গত ১৬ ডিসেম্বর কলকাতার বুকে বিপূল সংখ্যক কৃষকের জনজোয়ার দিল্লী আর কলকাতার রাজপথকে যেন একাকার করে দিলো। পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উঃ প্রদেশের কৃষকের সাথে একযোগে গ্রামবাংলার কৃষকরাও জানান দিলো, নয়া কৃষি আইন সম্পূর্ণ বাতিল করতেই হবে। টুকিটাকি সংশোধন করে কৃষকদের ধোঁকা দেওয়া চলবে না। কৃষকদের কর্পোরেটের ক্রীতদাসে পরিণত করার চক্রান্ত বন্ধ করো। কর্পোরেটদের মজুতদারী কালোবাজারি, জমি লুঠের ছাড়পত্র দেওয়া চলবে না। পাঁচতারা হোটেল আর চাষের মাঠে বিদ্যুৎ একদর করে দেওয়ার নয়া বিদ্যুৎ বিল প্রত্যাহার করো। দিল্লিতে প্রবল শীতের মধ্যে লক্ষ লক্ষ কৃষক যখন রাজপথে ২১ দিন ধরে বসে রয়েছে, রাজধানীর পার্শ্ববর্তী কৃষক আন্দোলনস্থল হিসাবে সুপরিচিত সিংঘু আর টিকরির পর খবর আসছে সাজাপুর আর পালওয়াল জেগে উঠছে, সেখানে বিভিন্ন রাজ্য থেকে আগত হাজার হাজার কৃষক নতুন করে আন্দোলনে যোগ দিচ্ছে, অচল হতে চলেছে দিল্লী জয়পুরের সড়ক যোগাযোগ। তখন কলকাতায় ধর্মতলায় রাসমনি রোডের রাজপথকে কয়েক ঘন্টার মহড়ায় অবরুদ্ধ করে দিয়ে বাংলার কৃষকরা আওয়াজ তুলে ধরলো – আমরাও আছি তোমাদের সাথে, সংগ্রামের ময়দানে। এ লড়াই দেশের লড়াই, বাঁচার লড়াই, এ লড়াই জিততে হবে।
কলকাতার বুকে দীর্ঘ কৃষক মিছিলের কলতানে যেন ভেসে উঠলো সেই গান “লড়াই করো, যতদিন না বিজয়ী হও”। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সমস্বরে কৃষকরা বলে উঠলো, আমরা চাই কৃষকের আইন-মোদী বানালো কোম্পানি আইন-এ আইন মানছি না, মানবো না। আজ ঐক্যবদ্ধ ভাবে দেশের অন্নদাতারা দাবি তুলেছে – আমাদের রক্ত জল করা শ্রমে ঘামে তৈরি ফসলের দাম গ্যারান্টি করার আইন চাই। ধান গম ভুট্টা পাট থেকে শুরু করে আখ তুলা সহ লঙ্কা থেকে লাউ (কিষাণ সংগঠনের মতে প্রায় ১২৯টি) সমস্ত ফসলের দর সরকার নির্ধারণ করুক। সংরক্ষণের ব্যবস্থা করুক। কম দামে অভাবীবিক্রি বন্ধ করুক। সরকার ক্ষুদ্র- মধ্য চাষিদের পাশে দাঁড়াক। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিশ্চিত করার আইন তৈরি হোক। কিন্তু মোদী সরকার এর বিপরীতে কর্পোরেটদের স্বার্থে আইন করলো। একে কোন মতেই মেনে নেওয়া যাবে না। কৃষি সংকট এক। দাবি এক, শত্রুও এক। তাই কলকাতার বুকে সমাবেশ থেকে বাংলার কৃষকরা জানান দিলো একই মাটির সন্তান আমরা,আমাদের দাবি একটাই – নয়া কৃষি আইন সম্পূর্ণ বাতিল করো। লকডাউনের পর বিগত নয় মাসে কলকাতার বুকে এতো বিশাল সংখ্যক মানুষের বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ ঘটলো এই প্রথম।
দঃ বঙ্গের হাজার হাজার কৃষক শিয়ালদা ও হাওড়া স্টেশন থেকে সুদীর্ঘ মিছিল করে ধর্মতলায় রাণী রাসমনি রোডে এসে সমাবেশিত হলো রাজভবন অভিযানে। কিন্তু রাজ্যপাল কৃষকের দাবির কথা শুনতে আদৌ রাজি হলেন না। আগাম খবর জানানো হয়েছিলো দাবিসনদ দেওয়া হবে,তা স্বত্বেও তিনি রাজভবন ছেড়ে চলে গেলেন। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠলো কৃষকের ন্যায়সঙ্গত যুক্তির সামনে কি তাঁর কিংবা কেন্দ্রীয় সরকারের দাঁড়ানোর সাহস নেই? তাই কি তিনি পালিয়ে গেলেন? এই প্রশ্ন তুলে ধরে এআইকেএসসিসি’র এক প্রতিনিধি দল রাজভবনে স্মারক লিপি জমা দিয়ে আসেন। প্রতিনিধি দলে ছিলেন সুভাষ নস্কর, অভীক সাহা, জয়তু দেশমুখ, হরিপদ বিশ্বাস প্রমূখ।
রাসমনি রোডে একটি গাড়ির উপর মঞ্চ করা হয়েছিলো। সেখানে বেলা ২টায় অনুষ্ঠিত হলো বিক্ষোভ সমাবেশ। শুরুতে আহ্বায়ক অমল হালদার বলেন, গ্রামে গ্রামে জাঠা করতে হবে। গ্রামের মানুষ অনেকেই কৃষি আইনের বিপদটা বুঝতে পারছেন কিন্তু বিপদটা যে কতটা সেটা হয়তো উপলগ্ধি করতে পারছেন না৷ তাই আমাদের কর্পোরেটের দালাল মোদীর মুখোস খুলে দিতে হবে। এ রাজ্যের তৃণমূল সরকারের সমালোচনা করে তিনি বলেন, বিধানসভায় কেন বিরোধীতার প্রস্তাব গ্রহণ করা হচ্ছে না। রাজ্য সরকার কেন বিকল্প আইন প্রণয়ন করছে না? এ রাজ্যে কৃষকরা ধানের সরকারী দাম পাচ্ছে না। বস্তায় মাত্র ৭০০/৭৫০ টাকা পাচ্ছে (৬০ কেজি বস্তা। সরকারী দর ১৮৬৫ টাকা কুইঃ) ফড়ে মহাজনরা কৃষকদের ঠকাচ্ছে।
এআইকেএসসিসির সাংগঠনিক সম্পাদক কার্তিক পাল বলেন, প্রধানমন্ত্রী নানা ধরনের মিথ্যা প্রচার ও কূৎসা করে কৃষকদের অপমান করছেন। কৃষকের অপমান দেশের অপমান। সর্বস্তরের মানুষ এর প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। বিগত সাধারণ ধর্মঘট ও গ্রামীণ বনধের মধ্য দিয়ে দেশের কৃষকরা এই নয়া কৃষি আইন বাতিল করে দিয়েছে, একে ছেঁড়া কাগজে পরিণত করেছে। তাই একে প্রত্যাহার করতেই হবে। আমাদের গ্রামে গ্রামে কৃষক আন্দোলনকের বার্তা ছড়িয়ে দিতে হবে, কৃষকদের পথে নামাতে হবে। এআইকেএসসিসি-র সর্বভারতীয় নেতা দিল্লীর আন্দোলনের ময়দান থেকে আগত হান্নান মোল্লা বলেন, দিল্লীর এই ঐতিহাসিক আন্দোলন স্বাধীনতার পর অন্যতম সর্ববৃহৎ কৃষক আন্দোলন। শুরুতে সরকার একে নিছক পাঞ্জাবের আন্দোলন বলে তুচ্ছ করে দেখানোর চক্রান্ত চালিয়েছে। কিন্তু যে কোনো আন্দোলনেই দেখা যায় কোনো রাজ্যের অগ্রণী ভূমিকা থাকে। যত দিন গেছে ক্রমশ আন্দোলনটা সর্বভারতীয় চেহারা নিচ্ছে। আন্দোলনের নেতৃত্বে রয়েছে এআইকেএসসিসি সংগ্রামী মঞ্চর সাথে যোগদান করা মোট ৫০০টি কৃষক সংগঠন। এই সংগ্রামী ঐক্য নজিরবিহীন। আন্দোলনের চাপে সরকার এই আইন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হবে। ইতিমধ্যে আন্দোলনে যোগদান করতে আসা ৩০ জন কৃষক নানা কারনে মারা গেছে। তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আগামী ২০ ডিসেম্বর সারা দেশে শহীদ দিবস পালন করা হবে। কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্বের সাথে সরকার এজেন্ডা ছাড়া মিটিং করছে। ইতিমধ্যে পাঁচ বার মিটিং হয়েছে৷ আমরা বলেছি আইনটা কত ভালো এসব আমাদের বোঝাতে হবে না। সংশোধন করে বদলানো যাবে না। কসমোটিক পরিবর্তন মানবো না, মিটিং এর নামে তামাসা নয়। আইন প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলন চলবে। সরকার গোটা এলাকা মিলিটারী নিয়ে ঘিরে রেখেছে। যেন কৃষকদের বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধের পরিস্থিতি সৃস্টি করা হয়েছে। তাই আমাদের স্বতস্ফূর্তভাবে নয়, দিকে দিকে সচেতন আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে, সেটা এই সমাবেশে অংশ নেওয়া কর্মীদের দায়িত্ব।
এআইকেএসসিসি নেতা অভীক সাহা বলেন, সুপ্রীম কোর্ট এক উপদেষ্টা কমিটি গঠনের রায় দিয়েছে। কিন্তু আমরা বলেছি, এই কমিটি কার্যকরী হবে তখনই যখন কৃষি আইন প্রত্যাহার করা হবে। সুপ্রীম কোর্টের এই রায় কৃষক আন্দোলনের নৈতিক জয়। এছাড়াও বক্তব্য রাখেন সুভাষ নস্কর, অজিত মুখার্জি, গোবিন্দ রায়, সুশান্ত ঝা প্রমূখ কৃষক নেতৃবৃন্দ।গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন গণসংস্কৃতি পরিষদের নীতীশ রায়। মিছিলের সামনে সারিতে থেকে আইসার ছাত্রীদের উত্তাল স্লোগান শহর কলকাতার গোটা যাত্রাপথকে উদ্দীপনাময় করে তোলে। ভারতীয় গণনাট্য সংঘের শিল্পীরা মিছিলের সামনে পথ হেঁটে গণসঙ্গীত গাইতে গাইতে তুলে ধরেছেন কৃষকদের পাশে দাঁড়ানোর সংগ্রামী ঐতিহ্যকে। বিভিন্ন কেন্দ্রীয় ট্রেডইউনিয়নের এক যুক্ত মিছিল সমাবেশে অংশগ্রহণ করে। এছাড়া রেল, বিদ্যুৎ সহ বিভিন্ন কর্মচারী সংগঠন, শিক্ষক, ছাত্র যুব, আদিবাসী সংগঠন, ঋণমুক্তি আন্দোলনের সংগঠন সহ সমাজের নানান স্তর থেকে আগত মানুষেরা কৃষক আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানাতে সমাবেশে যোগ দেন।
- জয়তু দেশমুখ
তেল সংস্থাগুলো আবার গ্যাসের দাম চড়ালো। একবার নয়, এক সপ্তাহে পরপর দুবার! পঞ্চাশ-পঞ্চাশ করে একশ টাকা! মোদী সরকার গ্যাসের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় বিষয়টি অত্যাবশ্যকীয় পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের আওতা থেকে ইতিমধ্যেই তুলে দিয়েছে। মাত্র এক স্বল্পাংশের জন্য ভর্তুকিযুক্ত গ্যাসের এখনাবধি সংস্থান রাখা আছে। সেক্ষেত্রেও অভিযোগের পাহার জমার অন্ত নেই। ভর্তুকির টাকা ব্যাঙ্কের পাশ বইয়ে ঠিকমতো না আসার নানা গাঁট গেরোর দূর্ভোগ পোহাতে হয়। আর ভর্তুকিহীন গ্যাসের দাম চড়চড়িয়ে বাড়ালেও ভর্তুকির পরিমাণ কিন্তু বাড়ানোর নাম নেই। এবারের নমুনাটাই দাঁড়াচ্ছে কি? মূল্য বাড়লো মোট একশ টাকা। আর ভর্তুকির অঙ্ক পড়ে রইল সাড়ে ঊনিশ টাকায়। বস্তুত ভর্তুকির প্রশ্নটিকে পরিত্যক্ত করে রাখা হচ্ছে, বহন করতে বাধ্য করা হচ্ছে উত্তরোত্তর মূল্যবৃদ্ধির বোঝা।
পশ্চিমবঙ্গে গ্যাসের গ্রাহক সংখ্যা দু’কোটি নব্বই লাখের মতো। এর ব্যাপক অংশ মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর। এর মধ্যে উচ্চবিত্ত নেই, উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণীও প্রায় নেই বললে চলে। এই বিত্তশালী শ্রেণীগুলো রান্নার উপায় হিসাবে বহুমূল্যের বিদ্যুৎচালিত উপকরণগুলি ব্যবহার করে থাকে। অন্যদিকে কেরোসিনের সরকারী বণ্টন ব্যবস্থায় ক্রমাগত পরিমাণ হ্রাস আর মূল্যবৃদ্ধির সাঁড়াশি চাপ সহ খোলাবাজারে দেদার চড়া দামের কারণে নিম্নবিত্তের এক উল্লেখযোগ্য অংশ গ্যাসের ব্যবহারকারী। আর, ব্যাঙ্কের বই খুললেই যে মূল্যবৃদ্ধির বোঝা বহনের ক্ষমতা রাখে এমন যুক্তিজাল ধোপে টেঁকে না। কারণ, এখন পেনশন, বেতন, তথাকথিত ‘সাম্মানিক’ মাসোহারা, সরকারী বিভিন্ন অনুদান, বরাদ্দ যেটুকু মেলার, বলাবাহুল্য সবই পেতে গেলে ব্যাঙ্কের পাশবই দরকার। সুতরাং ওটা দেখিয়ে মূল্যবৃদ্ধির সাফাই গাওয়ার উপায় নেই, ওই চালাকি খাটে না। তেল সংস্থাগুলোর চাপানো মূল্যবৃদ্ধির বোঝার ওপর শাকের আঁটির মতো চাপানো রয়েছে জিএসটি। ২০১৭-র জুলাই থেকে জারি রয়েছে পাঁচ শতাংশ জিএসটি। রাজ্যকে জিএসটির টাকার ন্যায্য ভাগ দেওয়া হচ্ছে না, মোদীর কেন্দ্র দেয় না। না দেওয়ার ক্ষেত্রে ছুতো দেখায় অতিমারী জনিত কেন্দ্রের রাজকোষের টানাটানি অবস্থার। কিন্তু অতিমারীতে বে-রোজগারী হয়ে যাওয়া, আর্থিক দূর্গতিতে অতিষ্ট হওয়া জনতার কাঁধে উপর্যুপরি চড়া মূল্যের সিলিন্ডার চাপিয়ে দেওয়া হল।
মোদী সরকার পেট্রোপণ্যের মূল্যমান নির্ধারণকে বহু আগেই আন্তর্জাতিক বাজারে দাম-ওঠা নামার সাথে যুক্ত করে দিয়েছে। আমজনতার বহু সংগ্রামের মূল্যে অর্জিত একদা রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের সংস্থাগুলোকে কার্যত কর্পোরেটরাজ-কোম্পানিরাজের স্বার্থ হাসিলের ক্ষেত্রে পরিণত করা হয়েছে। এ হল নয়া উদারবাদী অর্থনীতির খাঁড়ায় মারা কোপের পর কোপ। তারপর থেকে যখনই মূল্যবৃদ্ধির পন্থা নিয়েছে শোনায় আন্তর্জাতিক বাজারে দাম চড়া হওয়ার ‘গল্প’। তা ধরে ফেললেই শুরু করে দেয় গলাবাজি। মিথ্যাচার ধাপ্পাবাজিকে ‘সত্যি’ আর হিসেব কষে হাতেনাতে ধরে ফেলে স্বরূপ উন্মোচন ও পাল্টা আঙুল তুললে দাগিয়ে দেওয়া হয় ‘উন্নয়ন বিরোধী’! তাছাড়াও প্রশ্ন হল, আন্তর্জাতিক বাজারে আগুন লাগলে কি দেশের বাজারেও আগুন লাগিয়ে দেওয়া হবে? অতিমারী পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ যখন আর্থিকভাবে নাজেহাল হচ্ছে, জীবনীশক্তি পুনরুদ্ধারের প্রশ্নে সহায়-সম্বল পেতে দিশেহারা, যখন গ্যাসের ভর্তুকি আরও বাড়ানো, ভর্তুকির আওতায় আসতে চেয়ে আবেদন করলেই মঞ্জুর করার পলিসি ও পদক্ষেপের জরুরি পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন, তখন সেসব না করে আবারও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি করা হল। এ এক তীব্র ও ব্যাপক জনবিরোধী ক্ষমাহীন আচরণ।
