আজকের দেশব্রতী : ৩ ডিসে্বর ২০২০ (অনলাইন সংখ্যা)
ajkkkkkmmm

প্রধানমন্ত্রী মোদী বিরোধীশূন্য শাসনের পক্ষপাতী। তিনি সর্বশক্তিমান এবং সারা দেশকে একটি শিকলে বেঁধে ফেলার জন্য যাবতীয় হাতিয়ারকে তিনি জড়ো করেছেন। তাঁর আয়োজনে বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবার প্রবলভাবেই সক্রিয়। কিন্তু আপাত শান্ত, দেশের অগণিত অন্নদাতা কৃষকদের অস্তিত্ব ও অধিকারের ওপর জোর খাটাতে গিয়ে মোদীজির সমস্ত ফ্যাসিবাদী প্রকল্প জনরোষে ঝলসে উঠেছে। মোদী জমানায় কৃষকদের প্রতি উপর্যুপরি প্রতারণা ও শঠতার ফলে তলে তলে যে ক্ষোভের আগ্নেয়গিরি সৃষ্টি হচ্ছিল, কোম্পানিরাজ কায়েমের তিন কৃষি আইন তার জ্বালামুখকেই উন্মুক্ত করে দিয়েছে।

সত্যিই আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত

২৪ নভেম্বর রাত থেকেই পাঞ্জাব, রাজস্থান, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশের মিরাট, আগ্রা প্রভৃতি স্থান থেকে হাজার হাজার কৃষক রাজধানী দিল্লীর দিকে রওনা দিয়েছেন। দলে দলে নারী, পুরুষ হাঁটছেন। আবার ট্রাক, ট্রাক্টর, টেম্পো ইত্যাদিতে চেপেও আসছেন বিক্ষুব্ধ কৃষকেরা। তাঁদের দাবি – ন্যায্য দামে সরকারের উদ্যোগে ফসল কেনার ব্যবস্থাকে লোপাট করা চলবে না। কোম্পানিরাজ কায়েমের লক্ষ্যে তৈরি নতুন তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার করতে হবে। চুক্তি চাষের নামে কৃষকদের দেশী-বিদেশী কর্পোরেটদের ক্রীতদাসে পরিণত করা চলবেনা। চাল, গম, ভোজ্য তেল, তৈলবীজ, আলু, পেঁয়াজ ইত্যাদি কৃষিপণ্যকে ‘অত্যাবশ্যকীয়’ তালিকা থেকে বাদ দেওয়া চলবেনা। সর্বনাশা বিদ্যুৎ বিল ২০২০ বাতিল করতে হবে। হাড় হিম করা ঠান্ডা, রাতের শিশির ইত্যাদি শত কষ্ট সত্বেও মুখে হাসি নিয়ে কৃষকরা দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছেন দিল্লী অভিমুখে। তবে কি মোদীর দুর্গ ভেঙ্গে পড়বে! প্রবল প্রতাপ রাষ্ট্রশক্তি অবাধ্য কৃষকদের ‘আবদার’ কি সহজে মেনে নেবে? কখনোই না। রাজধানীর পথে পথে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী। বিশাল বিশাল ব্যারিকেড খাড়া করে, জলকামান ও কাঁদানে গ্যাস নিয়ে তৈরি আছে উর্দিধারীরা। দিল্লী প্রবেশের মুখে সমস্ত রাজপথে হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশে মোদীর স্তাবক দুষ্মন্ত চৌতালা ও যোগী আদিত্যনাথের পুলিশ লাঠি চালিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিচ্ছে নিরস্ত্র কৃষকদের। কুছ পরোয়া নেই। রক্তাক্ত হলেও দিল্লী অভিযান থামবেনা। দিল্লী-হরিয়ানা জাতীয় সড়কে সিঙ্ঘু বর্ডারে পুলিশী ব্যারিকেড নদীর জলে ফেলে দিলেন কৃষকেরা।  আম্বালা, ভিওয়ানি, কার্নাল, বাহাদুরগড়, ঝাজ্জর, শোনপত সর্বত্রই কংক্রিট আর লোহার খাঁচা রুখতে পারছেনা কৃষক মিছিলের ঢলকে। শীতের সন্ধ্যায় জলে ভিজে চুবচুব, তবু কৃষকের দল অদম্য।

নবদীপ সিং, গুরমিত লহরাঃ শৌর্য্য ও আত্মত্যাগের নয়া ইতিহাস লেখা হল

হরিয়ানার আম্বালা। দিল্লী অভিমুখী সারে সারে ট্রাক, ট্রাক্টর দাঁড়িয়ে পড়েছে। জলকামান থেকে প্রবল জলের ধারায় ভিজে যাচ্ছে কৃষকদের শরীর। এই জলের তোড় ভেদ করে গাড়িগুলোর এগিয়ে চলা অসম্ভব। দিশাহারা কৃষকেরা। তাহলে কি ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবেন তাঁরা? কী আশ্চর্য্য! সকলকে অবাক করে একটি ট্রাকের ওপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল এক যুবক, এ্যাক্কেবারে জলকামানের নলের মাথায়। সে প্রাণপণ শক্তিতে চেপে ধরল কামানের নল। রুদ্ধ হয়ে গেল জলের ধারা। জলকামান অচল হয়ে যেতেই হু হু করে কৃষক বোঝাই ট্রাক ও ট্রাক্টরগুলি এগিয়ে গেল সামনের দিকে। এই অসমসাহসী কৃষক যুবকের নাম নবদীপ সিং। সারা দেশ মুগ্ধ বিষ্ময়ে তারিফ করছেন নবদীপকে। বিপরীতে হরিয়ানার বিজেপি জোট সরকার নবদীপের বিরুদ্ধে সরকারীকাজে বাধা দান ও হিংসা ছড়ানোর অভিযোগে মামলা রুজু করেছে।

হরিয়ানার রোহতক-পানিপথ সরক ধরে হেঁটে চলেছেন ক্লান্ত কৃষকের দল। শরীর বইছে না তবু অন্যদের সঙ্গে হাঁটতে সঙ্কল্পবদ্ধ তরুন কৃষক গুরমিত লহরা। জান কবুল আর মান কবুল। কৃষকদের দাবির প্রতি নির্বিকার মোদীকে জবাবদিহি করতেই হবে। সুতরাং গুরমিতকে থামলে চলবেনা। কিন্তু হৃদযন্ত্র অচল হয়ে যেতে গুরমিত লহরার দেহ লুটিয়ে পড়ল শীতের রাজপথে। কিন্তু লেখা হয়ে গেল নতুন ইতিহাস। সরকারের কৃষক বিরোধী আইন প্রত্যাহার তথা নীতি বদলের দাবিতে সংগ্রামে প্রথম শহদ হিসেবে চিরজীবী হয়ে থাকবেন গুরমিত লহরা।

শুধু পাঞ্জাব ও হরিয়ানার কৃষকরাই বিক্ষোভে উত্তাল?

বিজেপি অপপ্রচার করছে, পাঞ্জাব-হরিয়ানার ধনীচাষিরা প্রভাব খাটিয়ে ছোট, মাঝারি চাষিদের কাছ থেকে কমদামে ফসল কিনে মান্ডিতে এসে এফসিআই-এর কাছ থেকে বেশীদাম হাতিয়ে নিয়েছে। তারাই এখন লোক ভাড়া করে এনে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। দেশের অন্যত্র কৃষকরা এই আন্দোলনের পাশে নেই। এ ডাঁহা মিথ্যে কথা। উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরাখন্ড, কর্নাটক, তেলেঙ্গানা – বিভিন্ন রাজ্য থেকে কৃষকরা সামিল হয়েছেন দিল্লী অভিযানে। দিল্লী আসার পথে উত্তরপ্রদেশের আগ্রায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে বহু আন্দোলনকারীকে। ধৃতদের মধ্যে রয়েছেন মধ্যপ্রদেশের কৃষক নেতা যশবিন্দর, প্রতিভা সিন্ধে, কর্নাটক কৃষকসভার নেতা যশবন্ত, সমাজকর্মী মেধা পাটকর প্রমুখ। গুরগাঁওয়ে দিল্লীর রাস্তা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে যোগেন্দ্র যাদব সহ অন্তত ৫০ জনকে। আর মোদী যখন কৃষকদের নিন্দামন্দ  করছে তখন দিল্লীর সর্বস্তরের মানুষ এবং দিল্লীর সীমান্তবর্তী হরিয়ানার জনপদগুলিতে ব্যাপক জনগণ কৃষকদের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছেন। শিখ গুরুদ্বারগুলি যেমন কৃষকদের জন্য খাবার পরিবেশন করছে তেমনই মসজিদগুলি থেকেও তাঁদের খাদ্য সরবরাহ করা হচ্ছে। (আন্দোলনের অভিঘাতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা থেকে কয়েকদিন আগেই আকালি দলের মন্ত্রী হরসিমরত কাউর ইস্তফা দিয়েছেন। আর দিল্লীর স্টেডিয়ামগুলিকে কৃষকদের জন্য অস্থায়ী বন্দিশালারূপে ব্যবহারের কেন্দ্রীয় প্রস্তাবে কেজরিওয়াল ‘না’ করে দিয়েছেন) সর্বক্ষণ বিজেপি যখন ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও ঘৃণার রাজনীতি ফেরি করছে তখন এই বিশাল কৃষক আন্দোলন এক ঐক্যবদ্ধ ভারতের চেহারাকেই নতুন করে সামনে আনতে সাহায্য করেছে। আর শত বাধা পার করে কাতারে কাতারে কৃষক রাজধানীকে অচল করে দেওয়ার সঙ্কল্পে যখন অটল তখন মোদী সরকারকে সুর নরম করতে হয়েছে। কেন্দ্রের কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র তোমর বলছেন, কৃষক নেতাদের সঙ্গে তিনি ৩ ডিসেম্বর আলোচনায় বসতে রাজি। আর মোদী সরকার নিরুপায় হয়ে জানিয়েছে, উত্তর দিল্লীর নিরাঙ্কারি ময়দানে (যা আসলে দিল্লীর প্রায় বহির্ভাগে এক জনবিরল প্রান্তর) কৃষকরা সমাবেশ করতে পারে। সংযুক্ত কৃষক মোর্চা বা এআইকেএসসিসি-র নেতারা অবশ্য জানিয়েছেন, হয় তাঁদের রামলীলা ময়দান অথবা যন্তর মন্তরে সমাবেশ করতে দিতে হবে নয়ত কৃষকরা দিনের পর দিন দিল্লী ও দিল্লীগামী নিকটবর্তী রাজপথগুলি অবরুদ্ধ করে রাখবেন। হ্যাঁ, লাগাতার অবরোধের কথা তাঁরা বলতেই পারেন কারণ কৃষকরা এসেছেন কোমর বেঁধে, বেশ কিছুদিনের খাদ্যসামগ্রী বস্তাবন্দি করে।

ki

কৃষকদের দিল্লী অভিযান গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের এক মাইল ফলক হয়ে থাকবে

কৃষিপণ্যের বাণিজ্য ও বিপণন, চুক্তিচাষ ও অত্যাবশ্যক পণ্য (সংশোধনী) সংক্রান্ত তিনটি আইন আন্দোলনের চাপে প্রত্যাহার হবে কিনা, তা সময়ই বলবে। কিন্ত মোদী সরকারের ভণ্ডামির মুখোশ উন্মোচনে এবং গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কৃষকদের আন্দোলন সমগ্র দেশবাসীকে বিপুল শক্তি জোগাবে। ২০১৪-তে প্রথমবার ক্ষমতায় এসেই নরেন্দ্র মোদী জোর করে জমি অধিগ্রহণের জন্য এক অধ্যাদেশ এনেছিল। দেশজোড়া প্রতিবাদের মুখে সে যাত্রায় পিছু হটলেও মোদী সরকার কৃষিক্ষেত্রকে কর্পোরেটদের হাতে সঁপে দেওয়ার জন্য এই কুৎসিত আইনগুলি প্রণয়ন করেছে। মোদীপন্থীরা বলছে, ফড়েদের হাত থেকে কৃষকদের স্বাধীনতা দেওয়াই নাকি আইনগুলির লক্ষ্য। বাজপেয়ী জমানার মন্ত্রী শান্তাকুমারকে দিয়ে একটা রিপোর্ট তৈরি করিয়ে মোদিজিরা বলছেন, কৃষকদের মাত্র ৪% সরকারি দরে ফসল বেচার সুযোগ পায়। সুতরাং বাকি ৯৬% কৃষকের স্বার্থেই নাকি নয়া আইন। সরকারী উদ্যোগে ফসল কেনার ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাকে মেরামত করে আরো বেশি বেশি কৃষকের কাছ থেকে ফসল কেনার বন্দোবস্ত না করে আদানি-আম্বানি জয় শাহদের কোম্পানিসমূহের কবলে কৃষকদের ঠেলে দেওয়ার চক্রান্ত কিন্তু ছোট-বড় সমস্ত কৃষক বুঝে ফেলেছেন। ঠেলায় পড়ে বিজেপি নেতারা বলছেন “সরকারী উদ্যোগে ফসল কেনার ব্যবস্থাও বহাল থাকবে।” তাহলে কোনোমতেই এমএসপি’র নীচে কোনো সংস্থা ফসল কিনতে পারবে না – আইনের মধ্যে স্পষ্টভাষায় এই ধারা সংযোজিত হলনা কেন? এর আগে স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ কার্যকরী করবেন বলে মোদী ক্ষমতায় এসেছিলেন। আর গদিতে বসেই স্বামীনাথন কমিটির রিপোর্টকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। ছ’বছর আগে সেই বিশ্বাসঘাতকতা দেখে কৃষকরা হয়ত হতবাক হয়েছিলেন। কিন্তু গঙ্গা-যমুনা-বিতস্তা-বিপাশা দিয়ে এরপর জল অনেক গড়িয়েছে। এবার মোদীর নতুন বিশ্বাসঘাতকতা বিনা চ্যালেঞ্জে দেশ মেনে নেবেনা। কৃষকদের দ্বারা অবরুদ্ধ দিল্লীতে ছাত্র-যুবরাও যখন আন্দোলনকারীদের পাশে তখন মোদী জমানার পতনের যে কাউন্টডাউন শুরু হল, তা দিনের আলোর মতেই পরিষ্কার।

  - মুকুল কুমার    

dddaaa

সারা ভারত কৃষক সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি (এআইকেএসসিসি)-র পশ্চিমবঙ্গ শাখার ৩০ নভেম্বরের বৈঠক থেকে নিম্নলিখিত আশু কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে।

