আজকের দেশব্রতী : ৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ (অনলাইন সংখ্যা)
edde

লেখাগুলির আলাদা আলাদা ফাইল দেখার জন্য ঠিক এর উপরে ক্লিক করুন অথবা লেখার হেডিং-এ ক্লিক করুন

 

polede

তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী হাঁক দিলেন মোদী সরকারের ‘তাণ্ডব’ থামাতে হবে। দলের এক ভার্চুয়াল ছাত্র সমাবেশ থেকে ঐ ডাক শোনানো হল। আহ্বানটা দেশজোড়া প্রেক্ষিতে দিলেও তার বিশেষ লক্ষ্য-উদ্দ্যেশ্য যে বাংলার ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচন, তা চাপা থাকেনি। নেত্রীর মোদ্দা কথা হল, দেশে স্বাধীনতার পুনঃপ্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে হলে বাংলার ছাত্রসমাজ তথা লোকসমাজকে তাঁর পাশে থাকতে হবে, ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে টিএমসি-কে ফের ক্ষমতায়  আনতে হবে।

মত-পথ-চরিত্রের বিচারে মমতা সরকার নিশ্চয় মোদী সরকারের সমতুল্য নয়, অথবা টিএমসি অবশ্যই বিজেপির সমগোত্রের দল নয়। কিন্তু তবু এ প্রশ্ন অসঙ্গত নয় যে, মোদী-তাণ্ডব রুখে দেওয়ার প্রশ্নে মমতার হাঁকডাকের নৈতিক অধিকার থাকে কী করে? তা দাবি করলেও তার আবেদনের সারবস্তু বা কার্যকারিতা কতটুকু?

কেন্দ্রে মোদী জমানা কায়েমের পর থেকে টিএমসি যে বিরোধিতায় সরব হয়নি তা নয়। মুখ খুলেছে মূলত রাজ্যের প্রতি অর্থনৈতিক বঞ্চনা, যুক্তরাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ওপর এককেন্দ্রিক হস্তক্ষেপ চাপিয়ে দেওয়া, বিদ্বেষ-বিভাজনের সমাজনীতি- রাজনীতি এবং নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে। যদিও এনপিআর অভিযান তৃণমূল সরকার প্রথম প্রথম শুরু করে দিয়েছিল, পরে গণক্ষোভের আঁচ পেয়ে গুটিয়ে নেয়। অন্যদিকে, কোভিড অতিমারী ও লক ডাউন অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে মোদী সরকার তান্ডব শুরু করে। কিন্তু দেশের প্রেক্ষিতে বিজেপির বিপ্রতীপে টিএমসি অবস্থান নেয় নামমাত্র কয়েকটি ইস্যুভিত্তিক। কাশ্মীরের ওপর থেকে সাংবিধানিক বিশেষাধিকার প্রত্যাহার, বাবরি মসজিদ ভাঙার মতো অপরাধ ও রামমন্দির প্রতিষ্ঠার শিলান্যাস পূজানুষ্ঠানের বিরুদ্ধে খুব একটা সোচ্চার হয়নি। কয়লা, রেল, খনি, প্রতিরক্ষার মতো মূল মূল ক্ষেত্রের বড় মাত্রায় বেসরকারীকরণের পদক্ষেপ নিয়ে বিশেষ মুখ খোলেনি। তবে কেন্দ্র-রাজ্যের মধ্যে নিষ্ঠুর-নির্লজ্জ বিরোধ বাঁধে পরিযায়ী শ্রমিকদের দায়দয়িত্ব নেওয়া নিয়ে। মমতা সরকার সবচেয়ে সরব কোভিড ও আমফান মোকাবিলার প্রয়োজনে কেন্দ্রের কাছে পর্যাপ্ত আর্থিক সাহায্যের দাবিতে। আর, সদ্য কংগ্রেস ও আর পাঁচটা রাজ্য সরকারের সাথে মিলে জিএসটি ক্ষতিপূরণ এবং জয়েন্ট ও নিট পরীক্ষা সংক্রান্ত ইস্যুতে। কিন্তু এই ধারার মতিগতি টিএমসি-কে আকর্ষণের কোনো নতুন মাত্রা এনে দিতে কাজ দেয়নি। বরং অন্য কিছু ঘটনা ও প্রবণতার কারণে মমতা সরকার সম্মুখীন হচ্ছে জনগণের আরও ক্ষোভ ও অসন্তোষের।

তৃণমূলের অপশাসন চিহ্নিত মূলত তিনটি কারণে – দুর্নীতি, দলতন্ত্র ও দমনতন্ত্র। আর, কোভিড সংক্রমণ, অতিমারী ও লকডাউনের পরিস্থিতিতে তিনটি প্রবণতাই আরও বেড়েছে। শুধু তাই নয়, চরম অপদার্থতা প্রকাশ হয়ে চলেছে সবচেয়ে জরুরী স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে। কোভিড ও আমফান পরিস্থিতিতে রেশন ও সরকারী অন্যান্য ত্রাণ বিলিবণ্টনে, পিপিই সরঞ্জাম কেনার দরপত্র নির্ণয়ে দুর্নীতির কথা চাপা নেই। সবক্ষেত্রেই শাসকদলের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা পাকা, ছড়ি ঘোরাচ্ছে দলতন্ত্র। তার তথ্য মিলেছে জেলায় জেলায় পঞ্চায়েত সূত্রে। দুর্নীতির উৎস সন্ধান ও ব্যবস্থা নেওয়ার নামে মাঝেমধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর পৌরহিত্যে দরবারি আসর বসে, কার্যকরি কিছু হয় না।

টিএমসি যুক্তরাষ্ট্রীয়তার প্রশ্নে যতটা সরব, ততটাই খড়গহস্ত বিরোধী শক্তিগুলোর গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিতে। ত্রাণ কাজে, কোভিড বা অন্যান্য চিকিৎসায় নজরদারী রাখার ব্যাপারে কিংবা রাজনৈতিক কর্মসূচী সংগঠিত করা, সব প্রশ্নেই। বিধিনিষেধের বেড়াজাল তুলে আটকানোর চেষ্টা হয়েছে অন্যদের গণতান্ত্রিক অধিকারকে। শাসকদলের কর্মসূচী রয়েছে বলে আগে লকডাউনের দিন ঘোষণা করেও পরে প্রত্যাহার হয়, আর বিরোধীদের বহুল পরিচিত কর্মসূচী আটকাতে লকডাউন চাপিয়ে রাখা হয়। এমনকি ফ্যাসিস্ত দল বিজেপি অনেক প্রশাসনিক সুবিধা পায়, বাম দলগুলোর আবেদন সচরাচর অনুমোদন পায় না। প্রায়শই নামিয়ে আনা হয় পুলিশী দমন, ফাঁসিয়ে দেওয়া হয় মিথ্যা মামলায়।  লক ডাউন কায়েম রাখতে সাধারণ মানুষের ওপর চলে অমানবিক পুলিশী আচরণ। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এখানে শাসকের উৎপীড়নে অবরুদ্ধ। এখানে চলছে এক অপশাসন। এরাজ্যে বিজেপির অনুপ্রবেশের জন্য টিএমসি যথেষ্ট দায়ী। অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে তার। তাই টিএমসি যখন আবার বিজেপিকে ঠেকানোর একচেটিয়া ঠিকেদারী দাবি করে তখন তার উপযুক্ত বিকল্প তুলে ধরার ভূমিকা নিতে হবে বাম শক্তিকে।

oneree

দুটো টুইটের জন্যে প্রশান্ত ভূষণকে দোষী সাব্যস্ত করে ১০০ পাতারও বেশি এক রায় দেওয়ার পর বিচারপতি অরুণ মিশ্র ও তাঁর সহকর্মীরা আরও একটা লম্বা রায় দিয়ে সাজার পরিমাণ ঘোষণা করলেন। প্রশান্ত ভূষণকে ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে এক টাকা জরিমানা জমা দিতে বলা হয়েছে, আর তা না দিলে তিন মাস কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে এবং তার সাথে তিন বছর ওকালতি পেশার ওপর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে। বুঝতে অসুবিধা হওয়ার নয় যে, প্রশান্ত ভূষণ জরিমানা দেওয়ার বিকল্পটাকেই বেছে নিয়েছেন, কেননা, তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে টুইটগুলোর জন্যে তিনি কোনো মার্জনা ভিক্ষা করবেন না, আর এর জন্য সুপ্রিম কোর্ট আইনসিদ্ধভাবে যে শাস্তি নির্ধারণ করবে তিনি খুশিমনে তাকে মেনে নেবেন।

আদালত অবমাননার এই মামলায় বিচারপতি অরুণ মিশ্র যে দুটো রায় ঘোষণা করেন তার মধ্যে ১৪ আগস্টের রায়ে টুইট দুটোর জন্যে প্রশান্ত ভূষণকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়, আর আদালত চাপ প্রয়োগ করে তাঁর কাছ থেকে মার্জনা ভিক্ষা আদায়ে ব্যর্থ হওয়ার পর ৩১ আগস্টের রায়ে সাজা ঘোষণা করা হয়। ভারতের বিচার বিভাগের ইতিহাসে চূড়ান্ত স্বেচ্ছাচারী ও উদ্ভট রায়গুলো নিয়ে তালিকা তৈরি হলে তার যে কোনো তালিকাতেই এই রায় দুটোর অবশ্যই স্থান হবে। দুটো টুইটকে আদালতের মর্যাদা হানি করা ও তাকে অস্থিতিশীল করে তোলার অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত করার পর তথাকথিত এই গুরুতর অপরাধের শাস্তি স্বরূপ এক টাকার প্রতীকী জরিমানা নির্ধারণ করাটা আদালতের পক্ষে চূড়ান্ত সামঞ্জস্যহীনতার লক্ষণকেই প্রকাশ করে। এই মামলায় আদালত এই ধারণারই জন্ম দিয়েছে যে সে নিজেকে এমন এক সংকটজনক পরিস্থিতিতে নিয়ে গিয়েছিল যেখান থেকে বেরিয়ে আসাটা তার পক্ষে দুরূহ হয়ে দেখা দিয়েছিল।

আমরা কিন্তু গোটা বিষয়টাকে এমন এক বিচ্যুতি বলে গণ্য করতে পারি না যেখানে এই উদ্ভট রায়ের পর সবকিছুকে ভুলে যাওয়া যেতে পারে। আদালত সুস্পষ্টভাবেই একটা দৃষ্টান্তের অবতারণা করে নির্দিষ্ট বার্তা দিতে চেয়েছিল। টুইটার সংস্থার কাছে বার্তাটা ছিল যে তাকে ‘যথোচিত আচরণ’ করতে হবে, তার মঞ্চকে নিয়ন্ত্রিত করতে ও বিধি-নিষেধের নিগড়ে বাঁধতে হবে এবং বিরোধী মত প্রকাশের প্রতি মুক্তহস্ত হলে চলবে না। এবং তা অভপ্রেত ফল দিল। সুপ্রিম কোর্ট তার রায় দেওয়ার আগেই টুইটার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আলোচ্য টুইটজোড়াকে মুলতুবি করে দেয়। ওই বার্তার লক্ষ্য প্রশান্ত ভূষণ এবং আপামর জনসাধারণও ছিল। ভূষণ চাপের কাছে নতিস্বীকার না করলেও সুপ্রিম কোর্ট এই সুযোগে এমন একটা দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করল যাতে করে অন্যান্য সমালোচনামূলক স্বরকে ভয় দেখিয়ে স্তব্ধ করে দেওয়া যায়।

তীব্রতর ফ্যাসিবাদী আক্রমণের মুখোমুখি হয়ে জনগণ ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্রের জন্য যে লড়াই চালাচ্ছেন, তার কাছে এই গোটা আখ্যানটার দুটো গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা রয়েছে। প্রশান্ত ভূষণ জনগণের যে স্বতস্ফূর্ত সমর্থন ও সংহতি পেয়েছেন তা সুস্পষ্টভাবে দেখিয়ে দেয় যে, ভারতের জনগণের বড় অংশই গণতন্ত্রের ক্রমবর্ধমান বিপদ সম্পর্কে সচেতন রয়েছেন এবং তাঁদের সমস্ত শক্তি দিয়ে একে রক্ষা করতে তাঁরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। নিজের অবস্থানে দৃঢ় থেকে এবং চাপের কাছে নতিস্বীকার না করে মার্জনাভিক্ষায় অস্বীকৃত হয়ে প্রশান্ত ভূষণ অত্যন্ত জোরালোভাবেই জনগণের এই অঙ্গীকারকে মূর্ত করেছেন। প্রত্যয়ের এই দৃঢ়তা এবং লড়াইয়ের এই নাছোড় মনোভাব দীর্ঘস্থায়ী লড়াইয়ে জয়ী হওয়ার জন্য অপরিহার্য গুণাবলী। ভীমা কোরেগাঁও মামলায় অভিযুক্ত বারোজন এবং আরো অনেকে যেমন ভোগ করছেন, সেরকমভাবে আমাদের যদি মাসের পর মাস বা বছরের পর বছর জেলে কাটাতে হয়, অথবা আমরা যদি অরুন্ধতি রায়ের মতো একদিনের কারাবাস বা প্রশান্ত ভূষণের জন্য একটাকা জরিমানার মতো লঘু সাজা পেতে সমর্থও হই, সব ক্ষেত্রেই আমাদের এই গুণাবলীর প্রয়োজন।

অন্য শিক্ষাটা হল আইনি সংস্কার এবং বিচারবিভাগের জবাবদিহির বাস্তবায়নের জন্য লড়াই করা। আদালত অবমাননা অথবা দেশদ্রোহ অথবা মানহানি আইনের মতো ঔপনিবেশিক যুগের মতবাদ এবং দানবীয় আইন, অথবা এনএসএ, ইউএপিএ বা আফস্পার মতো আইনগুলোকে নিয়মিতভাবে ব্যবহার করা হয় বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করতে, বিরোধী মত প্রকাশের বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ আনতে এবং বিচার-বহির্ভূত নিপীড়ন ও হিংসা চালানোকে শাস্তিহীন করে তুলতে। স্বাধীন ভারতের সাংবিধানিক গণতন্ত্রে এই আইনগুলোর কোনো স্থান থাকতে পারে না। সর্বশেষ এই ঘটনার পর আইনবিশারদদের আন্তর্জাতিক কমিশনও ভারতের অবমাননার জন্য শাস্তিযোগ্য আইনগুলোকে পুনর্বিবেচনার আবেদন জানিয়েছে। যখন আমরা দেখি যে, ক্ষমতাধর ও সুবিধাভোগীরা নিয়মিতভাবে আইনের শাসনকে লঙ্ঘন করছেন এবং রাষ্ট্র প্রণালীবদ্ধভাবে সাধারণ নাগরিকদের, বিশেষভাবে দরিদ্র ও মতাদর্শগতভাবে বিরোধী ভাবাপন্নদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে ও তাদের ক্ষমতার হানি ঘটাচ্ছে, বিচারবিভাগের জবাবদিহির প্রয়োজন কতটা জরুরি তখন তা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।

