আজকের দেশব্রতী : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ (অনলাইন সংখ্যা)
iss

[ এক নজরে লেখার ফাইলগুলি আলাদা আলাদা দেখার জন্য ঠিক এর উপরের লাইনে (অনলাইন সংখ্যায়) ক্লিক করুন। -- আর হেডিং-এ ক্লিক করলে সেই ফাইলটি খুলবে ]

lonave

সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতির দেশব্যাপী একমাস ধরে গ্রামে গ্রামে চলো, ঘরে ঘরে চলো প্রচার অভিযানের শেষ দিন ১৫ সেপ্টেম্বর সারা দেশের সাথে সাথেই পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলার জেলাশাসক ডেপুটেশনের কর্মসূচী সংগঠিত হয়। এই রাজ্যে সারা ভারত কৃষক মহাসভা, আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চ, সারাভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি ও আয়ারলার অন্তর্ভুক্ত ঋণ মুক্তি কমিটি মিলিতভাবেই এই কর্মসূচী পালনে উদ্যোগ গ্রহণ করেন ।প্রচারের মধ্যে দিয়েই গ্রামীণ মেহনতিদের যে দাবিগুলো জীবন্ত সমস্যা হিসেবে উঠে আসে। ঋণ মুক্তির প্রশ্ন বিশেষ করে মাইক্রোফিনান্স সংস্থা গুলোর ঋণ আদায়ের জন্য গ্রামীণ গরিব মেহনতিদের পরিবারের মহিলাদের উপর চরম জুলুম চালানোর বিরুদ্ধে মহিলাদের ক্ষোভ। আদিবাসীদের জমির অধিকারের প্রশ্ন। লকডাউন এ ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ এর প্রশ্ন। পরিযায়ী শ্রমিকদের ও গ্রামীণ গরিবদের ১০০ দিনের কাজের দাবি। তাই এই দিনের বিক্ষোভ ডেপুটেশনে অন্যান্য দাবির সাথে এই দাবিসমুহ বেশি সামনে আসে। বিভিন্ন জেলার জমায়েতে গ্রামীণ মহিলাদের অংশগ্রহণ ছিল অভূতপূর্ব। শাসক দল তৃণমূল ও বিজেপি বিভিন্নভাবেই জমায়েতে অংশগ্রহণ আটকানোর চেষ্টা করেছে। প্রশাসন ও এই কর্মসূচীকে বিভিন্ন অজুহাতে সীমিত করার চেষ্টা করেছে। মুর্শিদাবাদ ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলার প্রশাসন এই কর্মসূচীর কোনো রকম অনুমতি দেয়নি। এমন কী নিষিদ্ধ ঘোষণা করে শমন জারি করেছেন। এই সব মোকাবিলা করার মধ্য দিয়েই হাজার হাজার মানুষ জমায়েত হয়েছিল। অনেক ক্ষেত্রেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপেক্ষা করেই বৃষ্টির মধ্যেই কর্মসূচী সফল করেছেন।

পুর্ব বর্ধমান জেলার ১১টা ব্লক থেকে ৩০০০-এর বেশি মানুষ বেলা ১১টা ৩০ মিনিট এর মধ্যেই বর্ধমান শহরের উৎসব ময়দানে যানবাহনের প্রতিকুলতার মোকাবিলা করেই জমায়েত হন। এর মধ্যে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর, মাইক্রোফিনান্স-এর ঋণগ্রস্ত আদিবাসী, সংখ্যালঘু মহিলা সহ বেশিরভাগই মহিলাদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য।উৎসব ময়দান থেকে মিছিল বের হবার পর ২ কিলোমিটার রাস্তা পরিক্রমণ করে জেলাশাসক অফিস অভিমুখে ঢোকার আগেই পুলিশ মিছিল আটকায়। সেখানেই অবস্থান বিক্ষোভ চলতে থাকে। তার পর তিন জন প্রতিনিধি ডেপুটেশন জমা দেন এবং সমস্ত এলাকার গণ স্বাক্ষর সহ মুখ্যমন্ত্রী এবং প্রধান মন্ত্রীর উদ্দেশ্যে স্মারকপত্র জমা দেওয়া হল।

hoog

 

হুগলি জেলার বিভিন্ন ব্লক থেকে আগত ২০০০-এর বেশি মানুষ চুচুড়া স্টেশন থেকে বৃষ্টির মধ্যেই মিছিল করে শহরের মধ্যে দিয়ে জেলাশাসক অফিসের দিকে যেতে থাকলে ঘড়ির মোড়ে পুলিশ আটকায়। সেখানেই অবস্থান বিক্ষোভ চলতে থাকল। তারপর প্রতিনিধিরা দপ্তরে ডেপুটেশন জমা দেন এবং মুখ্যমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে গণ স্মারকপত্র জমা দেন। জমায়েতে আদিবাসী মহিলাদের অংশগ্রহণ সহ বেশিরভাগই মহিলাদের উপস্থিতিছিল।

বাঁকুড়া জেলার বিভিন্ন ব্লক থেকে আসা ৫০০ মতো মানুষের মিছিল মাচানতলা থেকে শুরু করে জেলা শাসকের দপ্তরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। মিছিলে সাফাই কর্মীদের ইউনিয়ন, আদিবাসী ও তপশীল জাতির লোকদের  উপস্থিতি বেশি ছিল। মহিলাদের উপস্থিতিও উল্লেখযোগ্য। জেলা শাসকের অফিসের সামনের রাস্তায় অবস্থান বিক্ষোভ চলাকালীন প্রতিনিধিদের ডেপুটেশন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। গণস্বাক্ষর সহ মুখ্যমন্ত্রী ও প্রধান মন্ত্রীর উদ্দেশ্যে স্মারকপত্র পাঠানোর ব্যবস্থা হয়।

নদীয়া জেলার জেলাশাসক অফিসের সামনে বিক্ষোভ অবস্থান সংগঠিত করাহল। জেলার বিভিন্ন ব্লকের ২০০ শতাধিক মানুষ জমায়েত হন। দীর্ঘ সময় অবস্থান বিক্ষোভের পর প্রতিনিধিদের মাধ্যমে ডেপুটেশন গ্রহণ করার ব্যবস্থা করেন ।

উত্তর ২৪ পরগণা জেলার বসিরহাট মহকুমা শাসকের অফিসে সহস্রাধিক মানুষের দীর্ঘ মিছিল পরিক্রমা করে  উপস্থিত হন। সেখানে বিক্ষোভ অবস্থান সংগঠিত করার পর প্রতিনিধিরা ডেপুটেশন জমা দেন। উপস্থিত মানুষের বেশিরভাগই মেহনতিদের পরিবারের মহিলা ছিলেন। মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে গণস্বাক্ষর সহ স্মারকপত্র জমা দেওয়াহল। হাবড়া ২নং ব্লক অফিসে শতাধিক মানুষ মূলত মহিলাদের মিছিল করে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। এই মিছিলে মিড ডে মিল ইউনিয়ন ও যুক্ত ছিলেন। শিবদাসপুর গ্রাম পঞ্চায়েত অফিসে শতাধিক মানুষ মিছিল করে গিয়ে ডেপুটেশন জমা দেন।
হাওড়া জেলার বাগনান ১নং ব্লকের অফিসে ২০০ শতাধিক মানুষ জমায়েত হয়ে মিছিল করে ডেপুটেশন জমা দেন। বেশিরভাগই গরিব মেহনতিদের পরিবারের মহিলাদের অংশগ্রহণ ছিল। বিডিও মারফত মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে গণস্বাক্ষর সহ স্মারকপত্র পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। আমতা ১নং ব্লকের শতাধিক মানুষ মিছিল করে বিডিও অফিসে ডেপুটেশন দেন এবং মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে গণস্বাক্ষর সহ স্মারকপত্র বিডিও মারফত পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।

dar

 

দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি মহকুমা শাসক অফিসে প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যেও মিছিল করে যাওয়ার পর মিছিল পুলিশ আটকায়। অবস্থান বিক্ষোভ করে বক্তব্য রাখার পর ডেপুটেশন জমা দেওয়াহল।

জলপাইগুড়ি জেলার প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যেই জেলাশাসক-এর কাছে ডেপুটেশন ও গণস্বাক্ষর সহ স্মারকপত্র মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
মালদহ জেলার কালিয়াচক ১নং ব্লকের বিডিও অফিসে ৫০ জনের মিছিল সংগঠিত করে ডেপুটেশন সংগঠিত হয়। এখানে বিডিও সাহেবের সাথে প্রতিনিধিদের সাথে বিভিন্ন প্রশ্নে বচসা হয়।

সমস্ত জেলাতেই আয়ারলা এআইকেএম আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চ ঋণ মুক্তি কমিটির নেতৃত্ব ও বিভিন্ন স্তরের সিপিআই(এমএল) লিবারেশন ও এআইসিসিটিইউ-র নেতৃবৃন্দ ও  উপস্থিত ছিলেন। এই কর্মসূচী গরিব জনগনের আলোড়ন সৃষ্টি করেছে এবং উৎসাহ জাগিয়েছে। আগামী দিনে এই আন্দোলন পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে নিয়ে যেত হবে।

edddder

রাজ্য বিজেপি নরেন্দ্র মোদীর জন্মদিন উদযাপনকে উপলক্ষ হিসেবে কেন্দ্রে রেখে চলতি সপ্তাহে কর্মসূচী নিয়েছে ‘সেবা সপ্তাহ’ পালনের। এই কর্মসূচী বুথভিত্তিক এবং দশ দফা কাজের। বৃক্ষরোপণ, স্বাস্থ্য সচেতনতা, কৃত্রিম অঙ্গদান, রক্তদান শিবির, প্লাষ্টিক বর্জন, মোদীর ভার্চুয়াল মহিমাকীর্তন, ‘আয়ুস্মান ভারত’ নামরূপী স্বাস্থ্য বিমা, ফসল বিমা, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা ও সড়ক যোজনা-র ভার্চুয়াল মাহাত্ম প্রচার-প্রদর্শনী – এসবই রয়েছে কর্মসূচীতে। ঘাতক বিজেপি আবার ভেক ধরছে ‘করসেবা’র! বাংলার ‘গণদেবতা’র মনের তল পাওয়ার! শ্যেনদৃষ্টি এখন পরের বিধানসভা নির্বাচনের দিকে। পূর্বাঞ্চলে দখল নিয়েছে ত্রিপুরা ও আসামের; বিহারেও নির্বাচন আসন্ন, শাসকদল জেডিইউ পাল্টি খেয়েছে যথেষ্ট, মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার বিজেপির সাথে আঁতাতের মুখ হয়ে উঠতে উন্মুখ। এই হাওয়ায় বাংলায় এবার বড় মাত্রায় ফায়দা তুলতে বিজেপি মরীয়া। সেই লক্ষ্যেই নিচ্ছে যত কর্মসূচী, কষছে যত মেরুকরণের অঙ্ক, আর ভোট শতাংশ পঞ্চাশে তোলার মারপ্যাঁচ।

এরাজ্যে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের ভাগ ছিল ৪০ শতাংশ। একে ৫০ শতাংশে ওঠাতে হলে প্রয়োজন আরও ১০ শতাংশ ভোট। সেই সংস্থান করতে সাজাতে শুরু করেছে প্রচার সামগ্রী। ফন্দি আঁটছে বিশেষত যুব ও সংখ্যালঘু ভোটে দাঁও মারার। ময়দানে নামাচ্ছে দলের সংগঠন ‘যুব মোর্চা’-কে, সংঘর্ষ ও সদস্য সংগ্রহের জন্য। আর ব্যবহার করা শুরু করেছে দলের 'সংখ্যালঘু সেল'-কে। সংখ্যালঘুদের ভয়ে ‘ভক্তি’-তে টেনে আনার জন্য। এরাজ্যে মুসলিম ভোট ২৯-৩০ শতাংশের মতো। হিন্দুত্বের ও তার আনুসঙ্গিক সবকিছুর সর্বব্যাপী প্রচার চালিয়ে গত লোকসভায় দলের ভোট অনেক ফুলে-ফেঁপেছিল। উঠেছিল নজিরবিহীন শতাংশে। তবু খোয়াব দেখার তুলনায় থাকতে হচ্ছে অনেকটাই পেছনে। তাই সংখ্যালঘুদের সন্ত্রস্ত করে চলার লাইন চালিয়ে যাওয়ার সাথে বাজি ধরতে হচ্ছে সংখ্যালঘু ভোট হাতানোরও। ছলে-বলে-কৌশলে। মুসলিম অধ্যূষিত বিধানসভা কেন্দ্রের সংখ্যা ১২৫টি। তার মধ্যে গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি লিড পেয়েছিল ২৩টি ক্ষেত্রে মাত্র। এবার এর বড় মাপের সংখ্যা বাড়াতে নামছে দুই বিশেষ বর্গে ক্ষেত্র বাছাই করে। প্রথম বর্গের নিশানায় রয়েছে দক্ষিণবঙ্গের তিনটি অঞ্চল উলুবেড়িয়া, বারাসাত ও খড়গপুর শহর। পরের তালিকায় রেখেছে উত্তরবঙ্গের কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, মালদা সহ মুর্শিদাবাদকে। সংখ্যালঘু অধ্যূষিত অঞ্চলের জন্য প্রচারের বিষয়বস্তু ছকা হচ্ছে বিশেষভাবে। তা হল, ‘সেল’ প্রচারমাধ্যম থেকে প্রচার করা হবে ‘সিএএ বিরোধী প্রতিবাদ ও আন্দোলন করে ভুল হয়েছে। বাংলার মুসলিমদের ভয় নেই। এখানে এনআরসি হবে না।’ ছকবাজি চলবে এইসমস্ত ছদ্মবেশী প্রচারে মুসলিম মন আত্মসাৎ করার।

পশ্চিমবাংলায় বিশেষত বিগত একদশক সময়কালে, বিভিন্ন কারণে, তা সে বামপন্থীদের প্রতি আস্থা ক্ষুণ্ণ হওয়া ও বিচ্ছিন্নতা বেড়ে যাওয়ার কারণে হোক, তৃণমূল কংগ্রসের প্রতি প্রবল বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠার কারণে হোক, ব্যাপক গণতান্ত্রিক শক্তির এক উল্লেখযোগ্য অংশ, তার মধ্যে আছে যুবশক্তি, আছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষেরাও, তাঁরা রাজ্য বিজেপির ‘বিরোধীদল’রূপী হাতছানিতে বচনে বিমোহিত হয়ে গেছেন। মোদী জমানার দেশব্যাপী ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন-দমন-পীড়ন দেখেও এসব ঘটেছে। আর, এই বাড়বৃদ্ধি দেখেই বাংলায় বিজেপির একদিকে যত হুঙ্কার অন্যদিকে তত ছলচাতুরি। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় জনতাকে বিজেপির পাতা ফাঁদ সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে সম্যক। ওদের তৈরি ‘সংখ্যালঘু সেল’ আদৌ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সুরক্ষার তো নয়ই, কোনও ভালো কিছু করার হতে পারে না; ওসব হল সংখ্যাগুরুবাদী হিন্দুত্বের জোয়াল মেনে নেওয়া মানিয়ে নেওয়ার মতো আদায়ের হাতিয়ার। বুঝতে হবে সিএএ-বিরোধী আন্দোলন তীব্র হয়েছে বলেই ক্ষমতায় আসার জন্য মুখিয়ে থাকা এত মাখো মাখো স্তোকবাক্য।

