কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নসমূহ, শিল্পভিত্তিক ফেডারেশন/এ্যাসোশিয়েসনগুলির যৌথ আহ্বানে শ্রমিকদের ২ অক্টোবর, ২০২০, গান্ধী জয়ন্তী দিবসে একটি অনলাইন কনভেনশন সংগঠিত হয়। দেশের শ্রমিক, কৃষক ও সাধারণ মানুষের বুনিয়াদি গণতান্ত্রিক অধিকার ও সাংবিধানিক অধিকারের ওপর কেন্দ্রের মোদি নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার ও বিজেপি শাসিত রাজ্য সরকারগুলি যে ভয়ানক আক্রমণ নামিয়ে এনেছে তার বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানিয়ে এই কনভেনশন শুরু হয় এবং ঘোষণায় বলা হয় –
প্রথমবার ক্ষমতায় থাকা কালে (২০১৪-২০১৯) বিভিন্ন বিষয়গুলিতে সংশ্লিষ্ট জনেদের সাথে আলাপ আলোচনার যে মনোভাব মোদি সরকার দেখিয়েছিল, ২০১৯-এ দ্বিতীয়বার ক্ষমতাসীন হবার পর তার কোনও তোয়াক্কা করছে না। যখন অর্থনীতির সমস্ত সূচক জানাচ্ছে যে, চাহিদা না থাকার ফলে দেশের অর্থনীতির ব্যাপক অবনমন ঘটছে, তখন সরকার কর্পোরেটদের ব্যবসার পথ আরো মসৃণ করতে (ঈজ অব ডুইং বিজনেস) একই নীতি অনুসরণ করে চলেছে যার পরিণতি হচ্ছে দারিদ্রের ব্যাপ্তি এবং আরও গভীর সংকটের আবর্তে তলিয়ে যাওয়া। এই অবস্থার মধ্যেও, এই সরকার শুধু মাত্র কর্পোরেট ট্যাক্স কমিয়েই থেমে থাকেনি, অত্যান্ত অগণতান্ত্রিকভাবে, সংসদে বিরোধী দলের সদস্যদের অনুপস্থিতিতে গাজোয়ারী করে তিনটি শ্রম কোড পাশ করিয়ে নিয়েছে। এই শ্রম কোডগুলি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যার মধ্যে দিয়ে বাস্তবে শ্রমিকদের ক্রীতদাসে পরিণত করার সমস্ত শর্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে; নতুন ইউনিয়ন তৈরি করাকে দুঃসাধ্য করে তোলা হয়েছে এবং শ্রমিকদের ধর্মঘটের সাংবিধানিক অধিকারও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। অসংগঠিত ক্ষেত্রের বিশাল সংখ্যবক শ্রমিক – যেমন রাস্তার হকার, গৃহ সহায়িকা, মিড ডে মিল কর্মী, বিড়ি শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক, রিক্সা চালক, গৃহশ্রমিকসহ দৈনিক মজুরির দিন-আনা-দিন-খাওয়া শ্রমিকদের সমস্তরকম শ্রম আইনের সুযোগ সুবিধার আওতার বাইরে রাখা হয়েছে।
ঠিক একইরকমভাবে, সমস্ত রকম সংসদীয় গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক রীতিনীতি ভেঙ্গে সরকার তিনটি কৃষি বিল সংসদে পাশ করিয়ে নিয়েছে এবং কৃষকের উৎপাদিত শস্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য আইনগতভাবে নিশ্চিত করার কোনও ব্যবস্থা না রেখেই অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন পরিবর্তন করেছে কর্পোরেটদের সুবিধা করে দিতে। যাতে দেশী ও বিদেশি সংস্থাগুলি চুক্তিভিত্তিক কৃষিতে, বৃহৎ খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও একচেটিয়া পাইকারি বাজারের পুরোপুরি দখল নিতে পারে, যা দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এক বিশাল অশনি সংকেত। সরকার এখানেই থেমে থাকেনি। বিদ্যুৎ (সংশোধনী) বিল, ২০২০ সংসদে পেশ না করেই, ১২টি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের গুরুতর আপত্তিকে গুরুত্ব না দিয়ে, বিদ্যু্ৎ বিতরণ ব্যবস্থাকে বেসরকারী হাতে তুলে দেওয়ার কাজ শুরু করে দিয়ে বর্তমান কর্মীদের ভবিষ্যৎ ফ্র্যানচাইজি মালিকের দয়ার ওপরে ছেড়ে দিয়েছে। ইতিপূর্বে, রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্কগুলির বিপুল পরিমাণ আনাদায়ী ঋণ উদ্ধার করার কোনও চেষ্টা না করে, আমানতকারীদের অর্থের বিনিময়ে সেই ক্ষতি সামলানোর ব্যবস্থা নিচ্ছে এবং আমানতকারীদের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে একাধিক ব্যাংকের একীকরণ করা হয়েছে। জিএসটির ক্ষেত্রে ভ্রান্ত নীতি ও দেশের মুখ থুবড়ে পড়া অর্থনীতির ফলে কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক অবস্থা আজ অত্যন্ত শোচনীয়। যার প্রভাবে রাজ্যগুলির আর্থিক অবস্থাও আজ গভীর সংকটে। অন্যদিকে, রিজার্ভ ব্যাংক, এলআইসি ও অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠানগুলিকে এটিএমএর মতো ব্যবহার কররছে এই কেন্দ্রীয় সরকার। রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থাগুলিকে নিলামে চড়িয়ে, ১০০% এফডিআই-এর মাধ্যেমে অত্যান্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে চলছে বেসরকারীকরণের প্রক্রিয়া। এর মধ্যে রয়েছে রেলের রুট, রেল স্টেশন, রেলের উৎপাদন ইউনিট, বিমান বন্দর, পোর্ট এবং ডক, লাভজনক সরকারী বিভাগ, কয়লাখনি, আর্থিক দিক দিয়ে সমৃদ্ধ ভারত পেট্রোলিয়ামের মতো সংস্থা, ৪১টি সমরাস্ত্র তৈরির কারখানা (অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি), বিএসএনএল (যার ৮৬,০০০ কর্মীকে দেশদ্রোহী আখ্যা ১ দেওয়া হয়েছে), এয়ার ইণ্ডিয়া, সড়ক পরিবহন এমন অজস্র সরকারী বিভাগ বা সংস্থা। আর এই ধ্বংসাত্মক অপকর্মগুলি অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সাথে এমন একটা সময়ে করে ফেলার ব্যবস্থা হচ্ছে, যখন সারা দেশ কোভিড-১৯ অতিমারীর আক্রমণে বিধ্বস্ত। এমনকি যাদের আমরা করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে সামনের সারির সৈনিক বলছি, সেই চিকিৎসক, নার্স, চিকিৎসাকর্মী, সাফাইকর্মী, অঙ্গনওয়াড়ী, আশাকর্মীরা নিজেদের জীবন বিপন্ন করেও বাধ্যা হচ্ছেন অঞ্চলে অঞ্চলে কাজ করতে যেতে। অথচ তাদের জন্য, যথাযথ সুরক্ষা ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে না। দেওয়া হচ্ছে না প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আর্থিক সুযোগ সুবিধা বা বীমার সুবিধা। আর সাঙ্গাত পুঁজিপতিরা এই অতিমারী আবহের মধ্যেই তাদের বাজার প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা বাড়ানোর কথা ঘোষণা করে খবরের শিরোনামে থাকছে।
আর এই অপরিকল্পিত লকডাউন কোটি কোটি পরিযায়ী শ্রমিকের জীবনে এক দুর্বিসহ যন্ত্রণা ডেকে এনেছে। যা কিনা নোটবন্দীর দুঃসহ অভিজ্ঞতাকেও ম্লান করে দিয়েছে। এই সময়টা মহিলাদের কাছেও ছিল কষ্টকর, যারা কর্মক্ষেত্রে, ঘরের বাইরে ও ভেতরে সর্বত্র অতিরিক্ত লাঞ্চনা-গঞ্জনার শিকার হয়েছেন।
দেশের অর্থনীতি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে। বেকারী, তথ্যের হিসেবে বিশেষ করে মহিলাদের ক্ষেত্রে বেকারী অতীতের সব সংখ্যাকে ছাড়িয়ে সর্বোচ্চ স্থানে আর ধারাবাহিকভাবে জিডিপি হ্রাস পেয়ে এমন বিশাল ঋণাত্মক মানে গিয়ে পৌঁছেছে, তা অতীতে কখনও কেউ প্রত্যক্ষ করেনি।
লকডাউনের শুরুতে, কোম্পানির মালিকদের প্রতি এ্যাডভাইসারি জারি করে সরকার জানিয়েছিল – লকডাউনের কারণে কোনও কর্মীকে যেন ছাঁটাই বা বেতন কাটা না হয়। পরবর্তীতে সরকার নিজেই তাকে গুরুত্বহীন করে দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টে মালিকদের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে, সরকার তাদের বশংবদের মতো, তা প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
আবার, এরই মাঝে পিএমকেয়ার নামে এক তহবিল গঠন করা হয়েছে যা আগাগোড়াই অস্বচ্ছতায় ভরা। এই তহবিলে গেছে কর্পোরেটদের বিপুল অংকের অর্থ, আর এই তহবিলে সরকারী কর্মচারিদের কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে বাধ্যতামূলক (যাকে বলা যায় – হাত মচকে আদায় করা) অনুদান। তাদের মহার্ঘভাতা বৃদ্ধি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বহু পুরোনো এক নির্দেশনামাকে খুঁজেপেতে বের করে সরকারী কর্মীদের অবসরের আগেই বাধ্যতামূলক অবসর চালু করার ব্যবস্থাকে কার্যকর করার উদ্দ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
কেন্দ্রীয় সরকার করোনা অতিমারীর এই সংকটে, তাদের সমস্ত দায়দায়িত্ব নিজেদের ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলে তা চাপিয়ে দিচ্ছে রাজ্যগুলির ওপর। প্রত্যক্ষ করাব যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক বিভিন্ন রাজ্যে নির্বাচিত রাজ্য সরকারগুলিকে উপেক্ষা করাক এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থা যেমন সিবিআই, ইডি, এনআইএ ইত্যাদির মাধ্যমে এবং আর্থিক চাপ প্রয়োগ করে বিরোধী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিশানা করা, হচ্ছে। আমাদের সমাজের ধর্মনিরপেক্ষতার পরিমণ্ডলকে নষ্ট করতে, ধর্মীয় বিভাজনের ভয়ংকর খেলা চলছে। দিল্লী পুলিশ সিএএ বিরোধী আন্দোলনকারী বুদ্ধিজীবীদের নাম জুড়ে দিয়েছে উত্তর-পূর্ব দিল্লির দাঙ্গায় উস্কানি দেবার অভিযোগে ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে। অথচ যে বিজেপি নেতারা প্রকাশ্যে ভয়ংকর বিদ্বেষ ছড়িয়ে বক্তৃতা করলেন, তাদের বিরুদ্ধে এফআইআর পর্যন্ত হল না। এই অপকর্মের জন্য সারা দেশ আজ দিল্লী পুলিশের নিন্দায় মুখর। দেশের সর্বোচ্চ আদালতকেও যেভাবে প্রভাবিত করা হচ্ছে তা অতীব বিপদজনক। এই সংকটজনক পরিস্থিতির মধ্যেই সরকার নয়া শিক্ষা নীতি প্রণয়ন করেছে যার মধ্যেএ দিয়ে শিক্ষাকে পু্রোপুরি বেসরকারীকরণ করে দেওয়া হয়েছে। এর ফলস্বরূপ, দেশের গরিব মানুষ বঞ্চিত হবে শিক্ষার সুযোগ থেকে।
মূল কথা হল, এই সরকার দেশের সংবিধানকেই অগ্রাহ্য, করে তা পরিত্যক্ত ঘোষণা করছে। পরিস্থিতি অত্যন্ত সংকট জনক। কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নসমূহের এই জাতীয় কনভেনশন, শ্রমিক বিরোধী, কৃষক বিরোধী, দেশ বিরোধী মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের এই কাজকর্মের তীব্র নিন্দা ও সমালোচনা করছে। এই কনভেনশন লক্ষ্য করেছে যে, বিভিন্ন ক্ষেত্রের শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষ তাদের জীবন ও জীবিকার ওপর সরকারের এই জঘন্য আক্রমণের বিরুদ্ধে, তাদের দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যেও দিয়ে অর্জিত অধিকার ও সুযোগ সুবিধা রক্ষায় ধারাবাহিকভাবে লড়াই করছেন। কয়লা শ্রমিকদের ৩ দিনের ধর্মঘট, অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির শ্রমিক কর্মচারিদের ধর্মঘট, রেলওয়ে উৎপাদন সংস্থার শ্রমিকদের আন্দোলন, ভারত পেট্রোলিয়ামের কর্মীদের ২ দিনের ধর্মঘট এবং পরিবহন, তৈলক্ষেত্র, ইস্পাত, বন্দর, সিমেন্ট, শিল্পের শ্রমিকদের ও প্রকল্প শ্রমিকদের আন্দোলন এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রের ও শিল্পের শ্রমিক কর্মচারিরা আন্দোলনে সামিল। উত্তর প্রদেশের বিদ্যুৎ কর্মী ও ইঞ্জিনিয়াররাও পথে নেমেছেন বৃহত্তর আন্দোলনে, যারা ইতিমধ্যে বেসরকারীকরণের প্রতিবাদে ও অন্যান্য দাবিতে ধর্মঘটে পর্যন্ত অংশ নিয়েছেন।
দেশের নিরাপত্তার প্রশ্নে, আগামী ১২ অক্টোবর, ২০২০ থেকে, অর্ডন্যান্স কর্মীদের অনির্দিষ্টকাল ধর্মঘটের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে এই কনভেনশন তাদের আন্দোলনের পাশে থাকার কথা ঘোষণা করছে এবং দেশের শ্রমিকদের আহ্বান জানাচ্ছে ১২ অক্টোবর, ২০২০ এবং তারপর যতদিন না ধর্মঘটের সম্মানজনক মীমাংসা হয়, ততদিন প্রতি সপ্তাহে সমস্ত কর্মক্ষেত্রে জঙ্গি প্রতিবাদ কর্মসূচী সংগঠিত করতে।
সংসদে ভোটাভুটি করতে না দিয়ে পাশ করিয়ে নেওয়া কৃষক বিরোধী কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলনকারী কৃষকদের প্রতি এই কনভেনশন পূর্ণ সংহতি জ্ঞাপন করছে এবং ঘোষণা করেছে যে, যৌথ ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন সর্বভারতীয় স্তর থেকে আঞ্চলিক স্তর পর্যন্ত সর্বত্র তাদের সবরকম আন্দোলনের প্রতি সমর্থন ও সংহতি জ্ঞাপনে অঙ্গীকারবদ্ধ।
লকডাউন চলাকালীন নানাবিধ বাধা নিষেধের মুখে দাঁড়িয়েও, যৌথ ট্রেড ইউনিয়নসমূহের আহ্বানে সারা দেশের শ্রমিকশ্রেণী ও শ্রমজীবী মানুষ স্বতঃস্ফূর্ততার সাথে সমস্ত কর্মসূচীতে যে বিপুল সংখ্যায় অংশ নিয়েছেন, তাদের এই কনভেনশন অভিনন্দন জানাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে আগামীদিনে এই আন্দোলনের তীব্রতা আরো বাড়িয়ে তুলতে হবে। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে মোদি সরকার কর্পোরেটদের স্বার্থ রক্ষা করতে দেশের শ্রমিক-কৃষক, শ্রমজীবী ও সাধারণ মানুষের স্বার্থ বলিদান দিতে নিঃসংশয়।
