সব লেখার আলাদা আলাদা ফাইলগুলি একনজরে দেখতে এর উপরে ক্লিক করুন (হেডিং-এ ক্লিক করলে সেই লেখাটি আলাদা খুলবে)
ভারতের প্রথম সারির মিডিয়ায়, বৈদ্যুতিন থেকে মুদ্রণ মায় প্রায় সমস্ত প্রধান প্রধান সংবাদ মাধ্যমে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে কুৎসা ও কলঙ্ক ছড়ানোয় প্রতিযোগিতার বান ছুটছে। এ নিছক কোনও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবাবেগের সম্প্রচার নয়। লাগাতার অনুধাবন করলেই বোঝা যায় চলছে পরিকল্পিতভাবে পেছনে লাগার প্রবণতা। পরোক্ষে হিন্দুত্বের রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে ফায়দা তোলার রসদ যোগানো। সম্প্রতি এরকম একটি বজ্জাতির কেস গড়ায় সুপ্রীম কোর্টে। বিচারপতি প্রকাশ্যে সংশ্লিষ্ট চ্যানেল কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্যে বিরল হুঁশিয়ারী দেন এই মন্তব্য করে যে, এভাবে একটা গোটা সম্প্রদায়কে কালিমালিপ্ত করার অধিকার থাকতে পারে না, এ চলতে দেওয়া যায় না, এসব উপস্থাপনা সংবিধান ও আইন বিরোধী। চ্যানেলটির সংবাদ পরিবেশনে বলা হয়েছিল, ইউপিএসসি অর্থাৎ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় যেসমস্ত মুসলিম পরীক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়েছেন, সেন্ট্রাল সার্ভিস পদে নির্বাচিত হয়েছেন, তাদের নাকি পাশ করানো হয়েছে কারসাজি করে, তারা নাকি সরকারী ঐসমস্ত পদে স্থলাভিষিক্ত হয়ে ‘অনুপ্রবেশকারী’র কাজ করবেন, এর পিছনে রয়েছে গভীর ষড়যন্ত্র, রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের আরব দুনিয়ার অর্থরাশি, রয়েছে ইসলামিক রাষ্ট্রবাদী সন্ত্রাসবাদের ছায়া, ভারতে অন্তর্ঘাত-নাশকতা চালানোর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য! গোটা প্রসঙ্গটা চিত্রিত করা হয়েছে এভাবে। কিন্তু ইউপিএসসি সরকার নিযুক্ত একটি স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান, যদিও একে কেন্দ্রের শাসকদলের কলকাঠিতে অঘোষিত নিয়ন্ত্রণের সর্বময় অপচেষ্টা চলে এবং সেটা সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী দৃষ্টিদূষণ অনুযায়ীই, তাই এজাতীয় কেন্দ্র থেকে অন্তত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কর্মপ্রার্থীদের কোনও সুযোগই থাকতে পারে না বিশেষ সুবিধা পাওয়ার। তাছাড়া এই পরীক্ষা যে তিনটি ধাপে নেওয়া হয় তার প্রাথমিক ধাপে শেষবার মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় আট লক্ষ, তারপরে দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কমে দাঁড়ায় পনের হাজার। তারপর সবশেষে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন আটশ ঊনত্রিশ জন। এদের মধ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে নিয়োগপত্র পাওয়ার সংখ্যা সামান্য মাত্র।
গত কয়েক বছরে এই সেন্ট্রাল সার্ভিসে মুসলিম সম্প্রদায় থেকে চাকরি পাওয়ার সংখ্যা একটু-আধটু বেড়েছে, তবু তা শতাংশের বিচারে অত্যন্ত নগণ্য, চার-পাঁচ শতাংশের মতো। অতএব তাদের বিশেষ সুবিধাভোগী প্রমাণের কোনও ‘যুক্তিজাল’ টেঁকে না। তবু মিডিয়া চ্যানেল সেরকমই চিত্রিত করেছে, করে থাকে। চ্যানেলে চ্যানেলে চলে এরকম আরও কতই না কুৎসা, কুনাট্য প্রদর্শনের রঙ্গ। চলে ছাপানো সংবাদপত্রেও। ঠোকরানো হয় মুসলিম মানেই তার দেশাত্মবোধে থাকে সন্দেহ, তারা যত না ভারতীয় তার চেয়ে মনে-প্রাণে নাকি অনেকবেশী ‘পাকিস্তানী’ বা ‘বাংলাদেশী’! যথেচ্ছ তকমা লাগিয়ে দেওয়া হয় ‘জেহাদী’। জীবন-জীবিকার যে কোনো বিষয়ে জেরবার করা হয় নানা প্রশ্নের ঝড় তুলে। সওয়াল করা হয় মুসলিমদের কোনো অংশেরই কেন ওবিসি সুবিধা পাওয়া উচিত নয়। অথবা কাঁচা বাড়ি পাকা করতে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার নাগাল পেতে কালঘাম ছুটিয়ে দেওয়া হয়। আর তা স্বাধীনভাবে করতে দেখলে, তা সে জমি বা পরিযায়ী শ্রম বেচা টাকায় হলেও সন্দেহ ছড়ানো হয়, গুজব রটানো হয়, সব হচ্ছে নিশ্চয়ই ‘জেহাদী’ বনে যাওয়ার বিনিময়ে পাওয়া টাকায়! কোনো-না-কোনো ইসলামিক সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের নাম জুড়ে দিলেই হল। গ্রেপ্তার হওয়ার খবর করার সাথে সাথে ‘গোপন অস্ত্রশস্ত্র’ পেয়ে যাওয়ার তৈরি তথ্য শোনানো শুরু হয়ে যায়, তা সম্ভব না হলেও সন্দেহের জাল বিছিয়ে রাখা হয়।
সর্বোপরি ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের সংযোগ ‘কবুল করা’, বিভিন্ন নাশকতা পরিকল্পনার হদিশ পাওয়া ইত্যাদি খবর থাকে। চলে ‘মিডিয়া ট্রায়াল’, গ্রেপ্তারেই যুক্তি জাহিরের তুবড়ি ছোটানো হয় বিচার সেরে ফেলার – কঠিন শাস্তি দেওয়ার রায় কি কেমন হওয়া দরকার! এরকম বহু কারসাজি পরবর্তীতে আদালতের বিচারে উন্মোচিত হয়েছে। মাঝখান থেকে বাধ্য করা হয়েছে বছরের পর বছর বিনা বিচারে বা সাজানো রায়ে কারারুদ্ধ থাকার দূর্ভোগ পোহাতে, জীবন হয়ে গেছে তছনছ। এনসিআরবি-র সাম্প্রতিক রিপোর্ট উল্লেখ করেছে, কারাদন্ডপ্রাপ্তদের অধিকাংশই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। এভাবে ইসলামোফোবিয়া ছড়িয়ে মিডিয়া বস্তুত পরিবেশকে পরিণত করছে হিন্দুত্বের সাম্প্রদায়িক সন্দেহ, অবিশ্বাস, বিদ্বেষ-বিভাজন সৃষ্টির মৃগয়াভূমিতে। সুবিধা লুটছে ফ্যাসিস্ট শাসক শক্তি, ‘মব লিঞ্চিং’-এ মদত যোগাতে বা ‘এনআইএ’-‘এসটিএফ’-র হামলা নামাতে। সুবিধা হচ্ছে মিডিয়া মালিকশ্রেণীরও, শিহরণ তোলা খবর বিকোনোর দৌলতে সরকারপক্ষের নেপথ্য হাতযশে খুলে যাচ্ছে বিজ্ঞাপনী ব্যবসা বাড়ানোর বাজার। গৈরিক শাসকের ঔদ্ধত্যে মদত পাচ্ছে আজ্ঞাবহে প্রভাবিত হওয়া মিডিয়া। বম্বে আদালত নিন্দা করলেও প্রধানমন্ত্রী সংসদে আবারও করলেন মিথ্যাচার, বললেন, করোনা ছড়িয়েছে গত মার্চ মাসের দিল্লীর তবলিগি জমায়েত থেকেই। সব মিলে এ হল কায়েমী স্বার্থের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক যোগসাজশের প্রকল্প।
প্রথমে দিল্লী দাঙ্গার তদন্তের চার্জশিটে বাম নেতৃবৃন্দের নাম ঢোকানো হল এবং তারপর গ্ৰেপ্তার করা হল ছাত্র আন্দোলনের কর্মী উমর খলিদকে। এরপর থেকেই দিল্লী পুলিশের “দাঙ্গা তদন্ত”র সমালোচনা ও তাকে ধিক্কার জানানোটা তীব্রতর হয়ে উঠেছে। সারা ভারতেরই ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, সমাজ আন্দোলনের কর্মীরা, এবং এর সাথে এমনকি প্রাক্তন পুলিশ অফিসাররাও দিল্লী পুলিশ কমিশনারের কাছে চিঠি লিখে পুলিশ যে একদেশদর্শী ধারায় “তদন্ত” চালাচ্ছে তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
ক্রমেই বেড়ে চলা এই সমস্ত নিন্দার চাপের মুখে দিল্লী পুলিশ শশব্যস্ত হয়ে একের পর এক “ব্যাখ্যা” ও বিবৃতি হাজির করতে থাকে। এই বিবৃতিগুলো সুনিশ্চিতভাবে কোনো কিছুকে যদি প্রতিপাদিত করে থাকে তবে তা হল – কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয় তাদের এই যে নির্লজ্জ কর্মকাণ্ড তার পক্ষে দাঁড়ানো বা তাকে গোপন করতে পারাটা দিল্লী পুলিশের পক্ষে একেবারেই সম্ভব হচ্ছে না।
দাঙ্গার বিভিন্ন মামলায় দিল্লী পুলিশ যে সমস্ত চার্জশিট পেশ করেছে তাতে নাম রয়েছে সিপিআই(এম)-এর সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি, সিপিআই(এমএল)-এর পলিটব্যুরো সদস্য কবিতা কৃষ্ণাণ, স্বরাজ অভিযান নেতা যোগেন্দ্র যাদবের মতো রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের; অধ্যাপক অপূর্বানন্দ ও জয়তী ঘোষের মতো বুদ্ধিজীবীদের; চলচ্চিত্র নির্মাতা রাহুল রায়ের; জেএনইউ-র ছাত্র আন্দোলনের প্রাক্তন নেতা উমর খলিদ এবং এআইএসএ, জেসিসি ও পিঁজড়া তোড়-এর মতো ছাত্র সংগঠন ও মঞ্চের কর্মীবৃন্দের। চার্জশিটে এঁদের নাম থাকার কারণ হিসাবে পুলিশ জানিয়েছে যে, কয়েকজন অভিযুক্ত “গোপনে দেওয়া বিবৃতিতে” এঁদের নাম প্রকাশ করেছেন। এরপর ক্রোধ ও নিন্দার যে ঝড় বয়ে যায় তাতে অনেকেই জানান যে, পুলিশি হেফাজতে নেওয়া এই ধরনের “গোপনে দেওয়া বিবৃতি”র আইনসম্মত সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসাবে কোনো গুরুত্ব নেই, কেননা, সেগুলোর পুলিশের নিজেরই বয়ান হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। দিল্লী হিংসার ঘটনাগুলোতে “গোপনে দেওয়া বিবৃতিগুলো” পুলিশের নিজেরই লিখে দেওয়া বয়ান হওয়ার ধারণাকে জোরালো করছে এই ঘটনা যে, বিভিন্ন ব্যক্তির বিবৃতি বলে যা বলা হচ্ছে সেগুলোর ভাষা হুবহু এক বলে দেখা যাচ্ছে; এবং এই ঘটনাও ওই ধারণাকে জোরালো করছে যে অন্ততপক্ষে তিন অভিযুক্ত — সাফুরা জারগর, নাতাশা নারওয়াল এবং দেবাঙ্গনা কলিতা – যে বিবৃতি দিয়েছেন বলে বলা হচ্ছে তাতে তাঁরা “স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করছি” শব্দগুলোও লেখেন। বিভিন্ন ব্যক্তি এই অভিযোগ করেছেন বলেও জানা গেছে যে, পুলিশের কাছে তাঁদের মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা হয়েছে: বলা হয়েছে, হয় মিথ্যা এজাহার দিয়ে আন্দোলনকারীদের অভিযুক্ত করতে হবে, আর না হয় দানবীয় ইউএপিএ আইনে অভিযুক্ত হতে হবে।
এই সমস্ত সমালোচনার জবাবে দিল্লী পুলিশ এই “ব্যাখ্যা” হাজির করে যে, শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিবিদদের যে নাম রয়েছে তা হল “সিএএ-বিরোধী বিক্ষোভ সংগঠিত করা ও তাতে বক্তব্য রাখার সঙ্গে যুক্ত এক অভিযুক্তর গোপনে দেওয়া বিবৃতির অংশ।” দিল্লী পুলিশ যেমন এই দাবি করেছে যে “গোপনে দেওয়া বিবৃতিতে অভিযুক্ত যে কথাগুলো বলেছেন তা যথাযথভাবে লিপিবিদ্ধ করা হয়েছে”, একই সাথে তারা এটাও বলেছে যে, “গোপনে দেওয়া বিবৃতির ভিত্তিতেই কাউকে অভিযুক্ত রূপে হাজির করা হয় না। আর, দৃঢ় সমর্থনসূচক সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকলে তবেই আরও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়।” এর পরদিনই দিল্লী পুলিশ উমর খলিদকে গ্ৰেপ্তার করে এবং তা শুধুই “গোপনে দেওয়া বিবৃতির” ভিত্তিতে যা তার ওপর হিংসায় প্ররোচনা দেওয়ার বক্তব্য রাখার দায় চাপিয়েছে। উমর খলিদ হিংসায় প্ররোচনা দিয়েছে বলে গোপনে দেওয়া বিবৃতিতে যে দাবি করা হয়েছে তার সমর্থনে “দৃঢ় সমর্থনসূচক সাক্ষ্যপ্রমাণ” কোথায়? এর বিপরীতে, সমদর্শী আইনের দাবিতে আন্দোলনের সময় উমর খলিদ বৈষম্যমূলক সিএএ এনআরসি এনপিআর আইনগুলোর বিরুদ্ধে যে ভাষণগুলো দেন তাতে হিংসার মুখেও শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের আহ্বান রাখা সম্পর্কে যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ রয়েছে।
নাতাশা নারওয়াল এবং দেবাঙ্গনা কলিতার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া যে মামলাগুলোর ভিত্তিতে তাঁদের গ্ৰেপ্তার করা হয়, সেগুলোর কয়েকটার জামিন মঞ্জুরির আদেশে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, পুলিশের দাবির বিপরীতে জনসমক্ষে দেওয়া তাঁদের ভাষণে কোনো হিংসা উস্কিয়ে তোলা হয়নি, শুধুই শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের আহ্বান জানানো হয়। সাক্ষ্যপ্রমাণের পুরোদস্তুর অভাবকে পুষিয়ে নিতেই পুলিশ ইউএপিএ-তে অভিযোগ দায়েরের আশ্রয় নিচ্ছে। ইউএপিএ এমন একটা আইন যা পরিকল্পিতই হয়েছে সরকারের সমালোচকদের আক্রমণের নিশানা বানানোর অস্ত্র হিসাবে: এটা এমনই আইন যার অধীনে রাষ্ট্র যে কোনো অভিযোগের ভিত্তিতেই জামিন না দিয়ে কোনো বিচার না করে কোনো ব্যক্তিকে বছরের পর বছর জেলে আটক রাখতে পারে। রাজ্য সভায় তোলা এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক স্বীকার করেছে যে ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ইউএপিএ-তে দায়ের করা ৩০০৫টি মামলার মধ্যে মাত্র ২৭ শতাংশের ক্ষেত্রে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে, আর এই তথ্যটা এই আইনের অধীনে মামলাগুলোর পলকা চরিত্রকেই দেখিয়ে দেয়। এ সত্ত্বেও পুলিশ তদন্তে অনন্তকাল ধরে বিলম্ব ঘটাতে পারে, এবং মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা বছর-বছর ধরে জেলে পচতে থাকে। পরবর্তীকালে কোনো অভিযুক্ত খালাস পেলেও ইউএপিএ আইনের অধীনে অভিযুক্ত হওয়ার কারণেই সে শাস্তি পেয়ে যায়।
প্রাক্তন পুলিশ প্রধান জুলিয়ো রিবেইরো দিল্লী পুলিশ কমিশনারকে একটা চিঠি লিখে এই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন যে – দিল্লী পুলিশ শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের জন্য নাগরিকদের গ্ৰেপ্তার করলেও কপিল মিশ্র ও অনুরাগ ঠাকুরের মতো বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ওই চিঠির প্রত্যুত্তরে দিল্লী পুলিশ কমিশনার এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে, পুলিশের পক্ষপাতদুষ্টতা নিয়ে দুরভিসন্ধি পোষণ করা ব্যক্তিদের “উদ্ভাবিত মিথ্যা গাল-গল্পে” রিবেইরোর নিজের নাম জড়ানো উচিৎ নয়। পুলিশ কমিশনারের প্রত্যুত্তরের অনুকরণ করে দিল্লী পুলিশের এক প্রতিনিধিও মিডিয়ার কাছে একটা বিবৃতি পেশ করেন যাতে দাবি করা হয় যে তারা হিন্দু ও মুসলিমদের সমান চোখেই দেখেছে। বলা হয়, “দাঙ্গার ঘটনাগুলোতে ২৫০টা চার্জশিট দেওয়া হয়েছে যাতে মোট ১১৫৩ জন অভিযুক্তর বিরুদ্ধে (৫৭১ জন হিন্দু ও ৫৮২ জন মুসলমান) চার্জশিট দেওয়া হয়েছে।” এই দাবিটা বিভ্রান্তিকর। অভিযুক্ত হিন্দু ও মুসলমানদের সংখ্যা তুলে ধরে দিল্লী পুলিশ যে প্রশ্নটাকে এড়িয়ে যেতে চাইছে তা হল সমদর্শী নাগরিকত্বের (সিএএ-বিরোধী) জন্য আন্দোলনকারীদের তুলনায় সিএএ সমর্থনকারী কত জনকে ইউএপিএ এবং অন্যান্য কঠোর আইনে অভিযুক্ত করা হয়েছে? যে ৫৭১ জন হিন্দুকে অভিযুক্ত করা হয়েছে তার মধ্যে সমদর্শী নাগরিকত্বের দাবি জানানো নাতাশা ও দেবাঙ্গনা ছাড়া অন্য কাউকে কি ইউএপিএ সহ কঠোর আইনগুলোর ধারায় অভিযুক্ত করা হয়েছে? তাদের মধ্যে ব্যাপক সংখ্যাধিকের বিরুদ্ধেই কি লঘু আইনে অভিযোগ দায়ের হয়নি?
