( হেডিং-এর ওপর ক্লিক করে নির্দিষ্ট লেখাটিই শুধু দেখতে পাবেন )
কোভিড-১৯ সংক্রমণ আটকাতে অবিবেচনাপ্রসূত ও অপরিকল্পিত লকডাউন ঘোষণার ফলে ১২ কোটি পরিযায়ী শ্রমিক ও তাদের পরিবারবর্গের জীবন-জীবিকা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। কাজ হারা এই শ্রমিক ও তাদের পরিবার পরিজন যখন চরম আর্থিক দুরবস্থায় দিন কাটাচ্ছে, তখন তাদের পাশে এসে সাহায্যের হাত বাড়ায়নি কোনো সরকার। কেন্দ্রের সরকার রাজ্যের ঘাড়ে দায় চাপিয়েছে, রাজ্যের সরকার “ওরা আমাদের কেউ নয়” বলে দায় এড়িয়ে ছিল। এমনকি তাঁরা যাতে নিজের নিজের রাজ্যে ফিরতে না পারে তার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে যোগসাজশে পুঁজিপতি ও নিয়োগ কর্তারা আটকে রাখার চেষ্টা চালায়। দেশজুড়ে তীব্র প্রতিবাদ, বিক্ষোভ ও আন্দোলনের পর পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরা শুরু হয়েছে, ইতিমধ্যে কত শ্রমিক ও তাদের সন্তান-সন্ততির প্রাণ চলে গেছে, ইতিহাস তার সাক্ষী থাকল।
আমাদের রাজ্যের ১২ থেকে ১৩ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক ও তাদের পরিবারের মানুষেরা ঘরে ফিরবেন, আজ না হোক কাল এ তথ্যও সকলের জানা। আড়াই-তিন মাস ধরে রাজ্য জুড়ে এ নিয়ে চর্চা চলছে। যেহেতু এই শ্রমিকদের অধিকাংশই কোভিড-১৯ সংক্রমণের শীর্ষে থাকা রাজ্যগুলি যথা মহারাষ্ট্র, গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, পঞ্জাব, দিল্লি, তামিলনাড়ু থেকেই আসবেন, ফলে তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা, দীর্ঘপথে একটু খাবার ও পানীয় জলের ব্যবস্থা করা, সংক্রমণ এড়াবার জন্য শারীরিক দূরত্ব ও মাস্কের ন্যূনতম ব্যবস্থা করা যায় তা কেন্দ্রের বিজেপি সরকার আগেই দায় ঝেড়ে ফেলেছে, চেষ্টা করেছিল ট্রেন ভাড়াটাও আদায় করে নেওয়ার।
আড়াই-তিন মাস সময় পেয়েও রাজ্য সরকারও কোনো ব্যবস্থা প্রস্তুত করেনি। কত ভিডিও কনফারেন্স, কত চিঠিপত্রের আদান প্রদান, জল একবিন্দু এগোয়নি। এরমধ্যে কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী পীযূষ গয়ালের মাধ্যমে রাজনীতির নতুন খেলা শুরু হয়েছে। রাজ্যের সরকারগুলির সাথে বিন্দুমাত্র আলাপ আলোচনা ও পরিকল্পনা না করে ট্রেনে পরিযায়ীদের ফেরানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ন্যূনতম স্বাস্থ্য পরীক্ষা না করে, সরকারী কোয়ারাইন্টিন ব্যবস্থাকে লাটে তুলে দিয়ে পরিযায়ীরা ঘরে ফিরছেন। যার ঘর আমপান বিধ্বংসী ঝড়ে উড়ে চলে গেছে, তিনি কোথায় নিভৃতবাসে থাকবেন তা কেউ জানে না।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এরফলে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশংকা যেমন করছেন, গ্রাম-শহরে জনগণের মধ্যে বিবাদ তৈরির খেলায় নেমেছে স্বার্থান্বেষী বিভিন্ন শক্তি। একে কী করে বৈরী দ্বন্দ্বে পরিণত করা যায় তারও চেষ্টা চলছে, চলবে।
আমরা রাজ্যের বিবেকবান, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিশীল জনগণের কাছে আবেদন জানাই, আসুন আমরা চরম সংকটগ্রস্ত বাংলায় কোনো বিভেদকামী শক্তি যাতে এ সুযোগ না পায়, তার জন্য সচেষ্ট হই। রাজ্য সরকারকে স্পষ্ট ভাষায় পরিযায়ী শ্রমিকদের পুনর্বাসন ও জীবন-জীবিকার দায়িত্ব পালনের নীতি ও পদক্ষেপ ঘোষণা করতে হবে।
ধন্যবাদান্তে
পার্থ ঘোষ
রাজ্য সম্পাদক, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি, সিপিআই(এম-এল) লিবারেশন
করোনা ভাইরাস সংকটজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই মর্মে হুঁশিয়ারি জারি করার পর প্রায় চার মাস পেরিয়ে গেল, আর ভারত সরকার সারা দেশে লকডাউন চাপিয়ে দেওয়ার পরও পেরিয়ে গেল দু-মাস। ভাইরাসের উৎস দেশ চীন এবং এশিয়ার অন্যান্য কয়েকটি দেশ ভাইরাসের কবল থেকে মোটামুটি মুক্ত হতে পেরেছে। এবং ভাইরাসের মোকাবিলায় চীন যে পরিকল্পনা গ্ৰহণ করেছিল, সেই লকডাউনই সারা বিশ্বে ভাইরাস মোকাবিলার অনিবার্য পথ হয়ে উঠেছে, যদিও স্থানীয় ভিত্তিতে তার রকমফের ঘটেছে। তবে আমেরিকা মহাদেশ ও ইউরোপের অনেক দেশেই, এবং যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণভাবে ভারতে এবং দক্ষিণ এশিয়ার বাকি দেশগুলোতে এই মহামারী ভয়ঙ্কর আকার নিয়েই চলেছে। আর বিশ্বের কোথাও যদি মহামারী সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতিকে বহুগুণ ছাপিয়ে গিয়ে থাকে লকডানের আদায় করা মাসুল, তবে সে দেশটার নাম হল ভারত। পরিতাপের ব্যাপার হল, দু-মাস ধরে তালগোল-পাকানো, দিশাহীন এবং স্বৈর চরিত্রের লকডাউন চলার পর ভারত যখন এর থেকে বেরিয়ে আসার পথ হাতড়ে বেড়াচ্ছে, মহামারী তখনও তার বিস্তার ঘটিয়ে চলেছে এবং মহামারীর ঊর্ধ্বমুখী রেখাকে আনুভূমিক করার যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল তার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না।
দুনিয়ায় অতীতে এর চেয়েও মারাত্মক ভাইরাসের প্রকোপ দেখা গেছে, আধুনিক ইতিহাসে ভাইরাসের ভয়াবহ প্রকোপের একটা দৃষ্টান্ত হল ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু এবং তারপর সাম্প্রতিক দশকগুলোতে যে সমস্ত প্রাণঘাতী ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে তার মধ্যে রয়েছে ইবোলা, জাইকা, সারস এবং নিপা। তবে কোভিড-১৯ তার ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপ্তি ও গতি দিয়ে গোটা দুনিয়াকেই হতবুদ্ধি করে দিয়েছে। এর সাথে লকডাউন প্রসূত বিপর্যয়কে মেলালে সংকটটা অভূতপূর্ব এবং অভাবনীয় হয়েই দেখা দিচ্ছে। অনেক দিক থেকেই এই অতিমারিকে সৃষ্টি করেছে এবং বাড়িয়ে তুলেছে বৈশ্বিক পুঁজির সম্প্রসারণ ও শক্তিবৃদ্ধি। প্রকৃতির নির্বিচার ধ্বংস, বিশ্বে বেড়ে ওঠা যাতায়াত ও পরিযান, কৃষির কর্পোরেটিকরণ এবং জনস্বাস্থ্যর প্রণালীবদ্ধ অবহেলা -- এ সবই বিশ্বায়নের ধাঁচা ও গতিধারার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত এবং কোভিড-১৯ সৃষ্ট বিপর্যয়ে এ সবেরই অবদান রয়েছে।
ভারতের কথা ধরলে, এখানে অনিষ্ট অতিমারির চেয়ে লকডাউনের কারণে হয়েছে অনেক বেশি। এটা বলার মধ্যে দিয়ে অবশ্য সাম্প্রতিক সময়ে ভারতে মহামারীর বিপজ্জনক আকার নেওয়ার ব্যাপারটাকে একেবারেই খাটো করা হচ্ছে না। এখানে নমুনা পরীক্ষা চূড়ান্ত রূপে কম হওয়া সত্ত্বেও কোভিড-১৯ ব্যাধিতে আক্রান্তের সংখ্যা এক লক্ষের গণ্ডি পেরিয়ে গেছে, তবে ভারতে মহামারীর ভয়ালতার হার বিশ্ব গড়ের তুলনায় অনেক কম। ভারতে সংক্রমিতের প্রাণহানির হার ৩ শতাংশের সামান্য বেশি যা বিশ্ব গড়ের বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নথিবদ্ধ হারের অর্ধেক, এবং তা আবার ইউরোপের কয়েকটি দেশে প্রাণহানির হার ১০ থেকে ২০ শতাংশের মধ্যে হওয়ার চেয়ে তো অনেক নীচে। কিন্তু মহামারীর এই মাঝারি মাপের ভয়ালতার কাছেও ভারতের নীচু মানের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নাকানি-চোবানি খাচ্ছে। মহামারী মোকাবিলার ওপরই যাবতীয় দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকায় অন্যান্য ব্যাধির শিকার বহুসংখ্যক রোগী যে ন্যূনতম স্বাস্থ্য পরিষেবাটুকুও পেলেন না সেটাকেও এর সাথে বিচার করতে হবে এবং তখন আমরা ভারতের জনস্বাস্থ্যের পরিস্থিতির ওপর কোভিড-১৯ কী ভয়ঙ্কর চাপ সৃষ্টি করেছে সে সম্পর্কে একটা ধারণা করতে পারব।
কোভিড-১৯ যে চ্যালেঞ্জ খাড়া করেছে তার মোকাবিলায় মোদী সরকার অনুসৃত পথ প্রধানত লকডাউনের ওপরই কেন্দ্রীভূত হয়েছে, এবং এই যুদ্ধ জয়ের অবধারিত হাতিয়ার রূপেই লকডাউনকে তুলে ধরা হয়েছে। লকডাউন ঘোষণার সময় – যা পরবর্তীতে দীর্ঘায়িত লকডাউনের প্রথম পর্যায় রূপেই প্রতিপন্ন হয় – নরেন্দ্র মোদী আমাদের বলেন, দেশ যদি লকডাউনের বিধিকে ২১ দিন কঠোরভাবে মেনে না চলে তবে দেশ ২১ বছর পিছিয়ে যাবে। তিনি তাঁর নির্বাচনী ক্ষেত্র বারানসিতে জনগণকে স্মরণ করিয়ে দেন – মহাভারতের যুদ্ধে জয় হয়েছিল ১৮ দিনে, আর কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জয় আসবে ২১ দিনে। এরপর লকডাউনের সম্প্রসারণ ঘটানো হলে সরকারের প্রধান পরামর্শদাতা সংস্থা নীতি আয়োগ এপ্রিলের শেষে পূর্বাভাস দিয়ে বলে যে, সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখী রেখাকে মে মাসের মাঝামাঝি অবশ্যই আনুভূমিক করা যাবে এবং ১৬ মে-র পর সংক্রমণের নতুন ঘটনা আর ধরা পড়বে না। এই সময়টাতেই কিন্তু সংক্রমণের ঘটনার সবচেয়ে স্ফীতি দেখা গেল এবং বৃদ্ধির এই ঢেউ অব্যাহতভাবে চলতে থাকল, এবং সংক্রমণের সংখ্যা প্রতি দু-দিনে ১০০০০ হতে দেখা গেল।
লকডাউন ভারতে অভিপ্রেত ফল আনতে স্পষ্টতই ব্যর্থ হয়েছে। লকডাউন চীনে সম্পূর্ণরূপে সফল হয়েছে। সে দেশে এটাকে সীমিত ও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের কৌশল রূপে গ্রহণ করা হয় যাকে কোনো ধরনের লঙ্ঘন ছাড়াই পুরোমাত্রায় বলবৎ করতে চীনা রাষ্ট্রের স্বীকৃত সামর্থ্যও সহায়ক হয়ে ওঠে। ভিয়েতনাম ও নিউজিল্যান্ড এবং আরও কয়েকটি দেশে লকডাউনের রকমফের কাজে দিয়েছে, যে দেশগুলোতে লকডাউন যথাসময়েই নামানো হয় এবং রাষ্ট্র চিকিৎসা পরিষেবা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় বস্তুর জোগানের পরিকল্পনাকে সফল করে তোলাটাকেও সুনিশ্চিত করে। এই রাষ্ট্রগুলোর কাছে এই উপলব্ধিটা সুস্পষ্ট ছিল যে লকডাউন আসলে কিছু সময় জোগাড়ের কৌশল মাত্র, যেটা বিবেচ্য তা হল, মহামারীর নিয়ন্ত্রণে ও মোকাবিলার লক্ষ্যে চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রস্তুতিকে বাড়িয়ে তোলা এবং আনুষঙ্গিক পরিকল্পনার রূপায়ণে ঐ সময়টাকে ঠিকঠাক কাজে লাগানো হচ্ছে কিনা। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে, ভারতে রাজ্য হিসাবে লকডাউন সবচেয়ে ভালো কাজ দিয়েছে কেরলে এবং অন্য কয়েকটি রাজ্যের গুটিকয়েক জেলায়, যেখানে রাজ্য লকডাউন বলবৎ করার চেয়ে গুরুত্ব বেশি দিয়েছিল সামগ্ৰিক পরিকল্পনার পরিপূরক অংশগুলোর রূপায়ণকে সুনিশ্চিত করার ওপর।
মোদী সরকার যেভাবে লকডাউনকে ব্যবহার করেছে তা একেবারে বিপরীত ফলদায়ী না হলেও তাতে সমস্ত দিক থেকেই খামতি থেকে গেছে। ফেব্রুয়ারী এবং মার্চের প্রথম তিন সপ্তাহে অতি গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট করা হয়েছে। সরকার ও সংঘ-বিজেপি বাহিনী এবং ভারতের আধিপত্যকারী মিডিয়ার কাছে অগ্রাধিকারগুলো অবশ্য ছিল ভিন্ন -- ভারতে যারা অনুষ্ঠানাদির পরিকল্পনা করে সেগুলোকে পরিবেশন করে থাকে তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা দুটো ঘটনার উল্লেখ করতে গেলে বলতে হয় আমেদাবাদে ‘নমস্তে ট্রাম্প’ এবং মধ্যপ্রদেশে সরকার ফেলে দেওয়ার কর্মসূচির কথা। এই সময়কালে তারা কখনও যদি কোভিড-১৯-এর উল্লেখ করে থাকে তবে তার উদ্দেশ্য ছিল ভারতে এর বিপদকে অস্বীকার করা ও খাটো করে দেখানো। এবং সরকারের অবশেষে যখন হুঁশ জাগলো, সে লকডাউন ব্যাপারটাকে ২০১৬-র নভেম্বরের বিমুদ্রাকরণের মতো ঝটিকা ধাক্কায় অভিভূত করে দেওয়ার আর একটা কসরত হিসাবে, বিশ্বে এ যাবৎ কালের বৃহত্তম লকডাউনের তাক লাগানো দৃশ্য করে তোলার সুযোগ হিসাবে আঁকড়ে ধরল! সেই মানুষগুলোর কথা একবারও ভাবা হল না যাদের হয় নিজেদের কোনো ঘর নেই, অথবা যে জায়গাগুলোকে ওরা ওদের ঘর বলে বলে থাকে এবং যে সমস্ত স্থানে ফেরার জন্য ওরা মরিয়া হয়ে উঠবে। ক্ষণেকের জন্যও ভাবা হল না সেই সমস্ত মানুষদের কথাও যারা প্রতিদিন কাজ করে রোজগার করার পরই দুবেলা ভরপেট খাবার কথা চিন্তা করতে পারে।
এইভাবে ভারতে লকডাউন কখনই ছাঁচেঢালা পরিকল্পিত চমকপ্রদ দৃশ্য হয়ে উঠল না, যেটাকে সরকার সৃষ্টি করতে চেয়েছিল এবং যাতে মাঝে-মাঝে শুরুর সময় থাকবে তালি ও থালি বাজানো, টর্চ ও মোমবাতি জ্বালানো অথবা আকাশ থেকে গোলাপের পাপড়ি বর্ষণের মতো নজরকাড়া ঘটনা। লকডাউনকে মনে রাখা হবে না এই সমস্ত শব্দ ও আলো ও ফুলের প্রদর্শনীর জন্য, অথবা স্মরণ করা হবে না রাত ৮টার সময় মোদীর ভাষণ এবং ২০ লক্ষ কোটি টাকার ধাপ্পাবাজির প্যাকেজ ও আত্মনির্ভর ভারত অভিযানের জন্য। তাকে মনে করা হবে না পরিবেশ ও শব্দ দূষণ সহসাই কমে যাওয়ার জন্য, ক্রমেই বেড়ে চলা আমাদের নগরসুলভ, ভোগবিলাসী জীবনযাত্রার প্রেক্ষাপটে হারিয়ে যেতে থাকা প্রকৃতির শব্দ ও দৃশ্যগুলোর, তার পুষ্পরাজি ও প্রাণীকুলের আবার স্বপ্নবৎ দেখা মেলার জন্য। ভারতে লকডাউনকে মনে রাখা হবে লোকচক্ষুর আড়ালে চাপা দিয়ে রাখা সামাজিক বাস্তবতার প্রত্যাবর্তনের জন্য, ট্রাম্পের সফরের সময় যে বাস্তবতার সামনে মোদী দেওয়াল তুলতে চেয়েছিলেন, বিশ্বায়নের চোখ ধাঁধানো ছটার মধ্যে যে অস্বস্তিকর বাস্তবতা অদৃশ্য হয়ে থাকে, উন্নয়নের ঢক্কানিনাদের মধ্যে যাকে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। লকডাউনকে মনে রাখা হবে ভারতের পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য।
ভারতে মহিমান্বিত করে তোলা ‘ক্রিয়াশীল নৈরাজ্য’ যদি আজও কাজ করে চলে তবে তা আমাদের সুপ্রাচীন সভ্যতার কারণে নয়। রাষ্ট্র ও তার সামন্ততান্ত্রিক-ঔপনিবেশিক ক্ষমতা কাঠামো আর তার দানবীয় আইনসমূহ, বন্দুকবাজ নিরাপত্তা বাহিনী ও আত্মদর্পী আমলাতন্ত্রের জন্যও নয়। আমাদের জাতপ্রথা ও প্রচলিত লোকাচার, সুপ্রাচীন ধর্মীয় বিশ্বাস ও আধুনিকতার প্রতি অনুরাগের জন্যও তা ক্রিয়াশীল নয়। সত্যিকারের জনগণ, ভারতের লক্ষ-লক্ষ শ্রমজীবী মানুষ, তাদের হার-না-মানা মনোবল ও অদম্য সাহসিকতাই ভারতকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আধিপত্যকারী মিডিয়া যদি তাদের অকিঞ্চিৎ করে দৃষ্টির বাইরে রাখতে থাকে, বিচারবিভাগ যদি তাদের প্রয়োজন ও অধিকারসম্পন্ন মানুষ বলে স্বীকার করতে ব্যর্থ হয়, তা সত্ত্বেও ওরা কিন্তু ভারতের মানস জগতে অভাবনীয় মাত্রায় আত্মপ্রতিষ্ঠা ঘটিয়েছে। ওরা আধুনিক ভারতের প্রকৃত যোদ্ধা ও নির্মাতা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
লকডাউন আবার গণতন্ত্র ও ন্যায়ের জন্য ভারতীয় জনগণের নিবিড় আকাঙ্ক্ষাকেও সামনে এনেছে। ঘরে থাকতে অসুবিধা হওয়ার নয় এমন অনেক তুলনামূলকভাবে সুবিধাভোগী মানুষও সরকারের ‘ঘরে থাকুন’ নির্দেশের কাছে অথবা পুঁজির ‘ঘর থেকে কাজ করুন’-এর নতুন বিধি অথবা ‘ঘরোয়া বিনোদন’-এর মন্ত্রর কাছে নিজেদের জীবনধারাকে বাঁধা দিতে অস্বীকার করেছেন। এর বিপরীতে তাঁরা নব উদ্ভাবিত ‘ঘর থেকে প্রতিবাদ’-এর ব্যবস্থাপনা এবং ‘ঘর থেকে লড়াই’-এর মানসিকতা দিয়ে প্রতিরোধের অভিনব রূপের প্রবর্তন ঘটিয়েছেন।
কোভিড-১৯ পরবর্তী দুনিয়া পুরোনো স্বাভাবিকতায় ফিরে যেতে পারে না বলাটাই যথেষ্ট নয় বা তা বলাটা অনাবশ্যক। ভারতে শাসকরা জনগণের জন্য যে ‘নতুন স্বাভাবিক অবস্থাকে’ নির্দেশিত করতে চাইছে, আমরা তার রূপরেখাকে সুস্পষ্টরূপে দেখতে পাচ্ছি। গণতন্ত্রকে যতদূর এবং যত দীর্ঘ সময় ধরে মুলতুবি বা খর্বিত করে রাখা সম্ভব তা তারা করতে চাইছে। শ্রম আইনগুলোকে বাতিল করা হচ্ছে; জমির অধিকারকে নাকচ করা হচ্ছে; ম্যানুফ্যাকচারিং ও পরিষেবা ক্ষেত্রের পর কৃষিকেও আরও বেশি কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণাধীনে আনার চেষ্টা হচ্ছে। নজরদারির নতুন-নতুন হাতিয়ারকে বলবৎ করা হচ্ছে এবং সমস্ত উপায়ে প্রতিবাদকে দমন করতে লকডাউনকে লাইসেন্স করে তোলা হচ্ছে।
এই ‘নতুন স্বাভাবিক অবস্থা’ ভারতের কাছে যথার্থই এক ঔপনিবেশিক যুগের স্বাভাবিক অবস্থা, এবং এর সহগামী হচ্ছে সংঘ-বিজেপির সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী এজেণ্ডার ভয়াবহতা এবং বৈশ্বিক পুঁজি ও ভারতের নিজস্ব রাষ্ট্রীয়-মদতপুষ্ট স্যাঙাতি পুঁজিপতিদের দাপট। অতিমারির ছায়া এবং লকডাউনের ভুলভুলাইয়া থেকে আমরা যখন বেরিয়ে আসছি তখন চ্যালেঞ্জটা আমাদের কাছে সুস্পষ্ট হয়েই রয়েছে : পুরনো অবস্থার এই পশ্চাদমুখী পুনরুদ্ধারকে আটকাতে হবে এবং নতুন অবস্থার উদ্ভবের জন্য লড়াই করতে হবে। ঘরে ফিরে আসতে গিয়ে, বিপরীত পরিযাণ কালে পরিযায়ী শ্রমিকদের যে গ্লানির মুখোমুখি হতে হল, এবং বিদ্যমান ব্যবস্থার নির্মমতা সম্পর্কে তাদের যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হল, তাকে গ্ৰামীণ ও শহরের দরিদ্রের মধ্যে এক নতুন ঐক্যের পরিণতি দিতে হবে, এবং শ্রমজীবী জনগণের শ্রেণী সচেতনতা ও জঙ্গী আত্মঘোষণাকে এক নতুন স্তরে উন্নীত করতে হবে।
(লিবারেশন পত্রিকার মে-জুন ২০২০ সংখ্যা থেকে)
তালাবন্দী দশা জুনের গোড়ায় গড়ালো পঞ্চম পর্বে, তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তালা খোলাও শুরু করে দেওয়া হল। ইতিমধ্যে পুরোমাত্রায় গৃহবন্দীকাল কেটেছে চার দফায় মোট দু’মাস দশদিন। যা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল মাত্র চার ঘণ্টার নোটিশে। চূড়ান্ত অপ্রস্তুত অবস্থায় এবং অপরিকল্পিতভাবে। তার দুর্বিষহ জের যে তিলে তিলে কেমন ভোগ করতে হয়েছে তা যারা ভুগেছে তারাই সবচেয়ে বুঝেছে। রাষ্ট্রের দিক থেকে ফোলানো-ফাঁপানো অর্থনৈতিক চিত্র দেখানো পরিস্থিতিতে পরন্তু এক মারণঘাতী সংক্রমণ করোনা হানার অবস্থায় রাষ্ট্রশক্তির নির্মম নিষ্ঠুর নিপীড়ক চরিত্র বর্ণনাতীতভাবে উন্মোচিত হয়ে গেছে। মানুষের সহায় সম্বল হারা অবস্থার প্রতিকার প্রদানের দাবি ক্ষমতাসীন সরকার গ্রাহ্য করেনি, উল্টে শঠতার পরিচয় দিয়েছে এই দাবি করে যে, সরকার ‘যথাসাধ্য’ করেছে। প্রধানমন্ত্রী এই জীবনযন্ত্রণাকে বিবৃত করেছেন দেশবাসীর তথাকথিত ত্যাগ স্বীকারের পরিচয় বলে, উদ্দেশ্য হল ক্ষমাহীন অপরাধসম রাষ্ট্রীয় ভূমিকার উলঙ্গ চেহারাকে আড়াল দেওয়ার অপচেষ্টা। সরকারের দিক থেকে উচিত ছিল এক জরুরি সর্বাঙ্গীণ মানবিক প্যাকেজের ব্যবস্থা গ্রহণ, যার মধ্যে থাকতে হোত একদিকে পর্যাপ্ত সুষ্ঠু সুলভ পরীক্ষা-নিরীক্ষা, হাসপাতাল ও নিভৃতবাস ব্যবস্থার সম্প্রসারণ মায় সহজবোধ্য বিজ্ঞানসম্মত সামাজিক চেতনার প্রচার-প্রসার; অন্যদিকে মজুরি আদায়, পরিযায়ী শ্রমিকদের সুষ্ঠভাবে রক্ষণাবেক্ষণ অথবা তারা ঘরে ফিরতে চাইলে তাদের ফেরার ব্যবস্থা করা এবং নিঃস্ব, অভাবী বা গরিব মানুষদের হাতে তালাবন্দী থাকাকালীন পর্যায়ের জন্য নগদ অর্থপ্রদান ও খাদ্যশস্য সরবরাহের যোগান। কিন্তু রাষ্ট্রের পরিচালকরা নেয় এক পীড়াদায়ক প্যাকেজ, যা কেবল কিছু মানুষকে কিছু পরিমাণ খাদ্যশস্য, চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা ছাড়া বাকি যা অনুসরণ করেছে তার পুরোটাই অগণতান্ত্রিক অমানবিক; চালিয়েছে বঞ্চনা-প্রতারণা-দীর্ঘসূত্রিতা-দুর্নীতি-উৎপীড়ন-গ্রেপ্তারি, প্রশ্রয় দিয়েছে সাম্প্রদায়িকতা-অস্পৃস্যতা-কুসংস্কারকে এবং রোগী ও স্বাস্থ্যকর্মীদের কেন্দ্র করে সামাজিক দ্বন্দ্ব-বিরোধকে; রাষ্ট্র জেগে ঘুমিয়েছে মালিকশ্রেণীর দ্বারা মজুরদের আটকে রাখার জন্য মজুরি না দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা মজুরি কাটাই ও কাজ ছাঁটাই সংঘটিত হতে দেখেও। পাশাপাশি তালাবন্দীকালের সুযোগ নিয়ে, যখন আইনসভা-বিচারসভা সব বন্ধ, তখন সেরে ফেলা হল বেসরকারীকরণের বৃত্তপূরণের বাকি কৃতকর্ম সহ শ্রম আইনের শ্রমিক বিরোধী সংশোধন; প্রস্তাব রাখা হল অন্তত বছর তিনেক যাতে রাজনৈতিক আন্দোলন বন্ধের বন্দোবস্ত করা যায়। উত্তরপ্রদেশের যোগী সরকার আওয়াজ তুলেছে শ্রমিক পরিযায়ীকরণের পলিসির ওপর নিষেধাজ্ঞা চাপানোর। এই সবকিছুই চলছে করোনা সংকট থেকে ‘দেশোদ্ধারে’ র ও দেশকে ‘আত্মনির্ভর’ করে তোলার নামে।
এই পটভূমিতে চালু করে দেওয়া হল তালা বন্ধ রাখা আর তালা খুলে দেওয়ার যুগল প্রক্রিয়া পর্ব। বলাবাহুল্য, কেন্দ্র-রাজ্য সহমতের ভিত্তিতে, কেন্দ্রের নির্দেশিকা মেনেই রাজ্যগুলোকে উপরোক্ত পৃথকত্বের অনুশীলনে বাধ্য থাকতে হবে। রাষ্ট্রের ক্ষমতার ভাগীদার, মোড়ল-মাতব্বর- আমলা-গামলারা নিচ্ছেন তাদের সিদ্ধান্ত। কিন্তু নাগরিক ভারতকে মাপতে হবে ভাবতে হবে। বিশেষত তালা খোলার ব্যবস্থা শুরু করে দেওয়া হচ্ছে ঠিক ঠিক কোন পরিস্থিতিতে!
