূচীতে বাজারের ব্যাপক কৃষক জমায়েত হয়। নরেন্দ্র মোদী ও বিজেপি সরকারের প্রতি ধিক্কার প্রদর্শন করেন। এবং শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

২২ ডিসেম্বর মন্তেশ্বর বিধানসভার অন্তর্গত কুসুমগ্রাম বাজারে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের মন্তেশ্বর লোকাল কমিটির উদ্যোগে মিছিল পরিক্রমা করা হয়। তারপর বাসস্ট্যান্ডে দিল্লীতে নয়া কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে প্রয়াত কৃষকদের স্মরণে শহীদ বেদী তৈরি করে মাল্যদান ফটো সহ ব্যানার ও মোমবাতি জ্বালিয়ে শ্রদ্ধাঞ্জাপন করা হয়। শহীদদের স্মরণে শ্লোগান দেওয়া হয়। নয়া কৃষি আইন ও বিদ্যুৎ বিল ২০২০ বাতিলের দাবি তোলা হয়। শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। তারপর সভায় বক্তব্য রাখেন রাজ্য কমিটির সদস্য আনসারুল আমন মন্ডলও অশোক চৌধুরী, সভা পরিচালনা করেন সজল পাল। বাজারের ব্যাপক কৃষক জনগণ দাঁড়িয়ে বক্তব্য শোনেন ও সমস্ত কর্মসূচীর প্রতি মনোনিবেশ করেন এবং নরেন্দ্র মোদীর প্রতি ধিক্কার জানান।

ddd

দক্ষিণ ২৪ পরগণা

জেলা অফিসে কর্মসূচীর শুরুতেই চলমান কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন AIKM দঃ ২৪ পরগণা জেলা সম্পাদক দিলীপ পাল। এরপর শহীদ সাথীদের স্মরণে শহীদ বেদীতে মাল্যদান করেন দিলীপ পাল, পুস্পার্ঘ্য অর্পণ করেন আয়ারালার নেতা নবকুমার বিশ্বাস, দেবযানী গোস্বামী, ইন্দ্রজিৎ দত্ত, AIKM জেলা নেতা জগদীশ মন্ডল, মহিলা নেত্রী কাজল দত্ত, পার্টির জেলা সম্পাদক কিশোর সরকার, RYA জেলা নেতা শুভদীপ পাল, সেখ সাবির, চলার পথে সাংস্কৃতিক সংস্থার পক্ষে দেবাশীষ মিত্র সহ আরো অনেকে। এরপর শহীদ সাথীদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে এক মিনিট নিরাবতা পালন করা হয়। সমগ্র কর্মসূচী পরিচালনা করেন পার্টির জেলা সম্পাদক কিশোর সরকার।

rrr

গত ১৭ ডিসেম্বর পুর্ব বর্ধমান জেলার রায়না ২নং ব্লকে ঋণমুক্তি কমিটির উদ্যোগে ঋণগ্রস্ত মহিলাদের গণডেপুটেশন ও বিক্ষোভ সংগঠিত হয়। শতাধিক মহিলা ও পুরুষ মিছিল করে বিডিও অফিসে জমায়েত হয়ে দীর্ঘ সময় বিক্ষোভ ও বক্তব্যের পর প্রতিনিধি দল বিডিও’র কাছে ডেপুটেশন দেয়।

দাবি ছিল
১) মাইক্রোফিনান্স সংস্থার এজেন্টদের ঋণগ্রস্ত মহিলাদের উপর জুলুম, অপমান অসম্মান ও নির্যাতন বন্ধ করতে হবে।
২) ২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত গরিব জনগণের সমস্ত ধরনের ঋণ মুকুব করতে হবে।
৩) মাইক্রোফিনান্স সংস্থার উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে হবে।

তারপর মিছিল করে মাধবডিহি থানায় বিক্ষোভ ডেপুটেশন সংগঠিত হয়। সমস্ত কর্মসূচির নেতৃত্ব দেন কুনাল বক্সী ও ঋণমুক্তি কমিটির এলাকার নেতা অশোক ভট্টাচার্য, স্বর্নময়ী রায় ও দীপা প্রামাণিক।

kkmsss

শীতের কনকনে সকালে গরম কফি সহ হালকা টিফিন!! কিংবা রাতের হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় লেপের ভিতরে আধশোয়া হয়ে এক কাপ গরম চা সাথে সিগারেট!  আহা! এই নাহলে শীতকাল। উপভোগ্য শীতকাল!!

কিন্তু এই গোটা কনসেপ্ট-টাই গুলিয়ে গেল যখন আইসার আপাত ‘মধ্যবিত্ত’-ঘরের ছেলে-মেয়েরা প্রতক্ষ্য করলো শীতের রাতে দুঃস্থ সহনাগরিকদের অবস্থা। না কোনও গ্রামে যেতে হয়নি তারজন্যে। বালি বেলুড়ের বিভিন্ন বস্তি ও অস্থায়ী বসতিগুলোই সেই মানুষদের অসহায়তার সাক্ষ্য বহন করছিল। সরকারের উন্নয়নের সাক্ষ্য বহন করছিল ঘরগুলোর ছেঁড়া ত্রিপল আর ‘প্রধান বিরোধী’-‘হিন্দু ঠিকাদার’-দের হিন্দুত্বের পরশে মাখা গেড়ুয়া পতাকাগুলো যেন বিদ্রুপের ঢঙে উড়ছিল মহল্লার এদিক সেদিকে।

আইসার ছাত্রছাত্রীরা গত ২০ ডিসেম্বর থেকে টানা তিনদিন ধরে বালি বেলুড়ের বিভিন্ন অস্থায়ী বসতি ও স্টেশনবাসীদের হাতে তুলে দিল গরম জামাকাপড় ও নতুন কম্বল।

মোট ১৩৫টা পরিবারকে তুলে দেওয়া হল শীতের সম্বল। এই সাহায্য কোনও সমাধান নয়! সমাধানের জন্য আইসার সংগ্রাম এবং সমস্ত মেহনতি মানুষের সংগ্রাম একসাথেই চলবে। আগামীদিনে এই অকল্পনীয় বঞ্চনা ও অসহায়তার হিসাব ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে বুঝে নেওয়া হবে।
- অঙ্কিত  মজুমদার

kkllnmm

দিল্লীর কৃষক আন্দোলনের সংহতিতে ১৫ ডিসেম্বর মুর্শিদাবাদ জেলার বড়ঞা ব্লকের কুলী চৌরাস্তা গঞ্জে যৌথভাবে অবস্থান বিক্ষোভ অবরোধ সংগঠিত করা হয়। এক হাজারের বেশী মানুষ জমায়েত হয়েছিল। দীর্ঘ সময় অবস্থান চলে এবং বিভিন্ন বক্তা বক্তব্য রাখেন। কৃষক বিরোধী কেন্দ্রের নয়া কৃষি আইন বাতিল ও বিদ্যুত বিল ২০২০ বাতিলের দাবি তোলা হয়। অবস্থান অবরোধে ধান রাখা হল। ধান নিয়ে মিছিল হয়। আধ ঘণ্টা অবরোধ করার পর কর্মসূচীর সমাপ্ত হয়। সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পক্ষ থেকে শতাধিক মানুষ জমায়েত হয়েছিল। নেতৃত্বে ছিলেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের মুর্শিদাবাদ জেলাকমিটির সদস্য হায়দার সেখ এবং আয়ারলার মুর্শিদাবাদ জেলার সম্পাদক হাসান সেখ। এই কর্মসূচীতে আরএসপি ভাল সংখ্যক মানুষ জমায়েত করেছেন।

বহরমপুর অফিসে ১৮ ডিসেম্বর কমরেড বিনোদ মিশ্রের ২২তম প্রয়াণ দিবসে সংকল্প দিবস পালন করা হয়। ২০ জন কমরেডের উপস্থিতিতে কমরেড বিনোদ মিশ্রের প্রতিকৃতিতে মাল্যদান ও এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। তারপর অফিসে বসে কেন্দ্রীয় কমিটির ১৮ ডিসেম্বরের আহ্বান পাঠ করা হয় ও আলোচনা করা হয়। জেলা সম্পাদক রাজীব রায় সমস্ত কর্মসূচীর নেতৃত্ব দেন।

dddd

নরেন্দ্র মোদি ‘আত্মনির্ভর ভারত’ গড়ে তোলার ডাক দিয়েছেন।অথচ কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে মোদি সরকার অর্থনীতির হৃৎপিন্ডগুলিকেই বড় বড় প্রাইভেট কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে। আমাদের সকলের গর্ব ভারতীয় রেলের ১৪৯টি দূরপাল্লার ট্রেনকে পর্যন্ত মোদি সাহেব বিক্রি করে দিচ্ছেন। কয়লা খনি, খনিজ তেল, বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষেত্র, সরকারী ব্যাঙ্ক – ইত্যাদি সব কিছুই বড় বড় প্রাইভেট কোম্পানির দখলে চলে যাচ্ছে।দেশের সম্পত্তি বেচে খেলে-দেশ নিজের পায়ে দাঁড়াবে কেমন করে? আপনি যখন এই প্রশ্ন তুলছেন ঠিক তখনই নরেন্দ্র মোদির সরকার সবথেকে ভয়ংকর এক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে দেশের কোটি কোটি কৃষক, খেতমজুর যে কৃষিক্ষেত্রকে এতদিন বাঁচিয়ে রেখেছেন সেই কৃষিকেও বড় বড় কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার জন্য মোদি সরকার সমস্ত বিরোধিতাকে অগ্রাহ্য করে নতুন তিনটি আইন মারাত্মক কৃষি আইন পাশ করিয়েছে। প্রথম আইনটি কৃষিপণ্যের বাণিজ্য সংক্রান্ত এবং দ্বিতীয় আইনটি চুক্তি চাষ সংক্রান্ত। মজুতদারীকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য দেশের যে সাবেক আইন ছিল আমূল বদলে ফেলে তিন নম্বর আইনটি আনা হয়েছে।

মোদি সরকারের মন্ত্রী ও বিজেপি নেতারা সাফাই গাইছেন : সরকারের কাছে ফসল বেচার সুযোগ দেশের মাত্র ৪% চাষি পেয়ে থাকে।নতুন আইনের ফলে বড় বড় কোম্পানি ফসল কিনতে আসবে। চাষিদের আর ফড়েদের খপ্পরে পড়তে হবেনা। তাঁদের সাফ কথা, দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও বেড়ে গেছে। সরকারের নিয়ন্ত্রণ বা হস্তক্ষেপের আর তেমন দরকার নেই। এর অর্থ, সরকারী উদ্যোগে ধান, গম ইত্যাদি ফসল কেনা থেকে সরকার হাত গুটিয়ে নেবে। ফলে উপযুক্ত সহায়ক মূল্য না পেয়ে কৃষকদের দুর্ভোগ তো বাড়বেই, রেশন ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গিয়ে কোটি কোটি দরিদ্র দেশবাসী আবার এক খাদ্য সঙ্কটের মুখে পড়বেন।

চুক্তি চাষের জন্য নতুন সরকারী আইনে বলা হয়েছে, যে সব কোম্পানি কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তি ও পরিকাঠামোর জোগান দিতে এগিয়ে আসবে সরকার তাদের কার্যকলাপে বাধা দেবে না। চাষি আর এইসব কোম্পানি নিজেদের মধ্যে চুক্তি করে নতুন নতুন ফসল চাষ করবে। এইসব ফসল কৃষকরা বিদেশেও রপ্তানি করতে পারবে।

স্পষ্টতই বোঝা যায়, চুক্তি চাষের এই আইনে সরকার নীরব দর্শক হওয়ার ফলে দরকষাকষির সুযোগ থেকে ছোট কৃষক ক্রমেই পিছু হটবে। বিদেশে ফসল রপ্তানির সুযোগ নেবে তো কেবল বড় বড় কোম্পানি ও তাদের এজেন্টরাই। রপ্তানিমুখী শস্যের আবাদ বেড়ে যাওয়ায়, খাদ্যশস্যের আকাল দেখা দেবে এবং খাদ্যের জন্য দেশকে আবার বিদেশের মুখাপেক্ষী হতে হবে।