বিজেপির এই ছদ্মবেশী ধেয়ে আসার মুখোমুখি মোকাবিলার খুব প্রয়োজন। যেখানে যেমন সেখানে তেমন। দূরন্ত উদ্যোগ ও সক্রিয়তা চাই জোরের সাথে পাল্টা প্রচার-প্রভাবিত ও সংগঠিত-সমাবেশিত করার। যে বিজেপি দেশকে সর্বনাশের দিকে নিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত, এমনকি অতিমারী অবস্থাতেও, একে বাংলায় কিছুতেই ‘পরিত্রাতা’ হয়ে ওঠার সর্বনাশা ছদ্মবেশ ধারণ করতে দেওয়া যায় না। দেশের গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, বহুত্ব, বিশেষত দলিত-আদিবাসী-সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বাধিকার, নারীসমাজের অধিকার আজ সবদিক থেকেই সর্বব্যাপী আক্রান্ত, বিপন্ন। তাই বিজেপির স্বরূপ উন্মোচন করতে, বিজেপিকে বিচ্ছিন্ন ও পর্যূদস্ত করতে প্রয়োজন সমস্ত শক্তি উজার করে দেওয়া। পাল্টা চেপে ধরার জ্বলন্ত সুযোগ রয়েছেই।

deemod

এখন আমাদের সামনে রয়েছে সরকারের নিজেরই প্রকাশ করা ২০২০-২১ অর্থবর্ষের প্রথম ত্রৈমাসিকের অর্থনৈতিক ফলাফল। গত বছরের এই ত্রৈমাসিকের তুলনায় জিডিপি ধসে গেছে একেবারে ২৩.৯ শতাংশ, ভারতের সঙ্গে তুলনা চলতে পারে বিশ্বের এমন সমস্ত দেশের মধ্যে যেটা সবচেয়ে নিকৃষ্ট ফলাফল। এর আগে গত চার দশকে ভারতের অর্তনীতিতে বৃদ্ধির হার কখনও ঋণাত্মক হয়নি। এটা একটা প্রাথমিক হিসেব এবং অর্থনীতিবিদদের ধারণা চূড়ান্ত পরিসংখ্যান এর চেয়েও খারাপ হবে বলে মনে হয়। ভারতের প্রাক্তন প্রধান পরিসংখ্যানবিদ প্রণব সেন মনে করেন অর্থনীতির সংকোচন হয়েছে ৩০ শতাংশেরও বেশি। তিনি তাঁর হিসেবের মধ্যে অবিধিবদ্ধ ক্ষেত্রটিকেও ধরেছেন যে ক্ষেত্রের কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য এখনও আমাদের কাছে নেই।

যে সরকার অর্থনীতির ক্ষয়ের কথা কখনও স্বীকার করতে চায়নি, সেই সরকারই এখন এই ক্ষয়কে ‘দৈব দুর্বিপাক’ হিসাবে, লকডাউনের কারণে অর্থনীতিতে ঘটা বিপর্যয়ের স্বাভাবিক পরিণতি বলে চালাতে চাইছে। এটা স্পষ্টতই এক মস্ত বড় মিথ্যা। বিমুদ্রাকরণের পর থেকে বেশ কিছু সময় ধরেই ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধিতে মন্দা দেখা যাচ্ছে। ২০১৮-১৯ বর্ষ থেকে পরপর আটটা ত্রৈমাসিকে ভারতের জিডিপির পতন হতেই থেকেছে, লকডাউন পরবর্তী পর্যায়ে বৃদ্ধি ব্যাপক হারে ঋণাত্মক হওয়ার আগে বৃদ্ধির হার ৮.২ শতাংশ থেকে কমে ২০২০-র মার্চে শেষ হওয়া ত্রৈমাসিকে দাঁড়ায় একেবারে ৩.১ শতাংশে। ধারাবাহিক মন্থরতা অর্থনীতিকে এখন এনে ফেলেছে একেবারে রসাতলে। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন দেশই কোনো না কোনো ধরনের লকডাউনের আশ্রয় নিয়েছে, কিন্তু কোথাও তা অর্থনীতিতে এই ধরনের বিপর্যয় ঘনায়নি। সবচেয়ে কঠোর ও দানবীয় লকডাউন সবচেয় বিপর্যয়কর পরিণামই ঘটিয়েছে।

অর্থনীতির ক্ষেত্রগুলি ধরে ধরে জিডিপির পতনের বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে যে, এই পতন শুধু নির্মাণ, পরিবহন, বিমান চলাচল, আতিথেয়তা এবং পর্যটনের মতো ক্ষেত্রগুলিতেই সীমিত নেই, যে ক্ষেত্রগুলিতে ব্যাপক বিপর্যয় ঘটা নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকতে পারে না। এমনকি প্রধানত বিচ্ছিন্ন করে রাখা খনন ক্ষেত্র অথবা জন পরিষেবাগুলিরও – সরকার স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং সাধারণের প্রয়োজনীয় বস্তুগুলোর যোগানের ওপর গুরুত্ব দিলে যেগুলিতে বৃদ্ধি দেখা যেত – ব্যাপক হারে সামগ্ৰিক পতনে যথেষ্ট অবদান রয়েছে। একমাত্র যে ক্ষেত্রটিতে সামান্য ধনাত্মক বৃদ্ধি দেখা গেছে তা হল কৃষি। কিন্তু জিডিপিতে কৃষির অবদানের হার ক্রমেই কমে আসছে আর কৃষি ক্ষেত্রের সামান্য বৃদ্ধি তাই সামগ্ৰিক পরিসংখ্যানের উন্নতি ঘটাতে পারে না।

ভয়াবহ সংকোচনের এই পরিস্থিতি থেকে অর্থনীতির কি নিজের থেকেই পুনরুজ্জীবন ঘটতে পারে? সরাকার এবং তার দায়িত্বশীল অর্থনৈতিক প্রশাসকরা বোধকরি এমনই একটা খোয়াব দেখে থাকেন। তাঁদের মধ্যে কেউ-কেউ ইংরাজি ‘ভি’ অক্ষরের আকারে পুনরুজ্জীবনের পূর্বাভাস দিচ্ছেন, যার অর্থ হল, যে তীব্র হারে অর্থনীতির পতন হয়েছিল সেরকম দ্রুত গতিতেই তা চাঙ্গা হতে শুরু করবে। কিন্তু যাঁরা বিশ্ব অর্থনীতির প্রবণতাকে পর্যবেক্ষণ করে থাকেন তাঁদের মধ্যে ক্রমেই আরও বেশি-বেশি পর্যবেক্ষক জানাচ্ছেন যে, পুনরুজ্জীবনের রেখাচিত্রটি দেখতে ইংরাজি ‘ভি’ বা এমনকি ‘ইউ’ অক্ষরের মতনও হবে না, তা হবে ‘কে’ অক্ষরটির মতো, যেখানে কিছু অংশের (বলা ভালো, কর্পোরেট সংস্থার) বৃদ্ধি ঘটলেও অন্যান্য অংশের অবনতি হতে থাকবে, ফলে ফারাকের বৃদ্ধি ঘটবে বা অসাম্যের মাত্রা বাড়বে। তবে যে কোনো ধরনের পুনরুজ্জীবনেরই মূল শর্ত হল জরুরি ভিত্তিতে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ। ভূল নীতি এবং নিষ্ক্রিয়তার পরিণামেই এই বিপর্যয় ঘটেছে, পুনরুজ্জীবনের জন্য প্রয়োজন ফলদায়ী নীতি এবং দৃঢ় পদক্ষেপের ভিত্তিতে এতদিন অনুসৃত পথের আশু সংশোধন।
বিনিয়োগ, চাহিদা এবং উপভোগ – এই তিনটি বিষয়ই

ভারতের অর্থনীতির সংকোচনের পিছনে মূল কারণ বলে দেখা যাচ্ছে। বিপুল পরিমাণে কাজ ও আয় নষ্ট হয়েছে যা লক্ষ-লক্ষ মানুষকে ক্ষতিগ্ৰস্ত করেছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের এক যৌথ সমীক্ষার আনুমানিক হিসেব হল, কোভিড-১৯ অতিমারী পরবর্তী পর্যায়ে নির্মাণ সহ সাতটি মূল ক্ষেত্রে ৪১ লক্ষ যুবক কাজ হারিয়েছেন। ভারতীয় অর্থনীতির নজরদারী কেন্দ্র জানিয়েছে এপ্রিল মাসের পর থেকে ১ কোটি ৮৯ লক্ষ বেতন ভিত্তিক কাজ নষ্ট হয়ে গেছে। এই কাজ চলে যাওয়ার সাথেই এসেছে ব্যাপক হারে মজুরি হ্রাস, যার ফলে আয় ও সঞ্চয়ের প্রচুর পরিমাণে হ্রাস ঘটেছে যা উপভোগ, চাহিদা এবং অতএব বিনিয়োগকে দমিয়ে রাখতেই পারে।

এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র উপায় হল জরুরি ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় সরকারকে তার ব্যয়ে বৃদ্ধি ঘটাতে হবে। এই বৃদ্ধির পরিকল্পনায় যে বিষয়গুলোর ওপর জোর দিতে হবে সেগুলো হল – আয় নষ্ট হওয়ার ক্ষতিপূরণের লক্ষ্যে নগদ টাকা হস্তান্তর, গণবণ্টন ব্যবস্থাকে সর্বজনীন করে তুলে প্রতিটি পরিবারের প্রতিটি সদস্যের জন্য মাসে ১০ কেজি খাদ্যশস্য প্রদান সুনিশ্চিত করা, এমএনআরইজিএ প্রকল্পের অধীনে কর্মদিবস বাড়ানো এবং এই প্রকল্পেরই ধারায় শহর কর্মসংস্থান প্রকল্প চালু করা এবং সমস্ত ক্ষুদ্র ঋণ ও সুদ/কিস্তি পরিশোধ স্থগিতের সময়কালকে সম্প্রসারিত করা। মোদী সরকার এর বিপরীত পথটাই বেছে নিয়েছে – সে রাজ্যগুলোর পাওনা বকেয়া জিএসটি মেটাচ্ছে না, আর জনধন অ্যাকাউন্টগুলোতে টাকা পাঠানোর কথা না তোলাই ভালো। টাকার অভাবে জর্জরিত রাজ্য সরকারগুলোও বেতন প্রদানে বিলম্ব করছে এবং প্রয়োজনীয় খরচগুলোতে কাটছাঁট করছে, যা সরকারী ব্যয়, পরিষেবা প্রদান ও চাহিদাকে সংকুচিত করে তুলছে।

লকডাউনকে আচমকাই ঘোষণা করা হয়েছিল সাময়িক নিয়ন্ত্রণ ও কষ্ট স্বীকারের এক পদক্ষেপ রূপে যা ভারতে কোভিড সংক্রমণের রেখাচিত্রকে ফলপ্রসূভাবেই একেবারে নীচে নামিয়ে আনবে। কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে চালু রাখা কঠোর লকডাউন ভারতে ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়ার গতিকে মন্থর করতে পারেনি, তা শুধু সংক্রমণের শীর্ষ স্তরে পৌঁছানোর কালকে কিছুটা বিলম্বিত করেছে, ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার ছ-মাসেরও বেশি সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও সংক্রমিতদের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান হয়ে তার রেখাচিত্র তীব্রভাবে ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে। এখন আবার অতিমারি অত্যন্ত শঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলে মাত্র দু-সপ্তাহেরও কম সময়ে সংক্রমিতদের সংখ্যায় নতুন ১০ লক্ষ সংক্রমিতকে যুক্ত করলেও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু করা হচ্ছে, ছাত্র-ছাত্রীদের পরীক্ষায় বসতে বাধ্য করা হচ্ছে আর ভোটারদেরও বাধ্য করা হচ্ছে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্যে যুক্ত হতে।

সরকার অতিমারি এবং অর্থনীতি উভয় ফ্রন্টেই শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। অর্থনীতিকে উজ্জীবিত করার নামে সরকার ‘আত্মনির্ভর ভারত’-এর এক নতুন বুলি চালু করেছে আর প্রধানমন্ত্রী এর গুরুত্বকে পর্যবসিত করেছেন জনগণকে ভারতে তৈরি খেলনা কেনা, দেশি কুকুর পোষা এবং ফোনে অ-চীনা অ্যাপ ব্যবহারের পরামর্শ দানের মধ্যে। অন্যদিকে আদানি ও আম্বানিদের মধ্যে অধিগ্রহণের তুমুল ধুম পড়েছে, তারা তাদের নিয়ন্ত্রণকে সম্প্রসারিত করে নিয়ে যাচ্ছে পরিকাঠামো ও সংযোগের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে। প্রাধান্যকারী গণমাধ্যমসমূহ চটকদার কায়দাবাজিগুলো নিয়ে মাতামাতি করলেও জনগণ কিন্তু এই চিত্রনাট্য এবং নাচানোর কারুকলাকে ক্রমেই আরও বেশি করে প্রত্যাখ্যান করছেন। ছাত্র-ছাত্রীরা ইন্টারনেটে মোদীর ভিডিওকে এত ডিসলাইকের ঢেউয়ে ডুবিয়ে দিচ্ছে যে বিজেপি ডিসলাইক বোতামটাকে নিষ্ক্রিয় করে দিয়েই নিজেদের বাঁচানোর কথা ভাবতে পেরেছিল। সোশ্যাল মিডিয়ায় ডিসলাইককে প্রবল রাজনৈতিক প্রতিরোধে পরিণত করার সময় তরুণ ভারতের কাছে সমুপস্থিত; যে সরকারটা শুধু বিপর্যয়েরই জন্ম দিতে এবং জনগণের ওপর নিদারুণ যন্ত্রণা চাপিয়ে দিতে সিদ্ধহস্ত, নির্বাচনে তাকে প্রত্যাখ্যান করাটাও তরুণ ভারতের কাছে জরুরি হয়ে উঠেছে।

(এম এল আপডেট সম্পাদকীয় ৮ সেপ্টেম্বর ২০২০)   

desades

নয়া দিল্লি, ১৩ সেপ্টেম্বর

উত্তর-পূর্ব দিল্লির ফেব্রুয়ারী মাসের হিংস্রতার যে “তদন্ত” দিল্লি পুলিশ চালাচ্ছে তা দিন-কে-দিন আরও প্রতিহিংসাপরায়ণ ও প্রহসনে পর্যবসিত হচ্ছে।

এখন পর্যন্ত তাদের সমস্ত চার্জশিটে দিল্লি পুলিশ কপিল মিশ্র, অনুরাগ ঠাকুর ও অন্যান্য বিজেপি নেতারা যে সিএএ-বিরোধী আন্দোলনকারী ও মুসলমান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে হিংসা অভিযানে উস্কানি দিয়েছিল সে সংক্রান্ত তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে কোনোরকম পদক্ষেপ নিতে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করেছে।