প্রতিটি দিনের সংক্রমণ ছাড়িয়ে যাচ্ছে বিগত দিনের রেকর্ড। ভারত সংক্রমিত বিশ্বে দ্বাদশ স্থান থেকে এখন ওপরে উঠেছে সপ্তম স্থানে, অন্য একটি হিসাব মতে সপ্তম নয়, সক্রিয় সংক্রমণে ভারতের অবস্থা এখন পঞ্চম স্থানে -- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, ব্রিটেন ও রাশিয়ার ঠিক পরেই। আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ২ লক্ষ। ৮০ শতাংশ আক্রান্ত দেশের কলকাতা পুরসভা সহ ৩০টি পুরসভা অন্তর্গত এলাকায়। ৯০ শতাংশ নতুন সংক্রমণ লক্ষ্যণীয় পশ্চিমবঙ্গ সহ ১০টি রাজ্যে। তার মধ্যে ৭০ শতাংশ নতুন সংক্রমণ কলকাতা মহানগরী সহ দিল্লী, মুম্বাই তথা দেশের ১০টি বড় বড় শহরে। সংক্রমণ আজকের ভারতে সংক্রমণ যেমন তিনমাস আগের চীনকে ছাপিয়ে গেছে সংখ্যার হিসাবে, তেমনি অনেকবেশি রাজ্যওয়ারি হিসাবেও। একটা মিথ্যা প্রচারেরও সংক্রমণের জোর চেষ্টা চালিয়েছিল ক্ষমতাসীন সাম্প্রদায়িক স্বার্থান্বেষী মহল। করোনা সংক্রমণ নাকি ছড়িয়েছে এক বিশেষ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকেরা! বলাবাহুল্য, দিল্লীর তবলিগি জমায়েত থেকে! আর প্রকৃত বাস্তবে কি দেখা গেল? করোনা দেশজুড়ে ছড়িয়ে গেল পরিযায়ী শ্রমিকদের শরীরী মাধ্যমে। মালিকশ্রেণী তাদের জীবন-জীবিকাকে ছিবড়ে করে দেওয়ার পর রাষ্ট্র তাদের এমন হাল করল যে অজান্তে পরিযায়ী শ্রমিকরা পরিণত হল করোনার এক বড় সংখ্যায় বাহকে। দেশজুড়ে ঘরে ফেরাফিরি চলল লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকের। কেন্দ্র-রাজ্য কোনও পক্ষই এর দায়িত্ব নিতে চাইছে না। এই সমস্যা সমাজ জীবনে সৃষ্টি করছে এক অচেনা দ্বন্দ্বের, যার সমাধানের জন্য অব্যাহত রাখতে হবে রাষ্ট্রশক্তিকে বাধ্য করার চাপ, একইসাথে খুলতে হবে বহুমুখী নাগরিক উদ্যোগের দ্বার। যদিও সুস্থতার হার সরকারী মতে ৪৮ শতাংশের মতো, তবু দৈনিক যে হারে সংক্রমণ হচ্ছে তাতে জুনের শেষে সম্ভাব্য বিপদ থাকবে আক্রান্তের সংখ্যা ৮ লক্ষে পৌঁছে যাওয়ার! ইতালির দেশজুড়ে সব তালা খুলে দেওয়া প্রসঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্ক করেছে, ‘হু’ বলেছে কোবিডের ঘাতক ক্ষমতা কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি। ভারতে তালা খোলা নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহল একমত নয়। বিরোধী রাজনৈতিক মহলও সব ঐকমত্যে নেই। পেছনে ফেলে আসা বিপদের দিনগুলোর পর সামনের দিনগুলো দাঁড়াবে কেমন? ঝুঁকি যে বিস্তর থাকছে তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার নয়।
১৯৯৩ সালের ৩১ মে বর্তমান পূর্ব বর্ধমান জেলার সদর ২নং ব্লক এর নবস্থা ২নং গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার করন্দা গ্রামে এলাকার সামন্ত-পুঁজিবাদী জমিদারদের মদতপুষ্ট তৎকালীন শাসক দলের গুন্ডাবাহিনী পরিকল্পিত ভাবেই নৃশংস গণহত্যা সংগঠিত করে। ভোরের আলো-আঁধারে গরিব ক্ষেত মজুর পাড়ায় আগুন লাগিয়ে দেওয়া হল। প্রাণ বাঁচানোর জন্য মানুষগুলো ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে থাকলে জানোয়ার গুলো কুপিয়ে কুপিয়ে ৬ জন গরিব ক্ষেতমজুরকে খুন করে আরও অনেক মহিলা শিশু ও বয়স্ক মানুষকেও আহত করে ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। তাদের অপরাধ ছিল সমবায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবং গরিব মানুষের জন্য খাসজমি, মজুরি, কাজের দাবিতে আন্দোলনের প্রক্রিয়ায় পঞ্চায়েত নির্বাচনে সিপিআই (এম-এল) লিবারেশন তথা আইপিএফ প্রার্থী হয়ে প্রতিদন্ধীতা করেছিলেন। গ্রামীণ গণতন্ত্রের সর্বোচ্চ নির্বাচন পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরের দিন সকালেই এই গণহত্যার খবর শোনার পর বর্ধমান জেলার তথা রাজ্যের বাম গণতান্ত্রিক মানুষ স্তম্ভিত হয়ে যায়। প্রতিবাদ করতে থাকলেন। স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল বর্ধমান জেলার সর্বত্র। বন্ধ পালিত হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে। প্রতিবাদের চাপে খুনীদের বিরুদ্ধে কেস দিতে বাধ্য হল। কিন্ত জামিনে মুক্তি দেওয়াহল। তারপর শুরু হল বিচারের নামে প্রহসন। দেখা সাক্ষী থাকা সত্ত্বেও জর্জ কোর্ট একজন খুনীকে ও শাস্তি দেয়ার পক্ষে রায় না দিয়েই সমস্ত খুনীদের কেই বেকসুর খালাস করে দিল। চলল হাইকোর্ট। কয়েক বার ফাইল হারানোর নাটকের পর সমস্ত খুনীদের বেকসুর করে দিল। মনে হল যেন কেউ খুনই হয়নি। কিন্ত সংগ্রামী জনগন লড়াই চালিয়ে গেল। মানুষের সহযোগিতায় সুপ্রিম কোর্টে আপিল করা হল। সুপ্রিম কোর্ট নিচের কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে খুনীদের শাস্তির পক্ষের কয়েকটি যুক্তি দিয়ে হাইকোর্টকে পুনঃবিচার করতে বললেন। মানুষের সহযোগিতা নিয়ে আবার হাইকোর্টের দ্বারস্থ হতে হল। এখনও বিচারের অপেক্ষায় আছেন। বর্ধমান-এর বাম গণতান্ত্রিক মানুষের লড়াই অব্যাহত। তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পর করন্দা হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য একটা কমিশন গঠন করেছেন। কিন্ত সব শাসকের একই ডাক। শাসক শ্রেণীর সেবায় গরিব হত্যার বিচারের কমিশন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। খুনীরা শ্রেণীস্বার্থে আজ রং পাল্টে শাসক দলের ছত্র ছায়ায়।
গরিব মানুষের লড়াইয়ের প্রথিক হয়ে আছে করন্দার লড়াই। প্রতিবছর ৩১ মে করন্দার শহীদ বেদীর সামনে মানুষ জমায়েত হয়ে শহীদ দিবস পালন করে। শহীদদের স্মরণ সভা করে। বিক্ষোভ দেখান, খুনীদের বিচারের দাবি তোলেন। গরিব মানুষের স্বার্থে লড়াই-এর শপথ গ্রহণ করেন। এবারও ৩১ মে, ২০২০ পুর্ববর্ধমান-এর বিভিন্ন ব্লকের গরিব জনগণ সিপিআই(এম-এল) লিবারেশন-এর নেতৃত্বে করন্দা দিবস পালন করেন। সকাল আটটার সময় লকডাউন-এর প্রতিকুলতার মধ্যেও প্রচন্ড দুর্যোগের উপেক্ষা করেই করন্দার শহীদ বেদীর সামনে জমায়েত হল।
শহীদদের পরিবারের লোকজন পার্টির কমরেডরা উপস্থিত হন। শহীদ বেদীতে মাল্যদান করেন। খুনীদের বিচারের দাবির সাথে সাথে লকডাউন-এ ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবিও তোলেন। পরিযায়ী শ্রমিকদের দুরবস্থার বিরুদ্ধেও প্রতিবাদে সরব হন। এক মিনিট নিরবতা পালন করেন। সভা পরিচালনা করেন কমরেড সুকুমার সোম। উপস্থিত ছিলেন জেলা কমিটির সদস্য কমরেড কুনাল বক্সী।
কালনা ২নং ব্লক-এর অকালপোষ অঞ্চলের আগ্রাদহ গ্রামে করন্দার শহীদ দিবস পালন করা হয়। শহীদ বেদীতে মাল্যদান ও এক মিনিট নিরবতা পালন করেন।
রায়না থানার শ্যামসুন্দর গ্রামে বিক্ষোভ ও স্মরণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। মন্তেশ্বর ব্লকের কুলুট গ্রামে কমরেড আনসারুল আমন মন্ডলের নেতৃত্বে স্মরণ সভা হয় ।
নাদনঘাট থানার ইসলামপুর গ্রামের কমরেড জিয়াদুল সেখের পরিচালনায় স্মরণ ও প্রতিবাদ সভা সংগঠিত হয়।
পুর্বস্থলী ২নং ব্লকের ফলেয়া অফিসে করন্দার শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নিরবতা পালন ও শহীদ বেদীতে মাল্যদান করা হয়। কাটোয়া থানার সাহাপুর গ্রামে করন্দার বীর শহীদদের স্মরণে বিক্ষোভ ও শপথ অনুষ্ঠান সংগঠিত করাহল। শহীদদের স্বপ্ন সফল হবে।
লকডাউনের মধ্যেই ভয়ানক ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত দক্ষিণবঙ্গের একাধিক জেলা। সেই সমস্ত ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কাছে সরকারী সাহায্য অপ্রতুল। তার মধ্যেও সরকারি ত্রাণ নিয়ে নীচুতলায় রয়েছে বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি। তাই সেই সমস্ত সহনাগরিকদের পাশে দাঁড়ানোর তাগিদ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয় যাদবপুর-ঢাকুরিয়া এলাকার পার্টির পক্ষ থেকে। লকডাউনের সময়ে কয়েক হাজার মানুষের কাছে খাদ্যসামগ্রী তুলে দেওয়ার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে পাশে এসে দাঁড়ায় বহু ব্যক্তি ও সংগঠন।মানবাধিকার সংগঠন পিইউসিএল, ফোরাম ফর পিপলস হেলথ, আরওয়াইএ, বোকাবুড়ো সহ কিছু সংগঠনের পক্ষ থেকে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে পৌঁছনো হয় ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত এলাকায়।
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার কুলতলী ব্লক আমফানে বেশ ভালো মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ওই ব্লকের নদীতীর সংলগ্ন এলাকাগুলোর মানুষের জীবন-জীবিকা কার্যত বিপন্ন। কলকাতা থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরে, কুলতলির গোপালগঞ্জ গ্রাম পঞ্চায়েতে পৌঁছয় রিলিফ টিম। স্থানীয় হাইস্কুল-এর এক জন শিক্ষক সুধর মন্ডল। ওই অঞ্চলে মূলত তিনিই সাহায্য করেছেন মানুষের কাছে পৌঁছতে। গোপালগঞ্জ গ্রাম ও সাংকিজাহান কলোনি এই দুটি গ্রামের শতাধিক মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয় ন্যূনতম বাঁচার রসদ। মশারি, লম্ফ, ডাল, চিড়ে, গুড়, বিস্কুট, স্যানিটারি ন্যাপকিন তুলে দেওয়া হল ওই সমস্ত আমাদেরই সহ-নাগরিকদের কাছে।কলকাতা শহরের এক চিকিৎসক তার ব্যক্তিগত উদ্যোগে ওই মানুষগুলোর জন্য পাঠিয়েছিলেন, চাল-ডাল-আলু-সয়াবিন-তেল-এর প্যাকেট। তাও বিলি করা হয় ওই অসহায় মানুষগুলোর কাছে।
সাংকিজাহান কলোনির বাসিন্দাদের অধিকাংশের কাছেই রেশন কার্ড নেই। ফলে লকডাউনের গোটা সময়ে, সরকারী খাদ্যসামগ্রী তারা প্রায় পাননি। সাথেই রয়েছে স্থানীয় স্তরে তৃণমূল ও বিজেপির দ্বন্দ। এখানে এসে দেখা গেল, রেশন কার্ড ছাড়া রেশন পাওয়ার সরকারী প্রতিশ্রতি প্রায় ভাঁওতা। যার যাঁতাকলে পরে, ওই মানুষগুলো শোষিত, নিঃস্ব। নদীর পারের বাসিন্দা অধিকাংশেরই জীবিকা মাছ ধরা। খুব কম সংখ্যক মানুষের কাছেই রয়েছে নিজস্ব চাষের জমি। কাজেই রোজগারের উপকরণও তাদের কাছে এই মুহূর্তে নেই। আর তার মধ্যেই এসে উপস্থিত এই দুর্যোগ। কুলতলী সহ আশেপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন। কবে সেই বিদ্যুৎ আসবে, তা বলতে পারছেন না, এলাকার কেউই।
আমাদের এই সহনাগরিকদের পাশে দাঁড়াতে আমরা বদ্ধপরিকর। আমাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, অরিজিৎ মিত্র স্মারক কমিটি, বাঁশদ্রোণী এলাকার পার্টির কর্মীরা, ঝাড়গ্রামের একটি ফার্মার্স ক্লাব সহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন। আগামী দিনেও উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত এলাকার মানুষের কাছে সাধ্যমত সামগ্রী নিয়ে পৌঁছে যাবো আমরা।
আমফান ঝড় কবলিত উত্তর ২৪ পরগণার হাসনাবাদ ১নং পঞ্চায়েত এর অন্তর্গত বিভিন্ন গ্রামের মানুষ আজও এক কোমর জলেরতলায়, চারিদিকে জল, শুধুই জল, এক জল থৈ থৈ অবস্থা, আছে শুধুই কালো বাদামি রঙের দুর্গন্ধ যুক্ত জল! চারিদিকে এতো জল অথচ নেই কোনো পানীয় জলের সুসংস্থান; আদতে সবটাই তো লোনা জল,মানুষের পানের জন্য মিষ্টি জল কোথায়? এখনো চলছে পানীয় জলের জন্য হাহাকার! প্রচুর মানুষ এখনো জলবন্দী অবস্থায় দিন রাত এক করে সুদিনের প্রত্যাশায়!
