২৬ নভেম্বরের দেশজোড়া ধর্মঘটকে সফল করার আহ্বান জানিয়ে সিপিআই(এমএল) সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন -- সরকার ক্ষমতায় এলে আর যেতে চাইছে না। বিজেপি তো বলছে আরও পঞ্চাশ বছর ক্ষমাতায় থাকবে। অথচ মানুষের চাকরির নিরাপত্তা নেই। এখন অধিকংশ ক্ষেত্রেই তা বছরে বছরে নবীকরণ করতে হচ্ছে।
চাকরি হারাচ্ছে মানুষ। শ্রমিককে ক্রীতদাসে পরিণত করা হচ্ছে, তার ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। এসবের বিরুদ্ধে ২৬ নভেম্বরের ধর্মঘট। আগে মানুষ অনেক সময় বেসরকারীকরণের বিরুদ্ধে আন্দোলন মানে ট্রেড ইউনিয়নের আন্দোলন বুঝত। এখন শিক্ষা স্বাস্থ্যের প্রবল পণ্যায়নের সূত্রে মানুষ বুঝছেন তাদের অধিকার চলে যাচ্ছে। পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীর মানুষ দেখছেন সরকারী চাকরির সংকোচন ও বেসরকারী সংরক্ষণের ব্যাপার না থাকার ফলে কার্যত সংরক্ষণের অধিকারই চলে যাচ্ছে।
শ্রমিকদের মতো হামলা নামছে কৃষি ও কৃষকদের ওপরেও।
আলু পেঁয়াজের মতো পণ্যকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। যে কৃষি আইনগুলো হচ্ছে তাতে কৃষকের স্বাধীনতা চলে যাবে, কৃষক কর্পোরেটের দাস হয়ে যাবে। এর বিরুদ্ধে পাঞ্জাব লড়ছে। সেখানকার সম্পন্ন কৃষকেরাও সঙ্কটটা বুঝতে পারছেন। তাদের লড়াই আন্দোলনকে বিজেপি শাস্তিযোগ্য মনে করছে। যেহেতু পাঞ্জাবে কৃষকেরা অবরোধ করেছিলেন তাই সেখানে মালগাড়ি চালানো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কয়লা যাচ্ছে না। যুদ্ধেও যা করা হয় না, দেশের মানুষকে শুকিয়ে মারার জন্য তাই করা হচ্ছে। কাশ্মীরে বুলডোজার চালানো হচ্ছে। পাঞ্জাব, কাশ্মীরের অভিজ্ঞতা থেকে গোটা ভারতের শেখার আছে।
২৬ নভেম্বরের আন্দোলনে কৃষক শ্রমিক সাধারণ মানুষেরা গোটা দেশে বিজেপির বিরুদ্ধে আন্দোলনে সামিল হবেন।
আমরা দেখেছি অতীতের ধর্মঘটে অনেক সময় লেঠেল বাহিনী নেমেছে এর বিরুদ্ধে। আমরা আশা করি আগামী ধর্মঘটে এটা কেউ করবেন না। বাংলার মানুষ কৃষক শ্রমিকদের পাশে থাকবেন।
সংসদে বসে ওরা বাতিল করে দিতে পেরেছে শ্রম আইনে অর্জিত অধিকারগুলি, ঘোষণা করেছে বেসরকারীকরণের ছক, পাস করিয়ে নিয়েছে কৃষিকাজ ও ফসলের ওপর কোম্পানিরাজ কায়েমের নয়া আইন, শিক্ষার অধিকার বাঞ্চাল করতে এনেছে নয়া শিক্ষানীতি, খর্ব করেছে অরণ্যের অধিকার। সংসদের পর্ব শেষ, এবার লড়াই রাস্তার, লড়াই এখন রাজ্যে রাজ্যে। দেশের কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির মঞ্চর পক্ষ থেকে ডাকা ২৬ নভেম্বরের ধর্মঘট এই লড়াইয়ের শুরু। ক্ষমতাসীন কর্পোরেট ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে দীর্ঘনির্ধারক লড়াই চলবে।
শ্রম আইন বিল
দেশকে ওরা ১০০ বছর পিছিয়ে দিচ্ছে। ভারতীয় জনতা ও শ্রমিক শ্রেণী দীর্ঘ প্রচেষ্টায় যে শ্রম আইন বলবত করেছিল তা বিলোপ করছে। অধিকার ও মজুরির প্রশ্নকে অস্বীকার করে ওরা পুঁজির অমানবিক নৃশংস শোষণের কোড চালু করেছে।
মজুরি কোড ন্যায্য মজুরির অধিকারকেই নাকচ করে দিচ্ছে
‘মজুরি তল’ বা ‘ওয়েজ ফ্লোর’-এর মতো নতুন ধারণা হাজির করে ন্যূনতম মজুরির প্রশ্নকে ইতিমধ্যে নাকচ করে দেওয়া হয়েছে। মজুরি প্রদানে গাফিলতির ক্ষেত্রে যে শাস্তির ব্যবস্থা ছিল তা তুলে দিয়ে ইউনিয়ন নেতাদের বিরুদ্ধে শাস্তি বিধি চালু করা হচ্ছে
কেড়ে নেওয়া হয়েছে ধর্মঘটের অধিকার
‘শিল্পে সম্পর্ক কোড’ ধর্মঘটের অধিকার কার্যকরীভাবে নাকচ করে দিয়েছে। যে কোনও প্রতিষ্ঠানে স্ট্রাইক করতে ৬০ দিন আগে নোটিশ প্রদান বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এবং এবং ডিসপুট চলাকালীন স্ট্রাইক নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শান্তিপূর্ণ ধর্মঘটে অংশ নিলেও শাস্তি হিসেবে ৫০,০০০ টাকা জরিমানা ও হাজতবাসের দণ্ডবিধি আনা হয়েছে। রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে ট্রড ইউনিয়নকে শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
নির্দিস্ট সময়ভিত্তিক নিয়োগের নামে শ্রমিককে ইচ্ছে মতো ভাড়া করা ও তাড়িয়ে দেওয়াকে আইনি বৈধতা দেওয়া হয়েছে। সরকারী শ্রম দপ্তরের মধ্যস্থতায় ত্রিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে সমস্টিগত বোঝাপড়া ও সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর বদলে ‘ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির চুক্তি’-র কথা বলে শ্রম সম্পর্কে নৈরাজ্য তৈরি করা হয়েছে। শিল্পীয় সংস্থার সংজ্ঞা বদলে দিয়ে বহু শিল্পকে আইনের আওতার বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। রিট্রেঞ্চমেন্ট ক্লোজার লে-অফ ইত্যাদির ক্ষেত্রে আইন প্রযোজ্য হতে ন্যূনতম ৩০০ কর্মচারি সম্পন্ন সংস্থা হওয়ার বিধান বিপুল অংশের শ্রমিককে সুরক্ষার সুযোগ থেকে বের করে দিয়েছে।
মহিলাদের উপর যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ অভিযোগ জানানোর জন্য কমিটি গঠন করা বাধ্যতামূলক ছিল কিন্তু এই শ্রম কোডে তা নেই। এখন থেকে খনি সহ যে কোনো বিপজ্জনক কাজে মহিলাদের নিয়োগ করা যাবে। নিয়োগকর্তাকে কোনো আইনি বাধ্যতায় নিয়ন্ত্রিত রাখল না সরকার। মাতৃত্বকালীন ছুটির উপর নেবে এসেছে নানা ধরনের শর্ত। ফলে সন্তান সম্ভবা মহিলাদের কর্মচ্যুত করাটা অনেক সহজ হয়ে যাবে। আশা, অঙ্গনওয়াড়ি, মিড ডে মিল কর্মীদের ‘শ্রমিক/কর্মচারি’ হিসাবে স্বীকৃতি, পিএফ, ইএসআই-এর মতো সামাজিক সুরক্ষা, ন্যূনতম মজুরি- এইসব সুপারিশকেই নাকচ করে দিয়েছে শ্রমকোড।
বিজেপি যে বাংলা দখলে কত বেপরোয়া তার পরিচয়গুলো ইতিমধ্যেই দিতে শুরু করেছে। বিহার নির্বাচনের আগে থাকতেই শুরু তার বিশেষ ঝাঁকি দেওয়া। বাংলায় শারোদৎসবের মধ্যে মোদী শুনিয়েছিলেন এক ভার্চুয়াল বার্তা। তাতে বাংলার মনীষী ও পুরোধাদের বহুজনার স্মৃতিচারণ উঠে আসে, যার মধ্যে ধরা পড়ে সুপরিকল্পিত উদ্দেশ্যটি। তা হল উল্লেখিত সবারই প্রভাবিত জনতার ভোট বিজেপির প্রভাবে নিয়ে আসার জন্য উঠেপড়ে লাগা। সেই স্মরণ তালিকায় কার নাম নেই! মনুবাদী থেকে মনুবিরোধী অনেককেই রাখা হয়েছে। শ্রীরামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাবা লোকনাথ, অনুকূলচন্দ্র, পঞ্চানন বর্মা, হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম, সত্যজিৎ রায়, উত্তমকুমার...। হিন্দুমহাসভা ও জনসঙ্ঘের পুরোধা শ্যামাপ্রসাদ ‘মধ্যমনি’! মোদী আক্ষেপ শুনিয়েছেন সময়াভাবে সবার নাম উল্লেখ করতে পারেননি। তবে সুযোগ পেলেই তাঁরা যে ‘বন্দনায়’ মুখিয়ে সেটা তাঁরা বুঝিয়ে দিচ্ছেন, তা সেই ব্যক্তিত্ব চিন্তাভাবনায় বিজেপির প্রবল বিরুদ্ধবাদী বা তাঁদের বিজেপির সঙ্গে আদৌ কোনও মিলজুল নেই বুঝেও। যেমন, প্রহসনের ঘটনা হল, দক্ষিণবঙ্গে আদিবাসী বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজের ফটোশুট ফেরতা পথে শিকাররত আদিবাসীর মূর্তিদেখে ফুলমালা দিলেন অমিত শাহ — বিজেপি রটিয়ে দিল ‘শ্রদ্ধা নিবেদন’ করলেন ‘বীরসা মুন্ডা’র মূর্তিতে। এতে প্রচন্ড ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আদিবাসী সমাজ ও তাদের সংগঠন। তারপরে অতুলনীয় আইকন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণে দেখতে হল মোদী-অমিত শাহ’দের ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি’ প্রদর্শন! যে প্রয়াত ব্যক্তিত্বের গোটা সৃষ্টিশীল জীবন-ইতিহাস নিবেদিত ছিল বামপন্থা, প্রগাঢ় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, বহুত্ব ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি; রাষ্ট্রীয় দমন-দলতন্ত্র-সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদ ও পুঁজির দৌরাত্মের বিরুদ্ধে। তিনি সোচ্চার ছিলেন মব লিঞ্চিং-লাভ জেহাদের বিরুদ্ধে; সিএএ-এনপিআর-এনআরসি’র বিরুদ্ধে। তাঁর নাগরিক জীবনে লেখনীর স্বাক্ষর রেখে গেছেন সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক বর্বরতার বিরুদ্ধে। মোদী- শাহজী’রা এসব খবর রাখেন না তা নয়, তবু সামনে যে ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের ভোট, তা টানার স্বার্থেই নির্লজ্জের মতো যতসব ভন্ডামী ভরা ‘শোক-শ্রদ্ধা’র প্রদর্শন।
নির্বাচনকে ‘পাখির চোখ’ করতে বিজেপি এক মুহূর্ত থামাথামিতে নেই। দলের নয়া সর্বভারতীয় সভাপতি নড্ডা তো বটেই, খোদ তস্য মাথা-যুগল প্রধানমন্ত্রী-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যাতায়াত বাড়িয়ে দিয়েছেন, আরও বাড়াবেন।
তাছাড়া, এখন থেকেই এসে ঘাঁটি গাড়ছেন দলের কেন্দ্রীয় কমান্ড থেকে পাঠানো একগুচ্ছ ‘ভোটকুশলী’ পালোয়ান নেতা। এদের নিয়োগ করা হচ্ছে কয়েকটা বড় অঞ্চল ভিত্তিতে। একইসঙ্গে আমদানি হয়েছেন বিজেপির ‘আই টি সেল’-এর ‘সবসেরা’ মাথা মালব্য, মোদী-শাহ জোড়া ফলার পেয়ারের চাঁই, যিনি নাকি ডিজিটালি কৃত্রিম কলকাঠিতে ‘সাদাকে কালো কালোকে সাদা’ করে তুলতে সিদ্ধহস্ত! যার টিম দলকে অনবরত প্রচারের মালমশলা সরবরাহ করবে। চাঁদমারি ছকে দেওয়া হয়েছে পঁচাত্তর হাজারের বেশি বুথকে। এই বিনিয়োগ নেহাতই লোক দেখানো নয়, নিছক দলের রাজ্য ও জেলা নেতৃত্বের নানা খাস স্বার্থ জড়িত গোষ্ঠী সংঘাতের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ন্ত্রণ করতে শুধুমাত্র নয়। এরা কেউ ‘ত্রিপুরা’, কেউ ‘হরিয়ানা’, কেউ ‘উত্তরপ্রদেশ’, ‘মধ্যপ্রদেশ’, ‘উত্তরাখন্ড’ প্রমুখ দখলে ওস্তাদির পরিচয় দিয়েছে। তাই এদের ঠিকানা এখন বাংলা। সদর্থক কোনো ইস্যু ভিত্তিক সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রচার বিজেপির পক্ষে সম্ভব নয়। সর্বার্থেই সেই বিষয়ও নেই, মুখও নেই। তার বদলে বিদ্বেষ-বিভাজনের রাজনীতি ছড়িয়ে একদিকে হিন্দুভোটকে সংহত করা, অন্যদিকে এরাজ্যে সংখ্যালঘু ভোট যেহেতু শতাংশের বিচারে ও নির্বাচনী ফলাফল নির্ধারণে বিরাট গুরুত্বপূর্ণ, তাই সংখ্যালঘু জনতাকে সন্ত্রস্ত করা থেকে শুরু করে সাপ-লুডো খেলার সামগ্রীতে পরিণত করাই বিজেপি’র বিশেষ লক্ষ্য। আর লক্ষ্য হাসিল করতেই কাজ করাতে আমদানি করা হয়েছে ঐসব ঝানুদের।
বিজেপি ‘মাস্টার স্ট্রোক’ দিতে চাইছে আই টি সেল-এর মাথাকে নিয়ে এসে বসিয়ে। বিজেপি’র ‘আই টি সেল’ যে ভূয়ো তথ্য সম্প্রচারের হাতিয়ার তা যেমন বাইরে থেকেও ধরা যায়, তেমনি তার তথ্যপ্রমাণ ফাঁস হয়ে গেছে তাদের নিয়োগের জায়গা থেকেও। মূল পরিচালকের জায়গায় নিয়োজিত বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিটি বহু আগেই সংস্রব ছেড়ে চলে যান। সেই জায়গায় বিরাজমান মালব্য খোরাক যোগাচ্ছেন ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের সময় থেকে। ‘কারসাজির অবদান’ রেখে আসছেন দুটি লোকসভা নির্বাচন সহ বেশ কয়েকটি বিধানসভা নির্বাচনে। বিজেপি এবার তাঁকে কাজে লাগাতে চায় বাংলায়। তার এই সব মিলে বাংলার নির্বাচনে রণনীতি-রণকৌশল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার বিপদকে খাটো করে দেখা কোনোমতেই উচিত নয়। বিপদের এই ভয়ঙ্কর ধারাটা যথাযথ বুঝে নিতে পারলে তাকে প্রধান প্রতিপক্ষ হিসাবে নির্দিষ্ট করা সহজ হয়, একে কার্যকরীভাবে মোকাবিলার দুর্জয় সাহস আর দূরন্ত নীতি ও কৌশলগত প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব আয়ত্ত্ব করাও সম্ভব; সম্ভব বাম ও গণতান্ত্রিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা, আর বাংলার মাটিতে বিজেপিকে পর্যূদস্ত করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে প্রয়াসী হওয়া।