বিগত কয়েকমাসে দিল্লি পুলিশ জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া ও জেএনইউ-এর ছাত্রছাত্রী ও প্রাক্তনীদের অনেককেই গ্রেপ্তার করেছে। চার্জশিটে পুলিশ চলচ্চিত্রকার রাহুল রায়, প্রফেসর অপূর্বানন্দ, উমর খলিদের মতো ছাত্রআন্দোলনকর্মী বা আইসা নেতা কাওয়ালপ্রীত কউর সহ আইসা, জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটি, পিঞ্জড়া তোড় ইত্যাদি মঞ্চ/সংগঠনগুলিকে বারংবার ষড়যন্ত্রকারী ও হিংসার জন্য দায়ী বলে উল্লেখ করেছে। গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা তাদের তথাকথিত “ডিসক্লোজার” বিবৃতিতে আরও অনেকের পাশাপাশি নাকি সিপিআই(এমএল) পলিটব্যুরো সদস্য কবিতা কৃষ্ণান, সিপিআইএম সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি, সিপিআই নেতা আন্নি রাজা ও স্বরাজ অভিযানের নেতা যোগেন্দ্র যাদবের নাম বলেছে।

গতকাল খবরে প্রকাশ, দিল্লি পুলিশের পেশ করা সংযোজিত চার্জশিটটি নাকি মূলত ‘পিঞ্জড়া তোড়’-এর নারীবাদী ছাত্রীকর্মী নাতাশা নারওয়াল ও দেবাঙ্গনা কলিতার এরকম “ডিসক্লোজার” বিবৃতির ভিত্তিতেই তৈরি। এই তথাকথিত “"ডিসক্লোজার"” বিবৃতিগুলি তো আদতে হেফাজতে আদায় করা স্বীকারোক্তি যা আদালতে প্রমাণ হিসেবে গ্রাহ্য হয় না। তদুপরি, নাতাশা ও দেবাঙ্গনা উভয়েই উক্ত বিবৃতিতে সই করতে অস্বীকার করার কথা সুস্পষ্টভাবে নথীভুক্ত করেছেন। এই “বিবৃতিগুলি”-কে (যেগুলির ভাসাভাসা ধোঁয়াটে শব্দগুলি দেখলে অনুমান করা কঠিন হয় না যে সেগুলি পুলিসেরই তৈরি করা স্ক্রিপ্ট) ভর করে সিপিআই(এম) সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি ও প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ জয়তী ঘোষের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হল।

দিল্লি পুলিশের “দাঙ্গা তদন্ত”-কে মোদি সরকার ব্যবহার করেছে সরকার-বিরোধী কণ্ঠস্বরকে বিচারের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়ার হাতিয়ার হিসেবে। ওরা বামগণতান্ত্রিক আন্দোলনকে ভয় দেখিয়ে স্তব্ধ করে দেওয়ার স্বপ্ন দেখছে: কিন্তু ওদের কার্যকলাপ উল্টো ফল দেবে। একজনের প্রতি আঘাত, সকলের প্রতি আঘাত : সিএএ-বিরোধী প্রতিটি কণ্ঠ, যাকে পুলিশ শাস্তি দিতে চায়, তার পাশে আমরা দৃঢ়তার সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়াব। আমরা, এবং ভারতের জনতা, দিল্লি পুলিশের কার্যকলাপকে স্পষ্টতই গণতন্ত্র ও শান্তিকামী মানুষের বিরুদ্ধে নির্লজ্জ উইচ হান্ট হিসেবেই দেখছি। সরকার কাঠগড়ায় : ভারতকে বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে কোভিড আক্রান্ত দেশ বানিয়ে ফেলার দায়ে, অর্থনীতি ও জীবন-জীবিকা ধ্বংস করার দায়ে, শ্রমিক ও কৃষকের অধিকারগুলির ওপর আক্রমণ চালানোর দায়ে এবং দেশের সাংবিধানিক গণতন্ত্র ধ্বংস করার দায়ে সরকারকে অভিযুক্ত করছে ভারতের জনগণ। এই একই সরকার তার নিজের সংঘটিত অপরাধগুলি থেকে জনতার মনযোগ ঘুরিয়ে দিতে চাইছে তার সমালোচকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ উদ্ভাবন করে এবং নিপীড়নমূলক আইনের আওতায় পুলিশ ও তদন্তকারী সংস্থাগুলি দ্বারা নিরপরাধ ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার ও কারারুদ্ধ করে।

গণতন্ত্রের জন্য এবং সমস্ত মিথ্যা অভিযোগ ও বানোয়াট মামলার বিরুদ্ধে লড়ে প্রত্যেক সহযোদ্ধার পাশে দৃঢ়তার সাথে দাঁড়াচ্ছে সিপিআই(এমএল)।
আমরা লড়ব, আমরা জিতব।

-- দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, সাধারণ সম্পাদক, সিপিআই(এমএল) লিবারেশন    

dellst


(দিল্লী দাঙ্গার ঘটনাগুলোতে দিল্লী পুলিশ যেভাবে তদন্ত চালাচ্ছে তার তীব্র বিরোধিতা করে ১০০০ জনেরও বেশি নাগরিক এক জরুরি বিবৃতি দিয়েছেন। তাঁরা আবেদন জানিয়েছেন, তদন্ত এমনভাবে চালানো হোক যাতে জনগণের আস্থা অর্জন করা যায়। জোরজবরদস্তি ‘স্বীকারোক্তি’ আদায় এবং সাজানো সাক্ষ্যপ্রমাণের অকাট্য নিদর্শন তুলে ধরে তাঁরা দিল্লী পুলিশ কমিশনারেটকে আশ্বস্ত করতে বলেছেন – এই রীতিগুলোকে বন্ধ করতে হবে এবং পরিচ্ছন্ন ও নিরপেক্ষ তদন্ত চালিয়ে দাঙ্গার প্রকৃত সংঘটকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে হবে। বিবৃতিতে সাক্ষরকারীদের মধ্যে ছিলেন চিত্র পরিচালক অপর্ণা সেন, প্রাক্তন সংস্কৃতি সচিব জহর সরকার, ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ, প্রাক্তন রাজ্যপাল মার্গারেট আলভা, শিক্ষাবিদ জয়া হাসান, পার্থ চ্যাটার্জী, জয়তি ঘোষ, রাজনীতিবিদ বৃন্দা কারাত, কবিতা কৃষ্ণাণ ও অন্যান্যরা। পুরো বিবৃতিটির ভাষান্তর এখানে রাখা হচ্ছে।)

প্রতি দিল্লী পুলিশ

আমরা নাগরিকরা দিল্লী দাঙ্গার তদন্ত যেভাবে চালানো হচ্ছে তার বিরোধিতা করছি –
আপনাদের তদন্তে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনুন
সাক্ষ্যপ্রমাণ সাজাতে জোরজবরদস্তি “স্বীকারোক্তি” আদায় বন্ধ করুন
উমর খলিদ সহ নাগরিকদের মিথ্যাভাবে ফাঁসানো বন্ধ করুন
রাষ্ট্র-বিরোধী ষড়যন্ত্রের রং চড়াতে অন্যায়ভাবে ইউএপিএ-র প্রয়োগ বন্ধ করুন

উমর খলিদ ২০২০র ১ সেপ্টেম্বর দিল্লী পুলিশ কমিশনার শ্রী এস এন শ্রীবাস্তবকে যে চিঠি দিয়েছেন, যাতে বলপূর্বক আদায় করা বিবৃতির মাধ্যমে তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ সাজানোর দিল্লী পুলিশের প্রচেষ্টার ন্যক্কারজনক নিদর্শন রয়েছে, সেই সম্পর্কিত সংবাদ আমাদের শঙ্কিত করেছে। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, দিল্লী পুলিশ (স্পেশাল সেল) জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে এক যুবকের কাছ থেকে দিল্লী দাঙ্গা সম্পর্কে জোরজবরদস্তি মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করে তার ভিডিও তোলে। ওই যুবককে হুমকি দেওয়া হয় যে সে স্বীকারোক্তি দিতে অস্বীকার করলে তাকে ইউএপিএ আইনে গ্ৰেপ্তার করা হবে। আতঙ্কিত হয়ে সে ওই জুলুমের কাছে নতিস্বীকার করে, এবং পরে বিবেক তাড়িত হয়ে যা ঘটেছে তা প্রকাশ করে।

আমরা এই জন্য অত্যন্ত উদ্বিগ্ন যে, যিনি ইতিমধ্যেই গণমাধ্যমের একাংশের কলঙ্ক লেপনের ও আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়েছেন, সেই যুবক স্কলার উমর খলিদকেই এখন সাজানো সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে দাঙ্গার ঘটনাগুলোতে ফাঁসানোর চেষ্টা হচ্ছে। উমর খলিদ আইনের ঊর্ধ্বে নন এবং পুলিশের তদন্তে তাঁকে সহযোগিতা করতে হবে। কিন্তু আইনের প্রক্রিয়াকে যখন শর্টকাট ও গুরুত্বহীন করে তোলার চেষ্টা হয়, নাগরিকের স্বাধীনতা তখন গুরুতররূপে বিপন্ন হয়ে পড়ে।

এর আগে অন্যান্য নাগরিকরাও জানিয়েছেন যে, দিল্লী দাঙ্গার ঘটনাগুলোতে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাঁদের ওপরও জোর খাটানো হয়েছিল।

নিরপেক্ষ সংবাদ মাধ্যমের তদন্তে এই বিষয়টা ধরা পড়েছে : দিল্লী পুলিশের পেশ করা দয়ালপুর থানার অঙ্কিত শর্মা সম্পর্কিত চার্জশিটে (এফআইআর নং ৬৫/২০) চার ব্যক্তির হুবহু একই স্বীকারোক্তি রয়েছে। দয়ালপুর থানার রতনলাল সম্পর্কিত চার্জশিটে (এফআইআর নং ৬০/২০) সাতটা অভিন্ন স্বীকারোক্তি রয়েছে। এবং জাফরাবাদ থানার একটা চার্জশিটেও (এফআইআর নং ৫০/২০) দশ জনের স্বীকারোক্তিতে হুবহু মিল রয়েছে। এছাড়া, গোকুলপুরি থানার দিলওয়ার নেগি সম্পর্কিত চতুর্থ একটা চার্জশিটে (এফআইআর নং ৩৯/২০) ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকা ১২ জনের স্বীকারোক্তির মধ্যে ৯ জনের স্বীকারোক্তিতে প্রায় আক্ষরিক মিল খুঁজে পেয়েছে।

জোর করে আদায় করা স্বীকারোক্তি এবং মিথ্যা সাক্ষ্যপ্রমাণের এই নকশাটা অত্যন্ত শঙ্কাজনক। আমরা দিল্লী পুলিশের কাছে আর্জি জানাচ্ছি – মিথ্যা ও জোরজবরদস্তি আদায় করা এই সাক্ষ্যপ্রমাণের মোকাবিলা করুন, আইন এবং কার্যপ্রণালীর অবশ্যমান্যতাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরুন এবং তদন্তকে পরিচ্ছন্ন ও ন্যায়সংগত ধারায় পরিচালিত করুন যাতে সেই ভয়ংকর হিংসার প্রকৃত অপরাধীদের গ্ৰেপ্তার করা যায়, যে হিংসায় ৫৩ জন নিহত হয়েছেন, শতাধিক আহত হয়েছেন এবং সহস্রাধিক মানুষের সম্পদ নষ্ট করা হয়েছে।

দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা লিখিতভাবে জানাচ্ছি উত্তর পূর্ব দিল্লীর দাঙ্গার ঘটনাগুলোতে চালানো তদন্তের ধরন সম্পর্কে আমাদের আপত্তির কথা, আইনের শাসনের কাছে এই বিষয়টা কী ধরনের গুরুত্ব বহন করে তার কথা, নাগরিক স্বাধীনতা এবং প্রকৃত অপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করার কথা।

পুলিশ সম্পর্কে জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার হওয়াটা জরুরি। উত্তর-পূর্ব দিল্লীর দাঙ্গার ঘটনাগুলোর তদন্ত একদেশদর্শী হিসেবে চালানো হচ্ছে, ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে সিএএ-বিরোধী আন্দোলনকারী ও ওই আন্দোলনের সমর্থকদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু বানানো হচ্ছে।

আমরা চাই দিল্লী পুলিশ কমিশনারেট আমাদের এই আশ্বাস দিন যে – সাক্ষ্যপ্রমাণ সাজাতে জোরজবরদস্তির মাধ্যমে স্বীকারোক্তি আদায়ের রীতি অবিলম্বে বন্ধ করা হবে; যারা এই কাজগুলো করবে তাদের দায়ী করা হবে; এবং তথাকথিত এই স্বীকারোক্তি ও সাজানো সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে উমর খলিদ বা অন্য কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না।

জোরজবরদস্তি আদায় করা এই স্বীকারোক্তিগুলোকে ইউএপিএ প্রয়োগেরও ভিত্তি করা যায় না। এবং এই আইনকে বিচার-বিবেচনাহীনভাবেই প্রয়োগ করা হচ্ছে যাতে অভিযুক্তদের কাজে রাষ্ট্র বিরোধী ষড়যন্ত্রের একটা চেহারা দেওয়া যায়। এই মামলাগুলোর সবকটি থেকেই ইউএপিএ তুলে নেওয়ার জন্য আমরা দিল্লী পুলিশের কাছে আর্জি জানাচ্ছি।

kakave

(ভীমা কোরেগাঁও মামলায় মোদী সরকারের নিপীড়ন অব্যাহতভাবে চলার বিরুদ্ধে সিপিআই(এমএল)-এর বিবৃতি)

ভীমা কোরেগাঁও মামলায় জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ) সাগর গোরখে ও রমেশ গাইচর নামে কবীর কলা মঞ্চের দুই সাংস্কৃতিক কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে। এই নিয়ে এই মামলায় এখনও পর্যন্ত মোট ১৪ জন বিদ্বজ্জন, সমাজ আন্দোলনের কর্মী এবং আইনজীবীকে গ্ৰেপ্তার করা হল। ঠিক এক মাস আগে আমরা দেখেছি দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরাজির অধ্যাপক হানি বাবুকে কিভাবে গ্ৰেপ্তার করা হয়েছিল। এরপর পশ্চিম বাংলার এক বিজ্ঞানী পার্থসারথি রায়কেও এনআইএ জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।

দিন কয়েক আগে প্রকাশ করা একটা ভিডিওতে গোরখে এবং গাইচর দুজনেই সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে এনআইএ গ্ৰেপ্তার হওয়া মানুষদের বিরুদ্ধে বিবৃতি দেওয়ার জন্য তাঁদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। আর তাঁরা তা করতে অস্বীকার করায় তাঁদের সম্ভবত গ্ৰেপ্তার করা হবে। দিল্লী সাম্প্রদায়িক হিংসার “তদন্তেও” একই নকশা অনুসরণ করা হচ্ছে। এ সম্পর্কেও অভিযোগ পাওয়া গেছে যে দিল্লী পুলিশ মানুষকে হুমকি দিয়ে বলছে যে হয় তারা আন্দোলনের কর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিক, আর তা না করলে তাদের ইউএপিএ আইনে অভিযুক্ত করা হবে। দেখা যাচ্ছে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কর্মী, বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী এবং ডাক্তারদের হেনস্থা করা হচ্ছে, হুমকি দেওয়া হচ্ছে, দানবীয় আইনে গ্ৰেপ্তার করে অনির্দিষ্টকাল ধরে জেলে আটক রাখা হচ্ছে। কিন্তু বিজেপির যে সমস্ত নেতা হিংসায় উস্কানি দিয়েছে, যে সমস্ত সন্ত্রাসবাদী সংগঠন দলিতদের ওপর হামলা চালানোয় এবং সরকারের সমালোচকদের হত্যায় জড়িত রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। এমনকি যে “সাধ্বী” প্রজ্ঞার মতো ব্যক্তি এখনও ইসলামোফোবিক সন্ত্রাস চালানোর অভিযোগ অভিযুক্ত রয়েছে, প্রধানমন্ত্রী তাকে বেছে নিয়ে বিজেপি সাংসদ হিসাবে সংসদে প্রবেশের অধিকার দিয়েছেন।

