(যে কোনো লেখা এককভাবে খুলতে হেডিং-এ ক্লিক করুন)
১৯ জুন ‘সর্বদলীয় বৈঠকে’ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য চীন-ভারত এলএসি সংঘাত প্রসঙ্গে স্পষ্টতা প্রদানের বদলে আরও একগুচ্ছ প্রশ্ন জাগিয়ে তুলেছে। চীনা বাহিনীর সাথে হাতাহাতি সংঘর্ষে এক কর্নেল সহ কুড়ি জন ভারতীয় সৈনিকের মৃত্যু হয়েছে – অবিসংবাদিত এই একটি মাত্র দুঃখজনক সত্যই তিনি মেনে নিয়েছেন। চারজন অফিসার সহ দশ জন সৈনিককে শেষ পর্যন্ত চীন মুক্তি দিয়েছে, কিন্তু মোদি সরকার একবারের জন্যও স্বীকার করেনি যে, কোনও সৈনিক নিখোঁজ অথবা চীনের হাতে বন্দী।
প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে ভারতের দিকে চীনের অনুপ্রবেশ ও কাঠামো নির্মাণ প্রসঙ্গে বিদেশ মন্ত্রক যে বিবৃতি জারি করেছিল তাকেও কার্যত বিরোধিতা করলেন মোদি। তিনি যে তত্ত্ব দিলেন – ‘কেউ ঢোকেনি, ঢুকে থেকে যায়নি, কোনও সেনা চৌকি দখল করেনি’ – তা সকলকেই অবাক করে: তাহলে ডি-এস্কালেশন ও ডিসএনগেজমেন্ট বিষয়ে এত কথাবার্তা চলছিল কোত্থেকে! এত দীর্ঘ কাল ধরে ভারতের নিয়ন্ত্রণে থাকা গালোয়ান উপত্যকায় চীন যখন নিজের সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করছে, তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী চীনের বিরুদ্ধে অনধিকার অনুপ্রবেশের সবরকম অভিযোগকেই নাকচ করে দিচ্ছেন। তাহলে মোদি সরকার কি চীনের দাবিই মেনে নিচ্ছে? যদি কেউই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা লঙ্ঘন না করে থাকে তাহলে কীভাবে ও কেন আমাদের সৈনিকদের মরতে হল?
লাদাখ অঞ্চলের এলএসি বরাবর ভারত-চীন মুখোমুখি বিরোধের এই সমগ্র পর্ব জুড়ে দেশকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে এবং কুড়ি জন জওয়ানের আত্মত্যাগ, অনেক সংখ্যকের আহত হওয়া ও অনেক কষ্টসাধ্য বোঝাপড়ার শেষে চীন থেকে দশ জওয়ানের মুক্তি সম্ভব হওয়া – এত সবের পরও ‘সব কিছু ঠিক আছে’ বলে দাবি করে মোদি সরকার আমাদের বৈদেশিক নীতিকে স্পষ্টতই এক গভীর সংকটের আবর্তে ঠেলে দিচ্ছে। আর তাও এমন একটা সময়ে যখন সারা দেশ একদিকে কোভিড-১৯ সংক্রমণের ও অন্যদিকে লকডাউনে বৃদ্ধি পাওয়া অর্থনৈতিক অবনতি ও অস্থিরতা যুগপৎ ধাক্কার মুখে রয়েছে।
সরকারের ভাবগতি থেকে যত স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে সামরিক-কূটনৈতিক-রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে সরকার চীনের অবস্থানকেই নীরবে মেনে নিচ্ছে, সংঘ-বিজেপি শিবির তা আড়াল করতে তত জোরে গলা ফুলিয়ে বিরোধী দলগুলির বিরুদ্ধে পাগলের মতো অবান্তর সব অভিযোগ তুলছে আর চীনকে বয়কট করার নামে ভারতীয় জনসাধারণকে চীনা পণ্য কেনাবেচার অভিযোগে গালাগাল দিচ্ছে। এরকম অভিযান ভারতের লক্ষ লক্ষ খুচরো ব্যবসায়ীকেই কেবল ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
তথ্য বলছে মোদি ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারত ও চীনের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক সবিশেষ বৃদ্ধি পেয়েছে যার ফলে বর্তমানে চীন ভারতের সব চেয়ে বড় বাণিজ্যিক সহযোগী। এমনকি প্যাটেলের মূর্তিটিও তো ‘মেড ইন চায়না’ এবং সীমান্তে দুদেশ মুখোমুখী সংঘাতে দাঁড়িয়ে পড়ার পরও চীনা কোম্পানিগুলিকে বিভিন্ন বরাত পাইয়ে দেওয়া হচ্ছে। ভারতের বৃহৎ টিভি-চ্যানেলগুলি চীনা কোম্পানিদের বিপুল বিজ্ঞাপণের অর্থবলে বলীয়ান, আর চীনা কোম্পানি ও চীনা পুঁজির সঙ্গে ভারতের বড় বড় কর্পোরেট ঘরানার ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতার কথাও নতুন করে বলার কিছু নাই।
লজ্জার কথা হল প্রধানমন্ত্রী মোদি এই সীমান্ত সংঘাত ও ভারতীয় সৈনিকদের মৃত্যুকে বিহারের বিশেষ গর্ব হিসেবে তুলে ধরতে শুরু করেছেন, যেহেতু ঐ জওয়ানেরা ছিলেন ‘বিহার রেজিমেন্টের ১৬নং ব্যাটেলিয়ন’-এর অন্তর্ভুক্ত। বিহারে আর মাত্র কয়েক মাস বাদেই নির্বাচন। অমিত শাহের ডিজিটাল সভার মধ্যে দিয়ে ইতিমধ্যেই বিজেপি তার নির্বাচনী প্রচারাভিযান শুরু করেছেন। বুঝতে অসুবিধা হয় না কেন মোদি এখন ইণ্ডিয়ান আর্মিকে আঞ্চলিক লাইনে প্রজেক্ট করতে শুরু করেছেন। কর্নেল সন্তোষ বাবু তেলেঙ্গানার মানুষ, অন্যান্য নিহত জওয়ানেরাও বিহার সহ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে আসা। বিহারের মানুষেরা আঞ্চলিক পরিচিতি বা কে কোন রেজিমেন্টে ছিল সে হিসাব না করে সমস্ত নিহত সৈনিকের প্রতিই সমান শ্রদ্ধার আবেগ বোধ করবেন।
লাদাখে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় সংঘাতের প্রকৃত সত্য তথা ভারতের চীন-নীতি নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন গোটা দেশকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে, আমরা ভারতের জনসাধারণের কাছে আবেদন জানাব সরকারের কাছ থেকে এইসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর ও প্রকৃত তথ্য দাবি করতে। দেশের ভূখণ্ডগত প্রশ্নে দেশের জনতাকে অন্ধকারে না রাখার দাবি জানাব আমরা সরকারের কাছে। যে সরকার সবসময় সীমান্তে মোতায়েন সৈনিকদের দোহাই দিয়ে দেশের অভ্যন্তরের সংগ্রামকে দমন করতে চেয়েছে সেই সরকারকে জবাবদিহি করতে হবে কীভাবে ভারতীয় সৈনিকদের অস্ত্রহীন অবস্থায় সীমান্ত-সংঘাতে ঠেলে দেওয়া হল এবং এতগুলো প্রাণ অকালে ঝরে গেল।
- সিপিআই(এমএল) কেন্দ্রীয় কমিটির বিবৃতি
২৫ জুন এক প্রেস বিবৃতিতে সিপিআই(এমএল) রাজ্য সম্পাদক পার্থ ঘোষ বলেন, ১৯৭৫ সালের ২৫ জুন মধ্যরাতে জারি হল সেই কালা আদেশনামা ও ফরমান। তোড়জোড় চলছিল বেশ কিছু দিন ধরেই। ইন্দিরা গান্ধী, দেবকান্ত বড়ুয়া (তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি), রজনী প্যাটেল, সিদ্ধার্থশংকর রায়ের দুষ্ট চতুষ্ঠয়ের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে দেশের ঘনীভূত অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সংকট সমাধানে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে শাসক শ্রেণী ও শাসক জোটকে রক্ষা করতে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার নামিয়ে আনলো এমার্জেন্সি তথা জরুরি অবস্থা। ভারতের সংবিধান, গণতন্ত্র, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো সবকিছুকে নস্যাৎ করে শুরু হল রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও স্বৈরশাসন। জনগণের তীব্র গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা ও লাগাতার আন্দোলনের চাপে স্বৈরাচার শেষ পর্যন্ত পিছু হঠেছিল।
বর্তমান ও ভবিষ্যতের গণতন্ত্র রক্ষার স্বার্থে আজও এই দিনটির কথা আমরা স্মরণ করি, এই দিনটির কথা জনগণের কাছে তুলে ধরি। আজ দেশজুড়ে শুরু হয়েছে ফ্যাসিস্ট হামলা। সংঘ পরিবারের প্রত্যক্ষ সহায়তায় ও পৃষ্ঠপোষকতায় কেন্দ্রের বিজেপি সরকার নামিয়ে এনেছে এই ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাস। দলিত, সংখ্যালঘু জনগণকে মব লিঞ্চিং করে হত্যা করা, ছাত্র-যুব-মহিলা, সাংস্কৃতিক আন্দোলন, নাগরিক আন্দোলন ও প্রতিবাদের উপর নেমে এসেছে রাষ্ট্রীয় হামলা। ভীমা কোরেগাও থেকে এনআরসি, সিএএ, এনপিআর বিরোধী প্রতিবাদকারীদের উপর প্রয়োগ হচ্ছে কুখ্যাত কালাকানুন ইউএপিএ। যুদ্ধজিগির তুলে, উগ্রজাতীয়তাবাদের আবহাওয়ায় এই সন্ত্রাসকে লাগামহীন করে তোলার চেষ্টা হচ্ছে। ২০২০ সালের ২৬ জুন গণতন্ত্র বাঁচাও, সংবিধান বাঁচানোর শ্লোগানে রাজ্যজুড়ে এই দিনটি পালন করা হবে।
যে স্লোগানগুলি আমরা তুলে ধরব :
► করোনা সংকটকে কাজে লাগিয়ে সারা দেশে অঘোষিত জরুরি অবস্থা জারি করা চলবে না ।
► সংবিধান বাঁচাও, গণতন্ত্র বাঁচাও।
► সিএএ, এনপিআর, এনআরসি বিরোধী আন্দোলনকারীদের উপর রাষ্ট্রীয় দমন পীড়ন, বিনা বিচারে আটক রাখা চলবে না।
► বিনাবিচারে আটক রাখার স্বৈরাচারী আইন ইউএপিএ বাতিল করো।
► রাষ্টীয় দমন পীড়ন পুলিশী সন্ত্রাস বন্ধ করো।
► সমস্ত রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি চাই।
► সীমান্ত সংঘর্ষ নয়, আলোচনার মাধ্যমে কূটনৈতিক সমাধান করো।
► আপৎকালীন পরিস্থিতির নামে শ্রমিক-কৃষক জনবিরোধী আইন লাগু করা চলবে না।
► ভারত চীন প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখায় বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করো।
ঘরে ফেরা পরিযায়ী শ্রমিকদের জীবিকায় পুনর্বাসন দেওয়ার প্রশ্নে মোদী সরকার ঘোষণা করল একটা প্যাকেজ প্রকল্প। নাম দেওয়া হয়েছে ‘গরিব কল্যাণ রোজগার যোজনা’। ১২৫ দিনের প্রকল্প। কোভিড সংক্রমণ আর লক ডাউনে তিন মাস যাবত কাজ হারানো, বেতন না পাওয়া এবং কোনরকম সরকারী অনুদান না পাওয়া শ্রমিকদের জন্য অগত্যা ঘোষণা হল চার মাসের মতো কাজের ব্যবস্থা করা হবে। প্যাকেজ ৫০ হাজার কোটি টাকার। যোজনার তালিকাভুক্ত ধরা হয়েছে ছয়টি রাজ্যের ১১৬টি জেলাকে। মাপকাঠি করা হয়েছে ফিরে আসা পরিযায়ী শ্রমিক সংখ্যা যেখানে ২৫ হাজারের ওপর, প্রকল্পের আওতায় আসবে কেবল সেইসব জেলা। কর্মসংস্থানের মোট আনুমানিক লক্ষ্যমাত্রা হতে পারে ৩০ লক্ষাধিক। এই পরিকল্পনা গ্রামীণ ক্ষেত্র ভিত্তিক, থাকবে ২৫ রকমের কাজ, যা কেন্দ্রের ১২টি মন্ত্রকের যেমন জল সংরক্ষণ থেকে ইন্টারনেট পরিষেবা, সড়ক নির্মাণ থেকে রেল, টেলিকম ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকল্প রূপায়ণের অঙ্গ। স্বীকৃতি পাওয়া ছয়টি রাজ্যের মধ্যে রয়েছে বিহার, উত্তরপ্রদেশ, ওড়িশা, ঝাড়খন্ড, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থান। তালিকায় পশ্চিমবাংলার নাম নেই। তাজ্জবই লাগার কথা। যে রাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিকদের ফেরানো নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাত হল সবচেয়ে বেশি সেই রাজ্যের নাম কেন্দ্রের তৈরি কর্মসংস্থানে পুনর্বাসনের রাজ্য তালিকায় নেই! দেশের আজকের পরিস্থিতিতে শ্রমশক্তি পরিযায়ী হয় মূলত পূর্ব ও উত্তর ভারতের কয়েকটি রাজ্য থেকে, যার অন্যতম পশ্চিমবঙ্গ। বিহারে ফিরে আসা পরিযায়ী শ্রমিক সংখ্যা ২০ লক্ষাধিক, তালিকায় থাকা বাকি রাজ্যগুলির সংখ্যাও নিশ্চয় বিপুল; পশ্চিমবঙ্গের ফিরে আসা সংখ্যাটিও যথেষ্ট, ১১ লক্ষাধিক, এবং কেন্দ্রের ঘোষিত মানদন্ড অনুসারে প্রকল্পটির আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত ছিল একনজরে গণ্য করলে এরাজ্যের অন্তত ছয়টি জেলাকে। উত্তরবঙ্গের কোচবিহার, মালদা; দক্ষিণবঙ্গের মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, পুরুলিয়া ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা। কিন্তু তা করা হল না। আরও একবার বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার বানানো হল বাংলাকে, বাংলার জেলাগুলির হাজার হাজার ঘরে ফেরা গ্রামীণ গরিব পরিযায়ী শ্রমজীবীদের। এই অসদাচরণ করে ছাড়তে কেন্দ্র ও বিজেপি সাফাই গাইছে, তৃণমূল সরকার ফিরে আসা পরিযায়ী শ্রমিকদের জেলাওয়ারী তথ্য পরিসংখ্যান পাঠায়নি, তাই এরাজ্য বাদ থেকে গেছে। কথা হল, রাজ্য না হয় গাফিলতি দেখিয়েছে, কিন্তু কেন্দ্র আগ্রহ দেখিয়েছে কতটা? কোভিড মোকাবিলার প্রশ্ন তুলে কেন্দ্র যেভাবে হস্তক্ষেপের ঝড় তুলেছিল, তার কণামাত্র নমুনা কি পরিযায়ীদের এককালীন আর্থিক অনুদানের নিরন্তর দাবি ওঠা সত্ত্বেও দেখিয়েছে? কেন্দ্রের কাছে ট্রেনে ফেরানোর মোট সংখ্যাগত হিসাবও ছিল, ক’বার জেলা ভিত্তিক তালিকা চেয়ে পাঠিয়েছে? প্রত্যুত্তর দেওয়ার মুখ আছে বিজেপির?