ওপরে উল্লেখিত দিল্লী পুলিশের বিবৃতিতে এই ঘটনার বিরুদ্ধে আপত্তি জানানো হয়েছে যে “বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী সোশ্যাল মিডিয়ার মঞ্চসমূহ এবং অন্যান্য অনলাইন পোর্টালগুলোকে কাজে লাগিয়ে উত্তর পূর্ব দিল্লীর দাঙ্গার ঘটনাগুলোর তদন্তের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।” এইভাবে বোঝানো হয়েছে যে – রিবেইরোর চিঠির উত্তরে পুলিশ কমিশনার যেমন জানিয়েছিলেন – তদন্ত নিয়ে কারুর ক্ষোভ থাকলে তাদের সামাজিক মাধ্যম ও নতুন পোর্টালগুলোকে ব্যবহার না করে আদালতের শরণাপন্ন হওয়া উচিৎ। এই সমস্ত প্রতিক্রিয়া এটাই দেখাচ্ছে যে, তাদের সমালোচকদের নিয়ে, এবং স্বাধীন মিডিয়ার স্বাধীন মতপ্রকাশ নিয়ে দিল্লী পুলিশের কিছু সমস্যা রয়েছে (প্রসঙ্গত, অনলাইন সংবাদ পোর্টালগুলোই দিল্লীর হিংসা ও পুলিশি তদন্ত নিয়ে সবচেয়ে পরিশ্রমসাধ্য প্রতিবেদনগুলো প্রকাশ করেছে)। এরই সাথে দিল্লী পুলিশ যে সরকারের ধামাধরা কিছু মিডিয়া সংস্থাকে বেছে নিয়ে তাদের কাছে হেফাজতে করা “স্বীকারোক্তি”কে (বানানো) ফাঁস করেছে তা নিয়ে তাদের কোনো বিবেক দংশন নেই। আর এগুলোকে ফাঁস করা হয়েছিল সমদর্শী নাগরিকত্বের জন্য আন্দোলনকারী অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলাগুলোকে প্রভাবিত করার লক্ষ্যে। এই সমস্ত ফাঁসকে আটকাতে দিল্লী হাইকোর্টকে একটা বিজ্ঞপ্তি জারি করতে হয়। ঘটনা হল, গণতন্ত্রে পুলিশ এবং তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে সাধারণ নাগরিকদের বিচার-বিশ্লেষণ এবং প্রশ্নকে খোলা মনে গ্ৰহণ করতে হবে; এই সব প্রশ্নকে আদালত কক্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না, যে আদালতের দ্বারস্থ খুব কম লোকই হতে পারে।
পুলিশ কমিশনারের প্রত্যুত্তরের পাল্টা জবাবে রিবেইরো যথার্থভাবেই বলেছেন যে, বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর এবং সাংসদ প্রবেশ ভার্মাকে “গলাবাজি করা, ধাতানি দেওয়া এবং উপলব্ধ অন্যায়ের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের প্রতি হুমকি দেওয়ার” যে “লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে” পুলিশ কমিশনার সে সম্পর্কে মুখে কুলুপ এঁটেছেন”।
দিল্লী পুলিশের ১১ লক্ষ পাতার চার্জশিট এবং তাদের আত্মরক্ষামূলক বিবৃতিগুলো সত্যটাকে আড়াল করতে পারবে না। দিল্লী পুলিশ একদিকে সমদর্শী আইনের জন্য আন্দোলনকারীদের শাস্তি দিতে ইউএপিএ-র মতো দানবীয় আইনের প্রয়োগ ঘটাচ্ছে, অন্যদিকে দিল্লী হিংসার প্রকৃত সংঘটকদের রক্ষা করছে। তারা সমালোচনার জবাবে বলছে যে, সমালোচকরা হয় “দুরভিসন্ধি চালিত কায়েমি স্বার্থের” প্রতিনিধি, আর না হয় এই ধরনের লোকেদের দ্বারা ব্যবহৃত হচ্ছেন। যে বিজেপি নেতাদের তারা রক্ষা করছে তাদের কি কোনো অভিসন্ধি ও কায়েমি স্বার্থ নেই? দিল্লী পুলিশ কেন তাদের হাতে নিজেদের ব্যবহৃত হতে দিচ্ছে?
লক্ষ-লক্ষ পাতার চার্জশিট আমাদের বেরটোল্ট ব্রেখটের এই কথাগুলো মনে পড়িয়ে দিচ্ছে: “সরকারের বিপুল ক্ষমতা/তাদের শিবির ও নিপীড়ন কক্ষগুলো/তাদের হৃষ্টপুষ্ট পুলিশ/তাদের সশঙ্ক বা অসাধু বিচারপতিরা আছে বলে/গোটা বাড়িটার ছাদ পর্যন্ত ঠাসা/কার্ডে লেখা পরিচয়পত্র এবং সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের তালিকা আছে বলে/লোকটার মনে হয় ওদের/একটা সাদাসিধা লোকের খোলামেলা কথায় ভয় পাওয়ার কিছু নেই।” সারা ভারতের সহজসরল জনগণ শুধুই “খোলামেলা কথা” দিয়ে, তাদের ঐক্য এবং সত্যের প্রতি তাদের অঙ্গীকারকে আয়ুধ করে প্রতিশোধলিপ্সু এক সরকারের মোকাবিলা করছেন। এই সরকারটাই জনগণকে ভয় পাচ্ছে।
(এম এল আপডেট সম্পাদকীয় ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০)
সারা ভারত কৃষক সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির ডাকে ২৫ সেপ্টেম্বর দেশব্যাপী প্রতিরোধ দিবসের আহ্বান জানানো হয়।
মোদী সরকারের নয়া কৃষি আইনে কৃষিপণ্যের সরকারী সংগ্রহ বা ফসল কেনার ব্যবস্থা পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হবে। কৃষকদের ফসলের দাম সম্পর্কে যেটুকু নিরাপত্তার আশ্বাস ছিল তাও আর থাকবে না। এই আইনে বেসরকারী মান্ডি (ফসলের বাজার) গড়ে ওঠার রাস্তা পরিষ্কার হয়ে যাবে। এতদিন অত্যাবশ্যকীয় পণ্য হিসাবে যা ছিল এখন থেকে সেগুলির বিপণন এবং দাম ধার্য করবে বড় বড় ব্যবসায়ীদের চক্র এবং কর্পোরেটরা। বেড়ে যাবে কৃষকের অভাবী বিক্রি এবং ঋণগ্রস্ত কৃষকের আত্মহত্যা। পরিসংখ্যান বলছে দেশে প্রতি দু-ঘন্টায় এক জন কৃষক এই চরম পথ বেছে নিচ্ছেন।
ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) অব্যাহত থাকবে বলে সরকার প্রচার চালালেও তা আসলে মিথ্যা। কারণ এ জন্য কোনো আইন নেই। উল্টে বিজেপি সরকার দ্বারা গঠিত শান্তা কুমার কমিটি জানিয়ে দিয়েছে যে মাত্র ৬% কৃষক সহায়ক মূল্যের সুবিধা ভোগ করেন। সহায়ক মূল্য প্রত্যাহার ছাড়াও এই কমিটির সুপারিশে এফসিআই ও নাফেডের শস্য সংগ্রহ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়া হবে। গণবন্টন বা রেশনের মাধ্যমে খাদ্য সরবরাহ ধাপে ধাপে তুলে দেওয়া হবে। এভাবে কৃষিতে কোম্পানিরাজ কায়েম করতে চাইছে মোদী সরকার।
তাই নতুন করে স্বাধীনতার লড়াইয়ে ঐক্যবদ্ধ কৃষক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ২৫ সেপ্টেম্বর সারা দেশব্যাপী প্রতিরোধ দিবসের ডাক দেয় সারা ভারত কৃষক সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি।
মোদী সরকার চুক্তি চাষের মাধ্যমে কৃষকদের কর্পোরেটদের গোলামে পরিণত করতে চাইছে, ফিরিয়ে আনতে চাইছে নয়া জমিদারতন্ত্র। কর্পোরেটদের খাদ্য উৎপাদনের কোনো দায় নেই, মুনাফাই ওদের একমাত্র লক্ষ্য। তাই আগামীদিনে চুক্তি চাষের প্রভাবে খাদ্য উৎপাদন তথা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে বিপন্ন হয়ে পড়বে। গ্রাম ভারতে দেখা দেবে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনা! কেন্দ্র কৃষিকে পুরোপুরি কর্পোরেট জগতের হাতে তুলে দিতে চাইছে। সে জন্য খাদ্য শৃঙ্খলটিকে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তাদের হাতে তুলে দিচ্ছে মোদি সরকার। কৃষি ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের যে ক্ষমতা ছিল তাও সম্পূর্ণ বাতিল করে দেওয়া হল।
নয়া নীতিতে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন সংশোধন করে পণ্য মজুত করার ঊর্দ্ধসীমা তুলে দিয়ে যত খুশী মজুত করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে বেড়ে যাবে মজুতদারী কালোবাজারি। ওরা মুনাফার স্বার্থে কৃত্রিম অভাব তৈরি করবে। মূল্যবৃদ্ধি চরম সীমায় পৌঁছাবে। বিজেপির আমলে কৃষকদের ঋণ বেড়ে গেছে। যেহেতু কাঁচা মাল, সেচের জন্যে বা যন্ত্রপাতিতে যা একান্ত প্রয়োজন যেমন বিদ্যুৎ ও ডিজেলের দামও বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে, কৃষিতে ‘আত্মনির্ভরতা’র শ্লোগান কৃষকদের প্রতি চরম প্রতারণা।
যেসব মানুষ দেশকে ভালোবাসেন তাঁদের সবার কাছে এআইকেএসসিসি আবেদন করছে, এই বিল তথা আইনগুলির বিরোধিতা করুন। একই সঙ্গে ঋণ থেকে মুক্তি পেতে ও ফসলের পুরো দাম পাওয়ার জন্য গণমুখী সংস্কারের দাবিতে সোচ্চার হোন। আমরা দাবি জানাই এ রাজ্যে বিধানসভায় নয়া কৃষি আইনের বিরুদ্ধে সর্বদলীয় প্রস্তাব গ্রহণ করতে হবে।
মুর্শিদাবাদের গ্রামে এনআইএ হানা ও ধরপাকড় প্রসঙ্গে গত ২১/৯/২০২০ একটি প্রেস বিবৃতি জারি করে সিপিআই(এমএল) রাজ্য সম্পাদক পার্থ ঘোষ বলেন যে, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার এই অভিযান রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। ভীমা কোরেগাঁও এলগার পরিষদ মামলায় এনআইএর ভূমিকা তথা এরাজ্যে এক তরুণ বিজ্ঞানীকে তলব করার সাম্প্রতিক ঘটনার মধ্যে দিয়ে এই ‘জাতীয় তদন্ত সংস্থা’টির প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে রাজ্যের মানুষ খানিকটা সচেতন হয়েছেন।
পার্থ ঘোষ আরও বলেন, “এনআইএ’র পক্ষ থেকে সরকারীভাবে কিছু জানানো না হলেও সংবাদমাধ্যমের একাংশ ধৃত মানুষগুলিকে উচ্চস্বরে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আল কায়েদার সদস্য হিসেবে তুলে ধরছে। গল্পের গরু ইতিমধ্যেই গাছে উঠতে শুরু করেছে। আল কায়েদার কি মাত্রায় অবনতি হয়েছে যে, প্রায় নিরক্ষর কিছু যুবক এই টেক স্যাভি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের সিক্রেট মডিউলের সদস্য হিসেবে কাজ করে! সংবাদ মাধ্যমের একাংশ জানাচ্ছে, মুর্শিদাবাদে এদের বাড়িতে নাকি গোপন সুড়ঙ্গের সন্ধান পাওয়া গেছে এবং তার মধ্যে কিছু আতস বাজি, তার ও কিছু ইলেকট্রনিক গুডস পাওয়া গেছে। অথচ স্থানীয় সাংবাদিকরা সরেজমিন রিপোর্টে জানাচ্ছেন, সুড়ঙ্গ নয়, ওটা পায়খানার সেফটি ট্যাংক! এনআইএ’র তরফ থেকে এই সংবাদের কোনো পুষ্টিকরণ এখনও পাওয়া যায়নি।
কেন্দ্রের শাসকদল ২০২১ এর নির্বাচনী পরিকল্পনা তৈরি করতে ইতিমধ্যে দিল্লিতে বৈঠকে মিলিত হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই ‘মুসলিম সন্ত্রাসবাদের’ এতবড় ঘটনায় নীরব থাকতে পারেনি। সামনেই নির্বাচন। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারী থেকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীরা রাজ্যের শাসকদল ও সরকারের প্রশ্রয়ে এরাজ্যে এবং কেরলে শক্তিবৃদ্ধি করছে – এই প্রচারে নেমে পড়েছে তারা। বিজেপি-বিরোধী কোন কোন দলের নেতৃবৃন্দ বিজেপির এই প্রচারে প্রভাবিত হয়ে বিবৃতিও দিয়েছেন। তাঁরা ভুলে গেছেন, শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, বিজেপির প্রচারে এলডিএফ শাসিত কেরলও আছে।
