( হেডিং-এ ক্লিক করুন শুধুমাত্র সেই লেখাটিই দেখতে পাবেন )
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দৃঢ় শিকড় চাড়ানো বর্ণবাদী পক্ষপাত ও হিংসার বিরুদ্ধে বিপুল আকারের বিদ্রোহ ফেটে পড়ছে। এই বিদ্রোহের সূত্রপাত ঘটানো সাম্প্রতিক ঘটনাটা এইরকম : মিনিয়াপোলিসে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসাররা এক আফ্রিকান আমেরিকান পুরুষ জর্জ ফ্লয়েডকে মাটিতে শুইয়ে মুখ নীচের দিকে করে চেপে ধরে এবং তাদের মধ্যে একজন তার ঘাড়ের ওপর হাঁটু চেপে রেখে শ্বাসরোধ করে ওকে মেরে ফেলে। ফ্লয়েড বারবারই বলছিল যে ওর শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে আর ও মরে যাচ্ছে, এ সত্ত্বেও পুলিশগুলো ওর শ্বাসরোধ করে চলেছিল। ফ্লয়েডের হত্যা কোন ব্যতিক্রমী ঘটনা নয় – পুলিশ এবং এমনকি শ্বেতাঙ্গদের হাতে আফ্রিকান আমেরিকানদের হত্যার দীর্ঘ তালিকায় এটা সাম্প্রতিক সময়ে আর একটা সংযোজন মাত্র।
এই ধরনের হত্যার ঘটনা যেমন বহুসংখ্যকই ঘটে, তেমনি নিজেদের জীবনে কালো মানুষদের মুখোমুখি হতে হওয়া বর্ণবিদ্বেষের ঘটনাও অসংখ্যই দেখা যায়। পুলিশ স্বেচ্ছাচারীভাবে কালো মানুষদের আটক করে তাদের ওপর পৈশাচিক অত্যাচার চালায়, এবং কালো মানুষদের হুমকি দিতে ও চোখ রাঙাতেও শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদীরা পুলিশকে ডেকে আনে।
পুলিশ বাহিনীর মধ্যে এবং অপরাধ বিচার ব্যবস্থায় অঙ্গীভূত প্রণালীবদ্ধ বর্ণবাদী পক্ষপাতিত্বের বিরুদ্ধে এবং বর্ণবাদ প্রসূত হত্যার ঘটনাগুলোতে হয়ে চলা ন্যায় বিচারের বঞ্চনার বিরুদ্ধে কয়েক বছর আগে শুরু হয় ‘কালো মানুষের জীবনেরও মূল্য আছে’ আন্দোলন যা আজও অব্যাহত রয়েছে। এই প্রতিবাদগুলো দেখিয়ে দিচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনী কী ভয়ঙ্কর যুদ্ধবাজ এবং যুদ্ধের মনোভাবে সম্পৃক্ত পরিকাঠামো ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা কতটা প্রবল মাত্রায় ঔপনিবেশিক দখলদারির রাষ্ট্র ইজরায়েলের মডেলকেই অনুসরণ করে। বর্তমানে প্রতিবাদের যে ঢেউ দেখা যাচ্ছে তা আগের প্রতিবাদগুলোরই ধারাবাহিকতা হলেও ব্যাপ্তি ও অভিঘাতের দিক থেকে অভূতপূর্ব ও ঐতিহাসিক।
কোভিড-১৯ অতিমারির প্রকোপে কালো মানুষরাই তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি ক্ষতিগ্ৰস্ত হয়েছেন, যা দেখিয়ে দিচ্ছে যে এই সম্প্রদায়ের মানুষদের ব্যাপক সংখ্যকই দরিদ্র, অনথিবদ্ধ এবং শ্রমিক শ্রেণীর সবচেয়ে অসহায় ও নিরাপত্তাহীন অংশের অন্তর্ভুক্ত। মার্কিন সমাজের অঙ্গ হয়ে থাকা অসাম্যের সর্বব্যাপী ও সুগভীর ফাটল ওই সমাজকে অতিমারির কারণে বিদ্রোহের জন্ম নেওয়ার পক্ষে বিশেষভাবে অনুকূল করে তুলেছে। এখন জনগণের ক্ষোভ ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে থাকা অসাম্য ও অবিচারের বিরুদ্ধে ফেটে পড়ে দায়বদ্ধতার দাবি জানাচ্ছে।
প্রতিবাদগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শান্তিপূর্ণ ছিল, তবে কোথাও-কোথাও ক্রুদ্ধ প্রতিবাদকারীরা পুলিশের গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং সমবায় বিপণিগুলোতে ভাঙচুর চালায়। এই ফেটে পড়া রোষ ও ক্রোধ একেবারেই ন্যায়সংগত, এবং ঘটনা হল ক্ষতিগ্ৰস্ত অনেক বাড়ি ও দোকানের মালিকই আন্দোলনকারীদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছেন। কিন্তু মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প প্রতিবাদকারীদের ‘গুণ্ডা’ ও ‘লুটেরা’ বলে ছাপ মেরেছেন, তাদের দমন করতে জাতীয় রক্ষী বাহিনীকে নামিয়েছেন এবং রাস্তায় ‘কর্তৃত্ব করার জন্য’ সামরিক বাহিনীকে নামানোর কথাও বলছেন। যুদ্ধবাজি মানসিকতায় সম্পৃক্ত পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে ক্রোধের আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়ে ট্রাম্প প্রতিবাদকারীদের গুলি করে মেরে ফেলা অথবা গ্ৰেপ্তার করে অন্তত এক দশক জেলে পুরে রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।
ট্রাম্প শ্লোগান দিয়েছেন, “লুট শুরু হলে গুলি চালানোও শুরু হয়।” এই শ্লোগান আমাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের কিছু ঘটনাকে মনে পড়িয়ে দেয় – যথা, শ্রমিকরা যখন ৮-ঘন্টার শ্রমদিবসের জন্য ধর্মঘট করেছিলেন কিংবা বর্ণবাদ-বিরোধী প্রতিবাদকারীরা নাগরিক স্বাধীনতার দাবি জানিয়েছিলেন, তখন তাদের “লুটেরা” বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল, আর সংবাদপত্রগুলো ও রাজনীতিবিদরা তাদের গুলি করে মেরে ফেলার দাবি তুলেছিল। আজ দুনিয়া জুড়ে যে প্রতিবাদ চলছে এবং ট্রাম্প প্রশাসন শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ প্রদর্শনকারীদের ওপর যেভাবে দমন নামিয়ে আনছে তা মার্কিন গণতন্ত্রের পলকা চরিত্রকে উন্মোচিত করে দিচ্ছে এবং সামরিক একনায়ক হওয়ার মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পের অভিপ্রায়কেও সামনে নিয়ে আসছে।
ভারতে এটা স্মরণে রাখা জরুরি যে, বিজেপি নেতারা “দেশ কো গদ্দারো কো, গোলি মারো শালো কো”র (বিশ্বাসঘাতকদের গুলি করে মারো) যে শ্লোগান দিয়েছেন তা “লুট শুরু হলে গুলি চালানোও শুরু হয়” শ্লোগানেরই জুড়ি। ট্রাম্প যেমন বর্ণবাদ-বিরোধী বিক্ষোভকারীদের লুটেরা বলে ছাপ মারছেন এবং তাদের পাইকারি হারে মেরে ফেলার দাবি তুলছেন, একই ভাবে বিজেপি এবং মোদী সরকারও গণতন্ত্রকামী, সিএএ-বিরোধী বিক্ষোভকারীদের “বিশ্বাসঘাতক” বলে ছাপ মেরে তাদের কচুকাটা করা ও গুলি করে মেরে ফেলার দাবি জানিয়েছিল। ভারতে মোদী ২০২০র ফেব্রুয়ারীতে যখন ট্রাম্পকে আপ্যায়ন করছিলেন, কপিল মিশ্রর মতো বিজেপি নেতারা তখন সিএএ-বিরোধী বিক্ষোভকারীদের এবং ওই প্রতিবাদগুলোকে সমর্থন জানানো মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে তাদের হত্যা করার জন্য দাঙ্গাবাজদের প্ররোচিত করছিলেন।
সেই কপিল মিশ্রই এখন টুইট করে বলেছেন যে, তাঁর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এবার উপলব্ধি করতে হবে যে “খারাপ লোকেরা” যখন রাস্তার দখল নেয় তখন “ভালো মানুষদের” রাস্তায় নেমে এসে তাদের আটকাতে হবে। এর ইঙ্গিতটা দ্ব্যর্থহীন: বিজেপির বিশ্ব বীক্ষায় আমেরিকায় আফ্রিকান আমেরিকানরা, কালো মানুষ এবং বর্ণবাদ-বিরোধীরা আর ভারতে মুসলিমরা ও সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী প্রতিবাদকারীরা হল “খারাপ মানুষ” আর আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা এবং ভারতে সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী সংগঠনগুলোর ক্যাডাররা হল “ভালো মানুষ”।
ভারতের পুলিশ ও অপরাধ বিচার ব্যবস্থায় অঙ্গীভূত সাম্প্রদায়িক, জাতপপাতবাদী ও শ্রেণী পক্ষপাতিত্বকে স্বীকার করে নেওয়ার যথার্থ সময় উপস্থিত। এই পক্ষপাতিত্ব একেবারেই নতুন নয় – স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে ছড়িয়ে রয়েছে পুলিশ ও সেনা বাহিনীর হাতে মুসলিম, শিখ ও খ্রিস্টান সংখ্যালঘুদের, দলিত-আদিবাসী-কাশ্মীরী-মনিপুরী-নাগাদের গণহত্যার অসংখ্য ঘটনা; আরও রয়েছে সাম্প্রদায়িক ও সামন্ততান্ত্রিক সংগঠনগুলোর হাতে মুসলিম ও দলিতদের গণহত্যার বহুসংখ্যক ঘটনা। বিক্ষোভকারীদের দমন করতে কাঁদানে গ্যাস, লাঠি ও গুলির ব্যবহার (কাশ্মীরীদের দমনে ছররা বন্দুক) খুবই সাধারণ ব্যাপার। এই সমস্ত ঘটনার অধিকাংশর ক্ষেত্রেই প্রণালীবদ্ধভাবে ন্যায়বিচারের বঞ্চনা হয়েছে, এবং গণহত্যার সংঘটকদের পদোন্নতি ঘটিয়ে এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার আসনে বসিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছে।
আমেরিকায় জেলে বন্দী মানুষদের মধ্যে আফ্রিকান আমেরিকান এবং কালো মানুষদের সংখ্যা শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় অনেক বেশি এবং তারাই বন্দীদের ব্যাপকতর অংশ – ভারতে দলিত, আদিবাসী ও মুসলিমদের ক্ষেত্রেও একই কথা সত্যি। ভারতের জেলগুলোতে যত বন্দী রয়েছে তার ৫৩ শতাংশই হল মুসলিম, দলিত ও আদিবাসী। জনগণের এই অংশটার বিরুদ্ধে – যে অংশটা আবার দরিদ্রতম ভারতীয়দের মধ্যে পড়ে – পুলিশের নিপীড়ন, মিথ্যা অভিযোগ দায়ের এবং ভুয়ো সংঘর্ষে তাদের হত্যা (হেফাজতে হত্যা) ব্যতিক্রম না হয়ে নিয়ম হয়েই দাঁড়িয়েছে।
মোদী সরকারের নেতৃত্বাধীন গত ছ-বছরে ব্যবস্থার মধ্যেকার এই প্রবণতাগুলো আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। সাম্প্রদায়িক দলবল মুসলিমদের পিটিয়ে হত্যা করেছে, আর পুলিশ পিটিয়ে হত্যায় যুক্ত দলবলকে সুরক্ষা যুগিয়েছে এবং মৃতপ্রায় মুসলিমদের সঙ্গে নির্মম আচরণ করেছে। সম্প্রতি, যখন কোভিড-১৯ অতিমারী চলছে সেই সময় মধ্যপ্রদেশের বেতুলে পুলিশ এক দলিত মানুষকে প্রচণ্ড প্রহার করে। পুলিশ পরে তার কাছে “ক্ষমা চাওয়ার” চেষ্টা করে, এবং এই অজুহাত দেয় যে তার দাড়ির জন্য সে তাকে মুসলমান বলে মনে করেছিল! সিএএ-বিরোধী প্রতিবাদ চলার সময় পুলিশ জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে অন্ধ করে দেয় এবং আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে পঙ্গু করে তোলে, মুসলিমদের চোখে গুলি করে, উত্তরপ্রদেশ ও কর্ণাটকে নিরস্ত্র মুসলিমদের গুলি করে হত্যা করে, এবং সুপরিকল্পিতভাবে মুসলিমদের ঘরবাড়ি তছনছ করে।
পুলিশ এখন আবার সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের কর্মীদের গ্রেপ্তারে উঠেপড়ে লেগেছে এবং যারা প্রকৃতই হিংসা চালিয়ে ছিল তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগটুকু দায়ের করতে পর্যন্ত অস্বীকার করছে। ছত্তিশগড়ে পুলিশ ও সেনারা যে আদিবাসীদের গ্ৰেপ্তার করছে এবং যাদের ওপর হেফাজতে নির্যাতন চালাচ্ছে, তাদের আইনি সহায়তা দিয়েছিলেন আইনজীবী ও সমাজ আন্দোলনের কর্মী সুধা ভরদ্বাজ। মোদী জমানায় তাঁকে দানবীয় ইউএপিএ আইনে মিথ্যাভাবে অভিযুক্ত করে জেলে পোরা হয়েছে। ট্রাম্প বিক্ষোভকারীদের গ্রেপ্তার করে এক দশক জেলে বন্দী করে রাখার দাবি তুলছেন; আজ ভারতে কোভিড-১৯ অতিমারী চলার সময় সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের কর্মীদের ইউএপিএ আইনের অধীনে জেলে পোরা হচ্ছে, আর এই আইনে কোনো বিচার বা জামিন ছাড়াই বছরের পর বছর আটক রাখার বিধান আছে। একইভাবে কাশ্মীরীদেরও বিচার ছাড়াই দানবীয় পিএসএ আইনে দশকের পর দশক ধরে জেলে বন্দী করে রাখা হচ্ছে।