বৈষম্য ও বঞ্চনার এই বিষয়টিকে বাংলার ‘বিশেষ থেকে সার্বিক’ সারা ভারতের প্রশ্ন হিসাবেও তোলা প্রয়োজন। প্রথমত, পঁচিশ হাজার শ্রমিকের বাধ্যতামূলক সীমার শর্ত চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে কেন? কোন ‘যুক্তি’তে এটা নির্দ্ধারিত হল? এবিষয়ে কি রাজ্যগুলোর মতামত নেওয়া হয়েছে? বাকি পরিযায়ী শ্রমিকদের জীবিকার সংস্থান পরিত্যক্ত হয়ে থাকবেন কেন? এই পলিসির মধ্যে নতুন এক বিপদ ডেকে নিয়ে আসার অশনি সংকেত থাকছে। অবশ্যম্ভাবীভাবে পরিযায়ী শ্রমিকদের নতুন এক ধরনের বৈষম্য-বঞ্চনা তো বটেই, পরন্তু বিদ্বেষ-বিভাজনের রাজনীতির বা দলাদলি-দ্বন্দ্ব-সংঘাতের শিকার করে তুলবে। মোদী সরকার মুখোশ আর মুখ আবারও উন্মোচিত হচ্ছে। মোদী প্রায়শ বলেন, ’সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, সবকা বিশওয়াস’। আর মোদী সরকারের পলিসি আচরণ ঠিক বিপরীত, বৈষম্য ও বঞ্চনা চালিয়ে যাওয়া। মোদী বলেন, ‘প্রতিযোগিতামূলক জনকল্যাণবাদ, যুক্তরাষ্ট্রবাদ’ অনুশীলনের কথা, আর মোদী সরকার অনুসরণ করছে একদিকে দেশ বেচার, অন্যদিকে কেন্দ্রের মর্জিমাফিক ছকে দেওয়া কিছু অস্থায়ী জীবিকার দুমুখো পলিসি। আর ‘যুক্তরাষ্ট্রীয়তাকে আমল দিচ্ছে’ কেবল কেন্দ্রকে শক্তিশালী করার জিগির তুলে কেন্দ্রের হাতে ক্ষমতার লাগাতার অতিকেন্দ্রীকরণ করে চলে, একইসাথে পক্ষে থাকা রাজ্যগুলোর প্রতি পক্ষপাতিত্ব এবং বিপক্ষে থাকা রাজ্যগুলোর ওপর ছড়ি ঘুরিয়ে।
লাদাখে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর গালোয়ান উপত্যকা অঞ্চলে ভারত ও চীনা সেনাদের মধ্যে সংঘর্ষ দুই প্রতিবেশীর মধ্যে এক নতুন বিস্ফোরক পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে। ১৯৭৫ সালের পর এটাই ভারত ও চীনের মধ্যে সীমান্ত অঞ্চলে খণ্ডযুদ্ধের প্রথম বড় ঘটনা। উভয় পক্ষেই হতাহতের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলায় এই সংঘর্ষ ১৯৬৭ সালে সিকিম সীমান্তে নাথু লা ও চো লা অঞ্চলে ১১-১৪ সেপ্টেম্বর ও ১ অক্টোবরের সংঘর্ষের পর সবচেয়ে বড় আকারের রক্তক্ষয়ী সংঘাত হয়ে দেখা দিয়েছে।
লাদাখের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখায় দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাত তথা অচলাবস্থার সংবাদ কয়েক সপ্তাহ ধরেই প্রকাশ্যে আসছে। বাস্তব ক্ষেত্রে দু-পক্ষের সেনাদের মধ্যে চলা উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের ভিডিও ইন্টারনেটে ভাইরাল হয়েছে। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রের বিশ্লেষকরা চীনা সেনাদের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা পেরিয়ে ভারতের দিকে ঢুকে আসার কথা জানাচ্ছিলেন, যে অনুপ্রবেশের ফলে ভারতকে গালোয়ান উপত্যকায় ষাট বর্গ কিলোমিটার এলাকার ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে হয়েছে। মোদী সরকার কিন্তু এই রিপোর্টগুলোর কোনোটাকেই সরকারীভাবে স্বীকার তো করেইনি, উল্টে বলে এসেছে যে উত্তেজনা প্রশমন নিয়ে কথাবার্তা চলছে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
ভারতীয় সেনার তরফে প্রাথমিকভাবে দেওয়া ১৬ জুনের বিবৃতিতে তিন জওয়ানের মৃত্যুর কথা স্বীকার করা হয় – কর্ণেল সন্তোষ বাবু, হাবিলদার কে পালানি এবং সিপাই কুন্দন ওঝা। এরপর নিহতের সংখ্যা কুড়িতে পৌঁছেছে বলে আমাদের জানানো হয় – যার মধ্যে গুরুতর আহত ১৭ জন শূন্য ডিগ্ৰির নীচের তাপমাত্রায় প্রবল ঠাণ্ডার কারণে মারা যান। কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রকৃত পরিস্থিতি অস্বীকার করে আসার ব্যাপারটা অবশেষে একেবারে কুড়ি জনের নিহত হওয়ার মর্মান্তিক স্বীকৃতিতে পরিণত হল। চীনের পক্ষে কতজন নিহত হয়েছে সে কথা অবশ্য চীন সুস্পষ্টভাবে জানায়নি। ভারতীয় সেনাদের সম্পর্কে আরও যা সরকারীভাবে আমাদের জানানো হয়নি তা হল, কতজন আহত সেনার চিকিৎসা চলছে এবং কোন সেনা চীনাদের হাতে বন্দী হয়ে আছে কিনা।
বিরোধী পক্ষে থাকার সময় বিজেপি মনমোহন সরকারের বিদেশ নীতিকে দুর্বল বলে চড়া পর্দায় তার সমালোচনা করত। আর এখন মোদী সরকার প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখায় বর্তমান পর্যায়ের সংঘাতময় পরিস্থিতিকে গোপন করা ও এড়িয়ে চলার যে নিদর্শন রাখল তা ওপরে ব্যক্ত প্রতিক্রিয়ার সম্পূর্ণ বিপরীত। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে পুলওয়ামা-বালাকোট উপাখ্যানে মোদী সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যেভাবে গলা চড়িয়েছিল এবং আগ্ৰাসী হাবভাব দেখিয়েছিল, এবারের প্রতিক্রিয়া প্রকটভাবেই তার সম্পূর্ণ বিপরীত হয়েই দেখা দিচ্ছে। এর সঙ্গে সার্কভুক্ত কার্যত সমস্ত দেশের সঙ্গেই, আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তান থেকে নেপাল, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের অবনতির কথা ধরলে, চীনের সঙ্গে এই সংঘাত বিদেশ নীতির ক্ষেত্রে মোদী সরকারের বড় ধরনের সংকটকেই প্রতিপন্ন করছে।
চীন ও ভারতের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে গেলে তা দু-দেশের কাছে সর্বদাই বিপর্যয় ঘনিয়ে তুলবে। কোভিড-১৯ মহামারী এবং বিপুল অর্থনৈতিক মন্দার বর্তমান পরিস্থিতিতে সংঘর্ষ বাধলে তা ভারতের কাছে বিভীষিকাময় হয়েই দেখা দেবে। এই সম্ভাবনা এতটাই প্রকট যে তা আমাদের ভাবনায় ধরা না দিয়ে পারে না। যেদিন কুড়ি জন সেনাকে হারানোর খবর এল, সেদিনই আবার এল কোভিড-১৯ রোগীদের একদিনে সবচেয়ে বেশি সংখ্যকের মৃত্যু সংবাদ। মাত্র একদিনে ২০০০-এর বেশি রোগীর মৃত্যু ১৬ জুনকে অবশ্যই ভয়াবহ মঙ্গলবার করে তুলেছিল।
দু-দেশের সরকারের মধ্যে আন্তরিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়েই সংঘাত তথা অচলাবস্থার অবসান ঘটাতে হবে। ভারতের সমস্ত প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে নরেন্দ্র মোদীই সবচেয়ে বেশি বার চীন সফর করেছেন, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাঁচ বার এবং তার আগে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে চার বার। প্রতিবারের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তিনি চীনা প্রেসিডেন্ট শি শিনফিং-এর সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সৌহার্দ্যকে জাহির করার চেষ্টা করেছেন। চীন ভারতীয় বাণিজ্যের সবচেয়ে বড় শরিক হওয়ায় দু-দেশের মধ্যে জড়িয়ে থাকা অর্থনৈতিক স্বার্থের পরিমাণও যথেষ্ট। কোভিড-১৯ নিয়ে ট্রাম্প তত্ত্বের পুনরাবৃত্তি করা অথবা চীনা পণ্য বয়কটের ডাক দিয়ে উগ্ৰ চীন-বিরোধী জিগির উস্কিয়ে তোলার চেয়ে ভারতের বিদেশ নীতির সাফল্যের প্রকৃত পরীক্ষাটা রয়েছে চীনের সঙ্গে দ্রুত ও সম্মানজনক কূটনৈতিক সমাধানে পৌঁছতে পারার মধ্যে। মোদী দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০১৪ সালে ক্ষমতায় এসেছিলেন, কিন্তু মোদীর শাসনাধীনে অর্থনীতির ক্রমাবনতি হয়ে চলেছে। নিজের “বিশ্ব নেতার” তথাকথিত ভাবমূর্তিকে ধরেই মোদী ২০১৯ সালে তাঁর প্রচারকে চালিয়েছিলেন।
‘হাউডি মোদী’ ও ‘নমস্তে ট্রাম্প’-এর লোকদেখানো দৃশ্যকে ছাড়িয়ে লাদাখে সংঘাত তথা অচলাবস্থার সমাধানই মোদীর বিদেশ নীতির সাফল্যের সামনে সবচেয়ে বড় প্রশ্নচিহ্ন হয়ে রয়েছে।
(এমএল আপডেট সম্পাদকীয় ১৬ জুন ২০২০)
মহম্মদ ইউনুস যখন বাংলাদেশের মতো পিছিয়ে থাকা অর্থনীতিতে পু্ঁজিবাদী উন্নয়নের এক বিকল্প ধারা রূপে মাইক্রো ফাইন্যান্স এর ধারণা সামনে আনেন ও প্রয়োগ ঘটান, তখন পুঁজিবাদীদের মক্কা আমেরিকাও ধন্য ধন্য করে। ইউনুস নোবেল পান। উন্নয়নের তকমার আড়ালে পুঁজির গঠন ও শোষণ একেবারে কুঁড়েঘর পর্যন্ত বিস্তৃত করার জন্যই এই নোবেল প্রাপ্তি। বাংলাদেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে প্রথম দিকে ধীরে ধীরে, পরবর্তীতে অত্যন্ত দ্রুততায় ভারতের গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে মাইক্রো ফাইন্যান্স এর জাল। এই ব্যবস্থায় ঋণ গ্রহীতা মহিলারা। গ্রামের দরিদ্র মানুষের ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ পাওয়ার সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। মাইক্রো ফাইন্যান্স এ বিভিন্ন ঋণদাতা কোম্পানি এই দরিদ্র মানুষদের ঋণ দেয়, সম্পত্তি বন্ধক না রেখেই। আন্দোলনের ময়দানে ঘুরতে ঘুরতে বোঝা গেল, মেয়েরা এই ঋণ নিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তুলে দেন বাড়ির পুরুষদের হাতে, ব্যবসা বা চাষের কাজে, ঘরবাড়ি তৈরি বা অন্য কোনো প্রয়োজনে। এই দরিদ্র পরিবারগুলিকে অন্য কেউ ঋণ দেবেনা, যা মাইক্রো ফাইন্যান্স দেয়। কিন্তু দেয় কিসের ভরসায়! ঋণ ফেরতের গ্যারান্টি আছে এই জাতীয় ঋণের ব্যবস্থাপনার মধ্যেই। এটি গোষ্ঠী ঋণ। গোষ্ঠীর একজনের ঋণ শোধের দায়িত্ব নেন গোষ্ঠীর অন্যরা। একজন ঋণ শোধ করতে ব্যর্থতা দেখালে ওই দলের অন্যরা তাকে চেপে ধরেন। একদম গোষ্ঠীর মধ্যে থেকেই উঠে আসা ঋণ শোধের এই চাপ কতটা তীব্র, একজন ভুক্তভোগীই বোঝেন। ফলে ঋণ সুদসহ ফেরতের গ্যারান্টি বেশ।
এইভাবেই বেশ চলছিল। মানুষ ঋণ নিচ্ছিলেন নানা ব্যবসার কাজে, চাষের জন্য। এছাড়া অন্য একটি গুরুতর কাজেও মানুষ ঋণ নিয়েছে। দরিদ্র মানুষদের অধিকাংশই প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা থেকে বঞ্চিত। ঝড়, বৃষ্টিতে একটা পাকা ঘরের নিরাপত্তার প্রয়োজন সকলের। অথচ ঘর তৈরির জন্য লাগে এককালীন অনেকটা টাকা। এমন অসংখ্য মানুষ আছেন, যারা মাইক্রো ফাইন্যান্স থেকে ঋণ নিয়ে তৈরি করেছেন মাথার উপর একটুকরো ছাদ। যদিও হাতে গোনা, তবু এমন উদাহরণও আছে, যেখানে এককালীন টাকার মোহে ঋণ নিয়ে মানুষ টাকা রেখেছেন ব্যাঙ্কে আর খেটে শোধ করছেন কিস্তি! বলছিলেন ফতেমা বেগম, তাঁর পর্যবেক্ষণের কথা, “বিশ বিঘা জমির মালিকরা মাইক্রো ফাইন্যান্স এর ঋণ নেয় না। এই ঋণ গরিবদের জন্য। চড়া সুদ-১৮/২০/২২/২৪ শতাংশ। তবুও এই সুদে ঋণ নেয় গরিবেরা-আদিবাসী, ভাগচাষি, গরিব কৃষক, ছোট ব্যবসাদার, মেহনতিরা। কারণ ব্যাঙ্ক এদের ঋণ দেয় না। ব্যাঙ্ক ঋণ দেয় বড় লোকদের।”
ফতেমা নিজেও গরিব, এবং চটপটে ও উদ্যোগী। চিকনের কাজ নিয়ে নাবার্ড থেকে সবলা বিভিন্ন সরকারী উদ্যোগে চিকনের ষ্টল দেন। থাকা খাওয়ার খরচ সরকার বহন করে। ষ্টল থেকে যে বিক্রিবাটা, তার লভ্যাংশ ফতেমার। কিন্তু ষ্টলে চিকনের বস্ত্র নিয়ে বসতে গেলে কমপক্ষে ৪/৫ লাখ টাকা লাগে। ফতেমা তাই দেড় লাখ টাকা নিয়েছেন বন্ধন থেকে চড়া সুদে। মহাজনরা কিছু ধার দেয়। এছাড়াও আছে স্ব-নিযুক্তির ঋণ। এক্ষেত্রে সুদ সাড়ে ১২ শতাংশ। সময়ে ঋণ শোধ করলে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্যদের নাকি সুদের একাংশ ফিরিয়ে দেওয়া হয়। ফতিমারা এই সুযোগ কোনদিন পাননি! তবুও চলছিল একরকম। কিন্তু লকডাউনে সরকারী মেলা বন্ধ, ব্যবসাও বন্ধ; সুদ কিন্তু বেড়েই চলেছে। উদ্যোগী হয়েও দিশেহারা। ফতিমারা তাই আজ ঋণমুক্তির আন্দোলনে। বলছিলেন ফতিমা, আমার যদি এই অবস্থা হয়, আমার আশেপাশের গ্রামের মেয়েরা যারা বাড়ি থেকে বের হয় না, ৪/৫টা ঋণ নিয়েছে, তারা বুকফাটা যন্ত্রণা নিয়ে ঘুরছে!
কৃষিতে ভাগ চাষের কথা আমরা জানি। পুরো ব্যবস্থাটা এখানে দাঁড়িয়ে থাকে ভাগচাষির পারিবারিক শ্রমের নির্মম শোষণের উপর, মজুরি শোষণের সামন্তিপথ। এই আদিবাসী, মেহনতি, গরিব কৃষক পরিবারগুলি যখন আবার জানা, উজ্জীবন, গ্রামশক্তি, বন্ধন, আশীর্বাদ মারফৎ চাষাবাদ থেকে সংসারের এককালীন টাকার প্রয়োজনে ঋণ নিচ্ছেন; এরপর চড়া সুদের সাপ্তাহিক কিস্তি মেটাতে সারা সপ্তাহ গাধার মতো খাটছেন, একটা মিটিয়ে সাথে সাথেই মাথার উপর মস্ত ভার নিয়ে পরবর্তী কিস্তি মেটানোর লক্ষ্যে ছুটছেন, তা আধুনিক পুঁজিবাদী শোষণের নবতম যাঁতাকল। মার্কস নতুন করে ক্যাপিটাল লিখলে পুঁজির এই আধুনিকতম দৌরাত্ম্য নিয়ে নিশ্চিত কলম ধরতেন!
কেমন ঋণ, কেমন তার কিস্তি, দেখা যাক। দাদপুরের আসমা বেগম, বন্ধন থেকে নিয়েছেন দেড় বছর মেয়াদী ৪০ হাজার টাকার ঋণ। ইনি কিস্তি দেন মাসে ৩০২৪ টাকা। অর্থাৎ ১৮ মাসে দেবেন ৫৪ হাজার ৪৩২টাকা। এর সাথে আছে শুরুতেই হাজার আড়াই এর লাইফ ইন্স্যুরেন্স! বার্ষিক সুদ মোটামুটি ২৪ শতাংশ! সাথে আবার বাসন কিংবা চড়া দামে উনুন কেনার বায়নাক্কা!
গোয়ালজোড়ের রেহানা সুলতানা বন্ধন থেকে নিয়েছেন ১ লক্ষ টাকা। এখন ১১৫০ টাকা সপ্তাহে সপ্তাহে ২ বছর দিয়ে ঋণমুক্ত হবেন। আখনার টুম্পা পাত্র উজ্জীবন থেকে নিয়েছেন ৩০ হাজার, সমস্তা থেকে ৩০ হাজার, ভিলেজ থেকে ৩৫ হাজার, এসকেএস থেকে ১৮ হাজার, বন্ধন থেকে ৪০ হাজার! সবকটিরই কিস্তি দিতে হয় সপ্তাহে, সপ্তাহে।
এদের কারো স্বামী রাজমিস্ত্রি, কেউ ঋণ নিয়েছেন রাজ্যের বাইরে থাকা ছেলের পাঠানো টাকার ভরসায়, কেউ ভরসায় ছিলেন সব্জি বেচে কিস্তি পরিশোধ করবেন।
এভাবেই চালিয়ে যাচ্ছিলেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। কেউ কেউ এক সাথে আট/দশটা পর্যন্ত ঋণ করেছেন।
এভাবেই তো চলছিল। ঋণ করলে শোধ করতে হয়, এটাই এদেশের মরাল। আর ঋণ শোধ করার তাগিদে অনেকে একটা সংস্থা থেকে নিয়ে অন্য সংস্থায় কিস্তি মিটিয়েছেন! অনেকটা শিব্রামের হর্ষবর্ধনের ঋণ শোধের বিখ্যাত গল্পের মতো।
কিন্তু লকডাউন দরিদ্র ঋণগ্রহিতাদের এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে যে কিস্তি পরিশোধের নিয়মিত ব্যবস্থাপণাই ভেঙ্গে পড়েছে। মাইক্রো ফাইন্যান্স সহ ঋণের জাল এখন এ্যতোটাই বিস্তৃত যে ব্যবস্হাকে রক্ষা করার স্বার্থেই লকডাউনের শুরুতে সুপ্রিম কোর্ট তড়িঘড়ি রায় দেয় যে তিন মাস কিস্তি নেওয়া বন্ধ রাখতে হবে। কিন্তু এর জন্য ঋণগ্রহিতাকে ব্যাঙ্কের কাছে আবেদন করতে হবে। মরাটোরিয়ামের এই খবরটুকুও পৌঁছায়নি গ্রামের দরিদ্র মানুষের কাছে। উল্টে, লকডাউনের মধ্যেও কিস্তির তাগাদা চালাতে থাকে কোম্পানিগুলোর এজেন্টরা। পরন্তু তিনমাস কিস্তি আদায় করা হয়নি (যা সুপ্রিম কোর্টের রায় ছিল) সময় বৃদ্ধির এই অজুহাতে ব্যাঙ্ক বাড়তি সুদ দাবি করে। যা পুনরায় কোর্টে তিরস্কৃত হয়। কোর্ট এই প্রশ্ন তোলে, এনপিএ-তে হাজার, হাজার কোটি টাকা ছাড়, আর মরাটোরিয়াম পিরিয়ডে কয়েক মাসের সুদ ছাড় দেওয়া যাচ্ছে না! কোর্ট বিষয়টি কেন্দ্রীয় সরকার ও রিজার্ভ ব্যাংককে বিবেচনা করতে বলেছে, যদিও কোর্টের ভর্ৎসনার আগে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি বলে, এমন ছাড় দিলে খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হবে!