এই জলবন্দী মানুষগুলোর নেই মাথার উপর কোনো ছাউনি, ঝড়ো হওয়ার দাপটে ভেঙে পড়েছে অজস্র মাটির তৈরি বাড়ি, উড়ে গেছে কারো বাড়ির টিনের চাল, ভেসে গেছে মেছো ভেরী, চাষের জমিতে ঢুকে পড়েছে লোনা জল, স্থানীয় পুকুরের জল, ভেরিগুলো আজ ভরে গেছে নদীর লোনা জলে, বিষাক্ত জলে মরা মাছগুলো ভেসে উঠেছে,গাছের পাতা, ডালপালা জলে পড়ে পচে এক দুর্গন্ধ বের হচ্ছে, অজস্র ছোট বড় গাছপালা উপরে পড়েছে; বিদ্যুতের খুঁটি গুলো বেঁকে গেছে, নয়তো ভেঙে পড়েছে কারো বাড়ির চালে বা কোনো গাছের গায়ে। অজস্র বিদ্যুৎবাহি তার কুণ্ডুলী পাকিয়ে পড়ে আছে, রাস্তায় সাপের মতো যেন সব শুয়ে শুয়ে আছে! আর এরকম দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে গ্রামের মানুষজন, স্ত্রী পুত্র কন্যা, ছোট বাচ্চাদের নিয়ে দিনাতিপাত করছেন! বিরাজ করছে চারদিকে এক ধ্বংসলীলার জলছবি, চারদিকে জলের মধ্যে দ্বীপের মতো গ্রাম গুলো জেগে আছে, যা তৈরি করছে অতীব করুণ এক অসহনীয় দৃশ্যপট। এতদ অঞ্চলে এক বীভৎস হিংস্র তান্ডবলীলা চালিয়েছে প্রকৃতি। যেন এক দামাল মদমত্ত হাতি সবকিছুকে দুমড়ে মুচড়ে তছনছ করে দিয়েছে।
হাসনাবাদ এর ইছামতি নদীর ব্রিজ পেড়িয়ে কালীবাড়ি হয়ে বরুনহাট, লেবুখালী, ভান্ডারখালি , টিয়ামারি, চকখাঁপুর, পুঁটিমারি সহ বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমফানে একেবারে বিপর্যস্ত-বিধস্ত। ভেঙে গেছে ইছামতী নদীর টিয়ামারীতে মাটির তৈরি নদীবাঁধ! ফলত হাসনাবাদের মূল ভুখন্ড থেকে ওখসনকার মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। এই টিয়ামারীর উল্টো দিকেই বেলেডাঙ্গা গ্রাম, প্রায় ৩৫০ পরিবারের বাস, ইছামতী নদীর জলের তোরে প্লাবিত চারিদিকের গ্রামগুলো সম্পূর্ণভাবে স্বাভাবিক জনজীবন থেকে আজ দশ বারো দিন ধরে বিচ্ছিন্ন, যেন দ্বীপরাজ্যে অবস্থান করছে এক একটা গ্রাম। বহু মানুষ নিজ ভিটেমাটি ছেড়ে শুধুমাত্র প্রানের দায়ে আশ্রয় নিয়েছেন পাকাবাড়ি বা স্কুলবাড়িতে। বহু জায়গায় গবাদি পশুকে নিয়ে রাস্তার উপর মানুষ খোলা আকাশের নীচে দিন কাটাচ্ছেন এক গভীর অনিশ্চয়তায়। বেঁচে যাওয়া গবাদি পশু গুলোও একটু মিষ্টি জল, খাবারের অভাবে যেন ধুঁকছে। এখানের মানুষের জীবিকা মূলত কৃষিকাজ, আর মেছো ভেরীর কাজের সাথে যুক্ত আর অল্পবিস্তর ছোটখাটো ব্যবসা, কিছু মানুষের জীবিকা হলো ম্যাজিক গাড়ি, ডিজেল অটো, ইঞ্জিন ভ্যান বা ভ্যানো আর টোটো চালনা, অবশ্য কিছু লোকের শহরে দিনমজুরি, বা ছোটখাটো কাজ, উপার্জন বলতে তো এইই। এই নিয়েই তাঁদের জীবনের বারোমাস্য চলে জল ঝড়কে সঙ্গী করেই। এখন কার মানুষ আয়লায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, মোকাবিলা করেছে ফনি-কেও, কিন্তু এবারের আমফন ঝড় তাঁদের জীবনের সব হিসাবকে একেবারে উল্টে পাল্টে দিয়েছে। একে তো করোনার জন্য লকডাউনের ফলে গৃহবন্দী ছিলেন তাঁরা, তার উপর মড়ার ঘাড়ে খাঁড়ার কোপ হলো এই আমফান ঝড়। ফলে এখানকার মানুষের প্রতিদিনকার যাপন আজ নানাভাবেই ব্যাহত। ফলত এখন স্থানীয় মানুষের হাতে নেই কোনো ধরনের কাজ, নেই একশো দিনের কাজও, তাঁদের চাষের জমিতে জল ঢুকে চাষ আবাদ পুরোপুরিভাবে বন্ধ! আমফনের তাণ্ডবে তাদের ঘরবাড়ি লণ্ডভণ্ড। হাড়হাভাতে মানুষগুলো এখন একটু ত্রাণের আশায় রাস্তার দিকে সব সময় তাকিয়ে আছেন, কখন একটা ত্রাণের গাড়ি আসে, আসলেই হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন ত্রাণ-গাড়ির ওপর, আর অসহায় মুখগুলো, আবাল বৃদ্ধ বনিতা প্রতি মুহূর্তে এক গভীর হতাশায় বিষোদগার করছেন স্থানীয় চতুর রাজনৈতিক নেতাদের নামে, এই দুর্বিপকের সময়ে দেখা নেই অনেক তথাকথিত জনদরদী নেতারাও, তাই সরকারী ত্রাণের ছিটেফোঁটা, কিছু কালো প্লাস্টিক ,কিছু চাল মিললেও বেসরকারী ত্রাণ-এর উপর যেন স্থানীয় মানুষের ভরসা বেশি।
এইসব অসহায়, ক্ষুধার্ত, পিপাসার্ত গ্রামীণ মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর মানবিক দায়, তাঁদের ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ির পুনর্নির্মাণ, তাঁদেরকে সামাজিকভাবে পুনর্গঠনের জন্য আর্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো আজ তাই সময়ের ডাক। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে আজ হাসনাবাদ-এর প্রত্যন্ত অঞ্চলে ত্রাণ কার্যের জন্য ৭ জনের একটি টিম হাজির হয় যেখানে বাঁধ ভেঙেছে সেই টিয়ামারীর ঠিক উল্টোদিকেই বেলেডাঙ্গা গ্রামে, যেখান থেকে দেখা যাচ্ছে ভেঙে পড়া মাটির তৈরি বাঁধটা, ওই টিম এর লোকজন শোনেন স্থানীয় মানুষের গ্রামের মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতার কথা, শোনেন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা, তাঁদের নানান অভাব অভিযোগের কথা। স্থানীয় মানুষের কথায় জানা গেলো, তাঁরা রেশনে চাল আটা পেলেও রান্না করে খাওয়ার উপায় নেই, কারণ চতুর্দিক জলমগ্ন। বসিরহাট ও হাসনাবাদ ও বারাসাত-এর কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন-এর পক্ষ থেকে রান্না করা খাবার ভাত ডাল তরকারি পৌঁছে দিলেও প্রয়োজনের তুলনাতে তা সত্যিই অপ্রতুল। গ্রামবাসীদের অভিযোগ, এখানেও চলছে ত্রাণ নিয়ে দলবাজি, দুর্নীতি, স্বজন পোষন, এমনকি ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সরকারী অনুদান নিয়ে আবেদন পত্র জমা নিচ্ছে না স্থানীয় পঞ্চায়েত। অপরদিকে দূরবর্তী গ্রাম গুলিতে এখনো ঠিক ভাবে পৌঁছাতে পারছেন না অনেকেই, ফলত বহু মানুষ জলবন্দী হয়ে এক চরম দুর্দশাতেই আছেন। তাই তারা আশা করেন তাঁদের জন্য শুকনো খাবার, বাচ্চাদের জন্য বেবিফুড দরকার, দরকার তাঁদের জন্য সাবান, মাথায় মাখার তেল, আর জামাকাপড় কাচার জন্য সাবান। এই গ্রামবাদীদের সাথে আলাপ আলোচনার পরে স্থানীয় কিছু যুবককে নিয়ে একটা আপদকালীন ত্রাণ পরিচালনাকারী টিম তৈরি করে দেওয়া হয় যাদের সাহায্য ও সহযোগিতায় আগামী ৫ জুন হাসনাবাদ ১নং পঞ্চায়েতের বালিয়াডাঙ্গা গ্রাম ও খাঁপুর গ্রামের প্রায় ৫২০টি পরিবারের মানুষদের হাতে প্রচলিত স্বাস্থ্য বিধি বজায় রেখেই ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছে দেওয়া হবে এক নাগরিক উদ্যোগ এর মাধ্যমে। পরবর্তীতে ওখানকার মানুষদের জন্য একটি অস্থায়ী চিকিৎসা শিবির অনুষ্ঠিত করার গ্রামের মানুষ আবেদন করেন, কারণ এর পরই শুরু হবে জলবাহিত রোগের প্রকোপ।
অসহায় এই মানুষদের সাথে একটু প্রাথমিক কথাবার্তা, যোগাযোগ ও ত্রাণ বিলিবণ্টনের সুষ্ঠ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য একটি দল ২ জুন ২০২০ বারাসাত থেকে খুব ভোরে রওনা দেয় হাসনাবাদের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। এই দলে ছিলেন জয়শ্রী দাস, (মিড ডে মিল রন্ধন কর্মী ইউনিয়নের রাজ্য সম্পাদিকা), অজয় বসাক, জেলা সম্পাদক ক্ষেত ও গ্রামীণ মজদুর সংগঠন, ছিলেন এআইপিএফ-এর নেতা নির্মল ঘোষ, পশ্চিমবঙ্গ গণ সংস্কৃতি পরিষদের পক্ষে রবীন দাস, পশ্চিমবঙ্গ নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা দেবব্রত (বাবু) বিশ্বাস, ছিলেন সুব্রত সেনগুপ্ত, সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের উত্তর ২৪ পরগণা জেলা সম্পাদক, বসিরহাট-এর ‘চেতনায় বিজ্ঞান’ সংগঠন ও পশ্চিমবঙ্গ সাংস্কৃতিক পরিষদের অন্তর্ভুক্ত “নির্মাণ সাংস্কৃতিক সংস্থা”র মলয় মন্ডল।
আমফান ঝড়ে দুর্গত মানুষদের জন্য যেকোনো ব্যক্তি, যেকোনো ধরনের উদ্যোগ, গণসংগঠন, ক্লাবের সদস্য সমর্থকদের কাছে আবেদন, এই দুঃসময়ে আসুন অসহায় ক্ষুধার্ত দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াই, এই আর্ত মানুষের জন্য আপনার সাহায্যের হাতটা আবার একবার বাড়িয়ে দিন, অতীতেও যেমন দিয়েছিলেন, এবারও আমরা চাই আপনার / আপনাদের হাত ধরেই অসময় থেকে সুসময়ে পৌঁছে যেতে।
পশ্চিমবঙ্গের নির্মাণ শ্রমিকদের দাবি নিয়ে প্রথমে মুখ্যমন্ত্রী তারপর শ্রমমন্ত্রীর নিকট অনেক আগেই দাবিপত্র পেশ করা হয়েছিল।মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে খোলা চিটি লেখা হয়েছিল, কিন্তু কোনো সদোত্তর পাওয়া যায়নি। ক্রমশ নির্মাণ শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভ বিক্ষোভ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। শেষে আমরা ঠিক করি বিগত ২১ মে রাজ্যজুড়ে বিডিও থেকে ডিএম, এএলসি থেকে ডিএলসি মারফত মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দ্যেশ্যে যে যেখানে সম্ভব গণস্বাক্ষর সহ গণডেপুটেশন দেওয়া হবে। ইতিমধ্যেই আমফানের আক্রমনে বাংলা তছনছ হয়ে গেছে। ফলে ডেপুটেশনের দিন পরিবর্তন করে ২৯/০৫/২০২০ শুক্রবার করা হয়। শত বাধা উপেক্ষা করেই কলকাতা সহ রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় ২৯/০৫/২০২০ গণ স্বাক্ষর সহ গণডেপুটেশন দেওয়া হয়।
গণডেপুটেশনের মূল বিষয় ছিল – আমাদের হকের অর্থ আমাদের দাও।আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচতে দাও।
আমাদের রক্ত, ঘাম, পরিশ্রমে অর্জিত অর্থ পশ্চিমবঙ্গ নির্মাণ শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদ তহবিলে সঞ্চিত। অথচ আমরা অর্ধাহারে, অনাহারে। অতএব, উক্ত সঞ্চিত তহবিল থেকে সমস্ত নির্মাণ শ্রমিকদের লকডাউন ভাতা হিসাবে ১০০০০ টাকা দেওয়া হোক।
নির্মাণ শ্রমিকদের ন্যায্য দাবিসনদ নিয়ে রাজ্য সরকারের নিকট বারংবার আবেদন করা সত্বেও সরকারের কর্ণপাত না হলে, লকডাউন উঠে যাওয়ার পর রাজ্য স্তরে বড় বিক্ষোভ কর্মসূচী নেওয়া হবে।
কলকাতা
আমাদের হকের অর্থ আমাদের দিন আত্মসন্মান নিয়ে বাচতে দিন। এই দাবিতে ২৯ মে নির্মাণ শ্রমিকদের রাজ্য সদর দপ্তরে ১৫ জন নির্মাণ শ্রমিক সহ মোট ২০ জন বিক্ষোভ দেখায়। তারা দাবি তোলে নির্মাণ শ্রমিকদের জন্য নির্মাণ শ্রমিকদের বোর্ডে গচ্ছিত টাকা থেকে সরকারিভাবে নাম নথিভুক্ত শ্রমিকদের ১০০০০ টাকা তাদের ব্যাঙ্ক একাউন্টে দিতে হবে। এর পাশাপাশি নির্মাণ বোর্ডের অন্যতম সদস্য এডিশনাল লেবার কমিশনারের সাথে এক প্রতিনিধিদল দেখা করে দাবিপত্র পেস করে। এই প্রতিনিধি দলে ছিলেন এআইসিসিটিইউ-র রাজ্য সম্পাদক বাসুদেব বসু ও প্রবীর দাস। উল্লেখ্য পুরো কর্মসুচীতে উপস্থিত ছিলেন সিপিআই(এমএল)-র রাজ্য নেতা জয়তু দেশমূখ ও পশ্চিমবঙ্গ গৃহ ও অন্যান্য নির্মাণ শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের নেতা স্বপন কুমার রায়চৌধুরীর।
উত্তর ২৪ পরগণা
বসিরহাট-১ ব্লকে বিক্ষোভ কর্মসূচীতে প্রায় ১৭০ জন নির্মাণ শ্রমিক অংশগ্রহণ করেন। ব্লক অফিসের সামনের রাস্তা জুড়ে প্ল্যাকার্ড, ব্যানার নিয়ে তারা দীর্ঘক্ষণ বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। নির্মাণ শ্রমিকদের ১০০০০ টাকা লকডাউন ভাতার দাবিতে গণস্বাক্ষর সহ ডেপুটেশন চারজনের প্রতিনিধি দল বিডিও-র কাছ তুলে ধরেন। প্রতিনিধি দলে ছিলেন এআইসিসিটিইউ-র অনুমোদিত নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়নের জেলা সভাপতি দেবব্রত বিশ্বাস, হাসানুর জামান মোল্লা, মলয় মন্ডল ও নূর ইসলাম মোল্লা। বিডিও-র সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা চলে। আলোচনা প্রসঙ্গে বিডিও জানান যে প্রায় ১০০০ পরিযায়ী শ্রমিক আজ বসিরহাটে তাদের ঘরে ফিরেছেন, ফলে প্রশাসন এই নিয়ে প্রচন্ড ব্যস্ত।
হাবড়া ব্লক-২ অফিসে এই কর্মসূচীতে নির্মাণ শ্রমিকদের অংশগ্রহণ ছিলো উল্লেখযোগ্য। এছাড়া আয়ারলার কর্মীরাও এই বিক্ষোভে সামিল হয়। অজয় বসাক, গোবিন্দ টুডু ও নাজিম মন্ডল – এই তিনজনের প্রতিনিধি দল ইউনিয়নের পক্ষ থেকে গণস্বাক্ষর সম্বলিত দাবিসনদ বিডিও-র হাতে তুলে দেন। আলোচনা চলাকালীন প্রতিনিধিরা গ্রামীণ এলাকায় ১০০ দিনের কাজ চালু না হওয়ার অভিযোগ তুললে বিডিও জবাব দেন যে ১০০ দিনের কাজের জন্য শত শত মানুষ ভিড় জমাচ্ছেন, ফলে স্বাস্থ্যবিধি মানা সম্ভব হচ্ছে না বলে কাজ করানো যাচ্ছে না। সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রতিটি গ্রাম ধরে আলাদা আলাদা কাজের পরিকল্পনা গ্রহণ করার দাবি জানানো হয়।
এই কর্মসূচীর ঠিক এক ঘণ্টা আগে পুলিশ থেকে সংগঠকদের জানানো হয় যে আজকের কর্মসূচীতে ৫ জনের বেশি অংশগ্রহণ করলে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তা সত্বেও শ্রমিকরা কৌশলে একটু দূরে জমায়েত হয়ে শ্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ দেখান। ঐ ব্লকে পরিযায়ী শ্রমিকরা ঘরে ফিরছেন এবং তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও কোয়ারিনটাইনের চরম অব্যবস্থার ফলে করোনা আক্রান্তদের সংখ্যাও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। অঞ্চলের মানুষ আতঙ্কে লোকালয়ের স্কুলগুলিতে কোয়ারিনটাইনের বিরোধিতা করায় পরিস্থিতি আরো জটিল হয়েছে। আর তার সাথেই বেড়ে চলেছে প্রশাসনের প্রতিবাদী কর্মসূচীর উপর বিধি নিষেধ আরোপ।
এরপর নেতৃবৃন্দ অশোকনগর পৌরসভায় যান আমফানে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের ক্ষতিপূরণের দাবি জানাতে। পৌরসভা থেকে তাদের জানানো হয় যে শহরাঞ্চলের ক্ষতিপূরণের দাবি জানানোর শেষ দিন গতকালই শেষ হয়ে গেছে। মানুষকে অন্ধকারে রেখে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার এই ধরনের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে দ্রুততার সঙ্গে কয়েকজন নির্মান শ্রমিকের ক্ষতিপূরণের আবেদন পত্র জমা দিতে তারা সমর্থ হয়। পরে গ্রামীণ অঞ্চলের ক্ষেত্রে এই আবেদনের শেষ দিন কবে তা জানতে চাওয়া হলে বিডিও কোনো সুস্পষ্ট উত্তর দিতে পারেননি।
ব্যারাকপুর ব্লক ১-এর নৈহাটি গ্রামীণ, বীজপুর ও জগদ্দল কমিটির নির্মাণ সংগঠনের কর্মীরা মিলিতভাবে পানপুর ব্লক অফিসে বিক্ষোভে সামিল হন। এই বিক্ষোভ কর্মসূচিতে আয়ারলা-ও যুক্ত হয়। দীর্ঘক্ষণ বিক্ষোভ চালানোর পর চারজনের এক প্রতিনিধি দল বিডিও-র কাছে ৩০০ জনের গণস্বাক্ষর সম্বলিত স্মারকলিপি জমা দেন। আলোচনায় বিডিও জানান গ্রামীণ এলাকায় যে সমস্ত নির্মাণ শ্রমিক কাজ পাচ্ছেন না তারা পঞ্চায়েতে জব কার্ডের জন্য আবেদন করুক। যদি কাজ পেতে অসুবিধা হয় বিডিও নিজে তার সমাধান করবেন। প্রতিনিধি দলে ছিলেন নির্মাণ সংগঠনের জেলা সম্পাদক নারায়ণ রায়, এআইসিসিটিইউ-র জেলা নেতা নারায়ণ দে ও শম্ভু ব্যানার্জী এবং শিবদাসপুর ইট ভাটা মজদুর ইউনিয়নের সম্পাদক সেখ আব্দুল মফিজ।
শিবদাসপুর ইট ভাটায় কর্মরত প্রায় ৯০৭ জন পরিযায়ী শ্রমিক ও তাদের পরিবারের তালিকা এআইসিসিটিইউ-র পক্ষথেকে আগেই বিডিও-র কাছে জমা দিয়ে তাদের ঘরে ফেরানো ও জিআর-এর দাবি জানানো হয়েছিলো। সংগঠনের এই দাবি মেনে ১৫০ জন শ্রমিককে বাসে করে প্রশাসন কয়েকদিন আগেই ঝাড়খন্ডে পৌঁছিয়ে দেয় এবং দুদিন আগে আরো ১৫২ জন পরিযায়ী শ্রমিকের কাছে জিআর-এর চাল পৌঁছিয়ে দেয়। বিডিওর কাছে এই দিন নেতৃবৃন্দ দাবি করে বাকি শ্রমিক পরিবারগুলোর (যারা মূলত বিহার থেকে এসেছেন) কাছেও জিআর পৌঁছানোর ও তাদের ঘরে ফেরানোর ব্যবস্থা করার।
দক্ষিণ ২৪ পরগণা
বিষ্ণুপুর-২ নং ব্লকে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। সাঁজুয়া নতুন রাস্তার মোড় থেকে বিবিরহাটে ব্লক অবধি মিছিল করে নির্মাণ শ্রমিকরা ব্লকে উপস্থিত হয়। মিছিল শেষে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে জমায়েত করে কেন্দ্র রাজ্য সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখায় নির্মাণ শ্রমিকরা। জমায়েতে বক্তব্য রাখেন পার্টির জেলা কমিটির সদস্য কমরেড শুভদীপ পাল।ডেপুটেশনের প্রতিনিধি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ গৃহ ও নির্মাণ শ্রমিক কর্মচারি ইউনিয়নের জেলা কমিটির সদস্য কমরেড নিখিলেশ পাল।
পশ্চিম বর্ধমান
আসানসোলে যুক্ত শ্রমিক কমিশনরের কাছে স্মারকলিপি জমা দেওয়া হয়। সকাল ১০টা থেকে আসানসোল বিএনআর রবীন্দ্র ভবনের সামনে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে জমায়েত করে প্রায় দুই ঘণ্টা বক্তব্য রাখার পর স্মারকলিপি জমা দেওয়া হয়।
গত সপ্তাহখানেক ধরে বৈঁচির বেড়েলা-কোঁচমালি এলাকায় পরিযায়ী শ্রমিকরা ভিন রাজ্য থেকে ফিরছেন। তাঁদের মধ্যে যাঁরা বাসে করে আসছেন, তাঁদের বেশিরভাগ শ্রমিকের ন্যূনতম টেস্টও হচ্ছে না এবং সরকার ও প্রশাসনের তরফে কোনোপ্রকার প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারান্টাইনের ব্যবস্থা না থাকায় তাঁদেরকে সরাসরি বাড়িতেই থাকতে হচ্ছে। এটা এলাকার মানুষ মেনে নিতে পারছিলেন না। গ্রামের বিভিন্ন পাড়ার বেশ কিছু মানুষ বিশেষত যুবকরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে এর প্রতিকারে উদ্যোগী হন। ফিরে আসা পরিযায়ী শ্রমিকদের সরকারী তত্ত্বাবধানে ১৪ দিন কোয়ারেন্টিন ও উপযুক্ত টেস্টের ব্যবস্থার দাবি ওঠে গ্রামবাসীদের মধ্যে। ওখানকার সিপিআই(এম-এল) লিবারেশনের সংগঠক কমরেড পাভেল গত ৩০ মে স্থানীয় ফাঁড়িতে কথা বলায় পুলিশকর্তা জানান যে, এটা সম্পর্কে আগে তাদের কাছে তেমন কোনো সরকারী নির্দেশ ছিল না, তবে পরে নির্দেশ আসায় স্বাস্থ্যকর্মীরা সেদিনই দায়িত্ব নিয়ে ওদের কোয়ারেন্টিন করবে। কিন্তু সেইমত কাজ না হওয়ায় পার্টির তরফ আবার সন্ধ্যায় যোগাযোগ করলে উনি জানান, এটা সম্পূর্ণ বিডিও আর স্বাস্থ্য বিভাগের এক্তিয়ারভুক্ত তাই তিনি কিছু করতে পারবেন না। ফলত পাভেলের নেতৃত্বে গ্রামবাসীরা ঠিক করেন আর কোথাও তাঁরা দরবার করবেন না।
৩১ মে সকাল থেকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ সত্ত্বেও অবরোধে সামিল হয় গ্রামের মানুষ। এক ঘণ্টার উপর অবরুদ্ধ হয় জি টি রোড। পার্টির তরফ থেকে কমরেড মুকুল কুমার পাণ্ডুয়ার বিডিওর সাথে যোগাযোগ করলে জানা যায় যে, বেড়েলা জুনিয়র বেসিক স্কুলে ঐ শ্রমিকদের রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু তা বাস্তবায়িত হচ্ছিল না এবং এবিষয়ে আগে গ্রামবাসীদের কিছু জানানোও হয়নি। মানুষ পথে নামায় প্রশাসন অবশেষে নড়েচড়ে বসলো। এরপরে পার্টি নেতৃত্বের মধ্যস্থতায় প্রশাসন আজকের মধ্যে বিষয়টির সমাধান করার আশ্বাস দিলে অবরোধ উঠে যায়।
ঘূর্ণিঝড় আমফানের পরেই তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত কলকাতা পুরসভার অপদার্থতা প্রকাশ্যে চলে আসে।কলকাতা শহরের ১০৩, ১০৪, ১০৫, ৯২, ৯১ সহ অসংখ্য ওয়ার্ডে বিদ্যুৎ পরিষেবা বন্ধ থাকে প্রায় ৪/৫ দিন। সিইএসসি কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকেও অবস্থা সামাল দিতে পর্যাপ্ত প্রস্তুতির অভাব স্পষ্ট হয়ে যায়। এর ফলে এলাকায় এলাকায় শুরু হয় অবরোধ-বিক্ষোভ।
এর মধ্যেই ২৩ তারিখ হামলা হয় ৯২ নম্বর ওয়ার্ডের সিপিআই কাউন্সিলর মধুছন্দা দেব-এর ওপর। স্থানীয় ১০৫নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তরুণ মন্ডলের বাহিনী আচমকাই হামলা চালায় বামপন্থী কাউন্সিলর ও তার সমর্থকদের ওপর। ৯২নং ওয়ার্ডের ৮-নম্বর শহীদনগর এলাকায় সিইএসসি-র কর্মীদের নিয়ে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা স্বাভাবিক করার কাজ করছিলেন মধুছন্দা দেব। সেই সময় তৃণমূল কাউন্সিলর তরুণ মন্ডলের অনুগামীরা দাবি জানায়, তারা ওই সিইএসসি-র টিমকে নিয়ে তাদের ওয়ার্ডে কাজ করাবে।
বামপন্থী কাউন্সিলর ও উপস্থিত এলাকাবাসী এর প্রতিবাদ করেন। তখনই স্থানীয় গড়ফা থানার পুলিশের উপস্থিতিতেই শারীরিকভাবে হেনস্থা করা হয় ষাটোর্দ্ধ পেরোনো এই কাউন্সিলরকে। তাকে বাঁচাতে গিয়ে আক্রান্ত হন, ঢাকুরিয়া এলাকার সিপিআইএম নেতা অচ্যুত চক্রবর্তীও। এই খবর এলাকার বিভিন্ন বামপন্থী কর্মীদের কাছে পৌঁছলে জড়ো হয়ে যান বহু মানুষ।
শহীদনগরের ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায়, সিপিআই(এমএল) লিবারেশন-এর যাদবপুর-ঢাকুরিয়া লোকাল কমিটির সদস্যরাও। সেখানেই বিভিন্ন দলগুলোর পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, এই ঘটনার প্রতিবাদে মিছিল করা হবে এলাকায়। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সিপিআই, সিপিআই(এমএল), সিপিআই(এম) ও আরএসপি-র পক্ষ থেকে এলাকায় ধিক্কার মিছিল বেরিয়ে সেলিমপুর পর্যন্ত যায়। তার পরে চারটি বাম দলের পক্ষ থেকে এক প্রতিনিধি দল গড়ফা থানায়, দোষীদের গ্রেপ্তারির দাবিতে ডেপুটেশন জমা দেয়। সেই প্রতিনিধি দলে সিপিআইএমএল)-এর পক্ষ থেকে লোকাল সম্পাদক কম: বাবুন চ্যাটার্জি প্রতিনিধিত্ব করেন।
এই তৃণমূলী কাউন্সিলর তরুণ মন্ডল, এর আগেও একাধিক বার বিভিন্ন বামপন্থী কর্মীর ওপর আক্রমন করেছে। কয়েক দিন আগেই লকডাউনের ত্রাণ-বিলি বন্ধ করতে হামলা হয় লোকাল পার্টির সম্পাদক বাবুন চ্যাটার্জির ওপর। তৃণমূলী গুন্ডাদের এই নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে আগামী দিনে বামপন্থী দলগুলো ঐক্যবদ্ধ ভাবে এলাকায় প্রতিরোধ গড়ে তুলবে।
কেন? কোন অপরাধে? সে অপরাধ কি মাতৃগর্ভের ভ্রূণকে ত্রিশূলে খুঁচিয়ে হত্যা করার, জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারার, বাইশবার ধর্ষিতা বিলকিস বানোর চোখের সামনে তিন বছরের সন্তানকে আছড়ে মারার থেকেও ঘৃণ্য? অপরিকল্পিত লকডাউনের হঠাৎ ঘোষণায় কয়েক কোটি মানুষের রুটি-রুজি কেড়ে রোদে-জলে খিদে-তেষ্টাকে সঙ্গী করে হাজার মাইল হাঁটতে বাধ্য করা, শ্রমিক স্পেশাল ট্রেনে তীব্র দাবদাহে জল খাবার ছাড়া গাদাগাদি করে তুলে দিয়ে কার্যত অনাহারে তেষ্টায় মেরে ফেলার থেকেও জঘন্য? দেশের মানুষের তিল তিল রক্ত-ঘামে গড়ে ওঠা রাষ্ট্রের সম্পদকে, নদী পাহাড় খনি জঙ্গলকে দেশি বিদেশি কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার থেকেও গুরুতর? শিক্ষা স্বাস্থ্য পরিকাঠামোকে ধ্বংস করে, শিশুদের অপুষ্টি-মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে জাতীয় সম্পদকে মন্দির মূর্তি গড়তে ব্যয় করার থেকেও অমানবিক? করোনা প্রতিষেধকের নামে গোমূত্র গোময়ে তৈরি ‘ওষুধ’ সরকারী হাসপাতালে ‘হিউম্যান ট্রায়াল’ দেওয়ার ষড়যন্ত্রের থেকেও ভয়াবহ?