গত মার্চ মাস থেকে কোভিড অতিমারী ও অপরিকল্পিত লকডাউন ও কর্মচ্যুতির অনিশ্চিত জীবনে যে হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী/প্রবাসী শ্রমিক দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে পরিবার পরিজন নিয়ে প্রাণ বাঁচাতে লং মার্চ করলেন, পথে অন্তত ৭৯২ জন প্রাণ হারালেন, তাদের ভবিষ্যৎ আজো অন্ধকারে। অবশ্য সরকারের কাছে এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য নেই বলেই সংসদের চলতি বাদল অধিবেশনে জানান হয়েছে। তবে এদের মধ্যে কারা কারা সন্ত্রাসবাদী সংগঠনে নাম লিখিয়েছে বা তার হয়ে কাজ কাজ করছে, সে তথ্য সংগ্রহে কেন্দ্রীয় সরকার ও কেন্দ্রের শাসকদল অত্যন্ত তৎপর।
অতিমারী ও লক ডাউনের কারণে এনপিআর, এনআরসি এবং সিএএ-র কাজ বন্ধ হয়ে আছে। তাকে পুনরায় শুরু করার এক আবহাওয়া ধীরে ধীরে গড়ে তোলা হচ্ছে। বাংলা ও কেরলে এই আন্দোলন যথেষ্ট জোরালো। তাকে মাথায় রেখেই কোনো পরিকল্পনা হচ্ছে কিনা, সে ব্যাপারে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে। নির্বাচনে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মেরুকরণ, সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও ঘৃণার রাজনীতি ফেরি করতে কোনো স্বাধীন সরকারী সংস্থা বা গোয়েন্দা সংস্থার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার হতে হবে। স্থানীয় জনগণের থেকে প্রকৃত ঘটনা জানতে রাজ্যের মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক সংগঠনগুলির দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া দরকার।”
স্বনিযুক্ত গোষ্ঠীগুলোর নেওয়া ঋণের ক্ষেত্রে তাদের সুরাহা করার দাবিতে আয়ারলা ১৬ আগস্ট থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর একমাস ব্যাপী প্রচার আন্দোলন সংগঠিত করে। করোনা অতিমারী সৃষ্ট সামাজিক ও অর্থনৈতিক দুরবস্থাই সুরাহার এই দাবিকে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। বিচার বিবেচনাহীনভাবে চালু করা লকডাউন জনগণের মধ্যে অনাহার ও প্রায়-অনাহারের ঘটনাগুলোকে বাড়িয়ে তুলেছে। জীবিকা ও কর্মসংস্থানের অভাব গ্ৰামীণ অর্থনীতিতে ধস নামিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে লুটেরা মাইক্রোফিনান্স সংস্থাগুলোকে নিয়ন্ত্রিত করে তাদের হাত থেকে জনগণকে রক্ষা করাটা সরকারের কর্তব্য।
নারী ও গ্রামীণ দরিদ্ররা যে বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছেন তাকে সামনে আনতে আয়ারলা, এআইপিডব্লিউএ এবং সিপিআই(এমএল) গত ১৫ সেপ্টেম্বর বড় আকারে ও উদ্দীপিত প্রতিবাদ সংগঠিত করে। হাজার-হাজার মহিলা ও পরিযায়ী শ্রমিক এই প্রতিবাদগুলোয় অংশ নেন। ব্যাপক সংখ্যক মানুষের অংশগ্ৰহণ এবং প্রতিবাদগুলো যে সাড়া পেয়েছে তার থেকে একটা জিনিস পরিষ্কার : গ্রামীণ জনগণ কোভিড-১৯-এর চেয়েও বেশি ভয় পাচ্ছেন ঋণদাতাদের হাতে শোষিত হওয়া ও হেনস্থার সম্ভাবনাকে। কর্মহীনতা ও অর্থনৈতিক বিপন্নতা গ্রামীণ দরিদ্র ও নারীদের কাছে একটা অতিমারী রূপেই দেখা দিয়েছে।
এই প্রতিবাদগুলো বিহারে একটা আন্দোলনের রূপ নিয়েছে। পাটনা, সিওয়ান, মধুবনি, দ্বারভাঙ্গা, সমস্তিপুর ও অন্যান্য স্থানে সংগঠিত হয়েছে বড়-বড় প্রতিবাদ। এই প্রচার আন্দোলনের ফলে আগামী নির্বাচনে ঋণভার থেকে সুরাহা একটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে উঠবে এবং জেডিইউ ও বিজেপিকে এই প্রশ্নে সুনির্দিষ্ট সমাধানের কথা বলতে হবে। প্রতিবাদে অংশ নেওয়া জনগণ ক্রোধের সঙ্গে প্রশ্ন তুলছেন – শুধু অতি ধনীদের সুবিধা দিতেই ‘মকুব’ ও ‘স্থগিতাদেশের’ ঘোষণা হচ্ছে কেন, সর্বনাশের কবলে পড়া নারী ও গ্রামীণ দরিদ্রদের জন্য এই ধরনের ঘোষণা হচ্ছে না কেন? কর্মহীনতা, ক্ষুধা ও পরিবারকে কিভাবে বাঁচিয়ে রাখবে তা নিয়ে গ্ৰামীণ জনগণ যখন ভেবে কূল পাচ্ছেন না, তখন ঋণদাতা রক্তচোষারা তাদের নির্যাতন করছে। এই পরিস্থিতিতে জনগণ দাবি জানাচ্ছেন বিহারে নীতিশ সরকার এবং কেন্দ্রে মোদী সরকার ২০২১-এর মার্চ পর্যন্ত ঋণ আদায় স্থগিত রাখার পদক্ষেপ গ্রহণ করুক।
সংগঠিত প্রতিবাদগুলো থেকে দাবি ওঠে, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে অবিলম্বে এই সমস্ত বিষয়ে সুরাহা প্যাকেজ ঘোষণা করতে হবে – ঋণের কিস্তি আদায় স্থগিত রাখতে হবে, নেওয়া ঋণের ওপর সুদ প্রদান থেকে রেহাই দিতে হবে এবং গোষ্ঠীর নেওয়া ঋণের ক্ষেত্রে সুদের হার কমাতে হবে। আর প্যাকেজ ঘোষণা করা না হলে লাগাতার আন্দোলন চলতেই থাকবে।
রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের ব্যাঙ্কগুলো থেকে ঋণ পায় না বলেই নারী ও গ্ৰামীণ দরিদ্ররা মাইক্রো ফিনান্স সংস্থাগুলো থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছে। আয়ারলা ও এআইপিডব্লিউএ লাগাতার এই বিষয়টাকেই তুলে ধরছে যে – স্বল্প মেয়াদে সরকারকে এই মাইক্রো ফিনান্স সংস্থাগুলোকে নিয়ন্ত্রিত করতে হবে, এবং দীর্ঘ মেয়াদে সরকারী প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোকে আর্থিক সহায়তা জোগাতে হবে।
২২ সেপ্টেম্বর রন্ধনকর্মী ইউনিয়নের হুগলি জেলা শাখার পক্ষ থেকে মিড ডে মিল প্রকল্পের জেলা আধিকারিকের কাছে একটি ডেপুটেশন দেওয়া হয়। মূল দাবিগুলো ছিল :
১। বর্তমান সঙ্কটের পরিস্থিতিতে পূজোর ছুটিতেও অক্টোবর মাসের ভাতা দিতে হবে,
২। বিশেষ লকডাউন ভাতা,
৩। স্বাস্থ্যসাথী কার্ড,
৪। উৎসবে বোনাস/অনুদান,
৫। রন্ধন কর্মীদের পরিচয়পত্র দিতে হবে, যাতে শাসক পাল্টালে নিজেদের লোক ঢোকানোর অপচেষ্টা বন্ধ করা যায়।
আধিকারিক দাবিগুলোর সাথে সহমত হয়ে অনেকক্ষণ আলোচনা করেন। স্বাস্থ্যসাথী কার্ড দ্রুত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। পরিচয়পত্র প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিডিওদের নির্দেশ দেবেন যাতে কর্মরত কর্মীদের কোনোভাবেই ছাঁটাই করা না হয়।
আমাদের অভিযোগ ছিল — বর্তমানে ছাত্রদের সঙ্গে রন্ধনকর্মীদেরও খাদ্যসামগ্রী দেওয়া হয়, কিন্তু কোনো কোনো স্কুলে রন্ধনকর্মীদের তা দেওয়া হয় না। আধিকারিক এই সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন।
একই দিনে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মূল দাবি গুলো নিয়ে মহিলা সমিতির পক্ষ থেকে এডিএম-র কাছে একটি ডেপুটেশন দেওয়া হয়। ঋণগ্রহিতাদের নিজের মুখে সমস্যাগুলোর কথা তিনি মন দিয়ে শোনেন।
তিনি বলেন, দিন কয়েক আগে ব্যাঙ্কগুলোর সাথে চাপ সৃষ্টির ব্যাপারে বৈঠক হয়েছে, তবু আমি আবারও কথা বলব এবং আপনাদের তার কপি দেব। আমরা বলি রাজ্য সরকার এপ্রিল মাসে ঘোষণা করেছিল সমবায় ব্যাঙ্কগুলো ঋণ গ্রহিতাদের তিন মাসের কিস্তি মকুব করবে, কিন্তু তা হচ্ছে না। এডিএম বলেন বিষয়টা দেখবেন। গোষ্ঠীগুলো যাতে প্রকৃত স্বনির্ভর হয়ে উঠতে পারে, তার জন্য তিনি বেশ কিছু পরামর্শ ও সহযোগিতার কথা বলেন। শেষে এডিএম বলেন আপনাদের দাবিগুলোর সাথে সহমত হয়েই দ্রুত ওপরে পাঠিয়ে দেব, তার ডকুমেন্ট ২৯ সেপ্টেম্বর এই অফিস থেকে নিয়ে নেবেন।
আর একটা কথা :
গোষ্ঠীদের নিয়ে আন্দোলন করতে গিয়ে একটি ভালো জিনিস লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিভিন্ন অঞ্চলের কয়েক জন নতুন এগিয়ে এসে মহিলা সমিতির সদস্য সংগ্রহের কাজটিও শুরু করেছেন। তার চাঁদাও জমা দিয়েছেন।
গত ১৬ সেপ্টেম্বর এআইসিসিটিইউ অনুমোদিত বিভিন্ন ইউনিয়ন শ্রম শক্তি ভবনের সামনে প্রস্তাবিত শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী শ্রম বিধি বিলগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংগঠিত করে। এই ভবনেই রয়েছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রক। মোদী সরকার ৪৪টা গুরুত্বপূর্ণ শ্রম আইন বাতিল করে শ্রমিকদের অধিকার কেড়ে নিতে উঠেপড়ে লেগেছে। দীর্ঘদিন বাদে শুরু হয়েছে সংসদের অধিবেশন, আর এই বাদল অধিবেশন এমনভাবে “পরিকল্পিত” হয়েছে যাতে কোটি-কোটি শ্রমিক ও কৃষকের স্বার্থ জড়িত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রশ্ন ও আলোচনাকে এড়িয়েই বিল পাশ করানো যায়। যেভাবে এইসব প্রশ্নে সমস্ত বিরোধিতাকে এবং শ্রমিক শ্রেণীর আকাঙ্খাকে অগ্ৰাহ্য করা হচ্ছে এবং সেই সমস্ত আইন প্রণয়নে তৎপরতা দেখানো হচ্ছে তা সরকারের শ্রমিক-বিরোধী ও কর্পোরেটপন্থী অবস্থানকেই দেখিয়ে দিচ্ছে। এবারের বাদল অধিবেশনে শ্রমিক স্বার্থের চরম বিরোধী তিনটি বিল পেশ হওয়ার কথা – বৃত্তিগত নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও কাজের পরিবেশ সংক্রান্ত শ্রম বিধি বিল, সামাজিক নিরাপত্তা বিধি বিল এবং শ্রম বিধি বিল।
যে সাংসদরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন তাঁরা শ্রমিকদের দুরবস্থা নিয়ে ভাবিত নন বলেই মনে হয়। যেভাবে বেতন সংক্রান্ত বিলটি পাশ হয়ে গেল তাতে এই কথাটাই সুস্পষ্ট হচ্ছে। বাম দলগুলোর এবং অন্যান্য গুটিকয়েক সাংসদরা ছাড়া দল নির্বিশেষে ব্যাপক সংখ্যক সাংসদই বেতন সংক্রান্ত বিলের অবলীলায় পাশ হয়ে যাওয়ার পথকে প্রশস্ত করতেই ভোট দিলেন। মোদী সরকার বেহায়ার মত বলছে যে, লকডাউনের সময় কত শ্রমিক মারা গেছে সে সম্পর্কে কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই, অথচ তারাই এখন আশা করছে যে বাকি তিনটে বিলকেও তারা বিনা বাধায় পাশ করিয়ে নিতে পারবে।
গত কয়েক বছর ধরে বড়-বড় কর্পোরেট সংস্থা এবং সরকারপন্থী পরামর্শদাতারা একটা বিষয়কে গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরছেন-আর সেটা হল ব্যবসা করাকে সহজ করে তোলা। এটা ঘুরিয়ে সরকারের শ্রমিক বিরোধী নীতি চালুর ওকালতি ছাড়া অন্য কিছু নয়। এই সমস্ত নীতি যে কঠোর পরিশ্রমের মধ্যে নিয়োজিত ও প্রান্তিক অংশগুলোর যন্ত্রণাকে বাড়িয়ে তোলে তা প্রশ্নাতীত। সরকার একদিকে অল্প সংখ্যক অতি ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধির পথকে সহজসাধ্য করে তুলছে, অন্যদিকে শ্রমিকদের দাসত্ব ও নিঃস্বতার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে।