৬৫ বছরের পুরনো অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনকে বদলে যে নতুন আইন আনা হয়েছে সেখানে দানাশস্য, ভোজ্য তেল, আলু, পেঁয়াজ – এসব কিছুকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। সুতরাং এই সব নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী এখন যত খুশী মজুত করা যাবে এবং এগুলির দাম হু হু করে বেড়ে গেলেও “দু্ভিক্ষ, যুদ্ধ ইত্যাদির মতো অস্বাভাবিক পরিস্থিতি দেখা দিলে” তবেই কেবল সরকার মূল্য নিয়ন্ত্রণে হস্তক্ষেপ করবে।

সুতরাং ‘বিনিয়োগকারী খুশী হলে কৃষকও খুশী হবে’-মোদি সরকারের এহেন যুক্তিকে এই কনভেনশন তীব্র ধিক্কার জানাচ্ছে।

এই কনভেনশন কেন্দ্রের মোদি সরকারের আনা তিনটি কৃষি আইনকে অবিলম্বে প্রত্যাহার করার জন্য প্রস্তাব গ্রহণ করছে।একই সঙ্গে এই কনভেনশনের প্রস্তাবঃ পঃবঙ্গ বিধানসভায় কেন্রীয় কৃষি আইন বাতিল করার জন্য সত্বর প্রস্তাব গ্রহণ করতে হবে।

সাথে সাথে কনভেনশন দাবি জানাচ্ছে –
১) গ্রামে গ্রামে ক্যাম্প করে, কৃষকের কাছ থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে ধান সরকারকে উপযুক্ত সহায়ক মূল্যে ক্রয় করতে হবে।      
২) ভাগচাষি ও গরিব ঠিকা চাষিদের ফসলও সরকারকে ক্রয় করতে হবে।
৩) ফসলের উৎপাদন খরচের দেড়গুণ বেশি দামে সরকারকে ফসল কিনতে হবে।
৪) ক্ষুদ্র, মাঝারি ও প্রান্তিক ক,ষকদের সমস্ত কৃষিঝণ সহ মাইক্রো ফিনান্স ও স্বনির্ভর গোষ্ঠীর ঝণ মকুব করতে হবে।     
৫) সার, বীজ, কৃষিতে ব্যবহার্য বিদ্যুৎ ও ডিজেল সুলভে সরবরাহ করতে হবে।
৬) এনআরইজিএ প্রকল্পে বছরে ২০০ দিনের কাজ ও দৈনেন ৬০০ টাকা মজুরি দিতে হবে।

সিপিআই(এমএল) লিবারেশন   
-মুকুল কুমার   

cccccccf

(নিউজক্লিক-এ ২০ ডিসেম্বর প্রকাশিত হয়েছে শিঞ্জানি জৈনর এক প্রতিবেদন। চুক্তি চাষ পঞ্জাবে কি সর্বনাশ ডেকে এনেছে, এটা তার এক জীবন্ত ছবি। গুরুত্ব বিচারে এর কিছু অংশ অনুবাদ করা হলো পাঠকদের জন্য)

১৯৮৮ সালে ভারত সরকার চুক্তি চাষের সবুজ সংকেত দেওয়ার পর পঞ্জাবে “দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লব”-এর সূচনা করতে পেপসি তার প্রজেক্ট শুরু করে। ইতিমধ্যে, পঞ্জাবে প্রথম কৃষি বিপ্লবের গতিভঙ্গ হওয়া শুরু হয়। প্রধান প্রধান ফসলের উৎপাদন কমতে শুরু করে। পেপসি কোম্পানি, ভোল্টাস এবং পঞ্জাব অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রি কর্পোরেশন, এই তিনটে সংস্থার যৌথ প্রকল্পের অধীনে কৃষির বৈচিত্রকরণের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়, তার লক্ষ্য ছিল ধান ও গম উৎপাদন থেকে কৃষকদের সরিয়ে নানা ধরনের সব্জি ও ফল চাষের দিকে নিয়ে যাওয়া। ১৯৮৮ সালে ভারতীয় কিষাণ ইউনিয়ন এবং অকালি দল সোৎসাহে এই প্রকল্পকে সমর্থন করে। ১৯৯০’র গোড়ার দিকে পেপসিকোর সাবসিডিয়ারি পেপসি ফুডস পঞ্জাবে টমেটো ও লঙ্কা ফলানো শুরু করে চুক্তি চাষের মাধ্যমে। স্থানীয় এক সংস্থা নিজ্জের অ্যাগ্রো ফুডস ও টমেটো চাষ শুরু করে দেয়। কিন্তু ১৯৯০-এর শেষ থেকেই পেপসি প্রজেক্টের প্রতি মোহভঙ্গ ঘটতে শুরু করে বিকেইউ-অকালি দল ও পঞ্জাব অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ্ কর্পোরেশন ও ভোল্টাজ এর, যারা কিছুদিন আগে পর্যন্ত ছিল এর প্রবল সমর্থক।

হিন্দুস্থান লিভারের কাছে টমেটো উৎপাদনের প্রকল্পটি বিক্রি করার পর ১৯৯০ দশকের শেষে পেপসি চুক্তি চাষের মাধ্যমে আলু উৎপাদন শুরু করে। ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত শ’য়ে শ’য়ে টমেটো ও লঙ্কা চাষিদের সাথে চুক্তি প্রথায় ব্যবসা করার পর এবার পেপসি মাত্র কয়েক ডজন আলু ও লঙ্কা চাষিদের সাথে চুক্তি করতে শুরু করলো। আলু চাষিরা যে উৎপাদন করতো তার মাত্র দশ শতাংশ তারা সংগ্রহ করতো। তখন বলা হয়েছিল, পেপসি নরম পানীয়র সাতটা বটলিং প্ল্যান্ট পঞ্জাবে স্থাপন করবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মাত্র একটাই দিনের আলো দেখল। যে চাষিরা পেপসির সাথে চুক্তিবদ্ধ ছিল, তারা দেখল পেপসি পরিমাণ ও গুণের দিক থেকে অল্প পরিমাণে কমা বীজ দিচ্ছে। তারা এটাও অভিযোগ করেন, যে সারের সুপারিশ তারা করছে, তার দামও অনেক বেশি।

হিন্দুস্থান লিভার সম্পর্কে চাষিদের অভিযোগ, চুক্তিবদ্ধ চাষিরা উদ্বৃত্ত ফসল ফলালেও চুক্তিবদ্ধ নয় এমন চাষিদের কাছে তারা চারাগাছ বিক্রি করতে শুরু করে। অতিরিক্ত উৎপাদন হলেও চাষিদের কাছ থেকে সেই ফসল তারা কিনতো না। এটা বারবার হয়েছে। পঞ্জাবে পেপসির মতো বৃহৎ এগ্রি-বিজনেসের কাছ থেকে এই  অভিজ্ঞতার দরুণ এ রাজ্যে চুক্তি চাষের প্রতি রীতিমতো নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে।

যে তিনটি কৃষি আইন পাশ হয়েছে, তার মধ্যে একটা আইন চুক্তি চাষ সংক্রান্ত। কৃষকেরা আশংকা প্রকাশ করছেন যে এই আইনের ফলে তারা নিজের জমিতেই মজুরি দাসত্বে বাঁধা পড়বে। বিশাল বিপুল এগ্রি-বিজনেসগুলো অসম ময়দানে নিজের শর্তে ব্যবসা করবে — কখন কি ফসল ফলাতে হবে, তার দাম, গুণমান কি হবে, সব ব্যাপারেই ছড়ি ঘোড়াবে।

সজ্জন সিং, বয়স ৬৮ জানান, “আমাদের মতো ছোট চাষিদের কোনো লাভই হবে না এই চুক্তি চাষে। প্রথম প্রথম কর্পোরেটরা ভাল দাম দেবে। তারপর তারা কব্জা করে নেবে বাজার, ও দাম নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করবে। দিল্লি থেকে ৪৩০ কিলোমিটার দূর তারণ জেলা থেকে তিনি এসেছেন আন্দোলনে যোগ দিতে।

অমৃতসরের কোহালী গ্রামের দেহাতী মজদুর সভার প্রধান লাভ সিং জানালেন, কেন এই দীর্ঘ পথ উঁজিয়ে কৃষিমজুর ও ছোট চাষিরা দিল্লি এসেছেন বিক্ষোভ দেখাতে। তিনি নিজেই ভূমিহীন কৃষক এবং তপশীলী জাতির।

“আমরা জানি এই সমস্ত বৃহৎ কর্পোরেট ঘরানাগুলো আইনের সুযোগ নিয়ে সমস্ত কিছুই নিজেদের কব্জায় রাখবে। তারাই নির্ধারণ করবে ফসলের দাম, আর আমরা রসাতলে যাব”।

যে সমস্ত হাজারে হাজারে কৃষকেরা কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে দিল্লি অভিমুখে যাচ্ছেন, তাদের রয়েছে চুক্তি চাষের বাস্তব নির্মম অভিজ্ঞতা। তাদের কাছে এই সমস্ত কর্পোরেটদের চুক্তি চাষ নতুন কোন ব্যাপার স্যাপার নয়, জীবনের অভিজ্ঞতায় যা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। কয়েক দশকের অনুশীলনের পর পঞ্জাবে এই চুক্তি চাষ আজ ব্যর্থ, কৃষক স্বার্থবিরোধী হিসাবেই প্রতিপন্ন হয়েছে। পঞ্জাব ছিল প্রথম রাজ্য যেখানে ২০০২ সালে চুক্তি চাষ চালু হয়। আর তার এক দশক পর, ২০১২ সালে তা বাতিল করা হয়।

চুক্তি চাষ হলো, চাষের ও কৃষি পণ্যের যোগানের ব্যবস্থাপনা, যা চাষি ও ব্যবসায়িক কোম্পানিগুলোর মধ্যে পূর্বনির্দ্ধারিত দামের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। এ ক্ষেত্রে, খরিদ্দার (যারা বৃহৎ কর্পোরেট বা ব্যবসায়িক কর্পোরেশন হয়) চাষাবাদের নানা সরঞ্জাম, যেমন, বীজ, সার, কীটনাশক ও তার সাথে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত সুবিধা সরবরাহ করে থাকে। খরিদ্দারের প্রয়োজন অনুযায়ী কৃষককে উৎপন্ন করতে হবে নির্দিষ্ট পরিমাণ ও গুণ সম্পন্ন ফসল। আধুনিক চুক্তি চাষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটা সংঘবদ্ধ ব্যবস্থা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে, যেখানে কৃষির কর্পোরেটকরণ পৌঁছেছে শিখরে, আর বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বহুজাতিক কর্পোরেট সংস্থাগুলো গোটা কৃষি উৎপাদন ও বিপণনকে রেখেছে নিজেদের হাতের মুঠোয়।

১৯৮৬ সালে পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী অমরিন্দর সিংএর আমলে গঠিত হয় এক বিশেষজ্ঞ কমিটি আর লক্ষ্য ছিল কৃষির বৈচিত্র্যকরণ। এস এস জোহল ছিলেন সেই কমিটির চেয়ারম্যান। এই কমিটি প্রস্তাব দেয়, গম ও ধানের অধীনে কুড়ি শতাংশ জমিতে অন্য বাণিজ্যিক ফসল, যেমন, ফল ও সব্জি চাষ করা হবে। তারপর, আবার ২০০২ সালে এই কমিটি প্রস্তাব দেয়, ধান ও গমের অধীনে থাকা দশ লক্ষ হেক্টর জমিতে ফলানো হবে বাণিজ্যিক ফসল। তারপর, পঞ্জাব সরকার ২০০২ সালে প্রবর্তন করলো চুক্তি চাষ প্রকল্প। চুক্তি চাষকে গতি দিতে গঠিত হয় পঞ্জাব এগ্রো ফুডগ্রেণ কর্পোরেশন (পিএএফসি)-কে নিয়োগ করা হয় নোডাল এজেন্সি হিসাবে, যারা কৃষকদের নানা সরঞ্জাম দেবে, টেকনিক্যাল নজরদারী রাখবে, আর কৃষকদের কাছ থেকে ক্রয় করবে উৎপন্ন ফসল।