মানুষ যে ঋণের জালে জড়িয়ে পরছে, বোঝা যাচ্ছিল অনেক দিন থেকেই কারণ একটার পর একটা সংস্থায় ঋণ তার বেড়েই চলছিল। মাইক্রো ফাইন্যান্স-এও ঢুকে পরছিল নিত্যনতুন কোম্পানি। এখান থেকেই মুনাফার পাহাড় তৈরি করেছে বন্ধন। পরিণত হয়েছে ব্যাঙ্ক-এ। আশীর্বাদ, জানা, গ্রামশক্তি, সমস্তা, উজ্জীবন, এসকেএস, আরোহণ অজস্র কোম্পানির রমরমা ব্যবসা এখন। সুদের ব্যবসা। কুসিদজীবী এরা। আধুনিক কোম্পানির ঝকঝকে মোড়কে পৃথিবীর আদিমতম ব্যবসা!
লকডাউনের শুরু থেকে ত্রাণ ও রেশন সংক্রান্ত আন্দোলন যতই প্রসারিত হচ্ছিল, ততই স্পষ্ট হচ্ছিল বিপন্ন মানুষের আর্তনাদ। ঘরে খাবার নেই, সরকার বড়জোর দিচ্ছে সামান্য চাল, আটা। নেই তেল, নেই ডাল, নেই জ্বালানি, নেই ওষুধ! কিন্তু মহাজনের আনাগোনা বন্ধ হয়না। কি হবে! দিশেহারা মানুষ।
এই পরিস্থিতিতে আমাদের ঋণমুক্তির ডাক, বিদ্যুৎ চমকের মতো ছড়িয়ে পড়ে গ্রাম-গ্রামান্তরে। পোলবা-দাদপুরের বুকে বিডিও-তে পরপর দুটি ধর্ণা-ডেপুটেশনেই জড়ো হন বিপুল সংখ্যক ঋণগ্রস্ত মানুষ- ঋণমুক্তির প্রত্যাশায়।
আন্দোলন সংগঠিত করতে গিয়ে যে যুক্তি তুলে ধরা হচ্ছে --
মানুষকে সমাবেশিত করতে গড়ে তোলা হয়েছে ‘ঋণ মুক্তি কমিটি’। এটি হুগলিতে আয়ারলার অন্তর্ভুক্ত হয়ে কাজ করছে। গ্রামে গ্রামে একটার পর একটা বৈঠক সংগঠিত করার কাজ চলছে।
ঋণগ্রস্তদের সংগঠিত করতে, ঋণের বর্তমান পরিস্থিতি ইত্যাদি জানা ও সরকারকে অবহিত করার লক্ষ্যে প্রথমেই কমিটির করে দেওয়া বয়ানে প্রত্যেক গোষ্ঠীকে ঋণদাতা ব্যাঙ্ক এর নাম, ঋণের পরিমাণ, ঋণগ্রহীতার নাম ইত্যাদি জমা দিতে বলা হয়। ইতিমধ্যে এমন প্রায় ২৫/৩০ হাজার ফর্ম জমা পড়েছে। এগুলো এক্সেল পেপারে টাইপ করে পিডিএফ আকারে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য অর্থ দপ্তর সহ প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পাঠানোর কাজ চলছে। চলছে বিভিন্ন ব্লক দপ্তর মাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে দাবিসনদ পাঠানোর কাজ। একই সাথে চলছে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ। প্রতিটি গোষ্ঠী এই মাস পিটিশন পাঠাচ্ছে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকে।
ইতিমধ্যে ঋণ মুক্তি চেয়ে ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিরা স্বয়ং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠাচ্ছেন হাজার হাজার পোষ্টকার্ড। কমিটি নিজেই এখনো পর্যন্ত ছাপিয়ে দিয়েছে ১২/১৪ হাজার পোস্টকার্ড।
শিল্পপতি, বড়লোকদের ঋণ মকুব হয় বারবার, তবে আমরা আমজনতা, আমাদের ঋণ মকুব করতে সরকার কেন পাশে দাঁড়াবে না? – এই মর্মধ্বনি নিয়ে এগিয়ে চলেছে আন্দোলন। দেশের সরকারকেই এখন দেখাতে হবে, তারা কোন পক্ষের প্রতিনিধি। কাদের স্বার্থবাহী?
আন্দোলনকারীদের কাছে এই বার্তা আমরা প্রথম থেকেই ছড়িয়ে দিচ্ছি যে, ঋণমুক্তি কমিটিতে তারাই সংযুক্ত হোন, যাদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকেছে। যারা ঋণজালে জড়িয়ে পড়েছেন, নিত্য অপমান, টেনশন নিয়ে না বেঁচে, আসুন সরকারের নীতির প্রশ্নে সোচ্চার হই। জোটবদ্ধ হয়ে সরকারী নীতির অভিমুখ বদলে দেশকে গরিবদেরও বাসযোগ্য করে তুলি।
- সজল অধিকারী
চীন-ভারত প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় সংঘাত ও ২০ জন ভারতীয় সেনার মৃত্যু প্রশ্নে দেশকে অন্ধকারে রেখে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যেরকম বিভ্রান্তিকর ও ছলনাময় বক্তব্য রেখেছেন তাকে ধিক্কার জানিয়ে এবং নিহত সৈনিকদের প্রতি শোক জ্ঞাপন করতে সিপিআই(এমএল) কেন্দ্রীয় কমিটি ২২ জুন দেশজুড়ে শোক ও ধিক্কার দিবস পালন করে। সীমান্তে “সব ঠিক হ্যায়” বলে দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে কেন? দেশে করোনা সংকট, আর্থিক সংকটের সময়কালে নতুন করে কেন সীমান্ত সংকট সৃস্টি করা হচ্ছে? প্রধানমন্ত্রী মোদী বলছেন, চীন সীমান্তে কোনোরকম অনুপ্রবেশ হয়নি! তাহলে কোথায় কিভাবে আমাদের সেনারা মারা গেলেন? এই সমস্ত প্রশ্নগুলি তুলে ধরে রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে এই কর্মসূচী পালিত হয়।
পার্টির রাজ্য দপ্তরের সামনে মৌলালি মোড়ে পোস্টার প্ল্যাকার্ড নিয়ে রাজ্য কমিটির বিভিন্ন সদস্য সহ জেলার অন্যান্য কর্মীরা শোক ও প্রতিবাদ প্রদর্শন করেন। সমগ্র বিষয়টি তুলে ধরে রাজ্য সম্পাদক পার্থ ঘোষ বক্তব্য রাখেন। সকালে বাঁশদ্রোণী মেট্রো স্টেশনের সামনে স্থানীয় ব্রাঞ্চের পক্ষ থেকে এই কর্মসূচী হয়। বিকেলে বেহালার কালিতলা ব্রাঞ্চের উদ্যোগে এবং সন্ধ্যায় যাদবপুর লোকাল কমিটির পক্ষ থেকে পালবাজার মোড়ে ও টালিগঞ্জ লোকাল কমিটির উদ্যোগে বাঘাযতীন মোড় ও আই-ব্লক মোড়ে মাইক সহ সভা হয় যেখানে পার্টির বক্তারা বক্তব্য রাখেন। মৌলালি ও বাঘাযতীনের প্রদর্শনে উপস্থিত ছিলেন জেলা সম্পাদক অতনু চক্রবর্তী।
ধুবুলিয়ার নেতাজী পার্কের জনবহুল এলাকায় শোক ও ধিক্কার সভা আয়োজিত হয় জেলা সম্পাদক সুবিমল সেনগুপ্তর নেতৃত্বে। বিভিন্ন বক্তারা বক্তব্য তুলে ধরেন যা বহু মানুষ আগ্রহ সহকারে শোনেন। গালোয়ান উপত্যকায় চীনের সাথে সংঘর্ষে হত ভারতীয় সেনাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য নীরবতা পালন করার সময় বহু সাধারণ মানুষ উঠে দাঁড়িয়ে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধ উন্মাদনা সৃষ্টির বিরুদ্ধে, শান্তির স্বপক্ষে সভা সোচ্চার হয়ে ওঠে। জেলা সদর কৃষ্ণনগর শহরের কর্মীরা মিছিল করে বাসস্ট্যান্ডে যায় এবং সেখানে খালি গলায় প্রচার সভা করেন। বক্তব্য রাখেন জেলা নেতা অমল তরফদার। নবদ্বীপে অনুরূপ কর্মসূচীতে রেল হকার ইউনিয়নের কর্মীরাও অংশগ্রহণ করেন। চাকদা শহরে বিক্ষোভ কর্মসূচী সংগঠিত হয়, সেখানে ব্যাপক পোষ্টারিং করা হয়।
দার্জিলিং জেলা কমিটির পক্ষ থেকে শিলিগুড়ির হাসমি চকে প্রদর্শন হয়।
জলপাইগুড়ি কদমতলা বাস স্ট্যান্ডে শহর লোকাল কমিটির পক্ষ থেকে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়।
উত্তরপাড়া-রিষড়া এরিয়া কমিটির তরফ থেকে সংক্ষিপ্ত প্রতিবাদ সভা ও নীরব মিছিল সংগঠিত হয় কোতরং ২ নং কলোনি বাজার এলাকায়। মিছিলের শুরুতে রাজ্য সম্পাদক পার্থ ঘোষ ও শেষে এরিয়া কমিটির সদস্য সৌরভ রায় বক্তব্য রাখেন। হুগলির চার্চের মোড়ে, নিহত সৈনিকদের স্মরণে, নীরবতা পালন ও কালো ব্যাজ ধারণ করেন উপস্থিত মানুষেরা। চীনা দ্রব্য বয়কটের নামে খুচরো ব্যবসায়ীদের ওপর হামলার আশঙ্কা ব্যক্ত করে, মানুষকে এই কঠিন পরিস্থিতিতে ঐক্যবদ্ধ হবার আহ্বান জানানো হয়। পাণ্ডুয়া ব্লকের বৈঁচিতে পোস্টারিং করা হয়। বলাগড় ব্লকের গুপ্তিপাড়া ও ইছাপুর-বেলেডাঙা এই দুটি পার্টি ব্রাঞ্চের পক্ষ থেকে শোক দিবসের কর্মসূচী অনুষ্ঠিত হয়।
কালনা ২নং ব্লকের অকালপৌষ গ্রাম পঞ্চায়েতের আগ্রাদহতে ৫০ জনের বেশি মানুষকে কালনা লোকাল কমিটির ডাকে জমা হয়ে শ্লোগান তোলেন। এক মিনিট নিরবতা পালন হয়। সভায় সমগ্র বিষয় তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন রফিকুল ইসলাম। বর্ধমান শহর কমিটি, পূর্বস্থলী এরিয়া কমিটি, রায়নার শ্যামসুন্দর এলাকা ও মেমারীর নিমো এলাকায় অনুরূপ কর্মসূচীতে সামিল হন জেলার নেতৃবৃন্দ।
জেলা অফিস ছাড়াও জেলার বিভিন্ন প্রান্তে ২২ জুন কর্মসূচী পালিত হয়। বীজপুর, অশোকনগর চৌরঙ্গী মোড়, হালিশহর সরকার বাজার ও বারাসাত কোর্ট চত্তরে প্ল্যাকার্ড শ্লোগান সহ এই কর্মসূচীতে বক্তব্য রাখা হয়। পথচলতি মানুষ দাঁড়িয়ে শোনেন। জেলা সম্পাদক সুব্রত সেনগুপ্ত বীজপুর আঞ্চলিক কমিটি আয়োজিত প্রতিবাদ সভায় বক্তব্য রাখেন।
বজবজে বজবজ গ্রাম লোকাল কমিটি ও আইসা বজবজ জোনাল কমিটি যৌথভাবে কর্মসূচী পালন করে। বাখরাহাটে বিষ্ণুপুর-সাতগাছিয়া লোকাল কমিটির উদ্যোগে ধিক্কার কর্মসূচী চলাকালীন কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বান সম্বলিত লিফলেট এলাকার জনগণের মধ্যে বিলি করা হয়।
রাজ্যের এই কর্মসূচীগুলিতে শ্লোগানে ও বক্তব্যে যুদ্ধের বিরোধিতা, সীমান্ত সমস্যার কূটনৈতিক সমাধান দাবি এবং বিজেপি-আরএসএসের উগ্র জাতীয়তাবাদ ও চীনা পণ্য বয়কটের নামে মানুষকে ও খুচরো ব্যবসায়ীদের হুমকির বিরোধিতা জোরালোভাবে তুলে ধরা হয়।
দ্বিতীয় দফায়, ১৭ই জুন ২০২০, আমফান ঝড়ে বিধস্থ উত্তর ২৪ পরগণা জেলার হাসনাবাদ ব্লকের চক পাটলি খানপুর পঞ্চায়েতের বেলিয়াডাঙ্গা, টিয়ামারী ও জয়গ্রামের বিপন্ন মানুষের পাশে আমরা হাজির হয়েছিলাম ত্রাণসামগ্রী নিয়ে। এবারের ত্রাণ কাজে আমাদের সঙ্গী হয়েছিলেন ছাত্র নেতা রুদ্রর নেতৃত্বে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীরা, ছিলেন আইসার রাজ্য সম্পাদক স্বর্ণেন্দু এবং রুমেলা, অন্বেষা, নাতাশা, অনন্যা, বর্ষা সহ ১৭ জন ছাত্র-ছাত্রী, ছিলেন এআইসিসিটিইউ, আয়ারলা, পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদ ও এআইপিএফ-এর নেতৃবৃন্দও। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের এবং বিভিন্ন গণসংগঠন ও ব্যক্তিবর্গের সহযোগিতায় “নাগরিক উদ্যোগ”-এর মাধ্যমে এই ত্রাণ কার্য পরিচালনা করা হয়। প্রথম দিনের মতই এদিনের এই কর্মসূচীর ব্যবস্থাপনায় ছিল বসিরহাটের পশ্চিমবঙ্গ গণ সংষ্কৃতি পরিষদের অন্তর্ভুক্ত ‘নির্মাণ সাংস্কৃতিক সংস্থা’। নাগরিক উদ্যোগের এই কাজে সহযোগিতা করতে পাশে ছিলেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের জেলা নেতৃত্বও।
চিঁড়ে, ছাতু, বিস্কুট, বাতাসা, ওআরএস, সাবান, রিচার্জেবল টর্চ, খাতা-পেন সহ দুই গাড়ি ত্রাণ সামগ্রী গ্রামগুলোর ৫০০ পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়। প্রচন্ড বৃষ্টিকে অগ্রাহ্য করেই ত্রাণ সামগ্রী বিলি করার পাশাপাশি ছাত্র ছাত্রীরা গ্রামের মানুষের সাথে কথা বলেন এবং অনুসন্ধানমূলক কাজও চালান। বহু মানুষ আসেন জল পেরিয়ে, তাঁদের হাতে একে একে তুলে দেওয়া হয় ত্রাণসামগ্রী। ডাঁসা নদীর বাঁধ ভেঙ্গে প্লাবিত এই অঞ্চলে জল কিছুটা কমলেও এখনো অনেক মানুষ ঘর ছাড়া, অনেকের ঘর ভেঙ্গেও গেছে। এখনো ধান ক্ষেতগুলোতে লোনা জলে পরিপূর্ণ, তারই মাঝে জেগে উঠেছে পায়ে চলা আল পথ। সেই পথ ধরে প্রায় এক দেড় কিমি পায়ে হেঁটে বা কোথাও জল ডিঙিয়ে টিয়ামারী গ্রামের লোকজন এসেছেন ত্রাণ সংগ্ৰহ করতে।বেলিয়াডাঙ্গা গ্রামের মুদিখানা দোকান চালান ওমপ্রকাশ দাস জানালেন, “তৃষা ভাটার কাছে যে বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল তা স্থানীয় ঠিকাদারের মাধ্যমে জোড়াতাপ্পি দিয়ে কোনোমতে মেরামত করা হয়েছে বটে তবে আবার কবে ভরা কোটালের জলের ধাক্কায় ভেঙে পড়বে তা কেউ বলতে পারে না।” এদিকে জলমগ্নতার দরুন তার দোকান বন্ধ, রুজিরোজগার নেই, তাই দুঃখ করে বললেন,’ ৫ জনের সংসার চালানোই এখন দায়। বাড়িতে রান্নাবান্না হচ্ছে না, ওই নানা সংস্থার লোকেরা দুপুরে একটা রান্না করা ভাত ডাল দেয়, সেটাই খাই, শুকনো খাবার দিয়ে গিয়েছিল আপনাদের মতোই দাদারা, সেই দিয়েই চলে যায় কোনোরকমে। ব্যবসার পুঁজিও শেষ। কীভাবে যে চলবো?” জানালেন, সরকারী কুড়ি হাজার টাকার সাহায্য পাননি, দরখাস্তই জমা নিচ্ছে না তৃণমূলের মেম্বার সুদীপ দাস। ওপর দিকে সেই চেনা ছবি ফুটে উঠেছে, সরকারী ত্রাণ বিলিবন্টন নিয়ে পঞ্চায়েতের মেম্বার থেকে তৃণমূলের প্রধানের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগে। অভিযোগ ঝড়ে পড়লো আরিপাড়া খালের পাড়ের খাদিজা বিবির গলায়। পেশায় তার স্বামী একজন ভ্যান চালক, কাজ বন্ধ, তিনি নিজেও বিড়ি বাঁধার কাজের সাথে যুক্ত, তিনি জানালেন, “আমাদের বড্ড কষ্ট, ঠিক মতো খেতেও পাই না, কোলের ছেলেটার মুখে যে দুমুঠো দেবো, তারও উপায় নেই! ভরসা বলতে এই আপনাদের মতো লোকজন, প্রধান একবারের জন্য গ্রামে আসেনি। রেশনের চাল পেয়েছি, কিন্তু রান্নাবান্না করার সব সরঞ্জাম ভেসে গেছে।চারিদিকে জল, দু-একজনের বাড়িতে গ্যাস আছে, তাদের রান্না হয়, আমরা শুকনো মুড়িটুরি খেয়ে কোনো রকমে টিকে আছি আমরা!”
