আমরা জম্মু ও কাশ্মীর, ব্যাঙ্গালোর ও দিল্লীতে নাগরিক সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গের উপর জাতীয় অনুসন্ধান সংস্থার হামলার তীব্র নিন্দা করছি। এনআইএ-র দাবি হচ্ছে “সন্ত্রাসে আর্থিক মদতের বিরুদ্ধে’’ কড়া শাস্তিমূলক পদক্ষেপের জন্যই এই হানা — কিন্তু এটা আদতে যারা জম্মু ও কাশ্মীরের মানুষের অধিকার ও ভালো থাকা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ তথা চিন্তা ভাবনা করছেন, তাদের হেনস্থা ও চুপ করানোর একটা খুব সহজবোধ্য অজুহাত। মানবাধিকার রক্ষাকারী, মানবাধিকার সংগঠন, সাংবাদিক, এবং নাগরিকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য এনআইএ-কে ব্যবহার করে মোদী সরকার জম্মু ও কাশ্মীরের মানুষের প্রতি যে অপরাধ তারা করে চলেছে তার সাক্ষী যাতে কেউ না থাকে সেটা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে।
যে সব সংগঠন (গ্রুপ) এবং ব্যক্তিকে এনআইএ নিশানা করেছে, তাদের মানবাধিকার রক্ষার ও মানবিক কাজের দীর্ঘ ও হৃদয়গ্রাহী ধারাবাহিক ইতিহাস আছে। যেমন জম্মু ও কাশ্মীর কোয়ালিশন অব সিভিল সোসাইটি (জেকেসিসিএস) অচিহ্নিত গণ কবর, সাজানো সংঘর্ষ, পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন, যৌন হিংসা এবং জম্মু ও কাশ্মীরে শিশুদের উপর হিংসার প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেছে এবং নথিভিত্তিক রিপোর্ট তৈরি করেছে। জেকেসিসিএস উপত্যকায় নিহত কাশ্মীরি পণ্ডিতদের জন্যও ন্যায় সুনিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে একটি বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের চেষ্টা চালিয়ে গেছে। দ্য অ্যাসোসিয়েশন অব পেরেন্টস অব ডিসঅ্যাপিয়ার্ড পার্সনস (এপিডিপি) এমন একটি সংগঠন যা ন্যায় ও সত্যের জন্য অন্যতম এক দীর্ঘতম লড়াই চালিয়েছে : রাষ্ট্র শক্তির দ্বারা “নিখোঁজ” মানুষদের অভিভাবকদের সংগঠিত করেছে, তাদের স্মৃতিতে প্রতি সপ্তাহে পদযাত্রার আয়োজন করেছে।
এনআইএ-র নিশানায় থাকা আরেক জন হলেন জাফারুল ইসলাম খান, দিল্লী মাইনরিটি কমিশনের প্রাক্তন সভাপতি এবং দিল্লী গেজেট-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, যিনি চ্যারিটি অ্যালায়েন্স নামে একটি মানবিক সংগঠন চালান। মিস্টার খানের নেতৃত্বে দিল্লী মাইনরিটি কমিশন ফেব্রুয়ারী ২০২০-তে দিল্লী হিংসার একটি রোমহর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে যা মুসলিমদের বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিত হিংসায় দিল্লী পুলিশের জড়িত থাকার এক সাক্ষ্যপ্রমাণ সম্বলিত দলিল। চ্যারিটি অ্যালায়েন্স দিল্লী হিংসার শিকার বিপর্যস্ত মানুষদের ত্রাণ বিলি করেছিল।
এনআইএ-র হানার নিশানায় অন্য গ্রুপগুলিও রয়েছে যারা তাদের দীর্ঘ দিনের মানবিক কাজকর্ম, বিপর্যয়কালীন ত্রাণকাজ, জম্মু ও কাশ্মীর অঞ্চলে সাহায্যমূলক কাজের জন্য সুপরিচিত। মোদী সরকার এই গ্রুপগুলির গায়ে “সন্ত্রাসের” রং লাগিয়ে, চরম সংকটের সময় জম্মু ও কাশ্মীরের মানুষের মানবিক সাহায্য ও ত্রাণ পাওয়াটুকুও বন্ধ করে দিতে চাইছে। এনআইএ ‘গ্রেটার কাশ্মীর’ সংবাদপত্রের অফিসেও হানা দিয়েছে — যে সংবাদ পত্রটি অত্যন্ত পেশাদারিত্বের সাথে সৎ ও সাহসী সাংবাদিকতার জন্য বিশেষ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত।
বেঙ্গালুরুতে এনআইএ স্বাতী শেষাদ্রির বাসস্থানে হানা দিয়েছে — এক সচেতন বিবেকনিষ্ঠ নাগরিক যিনি মানুষের প্রয়োজনে সাড়া দিয়েছেন, এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে মানবাধিকার নিয়ে নিজের শহর তো বটেই, ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে সরব হয়েছেন। যেমন, লকডাউনের সময় স্বাতী শেষাদ্রি বৃহত্তর নাগরিক সমাজের জোট “ব্যাঙ্গালোর উইথ মাইগ্র্যান্টস”-এর পক্ষ থেকে, ব্যাঙ্গালোরে আটকে পড়া খাদ্যহীন আশ্রয়হীন ভিন রাজ্যে খাটতে যাওয়া শ্রমিকদের ত্রাণ বিলির কাজ করেছেন।
মোদী জমানায় এনআইএ অন্য বহু সংস্থার মত “খাঁচাবন্দি তোতাপাখি”তে পরিণত হয়েছে : বোমা বিস্ফোরণে অভিযুক্ত বিজেপি সাংসদ প্রজ্ঞা সিং ঠাকুরের বিরুদ্ধে মামলাকে দুর্বল করা, এবং সন্ত্রাসবাদী পাচারে ধৃত জম্মু ও কাশ্মীরের পুলিশ অফিসার দাভিন্দর সিং-এর জামিন পাওয়া নিশ্চিত করা আর অন্যদিকে মানবাধিকারের পক্ষে সওয়ালকারীদের, আইনজীবী ও সাংবাদিকদের ভীমা কোরেগাঁও মামলার সূত্রে তাড়া করে বেড়ানোর জন্য পরিচিত হয়ে উঠেছে। এবার তাদের ডাইনি-খোঁজ সম্প্রসারিত হচ্ছে, নতুন অছিলা জম্মু ও কাশ্মীর।
সারা ভারতবর্ষ জুড়েই গরিব এবং নিপীড়িত মানুষ পুলিশ ও অন্যান্য সরকারী সংস্থাগুলোর অবাধ উন্মত্ত হিংস্রতার সঙ্গে খুব পরিচিত। তুতুকোড়িতে তামিলনাড়ু পুলিশের হাতে জেয়ারাজ ও বেনমিক্স-এর মৃত্যু ভারতে মহামারী হারে বেপরোয়া বন্দি-নির্যাতন ও হাজত-মৃত্যুর ঘটনাকে আলাদাভাবে চিনিয়ে দিয়েছে। অতি সম্প্রতি, বিহারের মুঙ্গেরে দুর্গা প্রতিমার বিসর্জনের জন্য অপেক্ষমান ভক্তদের উপর পুলিশের লাঠিচার্জ ও গুলিচালনার ঘটনায় মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল। মুঙ্গের পুলিশ কর্তৃপক্ষের অফিসে ক্রুদ্ধ জনতা বিক্ষোভ দেখায়, এমনকি বিক্ষোভকারীরা কেউ কেউ গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। পুলিশী লাঠিচার্জের প্রতিক্রিয়ায় ভক্তরা পাথর ছুঁড়তে থাকলে পুলিশ নাকি বাধ্য হয়ে গুলি চালায়—এই পুলিশী অজুহাতকে মানুষ সঠিকভাবেই প্রত্যাখ্যান করেছেন। মানবাধিকার রক্ষাকারীরাই মুঙ্গের, বস্তার, জম্মু ও কাশ্মীরে নাগরিক ও পুলিশ বাহিনীর মধ্যে সুরক্ষা-ঢাল হিসেবে সংবিধানকে তুলে ধরেছেন। সত্যকে উন্মোচিত করেছেন সাংবাদিকরাই — সে মুঙ্গের, তুতুকোড়ি বা কাশ্মীর উপত্যকা যেখানেই ঘটুক। এনআইএ-র মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিকদের উদ্দেশে হানা ও গ্রেপ্তারি চালানোর আসল উদ্দেশ্য হল সেই সাংবিধানিক ঢালকে সরিয়ে দেওয়া। আমাদের, ভারতবর্ষের মানুষকে অবশ্যই তাদের অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য পাশে দাঁড়াতে হবে যারা নাগরিক এবং মানুষ হিসাবে আমাদের অধিকারকে রক্ষা করে চলেছেন।
সিপিআই(এমএল) কেন্দ্রীয় কমিটি
অতি সক্রিয়তার মূর্তি ধারণ করে চলছেন রাজ্যের রাজ্যপাল জগদীপ ধনকর। দিল্লী গেলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর কাছে। উদ্দেশ্য চাপা থাকেনি। আগে-পরের মন্তব্যে ধরা পড়েছে পরিষ্কার। রোষ বর্ষণ করেছেন বিস্তর। এরাজ্যে সাংবিধানিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে! মহিলারা রাস্তায় বেরোতে পারেন না, আক্রান্ত হচ্ছেন পথে-ঘাটে, নিরাপত্তা মেলে না থানা-পুলিশের সাহায্যের। এখানে আল কায়দা বাড়ছে, দাঁত-নখ বার করছে! অথচ পুলিশ-প্রশাসন টের পায় না। যোগসাজশে তৈরি হয়েছে পুলিশ রাষ্ট্রের পরিস্থিতি! আইএএস-আইপিএস’রা শাসকদলের প্রথম শ্রেণীর কর্মীর মতো আচরণ করছেন। এখানে তাই ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করা প্রয়োজন! এই সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচন অবাধ, পরিচ্ছন্ন ও ভয়শূন্য পরিবেশে হওয়া সম্ভব নয়।
রাজ্যপাল যা যা প্রশ্ন তুলছেন তার সবটাই ভিত্তিহীন নয়। কিন্তু ধরা পড়ছে গূঢ় উদ্দেশ্য। হিম্মৎ দেখাচ্ছেন বটে, খতিয়ে দেখতে হবে এতসব লম্ফঝম্ফ কীসের স্বার্থে, কাদের স্বার্থে!! মদত দিচ্ছেন কারা! রাজ্যপাল হঠাৎই ছুটে গেলেন রাজধানীতে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে সমস্ত রিপোর্ট দিলেন। ওপরতলায় নিয়মিত রিপোর্ট দেওয়ার নিয়মগত বাধ্যতা থাকে। সাধারণভাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকে, কখনও কোন বিশেষ জরুরি পরিস্থিতিতে সরাসরি রাষ্ট্রপতির কাছে, এটাই দস্তুর। কিন্তু কী এমন মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল যে সশরীরে যেতে হল! মিলেছে খবর, এসেছিল তলব। সময় নিয়ে আলোচনা হয়েছে উভয়ের মধ্যে। মূলত কী চর্চা হয়েছে তা পরে খোলসা হয়ে গেছে অমিত শাহর মুখ হা-করার মধ্যে। শাহর মন্তব্য হল, বাংলায় বিজেপি নেতাদের ৩৫৬ কায়েমের দাবি খুব ন্যায়সঙ্গত। এই দাবির সপক্ষে সোরগোল তুলে আপন বাজার গরম করার একটা চেষ্টা বিজেপির আছে। বোঝার অভাব রাখে না, ঐ দাবিতেই ধুনো দিয়ে এসেছেন রাজ্যপাল। শুধু তাই নয়, নিশ্চিত পরবর্তী করণীয় কী কী সেই কাজ বুঝে নিয়ে এসেছেন। এসেই প্রায় তুরন্ত ছুটলেন দার্জিলিং। যেখানেই কোনো ঘটনায় বিজেপি-র টক্কর লাগার সংকেত অনুভূত হচ্ছে সেখানেই রাজ্যপাল পৌঁছে যাচ্ছেন। গোর্খাল্যান্ড রাজনীতির বহুপাক্ষিক সংঘাতে এবং কিছু হত্যার রাজনীতিতে জড়িয়ে প্রায় ৩ বছর আত্মগোপনে ছিলেন বিমল গুরুং। রাজ্যের শাসক টিএমসি-র সাথে তাঁর সম্পর্ক গড়ায় অহি-নকুলে। গত লোকসভা নির্বাচনে গোর্খাল্যান্ড ও মামলা-মোকদ্দমা থেকে মুক্তি পাইয়ে দেওয়ার ‘প্রতিশ্রুতি’র ধোঁকা দিয়ে গুরুং-গোষ্ঠীর সমর্থনের সুবিধা জোগার করতে সফল হয়েছিল বিজেপি। তারপর এতদিনেও প্রত্যাশা ফলপ্রসূ হল না বুঝে পরিত্রাণ পাওয়ার আশায় গুরুং ফের মুখ ফেরালেন মুখ্যমন্ত্রীর দিকে। এই পরিবর্তিত ঘটনার মধ্যে পাহাড়ে বিজেপি বিরোধী মেরুকরণের পুনরুত্থানের আঁচ পেয়ে আগেই ছুটলেন রাজ্যপাল। পথে আইন-শৃংখলা বিষয়ে মালদায় নিয়েছেন বিজেপি প্রতিনিধিদের ডেপুটেশন। আর পাহাড়ে গিয়ে তলব করেছেন জেলা শাসক ও পুলিশ সুপারকে। তাদের সামনে উগরে দেন বিষোদগার। বললেন, বিমল গুরুং গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক! পুলিশ-প্রশাসনের বড় কর্তারা আচরণে নাকি শাসকদলের আজ্ঞাবহ হয়ে যা করা উচিত নয় তাই করছেন, ‘নিরপেক্ষতা’ বিসর্জন দিচ্ছেন। রাজ্যপালের এইসব আচরণ-বিচরণে একমাত্র উৎফুল্ল রাজ্য বিজেপি। অন্যান্য সক্রিয় বিরোধীদল সব রাজ্যপালের এই দাদাগিরির বিরুদ্ধে সরব।