এই কারণে আজ প্রত্যেক সাধারণ রাজ্যবাসী ও দেশবাসীকে মোদী জমানার বিরুদ্ধে সরব হওয়া দরকার। পশ্চিমবাংলায় আসছে বিধানসভা নির্বাচন। নির্বাচনকে চাঁদমারী করে বিজেপি প্রচারের ঢাক পেটাচ্ছে, ক্ষমতায় এলে কেন্দ্র-রাজ্যের অভিন্ন যুগল সরকারের জোরে ‘উন্নয়নের বান’ ছোটাবে! এর জবাবে আজ জেরবার করা মূল্যবৃদ্ধির জবাব দেওয়া দরকার, বিজেপিকে বাংলা ছাড়া করার পণ করা প্রয়োজন।
১৮ ডিসেম্বর ২০২০ কমরেড বিনোদ মিশ্রের দ্বাবিংশতম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৯৯ থেকে এই দিনটিকে, গোটা পার্টি জুড়ে বিপ্লবী শপথকে নতুনভাবে গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে আমরা ‘সংকল্প দিবস’ হিসাবে পালন করে চলেছি। এই বছর আমরা দিনটি উদযাপন করছি অভূতপূর্ব এক কৃষক আন্দোলনের মধ্যে, যার ক্রমবর্ধমান কর্পোরেট আধিপত্য (যাকে আদানি-আম্বানি-কোম্পানি রাজ বলে অভিহিত করা হয়) ও ভারতে ফ্যাসিস্ট দখলদারীর বিরুদ্ধে এক বলিষ্ঠ গণ-প্রতিরোধ হয়ে ওঠার সমস্ত সম্ভাবনা রয়েছে। সদ্য সমাপ্ত বিহার নির্বাচনের উদ্দীপনাময় সাফল্য আমাদের ভারতবর্ষকে ফ্যাসিবাদের বিপদ থেকে মুক্ত করার চ্যালেঞ্জের আরও সাহসী মোকাবিলার সুযোগ করে দিয়েছে। আমাদের অবশ্যই এই চ্যালেঞ্জের যথাযথ মোকাবিলা, ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগতভাবে নিজেদের তৈরি করতে হবে।
কমরেড বিনোদ মিশ্র পার্টিকে, গণতান্ত্রিক সংগঠনসমূহের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণসহ সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক উদ্যোগ পরিচালনাকারী বিপ্লবী কমিউনিস্টদের এক সর্বভারতীয় কেন্দ্র হিসাবে আত্মপ্রকাশে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। পার্টির ক্রমবর্ধমান নির্বাচনী উপস্থিতি সবচেয়ে নিপীড়িত জনগণের মৌলিক মানবিক মর্যাদা থেকে শুরু করে মানুষের অধিকারের সংগ্রামের শক্তিতে অর্জিত নির্বাচনী বিজয়গুলি রক্ষা করা পর্যন্ত আমাদের দৃঢ় আত্মঘোষণার উত্তরণকে এক জীবন্ত ব্যঞ্জনা দিয়েছে। কমরেড ভি এম আমাদের একটি বৃহৎ কমিউনিস্ট পার্টি হয়ে উঠতে অনুপ্রাণিত করেছেন, কিন্তু তা কখনও একটি বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির মূল মতাদর্শগত নোঙরবন্ধনকে, সুস্থ সজীব প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রাণচঞ্চল গণসংস্কৃতিকে এবং সাংগঠনিক ব্যবস্থাকে এতটুকু শিথিল বা দুর্বল না করেই করার কথা বলেছেন। আমরা পার্টির সমস্ত বিকাশ-সম্ভাবনাকে বাস্তবায়িত করার চ্যালেঞ্জ নিয়েছি, তাই পার্টির মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলির প্রতি আমাদের প্রহরাকে সদাজাগ্রত রাখতে হবে।
গোটা ১৯৯০-এর দশক জুড়ে, কমরেড ভি এম ক্রমশ বেড়ে চলা সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদের বিপদ সম্পর্কে পার্টিকে সচেতন করেছেন। বাথানিটোলা গণহত্যাকে তিনি এক নতুন চোখে দেখেছেন – গরিবদের উপর সামন্ততান্ত্রিক হিংসা যে ক্রমশ সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী আক্রমণ এবং বিপ্লবী বামেদের উপর ভয়ঙ্কর আক্রমণের চেহারা নিতে চলেছে তার অভ্রান্ত সংকেতকে তিনি জোরের সাথে তুলে ধরেছিলেন। এই ইঙ্গিত পার্টিকে বিজেপি ও সঙ্ঘ বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে সতর্ক এবং স্থিরসংকল্প থাকতে সাহায্য করেছে যদিও তখন আমাদের বিহারে আরজেডি এবং পরবর্তীতে কেন্দ্রে ইউপিএ সরকারের মোকাবিলা করতে হয়েছে। আজ ভারত এবং ভারতীয় গণতন্ত্রকে মোদী সরকারের ফ্যাসিবাদী আক্রমণ থেকে রক্ষা করাই বাম এবং অন্যান্য বিরোধী শক্তিগুলির কাছে সবচেয়ে বড় নির্ণায়ক চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। এই জন্যই বিহার নির্বাচনে জয় দেশজুড়ে এত অভিনন্দিত হয়েছে। এইজন্যই আমাদের পশ্চিমবঙ্গের বাম-উদারপন্থী শিবিরের কাছে বিজেপি’কে ক্ষমতা দখল থেকে রোখার আবেদন এত ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। মোদী সরকারের ফ্যাসিবাদী আক্রমণ এবং দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিপর্যয় বলিষ্ঠ প্রতিবাদ এবং গণবিরোধিতার জন্ম দিয়েছে। হিংসার বিরুদ্ধে বিশিষ্ট লেখক ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের প্রতিবাদ; রোহিত ভেমুলার প্রাতিষ্ঠানিক হত্যার বিরুদ্ধে ছাত্র জাগরণ যা এখন শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং গণতন্ত্রের জন্য তরুণ প্রজন্মের ভারতের (ইয়ং ইন্ডিয়ার) কাছে এক প্রবল আত্মঘোষণা হয়ে উঠেছে; এনআরসি-এনপিআর-সিএএ’র বিরুদ্ধে অভূতপূর্ব প্রতিবাদ যার সামনের সারিতে ছিলেন মুসলিম নারীসমাজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা এবং নাগরিক সমাজের কর্মীরা; মান্দাসৌর গণহত্যার পর কৃষক আন্দোলন যা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল এবং এখন এক ঐতিহাসিক অভ্যুত্থান হয়ে উঠেছে; মহিলা ও মেহনতি জনগণের বিভিন্ন অংশের পর্যাক্রমিক সংগ্রাম – ভয়ঙ্কর নিপীড়ন ও ফ্যাসিবাদী হিংসা, বিদ্বেষ ও মিথ্যা প্রচার, তথ্য বিকৃতিকে স্পর্ধাভরে উপেক্ষা করে গণপ্রতিরোধ ক্রমশ বেড়ে চলেছে। পুলওয়ামার ঠিক পরপর মোদী দ্বিতীবারের জন্য জিততে সক্ষম হলেও, পরবর্তীতে ঝাড়খণ্ড ও বিহার নির্বাচন পরিষ্কার দেখিয়ে দিয়েছে এই প্রতিরোধ নির্বাচনী মল্লভূমিতেও তার দাগ রেখে যেতে কতটা সক্ষম। বিধানসভা নির্বাচনের আসন্ন দফাগুলিতে, বিজেপি’কে আসামে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা, পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসা রুখে দেওয়া এবং তামিলনাড়ু, কেরালা ও পুদুচেরীতে বিজেপি’র অনুপ্রবেশ রুখে দেওয়ার জন্য সমস্ত রকম চেষ্টা চালাতে হবে।
মোদী সরকারের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস এবং বিধ্বংসী নীতিগুলির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সময় আমাদের অবশ্যই নজর রাখতে হবে আরএসএস-এর দুষ্ট ভূমিকা, তার অতি সূক্ষ্ম জটিল নেটওয়ার্ক এবং তৃণমূল স্তরে তার জনসংযোগ ও সমাবেশিত করার কার্যকলাপের প্রতি। আরএসএস-এর ফ্যাসিবাদী প্রকল্পগুলির বিরুদ্ধে কমিউনিস্টসুলভ আক্রমণ অভিযানে শুধু নিজস্ব কমিউনিস্ট মতাদর্শগত সাহস ও রাজনৈতিক স্বচ্ছতা থাকলেই হবে না, চাই গণকাজের অনমনীয় জেদ আর একনিষ্ঠতা এবং গভীর সযত্ন শ্রমসাধ্য কর্মরীতি যা কমিউনিস্টদের সুবিদিত বৈশিষ্ট্য। কোভিড১৯ অতিমারীর বিশৃঙ্খলা এবং কু-পরিকল্পিত লকডাউনের নিষ্ঠুরতার পরে ভারত মোদী সরকারের হুকুমদারির কাছে নতিস্বীকার করবে না। পাঞ্জাবের কৃষকদের স্পর্ধিত মেজাজ ইতিমধ্যেই দেশজুড়ে সংগ্রামী জনতাকে পুরোনো স্মৃতি ফিরিয়ে আবেগ-উদ্দীপ্ত করে তুলেছে। বিহার নির্বাচনে সিপিআই(এমএল)-এর চমৎকার সাফল্য দেশের বাম শক্তি এবং পরিবর্তনকামী মানুষের মধ্যে নতুন আশা জাগিয়েছে, প্রবল উৎসাহ-উদ্দীপনার সঞ্চার করেছে। অবশ্যই কমিউনিস্ট আন্দোলনের পুনরুজ্জীবন এবং ফ্যাসিবাদী হুমকিকে ব্যর্থ করার জন্য এই নতুন সন্ধিক্ষণকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে হবে।
কেন্দ্রীয় কমিটি, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি
(মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)
মার্চ মাসের পর কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক হয় ৩-৪ ডিসেম্বর পাটনায় বিহার রাজ্য অফিসে। আলোচনা ও সিদ্ধান্ত যা গৃহীত হয়েছে তা সংক্ষেপে উল্লেখ করা হল।
কেন্দ্রীয় কমিটির শেষ অনলাইন বৈঠকের পর থেকে প্রয়াত কমরেড এবং বিশিষ্ট প্রগতিশীল ব্যক্তিত্বদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে নীরবতা পালন করে কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক শুরু হয়। বিশেষত, ৩ মাস ধরে চলা পাঞ্জাবের দীর্ঘ কৃষক আন্দোলনের প্রতি এবং দিল্লী অবরোধের সময় মারা যাওয়া কৃষকদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। এছাড়া বিহারের কমরেড ধ্রুব ভগত, হরিবংশী রাম, রাজমতী, সুশান্ত কিশোর, ডাঃ বিজয় প্যাটেল, দেবমুনি যাদব এবং ইউপি-র মারদুজি, ওড়িশা রাজ্য কমিটির সদস্য কমরেড নীলাঞ্জন ভট্টাচার্য, পাঞ্জাবের আমরিক সিং সামাওন ও মুখতার কৌর, পশ্চিমবঙ্গের প্রবীর বল, বন্ধনা ওরাঁও, রহিম শেখ, অমিতাভ সরকার, কেতকী ব্যানার্জী, তরুণ প্রকাশ কুণ্ডু, বিশ্বনাথ সরেন, স্বপন বড়ুয়া, ভোলানাথ লাহিড়ী, মিহির রায়চৌধুরী এবং সুনীল বসু; দিল্লির বেদপাল, পুদুচেরীর অয়নার, তামিলনাড়ুর কুজান্দাইভেলু, ঝাড়খণ্ডের বীরেন্দ্র চৌধুরী, রণধীর সিং এবং অখিলেশ্বর ভার্মা এবং কর্ণাটকের সিপিআই(এম)’র প্রবীণ নেতা কমরেড মারুথি মনপুডের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়।
(ক) সদ্য সমাপ্ত বিহার নির্বাচনে পার্টির উৎসাহজনক ভূমিকার জন্য কেন্দ্রীয় কমিটি বিহারের রাজ্য কমিটি এবং বিহারের সমস্ত সদস্যদের অভিনন্দন জানায়। আমাদের সকল প্রার্থীদের উৎসাহপূর্ণ লড়াইকে উষ্ণ শুভেচ্ছা জানায়। সমগ্র পার্টিকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করার সাথে সাথে মহারাষ্ট্রের লাল নিশান পার্টি (লেনিনবাদী)-কে এবং পার্টির সকল শুভাকাঙ্ক্ষীদের বিহারে নির্বাচনী প্রচারে আন্তরিক সমর্থন করার জন্য ধন্যবাদ জানায়। প্রতিবেশী কয়েকটি রাজ্য ও পার্টির সদর দফতরের বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় কমরেড এবং ছাত্র-যুব ও শ্রমিক ফ্রন্টের কর্মীরা তাঁদের দিনরাত সপ্তাহ এক করে ব্যাপকভাবে কাজ করেছেন।
(খ) বিহার নির্বাচনে পার্টি যে ফল করেছে তা দেশজুড়ে ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছে। আমাদের বিজয় বেশিরভাগই বেশ নির্ধারক ধরনের, খুব বিশ্বাসযোগ্য ব্যবধানে। আর যে সমস্ত জায়গায় আমাদের পরাজয় হয়েছে তার বেশিরভাগই অত্যন্ত কম ব্যবধানে। আমাদের নিজস্ব জায়গাগুলিকে ভালো মাত্রায় একত্রিত করতে পারা, আমাদের জোটের শরিকদের উৎসাহজনক সমর্থন, বিশেষত আরজেডির (মুজাফফরপুরের আওরাই ব্যতীত, যেখানে আরজেডির যাদব ভোটাররা আমাদের মুসলিম প্রার্থীকে ভোট দেয়নি) এবং এমনকি বরাবরকার বিজেপি-জেডিইউ ভোটারদের ভোটও পাওয়া (অনেক কেন্দ্রে ভালো সংখ্যক যুব সম্প্রদায়, পরিযায়ী শ্রমিক, কৃষক যারা উঁচু জাতের তারাও আমাদের জন্য প্রচার করেছেন এবং ভোট দিয়েছেন) আমাদের বিশাল বিজয়ে অবদান রেখেছে। কমরেড মেহবুব আলম ১,০৪,৪৮৯ ভোট পেয়েছেন (এই নির্বাচনের তৃতীয় সর্বোচ্চ প্রাপ্ত ভোট) এবং মোট ভোটের পরিপ্রেক্ষিতে সর্বোচ্চ ৫৩,৫৯৭ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন। কমরেড মনোজ মঞ্জিল ৬১.৩৯% ভোট পেয়েছেন (বিজয়ী প্রার্থীদের মধ্যে সর্বোচ্চ ভোট শেয়ার), জয়ের ব্যবধান শতকরা হিসাবে (৩৪.৫২%) যা বিজয়ীদের মধ্যে সর্বোচ্চ ব্যবধান।