  • ১) এআইকেএসসিসি পশ্চিমবঙ্গ শাখা দিল্লীতে চলমান কৃষক আন্দোলনের অন্যতম শরীক হিসাবে এ রাজ্যের বুকে কেন্দ্রীয় নয়া কৃষি আইন এবং বিদ্যুৎ আইনের সর্বনাশা ক্ষতিকারক দিকগুলি তুলে ধরে আগামী ১ ও ২ ডিসেম্বর সমস্ত জেলার গ্রামে গ্রামে অসংখ্য প্রচার সভা, মোদীর কুশপুত্তলিকা দাহ, কৃষি আইনের প্রতিলিপি জ্বালিয়ে দেওয়ার কর্মসূচী সংগঠিত করবো।
  • ২) ৩, ৪ ও ৫ ডিসেম্বর জেলায় জেলায় গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলিতে কৃষকদের পথ অবরোধ সংগঠিত করা হবে।
  • ৩) নয়া কৃষি আইন ও বিদ্যুৎ আইন ২০২০ প্রত্যাহারের দাবিতে ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে কলকাতায় হাজার হাজার কৃষকদের রাজভবন অভিযান সংগঠিত হবে।
  • ৪) আগামীদিনে পশ্চিমবঙ্গ থেকে কৃষকদের একদল প্রতিনিধি আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে দিল্লী অভিমুখে রওনা দেবে।
  • ৫) রাজ্য সরকারের কাছে আমাদের দাবী অবিলম্বে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় কেন্দ্রীয় কৃষি আইনের বিরুদ্ধে প্রস্তাব গ্রহণ করতে হবে এবং কৃষক স্বার্থবাহী রাজ্য আইন প্রনয়ণ করতে হবে।
  • ৬) দিল্লীতে কৃষক আন্দোলনের শহীদ জনক রাজ ও ধান্না সিং-এর প্রতি এআইকেএসসিসি পশ্চিমবঙ্গ শাখা বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করছে।
999aaaproed

পশ্চিমবঙ্গে ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে পয়লা নম্বর প্রতিপক্ষ নির্ণয় করা নিয়ে বামপন্থার বৃহত্তর মহলে মতপার্থক্য থেকেই যাচ্ছে। কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থবাহী এবং আরএসএস মদতপুষ্ট হিন্দুরাষ্ট্রবাদী সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী বিজেপি-ই যে সন্দেহাতীতভাবে প্রধানতম প্রতিপক্ষ এবং মোকাবিলার রণকৌশলগত অবস্থান যে অনুরূপ সঙ্গত হতে হবে — এই সারসত্যটা বাম-কংগ্রেস জোট প্রয়াসী বাম নেতৃত্ব বুঝে উঠতে হিমশিম খাচ্ছেন। এই ভাবধারার ধরনটা কেবল 'জাতীয় ক্ষেত্রে বিজেপি আর রাজ্যের ক্ষেত্রে তৃণমূল শাসক প্রধান বিপদ', 'তাই লোকসভা নির্বাচন ছিল আলাদা, পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন হবে আলাদা চরিত্রের'! অন্যদিকে আবার সেই একই 'মোদী-দিদি এক হ্যায়' মার্কা যুক্তিহীন হাস্যকর শ্লোগান চলছে! মোদী সরকারের বিরুদ্ধে ঘোষিত সদ্য সংগঠিত ধর্মঘটেও এই নিনাদ চলল! এই ধরনের চূড়ান্ত অবাস্তব কান্ডজ্ঞানহীন সূত্রায়ন কোন 'বাম' চিন্তার পরিচয়? জনতাকে যুক্তি-তর্কে কোন চেতনায় শিক্ষিত করবে? এসব নিয়ে একবারও পুনর্বিবেচনার কোনও সদিচ্ছা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। তৃণমূল এককালে এনডিএ-তে ছিল, প্রায় দু'দশক আগে, সেই জের টেনে এখনও 'এক হ্যায়' আওয়াজ দিয়ে যাওয়ার কোনও মানে হয় না।

দ্বিতীয়ত, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি'র জমি পাওয়ার জন্য শাসক তৃণমূলের অত্যাচার, দুর্নীতি, রাজনৈতিক সন্ত্রাস অবশ্যই পরোক্ষভাবে দায়ি, এর ফলে বহু মানুষ বিজেপি'র হাতছানিতে বিপথে প্রভাবিত হয়েছে। কিন্তু এই ব্যর্থতার দায় তো সেই বাম দলেরও নিতে হবে যাদের ভোট ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে চুপিসারে 'এবার রাম পরের বার বাম' মার্কা আত্মঘাতী কৌশলে বিজেপিতে চলে গিয়েছিল। ভরসার এমন দশা কেন হয়েছিল? ভাবা প্র্যাকটিশ করা দরকার। অতীতের ভুল থেকে অকপটভাবে শিক্ষা না নিয়ে কোনও নতুন যাত্রাপথ উন্মুক্ত করা যায় না। যে ভোট তৃণমূল থেকে বিজেপিতে গেছে বা যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে তা ফেরাতে তৃণমূল মরীয়া হচ্ছে। তাহলে যে ভোট বাম দল থেকে বিজেপিতে চলে গেছে, এখনও চোরাস্রোতের মতো যাচ্ছে, তা ফেরানো-ঠেকানোয় বাম দলগুলো চ্যালেঞ্জ নিয়ে উঠে দাঁড়াবে না কেন? এমনকি একদা বাম-ছুট তৃণমূলে যাওয়া, তারপরে তৃণমূল-ছুট বিজেপিতে যাওয়া সব ভোট আবার বাম শিবিরেই ফেরানোয় কেন ঝাঁপানো হবে না! এটাই তো আজকের নির্দিষ্ট অবস্থায় সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক লক্ষ্য হওয়া উচিত। আর এই লক্ষ্যে বিজেপিকেই মূল নিশানা করা দরকার। তৃণমূলকে মূল লক্ষ্য বানিয়ে তা করা সম্ভব নয়। অথবা বিজেপিকে ঠেকানোর জন্য তৃণমূলকে হটানো আর সেই জায়গায় বাম-জোটের ক্ষমতায় আসার ভাববাচ্যের মধ্যে আদৌ কোনও বাস্তব বিবেচনা বোধ নেই। ওসব জগাখিচুড়ি আকাশকুসুম হয়েই থাকবে, আরও অবক্ষয়-ক্ষয় ডেকে আনবে। তাই বাম বর্শামুখ তাক করা দরকার বিজেপির দিকেই। মতাদর্শ-রাজনীতি-মূল লড়াই-দাবিসনদ তৈরি, প্রধান শ্লোগান সবই স্থির করতে হবে সেভাবেই। এই বামপন্থী কলাকৌশলগত অবস্থানের মধ্যে বিজেপির সাথে তৃণমূলের যা ফারাক টানার এবং একইসাথে তৃণমূলের সঙ্গে বামেদের যা টক্কর দেওয়ার, সব সম্ভব। এর মধ্যে অযথা তৃণমূলের সঙ্গে 'জোট তৈরির ভূত দেখিয়ে' লাভ নেই। এরকম 'ভূত আবিষ্কারে'র বিশেষজ্ঞের তালিকায় দেখা যাচ্ছে আবার কোনও 'নকশালপন্থী' আত্মপরিচিতি দেওয়া বন্ধুও নাম তুলছেন! অদ্ভূত সব উপসংহার টানা হচ্ছে! একদিকে মানছেন বিজেপি চলে এলে আসবে ভয়ঙ্কর বিপদ, আবার দাবি করছেন বিজেপিকে ঠেকাতে তৃণমূলের মোকাবিলা হতে হবে 'পূর্বশর্ত'! কিন্তু বিজেপিকে আজকের পশ্চিমবাংলার পরিস্থিতিতে শাসক তৃণমূলের বিপরীতে নিছক প্রতিদ্বন্দ্বী বিরোধী দলের বর্গে ফেলে রাখাটা হবে বাস্তবের বহু বহু পিছনে পড়ে থাকা। এই ভাবনাকে নির্বুদ্ধিতা আখ্যা দিলে অত্যুক্তি হয় না। মতাদর্শ ও রাজনৈতিক দর্শনের নিরীখে বিজেপিকে প্রধান প্রতিপক্ষ নির্ধারণ না করে পারা যায় না, তার ওপর কেন্দ্রে এবং রাজ্যে রাজ্যে ক্ষমতা দখলের দৌলতে বিজেপি রাষ্ট্রক্ষমতায় অনেকটাই আধিপত্যের জায়গায় চলে গেছে। বাংলায় তার এবারের আগ্রাসন ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে।আর একবার এখানে ক্ষমতায় তাদের চলে আসা মানে কয়েক দশকের বাম গড়ের জায়গায় রাম গড়ের গোড়াপত্তন হয়ে যাওয়া, সেটা হলে তার উপর্যুপরি বিপর্যয়কারী প্রভাব শুধু বাংলায় সীমিত থাকবে না, সারা দেশেই পড়বে। তাই তা হতে না দিতে বিজেপিকে লক্ষ্যবস্তু করতে হবে। বিহারে বাম শক্তি যা চ্যালেঞ্জ নিয়ে করে উৎসাহের সঞ্চার করেছে, বাংলায় সেই প্রতিস্পর্ধাকেই ঊর্দ্ধে তুলে ধরা উচিত।

ddastst

মোদী সরকারের গায়ের জোরে এবং অবৈধভাবে চাপিয়ে দেওয়া কৃষক-বিরোধী, কর্পোরেট-তোষণকারী তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে এক অভূতপূর্ব ঐতিহাসিক প্রতিবাদে লক্ষ লক্ষ কৃষক দিল্লীর সীমানায় ধর্ণায় বসেছেন। দিল্লী অভিযানের পথে কৃষকরা পুলিশের হিংস্র আক্রমণের মুখোমুখি হয়েছিলেন। বাধা ভেঙে, কাঁদানে গ্যাস আর জল কামানের আক্রমণকে হিম্মতের সাথে মোকাবিলা করে সেই থেকে প্রতিবাদী কৃষকরা জাতীয় সড়ক অবরোধ করে দেশের রাজধানী শহরের সীমানায় অবস্থান করছেন। সড়ক থেকে দিল্লীর প্রত্যন্তে বুরারির ময়দানে সরে যাওয়ার সরকারি প্রস্তাব খুব সঠিক ভাবেই তাঁরা খারিজ করে দিয়েছেন ।

কৃষক আন্দোলন নিয়ে মোদী সরকার এবং শাসকদল বিজেপি'র প্রতিক্রিয়া আদৌ অপ্রত্যাশিত নয় – একেবারে পূর্বানুমান মাফিক। বহু ব্যবহারে জীর্ণ সেই একঘেয়ে চিত্রনাট্য, আমরা যা ইতিমধ্যেই সমান নাগরিকত্ব আন্দোলন ও প্রতিবাদী ছাত্রদের উদ্দেশে ব্যবহৃত হতে দেখেছি — এই বাহিনীর প্রচার যন্ত্র এই বিশাল কৃষক আন্দোলনকে "খালিস্তানী সন্ত্রাসবাদীদের" মদতপুষ্ট বলে দাবি করার চেষ্টা করেছে যাদের সঙ্গে নাকি বিরোধী দলগুলোর আঁতাত রয়েছে। এই প্রচার ব্যর্থ হয়েছে এবং সমাজের সর্বস্তরের মানুষ কৃষকদের প্রতি আন্তরিক সংহতি জানিয়েছেন।

একদিকে যেমন বিজেপি'র পোষা "গণ্যমান্যরা" এবং সংবাদমাধ্যম গোষ্ঠীগুলো কৃষকদের প্রতি অবিরাম হিংস্র গালিগালাজ আর কুৎসা ছিটিয়ে চলেছে, অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং ঘোষণা করেছেন, সরকারের অভিপ্রায় নাকি "গঙ্গার মতই পবিত্র" ছিল! তাঁর দাবি, কৃষকরা কায়েমি স্বার্থের দ্বারা বিভ্রান্ত হয়েছে। কৃষকদের সঙ্গে  প্রথম দফার আলোচনায় সরকার প্রধানমন্ত্রীর সংলাপই আউড়ে গেছে। কৃষি আইন নিয়ে "আলোচনার"র জন্য সরকার একটি প্যানেল গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিল। কৃষকদের সঙ্গে সম্পর্কিত এই আইনগুলো বলবৎ করার আগেই কৃষকদের সঙ্গে এই "আলোচনা" হওয়া উচিত ছিল। বর্তমান পর্যায়ে, মনে হচ্ছে সরকারি "প্যানেল"-এর উদ্দেশ্য, কৃষকদের প্রণোদিত করা এবং এই "শিক্ষা"দেওয়া যে এই কৃষি আইনগুলি তাদেরই স্বার্থে। কৃষকদের প্রতিনিধিরা এইরকম একটি প্রস্তাবকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতেই অনড় থেকেছেন।

যে আইনগুলো কৃষিকে প্রভাবিত করছে, সেগুলো সম্পর্কে কৃষকদের "শিক্ষিত" হওয়ার দরকার আছে — এই প্রস্তাব রাখাটা তাদের দাঁড় করিয়ে অপমান করা। কৃষিতে যখন এটি লাগু হচ্ছে, এই কৃষকরাই সেক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ—তারা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন যে এই নতুন আইনগুলো তাদের কর্পোরেট-স্বার্থের দয়ার ভিখারী করে তুলবে। সরকার যখন দাবি করছে যে এই আইনগুলি কৃষকদের "মুক্ত" করবে, সত্যিটা হল — এই আইনগুলো সরকারকে কৃষি ও কৃষকের পাশে থাকার যে কোনোরকম দায় থেকে "মুক্ত" করে দেবে। এই আইনগুলি কর্পোরেটদের অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যসামগ্রী যথেচ্ছ মজুত করার এবং এইভাবে দাম ও বাজারকে নিজেদের ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রণ করার স্বাধীনতা দিয়েছে।

বড় বড় কর্পোরেশন যারা ভারতের কৃষক এবং দেশের খাদ্য স্বনির্ভরতার শিরদাঁড়া ভেঙে দিতে উদ্যত, তাদের দালাল, এজেন্ট হিসেবে মোদী সরকার নিজেকে উন্মোচিত করে ফেলেছে। কৃষকদের বর্তমান আন্দোলন শুরু হয়েছে ২৬ নভেম্বর থেকে : ঐ একই দিনে ছিল ভারতব্যাপী ঐতিহাসিক শ্রমিক ধর্মঘট —শ্রমিক আইনের শিথিলকরণ যা শ্রমিকদের মালিক ও বড় কর্পোরেশনগুলোর দয়ার উপর ছেড়ে দিয়েছে — তার বিরুদ্ধে। ২৬ নভেম্বর সংবিধান দিবসও বটে — যেদিন ভারতের জনগণ "নিজেদের ভারতের সংবিধান উপহার দিয়েছেন"। ফ্যাসিস্ট বিজেপি সরকারের হাত থেকে জনগণের অধিকারসমূহ ও ভারতের সাংবিধানিক গণতন্ত্র রক্ষার্থে সিএএ-এনপিআর-এনআরসি'র বিরুদ্ধে সমান নাগরিকত্ব আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এসেছে শ্রমিক ধর্মঘট এবং চলমান কৃষক আন্দোলন।