পিএএফসি ছাড়াও অনেক এগ্রিবিজনেস সংস্থা পঞ্জাবে সরাসরি কৃষকদের সাথে চুক্তি চাষ শুরু করে। ১৯৮৯-এর গোড়ায় পেপসিকো পঞ্জাবের হোশিয়ারপুরে টমেটো প্রক্রিয়াকরণ প্ল্যান্ট স্থাপন করে। তারপর, টমেটো কেনা বন্ধ করে পটেটো চিপসের জন্য আলু কিনতে শুরু করে। একেবারে প্রথম দিকে মনে করা হচ্ছিল যে পঞ্জাবে চুক্তি চাষ কৃষির বৈচিত্র্যকরণ ও কৃষকদের আয় বাড়াতে সফল হয়েছে। কিন্তু ২০০০-এর পর থেকেই সমস্যার কালো মেঘ জমতে শুরু করে। প্রখ্যাত অর্থশাস্ত্রী জয়তী ঘোষ দেখান, চুক্তি চাষের ফলে কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তারা ক্রমেই মুখ ফেরাতে শুরু করেন। বহু অনুসন্ধামূলক সমীক্ষা দেখায়, বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থাগুলো নানা ধরনের ছক ও অসৎ উপায় নেওয়ায় কিভাবে কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। দেখা গেছে, পূর্ব নির্দ্ধারিত দাম না দিয়ে কোম্পানিগুলো তার থেকে অনেক কম দামে ফসল বিক্রি করতে কৃষকদের বাধ্য করেছে।

বেশ কিছু ক্ষেত্রে, অবশেষে পিএএফসি-কে ময়দানে নামতে হয় চাষি ও কোম্পানির মধ্যেকার গ্যারান্টার হিসাবে। আর, কোম্পানিগুলো প্রতিশ্রুতি মতো যে ফসল কেনেনি, পিএএফসি-কে তাই কিনতে হয়।

২০১২ সালের পর নতুন সরকার পারিপার্শ্বিক নানা কারণে আগ্রহ হারাতে শুরু করে, কেন্দ্র এ ব্যাপারে সাহায্যের হাত বাড়ায় নি, ফলে তারপর থেকে চুক্তি চাষ বাতিল হতে শুরু করে।

পঞ্জাব হরিয়ানার নানা অনুসন্ধান থেকে এটা স্পষ্ট যে চুক্তি চাষ কৃষকদের সামনে বিরাট এক সমস্যা নিয়ে হাজির হয়েছে। প্রতিশ্রুতি মতো উৎপন্ন ফসল না কেনা, নিম্ন মানের কৃষি সরঞ্জাম দেওয়া, বিলম্বিত পেমেন্ট, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া প্রভৃতি হল নানা কারণ। আমেদাবাদের ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট এর অধ্যাপক শুকপাল সিং বলেছেন, “চুক্তি চাষ কেবলমাত্র কোম্পানির স্বার্থবাহী। এটা কোনোভাবেই কৃষকদের স্বার্থে পরিচালিত হয় না। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে বা বাজারে দাম অস্বাভাবিক হারে পড়ে গেলে কৃষকেরা বিরাটভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।”

সিং এটাও জানিয়েছেন, কোম্পানিগুলো বৃহৎ ও মাঝারি কৃষকদের সঙ্গে চুক্তি চাষ করার আগ্রহ দেখায়। এর ফলে বিপরীত এক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে পঞ্জাবে। সেখানে বৃহৎ-মাঝারি কৃষকেরা ছোট/মাঝারি কৃষকদের কাছ থেকে জমি লিজে নেয়।

ভারতে এখনও প্রায় ৭০ শতাংশ পরিবার জীবন ধারণের জন্য কৃষির উপর নির্ভরশীল আর তাদের মধ্যে প্রায় ৮২ শতাংশই হলেন ছোট মাঝারি কৃষক। অধ্যাপক শুকপাল সিং জানিয়েছেন, পঞ্জাবে কৃষি অবস্থা তীব্র সংকটাপন্ন, আর ছোট কৃষকেরা বিরাট সমস্যায় জর্জরিত। ছোট কৃষকদের একর পিছু ঋণ সব থেকে বেশি, ছোট মাঝারি কৃষকরাই সব চেয়ে বেশি আত্মঘাতী হচ্ছেন। ছোট কৃষক ও প্রান্তিক চাষিরা ক্রমেই জমি হারাচ্ছেন, কৃষি জমি তাদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে “কৃষকেরা তাদের জীবনের অভিজ্ঞতার উপর দাঁড়িয়ে তাই কৃষি আইনগুলোর লাগাতার বিরোধিতা করছেন, এই আন্দোলন নতুন নতুন সীমানা, পরিধি জুড়ে ব্যাপ্ত হচ্ছে, টেনে এনেছে সারা ভারতবর্ষের মানুষকে — আবালবৃদ্ধবনিতা আজ সামিল এই মহারণে।

মোদী সরকারের জেদ নাকি কর্পোরেটদের স্বার্থবাহী আইনকে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত করা দুর্দমনীয় হিম্মত, কে জয়ী হবে তা বলবে অনাগত ইতিহাস।

- অতনু চক্রবর্তী    

daaajob

পশ্চিমবাংলায় ক্ষমতায় আসীন হওয়ার জন্য উদগ্রিব বিজেপি। ‘অখন্ড ভারত’ নির্মাণের লক্ষ্যে বঙ্গবিজয় তাদের কাছে অপরিহার্য হয়ে পড়েছে এবং তাই বর্গিবাহিনী নখ দাঁত উন্মোচিত করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে রাজ্যের ওপর। সাবেকি সমস্ত আগ্রাসনের মতো এই আক্রমণও দুমুখো – একদিকে আছে আইন শৃংখলাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, যাবতীয় শিষ্টাচার বিসর্জন দিয়ে, গাড়ি চাপা দিয়ে বিরোধী নেতাদের মেরে ফেলার হুমকির মতো মধ্যযুগীয় বর্বরতা আবার অন্যদিকে আছে মনভোলানো ৭৫ লাখ চাকরির আষাঢ়ে গপ্পো। খবরে প্রকাশ নির্বাচনে জয়লাভ করলে নতুন বিজেপি সরকার আগামী পাঁচ বছরে ৭৫ লক্ষ বেকার ছেলেমেয়েকে চাকরি দেবে। তাঁরা মানুষের ঘরে ঘরে যাবেন, ফর্ম ভর্তি করাবেন এবং দুই মাসের মধ্যে চাকরির একটি ‘প্রতিশ্রুতি কার্ড’ প্রার্থির হাতে তুলে দেবেন। রাজ্যবাসীর চক্ষু চড়কগাছ তো হয়েছেই বিরোধীরাও মন্তব্য করেছেন যে এটা কোনো ‘প্রতিশ্রুতি কার্ড’ নয় এটা আদপে একটি ‘প্রতারণা কার্ড’।

গালভরা প্রতিশ্রুতি ও ভারতীয় গণতন্ত্র অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। ২০১৪ সালে প্রত্যেক ভোটারের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ১৫ লাখ টাকা জমা করার অঙ্গীকার ইতিহাসে এক অভাবনীয় জুমলা হিসাবে স্থান করে নিয়েছে। নির্বাচনে জয়লাভ করতে একটা দল যে কী বেলাগাম মিথ্যাচার করতে পারে এটি তার উৎকৃষ্টতম প্রমাণ। তারপর তো এলো বিমুদ্রাকরণ নামে সেই মহাবিপর্যয় যখন বলা হল এই একটা পদক্ষেপের ফলে সমস্ত কালো টাকা উদ্ধার হবে এবং তথাকথিত সন্ত্রাসবাদ এবং দেশদ্রোহী কার্যকলাপ নির্মূল হয়ে যাবে। উল্টে দেখা গেলো সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত আমানত লুটপাঠ করে কয়েক হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে নীরব মোদী ও মেহুল চোক্সি নামক দুই জালিয়াত দেশ ছেড়ে পলায়ন করল। শাসক তবুও অননুতপ্ত। এই ধরণের দু’চারটে ঘটনা হিন্দু রাষ্ট্রের দিকে তাদের যাত্রাপথে মামুলি কিছু যতি চিহ্ন মাত্র। ২০১৯-এর ভোটে আরও মনোমোহিনী প্রতিশ্রুতি তারা বাজারে ছাড়ল, এবার দুই কোটি চাকরি, বেকার সমস্যার একটা হেস্তনেস্ত করেই তাঁরা ছাড়বে। উল্টে দেখা গেলো লকডাউনের সময় দুই কোটি স্থায়ী চাকরি বিলোপ হয়ে গেল। লকডাউন কোনো অজুহাত হতে পারে না কারণ বিভিন্ন রিপোর্ট দেখাচ্ছে মহামারীর প্রাদুর্ভাবের আগেই শহরে বেকার সমস্যা ২০%র আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছিলো, যা এক কথায় অভূতপূর্ব। ঐ নির্বাচনের সঙ্কল্পপত্রে তারা অঙ্গীকার করেছিলো যে কৃষকদের আয় ২০২২ এর মধ্যে তারা দ্বিগুণ করে দেবে, উল্টে দেখা যাচ্ছে পুরো কৃষিক্ষেত্রটা তারা কিষাণদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আম্বানি আদানিদের হাতে তুলে দেবার আয়োজন করে ফেলেছে।

বেকার সমস্যার সমাধান করতে সম্পূর্ণ অপারগ শাসক দল এখন একটা নতুন কায়দা চালু করার চেষ্টা করছে। তারা বলছে সরকার খালি চাকরি দেবে এমনটা হবে না, সরকার উপার্জনের সুযোগ, বাণিজ্যবান্ধব পরিবেশ তৈরি করে দেবে। কম সুদে ব্যাংক ঋণ পাওয়া যাবে, আমলাতান্ত্রিক লালফিতে আলগা হবে, কাঁচামাল সহজলভ্য হবে যাতে প্রচুর নতুন সংস্থা ও উদ্যোগপতি তৈরি হয়। এরফলে নতুন সব ক্ষেত্র তৈরি হবে যা বেকারত্ব লাঘব করতে সাহায্য করবে। প্রথম কথা সরকার রেল, ব্যাংক, সরকারী চাকরিতে নিয়োগ প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে এরফলে বেকার সমস্যা সমাধান করার বিপুল ক্ষেত্র রুদ্ধ হয়ে গেছে। ব্যাংকের প্রচুর কাজ এখন আউটসোর্সিং, বা বাইরের সংস্থাকে দিয়ে করানো হয়। রেলের ক্যাটারিং তো বেসরকারী হাতে চলেই গেছে, তেজস এক্সপ্রেসের মতো বেসরকারী ট্রেন চালু হয়েছে, এছাড়া বিভিন্ন বড় স্টেশনে হকারদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হচ্ছে। বিশাল বিপুল জনস্রোতে এই সব মানুষ যে কোথায় হারিয়ে গেছেন তা কারো জানা নেই। সরকারী ক্ষেত্রে প্রতি তিন মাস পঞ্চাশ ঊর্ধ্ব প্রতিটি  কর্মচারির কাজের মূল্যায়ন করা চালু হচ্ছে। যাঁদের মনে করা হবে ‘অলস’, ‘ফাঁকিবাজ’ ইত্যাদি তাঁদের অবসর গ্রহণ করতে হবে। সুতরাং নতুন চাকরি তো দূর অস্ত, পুরানো কর্মচারিদের নিজেদের কাজ টিকিয়ে রাখাই এখন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দ্বিতীয়ত স্টার্ট-আপ বা নতুন ব্যবসা শুরু করতে যুবক যুবতীরা দ্বিধাগ্রস্ত। ব্যাংকে নতুন ব্যবসা-ঋণের জন্য আবেদনে কোন উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি হয়নি। অথচ অর্থমন্ত্রী মে মাসে এমএসএমই (মাইক্রো, স্মল, মিডিয়াম) শিল্পে অতিরিক্ত জামিন বিহীন (কোল্যাটারাল) ৩ লক্ষ কোটি টাকার ঋণ পাওয়ার সুযোগের কথা ঘোষণা করেছেন। কিন্তু ব্যবসা শুরু করলেই তো হল না, ক্রেতা কোথায়? লোকের হাতে টাকা নেই, কে কিনবে নতুন সব পণ্য? সরকার ‘ইজ অফ ডুয়িং বিজনেস’-এর কথা বলে এবং সেটার জন্য নাকি শ্রম আইন কঠোর করা প্রয়োজন। কিন্তু কয়েক বছর আগে চেম্বার অফ কমার্সের রিপোর্ট বলছে যে আমাদের দেশে ব্যবসা করার মূল প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে, জমি পাওয়ার অসুবিধা, পরিকাঠামোর অভাব, আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা, অনভিপ্রেত সরকারি হস্তক্ষেপ ইত্যাদি। শ্রমিক সমস্যা তালিকায় অনেক পরে আসছে। এখন এরসাথে যোগ হয়েছে চাহিদার অভাব। সুতরাং রাতারাতি প্রচুর উদ্যোগপতি তৈরি হবে এবং তার ফলে চাকরির বাজারে জোয়ার আসবে এটা একটা ধাপ্পাবাজি ছাড়া আর কিছু না।