(গ) বিহারের নির্বাচনের গতিপ্রকৃতি এনডিএ-কে পরাজিত করার সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেছিল। নির্বাচনের প্রথম পর্যায়ে (দক্ষিণ বিহারের বিস্তীর্ণ অঞ্চল, সম্পূর্ণ সাহাবাদ ও মগধ অঞ্চলের অনেকটা অংশ) মহাগটবন্ধন প্রায় ৭০% আসন জিতেছে এবং এই প্রথম পর্বে আমরা যে আটটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছি তার মধ্যে ৭টি আসন জিতেছি। তবে শেষ দুটি পর্যায়ে এনডিএ অপ্রত্যাশিতভাবে ম্যানেজ করতে সক্ষম হয়, বিশেষত মিথিলা-কোশী-সীমাঞ্চল বলয়ে, যার ফলে কোনোরকমে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতা অর্জন করেছে। এই অঞ্চলে বামেদের দুর্বল উপস্থিতির কারণে এনডিএ ইসলাম-ফোবিয়াকে কাজে লাগিয়ে মহাগটবন্ধনকে কোণঠাসা করতে সক্ষম হয় এবং আরজেডি-র বিরুদ্ধে জনগণকে প্রভাবিত করে।
(ঘ) শক্তিশালী বিধায়কদের একটি বড় টিম নিয়ে বিহারের রাজনীতিতে আমাদের হস্তক্ষেপের মাত্রা বিধানসভার অভ্যন্তরে ও বাইরে উভয়তই বাড়াতে হবে। আমাদের ১২টি আসনের মধ্যে সাতটিতে প্রার্থীরা জেডিইউ মনোনীত প্রার্থীদের পরাজিত করেছেন এবং পাঁচটি বিজয় হয়েছে বিজেপি (৪) এবং ভিআইপি (১) এর বিরুদ্ধে। বিজেপি যত তার জোটের শরিকদের প্রান্তিককরণ করবে, আমাদের ততই সামাজিক ভিত্তি, রাজনৈতিক প্রভাব এবং নির্বাচনী নেটওয়ার্কের প্রসার ঘটাতে প্রবল প্রচেষ্টা করতে হবে। আমাদের বিধায়কদের তাদের জেতা আসনগুলিতে আমাদের জোটের শরিকদের পাশাপাশি জেডিইউ এবং এলজেপি’র মতো প্রতিপক্ষদের ভোটারদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করতে হবে।
আমাদের বিহারের ফলাফল এবং আমাদের সাহসী বিজেপি-বিরোধী অবস্থান পশ্চিমবঙ্গে বাম-উদারপন্থী শিবির দ্বারা ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। সিপিআই(এম) নেতৃত্বের প্রভাবশালী অংশটি যদিও খুব নেতিবাচক এবং গোঁড়ামিপূর্ণ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। পশ্চিমবঙ্গে সিপিআই(এম) মূলত টিএমসি’কে টার্গেট করে কংগ্রেসের সাথে একটি জোট বেঁধে ফেলার জন্য প্রস্তুত। আমাদের কৌশলগত লাইন এবং আমাদের নির্বাচনী কৌশলের মধ্যেকার বিতর্কটি আসন্ন দিনগুলিতে স্বাভাবিকভাবেই তীক্ষ্ণ হবে। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি’কে ক্ষমতায় আসা আটকাতে পার্টি সুস্পষ্ট জোর দিয়ে বাছাই করা কয়েকটি নির্বাচনী এলাকায় প্রার্থী দেবে। আসামেও আমরা প্রতিযোগিতার জন্য কয়েকটি আসন চিহ্নিত করেছি। কার্বি আংলংয়ের কমরেডরা জেলার চারটি আসনেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার পরিকল্পনা করছেন। আমাদের নীচুস্তরের প্রস্তুতি বাড়ানোর সাথে-সাথে, প্রধান বিরোধী জোটের সাথেও কোনও সম্মানজনক আসন ভাগাভাগির ব্যবস্থার সম্ভাবনাগুলির অনুসন্ধান করতে হবে। পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম উভয় ক্ষেত্রেই আমাদের বিভিন্ন লড়াইয়ের শক্তির সহযোগিতায় নির্বাচনের জন্য জনগণের সনদ তৈরি করার চেষ্টা করা উচিত। তামিলনাড়ু ও পুদুচেরিতে এবং সম্ভব হলে কেরালায়ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার পরিকল্পনা রয়েছে।
কৃষক বিরোধী কৃষি আইনের বিরুদ্ধে কৃষকদের আন্দোলন একটি ঐতিহাসিক উত্থানে পরিণত হয়েছে। সরকারের দমন ও গুজব ছড়ানো প্রচারাভিযান কৃষকদের নিরস্ত করতে বা আন্দোলনকে বিভক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই আন্দোলনের পক্ষে দেশজুড়ে সমর্থন বাড়ছে এবং ৮ ডিসেম্বর ভারত বন্ধের সমর্থনে বেশিরভাগ বিরোধী দল ব্যাপক প্রচার করতে সমর্থ হয়েছে। আমাদের পাঞ্জাবের কমরেডরা এই আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। সরকারের সঙ্গে আলোচনায় যে দলটি অংশ গ্রহণ করছে তার মধ্যে আছেন আমাদের কমরেড রুলদু সিং, পাঞ্জাব কিষাণ ইউনিয়নের সভাপতি এবং অল ইন্ডিয়া কিসান মহাসভার সদস্য। দিল্লি ও পাঞ্জাবের ক্ষেত্রে আমাদের ভূমিকা জোরদার করার সময় কৃষকদের সমর্থনে আমাদের একটি বৃহত্তর সংহতি অভিযান গড়ে তোলা উচিত। ট্রেড ইউনিয়ন, ক্ষেতমজুর সমিতি, মহিলা সংগঠন এবং ছাত্র-যুব সংগঠনের সকলকেই এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া উচিত। কৃষকদের প্রতি সংহতি কর্মসূচীর পাশাপাশি কৃষক এবং জনগণের অন্যান্য অংশের কর্পোরেট-বিরোধী, সরকার-বিরোধী সংগ্রামকে আরও তীব্র করার জন্য আমাদের এই সুযোগটি নেওয়া উচিত যেখানে তা আমাদের পক্ষে করা সম্ভব।
এ বছর ৬ ডিসেম্বর (বাবরি মসজিদ ধ্বংসের আঠাশতম বার্ষিকী) এবং ১১ ডিসেম্বর (সিএএ আইনটির প্রনয়ণের প্রথম বার্ষিকী) ‘দেশ বাঁচাও, সংবিধান বাঁচাও’ আহ্বানের সাথে পালন করা হচ্ছে। কৃষকদের আন্দোলনের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে, ৬ ও ১১ ডিসেম্বর উপলক্ষে পৃথক কর্মসূচী অনেক জায়গায় সম্ভব নাও হতে পারে, তবে আমাদের বর্তমান সন্ধিক্ষণে যে সমস্ত প্রতিবাদ ও আন্দোলন গড়ে উঠেছে তাতে সাধারণ ফ্যাসিবাদ বিরোধী বিষয়বস্তুকে জোরের সাথে উত্থাপিত করতে হবে।
কমরেড বিনোদ মিশ্র-র ২২তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে সমগ্র পার্টির কাছে কেন্দ্রীয় কমিটি একটি আহ্বান রেখেছে। ১৮ ডিসেম্বরের আহ্বানটি ব্যাপকভাবে প্রচারিত করা ও সেটি অধ্যয়ন করা এবং সমগ্র পার্টিকে তাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে নতুন সুযোগগুলি উন্মোচনে সচল হতে হবে। এই বছর নবীকরণ কর্মসূচী অবশ্যই নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে পরিচালিত হতে হবে এবং বিহার ও পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলিতে পার্টি কমিটি অবশ্যই পার্টির সদস্যপদ বৃদ্ধির জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে। বর্তমান সন্ধিক্ষণের পুরোপুরি ব্যবহার করতে আমাদের অবশ্যই বিভিন্ন ভাষায় দলীয় প্রকাশনাগুলির নিয়মিত প্রকাশ নিশ্চিত করতে হবে এবং বিশেষত লোকযুদ্ধের জন্য একটি বড় সংখ্যক গ্রাহক সংগ্রহ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
১২-১৩ ডিসেম্বর কলকাতার মৌলালী যুব কেন্দ্রে রাজ্য কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড দীপঙ্কর ভট্টাচার্যও উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকের শুরুতে বিগত দিনে প্রয়াত কমরেডদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। বিশিষ্ঠ সাংস্কৃতিক কর্মী ও সংগঠক প্রবীর বল, নদীয়ার বর্ষীয়ান কমরেড রহিম সেখ, উত্তরবঙ্গের চা শ্রমিক বাঁধনা ওঁরাও, উত্তর ২৪ পরগণার সাংস্কৃতিক কর্মী অমিতাভ সরকার, বাঁকুড়ার প্রবীণ পার্টি কর্মী তরুণ প্রকাশ কুন্ডু, হুগলীর আদিবাসী নেতা বিশ্বনাথ সরেন, চুঁচুড়ার পার্টি কর্মী ভোলানাথ লাহিড়ী, হুগলীর কেতকী ব্যানার্জী, স্বপন বড়ুয়া, কলকাতার মিহির রায়চৌধুরী, মুর্শিদাবাদের মালেক সেখ, ময়নাগুড়ির কার্তিক রায়, দক্ষিণ ২৪ পরগণার উস্থি এলাকার হরেন মন্ডল, মাধবী হালদার, পথ দুর্ঘটনায় প্রয়াত বালীর ছাত্র কর্মী দীপন দাসের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়।
বৈঠকের শুরুতে চলমান কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে সাধারণ সম্পাদক বক্তব্য রাখেন। যার মূল কয়েকটি দিক হল : এই কৃষক আন্দোলন মোদী সরকারকে প্রবল চাপের মুখে ফেলে দিয়েছে। সরকার আন্দোলনে বিভাজন সৃষ্টি করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে কিন্তু তাকে মোকাবিলা করেই আন্দোলন এগিয়ে চলেছে। আন্দোলনে সমাবেশিত বিভিন্ন ধরনের শক্তিগুলির মধ্যে বামপন্থীদের একটা ভালো অংশগ্রহণ রয়েছে। আমাদের পার্টির পাঞ্জাবের কমরেডরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছেন যার মধ্যে কৃষক নেতা ও এআইকেএম সভাপতি কমরেড রুলদু সিং একজন প্রতিষ্ঠিত ও সন্মানীয় নেতৃত্বের অবস্থানে রয়েছেন। এই দিকগুলিকে আমাদের প্রচারে নিয়ে যেতে হবে। এই আন্দোলনে এবং সারা দেশ জুড়ে সংগঠিত নানাবিধ কর্মসূচীতে বিভিন্ন শক্তির বড় মাত্রায় অংশগ্রহণ, সমর্থন ও সহানুভূতি গড়ে উঠেছে। শাহিনবাগ আন্দোলনে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও যে ভীতির পরিবেশ ছিল, এখানে তার বিপরীতে দেখা যাচ্ছে এক উৎসবের মেজাজ। দেশের বুকে এক বিশাল গণআন্দোলন যা কর্পোরেট বিরোধী, বেসরকারীকরণ বিরোধী অভিমুখকে সামনে নিয়ে এসেছে। পশ্চিমবঙ্গে কয়েকটি জায়গায় ধারাবাহিক সংহতিমূলক অবস্থান শুরু করা যায় কিনা আমাদের সেই প্রচেষ্টা নিতে হবে।
এ রাজ্যে বিজেপিকে প্রধান বিপদ হিসাবে চিহ্নিত করে আমাদের বলিষ্ঠ রাজনৈতিক অবস্থান উদারনৈতিক বাম মহল সহ সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে ভালো মাত্রায় চর্চিত ও সমাদৃত হয়েছে। পশ্চিমবাংলার বুকে বিজেপির ফ্যাসিষ্ট আগ্রাসন সম্পর্কে রাজনৈতিক সংবেদনশীলতা (সেনসিটাইজেশন) বাড়িয়ে তোলা এবং সেটাকে প্রচারের আলোয় নিয়ে আসার লক্ষ্যে আমরা সচেষ্ট রয়েছি। বিহারে নির্বাচনী সাফল্যের প্রেক্ষাপটে এই ক্ষেত্রে আমরা বেশ খানিকটা সফল হয়েছি। এরাজ্যে আমাদের লক্ষ্য হল বিজেপির ভয়ংকর বিপর্যয়ের মোকাবিলায় জনগণের এক সার্বিক প্রতিরোধ সংগঠিত করা। এ জন্য আমরা বাংলায় জনগণের দাবিসনদ সূত্রবদ্ধ করব,তাকে জনপ্রিয় করে তুলব। এই লক্ষ্যে সমমনোভাবাপন্ন বিভিন্ন শক্তির সাথে মতামত বিনিময় বা গ্রহণ করার কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে। সিপিএম ও কংগ্রেসের যে সমঝোতা গড়ে উঠেছে তাতে কংগ্রেস সম্পূর্ণ প্রাধান্য বজায় রাখছে। বামপন্থার চরম দেউলিয়া অবস্থান থেকে সিপিএম আত্মসমর্পনের পথ গ্রহণ করেছে। এ রাজ্যের শাসক তৃণমূলকে প্রধান বিপদ রূপে চিহ্নিত করে ওরা বিজেপিকে সুবিধা করে দিচ্ছে। তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপিকে একই সারিতে (বন্ধনীতে) রাখার ভ্রান্ত অবস্থান গ্রহণ করেছে। বিগত দিনগুলিতে বাম ভোটের একটা বড় অংশ বিজেপিতে চলে যাওয়ার যে প্রবণতা এ রাজ্যের বুকে দেখা গেছে, তাকে বিপরীতমুখী করার আন্তরিক প্রচেষ্টাও তেমন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