সমস্ত ট্রেড ইউনিয়নসমূহের ধারাবাহিক দাবির সাথে সহমত হয়ে দেশের নামজাদা অর্থনীতিবিদরাও বার বার বলে আসছেন যে এই সময়ে সরকারের উচিৎ সাধারণ মানুষের হাতে অর্থের যোগান নিশ্চিত করা, যার ফলে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা যেমন কিছুটা বৃদ্ধি পাবে পাশাপাশি তা দেশের ক্ষয়িষ্ণু অর্থনীতিকেও পুনরুজ্জীবিত করতে সহায়ক হবে। কিন্তু বিজেপি সরকার তা করতে কিছুতেই রাজি নয়।
দেশের সরকারী গুদামগুলিতে অপর্যাপ্ত খাদ্য শস্য মজুত থাকা সত্বেও সরকার গরিব মানুষকে বিনামূল্যে রেশন দেবার পরিপন্থী।
এই কনভেনশন দৃঢ়তার সাথে জানাচ্ছে যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে সমস্ত শ্রমিকশ্রেণীর ঐক্যরবদ্ধ প্রতিরোধ আন্দোলনকে আরও উচ্চ পর্যায়ে উঁচু মাত্রায় নিয়ে গিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে সার্বিক অসহযোগিতা ও অমান্য তার আন্দোলনে উন্নীত করতে হবে। এর সাথে সমস্ত স্তরের শ্রমজীবী মানুষ, শ্রমিক, কৃষক ও ক্ষেতমজুরদের ঐক্যরকে সংহত করে এই আন্দোলনে সামিল করতে আহ্বান জানাচ্ছে এই কনভেনশন।
এই কনভেনশন দেশের শ্রমিক শ্রেণী ও শ্রমজীবী মানুষকে আহ্বান জানাচ্ছে নিম্নলিখিত দাবিসমুহের ভিত্তিতে দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের জন্য প্রস্তুত হতে।
১) আয়করের আওতাভুক্ত নয় এমন প্রতিটি পরিবারকে জন্য প্রতি মাসে নগদ ৭৫০০ টাকা দিতে হবে।
২) প্রতিটি অভাবগ্রস্ত পরিবারের সদস্য পিছু মাসে ১০ কেজি বিনামূল্যে রেশন দিতে হবে।
৩) এমজিএনআরইজিএ প্রকল্পের পরিসর বৃদ্ধি করে গ্রামীণ এলাকায় বছরে ২০০ দিনের কাজ দিতে হবে, শহর এলাকায় কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা দিতে হবে।
৪) সমস্ত কৃষক-বিরোধী আইন এবং শ্রমিক-বিরোধী সকল শ্রম কোড সমূহ বাতিল করতে হবে।
৫) রাষ্ট্রায়ত্ব শিল্প/ক্ষেত্রসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি বেসরকারীকরণ করা বন্ধ করতে হবে এবং সরকারী উৎপাদন কেন্দ্রগুলি যেমন রেলওয়ে, অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি এবং বন্দর ইত্যাদি কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া চলবে না।
৬) সরকারী এবং রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্রগুলির কর্মীদের চাকরির মেয়াদ শেষ হবার আগেই তাদের অবসর নিতে বাধ্য করার দানবীয় আইন বাতিল করতে হবে।
৭) সকলের জন্য পেনশনের ব্যহবস্থা করতে হবে, এনপিএস (ন্যাশনাল পেনশন স্কিম) বাতিল করে পুরোনো পেনশন ব্যবস্থা চালু করতে হবে। ইপিএস-৯৫ (এমপ্লয়িস পেনশন স্কিম-১৯৯৫)-কে উন্নত করতে হবে।
এই কনভেনশন প্রস্তাব করছে অক্টোবর, ২০২০র মধ্যেই সারা দেশের প্রতিটি রাজ্যে/ জেলায়/ শিল্পক্ষেত্রে/ প্রতিটি কাজের জায়গায় শারীরিক উপস্থিতির সাহায্যে অথবা যেখানে তা সম্ভব নয় সেখানে অনলাইনে সবাইকে যুক্ত করে কনভেনশন আয়োজন করার। শ্রমজীবী মানুষের ওপর সরকারের শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী এই শ্রম কোডগুলির প্রতিকূল প্রভাবের বিষয়ে তৃণমূল স্তর পর্যন্ত আগামী নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত ব্যাপক প্রচার সংগঠিত করে আগামী ২৬ নভেম্বর, ২০২০ একদিনের সর্বভারতীয় সাধারণ ধর্মঘটকে সফল করে তুলতে সার্বিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে এই একদিনের সাধারণ ধর্মঘট হচ্ছে আগামী দিনে আরও তীব্র, আরও কঠিন দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের এক প্রস্তুতি।
এই কনভেনশন আহ্বান জানাচ্ছে, যারা কোনও অনুমোদিত ইউনিয়নে বা সংগঠনে সংঘবদ্ধ অথবা যারা কোনও সংগঠনের আওতাভুক্ত নয় বা তার বাইরে রয়েছেন, যারা সংগঠিত বা অসংগঠিত ক্ষেত্রের যেখানেই থাকুন না কেন সরকারের সবরকম জন-বিরোধী, শ্রমিক-বিরোধী, কৃষক-বিরোধী এবং দেশ-বিরোধী নীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই আন্দোলনকে সামনে রেখে আগামী ২৬ নভেম্বর, ২০২০ সারা দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটকে সফল করে তুলতে সর্বশক্তি নিয়োজিত করুন।
– আইএনটইউস, এআইটিইউসি, এইচএমএস, সিআইটিইউ, এআইইউটিইউসি, টিইউসিসি, সেওয়া,
এআইসিসিটিইউ, এলপিএ, ইউটিইউসি এবং সমস্ত শিল্পভিত্তিক ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনগুলির পক্ষ থেকে
এরাজ্যে সবকিছু ঢেলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে বিজেপি। তার এক নজরকাড়া নজীর স্থাপন করতে সংঘটিত করল ‘নবান্ন অভিযান’। দলের যুব সংগঠনের ব্যানারে নেওয়া হলেও এটা ছিল বিজেপির সর্বাত্মক কর্মসূচী। তার মানে বিজেপি এখানে বাড়তে চাইছে বিশেষত যুবশক্তির ওপর ভর করে। আসল প্রচার চালাচ্ছে সামনে বিজেপি আর নেপথ্যে আর এস এস-এর সমন্বয়ে হিন্দুত্বের মেরুকরণের রাজনীতির রণকৌশলে। আর ওপর ওপর দেখাচ্ছে গণতন্ত্র ও কর্মসংস্থান ফেরানোর বাহানা। ইস্যু দুটো হল উপলক্ষ। লক্ষ্য হল ২০২১-এ ক্ষমতা দখল। কিন্তু ক্ষমতায় এলে কি হবে তার প্রমাণ হল যোগীরাজের উত্তরপ্রদেশ, মোদীরাজের কেন্দ্র। কোনও সন্দেহ নেই, টিএমসি শাসনে পশ্চিমবঙ্গ পর্যবসিত হয়েছে গণতন্ত্র দমনের রাজ্যে, কিন্তু বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশ পৌঁছেছে গণতন্ত্র নিধনের সীমাহীন চরমে। তুলনাটা কথাপ্রসঙ্গে বিজেপির বাংলা সভাপতির মুখ থেকেও বেরিয়ে এল! আর কেন্দ্রের মোদী সরকারও কার্যত গণতন্ত্রের কবরই রচনা করে চলছে। ‘করোনাবিধি’র নামে কর্তন করে চলছে সমস্ত ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠান বহির্ভূত সামাজিক রাজনৈতিক প্রতিবাদ-প্রতিরোধের পরিসরকে। তাই বিজেপি কিছুতেই টিএমসির বিপ্রতীপে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক বিকল্পের যুক্তিসঙ্গত দাবি করতে পারে না। তবু মরীয়া হচ্ছে ফুলে-ফেঁপে ওঠায়, নানা ভেক ধারণ করে। ফ্যাসিবাদীরা ঠিক যেমনটা করে থাকে। গণঅসন্তোষের বিভিন্ন ইস্যু আত্মসাৎ ও পুঁজি করে চলা। তৃণমূলী শাসনে এরকম ইস্যু তৈরি হচ্ছে হামেশাই। পশ্চিমবঙ্গে ক্রমাগত উধাও হচ্ছে কাজ। বেকারি বাড়ছে তীব্র ও ব্যাপকভাবে। গ্রাম ও শহরে সর্বত্র। কাজের খোঁজে পরিযায়ী হয়ে যাওয়ার প্রবণতা এখানে কর্মসংস্থানের সংকটকে আরও অসহনীয় মাত্রায় উন্মোচিত করে দেয়। চূড়ান্ত অপদার্থতা থাকছে রাজ্য সরকারের। তার সাথে মিলে চলছে দুর্নীতি-দলতন্ত্র। যেখানেই অসংগঠিত কিছু কাজের ঠিক-ঠিকানা মেলে সেখানেই পড়তে হয় দাদাগিরির।
কিন্তু বিজেপির ব্যর্থতা ক্ষমাহীন। গত লোকসভা নির্বাচনে কাজের বহুত প্রতিশ্রুতির ফিরিস্তি শুনিয়ে গঙ্গার দু’পাড়ে দুটি আসন কব্জা করেছিল বিজেপি। তারপরে কিছুই হয়নি। হবেটা কি করে? কর্মসংস্থানের দায়দায়িত্বই তো মোদী সরকার পরিত্যাগ করার পলিসি নিয়েছে মোদী সরকার। কৃষি থেকে শিল্প, পরিষেবা সবকিছু তুলে দিচ্ছে কর্পোরেটদের হাতে। অগত্যা দলের নির্দেশে বাংলার গঙ্গাপাড়ের সাংসদ নেতা-নেত্রী দুজন লিপ্ত হয়েছেন অন্য কাজে — সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চাষ ছড়াতে আর মাফিয়া জোগাড়ে চষে ফেলতে। বিরোধী দল হয়ে থাকলেও উত্তরবঙ্গ থেকে গাঙ্গেয়বঙ্গে বাহুবলী দাদাদের অন্তর্ভুক্তি বাড়ছে বিজেপিতে। এসব ‘সম্পদ’ মিলছে মূলত টিএমসি থেকে। এজন্য কখনও কখনও চড়া মাশুলও গুণতে হচ্ছে। সম্প্রতি উত্তর চব্বিশ পরগণার শিল্পাঞ্চলে যে ডাকসাইটে নেতার গুলিতে মারা যাওয়া হজম করতে হল, তিনি ছিলেন বিশাল এলাকার দাপুটে বাহুবলী, দলের ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদের ডান হাত, বলাবাহুল্য ঐ সাংসদও কুখ্যাত বাহুবলী।
বাংলায় বিজেপি এক সুযোগ সন্ধান ও সংকটের জটিল সন্ধিক্ষণের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ‘ম্যাজিক বৃদ্ধি’র জন্য নির্ভর করছে তৃণমূল কংগ্রসের ভাঙ্গনের ওপর, আবার সেই ফায়দা ওঠাকে কেন্দ্র করে দলের মাথা-নেতাদের ক্ষমতার বিন্যাস-পুনর্বিন্যাস করতে বিজেপি পড়ছে ‘আদি-নব’-র সংঘাতেও।
দেশব্যাপী পরিস্থিতি দাবি করছে বিজেপিকেই প্রতিরোধের প্রধান লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করে চলতে। এই পরিস্থিতি মাথায় রেখেই চলতে হবে পশ্চিমবাংলার বাম রাজনীতিকে। কোনোমতে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের তাড়না থেকে জগাখিচুড়ি শ্লোগান আর তার সাথে খাপ খাওয়ানোর সুবিধাবাদী সমীকরণে শরিক খোঁজার অভিলাষ থেকে বিরত থাকাই উচিত। বামপন্থী শক্তিগুলোর সবচেয়ে জোর দেওয়া প্রয়োজন বাম ধারায় সম্মিলিত উদ্যোগ, হস্তক্ষেপ ও সক্রিয়তা বাড়িয়ে চলায়। দরকার আন্দোলনের ধারার দৃঢ় বনিয়াদ নির্মাণের ভিত্তিতে অনন্য নজির সৃষ্টি করে চলা, সংগ্রামী সংকল্প নির্ভর বামপন্থার মর্যাদার পুনরুজ্জীবন ঘটিয়ে চলা। এটাই আসল চাবিকাঠি, এভাবে চলতে পারলে এই ধারার কার্যকারিতাকে মান্যতা দিয়ে আরও অনেক শক্তি বাড়ার বহু শর্ত তৈরি হবে, নাহলে কোনো কার্যকরী শক্তি থাকবে না। তাই যা বেছে নেওয়ার এখনই নিতে হবে।
(সিপিআই(এমএল) পলিটব্যুরো সদস্য কবিতা কৃষ্ণাণের এই লেখাটি দ্য প্রিন্ট ওয়েব পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ৬ অক্টোবর। ২০১২ সালের সঙ্গে আজ পরিস্থিতি কোন দিক থেকে আলাদা, ফ্যাসিবাদী জমানায় গণধর্ষণ ও হত্যার ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে, জাতপাতবাদী ঔদ্ধত্যের নিশান ওড়াতে ফ্যাসিবাদ কিভাবে রাষ্ট্রের সমস্ত শক্তিকে কাজে লাগায়, লেখাটিতে সেই বিশ্লেষণই লিপিবদ্ধ হয়েছে। লেখাটির গুরুত্ব বিবেচনা করে সেটির ভাষান্তর আমরা এখানে রাখছি।– সম্পাদকমণ্ডলী)
মাঝরাতে দেহটাকে পুড়িয়ে দেওয়া, ধর্ষিতা মেয়েটির পরিবারকে আটক করে রাখা, ঠাকুর জাতের আধিপত্যকে জাহির করতে দেওয়া — এ সবই হাথরসের বৈশিষ্ট্য।
দিল্লীর বাসে গণধর্ষণের ঘটনাটার পর ২০১২-১৩ সালে আমরা যখন রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানাচ্ছিলাম, সে সময় নারীবাদী প্রতিবাদকারীদের মধ্যে ক্রোধ এবং দীর্ঘদিন আন্দোলন জনিত পরিশ্রান্তি দেখা গিয়েছিল। প্রতিবাদ আন্দোলনে যারা যোগ দিয়েছিল তাদের মধ্যে শত-শত ভারতীয় তরুণ-তরুণী ছিল যারা প্রথম বারের মতো প্রতিবাদ আন্দোলনে শামিল হয়েছিল। তবে প্রতিবাদকারীদের ক্রোধ ও পরিশ্রান্তির মধ্যে আশার এক উজ্জ্বল ধারা, সামাজিক জাগরণ এবং প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের এক প্রতিশ্রুতি বহে চলেছিল। সেই প্রথমবারের মতো সমাজ ধর্ষণ সংস্কৃতি, ধর্ষিতার প্রতি দোষারোপ, এবং নিরাপত্তার নামে নারীদের স্বায়ত্ততার ওপর আক্রমণের নারীবাদী উদ্বেগের বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্ব দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যে, রাষ্ট্র অবশেষে এটা স্বীকার করতে বাধ্য হবে যে, ধর্ষিতাদের লব্ধ অভিজ্ঞতার অনেক কিছুই যৌন হিংসা সম্পর্কিত বিদ্যমান আইনের বাইরে থেকে গেছে।
এবার ২০২০-তে হাথরসে এক দলিত মহিলার গণধর্ষণ ও হত্যা বলে জ্ঞাত ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী যে আন্দোলন হচ্ছে সেই পরিস্থিতির সঙ্গে ২০১২ সালের পরিস্থিতির যেমন মিল রয়েছে, তেমনি আবার অনেক দিক থেকে ভয়াবহ ধরনের পার্থক্যও রয়েছে।
এবারও জাত-ভিত্তিক নিপীড়ন ও ধর্ষণের ঘৃণ্য বাস্তবতার বিরুদ্ধে কাঙ্খিত সামাজিক জাগরণ দেখা যাচ্ছে। আবার এবারের আন্দোলনটা কিন্তু সমাজ পরিবর্তনের আকাঙ্খার শিখাটাকে অনির্বাণ রাখার ব্যাপার, যে শিখাটাকে নির্বাপিত করতে বদ্ধপরিকর কট্টর মনুবাদী জমানার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জাতপাত-বিরোধী ও পিতৃতন্ত্র-বিরোধী জাগরণেরও ব্যাপার।