মোদী সরকারের অঘোষিত জরুরি অবস্থায় মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মী এবং সরকারের সমালোচকদের হয় গুলি করা হচ্ছে, হত্যা করা হচ্ছে, আর না হয় তাদের ঘরে তল্লাশি চালানো হচ্ছে, গ্ৰেপ্তার করা হচ্ছে ও জেলে পোরা হচ্ছে। কিন্তু এই তমসাচ্ছন্ন সময়েও আমরা রমেশ গাইচরের এই কথাগুলো থেকে পাল্টা লড়াই চালানোর প্রেরণা পাচ্ছি : “আমরা (বিনায়ক দামোদর) সাভারকারের বংশধর নই, বরং ডঃ আম্বেদকরের উত্তরাধিকারী। আমরা কোনো অন্যায় করিনি, আমরা সর্বদাই সংবিধানকে অনুসরণ করেছি।”

সিপিআই(এমএল) কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষে  
প্রভাত কুমার  

ddakkk

১৪ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া লোকসভা সত্রে বিজেপি সরকার শ্রমিকদের অর্জিত অধিকারগুলিকে সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত করার লক্ষ্যে চারটি শ্রমকোডের মধ্যে বাকি তিনটি শ্রমদাসত্বের কোডকে আইনি মান্যতা দিতে বদ্ধপরিকর। এই শ্রমিক বিরোধী নীতি প্রণয়নের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে শ্রমিক অধিকার বাঁচানোর জন্য দাসত্বের চারটি শ্রমবিরোধী শ্রম বিল বাতিলের দাবিতে এআইসিসিটিইউ-র দেশব্যাপী প্রচারাভিযান শুরু হয়েছে ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে, চলবে ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।

শিলিগুড়ি শহরে হাসমি চক মোড়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়। এই প্রতিবাদ বিক্ষোভ প্রস্তাবিত চারটে শ্রম বিলের কপি পোড়ান এআইসিসিটিইউ-র দার্জিলিং জেলা সভাপতি অভিজিৎ মজুমদার। তার আগে বিক্ষোভ প্রদর্শনে বক্তব্য রাখেন এআইসিসিটিইউ-র রাজ্য সম্পাদক বাসুদেব বসু।

জলপাইগুড়ি শহরের কদমতলা মোড়ে প্রতিবাদ প্রদর্শিত ও বিলের কপি পোড়ানো হয়। ভাস্কর দত্ত, প্রদীপ গোস্বামী, শ্যামল ভৌমিক, সুভাষ দত্ত, মুকুল চক্রবর্তী, গোপাল রায় প্রমুখেরা অংশগ্রহণ করেন।

পশ্চিম বর্ধমানের শিল্প শহর আসানসোলের কেন্দ্রে, হটন রোডে ১৬ সেপ্টেম্বর, পশ্চিম বর্ধমানের জেলা নেতৃত্বকারী দলের সম্পাদক সুরেন্দ্র কুমার সহ বাকি অন্যান্য আঞ্চলিক নেতৃত্বও সমর্থকদের উপস্থিতিতে পোড়ানো হলো শ্রমিক বিরোধী শ্রম-কোড।

“শ্রমিক অধিকার বাঁচাও- দাসত্বের শ্রম কোড জ্বালাও” এই আহ্বানে প্রচার চলছে। এর মধ্যে ১৯ সেপ্টেম্বর পালিত হবে রেল বেসরকারীকরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ দিবস, আর ২৩ সেপ্টেম্বর সমস্ত কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন গুলো “রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র বাঁচাও” দিবস পালন করবে। কলকাতার হাজরা মোড়ে প্রতিবাদী সভা অনুষ্ঠিত হলো। শ্রম কোড ছাড়াও, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর বেসরকারীকরণ-বিলগ্নিকরণ-কর্পোরেটকরণের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্রের উপর নেমে আসা সার্বিক হামলার বিরুদ্ধে সভায় বক্তব্য রাখেন তরুণ সরকার, তমাল চক্রবর্তী, অতনু চক্রবর্তী। সভা পরিচালনা করেন মমতা ঘোষ। সভা শেষে শ্রম কোডের প্রতিলিপি জ্বালানো হয়।

kkrrrkri

অখিল ভারতীয় কিষাণ সংঘর্ষ সমন্বয় সমিতি-র নেতৃত্বে বাংলার তথা সারা দেশে দশ লক্ষ কৃষক গর্জে ওঠে গত ১৪ সেপ্টেম্বর। কোনোমতেই কৃষক বিরোধী ৪টি আইন পাস করা চলবে না।

কেন্দ্রীয় সরকারের জারি করা ও ১৪ সেপ্টেম্বর সংসদে পেশ করা

(১) অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন সংশোধনী অধ্যাদেশ/বিল, ২০২০

(২) কৃষি পণ্যের ব্যবসা বাণিজ্য অধ্যাদেশ/বিল, ২০২০

(৩) কৃষি কাজের চুক্তি অধ্যাদেশ/বিল, ২০২০ এবং

(৪) বিদ্যুৎ (সংশোধনী) বিল, ২০২০ অবিলম্বে বাতিল করার দাবিতে সারা দেশের ২৫০-র ও বেশি কৃষক ও খেতমজুর সংগঠনের যুক্ত মঞ্চ – অখিল ভারতীয় কিষাণ সংঘর্ষ সমন্বয় সমিতি-র নেতৃত্বে বাংলার তথা সারা দেশে দশ লক্ষ কৃষক প্রায় সাত হাজার জায়গায় আজ গর্জে উঠেছে। কৃষকদের মতো স্পষ্ট – কোনোমতেই কৃষক-বিরোধী এই ৪টি আইন পাস করা চলবে না। কৃষকদের আরো দাবি — ডিজেলের ৫০% মুল্য হ্রাস করতে হবে, ফসলের ন্যায্য মুল্য পাওয়া নিশ্চিত করতে হবে ও কৃষকের সব ঋণ মকুব করতে হবে।

কৃষক বিরোধী চারটি অধ্যাদেশ/বিল ও দেশের কৃষিক্ষেত্রকে কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের বিরোধিতা করে বিক্ষোভ কর্মসূচী পালন করা হয়। দিল্লীতে সংসদ ভবনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়। সারা দেশ জুড়ে জেলা, মহকুমা এবং ব্লক আধিকারিকদের সামনে লক্ষ লক্ষ কৃষক বিক্ষোভ দেখান।

অখিল ভারতীয় কৃষক সংঘর্ষ সমন্বয় সমিতির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য শাখার পক্ষ থেকে মৌলালীর কাছে বিক্ষোভ প্রদর্শনের ডাক দেওয়া হয়েছিল। কৃষক নেতারা এই বিক্ষোভ সমাবেশে যোগ দেন। এআইকেএসসিসি-র সর্বভারতীয় সম্পাদক অভীক সাহা, রাজ্য সম্পাদক কার্তিক পাল, মদন ঘোষ, বেচু দলুই, প্রভাত মজুমদার, মিহির পাল, হরিপদ বিশ্বাস, পরেশ পাল প্রমুখ কৃষক নেতৃবৃন্দ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। তাঁরা বলেন, এই কেন্দ্রীয় সরকার সর্বতোভাবে কৃষক বিরোধী। ক্ষমতায় আসার পর থেকেই কর্পোরেট স্বার্থকে রক্ষা করার জন্য কৃষি ও কৃষকের স্বার্থকে বিসর্জন দেওয়া হচ্ছে। কোভিড-১৯ অতিমারীর সময়কে কাজে লাগিয়ে সরকার দ্রুত বিভিন্ন অধ্যাদেশ ও বিল এনে দেশের কৃষি ব্যবস্থাকে কর্পোরেট জগতের হাতে তুলে দিতে চাইছে। মজুতদার ও কালোবাজারি ব্যবসায়ীদের স্বার্থে আইন প্রণয়ন করছে। কৃষক বিরোধী এই আইনগুলি অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। বলা হয়, দাবিগুলি না মানা হলে দেশজুড়ে লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া হবে।

bisbis

আর্থিক সংকটের তীব্র আবহে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিষ্ণুপুর পৌরসভাতে শহরবাসীর জনস্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখে সাফাইকর্মী, পানীয়জল সরবরাহ দপ্তর, বিদ্যুৎ বিভাগের পৌরসভা কর্মীরা কাজ করে গেলেও, তাঁদের বকয়ে মজুরি মেটানো হয়নি তিন মাসের ওপোর। এই অবস্থায় গত ১ মাসের বেশি সময় ধরে সরাসরি সম্পর্ক গঠন ও বিগত দেড় বছরের এআইসিসিটিইউ কর্তৃক প্রচারের ফলেই, শ্রমিকরা এআইসিসিটিইউ-র নেতৃত্বে ইউনিয়ন গড়ে তোলেন এবং আন্দোলনে দৃঢ় বিশ্বাসী হন। গত ১৪ সেপ্টেম্বর এআইসিসিটিইউ-র নেতৃত্বে বিষ্ণুপুর পৌরসভা সংগ্রামী শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন প্রথমবার মিছিল করে অ্যাসিস্ট্যান্ট লেবার কমিশনারকে ৪ দফা দাবিতে ডেপুটেশন দেয়। মিছিলে লোকসংখ্যা ছিল ১৫০-র অধিক।

ইউনিয়নের অভিযোগ, শুধু বেতন বকেয়া একমাত্র কারণ নয় আন্দোলনের বরং তাঁদের মজুরি দৈনিক ১৫০ টাকা। কাজে যোগ না দিলে বেতন কাটা হয়, এমনকি শারীরিক অসুস্থতা থাকলেও কাজ না করলে বেতন কাটা যায়। মহিলা কর্মীরা মাতৃত্বকালিন ছুটি থেকেও বঞ্চিত হয়েছেন। ২৫ বছরের ঊর্ধ্বে কাজ করেও অনেক মজদুরের কোনো পিএফ, পেনশন কিছুই চালু হয়নি। আর এসব না পাওয়া অধিকার নিয়ে পৌর কর্তৃপক্ষকে প্রশ্ন করলে ছাঁটাই এর হুমকি এমনকি কাজে যোগ দিতে দেওয়া হয় না জোর করে। এ এক তীব্র দাসত্বের জামানা দেখছেন সাফাইকর্মীরা। তায় তাঁরা আর উপেক্ষিত হতে চান না, এবার সময় অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার। সরকার নির্ধারিত নুন্যতম মজুরি চালু করানো। নিজেদের কর্মের সুরক্ষা চাইছেন তাঁরা, জীবনের সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় জুতো, গ্লাবস সহ পর্যাপ্ত পরিমাণে সাবান, স্যানিটাইজার সহ অন্যান্য সামগ্রী প্রদানের দাবি তুলছেন। ইউনিয়নের সভাপতি পদ্মা মাদ্রাজি বলছেন, “কাজ ছাড়িয়ে দেওয়ার শাসানি তো আমরা সবসময়ই পায় তারপরও আমাদের বয়স্ক পুরনো কর্মীরা ৬০ বছর পর কোনো সুবিধা পেয়েছে কি? তাহলে আমাদের আন্দোলনই পথ, শাসানি চলুক কত চলবে।” ইউনিয়ন সম্পাদক দিলবার খাঁ সহ অন্যান্য কিছু কর্মীরা বলছেন, “ইউনিয়ন কে প্রতিষ্ঠা করাই এখন মূল লক্ষ্য, তবেই ভবিষ্যৎ এ দাবি আদায় সম্ভব।”

একদিকে দীর্ঘ ৩৫ বছর পর বহু রাজনৈতিক জামানার অদলবদলের পর শ্যামা প্রসাদ মুখার্জীর (২৫ বছরের ঊর্ধ্বে চেয়ারম্যান) হুমকি, ভয় উপেক্ষা করে বিষ্ণুপুর পৌরসভাতে কোনো ইউনিয়ন তৈরি হল। এবং একই সাথে আন্দোলনের পথেই সমস্ত দাবিগুলিকে তারা সম্মিলিত রূপ দিয়ে একটি শক্তিশালী সাংগঠনিক ভিত্তি তৈরি করতে সক্ষম হলো।

এই ডেপুটেশন সফল ভাবে সম্পন্ন হয় এএলসি-র তরফ থেকে ত্রিপাক্ষিক বৈঠক ডাকার আশ্বাস পেয়ে। আন্দোলনকে ভবিষ্যতে কি ভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে তা জানান এআইসিসিটিইউ-র নেতৃত্ব, বিল্টু ক্ষেত্রপাল এবং ফারহান খান জানান, “আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর বাঁকুড়া জেলাশাসকের কাছে ডেপুটেশনে ইউনিয়নের দাবিগুলিও যুক্ত করা আছে। বিষ্ণুপুর থেকে ৬০ জন কর্মী ঐ ডেপুটেশনে যোগ দেবেন এবং সেখান থেকে ফিরে মিটিং করে আগামী কর্মসূচী ঠিক করা হবে।”

jadddpr

কুখ্যাত জাতীয় তদন্ত সংস্থা বা এনআইএ এবার বিজ্ঞানী পার্থ সারথি রায়কে তাদের মুম্বাই স্থিত সদর দপ্তরে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করে ১০ সেপ্টেম্বর তারিখে। শ্রী পার্থ রায়-এর মাধ্যমে এবার অমিত শাহ-র ব্যক্তিগত বাহিনীতে রূপান্তরিত হওয়া এনআইএ এ রাজ্যে ঢোকার ফন্দি আঁটছে। এর বিরুদ্ধে পার্টি ১০ তারিখ প্রতিবাদ দিবসের ডাক দেয়। এর সাথে আরও দুটো ইস্যুকে যুক্ত করে যাদবপুর ৮বি-তে পালিত হয় ধিক্কার ও প্রতিবাদ সভা। অধ্যাপক মেরুনা মুর্মুর বিরুদ্ধে বর্ণবাদী, ব্রাহ্মণ্যবাদী কুৎসা ও দিল্লি দাঙ্গাকে সামনে রেখে প্রতিবাদী ছাত্র, গণতান্ত্রিক ব্যক্তিবর্গ, সমাজকর্মীদের হেনস্থা ও অন্যায় গ্রেপ্তারির বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়।

যাদবপুরে এই সভার আয়োজক ছিল আইসা, এআইসিসিটিইউ, এআইপিডব্লিউএ, গণসংস্কৃতি পরিষদ এআইপিএফ ও আরওয়াইএ।

