(একটি লেখা এককভাবে খুলতে হেডিং-এ ক্লিক করুন)
আমপান ত্রাণের বরাদ্দ টাকা নয়ছয় করার অভিযোগে শাসকদল তৃণমূলকে দাঁড়াতে হচ্ছে গণবিক্ষোভের কাঠগড়ায়। অভিযোগ এমনই ব্যাপক মাত্রায় যে মুখ্যমন্ত্রীকে অবিলম্বে নির্দেশ দিতে হয়েছে ফেরত দিতে হবে দুর্নীতির টাকা, আর অভিযুক্ত দোষীদের বিরুদ্ধে নেওয়া হবে কড়া ব্যবস্থা। দক্ষিণবঙ্গের যে জেলাগুলি আমপান তাণ্ডবে বিধ্বস্ত হয়েছে সেখানে ক্ষতিপূরণের তালিকায় ধরা হয়েছে ৬৯টি ব্লককে। আর সেখানে প্রদত্ত অর্থ নিয়ে চলেছে যথেচ্ছ দুর্নীতি। সরকারী সূত্র জানিয়েছে অভিযোগ জমা পড়েছে হাজার চল্লিশ, যার নব্বই শতাংশই সঠিক বলে স্বীকারও করেছে। প্রশ্ন হল, এত ব্যাপক মাত্রায় দুর্নীতি হতে পারল কিভাবে? সরকারের আগাম নজরে তা ধরা পড়ল না কেন? এই অন্যায় পঞ্চায়েত স্তরে সংঘটিত হলেও ব্লক স্তরের দলনেতৃত্ব ও ব্লক প্রশাসন অন্ধকারে ছিল একথা কি বিশ্বাসযোগ্য! শাসকদলের শুধু ব্লক স্তরের মাথারা কেন, জেলা ও রাজ্য স্তরের নেতাদের অজ্ঞাতসারে এসব অনাচার চলেছে তা কি বলার মুখ আছে? সত্যিকারের তথ্য তালাশ করলে সমস্ত প্রকৃত অন্তর্নিহিত সত্য প্রকাশ হতে পারে। দুর্নীতি ধরা পড়ে যাওয়ার পর অভিযুক্তরা বলছেন ‘ভুল হয়ে গেছে’, তার বেশি মুখ খুলছেন না। তবু নিশ্চিতভাবেই ধরে নেওয়া যায় যা কিছু চিহ্নিত হচ্ছে তা কেবল দৃশ্যমান খন্ডচিত্র মাত্র। এই দুর্নীতি সংঘটিত করার জন্য যদি দায়ী থাকে ব্লক অফিস-পঞ্চায়েত প্রতিনিধি ও শাসক দাদাদের সুপরিকল্পিত নেপথ্য যোগসাজশ, তাহলে বুঝে নিতে হবে এতে মদত বা প্রশ্রয় রয়েছে দলের ওপরতলার। দুর্নীতি চলেছে দলতন্ত্রের, গোষ্ঠীর কায়েমী স্বার্থের এবং নানা খাস স্বার্থসর্বস্ব স্বজনপোষণ চালাতে। দুর্নীতি করার শর্তটি তৈরি করে দেওয়া হয়েছে সমস্ত ত্রাণ ও ক্ষতিপূরণ প্রদানের প্রক্রিয়ায় তৃণমূল বহির্ভূত কোনোরকম ভিন্নমতের তদারকি-গণতদারকি করতে না দেওয়ার অঘোষিত ফতোয়া জারি করে। সবকিছুতে শাসকের একচেটিয়া দলতন্ত্র কায়েম করে। কিন্তু নির্দয় নিষ্ঠুর বৈষম্য-বঞ্চনা-অপ্রাপ্তির বিরুদ্ধে মানুষের ধাওয়া করা ঘেরাও, অবরোধ দুর্নীতির পর্দা ফাঁস করে দিয়েছে। এযাত্রা তৃণমূলের সাধ পূরণ হল না। দলনেত্রী এই বোধহয় প্রথমবার প্রথম ধাক্কাতেই দুর্নীতির সত্যতা স্বীকার করে নিলেন। না, কোনও শুভবুদ্ধির উদয় থেকে নয়, উপায় না দেখে। কারণ, তাড়া করছে পরের বিধানসভা নির্বাচনের দুর্ভাবনা।
মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, কোভিড ও আমপান তহবিল ব্যয়বরাদ্দের অডিট হবে। প্রশ্ন হল, এই শুখা আশ্বাসকে বিশ্বাস কী? ভাবের ঘরে চুরি করে পরিচ্ছন্ন হিসাব পরীক্ষা করা যায় না, তার স্বচ্ছতা ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা দাবি করা যায় না। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, দুর্নীতিগ্রস্তদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে? হয়ত কিছুকে সাময়িক বরখাস্ত, কিছুকে দল থেকে দাঁড়ানো, তবুও সে তো কেবল দলের আভ্যন্তরীণ ফয়সালার বিষয়। সরকারী অর্থ নিয়ে প্রতারণা ও দুর্নীতির তথ্য তো ফৌজদারী অপরাধ। তার বিরুদ্ধে কি তৃণমূল সরকার আদালতে যাওয়ার পদক্ষেপ শুরু করেছে? আদৌ কি এফআইআর করা হচ্ছে? এখনও সেরকম সরকারী ঘোষণা নেই। সুতরাং আমপান ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত দুর্নীতির স্বরূপ উন্মোচন সম্পর্কে এখনও অনেক প্রশ্ন তোলার আছে, কড়া ব্যবস্থা বুঝে নেওয়া বাকি থাকছে। মুখ্যমন্ত্রী প্রসঙ্গত বলেছেন বটে, আত্মসাৎ করা অর্থ উদ্ধার করা হবে, বরাদ্দ বিলিবণ্টনের পুনর্মূল্যায়ন করে বঞ্চিতদের প্রাপ্য ক্ষতিপূরণের অর্থ মিটিয়ে দেওয়া হবে। তার জন্য নাকি প্রশাসনিক কমিটিকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। কিন্তু বিগত অসংখ্য তিক্ত অভিজ্ঞতা শিক্ষা দিয়েছে, কার্যোদ্ধার করতে হলে লেগে থাকতে হবে গণতদারকি ও গণবিক্ষোভের চাপ সংগঠিত করতে।
কেন্দ্রীয় সরকার একটা “ঐতিহাসিক পদক্ষেপ” নিয়েছে, যদিও একমাত্র ভবিষ্যতই বলতে পারবে যে এই পদক্ষেপ ঐতিহাসিক ছিল কিনা। কেন্দ্রীয় সরকারের দাবি, তাদের জারি করা তিনটে অধ্যাদেশের মধ্যে দিয়ে তারা যে সংস্কারের সূচনা ঘটিয়েছে তার ফলে কৃষিকাজে নিযুক্ত মানুষজনের অবস্থায় বিপ্লবী পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রথম অধ্যাদেশটা হল ‘অত্যাবশ্যকীয় পণ্য (সংশোধনী) অধ্যাদেশ ২০২০’। এর ঘোষিত লক্ষ্য হল কৃষি ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া; কৃষকদের আয়ের বৃদ্ধি ঘটানো; নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার উদারিকরণ ঘটানোর সাথে ক্রেতাদের স্বার্থের প্রতিও নজর দেওয়া। দ্বিতীয় অধ্যাদেশটা হল ‘কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের ব্যবসাবাণিজ্যকে (উন্নত ও সুবিধাজনক করা) অধ্যাদেশ ২০২০’। এর ঘোষিত উদ্দেশ্য হল, নিজেদের পণ্য বিক্রয়ে ক্রেতা বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে কৃষকদের স্বাধীনতা জোগানো, যা কৃষি বাণিজ্যে প্রতিযোগিতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে কৃষকদের ফসলের লাভজনক দাম এনে দেবে। তৃতীয় অধ্যাদেশটার নাম দেওয়া হয়েছে ‘দাম পাওয়া বিষয়ে সুনিশ্চয়তা ও ফার্ম পরিষেবা সম্পর্কে কৃষকদের (ক্ষমতায়ন ও সুরক্ষা) অধ্যাদেশ ২০২০’। এই অধ্যাদেশটির ঘোষিত লক্ষ্য হল জাতীয় স্তরের একটা ব্যবস্থাপনা যুগিয়ে কৃষকদের ক্ষমতাশালী করা যাতে তারা কর্পোরেট সংস্থা, প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে নিযুক্ত উৎপাদক, পাইকারি ব্যবসায়ী, রপ্তানিকারক ও কৃষি-পরিষেবা প্রদানকারীদের সাপেক্ষে নিজেদের স্বার্থকে সুরক্ষিত করতে পারে।
ঘটনা হল, প্রথম অধ্যাদেশটা ১৯৫৫ সালের অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনকে খারিজ করছে এবং তা মজুতদারির প্রকোপ বৃদ্ধি করবে এবং কৃষিপণ্য কিনতে গিয়ে ক্রেতাদের বেশি দাম দিতে হবে। এটা যদিও দাবি করা হচ্ছে যে, অন্য অধ্যাদেশগুলো উৎপাদিত পণ্য যেখানে খুশি যাকে খুশি বিক্রি করতে কৃষকদের স্বাধীনতা দেবে, বাস্তবে কিন্তু কৃষিপণ্যের ব্যবসায়ে নিযুক্ত কোম্পানিগুলোর ওপরই তাদের নির্ভর করতে হবে। কৃষিপণ্য বাজার কমিটি (এপিএমসি) বিলোপের অর্থ হবে বিধিসম্মত বাজার ব্যবস্থা এবং মাণ্ডি বোর্ডের আয় বিলুপ্ত করা। এই ক্ষতি গুরুতর প্রভাব ফেলবে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের ওপর, এবং শহরাঞ্চলে অবস্থিত মাণ্ডিগুলোর সঙ্গে গ্ৰামসমূহের সংযোগকারী রাস্তার নেটওয়ার্ক গড়ে তোলাটাও ক্ষতিগ্ৰস্ত হবে। এইভাবে গ্ৰামোন্নয়নের গোটা ব্যবস্থাটাই চরম ক্ষতির মুখে পড়বে। এই অধ্যাদেশগুলোর মধ্যে দিয়ে দেশের কৃষি বা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ধ্বংসসাধন তো হবেই, সেই সাথে রাজ্যের কয়েকটি সাংবিধানিক অধিকারেরও ক্ষয় ঘটাবে।
দেশের জনগণের একটা বড় অংশকে কৃষি কাজ থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে শহর ভিত্তিক কাজে যুক্ত করাতে পারলে তবেই দেশের উন্নতি সম্ভব — দীর্ঘদিন ধরে চর্চায় নিয়ে আসা এই ভুল ধারনাকে ধরেই এই অধ্যাদেশগুলোকে সমর্থন করার চেষ্টা হচ্ছে। তবে এর পিছনে থাকা গোপন এজেন্ডাটা হল কৃষিক্ষেত্র এবং কৃষিপণ্যের প্রক্রিয়াকরণ, আগাম বাণিজ্য এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের মতো কৃষির আনুষঙ্গিক উদ্যোগগুলোর ওপর কর্পোরেট ক্ষেত্রকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে দেওয়া যাতে তাদের স্বার্থ সম্পূর্ণ চরিতার্থ হয়।
অধ্যাদেশগুলো কৃষি বিপণনের সঙ্গে যুক্ত কৃষি পণ্যের খরচ ও মূল্য নির্ধারণ কমিশন (সিএসিপি), ফুড কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া এবং রাজ্য মাণ্ডি বোর্ডসমূহের মতো কালোত্তীর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মৃত্যু ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে তৈরি করা হয়েছিল কেন সে কথা প্রথমে স্মরণে আনা দরকার। সবুজ বিপ্লবের মডেলে কৃষি পণ্যের উৎপাদন বেড়ে যাওয়ার পরিণামে সেগুলোর বিপণন ও সংরক্ষণের মতো বিষয়গুলোর মোকাবিলায় প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপ নেওয়ার আগে কৃষক ও ক্রেতাদের মাণ্ডিগুলোতে শোষণ করা হত। এই অবাধ শোষণ ব্যবস্থা থেকে কৃষক এবং ক্রেতাদের রক্ষার্থেই সিএসিপি, এফসিআই এবং রাজ্যে-রাজ্যে এই মাণ্ডিগুলোর মতো প্রতিষ্ঠানসমূহ তৈরি হয়েছিল। এপিএমসি আইন বলবৎ হওয়ায় কৃষি পণ্যগুলোর ক্রয় বিধিসম্মত মাণ্ডিগুলো থেকেই হতে লাগল। পাঞ্জাব ও হরিয়ানায় সরকারী সংস্থাগুলো ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে গম ও চাল সংগ্ৰহ করতে লাগল। এই কারণেই অন্যান্য রাজ্যের কৃষকদের তুলনায় এই দুই রাজ্যের কৃষকদের আয় বেশি। অপরদিকে বিহার ইতিমধ্যেই মাণ্ডি ব্যবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণকে তুলে দিয়ে একটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে যাতে বেসরকারী ব্যবসাদাররা দরকষাকষি করে ইচ্ছেমতো দামে ক্রয় করতে পারে। কৃষকদের কাছে এর পরিণাম ভয়ংকর রূপের বিপর্যয়করই হয়েছে। স্বতন্ত্র কৃষকদের সাপেক্ষে ব্যবসায়ীরা সর্বদাই অনেক বেশি দর কষাকষির ক্ষমতা প্রয়োগ করে কম দামে জিনিস বেচতে কৃষকদের বাধ্য করেছে।
ঘটনা হল, বহুজাতিক সংস্থাগুলো ভারতীয় কৃষির ওপর ওদের কব্জাকে শক্তিশালী করে তুলতে চায়। এই কারণেই গোটা ১৯৯০-এর দশক জুড়ে বিশ্বায়ন ও বেসরকারীকরণের নীতিমালার মধ্যে দিয়ে অবাধ বাণিজ্যকে আগ্ৰাসীভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হয়। আর তখন থেকেই বিভিন্ন মহল কৃষিক্ষেত্রে ভর্তুকিকে নিয়ন্ত্রিত করার কথা বলে আসছে। ২০১৩ সালে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে শান্তি ধারা অনুসারে কৃষিক্ষেত্রে কেবলমাত্র ২০১৭ সাল পর্যন্ত বাজারের সাপেক্ষে সহায়তা দেওয়াটাকে অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপর থেকে ভারত সরকার বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার চাপানো নিয়ন্ত্রণকে মেনে চলার চেষ্টা করছে। আর তাই বাজারের সাপেক্ষে সহায়তাকে এড়াতে সরকার পিএম-কিসান, পিএম-আশা, ভাবান্তরভোগতান যোজনা, কালিয়া ইত্যাদির মতো অনেক বিকল্প পদক্ষেপ নিয়েছে।
এরসাথে সঙ্গতি রেখে বিভিন্ন কমিশন ও কমিটির সুপারিশ মেনে শস্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের বৃদ্ধি ঘটানো হচ্ছে না। শান্তা কুমার কমিটি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে ভারতে মাত্র ৬ শতাংশ কৃষক ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের সুবিধা পায়। ওই কমিটি এফসিআই-কে তুলে দেওয়ার সুপারিশও করে। কৃষকদের সম্পর্কে জাতীয় কমিশনের রিপোর্টেও, যাকে স্বামিনাথন কমিশনের রিপোর্ট বলেই সবাই জানে, সুপারিশ করা হয়েছে যে, কৃষকদের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য দেওয়ার ভিত্তি হবে উৎপাদনের সম্পূর্ণ খরচ (সি২) এবং এর ওপর আরও ৫০ শতাংশ। পরবর্তীতে রমেশ চাঁদ কমিটির সুপারিশেও ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে অন্যান্য খরচকে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়, যথা কৃষক পরিবারের প্রধানকে দক্ষ শ্রমিক ধরে তার মজুরি; পুঁজির ওপর বর্তমানে কেবল আধা মরশুমের সুদ দেওয়ার যে চল আছে তার পরিবর্তে পুরো মরশুমের জন্য সুদ; জমির প্রকৃত খাজনা, খামার থেকে মাণ্ডি পর্যন্ত পরিবহণ ব্যয় সহ মাণ্ডির খরচ সমূহ এবং তার সাথে ব্যবস্থাপনার খরচ। কিন্তু কেন্দ্রের একের পর এক সরকার তাদের নিজেদেরই বসানো কমিশন/কমিটির সুপারিশকে অগ্ৰাহ্য করে। সি২-এর পরিবর্তে সরকার কম ব্যয়ের হিসাবকেই (এ২+এফএল) বিবেচনায় নেয় এবং তারপর থেকে তারা দেখানোর চেষ্টা করছে যে উৎপাদিত পণ্যের জন্য কৃষকদের ইতিমধ্যেই বেশি দাম দেওয়া হচ্ছে। বর্তমান ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের নির্ধারণের ক্ষেত্রেও সেই একই অভিপ্রায় সুস্পষ্ট হয়ে দেখা দিচ্ছে।
বর্তমানে চালু বিপণন ব্যবস্থাকে আরও নিপুণ না করে তার বিপরীতটাই করা হয়েছে। এই বিষয়টার উল্লেখ না করলেও চলবে যে, পাঞ্জাবের কৃষি বিপণন ব্যবস্থা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ব্যবস্থাগুলোর অন্যতম। ন্যূনতম সহায়ক মূল্যকে সুনিশ্চিত করা এবং সমস্ত শস্য সংগ্ৰহ করার মধ্যে দিয়ে একে আরও উন্নত করারই প্রয়োজন ছিল। সারা দেশে প্রায় ৭,০০০ বিধিসম্মত মাণ্ডি রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সংখ্যাটাকে বাড়িয়ে ৪২,০০০ করতে হবে। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হল, তাদের সংখ্যাকে বৃদ্ধি করা এবং নৈপুণ্যকে আরও শাণিত করার পরিবর্তে দুঃসময়ে এবং অবিবেচনাপ্রসূত পরামর্শের ভিত্তিতে বিদ্যমান মাণ্ডিগুলোকেও উঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