বামপন্থার এই ক্রমাবনতি বা অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে নিজেদের রাজনৈতিক পার্থক্য বজায় রেখে আমরা বাম-কংগ্রেস নির্বাচনী জোট থেকে সরে থাকছি। যদিও গণআন্দোলনের ময়দানে বামপন্থীদের যৌথ কার্যকলাপ আমরা অব্যাহত রাখব। নির্বাচনে বাছাই করা তুলনামূলক স্বল্প সংখ্যক আসনে আমরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব। বিগত বিধানসভা নির্বাচনে সাধারণ ভাবে বামেদের জয়ী আসনগুলিতে (২৬টা) তাঁদের সমর্থন জানাব। বাম ঐক্যের একটা সংকেত বা বার্তা তুলে ধরতে সেই কেন্দ্রগুলিতে আমরা সাধারণভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা থেকে বিরত থাকব। কয়েকটি আসনে বন্ধু/আন্দোলনকারী শক্তিদের সমর্থন জানাব। স্বল্প সংখ্যায় হলেও আমাদের কিছু বন্ধু শক্তি রয়েছেন যারা বামপন্থী বা নীচুতলায় আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন তাদের সাথে নির্বাচনী বোঝাপড়া গড়ে তোলার প্রক্রিয়া চালাব। বাকি বড় সংখ্যক আসনগুলিতে আমরা “বিজেপিকে পরাস্ত করুন” আহ্বান জানিয়ে কার্যকরী বা সক্ষম এমন প্রার্থীদের ভোট দেওয়ার জন্য জনগণের কাছে আহ্বান জানাব। বিগত দিনে বামফ্রন্টকে সরিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের ক্ষমতায় আসাকে আমরা স্বাগত জানাইনি। তৃণমূল সরকারের জনবিরোধী নীতি, দুর্নীতি, দলবাজি, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলন চলছে। এ রাজ্যে বিজেপির বিরোধিতায় তৃণমূলের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা জোরালো করে তুলতে হবে। কিন্তু তৃণমূলকে অপসারিত করে ফ্যাসিষ্টরা ক্ষমতা দখল করতে উদ্যত। এই পরিবর্তিত পরিপ্রেক্ষিতকে আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে। পশ্চিমবাংলায় বাম পুনর্জাগরণ ঘটানো এবং ফ্যাসিস্টদের পরাজিত করা এই দুই কর্তব্য আমরা মেলাতে চাই। সব মিলিয়ে বলা যায় বামপন্থার সবচেয়ে আক্রমনাত্মক অবস্থান থেকে নিজেদের শক্তির বিকাশ ঘটানো, বামফ্রন্টের সাথে আংশিক বোঝাপড়া, আন্দোলনরত ও বাম বন্ধুশক্তির সাথে সমঝোতা গড়ে তোলা এবং বিজেপিকে পরাস্ত করা এই দিকগুলিকে সমন্বিত করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
দেশব্যাপী কৃষক আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এ রাজ্যের বুকে বিশেষত গ্রামাঞ্চলে কৃষক ও কৃষিমজুরদের মধ্যে প্রচার অভিযানকে একেবারে নীচুতলায় নিয়ে যেতে হবে। মোদী সরকারের নয়া কৃষি আইনের সর্বনাশা দিকগুলি সম্পর্কে এ রাজ্যের সাধারণ কৃষকদের মধ্যে বিরোধিতা দেখা যাচ্ছে, কিন্তু এই নির্দিষ্ট ইস্যুগুলিতে কৃষকদের আরও সচেতন করে তোলা ও তাঁদের সক্রিয়তা সৃষ্টি করার বিষয়টা বিভিন্ন স্তরের নেতৃত্বের অগ্রণী ভুমিকার উপর নির্ভর করছে। একে স্বতস্ফূর্ততার উপর ছেড়ে দিলে হবে না। বর্তমানে ফসলের ( বিশেষত ধানের) ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ও সরকারী সংগ্রহ ইস্যুতে এলাকা বা ব্লক স্তরে আন্দোলনমুখী উদ্যোগ নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই আন্দোলনকে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার উভয়ের বিরুদ্ধেই পরিচালিত করতে হবে। আমাদের কৃষক সংগঠনের সক্রিয়তা বা কাঠামোগত যে দুর্বলতাগুলি রয়েছে তাকে কাটিয়ে তুলতে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে নামতে হবে। যে বিধানসভা কেন্দ্রগুলিতে আমরা প্রতিদ্বন্দ্বীতা করার কথা বিবেচনা করছি সেখানে নিবিড় অনুশীলনকে কেন্দ্রীভূত করতে হবে।
গরিব মেহনতি মানুষদের প্রতি বঞ্চনা-প্রতারণা ও সরকারী প্রকল্প রূপায়ণে চরম ব্যর্থতাকে আড়াল করতে তৃণমূল সরকার “দুয়ারে সরকার” নামক এক প্রকল্প শুরু করেছে। এগুলি যে জনগণের অধিকার, সরকারী অনুগ্রহ নয় বা একে দলীয় আনুগত্যর প্রশ্ন করে তোলা চলবে না – এই প্রচারকে আমাদের জোরের সাথে তুলে ধরতে হবে। এর পাশাপাশি “জনগণের কথা শুনুন, জনগণের দাবিগুলি তুলে ধরুন” বিষয়ক জনসংযোগ অভিযান শুরু করতে হবে। এই প্রচার অভিযানকে জনপ্রিয় রূপ দিতে হবে। প্রতিটি বিধানসভা কেন্দ্রে ন্যূনতম পাঁচটি জনগণের বৈঠক করে মানুষের কথা শুনতে হবে। আমাদের নির্বাচনী দাবিসনদ সূত্রবদ্ধ করতে এটি গুরুত্বপূর্ণ ও সহায়ক হয়ে উঠবে।
সাংস্কৃতিক ফ্রন্টে বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে পারস্পরিক কাজের ঐক্য গড়ে তোলার জন্য সকলকে আরও ধৈর্য্যশীলভাবে সচেষ্ট হওয়ার জন্য রাজ্য কমিটি আহ্বান জানাচ্ছে। ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধকে আরও শক্তিশালী করে তোলা, ব্যাপকতম প্রগতিশীল, বাম ও গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক ক্ষেত্রে কর্মরত শক্তি ও ব্যক্তিবর্গের সাথে ঐক্য গড়ে তোলা, ক্ষুরধার ও সমৃদ্ধ সৃজনকর্মের অনুশীলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আামাদের যা কিছু ইতিবাচক ঐতিহ্য তাকে হাতিয়ার করে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে।
ছাত্রফ্রন্টের আশাপ্রদ সক্রিয়তা বা অগ্রগতি লক্ষ করা যাচ্ছে। বিহারের বিধায়কদের নিয়ে এসে কলকাতায় অনুষ্ঠিত কর্মসূচী সফল করতে তারা খুবই ইতিবাচক ভুমিকা নিয়েছে। এ জন্য রাজ্য কমিটি ছাত্র কমরেডদের সংগ্রামী অভিনন্দন জানাচ্ছে। যুব সংগঠনও উদ্যোগ নিতে শুরু করেছে। আগামী ফেব্রুয়ারী মাসে তারা রাজ্য যুব সম্মেলন করবে বলে স্থির করেছে।# মিডডেমিল রন্ধনকর্মীদের প্রতি সীমাহীন বঞ্চনার বিরুদ্ধে আগামী জানুয়ারী মাসে কলকাতায় এক বৃহত্তর কর্মসূচী গ্রহণ করা হবে( সম্ভাব্য নবান্ন অভিযান) একে সফল করে তুলতে সমস্ত জেলা পার্টি কমিটিকে সহযোগিতা করতে হবে। (ঈষৎ সংক্ষেপিত)
কৃষি ও কৃষক বিরোধী কেন্দ্রীয় নয়া কৃষি আইনের বিরুদ্ধে এবং দিল্লিতে আন্দোলনরত কৃষকদের সংহতিতে গত ১০ ডিসেম্বর সোচ্চার হয়ে উঠল হুগলির দাদপুর থানার মহেশ্বরপুর। কৃষক আন্দোলনের সংহতিতে সংগঠিত এই সমাবেশের নামকরণ হয়েছিল “সংবিধান বাঁচাও, দেশ বাঁচাও” সমাবেশ। আয়োজক সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতি, আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চ এবং সারা ভারত কিষান মহাসভা।
সমাবেশে উপস্থিত হয়েছিলেন আয়ারলা’র দুই সর্বভারতীয় নেতা ও বিধায়ক সত্যদেব রাম এবং বীরেন্দ্র গুপ্তা। এই সমাবেশ উপলক্ষে সারা ব্লক জুড়ে বিজেপি বিরোধী তীব্র প্রচারাভিযান সংগঠিত হয়। সত্যদেব রাম তাঁর আবেগঘন বক্তৃতায় সহজেই উপস্থিত সকলের মন স্পর্শ করতে সক্ষম হন। বীরেন্দ্র গুপ্তা এখানকার চলমান আন্দোলনের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেন।
এছাড়াও বক্তব্য রাখেন ধনেখালি লোকাল কমিটির সম্পাদক এবং জেলা কমিটির সদস্য সজল দে; কিষান মহাসভার জেলা নেতা মুকুল কুমার, আদিবাসী মঞ্চের জেলা সম্পাদক পাগান মুর্মু প্রমুখ। দিল্লির কৃষক শহীদদের স্মরণে সভার শুরুতেই নীরবতা পালন করা হয়। আদিবাসী নৃত্যের মধ্য দিয়ে শেষ হয় সভা।
কেন্দ্রীয় সরকারের নয়া কৃষি আইনের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে চলছে কৃষক আন্দোলন। দেশের রাজধানী দিল্লীর সীমান্ত অবরোধ করে কৃষকরা জানিয়ে দিয়েছেন এই আইন বাতিল না হওয়া পর্যন্ত তাদের সংগ্রাম জারি থাকবে। দেশের কৃষকদের ভবিষ্যতকে সংকটের মুখে ঠেলে আম্বানি-আদানির হাতে কৃষিক্ষেত্রকে তুলে দেওয়ার চক্রান্তের বিরুদ্ধে পথে নেমেছেন কৃষকদের পাশাপাশি সমাজের সর্বস্তরের মানুষ। সেই চক্রান্তকে প্রতিহত করতেই আন্দোলনরত কৃষকরা গত ১৪ ডিসেম্বর দেশবাসীর কাছে আহ্বান জানিয়েছিলেন দেশজুড়ে প্রতিবাদ দিবসে যোগদান করার জন্য, আম্বানি-আদনির সমস্ত পণ্য বয়কট করার জন্য। স্পষ্ট কথায় তারা দাবি জানিয়েছিলেন নয়া কৃষি আইন বাতিল করতে হবে, এমএসপি’র আইনি অধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে।
কৃষকদের সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১৪ তারিখ কলকাতার রাজপথে বিক্ষোভে নামল আইসা, এআইসিসিটিইউ, সিপিআই(এমএল) লিবারেশন। ধর্মতলায় রিলায়েন্স ট্রেন্ডস এবং জিও স্টোরের সামনে চলল বিক্ষোভ কর্মসূচী, ছাত্রছাত্রীরা দীর্ঘক্ষণ অবরোধ করে রাখে ধর্মতলার রাস্তা। দাহ করা হয় নরেন্দ্র মোদী – মুকেশ আম্বানি – গৌতম আদানীর কুশপুত্তলিকা, রাজপথে জ্বালানো হয় জিও’র পণ্য, জানিয়ে দেওয়া হয় দেশের কৃষকদের তথা মেহনতি মানুষের উপর যে কোনো ফ্যাসিবাদী আক্রমণ প্রতিহত করা হবে জোরকদমে। কর্মসূচীতে বক্তব্য রাখলেন আইসার পক্ষ থেকে সৌমেন্দু মিত্র, লিবারেশনের পক্ষ থেকে তমাল চক্রবর্তী, বাসুদেব বসু। বক্তারা স্পষ্ট বুঝিয়ে দিলেন দমনপীড়নের মাধ্যমে, আন্দোলনকে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা করে কৃষকদের এই লড়াইকে থামানো যাবে না। কোনোরকম সংশোধনী নয়, কৃষি আইন বাতিল না করা পর্যন্ত আন্দোলন চলছে, চলবে।
রাজধানীর বুকে চলমান কৃষক আন্দোলনের ১৯তম দিনে কৃষকরা দিল্লি জয়পুর জাতীয় সড়ক অবরোধ করে বসে ছিলেন। এদিন একইসঙ্গে ছিল কৃষকদের গণঅনশনের কর্মসূচী। পাশাপাশি এদিন দেশব্যাপী এআইসিসিটিইউ, ছাত্র সংগঠন আইসা এবং এআইপিএফ সহ বিভিন্ন গণসংগঠন কর্পোরেট আম্বানি আদানিদের কোম্পানিরাজের উপর চাপ তৈরি করার কূর্মসুচী গ্রহণ করে। এই উপলক্ষে ১৪ ডিসেম্বর বারাসাত সুভাষ ময়দানের পাশে রিলায়েন্স স্টোরে আইসা, এআইপিএফ এবং বেশ কিছু গণতান্ত্রিক মানুষ বিক্ষোভ দেখায়। ‘বয়কট রিলায়েন্স’ আওয়াজ তুলে কলোনি মোড় থেকে শুরু হয়ে মিছিল নবপল্লী আবাসিক এলাকায় অবস্থিত রিলায়েন্স স্টোরের সামনে পৌঁছায় এবং ক্রেতাদের রিলায়েন্সের জিনিসপত্র না কিনতে অনুরোধ করে। অবরোধ চলাকালীন সময়ে বক্তব্য রাখেন আইসা’র সংগঠক অন্নেষা রায় ও আমান, সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির সংগঠক শোভনা, প্রাক্তন শিক্ষক এবং গণআন্দোলনের সংগঠক নীলকন্ঠ আচার্য প্রমুখ। বক্তারা কৃষি ও কৃষক বিরোধী আইন প্রত্যাহারের দাবি এলাকাবাসীদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরেন। গণসঙ্গীত গেয়ে উজ্জীবিত করেন পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের সংগঠক অনুপ মজুমদার এবং মেঘনা মজুমদার। অবরোধের পর মিছিল কলোনি মোড়ে ফিরে এসে আম্বানি আদানি এবং তাদের দোসর নরেন্দ্র মোদীর প্রতিকৃতি পোড়ানো হয়। শ্লোগান তোলে আইসা সংগঠক রুমেলা। এই যুক্ত কর্মসুচীতে নেতৃত্বের অন্যতম ভূমিকায় ছিলেন এআইপিএফ-এর উত্তর ২৪ পরগণা জেলা আহবায়ক সুজিত ঘোষ।
নৈহাটি পৌরসভার পাশে জিও ডিজিটালের সামনে কৃষক আন্দোলনের সংহতিতে ‘একটি নাগরিক উদ্যোগ’এর অবস্থান ও প্রতিকী জিও সিম পোড়ানো হয়। দীর্ঘক্ষণের এই অবস্থান-বিক্ষোভে নাগরিকদের অংশগ্রহণ ছিলো চোখে পড়ার মতো।
১৪ ডিসেম্বর দিল্লীতে আন্দোলনরত কৃষকদের ডাকা সারা ভারত প্রতিবাদ দিবসে বালিতে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন ও আইসা’র নেতৃত্বে কৃষিতে কর্পোরেট রাজের বিরুদ্ধে মিছিল সংগঠিত হয় বালি পার্টি অফিস থেকে বালিখাল পর্যন্ত। দৃপ্ত এই মিছিল থেকে আওয়াজ ওঠে কৃষি আইন ২০২০ বাতিল করতে হবে। শ্লোগান ওঠে কৃষিতে কর্পোরেট রাজ মানছি না। মিছিলের শেষে আম্বানি-আদানির প্রতিকৃতি জ্বালানোর মধ্যে দিয়ে প্রতিবাদ ব্যক্ত করা হয়। শেষে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন পার্টির হাওড়া জেলা কমিটির সদস্য নীলাশীষ বসু।