আমাদের ইতিহাসে আগস্ট হল প্রতিরোধ ও স্বাধীনতার মাস। ফ্যাসিবাদী জমানা আমাদের ইতিহাসের বিকৃতিসাধন করে তাকে নতুন ধারায় লিখতে চাইছে এবং আরও চাইছে সংবিধানের সার্বিক বিপর্যয় ঘটিয়ে ও জনগণের ওপর দমন চালিয়ে তাদের “বিজয় ও কীর্তিগুলোকে” জাহির করতে। এই সময়ে কিন্তু প্রতিরোধকে তীব্রতর করে তুলে আমাদের বিজয়গুলোর উদযাপন ও সেগুলোকে সংহত করে তোলাটাও জরুরি। খ্যাতনামা আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা ব্লুমসবেরিকে দিল্লীর সাম্প্রদায়িক হিংসা নিয়ে সংঘের দুরভিসন্ধিমূলক আখ্যান প্রকাশ থেকে সরে আসতে বাধ্য করাই হোক, অথবা আদালত অবমাননা মামলায় সুপ্রিম কোর্টের পিছু হটা, এলাহাবাদ হাইকোর্টের ডঃ কফিল খানের মুক্তির নির্দেশ দেওয়া এবং জাতীয় সুরক্ষা আইনে তাঁর ওপর চাপানো অভিযোগ বাতিল করাই হোক – এই ধরনের প্রতিটি ঘটনার নৈতিক যাথার্থ্য প্রতিপাদিত হওয়া ও বিজয়কে পুঁজি করে ন্যায় ও গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলনের নিজেকে অব্যাহত রাখতে ও শক্তিশালী করে তুলতে হবে।

আর এই নৈতিক বিজয়ের মধ্যে দিয়ে ভারতীয় রাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান প্রতিশোধলিপ্সু এবং মজ্জাগত জাতপাতবাদী প্রকৃতি সম্পর্কেও আমাদের আরও বেশি করে অবহিত হতে হবে। প্রশান্ত ভূষণকে মাত্র একটাকা জরিমানা করে অব্যাহতি দেওয়া হলেও আমাদের মনে রাখতে হবে যে মুম্বইয়ের এক দলিত ছাত্র ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কর্মী তরুণ সুবর্ণ সালভের জামিনের জন্য ৫০ লক্ষ টাকার বণ্ড দিতে বলা হয়েছে। জেএনইউ-র ছাত্রছাত্রীদের ওপর ২০২০ সালের জানুয়ারী মাসে এবিভিপি-র হামলার বিরুদ্ধে মুম্বইয়ে শান্তিপূর্ণ সংহতিমূলক প্রতিবাদে অংশ নেওয়ার জন্য তাকে গ্ৰেপ্তার করা হয়। কাফিল খান বা সুবর্ণ সালভেরা মত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার প্রয়োগ করলে রাষ্ট্রের সংখ্যাগুরুবাদী ও মনুবাদী প্রবণতাই তাদের অনেক বেশি বিপন্ন করে তোলে। অতএব বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য লড়াইকে রাষ্ট্রের এই সংখ্যাগুরুবাদী ও মনুবাদী প্রবণতাকেও চ্যালেঞ্জ জানাতে হবে।

(এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ১ সেপ্টেম্বর ২০২০)   

logggr

বিভিন্ন জেলাতে গ্রামীণ গরিবদের আন্দোলন কিছুটা গতি পেতে শুরু করেছে। তার খবরাখবর দেশব্রতীর পাতায় নিয়মিত প্রকাশ হচ্ছে। এই সংখ্যায় পূর্ব বর্ধমানের কিছু অভিজ্ঞতা অন্যতম সংগঠক সজল পালের কলমে --

পুর্ব বর্ধমান জেলায় ‘গ্রামে গ্রামে চলুন, ঘরে ঘরে চলুন’ কর্মসূচীকে সামনে রেখে ঋণ মুক্তি কমিটি সংগঠিত করার উদ্যোগ বিভিন্ন ব্লকের গ্রামাঞ্চলে বিস্তার লাভ করছে।

এপর্যন্ত ৯টা ব্লকে বিভিন্ন ধরনের কমিটি গঠন হয়েছে। নতুন নতুন ব্লকে ও গ্রামে যেমন তৈরি হয়েছে, তেমনই সংগঠনের পুরনো কাজের গ্রামে তৈরি হচ্ছে। কোনও কোনও এলাকায় প্রথম প্রথম অনেকে  মনে করতেন যে তার নিজের এলাকায় সেই পরিস্থিতি নেই। কিন্ত সামান্য উদ্যোগ নিতেই  দেখা যাচ্ছে ব্যাপক মেহনতিদের পরিবারের মহিলাদের অংশগ্রহণ ঘটছে। গ্রামীণ গরিব মেহনতিদের পরিবারের মহিলাদের এক দিকে যেমন রোজগার করার জন্য বিভিন্ন ধরনের কাজ করতে হয় – তাঁতের কাজ, বিড়ির কাজ, সেলাই মেশিনের কাজ, বিভিন্ন ধরনের ইমিটেশন তৈরি, রাখী তৈরির কাজ, জমিতে কৃষি মজুরের কাজ, হাঁস মুরগী গরু ছাগল পালন করার কাজ – তেমনই আবার ঘরের গৃহস্থালীর কাজ করতে হয়। তাছাড়া গ্রামীণ সমাজের প্রচলিত রীতি-নীতিকে মোকাবিলা করেই অনেক ক্ষেত্রে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা সম্ভব হয়। এত প্রতিকুলতা অতিক্রম করেও পরিস্থিতির প্রয়োজনে মহিলারা দলে দলে ঋণ মুক্তির আন্দোলনে সামিল হচ্ছেন। অনেকেই এই আন্দোলনের সফলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

বাস্তব বিষয় হল গ্রামীণ গরিব জনগণের সমস্যার সমাধান করার দাবিতে সংগঠিত করার প্রশ্ন। আয়ারলার পক্ষ থেকে অনেক দাবিই তোলা হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন ধরনের দাবিতে সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। কোথাও ঋণের প্রশ্ন, কোথাও পরিযায়ী শ্রমিকদের কাজ। তার সাথে যুক্ত করেই মনরেগা প্রকল্পের কাজ, মজুরি, আবাস যোজনার ঘর, শৌচাগার, দলবাজি-দুর্নীতির বিরোধিতা ও অন্যান্য গ্রামীণ মেহনতিদের দাবি। আন্দোলনকে বৃহত্তর পরিধিতে বিস্তার ঘটানোর চেষ্টা চালাতে হবে। পুর্ব বর্ধমানে সেই চেষ্টাই চলছে। পুর্বস্থলী-২ ব্লকের মুকশিম পাড়া গ্রাম পঞ্চায়েতে প্রথমে অগ্রগতি শুরু হয়েছে পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে দিয়েই। বর্তমানে ঋণ মুক্তির দাবিতে গত ৩০ আগষ্ট প্রায় ১০০ জন মহিলা বৈঠক করেন বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। তার কিছুক্ষণ পরেই দেখা গেল আরও ৫০ জন মহিলা এসে উপস্থিত হয়েছেন। তাই আবার একবার আলোচনা চলল। শেষ হওয়ার পর রাত আটটার সময় আবার ৪০ জন মত হাজির হলেন এবং আবার আলোচনা চালানো হল। এইসব মহিলাদের বেশিরভাগই সংখ্যালঘু পরিবারের মহিলা। ৩১ আগষ্ট মেড়তলা গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার সিমলা মুসলিম পাড়া ও চণ্ডীপুর গ্রামের মহিলাদের নিয়ে বৈঠক হয়। ২৮ আগষ্ট রায়না ব্লকের বুরার গ্রামে শতাধিক মহিলাদের উপস্থিতিতে বৈঠক হয়। কমিটি গঠন হয়। কালনার আঙ্গারসন গ্রামেও বৈঠক হয়। গণস্বাক্ষর সংগ্রহ ও ১৫ সেপ্টেম্বর জেলা শাসকের কাছে ভেপুটেশন কর্মসূচীর প্রস্তুতি চলছে।

ddeaaa

শহীদ দিবস শিলিগুড়িতে

রাজ্যের অন্যান্য জায়গার সাথে শিলিগুড়ি শক্তিগড় ব্রাঞ্চ কমিটির পক্ষ থেকে বৃষ্টির উপেক্ষা করেই যথাযোগ্য মর্যাদায় স্মরণ করা হয় খাদ্য আন্দোলনের শহীদদের। দাবি করা হয় – খাদ্যের অধিকার প্রত্যেকের বুনিয়াদী অধিকার, গণবন্টনব্যবস্থা শক্তিশালী করে সবার খাদ্য-সুরক্ষা, খাদ্য-নিরাপত্তা সুনিশ্চিত কর। সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন, জেলা সম্পাদক অভিজিত মজুমদার এবং শাশ্বতী সেনগুপ্ত।

যাদবপুরে শহিদ স্মৃতি

১৯৫১ সালের ৩১ আগস্ট যাদবপুর স্টেশনের কাছে সন্ধ্যাবাজার এলাকায় পুলিশের গুলিতে শহিদ হন সন্ন্যাসী সর্দার। যাদবপুর স্টেশনের পাশে সর্দার পাড়ায় তাঁর বাড়ি। ‘শহিদ স্মৃতি রক্ষা কমিটি’-র পক্ষ থেকে ৩১ আগস্ট সন্ধ্যাবাজারে সন্ন্যাসী সর্দারের শহিদ বেদিতে মাল্যদান করা হয়। বিগত দু’বছর ধরে ওই শহিদ বেদি ‘শহিদ স্মৃতি রক্ষা কমিটি’র পক্ষ থেকে সংস্কার করে, রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে। সাথে সাথে, গণআন্দোলনের শহিদদেরও স্মরণ করা হয়। যাদবপুর লোকাল কমিটির সংগঠকদের সাথে স্থানীয় আরএসপি’র প্রতিনিধিরা ও এই কর্মসূচিতে উপস্থিত ছিলেন।

ge

নদীয়ার ধুবুলিয়া ও কৃষ্ণগর

লকডাউনের মধ্যেও নদীয়া জেলায় খাদ্য আন্দোলনের শহীদ স্মরণ  অনুষ্ঠান সংগঠিত হয়। ধুবুলিয়া পার্টি অফিস সংলগ্ন শহীদ বেদীতে মাল্যদান করে পার্টির জেলা সম্পাদক সুবিমল সেনগুপ্ত, রাজ্য নেতা কাজল দত্তগুপ্ত সহ পার্টি কর্মীরা গ্রামীণ গরিবদের অধিকারের দাবি নিয়ে ব্লকে বিক্ষোভ কর্মসূচী নেওয়া এবং গ্রামীণ গরিবদের ঘরে ঘরে যাওয়ার কর্মসূচীকে সফল করে তোলার শপথ গ্রহণ করেন। বহু সংখ্যক গ্রামীণ গরিব মানুষ আজও রেশনকার্ড পায়নি। অনুরূপ কর্মসূচী সংগঠিত হয় কৃষ্ণনগর জেলা পার্টি অফিসে। অংশগ্রহণ করেন স্বপন দাস, নদে সাহা, নীহার ব্যানার্জী প্রমুখ শহর লোকাল কমিটির নেতাকর্মীরা।

দঃ ২৪ পরগণা জেলা

বজবজে জেলা পার্টি অফিসের সামনে ও বাখরাহাটে বিষ্ণুপুর-সাতগাছিয়া লোকাল কমিটির পার্টি অফিসের সামনে সংক্ষিপ্ত কর্মসূচী অনুষ্ঠিত হয়। রক্তপতাকা উত্তোলন করে পার্টি নেতৃত্ব বক্তব্যে তুলে ধরেন আজকের সময়ের খাদ্য অধিকার আন্দোলনের প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলি।

কলকাতায় যৌথ কর্মসূচী

১ সেপ্টেম্বর সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী দিবসে কলকাতার চৌরঙ্গীতে মার্কিন তথ্যকেন্দ্রের পার্শ্ববর্তী এলাকায় ১৭ বাম দলের এক বিক্ষোভ কর্মসূচী সংগঠিত হয়। ঐ স্থান থেকে শুরু করে হোচিমিন মূর্তি পর্যন্ত ফুটপাথে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে বামপন্থী নেতৃবৃন্দ ও কর্মীরা লাল পতাকা প্ল্যাকার্ডে সুসজ্জিত ভাবে স্লোগানের মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। স্লোগান ওঠে – সাম্রাজ্যবাদ, ফ্যাসিবাদ নিপাত যাক। এশিয়া,আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা থেকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ হাত ওঠাও। ভারতীয় উপমহাদেশে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নজরদারি বন্ধ কর। আমেরিকা-ইজরায়েল-ভারত সামরিক অক্ষ বানানো চলবে না। দেশের জল, জঙ্গল, জমি, খনি ও প্রাকৃতিক সম্পদ দেশি বিদেশি কর্পোরেট কোম্পানিকে বিক্রি করা চলবে না। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দোসর ভারতীয় ফ্যাসিবাদ নিপাত যাক।

saf

 