হ্যাঁ, মোদী অমিত শাহ-র সরকার তেমনটাই মনে করে। এনআরসি-এনপিআর-সিএএ বিরোধী আন্দোলনে, প্রতিবাদী ধর্ণা অবস্থানে সামিল হওয়াটা নাকি দেশদ্রোহ! গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্য প্রতিবাদ করাটা নাকি রাষ্ট্রদ্রোহ! শ্রমিক কৃষক সংখ্যালঘু দলিত আদিবাসী সাধারণ মানুষের অধিকারের জন্য লড়াই করাটা ‘অপরাধ’! কী ভাবছেন? দেশদ্রোহ রাষ্ট্রদ্রোহ অপরাধের সংজ্ঞা পাল্টে গেছে? গেছে তো! ফ্যাসিস্ট বিজেপি-আরএসএস মোদী অমিত যোগীর রাজত্বে সংবিধান পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। তাই সংবিধান-বিরোধী সিএএ-এর বিরোধিতা তাদের চোখে এত ভয়ঙ্কর যে একটি মামলায় জামিন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি মনগড়া, মিথ্যা, ভিত্তিহীন অভিযোগে গ্রেপ্তার করে আবার নতুন মামলায় জড়ানো হয়!
তা, এই ‘অপরাধী’টি কে? ২৯ বছরের তরুণী দেবাঙ্গনা কলিতা, জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক। তাকে এবং জেএনইউ-এর আরেক গবেষক নাতাশা নারওয়ালকে গত ২৩ মে গ্রেফতার করা হয় জাফরাবাদে সিএএ-বিরোধী ধর্ণা অবস্থানে সামিল থাকার জন্য। দু'জনেই ‘পিঞ্জরা তোড়’ নারী আন্দোলনের কর্মী। পরের দিন জামিনে ছাড়া পাওয়া মাত্রই আবার গ্রেফতার করা হয়। উত্তর পূর্ব দিল্লির দাঙ্গায় হত্যা, হত্যার চেষ্টা, দাঙ্গা ও অপরাধ মূলক ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগে, দিল্লি পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চের আরেকটি ইউনিট। ১৪ দিনের বিচারবিভাগীয় হেফাজতে থাকার সময়েই প্রথমে নাতাশাকে ইউএপিএ-তে গ্রেপ্তার করে স্পেশাল সেল। গত ২৮ মে দেবাঙ্গনাকে আবার গ্রেফতার করা হয় ২০১৯-এর ডিসেম্বর দরিয়াগঞ্জে অবৈধ সমাবেশ ও দাঙ্গা হাঙ্গামায় জড়িত থাকার অভিযোগে। এই মামলায় মঙ্গলবার জামিন পেলেও তাকে অন্য একটি মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতেই রাখা হয়েছে। শুধু দেবাঙ্গনা বা নাতাশা নয়, গত দু’মাস ধরে লকডাউনের মধ্যে দিল্লি পুলিশ জামিয়া মিলিয়া বিশ্ব বিদ্যালয়ের সাফুরা জারগার (চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা) মিরান হায়দার, আসিফ ইকবাল, তান্থা, রাজনৈতিক কর্মী ইশরত জাহান, খালিদ সাইফার, গুলফিশা ফতিমা, সারজিল ইমাম সহ প্রায় শ’খানেক সংখ্যালঘু ছাত্রছাত্রী ও অন্যান্যদের সিএএ-বিরোধী আন্দোলনে থাকার জন্য গ্রেফতার করেছে। অনেককে ইউএপিএ-এর অধীনে। উত্তরপ্রদেশ পুলিশ সম্প্রতি আলিয়া মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারহান ফুবেরি, রাভীশ আলি খানকে গ্রেপ্তার করেছে, সিএএ বিরোধিতার জন্য । ভীমা-কোরেগাঁও মামলায় বিনা বিচারে আটক রয়েছেন অশীতিপর ভারভারা রাও সহ আটজন বিশিষ্ট মানুষ। কিন্তু দিল্লি দাঙ্গায় ইন্ধন সৃষ্টিকারী কপিল মিশ্র, অনুরাগ ঠাকুর, পরভেশ বর্মাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করা দূরে থাক, জিজ্ঞাসাবাদও করেনি।
প্রতিবাদী কণ্ঠকে স্তব্ধ করার জন্য দানবীয় আইনকে কাজে লাগানো হচ্ছে। এই ভয়ানক ফ্যাসিবাদী চক্রান্তের বিরুদ্ধে ধিক্কার ও প্রতিবাদ জানিয়ে সমস্ত রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিতে আজ ৩ জুন দেশ জুড়ে এক বিক্ষোভ কর্মসূচী পালিত হয়েছে।
সারা ভারত কিষান মহাসভা (AIKM), অখিল ভারতীয় কিষাণ সভা, ভারতীয় কিষাণ ইউনিয়ন (টিকাইত) এবং জয় কিসান আন্দোলন যৌথ বিবৃতিতে জানিয়েছে যে ২ জুন ২০২০-২১ সালের জন্য কেন্দ্রের মোদী সরকার খারিফ কৃষি পণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা কৃষকদের সাথে প্রকাশ্য এক জালিয়াতি। কৃষক সংগঠনগুলি পৃথক পৃথক বিবৃতিতে ২০২০-২১ সালের জন্য মোদি সরকার ঘোষিত খারিফ ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যকে বিগত ৫ বছরে সর্বনিম্ন বৃদ্ধি বলে উল্লেখ করেছে।
কিসান মহাসভার জাতীয় সভাপতি রুলদু সিং ও সাধারণ সম্পাদক রাজারাম সিং, কিষাণ সভার জাতীয় সভাপতি অশোক ধাওয়ালে, সাধারণ সম্পাদক হান্নান মোল্লা, কিষাণ ইউনিয়নের জাতীয় সভাপতি রকেশ টিকাইত ও জাতীয় মুখপাত্র ধর্মেন্দ্র মালিক, জয় কিসান আন্দোলন জাতীয় সংযোজক অভীক সাহা, পাঞ্জাব কিষান ইউনিয়নের প্রাদেশিক সচিব গুরুনাম সিং ও গোরা সিং আলাদা আলাদা বিবৃতিতে বলেছেন যে গতকাল কেন্দ্রীয় সরকার যে ১৪টি খারিফ ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বাড়ানোর ঘোষণা করেছেন তার মধ্যে ১২টি ফসলের ক্ষেত্রে এই বৃদ্ধি আজ অবধি সর্বনিম্ন। এই বৃদ্ধি মুদ্রাস্ফীতির কারণে ক্রমবর্ধমান ব্যয়কে হিসেবে তো রাখেইনি, উল্টে এটি ফসলের প্রকৃত মূল্যকে কমিয়ে দিয়েছে।
কৃষক সংগঠনগুলি কৃষকদের সাথে এই প্রতারনা অবিলম্বে প্রত্যাহার করা এবং স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে সি-২ + মোট ব্যয়ের দেড় গুণ সহায়কমূল্য ঘোষণা করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে। কৃষক সংগঠনগুলি জানিয়েছে যে, মোদি সরকার এ বছর প্রতি কুইন্টাল ধানের গড় উৎপাদন ব্যায় ১২৪৫ টাকা ধার্য করেছে। যেখানে গত বছর সি-২ অনুযায়ী ধানের উৎপাদন ব্যায় কুইন্টাল প্রতি ১৭২২ টাকা ধার্য হয়েছিল। এর সাথে + ৫০% মুনাফা যুক্ত করলে গত বছরই ধানের প্রকৃত সহায়কমূল্য কুইন্টাল প্রতি ২৫৮৩ টাকা হওয়ার কথা ছিলো। উৎপাদন খরচের হিসাবে কারচুপি করা হচ্ছে। কেবল সার, বীজ ও পারিবারিক শ্রমের দামকে বিবেচনায় রাখা হয়েছে। কিন্তু জমির খাজনা ও সুদ সহ ঋণ শোধের দায়কে (C2) হিসাবের বাইরে রাখা হয়েছে।
পাঞ্জাবের কৃষি মন্ত্রক গত বছর ধানের গড় সহায়ক মূল্য কুইন্টাল প্রতি ২৭৪০ টাকা ধার্য করেছিল। কেরল সরকার কৃষকদের ধান কিনছে প্রতি কুইন্টাল ২৬৯০ টাকায়। অন্যদিকে ছত্তিশগড় সরকারও গত বছর থেকে কৃষকদের ধান কিনছে কুইন্টাল প্রতি ২৫০০ টাকা হারে। পঃ বঙ্গ সরকার কিনছে ১৮১৫ টাকা তার সাথে পরিবহন বাবদ ২০ টাকা যোগ করে ১৮৩৫ টাকা কুইঃ দরে। এখন এক বছর পর, যখন ফসল উৎপাদনের ব্যয় আরও বৃদ্ধি পেয়েছে, তখন মোদি সরকার ধানের সর্বনিম্ন সমর্থন মূল্য কুইন্টাল প্রতি ১৮৬৮ টাকা নির্ধারণ করেছে, যা গত বছরের মোট ব্যয়ের সাথে ৫০% মুনাফার হিসাবে প্রতি কুইন্টালে ৫৬০ টাকা কম।
এটি গত বছরের ধানের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ৩.৯২% বৃদ্ধি থেকেও আরো কমিয়ে মাত্র ২.৭১% বৃদ্ধি। অথচ একেই ফসলের দামের দেড়গুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে বলে মোদী সরকার দেশের সামনে মিথ্যাচার করছে। কৃষকদের প্রতি এই প্রতারনার বিরুদ্ধে কৃষক সংগঠনগুলি অন্যান্য কৃষক সংগঠনের সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনে নামার ঘোষণা করেছে।
এআইকেএম দাবি জানিয়েছে প্রকৃত কৃষকদের থেকে ধান কিনতে হবে। এ জন্য গ্রামে গ্রামে ক্যাম্প করতে হবে। ভাগচাষি ও চুক্তিচাষিরাও যাতে সরকারী দর পায় তা সুনিশ্চিত করতে হবে। ফড়ে দালাল মহাজনদের থেকে ধান কেনা চলবে না।
-- জয়তু দেশমুখ
ভারত সরকারের সর্বাধিনায়ক আত্মনির্ভর ভারত গড়ার ডাক দিয়েছেন এবং সেজন্য ২০ লক্ষ কোটি টাকার (এর মধ্যে কতটা ফাঁপাপনা আছে, সে আলোচনায় আমরা যাচ্ছি না) প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন।
একটি দেশ আত্মনির্ভর হয়ে ওঠে তখনই, যখন তার নাগরিকরা, তার গরিব-মেহনতি নারী-পুরুষেরা, আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে মাথা তুলে নিজেদের পায়ে দাঁড়ান। এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে জাতীয় গ্রামীণ জীবিকা নির্বাহ মিশন (এনআরএলএম)-এর প্রায় এক কোটি স্বনির্ভর গোষ্ঠী। সম্প্রতি এ কথা খুব ভালো ভাবে প্রমাণিত হয়েছে। ভারত সরকারের গ্রামীণ বিকাশ মন্ত্রকের রিপোর্ট অনুসারে, এ বছর ১৫-৩০ মার্চের মধ্যে ১৪,৫২২টি গোষ্ঠীর ৬৫ হাজার ৯৩৬ জন সদস্য ১৩২ লক্ষ মাস্ক তৈরি করেছেন। এই গোষ্ঠীগুলো ভারতের চব্বিশটি রাজ্যের মোট ৩৯৯ জেলায় ছড়িয়ে আছে। এ থেকেই বোঝা যায় স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলোর কর্মক্ষমতা এবং দেশের প্রয়োজনে বড় ভূমিকা নেওয়ার দক্ষতা কত বেশি। তবে এখানে সমস্যাও আছে অনেক। যেমন বিহার সরকার ঘোষণা করেছিল গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে প্রচুর মাস্ক তৈরি করা হবে, যাতে প্রত্যেক পরিবারকে চারটি করে মাস্ক দেওয়া যায়। কিন্ত বাস্তবে অল্প কয়েকটি গোষ্ঠীকেই এই কাজ দেওয়া হয়। তাঁরা যথাসময়ে মাস্ক তৈরি করলেও তাঁদের কাছ থেকে সরকার তা কিনছে না। অর্থাৎ সেই গোষ্ঠীগুলো আরো বিপদে পড়েছে। এ থেকে বোঝা যায়, সরকারের সদিচ্ছার ওপরই সব কিছু নির্ভর করে।
এটা খুব পরিস্কার যে, সরকার নেহাত দায়ে পড়েই গোষ্ঠীগুলোকে সবচাইতে সস্তায় মাস্ক তৈরির অর্ডারটা দিয়েছিল। এটা ছিল নেহাতই ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ। কিন্তু ঠিকমত কাঁচা মালের অপ্রতুলতা ও বাজারের অভাব – এই দুটো মূল সমস্যার কোনো স্থায়ী সমাধানের সদিচ্ছা ভারত সরকার দেখায়নি। বহু বিজ্ঞাপিত আর্থিক প্যাকেজে স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলোর জন্য শুধু দুটি ঘোষণা আছে। তা হল, এই বছর তাঁদের ঋণ শোধের কিস্তি দিতে হবে না এবং এখন থেকে তাঁরা বছরে ১০ লক্ষর বদলে ২০ লক্ষ টাকা ঋণ নিতে পারবেন। কিন্তু এতে গোষ্ঠীগুলোর কোনো সুরাহা হবে না। কারণ ঋণ মকুব করা হচ্ছে না, পুরনো ও নতুন ঋণ পরে এক সাথে শোধ করতে হবে। সেটা ঋণের বোঝায় ভারাক্রান্ত এই গোষ্ঠীগুলোর পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। অথচ বেসরকারী মাইক্রো ফিনানস কোম্পানিগুলো (যাদের দাপট অন্ধ্র প্রদেশে সবচাইতে বেশি) এবং পশ্চিমবঙ্গে বন্ধন ব্যাংকের মতো কিছু প্রতিষ্ঠান প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাকে পাত্তা না দিয়ে এখনই কিস্তি শোধ করার জন্য চাপ দিচ্ছে। এটা বন্ধ করার জন্য রাজ্য বা কেন্দ্র কোনো সরকার অথবা রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কেউই কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না!