ঋণমুক্তির আন্দোলনের শুরু থেকেই মাইক্রোফিনান্স সংস্থার এজেন্টদের জুলুমবাজীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমেই ঋণমুক্তি কমিটি সংগঠিত হয়। এই আন্দোলনের ফলে অনেক ক্ষেত্রেই জুলুম অত্যাচার অপমান অসম্মান কিছুটা কমেছিল। কিন্ত ঋণ মকুবের প্রশ্নে এবং মাইক্রোফিনান্স সংস্থাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারে সরকারের কোনো পদক্ষেপ না থাকার ফলে মাইক্রোফিনান্স সংস্থাগুলোর জুলুমের প্রশ্ন বারবার উঠে আসছে। সরকার শুধুমাত্র ছয় মাসের সুদের উপর অতিরিক্ত সুদ মকুব করার কথা বলেছে, তা হলেও ব্যাপক গরিব মানুষ ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে শোধ করতে পারছেন না। তাদের ঋণগ্রস্ত দুরবস্থা থেকে কোনো পরিত্রাণ মিলছে না। তাদের সংকট বেড়েই চলেছে। ঋণের দায়ও বেড়ে যাচ্ছে। তাই ঋণমুক্তির আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। এই আন্দোলন যেহেতু অনেকটাই স্বতস্ফূর্ত ভাবে অনেক জায়গাতে বিস্তার লাভ করেছে, তার উপর শাসক পার্টিগুলোর বিভ্রান্তিমুলক প্রচার ও চাপের মধ্যেই এগোতে হচ্ছে, তাই অনেক টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়েই সংগঠনের কাঠামোগুলোকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ চালিয়ে যেতে হবে। এই পরিস্থিতির মধ্যেই ১৩ ডিসেম্বর পুর্ব বর্ধমান জেলার মেমারী ১নং ব্লকের নিমোতে শতাধিক ঋণগ্রস্ত মহিলাদের নিয়ে কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। কনভেনশনে উপস্থিত সমস্ত মানুষ ২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত সমস্ত ধরনের ঋণ মকুবের দাবিতে এবং এজেন্টদের জুলুমের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য অঙ্গীকার বদ্ধ হন। কনভেনশনে নেতৃত্ব দেন আয়ারলার জেলা কমিটির সদস্য সাধন কর্মকার। বক্তব্য রাখেন জেলার সিপিআই(এমএল) নেতা কুনাল বক্সী। দেশজুড়ে কৃষক আন্দোলনের সংহতিতে ঋণমুক্তি কমিটির পক্ষ থেকে ১৬ ডিসেম্বর কলকাতার জমায়েতে অংশগ্রহণের আহ্বান জানানো হয়।
লকডাউনের মাঝে অনিয়মিত বেতন পাওয়া, কোনোরূপ স্বাস্থ্য বা জীবন সুরক্ষার সামগ্রী ছাড়া কাজ চালিয়ে যেতে বাধ্য হওয়া বিষ্ণুপুর পৌরসভার সাফাই ও জল বিভাগের অস্থায়ী কর্মীরা কর্তৃপক্ষকে বিক্ষোভের কথা জানাতে যান কর্মীরা। কিন্তু পাওয়া গেল ধমক, ‘টাকা ছাড়া কাজ করতে হয় করো নইলে কেটে পড়ো’ – এমন কথা এবং কাজ থেকে ছাঁটাই এর হুমকি। শ্রমিকদের ক্ষোভ দানাবাঁধা শুরু করে সাথে সাথে, এআইসিসিটিইউ-র সাথে সরাসরি যোগাযোগ করেন তাঁরা, এবং আমাদের হস্তক্ষেপে শহর জুড়ে মিছিল করে এসডিও অফিসে ধর্না দিয়ে শুরু হয় আন্দোলন। আন্দোলন এরপর ক্রমাগত সংঘবদ্ধ হতে থাকে এবং এআইসিসিটিইউ-র হস্তক্ষেপে তৈরি হয় ‘বিষ্ণুপুর পৌরসভা সংগ্রামী শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন’। যার সম্পাদক হন এআইসিসিটিইউ-র নেতা দিলবার খান। এরপর আন্দোলন এতটাই জোরদার চলে, প্রচার এতটাই জোরালো ছিল যে নভেম্বরের মধ্যে, নবান্ন থেকে যে বেশ কিছু পৌরসভার প্রশাসক মণ্ডলী পরিবর্তনের তালিকা তৈরি হয় তাতে বিষ্ণুপুরের প্রশাসক শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীকেও সরিয়ে দিতে হয়।
নতুন প্রশাসক মণ্ডলী তৈরি হয়। তার প্রশাসক হন দিব্যেন্দু ব্যানার্জী, যিনি দায়িত্ব গ্রহন করেন যে দিন, সেই দিনই ইউনিয়নের তরফ থেকে তাঁকে ডেপুটেশন আকারে আন্দোলনরত ইউনিয়নের দাবিসনদ জমা করা হয়। আন্দোলনের গতিতেই ক্ষমতা যখন শ্রমিকদের তুঙ্গে এবং যখন পুজোর উৎসব বোনাসের টাকাও কর্তৃপক্ষ মেটাতে অক্ষম, তখন প্রবল চাপে পড়েই নতুন প্রশাসক তার অন্যান্য সহকারী সদস্যদের নিয়ে কর্মীদের আশ্বাস দেন বেতন নিয়মিত মিটিয়ে দেওয়ার। ডিসেম্বরে নতুন দায়িত্ব নিয়ে তাঁরা জানিয়ে দিল আন্দোলনের প্রতিটি দাবিই ন্যায্য, মজুরী বৃদ্ধি থেকে স্থায়ীকরণ, পিএফ থেকে পেনশন সবই মেটানোর চেষ্টা হবে ধাপে ধাপে। এরপর ইউনিয়ন সাধারণ সভা ডেকে ১২০ জন সদস্যের উপস্থিতিতে সিদ্ধান্ত নেয় যে, নিয়মিত বেতন মেটানো সহ অন্যান্য দাবিগুলি আদায় নিয়েও কড়া নজর রাখা হবে, প্রয়োজনে আরো তীব্র সংগ্রাম চালানো হবে। আপাতত, পৌরসভা চত্বরের সামনেই খোলা ময়দানে একদিন ইউনিয়নের সবাইকে নিয়ে প্রশাসক মণ্ডলীর সাথে দাবি আদায় নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা হবে। সেই আলোচনাতে এআইসিসিটিইউ-র বিষ্ণুপুরের নেতৃত্বও উপস্থিত থাকবেন, যদিও এর দিনক্ষণ এখনো ইউনিয়ন ঠিক করেনি। এখনও পর্যন্ত প্রায় পাঁচ মাস ধরে হয়ে চলা লাগাতার আন্দোলন ও ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা হওয়ার চাপ শাসককে অনেকটা রূপ বদলাতে বাধ্য করেছে, তবে এই রূপের বদল দেখিয়েই সংগ্রামী শ্রমিক কর্মচারি ইউনিয়নের শক্তিকে খাটো করে দেখলে সেটা শাসকের ভুল হবে বলে ইউনিয়নের নেতারা জানিয়েছেন। লড়াই জারি আছে, সংগঠনের সদস্য সংখ্যা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে, দাবিগুলো যে আদায় করা যেতে পারে, সেই বিশ্বাস তৈরি হয়েছে। তবুও এখনো পাওয়া গেছে যা তা হল, নিয়মিত বেতন মেটানো আর বোনাসের টাকা পাওয়ার আশ্বাস, এর সাথে বেতন বৃদ্ধির বিষয়টা নিয়ে মশকরা হচ্ছে, কারণ প্রতিদিন মাত্র ২০ টাকা করে বেতন বাড়ানো হয়েছে, এভাবে তাঁদের বেতন হবে ঐ পাঁচ থেকে সাড়ে ছয় হাজার টাকা, যেখানে ইউনিয়নের দাবি ন্যূনতম বারো হাজার টাকা মজুরি স্থির করা হোক। তায় অনেকটা পথ এখনো চলা বাকি, ফ্যাসিজমের যুগে কাজ হারানোর সম্ভাবনাও যত গাঢ় হচ্ছে শ্রমিকদের ইউনিয়নে সংযুক্ত হওয়ার পরিমাণও তত বেড়ে চলেছে।
- ফারহান হোসেইন খান
এমন একটা সময় যাচ্ছে, যেখানে বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বহু ছাত্র ছাত্রী। তাদের মধ্যে একটা অংশের মেয়েরা বিভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক চাপে পড়াশুনার অধিকার পাচ্ছে না। ঠিক এরকম সময়ে দাঁড়িয়ে স্মরণ করা হয় নারী শিক্ষার অন্যতম পথিকৃৎ রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেনকে। গত ৯ ডিসেম্বর তাঁর জন্মদিন এবং মৃত্যুদিনকে স্মরণ করে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয় বিষ্ণুপুর আইসা ইউনিটের পক্ষ থেকে বেশ কিছু ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে। রোকেয়ার ছবিতে মাল্যদান করেন সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির অন্যতম সদস্যা মল্লিকা দাশগুপ্ত। এরপর এক এক করে আমাদের ছাত্রছাত্রীরা মাল্যদান করে শ্রদ্ধা জানায়। ছাত্রীদের মধ্যে আসপিয়া খাতুন, সুমনা মাকুড় ও সহেলী দে বেগম রোকেয়া সম্বন্ধে কিছু কথা বলে এবং তাদের কিছু স্বরচিত কবিতা পাঠের মধ্যে দিয়ে স্মরণ সভা শেষ হয়।
১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে বাঁকুড়ার মাচানতলায় সভা করা হয় আইসার তরফ থেকে। সভাটি পরিচালনা করেন যুব সংগঠক প্রান্তিক এবং আইসার পক্ষে বক্তব্য রাখেন শুভঙ্কর, বিল্টু ক্ষেত্রপাল ও তিতাস গুপ্ত। তারা ভারভারা রাও থেকে শুরু করে সিএএ বিরোধী আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশী প্রতিশোধ, ভিমা কোরেগাঁও এর সাজানো মামলায় মানবাধিকার কর্মী, অধ্যাপক ও ছাত্রনেতাদের জেলে পাঠানো নিয়ে সরব হন এবং কাশ্মীরের জনগণের, আসামের জনগণের ওপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে, নয়া কৃষি আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত কৃষকদের মানবাধিকার হরণের প্রশ্ন নিয়েও সোচ্চার হন। এছাড়াও সিপিআই(এমএল) লিবারেশানের জেলা সম্পাদক বাবলু ব্যানার্জী সবশেষে বক্তব্যের মাধ্যমে তুলে ধরেন, বিজেপি মানেই বিপর্যয়, বিজেপি মানেই গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন।
৮ ডিসেম্বর ধর্মঘটের দিন বেলঘরিয়া এলাকায় তিনটি জুটমিল কামারহাটি, আগরপাড়া ও প্রবর্তক মিলের শ্রমিকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ধর্মঘটে শামিল হয়েছেন। দোকানপাট অধিকাংশ বন্ধ। বিটি রোডে যান চলাচল কম। সকালে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন জেলা কার্যালয় থেকে মিছিল শুরু হয়ে বিভিন্ন পথ পরিক্রমা করে রথতলা বিটি রোড কিছুক্ষণ অবরোধ করে, এরপর মিছিল আবার এগিয়ে যায়, প্রবর্তক জুটমিলের সামনে বিটি রোড অবরোধ হয়, সবশেষে কামারহাটিতে বিটি রোড অবরোধ হয়। সিপিআই(এমএল) এবং সিপিআই(এম)-এর পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন যথাক্রমে নবেন্দু দাশগুপ্ত এবং প্রদীপ মজুমদার। এরপর আবার মিছিল শুরু হয়ে সিপিআই(এম) কার্যালয়ে পৌঁছে শেষ হয়।
হরিন্দার কৌর বিন্দুর গল্প দিয়েই শুরু করা যাক।গেরুয়া মিডিয়ার একটি লাগাতার প্রচার হল, কৃষক-আন্দোলন খালিস্তানি জঙ্গীদের দ্বারা পরিচালিত। তাঁরা হরিন্দর কৌর বিন্দুকে চেনেন না, এমন হতে পারে কি? কৃষক আন্দোলনের অগ্রণী নেতাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। অমন দুঁদে মহিলা নেতা হওয়ায় আরওই বেশি চোখে পড়েন। অবশ্য দেখেও না দেখার ভান করা যায়। এই হরিন্দর তাঁর বাবাকে হারিয়েছেন খালিস্তানিদের গুলিতে। তিনি বলেন, “কৃষকদের খালিস্তানি বলে অপমান করা পিতৃবিয়োগের থেকেও মর্মান্তিক। কেন অপপ্রচার করছেন? ইতিহাস পড়ে আসুন বরং।” বিন্দুর বাবা মেঘরাজ ভাতুয়ানা ছিলেন বামপন্থী এবং প্রবল খালিস্তান-বিরোধী। ১৩ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছেন বিন্দু, তাই অপপ্রচারে আহত।
এতদিনে সকলেই জানে যে দেশের রাজধানীতে গণআন্দোলন চলছে। ২৬শে নভেম্বরের ভোর থেকেই রাজধানীর শীতযাপনের আলস্যকে চিরে ওয়াটার ক্যানন চলেছে। আছড়ে পড়ছে সেই বৃদ্ধ কৃষকের গায়ে যিনি অন্ন জোগান। টিয়ার গ্যাস সেই তরুণ চোখকে অন্ধ করছে যে চোখ চেনে উর্বরতার সম্ভাবনা। প্রথমে হরিয়ানা আর পাঞ্জাবের চাষিরা এসেছেন পায়ে হেঁটে, এসেছেন ট্রাক্টর চেপে৷ ব্যারিকেড ভেঙেছেন। তারপর যোগ দিয়েছেন উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্রের কৃষকরাও। টিকরি আর সিংঘু বর্ডারে ঘাঁটি গেড়েছেন তাঁরা। বুরারির নিরঙ্কারী মাঠের খোলা জেলখানায় তাঁরা যাননি।
অনেক আগে থেকেই তাঁরা প্রতিবাদ করে চলেছিলেন কৃষিবিলের বিরুদ্ধে। জুন মাস থেকেই সঙ্ঘবদ্ধ হচ্ছিলেন রাজ্যে রাজ্যে। সেসময় মূলধারার মিডিয়া ব্যস্ত ছিল সুশান্ত সিংহ রাজপুতের মৃত্যু নিয়ে। এরমধ্যেই বিল পাশ হয়ে অ্যাক্ট হল। রাজ্যে রাজ্যে কৃষকদের বোঝানো হল, এই অ্যাক্ট কৃষকদের ভালোর জন্য। কিন্তু তাঁরা মানলেন না। তাঁরা কর্পোরেট তোষণ ছাড়া আর কিছু পেলেন না অ্যাক্টে। হাজার মাইল সফর করে তাই তাঁরা দিল্লিতে।
কৃষি সংক্রান্ত অর্থনীতি বেশ জটিল। উত্তর ভারতের সুবিস্তৃত কৃষিজমিতে বড় চাষিদের উৎপাদন বেশি, নতুন আইনে ক্ষতিও বেশি। সরকারী মান্ডি তুলে দিলে কি কৃষকের লাভ হবে? মধ্যসত্ত্বভোগীদের অত্যাচারই যদি মাথাব্যথার কারণ হয়, তবে নতুন প্রথম আইন তো বরং কৃষকদের, বা যে কোনো ব্যক্তিকেই সরাসরি খোলাবাজারে নিজের শস্য বিক্রি করার অনুমতি দিচ্ছে৷ তাহলে অসুবিধে কোথায়? অসুবিধে হল এই যে প্রতি কৃষকের পক্ষে ভিনরাজ্যের পুঁজিপতির সঙ্গে মোলাকাত করা সম্ভব নয়। উপরন্তু খোলাবাজারে সকলেই সকলের প্রতিদ্বন্দী হয়ে উঠবে৷ তাতে দাম কমবে পণ্যের। মান্ডি কৃষক ও মধ্যসত্ত্বভোগীদের লাইসেন্স দিত, অর্থাৎ একটা নিয়ন্ত্রণ ছিল। মান্ডি ন্যূনতম দামও (MSP) নির্ধারণ করত। তাহলে মান্ডি উঠে গেলে ন্যূনতম দামও কি কৃষকরা পাবে? নাকি স্বামীনাথন কমিশন যে ন্যূনতম মূল্যের কথা বলেছিল, তার থেকে হাত তুলে নিচ্ছে সরকার (তৃতীয় কৃষি-আইন অনুসারে)?