শ্রম আইনগুলোকে বাতিল করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ইউনিয়নের কর্মীরা শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রকের সামনে শ্রমিক স্বার্থবিরোধী বিধি বিলের কপিগুলো পোড়ান। দিল্লী পুলিশ এআইসিসিটিইউ-র জাতীয় সাধারণ সম্পাদক কমরেড রাজিব ডিমরি, দিল্লী এআইসিসিটিইউ-র সভাপতি ও সম্পাদক যথাক্রমে সন্তোষ রায় ও শ্বেতা রাজ এবং অন্যান্য বিক্ষোভকারীদের মন্দির মার্গ ও পার্লামেন্ট স্ট্রিট থানায় আটক করে। সমবেত বিক্ষোভকারীদের সামনে তাঁর ভাষণে রাজিব ডিমরি বলেন, “মোদী সরকার মনে করছে যে তারা কোনো ধরনের প্রতিরোধের মুখোমুখি না হয়েই শ্রম আইনগুলোকে বাতিল করার পথে এগিয়ে যেতে পারবে। আমরা দৃঢ়তার সাথে বলছি, এআইসিসিটিইউ এবং অন্যান্য লড়াকু ইউনিয়ন রাস্তায় সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। অতিমারী, বেকারি এবং মুখ থুবড়ে পড়া অর্থনীতির মতো সমস্যাগুলোর সমাধানে এই অধিবেশন ডাকা হয়নি, তা ডাকা হয়েছে শ্রমিক-বিরোধী, কৃষক-বিরোধী বিল ও অধ্যাদেশগুলো পাশ করানোর জন্যে।” তিনি আরও জানান, এআইসিসিটিইউ-র দেশব্যাপী প্রতিবাদের অংশ হিসাবে বিভিন্ন রাজ্যের রাজধানী ও জেলাগুলোর শ্রম দপ্তরের সামনেও এই ধরনের প্রতিবাদ সংগঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাদল অধিবেশন চলার প্রত্যেক দিনই এই ধরনের প্রতিবাদ সংগঠিত হবে। কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলো ২৩ সেপ্টেম্বর এক যৌথ প্রতিবাদ সংগঠিত করার ডাক দিয়েছে।
২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ব্যারাকপুরে শ্রমকোড বিল এবং কৃষি বিলের বিরুদ্ধে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন সমূহের যৌথ প্রতিবাদ সভা সংগঠিত করা হয়। বক্তব্য রাখেন এআইসিসিটিইউ–র সুজিত ঘোষ, সিআইটিইউ–র গার্গী চ্যাটার্জি, এআইটিইউসি–র লিয়াকত আলি, এআইসিসিটিইউ–র মাজাহার খান এবং টিইউসিসি ও ইউটিইউসি-র নেতৃবৃন্দ। সভা শেষে চিড়িয়া মোড়ে নরেন্দ্র মোদীর কুশপুতল পোড়ানো হয়।
এনআরসি-সিএএ-এনপিআর-বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম মুখ উমর খলিদকে ষড়যন্ত্র মুলক ভাবে দিল্লির সামপ্রদায়িক হিংসায় জড়িয়ে গ্রেফতার করা হয়েছে। যোগেন্দ্র যাদব, কবিতা কৃষ্ণান, সীতারাম ইয়েচুরিদের মতন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং প্রফেসর জয়তী ঘোষ ও প্রফেসর অপুর্বানন্দকে চার্জশীট-এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর প্রতিবাদে ও মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার হওয়া ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবীদের মুক্তির দাবিতে লাগাতার প্রতিবাদী কর্মসূচী চলছে।
গত ২০ সেপ্টেম্বর রবিবার বারাসাত শহরে এআইপিএফ, এপিডিআর এবং এআইএসএ একটি মিছিল শহর পরিক্রমা করে। ব্যস্ত সময়ে মিছিল সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মিছিলের শুরুতে এবং শেষে বক্তব্য রাখেন আইসার শেখ আব্দুল আমান এবং অন্বেষা রায়।
২২ সেপ্টেম্বর ‘কো-অর্ডিনেশন অব ডেমোক্র্যাটিক রাইটস অর্গানাইজেশন’-এর ডাকে দেশব্যাপী প্রতিবাদী কর্মসূচীর অঙ্গ হিসেবে কলকাতায় বৌবাজার ব্যাঙ্ক অব ইণ্ডিয়ার সামনে দুপুর থেকে সন্ধ্যা অবধি অবস্থান কর্মসূচীতে সামিল হয় বিভিন্ন সংগঠন। আইপিএফ-এর পক্ষে সুজিত ঘোষ বক্তব্য রাখেন এবং স্বপন চক্রবর্তী ভারভারা রাওয়ের কবিতা পড়েন ও সঙ্গীত পরিবেশন করেন। ধর্ণামঞ্চ থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর কৃষকদের প্রতিরোধ কর্মসূচীতে সামিল হওয়ার আহ্বানও রাখা হয়।
উমর খালিদ সহ সমস্ত আন্দোলনকারীদের মুক্তির দাবিতে, কেন্দ্র সরকারের কৃষি সংক্রান্ত আইনের প্রতিবাদে সভা। পালবাজার মোড়ে, যাদবপুর-ঢাকুরিয়া লোকাল কমিটির পক্ষ থেকে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়। বক্তব্য রাখেন মানস ঘোষ, তমাল চক্রবর্তী, আকাশ দেশমুখ, অতনু চক্রবর্তী। গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন নীতীশ রায়। সভা সঞ্চালনা করেন সুশান্ত দেবনাথ।
এনআইএর ধরপাকপড় ও তাকে কেন্দ্র করে মিডিয়ার বিদ্বেষমূলক সংবাদের পরপরই সল্টলেকে ৩৯ডি এল ব্লকে ট্রিনিটি গেস্ট হাউস থেকে চারজন মাদ্রাসা শিক্ষককে জোর করে বের করে দেওয়া হয় কেবল মাত্র মুসলমান পরিচিতির জন্য। ওঁরা মালদহ থেকে এখানে এসেছিলেন প্রশাসনিক কাজে।এর প্রতিবাদে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন, সিপিআই(এম), সিপিআই এবং জাতীয় কংগ্রেস এর সম্মিলিত প্রতিবাদ সভা হয় এবং মিছিল করে সল্টলেক পুর্ব থানায় ডেপুটেশন দেওয়া হয়। ডিরোজিও ভবনের সামনে সভায় বক্তব্য রাখেন নির্মল ঘোষ। থানায় যে প্রতিনিধি দল যান সেখানে পার্টির পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেন জেলা কমিটির সদস্য তন্ময় নন্দী।
গত সপ্তাহে, লোকসভায় কৃষি সংক্রান্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বিল পাস হলো, তাও ধ্বনি ভোটের মারফত। এই বিলগুলি হল,
এদের মধ্যে তিন নম্বর বিলটি হল পুরোনো বিলের সংশোধনী।
লোকসভায় যবে থেকে বিলগুলি এসেছে, তবে থেকেই, ভারতের কৃষিসম্প্রদায়ের মধ্যে প্রবল অসন্তোষ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কৃষক সংগঠনগুলি, বিশেষত সবুজ বিপ্লব বেল্টর বড় কৃষক সংগঠনগুলি এই বিলগুলি বাতিল করার দাবিতে রাস্তায় নেমেছে। আড়াই শতাধিক কৃষকের সংগঠন অনশন কর্মসূচীতে ধর্নায় বসেছে।
ক্ষমতাসীন জোটের শরিকদের মধ্যেও তিনটি বিল বিভেদ সৃষ্টি করেছে। শিরোমণি আকালি দল থেকে নির্বাচিত সাংসদ ও সরকারের শরিক হরসিমরাত কৌর বাদল, তাঁর মন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগ করেছেন। আসুন এই বিলগুলোকে এক এক করে আলোচনা করা যাক।
১) The Farmers’ Produce Trade and Commerce (Promotion and Facilitation) Bill, 2020
এই বিলের প্রভাব বোঝার জন্য প্রথমে আমাদের এপিএমসি (কৃষি উত্পাদন বাজার কমিটি) আইনটা বুঝে নিতে হবে। কারণ এই নতুন আইনটা রাজ্যগুলির এপিএমসি আইনগুলোকে সরিয়েই প্রণীত হবে।
এপিএমসি (Agricultural Produce Market Committee) হল রাজ্য সরকার নিয়ন্ত্রিত আড়ৎ। এখানে কৃষকরা লাইসেন্সপ্রাপ্ত এজেন্টদের কাছে বিভিন্ন কৃষিপণ্য বিক্রি করতে পারেন। বর্তমানে, সারা দেশে এই মুহূর্তে এরকম ২,৪৭৭ খানা প্রধান আড়ৎ রয়েছে। এছাড়া এদের নীচে রয়েছে ৪,৮৮৩টি সাব-মার্কেট ইয়ার্ড। এই প্রণালীর মাধ্যমে, রাজ্য সরকারগুলি কৃষিক্ষেত্রের বাজার পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করে, যাতে কৃষকরা তাঁদের উৎপাদনের যথাযথ মূল্য থেকে বঞ্চিত না হন। এই বাজারগুলি সরকারী খাদ্যশস্য কেনার নোডাল পয়েন্ট হিসেবেও খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই কথা ঠিক যে এই আড়ৎগুলোকে কেন্দ্র করে নানা রকম দুর্নীতির চক্র গড়ে উঠেছে।
কিন্তু, সেই সমস্যা প্রতিকার করার চেষ্টা না করে সরকার এই আইন দিয়ে আড়তের এই দেশব্যাপী নেটওয়ার্কটাকেই ভেঙে দিতে চলেছে। নতুন এই আইন লাগু হলে একজন ব্যবসায়ী দেশের যেকোনো প্রান্তে গিয়ে যে কোনও কৃষকের কাছ থেকে কৃষিপণ্য কিনতে পারবেন। বাজারের নিয়ম মেনে নির্ণীত হবে পণ্যের মূল্য। এখন কথা হলো এসব শুনতে বেশ ভালো লাগে। কিন্তু আপনিই ভেবে দেখুন যে ক্রেতা যদি বহুজাতিক কর্পোরেট হয়, আর বিক্রেতা যদি হন জনৈক প্রান্তিক চাষি, তাহলে ডিমান্ড সাপ্লাই এর কি হবে?
এদেশে এই মুহূর্তে মোট কৃষি জনসংখ্যার ৬৪ শতাংশ হলেন ছোট বা মাঝারি কৃষক। এখন কোনো বিদেশী বা দেশি বহুজাতিকের সাথে দরদাম করে পণ্যের দাম নির্ণয়ের ক্ষেত্রে তাদের কী অবস্থা হবে তা নিশ্চয়ই বলে দেবার অপেক্ষা রাখে না।
আরেকটা জরুরি কথা। বর্তমানে এই এপিএমসিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে রাজ্য সরকার। এই বিল লাগু হলে তা আর থাকবে না। তার মানে ন্যূন্যতম সমর্থন মূল্য বা MSP থেকে শুরু করে খাদ্য শস্য অধিগ্রহনের যাবতীয় অধিকার – সবই রাজ্য সরকারের এক্তিয়ার থেকে বেড়িয়ে কিছু মুষ্টিমেয় বহুজাতিকের কুক্ষিগত হবে।
২০১৪ সালে, তার একটি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে বিজেপি নেতারা বলেছিলেন, তারা ক্ষমতায় এলে তাঁরা কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করার ব্যবস্থা করবেন। যাবতীয় চক্ষুলজ্জা হারিয়ে আজ কৃষকদের ন্যূন্যতম অধিকারও কেড়ে নিতে তৎপর।
প্রধানমন্ত্রী তার সাম্প্রতিক বিবৃতিতে বলেছেন যে, নতুন আইন লাগু হলেও এমএসপি, এপিএমসি এগুলো তাদের নিজের জায়াগাতেই থাকবে। সেগুলোকে সরানো হবে না। ডাঁহা এবং নির্জলা মিথ্যা। আপনিই ভেবে দেখুন যখন কর্পোরেট ক্রেতারা কৃষকদের কাছ থেকে অবাধে মাল কেনার ছাড় পাবেন, তখন এমএসপি বা এপিএমসি’গুলির কী পরিণতি হবে!
সরকারের তরফ থেকে আরো বলা হচ্ছে যে এই বিল, অবাধ লেনদেনের পথে বাধা সৃষ্টিকারী যাবতীয় প্রাচীনপন্থী আইনকে সরিয়ে দেবে, যার ফলে কৃষকদের আয় বাড়াবে। বাস্তব যদিও এই দাবিকে প্রত্যাখ্যান করে। ২০০৬ সালে, বিহারের এনডিএ সরকার তাদের রাজ্য এপিএমসি আইন বাতিল করে দেয়। তার ফল কি হল? আজ, দালালদের একটি বিশাল তন্ত্র বিহারের স্থানীয় বাজারগুলি থেকে শস্য সংগ্রহ করে তা অন্যান্য রাজ্যের এপিএমসিকে বেশি দামে বিক্রি করে। মানে কি হলো? একদিকে এপিএমসি অপসারণের ফলে, কৃষকরা খোলা বাজারের আড়ৎ মাফিয়াদের সামনে একদম অরক্ষিত হয়ে পড়লেন, আয় তো তাদের কমলই, উল্টো দিকে দুর্নীতির একটা নতুন তন্ত্র উন্মোচিত হল।
তার মানে সহজ ভাষায় বললে, সারা দেশের কৃষক এখন এই একই সংকটের মুখে পড়তে চলেছেন।
২) The Farmers (Empowerment and Protection) Agreement of Price Assurance and Farm Service.