প্রেস ক্লাবে দীপঙ্কর ভট্টাচার্য সাংবাদিক সম্মেলনে বললেন, বাঙালির প্রিয় দুই সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তকে শ্রদ্ধা জানিয়ে সিপিআই(এমএল)-এর সাধারণ সম্পাদক তাঁর সাংবাদিক সম্মেলন শুরু করেন। কলকাতা প্রেস ক্লাব তখন কাণায় কাণায় ভর্তি। বিহার ভোটে সিপিআই(এমএল) সহ বামেদের চমকপ্রদ সাফল্য এবং বাংলার আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে বামেদের ভূমিকা নিয়ে সিপিআই(এমএল) সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য শোনার জন্য রাজ্যের সমস্ত প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিয়ার মিডিয়ার প্রতিনিধিরাই সেখানে উপস্থিত। লিবারেশনের পলিটব্যুরো বৈঠকের অব্যবহিত পরে আয়োজিত এই সাংবাদিক সম্মেলনে দীপঙ্কর মূলত তিনটি বিষয়কে সামনে রেখে তাঁর বক্তব্য পেশ করেন। বিহার নির্বাচন ও তার বার্তা, ২৬ নভেম্বর দেশজোড়া ধর্মঘটকে সফল করার আহ্বান এবং আগামীদিনে বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে রাজ্য রাজনীতি ও বিশেষ করে সেখানে বামপন্থীদের ভূমিকা বিষয়ে সিপিআই(এমএল)-এর ভাবনাচিন্তা।
বিহার নির্বাচন প্রসঙ্গে দীপঙ্কর বলেন -- বিহারের নিরবাচনে মানুষের আকাঙ্ক্ষা ছিল সরকার বদলে যাক, সেটা সম্পূর্ণ সফল হয়নি। তবে মানুষের সরকার বিরোধী ক্ষোভের তীব্রতাটা বোঝা গেছে।
পোস্টাল ব্যালটের গণনার হিসেবে দেখা গেছে বিজেপি বিরাট মাত্রায় সেখানে পিছিয়ে থেকেছে। যা দেশের অন্যান্য নির্বাচনে সাধারণভাবে দেখা যায় না। এই হিসাব থেকে থেকে বোঝা গেছে শিক্ষক ও সরকারী কর্মচারিদের ক্ষোভ বিহার নির্বাচনে কী মাত্রায় ছিল। সরকারি কর্মচারীদের চাকুরির ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তা এই ফলাফলে বিশেষ প্রভাব ফেলেছে।
বিহার নির্বাচনে যে ২৫ দফার দাবিসনদ প্রস্তুত করা হয়েছিল, সেখানে ছিল সমান কাজের জন্য সমান বেতন, ঠিকা প্রথা বাতিল, মর্যাদাপূর্ণ নিরাপদ কর্মসংস্থান এর ওপর বিশেষ জোর ছিল। আশা অঙ্গনওয়ারি সহ বিভিন্ন স্কিম ওয়ার্কারদের দাবি সেখানে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে হাজির হয়েছিল। সাধারণ সময়ের রাজনীতিতে চর্চিত হলেও নির্বাচনের সময়ে এই অর্থনৈতিক দাবিগুলো অনেক সময় পেছনের দিকে চলে যায়। ভালো ব্যাপার বিহার নির্বাচনে এবার এটা হয়নি। বিহার নির্বাচন বস্তুত এবার জনগণের আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়েছিল। সিপিআই(এমএল) সহ বামেদের ভালো ফলের চাবিকাঠিটি এখানেই নিহিত আছে।
করোনা আবহে এই নির্বাচন হয়েছে। মানুষ কিন্তু তা সত্ত্বেও বিপুল মাত্রায় ভোট দিয়েছেন। নির্বাচনে সরকারটাকে বদলে দেবার আকাঙ্ক্ষা যে তাদের ছিল, এটা থেকে তা বোঝা যায়।
বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে শক্তিশালী করার জন্য এই প্রথম একটা বড় জোটে আমরা সামিল হই। জোট জনগণের মধ্যে তীব্র আশা তৈরি করতে সক্ষম হয়।
বামেরা এই নির্বাচনে খুব ভালো ফল করেছে। নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পর স্ট্রাইক রেট নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। জোটের দলগুলির মধ্যে সিপিআই(এমএল)-এর স্ট্রাইক রেটই সবচেয়ে ভালো। সবচেয়ে বড় ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন মেহবুব আলম। তাঁকে সিপিআই(এমএল) বিধায়ক দলের নেতা নির্বাচন করা হয়েছে।
সিপিআই(এমএল) তিনজন ছাত্র-যুবকে নির্বাচনে প্রার্থী করেছিল, যারা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে উঠে এসেছেন। সন্দীপ সৌরভ, জেএনইউ-এর প্রাক্তন সভাপতি জিতেছেন পালিগঞ্জ থেকে। মনোজ মঞ্জিল, সড়ক পর স্কুল আন্দোলনের নেতাও বড় জয় পেয়েছেন।
বিজেপি চেয়েছিল ভোটে হেরে গেলে দোষ হবে নীতীশের, জিতলে তা বিজেপির পক্ষে আসবে। ফলাফল বেরনোর পর বিজেপি বলার চেষ্টা করছে যে ক্ষোভ ছিল কেবল নীতীশের বিরুদ্ধে এবং সরকারটা নাকি নরেন্দ্র মোদির জন্য বেঁচে গেল। ২০১০-এর ভোটে এনডিএ ২০০-র বেশি আসন পেয়েছিল। বিজেপি তখন ৯০-এর বেশি আসন পেয়েছিল। সেটা কিন্তু প্রাক মোদি জমানা ছিল। এই নির্বাচন অবশ্যই নীতীশ বিরোধী এবং বিজেপি বিরোধীও।
বিজেপির কিছু নির্বাচনী কৌশলের কথাও দীপঙ্কর তুলে ধরেন। এই নির্বাচনে ভিআইপি পার্টি ছিল এনডিএ-র সহযোগী। তারা এক্সট্রিম ব্যাকওয়ার্ডক্লাসের প্রতিনিধি হিসেবে লড়েছিল বলা হচ্ছে। কিন্তু একটু বিশ্লেষণ করলেই দেখা যাবে ১৩টা আসনের মধ্যে দুটো আসনে তারা পাঁচশোরও কম ভোট পায়। আসলে ১১টা আসনে তারা লড়ে বিজেপির ছায়া হিসেবে। তাদের চারজন জয়ীই আসলে বিজেপি নেতা। যেমন মেহবুব যাকে হারিয়ে এবার জিতলেন তিনি আগের বার প্রত্যক্ষভাবেই বিজেপিরই প্রার্থী ছিলেন। এভাবে সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের নামটুকু ব্যবহার করে মানুষকে ভুল বুঝিয়ে বিজেপি আসলে এই অংশের মানুষকে অসম্মানই করল।
প্রশ্নোত্তর পর্বে আসাদউদ্দিন ওয়াইসি ও মিমের নির্বাচনে লড়ার প্রশ্নটি ওঠে। এই সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে দীপঙ্কর ভট্টাচার্য জানান যে অ-বাম অ-বিজেপি দলগুলো মুসলিম ভোট পেতে আগ্রহী। কিন্তু মুসলিমদের ওপর যখন আক্রমণ নামে তখন এরা চুপ থাকে বা কোনওরকমে এই ইস্যুগুলোকে পাশ কাটিয়ে যায়। এইখান থেকে অনেক মুসলিমের ক্ষোভের সঞ্চার হয়। মিম-এর মতো দলের সমর্থনের ভিত্তি এখান থেকেই তৈরি হয়।
এই নির্বাচনের সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হল কোথাও শক্তিশালী কোনও বিরোধী থাকবে না, বিজেপির এই ‘মন কি বাত’কে এই নির্বাচন আঘাত করেছে। নির্বাচন একটা আন্দোলন এর চেহারা নিয়ে শক্তিশালী বিরোধীপক্ষকে সামনে এনেছে।
নতুন সরকার সদ্য তৈরি হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যেই বেশ কিছু দিক সামনে এসেছে যা অচিরেই বেশ কিছু ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।
নতুন সরকার যাকে বিহারের শিক্ষামন্ত্রী বানাল তিনি আর্থিক দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে আগে দল থেকেই সাসপেন্ড হয়েছিলেন।
বিহারের নির্বাচন দেখিয়ে দিল আন্দোলন যথার্থ হলে মানুষের দাবি সামনে আসতে পারে ও বিজেপিকে বেগ দিতে পারে।
বাংলার আসন্ন নির্বাচন ও বামেদের অবস্থান প্রসঙ্গে দীপঙ্কর বলেন -- বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দৃঢ়তা দেখানোটাই এই সময়ের বাম আন্দোলনের লিটমাস টেস্ট। সেটা বিহার, বাংলা সহ গোটা ভারতের জন্যই সত্যি। বিজেপির কুৎসা ছিল আমাদের বিরুদ্ধে। প্রথম পর্যায়ে আমাদের যে ৮ জন লড়েছিলেন ৭ জন তার মধ্যে জিতেছেন নড্ডা ইত্যাদিদের জোরালো আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে।
বোঝা যাচ্ছে বিজেপির সঙ্গে বামেদের মতাদর্শগত লড়াই ই সবচেয়ে তীব্র হবে আগামীদিনে।
আমার একটা কথা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। আমি বলেছিলাম বিজেপির বিরুদ্ধে কথা বলাটা এখন সবচেয়ে জরুরি।
বিমানবাবু সবচেয়ে প্রবীণ বাম নেতা। তাঁকে পরামর্শদেওয়ার চেষ্টা আমি করছি না। আমার মূল বলার বিষয় বামেদের পুনর্জাগরণের প্রয়োজনিয়তা ও রাস্তা। সিঙ্গুর পর্বথেকে এখানে বামেদের ভোট ক্রমশ কমছে। বামেদের উঠে দাঁড়াতে হবে নতুন করে।
অন্যদিকে বিজেপির শাসন মানেই বিপর্যয়। নোটবন্দী, জিএসটি, লক ডাউন হয়ে ক্রমশ তলার দিকে চলেছে অর্থনীতি। হিন্দু-মুসলিমের ভালোবাসাকে লাভ জেহাদ নামে নিষিদ্ধ করার চেষ্টা চলেছে। স্বাধীন দেশে খাদ্যাভ্যাস, প্রেম ভালোবাসা, মত প্রকাশের অধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতার নানা দিকের ওপর হামলা চালিয়ে তারা দুঃস্বপ্ন নামিয়ে আনছে। আমরা চাই না রবীন্দ্রনাথ, চৈতন্য, লালন, সুভাষচন্দ্র, বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণের বাংলায় এই দুঃস্বপ্ন নেমে আসুক।
বিজেপি গণতন্ত্রর কথা বলে যে এই রাজ্যে শক্তিশালী হবার চেষ্টা করতে পারছে, তার মূল দায় তৃণমূলের। আমরা কখনো বলিনি তৃণমূল সম্পর্কে নরম থাকুন। আমরা বলেছি তৃণমূলের অগণতন্ত্রের কথা প্রচার করে বিজেপি যেন আড়ালে থাকার সুযোগ না পায়। ত্রিপুরা, উত্তরপ্রদেশ, আসাম সহ বাংলার আশেপাশের যে সব রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় আছে, সে সব জায়গায় গণতন্ত্রের স্বরূপ মানুষ দেখছেন। গণতন্ত্রের প্রশ্নে বিজেপির ভূমিকাকে প্রচারে সামনে আনা জরুরি। যেহেতু এটা রাজ্য নির্বাচন, তাই রাজ্যের শাসক দল নিয়েই শুধু কথা হোক, আর কেন্দ্রের শাসক দল সেই সুযোগে খানিকটা আড়ালে চলে যাক – এটা যেন না হয়।
(২৬ নভেম্বরের দেশজোড়া ধর্মঘটকে সফল করার আহ্বান জানিয়ে দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের বক্তব্য রয়েছে প্রথম পাতায়)।
পশ্চিমবঙ্গে সিপিআই(এমএল)-এর আগামীদিনের আন্দোলন ও নির্বাচনী লড়াই প্রসঙ্গে দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন -- লকডাউনের সময় হুগলিতে মাইক্রো ফিনান্স-এর চড়া সুদের জাঁতাকলের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে উঠেছে। আদিবাসীদের বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন গড়ে উঠেছে। হাজারে হাজারে মহিলা সামিল হয়েছেন মাইক্রো ফিনান্সের সংকটের বিরুদ্ধে।
আমাদের পক্ষ থেকে এইসব আন্দোলনের বাছাই করা কয়েকজন নেতা নির্বাচনে লড়বেন। আগামী দিনের রাজ্য কমিটির বৈঠকে সেগুলো ঠিক হবে। অন্যান্য বাম দলগুলির সঙ্গেও কথা হবে।
বিহারের নির্বাচন ও বাংলার রাজ্য নির্বাচন ঠিক একইরকম নয়। বিহারে রাজ্যে কেন্দ্রে দু জায়গাতেই এনডিএ ছিল। ফলে একটা ব্যাপক এনডিএ বিরোধী জোট বিহারে তৈরি হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গে এই সরলরেখা নেই। এখানে রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতায়। ফলে এখানে বিজেপির বিরুদ্ধে বাম কংগ্রেস তৃণমূল সবাই মিলে জোটের অবস্থা এখন নেই। তবে মহারাষ্ট্রে বিজেপি আর শিবসেনাকে আলাদা করে দেখা হচ্ছে। আগামীদিনে এখানে কী হবে সেটা দেখা যাবে। এখন এখানে বামেদের শক্তিশালী হওয়াটা বিশেষ দরকার।
বাংলায় গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের বর্শামুখ থাক বিজেপির বিরুদ্ধে থাকুক এটা আমরা চাই। একটা গোটা রচনা তৃণমূলের বিরুদ্ধে লিখে ফুটনোটে কিছুটা বিজেপি বিরোধিতা – এইভাবে চলতে পারে না, সেটা আমরা স্পষ্ট বলতে চাই। নতুন করে বামপন্থাকে পশ্চিমবঙ্গে সামনে আনতে হবে। ২০১১-র আগের কথা বলে নয়, নতুন সময়ের নতুন ইস্যুগুলির মোকাবিলা করেই এটা করতে হবে বামপন্থীদের।
১৩ নভেম্বর ২০২০
এনডিএ বিহারে এক চুল ব্যবধানে জিতে গেলেও, কোভিড১৯ অতিমারী এবং নির্মম, বেদনাদায়ক লকডাউনের আবহে অনুষ্ঠিত প্রথম বড় নির্বাচন হিসাবে বিহার বিধানসভা নির্বাচন সেই সব শক্তির কাছে এক দারুণ উদ্দীপনাময় বার্তা পাঠিয়েছে যারা মানুষের জীবিকা, মর্যাদা, অধিকার এবং ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসাবে আগামী ভারতকে গড়ে তোলার জন্য লড়ছেন।
বিহার নির্বাচন জনগণের এক যথার্থ আন্দোলন এবং যুবশক্তির অভ্যুত্থান হয়ে উঠেছিল। জনতার এই রায়ে বিহারে সরকার পরিবর্তনের প্রবল আকাঙ্ক্ষার স্পষ্ট প্রতিফলন ঘটেছে। যদিও চূড়ান্ত সংখ্যার বিচারে এনডিএ কোনওক্রমে উতরে গেছে, তবুও এক শক্তিশালী বিরোধী শক্তির উত্থান, ভারতীয় গণতন্ত্রকে সমস্ত রকম বিরোধিতা থেকে মুক্ত (বিরোধী-মুক্ত ভারত) করার বিজেপি’র ষড়যন্ত্রকে জোরালো প্রত্যাঘাত হেনেছে। বেশ কয়েকটি আসন, যেগুলিতে খুব নগণ্য ব্যবধানে ক্ষমতাসীন এনডিএ’র অনুকূলে ফয়সালা হয়েছে, সেগুলি নিয়ে নির্বাচন কর্তৃপক্ষের অনিয়ম বা কারচুপি সম্পর্কে যথার্থ উদ্বেগ রয়েছে, চেষ্টা চলছে সাক্ষ্য প্রমাণ যোগাড়ের যাতে প্রয়োজনে চ্যালেঞ্জ করা যায়।