ন্যূনতম দাম না পেয়ে চাষিরা চুক্তিচাষে ঝুঁকতে পারে। চুক্তিচাষ নিয়েই সরকারের দ্বিতীয় আইন। বৃহৎ কর্পরেট সেই দু’শ বছর আগের নীলকরদের মতো এসে চাষিকে বীজ ও অন্যান্য সামগ্রী এবং থোক টাকা ধরিয়ে বলবে, অমুক নয়, তমুক চাষ করতেই হবে। ধরা যাক, পোটাটো চিপ্স উৎপাদনে জড়িত সংস্থা গমের খেতে গমের সময়ে আলু চাষ করতে বাধ্য করবে। এই ধরনের চুক্তিচাষে চাষিরা আগ্রহী নয়। কারণ চুক্তি হওয়ার পর কোনো কারণে উৎপন্ন ফসল পছন্দ না হলে তা কিনতে বাধ্য নয়। কিংবা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে ফসল নষ্ট হলে সেই আর্থিক ক্ষতির দায় নিতে কোম্পানিগুলো বাধ্য নয়। সরকার বলছে, সেক্ষেত্রে ক্ষতির মূল্য পেতে চাষিরা আইনের সাহায্য নিতে পারে। কিন্তু আদানি-আম্বানির সঙ্গে আইনি লড়াই লড়ার জোর কৃষকের নেই।
আর প্রথম কৃষি আইনটির সঙ্গে সরাসরি সাধারণ মানুষও সম্পৃক্ত। খাদ্যশস্য ‘আবশ্যিক পণ্য’ ছিল। নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি মজুত করা যেত না। এখন করা যাবে। অর্থাৎ ব্যবসায়ী জোগান কমিয়ে যখন ইচ্ছে চাহিদা বাড়াবে, দাম বাড়াবে। কালোবাজারির সমূহ সম্ভাবনা। তাই এই জায়গায় এসে কৃষকদের আন্দোলন সাধারণ মানুষেরও আন্দোলন হয়ে যায়। সর্বোপরি, এই সব বিল পাশ করা হয়েছে কৃষকদের সঙ্গে, রাজ্যের সঙ্গে কোনো বার্তালাপ না করে, লকডাউনের সুযোগ নিয়ে, নিশ্চুপে। তার বিরুদ্ধেই এই আন্দোলন।
এই আন্দোলন আকাশ থেকে পড়েনি। এর পেছনে দীর্ঘদিনের পরিশ্রম আছে। মোদী সরকারের কৃষক-বিরোধী নীতি ২০১৪ সালের পর থেকেই পরিষ্কার হচ্ছে। আমাদের দেশে প্রতি ১২ মিনিট ৩৭ সেকেন্ডে একজন করে কৃষক আত্মহত্যা করেন। কোটি কোটি টাকার কর্পোরেট ঋণ মুকুব হলেও কৃষিঋণ আর মুকুব হয় না। তাই ২০১৬-১৭ সাল থেকেই দেশের সমস্ত কৃষক সংগঠনগুলি ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। ২০১৭ সালে সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ২৫০টি কৃষক সংগঠন ‘সমন্বয় কমিটি’ গঠন করে। এই সমন্বয় কমিটির মধ্যে ধনী কৃষকদের সংগঠনগুলি যেমন আছে, তেমনি বামপন্থী বা বাম-ঘেঁষা সংগঠনগুলিও আছে। গত ২৮শে সেপ্টেম্বর সমন্বয় কমিটির মিটিং-এ নভেম্বরের শেষে দিল্লী অভিযানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। দিল্লীর কাছাকাছি রাজ্যগুলি, যথা পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর-প্রদেশ ইত্যাদি থেকেই মূল দিল্লী-অভিযানটি করা হবে, সেই সিদ্ধান্তও হয়। ‘সমন্বয় কমিটি’র মধ্যেও নানা টানাপোড়েন আছে। আছে ধনী কৃষকদের সংগঠনগুলি এবং বামেদের মধ্যে স্বার্থসংঘাত। কিন্তু ফসলের ন্যয্য দাম এবং মান্ডি বহাল রাখার দাবিতে তাঁরা এক ছাতার তলায় এসেছেন।
এই মুখবন্ধের পর আবার ফিরি হরিন্দরদের গল্পে। এইবার হরিন্দর শুধু খালিস্তানিদের হাতে নিহত কমিউনিস্ট নেতার মেয়ে নয়, ধরা দেবেন নিজেই এক দুঁদে কৃষক নেত্রী হিসেবে। হরিন্দর বিন্দু এই মুহূর্তে ভারতীয় কিষাণ ইউনিয়ন পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন, কারণ সেক্রেটারি অসুস্থ। আদতে তিনি উপাধ্যক্ষ। নিজের বারো বছরের ছেলেকে মায়ের জিম্মায় রেখে ইউনিয়নের সঙ্গে এসেছেন সিঙ্গল মাদার হরিন্দর। সিঙ্গল মাদার হরিন্দর নিজে পিতৃপরিবারে আশ্রিতা হিসেবে নয়, থাকেন পরিবারের মূল কৃষক ও জাঁদরেল কৃষিনেত্রী হিসেবে। কৃষিতে তাঁর ছোটবেলা থেকেই আগ্রহ। ত্রিশ বছর ধরে কৃষিকাজ করছেন।
ইতোপূর্বে তিনি সেই সব নারীদের দুই-আড়াই লাখ টাকা সরকারী ক্ষতিপূরণ জোগাড় করে দিয়েছেন, যাঁদের ছেলে/স্বামী আত্মহত্যা করেছেন। চোদ্দটি জেলার দশ হাজার মেয়ে স্বাভাবিক কারণেই এসেছেন তাঁর পিছু পিছু। সবার মাথায় হলুদ ওড়না। হলুদ-সবুজ ভারতীয় কিষাণ ইউনিয়নের পতাকার রঙ। বিন্দু মনে করেন, মেয়েদের আন্দোলনে ঝাঁপানোর এটাই উপযুক্ত সময়। উনুন জ্বলা বন্ধ হয়ে গেলে তাঁরা রাঁধবেন কী? সংসারকে খাওয়াবেন কী?
এই ক্ষণে পৌঁছে আমাদের চোখ ফেরাতেই হয় এযাবৎ অদৃশ্য এক শ্রমশক্তির দিকে। মহিলা কৃষকদের দিকে। মহিলা কৃষকেরা কৃষিকার্যে চিরকালই ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন। সারা পৃথিবীতে ৯০টি দেশে প্রায় ৪০ কোটি নারী কৃষিতেই যুক্ত। কিন্তু পিতৃতান্ত্রিকতার মায়োপিক দৃষ্টি তাদের দেখতে পায়নি। তাঁদের ক্যামেরা ধরে না বা খুব কম সময়েই ধরে। গুগলে ‘ফার্মার’ লিখে সার্চ করলে পুরুষ কৃষকের ছবি ভেসে ওঠে। চাষি বলতেই মানসচক্ষেও কি ফুটে ওঠে না এক পুরুষের ছবি? যে ছবিগুলি কৃষক আন্দোলনের এই খেপে শিল্পীরা আঁকছেন, সেখানেও তো সবাই পুরুষ! তেভাগা আন্দোলনে বঁটি-কাটারি হাতে মেয়েরা যতই ঝাঁপিয়ে পড়ুক, গান বাঁধা হয় ‘চাষিভাই’দের নিয়ে। সেই ঐতিহাসিক ভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে এইবেলা আরও বেশি করে মেয়েদের খোঁজা কি উচিত নয়? কৃষক ছেলের বিরাট লাফের ‘পুরুষোচিত’ ছবি খুবই নায়কসুলভ, কিন্তু তা তো সবটা নয়!
এই যে চাষিরা ফসলের সময় ক্ষেত ফেলে চলে এলেন, এখন ঘর আর ক্ষেত একসঙ্গে সামলাচ্ছে কে? মেয়েরা। প্রেমচন্দের ‘পুশ কি রাত’ যদি পড়ে থাকেন, জানবেন কীভাবে মুন্নিরা গরম জামা ছাড়া ক্ষেতে রাত জাগে। এই যে পুরুষ চাষিরা আত্মহত্যা করছেন বছরের পর বছর, কে সামলাচ্ছে পরিবার তারপর? মেয়েরা।
মেয়েরা অনেকে হাজার মাইল হেঁটে দিল্লিও এসেছেন৷ খবরে বলছে, তিন লাখ কৃষক এসেছেন দিল্লীতে ও দিল্লীর সীমানায়, যার মধ্যে সত্তর হাজার মহিলা কৃষক। র্যানলির ছেলেদের ছবি তুলছে ক্যামেরা, আর তাদের বউরা তখন ট্রাকের পিছনে ছাউনি খাটিয়ে রুটি সেঁকছেন। এই যে আলোচনায় এসে আন্দোলনের নেতারা সরকারী খাবার খেতে প্রত্যাখ্যান করে মাটিতে বসে নিজেদের সঙ্গে আনা খাবার খাচ্ছেন, তাতেও অদৃশ্য হাতগুলির শ্রম মিশে আছে।
এই মেয়েরা কিন্তু কৃষির বিভিন্ন ধাপেই হাত লাগান। জমিকে চাষের যোগ্য করে তোলা, বপণ, রোপণ, সার ও কীটনাশক ছড়ানো, শস্য কাটা, ঝাড়াই মাড়াই, সবেতেই তাঁরা যোগদান করেন। উপরন্তু কৃষি ও গেরস্তালি কাজ সামলাতে তাঁদের উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে হয়। পুরুষেরা অবসরে হয়ত হুকা টানতে পারেন, মহিলারা সেসময়েও গবাদি পশুর যত্ন নেন, বা ঘুঁটে দেন। অথচ দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলনে তাঁদের স্বর ছিল অশ্রুত।
পরিসংখ্যান না দিলে বিষয়টার গুরুত্ব ঠিক বোঝা যাবে না। ভারতের উৎপাদনশীল যাবতীয় কর্মকাণ্ডে যত মেয়ে কাজ করেন, তার ৮০% কাজ করেন কৃষিক্ষেত্রে। ৩৩% ক্ষেতমজুর হলেন নারী। ৪৮% মেয়ে কাজ করেন পারিবারিক জমিতে। এই সবই অক্সফ্যামের ২০১৩ সালের পরিসংখ্যান।
কিন্তু জমির মালিকানা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁদের নয়। একই রিপোর্ট অনুসারে, জমির মালিকানা আছে মাত্র ১৩% মহিলার। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বিহারে, সেখানে মাত্র ৭% মহিলার নিজস্ব জমি আছে। ২০১১ সেন্সাস দেখাচ্ছে ৩.৬০ কোটি মহিলা কৃষিকর্মী। কিন্তু তাঁদের ‘চাষি’ বলা হচ্ছে না। সেখানে রয়েছে কৃষি-জমির মালিকানার শর্ত। অথচ কৃষিক্ষেত্রে ওয়ার্ক ফোর্সের বেশিরভাগই ভূমিহীন দলিত ও আদিবাসী মহিলা, যাঁদের মধ্যে আবার অশিক্ষিতর সংখ্যাও ৭৫% এর বেশি।
২০১৭-১৮ সালের সমীক্ষা বলছে, কৃষিকার্যের সার্বিক অবনতির জন্য ছেলেদের শহরে পরিযান বেড়েছে এবং মহিলাদের কৃষিক্ষেত্রে যোগদানও বেড়েছে। বিহারে এই মুহূর্তে কৃষিকাজে নিযুক্ত মানুষের ৫০% নাকি মহিলা। ভারতের যাবতীয় খাদ্যশস্যের ৬০-৮০% মহিলাদের উৎপাদিত।
আবার ইউনিভার্সিটি অফ মেরিল্যান্ড আর ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এপ্লায়েড ইকনমিক রিসার্চের ২০১৮ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, কৃষিশ্রমিকের ৪২% হলেন মহিলা, আর নিজস্ব জমি আছে মাত্র দু’শতাংশের।
হিন্দু ব্যক্তিগত আইন অনুযায়ী মেয়েরা পিতার সম্পত্তির অধিকারী, কিন্তু সামাজিক রীতি মেনে অধিকাংশই সেই অধিকার ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। মুসলমান আইন অনুসারে, কয়েকটি রাজ্য বাদে, মেয়েদের কৃষিজমিতে অধিকার স্বীকৃত নয়।
উত্তর-পশ্চিম ভারতে মেয়েরা বিয়ের পরেই পিতার বাড়ি ও জমি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বিধবারা তাঁদেরই ভায়ের বা শ্বশুরবাড়ির জমিতে জমিহীন কৃষিশ্রমিক হিসেবে কাজ করেন মহারাষ্ট্র বা রাজস্থানে।
জমির মালিকানা না থাকায় তাঁরা বীমা বা ঋণও পান না। ব্যাঙ্ক বা কো-অপারেটিভের সাহায্যও পাননা একই কারণে। অথচ কৃষিক্ষেত্রের সার্বিক উন্নতির জন্যই এই মহিলাদের কৃষকের স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন ছিল। রাষ্ট্রসংঘ বলে, মেয়েরা যদি নিজেদের জমির অধিকার পায় পূর্ণরূপে, তাহলে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নতিই হবে। খাদ্য ও কৃষি সংগঠন (FAO) ২০১১ সালে বলেছিল, মেয়েরা জমির অধিকার পেলে ফলনও ২.৫-৪% বাড়বে। পৃথিবীজুড়ে ক্ষুধা কমবে ১২-১৭%।
এই মেয়েরা যেভাবে নুয়ে কাজ করেন, তাতে কম বয়সেই পায়ের, ঘাড়ের, হাতের নানা ধরনের সমস্যায় ভোগেন। অনেকের গর্ভপাত হয়ে যায়, অনেকের সময়ের আগে শিশু ভূমিষ্ঠ হয়ে যায় অতিপরিশ্রমে। অজ্ঞতার কারণে এমন কিছু কীটনাশকও তাঁরা ব্যবহার করে ফ্যালেন, যা স্বাস্থ্যের পক্ষে বিষবৎ। উচ্চ-মানের চাষের যন্ত্রপাতি যা কিছু আছে, তা কিন্তু মূলত ছেলেদের কথা ভেবেই বানানো। তাই সেগুলি ব্যবহার করতেও মেয়েদের বেগ পেতে হয়।
আমরা ক’জন জানি ১৫ অক্টোবর জাতীয় মহিলা কৃষক দিবস? সংবিধানের ১৪ ধারায় লিঙ্গ নির্বিশেষে সমানতার কথা বলা হয়েছে। কৃষিক্ষেত্রে তার অবমাননা অন্যান্য পেশার চেয়ে বেশি৷ কৃষিশ্রমিক হিসেবে কর্মরত মেয়েরা পুরুষদের থেকে কম মজুরি পান। নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রক ২০১৬ সালের জাতীয় নারী নীতি অনুসারে মেয়েদের জমির অধিকার দেওয়ার গুরুত্ব স্বীকার করে নেয়। কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছুই হয় না।
বীণা অগরওয়াল ‘Who Sows Who Reaps’ (কে বোনে আর কে তোলে) বইতে ১৯৯৩ সালেই বলেন, মেয়েদের ভূমি-অধিকারের পথে অনেক বাধা। বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ির দূরত্ব, স্বাধীন যাতায়াতে বাধা, বাপের বাড়ির চাপে জমি ভাইকে দিতে বাধ্য হওয়া, সামাজিক লিঙ্গভূমিকা পালন করতে গিয়ে নিজের জমির অধিকার হারানো, অশিক্ষা, অজ্ঞতা, আইনি দরবারে পুরুষের প্রতিপত্তি ইত্যাদি সেইসব বাধার কয়েকটি। মেয়েরা পুরুষ অভিভাবকদের অবাধ্য হতে চায় না৷ দলিলপত্রও সঠিক ভাবে সংরক্ষিতও হয় না, যে তা সম্বল করে আইনি লড়াই করবে। আবার খাতায় কলমে মালিকানা থাকলেও অনেক সময় জমির নিয়ন্ত্রণ মেয়েদের হাতে থাকে না।