৩১ আগস্ট সকালে ১৯৫৯ সালের খাদ্য আন্দোলন এবং ১৯৯০ সালের মূল্যবৃদ্ধি ও বাসভাড়া বৃদ্ধি বিরোধী আন্দোলনের শহীদ স্মরণে সিপিআই(এমএল) নেতৃবৃন্দ কলকাতার সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে উপস্থিত হন। এছাড়া ১৬টি বাম ও সহযোগী দলের বিভিন্ন রাজ্য নেতৃবৃন্দ সেখানে উপস্থিত হলে সরকারি কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে একজন একজন করে ভেতরে ঢোকার নিয়মবিধির কথা জানানো হয়। বলা হয়, সাংবাদিকরা ভেতরে যাওয়ার অনুমতি পাবেন না, গেটে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। বাম নেতৃবৃন্দ এর তীব্র প্রতিবাদ করেন। তারা জানান, স্বাস্থ্যবিধি মেনে, দূরত্ব বজায় রেখে যদি প্রতিবারের মতো  মাল্যদান ও শহীদ স্মরণ করা হয় তাতে আপত্তি করা হচ্ছে কেন? বিগত ২৮ আগষ্ট এ রাজ্যের শাসকরা তো দিব্যি কলকাতার মেয়ো রোডে তাদের দলীয় কর্মসূচী পালন করেছে, তাহলে বিরোধীদের ক্ষেত্রে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারী করা হচ্ছে কেন? পুলিশ কর্তৃপক্ষ জানায়, উপরের নির্দেশ আছে। এর পর বামপন্থী নেতৃবৃন্দ গণতান্ত্রিক অধিকারের উপর এ জাতীয় হামলার প্রতি ধিক্কার জানিয়ে সারিবদ্ধ ভাবে বাইরে দাঁড়ান। সম্মিলিত স্লোগান সহকারে একজন একজন করে গিয়ে শহীদ বেদীতে মাল্যদান ও শ্রদ্ধা জানিয়ে আসেন।

এছাড়া বেহালার কালিতলা পার্টি অফিসে, বাঘা যতীন মোড়ে, বাঁশদ্রোণির বেলতলায় খাদ্য আন্দোলনের শহিদদের প্রতি সংশ্লিষ্ট এলাকার কর্মীরা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

age15

আদমশুমারি ২০১১ অনুযায়ী প্রায় ৬৫.১% মহিলা শ্রমিক কৃষিকাজের উপর নির্ভরশীল। চাষি বা কৃষিশ্রমিক তারা। সেটা পুরুষ শ্রমিকদের ৪৯.৮% উপস্থিতির বিপরীতে। এনএসএসওর ৬৮তম রাউন্ড ২০১১-১২ : সমস্ত মহিলা শ্রমিকের ৬৩% এবং গ্রামীণ মহিলা কর্মীদের ৭৫% কৃষিতে রয়েছেন।

আইএলও ২০১৯ অনুযায়ী কৃষিতে ৮১% এরও বেশি মহিলা দলিত এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের। আইএইচডিএস ২০১১-১২ ডেটা : গ্রামীণ পরিবারের জমিতে মহিলাদের মালিকানা ৬-১১% এর মধ্যে।

কৃষি আদমশুমারি ২০১৫-২০১৬ : ভারতে নারী-পরিচালিত জমির মালিকানার মোট ১৩.৮৭%, মোট পরিচালিত ক্ষেত্রের প্রায় ১১.৫৭%। এই আদমশুমারিতে কৃষিতে নিযুক্ত হিসাবে প্রায় ৩৬ মিলিয়ন মহিলা কৃষক কৃষি কাজে নিযুক্ত আছে।

নারী কৃষকদের মজুরি, পুরুষদের মজুরির তুলনায় কম। চাষের জমির মালিকানার দিকে নজর দিলেও বৈষম্যটা চোখে পড়ে। আজও ক্ষেতে কাজ করা মহিলারা চাষির মর্যাদা পান না। ফলে নানা রকম সরকারি সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকেন। বীজ, সার, সেচের ব্যবস্থা করতে গিয়ে এবং ফসল বিক্রি করার জন্য বাজারের সংস্থান করতে, ঋণ পেতে গিয়ে মহিলারা নানা বৈষম্যমূলক আচরণের সম্মুখীন হন এবং বর্তমানে পশ্চিমবাংলায় আম্ফান ঝড়ের ব্যাপক প্রভাবের পরে লকডাউনে বিক্রি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ব্যপক ক্ষতির সম্মুখীন মহিলা চাষিরা। তারপরে আছে ঋণের বোঝা। ঋণের দায়ে আত্মহত্যা করা কৃষকের(পুরুষ) ঋণ পরিশোধ করার দায়িত্ব মহিলা কৃষকদেরই বহন করতে হয়।

#যদিনাআমরাগর্জেউঠি প্রতিবাদ কর্মসূচী মহিলা কৃষকদের সমকাজে সমবেতন, ঋণ মুক্তি এবং মহিলা কৃষকদের চাষি হিসেবে স্বীকৃতির দাবিকে সমর্থন জানায়।

aeeer28

করোনা সংক্রমণ এবং তার ফলে দেশজোড়া লকডাউনে দেশের অন্যান্য বর্গের মতোই দেশের মহিলারাও বিপর্যস্ত। সরকারের এই অপরিকল্পিত লকডাউনের ফলে পরিকল্পিত ভাবে শ্রমজীবী মহিলাদের জীবনের অধিকারের প্রশ্ন নিয়ে সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি সহ বিভিন্ন নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে যৌথভাবে দেশ জোড়া প্রতিবাদে সামিল হন হাজার হাজার মহিলারা। পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন জেলায় এই কর্মসূচী সংগঠিত হয়।

augবী

গত ২১ আগস্ট ঔরঙ্গাবাদ জেলার দাউদনগরের আঞ্ছা গ্রামের দলিত টোলায় গুলি চালায় সামন্ততান্ত্রিক রাজপুতদের সংগঠিত বাহিনী। গুলিতে আহত হন ছয় দলিত যাদের সবাইকেই পাটনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত তিনজনকে ছেড়ে দেওয়া হলেও, বাকি তিনজন এখনও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। সিপিআই(এমএল)’র বিহার রাজ্য সম্পাদক কুনাল আঞ্ছা গ্ৰামের ঘটনাকে ধিক্কার জানিয়ে এক বার্তায় বলেছেন, বিহারে সামন্ততান্ত্রিক-সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোর চূড়ান্ত বাড়বাড়ন্ত ঘটেছে, এবং আঞ্ছা গ্রামের ঘটনা তাদের দ্বারা সংঘটিত একের পর এক হিংসাত্মক ঘটনায় একটা সংযোজন মাত্র।

সিপিআই(এমএল)-এর এক তদন্তকারী দল আঞ্ছা গ্রাম পরিদর্শন করেন। ওই দলে ছিলেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও প্রাক্তন বিধায়ক রাজারাম সিং, আরওয়াল জেলা সম্পাদক মহানন্দ, রাজ্য কমিটি সদস্য জিতেন্দ্র যাদব ও রবীন্দ্র যাদব এবং ঔরঙ্গাবাদ জেলা সম্পাদক মুনারিক। তাঁরা জানিয়েছেন, ২১ আগস্টের গুলিচালনার ঘটনার জের রয়েছে ১৪ আগস্টের এক ঘটনার মধ্যে। সেদিন দলিত মহল্লায় ঠাকুর জাতের গান্ধি সিং-এর বাড়িতে জন্মদিনের এক অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে উত্তেজনার সৃষ্টি হয় এবং তার পরিণতিতে গান্ধি সিং-এর ভাইপো ধীরাজ পাশোয়ান নামে এক দলিত যুবককে মোটরসাইকেল দিয়ে ধাক্কা মারে। পরিস্থিতি তখনকার মত শান্ত হলেও ১৯ আগস্ট মুকেশ কুমার ও রোশন কুমার নামে দুই দলিত যুবক বাজার থেকে ফেরার সময় রাজপুত জাতের যুবকদের হাতে প্রহৃত হয়, চিকিৎসার প্রয়োজন হলেও তাদের গ্ৰামের বাইরে যাওয়া থেকে আটকানো হয়। এই নিপীড়নকে মুখ বুজে মেনে না নিয়ে দলিত যুবকরা পরদিন ২০ আগস্ট কয়েকজন রাজপুত যুবককে মারধর করে। এটা হজম করা রাজপুতদের পক্ষে সম্ভব হয় না, ২১ তারিখে গুলিচালনার মধ্যে দিয়ে তারা এর জবাব দেয়। কয়েকজন অল্পের জন্যে মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পায় এবং ছ-জনকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। গুলিচালনার লক্ষ্য দলিত হত্যা ছিল বলেই গ্ৰাম পরিদর্শনকারী তদন্তকারী দলের সদস্যরা জানিয়েছেন।

এই গুলিচালনার বিরুদ্ধে সিপিআই(এমএল) ২৪ আগস্ট রাজ্যব্যাপী প্রতিবাদ সংগঠনের ডাক দেয়। আরওয়াল, জাহানাবাদ, গয়া প্রভৃতি জেলার বিভিন্ন গ্রামে গ্রামবাসীরা এবং সামাজিক আন্দোলনের কর্মীরা ব্যাপক সংখ্যায় প্রতিবাদ আন্দোলনে অংশ নেন। কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রাজারাম সিং পাটনায় বলেন, সামন্ততান্ত্রিক শক্তিগুলো আঞ্ছা গ্রামে আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। সিপিআই(এমএল) গ্রামবাসীদের পাশে দাঁড়ানোয় তারা ভরসা পেয়েছে ও সাহসী হয়ে উঠেছে। তিনি আরও বলেন, দলিত, দরিদ্র ও চরম পশ্চাদপদরা আগামী বিধানসভা নির্বাচনে জনবিরোধী ও সামন্ততান্ত্রিক শক্তিগুলোকে মদতদানকারী নীতীশ সরকারকে শিক্ষা দিতে মনস্থ করেছে।

reaj

নাম সত্যমেব জয়তে। তিনি ছিলেন পঞ্চায়েত প্রধান। কিন্তু তাঁর অপরাধ ছিল যে, উচ্চবর্ণের মাতব্বরদের কথামত না চলে নিজের বিচার বিবেচনা অনুযায়ী স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া। আধিপত্যকারী শক্তিগুলোর পক্ষে দলিত প্রধানের আত্মঘোষণাকে সহ্য করা সম্ভব হয়নি। গত ১৪ আগস্ট আজমগড় জেলার তারওয়ান থানার বাসগাঁও গ্ৰামের বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে তাঁকে হত্যা করেই তারা তাদের প্রতিশোধ স্পৃহাকে চরিতার্থ করে। এই হত্যার প্রতিবাদে গ্ৰামবাসীরা স্থানীয় পুলিশ চৌকি ঘেরাও করলে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ বাধে। গ্ৰামবাসীদের শিক্ষা দিতে আজমগড়ের লালগঞ্জের পুলিশ অফিসার জনগণের ভিড়ে মোটরবাইক চালিয়ে দেন এবং এর পরিণামে ঘটনাস্থলে ১২ বছরের এক কিশোরের মৃত্যু হয়।

ঘটনার তদন্তে সিপিআই(এমএল)-এর তিন সদস্যের একটি দল বাসগাঁও গ্ৰাম পরিদর্শন করে। মৃত গ্ৰাম প্রধানের পরিবারের সদস্য এবং অন্যান্য গ্ৰামবাসীদের সঙ্গে আলোচনার পর সামন্ততান্ত্রিক শক্তিগুলোর উৎপীড়ন এবং পুলিশ-দুর্বৃত্ত আঁতাতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

প্রতিবাদী সভায় সিপিআই(এমএল) নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ বলেন, দলিত প্রধান সত্যমেব জয়তে উচ্চ বর্ণের শক্তিগুলোর কাছে নতি স্বীকার করতে অসম্মত হন বলেই তাঁকে হত্যা করা হয়। তিনি আরও বলেন, আজমগড়ে দুর্বৃত্তরা স্পর্ধিত হয়ে উঠে একের পর এক অপরাধ সংঘটিত করলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয় না। শুধু আজমগড়ই নয়, গোটা উত্তরপ্রদেশেই যোগী সরকার ও তাদের পুলিশ দুর্বৃত্তদের মদত যোগাচ্ছে। দলিত ও দরিদ্রদের কাছে তিনি আবেদন জানান এই অনাচারের বিরুদ্ধে নির্ভয়ে প্রতিবাদ জানানোর। সেদিনের প্রতিবাদ কর্মসূচীর পর রাজ্যপালের উদ্দেশ্যে একটি স্মারকলিপি প্রেরণ করা হয়। তাতে নিম্নলিখিত দাবিগুলি জানানো হয়।

  • নিহত প্রধানের পরিবারকে ন্যূনতম ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং পরিবারের এক জনকে সরকারী চাকরি দিতে হবে।
  • লালগঞ্জের যে পুলিশ অফিসার মোটরবাইক চালিয়ে এক কিশোরকে মেরে ফেলেন, তাঁর বিরুদ্ধে দুর্ঘটনার বিপরীতে হত্যার মামলা রুজু করতে হবে। কিশোরের পরিবারকে কম করে ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
  • দলিত, নারী এবং সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে জেলায় চলা হিংসার ঘটনাগুলো বন্ধ করতে হবে।
  • জেলায় সংঘটিত প্রতিটি অপরাধের ঘটনায় পুলিশ নির্লজ্জভাবে দুর্বৃত্ত ও সামন্ততান্ত্রিক শক্তিগুলোর পক্ষ নিচ্ছে। এক নিরপেক্ষ সংস্থাকে দিয়ে পুলিশ-দুর্বৃত্ত-রাজনীতিবিদ আঁতাতের তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি দিতে হবে।
  • প্রধানের হত্যায় অভিযুক্তদের মধ্যে এখনও পর্যন্ত মাত্র একজনকেই গ্ৰেপ্তার করা হয়েছে। বাকি অভিযুক্তদেরও অবিলম্বে গ্ৰেপ্তার করতে হবে।
moveees