ত্রাণের কাজের পাশাপাশি AISA-র বন্ধুরা মানুষের সাথে কথা বলেছেন, কিছু অভিজ্ঞতার কথা জানালো অন্বেষা, “আর সামান্য কৃষিকাজই ভরসা, গ্রামগুলোর বেশিরভাগ মানুষই কাজ করেন ভেরিতে, ইট ভাটায়, বিড়ি বাঁধার কাজ অথবা তামিলনাড়ু এবং অন্যান্য রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে। লকডাউনের কারনে দীর্ঘদিন ধরে তাদের কাছে উপার্জন বন্ধ, আয়ের অন্য কোনো মাধ্যমও নেই। আর এই আমফানের জন্য সেই দুর্ভোগ চরম সীমায় পৌঁছেছে। রাজ্য সরকার এনাদের জন্য শুধু কিছু চিঁড়ে-গুড়ের বন্দোবস্ত করেই হাত তুলে নিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে গ্রামবাসীদের ব্যাংক একাউন্টে যে ৫০০ টাকা করে দেওয়া হয়েছিল তা কিছু লোকের একাউন্টে ঢুকেছে, কারো ঢোকেনি। স্থানীয় এক মহিলা বললেন “এতে কি হবে? কিছুই হবে না।” ঝড়ের সময় যখন গভীর রাতে জল ভীষণ স্রোতে ঢুকতে শুরু করলো গ্রামে তখন সবাই এলোপাথারি ছুটছে। “পালাও পালাও! নাহলে সব কিছু চলে যাবে” — এবং সব কিছুই চলেও গেছে, শুধু মানুষগুলো রয়ে গেছে। গবাদি পশু, দরকারি নথি-পত্র সব নিয়ে গেছে নদী। কোনরকমে তারা শুধু নিজেদেরকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছেন ঘর থেকে। তাঁদের দিন চলছে এই বিভিন্ন ত্রাণের উদ্যোগের ভরসায়। মহিলারা বললেন যে অনেকের রান্নাঘর হয় ভেঙে গেছে নয় পুরো কাদায় ভর্তি। রান্না করা তাদের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব না। জিজ্ঞেস করতে জানতে পারলাম যে সরকারের পক্ষ থেকে ছোটো শিশুদের জন্য দুধ পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। নাই নাই অবস্থায় কুড়িয়ে কাচিয়ে দিন কাটছে।
গ্রামের মানুষেরা আরো অভিযোগ করে বললেন যে তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রশ্নেও সরকার সেভাবে কোনোরকম উদ্যোগ নেয়নি, সেক্ষেত্রেও ভরসা সেই বিভিন্ন ত্রাণের উদ্যোগ।
এলাকার ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার বই ঝড়জলে নষ্ট হয়ে গেছে বা হারিয়ে গেছে। নতুন বই কেনা এখন অনেকের ক্ষেত্রে দুঃসাধ্য ব্যাপার।
ত্রাণ বন্টনের কাজ শেষ করে স্থানীয় পরিবারগুলোর তালিকা তৈরি করা থেকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্লিপ পৌঁছে দেওয়ার কাজ গ্রামবাসীদের পক্ষ থেকে করেছিলেন যারা, তারা কয়েকজন ও অন্যন্য কিছু গ্রামবাসীকে যুক্ত করে নিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে গাড়ি করে হাসনাবাদ স্টেশনের কাছে বিডিও অফিসে যাওয়া হয়। হাসনাবাদের বেলিয়াডাঙ্গার, টিয়ামারী গ্রামের মানুষের জীবন জীবিকার জ্বলন্ত সমস্যা নিয়ে একটি দাবিপত্রসহ মিছিল সহযোগে হাসনাবাদের বিডিওকে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। ডেপুটেশন টিমে উপস্থিত ছিলেন এআইসিসিটিইউ-র কম: দেবব্রত বিশ্বাস, এআইপিএফ-এর নেতা কমরেড নির্মল ঘোষ ও হাসনাবাদের গ্রামবাসীদের পক্ষ থেকে কমরেড মোকসেদ মিস্ত্রি। ডেপুটেশন চলাকালীন বিডিও অফিস চত্বরের বাইরে সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের জেলা সম্পাদক কমরেড সুব্রত সেনগুপ্ত, জেলা নেতা কম: শিবশঙ্কর গুহরায় ও ছাত্র নেতা সৌমেন্দু। জেলা সম্পাদক সুব্রত সেনগুপ্ত তার বক্তব্যে বলেন, “এভাবে ত্রাণ দিয়ে দিয়ে আর কত দিন চলবে? এই অঞ্চলের মানুষদের বাঁচানোর জন্য, সুন্দরবনকে বাঁচানোর জন্য সরকারকে উপযুক্ত পরিকল্পনা নিতে হবে, নদীবাঁধগুলো রক্ষণাবেক্ষণের সুষ্ঠ ব্যবস্থা, প্রয়োজনে কংক্রিটের বাঁধ দিতে হবে, বার বার বাঁধ ভেঙে মানুষ জলমগ্ন হয়ে পড়বে, এটা বেশি দিন চলতে পারে না, এর জন্য চাই স্থায়ি সমাধান।” প্রতিবাদ সভায় স্বভাবসিদ্ধ উদাত্ত গলায় গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন গণশিল্পী কমরেড বাবুনী মজুমদার। বিডিওর কাছে ডেপুটেশন দিয়ে ফিরে এসে সমবেত জনতার সামনে বক্তব্য তুলে ধরেন প্রতিনিধিদলের পক্ষে কমরেড নির্মল ঘোষ, তিনি বলেন, “বিডিও জানিয়েছেন অবিলম্বে গ্রামগুলোতে জলের জন্য ১০০টি ডিপ টিউবয়েলের ব্যবস্থা করা হবে এবং তার জন্য বিডিও ওপরতলায় চিঠিও পাঠিয়েছেন বলে প্রতিনিধি দলকে আশ্বস্ত করেন। আবার এমন কথাও শুনিয়েছেন, ‘আপনারা জায়গা ঠিক করেদিন, রেসকিউ সেন্টার গড়ে দেবো।’
বিডিওর কাছে গ্রামের মানুষের নিম্নলিখিত জ্বলন্ত দাবিগুলো পেশ করা হয় –
আগামী ২৭ জুন ঐ গ্রামগুলোতে ওষুধপত্র সহ একটি মেডিক্যাল টিম নিয়ে যাওয়া হবে বলে নাগরিক উদ্যোগের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত হয়েছে। আইসার পক্ষ থেকেও ঐ অঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত ছাত্র-ছাত্রীদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য যোগাযোগও প্রস্তুতি চালানো হচ্ছে।
ফিরে আসার সময় একজনের কথা কানে খুব বাজছিল, “শুনেছি সরকার থেকে নাকি ২৪ লক্ষ টাকা এসেছিল বাঁধ বানানোর জন্য। আমরা তো একদম নীচের লেভেল, আমাদের কাছে কিন্তু কিছুই পৌঁছায় না। তার আগেই সব উপরে উপরে কাজ হয়ে যায়”। এই হলো তাঁদের জীবন ও যন্ত্রণার জলছবি।
(হাসনাবাদ থেকে ফিরে — দেবল, বারাসাত)
আমফান ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ ও ত্রাণ নিয়ে দুর্নীতি-দলবাজির বিরুদ্ধে এবং ১০০ দিনের কাজের দাবিতে উত্তর ২৪ পরগণা সহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে জনগণের বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। গত ২২ জুন দেগঙ্গা বিডিও অফিসে ত্রাণ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে তুমুল বিক্ষোভ প্রর্দশন করেন দেগঙ্গার নানা প্রান্ত থেকে আসা হাজারের বেশি গ্রামবাসী। বিডিও দুর্নীতি আড়াল করার অপচেষ্টা চালালে জনগণও রুখে দাঁড়ায়। পরে তারা টাকি রোড অবরোধ করে। পুলিশ ও তৃণমূল আশ্রিত গুন্ডারা অবরোধ তোলার নামে নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের উপর হামলা চালায়। আহত হন অনেক গ্রামবাসী। রাতে বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারীকে অন্যায় ভাবে গ্রেপ্তার করে জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা দেওয়া হয়। এদের মধ্যে বেশির ভাগই ছাত্র-ছাত্রী ও সাধারণ গ্রামবাসী। সিপিআই(এমএল) লিবারেশন উত্তর ২৪ পরগণা জেলা কমিটি গ্রামবাসীদের এই ন্যায্য আন্দোলনকে সমর্থন জানাচ্ছে, পুলিশ ও দলীয় বাহিনীর হামলাকে তীব্র নিন্দা করছে এবং আন্দোলনকারীদের নিঃশর্তে মুক্তির দাবি করছে। জেলা জুড়ে ত্রাণ নিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবং ক্ষতিপূরণ, কাজ ও খাদ্যের দাবিতে চলমান এই আন্দোলনের সমর্থনে কর্মসূচী গ্রহণ করেছে।
- সুব্রত সেনগুপ্ত
সিপিআই(এমএল) জেলা সম্পাদক, উত্তর ২৪পরগণা
“আত্মনির্ভর ভারত’’ গড়ে তোলার ‘অভিযানে’ নেমে কয়লা শিল্পে ঢালাও বেসরকারীকরণের লক্ষ্যে এবার স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মাঠে নেমে পড়লেন। মাত্র দু’দিন আগে, ১৬ জুন, ছিল সেই বিভীষিকাময় মঙ্গলবার — যেদিন চীনা সেনার হাতে নিহত হলেন ২০ জন ভারতীয় জওয়ান, আর সেই একই দিনে কোভিড১৯-এর ছোবলে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক রোগী প্রাণ হারালেন। তার ঠিক দু’দিন পর, ১৮ জুন বেসরকারী বিনিয়োগের জন্য কয়লার বাণিজ্যিক খননের দরজা হাট করে খুলতে দেশের ৪১টি কয়লা ব্লকের অনলাইন নিলামের উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী। আর, তিনি এই পদক্ষেপকে তুলনা করলেন “আত্মনির্ভর ভারত’’ গড়ার লক্ষ্যে কয়লা শিল্পকে রাষ্ট্রায়ত্ত নিয়ন্ত্রণের দীর্ঘ লকডাউনের গ্রাস থেকে আনলক করার সঙ্গে। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা সম্পর্কে এমন নির্লজ্জ উক্তি আজ পর্যন্ত দেশের কোন প্রধানমন্ত্রী এর আগে করেছেন কিনা সন্দেহ রয়েছে।
কয়লা নিলামে বণিক সংস্থা ফিকির তরফে ছিলেন মোদীর পেয়ারের কর্পোরেট বেদান্তের কর্ণধার অনিল আগরওয়াল ও টাটা গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান এন চন্দ্রশেখরন প্রমুখ। ছিল কয়লা মন্ত্রকের হোমড়া চোমড়া ব্যক্তিবর্গ। গোটা দেশের এই ৪১টা কয়লা ব্লকের মধ্যে অবশ্য নাই এ রাজ্যের কোনো ব্লক।
যথারীতি, বেসরকারীকরণের এই পদক্ষেপকে বিপুল বিনিয়োগ ও ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ হিসাবে বিজ্ঞাপিত করেছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ। তিনি দাবি করেছেন, শুধুমাত্র এই ৪১টি কয়লা ব্লকে আগামী ৫-৭ বছরে লগ্নি আসবে প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকার। আর, তৈরি হবে প্রায় ২.৮ লক্ষ কর্মসংস্থান। সেই ২ কোটি কর্মসংস্থানের যে আষাঢ়ে গপ্পো শুনিয়েছিলেন মোদী ২০১৪-র নির্বাচনের সময়ে, তার আবার সামনে এলো। আর এ প্রসঙ্গেই আবার প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর পরস্পর বিরোধী মন্তব্য সামনে এলো। অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, কয়লা মজুত থাকা সত্ত্বেও আমদানি বন্ধ করে স্বনির্ভরতা বাড়াতেই নাকি এই বেসরকারীকরণ।
আর, প্রধানমন্ত্রী জানালেন, কয়লা মজুতে ভারত বিশ্বে দ্বিতীয়, কিন্তু রপ্তানিতে চতুর্থ। রপ্তানিতে ভারতকে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসার লক্ষ্যেই এই বেসরকারীকরণ।
এতদিন নিয়ম ছিল, মোট মজুত ভান্ডারের মূল্যের ১০ শতাংশ টাকা দিতে হতো কোল ব্লকের জন্য। বেসরকারী মালিকদের জন্য মোদী সরকার ০.২৫ শতাংশ টাকা করেছেন। মাত্র ৪ শতাংশ রেভিনিউ শেয়ারিং দিতে হবে। এদিকে, ১০০ শতাংশ এফডিআই-র অনুমতি দিয়ে দেওয়া হলো। বিদেশি সংস্থাগুলো এবার থেকে কয়লা রপ্তানি করতে পারবে। এইভাবে কোল ইন্ডিয়াকে ধাপে ধাপে তুলে দিয়ে কয়লা শিল্পকে দেশি বিদেশি মালিকদের কাছে সঁপে দেওয়া হল।
এর বিরুদ্ধে এআইসিসিটিইউ, সিটু, এআইটিইউসি, আইএনটিইউসি, এমনকি বিএমএস সহ আরও কয়েকটি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ২-৪ জুলাই গোটা শিল্প জুড়ে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যেদিন মোদী অনলাইনের মাধ্যমে কোল ব্লকের নিলাম করলেন, সেই ১৮ জুন ইউনিয়নগুলো ধর্মঘটের নোটিশ দেয়। দেশের যেখানে যেখানে কোল ইন্ডিয়ার সাবসিডিয়ারির সদর দপ্তর রয়েছে, সেখানেই শ্রমিক জমায়েত করে দেওয়া হয় ধর্মঘটের নোটিশ। যে পাঁচটা দাবিতে এই ধর্মঘট হচ্ছে সেগুলো হল :
এর পাশাপাশি, কয়লা শিল্পে ১০০ শতাংশ এফডিআই বিনিয়োগের ও তীব্র বিরোধিতা করছে ইউনিয়নগুলো।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ঝাড়খন্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন এই বেসরকারী বাণিজ্যিকরণের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বিজেপির শ্রমিক সংগঠন এখনো পর্যন্ত ধর্মঘটের পক্ষে রয়েছে। তারা এমনকি ধর্মঘটের প্রতিরক্ষা শিল্পে প্রস্তাবিত অনির্দিষ্টকালীন ধর্মঘটের পক্ষে স্ট্রাইক ব্যালট সংগঠিত করছে বাম ও অন্য ইউনিয়নগুলোর সাথে, যৌথভাবে।
কয়লা শিল্পের এই ধর্মঘটের পক্ষে সমস্ত রাজনৈতিক দল, অন্যান্য সংগঠনের কাছেও আবেদন রেখেছে ধর্মঘটী ইউনিয়ন গুলো। এই ধর্মঘটের সাফল্যের জন্য সমস্ত বাম গণতান্ত্রিক সংগঠনকে এগিয়ে আসতে হবে।
- অতনু চক্রবর্তী
এই প্রথম কাশীপুরে এআইসিসিটিইউ অনুমোদিত “গান শেল ফ্যাক্টরি ওয়ার্কার (পার্মানেন্ট) ইউনিয়ন” প্রতিরক্ষা শিল্পে আসন্ন সারা ভারত ধর্মঘটে শ্রমিক কর্মচারীদের মধ্যে স্ট্রাইক ব্যালট সংঘটিত করার অধিকার পেল।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গত বছরের ডিসেম্বর মাসে পুণেতে এই শিল্পে সর্বভারতীয় চতুর্থ ফেডারেশন এনপিডিইএফ (ন্যাশনাল প্রগ্রেসিভ ডিফেন্স এমপ্লয়িজ ফেডারেশন)-এর অনুষ্ঠিত সম্মেলনে কাশীপুর ইউনিয়ন উল্লিখিত ফেডারেশনের সঙ্গে সাংগঠনিকভাবে যুক্ত হয়। ডিএমকে-র ট্রেড ইউনিয়ন এলপিএফ, ফরওয়ার্ড ব্লকের টিইউসিসি এবং এআইসিসিটিইউ — এই তিনটি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের সম্মিলিত নেতৃত্বের অধীনে এনপিডিএফ কাজ করে। সর্বভারতীয় এই ফেডারেশনকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক এখনো স্বীকৃতি দেয়নি। বর্তমানে বামেদের একটি ফেডারেশন, কংগ্রেসের ফেডারেশন ও বিএমএস-এর ফেডারেশন, এই তিনটিকেই মান্যতা দেয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের শীর্ষতম প্রশাসনিক সংস্থা অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি বোর্ড। এরাই দর কষাকষি করার অধিকার ভোগ করে আসছে।