আসা যাক রাজ্যপালের মূল মূল অভিযোগ ওঠানোর কথায়। রাজ্যপাল বস্তুত সংবিধানের ৩৫৬ ধারার বিকৃত স্বেচ্ছাচারী প্রয়োগ চাইছেন। কোনোভাবেই ধোপে টেঁকে না রাষ্ট্রপতি শাসন জারীর ওকালতি। তেমন বিরল সাংবিধানিক সংকট দেখা দেওয়ার ভূত দেখিয়ে লাভ নেই। রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবি একমাত্র তখন অপরিহার্য হয় যখন একদিকে ক্ষমতাসীন সরকার প্রবল গণবিস্ফোরণে নিজের পতন ঘটিয়ে ফেলে, অন্যদিকে পরবর্তী নির্বাচন সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজন হয় কিছু সময়ের, পরিস্থিতির খোলামেলা বিকাশের। পশ্চিমবাংলায় শাসক ও বিরোধী পক্ষগুলোর মধ্যে সংঘাতের পরিস্থিতি চলছে, কিন্তু রাষ্ট্রপতির শাসন জারী করার কেন্দ্র-বিজেপি-রাজ্যপাল যোগসাজশের অভিসন্ধির এখানে কোন জমি পাওয়া উচিত নয়। পশ্চিমবাংলায় যথেচ্ছ পুলিশী উৎপীড়ন চলে, তবে এখনও ঠিক ‘ধরো-মারো’ মার্কা পুলিশ রাষ্ট্রে পরিণত হয়নি, অবশ্য রাশ না টানলে সেদিকেই যাবে, যেমনটা পরিণত হয়েছে বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশ। বাংলার বিজেপি নেতারাই বরং হুমকি দেন এখানে ক্ষমতায় “উত্তরপ্রদেশ বানিয়ে দেব। রাজ্যপাল এসব শুনেও ভান করেন না-শোনার। তিনি উগরে দিচ্ছেন দুমুখো অসত্য। একইসাথে বলছেন এখানে চলছে ‘পুলিশী রাষ্ট্র’, আবার বলছেন ‘আল কায়দা বাড়ছে, পুলিশের নাকের ডগায়’! কি বিচিত্র স্ববিরোধিতা! আসলে পশ্চিমবাংলায় বিজেপি-র মুসলিম-বিদ্বেষের রাজনীতি আর কেন্দ্রের ‘নিয়া’র হানা দেওয়াকে কি অজুহাতে গিলিয়ে দেওয়া যায় সেটাই তাঁর মতলব। আর তা করতে গিয়ে তিনি ছুটছেন উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে, দিচ্ছেন অনেক উল্টোপাল্টা বিবৃতি। রাজ্যপাল করছেন রাজ্যপালের রাজনীতি।
বিহার ২০২০ বিধানসভা নির্বাচনের একটি নজরকাড়া বৈশিষ্ট্য হল পার্টি এবং জোটের ইস্তাহার নিয়ে ভোটদাতাদের মধ্যে তীব্র আগ্রহ ও তাদের অংশগ্রহণ। এবার, বিহারের জনসাধারণ – তার যুব সম্প্রদায়, শ্রমিক, কর্মচারি, মহিলারাই বিহার রাজনীতির কেন্দ্রে ছুঁড়ে দিলেন চাকরি, সম কাজে সম মজুরি, অধিকার এবং মর্যাদার প্রশ্ন।
আরজেডি, কংগ্রেস, সিপিআই(এমএল), সিপিআই এবং সিপিএম-এর মহাজোটের (মহাগাঠবন্ধন) প্রচারে এবার বিহারের তরুণ সম্প্রদায়ের এইসব জরুরি ভাবনাগুলিই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, সঙ্গে রয়েছে কর্মসংস্থান সমস্যার মোকাবিলায় প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সরকারী দপ্তরে কয়েক লক্ষ শূন্য পদ পূরণের দৃঢ় অঙ্গীকার। ‘পরিবর্তনের জন্য প্রতিশ্রুতি’র ২৫ দফা সনদে মূল জোর রয়েছে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দীর্ঘদিন ধরে শূন্য পড়ে থাকা পদগুলি পূরণ, শোষণমূলক চুক্তিভিত্তিক কাজ বন্ধ করা, সম কাজে সম বেতন সুনিশ্চিত করা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে আরও ব্যয় বাড়ানো এবং কৃষকদের মোদী সরকারের পাস করা কৃষক-বিরোধী আইন থেকে সুরক্ষিত করা।
মুখ্যত শূন্য পড়ে থাকা সরকারী পদগুলি পূরণের মাধ্যমে ১০ লক্ষ চাকরি সুনিশ্চিত করার যে প্রতিশ্রুতি মহাজোট দিয়েছে তাকে এনডিএ সরকার বিদ্রূপ করেছে। কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতৃবৃন্দসহ মুখ্যমন্ত্রী নীতীশকুমার বিহারে তাদের নির্বাচনী জনসভায় ১০ লাখ চাকরির নম্র প্রতিশ্রুতিকে ‘অবাস্তব’ বলে হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন। অথচ, বিজেপি’র ইস্তাহার ১৯ লাখের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে! ১০ লাখ কাজের সংস্থান যদি অসম্ভব হয়, তাহলে ১৯ লক্ষ কাজের সংস্থান কীভাবে সম্ভব হবে? রহস্যের সমাধান হয়ে যাবে যদি আমরা প্রধানমন্ত্রীর ‘আত্মনির্ভর’ বিহার বা ভারতের প্রতিশ্রুতির মধ্যে যে সংকেত রয়েছে তার অর্থোদ্ধার করি! ‘স্বনির্ভরতা’ হচ্ছে মূলত ‘নিজের ভরণপোষণ নিজে করো’-কে একটু অন্যভাবে বলা। ‘পকোড়া বেচার’ মতো অত্যন্ত নড়বড়ে উপায়ে মানুষের কোনওক্রমে কষ্টেসৃষ্টে বেঁচে থাকাকে প্রধানমন্ত্রী ‘আত্মনির্ভরশীল কর্মসংস্থান’ বলে চালিয়ে দিয়েছেন, আর অন্যদিকে সরকার নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির যাবতীয় দায়িত্ব কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলেছে।
নীতিনৈতিকতা আর নির্লজ্জতার সমস্ত সীমা ছাড়িয়ে বিজেপির ইস্তাহার বিহারবাসীকে বিনামূল্যে কোভিড ১৯-এর টিকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী যখন বিধানসভা নির্বাচনের এই প্রতিশ্রুতির ঘোষণা দেন তখন বিষয়টি আরও ন্যক্কারজনক হয়ে ওঠে। মোদী সরকার, যারা কোভিড১৯-এর বিস্তার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ, যারা অপরিকল্পিত লকডাউনের সময় বিহার থেকে ভিন রাজ্যে খাটতে যাওয়া শ্রমিকদের অকথ্য নিষ্ঠুরতার শিকার হতে বাধ্য করেছে, তারা এখন ভ্যাকসিনের বিনিময়ে ভোট চাওয়ার নির্লজ্জ স্পর্ধা দেখাচ্ছে!
এনডিএ সরকারের বিরুদ্ধে ক্রোধের এক অমোঘ ঢেউ সমুদ্রলহরের মতো ক্রমশ ছড়িয়ে পড়েছে, যে সরকারের অপশাসনে রাজ্যকে কাটাতে হয়েছে পনেরোটা বছর। আর, ভিন রাজ্যে খাটতে যাওয়া বিহারের ভূমিপুত্রদের (যারা লকডাউনে ঘরে ফেরার জন্য কয়েকশো মাইল হেঁটে এসেছেন) বিহার সীমান্ত পেরোতে না দেওয়ার কথা বলে সরকারের উদ্ধত ঘোষণা সেই অপশাসনকেও ছাড়িয়ে গেছে। বিজেপি, যারা জোরের সঙ্গেই ঘোষণা করেছে যে এনডিএ জিতলে নীতীশকেই মুখ্যমন্ত্রী করা হবে, এই ক্রোধের আগুন থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন রাখার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আসল সত্যিটা হল, বিজেপি এবং জেডিইউ যারা একসঙ্গে পনেরোটা বছর সাঁতার কেটেছে, তাদের একসঙ্গেই ডুবতে হবে।
বিজেপি’র (৩৭০ ধারা বিলোপ, অযোধ্যা এবং অন্যান্য প্রশ্নে) ঘৃণা ও বিদ্বেষের বিষ নিয়মিত গেলানোর চেষ্টা বিহারের ভোটদাতাদের উপর কোন কাজ করেনি। তারা মহাজোটের কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং শ্রমিক ও কর্মচারিদের অধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতিতে আবেগ ও উদ্দীপনার সঙ্গে সাড়া দিচ্ছেন। যখন যোগী আদিত্যনাথ তার জনসভাগুলিতে বলেন – বিহারের মানুষ এবার জম্মু ও কাশ্মীরে বাড়ির মালিক হতে পারবেন – বিহারের গরিব মানুষ তাকে মনে করিয়ে দেন যে এনডিএ সরকার তাদের বাস্তুজমি বন্টন করেনি যা নিজেদের রাজ্যেই প্রাপ্য ছিল, উল্টে তারা গরিবদের বস্তিগুলো বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে।
বিহার নির্বাচন, চাকরি ও অধিকারের প্রশ্নকে সামনে এবং রাজনীতির কেন্দ্রে রেখে, আর সমস্ত সাম্প্রদায়িক ও গণতন্ত্র-বিরোধী বক্তব্যকে (ন্যারেটিভ) প্রত্যাখ্যান করে বিচার ছাড়িয়ে ভারতীয় রাজনীতির জন্য অ্যাজেন্ডা ঠিক করছে।
(এম এল আপডেট ২৭ অক্টোবর ২০২০)
রাজ্যের ১৩টি জেলা থেকে সহস্রাধিক কর্মীর উপস্থিতিতে কলকাতার রামলীলা পার্কে অনুষ্ঠিত হলো এআইকেএসসিসি আয়োজিত কৃষক গণ কনভেনশন। কেন্দ্রীয় নয়া কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে এবং ২৬ নভেম্বর সারা বাংলা গ্রামীণ ধর্মঘটের সমর্থনে বিভিন্ন কৃষক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন। নতুন কৃষি আইনকে কৃষি পণ্যের কালোবাজারি, মজুতদারী, বাজার ব্যবস্থা ভেঙ্গে দেওয়া এবং চুক্তি করে চাষিকে দিয়ে যা খুশী তাই চাষ করানোর আইন বলে অভিহিত করেন এআইকেএসসিসি-র জাতীয় সাংগঠনিক সচিব ও যোগেন্দ্র যাদবের নেতৃত্বাধীন জয় কিষাণ আন্দোলনের নেতা অভীক সাহা। তিনি বলেন, ২৬ নভেম্বর দিল্লীর বুকে লক্ষ লক্ষ কৃষক সংসদ অভিযান করবে। গড়ে তুলবে ঐতিহাসিক প্রতিরোধ আন্দোলন। রামলীলা পার্ক ময়দানে কনভেনশনে অংশগ্রহণকারী শক্তিগুলির পতাকার বিভিন্ন রং এবং সংগ্রামী প্রতীকের উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই বৈচিত্র দেখিয়ে দিচ্ছে কৃষকের স্বার্থে বড় ধরনের এক সংগ্রামী ঐক্য গড়ে উঠেছে, মোদী সরকার হুশিয়ার!