পুলিশের নির্যাতনে আহত হয়ে মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর ফৈজানকে দিল্লীর পুলিশ লাথি মারছে আর জাতীয় সঙ্গীত গাইতে বাধ্য করছে (যা সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের এক প্রতিবাদী সঙ্গীত এবং সমাবেশ ঘটানোর উদ্দীপনাময় আওয়াজ হয়ে উঠেছিল) – এই অত্যাচারের ভিডিও টেপ পুলিশের পক্ষপাতিত্ব ও পৈশাচিকতাকে কোনো অংশেই আমেরিকার পুলিশ বাহিনীর জর্জ ফ্লয়েডকে শ্বাসরোধ করে হত্যার চেয়ে কম ভয়ংকর বলে দেখায় না।
আমেরিকায় চলমান গণ আন্দোলন জর্জ ফ্লয়েডের জন্য এবং বর্ণবাদী পুলিশ ও শ্বেতাঙ্গ নাগরিকদের হাতে নিহত অন্য সমস্ত আফ্রিকান আমেরিকানদের জন্য ন্যায়বিচারের দাবি জানাচ্ছে। এই আন্দোলন পুলিশ বাহিনী এবং অপরাধ বিচার ব্যবস্থার গভীরে শিকড় চাড়ানো বর্ণবাদ ও যুদ্ধবাজি মানসিকতার অবসানেরও দাবি জানাচ্ছে। এই বিপ্লবী আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানানোর সাথে-সাথে ভারতে আমরা ভারতের বিদ্যমান ব্যবস্থায় অঙ্গীভূত পুলিশ বাহিনী এবং রাষ্ট্র যন্ত্রের পক্ষপাতিত্ব ও নিপীড়নকে গ্রাহ্য করার দাবি জানাচ্ছি, যে পুলিশ বাহিনী ও রাষ্ট্র যন্ত্রকে মোদী সরকার মুসলিম সংখ্যালঘু এবং গণতন্ত্রকামী প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করছে।
(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ২ জুন ২০২০)
কোবিড পরিস্থিতিতে এক জরুরি আলোচনার বিষয় হয়ে উঠছে বেকারির ভয়াল বৃদ্ধির প্রশ্ন। বিশ্ব অর্থনীতিতে অভূতপূর্ব সংকট। ভারতীয় অর্থনীতির দশাও চলছে একই খাতে। বৃদ্ধি ক্রমাগত নিম্নগামী, ঠেকেছে ১১ বছরের রেকর্ড ভাঙা তলাানিতে। জনমানুষের আর্থিক দুর্গতি দাঁড়িয়েছে ততোধিক। কাজ হারানো, কাজ না পাওয়া, দারিদ্র সীমার নীচে থাকা ও ক্রমাগত নামতে থাকা জনগণের কাছে ন্যূনতম ১০ হাজার করে টাকা দেওয়ার দাবি উঠেছে কেন্দ্রের মোদী সরকারের কাছে। কিন্তু আজও তার সুরাহা মেলেনি। তা পাওয়া বোঝাই যাচ্ছে সহজে হওয়ার নয়। দেশব্যাপী এই অসহনীয় অবস্থায় নাছোড় থাকতে হবে বেঁচে থাকার অধিকার সঞ্জাত অর্থকড়ি অনুদান আদায়ের লড়াইয়ে। পাশাপাশি বেকারি অবসানের অধিকার সম্বলিত লড়াইও শুরু করতে হবে নতুন করে। তার কারণ মোদী সরকারের দ্বিতীয় পর্বের প্রথম বছরের মধ্যেই বেকারি বেড়ে পৌঁছেছে ১১ বছরের রেকর্ড ছাপিয়ে যাওয়া অবস্থায়। আর করোনা সংক্রমণের পরিস্থিতিতে নিশ্চিতভাবেই কাজ উধাও হয়ে গেছে আরও ব্যাপক হারে। সেটা কত মারাত্মক বিচিত্র আকার ধারণ করেছে আর তা নিয়ে বিভিন্ন মূল্যায়ন কেমন চলছে সেইসব বিষয় পরখ করে নেওয়া যাক একনজরে।
গত মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে লক ডাউনের ঠিক আগের অবস্থায় বেকারির চিত্র ছিল ৮.১৪ শতাংশ। এপ্রিলে তা দাঁড়ায় প্রায় তিনগুণ বেশি, ২৩.৫২ শতাংশ। আর, মে মাসের প্রথমার্ধের মধ্যে বেকারি পৌঁছে যায় ২৭.০৬ শতাংশে। এই পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে সিএমআইই। পরবর্তী হিসাব এখনও অপ্রকাশিত। বলাবাহুল্য, জুনের প্রথম সপ্তাহের আগে পর্যন্ত কর্মক্ষেত্র ছিল পুরো লকডাউনে, ফলে বেকারির ধারা ছিল একই। এই দীর্ঘ সময়ে কাজ লোপাট সংক্রান্ত কোনও আলোচনার ধার-কাছ মাড়ায়নি মোদী সরকার। কোনও অভয়ও দেয়নি কোথাও কোনো কাজ ছেঁটে দিতে দেওয়া হবে না। দেশবাসীকে প্রধানমন্ত্রী বারকয়েক ভাষণে মোহিত করার চেষ্টার কার্পণ্য রাখেননি। কিন্তু একটিবারের জন্যও তাঁকে কাজ চলে যাওয়ার চালচিত্র বিষয়ে কিছু বলতে শোনা যায়নি। মে মাসের একেবারে শেষে শোনা গেল কেন্দ্রের অর্থমন্ত্রক নাকি শ্রমমন্ত্রককে নোটিশ করেছে, সমগ্র ইনফর্মাল সেক্টরে কাজ ছুটে যাওয়ার রিপোর্ট তৈরি করতে। বলাবাহুল্য, সরকারী ক্ষেত্র ক্রমেই বেচে দেওয়া হচ্ছে। যে সরকার লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকদের সর্বস্বান্ত দিশেহারা নিরন্ন পথে-ঘাটে বাঁচা-মরা অবস্থা দেখেও তার দায় দায়িত্ব পালন এড়াতে ইতর রাজনীতি করতেই ব্যগ্র থেকেছে, তাকে বেকারি বৃদ্ধির ক্রমাগত চাপের সামনে অগত্যা সবশেষে কিঞ্চিৎ মুখ খুলতে শোনা গেল। এরপর কর্মহীনতার হাল-হকিকৎ স্বীকার করার রিপোর্ট তৈরিতে শ্রমমন্ত্রক কত মাস লাগায় সেটা সময়েই পরিষ্কার হয়ে যাবে। কেউ ভোলে না, কেউ ভোলে; মোদী সরকারের বিরুদ্ধে ইতিপূর্বেই অভিযোগ উঠেছিল বেকারি বৃদ্ধি সংক্রান্ত এনএসও-র সর্বশেষ সমীক্ষা রিপোর্টে উল্লেখ থাকা তথ্য পরিসংখ্যান চাপা দেওয়ার। যে সরকার তৈরি করা রিপোর্ট ধামাচাপা দেয়, সে কেমন রিপোর্ট তৈরি করবে তা নিয়ে ষোলো আনা সংশয় থেকেই যায়।
বেকারি বাড়ছে গ্রাম, নগর, শহর, শিল্পাঞ্চলে সর্বত্র। সিএমআইই রিপোর্ট আরও উল্লেখ করেছে, প্রতি ৪ জন পিছু কাজ চলে গেছে ১ জনের। মোট কর্মরত ৪০০ মিলিয়নের মধ্যে মে মাসের প্রথমার্ধ পর্যন্ত কাজ হারানোর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১৪ মিলিয়ন। ভারতে বেকারি বৃদ্ধির এই চেহারার মধ্যে পর্যবেক্ষরা অনুভব করছেন গত শতকের তিরিশের দশকের মহামন্দার অশনি সংকেত। ১৯৩৩-এর মহামন্দার বিশ্ব পরিস্থিতিতে আমেরিকায় বেকারি ছিল ২৫ শতাংশ। আর আজকের কোবিড সংক্রমণময় বিশ্ব পরিস্থিতির অন্তর্গত ভারতে বেকারি অতিক্রম করে গেছে ২৭ শতাংশ। এ এমনই মন্দা যেখানে খাদ্যশস্য ও অন্যান্য পণ্যদ্রব্যের অভাব নেই, কিন্তু লোকের কেনার ক্ষমতা নেই, হাতে কাজ নেই। কাজ উধাও হওয়ার প্রবণতা চলছিল, করোনা পরিস্থিতিতে আরও যাচ্ছে।
মোদী সরকার এই কঠিন বাস্তব পরিস্থিতিতে ২০ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করল। কিন্তু তার মাত্র ৪০ হাজার কোটি টাকা হল নগদে সরকারি বিনিয়োগ বাবদ, বাকি সব কেবল ঋণ প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ। ৪০ হাজার কোটি টাকার নগদ বরাদ্দটা গ্রামীণ কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্পের উদ্দেশ্যে অতিরিক্ত বাবদ। আর সেটা গ্রামীণ পরিযায়ী শ্রমিকদের ইতিমধ্যে গ্রামে ফিরে আসার ঢল দেখে। ২০২০-২১-এর কেন্দ্রীয় বাজেটে এই প্রকল্পে বরাদ্দ ধরা আছে ৬১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, অতিরিক্ত ৪০ হাজার কোটি যোগ করলে মোট ধার্য বরাদ্দের পরিমাণ ১ লক্ষ ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। তবে গোড়াতেই গত বছরের বকেয়া মজুরি মেটাতে খরচ হবে ১১ হাজার কোটি টাকা। তারপর বিজ্ঞাপন ও সরঞ্জাম বাবদ বড় অঙ্কের ব্যয়বৃদ্ধির বোঝা চাপবে। সেসব কেটেকুটে এই প্রকল্পে জব কার্ড থাকা আর না থাকা অংশের মজুরদের এবং ফিরে আসা গ্রামীণ পরিযায়ীদের যোগফলে কর্মসংস্থান কতটা হবে? প্রশ্নটা ঝুলেই থাকছে। কেন্দ্র প্রচার করছে অতিরিক্ত ৩০০ কোটি কর্মদিবস সৃষ্টি হবে। সুতরাং ঘরে ফেরা পরিযায়ীরা কাজ পাবেন। অন্যদিকে এই প্রকল্পে কাজের ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রা হয়ে আছে বছরে ১০০ দিন মাত্র। আর এযাবৎ জব কার্ড পাওয়া মজুর সংখ্যা ১৪ কোটি। ২০১৯-২০ আর্থিক বছরে পরিবার পিছু কর্মসংস্থান হয়েছে বছরে গড়ে ২৫ দিন মাত্র। কেন্দ্র বলতে চায়, জব কার্ড পাওয়া সংখ্যা যত, চাহিদা কেবল ততটাই। বিপরীতে দাবি রয়েছে জোরদার, বছরে কাজ চাই ২০০ দিনের এবং মজুরি তিনগুণ বাড়ানোর। কিন্তু আসলে বাজেট বরাদ্দ অনুযায়ী কার্ডের কোটা স্থির হয়, মজুরি বাড়ে নামে মাত্র, কাজ ও মজুরি দেওয়া নিয়ে দুর্নীতি-দলবাজি সবই হয়। বর্ষার সময় কৃষি কাজে ক্ষেতমজুরির অভাব ঠেকাতে এই প্রকল্পের কাজ বন্ধ থাকে। এবারের বর্ষায় সরকার বলছে কাজ চালু থাকবে এবং সেই কাজ পাবে ফিরে আসা সেই শ্রমিকরা যাদের কৃষির ওপর নির্ভরশীল জনস্ফীতির চাপের কারণে গ্রামীণ কাজের অভাবে হতে হয়েছিল পরিযায়ী। কেন্দ্র জানাচ্ছে ২০১৯-এর মে মাসের তুলনায় ২০২০-র মে মাসে এই প্রকল্পে কাজের আবেদন বেড়েছে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ। যাই হোক, কেন্দ্রের প্রকল্পকে হাতিয়ার করে কাজের অধিকার কার্যকরী করতে নামতে হবে নতুন লড়াইয়ে।
শহর-নগর-বন্দরে-শিল্পাঞ্চলে বেকারির চিত্র আরও ভয়াবহ। আইএলও-র সমীক্ষায় ভারতে শ্রমজীবী মানুষের ৯০ শতাংশ কর্মরত ইনফর্মাল সেক্টরে। ২০২০-র দ্বিতীয়ার্ধের মধ্যে দারিদ্রের কবলে পতিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ৪০০ মিলিয়ন শ্রমজীবী জনতার, আর কাজ হারাতে পারেন ১৯৫ মিলিয়ন মানুষ। এই বিপদ সবচেয়ে বেশি তীব্র ও ব্যাপক হবে নির্মাণ, পরিবহণ ও উৎপাদনশীল ছোট-মাঝারি কলকারখানায়। যেখানে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় থাকেন অস্থায়ী ও ঠিকা শ্রমিকেরা। এমনকি বেতন পাওয়া চাকরিজীবীদেরও নিশ্চিন্ত থাকার উপায় নেই। কারণ বহুক্ষেত্রেই না থাকে নিয়োগের বৈধ চুক্তিপত্র, না মেলে সবেতন ছুটি, না রয়েছে সামাজিক সুরক্ষার সুযোগ-সুবিধা। কোবিড জর্জরিত পরিস্থিতিতে রুজি-রোজগারের নিরাপত্তা আরও হরণ হওয়ার বিপদ বেশি। আবার অনেকক্ষেত্রে সৃষ্টি হতে পারে পরিযায়ীদের কর্মস্থলে ফিরতে চাওয়া না-চাওয়াকে কেন্দ্র করে মজুরের চাহিদা ও যোগান ও মজুরির মান নির্ধারণজনিত জট-জটিলতা বৃদ্ধির সমস্যা। তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রেও ক্ষেত্রেও রয়েছে কোবিড উত্তর পরিস্থিতির শিকার হওয়া নতুন বেকারি বৃদ্ধির বিপদ। কারণ ভারতে কর্মসংস্থানের এই ক্ষেত্রটি চলছে মূলত পরনির্ভরতায়। এর বরাত সংযোগের ৬০ শতাংশ রয়েছে আমেরিকায়, ৩০ শতাংশ ইউরোপের দেশগুলোতে, ভারতের অভ্যন্তরে ১০ শতাংশ মাত্র।
বেকারি বৃদ্ধির এই প্রবণতাকে কার্যকরী নিরসনমুখী করাতে হলে ঋণ ঝোলা দেখানোয় কোনও কাজের কাজ হবে না। বাড়ানো চাই প্রধানত সরাসরি সরকারী বিনিয়োগ। সেই সাথে বিলগ্নীকরণ ও বেসরকারীকরণের সর্বনাশা পন্থা প্রত্যাহার করে কর্মসংস্থানের দায়িত্ব নিতে হবে সরকারপক্ষকে। নাহলে ত্বরান্বিত হবে আরও অশেষ দুর্গতি এবং তার অনিবার্য পরিণাম হিসাবে বিস্ফোরক পরিস্থিতি।