দিল্লী সীমানায় জাতীয় সড়কের উপর কৃষকদের ধর্ণা অবস্থানকে খুব সঠিকভাবেই 'নয়া শাহিনবাগ' বলে অভিহিত করা হয়েছে। শাহিনবাগ ছিল সমান নাগরিকত্ব রক্ষায় মহিলা-নেতৃত্বে পরিচালিত ধর্ণা। কুমন্তব্যকারী বিজেপি নেতৃবর্গ যারা নিজেরাই প্রতিবাদীদের বিরুদ্ধে হিংসাকে উস্কে দিয়েছে, তারা আন্দোলনকারীদের "সন্ত্রাসবাদী", "দাঙ্গাবাজ", "ভারত ভাঙার গোষ্ঠী" এবং "বাজারের মেয়ে মানুষ" অপবাদ দিয়েছিল। আজ কৃষক-ধর্ণার বিরুদ্ধেও সেই একই কুৎসা, কুমন্তব্য বর্ষিত হচ্ছে। ২০১৬-তে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীদের ঐ একই ভাষায় গালিবর্ষণ করা হয়েছিল। আজ ছাত্র যুব কৃষক শ্রমিক মহিলা, ভারতবর্ষের সমস্ত মানুষ বিজেপি'র সেই কুৎসিত অপপ্রচারের যোগ্য জবাব দিতে, যথার্থ প্রত্যাঘাত হানতে একজোট হয়েছেন। প্রতিবাদী নাগরিকরা গণতন্ত্রের প্রাণশক্তি। যে সরকার প্রতিবাদীদের "দেশ-দ্রোহী" আখ্যা দেয়, তারা গণতন্ত্রের শত্রু। আমাদের অবশ্যই স্বৈরাচারী এবং কৃষকবিরোধী মোদী সরকারের বিরুদ্ধে ভারতীয় কৃষকদের পাশে দাঁড়াতে হবে এবং নতুন তিনটি কৃষি আইন বাতিলের দাবি জানাতে হবে।

(এম এল আপডেট সম্পাদকীয়, ১ ডিসেম্বর ২০২০)     

dbbtm

(বিহার বিধানসভা নির্বাচনে ৬০%-এর বেশি আসনে সাফল্যের হারের ফলাফল বামপন্থিদের মধ্যে, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে ২০২১ নির্বাচনের আগে, আশা জাগিয়েছে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী), বা সিপিআই (এমএল)এর সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার ভাষ্যকার অরিন্দম রায়ের সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে, সাম্প্রতিক বিহার নির্বাচন, পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থিদের রণনীতি, এবং তার ভবিষ্যত নিয়ে কথা বলেন। এখানে তার অংশবিশেষ প্রকাশ করা হল।)

আপনারা যে ১৯টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন তার মধ্যে ১২টিতে জয় করবেন বলে আশা করেছিলেন? বিহারে বামপন্থীদের জন্য কী পরিবর্তন ঘটেছিল?

আমরা ১৫টি আসনে জয়ের প্রত্যাশী ছিলাম এবং খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছিলাম। একটি আসনে ৪৬২ ভোটে হেরেছি, এবং সিসি টিভি ফুটেজ দাবি করেছি। আরেকটি আসনে ভোটের তফাৎ ৩,০০০-এর আশেপাশে। বিহারে নির্বাচন এক খাঁটি গণআন্দোলনে রূপান্তরিত হয়েছিল যার সামনের সারিতে ছিল যুবকেরা ও ঘরছাড়া শ্রমিকরা। লকডাউনের অভিজ্ঞতা আগুনে ঘি ঢেলেছিল। জনতা দুই ইঞ্জিনের সরকারের ফাঁকা আওয়াজের মানে অনুভব করতে পেরেছিল এবং সিপিআই(এমএল) ও অন্যান্য বামপন্থী শক্তির গুরুত্বও অনুধাবন করতে পেরেছিল। যে সরকারকে জনগণ ভোটে নির্বাচিত করেছিল তার দ্বারাই প্রত্যাখ্যাত ও অপমানিত হওয়াটা মানুষ বুঝতে পেরেছিল, এবং বিরোধী মোর্চার দিকে ভোট দিতে জনগণ সংকল্পবদ্ধ হয়েছিল।

মহাজোট নির্বাচনে জিততে পারল না কেন? কোথায় আপনাদের ঘাটতি হল?

মহাজোট তৈরি হতে এত দেরি হল, তবুও তা এনডিএ সরকারকে ক্ষমতা থেকে প্রায় অপসারণ করার মত এত শক্তিশালী একটা ঢেউ তৈরি করতে সমর্থ হল। এটা একটা বিরাট পরিবর্তন, ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বিহারে এনডিএ-র সার্বিক জয়ের বিশাল বিপরীতযাত্রা। যদি জোটটা একটু আগে তৈরি হত এবং আসন সমঝোতা আরো বেশি বাস্তবসম্মত ভিত্তিতে করে সিপিআই(এমএল) ও অন্যান্য বামেদের আরো কিছু বেশি আসন দেওয়া হোত, তাহলে ফলাফল অন্যরকম হত। বিজেপি’র বিষাক্ত নোংরা প্রচার সত্বেও প্রথম পর্যায়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ৮টির মধ্যে ৭টি আসনে আমরা জিতেছি। আমাদের শক্তিশালী জায়গা দক্ষিণ বিহারে মালেকে আরো ১০টি আসন ছাড়লে নির্বাচন মহাজোটের পক্ষে প্রথম পর্যায়েই নির্ধারিত হয়ে যেত।

আপনি কি মনে করেন যে, রাজ্যে এবং সেভাবে বললে সারা দেশে নরেন্দ্র মোদীর জনপ্রিয়তা এখনো অটুট রয়েছে?

এটা ভুললে চলবে না যে মোদী-পূর্ববর্তী বিজেপি ২০১০ সালে বিহারে ৯০এর বেশি আসন পেয়েছিল। জেডি(ইউ) তখন ১১৫টি আসনে জিতেছিল। বিহারে নীতীশ কুমার সরকারের ১০ বছরের ও কেন্দ্রে  মোদী শাসনের ৬ বছরের পরে এনডিএ-র আসন ৮০টির বেশি কমেছে। বিজেপির আসল সাফল্য হল এই যে তারা নীতীশ কুমারের অধিকতর ক্ষতি করতে পেরেছে, যার ফলে জেডি(ইউ)-র ৭০এর থেকে বেশি আসন কমেছে, যেখানে বিজেপি নিজের ক্ষতি ১৫টি আসনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এটি পরিস্কার যে মোদীর জনপ্রিয়তা যথেষ্ট ক্ষয় পেয়েছে এবং জনগণের উপরে তার বাকচাতুর্যের সেই মনভোলানো প্রভাব আর নেই।

আপনি কি মনে করেন যে বামপন্থীরা বাংলায় পুনরুজ্জীবিত হতে পারবে, যেখানে বিজেপির উল্কার মতো উত্থান ঘটেছে?

বিজেপি ও সঙ্ঘবাহিনীর বিপর্যয় সৃষ্টিকারী নীতি ও রাজনীতির সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ আদর্শগত রাজনৈতিক বিপ্রতীপ হিসেবে বামেরাই রয়েছে। বিহারে আমাদের পার্টির উপরে বিজেপি’র জঘন্য আক্রমণ এই বক্তব্যকে জোরদার করেছে এবং গণতন্ত্রের জন্য লড়াইএ বামপন্থিদের শক্তিকে তুলে ধরেছে আমাদের নির্বাচনী সাফল্য। ১৯৭০এর জরুরী অবস্থার সময়ে গণতন্ত্রের পুন:প্রতিষ্ঠার লড়াই বামপন্থীদের জনপ্রিয় করে তুলেছিল। ফ্যাসিবিরোধী প্রতিরোধ এবং জনগণের অধিকারের জন্য বহমুখি সংগ্রাম আজকের প্রেক্ষিতে সিপিআই(এমএল)-কে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে।

বিজেপিকে বৃহত্তর শত্রু বলে চিহ্নিত করে তৃণমূল কংগ্রেস(টিএমসি)-কে ছাড় দেওয়ার যে কথা আপনি বলছেন সীতারাম ইয়েচুরি ও বিমান বসু তাকে বাতিল করছে। তাঁরা বলছেন যে বিজেপি ও টিএমসি-কে সমানভাবে আক্রমণ করতে হবে। আপনার ভাবনা...

আমি কখনো চাইনি যে বামেরা টিএমসির প্রতি নরম হোক; আমি বলেছি যে বিজেপিকে বাংলায় প্রতিরোধহীনভাবে বামেরা যেন বাড়তে না দেয়। বিজেপি ও টিএমসিকে এক করে দেখা পশ্চিমবঙ্গের সমাজের কোন অংশই গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করেনি – সেই সমান ভাবে দেখার তত্ব সিপিআই(এম)-কে কেবল দ্বিমুখি চাপে ফেলছে; যারা টিএমসি-কে মূল লক্ষ্য মনে করে তারা বিজেপি’র দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে এবং বিজেপি’র উত্থানে বিব্রত মানুষজন টিএমসির’র দিকে সরে যাচ্ছে। কেবল টিএমসি সরকার বিরোধিতার বাজনা বাজিয়ে বামেরা শক্তিশালী হতে পারবে না।  

২০১৯এর নির্বাচনে বিজেপি ৪০% ভোট পেয়েছিল। রাজ্য ক্রমাগত বিজেপি ও টিএমসি’র মধ্যে মেরুকৃত হচ্ছে। কীভাবে বামেরা নিজস্ব জায়গা তৈরি করতে পারবে?

লোকসভা ও বিধানসভা  নির্বাচনের প্রেক্ষিত আলাদা। মোদীর দ্বিতীয় দফা দেশের পক্ষে এক নিরবিচ্ছিন্ন বিপর্যয়ে রূপান্তরিত হচ্ছে। শ্রমিক, কর্মপ্রার্থী যুবক এবং সাধারণ জনগণ বেসরকারিকরণ এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয়, বিপুল কর্মহীনতা, মজুরি ছাঁটাই, মূল্যবৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতার ধাক্কার মুখোমুখি হচ্ছে। এই অবস্থায় বিজেপি’র ভোট মারাত্মকভাবে কমতে পারে।

বিজেপি’র ২০১৯ লোকসভার ভোটের সঙ্গে ঝাড়খন্ড ও বিহারের বিধানসভা নির্বাচনের ভোটের তুলনা করলে আমরা কীভাবে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির ভোট কমতে পারে তার একটা পরিস্কার ধারণা পেতে পারি।

পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী আন্দোলনের এক শক্তিশালী ঐতিহ্য আছে, ২৬ নভেম্বরের ধর্মঘটের সাড়া এবং কৃষকদের প্রতিবাদ বামেদের জন্য বিপুল সম্ভাবনার প্রতি ইঙ্গিত করছে। মূল বিষয়টি হল যে এই ধারাটা বজায় রাখতে হবে এবং বিজেপি’কে আবহাওযাকে বিষিয়ে দিতে, বিষয়বস্তুকে বিপথগামী করতে এবং জনগণের ক্রোধকে হাইজ্যাক করতে এবং তাকে তাদের বিভাজনের কর্মসূচীর অনুকূলে নিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না।

অনেকেই বলেন যে বিজেপি’র উত্থান বামেদের পতনের বিনিময়ে ঘটছে বলে মনে হয়। যখন আপনি বলছেন যে, বিজেপি অনেক বড় বিপদ, তখন কি আপনি মনে করেন না যে তা ভোটারদের আরো দূরে ঠেলে দেবে?

পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির উত্থান সমস্ত দলের ক্ষতি করেই হয়েছে, কংগ্রেস, টিএমসি এবং বাম। আমরা বামেদের ভোটের অংশ কমে যাওয়াতে চিন্তিত কারণ বিজেপির সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট রাজনীতির বিরুদ্ধে আদর্শগতভাবে সবথেকে বেশি দৃঢ় এবং দায়বদ্ধ থাকা উচিৎ বাম ভোটারদের। প্রথমত, সংজ্ঞাগতভাবেই বাম ভোট বিজেপিবিরোধী হওয়ার কথা। টিএমসি’র বিরুদ্ধে ক্রোধের কারণে বিজেপি’র পক্ষে ভোট দেওয়া বাম ভোটারদের পক্ষে আত্মঘাতী হবে, আমরা কেন বামেদের বলশালী করে একটি কার্যকরী রাজনৈতিক বিকল্প হিসেবে তাকে জনগণকে একত্র করার ক্ষমতাশালী কেন্দ্রে পরিণত করতে পারব না?

lkki

মোদী সরকার আন্দোলনে বিভেদ সৃস্টি করার চক্রান্ত করছে। এর বিরুদ্ধে কৃষকের সংগ্রামী ঐক্য মজবুত করার আহ্বান জানালো সারা ভারত কিষাণ মহাসভা (এআইকেএম)। প্রবল ঠান্ডার মধ্যে লাখো কিষাণ রাজধানী দিল্লীর রাজপথে অবস্থান করে চলেছে। প্রতিদিন আন্দোলনকারী কৃষকের সংখ্যা বাড়ছে। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ সংহতিতে এগিয়ে এসেছে। এই মুহুর্তটা কৃষি আইনের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা করার সময় নয়। সবার আগে নয়া কৃষি আইন ও বিদ্যুৎ বিল প্রত্যাহার করতে হবে। এই আওয়াজ তুলে ধরে দিল্লীর আন্দোলনকে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার ডাক দিলেন এআইকেএম সর্বভারতীয় সম্পাদক রাজারাম সিং। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গত ১ ডিসেম্বর ৩৫ জন কৃষক নেতার সাথে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের বৈঠকে কোন সমাধান সূত্র বেড়িয়ে আসেনি। বৈঠকে ছিলেন কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রী নরেন্দ্র সিং তোমার, বাণিজ্য মন্ত্রী পীযুস গোয়েল, রাস্ট্রমন্ত্রী সোম প্রকাশ। ৩২ জন কৃষক নেতা ছিলেন পাঞ্জাব ইউনিয়ন থেকে, ১ জন হরিয়ানা, ২ জন এআইকেএসসিসি ও আরকেএমএস থেকে। এই বৈঠকে কেন্দ্রীয় সরকার ৫ সদস্য বিশিষ্ট এক কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেয়, যারা কৃষি আইন সম্পর্কে উত্থাপিত বিরোধগুলি খতিয়ে দেখবে। কৃষক নেতারা এই প্রস্তাব সম্পূর্ণ খারিজ করে দেন। তারা বলেন, এ জাতীয় কমিটি অতীতে বহুবার হয়েছে, কিন্তু সেগুলি কোনেরকম ফলপ্রসু হয়নি। ৩ ডিসেম্বর পরবর্তী বৈঠক হওয়ার কথা। নয়া কৃষি আইন বিরোধিতার পয়েন্টগুলি কি কি সেটা বিস্তারিতভাবে এবং আরও নির্দিষ্টভাবে জানানোর জন্য কেন্দ্রীয় সরকার কৃষক নেতাদের কাছে প্রস্তাব দেয়, যা পাঠিয়ে দেওয়া হবে বলে জানানো হয়। কিন্তু ছোট খাটো সংশোধনী দিয়ে কৃষি আইনের মূল মূল ক্ষতিকারক দিকগুলিকে অব্যাহত রাখার চক্রান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী কৃষকরা দৃঢ়পণ অবস্থান গ্রহণ করেন। যেমন, পঞ্জাবের কৃষক নেতারা জোরের সাথে বলেন, আমাদের লড়াই কেবলমাত্র ফসলের সহায়ক মূল্যর জন্যই নয়, কৃষিক্ষেত্রে কর্পোরেট দখলদারী কায়েম করার নীতির বিরুদ্ধে। এ লড়াই বাঁচার লড়াই। কিছুতেই আমরা লড়াইয়ের ময়দান ছাড়বো না। এই পরিস্থিতিতে আন্দোলনকে সারা দেশে আরও ব্যপক ও তীব্রতর করে তোলার জন্য এআইকেএসসিসি আহ্বান জানিয়েছে।