প্রতিরক্ষা শিল্পে ঢালাও এফডিআই এবং করপোরেশন করার যে সিদ্ধান্ত মোদী সরকার নিয়েছে, তার বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত। এর বিরুদ্ধে গত বছর দু’দুবার ধর্মঘট হয়। সাময়িক ভাবে সরকার পিছিয়ে আসলেও এবার “আত্মনির্ভর’’ ভারতের প্রজেক্টে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে কর্পোরেশন করার সিদ্ধান্ত দ্রুততার সাথে কার্যকরী করতে চায়। এর বিরুদ্ধে ধর্মঘটের প্রস্তুতি চলছে। এনপিডিএফ স্বাধীনভাবে আসন্ন এই ধর্মঘটের প্রস্তুতি শুরু করার পর তিনটি স্বীকৃত ফেডারেশন এনপিডিএফ-কে যুক্ত সংগ্রামের প্রস্তাব দেয়। এই প্রেক্ষাপটে, এই প্রথম চারটি ফেডারেশনকে নিয়ে সর্বভারতীয় স্তরে যুক্ত সংগ্রাম কমিটি গড়ে উঠলেও এনপিডিএফ ভুক্ত ইউনিয়ন গুলোকে স্ট্রাইক ব্যালট নেওয়ার অধিকার দিতে সম্মত হয়নি ওএফবি। এ নিয়ে চাপ অব্যাহত রাখার পর, অবশেষে ওএফবি স্থানীয় স্তরের কারখানা কর্তৃপক্ষকে জানায় হয় এনপিডিএফ ভুক্ত ইউনিয়নকে স্ট্রাইক ব্যালট নেওয়ার অধিকার দিতে।
এই প্রথম কাশীপুরের এআইসিসিটিইউ-র ইউনিয়ন এই অধিকার পেল, যা এতদিন কেবলমাত্র স্বীকৃত ইউনিয়নগুলো ভোগ করে আসতো।
নিঃসন্দেহে, এটা গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি, যা আগামী আন্দোলনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
বেহালার সরশুনা বাজার মোড়ে অনলাইনের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করার তীব্র বিরোধিতায় বিক্ষোভ কর্মসূচী পালন করা হল। বক্তব্য রাখলেন, অতনু, অত্রি এবং আইসা কলকাতার জেলা কমিটির সভাপতি, অভিজিৎ।
আগামীদিনে, উপরে উল্লিখিত দাবিগুলি সরকার কতৃপক্ষ থেকে না মানা হলে, আইসা আরও দৃঢ় আন্দোলন সংগঠিত করবে৷ সবার শিক্ষা, সবার অধিকার।
২১ জুন রবিবার বালিতে অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন (আইসা) হাওড়া জেলার উদ্যোগে ব্লাড মেটস, শ্রমজীবী হাসপাতাল এবং বালি অ্যাথলেটিক ক্লাবের সহযোগিতায় বালি অ্যাথলেটিক ক্লাবে সংগঠিত হয় একটি রক্তদান শিবির। শিবিরের আগের দিন থেকে সংঘ পরিবার থেকে বালি জুড়ে একটা মেসেজ হোয়াটস অ্যাপে ছড়িয়ে দেওয়া হয় যে বলয় গ্রাস সূর্য গ্রহণে রক্ত দিলে নাকি করোনা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আমাদের পক্ষ থেকেও পাল্টা প্রচার চালানো হয় এই মতকে কাউন্টার করে। তুলে ধরা হয় গ্রহণ সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক তথ্যকে। শিবিরের দিন সকাল থেকেই তুমুল বৃষ্টি এবং সংঘ পরিবারের এই অপপ্রচার সত্ত্বেও ৪২ জন মানুষ রক্তদান করলেন সফলভাবে। যার একটা বড়ো অংশই তরুণ প্রজন্ম। এই শিবিরে উপস্থিত ছিলেন আইসা এবং সিপিআই(এমএল)-এর জেলা নেতৃত্ব।
মাস খানেক আগে সুইডেনের গোঠেনবারগ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভি-ডেম ইনস্টিটিউটের প্রকাশ করা বিশ্বে গণতন্ত্রের হালচাল সম্পর্কিত রিপোর্টে ভারতকে রাখা হয়েছে “স্বৈরতন্ত্রমুখী দেশসমূহের” বর্গতে। ওই অভিমতের কারণস্বরূপ বলা হয়েছে “প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকারের অধীনে সংবাদ মাধ্যম, নাগরিক সমাজ এবং বিরোধী পক্ষের পরিসর তীব্র মাত্রায় সংকুচিত হয়ে যাওয়া।” প্যারিস ভিত্তিক রিপোর্টারস উইদাউট ফ্রন্টিয়ার্স-এর ২০২০-র এপ্রিলের রিপোর্টে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার তালিকায় ভারতের স্থান ১৮০টা দেশের মধ্যে হয়েছে ১৪২ নম্বরে, যা ২০১৯-এর অবস্থানের দু-ধাপ নীচে। এত নীচে অবস্থানের কারণ হিসাবে রিপোর্টে সাংবাদিক-বিরোধী হিংসা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ক্ষয়, মিডিয়ার কণ্ঠরোধ বেড়ে চলা, মিডিয়ার ওপর সরকার ও রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণ কায়েমের চেষ্টা, ইত্যাদির উল্লেখ করা হয়েছে।
ওপরে যে দুই বিদেশী সংস্থার মূল্যায়নকে তুলে ধরা হল, তার সঙ্গে আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা হুবহু মিলে যায়। সাধারণভাবে মিডিয়ার টিকে থাকার জন্য তাদের সরকারী ও কর্পোরেট বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভর করতে হয়। এরপর সরকার অনুগত হওয়ার জন্য তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করলে ছাপা ও বৈদ্যুতিন উভয় সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীন কার্যকলাপে বিপর্যয় না এসে পারে না। হুমকি ও ভীতির পরিমণ্ডলকে উপেক্ষা করে যে সমস্ত সংবাদ প্রতিষ্ঠান ও সাংবাদিক নিজেদের বিকিয়ে না দিয়ে, সরকারী প্রসাদের প্রলোভনকে তুচ্ছ করে নিজেদের পেশার নৈতিকতার প্রতি বিশ্বস্ত থাকার চেষ্টা করেন, সরকারী রোষ তাদের শিক্ষা দিতে উদ্যত হয়। অনেকেরই ঠাঁই হয় জেলে, এফ আই আর-এর মুখে পড়তে হয় বহু সংখ্যককে, কাউকে-কাউকে আবার দুনিয়া থেকেই সরিয়ে দেওয়া হয়। গীতা সেসু ও ঊর্বশী সরকার তাঁদের “খুন করেও পার পেয়ে যাওয়া” শীর্ষক গবেষণামূলক রিপোর্টে জানিয়েছেন, ২০১৪ থেকে ২০১৯-এর মধ্যে সাংবাদিকদের ওপর অন্ততপক্ষে ১৯৮টা গুরুতর আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। এগুলোতে ৪০ জন সাংবাদিক নিহত হন যার মধ্যে কম করে ২১টার যোগ খুঁজে পাওয়া যায় সাংবাদিকতার দায়িত্ব পালনের মধ্যে। দিল্লীর রাইটস অ্যান্ড রিস্ক এনালিসিস গোষ্ঠীর সমীক্ষাও জানিয়েছে — এ বছরের ২৫ মার্চ (যে দিন মোদী লকডাউন নামান) থেকে ৩১ মে-র মধ্যে মহামারী সংক্রান্ত রিপোর্ট করার কারণে রাষ্ট্রের ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের হাতে অন্ততপক্ষে ৫৫ জন সাংবাদিকের ওপর নিপীড়নের খাঁড়া নেমে এসেছে। গ্ৰেপ্তার হওয়া ও এফআইআর-এর মুখে পড়া ছাড়াও অনেকের ওপর দৈহিক আক্রমণ নেমেছে, তাদের ভয়ানক পরিণতির হুমকি দেওয়া হয়েছে এবং এমনকি কিছু সম্পত্তিও নষ্ট করা হয়েছে। লকডাউন পর্বে মহামারী নিয়ন্ত্রণে সরকারী ব্যর্থতার সমালোচনা করার জন্যই যে রাষ্ট্রশক্তির ওই চোখ রাঙানি তা না বললেও চলবে। তবে শুধু কেন্দ্রীয় সরকারই নয়, বিজেপি ও অ-বিজেপি শাসিত বিভিন্ন রাজ্য সরকারও সাংবাদিক পীড়নে এগিয়ে আসতে দ্বিধা করেনি। রাইটস এন্ড রিস্ক-এর ডাইরেক্টর সুহাস চাকমা বলেছেন, “বিশ্বের মধ্যে ভারতই সাংবাদিকদের কাছে সবচেয় বিপজ্জনক স্থান হয়ে উঠেছে। মহামারী শুরু হওয়ার সময় থেকেই কেন্দ্রীয় সরকার কোভিড-১৯ সম্পর্কে ইচ্ছাকৃত বা অযথার্থ রিপোর্টের যুক্তিতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে দমন করতে উদ্যত হয়েছে।”
কলকাতায় এআইসিসিটিইউ দেশব্যাপী ন্যায় ও দাবি পক্ষ পালনের ডাক দিয়েছে। ১০ জুন থেকে ২৬ জুন চলবে এই প্রচার অভিযান। এর প্রেক্ষিতে কলকাতায় ২০ ও ২৩ তারিখ দু’টো কর্মসূচী নেওয়া হয়। ২০ তারিখে, প্রথম কর্মসূচীটি পালিত হয় বিরসুলহাট ও বিকালে যাদবপুর ৮বি বাস স্ট্যান্ডে।
সকালে বিরসুলহাট এলাকায় হকার ইউনিয়নের পক্ষ থেকে এই কর্মসূচীতে হকার ইউনিয়নের সদস্যদের মধ্যে ভালই উৎসাহ লক্ষ্য করা যায়। সমস্ত অসংগঠিত শ্রমিকদের আগামী ছমাস মাসিক দশ হাজার টাকা, প্রত্যেক শ্রমিককে বিনা মূল্যে রেশন, পুলিশী হয়রানি, হকারদের এককালীন ৫০ হাজার টাকা সুদ মুক্ত ঋণ প্রভৃতি দাবিতে বিক্ষোভ হয়। উপস্থিত ছিলেন হকার ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ, এআইসিসিটিইউর নেতা বাসুদেব বোস, প্রবীর দাস, অশোক মজুমদার প্রমুখ।
বিকালে যাদবপুর ৮বি বাস স্ট্যান্ডের বিক্ষোভ কর্মসূচীতে উপস্থিত ছিলেন নির্মাণ-রিক্সা চালক-পরিচারিকার কর্মীরা। মহিলা প্রায় ৮০ জনের মধ্যে মহিলা কর্মীদের উপস্থিতি ছিল প্রায় ১৬ জন। নির্মাণ শ্রমিকদের কল্যাণ তহবিলে শ্রমিকদের যে হকের টাকা গচ্ছিত রয়েছে, সেখান থেকে মাসে ১০,০০০ টাকা সহ আর্থিক ও খাদ্য সুরক্ষার দাবি করা হয়। প্রায় ঘন্টাখনেক ধরে সভা চলে। বক্তব্য রাখেন — অতনু চক্রবর্তী, বাসুদেব বসু, মমতা ঘোষ, চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরী, সুশান্ত দেবনাথ। সভা পরিচালনা করেন তরুণ সরকার।
২৩ জুন হাতিবাগান মোড়ে হোশিয়ারি-গ্যাস শ্রমিকদের নিয়ে সংগঠিত হয় প্রতিবাদী কর্মসূচীতে আইসার ছাত্ররাও অংশ নেন। সেখানে পোস্টার ব্যানার নিয়ে সুসজ্জিতভাবেই পালিত হয় এই কর্মসূচী।
২২ জুন ২০২০, রাজপুর সোনারপুর পৌরসভার চেয়ারপার্সন বোর্ড অফ এডমিনিস্ট্রেসনের কাছে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। দাবি করা হয় রানিয়াতে শ্রমিকদের খাদ্য সংকট চলছে, এই অঞ্চলে শ্রমিকদের টেমপোরারি কুপনের মাধ্যমে খাদ্য সরবরাহ করা হোক। ডেপুটেশন নিলেও ফুড কুপনের জন্য ফিলাপ করা ফর্ম নিতে তিনি অস্বীকার করেন ও বিডিও অফিসে যেতে বলেন। একদিন বাদে ফর্ম জমা দিতে আবার বোসপুকুরে বিডিও অফিসে যাওয়া হয়। বিডিও ফুড সাপ্লাই অফিসারের কাছে পাঠান। তিনি ফর্ম জমা দেওয়ার অদিকার অস্বীকার না করলেও ফর্মগুলি জমা না নিয়ে জনপ্রতিনিধির কাছে যেতে বলেন। আবার পৌরসভায় যাওয়া হয়। সেখানে স্থানীয় বিধায়ক ফিরদৌসি মহাশয়ার সাথে সাক্ষাৎ হয়। তিনি আবার লোকাল কাউন্সিলের সাথে ফোনে যোগাযোগ করার ব্যর্থ চেষ্টা করে কশোভ প্রকাশ করেন এবং তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে রানিয়া অঞ্চলেরই এক টিএমসি নেতার কাছে ফর্ম জমা করতে বলেন। সেই মতো আবার এলাকায় ফিরে গিয়ে ফর্মগুলি জমা দেওয়া হয়। আরও ফর্ম জমা দেওয়ার কথা হয়। মহেশতলা অঞ্চলে এক সাথিবন্ধু সুদেষ্ণা দত্ত বজবজের শেখপাড়ার গরিব মানুষদের জন্য এই ফর্ম ফিলাপের অভিজ্ঞতা বলছিলেন। সেখানে লোকাল কাউন্সিলর, পৌরসভার চেয়ারম্যান এবং ফুড সাপ্লাই অফিসারের কাছে গিয়ে বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন বলে জানান। তাঁকে বলা হয় যে এই ফর্মগুলি একমাত্র পরিযায়ি শ্রমিকদের জন্য। কিন্তু সরকারের নোটিফিকেশনে স্পষ্ট বলা আছে যে রেশন কার্ড না থাকা বা ডিজিটাল রেশন কার্ড না থাকা পরিবারগুলির জন্যও এই অধিকার প্রযোজ্য। যেদিন আমরা সোনারপুর পৌর সভায় ফর্ম জমা দেওয়ার জন্য এক অফিস থেকে আরেক অফিসের দরজায় ঘুরপাক খাচ্ছিলাম সেদিনই সর্বদলীয় বৈঠকের পর মুখ্যমন্ত্রী বলেন যে কেউ ত্রাণ বা রেশন না পেলে যেন থানায় অভিযোগ জমা করে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তাঁর দল ও প্রশাসন এই দুর্দিনে নিরন্ন ও অর্থহীন মানুষের পাশে সেভাবে দাঁড়াচ্ছে না।
রানিয়া অঞ্চলের সংগঠক শিখা নস্কর ও ঝর্ণা রায়দের সাথে টালিগঞ্জ লোকাল কমিটির কর্মীরা ছাড়াও এই সমগ্র প্রক্রিয়ায় রাজপুর সোনারপুর অঞ্চলের দায়িত্বশীল রাজ্য সদস্য নবকুমার বিশ্বাস ও অরিজিত মিত্র স্মারক কমিটির সদস্য সুজয় ভদ্র ছিলেন। পরবর্তীতে বিষয়টি নিয়ে প্রয়োজনমত এগনো হবে।
কয়েকদিন ধরেই সোশ্যাল মিডিয়া সহ বহু জায়গায় ঘুরছিল একটি ছবি। কলম উঁচিয়ে দৃপ্ত ভঙ্গিতে স্লোগানে মুখর একটি মেয়ে। জামিয়া মিলিয়ার রিসার্চ স্কলার সফুরা জারগর। ফেব্রুয়ারি মাসে হওয়া দিল্লি দাঙ্গায় ‘উস্কানি’ দেওয়ার অভিযোগে গত ১০ এপ্রিল সফুরা জারগরকে গ্রেফতার করে দিল্লি পুলিশ। তখন থেকেই তিহার জেলে বন্দি ছিলেন বর্তমানে পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা সফুরা জারগর। সিএএ-এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম মহিলা মুখ সফুরার বিরুদ্ধে ইউএপিএ আইনে মামলা দায়ের করা হয়। শাহীনবাগে প্রতিবাদীদের উপর গুলি চালানো কপিল গুজ্জর বিনা বাধায় জামিন পেলেও দিল্লির পাটিয়ালা হাউস কোর্টে তিনবার আবেদন করেও জামিন পাননি সফুরা। কিন্তু থামেনি লড়াই। সফুরা গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকেই লকডাউনের মধ্যেই বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল গোটা দেশ। হাতে পোস্টার নিয়ে, কখনও বা টুইটার হ্যান্ডেলে, কখনও বা সোশ্যাল মিডিয়ায়, আবার কখনও শারীরিক দূরত্ব বিধি মেনেই রাস্তায় নেমে প্রতিবাদে মুখর হয়েছে দেশজুড়ে। এর মধ্যেও অবশ্য সফুরার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কাটাছেঁড়া, ‘স্লাট শেমিং’, দেশদ্রোহী তকমা দিয়ে রগরগে প্রচার – সবটাই চালিয়ে গেছে বিজেপি ও আরএসএস। কিন্তু কোনো কিছুতেই দমেনি লড়াই। বরং আরও তীব্রভাবে উঠেছিল নিন্দার ঝড়। নিম্ন আদালতের জামিন খারিজের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে দিল্লি হাইকোর্টে আবারও জামিনের আবেদন করেছিলেন সফুরার আইনজীবী। সেই আবেদনেই গত ২১ তারিখ দিল্লি পুলিশের কাছ থেকে স্ট্যাটাস রিপোর্ট চেয়েছিল কোর্ট। তখন দিল্লি পুলিশের বক্তব্য ছিল ‘জঘন্য’ অপরাধে অভিযুক্ত কেউ গর্ভবতী হলেই যে জামিনে মুক্তি দিতে হবে এমন কোথাও লেখা নেই। তবে কেন জামিন পেয়েছিলেন কপিল গুজ্জরের মতো ব্যক্তিরা? সিএএ এনআরসির বিরুদ্ধে যুক্তিযুক্ত ও শান্তিপূর্ণভাবে প্রশ্ন তুললে তা ‘জঘন্য’ অপরাধ? – আবারও নিন্দায় সরব হয়েছিল দেশ। অবশেষে ২২ জুন দিল্লি পুলিশ জানায় তারা ‘মানবিক’ কারণেই আর বিরোধিতা করেননি সফুরার। তাই ১০,০০০ টাকার ব্যক্তিগত বন্ডের বিনিময়ে তাকে জামিন দিয়েছে আদালত। কিন্তু একদিন আগে সেই ‘মানবিকতা’ কোথায় ছিল, তাই নিয়েই উঠছে প্রশ্ন।