২০১২ সালে দিল্লী সরকার, কেন্দ্রের ইউপিএ সরকার এবং শাসক দল কংগ্রেসকে প্রতিবাদের মধ্যে দিয়ে রক্ষণাত্মক অবস্থানে ঠেলে দেওয়া গিয়েছিল। ধর্ষিতা ও তার পরিবারের প্রতি তারা সংবেদনশীল, এবং যৌন হিংসার বৃহত্তর ইস্যুটির প্রতিও তারা গুরুত্ব দেয় – এমন হাবভাব দেখিয়ে তারা পরিস্থিতির প্রতি তাদের প্রতিক্রিয়া জানান দিয়েছিল। কংগ্রেস পার্টির নেতৃবৃন্দ ধর্ষিতার পরিবারের সদস্যদের সাথে দেখা করেছিলেন, তাদের বেদনা ও বিশ্বাস চূর্ণ হওয়ার বোধের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। মনমোহন সিং নেতৃত্বাধীন সরকার বিচারপতি ভার্মা কমিটি গঠন করেছিলেন, যে কমটি সমস্ত ধরনের নারীবাদীদের কথা ধৈর্য ধরে শুনেছিলেন: নারীবাদী স্কলার ও নারী আন্দোলনের কর্মীদের কথা, দলিত নারীবাদীদের কথা, এলজিবিটি কিউ নারীবাদীদের কথা, সংঘাত প্রবণ এলাকায় কর্মরত নারীবাদীদের কথা, কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে সংগঠিত হওয়াদের কথা, এবং এরকম অন্যান্য নারীবাদীদের কথা। ভার্মা কমিটির সুপারিশগুলো প্রশ্নাতীতভাবেই নারীদের জন্য অধিকারের এক বিলের সূত্রপাত ঘটাল, যা সরকারগুলোর কাছে লিঙ্গ-ভিত্তিক অন্যায় ও হিংসার প্রতিটি ক্ষেত্রে সুরাহা করার চ্যালেঞ্জ হাজির করল, এবং তা রক্ষণশীল সামাজিক নৈতিকতা ও গণ উন্মাদনার বিপরীতে ডঃ আম্বেদকর অভিহিত সাংবিধানিক নৈতিকতার সুবিধাজনক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিত থেকে। ভার্মা কমিটি যে সুপারিশগুলো করেছিলেন, তৎকালীন সরকার তার আংশিকই রূপায়ণ করেছিল। এ সত্ত্বেও গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয়ের কথা বাদ দিলে আইনে নিষ্পাদিত পরিবর্তনগুলো মূলত সঠিক লক্ষ্যেই পদক্ষেপ ছিল।
আজ ২০২০-তে উত্তরপ্রদেশ এবং কেন্দ্রে এমন সরকার রয়েছে যারা সংবিধানে প্রদত্ত নারী ও দলিতদের স্বাধীনতা ও অধিকার রূপায়ণের প্রতীকী হাবভাব দেখানোর প্রয়োজনও বোধ করে না। এর বিপরীতে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী রূপে আমাদের সামনে রয়েছেন যোগী আদিত্যনাথ যিনি মনুবাদী জাতপাতবাদী পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে চাপিয়ে দিতে এবং জাতপাত-বিরোধী ধর্ষণ-বিরোধী আন্দোলনকে দমন করতে রাষ্ট্র যন্ত্রের পুরো শক্তিকে কাজে লাগাচ্ছেন।
বিরোধী নেতৃবৃন্দ, দলিত ও নারী গোষ্ঠীগুলো ধর্ষিতার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করে তাদের প্রতি সংহতি জানাচ্ছেন – যেটা তাঁদের করা উচিত। কিন্তু সে সময় বিরোধী দলগুলো দুর্নীতি-বিরোধী ও ধর্ষণ-বিরোধী আন্দোলনে নেমে ইউ পি এ সরকারকে নিশানা বানানোয় যে সংবাদমাধ্যমগুলো তখন তাদের শাবাশ জানানোর ভূমিকা নিয়েছিল, তারাই এখন ধর্ষণ নিয়ে “রাজনীতি করার” অভিযোগে বিরোধীদের অভিযুক্ত করছে।
তাদের সমস্ত ত্রুটি সত্ত্বেও ২০১২ সালে কংগ্রেস ধর্ষণকে অস্বীকার করার চেষ্টা করেনি, ধর্ষিতাকে মিথ্যাবাদী বলে দেগে দিতে যায়নি বা সাম্প্রদায়িক আখ্যান ছড়ানোর চেষ্টাও করেনি। এর বিপ্রতীপে ২০২০ সালে শাসক বিজেপি তার চিরাচরিত পাল্টা সাম্প্রদায়িক অভিযোগগুচ্ছ হাজির করার কৌশল অবলম্বন করে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে চাইছে। সে এমন সমস্ত ধর্ষণের ঘটনা তুলে আনছে যেগুলোতে অভিযুক্তরা হল মুসলিম, এবং সে দাবি করছে – ওই সমস্ত ঘটনাগুলোর প্রতিবাদ কেন করা হচ্ছে না। সে বলছে – কংগ্ৰেস-শাসিত রাজ্যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে তার প্রতিবাদ হচ্ছে না কেন।
আসল বিষয়টা কিন্তু হল: ওই ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট জাত ও ধর্ম-ভিত্তিক পঞ্চায়েতগুলো কি ধর্ষিতার দ্বারা অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সমর্থনে এগিয়ে এসেছিল? না, তা হয়নি, এটা যোগী শাসিত হাথরসের বৈশিষ্ট্য। ওই ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে পুলিশ এবং জেলা প্রশাসন কি পেট্রল ঢেলে ধর্ষিতার দেহ পুড়িয়ে দিয়েছিল, এবং তা করার মধ্যে দিয়ে প্রিয়জনদের হাতে মর্যাদাপূর্ণ অন্ত্যেষ্টিকে প্রতিহত করেছিল? না, এটাও হাথরসের নিজস্ব এক বৈশিষ্ট্য। ওই ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে কি সরকার ধর্ষিতার পরিবার এবং দলিত টোলাকে অবরুদ্ধ করে রেখে সাংবাদিক এবং অন্যান্যদের সঙ্গে তাদের কথা বলাকে আটকে রেখেছিল? ওই সমস্ত ক্ষেত্রে কি ধর্ষণ-বিরোধী প্রতিবাদকে আটকানো হয়েছিল এবং অভিযুক্তদের সমর্থনে ঠাকুর জাতের আধিপত্যের হিংসাত্মক পৌরুষ জাহির করতে দেওয়া এবং তাকে উৎসাহিত করা হয়েছিল? না, তা হয়নি, এটাও হাথরসের বৈশিষ্ট্য। ওই সমস্ত ঘটনায় শাসক দল কি করদাতাদের জমা করা টাকার ব্যবহার করে একটা জনসংযোগ কোম্পানিকে নিয়োগ করেছিল যারা ধর্ষিতাকে মিথ্যাবাদী বলে ছাপ মেরেছিল এবং চার ঠাকুর যুবকের দ্বারা ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনাকে অসত্য বলে ঘোষণার উদ্যোগ নিয়েছিল? হাথরসের ঘটনা নিয়ে জনগণ যে রাগে ফুঁসছেন তা আসলে পৈশাচিক ধর্ষণ ও হত্যার বিরুদ্ধে, এবং ঠাকুর জাতের লোকেদের জাতের আধিপত্য জাহির করা ধর্ষণের ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়ার লক্ষ্যে রাজ্য সরকার সংঘটিত অপরাধের কারণে। ওই ক্রোধ মুখ্যমন্ত্রীর তখতে এমন এক ব্যক্তির বসার জন্যে যিনি নারী ও দলিতদের অধীন ও পদানত করে রাখার মনুস্মৃতির বিধানে অনুমোদন দেওয়ার ব্যাপারে কোনো রাখঢাক করেননি।
২০১২ সালে নারীবাদী এবং জাতপাত-বিরোধী আন্দোলনের কর্মীরা ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালে তাঁদের সাধারণত দেশদ্রোহ ও ইউএপিএ আইনে অভিযুক্ত করা হত না (যদি না তাঁরা সংঘর্ষ প্রবণ এলাকায় কাজ করতেন, যে এলাকাগুলোকে পূর্ববর্তী সরকারগুলোও সাংবিধানিক সুরক্ষার আওতার বাইরে রাখত)। এখন আমরা কিন্তু এমন এক ব্যবস্থার মুখোমুখি যা একদিকে সংগঠিত জাতপাতবাদী আধিপত্যের সুরক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, আর অন্যদিকে নারিবাদী, জাতপাত-বিরোধী এবং সমদর্শী নাগরিকত্বের জন্য আন্দোলনকে সন্ত্রাসবাদের সমতুল্য বলে গণ্য করে। আমরা এটা ভীমা কোরেগাঁওয়ে দেখেছি। দিল্লী পুলিশের ‘দাঙ্গা তদন্ত’র ক্ষেত্রেও এটা দেখেছি যাতে পিঁজড়া তোড় সংগঠনের নারীবাদীরা সহ সমদর্শী নাগরিকত্বের জন্য আন্দোলনকারীদের ইউএপিএ-তে অভিযুক্ত করে জেলে পোরা হয়েছে।
এখন আবার হাথরসের পুলিশ ধর্ষণ-বিরোধী এবং জাতপাত-বিরোধী প্রতিবাদীদের ‘আন্তর্জাতিক চক্রান্তের’ অংশ বলে অভিযুক্ত করছে যারা জাতপাতবাদী দাঙ্গাকে উস্কিয়ে তুলতে এবং উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীকে কালিমালিপ্ত করতে ব্যগ্ৰ।
হাথরসের ঘটনাকে ধরে যে আন্দোলন চলছে তা ন্যায় ও পরিবর্তন দাবি করছে – প্রতিশোধ চাইছে না। আর উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর আসনে অধিষ্ঠিত যোগী আদিত্যনাথ যে অন্যায় ও পশ্চাদমুখী মনুবাদকে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। এই কারণেই মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে তাঁকে অপসারিত করাটাই হল ন্যায় ও পরিবর্তনের সম্ভাবনা সৃষ্টির প্রথম শর্ত।
মোদী সরকার সংসদীয় গণতন্ত্রকে যে ধরনের প্রহসনে পরিণত করেছে, সদ্য সমাপ্ত সংসদের বাদল অধিবেশন তারই এক দর্পণ হয়ে উঠল। প্রশ্ন তোলার সময়কে খেয়ালখুশি মাফিক বাতিল করা হল এবং এর মধ্যে দিয়ে প্রথাসিদ্ধ এই ধারণারই অবসান ঘটানো হল যে, সরকার এবং প্রশাসনিক বিভাগ আইনসভা, সংসদ এবং ফলত জনগণের কাছেও জবাবদিহি করতে দায়বদ্ধ।
সরকার ঘোষণা করল যে লকডাউনের কারণে যে সমস্ত পরিযায়ী শ্রমিকের প্রাণ গেছে তাদের সংখ্যা সম্পর্কে কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই। লকডাউন নামানোর ফলে কতজন কাজ হারিয়েছেন সে সম্পর্কেও কোনো তথ্য সরকার জানালো না। কতজন ডাক্তার এবং কোভিড১৯ যোদ্ধা (স্বাস্থ্য এবং সাফাই কর্মী সহ) এই মারণ ভাইরাসের মুখোমুখি হয়, পিপিই সরঞ্জামের অভাব এবং যথা সময়ে চিকিৎসা না পাওয়ায় প্রাণ হারিয়েছেন, সে সম্পর্কে কোনো তথ্যও সরকার জানায়নি। যে সরকার দিল্লীতে নাগরিকত্বের সমভিত্তির জন্য আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে চার্জশিটে ১১ লক্ষ পাতার তথ্যপ্রমাণ সংকলিত করতে পারে তারা তাদের গৃহীত বিপর্যয়কর কর্মনীতির – দায়সারাভাবে ও অবজ্ঞাভরে রূপায়ণ যাকে আরও সর্বনাশা করে তোলে – বলি হওয়া মানুষজন সম্পর্কে তথ্য রাখার ব্যাপারে কোনো গুরুত্বই দেয়নি। গণতান্ত্রিক রীতিনীতি এবং প্রথার প্রতি নির্লজ্জ অবজ্ঞা দেখিয়ে (আরও স্বতন্ত্র গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কথা না হয় বাদ দেওয়াই গেল) দেশের কৃষকদের তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়া কৃষি বিলগুলোকে ভোটে না ফেলে রাজ্যসভায় “পাশ হয়েছে” বলে ঘোষণা করা হল। সরকারের পক্ষে দাবি করা হয়েছে যে, বিরোধী সাংসদরা হট্টগোল করায় কক্ষে এমন শৃঙ্খলা ছিলনা যাতে ভোটাভুটি চালানো যায়। সেক্ষেত্রে এই প্রশ্নটা ওঠে যে – মাথাগুণে ভোট করার মতো অবস্থা যদি না থেকে থাকে তাহলে ধ্বনি ভোট চালানোর মতো শৃঙ্খলা এল কোথা থেকে? রাজ্যসভার কার্যক্রমের টিভি সম্প্রচারকে সে সময় স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। কাজেই, সংসদের ভিতরের কন্ঠগুলোকে শব্দহীন করে রাখাটা এটাই প্রমাণ করেছিল যে, ধ্বনি ভোটটাও ছিল মেকি। পরে বিরোধী সাংসদরা সংসদীয় কার্যক্রম বয়কট করেন এবং শাসক পক্ষ কক্ষে বিরোধীপক্ষের সাংসদদের উপস্থিতিহীন অবস্থায় চারটে শ্রমবিধি বিল পাশ হয়েছে বলে ঘোষণা করে। প্রাণোচ্ছল, সোচ্চার, শক্তিশালী, দৃশ্যমান বিরোধীপক্ষই বলিষ্ঠ গণতন্ত্রের পরিচায়ক। বিরোধীহীন সংসদ মুমূর্ষু গণতন্ত্রকেই দেখিয়ে দেয়। আর মুমূর্ষু গণতন্ত্রে দেশের শ্রমিক ও কৃষকরাই সরকারের আক্রমণের অঘোষিত নিশানায় পরিণত হয়, আর তাদের সাথেই শাসকদের আক্রমণের ঘোষিত নিশানা হয়ে ওঠে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা।
তিনটে কৃষি আইন ভারতের কৃষকদের এবং দেশের প্রধানত কৃষি অর্থনীতির মৃত্যুঘন্টা বাজিয়ে দিয়েছে। চারটে শ্রম বিধি বিল ভারতের অধিকাংশ শ্রমিকদের শ্রম আইনের নামমাত্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা থেকেও বঞ্চিত করে তাদের ইচ্ছেমতো নিয়োগ ও ছাঁটাই করার পথকে প্রশস্ত করবে। শ্রম বিধিগুলোতে নারী শ্রমিকদের অধিকারের সুরক্ষা এবং সবচেয় নিরাপত্তাহীন শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। কিন্তু বিধিগুলো ইউনিয়ন কার্যকলাপ চালানোকে একরকম অসম্ভবপর করে তুলেছে। আর শ্রমিকরাও জানে যে, কাগজে-কলমে আইন ও সুরক্ষা ব্যবস্থা থাকলেও বাস্তবে সেগুলোর প্রয়োগকে সম্ভব করে তুলতে লড়াই করার জন্য ইউনিয়ন না থাকলে সেগুলো তামাশা হয়েই দেখা দেয়।
সংসদের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র যদি বিলীয়মান হয়ে দেখা দেয় তবে রাস্তার প্রতিবাদ-প্রতিরোধগুলো ভারতীয় গণতন্ত্রের স্পর্ধিত প্রাণস্পন্দনের অব্যাহত ধারা হয়ে দেখা দিচ্ছে। গত ২৫ সেপ্টেম্বর সারা ভারতেই কৃষকরা এক বিশাল ভারত বনধকে সফল করে তুলতে রাস্তা ও রেল অবরোধ সংগঠিত করেন যা ভারতকে স্তব্ধ করে দেয়। সমস্ত স্থানেই শ্রমিক ও যুবকরা কৃষকদের সমর্থন জানান। পাঞ্জাবে কৃষকদের রোষ এমনই ছিল যে বিজেপির দীর্ঘ দিনের মিত্র আকালি দল তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে এনডিএ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
দানবীয় ও জনবিরোধী কৃষি আইনগুলোর বিরুদ্ধে কৃষকদের চাক্কা জ্যাম (রাস্তা অবরোধ) দানবীয় ও জনবিরোধী সিএএ-র বিরুদ্ধে জনগণের সুবিশাল আন্দোলনের কথা মনে পড়িয়ে দিচ্ছে। ওই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের আজ সহিংস “দাঙ্গাকারী” রূপে মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসানো হচ্ছে, কেননা, ওই আন্দোলনের মহিলা প্রতিবাদকারীদের একটা অংশ দিল্লীতে রাস্তা অবরোধ করেন। ওই প্রতিবাদীদের দানবীয় ইউএপিএ আইনে জেলে ভরা হচ্ছে – ইউএপিএ এমনই একটা আইন যাতে সরকারের সমালোচকদের একেবারে ভিত্তিহীন অভিযোগেও জেলে পুরে জামিন না দিয়ে বা বিচার না করে বছরের পর বছর আটক রাখা যায়।