এই অধ্যাদেশগুলোর মধ্যে দিয়ে কৃষি সংস্কারের যে ধারণা সামনে আসছে তা কোনো নতুন ধারণা নয়। অনেক উন্নত দেশেই সংস্কারের এই পথ কৃষক সম্প্রদায়ের বিপর্যয় ঘটিয়ে তাদের মজুরি শ্রমিক হিসাবে শ্রম বাজারে ঠেলে দিয়েছে। এই অধ্যাদেশগুলো মুনাফা-তাড়িত বড় বড় কর্পোরেট সংস্থাকে আমাদের কৃষি ক্ষেত্রে ঢোকার প্রশস্ত পথ তৈরি করবে। উন্নত দেশগুলোতে কৃষিক্ষেত্রের ওপর জোরালো কব্জা কায়েম করে এই ধরনের ব্যবসায়ী সংস্থাগুলো ইতিমধ্যেই কৃষক স্বার্থের প্রভূত ক্ষতিসাধন করেছে। এই দেশগুলোতে কৃষকদের বিপুল ভর্তুকি দেওয়ার ঘটনা সত্ত্বেও কৃষকরা ঋণ জর্জরিত হয়ে পড়ে আত্মহত্যা করছেন। বহু সংখ্যক কৃষককে এমন পরিস্থিতিতে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে যে কৃষির পেশাকে ত্যাগ করা ছাড়া তাদের কাছে কোনো বিকল্প আর থাকছে না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অষ্ট্রেলিয়া এবং অন্যান্য উন্নত দেশের কৃষকদের সঙ্গে সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা আমার আছে এবং তাদের অবস্থার অধ্যয়নও আমি করেছি। এর ভিত্তিতে আমার পর্যবেক্ষণ হল, খেয়ে পরে কোন রকমে বেঁচে থাকার মতোই তাঁদের উপার্জনের স্তর; কৃষি থেকে লাভের বড় অংশটাই আত্মসাৎ করে কৃষি পণ্যের ব্যবসায়ে জড়িত কোম্পানিগুলো। চুক্তি চাষই এই কোম্পানিগুলোর কাছে বেশি লাভজনক হয়ে দেখা দেয়, কেননা, জমির খাজনা কম হওয়ার ফলে জমি কেনার চেয়ে লিজে নেওয়াই অনেক সস্তা পড়ে।
এই ধরনের কোম্পানিগুলো দীর্ঘদিন ধরেই আমাদের কৃষি ক্ষেত্রের ওপর আধিপত্য কায়েম করতে চাইছে, কেননা, এখানে খাজনা অনেক কম, মজুরির হার সস্তা এবং এ দেশে রয়েছে ক্রেতাদের এক বিশাল বাজার। দীর্ঘ মেয়াদে বৃহদাকারের চাষ থেকে অনেক বেশি মুনাফার লক্ষ্যে ওরা আপাতত মজুরি এবং জমির খাজনা কিছু বেশি দিতেও রাজি থাকবে। কৃষি ব্যবসায়ের ওপর দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে এই কোম্পানিগুলো ভারতে ক্রেতাদের বিশাল বাজারে ঢুকে পড়তে পারবে। সারা বিশ্বে ওষুধের ব্যবসার পর কৃষি পণ্যের ব্যবসাতেই মুনাফা সবচেয়ে বেশি বলে গণ্য হয়ে থাকে।
মূল ব্যাপারটা এখানে সংস্কারের নয়, প্রকৃত ইস্যুটা হল কৃষিক্ষেত্রকে বেসরকারী কোম্পানিগুলোর হাতে তুলে দেওয়ার। শুরুতে এসবের মধ্যে দিয়ে কৃষকদের এবং কৃষি শ্রমিকদের আয় বাড়ার কিছু সম্ভাবনা রয়েছে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এসবই সম্ভবত কৃষকদের নিজস্ব সামাজিক কাঠামো এবং আর্থিক নেটওয়ার্ক ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে। এখন কিন্তু ঋণ-জর্জরিত, কৃষক-বৈশিষ্ট্য-চ্যুত এবং আত্মহত্যাকারী কৃষকদের রক্ষা করাটাই প্রথম দরকার। রাশিয়ায় ও চীনে হওয়া কৃষক কেন্দ্রিক কৃষি সংস্কারের গোড়ার দিকের যে সমস্ত দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে রয়েছে সেগুলো দেখায় যে কৃষকদের গ্ৰামাঞ্চল থেকে শহরে বা বিদেশে যেতে হয়নি, এ সত্ত্বেও কৃষকদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হয় এবং গ্ৰামাঞ্চলেই তাদের সম্মানজনক ও ভালো মানের জীবন যাপনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
দেশের সম্পদ, দক্ষতা, সংস্কৃতি এবং অর্থনীতির সামঞ্জস্যপূর্ণ বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার ওপর ভিত্তি করে ‘নিজস্ব দেশীয় মডেল’-এর বিকাশ আমাদের ঘটাতে হবে।
ডঃ সুখপাল সিং
লেখক কৃষি বিপণন অর্থনীতির বিশেষজ্ঞ এবং পাঞ্জাব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও সমাজতত্ত্ব বিভাগের পূর্বতন প্রধান)
লিবারেশন, জুলাই ২০২০ সংখ্যা থেকে অনুদিত
মধ্যপ্রদেশ, ঝাড়খন্ড, ওড়িশা, ছত্তিশগড় ও মহারাষ্ট্রের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে অরণ্যভূমি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যকে ধ্বংস করে এবং হাজার হাজার আদিবাসী পরিবারকে উচ্ছেদ করে ৪১টি কোল ব্লক কর্পোরেট হাঙ্গরদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য মোদী সরকার নিলাম প্রক্রিয়া শুরু করেছে। মধ্যপ্রদেশ, ঝাড়খন্ড সহ সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলির আদিবাসী জনগণ প্রতিবাদে রুখে দাঁড়াচ্ছেন। একই সাথে মোদী সরকার সমগ্র কয়লাক্ষেত্রকেই বেসরকারীকরণের যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তার বিরুদ্ধে কয়লা শিল্পের শ্রমিকরা ২-৪ জুলাই ধর্মঘট পালন করেছেন। ধর্মঘটী শ্রমিকদের প্রতি সংহতি জানাতে এবং অরণ্য ধ্বংস ও আদিবাসী গ্রামগুলিকে উচ্ছেদ করে কোল ব্লক নিলামের প্রতিবাদে হুগলী জেলার বিভিন্ন আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় গ্রামসভা সংগঠিত করা হয়।
৩ জুলাই বলাগড় ব্লকের মহীপালপুর ও কুলেপাড়া বাজারে বিক্ষোভ কর্মসূচী পালিত হয়। সবথেকে আকর্ষণীয় কর্মসূচীটি অনুষ্ঠিত হয় ৪ জুলাই পান্ডুয়া শহরে। বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে দলে দলে আদিবাসী নারী-পুরুষ ‘সারা বাংলা আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চ’-র আহ্বানে পথে নামেন। পান্ডুয়ার কালনা মোড়ে জিটি রোড অবরোধ করে দীর্ঘ সময় বিক্ষোভ প্রদর্শন শেষে ‘দেশ বিক্রির দালাল’ নরেন্দ্র মোদীর কুশপুতুল জ্বালানো হয়। ৩০ জুন হুল দিবসের অব্যবহিত পরই কর্পোরেট লুটের প্রতিবাদে এই বিক্ষোভ কর্মসূচীগুলি আদিবাসী জনগণের পাশাপাশি ব্যাপক শ্রমজীবী মানুষকে ভাল পরিমাণে আলোড়িত করে। রাজনৈতিক মহলেও এই কর্মসূচী চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে।
রিপোর্ট: মুকুল কুমার
পুর্ব বর্ধমান জেলার কালনা-২ ব্লকের অকালপোষ গ্রাম পঞ্চায়েতের আগ্রাদহ বাস স্ট্যান্ডে গত ৫ জুলাই সিপিআই(এম-এল) লিবারেশনের নেতৃত্বে গ্রামবাসীরা রাস্তা অবরোধ করেন। এই অঞ্চলে ১০০ দিনের কাজে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সিপিআই(এম-এল) লিবারেশনের নেতৃত্বে আন্দোলন চলছিল। আন্দোলনের প্রক্রিয়ায় গ্রামবাসীর সাথে পঞ্চায়েত প্রধান ও প্রশাসনের আলোচনার মাধ্যমেই পুরনো দুর্নীতিপরায়ণ সুপারভাইজারের পরিবর্তে নতুন সুপারভাইজার নিয়োগ করে কাজ চলছিল। বর্তমানে প্রধান সাহেব মাষ্টার-রোল আটকে দিয়ে কাজের হাজিরা করাতে দিচ্ছেন না। বারবার বলার পরও মাষ্টার-রোল দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে না। তাই গ্রামের গরিব মানুষ রাস্তা অবরোধ সংগঠিত করেন। একঘণ্টা অবরোধ চলার পর প্রশাসনের হস্তক্ষেপে সমস্যার সমাধান করার প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পর অবরোধ তুলে নেওয়া হয়। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ৬ জুলাই কালনা-২ ব্লক অফিসে বিডিওর পরিচালনায় প্রধান, উপপ্রধান, আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধি সিপিআই(এমএল) নেতৃবৃন্দ ও পুলিশ-প্রশাসনের উপস্থিতিতে আলোচনার মাধ্যমে ঠিক হয় প্রধান মহাশয়কে গ্রামবাসীদের উপস্থিতিতে নতুন সুপারভাইজারদের হাতে মাষ্টার-রোল তুলে দিয়ে সুষ্ঠভাবে কাজ চলতে দিতে হবে।
গত ৩ জুলাই পূর্ব বর্ধমান জেলার পুর্বস্থলী-২ ব্লকে এআইসিসিটিইউ, আয়ারলা ও আরওয়াইএ-র পক্ষ থেকে বেলা ২টায় ডেপুটেশন সংগঠিত করা হল। দাবি ছিল, ১) পরিযায়ী শ্রমিক সহ সমস্ত গ্রামীণ গরিবদের দ্রুত কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। যাদের জবকার্ড নেই জবকার্ড দিতে হবে। পরিবার পিছু ১০ হাজার টাকার লকডাউন ভাতা দিতে হবে। ২) লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত তাঁতীদের কাজ, মজুরি ও অনুদানের ব্যবস্থা করতে হবে। ৩) আমফান ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত সমস্ত মানুষের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের তালিকা প্রকাশ করতে হবে। ৪) চরের খাস জমির জরিপ করে গরিব মানুষের মধ্যে বণ্টন ও পাট্টা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ৫) স্বনির্ভর গোষ্ঠী ও বন্ধন সহ সমস্ত ধরনের মহাজনী সংস্থার ঋণ থেকে গ্রামীণ গরিব মেহনতিদের মুক্তি দিতে হবে।
ডেপুটেশনের প্রস্তুতি হিসাবে গ্রামে গ্রামে তাঁতীদের দাবি রাজ্য সরকারের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প মন্ত্রীর উদ্দেশ্যে পাঠানোর জন্য স্বাক্ষর সংগ্রহ করা হয়। ৪টি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার ৪৫২ জন তাঁত শ্রমিকের স্বাক্ষর সহ স্মারকপত্র বিডিও মারফত মন্ত্রীর কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হল। যাদের জবকার্ড নেই, বিশেষ করে পরিযায়ী শ্রমিকদের, জবকার্ড পাওয়ার জন্য প্রধানের কাছে আবেদন জমা দিয়ে জবকার্ড পাওয়ার চেষ্টা করা হয়। ৪(ক) ফর্ম পূরণ করে কাজের আবেদন প্রধানের কাছে জমা দেওয়ার মাধ্যমে কাজ পাওয়ার চেষ্টা করা হল। প্রধানগুলো কোনো আবেদন জমা নিতেই ইচ্ছুক নয়। কিছু ক্ষেত্রে চাপে পড়ে জমা নিলেও রিসিভ দিতে রাজি হল না। ২৯ জুন মেড়তলা গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় সাইকেল মিছিল করে প্রচার করা হয়। তাতে এলাকায় চাঞ্চল্য ছড়াল। এমনকি চরের খাস জমির প্রশ্নে পুলিশী তৎপরতা শুরু হল। ডিআইবি অফিসার চরের খাস জমির পরিদর্শন করে খোঁজ খবর নিতে লাগলেন। ডেপুটেশনের দিন সকাল পর্যন্ত গ্রামে তড়িঘড়ি কিছু কাজ দিতে শুরু করল। ডেপুটেশনের আলোচনায় বিডিও জবকার্ড দেওয়ার ব্যাপারে সম্মত হলেন। প্রধানগুলোকে আবেদন জমা নেওয়ার জন্য বলবেন বললেন। কাজ দেওয়ার জন্য সব পঞ্চায়েতকে বলা হয়েছে। কাজ দিচ্ছে সব পঞ্চায়েত, কিছু পঞ্চায়েত নিজেদের অপদার্থতা ও গোষ্ঠীকোন্দলের জন্য কাজ দিতে পারছে না।
আমরা বিশেষ করে মুকশিমপাড়া গ্রাম পঞ্চায়েত নিয়ে জোরালো দাবি করেছিলাম, কেননা এখানেই পরিযায়ী শ্রমিকদের সংখ্যা বেশি আছে। বিডিও সাতদিনের মধ্যে কাজ দেওয়ার চেষ্টা করবে, ১৫ দিনের মধ্যে অবশ্যই কাজ দেওয়া হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিলেন। কৃষকদের জমি সমান করে চাষযোগ্য করা ও সারের গর্ত করা, পুকুর খনন, জঙ্গল পরিস্কার ইত্যাদি বিভিন্ন খাতে কাজ দিতে চায়। কাজের মাপজোকের ক্ষেত্রে সমস্যার কথাও আলোচনা হয়। কেননা মাপজোক নিয়েও গরিবদের ঠকানো হচ্ছে। সাধারণত দুর্নীতিপরায়ন সুপারভাইজাররা যত লোক কাজ করে তার থেকে বেশি লোকের নামে মাষ্টার-রোল তৈরি করে টাকা আত্মসাৎ করে থাকে। কাজের ৮-১০ দিন পর মাপজোক হয়। মাটির মাপ পুরোটাই একসঙ্গে করে মাষ্টার-রোল দেখে সবাইকেই ভাগ করে মজুরি দেওয়া হয়। ফলে ভুয়ো নামগুলোও কাজের অংশীদার হয়ে যায়। প্রকৃতই কাজ করেছে এমন মজুরদের মজুরি কমে যায়। তাই দাবি করা হল কাজের দিনই মাপামাপি করতে হবে এবং প্রত্যেকের গ্রুপ ভিত্তিক আলাদা মাটির হিসাব দেখাতে হবে। তাহলে সবাই নিজের কাজ অনুযায়ী মজুরি পাবেন। বিডিও মহাশয় বিষয়টি মেনে নিলেন ও দেখবেন বললেন। আমফান ঝড়ের ক্ষতিগ্রস্ত ১৩ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করেন। অভিযোগ থাকলে জানাতে বলেন। ক্ষতিগ্রস্ত কোনো মৌজা ঘোষিত হয়নি। ৩৩ শতাংশের বেশি ক্ষতিগ্রস্থ মৌজা না থাকাতে ক্ষতিগ্রস্ত মৌজা ঘোষিত হল না। ঋণমুক্তির প্রশ্নে দাবিগুলোর যুক্তিগ্রাহ্যতা স্বীকার করে ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন বলেন। ডেপুটেশনে প্রতিনিধিদের মধ্যে ছিলেন সজল পাল, বিনয় মন্ডল, শিবু সাঁতরা, কাওসার আলী সেখ ও ফারুক সেখ। বিক্ষোভ সভায় বক্তব্য রাখেন আরওয়াইএ-র রাজ্য নেতা রনজয় সেনগুপ্ত, অশোক চৌধুরী ও সজল পাল।
মন্তেশ্বরে সিপিআই(এম-এল) লিবারেশন কর্মীদের ওপর পুলিশ-টিএমসি চক্রের হামলার খবর আপনারা আগের সপ্তাহে পড়েছেন। ৪ জুলাই এখানে কুসুমগ্রাম গ্রামপঞ্চায়েতের কুলুট গ্রামে কমরেড আনসারুল আমন মন্ডলের নেতৃত্বে শতাধিক লোকের মিছিল সংগঠিত হয়। লালঝান্ডায় সুসজ্জিত মিছিল গ্রাম পরিক্রমা করে বাসস্ট্যান্ডে জমায়েত হয়। সেখানে সভা করে বক্তব্য রাখা হয়। মিছিলে পরিযায়ী শ্রমিকদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য। দাবি ছিল পরিযায়ী শ্রমিকদের জবকার্ড, কাজ ও অনুদান দিতে হবে। পেট্রোল-ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি কার স্বার্থে কেন্দ্র-রাজ্য জবাব দাও। গণতান্ত্রিক আন্দোলনে পুলিশী হস্তক্ষেপ বন্ধ কর। জীবন-জীবিকার অন্যান্য দাবি উঠে আসে।