দেশজুড়ে সম্মিলিত প্রতিবাদের জেরে কোনোপ্রকারে জামিন মিললেও রয়েছে হাজার বিধিনিষেধ। দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতি রাজীব শাকধ নির্দেশ দিয়েছেন – তদন্তে বাধা পড়তে পারে, সেরকম কোনো কার্যকলাপ করা যাবে না, তার বিরুদ্ধে যে যে বিষয়ে তদন্ত চলছে (সিএএ, এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম মুখ হলেন সফুরা) সেরকম কোনও বিষয়ে অংশ নেওয়া যাবে না, অনুমতি ছাড়া দিল্লি ছাড়তে পারবেন না সফুরা এবং ১৫ দিনে অন্তত একবার তদন্তকারী অফিসারের সাথে ফোনে যোগাযোগ করতে হবে সফুরাকে। আপাতভাবে নির্বিষ মনে হলেও এই নির্দেশ যে আদপে তার রাজনৈতিক জীবনের উপর বেড়ি পরানো, তা স্পষ্টতই বোঝা যায়।
- সৌমি জানা
মানবতার লজ্জাউত্তরপ্রদেশ সরকারের পরিচালিত একটি শেল্টার হোমে কোয়ারান্টাইনে রাখা নাবালিকাদের চরম লাঞ্ছনা ও সম্ভাব্য যৌন উৎপীড়নের এক ভয়াবহ ঘটনা মিডিয়া রিপোর্টের মাধ্যমে আমাদের সামনে উঠে এসেছে। রিপোর্ট বলছে, এখানে একেকটি বেডে দুই এমনকি তিনজনকে গাদাগাদি করে রাখায় রোগ ছড়িয়ে পড়ে। টেস্ট করার পর দুদিনের মধ্যে ৫৭ জন নাবালিকার কোভিড-১৯ পজিটিভ ধরা পড়ে যার মধ্যে ৭ জন গর্ভবতী এবং একজন এইচআইভি পজিটিভ।
মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ শাসিত সরকারের একাধিক ব্যর্থতার ঘটনার সাথে আরও একটি যুক্ত হল। এই সরকারের আমলেই কয়েক বছর আগে ঐ রাজ্যেরই দেওরিয়া জেলার এক শেল্টার হোমে একই রকম ঘটনা আমরা দেখেছিলাম। সেই ঘটনার তদন্ত চলাকালীন যে সমস্ত তথ্য উঠে আসে তা থেকে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে নির্দিষ্ট সময় অন্তর রাজ্যের সমস্ত শেল্টারগুলির পর্যবেক্ষণ করা হবে এবং তার রিপোর্টিং করা হবে। কিন্তু সরকার এই নিয়মগুলোকে যথাযথ লাগু করার ক্ষেত্রে কড়া পদক্ষেপ তো অনেক দূরের কথা, বরং অত্যন্ত সচেতনভাবে সমস্ত কিছু এড়িয়ে যায়। যার ফলে কানপুর হোম শেল্টারের মতো ঘটনা এখনও আমাদের শুনতে হয়।
উত্তর প্রদেশ জুড়ে শেল্টার হোমগুলোতে নাবালিকাদের উপর দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা বিভিন্ন অমানবিক, নির্মম অত্যাচার, দুর্ব্যবহার এবং সরকারের উদাসীনতা ও দোষীদের বিরূদ্ধে কড়া পদক্ষেপ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে গাফিলতিকে তীব্র নিন্দা জানায়। বিভিন্ন শেল্টারগুলিতে যে একের পর এক যৌন নিগ্রহের ঘটনা অবিলম্বে রুখতে দ্রুত এই ঘটনার স্বতন্ত্র ও নিরপেক্ষ তদন্ত করে দোষীদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে। এই ঘটনায় কেন্দ্রীয় মহিলা কমিশনের অবিলম্বে হস্তক্ষেপ চাই।
প্রতিবেদন: সুমন ঘোষ
৯ জুন তিনসুকিয়া জেলার বাঘজান তৈলখাদে আগুন লেগেছে। ১০ জুন আমরা ঘটনাস্থল অভিমুখে মোটর সাইকেলে রাজগড় থেকে যাত্রা করলাম। গুইজান পুলিশ ফাঁড়ির কাছাকাছি চলে এসেছি .... মোটর সাইকেলে থাকা সত্ত্বেও বড়ো বড়ো লোহার পাইপ ফেলার শব্দ শুনতে পেলাম। আমরা প্রথমে ধরতেই পারিনি, শব্দটা কিসের! ধীরে ধীরে বেশ বড়ো আগুনের কুন্ডলী দৃষ্টিগোচর হলো। শব্দ আরো বেশি তীব্র। আমরা আরো কাছে যাচ্ছি। যতো কাছে, ততো তীব্র! নতুন গাঁও-এর কাছে মাগুরি মটাপুং বিলের ওপরের পাকা সেতু পার হয়ে আমরা দেখেছি বিজেপি সরকারের দূষণ মুক্ত আসাম কী তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করছে! সেই তীব্রতা আগুনের শব্দ আর উত্তাপের থেকেও বেশি। আমরা যখন অগ্নিকুন্ডের প্রায় ২০০ মিটারের কাছাকাছি গিয়েছিলাম অঞ্চলটির তাপমান স্বাভাবিক ছিলো না। সেখানে বেশিক্ষণ থাকাটা সম্ভব নয়। আগের দিন কিরকম অবস্থা হয়েছিলো যার ফলে দুর্লভ গগৈ ও তিখেশ্বর গোহাঁইকে প্রাণ দিতে হয়েছিলো! এঁরা ছিলেন অয়েল ইণ্ডিয়ার শ্রমিক। ওঁদের কেন শহীদের মর্যাদা দেওয়া হবে না?
বাঘজান তৈলখাদে আপনাকে ডুমডুমা হয়ে যেতে হবে। অয়েল ইণ্ডিয়া নিজের সুবিধার জন্যে মাগুরি বিলের কাছে নতুন গাঁও থেকে বিলের ওপর দিয়ে সেতু বানিয়ে একটা পাকা রাস্তা নির্মাণ করে নিয়েছে। আমরা বাঘজান খাদের একটি ছোটো অংশই এই দিক থেকে দেখতে পাই। ২৭ মে ২০২০ তারিখ বাঘজানের খাদ থেকে গ্যাস নির্গমন শুরু হয়েছিলো। নতুন গাঁও-এর মানুষেরা আন্দোলন শুরু করলো ডিব্রুশৈখোয়া রক্ষা ও খাদ বন্ধের দাবিতে। একটি রাষ্ট্রীয় উদ্যানের সীমানার খুব কাছে যেকোনো ধরনের খননকার্য বেআইনি। উল্লেখযোগ্য যে, এর আগে কৃষক মুক্তি সংগ্রাম সমিতির পক্ষ থেকে সেসিমিক সার্ভের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা হয়েছিলো।
গ্যাস নির্গমনের সপ্তম দিনে নতুন গাঁওয়ের আন্দোলনকারীদের স্থানীয় প্রশাসনের তরফ থেকে দূরে গিয়ে থাকতে বলা হলো কারণ গ্যাস নির্গমনের ফলে মানুষের শ্বাস প্রশ্বাসের কষ্ট, বমি, মাথা ব্যথা ইত্যাদি হচ্ছে। কিন্তু দূরে যেতে হবে নিজেদের উদ্যোগে। তার সাথে এটাও বলা হলো যে প্রশাসনের তরফ থেকে রেশনের ব্যবস্থা করা হবে ও তিনসুকিয়া জেলার ডেপুটি কমিশনারের সাথে দাবি সম্পর্কে আলোচনা করা হবে। গ্রামের বেশিরভাগ বাড়ির ছোটো ছোটো ছেলে মেয়েরা আজও আত্মীয়দের বাড়িতে আছে। অন্যান্য মানুষেরা বেশির ভাগ নিজেদের বানানো শিবির থেকে ১৪ দিন পরে আর গন্ধ না থাকায় ফিরে এসেছে। ১৪ দিনের মধ্যে একদিনের জন্যেও সরকার বা প্রশাসন রেশনের ব্যবস্থা করেনি। প্রশাসন যেদিন আলোচনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো সেইদিন আগুন লাগার ফলে আলোচনাও হলো না। প্রশাসনের তরফ থেকে লোকজনদের মাত্র একটি করে সাধারণ মাস্ক সরবরাহ করা হয়েছিলো। পোষ্য জীবজন্তুর ক্ষেত্রেও একই ব্যবহার। এখন আগুন লাগার পরের দিন অর্থাৎ ১০ জুন সরকার থেকে ১৪ কেজি করে “চাপর” (জন্তুর খাদ্য) দেওয়া হয়। নিতুমনি চুতিয়া, দীপাঞ্জলী ঘরফলীয়া, হরেন গগৈ দের কাছ থেকে কথাগুলো শুনে অবাক হলাম।
আমরা খাদের দিকে এগিয়ে গেলাম। সবুজ ডিব্রুশৈখোয়ার সুন্দর ঘাস জ্বলে গেছে। খাদের আশেপাশের ৫০০ মিটারের বেশি অঞ্চলের বন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। প্রায় ২ কিলোমিটার দূরের গাছের পাতা লাল হয়ে গেছে। আমরা যখন খাদের কাছে গেলাম, কোনো সুরক্ষা কর্মী ছিলো না। জন এনার্জি বা অয়েলেরও কোনো লোককে দেখতে পেলাম না। ঘুরে আসার সময় তিনজন পুলিশ কনস্টেবলের সাথে দেখা হলো। বললো ওঁদের আইসি কাল কোনোভাবে বেঁচে ফিরেছে। গত ২৭ মে থেকে ওঁরা ওখানে সুরক্ষার জন্য নিয়োজিত আছেন। গ্যাসের দুর্গন্ধ কিন্তু মাস্ক অথবা আগুন নেভানোর আধুনিক সরঞ্জাম কোনো কিছুই নেই। বাঘজানে মোট ২০টি খাদ আছে। ডিব্ৰুগড় লেপেটকাটার বিসিপিএল ও আপার আসামের প্রত্যেকটি উদ্যোগ মূলত চা ফ্যাক্টরিকে বাঘজান থেকেই গ্যাস সরবরাহ করে থাকে। অয়েলের নিজস্ব প্রতিবেদন অনুযায়ী বাঘজান বন্ধ হয়ে গেলে বিসিপিএল বন্ধ হয়ে যাবে।
নিরন্ত গোহাঁয়ের সাথে দেখা করলাম। ঘটনাটা ঘটার সময় থেকে তিনি দিন রাত সেতুর ওপরেই আছেন। তিনি বললেন অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে, ডলফিন শেষ হয়ে যাবে। যে ডলফিনকে আগে নাকি বিরিনা পাতার তীর দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। ডলফিন এতটাই স্পর্শকাতর যে একফোঁটা তেল গায়ে পড়লেও মৃত্যু হতে পারে। মাগুরী বিলে অজগর, কচ্ছপ, বহু প্রজাতির মাছ, বিশাল হাওর আছে। তাঁর মতে এই ঘটনার ফলে ব্রহ্মপুত্রের নীচের অংশে ব্যাপক ক্ষতি হবে। নতুন গাঁও-এর ৪ জন লোকের এই সময়ে মৃত্যু হয়েছে। তিনি বলেন এই মৃত্যুর পিছনে গ্যাস নির্গমনের প্রভাব আছে। গোঁহাই একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বললেন, এতদিন অয়েল এখানে কাজ করছে কিন্তু দুর্যোগ আসলে লোকজনেরা কী করবে কী করবে না ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে তাদের সচেতন করার জন্য গত ১৮ বছরে কিছুই করেনি। তিনি বলেন আমাদের গ্রামের বেশির ভাগ লোকের জমির পাট্টা নেই, অন্য রাজ্য থেকে আসা লোকেদের যে যুদ্ধকালীন তৎপরতার সাথে পাট্টা দেওয়া হয়, স্থানীয় লোকের ক্ষেত্রে তার ঠিক উল্টোটা। ডিব্রুশৈখোয়া রক্ষা করার জন্য গোহাঁইরা প্রচুর আবেদন নিবেদন করেছিলেন কিন্তু সমস্ত আবেদন নস্যাৎ করে দিয়ে গুজরাটের জন এনার্জি, যার কি পারদর্শিতা আছে কেউই জানে না (লোকের মুখ থেকে শোনা গেছে যে, তারা হয় লোহার বা কাপড়ের ব্যবসায়ী ছিল) সেই ধরনের একটা কোম্পানিকে খননের ঠিকা দেওয়া হলো। বাঘজানের অগ্নিকাণ্ডের সমগ্র ঘটনা সম্পর্কে তিনি (গোহাঁই) ইতিমধ্যেই গৌহাটি হাই কোর্টে একটি জনস্বার্থ জনিত আবেদন দাখিল করেছেন। তিনি বলেন এতে কোনো সন্দেহ নেই যে অয়েল এবং সরকার সময়মতো যদি কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতো তাহলে এই ধরনের ঘটনা সংঘটিত হতো না। চূড়ান্ত গাফিলতি ও উদাসীন মনোভাবের ফলেই আজ মানুষ ও প্রকৃতি তথা অবলা জীব জন্তুকে তার মূল্য দিতে হলো। নিরন্ত গোহাঁই এবং বৃদ্ধ হরেন গগৈ ও অন্যান্যদের সাথে কথা বলে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। আগুন তখনও জ্বলছে। সমগ্র অঞ্চল লাল। হ্যাঁ ... এই আগুন জ্বলছে সবার মনে প্রাণে। এই আগুনই নতুনের সংবাদ বয়ে আনবে। আমরা সবাই সেই আশাতেই নতুন গাঁও থেকে বিদায় নিলাম।
১১ জুন রাতে আমরা শহীদ গঙ্গারাম কোলের বাড়িতে থেকে সকালেই ডুমডুমা হয়ে বাঘজানের দিকে রওনা হলাম। সকাল থেকেই মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যেই আমরা বাঘজান পৌঁছালাম। জাতীয় বিদ্যালয়ে বাঘজান মিলন জ্যোতি সংঘের কর্মকর্তাদের সাথে দেখা হলো। আমাদের আগেই লোপামুদ্রা সেখানে হাজির। প্রবীন বরা, প্রাঞ্জল গগৈ, জিন্টু হাজরিকা, মনোজ হাজরিকা ও হেমন্ত মরান সহ অনেকে প্রথম থেকেই খননের বিরোধিতা করছিলেন যুব সংঘের ব্যানার সামনে রেখে। ওঁরা বললেন : ২০০২ সাল থেকে খননের কাজ শুরু হয়েছে। আমরা প্রতিবাদ করলাম। বহু মানুষের জেল হলো। ২০০২ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত চলল পুলিশ সেনার নির্যাতন। যে কোনো সময়েই থানা থেকে ডেকে পাঠায়। রাত ১টা ২টোর সময় সেনাবাহিনী এসে স্থানীয় ক্যাম্পে উঠিয়ে নিয়ে যায়। আন্দোলনকারীরা আলফার সাথে জড়িত আছে এই অভিযোগে নানান নির্যাতন চালিয়েছিলো। মনোজ হাজরিকা জানালেন যে তাঁর বাবা সরকারী গাঁওবুড়া ছিলেন। ছেলে আন্দোলন করছিলো বলে ওঁকে একবছর সাসপেন্ড করা হয়েছিলো। তিনি বললেন ভয়, হুমকি এবং লোভ সমস্ত প্রয়োগ করে খনন কাজ চলল। এবং খননের ১০ বছর পরে ২০১২ সালে প্রথম গণ হিয়ারিং বাঘজান বাগানের খেলার মাঠে হয়েছিলো। ওঁরা তখনও প্রতিবাদ করেছিলেন, কিন্তু কথা শুনলো না। যুব সংঘের অন্যান্যদের মতে এই ঘটনার জন্য মূলত দায়ী জন এনার্জি। তাড়াহুড়ো করে সিমেন্টিং করার ফলে এই রকম ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। গত ৬ বছরে এই অঞ্চলে বিষাক্ত কীটপতঙ্গ বৃদ্ধি পেয়েছে। ৬ বছরের বেশি হয়ে গেলো গ্রামে গাছের পোকামাকড় খেতে আগের মতো পাখিরা আর আসে না, প্রচন্ড শব্দের জন্য। অঞ্চলটির ৮০% লোক মাছ ধরে সংসার চালায়। তাঁরা বললেন এখন মাছের ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোনোর সময়েই এই ঘটনা ঘটলো। তাঁরা এর ক্ষতিপূরণ দাবি করার সাথে সাথে মাগুরি বিলের জল পরিস্কার করারও দাবি জানায়। বাঘজানের ব্রহ্মপুত্রের কাছের গ্রামটিতে বর্ষার জল যাতে ঢুকতে না পারে তার জন্য একটি ৫০ মিটারের বাঁধ আছে। ভরা বর্ষাতেও বাঁধের ৮ ফুট জলের ওপরে থাকে। এখন প্রতিদিন ভাইব্রেশন হওয়ার ফলে বাঁধ ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা গিয়েছে। আর যদি এই রকম হয়, তাহলে বাঘজান জলের নীচে তলিয়ে যাবে। তাঁদের মতে ১০০ বছর ওঁরা পিছিয়ে গেলেন। ওখানকার লোকেরা নিজেদের বাড়িতে সুপুরি, চা, গোলমরিচ এবং আরো বিভিন্ন গাছ লাগিয়ে খুব সুন্দর বাগান তৈরি করেছিলেন। আমরা কথা বলে জানতে পারলাম যে ৫০টা বাড়ি ও বাগান জ্বলে ছাই হয়ে গেছে। অনুমান করা যায় এক একটা পরিবারের প্রায় ২০ লাখ টাকার সম্পত্তি নষ্ট হয়েছে। পুড়ে যাওয়া জমিতে এখন কিছুই হবে না। সুতরাং ওঁরা মাটির বদলে মাটি ও ১০০ বছরের ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন। ২৭ তারিখ গ্যাস বেরোনোর দিনেই প্রায় ২০০০ এরও বেশি মানুষকে স্থানীয় বাঘজান দীঘল তরং এম ই স্কুলে রাখা হয়েছিল। গ্যাস বেরোনো খাদটির ৫০০ মিটার ভেতরে যাদের বাড়ি তাদের নিজের ঘর বাড়ি, পোষ্য জীবজন্তু দেখাশোনা করতে যাওয়ার সময় সই করে যেতে হয়েছিল। যদি কিছু ঘটে তার জন্য তিনি নিজে দায়ী থাকবেন। আগুন লাগার দিন এদের আশ্রয় শিবির থেকে করদৈগুড়ি আশ্রয় শিবিরে নিয়ে যাওয়া হলো। যুব সংঘের সদস্যরা জানান নতুন করে ৭টা খাদ খননের যে অনুমতি লকডাউনের সময় বিজেপি সরকার দিয়েছে, সেই সম্পর্কে ১২ মার্চ ২০২০ তারিখে বাঘজান বাগানের খেলার মাঠে গণ হিয়ারিং হয়েছিল। তখনও প্রতিবাদ করা হয়েছিলো, কিন্তু ওরা কোনো কথারই গুরত্ব দিলো না।