মিথ্যাচার, জুমলা এই কেন্দ্রীয় সরকারের ইউএসপি। বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে প্রচুর ঢাকঢোল পেটানো হয়, কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে জানা যাবে যে যতটা সাফল্য দাবি করা হয়, বাস্তবে তা অনেক কম। ধরা যাক ‘প্রধানমন্ত্রী উজালা যোজনা’ যা বিনামুল্যে নিম্নবিত্তের ঘরে রান্নার গ্যাস পৌঁছে দেয়। দাবি ইতিমধ্যে ৬ কোটি পরিবার এই সুযোগ পেয়েছে। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে এর ২০% নতুন সিলিন্ডার কেনার পয়সা না থাকার কারণে এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ঘরে ওভেন, সিলিন্ডার পরে থাকে তাঁরা চিরকালের মতো কাঠের আগুনই ব্যবহার করেন। আয়ুষ্মান ভারতে দাবি করা হয় ৫০ কোটি মানুষ নাকি স্বাস্থ্যবিমা পেয়েছে, আদপে মাত্র ২.৮৯ কোটি মানুষ বেনিফিসিয়ারি কার্ড পেয়েছেন। দাবি করা হয় দেশ উন্মুক্ত জায়গায় শৌচকর্ম থেকে মুক্ত, বাস্তবে ২৩% মানুষ নতুন তৈরি হওয়া শৌচাগার ব্যবহারই করেন না। মূল কারণ হচ্ছে জলের অপ্রতুলতা, নলবাহিত জলের ব্যবস্থাপনার অভাব এবং অবশ্যই দারিদ্র। যাঁদের মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের সমস্যা তাঁরা শৌচাগার নিয়ে কী করবেন! গ্রামে গেলে দেখা যাবে শৌচাগারগুলো অনেক জায়গাতেই গুদাম ঘরে পরিণত হয়েছে। শেষ একটা উদাহরণ দেখা যাক যা এখন খুব প্রাসঙ্গিক - কৃষকদের এমএসপি (নূন্যতম সহায়ক মূল্য)। সরকার নির্বিকার ভাবে দাবি করছে যে তারা নাকি স্বামীনাথন কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী এমএসপি দিচ্ছে। কমিটির সুপারিশ হচ্ছে সমস্ত খরচা (বীজ, সার, কীটনাশক, সেচ), ব্যাংক ঋণের ওপর সুদ, পারিবারিক শ্রমের মূল্য, লিজ নেওয়া জমির ভাড়া সব যোগ করে সেটার ওপর দেড়গুণ কৃষককে দিতে হবে। সরকার উপরে উল্লেখিত সমস্ত খরচা এবং মজুরি ব্যতীত আর কিছুই দিচ্ছে না। এর ফলে প্রতি কুইন্টালে চাষির ৩০০-৪০০ টাকা লোকসান। মিথ্যাচার, জুমলাবাজিকে এই সরকার একটা শিল্পে পরিণত করেছে। এই ৭৫ লক্ষ চাকরির গপ্পো ধাপ্পাবাজির সেই লম্বা তালিকার আর একটি মাত্র।

- সোমনাথ গুহ     

bbanp

ভারত সরকারের রেজিস্টার জেনেরাল অব ইণ্ডিয়া এনপিআর, এনআরসি ও সেন্সাস পরিচালনাকারী সংস্থা। সম্প্রতি তারা প্রতিটি রাজ্য সরকারের কোর্ডিনেটরকে চিঠি পাঠিয়ে নির্দেশ দিয়েছে প্রতিটি অঞ্চল এলাকা কলোনী ও বাড়ির সর্বশেষ হিসেব ‘চার্জ রেজিস্টারে’ লিপিবদ্ধ করতে। এই রেজিস্ট্রার বুক এনপিআর, এনআরসি ও সেন্সাসের অবিচ্ছেদ্দ এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রায় ৩০ লক্ষ এনুমারেটর (তথ্য সংরহকারী) — সরকারী  কর্মচারী ও সরকারী স্কুলের টিচারদের মধ্যে থেকে যাদের নিয়োগ করা হবে — প্রত্যেকে ৬৫০-৮০০ জন ব্যক্তির তথ্য সংগ্রহ করবেন। অনলাইন ও অফলাইন —দুভাবেই এই ডেটা কালেকশন চলবে।

এই এনপিআর হল এনআরসির প্রথম ধাপ। বিজেপি সরকার এনআরসি করতে বদ্ধপরিকর। কোটি কোটি মানুষকে তারা বেনাগরিক বানাতে চায়। আসামে ২০ লক্ষ মানুষকে ওরা বেনাগরিক করেছে যার মধ্যে সব ধর্ম ও ভাষার মানুষেরাই আছেন। আসামে কাট অফ ডেট ছিল ১৯৭১-এর ২৪ সেপ্টেম্বর। দেশের অন্য সব রাজ্যে তা ১৯৪৮-এর ১৯ জুলাই। অর্থাৎ ১৯৪৮ সালের ১৯ জুলাইয়ের আগের জমির কাগজ দেখাতে না পারলে মানুষের চাকরি, ব্যবসা, জমিজমা যা আছে সব তামাদি হয়ে যাবে, চিহ্নিত করা হবে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসাবে। বলাই বাহুল্য কোটি কোটি গরিব, মধ্যবিত্ত মানুষ, কোটি কোটি আদিবাসী মূলনিবাসী মানুষ উৎখাত হবেন। অনেকের জায়গা হবে ডিটেনশন ক্যাম্পে। আসাম তার প্রমাণ। আসাম থেকে শিক্ষা নিয়ে সারা দেশের মানুষই এনআরসির বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে। এনপিআর-এ বাবা মায়ের জন্মস্থান, জন্ম-তারিখ এবং বসবাসের শেষ ঠিকানা ও ভাষা সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ নিয়ে আপত্তি তোলে অনেক রাজ্য। দেশের ১৩টি রাজ্য সরকার ও ইউনিয়ন টেরিটরি এনআরসি ও নয়া নাগরিকত্ব আইন বিরোধিতা করেছে। তবু জনজীবনে এই বিপর্যয় নামিয়ে আনছে বিজেপি সরকার।

vvvvnur

প্রায় গোটা বছর করোনার বিরুদ্ধে প্রাণপাত সার্ভিস দিয়ে নার্সরা কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক থেকে যে দারুণ গিফট পেতে চলেছে তা হলো “ন্যাশনাল নার্সিং অ্যাণ্ড মিডওয়াইফারি কমিশন (NNMC) বিল, ২০২০”। ৭৩ বছরের পুরনো ‘ইণ্ডিয়ান নার্সিং কাউন্সিল (INC) অ্যাক্ট’ সরিয়ে এই নতুন আইন আসতে চলেছে। নার্সদের সংগঠন এই বিলের বিরোধিতা করে জানিয়েছে যে নতুন আইন নার্সিং এর স্বায়ত্বতা কেড়ে নেবে, বহু দিনের সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে অর্জিত নার্সিং ডিরেক্টরেট গুরুত্বহীন হয়ে যাবে এবং নার্সিং অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের সমস্ত কাজকর্ম ডিরেক্টর জেনেরাল অব হেলথ সার্ভিস দপ্তর দ্বারা কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে।

নতুন আইনে বলা আছে কেন্দ্রীয় সরকার মনোনীত বোর্ডের নিয়ন্ত্রণে নার্সিং শিক্ষা, অনুশীলন ও প্রশাসন চলবে। সেখানে কোনও নির্বাচিত প্রতিনিধি থাকবে না। রাজ্যগুলি থেকে নার্স-প্রতিনিধিও থাকবে না। কেবল সরকার মনোনীত ব্যক্তিরা (নার্সিং এবং অন্যান্য) এই বোর্ডগুলোর সদস্য হবেন। বহু কষ্টে অর্জিত স্বশাসন (অটোনমি) অবলুপ্ত হবে। এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিল যা ভবিষতে নার্সিং-এর সবকিছু নির্ধারণ করবে তা মূল পক্ষ অর্থাৎ নার্সদের সাথে কোনোরকম আলোচনা ছাড়াই তড়িঘড়ি পাস করানো হচ্ছে। নার্সিং জগত নার্সরা সবথেকে ভাল বুঝবেন ও চালাতে পারবেন। প্রস্তাবিত অ্যাডভাইসারি কমিটিতে নার্সের থেকে অন্য সদস্য বেশি রাখা এবং সংখ্যাধিক্যে সিদ্ধান্ত নেওয়া একেবারেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নয়। এই প্রক্রিয়ায় নার্সিং পেশা তার গুরুত্ব হারাবে। স্বাস্থ্য পরিষেবায় তার প্রতিফলন অনিবার্য। কোভিড মোকাবিলার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জরুরি ভিত্তিতে কী ধরনের ট্রেনিং বা অনুশীলন প্রয়োজন সে বিষয়েও সম্মুখ সমরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নার্সিং কর্মীদের যৌথ অভিমতই সবচেয়ে কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারে। সামনের সারির কর্মী হিসেবে যে কোনো কঠিন পরিস্থিতিতে নার্সদের ‘সেরাটা’ দেবার চাপ থাকেই, অর্জন করতে হয় আরো ভালো করে কাজ করার মানবিক ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা। আর এই পরিপ্রেক্ষিতে সরকারী হস্তক্ষেপ নয়, দরকার পেশাগত নেতৃত্বকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া।

নার্সিং পেশা একটা অত্যন্ত মর্যাদার পেশা এবং এর সাথে জড়িত আছে সমস্ত  চিকিৎসা পরিষেবা। আলোচ্য ক্ষেত্রে INC’র মধ্যে যে যে ত্রুটি আছে বা যদি দুর্নীতির অভিযোগ থেকে থাকে তা কি বিদ্যমান আইন দিয়ে শোধরানো যায়! অথবা, নতুন আইনটি নার্সিংয়ের উন্নতির জন্য যা করবে বলে দাবি করা হচ্ছে সেগুলো INC’র গণতান্ত্রিক কাঠামোর মাধ্যমেই তো বলবত করা যেত! স্বাধীন ভারতে গড়ে ওঠা INC’র ৭৩ বছরের নিজস্ব পরিচিতি, গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য, অথরিটি, সম্পদ, কাজের পরিধি, গবেষণা, সর্বোপরি সব স্বাধিকার-স্বশাসন একটা বিল এনে তড়িঘড়ি সরকারের কুক্ষিগত করার প্রস্তাব মেনে নেব কোন যুক্তিতে? ভারতবর্ষের তিরিশ লক্ষাধিক নার্সদের পক্ষেও এই পরিবর্তন মেনে নেওয়া সহজ নয়।