আজকের সময়কালে প্রায় ছয় দশক আগেকার সেই ঐতিহাসিক খাদ্য আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা বা খাদ্য সংকটের বিভিন্ন দিকগুলি নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ চলছে। কিন্তু এই সেদিন হাজার কিলোমিটার পথ হাঁটা পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃতদেহগুলি যেখানে পড়ে ছিলো সেই রেললাইনের পাশেই দেখা গিয়েছিল কয়েকটি পোড়া রুটি! ভাইরাল হয়ে যাওয়া এই ছবিটাই যেন আজ হয়ে উঠেছে দেশের প্রান্তিক মানুষের খাদ্য সংকটের প্রতীক! কেবল এ রাজ্যের গ্রামাঞ্চলের জনসংখ্যার পাঁচ ভাগের একভাগ পরিযায়ী। এটা ২০১১ সালের জনগণনা তথ্য। আজ সেটা নিশ্চিত আরও বেড়েছে। দেখা গেছে ছয়ের দশকে খাদ্য আন্দোলনের সময়কালে গ্রাম থেকে ভুখা মানুষ শহরে আসতো ভাতের ফ্যান চাইতে। আর আজ আসছে দলে দলে কাজের খোঁজে! এভাবেই সংকটের রূপ বদলে গেছে, কিন্তু চরিত্র অপরিবর্তিত। লকডাউনে কর্মহীন এই মেহনতিদের প্রতি দেখা গেলো সরকারের কী নিদারুন বঞ্চনা, অবহেলা! খাদ্যর অধিকারের বড় বড় ভাষণ শোনা যায়! কিন্তু সেটা এদের দেওয়া হয়েছে স্রেফ কাগজে কলমে! অনেক টালবাহানা, দেশ জুড়ে আলোড়নের পর পরিযায়ীদের জন্য বরাদ্দ হয়েছে ফুড কূপন। তাও সেটা লকডাউন চালু হওয়ার দু’মাস পর। একটি সমীক্ষা বলছে যে, ঘরে ফেরা ২০ শতাংশ পরিযায়ীরাও এর সুবিধা পায়নি।

অথচ খাদ্য সংকটকে সামাল দিতে কেন্দ্রীয় খাদ্যসুরক্ষা যোজনা বা রাজ্যের খাদ্যসাথী প্রকল্প নিয়ে প্রচারের ঢাকঢোল বাজানো হচ্ছে। বাস্তবে গরিবরা রেশনে খাদ্যদ্রব্য পাচ্ছে কতটুকু? অধিকাংশরাই পায় দৈনিক ১৬৬ গ্রাম বা মাসে ৫ কেজি চাল! যার মূল্য এক দিনের মজুরির থেকেও কম! কিন্তু লকডাউনে কাজ নেই, অর্থ নেই – সেই চাল ফুটিয়ে গরীবের একবেলা গরম ভাতের গল্পে একটু ডাল বা সব্জীও যে জুটছে না। তা নিয়ে সরকারের কোনো মাথাব্যাথা নেই। বিশেষজ্ঞরা কেউ কেউ একেই বলছেন ‘হিডেন হাঙ্গার’ বা লুকিয়ে থাকা অনাহার বা অর্ধাহার! কেউ বা বলছেন ‘ক্ষুধার প্রজাতন্ত্র!’ এর ফলশ্রুতিতে দেহ-ভর সূচকের হিসাবে দেশের ৪৬ শতাংশ মানুষ আজও অপুষ্টিতে ভুগছে। জাতীয় নমুনা সমীক্ষার রিপোর্ট বলছে শিশুদের ৫৩ শতাংশ অপুষ্টিজনিত রোগাক্রান্ত, আর গুরুতর অপুষ্টিতে রয়েছে ২১ শতাংশ। মানবদেহে প্রয়োজনীয় ন্যুনতম ২৪০০ ক্যালোরির থেকে কম পায় দেশের জনসংখ্যার ১০ ভাগের ৭ ভাগ! এই প্রেক্ষাপটে কখন কোথায় যে অনাহার মৃত্যুর মিছিল হবে বা রেশন নিয়ে বিদ্রোহ শুরু হয়ে যাবে কেউ বলতে পারে না।

দেখা যাচ্ছে সরকারী সংস্কারগুলি সংকট মোচন করতে পারেনি। সৃস্টি করেছে নতুন নতুন সংকটের।

এখন পরিযায়ীদের দিকে তাকিয়ে “এক দেশ এক রেশন কার্ড” এর প্রকল্প ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু করোনা সংকটের অনেক আগেই এবছর কেন্দ্রীয় বাজেটে খাদ্য ভর্তুকি খাতে ৭৮ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। বলা বাহুল্য ভণ্ড কেন্দ্রীয় সরকার এই পদক্ষেপ নিয়েছে সরকারী গণবন্টন ব্যবস্থাকে ধাপে ধাপে তুলে দেওয়ার লক্ষ্যে। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সম্প্রতি লকডাউনের মধ্যেই নতুন অর্ডিন্যান্স জারি করে উঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে খাদ্যদ্রব্য মজুত রাখার সীমা। এ জন্য সংশোধন করা হয়েছে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন। অর্থাৎ এখন থেকে মজুতদারী কালোবাজারিকে বৈধ করে দেওয়া হবে। খাদ্যদ্রব্যর ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করবে কর্পোরেট পুঁজিপতিরা। পাশাপাশি কৃষিপণ্য ব্যবসা সংক্রান্ত আরও দুটি অর্ডিন্যান্সের মধ্য দিয়ে সরকার কৃষিপণ্য ক্রয় বা সরকারী সংগ্রহর দায় থেকে সরে এসেছে। স্বভাবতই গণবন্টন থেকে হাত গুটিয়ে নিয়ে শস্য বা খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহর দায়িত্ব তুলে দেওয়া হচ্ছে কর্পোরেট বা বাণিজ্যিক পুঁজির হাতে। এ রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেস সরকার কৃষি পণ্য বিপনন থেকে সম্পূর্ণ হাত গুটিয়ে নিয়েছে। এ সংক্রান্ত রাজ্যের আইন সংশোধন করে কেন্দ্রীয় নীতির সুরে সুর মিলিয়েছে।

তাই আজ গ্রামে শহরে যে ভয়াবহ খাদ্য সংকট সৃস্টি হয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে জনগণের দাবি হয়ে উঠেছে, লকডাউনে কর্মহীন গরিব মানুষদের প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ করা হচ্ছে না কেন, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার জবাব দাও। করোনা সময়কালে সরকারকে প্রত্যেক ব্যক্তিকে পূর্ণ রেশন দিতে হবে, প্রতি মাসে ইউনিট পিছু ১৫ কেজি চাল/আটা, ১ কেজি তেল, ১ কেজি ডাল, ১ কেজি চিনি দিতে হবে। প্রতিটি পরিবারকে আগামী ৬ মাস মাসিক ৭৫০০ টাকা নগদ অর্থ দাও। রাজ্যের রেশন গ্রাহকদের একাংশের (আরকেএসওয়াই-২) বরাদ্দ অর্ধেক কমিয়ে দেওয়া হলো কেন রাজ্য সরকার জবাব দাও। মূল্যবৃদ্ধি রোধে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের চরম ব্যর্থতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন। ২০০ দিন কাজ ও ৬০০ টাকা মজুরি দাও। এর পাশাপাশি করোনা সংকট সরকারী চিকিৎসার যে চরম অব্যবস্থার চিত্র তুলে ধরেছে তাতে দাবি উঠেছে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় বাড়াও। জাতীয় আয়ের কমপক্ষে ৩ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ করতে হবে।

গত ৩১ আগস্ট ১৯৫৯ সালের খাদ্য আন্দোলন ও ১৯৯০ সালের মূল্যবৃদ্ধি-বিরোধী ও বাসভাড়াবৃদ্ধি বিরোধী আন্দোলনের শহীদ দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়েছে। গণআন্দোলনে লাঠি-গুলি-কালাকানুন জারি করার সেই ধারাবাহিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে তোলা এবং মাঠে ময়দানে সে লড়াই ছড়িয়ে দেওয়া আজ সময়ের দাবি। ছয়ের দশকে গ্রামেগঞ্জে লেগে পড়ে থেকে জনসমর্থন বাড়িয়ে বামপন্থীরা খাদ্য আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। আজও সেই স্পিরিটকে উর্ধ্বে তুলে ধরা প্রয়োজন।

- জয়তু দেশমুখ   

wrewar

কোভিড-১৯ মহামারী। ধারা ১০(২) ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট আইন, ২০০৫ (ডি এম অ্যাক্ট) মোতাবেক কেন্দ্রীয় সরকার ২৪  মার্চ ২০২০ দেশব্যাপী লকডাউন ঘোষণা করেছিল। যা কার্যকরী হয়েছে ২৫ মার্চ ২০২০ থেকে।

২৯ মার্চ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক নির্দেশ দিলেন লকডাউন সময়কার মজুরি/বেতন নির্দিষ্ট সময় দিতে হবে। এই সময় লে-অফ বা কাউকে কাজ থেকে ছাঁটাই করা যাবে না।

এপ্রিল মাসে বেশিরভাগ শিল্প প্রতিষ্ঠান, মার্চ মাসে যতদিন কাজ হয়েছে তারই মজুরি দিয়েছে। শ্রমিক-কর্মচারি এবং ইউনিয়নগুলি বুঝতে পারে, লকডাউনের সময়কার মজুরি পেতে তাদের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। শ্রমিক কর্মচারিরা নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের সামনে ধর্ণা, অবস্থান শুরু করে দিলেন। কেন্দ্রীয় ইউনিয়নগুলো, বিভিন্ন ফেডারেশন এবং কারখানার ইউনিয়নগুলো যৌথভাবে ও এককভাবে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য শ্রম দপ্তরে ভারতের শ্রম বিরোধ আইন ১৯৪৭ মোতাবেক স্মারকলিপি পাঠিয়ে দেয়। শিল্প প্রতিষ্ঠানের ‘স্ট্যান্ডিং অর্ডার’ যেখানে মহামারীতে মজুরি দেওয়ার কথা উল্লেখ আছে, স্মারকলিপির সাথে তা জুড়ে দেওয়া হয়। উল্লেখ করা হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নির্দেশিকাটি।

শ্রমিক অসন্তোষ ক্রমশ বাড়তে থাকে। শ্রমিক অসন্তোষ ঠেকাতে কারখানা কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে ৪০০০/৫০০০ টাকা অগ্রিম দিয়েছে। শর্ত, কারখানায় কাজ চালু হওয়ার পর বেতন থেকে কয়েকটা কিস্তিতে কর্তৃপক্ষ এই টাকা কেটে নেবেন। এখানে নিয়োগকর্তার স্বার্থ ছিল – লকডাউন উঠে গেলে কাজের লোক পেতে যাতে অসুবিধা না হয়, তার জন্যে অগ্রিম দেওয়া।

মহামারী ও লকডাউনের জন্যে নিয়োগকারীরা এবং সরকার ছিল সুবিধাজনক অবস্থায়, ইউনিয়ন কিছুটা অসুবিধাজনক পরিস্তিতিতে ছিল। এদিকে কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার করোনা পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে শ্রমিক প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনার জন্য কোনো সময় দিলেন না। কেন্দ্রের শাসকেরা সমস্ত ক্ষেত্রে যেমন এক তরফা সিদ্ধান্ত নেয় এই ক্ষেত্রেও তাই করা হল।

ইতিমধ্যে নিয়োগকর্তারা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নির্দেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টের দ্বারস্থ হলেন। ১৮ মে শুনানিতে সুপ্রিমকোর্ট নির্দেশ দিল লকডাউনের মধ্যে বেতন দিতে না পারলে বেসরকারী সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। এই নির্দেশ জুলাই মাস পর্যন্ত থাকবে। এই সুযোগে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক লকডাউনে বাধ্যতামূলক মজুরি দেওয়ার যে নির্দেশিকা জারি করেছিল তা প্রত্যাহার করে নিল। এর ফল যা দাঁড়ায় তা হল লকডাউনের বেতন বিশবাঁও জলে চলে গেল। কাজ থেকে বসিয়ে দেওয়া বা ছাঁটাই করা বৈধতা পেল। ১ জুন থেকে আনলক শুরু, লকডাউনের সময়কার মজুরির প্রশ্নটি পিছনে চলে গেল। এখন চলছে আনলক-৪ পর্ব।

২১ আগস্ট ২০২০ ইএসআইসি’র ১২৮তম সভায় কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী সন্তোষ গাঙ্গোয়ার প্রস্তাবে ‘অটল বিমিত ব্যক্তি যোজনা’ ইএসআইসি’র একটি প্রকল্প ছিল তার নিয়ম শিথিল করা হয়েছে। এবং লকডাউনে কাজ হারানো শ্রমিকদের বেকার ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। একজন কাজ হারানো শ্রমিক ৯০ দিনের অর্থাৎ তিন মাসের বেতনের ৫০ শতাংশ পাবেন। খবরে প্রকাশ কোভিড মহামারী লকডাউনের ফলে সংগঠিত ক্ষেত্রে ১ কোটি ৮৯ লক্ষ শ্রমিক কর্মচারি এবং অসংগঠিত ক্ষেত্র মিলে মোট ১২ কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছেন। ইএসআই অন্তর্ভুক্ত শ্রমিকদের মধ্যে ৪২ লক্ষ শ্রমিক কর্মচারি কর্মচ্যুত হয়েছেন। কাজ হারানো বা কর্মচ্যুতি নামে ছাঁটাইকে সহনীয় করা হচ্ছে। চালু হল বেকার ভাতার নামে দু’বছরের জন্য ছাঁটাই ভাতা। কাজ হারানো ইএসআই অন্তর্ভুক্ত শ্রমিকরা এই সুবিধা পাবেন। কাজ হারানো ব্যক্তি ২৪ মার্চ ২০২০ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত তিন মাসের বেতনের ৫০ শতাংশ পাবেন। ১ জানুয়ারী ২০২১ থেকে ১ জুন ২০২১ পর্যন্ত আগের নিয়মের ২৫ শতাংশ ভাতা পাবেন। এই যোজনায় নাম নথিভুক্ত করতে হলে যা আবশ্যক তা হল, কর্মহীন হওয়ার আগে অন্তত দু’বছর পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে ইএসআই তহবিলে আইপি’র চাঁদা জমা থাকতে হবে। কর্মহীন হওয়ার ঠিক আগে টানা ৭৮ দিনের তহবিলে চাঁদা জমা থাকতে হবে। আর, কাজ হারানোর দু’বছর আগে কোনো একটা ত্রৈমাসিকের কোন একটিতে ন্যূনতম ৭৮ দিন তার চাঁদা জমা থাকতে হবে। এই তিনটি শর্ত পূর্ণ হলেই নাম নথিভুক্ত করা যাবে। অন্যথায় হবে না। কর্মী নিজেই ইএসআই ব্রাঞ্চে ক্লেইম করতে পারবেন। তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা জমা হবে। এখানে নিয়োগকর্তার কোনো ভূমিকা নেই। ইএসআই-এ শ্রমিক কর্মচারিদের দেওয়া চাঁদা জমা আছে ২২,২৭৯ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় সরকার এই তহবিল থেকে ৭০০ কোটি টাকা বেকার ভাতা হিসাবে খরচ করবে।