চাষিদের আত্মহত্যার কথা বলা হয়, কিন্তু ২০১৪-১৫ সালের NCRB ডেটা অনুসারে যে ৮০০৭ জন আত্মহননকারীদের মধ্যে নিজস্ব জমিওয়ালা ৪৪১ জন মেয়েও ছিলেন, আর ৫৭৭ জন মহিলা কৃষিশ্রমিক ছিলেন, তা এড়িয়ে যাওয়া হয়। ‘মহিলা কিষাণ অধিকার মঞ্চ’ বা ‘মকাম’ ২০১৮ সালে দেখায়, ২০১২-২০১৮ পর্যন্ত বিদর্ভ ও মারাথওয়াড়ার যে সব কৃষকরা আত্মহত্যা করেছেন, তাঁদের বিধবা স্ত্রীদের ৪০% এখনও জমির অধিকার পাননি। মাত্র ৩৫% নিজেদের বাড়িতে থাকার জায়গা পেয়েছেন। ৩৩% বিধবা জানেনই না যে তাঁদের পেনশনের অধিকার আছে। এই মহিলারা কিন্তু নিজেদের বেশ কিছু দাবিদাওয়াকে এই মুহূর্তে পাঠিয়েছেন পিছনের সারিতে। যেমন, যাঁদের স্বামী আত্মহত্যা করেছেন, তিনিও এখন ক্ষতিপূরণের বদলে চাইছেন বিল প্রত্যাহার। দিল্লির আন্দোলনে তাঁদের যোগদান প্রথমবারের জন্য ভারতে মহিলা-কৃষকদের জনসমক্ষে উগ্রভাবে দৃশ্যমান করে তুলল।
অবশ্য আগেও তাঁদের কেউ কেউ দিল্লীতে এসেছিলেন ২০১৮ সালের জুলাইতে। মান্ডি হাউস থেকে পার্লামেন্ট স্ট্রিট পর্যন্ত ছিল কৃষক মার্চ। কিন্তু তাঁরা তখন সংখ্যায় কম ছিলেন। সেবার মেধা পাটেকর ঘোষণা করেছিলেন, কৃষি সর্বতোভাবে মেয়েদেরও বিষয়। উত্তরপ্রদেশ ও পাঞ্জাবের মহিলা-কৃষক দিল্লীর রাস্তায় প্রকাশ্যে বলেছিলেন, কীভাবে ট্রাক্টর চালানোর জন্য স্থানীয় গুণ্ডাদের টিটকরি শুনতে হয়। কীভাবে মান্ডিতে মহিলা কৃষক অস্বস্তিতে পড়েন। ২০২০ সালে তাঁরা সংখ্যায় অনেক বেশি।কিছু কৃষক সংগঠন বলছে, তারা ২০০০ সাল থেকেই একটু একটু করে সংগঠিত করছে মেয়েদের। এখন স্বতন্ত্র মহিলা শাখা আছে তাদের। পিতা বা স্বামীর আত্মহত্যার পর অনেক বাড়িই এখন পুরুষশূন্য। দারিদ্র ও ঋণগ্রস্ত সেই সব পরিবারের দায়িত্ব নিয়েছেন মেয়েরা৷ সংগঠনে তাঁরা যুক্ত হয়েছেন নিজেদের দাবিদাওয়া নিয়ে। যেমন ভারতীয় কিষাণ ইউনিয়ন (একতা উগ্রাহণ)-এর ৪০% সদস্যই মহিলা।
জানা গেল পাঞ্জাবের মানসা জেলায় দলিত মহিলারাই রাস্তা আটকে, পুলিশের মার খেয়ে প্রথম জমি অধিগ্রহণে বাধা দিয়েছেন দৃঢ়ভাবে। পরে সেই আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিল ইউনিয়নগুলি। দলিত নারীরা আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার পর জাট পুরুষের দ্বারা যৌন নিগ্রহের ঘটনার খবরও আসতে লাগল ইউনিয়নে। এভাবে কৃষক ইউনিয়ন মেয়েদের যৌন নিগ্রহ নিয়েও সরব হয়েছে প্রয়োজনে। দিল্লীর ঘটমান আন্দোলনে ছাত্রদের, শিক্ষকদের, যুক্তিবাদী নাগরিক সমাজের মতো মেয়েদের, বিশেষ করে দলিত মেয়েদের অংশগ্রহণও আজ প্রণিধানযোগ্য।
সত্তর বছরের সখবিন্দর কৌর এসেছেন জমি ফেলে। এসেছেন বাহাত্তুরে লাভ কৌরও, পুত্র-পুত্রবধূদের সাথে। সকলেই বলছেন, কাফন বেঁধে এসেছেন, দাবি না মানা হলে মরতেও তাঁরা তৈরি। পরমজিৎ কওর বলেন, গ্রামে থাকার সময়েও কৃষক ইউনিয়নের কাজে গ্রামের মেয়েদের একত্রিত করতে ঘুরে বেড়াতে হত তাঁকে। স্বামী প্রান্তিক কৃষক, তিনি ঘর ও ছেলে সামলাতেন। তাঁর মৃত্যুর পরও হকের লড়াই চালাচ্ছেন পরমজিৎ। পাঞ্জাব কিষাণ ইউনিয়নের জসবীর কওর ষাট বছরেও ইউনিয়নে হিসেব রাখা, শৃঙখলা বজায় রাখার দায়িত্ব নিয়ে ব্যস্ত। একাশির বলবিন্দর কৌর একাই এসেছেন। তিনিও এক প্রভাবশালী সংগঠক। বারবার মেয়ে ও ছেলের ফোন আসছে। তিনি বিরক্তই হচ্ছেন তাতে।
উত্তরপ্রদেশের ফৈজারপুর থেকে ছ’মাসের শিশু কোলে এসেছেন সাঁইত্রিশের মমতা। বলছেন, “এই শিশুর ভবিষ্যতের জন্যই এই আন্দোলন।” সপরিবারে এসেছেন রাধা। স্বামী ও তিন সন্তান সহ। তাঁরা টয়লেট পাচ্ছেন না৷ পাচ্ছেন না জামা বদলের জায়গা। শীতে কাঁপছেন। প্রতিবেশী রাজ্য থেকে আসা অচেনা চাষি কম্বল এগিয়ে দিচ্ছেন। স্থানীয় দোকান, হোটেল ও বাড়িগুলি তাঁদের বাথরুম ব্যবহার করতে দিচ্ছে। এঁরা অনেকেই এর আগে শহরে আসেননি। কেউ কেউ এর আগে শহরের হাসপাতালে গেছেন শুধু বাচ্চা বিয়োতে।
ভারতীয় কিষাণ ইউনিয়নের পুরুষ নেতা হরিন্দর সিং লাখওয়াল বলছেন, “দের ছাড়া আমরা অচল। পাঞ্জাবেও যখন আন্দোলন চলছিল, তখনও এই মেয়েরাই ছিলেন আন্দোলনেত মেরুদণ্ড। আজ এরা দিল্লীতেও এসেছেন। আন্দোলন এদের কাছে কৃতজ্ঞ।”
এই মেয়েরা আজ নির্দ্বিধায় ট্রাকটরে ঘুমোচ্ছেন। সকালে উঠে খাবার বানাচ্ছেন, দুপুর গড়িয়ে বিকেল পর্যন্ত শুনছে কৃষক নেতাদের স্লোগান। সন্ধে নামলে ট্রাক্টরের আড়ালে গিয়ে আবার খাবার বানাচ্ছেন।
কিন্তু তাঁরা বুঝিয়ে দিচ্ছেন, শুধু পুরুষ কৃষকের রুটি সেঁকতে তাঁরা আসেননি। এসেছেন তিনটি বিল পড়ে, তিনটি বিল প্রত্যাহারের দাবি নিয়েই। আমাদের চোখ এতে অভ্যস্ত হোক। লিঙ্গসাম্যের এক শিক্ষাক্ষেত্র হয়ে উঠছে আজকের কৃষক আন্দোলন। তাই মেয়েরা যখন স্লোগানিয়ারিং করছে, তখন আবার খাবার বানানোর কাজে হাত লাগাচ্ছেন পুরুষেরাও। তরুণীরা তরুণদের সঙ্গে নাচে মেতে উঠছে। যে নাচ জীবনের উদযাপন।
অন্য দিকে, মীরাটের ঘেশপুরের ২৩ বর্ষীয়া নিশু চৌধুরিকে স্নাতকোত্তরের পড়া করতে করতে খেত সামলাতে হচ্ছে, কারণ পুরুষেরা গেছে দিল্লীর আন্দোলনে। “এ হল ধান আর আখ কাটার সময়, গমের বীজ বপণের সময়৷ এ সময় খেতের কাজ তো ফেলে রাখা যায় না,” ঘেশপুরের প্রতিবেশী গ্রাম দাউরুলার মুকেশ দেবী বলছেন। অর্থাৎ পুরুষের অবর্তমানে কৃষিকাজ থমকে যেতে দেয়নি মেয়েরা।
আদিমকালে ফসল ফলানোর রহস্য নাকি ছিল নারীরই করায়ত্ত। পুরুষ যখন শিকারে যেত, নারী তখন মাটি আর বীজ নিয়ে নাকি চালাত উর্বরতার নিরীক্ষা। এভাবেই কৃষি শুরু হয়। অথচ ক্রমে নারীই হারিয়ে ফেলে জমির অধিকার, নেতৃত্বের অধিকার। কৃষক আন্দোলনের এই পর্যায়ে, একবিংশ শতকে, অন্তত আদি মাতার সেই মেয়েদের কথা কোনো ইতিহাস মুছে ফেলতে যেন না পারে।
- শতাব্দী দাশ
হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিক হাঁটছেন। রাষ্ট্রীয় পরিবহণ বন্ধ। তাই তাঁরা হেঁটেই রওনা দিয়েছেন। শত শত মাইল দূরে তাঁদের গ্রামের বাড়িতে পৌঁছাতে। আশ্রয়ের আশায়, খাবারের আশায় এবং তাঁদের পরিবারের সঙ্গে মিলিত হওয়ার আশায়। ১৯৫০ সালে পূর্ববঙ্গ থেকে আসা মানুষের স্মৃতিকথা অথবা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ থেকে শরণার্থী আসা মানুষের ছবি অথবা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ছবির সঙ্গে কোভিডকালে পথহারা শ্রমিকদের দৃশ্য মিলেমিশে যায়। বিশ্ব অভিবাসী দিবসে এসব ছবিগুলোই মনকে বড্ড নেড়েচেড়ে দেয়।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ব্যাপক হারে অভিবাসন ও বিপুলসংখ্যক অভিবাসীদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়াদিকে ঘিরেই দিবসটির সূচনা। ১৯৯৭ সাল থেকে ফিলিপাইন এবং অন্যান্য এশীয় অভিবাসী সংগঠনগুলো দিবসটি পালন করতে শুরু করে। শুরুর দিকে ‘আন্তর্জাতিক ঐক্য দিবস’ হিসেবে পালন করা হোত। ১৯৯০ সালে অভিবাসী শ্রমিক ও দেশে ফেলে আসা তাদের পরিবারের নিরাপত্তা রক্ষায় আন্তর্জাতিক সম্মেলন করেছিল রাষ্ট্রসংঘ। এরই প্রেক্ষাপটে ১৮ ডিসেম্বরকে লক্ষ্য করে মাইগ্রেন্টস রাইটস ইন্টারন্যাশনাল, ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন অন মাইগ্রেন্টস রাইটস সহ বিশ্বের অনেক সংগঠন অভিবাসীদের স্বার্থ রক্ষার্থে বিশ্ব জুড়ে প্রচার চালায়। ১৯৯৯ সালের শেষের দিকে অনলাইনে ব্যাপক প্রচারের ফলে, ২০০০ সালের ৪ ডিসেম্বর রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ পরিষদ অভিবাসী শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা এবং তাদের পরিবারের ন্যায্য অধিকার রক্ষায় আন্তর্জাতিক চু্ক্তি-৪৫/১৫৮ প্রস্তাব আকারে গ্রহণ করে ১৮ ডিসেম্বরকে ‘আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। অভিবাসী শ্রমিকরা যেন কোনোরূপ শোষণ, বঞ্চনা ও হয়রানির শিকার না হন, তা নিশ্চিত করতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
অভিবাসনের ইতিহাসও মানব সভ্যতার মতো সুপ্রাচীন। প্রাচীনকাল থেকেই জীবিকার সন্ধান, আর্থ-সামাজিক, জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা কারণে মানুষ পাড়ি জমিয়ে আসছে দেশ থেকে দেশান্তরে। গন্তব্য দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন ছাড়াও নিজ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অভিবাসীদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। বিশ্বের বিপুল সংখ্যক অভিবাসী জনগোষ্ঠী পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে মেধা ও শ্রমের মাধ্যমে তাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনমান উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন। কিন্তু যুদ্ধ-বিগ্রহ ও ভূ-রাজনৈতিক নানা কারণে অভিবাসন আজ কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। অভিবাসীদের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষায় বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন, কনভেনশন ও সনদসমূহে বর্ণিত বিধানবলীর যথাযথ প্রতিপালন অত্যন্ত জরুরি। অভিবাসন প্রক্রিয়াটি পৃথিবীতে মানবসভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গেই যে শুরু হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয় কাঠামো সৃষ্টি হওয়ার কারণে জীবনধারণের জন্য এক স্থান থেকে আরেক স্থানে মানুষের অবাধ যাতায়াতে আসে নানা নিয়ম-কানুন আর বাধা-বিপত্তি। তবে মানুষের অভিবাসন কখনো থেমে থাকেনি। শুধু যে অর্থনৈতিক কারণেই অভিবাসন ঘটে তা নয়। রাজনৈতিক, ধর্মীয়, যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সংস্কৃতি ইত্যাদি কারণেও অভিবাসন ঘটে থাকে। পৃথিবীর এমন কোনো অঞ্চল নেই, যেখানের মানুষ কোনো না কোনো সময় অন্য দেশে অভিবাসিত হয়নি। অভিবাসন প্রক্রিয়াটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হওয়ার পর অভিবাসী কর্মীদের (যারা অস্থায়ী অভিবাসী) স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব লাভ করে। বিপুল সংখ্যক অভিবাসী জনগোষ্ঠী পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে মেধা ও শ্রমের মাধ্যমে তাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনমান উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন। তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স জাতীয় অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। অথচ কোভিডকালের দুনিয়া অভিবাসী জনগোষ্ঠীর যে চিত্র দেখিয়ে দিল তাকে স্মরণ করে আরও একবার এই জনগোষ্ঠীর কথা নতুন করে ভাবার সময় এসেছে বলেই মনে হয়।