এ ছাড়াও বিভিন্ন গণতান্ত্রিক সংগঠন এই সভায় অংশ নেন। উপস্থিত ছিলেন অরিজিত মিত্র স্মারক কমিটির নেতৃবৃন্দ। বন্দী মুক্তি কমিটির ছোটন দাস, ফামার গৌতম দাশগুপ্ত, পিইউসিএল-র অম্লান ভট্টাচার্য, নাট্য ব্যক্তিত্ব ও গণসংস্কৃতি পরিষদের দেবাশীষ চক্রবর্তী প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। সময়াভাবে সকলকে বক্তব্য রাখার জন্য ডাকা সম্ভব হয়নি।

বক্তারা সকলেই গণতন্ত্র হরণের নানান দিক তুলে প্রতিবাদ জানান, মেরুনা মুর্মুর উপর বর্ণবাদী কুৎসার নিন্দা করেন ও বৃহত্তর আন্দোলনের প্র‍য়োজনীয়তার গুরুত্ব তুলে ধরেন। আইসা থেকে বক্তব্য রাখেন সৌমেন্দু, এআইপিডব্লিউএ-র থেকে ইন্দ্রাণী দত্ত, এআইসিসিটিইউ-র তরফ থেকে বাসুদেব বোস। সিপিআইএমএল পলিটব্যুরো সদস্য কার্তিক পাল উপস্থিত ছিলেন। সভার কাজ পরিচালনা করেন অতনু চক্রবর্তী।

wwedeea

জলপাইগুড়ির রাজগঞ্জে দুই আদিবাসী নাবালিকাকে গণধর্ষণ ও একজনের মৃত্যুর ঘটনা সহ বীরভূমে আদিবাসী মহিলাকে ধর্ষণ, বর্ধমানে গর্ভবতী মহিলার উপর অত্যাচার এবং গড়বেতায় মহিলাদের রাস্তায় লাঠিপেটার প্রতিবাদে ১৪ সেপ্টেম্বর রাজ্যের ৫টি বামপন্থী মহিলা সংগঠনের (সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি, সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি, পশ্চিমবঙ্গ মহিলা সমিতি, অগ্রগামী মহিলা সমিতি এবং নিখিল বঙ্গ মহিলা সংঘ) উদ্যোগে বিক্ষোভ মিছিল ও রাজ্য মহিলা কমিশনে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। ব্যানার, ঝান্ডা, প্ল্যাকার্ডে সুসজ্জিত বিক্ষোভ মিছিল সল্টলেক করুণাময়ী থেকে শুরু হয়ে জলসম্পদ ভবনে রাজ্য মহিলা কমিশনের দপ্তরের সামনে গেলে পুলিশ আর এগোতে দেয় না। পাঁচটি মহিলা সংগঠনের পক্ষ থেকে কোনিনিকা ঘোষ, শ্যমাশ্রী দাস, ইন্দ্রাণী দত্ত, ডলি রায় সহ ৬ জনের এক প্রতিনিধি দল কমিশনের দপ্তরে যান স্মারকলিপি জমা দিতে। প্রতিনিধিদল না ফেরা পর্যন্ত বক্তব্য ও শ্লোগান চলে প্রতিবাদকারী মহিলাদের।

স্মারকলিপিতে রাজ্যে ঘটে চলা ধর্ষণ, হত্যাকান্ডের অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি তোলা হয়। এছাড়া লকডাউন পরিস্থিতিতে নারীর উপর শারীরিক ও মানসিক হিংসা উত্তরোত্তর বৃদ্ধির প্রতি কমিশনকে মনোযোগী হতে ও এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উদ্যোগী হতে দাবি করা হয়।

kakkkpb

অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনের সংশোধনের বিরুদ্ধেও কৃষি-বাণিজ্য অর্ডিন্যান্স বাতিল করার দাবিতে এবং দিল্লীর দাঙ্গার প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেফতার ও বিচার, এনআরসি, সিএএ বিরোধী ষড়যন্ত্রমুলকভাবে জড়ানো মিথ্যা মামলার প্রত্যাহারের দাবিতে ১৪ সেপ্টেম্বর আগ্রাদহ বাস স্ট্যান্ডে মিছিল ও পথ সভা করেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশন-এর কালনা লোকাল কমিটি।

নাদনঘাট বাজারে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন ও সিপিআই(এম)-এর পক্ষ থেকে যৌথভাবে ঐ একই দাবির ভিত্তিতে  মিছিল ও পথসভা করা হয়।

ecccgra

খাদের নীচে গড়িয়ে পড়া দেশীয় অর্থনীতিতে সরু একটা রূপালি রেখা দেখা গেছিল কৃষি ক্ষেত্রে। কিন্তু, গোটা অর্থনীতির ভঙ্গুর কাঠামোয়, চাহিদার ঘোর সংকটের বাতাবরণে যে এটাও দীর্ঘস্থায়ী হবে না তা আমরা দেশব্রতীর ৩ সেপ্টেম্বর সংখ্যার একটা লেখায় বলেছিলাম। খুব সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকাশিত তথ্য তাই প্রমাণ করলো।

আশানুরূপ রবি ফসল প্রথম ত্রৈমাসিকে কৃষি ক্ষেত্রে ৩ শতাংশ বৃদ্ধি ও সাময়িক চাহিদা বাড়ালেও সম্প্রতি যে নতুন তথ্যগুলো আসতে শুরু করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে আবার দাম বা মুল্যের পতন নতুন এক কৃষি সংকটের ইঙ্গিতবাহী। ফুল বাগিচা-দুগ্ধজাত পণ্য-পোল্ট্রি প্রভৃতি ক্ষেত্রে উৎপাদিত পণ্যে দাম পড়তির দিকে।

কিছু সংখ্যক পরিযায়ী শ্রমিক ফের উন্নত মজুরি ও কাজের খোঁজে তাঁদের আগেকার কর্মক্ষেত্রে ফিরে গেলেও, এখনো বিরাট অংশটা নিজ নিজ এলাকাতেই রয়েছেন। পরিযায়ী শ্রমিকরা তাঁদের কর্মক্ষেত্র থেকে প্যান্ডেমিকের আগে পর্যন্ত গ্রামে তাঁদের পরিবারের জন্য যে টাকা পাঠাতেন, তা গ্রামীণ অর্থনীতিতে চাহিদা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কিছুটা ভূমিকা রাখতো। যেমন, সরকারী তথ্য অনুযায়ী, বিহারের রাজ্য জিডিপির ৩৫ শতাংশই হচ্ছে পরিযায়ী শ্রমিকদের গ্রামে পাঠানো উপার্জনের টাকা। আর, এটাই অ-কৃষি পরিবারের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা পালন করতো। ২০১৭-র আর্থিক সমীক্ষার প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, পরিযায়ী শ্রমিকদের সংখ্যা (এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে যাওয়ার) আনুমানিক ১৩.৯ কোটি। আর, শিল্প সংস্থাগুলোর হিসাব, ফি বছর গোটা দেশের পরিযায়ী শ্রমিকরা তাদের পরিবারের কাছে উপার্জনের যে অর্থ প্রেরণ করে তার পরিমান আনুমানিক দুলক্ষ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিহার ও উত্তর প্রদেশ, এই দুই রাজ্যে উক্ত পরিমানের প্রায় ৬০ শতাংশ প্রেরিত হয়। ওড়িষ্যা-ঝাড়খন্ড-তামিলনাড়ু-অন্ধ্র প্রদেশ হলো সেই সমস্ত রাজ্য যেখানে ভালো পরিমানে যায় এই প্রেরিত অর্থ। আমাদের এ রাজ্যে এ সম্পর্কিত প্রামান্য পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। লকডাউনের পর কাজ হারা পরিযায়ী শ্রমিকরা নিজ নিজ ঘরে ফিরে আসায় এই বিপুল অর্থের ঘাটতির কবলে পড়েছে নিম্ন আয় সম্পন্ন রাজ্যগুলি।

এবার নতুন এক স্বাস্থ্য সংকটের মুখে পড়তে চলেছে গ্রামীণ ভারত। ধাপে ধাপে আনলক পর্বে শহুরে ভারত থেকে কোভিড এবার গ্রামীণ ভারতের দিকে এগোচ্ছে। প্রায় প্রতিদিন দেশে নতুন করে এক লক্ষ মানুষ করোনা সংক্রামিত হচ্ছেন, আর নতুন নতুন জেলাগুলোতে হাজারেরও বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়ে পড়ছেন। একেই স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর চুড়ান্ত অপ্রতুলতার মধ্যে নতুন করে যদি কোভিড সংকট গ্রামীণ ভারতে ঘনিয়ে ওঠে, তবে আর্থিক দিক ছাড়াও সামাজিক ক্ষেত্রে তার প্রভাব পড়বে সুদুরপ্রসারি। আর, চাহিদা যেটুকু তৈরি হচ্ছিল, সেটা আরও নিম্নগামী হবে।

প্রাক্তন মুখ্য পরিসংখ্যানবিদ ও ইকনমিক স্ট্যাটিস্টিক্স এর স্ট্যান্ডিং কমিটির প্রধান প্রণব সেন দুটি উদ্বেগের দিক তুলে ধরেছেন। তিনি জানিয়েছেন, বিপুল রবি ফসল একটা নতুন সংকটকে ডেকে এনেছে। দেশের একটা প্রান্ত, যেখানে ফলেছে বিপুল ফসল সেখানে আবার ট্রাকটরের চাহিদা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু দেশের আরেকটা প্রান্তে অন্য সংকট – সেটা হচ্ছে লাভজনক দাম না পাওয়া। আর এইগুলো হচ্ছে সেই সমস্ত রাজ্য, যারা পরিযায়ী শ্রমিকদের পাঠানো আয়ের উপর বেশ নির্ভরশীল।

দ্বিতীয় উদ্বেগের দিক হল, পরিযায়ী শ্রমিকদের উপার্জনের উপর নির্ভরশীল পরিবারগুলোর আর্থিক সংকট চাহিদা সৃষ্টির উপর প্রভাব ফেলছে। এখনো পর্যন্ত গ্রামীণ উৎপাদিত পণ্যের ৪০-৪৫ শতাংশ শহরমুখী হয়, বাকি সিংহভাগই গ্রামীণ বাজারের উপর নির্ভরশীল। ফলে উৎপাদিত কৃষি পণ্য বিক্রি হতে পারছে না চাহিদার অভাবে, যা ডেকে আনছে নতুন এক সংকট।

জিএসটি বাবদ রাজ্যগুলোর যে পাওনা কেন্দ্রের কাছে ছিল তাতে রীতিমতো টান পড়েছে। এর প্রভাব রাজ্যগুলোর অর্থনীতিতেও পড়তে শুরু করেছে। সরকারের তথ্য দিয়ে প্রণব সেন দেখিয়েছেন, ২০২০-২১-র প্রথম ত্রৈমাসিকে গত বছরের সাপেক্ষে রাজ্য সরকারগুলোর আয় কমেছে ১৮.২ শতাংশ, আর খরচ বেড়েছে নামমাত্র ২.৭ শতাংশ। বেশ কিছু রাজ্য খরচের উপর বড় ধরনের রাশ টানায় চাহিদা আরো সংকটাপন্ন হয়ে উঠবে, যা, শেষ বিচারে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে সংকোচনে শ্বাসরোধকারী অর্থনীতিকে।

ক্রিসিল এর প্রকাশ করা তথ্য জানাচ্ছে, মধ্যবর্তী পর্যায়ে ভারতের প্রকৃত জিডিপির থেকে স্থায়ীভাবে লুপ্ত হবে ১৩ শতাংশ, যা এশিয়-প্যাসিফিক অঞ্চলের অর্থনীতির তুলনায় ৩ শতাংশ বেশি! স্থায়ীভাবে লুপ্ত হওয়ার অর্থ হল আর কোনোদিনই জিডিপির ঐ মূল্যটি পুনরুদ্ধার করা যাবে না। আরো সহজে বললে, এই অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ফলে ৩০ লক্ষ কোটি টাকা মূল্যের অর্থনীতি লোপাট হয়ে যাবে। এর পরিণাম – বিরাট মাত্রায় বেকারত্ব ও ছদ্মবেশী কর্মসংস্থান বা ডিসগাইসড এমপ্লয়মেন্ট।

সেন্টার ফর মনিটারিং ইন্ডিয়ান ইকনোমি (সিএমআইই)-র সিইও মহেশ ভ্যাস জানিয়েছেন, এক আতঙ্কজনক বেকারত্বের কোলে ঢলে পড়ছে ভারত। তিনি বলেছেন, প্রাক প্যান্ডেমিক পর্বেই দেশে কর্মহীন ছিলেন ৩.৫ কোটি। প্যান্ডেমিকের ছোবলে আরও দুকোটি বেতনভুক মানুষ কাজ হারায়। যা আবার ফিরে পাওয়ার আশা রীতিমতো দুষ্কর। এই ৩.৫ কোটির মধ্যে ২০ লক্ষ প্রতি মাসে যুক্ত হচ্ছেন শ্রম বাজারে। যাদের বয়স বছর ১৫ থেকে ৫৯-র মধ্যে। অর্থনীতির অন্যান্য ক্ষেত্রগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় গ্রামীণ ক্ষেত্রে কাজের জন্য ভিড় বেড়েছে, যাকে ছদ্মবেশী কর্মসংস্থান বলেই আখ্যা দেওয়া যায়। যত বেশি সংখ্যক শ্রমজীবী মানুষ যুক্ত হচ্ছেন কৃষি ক্ষেত্রে, ততই জোরালো হয়ে উঠবে নূন্যতম সহায়ক মূল্যের দাবি, যেমনটা এখন দেখা যাচ্ছে পঞ্জাব, হরিয়ানার বিস্তীর্ণ ক্ষেত্র জুড়ে। ভারতের কৃষিক্ষেত্র কোনোদিনই লাভজনক ছিল না, আর বর্তমানে আরো বেশি বেশি মানুষ তার সাথে যুক্ত হওয়ায় তা আরও অলাভজনক হয়ে পড়বে।

অকৃষি ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার সরাসরি বিনিয়োগ করার বদলে ব্যাঙ্ক মারফত ঋণ দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়ায় অর্থনীতির হাল ফিরে আসার সব সম্ভাবনায় তলিয়ে যাচ্ছে।

গভীর থেকে গভীরতর সংকটের কবলে দেশের অর্থনীতি। করোনা আক্রান্ত আর কোনো দেশের অর্থনীতি, এমনকি পাকিস্তানও এতো বিপর্যস্ত হয়ে পড়েনি। এদিকে, প্রতিদিন সংক্রমণের সংখ্যা ও গতির নিরিখে ভারত আজ বিশ্বে পয়লা নম্বরে।

মোদীর ভারত আর কত প্রশ্নেই যে রেকর্ড করবে তা বলবে আগামী দিনগুলো।

– অতনু চক্রবর্তী   

bibir

অনীক পত্রিকার প্রয়াত সম্পাদক দীপংকর চক্রবর্তী কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের খুবই প্রিয়পাত্র ছিলেন। দীপংকরদাকে নিয়ে কবি বীরেন্দ্র কবিতা লিখেছেন, দীপংকরদাকে তাঁর বই উৎসর্গও করেছেন। দীপংকরদা তাঁর অনীক পত্রিকার জন্যে কবিতা চাইলে সেই প্রার্থনা মঞ্জুর বীরেন্দ্রকে করতেই হতো। আর জন্যেই আমরা অনীক-এর পৃষ্ঠায় বীরেনদার অনেক কবিতা পেয়েছি।  অন্যদিকে দীপংকরদাও কবি বীরেন্দ্রকে আন্তরিকভাবেই শ্রদ্ধা করতেন। তাঁর কবিতার ছত্র উদ্ধৃত করে তিনি বারবার ‘অনীক’-এর পৃষ্ঠায় তাঁর তথা অনীক-এর প্রতিবাদকে সামনে নিয়ে এসেছিলেন। কবিও তাঁর সাম্প্রতিক লেখা রাজনৈতিক কবিতা অযাচিতভাবেই পাঠাতেন অনীক-এ আর বলতেন অনীক  ছাড়া এসব কবিতার যোগ্য জায়গা আর কোথায় পাবো? এভাবেই তিনি এই পত্রিকাটির ওপর তাঁর আস্থার প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন।

কবি বীরেন্দ্র প্রয়াত হন ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দের ১১ জুলাই বৃহস্পতিবার। সেই জুলাই মাসের অনীক পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত হয়েছিল ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে লেখা বীরেনদার সেই বিখ্যাত কবিতা জন্মভূমি আজ । আর দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় সম্পাদক স্বয়ং লিখেছিলেন ‘কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’ শীর্ষক সম্পাদকীয়। সেই সম্পাদকীয়তে দীপংকরদা বীরেনদার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে লিখেছিলেন :

বীরেনদা আমাদের কবি ছিলেন, আমাদের অর্থাৎ তৃতীয় শিবিরের। গদির সুখ পাওয়া এক বাম রাজনৈতিক দলের অনেকের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক সত্ত্বেও, বীরেনদা লেখেন :

আজ তোমরা রাজত্ব পেয়েছো/ আর তিন রাত্তির না ফুরুতেই/ তোমাদের মুখের চেহারা গেছে বদলে—/ যা ছিলো একদিন সূর্যের কাছে প্রার্থনা/ এখন তা গা-ছমছম ভূতের ভয়!