১। সচলতা এবং স্থানান্তর গমন সর্বদাই শ্রমিক শ্রেণীর গঠন ও বিকাশের অপরিহার্য বিষয় হয়ে দেখা দিয়েছে। গ্ৰাম থেকে শহর, শহর থেকে নগর ও মহানগর – শ্রমিকরা সর্বদাই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাচ্ছেন এবং নতুন স্থানের শ্রমিক হয়ে উঠছেন। স্থানান্তর গমনের নানা ধরন ও স্তর রয়েছে যেগুলোকে দূরত্ব ও স্থিতিকালের ভিত্তিতে শ্রেণীবদ্ধ করা যায় : আন্তঃজেলা, আন্তঃরাজ্য ও আন্তর্দেশীয় পরিযান, মরশুমি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিযান, ইত্যাদি। কিন্তু, পরিযায়ী শ্রমিকদের সর্বব্যাপী উপস্থিতি সত্ত্বেও তারা প্রধানত লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে গেছে। বড় ধরনের অর্থনৈতিক বিপর্যয় (উদাহরণস্বরূপ, বিমুদ্রাকরণ বা অর্থনৈতিক মন্দা) অথবা সামাজিক সংঘাতের সময়ই (পরিযায়ী শ্রমিকদের যখন নিজেদের কাজের এলাকায় সংকীর্ণতাবাদ প্রসূত হিংসার মুখোমুখি হতে হয়) আমরা কেবল তাদের উপস্থিতির টের পাই। তবে, মোদীর সম্পূর্ণরূপের পরিকল্পনাহীন এবং নির্মম লকডাউন লোকচক্ষুর অন্তরালে চাপা দেওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের সামাজিক বাস্তবতাকে হাট করে খুলে দিয়েছে। মোদী সরকার এবং দ্রুত উন্নয়ন ও সুশাসন সম্পর্কে তার যাবতীয় শূন্যগর্ভ বাগজালের সামনে তারা এক বিস্ফোরক আখ্যান রূপে ফেটে পড়েছে। স্থানান্তর গমনের ব্যাপারটা লোকচক্ষুর অন্তরালে ঘটলেও বিপরীতমুখী পরিযাণ গোটা দেশকেই ভীষণভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে।
২। কর্মস্থল ছেড়ে শ্রমিকদের দলে-দলে ঘরমুখী অভিযান লকডাউনের আপাদমস্তক পরিকল্পনাহীন ও স্বৈর চরিত্রকে চূড়ান্তরূপে উন্মোচিত করেছে। উন্নয়নের কর্পোরেট চালিত মডেলের মধ্যে নিহিত বিপর্যয়ের বাস্তবতা এখন প্রকট হয়ে সামনে এসেছে। আরও বুনিয়াদি একটা স্তরে এটা রাষ্ট্রের স্বরূপকেও অনাবৃত করে দিয়েছে। সরকার যখন লকডাউন ঘোষণা করল এবং আমাদের “ঘরে থেকে কাজ করুন”-এর মন্ত্র বিতরণ করল, তখন এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, সেই ব্যাপক সংখ্যক ভারতবাসী সম্পর্কে তার কোনো ভাবনাই ছিল না যাদের না আছে ঘর (অবশ্যই সেই ধরনের ঘর যেখানে দূরত্ব বিধি এবং স্বাস্থ্য রক্ষার অন্যান্য নিয়মকানুন মেনে চলা সম্ভব) আর না আছে কাজ (অবশ্যই এমন ধরনের কাজ যা ঘরে থেকে করা যায়)। এটা যদি চরম হৃদয়হীনতার পরিচায়ক হয়ে থাকে তবে শ্রমিকরা যে ঘরে ফিরতে মরিয়া হয়ে উঠেছে তা সুস্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পর যা ঘটল সেটা পুরোদস্তুর নির্মম ও অমানবিক বলেই প্রতিপন্ন হল। শ্রমিকদের ফেরাতে ট্রেন চালানোর সিদ্ধান্ত নিতে সরকারের এক মাসেরও বেশি সময় লেগে গেল আর এখন তো ট্রেনগুলোই এক কলঙ্কের ব্যাপার হয়ে উঠেছে, কেননা, রেল কর্তারা নিজেরাই শ্রমিক স্পেশ্যাল ট্রেনগুলোতে ৮০ জন শ্রমিকের মৃত্যু হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। ভারতে লকডাউন জনিত মৃত্যুর সংখ্যা, ৩০ মে পর্যন্ত নথিবদ্ধ হওয়া হিসেব অনুযায়ী, ৭০০ পেরিয়ে গেছে আর এই মৃতদের মধ্যে অনেক শ্রমিকও রয়েছেন।
৩। প্রশাসন তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে গণতন্ত্রে এটা প্রত্যাশিত যে বিচার বিভাগ সংশোধনকারীর ভূমিকা পালন করবে। ভারতে সরকারের নির্মমতা, হৃদয়হীনতা এবং চরম অপাদর্থতার দোসর হয়েছে বিচার বিভাগের অনীহা এবং সরকারের পদক্ষেপে মৌন সম্মতি প্রদান। পরিযায়ী শ্রমিকদের বিষয় নিয়ে প্রথম আবেদনটা যখন সুপ্রিম কোর্টে উঠল, সরকার রাস্তায় পরিযায়ী শ্রমিকদের অবস্থানের কথাই অস্বীকার করল। গোটা ব্যাপারটাকেই ভুয়ো খবর এবং আতঙ্ক ছড়ানোর কাজ বলে চালানো হল আর সুপ্রিম কোর্ট সরকারের কথাকেই মেনে নিল। লকডাউন কালে মজুরি দেওয়ার প্রসঙ্গ যখন উঠল, প্রধান বিচারপতি এই বলে বিস্ময় প্রকাশ করলেন যে, শ্রমিকরা যখন বিনা পয়সায় খাবার পাচ্ছে তখন তাদের মজুরির প্রয়োজনটা কোথায়। অবশেষে দু-মাস পর সুপ্রিম কোর্ট নিজের থেকেই বিষয়টাকে গ্ৰহণ করল এবং পরিযায়ী শ্রমিকদের বিনা ভাড়ায় ফেরানোর ব্যবস্থা করতে সরকারকে বলল। তখন কিন্তু সুবিপুল প্রতিবন্ধকতা এবং নিরাপত্তাহীনতা ও নিপীড়ন, যন্ত্রণা ও অবমাননার মোকাবিলা করে হাজার-হাজার শ্রমিক ইতিমধ্যেই বাড়ি ফিরে এসেছেন, এবং অনেক ক্ষেত্রেই নিজেদের জীবন দিয়ে তাঁদের বড় ধরনের মূল্যও চোকাতে হয়েছে। আধিপত্যকারী মিডিয়া গোটা সংকটটায় কোনো গুরুত্বই দিল না, তবে যে কয়েকজন সাংবাদিক গুরুত্ব দিয়ে সংকটটাকে তুলে ধরলেন সরকার সুপ্রিম কোর্টের সামনে তাদের ‘শকুন’ বলে অভিহিত করল।
৪। পরিযায়ী শ্রমিকরা বাড়ি ফিরে আসতে চেয়েছিল, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তাদের এখন কোয়ারান্টাইন কেন্দ্রে থাকতে হচ্ছে আর সেগুলোতে অব্যবস্থা এবং প্রস্তুতিহীনতা চরম অবস্থায় থাকায় সেগুলোকে অন্য নামে বন্দী শিবির বা নির্যাতন কক্ষ বলাই শ্রেয়। মুম্বাই, আমদাবাদ, সুরাট, দিল্লী এনসিআর অথবা বেঙ্গালুরুর মতো কোভিড বিপর্যস্ত নগরগুলোর ভিড়ে ঠাসা বাড়িগুলোতে পরিযায়ী শ্রমিকদের গাদাগাদি করে ঢোকানোয় কোভিড-১৯ অতিমারীর প্রকোপের সামনে ভারতে তাদের সবচেয়ে নিরাপত্তাহীন সামাজিক গোষ্ঠীগুলোর অন্যতম করে তোলা হয়েছে। লকডাউন শুরু হওয়ার আগে বা লকডাউনের গোড়ার দিকে তাদের বাড়ি ফেরাটা সুনিশ্চিত না করে এমন সময় তাদের ফিরতে বাধ্য করা হল যখন অতিমারী দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। এটা পরিযায়ী শ্রমিক এবং তাদের পরিবারগুলোকে শুধু মহামারীর শিকার হওয়ার সম্ভাবনার মুখে এনেই ফেলেনি, সামাজিক অনাস্থা ও বিভেদের শিকার হওয়ার এবং নিজেদের গ্ৰামগুলোতে ও সন্নিহিত অঞ্চলে ক্রমেই আরও বেশি করে মানসিক চাপে পড়ার সম্ভাবনাকেও প্রকট করে তুলেছে।
৫। মহামারী এবং স্বৈর চরিত্রের ও পরিকল্পনাহীন লকডাউনের সংযুক্ত অভিঘাত সৃষ্ট বিপর্যয় ক্ষণস্থায়ী এবং সীমিত মাত্রার হবে না। চার দিকের অবস্থা দেখে বোঝা যাচ্ছে যে লকডাউন থেকে বেরিয়ে আসার প্রক্রিয়া দীর্ঘস্থায়ী এবং তালগোল পাকানো হবে। লকডাউন শুরু হওয়ার আগে থেকেই অর্থনীতি মন্থরতার কবলে ছিল, আর এখন সরকারও স্বীকার করছে যে বিপুল আকারেই অর্থনীতির হ্রাস ঘটবে। অর্থনীতি সংকুচিত হয়ে বৃদ্ধি শূন্যের নীচে নেমে যাবে। মোদী সরকার যে দিশায় অর্থনীতিকে চালাচ্ছে তার কারণেই পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে। রাষ্ট্রের আরও বেশি হস্তক্ষেপ ঘটিয়ে, সরকারী ব্যয় বাড়িয়ে এবং দরিদ্রদের কাছে বড় আকারে নগদ অর্থ ও খাদ্যশস্য হস্তান্তর করে জনগণের মধ্যে চাহিদার বৃদ্ধি ঘটিয়ে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার দিকে পদক্ষেপ সরকার তো করছেই না, বিপরীতে, অর্থনীতির আরও উদারিকরণ ঘটাতে সরকার এই সংকটকে একটা সুযোগ করে তুলছে; আর শ্রম আইনগুলোকে বাতিল ও মুলতুবি করে দিয়ে এবং প্রয়োজনীয় পরিবেশগত ও কারখানা নিয়ন্ত্রণ বিধিগুলোকে লঘু করে তুলে পুঁজিকে তোষণ করারও একটা সুযোগ হয়ে তার কাছে দেখা দিচ্ছে এই সংকট। প্রতারণার উদ্দেশ্যে এই সবকিছুকেই হাজির করা হচ্ছে “আত্মনির্ভর ভারত অভিযান”-এর মোড়কে, যা নাকি ভারতকে আত্মনির্ভর করার অভিযান। সত্যিকারের আত্মনির্ভরতা বলতে কিন্তু বোঝাবে অভ্যন্তরীণ বাজার ও জনগণের ভোগব্যয়ের বিকাশ ঘটানো। সরকার কিন্তু এর বিপরীতটারই পরিকল্পনা করছে – সস্তা শ্রমের ভিত্তিতে বিশ্বের কাছে বিকোনোর লক্ষ্যে মজুরি ও ভোগব্যয়কে দমিয়ে রাখার আয়োজন করছে।
৬। বৃহত্তর স্তরের অর্থনীতির এই প্রেক্ষাপট পরিযায়ী শ্রমিকদের ভবিষ্যতের সামনে এক বড় প্রশ্নচিহ্নকে তুলে ধরছে। কতজন পরিযায়ী শ্রমিক তাদের কাজের জায়গায় ফিরে গিয়ে লকডাউন শুরুর আগের জীবন পথকে আবার ফিরে পাবেন তা বলা শক্ত। তাদের মূল যে অঞ্চল ও রাজ্য, সেখানের অর্থনীতির মধ্যে তাদের পুনরায় একীভূত হওয়া/স্থান হওয়ার সম্ভাবনার কথা কি আমরা ভাবতে পারি? তাদের নিজেদের অঞ্চলে/রাজ্যে কাজের ও মোটামুটি মজুরির সুযোগের যে অভাব ছিল, যার কারণে তুলনামূলক ভালো জীবিকার সন্ধানে তাদের ভিন্ন রাজ্যে ও শহরে পারি দিতে হয়েছিল, সেই পরিস্থিতি এখনও রয়েছে। স্থানীয় স্তরের অর্থনীতি পাল্টালে তবেই এই অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে – রুগ্ন ও বন্ধ কারখানার পুনরুজ্জীবন হওয়া ও সেগুলো পুনরায় খোলা, এবং কৃষিভিত্তিক ও অন্যান্য শ্রমনিবিড় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের শৃঙ্খল গড়ে ওঠা, এবং এইভাবে কর্মসংস্থান ও উপার্জনের সম্ভাবনার উন্নতি বিধান। স্বল্প-মেয়াদী পরিপ্রেক্ষিতের কথা ধরলে, এর পরিপূরক হতে হবে নরেগার আরও উন্নত ও কার্যকরী কাঠামো (যা বেশিদিন স্থায়ী হবে এবং যাতে কাজ পাওয়ার সুযোগ ও মজুরি বাড়বে), শহরাঞ্চলের বেকারদের জন্য কর্মনিশ্চয়তা আইন চালু করা, সরকারী কাজের বিপুল সম্প্রসারণ ঘটানো (যাতে অগ্ৰাধিকার দিতে হবে সরকারী হাসপাতাল এবং স্কুল ও কলেজ তৈরির ওপর), বেকারদের সুযোগ-সুবিধা/ভাতা দেওয়ার সংস্থান করা এবং স্ব-নির্ভর গোষ্ঠী ও স্টার্ট-আপদের আরও কার্যকরী উদ্যোগী সহায়তা প্রদান।
৭। পরিযায়ী শ্রমিকদের ফিরে আসাটা শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনের কাছে এবং প্রগতিবাদী সামাজিক রূপান্তরণের এজেণ্ডার কাছে একই সাথে নতুন সম্ভাবনায় এবং চ্যালেঞ্জে পরিপূর্ণ। সাধারণভাবে বললে, পরিযায়ী শ্রমিকদের গ্ৰাম সমাজের অগ্ৰণী অংশ রূপে গণ্য করা যায়। জীবিকার সন্ধানে বিভিন্ন শহরে চলে যাওয়ার আগে তাদের অনেকেই সামন্ততান্ত্রিক উৎপীড়নের বিরুদ্ধে এবং সামাজিক ন্যায়ের জন্য সংগ্ৰামে অগ্ৰণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাদের অনেকেই শিক্ষিত যুবক, গ্ৰামীণ অর্থনীতিতে লাভজনক কাজের নিশ্চয়তা না থাকায় যাদের গ্ৰাম থেকে চলে যেতে হয়েছিল। শহরে থাকার সময় শহুরে জীবনযাত্রার আদবকায়দা ও নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে ওদের পরিচয় ঘটলেও গ্ৰামে ওরা যে সামাজিক প্রাসঙ্গিকতা এবং প্রগতিশীল রাজনীতির প্রাণবন্ত পরিবেশ পেত সেটা সেখানে পাওয়া ওদের পক্ষে প্রায় সম্ভবই হয়নি। অনভিজ্ঞ/অনিশ্চিত শহর জীবনের নিরাপত্তাহীনতা এবং কাজের চাপ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের যে কোনো ধরনের শ্রেণী সংগঠন বা শ্রেণী রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে বাধ্য করেছে। অর্থনীতি এবং রাজনীতির ক্ষেত্রে গত কয়েক বছরে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে গেছে। এই পরিবর্তনের বৈশিষ্ট্য রূপে দেখা গেছে নয়া-উদারবাদী নীতিমালার নিরন্তর আক্রমণ, দক্ষিণপন্থী ধ্যানধারণার বিস্তার, সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলোর আগ্ৰাসী উত্থান, আধিপত্যকারী মিডিয়ার প্রকৃতিতে পরিবর্তন এবং সোশ্যাল মিডিয়ার পরিসরে মেকি ও বিকৃত সংবাদ এবং সাম্প্রদায়িক উগ্ৰ-জাতীয়তাবাদী প্রচারের রমরমা। এ সমস্ত কিছুই তাদের রাজনৈতিক পছন্দে প্রভাব ফেলেছে এবং পরিযায়ী শ্রমিকরা ২০১৪ ও ২০১৯ সালে মোদীর বিজয়ের শক্তিশালী মাধ্যম হয়ে ওঠে। এবার এই শ্রমিকরা চূড়ান্ত মোহমুক্ত অবস্থায় ফিরে আসছেন – রাষ্ট্র যাদের পরিত্যাগ করেছে, অর্থনীতি যাদের নিংড়ে নিয়েছে এবং প্রাধান্যকারী সমাজ যাদের অবমাননা ঘটিয়েছে। এই মোহমুক্তিকে নতুন রাজনৈতিক উদ্যম এবং চেতনার ধারায় চালিত করার ক্ষেত্রে যেমন প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে তা তেমনি আবার যথেষ্ট চ্যালেঞ্জময়ও বটে।