২০১৮-য় তোলা একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে ইউএপিএ-তে অভিযুক্ত সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের তিন সক্রিয় কর্মী মীরন হায়দার, আসিফ তানহা এবং খলিদ সইফি ভিন রাজ্য থেকে দিল্লীতে আসা কিষান যাত্রায় অংশগ্ৰহণকারী কৃষকদের জন্য সংগঠিত গণরসুইয়ে রান্না করছেন। এঁদের মতো ছাত্র ও যুবকরাই ছিলেন কৃষক আন্দোলন এবং সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের পদাতিক বাহিনী। সিএএ-বিরোধী শাহিনবাগগুলোতে গণরসুই সংগঠিত করাটাকে দিল্লী পুলিশ দণ্ডনীয় অপরাধ বলে সাব্যস্ত করেছে। পাঞ্জাবের যে কৃষকরা শাহিনবাগে এই ধরনের গণরসুইগুলো সংগঠিত করেছিলেন, আগামী দিনে তাঁরা ইউএপিএ-তে অভিযুক্ত হতেই পারেন! কৃষি আইন, শ্রম বিধি আইন, সিএএ এবং ইউএপিএ-র মতো দানবীয় আইনগুলোর বিরুদ্ধে এবং যে স্বৈরাচারী সরকার এই সর্বনাশা আইনগুলো জনগণের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সময় ভরতের কৃষক, শ্রমিক, সাধারণ জনগণের কাছে সমুপস্থিত।
(এম এল আপডেট সম্পাদকীয়, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০)
কৃষিক্ষেত্রে কোম্পানিরাজ নিয়ে আসার প্রতিরোধে গোটা দেশ উত্তাল। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য আইন প্রণয়নের পাশাপাশি কৃষিক্ষেত্রে সরকারী উদ্যোগে পূঁজি বিনিয়োগ তথা কৃষকদের কৃষি-ঋণ দেওয়ার দাবি তুলে ধরে কিষাণ মহাসভা এ রাজ্যে আন্দোলনে নামলো। বাস্তবে রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে দেখা যায় সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকরা আজও সেই মহাজনী ঋণের মুখাপেক্ষী হয়ে রয়েছে, কারন তারা ব্যাংক বা সমবায়ের কৃষিঋণ পায় না। এর ফলেই বন্ধন বা উজ্জীবনের মতো মাইক্রোফিনান্স কোম্পানির উপর নির্ভরতা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। চড়া সুদে সেই কোম্পানির ঋণ নিয়ে গ্রামের গরিবরা হয়ে আছে ঋণফাঁদে জর্জরিত। অথচ কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার ঢাকঢোল বাজিয়ে কিষাণ ক্রেডিট কার্ডের প্রচার করে চলেছে। তথ্য হলো এই কিষাণ কার্ডে মরসুমী চাষের জন্য কৃষি-ঋণ সময়সীমার মধ্যে পরিশোধ করলে তার সুদ ৪ শতাংশ। সময় পেরিয়ে গেলে ৭ শতাংশ। অথচ বন্ধনের সুদ তার চারগুনেরও বেশি, ১৮ শতাংশ! এই প্রেক্ষাপটে গ্রামের সমস্ত ক্ষুদ্র ও মাঝারি চাষিদের কিষাণ কার্ডের দাবি তুলে ধরে সারা ভারত কিষাণ মহাসভা গত ৫ অক্টোবর রাজ্যের বিভিন্ন ব্লকে সহ কৃষি অধিকর্তার দপ্তরে বিক্ষোভ ডেপুটেশন সংগঠিত করে। আরও যে দাবিগুলি তুলে ধরা হয় তা হলো, যারা ভাগে বা চুক্তিতে চাষ করে তাঁদের জন্যও কিষাণ কার্ড, শস্য বীমা, কৃষকদের সার বীজ সরবরাহ করা, আমফান ও লকডাউন ক্ষতিপূরণ প্রভৃতি। আধিকারিকরা জানায় যে কিষাণকার্ডের জন্য দপ্তরে কৃষকরা যে কাগজপত্র জমা দিয়েছে সেগুলি তারা ব্যাংকে পাঠিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ এভাবে তাদের দায় খালাস করে দিয়েছে। বাস্তবে ব্যাঙ্কে জমা পড়া কাগজের মধ্যে মুষ্টিমেয়রা কৃষিঋণ পায়, আর বিরাট সংখ্যক চারিরা বঞ্চিতই থেকে যায়। এ জন্য সরকারকেই দায়িত্ব নিতে হবে, ডেপুটেশনে এই দাবি তুলে ধরা হয়।
উত্তর ২৪ পরগণার গাইঘাটা ব্লকের সহ কৃষি অধিকর্তার কাছে বেলা ২ টায় ডেপুটেশন দেওয়া হয়। ভাগচাষি, লিজ চাষিদের কিষান ক্রেডিট কার্ড দেওয়া হবে বলে তিনি জানান। এই জন্য জমির দাগ খতিয়ান আধার কার্ড ভোটার কার্ড ব্যাংকের একাউন্ট বই দেখালে ফর্ম দেওয়া হবে। সেই ফরম ফিলাপ করে জমা দিতে হবে। এছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের কৃষি নীতি ও ফসলের লাভজনক দামের বিষয়টি উত্থাপন করা হয়। ডেপুটেশনে নেতৃত্ব দেন এআইকেএম নেতা কৃষ্ণ প্রামানিক।
দার্জিলিং জেলার ফাঁসীদেওয়া এডিও অফিসে সারা ভারত কিসান মহাসভা (এআইকেএম)’র পক্ষ থেকে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়। ফাঁসিদেওয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে মিছিল শুরু হয়ে এডিও দপ্তরে শেষ হয়। মিছিল ও সমাবেশে নেতৃত্ব দেন কিসান মহাসভার দার্জিলিং জেলা সম্পাদক পবিত্র সিংহ, শরৎ সিংহ, কান্দ্রা মুর্মু, মোজাম্মেল হক, নেমু সিংহ, পৈসাঞ্জু সিংহ, মোজাম্মেল হক, দীপক ঘোষ, মামনি বর্মন, তাপস বর্মন, সুমন্তি এক্কা, রমু সিংহ প্রমুখ। কিষাণ ক্রেডিট কার্ডের প্রশ্নে এখানেও সেই একই কথা শোনা যায়। কৃষি পেনশনের প্রশ্নে তিনি বলেন ফাঁসিদেওয়া ব্লকে মাত্র ১১০ জন পেনশন পায় অথচ দরখাস্ত করেছিলো হাজারেরও বেশি কৃষক।
জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়িতে এডিও দপ্তরে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয় ও আধিকারিককে স্মারকলিপি পেশ করা হয়। এই কর্মসূচীতে নেতৃত্ব দেন জেলা নেতা ভাস্কর দত্ত, শ্যামল ভৌমিক, মুকুল চক্রবর্তী, দেবনাথ রায়, শৈলেন রায়, বৈশাখী রায়, প্রদীপ দেবগুপ্ত প্রমুখ। সরকারী উদ্যোগে সার বীজ কীটনাশক প্রভৃতি উপকরণ স্বল্প মাত্রায় সরবরাহ করার ক্ষেত্রে চরম দলবাজি চলে। কিষাণ সভা স্বচ্ছভাবে বিলি করার দাবি জানায়। আধিকারিক জানায় এবার থেকে কিষাণ মহাসভাকে অবহিত করেই ঐ জিনিসগুলি সরবরাহ করা হবে।
নদীয়া জেলার নাকাশীপাড়া ব্লকে কৃষি দপ্তরে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। সহ কৃষি অধিকর্তা ও অন্যান্য আধিকারিকরা ডেপুটেশন গ্রহণ করেন। এই প্রথম ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য আমফান ক্ষতিপূরণের কথা শোনা গেলো। এ রাজ্যে “কৃষকবন্ধু” প্রকল্পে একর পিছু বছরে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা (জমির পরিমান কম থাকলে আনুপাতিক কম টাকা, সর্বনিম্ন ২০০০ টাকা) কৃষকদের দেওয়া হয়ে থাকে। ডেপুটেশনে জানা গেলো কৃষকবন্ধু উপভোক্তাদের আমফানের ক্ষতিপূরণের নামে দেওয়া হচ্ছে তার অর্ধেক মাত্র ২৫০০ টাকা! অর্থাৎ ক্ষতিগ্রস্ত ৭০-৮০ ভাগ ছোট চাষির ভাগ্যে জুটবে সামান্য ১০০০ টাকা! কিষাণ মহাসভা যুক্তিসঙ্গতভাবেই লকডাউন ও আমফানের ক্ষতিপূরণ বাবদ দাবি করেছিলো একর পিছু ২৫ হাজার টাকা। অথচ সরকার দিচ্ছে দশ ভাগের এক ভাগ, কিংবা তারও কম! কৃষকের প্রতি বঞ্চনা আর প্রতারণা কী মাত্রায় চলছে এটা তার একটা ছোট উদাহরণ। অথচ কেন্দ্রীয় সরকার কর্পোরেটদের মকুব করে দিচ্ছে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা। আর রাজ্য সরকার অনুৎপাদক “সামাজিক” দান খয়রাতিতে উদারহস্ত। আরেকটা করুণ তথ্য জানা গেলো যে, কৃষি পেনশনের টাকা সমগ্র ব্লকে পায় মাত্র ৩২১ জন চাষি। অথচ জমি আছে এমন পরিবারের সংখ্যা ব্লকে ৪০ হাজারেরও বেশি!
এই সংখ্যা কিন্তু বাড়বে না। একজন মৃত কৃষকের স্থানে ঢুকবে অপেক্ষায় থাকা অপর একজন! অথচ তথাকথিত “কৃষক দরদী” কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের প্রচারের ঢাকঢোল বেজেই চলেছে। ডেপুটেশনে ছিলেন আয়ারলার কাজল দত্তগুপ্ত, কিষাণ মহাসভার আসারুদ্দিন সেখ, আফজেল সেখ, জয়তু দেশমুখ। নদীয়া জেলার চাপড়া ও কালীগঞ্জে ডেপুটেশনে ছিলেন এআইকেএম নেতা ধনঞ্জয় গাঙ্গুলী, ইনসান সেখ, আলতাফ হোসেন প্রমুখ।
কৃষক সংগঠনগুলোর ডাকা ভারত বনধে সাড়া দিয়ে শত-শত সিপিআই(এমএল) ও কিসান মহাসভা কর্মী পাটনার রাস্তায়-রাস্তায় প্রতিবাদ সংগঠিত করেন। এই প্রতিবাদগুলোয় নেতৃত্বদানকারী কমরেডদের মধ্যে ছিলেন সিপিআই(এমএল)-এর সাধারণ সম্পাদক কমরেড দীপঙ্কর ভট্টাচার্য এবং সারা ভারত কিসান মহাসভার সাধারণ সম্পাদক রাজারাম সিং। এরআগে কৃষকরা বুদ্ধ স্মৃতি পার্ক থেকে ডাক বাংলা চক পর্যন্ত মিছিল করে গিয়ে সেখানে চাক্কা জ্যাম সংগঠিত করেন। প্রতিবাদে আরও যাঁরা নেতৃত্ব দেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন সিপিআই(এমএল)-এর বিহার রাজ্য সম্পাদক কুনাল, ধীরেন্দ্র ঝা, মীনা তেওয়ারি, উমেশ সিং, রাজেন্দ্র প্যাটেল, শম্ভুনাথ মেহতা, অভ্যুদয় ও অন্যান্যরা।
এক জনসভায় তাঁর ভাষণে দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন, সারা দেশই অসংখ্য স্থানে বনধ ও রাস্তা অবরোধ সংগঠিত করে কৃষক স্বার্থের বিরোধী এই বিলগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। এই বিলগুলো কৃষকদের পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক। রাজ্যসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকা সত্তেও জোরজবরদস্তি যেভাবে বিলগুলোকে পাশ করানো হয়েছে তা গণতন্ত্রের হত্যা ছাড়া অন্যকিছু নয় এবং দেশ কখনই এটাকে মেনে নেবে না। তিনি আরও বলেন, মোদী সরকার যেভাবে কৃষিকে নিলামে চড়াচ্ছে এবং কর্পোরেট সংস্থাগুলোর তোষণ করছে, আমরা কোনভাবেই তাকে মেনে নিই না। আজ ছাত্র, যুবক এবং সাধারণ জনগণ কৃষকদের সমর্থনে এগিয়ে এসেছেন। কৃষক-বিরোধী সরকারকে কখনই দেশ শাসন করতে দেওয়া যাবে না। আমরা কোম্পানি রাজকে প্রত্যাখ্যান করছি। আগে দেশে ব্রিটিশ রাজ বলবৎ ছিল; আজ যদি ওরা মনে করে থাকে যে দেশে এবার আম্বানি-আদানি রাজ কায়েম হবে তবে ওরা মস্ত ভুল করবে। এই বিলগুলো যতদিন প্রত্যাহার করা না হয় ততদিন আমাদের লড়াই চলবে। বিহার বিধানসভা নির্বাচনে এটা একটা ইস্যু হবে এবং কৃষকরা আগামী নির্বাচনে তাঁদের ক্রোধের প্রতিফলন ঘটাবেন।
সারা ভারত কিষান মহাসভার সাধারণ সম্পাদক রাজারাম সিং বলেন, দেশের কৃষক সংগঠনগুলো আজ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। শ্রমিক সংগঠনগুলোও এই আন্দোলনে পুরোমাত্রায় সমর্থন জানাচ্ছেন। আমরা মোদী সরকারকে কৃষক-বিরোধী বিলগুলো দেশে প্রয়োগ করতে দেব না। দেশের সমস্ত সম্পদকে ওরা একে-একে বেসরকারী কোম্পানিগুলোকে বিক্রি করে দিচ্ছে। আমরা এটাকে মেনে নেব না। এই সরকার ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিয়ে কোনো আইন করেনি, কিন্তু কৃষকদের কাছ থেকে কৃষিকে ছিনিয়ে নিতে ওরা মরিয়া হয়ে উঠেছে। এটা কখনই ঘটতে দেওয়া যাবে না।
পালিগঞ্জের প্রতিবাদে নেতৃত্ব দেন এআইএসএ-র সাধারণ সম্পাদক সন্দীপ সৌরভ। গোপাল রবিদাসের নেতৃত্বে সিপিআই(এমএল) ও সারা ভারত কিসান মহাসভার কর্মীরা মাসৌরির চৌরাস্তা অবরোধ করেন।
আরা, তারারি এবং আগিয়াঁওতে প্রতিবাদে নেতৃত্ব দেন যথাক্রমে রাজু যাদব, বিধায়ক সুদামা প্রসাদ এবং মনোজ মঞ্জিল। সিওয়ান, জাহানাবাদ ও আরওয়ালের প্রতিবাদী মিছিলগুলোতে নেতৃত্ব দেন অমরনাথ যাদব, রামবলি সিং যাদব এবং মহানন্দ।
পূর্ণিয়া, দ্বারভাঙ্গা, মধুবনী, মুজাফ্ফরপুর, সমস্তিপুর ও বেগুসরাইয়ে সংগঠিত প্রতিবাদগুলোয় চাক্কা জ্যাম, মিছিল সংগঠিত হয়, প্রধানমন্ত্রীর কুশপুতুল পোড়ানো হয় এবং ৫৭নং জাতীয় সড়ক অবরোধ করা হয়। গয়াতে প্রতিবাদী মিছিল ও প্রধানমন্ত্রীর কুশপুতুল পোড়ানোয় নেতৃত্ব দেন কিসান নেতা জীতেন্দ্র যাদব। বৈশালিতে সংগঠিত প্রতিবাদে নেতৃত্ব দেন সারা ভারত কিসান মহাসভার রাজ্য সভাপতি বিশ্বেশ্বর যাদব। সুপৌল, খাগারিয়া, রোহতাস, গোপালগঞ্জ, নওয়াদা, ঔরঙ্গাবাদ, কৈমুর, বক্সার, চম্পারণ, ভাগলপুর এবং অন্যান্য জেলাতেও কৃষকরা উৎসাহের সঙ্গে প্রতিবাদে অংশ নেন।
ভোটের আগে আবারও সেই ২০১৫-র কায়দায় গ্রেপ্তার করা হলো কমরেড মনোজ মঞ্জিলকে। কমরেড মনোজ বিহারের অগিয়াঁও বিধানসভা কেন্দ্রের সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের প্রার্থী। তিনি পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিরও সদস্য। দেশজুড়ে তোলপাড় ফেলে দেওয়া ‘সড়ক পে স্কুল’ আন্দোলনের প্রথিকৃৎ এই লড়াকু দলিত তরুণকে বরাবরই ভয় জেডিইউ-বিজেপির। গতবারও জেল থেকে লড়েই কমরেড মনোজ মাত্র ছয় হাজার ভোটে পরাজিত হয়েছিলেন। কিন্তু মনোজের লড়াই হেরে যায়নি। অগিয়াঁওয়ের আলপথ থেকে রাজপথে গরিব-দলিত মানুষের প্রতিদিনকার বেঁচে থাকার লড়াইয়ের সাথী মনোজের বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়ে রেখেছে প্রশাসন। আর এইসব মামলাগুলো কাজে লাগানো হয় ভোট এলেই। এইবারও সেটাই হলো। দীর্ঘদিন আইসা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং বর্তমানে বিপ্লবী যুব অ্যাসোসিয়েশনের সর্বভারতীয় সভাপতি কমরেড মনোজ মঞ্জিল লক্ষ্যে অবিচল। অন্য দলের প্রার্থীরা পাঁচ বছর মানুষের মাঝে না থেকে কেবল ভোটের সময় মানুষের কাছে এসে ভোট চায়, কমরেড মনোজের ক্ষেত্রে ঠিক তার উল্টোটা দাঁড়াল – পাঁচ বছর মানুষের সাথে থেকে ঠিক ভোটের সময়টাই তাঁকে জেলে থাকতে হয়। কিন্তু, গ্রেপ্তার করুক ওরা, লড়াই করবে ভোজপুরের লক্ষ লক্ষ মনোজ মঞ্জিলরা।