এআইকেএম পশ্চিমবঙ্গ শাখার পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে কলকাতায় রাজভবন অভিযানে হাজার হাজার কৃষক অংশগ্রহণ করবে। তার আগে চলতি সপ্তাহে রাজ্যের জেলায় জেলায় সংগঠিত হবে কৃষকদের সড়ক অবরোধ।

- জয়তু দেশমুখ    

bnnssss

হুগলী

কেন্দ্রীয় সরকারের নয়া কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে লাখো কিষাণের দিল্লী অভিযানের প্রতি সংহতি এবং কৃষকদের উপর মোদী সরকারের বর্বর আচরণকে ধিক্কার জানিয়ে হুগলী জেলার গ্রাম-শহরে প্রায় প্রতিদিনই পার্টি এবং বিভিন্ন বামপন্থী দল ও গণসংগঠনগুলির উদ্যোগে একের পর এক মিছিল, সমাবেশ ও বিক্ষোভ কর্মসূচী পালিত হচ্ছে।       

জেলাস্তরের কেন্দ্রীয় কর্মসূচীটি অনুষ্ঠিত হয় ২৭ নভেম্বর তারকেশ্বরের পূর্ব রামনগরে। এখানে পঞ্চায়েত সংলগ্ন মাঠে এআইকেএসসিসি’র হুগলী জেলা কমিটির ডাকা সমাবেশে প্রায় এক হাজার কৃষক ও কৃষিশ্রমিক উপস্থিত ছিলেন। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতির রাজ্য সম্পাদক সজল অধিকারী, সিপিআই(এম) নেতা সুদর্শন রায়চৌধুরী, এআইকেএস নেতা ভক্তরাম পান, অগ্রগামী কিষাণ সভার শিবপ্রসাদ মালিক প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।     

২৮ নভেম্বর গুপ্তিপাড়া বাজারে পার্টির বলাগড় ব্লক কমিটির উদ্যোগে বিক্ষোভ কর্মসূচী পালিত হয়। বিক্ষোভ শেষে মোদীর কুশপুতুল জ্বালানো হয়। বিক্ষোভ কর্মসূচীতে সেখ আনারুল, শোভা ব্যানার্জী প্রমুখ নেতারা উপস্থিত ছিলেন। ৩০ নভেম্বর পান্ডুয়া ব্লকের বৈঁচিতে জিটিরোড চৌমাথায় স্বল্প সময়ের বিক্ষোভ শেষে নরেন্দ্র মোদীর কুশপুতুল দাহ করা হয়। কর্মব্যস্ত জিটিরোডে মানুষের ভীড় জমে যায়। আয়ারলা নেতা নিরঞ্জন বাগ ও পার্টি নেত্রী সরস্বতী তুড়ি এই বিক্ষোভ কর্মসূচীতে নেতৃত্ব দেন। ১ ডিসেম্বর ধনেখালি ব্লকের আদিবাসী প্রধান কনুইবাঁকা গ্রামে বিক্ষোভ জমায়েতে নেতৃত্ব দেন পার্টির জেলা কমিটি সদস্য সজল দে, স্থানীয় পার্টি নেতা মহাদেব মুর্মু প্মুখ। বিক্ষোভ শেষে নয়া কৃষি আইনের প্রতিলিপি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।      

৩০ নভেম্বর হুগলীর বালি মোড়ে পার্টির চুঁচুড়া লোকাল কমিটির উদ্যোগে পথসভা সংগঠিত হয়। পথসভায় আয়ারলা নেতা সেখ আনারুল, শ্রমিক নেতা বটকৃষ্ণ দাস ছাড়াও বক্তব্য রাখেন এআইপিএফের সুদর্শন বোস। সভায় বর্ষীয়ান বামপন্থী নেতা সনৎ রায় চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। দীর্ঘক্ষণ পথসভার শেষে নরেন্দ্র মোদীর কুশপুতুল জ্বালানো হয়। ১ ডিসেম্বর কোন্নগর কোতরং এলাকায় পার্টি অফিস থেকে মহিলা, নির্মাণ শ্রমিক, ছাত্র-যুব ও মধ্যবিত্ত নাগরিকদের এক মিছিল বার করা হয়। মিছিলটি হিন্দমোটরের ২নং কলোনি বাজার, ইটখোলামোড়, নন্দনকানন, হিন্দমোটর রেল স্টেশন ও সংলগ্ন বাজার এলাকা পরিক্রমা করে বিনয় বাদল দীনেশ মোড়ে এসে শেষ হয়। মিছিল পরিসমাপ্তির সময় জমায়েতে বক্তব্য রাখেন যুব নেতা তথা পার্টির জেলা কমিটি সদস্য সৌরভ রায়। এরপর নয়া কৃষি আইনের প্রতিলিপি ও মোদীর কুশপুতুল জ্বালানো হয়।

ta

নদীয়া

দিল্লীতে কৃষক আন্দোলনের অন্যতম শরিক পশ্চিমবঙ্গ। এই আন্দোলন আমাদেরও আন্দোলন। এ বিষয়টিকে তুলে ধরে নদীয়ার ধুবুলিয়ায় প্রচার সভায় বক্তব্য রাখলেন কৃষক নেতা কলম বিশ্বাস, ঠান্ডু সেখ। ৩০ নভেম্বর ঐ প্রতিবাদ সভায় এছাড়াও বক্তব্য রাখেন এআইকেএম রাজ্য নেতা সুবিমল সেনগুপ্ত। তিনি বলেন, চুক্তি চাষের মধ্য দিয়ে মোদী সরকার ঘুরপথে কৃষকের জমি কর্পোরেট পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দিতে চাইছে। এ রাজ্যের কৃষকরা ফসলের ন্যায্য দাম পায় না। সার বীজের দাম দ্বিগুন করে দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় নীতির ফলে চুক্তি ও ভাগ চাষিরা দিন মজুরে পরিণত হবে এবং পরিশেষে তারা দলে দলে পরিযায়ী শ্রমিকের কাজে যুক্ত হবে। সমগ্র কৃষি ব্যবস্থাকে তুলে দেওয়া হবে কর্পোরেট পুঁজিপতিদের হাতে। এই নীতির বিরুদ্ধে সারা দেশের মতো এ রাজ্যের কৃষকরাও লড়াইয়ের ময়দানে রয়েছে। আগামী দিনে আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচী হিসাবে নদীয়া জেলায় সড়ক অবরোধ সংগঠিত হবে। এছাড়াও প্রচার সভায় বক্তব্য রাখেন আরওয়াইএ নেতা সন্তু ভট্টাচার্য। পরবর্তীতে ১ ডিসেম্বর সাধনপাড়া এলাকার বনগ্রামে অনুরূপ প্রচার সভা সংগঠিত হয়। চাপড়া এলাকায় কৃষক আন্দোলনের দাবিগুলিতে ব্যাপক পোস্টারিং করা হয়। সেখানেও অবরোধ কর্মসূচী সংগঠিত হবে বলে জানিয়েছেন কৃষক নেতা ধনঞ্জয় গাঙ্গুলী, ইনসান বিশ্বাস।

পুর্ব বর্ধমান

গত ২৭ নভেম্বর বর্ধমান রেল স্টেশন থেকে ৩০০ শতাধিক মানুষের যৌথ মিছিল শহর পরিক্রমা করে কেন্দ্রীয় সরকারের অফিসের সামনে বিক্ষোভ অবস্থানে জমায়েত হয়। মিছিলে ঋণ মুক্তি কমিটির ৭০ জন মহিলা ঋণগ্রস্ত মানুষ সামিল হন। শ্লোগান ছিল দিল্লির আন্দোলনরত কৃষকদের উপর অত্যাচার হচ্ছে কেন? মোদী সরকার জবাব দাও। কেন্দ্রীয় সরকারের নয়া কৃষি আইন জালিয়ে দাও পুড়িয়ে দাও। কৃষি ও কৃষক বিরোধী নয়া কৃষি আইন বাতিল করতে হবে। বিদ্যুত বিল ২০২০ বাতিল করতে হবে। ২লক্ষ টাকা পর্যন্ত সমস্ত ধরনের গরিবদের ঋণ মুকুব করতে হবে। বিক্ষোভ সভায় বক্তব্য রাখেন এআইকেএম-এর পক্ষ থেকে কুনাল বক্সী ও এআইকেএস-র পক্ষ থেকে অমল হালদার।

২৮ নভেম্বর কালনা ২নং ব্লকের অকালপোষ গ্রাম পঞ্চায়েতের আগ্রাদহ বাস স্ট্যান্ড বাজারে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন, এআইকেএম ও আয়ারলার পক্ষ থেকে মিছিল সংগঠিত করা হয়। দিল্লীর কৃষক আন্দোলনের উপর দমন-পীড়ন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে ও বিদ্যুত বিল ২০২০ বাতিলের দাবি এবং কেন্দ্রীয় সরকারের নয়া কৃষি আইন বাতিল-এর দাবিতে মিছিল গ্রাম পরিক্রমা করে। তারপর সভায় বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনোর জেলা কমিটির সদস্য রফিকুল ইসলাম।

১ ডিসেম্বর মন্তেশ্বর ব্লকের কুসুমগ্রাম বাজারে মিছিল করে আয়ারলা, এআইকেএম ও সিপিআই(এমএল) লিবারেশন-এর মন্তেশ্বর লোকাল কমিটির পক্ষ থেকে। মিছিলে দিল্লির কৃষক আন্দোলনের উপর দমন-পীড়ন-এর বিরুদ্ধে শ্লোগান ওঠে। কৃষক বিরোধী নয়া কৃষি আইন বাতিল-এর দাবি করা হয়। বিদ্যুত বিল ২০২০ বাতিলের দাবি তোলা হয়। মোদী হঠাও দেশ বাঁচাও শ্লোগান দিতে দিতে কৃষক বিরোধী ফ্যাসিস্ট ও কোম্পানির দালাল নরেন্দ্র মোদীর কুশপুতুল দাহ করা।

মুর্শিদাবাদ

মুর্শিদাবাদের বহরমপুর শহরে ২৭ নভেম্বর দিল্লির কৃষক আন্দোলনের উপর দমন-পীড়ন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে খাগড়া চৌরাস্তা মোড়ে ও কুঞ্জঘাটা বাজারে বিক্ষোভ সভা সংগঠিত করা হল। সভায় বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের মুর্শিদাবাদ জেলা কমিটির সদস্য অপুর্ব লাহিড়ী ও জেলা সম্পাদক রাজীব রায়।

bel

উত্তর ২৪ পরগণা

১ ডিসেম্বর বেলঘরিয়ায় কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে, কর্পোরেট কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে ও কৃষক আন্দোলনে দমন পীড়নের বিরুদ্ধে মিছিল এবং মোদীর কুশপুতুল পোড়ানো হয় সিপিআই(এমএল), আইপোয়া, আইসা এবং এআইসিসিটিইউ-র নেতৃত্বে। ২৭ নভেম্বর গাইঘাটায় কৃষক সমিতির নেতৃত্বে বিক্ষোভ ও কালা আইনের প্রতিলিপি পোড়ানো হয়। ঐদিন অশোকনগর ভুরকুণ্ডা অঞ্চলের হিজলিয়াঁ গ্রামে বাম কৃষক সংগঠনগুলির নেতৃত্বে বিক্ষোভসভা ও কপি পোড়ানো হয়। ঐদিন নৈহাটি স্টেশনে পার্টির উদ্যোগে বিক্ষোভসভা হয়। ৩০ নভেম্বর হাবরা নৈহাটি রোডে মগরা মোড়ে বাম কৃষক সংগঠনগুলির ডাকে বিক্ষোভসভা ও কপি পোড়ানো হয়। একই সাথে ONGC গ্যাস প্রকল্পে জমি নেবার প্রশ্নে স্বচ্ছতা ও কৃষকদের অধিকার রক্ষার দাবি জানানো হয়। বসিরহাটে পার্টি সহ বিজেপি বিরোধী দলগুলো মিলিতভাবে এক দৃপ্ত মিছিলে শহর পরিক্রমা করে। ১ ডিসেম্বর বেলঘরিয়া লোকাল কমিটি ও গণসংগঠনের যৌথ উদ্যোগে এলাকায় মিছিল ও মোদীর কুশপুতুল দাহ হয়। অশোক নগর শহর পার্টি কমিটির ডাকে মিছিল হয় গোল বাজারে এবং কালা কৃষি আইনের কপি পোড়ানো হয়। এ ছাড়াও সপ্তাহব্যাপী জেলাজুড়ে কর্মসূচী চলবে। ১ ডিসেম্বর বারাসাত শহরে AIPF এবং APDR এর উদ্যোগে এক প্রতিবাদ মিছিল সংঘটিত হয়। বারাসাত রেল স্টেশন থেকে শুরু করে শহরের ব্যস্ত পথ পরিক্রমা করে কলোনি মোড়ে মিছিল শেষ হয়। মিছিল শেষে বক্তব্য রাখেন AIPF-এর জেলা আহবায়ক সুজিত ঘোষ। বিকালের এই মিছিল এলাকার মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