স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির ঋণ মকুবের দাবিতে সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি (আইপোয়া) গত ২৯ মে দেশব্যাপী জাতীয় স্তরের আন্দোলন শুরু করে। ঐদিন এ রাজ্যে হুগলির পোলবা-দাদপুর ব্লকে সমাবেশের মাধ্যমে বিডিওকে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। কলকাতা ও হাওড়ায় প্রতীকী কর্মসূচী পালিত হয়। বিহার সহ অন্যান্য রাজ্যে এখনও এই দাবিতে আন্দোলন চলছে। পশ্চিমবঙ্গে সে সম্ভাবনা যথেষ্ট আছে। রন্ধনকর্মী ও আশা কর্মীদের মধ্যে মহিলা সমিতি কাজ করে এবং তাঁদের অনেকেই গোষ্ঠীভুক্ত।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় ঋণ মকুব নিছক একটি অর্থনৈতিক দাবি। আসলে এটা এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ইস্যুও বটে। বড় বড় শিল্পপতিদের পাহাড় প্রমাণ ঋণ ‘নন পারফর্মিং অ্যাসেট’ নাম দিয়ে মকুব করে দেওয়া হচ্ছে অথচ গরিবদের সামান্য ঋণ পরিশোধের জন্য নৃশংসভাবে ভয় দেখানো হচ্ছে। এই জ্বলন্ত বৈপরীত্য তুলে ধরে মানুষের কাছে সরকার ও রাষ্ট্রের শ্রেণীচরিত্র অনেকটা স্পষ্ট করা যায়। ঋণ মকুবের দাবিতে আন্দোলন গড়ে রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটানোর সুযোগ আছে। সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মকুর সমিতির (আয়ারলা) পাশাপাশি আইপোয়াও এই ইস্যুতে আন্দোলন অনেক জোরদার করতে পারে। সেই লক্ষ্যে ৮ জুলাই জেলা সদর চুঁচুড়ায়ও গণ অবস্থান সহ গণডেপুটেশন দেওয়া হয়।
হুগলি জেলার গ্রাম-গ্রামান্তরে আয়ারলা এবং ‘আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চ’ যৌথভাবে ‘ঋণমুক্তি কমিটি’ গড়ে ঋণমুক্তির আন্দোলন চালাচ্ছে, আন্দোলনের বিস্তারিত খবর দেশব্রতীর ২৫ জুন সংখ্যায় প্রাথমিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। এই সপ্তাহে তিনটি ব্লক পান্ডুয়া, ধনেখালি ও বলাগড়ে ব্যাঙ্কের উপরোক্ত জুলুমবাজির বিরুদ্ধে গণস্বাক্ষর সহ ডেপুটেশনে জোর দেওয়া হয়েছে। গ্রাম ছাড়িয়ে শহরেও ঢুকে যাচ্ছে ঋণমুক্তির আন্দোলন। শহরেও ঋণগ্রস্ত হাজারে হাজারে। প্রতিদিন মহাজনের মুখোমুখি দাঁড়ানোর অসহায়তা। আগামী ১৭ জুলাই ডিএম দপ্তরে ডেপুটেশন ও অবস্থানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ঋণমুক্তি কমিটির পক্ষ থেকে গ্রামে গ্রামে জমায়েতগুলিতে এটাও বলা হচ্ছে যে মানুষ যেহেতু ঋণ জর্জরিত তাই গ্রামগুলিতে পরিস্থিতি আরো খারাপ হচ্ছে। কারণ সরকার আমফান ক্ষতিগ্রস্ত ভাগচাষী/লিজচাষিদের (কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়েই) ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে না। ঋণমুক্তি কমিটির বক্তব্য হল, সরকার থেকে এক্ষেত্রে ভাগচাষিকেও ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ঋণগ্রস্ত পরিবারগুলোর বড় অংশই ভাগচাষি, লিজচাষি, খেতমজুর; তাদের কাছে উপরোক্ত বক্তব্য বেশ গ্রহণযোগ্য হচ্ছে এবং বিক্ষোভ জমায়েতে তার প্রতিফলন ঘটছে। ডেপুটেশনগুলোতে প্রধানত থাকছে ঋণমুক্তি, ঋণ আদায়ের নামে সরকারী/বেসরকারী ব্যাঙ্কগুলির জুলুমবাজির অবসান ও অবিলম্বে বৈষম্যমুক্ত আমফান ত্রাণ বন্টণের দাবি।
পরিযায়ী শ্রমিকদের কাজের দাবিতে এবং মোদী সরকারের জনবিরোধী আর্থিক নীতি, আট ঘণ্টার বদলে ১২ ঘণ্টা কাজ ও রেল কয়লা-সহ রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের বেসরকারীকরণের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন এবং ফেডারেশনগুলির ডাকে ৩ জুলাই হুগলি জেলার সর্বত্র প্রতিবাদ দিবস পালিত হয়। এআইসিসিটিইউ অনুমোদিত নির্মাণ শ্রমিক এবং জুট শ্রমিক সংগঠনের সংগঠক ও কর্মীরা এই প্রতিবাদ দিবসে সামিল হন, চুঁচুড়ার পরিবহন শিল্পের শ্রমিকরাও এআইসিসিটিইউ-র ঝান্ডা নিয়ে এই কর্মসূচীতে যোগ দেন। চন্দননগরে তেলিনিপাড়ার দাঙ্গা আক্রান্ত শ্রমিকেরাও প্রতিবাদ কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করেন। কোন্নগরে নির্মাণ শ্রমিকেরা হিন্দমোটর কোন্নগরের দুটি জায়গায় অংশ নেন।
হিন্দমোটর বিপিনভিলা মোড়ে কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির যৌথ পথসভায় বক্তব্য রাখেন প্রদীপ সরকার ও অপূর্ব ঘোষ। কোন্নগর চলচ্চিত্রম সিনেমা হল মোড়ে ট্রেড ইউনিয়নগুলির যৌথ সভায় এআইসিসিটিইউ-র পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন সৌরভ ও প্রদীপ সরকার। চন্দননগর এবং চুঁচুড়ায় এআইসিসিটিইউ-র পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন যথাক্রমে সংগঠনের জেলা সম্পাদক বটকৃষ্ণ দাশ ও ভিয়েত। জুট শ্রমিক নেতা সুদর্শন প্রসাদ সিং এবং নির্মাণ শ্রমিক সংগঠক সুভাষ অধিকারী এই দুই জায়গায় সভার সভাপতিমন্ডলীতে ছিলেন। সিটু, ইউটিইউসি, টিইউসিসি, এআইইউটিইউসি এই যৌথ কর্মসূচীতে সামিল হয়েছিল।
৩ জুলাই শ্রমিক সংগঠনগুলোর উদ্যোগে দেশজুড়ে কর্মসূচীর অংশ হিসেবে পারুলিয়া বাজারে যৌথভাবে অবস্থান বিক্ষোভ অবরোধ সংগঠিত করা হল। সভায় এআইসিসিটিইউ-র পক্ষে অশোক চৌধুরী ও সিটুর পক্ষে বিভিন্ন বক্তা বক্তব্য রাখেন।
পুর্বস্থলী-১ ব্লকের উত্তর শ্রীরামপুর মোড়ে শ্রমিক সংগঠনগুলোর ডাকে অবস্থান বিক্ষোভ সংগঠিত হয়। এই বিক্ষোভে আয়ারলার জেলা সম্পাদক আনসারুল আমন মন্ডল বক্তব্য রাখেন। উপস্থিত থাকেন সিপিআই(এম-এল) লিবারেশনের জেলা সম্পাদক সলিল দত্ত, জেলা কমিটির সদস্য জিয়াদুল সেখ ও ইব্রাহিম সেখ সহ অন্যান্য কর্মী সমর্থকরা। সিপিএমের শ্রমিক সংগঠন ও যুব সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন। বর্ধমান শহরে যৌথভাবে বিক্ষোভ সংগঠিত হয়। সভায় আয়ারলার পক্ষে বক্তব্য রাখেন শ্রীকান্ত রানা। মেমারী-১ ব্লকের মেমারী বাজারে মিছিল অবস্থান বিক্ষোভ সংগঠিত করা হয়। সভায় এআইসিসিটিইউ-র পক্ষে বক্তব্য রাখেন কুনাল বক্সী ও সাধন কর্মকার। কালনা-২ ব্লকে শ্রমিক সংগঠনগুলোর উদ্যোগে বিক্ষোভ সভা সংগঠিত হয়। সভায় আয়ারলার পক্ষ থেকে রফিকুল ইসলাম বক্তব্য রাখেন।
শ্রমিক সংগঠনগুলির পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচী অনুযায়ী চিত্তরঞ্জন রেল ইঞ্জিন কারখানার সমস্ত স্থানীয় কর্মচারী সংগঠনের যৌথ প্রতিবাদ সভা পালন করা হয়। সভায় কংগ্রেস ও বিজেপি ছাড়া সব দলেরই কর্মীরা যোগদান করেন, কংগ্রেসের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিইউসস ও এনএফআইআর যৌথভাবে পৃথক সভা করে। সারা দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পগুলিকে পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে কয়লা শ্রমিকদের লাগাতার ধর্মঘটের পাশে থাকা এবং শ্রমিকদের সুরক্ষার অধিকারগুলি তথা শ্রম আইন তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে দীর্ঘ আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়। প্রায় পাঁচশো শ্রমিক অংশগ্রহণ করে এই কর্মসূচীতে। চিত্তরঞ্জন রেল ইঞ্জিন কারখানা সন্নিহিত রূপনারায়ণপুর অঞ্চলের নিউমার্কেটে যৌথ আন্দোলন সংঘটিত হয় যেখানে মূলত বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়নগুলি অংশগ্রহণ করে। আসানসোল সংলগ্ন বার্নপুরে এআইসিসিটিইউ সহ অন্যান্য শ্রমিক সংগঠনগুলির প্রতিবাদ সভা করে, যেখানে সাড়ে তিন’শ শ্রমিক এক দীর্ঘ মানববন্ধন করে প্রতিবাদে অংশগ্রহণ করে। দুর্গাপুর, আসানসোল, চিত্তরঞ্জন, রানীগঞ্জ সহ বিস্তীর্ণ শিল্প ও কয়লা খনি অঞ্চলের মানুষ সরকারের পদক্ষেপে রুষ্ট।
কেন্দ্রীয় সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে দেশব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচীর অঙ্গ হিসাবে গত ৩ জুলাই বজবজে এআইসিসিটিইউ সহ অন্যান্য কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের যৌথ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। উপস্থিত ছিলেন এআইসিসিটিইউ রাজ্যনেতা কিশোর সরকার, পার্টির দঃ ২৪ পরগণা জেলানেত্রী কাজল দত্ত, দেবযানী গোস্বামী, অঞ্জন ঘোষ সহ আরো অনেকে। মিছিল শেষে নরেন্দ্র মোদীর কুশপুতুল পোড়ানো হয়।
বাখরাহাটে স্কুল মোড়ে বিক্ষোভ কর্মসূচী অনুষ্ঠিত হয়। উপস্থিত ছিলেন পার্টির দঃ ২৪ পরগণা জেলা নেতা দিলীপ পাল, শুভদীপ পাল, বিষ্ণুপুর-সাতগাছিয়া লোকাল কমিটির সম্পাদক নিখিলেশ পাল, মহিলা নেত্রী পূর্ণিমা হালদার সহ আরো অনেকে। বিক্ষোভ কর্মসূচীতে বক্তব্য রাখেন দিলীপ পাল ও শুভদীপ পাল।
মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর শহরের টেক্সটাইল মোড় থেকে ৩ জুলাই কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ও ফেডারেশনগুলোর ডাকে দেশব্যাপী বিক্ষোভ অবস্থান, মিছিল, অবরোধ ও আইন অমান্য আন্দোলন কর্মসূচীর অংশ হিসেবে মিছিল ও সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই বিক্ষোভ মিছিলে সিপিআই(এম-এল) লিবারেশন, সিপিএম ও অন্যান্য বাম সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও কর্মী সমর্থকদের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য। এআইসিসিটিইউ-র পক্ষে রাজীব রায়ের নেতৃত্বে বেলডাঙার শ্রমিক নেতা আবুল কাসেম সহ অন্যান্য কর্মী সমর্থক উপস্থিত ছিলেন।
কয়লা, রেল-সহ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির বেসরকারীকরণ, ৪১ কয়লাখনি নিলামে তুলে দেওয়া, শ্রম আইন পরিবর্তন, বনাঞ্চল আইন বাতিলের বিরুদ্ধে এবং আদিবাসীদের জমির পাট্টা দেওয়া, কৃষিঋণ মুকুব, লকডাউন ভাতা দেওয়ার দাবি সহ ১২ দফা দাবিতে কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ও ফেডারেশনের আহ্বানে দেশজুড়ে ৩ জুলাই প্রতিবাদ দিবসে সামিল ছিলেন দার্জিলিং জেলার এআইসিসিটিইউ-সহ বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন ও ফেডারেশনের নেতৃত্ব এবং কর্মীরা। সামিল হয়েছিল এআইকেএম-সহ বিভিন্ন কৃষক সংগঠনও।
শিলিগুড়ি মহানন্দা ব্রিজে দুপুর ১২টা থেকে ১টা অব্দি ১২ দফা দাবির সমর্থনে ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনগুলির নেতা ও কর্মীরা বিভিন্ন দাবি সম্মিলিত প্ল্যাকার্ড নিয়ে বৃষ্টি উপেক্ষা করেই অবস্থান বিক্ষোভে চালিয়ে যান। কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে শ্লোগান, অধিকার আদায়ের দীর্ঘ ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের পথকে এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে নেতৃত্ব আশা প্রকাশ করেন।
ফসল ন্যায্য মূল্যে কেনা, একশো দিনের কাজ এবং জবকার্ডধারীদের নিয়ে দুর্নীতি বন্ধ-সহ বিভিন্ন দাবিতে এআইসিসিটিইউ, এআইকেএম, সিপিআইএমের কৃষক সভা, কংগ্রেসের কৃষাণ সেলের নেতৃত্বে একটি মিছিল ফাঁসিদেওয়া থানার সামনে থেকে শুরু হয়ে বিডিও অফিসে এসে শেষ হয়। উল্লিখিত দাবি সম্মিলিত একটি স্মারকলিপি বিডিওকে দেওয়া হয়।
২ এবং ৩ জুলাই চা বাগানগুলিতে লকডাউন ভাতা, ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি সহ বিভিন্ন দাবিতে জয়েন্ট ফোরামের নেতৃত্বে বিক্ষোভ, ধর্না, সংঘটিত হয়। সবমিলিয়ে মেহনতি জনতা যে আগামীর লড়াই লড়তে প্রস্তুত তা উত্সাহব্যঞ্জক উপস্থিতি এবং উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে কর্মসূচী সফল করে তোলার মাধ্যমে বুঝিয়ে দেন।
৩ জুলাই দেশব্যাপী প্রতিবাদ দিবসকে সফল ভাবে সংগঠিত করার জন্য কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলো অভিনন্দন জানাচ্ছে শ্রমিক শ্রেণিকে।
কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলোর সংযুক্ত মঞ্চ, স্বাধীন সেক্টর ভিত্তিক ফেডারেশন ও এসোসিয়েশন ২-৩-৪ জুলাই, এই তিন দিন ব্যাপী সফল ধর্মঘটের জন্য সমস্ত কয়লা শিল্পের শ্রমিকদের অভিনন্দন জানাচ্ছে। এই ধর্মঘটের ফলে কোল ইন্ডিয়া ও এসএসসিএল-এর অধীনে সমস্ত কয়লা খনি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজকর্ম থমকে যায়, সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায় কয়লা উত্তোলন। ধর্মঘট ডাকা হয়েছিল গোটা কয়লা শিল্পকে পুরোপুরি বেসরকারী সংস্থার হাতে তুলে দেওয়ার কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করতে। এই বেসরকারীকরণের ফলে শুরু হবে কয়লা ক্ষেত্রে অনিয়ন্ত্রিত বাণিজ্যিক খনন ও বাণিজ্য, যেখানে অংশ নেবে বেসরকারী সংস্থাগুলোর সাথে বিদেশি সংস্থা, যা শেষ পর্যন্ত জাতীয় স্বার্থ ও আত্মনির্ভরতার বিরুদ্ধেই যাবে। ধর্মঘটের ফলে ব্যাহত হয় ৯০ লক্ষ কয়লা উৎপাদনও সরবরাহ।
কয়লা শিল্পের শ্রমিক ও ইউনিয়নগুলো দেশের শক্তি সংক্রান্ত নিরাপত্তা এবং আত্মনির্ভরতার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ ও বীরত্বপূর্ণ লড়াই চালিয়ে এসেছে যাতে দেশি বিদেশি কর্পোরেট দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ স্রেফ মুনাফার তাগিদে লুন্ঠন করতে না পারে।