চারিদিকে ঢাকঢোল পেটানো চলছে, কেন্দ্রীয় সরকার বেকার ভাতা দিচ্ছে। শ্রমিকের দাবি ছিল লকডাউন-মজুরি, হাতে পেল ছাঁটাই ভাতা। কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষ এই ৬ মাস কাজ হারিয়েছেন বা ছাঁটাই হয়েছেন। তারা ২ বছরের বেকার ভাতা হাতে নিয়ে সারা জীবন সংসার চালাবেন! ভয়ঙ্কর দিন। সরকার, বিচার ব্যবস্থা, শিল্পপতিদের রামধুন চলছে। মিথ্যা প্রচার আর কথার ফুলঝুরিতে সরকার নিজেদের সমস্ত অক্ষমতা শুধু নয়, অন্যায়গুলোকে ঢাকতে ব্যস্ত। এদিকে মানুষ পথে বসতে চলেছে।

- নবেন্দু দাশগুপ্ত   

lowsan

গভীর সংকটের আবর্তে নিমজ্জিত দেশের অর্থনীতি। শাসক ও তাদের পোষমানা খাঁচাবন্দী নীতিকারেরা এই নির্মম বাস্তবকে যতই এড়ানোর চেষ্টা করুক না কেন, এবার দেশের শীর্ষ ব্যাঙ্ক এমন বার্তা বহন করে আনলো যা মোটেই সুখকর নয়। ২৫ আগস্ট, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক প্রকাশ করলো ২০১৯-২০’র বার্ষিক রিপোর্ট। বেশ কিছু অপ্রিয় সত্যের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে তারা দিয়েছে কিছু প্রস্তাব, এরআগে, বহুবার যা অনেক প্রথিতযশা অর্থশাস্ত্রী দিয়ে এসেছেন, আর প্রতিবারই যা চরম ঔদ্ধত্যের সাথে নাকচ করেছে মোদী সরকার।

রিজার্ভ ব্যাঙ্ক যে ইঙ্গিত দিয়েছে তা হলো ভারত এবার ঢলে পড়তে চলেছে গভীর মন্দার কোলে। পরপর দুটি ত্রৈমাসিকে বৃদ্ধির হার নেমে গেছে শূন্যের নীচে। ২০০৮ সালে বিশ্বব্যাপী যে ফাইনান্সিয়াল মেল্টডাউন ভারতকে হানা দেয় তা ছিল মূলত ফাইনান্সিয়াল সেক্টরের মধ্যে সীমায়িত। কিন্তু এবারের কোভিড-১৯’র থাবা আরও অনেক ব্যাপ্ত, সর্বগ্রাসী, গভীর। যা চাহিদা ও জোগান, এই দুটো ক্ষেত্রকেই লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। শুধু আমাদের দেশেই নয়, বিশ্বজুড়ে। ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছে বিশ্বায়িত গ্লোবাল সাপ্লাই চেন বা শৃঙ্খলকে। তুলনামূলক মজবুত ভিতের উপর দাঁড়িয়ে থাকা ভারতের  রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্ক ২০০৮’র ফিনান্সিয়াল সংকটকে বেশ কিছুটা ঠেকাতে পেরেছিল। কিন্তু এবারের সংকট অভূতপূর্ব। তাই তাকে মোকাবিলার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রমী নজীরবিহীন পদক্ষেপের জন্য সমস্ত প্রতিষ্ঠান আবেদন জানায়। চাহিদা বাড়াও, লক্ষ-কোটি কাজ হারা কর্মক্ষম মানুষের হাতে এই মুহূর্তে তুলে দাও নগদ টাকা, সবাইকে দাও অন্তত ৬ মাস নিখরচায় রেশন। অত্যন্ত রক্ষণশীল শাসকগোষ্ঠী আবার তাদের নিজ নিজ দেশে অস্তাচলে পাঠানো রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোকে মজবুত করার পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রেটিং সংস্থার তরফ থেকে অবমূল্যায়নের আশঙ্কায় না ভুগে, ক্রমবর্ধমান রাজকোষ ঘাটতি বা বেড়ে যাওয়া মূল্যস্ফীতির দিকে না তাকিয়ে সরকারকে দু’হাতে ঢালাও খরচ করতে হবে। পরিকাঠামোর মতো ক্ষেত্রগুলোতে বিপুল পরিমাণে বিনিয়োগ করলে তৈরি হবে স্থায়ী সম্পদ আর তারই হাত ধরে চাঙ্গা হবে পণ্য পরিষেবার চাহিদা। কাজ হারা অনেক মানুষ কাজ পাবেন, বাড়বে বেতন আর তা খরচ করলে বৃদ্ধি পাবে চাহিদা। অবশেষে, গভীর খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে থাকা অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে এমন সব প্রস্তাব দিল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, তার সদ্য প্রকাশিত বার্ষিক রিপোর্টে।

রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জানিয়েছে, লকডাউন তুলে নেওয়ার পর মে-জুন মাসে  যেটুকু চাঙ্গাভাব লক্ষ্য করা গেছিল তা শক্তি হারায় জুলাই-আগস্টে এসে। শহরাঞ্চলে চাহিদার বিপুল ঘাটতি অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার ক্ষেত্রে বিরাট এক বাধা। তুলনামূলকভাবে বহুদিন পর ভালো বর্ষার কারণে গ্রামাঞ্চলে চাহিদা বৃদ্ধি বাড়লেও নিজ নিজ গ্রামে ফিরে আসা পরিযায়ী শ্রমিকদের পরিঘটনা, কর্মচ্যুতি ও নিম্নগামী মজুরি চাহিদা বৃদ্ধির পথে অন্তরায় হয়ে থাকছে। শহরাঞ্চলে স্বনিযুক্ত ও ক্যাজুয়াল শ্রমিকদের মিলিত সংখ্যার হার ৫১.৩%। আর, অতিমারী এই বিপুল জনসংখ্যার কর্মসংস্থান কেড়ে নেওয়ায় তা শহুরে অর্থনীতির উপর জোরালো আঘাত হেনেছে। গ্রামাঞ্চলেও প্রায় ৪০ শতাংশ ক্যাজুয়াল শ্রমিক নির্মাণ শিল্পের সাথে যুক্ত। লকডাউন সব কিছু স্তব্ধ করে দেওয়ায় এই ক্ষেত্রটিও মুখ থুবড়ে পড়েছে। লকডাউনের ফলে নিদারুণ এই কর্মচ্যুতি আর্থিক কর্মকান্ডে এতটাই প্রভাব ফেলেছে যে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মতে ২০২১’র অর্থবর্ষের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক পর্যন্ত তা গড়াবে।

সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী জিএসটি’র ক্ষতিপূরণ রাজ্যগুলোকে না দেওয়ার ক্ষেত্রে কোভিড-১৯’র ‘দৈবদুর্বিপাক’-এর দিকে আঙ্গুল তুলেছেন। কিন্তু আমরা সকলেই জানি যে এ দেশে কোভিড-১৯ হানা দেওয়ার আগে দেশের অর্থনীতি মোটেই এক সাজানো বাগান ছিল না। বিগত চার দশকে সর্বাধিক বেকারত্বের পাশাপাশি আর্থিক বৃদ্ধি ঠেকেছিল তলানিতে। নাভিশ্বাস উঠেছিল গ্রামীণ অর্থনীতির। তার সাথে যুক্ত হয় ব্যাঙ্কের বিপুল বহরের অনাদায়ী ঋণ, ইয়েস ব্যাঙ্কের পতন প্রভৃতি নানা সংকটের ফাঁদ। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রিপোর্ট জানাচ্ছে, পূর্বের অর্থবর্ষে ব্যাঙ্ক জালিয়াতির সংখ্যা লাফ দিয়ে বেড়েছে দ্বিগুণ, ২০১৮’র অর্থবর্ষে ব্যাঙ্ক জালিয়াতির ঘটনা ৫,৯০০ থেকে ২০১৯’র অর্থবর্ষে বেড়ে হয়েছে ৬,৮০০ যা মোট মূল্যের ৭৪ শতাংশ। যথারীতি, সরকারি ভাষ্যের সাথে গলা মেলানো রিজার্ভ ব্যাঙ্ক প্রাক প্যান্ডেমিক আর্থিক পরিস্থিতিতে যে নাছোড় স্লোডাউন চলছিল তা স্বীকার করেনি। সে তার রিপোর্টে প্রাক কোভিড অবস্থায় ফিরে যেতেই সরকারকে বিনিয়োগের দাওয়াই দিয়েছে, পরামর্শ দিয়েছে চাহিদা বৃদ্ধির জন্য সরকারি হস্তক্ষেপের। মনে রাখা দরকার, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কোনো উচ্চাকাঙ্খী লক্ষ্যমাত্রা না বেঁধে এক রক্ষণাত্বক অবস্থান থেকে  প্রাক-প্যান্ডেমিক স্লোডাউনের অবস্থায় ফিরে যেতে কিছু সুপারিশ করেছে, আর, একই নিঃশ্বাসে অবিলম্বে অন্তত চারটি লাভজনক সুবৃহৎ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিপিসিএল, কন্টেনার কর্পোরেশন, শিপিং কর্পোরেশন ও আইডিবিআই’র বিলগ্নিকরণের প্রস্তাব দিয়েছে, যার মাধ্যমে সরকারী কোষাগারে আসবে বিপুল রাজস্ব। আর, মোদীর ‘আত্মনির্ভর’ ভারতের আড়ালেই রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রগুলোর ঢালাও বেসরকারীকরণ, বিলগ্নিকরণের দেশ বিক্রির দাওয়াই।

gss

 

যে আইএমএফ, বিশ্বব্যাঙ্কের নির্দেশিত ‘উন্নয়নী’ মডেল ধরেই ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের আর্থিক গতিপথ তৈরি করেছিল, সেই আইএমএফ প্যান্ডেমিক পরবর্তী দুনিয়ায় আর্থিক কর্মকান্ড বিকাশের জন্য সরকারকে বিপুল পরিমাণে টাকা খরচ করার নিদান দিয়েছে। আইএমএফ’র প্রস্তাব, অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে  সরকার লগ্নি করুক স্বাস্থ্য-শিক্ষা-গবেষণা-পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি-পরিকাঠামো প্রভৃতি ক্ষেত্রে, আর প্রগতিশীল কর-এর প্রবর্তন করুক। যার যত বেশি আয়, সরকার তার থেকে তত বেশি কর নিক। কাজ হারা মানুষদের আর্থিক সাহায্য করুক। আর, সবচেয়ে বড় যে কথাটা বলেছে, অর্থনীতিকে সচল করতে এই সময়ে অনেক বেশি বেড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর গুরুত্ব। ৩ এপ্রিল লন্ডনের ফিনান্সিয়াল টাইমস তার সম্পাদকীয় নিবন্ধে লিখেছে, বিগত চার দশক ধরে পলিসির যে গতিমুখ ছিল, তার আমূল বদল ঘটিয়ে নতুন নীতি সামনে আনতে হবে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে আরো সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে সরকারকে। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগকে বোঝা হিসাবে না দেখে বিনিয়োগের উপর জোর দেওয়াটা জরুরি। যে শ্রম বাজার হয়ে উঠেছে মারাত্বক ঝুঁকিপূর্ণ, সেটাকে সুরক্ষিত করতে হবে। সম্পদের পুনর্বন্টনকে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে এক অ্যাজেন্ডা হিসাবে। যে নীতিগুলোকে এতদিন পাগলামো বলে গণ্য করা হতো, যেমন, বুনিয়াদী বা বেসিক আয়, সম্পত্তি কর, তার একটা মিশেল চালু করা দরকার। বাম অর্থশাস্ত্রীরা এতদিন যে সমস্ত কথা বলে আসছিলেন, আজ বিদেশের সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত মুখপত্র ফিনান্সিয়াল টাইমস স্বীকার করে নিচ্ছে যে বিগত চার দশক ধরে চলা আর্থিক নীতিমালা আজ অচল হয়ে গেছে। পরিহাস এটাই, গতবছর ব্রিটেনে নির্বাচনের সময়ে ব্রিটিশ লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন সম্পদের পুনর্বিন্যাসের অ্যাজেন্ডা সামনে নিয়ে আসায় এই ফিনান্সিয়াল টাইমস তীব্র সমালোচনা করে সম্পাদকীয় নিবন্ধ লেখে। তারা বলে এটা হচ্ছে ব্যবসার উপর আঘাত, আর ব্যবসার উপর আঘাতের অর্থ সম্পদ সৃষ্টির উপর আঘাত, যা শেষ বিচারে গণতন্ত্রের উপর হামলার সামিল। আজ তারাই সম্পূর্ণ বিপরীত কথা বলছে।

তবে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক স্বীকার করেছে যে অর্থনীতিকে গতি দিতে গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে অর্থমন্ত্রী বিনিয়োগ বাড়াতে কর্পোরেট সংস্থাকে যে বিপুল করছাড় ও অন্যান্য আর্থিক সুযোগ সুবিধা দিয়েছিলেন তা পুরোপুরি জলে গেছে। দেশীয় সংস্থাগুলোর জন্য ২২ শতাংশ ও নতুন দেশজ উৎপাদনভিত্তিক সংস্থাগুলোর জন্য ১৫ শতাংশ করছাড় সহ নানান ছাড় বাবদ রাজকোষ থেকে বাৎসরিক যে ১.৪৫ লক্ষ কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয়েছিল, সেই সুবিধা নিয়ে কর্পোরেট সংস্থাগুলো নিজেদের বকেয়া ধার দেনা মিটিয়েছে, বা নগদ সঞ্চয় করেছে, কিন্তু নতুন বিনিয়োগ করেনি। এমনকি মার্চে লকডাউন ঘোষিত হওয়ার পর বৃদ্ধিকে গতি দিতে এবং ফাইনান্সিয়াল ব্যবস্থাকে সবল করতে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক যে বিভিন্ন খাতে ১০ লক্ষ কোটি টাকা (নানা খাতে ঋণ বাবদ) সঞ্চালিত করে, তাও কোনো কাজে এলো না। রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগের পথ ধরে চাহিদা বাড়ানোর বদলে মোদী সরকার মে মাসে কুড়ি লক্ষ কোটি টাকার যে আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল তা বাস্তবে চার লক্ষ কোটি টাকার গন্ডি টপকাতে পারেনি। কিন্তু অর্থশাস্ত্রীরা বার বার বলেছিলেন অন্তত দশ লক্ষ কোটি টাকা, যা জিডিপির দশ শতাংশ অতিরিক্ত খরচ না করলে আর্থিক বৃদ্ধির রাস্তা সুগম হবে না। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার নগদের বদলে গোড়া থেকেই ঋণ প্রদানের মাধ্যমে পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করতে চেয়েছিল। অর্থনীতির নির্মম বাস্তব প্রমাণ করলো রিজার্ভ ব্যাঙ্ক যে বিরাট বহরের ঋণ স্টিমুলাস দিয়েছিল তাতে চিড়ে ভিজলো না।

রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জানিয়েছে, ক্রেতাদের আত্মবিশ্বাস একেবারে তলানিতে ঠেকেছে, আজ পর্যন্ত এতো নীচে তা কখনো নামেনি। কাজ হারানো, মূল্যস্ফীতি, আয়ের ক্ষেত্রে বিরাট মাত্রায় সংকোচন চরম হতাশার জন্ম দিয়েছে, যা বাজারকে গতি দিতে দুস্তর এক বাধা। আবার এই অতিমারী নগ্নভাবে উন্মোচিত করেছে বৈষম্য। এক শ্রেণির কর্মীরা যেমন পেয়েছেন বাড়ি থেকে কাজ করার সুবিধা, অপরদিকে বহু কর্মী, যেমন সাফাইকর্মী, পরিবহনকর্মী, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সাথে যুক্ত কর্মী, সমাজের দরিদ্রতম অংশকে এই অতিমারীর সমূহ বিপদ মাথায় নিয়ে পুরোভাগে দাঁড়িয়ে কাজ করে যেতে হয়েছে, যার সর্বোচ্চ মাশুলও দিতে হয়েছে এই অংশটিকে।

গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করে ৩১ আগস্ট কেন্দ্রীয় সরকারের দু’টি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রক প্রকাশ করলো অর্থনীতির দু’টো বিবর্ণ ছবি। এক, গত বছরের সাপেক্ষে, এবছর এপ্রিল-জুন-এর ত্রৈমাসিকে দেশের জিডিপি ২৩.৯ শতাংশ নীচে নেমে গেছে আর দ্বিতীয় তথ্যটি হলো, পরিকাঠামোর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত আটটি মূল বা কোর ক্ষেত্রের উৎপাদন পর পর পাঁচ মাস যাবৎ হ্রাস পেতে পেতে এই জুলাই মাসে কমেছে ৯.৬ শতাংশ। সার বাদে, কয়লা-অপরিশোধিত তেল-প্রাকৃতিক গ্যাস-রিফাইনারি-ইস্পাত-সিমেন্ট-বিদ্যুত ক্ষেত্রে জুলাই মাস পর্যন্ত বৃদ্ধির হার ঋণাত্বক।

৩০ আগস্ট ভারতে একদিনে করোনায় সংক্রামিত হলেন ৭৮ হাজার ৭৬১ জন। এরআগে বিশ্বে কোভিডে আর কোনো দেশে একদিনে এত বিপুল সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হননি। বিশেষজ্ঞদের মতে ভারতে সংক্রমণের গতি পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি। আর এই ভয়ংকর বিপন্ন সময়ে ভাবলেশহীন চরম অসংবেদী প্রধানমন্ত্রী মজে আছেন ময়ূরের কেকা রবে, পেখমের সৌন্দর্যে। অর্থনীতি যখন জাহান্নামে তখন তার আগুণে বসে ভারতকে আন্তর্জাতিক খেলনার হাবে পরিণত করতে, সেরা জাতের দেশীয় সারমেয় প্রজননের পরামর্শ দিচ্ছেন দেশবাসীকে।

এই গভীর দুর্দিনে মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে নির্দয় রাষ্ট্রনায়কদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের পতাকাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে।

 - অতনু চক্রবর্তী  

cregar

সম্প্রতি জোম্যাটো তার মহিলা কর্মচারিদের জন্য ঋতুকালীন সময়ে সবেতন ছুটি ঘোষণা করেছে এবং তা নিয়ে নেট দুনিয়া ও বিভিন্ন মহলে তুমুল শোরগোল শুরু হয়েছে। অতঃপর যেকোনো বিতর্কের নির্দিষ্ট প্যাটার্ন অনুযায়ী যুক্তি ও বিরুদ্ধতার কাড়া-নাকাড়া ক্রমাগত বেজে চলেছে। এই বৌদ্ধিক বিরোধিতার দু’পক্ষই নানারকম আশঙ্কা ও সম্ভাবনার বিষয়ে চিন্তা ব্যক্ত করছেন ও একই সাথে বিষয়টির স্থায়িত্ব ও ফলাফলের বিষয়ে নির্দিষ্ট বোঝাপড়ায় আসতে চাইছেন।

বলা হচ্ছে, লড়াইয়ের নানা ঘাত-প্রতিঘাতে বহুপথ অতিক্রম করে এসে বর্তমানে যতটুকু সমানাধিকার মহিলারা আদায় করে নিতে পেরেছেন তা এই ‘অতিরিক্ত সুবিধা’ পাওয়ার সিদ্ধান্তের ফলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হবে না তো, মহিলাদের সেই লড়াই আবার নতুন করে লড়তে হবে না তো? অথবা, বায়োলজিক্যাল সমস্যার জন্য তো মেডিক্যাল লিভ আছেই, তেমন হলে মেডিক্যাল লিভের এক্সটেনশন হোক; সমস্ত মহিলার জন্যই যে ঋতুকালীন ছুটি আবশ্যিক, এটা ভেবে নেওয়া হচ্ছে কেন, অতিপ্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে তো মেডিক্যাল লিভের এক্সটেনশনই যথেষ্ট। আর তা যদি এক্সটেনডেড হয়ই, তাহলে তা পুরুষদের জন্যও কেন নয়! কারণ পুরুষদেরও অনেক সময়ে স্বাস্থ্যের কারণে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, যা হয়তো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অজানা। ইত্যাদি ইত্যাদি।

এ প্রসঙ্গে সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির সম্পাদক ও নারী আন্দোলনের মুখ কবিতা কৃষ্ণান বলেছেন, বিশ্বজুড়ে এমনিতেই মহিলারা অসম ব্যবস্থা ও বৈষম্যমূলক পদ্ধতির মধ্যেই কাজকর্ম করে থাকেন এবং ঋতুচক্র সেক্ষেত্রে বাড়তি এক বোঝা ছাড়া অন্য কিছু নয়। এই সময়ের শারীরিক কষ্টানুভূতি ও মানসিক চাপ প্রকাশ করলেই কি পুরুষতান্ত্রিক ভাবনাচিন্তা অনুযায়ী এটাই ধরে নেওয়া হবে যে মহিলারা পুরুষদের মতো অতটা কাজের নয়?

সামাজিক সত্তা তো বটেই, প্রকৃতিগতভাবেই নারী ও পুরুষের শারীরিক গঠন আলাদা হয়। তবে কেন কর্মক্ষেত্রেও সেটা সার্বজনীনভাবে গৃহীত হবে না! নাকি আমরা সেই সনাতনী ক্যাপিটালিস্ট ভাবধারা ‘এক ছাঁচে সবকিছু ফেলে’ প্রগতির পথের দূরত্ব মাপব? তাহলে ‘শারিরীক ক্ষমতা ও নিজস্বতার বিভিন্নতা’ হিসেবে এনে কর্মচারিদের উৎপাদনশীলতা সর্বোত্তম করতে কর্মক্ষেত্রেও বিবিধ পরিসর থাকার কথা যে বলা হয় তার কী হবে?

সেই ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে চলমান নারী আন্দোলনের বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতেই আট ঘণ্টা শ্রম দিবস, সপ্তাহান্তে ছুটি, বাথরুম বিরতি, খাবার বিরতি ইত্যাদি আদায় করা গেছে, এমনকি নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমোনোর অধিকারের জন্যও কম লড়াই হয়নি। আর এই সমস্ত জয়কেই পুঁজিবাদী ব্যবস্থাপনা ‘কাজের সময় নষ্ট’ বা, বলা ভালো ‘টাইম স্টোলেন ফ্রম লেবার টাইম’ অভিধায় অভিহিত করে থাকে। প্রথমবার লাগু হওয়া ঋতুকালীন ছুটিকেও ‘অপ্রয়োজনীয় ও শ্রমসময় চুরি’ বলেই প্রচার করা হবে। কিন্তু আখেরে উপকৃত হবেন মহিলা কর্মচারিরাই। সমস্ত শারীরিক ও সামাজিক ভেদাভেদের কথা মাথায় রেখে কর্মক্ষেত্রের কর্মসম্পাদনের ব্যবস্থা তো এমনই হওয়া উচিত যাতে সমস্ত ধরনের কর্মচারিরা আরও সুবিধাজনক পরিসরে নিজেদের উৎপাদনশীলতাকে সর্বোত্তম করে কর্মক্ষেত্রকেই আরও প্রসারিত করতে পারে।

আমাদের একথা বুঝতে হবে যে, মেডিক্যাল লিভ বাড়ানো কমানোর সাথে ঋতুকালীন ছুটির কোনও সম্পর্ক নেই। ঋতুকালীন ছুটি স্বতন্ত্র ও নির্দিষ্ট স্বাধীনতার দাবি। প্রয়োজনে সকলের জন্যই মেডিক্যাল লিভ বাড়ালে তা তো ভালোই, তাতে কর্মচারিদের জন্য ভালোই হবে। কিন্তু ঋতুস্রাব বা তজ্জনিত অসুস্থতা, দুর্বলতা বা অস্বস্তি তো মেডিক্যাল ইস্যু নয়, বরং ঋতুস্রাব স্বাভাবিক ও ধারাবাহিক বিষয় এবং এটা কোনও রোগ নয়। ঋতুস্রাবের সাথে মহিলাদের স্বাভাবিক উৎপাদনশীলতার ওতপ্রোত সম্পর্ক, আর সেই উৎপাদনশীলতার সম্মান ও স্বীকৃতিই হলো ঋতুকালীন ছুটি।

এই পথে ব্যক্তি-বিভিন্নতার নিরীখে কর্মক্ষেত্রের পরিসরের দাবি তোলার সাথে সাথেই সার্বিক ভাবে সারা দেশে ঋতুকালীন সময় নিয়ে যে অসচেতনতা, কুসংস্কার ও ছুৎমার্গ বজায় আছে তার বিরুদ্ধেও আমাদের লড়াই জারি রাখতে হবে। জেনে রাখা ভালো শুধুমাত্র পৃথক শৌচাগার না থাকা ও শৌচাগারে স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার ও বদলানোর ব্যবস্থা না থাকার দরুন ঋতুমতী হওয়ার পরপরই প্রচুর ছাত্রী স্কুলছুট হয়। সারা দেশের স্কুলছুট ছাত্রীর সংখ্যার নিরিখে তা প্রায় কুড়ি শতাংশ। ফলত শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রের বিভিন্ন স্তরে পৃথক ঋতুকালীন সময়কে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া সময়ের দাবি এবং অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। একই সাথে ঋতুকাল নিয়ে যেকোনো ধর্মীয় ছুৎমার্গের প্রচার কঠোর হাতে দমন করতে হবে।

আর, ঋতুকালীন সময়ে যার কোনও অস্বস্তি হয় না, কোনও অসুবিধা থাকে না, তিনিও ঋতুকালীন ছুটি নেবেন? এটি তার ওয়ার্ক এথিক্সের বিরোধী হয়ে পড়বে না? এই প্রশ্নের উত্তরেও কবিতা বলছেন, বিশেষভাবে সক্ষম মতদাতাদের জন্য নির্বাচন কমিশন ভোটদান কেন্দ্রে আলাদা ব্যবস্থা রাখে, হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীদের কথা ভেবেই ধাপহীন ঢালু সিঁড়ি তৈরি করা হয়। কিন্তু সমস্ত বিশেষভাবে সক্ষম মানুষই যে হুইলচেয়ার ব্যবহার করেন এমনতো নয়, আবার যারা হুইলচেয়ার ব্যবহার করেন না বা ওই নির্দিষ্ট ঢালুপথ ব্যবহার করতে সাধারণ মানুষের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞাও থাকে না। তাছাড়া জোম্যাটো একটি সদ্যোজাত কোম্পানি, ১৯৯০ থেকে বিহারে এটি চালু আছে। কর্মচারিরা বিহার সরকারের কাছে ঋতুকালীন ছুটির দাবি জানিয়েছিলেন, সরকার তা মেনেছেন এবং কর্মচারীরা ঋতুকালীন ছুটির সুবিধাভোগ করছেন। কাজেই কর্মক্ষেত্রে যদি ক্রমাগত ঋতুকালীন ছুটির দাবি না জানানো যায় তা কখনই বাস্তবায়িত হবে না, এমনকি বর্তমানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যখন কর্মক্ষেত্রে হয়রানির বিষয়ে অভিযোগ জানালে তা মহিলাদের ভণিতা বলেই ধরে নেওয়া হয়, তেমনই ঋতুকালীন ছুটির আবেদনকেও একই ভাবে হয়তো ট্রিট করা হবে।

যেখানে কর্মচাররিদের কোনও লড়াকু সংগঠন নেই সেখানে এমনকি মাতৃত্বকালীন ছুটিকেই মান্যতা দেওয়া হয়না এবং তা নিয়ে আরও আনুসাঙ্গিক বিষয়ের সাথে জুড়ে মহিলাদের ‘কামচোর’, ‘সুবিধাবাদী’ ইত্যাদি নানা অভিধায় ভূষিত করা হয়, সেখানে জোরদার লড়াই ছাড়া ঋতুকালীন ছুটি আদায় করা এককথায় অসম্ভব।

তাই শ্রম-আইনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে ঋতুকালীন ছুটির মান্যতা দেওয়ার দাবিতে লড়াই যেমন চলবে, তেমনই ঋতুস্রাব নিয়ে বিভিন্ন অপপ্রচার, ছুৎমার্গ ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধেও জোরদার লড়াই চালাতে হবে।