মনোজ কিন্তু গ্রেপ্তারের সময়েও হাসছেন। কারণ মনোজ জানেন এক পা জেলে আর এক পা লড়াইয়ের ময়দানে রেখেই লড়ে যেতে হবে। আর এই লড়াই জিততেই হবে।
১) পালিগঞ্জ - সন্দীপ সৌরভ
২) আরা - কায়ামউদ্দিন আনসারী
৩) আগিয়াও (স) - মনোজ মঞ্জিল
৪) তারারি - সুদামা প্রসাদ
৫) ডুমরাঁও - অজিত কুমার সিংহ
৬) কারাকাট - অরুণ সিংহ
৭) আরওয়াল - মহানন্দ প্রসাদ
৮) ঘোষি - রামবলি সিং যাদব
৯) ফুলওয়ারী (স) - গোপাল রবিদাস
১০) দিঘা - শশী যাদব
১১) দারৌলি (স) - সত্যদেব রাম
১২) জিরাদেই - অমরজিৎ কুশওয়াহা
১৩) দারোন্ডা - অমরনাথ যাদব
১৪) ভোরে (স) - জিতেন্দ্র পাসওয়ান
১৫) সিকটা - বীরেন্দ্র প্রসাদ গুপ্তা
১৬) আওরাই - আফতাব আলম
১৭) কল্যাণপুর (স) - রঞ্জিত রাম
১৮) ওয়ারিশনগর - ফুলবাবু সিংহ
১৯) বলরামপুর - মেহবুব আলম
এআইসিসিটিইউ অনুমোদিত ‘বিষ্ণুপুর পৌরসভা সংগ্রামী শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন’-এর পক্ষ থেকে শতাধিক মজদুর বিষ্ণুপুর কবিরাজপাড়া থেকে মিছিল করে এসে মহকুমা শাসকের দপ্তরের সামনে একটি সভা অনুষ্ঠিত করে গত ৬ অক্টোবর। এই সভায় বক্তব্য রাখেন ইউনিয়নের নেতা বিল্টু ক্ষেত্রপাল, ফারহান হোসেন খান, দিলবার খান এবং এআইসিসিটিইউ জেলা সভাপতি বাবলু ব্যানার্জি। সভা থেকে প্রশাসনের কাছে দাবি রাখা হয় অস্থায়ী মজদুরদের স্থায়ীকরণ করতে হবে। সরকারী নিয়ম মেনে অবিলম্বে সবার পিএফপ চালু করতে হবে। অবসর গ্রহণের পর সকল মজদুরকে এককালীন ৫ লাখ টাকা ও মাসিক পেনশন দিতে হবে। সরকারী নির্দেশ মোতাবেক সকল কর্মচারিদের মাসে ১৮,০০০ টাকা বেতন এবং ৫০০০ টাকা পূজা বোনাস দিতে হবে। জীবন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, দ্রব্যাদি ও বীমা চালু করতে হবে। পুজোর আগে বকেয়া এক মাসের মজুরি এবং বোনাসের অর্থ না মেটালে আরো তীব্র আন্দোলনের হুঁশিয়ারী দেওয়া হয় সংগঠনের তরফ থেকে।
কেন্দ্রের বিজেপি সরকার নতুন কৃষি আইন চালু করে ধান কেনা বন্ধ করে রেশন তুলে দিতে চাইছে। এর ফলে গ্রামের কৃষকদের সাথে শহরের মেহনতি মানুষ বিপদে পড়বে, কারণ এই অসংখ্য মেহনতি মানুষ বেঁচে আছে রেশনের চাল-গমের উপর। শুধু তাই নয়। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন থেকে খাদ্যশস্যগুলি বাদ দেওয়ার ফলে মজুতদারী বেড়ে যাবে এবং চাল-ডাল-তেল-নুন-আলুর দাম বেড়ে গিয়ে আকালের সৃষ্টি হবে। তাই চাষিদের সাথে মজদুরদেরও এই আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হবে। তৃণমূল যদি সত্যিই এই আইনের বিরুদ্ধে হয় তবে অবিলম্বে রাজ্য বিধানসভার অধিবেশন ডেকে এই আইনের বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাশ করাক।
স্বনির্ভর গোষ্ঠী ও বন্ধন ব্যাংক সহ সমস্ত মাইক্রোফিনান্স সংস্থার ঋণ মুকুব ও ২ বছর কিস্তি আদায় স্থগিত রাখার এবং এই সময়ের অতিরিক্ত সুদ মুকুব করার দাবিতে আন্দোলন চলছিল। কিন্ত মাইক্রোফিনান্স মহাজনী সংস্থার এজেন্টগুলো প্রতিনিয়ত ঋণগ্রস্ত মহিলাদের অসম্মান অপমান ও হেনস্থা করে চলেছেন তাই গত ১ অক্টোবর পুর্ব বর্ধমান জেলার পুর্বস্থলী থানায় ঋণমুক্তি কমিটির পক্ষ থেকে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। সকাল ১১টার সময় ৪০০ মানুষের মিছিল শুরু করে বন্ধন ব্যাংক-এর সামনে জমায়েত হয়। বন্ধন অফিসে স্মারক লিপি জমা দেওয়া হয়। তারপর মিছিল থানার সামনে উপস্থিত হয়। থানার আইসি-কে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। দাবি রাখা হয় এজেন্টদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য। আইসি নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং থানা এলাকার বিভিন্ন সংস্থার নাম ঠিকানা জানাতে বলেন। বিক্ষোভে বক্তব্য রাখেন অশোক চৌধুরী ও আনসারুল আমন মন্ডল। জমায়েতে বেশিরভাগই মহিলাদের উপস্থিতি থাকলেও শতাধিক পুরুষের সামিল হওয়া উল্লেখজনক। এই জমায়েত এলাকার মানুষের মধ্যে ভালো উৎসাহ সৃষ্টি করে।
৫ অক্টোবর জামালপুর থানায় ২০০ মানুষ জমায়েত হয়ে বিক্ষোভ দেখান এবং থানায় ডেপুটেশন দেওয়া হয়। প্রতিনিধিদের মধ্যে ছিলেন অর্চনা মল, রহিমা বিবি ও নিতাই ক্ষেত্রপাল। বিক্ষোভে বক্তব্য রাখেন আয়ারলার জেলা সম্পাদক আনসারুল আমন মন্ডল।
৬ অক্টোবর পুর্বস্থলী ২নং ব্লক-এর পারুলিয়া বাজারে ২০০ মানুষের অবস্থান বিক্ষোভ মিছিল সংগঠিত হয়। পারুলিয়া বাজারে অবস্থিত সবকয়টি সংস্থার অফিসে লিখিত জমা দেওয়া বিক্ষোভ দেখানো হয়। মিছিল বাজার এলাকার মানুষের মধ্যে ভাল উৎসাহ সৃষ্টি করে। তারপর পুর্বস্থলী গঞ্জের আর কয়েকটি অফিসে মিছিল করে আবেদন জমা দেওয়া হয়।
৬ অক্টোবর কালনা ২নং ব্লক অফিসে বিক্ষোভ অবস্থান সংগঠিত হয়। কয়েকশ মানুষের উপস্থিতিতে বিক্ষোভ অবস্থান থেকেই ঋণমুক্তি কমিটি ও আয়ারলার পক্ষ থেকে বিডিও অফিসে ডেপুটেশন দেওয়া হয় এবং এআইকেএম-এর পক্ষ থেকে এডিও অফিসে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। দাবি ছিল, পঞ্চায়েত পঞ্চায়েতে ধান ক্রয় করতে হবে। ২,৩৫০ টাকা ধানের দাম ও ৬,০০০ টাকা পাটের দাম দিতে হবে। অনতিভুক্ত ভাগচাষি লিজচাষি গরিবদের শস্যবীমা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ফসলের দেড়গুণ দাম দিতে হবে। কৃষক পেনশন দিতে হবে।
৬ অক্টোবর পুর্ব বর্ধমান জেলা শাসক অফিসে মাইক্রোফিনান্স সংস্থার এজেন্টদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ডেপুটেশন সংগঠিত করা হয়। ১৫ সেপ্টেম্বর-এর ডেপুটেশন-এর ধারাবাহিকতায় এই ডেপুটেশন। ৬ জনের প্রতিনিধি ডেপুটেশনে প্রতিনিধিত্ব করেন। সারাভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতির জেলা সম্পাদক আনসারুল আমন মন্ডল-এর নেতৃত্বে ঋণমুক্তি কমিটির জামালপুর ব্লকের ২ জন, মেমারী ১নং ব্লক-এর ১ জন রায়না থানার ১ জন মহিলা সদস্য ও শ্রীকান্ত রানা প্রতিনিধিত্ব করেন। এডিএম ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে জানিয়ে দেবেন বলেন এবং হেনস্থার ব্যপারে থানায় অভিযোগ দায়ের করার পরামর্শ দেন।
যুব স্বাভিমান মোর্চা সংগঠিত যুব স্বাভিমান পদযাত্রা ২৮ মার্চ শহীদ ভগৎ সিং জন্ম বার্ষিকীতে প্রয়াগরাজ-এর চন্দ্রশেখর আজাদ পার্ক থেকে শুরু হয়। এই পদযাত্রার সময়কাল নির্দিষ্ট হয়েছিল ১২ দিন এবং যাত্রার লক্ষ্ণৌ পৌঁছানোর কথা ছিল ৯ অক্টোবর। কিন্তু পদযাত্রা একদিন হওয়ার পরই পুলিশ মাঝরাতে নবাবগঞ্জ থেকে পদযাত্রীদের গ্রেপ্তার করে। পরদিন পদযাত্রীদের ছেড়ে দেওয়া হলেও তাদের আর যাত্রায় এগিয়ে যেতে দেওয়া হয় না।
এই যাত্রার লক্ষ্য ছিল কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বেকার ভাতা প্রদান, ২০২০-র নয়া শিক্ষানীতি প্রত্যাহার এবং যুব সমাজের অন্যান্য দাবি তুলে ধরা। যুব স্বাভিমান মোর্চার আহ্বায়ক ডঃ পি আর গৌতম বলেন, এই প্রচারাভিযান চালানো হচ্ছে যুবকদের কাজ দেওয়ার দাবি তোলার জন্য। সরকার যদি এই দাবি পালনে সমর্থ না হয় তবে তার উচিত যুবকদের জন্য সম্মানজনক স্বাভিমান (আত্মমর্যাদা) ভাতার ব্যবস্থা করা। নয়া শিক্ষানীতি শিক্ষালাভকে সুনিশ্চিত করার বদলে শিক্ষাকে বেসরকারী হাতে তুলে দেওয়ার এক কৌশল। সামাজিক ন্যায়কে মান্যতা দেওয়ার কোনো দায় বেসরকারী ক্ষেত্রের নেই, ফলে নয়া শিক্ষানীতিতে সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে দুর্বল অংশের শিক্ষাক্ষেত্র থেকে বহিষ্কারের পথই প্রশস্ত হয়েছে। তফশিলি জাতি/জনজাতিভুক্ত ছাত্রছাত্রীদের ফি ছাড়াই ভর্তি হওয়ার ব্যবস্থা থেকে সরকার সরে আসছে এবং স্কলারশিপ ও গবেষণার অনুদানকে হ্রাস করছে, এবং এইভাবে ব্যয়বহুল পেশা সংক্রান্ত পাঠক্রম দরিদ্র ও বঞ্চিত অংশের আয়ত্তের বাইরে থেকে যাবে।
মোর্চার সহ আহ্বায়ক সুনিল মৌর্য বলেন, নরেন্দ্র মোদী দু-কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা তো হয়ইনি, বিপরীতে দু-কোটি কর্মসংস্থান নষ্ট হয়েছে। যেটুকু কর্মসংস্থান সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে, রেল-এলআইসি-বিপিএল-হ্যাল-এয়ার ইন্ডিয়ার মতো সংস্থাগুলোর বেসরকারিকরণ ঘটিয়ে সেই সম্ভাবনাকে নষ্ট করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, মোদী ও যোগী সরকারের যুব-বিরোধী নীতীগুলোর বিরুদ্ধে যুব স্বাভিমান মোর্চা তাদের আন্দোলন অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাবে।
শহীদ-ই-আজম ভগৎ সিং-এর ১১৩তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে গত ২৮ সেপ্টেম্বর সিপিআই(এমএল) সারা দেশেই বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে ভগৎ সিং স্মরণ কর্মসূচী সংগঠিত করে এবং তাঁর স্বপ্নের ভারতবর্ষ গড়ে তোলার শপথ নেয়। এআইসিসিটিইউ এবং আরওয়াইএ এই দিনটিকে “শ্রমিক ও কৃষকদের অধিকার রক্ষা এবং কাজের অধিকার দিবস” রূপে পালন করে।
পাটনায় শতশত শ্রমিক ও যুবক গান্ধী ময়দানে ভগৎ সিং-এর মূর্তিতে মালা দেন এবং ভগৎ সিং-এর স্বপ্নের ভারত গড়ে তোলার আহ্বান জানান। সেখানে অনুষ্ঠিত জনসভায় যাঁরা বক্তব্য রাখেন তাদের মধ্যে ছিলেন এআইসিসিটিইউ-র রাজ্য সাধারণ সম্পাদক আর এন ঠাকুর, সিপিআই(এমএল) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অভ্যুদয়, এআইসিসিটিইউ-র রাজ্য সম্পাদক রণবিজয় কুমার, মহাসংঘ (গোপ গোষ্ঠী) সাধারণ সম্পাদক প্রেমচাঁদ কুমার সিনহা, আরওয়াইএ রাজ্য সম্পাদক সুধীর কুমার ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। বক্তারা তাঁদের বক্তব্যে এই বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দেন যে, শ্বেত ব্রিটিশ রাজকে সরিয়ে তার স্থানে বাদামি ব্রিটিশ রাজকে আনা কখনই ভগৎ সিং-এর স্বপ্ন ছিল না। তিনি অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক দিক থেকে এমন এক সর্বজনীন সমানাধিকারের ভারত গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন যেখানে জাতপাতবাদী, ধর্মীয় ও বর্ণবাদী বৈষম্য থাকবে না। যেখানে প্রতিটি মানুষেরই জীবন ও জীবিকার অধিকার সুনিশ্চিত হবে, এমন এক আধুনিক গণতন্ত্রের স্বপ্নই ভগৎ সিং দেখেছিলেন। কিন্তু আজ মোদী জমানায় কোটি-কোটি যুবক বেকার আর সরকার আবার কাজ নষ্ট হওয়ার সমর্থনে যুক্তি দিচ্ছে। স্বাধীনতা লাভের ৭৩ বছর পর দেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র আজ আরও একবার বিপর্যয়ের মুখে এবং কৃষক ও শ্রমিকদের কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর ক্রীতদাসে পরিণত করা হচ্ছে।
এদিন সিপিআই(এমএল)-এর পালিগঞ্জ অফিসে ছাত্র ও যুবকদের শিক্ষা ও কাজের অধিকার নিয়ে এক আলোচনাসভা আয়োজিত হয়। এই সভায় প্রধান বক্তা ছিলেন পালিগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রের সিপিআই(এমএল) প্রার্থী সন্দীপ সৌরভ। তিনি বলেন, আজ যখন শিক্ষা ও কাজের মতো যুবকদের বুনিয়াদি অধিকারকে ধ্বংস করা হচ্ছে, কৃষক স্বার্থ বিরোধী কৃষি আইনের মধ্যে দিয়ে কৃষকদের কর্পোরেট দাসত্বের অধীন করে তোলা হচ্ছে, শ্রম আইনগুলোকে বাতিল করে দিয়ে শ্রমিকদের অধিকারকে খারিজ করা হচ্ছে, তখন ভগৎ সিং-এর তাৎপর্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়েই সামনে আসছে। নীতীশ কুমার বলেন যে, বিহারে এখন দুই ইঞ্জিন সম্পন্ন সরকার চলছে, এটা আসলে হল দুটো বুলডোজারওয়ালা সরকার, একটা বুলডোজার চালাচ্ছে কেন্দ্রের মোদী সরকার, আর বিহারে নীতিশ কুমার তাঁর বুলডোজার দিয়ে যুবকদের শিক্ষা ও কাজের অধিকারকে চূর্ণ করছেন।