এই আইনটি কৃষকদের সরাসরি নানাবিধ কৃষি ‘স্পনসর’দের সাথে চুক্তিবদ্ধ হবার অনুমতি দেয়। (বাংলায় নীল চাষ এই রকমভাবেই শুরু হয়েছিল। তারপর যেটা হয়েছিল, সে ইতিহাস আমাদের জানা।) ভেঙে বললে এই আইন অনুযায়ী এবার চুক্তিবদ্ধ হলে কৃষকরা তাদের ‘স্পনসর’দের চাহিদা ও ইচ্ছা মতো চাষ করতে বাধ্য থাকবেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই কায়দায় ‘সরাসরি চুক্তি’র মারফত ক্রেতা বিক্রেতাকে কাছাকাছি আনার চেষ্টা হয়েছে, এবং তার ফলাফল হয়েছে ভয়াবহ। স্থানীয় খাদ্যাভাস থেকে মাটির উর্বরতা, জল স্তর থেকে স্থানীয় পোকামাকড়ের জীবনচক্র এমনকি বাস্তুতন্ত্রকে পাকাপাকিভাবে বিষিয়ে দিয়েছে বহুজাতিক কর্পোর্রেটদের লোভ।
এবার আসুন দেখা যাক যদি কোনো আইনি বিবাদ হয় তাহলে কি হবে? কারণ আইনি চুক্তি হলে আইনি বিসম্বাদ ও থাকবে। কোনো আইনি মতবিরোধ দেখা দিলে কি হবে?
আন্তর্জাতিক স্তরে কৃষি বহুজাতিক কর্পোরেটদের সংখ্যা হাতে গোনা যায়। বিপুল অর্থের মালিক এই সংস্থাগুলির প্রধান শক্তি হচ্ছে এদের পোষা উকিল বাহিনী। কোনো আইনি বিবাদ দেখা দিলে এই সুশিক্ষিত উকিল বাহিনীর আইনি মারপ্যাঁচের সামনে এক সাদামাটা প্রান্তিক বা মাঝারি কৃষক কি করে টিকবেন? সারা পৃথিবীতে এরকম অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে, যেখানে সাদামাটা কৃষকেরা এই বহুজাতিকদের আইনি প্যাঁচে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছেন।
এই আইন ভাগচাষি ও ভূমিহীন কৃষকদের অবস্থা আরও দুর্বিষহ করে তুলবে। কোনও আইনী সুরক্ষা না থাকলে ভূমিহীন কৃষি শ্রমিকদের উচ্ছিন্ন হবার ঘটনা বাড়বে বই কমবে না।
৩) Essential Commodities (Amendment) Bill
মূল আইন ১৯৫৫ সালে পাস হয়। পরাধীন ভারতের একের পর দুর্ভিক্ষের অভিজ্ঞতা বুঝিয়ে দিয়েছিলো, যে মজুতদারী আর কালোবাজারি বন্ধ না করলে, কোনো ভাবেই আমাদের দেশে সবার জন্যে সুলভে খাদ্য সরবরাহ করা সম্ভব নয়। এই বোধ থেকেই ১৯৫৫ সালের ইসিএ বা এসেনশিয়াল কমোডিটিস অ্যাক্ট, খাদ্যশস্যের মজুত রোধে রোধে কার্যকর পদক্ষেপ ছিল।
নয়া-উদারপন্থী অর্থনীতিবিদদের একটা দল বেশ কিছুদিন ধরে এই কুতর্ক চালাচ্ছেন যে আজ আমাদের দেশে এই আইনের কোনো প্রয়োজনা আর নেই। কারণ খাদ্য সংকট মিটে গেছে। এই লাইনেই আরেক পা এগিয়ে বর্তমান আইনকে সংশোধন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সংশোধনীতে বলা হয়েছে যে বর্তমান আইনটি শুধুমাত্র যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদির মতোই বিশেষ পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে ব্যবহৃত হবে। সরকারের পক্ষ থেকেও এই কথা বলা হয়েছে যে আমাদের দেশ কৃষি ক্ষেত্রে স্বনির্ভর হয়ে উঠেছে এবং আজ আর এই আইনের প্রয়োজনীয়তা নেই।
এই যুক্তি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। প্রথমত আমাদের দেশে ক্ষুধার্তের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। তারমানে খাদ্য শস্যের বন্টন প্রণালীতে মজুতখোরদের উপস্থিতি সমেত আরও গাফিলতি আছে। তাছাড়াও, আমাদের দেশে কৃষি উৎপাদন এখনো মৌসুমি বায়ু সহ নানাবিধ শর্তের উপর নির্ভর করে। বাজারে কৃষিপণ্যের লভ্যতাও অনেকাংশে এইসব ঘটনার উপর নির্ভর করে। জাতীয় পরিস্থিতিতে, আইনটির প্রস্তাবিত লাঘবকরণ কেবল বড় ব্যবসায়ী এবং তাদের মাফিয়াকেই মজবুত করবে।
অর্থনীতিবিদদের একটি বিশেষ অংশ প্রায়ই এই যুক্তি দেন যে পুরো কৃষি সেক্টরটিকেই অবাধ বাণিজ্যের আওতায় আনা উচিত। তাঁরা বলেন যে ‘বাজার-বিরোধী’ বাধা ও সুরক্ষাবাদী পদক্ষেপগুলি আসলে কৃষিক্ষেত্রে উন্নতির প্রধান অন্তরায়।
তবে, এই অর্থনীতিবিদরা যে বিষয়টি উল্লেখ করতে ভুলে যান, এমনকি আমেরিকার মতো সচ্ছল দেশগুলিতেও তাদের কৃষিক্ষেত্র রক্ষায় বিশাল অঙ্কের ভর্তুকি ব্যয় করে।
প্রশ্ন উঠতেই হবে তাহলে সারা দেশের কৃষিক্ষেত্রকে ধ্বংসের সামনে নিয়ে গিয়ে লাভটা কার হবে?
কারণগুলি খুঁজে বের করা খুব কঠিন নয়। বর্তমান সরকার, ক্ষমতায় আসার প্রথম দিন থেকেই তার নির্বাচনী স্পনসরদের সেবা দেওয়ার জন্য সত্যই কঠোর পরিশ্রম করে চলেছে। এটি কারুর জানতে বাকি নেই যে বর্তমান নেতৃত্বে বিজেপি নির্বাচনী ব্যয়ের সমস্ত রেকর্ডকে ছাপিয়ে গেছে। প্রায় খবরের সবকটি কাগজ ও চ্যানেল তারা কিনে ফেলেছে। এই বিপুল অর্থ তারা পেলো কোত্থেকে? বা যারা বিজেপিকে তাঁদের তেজরতি খুলে চাঁদা দিয়েছেন বা দিচ্ছেন তারা এর বদলে কি চান? অতি বৃহৎ পুঁজিপতিদের একটা ছোট কিন্তু অত্যন্ত শক্তিশালী গোষ্ঠী প্রথম থেকেই এই সরকারের জন্যে আর্থিক এবং রাজনৈতিক সাহায্য দিয়ে আসছেন। আম্বানি ও আদানি গোষ্ঠীর বিশেষভাবে সরকার ঘনিষ্ঠ হওয়ার ব্যাপারটা কারুরই অজানা নয়। ঠিক যেমন অজানা নয় চাঁদা দেওয়ার বিনিময়ে একের পর এক বিশেষ সুবিধা তাঁরা এই সরকারের কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছেন। এবং ইদানিংকালে মুকেশ আম্বানির রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ এবং গৌতম আদনির মালিকানাধীন আদনী গোষ্ঠী তাদের কৃষি এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলিতে প্রচুর পরিমাণে বিনিয়োগ করছে।
- বিস্ময় বসু
পশ্চিমবঙ্গ সরকার ‘দলিত সাহিত্য আকাদেমি’ গঠন করেছে। এবং তা নিয়ে বাংলার সাহিত্য জগতে শুরু হয়েছে নয়া তর্ক-বিতর্ক। একদল, যাঁরা ‘দলিত সাহিত্য আকাদেমি’র বিরুদ্ধে, তাঁরা মতো দিয়েছেন সাহিত্যে বর্ণবিভাগ নেই, সুতরাং, ‘দলিত সাহিত্য আকাদেমি’ গঠনেরও কোনো প্রয়োজন নেই। তাঁরা এটিও বলছেন, এই ধরনের ‘ভাগ’ সাহিত্যের ক্ষতি করবে কেননা পরবর্তীতে ব্রাক্ষ্মণ, কায়স্থ কিংবা মুসলমান সাহিত্য আকাদেমি গঠনেরও দাবি উঠতে পারে! এছাড়া আর একটি চিন্তা উঠে এসেছে – বাংলা সাহিত্যে দলিতদের নিয়ে তো কম আখ্যান রচিত হয়নি, এবং যেহেতু বেশিরভাগ আখ্যানকার এক্ষেত্রে উচ্চবর্ণের, তবে কি আলাদা করে ‘দলিত সাহিত্য আকাদেমি’ গঠনের আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল? অর্থাৎ, দলিতদের জীবনসংগ্রাম ‘সাধারণ’ সাহিত্যের মধ্যেই লিপিবদ্ধ হতে পারে। কিংবা, ইতিমধ্যে, তা হয়েছেও!
এইসব তর্ক-বিতর্ক দেখে, খানিক নিজেকে জড়িয়ে ফেলে, আমার মনে হয়েছে, ‘দলিত সাহিত্য’ কী তা নিয়ে আমাদের মধ্যে বেশ ধোঁয়াশা রেয়েছে।
‘দলিত’ পরিচিতিকে কেন্দ্রে রেখে যে সাহিত্য নির্মিত তাকে কি আমরা দলিত সাহিত্য বলতে পারি? এই প্রশ্নটি যতটা সহজ, তার উত্তরটি পাওয়া ততটা সহজ নয়।
আমরা যদি ধরে নিই, ‘দলিত’ পরিচয়কে কেন্দ্রে রেখে নির্মিত সাহিত্য মাত্রই দলিত সাহিত্য, তাহলে আর একধাপ এগিয়ে বলা যেতে পারে – দলিত বা অদলিত, যে-কারো সাহিত্যই ‘দলিত সাহিত্য’র অন্তর্ভুক্ত হতে পারে যদি তিনি তাঁর সাহিত্যের নির্মাণে ‘দলিত’ পরিচয়টাকে কেন্দ্রে রাখতে পারেন।
এখানেই উঠে আসে ‘দলিত সাহিত্যে’ এস্থেটিক্সের প্রশ্নটি।
আসুন, আমরা পুনরায় একলব্যের গল্পটিকে স্মরণ করি। একলব্য জন্মসূত্রে ক্ষত্রিয় ছিল না। সে ছিল শূদ্র বংশীয় রাজপুত্র। নিম্নবর্ণ হওয়ার অজুহাতে ব্রাক্ষ্মণ গুরু দ্রোণাচার্য তাকে শিক্ষাদানে বিরত থাকেন। তখন একলব্য বালকমাত্র, এই ঘটনায় নিশ্চিত অপমানিত ও দুঃখিত হয়েছিল; তা সত্বেহ, সে দ্রোণাচার্যকেই গুরুরূপে গ্রহণ করে কারো সাহায্য ছাড়াই অস্ত্রশিক্ষার কঠোর প্রশিক্ষণে আত্মনিয়োগ করে। সে জঙ্গলে চলে যায়। গুরু দ্রোণাচার্যের মাটির মূর্তি গড়ে। তারপর মূর্তিটিকেই গুরুরূপে পুজো করে শিক্ষালাভ শুরু করে। পরবর্তীকালে, দ্রোনাচার্য তাঁর শ্রেষ্ঠ ছাত্র অর্জুনসহ বাকিদের নিয়ে সেই জঙ্গলেই হরিণ শিকার করতে আসেন। কিন্তু তাঁর পোষা কুকুরটি একটি হরিণকে ধাওয়া করতে গিয়ে হারিয়ে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও কুকুরটির সন্ধান পাওয়া যায় না। শেষে কুকুরটির কান্না শুনে তিনি ছাত্রসহ জঙ্গলের মধ্যে একটি কুটীরের সামনে উপস্থিত হন। এবং বিস্ময়ে দেখেন, সাতটি তিরের মাধ্যমে কুকুরটিকে একটি অশ্বত্থ গাছের সঙ্গে এমনভাবে গেঁথে ফেলা হয়েছে যে কুকুরটির গায়ে এতটুকু আঁচড় লাগেনি। অথচ কুকুরটি আর কোনোভাবেই নড়াচড়া করতে পারছে না।
এই ঘটনা দেখে অভিজ্ঞ দ্রোণাচার্য বুঝতে পারেন তিরন্দাজির এমন অভ্রান্ত প্রয়োগ তাঁর প্রিয় শিষ্য অর্জুনেরও অধরা। কিন্তু কে এই তিরন্দাজ? একলব্যকে অবহেলাবশত তিনি তখন ভুলে গিয়েছিলেন।
একলব্য কুটীর থেকে বেরিয়ে এসে গুরুর কাছে নিজের পরিচয় দেয়। একজন শূদ্রবংশীয় রাজপুত্রের এমন মেধা দেখে দ্রোণাচার্য চমকিত হয়ে ওঠেন!কিন্তু তিনি কোনো শূদ্রকেই বীরশ্রেষ্ঠরূপে মেনে নিতে পারেন না।
দ্রোণাচার্য একলব্যের কাছে গুরুদক্ষিণা দাবি করলেন।
একলব্য আর একমুহুর্ত দেরি না করে ডান হাতের বুড়ো আঙুল কেটে গুরুকে দান করলেন!
এই গল্পটির সঙ্গে আমরা কমবেশি সকলেই পরিচিত। ব্রাক্ষ্মণ্যবাদী শিক্ষা ব্যবস্থায় এই গল্পটিকে আমরা পড়েছি গুরুর প্রতি শিষ্যের অতুলনীয় সম্মান প্রদর্শনের গল্প হিসাবে। কিন্তু কখনই একলব্যের ভাষ্য জানবার প্রয়োজন বোধ করিনি। দলিত সাহিত্যিক শিখামণি তাঁর ‘Steel Nibs are Sprouting’ কবিতায় ঠিক এই কাজটিই করলেন। তিনি প্রচলিত বয়ানটিকে পাল্টে দিলেন। গুরুদক্ষিণাকে দেখলেন উচ্চবর্ণের দ্বারা তৈরি আইন হিসাবে। যে আইনের মাধ্যমে কোনো শূদ্রকে শিক্ষা থেকে, সংস্কৃতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়। যে আইনের মাধ্যমে একজন শূদ্রের ভূমির অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। তাকে মৃত পশুর মাংস খেতে বাধ্য করা হয়। ভারতের প্রায় এক চতুর্থাংশ জনবসতিকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে গ্রামের প্রান্তসীমায়। কারণ তারা নিম্নবর্ণ। তারা শূদ্র-অতিশূদ্র। গ্রামের কেন্দ্রে তাদের জমির অধিকার তো দূরে থাক, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রবেশও নিষেধ।
‘দলিত সাহিত্য’ তাই শুধুমাত্র ‘দলিত’ পরিচয়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেনি। গড়ে উঠেছে ‘দলিত’ অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্র করে। একজন উচ্চবর্ণের লেখক দলিতের প্রতি সহমর্মী হতে পারেন, তাঁর লেখার মাধ্যমে সমবেদনা জানাতে পারেন কিন্তু ‘দলিত’ অভিজ্ঞতা ব্যাতীত তাঁর সাহিত্য ‘দলিত সাহিত্যে’র অন্তর্ভূক্ত হতে পারে না। তা বলে উচ্চবর্ণের দ্বারা নির্মিত সাহিত্যমাত্রই তা যে দলিত বিরোধী সাহিত্য তা কিন্তু নয়। একথা কোথাও কখনো উচ্চারিত হয়নি। উচ্চবর্ণের লেখকদের লেখায় ‘দলিত’ এসেছে তাঁর রচনার আকর হিসাবে (এটি অবশ্যই ধ্বনাত্মক গুণ। এবং একজন সাহিত্যিকের পূর্ণ অধিকার আছে তিনি তাঁর রচনায় কী কী আকর হিসাবে গ্রহণ করবেন), অভিজ্ঞতা হিসাবে নয়।
এটাই দলিত সাহিত্যের এস্থেটিক্স। এখানে মগজের স্মৃতির থেকে চামড়ার স্মৃতিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই সাহিত্য সরাসরি শ্রমের সঙ্গে যুক্ত। ভুখা পেটের সঙ্গে যুক্ত। দলিত আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। এই সাহিত্যে চিৎকার উঠে আসবে তা-ই তো স্বাভাবিক। চিৎকার এখানে অলংকার নয়। এই চিৎকারটিই রচনাশৈলী!