আমরা জানি, কেন্দ্রীয় সরকার প্রায়শই বড় বড় পুঁজিপতিদের বিপুল পরিমাণ ঋণ মাফ করে দিয়ে থাকে। তথাকথিত ২০ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজেও এ জন্য সংস্থান রাখা হয়েছে। কিন্তু কেন এমনটা করা হবে? ধনকুবেরদের কাছ থেকে সব টাকা আদায় করা, আর গরিব মহিলাদের, কৃষকদের, অন্যান্য শ্রমজীবীদের ঋণ মকুব করা -- এই নীতিই কি ন্যায়সংগত নয়? এ কথাও মনে রাখা উচিত যে মাল্য-চোকসি-নীরব মোদীর মতো ক্রোনি ক্যাপিটালিস্ট অর্থাৎ সাঙাত পুঁজিপতিরা যেখানে সরকারী ব্যাংকের টাকা চুরি করে বিদেশে পালায় সেখানে স্বনির্ভর সংস্থাগুলোর ঋণ-পরিশোধের রেকর্ড অত্যন্ত ভালো। সুতরাং আজ যখন লকডাউনের মারে তাঁরা বিপর্যস্ত, পশ্চিমবঙ্গে যখন মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে নেমে এসেছে উমপুনের ধ্বংসলীলা, তখন কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে অবশ্যই কার্যকরীভাবে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।
এবং তা কেবল গোষ্ঠীর সদস্যদের স্বার্থে নয়। দেশ এবং দশেরও স্বার্থে। ভারতীয় অর্থ ব্যবস্থা এখন গভীর মন্দায় তলিয়ে যেতে শুরু করেছে। এর মোকাবিলায় একটি ইঞ্জিন হল বিনিয়োগ আর একটি হল কার্যকরী চাহিদা বা সোজা কথায় মানুষের হাতে কিছু টাকাপয়সা, যা দিয়ে তাঁরা কেনাকাটা করবেন। বিপুল সংখ্যক স্বনির্ভর গোষ্ঠীর ঋণ মকুব করে দিয়ে নতুনভাবে বিনা সুদে ঋণ দিলে কি ঘটবে? তাদের একাংশ সেই অর্থ ছোটখাটো কারবারে বিনিয়োগ করবে, যেটা সবচেয়ে বাঞ্ছনীয়। আর যেসব গোষ্ঠী নানা কারণে সেটা পেরে উঠবে না তাদের সদস্যরাও সেই টাকা দিয়ে বাজার থেকে কিছু না কিছু কিনবেন। এটাও বাজারকে চাঙ্গা করতে কিছুটা হলেও অবদান রাখবে।
এই সামগ্রিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির নেতৃত্বে স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলো ২৯ মে দেশের বহু জায়গায় ধরনা প্রদর্শন করে। মূল দাবি ছিল :
* সমস্ত স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সরকারি - বেসরকারি ঋণ মকুব করতে হবে ।
* মাইক্রো ফিনানস কোম্পানী থেকে নেওয়া ঋণ সরকারকে পরিশোধ করতে হবে।
* লকডাউন শিথিল হওয়ার সাথে সাথে স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলো যাতে আবার কাজে নামতে পারে সেজন্য তাঁদের বিনা সুদে ঋণ দিতে হবে।
* স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলোকে উৎপাদনের উপকরণ সরবরাহ করতে হবে ও উৎপন্ন দ্রব্য সরকারকে কিনে নিতে হবে ।
* স্বনির্ভর গোষ্ঠী, পঞ্চায়েত, বিডিও ও ব্যাংকের সমন্বয়কারী (সিএসপি)-কে মাসিক নূন্যতম ১৫০০০ টাকা পারিশ্রমিক দিতে হবে।
এই সমস্ত দাবি নিয়ে বিহার, ঝাড়খণ্ড, উওরপ্রদেশ, উওরাখন্ড, কার্বি আংলঙ, আসাম, উডিষ্যা, রাজস্থান, পাঞ্জাব, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাডু, কর্নাটক সহ আরো কিছু জায়গায় প্রতিবাদী ধরনা সংগঠিত হয়। সর্বত্রই ব্যাপক এবং বহুলাংশে স্বতঃস্ফূর্ত গণ সমাবেশ দেখা যায়।
পশ্চিমবঙ্গে হাওড়ায় আইপোয়ার জেলা সম্পাদিকা কমরেড কল্যাণী গোস্বামীর নেতৃত্বে দুটি ব্লকে কর্মসূচী পালিত হয়। আমতার তিনটি এলাকায় “আশার আলো” নামে গোষ্ঠীর মহাসংঘের পক্ষ থেকে কমরেড অঞ্জনা মন্ডলের উদ্যোগে এবং বাগনানে বাঙ্গালপুর অঞ্চলে “মাতংগিনী” ও “বিবেকানন্দ” নামে দুটি গোষ্ঠী একসাথে পোস্টার সমেত বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। গোষ্ঠীর মহিলাদের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের মেজাজ ছিল চোখে পড়ার মতো।
কলকাতার যাদবপুরে শহীদ নগর অঞ্চলে আইপোয়ার নেতৃবৃন্দ পোস্টার সমেত বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। কর্মসূচীর নেতৃত্বে ছিলেন রাজ্য সম্পাদিকা কমরেড ইন্দ্রাণী দত্ত। একই সাথে প্রবীণ বিপ্লবী সাংস্কৃতিক কর্মী ভারভারা রাও-এর মুক্তির দাবিও তোলেন কমরেডরা।
হুগলি জেলার পোলবা ব্লকে এই দিন বেলা ১১টা থেকে বিডিও অফিসে বিক্ষোভ অবস্থান ও ডেপুটেশন কর্মসূচী নেওয়া হয়। লকডাউনে যানবাহন প্রায় বন্ধ থাকলেও গোষ্ঠীর মহিলারা দলে দলে যথাসময়ে সমাবেশিত হন। পোস্টার সমেত সুসজ্জিত অবস্থান শুরু হয়। বেলা যত বাড়তে থাকে মুখে মুখে আন্দোলনের বার্তা ছড়িয়ে পড়ে এবং সন্ধ্যা ৬টায় বিক্ষোভকারীর সংখ্যা প্রায় ৩০০ দাঁড়ায়। আইপোয়ার পক্ষ থেকে বিডিও-কে ডেপুটেশন দেওয়া হয়।
এই কর্মসূচী সফল করার জন্যে সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতির উদ্যোগও থাকে। গোটা আন্দোলনকে নেতৃত্ব দেন আইপোয়া জেলা সদস্যা কমরেড অর্পিতা রায় ও পার্টির ও কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতির রাজ্য নেতা কমরেড সজল অধিকারী সহ অন্যান্য জেলা ও ব্লক নেতৃবৃন্দ। ঋণ মুক্তির দাবিতে আগামীদিনে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়। আইপোয়ার জেলা কমিটির পক্ষ থেকে একই দিনে জেলা শাসকের কাছেও ডেপুটেশনের কপি ই-মেইল করা হয়।
-- চৈতালি সেন
আধুনিক ধাত্রীবিদ্যার জনক ও স্বাস্থ্যবিজ্ঞানী ফ্লোরেন্স নাইটঙ্গেলের দ্বিশত জন্মবার্ষিকীতে তাঁকে শ্রদ্ধা জানানো হল গত ৩১ মে বাখরাহাটে। সারাভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি বিষ্ণুপুর ব্লক-২ কমিটির পরিচালনায় বাখরাহাটের মাখালিয়া গ্রামে ফ্লোরেন্স নাইটঙ্গেলকে স্মরণ করলেন মহিলারা। কর্মসূচীতে এলাকার আশা, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। মহিলা সমিতির ব্লক সম্পাদিকা কমরেড পূর্ণিমা হালদার তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে ধাত্রীবিদ্যায় ফ্লোরেন্স নাইটেঙ্গেলের অবদান সম্পর্কে আলোকপাত করেন। আশাকর্মীদের মধ্য থেকে দুজন বক্তব্য রাখেন। সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন পার্টির জেলা কমিটির সদস্য কমরেড দিলীপ পাল ও কমরেড শুভদীপ পাল।
আমফান ঘুর্ণিঝড়ের বেশ কয়েকদিন পেরিয়ে গেলো। ক্ষয়ক্ষতির থেকে দুই ২৪ পরগণা বা মেদিনীপুরের তুলনায় খানিকটা পেছনের দিকে থাকলেও কৃষিপ্রধান নদীয়া জেলায় ঝড় জলে চাষিদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। রানাঘাট হরিণঘাটায় ক্ষয়ক্ষতি ব্যাপক। ৮ জন মৃত। হাজার হাজার ঘরবাড়ি ভেঙ্গে গেছে। বিপর্যস্ত কৃষি। জেলা জুড়ে বিভিন্ন ব্লকে বোরো ধান মাঠ থেকে সম্পূর্ণ ওঠেনি। বেশ কয়েক হাজার চাষির ধান প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে। জেলায় ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়েছে বলে কৃষি দপ্তরের খবর। লক্ষাধিক পাট চাষি ক্ষেতে জল জমে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত। ব্যাপক এলাকায় বাড়ন্ত পাট গাছগুলি ঝড়ের আঘাতে শুয়ে পড়েছে। জেলার বড় এলাকায় তিল চাষ হয়। তিল, পেপে, কলা, নানা রকম সবজি, ফুল প্রভৃতি ক্ষেতে সেই একই শোচনীয় হাল। অথচ নদীয়া জেলা প্রশাসন বা রাজ্য সরকার আজও ঠিক করে উঠতে পারলো না আমফানে নদীয়া জেলায় কৃষির আদৌ কোনো ক্ষতি হয়েছে কিনা। আক্রান্ত চাষিরা ক্ষতিপূরণের জন্য কোনো কাগুজে আবেদন করার অধিকারটুকুও পাবে কিনা। সেটাও আজ অনিশ্চিত! চাষিদের এই জরুরি সংকট নিয়ে জেলা শাসকের কাছে আজ বামদলগুলির এক প্রতিনিধি দল ডেপুটেশনে গেলে জেলা শাসক বিভূ গোয়েল জানালেন এখনও নাকি তদন্ত চলছে। গ্রামে গেলে সাদা চোখে যা দেখা যায়, শাসকেরা রঙ্গীণ চশমা পড়ে তা দেখতে পান না। তারা চোখ বুজে থাকেন। মা মাটি মানুষের নাম করে এ রাজ্যের তৃণমূল সরকারের কৃষকদের প্রতি এই বঞ্চনা অমর্যাদার প্রতিবাদে আজ নদীয়া জেলায় বামপন্থী দলগুলির ডাকে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ক্ষতিপূরণের দাবিতে কৃষ্ণনগর শহরে এক বিক্ষোভ ডেপুটেশন সংগঠিত হয়।
ক্ষতিপূরণের অর্থ বরাদ্দে কেন্দ্রের মোদী সরকারের সীমাহীন বঞ্চনার বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কার জানানো হয়, তুলে ধরা হয় আমফানকে জাতীয় বিপর্যয় ঘোষণার দাবি। এছাড়া ত্রাণ বিলিতে দুর্নীতি দলবাজির বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ জানানো হয়। শহরের কেন্দ্র সদর মোড়ের রাস্তায় সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে আধ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে বাম কর্মী ও নেতৃবৃন্দের স্লোগান প্ল্যাকার্ড সহকারে বিক্ষোভ প্রদর্শন, খালি গলায় বক্তব্য বহু মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। নেতৃবৃন্দ বলেন, পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরানো নিয়ে রাজ্য সরকার দ্বিচারিতা করছে,তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা, প্রয়োজনীয় কোয়ারান্টাইন ব্যবস্থাপনা, সুরক্ষা, খাদ্য-কাজের সুব্যবস্থা নেই। সম্পূর্ণ দায়সাড়া ভাবে তাঁদের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ওরা তো আমাদের সমাজের সম্পদ! জেলায় পরিযায়ীদের বিরুদ্ধে ঘৃণা বিদ্বেষ ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক রং দেওয়ার অপচেষ্টা চলছে। এর বিরুদ্ধে প্রশাসনকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। কর্মসূচীতে বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এমএল) নদীয়া জেলা সম্পাদক সুবিমল সেনগুপ্ত, সিপিআইএম-এর এস এম শাদী প্রমূখ।
ডেপুটেশনে ছিলেন সিপিআই(এমএল)-এর জয়তু দেশমুখ, সিপিএম বিধায়ক রমা বিশ্বাস প্রমূখ। এসডিও দপ্তরে পৃথকভাবে ডেপুটেশনে ছিলেন সিপিআই(এমএল)-এর নীহার ব্যানার্জী ও অন্যান্য বাম নেতৃবৃন্দ। উপস্থিত ছিলেন কাজল দত্তগুপ্ত, সন্তু ভট্টাচার্য।
গত ২৫ মে জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর দশ দিন পেরিয়ে এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অসংখ্য ছোট বড় শহরে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়েছে। ২০০টির বেশি শহরে কারফিউ ঘোষণা করেছে শাসকেরা। হোয়াইট হাউসের দিকে এগনো বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশ্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হিংস্র কুত্তা লেলিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়, কিন্তু তার পরের দিন হোয়াইট হাউস ঘিরে ফেলে বিক্ষোভকারীরা এবং ট্রাম্প পালিয়ে মাটির তলার বাঙ্কারে আশ্রয় নেয়।
এই ঘটনা দুনিয়ার মানুষকে মনে করিয়ে দিয়েছে রাইখস্ট্যাগের বাঙ্কারে হিটলারের শেষ পরিণতির কথা। কিন্তু বাস্তবে তুলনাটা বরং উল্টো। ১৯৪৫-এ সোভিয়েত লাল ফৌজের বিজয়ে গর্তে ঢুকে যাওয়া হিটলারের তুলনায় বরং ১৯৩৩ সালে জার্মানির চ্যান্সেলর হওয়ার সময়কার হিটলারের সাথেই বর্তমানে ট্রাম্পের অবস্থা বেশি মিল খায়। বাস্তবিকই, হিটলারের কুখ্যাত ফ্যাসিস্ট ষড়যন্ত্রের কায়দাতে, গত বুধবার ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউস থেকে একটি ভিডিও কম্পাইলেশন ছড়িয়ে দেয় যেখানে দেখানো হয় যে অ্যান্টি ফ্যাসিস্টরা সাধারণ মানুষ ও সরকারী ভবনগুলিতে হামলা চালানোর জন্য বিভিন্ন জায়গায় ইঁটপাটকেল পাথর ইত্যাদি জমা করছে (দু-তিন ঘণ্টার মধ্যেই কিছু সংবাদমাধ্যম ও প্রতিবাদীরা এই ফেক ভিডিওর মিথ্যা প্রচার উন্মোচিত করে দেয় এবং হোয়াইট হাউস ভিডিওটি ডিলিট করে দিতে বাধ্য হয়। এই ষড়যন্ত্র ধরা পড়ে গেলেও কোনরকম ক্ষমা অবশ্য চায়নি ট্রাম্প)। বুর্জোয়া সংবিধানের গণতন্ত্রটুকু নস্যাৎ করে একটি সংকীর্ণ মুমূর্ষু ও মরিয়া পুঁজিগোষ্ঠির ‘ফ্যুয়েরর’ হয়ে ওঠার পথে এখন রয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
অন্যদিকে আমেরিকার তরুণ শ্রমিকশ্রেণি বলতে শুরু করেছে, “মূল বিষয় হলো এই সিদ্ধান্তটি নেওয়া যে, আমরাই সিদ্ধান্ত নেব”। বিগত দশ দিনের ঘটনাক্রম থেকে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে যে, মার্কিনী বুর্জোয়া গণতন্ত্র ভেতর থেকে ফুরিয়ে গেছে এবং মার্কিন সমাজ ও রাষ্ট্র এমন এক মোড়ের মাথায় এসে পড়েছে যেখানে হয় শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে বৈপ্লবিক পরিবর্তন অথবা গণতন্ত্রের খোলস ঝেড়ে ফেলে সরাসরি ফ্যাসিস্ট পুনর্গঠন। শ্রেণী সংগ্রামের ময়দানে দুটি পক্ষের এরকম মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়ার অভিব্যক্তি ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্য থেকেও স্পষ্ট হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্টেটগুলির গভর্নররা কেন আরও বেশি সংখ্যায় ‘ন্যাশনাল গার্ড’ নিয়োগ করে বিদ্রোহকে দমন করছে না সে বিষয়ে গভর্নরদের সাথে মিটিঙে ট্রাম্প “প্রতিবাদীদের মুছে ফেলা”-র নির্দেশ দিয়ে বলেন, “এটা একটা আন্দোলন এবং যদি আপনারা একে থামিয়ে না দেন তাহলে পরিস্থিতি উত্তরোত্তর খারাপ হতে থাকবে। আপনাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে, এবং যদি এখুনই দমন না করেন তাহলে আসলে আপনারা সময় নষ্ট করছেন। ওরা আপনাদের মাথায় চড়ে বসতে চলেছে এবং আপনারা শেষ পর্যন্ত একগুচ্ছ উদগাণ্ডুতে পরিণত হবেন”। বিচার বিভাগের কাছেও ট্রাম্প আবেদন জানিয়েছে প্রতিবাদীদের অন্ততপক্ষে দশ বছরের জন্য জেলে পুরতে। ট্রাম্পের এক সহযোগী সরাসরি ঘোষণা করেছে, “মধ্যপ্রাচ্যে যেভাবে আমরা টেররিস্টদের শিকার করি সেভাবেই অ্যান্টিফা নিকেশ করতে হবে”। ‘অ্যান্টিফা’ হল অ্যান্টি-ফ্যাসিস্টদের জনপ্রিয় নেটওয়ার্কের নাম। বাস্তবেই ট্রাম্প প্রশাসন বিদ্রোহীদের বিচার ও শাস্তির দায়িত্ব অর্পণ করেছে ‘জয়েন্ট টেররিস্ট টাস্ক ফোর্স’-এর ওপর, যে ফোর্স মধ্যপ্রাচ্য ও সেন্ট্রাল এশিয়ায় গ্রেপ্তার করা টেররিস্টদের বিচার করে শাস্তি দেওয়ার কাজে নিযুক্ত ছিল। তিরিশ হাজারের ওপর ন্যাশনাল গার্ডের সাথে সেনাবাহিনীর পুলিশও নেমে পড়েছে এবং দেশের ভেতরেই সেনা নিয়োগের মাধ্যমে সরকারি পদক্ষেপের যাবতীয় দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে সেনা প্রধানদের সর্বোচ্চ সংস্থা ‘জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ’-এর চেয়ারম্যানের ওপর। সব মিলিয়ে ট্রাম্পের নেতৃত্বে এক মিলিটারি-পুলিশ-ডিক্টেটরশিপের পথে এগোচ্ছে শাসকেরা।
জর্জ ফ্লয়েড বাধা দেননি গ্রেপ্তারির সময়। মাটিতে ফেলে গলায় হাঁটু গাড়া দিয়ে চেপে রাখার সময়ও প্রতিরোধ করতে দেখা যায়নি তাঁকে। ন’মিনিট ধরে কেবল বলার চেষ্টা করেছেন “আমি শ্বাস নিতে পারছি না” এবং ধীরে ধীরে নিথর নিস্তব্ধ হয়ে গেছেন। কিন্তু আমেরিকাকে আরেকবার জাগিয়ে দিয়েছেন তিনি। এই দৃশ্য মার্কিনী বুর্জোয়া গণতন্ত্রের নৃশংস বর্ণ-জাতিবাদ দুনিয়ার সামনে উন্মোচিত করে দিয়েছে। কিন্তু আমেরিকার তরুণ প্রজন্মের কাছে এই বাস্তবতা নতুন কিছু নয়। লুট করা জমিতে, লুট করা শ্রমের ওপর, বর্ণবাদের ভিত্তিতে তৈরি হওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার আদি কাল থেকে এরকম লক্ষকোটি হত্যা সংগঠিত করেছে। বর্তমান বিদ্রোহের নতুনত্ব হল- তরুণ প্রজন্মের শ্রমজীবি জনতা এই ইতিহাস সম্পর্কে বিশেষ সচেতন হয়ে উঠেছে, বর্ণবাদ খতম করে নানা-জাতি-বর্ণের ঐক্য দ্রুত প্রসারিত করছে এবং এই ধ্বংসাত্মক পুঁজিবাদ থেকে মুক্তির সন্ধানে পথে নেমেছে। কোভিড মহামারীতে লক্ষাধিক মানুষ তো জর্জ ফ্লয়েডের মতোই শ্বাস না নিতে পেরে মারা গেল কেবল নৃশংস মুনাফার স্বার্থে। সরকারি কোষাগার থেকে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার বেল-আউট হস্তগত করার ব্যবস্থা পাকা করে এখন খেটে-খাওয়া জনতাকে আবার ঠেলে দেওয়া হচ্ছে কোভিডের ঝুঁকির ভেতর। নিরস্ত্র নিরিহ ফ্লয়েডকে যারা হত্যা করল সেই পুলিশ বিভাগই নিত্যনতুন মারণাস্ত্র ও সাজসরঞ্জাম কেনার বাহানায় বাজেটের এক বিপুল অংশ শুষে নেয়। অথচ চার কোটির ওপর তরুণ-তরুণী জীবিকাহীন। এই পুলিশ বাহিনীই আধুনিক মার্কিনী দাসব্যবস্থা -- ‘প্রিজন ইন্ডাস্ট্রি’ -- পরিচালনায় লুটেরা পুঁজিপতিদের শিকারি কুকুরের কাজ করে।
তরুণ প্রজন্ম আওয়াজ তুলেছে, “মৃত্যু ও ধ্বংসের এই পুঁজিবাদী শৃঙ্খলার চেয়ে এখন বিশৃঙ্খলাই ঢের বেশি জরুরি”। এই বিদ্রোহ স্বতস্ফুর্ত প্রাণশক্তিতে যেমন ক্রমাগত প্রসারিত হচ্ছে তেমনই সমন্বয় সাধন ও ঐক্যবদ্ধতায় ক্রমশ দৃঢ় হচ্ছে। সরকার, গভর্নরগণ এবং কর্পোরেট মিডিয়া প্রতিবাদীদের ইমেজে যতই কালিমা লেপনের চেষ্টা করুক না কেন শান্তিপূর্ণ ও দায়িত্বশীল গণ বিদ্রোহের বাস্তব ছবিটা সম্পূর্ণ আড়াল করা সম্ভব হয়নি। এই প্রতিস্পর্ধা কতখানি জয়যুক্ত হবে তা বলা না গেলেও পরিবর্তনের দিন যে ঘনিয়ে আসছে তা বলা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান ‘ডেমোক্র্যাট’-রা মুদ্রার অপর পিঠ মাত্র, টুইডিলডি ও টুইডিলডামের চক্কর এই সংকটকালে কার্যকরী থাকবে বলে মনে হয় না। দুনিয়াও আর একই রকম থাকবে না যেরকমটা কয়েক মাস আগেও ছিল। আমাদের দেশেও আপাত শান্ত পরিস্থিতির তলায় খানিকটা একই ধরণের বস্তুগত পরিবর্তন দ্রুত ঘটে চলেছে। মহামারি ও লকডাউন ব্যাপক শ্রমজীবি তরুণ প্রজন্মকে আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে বহু কিছু শিখিয়েছে। নতুন উপলব্ধি নিয়ে গ্রামে ফিরেছে শহরের শ্রমজীবি তরুণ প্রজন্ম।
লেখার শুরুতেই সরাসরি বলে নেওয়া যাক এটা আলোচনা শুরুর একটা ভূমিকামাত্র। সমস্যাগুলোকে বুঝে নেওয়ার একটা প্রক্রিয়া। কোথাও কোথাও আলোচনা শুরুর জন্য খুব প্রাথমিক কিছু প্রস্তাব।
চলে আসা যাক করোনাকালীন লক ডাউন উঠে যাওয়ার পরে যখন স্কুলগুলো খুলবে তার সমস্যাগুলোর আলোচনায়। আমরা এগুলোকে একটু সূত্রবদ্ধ করেই উপস্থাপণ করি –
১) স্কুলের অল্পবয়স্ক ছেলে মেয়েদের মধ্যে ঠিক কাদের স্কুলের আঙিনায় আনা যেতে পারে, কাদের আনাটা বেশি ঝুঁকির হবে?
২) যারা আসবে তাদের ক্লাসের মধ্যে বসার ব্যবস্থা কি হবে, ক্লাসের বাইরে মেলামেশার ক্ষেত্রে কত ধরনের সতর্কতা অর্জন করতে হবে?
৩) সপ্তাহে কদিন ছেলেমেয়েদের স্কুলে আনা ঠিক হবে, রোটেশন পদ্ধতি নেওয়া হবে কিনা?
৪) সিলেবাস কি একই রাখা হবে, না কমিয়ে নতুন করে স্থির করা হবে?
৫) স্কুলের সময় নানা কারণে কমিয়ে দিতে হলে ডিজিট্যাল ক্লাসের ব্যবস্থাপণা কীভাবে গড়ে তোলা হবে, তার ফলে নতুন কী কী সমস্যা তৈরি হবে? তার সমাধানে কী কী করা যেতে পারে?
৬) মিড ডে মিল ব্যবস্থার কী হবে?
৭) যে সমস্ত স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা স্কুলগাড়ি বা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করে স্কুলে আসে, তাদের জন্য কী ধরনের নির্দেশিকা বা সতর্কতা থাকবে?
৮) যে সমস্ত শিক্ষক শিক্ষিকারা অনেক দূর থেকে অনেক রকম পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করে স্কুলে আসেন – তাদের ক্ষেত্রে কী নীতি নেওয়া হবে?
৯) স্কুলগুলিতে কতটা নিয়মিতভাবে স্যানিটাইজেশন হবে? কী ধরনের স্যানিটাইজেশন? কারা তা করবেন?