৮। বাম ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের কাছেও পরিযায়ী শ্রমিকরা কখনই শ্রমিকদের গুরুত্বপূর্ণ বর্গ হিসেবে বিবেচিত হয়নি। চরম নিরাপত্তাহীনতার সময় বাম ট্রেড ইউনিয়ন এবং দলগুলো অবশ্য শ্রেণী ঐক্যের পক্ষে এবং পরিযায়ী শ্রমিকদের বুনিয়াদি স্বার্থ ও জীবন রক্ষায় হস্তক্ষেপ ঘটিয়েছে। তবে সেটা কিন্তু তাদের জীবনধারা এবং কাজের পরিস্থিতির স্থায়ী উন্নতি এবং দরকষাকষির ক্ষমতার পরিপ্রেক্ষিতে তেমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেয়নি। পরিযায়ী শ্রমিকদের পরিবারগুলোর বাসস্থান, স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং শিক্ষার মত ইস্যুগুলো এবং নাগরিক হিসাবে পরিযায়ী শ্রমিকদের বিভিন্ন অধিকার (যথা, রেশন কার্ড ও ভোটার কার্ড থাকা) নিয়ে তেমন চর্চা হয়নি এবং সেগুলো অনার্জিতই থেকে গেছে। পরিযায়ী শ্রমিক পরিঘটনাটা দেরিতে হলেও যখন দেশের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে, আমাদের তখন এটা সুনিশ্চিত করতে হবে যে তাদের প্রতি এই স্বীকৃতিটা যেন সহানুভূতির কিছু শূন্যগর্ভ ভাবভঙ্গি প্রকাশের মধ্যে দিয়ে মিলিয়ে না যায়, তা যেন পরিযায়ী শ্রমিকদের সুনির্দিষ্ট অধিকার/লাভে পরিণতি পায়। পরিযায়ী শ্রমিকদের যে অন্যায় ও অবমাননার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে তাকে যেমন “দেশের স্বার্থে আত্মত্যাগ” বলে মহিমান্বিত করলে হবে না, সেরকমই, একটা ক্ষণিকের অসুবিধা বলেও তুচ্ছতায় পর্যবসিত করতে দেওয়া যাবে না। ভারতের শ্রমিক শ্রেণীর এক গুরুত্বপূর্ণ বাহিনীর প্রতি রাষ্ট্র সংঘটিত অপরাধ বলেই এটাকে স্বীকৃত হতে হবে এবং পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করার মধ্যে দিয়ে তার সংশোধন ঘটাতে হবে।
গতকাল নবান্নে সাংবাদিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী আমপান বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত মানুষের ত্রাণ ও পুনর্বাসনের সমস্ত দায় দায়িত্ব প্রশাসনের উপর ন্যস্ত করেছেন। যাদের জন্য ত্রাণ ও পুনর্বাসনের নীতি ও পদক্ষেপ, তাঁরা শুধুই গ্রহীতা, জনগণের অন্য কোনো ভূমিকা নেই। সকলেই জানেন, জনগণের সক্রিয় তদারকি ছাড়া শুধুমাত্র প্রশাসনের উপর নির্ভরতা পক্ষপাতদুষ্ট, বৈষম্যমূলক হতে বাধ্য। দুর্নীতি দূর করার পরিবর্তে আরও আরও বড়মাপের দুর্নীতির জন্ম দেয়ার সম্ভাবনা তৈরি করবে। শাসকদলের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করার লক্ষ্যে এই নীতি প্রয়োগ হবে।
আমরা দাবি করি দুর্নীতিমুক্ত, বৈষম্যহীন, স্বচ্ছ পদ্ধতিতে এবং প্রকৃতই ক্ষতিগ্রস্ত, বিপন্ন মানুষের কাছে ত্রাণ, পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনের অর্থ এবং অন্যান্য সামগ্রী পৌঁছে দেবার কাজে পঞ্চায়েতস্তরে এমনকি ওয়ার্ড স্তরে জনগণের তদারকি কমিটি গঠন করতে হবে।
বাংলার জনগণের এই বিপন্নতার দিনে রাজ্যের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক সংগঠন, নাগরিক উদ্যোগ, ক্লাব ও পাড়া-সংগঠন এমনকি ব্যক্তিবর্গ যখন উদ্যোগ নিতে শুরু করে দিয়েছে, তখন সেকাজ থেকে তাঁদের বিরত করা, তাঁদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার ফরমান মানবতার সঙ্গে প্রতারণা এবং স্বেচ্ছাচারিতার নিদর্শন হয়ে থাকবে। আমরা মুখ্যমন্ত্রীর এই নির্দেশ ও ফরমানের তীব্র বিরোধিতা করি ও নিন্দা করি। সমস্ত বাধা বিপত্তি অগ্রাহ্য করেই বাংলার বিপন্ন মানুষের পাশে আমরা আছি ও থাকব।
ধন্যবাদান্তে,
সিপিআই(এমএল) লিবারেশন, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির পক্ষে
পার্থ ঘোষ
৪/৬/২০২০
সরকারী হোক, বেসরকারি হোক, চিকিৎসা পরিষেবা ব্যবস্থার অ আ ক খ জ্ঞান সম্পন্ন যে কোনো ব্যক্তিই বুঝতে পারবেন, এই পরিষেবা একটি টিমওয়ার্ক। টিমের মধ্যে বোঝাপড়া যত উন্নত হবে, টিমের মধ্যেকার ভারসাম্য যত নিখুঁত ও মজবুত হবে এই পরিষেবা তত উন্নত হবে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ৫০ বেডের হাসপাতাল চালাতে কেউ যদি ৫০ জন চিকিৎসক, ৩ জন নার্স ও একজন সাফাইকর্মী নিয়োগ করেন, তবে হাসপাতাল কেমন চলবে, সহজেই বোঝা যাবে। কোভিড-১৯ সংক্রমণ প্রতিরোধে জুনিয়র চিকিৎসকদের প্রশংসনীয় ভূমিকার পুরস্কার স্বরূপ তাঁদের ভাতা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিল রাজ্য সরকার। রাজ্যের স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর বিবৃতি থেকে তা জানা গেল। আর রাজ্যের প্রাইমারি হেল্থ সেন্টার থেকে মহানগরীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালে কর্মরত যে অসংখ্য নার্স, সাফাই কর্মী, এ্যম্বুলেন্স ড্রাইভার সমান ঝুঁকি নিয়ে, আন্তরিকভাবে করোনা আক্রান্ত অথবা কো-মরবিডিটির রোগীর চিকিৎসায় নিজেদের উৎসর্গ করলেন, এমনকি বারাসাত হাসপাতালের একজন সিস্টার ইনচার্জ করোনা আক্রান্ত হয়ে প্রাণ দিলেন, “তাঁদের মজুরি বা ভাতা বৃদ্ধির প্রশ্ন, যথাসময়ে সিদ্ধান্ত নেবে রাজ্য। জানালেন মাননীয়া প্রতিমন্ত্রী”। এ শুধু বৈষম্য নয়, চরম অপমানজনক। আশাকর্মীরা ন্যূনতম স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়াই বাড়ি বাড়ি ঘুরে করোনা রোগীর সন্ধান করলেন, যে এ্যম্বুলেন্স ড্রাইভার বা সাফাইকর্মী জীবন বাজি রেখে এই অতিমারী সংক্রমণ প্রতিরোধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন, তাঁরা ব্রাত্য থেকে গেলেন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের এই অগণতান্ত্রিক, বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্তের আমরা তীব্র নিন্দা করি। কোভিড-১৯ অতিমারী সংক্রমণের বিরুদ্ধে রাজ্যের ভেঙে পড়া স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অন্তর্জলী যাত্রাপথকে সুগম করবেন না। সরকারী হাসপাতালে কর্মরত জুনিয়র চিকিৎসক বন্ধু ও তাঁদের সংগঠনগুলোর কাছে আমাদের আবেদন, এই বৈষম্যমূলক ভাতা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করুন। এই রাজ্যেরই জুনিয়র ডাক্তাররা আমাদের জন্য সেই ঐতিহ্য রেখে গেছেন।
ধন্যবাদান্তে
পার্থ ঘোষ, রাজ্য সম্পাদক
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি
সিপিআই(এমএল) লিবারেশন
৯/৬/২০২০
কোভিড-১৯ অতিমারী ও লক-ডাউনের যাঁতাকলে দেশ ও রাজ্য যখন চরম সংকটে, তখন নরেন্দ্র মোদীর সেই বহু আলোচিত উক্তি “সংকটই সুযোগ” এনে দেবেকে কার্যকরী করতে আসরে হাজির অমিত শাহ। বাংলা নিয়ে ভার্চুয়াল সভায় অমিত শাহ আমপান বিপর্যয়কে জাতীয় বিপর্যয় ঘোষণা করতে আগ্রহী নন। যে হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিকরা সর্বস্ব হারিয়ে বিপন্ন অবস্থায় ঘরে ফিরেছেন ও ফিরছেন, তাদের জন্য ন্যূনতম আর্থিক সহায়তা ঘোষণা করতেও উদগ্রীব নন। তিনি আগ্রহী তাঁর অসমাপ্ত কাজ এনপিআর, এনআরসি, সিএএ রূপায়ণ করার কাজে গতি আনতে। করোনা সংকটের আবহাওয়ায় নয়া বাংলা গড়ার নামে রাজ্য দখলের নীল নকশা তৈরি করার জন্য বাংলা নিয়ে ভার্চুয়াল সভায় হাজির হলেন অমিত শাহ। সভায় হাজির ব্যক্তিবর্গ হের হিটলার বন্দনার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ভার্চুয়াল সভা আলোকিত করল। ফ্যাসিস্ট রাজনীতির বাংলা দখলের রাজনীতিকে প্রতিহত করতে বাম গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকেই সোচ্চার হতে হবে।
ধন্যবাদান্তে
পার্থ ঘোষ
সম্পাদক, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি, সিপিআই(এমএল) লিবারেশন
৯/৬/২০২০
নাম হরেকরকম। সবার সুদের ব্যবসা। মাইক্রো ফাইন্যান্স জাল বিছিয়েছে পশ্চিম বঙ্গের প্রতিটি জেলার প্রতিটি গ্রামের প্রতি পাড়ায়। আশীর্বাদ মাইক্রো ফাইন্যান্স, এলএনটি ফাইন্যান্স, বন্ধন, উজ্জীবন, ভিলেজ, জানা স্মল ফাইন্যান্স, সমস্তা, এসকেএস, স্বতন্ত্র মাইক্রো ফাইন্যান্স, ভেদিকা ক্রেডিট ক্যাপিটাল, গ্রামশক্তি ফুলটন ইন্ডিয়া, শার্টিল ক্রেডিট কেয়ার এদের সবারই রমরমা ব্যবসা।
বাধ সেধেছে লকডাউন। তার উপর আমফানের ধাক্কা। গ্রামের মানুষ ঋণ নিয়েছিলেন রাজ্যের বাইরে কর্মরত ছেলেদের পাঠানো উপার্জনের ভরসায়। সে টাকায় ঋণের কিস্তি পরিশোধ হবে। কিন্তু এখন সে রাস্তা বন্ধ। কেউ বা লোন নিয়ে চাষে লাগান। আমফানে ক্ষতিগ্রস্ত খেত। ধান, সব্জি, তিল, আম, কলা সব ফসলের দফারফা। সংসার চালানোই দায়। কোনো ক্ষতিপূরণও মেলেনি। ঋণ শুধবেন কিভাবে? সরকার বলেছে, লকডাউনের সময় কিস্তি আদায় করা চলবে না। কিন্তু মাইক্রো ফাইন্যান্স কোম্পানি ছাড়ছে কৈ? নিয়ম করে চলছে হুমকি তাগাদা। সব মিলিয়ে দিশেহারা মানুষ।
লকডাউনের আগেও গ্রামীণ অর্থনীতির হাল ভালো ছিল না। ফসলের দাম না থাকা, নোট বাতিল, কাজের অভাব ইত্যাদি নানা কারণে ভুগছিল গ্রাম। তবুও কোনোরকমে ঋণ পরিশোধ চলছিল। লকডাউনের শুরু থেকেই মাইক্রো ফাইন্যান্স নিয়ে আমরা নিয়মিত প্রচার চালাতে থাকি। ইতিমধ্যে আইপোয়া স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির ঋণমকুবে সর্বভারতীয় দাবি দিবস পালনের ডাক দিলে পোলবা দাদপুরের আমনান অঞ্চলের ঋণগ্রস্ত মানুষের ডাক দেওয়া হয়। দেখা যায় মরিয়া মানুষ বড় সংখ্যায় যোগ দিলেন অবস্থানে। কিন্তু পরিস্থিতি কেবল ‘দাবি দিবসে’ সীমায়িত ছিল না। দাবি দিবস পালনের দিনেই আমরা স্থির করি এই মহাজনী পুঁজির দৌরাত্ম্য কোন অবস্থাতে পৌঁছেছে, তা আরো স্পষ্ট বুঝতে ফর্মের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা দরকার। সরকারের সাথে ঋণ মকুবের দাবিতে লড়তে গেলেও তথ্য নির্দিষ্ট হওয়া প্রয়োজন। সেইমতো সেদিনই জমা পরে কয়েকশো মানুষের ঋণ সংক্রান্ত বিবরণ। পরবর্তী কয়েক দিনই বিডিও অফিসে দলে দলে মানুষ আসতে থাকেন ঋণ মকুবের দাবিতে।
এই পরিস্থিতিতে ৮ জুন আবার আরো বড় আকারে বিডিও ডেপুটেশনের ডাক দেওয়া হয় ইতিমধ্যে গড়ে ওঠা লকডাউন ও আমফানে ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্রদের সংগঠন ঋণমুক্তি কমিটির ব্যানারে। ৮ জুন পোলবা বিডিও মাঠের চতুর্দিকে যারা জড়ো হয়েছিলেন; এদের সমস্যা শুধু নিত্যদিনের খাদ্য বা রেশন, করোনা কিংবা আমফানের ধাক্কায় জমির ফসলহানি, ভাঙ্গাচোরা ঘর ইত্যাদিই নয়, এসব ছাড়াও এদের খুবই বড় উদ্বেগ ঋণ সম্পর্কিত। শুধবেন কিভাবে!! ঋণ মুক্তির পথ কি?