আমরা নিশ্চয় করমছেদু গণহত্যার কথা ভুলিনি। বস্তুত ১৯৮০র দিকে অন্ধ্রে বেশ কয়েকটি দলিত গণহত্যার ঘটনা ঘটে। তার মধ্যে করমছেদু গণহত্যা বিশেষভাবে চর্চিত।
স্বাধীনতার পর ভারতের গ্রামাঞ্চলের অর্থনীতিতে দ্রুত পরিবর্তন ঘটছিল। সরকারের বিভিন্ন পলিসিতে লাভবান হচ্ছিল নীচুতলার মানুষেরাও। ফলত দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা বর্ণপ্রথার অস্তিত্ব প্রশ্নের মুখে এসে পড়ে। The Andhra Pradesh Land Reforms(Ceiling on Agriculture Holdings) Act পাস হল ১৯৭৩ সালে। এই Act-র ফলে কৃষিব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত নিম্নবর্ণের মানুষেরা সরাসরি লাভবান হল। তাছাড়া বংশানুক্রমে চলে আসা পেশাগুলি লোপ পাচ্ছিল। তারা গ্রামের বাইরে গিয়ে পছন্দমতো জীবিকা নির্বাচনের সুযোগ সামান্য হলেও পেল।
১৯৭০-৮০ ছিল সারা ভারত জুড়ে দলিত জাগরণের দশক। দলিতরা এইসময় নিজেদের পরিচিতি সম্পর্কে রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে উঠেছিল। তাঁরা মারাঠি, তামিল, তেলুগুসহ বিভিন্ন ভাষার সাহিত্যে তুমুল পরিবর্তন ঘটিয়ে দিল। ‘দলিত সাহিত্য সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হচ্ছিল বিভিন্ন রাজ্যে।
কিন্তু এইসবের মাঝখানে অন্ধ্রের রাজনীতিতে শুরু হয়েছিল নতুন ছক। ১৯৮২তে তৈরি হল তেলুগু দেশম পার্টি (টিডিপি)। এই পার্টির প্রতিষ্ঠাতা এন টি রামারাও, যিনি একজন বিখ্যাত ফিল্ম অভিনেতা ও কাম্মা সম্প্রদায়ের মানুষ। এই কাম্মা সম্প্রদায় হল উচ্চবর্ণের জমিদারশ্রেণী। ভোটের সময় দেখা গেল সিপিআই ও সিপিআই(এম), যাদের সমর্থকদের একটা বড় অংশ নিম্নবর্ণের মানুষ, জোট বাঁধল টিডিপির সঙ্গে। অপরদিকে কংগ্রেসের সমর্থকরা ছিল মূলত ভূস্বামী – কাম্মা, রেড্ডি ও কাপু সম্প্রদায়ের মানুষ। ফলে রাজনীতিতে নিম্নবর্ণকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে এমন কোনো দল আর থাকল না।
রাজনীতির এই চেনা ছকটিকেই ব্যবহার করল উচ্চবর্ণের মানুষেরা। এই ছকটি ব্যবহার করে তারা পুরানায় ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে এল।
করমছেদু্র ঘটনাটা এই রকম : দু-জন কাম্মা সম্প্রদায়ের ছেলে তাদের গরুকে চান করাতে গিয়েছিল গ্রামের পুকুরে। এই পুকুর থেকেই দলিতরা পানীয় জল সংগ্রহ করে। ফলে স্বাভাবিক কারণেই একজন নিম্নবর্ণের মহিলা প্রতিবাদ জানায়। প্রতিবাদে কান দেওয়া তো দূরের কথা ছেলে দুটো মহিলাটিকেই বেধড়ক পেটাতে শুরু করে দেয়। সেইসময় ঘটনাটা এখানেই থেমে গিয়েছিল। এমনকি এটা নিয়ে কোনো পক্ষই পুলিসে রিপোর্ট লেখাতে যায়নি।
কিন্তু কাম্মা সম্প্রদায় এই ঘটনাটিকে মোটেই কোনো ছোটো ঘটনা হিসাবে নেয়নি। মহিলাটির প্রতিবাদ তাদের কাছে ছিল অপমান। কেননা মহিলাটি তাদের জাতের আধিপত্যকে প্রশ্ন করেছিল।
ফলে প্রায় ৩০০০ জন কাম্মা সম্প্রদায়ের লোক একত্রিত হয়ে হামলা চালাল নিম্নবর্ণের গ্রামটিতে। ছয় জন নিম্নবর্ণের মানুষকে তারা হত্যা করল। তিনজন মহিলাকে ধর্ষণ করল। প্রায় ৩০০টি পরিবার সেই গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হল।
করমছেদু গণহত্যা অন্ধ্রে দলিত জাগরণে ইন্ধন জুগিয়েছিল। প্রথাগত বামপন্থীদের দৃষ্টিকোণে এই ঘটনাটি ছিল ভূমিহীনদের উপর ভূস্বামীদের অত্যাচার। কিন্তু শোষিত, অত্যাচারিত দলিতরা এই ঘটনাকে দেখেছিল বর্ণবাদের প্রকাশরূপে। এই ঘটনাটা, তাদের চোখে ছিল, উচ্চবর্ণের দ্বারা সংঘটিত অত্যাচার যা যুগ যুগ ধরে ঘটে আসছে।
করমছেদুর ঘটনার প্রভাব শুধু সমাজ-রাজনীতিতে লক্ষ করা যায়নি। এই ঘটনার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। গল্প, উপন্যাস, গান ও কবিতায় এই ঘটনার উল্লেখ ফিরে ফিরে আসে।
দলিত কবি কালেকাপুরি প্রসাদ প্রগ্রেসিভ সাহিত্যকে, এমনকি, ব্রাক্ষ্মণ্যবাদী সাহিত্য হিসাবে কটাক্ষ করেছেন। কারণ এই ঘটনার জন্য তাঁরা মূলত শ্রেণী বৈষম্যকেই দায়ী করেছেন। যদিও দলিত সাহিত্যিক ও এক্টিভিস্টরা মনে করেন এই ঘটনার অত্যাচারের মাত্রা এটাই প্রমাণ করে যে নিম্নবর্ণের উপর হওয়া এই অত্যাচারের কেন্দ্রে রয়েছে বর্ণবাদ। সুতরাং, বর্ণবাদকে খতম করতে না পারলে এই অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়।
দলিত কবি কালেকাপুরি প্রসাদের একটি কবিতার খানিক অংশ –
আমি জানি না আমি কখন জন্মেছি,
কিন্তু জানি কয়েক হাজার বছর আগে আমাকে এখানেই হত্যা করা হয়েছিল
এই হল জন্ম-মৃত্যুর সেই না-শেষ হওয়া বৃত্ত
আমি কর্মফল সম্পর্কে কিছুই জানি নাকিন্তু আমি জন্মাতেই থাকি,
জন্মাতেই থাকি আর বারবার একই জায়গায় মারা যাই…
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে – সমস্ত দলিত সাহিত্যিকের লেখাকেই কি আমরা ‘দলিত সাহিত্য’ হিসাবে গণ্য করতে পারি?
উত্তরটি সহজ – না, একজন দলিতের লেখা মাত্রই তা ‘দলিত সাহিত্য’ হিসাবে বিবেচিত হবে না। লেখাটিকে লিখতে হবে অবশ্যই দলিতের দৃষ্টিকোণ থেকে। ভারতীয় জনসমাজে দলিতের দুরবস্থার কারণ হিসেবে বর্ণবাদ প্রথাকেই চিহ্নিত করতে হবে। দলিত সাহিত্যে সূচীমুখ তীক্ষ্ণ। এখানে প্রধান শত্রু বর্ণবাদ/মনুবাদ। বর্ণপ্রথার বিনাশ তখনই সম্ভব যখন বর্ণপ্রথার অস্তিত্বকে স্বীকার করে নিয়ে আন্দোলন সংঘটিত করা যাবে। ‘দলিত সাহিত্য’ দলিত আন্দোলন নিরপেক্ষ হতে পারে না। যদিও কোনো কোনো দলিত সাহিত্যিকের লেখায় বর্ণবাদ ও শ্রেনিবৈষম্য – দুটোই সমান গুরুত্ব পেয়েছে। এখানে আমরা আফ্রিকান লিটারেচারকে স্মরণ করতে পারি। কামারা লাই – একজন বিখ্যাত আফ্রিকান কবি। তাঁর Dark Child এবং Dream of Africa পৃথিবীর যেকোনো দেশের কবিতা পাঠকের কাছেই পরিচিত। Dark Child কবিতায় তিনি আফ্রিকার কালো-মানুষদের আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলেন। এমনকি তাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনগুলি থেকেও সরে আসতে বলেছিলেন। আফ্রিকান হওয়া সত্বেহ তাই আফ্রিকান জাতীয়তাবাদীরা তাঁকে উপনিবেশবাদে দুষ্ট হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। এবং তাঁর সাহিত্যকে, যতই তা শিল্পগুনে সমৃদ্ধ হোক, আফ্রিকান/ব্লাক লিটারেচারের অন্তর্ভূক্ত করেননি। অন্যদিকে আমোস তুতুওলা কখনই একটিমাত্র পরিচয়ে পরিচিত হতে রাজি নন। বস্তুত তিনি কোনো একটি বর্গে নিজেকে আঁটকে রাখার বিরুদ্ধে। ব্লাক লিটারেচারের দাবিগুলির প্রতি তিনি সম্মান জানিয়েও দূরত্ব বজায় রেখেছেন।
‘দলিত সাহিত্যে’র একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে আত্মজীবনী। এখানে মারাঠি ভাষায় রচিত দলিত সাহিত্যিক দয়া পাওয়ারের ‘বলুত’ বইটির উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই ‘বলুত’ পাঠক মহলে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল। মহার জনগোষ্ঠীর মানুষদের জীবনসংগ্রামের কাহিনি রয়েছে এই বইটিতে। আমরা দেখি একটি পশুর মৃতদেহ। আকাশে উড়ছে শকুন। আর শকুনের সঙ্গে যুদ্ধে নেমেছে একজন মহার বালক। মৃত পশুর মাংস সে কিছুতেই হাতছাড়া হতে দেবে না।
‘দলিত’ শুধু একটি নির্দিষ্ট জাতিগোষ্ঠী নয়। দলিত একটি সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক পরিচিতি।
পশ্চিমবঙ্গে ‘দলিত সাহিত্য’ বহুদিন ধরেই লেখা হচ্ছে। কিন্তু পরিকাঠামোর অভাবে বইগুলো সহজলভ্য নয়। মারাঠি, কন্নড়, মালায়ালাম, তামিল ভাষায় যেভাবে এই সাহিত্যকে পড়া হচ্ছে সেই সুযোগ আমাদের ছিল না। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘দলিত সাহিত্য আকাদেমি’ গঠন একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। আশাকরছি, এই আকাদেমির মাধ্যমে ‘দলিত সাহিত্য’ চর্চার পথ সুগম হবে। দলিত আন্দোলন আরও সংঘটিত হবে। এবং অবশ্যই বর্ণবাদ প্রথার বিলুপ্তি ঘটবে।
-- সাদিক হোসেন
মাগুরা মোল্লাপাড়া, মহেশতলা, দঃ ২৪ পরগণা
১৫ মার্চ, ২০১৯। ছোট্ট দেশ নিউজিল্যান্ডে ঘটে ছিল এক নজিরবিহীন ঘটনা। দুটি মসজিদে শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসী ব্রেন্টন ট্যারেন্টের বন্দুক-হামলায় প্রার্থনারত অবস্থায় প্রাণ হারিয়ে ছিলেন ৫০ জন নিরপরাধ মানুষ। আহত শতাধিক। সেই ঘটনায় মর্মাহত প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন যেভাবে নিজের ক্ষোভ লজ্জা বেদনা প্রকাশ করেছিলেন তা সেই দেশের মুসলিম নাগরিকদের তো বটেই, সেই সৎ আবেগ গোটা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। ঘটনার বর্ষপূর্তিতে তিনি দিনটিকে ‘নিউজিল্যান্ডের অন্ধকারতম দিন’ বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর প্রতিশ্রুতিমত অস্ত্র-আইন সংশোধিত হয়েছে। অপরাধীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজাও ঘোষিত হয়েছে।
২০০২-এ প্রশাসনের মদতে তিনদিন ধরে চলা গুজরাট গণহত্যায় (যাকে পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ ‘এথনিক ক্লিনজিং’ বলে আখ্যা দিয়েছেন) বিশ্ববাসী সাক্ষী থেকেছিল সুপরিকল্পিত ক্রূরতম নিষ্ঠুরতম নারকীয় এক হত্যালীলার। ২০০০-এরও বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়া এই হামলা চালিয়েছিল উগ্র হিন্দুত্ববাদী একাধিক সংগঠন। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অভিযুক্ত হয়েও ক্লিনচিট পেয়ে গিয়েছিলেন। আজ অবধি, ভাষণপটু (অধুনা) প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে দুঃখপ্রকাশ করে একটি শব্দও দেশবাসী শোনেনি।