- সংগ্রাম মণ্ডল ও সৌমি জানা  

varffea

পৃথিবীর আলো দেখার আগেই ওদের হত্যা করা হল, লাখে-লাখে। ‘হল’ বললেও তো ঠিক বলা হল না – ওদের হত্যা তো শুধু অতীতের ব্যাপার নয় – বর্তমান এবং ভবিষ্যতেরও ব্যাপার। বলছে সমীক্ষা ও নানা গবেষণা। ওরা কন্যাভ্রূণ। নারীর প্রতি যে বিদ্বেষ আমাদের সমাজ লালন করে, সেই বিদ্বেষ ধেয়ে যায় এমনকি মাতৃগর্ভে। সেখানে তাদের নিকেশ করে পিতৃতন্ত্র তার পরাক্রম জাহির করে – কন্যার জন্মানোকে অনধিকারে পরিণত করে পুরুষতন্ত্র তার আধিপত্যের পতাকা ওড়ায়। কন্যাভ্রূণ হত্যা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা একটা ধারা হলেও সম্প্রতি তা নিয়ে উদ্বেগ আবার চর্চায় এসেছে।

কন্যাভ্রূণ হত্যার দিক থেকে ভারত যে এক অগ্ৰগণ্য দেশ তা সুবিদিত। গবেষকরা বিভিন্ন সমীক্ষা চালিয়ে, তথ্য বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, এক দশক কালে ভারতে প্রতিদিন গড়ে ১,২০০ কন্যাভ্রূণের হত্যা ঘটেছে, ঘটছে এবং ঘটতে থাকবে। তাঁদের হাজির করা পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, ২০১৭ থেকে ২০২৫-এর মধ্যে লিঙ্গ নির্ধারণ করে কন্যাভ্রূণের হত্যা বছরে গড়ে ৪,৬৯,০০০ করে হবে। আর ২০২৬ থেকে ২০৩০ সালে ওই হত্যার বার্ষিক গড় গিয়ে দাঁড়াতে পারে ৫,১৯,০০০। সরল অঙ্কের হিসেবে, ২০১৭ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত ভারতে ৬৮ লক্ষ সম্ভাব্য নাগরিক জন্মের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে শুধু লিঙ্গ পরিচয়ের জন্য। এই আশঙ্কার কথা, কন্যার জন্ম বিপন্ন হয়ে পড়ার এই বৃত্তান্ত সম্পর্কে সমাজপিতারা, শাসকরা অবহিত নয় এমনটা হতে পারে না। সমাজের গুরুত্বপূর্ণ চর্চা তাঁদের কাছে অবশ্যই পৌঁছায়। কিন্তু এই পরিঘটনা তাঁদের কি আদৌ বিচলিত করে? কন্যাভ্রূণ হত্যাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য করার আইন থাকলেও তাকে যে এমন অবলীলায় নখ-দন্তহীন করে তোলা হচ্ছে, তা নিয়ে কি তাঁরা বিন্দুমাত্র ভাবিত হন?

গত বছর জুলাই মাসে সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটা সংবাদকে অনেকেই হয়ত লক্ষ্য করেছিলেন। তবুও আলোচনার সুবিধার জন্য সেটিকে এখানে স্মরণ করা যাক। উত্তরাখণ্ডের উত্তরকাশি জেলার ১৩২টা গ্ৰামে তিন মাসে জন্মানো ২১৬টা শিশুর সবকটিই ছিল পুত্রসন্তান, সেই তিন মাসে একটা কন্যাও ওই গ্ৰামগুলোতে দিনের আলো দেখেনি। পুত্র লাভের আশীর্বাদ এমন অকৃপণভাবে ওই গ্ৰামগুলোতে ঝড়ে পড়েছিল কিভাবে? কোন জাদুদণ্ডের পরশে তা সম্ভব হয়েছিল?

নারী অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট বিভিন্ন সংস্থা দীর্ঘদিন ধরেই গোপনে বা অঘোষিত গর্ভপাতে সক্রিয় ক্লিনিকগুলোর দিকে আঙ্গুল তুলে আসছে। চণ্ডিগড়ের পোস্টগ্ৰ্যাজুয়েট ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল এডুকেশন এণ্ড রিসার্চ-এর ডাক্তাররা ২০১৭ সালে প্রামাণ্য নথির সাহায্যে ভ্রাম্যমান ক্লিনিকগুলোর কার্যকলাপের কথা বিশদে বর্ণনা করেছিলেন। এরা অন্তঃসত্ত্বা মেয়েদের ঘরে-ঘরে গিয়ে আল্ট্রাসাউণ্ড প্রযুক্তির সাহায্যে স্ক্যান করে মাতৃগর্ভে ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ করে এবং কন্যাভ্রূণের ক্ষেত্রে এমনকি গর্ভবতীর ঘরেই গর্ভপাত ঘটিয়ে থাকে। ভ্রুণের লিঙ্গ নির্ধারণ নিষিদ্ধকরণ আইনের বিধি বলছে, যে সমস্ত ক্লিনিক আল্ট্রাসাউন্ড প্রযুক্তির ব্যবহার করবে তাদের যথাযথ খাতাপত্র রাখতে হবে, ডাক্তারদেরও গর্ভবতী নারীদের ওপর করা প্রতিটি স্ক্যানকে খাতায় নথিবদ্ধ করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে আইন বইয়ের মধ্যেই আটকে থাকে, আর দালাল-ডাক্তার-ক্লিনিকের মালিক-পুলিশ গাঁটছড়া কন্যাভ্রূণ হত্যাকে ফায়দার রমরমা কালো কারবারে পরিণত করে। এই ধরনের ক্লিনিকগুলো এবং অর্থের প্রলোভনের কাছে নীতি-নৈতিকতাকে জলাঞ্জলি দেওয়া ডাক্তারদের ‘অপারেশনই’ যে উত্তরাখণ্ডের ১৩২টা গ্ৰামের ওই অত্যাশ্চর্য ঘটনাকে সম্ভব করে তুলেছিল, তার উল্লেখ বোধকরি না করলেও চলবে।

আমাদের সমাজে মেয়েদের জন্ম এত অবাঞ্ছিত কেন? সমাজ বিশ্লেষকরা এর পিছনে বিভিন্ন সামাজিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক বিষয়গুলোকে চিহ্নিত করেছেন। দারিদ্র, পণপ্রথা, পুরুষের দৈহিক শ্রম বড় সম্পদ রূপে গণ্য হওয়া, বংশরক্ষায় পুরুষ উত্তরাধিকারীর চাহিদা, বৃদ্ধ বয়সে অসহায় বাবা-মার পরিচর্যায় পুত্রের প্রয়োজনীয়তা – এ সবই মেয়ের চেয়ে ছেলের জন্য ব্যাকুলতাকে তীব্র করে তোলে বলে মনে করা হয়ে থাকে। এমনকি মৃত্যুকালে ছেলে মুখে আগুন না দিলে মোক্ষ লাভ হবেনা – এই ধর্মীয় বিশ্বাসও ছেলের জন্য কামনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ রূপে দেখা দেয়। কিন্তু মেয়েকে ‘বড় বোঝা’ জ্ঞান করে মাতৃগর্ভেই তার থেকে নিষ্কৃতি লাভের যে তৎপরতা, সব ছাপিয়ে তার পিছনে নির্ধারক হয়ে দেখা দেয় সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতা। এর রেশ সমাজের সংস্কৃতিতে প্রবল হওয়ার সাথে-সাথে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিরাও তার ঐকান্তিক বাহক হয়ে দেখা দেন। আর সে কারণেই সম্ভবত কন্যাভ্রূণ হত্যার ব্যাপকতা সম্পর্কে অবহিত হয়েও তাকে প্রতিহত করতে শাসকদের তেমন উদ্যোগী হতে দেখা যায় না।

দু-বছর আগে নীতি-আয়োগ তাদের এক রিপোর্টে জানিয়েছিল, ভারতের ২১টা রাজ্যের মধ্যে ১৭টাতেই শিশুপুত্রের তুলনায় শিশুকন্যার জন্মের হার যথেষ্ট কম বলে দেখা গেছে। ২০১১র জনগণনাও শিশুপুত্র ও শিশুকন্যার জন্মের হারে ফারাককে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান করেছিল। জনগণনায় প্রকাশিত কয়েকটা রাজ্যে ১০০ শিশুকন্যা জন্ম পিছু শিশুপুত্রের জন্মের হার ছিল এইরকম – হরিয়ানা ১১৯.৭, পাঞ্জাব ১১৭.৬, উত্তরাখণ্ড ১১৪.২, দিল্লী ১১৪.২। শুরুতে উল্লিখিত গবেষণাও জানিয়েছে, উত্তরপ্রদেশেই ২০১৭ থেকে ২০৩০-এর মধ্যে কন্যাভ্রূণ হত্যার সংখ্যা হবে সবচয়ে বেশি, প্রায় ২০ লক্ষ। আমরা অতএব দেখতে পাচ্ছি যে, জাতীয় রাজধানী সংলগ্ন রাজ্যগুলো, আরও নির্দিষ্টভাবে বললে, বেশ কিছুকাল ধরে যে সব অঞ্চলে গেরুয়া রাজনীতি জোরালো প্রভাব বিস্তার করে রয়েছে, সেই সমস্ত অঞ্চলেই সামন্ততান্ত্রিক ভাবধারা প্রসূত নারী বিদ্বেষ সবচেয়ে প্রকট।  “বেটি বচাও, বেটি পড়াও” শ্লোগান এই বলয়ে প্রতিদিনই প্রহসন হয়ে ফেটে পড়ছে। বেটিকে পড়াতে গেলে আগে তো বেটিকে বাঁচাতে হবে। অথচ এই বলয়েই কন্যাভ্রূণ সবচেয়ে অসুরক্ষিত, জন্মের আগেই তাদের ওপর চালানো হচ্ছে হিংসা। কন্যাভ্রূণ রক্ষায় সরকার কতটা আগ্ৰহী, সরকারের একটা নির্দেশিকা তার কিছুটা আন্দাজ দেয়।

গত এপ্রিল মাসের ৪ তারিখে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক একটা বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলেছিল, জন্মের আগে লিঙ্গ নির্ধারণে নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কিত বিধি ৩০ জুন পর্যন্ত মুলতবি রাখা হচ্ছে। কারণ হিসাবে বলা হয়েছিল, করোনার ‘জরুরি পরিস্থিতি’র জন্য সরকারের পক্ষে নজরদারি চালানো সম্ভব হবে না। নারী সংগঠনগুলো তখন প্রতিবাদ জানিয়ে সরকারকে ওই বিজ্ঞপ্তি তুলে নিতে বলেছিল। তাদের যুক্তি ছিল, ওই বিজ্ঞপ্তির সুযোগ নিয়ে অবৈধভাবে কন্যাভ্রূণর গর্ভপাতে লিপ্ত ক্লিনিকগুলো যথেচ্ছাচারী হয়ে উঠবে। কেউ বলতেই পারেন, বিজ্ঞপ্তি তো মাত্র তিন মাসের জন্য বলবৎ ছিল, তাতে পুত্রসন্তান ও কন্যাসন্তানের অনুপাতে কি এমন আর হেরফের হবে। পরিসংখ্যানের চেয়ে মনোভাবের প্রশ্নটাই এখানে বড়। সরল যুক্তি বলে, আইনকে এভাবে লঘু করে তোলার কোনো যুক্তি কি আদৌ ছিল? সাধারণ সময়ে সরকারের নজরদারির যে পরিচয় পাওয়া যায়, বিধি বলবৎ থাকলে করোনা কালে নজরদারির তেমন ফারাক কি চোখে পড়ত? অতএব, কন্যাভ্রূণ রক্ষায় নারী-বিদ্বেষী মানসিকতার বিরুদ্ধে লড়াইটা চালাতে গিয়ে যেমন ১৯৯৪ সালের ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ নিষেধাজ্ঞা আইনের প্রয়োগের ওপর জোর দিতে হবে, একই সাথে গুরুত্ব দিতে হবে সামন্ততান্ত্রিক ভাবধারা বিরোধী লড়াইয়ের ওপর, বিজেপির প্রবল প্রভাবের অঞ্চলে যার প্রকোপ সবচেয়ে বেশি।

– জয়দীপ মিত্র  

malmld

দুই দশক আগে নদীভাঙনের তীব্রতা যখন মালদা সহ সারা পশ্চিমবঙ্গকে নাড়িয়ে দিয়েছিলো, তখন এই চারজনের কারোর জগৎ দেখার চোখ ফোটেনি-একজন তো একেবারে মায়ের কোলের শিশু! পরে কাজ ও গবেষণার সূত্রে ১৯৯৮-২০০৩এ মালদা জেলার বন্যা ও ভাঙন নিয়ে তারা নিজেদের বৃত্তেই নানা সময়ে উত্তেজিত কথোপকথন চালিয়েছে... ‘ওরা’ বলতে চারজন ঋষি, স্বরজিৎ, সিদ্ধার্থ আর জাহ্নবী।

হিন্দি সিনেমার ‘বিস সাল বাদ’-এর ফর্মুলা মেনে ২০২০র অগাস্টের শেষদিকে তারা যখন একটা অসম বয়সী বন্ধুত্বের মধ্যে থেকে চিন্তার আদানপ্রদান চালায়, তখন হয়তো সাহিত্যপাঠের সাধারণ প্রবণতা থেকেই তারা ভাবতে চেয়েছে ভাঙনের তাৎক্ষণিক ও সুদূরপ্রসারী ফলাফলগুলি। অবশ্য ভাঙনের কারণ তারা কিছুটা পড়ে এসেছে ক্লাস টেনের ভূগোল বইতে। চারজনের তিনজন মালদাইয়া, তাদের মধ্যে দুজন আবার ভাঙন অধ্যুষিত এলাকার সরাসরি বাসিন্দা, একজন চাকরিসূত্রে এক দশকের বেশি মালদাবাসী। স্বাভাবিকভাবেই নানা কৌণিক দৃষ্টিকোণ উঠে আসে তাদের নানাসময়ের আড্ডা-আলোচনায়।