এই সম্পাদকীয় নিবন্ধে অনীক-সম্পাদক আরও লিখেছিলেন : প্রথাগত ‘বাম’পন্থার ব্যর্থতা কবি বীরেন্দ্রকে যে অবস্থানে আসীন করেছিল তাকে ‘ধান্ধাবাজ বামপন্থী’রা বলতেন উগ্রপন্থা। রক্তাক্ত, দুঃসাহস প্রদর্শনের এবং এক মুক্ত ভারতের স্বপ্নে উদ্বেল তারুণ্যের হাসিমুখে আত্মবলিদানের সময় কবি বীরেন্দ্র সেই নির্ভীক তারুণ্যের মধ্যেই তাঁর প্রত্যাশিত স্বপ্নের নবজন্ম দেখে কলমের আয়ুধ হাতে পথে নেমে এসেছিলেন সমস্তরকম ভয়ভীতি উপেক্ষা করেই। এই সময়েই কবি উপলব্ধি করেছিলেন যে আগুন ছাড়া ভালোবাসা মিথ্যে  বই আর কিছু নয়।

অনীক পত্রিকার পরের সংখ্যাতেই (অর্থাৎ অগাস্ট ১৯৮৫) আবার ‘বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্মরণে’ আরও একটি সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছিল। এই সংখ্যাটি ছিল কবি বীরেন্দ্র স্মরণ সংখ্যা। এই সংখ্যায় দীপংকরদা ‘সমকালের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর’ শিরোনামায় একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন কবিকে নিয়ে।

দীপংকরদার মুখে একটা কথা অনেকবারই শুনেছি। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে চীন-ভারত যুদ্ধের সময় আনন্দবাজার পত্রিকার কর্তৃপক্ষকে শিল্পীর স্বাধীনতা নিয়ে হঠাৎ ব্যস্ত হতে দেখা গিয়েছিল। সে সময় এই পত্রিকার তরফে উদ্দেশ্যমূলকভাবেই চীন-বিরোধী প্রচারের লক্ষ্যেই ধারাবাহিকভাবে পশ্চিমবাংলার লেখক-বুদ্ধিজীবীদের দিয়ে শিল্পীর স্বাধীনতা রক্ষার নামে চীনকে আক্রমণকারী বলে চীন-বিরোধী উগ্রজাতীয়তাবাদের প্রচার শুরু হয়েছিল। আমাদের তৎকালীন পশ্চিমবাংলার অধিকাংশ কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীরা এই শিল্পীর স্বাধীনতা রক্ষার নামে চীন-বিরোধী জিগিরে সামিল হয়েছিলেন। এই দলে কবি বীরেন্দ্রও নাম লিখিয়েছিলেন। পরে কবি বীরেন্দ্র নিজের ভুল বুঝতে পেরে একটি দৈনিক সংবাদপত্রে ধারাবাহিকভাবে নিজের ভুল স্বীকার করে এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। এমনকি ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দেও তিনি মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছিলেন :

ভারত-চীন সংঘর্ষের সময় আমি যে-সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলাম, তাকে এখন সম্পূর্ণ-ই ভ্রান্ত মনে করি।

— এই হলেন কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। সেই ঘটনার ৬৮ বছর পর বর্তমান দেশের ফ্যাসিস্ত সরকার পুনরায় দেশের জনসাধারণের অসমাধেয় সমস্যাবৃদ্ধির মুখে দাঁড়িয়ে এই করোনাকালেও আবার চীন-বিরোধী জিগির তোলার উদ্যোগ নিয়েছে। এখনও অবশ্য শিল্পীর স্বাধীনতা রক্ষার দাবি সামনে এনে হাজির করায়নি কেউ, তবে তেমন সম্ভাবনা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। বিশেষত বিহার-পশ্চিমবাংলার মতো আসন নির্বাচনে চীন-বিরোধী উগ্র জাতীয়তাবাদ ফ্যাসিস্তদের খুবই কাজে আসতে পারে।

১৯৭৫-এর ২৫ জুন থেকে ১৯৭৭-এর ২১ মার্চ পর্যন্ত জারি ছিল ইন্দিরা শাহির আমলের জারি করা কুখ্যাত জরুরি অবস্থা। এরপর নির্বাচনের মুখে বন্দিমুক্তির দাবি সামনে চলে আসে। সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সেসময় প্রতিশ্রুতি দেয় যে তারা ক্ষমতায় এলে বন্দিমুক্তির ব্যবস্থা করবে। এই বন্দিমুক্তির দাবিতে আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে সামিল হয়েছিলেন কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্বয়ং। এখানে একটি তথ্য উল্লেখ করা যেতে পারে। গত শতকের সত্তরের দশকে কবির আত্মজ নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে বিপদাপন্ন হয়েছিলেন। কবি নিজে নকশালপন্থার সমর্থক না হওয়া সত্ত্বেও নকশালপন্থীদের মধ্যে তাঁর প্রার্থীত স্বপ্নের মুক্তির সন্ধান পেয়েছিলেন। তাই আত্মজের এই রাজনীতির সম্পৃক্ততার জন্য নিজে কখনো রুষ্ট হননি। বরং সেই সত্তরের কালো দিনগুলিতে আত্মজের বিপন্ন অবস্থায় তাদের দলীয়দের কাছে গিয়ে তার আশ্রয়ের প্রার্থনা করে সরাসরি প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন! শেষপর্যন্ত এক ‘অনুজ কবির প্রশ্রয়ে’ আশ্রয় মেলায় কবি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন। — এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সাধারণত নকশাল-দরদি ব্যক্তিরও নকশালপন্থীদের প্রতি বৈরূপ্য প্রদর্শনের মনোভঙ্গি গ্রহণ সঙ্গত ছিল। কিন্তু কবি বীরেন্দ্র সেপথে হাঁটেননি। সংবেদনশীল কবি তাঁর বিপন্ন আত্মজকে আশ্রয় দিতে না-পারার কারণ যথার্থই উপলব্ধি করেছিলেন। ফলে তিনি এই নকশালপন্থীদের প্রতি বিরূপ হননি। তিনি এতটাই বড়ো মনের মানুষ ছিলেন।

সাতাত্তরের নির্বাচনে কংগ্রেসি শাসনের পতন এবং বাম জমানার অভ্যুদয় হওয়া সত্ত্বেও এই বন্দিমুক্তি আন্দোলন অব্যাহত ছিল কেননা বন্দিমুক্তি নিয়ে অনেক টালবাহানা চলেছিল। এই সময় বন্দিমুক্তি হবে এই প্রতিশ্রুতির প্রেক্ষিতে কবি বীরেন্দ্র প্রশ্ন তুলেছিলেন :

হবে
কিন্তু মহাশয়, কবে?

এইসময় জেল থেকে মুক্তি পেয়ে নকশালপন্থীরা কবি বীরেন্দ্রর সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগ রক্ষা করতে থাকেন। কবি তাঁদের কাছে হয়ে ওঠেন ‘আমাদের কবি’। চতুর্থ এবং পঞ্চম ট্রাইবুনালের বন্দিরা যথাসময়ে মুক্তি না পাওয়ায় কবি বীরেন্দ্রর উদ্বেগের অন্ত ছিলোনা। তিনি সেইসব বন্দিদের সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। সুযোগ আসতেই তিনি আলিপুর কোর্টে গিয়ে বন্দিদের সঙ্গে দেখা করেন। বন্দিরাও খুশিতে উদ্বেল। কবি স্বয়ং এসেছেন তাঁদের দেখতে, তাঁরা অনেকে কৃতজ্ঞতা ও আবেগে কবির হাত স্পর্শ করেন। বাড়ি ফিরে এসে কবি লিখেছিলেন :

আমি অনেক যুবককে একত্র হতে দেখেছি
জলসায়, খেলার মাঠে, সভায়, মিছিলে, মনুমেন্টের নীচে —
কিন্তু কখনো জীবনের ঐকতানকে, এতো গভীর প্রেমের মতো অনুভব করিনি।

এতগুলো বছর পর এখনও আবার এক বন্দিমুক্তির দাবিতে সোচ্চার হওয়া সত্ত্বেও দেশের বর্তমান ফ্যাসিস্ত সরকার ক্রমাগত তার অপছন্দের লোকজনকে একের পর এক মিথ্যে মামলায় জড়িয়ে গ্রেপ্তার করে চলেছে। অশীতিপর এবং অসুস্থ কবি ভারভারা রাও সহ বিভিন্ন স্থরের প্রতিবাদী কণ্ঠ রুদ্ধ করার ক্ষেত্রে এই সরকার অতীতের অনেক রেকর্ড ম্লান করে দিয়েছে। আইনজীবী, অধ্যাপক, সাংবাদিক, ছাত্র, ডাক্তার, বিজ্ঞানী সহ প্রতিবাদকারিদের জিজ্ঞাসাবাদের নামে ডেকে নিয়ে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে কিম্বা গ্রেপ্তারের হুমকি দিয়ে সরকারের বশীভূত করার ফ্যাসিস্ত পদ্ধতি প্রয়োগ করা হচ্ছে! এই দুষ্কর্মের কোনোরকম প্রতিবাদকেও গ্রাহ্য করা হচ্ছে না। আশি বছরের অসুস্থ কবি ভারভারা রাও সহ তাঁর সহবন্দিদের মুক্তির অনুরোধ জানিয়ে দেশ এবং বহির্দেশের বিভিন্ন প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবীদের পাঠানো আবেদনপত্রকেও এই সরকার এবং তার বিচারব্যবস্থা গুরুত্ব না দিয়ে ক্রমাগত উপেক্ষা করে চলেছে। এমনকি বন্দি কবি ভারভারা রাওয়ের জামাইকেও সম্প্রতি এলগার পরিষদ কেসে শমন পাঠিয়েছে সরকার-পোষিত এনআইএ। পশ্চিমবাংলার  এক তরুণ বিজ্ঞানীকেও এনআইএ ডেকে পাঠিয়েছে। এমনকি একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন কবির কলা মঞ্চ-এর তিনজন সদস্যকেও এনআইএ ডেকে পাঠিয়ে তাদের নিজেদের হেফাজতে নিয়েছে! কোনরকম প্রতিবাদকে এই সরকার বরদাস্ত করতে রাজি নয়। সম্প্রতি এক ছবিতে পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সি কবি ভারভারা রাও-কে দেখা গেল কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের এক বামপন্থী পুস্তক প্রকাশকের ঘরে। সময়টা ছিল ১৯৮৫, কবি বীরেন্দ্রর প্রয়াণের অবব্যহিত পরের ঘটনা। জানা গিয়েছে কবি ভারভারা রাওয়ের অন্যতম প্রিয় কবি ছিলেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। আজ সেই কবির বয়স আশি। তিনি আজ কারান্তরালে। আর কবি বীরেন্দ্রর এটাই জন্মশতবার্ষিকী বছর। এক অদ্ভুত সমাপতন।

কবি বীরেন্দ্র সরাসরি প্রতিবাদের রাস্তায় যেতে পছন্দ করতেন। বিলম্বিত অথা প্রলম্বিত প্রক্রিয়ার প্রতি তাঁর আস্থা খুবই কম ছিল। আর এর ফলেই দেখেছি সত্তরের দিনগুলিতে যখন প্রায় সবাই ঘরের নিভৃত আশ্রয়ে ঢুকে পড়েছেন প্রতিবাদ  শব্দটিকে অভিধান থেকে অবসৃত করে, তখন তিনি এক দুঃসাহসে ভর করেই রাস্তায় নেমেছিলেন তাঁর প্রতিবাদের আয়ুধ হাতে নিয়েই। এসময়ে তিনি সময়ের দাবি মেটাতে এমন অনেক কবিতাই লিখেছেন যা আদতে কবিতা পদবাচ্য হতে পারে না। কবি একথা জানতেন। নিজে উত্তরকালে স্বীকারও  করেছেন। তবে বলেছেন যে সময়ের দাবিই তাঁর কাছে সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছিল।

কবির জন্মশতবর্ষে আমরা কি সময়ের দাবির প্রতি কবির মতো দায়বদ্ধ হতে পারি না?