sil

দার্জিলিং

কৃষক বিরোধী কৃষি বিল বাতিল এবং দিল্লিতে আন্দোলনরত কৃষকদের সংহতিতে দার্জিলিং জেলার রাঙাপাণিতে ৩০ নভেম্বর এআইকেএম, এআইকেএস এবং এআইসিসিটিইউ-র নেতৃত্বে একটি মিছিল পার্টি অফিসের সামনে থেকে শুরু হয়ে বাজার ঘুরে পার্টি অফিসের সামনে এসে শেষ হয়। নেতৃত্বে ছিলেন এআইকেএম-এর দার্জিলিং জেলা সম্পাদক পবিত্র সিংহ, জেলা সদস্য শরত সিংহ, পঞ্চা বর্মণ, দীপক ঘোষ, এআইকেএম-এর ইন্দ্রনাথ সরকার প্রমুখ। ১ ডিসেম্বর শিলিগুড়ি প্রধান ডাকঘরের সামনে এআইসিসিটিইউ সহ কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলি অবস্থানে বসে দুপুর ২টা থেকে ৪টে পর্যন্ত। প্রতিবাদ অবস্থানে বক্তব্য রাখেন এআইসিসিটিইউ-র পক্ষ থেকে অভিজিৎ মজুমদার, সিআইটিইউ-র সমন পাঠক প্রমুখ।

josh

২৯ নভেম্বর শহীদ কমরেড জহর (সুব্রত)-কে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয় পার্টির রাজ্য অফিসের সামনে উপস্থিত ছিলেন পার্টির রাজ্য েনতৃবৃন্দ কার্তিক পাল, পার্থঘোষ, বাসুদেব বোস, অতনু চক্রবর্তী, ধীরেশ গোস্বামী, প্রবীর দাস, দিবাকর ভট্টাচার্য; ছাত্র নেতা স্বর্ণেন্দু, সৌমেন্দু, অন্বেষা, দীপায়ন, ঐশীক; অশোক সেনগুপ্ত, বাবুন দে, বাবু ভট্টাচার্য, বাবলু মাণ্ডি ও আরো অনেকে। পার্টিকে পুনর্গঠিত করা এবং বিশেষত বিহারের ভোজপুরের বিপ্লবী কৃষক সংগ্রাম সংগঠিত করতে কমরেড জহরের বিশিষ্ট অবদান সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন পার্টির রাজ্য সম্পাদক পার্থঘোষ। স্মরণ কর্মসূচী পালন হয় বাঘাযতীন মোড়ে, মাল্যদান করেন নীতীশ রায়, নিত্যানন্দ ঘোষ সহ আরো অনেকে। শ্লোগানে সচকিত মানুষের সামনে নিত্যানন্দ, কমরেড জহরের বীরত্বপূর্ণ ভোজপুরের লডাই সাধারণ সম্পাদক হিসাবে পার্টিকে সংগঠিত করা ও বীরের মতো শহীদত্ব বরণের অমর কথা তুলে ধরেন। একজন পথচারী নিজে থেকেই এসে শহীদবেদীতে পুষ্পার্ঘ প্রদান করেন।

বজবজে পার্টির জেলা অফিসের সামনে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন জেলা সম্পাদক কিশোর সরকার সহ জেলা কমিটির সদস্যবৃন্দ দিলীপ পাল, অঞ্জন ঘোষ, দেবাশীষ মিত্র, পঞ্চু ঘোষ, মিহির ধাড়া এবং আরো অনেকে।

২৯ নভেম্বর মন্তেশ্বর থানার কুলুট গ্রামে সিপিআই(এমএল)-এর ২য় সাধারণ সম্পাদক ভোজপুরের কৃষক আন্দোলনের বীর শহীদ কমরেড সুব্রত দত্ত (জহর)-এর ৪৬তম শহীদ দিবস পালন করেন। স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। শহীদ বেদীতে মাল্যদান ও এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। কমরেড জহরের কীর্তি অবিনশ্বর হোক। কমরেড জহর লাল সেলাম।

26hgh

২৬ নভেম্বর সাধারণ ধর্মঘটে হুগলী জেলার গ্রাম-গঞ্জ, শহর সর্বত্রই জনতার সাড়া ছিল নজরকাড়া। জেলা সদর চুঁচুড়ায় বাস স্ট্যান্ডে সকাল ৬টা থেকেই পিকেটিং শুরু করেন এআইসিসিটিইউ-র নেতৃত্বে চুঁচুড়া সংগ্রামী বাস শ্রমিক মঞ্চের সাথীরা। পার্টিতে যুক্ত হওয়া এই বাস কর্মচারী বন্ধুরা এ’দিন কোনো রুটের বাস চালাননি। বেলা বাড়ার সাথে সাথে অন্যান্য বামপন্থী সংগঠনের সাথে সিপিআই(এমএল) ও এআইসিসিটিইউ-র জেলা সম্পাদকের নেতৃত্বে ধর্মঘটীরা চুঁচুড়া কোর্ট, বাজার সহ বড় এলাকা জুড়ে মিছিল সংগঠিত করেন। গ্রামাঞ্চলে ধনিয়াখালির মল্লিকপুর, কনুইবাঁকা, বেলমুড়ি সহ বিভিন্ন এলাকা পরিক্রমা করে আয়ারলা, আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চ এবং পার্টির নেতৃত্বে দীর্ঘ মিছিল। পোলবা-দাদপুর ব্লকের মধ্যে দিয়ে যাওয়া দিল্লি রোডের সুগন্ধ্যা মোড়ে অবরোধ করেন সিপিআই(এমএল) ও সিপিআই(এম) কর্মীরা। বলাগড়ে ধর্মঘটের ব্যপক সাড়া পড়ে গুপ্তিপাড়া স্টেশন বাজার, সোমড়া, জিরাট, খামারগাছি, ইনছুড়া, একতারপুর বাজার সহ সমগ্র মহীপালপুরে। ইটাগড় মোড়ে বিকালে মিছিল ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন সিপিআই(এমএল) ও আয়ারলার সদস্যরা।

bain

 

পান্ডুয়া ব্লকের বৈঁচি বাজার এলাকা জুড়ে সকালে সিপিআই(এমএল) ও সিপিআই(এম) যৌথভাবে মিছিল সংগঠিত করে। এরপর জিটিরোড অবরোধ করা হয়। এই কর্মসূচীতে এসইউসিআই(সি)-ও সামিল হয়। অবরোধ চলাকালীন কেন্দ্রের কৃষি আইনের প্রতিলিপি পোড়ানো হয়। প্রায় এক ঘণ্টা অবরোধের পর পুনরায় মিছিল করে বৈঁচি রেল স্টেশনে যাওয়া হয়। বেশ কিছুক্ষণ রেল অবরোধ রাখা হয়। এরপর মিছিল নিয়ে স্টেট ব্যাঙ্কের স্থানীয় শাখা ও এফএসসিএস সমবায় দপ্তরে পিকেটিং করা হয়। ধর্মঘটের সমর্থনে শহরাঞ্চলের উত্তরপাড়া বিধানসভা এলাকায় কোন্নগরের পার্টি অফিস থেকে সকালে মিছিল বেরোয়।

কোন্নগরের ধাড়সা জিটিরোড, ডি-ওয়াল্ড-ডি, দক্ষিণ পাড়া, ২৪ পল্লী, বেঙ্গল ফাইন মোড়, জোড়পুকুর হয়ে হিন্দমোটরের নন্দনকানন এলাকা ঘুরে ২নং কলোনি বাজারের মধ্য দিয়ে এসে পুনরায় পার্টি অফিসে এসে শেষ হয়। এলাকার প্রায় সবকটি বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন সাইটের কাজ বন্ধ করে বড় সংখ্যায় মিছিলে যোগ দেন নির্মাণ শ্রমিক সাথীরা, এই দীর্ঘ পথ হাঁটায় সাথে ছিলেন সমস্ত শারীরিক ক্লান্তি ও সমস্যাকে তুচ্ছ করে কয়েকজন প্রবীণ কমরেড এবং একঝাঁক মহিলা ও ছাত্র-যুব কর্মী। এআইসিসিটিইউ ও সিপিআই(এমএল)-এর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বন্ধ থাকে বিদ্যাসাগর বাজার ও হিন্দমোটর স্টেশন বাজার। রিষড়ায় স্টেট ব্যাঙ্কের কর্মচারিরা পার্টির পতাকা চেয়ে নিয়ে ব্রাঞ্চের গেটে লাগিয়ে সকাল থেকে পিকেটিং শুরু করেন। পরে আইসা, এআইসিসিটিইউ ও আরওয়াইএ-র সদস্যরা তাঁদের সাথে সংগঠিতভাবে যোগ দেন এবং ব্যাঙ্কের যাবতীয় কার্যক্রম বন্ধ থাকে।

addadd

স্বাধীনতার এত বছর পরেও ভারতের মূল নিবাসীদের নিজ ধর্মবিশ্বাসের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা মেলেনি! ‘আত্মনির্ভর ভারতের’ গল্পকাররাই বারংবার হুমকি দিচ্ছে আদিবাসীদের আত্ম জাতির পরিচয় কেড়ে নেওয়ার।

ভারতের জনগণনায় ছটি ধর্মছাড়া আর কোন ধর্মবিশ্বাসকে স্বীকৃতি বা মর্যাদা দেওয়া হয় না। তাই আশির দশক থেকেই ভারতের প্রায় সব রাজ্যের আদিবাসীরা নিজের জাতির আত্মপরিচয়ের জন্য লড়ছেন।

২০১১-র আদমশুমারি অনুসারে গোটা দেশে ৫০ লক্ষ আদিবাসী তাদের ধর্মহিসেবে ‘সারনা’ নথিভূক্ত করে।

সারনা ধর্মের অনুগামীরা প্রকৃতিতে বিশ্বাসী, তারা জল-জঙ্গল-জমিনকে নিজের ঈশ্বর মনে করেন, বনাঞ্চল রক্ষা করাই তাদের কাছে পবিত্রতা। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই আদিবাসীদের এই বিশ্বাস পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায় মুনাফার লোভে বনাঞ্চল কেটে কারখানা বানানো পুঁজিপতিদের। তাদের তাঁবেদাররা চাইবে এই বিশ্বাসকে মুছে ফেলতে। তাই আরএসএস উঠে পড়ে লেগেছে আদিবাসীদের হিন্দুতে কনভার্ট করার জন্য!

দীর্ঘদিনের লড়াইয়ের ফলে ঝাড়খন্ড বিধানসভায় সর্বসম্মতিক্রমে ‘সারনা আদিবাসী ধর্মকোড’ প্রস্তাব পাশ হলো। “আদিবাসীরা হিন্দুনয়” বললেন ঝাড়খন্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন। এই প্রস্তাবের বৃহত্তম দাবী হল ২০২১ সালের আদমশুমারির সময় আদিবাসীদের ধর্মের কলামে ‘হিন্দু’র পরিবর্তে পৃথক ধর্মের কোড লেখার বিকল্প দেওয়া। ঝাড়খন্ড বিধানসভায় আনা এই বিলে সারনা ধর্মের কোডের দাবি করা হয়েছে।

জনগণনায় আদিবাসীদের জন্য আলাদা কলাম রাখার দাবিতে ১৮ জানুয়ারী দিল্লিতে সংসদের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন ভারতের ১টি রাজ্যের আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ। তাঁরা দাবি তোলেন হিন্দুত্ববাদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। জোর করে হিন্দুহিসেবে নথিভূক্ত করানোর ফলে আদিবাসীদের সংস্কৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তাই তাঁরা পথে নেমেছেন।

অথচ আদিবাসীদের এই দাবিকে অগ্রাহ্য করে আরএসএস এক সুরে বলে যাচ্ছে তারা আদিবাসীদের হিন্দু হিসেবেই নথিভুক্ত করাবে! তাদের মধ্যে হিন্দুত্ববাদের প্রচার করবে।

দেশজুড়ে যখন নাগরিকত্ব হননকারী আইনগুলোর বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠেছে তখন আদিবাসী সমাজের মানুষও ধরতে পেরেছে তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার চক্রান্ত, তাইতো তাঁরা ছত্রিশগড় ঝাড়খন্ড সহ সমস্ত আদিবাসী প্রধান অঞ্চলে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। এই আন্দোলনকে ভাঙার ষড়যন্ত্র করতেই ভোপালে আরএসএসের কো-অর্ডিনেশন মিটিং সংগঠিত হয়। এই মিটিংয়ে মোহন ভাগবত বলেন আদিবাসীদের মধ্যে হিন্দুত্বের প্রচার করতে হবে, পাশাপাশি তাদের মধ্যে এনপিআর নিয়ে প্রচার করবে আরএসএস।

ভারতের বহুত্বের ঐক্যকে ভাঙতেই বিজেপি আরএসএস-এর ওয়ান নেশন থিওরি। তাই সমস্ত জাতিসত্তার উপর নখ দাঁত ফোটাচ্ছে ওরা।

- আমন শেখ    

bbbppp

আজ থেকে আঠাশ বছর আগে ৬ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক স্থাপত্য কীর্তি হিসেবে মান্য বাবরি মসজিদকে যেদিন ধ্বংস করে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার মতো অপকর্মটি করেছিলেন বিজেপি সহ সংঘপরিবারের বিভিন্ন নেতৃত্ববৃন্দ এবং তাদের উচ্ছৃঙ্খল হিন্দুত্ববাদিরা, সেদিন যে কলঙ্ক রেখা লিপিবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল ইতিহাসের পাতায় তার অপনোদন বোধহয় কখনও সম্ভব নয়। তবু দেশের কোটি কোটি মানুষ আশা করেছিলেন দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়ের নিকট থেকে একটা আশাপ্রদ রায় মিলবে যাতে করে ভারতীয় গণতন্ত্রের মুখের কালিমা অনেকটাই মুছে যাবে।

এই ঘটনার পরেরদিনই ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকার সম্পাদকীয় কলামে এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে লেখা হয়েছিল : হিন্দু ধর্মীয়  উন্মত্ততা তার কুৎসিত অপকর্মের একটা সাক্ষ্য রেখেছে গতকাল। প্রায় সাড়ে চারশ’ বছরের সুপ্রাচীন বাবরি মসজিদের মতো একটি ঐতিহাসিক স্থাপত্যশিল্পকে উন্মত্ত করসেবকরা ভেঙে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে এক দুঃস্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটিয়েছে। তাদের এই অপকর্ম ভারতীয় গণতন্ত্রের ঐতিহ্যকে কলঙ্কিত করেছে। অল্পসংখ্যক রাজ্য-পুলিশ বাহিনীর বিপ্রতীপে সেখানে উপস্থিত ছিল অনেক অনেক বেশি সংখ্যক ত্রিশূলধারী ধর্মোন্মত্ত করসেবক বাহিনী। আরএসএস, বজরংদল, বিশ্বহিন্দু পরিষদের জঙ্গি বাহিনী নিয়ে বিজেপি নেতৃবৃন্দ বাস্তবিক এক ফ্যাসিস্ত কার্যক্রমের মহড়া দিয়েছে। আদবানি সহ বিজেপির নেতৃবৃন্দ এই ন্যক্কারজনক কর্মের ব্যাপারে দায় অস্বীকার করলেও তাঁরা তাঁদের এই কলঙ্কিত হাত ধুয়ে ফেলতে পারবেন না। এসব কথা লেখার পর এই সম্পাদকীয় নিবন্ধে আরও লেখা হয়েছিল : দেশের সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে একত্র হয়ে এই খাদের কিনার থেকে দেশকে রক্ষা করার উদ্যোগ নিতে হবে এবং অবিলম্বে এই ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে নতুন করে বাবরি মসজিদ সংস্থাপন করে ভারতীয় গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধার করতে হবে। (The Hindu, December 7, 1992)