ছত্তিশগড়ে সিপিআই ও সিপিআই(এমএল) দিনটিকে “কাজ বাঁচাও, অধিকার বাঁচাও, গণতন্ত্র বাঁচাও” দিবস রূপে উদযাপন করে। ভগৎ সিং এবং অন্যান্য শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করা হয়। বক্তারা তাঁদের বক্তব্যে বলেন, শ্রমিকরা আজ অত্যন্ত কঠোর সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু মোদী সরকার তাদের সুরাহা করার বদলে তাদের সঙ্গে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকারের মতোই আচরণ করছে এবং শ্রমবিধি বিলগুলো এনে শ্রমিকদের যেটুকু অধিকার অবশিষ্ট রয়েছে সেটুকুও ছিনিয়ে নিতে চাইছে।
ভগৎ সিং জন্মজয়ন্তী দিবসে অন্ধ্রপ্রদেশের গুন্টুর জেলার তেনালিতে আরওয়াইএ এক মিছিল সংগঠিত করে কেন্দ্রীয় সরকারের জনবিরোধী নীতিগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়। পূর্ব গোদাবরী জেলার কাঁকিনাড়াতেও শহীদ ভগৎ সিং স্মরণ অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। উড়িষ্যায় রায়গড়ার গুনুপুর এবং অন্যান্য স্থানে সরকারের নীতিমালার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে গুরুত্ব সহকারে ভগৎ সিং স্মরণ অনুষ্ঠিত হয়।
এআইসিসিটিইউ ১৬ থেকে ২৮ আগস্ট যে “শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা কর” প্রচারাভিযান চালায়, এদিন তার সমাপ্তি ঘটে।
ঝাড়খণ্ডে ডেবরির ভেলওয়াঘাটির সালাইয়া টাঁড়ে ঝাড়খণ্ড নির্মাণ মজদুর ইউনিয়ন ২৮ সেপ্টেম্বর এক জনসভা সংগঠিত করে। কয়েক শত নির্মাণ শ্রমিক সভায় যোগ দেন। স্থানীয় সাঁওতালি ভাষায় বক্তব্য রেখে আদিবাসী মহিলা ফুলমুনি কিস্কু এবং বড়কি বাস্কে নির্মাণ শ্রমিকদের দুর্দশার কথা তুলে ধরেন। তাঁরা বলেন, নির্মাণ শ্রমিকরা অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন এবং জীবিকার জোগাড় তাঁদের কাছে দু্ঃসাধ্য হয়ে দেখা দিচ্ছে।
উত্তরাখণ্ডে হলদোয়ানির বুদ্ধ পার্কে ভগৎ সিং স্মরণ অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে এআইসিসিটিইউ-র শ্রমিক অধিকার রক্ষা প্রচারাভিযানের সমাপ্তি ঘটে। এই অনুষ্ঠানে বিভিন্ন বাম সংগঠন অংশ নেয়। ভগৎ সিং ও তাঁর মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের নামিয়ে আনা কোম্পানি রাজের বিরুদ্ধে লড়াই করার শপথ নেওয়া হয়।
গুজরাটে সিপিআই(এমএল)-এর আহমেদাবাদ কমিটি আমরাইওয়াদি থেকে খোখার সর্কেল পর্যন্ত এক মিছিল সংগঠিত করে। ওই মিছিলে নেতৃত্ব দেন লক্ষ্মণভাই পাটানওয়াদিয়া এবং অমিত পাটানওয়াদিয়া। জাতীয় রাজধানী দিল্লিতে নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়ন আয়োজিত বেশকিছু স্থানে ভগৎ সিং স্মরণের মধ্যে দিয়ে সরকারের শ্রমিক স্থার্থ বিরোধী নীতিগুলোকে ধিক্কার জানানো হয়।
দিল্লীতে ২৯ সেপ্টেম্বর শাহিনবাগের অন্যতম ‘দাদি’কে সংবর্ধনা জানালেন দিল্লীর নাগরিকবৃন্দ, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং বিভিন্ন নারী গোষ্ঠী। প্রসঙ্গত, শাহিনবাগের এই ‘দাদি’ টাইম পত্রিকার বিচারে ২০২০-র সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির অন্যতম বলে বিবেচিত হয়েছেন। ওই সংবর্ধনা সভায় যাঁরা বক্তব্য রাখেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন ডঃ সয়িদা হামিদ, অ্যানি রাজা, ভাষা সিং, ডঃ পুনম বাটরা, ভার্টিকা মানি, বাণী সুব্রমনিয়ন ও অন্যান্যরা। তাঁরা বলেন, বিলকিস দাদি এবং শাহিনবাগে শুরু হওয়া সমভিত্তির নাগরিকত্ব আন্দোলন সারা বিশ্বের কাছেই শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধের এক শক্তিশালী প্রতীক হয়ে উঠেছে এবং সেগুলো আজও আমাদের অনুপ্রাণিত করে চলেছে। দিল্লী পুলিশের বিদ্বেষমূলক তদন্তে যেভাবে সমভিত্তির নাগরিকত্বের জন্য, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের (সিএএ) বিরুদ্ধে এবং প্রস্তাবিত নাগরিকপঞ্জির (এনআরসি) বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে দুরভিসন্ধিমূলক ষড়যন্ত্র বলে, দিল্লী দাঙ্গার অনুঘটক বলে চিত্রিত করা হচ্ছে, তাতে তাঁরা উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তাঁরা শাহিনবাগকে মহিলা নেতৃত্বে চালিত স্বাধীন ভারতের বৃহত্তম, সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন রূপে অভিহিত করেন। সমভিত্তির নাগরিকত্বের জন্য যাঁরা আন্দোলন চালিয়েছেন এবং মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে অন্যায়ভাবে যাঁদের জেলে পোরা হয়েছে, সংবর্ধনা সভার সংগঠকরা তাঁদের প্রতি সংহতি জানান এবং আন্দোলনকারীদের অন্যায়ভাবে নিশানা বানানোর অভিযান বন্ধ করার দাবি তোলেন।
হাতরাসের গণধর্ষণে মৃতার পরিবারের একজনের সঙ্গে এই ঘৃণ্য অপরাধে অভিযুক্ত এক ব্যক্তির ফোনালাপের ভিত্তিতে অর্ণব গোস্বামী ঘোষণা করে দিয়েছে যে “হাতরাসে ধর্ষণের অভিযোগ মিথ্যে!” মৃত্যুর আগে জবানবন্দীতে ভিকটিম বারবার বলেছেন যে তিনি ধর্ষিতা। তবু অর্ণব গোস্বামী তাকে মিথ্যেবাদী হিসেবে চিহ্নিত করলেন! যদি আমরা ধরেও নিই যে ভিকটিম অভিযুক্তদের একজনের সাথে পরিচিত ছিল এবং তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল – তার অর্থ কি এটা দাঁড়ায় যে তাকে গণধর্ষণের উদ্দেশ্যে ফুসলে নিয়ে যাওয়া হয়নি? এরকম ঘটনা কি এই প্রথমবার ঘটলো? মোটেও নয়। বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরিচিত পুরুষদের বিশ্বাস করে মহিলারা ধর্ষণ ও খুন হন।
পাশাপাশি, আমি বলতে পারি যে, গ্রাম্য ভারতে, বিভিন্ন অজুহাতে যৌন-শোষণমূলক, হিংসাত্মক পরিস্থিতি তৈরি করে উচ্চবর্ণের প্রভাবশালী পুরুষদের দ্বারা দলিত মেয়েদের ওপর জুলুম চালানোটা খুব সাধারণ বিষয়। আর এই গ্রামটিতে তো ৪০০টি ঠাকুর পরিবারের মাঝে মাত্র চারটি দলিত পরিবার বসবাস করে।
ভয়াবহ ধর্ষণ ও হত্যার শিকার একটি দলিত মেয়েকে মিথ্যেবাদী হিসেবে বর্ণনা করার মতো অপরাধ করেছে অর্ণব গোস্বামী। শুধু ক্ষমা প্রার্থনা করে পার পেয়ে যেতে চাইছে এখন। দেশের মানুষ কি এই গর্হিত অপরাধকারীকে ছেড়ে দেবে? প্রতিটি মানুষের উচিত এই লোকটাকে এই রকম নৈতিক বিকারগ্রস্ত আচরণের জন্যে সম্পূর্ণভাবে বয়কট করা, তাকে সমস্ত রকম হিসেবের বাইরে বের করে দেওয়া।
– কবিতা কৃষ্ণান
বিগত ১৪ সেপ্টেম্বর উত্তরপ্রদেশে হাথরাসে একটি ১৯ বৎসর বয়সী মেয়ের অতিমানবীয় যে ধর্ষণ ও খুন হয়েছে তার বিরুদ্ধে আজ আইসা ও আইপোয়া-র পক্ষ থেকে একটি প্রতিবাদ কর্মসূচী পালন করা হয়। সেই কর্মসূচীতে প্রথমে বিষ্ণুপুর পোকাবাঁধে স্লোগান ও কমরেড ফারহান কর্মসূচীর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রারম্ভিক বক্তব্য রাখেন। তারপর সেখান থেকে পথমিছিলের মাধ্যমে বিক্ষোভ কর্মসূচী শুরু হয় ও স্ট্যাচু মোড় তথা এসডিও অফিসে মিছিল থামে। সেখানে দাঁড়িয়ে বিক্ষোভ দেখানো হয়, বক্তব্য রাখেন আইপোয়া নেত্রী তিতাস গুপ্ত। তিনি বলেন “ধর্ষিতা মনীষা বাল্মীকির পরিবারের উপর যোগী তথা বিজেপি সরকার কী নির্মম অত্যাচার চালিয়েছে। এই দেশে ধর্ষিতা ও ধর্ষিতার পরিবারকে কেন প্রশ্নের মুখে দাঁড়াতে হয়...”। বক্তব্য রাখেন আইসা সদস্য বিল্টু ক্ষেত্রপাল। তিনি বলেন “এই ধর্ষণ, পুরুষতান্ত্রিক ও ব্রাহ্মন্যবাদ চিন্তা ছাত্রদের কিভাবে ভুল পথে পরিচালনা করে ..”। মঙ্গল মুর্মু বিষ্ণুপুর চন্দ্রকোনা আরও অনেক জায়গায় এই ধর্ষণের উদাহরণ টেনে সাধারণ মানুষের সচেতনতার প্রশ্ন তোলেন। আইসা সম্পাদক সুশান্ত ধীবর বলেন, “এই ব্রাহ্মণবাদের প্রচারের মাধ্যমে দলিতদের নিপীড়ন করা চলবে না...”। শেষে ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগান তুলে কর্মসূচী শেষ হয়।
- প্রান্তিক দাশগুপ্ত
হাথরাস, বলরামপুর স্পষ্ট দেখিয়ে দিয়েছে উত্তরপ্রদেশে কেবলমাত্র বিজেপি-আরেসএস মদতপুষ্ট ধর্ষক-খুনী-পুলিশ-আমলা আঁতাত চলছে। সেই বিজেপি আবার বাংলায় তৃণমূলী নৈরাজ্যের পরিবর্তে সুদিন আনার গল্প শোনায়! এই সীমাহীন ভণ্ডামির বিরুদ্ধে ও নির্যাতিতদের দ্রুত ন্যায় বিচারের দাবিতে গত ৫ অক্টোবর সন্ধ্যায় কোন্নগর বেঙ্গল ফাইন চৌরাস্তার মোড়ে জ্বলন্ত মশাল নিয়ে বিজেপিকে সোচ্চারে ধিক্কার ও হুঁশিয়ারি দিলো সিপিআই(এমএল) লিবারেশন। এই সমাবেশে মহিলারা ছিলেন নেতৃত্বে। এলাকার কিছু মানুষও বিক্ষোভে যোগ দেন। উপস্থিত ছিলেন পার্টির রাজ্য সম্পাদক পার্থ ঘোষ ও হুগলি জেলা সম্পাদক প্রবীর হালদার। সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন পার্টির উত্তরপাড়া থানা এরিয়া কমিটির সদস্য সৌরভ ও রাজ্য সম্পাদক। এরপরে স্লোগান দিয়ে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের কুশপুতুল জ্বালানো হয়।
গত ২ অক্টোবর বজবজের কালীপুরে উত্তরপ্রদেশের হাথরাস ও বলরামপুরে ধর্ষণ, হত্যা এবং পুলিশ দ্বারা রাতের অন্ধকারে দেহ পুড়িয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে বিক্ষোভ সংগঠিত হয়। আওয়াজ ওঠে খুনি মুখ্যযমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথকে অবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে। প্রবল প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যেও মহিলা ও ছাত্র-যুবরা প্রতিবাদে সামিল হন। উপস্থিত ছিলেন জেলা সম্পাদক কিশোর সরকার, আইপোয়ার-র রাজ্য নেত্রী কাজল দত্ত, সেখ সাবির (রাজা) সহ আরো অনেকে।
১ অক্টোবর সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির উদ্যোগে হাথরাসে দলিত তরুণীর নৃশংস গণধর্ষণ, হত্যা ও দেহ জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনাকে ধিক্কার জানিয়ে অপরাধীদের শাস্তির দাবিতে, দেশপ্রিয়নগর বাজার থেকে সমিতির অফিস পর্যন্ত পোস্টারিং করা হয়।
ভারতে আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং মণীষা বাল্মীকির ন্যায় বিচারের দাবিতে মিছিল ও প্রতিবাদী সভা হল। সিপিআই(এমএল) লিবারেশন প্রভাবিত সারাভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি (এআইপিডব্লিউএ), অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন (এআইএসএ), অল ইন্ডিয়া সেন্ট্রাল কাউন্সিল অব ট্রেড ইউনিয়নস (এআইসিসিটিইউ) যৌথভাবে প্রতিবাদে সামিল হয়। সভায় দাবি করা হয়, উত্তর প্রদেশে হাথরাসের দলিত তরুণী মণীষা বাল্মীকির ধর্ষক ও হত্যাকারীদের বিচার এবং শাস্তি চাই। উত্তর প্রদেশ সরকারের নির্দেশে মৃতা মণীষা বাল্মীকির শরীর অন্তিম সৎকারের জন্য তার পরিবারের হাতে তুলে না দিয়ে পুলিশ নিজেই গভীর রাতে মৃতদেহ সৎকার করেছে এবং তথ্য গোপন করার চেষ্টা করেছে। এই ঘটনায় জেলা শাসক সহ অভিযুক্ত অন্যদের অবিলম্বে চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে হবে এবং উত্তর প্রদেশ মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথকে পদত্যাগ করতে হবে। প্রতিবাদী মিছিল দেশপ্রিয় নগরের বিভিন্ন অঞ্চল পরিক্রমা করে শহীদ বেদীতে শেষ হয় এবং সভা শুরু হয়। সভায় বক্তা ছিলেন সায়ন্তন মিত্র, সৌমেন্দু মিত্র (এআইএসএ), অর্চনা ঘটক (এআইপিডব্লিউএ), অশোক সাহা এবং শিবশঙ্কর গুহরায় (সিপিআই (এম-এল))। মিছিল ছাত্র কমরেডদের, বিশেষ করে ছাত্রী ত্রিয়াশা লাহিড়ির দৃপ্ত শ্লোগানে মুখরিত ছিল। সভা পরিচালনা করেন জয়ন্তী দাশগুপ্ত।
৫ অক্টোবর ‘কামারহাটি আইডিয়াল এডুকেশনাল সোসাইটি’ হাথরাস ধর্ষণ ও হত্যার বিরুদ্ধে বিভিন্ন পথ পরিক্রমা করে। বক্তব্য রাখেন সেরাজ নোমানি, আসগর, শিবশঙ্কর গুহরায়, রাম বচন এবং নবেন্দু দাশগুপ্ত।
৭ অক্টোবর বেলঘরিয়া ‘নাগরিক উদ্যোগ’ হাতরাস ধর্ষণ-হত্যার বিরুদ্ধে এবং মোদী ও যোগী রাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মিছিল বিটি রোড রথতলা থেকে শুরু হয় এবং ফিডার রোড দিয়ে বেলঘরিয়া স্টেশনের কাছে শেষ হয়।
পুর্ব বর্ধমান জেলার পুর্বস্থলী ২নং ব্লক-এর ফলেয়া বাজারে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন-এর পুর্বস্থলী এরিয়া কমিটির পক্ষ থেকে ২ অক্টোবর মিছিল করে উত্তর প্রদেশের হাথরাস গণধর্ষণকারীদের উপযুক্ত শাস্তির ও যোগী আদিত্যনাথ-এর পদত্যাগের দাবি তোলা হয়। এরপর যোগীর কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়।