আরজেডি-বাম-আইএনসি জোটের উত্থানকে বিহারের ভোটাদাতারা বিপুলভাবে স্বাগত জানিয়েছেন এবং সিপিআই(এমএল) এই জোটকে একটি সম্ভবপর বিকল্প হিসাবে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এটা আমাদের প্রার্থীদের নির্বাচনী কৃতকার্যতায় প্রমাণিত হয়েছে -- ১৯টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ১২টিতে জয় -- জোটসঙ্গীদের মধ্যে পার্টিকে সর্বোচ্চ স্ট্রাইক রেট এবং মোট ভোটের প্রায় ৪% অংশীদার করেছে । বিজেপি’র তাবড় নেতাদের দ্বারা আমাদের দলের বিরুদ্ধে এক জঘন্য অপপ্রচারের মুখে এই অর্জন, আমাদের জনগণের জন্য সংগ্রাম ও তাদের সেবার মধ্য দিয়ে অর্জিত ক্রমবর্ধমান সমর্থন ও সুনামের সাক্ষ্যই বহন করছে।
এই নির্বাচনে ছাত্র-যুব নেতাদের বিরাট জয় বিশেষভাবে সন্তোষজনক হয়ে উঠেছে আমাদের বিধায়কদের পুনর্নির্বাচিত হওয়ার কারণে।
সিপিআই(এম) ও সিপিআই-এর চার বিজয়ী বিধায়কের সঙ্গে সিপিআই(এমএল)-এর ১২ জন বিধায়কের দলটি, বিহার বিধানসভায় এনডিএ-বিরোধী শক্তির মধ্যে একটি শক্তিশালী বাম বাহিনী হিসাবে কাজ করবে। কর্মসংস্থান এবং সকলের জন্য উপযুক্ত মানের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবার পাশাপাশি কৃষক ও শ্রমিকদের অধিকারের সুরক্ষা, ন্যায়বিচার এবং আইনের শাসন সুনিশ্চিত করাকে কেন্দ্র করে যে জনপ্রিয় অ্যাজেন্ডার উত্থান হয়েছে ভারতের গণতন্ত্রের পক্ষে তা শুভ ইঙ্গিতবাহী এবং সিপিআই(এমএল) এই এজেন্ডার বাস্তবায়ন এবং অগ্রগতির জন্য কঠোর সংগ্রাম চালিয়ে যাবে।
পার্টির বিহার নির্বাচনী প্রচারাভিযান সারা দেশের কমরেড এবং বন্ধুদের কাছ থেকে মূল্যবান নৈতিক, রাজনৈতিক এবং আর্থিক সমর্থন পেয়েছিল। যারা এই সমর্থন দিয়েছেন তাদের সকলকে উষ্ণ অভিনন্দন এবং আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছে কেন্দ্রীয় কমিটি। বিহারের ফলাফল এবং বিশেষ করে সিপিআই(এমএল) ও অন্যান্য বাম দলগুলির নির্বাচনী পুনরুত্থানের সংকেতগুলি বিহারের মধ্যে ও বাইরে অনেক আশা এবং উদ্দীপনা জাগিয়ে তুলেছে। বিহারে প্রত্যাশা পূরণে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানোর সঙ্গে সঙ্গে সিপিআই(এমএল) কেন্দ্রীয় কমিটি গোটা দল, বামপন্থী কর্মীবাহিনী এবং দেশের গণতন্ত্রপ্রেমী বিভিন্ন শক্তির সমগ্র সমাহারের কাছে মোদী সরকারের ধ্বংসাত্মক, কর্পোরেট-মুখী, জনবিরোধী নীতি এবং বিজেপি’র সাম্প্রদায়িক মেরুকরন ও ফ্যাসিবাদী হুমকির বিভেদকামী বিদ্বেষপূর্ণ রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াইকে তীব্রতর করার আহ্বান জানাচ্ছে।
গত ১৫ নভেম্বর রাত্রি আনুমানিক সাড়ে আটটা নাগাদ বিজেপি আশ্রিত ১২-১৫ জন সমাজবিরোধী দলবেঁধে উদয়পুরে সিপিআই(এমএল) রাজ্য সম্পাদক পার্থ কর্মকারের বাড়িতে হামলার চেষ্টা করে। বাড়িতে ও বাড়ির বাইরে শাসক দল বিজেপি’র বিরুদ্ধে মিটিং করা, প্রচার করা বা কথা বলা যাবে না বলে হুমকি দেয়। মিটিং করলে বা কথাবার্তা বললে বাড়িতে ঢুকে হামলা করবে বলে শাসিয়ে যায়। এমনকি প্রাণে মারার হুমকি দেয়। অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে। বাড়ির গেটে লাথি দেয়। বাউন্ডারি দেওয়াল টপকে ঢোকার চেষ্টা করে। তাছাড়া পার্থ কর্মকারের প্রতিবেশি পেশায় ক্ষুদ্র পোশাক ব্যবসায়ী চন্দন সাহার বাড়িতে দলবেঁধে ঢুকে শাসিয়ে যায়। তিনি পার্থ কর্মকারের বাড়িতে কেন কথা বলতে যান সেটাই তাঁর ‘অপরাধ’! এমন আরো কয়েকজনকে শাসিয়ে যায়। হামলার ঘটনার সময় পার্থ কর্মকার, তাঁর বৃদ্ধ বাবা, মা, স্ত্রী বাড়িতেই ছিলেন। তাঁদেরকে ভীতসন্ত্রস্ত করা, সামাজিক সম্মান নষ্ট করাই এদের উদ্দেশ্য ছিল। এই ঘটনা আরো একবার প্রমাণ করল, ব্যক্তি ও পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা, নাগরিকদের অধিকার আজ বিপন্ন। বাড়িতে শান্তিতে ও স্বাভাবিকভাবে বসবাস করার মৌলিক অধিকারটুকু আজ বিপন্ন। মত প্রকাশের অধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার আজ বিপন্ন। এর মূল কারণ হচ্ছে যে আইনের শাসন বলতে আজ আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। এখানে উল্লেখ্য যে, পার্থ কর্মকার নিজে আরকেপুর থানায় অভিযোগপত্র জমা দিয়েছেন। এই অবস্থায় এই ঘটনার প্রয়োজনীয় তদন্তপূর্বক দোষীদের গ্রেপ্তার ও আইনানুগ শাস্তির দাবি করেছে সিপিআই(এমএল) ত্রিপুরা রাজ্য কমিটি। একইসঙ্গে রাজ্যে আইনের শাসন, সাংবিধান ও গণতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে সমস্ত গণতন্ত্রপ্রিয় জনগণকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদে ও প্রতিরোধে এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান রেখেছে।
উপরোক্ত সমস্ত বিষয় জানিয়ে এক প্রেস বিবৃতি দেওয়া হয়েছে কমিটির পক্ষ থেকে।
করোনা ভাইরাস সংক্রমণ ও প্রস্তুতিহীন লকডাউনের ধাক্কায় বাংলার চা শিল্পে উৎপাদন বন্ধ থাকে। ফলে মার্চ-এপ্রিল মাসে দার্জিলিং চায়ের বিশ্বখ্যাত ‘ফার্স্ট ফ্লাশ’ -- বিক্রি করে বিপুল লাভের সম্ভাবনা থেকে বঞ্চিত হয় অসম সহ পশ্চিমবঙ্গের চা শিল্পপতিরা। তাঁদের মরিয়া প্রচেষ্টা ও রাজ্য/কেন্দ্র সরকারের প্রশ্রয়ে কোভিড সংক্রমণের সম্ভাবনাকে পাশ কাটিয়ে মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে শ্রমিকদের আপত্তিকে দূরে ঠেলে চা শিল্পের তালাবন্দী ঘুচিয়ে দেওয়া হয়। লকডাউন পর্যায়ের ন্যায্য মজুরি প্রদান ও কোভিড স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রতিশ্রুতি অচিরেই বাজে কাগজের ঝুড়িতে নিক্ষিপ্ত হয়। শ্রমিক বিক্ষোভ ঠেকাতে কোনও কোনও বাগানের স্থায়ী শ্রমিকদের মজুরির অগ্রিম হিসাবে অল্পকিছু টাকা হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়। একমাসের অধিক সময় মজুরি বঞ্চিত শ্রমিক পরিবারগুলি অগত্যা পরবর্তীতে ঋণদায়ী সংস্থাগুলির উপর আরো বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। তরাইয়ের ৪৫টি বাগান শ্রমিক পরিবারের প্রায় ৪৩,০০০ সদস্য মোদী সরকারের মাথা পিছু ৫ কেজি চালের খয়রাতি সাহায্যের আওতার বাইরে থেকে যায়। ‘সেকেন্ড ফ্লাশ’ চায়ের বাজারি চাহিদা ও যোগানের মধ্যে আপৎকালীন তফাতে উৎপাদন শুরুর প্রথম থেকেই মালিক কর্তৃপক্ষ চা অকশন কেন্দ্রের মাধ্যমে ও খোলা বাজারে বিগত বছরগুলির থেকে দ্বিগুনেরও বেশি দাম আদায় করতে পেরে বিপুল মুনাফা কামিয়ে নেয়। অতঃপর শ্রমিক সংগঠনগুলির লাগাতার লেগে থাকা ও পরবর্তীতে শ্রমিক অসন্তোষের ভয়ে আগষ্ট মাসে বোনাস সংক্রান্ত দ্বিতীয় বৈঠকেই চা শিল্পপতিরা সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ বোনাস ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।
লকডাউনের সমস্ত পর্যায় জুড়ে কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রমিক সুরক্ষা আইনের মান্যতাকে খর্ব করতে শ্রমকোড চাপিয়ে দেওয়া, ৮ ঘন্টার বদলে ১২ ঘন্টা কাজের সুপারিশ, শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থার গাফিলতি ইত্যাদির বিরুদ্ধে এবং লকডাউন ওয়েজ, ন্যূনতম মজুরি কাঠামো ঘোষণা, চা বাগানের স্থায়ী শ্রমিকদের বাসভূমির পাট্টা প্রদান, খাদ্য নিরাপত্তা, বন্ধ বাগান খোলা, শ্রমিক পরিবারগুলির সুরক্ষা বাবদ আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণার দাবিতে তরাই সংগ্রামী চা শ্রমিক ইউনিয়ন সহ জয়েন্ট ফোরাম অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য শ্রমিক ইউনিয়নগুলি সাধ্যমত সক্রিয় ভূমিকা পালন করে চলে। ইতিমধ্যে অসম, বাংলা, তামিলনাড়ু, কর্নাটক ও কেরালাতে কর্মরত এআইসিসিটিইউ অনুমোদিত ইউনিয়নগুলির একটি কোঅর্ডিনেশন টিম অনলাইন আলোচনার মাধ্যমে ১০ দফা দাবিপত্র নিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলিকে পাঠিয়ে দেয় এবং বাগান ভিত্তিতে সক্রিয়তাকে এগিয়ে নিয়ে চলে।
২৬ নভেম্বর সর্বভারতীয় সাধারণ ধর্মঘটকে সর্বাত্মকভাবে সফল করে তুলতে ইতিমধ্যে এলাকা ভিত্তিক কনভেনশন ও বাগানভিত্তিক গ্রুপ মিটিংগুলি সম্পন্ন হয়েছে। দুর্গাপূজা, দেওয়ালী ও আসন্ন ছটপুজোর দিনগুলির প্রতিকূলতা ও এতদ্অঞ্চলে কোভিডের বাড়তি সংক্রমণের বিপদকে অগ্রাহ্য করে শ্রমিক সংগঠনের নেতা ও কর্মীরা সক্রিয়তা বা তুলতে ব্যস্ত থাকছেন।
পাহাড়-তরাই-ডুয়ার্সের চা শিল্পে বিজেপি-আরএসএস পরিচালিত শ্রমিক ইউনিয়ন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে। অন্যদিকে, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে ভাঙন রুখতে চায় তৃণমূল পরিচালিত তিনটি ভাগে বিভক্ত বাগান ইউনিয়নগুলি। দার্জিলিং পাহাড়ের রাজনীতিতে বিমল গুরুংয়ের সাম্প্রতিক আত্মপ্রকাশ সঞ্জাত বিক্ষিপ্ত রাজনৈতিক বাতাবরণের এমত জটিল বাতাবরণের মধ্যেও বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়নগুলি চা শ্রমিকদের সংগঠিত রেখে ধর্মঘটকে সফল করে তুলতে বদ্ধপরিকর।
-- অভিজিৎ মজুমদার
দশটি কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠন ও ফেডারেশন সমুহের ডাকে আগামী ২৬ নভেম্বর ২০২০ সারা দেশজুড়ে কেন্দ্রীয় সরকারের জনবিরোধী ও শ্রমিক বিরোধী নীতির বিরুদ্ধে এবং সাত দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সাধারণ ধর্মঘট পালিত হবে। সারা দেশের ৪১টি প্রতিরক্ষা কারখানা, ইএমই ওয়ার্কসপ, এমইএস সহ প্রতিটি দফতরে কৃষক-বিরোধী আইন এবং শ্রমিক-বিরোধী শ্রম কোড সমূহ বাতিল, রাষ্ট্রায়ত্ব শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলির বেসরকারীকরণ বন্ধ করা, সরকারী ক্ষেত্র যেমন রেলওয়ে, অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি এবং বন্দর ইত্যাদি কর্পোরেটদের হাতে তুলে না দেওয়া ও এনপিএস বাতিল করে পুরোনো পেনশন চালু করা, সরকারি এবং রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্রগুলির কর্মীদের চাকরির মেয়াদ শেষ হবার আগেই তাদের অবসর নিতে বাধ্য করার মতো দানবীয় আইন বাতিল ও ডিএ পুণর্বহাল করা ইত্যাদি দাবিগুলো নিয়ে পোষ্টারিং ও ছোট ছোট গ্রুপে আলোচনার মাধ্যমে শ্রমিকদের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এছাড়াও আয়কর ভুক্ত নন এমন প্রতিটি পরিবারকে প্রতি মাসে নগদ ৭,৫০০ টাকা, অভাবগ্রস্ত পরিবারের সদস্য পিছু মাসে ১০ কেজি বিনামূল্যে রেশন, ১০০ দিনের পরিবর্তে বছরে ২০০ দিনের কাজ ও শহর এলাকায় কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা এই দাবিগুলো নিয়েও প্রচার চলছে। তবে প্রতিরক্ষা শিল্পের ক্ষেত্রে এই প্রচার মূলত সংহতি মূলক স্তরেই সীমাবদ্ধ।
এরসঙ্গে বলে রাখা প্রয়োজন গত ৪ আগষ্ট ২০২০ প্রতিরক্ষা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত এনপিডিইএফ (জিএসএফ ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন যার অন্তর্ভুক্ত) সহ চারটি ফেডারেশন ১২ অক্টোবর ২০২০ থেকে একক ভাবে প্রতিরক্ষা শিল্পে লাগাতার ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল, এই ক্ষেত্রকে কর্পোরাটাইজেশন করার কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। এই বিষয়ে গত ৯ অক্টোবর ২০২০ দিল্লিতে চিফ লেবার কমিশনারের উপস্থিতিতে সরকারপক্ষ ও ফেডারেশন নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয় আলোচনা চলা অবস্থায় সরকার পক্ষ কর্পোরেশনের সিদ্ধান্ত লাগু করবে না এবং ফেডারেশনগুলোও ধর্মঘটে যাবে না। এই পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মঘট স্থগিতঘোষণা করা হয়। এই অজুহাতে প্রতিরক্ষা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ফেডারেশনগুলো ২৬ নভেম্বরের ডাকা ধর্মঘটে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হওয়ার ডাক দেয়নি, অথচ ফেডারেশনগুলোও এই ধর্মঘটের সিদ্ধান্তের শরিক ছিল।