বাণিজ্যিক খননের সিদ্ধান্ত থেকে সরকারকে সরে আসতে হবে, সিএমপিডিআইকেসিআইএল থেকে বিযুক্ত করার পলিসি ও প্রত্যাহার করে ইউনিয়নগুলোর পেশ করা দাবি সনদে যে চুক্তি হয়েছিল, সরকারকে সেটা কার্যকরী করতে হবে।
কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলো সারা ভারতের শ্রমিকশ্রেণিকে অভিনন্দন জানাচ্ছে ৩ জুলাই দেশব্যাপী প্রতিবাদ দিবসকে সংগঠিত করার জন্য, যা পালিত হয় কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রমিক বিরোধী জনবিরোধী সরকারী নীতিকে বিরোধিতা করতে। আমরা এটাও লক্ষ্য করছি, কিষাণ সংগঠনগুলোর যৌথ মঞ্চ ও ৩ জুলাইয়ের কর্মসূচীর প্রতি সংহতি জানায়।
উদ্ধত কেন্দ্রীয় সরকার রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থাগুলোকে বেসরকারী হাতে তুলে ও বেচে দিতে ক্রমশ অগ্রসর হচ্ছে। এর ফলে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র, যেমন প্রতিরক্ষায়, বিদেশি পুঁজির অনুপ্রবেশে ৪৯ থেকে ৭৪ শতাংশ পর্যন্ত ছাড়পত্র দিয়ে দিল, ৪১টা প্রতিরক্ষা কারখানাকে কর্পোরেটকরণের সম্মতি দেওয়ায় তা বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতীয় রেলকেও ধাপে ধাপে বেসরকারীকরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আর সম্প্রতি স্থির করেছে ১৫১টা ট্রেনকে বেসরকারী সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হবে। ওই সব ট্রেনগুলো রেলেরই কর্মী ও পরিকাঠামো ব্যবহার করে চলবে অত্যন্ত লাভজনক রুটে, পকেটে পুরে নেবে বিরাট মুনাফা। এরই সাথে গত দু-মাসের মধ্যে ২২ বার পেট্রল ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়ে আমজনতার উপর চাপানো হলো বিরাট বোঝা।
কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলো শীঘ্রই পরবর্তী আন্দোলনের কর্মসূচী নির্ধারণ করবে, সরকারের জনবিরোধী নীতিগুলোকে অমান্য ও অসহযোগ করে নির্দ্ধারণ করবে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা।
তারিখ : ৪ জুলাই, ২০২০
স্বাক্ষরকারী ট্রেড ইউনিয়ন:
এআইসিসিটিইউ, আইএনটিইউসি, সিআইটিইউ, এআইটিইউসি, ইউটিইউসি
এআইইউটিইউসি, টিইউসিসি, এইচএমএস, সেবা, এলপিএফ
পুর্ব বর্ধমান জেলার কালনা ২নং ব্লকের বৈদ্যিপুর গ্রাম পঞ্চায়েতে ৭ জুলাই সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের উদ্যোগে গণডেপুটেশন সংগঠিত করা হল। এই পঞ্চায়েতে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের নেতৃত্বে এই প্রথম গণডেপুটেশন সংগঠিত করা হল। এই এলাকায় লকডাউনের মধ্যেই নতুন করে সংগঠন গড়ে উঠেছে। দাবি ছিল ১০০ দিনের কাজ, জবকার্ড, পানীয় জল ও রাস্তা সংস্কারের প্রশ্নে। শতাধিক মানুষ জমায়েত হয়েছিলেন মিছিল করে পঞ্চায়েত অফিসে। প্রধান মহাশয় দাবিগুলোর সাথে সহমত পোষণ করেন। দ্রুতই পাম্প বসানোর মাধ্যমেই জলের সমস্যার সমাধান করা হবে বলেন। রাস্তায় আপাতত ভ্যাটস্ ফেলে চলাচল স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নেবেন। জবকার্ড দিতে দেরী হলে আপাতত পরিবারের জবকার্ডের মাধ্যমেই কাজ দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। সিপিআই(এম-এল) লিবারেশনের জেলা কমিটির সদস্য প্রদ্যুত ঘোষের নেতৃত্বে ২ জন মহিলা সহ ৫ জনের প্রতিনিধি দল আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন।
করোনা উদ্বেগের মধ্যেই মে মাসে আমফান ঝড় বাঙলার শহর-গ্রাম তছনছ করে দিয়ে গেল। বিদ্যুতের পোস্ট ও খুঁটি সব উপড়ে গেছে, যেন কোন দৈত্য এসে সব কিছু দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে দিয়ে গেছে। শহরে বিদ্যুৎ পরিষেবা স্তব্ধ। বিদ্যুৎ সরবারহ স্বাভাবিক হতে ১০ দিন সময় লেগে গেল। গ্রামের অবস্থা আরও সঙ্গীণ, বিশেষ করে দুই ২৪ পরগনার উপকূলবর্তী অঞ্চলে। এখানেও এক মাসের বেশি সময় লেগেছে বিদ্যুৎ সরবারহ স্বাভাবিক হতে। রাজ্যের মানুষকে করনো, লকডাউন, আমফান ঝড় বিপর্যস্ত করেছে, আবার আমাদের সবাইকে এক কঠিন সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ও করিয়ে দিয়েছে।
রাস্তায় আলো ঝলমল করছে, ল্যাম্প পোস্টে শাপের মতো পেঁচিয়ে টুনি লাইট উঠেছে, কোথাও ত্রিফলা, রাস্তার মাঝে ফোয়ারা কত কী। প্রবাসীরা ছুটিতে বাড়ি এসে বলতো কত ‘উন্নয়ন’ হয়েছে। গর্বে আমাদের পা মাটিতে পড়তো না। গাছ কেটে, পুকুর বুজিয়ে উন্নয়নের রথের চাকা আরও জোরে ছুটতে লাগলো। কিন্তু করোনা, লকডাউনে আমাদের সব তাল কেটে দিল। আলোর নীচে গাঢ় অন্ধকার ছিটকে বেড়িয়ে এলো। লকডাউনে বেশিরভাগ বেসরকারী শিল্প প্রতিষ্ঠান কর্মীদের বেতন বা মজুরি না দিয়ে কাজ থেকে বসিয়ে দিল। সঙ্কট যতো বেড়েছে প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষরা নিরপদ আশ্রয়ে চলে গেছেন। বিপরীতে শ্রমিক কর্মচারিদের খালি হাতে, ভুখা পেটে ঘরে থাকতে বাধ্য করেছে। এক অমানবিক, নিষ্ঠুর রাষ্ট্র এবং বেসরকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষকে আমরা দেখতে পেলাম।
আমফান ঝড়ে বেসরকারী বিদ্যুৎ সংস্থার কঙ্কালসার চেহারা বেড়িয়ে এলো। ঝড়ে কলকাতা সহ শহরতলিতে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা বেহাল হয়ে পড়ল। দেখা গেল সঙ্কট মুহূর্তে বঙ্গবিভূষণ সঞ্জীব গোয়েঙ্কার সিইএসসি’র কোনো পরিকাঠামোই কাজ করছে না। উলটো দিকে লাইন থেকে গাছ কাটতে গিয়ে এক জন ফায়ার ব্রিগেডের কর্মী তড়িদাহত হয়ে মারা গেলেন। কলকাতায় ঝড়ে মৃত্যুর বেশিরভাগ হয়েছে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে। এই অব্যবস্থার অন্যতম কারণ হল, অন্য বেসরকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানের মতো সিইএসসি কর্তৃপক্ষও লকডাউনে সংস্থার ঠিকা শ্রমিক সহ কোম্পানির স্থায়ী কর্মীদের সিংহভাগকে কাজ থেকে বসিয়ে দিয়েছিল। আর অল্প সংখ্যক কর্মীকে দিয়ে এতবড় বিপর্যয় মোকাবিলা করা সম্ভবই নয়। ফল হল দমকল কর্মী সহ কয়েকজন সহনাগরিকের মৃত্যু। জরুরি পরিষেবার ক্ষেত্রে যা অন্যায় বা অপরাধ। ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট আইন দিয়ে সরকার সিইএসসি’র বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারতো, কিন্তু নেয়নি। সিইএসসি কর্মীর অভাবে গ্রাহকদের বাড়িতে তিন মাস মিটার রিডিং নিতে যায়নি। কিন্তু প্রতিমাসে ভুতুড়ে বিল পাঠিয়েছে। একদিকে সিইএসসি ঝড়ের পর বিদ্যুৎ সরবারহ স্বাভাবিক করতে কাজে ঢিলেমি করেছে। অতিমারী ও অপরিকল্পিত লকডাউনে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য ও আর্থিক সঙ্কট চরম পর্যায় পৌঁছেছে, কিন্তু সিইএসসি তার মুনাফার পাহাড় বাড়িয়ে চলেছে। সব গ্রাহকদের কাছে অস্বাভাবিক ভুতুড়ে বিল পাঠিয়েছে। অস্বাভাবিক মাশুলের বিরুদ্ধে বৃহত্তর কলকাতায় বিক্ষোভ চলছে।
বিভিন্ন রাজ্যের বিদ্যুৎ মাশুল দেখে নেওয়া যাক। এই হিসেব প্রতিমাসের। দিল্লী — ২০০ ইউনিট পর্যন্ত কোন মাশুল নেই। ২০১-৪০০ ইউনিট মাসে মাত্র ৫০০.০০ টাকা। অন্যান্য রাজ্যগুলো ৪০০ ইউনিটে কত নিচ্ছে? মহারাষ্ট্র (গড়) ৩১৪০.০০ টাকা, সিইএসসি (কলকাতা) ২৯১৭.১৫ টাকা, কেরল ২৭৬০.০০ টাকা, গুজরাট ১৫৮৮.০০ টাকা এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিদ্যুৎ বন্টন নিগম ৮১৩.২২ টাকা (ত্রৈমাসিক বিল ৪০০ ইউনিট ২৪৩৯.৬৬ টাকা)।
বেশিরভাগ গ্রাহক গড়ে ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন। প্রধান প্রধান রাজ্যগুলোতে ২০০ ইউনিট পর্যন্ত মাশুলের পরিমাণ কত নেয় দেখে নেওয়া যাক। দিল্লী ২০০ ইউনিট পর্যন্ত শূন্য চার্জ। সিইএসসি (কলকাতা) ২০০ ইউনিট ১২৯২.১৫, কেরল ১০৮৭.৫০, মহারাষ্ট্র ১০৬০, গুজরাট ৬৬২.৫০, পশ্চিবঙ্গ রাজ্য বিদ্যুৎ বন্টন নিগম ৫৮১ টাকা (ত্রৈমাসিক ১৭৪২.৬৬ টাকা)।
এই তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে সিইএসসি দেশের মধ্যে ৪০০ ইউনিট বিদ্যুতের মাশুলে দ্বিতীয় স্থানে আছে, মহারাষ্ট্র প্রথম। আর ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ, যা বেশিরভাগ গ্রাহক ব্যবহার করেন, সেখানে সিইএসসি’র মাশুল সবচেয়ে বেশি এবং দেশের মধ্যে ‘শীর্ষস্থান’ দখল করেছে। দিল্লি সব থেকে কম, শূন্য মাশুল। এক দেশ, এক ভোট, এক রেশন কার্ড চলছে, তখন বিদ্যুৎ মাশুলের ক্ষেত্রে দিল্লী মডেল সব রাজ্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হোক।
সিপিআই(এম-এল) লিবারেশনের নেতৃত্বে সিইএসসি’র ভুতুড়ে বিলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ডেপুটেশন চলছে। সিইএসসি কর্তৃপক্ষের কাছে দাবিপত্র পেশ করা হয়েছে কলকাতা ও উত্তর ২৪ পরগণায়। ১) লকডাউনের সময়কার ৩ মাসের বিল মুকুব করতে হবে। ২) ভুতুড়ে বিল নেওয়া বন্ধ করুন। ৩) প্রথম স্লাব ২৫ ইউনিট থেকে বাড়িয়ে ১০০ ইউনিট করতে হবে। ৪) ঠিকা শ্রমিকদের স্থায়ী করে পরিষেবা উন্নত করতে হবে। ৫) কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ আইন ২০২০ বাতিল কর।
-- নবেন্দু দাশগুপ্ত
সম্প্রতি বহুজাতিক সংস্থা ইউনিলিভার বিশ্বে সর্বাধিক বিক্রীত ‘ফেয়ারনেস ক্রীম’ ‘ফেয়ার এন্ড লাভলি’-র নাম থেকে ‘ফেয়ার’ অর্থাৎ ফরসা শব্দটি বাদ দিয়েছে। আমেরিকার শাসকের ঘুম কেড়ে নেওয়া বর্ণবাদবিরোধী “ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটারস(বিএলএম)” আন্দোলনের বহুল-বিস্তৃত প্রভাবের ফল এই সিদ্ধান্ত, এমনটা মনে করছেন অনেকে। ইউনিলিভার উৎপাদিত ফেয়ার অ্যাণ্ড লাভলি পণ্যের বর্ণনায় ত্বকের রঙ উজ্জ্বল করার অর্থাৎ সৌন্দর্য বাড়ানো – এই বর্ণবাদী ছকে বাঁধা ভাষার প্রয়োগ প্রত্যাহার করবে বলে জানিয়েছে উক্ত সংস্থাটি।
গত জুন মাসের শেষদিকে ফেয়ার এন্ড লাভলি পণ্যের উৎপাদন রদ করার দাবিতে আঠারো হাজার মানুষের স্বাক্ষরিত দুটি পিটিশন জমা পড়ে। এই পণ্যের উৎপাদন, পরিবেশন ও বিক্রয় নীতির মূলে থেকেছে বর্ণবাদ ও পিতৃতন্ত্রের যৌথ পরিভাষা। বিএলএম আন্দোলন বর্ণবাদের নিগড়ে থাকা শ্বেতাঙ্গ শাসক শ্রেণীর আগ্রাসনের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে নিঃসন্দেহে। পাশাপাশি পুঁজিবাদী উদারনীতির রন্ধ্রে লুকিয়ে রাখা প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদের মুখোশ খুলে দিয়েছে এই আন্দোলন। আমেরিকার মিনেসোটায় কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুতে উদ্বুদ্ধ বিএলএম আন্দোলনের প্রভাবে দুনিয়াজোড়া বহুজাতিক প্রসাধনী সংস্থাগুলি নিজেদের বিপননী কৌশল পুনর্মূল্যায়ন করে। এরই ফলস্বরুপ উইনিলিভারের পণ্যের বিপণনী প্রচারের অভিমুখে উপরুক্ত বদলের ঘোষণা। এই সংস্থার বিপণনের দায়িত্বে থাকা সানি জ্যানের কথায়, “‘ফেয়ার’ শব্দটি নির্দিষ্ট ত্বকের রঙকেই সৌন্দর্যের মাপকাঠি নির্ধারণ করে। আমরা এই মাপকাঠিকে সঠিক মনে করছি না। বরং বিশ্বজুড়ে সৌন্দর্যের বিভিন্নতাকে উদযাপন করার উদ্দ্যেশ্যেই আমাদের নীতি বদল।”
প্রসঙ্গত, ইউনিলিভার সংস্থার এই পণ্যের গ্রাহকদের মূল বাজার ভারত, পাকিস্থান, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ড। সমাজতাত্ত্বিকদের মতে এই পণ্যগুলি বিক্রীর মূল ক্ষেত্র হয়ে এসেছে এশিয়া, আফ্রিকা ও ভারতবর্ষের অশ্বেতাঙ্গ অধিবাসীরা। হিন্দুস্থান ইউনিলিভারের বাজারজাত ‘ফেয়ার এন্ড লাভলি’ প্রোডাক্টটি ভারতীয় বাজার থেকে বছরে লাভ করে ২,০০০ কোটি টাকা। “ইণ্ডিয়ান ফেয়ারনেস ক্রীম অ্যাণ্ড ব্লিচ মার্কেট” রিপোর্ট থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সাল নাগাদ আলোচিত পণ্যের বার্ষিক লাভের অংক দাঁড়াবে ৫,০০০ কোটি টাকায়। অর্থাৎ, পণ্যের নামের বদল ঘটলেও, ত্বকের রঙ উজ্জ্বলতর করার স্পৃহায় বদল ঘটার বিশেষ আশা নেই। এই রিপোর্ট বলছে, আধুনিক নারী চাকরি ক্ষেত্রে, বিবাহ প্রস্তাব বা সামাজিক সক্রিয়তার চাপ সামলাতে বিভিন্ন ব্রান্ডের প্রসাধনী দ্রব্যের দ্বারস্থ হয়ে থাকেন। নয়া উদারবাদের জমানায়, বিবিধের বিভিন্নতাকে সম্মানের গালভরা মিথ্যা থাকলেও, বহুলাংশে এই প্রসাধনী দ্রব্য কেনার মূলে থাকে ভারতীয় সমাজের প্রাতিষ্ঠানিকতায় নিহিত ব্রাহ্মণ্যবাদী পুরুষতন্ত্র। সমাজে পুরুষের কাঙ্খিত দৃষ্টির খিদে মেটাতে ব্যর্থ নারী ব্রাহ্মণ্যবাদী সৌন্দর্যের সংজ্ঞায় সমাজে ব্রাত্য থেকে যায়। এই প্রসাধনী পণ্যাদির বিপণনী প্রচারে ত্বকের ঔজ্বল্যের সাথে নারীর ক্ষমতায়নের সমীকরণ প্রতিষ্ঠা হয়। যেমন, বিবাহের বিজ্ঞাপনে উজ্জ্বল ত্বক, স্লিম চেহারা ও উচ্চবর্ণের নারীর চাহিদা সর্বাধিক। কর্মক্ষেত্রে বা পরিবারে, সমাজের কোলাহলে বা নিভৃতে নারীর স্বীকৃতি শরীরের মেদে, চামড়ার রঙের নির্দিষ্ট মানদন্ডে নির্ধারিত।