১০) স্যানিটাইজেশন, ছাত্রছাত্রীদের মাস্ক, ফেস শিল্ড, সাবান, স্যানিটাইজার ইত্যাদি খাতে যে সব অতিরিক্ত খরচ হবে, তার ভার কারা বহন করবেন ?
এভাবে আরো কিছু প্রশ্ন যুক্ত করা যায় বা প্রশ্নগুলির রদবদল করা যায়। তবে এই জিজ্ঞাসাগুলো সাধারণভাবে আছেই। এমন নয় এই প্রশ্নগুলোর সুনির্দিষ্ট উত্তর ঠিক হয়ে আছে। এমন তো নয়ই যে কোনও ব্যক্তি শিক্ষক শিক্ষিকা, অভিভাবক অভিভাবিকা, শিক্ষা প্রশাসনের কোনও ব্যক্তি এসব একা একাই ভেবে ফেলতে পারবেন। এমনকী এমনও নয় যে শিক্ষা প্রশাসন, সরকার বা শিক্ষা সংগঠনগুলির কাছেও এর সার্বিক উত্তর বেশ খানিকটা তৈরি হয়ে আছে। সকলেই ভাবছেন। মতামতও ব্যক্ত করছেন। তবে দুর্ভাবনা ও ধাক্কার প্রাথমিক পর্বটা পেরিয়ে আলোচনাগুলো এখনো তেমন দানা বেঁধে ওঠেনি। কিছু আলোচনা অবশ্যই হয়েছে। মূল্যবান বেশ কিছু কথাবার্তাও উঠে এসেছে। তবে সেসব এখনো খুবই প্রাথমিকভাবে আছে। মনে হয় আরো সূত্রবদ্ধভাবে, আরো অনেক বেশি বিনিময় আলাপ আলোচনা হওয়া দরকার।
একেবারে প্রথমে যে প্রশ্নটা রয়েছে সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। স্কুল যখন খুলবে (সেটা যখনই হোক) তখন কি সবাই আসবে স্কুলে? একেবারে ক্লাস ওয়ান থেকে টুয়েলভ? একটা কথা উঠেছে যে না সবাই নয়। ক্লাস ওয়ান (বা নার্সারি) থেকে ক্লাস সেভেন অবধি ছেলেমেয়েরা স্কুলে আসবে না স্কুল খোলা হলেও। ক্লাস এইট থেকে ক্লাস টুয়েলভ কেবল আসবে। এই যে ক্লাস সেভেন অবধি শিশুদের (ধরা যাক বারো বছর অবধি, টিন এজের ঠিক আগে অবধি) স্কুলে আসাটা বেশি ঝুঁকির মনে করা হচ্ছে তার বোধহয় মূলত তিনটি কারণ আছে। এক তো তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠছে, পূর্ণ বিকশিত হয়নি। ফলে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেশি এবং আক্রান্ত হলে তাকে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে ঝুঁকিও বেশি। দ্বিতীয়ত তারা তুলনায় অবুঝ, বিপদের গুরুত্ব পুরোটা বোঝার মতো বয়েস এখনো হয়নি তাদের অনেকেরই। ফলে যে নিয়মনীতি স্কুলের ভিড়ে এলে মানার কথা, তারা তা না মেনে বিপদ বাড়িয়ে তুলবে। তাদের দিক থেকে এই দুটো দিকের পাশাপাশি আর একটা পরিকাঠামোগত দিকও আছে। যেহেতু সব জায়গার মতো স্কুলেও ভিড় কমাতে হবে, তাই নিচু ক্লাসের ছেলেমেয়েরা যদি না আসে (হাই স্কুলে ক্লাস ফাইভ, সিক্স, সেভেন) তবে সেটা করার ক্ষেত্রে সুবিধে হবে।
এবারে আসছে দ্বিতীয় প্রশ্নটা। যারা আসবে -- আপাতত যদি ধরেও নেওয়া যায় ক্লাস এইট থেকে টুয়েলভ বা ক্লাস নাইন থেকে টুয়েলভ – তবে বসার অ্যারেঞ্জমেন্ট কী ধরনের হবে? ক্লাসঘর কিছু বাড়বে ছোটরা না এলে, শিক্ষকের সংখ্যাও বাড়বে এদের ক্লাস ভাগ করে নেওয়ার জন্য। যদিও সাবজেক্ট টিচারের একটা অসুবিধে হবেই, তবুও এত বড় সমস্যার সামনে আপাতত না হয় তাকে খানিক সরিয়ে রাখা গেল। অনেক শিক্ষকই নিজেকে অন্য কিছু বিষয়ের ক্লাস নেবার জন্য তৈরি করে নেবেন এটা আশা করা যায়। কিন্তু যদি ক্লাস ফাইভ থেকে সবাই আসতে থাকে তাহলে এভাবে যে সমস্যার সমাধান হবে না, তা বলাই বাহুল্য। তবে ছেলেমেয়েদের দূরে দূরে বসার বন্দোবস্তই বা ঠিক কতটা সম্ভব? ক্লাস এইট থেকে টুয়েলভ-এর ছেলেমেয়েদের ভিড় কিন্তু যথেষ্টই। ক্লাস ফাইভ অনেক জায়গাতেই প্রাইমারিতে সরে গেছে। সিক্স, সেভেন এর ক্লাস বন্ধ রেখেও অনেক স্কুলেই বাকিদের সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং এর নীতিমালা মেনে বসানো এক কথায় সম্ভব নয়। এই জরুরি বিষয়টার সাথে ক্লাসের বাইরে তাদের সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং কীভাবে কতটা রক্ষা করা যাবে -- এই বিষয়টা নিয়েও অনেক আলাপ আলোচনা দরকার।
যদি সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং কিছুটাও মানতে হয় তাহলে দেখা যাবে অনেক স্কুলেই ক্লাস সিক্স, সেভেনকে বাদ রেখেও রোটেশন পদ্ধতি ছাড়া স্কুল চালানো সম্ভবপর নয়। এক এক স্কুলের ক্ষেত্রে এক এক রকম ব্যাপার হবে নিশ্চয়, কিন্তু বহু স্কুলে যে রোটেশন পদ্ধতি ছাড়া সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং সম্ভব নয়, তা বলাই বাহুল্য।
যদি রোটেশন পদ্ধতি নিতে হয়, তার সাথেই এসে পড়ে সিলেবাসের প্রশ্ন। সিলেবাস কি কমানো হবে না কী একই সিলেবাস পড়ানোর ক্ষেত্রে অ্যাপ্রোচে বদল আনা হবে? মূল বিষয়গুলি পড়িয়ে বাকীটা ছাত্রছাত্রীদের পড়ে নিতে বলা হবে? উচ্চমাধ্যমিক স্তরে এটা সময় সংক্ষেপের কারণে করতে হয় অনেকটাই, মাধ্যমিক স্তরেও কি সেইদিকে যেতে হবে? উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের বিদ্যমান সূচীই সমস্যাজনক, সে আলোচনা না হয় এখন থাক। কেবল বলা যাক সময় আরো কমলে জটিলতা অনেক বাড়বে।
এই সমস্ত ক্ষতি ও বাধ্যতামূলক আপোষের ক্ষতিপূরণ কীভাবে হবে? কতটা করা সম্ভব? একটা কথা অনেকেই বলছেন। ডিজিট্যাল ক্লাসের যে ব্যাপারটা চালু হয়েছে সেটা বজায় থাক। স্কুল খোলার পর এটা পাশাপাশি চলুক, একে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পরিকল্পনার ভেতরে ঢুকিয়ে নেওয়া হোক। এই আলোচনাটা এত নানামাত্রিক, এত বড় পরিসর দাবি করে, যে সেটা নিয়ে আলাদা করে পরে বিশদে লেখাই ভালো। কেবল কয়েকটা মূল কথা বলে নেওয়া যাক। কম্পিউটার, ল্যাপটপ খুব অল্প ছাত্রছাত্রীর বাড়িতে থাকবে। স্মার্ট ফোন অনেক বেশি ছাত্রছাত্রীর বাড়িতে থাকলেও অসংখ্য ছাত্রছাত্রীর বাড়িতে নেই। আর বাড়িতে বাবার একটা ফোন থাকলেও নানা কারণে নিয়মিতভাবে তা ছাত্রছাত্রীদের হাতে আসে না। অভিভাবকেরাও তাদের ব্যক্তিগত ফোন ছেলেমেয়ের হাতে স্বাভাবিক কারণেই তুলে দিতে চান না অনেক সময়ে। ফলে ডিজিট্যাল ক্লাস কিছুটাও সফল করতে হলে ছাত্রছাত্রীদের নিজস্ব স্মার্টফোন বা ট্যাবলেট দেওয়া দরকার। একটা কথা উঠেছে সরকার একসাথে ব্যবস্থা করে অনেক কম খরচে এটা দিতে পারে ছাত্রছাত্রীদের। এই নিয়েও ভাবনাচিন্তা চলতে পারে। অনেক জায়গাতেই ডিজিট্যাল ক্লাসের জন্য প্রয়োজনীয় ইন্টারনেট নেই। সেই বিষয়টিরও সমাধান দরকার। ডিজিট্যাল ক্লাসের উপাদান সমৃদ্ধ ওয়েবসাইট তৈরি করার দরকার আছে বোর্ড ও কাউন্সিলের পক্ষ থেকে। এ তাবৎ প্রস্তুত করা মাস্টারমশাইদের টিচিং এইডগুলি থেকে বেছে নিয়ে, আরো নতুন অনেক কিছু যুক্ত করে এই কাজটি শুরু করে দেওয়া দরকার। তবে এটি শিক্ষা সহায়ক হিসেবেই কেবল ব্যবহৃত হতে পারে। কখনোই প্রথাগত শিক্ষার বিকল্প হিসেবে নয়। আমাদের বর্তমান পরিকাঠামো ও সামাজিক পরিস্থিতিতে ডিজিট্যাল ক্লাস নির্ভর সমাধানসূত্র খোঁজার ক্ষেত্রে নানাবিধ বিষয়কে বারবার পর্যালোচনা করে খুব সতর্কতার সাথে এগনো দরকার।
স্কুল শুরু হলেই আসবে মিড ডে মিল সংক্রান্ত সমস্যাবলী। মিড ডে মিল কি চলবে? যদি চলে কীভাবে? ক্লাস নাইন থেকে টুয়েলভ শুধু যদি চলে, তাহলে মিড ডে মিল স্কুলে চলার দরকার পড়ছে না বর্তমান আইন অনুযায়ী। সেক্ষেত্রে মাসে এক দুদিন ফাইভ থেকে এইটের অভিভাবকদের ডেকে চাল আলু ইত্যাদি দিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থাই আপাতত চালু রাখা যায়। ক্লাস এইট এলে অন্তত কিছুদিন শুকনো প্যাকেট খাবার, চিঁড়ে কেক ইত্যাদি দেওয়ার কথা ভাবা যায়। কারণ খাবারের তৈরি ও পরিবেশনের বিষয়টি খুবই সংবেদনশীল। স্কুলে মিড ডে মিল রান্না ও বিতরণ যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে – অনেকেই এরকম ভাবছেন। মিড ডে মিল কর্মীদের অবশ্যই তাদের সাম্মানিকের পুরোটা দিয়ে যেতে হবে।
ছাত্রছাত্রীদের স্কুলে আসার ব্যাপারটা প্রাইভেট স্কুলের ক্ষেত্রে বেশি সমস্যাজনক। কারণ তাদের অনেকেই স্কুলগাড়িতে বা অন্য পাবলিক ট্রান্সপোর্টে বেশ কিছুটা দূরের পথ পাড়ি দেয়। সরকারী স্কুলের ক্ষেত্রে এই সমস্যাটা নেই তা নয়, তবে তুলনামূলকভাবে অনেক কম। তারা হেঁটে সাইকেলেই আসে অধিকাংশ। তবে সবাই নিশ্চয় নয়। সেক্ষেত্রে তাদের জন্য অতিরিক্ত কিছু সতর্কতা প্রয়োজন।
মাস্টারমশাই দিদিমণিদের অধিকাংশই এখন আসেন দূর থেকে। অনেক রকম যানবাহন বদলে। লোকাল ট্রেন চালু না হলে তাদের অনেকের আসা কার্যত অসম্ভব। আর ভিড় লোকাল ট্রেন বা বাসে এসে সেই পোষাকে ছাত্রছাত্রীদের সামনে যাওয়াটা বিপদ বাড়িয়ে তোলা বলেই অনেকে মনে করছেন। এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। বদলি ব্যবস্থাকে কতটা ব্যাপক করা যায়, সেটা দেখতে হবে। তার পাশাপাশি অন্তত অ্যাড হক ভিত্তিতে আগামী এক দেড় বছরের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা হিসেবে কতটা কাছাকাছি স্কুলে শিক্ষক শিক্ষিকাদের পড়ানোর ব্যবস্থা করে দেওয়া যায়, সেটা খতিয়ে দেখা দরকার। খুব জরুরি ভিত্তিতে এক দেড় বছরের জন্য এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার হলে ছাত্র শিক্ষক অনুপাত খানিকটা বিপর্যস্ত হবে নিশ্চিত। তবুও সবদিক খতিয়ে দেখে সেদিকেই হয়তো এগনো দরকার। অনেক জায়গায় এলাকার শিক্ষিত যুবক-যুবতীদের এই সময়কালের জন্য শিক্ষক/শিক্ষা সহায়ক হিসেবে নিয়োগ করে সমস্যা খানিকটা মেটানোর চেষ্টা করা যেতে পারে। প্রাইমারি স্কুল বন্ধ থাকলে সেখান থেকেও শিক্ষক শিক্ষিকাদের কাউকে কাউকে এই অতি বিশেষ পরিস্থিতিতে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাদানে ব্যবহার করার কথা ভাবা যেতে পারে। আলাপ আলোচনার ভিত্তিতেই সবচেয়ে ভালো সমাধানটা বেরিয়ে আসতে পারে। সেই আলাপ আলোচনাটা শুরু হওয়া দরকার।
স্কুলগুলির নিয়মিত স্যানিটাইজেশন, প্রোটেকটিভ ব্যাবস্থাপণা, নিয়মিত স্যাম্পেল টেস্ট ইত্যাদি অত্যন্ত জরুরি বিষয় বলাই বাহুল্য। সেগুলো কী কী করা হবে, তার আয়োজন, খরচ কীভাবে হবে – তা নিশ্চিতভাবেই কেবল স্কুল কর্তৃপক্ষের ব্যাপার হতে পারে না। শিক্ষাদপ্তর, স্বাস্থ্যদপ্তর, পৌরদপ্তর, পঞ্চায়েত ও জনস্বাস্থ্য দপ্তর ইত্যাদি নানা কিছুর সমন্বয় দরকার। স্কুল খোলার আগেই যদি এই বিষয়গুলি নিয়ে সুনির্দিষ্ট আলোচনা, সিদ্ধান্ত ও ব্যবস্থাপণা তৈরি করতে না পারা যায়, তাহলে কিন্তু জটিল পরিস্থিতি জটিলতর হবে।
-- সৌভিক ঘোষাল
বিভিন্ন রাজ্য থেকে শ্রমিকরা বাড়ি ফিরছেন। জনমতের চাপে ও বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়নের হস্তক্ষেপে এখন প্রচুর শ্রমিক ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিনই নিজেদের গ্রামে ফিরছেন। তারা কোথায় থাকবেন সে নিয়ে বহুবিধ প্রশ্ন উঠছে। কোথাও কোথাও বিক্ষোভ হচ্ছে।
কোয়ারানটাইন কোথায় করা হবে। এব্যাপারে সরকারও কিছু গাইড লাইন করেছেন। পাঁচটি রাজ্য যেখানে করোনা সংক্রমণের হার বিপজ্জনক তাদের ক্ষেত্রে ইনস্টিটিউশনাল কোয়ারানটাইন বাধ্যতামূলক। এখন কথা হচ্ছে কোয়ারানটাইন কি এবং কেন করতে হয়। আসলে এটা এমন একটি প্রক্রিয়া যার দ্বারা কোন মানুষ যিনি আক্রান্ত কোনো এলাকা থেকে আসছেন বা আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এসেছেন তাঁকে একটি নির্দিষ্ট দিন অবধি আলাদা রাখা হয়। ওই সময়ের মধ্যে তার যদি রোগটি ধরা পড়ে, তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। আর না হলে তিনি একসঙ্গে থাকতে পারেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কোথায় থাকবেন। নিজের বাড়িতে থাকতে পারেন। অথবা কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় থাকবেন। গরিব শ্রমিকদের অনেক সময়েই নিজের বাড়িতে জায়গার সংকুলান হয় না। সেক্ষেত্রে বাড়ি থেকে অন্য জায়গায় থাকতে হবে। এখন যেসব জায়গায় করোনা সংক্রমণের হার খুব বেশি সেখান থেকে যারা এসেছেন তারা কোনো আলাদা স্থানে থাকবেন। বা যার জ্বর সর্দির মতো উপসর্গ আছে তারও একটু আলাদা থাকা প্রয়োজন। তবে এখন খুব কম উপসর্গ আছে এমন করোনা কেসেও ঘরেই আইসোলেশন-এ থাকতে বলা হচ্ছে। এখন করোনা রোগটি অতি দ্রুত সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খুব কম উপসর্গ হয় এবং সেরেও যায়। ১৫ ভাগ ক্ষেত্রে বেশি উপসর্গ হয় আর মোটামুটি শতকরা ২ থেকে আড়াই ভাগ রোগী মারা যান। কিন্তু এটি সংক্রমণ করে দ্রুত।।
বাড়িতে আলাদা থাকবার ব্যবস্থা আছে এবং যত্ন নেবার ও খাবার দেবার মানুষ থাকলে বাড়িরই উৎকৃষ্ট থাকবার বা কোয়ারানটাইন-এর জায়গা। এক্ষেত্রে সাধারণ কিছু সাবধানতা অর্থাৎ ঘর জামাকাপড় সাবান দিয়ে ধোবার ব্যবস্থা বা পরিষ্কার রাখা আর বারংবার হাত ধোয়ার মতো কিছু ব্যাপার করতেই হবে।
সাবান দিয়ে হাত ধোওয়া, চেয়ার টেবিল হাতল ছিটকিনি সাবান দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। আর ইনস্টিটিউশনাল কোয়ারানটাইন কোনো স্কুল বিয়েবাড়ি মসজিদ মাদ্রাসায় হতে পারে। একটা বাউন্ডারির মধ্যে হওয়া বাঞ্চনীয়। যেখানে খাওয়া দাওয়া আলো বাতাস শৌচাগার জলের যথাযথ ও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখতেই হবে। এক দু-মিটার অন্তর অন্তর বিছানা থাকতে হবে। আর সামান্য উপসর্গ আছে এমন মানুষদের, এদের থেকে আলাদা রাখতে হবে। সেটি লোকালয়ের থেকে দূরে হতে হবে তার কোনো মানে নেই। কেননা এটা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে না। মশাবাহিত নয়। ইঁদুর বা অন্য প্রাণীর দ্বারা বাহিত হবে না বা জলবাহিতও নয়। যদি নির্দিষ্ট কিছু সাধারণ নিয়ম মেনে চলা যায় তাহলে এটা ছড়িয়ে পড়বে না। কেউ যদি একদম বাইরে না আসেন বা কারও সঙ্গে মেলামেশা না করেন, সেক্ষেত্রে কেউ আক্রান্ত হলেও ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা নেই। বহু ক্ষেত্রেই সাধারণ নিয়ম মেনে চলেছেন বলে একই বাড়িতে থাকা সত্ত্বেও বাড়ির কেউ আক্রান্ত হননি।
এখন নিয়মগুলো তো সবাই জানেন। চোখ মুখ নাকে হাত দেওয়া বন্ধ করতে হবে স্বাস্থ্যকর্মী বা বহুল সংক্রমিত এলাকার মানুষ N95 মাস্ক পরে থাকবেন। কিন্তু সাধারণ ক্ষেত্রে সাধারণ কাপড়ের মাস্কই যথেষ্ট। হাতে গ্লাভস পরে থাকার থেকে বারে বারে সাবান দিয়ে হাত ধোওয়া বাঞ্চনীয়। আর বাইরে থাকলে স্যানিটাইজার দিয়ে হাত মুছে নিতে হবে প্রয়োজন ছাড়া কোথাও হাত না দেওয়াই উচিত। আর হাত দিলে যেমন বাজার করলে টাকা পয়সা দেওয়া নেওয়ার পর হাত স্যানিটাইজার দিয়ে মুছে নিতে হবে। ঘড়ি আংটি বালা জাতীয় কিছু না পরা বাঞ্ছনীয়। চোখে চশমা বা রোদ চশমা রাখা উচিত। জুতো বাড়ির বাইরে খুলে রাখা উচিত। বাইরে থেকে এসে সাবান দিয়ে ভালো করে হাত পা ধুতে হবে এবং সোজাসুজি বাথরুমে সমস্ত জামাকাপড় খুলে স্নান করা বা তা নাহলেও অন্য পরিষ্কার জামাকাপড় পরা উচিত। চেষ্টা করা কর্মক্ষেত্রে চুল ঢেকে রাখা, নাহলে কিন্তু এসে মাথায় সাবান দেওয়া উচিত। মোবাইল বেশি ব্যবহার না করাই ভালো। করলেও স্যানিটাইজার দিয়ে মুছে নিতে বলব বারবার। কাপড়ের মাস্ক হলে সাবান দিয়ে কেচে রোদে মেলে দিতে হবে। মোটামুটি এই। তাই বলছি কোয়ারানটাইন নিয়ম মেনে হলে সেটা কোথায় হল সেটা বড় ব্যাপার নয়। কিছু নিয়মে আমাদের অভ্যস্ত হয়ে উঠতে হবে। সেটিই বড় ব্যাপার।
-- ডাঃ দেবাশিস মুখার্জি
সারা দেশে এখন চলছে পঞ্চম দফা লকডাউন। কোভিড-১৯ থেকে বাঁচতে শ্রমিক, মজুর, গ্রামীণ কৃষিনির্ভর শ্রেণীগুলিও ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ বা ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’ জাতীয় প্রবাদের পুনরাবৃত্তি করছে নতুন নতুন পদ্ধতিতে। এই সামাজিক প্রবৃত্তি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার ছড়ানো নিরন্তর গুজবের ফল। এইরকম সামাজিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে পরিযায়ী শ্রমিকদের বাড়ি ফেরার বিষয়টি ঘটছে। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি নেতারা এখন হঠাৎ করে পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য চোখের জল ফেলতে শুরু করেছে, যদিও ঘরে ফেরার পথে পরিযায়ি শ্রমিকদের মৃত্যুর মর্মন্তুদ ঘটনাগুলিকে বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষের “ছোট ঘটনা” বলার মধ্যে দিয়েই তাদের মন-কি-বাত প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, ওপর-বিবৃতির স্তরে নিজেদের খুব উদ্বিগ্ন হিসেবে তুলে ধরার সাথে সাথে স্থানীয় স্তরে বিজেপি জনতার কানে কানে ক্রমাগত প্রচার করে চলেছে ‘পরিযায়ী শ্রমিকেরা করোনা বাহক, ওদের একঘরে করো’। একদিকে মানুষের মনে কোভিড সংক্রমণে মৃত্যুর প্রবল আশঙ্কা ও অন্যদিকে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যর্থতা -- এই দুইকে কাজে লাগিয়ে গ্রামীণ শ্রমজীবিদের মধ্যে নতুন বিভাজন ঘটাতে চাইছে ওরা। মহামারী ও লকডাউনের এই গোটা পর্বে কেন্দ্র সরকারের চরম অমানবিক আচরণ ও শ্রমিকবিরোধী কার্যকলাপ আড়াল করতে মরিয়া বিজেপি। সারা দেশে পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরার যে জনস্রোত চলছে তার দিকে তাকালে ও তাদের কথা শুনলে একথা বোঝা যায় যে তাদের মধ্যে মোদি ও হিন্দুত্ব রাজনীতির প্রতি মোহমুগ্ধতা দ্রুত ভাঙতে শুরু করেছে।