আমরা যুব সংঘের সদস্যদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আশ্রয় শিবিরগুলোতে গেলাম। যাওয়ার পথে দেখলাম দৈত্যাকার পাইপ গুলো রাস্তার ধারে পরে আছে গ্যাস নেওয়ার জন্য। বাঘজানের মোট ২০ টা খাদ গ্রামের মধ্যে আছে। আগুন লাগার দিন বাঘজানের সাথে দীঘল দলং ও কলিয়াপানী অঞ্চলটির মোট ৭ হাজার লোককে করদৈগুড়ি, বান্দরখাটি, জকাইচুক ও দিয়ামুলী আশ্রয় শিবিরে রাখা হয়েছে। বান্দরখাটি আশ্রয় শিবিরের লোকেরা জানালেন যে বাড়ি থেকে ওনাদের নিজেদের আসতে হয়েছে। কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থাই করে দেয়নি। করদৈগুড়ি আশ্রয় শিবিরে মূলত যে ৫০টা বাড়ি পুড়ে ছারখার হয়ে গেলো তাদের সাথে গ্রামের অন্যান্য লোকেরাও আশ্রয় নিয়েছে।
বর্ণালী মরানের সাথে দেখা করলাম। খাদের কাছের প্রথম ঘরটাই ওঁদের। হাতে দেখলাম লাল লাল ফোঁড়ার মতো বেরিয়েছে। ৯ তারিখ থেকে শিবিরে মশারি ছাড়াই আছে মশার কামড় খেয়ে। মরানের ঘরের সাথে বাঁশ, সুপারি, চা, পোষা জীব জন্তু সমস্ত শেষ। ২০১২ সালেও ওঁরা পাইপ লাইন বসানোর বিরোধিতা করেছিলেন। তখনও আগের মতোই চলেছিলো পুলিশের নির্যাতন। তিন জনের জেল হয়েছিলো। আশ্রয় শিবিরে সাক্ষাৎ হওয়া যুব সংঘের একজন সদস্য বললেন উদ্যোগমন্ত্রী চন্দ্রমোহন পাটোয়ারীর মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে। কাল আমরা অনেক প্রশ্ন করলাম কিন্তু উত্তর দিলেন না। উল্লেখযোগ্য যে চন্দ্রমোহন পাটোয়ারী কাল করদৈগুড়ি শিবিরে মানুষের ক্ষোভ থেকে কোনোরকমে বেঁচে গেছে। শিবির পরিদর্শনে গিয়ে চন্দ্রমোহন বাবু বলেছিলেন রাশিয়া, ইরান, ত্রিপুরায় বাঘজানের থেকে বেশি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। জনগন একথার প্রতিবাদ করে বলে, “রাশিয়ার কথা না বলে বাঘজানের কথা বলুন। আপনি রাশিয়ার মন্ত্রী না আসামের? আমাদের তো সব শেষ হয়ে গেলো, তার ক্ষতিপূরণের কী হবে?” এই প্রশ্নের উত্তর তিনি দিতে পারলেন না আর কোনো ঘোষণাও করতে পারলেন না। অয়েল যা বলেছিলো সেগুলোই বললেন, আসাম সরকার কোনো সাহায্য, ক্ষতিপূরনের প্যাকেজ ঘোষণা করতে পারেনি। ঠিক এই ভাবেই মন্ত্রী যোগেন মোহনও অয়েলের গ্যাসের জন্য মাগুরি মটাপুং বিলের নদী ডলফিন, মাছ, কচ্ছপ মরেনি ইত্যাদি হালকা কথা বলে অয়েলকে রক্ষণাবেক্ষণ দিয়েছিল। মানুষ তখনও প্রতিবাদ করেছিল। জানা যায় দুর্লভ গগৈ এর পরিবারকে ১ কোটি ও তিখেশ্বর গগৈ এর পরিবারকে ৬০ লাখ টাকা দেওয়ার কথাটাও মিথ্যা প্রচার। এটা নিহত দুই ব্যক্তির অয়েলে চাকরি করা কালীন প্রাপ্য টাকা (নিহত হয়েছে বলে অবসরের সময় পর্যন্ত মাইনে পাবে) ছাড়া অন্য কিছু নয়।
অপরদিকে, খুবই দুঃখজনক যে, মহিলাদের স্নানের কোনো ব্যাবস্থা আশ্রয় শিবিরগুলিতে নেই। কোনো কোনো শিবিরে মশারির ব্যাবস্থা আছে, কোনো কোনো শিবিরে নেই। ভেতরের অবস্থা বাসযোগ্য নয়। বোঁটকা গন্ধ। দিয়ামুলী শিবিরে দেখলাম ওখানকার লোকেরা চন্দ্রমোহন পাটোয়ারীর প্রতিকৃতি পোড়ানোর প্রোগ্রাম নিয়েছে। আমাদের সঙ্গে মানস তামুলী ছিলেন। উনি জানালেন CSR-এর নামে লাভের ২% খরচ করার কথা কিন্তু ২০১২-১৩ বর্ষে অয়েল খরচ করেছে ১.৪১%। অয়েল এই টাকা রাস্তা তৈরির খরচের মধ্যে দেখায়। কিন্তু সেই রাস্তা গুলোর বেশির ভাগ তাদের খাদের রাস্তা। একফোঁটা তেলও উৎপাদন করে না যে দিল্লীর করপোরেট অফিস, তাদের দেওয়া হয় ৫ কোটির থেকেও বেশি টাকা।
২০০২ ও ২০২০ দুটো সময়েই কেন্দ্রে বিজেপি সরকার। প্রথম অবস্থায় সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক, মাফিয়া কায়দায় খনন করা হলো। আর এখনও দুর্যোগের বলি হওয়ার জন্য মানুষকে শুধুমাত্র বাধ্য করাই নয় মৃত্যু মুখে ঠেলে দেওয়া হলো।
আমরা দাবি জানাই
গত ১৮ বছর ধরে বাঘজানের বুক থকে যে সম্পদ আমাদের সরকার আহরণ করে লাভ করেছে তার তুলনায় এই দাবিগুলি আর্থিক দিক দিয়ে নগণ্য। আশ্চর্যজনক ভাবে বাঘজানের গ্যাস নির্গমন হওয়ার সময়ে রাজ্যের বিজেপি সরকারের বহু মন্ত্রী, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মহাশয়, উপর আসামের বিভিন্ন জায়গা পরিদর্শন করছিল। কিন্তু বাঘজানের কাকুতি মিনতি একবারও শোনার সময় ওঁদের হলো না।
আশ্রয় শিবিরগুলো পরিদর্শন করে ফেরার সময় কালো মেঘ চিড়ে সূর্য বেরোলো ... পরিস্কার আকাশ ... দূরের পাহাড়গুলো সূর্যের আলোয় ঝলমল করে উঠেছিলো। আমাদের চোখে বারবার ভেসে আসছিলো ক্ষোভ বেদনায় লাল হয়ে যাওয়া আক্রান্ত মানুষের মুখগুলো। ভাবলাম বাঘজানের মানুষগুলোর মন প্রস্ফুটিত ও ঝলমলে করে তোলার জন্য আমাদের সরকার সত্যিকারের কোনো পদক্ষেপ নেবে কিনা। যদি না নেয় বাঘজানের মানুষের বুকে জ্বলা আগুন সরকারকেও রেহাই দেবে না। আজ সমগ্র দেশকে বাঘজানের পক্ষে দাঁড়াতে হবে।
- বলিন্দ্র শইকীয়া, সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, সিপিআই(এমএল)
(অসমীয়া থেকে বাংলায় অনুবাদ: মৈত্রেয়ী বাগচী)
৩০ জুন হুল দিবস। ১৮৫৫ সালের এই আদিবাসী কৃষক জাগরণ ব্রিটিশ শাসনের জমিদারীতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছিল। এর দুবছর পর ১৮৫৭-তে আরও ব্যাপক বিস্তারে দেশজুড়ে ঘটা মহাবিদ্রোহের প্রথম স্ফুলিঙ্গ ছিল হুল। মহাবিদ্রোহ পরবর্তী ব্রিটিশ শাসন পর্বে প্রথম তীব্র গণবিদ্রোহ ছিল বিরসা মুণ্ডার নেতৃত্বে উলগুলান। পরবর্তীতে, স্বাধীন ভারতেও, জমির ওপর আদিবাসী ও কৃষকের অধিকারের প্রশ্নকে কেন্দ্র করে প্রান্তিক জনতার অভ্যুত্থান ঘটে নকশালবাড়িতে, যেখানে দুজন শিশু সহ ১১ জন আদিবাসী মহিলা প্রথম দিনে শহীদ হন। ১৮৫৫-র হুলের নেতৃবৃন্দ— মুর্মু পরিবারের চার ভাই ও দুই বোন সহ পনের হাজারের ওপর মানুষ শহীদ হন।
এবছর ৩০ জুন যখন হুল দিবস পালিত হবে ঠিক তখনই কেন্দ্রের বিজেপি সরকার একটি নতুন বিধি পাশ করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। গত ১২ মার্চ এই বিধির খসড়া প্রস্তাব সামনে এনেছিল সরকার। সে বিষয়ে জনমত নেওয়ার শেষ দিন হিসেবে ৩০ জুনকেই নির্ধারিত করেছে। এই বিধি ভারতে ‘এনভায়রনমেন্টাল ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট’ ব্যবস্থা তুলে দেবে। এর অর্থ হল, পরিবেশের ওপর কী প্রভাব পড়তে পারে তার কোনোরকম বাছবিচার ছাড়াই কর্পোরেট কোম্পানিগুলি তাদের বিভিন্ন প্রকল্প চালাতে পারবে। অর্থাৎ জমি নেবে, অরণ্য ধ্বংস করবে, নদী বেঁধে দেবে, যেখানে খুশি শিল্পজাত বর্জ্য ডাম্প করবে - পরিবেশ প্রকৃতির কথা ভাবতে হবে না। মোদি সরকার ইতিমধ্যেই একচল্লিশটি কয়লা ভাণ্ডার নিলাম করছে যা আবার বহু অরণ্যগ্রামের জনজীবন ধ্বংস করবে। বিভিন্ন সরকারী বিজ্ঞপ্তি জারি করে আদিবাসীদের অরণ্যের অধিকার আইনও বহুলাংশে খর্ব করে দিয়েছে। সংরক্ষণ ব্যবস্থার সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার তোড়জোর চালাচ্ছে। জমি-অরণ্য-জল-বাতাস সবকিছু ছিনিয়ে নিতে চলেছে মোদি সরকার। পরিবেশের প্রশ্ন নাকচ হয়ে যাবে কি না সে বিষয়ে মতামত দেওয়ার শেষ দিন আপাতত ৩০ জুন! ওইদিন মোদি সরকার আমাদের শ্বাস নেওয়ার অধিকারটাও কেড়ে নিতে চলেছে।
সিদো কানু চাঁদ ভৈর ফুলো ও ঝানো সহ হাজারো শহীদের হুল থেকে শুরু করে অগণিত স্বাধীনতা সংগ্রামীর প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীন ভারতের সংবিধানে যে অধিকার সাধারণ মানুষের জন্য লিপিবদ্ধ হয়েছিল, আজ বিজেপির শাসনে তা দ্রুত অকার্যকর করে দেওয়া হচ্ছে। হুল ও উলগুলানের মাধ্যমে অর্জিত এসপিটিএ ও সিএনটিএ’র রক্ষাকবচও ঝাড়খণ্ডের বিজেপি সরকার নাকচ করে দেওয়ার চেষ্টা করে। সাম্প্রতিক সময়ে এনআরসি-এনপিআর-সিএএ বিরোধিতাকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে সংবিধান রক্ষার আন্দোলন দেখেছি আমরা। তার ঠিক আগে আমাদের আদিবাসী সমাজের মধ্যে থেকে এক অভিনব আন্দোলন উঠে আসে। ঝাড়খণ্ডে শত শত গ্রামে তা ছড়িয়ে পড়ে। সংবিধানে বর্ণিত অধিকারগুলি বড় বড় পাথরে খোদাই করে গ্রামে গ্রামে স্থাপন করার এই আন্দোলন পাথালগাঢ়ি আন্দোলন নামে পরিচিত হয়। ঝাড়খণ্ডের তৎকালীন বিজেপি সরকার পাথালগাঢ়ি আন্দোলনের ২১ হাজার নেতাকর্মীর ওপর ইউএপিএ ধারায় মামলা দায়ের করে। রাজ্যের ক্ষমতা থেকে বিজেপি অপসারিত হওয়ার পরই একমাত্র এই মামলাগুলি প্রত্যাহৃত হয়।
আদিবাসী জনতা নিজেদের জীবনযাত্রা রক্ষায় সংগঠিত হয়ে প্রতিরোধ করলেই এই রাষ্ট্র তাদের ‘মাওবাদী/নকশাল জঙ্গী’ তকমা দিয়ে জেলে পোরে, সিআরপিএফ নামিয়ে চরম অত্যাচার চালায়। গণতান্ত্রিক ও সামাজিক আন্দোলনের কর্মীরা আদিবাসীদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালে তাঁদের ‘আর্বান নকশাল’ তকমা দিয়ে জেলে পোরা হয়। লকডাউন পর্বেও পুলিশী নৃশংসতার সবচেয়ে বেশি শিকার হয়েছে আদিবাসীরা। ভারতের তথাকথিত উন্নয়ন প্রকল্পগুলিতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় উদ্বাস্তু হয়ে শহরের আসপাশে ছিন্নমূল জীবনযাপনে বাধ্য হয়েছিলেন যারা, সেই আদিবাসীরা এই দীর্ঘ লকডাউনে আরও একবার সর্বাধিক বিপর্যস্ত। বাড়ি ফেরার পথে পুলিশের নির্মম প্রহারে প্রাণ হারানো ৬৫ বছরের বৃদ্ধ টিবু মেড়া বা হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির কাছে পৌঁছেও তৃষ্ণায় ক্লান্তিতে মৃত্যুমুখে ঢলে পড়া ১২ বছর বয়সী কিশোরী জামালো মাড়কম এরকম দুটি নাম।
হুল দিবস পালন তাই নতুনতর তাৎপর্য নিয়ে ফিরে ফিরে আসে। আমাদের ভূমি জমি জল অরণ্য বাতাস প্রকৃতি রক্ষার লড়াই হোক বা অধিকার ও সংবিধান বাঁচানোর লড়াই-প্রতিরোধের সামনের সারিতে বিছনের মতো ছড়িয়ে আছে হুল মাহা। ছত্তিশগড় ঝাড়খণ্ডের বৃহৎ ক্ষেত্রগুলি থেকে শুরু করে রায়গঞ্জের বিদ্রোহ বা হুগলির ‘আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চ’ পরিচালিত ছোটো পরিসরের ধারাবাহিক সংগ্রামেও আমরা তা দেখতে পাই।
হুল মাহার আশু আহ্বান
- হুল জোহার, সিপিআই(এমএল) রাজ্য কমিটি
ভয়াবহ আমফান ঘুর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত দঃ ২৪ পরগণা, উঃ ২৪ পরগণা, হাওড়া, পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ মেদিনীপুর, কলকাতা সহ রাজ্যের বেশ কয়েকটি জেলার মানুষ বিপর্যস্ত। একদিকে প্রায় শতাধিক মানুষের প্রাণহানি, প্রচুর গবাদিপশুর জীবনহানি, ধান, পাট, সব্জি, তিল সহ নানাবিধ ফল ও ফুল চাষ, পোল্ট্রি ফার্মের বিপুল ক্ষতি হয়েছে। লক্ষাধিক মানুষের ঘরবাড়ি ধুলিসাৎ হয়ে গেছে। অপর দিকে বিধ্বস্ত অঞ্চলগুলিতে মানুষের বেঁচে থাকার ন্যূনতম সুযোগসুবিধা না থাকা – সব মিলিয়ে এক ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। এই বিশাল বিপর্যয়কে জাতীয় বিপর্যয় হিসাবে ঘোষণা করতে হবে – বাংলার মানুষের এই ন্যায্য দাবিকে কেন্দ্র সরকার গুরুত্ব দিতে চাইছে না। এ সব নিয়ে এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের জন্য আমরা বিগত মে মাসের ৪ তারিখে চিঠি দিয়েছিলাম। কিন্তু আজ পর্যন্ত তার কোনো উত্তর আমরা পাইনি। দেখা যাচ্ছে এ রাজ্যের কৃষক ও কৃষিজীবী মানুষেরা ক্ষতিপুরণ হিসাবে কোনো কিছুই পেলো না। ক্ষতিগ্রস্ত ঘরের টাকা নিয়ে চলছে বিপুল দুর্নীতি ও দলবাজি।