জিএসএফ ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন (এনপিডিইএফ এবং এআইসিসিটিইউ অনুমোদিত) ফেডারেশনগুলোর এই দায় সারা মনোভাবকে অনুমোদন করেনা। আবার এককভাবে শুধুমাত্র একটি কারখানাতে একটি ইউনিয়নের পক্ষেও আলাদাভাবে কিছু করা সম্ভব নয়। তাই জিএসএফ ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন ও অন্য তিনটি ফেডারেটেড ইউনিয়নের সঙ্গে যৌথভাবে কর্মসূচী পালন করছে।
ফেডারেশন সমূহের নির্দেশ অনুযায়ী আগামী ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত ধর্মঘটের দাবিগুলো তুল ধরে গেট মিটিং ও পোষ্টারিং-এর মাধ্যমে প্রচার চলবে। ২৬ নভেম্বর ধর্মঘটের সমর্থনে কালো ব্যাজ ধারণ ও কালো পতাকা সহ সমস্ত কারখানায় সামনে সংহতি সভা অনুষ্ঠিত হবে ।
ধর্মঘট বিষয়ে জিএসএফ ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের কিছু আলদা দৃষ্টিভঙ্গি আছে যা এই ক্ষুদ্র পরিসরে রাখা হল। কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রমিক বিরোধী নীতিগুলোর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সরকারী ও রাষ্ট্রয়ত্ব সংস্থার সঙ্গে যুক্ত শ্রমিক সংগঠনগুলো আলাদা আলাদা সময়ে একক ভাবে ধর্মঘটের ডাক দেয়। অন্যান্য সংগঠনগুলো সেখানে সংহতি জানায় দায়সারা ভাবে মিটিংএ উপস্থিত হয়ে বা ঐদিনে সংহতি সভা করে। আবার কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠনগুলোও এক বা একাধিক সময়ে সারাদেশ ব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়। এক্ষেত্রে জণগণের সাধারণ সমস্যা ও দাবিগুলোর সঙ্গে অসংগঠিত ক্ষেত্র, সংগঠিত সরকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্র এবং অন্যান্য সমস্ত ক্ষেত্রের সমস্যা ও দাবিসমূহ যুক্ত থাকে। তাহলে আলদা আলাদাভাবে ধর্মঘট ডাকার যৌক্তকতা কোথায়? এক্ষেত্রেও বাকির দায়সারাভাবে সংহতি জানায়। একটা সময় এই সংহতি বিষয়টা চালু হয়েছিল শধুমাত্র লড়াইএ পাশে আছি এটা বোঝাতে কিন্তু ধর্মঘটে এই সংহতির কোন গুরুত্ব নেই। ধর্মঘটের ক্ষেত্রে সংহতি জানানো সোনার পাথর বাটির মত। আগামী দিনে এই দুই-এর মেল বন্ধনের লক্ষ্যে ২৬ নভেম্বর ২০২০ সারা দেশে সাধারণ ধর্মঘটকে সফল করে তুলতে হবে ।
রেল শিল্পের বর্তমান পরিস্থিতি ১৯৭৪ সালের ঐতিহাসিক রেল ধর্মঘটের সময়ের চেয়েও অগ্নিগর্ভ। রেল শ্রমিকের অস্তিত্ব আজ ভয়ঙ্করভাবে বিপন্ন। এক সর্বাত্মক হামলা নামিয়ে এনেছে মোদী সরকার। স্বয়ংসম্পূর্ণরেল ব্যবস্থাকে পুরোপুরি ভেঙে তছনছ করে বড় পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দিচ্ছে। রেল বাজেট তুলে দিয়েছে, রেল বোর্ড ভেঙে সেখানে টাটা-আম্বানিদের জায়গা করে দিয়েছে। রেলের বিরাট বিরাট কারখানাগুলো, এমনকি স্টেশন আর ট্রেনও বেসরকারী হাতে তুলে দিচ্ছে। এবারে এক ধাক্কায় ১৫১টি ট্রেন বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। হামলা নেমে আসছে আরো নানাভাবে -- প্রিন্টিং প্রেস বন্ধ, ই-অফিস, মেয়াদের আগেই রিটায়ারমেন্ট, নাইট ডিউটি ভাতা বন্ধ ইত্যাদি বিভিন্ন রূপে। রেল শ্রমিকরা প্রতিনিয়ত এই হামলার আঁচ অনুভব করছেন এবং তাদের ভবিষ্যত প্রতিদিনই আরো বেশি অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। এত বড় হামলা এর আগে কখনো হয়নি
কিন্তু শুধু রেল শ্রমিকদেরই নয়, রেল বেসরকারীকরণের আঁচ এসে লাগবে সাধারণ মানুষের ওপরেও। ইতিমধ্যেই ‘তেজস’ নামে যে বেসরকারি ট্রেন চালু হয়েছে সেখানে শুধু যে ভাড়া বেশি তাই নয়, ভাড়ায় সব ধরনের ছাড়ও বন্ধ। অতীতে স্থানীয় মানুষের সুবিধার্থে এমনকি তাদের অনুরোধেও ট্রেনের স্টপ দেওয়া হতো, নতুন স্টেশনও স্থাপন করা হোত। কিন্তু এখন ট্রেন চালনাকারী বেসরকারী সংস্থার ইচ্ছাতে ট্রেনের স্টপ নির্ধারিত হবে। ট্রেন স্টেশন এলাকায় বা চলন্ত ট্রেনে যে সমস্ত হকার জীবিকা নির্বাহ করেন তাদের জীবিকার ওপর ভয়ঙ্কর আঘাত নামিয়ে আনবে রেলের বেসরকারীকরণ। মূলত শ্রমনিবিড় রেল শিল্প যুব সমাজের কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় সংগঠিত ক্ষেত্র ছিল, বেসরকারীকরণ সেখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ ব্যাপক ভাবে সংকুচিত করে দেবে।
রেল শ্রমিকরা তাদের ওপর নামিয়ে আনা এই আক্রমণ এবং জনগণের সম্পত্তি রেল শিল্পকে বেসরকারিকরণের এই প্রচেষ্টার সামনে নতিস্বীকার করতে রাজি নন। রেল শিল্পের একমাত্র বামপন্থী ফেডারেশন, এআইসিসিটিইউ অনুমোদিত ইন্ডিয়ান রেলওয়ে এম্প্লয়িজ ফেডারেশন (আইআরইএফ)-র উদ্যোগে রেল শিল্পের বেসরকারীকরণের বিরুদ্ধে রেল শ্রমিক ও জনগণের সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলার লক্ষ্যে ন্যাশনাল মুভমেন্ট টু সেভ রেলওয়ে (এনএমএসআর, রেল বাঁচাও রাষ্ট্রীয় আন্দোলন) নামক ঐক্যমঞ্চ গড়ে উঠেছে। বেসরকারী হাঙরদের হাত থেকে রেল শিল্পকে রক্ষা করতে এই মঞ্চকে আগামীদিনে আরো বিস্তৃত করার লক্ষ্যে প্রচেষ্টা চলছে।
এই পরিস্থিতিতে আগামী ২৬ নভেম্বরের ধর্মঘট রেল শিল্প তথা শ্রমিকের কাছে এক বিশেষ তাৎপর্য নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। ধর্মঘট ঘোষণা হওয়ার সাথে সাথে আইআরইএফ অন্তর্ভুক্ত জোনাল ইউনিয়নগুলি কখনো একক উদ্যোগে কখনো যৌথভাবে ধর্মঘটের সমর্থনে প্রচার শুরু করে দেয়। দক্ষিণ-পূর্বরেলওয়ে মজদুর ইউনিয়নের উদ্যোগে ৭ অক্টোবর সাঁতরাগাছিতে এআইসিসিটিইউ পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ সম্পাদক বাসুদেব বোসের উপস্থিতিতে এক বিরাট বিক্ষোভ সমাবেশের মধ্য দিয়ে ধর্মঘটের প্রচারের সূচনা হয়। এরপর আদ্রায় একাধিক বিক্ষোভ সমাবেশ এবং গত ৬ নভেম্বর গার্ডেনরীচে বিক্ষোভ সমাবেশ সংগঠিত করা হয়। সিএলডব্লু রেলওয়ে এম্প্লয়িজ ইউনিয়নের পক্ষ থেকেও একের পর এক প্রচার কর্মসূচী নেওয়া হয়। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য ৮ নভেম্বর আমলাদহি বাজারে বাসুদেব বোসের উপস্থিতিতে প্রচার সভা হয়। পশ্চিমবঙ্গে আইআরইএফ অনুমোদিত অপর ইউনিয়ন, ইস্টার্নরেলওয়ে এম্প্লয়িজ ইউনিয়নের উদ্যোগেও ধর্মঘটের সমর্থনে প্রচার কর্মসূচী শুরু হয়ে গেছে। ১৭ নভেম্বর কাঁচরাপাড়া কারখানা গেটে প্রচার কর্মসূচী অনুষ্ঠিত হয় এবং আগামী সপ্তাহে হাওড়া, ব্যান্ডেল সহ বিভিন্ন জায়গায় প্রচার কর্মসূচীর পরিকল্পনাও তারা নিয়েছে। ১১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত আইআরইএফ-এর কোর কমিটির মিটিং থেকে ২৬-এর ধর্মঘটের সমর্থনে ২৩ থেকে ২৬ নভেম্বর প্রতিটি জোনে লিফলেট বিলি, কালো ব্যাজ ধারণ, গেট মিটিং ইত্যাদি কার্যক্রম করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেই অনুযায়ী পূর্ব, দক্ষিণপূর্বরেলে ও চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভ ওয়ার্কসে ধর্মঘটের সমর্থনে রেলশ্রমিকদের সংগঠিত করতে জোরদার কর্মসূচী নিতে আইআরইএফ অনুমোদিত ইউনিয়নগুলি সংকল্পবদ্ধ।
২৬ নভেম্বর সাধারণ ধর্মঘট। চটকলে এআইসিসিটিইউ অন্তর্ভুক্ত ‘বেঙ্গল চটকল মজদুর ফোরাম’ সহ অন্যান্য ২১টি ট্রেড ইউনিয়ন ৭ অক্টোবরের মিটিং থেকে ধর্মঘটে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২৬ নভেম্বরের সাধারণ ধর্মঘটে কেন্দ্রীয় ৭ দফা দাবির সাথে চটকল শ্রমিকদের নিজেদের ১০ দফা দাবি যুক্ত করা হয়েছে। ইতিমধ্যেই চটকলের সব ইউনিয়ন একসাথে মিলে ধর্মঘটের বিজ্ঞপ্তি কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্যসরকার, আইজেএমএ, জুট কমিশনার এবং প্রতিটি মিল কর্তৃপক্ষকে দিয়েছে।
ধর্মঘটের নোটিশে কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রমিক বিরোধী শ্রমবিধি প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে শ্রম আইন সংশোধন করে শ্রমিকদের সর্বনাশ করা হচ্ছে। মধ্যশযুগীয় বর্বর শোষণ ব্যেবস্থা কায়েম করার চেষ্টা চলছে। এছাড়াও বকেয়া লকডাউন মজুরি বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। চটকল মালিকদের শ্রমিক বিরোধী ভূমিকায় তীব্র ক্ষোভ শ্রমিকদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। চটকল অধ্যুষিত হাওড়া, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হুগলি এবং উত্তর ২৪ পরগনায় যৌথ ভাবে মিটিং মিছিল গেট সভা প্রচার কর্মসূচী শুরু হয়েছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে শ্রমিক মহল্লায় মশাল মিছিল ও প্রধানমন্ত্রীর কুশপুতুল দাহ করার কর্মসূচী। দেওয়ান লিখন, পোস্টিরিং-এর কাজ প্রায় শেষের মুখে। মিলে মিলে স্ট্রাইক কমিটি গঠনের চেষ্টা চলছে। ধর্মঘটের দিন ভোর থেকেই গেটে পিকেটিং করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ধর্মঘটের দিন যত এগিয়ে আসছে শ্রমিকদের একতা ও মেজাজ ততো বাড়ছে। শ্রমিকদের দাবিতে চিন্তিত রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটক তড়িঘড়ি ইউনিয়নগুলোর সাথে ২৩ নভেম্বর দ্বিপক্ষীয় মিটিং ডাকতে বাধ্য হয়েছেন।
এদিকে আবার মিল কর্তৃপক্ষ এবং জুট বিক্রেতাদের মধ্যে নতুন সংঘাত দেখা দিয়েছে। কাঁচা পাটের দর আকাশ ছোঁয়া! আইজেএমএ চেয়ারম্যান রাঘবেন্দ্র গুপ্তা রাজ্যের অর্থ ও বানিজ্য মন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন জুনজুলাই মাসে কাঁচা পাট ওঠার পর থেকেই দাম বাড়তে থাকে। জুন মাসে কুইন্টাল প্রতি কাঁচা পাটের দাম ছিল ৪,৬০০টাকা, যা নভেম্বরে এসে দাঁড়িয়েছে ৬,১০০ টাকায়। অভিযোগ পাট ব্যবসায়ীদের একটা বড় অংশ (এই পাট ব্যবসায়ীরা বেশিরভাগই চটকল মালিক) পাটের বেআইনি মজুত করাতেই কাঁচা পাটের দাম বাড়ছে। আইজেএমের অভিযোগ পাওয়ার পর ‘জুট কমিশনার অব ইন্ডিয়া’ পাটের যোগান বাড়াতে মজুতের পরিমাণ ১,৫০০ কুইন্টাল থেকে কমিয়ে ৫০০ কুইন্টাল করার নির্দেশ জারি করেছে এবং ১৭ নভেম্বর থেকে তা কর্যকর হবে। পাটের মজুতদারি কমাবার নির্দেশের ক্ষুব্ধ কাঁচা পাট ব্যবসায়ী সংগঠন ‘দ্য জুট বেলার্স অ্যাসোসিয়েশন’ ২৩ নভেম্বর থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ব্যবসা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চটকল মালিকরা জানাচ্ছে কেন্দ্রের বরাত পাওয়া চটের বস্তার তাদের চার লক্ষ বেল সরবারহ বাকি রয়েছে, এরকম চলতে থাকলে নির্দিষ্ট সময়কালে ৫০ শতাংশ বস্তাও সরবারহ করা যাবেনা। রাজ্য সরকার ২৪ নভেম্বর সমস্যা সমাধানে ‘দ্য জুট বেলার্স অ্যাসোসিয়েশন’ এবং আইজেএমএ-কেও এই মিটিং-এ ডেকেছে। দেখা যাক এই মজুতদারি, পাটের দর এবং বস্তা সরবারহ কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়? তবে এই দ্বন্দ্বে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শ্রমিকরা। কারণ কাঁচা পাটের কৃত্রিম অভাব ও মূল্যবৃদ্ধিতে উৎপাদন কম হচ্ছে এবং উদ্বৃত্ত শ্রমিক সংখ্যা বাড়ছে। এরকম সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতিতে চটকল শ্রমিকরা ধর্মঘটের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমাদের আশা যতই প্ররোচনা আসুক শ্রমিকরা তার মোকাবিলা করেই ১০০ শতাংশ ধর্মঘট সফল করবেন।
- নবেন্দু দাশগুপ্ত, বিসিএমএফ
আমরা আজ সারা দেশজুড়ে এক ভয়ঙ্কর সংকটের মুখে এসে পড়েছি। একদিকে মহামারির প্রকোপ, অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। শ্রমিকরা কাজ হারিয়েছে। কম মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হয়েছে বহু মানুষ, বিশেষ করে মেয়েরা। আজ ভারতবর্ষে ২৫.৩% মহিলা কাজ পায়।