যাঁরা বিদেশ বিভুঁইয়ে দুর্দশা ও অবহেলায় ক্ষুধায় অনাহারে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়তে পড়তেও শেষ পর্যন্ত বাড়ি ফিরে আসতে পারলেন, তখন বাড়িতে পাড়ায় নিকটজনদের মাঝে তা যতটা সুমিষ্ট অনুভূতির মধ্যে দিয়ে হওয়ার কথা ছিলো তার বদলে জুটলো তীব্র আতঙ্ক, তাঁদের পরিচয়ের সাথে জড়িয়ে দেওয়া হল বিপজ্জনক তকমা।
দেশ জুড়েই আওয়াজ উঠেছিল – পরিযায়ী শ্রমিকদের সুস্থ ভাবে নিরাপত্তার সাথে বাড়ি ফেরাও। কিন্তু কেন্দ্রের বিজেপি সরকার করলো অন্যরকম। দীর্ঘদিন সে টালবাহানা করল। আটকে পড়া শ্রমিকদের দুর্দশা বাড়িয়ে চলল। ট্রেনের ভাড়া নিয়ে বেগড়বাই করল। অবশেষে রেলপথে ফেরত পাঠাতে যখন শুরু করল তখন দেখা গেল স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য চেক-আপ, খাবার পাওয়ার গ্যারান্টি ও অন্যবিধ নিরাপত্তার জরুরি বিষয়গুলি সম্পূর্ণ জলাঞ্জলি দিয়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের যেন-তেন প্রকারেণ রাজ্যে নিয়ে ফেলতে পারাটাই একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে উঠল বিজেপির। এভাবে এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চায় তারা -- রাজ্য সরকারকে দোষারোপ উপরিস্তরে, আর নীচে পরিযায়ী শ্রমিকের বিরুদ্ধে সমস্ত পাড়া ও ক্লাবকে লেলিয়ে দেওয়া। এই খেলাটা বিজেপি-সঙ্ঘ-পরিবার করেই থাকে : সংকট তৈরি করে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার রাজনীতি।
আপাত ভাবে বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ার দুই জেলাশাসক, জেলাজুড়ে বাম সংগঠনগুলি স্মারকলিপি জমা দেওয়ার পর, ঘোষণা করেছেন যে, পরিযায়ী শ্রমিকদের ফেরার পর, তাঁরা পরিবহনের সাহায্যটুকু দেবেন এবং আলাদাভাবে কোয়ারেন্টাইন করবেন। এই চাপ সৃষ্টি জরুরি ছিল কারণ বিজেপির উস্কানিসহ সাধারণ মানুষও মৃত্যু-ভয়ের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর সর্বত প্রচেষ্টা দিয়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের, ‘অচ্ছুৎ’ বানিয়ে সামাজিক বয়কট করাকেই সঠিক বলে ভাবতে শুরু করছে। ১৪ দিনের হোম কোয়ারেন্টাইন মুখে শুনতে ভালো লাগলেও সমস্ত পরিযায়ী শ্রমিকদের পক্ষেই বাস্তবে প্রায় অসম্ভব, তাঁদের অর্থনৈতিক অবস্থার দুর্দশার কারণেই। তাই তাঁদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা এবং সামাজিক সুরক্ষা সরকারকেই করতে হবে, এ'কথা জোর দিয়ে বলার ভীষণ প্রয়োজন এই সময়েই।
পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রতি অস্পৃশ্যতা ও সামাজিক বহিষ্কারের নিদারুণ ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী আমরা। বিষ্ণুপুর মিউনিসিপালিটির ৬ নং ওয়ার্ডে ১৯ মে দু-জন জন শ্রমিক চেন্নাই থেকে বাড়ি ফেরেন। কোনোরকম স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়ে বাড়ি ফেরার অবস্থাতেও তাঁরা ছিলেন না। পরবর্তী ৩-৪ দিন ধরে পাড়ার লোকজনের ক্রমাগত গঞ্জনার ফলে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন তাঁরা। তাঁদের একঘরে করে দেওয়া হয়। ওয়ার্ড কাউন্সিলর আশ্বস্ত করতে ব্যর্থ হন, উল্টে জনতার চাপে তিনি পরিযায়ী শ্রমিক পরিবার দুটির ওপরই গলা চড়ান। যদিও এর মধ্যে সাধারণ স্বাস্থ্য পরীক্ষা তাদের হয়ে গেছিলো। আম্ফান ঝড়ের দিনও অশান্তি হয়। এর ৩-৪ দিন বাদে ওই পরিবার দুটির একটি পরিবার ত্রাণ নিতে পর্যন্ত অস্বীকার করেন চরম দুর্দশার মধ্যে থেকেও, পাছে লোক জানাজানি হয়, যদি আবার পাড়ার লোকের গঞ্জনা শুনতে হয়। চরম মানসিক অবসাদ ঘিরে ধরেছে মানুষগুলোকে। বাড়ির মহিলারা বিড়ি বাঁধার কাজ করেন। তারা বিড়ি জমা দিতেও বাধার সম্মুখীন হয়েছে। পাড়ার তাঁতিদের মহাজনরা ছুটিতে থাকার কথা বলছে কারণ, পাড়ার মধ্যে পরিযায়ী শ্রমিক এসেছে, বলা চলে, “করোনা এসেছে” বলছে।
মনুবাদী পরম্পরা, শাস্ত্রের পুরোনো সব বিধান, সংকটকালের দায়িত্ব ইত্যাদি ভারতবাসীর মনকে এখন অনুপ্রাণিত করছে। কিন্তু এই পর্বের সমগ্র অভিজ্ঞতার ফলে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের যে মোহ ভঙ্গ হতে শুরু করেছে এবং যে বাস্তব অর্থনৈতিক মন্দায় দেশ পড়েছে তাতে অনেকেই বুঝতে শুরু করেছেন কিম্বা আগামীতে বুঝতে পারবেন যে, নাগরিকদের, শ্রমিকদের স্বস্তায় গোলাম বানিয়ে রাখার রাষ্ট্রীয় মনুবাদী চেতনা অপেক্ষা আম্বেদকার সংকলিত ভারতীয় সংবিধানে দেওয়া অধিকারগুলির গুরুত্ব কতখানি। তাই পরিযায়ী শ্রমিক বনাম স্থানীয় শ্রমিকদের কাজ পাওয়া-না-পাওয়া নিয়ে যে দ্বন্দ্বের পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে, যার পিছনে সর্বত পরিকল্পনা মাফিক কাজ সারবে সঙ্ঘপরিবার বা বিজেপি, সেই স্থানে আমাদের সংগঠিত করতে হবে শ্রমিক শ্রেণিকে তার হারানো অধিকার ও মর্যাদা ফিরে পাওয়ার লড়াইয়ে। কাজের দাবি বা কাজ পাওয়ার নিশ্চয়তা আগামীতে মৌলিক অধিকারের মধ্যে নিয়ে আসার কথাও উঠতে পারে মানুষের মধ্যে থেকেই। ১০০ দিনের কাজ নয়, বরং সারা বছর মেহনতি জনগনকে কাজ দেওয়া সুনিশ্চিত করো। শুধু ‘আত্মনির্ভরতার’ নামে লোন দিয়ে গুটিকয়ের ব্যবসা খোলানোর কায়দা বন্ধ করো। নতুন পরিস্থিতিতে নতুন আন্দোলন ও বৃহত্তর ঐক্যের সম্ভাবনাগুলোর সন্ধান করতে হবে আমাদের।
-- ফারহান হোসেইন খান
৩ জুন ২০২০ অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মশতবর্ষ বেশ নীরবেই চলে গেল। তার একটা কারণ নিশ্চয় এই করোনা আক্রান্ত দিনকাল। তবে অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর দশ খণ্ডে লেখা সুবিস্তৃত বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্তর কারণে সাহিত্যের ছাত্র ও গবেষক সহ মননশীল পাঠকদের কাছে যে জায়গায় পৌঁছেছেন, সেই জায়গাটা চিরন্তনই।
অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম হয়েছিল হাজার ১৯২০ সালের ৩ জুন উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁতে। তাঁর পিতা ছিলেন অক্ষয় কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, মাতা চারুবালা দেবী। ১৯২৫ সাল থেকেই তারা হাওড়ায় বসবাস করতে থাকেন। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় আমৃত্যু হাওড়াতেই থেকেছেন। ১৯৩৮ সালে হাওড়া জেলা স্কুল থেকে তিনি মেট্রিক পরীক্ষায় পাস করেন। বাংলায় তার তার পাওয়া ৭৭ শতাংশ নম্বর ছিল জেলার মধ্যে এই বিষয়ে সর্বোচ্চ। এরপর তৎকালীন রিপন কলেজ, বর্তমান সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে তিনি আইএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এই পরীক্ষায় বাংলা ও আসাম-এর পরীক্ষার্থীদের মধ্যে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করে স্নাতক স্তরে বঙ্গভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনোর সিদ্ধান্ত নেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উভয় পরীক্ষাতেই তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে উত্তীর্ণ হন এবং স্বর্ণপদক লাভ করেন। কলেজে পড়ার সময়েই নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সায়গন থেকে প্রদত্ত বক্তৃতাগুলো তিনি বাংলায় অনুবাদ করেন এবং সেগুলো ফরোয়ার্ড পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। ব্রিটিশ শাসন ও যুদ্ধপরিস্থিতির নিরিখে এ ছিল এক দুঃসাহসিক দেশপ্রেমের পরিচয়।
১৯৪৫ সালে নবদ্বীপ বিদ্যাসাগর কলেজে অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের অধ্যাপনা জীবনের শুরু। এরপর তিনি রিপন কলেজে পড়াতে আসেন। ১৯৫৭ সালে যোগদান করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় চেয়ার অধ্যাপকের পদে বৃত হন। ১৯৮৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি অবসর নেন। অন্নদাশঙ্কর রায়ের মৃত্যুর পরে ২০০২ সালে অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির সভাপতি হয়েছিলেন। কিন্তু এর কিছুদিন পরেই ২০০৩ সালের ২১ মার্চ তিনি প্রয়াত হন।
দশ খণ্ডের ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’র মতো এই রকম মহা পরিকল্পনা নিয়ে একক প্রয়াসে এত বড় মাপের গবেষণা এর আগে বাংলা সাহিত্যে হয়নি। দীনেশ চন্দ্র সেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস লেখার কাজটা শুরু করেছিলেন দু-খণ্ডে প্রকাশিত বঙ্গভাষা ও সাহিত্য বইতে। সুকুমার সেন এর পাঁচ-খণ্ডে লেখা বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস এ আচার্য অনেক বেশি মৌলিক কথা বলেছেন। কিন্তু বিভিন্ন মতের মধ্যেকার বিতর্ক, নানা দৃষ্টিকোণের তুলনামূলক আলোচনা, সাম্প্রতিকতম গবেষণা অবধি সমস্ত তথ্যের সমন্বয় এবং অবশ্যই তার সঙ্গে নিজের গবেষণা, বিশ্লেষণ ও অভিমত যেভাবে অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় পাওয়া যায়, তাতে নিঃসন্দেহে বলা যায় – এমন কাজ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে এর আগে বা পরে আর হয়নি।
অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই অসামান্য গবেষণা কর্মের সবচেয়ে মৌলিক অংশটি পাওয়া যাবে অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় পর্ব থেকে ঊনিশ শতকের প্রথম পর্ব -- ভারতচন্দ্রের পর থেকে মাইকেলের আগে অবধি বাংলা সাহিত্যের তুলনামূলকভাবে কম আলোচিত পর্বটি নিয়ে। মহা গ্রন্থের চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ খণ্ডে প্রায় আড়াই হাজার পাতায় যে তথ্য বিশ্লেষণ ও সাহিত্য বিচারের নিদর্শন তিনি হাজির করেছেন, বাংলা সাহিত্যে তার তুলনা কমই আছে।
এই মহাগ্রন্থের কোন খণ্ডে কী আছে তার পরিচয় দেওয়া যাক
প্রথম খণ্ড - বাংলা ভাষা সাহিত্যের উদ্ভবের পটভূমি, ইতিহাস ও চর্যাপদ, চর্যাপদ এর পর থেকে চৈতন্যদেব-এর আগে অবধি আদি মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য। কৃত্তিবাস, মিথিলার বিদ্যাপতি প্রমুখদের নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে এই খণ্ডে।
দ্বিতীয় খণ্ড - ষোড়শ শতাব্দীর চৈতন্যযুগের বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন ধারা এখানে আলোচিত। চৈতন্যদেবের জীবন, সাহিত্যে সমাজে তার প্রভাব, চৈতন্য জীবনী সাহিত্য, চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস প্রমুখের বৈষ্ণবপদাবলী এখানে বিস্তারিতভাবে আলোচিত। পাশাপাশি রয়েছে মনসামঙ্গলের বিজয়গুপ্ত, নারারণদেব, বিপ্রদাস পিপলাই, চণ্ডীমঙ্গলের দ্বিজ মাধব, মুকুন্দ চক্রবর্তী প্রমুখের আলোচনা।
তৃতীয় খণ্ড - এর প্রথম পর্বে রয়েছে সপ্তদশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যের আলোচনা। কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের মনসামঙ্গল, দৌলত কাজী সৈয়দ আলাওলের মত মুসলিম কবিদের লেখা প্রণয়কাব্য ও অনুবাদ সাহিত্য, কাশীরাম দাসের মহাভারত নিয়ে আলোচনা পাওয়া যাবে এইখানে।
দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম পর্বের বাংলা সাহিত্য নিয়ে আলোচনা। রামপ্রসাদ, কমলাকান্তের শাক্ত পদাবলী বা ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর নিয়ে আলোচনা এখানে পাওয়া যাবে।
চতুর্থ খণ্ড - এই খণ্ডে আলোচিত বিষয়বস্তু অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় পর্ব থেকে ঊনিশ শতকের প্রথম পর্ব পর্যন্ত আখড়াই, হাফ আখড়াই, কবিগান ইত্যাদি প্রসঙ্গ।
পঞ্চম খণ্ড - প্রায় হাজার পাতার সুবিশাল এই খণ্ডটি বাংলা গদ্যের আদিপর্বের ইতিহাস সম্পর্কে এখনো অবধি শ্রেষ্ঠ কাজ। বাংলা গদ্যের প্রাক উনিশ শতকীয় বিভিন্ন নিদর্শন নিয়ে আলোচনার পর পর্তুগীজদের লেখা বাংলা গদ্য, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের লেখকদের লেখা গদ্য গ্রন্থ নিয়ে অজস্র অজানা অচেনা তথ্যকে তিনি মহাফেজখানা খুঁড়ে বের করে এনেছেন।
ষষ্ঠ খণ্ড - এই খণ্ডে রামমোহন সমসাময়িক বাংলা সাহিত্য, বাংলা সাংবাদিকতা ও সাময়িক পত্রের উদ্ভব বিকাশের ইতিহাস পাওয়া যাবে।
সপ্তম খণ্ড - এই খণ্ডের কেন্দ্রীয় চরিত্র অবশ্যই মাইকেল মধুসূদন ও বিদ্যাসাগর। ঈশ্বর গুপ্ত এবং মহাকাব্যযুগের রঙ্গলাল, হেমচন্দ্র, নবীন চন্দ্রও এখানে আলোচিত হয়েছেন। বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাসাগর নামে বিদ্যাসাগর সম্পর্কে একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থও রয়েছে অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের।
অষ্টম খণ্ড - এই খণ্ডের কেন্দ্রীয় চরিত্র বঙ্কিমচন্দ্র। ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের বাংলা সাহিত্যের পরিচয় রয়েছে এখানে।
নবম খণ্ড - বঙ্কিমচন্দ্র থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন লেখকেরা এখানে আলোচিত হয়েছেন।
দশম খণ্ড - এই খণ্ডটি লিখতে লিখতে অসিত বাবু অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং প্রয়াত হন। রবীন্দ্রনাথের কাব্য সাহিত্যের আলোচনাটুকুই কেবল এখানে পাওয়া যাবে। রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি অন্য গ্রন্থ অবশ্য আগে প্রকাশিত হয়েছিল। সাহিত্য সমালোচক রবীন্দ্রনাথ নিয়ে সেখানে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে।
অলিখিত থেকে গেছে রবীন্দ্র উত্তর সাহিত্য নিয়ে প্রস্তাবিত একাদশ খণ্ডটিও। এই আলোচনা কেমন হতে পারত তার ইঙ্গিৎটুকু কেবল ধরা আছে জনপ্রিয়তায় শীর্ষবিন্দু স্পর্শকারী একখণ্ডে প্রকাশিত বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত বইটিতে।
-- সৌভিক ঘোষাল
কাট ওয়ান: আইআইএসসি বেঙ্গালুরু-র ডিরেক্টর অধ্যাপক অনুরাগ কুমার এই বছর এপ্রিলের মাঝামাঝি নাগাদ একটি ইমেল পাঠান সমস্ত সহকর্মীদের উদ্দেশে। তাতে এই করোনা পরিস্থিতির জন্য কিছু প্রশাসনিক পদক্ষেপের পাশাপাশি একটি বার্তা তিনি দেন, তা হলো : যেহেতু দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে স্রেফ মেধার ভিত্তিতে এই প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী ও গবেষকরা আসেন, স্বাভাবিক কারণেই তাদের সমাজ-অর্থনৈতিক পরিবেশও একরকম নয়। ফলত সবার পক্ষে বাড়িতে অনলাইন পড়াশোনা করার মতো 'ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল সেটাপ' বানানো সম্ভব নয় — তাই এখানে অনলাইন ক্লাসের ব্যাপারে কোনো জোর দেওয়া হবে না, বাকিটা শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের স্বাধীনতা। সামান্য ভিন্ন যুক্তিতে এই একই পদক্ষেপ নেয় দেশের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানেও বিষয়টি ছেড়ে দেওয়া হয় সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলির বিবেচনার উপর।
কাট টু : পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উচ্চশিক্ষা দপ্তর রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে (যেগুলির অধীনে কলেজ আছে) প্রায় একই সময়ে একটি নির্দেশ দেয় অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে পাঠদানের প্রক্রিয়াটি যেন স্তব্ধ না হয়, সে বিষয়ে নজর রাখতে। কলেজ পরিদর্শকরাও সেভাবেই কলেজগুলিতে নির্দেশ পাঠান — কোনোভাবে পঠনপাঠন চালু রাখার বিষয়টির দিকে যেন লক্ষ রাখা যায়, কোন মাধ্যমে বা কি উপায়ে বিষয়টি চালাতে হবে — তা নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো নির্দেশিকা কিন্তু জারি করা হয়নি। আর এই ‘সুযোগ’টিকে কাজে লাগিয়ে ‘অনলাইন ক্লাস’ নামক বিষয়টিকে নিয়ে উম্পুনের থেকেও ঝোড়োগতিতে এবং তার আসার আগে থেকেই যা ঘটতে লাগলো, হয়তো তার পূর্বসূত্র হিসাবেই বাঙালির চির রসিক দাদাঠাকুর (শরৎচন্দ্র পণ্ডিত) বহুকাল আগে গেয়েছিলেন : “তৈলাধার পাত্র, নাকি পাত্রাধার তৈল – এই তর্কেই শিক্ষা কাবার বাকি কী আর রইলো?”