উত্তরপ্রদেশের হাথরাসের দলিত মহিলার গণধর্ষণ এবং হত্যার প্রতিবাদে রাজ্যের অন্যান্য জায়গার সাথে শিলিগুড়ির শক্তিগড়, ফকদইবাড়ি এবং কাওয়াখালিতে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির চেয়ে এবং মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ দেখান এআইপিডব্লিউএ এবং পার্টি কর্মীরা। তিনটে জায়গায় বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেন মীরা চতুর্বদী, ময়না সূত্রধর, মামণী বর্মণ, শ্যামল ভৌমিক, রুবী সেনগুপ্ত, মিলি ভট্টাচার্য, রজত বর্মণ, শাশ্বতী সেনগুপ্ত প্রমুখ।
উত্তরপ্রদেশের হাথরাসে দলিত নাবালিকার ধর্ষণ এবং হত্যার বিরুদ্ধে, যোগী আদিত্যনাথের পদত্যাগের দাবিতে, বিরোধী দলগুলি এবং সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের হাথরাসে যাওয়া আটকানোর বিজেপির ফ্যাসিস্ট আচরণের বিরুদ্ধে ৪ঠা অক্টোবর হাওড়া জেলার বালি এবং আড়ুপাড়ায় বিক্ষোভ সংগঠিত হয়। আড়ুপাড়ায় বিক্ষোভ কর্মসূচীতে বক্তব্য রাখেন পরিতোষ ব্যানার্জী এবং সুপ্রিয় রায়। বালিতে জোড়া অশ্বত্থতলা লেভেল ক্রশিং থেকে মিছিল করে শ্রীকৃষ্ণ হল পর্যন্ত যাওয়া হয় এবং রাস্তা অবরোধ করে যোগীর কুশপুতুল পোড়ানো হয়।
কলকাতায় ধারাবাহিক বিক্ষোভ চলছে। বিভিন্ন বামপন্থী ছাত্রছাত্রী-যুব ও মহিলা সংগঠনের ডাকে মৌলালি থেকে ধর্মতলা যৌথ মিছিল বিশেষ উদ্দীপনা সৃস্টি করেছিল। আইসা, আইপোয়া, এআইসিসিটিইউ, এআইপিএফ অন্যান্য সংগঠনের সাথে একাধিক বিক্ষোভ সংগঠিত করে। স্থানীয় স্তরে ৪ অক্টোবর বাঘাযতীন থেকে পল্লিশ্রী পোর চার জায়গায় পথসভায় বক্তব্য রাখেন বাসুদেব বোস, চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরি, ইন্দ্রানী দত্ত, রুদ্র প্রভাকর দাস, সম্প্রীতি মুখার্জী, মিলন সমাদ্দার। এই প্রচার এলাকায় প্রভাব ফেলে। একইভাবে ৬ অক্টোবর সন্ধ্যায় ইউনিভার্সিটির ৪ নং গেট থেকে যাদবপুর কমিউ ও ফেমিনিস্ট ইন রেজিস্ট্যান্স সহ আইসা আইপোয়া যৌথভাবে পোদ্দারনগর, বিক্রমগড় বাজার, গলফগ্রীন মোড় ও বিজয়গড় বাজারে প্রচার সভা চালায় যেখানে ১২ জনের ওপর মহিলা বক্তব্য রাখেন এবং শেষে মোদির কুশপুতুল ও মনুস্মৃতি পুড়িয়ে বিক্ষোভ দেখানো হয়। একদম পাড়া স্তরে প্রচার চালিয়ে বিজেপি ও আরএসএস-এর স্বরূপ উন্মোচিত করার আহ্বান রাখা হয়।
সঙ্গীতহীন শরীরটার এখানেই ইতি টানলেন প্রবীর বল। আমাদের প্রিয় মনাদা। ২ অক্টোবর পার্কসার্কাসের ফ্লেমিং হাসপাতাল থেকে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ ক্রিক রো-র পার্টি অফিসে তাঁর দেহ পৌছালে সেখানে তাঁর অনুরাগীরা তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানান। পার্টির পলিটব্যুরো মেম্বার কার্তিক পাল রাজ্য কমিটির সদস্য সলিল দত্ত, জয়তু দেশমুখ, বাসুদেব বসু কল্যাণ গোস্বামী, অতনু চক্রবর্তী, ধীরেশ গোস্বামী প্রমুখ। এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের সভাপতি দেবাশিস চক্রবর্তী, মাধব মুখার্জী, অরিন্দম সেনগুপ্ত, বরুণ গাঙ্গুলী, মানস ঘোষ, নীতীশ রায় সহ অন্যান্য কর্মীরা। পরিবারের পক্ষে মাল্যদান করেন প্রবীর বলের স্ত্রী, পুত্র, বোন ও অন্যান্যরা। সেখান থেকে ক্যাওড়াতলা শ্মশানে “লালে লাল আগুনে অগ্নিস্নাত আমি ইস্পাত দৃঢ় মানুষ”-এর একটি পর্বের অন্তিম ঘোষণা হল।
প্রবীর বা আমাদের প্রিয় মনাদা এখন ইতিহাস। সঙ্গীত শিল্পী সুবোধ বলের সুযোগ্য উত্তরাধিকারী অসাধারণ কন্ঠের অধিকারী, উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের সাথে আধুনিক গানে তাঁর বিশেষ কদর ছিল। কিন্তু নকশালবাড়ির ডাকে সারা দিয়ে হয়ে উঠলেন আদ্যপান্ত গণসঙ্গীত শিল্পী। শুধু গাওয়া নয়, গীত রচনা, কবিতায় সার্থক সুর সংযোজন করে হয়ে উঠলেন প্রকৃতই জনগণের শিল্পী। মাঠে ময়দানে গণসংগ্রামের প্রতিটি পদক্ষেপে, তাঁর কথায় “মৃত্যুর মুখোমুখি মিছিলে” মনাদা ছিল আদর্শ গণশিল্পীর প্রতীকস্বরূপ। বেহালায় গড়ে তুললেন “পূবের আওয়াজ” নামে গণসংগীতের দল। সে দল সারা বাংলা জুড়ে দাপিয়ে গেয়ে বেরিয়েছে। বন্ধুদের বিপদে আপদে সবার আগে বারংবার ছুটে গেছেন। কাস্টমসের গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করেও কিভাবে কমিউনিষ্ট পার্টির কর্মী হিসাবে পথের প্রতিবাদী মিছিলে হাঁটতে হয় তা তিনি বারবার পথে নেমেই প্রমাণ করেছেন।
১৯৮৫ সালে ‘পশ্চিমবঙ্গ গণশিল্পী পরিষদ’, ১৯৮৯-এ ‘পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদ’ সংগঠিত করার প্রশ্নে তিনি ছিলেন অগ্রণী। অনেকটা সময় তিনি সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর গান ছড়িয়ে আছে অগণিত শিল্পী ও সংগ্রামী মানুষের মধ্য। “প্রতি দিন বাঁচার লড়াইয়ে প্রতিদিন”, সুর বৈচিত্রে অনবদ্য। চা বাগনের শ্রমিকদের নিয়ে “এখানে চা বাগানে প্রতিদিন আঁধার নামে”, “প্রতিরোধের আওয়াজ ওঠাও”— আজও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জ্বলে উঠবার মতো গান। “বরফে বারুদ ঢেকো না” কিংবা অরিন্দমের কবিতা নিয়ে “হৃদয় আমার জুরাস না/ যন্ত্রণা তুই মরিস না/ স্মৃতিগুলো দোহাই তোদের/ বুকের মাঝে দাপাস না”।
শেষ জীবনটা তাঁর ভাল কাটলো না। গলায় ক্যানসার — অপারেশন, রেডিয়েশন সবই হল, কিন্তু গলায় গান আর ফিরে এলোনা। তার মাঝেই মস্তিস্কে অ্যলঝাইমার, চিনতে না পারা, ভুলে যাওয়া, সর্বশেষ সিরোসিস অফ লিভার।
তখনো কথা বলার অবস্থায় ছিল মনাদা, আমরা বাবলি সিতাংশু গৌতম অরিন্দম আলো মামু গিয়েছিলাম, চিনতে পারলো, কিন্তু নাম মনে করতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। বারবার বলছিল আমি আর গান গাইতে পারি না ...। আমারা বলছিলাম মনাদা আমরা একটা গানের অনুষ্ঠান কারবো শুধু তোমার গান নিয়ে, তুমি আমাদের সাথে গাইবে। খুব খুশি হয়েছিল। কিন্তু তার পর নেমে এলো কোভিড সঙ্কট। আমাদের আর একসাথে গাওয়া হলো না। সব আশাতো সবসময় পূরণ হয় না। এটাও হল না।
যখনই আমরা গাইতে থাকবো, তখনি আমাদের স্কোয়াড লিডার প্রবীর বল আমাদের সামনে থাকবে আমাদের কোরাস থেকে আরো নতুন নতুন শিল্পীদের গালায় ছড়িয়ে পড়বে মনাদা, প্রবীর বলের গান। শিল্পী কমরেড প্রবীরের কীর্ত্তি অবিনশ্বর হোক।
– নীতিশ রায়
বিশিষ্ট গণসংগীত শিল্পী ও আজীবন সিপিআই(এমএল) সদস্য কমরেড প্রবীর বল গত ২ অক্টোবর শেষনিঃস্বাস ত্যাগ করেন। কমরেডকে স্মরণ করে এদিন বিকালে দঃ ২৪ পরগণা জেলা অফিসে শ্রদ্ধা জানানো হয়। উপস্থিত ছিলেন জেলা সম্পাদক কিশোর সরকার, বজবজ চলার পথের পক্ষে দেবাশিস মিত্র, অঞ্জন ঘোষ সহ মহিলা ও আইসার কর্মীরা।
কোভিড মহামারী এবং তার পরবর্তী সময়ে লকডাউন হওয়ার ফলে শ্রমের বাজারের যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। অনেক মানুষ কাজ হারিয়েছেন অর্থনৈতিক কাজ থেমে যাওয়ার জন্য। অসংগঠিত ক্ষেত্র সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, স্বাভাবিক অবস্থাতেই অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকরা কোনোভাবে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে। লকডাউনে অর্থনৈতিক কাজকর্ম বন্ধ হওয়ার ফলে অবস্থা খুব খারাপ জায়গাতে পৌঁছেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি হিসেব অনুযায়ী শুধু সংগঠিত ক্ষেত্রেই জুলাই মাসেই ৬ লক্ষের বেশি মানুষ কাজ হারিয়েছেন। অসংগঠিত ক্ষেত্রের জন্য পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন। তাও যা পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে তাদের ১২ কোটির মতো শ্রমিক কোভিড পরবর্তী সময়ে নানাভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এই অসংগঠিত শ্রমিকদের মধ্যে স্বনিযুক্তি পেশার সাথে জড়িত। পূর্ণ লকডাউন এবং পরবর্তী সময়ে এই শ্রমিকরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
কোভিড পরবর্তী সময়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের দুরবস্থার কথা কারও অজানা নয়। পরিযায়ী শ্রমিকরা আমাদের মধ্যেই কাজ করতেন। কিন্তু মধ্যবিত্ত ভারতবাসী কোভিড পরবর্তী লকডাউনের সময় পরিযায়ী শ্রমিকে উপস্থিতি অনুভব করলেন। জাতীয় সড়ক ধরে তাদের হাঁটতে দেখা গেল। কিছু মানুষ রেল লাইন ধরে হাঁটতে গিয়ে প্রাণ হারালেন। ছড়িয়ে থাকা বাসি রুটি, মৃতদেহের ছবি সব ধরনের গণমাধ্যমে প্রকাশিত হল। সরকার মে-জুন মাসে কিছু ট্রেন চালালেন। তাতেও দুর্গতির শেষ ছিল না। খাবার বা পানীয় জল না পাওয়া, এক গন্তব্যের বদলে অন্য গন্তব্যে চলে যাওয়া, ট্রেনে জায়গা না পাওয়া এইরকম অনেক সমস্যার মধ্যে পরিযায়ী শ্রমিকদের পড়তে হয়েছে। এরপরেও যারা গন্তব্যে পৌঁছেছেন তাদের কাউকে অ্যাসিড জল দিয়ে ধোয়ানো হয়েছে।
নিজের গ্রামে বা শহরে ফিরেও পরিযায়ী শ্রমিকরা কোনো জীবিকার ব্যবস্থা করতে পারেননি। এক্ষেত্রে ১০০ দিনের কাজ বা মনরেগা কিছু সাহায্য করেছে, সব জেলাতেই মনরেগা-তে যে কাজের ব্যবস্থা হয়, সেটা বাড়ানো হয়েছে। কিছু পরিযায়ী শ্রমিক তাতে কাজ পেয়েছেন। তবে এটা দীর্ঘস্থায়ী সমাধান নয়। পরিযায়ী শ্রমিকরা আবার কখন তাদের পুরানো কাজের জায়গাতে ফিরে যাবেন সেটা অনিশ্চিত। তারা যে কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, সেগুলো অনেক ক্ষেত্রে পুনরায় শুরু হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে শুরু হলেও পরিযায়ী শ্রমিকরা ফিরে যেতে চান না কয়েক মাস আগে হওয়া তিক্ত অভিজ্ঞতার জন্য। এই অবস্থায় পরিযায়ী শ্রমিক এবং তাদের পরিবারের আর্থিক সংকটের মধ্যে আছে।
সরকারী সাহায্য কিছুটা পাওয়া গেলেও কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা নিতান্তই কম। বিনামূল্যে রেশন বা ঐ জাতীয় কিছু সুবিধা পাওয়া গেলেও বিকল্প জীবিকার ব্যাপারে কিছু সুবিধা হয়নি। জীবিকার সুরাহা ছাড়া দীর্ঘস্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। কোভিডের ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে আর এই অবস্থায় অর্থনৈতিক কাজকর্ম খুব তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক হবে সেই আশা করা ভুল হবে। স্থানীয় অর্থনীতিতে জীবিকার সন্ধান করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। স্থানীয়ভাবে কৃষিভিত্তিক শিল্প, গ্রামাঞ্চলের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো তৈরি এইরকম কাজে কর্মস্থানের সন্ধান করা ছাড়া তেমন কোনো সুযোগ দেখা যাচ্ছে না। কৃষিকাজে এমনিতেই প্রয়োজনের তুলনায় বেশি শ্রমিক রয়েছেন। ফলে কৃষির পক্ষে সম্ভব নয় আগের থেকে বেশি শ্রমিকে কর্মস্থান করা। এই অবস্থায় কৃষিভিত্তিক শিল্প, গ্রামাঞ্চলের অর্থনৈতিক সম্পদ তৈরি করা, ছোট ছোট স্টার্ট-আপ, কৃষি বিপণনে ভূমিকা, শিক্ষা-স্বাস্থ্য এইসব ক্ষেত্রে আগের থেকে বেশি করে কর্মস্থানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
অসংগঠিত শ্রমিকদের প্রায় কোনোরকম সামাজিক সুরক্ষা নেই। বেশিরভাগ শ্রম আইন তাদের জন্য লাগু হয় না। ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে তারা ন্যূনতম মজুরিও পান না। বেশিরভাগেরই দিন আনি দিন খাই অবস্থা। এই অবস্থাতে প্রায় ছ-মাস অর্থনৈতিক কাজে মন্দা থাকলে আর লকডাউন হতে থাকলেও এই শ্রমিকদে বেঁচে থাকাই দুষ্কর হয়ে দাঁড়ায়। কোনোরকম সামাজিক সুরক্ষা না থাকাটা এই ক্ষেত্রে সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তার উপর সামাজিক সুরক্ষার উপর নতুন যে বিল আনতে চলেছে তাতেও সামাজিক সুরক্ষাকে সার্বজনীন করা হয়নি। বেশিরভাগ অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক সামাজিক সুরক্ষা বলয়ের বাইরে থাকবেন এই নতুন বিল আসার পরও। সেই সমস্ত সংস্থা ১০ বা তার বেশি শ্রমিক নিযুক্ত করেন। তাদের ক্ষেত্রেই সামাজিক সুরক্ষা আইনগুলি লাগু হয়। নতুন বিলের এই শ্রমিকের সংখ্যার সীমাবদ্ধতা আছে।