সামগ্রিক পরিস্থিতির কথা ভেবেই আমরা ডাক দিয়েছিলাম-বলা হয়েছিল প্রতিটি গ্রুপের সকলে (১০/১৫ জন থেকে ৮০/৯০ জন) নয়, কোভিডের সংক্রমণ বিষয়টি মাথায় রেখে প্রত্যেক গোষ্ঠী থেকে ২ জন চলে আসুক পোলবা-দাদপুর বিডিও অফিসের মাঠে। পৌঁছাতে হবে বেলা ১টায়। প্রথমে আলোচনা হবে। শেষে বিডিও মারফত মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে স্মারকলিপি পাঠানো হবে। দেখা গেল বেলা ১ টার আগেই ব্লকের প্রত্যন্ত এলাকাগুলি থেকেও চলে এসেছেন কয়েকশো মানুষ। বেলা ২টার মধ্যে জমায়েত ২/৩ হাজারের!
শুরুতেই আমরা তুলে ধরি আমাদের শ্লোগান, শিল্পপতিদের যদি লোন মকুব হয়, রাইট অফ হয়, বেল আউট হয়, সংকটে নানা ছাড় হয়; তবে এই লকডাউন-আমফান পর্যায়ে গরিবের ঋণমুক্তিতে কেন সরকার ভূমিকা রাখবে না? সব সরকার দাবি করে তারা “আম আদমি”র সরকার। তবে ঋণগ্রস্ত মানুষের দাবি কেন শুনবে না সরকার। আমাদের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য স্পষ্ট করে তুলে ধরে আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে কিনা, সমবেত মানুষের কাছে জানতে চাইলে আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যেতে হাত তুলে সম্মতি প্রদান করলেন সকলেই।
৯ জুন থেকে শুরু হচ্ছে আন্দোলনের নতুন উদ্যোগ-মুখ্যমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে প্রত্যেক ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিদের চিঠি-ঋণমুক্তির আবেদন সহ। ৮ তারিখে প্রিন্ট করে নিয়ে যাওয়া কয়েকহাজার পোস্টকার্ড ফুরিয়ে গেল নিমেষে। একই সাথে চলছে এলাকায় এলাকায় ঋণমুক্তি কমিটির শাখা গঠনের কাজ। আন্দোলন চলার মাঝে ২/৩ ভ্যান পুলিশ ঢোকে সংক্রমণ ছড়ানোর অজুহাতে আন্দোলন ভাঙ্গতে, ঢোকেন জেলা পরিষদের বড় নেতা। জয়েন্ট বিডিও-কে এগিয়ে দেওয়া হয় বলতে যে এই আন্দোলন ভাঁওতা মাত্র। তিনি চেষ্টা করেন আমাদের বিরুদ্ধে সমবেত মানুষকে দাঁড় করাতে। কিন্তু ব্যর্থ হলেন।
সমস্ত প্ররোচনা নস্যাৎ করে শেষে মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে লেখা স্মারকপত্র বিডিও-কে জমা দিয়ে বাড়ি ফিরলেন পাগান মুর্মু, গোপাল রায়, শৈলেন মাজি, সোমা রায়, সজল দে, সজল অধিকারীরা। তাঁদের সাথেই সমান তালে নেতৃত্ব দিলেন সাথী সম্রাট, নন্দলাল জাহাঙ্গীর, হারু রায়, নীলিমা পালের মতো গণ আন্দোলনের একদল সম্ভবনাময় নেতৃবৃন্দ।
৯ জুন সকালে হুমকি ফোন করেন গোস্বামী মালিপাড়ার এক তৃণমূল নেতা। ওঁদের বক্তব্য স্পষ্ট; লোন নিয়েছে; শোধ করতে হবে যেকোনো প্রকারে! এসব ওঁরা বরদাস্ত করবেন না। এই ফোন আসার আগে ও পরে প্রায় সারাদিন ধরে ফোন আসে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী এবং এখনো পর্যন্ত অংশ নেননি এমন অনেক মানুষের, যাঁদের বক্তব্যও পরিষ্কার; শিল্পপতিদের যদি বারংবার ঋণ মকুব হতে থাকে, তবে গ্রামীণ দরিদ্রদের কেন ঋণমকুব হবে না!! লড়বো আমরা, জিতবো আমরা।
লকডাউন সম্ভবত এমন এক অভিজ্ঞতা, যা চিনিয়ে দিচ্ছে অনেককিছু। জনপ্রতিরোধের মুখে ব্যাঙ্কারে ছুটতে হয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ট্রাম্পকেও! নতুন পৃথিবীর এই দিনবদলের গান যেন শুনি পোলবার মাটিতে। সাথী, কোনদিক বেছে নিবি বল –
-- সজল অধিকারী
ধনেখালিতে আন্দোলনরত জনগণের জয়। অনশনস্থলে উপস্থিত হলেন পঞ্চায়েত ও বিডিও অফিসের কর্মকর্তারা। দু-এক দিনের মধ্যে শুরু হবে ১০০ দিনের কাজ, জয়হরিপুরে। একাংশের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে পারিবারিক জবকার্ডে। নতুন জবকার্ডের জন্য বাকিদের তালিকা দেওয়া হল প্রশাসনকে।
পুর্ব বর্ধমান জেলার কালনা-২নং ব্লক-এর অকালপোষ অঞ্চলের আগ্রাদহ, ঝিকড়া ও বাজিতপুর গ্রামের পানীয় জল সরবরাহ করার জন্য ২টি পিএইচই জল প্রকল্প তৈরি হয়ে আছে অনেক দিন হয়ে গেল। এমনকি গ্রামের মানুষদের না জানিয়ে গোপনে তৃণমূলের নেতারা নিজেদের মতো ৪ জন অপারেটর নিয়োগ করে ফেলেছে। যারা জানুয়ারী মাস থেকেই বেতন পাচ্ছেন। কিন্ত গ্রামের মানুষ এখনও পানীয় জল পাচ্ছেন না। শোনা যাচ্ছে তৃণমূলের নেতারা ঠিকাদারদের থেকে জল সরবরাহের পাইপের মিটার পিছু কাটমানি চাইছেন। তাই দুর্নীতি দলবাজি ও পানীয় জল না পাওয়ার ফলে এলাকার মানুষের মধ্যেক্ষোভ বেড়ে চলেছে। গত ৫ জুন আগ্রাদহ গ্রামের বাস স্ট্যান্ড এলাকায় সিপিআই(এম-এল) লিবারেশন-এর কালনা লোকাল কমিটির নেতৃত্বে প্রায় ২০০ লোকের মিছিল ও বিক্ষোভ সংগঠিত হয়। বিক্ষোভে দাবি ছিল – পিএইচই প্রকল্প দ্রুত চালু করে পানীয় জলের ব্যবস্থা করতে হবে। অপারেটর নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতি দলবাজির বিরুদ্ধে সমস্ত মানুষ এক হোন। জল সরবরাহ নিয়ে কাটমানি নেওয়া চলবে না। আমফান ঝড়ের ক্ষতিপূরণ নিয়ে দলবাজি দুর্নীতির বিরুদ্ধে সমস্ত মানুষ রুখে দাঁড়ান। বিক্ষোভ সমাবেশ এ বক্তব্য রাখেন লোকাল কমিটির সম্পাদক কমরেড রফিকুল ইসলাম।
৮ জুন বর্ধমান শহরে আমেরিকায় জর্জ ফ্লয়েড নৃশংস ভাবে পুলিশের হাতে খুন হন। তার বিরুদ্ধে আমেরিকান জনগণের উত্তাল বিক্ষোভ আন্দোলনের সমর্থনে বামপন্থীদের গণ সংগঠন গুলো যৌথভাবে প্রতিবাদ সংগঠিত করেন। এই প্রতিবাদ কর্মসূচীতে সিপিআই (এম-এল) লিবারেশন-এর জেলা সম্পাদক কমরেড সলিল দত্ত এআইকেএম-এর রাজ্য সভাপতি কমরেড অন্নদাপ্রসাদ ভট্টাচার্য সহ শহরের কমরেডরা উপস্থিত ছিলেন। আমেরিকার বর্নবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো হয়। সাথে আমাদের দেশের দলিত আদিবাসীও সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানোর বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ জানান হয়।
-- সজল পাল
রাজ্যের বিভিন্ন গণসংগঠনগুলির সমন্বয়ে কেন্দ্রীয় ভাবে ত্রাণ সংগ্রহ করে লকডাউনে বিপন্ন ও আমপান ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় বিলিবন্টনের কাজ চলছে। শিরোনাম “মানুষ মানুষের জন্য”। সেই সাথে বিভিন্ন এলাকা স্তরেও বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে গঠিত নাগরিক উদ্যোগে বহুবিধ কাজ চলছে। কোথাও জরুরি প্রয়োজনের নিরিখে প্রত্যন্ত ও সম্পূর্ণ অপরিচিত এলাকায় দ্রুত ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে, কোথাও ধারাবাহিকভাবে ত্রাণের সাথে পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনের আন্দোলনমুখী প্রশ্নকে সমন্বিত করার প্রচেষ্টা চলছে।
চাষের জমিতে নোনা জল ঢুকে গিয়ে চার পাঁচ বছর ধরে তাকে চাষযোগ্য করে তোলার মতো খানিক দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা যেমন রয়েছে, তেমনি প্রকৃত অর্থে সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়তে চলেছে সুন্দরবনের অরণ্য-প্রকৃতি ধ্বংসের মাধ্যমে। সবুজ ধ্বংসের একটা বাস্তবতা দেখা যাচ্ছে আমফানপূর্ব ও আমফানোত্তর সুন্দরবনের স্যাটেলাইট চিত্রের তুলনা থেকে। পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনের প্রশ্নের সাথে এই সুদূরপ্রসারী ও দীর্ঘকালীন প্রেক্ষাপটটিও যুক্ত।
নীচে গত সপ্তাহের কিছু উদ্যোগ ও অভিজ্ঞতার রিপোর্ট দেওয়া হল। সাধারণভাবে ফুড প্যাকেট বলতে চাল, ডাল, তেল, নুন, সয়াবীন, আলু, পেঁয়াজ, ছাতু, চিঁড়ে, চিনি, চা-পাতা ইত্যাদি দ্রব্য প্রয়োজন ও সামর্থ্য অনুযায়ী পরিমাণে একত্রিত প্যাকেট বোঝানো হয়েছে। অন্যান্য সামগ্রির মধ্যে রয়েছে ত্রিপল, মোমবাতি, লম্ফ, স্যানিটরি প্যাড, ওআরএস, সাবান, সার্ফ, বাচ্চাদের ওয়েফার ইত্যাদি। সব রিপোর্টে বারবার এইসবের পুনরাবৃত্তি এড়ানো হয়েছে। অর্থ সংগ্রহ থেকে শুরু করে ব্যবস্থাপনা, স্পটে গিয়ে পৌঁছনো থেকে শুরু করে সার্ভে ইত্যাদি কাজে বহু সাথি বন্ধুর উদ্যোগ যুক্ত। অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে গিয়ে কয়েকটি মাত্র নাম এসেছে বর্ণনার প্রয়োজনে। ধারাবাহিক এই নাগরিক উদ্যোগে সিপিআই(এমএল)-এর সাথে যুক্ত বা পরিচালিত সমস্ত গণসংগঠন ও গ্রুপ ছাড়াও সাথে আছে পিইউসিএল, অরিজিৎ মিত্র স্মারক কমিটি, সহমন, বোকাবুড়ো প্রভৃতি সংগঠন ও গ্রুপ এবং বহু ব্যক্তিবর্গ।
৫ জুন দঃ ২৪ পরগণার বাখরাহাট গ্রাম পঞ্চায়েতের হাটবেরিয়া গ্রামে ত্রাণের কাজ চলে। এলাকায় প্রধানত সংখ্যালঘু দিনমজুরদের ঘনবসতি। প্রায় চারশত পরিবারের বসবাস। এখানে দেখা গেলো কোনরকম ‘সামাজিক দূরত্ব’র বালাই নেই! গরিবগুর্বো মানুষদের মধ্যে রয়েছে এক স্বাভাবিক পারস্পরিক সামাজিক নৈকট্য। ঘিঞ্জি গলিতে সারি সারি চাপবন্দি ঘর গেরস্তালি। সেখানে নেই কোনো শারিরীক দূরত্বের পরিসর বা অবকাশ, কিংবা তা নিয়ে কোনো দুর্ভাবনা!