ভারতে উপনিবেশিক শাসনকাল সাদা চামড়ার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার আদিকাল সুনিশ্চিত করে। পুঁজিবাদ ও ঔপনিবেশিকতার যৌথতায় তৈরি শ্রেণীবিভাগে সাদা চামড়া, বা ‘ফেয়ারার স্কিন’-এর অধিকারীরা সাধারণত অভিজাত বংশ বা উচ্চশ্রেণীর প্রতিনিধি। শ্রেণী-বর্ণ বিভক্ত সমাজের মানদণ্ডে রোদে, ঝড়ে, জলে খেটে-খাওয়া মানুষের চামড়ার রঙ তাই অপাংক্তেয়, অস্পৃশ্যতার প্রতীক। বৈদিক যুগ পরবর্তী সময়কালে আর্য ভারতে নারীর শরীর ও স্বায়ত্বের সীমানা টানা হয় জাতিভেদ প্রথা দ্বারা। পরবর্তীতে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বা স্বাধীনতা-পরবর্তী শাসকশ্রেণী ভারতীয় নারীর শরীরের লাগাম নিজের হাতে রাখতে চেয়েছে। তাই, সামাজিক পণ্যের মত নারীর শরীরকে শাসক শ্রেণীর প্রতিনিধিদের কাছে গ্রহণযোগ্য করে রাখার দায় বর্তেছে নারীর উপর।
বর্তমানে, মোদী জমানায় হিন্দু নারীর আদর্শ চেহারা ও গতিবিধির নিয়ম চেপে বসেছে নারীর ক্ষমতায়নের বিপ্রতীপে। ছেলেবেলা থেকে কালো মেয়েদের চামড়ার রঙের জন্য পরিবার, আত্মীয়, সমাজ থেকে পাওনা হওয়া কটুক্তি (পড়ুন, হেনস্থার) অভিজ্ঞতা সর্বজনবিদিত। ১৯৭৫ সাল থেকে ভারতের বাজারে ‘ফেয়ার এন্ড লাভলি’ মেয়েদের স্বাধীনতা আর স্বায়ত্বতার অধিকারের অবমাননা করেই ব্যবসা চালাচ্ছে। পুঁজিপতির লাভের ঘড়া পুর্ণ হচ্ছে সমাজের পুরুষতান্ত্রিক ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রত্যাশাকে মূলধন করে। হিন্দুস্থান ইউনিলিভারের ‘ফেয়ার’ শব্দ বাদ রাখার ঘোষণা বর্ণবাদ-বিরোধী আন্দোলনের পার্শ্বিক ফসল হলেও, এই অবস্থান যে কোনও জনপ্রিয় প্রবণতাকে পুঁজিতে পরিণত করার প্রাচীন কৌশলের দিকনির্দেশ করে। নারীর স্বাধীনতার আকাঙ্খার পরিপন্থী পুঁজিবাদ। সমাজে নির্মিত, পুঁজিবাদের টিকিয়ে রাখা শৃঙ্খল ছিঁড়ে বিভিন্নতায় ঐক্যবদ্ধ নারী বিনির্মান করছে সৌন্দর্য ও নারীত্বের সংজ্ঞা। বিএলএম আন্দোলন বা শাহীনবাগের প্রতিবাদ-সমাজকে ফ্যাসিবাদ-পুঁজিবাদ বিরোধী লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে মেয়েরা। ইউনিলিভার সহ অন্যান্য কর্পোরেটদের নয়া বিপণন ছক তারা সহজেই বুঝবে। বহুজাতিক সংস্থার মলম দ্বারা নির্ধারিত নয়, সমানাধিকার ও সমমর্যাদার অভিব্যক্তিতে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠছে আজকের নারীর চেহারা।
-- সম্প্রীতি মুখার্জী
সুপ্রিম কোর্টের একটা বেঞ্চ মৌখিকভাবে এই অভিমত প্রকাশ করেছে যে নিপীড়িত এবং পশ্চাদপদ শ্রেণীগুলোর জন্য সংরক্ষণ সংবিধান প্রদত্ত কোন মৌলিক অধিকার নয়। এই অভিমত আরও একবার এই আশঙ্কাকেই শক্তিশালী করছে যে সামাজিক ন্যায়ের সংস্থানগুলোকে দুর্বল করে তোলার লক্ষ্যে সমবেতভাবে পরিকল্পিত এক প্রচেষ্টা সক্রিয় রয়েছে। তামিলনাড়ুর সমস্ত রাজনৈতিক দল রাজ্যগুলোর ছেড়ে দেওয়া নিট (এনইইট) আসনগুলোতে ৫০ শতাংশ ওবিসি সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে আবেদন পেশ করতে গেলে সুপ্রিম কোর্টের ওই বেঞ্চ আবেদন গ্ৰহণ করতে অস্বীকার করে এবং উক্ত অভিমত প্রকাশ করে। পরবর্তীতে তামিলনাড়ুর দলগুলো ওই আবেদন তুলে নিয়ে মাদ্রাজ হাইকোর্টে আবেদন দাখিল করে।
সুপ্রিম কোর্ট ফেব্রুয়ারি মাসে পদোন্নতি সম্পর্কে উত্তরাখণ্ড হাইকোর্টের দেওয়া একটা রায়কে বাতিল করতে গিয়ে বলে যে সংরক্ষণ কোন মৌলিক অধিকার নয় এবং রাজ্যই এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী। অনেক সংবিধান বিশেষজ্ঞই দেখিয়েছেন যে এই দাবি বিভ্রান্তিকর এবং সঠিক নয়। সংবিধানের ১৬(১) ধারা সমস্ত নাগরিককে সমান সুযোগ লাভের মৌলিক অধিকারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং এই ধারা বৈষম্যের শিকার হওয়া থেকেও রক্ষা করে। ১৯৭৬ সালের এক ঐতিহাসিক রায়ে সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল যে, ১৬(৪) ধারা — যা রাষ্ট্রকে নিপীড়িত এবং পশ্চাদপদ সম্প্রদায়গুলোর জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করার অনুমতি দিয়েছে — ১৬(১) ধারায় প্রদত্ত সমতার সংস্থানের কোন ব্যতিক্রম নয়, বিপরীতে তা এরই একটা “দিক” এবং “জোরালো পুনরাবৃত্তি”।
ভারতীয় সমাজে অসাম্য এবং নিপীড়িত ও পশ্চাদপদ জাতগুলোর বিরুদ্ধে চালানো বৈষম্য এখনও ব্যাপক হারেই চলছে। সংরক্ষণ নিজের থেকেই ব্যবস্থার মধ্যে নিহিত অসাম্যকে শুধরে দিতে পারে না। তবে, শিক্ষা ও কাজ পাওয়ার অধিকার থেকে নিপীড়িত ও পশ্চাদপদ সম্প্রদায়ের মানুষদের বঞ্চিত করার যে প্রবণতা ব্যাপক হারে রয়েছে, তাকে শোধরানোর ব্যাপারে সংরক্ষণ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বন্দোবস্ত হয়েই দেখা দিয়েছে।
সংরক্ষণ হল ভারতের সামাজিক ন্যায়-এর লক্ষ্যে গৃহীত মৌলিক নীতি, এবং গত কয়েক বছরে বেশ কিছু উদ্বেগজনক সংকেত পাওয়া গেছে যার থেকে মনে হচ্ছে যে সংরক্ষণ ব্যবস্থা বিপন্নতার মুখে। আরএসএস হল বিজেপির মূল সংগঠন, এবং বিজেপি গৃহীত নীতিমালার পিছনে প্রধান অনুপ্রেরণা তারই থাকে। এই আরএসএস ইতিহাসগত দিক থেকে জাত-ভিত্তিক সংরক্ষণের প্রতি বিরুদ্ধতাই দেখিয়ে এসেছে। আরএসএস প্রতিষ্ঠাতা গোলওয়ালকার তাঁর ‘বাঞ্চ অব থটস’ রচনা সংকলনে এসসি/এসটি-দের জন্য সংরক্ষণের দাবিকে সাম্প্রদায়িক ও জাতি-বিরোধী বলেই গণ্য করেছেন। মাঝেমধ্যেই আরএসএস নেতারা সংরক্ষণের নীতির পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়ে থাকেন, আর বিজেপি নেতারা সেই সংবিধান সংশোধনের কথা বলেছেন যা নাগরিকদের, ভারতের নিপীড়িত সম্প্রদায় ও সংখ্যালঘুদের অধিকারকে সুরক্ষিত করেছে।
মোদী জমানার গত ছ-বছরে সরকার এমন বেশকিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে যা সংরক্ষণের সুযোগ ও বৈধতাকে লঘু করে তুলেছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন তাদের ২০১৬ সালের ৫ মে তারিখের বিজ্ঞপ্তিতে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতকে নিয়ন্ত্রিত করার যে কথা বলে তা ব্যাপক সংখ্যক আসন হ্রাসে পরিণতি পায় এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমফিল/পিএইচডি পাঠক্রমে ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রে সংরক্ষণ কার্যত বিলুপ্ত হয়। মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক বহু সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে “স্বায়ত্তশাসিত” বলে ঘোষণা করে। এই সমস্ত “স্বশাসিত” প্রতিষ্ঠান এবং তার সাথে “প্রসিদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোকে” ভর্তি এবং অধ্যাপক নিয়োগের ক্ষেত্রে সংরক্ষণ পূরণ করার বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এগুলির সাথে সংরক্ষণের সাংবিধানিক বন্দোবস্তকে নিয়ন্ত্রিত ও লঘু করে সুপ্রিম কোর্টের একের পর এক রায় প্রদানকে মিলিয়ে বিচার করলে তা যথেষ্ট উদ্বেগজনক হয়েই দেখা দিচ্ছে। ২০১৮ সালের মার্চ মাসে সুপ্রিম কোর্টের একটা রায়ে এসসি/এসটি নিপীড়ন নিরোধক আইনকে ভোঁতা করে তোলার চেষ্টা হল, এবং ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের আর একটা রায়ে উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোতে যে ১৩ দফা রোস্টার বলবৎ করা হল তাতে অধ্যাপক নিয়োগের ক্ষেত্রে সংরক্ষণের দফারফা হওয়ার উপক্রম হল। উভয় রায়ের ক্ষেত্রেই দেশব্যাপী ব্যাপক আকারের প্রতিবাদ সরকারকে হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য করে এবং সরকার এমন আইনি বিধান গ্ৰহণ করে যাতে সুপ্রিম কোর্টের রায় অকার্যকর হয়ে যায়।
এখন সুপ্রিম কোর্টের এই সমস্ত রায়ে এবং মৌখিকভাবে ব্যক্ত অভিমতে সংরক্ষণকে মৌলিক অধিকার নয় বলে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা সংরক্ষণের অবস্থানকে টলোমলো করে তুলছে। এসসি/এসটি/ওবিসি-দের জন্য সংরক্ষণ সামাজিক ন্যায়ের পরীক্ষিত বন্দোবস্ত। এর মাথার ওপর অনিশ্চয়তার যে খাঁড়া নিরন্তর ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, তার থেকে একে রক্ষা করতে হবে। সমাজের সমস্ত গণতান্ত্রিক অংশকে এগিয়ে এসে এটা সুনিশ্চিত করতে হবে যে সংসদ যেন সংরক্ষণ সম্পর্কিত সমস্ত আইনকে সংবিধানের নবম তপশিলে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা নেয় যার ফলে সংরক্ষণকে আর আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে না পড়তে হয়।
-- কবিতা কৃষ্ণাণ
তাদের কার্যধারার মধ্যে তারা যে ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারকেই বহন করছে, ভারতের পুলিশ বাহিনী প্রতিদিনই তার প্রমাণ দিয়ে চলেছে। এ দেশের জনগণের সুরক্ষার চেয়ে তাদের ওপর অত্যাচার ও দমনের যে লক্ষ্য নিয়ে ব্রিটিশের পুলিশ বাহিনী চালিত হত, স্বাধীন দেশের জনগণের সাপেক্ষে সার্বভৌম রাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনীর মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গিতে তার চেয়ে খুব একটা ইতরবিশেষ দেখা যায় না। ভারতে প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও পুলিশি হেফাজতে পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে ঔপনিবেশিক আমলের পুলিশি সংস্কৃতিকে। তামিলনাড়ুর থুতুকুড়ির এক থানায় বাবা ও ছেলের ওপর অত্যাচার ও তার পরিণামে তাদের মৃত্যুকে এ ছাড়া আর কিই বা বলা যেতে পারে। মোবাইল ফোনের দোকান চালাতেন ৫৯ বছরের পি জয়রাজ। থুতুকুড়ির সাথানকুলাম থানার পুলিশ এসে ১৯ জুন তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। ঘোষিত অপরাধ — লকডাউনে যতটা সময় দোকান খুলে রাখার অনুমতি ছিল তিনি নাকি তার চেয়ে ১৫ মিনিট বেশি দোকান খুলে রেখেছিলেন। সে সময় অন্যান্য দোকানও খোলা ছিল বলে অনেকে জানিয়েছেন, আর তাই অননুমোদিত সময়সীমার পরও দোকান খুলে রাখার চেয়ে পুলিশের অন্য অভিসন্ধিই তাঁর গ্ৰেপ্তারের পিছনে কাজ করেছে বলে মনে হয়। সে যাই হোক, বাবাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর ৩১ বছর বয়স্ক ছেলে জে রেনিক্স বাবার খোঁজে থানায় গেলে পুলিশ তাঁকেও গ্ৰেপ্তার করে। এরপর থানায় নির্মম অত্যাচারে দুজনেরই অবস্থার অবনতি ঘটলে ২২ জুন তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয় — ছেলে রেনিক্স ২২ জুন রাতেই মারা যান আর বাবা পি জয়রাজ মারা যান পরদিন সকালে। পুলিশি অত্যাচারের আর পাঁচটা ঘটনার মত এটাও হয়ত দস্তুর বলেই গণ্য হত আর ধামাচাপা পড়াই তার নিয়তি হয়ে উঠত। কিন্তু অত্যাচারের অকাট্য প্রমাণ, বাড়ির পরিজনদের জোরালো প্রতিবাদ, আদালতের হস্তক্ষেপ, সোশ্যাল মিডিয়ায় তোলা আলোড়ন সারা দেশকেই নাড়িয়ে দেয় এবং সরকারের পক্ষেও কিছু পদক্ষেপ গ্ৰহণ করা ছাড়া উপায় থাকে না।
থানায় কী ধরনের অত্যাচার তাঁদের ওপর চালানো হয়েছিল? অভিযোগ, প্রথাগত প্রহার ছাড়াও মলদ্বারে লাঠি ঢুকিয়ে নির্যাতন, ছেলের পিঠ থেকে মাংস খুবলে নেওয়া, বুকের রোম ছিঁড়ে নেওয়ার মত নৃশংসতা তাঁদের ওপর প্রয়োগ করা হয়েছিল। ‘থার্ড ডিগ্ৰি’-র এই বাড়বাড়ন্ত স্বাধীন ভারতের পুলিশি হেফাজতে কেমন স্বাভাবিক ব্যাপারই না হয়ে উঠেছে। পুলিশ যথারীতি মিথ্যা ঘটনার অবতারণা করে অত্যাচারের অভিযোগ থেকে রেহাই পাবার চেষ্টা করে। তারা বলে — গ্ৰেপ্তার করার আগেই বাবা ও ছেলে রাস্তায় পড়ে আহত হয়েছিল আর সেটাই তাদের মৃত্যুর দিকে নিয়ে গেছে। কিন্তু স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মোবাইলে তোলা ছবি পুলিশের বয়ানকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। পুলিশি অত্যাচারের ঘটনা সামনে আসায় মাদ্রাজ হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ঘটনার তদন্ত করে। ময়না তদন্তের রিপোর্টে বাবা ও ছেলের দেহে একাধিক আঘাতের চিহ্নের উল্লেখ থাকে। এই রিপোর্টের ভিত্তিতে মাদ্রাজ হাইকোর্টের বিচারপতি উল্লেখ করেন — “অভিযুক্ত পুলিশ কর্মীদের বিরুদ্ধে খুনের মামলা রুজুর যুক্তিসংগত কারণ এবং প্রমাণ রয়েছে”। পরিস্থিতির চাপে এক হেড কনস্টেবলও নির্মম অত্যাচার হওয়ার সাক্ষ্য দেয়। তামিলনাড়ুর রাজ্য সরকার অবশেষে কিছু ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়। ঘটনার তদন্ত সিবিআই-এর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে, দুই সাব ইন্সপেক্টর, দুই কনস্টেবল এবং অন্য দুই ব্যক্তিকে খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে এবং থুতুকুড়ি জেলার এসপি-কেও সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সবার মনে যে প্রশ্নটা খুব স্বাভাবিকভাবেই জাগছে তা হল — দোষী পুলিশরা কি আদৌ শাস্তি পাবে?