২০০৮-এর ২৯ সেপ্টেম্বর। মালেগাঁও-তে নুরাজি মসজিদের সামনে বাইক বিস্ফোরণে ৬ জনের প্রাণ গিয়েছিল, আহত হয়েছিলেন শতাধিক মানুষ। এই হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত হয়েছিলেন সাধ্বী প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর সহ উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের সাত সদস্য। সাধারণ মানুষ এইভাবে বলি হয়েই চলেছেন কখনও জঙ্গী সংগঠনের, কখনও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের হামলার। কাশ্মীরে গত কয়েক দশক ধরে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার সাধারণ মানুষ। জঙ্গী নিধনের নাম করে বহু সাধারণ নাগরিককে হত্যা করা হয়েছে। ৩৭০ ধারা বিলোপের পর তো ভূস্বর্গ পুরোপুরি সামরিক বাহিনীর দখলে। গত বছর কাশ্মীর থেকে কফিনবন্দি হয়ে ফিরেছিলেন মুর্শিদাবাদের পাঁচ ভূমিপুত্র। তারা সকলেই মুসলিম, পেটের তাগিদে আপেলের মরশুমে গিয়েছিলেন বাগানে খাটতে। জঙ্গি হামলায় নিহত হন। কাশ্মীরের শোপিয়ানে কিছু দিন আগে আরশিপোরা অপারেশনে সাজানো এক এনকাউন্টারে তিনজন নিরীহ যুবককে সেনাবাহিনী হত্যা করেছিল, সম্প্রতি সেনা আধিকারিকরা স্বীকার করেছেন। মায়ানমারে প্রশাসনিক সন্ত্রাসে নিহত, ভিটেছাড়া, সর্বস্বান্ত হয়েছেন রোহিঙ্গা জনসাধারণ। আক্রমণকারীরা বৌদ্ধ। আমেরিকায় কিছু দিন আগে নিহত হয়েছেন কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েড, মিনিয়াপোলিসের পুলিশের বর্বরতায়। তারপরও কৃষ্ণাঙ্গ হত্যা হয়েছে আমেরিকায়। এইভাবে মানবাধিকার লাঞ্ছিত, লঙ্ঘিত হচ্ছে পৃথিবী জুড়ে। এইসব ঘটনায় কি সমস্ত হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে দেগে দেওয়া হয়েছিল? না, তা করা যায়? কোনো সভ্য সমাজ তা করতে পারে না।
কিন্তু আমাদের ভারতবর্ষে বর্তমানে এমন একটি সরকার ক্ষমতায় আছে, যার ক্ষমতায় আসাটাই সাম্প্রদায়িক বিভাজন আর জাতি বিদ্বেষকে ভর করে। তাই অবলীলাক্রমে একটি গোষ্ঠীকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ হিসেবে দেগে দিতে তাদের বিন্দুমাত্র দ্বিধা হয় না। মুড়ি বা পান্তা খেলে, লুঙ্গি পরলে, দাড়ি রাখলেই সে মুসলমান, আর মুসলমান মানেই সে ‘সন্ত্রাসবাদী’! আর এই শাসকদল দেশের সমস্ত সম্পদ লুঠে মানুষকে হৃতসর্বস্ব করলেও একটা জিনিষ সাধারণ্যে বিতরণে তারা দরাজ এবং ক্লান্তিহীন — দলিত, সংখ্যালঘুদের প্রতি আকণ্ঠ ঘৃণা, বিদ্বেষ আর অবিশ্বাস! তাদের অনুগৃহীত সংবাদমাধ্যমগুলি নজিরবিহীন ‘দায়বদ্ধতা’য় সেই বিষ ছড়িয়ে যাচ্ছে সমাজ দেহের প্রতিটি রক্ত কণিকায়। এরাজ্যেও তার বিরাম নেই। গদীলোভী মোদীভক্ত ছোট, বড়, মেজো, সেজো বিজেপি নেতারা তাদের ‘লাশ ফেলা’ ভাষণে অনবরত সেই বিষ উগড়ে চলেছেন। সেই বিষবৃক্ষের ফল ফলতে শুরু করেছে। আসছি সে কথায়।
অর্থনীতির বিধ্বংসী পতন (“দৈব দুর্বিপাক”!), ১২ কোটি মানুষের কাজ হারানো, দৈনিক প্রায় লাখখানেক করোনা-সংক্রমণ— এসবে মোদী সরকারের ঐতিহাসিক অবদানকে আড়াল করতে কখনও সীমান্তে হাস্যকর তাল ঠোকার, কখনও সুশান্ত-রিয়া-কঙ্গনা উপাখ্যানের আমদানি করতে হয়েছে। এবার দেশের মানুষের খাদ্য সুরক্ষাকে ধ্বংস করে দেশের কৃষিক্ষেত্রকে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য পাস হয়ে গেল নতুন কৃষি আইন। আর এই সর্বনাশকে আড়াল করতে নতুন এপিসোড — ‘নিয়া’র তৎপরতা! ক’দিন আগে এক বিশিষ্ট বিজ্ঞানীকে ডেকে পাঠানো হল। এবার একেবারে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলা মুর্শিদাবাদের গ্রাম থেকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হল ৬ ‘জঙ্গি আল কায়েদা সদস্যকে’। কেরল থেকেও। এরা কারা? হত দরিদ্র প্রবাসী শ্রমিক, কাঠ মিস্ত্রি, ছাত্র, ক্ষেতমজুর। এরা ‘সন্দেহভাজন’। তাদের অপরাধ তো প্রমাণিত হয়নি এখনও! কিন্তু ‘দায়বদ্ধ’ মিডিয়া সবিস্তারে নানা লোম খাড়া করা কাহিনি নামিয়ে ফেললো বলে!
আসলে ভয় হয়। ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’-এ দিন দুই আগে এক খবরে প্রকাশ, জঙ্গী সন্দেহে ধৃত বেশ কয়েকজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষকে কয়েক দশক ধরে জেলবন্দি রাখার পর সম্প্রতি জানা গেছে — তারা সম্পূর্ণ নির্দোষ। ‘নিয়া’র এই তৎপরতায় সাধারণ মানুষ ‘বলি’ হবেন না তো?
এবার আসি একটু পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম সমাজের কথায়, যাদের প্রতি বিজেপি-আর এস এস-এর ঘৃণা ক্রমশ ব্যাপ্ত হচ্ছে সমাজে। এরা এই রাজ্যের জনসংখ্যায় ২৭.১% (২০১১-র জনগণনা অনুসারে)। ২০১৪-তে Snap & Guidance Guild-এর এক সমীক্ষায় প্রকাশ — মুসলিম জনসংখ্যার ১৭.৩% নিরক্ষর, ১১.৮% প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডি পেরোতে পারেননি ৮০% কায়িক শ্রম বা দিনমজুরির সঙ্গে যুক্ত। মাত্র ১৭% মানুষ শহরে বাস করেন। মাত্র ০.৪% অধ্যাপনা, চিকিৎসা, ওকালতি ইত্যাদি পেশায় যুক্ত। ‘পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানের জীবনের বাস্তবতা : একটি প্রতিবেদন’ শীর্ষক রিপোর্টে প্রকাশ —মুসলিম জনসংখ্যায় স্নাতক স্তর পর্যন্ত পড়াশুনো ৪.৮৫%; স্নাতকোত্তর ১.৮৬%; সরকারী চাকরিতে আছেন ৩-৪%; মনমোহন সিং সরকারের আমলে গঠিত সাচার কমিটির বহুচর্চিত রিপোর্ট ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের করুণ আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির কথা তুলে ধরেছিল। চমকে দিয়ে এই রিপোর্ট জানিয়েছিল – পশ্চিমবঙ্গে মুসলিমদের অবস্থা দলিতদের থেকেও খারাপ। গ্রামীণ মুসলিম প্রধান অঞ্চলে শিক্ষা-স্বাস্থ্য পরিকাঠামো অত্যন্ত দুর্দশাগ্রস্ত। সাচার কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৬-এ। তারপর গঙ্গা যমুনা ব্রহ্মপুত্র দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। দেশে-রাজ্যে সরকার পাল্টে গেছে। কিন্তু মুসলিম সম্প্রদায়ের অবস্থার কিছু হেরফের হয়নি। কোনও সরকারই আন্তরিক উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসেনি। কিন্তু ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে তাদের ব্যবহার করেছে। কিছু প্রসাধনী সংস্কার অবশ্য হয়েছে। বাংলার মসনদ যাদের চাই-ই চাই, সেই দিলীপ-সায়ন্তন-রাহুল কোম্পানি কতটুকু জানেন বাংলার এই দ্বিতীয় বৃহত্তম নাগরিক সমাজ সম্পর্কে? আমরা শহরবাসীই বা কতটুকু জানি যারা টিভি-র সামনে বসে গোল গোল চোখ করে মুগ্ধ বিস্ময়ে মিডিয়ার কল্পকাহিনিগুলো শুনি আর ঝালিয়ে নিই নিজের অবচেতনে থাকা জাতিবিদ্বেষ?
দু’দিন আগে সল্টলেকের সি এল ব্লকের অতিথিশালায় কয়েকজন মাদ্রাসা শিক্ষকের সঙ্গে, শুধু মুসলিম হওয়ার জন্য চরম অমানবিক ব্যবহারের ঘটনা দুর্ভাগ্য ক্রমে আমরা সবাই জানি। শুধু একটি বিষয় — সেই হতবাক শিক্ষকদের অপমান-গোটা বাংলার চিন্তা চেতনা সংস্কৃতি সমাজবোধের অপমান। আজও বাঙালি হিন্দু-মুসলিম প্রতিবেশীরা ঈদ-বিজয়ায় পরস্পর কোলাকুলি করে মিষ্টিমুখ করেন। সেই ঐতিহ্য আমরা ভুলে যাব রামনবমীর নামে শিশুদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া গোমূত্রপায়ীদের প্ররোচনায়? কখনও না! বাংলায় এদের ঘৃণাভরা প্রত্যাখ্যানের মধ্য দিয়েই আমরা আমাদের বর্ষীয়ান শিক্ষকের চোখের জলের দাম মিটাবো!
- জয়ন্তী দাশগুপ্ত
গোটা দুনিয়া দেখলো লকডাউনের পর ভারত জুড়ে ঘনিয়ে ওঠা অভূতপূর্ব মানবিক সংকট – লাখে লাখে কাজ হারা, বিপন্ন পরিযায়ী শ্রমিকদের পায়ে হেঁটে ঘরে ফেরার মর্মান্তিক দৃশ্য, দেশ ভাগের পরও যা দেখা যায়নি। শুধু, মোদী সরকারের গোচরে এসব এলো না কিছুই। ১১ লক্ষ পাতার চার্জশিট তৈরি করতে না-ঘটা হাজার হাজার “অপরাধ” যে সরকারের নজরে এলো, বুদ্ধ পূর্ণিমার রাতে চলন্ত ট্রেনে কাটা ১৬ জন পরিযায়ী শ্রমিকের ছিন্ন ভিন্ন লাশ, চতুর্দিকে ছড়ানো ছিটানো পোড়া রুটির গা হিম করা সেই দৃশ্য মোদীর চোখে ধরা পড়লো না। ভারতীয় সংসদ আর কত মিথ্যাভাষণের সাক্ষী থাকবে কে জানে!!
পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে এই পর্বে যারা নানাবিধ অনুসন্ধান ও কাজ করেছে, সেই “স্ট্রান্ডেড ওয়ার্কারস্ অ্যাকশন নেটওয়ার্ক” (এসডব্লিউএএন) জানালো, ৪ জুলাই পর্যন্ত তাদের রিপোর্টে ধরা পড়েছে ৯৭২ জন পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃত্যুর ঘটনা। তারা তালিকা প্রকাশ করে ছুঁড়ে দিয়েছে চ্যালেঞ্জ – সরকারের দায়িত্ব এর সত্যতা যাচাই করে অবিলম্বে মৃত ব্যক্তিদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া।
এমনকি প্রধানমন্ত্রীর ১৬ মে’র একটা ট্যুইট তারা উল্লেখ করেছেন, যাতে মোদী জানিয়েছিলেন উত্তর প্রদেশের ঔরাইয়ার কাছে দুর্ঘটনায় নিহত পরিযায়ী শ্রমিকদের পরিবারকে মাথা পিছু দু’লক্ষ টাকা দেওয়া হবে প্রধানমন্ত্রীর রিলিফ তহবিল থেকে! তারা দেখিয়েছেন, ২১৬ মারা গেছেন অনাহার ও আর্থিক অনটনের জন্য, ২০৯ জন রাস্তায় ও ট্রেন দুর্ঘটনায়, ১৩৩ জন আত্মহত্যা করেছেন চরমতম হতাশায়, ৯৬ জন শ্রমিক স্পেশাল ট্রেনে ঘরে ফেরার পথে, ৭৭ জন চিকিৎসার অভাবে, ৪৮ জন দীর্ঘ পথ হেঁটে অবসন্ন পরিশ্রান্ত হয়ে, পুলিশি অত্যাচারের মুখে ৩০ জন – এরকম আরো নানা কারণে পথ চলার মাঝেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয় ১২টি রাজ্যের পাঁচ হাজার শ্রমিকের মধ্যে সমীক্ষা চালায়। এদের মধ্যে দুই তৃতীয়াংশই কাজ হারিয়েছে। শহুরে শ্রমজীবীদের মধ্যে সমীক্ষা করে দেখা গেছে স্বনিযুক্ত পেশার মধ্যে ৯০ শতাংশের কাজ খোয়া গেছে। এটাও উঠে এসেছে, ৯১ শতাংশ বিপিএল পরিবারের প্রধান রোজগেরে যিনি ছিলেন, তার হাতে এখন কোনো কাজ নেই। তিন মাস পর্যন্ত জন-ধন প্রকল্পে অন্তর্ভুক্তদের প্রতিশ্রুত ৫০০ টাকা পাননি এমন পরিবার হলো ৬৭ শতাংশ।
কৃষকদের মধ্যেও সমীক্ষা করে দেখা গেছে বেশির ভাগ চাষি তাদের উৎপন্ন ফসল হয় বিক্রি করতে পারেননি, অথবা কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু সরকার জানিয়েছে, এ সম্পর্কে কোনো তথ্যই তাদের কাছে নেই।
স্বাধীন ভারত কি আজ পর্যন্ত দেখেছে এমন নির্দয় ঔদাসীন্য, অপরাধসম নির্লিপ্ততা, জাহান্নামের আগুনে বসে রাষ্ট্র নায়কের চরম উপেক্ষার হাসি?