লকডাউন এঁদের জীবিকা কেড়ে নিয়েছে। তবে, সংক্রমন এখনও থাবা বসায়নি। এখানকার মেহনতি মানুষেরা অনেকেই দর্জির কাজ করেন। এছাড়া ভ্যান রিকসা চালানো, মরসুমী ক্ষেতমজুরি, হোটেলে কাজ করা প্রভৃতি নানাবিধ পেশায় এঁরা দিন গুজরান করেন। লকডাউনে দর্জির কাজ বন্ধ। রেশনে অধিকাংশ মানুষেরা ৫ কেজি চাল পেয়েছে, স্বল্প সংখ্যকের জুটেছে ১০ কেজি চাল-গম বা আটা। এ ছাড়া লকডাউনে আর কিছুই গরিব মানুষেরা পায়নি। আমফান ঘূর্ণিঝড়ে বেশ কয়েকটি পরিবারের ঘর ভেঙ্গে গেছে, যাদের রয়েছে মাটির ঘর, টালির চাল। আংশিক ক্ষতি বহুসংখ্যকের। মুস্টিমেয় কয়েকজন প্লাস্টিকের ছাউনি পেয়েছে। অনেকের সেটাও জোটেনি। ক্ষতিগ্রস্ত ৩৩ জনের একটা তালিকা তৈরি করা হলো। দেখা গেলো তার মধ্যে প্লাস্টিকের শীট পেয়েছে মাত্র ৪ জন! পাকা ঘরের খবর নিয়ে জানা গেলো গোটা বাখরাহাট গ্রাম পঞ্চায়েতের ১৯টি বুথে (প্রতি বুথে প্রায় তিন-চারশ পরিবার থাকার সম্ভাবনা) আবাস যোজনার ঘর পেয়েছে মাত্র ৬৫০ জন! সকলের জন্য পাকা ছাদের সরকারী ঘোষণার দৌড় কতটা এখান থেকে সহজেই অনুমান করা যায়। রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে প্রান্তিক জনজীবনের দারিদ্র্য বঞ্চনার এক সাধারণ চিত্র এখানেও প্রকটভাবেই চোখে পড়ে।
গ্রামের কয়েকটি পাড়ায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ঘরবাড়ি পর্যবেক্ষণ করে ক্ষতিপূরণের জন্য প্রাথমিক একটা তালিকা তৈরি করলেন এলাকার পরিচিত নকশালপন্থী নেতা দিলীপ পাল। একরাশ ক্ষোভ নিয়ে ভীড় করে আসা মানুষদের তিনি বললেন, “আমরা সরকারী লোক নই, আমরা না পাওয়া লোকদের নিয়ে আন্দোলন করি, সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করি। আপনাদেরও আমাদের সঙ্গে থাকতে হবে”। উপস্থিত মানুষের চোখে মুখে ফুটে ওঠে সম্মতি। এর আগে ঐ গ্রামের ৫০ জন মানুষকে ফুড প্যাকেট ও অন্যান্য সামগ্রি দেওয়া হয়। খুবই দুঃস্থ আরও ২৫/৩০ জনকে ত্রাণ প্যাকেট দেওয়ার কথা বলেন স্থানীয়রা। সেটা পূরণ করা ও আগামীদিনে ঘর ও ক্ষতিপূরণের দাবিতে আন্দোলনের কথা মানুষকে জানানো হয়। আমফানের পরবর্তীতে স্পেশাল রিলিফের খাদ্যদ্রব্যের প্যকেট বিলি করেছে শাসক তৃণমূলের নেতারা। ঐ পাড়ায় বেছে বেছে ২৫/৩০ জনকে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া পঞ্চায়েতের “সহায়” নামক প্রকল্পে একেবারেই নিঃসহায় এমন মানুষদের বিনামূল্যে খাদ্য সরবরাহ করার কথা। এলাকার সাংসদের ছবি নিয়ে ঐ প্রকল্পের মাধ্যমে দুই দিন রান্না করা খাবার দেওয়া হয়েছে গড়ে একশো মানুষকে। অপ্রাপ্তি ও বঞ্চনার এই প্রেক্ষাপটে আগামী ১২ জুন বিষ্ণুপুর-২ ব্লক দপ্তরে এআইকেএম-এর পক্ষ থেকে বিক্ষোভ ডেপুটেশনে এলাকার মানুষকে সামিল করার উদ্যোগ নিচ্ছে এলাকার সংগঠন।
-- রিপোর্ট: জয়তু দেশমুখ
জয়নগর-২ ব্লকের নলগোড়া দ্বীপে কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতি (আয়ারলা)-র পক্ষ থেকে ৯ জুন ৩২টি পরিবারের মধ্যে ত্রাণ বন্টন হয় স্থানীয় নির্মাণ শ্রমিক স্বপন নাইয়ার ব্যবস্থাপনায়।
রিপোর্ট: নবকুমার বিশ্বাস
লকডাউনের প্রথম পর্ব থেকেই সিপিআই(এমএল)-এর যাদবপুর শহীদনগর পার্টি অফিসকে কেন্দ্র করে স্থানীয় কর্মহীন ও বিপন্ন মানুষের মাঝে ফুড প্যাকেট দেওয়ার নাগরিক উদ্যোগ ধারাবাহিকভাবে চলছিল। ২০ মে আমফান ঘূর্ণীঝড়ের পর থেকে বিধ্বস্ত এলাকায় দ্রুত খাবার ও অন্যান্য জরুরি সামগ্রি পৌঁছে দেওয়ার বিষয়টি প্রধান হয়ে ওঠে। এধরনের অনেক এলাকা থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে সাহায্যের আবেদন আসতে থাকে। সেই অনুযায়ী প্রথম সপ্তাহে দক্ষিণ ২৪ পরগণার কুলতলি ও উত্তর ২৪ পরগণার মিনাখাঁ ব্লকে কয়েকটি এলাকায় পৌঁছে যাওয়া গেছিল। গত সপ্তাহে ক্যানিং-১ ব্লকের ঘুটিয়ারী শরিফ, গোসাবা ব্লকের বালি দ্বীপ ও ক্যানিং-২ ব্লকের দক্ষিণ বুধাখালিতে ত্রাণ সামগ্রি নিয়ে যাওয়া হয়।
৯ জুন যাওয়া হয় দক্ষিণ বুধখালি, ক্যানিং থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে একটি গ্রাম। আমফান বিধ্বস্ত এই গ্রামে এর আগে পৌঁছায়নি কোনোরকম সাহায্য। স্থানীয় এক কলেজ পড়ুয়ার ডাকে সাড়া দিয়ে কলকাতার কমরেডরা ন্যূনতম জীবনধারণের কিছু সামগ্রী নিয়ে পৌঁছে গেছিলেন। ১৫০টি পরিবারে তা বিতরণ করা হয়। ক্যানিং মহকুমা হাসপাতাল পেরিয়ে ডানদিকে ঢুকতেই রাস্তা জুড়ে ভাঙা বিদ্যুতের খুঁটি আর গোড়া উপড়ানো গাছ। দুপাশে অসংখ্য ছোট বড় বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত। হেড়োভাঙা বাজারের পর থেকে রাস্তা পুরোটাই ভাঙা। মাতলা নদীর ধার দিয়ে আরো এগিয়ে ভিতরের ইঁটের রাস্তা পার হয়ে গ্রামের ভিতরে ঢুকতেই নজরে পড়ে আমফানের প্রকোপ। মাতলা নদীর মাটির বাঁধ ভেঙে গ্রামে জল ঢুকে ভাসিয়েছে খাল, বিল, চাষের জমি। সর্বত্র নোনা জলের আস্তরণ। খালের পাশের যে মাটির রাস্তা, গত সপ্তাহেও সেখানে নোনা জল জমে ছিল, খালে জোয়ার ভাঁটা খেলছিল। তীব্র নোনা জলের বাষ্পে জ্বলে গেছে বহু গাছের পাতা। দশ বছর আগে আয়লা হওয়ার পরে যে বাঁধ পাকা করার করা ছিল তা আজও হয়নি। দক্ষিণ ২৪ পরগণার এই অঞ্চল সবজি চাষের জন্য বিখ্যাত। এখান থেকে সবজির একটা বড় অংশ আসে কলকাতার বাজারগুলোতে। গ্রামবাসীদের অনেকেই ভিনরাজ্যে যান নির্মাণ শ্রমিকের কাজে, আর বেশিরভাগই সবজি চাষ করেন। লকডাউনে তাদের কাজ হারিয়েছে আর আমফানে গ্রামের সমস্ত জমি নোনা জলের প্রভাবে চাষের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। ফলে তাদের সামনে আজ জীবিকা নির্বাহের সব রাস্তাই বন্ধ।
গ্রামে আসা প্রথম ত্রাণের গাড়িটির জন্য স্থানীয় স্কুল বাড়ির সামনে জমে ছিল ভীড়। সেখানে গ্রামবাসীদের সাথে কথা বলতেই তারা স্থানীয় পঞ্চায়েতের বিরুদ্ধে একরাশ ক্ষোভ উগরে দিলেন। আমফানের পর প্রায় কুড়ি দিন কেটে গেলেও ফেরেনি বিদ্যুৎ, জোটেনি কোনো ত্রাণ বা সরকারি সাহায্য। হেড়োভাঙা থেকে ভিতরে যাওয়ার সময়ে রাস্তায় সাধারণ মানুষ বারবার বলেন, ত্রাণ যেন সরাসরি গ্রামের মানুষের হাতেই তুলে দেওয়া হয়, নাহলে পুরোটাই বেহাত হয়ে যাবে। একই কথা বললেন বুধোখালির বাসিন্দারা। ত্রাণ লুঠ, পঞ্চায়েতের দুর্নীতি ও স্বজনপোষণের অভিযোগ বারবার শোনা গেল তাদের মুখ থেকে।
৭ জুন যাওয়া হয় গোসাবা ব্লকের বালি। প্রত্যন্ত বালি দ্বীপে ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাঁধ, ভেঙেছে মাটির বাড়ি, উড়ে গেছে ঘরের চাল। একফসলী জমিতে নোনা জল ঢুকে পড়ায় অনিশ্চিত সময়ের জন্য চাষের কোনো সম্ভাবনা নেই। বালি-২ পঞ্চায়েত এলাকায় বেশিরভাগ মানুষই কাজ করেন ভিন রাজ্যে। লকডাউনে তাদের অনেকেই আটকে ছিলেন সেখানে। জব কার্ডের কাজও গ্রামে অনিয়মিত। মেলে না নিয়মিত টাকা। গ্রামের মহিলারা বলছিলেন, লকডাউনে রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাড়িতে দুবেলা সবার মুখে সামান্য খাবার তুলে দেওয়াই দায়। তার উপরে এই ঝড়ের প্রকোপে তারা পুরোপুরি বিপর্যস্ত।
ঘুটিয়ারী শরিফের বাঁশড়া গ্রাম পঞ্চায়েতে একই অবস্থা। এখানে কমিউনিটি কিচেন চালাচ্ছিলেন যারা তাঁদের আবেদনে সাড়া দিয়ে আগেই চার দিনের খরচ পাঠানো হয়েছিল। আরও চার দিনের মতো চাল ডাল ও একশ পঁচিশটি ফুড প্যাকেট ও অন্যান্য জরুরি জিনিস নিয়ে যাওয়া হয় ৫ জুন। গিয়ে দেখা গেল ক্ষয়ক্ষতির তুলনায় সরকারি সাহায্য নিতান্তই অপ্রতুল। আবেদনপত্র জমা হয়েছে, কিন্তু ক্ষতিপুরণের টাকা এখনও কেউ পাননি। পঞ্চায়েতের এক কর্মকর্তা জানালেন, ক্ষতিপূরণের টাকা জব-কার্ড হোল্ডারদের দেওয়ার জন্য নির্দেশ এসেছে। তবে জব-কার্ডবিহীন ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ কিভাবে ক্ষতিপূরণ পাবেন তা স্পষ্ট নয়। এই এলাকার অধিকাংশ মানুষই বিভিন্ন অসংগঠিত পেশার সাথে যুক্ত। কেউ কলকাতায় পরিচারিকার কাজ করেন, ছোটো কারখানায় কাজ করেন, রং-এর কাজ করেন, কেউ বা ট্রেনে হকারি করেন। লকডাউনের ফলে তাদের রোজগার বন্ধ। লোকাল ট্রেনের সচলতার ওপরই এই মানুষগুলোর কর্মস্থলে পৌঁছোনো নির্ভর করে। ট্রেন কবে চালু হবে, সেই নিয়েই চিন্তিত অধিকাংশ মানুষ। খুব কম সংখ্যক মানুষই চাষ, মৎসচাষ বা অন্যান্য পেশার সাথে যুক্ত। এখানেও বহু মানুষের রেশন কার্ড নাই বলে জানা গেল। স্থানীয় সাংসদ প্রতিমা মন্ডল(জয়নগর)ও বিধায়ক শ্যামল মন্ডল (ক্যানিং পশ্চিম)-এর বিরুদ্ধে ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতির পরে একবারও এলাকায় না আসার অভিযোগ তোলেন এলাকার মানুষ।
রিপোর্ট: মধুরিমা বক্সী ও আকাশ দেশমুখ