কিছু পরিসংখ্যানের দিকে তাকানো যাক। ২০০১ সাল থেকে ২০১৮র মধ্যে পুলিশি হেফাজতে ১৭২৭ জনের মৃত্যু ঘটেছে বলে সরকারী খাতায় নথিবদ্ধ রয়েছে। এরমধ্যে হেফাজতে হিংসা চালানোর জন্য মাত্র মাত্র ২৬ জন দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। আর একটা তথ্য বলছে, ২০১৭ সালে পুলিশি হেফাজতে প্রায় ১০০ জনের মৃত্যু হলেও একজন পুলিশ অফিসারও দোষী সাব্যস্ত হয়নি। তথ্য আরও জানাচ্ছে, ২০১৯ সালে হেফাজতে মারা গেছে ১৭৩১ জন (এর মধ্যে পুলিশি হেফাজতে ১২৫ জন ও বিচার বিভাগীয় হেফাজতে ১৬০৬ জন)। অর্থাৎ, প্রতিদিন গড়ে পাঁচজন কোনো না কোনো হেফাজতে মারা যাচ্ছে, আর এরজন্য দোষী সাব্যস্ত হওয়ার ঘটনা যে নগন্য তা বলাই বাহুল্য। তবে, এই পরিসংখ্যানের মধ্যে দিয়ে যে প্রকৃত ছবি বেরিয়ে আসছে এমন নয়। কেননা, হেফাজতে অনেক মৃত্যুর খবরই প্রকাশ্যে আসে না বা নথিবদ্ধ হয় না। আর, দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হাত থেকে অব্যাহতি পাওয়ার অবধারিত কৌশল হয়ে ওঠে হেফাজতে মৃত্যুর কারণ হিসাবে কোন ব্যাধিকে দেখানো, অর্থাৎ, মৃত্যু অত্যাচারের কারণে হয়নি বলে প্রতিষ্ঠিত করা। অবশ্য, শুধু তামিলনাড়ুর পুলিশই যে হেফাজতে নির্মম অত্যাচার চালানো, বিচার বিভাগ নির্ধারিত দণ্ডের বাইরে ঘটানো হত্যার ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির ধারক হয়ে রয়েছে, এমন মনে করাটাও ভুল হবে। রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো পুলিশ বাহিনীও শাসকদের, ধনীদের সেবায় নিয়োজিত হয় এবং গোটা রাষ্ট্রটারই পুলিশি বৈশিষ্ট্য অর্জনের অভিমুখ অত্যন্ত প্রবল হয়েই সামনে এসেছে।
ফ্যাসিবাদ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ায় রাষ্ট্রকে মুড়ে দেওয়া হচ্ছে গণতন্ত্রহীনতার বর্মে। যে কোন সরকার বিরোধিতার ওপরই নেমে আসছে দমনের খাঁড়া। ছাত্র আন্দোলনের দমনে চলছে সুপরিকল্পিত ও সমবেত রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন। সমাজ আন্দোলনের কর্মীদের ওপর চলছে পাইকারি হারে গ্ৰেপ্তারি। সিবিআই ও এনআইএ-কে আজ্ঞাবহ দাসে পরিণত করে লেলিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিরোধীদের ওপর, চরিতার্থ করা হচ্ছে প্রতিহিংসা। ইউএপিএ, রাষ্ট্রদোহিতার মত দানবীয় আইনের ঘটছে আকছার প্রয়োগ। সংখ্যালঘু নিধন ও উৎপীড়নকে পুরোপুরি নগ্ন করে তোলা হয়েছে। সাংবিধানিক অধিকারকে পরিণত করা হচ্ছে বর্জনীয় বস্তুতে, মানবাধিকার হয়ে উঠছে অস্তিত্বহীন পদার্থে। আর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বলীয়ান হয়ে শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীরা যাবতীয় অনাচারে মদত যোগাচ্ছেন। কি করে ভোলা যাবে ২০১৮র গোড়ার দিকে ‘বলাৎকারী বাঁচাও আন্দোলনের’ কথা, যখন জম্মু ও কাশ্মীরের বিজেপি মন্ত্রী ও বিধায়করা বাকেরওয়াল গুজ্জর সম্প্রদায়ের নাবালিকার ধর্ষকদের গ্ৰেপ্তারের বিরোধিতায় রাস্তায় নামলেন! উন্নাওয়ের অপ্রাপ্তবয়স্ক বালিকা উত্তরপ্রদেশের বিজেপি বিধায়কের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ জানালে তার বাবাকে ধরে নিয়ে এসে হেফাজতে পুলিশের মেরে ফেলার কথাও তো ভুলিয়ে দিতে চাইলেই ভোলা যাবে না। উত্তরপ্রদেশ কি পুলিশি দৌরাত্ম্যের রাজ্য হয়ে ওঠেনি যেখানে বিচার ছাড়াই ‘দুর্বৃত্ত’ অভিযোগে বহুসংখ্যক মানুষকে পুলিশের মেরে ফেলাটা প্রশাসনের কাছে শ্লাঘার ব্যাপার হয়ে উঠছে! হালফিলের দিল্লীর দাঙ্গায় যেভাবে মূল উস্কানিদাতাদের ছেড়ে দিয়ে জড়িত না থাকাদের ওপর মিথ্যা অভিযোগে পুলিশি নিপীড়ন নামানো হল, নির্যাতন ও প্রতিহিংসাপরায়ণতার যে সাক্ষ্য রাখা হল, তা তো দেশের মানুষের চোখের সামনেই ঘটল। সর্বোপরি, অবশীভূত সাংবাদিক ও সংবাদ মাধ্যমও ক্রমেই আরও বেশি করে শাসকের আক্রমণের মুখে পড়ছে। আর, আজ যাঁরা কেন্দ্রে শাসন ক্ষমতায়, গুজরাটে সংখ্যালঘু নিধন যজ্ঞ, ‘এনকাউন্টার’ তথা ভুয়ো সংঘর্ষে হত্যার বিপুল অভিজ্ঞতায় তাঁরা তো নিজেদের সমৃদ্ধ করেছেন। অতএব, তামিলনাড়ুর হেফাজতে হত্যার ঘটনার মধ্যে আজকের ভারতীয় রাষ্ট্রের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই মূর্ত হয়ে উঠেছে। এই ঘটনায় দোষীদের শাস্তির দাবি তোলার সাথে-সাথে সারা দেশের প্রতিও আমাদের দায়বদ্ধতার প্রমাণ রাখতে হবে। ভারতকে পুলিশ রাষ্ট্র করে তোলার যে উপক্রম চলছে, তাকে প্রতিহত করতে আমাদের, ভারতের জনগণকেই এগিয়ে আসতে হবে।
-- জয়দীপ মিত্র
“আপনি ধনী কেননা আপনি সাদা মানুষ, আপনি সাদা মানুষ কেননা আপনি ধনী।” —ফ্রানৎস ফ্যানো
সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লাইব্রেরি অফ কংগ্রেস দুষ্প্রাপ্য কয়েকটি ছবি প্রকাশ করেছে। যা সেদেশে অতীতের একটি ভয়ঙ্কর ঘটনাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ঘটনাটি ঘটে ৩১ মে-১ জুন ১৯২১ সালে, ওকলাহোমার তুলসায় কালো মানুষের বসতি গ্রিনউড ডিস্ট্রিক্টে। ডিক রোল্যান্ড নামের উনিশ বছরের এক কালো তরুণ একটি বিল্ডিং-এর লিফটে উঠছিলেন, হঠাৎ লিফট-অপারেটর সতেরো বছরের সাদা তরুণী স্যারাহ পেজের চিৎকার নাকি আশেপাশের লোকজনের কানে আসে। ছুটে এলে তারা দেখতে পান ডিক দৌড়ে পালাচ্ছেন আর স্যারাহ বিধ্বস্ত অবস্থায়। পুলিশ এসে ডিককে গ্রেপ্তার করে, কিন্তু গুজব ছড়াতে থাকে, দলে দলে লাঠি-সোঁটা-বন্দুক হাতে সাদারা জড়ো হয়। তারপর আক্রমণ নেমে আসে গ্রিনউডের ওপর, নির্বিচারে গুলি চলে, জ্বালিয়ে দেওয়া হয় কালোদের বাড়িঘর, লুট হয় সম্পত্তি। ৩০০-র বেশি কালো মানুষকে হত্যা করা হয়, হাজারের ওপর গৃহহীন হয়ে পড়ে। তান্ডব শেষ হলে, ডিক রোল্যান্ড নির্দোষ প্রমাণিত হন এবং বেকসুর খালাস হয়ে যান।
তুলসার ওই বর্ণবিদ্বেষী গণহত্যার কথায় এসে পড়ে আমাদের দেশের ও জাতকেন্দ্রিক হত্যাকান্ডগুলির স্মৃতি। এইতো সেদিন ২০০৬ সালে ঘটেছিল খায়রলঞ্জির ঘটনা। মহারাষ্ট্রের ভান্ডারা জেলায় খায়রলঞ্জি এক বর্ধিষ্ণু গ্রাম। এখানেই বসবাস করতেন দলিত কৃষক ভটমঙ্গে পরিবার-ভাইয়ালাল (বয়স৫৫), স্ত্রী সুরেখা(৪০), দুই ছেলেসু ধীর(২১) ও রোশন(১৯) এবং মেয়ে প্রিয়ঙ্কা(১৭)। এদের পাঁচ একর জমির পাশেই ছিল সেচের খাল কিন্তু নিচুজাত -মাহার- হওয়ায় খালের জল চাষের কাজে ব্যাবহার করা সহজ ছিলনা। এমনকি পানীয় জলও গ্রামের কুয়ো থেকে নিতে বাধা দেওয়া হত। নানা বিষয়ে গ্রামের অন্যান্য জাতের – কুনাবি, কালার ইত্যাদি – লোকেদের সাথে বিবাদ লেগে থাকত। এইরকমই কোনও এক বিবাদের জেরে একদল গ্রামবাসী ২৯সেপ্টেম্বর ভটমঙ্গে পরিবারের ওপর হামলা চালায়। মা ও মেয়েকে বিবস্ত্র করে গ্রামে ঘোরানো হয়, তারপর গণধর্ষণ করে খুন করা হয়। দুই ছেলেকে মেরে টুকরো টুকরো করে খালে ফেলে দেওয়া হয়। মিডিয়াতে ঘটনাটি প্রচার পায় দেশ জুড়ে দলিত মহিলারা প্রতিবাদী আন্দোলনে নামার পরে।
গত দেড়শো-দুশো বছর ধরে বর্ণ কিংবা জাতকে কেন্দ্র করে এধরনের জঘন্য হত্যাকান্ড অবিরত ঘটে চলেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ও প্রজাতান্ত্রিক ভারতে। এবং আরও অনেক দেশেই। কিন্তু তুলসা বা খায়রলঞ্জির মতো ঘটনার কয়েকটি বৈশিষ্ট উল্লেখযোগ্য : তুলসার আক্রান্ত কালো মানুষেরা ছিলেন ব্যবসায়ী, আর্থিক দিক থেকে সচ্ছল – এতটাই সংগতিপন্ন যে তাদের বাসস্থান গ্রীনউডকে বলা হত ‘ব্ল্যাক ওয়াল স্ট্রীট’। অন্যদিকে, যারা তাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছিলেন সেই সাদা মানুষদের সিংহভাগ ছিলেন কলে-কারখানায় কাজ করা শ্রমজীবি মানুষ, অর্থনৈতিক মানদন্ডে পিছিয়ে পড়া। খায়রলঞ্জির ভটমঙ্গে পরিবারও শুদ্র হলেও ছিলেন সম্পন্ন কৃষক, নিজেরই জমিতে চাষবাসে নিযুক্ত। আর, তাদের হত্যাকারীর দলে যারা ছিলেন তাদের জমিজমা ছিল সামান্য, কেউ কেউ অন্যের জমিতে কাজ করে জীবিকা অর্জন করতেন। তাছাড়া, তারা ছিলেন ওবিসি, উচবর্ণের তো নয়ই, বরং জাত ব্যবস্থায় মর্যাদার ক্রমানুসারে নিচের দিকেই।
দেখা যাচ্ছে, বাস্তব জীবনে বর্ণ ও জাত – রেস ও কাস্ট – সর্বক্ষেত্রে পুরোপুরি অর্থনৈতিক বা শ্রেণিগত অবস্থানের ওপর দাঁড়িয়ে নেই। শুধু অর্থনীতি বা শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে তাই বর্ণবাদ বা জাতকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। রেসিজম অথবা কাস্ট মূলত আছে মনের গভীরে, অবচেতনায়। বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকারের মতে, “কাস্ট ইজ এ নোশন, এ স্টেট অফ মাইন্ড” – জাত একটা ধারণা, মনের অবস্থা। বহু যুগ ধরে কর্তৃত্ববাদী, বিভেদকামী সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশ তাকে সযত্নে লালন করে এসেছে, শিশুকাল থেকেই পালিত হয়েছে মানুষে মানুষে আলাদা করার ভাবনাটা, একে অপরের মধ্যে স্তর বিন্যাসের ধারণাটা।
এই যে আমেরিকা-ইউরোপের কোথাও কোনও একটি রেস্তোরাঁয় বা সিনেমা হলে কালো মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ, স্কুলে এমনকি কলেজে তাদের আলাদা বসার নিদান অথবা আমাদের এই পোড়া দেশে নীচু জাতের কেউ গোঁফ রাখলে, ঘোড়ায় চড়ে বিয়ে করতে গেলে কপালে জোটে বেধড়ক পিটুনি – এ সবের পিছনে অর্থনৈতিক কারণ খুঁজতে যাওয়া বাতুলতার নামান্তর। বেস্টসেলার উপন্যাসে – টু কিল এম কিংবার্ড -- বা হলিউডের রূপোলি পর্দায় – গন উইথ দ্য উইন্ড – কালো মানুষকে অবজ্ঞার চোখে দেখা, পাতি বাংলা সিরিয়ালের নায়িকাদের কেমন যেন ফর্সা ফর্সা হওয়া, রবিবারের আনন্দবাজারে ‘পাত্র-পাত্রী’ বিজ্ঞাপনে গাত্রবর্ণ ও সবর্ণ পরিচিতির প্রতি সীমাহীন আকুতি, এমনকি প্রগতিশীল মিছিলে ‘কালা আইন বাতিল কর’ বা ‘কালো হাত গুড়িয়ে দাও’ স্লোগান ইত্যাদি ইত্যাদি -- বর্ণবাদ বা জাত যে আমাদের দীর্ঘকালীন অন্তরের ব্যাধি, সমাজ-মানসের পর্যুদস্ত হবার লক্ষণ তা ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই।
তবু না মেনে উপায় নেই যে বর্ণ-জাতের একটা জবরদস্ত শ্রেণি-অর্থনৈতিক বুনিয়াদও আছে। ইতিহাসের পাতা ওল্টানো যাক, চোখ ফেরানো যাক আমেরিকায় বর্ণবিদ্বেষী আর এদেশে জাতবিদ্বেষী দুটি কুখ্যাত গণহত্যাকান্ডের দিকে : ২০ এপ্রিল ১৯১৪ সাল, কলোরাডোর লুডলো কয়লা খনিতে ন্যাশনাল গার্ড ও আয়রন অ্যান্ড ফুয়েল কম্পানির পাহারাদাররা স্ট্রাইক ভাঙ্গতে খাদান শ্রমিকদের তাঁবু খাটিয়ে থাকার জায়গা টেন্ট কলোনিতে নির্বিচারে গুলি চালায়; নিহত হন শ’খানেক শ্রমিক ও তাদের পরিজনরা; গুহার ভিতরে আশ্রয় নেওয়া ১৩ জন শিশুকেও নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয়। বলা বাহুল্য, শ্রমিকরা ছিলেন কালো আর খাদান-মালিকরা সাদা। (উডি গাথ্রির গানও আছে এই হত্যাকান্ড নিয়ে – লুডলো ম্যাসাকার)। দ্বিতীয় ঘটনা ঘটে ১৯৬৮ সালের ২৫ ডিসেম্বর; তামিলনাডুর কিলভেনমানিতে ৪৪ জন দলিত ক্ষেতমজুরকে একটি কুড়েঘরে আটকে জীবন্ত জ্বালিয়ে দেওয়া হয়; ক্ষেতমজুররা মজুরি বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন করছিলেন দীর্ঘদিন ধরে; উচ্চবর্ণের জমিদার ও ক্ষেত-মালিকরা এতে ক্ষিপ্ত হয়ে হত্যাকান্ডটির আয়োজন করে।
ঘটনা দুটি থেকে পরিষ্কার, জাত–বর্ণের ব্যাপারটিকে শ্রেণিনিরপেক্ষ ও অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কহীন বলার অর্থ ইতিহাসকে অস্বীকার করা এবং সামাজিক প্রক্রিয়ায় কার্য-কারণ সম্বন্ধকে গুলিয়ে ফেলা। তাই রেস-কাস্টের যে একটা শ্রেণিভিত্তি আছে তা জোরের সাথেই ব্যক্ত করা যেতে পারে। কাস্ট নিয়ে আম্বেদকারের লেখায় এমন ভাবনারই প্রতিফলন ঘটেছে। মনুবাদী বর্ণব্যবস্থা যে আসলে শ্রেণি ব্যবস্থাই তা যৌবনেই তিনি অনুধাবন করেন। ১৯১৬ সালে, ২১ বছর বয়সে, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি তার প্রথম রিসার্চ পেপার – কাস্ট ইন ইন্ডিয়া – পেশ করেন, তাতে লিখেছিলেন “কাস্ট ইজ এনক্লোজড ক্লাস।” জীবনভর তার যত কাজ, তা এই চিন্তাকে ধারণ করেই। তার কাছে কাস্ট সামাজিক উপরিকাঠামো যা দাঁড়িয়ে আছে অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর ওপর। চমৎকার একটি উদাহরণও দিয়েছেন তিনি : “ল্যান্ডলর্ডস আর এ ক্লাস, নোবিলিটি এ কাসট।”
আজ একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে পা রেখে রেস-ক্লাস বা কাস্ট-ক্লাস প্রশ্নের সঠিক মীমাংসা জরুরি হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে জর্জ ফ্লয়েডের হত্যা এবং বিশ্বের নানা প্রান্তে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে। এ প্রশ্নের উত্তর পেতেই হবে, তাহলেই সন্ধান পাওয়া যাবে পুঁজিবাদকে, তার এযাবৎ সবচেয়ে সংকটময় মূহুর্তে, মোকাবিলার পথ।