- সুতপা ভট্টাচার্য চক্রবর্তী
কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ায় বহু দোকান কর্মচারি কোভিড মহামারী পর্বে কাজ খুইয়েছেন। বড় ও ছোট দোকান মালিকরা কর্মচারিদের দূর্দশা লাঘবের প্রশ্নে একই অবস্থানে বিরাজ করেন না। লকডাউনের প্রথম পর্যায়েই দীপ প্রকাশনের মালিক শংকর মন্ডল মার্চ মাসের বেতন দিয়ে বেশ কয়েকজন কর্মচারিকে ছাঁটাই করেন। তাদের কলেজ স্ট্রিটের শো-রুমে দু’জন কর্মচারির একজন দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত, তাঁকে প্রথমে ছাঁটাই করা হয়, তারপরে অন্য জনকেও। বিধান সরণীতে আর্য কন্যা বিদ্যালয়ের উল্টোদিকে প্রকাশনা সংস্থার কার্যালয় থেকেও শ্রীমন্ডল বেশ কয়েক জনকে ছাঁটাই করেছেন। দীপ প্রকাশন মালিকের ব্যবসার বৃদ্ধি হয়েছে এইসব কর্মচারিদের নিরলস শ্রমেই। মালিক মাঝেমধ্যেই সপরিবারে বিদেশ ভ্রমণে যান। দোকান কর্মচারি ও ছাপাখানার শ্রমিকদের সদিচ্ছা থাকলে সবাই দু’বছর বসিয়ে বেতন দিতে পারেন। তাঁর ব্যবসার মুনাফা যে শীর্ষ বিন্দুতে পৌঁছেছে সেই অবস্থায় এটুকু করা এমন কিছু ব্যাপার নয়। তা সত্ত্বেও প্রকাশন সংস্থার মালিক লকডাউনের প্রথমেই নির্মমভাবে ছাঁটাইয়ের রাস্তা বেছে নেন। দীপ প্রকাশনের পাশেই ফুটপাথে বই বিক্রি করেন ক্রেতাদের কাছে ‘পন্ডিত’ নামে পরিচিত একজন। আনলক পর্ব শুরু হওয়ার পর দেখা মিলল রুগ্ন শীর্ণ পন্ডিতের। জানা গেল তাঁর দিন কাটছে অর্দ্ধাহারে, কোনোভাবে একবেলার খাবারের সংস্থান করতে পারছেন। প্রায় একইরকম দুরবস্থা প্রেসিডেন্সী কলেজের গা-ঘেঁষা সারিবদ্ধ বই বিক্রির ছোট দোকানগুলোর। খোঁজ নিতে জানা গেল ব্যবসা ঠেকেছে দশ থেকে পঁচিশ শতাংশে। রাজ্যের হেরিটেজের অন্তর্ভুক্ত এইসমস্ত দোকানে বিকেল-সন্ধ্যে ক্রেতা গিজগিজ করত। এখন অধিকাংশ দোকানই মাছি তাড়াচ্ছে। সোদপুরের বাসিন্দা মৌসুমী দে এসেছিলেন তাঁর মেয়ের পড়ার বই কিনতে, মেয়ে পরের বছর উত্তীর্ণ হবে সপ্তম শ্রেণীতে। তিনি বেশ কিছু দোকান ঘুরে ভবানী দত্ত লেনে সারদা বুক স্টলে বই পেলেন। দাম জানতে চাইলে দোকানদার বললেন ১৫০ টাকা, লেখা আছে দেখালেন ৩০৫ টাকা, ক্রেতা দিতে চাইলেন ১০০ টাকা, দোকান মালিক দিয়ে দিলেন সেই দামেই। বললেন, বিক্রি-বাট্টা একেবারেই হচ্ছে না, তাই না দিয়ে পারেন কি করে! ক্রেতা এলেই বিক্রেতারা আঁকড়ে ধরছেন।
কলেজ স্ট্রিট, বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রিট, কলেজ রো, ভবানী দত্ত লেন, কলেজ স্কোয়ার, মহাত্মা গান্ধী রোড, রমানাথ মজুমদার স্ট্রিট, টেমার লেন, বেনিয়াটোলা ইত্যাদি সব মিলিয়ে যে বিশাল বইপাড়া, সেখানে রয়েছে সহস্রাধিক ছোট-মাঝারি ও বড় বইয়ের দোকান। বছরে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেচাকেনা হয়ে থাকে। এখনও স্কুল-কলেজ বন্ধ, তাই স্কুল-কলেজের বই বিকোচ্ছে না। গত মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত বই বিক্রি যা হওয়ার হয়েছে। তারপর থেকে বিক্রি আগের তুলনায় দশ শতাংশও হচ্ছে না। কফি হাউসের ওপরে রূপা, চক্রবর্তী এ্যান্ড চ্যাটার্জীতে গিয়ে দেখা গেল কর্মচারিদের হতাশ মুখ। কর্মচারিদের বেতন ঠিকঠাক হচ্ছে কীনা জানতে চাইলে কোনও উত্তরই তাঁরা দিলেন না। বিক্রি কেমন জানতে চাইলে বললেন, “দেখতেই তো পাচ্ছেন”। সুধাংশু দে’র পুত্র শুভঙ্কর দে’র কাছে জানা গেল ওদের ব্যবসা হচ্ছে প্রায় ৬০ শতাংশ। ওদের দোকানে পুরানো মুখগুলো দেখে আশ্বস্ত হওয়া গেল অন্তত ছাঁটাই হতে হয়নি। কাউন্টারে ভীড় এখন অর্দ্ধেক, আগে যেখানে লেগে থাকত ১৫-২০ জন, এখন সেখানে ১০-১২ জন ক্রেতা। আনন্দ পাবলিশার্স, মিত্র এ্যান্ড ঘোষ-এ ভীড় না থাকলেও ক্রেতা মিলছে। বিষ্ণুপ্রিয়ায় কোনো কর্মচারির দেখা মিলল না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্ণধার একরাশ ক্ষোভ উগরে দিলেন গিল্ড ও পুস্তক বিক্রেতা সমিতির উপর। “শাহরুখ খান ১০ লক্ষ টাকা অনুদান দিয়েছিলেন, কিন্তু কে পেলেন সেই টাকা? খোঁজ নিয়ে লিখুন। শুনেছি আমফানে ক্ষতিপূরণে গিল্ড ছোট প্রকাশন সংস্থা আর ফুটপাতের বই বিক্রেতাদের টাকা দিয়েছে। কে কত টাকা পেয়েছে তার হিসাব আছে? লিস্ট কি তারা দেখাতে পারবেন?” ছোট বিক্রেতা ধ্যানবিন্দু’র মালিক শুভ জানালেন আমফান বা অন্য কোনো অনুদান খাতে কোনও টাকা পাননি, পাওয়ার জন্য আবেদনও করেননি। আর বললেন, বিক্রি ফিরেছে ২৫ শতাংশ মাত্র। আমফানে কিন্তু ধ্যানবিন্দু সমেত বহু ছোট বই দোকানে জল ঢুকে কয়েক লক্ষ টাকার বই নষ্ট হয়েছে। বিশ্বভারতী স্টলে গিয়েও অভিজ্ঞতা একই। দোকান মালিক জানালেন বিক্রি মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। পারুল প্রকাশনা কিছু কর্মচারিকে ছাঁটাই করেছে।
সব মিলে অবস্থা হল, কলেজ স্ট্রিট বইপাড়া পড়েছে তীব্র সংকটে। বিশেষ করে ছোট দোকান এবং ফুটপাথের বই বিক্রেতাদের দুর্দশা চোখে পড়ার মতো। এই দুরবস্থা কবে দূর হবে তা ভীষণ অনিশ্চিত। যেমন অনিশ্চিত দেশ কোভিড থেকে কবে মুক্ত হবে? টিকার আশায় মানুষ হাপিত্যেশ করে বসে আছে। টিকা তাড়াতাড়ি আসবে কিনা বা কতটা কার্যকরী হবে সেই সন্দেহ থেকেই যায়। অতীতে দেখা গেছে কোনো ভাইরাস ঘটিত রোগের টিকা বের হতে কয়েক বছর লেগে গেছে। সুতরাং কোভিডের সংক্রমণ যতদিন চলবে ততদিন বই ব্যবসার দোকান বাজার স্বাভাবিক হবে না। এই অস্বাভাবিক অবস্থায় ক্ষয়ক্ষতি, ছাঁটাই, শোষণ, বঞ্চনা, মন্দা, বিশেষ করে ছোট দোকান কর্মচারি ও ফুটপাথের বিক্রেতাদের জীবনধারণের আর্থিক দুর্গতি আরও বেড়ে গেছে। বইয়ের বাজার কবে নতুন ছন্দে ফিরবে বলা মুশকিল। দুর্দশার মধ্যেই কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়া চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।
- নিত্যানন্দ ঘোষ
চলে গেলেন অধ্যাপক লেখক সুধীর চক্রবর্তী। বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতি জগৎ অনেকখানি রিক্ত হল তাঁর প্রয়াণে। বাংলা গান নিয়ে, বিশেষত বাউল ফকিরদের নিয়ে তাঁর কাজ আমাদের মনন জগৎকে ঋদ্ধ করেছে প্রবলভাবে। তাঁর লেখা ‘বাউল ফকির কথা’ বইটি বাংলা সাহিত্যের এক চিরন্তন ক্লাসিকে পরিণত হয়েছে।
বাংলা গান নিয়ে সুধীর চক্রবর্তী অনেক বই লিখেছেন। সেগুলির মধ্যে আছে – সাহেবধনী সম্প্রদায় ও তাদের গান, বলাহারি সম্প্রদায় ও তাদের গানে পশ্চিমবঙ্গের মেলামহোৎসব, লালন, ব্রাত্য লোকায়ত লালন, গানে গানে গাওয়া, গানের লীলার সেই কিনারে, গান হতে গানে, বাংলা গানের আলোকপর্ব, বাংলা দেহতত্বের গান, লালন সাঁই কুবির গোসাই ও তাদের ১০০ গানা ইত্যাদি।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে, তাঁর গান নিয়ে লিখেছেন নির্জন এককের গান রবীন্দ্রসঙ্গীত, গীতাঞ্জলীঃ সুর ও বাণী, রবিকররেখা প্রভৃতি। সত্যজিৎ ও সিনেমার গান নিয়ে লিখেছেন বাংলা ফিল্মের গান ও সত্যজিৎ রায়।
সুধীর চক্রবর্তীর পৈতৃক ভিটে নদীয়া। শৈশব কৈশোর হাওড়ার শিবপুরে কাটলেও নিজেকে তিনি ‘কৃষ্ণনাগরিক’ বলতেই ভালোবাসতেন। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে তিনি পিএইচডি করেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন কৃষ্ণনগর সরকারী মহাবিদ্যালয়ে।
তাঁর একটি বিশিষ্ট কীর্তি ধ্রুবপদ পত্রিকার সম্পাদনা। এই পত্রিকাটির প্রতিটি সংখ্যাই মননশীল পাঠকের কালেক্টরস আইটেম হয়ে উঠতে পেরেছিল। বুদ্ধিজীবীর নোটবই, নারীবিশ্ব, যৌনতা ও বাঙালি সংস্কৃতি, রবীন্দ্রনাথ বা বাংলা গান নিয়ে ধ্রুবপদের প্রকাশিত সংখ্যাগুলি অত্যন্ত জনপ্রিতার জন্য সেগুলিকে আলাদা বই হিসেবে প্রকাশ করতে হয় পাঠকদের তাগাদায়। যে কোনও পত্রিকা সম্পাদকের কাছেই যা অত্যন্ত আনন্দের।
মননশীল সাংস্কৃতিক গবেষণার জন্য তিনি আনন্দ ও সাহিত্য আকাদেমীর মতো বিশিষ্ট পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন, তবে তাঁর সবচেয়ে বড় পুরস্কার বোধহয় মননশীল বাঙালি পাঠকের তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
সুধীর চক্রবর্তী চলে গেলেন। থেকে গেল তাঁর সারস্বত সাধনার ভাণ্ডার।
- সৌভিক ঘোষাল
বর্ষীয়ান সংগ্রামী বামপন্থী বুদ্ধিজীবী ত্রিদিব ঘোষ গত ১৫ ডিসেম্বর প্রয়াত হয়েছেন রাঁচীতে। তিনি কোভিডে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাঁর জীবনসাথী মালঞ্চ ঘোষও কোভিডে আক্রাম্ত হয়ে রাঁচীর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কমরেড ত্রিদিব ঘোষ তাঁর ঝাড়খন্ড-বিহার-বাংলার বিস্তৃত পরিসরে সকলের কাছে বিশেষ পরিচিত ছিলেন “ঘোষদা” নামে। রাঁচীতে তাঁর বসবাস কয়েক দশকের। ঝাড়খন্ডে আদিবাসী সম্প্রদায় থেকে শুরু করে নারী সমাজের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজে-কর্মে-সংগ্রামে-সংগঠনে তিনি নিজেকে জীবনভর উৎসর্গ করে এসেছেন। তাঁর বাড়ি ছিল বঞ্চিত-নিপীড়িত জনতার জন্য হাটখোলা। তিনি ছিলেন সাধারণত শান্ত প্রকৃতির, সদালাপী, মিষ্টভাষী, নিরহঙ্কারী ও পরার্থে নিবেদিত মানবিক দৃষ্টান্ত; কিন্তু প্রয়োজনে শাসকের চোখে চোখ রেখে সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতেন।
কমরেড ত্রিদিব ঘোষ ঝাড়খন্ডের বুকে সিপিআই(এমএল) দিশায় গণ রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলার উদ্যোগে অন্যতম অগ্রণী ভূমিকা নিতে শুরু করেন ১৯৮০-র দশকের গোড়া থেকেই। আইপিএফ গঠনে তিনি অন্যতম আহ্বায়কের ভূমিকা পালন করেছিলেন। ঝাড়খন্ডে সংগ্রামে ঝড় তোলা নেতৃত্বদায়ী শহীদ কমরেড মহেন্দ্র সিং-এর সঙ্গে কমরেড ঘোষদা’র এক গভীর পারস্পরিক বোঝাবুঝির সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তাঁর প্রয়াণ এক অপূরণীয় ক্ষতি। অন্তিম বিদায় কমরেড ত্রিদিব ঘোষ, লাল সেলাম।
দক্ষিণ ২৪ পরগণার মল্লিকপুর নিবাসী সাথী অচিন্ত্য গুপ্ত গত ১৫ ডিসেম্বর প্রয়াত হয়েছেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। পারিবারিক সম্পর্কে তিনি শহীদ কমরেড জহর (সুব্রত) দত্ত’র তুতো ভাই। একসময় পর্যন্ত গণতান্ত্রিক অধিকার আন্দোলনের একনিষ্ঠ সংগঠকের ভূমিকা পালন করে গেছেন যার মূল্য অপরিসীম। তিনি দেশব্রতী পত্রিকার নিয়মিত পাঠক ছিলেন। তাঁর মৃত্যু বাম ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এক অপূরণীয় ক্ষতি। আমরা তাঁর পরিবার-পরিজন ও সংগ্রামী সাথীদের গভীর শোকের অংশীদার। কমরেড অচিন্ত্য গুপ্তের স্মৃতি থাকবে জাগরুক।