অগ্রগামী কিষান সভার নেতা হাফিজ আলম সাইরানী বলেন, নয়া আইনে দেশের কৃষি উৎপাদন, সংরক্ষন ও বিপননকে দেশী বিদেশী কর্পোরেট শক্তির হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন আমাদের দেশের কৃষির উপর কর্পোরেটদের লোভী নজর কেন? দেশের জলবায়ু অংশত কৃষির অনুকুল, এখানে সারা বছর চাষাবাদ হয়। আমাদের দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। নয়া কৃষি আইন এদের উপর চরম আঘাত নামিয়ে আনবে। এ রাজ্যে তৃণমূল সরকারের সমালোচনা করে তিনি বলেন, পাঞ্জাব, কেরল যদি পারে তাহলে এ রাজ্যের সরকার কেন কেন্দ্রীয় আইনকে প্রতিহত করার উপযোগী আইন প্রনয়ণ করবে না?
এআইকেএস (বি বি গাঙ্গুলী স্ট্রিট) সংগঠনের নেতা তপন গাঙ্গুলী বলেন,নয়া আইনে কেবল কৃষকরাই নয়, দেশের সমগ্র জনগণের স্বার্থ বিপন্ন। খাদ্যদ্রব্য এখন আর ওদের কাছে অত্যাবশ্যকীয় নয়! আগে জিনিষপত্র মজুত করে দাম বাড়ালে মামলা করা যেতো। এখন কর্পোরেট ক্ষেত্রের অবাধ মজুতদারী মূল্যবৃদ্ধিকে চতুর্গুন করে তুলবে। কৃষি বাঁচলে দেশ বাঁচবে, তাই আজ সমগ্র কৃষক শ্রেণীর স্বার্থে বিভিন্ন রং এর পতাকার সংগ্রামী একতা গড়ে উঠেছে।
এআইকেএম নেতা কার্তিক পাল বলেন, চরম কৃষক বিরোধী বিজেপি এ রাজ্যে জায়গা করে নিতে পারবে না। এই লক্ষে কৃষক সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে। এই নয়া কৃষি আইনে পঃ বাংলার চাষিদের তেমন ক্ষতি নেই বরং লাভ হবে বলে অপপ্রচার চলছে। বাস্তবে তৃণমূলের অপশাসনে এ রাজ্যের কৃষকরা আদৌ ভালো নেই। এ রাজ্যে কৃষক স্বার্থবাহী আইন প্রনয়ণের দাবিতে আন্দোলনের পথে যেতে হবে। পঞ্চায়েতের তিনটি স্তরেই নয়া কৃষি আইনের বিরুদ্ধে প্রস্তাব গ্রহণের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
কেকেএসএস সংগঠনের নেতা সমীর পুতুতুন্ডু বলেন, এ রাজ্যে চাষিদের ফসলের সরকারী দাম পাওয়ার বিষয়টি রাজ্য সরকারের ফসল কেনার সময় ও পদ্ধতির উপর অনেকটাই নির্ভর করে। যথা রাজ্য সরকার অনেক দেরীতে ধান কিনতে নামে, ফলে গরিব চাষিদের অভাবী বিক্রি চলতেই থাকে। পঃ বঙ্গে ক্ষুদ্র জোতের আধিক্য থাকার জন্য গ্রামীণ জনগণের ব্যাপকতর সংগ্রামী একতা গড়ে তোলার সভাবনা রয়েছে। কেন্দ্র ও রাজ্য দুই সরকারের কৃষক বিরোধী নীতির বিরুদ্ধেই সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে। সারা ভারত কৃষিমজুর ইউনিয়নের সভাপতি তুষার ঘোষ বলেন, কেন্দ্রীয় নয়া আইন গরিবের বিরুদ্ধে, ক্ষেতমজুরের বিরুদ্ধে এমনকি ধনী চাষিদেরও বিরুদ্ধে। তাই বৃহত্তর একতা গড়ে উঠেছে। আমাদের দেশে খাদ্যে যে স্বয়ংভরতা রয়েছে সাম্রাজ্যবাদীরা সেটাকেই ভেঙ্গে দিতে চাইছে৷ মোদী সরকার সেই লগ্নিপুঁজির কাছে নতজানু হয়ে আত্মসমর্পণ করেছে। আম্বানি আদানি ওয়ালমার্টের স্বার্থ সেবা করতে এই কৃষি আইন নিয়ে আসছে। চুক্তিচাষের মধ্য দিয়ে চাষির স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হবে। এ রাজ্যে বিধানসভায় আইন করার দাবি তুলে ধরে তৃণমূলের মুখোষ খুলে দিতে হবে। রাজ্যের চাষিরা ফসলের সরকারী দর পায় না। গরিবরা অভাবী বিক্রি করতে বাধ্য হয়। আমাদের দাবি কেবল মান্ডি থেকেই নয়, পঞ্চায়েত স্তর থেকে ফসল কিনতে হবে। এ রাজ্যে কৃষকের সংগ্রামী একতা সাম্প্রদায়িক শক্তির বিষবাস্পকে প্রতিহত করতে পারবে।
এআইকেএসসিসি পঃ বঙ্গ আহ্বায়ক অমল হালদার আগামী কর্মসূচী ঘোষণা করে বলেন, ২৬ নভেম্বর গ্রামীণ ধর্মঘটকে এরাজ্যে সর্বাত্মক সফল করে তুলতে হবে। এজন্য রাজ্যের সমস্ত জাতীয় ও রাজ্য সড়কে কৃষকরা অবরোধে সামিল হবে। আগামী ২০ নভেম্বরের মধ্যে ব্লক ও মহকুমাস্তরে কৃষক গণ কনভেনশন সংগঠিত করা হবে। ধর্মঘটের পরদিন ২৭ নভেম্বর জাতীয় স্তরে কৃষক বিক্ষোভ কর্মসূচীর অঙ্গ হিসাবে রাজ্যের জেলায় জেলায় কৃষক সমাবেশ সংগঠিত হবে। পরবর্তীতে রাজ্য বিধানসভা খোলার পর রাজ্যে কেন্দ্রীয় আইনের বিরুদ্ধে প্রস্তাব গ্রহণ ও রাজ্য আইন প্রনয়ণের দাবি তুলে ধরে কর্মসূচী গৃহীত হবে। এছাড়াও কনভেনশনে বক্তব্য রাখেন সংযুক্ত কিষাণ সভার নেতা মিহির পাল, এআইকেএমএস নেতা সুশান্ত ঝা।
- জয়তু দেশমুখ
প্রিয় সাথী,
এক গভীর সংকটের বাঁকে দাঁড়িয়ে রয়েছে আমাদের দেশ। দেশের অর্থনীতি আজ একেবারে তলানিতে। মোদীর অপরিকল্পিত ও পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে কঠোর লকডাউন গোটা দেশে কল্পনাতীত দুর্গতি ডেকে আনল। এক লহমায় লক্ষ কোটি শ্রমজীবী মানুষ কাজ খোয়ালো, রুটি-রুজি আর মাথার উপর এক চিলতে ছাদ হারিয়ে লাখে লাখে পরিযায়ী শ্রমিকদের অভাবনীয় দুর্দশা গোটা দেশ, সারা পৃথিবী দেখল। স্বাধীনতার পর দেশ ভাগের সময়েও এমন নির্দয় মানবিক সংকট কখনো দেখা যায়নি।
গোটা দেশ যখন অতিমারির ভয়ংকর থাবায় আক্রান্ত, তখন মোদির আশীর্বাদে মুকেশ আম্বানি প্রতি ঘন্টায় পকেটে ঢোকালো ৯০ কোটি টাকা, আত্মপ্রকাশ করল বিশ্বের চতুর্থতম ধনকুবের হিসাবে। একের পর এক বিমানবন্দর বেচে দেওয়া হল আম্বানি আদানিদের, আর লকডাউনের পর্যায়ে শ্রমিক কর্মচারিদের বেতন দেওয়া, কাউকে কাজ থেকে বসিয়ে না দেওয়ার যে আদেশনামা বলদর্পী অমিত শাহ’র মন্ত্রক করেছিল, তাকে তামাশায় পরিণত করল দেশী বিদেশি কর্পোরেটরা। সেন্টার ফর মনিটারিং অফ ইন্ডিয়ান ইকনমি জানাচ্ছে, অতিমারীর আগেই দেশে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা ছিল ৩.৫ কোটি, আর কোভিডের পর নতুন করে ২.১ কোটি বেতনভুক কর্মী কাজ হারায়, যার ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনাই আর নেই। জুলাই মাসে কর্মচ্যুত হয়েছেন ৪০ লক্ষ ৮ হাজার মানুষ, আর আগস্টে সেই সংখ্যাটা হল ৩০ লক্ষ ৩ হাজার।
এরকম সার্বিক এক মহাসংকট থেকে সাময়িক পরিত্রাণ পেতে দেশের তাবড় তাবড় অর্থনীতিবিদ কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রস্তাব দেয়, আয়কর আওতায় যারা নেই, জনগণের সেই বৃহৎ অংশের হাতে নগদ টাকা তুলে দাও, অন্তত ৬ মাস সকলকে নিখরচায় পর্যাপ্ত রেশন দাও, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোকে মজবুত করে সরকারী খরচ বাড়াও, এই পর্যায়ে যারা কর্মহীন হয়েছেন, তাদের কাজে ফেরাতে ব্যবস্থা নাও। কিন্তু মোদী সরকার সেই সমস্ত পরামর্শকে বিন্দুমাত্র আমল না দিয়ে উল্টো রাস্তা ধরলো। দেশের দুই বুনিয়াদি শ্রেণী – শ্রমিক ও কৃষকদের উপর নামিয়ে আনলো বিরাট বড় হামলা। এক শতাব্দীব্যাপী রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে যে সমস্ত অধিকারগুলো ঔপনিবেশিক যুগ থেকে শুরু করে পরবর্তীতে আদায় করেছিল ট্রেড ইউনিয়নগুলো, তা মাত্র তিন ঘন্টার সংসদ অধিবেশনে সব ছিনিয়ে নিল। নজিরবিহীনভাবে কৃষি বিল পাশ করালো বলপূর্বকভাবে, গজোয়ারি করে। নতুন শ্রম কোড মালিক পক্ষকে দিয়ে দিল ছাঁটাই করার অবাধ অধিকার। স্থায়ী কাজ, স্থায়ী শ্রমিকদের পরিণত করা হলো ফিক্সড টার্ম কন্ট্রাক্টে, প্রবর্তন করা হলো এক নতুন দাস প্রথা। সমকাজে সমমজুরির আইন নিক্ষিপ্ত হলো ডাস্টবিনে, ধর্মঘটের সাংবিধানিক অধিকার চুলোয় গেল, লক্ষ লক্ষ স্কীম কর্মীদের দেওয়া হলো না ন্যূনতম বেতন, সামাজিক সুরক্ষার অধিকার বা শ্রমিকের স্বীকৃতি; কন্ট্রাক্টরের গায়ে পরিয়ে দেওয়া হলো নিয়োগকর্তার জামা। গোটা শ্রম বাজার এই শ্রম কোডের দৌলতে ছেয়ে যাবে অস্থায়ী, ক্যাজুয়াল, ঠিকা শ্রমিকে। বাড়িতে বাড়িতে গৃহ নির্মাণের কাজে যুক্ত নির্মাণ শ্রমিকরা এরপর থেকে পাবেন না নির্মাণ কল্যাণমূলক বোর্ডের কোনো ধরনের সুযোগ সুবিধা। এরপর যে কোনো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে, রাতের শিফটে মহিলাদের নিয়োগ করা যাবে, কিন্তু আইসিসি গঠনের যে বাধ্যতা এতদিন আইনত ছিল, এরপর তাও থাকবে না। মাতৃত্বকালীন ছুটিকে বিদায় জানানো হলো। জেলা ভিত্তিক শ্রম আদালত তুলে দিয়ে রাজ্যে করা হবে একটা মাত্র শ্রম আদালত। এইভাবে শ্রম বিরোধ নিরসনের প্রক্রিয়া হয়ে গেল জটিল, নাগালের বাইরে।
সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর ঢালাও বেসরকারীকরণ এখন মোদী সরকারের নীতি। মাত্র চারটি সংস্থাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখে বাকি সবগুলোকেই বেচে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে অর্থমন্ত্রী। রেল বেচে দেওয়া হচ্ছে। এরপর বেসরকারী সংস্থা যাত্রী ভাড়া ঠিক করার স্বাধীনতা পাবে, আর বন্ধ হবে সমস্ত ধরনের ভর্তুকি। লক্ষ লক্ষ রেল কর্মীকে ধরানো হচ্ছে বাধ্যতামূলক স্বেচ্ছা অবসর গ্রহণের কাগজ। গোটা দুনিয়া যখন প্যান্ডেমিক পরবর্তী পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রায়ত্ত বা সরকারী সংস্থাগুলোকে মজবুত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তখন একমাত্র মোদী সরকার বিপরীত পথে হাঁটছে।