ইতিহাস বলছে, বিশ্বব্যবস্থা হিসেবে পুঁজিবাদের সূচনা বর্ণবিদ্বেষকে বা রেসিজমকে পাথেয় করেই। সতেরো শতক থেকেই ইউরোপীয় পুঁজিপতিদের একাংশ মধ্য ও উত্তর আফ্রিকায় উপনিবেশ স্থাপনের পর দাস ব্যবসায় নামে। কালো মানুষদের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে গায়ের জোরে তাদের তুলে আনা হত এবং তারপর অ্যাটলান্টিক মহাসাগর পার করে বেচে দেওয়া হত আমেরিকায়। এভাবে কয়েক শতক ধরে দাস ব্যবসার মাধ্যমে ইউরোপ আমেরিকা দুই মহাদেশের পুঁজিপতিরাই বিপুল ধন সঞ্চয়ন করে। আবার দাস ব্যবসাই পুঁজিবাদকে বিশ্বব্যবস্থায় পরিণত করে। কার্ল মার্কস দেখিয়েছেন কিভাবে আমেরিকার ক্রীতদাসরা উৎপাদনের রসদ ও যন্ত্র হিসেবে বুর্জোয়া শিল্পের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিলেন। আমেরিকার দক্ষিণে অ্যালাবামা, অ্যারিজোনা, লুইসিয়ানা, মিসিসিপি, নিউ মেক্সিকো, টেনেসি, টেক্সাস, ভার্জিনিয়া ইত্যাদি রাজ্যের বিস্তীর্ণ তুলো চাষের ক্ষেতগুলিতে আফ্রিকা থেকে আনা কালো ক্রীতদাসদের হাড়ভাঙ্গা খাটুনির ফলেই ইংল্যান্ডের টেক্সটাইল মিলগুলি সচল হতে পেরেছিল এবং বিশ্ববাজারের দখল নেওয়া সম্ভব হয়েছিল। মার্কসের কথায়, “মিসিসিপির ইতিহাস ছাড়া ম্যানচেস্টারের কোনও ইতিহাস নেই।”
আমেরিকার ক্রীতদাস প্রথার বহু শতক আগেই ভারতে যে জাতব্যবস্থা চালু হয়েছিল তা আমরা জানি। জোতিবা ফুলে ১৮৭৩ সালে তার গুলামগিরি প্রকাশ করেন, তাতে তিনি লিখেছেন, শুদ্র, অতি-শুদ্ররা দাসপ্রথা সম্যক উপলব্ধি করতে সক্ষম, কেননা “তাদের দাসপ্রথার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা রয়েছে। ... ব্রাহ্মণরা তাদের জয় করে দাসত্বের শৃঙ্খলে বেঁধেছিল।” এই মতের সাথে আম্বেদকার পুরোপুরি সহমত না হলেও, দাস প্রথা আর জাতপ্রথা যে তুলনীয় তা তিনিও উল্লেখ করেছিলেন। দুটোই তো জন্মের আধারে সৃষ্ট।
১৯৪৭-এর পরে কৃষিতে ‘সবুজ বিপ্লব’, দ্রুত হারে শিল্পায়ন, নগরায়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও তথ্যপ্রযুক্তির চোখ ধাঁধানো অগ্রগতি কিন্তু জাতব্যবস্থার ওপর বুলডোজার চালাতে পারেনি। আজও ম্যানহোল সাফ করার মতো, মৃতদেহ দাহ করার মতো, গরুর চামড়া ছাড়ানোর মতো ‘হীন কাজ’ — মেনিয়াল জব — ওই শূদ্রদের হাতেই ন্যস্ত। আজও সগোত্রবিবাহ — এন্ডোগ্যামী — প্রচলিত, উৎসাহিত। আজও নানাভাবে অস্পৃশ্যতা বিদ্যমান। আর নয়া-উদারনীতির প্রকোপে দলিত ও আদিবাসীরা আজ বাস্তুচ্যুত, জীবিকাচ্যুত। তাদের ওপর অত্যাচার অবিচারের ধারা কেবল অব্যাহত নয়, তার মাত্রা ক্রমবর্ধমান।
বলা হচ্ছে, ‘সাহসী এক নতুন দুনিয়া’ -- এ ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড -- আগত। আসলে মুনাফার হার দ্রুত ও ক্রমাগত পড়তে থাকার ফলে পুঁজিবাদ ভয়াবহ সংকটের সম্মুখীন। এর থেকে উদ্ধার পেতে নয়া-দুনিয়ার নামে পুঁজিবাদ তার পরিক্ষিত সবচেয়ে পুরোনো ব্যবস্থাটাকেই ফিরিয়ে আনতে চায়। দুনিয়া জুড়ে সস্তা মজুরির দাসশ্রমিক তৈরি করে পুঁজির হিমালয় পাহাড় গড়ে তোলাই তার অভিপ্রায়। খেটেখাওয়া মানুষের ঐক্য ভেঙ্গে চুরমার করতে তার মূল হাতিয়ার বর্ণবাদ।
তাই মনে রাখতে হবে মার্কসের কথা : “সাদা চামড়ার শ্রমিক নিজের মুক্তি আনতে পারে না যতক্ষণ অন্য শ্রমিকদের কালো চামড়ার বলে দাগিয়ে দেওয়া হবে”, আর এঞ্জেলা ডেভিসের কথা : “রেসিজম উন্মূলিত করা যাবে না ক্যাপিটালিজম উন্মুলিত না করলে।” এক হতে হবে দুই লড়াইকেই।
-- সুমিত
করোনা আবহে সাধারণ মানুষের দুর্বিসহ অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার নির্লজ্জভাবে ভারতীয় রেলকেও কর্পোরেট স্বার্থে ব্যবহার করে জনজীবনকে এক ভয়ংকর পরিণতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কর্পোরেট কোম্পানির স্বার্থই এই বিজেপি সরকারের একমাত্র চালিকাশক্তি। শুরু হয়েছিল আগেই, প্রতিবাদও ছিল ব্যাপক অংশের রেলকর্মী-সহ সাধারণ মানুষের মধ্যে। সরকার কর্তৃক একপ্রকার অঘোষিত জরুরি অবস্থা জারি করার মধ্যে দিয়ে, পরিবহন তথা জীবিকা নির্বাহে এক বৃহত্তর অংশের শ্রমজীবী মানুষের রেল-নির্ভরতাকে ধর্তব্যের মধ্যে না রেখে গুটিকয়েক মুনাফেকের মুনাফা নির্ভর এজেন্ডা রুপায়নে একগুচ্ছ কর্মসূচী নিয়েছে ভারতীয় রেল। তারা ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছে পর্যায়ক্রমে সারা রেল ব্যাবস্থাকেই বেসরকারী হাতে তুলে দেওয়ার।
১) আনলক পর্যায়ে রেল চলাচল স্বাভাবিক না হতেই রেলমন্ত্রক বহু ট্রেনকেই স্থায়ীভাবে বাতিল ঘোষণা করেছে, যে ট্রেনগুলো মুনাফা তথা বাবুয়ানায় অন্যদের থেকে পিছিয়ে থাকলেও শ্রমজীবী মানুষের কাছে তাদের গুরুত্ব ছিলো একটু বেশিই। তারমধ্যে পূর্ব রেল অর্থাৎ পশ্চিম বাংলার সংযোগকারী ১৭ জোড়া ট্রেন (মেল/এক্সপ্রেস সহ) তালিকায় রয়েছে। আছে হাওড়া-অমৃতসর এক্সপ্রেস, তুফান এক্সপ্রেস, হাওড়া-রাজগির, শিয়ালদহ-বারানসি, শিয়ালদহ-সিতামাড়ি (মুজফফরপুর), কোলকাতা-পাটনা সহ অন্যান্য।
২) ইতিমধ্যেই রেল ১০৮টি রুটে প্যাসেঞ্জার ট্রেন চালাতে বেসরকারী টেন্ডার জারি করেছে। হাওড়া শিয়ালদহ থেকে ছাড়ে এমন ১৯টি গুরুত্বপূর্ণ ট্রেনের বেসরকারী হাতে দেওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে। টিকিট ব্যবস্থা প্রায় পুরোটাই আইআরসিটিসি-র হাতে। নামমাত্র কিছু অংশ এখনও রেলের হাতে থাকলেও অনেক ট্রেনে টিকিট বিক্রির অধিকার নেই রেলের। ডরমিটরি, ওয়েটিং রুম-সহ সমস্ত ক্যাটারিং ব্যবস্থায় ব্যাবসায়ী অধিকার পেয়েছে বেসরকারী সংস্থা।
৩) ৪ লাখ কর্মচারি সংকোচনের লক্ষ্য সহযোগে ননসেফটি ক্যাটাগরিতে ৫০ শতাংশ পোস্ট সারেন্ডার করার আদেশ জারি হয়েছে এবং কোথাও তা কার্যকরী করার সময়সীমা বেধে দেওয়া হয়েছে বর্তমান মাসের (জুলাই) ১০ তারিখ, কোথাও একটু বেশি বা কম। রেলওয়ে রিক্রুটমেট বোর্ড/সেল তুলে দেওয়ার প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে, পাশাপাশি রেলওয়ের তত্ত্বাবধানে বেসরকারী সংস্থার দ্বারা অত্যন্ত কম বেতনে কর্মী নিয়োগ করে অনুসন্ধান, চেকিং ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করানো হচ্ছে।
৪) নিউ পেনশন স্কিম বাতিল সহ কিছু অধিকারের দাবিতে রেল কর্মচারীরা দীর্ঘদিন লড়াই চালানো সত্ত্বেও তার বিপরীতে হেঁটে কর্মজীবন কমিয়ে (৫৫ বছর বয়স বা ৩০ বছর চাকরি যেটা আগে আসে) আনার কৌশলগত পথ অবলম্বন করে বাধ্যতামূলক স্বেচ্ছাবসরে পাঠানোর তালিকা প্রস্তুত করার বিজ্ঞপ্তি জারি করছে এই সরকার।
৫) ট্রেন কম্পার্টমেন্ট সহ সমস্ত স্টেশনগুলির হকার উচ্ছেদের ব্লুপ্রিন্ট প্রস্তুত, জীবিকা হারাবে গরিব মানুষ আর সেখানে ব্যাবসার একচেটিয়া অধিকার থাকবে কোন বহুজাতিক সংস্থার।
৬) ব্যাপক মানুষের বেকারত্বর সুযোগ নিয়ে অতি সামান্য বেতনে অস্থায়ী কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু এবং ৮ ঘণ্টার পরিবর্তে ১২ ঘণ্টা কাজে বাধ্য করার আইনি স্বাধীনতা যথেচ্ছ ভাবেই বহুজাতিক সংস্থাগুলোকে দিচ্ছে এই সরকার বিভিন্ন শ্রম আইন সংশোধনের মধ্যে দিয়ে।
একদিকে দেশের প্রধানমন্ত্রী আমাদের আত্মনির্ভরশীল হওয়ার কথা বলছেন, অপর দিকে দেশের সমস্ত সরকারী ক্ষেত্রই দেশি-বিদেশি কর্পোরেটের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। মানুষ হারাচ্ছে তার অধিকার। রেলের ক্ষেত্রেও ভিন্ন কিছু নয়। সমস্ত পরিবর্তনগুলো ঘটছে অতি দ্রুততার সাথে এই লকডাউন সময়কাল জুড়ে সাধারণ মানুষের অসহায়তাকে কাজে লাগিয়ে। সামান্য অংশের বিলাসী মানুষ প্রাথমিকভাবে এই দৃশ্যত ঝাঁচকচকে ব্যবস্থার শরিক হতে চাইলেও দেশের বেশিরভাগ মানুষের জীবনে নেমে আসতে চলেছে এক ভয়ানক পরিণতি।
জেনারেল কম্পার্টমেন্ট তুলে দেওয়ার পক্ষে রেল। ট্রেন যাত্রায় গরীব মানুষের অধিকার খর্ব করা হচ্ছে মুনাফার মাপকাঠিতে। রেলে কয়েকগুণ ভাড়া বৃদ্ধি এখন সময়ের অপেক্ষা মাত্র। ইতিমধ্যেই সারা বছরকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে চাহিদার নিরিখে চার থেকে ছয় গুণ ভাড়া আদায়ের নজির রেখেছে রেল ‘প্রিমিয়াম’ শব্দ ব্যবহার করে। প্রস্তাব আছে প্রতি সপ্তাহেই চাহিদার নিরিখে দিন ভাগ করে ভাড়া বৃদ্ধির। বেসরকারী টিকিটিং ব্যাবস্থায় ইতিমধ্যেই লক্ষ্য করা গেছে কিছু ট্রেনে উচ্চশ্রেণির কামরা না চালিয়েও মাসের পর মাস ওই নির্দিষ্ট কামরার টিকিট বিক্রি করা হয়েছে, যার অনিবার্য পরিণতি হিসেবে এসেছে কর্মরত রেলকর্মী আর যাত্রীদের মধ্যে সংঘাত।
রেল বেসরকারী হওয়ার দুর্ভোগ শুধুমাত্র রেলকর্মী ও তার পরিবারের নয়, প্রায় সর্বস্তরের মানুষের ক্ষেত্রেই কোনও না কোনও ভাবে তার প্রভাব থাকবে। দেশের সর্ববৃহৎ পরিবাহী ব্যবস্থা রেলের ওপর নির্ভরতা আমাদের সবার। প্রতিহত করার দায়ও তাই আমাদেরই। রেল কর্মচারিরা সংগঠিতভাবেই লড়াইয়ে আছেন, থাকবেনও। শুধুমাত্র রেলকর্মী নয়, সর্বস্তরের মানুষের প্রতিবাদী প্রয়াসেই বন্ধ হতে পারে এই লুঠের কারবার, পাল্টে যেতে পারে এই লুটেরার সরকার।
-- শঙ্কর রায়
ঝোড়ো হাওয়ায় বেশ কিছু পাতা উল্টে গেছে। কিন্তু অধ্যায়টা এখনও শেষ হয়নি। প্রকৃতির লীলানিকেতন সেই রম্যভূমি এখন কাঁটাতার ঘেরা — মানবতার বধ্যভূমি।
৩৭০ ধারা বিলোপ তথা রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা খোওয়ানোর পর প্রায় বছর ঘুরে এল। ‘ভূস্বর্গ’ কেমন আছে? কেমন আছেন উপত্যকার মানুষজন? উত্তরটা জানা। সামরিক বাহিনীর ভারী বুটের তলায় নেট-বিচ্ছিন্ন উপত্যকায় এখনও সংঘাত সংঘর্ষ রক্তস্নান অব্যাহত। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, লকডাউনপর্বে অন্তত ৭৩ জন কাশ্মীরী জঙ্গি নিহত হয়েছে, শুধু এপ্রিলেই ২৮ জন। নিরীহ নাগরিকও মারা গেছেন।
কিন্তু অতিমারী কোভিড১৯-এর লকডাউনের আড়ালে যেটা চলছে, তা বোধ হয় আমাদের জানা ছিল না। সেখানটাতেই একটু আলোকপাত করা যাক। গত ৯ মে সাউথ এশিয়া সলিডারিটি গ্রুপের উদ্যোগে এক অন-লাইন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় — ‘সাইলেন্সিং দ্য ট্রুথ টেলার্স: কাশ্মীর আন্ডার অকুপেশন ইন দ্য টাইম অব কোভিড-১৯’ শিরোনামে। সেই বৈঠকে বক্তাদের কণ্ঠে একে একে উঠে এসেছে কীভাবে কোভিড১৯-এর আড়ালে, ৩৭০ ধারা বিলোপ ও নতুন স্থায়ী বাসস্থান সংক্রান্ত আইন (ডোমিসাইল ল)-কে কাজে লাগিয়ে চলছে কর্পোরেট পুঁজির দ্বারা অবাধ লুণ্ঠন, তার জ্বলন্ত, মর্মস্পর্শী ছবি।
এই ওয়েবিনারে অংশ নেন লেখক ও আইনজীবী মির্জা সালিব বেগ, কাশ্মীর উইমেন্স কালেকটিভ-এর প্রতিনিধি আর্শি কুরেশি এবং কাশ্মীর সলিডারিটি মুভমেন্ট থেকে মেহরুশ তাক।
এমনিতেই ব্যাপক মাত্রায় সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি এবং যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা কাশ্মীরে কোভিড-১৯ পরিস্থিতিকে আরও ভয়ঙ্কর করে তুলেছে, মানুষের বিপন্নতা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। আর এই পরিস্থিতিতে লকডাউনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে মোদী সরকার কাশ্মীরী জনসাধারণের উপর দমনপীড়ন তথা নজরদারির মাত্রা তীব্রতর করে উপত্যকায় ঘটে চলা সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠকে স্তব্ধ করার ভয়ঙ্কর অভিযানে নেমেছে। এই ভয়ানক আবহে ৩৭০-ধারা-বিলোপ-পরবর্তী পরিস্থিতি এক নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। কাশ্মীরে ইজরায়েলি ধাঁচে এক ‘সেটলার’ উপনিবেশবাদ কায়েম হতে চলেছে আর তার ক্রমবিকাশে সহায়ক হয়ে উঠেছে নতুন ‘স্থায়ী বাসস্থান সংক্রান্ত আইন’। এই সব লুঠের যারা প্রতিবাদ করছেন তাদের জন্য প্রযুক্ত হচ্ছে দানবীয় আইন। কাশ্মীরের বিখ্যাত চিত্রসাংবাদিক মাশরত জাহরাকে গত ২০ এপ্রিল ইউএপিএ-১৯৬৭-তে অভিযুক্ত করা হয়েছে ১৯ মাস আগের একটি ফোটোগ্রাফের বাহানায়। ঐ দিনই ‘দ্যা হিন্দু’ পত্রিকার কাশ্মীর করেসপন্ডেন্ট পীরজাদা আশিকের বিরুদ্ধে জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশ এফআইআর করে ‘ফেক নিউজ’-এর অভিযোগে — আর যথারীতি সংবাদপত্রকে কোন কারণ না দর্শিয়েই এটা করা হয়। ২১ এপ্রিল জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশ প্রখ্যাত লেখক ও সাংবাদিক জওহর গিলানিকে ‘সন্ত্রাসবাদকে গৌরবান্বিত করা’ এবং ‘ভাবতের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতার প্রতি ক্ষতিকর কাজকর্মকে প্রশ্রয় দেওয়ার’ অভিযোগে গ্রেফতার করে। তিনি আগের দিন মাশরত ও পীরজাদার সমর্থনে লিখেছিলেন, এটাই তাঁর ‘অপরাধ’! এইভাবে সাংবাদিক নিগ্রহ চলছেই। সম্প্রতি ‘কাশ্মীরওয়ালা’-র সম্পাদককে পুলিশি হেনস্থার মুখে পড়তে হয় — পুলিশের ‘সুনাম’ ‘কালিমা লিপ্ত’ করার অভিযোগে। আসলে কী ‘অপরাধ’ করেছিলেন তিনি? নাওয়াকাদালে গুলিযুদ্ধের পর পুলিশ এই অতিমারীর সময় অন্তত পনেরোটি বাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় আর সরকারী কর্মচারিরা সেখানে ব্যাপক লুঠপাট চালায় — স্থানীয় অধিবাসীদের এই অভিযোগ তিনি তাঁর পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন।