টালিগঞ্জ এলাকায় বাঘাযতীন ও বাঁশদ্রোনীকে কেন্দ্র করে লকডাউনে কর্মহীন মানুষের মাঝে কাজ চলেছে। স্থানীয় নাগরিক আন্দোলনের ব্যক্তিদের সাথে চার পাঁচ দফায় দুই শতাধিক পরিবারকে ফুড প্যাকেট দেওয়ার কাজ হয়। এলাকাটির এক বিপুল অংশ বিভিন্ন ধরনের অসংগঠিত শ্রমিক। বিভিন্ন দোকানে কাজ করা মানুষরা ছাড়াও আরও একটা প্রান্তিক গরিব অংশ হলেন পরিচারিকারা, যারা এলাকার গরিব বস্তিগুলিতে কোনোরকমে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকেন। ঝড়ের পরেই টালিগঞ্জ এলাকার লাগোয়া দক্ষিণ ২৪ পরগণার রানিয়া অঞ্চলে যোগাযোগ করে প্রতিনিধি দল যান। এই অঞ্চলটি সোনারপুর-রাজপুর পৌরসভার একপ্রান্তে হোগলা জঙ্গলপূর্ণ জলা এলাকা এবং এখানকার বাসিন্দাদের একটি বড় অংশই বিভিন্ন সময়ে দক্ষিণ কলকাতার বিভিন্ন বস্তি থেকে উচ্ছেদ হয়ে ওখানে গিয়ে ঘর বাঁধা মানুষ। এছাড়াও সুন্দরবন লাগোয়া এলাকার মানুষেরা এখানে ভাড়া থেকে দিনমজুরি করতে কলকাতা যান। এখানে দুই দফায় পঞ্চান্নটি পরিবারকে ফুড প্যাকেট দেওয়া হয় এবং সমীক্ষা চালানো হয়। এখানে লকডাউনে কর্মহীন মানুষদের অনেকেই রেশন পাননি, যাদের রেশন কার্ড নেই তারা সরকির প্রতিশ্রুত ফুড কুপন পাননি। কোনোরকম সরকারী সহযোগিতা পাননি অধিকাংশ মানুষ। পরিচারিকাদের অনেকেই জানালেন যে লকডাউনের শেষে আবার কাজ ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা কম। ঘরমিস্ত্রির কাজ করেন এমন কয়েকজন লকডাউনের আগে করা কাজের মজুরি পাননি। এলাকার বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে।সামনের সপ্তাহে থানা ও পৌরসভায় ডেপুটেশনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। রানিয়া অঞ্চলে মূলত পরিচারিকাদের মাঝে অ্যাপোয়া কর্মী শিখা নস্কর ও ঝর্ণা রায় এবং নির্মাণ শ্রমিক কর্মীদের ব্যবস্থাপনাতেই এখানকার ত্রাণের কাজ চলছে।
রিপোর্ট: চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরি
হাওড়া জেলায় লকডাউনে কর্মহীন গরিব মানুষদের সহযোগিতার কাজ চলছিল। ঝড়ের রাত থেকে অন্যান্য কিছু এলাকার মতো বালি-বেলুড় এলাকাও জলোচ্ছ্বাসে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, তিনদিন বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন ছিল। তারই মাঝে বালিঘাট বস্তিতে বিপন্ন মানুষের মাঝে যাওয়া হয় এবং কয়েকদিন পর জরুরি ভিত্তিতে ২৩টি পরিবারকে ত্রিপল পৌঁছে দিয়ে আসা হয়।
৩ জুন যখন রামরাজাতলার আড়ুপাড়া-কামারডাঙ্গা বস্তিতে পৌঁছন হয়, জল তখনও নামেনি। ডেঙ্গু ছড়ানোর আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এই বস্তির মহিলারা মূলত পরিচারিকার কাজ করেন। পুরুষরা কেউ ঠেলা চালক, কেউবা ছোটো কোনও কারখানায় কাজ করেন, লকডাউনে সকলেই কর্মহীন। সরকারের ত্রাণ তো পরের কথা সরকারী দলের নেতাদেরও দেখা যায়নি ঝড়ের দিন থেকে। এখানে একশোটি পরিবারকে খাবারের প্যাকেট দেওয়া সম্ভব হয়। বস্তি এলাকা জুড়ে ব্লিচিং পাউডার ছড়ানোর কাজ করেন আইসার ছাত্রছাত্রী সাথিরা।
৬ জুন হাওড়ার বাগনান-১ ও বাগনান-২ ব্লকের বিভিন্ন গ্রামে যাওয়া হয়। বাগনান বিধানসভা এলাকার বাঙালপুর, হাড়োপ, হাটুরিয়া, রাজাপাড়া, কাঁটাপুকুর, বৃন্দাবনপুর, পিপুল্যান এবং মনিপাড়ায় মানুষের মাঝে তুলে দেওয়া হলো ত্রাণসামগ্রী। সরকার হাত তুলে দিয়েছে। পিপুল্যানে এখনও রাস্তা অচল।
ঘোড়াঘাটায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ঘর মেরামতের জন্য পঞ্চায়েতের ওপর চাপ বৃদ্ধির আন্দোলন চলছে। চিঠি লিখে জমা দেওয়া হচ্ছে পঞ্চায়েতে।
রিপোর্ট: অঙ্কিত মজুমদার
ভিক্ষা করে অথবা কিছু ছোটোখাটো কাজ করে যাদের দিন চলে, এরম বহু লোক থাকেন দমদম স্টেশন চত্বরে। অপরিকল্পিত লকডাউনের ফলে এই নিরাশ্রয়, সম্বলহীন মানুষদের দুর্দশা চরমে পৌঁছয়। শারীরিক দূরত্ব-স্যানিটাইজেশনের বালাই নেই, মাথার উপর ছাদ নেই, দুমুঠো ভাত যোগানেরও কোনো নিশ্চয়তা নেই। লোকাল কাউন্সিলরের তদারকিতে লকডাউনের প্রথম দিকে এলাকার একটি স্কুলে এনাদের রাখার এবং রোজকার খাবারের বন্দোবস্ত করা হলেও আমফান ঘূর্ণিঝড়ের পর সেই স্কুল থেকে তাদের সরিয়ে দেওয়া হয় এবং করোনা সংক্রমনের বিপদের মাঝেও বাধ্য হয়ে তাদের পুরনো জায়গাতেই আশ্রয় নিতে হয়। এরকম দুর্দিনে দমদমের কিছু সাধারণ ছাত্রছাত্রী নিজেদের যথাসাধ্য সামর্থ্য নিয়ে এই অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়াবার সিদ্ধান্ত নেয়, আরও বহু মানুষকে পাশে পাওয়া যায়। সকলের প্রচেষ্টার উপর ভর করে ওই বিপন্ন মানুষদের জন্য কিছু খাবার সরবরাহ করা হয়। এখান থেকে উদ্যোগ নিয়ে কিছু অর্থ সংগ্রহ করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় সুন্দরবনের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের জন্য।
ঝড়ে দমদম এবং দমদম ক্যান্টনমেন্ট সংলগ্ন বেশ কিছু বস্তি অঞ্চলের ক্ষতির পরিমাণ যথেষ্ট বেশি। এমনই একটি বস্তি, ‘প্রমোদনগর বস্তি’। সেখানে ১৬২টি বাড়ি। লকডাউনের জন্য তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার বেহাল দশা। তার ওপর এই আম্ফানের ক্ষয়ক্ষতির প্রকোপ! ঘরে দু'বেলার খাবার মজুত নেই অনেকেরই৷ যেহেতু এই এলাকার পাশে রয়েছে বাগজোলা খাল, তাই আম্ফানের জলোচ্ছ্বাসে বস্তির সমস্ত বাড়িতে খালের নোংরা জল ঢুকে যায়। এলাকাবাসী ক্ষোভের সাথে জানায়, তাদের এই দুর্দিনে প্রশাসনের কেউ তাদের পাশে এসে দাঁড়ায়নি৷ কাউন্সিলর তাদের বিষয়ে উদাসীন। রেশন বলতে তারা সাকুল্যে স্রেফ ৫ কেজি করে চাল পেয়েছে। ওখানকার বেশিরভাগ ঘরের চাল উড়ে গেছে, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ভেসে গেছে, খাদ্য সংকট চরমে পৌঁছেছে। এমন অবস্থায় ছাত্রছাত্রীরা তাঁদের কাছে পৌঁছে যায় শুকনো খাবার ও মহিলাদের জন্য স্যানিটারি প্যাড নিয়ে। এর সাথে ছিল খাবার স্যালাইন এবং ব্লিচিং পাউডার।
রিপোর্ট: সৌমেন্দু মিত্র
২০ মে আম্ফান পশ্চিমবঙ্গে যে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রচুর মানুষ। কিছু মানুষ চিরকালের জন্য হারিয়ে গেছে। আম্ফান বহু মানুষকে গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। লকডাউনে গরিব মানুষের পেটে খিদের জ্বালা তো ছিলই, ঝড় তাদের মাথার উপরের চালটাও কেড়ে নিল। এই কঠিন সময়ে আমরা বারাসাতের কাছাকাছি এলাকার কিছু বন্ধুরা মিলে ঠিক করি যে যথাসাধ্য কিছু ত্রাণের যোগানের চেষ্টা করব।
ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বহু বস্তি। তাদেরই মধ্যে একটি হল বারাসাতের পুঁইপুকুড় ও ক্ষুদিরাম পল্লি। ঝড়ে অনেক মানুষের চাল, টালি উড়ে গেছে, দরজা ভেঙে গেছে। কিছু বাড়ির ওপরে গাছ ভেঙে পড়েছে। এলাকার লোকজনের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম যে রেশন মোটামুটি সবাই পাচ্ছে। কিন্তু যাদের বাড়ি ভেঙে গেছে তারা এখনও সরকারের কাছ থেকে ত্রিপ্পল পায়নি। মানুষের সাথে কথা বলতে বলতে পৌঁছলাম পুঁইপুকুড় ও ক্ষুদিরাম পল্লির মধ্যবর্তী জেলে পাড়াতে। সেইখানে মানুষের অবস্থা খুবই খারাপ। অনেকের কাছেই রেশন কার্ড নেই, তাই রেশন পাচ্ছে না। কিছু মানুষের কাছে পুরোনো রেশন কার্ড আছে বলে তাদেরকে রেশন দেওয়া হচ্ছে না। লকডাউনে তাদের কাছে রোজগারের উপায়ও বন্ধ। জেলে পাড়াতে কম করে ২০০টি পরিবার রয়েছে। আমরা বন্ধুরা সকলেই ছাত্রছাত্রী – বিশ্বাস করি শিক্ষার অধিকার সবার। ঠিক করলাম জেলে পাড়ার ২৫০ জন ছাত্রছাত্রীদের হাতে তুলে দেব স্টুডেন্টস কিট। স্টুডেন্টস কিট বলতে লেখাপড়ার প্রয়োজনীয় সামগ্রী আর কিছু শুকনো খাবার – আমাদের সাধ্যমতো যেটুকু সম্ভব সেটাও পৌঁছে দিলাম এলাকার আগামী প্রজন্মের হাতে। স্টুডেন্টস কিটের পাশাপশি এলাকার সমস্ত শিক্ষার্থীদের শিক্ষার অধিকার সুনিশ্চিত করার বিষয়েও আমরা পরবর্তীতে আওয়াজ তুলব।
রিপোর্ট: অন্বেষা রায়
দার্জিলিং জেলার বিভিন্ন অংশে, বিশেষত শিলিগুড়ি মহকুমা ও সন্নিহিত অঞ্চলে কয়েক দফায় ফুড প্যাকেট দেওয়া হয়। শিলিগুড়ি কর্পোরেশনের ৩১নং ওয়ার্ডের শক্তিগড়ে লকডাউনের শুরুর দিন থেকেই বয়স্ক মানুষদের ওষুধ পৌঁছে দেওয়া বা বাজার করে দেওয়ার মতো সহযোগিতার কাজ শুরু হয়েছিল। পরবর্তীতে কয়েকজন বিএসএনএল কর্মীর উৎসাহ ও উদ্যোগ এবং স্হানীয় কিছু সহৃদয় মানুষের সহযোগিতায় কয়েক দফাতে আমরা লাগাতারভাবে এলাকার একটি বড় অংশের শ্রমজীবী দরিদ্র মানুষদের মাঝে ফুড প্যাকেট পৌঁছে দেওয়া হতে থাকে। বেশ কিছু শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে নতুন করে যোগাযোগ হয়। লকডাউনের মাঝে বিভিন্ন প্রতিবাদী কর্মসূচী সংগঠিত করার ক্ষেত্রেও এঁরা অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তির কাজ করেছেন। এখানে ৭ম দফার পর এখন ৮ম দফার প্রস্তুতি চলছে।
রামনগর এলাকাতে কয়েক দফায় বেশ কিছু মানুষের হাতে খাদ্যসামগ্রী তুলে দেওয়া হয়েছে। ফাঁসিদেওয়া এলাকার পার্টি ও আইসার উদ্যোগে রাঙাপাণি-রাণীডাঙা, ছোট পথু জোত, বড় পথু জোত, কাওয়াখালির নিমতলা এলাকায় দু-দফায় সাধারণ দরিদ্র মানুষের হাতে খাদ্যসামগ্রী ও আবশ্যক দ্রব্য তুলে দেওয়া হয়েছে।
রিপোর্ট : শাস্বতী সেনগুপ্ত
নদীমাতৃক বঙ্গের গৌরবময় ঘনসবুজ এই সুন্দরবন পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বা লবণাম্বুজ অরণ্য। সমুদ্র উপকুলে অজস্র নদীনালার মোহনায় নোনা জলের এই অরণ্যের শিকড়ের জাল ধরে রাখে উপকুলের মাটি। এ অরণ্যের ধ্বংস মানে সমুদ্রের ঢেউয়ে ক্রমাগত মাটি ক্ষয়ে যাওয়া, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া। মুনাফার আগ্রাসনে সেই পরিণতির দিকেই চলেছে বঙ্গোপসাগরের উপকুল। ট্যুরিজমের রমরমা ব্যবসা, ব্যবসায়ির লোভ ও তথাকথিত উন্নয়নের ফন্দিফিকিরে বলী প্রদত্ব হয়ে পড়েছে এই সুন্দরবন! চলছে নির্বিচারে বৃক্ষছেদন, বনাঞ্চলের জমিকে গ্রাস করে বসতি নির্মাণ, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, তার সাথে নদীবাঁধগুলির অনিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ সুন্দরবনকে যেন এক অসুন্দর, অস্থির, অপ্রাকৃতিক ব্যবস্থার বিপর্যয়ের ধ্বংসলীলাক্ষেত্রে পরিণত করেছে। ফি বছরের জোয়ারের টানে, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস, নদী বাঁধের ভাঙন, ভুমিক্ষয়, আর নাচার মানুষের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের যুগপৎ সমাপতনে এই অঞ্চলের গ্রামীণ অর্থনীতি, সমাজনীতি মায় রাজনীতির নানান গলিঘুঁজির মাঝেই মানুষগুলো খুঁজে চলেছে তাদের জীবনের সন্ধান। বিগত ২০ মের প্রলয়ংকরী আমফান ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে যেন কপর্দকশূন্য, নিঃস্ব, রিক্ত, অসহায় অবস্থায়।