- অতনু চক্রবর্তী
একটা খুব সোজা প্রশ্ন করি শুরুতেই, আপনি যে বাড়িটাতে থাকেন সেখানে এসে গভর্নমেন্ট যদি আপনাকে বলতে শুরু করে যে এই বাড়িটি আপনার না, আপনি বেআইনিভাবে এখানে রয়েছেন – অথচ গত পঁচাত্তর বছর ধরে আপনার পরিবার এখানেই থাকে। কেরালার ওয়েস্টার্ন ঘাট জুড়ে দলিত আদিবাসীদের নিজেদের জায়গা থেকে উচ্ছেদ করে দেয় গভর্নমেন্ট। এই নিয়েই ২০১৩ সালে জয়ান বলে একজন চিত্রপরিচালক মালায়লাম ভাষায় একটি সিনেমা তৈরি করে, ‘প্যাপিলিও বুদ্ধা’।
পুঁজিপতি, বুর্জোয়াদের দেশের গরিব জনগণকে শোষণ করার ইতিহাস প্রতিবার আরো ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে ফেলে। প্যা পিলিও বুদ্ধা আসলে একটি বিলুপ্তপ্রায় ও মূল্যবান প্রজাপতি বিদেশের বাজারে এর দাম খুব চড়া। সিনেমাটির প্রথম দিকে দেখা যায় অন্যতম চরিত্র জ্যাবক, একজন বিদেশি লোক, শংকরকে সামান্য কিছু হাত খরচা দিয়ে এই প্রেসাশ প্রজাপতিটি তাকে দিয়ে বিদেশের বাজারে বিক্রি করার জন্য বেশ কিছু সময় ধরে ওয়েস্টার্ন ঘাটে রয়েছে। এটা একটা উদাহরণ মাত্র। দেশি ও বিদেশি উভয়কার বুর্জোয়া শ্রেণি দেশের গরিব শ্রেণীকে দিনের পর দিন শোষণ করে আসছে নিজেদের স্বার্থে। উড়িষ্যার নিয়ামগিরিতে ‘ভেদান্ত গ্রুপ’ নিজেদের লাভের জন্য সেখানকার দলিত আদিবাসীদের উচ্ছেদের ব্যবস্থা করে দিয়েছে সরকারের সাহায্য নিয়ে, ঠিক যেমন এই সিনেমাটিতে তুলে ধরা হয়েছে।
সিনেমাটির শেষের দিকে একটি দৃশ্যে বলা হচ্ছে যে এই দলিত আদিবাসীরা যদি সরকারের জায়গা দখল করে থাকে, তাহলে সাধারণ মানুষেরা থাকবে কোথায়? সমাজের শ্রেণী বৈষম্য কি ভীষণ পরিমাণে মানুষের মাথায় ঢুকে বসে থাকলে এরকম কথা বলা যায়! আর এই কথাটা একদম মিথ্যে নয়, বর্তমান ভারতবর্ষে দলিত আদিবাসীদের মানুষ বলেই গণ্য করা হয় না, তারা অপমান-ঘৃণা আর রাষ্ট্রের অত্যাচার ছাড়া আর কিছুই পায় না। ঠিক যেমন মোদি-শাহের ফ্যাসিবাদী সরকার দিল্লির ঝুপড়িতে থাকা ৪৮ হাজার গরিব মানুষকে মানুষ বলেই মনে করে না, হঠাৎ করে একদিন তাদেরকে উচ্ছেদের অর্ডার দিয়ে দেয়। ঠিক যেমন করে কোন আদিবাসী মহিলার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর হয়ে গেলে রাষ্ট্র তা ঠিক বিশ্বাস করতে পারে না, তার প্রচন্ড অবাক লাগে!
শ্রেণী বৈষম্য ও জাতিভেদ প্রথা ভারতবর্ষে কী ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে, তা এই সিনেমাটি দেখেই সুস্পষ্ট হয়ে যায়। একদল সমাজকর্মী তথা ফিল্মমেকার এই ওয়েস্টার্ন ঘাটে এসে নিপীড়িত এই দলিতদের ওপর সিনেমা বানাচ্ছে, তাদের নিয়ে দুটো কথা বলছে, আর ওদিকে রাতের বেলায় নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে গিয়ে বলে ফেলছে যে দলিতদের আন্দোলন নিয়ে সমস্যা আছে, কারণ দলিত আদিবাসীরা শুধুই ভান করছে। এটুকুই প্রমাণ করে দেয় দলিত আদিবাসীদের উপর দেশ জুড়ে চলে আসা অত্যাচারের কথা।
অ্যান্টি এনআরসি আন্দোলনে আলিগড়, জেএনইউ, জামিয়ার ছাত্রছাত্রীদের ওপর পুলিশ গুলি চালাতেও পিছপা হয়নি। সিনেমাটিতে শঙ্করকে থানার মধ্যে বেদম শারীরিক অত্যাচার করা হয়, জেএনইউ থেকে সে পড়াশোনা করেছে সেটাই তার সবচেয়ে বড় ‘অপরাধ’। সিনেমা এবং বর্তমান সময়ে এই জায়গায় হুবহু মিলে যাচ্ছে – দুদিন আগেই জেএনইউ’এর প্রাক্তন ছাত্র উমর খালিদকে অ্যাদরেস্ট করা হয়েছে, তাঁর বিরুদ্ধে ১১ লক্ষ পাতার চার্জশিট তৈরি করা হয়েছে, আর অন্যদিকে দলিত আদিবাসীদের উপর চলে আসা অত্যাচার, লকডাউনে পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যা নিয়ে রাষ্ট্র একটা বাক্যও খরচা করতে রাজি নয়। সিনেমাটির একটি দৃশ্যে যখন শঙ্করকে থানায় মারা হচ্ছিল, বারবার বলা হচ্ছিল ‘নকশাল’ শব্দটি, বারবার বলা হচ্ছিল ‘দলিত টেররিস্ট’ কথাটি। যাদেরকে এই রাষ্ট্র মানুষ বলেই গণ্য করে না তাদেরকে টেররিস্ট বলছে, আর অন্যদিকে আরএসএস যা প্রকৃত জঙ্গির আস্তানা, তাদেরকে দেশের সর্বোচ্চ ভক্ত বলে ঘোষণা করে দিয়েছে। আর করবে নাইবা কেন – দলিতদের উপর অত্যাচার করা থেকে শুরু করে কাশ্মীরে কালাকানুন চালু, উমর-সাফুরা-ভারভারা রাওদের বন্দী বানানো – সবকিছুই নাগপুর ও দিল্লির মধ্যে পরামর্শ করে নেওয়া সিদ্ধান্ত।
সিনেমাটির একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, মঞ্জুশ্রী, একজন আদিবাসী মহিলা, তিনিও আর পাঁচটা মানুষের মতো স্বপ্ন দেখেন। মঞ্জুশ্রী একদিকে অটো চালান টাকা উপার্জনের জন্য, অন্যদিকে মেপ্পারা অঞ্চলের আদিবাসী বাচ্চাদের জন্য একটি স্কুল চালান। মঞ্জুশ্রী তাঁর জন্ম থেকে দেখে দেখে আসছেন তাদের ওপর চলতে থাকা এই অত্যাচার, তিনি আবার এই দলিত আন্দোলনে বেশ সক্রিয়। তবে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একজন মহিলা অটোচালক অটো চালিয়ে স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ালে বাদবাকি অটোচালকেরা অর্থাৎ লিঙ্গবৈষম্যক পূর্ব এই সমাজ ঠিক হজম করে উঠতে পারে না, তাদের অস্বস্তি হয় মাথায়, শরীরে, চোখে। মঞ্জুশ্রী তাদের কুমন্তব্য আর ব্যবহারের পাল্টা জবাব দিলে তারা কেউই আর মানুষ থাকতে পারেনা। পরিকল্পিতভাবে তাঁকে একাধিক পুরুষ মিলে ধর্ষণ করে, তাঁর দেহের উপর প্রস্রাব করে, তাঁর মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়। আমরা আসিফাকে ভুলিনি, আসিফার ধর্ষণকারীদের মুক্তির দাবিতে বিজেপির মন্ত্রীরা সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে মিছিল করেছে – আমরা তাও ভুলিনি। আমরা উত্তর প্রদেশের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের সেই বক্তব্যও ভুলিনি, যেখানে তিনি বলেছিলেন মুসলিম মহিলাদের কবর থেকে বের করে ধর্ষণ করা হবে! এই রাষ্ট্র ধর্ষক, এই রাষ্ট্র মহিলাদের সমানাধিকারের বিরুদ্ধে, এই রাষ্ট্র শুধু ভেদাভেদ চায়।
বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে ছাত্র-ছাত্রীদের পক্ষে পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব না, এই দাবিতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপিকা মেরুনা মূর্মু ছাত্র-ছাত্রীদের পাশে দাঁড়ালে আরেক ছাত্রী তাঁর জাত নিয়ে, রিজার্ভেশন নিয়ে কুমন্তব্য করে এবং সেই মন্তব্যকে ধরেই বাংলায় বিজেপির লোকজন অ্যান্টি-রিজারভেশন প্রোপাগান্ডা চালায়। ছাত্র-ছাত্রীদের মনের মধ্যে দাঙ্গাবাজ বিজেপি দলিতআদিবাসী বিরোধী, মানববিরোধী ভাবনা-চিন্তা ঢোকানো ছাড়া আর কিছুই করছে না, বিজেপি চায়না সকলে পড়াশোনার সমান অধিকার পাক, না হলে কি আর নয়া শিক্ষা নীতি চালু করে!
তবে সে বিজেপি হিটলার মুসোলিনি যেই হোক না কেন, কেউ কোনোদিনও নিপীড়িত মানুষের আন্দোলন থামাতে পারেনি, আজও পারবে না। সিনেমাটির শেষ দৃশ্যে যুবক-যুবতীরা একজোট হয়ে আন্দোলন করে, রাষ্ট্রের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিতে থাকে তাদের মাতৃভাষায়। পুলিশ তাদেরকে অসম্ভব মারে, গ্রেফতার করে – ঠিক যেমনটা ওমর খালিদের সাথে করেছে। কিন্তু তাই বলে কি আন্দোলন থেমেছে? না থামেনি, বরং আরও শক্তিশালী হয়েছে দলিত আদিবাসীদের আন্দোলন, ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন, মহিলাদের আন্দোলন, শ্রমিক-কৃষকদের আন্দোলন, আরএসএস-বিজেপির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আন্দোলন।
যত হামলা করো সব সামলে নেব, চ্যালেঞ্জ তোমায় যদি মারতে পারো – আমরা জিতবোই! আম্বেদকর ভগৎ সিংয়ের ছাত্রছাত্রীরা হারতে পারে না!
- আকাশ ভট্টাচার্য
উত্তর ২৪ পরগনা জেলা এআইপিএফ-এর উদ্যোগে ৪ সেপ্টেম্বর বারাসাত কোর্ট চত্বরে জাতীয় শিক্ষানীতি (NEP) ২০২০-র বিরুদ্ধে এক নাগরিক কনভেনশন অনুষ্টিত হল। বর্তমান অতিমারী পরিবেশের সুযোগে সংসদকে পাশ কাটিয়ে জুলাই মাসের একদম শেষে কেন্দ্রীয় সরকার শিক্ষা সংক্রান্ত এই নীতিমালা ঘোষণা করল। শিক্ষা যুগ্ম তালিকাভুক্ত, কিন্ত শিক্ষাসক্রান্ত নুতন নীতি পলিসি গ্রহণের সময় রাজ্য সরকারগুলির মতামতের কোনো তোয়াক্কাই করা হল না। ভারতের যুক্তরাষ্ট্রিয় কাঠামো নস্যাৎ করার বিজেপি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গীর আরও একটি নমুনা পাওয়া গেল। ৬২ পাতার প্রস্তাবনায় বহুত্ববাদের কথা দু’একবার বলা হলেও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের কথা একবারও উল্লিখিত হয়নি। সমাজের দরিদ্র এবং পিছিয়ে থাকা অংশের ছেলে-মেয়েদের প্রাথমিকস্তর থেকেই শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। সর্বশিক্ষা অভিযান প্রকল্প অকার্যকরী হয়ে গেলে হাজার হাজার রন্ধনকর্মী ও কাজ হারাবেন। বামপন্থী শিক্ষক এবং ছাত্রসংগঠন কনভেনশনে অংশগ্রহণ করেন। এবিপিটিইএ-র পক্ষে বলেন শিক্ষক দুলাল পাল, WBSTF-এর (ফব অনুমোদিত) প্রতিদিন শিক্ষক প্রবীর ঘোষ। ছাত্র সংগঠন এসএফআই-এর অর্কপ, এআইএসএ-র অন্নেষা, ডিএসও-র পক্ষে বলেন অভিজিৎ মুখার্জি। আরওয়াইএসএফ-এর প্রতিনিধিত্ব করেন রওনক। এছাড়াও বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক অমিত দাশগুপ্ত এবং রাজ্য সংগঠক মলয় তেওয়ারি। NEP 2020 বাতিলের দাবিতে সর্বত্র প্রচার এবং জনমত গড়ে তোলার স্বপক্ষে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। কনভেনশন পরিচালনা করেন এআইপিএফ-এর জেলা আহবায়ক সুজিত ঘোষ।
“এক আরম্ভের জন্য” এই শিরোনামে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘ, ভারতীয় গণনাট্য সংঘ, ক্রান্তি পরিষদ প্রভৃতি বামপন্থী সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলির সাথে পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদ একযোগে পথে নামে। পরিষদের অন্তর্ভূক্ত সংযোগ সাংস্কৃতিক সংস্থা ও কান্ডীর সাংস্কৃতিক সংস্থা যৌথভাবে একটি প্রতিবাদী সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
দার্জিলিং জেলার ফাঁসিদেওয়া ব্লকের বিধাননগরের বাসভবনে গত ২০ সেপ্টেম্বর প্রয়াত হলেন ছয়ের দশক থেকে নকশালবাড়ি আন্দোলনের নেত্রী কমরেড দীপিকা আহমেদ। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। ১৯৬৭ সালে নকশালবাড়ি কৃষক অভ্যূত্থান সংঘটিত হওয়ার অল্প কিছুদিন আগে কমরেড দীপিকা কলকাতা মহানগর থেকে বিধাননগরে এক সরকারী প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষিকার চাকরি নিয়ে দার্জিলিং জেলায় আসেন। কর্মসূত্রে তাঁর সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হয় কমিউনিস্ট বিপ্লবী ডা. সিকন্দর আহমেদের। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ডা. আহমেদের বাড়িতে গোপনে রাত্রিবাস করে, তাঁর সক্রিয় সহযোগিতায় ১৯৬৭ থেকে উপর্যুপরি তিনটি বিপ্লবী প্রতিনিধিদের দল নেপাল সীমান্ত পেরিয়ে চীন অভিমুখে যাত্রা করে। পার্টি নিষিদ্ধ থাকাকালীন সময়েও ইতিমধ্যে ডা. আহমেদের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ কমরেড দীপিকা অসম্ভব সাহস ও মতাদর্শগত দৃঢ়তা নিয়ে বিপ্লবীদের গোপন আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা ও বিপ্লবের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার কাজকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন, স্কুলের চাকরি ছেড়ে সদ্যভূমিষ্ঠ প্রথম পুত্রসন্তানকে পালনের কষ্টসাধ্য জীবনচর্যার মধ্যেও। স্বামীর বারংবার দীর্ঘ জেলবাসের সময়গুলিতেও তিনি প্রত্যয়ী থেকেছেন। কমরেড দীপিকা আহমেদ লাল সেলাম।