--  অশোক চট্টোপাধ্যায়  
সেপ্টেম্বর ১০, ২০২০  

rrregra

মনুস্মৃতি জ্বালিয়ে আমরা জাতপ্রথার শিকর উপড়ে ফেলার কাজ শুরু করলাম।

- বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকার

কয়েকদিন আগে (৪ সেপ্টেম্বর) আমাদের প্রিয় বন্ধু ও কমরেড ডঃ পার্থ সারথী রায়কে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা – ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এনআইএ) – সমন জারি করে মুম্বাই তলব করে। সমনে জানানো হয়, এলগার পরিষদ-ভীমা করেগাঁও মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্যই তাকে ডাকা হয়েছে। ১০ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টায় তাকে মুম্বাইতে এনআইএ-র দপ্তরে হাজিরা দিতে আদেশ দেওয়া হয়।

পার্থ একজন কৃতি বিজ্ঞানী, বিজ্ঞান জগতে সুপরিচিত। কল্যাণীতে অবস্থিত ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট ফর সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ-এর সহযোগী অধ্যাপক এবং গবেষক। মলিকিউলার বায়োলজিতে, বিশেষ করে ভাইরাস নিয়ে তার গবেষনার কাজ বিশ্বের বিজ্ঞান মহলে সাড়া ফেলে দিয়েছে। আজকের কোভিড-১৯ সংক্রমণ অতিমারির বিরুদ্ধে যুদ্ধে তার গুরুত্বপূর্ণ অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা – ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (হু) – তাকে ভারতের নীতি-নির্ধারণকারী দলের অন্যতম সদস্য হিসাবে নিযুক্ত করেছে। পার্থর নির্দেশিত রণনীতি, করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জোট বেঁধে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ – কমিউনিটি পার্টিসিপেশন – রাজ্য সরকারের সহযোগিতায় পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলায় কার্যকরী করে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে।

পার্থর সবচেয়ে বড় পরিচয় অবশ্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তার নিরন্তর জড়িয়ে থাকা। মানবাধিকার ও রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তির দাবিতে সর্বদা তিনি যেমন সরব থাকেন, তেমনই নিরন্ন, হতদরিদ্র প্রান্তিক মানুষের, বিশেষত দলিত ও আদিবাসীদের, অধিকার আন্দোলনে তিনি আছেন একেবারে সামনের সারিতে। পস্কো, নিয়মগিরি, নন্দীগ্রাম, লালগড়, নোনাডাঙা, ঝাড়খন্ডের পাথলগড়ি আন্দোলন, কোথায় নেই তিনি! যে কোনও প্রতিবাদী মিছিল, জনসভা, পথসভা, ঘরোয়া সভায় পার্থর সক্রিয় উপস্থিতি, প্রাঞ্জল, যুক্তিপূর্ণ বক্তৃতা এবং সদা আপন-করে-নেওয়া হাসিমুখ আমাদের মুগ্ধ করেছে, অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। এহেন ব্যাক্তিটিকে সমন জারি করে রাষ্ট্র রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করবে, সেটাই তো স্বাভাবিক।

পার্থকে সমন জারির খবর ছড়িয়ে পড়তেই দেশ-বিদেশের বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, অধ্যাপক, শিক্ষক, সাহিত্যিক, নাট্যকর্মী, সঙ্গীত শিল্পী, ফিল্মমেকার সহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক, অধিকার ও গণআন্দোলনের কর্মী ও সংগঠন, নারী আন্দোলন, ছাত্রযুব সংগঠন, ট্রেড ইউনিয়ন, কৃষক সভা, এনজিও ইত্যাদি এবং সর্বোপরি নানান দলিত ও আদিবাসী সংগঠন প্রতিবাদে সোচ্চার হয়। জোরদার প্রতিবাদ জানায় ছোট-বড় রাজনৈতিক দলগুলিও। অতিমারির কারণে বিধিনিষেধ থাকলেও মিছিল, পথসভা করেও প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়। পার্থ অবশ্য শেষ পর্যন্ত মুম্বাই যাননি। এনআইএকে ই-মেল করে তিনি জানিয়ে দেন, যেহেতু তিনি কোভিড১৯ ভাইরাস নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছেন, তাই তিনি বিমানযাত্রার ঝুঁকি নিতে পারবেন না।

এদিকে, পার্থকে সমন জারির পরের দিনই এনআইএ সমন জারি করে হায়দ্রাবাদের ইংলিশ অ্যান্ড ফরেনল্যাঙ্গুয়েজ ইউনিভার্সিটির কালচারাল স্টাডিজ-এর প্রবীন অধ্যাপক কে সত্যনারায়ণ এবং অভিজ্ঞ সাংবাদিক কে ভি কুর্মানাথকে। অধ্যাপক সত্যনারায়ণ দলিত সাংস্কৃতিক অন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন দীর্ঘদিন ধরে এবং তার কাজ আন্তর্জাতিক স্তরে সমাদৃত। আর, কুর্মানাথ সংবাদপত্রে লিখে চলেছেন দলিত শোষণ, অত্যাচার ও প্রতিরোধ আন্দোলনের নানা কাহিনী। এদেরও এলগার পরিষদ-ভীমা করেগাঁও মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৯ সেপ্টেম্বর মুম্বাই তলব করা হয়। প্রসঙ্গত, এরা দু’জনেই বিপ্লবী কবি ভারাভারা রাওএর জামাই, যাকে ইতিমধ্যেই ভয়ংকর ইউএপিএ ধারায় গ্রেপ্তার করে জেলবন্দি করা হয়েছে ওই ভীমা-করেগাঁও মামলাতেই। আশি বছরের জোয়ান কবি প্রায় দু’বছর বিনা বিচারে কারাবাস করছেন, আজ তিনি গুরুতর অসুস্থ এবং তার পরিবারের দাবি তার সুচিকিৎসা হচ্ছে না।

পার্থ সারথী রায়ের মতো অধ্যাপক সত্যনারায়ণ ও কুর্মানাথকে সমন দেওয়ায় বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে প্রতিবাদের ঝড় বয়ে আসে। হয়ত সেই সম্মিলিত প্রতিবাদের চাপেই দু’জনকে মাত্র একদিন জেরা করে ছেড়ে দেওয়া হয়।

ছাড় কিন্তু পায় না প্রতিবাদী দলিত সাংস্কৃতিক কর্মী সাগর তাতারাম গোর্খে, রমেশ মুরলীধর গেইচর ও জ্যোতি রাঘব জগতাপ। এরা তিনজনেই কবীর কলা মঞ্চএর সক্রিয় সদস্য। কবীর কলা মঞ্চ একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন, এরা বহুদিন ধরে গ্রামে গ্রামে ঘুরে গান-নাটক-কবিতার মাধ্যমে দলিত সমাজকে জাগ্রত করার কাজে লিপ্ত। বি আর আম্বেদকার ও জ্যোতিরাও ফুলের চিন্তাধারা এদের অনুপ্রেরণা। এর আগে, ইউপিএ আমলেই, এদের ‘মাওবাদী’ শাখা সংগঠন বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল এবং কয়েকজন সদস্য কে ইউএপিএ ধারায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এখন এদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে আবার ইউএপিএ ধারাতেই এবং ভিমা-করেগাঁও মামলাতেই। নভেম্বর ২০১৮ ভীমা-করেগাঁও মামলায় যে চার্জশিট দেওয়া হয় তাতে তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল এরা পুণেতে এলগার পরিষদের সভায় জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে মানুষের মনে হিংসা ছড়িয়েছিল। গ্রেপ্তারির আগে এদেরকে বলা হয়, মাফ চাইলে ছেড়ে দেওয়া হবে, এদের জবাব ছিল, আমরা সাভারকারের না, আম্বেদকারের সন্তান, মাফ আমরা চাইব না।

গোর্খে, গেইচর ও জগতাপের গ্রেপ্তারের সঙ্গে ভীমা-করেগাঁও মামলায় এখনও পর্যন্ত ইউএপিএ ধারায় জেলবন্দীর সংখ্যা দাঁড়াল ১৫ জন। ৮ জুন, ২০১৮ প্রথম গ্রেপ্তার হন আইনজীবী সুরেন্দ্র গ্যাডলিং যিনি মানবাধিকার রক্ষার খাতিরে আইনি লড়াই লড়েছেন বহু মামলায়, দলিত কবি সুধীর ধাওয়ালে, নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক সোমা সেন, রাজনৈতিক বন্দিমুক্তি আন্দোলনের সংগঠক রোনা উইলসন এবং জাতীয় পুরষ্কার প্রাপ্ত সমাজ কর্মী মহেশ রাউত। এর পর ২৮ আগস্ট, ২০১৮ পুলিশ তল্লাসি চালায় ন’জনের বাড়িতে এবং পরে একে একে গ্রেপ্তার হন আরও ছ’জন – ২৬ অক্টোবর, ২০১৮ গ্রেপ্তার হন মানবাধিকার কর্মী ও লেখক অরুণ ফেরেরা এবং ভারনন গঞ্জালভেস; ঠিক তার পরের দিন গ্রেপ্তার করা হয় ছত্তিসগড় মুক্তি মোর্চা-র অন্যতম নেত্রী ও আইনের শিক্ষক সুধা ভরদ্বাজকে; ১৭ নভেম্বর, ২০১৮ গ্রেপ্তার হন বিপ্লবী কবি ভারাভারা রাও; এর পর কোভিড১৯ অতিমারীর মধ্যেই ১৪ এপ্রিল, ২০২০ গ্রেপ্তার করা হয় ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি-র উপাদেষ্টা সম্পাদক ও কলমনিস্ট গৌতম নাভলাখা এবং দলিত রাজনীতির তাত্ত্বিক লেখক আনন্দ তেলতুম্বড়েকে। শেষে ২৮ জুলাই, ২০২০ গ্রেপ্তার হন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হ্যানি বাবু। এদের সবাই এখন পুণের কুখ্যাত ইয়েরওয়ারা জেলের বাসিন্দা, প্রত্যেকেই বিচারাধীন। সকলেরই জামিনের আবেদন পুণে কোর্ট, বম্বে হাই কোর্ট এবং সুপ্রীম কোর্ট নাকচ করে দিয়েছে। মহারাষ্ট্রে বিজেপি সরকারের পতনের পরে, ২৫ জানুয়ারি, ২০২০ মহারাষ্ট্র পুলিশের হাত থেকে তুলে নিয়ে এই মামলার তদন্তভার দেওয়া হয় এনআইএকে।

গ্রেপ্তার হওয়া বন্দীদের বিরুদ্ধে এনআইএ যে অভিযোগগুলি এনেছে সেগুলির মধ্যে অন্যতম দু’টি হল : এক, এলগার পরিষদে বক্তৃতা করে ভিমা-করেগাঁওতে হিংসার উস্কানি দেওয়া; দুই, নরেন্দ্র মোদিকে হত্যার ষড়যন্ত্র (পুণে পুলিশের আনা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনআইএ অজ্ঞাত কারণে বাতিল করে দিয়েছে)। মজার ব্যাপার হল, জেলবন্দীদের অধিকাংশই পুণের এলগার পরিষদের সভায় অংশগ্রহণ করেননি কিংবা ভিমা-করেগাঁওতে পা রাখেননি। তবে, এদের মধ্যে একটা মিল অবশ্য আছে – এরা প্রত্যেকেই দলিত-আদিবাসী অধিকার আন্দোলনের সাথী, প্রত্যেকেই সামাজিক ন্যায়ের পক্ষে সোচ্চার।

ঠিক কি ঘটেছিল ভীমা-করেগাঁওতে যার ফলে রাষ্ট্রশক্তি তার সমস্ত শক্তি নিয়োগ করে দেশের তাবড় তাবড় চিন্তাশীল ব্যক্তি, যারা শোষিত-নিপীড়িত মানুষের সংগ্রামের সাথে যুক্ত, তাদের কারাগারের অন্ধকার কুঠরিতে আবদ্ধ করে রাখা হচ্ছে? উত্তর পেতে দৃষ্টি ফেরাতে হবে ইতিহাসের পাতায় :

আজ থেকে দু’শ বছর আগে, মারাঠা যুক্তরাষ্ট্র বা কনফেডেরেসির একছত্র অধিপতি তখন পেশোয়া বাজিরাও ২। ‘পেশোয়া’ শব্দের অর্থব্রাহ্মণ, এবং কে না জানে জাতব্যবস্থায় ব্রাহ্মণরা প্রবল পরাক্রমশালী। এই ‘পেশোয়াই’ বা ব্রাহ্মণত্বের বলে বলীয়ান হয়েই বাজিরাও ২ যথেচ্ছাচারী, অত্যাচারী, স্বৈরতান্ত্রিক রাজা হয়ে উঠেছিলেন। জাতব্যবস্থায় যারা নিম্ন বর্ণের, বিশেষ করে অস্পৃশ্য মাহার সম্প্রদায়ের, তাদের আচারআচরণের ওপর তিনি আরোপ করেছিলেন অমানবিক বিধিনিষেধ। স্বাভাবিকভাবে, নিম্ন বর্ণের মানুষজন, যাদের আমরা আজ ‘দলিত’ বলি, তারা পেশোয়ার ওপর ক্ষিপ্ত ছিলেন এবং চাইছিলেন পেশোয়াই-এর অবসান।

১৮১৭ সালের শেষ লগ্নে বাজিরাও ২৮,০০০ সৈন্য নিয়ে ডেকান উপত্যকার পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত পুণেতে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির ঘাঁটি আক্রমণ করেন। কম্পানির বাহিনীতে কিছু অফিসার ছিলেন কিন্ত লড়াইয়ের উপযুক্ত সৈনিক ছিল না। ক্যাপ্টেন ফ্রান্সিস স্টৌন্টন তড়িঘড়ি শক্তসমর্থমাহার কৃষকদের জড়ো করে ৮০০ সেনার এক বাহিনী তৈরি করেন। ১৮১৮-র প্রথম দিনে পেশোয়া বাহিনী পুনে থেকে ৪০ মাইল দূরে ভীমা নদীর ধারে কোরেগাঁওতে কম্পানির মাহার বাহিনীর সম্মুখীন হয়। ৮০০ সেনা ২৮,০০০ সেনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ১২ ঘণ্টা ভয়ানক যুদ্ধের পর পেশোয়া বাহিনী পিছু হটে। এই পরাজয়ের ফলেই অবশেষে পেশোয়া রাজত্বের অবসান ঘটে।

পরবর্তী কালে ইংরেজ সাহেবরা ভীমা-কোরেগাঁওতে নিহত ব্রিটিশ অফিসার ও মাহার সেনার নামাঙ্কিত একটি বিজয় স্তম্ভ তৈরি করে। ১ জানুয়ারী, ১৯২৭ আম্বেদকার ভীমা-কোরেগাঁওতে আসেন এবং বিজয় স্তম্ভটিকে দলিত শৌর্যের প্রতীক হিসাবে চিহ্নিত করেন। প্রতি বছর তাই ১ জানুয়ারী দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কাতারে কাতারে দলিত মানুষ ভীমা-কোরেগাঁওতে জড়ো হয়ে দলিত উত্থানের বিজয় উৎসব পালন করেন।

১ জানুয়ারী, ২০১৮ ছিল ভীমা- কোরেগাঁওর ২০০ বছর পুর্তিপালন দিবস। আগের দিন, অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৭ পুণের শনিওয়ারওয়াদা দূর্গে এলগার পরিষদের সভার আয়োজন করা হয়। সভাটি আহ্বান করেছিলেন অবসরপ্রাপ্ত দুই বিচারপতি পি বি সাওয়ান্ত ও বি জি কোলসে-পাটিল এবং আম্বেদকারের পৌত্র প্রকাশ আম্বেদকার। ৩৫,০০০ মানুষ এই সভায় উপস্থিত হয়েছিলেন। বক্তাদের মধ্যে ছিলেন গুজরাতের বিধায়ক জিগ্নেশ মেভানি, রোহিত ভেমুলার মা রাধিকা ভেমুলা, আদিবাসী আন্দোলনের সোনি সোরি, ভীম আর্মির বিনয় প্রতাপ সিং এবং জেএনইউ-এর ছাত্র নেতা উমার খালিদ। জাত-ব্যবস্থা নিয়ে বেশ কয়েকটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও হয় এই সভায়। কবিগান গেয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয় সন্ত তুকারাম, মহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলে, শিবাজি ও সাহু মহারাজকে। পরিবেশিত হয় প্রতিবাদী নৃত্যনাট্য এবং হিপ-হপ গান। জাতপ্রথা গুঁড়িয়ে দেবার প্রতীকী অর্থে রাধিকা ভেমুলা গাদা করা মাটির কলস ভাঙেন।