আর অন্যদিকে লকডাউনের অজুহাতকে কাজে লাগিয়ে দীর্ঘদিন লোকাল ট্রেন বন্ধ রাখা হয়েছে। নিত্যযাত্রী, মেহনতি মানুষের জীবনে যাতায়াত বন্ধের ফলে নেমে এসেছে এক চরম দুর্দশা। প্রায় লক্ষাধিক রেল হকারদের রুটি-রুজি বন্ধ।
অত্যাবশকীয় পণ্য আইনকে তুলে দিয়ে মোদী কালোবাজারি ও মজুতদারদের হাতকে শক্তিশালী করলো। তিনটি কৃষি আইন এবার দেশের গোটা কৃষি ক্ষেত্রকে নিয়ে আসবে কর্পোরেটদের দখলে। একই ভাবে নতুন শিক্ষা নীতিও শিক্ষাঙ্গনকে নিয়ে আসবে ব্যক্তি মালিকানাধীন সংস্থা ও কর্পোরেটদের কব্জায়। আর গোটা শ্রম বাজার ও শিল্প ক্ষেত্রই এরপর পরিচালিত হবে ইনফর্মাল, ক্যাজুয়াল ও ঠিকা শ্রমিকদের মাধ্যমে। যেখানে থাকবে না কাজের কোনো নিশ্চয়তা, শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও সামাজিক সুরক্ষা। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিজেপির হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদ ও আর্থিক ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী বিদেশী কর্পোরেটদের কাছে আত্মসমর্পণই হলো মোদীর বহু ঢাক পেটানো আত্মনির্ভর ভারত অভিযানের মূল কথা।
মোদীর আমলে ভারত যেন পরিণত হয়েছে বিরাট এক জেলখানায়। যে কোনো বিরোধী কন্ঠস্বর বা ভিন্ন মতাবলম্বীদের দমন করা হচ্ছে চরম নির্দয়ভাবে গোটা দেশ জুড়ে যেন এক অলিখিত জরুরী অবস্থা জারি আছে। গণতন্ত্রের সমস্ত প্রতিষ্ঠান আজ ভুলুন্ঠিত। সমগ্র দেশ, জাতি, দেশের সংবিধান চরম বিপদের মুখে। স্বাধীন ভারতে এতো বড় বিপদ এর আগে আসেনি কখনো।
এর বিরুদ্ধে দেশের কেন্দ্রীয় ইউনিয়ন ও ফেডারেশন সমূহ আগামী ২৬ নভেম্বর ২০২০ সারা ভারত সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। ওইদিন কৃষক সংগঠনগুলোও গ্রামীণ বনধের ডাক দিয়েছে। সমস্ত বামপন্থী দল, বিভিন্ন ছাত্র-যুব-মহিলা সংগঠনও এই ধর্মঘটকে সর্বাত্বকভাবে সমর্থন জানাচ্ছে।
আসুন, মোদীর ফ্যাসিস্ট জমানার থেকে দেশকে মুক্ত করার প্রথম ধাপ হিসাবে ২৬ নভেম্বর ২০২০ সাধারণ ধর্মঘটকে সফল করে তুলি।
সংগ্রামী অভিনন্দন সহ,
এআইসিসিটিইউ,
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি
জলপাইগুড়ি: সিপিআই(এমএল) লিবারেশানের জলপাইগুড়ি জেলা কমিটির পক্ষ থেকে প্রদীপ গোস্বামী, রাম ভগৎ, রমা গুহ নিয়োগী ও সম্পাদক ভাস্কর দত্ত – চার সদস্যের প্রতিনিধিদল জলপাইগুড়ি আনন্দ চন্দ্র কলেজে ১৮ দিন যাবৎ অনশনরত অস্থায়ী কমচারিদের সাথে সাক্ষাৎ করে সহমর্মিতা প্রকাশ করে আন্দোলনে যুক্ত থাকার প্রতিশ্রুতি দেন।
বর্ধমান: পশ্চিমবঙ্গের কলেজ ক্যাজুয়াল কর্মচারি সমিতির পক্ষ থেকে ২৬তম দিনের অনশন কর্মসূচী চলার মাথায় বর্ধমান জেলার শ্যামসুন্দর কলেজের সামনে ধর্না মঞ্চে এআইসিসিটিইউ এবং সিপিআই(এমএল) বর্ধমান জেলা কমিটির পক্ষ থেকে শ্রীকান্ত রাণা ও কুনাল বক্সী তাদের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের আন্দোলনে সংহতি জানান। ভবিষ্যতে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন বলে জানান।
বাঁকুড়া: কলেজের অস্থায়ী কর্মচারিরা বাঁকুড়ার সম্মিলনী কলেজের সামনে গত ৪ দিন ধরে অনশন করছেন তাদের চাকরির স্থায়ীকরন এবং সম্মানজনক বেতনের দাবিতে। সেই অনশন মঞ্চে আজকে উপস্থিত হন এআইসিসিটিইউ-র পক্ষে বাবলু ব্যানার্জী সহ রবি এবং শ্যামল। বক্তব্যে বাবলু ব্যানার্জি বলেন, আজকে বাঁকুড়ায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অমিত শাহ এসেছেন। তিনি ভোটের চমকের জন্য শহর থেকে ৫ কিমি দূরে ৫০টা গাড়ির কনভয় নিয়ে ভাত খাওয়ার জন্য আদিবাসী পাড়ায় যেতে পারেন, কিন্তু এই শহরেই তিনি বা তার কোনো প্রতিনিধি আপনাদের কাছে আসতে পারবেন না, কারণ তারাই তো সংখ্যার জোরে শ্রম আইন পাশ করিয়ে স্থায়ী পদ তুলে দিয়ে অস্থায়ী করে দিচ্ছে। আর, রাজ্যের শাসকদল আপনাদের দিচ্ছে পুলিশের লাঠি এবং জেল। তাই আপনাদের কাছে আমাদের পরামর্শ শহরের একপ্রান্তে আপনাদের এই অনশন শহরের প্রানকেন্দ্র আকাশ মঞ্চে নিয়ে চলুন। আপনাদের ১৪৮ জন সপরিবারে জেলা শাসককে ঘেরাও করে রাখুন। আপনারা আন্দোলন চালিয়ে যান, আমরা আপনাদের সাথে আছি, চাইলে সামনের সারিতে থাকতে পারি।
শতাধিক অনশনরত, শারীরিক সংকটাপন্ন পশ্চিম বাংলার কলেজ ক্যাজুয়াল কর্মচারিদের দাবিগুলির সুষ্ঠু মিমাংসার লক্ষ্যে মুক্ষ্যমন্ত্রীর দ্রুত হস্তক্ষেপের আবেদন জানিয়ে এআইসিসিটিইউ’র রাজ্য সম্পাদক দিবাকর ভট্টাচার্য ২ নভেম্বর একটি খোলা চিঠিতে বলেন, মহাশয়া, আপনি নিশ্চয় অবগত আছেন যে, প্রায় ৬ হাজারেরও অধিক ক্যাজুয়াল কর্মচারি পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন কলেজে দীর্ঘ ৭/১০/১৫ বছর ধরে কাজ করে আসছেন। কলেজ ভিত্তিক গভর্নিং বডির মাধ্যমে এঁদের নিয়োগ করা হয়েছে। যাঁদের উপর নির্ভর করছে পশ্চিম বাংলার সমস্ত কলেজগুলির সচলতা। বেতনের কোন নির্দিষ্ট কাঠামো না থাকায় এঁদের ২ হাজার থেকে ৮/১০ হাজার টাকা বেতন দেওয়া হয়। লকডাউন পর্যায়ে অনেক কলেজের কর্তৃপক্ষ এঁদের বেতনও দেয়নি। এঁরা বিগত ৩/৪ বছরেরও অধিককাল যাবত তাঁদের সমস্যার কথা সরকারের কাছে জানিয়ে আসছেন। বেশ কয়েকবার “পশ্চিমবঙ্গ কলেজ ক্যাজুয়াল কর্মচারি সমিতি”র পক্ষ থেকে উচ্চ শিক্ষামন্ত্রীর সাথে দেখা করে তাঁদের দাবিগুলি জানিয়েছেন। কোনো সমাধান না হওয়ায় আপনার হস্তক্ষেপের জন্য বারংবার আবেদনও করেছেন। অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় যে, সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সদর্থক ভুমিকা না নেওয়ায় আজ রাজ্যের ১২/১৩টি জেলায় শতাধিক ক্যাজুয়াল কর্মচারি দীর্ঘ ২৮/২৯ দিন যাবত অনশন কর্মসূচী চালিয়ে যাচ্ছেন। পশ্চিম বাংলার মানুষ দেখলেন শারদ উৎসবের দিনগুলিতেও তাঁরা তাঁদের পরিবার পরিজনদের সাথে না থেকে অনশন মঞ্চে দিন কাটাচ্ছেন। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন কর্মচারির শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে যার কারণে রাজ্যবাসী আশংকিত এবং উদ্বিগ্ন। আজ পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কোন প্রতিনিধি অনশনকারীদের সাথে আলোচনায় বসে সমস্যা সমাধানের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। আমরা মনে করি শারীরিক অবনতির কারণে কোনো দূর্ঘটনা ঘটলে রাজ্য সরকার দায়ী থাকবে। এমতাবস্থায় আমরা এআইসিসিটিইউ’র রাজ্য কমিটি অত্যন্ত উদ্বেগের সাথে অনতিবিলম্বে আপনার হস্তক্ষেপের দাবি জানাচ্ছি।
কর্মচারিদের দাবিগুলি যথাক্রমে, অবিলম্বে (১) লকডাউন পর্যায়ে যাদের বেতন প্রদান করা হয়নি তাঁদের বেতন প্রদান করা হোক, (২) গেস্ট টিচারদের যেমন কলেজ গভর্নিং বডি নিয়োগ করলেও তাঁদের একটা বেতন কাঠামো ও চাকরির নিশ্চয়তা সরকার দিয়েছে, সেরকম এঁদের জন্যও একটা বেতন কাঠামো চালু করা ও ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত চাকরির নিশ্চয়তা দেওয়া হোক, (৩) যতদিন না স্থায়ীকরণ করা হচ্ছে ততোদিন রাজ্য সরকারের সার্কুলার ৩৯৯৮এফ (পি-২) অনুযায়ী এঁদেরকে স্বীকৃতি ও সুবিধা প্রদান করা হোক।
গত ৩০ অক্টোবর সিপিআই(এমএল) লিবারেশানের ত্রিপুরা রাজ্য কমিটি এক প্রেস বিবৃতিতে বলে, রাজ্যে নারী সুরক্ষার বিষয়টি আজ অর্থহীন হয়ে পড়েছে। নারীদের উপর লাগাতর যৌন হিংসা, গণধর্ষণ, খুন বেড়েই চলেছে। আইনের শাসন শিকেয় উঠেছে। মা-বোনেরা আজ সম্পূর্ণ নিরাপত্তাহীন। শিশুকন্যা, নাবালিকা, গৃহবধূ, সব বয়সের নারীরা কেউই মানুষরূপী হায়নার হাত থেকে বাদ যাচ্ছে না। এমনকি নব্বই বছরের বৃদ্ধাও গণধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। দশমীর রাতে এক প্রতিভাবান মহিলা বাউল শিল্পীকে যেভাবে যৌন হেনস্থা করা হয়েছে এবং তাঁর সম্ভ্রম নিয়ে হায়নার দলের পৈশাচিক উল্লাস সামাজিক মাধ্যমে প্রচার হতে দেখে রাজ্যের মানুষ ভয়ে আঁতকে উঠেছেন। একে সাধারণত আমরা একটি সামাজিক ব্যধি হিসাবে দেখি। কিন্তু তার সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত রয়েছে চলমান আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক শাসন ব্যবস্থা। পুঁজিবাদী কর্পোরেটমুখী অর্থনীতিতে নগ্ন নারীদেহকে আজ যেমন পণ্য হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে। তেমনি তার সাথে যুক্ত হয়েছে মধ্যযুগের মনুবাদী পিতৃতান্ত্রিক দর্শন ও মূল্যবোধ। যাতে নারীর স্থান পুরুষের নীচে। নারী সর্বকালের পরাধীন, ভোগ্য পণ্য, সন্তান উৎপাদনের মেশিন। তাই মনুবাদীদের মডেল রাজ্য উত্তরপ্রদেশে একের পর এক উন্নাও কান্ড, গিরিরাজ কান্ড, হাথরাস কান্ড আমরা দেখতে পাচ্ছি। ধর্ষণকারীদের পক্ষে দল ও সরকার সরাসরি পক্ষ নেয় ও মদত যোগায়। তাই যোগীরাজ জঙ্গলরাজে পরিণত হয়েছে।