(সুব্রতা সরকারের লেখা থেকে সংক্ষেপে)    

mummmaaa

ভারত যখন তার স্বাধীন সংবিধান রচনা করছিল তখন কেবল দুশো বছরের ব্রিটিশ শাসন থেকে নয়, বরং মুক্তি পেতে চেয়েছিল আরও বহু বহু যুগ ধরে – “ছয় হাজার বছর ধরে চলে আসা” -- ঐতিহাসিক অন্যায়ের শেকল থেকে। ডক্টর ভীমরাও আম্বেদকরের নেতৃত্বে সংবিধান রচনার বছরগুলিতে ভারতেতিহাসের সেই আদি দ্বন্দ্বের বিনম্র প্রতিনিধি হিসেবে সগৌরবে নিজেকে তুলে ধরেছিলেন মারাং গোমকে জয়পাল সিং মুণ্ডা।

ভারতে ব্রিটিশ আসার বহু যুগ আগে থেকেই আদিবাসীরা যে কোনঠাসা এবং ব্রিটিশ চলে যাওয়ার পরও যে সব বদলে যাবে না তা জয়পাল সংবিধানসভার বিভিন্ন বিতর্কে বারবার বলেছেন। ১৯৪৬’র ১৯ ডিসেম্বর সংবিধানসভায় তাঁর প্রথম বক্তৃতাতে নিজেকে তিন কোটি আদিবাসীর ‘জংলি’ প্রতিনিধি হিসেবে পরিচয় দিয়ে সুস্পষ্ট ভাষায় স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, “স্যর, ভারতীয় জনগণের মধ্যে সবচেয়ে হীন আচরণ করা হয়েছে আমার জনগোষ্ঠির সাথেই। বিগত ৬০০০ বছর ধরে অবমাননা আর অবহেলা করা হয়েছে। ... বিগত ৬০০০ বছর আমার মানুষেরা আপনাদের জাতিবিদ্বেষের কারণে ভুগছে, হিন্দু রেসিজম এবং বাকি অন্য সকল রেসিজমের ফল ভুগছে”। যারা সিলেক্ট করলেন তাঁদের মাথায় একবার এল না বিষয়টা! মৌলিক অধিকার কমিটিতে একজনও আদিবাসী প্রতিনিধি নেই কেন? শিক্ষা ও চাকুরিতে এসসি এসটিদের জন্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন জয়পাল সিং মুণ্ডা। বস্তুত সমাজে প্রান্তিক করে রাখা সমস্ত অংশের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার বিষয়ে তাঁর মতো গভীরভাবে সোচ্চার বোধহয় সংবিধানসভায় আর কেউ ছিলেন না। সংবিধানসভার কাঠামো নিয়েই প্রশ্ন তুলে জয়পাল সরাসরি বলেন, “সংবিধানসভায় বড্ড বেশি পুরুষ আধিক্য। আমরা আরও অনেক বেশি মহিলা প্রতিনিধি চাই, বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতের মতো মহিলা, যিনি আমেরিকাতে রেসিয়ালিজম ধ্বংস করার কাজে জয় অর্জন করেছেন”। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন – পরামর্শদাতা কমিটিতে কোনও আদিবাসী মহিলার নাম নেই কেন? যারা সিলেক্ট করলেন তাঁদের মাথায় একবার এল না বিষয়টা! মৌলিক অধিকার কমিটিতে একজনও আদিবাসী প্রতিনিধি নেই কেন? আদিবাসীদের লোকাচার ও প্রথাগত ঘরোয়া অস্ত্র ধারণকে অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত করা রোধ করেছিলেন জয়পাল। আদিবাসীদের জন্য স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল গঠনের জন্য লড়েছেন। জল জঙ্গল জমিন থেকে আদিবাসীদের উচ্ছেদের বিরুদ্ধে তীব্র তিক্ত বিতর্ক করেছেন। উন্নয়নের যৌক্তিকতায় উচ্ছেদ ও পুনর্বাসনকে সহজেই মান্যতা দিয়ে দেওয়া প্রসঙ্গে সেই চল্লিশের দশকেই গভীর প্রশ্ন তুলেছিলেন, গরিবমুখী জনমুখী নীতির জন্য লড়েছিলেন জয়পাল। ‘চিত্তরঞ্জন লোকো’ প্রসঙ্গে বলছেন, “উচ্ছেদ হওয়া সাঁওতালদের ক্যাশ টাকা দেওয়া হল, তিন সপ্তাহের মধ্যে তাঁরা ভূমিহীন মজুরে পরিণত হলেন … আমরা কি দেশে ভূমিহীন মজুরের বাহিনীই বাড়িয়ে চলতে চাই?”  ‘দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন বিল’ নিয়ে সংবিধানসভায় ১৯৪৮’এর ১৪ ফেব্রুয়ারী বলেছিলেন, “আমরা ওদের আরও ভালো বাড়ি বানিয়ে দেব – একথা বলে দিলেই তো হবে না। মূল কথাটা হল ওদের আত্মসম্মানবোধটা কি ফিরিয়ে দেবেন? ‘টেগর’-এর শান্তিনিকেতনের উদাহরণ টেনে বলেছিলেন যে, সাঁওতালদের নাচ আসলে ভারতীয় জীবনের ছন্দ। সংবিধানসভার সমগ্র বিতর্কে বারবার একটি বার্তা দিয়ে গেছেন তিনি, “প্রকৃত গণতন্ত্রের অন্তর্বস্তু নিহিত থাকে সহবাসী মানুষের ওপর বিশ্বাস ভরসা না হারানোর ওপর”। আদিবাসীদের ‘সিন্ধু সভ্যতার সন্তান, যারা বহিরাগতদের দ্বারা জঙ্গলে বিতাড়িত হয়েছিল’ বলে বর্ণনা করে বিনীতভাবে জানিয়েছিলেন, “ট্রাইবাল জনতাকে আপনারা গণতন্ত্র শেখাতে পারেন না, বরং তাঁদের কাছ থেকেই আপনাদের শিখতে হবে গণতান্ত্রিক আদব কায়দা”। বহিরাগতদের দ্বারা শোষিত নিপীড়িত ও নিরন্তর উচ্ছিন্ন হওয়ার ধারাবাহিক ইতিহাসে মাঝে মাঝে ছেদ এসেছে কেবল বিদ্রোহের দিনগুলিতে অথবা বিশৃঙ্খলায় –  একথা উল্লেখ করে জয়পাল বলেন যে এসবের পরেও তিনি পণ্ডিত নেহরুর কথা অনুযায়ী মেনে নিচ্ছেন যে – স্বাধীন ভারতে শুরু হচ্ছে সমতা ও সুযোগের এক নতুন অধ্যায় যেখানে কেউই আর অবহেলিত থাকবে না।

ভারতীয় সংবিধান জয়পাল সিং মুণ্ডার এই আশা পুরণের প্রতিশ্রুতি ও সম্ভাবনা তৈরী করেছিল। কিন্তু, অনেক ঝড়ঝাপটার মধ্যে দিয়ে বিগত দশকগুলিতে যেটুকু অর্জন আজ তা বিপন্ন। “বিভিন্ন সাব-কমিটির করা অনুবাদে “আদিবাসী” শব্দটি কখনও ব্যবহার হয় না। কেন? … আদিবাসী শব্দটি আসলে সমীহ জাগায়। আমি ভেবে পায় না কেন এখনও তাদের প্রতি অবমাননাকর ‘বনজাতি’ বিশেষণ প্রয়োগ করা হয় – কিছুদিন আগে পর্যন্তও এই বিশেষণটি দিয়ে অসভ্য বর্বর বোঝানো হত।” – সংবিধান সভায় বলেছিলেন জয়পাল সিং মুণ্ডা। বর্তমান সময়ে আমরা দেখতে পাই যে আরএসএস-বিজেপি কিছুতেই ‘আদিবাসী’ শব্দটিকে স্বীকৃতি দিতে রাজি নয়। তারা সেই পুরনো অবমাননাকর ‘বনবাসী’ বিশেষণই প্রয়োগ করে। অন্যদিকে, বনের ভেতরের গ্রামগুলির আদি বাসিন্দাদের বনের জমি ও সম্পদের ওপর যে চিরাচরিত অধিকার আইনী স্বীকৃতি পেয়েছিল তাকেই কেন্দ্র সরকার লুপ্ত করে দিচ্ছে নয়া বন আইন এনে, সংরক্ষণ ও প্রতিনিধিত্বের প্রশ্ন নস্যাৎ করে দিচ্ছে। সিধু–কানু-ফুলো-বিরসা-জয়পালদের স্বপ্ন ও সংগ্রাম আজ আরও প্রাসঙ্গিক আরও জরুরি হয়ে ওঠে। ৩ জানুয়ারী ২০২০ মারাং গোমকে জয়পাল সিং মুণ্ডার ১০৮তম জন্মবার্ষিকীতে সশ্রদ্ধ সেলাম জানাচ্ছি আমরা।

savsav

সাবিত্রীর জন্ম সাতারা জেলার নইগাঁওয়ে। বছর বারো আগে ১৮১৮ সালে ভীমা কোরেগাঁওয়ের যুদ্ধে মহারাষ্ট্রে পেশোয়া শাসনের অবসান ঘটেছিল, কুখ্যাত ‘পেশোয়া রাজ’ যেখানে ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসন অত্যন্ত হীন ও নৃশংস চেহারা নিয়েছিল। কিন্তু, ব্রিটিশ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হলেও সমাজে ব্রাহ্মণ্যবাদী অনাচার শেষ হয়ে যায়নি। সেরকম পরিস্থিতিতে ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধে সাবিত্রী ও জোতিরাও ফুলে, তাঁদের দুই বন্ধু দুই ভাইবোন উসমান শেখ ও ফতিমা শেখ এবং আরও সঙ্গীসাথীদের নিয়ে মহারাষ্ট্রের শুদ্রাতিশুদ্র সমাজের প্রান্তিক অন্ধকার জগত থেকে নবজাগরণের আলোকশিখা উৎসারিত করেছিলেন। সেই সময়ে ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে সাবিত্রী ফুলের জীবন ও সংগ্রাম ভারতের সমাজবিপ্লবে এক অন্যতম আলোকবর্তিকা। ভারতীয়দের দ্বারা আধুনিক স্কুলের প্রথম প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম শিক্ষয়িত্রীই নন কেবল, বহু বিষয়েই পিতৃতান্ত্রিক লক্ষণরেখা পেরনোর তিনিই পথিকৃৎ।

১৮৯০ সালে বন্ধু ও সহকর্মী, স্বামী ও শিক্ষক মহাত্মা জোতিরাও ফুলের মৃত্যুর পর শেষকৃত্যের লোকাচার নিজের হাতে সম্পন্ন করেন সাবিত্রী। হাজার বছরের ইতিহাসে সম্ভবত সেই প্রথম কোনও নারীর হস্তে শেষকৃত্যের লোকাচার সম্পন্ন হয়েছিল। ব্রাহ্মণ্যবাদী বিধানে শেষকৃত্যের অধিকার কেবলমাত্র পুরুষ উত্তরাধিকারীর ওপরই অর্পিত। সাবিত্রীবাই এই পিতৃতান্ত্রিক বিধান অমান্য করেছিলেন। ১৮৯৩ সালে সাবিত্রীবাই ফুলের সভানেতৃত্বে সাসওয়াড়ে ‘সত্যসোধক সম্মেলন’ সংগঠিত হয়। সম্মেলনের সর্বোচ্চ পদে একজন মহিলার অধিষ্ঠানও ছিল এক বৈপ্লবিক ঘটনা।