কিন্তু এই সম্পাদকীয় নিবন্ধের বক্তব্য বা আবেদন হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্তদের কাছে মান্যতা পায়নি, দেশের ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিও এমন কোনও ভূমিকা বা উদ্যোগ নিয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন যাতে করে সেই ধ্বংসস্তূপে বাবরি মসজিদের পুনর্নিমাণ সম্ভবের শিল্প হয়ে ওঠে। সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা সমবেত হয়ে আইন এবং বিচারব্যবস্থার ওপর নিবিড় আস্থা রেখেছিল।

তাঁর ‘বঙ্গদেশের কৃষক’-এ বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন: আমাদের দেশে ‘ভাল আইন’ ছিলনা, তাই ‘বিলাত’ থেকে ‘ভাল আইন’ আনা হয়েছে। এখন সেই আইন দেশে দেশে ‘চড়া দামে’ বিক্রি হচ্ছে। আর এর ফলেই ওকালতি, হাকিমি, আমলাগিরির অত ‘আধুনিক ব্যবসায়ের’ সৃষ্টি হয়েছে। আগে যারা নিজেদের পণ্যদ্রব্যের প্রশংসা তথা বিজ্ঞাপন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন অথচ দারিদ্র্য ঘুচত না, এখন এই আইনের আগমনে তাঁরা রীতিমত ‘বড়লোক’ হয়ে উঠেছেন। ফলে দেশের ‘শ্রীবৃদ্ধির আর সীমা’ নেই। কেননা দেশের সর্বত্রই ‘আইন’ মোতাবেক ‘বিচার’ হচ্ছে, ‘বে-আইনি’ কাজ করে এখন আর কেউ ‘সুবিচার’ এড়িয়ে যেতে পারেন না।

এই ‘সুবিচার’-এর পরিণতিতে বাবর-মির বাকি-র বংশধরেরা আজ আর ‘সুবিচার’-এর নির্মম হাত থেকে  নিষ্কৃতি পেলেন না! আটাশ বছর আগে এক ৬ ডিসেম্বরে যে অপকর্ম করেছিল  হিন্দুত্ববাদিরা সেইকাজ যে কত যথার্থ ছিল গত বছর ৯ নভেম্বর (২০১৯) আমাদের দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়ের সুবিচারের মাধ্যমে তা সপ্রমাণ হয়েছে! পাঁচজন বিচারপতির বেঞ্চ একদিকে যেমন নিছক বিশ্বাসকে গুরুত্ব দেননি, তেমনই অন্যদিকে তাঁরাই আবার বিতর্কিত স্থানে ‘ভগবান’ রামচন্দ্র যে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তা বিতর্কাতীত বলে জানিয়েছেন! একারণেই তাঁরা অবলীলায় ‘রামলালা’-কেই ওই জমি দান করে দেন! ফলে দেশের মানুষের দীর্ঘদিনের ন্যায়বিচারপ্রাপ্তির আশা চিরতরে তিরোহিত হয়েছে।

দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয় ভগবান নামক ‘রামচন্দ্র’-এর অলীক অস্তিত্ব এবং তাঁর নির্দিষ্ট জন্মস্থান(!)কে মান্যতা দিয়ে স্পষ্টতই একটা সাম্প্রদায়িক অবস্থান নিয়ে প্রতিপক্ষের ওপর তা চাপিয়ে দিয়েছেন! ইতিহাসের তথ্যের বিপ্রতীপে হিন্দুত্ববাদিদের ‘বিশ্বাসই’ তাঁদের নিকট গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে! বাবরি মসজিদ ধ্বংসের কাজকেও তাঁরা পরোক্ষভাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন! ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার ঘোষিত উচ্চারণকে আজ তাঁরা খারিজ করে দিয়েছেন একটি সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পরিপোষণার মধ্যে দিয়ে! বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দির-ই হবে -- চারজন বিচারপতির ‘বিরোধহীন’ রায়ের মধ্যে দিয়ে দেশে ‘সুপবন’ প্রবাহিত হলো, আর সেই সুপবনে হিন্দুত্বের বিজয় পতাকা উড়িয়ে দিয়ে তাতে লেখা হয়েছে ‘জয় শ্রীরাম’! হিন্দু ভারতবর্ষের অনেক কাছে চলে এলো মোদীর স্বপ্নের ভারত! রায়ে বাবরি মসজিদ ভাঙার কাজ প্রথামাফিক নিন্দিত হলেও আসলে তা নন্দিতই হয়েছে এবং সেই ভাঙার-কাজে যুক্ত যাঁরা ছিলেন তাঁরা কোনও শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেননি, এই রায়ই তার প্রমাণ! এই রায়ের পর ‘সংযত’ আবেগের উচ্ছ্বাসময় যৌবনের জলতরঙ্গ আর ধরে রাখতে পারেনি হিন্দুত্ববাদীরা। আরএসএস প্রধান বলেই দিয়েছেন মন্দির তো তাঁরা পেয়েই গিয়েছেন! আর পেয়ে যে গিয়েছেন তা তো গত ৫ অগাস্ট স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর পৌরোহিত্যে সেই একদা বিতর্কিত স্থানে রামমন্দির নির্মাণের লক্ষ্যে ‘পূজন’ সমাপনের মাধ্যমেই তা সপ্রমাণ হয়েছে। আর গত ৩০ সেপ্টেম্বর সিবিআই-এর স্পেশাল বিচারপতি সুরেন্দ্রকুমার যাদব তাঁর রায়ে জানিয়েছেন যে বাবরি মসজিদ ধ্বংস আসলে ছিল একটি ‘অপরিকল্পিত’ কাজ! কোনও পূর্ব পরিকল্পনামাফিক এই ধ্বংসকার্য সম্পন্ন হয়নি! ফলে এই মসজিদ ধ্বংসের কাজে অভিযুক্ত স্বয়ং আদবানি সহ সবাই অভিযোগ থেকে নিঃশর্ত মুক্তি পেয়েছেন! অথচ সেদিন (১৯৯২-এর ৬ ডিসেম্বর) বাবরি ধ্বংসের সময় আওয়াজ তোলা হয়েছিল: এক ধাক্কা আউর দো, বাবরি মসজিদ তোড় দো। (The Quint, September 30, 2020) আর এদিন (৩০ সেপ্টেম্বর) বিচারপতি জানালেন এই মসজিদ ধ্বংস আদৌ পূর্বপরিকল্পনা মাফিক ছিলনা!

গতবছরের ৯ নভেম্বর দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বাবরি মসজিদ বিবাদ সংক্রান্ত মামলার নিস্পত্তিমূলক রায়ের সঙ্গে এবছরের ৩০ সেপ্টেম্বরের সিবিআই আদালতের স্পেশাল বিচারপতির রায় একই মুদ্রার অন্যপিঠ হিসেবেই শাসক শ্রেণীর হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ত রাজনীতির পরিপোষণা দিয়েছে। স্বভাবতই এই হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদিদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ পথের লড়াই-ই আজ একমাত্র কর্তব্য হিসেবে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এবারের ৬ ডিসেম্বর সেই লড়াইয়ের নবসূচনার উদ্বোধন করুক। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে কেবল স্ট্রিটের যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ ফ্যাসিবিরোধিরা আওয়াজ তুলেছিলেন: ‘নো পাসারন’। এর পাশাপাশি আরও একটা আওয়াজ উঠেছিল: ‘নসোত্রোস পাসারেমোস’, যার অর্থ আমরা যাবোই। আজ দিল্লীতে কৃষকরা সরকারী ব্যারিকেড ভেঙে তো এই কথাটি বলে চলেছেন: আমরা যাবোই। তাঁরা এগোচ্ছেন। তাঁদের বাধা দিতে ব্যর্থ হয়েছে সরকারি বাহিনী। এবারের এই ৬ ডিসেম্বরও পথে নেমে এই আওয়াজ দুটিই উঠুক: আমরা ফ্যাসিবাদিদের আসতে দেবো না (নো পাসারন) এবং আমরা এগোবোই (নসোত্রোস পাসারেমোস)।

- অশোক চট্টোপাধ্যায়     

immvvv

ভারতের মানুষজনের আর্থিক অবস্থা আর দেশের অর্থনীতির মধ্যে সম্পর্ক খোঁজা বেশ কঠিন হয়ে পড়ছে দিন কে দিন। শহরের জীবন যাপনের নির্দেশকগুলির দিকে চোখ রাখলে অর্থনীতি কেমন চলছে তার হদিশ পাওযা যায় তেমন কোনো জটিল হিসেব নিকেশ ছাড়াই। বাসগুলিতে এখনও অবধি সেই ভিড় চোখে পড়ে না, যদিও সাবধানী উচ্চ মধ্যবিত্তকে খুশি রাখার সংবাদ মাধ্যমগুলি প্রতিনিয়ত বাসে নির্ধারিত সামাজিক দূরত্ব মানা হচ্ছে না বলে সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত সাধারণ মানুষকে গালিগালাজ করে চলেছে। কলকাতার রাস্তায় অনায়াসে ট্যাক্সি পাওয়া যাচ্ছে, কেউ কেউ তেলের দামের জন্য দশ বিশ টাকা বেশি চাইছেন, কেউ কেউ তাও নয়। শপিং মলে এই উৎসবের মরশুমেও ভিড় নেই। রেস্তরাতে নেই দরজার বাইরে লাইন, ভিতরে বসার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধের জন্য আসন কমে যাওয়া সত্বেও। ট্রেনতো সদ্য চলা শুরু করেছে। দূর পাল্লার ট্রেন এখনো নিয়মিত টাইম টেবল মেনে চলছে না। আমাদের সকলের পরিচিত দু-চার জন রয়েছেন যাদের কাজ চলে গেছে বা নিয়মিত বেতন হচ্ছেনা অথবা বেতন কমেছে। বহু পরিবারেই গৃহ-পরিচারিকাদের কাজ গিয়েছে। বিদ্যালয়গুলি খুলছে না, ফলে ছাত্রীছাত্রদের নিয়ে যাওয়া-আসার গাড়িগুলির এখন অবধি কাজ নেই। শিল্পের যে ক্ষেত্রটি কোভিডের ফলে একটুও ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি বা লাভজনক হযেছে, তথ্যপ্রযুক্তি পরিষেবা ক্ষেত্রে বাড়ি থেকে কাজ চলছে, ফলে সংস্থাগুলির দফতরগুলি প্রায় বন্ধ, এমনকি ব্যাঙ্গালোর হায়দ্রাবাদ, চেন্নাই, দিল্লি, কলকাতা, মুম্বাই-এ ভাড়াবাড়িতে থাকা বহু কর্মী নিজেদের পারিবারিক আবাসে ফিরে গেছেন; ফলে সেই বাড়িগুলির ভাড়া থেকে আয়, সেখানকার গৃহ পরিচারিকাদের আয়ও বন্ধ, যেমন বন্ধ ফাঁকা পড়ে থাকা দফতরগুলির উপর নির্ভরশীল বহু অস্থায়ী কর্মী বা ছোট ব্যবসায়ের কাজ। লকডাউনের দুমাস আগে হায়দ্রাবাদ গিয়ে দেখেছিলাম তথ্যপ্রযুক্তি পরিষেবার পেল্লায় পেল্লায় অফিস, আর তার আশেপাশে ভর্তি ভোজ্য-পানীয়ের দোকান। ওয়ার্ক ফ্রম হোমের জগতে সেগুলির ব্যবসা বন্ধ যদি নাও হয়, কমেছে তো নির্ঘাত। ছুটির মরশুমে মধ্যবিত্তের ভ্রমণ মোটামুটি বন্ধ, শীতের মরশুমেও তাতে খুব ফেরবদল হবে মনে হয় না। পরিচিত পরিজনদের প্রায় কাউকেই পুজোয় বা শীতের ছুটিতে কন্যাকুমারি বা কাশ্মীর যাওয়ার পরিকল্পনা করতে শুনছি না। দেশের অর্থনীতিতে জিডিপির ৯%এর কিছুটা বেশি আসে ভ্রমণ শিল্প থেকে। তার সিংহভাগই ধ্বংস হতে বসেছে।