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার কৃষিপণ্য বাণিজ্য অর্ডিন্যান্স জারি করেছে যাতে স্বাধীনতার পর কৃষি ও কৃষকদের এক নজিরবিহীন সংকটের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। সারা দেশের কৃষকদের দাবিকে মেনে নিয়ে ফসলের উৎপাদন খরচের দেড়গুন দাম সুনিশ্চিত করা হলো না। ঋণমুক্তির জন্য নেওয়া হলো না কোনো পদক্ষেপ। লকডাউন ক্ষতিপূরণের কোনো ঘোষণাই নেই। শস্যবীমা বা নানারকম কৃষক কল্যাণ প্রকল্পগুলিকে কাগজে কলমেই রাখা হলো। এখন লকডাউন সংকটের সময়কালে স্বৈরতান্ত্রিক কায়দায় অর্ডিন্যান্স চাপিয়ে দিয়ে কৃষি ক্ষেত্রে কর্পোরেট পুঁজিপতিদের দখলদারী কায়েম করা হলো। ওদের হাতে কৃষি পণ্যের ব্যবসা বানিজ্যের সমগ্র ব্যবস্থাকে তুলে দেওয়া হলো। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণ সহ কৃষকের স্বার্থরক্ষায় যতটুকু সরকারী বিধি ব্যবস্থাগুলি ছিলো সেগুলিকে উঠিয়ে দেওয়া হবে, ফলে কৃষকদের কর্পোরেট পুঁজিপতিদের গোলামে পরিণত করা হবে। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন সংশোধনের মাধ্যমে কৃষিপণ্যের মজুত ও মূল্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা উঠিয়ে দেওয়ার কারনে বড় ব্যবসায়ীরা যত খুশি পণ্য মজুত করতে পারবে। কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করে তারা নিজেদের সুবিধা মতো কৃষি পণ্যের দাম বাড়াবে, অথচ চাষিরা তাঁদের রক্ত ঘামে উৎপাদিত ফসলের লাভজনক দাম পাবে না। দেশী বিদেশী পুঁজিপতি-ব্যবসায়ী-আমলা-অসাধু রাজনৈতিক নেতাদের চক্র কৃষিপণ্যের ব্যবসা থেকে মুনাফার পাহাড় তৈরি করবে। কৃষিপণ্য বাজার কমিটি আইন (APMC) তুলে দেওয়ার ফলে কৃষিপণ্যের ফাটকাবাজি মজুতদারী বাড়বে। এ ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারগুলির যে অধিকার রয়েছে অর্ডিন্যান্সে তাকে খর্ব করা হয়েছে। কৃষি পণ্যের বাজার বা কিষাণ মান্ডিগুলি সীমিত ভাবে হলেও চাষিদের দরকষাকষি ও ফসলের সরকারী ক্রয়ের জন্য নির্ধারিত। সেই ব্যবস্থাটা তুলে দিয়ে চাষিদের চরম লোকসান ও ঋণফাঁদের দিকে ঠেলে দেওয়া হবে। ব্যবসায়ী ও পু্ঁজিপতিদের চুক্তিচাষের অবাধ অধিকার দেওয়া হয়েছে। এতে ঘুরপথে কৃষিজমি থেকে কৃষকদের উচ্ছেদ করে চালু করা হবে কর্পোরেটদের জমি গ্রাস অভিযান। বাস্তবে ওরাই কৃষি উৎপাদনকে নিয়ন্ত্রন করবে। ফলে আমাদের দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হয়ে পড়বে মারাত্মক ভাবে বিপন্ন। বিগত বছরগুলিতে আমাদের দেশে কৃষিপণ্যের আমদানী ক্রমশ রপ্তানির থেকে বেড়ে চলেছে। আগামীদিনে সেটা আরও বেড়ে যাবে। উন্নত দেশের অত্যধিক পরিমাণে কৃষি ভর্তুকিযুক্ত পণ্য আমাদের দেশের কৃষি পণ্যের বাজারকে নষ্ট করে দেবে। ফলে নতুন নিয়ম বিধির মধ্য দিয়ে চাষিদের ফসলের ভালো দাম পাওয়ার যে স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে সেটা সম্পূর্ণ মিথ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়।
সমগ্র কৃষি ক্ষেত্রে ৫০-৬০ শতাংশ ছোট ভাগচাষি-চুক্তি চাষিরা রয়েছে। চুক্তি চাষের প্রভাবে এদের জীবন জীবিকা সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়া হবে। কৃষিমজুরদের জীবিকাও হয়ে উঠবে বিপন্ন। তীব্রতর হয়ে উঠবে গ্রামীণ বেকারী।
সব মিলিয়ে এই কৃষি সংস্কারে লাভবান হবে বড় বড় কোম্পানিরা। তৈরি হবে কোম্পানি রাজ।
এ রাজ্যে লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকরা অমানবিক দূর্দশার মধ্যে রয়েছে। তাঁদের ঘরে ফেরানো, স্বাস্থ্যপরীক্ষা করা, সুরক্ষা দেওয়া, কাজ ও খাদ্য সরবরাহ করা প্রভৃতি প্রশ্নে চলছে চুড়ান্ত সরকারী অব্যবস্থা।
পিএম কিষাণ নিধির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার কৃষকদের বছরে তিন দফায় ৬ হাজার টাকার যে সহায়তা প্রকল্প চালু করেছে এ রাজ্যে সেটাকেও কার্যকরী করা হচ্ছে না।
বিদ্যুৎ ক্ষেত্রকে সম্পূর্ণ বেসরকারীকরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে, যা কৃষকদের মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
আমাদের দাবি –
ধন্যবাদান্তে,
এআইকেএসসিসি পঃ বঙ্গ শাখার পক্ষে অমল হালদার, আহ্বায়ক
কার্তিক পাল, সাংগঠনিক সম্পাদক
লকডাউন ধাপে ধাপে আনলক হলেও দীর্ঘতর এ সময়কাল মানুষের কাছে ক্রমশই অসহনীয় হয়ে উঠছে। আমফান ঘুর্ণিঝড় সৃষ্টি করেছে চরম বিপর্যয়। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের হাতে কাজ নেই, অর্থ নেই। বিপরীতে চলছে শাসকের মিথ্যা ভাষণ, সম্বল মাসে ৫ কেজি রেশন। এই সার্বিক বিপদের মুখে কেন্দ্র রাজ্য শাসকদলের নেতাদের চরম অপদার্থতা, ছিঁটেফোটা যতটুকু সরকারী সাহায্য আসছে সেগুলিতে দুর্নীতি দলবাজি মানুষের মধ্যে সৃস্টি করেছে চরম ক্ষোভ বিক্ষোভ। একে প্রতিবাদের ভাষা দিয়ে গত ১৬ জুন রাজ্য কর্মসূচীর অঙ্গ হিসাবে নদীয়া জেলার বিভিন্ন স্থানে সংগঠিত হলো ১৬টি বামদলের বিক্ষোভ কর্মসূচী। ধুবুলিয়া বাজার, বেথুয়াডহরী স্ট্যাচুর মোড়, চাপড়া বাজারে রাস্তার পার্শ্ববর্তী দীর্ঘ লাইনে সারিবদ্ধ ভাবে প্ল্যাকার্ড হাতে কর্মীদের স্লোগানে সোচ্চার হয়ে ওঠা এই কর্মসূচী ব্যাপক মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। চাকদা শহরে পথসভা সংগঠিত হয়। নবদ্বীপ, তাহেরপুর, শান্তিপুরেও অনুরূপ কর্মসূচী অনুষ্ঠিত হয়। ১৭ জুন শান্তিপুরে তাঁত শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবি নিয়ে বাম ট্রেড ইউনিয়নগুলির পক্ষ থেকে বিক্ষোভ ডেপুটেশন কর্মসূচী অনুষ্ঠিত হয়।
পুর্ব বর্ধমান জেলার কালনা ২নং ব্লকের অকালপৌষ গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার আগ্রাদহ থেকে ঝিকড়া গ্রামের রাস্তার অবস্থা বর্তমানে যাতায়াতের অযোগ্য হয়ে গিয়েছে। দীর্ঘ সাত বছর এই রাস্তার সংস্কার হয়নি। মড়াম রাস্তা এখন মাটির রাস্তা থেকেও বেশি দুর্গম হয়ে উঠেছে। এই রাস্তা এক সময় ঢালাই করার জন্য বরাদ্দ হয়েছিল। কিন্ত হয় নাই। এই গ্রামগুলো সিপিআই(এমএল) লিবারেশন-এর প্রভাবিত গ্রাম। কয়েকবার পঞ্চায়েত নির্বাচনে সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল জোর করেই পরাজিত করে। তৃণমূল তাদের বিরোধী মনোভাবের জনগণকে শাস্তিদানের জন্যই রাস্তা সংস্কার করছে না। তাই সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পক্ষ থেকে ১৮ জুন অকালপৌষ পঞ্চায়েতে গ্রামের মানুষকে সামিল করে রাস্তার সংস্কারের দাবি জানাতে যান। কিন্ত প্রধান বা উপপ্রধান কেউ কথা বলার জন্য আন্দোলন কারীদের সাথে দেখা করতেই রাজি হলেন না। তখন বাধ্য হয়ে পঞ্চায়েত অফিসে তালা লাগিয়ে বিক্ষোভ দেখানো শুরু হল। দুপুর ১২টা থেকে ৪টা পর্যন্ত বিক্ষোভের পর বাধ্য হয়ে উপপ্রধান এসে আন্দোলন কারীদের সাথে আলোচনায় বসেন। ২৩ জুন থেকে রাস্তার সংস্কারের কাজ শুরু করার প্রতিশ্রুতি দিলেন। তারপর পঞ্চায়েত অফিসের তালা খোলার পর আন্দোলন সমাপ্ত হয়।
করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে, দরিদ্র ও ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে, হাওড়া ডুমুরজলা মাঠের লাগোয়া একটি ছোট মাঠ, যেখানে অতিতে হাওড়া জেলা ফুটবল খেলা ও কলকাতা মাঠে বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে আইএফএ লিগ খেলা এবং বর্তমান চারটি ফুটবল কোচিং লাইসেন্স অধিকারী এবং এক সময়ে সারা ভারত সিজিএইচএস কর্মচারি ইউনিয়নের কলকাতা শাখার নেতা/সংগঠক ও সর্বোপরি সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের কর্মী দিলীপ ঘোষ ওখানকার ফুটবল অনুশীলন কেন্দ্রের (বর্তমান কোচ) দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে ১ এপ্রিল থেকে ১১টা পরিবারকে নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী ও অল্প কিছু আর্থিক সহায়তা করে চলেছেন। এই কাজে আন্তরিক সাহায্য করার জন্য প্রথমে ফোনের মাধ্যমে এবং পরে অনুশীলন কেন্দ্রের ৭০টি পরিবারকে নিয়ে যে হোয়াটস্যাপ গ্রুপ তৈরি হয়েছিল তার মাধ্যমে আবেদন রাখা হয়। আবেদনে সাড়া দিয়ে ১২টা পরিবার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়, ফলে ১১টি পরিবারকে এখনও পর্যন্ত আমরা সুস্থ রাখতে পেরেছি। এটা গেলো একটা দিক —
দ্বিতীয়টা হলো, এই মহামারীর জেরে সরকারের অ-পরিকল্পিত লকডাউন, সবথেকে বেশি কষ্ট যাদের সইতে হচ্ছিল, সেই দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের পার্টি সরকারের কাছে কিছু দাবি এবং সরকারের অপদার্থতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যাতে ঐ ভুক্তভোগী মানুষগুলো আওয়াজ তুলতে পারে তার জন্য একাধারে ত্রাণ বিলি ও অন্যদিকে রাস্তায় নেমে জনসমক্ষে এআইসিসিটিইউ-এর ব্যানারে প্রতিবাদ সংগঠিত হয় যাতে বুঝতে পারে যে, ত্রাণ পাওয়াটা তাদের অধিকার, কোনো দয়া দাক্ষিণ্য নয়। ফলে স্ব-ইচ্ছায় ত্রাণ গ্রহিতা এবং ত্রাণ প্রদানকারী সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সামিল হয়। অর্থাৎ সচেতন ভাবে এই অনুশীলন চালানো গেলে হয়তো এই নতুন অভিজ্ঞতা আমাদের কাজে লাগবে।
দীর্ঘ লকডাউনে রুটি রুজি প্রায় বন্ধ হওয়ায় চরম অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে সাধারণ মানুষ। তার উপর আম্ফানের বিভৎস তাণ্ডবে বহু মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে আমাদের সমিতির বেশ কিছু কাজের অঞ্চলে। সমিতির এরকম একটি কাজের অঞ্চল বজবজ গ্রামীণ এলাকা পূজালী পুরসভার অধীনে নিশ্চিন্তপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের ৯ ও ৩ নং ওয়ার্ডের অধীনে জামালপুরের সেখপাড়া, দাসপাড়া ছাড়াও শিংপাড়া, মালিকপাড়া, বৈষ্ণবপাড়া ও হালদারপাড়া মিলিয়ে প্রায় একশোটি পরিবারকে সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির উদ্যোগে (মুসুর ডাল, সরষের তেল, সোয়াবিন, হলুদ, নুন, বিস্কুট, মাস্ক) ইত্যাদি সামগ্রি বিলি করা হয়। এখানকার মহিলারা বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত। যেমন, ঝুড়ি বাধা, রাখী বাধা, ঠোঙা বানানো, মাছ ধরা ও নির্মানের কাজ করেন। কেউ কেউ আবার একশো দিনের প্রকল্পেও কাজ করেন। সমস্ত কাজ এখন প্রায় বন্ধ। একদিকে চরম আর্থিক অনটন অন্যদিকে আম্ফানের ঘূর্নীঝড়ে এদের বেশির ভাগের ঘরের চাল উড়ে গেছে। সবই কাঁচা বাড়ি। অনেকে মাটির দেওয়াল, অপোক্ত ইটের দেওয়াল ভেঙ্গে পড়েছে। এই অসহায় মানুষ গুলো বার বার পঞ্চায়েতে জানানো সত্বেও পঞ্চায়েত প্রধান আশ্বাস দিলেও একদিনও পরিদর্শনে আসেননি বা কোনো রকম সহযোগীতা করেননি। কোনো গুরুত্ব দিচ্ছে না। সমিতির পক্ষ থেকে বারে, বারে তাদের কাছে গেছে এবং খোঁজ খবর করেছে। এঁদের মূল দাবি ঘরে থাকার মতো ত্রিপলের ব্যবস্থা। এদের কাছে এই মূহুর্তে এই খাদ্য সামগ্রির থেকেও অনেক বেশি প্রয়োজন মাথার উপর ন্যূনতম আচ্ছাদন যেখানে সন্তান ও পরিবার নিয়ে এই বর্ষার দিনে মাথা গুঁজে থাকতে পারে। কিন্ত গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধানের কাছ থেকে কোন রকম সহযোগীতা না পেয়ে এরা প্রচন্ড ক্ষুব্ধ। শিংপাড়ার পার্বতী খাঁ, মৌসুমী দলুই বলছেন “আমাদের মাটির বাড়ির দেওয়াল ভেঙ্গে গেছে, টিনের চাল উড়ে গেছে। ছেলে, মেয়ে নিয়ে থাকাই দায়। বার বার আবেদন করেন কিছু ব্যবস্থা করার জন্য শুক্লা দাসের কথায়’, তার ঘরের টিনের চাল উড়ে গেছে, অপোক্ত ইটের দেওয়াল ভেঙ্গে গেছে। স্বামী রঙের কাজ করে। এখন কোনো কাজ নেই। কোলে কয়েক মাসের বাচ্ছা। খাবারের সংস্থান করবে না মাথার উপর আচ্ছাদনের ব্যবস্থা করবে ভেবেই পাচ্ছে না। এরা সকলেই ক্ষোভে ফুসছে। এখানকার আঞ্চলিক সমিতির পক্ষ থেকে শীঘ্রই এদের নিয়ে পঞ্চায়েতে বিক্ষোভ কর্মসূচী নেওয়া হবে। ১৫ জুন এই কর্মসূচী পরিচালনায় উপস্থিত ছিলেন রাজ্য সম্পাদিকা ইন্দ্রানী দত্ত, দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলা সম্পাদিকা কাজল দত্ত, রাজ্য কমিটির সদস্য মমতা ঘোষ এবং শীলা দে সরকার, স্বপ্না চক্রবর্ত্তী, দেবযানী ব্যানার্জী ও অঞ্জনা মাল।
====