ঠিক একইভাবে ত্রিপুরায় আরএসএস-বিজেপি আশ্রিত উগ্র হিন্দুত্ববাদী উন্মাদ ও সমাজবিরোধীদের সরকার ও পুলিশ প্রশাসন সরাসরি মদত দিচ্ছে। ফলে সমাজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সংবিধান ও আইনের শাসন ভেঙ্গে পড়েছে। নারীদের উপর পৈশাচিক যৌন হিংসায় যুক্ত আসামীরা গ্রেপ্তার হয় না। লোক দেখানো গ্রেপ্তার করা হলেও সরকারী মদতে জামিন ব্যবস্থা পাকাপোক্ত হয়ে যায়। আদালতে আইনজীবিরা আক্রান্ত হচ্ছেন। পুলিশের উপরমহলের চাপে তদন্তকারী পুলিশ আধিকারিক আদালতে আসামীর বিরুদ্ধে ফরোয়ার্ডিং জমা দিতে পারেন না। কে কি খাবে? কে কি পড়বে? কে কাকে বিয়ে করবে? আইনজীবীরা কে কোন মামলায় আসামী পক্ষে পেশাগত কাজ করবে? তা পর্যন্ত ঠিক করে দেবে উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংঘ পরিবারের ঠিকাদারেরা। সরকারী অফিসে, আদালতে, থানায়, সব ক্ষেত্রে সমাজবিরোধীদের অবাধ দৌরাত্ম কায়েম হয়েছে। আমরা নাগরিকের অধিকার হারিয়ে আজ প্রজা হয়ে পড়েছি। নাগরিক অধিকার বিপন্ন। মতপ্রকাশের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রতিবাদ, সভা, সমিতি করার অধিকার নেই।
বিরোধী দলের কর্মীদের উপর প্রতিদিন দুর্বৃত্তদের হামলা, সন্ত্রাস চলছে। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর হুমকির মুখে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকরা আক্রান্ত। প্রেস ক্লাবের নির্বাচন ঘিরে নজিরবিহীন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। পুলিশ ও গুন্ডা দিয়ে সাংবাদিকদের ভয়ভীতি প্রদর্শন ও নজরবন্দি করে রাখা হয়েছে বলে প্রকাশ। গণতন্ত্রের প্রতিটি স্তম্ভ আজ আক্রান্ত ও বিপন্ন। মনুবাদের মডেল রাজ্য উত্তরপ্রদেশের মতো গুন্ডারাজ ও পুলিশরাজ কায়েম করা হচ্ছে ত্রিপুরায়। আরএসএস-বিজেপি ত্রিপুরাকে উত্তরপ্রদেশ বানাতে চায়। কিন্তু তা কখনো সফল হবে না। কারণ বিহারের ছাত্র-যুবরা ও সাধারণ জনগণ এবার ঐক্যবদ্ধভাবে রাজনৈতিক মহাজোট গঠন করে বিহারের বুক থেকে বিশ্বাসঘাতক নীতিশ কুমার ও মনুবাদী বিজেপির অপশাসনকে ছুঁড়ে ফেলার সংকল্প গ্রহণ করেছে। বিহার বিধানসভা নির্বাচনে এবার রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিকাশে মুখ্য ইস্যু যেমন সবার জন্য রোজগার, জনস্বাস্থ্য, সর্বজনীন শিক্ষা ও অন্যান্য জ্বলন্ত ইস্যুর উপর নির্ভরশীল সামাজিকভাবে নতুন গতিশীলতায় প্রথাগত জাতপাত, ধর্মীয় বিভাজন ভিত্তিক মেরুকরণের রাজনীতি স্থান পায়নি। বিজেপি তার রাজনৈতিক এজেন্ডাই সেট করতে পারেনি। এনডিএ জোট ভেঙ্গে পড়েছে। এই রাজনৈতিক শিক্ষা উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা ও সারা দেশের মানুষের কাছে নিয়ে যেতে হবে। তাই নারীদের সুরক্ষা আজ সংবিধান, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন সুরক্ষার সাথে যুক্ত। তাই গণতন্ত্রপ্রিয় শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের এই সমাজবিরোধী দুর্বৃত্ত রাজ, পুলিশ রাজ ও মনুবাদী সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে এবং একে পরাস্ত করতে হবে। সংবিধান, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন রাজ্যে পুন:প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
২৬ অক্টোবর হরিয়ানার ফরিদাবাদের এক নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনার খবর সামনে আসতেই আলোড়ন উঠল ভারতের বুকে। ‘নিকিতা তোমার’ নামে এক কলেজ ছাত্রীকে তৌসিফ নামের এক যুবক সেদিন প্রথমে অপহরণ করার চেষ্টা করে, তারপর সেই কাজে ব্যর্থ হয়ে একদম কাছ থেকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। প্রকাশ্য রাস্তায় ঘটা এই হত্যাকাণ্ড জনৈক প্রত্যক্ষদর্শীর মোবাইল ফোন ক্যামেরায় বন্দী হয়ে ভিডিও চিত্র হিসেবে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
এই নৃশংস ঘটনাটির অনুসন্ধান সূত্রে জানা যায় তৌসিফ অনেকদিন থেকেই নিকিতাকে প্রেম প্রস্তাব দিয়ে আসছিল ও নিকিতা বারেবারেই তা প্রত্যাখ্যান করেছিল, জানিয়েছিল অভিযোগও। তৌসিফ তা সত্ত্বেও জোর খাটিয়েই যেত এবং শেষমেষ মরীয়া হয়ে অপহরণের চেষ্টা করে ও তাতে ব্যর্থ হয়ে খুন করে নিকিতাকে।
মুসলিম যুবক এক হিন্দু মেয়েকে জোর করে বিয়ে করতে চাইছে এবং তারপর তাতে ব্যর্থ হয়ে তাকে খুন করছে – এই ঘটনাধারাকে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি প্রত্যাশিতভাবেই তাদের সুপরিচিত লাভ জেহাদ ছকে ব্যাখ্যা করে ও এই সোচ্চার প্রচারে সামিল হয়। যেটা চাপা পড়ে যায় সেটা হল এই ধরনের ‘স্টকিং’ ও যৌন উৎপীড়নের ঘটনায় পুলিশ ও প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গীর সমস্যা, যা এই ধরনের সমস্যাকে ক্রমশ ভয়ংকর আকার দিচ্ছে।
আমাদের সমাজের একাংশ এগুলিকে যৌন উৎপীড়ণের বদলে প্রেম ভালোবাসার সমস্যা হিসেবেই দেখার পক্ষপাতী এবং পুলিশ প্রশাসনও সেই দৃষ্টিভঙ্গীতে সামিল হন। তারা এই ঘটনাগুলিতে অভিযুক্তকে যথাযথ শাস্তি দেবার বদলে প্রায়শই আপোষ মীমাংসার রাস্তায় হাঁটতে চান ও অপরাধ এইভাবে লঘু হয়ে যায়। সেইসঙ্গে তৈরি হয় এই ধরনের মারাত্মক পরিণতির সম্ভাবনা। আমাদের পপুলার সংস্কৃতিতেও বিষয়টিকে প্রেমের এক অদ্ভুত প্রকাশ হিসেবে দেখার চল আছে। বিখ্যাত বলিউডি ছবি ‘ডর’ সিনেমাটির মধ্যে, তার ‘তু হাঁ কর ইয়া না কর তু হে মেরি কিরণ’ গানটির মধ্যে যার প্রকাশ খুব স্পষ্ট।
আগেকার ও সমকালের আরো অসংখ্য ঘটনার মতো (যেগুলিতে নারী পুরুষ প্রায়শই একই ধর্মগোষ্ঠীর) নিকিতা তোমার হত্যাকাণ্ড আরো একবার স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিল স্টকিং-কে ভালোবাসার বিচিত্র প্রকাশের পরিবর্তে একটি যৌন উৎপীড়নমূলক অপরাধ হিসেবে দেখাটা ও সেই অনুযায়ী আইনি ব্যবস্থা নেওয়াটা কতটা জরুরি। আইনের একটি ধারাকেও এই প্রসঙ্গে পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। স্টকিং-এর ঘটনা প্রথমবার আসলে তাকে জামিনযোগ্য বিষয় ও দ্বিতীয়বার থেকে তাকে জামিন অযোগ্য বিষয় হিসেবে দেখার দরকার আছে। কারণ কোনো মেয়েকে কোনও পুরুষ প্রথম প্রেম প্রস্তাব দিলে সেটি নিয়ে কেউ পুলিশে অভিযোগ জানাতে যায় না। তখনি অভিযোগ আসে যখন বারবার একই ঘটনার মধ্যে দিয়ে তাকে বিরক্ত করা হয়, ভয় দেখানো হয়। স্টকিং-এর প্রথম অভিযোগটি অপরাধ বেশ কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার পরেই যেহেতু করা হয় তাই প্রথম থেকেই একে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখে জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা করে অভিযোগকারিণীকে সুরক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। সমাজ ও বিশেষ করে পুলিশ প্রশাসনের তরফে স্টকিং নিয়ে দৃষ্টিকোণ বদলই নিকিতা তোমারদের মর্মান্তিক পরিণতি রুখতে পারে।
- সৌভিক ঘোষাল
‘জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টরস’-এর পক্ষ থেকে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে একটি চিঠিতে আবেদন জানানো হয়েছে, এই মুহূর্তে আমাদের রাজ্যে কোভিডের দাপট বেশ চিন্তাজনক পর্যায়ে! গত ছ’সপ্তাহ ধরে ক্রমেই বেড়ে চলেছে সংক্রমণ এবং মৃত্যু!
সারা দেশে যে রাজ্যগুলিতে দৈনিক সংক্রমণ (এবং মৃত্যু) সবচেয়ে বেশি, অতীব দুঃখ ও বেদনার সাথে আমরা দেখতে পাচ্ছি সেই তালিকায় এখন প্রায় শীর্ষে চলে আসছে আমাদের রাজ্য।
চিকিৎসাবিজ্ঞান-এর নিয়ম অনুযায়ী এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে যাঁরা কোভিডের শিকার হন, তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষেরই সমস্যাটা বাসা বাঁধে ফুসফুসে। তাঁদের শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।
যারা করোনা থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে সুস্থ হয়ে ওঠেন তাদেরও পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে উঠতে অনেক সময় লাগে।
শীত আসছে। ঠিক এই সময়ে জ্বর-সর্দি-কাশির প্রকোপ প্রতিবছরেই কম বেশি হয়েই থাকে, সঙ্গে দোসর পরিবেশ দূষণ! গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো এবছর তার ওপর আবার সর্বব্যাপী এই কোভিড অতিমারীর করাল ছায়া !