সাদা চোখে যখন এমন মন্দার ছবি চোখে পড়ছে, তখন শুনতে পাওয়া যাচ্ছে, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, অর্থমন্ত্রী, মায় মুডি বলছে, দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে, বর্তমান আর্থিক বছরের তৃতীয় ত্রৈমাসিকে অর্থাৎ অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০২০ সময়কালেই নাকি জিডিপির ইতিবাচক বৃদ্ধি হবে। কেবল ভ্রমণ শিল্পেই যে ঘাটতি হবে তাই তো অর্থনীতিকে পিছনে ঠেলতে যথেষ্ট, কারণ এই ত্রৈমাসিকটি ভারতে ভ্রমণের সব থেকে ব্যস্ত সময়, তাছাড়া সরকার এলটিসি বা ছুটিতে ভ্রমণের টাকাকে অন্যখাতে ব্যয়ের জন্য ছাড় দিয়ে দিয়েছে। ফলে যা সাধারণ মানুষ অনুভব করছে বা সাধারণ বুদ্ধিতে অনুভূত হচ্ছে তার সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান বা অর্থমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর অনুধাবনের বেশ গরমিল রয়েছে। ওদিকে সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনোমির তথ্য অনুযায়ী অক্টোবর মাসে কর্মসংস্থান বা কাজ কমেছে ৫.৫ লক্ষ মানুষের; কাজ করতে ইচ্ছুক কিন্তু কাজ পাচ্ছে না এমন লোকের সংখ্যা অর্থাৎ বেকারের সংখ্যা বেড়েছে ১ কোটি ২০ লক্ষ, অক্টোবর মাসে। অক্টোবর মাসে শ্রমশক্তিতে অংশ গ্রহণের হার (লেবার ফোর্স পার্টিসিপেশন রেট বা এলএফপিআর), কর্মসংস্থানের হার ও বেকারির হার এই ৩টি সূচকেই অর্থনীতির বেহাল অবস্থা পরিলক্ষিত হয়েছে। এলএফপিআর দাঁড়িয়ে রয়েছে ৪০.৭%-এ, বেকারির হার সেপ্টেম্বরের ৬.৭% থেকে বেড়ে ৭% হয়েছে, কর্মসংস্থানের হার ৩৮.0% থেকে কমে ৩৭.৮% হয়েছে। অক্টোবর মাস উৎসবের মাস হওয়া সত্বেও শ্রম নিয়োগের ক্ষেত্রে এই ছবি কোনোমতেই উৎসাহ ব্যঞ্জক নয়। এলএফপিআর বলতে ১৫ বছরের উপরে বয়স্ক জনসাধারণের মধ্যে কাজ করতে ইচ্ছুক জনগণের অনুপাতকে বোঝানো হয়। সেই অনুপাতটি ক্রমাগত গত কয়েক বছরে কমেছে। সাম্প্রতিক অতীতে লকডাউনের আগে যে অনুপাত ছিল অক্টোবর মাসে তার তুলনায় সেই অনুপাত ২% কম।  সিএমআইই-র তথ্য অনুযায়ী ২০১৬-১৭ সালে এলএফপিআর ছিল ৪৬.১%, ২০১৭-১৮ সালে নোট বাতিল ও জিএসটি’র প্রভাবে তা ২.৫৬% কমে যায়, ২০১৮-১৯এ কমে ০.৭৭%, ২০১৯-২০তে ০.১৪% কমে পৌঁছয় ৪২.৭%-এ। আগেই বলেছি অক্টোবর মাসে তা আরো ২%  কমে  ৪০.৭% হয়েছে। ফলে কর্মক্ষম জনসাধারণের মধ্যে কাজ করতে ইচ্ছুক মানুষের সংখ্যা কমছে। অন্যদিকে এমপ্লয়মেন্ট রেট বা কর্মসংস্থানের হারও কমেছে। ২০১৬-১৭ সালের ৪২.৭% থেকে ২০১৮-১৯ সালে ৪১.৬%, ২০১৮-১৯ বছরে ৪০.১% ও ২০১৯-২০ সালে ৩৯.৪% হওয়ার পরে অক্টোবরে তা আরো ১.৬% কমে  দাঁড়িয়েছে ৩৭.৮%-এ।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বা আইএলও-র মডেল অনুসারে সারা বিশ্বে কর্মক্ষম বয়সের জনসংখ্যার ৫৭.২% কাজ করছে। ওই মডেল অনুসারে ভারতের ক্ষেত্রে ওই হার ৪৭%, দক্ষিণ এশিয়াতে ৪৮%, পাকিস্তানে ৫০%, শ্রীলঙ্কায় ৫১% ও বাংলাদেশে ৫৭%। চিনের হার অনেক বেশি, ৬৫%। ফলে ভারতকে বিশ্বমানে বা প্রতিবেশি দেশের সমমানে পৌঁছতে গেলে বহুদূর পথ যেতে হবে। ভারতের জিডিপি সাম্প্রতিক অতীতে দ্রুত বাড়ছিল। কিন্তু নিয়োজিত জনসংখ্যা কমছিল। মোট নিয়োজিতের সংখ্যা ২০১৬-১৭ সালে ৪০.৭ কোটি থেকে কমে ২০১৯-২০ তে ৪০.৩ কোটিতে পৌঁছেছিল। অক্টোবর, ২০২০ তে তা ৪ কোটির নিচে নেমেছে। ফলে দেশে আগেই কর্মহীন বৃদ্ধি বা জবলেস গ্রোথ হচ্ছিল, তা আরো প্রকট হয়ে উঠছে। একদিকে জনসংখ্যা বাড়ছে, অন্যদিকে কর্মসংস্থান কমছে।

দেশ জোড়া কর্ম সংস্থানের এই দুরবস্থার মধ্যে যখন অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর কথা, আত্মনির্ভর ভারতের কথা শোনানো হয়, তখন সন্দেহ জাগে সত্যিটা কী? গ্রাম শহরের সরকারি বিদ্যালয়ে পড়াশোনা বন্ধ, সেইসব সাধারণ ছেলে মেয়েরা গত ৮-৯ মাস কোনো পড়াশোনার মধ্যে নেই, সরকারের চর্চায় তাদের কোনো কথা নেই। বিশ্বব্যাঙ্কের সমীক্ষা অনুযায়ী শিক্ষায় এই দীর্ঘ লকডাউনের জন্য ভারত প্রায় ২৯ লক্ষ কোটি টাকার সম্মুখিন হবে। মনে রাখা দরকার অনলাইন শিক্ষার ফলে বিত্তবান বেসরকারি বিদ্যালয়ের ছাত্রীছাত্ররা নিম্নবিত্ত ছাত্রদের থেকে অনেক বেশি সুবিধেজনক অবস্থানে আছে। ফলে এই ক্ষতির ভার বহন করতে হবে গরিব পরিবারের ছাত্রীছাত্রদের। একইভাবে প্রতিষ্ঠিত শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলিতে মজুরির তথ্য অনুযায়ী এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকে মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছে চলতি মূল্যে টাকার অঙ্কে ২.২%, জুলাই-সেপ্টেম্বরে তার পরিমাণ ৫%এর আশেপাশে হবে। ফলে সামগ্রিকে তা ৩-৩.৫% হবে। যেহেতু মূল্যবৃদ্ধির হার ৬-৭%এর উপরে যাচ্ছে তাই ওইসব তালিকাভুক্ত কোম্পানিতেও এপ্রিল-সেপ্টেম্বর ষান্মসিকে প্রকৃত মজুরি কমবে। ওই ধরণের সংগঠিত ক্ষেত্রের সংস্থাগুলিতে যখন এই হাল, তখন অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের মজুরি ও নিয়োগের হারের করুণ অবস্থা আন্দাজ করা যেতে পারে।

কর্মসংস্থান, বেকারি, সমস্ত বিষয়ে যখন সাধারণ বিত্তহীন মানুষ দুর্বিপাকে, ঠিক তখনই শেয়ার বাজার অতিদ্রুত বেড়ে চলেছে। লকডাউনের সময়ে শেয়ার সূচকে যে ধ্বস নেমেছিল তাকে পূরণ করে তা উপর দিকে চলেছে। বাস্তব অর্থনীতির সঙ্গে লগ্নিপুঁজির অর্থনীতিতে কতটা সম্পর্করহিত তা ফাটকা বাজার দেখলে বোঝা যাচ্ছে। একই সঙ্গে নিম্নবিত্ত জনতার উপরে চাপ বাড়াচ্ছে ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার। গত সাড়ে ছয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছে সেই হার ৭.৬১%। মনে রাখা দরকার ব্যাঙ্কের ফিক্সড ডিপোজিটে সুদের হার কমতে কমতে ৬%এর নীচে নেমে গেছে। ফলে অর্থনীতির ভাষায় প্রকৃত সুদের হার এখন ঋণাত্মক। কেবল ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটছে তাই নয়, পাইকারি মূল্যও অক্টোবরে বেড়েছে ১.৪৮%, গত ৮ মাসে সর্বোচ্চ।

সাধারণ যুক্তিতে বোঝাই যায় যে, যাতায়াতের উপরে আরোপিত বিধিনিষেধ যখন উঠে যাচ্ছে, মানুষ আস্তে আস্তে যখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরছে তখন অর্থনৈতিক কাজকর্ম কিছুটা বাড়বে। কিন্তু তা দেশের অর্থনীতিতে কাঙ্খিত গতি আনবে তেমনটা নাও হতে পারে। পরপর দুটি ত্রৈমাসিকে ঋণাত্মক অর্থনৈতিক বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হয়েছে। ফলে তাকে অর্থনীতির পরিভাষায় মন্দার আক্রমণ বলা যেতে পারে। কিন্তু, যেহেতু, তা বাহ্যিক কারণে, একটি অতিমারীর কারণে ঘটেছে তাই স্বাভাবিক অর্থনীতির সংজ্ঞায় একে মন্দা বলে অভিহিত করা যায়না। তবে যদি এই বছরের শেষ দিকে অর্থনৈতিক বৃদ্ধিতে দেশ পৌঁছায়ও, তা সম্ভবত সরকারী পরিসংখ্যানেই ঘটবে। কারণ সরকারী পরিসংখ্যান অত্যন্ত বেশি সংগঠিত ক্ষেত্রের উপর নির্ভরশীল। অসংগঠিত বা ইনফর্মাল সেক্টরের তথ্যের সঙ্কলন হয় না, তার অনুমান করা হয় সংগঠিত ক্ষেত্রের উৎপাদন, মূল্য সংযোগের তথ্যের উপর নির্ভর করে। যেহেতু এই পুরো অতিমারির প্রক্রিয়ায়, নোট বাতিলে, জিএসটি’তে অসংগঠিত ক্ষেত্রটি অনেক বেশি আক্রান্ত হয়েছে তাই সংগঠিত ক্ষেত্রের উপর নির্ভর করে অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি হিসেব করা ভুল হবে, উদ্দেশ্যপ্রণীতভাবে করে তা হবে অনাচার। যে অনাচারের অন্যায় শাসক দলের রীতি কারণ তারা মনে করে আদানির উন্নতি হলেই দেশের রামা কৈর্বর্ত্য ও রহিম শেখের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। আম্বানির সম্পদ বৃদ্ধি পাওয়ার অর্থ যে রাস্তার ধারের হকার বা চা-দোকানির সম্পদশালী হয়ে ওঠা নয়, এটা তারা জানলেও প্রচার অন্যরকম করে।

- অমিত দাশগুপ্ত     

baacor

রিজার্ভ ব্যাংকের একটি আভ্যন্তরীণ কমিটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ব্যবস্থা আরও উন্নত ও লাভজনক করার লক্ষ্যে কর্পোরেট সংস্থাকে ব্যাংক খোলার লাইসেন্স দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। ২০১৩ সালে এইরকম একটি প্রস্তাব এসেছিল কিন্তু আইডিএফসি এবং বন্ধন ফিনান্সিয়াল সার্ভিসেস ব্যতীত আর কেউই শীর্ষ ব্যাংক নির্ধারিত যোগ্যতার মান অর্জন করেনি। ২০১৪ সালে রঘুরাম রাজন যখন রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন তখন কর্পোরেটদের ব্যাংক খোলা নামঞ্জুর করে দেওয়া হয়। ঝাড়পোঁচ করে আবার সেই প্রস্তাবটি ঝুলি থেকে বার করা হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সংস্কারের প্রসঙ্গ উঠলেই সরকারের একটাই সমাধানসূত্র - বেসরকারীকরণ। এটাই বিশল্যকরণী, সব সমস্যার সমাধান করে দেবে। এবার কর্পোরেটদের মাধ্যমে সেটা করার প্রস্তাব।

শুরুতেই বলে রাখা ভালো এটা ব্যাংক শিল্পে অবধারিতভাবে বিপর্যয় ডেকে আনবে। প্রথমত কোনো কর্পোরেট সংস্থা ব্যাংক চালানোর অর্থ মালিক ও পরিচালক এক হয়ে যাবে, বাণিজ্যিক পুঁজি ও ব্যাংক পুঁজি হবে একাকার। ‘কানেকটেড’ লেন্ডিং, অর্থাৎ যে ঋণ দিচ্ছে এবং যে ঋণ নিচ্ছে দুজন একই ব্যক্তি, ইতিমধ্যেই চালু আছে, এটা নতুন কিছু নয়। সম্প্রতি হয়ে যাওয়া ইয়েস ব্যাংকের সংকট জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ। মূল প্রমোটার রানা কাপুর তাঁর তাঁবেদার বিভিন্ন সংস্থাকে দেদার ঋণ দেয়, সেখান থেকে দফায় দফায় তাঁর স্ত্রী, কন্যাদের অ্যাকাউন্টে টাকা জমা হয়। ২০০৪ থেকে শুরু করে দশ বারো বছরের মধ্যে ব্যাংক ফুলেফেঁপে ওঠে তারপর হুড়মুড় করে সেটির পতন হয়। শেষমেশ স্টেট ব্যাংক তাদের ৪৯% শেয়ার কিনে আমানতকারীদের রক্ষা করে। প্রায় ৪৫০০ কোটি টাকা তছরুপের দায়ে রানা কাপুর এখন ইডির তদন্তাধীন। ‘কানেকটেড’ লেন্ডিং বাস্তবে ক্রোনি লেন্ডিং। ঋণগ্রহিতার ব্যবসার ঠিক মতো যাচাই হয় না, তাঁর লেনদেনের মূল্যায়ন করা হয় না, শুধুমাত্র মালিক/পরিচালকের সাথে সম্বন্ধ বা যোগসাজশের কারণে তাকে সাধারণ মানুষের গচ্ছিত অর্থ পাইয়ে দেওয়া হয়। চাটুকারদের রমরমা বাড়ে, ব্যাংক ধসে পড়ে। ১৯৯৭-৯৮ সালে জাপান, কোরিয়াতে এরকমটা হয়েছে।

দ্বিতীয়ত কর্পোরেটরা যদি ব্যাংকের মালিকানা পায় তাহলে তারা প্রায় একছত্র অর্থনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হবে যা তারা খেয়ালখুশি মতো ব্যবহার করতে পারবে। মনে রাখতে হবে সরকারি ব্যাংকের আমানত প্রায় ১৪০ লক্ষ কোটি টাকা যা আদানি, আম্বানিরা সামান্য কিছু বিনিয়োগ করে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। এই ধনকুবেররা তাদের সীমাহীন অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি কাজে লাগিয়ে ছোটখাটো ব্যাংক এবং আর্থিক সংস্থাগুলি করায়ত্ত করবে, ব্যাংক শিল্পে তাদের একচেটিয়া আধিপত্য কায়েম হবে। অত্যন্ত প্রভাবশালী রাজনৈতিক যোগাযোগের কারণে রিজার্ভ ব্যাঙ্কও এদের ক্রীড়ানকে পরিণত হবে। শীর্ষ ব্যাংক সংকটের গভীরতা অনুমান করতে পারলেও এই ধনকুবেরদের প্রবল প্রভাবের কারণে সংকটের মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা করবে। গত অক্টোবর মাসে আমেরিকার কংগ্রেস গুগল, ফেসবুক, অ্যাপেল, অ্যামাজনের বিরুদ্ধে ছোট সংস্থাকে বিপন্ন করা ও একচেটিয়া অধিকার কায়েম করার অভিযোগ আনে এবং এই প্রবণতা রোধ করার জন্য এদের ব্যবসার কিছু অংশ খণ্ডিত করার প্রস্তাব আনে। এর থেকে বোঝা যায় বাণিজ্যিক ও ব্যাংক পুঁজির মেলবন্ধন এবং সেটির একচেটীয়াকরণ রাজনৈতিক ব্যবস্থাকেই অসহায় ও সংকটাপন্ন করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।