মার্চ মাসে এক অপরিকল্পিত লকডাউন বহু কোটি শ্রমিককে এক অসহায় অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল বোম্বাই, দিল্লী, বেঙ্গালুরুর মত শহরে। কাজ বন্ধ থাকার জন্য তাঁদের না ছিল হাতে কোন পয়সা, না ছিল খাদ্য, না ছিল বাসস্থান। কিন্তু ভাষণ দেওয়া ছাড়া আর কিছুই সুরাহা করে নি এই মোদী সরকার। তাই বাধ্য হয়েই প্রতিকুলতার মধ্যেই শ্রমিকরা তাদের পরিবার নিয়ে পথ হাঁটতে শুরু করে নিজেদের গ্রামে ফিরে যাবার জন্য। আর মহিলারা অসহায় নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে নিজের শিশুকে কোলে নিয়ে পথ চলতে বাধ্য হয়েছে। এই রকম অনেক দৃশ্য সোশ্যাল মিডিয়া, টিভি, খাবরের কাগজে আমরা সকলেই দেখতে পেয়েছি। সেই সময় মোদী সরকারের অমানবিক চেহারাও দেখেছে দেশের মানুষ।
লকডাউনকে কাজে লাগিয়ে ইতিমধ্যেই মোদি সরকার শ্রম আইনকে বাঞ্চাল করে দিয়েছে। শ্রমিকদের আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে অর্জিত ৪৪টি শ্রম আইনকে খর্ব করে চারটে শ্রম কোডের ছাতার তলায় আনা হল। মহিলা শ্রমিকরা তাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হলেন। ২০১২ সালের নির্ভয়া আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে মহিলাদের উপর যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ অভিযোগ জানানোর জন্য কমিটি গঠন করা বাধ্যতামূলক ছিল কিন্তু এই শ্রম কোডে তা নেই। এতদিন মহিলারা নাইটশিফটে কাজ করতেন না। সকাল সাতটার আগে আর সন্ধ্যা সাতটার পরও এবার মহিলাদের কাজে লাগাতে পারবে মালিকপক্ষ। আগে কোন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে মহিলাদের নিয়োগ করাটা ছিল আইন বিরুদ্ধ। কিন্তু নতুন শ্রম কোড এই সমস্ত কিছু বদলে দিল। এখন থেকে খনি সহ যে কোনো বিপজ্জনক কাজে/পেশায় মহিলাদের নিয়োগ করা যাবে। এর ফলে অত্যন্ত শ্রম সাধ্য, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে কম মজুরিতে মহিলাদের নিয়োগ করার অবাধ ছাড়পত্র পেয়ে গেল মালিকপক্ষ। শ্রম কোডে অত্যন্ত ভাসাভাসা কথায় বলা হয়েছে যে মহিলাদের নিয়োগের প্রশ্নে নিয়োগকর্তাকে কিছু রক্ষাকবচ রাখতে হবে, অর্থাৎ, এ ব্যাপারে মালিক পক্ষের মর্জির উপরই গোটা ব্যাপারটা ছেড়ে দেওয়া হোল। নিয়োগকর্তাকে কোন আইনি বাধ্যতায় নিয়ন্ত্রিত রাখল না সরকার। মাতৃত্বকালীন ছুটির উপর নেবে এসেছে নানাধরনের শর্ত। ফলে সন্তান সম্ভবা মহিলাদের কর্মচ্যুত করাটা অনেক সহজ হয়ে যাবে। যে শ্রম কমিশনের সুপারিশে ৪৪টি কেন্দ্রীয় শ্রম কানুনকে চারটে কানুনে মিশিয়ে দেওয়া হল সেই কমিশনের আরও সুপারিশ ছিল — আশা, অঙ্গনওয়াড়ি, মিড ডে মিল কর্মীদের যেন কেন্দ্রীয় সরকার ‘শ্রমিক/কর্মচারি’ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়, তাঁরা যেন পায় পি এফ, ইএসআই-এর মতো সামাজিক সুরক্ষা, আর তারা যেন পায় ন্যূনতম মজুরি। কিন্তু এইসব সুপারিশকে আমলই দিল না মোদি সরকার। মূলত ৭০% মহিলারাই দেশব্যাপী এইসব পেশার সঙ্গে যুক্ত। চরম ঝুঁকি নিয়ে কোভিড যুদ্ধে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে লড়াই করলেও মোদী সরকার তাদের বঞ্চিতই রাখল।
বিরোধীদের কথা বলতে না দিয়ে সংসদে জোর করে পাশ করা হল কৃষি বিল। প্রায় ৮০% কৃষিক্ষেত্রে মহিলা শ্রমিক কাজ করে। তবে মহিলাদের জমির মালিকানা ২%- এরও কম। এমনকি নারী কর্ষকদের মজুরি পুরুষদের তুলনায় কম। আজ ও ক্ষেতে কাজ করা মহিলারা চাষির মর্যাদা পান না। ফলে নানা রকম সরকারি সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকেন। বীজ, সার, আর সেচের ব্যবস্থা করতে কৃষক পরিবারের মহিলাদের ঋণ নিতে হয়, মাইক্রো ফিনান্স বা অন্যান্য ঋণজালে তারা জড়িয়ে পরে। এবং পরিশোধ না করতে পারলে নানা রকম অত্যাচারের সম্মুখীন হয়। বর্তমানে পশ্চিমবাংলায় লকডাউন ও তার পর আম্ফানের ফলে বিক্রি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে স্বনির্ভরগোষ্ঠি সহ সমস্ত খেটে খাওয়া মহিলারা। তাই ঋণ মুক্তির দাবিতে সরব হয়েছেন তারা। আদানি আম্বানিদের কোটি কোটি টাকা ছাড় দিলেও মোদী আমিত শাহ সরকার এই গরিব মহিলাদের এক পয়সাও ছাড় দিতে নারাজ। তারই মাঝে বর্তমানে এই নয়া কৃষি আইন কৃষিপণ্যের সরকারী সংগ্রহ বা ফসল কেনার ব্যবস্থা পুরোপুরি বন্ধ করে দিল। নয়া কেন্দ্রীয় কৃষি আইন আসলে কর্পোরেট পুঁজিপতিদের হাতেই কৃষিকে তুলে দিচ্ছে। এই আইনের মধ্যে দিয়ে চুক্তিচাষের কথা বলে জমি হাতাতে পাড়বে পুঁজিপতিরা, চাষিকে গোলাম বানাতে পারবে, জলের দরে কিনে কৃষিপণ্য মজুত করে আইন সংগতভাবে চড়া দামে কালোবাজারি চালাতে পাড়বে, এ ছাড়াও জমির লুটেরা বা কালোবাজারিরা সমস্ত রকম ট্যাক্স, লেভি বা সেস ছাড়ের সুবিধা পাবে। যেমন ভাবে রেল, কয়লা টেলিকমকে বেসরকারীকরণ করা হচ্ছে একইভাবে এখন কৃষিক্ষেত্রকে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়াও নতুন যে শিক্ষা নীতি এই সরকার এনেছে তার মধ্যে দিয়ে সরকারের শিক্ষা ক্ষেত্রে যাও বা দায়িত্ব ছিল তাও ঝাড়ে ফেলে দিয়ে চূড়ান্ত বেসরকারীকরণ করে দিচ্ছে শিক্ষাকে। দেখা যাবে যেটুকুনও মেয়েরা পড়ার সুযোগ পাচ্ছিলো তাও আর পাবে না।
এইসব প্রশ্ন নিয়েই আমরা আগামী ২৬ নভেম্বার ধর্মঘট করব। বিভিন্ন কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন, বহু কৃষক সংগঠন, গ্রামীণ মজুরদের সংগঠন, ছাত্র-যুব-মহিলা সংগঠন একত্রিত হয়ে এই সাধারণ ধর্মঘটকে ভারত বন্ধের চেহারা দেবে। শোষণ অত্যাচারের চাকাকে একদিনের জন্য হলেও স্তব্ধ করে দিতে আপনিও সামিল হোন এই সাধারন ধর্মঘটে।
কেন্দ্রীয় সরকারের নয়া কৃষি আইনে রাষ্ট্রপতি সন্মতি দিয়েছেন। অথচ রাজ্যসভায় এই আইন নিয়ে বিধিসন্মত কোনো আলোচনাই হলো না! সংখ্যা বা বলা ভালো গায়ের জোরে তড়িঘড়ি তিনটি বিল পাশ করিয়ে নেওয়া হলো। এখন কর্পোরেট কোম্পানিরা নাকি সরাসরি কৃষকের থেকে ফসল কেনা শুরু করে দিয়েছে, এবং তারা সরকারী সহায়ক মূল্যের থেকে বেশি দামে ফসল কিনছে! মোদী সরকারের গোয়েবলসীয় প্রচারযন্ত্র এ জাতীয় মিথ্যা প্রচার ছড়িয়ে দিচ্ছে। বলা হচ্ছে নতুন ব্যবস্থায় চাষিরা নাকি “ফড়েরাজ” থেকে মুক্তি লাভ করবে, তারা “স্বাধীন” হয়ে উঠবে,ইত্যাদি ইত্যাদি! কিন্তু এই সময়কালে উঃপ্রদেশসহ বিভিন্ন রাজ্য থেকে খবর পাওয়া যাচ্ছে যে দালালরা চাষির থেকে কম দামে ধান কিনে রাইস মিলে নিয়ে যাচ্ছে কুইন্টালে প্রচুর পরিমান কমিশনের বিনিময়ে। এখন মৌলিক যে প্রশ্ন উঠে আসছে তা হলো কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত কৃষিপণ্যের বাজারে চাষির কাছ থেকে কত দামে ফসল কেনা হবে? নয়া কৃষি আইনে তার কোনো গ্যারান্টি আছে কি? আদৌ নেই। বাস্তবে কর্পোরেট বাজারে চাষির অধিকার রক্ষায় কোনো আইন থাকবে না, কোনো তথ্য পাওয়া যাবে না,লেনদেনে চলবে চরম অস্বচ্ছতা! ফসলের দাম নিয়ে কোন বিরোধ বা ক্ষোভ বিক্ষোভ দেখা দিলে সেটা নিরসনের কোনো আইনি সংস্থান থাকবে না। এভাবে কৃষি ও কৃষকদের তুলে দেওয়া হবে সম্পূর্ণ কর্পোরেটদের নিয়ন্ত্রণে।
কৃষি বিপনন ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারী ব্যবস্থায় যে চরমতম অকর্মন্যতা- দুর্নীতি - বঞ্চনার দিকগুলি রয়েছে তাকে কাটিয়ে তোলার কথা বলা হচ্ছে না। অনেকেই সেই চিরপরিচিত গল্পটা তুলে ধরছেন যে, গামলায় শিশুর স্নানের জল খারাপ হয়ে গেলে জলসহ শিশুটিকেও ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হচ্ছে! বলা বাহুল্য শিশুর সাথে তুলনা করা হচ্ছে কৃষকদের! যেমন শিল্পজাত বিভিন্ন পণ্যদ্রব্যের গায়ে লেখা থাকে এমআরপি অর্থাৎ ম্যাক্সিমাম রিটেল প্রাইস। কিন্তু চাষির ফসলে কোনো নির্দিষ্ট দাম লেখা থাকে না। সরকার নির্ধারণ করে এমএসপি বা মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস (ন্যূনতম সহায়ক মূল্য)। এটাকে এক ধরনের বীমা ব্যবস্থা বলা যায়। প্রকৃত উৎপাদকরা যাতে ফসলের ন্যয্য দাম পায় সে জন্য বাজারকে খানিকটা নিয়ন্ত্রণ করার বন্দোবস্ত! এর লক্ষ্য হলো চাহিদা কমে গেলে উৎপাদক চাষিদের লোকসান বা অভাবী বিক্রির হাত থেকে রক্ষা করা। এর সাথে গণবন্টন বা রেশনে খাদ্য সরবরাহ তথা খাদ্য সুরক্ষার প্রশ্ন অঙ্গাঙ্গী ভাবে যুক্ত। একটা থাকলে অন্যটা থাকবে,উঠিয়ে দিলে দুটোই উঠে যাবে। কিন্তু কাগজে কলমে এমএসপি বা ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের কথা লেখা থাকলেও সেই দামে সরকার চাষির থেকে ফসল কেনে না। মাঠে চাষি ফসলের যে দাম পায় বাজারে সেটা বিক্রি হয় চারগুন দামে। কারও “পৌষ মাস আর কারও সর্বনাশ”! এ রাজ্যে সাম্প্রতিক আলু পিঁয়াজের আগুন দামে সে জিনিস আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি যে আগামী দিনটা কোথায় চলেছে! কি ভাবে শাসকদল- দালাল মহাজন চক্র কাজ করে চলেছে। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন সংশোধন করে দিয়ে মজুতের উর্ধ্বসীমা তুলে দেওয়ার ফল কি হতে পারে! একটা সরকারী তথ্য দেওয়া হচ্ছে যে মাত্র ৩০ ভাগ চাষি নাকি সরকারী দর পেয়ে থাকে। দেশ জুড়ে প্রতিবাদের চাপে মোদী সরকার এখন বলছে এমএসপি নাকি থাকবে! কিন্তু এটা সম্পূর্ণ মিথ্যাচার। বাস্তবে বিগত দিনে সরকার এটাকে ধাপে ধাপে তুলে দিতেই চেয়েছে। মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পরবর্তী সময়কালে চাষের খরচ বিপুল পরিমানে বেড়ে গেছে কিন্তু এমএসপি বা সহায়ক মূল্য বৃদ্ধির হার ক্রমাগত কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। যথা ২০১৩-১৪ সালে ধান ও গমের ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার ছিলো ১৪ শতাংশ ও ৯ শতাংশ। ২০১৫- ১৬ সালে ছিলো ৫ ও ৫.৫ শতাংশ,২০২০-২১ সালে ২.০৯ ও ২.৬ শতাংশ! এছাড়া এমএসপি নির্ধারণে কারচুপি করা হচ্ছে। উৎপাদন খরচের দেড়গুন দাম সঠিক ভাবে হিসাব না করে প্রতি কুইন্টালে ৪০০-৫০০ টাকা কম করে ধরা হয়েছে। যেমন ধানের সহায়ক মূল্য হওয়া উচিত ২৩৫০ টাকা অথচ রয়েছে ১৮৬৫ টাকা কুইঃ।
দেশের বিভিন্ন রাজ্যে নিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থায় (এপিএমসি) সরকারঘোষিত সহায়ক মূল্যে চাষির ফসল কেনার একটা ব্যবস্থা রয়েছে। নয়া কৃষি আইনে সেটা কার্যত তুলে দেওয়া হবে। অর্থাৎ মান্ডি থেকে কোম্পানীরা আর ফসল কিনবে না। কেননা তারা সরকারকে ট্যাক্স বা সেস দেবে কেন? মান্ডির বাইরে থেকে কিনবে। এতে রাজ্য সরকারের আয় কমে যাবে। শুধু তাই নয় কৃষিক্ষেত্রে রাজ্যের কোন অধিকারই আর থাকবে না। বলা হচ্ছে “ফড়ে রাজ” নাকি বিলুপ্ত হবে। কিন্তু বড় সংখ্যক চাষিদের সাথে কর্পোরেট পুঁজিপতিদের সরাসরি লেনদেন অনেক বেশি ব্যয়বহুল। তাই কোম্পানিরা মধ্যস্বত্বভোগীদের উপর নির্ভর করতে বাধ্য। এ কারণেই সৃস্টি হবে নতুন রূপের কর্পোরেট ফড়েরাজ! পাঞ্জাব, হরিয়ানা রাজস্থানে ঐ মান্ডি ব্যবস্থা ছিলো। সংখ্যাগরিষ্ঠ চাষিরা সেখানে ফসলের সরকারী দর পেতো। স্বভাবতই সেটাকে তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে চাষিদের তুমুল আন্দোলন। আগামী ২৬ নভেম্বর হাজার হাজার ট্রাক্টরে করে তারা রাজধানী অভিমুখে প্রতিবাদী অভিযান করবে। এখন বলা হচ্ছে পঃ বাংলায় তেমন বড় মাপের কোনো আন্দোলন দেখা যাছে না। বাংলা সহ ভারতের অন্যান্য রাজ্যে সরকারী নিয়ন্ত্রিত বাজারে ফসল বিক্রি করার কোনো বাধ্যতা বা ব্যবস্থা নেই। এ রাজ্যে ইতিমধ্যেই আইন সংশোধন করে চুক্তিচাষ বৈধ করে দেওয়া হয়েছে,কৃষি পণ্যের ব্যাবসায় পুঁজিপতিদের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তাই এ রাজ্যে নয়া কৃষি আইনের নাকি কোনো প্রাসঙ্গিকতাই নেই। কিন্তু সারা দেশে ক্ষুদ্র কৃষির বিকাশের রাস্তাটা সরকার ক্রমশ বন্ধ করে দিচ্ছে। তাই কৃষি সংকটের সাধারণ চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে চাষিদের অভাবী বিক্রি! অপরদিকে চাষের খরচের বিপুল ব্যয় বৃদ্ধি,সরকারী সহায়ক মূল্য নির্ধারণে সরকারের কারচুপি, ফসল ক্রয়ে সরকারের তঞ্চকতা! তাই কৃষি উপকরণ যথা সার, বীজ, জল, বিদ্যুৎ-এর সুলভে সরবরাহ করা, দালাল বাদ দিয়ে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ফসল কেনার দাবিতে সারা দেশেই চলছে কৃষক আন্দোলন।
এই আন্দোলনের অন্যতম দাবি হয়ে উঠেছে সমস্ত রকম ফসলের এমএসপি গ্যারান্টি আইন করতে হবে। পঃ বাংলায় যা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। কেবল পঃ বাংলা নয়, বিহার, কেরল সহ বিভিন রাজ্যে দীর্ঘদিন ধরে এপিএমসি তুলে দেওয়া হয়েছে। সরকার নিয়ন্ত্রিত শস্যক্রয় ব্যবস্থা যদি কৃষি ক্ষেত্রে বেসরকারী পুঁজি বিনিয়োগের পথে বাধা হয়ে থাকে তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে ঐ সমস্ত রাজ্যের কৃষি বিপননে বেসরকারী পুঁজি ঝাঁপিয়ে পড়লো না কেন? আসলে বাজারের কাঠামোর উপর ফসলের দাম নির্ভর করে না। সরকারের হস্তক্ষেপ অর্থাৎ ভর্তুকি বা সরকারী সংগ্রহ যদি না থাকে কৃষকের চরম অভাবী বিক্রি ও দারিদ্র্য বাড়বে। ঋণগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যার মিছিল বাড়বে। দেশে প্রতি ৩০ মিনিটে একজন চাষি আত্মহত্যা করছে। এই হার কমার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। পঃ বাংলাতেও প্রতিবছর আলু চাষির আত্মহত্যার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এ বছর সরকারের কোন হস্তক্ষেপ না থাকায় আলু বীজের দাম বিপুল। চাষিরা বড় আশা করে,ঋণ নিয়ে আলুচাষে খরচ করছেন। কিন্তু খবর পাওয়া যাচ্ছে হিমঘরে আলুর বন্ডের ৮০ ভাগই নাকি বড় ব্যবসায়ীরা কিনে নিয়েছে। তাহলে চাষিরা আলুর ন্যায্য দাম পাবে কি? এ নিয়ে রয়েছে চরম অনিশ্চয়তা! পঃ বাংলায় এমএসপির যদি কোনো প্রাসঙ্গিকতাই না থাকে তাহলে সরকার কেন ঢাক ঢোল পিটিয়ে সরকারী দরে ধান কেনার কৃতিত্ব জাহির করে? তথ্যে জল মেশানো হয় সেটা আলাদা বিষয়, কিন্তু চাষি দরদী মুখোষ পড়ে সরকার কতটা সক্রিয় তার প্রমান দিতে ফসল কেনার বড় বড় হিসাব দেওয়া হয় কেন? তাই সারা দেশেই নয়া কৃষি আইনের যে ভয়ংকর প্রভাব রয়েছে বাংলা তার কোনো ব্যাতিক্রম নয়। এখানে ব্লকে ধান কেনার কৃষক মান্ডিগুলিতে বড় ব্যবসায়ী মহাজনেরা নানারকম কারসাজি করে নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখছে। তাই গ্রামে ক্যাম্প করে কিংবা গ্রামীণ সমবায়ের মাধ্যমে ধান না কিনলে চাষিরা সরকারী দর ১৮৬৫ টাকার বদলে ১১০০-১২০০ টাকা দাম পাচ্ছে। সেই ধান কিনে মধ্যস্বত্বভোগীরা সরকারী দর হাতিয়ে মুনাফা করে নিয়ে চলেছে।
বলা হচ্ছে চুক্তিচাষে নাকি চাষির লাভ হবে। কিন্তু চুক্তি চাষের নতুন আইনে মারাত্মক যে দিকটা রয়েছে তা হলো কোম্পানির সাথে চাষির কোন বিরোধ দেখা দিলে চাষিরা আদালতে যেতে পারবে না। প্রশাসনই নাকি সেই বিচার করবে। স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন ওঠে এটা করা হলো কেন? কাদের স্বার্থে? আসলে এই ভাবে কৃষকের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে তাঁকে কোম্পানির গোলামে পরিণত করা হবে। এ রাজ্যে বা অন্যত্র পেপসি কোম্পানির আলুর চুক্তি চাষে চাষির তথাকথিত “লাভ” এর কথা তুলে ধরা হচ্ছে। কিন্তু বাজারে চরম মন্দা, মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ছে না, শিল্পে গতি নেই। তাই এ রাজ্যে চুক্তি চাষে চাষির সুদিন আনার গল্প বেশি দুর এগোতে পারেনি। কার্যত এটা ক্ষুদ্র প্রান্তিক চাষির জমি ঘুরপথে হাতিয়ে নেওয়ার চক্রান্ত! তাই কেন্দ্রীয় সরকারের নয়া কৃষি আইনের বিরুদ্ধে এবং রাজ্য সরকারের কৃষক বিরোধী ভুমিকার বিরুদ্ধে আগামী ২৬ নভেম্বর সংগঠিত হবে গ্রামীণ ধর্মঘট।
-- জয়তু দেশমুখ
কেন্দ্রের সরকারের শ্রম আইন সংশোধন ও নয়া কৃষিআইন প্রণয়নের বিরোধীতা করে ও ২৬ নভেম্বর কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির ডাকা দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটকে সমর্থন জানিয়ে মিছিল করলো সিপিআই (এমএল) লিবারেশন। কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রম আইনের সংশোধন ও কৃষি আইন প্রণয়নের বিরোধীতা করে কৃষ্ণনগরে মিছিল করলো সিপিআই (এমএল) লিবারেশন। কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রমআইন সংশোধন ও নয়া কৃষিআইন প্রনয়নের বিরোধিতা করে মিছিল শহরের বাসষ্ট্যান্ড থেকে শুরু করে সদর হাসপাতাল মোড় পর্যন্ত যায়। শতাধিক কর্মীর অংশগ্রহণে মিছিলের থেকে আওয়াজ ওঠে মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধেও । অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন সংশোধন করে খাদ্যদ্রব্যর মজুতদারীকে কেন্দ্রীয় সরকার বৈধ করে দিয়েছে। রাজ্য সরকার দাম বেঁধে দেওয়ার কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। এর ফলেই বাজারে আলু পেঁয়াজ সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যর দাম আকাশছোঁয়া হয়ে উঠেছে বলে সিপিআই (এমএল) নেতৃত্বের দাবি। মিছিলের শেষে সদর মোড়ে এক প্রচার সভা বক্তব্য রাখেন সিপিআই (এমএল) লিবারেশনের নদীয়া জেলা সম্পাদক সুবিমল সেনগুপ্ত,দলের রাজ্য নেতা ও কৃষক সংগঠন কিষাণ মহাসভার জয়তু দেশমুখ, শ্রমিক সংগঠন এআইসিসিটিইউ নেতা জীবন কবিরাজ, অমল তরফদার প্রমুখ। মিছিল ও সভা থেকেই ‘আগামী ২৬ নভেম্বর কেন্দ্রীয় ট্রেডইউনিয়নগুলির ডাকা দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট সফল করে তোলার আহ্বান জানানো হয়।
ধর্মঘটের দাবিগুলি হল—
এখন ধান কাটার ও আলু বসানোর মরশুম চলছে গ্রাম বাংলায়। অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে পোলবা-দাদপুরের সাটিথান গ্রাম পঞ্চায়েতের সাটিথান গ্রামের কৃষি মজুররা সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতি (আয়ারলা)-র জেলা নেতা তরুণ বাঊলদাসের নেতৃত্বে গতকাল থেকে মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে ধর্মঘটের ডাক দেয়। একদিন ধর্মঘটের পর বড় চাষিরা না মানলে ‘আয়ারলা’র নেতৃত্বে কৃষি মজুররা ১৬ নভেম্বর দলবদ্ধভাবে মাইক প্রচার করে দেন যে ধান কাটা মেশিন লাগালে সংঘর্ষ হবে, মেশিন তুলে দেওয়া হবে। কারণ এক বিঘা জমিতে শুধুমাত্র আলুবীজের দাম এবছর বেড়েছে কমপক্ষে ৩০০ গুণ (১৬০০ টাকা ৫০ কেজির বস্তা থেকে এবছর ৪৯০০ টাকা চন্দ্রমুখী আলুবীজের বস্তা)। চাষিরা বীজের এই মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদ করেনি। করলে কৃষি মজুররা চাষিদের সাথে থাকতে রাজি। কিন্তু নিত্যপ্রয়োজনীয় তেল, আলু, পেঁয়াজ, ডাল ইত্যাদির তীব্র মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে কৃষিমজুরদের মজুরিবৃদ্ধি ছাড়া বাঁচা অসম্ভব হয়ে উঠছে। এই পরিস্থিতিতে গ্রামের বড় চাষিরা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি বিবেচনা করে মজুরি বৃদ্ধির দাবি মেনে নেন। মজুরি ১০০ টাকা ও ২ কেজি চাল থেকে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১২০ টাকা ও ২কেজি চাল। কোদালের কাজে ১৫০ টাকা ২কেজি চাল, ধান তোলা ১৮০ টাকা ২ কেজি চাল।
এই বছর ২৫/৬/২০২০ রাজ্য শ্রম দপ্তরের সার্কুলার অনুসারে কৃষিতে ন্যূনতম মজুরি ২৫৭ টাকা। সেই অনুযায়ী এই মজুরি এখনো যথেষ্ট কম (১২০+২ কেজি চাল = ১২০+৬০= ১৮০ টাকা, এটা সারা বছর সর্বনিম্ন মজুরি এবং ভারী কাজে ও সর্বোচ্চ মজুরির দাঁড়িয়েছে ১৮০+৬০= ২৪০ টাকা)।
সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছে, অবিলম্বে ন্যূনতম মজুরি কার্যকর করতে হবে।
-- সজল অধিকারী
২৬ নভেম্বর সারা দেশে ডাকা সাধারণ ধর্মঘটের সমর্থনে ১১ নভেম্বর বাম গনসংগঠন সমূহের এক গনকনভেনশন অনুষ্ঠিত হয় বর্ধমান জেলার সদর ২ ব্লকের পালসিটে। এতে ৫০০ মতো মতো মানুষ উপস্থিত ছিলেন। সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতির পক্ষ থেকে এই মঞে উপস্থিত ছিলেন শ্রীকান্ত রাণা ও তরুণ মাঝি। বক্তব্য রাখেন শ্রীকান্ত রাণা। ১২ নভেম্বর সদর ১ ব্লকের ভিটায় গনকনভেনশন অনুষ্ঠিত হয় এতে উপস্থিত ছিলেন শ্রীকান্ত রাণা ও তরুণ মাঝি। বক্তব্য রাখেন শ্রীকান্ত রাণা।
বিজেপি-নীতীশ জোট পুনরায় ক্ষমতায় আসতে না আসতেই বিহারে পুড়িয়ে মারা হল এক মুসলিম যুবতীকে। ২০ বছরের কিশোরী গুলনাজ তাঁর মা, বোন এবং তিন ভাইয়ের সাথে বিহারের বৈশালী জেলার দেশরী থানা এলাকার রসুলপুর হাবিব গ্রামে থাকতো। গুলনাজের বাবা না থাকায় মা একাই দর্জির কাজ করে সংসার চালাতেন। গুলনাজ ছিল চার ভাইবোনের সব চেয়ে বড়। দু’মাস পরেই বিয়ে হওয়ার কথা ছিল গুলনাজের। কয়েক সপ্তাহ ধরেই প্রতিবেশি সতীশ ও তার ভাই চন্দন কুমার তাকে রাস্তায় নানাভাবে যৌন হেনস্থা করতো। গুলনাজ তাঁর প্রতিবাদ করায় হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। ৩০ অক্টোবর সন্ধ্যে বেলায় গুলনাজ ময়লা ফেলতে বাইরে গেলে তাঁর গায়ে কেরাসিন তেল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেয় সতীশ কুমার এবং তাঁর বাবা ভিনয় এবং ভাই চন্দন কুমার। শরীরের ৭০ শতাংশ পোড়া অবস্থায় হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়াই করতে করতে গত ১৫ই নভেম্বর চিরতরে বিদায় নেয় ২০ বছরের গুলনাজ। কিন্তু সেই কষ্টের মধ্যেও তাঁর খুনিদের নাম জানিয়ে যায় পুলিশকে। পাটনা হাসপাতাল থেকে গুলনাজকে মৃতঘোষণার কিছুক্ষণ পরই তাঁর পরিবারের সদস্যরা পাটনার রাস্তায় লাশ নিয়ে বেরিয়ে এসে প্রতিবাদ শুরু করেন এবং অভিযুক্তদের কঠোর শাস্তির দাবিতে সরব হন।
সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির (আইপোয়া) সাধারণ সম্পাদিকা মীনা তেওয়ারির নেতৃত্বে একটি টিম গুলনাজের গ্রামে গিয়ে পরিবারের সদস্যদের সাথে দেখা করে ও আশেপাশের মানুষের সংগে কথা বলেন। এই টীমে সিপিআই(এমএল)-এর নেতা কমরেড বিশেশ্বর যাদব এবং জেলা সচিব যোগেন্দ্র রায় ও অন্যান্যরাও সামিল ছিলেন। গুলনাজের মা শাইমুনা জানান ২০১৭ সালে তাঁর স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি নিজের পরিশ্রম দিয়ে ছেলেমেয়েদের বড় করছিল, তার না ছিল পেনশন না ছিল কোনো যোজনা। শৈমুনা জানান “আমার শুধু বিচার চাই, আর কিছু না”।
এই সমগ্র ঘটনায় নিতীশ কুমারের পুলিশের সাথে অপরাধীদের গভীর আঁতাত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাঁর জন্যেই গুলনাজ অপরাধীদের নাম বলে দেওয়ার পরেও আজও তাদের গ্রেফতার করেনি পুলিশ। আইপোয়ার পক্ষ থেকে গুলনাজ হত্যার নিন্দা জানিয়ে সরকারের কাছে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে। জাতীয় সাধারণ সম্পাদক মীনা তিওয়ারি বলেছেন যে পুলিশ কর্তৃক অপরাধীদের আশ্রয় দেওয়া চলবে না।
আইপোয়া এবং বিহারের সিপিআইএমএল লিবারেশন দাবি জানায় — চাঁদপুরা থানার ইনচার্জ ও দেশারী থানার প্রধানকে অবিলম্বে বরখাস্ত করতে হবে। সমস্ত অপরাধীকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার এবং দ্রুত বিচারের মাধ্যমে শাস্তি দিতে হবে।
শাইমুনা খাতুনকে সরকারী চাকরী এবং পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
-- মিতালি বিশ্বাস
রামগরুড়ের ছানা
হাসতে তাদের মানা,
হাসির কথা শুনলে বলে,
“হাসব না-না, না-না!”
সদাই মরে ত্রাসে -- ওই বুঝি কেউ হাসে!
এক চোখে তাই মিটমিটিয়ে
তাকায় আশেপাশে।
ঘুম নাহি তার চোখে
আপনি বকে বকে
আপনারে কয়, “হাসিস যদি
মারব কিন্তু তোকে!”