জ্যোতির পিসিমা বাল্যবিধবা সাগুনাবাইয়ের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৮৪৮ সালে ভিদেওয়াড়ায় মেয়েদের জন্য প্রথম স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন ফুলেরা। সাবিত্রী এই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। যে ভারতবর্ষে হাজার বছর ধরে ব্রাহ্মণ্যবাদী বিধানে শুদ্র ও নারীর জ্ঞানার্জন নিষিদ্ধ ছিল, সেখানে শুদ্র নারী-পুরুষ দ্বারা শুদ্রাতিশুদ্র ছেলেমেয়েদের জন্য আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞান শিক্ষার স্কুল প্রতিষ্ঠা ছিল এক যুগান্তের সূচনা, এক সুদূরপ্রসারী শ্রেণীসংগ্রামের নয়া ঘোষণা। এর কিছুদিনের মধ্যেই জোতির বাবা গোবিন্দরাও সমাজের চাপে পুত্র ও পুত্রবধুকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন। এই সময় পাশে এসে দাঁড়ান উসমান শেখ ও ফতিমা শেখ। ফতিমাদের বাড়িতেই আবার শুরু হয় স্কুল, নাম, ‘ইন্ডিজেনাস লাইব্রেরি’। ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করায় শারিরীক আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে ফুলেদের। জোতিবাকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে। সাবিত্রীবাই ও ফতিমা শেখ যখন স্কুলে যেতেন তখন রাস্তায় তাদের দিকে টোনটিটকিরি সহ কাদানোংরা বা গোবর ছোড়া হত। ফতিমাকে ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজের সাথে সাথে নিজের মুসলমান সমাজের মধ্যে থেকেও বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। কিন্তু তাতে মোটেই দমে যাননি তিনি। বাড়ি বাড়ি ঘুরে ছাত্রী জোগাড় করতেন, অসীম ধৈর্য নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা পরিবারের মানুষদের বোঝাতেন মেয়েদেরকে লেখাপড়া শেখানোর প্রয়োজনীয়তা। নারীমুক্তি আন্দোলনের ময়দানে নিপীড়িতের ঐক্যের উজ্জ্বল প্রতীক সাগুনা সাবিত্রী ও ফতিমা। ১৮৫২ সালে ‘মহিলা সেবা মণ্ডল’ গঠন করেন ফুলেরা। এটিই ভারতের প্রথম নারীবাদী সংগঠন। মেয়েদের অধিকার সচেতন করে তুলতে বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে, বিধবা বিবাহের পক্ষে ও বিধবাদের দুর্দশার বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান চলে। বিধবা বিবাহে উৎসাহ দিতে থাকেন। ভ্রূণহত্যার বিরুদ্ধে প্রচার চালান। অন্তঃসত্বা বিধবারা যাতে সমাজের চাপে আত্মহত্যা করতে বা ভ্রূণহত্যা করতে বাধ্য না হন তার জন্য ‘বাল হত্যা প্রতিবন্ধক গৃহ’ প্রতিষ্ঠা করেন। সাবিত্রীর নিজের বাড়িটাও হয়ে ওঠে তথাকথিত ‘অবৈধ’ অনাথ সন্তান এবং সন্তানসম্ভবা বিধবাদের আশ্রয়। অনেক ব্রাহ্মণ বিধবা সাবিত্রীর আশ্রয়ে আসেন। এরকমই একজনের সন্তান যশবন্তকে অফিসিয়ালি দত্তক নেন ফুলে দম্পতি। সাবিত্রীর পরামর্শে ফুলেদের বন্ধু ওয়ালভেকার ‘গৃহিণী’ পত্রিকা প্রকাশ করা শুরু করেন যেখানে কেবলমাত্র নারীমুক্তির প্রশ্নেই লেখা ছাপা হত। ১৮৭৩ সালে স্থাপিত ‘সত্যসোধক সমাজ’ ভারতে তৃণমূল স্তরে প্রথম জাতব্যবস্থা-বিরোধী গণসংগঠন। সংগঠনের দৈনন্দিন কাজকর্ম দেখাশোনা করতেন সাবিত্রী। সংগঠনের মহিলা ইউনিট চলত তাঁর নেতৃত্বে। সত্যসোধক সমাজের আন্দোলনের একটি দিক ছিল সত্যসোধক বিবাহ। ব্রাহ্মণ পুরোহিত তথা ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতান্ত্রিক লোকাচার এবং পণ দেওয়া-নেওয়া বর্জন করে পাত্র-পাত্রীর পারস্পরিক সম্মতি ও মঙ্গলকামনা উচ্চারণের মাধ্যমে সম্পন্ন হত বিবাহ। সাবিত্রী নিজের সন্তান যশবন্তের বিবাহও অসবর্ণ ও সত্যসোধক পথে দিয়েছিলেন। এবং শুধু তাই নয়, বিবাহের বেশ কিছুদিন আগেই হবু পুত্রবধু রাধাকে সাবিত্রীবাই বাড়িতে এনে রেখেছিলেন যাতে বিবাহের আগে তারা পরস্পরকে আরও ভালোভাবে জেনেবুঝে নিতে পারে।

একদিকে প্রত্যক্ষ অ্যাক্টিভিজমের ময়দানে সরাসরি নেতৃত্ব দেওয়া, অন্যদিকে বহু সংখ্যক আশ্রিত ছাত্রছাত্রীদের পালনপোষোন-শিক্ষার কাজ দেখভাল করা — এই দুইয়ের মাঝেও সাবিত্রীবাই লেখালেখি ও সংকলন-সম্পাদনার কাজ চালিয়ে গেছেন। বস্তুত সাবিত্রীবাইকে আধুনিক মারাঠি কবিতার জননী হিসেবে গণ্য করা হয়। ১৮৫৪ সালে প্রকাশিত ‘কাব্য ফুলে’ সম্ভবত ব্রিটিশ ভারতে কোন ভারতীয়র লেখা প্রথম মুদ্রিত কাব্যগ্রন্থ। কবিতাগুলি সমাজে বিদ্যমান বৈষম্যের উন্মোচন ও দরিদ্র নিপীড়িত দলিত মানুষের প্রতি আহ্বান,

জাগো, ওঠো, এবং শিক্ষিত হও
নিজেকে মুক্ত কর — ঐতিহ্য-প্রথা গুঁড়িয়ে দাও!

১৮৯৭-এ প্লেগ মহামারির রোগিদের সেবা করতে গিয়ে রোগ সংক্রমিত হয়ে ১০ মার্চ এই মহিয়সী নারী মৃত্যুবরণ করেন। সাবিত্রীবাই ফুলে উনবিংশ শতকের সেই ব্যতিক্রমী সমাজবিপ্লবী যিনি জাতবর্ণের প্রশ্নকে পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর সাথে যুক্ত করে বুঝেছিলেন। বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকর বুদ্ধ-কবীর-ফুলে ত্রয়ীকে তাঁর জীবনের শিক্ষক ও অনুপ্রেরণা বলে বারবার উল্লেখ করেছেন এবং জাতের বিনাশ ও নারীস্বাধীনতার প্রশ্নকে অবিচ্ছেদ্য বিষয় বলে তাঁর সমস্ত লেখাপত্রে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। বাস্তবেও ভারতে ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে যে কোনও উত্থানেই নারীসমাজ উৎসাহভরে সামনের সারিতে থেকেছে এবং শ্রেণীসংগ্রামের দিগন্ত প্রসারিত করেছে।

– মলয় তেওয়ারী     

addakkk

২০২০ সন ছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতোই ঊনিশ শতকের আর এক বিশিষ্ট চিন্তাবিদ অক্ষয় কুমার দত্তের জন্ম দ্বিশতবর্ষ। দুজনেই জন্মেছিলেন ১৮২০ সালে। উনিশ শতকে বাংলায় ইউরোপীয় শিক্ষা ও শাসনের সূত্র ধরে যে নতুন চিন্তাভাবনা বিকশিত হয়েছিল, সমাজ ও ইহজগৎ সম্পর্কে চর্চায় যে নতুন জোয়ার এসেছিল, বিদ্যাসাগরের মতো অক্ষয় দত্তও ছিলেন তার অন্যতম শরিক।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ধর্মচিন্তা নিয়ে সারাজীবনে কখনোই ব্যস্ত হননি। অক্ষয় কুমার দত্ত আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রাহ্মধর্ম ও সমাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বটে, কিন্তু তিনিও বস্তুজগতের সঙ্গে মানবপ্রকৃতির সম্পর্ক নিয়েই বেশি ব্যস্ত ছিলেন। অক্ষয় দত্তের আগে রাজা রামমোহন রায়ও ব্রাহ্ম ধর্ম আন্দোলনের মধ্যে থেকেই ইহজাগতিক বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি একদিকে ব্রাহ্ম ধর্ম আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা, আবার অন্যদিকে তিনি অর্থনৈতিক সামাজিক নানা বিষয় নিয়ে আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে সামিল। এই উত্তরাধিকার অক্ষয় কুমার দত্তের মধ্যেও আমরা দেখতে পাই।

অক্ষয় দত্ত মাত্র তেইশ বছর বয়সে, ১৯৪৩ সালে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। প্রায় বারো বছর একটানা সেই পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। অক্ষয় দত্তের সম্পাদনা পর্বে ব্রাহ্মধর্ম আন্দোলনের তাত্ত্বিক মুখপত্রের উদ্দিষ্ট পরিসরকে অতিক্রম করে তত্ত্ববোধিনী বহুবিস্তৃত হয়। সমাজজীবন ও বস্তুজগতের নানাকিছু সেখানে নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে। এমনকি জমিদার পরিবারের মালিকানাধীন এই পত্রিকায় অক্ষয় দত্ত নিজেই লেখেন ‘পল্লীগ্রামস্থ প্রজাদের দূরবস্থা বর্ণন’ নামের প্রবন্ধ। সেখানে জমিদার সহ জমিদারী ব্যবস্থার নানা আমলা – ইজারাদার, পত্তনিদার, নায়েব থেকে শুরু করে পুলিশ প্রশাসন পর্যন্ত একটি বৃহৎ চক্রের যাঁতাকলে কৃষকেরা কীভাবে লাঞ্ছিত ও পিষ্ট হয়, তার বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে।

অক্ষয় দত্ত রামমোহন বা বিদ্যাসাগরের মতো সক্রিয়ভাবে সামাজিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। এর অন্যতম কারণ তাঁর ভগ্নস্বাস্থ্য। বিশেষ জীবনের শেষ কয়েক দশক তাঁকে একরকম গৃহবন্দী দশাতেই কাটাতে হয়েছিল। কিন্তু শারীরিকভাবে বাইরের জগতের সঙ্গে বিনিময় করতে সক্ষম না হলেও তিনি তাঁর মনের দরজা সব সময়ে খুলে রেখেছিলেন। মূলত বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশুনো ও লেখালিখিতেই বেশিরভাগ সময়ে তিনি নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন।

অক্ষয় দত্তের পড়াশুনো ও লেখালিখির জগৎটি ছিল সুবিস্তৃত। ১৮২০ সালে তাঁর জন্ম, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে একই বছরে। ১৮৩৬ সালে তিনি সেকালের নামজাদা স্কুল ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার পর অর্থসঙ্কটের কারণে ১৯৩৮-৩৯ সালে আঠারো বছর বয়েস হতে না হতেই তাঁকে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনো থেকে সরে আসতে হয়। এরপর শুরু হয় তাঁর স্বশিক্ষার পালা, যা আজীবন চলেছিল। ষোল থেকে কুড়ি বছর বয়সের মধ্যেই তিনি ইউক্লিডের জ্যামিতি, জ্যোতিষ, উচ্চতর গণিত, বীজগণিত, ত্রিকোণমিতি, ক্যালকুলাস, মেকানিক্স, হাইড্রোস্ট্যাটিক্স, মেটিরিয়োলজি, এস্ট্রোনমি, ফ্রেনোলজির মতো বহু বিষয় আয়ত্ত করেছিলেন বলে তাঁর জীবনীকার নকুড়চন্দ্র বিশ্বাস ‘অক্ষয় চরিত’এ জানিয়েছেন। ঈশ্বর গুপ্ত মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে অক্ষয় দত্তের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। এই নব্য যুবকের জ্ঞানের গভীরতা দেবেন্দ্রনাথকে মুগ্ধ করে। তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে অক্ষয় দত্তকে বেছে নেন। এই মাসিক পত্রিকাটি সম্পাদনার আগে অক্ষয় দত্ত কিছুদিন বিদ্যাদর্শন নামে একটি স্বল্পস্থায়ী পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। ১৮৪২ সালে মাত্র চারটি সংখ্যা প্রকাশের পর এটি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে তিনি বারো বছর একটানা কাজ করেন। অবশেষে ১৯৫৫ সালে তিনি এই পত্রিকা সম্পাদনার জায়গা থেকে সরে আসেন এবং বিদ্যাসাগর পরিচালিত কলকাতা নর্ম্যাল স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদে যোগ দেন। কিন্তু স্বাস্থ্য সমস্যার কারণে ১৯৫৮ সালের অগস্ট মাসে তাঁকে চাকরি ছেড়ে দিতে হয়। বাকি জীবন তিনি প্রায় গৃহবন্দী হয়েই কাটান। পড়াশুনো ও লেখালিখিই জীবনের শেষ তিন দশক তাঁর একমাত্র সঙ্গী ছিল। ১৮৮৬ সালে ছেষট্টি বছর বয়সে তাঁর প্রয়াণ হয়।