শহরের সীমা ছাড়িয়ে অমৃতি বাজার পেরোনোর পর গাড়ি যে সময়ে একটু গতি পেল, তার মধ্যে স্বরজিৎ আর সিদ্ধার্থ ঋষিকে বুঝিয়ে ফেলেছে, নদীভাঙন এই অঞ্চলের জনজাতির যাপনের অঙ্গ বহুকাল থেকে। মালদা জেলার কালিয়াচক ব্লক-২ অঞ্চলের বাঙ্গীটোলা সংলগ্ন এলাকার গোলকটোলা, পাঁচকড়িটোলা বা জোতকস্তুরীর মানুষ এই নিম্নগতির নদীর সঙ্গে লড়াই করেই বেঁচে থাকতে অভ্যস্ত। কথায় কথায় স্বরজিৎ মনে করিয়ে দেয় তার মায়ের মুখে শোনা গল্প, ১৯৯৮ সালের বন্যায় কেবি ঝাউবোনা অঞ্চলের রাতারাতি গঙ্গাগর্ভে তলিয়ে যাওয়ার কথা। সেই সময়ের বিপর্যয়ে সবকিছু হারানো মানুষেরা বসবাস করছিলেন গঙ্গার ধার বরাবর বাঙ্গীটোলার পিছনের অংশে। বেশ কয়েক বছরের আপাত নিশ্চিন্তির পর এবছর সকলেই এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সামনে। লকডাউনের নতুন বিপদ মিলেমিশে যাচ্ছে ভাঙনের পূর্ব অভিজ্ঞতার সঙ্গে ... বাকিটা কেউ জানে না। জেলার সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, একেবারে স্বাধীনতা দিবসের দিন বাঙ্গীটোলার পাশাপাশি ভাঙন শুরু হয়েছে কালিয়াচক-৩ ব্লকের চক বাহাদুরপুর, সূর্যপাড়া ও সরকারপাড়ার মতো এলাকায়। এলাকার মানুষজন বলছেন, এ ভাঙন দ্বিতীয় দফার, এর আগেও একদফা হয়ে গেছে। সেচ দপ্তরের কর্তারা বলছেন, এই ভাঙন একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে। তাঁরা বলছেন, মানিকচক থেকে ফারাক্কা পর্যন্ত নানা পয়েন্টে অল্পস্বল্প ভাঙনের সম্ভাবনা আছে, প্রশাসন নজর রেখেছে। এলাকাবাসীরা বলছেন, ১৮ বিঘা জমিসহ ২০০ মিটার রাস্তা চলে গেছে গঙ্গাগর্ভে। পার চকবাহাদুরপুর থেকে হোসেনপুর যাওয়ার রাস্তা বিচ্ছিন্ন। কৃষ্ণপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের পাশেই পাশের জেলা মুর্শিদাবাদের কুলিদিয়ারা অঞ্চল। এই কুলিদিয়ারা অঞ্চলের অবস্থাও কালিয়াচক-৩ এর মতোই। উল্লেখ্য, এই ক্ষতিগ্রস্ত ১৮ বিঘা মূলত পটল, ভুট্টা ও আখচাষের জমি।

এইসব কথাবার্তার মাঝেই মাঝপথ থেকে হাঁপাতে হাঁপাতে গাড়িতে ওঠে জাহ্নবী, সে ফোটোগ্রাফি করে, একেবারে বাঙ্গীটোলারই ভূমিকন্যা। সেও পরিবারের বড়োদের মুখে শুনেছে গঙ্গাভাঙনে ৩০-৩৫টি গ্রাম রাতারাতি হারিয়ে যাওয়ার কথা ... কেবি ঝাউবোনা এখন শুধু স্মৃতি আর আতঙ্কের আরেক নাম। ঋষির হঠাৎ মনে পড়ে, জীবনানন্দ লিখেছিলেন “গ্রামপতনের শব্দ হয়”, সেটা কি এরকমটা ভেবেই লেখা? কে জানে! জাহ্নবী ও স্বরজিৎ স্থানীয় হওয়ার সুবাদে আঞ্চলিক লোকবিশ্বাসের সঙ্গেও বিশেষভাবে পরিচিত। তারা একসঙ্গেই বলে, বিগত বেশ কয়েকবছর যাবৎ বাঙ্গীটোলায় বসবাসকারী মৈথিল ব্রাহ্মণসহ জোতকস্তুরী থেকে পঞ্চানন্দপুর পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকার চাঁই, মণ্ডল, বিন ও নাপিতরা বিশ্বাস করে, বাঙ্গীটোলার গ্রামদেবী মা মুক্তকেশী এই ভাঙন আটকে দিয়েছেন ... কিন্তু এই বিশ্বাসও তাদেরকে আপাতত স্বস্তি দিতে পারছে না। স্বরজিৎ বিশ্লেষণ করে বলে, বাঙ্গীটোলার কাছে গঙ্গার স্থির হয়ে দাঁড়ানোর ভৌগোলিক কারণ নদীর উজানে সৃষ্টি হওয়া একটি বড়ো চর। কিন্তু এই বছর গঙ্গার স্রোত চরটি অনেকটা কেটে ফেলায় মূল স্রোত পূর্ব থেকে নিচের দিকে এসে সরাসরি এলাকায় ধাক্কা মারছে।

পুরো এলাকা জুড়ে রেইকি করার ফাঁকে সিদ্ধার্থ জানায়, স্থানীয় লোকজন  বোল্ডার ও ক্রেট ফেলে স্থায়িভাবে ভাঙন রোধের পক্ষে, কিন্তু সেচ দপ্তরের কর্তারা তাঁদেরকে স্পষ্ট বলছেন, বর্ষাকাল এই জাতীয় কাজের অনুপযুক্ত। তাই বাঁশ ও ধাতব তার ব্যবহার করে ডিপট্রিজ  করে অস্থায়ীভাবে ভাঙন রোধের চেষ্টা করছেন। আগে কি কিছুই করা যেত না? কেন জোড়াতালি দেওয়া ব্যবস্থাকেই বছরের পর বছর লাগু রাখা হয়েছে? অভিমান জমে জমে পাথর হয়, এমএলএ ম্যাডামের সহানুভূতি সেই পাথরে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে ... বাঙ্গীটোলা থেকে যায় বাঙ্গীটোলাতেই। কোন প্রতিশ্রুতিই স্থায়িভাবে বাস্তবয়িত হয় না, হয়নি কোনদিনও।

এরই মধ্যে ফুটেজ তোলার মাঝে স্বরজিৎ-এর মোবাইলের কলার টিউন বেজে ওঠে, ভূপেন হাজারিকার কালজয়ী “গঙ্গা আমার মা” ... এরমধ্যেই সিদ্ধার্থ পাড় থেকে অনেকটা ঝুঁকে পড়ে ডিপট্রিজের বাঁশের গভীরতা পরখ করতে গিয়ে মাঝির সতর্কতামূলক গালাগালি শুনেছে ... ছবি তোলবার উত্তেজনায় জাহ্নবী হাতে লাগিয়ে ফেলেছে নৌকার আলকাতরা ... আর সবাইকে সচকিত করে ঋষি খেয়েছে এক পেল্লায় আছাড়! তবে সেই আছাড়ের ফলেই আবিষ্কার করা গেল, ডিপট্রিজের ধাতব তার ভাঙন কবলিত পাড়কে নিজের সাধ্যমতো ক্ষমতাবলে বেঁধে রাখতে চাইছে। কিন্তু গঙ্গায় জলস্তর বেড়ে স্রোতের ধাক্কা (স্থানীয় ভাষায় ‘পহল লাগা’) হঠাৎ বাড়লে? গঙ্গার জোরালো হাওয়ায় তার থিরথির করে কাঁপতে কাঁপতে মাথা নাড়ে-জানি না, জানি না! আর্কিমিডিসের আবিষ্কারের মতো ঋষির মনে পড়ে যায় নাইজেরিয়ান কবি বেন ওকরির নয়ের দশকের সাড়াজাগানো উপন্যাস “দ্য ফেমিশড রোড”-এর শুরুর লাইনগুলো, অনেকদিন আগে পড়া, তাও ... সব পথই একদিন নদী ছিলো, তারপর নদীরাই পথ হলো আর সারা পৃথিবীতে ডালপালা ছড়ালো-তাই পথের ক্ষুধা কোনোদিন ফুরোয় না, নদীর ক্ষুধাও।

বাঙ্গীটোলার প্রায় সাত কিলোমিটার দূরের পঞ্চানন্দপুরের মানুষেরা মনে করেন, তাঁরা আপাতত নিরাপদ। জোতকস্তুরীর গঙ্গাতীরে দাঁড়িয়ে জলের তীব্র স্রোত আর ঘূর্ণি দেখতে দেখতে ঋষি সিদ্ধার্থকে বলে, বুদ্ধদেব বসুর কবিতায় পড়েছিলাম, “আকারহীন হিংস্র, খল/অনিশ্চিত ফেনিল জল/মিলিয়ে গেল অদৃষ্টের মৌন ইশারাতে/তোমায় আমি রেখে গেলাম ভবিষ্যের হাতে”, এখানে না এলে এ কবিতার ব্যঞ্জনআর আর একটা স্তর অনাবিষ্কৃত থেকে যেত। স্বরজিৎ মনে করিয়ে দেয়, কথাসাহিত্যিক অভিজিৎ সেনের নানা লেখায় এই বিষয় আর এই অঞ্চলের মানুষ নানাভাবে উঠে এসেছে ... তাকে হৈচৈ করে সমর্থন করে সকলে! কেননা, এই চারজনের বন্ধুত্বের একটা সাধারণ সূত্র অভিজিৎ সেনের লেখা। জাহ্নবী মনে করিয়ে দেয়, এই লেখকের বেশ কিছু ছোটগল্প ও “নিম্নগতির নদী” উপন্যাসের পটভূমি এই ১৯৯৮-এর বন্যা ও নদীভাঙন।

হাওয়ায় এলোমেলো চুলের গোছা সামলে তাড়াতাড়ি একটা হাতখোঁপা বেঁধে ফেলে জাহ্নবী বলে, কাছাকাছি বিহার ঝাড়খণ্ডসহ এখানকার মৈথিল সম্প্রদায়ের বিয়ের গানেও এই ভাঙন একটা রূপক হিসাবে উঠে এসেছে। বাকিদের কৌতূহলী প্রশ্নের উত্তরে সে বলে, আশীর্বাদের দিন (এখানে বলা হয় ‘পানপত্র’) গাওয়া হয়,

“এ পার গঙ্গা ও পার যমুনা
বিচহি লগাইলে ফুলবাড়ি
হো গঙ্গা মাঈঈ
বিচহি লগাইলে ফুলবাড়ি”

অর্থাৎ, ভাঙনপ্রবণ দুই নদীর মাঝে রচিত হয় ফুলে সাজানো বাসরঘর ... সব ভাঙন পেরিয়ে সৃষ্টির আনন্দে মিলিত হয় দুটি প্রাণ, দুটি পরিবার। এই মিলন সত্য, আর ভাঙন মিথ্যা নয়; কেননা, তার পটভূমিতেই সেই মহাসত্য রচিত হয়। সে বলে, মূল গানটা অনেক লম্বা-আমি শুধু ধুয়াটা শোনালাম।

তাকে নামিয়ে গাড়ি এখন অমৃতির বাজারে থেমেছে। সিদ্ধার্থরা একটু ‘আড়ালে’ গেছে আর চায়ের গ্লাস হাতে ঋষি ভাবতে থাকে সকালের সেই ফোনটার কথা। ফোনের ওপারের অচেনা ছেলেটি তার পরিচিত এক সমাজকর্মীর রেফারেন্স টেনে বলেছিলো, দাদা বলেছেন একটা ভাঙন বিরোধী সচেতনতা মঞ্চ তৈরি হওয়া দরকার ... শুধু অঞ্চলগুলোতে নয়, টাউনেও ... মাসে অন্তত একটা করে মিটিং ... ডিএমের কাছে ডেপুটেশন ... ৭০০ ঘরহারা মানুষদের জন্য কুড়িটা ত্রিপল... সে শুধু মাথা নেড়ে যায়, তার মাথায় কিছু আসে না। চারিদিক থেকে উড়ে আসতে থাকে নানা টুকরো শব্দ ... বোল্ডারের কাটমানি, মাঝির গোপন খাতা, বানানো পরিসংখ্যান, অল ক্লিয়ারের বিপবিপ ... তার মাথায় কিছু ঢোকে না।

সম্বিত ফেরে রথবাড়ি মোড়ের ট্রাফিকের গর্জনে। আনলক পর্বের ব্যবসাকে বাড়াতে বাস, অটো, ম্যাক্সি (মিনিবাস), টোটো সবাই যেন হর্ন বাজিয়ে প্যাসেঞ্জার ধরার প্রতিযোগিতায় নেমেছে ... এই গর্জনের মাঝেই চোখ বুজে ফেলে ঋষি। চোখ বুজে সে দেখতে পায় তার বুক শেলফে রাখা বইগুলোকে, অভিজিৎ সেনের “নিম্নগতির নদী”, জয়ন্ত জোয়ারদারের “ভূতনি দিয়ারা”, “রূপান্তরের পথে”র ভাঙন বিষয়ক সংখ্যার বাঁধানো কপি, কল্যাণ রুদ্রর “বাংলার নদীকথা”... ডকুমেন্টেশনের কাজ কীভাবে আরো জোরালো ও অকাট্য করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা করতে করতে ফুটপাত দিয়ে এগিয়ে চলেছে স্বরজিৎ-সিদ্ধার্থ … ঋষি পিছিয়ে পড়ে, ক্রমশ পিছোতেই থাকে ... তাকে ফিরে যেতে হবে তার বুক শেলফের কাছে, ঐ বইগুলির কাছে, পুনপাঠের প্রস্তুতি নিতে হবে তাকে, আবার …

- তপোমন ঘোষ 

srwwsr

কমরেড সুবোধ মজুমদার প্রয়াত হন ২০১০ সালের ২৭ আগষ্ট। ছাত্র জীবনের শেষে কর্মজীবনের শুরুতেই শিক্ষকতা স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিয়ে বিপ্লবী কমিউনিস্ট সংগঠন গড়ে তোলার জন্য কলকাতা শহর ছেড়ে চলে আসেন গ্রামে গরিব ভূমিহীনদের মধ্যে। সেেই থেকে জীবনের শেষ পর্যন্ত বিপ্লবী সংগ্রামে আত্মোৎসর্গ করেছেন। শত্রুর কারাগার, পুলিশের নির্মম অত্যাচার, গোপন বিপ্লবী জীবনের নিদারুণ কষ্ট, মধ্যবিত্ত স্বছন্দ জীবনের মোহ, কোনো কিছুই আজীবন বিপ্লবী সংগ্রামী কৃষক নেতার মাথা নীচু করাতে পারেনি। বিপ্লবী জীবনের দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন নদীয়া-বর্ধমান জেলার গ্রামাঞ্চলে। তাই প্রতি বছর এই দিনে এই এলাকার মানুষ শ্রদ্ধার সাথে প্রয়াত কমরেড সুবোধ মজুমদারকে স্মরণ করেন। কমরেড সুবোধ মজুমদার অমর রহে।

খণ্ড-27
সংখ্যা-31