হাসতে এত ভয় পায় কারা? সুকুমার রায়ের কবিতাটা ছোটবেলা থেকে অসংখ্য বার পড়তে গিয়ে আপামর বাঙালির মনে এই প্রশ্নটা জাগে, এবং নেহাত খেয়াল রসের আজগুবি কবিতা ভেবে প্রশ্নটা পাশে সরিয়ে রেখে আমরা প্রাণ খুলে হাসি। কিন্তু বড় হতে হতে ক্রমশ মালুম হয়, এমন রামগরুড়ের ছানা আমাদের চারিদিকে নেহাত কম নেই। ব্যতিক্রমহীনভাবে তারা সকলেই ক্ষমতাবান। দোর্দণ্ডপ্রতাপ জ্যাঠামশাই, অফিসের বস, ক্লাবের প্রেসিডেন্ট, পুলিশকর্তা, অমুক মন্ত্রী তমুক মন্ত্রী -- এদের মধ্যেই রামগরুড়ের ছানাদের দেখা যায়। কখনো হাসতেন না এমন জেঠিমার স্মৃতি খুব বেশি লোকের আছে কি? কারো অফিসে সদা গোমড়ামুখো চাপরাশি আছে? যে রোজ ক্লাবঘর ঝাঁট দেয়, তার পক্ষে কি রামগরুড়ের ছানা হওয়া সম্ভব? নাকি পুলিশ কনস্টেবল গাম্ভীর্য দেখাতে পারে? রাশভারী ফুটপাথবাসী দেখেছেন কখনো? আসলে ক্ষমতা বজায় রাখতে চাই কর্তৃত্ব। আর হাসলেই কর্তৃত্ব হারিয়ে যাওয়ার ভয় পায় ক্ষমতাশালী। যার ক্ষমতার ভিত যত দুর্বল, সে ভিতে যোগ্যতার মাটি যত কম, তার ক্ষমতা হারানোর ভয়ও তত বেশি। অতএব হাসতে ভীষণ ভয়। যারা হাসায়, তাদেরও ভয়। আর ক্ষমতাশালীর ভয়ের প্রকাশ আক্রমণে। যারা হাসায়, তাদের নিষিদ্ধ করতে হয়, তাদের বিরুদ্ধে এফআইআর করতে হয়, আদালত অবমাননার মামলা ঠুকতে হয়। কারণ হাসির মতো বিপজ্জনক জিনিস আর নেই। হাসি ভয় ভেঙে দেয়। ক্ষমতাশালীর চোখে স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান কুণাল কামরা তাই উমর খালিদ, স্ট্যান স্বামী বা ভারভারা রাওয়ের চেয়ে কম বিপজ্জনক নন।
কুণাল অবশ্য এই প্রথম ক্ষমতাশালীর চাঁদমারি হলেন তা নয়। এর আগেও একাধিক জায়গায় তাঁর অনুষ্ঠান নিয়ে গোলমাল হয়েছে, এফআইআর হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দলকে খোঁচা মেরে লোক হাসান বলে তিনি নিয়মিত প্রকাশ্যে (ইন্টারনেটে) খুনের হুমকি পেয়ে থাকেন। ইউটিউবে দেখতে পাবেন, আরেক স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান বরুণ গ্রোভার তাঁর এক অনুষ্ঠানে বলছেন “অনেকে আমাকে জিজ্ঞেস করে ‘আপনি এইসব জোক বলেন, আপনার ভয় করে না?’ তা আমি বলি হিট লিস্টে আমার আগে কামরার লাইন আছে। ওকে উড়িয়ে দিলে তারপর ভয় পাবখন।”
তবে এবার কুণাল নরেন্দ্র মোদী বা বিজেপির পা টেনেই থামেননি। সরাসরি সুপ্রিম কোর্টকে হাসির পাত্র করে দিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টকে সুপ্রিম জোক বলেছেন। প্রাসাদোপম আদালতের মাথায় যেখানে জাতীয় পতাকা লাগানো থাকে, ফোটোশপে সেখানে বিজেপির পতাকা বসিয়ে ছবি টুইট করেছেন, মহাত্মা গান্ধীর জায়গায় আইনজীবী হরিশ সালভের ছবি টাঙানোর পরামর্শ দিয়েছেন। দুঃসাহস এমন জায়গায় পৌঁছেছে, যে অ্যাটর্নি জেনারেল কে কে বেণুগোপাল তাঁর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা শুরু করতে অনুমতি দেওয়ার পর কুণাল নাতিদীর্ঘ টুইটার বিবৃতিতে পরিষ্কার বলে দিয়েছেন ক্ষমাও চাইবেন না, টুইটগুলো প্রত্যাহারও করবেন না। মুখ গোমড়া না করে উপায় আছে?
কমেডিয়ানদের দুঃসাহস অবশ্য নতুন কিছু নয়। আমাদের দেশে প্রাচীনকাল থেকে এঁদের বলা হয় বিদূষক। বস্তুত দুঃসাহস না থাকলে বিদূষক হওয়ার মানে হয় না। রাজা রাজড়াদের আমলেও অন্য কেউ যা বললে গর্দান যাওয়ার ভয় থাকত, বিদূষক অনায়াসে রাজাকে সেসব বলতে পারতেন। বাদশা আকবরের বিদূষক বীরবল বা মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের গোপাল ভাঁড়ের প্রচলিত গল্পগুলো থেকে তা পরিষ্কার। যদিও গল্পগুলোয় ইতিহাস আর গল্পকথার মিশেল কতটা তা বলা দুঃসাধ্য, তবু বিদূষকের অধিকারের সীমানা যে বহুদূর বিস্তৃত, তা বোঝা যায়। যা রটে তার কিছু তো বটে। সত্যজিৎ রায়ের অনুবাদে বিপুল জনপ্রিয় মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্পগুলো বিদেশ থেকে এসেছে, কিন্তু সেখানেও মোল্লার দুর্দমনীয় স্পর্ধা। এ যুগে যা নতুন, তা হল বিদূষক কেবল বিদূষক থাকতে পারছেন না। তাঁকে এমন অনেক কাজ করতে হচ্ছে যা তাঁর করার কথা নয়।
তাঁকেই সরকারের রাজনৈতিক বিরোধী হয়ে উঠতে হচ্ছে। বিরোধীরা কোন ইস্যুতে সরকারের কৈফিয়ত দাবি করবেন, তা বুঝতেই অনেক সময় হিমশিম খাচ্ছেন। অথচ স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ানরা হাসির ছলে সরকারকে বিবস্ত্র করে দিচ্ছেন সেইসব ইস্যুতে। গোরক্ষার নামে মুসলমান নিধন থেকে শুরু করে চীনা দ্রব্য বয়কট পর্যন্ত বহু ইস্যুতেই এই ঘটনা দেখা গেছে। তার চেয়েও বেশি করে যে ভূমিকা কমেডিয়ানদের নিতে হচ্ছে, তা সাংবাদিকের। দেশের সংবাদমাধ্যম -- গণতন্ত্রের তথাকথিত চতুর্থ স্তম্ভ -- সরকারের কণ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপরন্তু বাবু যত বলে পারিষদ-দলে বলে তার শতগুণ। সরকার নোট বাতিল করে দিলে নিউজ চ্যানেল বলে নতুন নোটে নাকি মাইক্রোচিপ বসানো আছে। মাটির নীচে পুঁতে রাখলেও সিগনাল পাঠাবে। ফলে কালো টাকা ধরা পড়বে। সংবাদমাধ্যম তার প্রধান দুটো কাজই বিস্মৃত হয়েছে। (১) প্রচার থেকে মিথ্যা সরিয়ে সত্য উদ্ঘাটন, (২) বঞ্চিত, ক্ষমতাহীন মানুষের কথা প্রচার করা। ক্ষমতাকে প্রশ্ন করা। এক নম্বর কাজটা পুরোপুরি ছেড়ে দিয়ে অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম এমনই কলের গান কুকুর মাথা হয়ে উঠেছে, সত্যাসত্য বিচার যে সাংবাদিকতার অ আ ক খ, সে কথা আমরা ভুলেই গেছি। আলাদা করে ফ্যাক্ট চেকিং ওয়েবসাইট তৈরি হয়েছে। আর ক্ষমতাকে প্রশ্ন করার দায়িত্ব পড়েছে কমেডিয়ানদের ঘাড়ে। কুণাল কামরা তাই স্ট্যান্ড আপ কমেডি করেই থেমে থাকেন না, ‘শাট আপ ইয়া কুণাল’ নামে সাক্ষাৎকারের অনুষ্ঠানও করেন। সেখানে আগত রাজনীতিবিদ বা অন্য ক্ষেত্রের বিখ্যাত মানুষদের জিজ্ঞেস করা হয় না “আপনি কি আম চুষে খান না ছাড়িয়ে খান?” প্রশংসায় ভরিয়ে দেওয়া হয় না আগত মানুষটিকে, বলা হয় না “এক ফকিরি হ্যায় আপ মে”।
কুণাল, বরুণ বা অন্যরা অবশ্য এখনো জন অলিভারের মতো হাসতে হাসতে খবরের সম্পূর্ণ কাটাছেঁড়ায় প্রবেশ করেননি। হয়ত শিগগির করতে হবে, কারণ বিদূষকের অবস্থান সবসময়ই মোসাহেবের বিপরীত মেরুতে। আর যে দেশের সংবাদমাধ্যম মূলত রাজার মোসাহেব হয়ে গেছে, সে দেশে বিদূষকদের আরো বেশি সংবাদে মন দিতেই হবে। সবচেয়ে বিখ্যাত মোসাহেবটির সাথে আবার কুণালের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তাঁকে নিয়ে কুণাল যারপরনাই রসিকতা করে থাকেন। ভদ্রলোককে সবচেয়ে ফাঁপরে ফেলেছিলেন এ বছরের জানুয়ারি মাসে। বিমানে তাঁর দেখা পেয়ে কুণাল তাঁকে কিছু প্রশ্ন করতে চেয়েছিলেন। সিংহহৃদয় অর্ণব গোস্বামী, যিনি নিজেকে জাতির কণ্ঠ মনে করেন, গগনবিদারী চিৎকারে নিজের অপছন্দের লোকেদের কাছে নেশনের দিব্যি করে জবাব চান, তিনি মুখ খোলা দূরে থাক, নিজের মোবাইলের পর্দা থেকে চোখ তুলে তাকাতে পর্যন্ত পারেননি। রাজানুগ্রহে তাঁর লাঞ্ছনার প্রতিকার হয়েছিল ছ’মাসের জন্য কুণালের বিমানে চড়ার অধিকার কেড়ে নেওয়া।
কুণালের সুপ্রিম কোর্টকে নিয়ে দুর্বিনীত রসিকতার পিছনেও তাৎক্ষণিক কারণ এই মোসাহেবটি। আত্মহত্যার প্ররোচনা দেওয়ায় অভিযুক্ত অর্ণব হাইকোর্টে নাকচ হওয়া জামিনের আবেদন নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে দরবার করতেই শুনানির দিন পেয়ে গেলেন এবং জামিন পেয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামীর মতো হাত নাড়তে নাড়তে বেরিয়ে এলেন। অথচ গত বছরের আগস্ট মাস থেকে কাশ্মীরের বাসিন্দাদের কয়েকশো habeas corpus (বন্দী প্রত্যক্ষীকরণ) পিটিশন শোনার সময়ই পাচ্ছেন না সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা। অর্ণবের গ্রেপ্তারির নিন্দা করে বিচারপতি চন্দ্রচূড় ব্যক্তিগত স্বাধীনতার পবিত্রতা সম্বন্ধে বিস্তর ভাল ভাল কথা বলেছেন। অথচ স্ট্যান স্বামী, ভারভারা রাও, আনন্দ তেলতুম্বড়ে, উমর খালিদ বা শার্জিল ইমামের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য নেই। সিএএ বিরোধী আন্দোলন করার অপরাধে আরো বহু নাম না জানা মানুষ গ্রেপ্তার হয়ে আছেন, জামিন পাচ্ছেন না। তাঁদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা নিয়েও কোন উচ্চবাচ্য দেখা যায় না। এমনকি অর্ণবের মতই পেশায় সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানের ব্যক্তিগত স্বাধীনতাও বিচারপতিদের কৃপা দৃষ্টি পায়নি। তাই কুণাল তাঁর টুইটার বিবৃতিতে লিখেছেন “আমার অবমাননার পিটিশনের শুনানিতে যে সময় খরচ হবে (প্রশান্ত ভূষণের শুনানির কথা মাথায় রাখলে অন্তত ২০ ঘন্টা তো বটেই) সেটা আমি তাঁদের দিতে চাই, যাঁদের আমার মত লাইন টপকে আদালতের সামনে আসার সৌভাগ্য হয়নি।” (ভাষান্তর আমার)
বিবৃতির শেষ দিকে কুণাল লিখেছেন “ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এখনো আমার টুইটগুলো সম্বন্ধে কিছু বলেননি। কিন্তু যখন বলবেন, তখন ওগুলোতে আদালত অবমাননা হয়েছে বলে রায় দেওয়ার আগে আশা করি একটু হেসে নেবেন।” বিচারকরা হাসবেন কিনা জানি না, অর্ণব গোস্বামী কিন্তু হাসেন না।
- প্রতীক
এক বছরের মধ্যেই বলিভিয়ায় ঘুরে দাঁড়ালেন বামপন্থীরা। ২০০৬ সালে বলিভিয়ার নির্বাচনে জয় পেয়ে রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন মুভমেন্ট ফর সোসালিজমের নেতা ইভো মোরালেস। দেশের আদিম জনগোষ্ঠীর কোনও প্রতিনিধির সেটাই ছিল প্রথমবারের জন্য বলিভিয়ার রাষ্ট্রপতির আসনে বসা। সেই সময়টা গোটা লাতিন আমেরিকাতেই বাম ঝোঁক সম্পন্ন সরকারদের একে একে ক্ষমতায় আসার পর্ব ছিল, যাদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল ছিলেন ভেনেজুয়েলার হুগো স্যাভেজ।
এরপর অনেক বদলে গেছে লাতিন আমেরিকা ও বিশ্বের রাজনৈতিক মানচিত্র। জোর করে নির্বাচনে হারিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে বাম ঝোঁক সম্পন্ন সরকারের প্রধানদের। কোথাও কোথাও তাদের বিরুদ্ধে ক্যু করার চেষ্টা হয়েছে, সেনাবাহিনী তাতে মদত দিয়েছে কর্পোরেট ও মার্কিনি ইঙ্গিতে। গত বছর ইভো মোরালেসের বিরুদ্ধেও এই ঘটনা ঘটে। ২০১৯-এর নির্বাচনে মোরালেস বিজয়ী হবার পরেও মার্কিন রাষ্ট্র ও কর্পোরেট মদতে সেই জয়ের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার চলে। জনগণের একাংশকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয় কর্পোরেট প্রচারযন্ত্র। ইভো মোরালেস বাধ্য হন দেশ ছেড়ে চলে যেতে। নির্বাচনে জিতেও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ে একটা গোটা বছর কাটাতে হয় তাকে।
কিন্তু এই চক্রান্তর সাফল্য দীর্ঘমেয়াদি হল না। মাত্র এক বছরের মধ্যে পুনরায়োজিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয় পেলেন ইভো মোরালেসের দল মুভমেন্ট ফর সোসালিজম এর রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী লুইস আর্ক। যিনি আগে মোরালেসের শাসনকালে বলিভিয়ার অর্থমন্ত্রী ছিলেন। আর্ক শুধু যে জিতেছেন তাই নয়, এই জয়ের মার্জিন বুঝিয়ে দিয়েছে একবছর আগের দক্ষিণপন্থী চক্রান্তর চাকাকে উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দিতে বলিভিয়ার জনগণ কতটা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। লুইস আর্ক যেখানে ৫২ শতাংশ মতো ভোট পেয়েছেন, দ্বিতীয় স্থানে থাকা কার্লোস মেসা সেখানে পেয়েছেন ৩১ শতাংশের মতো। মনে রাখতে হবে মোরালেস ও মুভমেন্ট ফর সোসালিজম বিরোধী ভোট যেন ভাগ না হয়, তাই নিয়ে বিরোধিরা যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করেছিলেন। মোরালেস বিরোধী ক্যু’এর পর প্রেসিডেন্ট হিসেবে যিনি দায়িত্ব নেন, কনজারভেটিভ পার্টির সেই নেতা জেনাইন আনিয়েজ নিজেকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন থেকে সরিয়ে নেন। কিন্তু এতদ সত্ত্বেও কার্লস মেসা মুভমেন্ট ফর সোসালিজম প্রার্থী আর্ককে যথেষ্ট প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফেলতে পারলেন না, পিছিয়ে থাকলেন বিরাট ব্যবধানে।