কিছুদিন আগে সংসদীয় অধিবেশন চলাকালীন কয়েকটি প্রশ্নের উত্তরে কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী জানান তাদের কাছে মৃত পরিযায়ী শ্রমিকদের সংখ্যা নিয়ে কোনো পরিসংখ্যান নেই। আর যেহেতু পরিসংখ্যান নেই, তাই মৃতের পরিবারদের আর্থিক অনুদান দেওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। সরকারের এহেন মন্তব্য কিছু মানুষকে অবাক করেছে। কিন্তু বিষয়টির দিকে ভালো করে দেখলে বোঝা যায় সরকারের কাছে পরিযায়ী শ্রমিকদে সংখ্যা না থাকাটা খুব একটা আশ্চর্যের নয়! আমাদের দেশে পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য একটি আইন আছে যা ১৯৭৯ সালে প্রণয়ন করা হয়। সেই আইনে ধরে নেওয়া হয়েছিল যে পরিযায়ী শ্রমিকরা শুধুমাত্র কনট্রাক্ট্ররদের দ্বারাই নিযুক্ত হয়। তাই ১৯৭৯ সালের এই আইনে নিজ রাজ্যে এবং যে রাজ্যে শ্রমিক কাজ করতে যাচ্ছে এই দুই জায়গাতেই নথিভুক্তিকরণ করতে হয়। যে সময় এই পরিযায়ী শ্রমিকদের আইন করা হয়, সেই পরিপ্রেক্ষিতে এই আইন ঠিকই ছিল। কারণ তখন পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা কম ছিল এবং যারা ছিলেন তাদের প্রায় সবাই কনট্রাক্ট্রদের মাধ্যমেই নিযুক্ত হতেন। ফলে ১৯৭৯ বা তার পরবর্তী কিছু সময় এই আইন ভালোভাবেই পালন করা হয়েছিল। কিন্তু ’৮০-র দশকের শেষ দিক থেকেই মাইগ্রেশনের চরিত্রের আমূল পরিবর্তন হতে শুরু করে। শ্রমিকরা নিজেরাই নিজেদের তাগিদে অন্য রাজ্যে কর্মসংস্থানের আশায় যেতে শুরু করেন। ১৯৯১ সালের উদারীকরণের পর এই ধরনের মাইগ্রেশন আরও বৃদ্ধি পায়।
জাতীয় আয়ে কৃষিক্ষেত্রের গুরুত্ব ধীরে ধীরে কমলেও অধিকাংশ শ্রমিক এখনও কৃষি ক্ষেত্রেই আটকে আছেন। ২০১৭-১৮ আর্থিক বছরে জাতীয় উৎপাদনে কৃষিক্ষেত্রের অবদান ছিল ১৪.৮ শতাংশ। কিন্তু জীবিকার বন্টন পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এখনও ৪২ শতাংশ শ্রমিক কৃষিক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত। এর থেকে বোঝা যায় কৃষিক্ষেত্রে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি শ্রমিক রয়েছেন। স্বাভাবিক অবস্থাতে শিল্পক্ষেত্রে এই শ্রমিকদের কর্মসংস্থান হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু সেটা হয়ে ওঠেনি। শিল্পক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের হার এত কম যে কৃষিক্ষেত্রে উদ্বৃত্ত শ্রমিকদের শিল্পক্ষেত্রে জীবিকার সুযোগ হয়নি। এই শ্রমিকদের অনেকেই কাজের খোঁজে বড়, মাঝারি বা ছোট শহরগুলোতে আসেন। শিল্পে না হলেও শহুরে পরিষেবা ক্ষেত্রে কোনো না কোনো অসংগঠিত কাজে যুক্ত হয়ে পড়েন। এই সমস্ত অসংগঠিত পরিযায়ী শ্রমিক হঠাৎ লকডাউন ঘোষণা হওয়ার জন্য জীবিকা হারান এবং সমূহ বিপদে পড়েন। সেই সংকট এখনো চলছে।
পরিযায়ী শ্রমিকদের বাইরে কাজ করতে যাওয়া অনেকটাই দুর্দশাজনিত কারণে। গুণগতভাবে এই ধরনের মাইগ্রেশন অন্য মাইগ্রেশন যেখানে একজন কর্মচারি ভালো জীবিকার খোঁজে বাইরে যাচ্ছেন তার থেকে আলাদা। অসংগঠিত পরিযায়ী শ্রমিকদের জীবিকা বাছাই বা স্থান নির্ধারণের তেমন কোনো সুযোগ নেই। যে কোনো ধরনের জীবিকাই তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য। এই অবস্থায় যে ধরনের মাইগ্রেশন হয় তা মধ্যস্বত্বভোগীরা নিয়ন্ত্রণ করেন না। শ্রমিক অনেকখানি নিজের কারণে নিজের মূল নিবাস ছেড়ে অন্য কোনো জায়গা বিশেষত বড় শহরে কাজের খোঁজে হাজির হন। অনেক ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই একসাথে কাজের খোঁজে বাড়ি ছাড়েন। এক্ষেত্রে পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য নির্দিষ্ট আইন সেভাবে প্রণয়ন করা যায় না কারণ এক্ষেত্রে শ্রমিকরা কনট্রাক্ট্রদের মাধ্যমে বাইরে যান না, নিজেরাই যান নিন্তাতই জীবিকার তাগিদে।
এখানে এটা আশ্চর্যের নয় যে সরকারীভাবে পরিযায়ী শ্রমিকদের কোনো পরিসংখ্যান নেই। এখানে শ্রমিকের পরিচয় নিয়ে মাইগ্রেশন হয় না বা পরিযায়ী শ্রমিক আইন ১৯৭৯-এ পরিযায়ী শ্রমিকদের ভিন রাজ্যে যাওয়া যেভাবে ভাবা হয়েছিল সেভাবেও মাইগ্রেশন হয় না। গত তিন দশকে মাইগ্রেশনের চরিত্রটা অনেকটাই বদলে গেছে। কয়েকটি রাজ্য থেকে বিশেষত উত্তরপ্রদেশ, বিহার, উড়িষ্যা, ঝাড়খণ্ড, ছত্রিশগড়, পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ জীবিকার খোঁজে ট্রেন ভর্তি করে অন্য রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছেন। পশ্চিমবঙ্গ থেকে অনেক নির্মাণ শ্রমিক জীবিকার খোঁজে দিল্লী, আমেদাবাদ বা ব্যাঙ্গালোরে পাড়ি দিচ্ছেন। এ যাত্রা নাগরিক হিসেবে মূলত, ফলে এই পরিসংখ্যান রাখার কোনো সরকারী পদ্ধতি নেই। আর পাঁচটা যাত্রার মতো সাধারণ নাগরিক হিসাবে এই যাত্রা জীবিকার খোঁজে। ভারতের নাগরিক হিসাবে দেশের যে কোনো জায়গাতেই একজন নাগরিক জীবিকার কারণে যেতে পারেন। থাকতে পারেন। এখন মাইগ্রেশন সেইভাবেই দেখা হয়ে থাকে। আলাদা করে পরিসংখ্যান নেই।
নিজের জায়গাতে কাজ না পেয়ে, মানুষ বাইরে কাজের খোঁজ করেন। বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন, পরিচিত এদের মাধ্যমে কিছু বার্তা বা খবর আসে। সেইমতো তারা কাজের খোঁজে বেরিয়ে পড়েন। কনট্রাক্ট্ররা নিয়ে যাচ্ছেন অন্য জায়গাতে কাজের সূত্রে এটা বহুলাংশে কমে আসছে। ভিন রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকদের সরকারীভাবে সবসময় পরিযায়ী দেখানো হয় না। স্থানীয় শ্রমিক হিসাবেই দেখা হয়। পরিযায়ী শ্রমিকরাও অবস্থার সঙ্গে দ্রুত মানিয়ে নেয় বা নেওয়া ছাড়া কোনো উপায়ও নেই।
বিভিন্ন সূত্র এবং তথ্য থেকে বলা যায় আমাদের দেশে প্রায় ৫ কোটির মতো পরিযায়ী শ্রমিক আছেন। তাদের মধ্যে ৭৫ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক লকডাউনের সময়ে নিজের জায়গাতে ফিরে গেছেন। তারা আবার অবস্থা স্বাভাবিক হলে নিজেদের কাজের জায়গাতে ফিরে যাবেন বা যাওয়ার কথা ভাববে কিনা সেই প্রশ্নের উত্তর জানা নেই। অর্থনীতি নিজের নিয়মে আপন ছন্দ অনুসারে পুননির্মিত হবে। তবে পরিযায়ী শ্রমিক কোভিড পূর্ববর্তী সময়েও মোটেই ভালো ছিলেন না। পুরো অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকরাই শ্রমের বাজারে যথেষ্ট শোষিত হন বিভিন্ন দিক থেকে দেখলে। কোভিড পরবর্তী সময়ে জনগোচরে শ্রমিকদের দুর্দশা অনেক বেশি করে প্রথিত হয়েছে। তবে এই সংকটের কোনো আশু সমাধান চোখে পড়ছে না। সরকারের অনেকখানি দায়িত্ব থেকে যায়। কিন্তু এখনও পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য দীর্ঘমেয়াদী সরকারী হস্তক্ষেপ দেখা যায়নি।
কোভিড পরবর্তী সময়ে অনেক কিছুই পাল্টে গেছে। ভারতের শ্রমের বাজার স্বাভাবিক সময়েই বেশ ভঙ্গুর। মহামারী জনিত কারণে সেই অবস্থাটা আরও খারাপ হয়েছে। অনেক মানুষ কাজ হারিয়েছেন অসংগঠিত ক্ষেত্রে এবং সংগঠিত ক্ষেত্রেও। তবে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকরা বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকরা মোট শ্রমিক সংখ্যার ৯০ শতাংশের চেয়েও বেশি। তাই সংকটের মাত্রাটা অনুমেয়। অসংগঠিত ক্ষেত্রের মধ্যে পরিযায়ী শ্রমিকদের অবস্থাটা তুলনামূলকভাবে খারাপ। কিছু ছোট ছোট ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। কোভিড পূর্ববর্তী সময়েই বেকারের হার যথেষ্ট বেশি ছিল, কোভিডের জন্য সেটা বহুগুণ বেড়েছে, জাতীয় আয়ের বৃদ্ধি কোভিড পূর্ববর্তী সময়ে বেশ ভালো ছিল (৬.৭ শতাংশ), কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে জাতীয় আয়ের বৃদ্ধি অনেকখানি কমে যাবে এবং কর্মসংস্থানের জায়গাও অনেক সংকুচিত হবে। এখন বেশ স্পষ্টভাবেই এই পরিস্থিতির আঁচ পাওয়া যাচ্ছে। এমতাবস্থায় অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের ন্যূনতম জীবনধারণের সুযোগ করে দেওয়া একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শ্রমিক শুধুমাত্র উৎপাদনের সামগ্রী নয়, তার থেকে অনেক কিছু বেশি।
- কিংশুক সরকার
অপরিকল্পিত লকডাউনের ফলে আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত শ্রমজীবী জনতা। লকডাউনের ফলে আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত সমস্ত মানুষের ঋণ মকুবের দাবিতে লড়ছে ঋণমুক্তি কমিটি। গত ৫ অক্টোবর বজবজের কালিপুরে সমস্ত গরিব জনতার ঋণমকুবের দাবিতে, সকলের জন্য ২০০ দিনের কাজ ও ৫০০ টাকা মজুরি, লকডাউনের ফলে বিপর্যস্ত সমস্ত গরিব মানুষকে মাসিক ১০,০০০ টাকা লকডাউন ভাতা সহ বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ দেখায় আয়ারলা ও ঋণমুক্তি কমিটি। বিক্ষোভে গ্রামীণ শ্রমজীবী জনতার উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। উপস্থিত ছিলেন পার্টির জেলা সম্পাদক কিশোর সরকার সহ ইন্দ্রজিৎ দত্ত, আশুতোষ মালিক, দেবযানী গোস্বামী, অঞ্জনা মাল ও আরো অনেকে।
৬ অক্টোবর উত্তর ২৪ পরগনা হালিশহর মিড ডে মিল কর্মীদের সংগঠন রন্ধনকর্মী (মিড ডে মিল) ইউনিয়নের চার সদস্যের এক প্রতিনিধি দল পাঁচ দফা দাবি নিয়ে হালিশহর পুরসভার চেয়ারম্যানের কাছে ডেপুটেশন দিলেন। দাবিগুলি হল – বারোমাসের ভাতা প্রতি মাসে দিতে হবে, প্রত্যেক রন্ধনকর্মীকে স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের আওতায় আনতে হবে, বাজারদরের অত্যধিক বৃদ্ধির কারণে ভাতা বাড়াতে হবে, প্রত্যেক রন্ধনকর্মীকে উৎসব অনুদান দিতে হবে, হালিশহরের মিড ডে মিল ব্যবস্থা এনজিওদের হাতে তুলে দেওয়া চলবে না।
এরপরে ঋণমুক্তি কমিটির বিক্ষোভ মিছিল বিভিন্ন অঞ্চল পরিক্রমা করে বলদীঘাটে শেষ হয়। বক্তব্য রাখেন উত্তম দাস। নেতৃত্ব দেন দিলীপ পাসি, সুকুমার দাস প্রমুখ।
গত ৬ অক্টোবর বিকাল ৪টার সময় সেখ পাড়া বাজারে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন-এর পক্ষ থেকে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। হাথরাস গণধর্ষণের বিরুদ্ধে ও কেন্দ্রের কৃষক বিরোধী নয়া কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে মুলত এই সভা। সভায় বক্তব্য রাখেন রানীনগর-এর সিরাজ সরকার, মানসিক মুকুল ও আরওয়াই-এর রাজ্য নেতা রনজয় সেনগুপ্ত। সভা পরিচালনা করেন জেলা সম্পাদক রাজীব রায়। সভায় ভাল সংখ্যক মানুষের অংশগ্রহণ এলাকায় ভালো উৎসাহ সৃষ্টি করে।
পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদ-এর অন্তর্ভুক্ত সংগঠন ঠাকুরনগর সাংস্কৃতিক পরিষদ-এর কর্মী ও বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক গুণসম্পন্ন (বিশেষ করে মাইম শিল্পী ও ঠাকুরনগর সাংস্কৃতিক পরিষদ-এর আর্ট স্কুলের প্রশিক্ষক ও সংগঠক) ব্যক্তিত্ব অমিতাভ সরকার (পপি) বেশ কিছুদিন যাবৎ কিডনির রোগে চিকিৎসাধীন ছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, অমিতাভ সরকারের পিতা আমাদের কর্মী ও সংগঠক কালীপদ সরকার (কালীদা)। খুবই মর্মান্তিক সংবাদ, গত ৬ অক্টোবর অমিতাভ সরকার(পপি)-কে আমরা হারিয়েছি, যা সংগঠনে এক গভীর শূন্যতা সৃষ্টি করেছে। তাঁর অকাল মৃত্যুতে পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের তরফে আমরা গভীর শোক জ্ঞাপন করছি এবং সাথে সাথে তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করছি। এই অসময়ে দুঃখের দিনে, বন্ধু কালীদা আমরা আন্তরিকভাবে তোমার পাশে থাকার অঙ্গীকার করছি।
- নীতীশ রায়সম্পাদক, পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদ
পার্টির বর্ষীয়ান কমরেড ভোলানাথ লাহিড়ী বেশ কিছু দিন ধরে বার্ধক্যজনিত জনিত রোগে ভুগছিলেন। কয়েকদিন ধরে কোমায় চলে গিয়েছিলেন। বাড়িতেই চিকিৎসা চলছিল। গত ৬ অক্টোবর রাতে কমরেড লাহিড়ীদা প্রয়াত হন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। বিদ্যুৎ শিল্পের পার্টি কমিটির একজন অভিজ্ঞ, দক্ষ এবং সক্রিয় কমরেড ছিলেন। এই শিল্পের খুঁটিনাটি যে কোনো জিজ্ঞাসার চটজলদি উত্তর লাহিড়ীদার কাছ থেকে পাওয়া যেত। রাজ্য পার্টি কমিটি এই প্রবীণ কমরেডের প্রয়াণে শোকাহত। কমরেড ভোলানাথ লাহিড়ী লাল সেলাম।