চোদ্দ বছর বয়সে অক্ষয় দত্ত তাঁর প্রথম বইটি লিখেছিলেন। সেটি অবশ্য ছিল একটি আদিরসের কাব্য, নাম অনঙ্গমোহন। এরপর তিনি বালক বালিকাদের পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ভূগোল নামে একটি বই লেখেন। ১৯৪১ সালে এই বইটি প্রকাশের সময় তাঁর বয়েস ছিল মাত্র একুশ। এর এক দশক পরে তিনি লেখেন চারুপাঠ-এর প্রথম খণ্ড (১৮৫৩)। অতপর ১৮৫৪-তে চারুপাঠের দ্বিতীয় খণ্ড ও ১৮৫৯-এ চারুপাঠের তৃতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয়। এর মধ্যেই তিনি লেখেন পদার্থবিদ্যা (১৮৫৬)।

অক্ষয় দত্তের লেখা ভূগোল বইটি তত্ত্ববোধিনী পাঠশালার জন্য রচিত হয়েছিল। তাঁর চারুপাঠ গ্রন্থেও এসেছে ভূগোলের নানা প্রসঙ্গ, যেমন – আগ্নেয়গিরি, জলপ্রপাত, উষ্ণ প্রস্রবণ, হিমশিলা, প্রবাল, সৌরজগৎ, ধূমকেতু। জীব জগতের অনেক বিষয়, যেমন – সিন্ধুঘোটক, বীবর, পুরুভুজ, বনমানুষ, অতিকায় হস্তী, পতঙ্গভুক বৃক্ষ ইত্যাদি এর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। মনমোহন তর্কালঙ্কার বা বিদ্যাসাগরের শিশু কিশোর পাঠ্যগ্রন্থগুলিও এই সময়ে প্রকাশিত হচ্ছিল। অক্ষয় দত্তও ছোটদের নানাবিষয়ক জ্ঞানবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে এই প্রকল্পে সামিল হন।

অক্ষয় দত্তের যে বইটি তাঁর মনোজগতের দুয়ারকে আমাদের সামনে সবচেয়ে স্পষ্টভাবে উন্মচিত করে সেটি হল বাহ্যবস্তুর সহিত মানব প্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার (১ম খণ্ড ১৮৫১, দ্বিতীয় খণ্ড – ১৮৫৩)। তবে মননশীল পাঠকের চিরকালীন সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে তাঁর যে বইটি, সেটি হল ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় (১ম খণ্ড ১৮৭০, ২য় খণ্ড ১৮৮৩)। এই বইটি বাংলাভাষায় লেখা ভারতের দার্শনিক সাংস্কৃতিক ইতিহাসের প্রথম ক্লাসিক। শুধু বাংলা নয়, কোনও আধুনিক ভারতীয় ভাষাতেই এই ধরনের বই সেকালে আর লেখা হয়নি। বইটির প্রথম খণ্ড প্রকাশের এটি সার্ধ শতবর্ষ। দেড়শো বছর পরেও এই বইটি একালের মননশীল পাঠককে একইভাবে আকর্ষণ করে, আর এ থেকেই বোঝা যায় বইটির বিশিষ্টতা।

বইয়ের প্রথম খণ্ডে বৈষ্ণব, রামানুজ, রামানন্দী, কবীরপন্থী, রয়দাসী, সেনপন্থী, মলূকদাসী, দাদূপন্থী, রামসনেহী, আচারী, মধ্বাচারী, বল্লভাচারী, মীরাবাই, সনকাদি সম্প্রদায়, চৈতন্য সম্প্রদায়, বাউল, ন্যাড়া, সহজী, গৌরবাদী, দরবেশ, সাঁই, কর্তাভজা, রামবল্লভী, সাহেবধনী, আউল, হরিবোলা, রাতভিখারী, বলরামি, সাধ্বিনী, হজরতী, রাধাবল্লভী, কবিরাজী, সৎকুলী, চামার বৈষ্ণব, চরণদাসী, সৎনামী, হরিশ্চন্দ্রী, বৈরাগী, নাগা প্রভৃতি সুপরিচিত ও স্বল্প পরিচিত সম্প্রদায়ের কথা আলোচিত হয়েছে। দ্বিতীয় খণ্ডে ভারতীয় দর্শনের মূল ধারাগুলি – সাংখ্য, যোগ, ন্যায়, বৈশেষিক, পূর্ব মীমাংসা, বেদান্ত, চার্বাক ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা রয়েছে। আজকে ধর্মকে রাষ্ট্রের সঙ্গে মিলিয়ে মিশিয়ে ফেলে যখন হিন্দুত্বকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এক মনোলিথিক চেহারা দেওয়ার চেষ্টা চলছে, তখন অক্ষয় দত্তের নানাত্ববাদী ভারতীয় সাধনার ধারা নিয়ে লেখা এই বইটি প্রকৃত ইতিহাস ও বৈচিত্র্যকে সামনে আনে ও এই সূত্রে তা সমকালে এক বিশেষ গুরুত্বে উপনীত হয়।

- সৌভিক ঘোষাল   

chh

 

ssa

প্রথমেই যেটা বলা দরকার সেটা হল - এই সংরক্ষণ (reservation)  শব্দটি ভুল; এটা হওয়া উচিৎ ‘প্রতিনিধিত্ব’ (representation)। SC/ST/OBC (এবং মাইনোরিটি) নাগরিকেরা স্বাধীন ভারতে নানা রকম বঞ্চনা-অবিচার-নিপীড়নের শিকার, অথচ তারাই এদেশে জনসংখ্যার মেজরিটি। কিন্তু দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে-দপ্তরে তাদের প্রতিনিধিত্ব অত্যন্ত কম। উচ্চবর্ণের হিন্দুরাই সর্বত্র হর্তাকর্তা হয়ে গেঁড়ে বসে থাকে, যদিও তারা জনসংখ্যার ৩%। দক্ষিণ আফ্রিকার স্থানীয় মেজরিটির ওপর মুস্টিমেয় ইউরোপিয়দের শাসন যদি অন্যায্য হয়, কোটি কোটি ভারতবাসীর ওপর গোটাকতক ইংরেজের কর্তৃত্ব যদি অন্যায্য হয়, তাহলে স্বাধীন ভারতে এই উচ্চবর্ণের আধিপত্য অন্যায্য। এটা হচ্ছে বর্ণহিন্দুদের একচেটিয়া অধিকার সংরক্ষণ – হ্যা, তারাই বাস্তবে নিজেদের রিজার্ভেশন সিস্টেম কায়েম করেছে।

এটা কোনো মনগড়া কথা নয়। স্বয়ং রাষ্ট্রপতি খেদ জানিয়ে বলেছিলেন “The low representation of traditionanally weaker section in the higher judiciary is unacceptable”। তিনি বিচার বিভাগে বর্ণহিন্দুদের আধিপত্য দেখেই এই মন্তব্য করেছেন। ২০১৮-তে India for Diversity Institute-এর প্রধান ডঃ সুরাজ ইয়েংদে (হার্ভার্ড) দেখিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের ২৮ জন জাজের মধ্যে ৯ জন (৩৩%) জাজেদের আত্মীয়স্বজন অথবা কোনো ডাকসাইটে আইনজ্ঞের কাছের লোক। এলাহাবাদ হাইকোর্টের ৩৩ জন বিচারকের ১১ জনই (সেই ৩৩%!) বিচারবর্গের কাছের লোক – এই খবরটা জানাজানি হওয়ার পর বেশ শোরগোল উঠেছিল, বছর দুয়েক আগে।

তাহলে আমরা দেখছি আমাদের হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টেও একধরনের ‘উচ্চবর্ণ-সংরক্ষণ ব্যবস্থা’ চলছে, অথচ তা নিয়ে সংরক্ষণ-বিরোধীরা টুঁশব্দও করে না।

উচ্চবর্ণের একটা বিরাট অংশের বদ্ধমূল ধারণা – SC/ST/OBC ‘সংরক্ষণ’ সরকারী নানা প্রতিষ্ঠানে-দপ্তরে অদক্ষতা (inefficiency) নিয়ে এসেছে, কারণ ওইখানে রিসার্ভড ক্যাটেগরির কর্মচারিরা সকলেই নাকি অদক্ষ, অযোগ্য। আমরা তাহলে দেশের প্রাইভেট কর্পোরেট সেক্টরের দিকে একবার নজর ফেলি; সেখানেতো রিজার্ভেশনের বালাই নেই। শুধু তাই নয়, কর্পোরেট ম্যানেজার স্তরে SC/ST প্রায় নেই বললেই চলে, তাদের সংখ্যা সাত পারসেন্টের কম (টাইমস্ অফ ইন্ডিয়া, ২২ ডিসেম্বর ২০১৮ রিপোর্ট), তেমন ‘বিশুদ্ধ’ কর্পোরেট সেক্টরের দক্ষতা কেমন? তাদের পারফর্মেন্স কেমন? দেখা যাক।

দুনিয়ার যত দেশ আছে তাদের কর্পোরেট সেক্টরের ‘profitability’ নিয়ে যদি একটা তালিকা করা হয় তাহলে ভারতীয় কোম্পানিগুলো তালিকার অনেক নিচের দিকে ঠাঁই পাবে। দেশের সেরা ৫০০টি কোম্পানির মোট লাভ ৬৩ বিলিয়ন ডলার মতো, অর্থাৎ জিডিপি’র ২.৩১%, যেখানে মার্কিন মুলুকের ক্ষেত্রে সেটা জিডিপি’র ৬.১%। পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম দেশ ভারত, অথচ বিশ্ববাজারে তার তৈরি পণ্যের যোগান মাত্র ১.৬৭%। বিশ্বের সেরা ৩০০ কোম্পানির মধ্যে মাত্র ৪টি ভারতীয় কোম্পানি, যার তিনটে রাষ্ট্রায়ত্ব – ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশন, ওএনজিসি এবং এসবিআই। এটা ২০২০’র ফরচুন ৫০০ তালিকা থেকেই জানা যাচ্ছে।

আরও একটা খবর দেওয়া যাক।

দিল্লী স্কুল অফ ইকোনমিক্সের অধ্যাপক আশ্বিন দেশপান্ডে এবং মিশিগান ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক Thomas Weisskoff-এর একটা বড়সড় সমীক্ষা প্রকাশিত হয়েছিল নামজাদা World Development Journal-এ। ১৯৮০ থেকে ২০০২ পর্যন্ত ভারতীয় রেলের গ্রুপ-ডি কর্মীদের ওপর সমীক্ষা করে এনারা দেখিয়েছিলেন দক্ষতা এবং উৎপাদনশীলতায় কোনো অবনতি বা ঘাটতি কোথাও দেখা যায়নি, বরং অনেক জায়গাতেই উন্নতি লক্ষ্য করা গেছে।