এই পটভূমিতে দাঁড়িয়ে আমরা আপনাকে অনুরোধ করছি এই বছর কালীপুজো, দীপাবলির সময় কোনো রকম পটকা ও আতসবাজি জ্বালানোর ঘটনা যাতে না ঘটে তার জন্য রাজ্য প্রশাসন যথাযথ সক্রিয় ভূমিকা নিয়ে রাজ্যবাসীকে সমূহ বিপদ থেকে রক্ষা করে দেশের অন্যান্য রাজ্য তথা বিশ্বের কাছে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পথিকৃতের দাবিদার হয়ে উঠুক।
পটকা, আতসবাজি থেকে নির্গত হওয়া বিষাক্ত গ্যাস বাড়িতে বা কোয়ারান্টিনে বা হাসপাতালে থাকা রোগীদের জন্য খুব মারাত্মক। পটকা বা আতসবাজি খুব অল্প সময়ে বিপুল পরিমাণ বায়ু দূষণের কারণ হয়ে যায় তার মধ্যে থাকা ধাতব কণা, বিপজ্জনক টক্সিন, সালফার বা কার্বনের মতো ক্ষতিকারক রাসায়নিকের কারণে! এই মারাত্মক সূক্ষ্ম দূষণকণাগুলির প্রভাবে কাশি, শ্বাসকষ্ট, হাঁপানির আক্রমণ এবং এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। এই বিপদ থেকে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি হৃৎপিণ্ড বা ফুসফুসের রোগী, বয়স্ক ও শিশুদের।
অতিসুক্ষ বায়ুবাহিত দূষণকণা (যেমন পিএম ২.৫) বিশেষভাবে বিপজ্জনক কারণ তারা ফুসফুসের গভীরে প্রবেশ করতে পারে এবং বিভিন্ন ধরনের প্রতিকূল প্রভাব ফেলতে পারে। ২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্ট তাঁর রায়ে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের (সিপিসিবি) গবেষণার উল্লেখ করে রায় দেন “দিওয়ালি চলাকালীন পটকা ফাটানো অবশ্যই বায়ু দূষণে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে।” এতে আরো বলা হয়েছে, পটকা ফাটানোতে দূষণকণা পিএম ২.৫ যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা “স্বাস্থ্যের পক্ষে একটি গুরুতর ঝুঁকি।”
গতবছর (২০১৯) ভারতে ১৬ লক্ষ ৭০ হাজার মানুষ মারা গেছেন কেবলমাত্র বায়ু দূষণের কারণে হওয়া বিভিন্ন রকমের অসুস্থতায়! গতবছর কিন্তু কোভিড ছিল না! কিন্তু এটা কোভিডের বছর!
সরকারী তথ্য অনুযায়ী আমাদের রাজ্যে এপর্যন্ত প্রায় তিনলক্ষ বাষট্টি হাজার মানুষ কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন।
তাদের মধ্যে প্রায় চল্লিশ হাজার মানুষ এখন এ রাজ্যে কোভিড জনিত কারণে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন! তাঁদের অনেকেরই ফুসফুস পুরোপুরি কাজ করছে না, কারো অক্সিজেন চলছে, কেউ বা আবার ভেন্টিলেশনে!
প্রায় তিনলক্ষ আঠেরো হাজার জন সুস্থ হয়ে ওঠার বিভিন্ন পর্যায়ে। কেউ এখনো অত্যন্ত দুর্বল, কেউ মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে আসার অপরিসীম মানসিক-শারীরিক ক্লান্তি নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন, অনেকেরই শ্বাস-কষ্টের সমস্যা থেকে গেছে। আইসোলেশনে-কোয়ারান্টানে মানসিকভাবেও অনেকে বিপর্যস্ত !
অর্থনৈতিক ভাবে তো বটেই !
ধুঁকতে থাকা, একটু মুক্ত বাতাসের জন্য হাঁফাতে থাকা অসংখ্য অসুস্থ মানুষ আমাদের চারপাশে !
কিছু মানুষের আনন্দের জন্য বাজি ফাটিয়ে আতসবাজি জ্বালিয়ে সেই মানুষগুলির প্রাণসংশয়ের কারণ হওয়ার বিষয়টি নিশ্চয়ই প্রশ্রয় পেতে পারেনা। আমরা নিশ্চিত রাজ্যের প্রশাসনিক অভিভাবক হিসেবে আপনিও এবিষয়ে সহমত।
দীপাবলির সময় আতসবাজির বিষাক্ত ধোঁয়া এবার যে কোনোভাবে এড়াতে হবে এবং যারা লড়াই করছেন বা করোনায় ভুগছেন তাঁদের আরও কষ্টের হাত থেকে বাঁচাতেই হবে।
কারণ, তাঁদের কেউ আপনার কাছে মা, কেউ বাবা, ভাই, বোন, সন্তানসম। এমনকি তাঁদের কেউ কেউ এই রাজ্যের চিকিৎসকও!
পাড়া, বস্তি, বাড়ি, বিল্ডিং কমপ্লেক্স, সোসাইটি, পার্ক, বাগান, প্রতিষ্ঠানে সবরকম আতসবাজি-পটকা এবছর বর্জন করার জন্য হাতজোড় করে আমরা অনুরোধ করছি। আপনার নেতৃত্বে রাজ্য প্রসাশনও আমাদের সহযাত্রী হলে এই কাজে অনায়াস সাফল্য আসবে।
এই বছর অন্তত পটকা আতশবাজির থেকে রাজ্যবাসীকে দূরে রাখা যাবে। এলাকার প্রত্যেককে বোঝাতে এবং চেষ্টা করতে পরিবেশকে যথাসম্ভব দূষণমুক্ত রাখতে।
আপনার নেতৃত্বে প্রশাসনের সহযোগিতায় এই পদক্ষেপটি গ্রামে, গঞ্জে, শহরে আমাদের প্রতিবেশীদের কাছেও সচেতনতার একটি দারুণ উদাহরণ হয়ে উঠবে।
অসংখ্য মানুষের প্রাণরক্ষা পাবে। সকলকে সচেতন করতে আপনি আমাদের সহায়তা করুন।
করজোড়ে আমাদের সবিনয় নিবেদন, দীপাবলি এবার দূষণহীন হোক।
গত ২২ থেকে ২৫ অক্টোবর চার দিন হালিসহর রবীন্দ্র বিদ্যামন্দিরে বিকেল পাঁচটা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের অন্তর্ভূক্ত হালিসহর সাংস্কৃতিক সংস্থা’র আয়োজনে ৪২তম ‘কাগজ ভাঁজের খেলা, আলোকচিত্র, চিত্র ও ভাস্কর্য প্রদর্শনী’ অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭৯ সালে পথ চলা শুরু। আমরা যারা ভাববাদে বিশ্বাসী নই, তারা চিন্তা করি বিকল্প সংস্কৃতির সপক্ষে অসহায় মানুষের স্বার্থে কিছু সৃজন আমরা করতেই পারি। প্রায় প্রতি বছর বিভিন্ন শাসকদলের বাধার সম্মুখীন হতে হয়। আর প্রতিবারই সাধারণ মানুষের উৎসাহ আর সংস্থার উদ্দীপনা অতিক্রম করার সাহস দেখিয়েছে। প্রতিবার ‘হাসাস’ মানুষের কাছে কিছু না কিছু বার্তা দিয়েছে। এবছর সংগঠনের সম্মিলিত প্রদর্শনী আয়োজিত হয় শতবর্ষের সত্যজিৎ রায় ও বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে উৎসর্গ করে। প্রদর্শনীতে স্মরণ করা হয় প্রয়াত শিল্পীদের সাথে গণসঙ্গীত শিল্পী ও পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের প্রাক্তন সভাপতি প্রবীর (মনা) বল এবং মাইম ও অঙ্কন শিল্পী অমিতাভ (পপি) সরকারকে।
এবার হালিসহর সাংস্কৃতিক সংস্থা সুধী সাধারণ দর্শকদের বার্তা দিয়েছে সৃজনশীল শিল্পের মাধ্যমে “ফ্যাসিবাদ ও বিপন্ন স্বদেশ”। পাঁচটি হোর্ডিং-এ শিল্পী অভিজিত সেনগুপ্ত ও একটি কক্ষে শিল্পী কল্লোল দাস এই বিষয়টি নান্দনিকভাবে উপস্থাপিত করেছে, সাধারণ মানুষকে স্তম্ভিত করে, অনুভূতিকে দ্রোহে পরিণত করেছে। একএকটি কক্ষে শিশুদের আঁকা, বৈচিত্র্যময় আলোকচিত্র এবং কারিগরদের চিত্র ও ভাস্কর্য শিল্প প্রদর্শিত হয়েছে। শতবর্ষে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা উপলক্ষে তমাল সাহার কবিতা কোলাজ উপস্থাপিত হয়েছে। জাতীয়তাবাদী জিগীরের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের ভাবনা ও শিশু মনোপযোগী শিল্প ভাবনায় - সৌমেন প্রধানের রঙ বেরঙের কাগজ ভাঁজের খেলা মানুষকে উৎসাহিত করেছে। পরিযায়ী শ্রমিকদের বিভিন্ন অবস্থা আলোকচিত্রে দর্শককে বিমূঢ় করে তুলেছে। সাইকেলকে ধরে খেটে খাওয়া মানুষের ব্যবহৃত জিনিস দিয়ে ইনস্টলেশন মানুষকে আকৃষ্ট করেছে।
শেষদিন ২৫ অক্টোবর সত্যজিৎ রায় জন্মশতবর্ষে স্মরণে ‘সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্র এবং সত্যজিৎ’ আলোচনা উপস্থাপিত হয়। স্ক্রিনে চলচ্চিত্রে সত্যজিৎ দেখানোর সাথে সাথে প্রাণবন্ত মনোগ্রাহী আলোচনা করেছেন ‘সংবর্ত সিনে সোসাইটি’র বিশিষ্ট বক্তা আবীর মজুমদার। পরে সত্যজিৎ রায়ের পোস্টমাস্টার চলচ্চিত্রটি প্রদর্শন করা হয়। ৫৯ জন শিল্পীর উৎকর্ষতা দেখতে অন্যবারের তুলনায় কিছু কম হলেও, চেনা রাজনৈতিক বন্ধুদের অনাগ্রহ থাকলেও (বৃহৎভাবে দেখলে, এই উপেক্ষা আমাদের সার্বিক ব্যর্থতা। প্রসঙ্গক্রমে এক রাজনৈতিক বন্ধু বলেছিলেন, তোমাদের সাথে আমাদের পার্থক্য কি জানো? তোমরা রাজনৈতিক পত্রিকা কিনে পড়, আমরা সাংস্কৃতিক পত্রিকা কিনে পড়ি না, দিলে দেখি) প্যান্ডেলে না ঘোরা বেশ কিছু শিল্প রসিক বন্ধু (শুধু প্রদর্শনী দেখতেই এসেছে) ও প্রচুর সাধারণ মানুষের অসাধারণ সমাগমে এ বছরের আলোকজ্জ্বল, বর্ণময় প্রদর্শনী দৃঢ়তা রেখেই সার্থক হয়েছে, মানুষের উৎসাহে।
“ডু ইউ থিংক ইউ আর অ্যান অ্যাকটিভিস্ট? ইয়েস অর নো? তোমাকে অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয়েছে এবছর মালদার গঙ্গা ভাঙনের উপর পোস্ট এডিট লেখার জন্য... সঙ্গে সাবজেক্ট এক্সপার্ট আর গভর্নমেন্ট অফিসিয়ালদের কমেন্টগুলো যোগ করা... অ্যালংউইথ ডিটেলড স্ট্যাটিস্টিক্যাল ডেটা অ্যান্ড সাইটেশনস... আর সেখানে তুমি ক্যারেক্টারের পর ক্যারেক্টার এনে স্টোরি লিখতে বসেছ! ডোন্ট ফরগেট-তুমি অধ্যাপক, সাংবাদিক, নদী ভাঙন বিশেষজ্ঞ — যা খুশি হতে পারো, বাট শ্যুড নট অ্যান অ্যাক্টিভিস্ট, আন্ডারস্টুড?” পীরগঞ্জ পেরিয়ে রতুয়ার দিকে গাড়ি যত এগোচ্ছে, ঋষির কানে ঝনঝন করে বাজছে ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষের প্রবল ধাতানি, আর সে ভাবার চেষ্টা করছে “মানুষের জন্য রিপোর্ট”, না “রিপোর্টের জন্য মানুষ” – কোন পথটা সে শেষ লেখাটার জন্য বেছে নেবে?
রতুয়া হয়ে তারা যাবে বালুপুর-তারপর সেখান থেকে নৌকায় মহানন্দাটোলা। ভূতনি-মহানন্দাটোলা আর কাটাহা দিয়ারা মালদা জেলার সেই অঞ্চলগুলোর মধ্যে পড়ে, সেখানে সামান্য বিরতি সহ বাৎসরিক নদী ভাঙন নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মতোই স্বাভাবিক। হয়তো সেজন্যই সংবাদমাধ্যম নিউজপ্রিন্ট বা ফুটেজ – কোনটাই তেমন খরচ করতে চায় না এই এলাকার জন্য। মাথা নেড়ে ঋষির ভুল সংশোধন করে দেন হিমাংশুদা – এবারের সঙ্গী তিনি আর তাঁর স্ত্রী রুমাশ্রী। তাঁর মতে, মিডিয়া চায় ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়ার ছবি, মানুষের হাহাকারের দৃশ্য – সে ছবি এখানে তারা পাবে কোথায়? এখানে গঙ্গা আর ফুলহার মিলে নিঃশব্দে খেয়ে ফেলতে থাকে উর্বর ফসলী জমি… প্রায় চল্লিশ বছর ধরে ছবিটা একইরকম আছে। কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে অভ্যস্ত স্থানীয় কিষান, বিন বা চাঁই মণ্ডলেরা অর্থনৈতিকভাবে সর্বস্বান্ত হয়ে কৃষিভিত্তিক সমাজজীবন থেকে সরে আসছেন, সরে আসতে বাধ্য হচ্ছেন শ্রমভিত্তিক নগরজীবনে। তিনি যোগ করেন, অনেকে কৃষি নির্ভরতাকে আঁকড়ে ধরতে চেয়ে চলে গেছেন মালদার গাজোল অঞ্চল বা উত্তর দিনাজপুরের ইটাহার অঞ্চলে, অর্থাৎ কৃষিনির্ভর গ্রামীন এলাকায়-অনেকে আবার একদিক হারিয়ে অন্যদিকে জেগে ওঠা চরে কোনমতে কুঁড়েঘর বেঁধে চাষবাস করে পেট চালানোর চেষ্টা করছেন। ১৯৮৬-৮৭ সাল থেকে অনিয়মিত বিরতিতে এই বাৎসরিক নদীভাঙন এখানকার ভূমিরূপকে এমনভাবে পরিবর্তিত করেছে যে গঙ্গা ও ফুলহারের সংযোগস্থল, পশ্চিম ও পূর্বদিকের গঙ্গারামটোলা ও শ্রীকান্তটোলার দূরত্ব ক্রমাগত কমে আসছে। কাটাহা দিয়ারার পশ্চিমে গঙ্গা আর পূর্বে ফুলহার... ফলে, এই ব্যবধান যত কমছে, বিপদ তত বাড়ছে। এ বছর আগস্টের শেষ থেকে শুরু করে সেপ্টেম্বরের দিকে দিনগুলো যত এগিয়েছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে নদীর তল কাটা। সঙ্গে লাগাতার বৃষ্টি নদীর জলস্তর ফুলিয়ে বিপদের মাত্রাকে ক্রমাগত বাড়িয়ে তুলছে, আর এরই ফলশ্রুতি হিসাবে মানিকচকের ভূতনিতে ১১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার বিকেল থেকে গঙ্গাগর্ভে তলিয়ে গেছে কয়েকশো মিটার বাঁধ সংলগ্ন এলাকা। লাগাতার ভাঙনের ফলে একেবারে বাঁধের গোড়ায় পৌঁছে গিয়েছে নদী-স্বাভাবিকভাবেই গ্রামবাসীদের মধ্যে গ্রামে জল ঢোকার আশঙ্কা ক্রমাগত বেড়েছে। ভাঙনের এই আতঙ্কে মানিকচক ব্লকের হীরানন্দপুর ও উত্তর চণ্ডীপুর অঞ্চলের সংযোগস্থল কেশবপুরের কালটনটোলা এলাকায় কয়েক ঘন্টার মধ্যে কয়েকশো মিটার বাঁধ তলিয়ে যায় জলে। সেচ দপ্তরের তৎপরতা থাকলেও বাঁশ আর বালির বস্তা দিয়ে ভাঙন রোধের তাৎক্ষণিক প্রয়াস যথারীতি ব্যর্থ হয়েছে। সংবাদমাধ্যমের সূত্রে জানা যাচ্ছে, মাসখানেক আগে ভাঙনের কথা আগাম মাথায় রেখে ভাঙনরোধের জন্য সেচ দপ্তর মারফৎ প্রায় সাত কোটি টাকা ব্যয়ে ভাঙনরোধের কাজ হয়েছে রাজকুমারটোলা ও টেনুটোলা অঞ্চলে। যদিও সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অভিমত, হঠাৎ করে নদীর জলস্তর বৃদ্ধির ফলেই ভাঙনের ঘটনা সামনে এসেছে।হিমাংশুবাবুর মতো রুমাশ্রীও ভূমিকন্যা। ২০০২-০৩ সালের ভয়াবহ ভাঙনে বাড়ি ভেসে যাওয়ার পর তারা উঠে আসে মালদা শহরে। তারপর অনেক ঠাঁইবদলের পালা পেরিয়ে তারা এখন মালদা টাউনেরই স্থায়ী বাসিন্দা। হাইস্কুল শিক্ষিকা রুমাশ্রী উত্তর ভারতের একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ভূতনি দিয়ারা অঞ্চলের কিষান জনজাতির লোকসংস্কৃতি নিয়ে গবেষণারত। সে জোর দিয়ে বলে, এই বালির বস্তা বা বোল্ডার ফেলাটা লোক দেখানো - এতে কাজের কাজ কিছু হয় না। যেহেতু ভূতনি, মহানন্দাটোলা বা বিলাইমারি পুরোটাই বালিমাটির জায়গা, বোল্ডার বা ক্রেট নিজের ওজনে মাটিতে বসে গিয়ে মাটি বা বাঁধকে একেবারে গোড়া থেকে দুর্বল করে দেয় – ফলাফল সবারই জানা। রতুয়া থানার অধীনস্থ মহানন্দাটোলা গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত শ্রীকান্তটোলা, মুলিরামটোলা, কান্তুটোলা, বীরুটোলা, আমিরচাঁদটোলা, পটলডাঙা, রাজকিশোরটোলা বা দ্বারিকটোলা; বিলাইমারি গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত গঙ্গারামটোলা, রুহিমারি, নাকাট্টি বা পাশের রাজ্য বিহারের দিনারামটোলা, বাবলাবোনা, খাট্টি, ভোলামারি বা কাতলামারির মতো অঞ্চল অথবা মানিকচকের ভূতনি থানার অধীনে হীরানন্দপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত গৌরাঙ্গটোলা, ডোমনটোলা, বৈকুন্ঠটোলা, নন্দীটোলা, নবরারজায়গির, গোবর্ধনটোলা বাগডুকরা, নতুনটোলা; এমনকি ভূতনির চণ্ডীপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের বেশ কিছু অঞ্চল হয় নিশ্চিহ্ন, নয় তীব্র ভাঙনপ্রবণ। এসব এলাকায় নদীর সঙ্গে লড়াইয়ে মানুষ নিজেদের মতো আত্মরক্ষার চেষ্টা করতে থাকে -আর নদী তাদেরকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে থাকে; এ খেলা চলছে নিরন্তর... রুমাশ্রী জোর দিয়ে বলে, বাগডুকরা বাদ দিয়ে প্রায় সব অঞ্চলে কিষান জনজাতির বাস – প্রতিবছরের বন্যায় সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এরাই, প্রত্যেকবারই প্রতিশ্রুতি ছাড়া আর কিছু তাদের ভাগ্যে জোটে না। শুধু ভোটব্যাঙ্কের স্বার্থে ব্যবহৃত হতে থাকে তারা। সে বলে, পার্শ্ববর্তী রাজ্য বিহারে এই জনজাতি এসটি স্টেটাসের অধীনে সংরক্ষণের সুবিধা পায় – অথচ বিহার-বাংলার গা ঘেঁষা সীমান্তের এই মানুষেরা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের খাতাকলমে এসটি সংরক্ষণের আওতার বাইরে। এ নিয়ে লাগাতার দাবিদাওয়া-আন্দোলনেও কোনো কাজ হয়নি।
সব শুনতে শুনতে আবারও অন্যমনস্ক হয়ে যেতে থাকে ঋষি। তার মনে হয়, মানিকচক ব্রিজ আর নাকাট্টি ব্রিজ দিয়ে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত এই ভাঙনপ্রবণ ভূখণ্ড আগামী পাঁচ বছর বাদে কোন অবস্থানে থাকবে? তখন কি আর এক খণ্ডহরের সামনে দাঁড়াতে হবে? হঠাৎ বিনয় মজুমদারের কবিতার লাইন মনে পড়ে যায় তার: “সেতু চুপে শুয়ে থাকে ছায়ার উপরে/ ছায়া চুপে শুয়ে থাকে সেতুর উপরে”। রুমাশ্রী বলে চলে তার ব্যক্তিগত ভাঙন অভিজ্ঞতার কথা – ২০০২-০৩এর ভাঙনে নন্দীটোলায় তাদের বাড়ি টেনে নেয় গঙ্গা, শুধু মার্কশিট-সার্টিফিকেটের ফাইল বুকে আঁকড়ে ধরে বাড়ির গোয়ালঘরে রাত কাটানোর স্মৃতি তার মনে এখনো টাটকা। ২০০৮এর ভাঙনে জঞ্জালীটোলা গ্রামও এমনভাবেই তলিয়ে গিয়েছিল রাতারাতি। মুঠোখোলা খইয়ের মতো ছিটকে গেছে সেই পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় বন্ধুরা... হয়তো বহুদিন বাদে চেনা শহরের অচেনা আলোর নিচে হঠাৎই মুখোমুখি হয়ে গেছে তারা... প্রাথমিক বিস্ময়টুকু পেরিয়ে প্রথমেই ফিরে এসেছে সেই ভাঙনদিনের প্রসঙ্গ। এই স্মৃতিযাত্রা থেকে কোনদিন বেরোতে পারেনি তারা। সে বলে, গ্রামের বাড়ি থেকে কোনমতে বাঁচিয়ে আনা ইঁট, কাঠ বা অন্য উপকরণ তারা ব্যবহার করেছিল শহরের উপকন্ঠে মাথাগোঁজার ঠাঁই বানানোর জন্য… এভাবেই ভাঙনের স্মৃতি, পুরনো অস্তিত্বের স্মৃতি মিলেমিশে গেছে নতুন বসতের সঙ্গে, নতুন অস্তিত্বের সঙ্গেও, হয়তো…
এর মধ্যে ঘনঘন বেজে উঠছে ঋষির মোবাইল। দুর্বল টাওয়ার লোকেশন পেরিয়ে যতোটুকু সে শুনতে পেরেছে, তা অনেকটা এই : খারাপ হলেও তার স্পেকুলেশন মিলে গেছে – বাঙ্গীটোলার জোতকস্তুরীতে মাঝরাতের পহলে ডিপট্রিজ খুলে গিয়ে নিঃশব্দে পাড় কাটা আরম্ভ হয়েছে; আর ২১ সেপ্টেম্বর তৃতীয় দফার ভয়ংকর ভাঙনে চিনাবাজার-দুর্গারামটোলা অঞ্চল মানচিত্র থেকে মুছে যাওয়ার পথে। অফিস চায়, আর একবার সে তার নিজের টিম নিয়ে স্পট রিভিজিট করে আরো কয়েকটা কিস্তি লিখুক... অনেক অভিনন্দন তাকে, এভাবে অন্য আঙ্গিকে সত্যিটাকে তুলে ধরার জন্য; নয়তো এরকম একটা মিক্সড জঁরের লেখার এত ভিউ বা কমেন্ট হয় না বা সে লেখা এডিটরস চয়েস টানা পাঁচদিন এক থেকে পাঁচের মধ্যে থাকে না, এটা তার একটা নতুন কামব্যাক... ইত্যাদি ইত্যাদি। অন্য ডেস্ক থেকে ফোন করে বলে, নিউজফিড দেখতে – ২৩ সেপ্টেম্বরের পার্লামেন্টে উত্তর মালদার এমপি সরব হয়েছেন মালদার নদীভাঙন ও দুর্গতদের ক্ষতিপূরণের বিষয়ে... সবটুকু শোনে ঋষি, শুনে শান্তভাবে ‘না’ করে। ব্যক্তিগত শারীরিক কারণ দেখায়, তার টিম ছিটকে গেছে বলে জানায়... কোনমতে বুঝিয়ে দিয়ে দায় ঝেড়ে ফেলতে চায়। আসলে, সে পালাতে চায়! সে পালাতে চায় জোতকস্তুরীর সেই জেলের থেকে, যে হাতজোড় করে বলেছিল, “স্যর, অনেক সময় ধরে আমাদের কথা শুনলেন, এবার একটু দেখবেন”... সে পালাতে চায় চিনাবাজার-দুর্গারামটোলায় আলাপ হওয়া সেই জেসিবি চালকের থেকে, গঙ্গার হাওয়াতেও একচান্সে বিড়ি ধরিয়ে সে বলেছিল, “যেমন চাইছেন, তেমন গল্প এখানে শয়ে শয়ে ঘুরে বেড়ায়... আমার বাবা তিনবার ঘর খুলেছে, ওর গল্প একটু বেশি-আর আমি একবার, আমার একটু কম-ফারাক এটুকুই”... সে পালাতে চায় সুখসেনা ঘাটের সেই মাঝির থেকে-সরাসরি আঙুল দেখিয়ে ঋষির স্নিকারের দাম জানতে চেয়েছিলো সে, খানিকবাদে নৌকা বাইতে বাইতে আপনমনে বলেছিল, “খুব শখ ছিল এমন জুতার, পয়সাও করেছিলাম -তা এবার তো আর...” ঋষি ভাবে, অভিজিৎ সেনের গল্পে ভূতনির চরের সেই দেয়াশিনীর কথা; তার বলা ধাঁধায় কি এমনভাবেই সব ভাঙনের গল্পগুলোকে মানবজীবনের সঙ্গে এক জায়গায় মিলিয়ে দিতে চেয়েছিল সে? “চার কবুতর চার রং, খোপমে ঢুকলে সে এক্কেরং-কা হোতে রে ছেউড়া? কা হোতে, বোল!” তার বুকের মধ্যে কে যেন বিশাল চিৎকার করে বলে ওঠে, “তু হোতে, তু!”
নৌকায় করে ভাঙন দেখতে দেখতে মাঝি গল্প করে, মাছ মারতে গিয়ে হঠাৎ ঘূর্ণিতে দাদু আর নাতির একসঙ্গে তলিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে এই সেদিন... এমন কতো ঘটনা রোজ রোজ ঘটতে থাকে এখানে, যা সাধারণ ‘ঘটনা’ পেরিয়ে ‘দুর্ঘটনা’ হয়ে ওঠে না - খুব ম্যাটার অফ ফ্যাক্ট ভঙ্গিতে আঙুল তুলে জায়গাটা দেখিয়ে দেয় সে। ক্যামেরার ফোকাস ঠিক করতে করতে হঠাৎই ঋষির চোখে পড়ে: চতুর্দিকে জল, তার মধ্যে একটি চরে গুটিকয়েক ভয়ার্ত, দরিদ্র মানুষ একজন মৃতকে অন্য জগতে রওনা করিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়াটিকে যত দ্রুত সম্ভব এগিয়ে নিয়ে চলেছে। নৌকায় ওদেরকে দেখে তাদের কাজের দ্রুততা আরও বাড়ে -কোনমতে যেন পালাতে চায় মানুষগুলো! “ফ্যাক্ট অফ ক্যারেক্টার”, না “ক্যারেক্টার অফ ফ্যাক্ট” – কোনটা বেশি জরুরি, সেই ভাবনায় আর লেখা শেষ হওয়ার দমচাপা কষ্টে কন্ঠার কাছে একটা অস্বস্তি নিয়ে ঋষি লক্ষ করে: ডোম বাঁশ দিয়ে সযত্নে পাশ ফিরিয়ে দিচ্ছে দেহটিকে... যেদিকে তার সারাজীবন ধরে বড়ো ব্যথা ছিল!
- তপোমন ঘোষ
২ নভেম্বর ২০২০ পোলবার সেঁইয়া সংলগ্ন বালিটানা গ্রামে সমবেত হয়েছিলেন অসংখ্য মানুষ, আদিবাসী মঞ্চের সংগঠক কমরেড বিশ্বনাথ সরেনের স্মরণসভায়। হরিপাল থেকে বলাগড়, ধনেখালি, পোলবা, দাদপুর, পাণ্ডুয়া সহ জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে এসেছিলেন আদিবাসী মঞ্চের পতাকাতলে সংগ্রামরত তাঁর সহযোদ্ধারা। কলকাতা থেকে ছুটে এসেছিলেন পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের রাজ্য সম্পাদক কমরেড নীতীশ রায়, শীলা দে সরকার, কোন্নগর থেকে এসেছিলেন আইসা সংগঠক সৌরভ, সিপিআই(এমএল) জেলা কমিটির পক্ষে উপস্থিত ছিলেন মুকুল কুমার শুভাশীষ চ্যাটার্জী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।
৫৫ বছরের জীবনযুদ্ধ শেষে গত ১৪ অক্টোবর ২০২০ কলকাতার পিজি সংলগ্ন রামরিক হাপাতালে মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ জনিত কারণে দীর্ঘ ১২ দিন অসচেতন অবস্হায় কাটিয়ে ভোররাতে অকালে বিদায় নেন কমরেড বিশ্বনাথ সরেন। রেখে গেছেন স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, পুত্রসম জামাই সহ গুণমুগ্ধ হাজারো মানুষকে, যাদের উদ্যোগে ছিল এই স্মরণসভা।
সকলের প্রিয়, সাহসী, বিনয়ী, মৃদুভাষী নেতা বিশ্বনাথ সরেন ছিলেন সারা বাংলা আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চের রাজ্য কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও হুগলি জেলার সহ সভাপতি। কমরেড বিশ্বনাথ শুধু আদিবাসী নেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন সমস্ত মেহনতি মানুষের লড়াইয়ের সাথী, বামপন্থী আদর্শে আজীবন স্হির বিশ্বাস ছিল তাঁর। এই আদর্শবোধ, গরিব মানুষের অধিকার রক্ষার লড়াইয়ের প্রতি দায়বোধ থেকেই তিনি সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের সদস্যপদ গ্রহণ করেন। আমৃত্যু ছিলেন লিবারেশনের ধনেখালি, পোলবা-দাদপুর এরিয়া কমিটির সদস্য।
সমবেত সকলেই স্মরণ করলেন এই পর্যবেক্ষণ যে আদিবাসী মঞ্চের প্রতিটি সভায় কমরেড বিশ্বনাথদা তুলে ধরতেন আদিবাসীদের প্রতি বঞ্চনার ইতিহাস। এই বঞ্চনাকে তিনি অন্তর থেকে ঘৃণা করতেন; বঞ্চনার বিরুদ্ধে, আদিবাসী সমাজের উন্নয়নের দাবিতে বারবার ডাক দিতেন ‘হুল’ মাহা’র। অন্যায়ের প্রতিবাদ জানানোর জন্য তুলে ধরতেন জননেতা সিধু, কানহুর জীবন সংগ্রামের কথা। বলতেন, এই জমি, জঙ্গল সবকিছুই ছিল আদিবাসীদের। আজ সেখান থেকেই সাঁওতালদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে। স্মরণসভার শুরুতে বাজছিল তাঁর গান, যে গানের মূল বিষয় আদিবাসী কৃষকদের, সাঁওতালদের বীরত্ব কাহিনী।
এসবই তাঁকে আদিবাসী জনগণের নেতৃত্বে তুলে এনেছিল। কৃষক জনগণের আপনার জন করে তুলেছিল। তাঁর স্মৃতিতে গান গাইতে গিয়ে তাই চোখের জল ফেলছিলেন মঞ্চ নেত্রী আরতি হাঁসদা, সরস্বতী বেসরা সহ অনেকেই। পুত্র বিকাশ বাবাকে নতুন করে অনুভবের কথা তুলে ধরলেন। সিপিআই(এম)-র পোলবা-দাদপুর জোনাল সম্পাদক কমরেড মজিদ মণ্ডল ছিলেন প্রয়াত কমরেডের বিশেষ পরিচিত। তাঁর বক্তব্যে তিনি তুলে ধরেন কমরেডের লড়াকু চরিত্রের দিকটি। কমরেড মুকুল কুমার বললেন, আদিবাসী মঞ্চকে গড়ে তোলার অনেক আগে থেকেই বিশ্বনাথ সরেন ছিলেন একজন কমিউনিস্ট যোদ্ধা, সিপিআই(এমএল) সংগঠক। সভায় শেষ পর্যন্ত উপস্থিত ছিলেন কমরেডের স্ত্রী, লড়াইয়ের সাথী কমরেড সাগরী সরেন।
বালিটানায় এই বিশেষ সভাটি সংগঠিত করতে সিপিআই(এমএল) সংগঠক, কমরেড বিশ্বনাথ সরেনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহযোদ্ধা গোপাল রায়ের পাশাপাশি সমান ভূমিকা পালন করলেন ওই গ্রামেরই আলপনা হাঁসদার নেতৃত্বাধীন আদিবাসী লোকশিল্পী দলের সকল সদস্যারা, যে দলটি অনেক যত্নে গড়ে তুলেছিলেন প্রয়াত বিশ্বনাথ সরেন।
বিশ্বনাথ সরেন ছিলেন একজন সাধারণ কৃষিজীবী, গরিব কৃষক; প্রতিদিন কঠোর পরিশ্রম করে যাঁকে বেঁচে থাকতে হতো। আবার তিনিই ছিলেন এমন এক বিপ্লবী নেতা, যাঁর রক্তে ছিল সিধু, কানহু, ভগবান বীরসার সার্থক উত্তরাধিকার। যিনি অন্যায়, অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ডাক দেওয়ার সাহস রাখতেন। আদিবাসীদের শোনাতে পারতেন বিদ্রোহের গান। সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামের এমন একজন লড়াকু সহযোদ্ধাকে মনে রাখার সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য পথ হল বিশ্বনাথ সরেনের সংগ্রামকে অব্যাহত রাখা, স্মরণ সভায় উপস্থিত সকলের এই উপলব্ধি বারবার উচ্চারিত হচ্ছিল নানান জনের বক্তব্যে। স্মরণ সভা হয়ে উঠেছিল সমবেত মেহনতি জনগণের অঙ্গীকার সভা। নীতীশ রায়ের গান পরিবেশকে করে তুলেছিল মর্মস্পর্শী।
কমরেড বিশ্বনাথ সরেন, তোমায় আমরা ভুলিনি, ভুলবো না।
চুঁচুড়ার পার্টি সদস্য কমরেড স্বপন বড়ুয়া ২৭ অক্টোবর সকাল ৯টায় প্রয়াত হন, মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৬ বছর। কোভিড আক্রান্ত অবস্থায় ২৪ দিন বেসরকারী হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন, সেখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। স্থানীয় কমরেডরা হাসপাতালে গিয়ে তাঁর একমাত্র পুত্রের সাথে দেখা করেন, জেলা সম্পাদকও ফোনে কথা বলেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি নকশালবাড়ি আন্দোলনে যোগদান করেন, সেই সময় তিনি বিরোধী দলের গুন্ডাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন। মাঝে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলেও ৯০এর দশকে আবার পার্টির সাথে যোগাযোগ স্থাপিত হয় এবং পার্টি সদস্যপদ গ্রহণ করেন। রাঁচিতে অনুষ্ঠিত নবম পার্টি কংগ্রেসে তিনি মনোনীত পর্যবেক্ষক হিসেবে গিয়েছিলেন। কমরেড স্বপন বড়ুয়া লাল সেলাম!