১ জানুয়ারী লক্ষ লক্ষ মানুষ জড়ো হতে থাকেন ভীমা-কোরেগাঁওতে। কিন্তু কোন এক অজানা কারণে বন্ধ হয়ে যায় জল সরবরাহ। যে বাসগুলিতে দূর থেকে আগত যাত্রীরা আসছিলেন তাদের ওপর হতে থাকে পাথর-বর্ষণ। একটি হোটেলে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। লেগে যায় মারামারি, সংঘাতে মৃত্যু হয় ২৮ বছরের যুবক রাহুল পতঙ্গলির। প্রতিবাদে ৩ জানুয়ারী মহারাষ্ট্র জুড়ে স্ট্রাইক ডাকেন প্রকাশ আম্বেদকার। স্ট্রাইক হয় সর্বাত্মক, হিংসার ঘটনাও ঘটে, মৃত্যু হয় একজনের, আহত হন ৩০০ জন।

ভীমা-কোরেগাঁওতে হিংসার ঘটনার পিছনে ছিলেন সম্ভাজি ভিদে এবং মিলিন্দ একবোটে, এই মর্মে এফআইআর দায়ের করেন প্রকাশ আম্বেদকার। প্রাথমিক তদন্তে এর যাথার্থতা প্রমানিত হয়। তৎকালীন মহারাষ্টের বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিস দোষীদের গ্রেপ্তার করার প্রতিশ্রুতিও দেন। কিন্তু সম্ভাজি ভিদের বিরুদ্ধে আজ পর্যন্ত কোনও তদন্ত হয়নি, কোনও ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। মিলিন্দ একবোটে গ্রেপ্তার হন ১৪ মার্চ, সুপ্রীম কোর্ট অন্তরবর্তী জামিনের আবেদন নাকচ করে দিলেও ১৯ এপ্রিল পুণের জেলা ও দায়রা আদালত তাকে বেকসুর খালাস করে দেন।

এখানে বলা প্রয়োজন, সম্ভাজি ভিদে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির গুরু, একসময় ছিলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস)-এর সদস্য, পরে ‘শিব প্রতিষ্ঠান হিন্দুস্তান’-এর প্রতিষ্ঠাতা। আর মিলিন্দ একবোটে ‘সমস্ত হিন্দু আঘারি’-র সভাপতি। অনুমান করা যায়, কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা ভীমা-কোরেগাঁওয়ের হিংসাত্মক ঘটনা ঘটানোর ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিলেন। পেশোয়াই-এর পরাজয়ের গ্লানি তারা আজও মুছে ফেলতে পারেননি, দলিত সচেতনতার উন্মেষ মেনে নিতে তারা অপারগ।

*** *** ***

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কাছে মুচলেখা দেওয়া ‘বীর’, ভি ডি সাভারকার এসেন্সিয়ালস্ অফ হিন্দুত্ব (১৯২৩) গ্রন্থে লিখেছিলেন, “ব্রাহ্মণ শাসনব্যবস্থা হিন্দুনেশনের মডেল। ১৮১৮ সালে এখানে সর্বশেষ এবং সবচেয়ে গৌরবময় হিন্দু সাম্রাজ্যের কবর দেওয়া হয়।”

এখানে সাভারকার পেশোয়া রাজত্বের কথাই বলেছেন, ১৮১৮ সালে ভীমা-কোরেগাঁওতে যার মরণ হয়েছিল। তার ‘সবচেয়ে গৌরবময় হিন্দু সাম্রাজ্যে’ অবশ্য অস্পৃশ্যদের গলায় হাঁড়ি ঝুলিয়ে রাখতে হত থুতু ফেলার জন্য, কোমরের পিছনে ঝাড়ু বেঁধে রাখতে হত পদচিহ্ন মুছে ফেলতে। পুনরায় সেই ঘৃণ্য রাষ্ট্র গঠনেরই স্বপ্নে বিভোর আজকের হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা।

হিন্দু জাতি-রাষ্ট্রের ধারণাটা দাঁড়িয়ে আছে মনু-নির্মিত চতুর্বর্ণ সমাজ কাঠামোর ভিতের উপর। আরএসএস-এর দ্বিতীয় সরসংঘচালক ‘গুরুজি’ মাধব সদাশিব গোলওয়ালকার তাই মনুকে ‘ভগবান’ আখ্যায় ভূষিত করেছেন। উই, আওয়ার নেশনহুড ডিফাইন্ড গ্রন্থে (১৯৩৯) তিনি লিখেছেন, “মনু, মানব ইতিহাসে প্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ আইন-প্রণয়েতা, যার নির্মিত সামাজিক নিয়মবিধি পৃথিবীর সমস্ত মানুষের কাছে শিক্ষণীয়।” গোলওয়ালকার রচিত আরেকটি গ্রন্থ বাঞ্চ অফ থটস্-এ (১৯৬৬) এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত লিখেছেন। এমনকি, মারাঠি দৈনিক নভ কাল-কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে (১৯৬৯) উনি বলেছিলেন, “বর্ণ প্রথা ঈশ্বরের সৃষ্টি এবং যতই প্রচেষ্টা চলুক না কেন সেটা ধ্বংস করা যাবে না।”

আজকে সাভারকার-গোলওয়ালকারের উত্তরসূরিরা ক্ষমতার মসনদে আসীন। ব্রাহ্মণবাদী আধিপত্যবাদের সাথে ইদানীং হাত মিলিয়েছে কর্পোরেট লুঠতরাজী আধিপত্যবাদ – এটাই নয়া-হিন্দুত্ব, ব্রাহ্মণবাদের নয়া অবতার। সাম্য-মুক্তি-মৈত্রী-ন্যায়র মন্ত্রে দিক্ষিত সংবিধানকে চিতায় উঠিয়ে আজকের ক্ষমতাশালীরা মনুসংহিতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে উদ্যত। ভীমা-কোরেগাঁওর স্মৃতিকে মুছে ফেলে এরা মনুস্মৃতিকে ফিরিয়ে আনতে চায়।
যেভাবেই হোক এদের রুখতেই হবে। করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে।

- সুমিত  

ageesde

স্বামী অগ্নিবেশের মৃত্যুতে আমরা শোকাহত। তিনি ছিলেন সামাজিক দসপ্রথা ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে আজীবন এক নিরলস যোদ্ধা এবং জনগণের সমস্ত ধরনের সংগ্রামের এক পরম সুহৃদ।

স্বভাবত সুধীর ব্যক্তিত্বের অধিকারী অগ্নিবেশ ঘৃণার রাজনীতির বিরুদ্ধে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে গেছেন। এজন্য তাঁকে, বেশি দিনের কথা নয়, ভারতের শাসকদল বিজেপির কর্মীবাহিনীর দলবদ্ধ হামলার মুখেও পড়তে হয়েছে। এক বিজেপি মন্ত্রী উন্মত্ত জনতার সেদিনের সেই প্রাণঘাতী হামলার চেষ্টাকে সমর্থন জানিয়ে ওকালতিও করেছিলেন। শুধুমাত্র সাম্প্রদায়িকতার বিবেকনিষ্ঠ বিরোধিতার জন্যই নয়, গৈরিক বেশে অগ্নিবেশ নির্যাতিত মানুষের অধিকারের কথা, সমতার কথা বলতেন আর এভাবেই বিজেপির, গৈরিক বেশকে ভয়ঙ্কর ধর্মান্ধতার সঙ্গে সমার্থক করে তোলাকে প্রত্যাখ্যান করায়, বিজেপির এত রাগ তাঁর উপর। তাঁর সাহস, ধৈর্য ও সংগ্রামী মানসিকতা ভারতকে সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অনুপ্রেরণা যুগিয়ে যাবে।

আমরা স্বামী অগ্নিবেশকে শ্রদ্ধা জানাই তাঁরই প্রিয় শ্লোগানে,

“কামানেওয়ালা খায়গা
লুটনেওয়ালা যায়গা
নয়া জমানা আয়েগা”

(শ্রমজীবীরাই ভাত পাবে, লুঠেরারা বিদায় হবে, নতুন ভোর জাগবে)

dera

কোন্নগর নিবাসী কমরেড কেতকী ব্যানার্জী গত ১৩ সেপ্টেম্বর এসএসকেএম হাসপাতালে প্রয়াত হয়েছেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর। হাসপাতালে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন কদিন আগে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে আক্রান্ত হয়ে। তাঁর মরদেহ সেরাতেই কোন্নগরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পার্টির রাজ্য সম্পাদক পার্থ ঘোষ, হুগলি জেলা সম্পাদক প্রবীর হালদার সহ পার্টি কমরেডদের অন্তিম শ্রদ্ধা নিবেদনের পর তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। শোকপ্রকাশ করেন পার্টি নেতা কার্তিক পাল, মীনা পাল, চৈতালি সেন প্রমুখ অনেক কমরেড। কমরেড কেতকী ব্যানার্জী পার্টিতে বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন ‘ব্যানার্জী বৌদি’ হিসেবে।

কার্তিক পাল স্মৃতিচারণ প্রসঙ্গে বলেন, হিন্দমোটর কারখানার শ্রমিক কমরেড নবকুমার ব্যানার্জী ও কেতকী ব্যানার্জীর পরিবার পার্টির সাথে এক পরিবার হয়ে গেছিলেন। নবকুমার আগে চলে গেছেন, এবার হারাতে হল কেতকী ব্যানার্জীকে। কেতকী আগে মহিলা সমিতির সক্রিয় কমরেড ছিলেন। তাঁর মৃত্যু পার্টির কাছে আঘাত জনক ও বেদনাদায়ক। তিনি দীর্ঘ লকডাউন পর্যায়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসা প্রক্রিয়ায় সুস্থতার পথে যেতে যেতে হঠাৎই সেরিব্রাল হওয়ায় তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। তিনি বিগত নব্বই দশকের গোড়ায় দিল্লীর মিছিলে গিয়েছিলেন, কলকাতার বিভিন্ন মিছিলে হেঁটেছিলেন। খুব কষ্টের দিনগুলোতেও তাঁরা পার্টির থেকে নিজেদের আলাদা করেন নি, দীর্ঘ ৩৫ বছর পার্টির সাথে যুক্ত থেকেছেন। মীনা পাল বলেন, ছেলে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। কমরেড ব্যানার্জীদা আমাদের সবাইকে ছেড়ে চিরবিদায় নিলেন। কিন্তু কমরেড কেতকী বৌদি শোকে দুঃখে জর্জরিত মানুষটি পার্টিকেই আঁকড়ে ধরে এতদিন বেঁচে ছিলেন। পার্টির সাথেই রয়ে গেলেন এতগুলো বছর। কমরেড চৈতালি সেন বলেন, একসাথে কাজ করার বহু স্মৃতি মনের মধ্যে ভীড় করছে। এক সময়ে মহিলা সমিতির সক্রিয় কর্মী কমরেড কেতকী ব্যানার্জী পার্টির প্রতি জীবনের শেষ পর্যন্ত ভীষণ অনুগত ছিলেন।

কমরেড কেতকী ব্যানার্জী লাল সেলাম।

arew

নদীয়া জেলার গাছা গ্রামের পার্টির ঘনিষ্ঠ দরদী মাসীমা কোহিনুর বেওয়া আজ ১৬ সেপ্টেম্বর সকাল ১২টায় বার্ধক্যজনিত কারনে প্রয়াত হলেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৮। তিনি গাছা-শালিগ্রাম এলাকার পার্টি কর্মী আসারুদ্দিন (পচা) সেখের মা। নদীয়া জেলার ন'পাড়া শালিগ্রামের সংগ্রামী এলাকায় গোপন পার্টির সময়কাল থেকে দিনের পর দিন ধারাবাহিকভাবে, নিশ্চিত আশ্রয় দিয়ে,খাদ্য দিয়ে, পার্টিকে রক্ষা করার কাজে যে মহিলারা নীরবে অবদান রেখে গেছেন কোহিনুর বেওয়া তাঁদের অন্যতম। এলাকায় পুলিশী দমনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামে তিনি অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন, এ জন্য অন্যান্য মহিলাদের সাথে হেফাজতেও তাকে থাকতে হয়েছিলো। নদীয়া জেলায় পার্টি ও কৃষক সংগ্রাম এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে এদের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। কমরেড কোহিনুর বেওয়া অমর রহে। তাঁকে জানাই লাল সেলাম।

per

গত ১০ সেপ্টেম্বর হঠাৎ করেই হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে চলে গেলেন ধনেখালিতে সিপিআই(এমএল) লিবারেশানের দরদী হয়ে ওঠা কমরেড সুনীলাক্ষ বসু। চিকিৎসার কারণে তিনি এইসময় একমাত্র কন্যার যাদবপুরের বাড়িতে ছিলেন। গত শতকের সাতের দশক থেকে শুরু করে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বের ঠিক পূর্ব পর্যন্ত ধনেখালি সিপিএমের অন্যতম প্রধান নেতৃত্বে ছিলেন কমরেড। এই শতকের শুরুতেই সিপিএমের ধনেখালি জোনাল কমিটি আড়াআড়ি ভেঙ্গে যায়। সুনীলাক্ষর নেতৃত্বে ধনেখালি জোনাল কমিটির বেশিরভাগ সদস্য পার্টি থেকে বেরিয়ে আসেন। জোনাল নেতৃত্বের এই দলত্যাগী অংশের বেশিরভাগ নেতা নিস্ক্রীয় হয়ে যান। ব্যতিক্রম থাকেন কমরেড বসু। তিনি আমাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। দেশব্রতী, লিবারেশন পড়তেন। কমরেড পার্থ ঘোষের সাথে একটি বৈঠকেও মিলিত হন। কমরেড কার্তিক পালের সাথেও পরিচিত ছিলেন। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম ঘটনা প্রবাহের সময় তাঁর ঐকান্তিক সহযোগিতায় মূলত বেলমুড়ি, দাদপুর ও মাকালপুর গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে সিপিএম প্রভাবিত জনগণের এক ভালো অংশ সিপিআই(এমএল) লিবারেশানে যোগদান করেন। এভাবে সিপিআই(এমএল) বিশেষত বেলমুড়ি অঞ্চলে অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। তারপর রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর শাসক দলের লাগাতার তীব্র দমন পীড়নের মুখে ঐ জনতা ধীরে ধীরে পার্টির সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে। সক্রিয়তা নিয়ে থেকে যান কমরেড মহাদেব মুর্মু, ফকির সরেনদের মতো সাথীরা।

কমরেড বসু সিপিআই(এমএল)-এর সদস্যপদ গ্রহণ না করলেও পার্টির খোঁজ নিয়মিত রাখতেন। দিন সাতেক আগে ফোনে জানান কয়েকদিনের মধ্যেই ধনেখালি ফিরতে চান। পার্টির সহায়তা চান।

সেই তিনি ফিরলেন – তবে শেষ যাত্রায়।

আজ তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে তাঁর বেলমুড়ির বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশানের মহাদেব মুর্মু, সজল দে, জয়দেব বাগ, সজল অধিকারী প্রমুখ।

লাল সেলাম কমরেড সুনীলাক্ষ বসু।

খণ্ড-27
সংখ্যা-33