আরও কিছু তথ্য আর খবর লেখার আগে একটা শব্দকে একটু বদলে নিতে চাইব। এই শব্দটা (বা শব্দগুচ্ছ) বহুবার নানা মঞ্চে নানা রচনায় ব্যবহৃত হয়; হিন্দিতে এটা হল ‘পিছড়ে বর্গ’, বাংলায় ‘পিছিয়ে পড়া শ্রেণী’, অর্থাৎ SC/ST/OBC। সংবিধানে যে এদের জন্য সংরক্ষণের (প্রতিনিধিত্বের) ব্যবস্থা চালু করার নির্দেশ রয়েছে তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল এদের সামাজিক প্রতিষ্ঠা দেওয়া। বহুকাল ধরে যাদেরকে অচ্ছুৎ বলে, ছোটলোক বলে হেয় করা হয়েছে, যাদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালান হয়েছে, যাদেরকে জোর করে ঠেলে পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাদেরকে স্বাধীন ভারতের সমাজে সম্মান ও প্রতিষ্ঠা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন সংবিধান প্রণেতারা।

কিন্তু আজ স্বাধীনতার এত বছর পরেও কি তাদের সামাজিক অবস্থানের উন্নতি হয়েছে? তাদের প্রতি ঘৃণ্য বৈষম্যমূলক আচরণ করা থেকে কি বিরত হয়েছে বর্ণহিন্দুরা? বাস্তবের ছবিটা কেমন? দেখা যাক।

২০১৭-১৮ জাতীয় নমুনা সমীক্ষা (NSS) জানাছে বর্ণহিন্দু এবং ‘পিছিয়ে পড়া বর্গ’-এর মধ্যে ‘access to employment’-এর বিস্তর ফারাক আছে, অর্থাৎ SC/ST/OBC নাগরিকেরা বঞ্চিত হচ্ছেন। কারণ NSS বলছে ‘due to discrimination in hiring’। নিয়গের ধাপ থেকেই হঠিয়ে দেওয়ার চক্রান্তের শিকার হচ্ছে অসংখ্য যোগ্য, দক্ষ ভারতীয়। NSS বলছে ৭১% কেসেই এই ধরনের ‘discrimination’ দেখা গেছে।

EPW পত্রিকার পক্ষ থেকে ওঙ্কার যোগী এবং অমিত থরাত একটা সার্ভে করেন সম্প্রতি। জানা যাচ্ছে অস্পৃশ্যতার ভাইরাস ভারতে এখন গ্যাঁট হয়ে বসে আছে। উত্তর ভারতে ৪৯% বর্ণ হিন্দু অস্পৃশ্যতা মানে, মধ্য ভারতে ৪০% এবং দক্ষিণ ভারতে ২০%।

গুজরাত অবশ্য এই ব্যাপারে অনেক এগিয়ে! জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের একটি বেঞ্চ ২০১৮’র ৩০ এপ্রিল জানাচ্ছেন গুজরাতে ৭৫% গ্রামাঞ্চলে এখনও ‘caste-based atrocity’ এবং ‘Untouchability’ দৌরাত্ম্য চলছে।

গুজরাত-মডেলের আরও একটা ছবি দেখাই। আমেদাবাদ-এর ‘Council for Social Justice’ একটা বিশদ সমীক্ষা করে দেখাচ্ছে “95% of cases under the SC/ST (PoA) Act have resulted in acquittal due to technical lapses on account of negligent police investigation and hostile public prosecutors.” সেখানে দলিত ও জনজাতি নাগরিকদের ওপর উৎপীড়নে প্রশাসন-বিচারবিভাগ-সরকার সকলেই সামিল।

২০১৯ অক্টোবরে SC/ST (PoA) Act সংক্রান্ত ঐতিহাসিক রায় দেওয়ার আগে সুপ্রিম কোর্ট  বলেছে “... they are still forced to bonded labour…. and women are not treated with dignity and are sexually abused in various forms.”

সংরক্ষণ-বিরোধীদের শ্রেণী-চরিত্র আমাদের জানা। তারা ক্ষমতালোভী সুবিধাভোগী উচ্চবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত। পিছিয়ে দেওয়া; হটিয়ে দেওয়া ভারতীয়রা ঘাম-ঝরানো শ্রমিক শ্রেণীতে পড়েন। তাদেরকে বঞ্চনা করে, তাদেরকে নিঙরে নিয়েই উচ্চবর্গ ফুলে ফেঁপে উঠে। এই জ্বলজ্বলে সত্যিটাকে ঢেকে চেপে রাখার ধান্দাতেই তারা হরেক্ রকম মিথ্যাকে বারবার শুনিয়ে সকলের মগজে গেঁথে দিতে চায়।

এই যে বঞ্চনার কথা তুললাম তার ভয়াবহ রূপটা খুলে দেখাতে হলে একটা মোটা বই লিখতে হবে। এখানে আমি শুধু দুটো চমকে দেওয়া খবর শোনাবো। বর্তমানে যে হীন মনুবাদী দলটা দেশটাকে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে তাদের আরও দুটো কুকর্মের কথা জানা যাবে এই খবর থেকে।

SC/ST নাগরিকদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার উদ্দেশে দুটো প্রকল্প চালু করা হয়েছিল চার দশকেরও আগে। একটার নাম TSP (Tribal SubPlan) শুরু হয় ১৯৭৪এ। অন্যটা হল SCP (Social Component Plan) চালু হয় ১৯৭৯এ। এই দুটি প্রকল্প অনুসারে SC এবং ST জনসংখ্যার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রতিবছর কেন্দ্রীয় সরকার অর্থ বরাদ্দ করে। এটা বাধ্যতামূলক। কিন্তু এই ধনীর-দালাল গরিবের-শত্রু মোদী সরকার গত পাঁচটি আর্থিক বছরে এই খাতে ৫ লক্ষ্য কোটি টাকা মঞ্জুর করেনি। শুধু ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষেই SC/ST ভারতীয়দের ন্যায্য প্রাপ্য ১,৬৯,৩৯৩ কোটি টাকা দেওয়া হয়নি। (অবাক লাগে যখন দেখি এই এতবড় কেলেংকারী নিয়ে কোনো মহল থেকে, কোনো মঞ্চ থেকে ধিক্কার শোনা যায় না।)

যে সমস্ত পরিবারের বার্ষিক আয় ২.৫ লাখ টাকার কম, তাদের ঘরের পড়ুয়াদের জন্য স্কলারশিপের বন্দবস্ত করে দিয়েছিল পুর্বতন সরকার। এই স্কলারশিপের খাতেও টাকা দিচ্ছেনা ক্ষমতাসীন মনুবাদী সরকার। ২০১৪ থেকে ২০১৭ এই তিন বছরেই ১১,১৫৬ কোটি টাকা দেওয়া হয়নি, এখনও দেওয়া হচ্ছেনা। এর কুফলে ৭১,৩৬,৯৩৪  জন ছাত্রছাত্রীর লেখাপড়া বন্ধ হতে বসেছে, অনেকেই আত্মাহত্যা করছে, যদিও খবরওয়ালারা সেগুলো চেপে যায়। একজন ফিল্মি তারকার আত্মহত্যার পরে মিডিয়া তারস্বরে কল্পিত অপরাধিদের জাত তুলে গালাগালি দিতে থাকে, কিন্তু লক্ষ্য লক্ষ্য বালক-বালিকাকে যারা অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে তাদের অপকর্মের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলছেনা। অবশ্য সেটা আশা করাও মূর্খতা; মিডিয়াও তো মানুবাদী আর বরপুঞ্জির চাকরদের কব্জায়।

ভারতের প্রাইভেট সেক্টরের বড় বড় কোম্পানিগুলোর অদক্ষতার প্রমাণ করতে আমি উপরে কিছু তথ্য তুলে দিয়েছিলাম; একটু ভুল হয়ে গেছে। এরা কয়েকটা কাজে খুব দক্ষ। করফাঁকি দেওয়া, বাঙ্ক লুট করা, আর নানানরকম জালিয়াতি জোচ্চুরিতে আমাদের বিগ বিজনেস খুব দক্ষ। আমি এখানে শুধু তিন চারটে খবরের উল্লেখ করব।

প্রতি বছর ভারতের বড় বড় কোম্পানিগুলো আমদানি রপ্তানির নথিপত্রে কারচুপি করে হাজার হাজার কোটি টাকা চুরি করে ছলেছে। এই সত্যিটা ফাঁস করে দিয়েছে ‘Global Financial Integrity’র একটা সমীক্ষা। শুধু ২০১৬-তেই এইভাবে ১,৩০০ কোটি ডলার করমাসুল ফাঁকি দিয়েছে এইসব পুঁজিপতিরা। এটা মোট রেভেন্যুর ৫.৫%রও বেশি।

Trans-Union Cibil রিপোর্ট (২০১৯ ডিসেম্বর) দেখাচ্ছে ১১,০০০ কোম্পানি ‘উইলফুল ডিফল্টার’, যারা ইচ্ছাকৃতভাবে নানা বাঙ্কের টাকা মেরে দিয়েছে; লুটের পরিমাণ? এক লক্ষ একষট্টি হাজার কোটি টাকা। সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নিচ্ছে না, উল্টে বারবার ঋণ মুকুব করে দেওয়া হচ্ছে সরকারী নির্দেশে।

দেশি-বিদেশি আইনের ফাঁকফোকর খুজে নিয়ে ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার কাজটাতে আমদের বড় কোম্পানিগুলো খুব দক্ষ। এই কুকর্মের পোশাকি নাম Corporate Tax Avoidance। UN-এর World Institute of Development Economics Research (WIDER)-এর গণনা অনুযায়ী ভারতে এই করফাঁকির পরিমাণ জিডিপি’র ২.৩৪% প্রতি বছর।

২০১৭-এর এপ্রিলে তখনকার বিত্তমন্ত্রী আরুণ জেটলি রাজ্যসভায় জানিয়েছিলেন ১৩৩টা কোম্পানির কাছে ভারত সরকারের বকেয়া প্রাপ্য ৩,৩৯,৭০৪ কোটি টাকা, যার ২,৪৫,৪৮০ কোটি টাকা ’unrealizable’, অর্থাৎ ও টাকা আর পাওয়াই যাবে না! এই ১৩৩টা কোম্পানির প্রত্যেকে ৫০০ কোটি টাকার উপর ট্যাক্স দেয়নি। চলে আসি ২০১৯-এর অক্টোবরে। লোকসভায় কর্পোরেট-বিষয়ক মন্ত্রকের বিবৃতিতে স্বীকার করা হল এক বিস্ফোরক তত্ত্ব। ২০১৪-১৫ থেকে ২০১৯-২০-তে মোট বকেয়া কর্পোরেট ট্যাক্স ২০,৭৮,২৬৭ কোটি টাকা। না ছাপার ভুল নেই এখানে। ওই অত টাকার মাত্র ১৫% নাকি আদায় করা গেছে; বাকিটা? হ্যাঁ, ওটা ‘unrealizable’ বলেই ধরে নেওয়া যায়।

এর থেকে বড় ‘স্ক্যাম’ কি হতে পারে? জানি না। এ বিষয় কেন যে বিরোধীরা নীরব, সেটাও বোঝা যাচ্ছে না। এসব জেনেও কিন্তু সরকার বিগ বিজনেসকে বিপুল পরিমাণ কর ছাড় দিয়েছে, দিচ্ছে।

আসলে এক অন্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে ভারতে। দেশি-বিদেশি বৃহৎ পুঁজির জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়েছে যাবতীয় রকমের সুযোগ-সুবিধা, আইনকানুন বানিয়ে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রগুলি, দেশের জঙ্গল-জমি-খনি তাদের জন্যই সংরক্ষিত রাখা হচ্ছে যাতে তারা অবাধে লুটতরাজ চালাতে পারে। যথেষ্ট দূষণ ছড়ানোর অধিকারও তাদেরকে দেওয়া হচ্ছে আইন চালু করে। আজ সময় এসেছে এই সংরক্ষণ চক্রান্তের তুমুল বিরধিতা করার – সর্বত্র, সর্বস্তরে।

- শেখর ভট্টাচার্য    

dddddd
jddd
যাদবপুর, আইসা
ddd
নৈহাটী, উত্তর ২৪ পরগণা
baraa
বারাসাত, উত্তর ২৪ পরগণা
nnnn
ধুবুলিয়া, নদীয়া
bbb
বর্ধমান
be
বেহালা, কলকাতা
kkkk
কোন্নগর, হুগলী

END

খণ্ড-27
সংখ্যা-46