তৃতীয়ত এই কর্পোরেটদের আরও বহু ব্যবসায় বিনিয়োগ আছে। যেমন আম্বানিদের টেলিকমে বিপুল বিনিয়োগ আছে, আদানিদের আছে তেল, গ্যাস, বিদ্যুতে। এঁদের ব্যবসার ক্ষেত্র ক্রমবর্ধমান, প্রতিনিয়ত তা অজানা অনাবিষ্কৃত ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ছে। এতে মুনাফা যেমন আছে, ঝুঁকিও আছে। এই বিশাল সাম্রাজ্যে বিনিয়োগ উত্তরোত্তর বাড়াতে তারা সরকারি ব্যাংকের সম্পদ কাজে লাগাবে, এই সম্পদ ঐ ঝুঁকির শিকার হবে অথচ সেটি থেকে মুনাফার কারণে ব্যাংক শিল্পের এতটুকুও লাভ হবে না। সরকারি ব্যাংকের এই সম্পদ তাঁদের অন্যান্য ব্যবসার উত্থান পতনের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জুড়ে যাবে। এরফলে ব্যাংকে টাকা জমা রাখা আম আদমির পক্ষে আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে।  

ব্যাংক শিল্পের সংকট নিয়ে সরকারের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। অনুৎপাদক সম্পদ বাড়ছে, মূলধন নেই, পরিষেবা খারাপ। অতএব বেসরকারীকরণ কর। অথচ গত পঞ্চাশ বছরে যত ব্যাংক ফেল করেছে তার অধিকাংশই বেসরকারী। ইদানিং তিনটি ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে, তিনটিই প্রাইভেট -পাঞ্জাব এন্ড মহারাষ্ট্র কো-অপারেটিভ ব্যাংক, ইয়েস ব্যাংক এবং লক্ষ্মীবিলাস ব্যাংক। ইয়েস ব্যাংকের মতো পিএমসি ব্যাংকেও যাবতীয় সম্পদ মূল প্রমোটার ওয়াধাওয়াদের স্বার্থে কাজে লাগানো হয়েছে। ব্যাংকের মোট ঋণের প্রায় ৭৫%, এদের সংস্থা HDIL করায়ত্ত করেছে। ভাবা যায়! এটা যদি ক্রোনি লেন্ডিং না হয় তো কোনটা? এরফলে প্রায় ৫২,০০০ গ্রাহক গত পনেরো মাস ধরে চূড়ান্ত হেনস্থার সম্মুখীন হচ্ছে, কয়েকজন আত্মহত্যা করেছে। একই কারণে লক্ষ্মীবিলাস ব্যাংকও সংকটে। সেটাকে সিঙ্গাপুরের ডিবিএস ব্যাংকের হাতে তুলে দেওয়া হল। আত্মনির্ভরতা চূলোয় তুলে, ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রে চুপিসাড়ে বিদেশী ব্যাংকের পদার্পণ ঘটল।

সুতরাং বেসরকারিকরণ কোন সমাধানই নয়। সরকারি ব্যাংক পরিচালনায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ কর। নেতা তার পছন্দসই লোককে সিএমডি বানিয়ে দিয়ে তাকে দিয়ে নিজের চাটুকারদের ঋণ বিলি করবে এবং সেগুলি অনতিবিলম্বে এনপিএতে পরিণত হবে এবং তার ফলে অধস্তন অফিসার ও কর্মচারীদের অদক্ষ, অকর্মণ্য, অলস বলে গাল দেওয়া হবে এবং পুরো সরকারি ব্যবস্থাটাই অচল বলে দেগে দেওয়া হবে এই প্র্যাক্টিশ বন্ধ কর। ব্যাংক পরিচালনায় স্বচ্ছতা আন। রিজার্ভ ব্যাংকের মনিটরিং আরও কড়া, সতর্ক ও নিরপেক্ষ হোক। বারবারই তোতা পাখির মতো বলা হয় অনুৎপাদক সম্পদ বাড়ছে, মূলধন নেই। তা এই অনুৎপাদক সম্পদ উদ্ধারের প্রচেষ্টা নেওয়া হচ্ছে না কেন? এআইবিএ, ব্যাংক কর্মচারীদের সর্ববৃহৎ কর্মচারী ইউনিয়ান সরকারি ব্যাংকে উইলফুল ডিফল্টারদের (যারা ইচ্ছাকৃত ভাবে ঋণপরিশোধে অক্ষম) একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। ২,৪২৬টি এই ধরণের সংস্থার থেকে ব্যাংকের মোট পাওনা ১.৪৭ লক্ষ কোটি টাকা। এদের সর্বাগ্রে কুখ্যাত মেহুল চোক্সির গীতাঞ্জলী জেমস লিমিটেড। এই বিপুল অঙ্ক উদ্ধারে সরকার সচেষ্ট হোক। এতে নানা ছুতোয় গ্রাহকদের থেকে এখন যে টাকা কাটা হচ্ছে তা বন্ধ হবে। হয়তো আমানতের ওপর সুদও কিছু বাড়ানো যাবে। অর্থনীতির এই চরম সংকটকালে তাদের কিছু সুরাহা দেওয়া যাবে।   

- সোমনাথ গুহ     

mmmdddd

অসামান্য, কিংবদন্তী, সর্বকালের সেরা ফুটবলারদের মধ্যে একজন। বিরলতম প্রতিভা অথচ সদা বিতর্কিত! সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সামনে চোখে চোখ রেখে পক্ষ বেছে নেওয়া এক অকুতোভয় মানুষ এবং তৃতীয় বিশ্বের প্রতি অমলিন ভালোবাসা - ফুটবলের জগতে এই বিপরীত বৈশিষ্ট্যযুক্ত চরিত্রের উদয় খুবই কম দেখা গিয়েছে। মারাদোনাকে হয়তো এই ভাবেই মনে রাখবে গোটা দুনিয়া।

বুয়েনস আইরেসে ৬০ বছর আগে জন্মানো দরিদ্র শিশুটার জীবন্ত কিংবদন্তী হয়ে উঠার কাহিনী-ই আর্মান্দোর জীবন। তাঁর শৈশবের দল লস সেবোলিটাসকে টানা ১৩৮টা ম্যাচ অপরাজিত রেখেছিলেন এই বিস্ময় প্রতিভা। মাত্র ১৬ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ফুটবলে ‘পরিচিত’ নীল-সাদা জার্সি গায়ে আর্জেন্টিনার হয়ে মাঠে নামেন দিয়েগো। তাঁর পায়ের ‘অবিশ্বাস্য’ শিল্পের জোর বিশ্বের তামাম ডিফেন্ডারের সামনে কার্যত তাঁকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছিল। দেশের হয়ে ৯১টি ম্যাচে ৩৪টি গোল করেন মারাদোনা। কেবল সংখ্যার বিচারেই এর গুরুত্ব বিচার করা চলে না। ১৯৮৬-র বিশ্বকাপ সেই বিরলতম প্রতিভার সাক্ষী এখনও। যার জেরে তামাম বিশ্ব ফুটবল বিশেষত ভারতীয় উপমহাদেশের ফুটবল দুনিয়া ভাগ হয়ে যায় ব্রাজিলের পাশাপাশি আর্জেন্টিনা শিবিরে। ইংল্যাণ্ডের সাথে তাঁর সেই বিখ্যাত ‘হ্যান্ড অফ গড’ গোল ফুটবল দুনিয়ায় আজও প্রবল বিতর্কিত। ম্যাচের কিছু আগেই ইংল্যাণ্ড ও আর্জেন্টিনা দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক বিবাদ তুঙ্গে। চলছে ফকল্যান্ডের যুদ্ধ।

ম্যাচের ৫১ মিনিটের মাথায় ইংল্যাণ্ডের গোলকিপার পিটার শিলটনের মাথার উপরে লাফিয়ে মুষ্টিবদ্ধ হাতের ঠেলায় গোল করেন দিয়েগো। স্বভাবতই বিতর্ক-টিপ্পনী চলছিল মাঠেই। কিন্তু তাঁর নাম তো মারাদোনা। জবাব দেওয়া যাঁর স্বভাবগত। ঠিক ঐ বিতর্কিত গোলের চার মিনিট পরেই ফুটবলের ইতিহাসে সেরা ‘বিস্ময় গোল’ উপহার দিলেন তিনি। নিজেদের হাফে বল ধরে স্বপ্নের দৌড়ে একের পর এক ইংরেজ ফুটবলারকে ধরাশায়ী করে গোলকিপার শিলটনের প্রতিরোধ ভেদ করে গোল করলেন তিনি। ধারাভাষ্যকার বলে উঠেছিলেন “নিজেদের চোখে অলৌকিক দেখলাম আমরা। এমন গোলও হয়?” ম্যাচ জেতার পরে আর্মান্দো বলেছিলেন “ম্যাচ জেতাটাই লক্ষ্য ছিল না। উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজদের পর্যুদস্ত করা”। হ্যাঁ, এমনটাই ছিলেন মারাদোনা।

প্রবাদপ্রতীম ফুটবলার হয়েও আন্তর্জাতিক সমস্ত চাপ অগ্রাহ্য করেই ৮৬-র বিশ্বকাপ জেতার পরেই আর্মান্দো ছুটে যান সমাজতান্ত্রিক কিউবায়!! যার দুই পায়ের জাদুতে সারা বিশ্ব মুগ্ধ তিনি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেলেন ফিদেল কাস্ত্রোর বিপ্লবের কাহিনীতে। মাদকাসক্ত হয়ে পড়ায় জাতীয় দল থেকে ছিটকে গিয়েছিলেন ১৯৯০ সালে। নিজের দেশের দরজা বন্ধ হয়ে গেলেও সেদিন পাশে পেয়েছিলেন কিউবা ও কাস্ত্রোকে। হাভানার “লা পেদ্রেরা”-তে চিকিৎসার পরে সুস্থ হয়ে ফিদেলকে তার ‘দ্বিতীয় পিতা’র আখ্যা দিয়েছিলেন মারাদোনা। বহুবার সরাসরি বলেছেন, “সাম্রাজ্যবাদ নয় সমাজতন্ত্রই ভবিষ্যৎ”। তাঁর এই নির্ভয়চিত্ততা তাঁর অজান্তেই তাঁকে করে তুলেছিল তৃতীয় বিশ্বের স্বপ্নের মুখ। যে মুখটা স্বপ্ন দেখার স্বাধীনতা দিয়েছিল তরুণ-তরুণীদের, যে মুখটা স্পষ্টভাবে পক্ষ নিতে শিখিয়েছিল মানুষকে, যে মুখটা সমার্থক হয়ে উঠেছিল ‘অবিশ্বাস্য’ শব্দটার সাথে, সেই মুখটার নাম মারাদোনা। বুক চিতিয়ে বাঁচতে শেখানো আর্মান্দোর এই আকস্মিক মৃত্যুতে শেষ হল এক স্বপ্নালু অধ্যায়ের। তবে তাঁর কিংবদন্তী চিরকাল থেকে যাবে যাবতীয় বিতর্ক নিয়েই।

- অঙ্কিত মজুমদার     

sa

সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পুর্ব বর্ধমান জেলা কমিটির সদস্য কমরেড সুনীল কুমার বসু (সন্তুদা) গত ২৪ নভেম্বর কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭০ বছর। তিনি কিছুদিন আগে উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়িতে তাঁর ছেলের কাছে যান। সেখানেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেই অবস্থাতেই ছেলের সাথে পুর্ব বর্ধমান জেলার রায়না থানার শ্যামসুন্দরে নিজের বাড়িতে আসেন। তারপর প্রথমে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ ও পরে কলকাতা নিয়ে যাওয়া হয়। নিমোনিয়া ইনফেকশনের ফলে মৃত্যু হয়। ওনার করোনা ছিল কিনা জানা যায়নি। তিনি ছাত্র অবস্থায় বর্ধমান রাজ কলেজে পার্টির সাথে যুক্ত হন। তারপর কর্মজীবনে ধানবাদ কোলিয়ারীতে কাজ করতেন। তখনও মাসে মাসে বাড়িতে আসতেন, পার্টির কাজে যুক্ত থাকতেন। কয়েক বছর আগে অবসর নেওয়ার পর রায়না ব্লকের দায়িত্বশীল হিসেবে সংগঠনের নেতৃত্বে ছিলেন। বিগত জেলা সম্মেলনে জেলা কমিটির সদস্য হন। বিগত পার্টি কংগ্রেসে প্রতিনিধি ছিলেন। এআইকেএম-এর জেলা কমিটির সদস্য হন। সাম্প্রতিক ঋণ মুক্তির আন্দোলনে রায়না ১নং ব্লক, ২নং ব্লক ও খন্ড ঘোষ ব্লকে ভালো উদ্যোগ নেন। কমরেডের মৃত্যুতে পার্টির, বিশেষ করে পুর্ব বর্ধমান জেলার অপুরণীয় ক্ষতি হল। সব সময় হাসিমুখের কষ্টসহিষ্ণু জনদরদী কমরেড সুনীল কুমার বসু লাল সেলাম ।

mmmmm

চলে গেলেন কমরেড মিহির রায় চৌধুরী। ৩০ নভেম্বর বেহালা সরশুনায় একাকী নিজ বাসভবনে সকলের অগোচরে প্রয়াত হলেন। স্থানীয় পার্টি কর্মীরা তার সন্ধানে গিয়ে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। তাঁর আদি বাসস্থান উত্তর ২৪ পরগনার অশোকনগরে। সেখানেই ’৬০-এর দশকে ছাত্র জীবনে বিপিএসএফ পতাকাতলে খাদ্য আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে বাম আন্দোলনে যুক্ত হন। পরবর্তীকালে নকশালবাড়ি আন্দোলনে যুক্ত হয়ে সিপিআই(এমএল) ধারায় সক্রিয় বিপ্লবী কর্মী হয়ে ওঠেন। এক সময়ে গ্রেফতার হন, দীর্ঘ জেল জীবন কাটান। ’৮০ দশকে নতুন পার্টি কাঠামোয় তিনি আবার তাঁর সক্রিয় ভূমিকায় ফিরে আসেন। গণআন্দোলনের নতুন পথে উদ্বাস্তু অধিকার আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকায় আবারও তিনি গ্রেফতার হন। স্ত্রী হারা, নিঃসন্তান জীবনে পার্টিই ছিল তাঁর পরিবার। এক বুক আশা নিয়ে কৈশোর থেকে বার্ধ্যক্যে পৌঁছেও তিনি ছিলেন চির নবীন। পার্টির সমস্ত কর্মসূচিতে দৃঢ়তার সাথে সামিল হতেন। একজন দরদী মনের কমরেড হয়ে উঠেছিলেন, পার্টির অনুশীলন নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলে পার্টি সংগঠনকে চিন্তাশীল হওয়ার জন্য প্ররোচিত করতেন। তিনি রেখে গেলেন ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী ও ভাইঝি এবং পার্টির অসংখ্য কর্মী সমর্থকদের। সদা আলাপি, মিষ্টভাষী স্বপ্নসন্ধানী মিহির রায়চৌধুরী আপনি বিশ্রাম নিন, আপনার সাথী-সহযোদ্ধারা জেগে আছেন, জেগে থাকবেন আগামীর সন্ধানে।

কমরেড মিহির রায়চৌধুরী লাল সেলাম!

খণ্ড-27
সংখ্যা-43