লুইস আর্ক মোরালেস সরকারের অর্থ মন্ত্রী হিসাবে হাইড্রোকার্বন, টেলিযোগাযোগ, খনি জাতীয়করণের কাজে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ফলে তার বিরুদ্ধেও বহুজাতিক সংস্থাগুলির ক্ষোভ ছিল যথেষ্ট। মোরালেস বিরোধী ক্যু’এর পর মোরালেসের মতো তিনিও দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। দু’মাস পরে অবশ্য তিনি দেশে ফিরে আসেন। তখন অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করছেন শত শত মানুষ। তাকে দমনে নয়া সরকার উদ্যত। মুভমেন্ট ফর সোসালিজমের কর্মী, সমর্থকদের বিরুদ্ধে নামিয়ে আনা হয় পুলিশি সন্ত্রাস, অনেককে কারারুদ্ধ করা হয়। সাকাবা, সেনকাটা, পেদ্রেগাল, ইয়াপাচানি সহ দেশের নানা প্রান্তে সরকার গণহত্যা চালায় প্রতিরোধ দমন করতে। শহীদ হন অনেক তরুণ। কিন্তু আন্দোলন তাতে স্থিমিত হয়নি, বরং গড়ে ওঠে শ্রমিক, কৃষকদের বড় বড় গণসংগ্রাম। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে চলতে থাকা নিরন্তর লড়াই শেষপর্যন্ত একবছরের মধ্যেই পরিস্থিতিকে বদলে দিতে সক্ষম হল সদ্য সমাপ্ত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে। ইভো মোরালেসকে এই নির্বাচনে নিষিদ্ধ ঘষণা করা হলে তার বদলে তার সরকারের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী লুইস আর্ক প্রার্থী হয়েছিলেন। আর্কের বিপুল বিজয় স্বাভাবিকভাবেই মোরালেসের বলিভিয়ায় প্রত্যাবর্তন ও মুভমেন্ট ফর সোসালিজমের দেশজোড়া শ্রেণিশক্তির ভারসাম্য বদলানোর চলমান লড়াইকে সাহায্য করবে।
২০২০-র বলিভিয়ার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের গুরুত্ব ও মুভমেন্ট ফর সোসালিজমের ক্ষমতায় ফিরে আসার তাৎপর্যকে বুঝতে বলিভিয়ার সাম্প্রতিক ইতিহাসের দিকে পরিশেষে একটু ফিরে তাকানোর দরকার আছে।
নব্বইয়ের দশকে গঞ্জালো স্যাঞ্জেজ নয়া উদারবাদ নির্দেশিত নীতির ভিত্তিতে দেশ চালানো শুরু করেন। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির পঞ্চাশ শতাংশ পর্যন্ত মালিকানা ও পরিচালনার নিয়ন্ত্রণ ব্যক্তি মালিকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়, যাদের অধিকাংশই ছিলেন বিদেশী। পরবর্তী রাষ্ট্রপতি বেনজারের সরকারও একইভাবে নয়া উদারবাদী নীতি গ্রহণ করে। অন্যান্য বিভিন্ন নীতির সঙ্গে কোকো উৎপাদন বন্ধের একটি বিশেষ নীতি এই সরকারের বিরুদ্ধে প্রবল ক্ষোভের জন্ম দেয় এবং সেই বিক্ষোভ আন্দোলনের প্রধান কাণ্ডারী ইভো মোরালেসকে গণআন্দোলনের ওপর ভর করে আমরা ২০০৫ সালে বলিভিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ক্ষমতায় আসতে দেখি।
বলিভিয়ার একটি প্রধান কৃষিপণ্য হল কোকো। এটি ওষুধ তৈরির উপকরণ হিসেবে জরুরি, আবার বলিভিয়ার অনেক অঞ্চলে এটি সাংস্কৃতিক প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই কোকোকেই আবার অনেকে ব্যবহার করেন মাদক কোকেন তৈরির কাজে। মূলত মাদক কোকেনের ব্যবহার বন্ধ করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের নির্দেশে বলিভিয়ার এই পর্বের মার্কিন অনুগত সরকার কোকো উৎপাদনকেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। কোকা উৎপাদন বন্ধে বলিভিয় সরকারকে সাহায্যের জন্য আমেরিকা সেনাবাহিনী পর্যন্ত পাঠায়। রুটি রুজির প্রধান অবলম্বন কেড়ে নেওয়ার এই স্বৈরাচারী নীতির বিরুদ্ধে কোকো উৎপাদনকারীরা পথে নামেন। কোকা উৎপাদনের প্রশ্নটি ক্রমশই বলিভিয়ার সার্বভৌমত্বের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যায় এবং মার্কিনীদের দেখা হতে থাকে সাম্রাজ্যবাদী হিসেবে। কোকা উৎপাদকদের ইউনিয়ন সরাসরি রাজনীতিতে প্রবেশ করবে কিনা এ নিয়ে দীর্ঘ বিতর্কের পর অবশেষে তারা প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। কোকা উৎপাদকদের নেতা হিসেবে মোরালেসকে অনেকবার জেল খাটতে হয়েছে, ১৯৮৯ সালে তাকে একবার প্রচণ্ড মারধোর করে মরণাপন্ন করে ফেলা হয়।
মোরালেস কোকাকে আন্দিয়ান সংস্কৃতির প্রতীক হিসেবে বর্ণনা করেন এবং কোকা ও কোকেনের পার্থক্যকে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরার জন্য প্রচার অভিযানে সামিল হন। ১৯৯৫ থেকে মোরালেস তাঁর আন্দোলনকে অভিহিত করেন ‘মুভমেন্ট ফর সোস্যালিজম’ নামে।
২০০৫ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মোরালেস বিপুল সমর্থন নিয়ে বিজয়ী হন এবং এই বছরেই পালিত হয় ‘মুভমেন্ট ফর সোশ্যালিজম’ এর দশম বর্ষপূর্তি। আদিবাসী মানুষের দীর্ঘদিনের বঞ্চনা ও তার আন্দোলন অবশেষে মোরালেসের রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে সাফল্য পায়। অভিষেক ভাষণে মোরালেস জানান “৫০০ বছরের ঔপনিবেশিকতার অবসান হলো”। মোরালেসের মন্ত্রীসভায় আদিবাসী মানুষ ও বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের আধিক্য প্রথম থেকেই তাঁর দৃষ্টিকোণ স্পষ্ট করে দিয়েছিল। মোরালেস সরকার প্রথমেই বলিভিয়ার ব্যাপক দারিদ্রের প্রকোপ সীমায়িত করার দিকে নজর দেয়। প্রথম পাঁচ বছরের মধ্যেই দারিদ্রসীমার হার ৩৫ শতাংশ থেকে ২৭ শতাংশে নেমে আসে। অশিক্ষা দূরীকরণেও বিশেষ নজর দেওয়া হয়। অনেক গুরূত্বপূর্ণ আর্থিক উৎপাদন ক্ষেত্রের জাতিয়করণ করা হয়, যার মধ্যে ছিল তেল, খনি, প্রাকৃতিক গ্যাসের পাশাপাশি যোগাযোগ ক্ষেত্র। সামাজিক ক্ষেত্রেও ব্যাপক ব্যয় বরাদ্দ করা হয় সরকারের তরফে। বয়স্কদের পেনসনের ব্যবস্থা করা হয়, এজন্য আগে থেকে অর্থ প্রদানের কোনও প্রয়োজন ছিল না। শিশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও শিক্ষার জন্য মায়েদের বিশেষ ভাতা দেওয়া হয়। কৃষকদের শয়ে শয়ে ট্রাক্টর বিনে পয়সায় বিলি করা হয়। জ্বালানি ও খাদ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করা হয়, খাদ্য রপ্তানির পরিবর্তে স্থানীয় বাজারে খাদ্য বিক্রির ওপর জোর দেওয়া হয়। ভরতুকি মূল্যে খাদ্য সরবরাহের জন্য একটি সরকারী সংস্থাও গঠন করা হয়। ২০০৬ আহূত নতুন সংবিধান সভার মাধ্যমে তৈরি হয় নতুন সংবিধান এবং বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষকে স্বীকৃতি দিয়ে তার নতুন নাম হয় ‘প্লুরিন্যাশানাল স্টেট অব বলিভিয়া’। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শিল্পক্ষেত্রকে রাষ্ট্রীয় আঙিনায় নিয়ে আসতে থাকে ইভো মোরালেসের নেতৃত্বাধীন মুভমেন্ট ফর সোশালিজম, আর সেই পর্ব জুড়ে অর্থমন্ত্রী হিসেবে এই প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা নেন সরকারের অর্থমন্ত্রী লুইস আর্ক। ২০১৯ সালে নির্বাচনে জনরায়ের মধ্যে দিয়ে মোরালেস পুনর্বার ক্ষমতায় ফেরেন। ২০১৯ এর অক্টোবর মাসে এই নির্বাচন হয় ও নভেম্বরের গোড়াতেই এক জার্মান বহুজাতিকের সাথে লিথিয়াম নিষ্কাশন সংক্রান্ত চুক্তি বাতিল করে দেয় নতুন সরকার। মোরালেস সরকার চীনা ও রুশ সংস্থাগুলোর সাথে নতুন চুক্তিতে আবদ্ধ হন, কারণ সেগুলো বলিভিয়ার অর্থনীতির জন্য অপেক্ষাকৃত লাভজনক ছিল। এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার অটোমোবাইল থেকে সেল ফোন, আজকের বাণিজ্যের নানা গুরুত্বপূর্ণ পণ্যর অন্যতম ভিত্তি ব্যাটারি তৈরিতে লিথিয়ামের গুরুত্ব অপরিসীম। আন্দিজ পর্বতমালার ওপরে অবস্থিত ‘সালার দে উইয়ানি’ নামের বিশাল লবণাক্ত প্রান্তর সহ পৃথিবীর মোট লিথিয়ামের ৪০ শতাংশর বেশি রয়েছে বলিভিয়ায়। গুরুত্বপূর্ণ লিথিয়াম কাকে দেওয়া হবে তাই নিয়ে বলিভিয়ার এই ‘বাড়াবাড়ি’ মার্কিন কর্তাব্যক্তি ও কর্পোরেটরা মেনে নিতে পারেনি। বলিভিয়ার মিলিটারি জেনারেল উইলিয়ামস কালিমান ও বিরোধী নেতা ফার্নান্দো কামাচো সহ দক্ষিণপন্থী রাজনীতিবিদ, কর্পোরেট প্রসাদধন্য মিডিয়া ও মার্কিন তাঁবেদারদের কাজে লাগিয়ে ক্যু করে বাধ্য করা হয় ইভো মোরালেসকে পদত্যাগ করতে। তবে শেষরক্ষা যে হয়নি তা বোঝাই যাচ্ছে। গণআন্দোলনের ঢেউয়ে চেপে বলিভিয়ার সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে আবার ক্ষমতা ফিরে পেয়েছে মুভমেন্ট ফর সোশালিজম।
বলিভিয়ার নির্বাচনের এই ফলাফল দেশে ও লাতিন আমেরিকা জুড়ে কি পরিমাণ প্রেরণা ছড়াচ্ছে তা দেখতে আগ্রহী চোখ থাকবে আমাদের। তবে অনেকেই যে এই বিজয়কে ঘিরে আশাবাদী, সেই বার্তা আসতে শুরু করেছে। মোরালেসের মতোই ক্যু'এর শিকার হয়ে ২০০৯ সালে অপসারিত হন্ডুরাসের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ম্যানুয়েল জেলায়া ক্যু এবং প্রতারণাকে পরাভূত করার জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন বলিভিয়ার মানুষকে। হুগো স্যাভেজ পরবর্তী সময়ে ভেনেজুয়েলার চলমান বলিভারিয়ান বিপ্লবের দায়িত্ব যার কাঁধে, সেই রাষ্ট্রনায়ক নিকোলাস মাদুরো বলেছেন, ‘মহান জয়! ক্যবদ্ধ ও সতর্ক বলিভিয়ারঐ জনগণ আমাদের সহোদর ইভোর বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানকে পরাস্ত করতে ভোটকে ব্যবহার করেছেন।’ কাস্ত্রো পরবর্তী সময়ে কিউবাকে যিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন, সেই রাষ্ট্রপতি মিগুয়েল দিয়াজ ক্যানেল বলেছেন, ‘সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের নির্দেশে যে অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল তা ফিরিয়ে এনেছেন বলিভিয়ার জনগণ। কিউবা এই আনন্দের অংশীদার’। সাইমন বলিভারকে স্মরণ করে তিনি বলেছেন এই জয় বলিভিয়ারান মতাদর্শের জয়। বলিভারিয়ান মতাদর্শ হল সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দেশপ্রেমিকদের নাছোড় লড়াইয়ের মতাদর্শ, আর সে কারণেই তা এত গুরুত্বপূর্ণ।
- সৌভিক ঘোষাল
সৃজনশীল অনন্য শিল্পী অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নবান্ন পত্রিকা ও পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের পক্ষ থেকে বিদায়ী শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। বামপন্থা ও সাম্যবাদের দর্শনে বিশ্বাসী শিল্পী, রবীন্দ্র সদনে অন্তিম শয্যায় শায়িত, রক্তগোলাপের স্তবক দিয়ে শ্রদ্ধা জানান পরিষদের সম্পাদক নীতীশ রায়। তারপর বিকেল পাঁচটা নাগাদ অন্তিম মিছিল চলে ক্যাওড়াতলা মহাশ্মশানের দিকে। “আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে” গানের সুরে অগনিত অনুরাগী কবি শিল্পী সাহিত্যক অভিনেতা রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব সমাজকর্মী বিদায় মিছিলে পা মেলায়। মিছিলের শেষে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। ভীড়ের মধ্য থেকেই শ্লোগান ভেসে আসে কমরেড সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় লাল সেলাম। অমর শিল্পী অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অমর রহে। তিন তিনবার বন্দুকের ফায়ারের আওয়াজের চেয়েও এই শ্লোগানের আওয়াজ ছিল অনেক বেশি জীবন্ত, ভালবাসার প্লাবনে আপ্লুত।
-নীতীশ রায়
প্রায় বছর দু’য়েক কিডনি জনিত অসুস্থতা সয়ে গত ৫ নভেম্বর দার্জিলিং জেলার খড়িবাড়ি ব্লকে অবস্থিত শচীন্দ্র চন্দ্র চা বাগানের চাপাটি লাইনের বাসিন্দা কমরেড বান্ধনা ওরাওঁ প্রয়াত হয়েছেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৫৩ বছর। ১৯৯৮ সালে তরাই সংগ্রামী চা শ্রমিক ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠার কিছুদিন পর থেকেই চা শ্রমিকদের দাবিদাওয়ার আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা নিতে শুরু করেন। কমরেড বান্ধনা তাঁর সক্রিয়তা এবং নিষ্ঠা নিয়ে অচিরেই ইউনিয়নের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। শ্রমিক আন্দোলন ছাড়াও সিপিআই(এমএল)-এর খড়িবাড়ি লোকাল কমিটির একজন লড়াকু সদস্য হিসাবে নকশালবাড়ি আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তি সহ অন্যান্য রাজ্য ও জেলা স্তরের কর্মসূচীগুলিতে সংগঠকের ভূমিকায় অংশগ্রহন করতেন। প্রতি বছর মে দিবস উদযাপনের প্রস্তুতি পর্বেতিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করতেন। আগামীর আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ে কমরেড বান্ধনা ওরাওঁ-এর অনুপস্থিতি গভীর ভাবে অনুভূত হবে। কমরেড বান্ধনা ওরাওঁ লাল সেলাম। গত ১২ নভেম্বর শচীন্দ্র চন্দ্র চা বাগানের চাপাটি লাইন সংলগ্ন ময়দানে প্রয়াত কমরেড বান্ধনা ওরাওঁ-এর স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। উপস্থিত ছিলেন কমরেড বান্ধনা ওরাওঁ-এর পরিবারের সদস্যসহ জেলা নেতৃবৃন্দ ও খড়িবাড়ি বাগান ও বস্তীর নেতৃস্থানীয় ইউনিয়ন ও পার্টি সদস্যরা। বক্তব্য রাখেন তরাই সংগ্রামী চা শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষে তাশিলাল ওরাওঁ, বন্ধুবেক, সুমন্তী এক্কা এবং জেলা পার্টির পক্ষে মোজাম্মেল হক ও অভিজিৎ মজুমদার। স্মরণসভা পরিচালনা করেন রাজ্য সদস্য পবিত্র সিংহ।