অনলাইন বৈঠকে মির্জা সালিব বেগ ডোমিসাইল আইনপ্রণয়ণ সংক্রান্ত পরিবর্তনের মারাত্মক বিষয়টি নিয়ে বলেন। কোভিড১৯ লকডাউনের সূচনা থেকেই মোদী সরকার এই প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের এই কর্তৃত্বমূলক সুবিধাবাদের নাটকীয় ফলাফল কাশ্মীরের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নির্লজ্জভাবে প্রকটমান। নতুন স্থায়ী বাসস্থান সংক্রান্ত আইন পাস করানোর জন্য লকডাউনের সময়টা বেছে নেওয়া মোদী সরকারের রণকৌশলগত (স্ট্র্যাটেজিক) সিদ্ধান্ত। কারণ সেই মাত্রায় প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ এখন অসম্ভব। এই আইন শুধু জনবিন্যাসগত পরিবর্তনকেই অনুমোদন করছে না, কাশ্মীরকে লুঠ করার অবাধ সুযোগও করে দিয়েছে। এই প্রথম কাশ্মীরে ভারতীয় নাগরিকদের ও কোম্পানিগুলিকে জমি ও খনিজ উত্তোলনের অধিকার দেওয়া হল। খনিজ উত্তোলনের নিলাম ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে। ১০০% লিজ-ই চলে গেছে অ-কাশ্মীরীদের হাতে। সত্যি বলতে কি, খুব ভেবে চিন্তেই অকশন করা হয়েছে অনলাইনে। কারণ কাশ্মীরে এখনও ‘ইন্টারনেট শাটডাউন’ চলছে। তাই নেট-বঞ্চিত কাশ্মীরীরা এই নিলামে অংশও নিতে পারেননি। মির্জা সালিব বেগ মনে করেন, বিবেকবান ভারতীয়দের এই প্রক্রিয়ায় অংশ গ্রহণ থেকে বিরত থাকা উচিত।
কাশ্মীর উইমেন্স কালেকটিভ-এর সদস্য আর্শি কুরেশি একজন গবেষক ও মহিলা মানবাধিকার কর্মী। তিনি গার্হস্থ্য হিংসার শিকার মহিলাদের নিয়ে কাজ করছেন। তাঁর সংগঠন মহিলা অধিকার রক্ষা নিয়ে কাজ করছে। নেট-বিচ্ছিন্ন থাকায় তিনি সরাসরি বৈঠকে অংশ নিতে পারেননি। আগে রেকর্ড করা ভিডিও পাঠিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন কাশ্মীরে মানবাধিকার থেকে বিচ্ছিন্ন করে নারীর অধিকারকে বোঝা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, কাশ্মীরে কোভিড১৯ নিয়ে বিদ্রোহ দমনের মনোভাব মানবাধিকারের প্রশ্নটিকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। মোবাইল পরিষেবা বন্ধ রাখা আসলে গোটা কাশ্মীরী সমাজকে শাস্তি দেওয়া। অতিমারির পরিস্থিতিতে মানুষ স্বাস্থ্য পরিষেবা পাচ্ছে না। গার্হস্থ্য হিংসার শিকার মহিলারা কোন সাহায্য পাচ্ছেন না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মাত্র ১৯৬-টি বা তার কম বাড়িতে ল্যান্ড ফোন আছে।
ডঃ মেহরুশ তাক, কৃষি ও খাদ্য বিষয়ক অর্থনীতির বিশেষজ্ঞ, কাশ্মীর সলিডারিটি মুভমেন্টের সহ-প্রতিষ্ঠাতা জানালেন, ঐ মুহূর্তে শ্রীনগরে কোভিড১৯-এ আক্রান্ত রেড জোনের সংখ্যা ১৫টিরও বেশি। এই বিষয়ে, সেনাবাহিনী প্রতিবাদ দমনের উদ্দেশ্যে অঞ্চলগুলিকে কর্ডন করার জন্য নিজেদের খেয়াল খুশিমত ঘোষণা করে। বাস্তব পরিস্থিতি অনুযায়ী নয়। তিনি আরও বলেন, কাশ্মীরী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির সাম্প্রতিক অধিগ্রহণ কীভাবে কাশ্মীরের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও কৃষক সম্প্রদায়কে ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে এবং তাদের ভারতীয় কর্পোরেটদের কাছে ‘অভাবী বিক্রি’ করতে বাধ্য করছে। কাশ্মীরে অনেকেই অরণ্যভূমির উপর নির্ভরশীল, সেই অধিকারও ৩৭০ ধারা বিলোপের মাধ্যমে তলে তলে গ্রাস করা হচ্ছে। খাদ্যের অধিকার ও খাদ্য সুরক্ষা বিপন্ন। কোভিড১৯ পরিস্থিতিতে অনাহারের আশঙ্কা অনেকটাই বেড়ে গেছে। কাশ্মীরে আন্তর্জাতিক মানবিক ত্রাণ বন্ধ, যবে থেকে এটি একটি দ্বিপাক্ষিক বিষয় হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। ড: তাক আরও বলেন, গ্রেট ব্রিটেন এবং ভারতের মধ্যে ঘনিষ্ঠ আর্থিক সম্পর্ক, ব্রিটেনে হিন্দুত্ববাদীদের লবিবাজি এবং জাতি বৈষম্য আইন, কাশ্মীর সম্পর্কে সঠিক অবস্থান নেওয়ার পথে ব্রিটেনের অন্তরায়।
সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে ‘ফ্রন্ট লাইন’-কে লেখক মির্জা ওয়াহিদ সক্ষোভে বলেছেন, “ভারত কাশ্মীরে ক্রমবর্ধমানভাবে যে আচরণ করে চলেছে তা ইজরায়েল-অধিকৃত প্যালেস্টাইনের সঙ্গেই তুলনীয়। দিল্লি কাশ্মীরকে ধ্বংস করতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু ইতিহাস আমাদের বলে, কাশ্মীরী জনজীবনকে ভেঙেচুরে অন্য কাঠামো দেওয়ার নিষ্ঠুর চেষ্টা যতই চলুক কাশ্মীরী জনগণ আত্ম-নির্ধারণের সংগ্রামে অবিচল থাকবেন”।
-- জয়ন্তী দাশগুপ্ত
করোনা ভাইরাসের প্রকোপ পুরো বিশ্বে চলছে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সারা বিশ্বে গবেষণা করছেন বিজ্ঞানীরা। দুই ধরনের জিনিস বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে -- এক হল ওষুধ আর আরেক হল প্রতিষেধক। ওষুধের কাজ কোনো রোগে কেউ সংক্রমিত হয়ে গেলে তা সারিয়ে তোলা। প্রতিষেধকের কাজ হল কোনো রোগের বিরুদ্ধে আমাদের শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলা যার ফলে আমাদের রোগটা আর হবেই না বা খুব কম হয়ে সেরে যাবে। আমরা সবাই ছোটবেলায় পোলিও প্রতিষেধক নিয়েছি। ট্রিপিল এন্টিজেন নামে তিনটি অসুখের প্রতিষেধক শিশুদের একদম ছোটবেলায় দেওয়ার চল আছে।
ভারতীয় কোম্পানি ‘ভারত বায়োটেক’ আর সরকারী গবেষণা সংস্থা আইসিএমআর মিলে কোভিড১৯-এর একটি প্রতিষেধক বার করেছে। কিন্তু তা সত্যি কার্যকরী কিনা সেটা বুঝতে মানুষের ওপর সেই প্রতিষেধকের পরীক্ষা চালাতে হবে। ভারতের ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা এই প্রতিষেধকের পরীক্ষা চালু করার নির্দেশ দিয়েছে।
এই পরীক্ষার জন্য চিহ্নিত হয়েছে বেশ কয়েকটি হাসপাতাল যেখানে এই পরীক্ষা চালানো হবে। কিন্তু গোল বেঁধেছে আইসিএমআর-এর প্রধান এম ভার্গভের ২ জুলাইয়ের চিঠিতে। তিনি এই হাসপাতালগুলোকে লিখিত নির্দেশ দিয়ে বলেছেন যে যাদের ওপর ভ্যাক্সিনটি পরীক্ষা করা হব তাদের চিহ্নিত করার কাজ ৭ জুলাইয়ের মধ্যে হয়ে যাওয়া চাই। একথাও জানিয়ে দেওয়া হয় যে, প্রতিষেধকটি সর্বসাধারণের জন্য ১৫ আগস্ট ২০২০ থেকেই বাজারে ছাড়া হবে। মানে পরীক্ষা চালু হওয়ার দেড় মাসের মধ্যে বাজারে প্রতিষেধক চলে আসবে।
প্রশ্ন হল এই পরীক্ষা কি দেড় মাসে করা সম্ভব? এবং পরীক্ষা যদি ঠিক মতো না হয় তাহলে মানুষের কী কী ক্ষতি হতে পারে?
নতুন প্রতিষেধক পরীক্ষার ৩ টি আবশ্যিক ধাপ আছে। এক নম্বর ধাপে কয়েকশো লোককে বাছা হয়। তাদের দুটো টিম করা হয়। এক টিমকে প্রতিষেধক দেওয়া হয়। আরেক টিমকে বলা হয় যে প্রতিষেধক দেওয়া হচ্ছে কিন্তু আসলে দেওয়া হয় না। এর পর দেখা হয় যে প্রতিষেধক পাওয়া টিমের লোকেরা প্রতিষেধক না পাওয়া টিমের থেকে ভাল থাকছে কি না। দ্বিতীয় ধাপে এই একই জিনিস কয়েক হাজার লোকের ওপর করা হয়। তৃতীয় ধাপে এই একই পদ্ধতিতে কয়েক লাখ লোকের ওপর পরীক্ষা করা হয়।
প্রথম পরীক্ষায় দেখা হয় যে এই প্রতিষেধক মানুষের জন্য নিরাপদ কিনা। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে দ্বিতীয় পরীক্ষায় দেখা হয় যে প্রতিষেধকের কোন ডোজটা সবচেয়ে কার্যকরী এবং তার সঙ্গে কোন ডোজটা কতটা নিরাপদ। তৃতীয় ধাপে দেখা হয় যে নির্দিষ্ট এই ডোজে প্রতিষেধকটি ব্যবহার করলে বড় সংখ্যক মানুষের ওপর তা কার্যকরী হচ্ছে কি না। এই প্রত্যেকটি ধাপে উত্তীর্ণ হলে তবেই জন সাধারণের জন্য এই প্রতিষেধক ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়।
এই পুরো পরীক্ষাটি খুব তাড়াতাড়ি করলে লাগে ১ থেকে দেড় বছর। কিন্তু মোদী সরকার সেটা সেরে ফেলতে চাইছে দেড় মাসে। এরকম চাওয়ার কারণটা ন্যাক্বারজনক — স্বাধীনতা দিবসে মোদির ভাষণে ক্রেডিট নিয়ে রাজনৈতিক মুনাফা লোটার ইচ্ছে — বলে লোকে মনে করছে।
এই ধরনের প্রতিষেধককে যদি সঠিক ভাবে না পরীক্ষা করেই চালু করে দেওয়া হয় তাহলে তার ফল হতে পারে মারাত্মক। সবচেয়ে খারাপ জিনিস যেটা হতে পারে সেটা হল শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা না বাড়িয়ে তা মানুষের শরীরকে আরও রোগ প্রবণ করে তুলতে পারে। আমেরিকায় ১৯৫৫ সালে পোলিও প্রতিষেধক দেওয়া হয়েছিল বহু বাচ্চাকে। কিছুদিনের মধ্যেই জানা গেছিল যাদেরকে সেই প্রতিষেধক দেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে অনেকের পোলিও ধরা পরেছে। ৪০,০০০ বাচ্চা পোলিও রোগে আক্রান্ত হয়ে গেছিল।
ভারতের আকাদেমি অফ সাইন্স এই ধরনের সরকারী আদেশের নিন্দা করেছে এবং বলেছে দেড় মাসের সময়সীমা এই পরীক্ষার জন্য মোটেই যথেষ্ট নয়।
এই পুরো ঘটনায় এটা পরিষ্কার হয়ে গেল যে মোদী সরকার নিজের রাজনৈতিক মুনাফা লোটার ধান্দায় হাজার হাজার মানুষের প্রাণ বিপন্ন করতেও পিছপা হবে না। তারা আগে বহু অবৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার পরিচয় দিয়েছে। করোনা ভাইরাস মহামারী শুরু হওয়ার সময় তারা বলছিল যে গোমূত্র খেয়ে বা গঙ্গা জল খেয়ে নাকি করোনা ঠিক হয়ে যাবে। আজ পর্যন্ত কেউ এভাবে ঠিক হয়নি। এরপর সঠিক ভাবে পরীক্ষা না করে যদি মানুষকে এই প্রতিষেধক দেওয়া হয় তাহলে তা প্রচুর জীবন নষ্ট করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। তার ওপর তাদের এই অবৈজ্ঞানিক কার্যকলাপের জন্য একটি প্রতিষেধক শেষ পর্যন্ত আবিষ্কার হলেও মানুষ সেটি নিতে ভয় পাবে।
-- প্রত্যুষ নন্দী
সিপিআই(এমএল)-এর বিহার রাজ্য সম্পাদক কুনাল ২৯ জুনের এক বিবৃতিতে দাবি করেছেন, বিজেপি-জেডিইউ জমানায় সিবিআই সৃজন দুর্নীতি নিয়ে যে চার্জশিট দাখিল করেছে তা একেবারেই সন্তোষজনক নয়। কেননা, এর মধ্যে দুর্নীতিতে জড়িত রাঘববোয়ালদের আড়াল করার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে। সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার এবং উপ-মুখ্যমন্ত্রী সুশীল মোদীর জড়িত থাকার দিকেই নির্দেশ করছে এবং তাঁদেরও তদন্তের আওতায় আনতে হবে।
অতিকায় এই দুর্নীতি সম্ভবত আজ পর্যন্ত বিহারে হওয়া সবচেয়ে বড় দুর্নীতি এবং ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের নাকের ডগাতেই এই দুর্নীতি ঘটেছে। অতএব, দুর্নীতিতে যোগানো রাজনৈতিক সুরক্ষার বিষয়টা নিয়ে তদন্ত না হলে সত্য কখনই প্রকাশ পেতে পারে না।
সুশীল মোদী নাকি এমন মানুষ যিনি ‘দুর্নীতি ফাঁস করে থাকেন’। সেই তিনিই দীর্ঘদিন ধরে অর্থমন্ত্রী হয়ে রয়েছেন। তাঁর অনেক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ই এই দুর্নীতিতে জড়িয়ে রয়েছেন। মনোরমা দেবীর সঙ্গে ওঠাবসা করা অনেক বিজেপি নেতার ছবিই ভাইরাল হয়েছে। এই ব্যাপারে নীতীশ কুমার ও সুশীল মোদী তাঁদের দায় এড়িয়ে যেতে পারেন না। সুশীল মোদীকে এই প্রশ্নের উত্তর দিতেই হবে: এত দীর্ঘ সময় ধরে সরকারের তহবিল যখন লুট হয়ে চলেছিল তখন তিনি কি করছিলেন?
লালু প্রসাদ সে সময় অর্থমন্ত্রী ছিলেন বলে পশু খাদ্য কেলেঙ্কারিতে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। সৃজন দুর্নীতির আকার পশু খাদ্য কেলেঙ্কারির দ্বিগুণ এবং এটা এক সংগঠিত লুট। কাজেই, মুখ্যমন্ত্রী এবং উপ-মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হবে না কেন? অতিকায় এই দুর্নীতিতে জড়িত রাঘববোয়ালদের উদ্দেশ্যমূলকভাবে আড়াল করা হচ্ছে। নির্লজ্জতার সমস্ত সীমা ছাড়িয়ে গিয়ে সুশীল মোদী বলেছেন যে, তদন্ত যে দিশায় এগোচ্ছে তাতে তিনি সন্তুষ্ট। সম্ভবত এই জন্যই তিনি এই কথা বলছেন যে, তদন্তের দিশা তাঁর থেকে ক্রমশই দূরে সরে যাচ্ছে এবং তাঁকে আড়াল করতে সিবিআই চেষ্টার কোন কসুর করছে না।
হাওড়া জেলার শেষ প্রান্তে ভাটোরা। ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। রূপনারায়ন, মুন্ডেশ্বরী ও দামোদর নদী পরিবেষ্টিত ভাটোরা অপরদিকে তিনটি জেলার সন্নিহিত (হাওড়া, হুগলী ও পূর্ব মেদিনীপুর) অঞ্চল, পূর্ব দিকে রূপনারায়ন পাড়ে গুপিগঞ্জ (পূর্ব মেদিনীপুর) পশ্চিম দিকে দামোদর পেরিয়ে খানাকুল (হুগলী) আর উত্তরে মুন্ডেশ্বরীর কোলে ভাটোরা। আমতা-২ ব্লকের শেষ প্রান্তে কয়েক হাজার মানুষের বসবাস। জীবিকা বলতে মুলতঃ কৃষিকাজ, বিড়ি বাঁধা, সময় বিশেষে নদীতে মাছ ধরা। যাতায়াত ব্যবস্থা বলতে নৌকা/বাঁশের তৈরি ব্রীজ। বাজারহাট করতে গেলেও যেতে হবে বাকসী না হয় গুপীগঞ্জ। সাধারণ মানুষের আক্ষেপ এখানে কিছুই নেই, বন্যাপ্রবণ এলাকার মানুষের দাবি সড়কপথে হাওড়া ও মেদিনীপুরের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থার। নেইএর রাজ্যে আছে তবু উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের স্কুল, চিকনানের দিকে একটি মাদ্রাসা আর পুলিশ চৌকি। আমরা উত্তর ভাটোরার দিকে গিয়েছিলাম। কুলিয়া বাস ষ্ট্যান্ডে (বিধ্বংসী সাইক্লোন আমফানে হাওড়া জেলার বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার অন্যতম এই অঞ্চলটি)। স্বাস্থ্যবিধি মেনে দুটি লাইন করে দুরত্ব বজায় রেখে ত্রাণ দেওয়া হয়। সর্বতোভাবে সহযোগিতা করে স্হানীয় ক্লাবের ছেলেরা। প্রায় একশ ষাটজন মতো মানুষের হাতে ত্রাণসামগ্রী তুলে দেওয়া হয়। কমরেড নিত্যানন্দ ঘোষ প্রথম প্যাকেটটি তুলে দেন। আইপোয়া ও পরিষদের কর্মীরা ছাড়াও বাগনানের এবং জেলা পার্টি নেতাদের অনেকে উপস্থিত ছিলেন। এলাকাবাসীর সাথে আগামী দিনে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।