২০১৫-পরবর্তী সময়ে জাতীয় শিক্ষানীতির নানাস্তরে বিভিন্ন কৌশলে স্পষ্ট করে দেওয়া এবং হয়েছে ‘নলেজ’ আর ‘ইনফর্মেশন’এর পার্থক্য, এবং এটাও বলা হচ্ছে এই তথাকথিত ডিজিটাল বিপ্লবের যুগে যেহেতু সবাই ‘ডিজিটালি কম্পিটেন্ট’(!) এবং ‘ডিজিটালি অ্যাক্টিভ’(!), তাই শিক্ষকের কাজ শুধুমাত্র ‘ইনফর্মেশন শেয়ার’ করেই ফুরিয়ে যাচ্ছে না, কেননা চাহিদার থেকেও কয়েকগুণ বেশি ইনফর্মেশন তারা পেয়ে যাচ্ছে ইন্টারনেট থেকে — তাঁর কাজ এই ‘ইনফর্মেশন’কে ‘নলেজ’-এর পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার জন্য শিক্ষার্থীকে সবরকমের সাহায্য করা।
কিন্তু অনলাইনের বাজারে অতকিছু তলিয়ে ভাবার সময় থাকলে তো! গুগল ক্লাসরুম, অনলাইন টিএলএম, স্কাইপ প্রেজেন্টেশন, জুম অ্যাপ ... এইজাতীয় নতুনতর শব্দবন্ধের চাপে অধিকাংশ শিক্ষার্থী যখন দিশাহারা, তখন তাদের পাখিপড়ার মতো মোবাইল ব্যবহার করে পাঠগ্রহণে বাধ্য করা হলো! সেই যে একটি বাচ্চা ছেলেকে তার বাবা শিখিয়েছিলেন, “বাবু, কেউ কিছু চাইলে ‘নেই’ বলতে নেই, বলতে হয় ‘বাড়ন্ত’" ... শিক্ষার ফল ফললো হাতেনাতে! বাবা বাড়িতে নেই – এই তথ্য জানাতে শিশুটি সটান জানিয়ে দেয় — “বাবা বাড়ন্ত”! এখানেও অবস্থা দাঁড়ায় কতকটা সেইরকম। হাতে টাকা থাকলে স্মার্টফোন কেনা যায়, তার জন্য খুব স্মার্ট হওয়ার দরকার নেই; ইন্টারনেটের ব্যবহারকৌশলও আয়ত্ত করা যায় সহজে — কিন্তু যা সহজে আয়ত্ত করা যায় না, তা হলো কাণ্ডজ্ঞান। আমরা ভুলে গেলাম যে মাটিতে ধান ফলে, সে মাটিতে চা ফলে না (বা উল্টোটা)। আমরা ভুলে গেলাম, সেমেস্টারের ধান তিনমাসে কাটা গেলেও ইয়ার্লির আখ বছরশেষেই কাটতে হয়...ভুলে গেলাম, শুধু দাঁতে দাঁত চেপে জেটগতিতে ইনফর্মেশন শেয়ার করে গেলেই হবে না, তাকে ‘নলেজ’এ রূপান্তরিত করার সময়টুকুও দিতে হবে তাদের! কাদের? পশ্চিমবঙ্গের সেই ৭২% শিক্ষার্থীদের, যাদের সিংহভাগই আসে গ্রামীণ পরিমণ্ডল থেকে, যে পরিবেশ করোনার “আলোহীনতায় ডুবে নিস্তেজ নিস্তেল” ... এই আক্ষরিক অর্থেই অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে তারা দিশেহারা। ঋত্বিক ঘটকের ‘সুবর্ণরেখা’ ছবির সেই কালজয়ী সংলাপের মতো তারা মহামারী দেখলো, মড়ক দেখলো — হয়তো মন্বন্তরও দেখবে। আর আমরা তাদের মুখ জোর করে ঘুরিয়ে দিলাম মোবাইল ও ল্যাপটপের পর্দার দিকে ... তার হাত শুধু কিবোর্ডের উপর সচল থাকলো, কারোর দিকে সাহায্যর হাত বাড়ানোর জন্য এগিয়ে গেল না! তার দুচোখ এই বিপর্যয় দেখেও যেন দেখলো না ... সে শুধু দেখে গেল, মেপে গেল অনলাইন টেস্টে তার প্রাপ্ত নম্বরের গ্রাফ কীভাবে ওঠাপড়া করছে! তার মন বাইরের জগতের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে পড়ে রইলো দিনের কোন সময়ে কোন স্যর বা ম্যাডাম অনলাইন ক্লাসে কি বলবেন, সেই দিকে বা কোন হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপে কোন কমেন্ট লিখে স্যর/ম্যাডামের থেকে ইন্টারনাল অ্যাসেসমেন্টে বেশি নম্বর ছিনিয়ে নেওয়া যায়, তার কৌশলী হিসাব কষতে! অনেক ‘ইনফর্মেশন’ সে পেলো, কিন্তু তাকে ‘নলেজ’-এ পরিণত করার অবকাশ বা শিক্ষা -- কোনোটাই সে কিন্তু পেল না।
আর আমরা শিক্ষকরাও কোমর বেঁধে নেমে গেলাম অনলাইনের দাসত্ব করতে! এই দেড় দু’মাসে আমি পুলিশ বা ডাক্তারের মতো সামনাসামনি লড়াই করতে পারলাম না, যোগ্যতার অভাবে কৃষকের কাজও করতে পারলাম না, ব্যবসায়ীদের মতো মাথায় হাত দিয়ে বসতে পারলাম না — ইন্টারনেট শাসিত ভার্চুয়াল জগৎ ছাড়া আমার অস্তিত্বই তো সংকটের মুখোমুখি! ফলে চুলোয় গেল কপিরাইট ইনফ্রিঞ্জমেন্ট ... গাদা গাদা বইয়ের পাতা স্ক্যান করে তাতে ‘আমার স্টাডি মেটেরিয়াল’ বলে ছাপ্পা মেরে গুগল ক্লাসরুমের খুপরিতে তাদেরকে চেপেচুপে ঢুকিয়ে দিলাম! যে আমি রোলকলের ছুতোয় ক্লাসের প্রথম আধঘন্টা কাটিয়ে দিই, সেই আমিই নিজের পড়ানোর ‘সিনেমা’ বানিয়ে ইউটিউবে ছাড়লাম! একটিবার ভাবলামও না, ইন্টারনেটের দৌলতে কী সহজে আমি সকলের কাছে হাসির খোরাক হয়ে উঠলাম — বন্ধ দরজার আড়ালের দৃশ্যকে এনে ফেললাম বেআব্রু রোদেলা উঠোনে! রোপা ২০১৯-এর হিসাবের ফাঁকে, ছেলের আবৃত্তি, মেয়ের নাচ আর গিন্নির ডালগোনা কফি বানানোর দৃশ্যের পাশাপাশি আমার ফেসবুক সেজে উঠলো আমার অনলাইন ক্লাস নেওয়ার ক্রমিক ধারাবিবরণীতে ... আমার ইনবক্স ভরে উঠলো সেই ছাত্রছাত্রীর কমেন্টে, যারা চিরকাল ইনফরমেশনকে ‘নলেজ’ ভেবে ভুল করে যাবে।
আর এভাবেই আমরা, যারা স্রেফ একটা চাকরির সুযোগে সমস্ত সামাজিক সুবিধার প্রত্যাশা করি ও না পেলে রেগে যাই, তারা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার মতো বাঁদিকের বুকপকেটটা সামলাতে সামলাতে টেরই পেলাম না সেই বুকপকেটের একটু নীচে নামলেই পাওয়া যেত আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ ... হৃদয় — অনলাইন সক্রিয়তাকে অতিসক্রিয়তার পথে নিয়ে যেতে এই হারিয়ে যাওয়াটাই আমাদের স্থায়ী সঙ্গী হয়ে রইলো।
-- অধ্যাপক ঋষি ঘোষ
আজ ৩১ মে। আজ থেকে ২৭ বছর আগে বর্ধমানের করন্দা গ্রামে প্রকাশ্য দিবালোকে আগুনে পুড়িয়ে, ধারালো অস্ত্র দিয়ে খুন করা হয়েছিলো ৬ জন কৃষিমজুর গরিব কৃষকদের। পরদিন শহীদদের মরদেহগুলি সারিবদ্ধ ভাবে লালপতাকায় ঢেকে রাখা হয়েছিল পাড়ার লাগোয়া উন্মুক্ত মাঠে। তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা ব্যানার্জী সেখানে পৌঁছে গেলে পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা শঙ্কর মিত্র, বর্ধমানের কৃষক নেতা বিশ্বনাথ ঘোষ তাঁকে বলেছিলেন, দয়া করে আমাদের শহীদদের নিয়ে রাজনীতি করবেন না। একথা শুনে নেত্রী ফিরে এসেছিলেন। হত্যাকারী সিপিএমের বিরুদ্ধে বর্ধমানের মাটিতে উঠেছিলো নকশালবাড়ির বিপ্লবী সংগ্রামের লালপতাকা। তারপর সেই বধ্যভূমিতে এসে পার্টির সাধারণ সম্পাদক বিনোদ মিশ্র বলেছিলেন, করন্দা হত্যাকান্ড নিছক কোনো নির্বাচন পরবর্তী হিংসার ঘটনা নয়, এটা পশ্চিম বাংলার গ্রামাঞ্চলে শ্রেণীসংগ্রামের প্রতিফলন। গণহত্যার ঠিক আগের দিনই অনুষ্ঠিত পঞ্চায়েত নির্বাচনে ঐ বুথে সিপিএমের পরাজয় হয়েছিলো। জয়ী হয়েছিলো নকশালপন্থীরা। কিন্তু লন্ঠনের আলোয় গননায় ব্যালট বাক্স বদল হয়ে যায় মাঝরাতে। আর পরদিন ভোরে সূর্য ওঠে রক্তস্নাত হয়ে। ঘরপোড়া গ্রাম করন্দা জেগে থাকে শ্রেণীসংগ্রামের আলোকবর্তিকা হয়ে। আজও সেই এলাকার গরিব মানুষেরা শহীদের স্বপ্নকে তাঁদের বুকের গভীরে ধরে রেখেছেন।
নব্বইয়ের দশকের সেই সময়কালে গ্রামাঞ্চলে কায়েমী স্বার্থান্বেষী নব্য ধনী - জোতদারেরা সিপিএম-এর সম্প্রসারিত শ্রেণীভিত্তি হয়ে উঠেছিলো। ওরাই হয়ে উঠেছিলো গ্রামীণ নেতৃত্ব। স্বভাবতই সিপিএমের মধ্যে থাকা কৃষিমজুর ও গরিব কৃষকদের সাথে তাদের দ্বন্দ্ব তীব্র হয়ে ওঠে। দলে দলে শোষিত বঞ্চিত প্রান্তিক মানুষেরা সংগ্রামী বামপন্থার পতাকা তলে ঐক্যবদ্ধ হয়। জমি ও মজুরির দাবিতে সমবায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে ওঠে। শুরু হয় অধিকার মর্যাদা ও গরিব মানুষের পাল্টা আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াই। এই গতিকে স্তব্ধ করতেই ঘটানো হয় করন্দা গণহত্যা। রচিত হয় সরকারি বামপন্থার কলঙ্কিত ইতিহাস।
আজ শাসকের রং বদলে গেছে। কিন্তু বর্ধমান সহ গ্রামবাংলার বুকে আজও এগিয়ে চলেছে কৃষিমজুর, গরিব ভাগচাষি, চুক্তিচাষিদের অধিকার বুঝে নেওয়ার লড়াই। নকশালবাড়ির পর করন্দা তারপর সিঙ্গুর নন্দীগ্রামে প্রতিরোধ সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় এগিয়ে চলেছে কৃষকের জীবন-জীবিকা রক্ষা ও বিকাশের লড়াই।
দীর্ঘদিন ধরে সেই হত্যাকান্ডের বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কেঁদেছে। এতোগুলি বছর ধরে লেগে থেকে হত্যাকারীদের শাস্তির দাবিতে আইনি লড়াই সুপ্রিম কোর্ট অবধি গড়িয়েছে। তাদের আদেশে শুরু হয়েছে তথাকথিত “বেকসুর খালাস” খুনীদের পুর্নবিচারের প্রক্রিয়া। মামলা এখন হাইকোর্টে। যদিও জনগণের আদালতে সে বিচার আর বকেয়া নেই। কারা হত্যাকারী সাধারণ মানুষের কাছে দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট।
তবু আজও সংগ্রাম ও ঐক্যের দ্বান্দ্বিকতায় ঐক্যবদ্ধ বামপন্থী আন্দোলন চলছে। দেশব্যাপী কৃষকের লং মার্চ, শ্রমিকের ধর্মঘট, দলিতের জাগরণ, ক্যাম্পাসে আজাদীর লড়াই প্রভৃতি শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের সংগ্রামের ময়দানে বাম ঐক্যের পতাকা উড়ছে। সাম্প্রদায়িক শক্তির ফ্যাসিস্ট আগ্রাসন, কর্পোরেট লুঠ, সাম্রাজ্যবাদের কাছে দেশকে বিক্রি করে দেওয়ার বিরুদ্ধে গড়ে উঠছে ঐক্যবদ্ধ বাম আন্দোলন। কারন তেভাগা, খাদ্য আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় গড়ে ওঠা নকশালবাড়ি অভ্যুত্থানের বিপ্লবী নেতা কমরেড চারু মজুমদার বলেছিলেন, “জনগণের স্বার্থই পার্টির স্বার্থ”।
করন্দার শহীদের রক্তে রাঙ্গা পতাকা তুলে ধরে বামপন্থার স্বাধীন আত্মঘোষণার সংগ্রাম আজও এগিয়ে চলেছে কঠোর কঠিন পথে। করন্দার শহীদদের জানাই লাল সেলাম।
-- জয়তু দেশমুখ
বামপন্থী কৃষক সংগঠনের যৌথ মঞ্চ এআইকেএসসিসি এবং কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির ডাকে সারা রাজ্যের সাথে বাঁকুড়া জেলার ধলডাঙি, ছাতনা, মাকুড়গ্রামে নীচের দাবিতে লকডাউনের নিয়ম মেনে মিছিল ও বিক্ষোভ কর্মসূচী হয়। এই কর্মসূচীতে ধলডাঙায় বক্তব্য রাখেন সিটু জেলা নেতা প্রতীপ মুখার্জি, সিপিআই(এমএল) লিবারেশন এর কৃষক সংগঠন এআইকেএম নেতা বাবলু ব্যানার্জি, অগ্রগামী কিষান সভার নেতা শ্যামাপদ ডাঙর, সিপিআই-এর কৃষক নেতা জয় হালদার। ছাতনাতে রাখেন এআইকেএস নেতা যদুনাথ রায়। মাকুড়গ্রামে রাখেন এআইকেএম নেতা বাবলু ব্যানার্জি।
দাবি -- (১) আমফান ঝড়কে জাতীয় বিপর্যয় হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। (২) আমফান ঝড় ও লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের একর প্রতি ২৫০০০ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। (৩) অত্যাবশ্যকীয় পন্য আইন তুলে দিয়ে কালোবাজারি ও মজুতদারিকে বৈধ করা চলবে না। (৪) চুক্তি চাষের নামে চাষের জমি বড় বড় ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেওয়া চলবে না। (৫) লকডাউনে কাজ হারা সব গরিব মানুষদের মাসে ১০০০০ টাকা লকডাউন ভাতা দিতে হবে। (৬) লকডাউনের সুযোগ নিয়ে শ্রম আইন গুলো বাতিল করা চলবে না। (৭) লকডাউনের সুযোগে ৮ ঘণ্টার কাজ কে ১২ ঘণ্টা করা চলবে না।
এছাড়াও বিষ্ণুপুর, বড়জোড়া, তালডাংরা, হীড়বাঁধ সহ বিভিন্ন ব্লকে কর্মসূচী পালিত হয়।
গত ২৭ মে নদীয়া জেলার ধুবুলিয়া ও নাকাশীপাড়া ব্লকে বিক্ষোভ ডেপুটেশন সংগঠিত হয়। আমফান ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ক্ষতিপূরণ ও ফসলের সরকারী ক্রয় সম্পর্কিত দাবিগুলি তুলে ধরা হয়। এআইকেএম, আয়ারলা সহ বিভিন্ন বাম কৃষক সংগঠনের নেতৃত্ব এই কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করেন।
ঐ দিনই এআইসিসিটিইউ সহ বামপন্থী ট্রেডইউনিয়নগুলির যৌথ কর্মসূচী এই দুটি ব্লকে অনুষ্ঠিত হয়। অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের লকডাউন ক্ষতিপূরণের দাবিতে, কাজ থেকে বসিয়ে দেওয়া বা মজুরি কমিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে দাবিগুলি জানানো হয়। ধুবুলিয়া ব্লকে মহিলা বিড়ি শ্রমিকদের অংশগ্রহণ ছিলো উল্লেখযোগ্য। অনুরূপ কর্মসূচী সংগঠিত হয় নবদ্বীপ ও কৃষ্ণনগর শহরে।
লকডাউনের অজুহাতে শ্রম আইনকে লঙ্ঘন করে শ্রম ঘণ্টাকে ১২ ঘণ্টা করা, আমফানকে জাতীয় বিপর্যয় ঘোষণা করা -- একহাজার কোটি টাকার ভিক্ষা নয়, উপযুক্ত আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা এবং পুনর্বাসনের দাবিতে, এবং রাজ্য জুড়ে চলা রেশন দুর্নীতি এবং ত্রাণ দুর্নীতির বিরুদ্ধে ২৮ মে শিলিগুড়ির সুভাষপল্লী মোড়ে বাম দলগুলোর আহ্বানে অভিজিৎ মজুমদার, পুলক গাঙ্গুলী, সিপিআই(এম)-এর অশোক ভট্টাচার্য, জীবেশ সরকার, আরএসপি-র তাপস গোস্বামী, বিকাশ সেন রায়, ফরোয়ার্ড ব্লকের রাণা বসু, সিপিআই-এর লক্ষ্মী মাহাতোর নেতৃত্বে বেশ কিছুক্ষণ ধরে অবস্থান বিক্ষোভ চলে।
ভারতবর্ষে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ যত বাড়ছে তত বেশি বেশি করে চ্যালেঞ্জের সুন্মুখীন হচ্ছেন স্বাস্থ্যপরিষেবার সাথে যুক্ত মানুষেরা। ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ডবয়, ল্যাব টেকনোলজিস্ট, টেকনিশিয়ান, ক্লিনার, গ্রামে গ্রামে আশা কর্মীরা প্রত্যেকদিন নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে করোনা যুদ্ধে সামিল হচ্ছেন। সংক্রমণের শুরু থেকেই সবার জন্য মাস্ক, গাউন, গ্লাভস এবং অন্যান্য ব্যক্তিগত সুরক্ষামূলক সরঞ্জামের (পিপিই) অভাব এবং কোভিড-১৯ টেস্টিং সরঞ্জাম ও শ্বাসযন্ত্রের মেশিনের (ভেন্টিলেটর) অপ্রতুলতা নিয়ে দেশ জুড়েই স্বাস্থ্যপরিষেবার সাথে যুক্ত ব্যাক্তিরা সরকারের কাছে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন। কিন্তু তাদের নিরাপত্তার কথা সরকার কতটুকুই বা ভাবছেন? উপরন্তু মাস্ক, পিপিই নিয়ে অভিযোগ জানানোয় ডাক্তার সুধাকর রাওকে বিশাখাপটনাম শহরের পুলিশ মারধোর করে মানসিক রোগি প্রমাণ করার চেষ্টায় জোর করে মানসিক হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছে।
করোনা এবং তার সংক্রমণ নিয়ে উপযুক্ত শিক্ষা এবং সচেতনতার অভাব এবং সরকারের পক্ষ থেকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার মতো প্রচারের ফলে মানুষের মনে অন্য মানুষের প্রতি নানা সন্দেহ ও অস্পৃশ্যতার মনোভাব দেখা দিচ্ছে। আর এর শিকার হচ্ছেন যেমন গরিব মানুষেরা তেমনি নানা জায়গায় আক্রান্ত হচ্ছেন স্বাস্থ্যপরিষেবার সাথে যুক্ত ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য কর্মীরা। নাগপুরের আশা কর্মীরা ঘরে ঘরে গিয়ে সমীক্ষা ও দেখাশোনার সময় ক্রুদ্ধ জনতা তাদের উদ্দেশে পাথর ছুঁড়ে মেরেছে।
এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন রাজ্য থেকে ফিরছেন প্রবাসী শ্রমিকেরা। প্রশাসনের উদ্যোগে তাদের বিভিন্ন জায়গায় কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে থাকার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। গ্রামের দিকে আশা কর্মীদের অঞ্চলে অঞ্চলে গিয়ে সেই সেন্টারগুলি পরিদর্শন এবং শ্রমিকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হয়। কিন্তু সেই কাজে প্রায়ই নানারকম অপমান ও হেনস্থার শিকার হতে হচ্ছে আশা কর্মীদের। হাওড়ার পাঁচলা থানার অন্তর্গত দেউলপুরগ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় ব্লক প্রশাসন থেকে কুশডাঙা গ্রামের গার্লস প্রাথমিক বিদ্যালয়কে কোয়ারেন্টাইন সেন্টার করে আগত শ্রমিকদের থাকার ব্যাবস্থা করা হয়েছে। গত ২৯ মে সেই সেন্টারের ব্যবস্থাপনা পরিদর্শনে যান কুশডাঙা সাব-সেন্টারে কর্মরত আশা কর্মী মিঠু দাস সহ স্থানীয় পঞ্চায়েত কর্মী ও অন্যান্য স্বাস্থকর্মীরা। তখন সেইখানের স্থানীয় বাসিন্দারা কেন ওই অঞ্চলে কোয়ারেন্টাইন সেন্টার করা হয়েছে বলে বচসা শুরু করেন এবং মিঠু দাস ও দু’জন এএনএম (অক্সিলিয়ারি নার্সিং মিডওয়াই) কর্মীর উপর হামলা করেন, তাদের প্রচণ্ডভাবে শারীরিক হেনস্থা ও অত্যাচার করা হয়। এটা শুধু একটা ঘটনা নয় সমগ্র হাওড়া জুড়ে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এরকম নানা হামলার খবর আসছে। আশা কর্মীরা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত। তাই হাওড়ার পাঁচলা ব্লকের আশা কর্মীরা পয়লা জুন ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিকের কাছে একটি ডেপুটেশন জমা দেন। ডেপুটেশনে বলা হয় মিঠু দাস ও এএনএম কর্মীদের উপর যারা শারীরিক হেনস্থা করেছে তাদের অবিলম্বে শাস্তি দিতে হবে। অন্যথায় ব্লকের সমস্ত আশা কর্মীরা কাজে আসা বন্ধ করে দেবেন। কুশডাঙা গ্রামে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে তাদের পক্ষে কাজ করা সম্ভব নয় বলে তারা জানিয়েছেন। প্রয়োজনে দেউলপুর স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে শ্রমিকদের পরিষেবা দেবার ব্যবস্থা করতে হবে। সমগ্র পাঁচলা ব্লক জুড়ে আশা কর্মী এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে এবং যারা তাদের উপর আক্রমণ করছেন তাদের শাস্তি দিতে হবে। উপ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সরকারি কাজে যাতায়াতের জন্য আশা কর্মীদের গাড়ি ভাড়া দেওয়া হয় না। এই ডেপুটেশনে আশা কর্মীরা দাবি রেখেছেন সরকারি কাজে পাঠালে তাদের গাড়ি ভাড়ার ব্যবস্থা স্বাস্থ্যকেন্দ্রকে করতে হবে এবং করোনা ভাইরাসের সাথে এই যুদ্ধে সবার আগে স্বাস্থ্যকর্মীদের সুস্থ্ থাকা প্রয়োজন। তাই গ্রামে গ্রামে আশা কর্মীদের পর্যাপ্ত পরিমাণে মাস্ক ও স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা সরকারকে করতে হবে। ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক এই ডেপুটেশন গ্রহণ করেন এবং মৌখিক প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে তিনি উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। পাঁচলা ব্লকের আশা কর্মিরা আপাতত ২রা এবং ৩রা জুন কর্মবিরতি ঘোষণা করেছেন, তাদের দাবি মানা না হলে পরবর্তীকালে বৃহত্তর আন্দোলনে যাবেন বলে জানিয়েছেন।
-- মিতালি বিশ্বাস
২৮ মে ২০২০ ন্যাশান্যাল প্রোগ্রেসিভ ডিফেন্স এমপ্লইজ ফেডারেশন (এনপিডিইএফ) ও এআইসিসিটিইউ অনুমোদীত “কাশীপুর গান এন্ড শেল ফ্যাক্টরী ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের” পক্ষ থেকে মাননীয় জেনারেল ম্যানেজারের হাতে স্মারকলিপি পদান করা হয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর কাছে পাঠানোর জন্য। এই স্মারকলিপিতে প্রতিরক্ষা শিল্পে কর্পোরেটাইজেশনের প্রস্তাব প্রত্যাহার, প্রতিরক্ষা উৎপাদনে এফডিআই ৪৯% থেকে ৭৪ % পর্যন্ত বৃদ্ধি না করা ও কারখানাগুলোকে আধুনিক প্রযুক্তি, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও শ্রমশক্তির বৃদ্ধি করে পর্যাপ্ত কাজের বরাত দেওয়ার দাবি জানানো হয় ।
এর প্রতিলিপি পাঠানো হয় প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, চেয়ারম্যান/ডিজিওএফ, প্রতিরক্ষা সচিব, সচিব (ডিপি) ও চিপ লেবার কমিশনারের দফতরে।
ধন্যবাদান্তে
জয়দেব দে
সভাপতি, জিএসএফ ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন