২০১৫ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিহারের জনগণের দেওয়া বিজেপি-বিরোধী জনমতের বিরুদ্ধে নীতীশ কুমারের সাথে আঁতাত করে ক্ষমতালিপ্সু বিজেপি বিহারের মসনদ ছিনতাই করেছিল। এবারও তারা ভেবেছিল কোভিড-১৯ ও লকডাউনকে এনডিএ-র ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে বিহার নির্বাচনকে লুঠ করবে। কিন্তু বাস্তবে নীতীশ কুমার সরকারের উদ্ধত দুঃশাসন ও বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে জনগণের ক্রোধ ও সংকল্প স্পষ্টত বিজেপির বুকে কাঁপন ধরিয়েছে এবং আরজেডি-বাম-আইএনসি বৃহত্তর জোটের বিরুদ্ধে ও বিশেষত জোটে সিপিআই(এমএল)-এর উপস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে জনগণকে ভয় দেখানোর চেষ্টা শুরু করেছে তারা।
বিজেপিকে কোন বিষয়টা এত ভীত ও মরিয়া করে তুললো? এই নির্বাচনে জনগণের মনে সর্বাগ্রে যে প্রশ্নগুলি উঠে আসছে তার কোনো স্পষ্ট জবাব বিজেপির কাছে নেই। আসলে জনতার ভাবনার গতিমুখ পাল্টানোর জন্যে তাদের একটি অবান্তর শত্রুকে খাড়া করা দরকার এবং তারা মনে করে সিপিআই(এমএল)-কে শত্রু হিসেবে জনগণের সম্মুখে খাড়া করতে পারলে বিজেপির সর্বনাশা নীতি, বিদ্বেষপূর্ণ রাজনীতি এবং নিষ্ঠুর ও দমনমূলক শাসনে সারা দেশে যে ভীতির সৃষ্টি হয়েছে তা লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যাবে। তাদের প্রতিবেশি উত্তরপ্রদেশে যা কিছু ঘটে চলেছে – শান্তি ও সমৃদ্ধির তালুকের বদলে সেখানে যোগীরাজ ধর্ষণ ও নিপীড়ন, মব লিঞ্চিং ও ভুয়ো সঙ্ঘর্ষে হত্যা এবং সম্পূর্ণ ভেঙে পড়া আইনশৃঙ্খলার শাসন হিসাবে চিহ্নিত হয়ে গেছে – তাতে বিহারের মানুষের বিজেপিকে ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
নির্বাচনী অঙ্গনে সিপিআই(এমএল)-এর ট্র্যাক রেকর্ডটি কী? ১৯৮০-র শেষদিকে সিপিআই(এমএল) নির্বাচনী বুথ-দখল রুখে দেওয়া এবং ভূমিহীন দরিদ্র ও ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত দলিতদের তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা ও ক্ষমতায়নের দল হিসাবে চিহ্নিত হয়েছিল। প্রথম ভোটের পরেই ভোজপুরে দলিতদের গণহত্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল, কিন্তু তারা ১৯৮৯ সালে প্রথম মার্কসবাদী-লেনিনবাদী সাংসদ হিসাবে কমরেড রামেশ্বর প্রসাদকে সংসদে পাঠাতে সফল হয়। আরো একজন সিপিআই(এমএল) নেতা ডাক্তার জয়ন্ত রংপি পরপর চারটি নির্বাচনে লোকসভায় নির্বাচিত হয়েছিলেন, অসমের স্বায়ত্তশাসিত জেলার আসন থেকে।
বিহার ও ঝাড়খণ্ডে সিপিআই(এমএল) বিধায়ক কে কে ছিলেন? সাহার থেকে পরপর তিনটি নির্বাচনে জয়ী ভোজপুরের প্রবাদ প্রতিম কমিউনিস্ট নেতা কমরেড রাম নরেশ রাম। বিহারের রাজ্য সরকারী কর্মচারী আন্দোলনের কিংবদন্তি নেতা কমরেড যোগেশ্বর গোপ। ঝাড়খণ্ডের জনগণের সবচেয়ে দুঃসাহসী কণ্ঠ, কমরেড মহেন্দ্র সিং, যাঁকে ২০০৫ সালের নির্বাচনের মনোনয়ন পেশের ঠিক পরেই হত্যা করা হয়েছিল। এছাড়াও বিহারের মানুষ তাদের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত করেছিলেন চন্দ্রদীপ সিং, অমরনাথ যাদব, অরুণ সিং, সুদামা প্রসাদ ও রাজরাম সিংয়ের মতো প্রখ্যাত কৃষক নেতাদের। কৃষিমজুর নেতা সত্যদেব রাম, সীমাঞ্চলের জনপ্রিয় কমিউনিস্ট নেতা মেহেবুব আলম, বিনোদ সিং ও রাজকুমার যাদবের মতো ঝাড়খণ্ডের জনপ্রিয় নেতারা বিহার ও ঝাড়খন্ড বিধানসভায় সিপিআই(এমএল) বিধায়ক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন।
বিজেপির অনেক বিধায়ক ও সাংসদ এই বিশিষ্ট জননেতাদের তালিকার বিপরীতে ঘৃণ্য, কলঙ্কিত ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিহ্নিত হবেন। কুলদীপ সেঙ্গারের মতো ধর্ষণে অভিযুক্ত এবং দোষী সাব্যস্ত বিধায়ক, সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে অভিযুক্ত প্রজ্ঞা ঠাকুর, যিনি গান্ধীর ঘাতক গডসের গুণগান করেন বা গিরিরাজ সিংয়ের মতো মন্ত্রী যিনি কুখ্যাত গণহত্যার মাস্টারমাইন্ড রণবীর সেনার সর্বোচ্চ নেতা ব্রহ্মেশ্বর সিংকে বিহারের গান্ধী হিসাবে মহিমান্বিত করেন এবং মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ, যিনি তার পদের অপব্যবহার করে নিজের বিরুদ্ধে সমস্ত ক্রিমিনাল চার্জগুলিকে বাতিল করে দেন – এমন লজ্জাজনক উদাহরণ নিয়ে বিজেপি বড়াই করতে পারে, কিন্তু আসলে এ’সমস্তই গণতন্ত্রের ইতিহাসে কলঙ্কময় দৃষ্টান্ত হিসেবে লেখা থাকবে।
বিজেপি গরিব ও নিপীড়িতদের কণ্ঠ শুনেই ভয় পাচ্ছে। বিহার জানে যে বিজেপি কীভাবে গণহত্যার খলনায়কদের পাশে দাঁড়িয়ে নিপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষের জন্মগত মর্যাদাবোধ, গণতান্ত্রিক অধিকার এবং বিকাশের অন্বেষণকে ডুবিয়ে মারতে চাইছিল। বিজেপি এই সত্যটি ঠিক হজম করতে পারছে না যে দরিদ্ররা এই ষড়যন্ত্রের নকশাকে প্রতিহত করতে এবং প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছে এবং বিহারের চলমান পরিবর্তনের লড়াইয়ে তারা যোদ্ধা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এই লড়াইকে প্রবল শক্তিশালী করে তুলতে সক্ষম হয়েছে।
বিহারের ‘মহাগঠবন্ধন’ বা মহাজোট কমিউনিস্ট, সমাজবাদী ও কংগ্রেস এই তিন শিবিরকে একত্রিত করে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের গৌরবময় জোটের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। বিজেপির মতাদর্শগত ও সাংগঠনিক পূর্বসূরীরা ব্রিটিশ শাসকদের সাথে সহযোগিতা করে স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। আজ তারা ‘ভুঁড়ে আংরেজ’ বা বাদামি ইংরেজের মতো দেশকে শাসন করার চেষ্টা করছে, যাদের বিরুদ্ধে ভগত সিং আমাদের আগেই সতর্ক করেছিলেন – ভারতীয় অর্থনীতিকে আদানি-আম্বানির সাম্রাজ্যে পরিণত করে দেশে কোম্পানি রাজ চালু করে এবং বিরোধী স্বর ও গণতন্ত্রের কণ্ঠকে অসীম নিষ্ঠুরতায় দমন করে কালা কানুন ও দমনমূলক শাসন প্রয়োগ করে তারা ভারতবর্ষে এমন এক শাসন ব্যবস্থা জারি করেছে যা একমাত্র ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার সঙ্গেই তুলনীয়।
আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং গণতন্ত্রের গৌরবদীপ্ত উত্তরাধিকার রয়েছে। আমরা ভগত সিং ও আম্বেদকরের উত্তরসূরী যাঁরা সামাজিক সমতা এবং জনগণের মুক্তির নতুন পথের সন্ধান দিয়েছিলেন। আরএসএস, যারা মুসোলিনী এবং হিটলারের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল এবং মনুস্মৃতিকে আধুনিক ভারতের সংবিধানে পরিণত করতে চেয়েছিল, আজ তারা সংবিধানের প্রস্তাবনায় ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য এবং ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা, সাম্য ও সৌভ্রাতৃত্বের অভীষ্ট লক্ষ্যকে তীব্র ভাবে বিরোধিতা করে চলেছে।
গরিব ও নিপীড়িত জনগণকে তাদের উত্থানের জন্য এবং গণতন্ত্র ও সংবিধান রক্ষার জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে দেখে বিজেপি ভয় পেতে থাকুক। বিহারে ২০১৫ সালের জনাদেশ লুন্ঠনকারী বিশ্বাসঘাতকদের, ভারতের অর্থনীতির ধ্বংসকারী এবং যে লকডাউনের ফলে বিহারী জনগণ সীমাহীন যন্ত্রণা ও অবমাননার মুখোমুখি হয়েছেন সেই নিষ্ঠুর ও অমানবিক লকডাউনের স্থপতিদের বিহারের মানুষ শাস্তি দিতে বদ্ধপরিকর। পরিবর্তনের জন্য নির্ধারিত সময় এসে গেছে এবং বিহার এই যুদ্ধে লড়াই ও জয়ের জন্য প্রস্তুত।
- দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, সাধারণ সম্পাদক, সিপিআই(এমএল)
বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নাড্ডা এসেছিলেন বঙ্গ সফরে। দলের উত্তরবঙ্গের কর্মকর্তাদের বৈঠক উপলক্ষে এসে শোনালেন কিছু টোটকা প্রচারের কথা। তাতে রয়েছে একদিকে রাজ্য রাজনীতির সমস্ত মনযোগকে টিএমসি সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র করে তোলার চেষ্টা, যার বাস্তব ভিত্তি আছে অবশ্যই। অন্যদিকে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন মোদী সরকার যা করছে তার সাফাই গাওয়া, আর এরাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় এলে কী করবে তার রঙীন কিছু প্রতিশ্রুতি; যেগুলোর আদৌ কোনো ভিত্তি বাস্তবিকই নেই।
বিজেপি জানে তাকে সবচেয়ে বেশি সম্মুখীন হতে হচ্ছে “বিদ্বেষ-বিভাজনের রাজনীতি”র কারবারী হিসেবে, তার সাম্প্রদায়িক-জাতিবাদী-বর্ণবাদী-পিতৃতান্ত্রিক চিহ্নিত সত্তার কারণে। তাই নাড্ডাজী এবার সেইসব কলঙ্ক খন্ডাতে মরীয়া হয়ে উল্টে ‘বিভেদের রাজনীতি’র দায় চাপাতে চাইলেন যাবতীয় বিরোধী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে। তার জন্য মানুষের ক্ষোভের কারণ হয়ে থাকা আপাত একটা সুবিধাজনক 'অপর' দল খাড়া করা দরকার, সেই উদ্দেশ্যে তার আশু টার্গেটে রাজ্যের শাসক তৃণমূল। নাড্ডার অভিযোগের উপাদানও বড় বিচিত্র! কেন্দ্রের ‘আয়ুস্মান ভারত’ প্রকল্প আর ‘কৃষক সম্মাননা নিধি’ কার্যকরী না করে রাজ্য সরকার নাকি ‘বিভেদ ও বঞ্চনা’র এবং ‘ভাগ কর শাসন কর’ পলিসি নিয়ে চলছে! পক্ষান্তরে রাজ্য সরকার চায় না কেন্দ্রের ‘আয়ুস্মান’ প্রকল্পে জুড়তে। রাজ্যকে আর্থিক দায়ভাগ বহন করতে হবে শতকরা আশি ভাগ, অথচ প্রকল্পের নামকরণে তার স্বীকৃতি নেই, কেবল নাম কিনতে চায় কেন্দ্র, এই ধূূূয়ো তুলেছে রাজ্য। ‘কৃষক সম্মাননা নিধি’ প্রকল্প নিয়েও থাকছে জটরহস্য। এসবের উৎসে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রীয়তাকে কেন্দ্র করে কেন্দ্র-রাজ্যের সংঘাত। মোদী সরকার যুক্তরাষ্ট্রীয়তার সাংবিধানিক ক্ষমতাকে, বিশেষ করে বিরোধীদল ক্ষমতায় থাকা রাজ্যগুলোতে ছলে-বলে-কৌশলে নস্যাৎ করে দিতে সক্রিয়। তবু তোতার মতোই নাড্ডা কার্যত কেবলই যাতনাময় মোদীর ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’-এর ধ্বনি তুললেন। আসলে এই আওয়াজ বিজেপি জমানার সর্বনাশা বিভাজনের রাজনীতিকে আবরণ দেওয়ার প্রয়োজনে কৌশলগত হাতিয়ার। তা প্রতিনিয়ত উন্মোচিতও হয়ে চলেছে। ভারতে ‘ভাগ কর শাসন কর’ পলিসির সূত্রপাত সুদূর অতীতে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের আমলে, ব্রিটিশ শাসকরা চলে গেলেও ভারতের শাসকশ্রেণীগুলো সেই ব্রিটিশ পলিসি উত্তরাধিকারীর মতো ধারণ ও প্রয়োগ করতে দ্বিধা করেনি। শাসনের সংকট থেকে পরিত্রাণ খুঁজতে দমনের বিভিন্ন কঠোর আইন কানুন ব্যবহারের সাথে সাথে কেন্দ্রে এবং রাজ্যে রাজ্যে শাসকরা নানা রূপে ঐ “ভাগ করে মোকাবিলা”র পলিসি চালিয়ে এসেছে। কোনও রঙের সরকার এই অপরাধমুক্ত নয়, মমতা সরকারও নয়। তবে এহেন ঔপনিবেশিক শাসক আচরণের সবচেয়ে নৃশংস পুনরাবৃত্তি করে চলার দায়ে অভিযুক্ত ও অপরাধী প্রমাণ হচ্ছে কেন্দ্র-রাজ্যের বিজেপি সরকারগুলো। সংসদে ও প্রাতিষ্ঠানিক আদালতে না হলেও জনতার বিচারে ও জনআন্দোলনেে। এর কারণ হল তাদের মূল অবস্থানটাই “বিদ্বেষ-বিভাজনের মতাদর্শ ও রাজনীতি”র ভিত্তির ওপর। নাড্ডা বিজেপির পরিচালনার মাহাত্ম প্রচার করতে বিপরীতে কোনও শাসকদলে ‘মা ও ছেলে’র বা কোথাও বা ‘পিসি-ভাইপো’র পরিবারতন্ত্র চলছে বলে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। জানা কথা। কিন্তু তা নিয়ে কথা বলার মতাদর্শগত, রাজনৈতিক, নৈতিক — কোনও ‘শ্রেষ্ঠত্ব’ দাবি করা বিজেপির সাজে না, বরং এই প্রশ্নে খোদ বিজেপি সবচেয়ে কলঙ্কিত, বিজেপির তুলনা কেবলমাত্র বিজেপি। গৈরিক এই দলটি পরিচালিত হয় সবচেয়ে পরিবারতন্ত্রের স্বার্থে, পরিবারতন্ত্রের জন্য, পরিবারতন্ত্রের দ্বারা। বিজেপির মাথার ওপর রয়েছে আরএসএস-সংঘ পরিবার।
নাড্ডা এই হুমকি আরও একবার দিয়ে রাখলেন, সিএএ হবেই। অতিমারী পরিস্থিতি দেখা দেওয়ার কারণে সাময়িক স্থগিত রয়েছে, অবস্থা স্বাভাবিক হলেই আবার তা শুরু হবে। কঠোর বাস্তবতা হল, এই ঘোরতর বিপদটি রয়েই গেছে। একটু মওকা পেলেই বিজেপি এটা অভিযান আকারে চালাতে চাগিয়ে তুলবে। বিপরীতে, এই অভিসন্ধির মোকাবিলা করতে, এই অ্যাজেন্ডা প্রত্যাহারের দাবিতে তাই প্রতিরোধ আন্দোলনের ধারাটিকেও পুনরুজ্জীবিত করে তোলার চ্যালেঞ্জ রাখতে হবে।
নাড্ডা তৃতীয় যে বিষয়টির উল্লেখ করেছেন তা হল বিজেপি এরাজ্যে ক্ষমতায় এলে চাষিদের সব অভাব-অভিযোগ দূর করবেন। আর আজকের প্রকৃত নিষ্ঠুর প্রহসনের বিষয়টি কী! মোদী সরকার সম্প্রতি প্রচণ্ড ক্ষতিকারক একগুচ্ছ আইন তৈরি করেছে, যার ফলে কৃষকের জীবন-জীবিকায়, চাষবাস, ফসলের মূল্য, বেচাকেনা, ঋণ পরিশোধ, বিনিয়োগ, কৃষি জমিরক্ষা, খাদ্যশস্যের সরকারী সংগ্রহ ও মজুতের ভিত্তিতে খাদ্য সরবরাহের নিরাপত্তার চরম বিপর্যয় ঘনিয়ে আসার বিপজ্জনক সম্ভাবনা রয়েছে বিস্তর। তারপরও নাড্ডাদের আব্দার চাষিদের ভালোর জন্য নাকি বিজেপি আছে!
বিজেপির বাংলায় জমি তৈরির স্বার্থবাদী নষ্টামীর নির্দিষ্ট প্রকাশগুলো সম্পর্কে সজাগ-সচেতন হোন, সেগুলোকে চিহ্নিত করুন, সেইমতো মোকাবিলায় এগিয়ে আসুন, এক হোন; এই সংকল্পে সংগ্রাম-সম্প্রীতি-ঐক্য-ব্যাপকতর সংগ্রামী ঐক্য গড়ে এগিয়ে চলাই আজ সবচেয়ে বড় দাবি।
বিহারের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচন কোভিড-১৯ মহামারির ছায়াতেই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এবং নির্বাচনী প্রচার ও জনসমাবেশের ওপর থাকছে বড় ধরনের নিয়ন্ত্রণ। বিহারের ব্যাপক অঞ্চল এখনও বন্যা বিপর্যয়ের কবলে। বিহারই হবে ভারতের প্রথম রাজ্য যেখানে ব্যাপক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে বড় ধরনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতিকে বিবেচনায় নিয়েই নির্বাচনের দিনক্ষণ নির্ধারণের অনুরোধ আমরা ভারতের নির্বাচন কমিশনের কাছে রেখেছিলাম, যাতে জনগণের অংশগ্ৰহণে কোনো ব্যাঘাত না ঘটে। নির্বাচন কমিশন কিন্তু বাঁধা নিয়মের অনুসরণেই নির্বাচনের দিন ঘোষণা করেছে। আমরা জনগণের কাছে আবেদন জানাচ্ছি, কোভিড১৯-এর পরিপ্রেক্ষিতে পালনীয় সতর্কতা ও বিধিনিয়ম মেনে উৎসাহের সঙ্গে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশ নিন।
নীতীশ কুমার সরকার উন্নয়ন ও সুশাসনকেই এখনও তাদের অভীষ্ট লক্ষ্য বলে বড় গলায় ঘোষণা করে চলেছে; কিন্তু এই লক্ষ্যকে গণতন্ত্রের বুনিয়াদি পরিপ্রেক্ষিত থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন করে তোলা হয়েছে, ফলে বহু বিজ্ঞাপিত গালভরা এই কথাগুলো মোদীর ‘অচ্ছে দিন’-এর পরিণতির ধারাতেই শূন্যগর্ভ বুলি বা নির্মম তামাশায় পরিণত হয়েছে। ২০১৫-র নির্বাচন এক অ-বিজেপি সরকারের পক্ষেই প্রবল রায় দিয়েছিল, কিন্তু ক্ষমতার ও তামাম নিয়ন্ত্রণের বিজেপির সীমাহীন লালসা এবং তার সাথে নীতীশ কুমারের নির্লজ্জ রাজনৈতিক সুবিধাবাদ যুক্ত হয়ে ওই রায়কে চূড়ান্ত প্রহসনে পরিণত করে এবং অভূতপূর্বরূপে নির্বাচকমণ্ডলীরও অবমাননা ঘটায়। ক্ষমতা কবজা করার দুরভিসন্ধি দ্বারা চালিত হয়ে বিজেপি এখন এমনকি তার নিজের জোটেই বিভাজন ঘটিয়েছে এবং এলজেপি জোট থেকে বেরিয়ে গিয়ে জেডিইউ-র মোকাবিলা করছে এবং বেশকিছু বিজেপি নেতাও এলজেপি-র পথ ধরেছেন।
নীতীশ কুমারের প্রশাসনিক মডেলে প্রথম থেকেই ছড়ি ঘুরিয়েছে আমলাতন্ত্র, এবং তাতে বিভিন্ন স্তরের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কোনো ভূমিকাই থাকেনি এবং জনগণের নানান অংশের বৈধ দাবি ও আন্দোলনগুলোর প্রতি কোনো সম্মানও দেখানো হয়নি। বছর-বছর ধরে চলা এই আমলাতন্ত্র-কেন্দ্রিক ব্যবস্থা ক্রমেই আরও বেশি স্বেচ্ছাচারী ও অনির্ভরযোগ্য হয়ে দেখা দিয়েছে, বিভিন্ন বিভাগ ও অঞ্চলে চক্রগুলোই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেছে; যে সমস্ত অফিসার নির্দেশ মতো চলেননি, প্রধান্যকারী নেতা ও স্বার্থের প্রতি অনুগত না হওয়ায় তাদের হেনস্থা ঘটানো ও শাস্তি দেওয়া হয়েছে। নীতীশ কুমারের ‘সুশাসন’-এর এই আষাঢ়ে কাহিনী এখন সৃজন-এর মতো দুর্নীতিতে কালিমা লিপ্ত, মুজাফফরপুরের নারী আবাসে ধর্ষণ ও মেয়েদের হত্যা এবং ছাপরা থেকে মাধেপুরা, ঔরগঙ্গাবাদ থেকে জাহানাবাদ পর্যন্ত বিস্তৃত ক্ষেত্রে দাঙ্গার মতো রাষ্ট্র চালিত ভয়াবহ অপরাধগুলোর কলঙ্কে কলঙ্কিত।
যে বিজেপি নীতীশ কুমারকে তাদের মুখ হিসাবে কাজে লাগিয়ে নিজেদের অনুপ্রবেশকে গভীরতর এবং নিয়ন্ত্রণকে ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী করে তুলেছে, তারাই এখন সমস্ত ক্ষমতাকে আত্মসাৎ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। ক্ষমতার সংহতকরণ ও কেন্দ্রীভবন মোদী সরকারের বৈশিষ্ট্য রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। আর যে ক্ষমতা তারা নিজেদের হাতে রাশিকৃত করছে, ভারতের কৃষক ও শ্রমিক এবং সাধারণ জনগণের স্বার্থের বিনিময়ে তার সমস্তটাকেই কাজে লাগানো হচ্ছে আদানি-আম্বানী সাম্রাজ্যের সুবিধার স্বার্থে। নীতীশ কুমার বিহারের বিশেষ মর্যাদা পাওয়ার ব্যাপারে প্রভূত উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেও মোদী সরকার কিন্তু সুপরিকল্পিতভাবে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয়তাকে ধ্বংস করছে। জম্মু ও কাশ্মীরের মতো সংবিধান স্বীকৃত রাজ্যের শুধু বিশেষ মর্যাদাই হরণ করা হয়নি, তার রাজ্যের মর্যাদাটুকুও কেড়ে নিয়ে তাকে দুটো কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে পর্যবসিত করা হয়েছে। সহযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রীয়তার বুলি কিন্তু আর জুলুমবাজি ভিত্তিক কেন্দ্রীভবনের বুলডোজারকে আড়াল করতে পারছে না। নরেন্দ্র মোদী ও নীতীশ কুমারের সরকার দুটোর দিকে তাকিয়ে আমরা “চূড়ান্ত ক্ষমতা চূড়ান্ত রূপে নীতিহীন করে তোলে” প্রবাদটাকে একটু অদলবদল করে নিয়ে বলতে পারি, “চূড়ান্ত ক্ষমতা নিয়ে আসে চূড়ান্ত ঔদ্ধত্য ও চরম আগ্ৰাসন।” যে ‘দু-ইঞ্জিন ওয়ালা’ সরকার বিহারকে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে, তাকে ক্ষমতা থেকে অপসারিত করতে হবে।
বিহার ১৯৭০-এর দশকে গণতন্ত্রের এক গুরুত্বপূর্ণ রণাঙ্গন হয়ে দেখা দিয়েছিল। জয়প্রকাশ নারায়ণের পথপ্রদর্শনে ১৯৭৪র ছাত্র আন্দোলন গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধারে এবং জরুরি অবস্থার অবসানে প্রবল ভূমিকা পালন করেছিল। বিহার আরও একবার ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে সংঘ বাহিনীর সামন্ততান্ত্রিক-সাম্প্রদায়িক আগ্ৰাসনের বিরুদ্ধে সামাজিক ন্যায় ও ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিল। বিহারকে আজ আবার তার সমস্ত শক্তি, উদ্যম ও অঙ্গীকারের সম্মিলন ঘটিয়ে মোদীর ফ্যাসিবাদী বুলডোজারকে রুখে দিতে হবে, সংবিধানকে বাঁচাতে, গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করতে এবং জনগণের জন্য অধিকার অর্জন করতে হবে। বিহারে সিপিআই(এমএল) বিহারি সমাজের সর্বাপেক্ষা নিপীড়িত ও প্রান্তিক অংশের পার্টি হিসাবে উঠে আসে, এবং পাঁচ দশক আগে পথ চলা শুরুর পর থেকে সে সামন্ততান্ত্রিক হিংস্রতা ও রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের মোকাবিলা করে গণতন্ত্র, মর্যাদা ও সামাজিক রূপান্তরণের পতাকাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার পথে অবিচল থেকেছে। বিহার বিধানসভায় সিপিআই(এমএল) বিধায়করা ক্লান্তিহীনভাবে ন্যায় ও জনগণের অধিকারের পক্ষে উদ্যোগ নিয়েছেন। মোদী সরকার তার ফ্যাসিবাদী আগ্ৰাসন অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে এবং সংঘ বাহিনী বিহারের দখল নিয়ে পাশের রাজ্য উত্তরপ্রদেশের মতো তাকে সামন্ততান্ত্রিক-সম্প্রদায়িক-পিতৃতান্ত্রিক হিংসা, ধর্মান্ধতা ও ঘৃণার পরীক্ষাগারে পরিণত করার দুরভিপ্রায় চালাচ্ছ। বিহার ও ভারতের ইতিহাসের এই সংকটময় রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে এর বিরুদ্ধে যে বিস্তৃত ঐক্য আত্মপ্রকাশ করছে, তাকে শক্তিশালী করে তুলতে সিপিআই(এমএল) তার সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করতে অঙ্গীকারবদ্ধ।
অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এবং পরিকাঠামো উন্নয়নের লম্বাচওড়া দাবি সত্ত্বেও বিহার আজও স্থায়ী দারিদ্র্য, নাছোড় অর্থনৈতিক পশ্চাদপদতা এবং জনস্বাস্থ্য ও জনশিক্ষার অতলস্পর্শী দুর্বলতার মধ্যে আটকে রয়েছে। লকডাউন পর্বে বিহারের লক্ষ-লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক ও ছাত্র-ছাত্রীদের যে যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে তা গোটা দুনিয়ার সামনে কর্মহীন বৃদ্ধি এবং ভালো কাজ ও শিক্ষার সুযোগের সন্ধানে শ্রমিক ও ছাত্র-ছাত্রীদের স্থানান্তর গমনের অব্যাহত ধারার বাস্তবতাকে প্রতীয়মান করেছে। বিহারের উন্নয়নের এজেণ্ডাকে কখনই হরেক প্রকল্পের এক জগাখিচুড়িতে পর্যবসিত হতে দেওয়া যাবে না, যার উপরিতলে সামান্য অভিঘাত সৃষ্টির সমর্থ্যও থাকে না এবং যা বড় ধরনের ও লাগাতার কোনো সমস্যার মূল কারণের সমাধান থেকে শতহস্ত দূরে থাকে। উন্নয়নের এজেণ্ডাকে জনগণের ক্ষমতায়ন ও সামাজিক রূপান্তরণের পরিপ্রেক্ষিতেই দৃঢ়ভাবে স্থাপিত করতে হবে এবং ন্যায়, স্বাধীনতা ও সাম্যের সাংবিধানিক অধিকার দ্বারা চালিত হতে হবে। আশা ও পরিবর্তনের এই সম্মুখদর্শী বীক্ষাকে সামনে রেখে সিপিআই(এমএল) ২০২০-র নির্বাচনী ইস্তাহার প্রকাশ করছে, যে ইস্তাহার বিহারের জনগণের পরিস্থিতিকে উন্নত করতে পার্টির স্থায়ী অঙ্গীকারের এক সনদ হয়ে থাকবে।
(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ৬ অক্টোবর ২০২০)
১৮ অক্টোবর পুর্ব বর্ধমান জেলার পুর্বস্থলী ২নং ব্লকের ফলেয়া স্টেশন বাজারে ঋণ মুক্তি কমিটির ডাকে গণ কনভেনশন সংগঠিত হয়। এই গণ কনভেনশনের প্রস্তুতি হিসেবে ৩ হাজার লিফলেট বিলি হয়, ব্লকের ৯টা গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার গ্রামে গ্রামে মাইক নিয়ে প্রচার করা হয়। অনেকগুলো গ্রামে ঋণগ্রস্ত মহিলাদের নিয়ে বৈঠক করা হয়। ঋণ মকুবের দাবিতে পোষ্টার ছাপানো হয়। লিফলেট ও পোষ্টারে যোগাযোগের জন্য ফোন নম্বর দেওয়া হয়। যেহেতু এর আগে বিডিও ডেপুটেশন, থানা ডেপুটেশন ও ব্লকের মাইক্রোফিনান্স সংস্থাগুলোর অফিসে অফিসে বিক্ষোভ ডেপুটেশন সংগঠিত করা হয়েছিল তাই ব্লকের বিভিন্ন এলাকাতেই মাইক্রোফিনান্স সংস্থার এজেন্টদের গরিব ঋণগ্রস্ত মহিলাদের সাথে বচসা কিস্তি আদায়ের জন্য বাদানুবাদ ঘটেই চলছে। এমতাবস্থায় কনভেনশনের প্রচারে গরিব মানুষের, বিশেষ করে মহিলাদের মধ্যে, সাড়া পড়ে। আবার মাইক্রোফিনান্স সংস্থার এজেন্ট ও শাসক পার্টির কর্মী নেতাদের, বিশেষ করে বিজেপি-তৃণমূলের, ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ফলে গ্রামে গ্রামে মহিলারা যাতে এই কনভেনশনে সামিল হতে না পারে সেজন্য বিভিন্ন ধরনের বিভ্রান্তিমুলক প্রচার ও ঘর পাওয়ার টোপ ও বিভিন্ন ধরনের ঋণ অনুদান থেকে বঞ্চিত করার হুমকি দিতে থাকেন তার। এমনকি পারিবারিক ও সামাজিক চাপের মাধ্যমেও মহিলাদের অংশগ্রহণ আটকানোর চেষ্টা করে। তাই প্রচণ্ড আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও অনেকেই আসতে পারেননি। সমস্ত বাধা মোকাবিলা করেই ৫০০-এর অধিক ঋণগ্রস্ত মহিলা বেলা ২টার মধ্যেই কনভেনশনে সামিল হয়েছেন। শতাধিক পুরুষও উপস্থিত ছিলেন। বিশেষ করে নতুন নতুন গ্রাম থেকে ভাল সংখ্যক মহিলাদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। অনেকেই বলছেন তাঁরা মাইকের প্রচার এবং লিফলেট পেয়ে এসেছেন। মহিলারা নিজেদের উদ্যোগেই অটো, টোটো ট্রাক্টর ভাড়া করে কনভেনশনে সামিল হয়েছেন। কনভেনশন শুরু হল বেলা আড়াইটার সময়। আহ্বায়ক শিবু সাঁতরা কনভেনশন শুরু করেন এবং প্রস্তাবনা পাঠ করেন। কনভেনশন পরিচালনা করেন সজল পাল। বক্তব্য রাখেন সলিল দত্ত। তার পর উপস্থিত মহিলাদের মধ্যে থেকে সান্তনা দাস, অলকা দে, আলেমা বিবি, গৌরী মাঝি, মনসুরা বিবি, সায়েরা বিবি, সালেহার বিবি ও আসমানী বিবি বক্তব্য রাখেন। উপস্থিত পুরুষদের মধ্যে থেকে ময়না সেখ বক্তব্য রাখেন। আয়ারলার জেলা সম্পাদক আনসারুল আমন মন্ডল বক্তব্য রাখেন। অশোক চৌধুরীর বক্তব্য ও গানের মধ্যে দিয়ে কনভেনশনের কাজ সমাপ্ত হয়। কনভেনশন থেকে প্রস্তাব নেওয়া হয় –
(১) ঋণের কিস্তি আদায়ের নামে মাইক্রোফিনান্স সংস্থার এজেন্টদের গরিব মহিলাদের অসম্মান অপমান ও হেনস্থা বন্ধ করতে হবে।
(২) আগামী ২ বছর ঋণের কিস্তি আদায় স্থগিত রাখতে হবে। এই সময়ের অতিরিক্ত সুদ নেওয়া চলবে না। এবং নতুন করে ঋণ দিতে হবে।
(৩) স্বনির্ভর গোষ্ঠী ও মাইক্রোফিনান্স সংস্থা সহ গরিবদের সমস্ত ধরনের ঋণের ২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত মকুব করতে হবে।
এই সমস্ত দাবি নিয়ে এলাকায় এলাকায় কনভেনশন প্রচার ও এজেন্টদের হামলার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ সংগঠিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এবং আগামী দিনে আরও বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়।
গত ১৬ অক্টোবর পূর্ব বর্ধমান জেলার মেমারী ১নং ব্লকে সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতির অন্তর্ভুক্ত ঋণ মুক্তি কমিটির ডাকে গণ ডেপুটেশন সংগঠিত করা হল। ব্লকের বিভিন্ন গ্রাম থেকে দেড় শতাধিক ঋণগ্রস্ত মহিলা এই ডেপুটেশনে অংশগ্রহণ করেন। ভাল সংখ্যক পুরুষও উপস্থিত ছিলেন। মেমারী শহরের চেক পোস্ট থেকে ব্যনার প্লাকার্ড হাতে সুসজ্জিত মিছিল শহরের মধ্যে দিয়ে বিডিও অফিসে হাজির হয়। বিডিও অফিসের সামনে বিক্ষোভ সভায় বক্তব্য রাখেন আয়ারলার জেলা সম্পাদক আনসারুল আমন মন্ডল ও রফিকুল ইসলাম।
ডেপুটেশনে প্রতিনিধিদের মধ্যে ছিলেন মুনমুন পাল, ঝুমা রাই, পার্বতী হাজরা, সীমা মাল, বেবী বিবি, রিনা বিবি, মারুফা বিবি, মমতাজ বিবি, রাসদা বিবি ও চাদু দে। ডেপুটেশনে দাবি ছিল –
(১) স্বনির্ভর গোষ্ঠী ও মাইক্রোফিনান্স সহ সমস্ত ধরনের গ্রামীণ গরিবদের ঋণ মকুব করতে হবে।
(২) আগামী ২ বছর ঋণের কিস্তি আদায় স্থগিত রাখতে হবে। এই সময়ের অতিরিক্ত সুদ নেওয়া চলবে না।(৩) কিস্তি আদায়ের নামে এজেন্টদের গরিব মহিলাদের অসম্মান অপমান ও হেনস্থা বন্ধ করতে হবে।
(৪) কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্পে গ্রামের গরিব মেহনতীদের ২০০ দিন কাজ ও ৫০০ টাকা দৈনিক মজুরী দিতে হবে। ব্যক্তিগত জবকার্ড দিতে হবে।
(৫) গ্রামীণ গরিবদের পরিবার পিছু মাসিক ১০ হাজার টাকা লকডাউনের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
(৬) কৃষকবিরোধী কেন্দ্রের ৩টি নয়া কৃষি আইন বাতিল করতে হবে এবং বিদ্যুৎ বিল ২০২০ বাতিল করতে হবে।
২১ অক্টোবর পুর্ব বর্ধমান জেলার জামালপুর ব্লকের আটপাড়া গ্রামে ঋণ মুক্তি কমিটির ডাকে গন কনভেনশন সংগঠিত হয়। বিভিন্ন গ্রাম থেকে দুই শতাধিক মানুষ জমায়েত হন। বেশিরভাগই মহিলা ঋণ গ্রস্ত মানুষ। কনভেনশনের প্রস্তাবনা পাট করেন জয়দেব বাগ। কনভেনশনে বক্তব্য রাখেন অর্চনা মল, মনিকা দাস, রুপালী কিস্যু ও ময়না সাঁতরা। তার পর আয়ারলার জেলা সম্পাদক আনসারুল আমন মন্ডল বক্তব্য রাখেন ও হুগলি থেকে আসা অরুণ বাগ। সভা পরিচালনা করেন আয়ারলার রাজ্য সভাপতি সজল পাল। কনভেনশনে উপস্থিত ছিলেন সলিল দত্ত। কনভেনশনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন — গ্রামে গ্রামে প্রচার অভিযান চালাতে হবে। পুজোর ছুটির পর ব্লকের মাইক্রোফিনান্স সংস্থার অফিস গুলোর সামনে বিক্ষোভ ডেপুটেশন সংগঠিত করা হবে। এজেন্টদের হামলার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ সংগঠিত করার ব্যবস্থা করতে হবে। ঋণ মকুবের দাবিতে আন্দোলন জোরদার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল।
সমস্ত গরিব মানুষের ঋণমুক্তি এবং এজেন্টদের জুলুমবাজির বিরুদ্ধে, এলাকার শাসকদলের চাপ ও চক্রান্তকে নাকচ করে বাগনানের দেবলীনা হলে সংগঠিত হলো ঋণমুক্তি কমিটির হাওড়া জেলা কমভেশন। প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আয়ারলা রাজ্য সম্পাদক এবং ঋণমুক্তি কমিটির আহ্বায়ক সজল অধিকারী। এছাড়াও বক্তব্য রাখেন সজল দে, দেবাশীষ মুখার্জী, দিলীপ দে, নীলাশিস বসু, দেবব্রত ভক্ত, কাকলী ঘোষাল, আনোয়ারা বেগম, গীতা মান্না, আরবিনা বেগম, হাফেজা বেগম। ৩০০ জনের ওপর ঋণগ্রহিতা কনভেনশনে সামিল হন। কনভেনশন থেকে ১৮ জনের কমিটি গঠিত হয়। জেলা আহ্বায়ক হন কল্যাণী গোস্বামী এবং নবীন সামন্ত। আগামী দিনে সমস্ত ব্যাঙ্কগুলোর শাখা অফিস এবং স্থানীয় থানা ঘেরাও ও আগামীদিনে জেলা শাসকের দপ্তর অভিযানের সিদ্ধান্ত হয়।
অপরিকল্পিত লকডাউনের ফলে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত ঋণগ্রস্ত শ্রমজীবী জনতাকে নিয়ে গড়ে উঠেছে ঋণমুক্তি কমিটি। বজবজে ঋণমুক্তি কমিটির কনভেনশন অনুষ্ঠিত হল। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। বক্তব্য রাখেন মহিলা সমিতির পক্ষে কাজল দত্ত, দেবযানী গোস্বামী, অঞ্জনা মাল, অর্চনা দাস, লতিকা রায়, মমতাজ বেগম। উপস্থিত ছিলেন আয়ারালা জেলা নেতা ইন্দ্রজিৎ দত্ত, সারাভারত কিষাণ মহাসভার জেলা সম্পাদক দিলীপ পাল। ঋণমকুবের দাবিকে শক্তিশালী করতে আগামীদিনে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের অঙ্গীকার নিয়ে কনভেনশন শেষ হয়।
গত ১৮ অক্টোবর হুগলি জেলার পান্ডুয়া ব্লকের বৈঁচিতে সিপিআই(এমএল)-এর পক্ষ থেকে হাথরাস ঘটনার প্রতিবাদে গণ কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়।
কনভেনশনের প্রস্তাবনায় বিজেপির নারীবিদ্বেষী, দলিত বিরোধী বর্ণবাদী ঘৃণার রাজনীতিকে রুখে দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়, সাম্প্রতিক সময়ে বিজেপির বিভিন্ন জনবিরোধী ফ্যাসিস্ট পদক্ষেপ এবং হাথরাস ঘটনায় সামনে আসা বিজেপির হিংস্র নগ্নতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়। প্রস্তাবনাকে সমর্থন করে বক্তব্য রাখেন ঊজ্বল ঘোষ (ডিওয়াইএফ-এর বৈঁচি এরিয়া কমিটির নেতা), সমুদ্রগুপ্ত নন্দী (এসএফআই-এর পান্ডুয়া ব্লকের প্রাক্তন নেতা), সুমনা সাহানি (স্কুল ছাত্রী)। অঞ্চলের বিশিষ্ট আবৃত্তি শিল্পী দীপনিকা সাহা কনভেনশনের বিষয়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ দুটি কবিতা আবৃত্তি করেন। প্রগতিশীল মহিলা সমিতির জেলা নেত্রী সরস্বতী বেসরার সাবলীল বক্তব্য শ্রোতাদের আলোড়িত করে। বক্তব্য রাখেন স্বরস্বতী তুড়ি, শিপ্রা চ্যাটার্জি, নিরঞ্জন বাগ, শুভাশিস চ্যাটার্জি প্রমুখ। কনভেনশনের শুরুতে মণীষা বাল্মীকির স্মরণে স্মৃতি স্তম্ভে পুষ্প অর্পণ ও নীরবতা পালিত হয়।
আগামী ২৬ নভেম্বর এআইসিসিটিইউ সহ কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির আহ্বানে সারা ভারত সাধারণ ধর্মঘটের সমর্থনে ১৬ অক্টোবর শিলিগুড়ি কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়ামে এক কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। এই কনভেনশনে এআইসিসিটিইউ, সিটু, আইএনটিইউসি, এআইটিইউসি, ইউটিইউসি, এআইইউটিইউসি, টিইউসিসি, ১২ জুলাই কমিটি অংশগ্রহণ করে। সব ইউনিয়নগুলির প্রতিনিধি নিয়ে সভাপতিমন্ডলী গঠন হয়। সভাপতিমন্ডলীর পক্ষ থেকে অভিজিৎ মজুমদার সভা পরিচালনা করেন। সভায় বক্তব্য রাখেন এআইসিসিটিইউ’র রাজ্য সাধারণ সম্পাদক বাসুদেব বসু, সিটু’র রাজ্য সম্পাদক অনাদি সাহু, আইএনটিইউসি-র জেলা সভাপতি অলোক চক্রবর্তী এআইটিইউসি-র পক্ষে শ্যাম সুন্দর দাস, এআইইউটিইউসি-র পক্ষে অভিজিৎ রায়, ইউটিইউসি-র পক্ষে বিকাশ সেন রায়, টিইউসিসি-র পক্ষে অমরেশ গোস্বামী ও ১২ জুলাই কমিটির পক্ষে নন্দা সেন প্রমুখ। সভার সমাপ্তি ভাষন দেন সিটু’র জেলা সম্পাদক সমন পাঠক।
১৬ অক্টোবর রানিবাঁধ বিধানসভার অন্তর্গত হিড়বাঁধ ব্লকে, কৃষক ও কৃষি-মজুরদের সংগঠিত করে কৃষক বিরোধী কৃষি অধ্যাদেশগুলি বাতিলের দাবি সহ মেহনতি আদিবাসী জনসমাজের একাধিক বুনিয়াদি দাবি নিয়ে ব্লক ডেপুটেশন সংঘটিত করে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন। একটি বিক্ষোভ মিছিল করে ব্লক অফিসের সামনে জমায়েত করা হয়, পরে ৫ জনের প্রতিনিধি দল ডেপুটেশন জমা দেন এবং আধিকারিকদের কাছে স্থানীয় সমস্যাগুলি মেটানোর আশ্বাস পাওয়ার পর নভেম্বর মাসের প্রথমেই পুনরায় যোগযোগ করে আলোচনা ও সমাধানের কথা ঠিক হয়। আদিবাসী ও বনবাসীদের পরোক্ষভাবে বনদপ্তর কর্তৃক উচ্ছেদের পরিবর্তে প্রত্যেককে পর্চা সহ পাট্টা প্রদানের প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু করার দাবি জাননো হয়। এছাড়া বার্দ্ধক্য ভাতা, কৃষকবন্ধু, কিসান ক্রেডিট প্রকল্প, সাসফাউ-এর টাকা পাওয়ার জটিলতা এক্ষুণি দূর করে জনগণকে বঞ্চিত করা বন্ধ করতে বলা হয়। রেশনে চাল ব্যক্তি পিছু ১৫ কেজি করার কথা বলা হয় খাদ্য সুরক্ষার স্বার্থে। সর্বোপরি বেশি থেকে বেশি সংখ্যক ক্যাম্প করে নুন্যতম সহায়ক মূল্য অনুযায়ী ফসল ক্রয় করার দাবি ও জব কার্ডে ২০০ দিন কাজ ও মজুরি বৃদ্ধির দাবি তোলা হয়। বেশি মাত্রাতে ক্যাম্প (ফসল কেনার) করার বিষয়ে এবং সরকারী প্রকল্প গুলি থেকে বঞ্ছিত হওয়া নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে পার্টি নেতৃত্বের সাথে ব্লক অফিসের যোগাযোগ নিয়মিত করার আশ্বাস পাওয়া যায়। এইদিন ডেপুটেশনে উপস্থিত ছিলেন জেলা কমিটির সুধীর মুর্ম্মু, অমল, ফারহান, ছাত্র নেতা মঙ্গল মুর্ম্মু, প্রান্তিক, সুশান্ত ধীবর ও পার্টির জেলা সম্পাদক বাবলু ব্যানার্জী।
সম্প্রতি (১৭ অক্টোবর) ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) প্রবাসে গঠিত (তাসখন্দে) ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ১০০তম প্রতিষ্ঠা দিবস পালনের দিনে পার্টির রাজ্য কমিটির সংক্ষিপ্ত বৈঠকও সেরে নিয়েছে। কাকতালীয়ভাবে দিনটি বহু বিতর্কের সঙ্গে যুক্ত। তাসখন্দে গঠিত পার্টির প্রতিষ্ঠাকে প্রতিষ্ঠা দিবস হিসেবে স্বীকার করা কতটা যুক্তিযুক্ত তা নিয়েও বিতর্ক আছে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (অবিভক্ত) কেন্দ্রীয় সম্পাদকমন্ডলী ১৯৫৯ সালের ১৯ আগস্ট বহু আলোচনার পর ১৯২৫ সালের ২৬ ডিসেম্বর কানপুর সম্মেলনের দিনটিকেই প্রতিষ্ঠা দিবস হিসেবে প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল। এই প্রস্তাবের বিপক্ষে কেউ মতপ্রকাশ করেছিল বলে জানা নেই। এমনকি কানপুর সম্মেলনে উপস্থিত কোনো প্রতিনিধিও তাসখন্দ পার্টির প্রসঙ্গ তোলেননি। অন্তত মিনিটসএ তার কোনো উল্লেখ নেই। ফলে কেউ ১৯২৫ সালের পরিবর্তে ১৯২০ সালকে প্রতিষ্ঠা বছর হিসাবে গ্রহণ করতেই পারেন, কিন্তু বিতর্ক পিছু ছাড়বে না। তবে এই সংক্ষিপ্ত ধারাভাষ্য এই প্রসঙ্গে নয়। তা অন্যসময় করা যাবে।
সিপিআই(এম)-এর রাজ্য কমিটির সংক্ষিপ্ত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এই বৈঠকের যে নির্যাস সংবাদ মাধ্যমে এসেছে, তা বাম মহলে যথেষ্ট বিতর্কের জন্ম দিতে বাধ্য। ১৮ অক্টোবরের প্রভাতী আনন্দবাজার রাজ্য নেতৃত্বকে উদ্ধৃত করে জানাচ্ছে, “বিজেপি না তৃণমূল-কে বড় শত্রু, এই বিতর্কে কালক্ষেপও নিস্প্রয়োজন” (বিতর্ক নয়, আসনের তালিকা চান সূর্যেরা)। কমিউনিস্ট আন্দোলনে কে বড় শত্রু বা প্রধান শত্রু কে তা নিয়ে বিতর্ক কবে থেকে অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেল? সময় লাগলেও এই প্রধান শত্রু চিহ্নিত করার উপরই তো পরবর্তী কর্মকৌশল ও পদক্ষেপগুলি নির্ভর করে থাকে। এই যে মার্কসবাদী নেতৃবৃন্দ লাগাতার বলেন, নির্দিষ্ট অবস্থার নির্দিষ্ট বিশ্লেষণ (concrete analysis of the concrete situation) করতে হবে, তার কি হবে? একটি নির্দিষ্ট অবস্থায় একাধিক বড়/প্রধান শত্রু থাকে? বিতর্ক কি এতে বন্ধ করা যাবে? যেহেতু আবাপ পার্টি মুখপত্র নয়, মার্কসবাদী পত্রিকাও নয়, তাই প্রকৃত সংবাদের খোঁজে গণশক্তির শরণাপন্ন হতে হলো। ১৮ অক্টোবরের গণশক্তি লিখছে, “রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সিপিএমের স্পষ্ট অবস্থান তৃণমূল হটাও, বিজেপি-কে ঠেকাও। তার জন্য বিকল্প সরকার চাই”। এই উদ্ধৃতিটুকু সিপিএম কাকে বড়/প্রধান শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করছে, তা বুঝতে কারো অসুবিধা হবার কথা নয়। কর্মপন্থাও সেই অনুযায়ী ঠিক করে ফেলেছে। “জনগণের সামনে বিকল্প কর্মসূচি হাজির করে বাম গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ বিকল্প গড়ে তোলা হবে”। আরও একটা ছোট তথ্যও জানানো হয়েছে। সূর্য মিশ্র জানাচ্ছেন, “বামফ্রন্টের বাইরের কিছু বাম দল, যাদের সঙ্গে আন্দোলনের ঐক্য গড়ে উঠেছে তাদেরও কিছু আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেওয়া হবে” (ভাষার ঔদ্ধত্য ক্ষমা করে নেবেন)। তাহলে দাঁড়ালো কী? আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে প্রধান শত্রু তৃণমূল কংগ্রেসকে পরাস্ত করে বিকল্প সরকার গঠন করা। এবং তার জন্য কংগ্রেস ও বাম সহযোগী দলগুলির একটি বিকল্প কর্মসূচির ভিত্তিতে জনগণকে বিকল্প সরকার উপহার।
আজকাল সিপিএম নেতৃত্ব বহুদলীয় বৈঠকে বা ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় ২০১৬ সালে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করতে গিয়ে যে বিরাট ভুল হয়েছে, তা স্বীকার করছেন। এবার যেন তা না হয়, তার জন্য সতর্ক বার্তা জারি করেছেন। “পাঁচ বছর আগের বিধানসভা ভোটের মতো এবার আর কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতা ঘিরে ‘বিভ্রান্তি ও বিতর্কের’ পুনরাবৃত্তি চায় না সিপিএম। আসন ভাগাভাগি যেভাবে হবে নির্দিষ্টভাবে সেই সমঝোতাই মেনে চলার স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হল রাজ্য কমিটির বৈঠকে”।
এবার একটু ধীরে ধীরে এগুনো যাক। যতদূর জানা আছে, এখনও ফ্রন্টের বাইরের কোনো দলের সঙ্গে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের কর্মনীতি কর্মকৌশল নিয়ে সিপিএমের কোনো বিস্তারিত কথাবার্তা হয়নি। এমনকি তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী কংগ্রেসের সঙ্গেও কোন কথা হয়নি। সে যাই হোক, দিন কয়েক আগে ১৬ দলের বৈঠকের যে সংবাদ পেয়েছি, সেখানে রাজ্যে কার বিরুদ্ধে প্রচারের বর্শামুখ থাকবে তা নিয়ে যথেষ্ট জোরালো বিতর্ক হয়। নির্বাচনী লড়াই হোক আর দৈনন্দিন রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক লড়াই হোক গোটা দেশ যেখানে ফ্যাসিস্ট বিজেপি এবং আরএসএস ও তার শাখা প্রশাখার বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াই চালাচ্ছে, সেখানে তাকে প্রতিহত করা, প্রতিরোধ করা, পরাস্ত করা এই নির্দিষ্ট সময়ে এরাজ্যে প্রধান কাজ হবে না কেন? একটি ফ্যাসিস্ট, সাম্প্রদায়িক, দেশবিরোধী, কর্পোরেট দালাল দল এবং একটি আঞ্চলিক ক্ষমতাসীন দুর্নীতিগ্রস্ত, স্বৈরাচারী এবং স্বেচ্ছাচারী দলকে একাসনে বসানো হবে কোন যুক্তিতে? একটি বিকল্প কর্মসূচীর ভিত্তিতে আসন সমঝোতা হবে, সেটাই বা ঠিক হলো কোথায়? যতদূর খবর পাওয়া গেছে, কংগ্রেস বলে বেড়াচ্ছে ৬০:৪০ ভিত্তিতে আসন বোঝাপড়া করা যেতে পারে। ২০১৬-র পর ২০১৯ লোকসভা নির্বাচন গেছে। শুনেছি, ১৬ দলের বৈঠকে কোনো কোনো সংগঠন প্রশ্ন তুলেছে, লোকসভা নির্বাচনে বামফ্রন্টের প্রায় ২২-২৩ শতাংশ ভোট বিজেপির দিকে চলে গেছে কোন রাজনৈতিক কারণে? তা কি তৃণমূল কংগ্রেসকে উচিত শিক্ষা দেবার জন্য? এ ব্যাপারে সিপিএম নেতৃত্বের ব্যাখ্যা কী? ২০১৬ সালের ভুল নিয়ে কথা বার্তা হচ্ছে, ভালো। কিন্তু ২০১৯ থেকে কি কোনো শিক্ষা নেবার নেই? একটা নীতিনিষ্ঠ বাম গণতান্ত্রিক বিকল্প পশ্চিমবঙ্গে গড়ে উঠুক এটা সময়ের দাবি, শ্রমজীবী, মধ্যবিত্ত, বামপন্থী গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, দেশপ্রেমিক মানুষের দাবি।
একটা কথা সিপিএম নেতারা হামেশা প্রচার করেন, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির উত্থান হচ্ছে তৃণমূলের জন্য। কথাটা একদম মিথ্যা মোটেই তা নয়। কিন্তু একই কথা কি ত্রিপুরার সিপিএমের জন্যও সত্য? আর একটু বড় পরিধিতে দেখলে দেশজুড়ে বিজেপির উত্থানের জন্য কি জাতীয় কংগ্রেসের নীতি পদক্ষেপ অপশাসন ইত্যাদি দায়ী নয়? সে কথাই তো জর্জ ডিমিট্রভ বলেছেন, পূর্বতন সরকারগুলির সমস্ত জনবিরোধী নীতি ও পদক্ষেপকে যু্ক্তি হিসাবে কাজে লাগায় ফ্যাসিবাদ। কেউ কেউ বলেন, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের উত্থানের জন্য দায়ী সিপিএম ও বামফ্রন্ট সরকার। ওরা যদি সিঙ্গুর নন্দীগ্রামে জোর করে কৃষকের জমি দখল করতে না যেত, তাহলে তৃণমূল কংগ্রেস এত সহজে রাজ্যে ক্ষমতায় আসতো কিনা সন্দেহ আছে। আসলে এইভাবে দেখার মধ্যে সরলীকরণের একটা বিপদ থেকে যেতে পারে। একটা ফ্যাসিস্ট শক্তি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বহুবিধ কারণকে কাজে লাগিয়ে তার উত্থানের জমি তৈরি করে। শোনা যায়, ১৬ দলের সর্বশেষ বৈঠকে এসব নিয়েও মত বিনিময় ও কথাবার্তা হয়েছে। এমনকি এ প্রশ্নও উঠেছে যে জাতীয় স্তরের বিভিন্ন বৈঠকে সোনিয়া গান্ধী ও মমতা ব্যানার্জিকে পালা করে সভার কাজ পরিচালনা করতে দেখা গেছে। এর কী ব্যাখ্যা আছে? সিপিএম ও বামফ্রন্টের দলগুলি কি এই উদ্যোগের বিরোধী? কোন গ্রহণযোগ্য উত্তর এখনো মেলেনি। এই কথাগুলো বলার অর্থ মোটেও এটা নয় যে এ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের সাথে নির্বাচনী আসন সমঝোতা করতে হবে। যদিও ১৬ দলের মধ্যেকার একটি সংগঠন তৃণমূলের সঙ্গে আসন সমঝোতার জন্য প্রেস বিবৃতি জারি করেছে! আবার এসইউসিআই(সি) এখনো তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেনি। কিন্তু ইতিমধ্যেই দেখা গেল গত নির্বাচনের প্রাক্কালে হঠাৎ তৃণমূল থেকে দলবদল করে আসা বসিরহাটের সিপিএমের নির্বাচিত বিধায়ক আবার দলবদল করে পূর্বতন দল তৃণমূল কংগ্রেসে ফিরে গেছে! ক্ষমতা দখলের জন্য মরীয়া বিজেপিও নির্বাচনের আগে এমনকি নির্বাচনের পরেও দল ভাঙানো, বিধায়ক কেনাবেচার নোংরা রাজনীতিকে এরাজ্যে আরো গতি দেবে। সেই আবহাওয়া ও পরিবেশ গড়ে তুলতেই রাজ্যপালকে নিয়মিত রাজনৈতিক আসরে নামানো, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নাড্ডার রাষ্ট্রপতি শাসন জারির হুমকি শোনা যাচ্ছে।
এরাজ্যে বিজেপির আরও ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠা বা ক্ষমতা দখল নিছক আর একটা রাজ্য সরকারে আসা নয়। বাম গণতান্ত্রিক লড়াই সংগ্রামের যে দীর্ঘ ঐতিহ্য এরাজ্যে গড়ে উঠেছে, তাকে এক লহমায় মুছে দিয়ে বাংলা বিভাজনের দুঃখজনক স্মৃতিকে আবার জাগিয়ে তুলবে। ফ্যাসিস্ট রাজনীতির এক পাকাপোক্ত পরীক্ষাগার হয়ে উঠবে এই বাংলা। সিএএ, এনপিআর, এনআরসি’র কথাবার্তা তাই আবার হাওয়ায় ভাসছে। বিভাজনের রাজনীতিও তার সমস্ত শাখা প্রশাখা বিস্তার করতে শুরু করেছে। সাম্প্রতিক কালে এরাজ্যে এনআইএ’র অতি তৎপরতা ঐ বিভাজনের রাজনীতিকে রাষ্ট্রীয় সিলমোহর দেবার সঙ্গে জড়িত।
এরকম এক সঙ্কট মুহুর্তে বামপন্থীরা নিজেদের মধ্যে আরও মতামত আদান প্রদান করুক, প্রয়োজনে তীব্র বিতর্ক হোক। বামপন্থার স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে, সর্বোপরি ফ্যাসিস্ট অগ্রগতি প্রতিরোধে, স্বৈরাচারের হাত থেকে বাংলার গণতন্ত্র, জনগণের জীবন জীবিকা ও অধিকার রক্ষার স্বার্থে। কঠিন কাজ, কোনো চটজলদি উত্তর নেই। পাশের রাজ্য বিহারের শ্রমজীবী জনগণ ও বামপন্থী শক্তি এক মহাজোটে সামিল হয়ে এই লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বাংলাকে আবার পথ দেখাতে হবে। শুধু বাংলার নয়, দেশের শ্রমজীবী জনগণ এই দিকে তাকিয়ে আছেন। বিতর্ক চলুক, লড়াই সংগ্রামের ঢেউ ওঠুক। ১৬ দলের নেতৃবৃন্দ নিশ্চয়ই এসব নিয়ে ভাবছেন। নিছক আসনের বাটোয়ারা নয়, রাজনীতির দৃঢ় বন্ধন গড়ে উঠুক পর্যবেক্ষক সেদিকেই তাকিয়ে থাকবে।
- পর্যবেক্ষক
ফ্রান্সের আতঙ্কজনক হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা ধ্বনিত হয়েছে সমস্ত মহল থেকে। সম্প্রদায়ের বিশ্বাসকে রক্ষা করার নামে এই ধরনের উন্মত্ত হিংস্রতা বাস্তবে বিপন্ন মানুষের পরিচিতির আবেগকে ব্যবহার করে শোষণ কায়েম রাখার হাতিয়ার। এই ধরণের অন্ধভক্তির পশ্চাদপদতা চূর্ণ করতে কাবার মূর্তিগুলি ভেঙে ছিলেন নবী মহম্মদ। ফরাসি মুসলমান সম্প্রদায়ের নেতারা এই হত্যাকে ধিক্কার জানিয়েছেন। গ্রাণ্ড প্যারিস মসজিদের হাফিজ সেমসএদ্দিন টুইট বার্তায় বলেন, “আমি আতঙ্কিত। আমি আরও আতঙ্কিত এই কারণে যে হামলাটি করা হয়েছে আমার ধর্ম ইসলামের নামে। এ মানা যায় না”।
ফ্রান্সের সাধারণ মানুষের লড়াইয়ের ওপর এই হত্যাকাণ্ড এক প্রবল আঘাত। দু’দিন অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই ফ্রান্সের প্রায় সমগ্র রাজনৈতিক মহল এককাট্টা হয়ে ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ সরকারের প্রস্তাবিত প্রকট মুসলমান-বিরোধী আইনটিকে আরও কঠোর করার পক্ষে “জাতীয় ঐক্য” গড়ে তোলার অভিযানে সামিল হয়ে পড়েছে। আর, মুসলমান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারে দুনিয়ার গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যম অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে।
প্যারিসের উপকণ্ঠে এক মিডিল স্কুলের ৪৭ বছর বয়সী ভূগোল শিক্ষক স্যামুয়েল প্যাটি স্কুল শেষে ফেরার পথে এক ১৮ বছর বয়সী যুবকের দ্বারা আক্রান্ত ও নিহত হন। প্রায় দুই ফিট লম্বা একটি ছুড়ি দিয়ে তাঁকে আঘাত করা হয় এবং শেষে শিরশ্ছেদ করা হয়। পুলিশ এসে পৌঁছনোর পর, পুলিশের বয়ান অনুযায়ী, হামলাকারী যুবকটি “আল্লাহু আকবর” ধ্বনি দেয় এবং সেখানেই পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। জানা যায় যে যুবকের নাম আব্দৌল্লাখ আন্তসনভ। চেচনিয়া থেকে ১২ বছর আগে ফ্রান্সে শরণার্থি হয়ে আসে তার পরিবার, সদ্য সে ফ্রান্সের নাগরিকত্ব পেয়েছে। ঘটনার দিন সে তার বাড়ি থেকে ৮০ কিলোমিটার জার্নি করে ওই স্কুলে আসে, কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করে, ছুটির পর ছাত্রছাত্রীদের কাছে জিজ্ঞাসা করে চিনে নেয় স্যামুয়েল প্যাটিকে, প্রায় আধা কিলোমিটার ফলো করে এবং তারপর রাস্তার ওপর এই নৃশংস হত্যাটি সংঘটিত করে।
ফরাসি রাষ্ট্র পরিচালিত জাতিবিদ্বেষমূলক সন্ত্রাসের আবহের মধ্যেই শিক্ষকের মুণ্ডচ্ছেদের নারকীয় ঘটনাটি ঘটেছে এবং কদর্য এই হত্যাকাণ্ডের আতঙ্কজনক ঘটনাকে কাজে লাগিয়ে ফ্রান্সের সরকার তাদের মুসলমান বিরোধী অভিযান জোরালো করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ঘটনা প্রকাশ্যে আসতে না আসতেই প্রধানমন্ত্রী ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ একে “ইসলামিস্ট অ্যাটাক” বলে অভিহিত করেন এবং তাঁর সরকার ইসলামী ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’ দমন করতে ইতিমধ্যেই যে আইনটি প্রণয়ন করার প্রস্তাব এনেছে তার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে এই ঘটনাটির দিকে তাকাতে বলেন। ইসলামী ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’ বিরোধী প্রস্তাবিত আইনটি আগামী ৯ ডিসেম্বর ফ্রান্সের পার্লামেন্টে পেশ করতে চলেছে ম্যাক্রোঁ সরকার, এবং এখন তাকে আরও কঠোর চেহারা দেওয়া হবে।
নতুন এই আইনটি ফরাসি রাষ্ট্রের মুসলমান-বিদ্বেষী চরিত্রকে খোলাখুলি আইনি প্রতিষ্ঠা দিতে চায়। যে সমস্ত দেশ দখল করে ফ্রান্স উপনিবেশ গড়েছিল তার সবই ছিল মুসলমান জনাধিক্যের দেশ, ফ্রান্সের মুসলমানদের সিংহভাগই ফ্রান্সের পূর্বতন উপনিবেশগুলির জনগোষ্ঠি। ইউরোপের বাকি অংশের তুলনায় ফ্রান্সের মুসলমান-বিরোধী আধুনিক রেসিজমের রূপটিও তাই বিশিষ্ট ও গভীর। উপনিবেশের একদা প্রজা এইসব মানুষের বিরুদ্ধে ফরাসি অভিজাতদের ঘৃণা প্রায়শই খোলাখুলি চেহারা নেয় এবং অতি সম্প্রতি তাদের এই বিদ্বেষ খোলাখুলি প্রকাশ করাটা প্রায় গর্বের বিষয় হয়ে উঠেছে। ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে স্বীকার করে রেসিজমের এই ফাঁদ থেকে ফ্রান্সকে মুক্ত করার বদলে একের পর এক শাসকেরা ক্রমাগত আরও বেশি বেশি এই পঙ্কিল আবর্তে ফ্রান্সকে নিমজ্জিত করেছে। ম্যাক্রোঁ সরকারের নতুন আইনটি ফরাসি মুসলমানদের ওপর ‘বিদেশী প্রভাব’ দূর করার লক্ষ্যে আনা হচ্ছে বলে ঘোষণা। আইনটি ফ্রান্সের মসজিদগুলির তহবিলের ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা, ইমামদের জন্য সরকারী সার্টিফিকেশন প্রোগ্রাম চালু করা, ফরাসি মুসলমানদের বিভিন্ন রকম ধর্মীয় সংস্থা দ্বারা পরিচালিত স্কুলগুলিকে নিষিদ্ধ করা এবং ‘রিপাব্লিকান মূল্যবোধের পরিপন্থী’ এমন সমস্ত সংস্থাকে ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা দেবে রাষ্ট্রকে। এটুকু ইতিমধ্যেই ঘোষিত, বর্তমান ঘটনার সুযোগে তাতে আরও কঠোর ধারা যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা।
‘রিপাব্লিকান’ মূল্যবোধ তথা ‘ফ্রি স্পিচ’-এর নামে জাতিবিদ্বেষকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার প্রক্রিয়া ফ্রান্সে বেশ কয়েক বছর ধরেই চলছে। ২০০৪ সালে সরকারী স্কুলে ধর্মীয় চিহ্ন ধারণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। আপাত দৃষ্টিতে এই নিষেধাজ্ঞা ইহুদি, ক্যাথলিক ও ইসলাম – এই তিন ধর্মের জন্যই প্রযোজ্য মনে হলেও বাস্তবে তা ছিল মুসলমান মেয়েদের পরিধানের ইসলামি ঘোমটা বা মস্তকাবরণের ওপর নিষেধাজ্ঞা। ফরাসি ইহুদি সম্প্রদায়ের অধিকাংশ ছেলেমেয়েরা কিন্ডারগার্টেন থেকে শুরু করে মিডিল স্কুল পর্যন্ত ইহুদিদের নিজস্ব স্কুলগুলিতেই পড়ে। এই স্কুলগুলি, সরকারী এফিলিয়েটেড হোক বা না হোক, ধর্মীয় ব্যাপারে স্বায়ত্ততা ভোগ করে, কারণ ইহুদিদের ধর্মাচরণের স্বাধীনতা ফ্রান্সে আইন দ্বারা সুরক্ষিত। সত্তর পঁচাত্তর বছর আগে হিটলারের নেতৃত্বে ইহুদি নিধন যজ্ঞে ফ্রান্সও সামিল হয়ে পড়েছিল এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিণতি তথা ন্যুরেনবার্গ ট্রায়ালের ফলশ্রুতিতে ইহুদিদের সাম্প্রদায়িক সুরক্ষার এই আইন চালু হয়। ফলত ফ্রান্সের স্কুলে ধর্মীয় চিহ্ন ধারণের ওপর নিষেধাজ্ঞা তাদের ওপর বর্তায়নি। ধার্মিক ক্যাথলিক খ্রীষ্টান পরিবারের ছেলেমেয়েরাও মূলত প্রাইভেট স্কুলেই পড়াশোনা করে। ফলত এই আইন তাদের ওপরও বর্তায়নি। আঘাতটা নেমেছে কেবল ফরাসি মুসলমানদের ওপর। অল্প কিছু মুসলমান পরিবার, যাদের আর্থিক ক্ষমতায় কুলিয়েছে, তাঁরা ছেলেমেয়েদের ক্যাথলিক প্রাইভেট স্কুলে পাঠিয়েছেন, বাকিরা মস্তকাবরণ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। একইভাবে ২০১০ সালে প্রকাশ্যে বোরখা পরা নিষিদ্ধ হয়। এখন সরাসরিভাবে ফরাসি মুসলমানদের বিরুদ্ধে নতুন আইনটি আসছে। আইন বলবত হওয়ার আগেই অবশ্য ক্র্যাকডাউন নেমেছে। প্যারিসের শিক্ষক হত্যার জঘন্য ঘটনাটির চারদিন আগে (১৩ অক্টোবর) ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেরাল্ড ডারমানিন তাঁর টুইট বার্তায় জানান যে ফ্রান্সের সরকার গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে অভিযান চালিয়ে ৭৩টি মসজিদ ও ইসলামি স্কুল বন্ধ করে দিয়েছে ‘রাডিকাল ইসলাম’ দমনের লক্ষ্যে, যদিও ‘রাডিকাল ইসলাম’ কী তার ব্যাখ্যা এবং তার সাথে ওই সংস্থাগুলির যোগাযোগের কোনও তদন্ত বা প্রমাণ সামনে আসেনি। এই অভিযানের বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদ করেছেন তাঁদের ওপর তীব্র পুলিশী নিপীড়ন নেমেছে। বস্তুত ফ্রি-স্পিচের নৈতিক পাহারাদার হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে চাওয়া ম্যাক্রোঁ সরকার সমস্ত ধরণের প্রতিবাদের ওপর পুলিশি নিপীড়ন নামানোর জন্য বিশেষ পরিচিত। মধ্যপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে যুক্ত তার সরকার, হাজার হাজার মানুষকে আশ্রয়ের সন্ধানে নৌকোয় তুলে ভূমধ্যসাগরে ডুবিয়ে মারার কাজে লিপ্ত ছিল। ইয়েমেনে সৌদি আরবের নৃশংস হামলাকে মদদ দিতে ফ্রান্সের বেআইনি অস্ত্র সরবরাহের খবর ফাঁস করে দিয়েছিল যে সাংবাদিকেরা তাঁদের পরিচয় প্রকাশ্যে আনতে বাধ্য করেছিল ফ্রি-স্পিচের হোতা হতে চাওয়া এই ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সরকার। এখন ‘ইসলামি বিচ্ছিন্নতাবাদ’ মোকাবিলা করার নামে ফরাসি মুসলমান জনসমূদায়কে সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন করাকে আইনসিদ্ধ করতে চাইছে। এবং এই লক্ষ্য পূরণে “জাতীয় ঐক্য” গড়ে তোলার হাতিয়ার বানাচ্ছে শিক্ষক হত্যার ঘটনাটিকে।
প্রশ্ন উঠেছে হত্যাকাণ্ডটি আটকাতে ফরাসি পুলিশ-প্রশাসনের ব্যর্থতা সম্পর্কেও। এই হত্যাকাণ্ডটির কিছুদিন আগেই আরও একটি হামলার ঘটনা ঘটে গেছে। অক্টোবরের ৫ তারিখ স্যামুয়েল প্যাটি তাঁর ক্লাসে ঘোষণা করেছিলেন যে পরদিন তিনি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ে বিতর্কের ক্লাসে সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘সার্লি এব্দো’-তে প্রকাশিত বিতর্কিত কার্টুনটি দেখাবেন। তিনি ছাত্রছাত্রীদের বলেন যে কার্টুনটি অনেককেই আঘাত করতে পারে, সেক্ষেত্রে তারা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকতে পারে বা ক্লাসের বাইরে চলে যেতে পারে। কার্টুনটি ছিল একজন পুরুষের নগ্ন কদর্য ড্রয়িং যাকে মহানবী হজরত মহম্মদের চিত্ররূপ হিসেবে তুলে ধরেছে পত্রিকাটি। ২০১৫ সালে এই কার্টুনটি প্রকাশিত হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে সার্লি এব্দোর অফিসে ও একটি বাজারে কুখ্যাত সন্ত্রাসী হামলায় মোট ১৭ জনকে হত্যা করেছিল কয়েকজন যুবক। গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে ফ্রান্সের আদালতে এই সন্ত্রাসবাদী হামলার বিচার শুরু হয়েছে, এবং সেই উপলক্ষ্যে সার্লি এব্দো পত্রিকায় সেই বিতর্কিত ব্যাঙ্গচিত্রটি পুনরায় ছাপা হয়। এরপর এক যুবক পত্রিকা অফিসের সামনে এসে ছুরি নিয়ে হামলা করার চেষ্টা করে। শিক্ষক স্যামুয়েল প্যাটি ক্লাসে ব্যাঙ্গচিত্রটি দেখানোর পরদিন থেকেই একজন গার্জেন সোশাল মিডিয়ায় প্রকাশ্যে প্রতিবাদ ও প্রচার শুরু করেন এবং আদালতে মামলা করেন ক্লাসে ‘পর্নোগ্রাফিক ছবি’ প্রদর্শনের অভিযোগ এনে। এতসবের পরও ফ্রান্সের পুলিশ প্রশাসনের চোখের সামনে শেষপর্যন্ত এরকম একটি হত্যাকাণ্ড কীভাবে সংঘটিত হতে পারল তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, বিশেষত এর আগেও এরকম হামলাগুলির ক্ষেত্রেই হামলাকারিরা ফরাসি ইন্টেলিজেন্সের নজরদারির আওতায় থাকা ব্যক্তি বলেই শেষ পর্যন্ত জানা গেছে।
- মলয় তেওয়ারী
কলকাতা, ১৯ অক্টোবর ২০২০
করোনা সংক্রমণ যখন এদেশে ছড়াতে শুরু করেছে সেই পর্বে তবলিগি জামাতের একটি সমাবেশকে রাষ্ট্র অপরাধী বানানো শুরু করেছিল। সর্বভারতীয় সংবাদ মাধ্যম একে কেন্দ্র করে প্রতিদিন ইসলামোফোবিয়া ছড়াত।
আমরা সেদিন তবলিগি জামাতের জমায়েত বিবেচনাপ্রসূত হয়নি বলেছিলাম। আর বিরোধিতা করেছিলাম একটি জমায়েতের সূত্র ধরে একটি গোটা কমিউনিটিকে ভিলেন বানানোর পরিকল্পিত চেষ্টার।
তার পর মাস সাতেক পেরিয়ে এখন এসেছে দুর্গাপূজা। এর আগে হয়েছিল ইদ। দুটোই এমন সময়ে যখন অতিমারির প্রকোপ তুঙ্গে।
ইদ ঘরে বসে পালন করার কথা বলা হল। তা সেভাবে পালিতও হল বিবেচনাবুদ্ধির পরিচয় দিয়ে৷ দুর্গোপুজোর সময় ব্যাপারটা একেবারে উলটে গেল।
সর্বজনীন পুজোর আয়োজকদের ভিক্টিম বানানো দূরে থাক, কমিউনিটিকে ভিলেন বানানোর কথাটা এক্ষেত্রে কেমন হাস্যকর রকম অলীক সেই আলোচনাও শিকেয় তোলা থাক, শুধু দেখা যাক প্রশাসনের ভূমিকা। যে মুখ্যমন্ত্রী বাড়ি বসে ইদ পালন করার কথা বলেন, তিনিই ঘরে বসে আবার দুর্গোৎসব হয় নাকি, একথা বলে রাস্তায় জনজোয়ারের প্রেক্ষাপট তৈরি করেন। পুজো কমিটি পিছু পঞ্চাশ হাজার অনুদান ঘোষণা করে সর্বজনীন পুজোর ভিড়ের প্রেক্ষাপট রচনা করে দেন। চিকিৎসক সমাজের আকুল আবেদন কানেই তোলার প্রয়োজন মনে করেন না।
মার্চে তবলিগি জামাতের সেই জমায়েত থেকে মাঝে ইদ হয়ে এই শেষ অক্টোবরে দুর্গাপুজো – আমাদের সেকুলারিজম, ইসলামোফোবিয়া, তথাকথিত সংখ্যালঘু তোষণের মুখোশ ও প্রকৃত মুখ – সবকিছুকেই দেখিয়ে দেয়।
প্যারিসে যে হত্যাকাণ্ডটি ঘটল, সেটি নিঃসন্দেহে একটি বর্বরোচিত কাজ। “ধর্মানুভূতি বলে কিছু থাকারই কথা নয়, তা কেন থাকবে, এই জাতীয় ইউটোপিক কল্পনার বাইরে বাস্তব বুঝে, অন্যের অনুভূতিকে মর্যাদা দেওয়াটাই উচিত” – একথা মনে রাখার কথা যারা বলছেন, তাদেরও অধিকাংশই মানছেন দেড় হাজার বছরের ও দেড়শ কোটি অনুসারী মানুষের ধর্মটিকে রক্ষার জন্য গলা কেটে খুন করার ব্যাপারটি অপ্রয়োজনীয়, ক্ষতিকর এবং নৃশংস।
কিন্তু সদ্য তরুণ চেচেন যুবকটির উন্মাদ বীভৎসতার জন্য মুসলিম সমাজকেই সন্ত্রাসবাদী বানানোর উচ্চারণগুলি মারাত্মক। ব্যক্তি বা সংগঠনের দায়কে গোটা সমাজের ওপর চাপিয়ে দেওয়া এবং তার পেছনে প্রবলভাবে রাষ্ট্র ও কর্পোরেটের মদত থাকার বিষয়গুলি আমরা গত কয়েক দশকে বারবার দেখছি।
এই প্রক্রিয়ায় ক্ষমতাতন্ত্র একটি ভিলেনকে দেখিয়ে সংখ্যাগুরুকে সংগঠিত করতে চায় আমাদের দেশে। ইউরোপ, আমেরিকার ন্যাটো অক্ষ চায় ওয়ার অন টেররিজম এর নামে তার দেশদখল, লুন্ঠন ও কর্পোরেট স্বার্থকে চরিতার্থ করার দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। অন্যদিকে পরম মিত্র সৌদি আরব সহ নানা ইসলামিক রাষ্ট্রেও প্রগতিশীল সংস্কার ও প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতাতন্ত্র বিরোধী বিদ্রোহকে রুখতে সে পলিটিক্যাল ইসলামকে নানাভাবে সার জল দেয়। এশিয় ভূখণ্ডে সোভিয়েতকে রোখার জায়গা থেকে যে নক্সা শুরু হয়েছিল, তা পরে ক্রমেই তার ডালপালা মেলেছে নানাদিকে।
বিশ্ব রাজনীতির গত কয়েক দশকের ঘটনাপ্রবাহকে বিশ্লেষণ করলে আমরা বুঝতে পারি কর্পোরেট স্বার্থ, তাঁবেদার শাকরেদকুল সহ সাম্রাজ্যবাদী ক্ষমতাতন্ত্র ও পলিটিক্যাল ইসলাম এক দুষ্টচক্র গড়ে তুলেছে।
সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার সামনে আপাত যুযুধান কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সহযোগী শক্তিগুলোর মুখোশ উন্মোচন এই সময়ের প্রগতিশীল রাজনীতির অন্যতম কাজ। কেবল পুতুলগুলির বিরুদ্ধে যাবতীয় ঘৃণাকে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটি কর্পোরেট ও সাম্রাজ্যবাদী অক্ষ যতদিন সফলভাবে করে যেতে পারবে, ততদিন পর্দার আড়ালে থাকা ক্ষমতাসীন সব বাজিগরদের স্বস্তিতে থাকা আটকাবে কে?
- সৌভিক ঘোষাল
১৪ তারিখে আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডারের (আইএমএফ) তরফে যে বিশ্ব অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে অনুমান পেশ করা হয়েছে তা ভারতের পক্ষে কোনোভাবেই সুখপ্রদ নয়। একদিকে গত জুন মাসে করা বৃদ্ধির হারের অনুমান, -৪.৫%-কে সংশোধন করে ভারতের ২০২০-২১-এর অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হারকে -১০.৩% করা হয়েছে। যদি আইএমএফ-এর তার তিন মাস আগে এপ্রিল, ২০২০র যে বিশ্ব অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে অনুমানের সঙ্গে তুলনা করা হয়, তাহলে বৃদ্ধির হারের অনুমান ১.৯%কে সংশোধন করে -১০.৩% করা হয়েছে। অর্থাৎ, আইএমএফ এপ্রিল মাসে ভারতীয় অর্থনীতির ২০২০-২১ সালে ১.৯% বৃদ্ধি হবে বলে অনুমান করেছিল, তার তিনমাস বাদে অনুমান করা হল ভারতীয় অর্থনীতির বৃদ্ধিতো হবেই না বরং হ্রাস ঘটবে ৪.৫%; আর সাম্প্রতিক অনুমান হল হ্রাস আরো ভয়ানক হবে, ১০.৩%। অর্থাৎ, এপ্রিলের তুলনায় হ্রাসের পরিমাণ ১২.২%। এভাবে ক্রমাগত অর্থনীতির ধ্বসের অনুমান ভারতীয় অর্থনীতির ভয়ঙ্কর ক্ষয় নির্দেশ করছে নাতো? আশা করা যাক, দেশের অর্থনীতি কৃষক-শ্রমিক-শ্রমজীবী মানুষের হাত ধরে ঘুরে দাঁড়াবে।
একদিকে যখন ভারতীয় অর্থনীতির বৃদ্ধির হার সম্পর্কে আইএমএফ-এর অনুমান গত ৬ মাসে ক্রমাগত নেতিবাচক হয়েছে, ঠিক তখনই বিশ্ব অর্থনীতি সম্পর্কে অনুমান কিন্তু বিপরীতমুখী হয়েছে। জুন মাসে আইএমএফ-এর অনুমান ছিল যে বিশ্ব অর্থনীতি ২০২০ সালে ৫.২% হ্রাস পাবে, সাম্প্রতিক অনুমানে সেই হ্রাসের মাত্রা ০.৮% কমে ৪.৪% হয়েছে। আমাদের প্রতিবেশি দেশ চিনের ক্ষেত্রে এপ্রিলের অনুমানের তুলনায় সাম্প্রতিক বৃদ্ধির অনুমান ১.৬% বেড়েছে। কোভিডে সর্বাধিক আক্রান্ত অন্যতম দুটি দেশ আমেরিকা ও ব্রাজিলের বৃদ্ধি সম্পর্কে পূর্বাভাষ জুন মাসে করা আইএমএফের অনুমানের তুলনায় বেড়েছে যথাক্রমে ৩.৭% ও ৩.৩%। আইএমএফ-এর পূর্বাভাষ অনুযায়ী ২০২০তে ইউরোপের কেবল দুটি দেশ স্পেন (-১২.৮%) ও ইতালি (১০.৬%)র অর্থনৈতিক হ্রাস ভারতের তুলনায় বেশি হলেও কিন্তু ওই দুটি দেশের ক্ষেত্রেও আইএমএফ-এর হ্রাসের পূর্বাভাষ জুনের তুলনায় বাড়েনি, বরং ইতালির ক্ষেত্রে ২.২% কমেছে (স্পেনের ক্ষেত্রে একই থেকেছে)। মনে রাখা দরকার, স্পেনের প্রতি ১০ লাখে করোনায় মারা গেছেন ৭২৭ জন, ইতালিতে ৬০৬ জন; অন্য দিকে ভারতে সেই হার ৮৩ জন। ফলে কোভিডের তুলনায় ভারতে অর্থনৈতিক দুর্দশার তীব্রতা অনেক মারাত্মক।
অর্থনৈতিক অবহেলার সরকারী নীতির পরিণাম হিসেবেই এই মারাত্মক অর্থনৈতিক ক্ষতিকে দেখতে হবে। ভারতের প্রতিবেশি অন্য সকল দেশের তুলনায় আইএমএফ কর্তৃক অনুমিত ভারতের অর্থনৈতিক ক্ষতি ভয়ানক। অনুমিত বাংলাদেশের বৃদ্ধি ৩.৮%, মায়ানমারের বৃদ্ধি ২%, চিনের বৃদ্ধি ১.৯%, ভূটানের বৃদ্ধি ০.৬%, নেপালের ০.০%, পাকিস্তানের (হ্রাস) -.০.৪%, শ্রীলঙ্কার (হ্রাস) -৪.৬%, আফগানিস্তানের (হ্রাস) -৫%। এর তুলনায় ভারতের আনুমানিক অর্থনৈতিক ক্ষতির মাত্রাটা দেখুন, -১০.৩%। আইএমএফ-এর অনুমানকে যদি অনুসরণ করা যায় তাহলে বোঝা যাবে যে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক মোর্চা সরকার দেশের অর্থনৈতিক পরিচালনে কী অপরিসীম অক্ষমতা প্রদর্শন করেছে।
সেই অক্ষমতার অন্যতম নিদর্শন হল, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়ের তুলনায় ভারতের মাথাপিছু আয়ের পশ্চাদপসরণ। আইএমএফ-এর পূর্বাভাষ অনুযায়ী ২০২০-২১-এ ভারতের বার্ষিক মাথাপিছু আয় হবে (ডলারের হিসেবে) ১৮৭৭ ডলার, আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা দাঁড়াবে ১৮৮৮ ডলার। যদিও ২০০৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত বেড়েছে, কিন্তু ভারতের বৃদ্ধি তার তুলনায় বেশি হওয়ায় ভারত ও বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়ের পার্থক্যটা বেড়েছে। কিন্তু ২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার বেড়েছে অন্যদিকে ভারতের বৃদ্ধির হার কমেছে। তাছাড়া ২০০৪ থেকে ২০২০ এই সময়কালে ১৫ বছরে বাংলাদেশর জনসংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছে ১৮%, ভারতে যা ২১%। বাংলাদেশে জনসংখ্যার তুলনামূলক কম বৃদ্ধি মুসলমানদের দ্রুত জনসংখ্যাবৃদ্ধির কল্পকথাকে নির্ঘাৎ ধূলিসাং করছে। অন্যদিকে ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের দ্রুত অর্থনৈতিক বৃদ্ধি বাংলাদেশ থেকে ভারতে অনুপ্রবেশের অমিত-কথনকেও মিথ্যে প্রমাণিত করছে। ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের এই অগ্রগতিকে কেবল কোভিডের সঙ্গে মেলালে ভুল করা হবে। ৫ বছর আগেও ভারতের মাথা পিছু জিডিপি ভারতের থেকে প্রায় ৪০% কম ছিল। কিন্তু গত ৫ বছরে বাংলাদেশের জিডিপি বার্ষিক ৯.১% চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়েছে, যা ভারতের ক্ষেত্রে মাত্র ৩.২%।
কেবল মাথাপিছু আয়েই নয়, ভারত বাংলাদেশ থেকে বেশ কিছু সূচকে পিছিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশের ঋণ বনাম জিডিপি অনুপাত ৪৫.৯৫, ভারতের ৯০.৪%; ভারতের গড় আয়ু ৬৯.৪ বৎসর, বাংলাদেশের ৭২.৩ বৎসর; মহিলাদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার বাংলাদেশে ৩৬, ভারতে ২০। লিঙ্গ সমতায় বাংলাদেশের অবস্থান ৫০তম, ভারতের ১১২তম; বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের নিরিখে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৫তম, ভারতের ৯৪তম; অনিরাপদ পানীয় জল, অস্বাস্থ্যকর মলনিকাশী ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যবিধির অভাবে প্রতি লাখ জনসংখ্যায় মৃত্যুহার বাংলাদেশে ১২, ভারতে ১৯; ফলে বেশিরভাগ সামাজিক সূচকেই ভারত বাংলাদেশের তুলনায় পিছিয়ে আছে যদিও বহুচর্চিত সহজে ব্যবসার সুযোগে, জিডিপির তুলনায় বিদেশী বিনিয়োগের হারে বাংলাদেশ ভারতের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে।
সামগ্রিকে, দেশের সরকার ও প্রধানমন্ত্রী মোদী ও তাঁর শাগরেদ অমিত শাহ পুরো দেশ জুড়ে যে বিভেদের রাজনীতি ও গণতন্ত্রহীনতার পরিবেশ তৈরি করেছে তার খেসারত দিতে হচ্ছে দেশের নাগরিকদের। কেবল ধার্মিক বিভাজনের শ্লোগান ও কর্পোরেট তোষণের কর্মসূচী দিয়ে কোনো দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না। কেবল মিথ্যে ও ধোঁয়াশা তৈরি করেও অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ঘটানো যায় না। ২০১৯-২০-র বাজেটে ২০২৪-২৫এর মধ্যে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির মনভাোলানো শ্লোগান দেওয়া হয়েছিল। যার জন্য প্রতি বছরে চক্রবৃদ্ধি হারে গড় বৃদ্ধির প্রয়োজন ছিল ৮% অন্তত। যদি ২০১৮-১৯-এর তুলনায় ২০২১-২২ পর্যন্ত অর্থনীতির কথা ভাবা হয়, তাহলে ২০১৮-১৯-এর জাতীয় আয় ১০০ টাকা হলে ২০২১-২২-এ তা হওয়া দরকার ১২৬ টাকা, ২০২৪-২৫-এ ১৫৯ টাকা। আইএমএফ-এর অনুমান অনুযায়ী ২০২১-২২-এ তা হবে ১০১ টাকা, ২০২৪-২৫-এ হবে ১২৫ টাকা। মোদিজির ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি কত বড় মিথ্যে তা বোঝাই যাচ্ছে।
শেষে আরেকটি কথা শাসক দলের অনেকেই বলতে শুরু করেছে ২০২১-২২-এ অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে ও আমাদের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার ৮.৮% হবে বলে আইএমএফ বলেছে। ওই বৃদ্ধির হারের অনুমানটি আপাতত সত্যি হলেও চেচিয়ে বলাটা ধোঁকা। কারণ, ২০১১-১২ সালের টাকার মূল্যে ২০১৯-২০-র জিডিপি যদি ১০০ টাকা হয় তাহলে অনুমান অনুসারে ২০২০-২১-এ জিডিপি হবে ৮৯ টাকা ৭০ পয়সা; ২০২১-২২-এ ৯৭ টাকা ৬০ পয়সা। সেই হিসেবে ২০১১-১২ সালের টাকার মূল্যে ভারতের জিডিপি ২০১৯-২০ সালের ১৪৫.৭ লক্ষ কোটি টাকা থেকে কমে ২০২০-২১-এ ১৩০.৭ লক্ষ কোটি টাকা হবে ও ২০২১-২২-এ ১৪২.২ লক্ষ কোটি টাকা হবে। ফলে ২০১১-১২ সালের টাকার মূল্যে দু বছরে জিডিপির ক্ষতি হবে প্রায় ১৯ লক্ষ কোটি টাকার। বর্তমান টাকার মূল্যে যা প্রায় ৩০ লক্ষ কোটি টাকা। কাদের পকেট থেকে যাবে তা, কাদের ক্ষতি হবে তাতে? অবশ্যই খেটে খাওয়া শ্রমিক কৃষকদের, যদি খেটে খাওয়া শ্রমিক-কৃষকদের সংখ্যা জনসংখ্যার ৯০% ধরা হয় তাহলে ২ বছরে তাদের মাথাপিছু আয় কমবে ২৫ হাজার টাকা। ওদিকে আম্বানি আদানিদের সম্পত্তিতো করোনাভাইরাসেও বেড়েই চলেছে।
• অমিত দাশগুপ্ত
বহুকাল ধরে পশ্চিম বাংলায় বিজেপির প্রভাব বলতে তেমন কিছু না থাকলেও বিগত কয়েক বছরে এই রাজ্যে তার প্রতিপত্তি কিছুটা বেড়েছে। গত লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিম বাংলা থেকে নয়-নয় করে ১৮ জন বিজেপি সাংসদ নির্বাচিত হওয়ায় বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মনে হয়েছে যে, ২০২২-র বিধানসভা নির্বাচনে এই রাজ্যে তাদের ক্ষমতা দখলের আকাঙ্খা একেবারে দুরাশা নয়। সেই লক্ষ্যে তাঁরা তাঁদের যাবতীয় কলাকৌশলের প্রয়োগ ঘটাতে শুরু করেছেন। কিন্তু বিজেপির কাছে মুশকিলটা হল, বাংলায় তুলে ধরার মতো ভাবমূর্তি সম্পন্ন তেমন আইকন তাদের নেই। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীকে নিয়ে একটা উদ্যোগ তারা নিলেও সেই প্রচেষ্টা তেমন কলকে পায়নি। স্বাধীনতা সংগ্ৰামের সঙ্গে যোগচ্ছিন্ন নেতাকে জনমানসে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলেও ব্যর্থ হওয়াই অমূলক সেই প্রয়াসের নিয়তি হয়ে ওঠে। কিন্তু প্রচেষ্টাতো তাদের চালিয়ে যেতে হবে। গত ১০ অক্টোবর আনন্দবাজার পত্রিকায় বিশ্বভারতীর উপাচার্য শ্রী বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর ‘সাভারকারের ভাবাদর্শ’ শীর্ষক উত্তর সম্পাদকীয় নিবন্ধ এই লক্ষ্যে একটি প্রয়াস বলে মনে হয়। শ্রী বিদ্যুৎ চক্রবর্তী মহাশয়ের সঙ্গে বিজেপির কোনো যোগ আছে কিনা, থাকলেও তা কোন মাত্রার তা আমাদের জানা নেই। কিন্তু বিশ্বভারতীতে আসার পর নানান কার্যকলাপের মধ্যে দিয়ে যে চিন্তাধারার পরিচয় তিনি রেখেছেন, বিভিন্ন প্রসঙ্গে যে সমস্ত মন্তব্য করেছেন, তাতে তাঁর বিজেপি অনুরাগ চাপা থাকেনি।
বিদ্যুৎ বাবুর নিবন্ধে যে সমস্ত বিষয় গুরুত্ব পেয়েছে সেগুলো হল: প্রথম জীবনে সাভারকার একটি বিপ্লবী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং গান্ধীজির অহিংস পথের বিপরীতে ঔপনিবেশিক রাজের নিপীড়নের পাল্টা হিংসাত্মক কর্মকাণ্ডকেই ইংরেজের হাত থেকে ভারতকে স্বাধীন করার যথার্থ পথ বলে মনে করতেন। দ্বিতীয়ত, আন্দামান সেলুলার জেলে বন্দী থাকার সময় ব্রিটিশ শাসকদের কাছে যে মুচলেকা তিনি দেন, তা আসলে ছিল তাঁর এক কৌশল। তাঁর চিন্তাধারায় ক্রমে পরিবর্তন আসে এবং ভাবাদর্শের যে রুপরেখা তাঁর মধ্যে জন্ম নেয়, তার সঙ্গে গান্ধীর রাজনীতির বিরোধ ছিল না। তৃতীয়ত, তিনিই প্রথম চিন্তাবিদ যিনি স্বাধীনতার জন্য হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে ঐক্যের আহ্বান জানান।
তাঁর রাজনৈতিক জীবনের গোড়ার দিকে সাভারকার যে ‘ইণ্ডিয়া হাউস’ নামক বিপ্লবী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে যোগ থাকার জন্য ১৯১০ সালে গ্ৰেপ্তার হওয়ার পর তাঁকে ভারতে নিয়ে আসার সময় ফ্রান্সের মারসেইলি বন্দর থেকে পালাতে গিয়ে পুনরায় গ্ৰেপ্তার হন, তা ঐতিহাসিক তথ্য এবং কেউই তা অস্বীকার করতে পারবেন না। সাভারকারের বয়স তখন ২৮ বছর এবং তিনি ১৯৬৬ সালে মারা যান ৮৩ বছর বয়সে। তাঁর সমগ্ৰ জীবনে ইতিবাচক কর্মকাণ্ডের নিদর্শন ওই জেলে যাওয়ার আগের পর্যায়েই সীমাবদ্ধ এবং ২৮ বছর বয়সে ৫০ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে আন্দামানের সেলুলার জেলে বন্দী হওয়ার পর থেকে বাকি জীবন যে ব্রিটিশদের সঙ্গে সহযোগিতায়, স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি বিশ্বাসঘাকতায় এবং হিন্দু-মুসলিম বিভেদকে গভীরতর করায় নিয়োজিত হয়েছিল, ইতিহাস তার প্রামাণ্য নজির বহন করছে। বিদ্যুৎবাবু সাভারকারের কৌশল ভাবনায় পরিবর্তনের কথা বললেও তা কিন্তু বিশদ করেননি এবং পরিবর্তিত কৌশল স্বাধীনতা আন্দোলনে কিভাবে কাজে লেগেছিল তাও আমাদের জানার বাইরে থেকে গেছে। এবং তাঁর চিন্তাধারায় গান্ধীর চিন্তাধারার বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ার বিদ্যুৎবাবুর দাবি ঘটনাবলীর কষ্টিপাথরে ভিত্তিহীন বলেই প্রমাণিত হয়েছে।
বিদ্যুৎবাবু তাঁর নিবন্ধে ১৯২০ সালে লেখা সাভারকারের মার্জনা ভিক্ষার চিঠিটির কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সাভারকার তাঁর সেলুলার জেল জীবনের দশ বছরে পাঁচটা মার্জনা ভিক্ষার চিঠি দেন - ১৯১১, ১৯১৩, ১৯১৪, ১৯১৮ এবং ১৯২০ সালে (এর মধ্যে প্রথমটা সেলুলার জেলে পৌঁছানোর দু-মাসেরও কম সময়ে এবং এত অল্প সময়ে তাঁর হাবভাবে এই পরিবর্তন আমাদের বিস্মিত না করে পারে না)। দ্বিতীয় মুচলেকাটাতে তিনি বললেন, “... সাংবিধানিক পথে আমার রূপান্তরণ সেই সমস্ত বিপথগামী যুবকদের সাংবিধানিক পথে ফিরিয়ে আনবে, ভারতে এবং বিদেশে যে যুবকরা একসময়ে আমাকে তাদের পথপ্রদর্শক বলে মনে করত। সরকার যে ভূমিকায় আমাকে তাদের সেবা করতে বলবে, আমি তাতেই রাজি। … অন্যথায় যা হতে পারে, আমায় জেলে আটক রেখে তার তুলনায় কিছুই পাওয়া যাবে না। …” বিদ্যুৎবাবু ১৯২০ সালের যে মুচলেকাটির উল্লেখ করেছেন, সেটিতেও বলা হয়, “... সাংবিধানিক পথে চলার জন্য অকপটভাবে আমি আমার আন্তরিক অভিপ্রায় প্রকাশ করছি এবং ব্রিটিশ ডমিনিয়নের হস্তে ভালোবাসা এবং সম্মান ও পারস্পরিক সহায়তার বন্ধন অর্পণ করার যথাসাধ্য চেষ্টা করছি।…” দুটি মুচলেকাতেই বিপ্লবী পথ পরিত্যাগ করা, সাংবিধানিক পথকে বরণ করা এবং বিপ্লবী পথে অবিচল থাকা যুবকদের সেই পথ থেকে ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি সুস্পষ্ট। এর মধ্যে কি সাদা, কি বাঁকা চোখে ব্রিটিশদের সঙ্গে সহযোগিতা, তাদের সেবার অঙ্গীকার ছাড়া অন্য কোনো কৌশলকে খুঁজে পাওয়া ভার।
তাদের অনুগত সেবককে বুঝতে ব্রিটিশদের ভুল হয়নি। নারকেল ভেঙ্গে তেল বার করার মতো দৈহিক পরিশ্রম থেকে রেহাই দিয়ে তাঁকে জেলে হালকা কাজ দেওয়া হয়, সেলুলার জেল থেকে তাঁকে ১৯২১ সালে মহারাষ্ট্রের রত্নগিরি জেলে স্থানান্তরিত করা হয় এবং এখান থেকে রত্নগিরি জেলার বাইরে যাওয়া যাবে না এই শর্তে ১৯২৪-র ৬ জানুয়ারী তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। সেলুলার এবং অন্যান্য জেলে বন্দী স্বাধীনতা সংগ্ৰামীরা বছর-বছর ধরে জেলে পচলেও মাত্র ১৪ বছর কারাবাসের পর সাভারকারের ৫০ বছরের কারাদণ্ডের অবসান ঘটে। রত্নগিরি জেলে বসেই সাভারকার “এসেনসিয়েলস অব হিন্দুত্ব” বইটি লেখেন যাতে হিন্দুত্বর তত্ত্ব বিধৃত হয়। ‘হিন্দুত্ব’ শব্দটির উদ্ভাবনার এবং আধুনিক হিন্দুত্বর প্রথম প্রবক্তা হওয়ার কৃতিত্ব যে তাঁরই, সে কথা তো অনস্বীকার্য।
বিদ্যুৎবাবু ১৮৫৭ সালের মহাযুদ্ধ নিয়ে “ওয়ার অব ইণ্ডিপেণ্ডেন্স” বইটি লেখার জন্য সাভারকারকে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরার পথিকৃৎ রূপে অভিহিত করেছেন। একথা ঠিকই যে, ভগৎ সিং এবং সে সময়ের অন্যান্য বিপ্লবীরা বইটা পড়ে তার থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। কিন্তু বইটার মধ্যে সাভারকার এমন কিছু বিষয়ের অবতারণা করেছেন যা দেখায় যে, এ দেশের সমাজ-সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে ওঠা মুসলিমদের তিনি ‘বিদেশী আক্রমণকারী’ রূপে ভুলতে পারছেন না এবং বিষয়গুলো তাঁর ভবিষ্যতের ‘হিন্দুত্ব’র তাত্ত্বিক হওয়াকে আভাসিত করছে। দু-একটা নমুনা পেশ করা যাক। বইটার ভূমিকার এক জায়গায় তিনি বলছেন, “শিবাজির সময় মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা পোষণ যথার্থ এবং প্রয়োজনীয় ছিল, কিন্তু ওই ধরনের অনুভূতি এখন পোষণ করলে তা অনুচিত এবং মুর্খামি হবে।” আর এক স্থানে তিনি বলছেন, “যতদিন মুসলমানরা ভারতে বিদেশী শাসকের মর্যাদায় ছিল, ততদিন তাদের সঙ্গে থাকলে তাতে জাতীয় দুর্বলতাকে স্বীকার করে নেওয়াই হত।…”
বইটা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯০৯ সালে। এর ২৮ বছর পর ১৯৩৭ সালে – মুসলিম লিগ ১৯৪০ সালে পাকিস্তানের দাবি তোলার তিন বছর আগে - হিন্দু মহাসভার ১৯তম অধিবেশনে সাভারকার বললেন, “ব্যাপারটা হল, ভারতে পারস্পরিকভাবে বৈরি দুটো জাতি বাস করছে। ... আজ ভারতকে কোনোভাবেই একতাবদ্ধ ও সমজাতীয় দেশ বলা যাবে না, বিপরীতে ভারতে প্রধানত দুটো জাতি আছে – হিন্দুরা ও মুসলমানরা।” এরপর ১৯৪৩ সালে জিন্নার দ্বিজাতি তত্ত্বকে সমর্থন করে তিনি বললেন, “মাননীয় জিন্নার দ্বি-জাতি তত্ত্বের সঙ্গে আমার কোনো বিরোধ নেই। আমরা, হিন্দুরা নিজেরাই একটা জাতি এবং হিন্দুরা ও মুসলমানরা যে দুটো স্বতন্ত্র জাতি তা ঐতিহাসিক তথ্য।” সাভারকারের মুসলিম প্রীতির যে কোন দৃঢ় ভিত্তি ছিল না, মুসলিম বিদ্বেষ তাঁর মধ্যে যে ফল্গুধারার মত বয়ে চলেছিল এবং পরবর্তীতে সেটাই যে তাঁকে ‘হিন্দুত্ব’র তাত্ত্বিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, তা সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়ছে।
গান্ধী হত্যা ষড়যন্ত্রেও সাভারকার অভিযুক্ত হয়েছিলেন। তৎকালীন সহ-প্রধানমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভভাই প্যাটেল ১৯৪৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারী নেহরুকে লেখা একটা চিঠিতে জানান, “সাভারকারের নেতৃত্বে হিন্দু মহাসভার উগ্ৰ গোষ্ঠী এই ষড়যন্ত্র রচনা করেছে এবং আগাগোড়া এটি তদারকি করেছে।…” প্রত্যক্ষ প্রমাণের অভাবে সাভারকার অপরাধী সাব্যস্ত হওয়া থেকে রেহাই পেয়ে গেলেও গান্ধী হত্যা মামলার রাজসাক্ষী দিগম্বর ব্যাজ কিন্তু সাভারকারকে গান্ধী হত্যার অন্যতম চক্রী রূপে দেখিয়েছিলেন।
বিদ্যুৎবাবু ইতালির রাজনৈতিক নেতা মাৎসিনির ভাবাদর্শে সাভারকারের অনুপ্রাণিত হওয়ার উল্লেখ করেছেন। বিদেশী শক্তিদের নিয়ন্ত্রণে থাকা কয়েকটি স্বতন্ত্র রাজ্যকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীন সংহত ইতালিতে রূপ দেওয়ায় মাৎসিনির গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। কিন্তু এই মাৎসিনির জঙ্গী জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শ আবার মুসোলিনির ওপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলে এবং এই দিক থেকে মাৎসিনি ছিলেন মুসোলিনির মতাদর্শগত গুরু। প্যারি কমিউনের সমালোচনার জন্য মার্কস মাৎসিনিকে ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ এবং ‘চিরস্থায়ী বুড়ো গাধা’ বলে অভিহিত করেছিলেন এবং মাৎসিনির চিন্তাধারা সম্পর্কে বলেছিলেন, “কার্যত মধ্যবিত্ত-শ্রেণী ভিত্তিক প্রজাতন্ত্রের সেকেলে চিন্তাধারার মতোই।” সাভারকার নেহরুর সমালোচনা করে বলেন, “জার্মানির পক্ষে কোনটা সবচেয়ে ভালো সেটা পণ্ডিত নেহরুর চেয়ে হিটলার অবশ্যই ভালো জানেন”; নাজিবাদী ইতালি ও ফ্যাসিবাদী জার্মানির স্তুতিতে আরও বলেন, “নাজি বা ফ্যাসিবাদী জাদু দণ্ডের ছোঁয়ায় জার্মানি ও ইতালি আগের যে কোন সময়ের তুলনায় এমন বিস্ময়করভাবে নিজেদের পুনরুজ্জীবন ঘটাতে ও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারল, এই ঘটনাটাই এটা প্রমাণ করার পক্ষে যথেষ্ট যে, ওই রাজনৈতিক মতবাদগুলোই তাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় টনিক ছিল।” এই অভিমতগুলোর পিছনে মাৎসিনির তথা ফ্যাসিবাদের অনুপ্রেরণার ইঙ্গিত সুস্পষ্ট।
কেন্দ্রের ক্ষমতায় আজ সাভারকারের ভাবশিষ্যদের অধিষ্ঠান। অধিকাংশ রাজ্যেও আজ বিজেপি ক্ষমতায়। তাদের জমানায় সংখ্যালঘু-বিরোধী ঘৃণা ও হিংসাকে অভিযান আকারে নামানো হয়েছে। সরকার বিরোধিতাকে দেশদ্রোহের ছাপ মেরে সরকারের সমালোচকদের জেলে পোরা হচ্ছে। স্বাধীনতার পর গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর, সংসদীয় গণতন্ত্রের ওপর নেমেছে প্রণালীবদ্ধ হামলা। সংবিধানের বিপর্যস্ত হওয়া নিত্যদিনের বাস্তবতা। হাথরাসে দলিত কন্যার লাশের সঙ্গে ভস্মীভূত হয়েছে ন্যায়ের ধারণা এবং সংবিধানের কয়েকটা পাতা। সাভারকারের জীবনকালের অধিকাংশ সময়টাই ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের যুগ। আজ নতুন এক আজাদির লড়াই জরুরি হয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে – সাভারকারের ভাবশিষ্যদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার, পুনরুজ্জীবিত করে তোলা মনুবাদের মূলোৎপাটনের, বহুত্ববাদকে তার অখণ্ড গরিমায় প্রতিষ্ঠিত করা, ফ্যাসিবাদকে প্রতিরোধ করার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ লড়াই।
- জয়দীপ মিত্র
পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের প্রাক্তন সভাপতি গণগায়ক প্রবীর বল (মনা) গত ২ অক্টোবর প্রয়াত হয়েছেন বেশ কিছুদিন রোগভোগের পর। তাঁর প্রয়াণের পর গণসংস্কৃতি পরিষদ অন্তর্ভুক্ত কয়েকটি সংগঠন তাঁকে স্মরণ করেছেন। এছাড়াও গত ১২ অক্টোবর প্রবীর বলের সাংস্কৃতিক বন্ধুদের দ্বারা পরিচালিত সম্প্রীতি মনন পত্রিকা বারাসাতে একটি অনুষ্ঠানে কথায় গানে কবিতায় তাঁকে শ্রদ্ধা জানান। প্রয়াত শিল্পীকে স্মরণের এই ধারাবাহিকতায় সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানটি গত ১৬ অক্টোবর কলকাতার রিপন স্ট্রীটের ক্রান্তি প্রেস হলে পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদ কর্তৃক আয়োজিত হয়। ১ মিনিট নীরবতা পালনের পরে প্রয়াত গণশিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন উপস্থিত সুধীজনেরা, যাদের মধ্যে পরিষদের প্রাক্তন সভাপতি বিপুল চক্রবর্তী, বর্তমান সভাপতি দেবাশীষ চক্রবর্তী, প্রবীরের দীর্ঘদিনের শিল্পীজীবনের অগ্রজ অমিত রায়, অনুজ অসীম গিরি, সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের রাজ্য সম্পাদক পার্থ ঘোষ, পলিটব্যুরো সদস্য কার্তিক পাল, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য জয়তু দেশমুখ, রাজ্য কমিটির সদস্য মীনা পাল, ভারতীয় গণসংস্কৃতি সঙ্ঘের রাজ্য সম্পাদক অমিতাভ চক্রবর্তী, নাগরিক আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ নেতা অমলেন্দুভূষণ চৌধুরী, বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক অধ্যাপক নিত্যানন্দ ঘোষ প্রমুখ। উল্লেখ্য যে, প্রবীর বল আমৃত্যু সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের সদস্য ছিলেন। অমিত রায় প্রবীরের স্মৃতিচারণ করার সময়ে গত ৯০-এর দশকে পরিষদের অন্যতম সংগঠক প্রয়াত অরিজিৎ মিত্রের সূত্রে মনার সঙ্গে আলাপের কথা বলেন ও তিনি কীভাবে মনার গানে আবিষ্ট হয়েছিলেন তার উল্লেখ করেন। তিনি বলেন যে সংক্ষেপে বললে বলতে হয় যে, মনা ছিলেন একজন অত্যন্ত ভালো গায়ক ও অত্যন্ত ভালো একজন মানুষ, সাংস্কৃতিক জগতের রেষারেষি যাকে কখনো ছুঁতে পারেনি। বিপুল চক্রবর্তী আক্ষেপের সঙ্গে মনে করিয়ে দেন যে প্রবীরের গানের রক্ষণাবেক্ষণ যথাযথ হয়নি। অসীম গিরি জানান যে, তিনি মনাদার গানের গুণমুগ্ধ শ্রোতা ছিলেন আর মনাদার ছিল গানের দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার অসামান্য ক্ষমতা। পরিষদের বর্তমান সভাপতি দেবাশীষ চক্রবর্তী প্রবীরের নেতৃত্বে পূবের আওয়াজ দলের জনপ্রিয়তার কথা উল্লেখ করে বলেন যে ভাবতাম আমি যেন পরজন্মে ও রকম গান গাইতে পারি। পার্থ ঘোষ প্রবীরের রাজনৈতিক দৃঢ়তার কথা উল্লেখ করে বলেন প্রবীর ছিল বামপন্থী নকশালবাড়ির রাজনীতির প্রতি নিবেদিত প্রাণ, তাঁর গানেও ছিল সেই রাজনীতির পরশ। তিনি জানান কীভাবে নদিয়ার কালিগঞ্জে ৭০-এর দশকের শেষ দিকে প্রবীর শাসক দলের শারীরিক আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে গান গেয়ে ঢিল ছোড়াকে প্রতিরোধ করেছিলেন। কার্তিক পাল ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের প্রয়োজনীয়তাকে উল্লেখ করে প্রবীরকে সাংস্কৃতিক আন্দোলনে ঐক্যের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেন।
স্মৃতিচারণের পাশাপাশি পরিষদের কর্মীরা গান ও আবৃত্তির মধ্য দিয়ে তাদের প্রিয় মনাদাকে স্মরণ করেন। শোভনা নাথ আবৃত্তি করেন, প্রণব মুখার্জী, সুব্রত ভট্টাচার্য ও বাবুনি মজুমদার সঙ্গীত পরিবেশন করেন। কান্ডীরের শিল্পীরা সমবেত কন্ঠে প্রবীরের সুর দেওয়া দুটি গানের (একটির কথা অরিন্দম সেনগুপ্ত ও অন্যটির প্রবীর বল) সুঠাম পরিবেশনের মধ্য দিয়ে জানান দেন যে প্রবীরের গানকে পরিষদ বাঁচিয়ে রাখবেই। অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রবীরের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধার্ঘ হিসেবে পরিষদের নিজস্ব ওয়েবসাইট www.paschimbangaganasanskritiparisad.org-এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন বিপুল ও দেবাশীষ চক্রবর্তী। এছাড়া প্রবীরের স্মৃতিচারণ সমৃদ্ধ মূল্যবান একটি স্মরণিকা, “আগুনে আমার রক্ত লেগে আছে” প্রকাশ করে পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদ।
প্রবীরের স্মরণে আয়োজিত অনুষ্ঠানটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত সুচারু ভাবে সঞ্চালনা করেন পরিষদের সম্পাদক গণকবিয়াল নীতীশ রায়, পরিষদের সভাপতি দেবাশীষ চক্রবর্তীর পাশাপাশি সহসভাপতি সাগর চট্টোপাধ্যায়ও সারাক্ষণ মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া, পরিষদের অন্যান্য কর্মকর্তা বা সদস্য যেমন অরিন্দম সেনগুপ্ত, শীলা দে সরকার প্রমুখ প্রিয় মনাদার প্রয়াণে বিমর্ষ থাকলেও তাদের প্রচেষ্টায় সমগ্র অনুষ্ঠানটি মর্মস্পর্শী হয়ে উঠেছে; উপস্থিত ছিলেন প্রয়াত শিল্পীর শোকসন্তপ্ত স্ত্রী বাণী ও পুত্র অর্কনাভ ।
অনুষ্ঠানটি শেষ হয় সমবেত কন্ঠে ইন্টান্যাশনাল গানের মধ্য দিয়ে।
এই শিরোনামে গতকাল ১৮ অক্টোবর (রবিবার) বজবজ “চলার পথের” আয়োজনে, মনোরঞ্জন নস্কর ভবনে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল প্রখ্যাত গণসঙ্গীত শিল্পী প্রবীর বল-এর স্মরণ সভা। সভার সূচনা হয় তাঁর ছবিতে মাল্য ও পুস্প দানের মধ্য দিয়ে। মাল্যদান করেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের দক্ষিন চব্বিশ পরগনার জেলা সম্পাদক কমরেড কিশোর সরকার, পশ্চিমবঙ্গ গণ সংস্কৃতি পরিষদের রাজ্য সম্পাদক গণসঙ্গীত শিল্পী নীতীশ রায়, চলার পথের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক অঞ্জন ঘোষ, চলার পথের পক্ষে অভিজিৎ মন্ডল ও আইসার পক্ষ থেকে দীপ মালিক, সৌম্য সেনগুপ্ত, মহ: মহসিন, প্রগতিশীল মহিলা সমিতির পক্ষ থেকে কাজল দত্ত, সারা ভারত কিষাণ মহাসভার জেলা সম্পাদক দিলীপ পাল, এছাড়া ইন্দ্রজিৎ দত্ত সহ প্রমূখ। প্রবীর বল (মনাদার) স্মৃতি চারণ করে বক্তব্য রাখেন দেবাশীষ মিত্র ও অঞ্জন ঘোষ (চলার পথে), কিশোর সরকার (সিপিআইএমএল), সৌম্য সেনগুপ্ত (দৃষ্টি পথ), নীতীশ রায় (প:ব: গণ সংস্কৃতি পরিষদ), প্রদীপ বাবু (সাংস্কৃতিক কর্মী) প্রমূখ। অভিজিৎ মন্ডল তার গান আর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে মনাদাকে শ্রদ্ধা জানান। মোহন মন্ডল স্বরচিত কবিতা পাঠের মধ্য দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।সব শেষে গণ শিল্পী নীতিশ রায়-এর গান দিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে। সমগ্র অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন দেবাশীষ মিত্র।
মনাদা আমাদের কাছে চির স্মরণে-চির মননে
৪৭ বছর আগে ৩ অক্টোবর আমার বন্ধু ও কমরেড সঞ্জয় বসু রায়, মায়ের দেওয়া আদরের নাম বুবলু, পার্টির নাম নন্দ, শহিদের মৃত্যু বরণ করেছিল। কলকাতায় আলিপুর জেল – ব্রেক করতে গেলে সিআরপিএফ তার পেটে পরপর তিনবার গুলি করে। সঞ্জয় আমাদের মধ্যে রেখে গেল তার অপূর্ণ স্বপ্ন – নিপীড়নমুক্ত এক বিপ্লবী ভারতবর্ষের স্বপ্ন।
১ অক্টোবর ১৯৭৩। কোনদিন ভুলব না ঐ দিনটি। ঐদিন আমরা কয়েকজন কমরেড একজোট হয়ে আলিপুর সেন্ট্রাল জেল গেরিলা কায়দায় আক্রমণ করেছিলাম, আমাদের পরিচিত কিছু নকশাল বন্দিদের কারাগার থেকে মুক্ত করার জন্য। আক্রমণের এই দুঃসাহসিক পরিকল্পনা যে ‘ফেল’ করতে পারে এটা নিয়ে আমরা, ক’টি আবেগউদ্দীপ্ত তরুণ, একেবারেই চিন্তিত ছিলাম না। নকশালবাড়ির আগুনই আমাদের এগিয়ে নিয়ে গেছিল।
জেলখানার পাগলা ঘণ্টি বাজল ও সঙ্গে সঙ্গে সিআরপিএফ গুলি চালাতে শুরু করে। নন্দ ও আমি গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যাই। ওর পেটে গুলি লেগেছিল তিনটি আর আমার দু’টো – থুতনির নিচে ও বাঁ – হাতের উপর দিকে। জেল গেটের সামনে আমরা রক্তাক্ত অবস্থায় পড়েছিলাম। অন্য কমরেডদের কী হয়েছিল, জানতে পারিনি। কিছুক্ষণ বাদে আমাদের দু’জনকে পুলিশ ভ্যানে তোলা হয়। আমরা পড়েছিলাম পাশাপাশি। যেন কোনো একটা লম্বা সফরের আগের মুহূর্ত। মনে আছে বুবলু হাত বাড়িয়ে আমায় ছুঁয়ে বলল, “লড়ে যাও গুরু”। এই ছিল ওর সংগ্রামী, লড়াকু মানসিকতা।
আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল পিজি হাসপাতালে। ৩ অক্টোবর কার্জন ওয়ার্ডে কমরেড নন্দ শহীদের মৃত্যু বরণ করে।
সঞ্জয়ের সাথে আমার প্রথম আলাপ দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স কলেজ হোস্টেলে। আমরা আলাদা আলাদা ভাবে সেখানে গিয়েছিলাম আমাদের বন্ধুদের সাথে দেখা করতে (অজয় বসু ও সুমন্ত ব্যানার্জি যারা ঐ কলেজে পড়ত এবং পরে নকশাল আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল)। কলকাতায় ফিরে সঞ্জয়ের সাথে হঠাৎ দেখা গোল পার্কের পুরোনো বইয়ের দোকানের সামনে। সেই থেকে বন্ধুত্ব ও এক সাথে পার্টির কাজ করা। আমরা তিলজলা-বালিগঞ্জ লোকাল কমিটির সদস্য ছিলাম। একসাথে অন্যান্য কমরেডদের সঙ্গে আমরা গোপন কায়দায় পোস্টার লাগাতাম। গড়িয়াহাটার মোড়ে যশোদা ভবনের ছাদে গিয়ে বিরাট গ্যাস বেলুন উড়িয়ে দিয়েছিলাম তার গায়ে লেখা হয়েছিল ‘নকশালবাড়ি জিন্দাবাদ’। কখনও আবার দোতালা বাসের জানালা দিয়ে লিফলেট ফেলতাম। চৌরঙ্গীর মোড়ে আমেরিকান লাইব্রেরীর ছাদ থেকেও নিচে রাস্তায় লিফলেট ছড়িয়ে দিয়েছিলাম, দেখতাম মানুষজন তা তুলে নিয়ে, অবাক হয়ে ওপরের দিকে তাকিয়ে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে। রাতে গার্ডেন রীচের এক হস্টেলে আমরা সিল্ক স্ক্রিনে পোস্টার ছাপাতাম, তাতে শ্লোগান ছাড়াও থাকত স্টেন্সিল করা চারু মজুমদার ও মাও সে তুঙ-এর ছবি।
বুবলু মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে পার্টির হোলটাইমার হয়ে গিয়েছিল। মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতে থাকত। আমার মা-বাবা ওকে স্নেহ করত। ও বালিগঞ্জ এলাকায় কারখানার গেটে যেত শ্রমিকদের মধ্যে নকশালবাড়ির রাজনীতি ও শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে। যোগাযোগের চেষ্টা করত এমন শ্রমিকের সাথে যাকে পার্টি সদস্য করা যাবে। অসুস্থ শ্রমিকদের চিকিৎসার জন্য ওর মামার (ডাক্তার) চেম্বারে নিয়ে যেত। ও বিশ্বাস করত একদিন অত্যাচারিত ও গরিব মানুষ এক সাথে উঠে দাঁড়াবে, বিদ্রোহ করবে, নিয়ে আসবে এক নতুন দিন।
সঞ্জয় বসু রায়, বুবলু, নন্দ আমার কাছে বরাবরের অনুপ্রেরণা। নন্দর মতো অগুনতি শহীদ আছেন যাদের মৃত্যু পাহাড়ের চেয়েও ভারী। যারা আজও উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, পথ দেখাচ্ছে। পথ দেখাচ্ছে আজকের হাজারো তরুণকে, যারা দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সংগ্রামের মশাল।
- তপন সেন
লাভ জিহাদ কী জিনিস? এটি মূলত একটি ইসলামোফোবিক চক্রান্তকে শানিত করে এমন একটি থিওরি, যেখানে প্রচার করা হয় হিন্দু মেয়েদের ধর্মান্তরিত করতে মুসলমান যুবকরা প্রেমের ফাঁদ পাতে। আসলে প্রেম ভালোবাসা নয় ইসলামের সম্প্রসারণই হলো তাদের আসল উদ্দেশ্য। ২০০২-এর পরবর্তীতে একটু একটু শোনা গেলেও লাভ জিহাদ কথাটি ব্যাপকভাবে জনমানসে আসে ২০০৯ সালে কর্ণাটকের হিন্দুত্ববাদীদের দ্বারা সংগঠিত কিছু নির্দিষ্ট হিংসাশ্রয়ী ঘটনার পর। অতএব বোঝাই যাচ্চে লাভ জিহাদ কোনও একদিনের হুজুগ নয়। এই ঘৃণার, এই ভয়ের ধারণা আমাদের চেতনায়, মননে, বাচনভঙ্গি ও জীবনশৈলীতে – আমাদের অস্তিত্বের পাকে পাকে ক্রমশ জড়িয়ে যেতে থাকে। প্রত্যেক মুহূর্তে সমাজ এগুলোই আমাদের শেখায়। আমরাও সমাজের শৃঙ্খলাবদ্ধ সৈনিকের মতো আমাদের সামাজিক জীবনে সেই তথাকথিত শিক্ষাকে সংপৃক্ত করে ফেলি। মেয়েদের ক্ষেত্রে এই ‘শেখা’র শেকলগুলো আরেকটু শক্ত, আরেকটু কঠিন। কারণ “নিজের শরীর বা মনের প্রতি যে আমার নিজের অধিকার আছে”, এই বোধটাকেই বিসর্জন দিতে শেখানো হয় তাদের ছোট থেকেই। জন্মের পর বাবা, বিয়ের পর ‘স্বামী’ আর বৃদ্ধ বয়সে সন্তান, বলা ভালো ‘ছেলে’। এই অধীনে থাকার ট্রায়াঙ্গেল সমাজ ‘ভালো মেয়ে’ হওয়ার একটা সংজ্ঞা, একটা স্ট্রাকচার। যে সংজ্ঞা বা ধাঁচের বাইরে গেলে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষের যে একচেটিয়া রাজ, নিয়ন্ত্রণ এবং পায়ের তলায় রাখার একচেটিয়া যে পরম্পরা তাতে আঘাত করে। আমার মেয়ে সে আমার মতেই চলবে, নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করবে, অধিকার ফলাবে তাহলে পরিবারকে নিয়ন্ত্রণ করার সেই সামাজিক পুরুষত্ব নিয়ে লোকে ইপ্রশ্ন তুলবে না? কি বলবে লোকে! আলমারীতে সাজিয়ে রাখা বস্তু থেকে মানুষ হলে সে অধিকার নিয়ে সোচ্চার হবে, তার মন, মনন, শরীর, জীবিকা, স্বাধীনতা ও বাঁচার অধিকার নিয়ে। যা হিন্দুত্ববাদী ও মনুবাদী ভাবধারার পক্ষে আতঙ্কের।
ভাবছেন আমাদের ভূমিকা কোথায় এখানে? আসলে কি বলুন তো ওই যে ছোট্ট থেকে আমরা শেখাই “মেটিয়াবুরুজ যাচ্ছিস? জায়গাটা খুব আনসেফ রে!” আমরা কামদুনি বা পার্ক স্ট্রীট-এর ক্ষেত্রে হাজারটা ঘটনা ঘটলেও বলব না কিন্তু। তারপর ধরুন “যত্ত চোর, জঙ্গি দেখ ভাই সব হচ্ছে ওই একটা জাতের” বা “ইস কালো পরেছিস কেন সব! পুরো মোল্লা লাগছে তো” বা “এতগুলো বাচ্চা, তার মানে নিশ্চয়ই ওই জাতের, এই স্কুলে ওর টিফিন খাবি না!”। নিজের শরীর, মনের প্রতি অধিকার বোধের কথা বাদ দিন এই যে ফোবিয়া আমরা দিনের পর দিন তৈরি করি সেখান থেকেই চিন্তাধারায় ভালোবাসায় দেওয়াল তুলতে শুরু করি আমরা। এই ধরনের আগ্রাসন আসলে মানুষের স্বাভাবিক চাওয়া পাওয়াগুলোকে বন্ধ করতে চায়। পারিবারিক ও ব্যক্তিগত পরিসরে বিভেদের বিষ ঢুকিয়ে যে কোনও রকম সুস্থ চিন্তাকে ব্যাহত করে, আরও শক্ত হয় শিকল।
দুটো মানুষ একসঙ্গে থাকবেন, ভালোবাসবেন তাতে জাত ধর্ম কোথা থেকে আসছে বলতে পারেন? হিন্দুকে ভালোবাসলে একটু বেশি প্রেম, আর অন্য ধর্মের কাউকে ভালোবাসলে কম প্রেম এটা কোন ধরনের যুক্তি? ভালোবাসতে মানুষ লাগে। ধর্ম সেখানে কোথাকার কে? যদি বলেন ‘মানিয়ে নেওয়া’, সেটা তো বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠান যেটাকে এই সমাজে দাঁড়িয়ে এখনও অস্বীকার করতে পারি না আমরা তার প্রতিটা পদক্ষেপে আছে। একটি মেয়েকে অন্য পরিবারে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে যে রক্ত ঝরাতে হয়, যে সংগ্রাম করতে হয় সেই সমস্যাগুলো আছে। কিন্তু তার সঙ্গে ধর্মের যোগ কোথায়?
প্রেম মানে আত্মার একাত্মকরণ, আত্মীয়তা। সেখানে ধর্ম, বর্ণ, ভেদাভেদ কোথা থেকে আসে? প্রশ্নটা আপনার কাছে রইল।
- সৌমি জানা
সিপিআই(এমএল) লিবারেশানের ত্রিপুরা রাজ্য কমিটি গত ২২ অক্টোবর এক প্রেস বিবৃতিতে বলে, ১৮ অক্টোবর আমবাসায় জনজাতি মোর্চার প্রদেশ কমিটির সভায় মুখ্যমন্ত্রীর হুঙ্কার — “২০২৩-এর মধ্যে রাজ্য থেকে কমিউনিস্ট বীজ মুছে ফেলতে হবে”। ২১ অক্টোবর সাংসদ প্রতিমা ভৌমিক উদয়পুরে এসে একটি অরাজনৈতিক খুনের ঘটনায় রাজনীতি যুক্ত করে প্রতিশোধের ডাক দিয়েছেন বলে খবরে প্রকাশ। ১৫ অক্টোবর বিহারে নির্বাচনী প্রচারে এসে বিজেপি-র জাতীয় সভাপতি নওয়াদা জেলায় এক নির্বাচনী সভায় বিরোধী মহাজোটকে মুখোশ ও বামপন্থী উগ্রবাদ ও বিধ্বংসকারী শক্তির আসল চেহারা বলে উল্লেখ করেন, যা ত্রিপুরায়, বিহারে তথা জাতীয় রাজনীতিতে বিজেপির চরম রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা ও দুর্বলতাকে দেখিয়ে দেয়। এই ধরনের বক্তব্য আরএসএস ও বিজেপি-র সংখ্যালঘু মুসলিম-দলিত ও কমিউনিস্ট বিরোধী ফ্যাসিবাদী মতাদর্শের অঙ্গ। কারণ গত একত্রিশ মাসের অপশাসনে অতিষ্ঠ হয়ে ত্রিপুরার জনগণ বিজেপি দল ও সরকারের কাছ থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন। বিশেষ করে বিরোধী বামপন্থী আন্দোলনের ওপর তীব্র দমন পীড়নকে পরোয়া না করে জনগণের অংশগ্রহণ ও গণসক্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাতে ভয় পেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। দলে ও সরকারে কোণঠাসা ও স্বদলীয় বিধায়কদের তীব্র বিদ্রোহের মুখে পড়ে ভীত মুখ্যমন্ত্রী দলের অভ্যন্তরে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করার জন্য এই কমিউনিস্ট বিরোধী বিদ্বেষ চাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছেন এবং রণহুঙ্কার দিচ্ছেন। একইভাবে বিহারের নির্বাচনে জনগণের মধ্যে জমে থাকা কেন্দ্র ও রাজ্য নীতীশ সরকার বিরোধী তীব্র ক্রোধ ও আক্রোশের মুখে পড়ে কোনো উপায় না দেখে বামপন্থীদের বিশেষ করে সিপিআই(এমএল)-কে উগ্রবাদী বলে আক্রমণ করছেন। অথচ এখন দেশে ও রাজ্যে সবচেয়ে বড় উগ্রবাদী দল হচ্ছে আরএসএস ও বিজেপি। সরকারী প্রশাসনিক মদতে ভীড় হিংসায়, মিথ্যা এনকাউন্টারের গল্প বানিয়ে এরা মানুষ খুন করে; বলাৎকারীদের পক্ষে দাঁড়ায়, মিছিল করে। বিরোধী দল ও মতকে দমন করে নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াস চালায়। জনগণের রুটি রূজি কেড়ে নেয়। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে বিহারে জনগণের স্বাভাবিক আকাঙ্ক্ষা ও ঐক্যের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে এই মহাজোট। রাম মন্দির, পাকিস্তান ও চীন বিরোধী জিগির তোলার সুযোগ নেই। কাজ, খাদ্য, চাকরি, সবার জন্য শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য, আবাস, নারী সুরক্ষা ও সম মর্যাদা, দলিত, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও পশ্চাদপদ অংশের জন্য সমানাধিকার, সংরক্ষন ও আত্মসম্মান এবার প্রধান ইস্যু। আর জনগণের স্বার্থে এসব প্রশ্নে বামপন্থীরা তথা সিপিআই(এমএল) বিহারে নীচুতলায় গণসক্রিয়তায় এগিয়ে থাকা শক্তি। তাতে ভীত হয়েই তারা এমন প্রলাপ বকছেন। যা গণতন্ত্র ও সংবিধান বিরোধী। আমরা এই ধরনের অগণতান্ত্রিক, সংবিধান বিরোধী ফ্যাসিস্ট মন্তব্যের তীব্র নিন্দা করি ও ধিক্কার জানাই। মানব সভ্যতার ইতিহাসে যতদিন বৈষম্য থাকবে, শোষণ থাকবে, অন্যায় অবিচার ও অত্যাচারী ব্যবস্থা টিকে থাকবে, ততদিন সমাজের প্রয়োজনে কমিউনিস্টরা বেঁচে থাকবে। ততদিন কমিউনিস্টদের কেউ শেষ করতে পারবে না। মুখ্যমন্ত্রী ও বিজেপি নেতাদের এই রাজনৈতিক পাঠ নিতে হবে।
পার্টির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং একসময় পার্টির সদস্য পুলকেশ গোস্বামী গত ২১ অক্টোবর মধ্যরাতে প্রয়াত হন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৬ বছর। কমরেড পুলক সম্পর্কে কমরেড ধীরেশ গোস্বামীর ভাই। কমরেড পুলক সহ পরিবারের তিনজন কোভিড আক্রান্ত হয়েছিলেন, স্ত্রী ও চিকিৎসক মেয়ে রোগমুক্ত হলেও পুলককে ফেরানো যায়নি। পুলকের ২০১৬ সালে কিডনি প্রতিস্থাপন হয়েছিল। ডায়ালেসিস করার চেষ্টা হয়, কিন্তু সম্ভব হয়নি। তাঁর প্রয়াণে পার্টির নেতৃবৃন্দ, বন্ধুবান্ধব জগৎ গভীর শোকপ্রকাশ করেছেন।
পুলক পারিবারিক ও আর্থিক জীবনে কঠোর পরিশ্রম করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। আরও অনেকের মতই প্রয়াত কমরেড অরিজিৎ মিত্র, দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায়দের উষ্ণ সান্নিধ্য উপভোগ করতেন। পুলক আইপিএফ-এর সময় সক্রিয় সদস্য ছিলেন। এছাড়া “চিত্রচেতনা” সংস্থার সাথেও যুক্ত ছিলেন। নদীয়া জেলায় ‘সরকারী সন্ত্রাস’ তথ্যচিত্র নির্মাণে সফরসঙ্গী হয়েছিলেন। খুবই মানবিক ঔদার্যের গুনসম্পন্ন মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। করন্দা গণহত্যার প্রতিবাদে ছুটে যাওয়া, কলকাতায় পার্টি কংগ্রেসের পর প্রকাশ্য জমায়েতের প্রস্তুতিতে দিনরাত এক করে পরিশ্রম করা, এরকম অনেক ভূমিকাই রেখেছেন।
কমরেড পুলক লাল সেলাম।