ঝড়ের তান্ডবে উত্তর ২৪ পরগণার হাসনাবাদ ১নং পঞ্চায়েত এলাকার টিয়ামারী গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা ইছামতীর শাখা ডাঁসা নদীর পাড়ের মাটির বাঁধ প্রায় ৬০ - ৮০ ফুট ভেঙে গিয়েছিল। আর তার একপক্ষকাল কাটতে না কাটতেই বিগত ৪ ও ৫ তারিখের ভরা কোটালে নতুন করে ভেঙেছে নদীবাঁধ। লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, উভয় ক্ষেত্রেই বাঁধ সেখানেই ভেঙেছে যেখানে বাঁধের লাগোয়া ইটভাঁটা আছে। বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে বহু নতুন নতুন গ্রাম। যেমন টিয়ামারি, টিলারচক, বাইলানি, সুলকুনি, বেনে, বেদপাটলি, বালিয়াডাঙ্গা, ঠাকুরানিয়াবাদ, গোয়ালআটি ইত্যাদি। নোনা জলে ভেসে গিয়েছে গ্রামগুলি। প্রবল জলস্রোতের ফলে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো বেড়েছে। শস্যহানি সহ গবাদি পশু, পুকুর ও ভেরির মাছ, হাঁসমুর্গি মরেছে। অজস্র মানুষ ভরা কোটালের বানে আবারও ভিটেমাটি হারা হয়ে বা ঘরবাড়ি ছেড়ে একবুক জলে সাঁতরে আশ্রয় খুঁজছেন বাঁচার তাগিদে। নোনা জলের স্রোত কোথাও কোমর কোথাও বা হাঁটু সমান। গ্রামের রাস্তাই বা কি আর জমিই বা কি ঠাওর করাই যেন মুশকিল।
‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’-এর সকালে এমনই এক পরিস্থিতির মাঝে আমরা হাজির হয়েছিলাম। ১০টা নাগাদ কালীবাড়ি মোড় হয়ে পিচ রাস্তা ধরে আমরা যখন সুলকুনি ঘাটে যাওয়ার রাস্তার মোড়ের কাছে, তখনই দেখা গেল মহিলারা দলে দলে মাথায় পোটলা পুটলি নিয়ে গ্রাম থেকে বেড়িয়ে আসছেন। একটু উঁচু আশ্রয়ের খোঁজে। আরও অগ্রসর হতেই দেখা গেল রাস্তায় জলের স্রোত, স্থানীয় লোকজন চিৎকার করে বলছেন, “জোয়ারের জল বাড়ছে, আর এগোবেন না।” সামনে যতদূর দৃষ্টি যায়, জল আর শুধুই জল! অগত্যা আমরা গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরে এলাম ৪ কিমি দূরে কালিতলার মোড়ে যেখানে অপেক্ষা করছে ত্রাণ সামগ্রী ও জলের গাড়ি। টিয়ামারী গ্রামের বিপ্লব, কালিপদ ও বেলিয়াডাঙ্গার নিরঞ্জন ফোনে জানালেন সবাই বেলেডাঙ্গা গ্রামে দাসপাড়ার মোড়ের কাছে জলের উপরেই দাঁড়িয়ে আছেন ত্রাণসামগ্রির অপেক্ষায়, টিয়ামারীর লোকজন জলবন্দী। জোয়ারের জল নামতে নামতে বিকেল গড়িয়ে যাবে। একবুক জল ঠেলে, সাঁতরে এলেন টিয়ামারীর হজরত, লুৎফার, কালিপদ, বিপ্লব, নিরঞ্জন সহ জনা সাতেক যুবক। স্থানীয় যুবক শুভ পাত্রের স্কুটিতে ঘুরে আশপাশের অন্য গ্রামগুলোতে দেখা গেল জোয়ারের জল ভাসিয়ে দিয়েছে গ্রাম মাঠ ঘাট জমি, হু হু করে জল ঢুকছে। পথের দুপাশ জলমগ্ন। ঘর গেরস্থলী ছেড়ে মানুষ আশ্রয় নিয়েছে রাস্তার ওপর। চৌকির চারপায়ায় বাঁশ বেঁধে উঁচু করে চারপাশে ছাগলের খোঁয়ারের মতো বাঁশের চাচরি বা প্লাস্টিক বেঁধে ওই চৌকির উপরই চলছে সংসার, রান্নাবান্না, রাত্রি যাপন। আর তলা দিয়ে বয়ে চলেছে জলস্রোত! পূর্ব ঘূণি হয়ে আরিপাড়ার দিকে যেতে যেতে পথে এমনই একটি চালাঘর থেকে হঠাৎ শুনতে পেলাম এক নবজাতকের কান্নার আওয়াজ। এক পা দুপা করে সামনে গিয়ে দেখি বছর কুড়ি বাইশের এক মায়ের কোল আলো করে এক কন্যা সন্তান। কথা হল ফরিদা ও তাঁর স্বামী আব্বাসের সাথে। শুনলাম ঝড়ের রাতের বীভৎস অভিজ্ঞতার কথা – প্রবল ঝড়-বাদলের সন্ধ্যায় প্রসূতিকে নিয়ে যমে মানুষে টানাটানি, ভরসা বলতে গ্রামের ওই দাই মা মেহেরজান বিবি। আব্বাস মেয়ের নাম রাখলেন ‘ঝরা’। আরো পথ গিয়ে আবিষ্কার করলাম এগোনোর সব পথ রুদ্ধ, রাস্তার দুপাশে গ্রামের লোকজন মাটি দিয়ে তৈরি করেছেন ফুট তিনেক উঁচু সরু মাটির বাঁধ, সে বাঁধ টপকে জল ঢুকছে গ্রামের এমাথা থেকে ওমাথার দিকে। লোকজন অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছেন, বলছেন, এ জিনিষ তারা আয়লার সময়েও দেখেন নি। এমন কান্ড নাকি ঘটেছিল ৭৮-এর বন্যার সময়ে। ফিরতি পথে দেখা হলো পূর্ব ঘূণি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের গোলাপি দিদিমণি (ফার্স্ট এএনএম) রেখা গায়েনের সাথে। সাড়ে আট হাজার পপুলেশন দেখভাল করতে হয় তাঁকে। গর্ভবতী মায়েদের টিকাকরণ থেকে নবজাতক শিশুদের ভ্যাকসিনেশনের কাজ, স্কুলে স্কুলে স্বাস্থ্য শিবির, টিবি রুগীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঔষধ খাওয়ানো, হাজার একটা খাতাপত্র লেখালেখি সবই করতে হয় জনা দশেক আশাকর্মীকে নিয়ে। স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাক্তারবাবু অবশ্য আসেন, কিন্তু সপ্তাহে ওই একদিনই মাত্র। এভাবেই এঁরা গ্রামের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সলতেটা কোনোমতে জ্বেলে রেখেছেন। দেখা গেল দলদলে মুসলিম নারী-পুরুষ হেঁটে চলেছেন লেইয়ে পাড়ার দিকে, ওই গ্রামের বছর ৩৫-এর যুবক আকবর মারা গেছেন কিডনির অসুখে ভুগে, তাঁর কবরে মাটি দেওয়ার জন্য তাঁরা জলস্রোত ভেঙে চলেছেন গোরস্থানের দিকে। এই লকডাউনের ফলে যাতায়াতের অসুবিধার জন্য নিয়মিত ডায়ালিসিস বন্ধ হয়ে যায় আকবরের, ফলত প্রায় ঘরে বসে বসেই বেঘোরে প্রাণ গেলো যুবকের। শুনতে পেলাম এক মায়ের বুক ফাটা আর্তনাদ, ক্রমশ কেমন ভারী হয়ে উঠেছে পরিবেশ।
বেলা ২টা পর্যন্ত অপেক্ষার পর যখন দেখা গেলো জল নামার কোনো উপায় নেই, ক্রমশ ক্রমশ জল বাড়ছে, তখন সবাই হাজির হলাম জয়গ্রাম আর বেলেডাঙ্গা গ্রামের অপর সীমান্তে। সংবাদ পেয়ে ওখানে বহু মানুষ অধীর অপেক্ষায়। আগেই, ২ জুন আমরা এসেছিলাম একবার। সেই দিনের পরিকল্পনা অনুযায়ী যাঁদের কুপন দেওয়া হয়েছিল তাঁদের হাতেই কুপন দেখে দেখে তুলে দেওয়া হলো ফুড প্যাকেট ও অন্যান্য সামগ্রি। প্রায় ৬০০ পরিবারের মতো ত্রাণ সামগ্রির ব্যবস্থাপনা ছিল।
গ্রামের মহিলাদের সাথে কিছু আলাপচারিতার কথা শোনালেন ছাত্রী কমরেড অন্বেষা। জানা গেল যে গ্রামের মহিলারা স্যানিটারি ন্যাপকিন সচরাচর ব্যবহার করেন না। একটা স্যানিটারি ন্যাপকিনের প্যাকেটের দাম কম করে ৩০ টাকা। একটি মেনাস্ট্রুয়াল সাইকেলে কম করে একজন মহিলার দুটি প্যাকেট লাগে। লকডাউনে সেটা কেনা যে কতটা কঠিন তা বলাই বাহুল্য এবং ঝড়ের পরে তো সেটা পাওয়াও বন্ধ হয়ে গেছে। বাড়িগুলো অর্ধেক জলে, সেই অবস্থায় যখন মহিলারা কাপড় ব্যবহার করেন তখন তাদের স্বাস্থের যে কতটা ক্ষতি হতে পারে সেটা বোঝাই যাচ্ছে। জানলাম আরো এক মর্মস্পর্শী কাহিনী তার মুখেই, “জোয়ারের জল অনেক বেড়ে গেছে বলে অনেক মহিলাই ত্রাণ নিতে এসেছেন সাঁতার কেটে। একরত্তি বাচ্চা ছেলে, সেও ত্রাণ নিতে এসেছিল, সে এসে তার মায়ের জন্য একটি স্যানিটারি ন্যাপকিনের প্যাকেট নিতে চায়। তার মায়ের শরীর খারাপ বলে সাঁতার কেটে আসতে পারেননি। এক দিনমজুর এসে তাঁর স্ত্রীর জন্য নিয়ে গেলেন স্যানিটারি ন্যাপকিন কারণ উনিও আসতে পারেননি সাঁতার কেটে।” কমরেড জয়শ্রী দাসের কাছে অভিযোগ জানালেন ওই গ্রামের মিড-ডে-মিলের রন্ধন কর্মীরা। লকডাউনের জন্য স্কুল বন্ধ থাকায় জোটেনি তাঁদের কোনো মজুরি। স্থানীয় সেল্ফ হেল্প গ্রুপের সাথে যুক্ত মানুষজন এমন দাবিও করেছেন যে এই অসময়ে যেন তাঁদের স্বনির্ভর প্রকল্পের ঋণ সরকার মকুব করেন। কথা বলেছিলাম জয়গ্রামের শ্যামল মণ্ডল জানালেন ১৭ দিন পরে গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছে, ক্ষোভ ঝরে পড়লো তার কথায়। ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতির জন্য পঞ্চায়েত সকলের দরখাস্ত জমা নিচ্ছে না, চলছে সরকারি ত্রাণ নিয়ে দুর্নীতি, যাদের পাকাবাড়ি আছে তারা অনেকে পেয়েছে ত্রিপল, আর যাঁদের মাটির বাড়ি তারা অনেকেই পাননি সরকারি ত্রাণ। আরো জানালেন, এই অঞ্চলে আমফানের ক্ষয়ক্ষতির প্রভাব আয়লার মতই ব্যাপক। বিড়িবাঁধার কাজে যুক্ত শ্রমিক মহিলারা জানালেন, প্রতি এক কেজি বিড়ির পাতা দিয়ে বিড়ি বাঁধতে হয় ২৪০০ থেকে ২৭০০টি। এর থেকে কম হলে মজুরি কেটেও নেওয়া হয়। মজুরি মাত্র ৩৭৫ টাকা, এক একজনের ওই বিড়ি বাঁধতে সময় লাগে এক সপ্তাহ। স্থানীয় দুটি ইটভাটায় কিছু লোকজন কাজ করেন, আর মেছো ভেরিতে কিছু লোকের যেটুকু কাজকর্ম ছিলো তাও আজ বন্ধ। আমরা যে সকল ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে গিয়েছিলাম সেখান থেকে জলবন্দী হয়ে মূল ভুখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন টিয়ামারী গ্রামের জন্য আলাদাভাবে কিছুটা সরিয়ে রাখা হলো, কালীবাড়ি মোড়ের কাছে পরের দিনের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণের পর। কথা হলো স্থানীয়দের সাথে, তাঁদের আবেদন খুব তাড়াতাড়ি একটা মেডিকেল ক্যাম্প করার। আশঙ্কা অমূলক নয়, কারণ জলবাহিত রোগের প্রার্দুভাব কিন্তু ওই সকল এলাকায় বাড়ছে। আমাদের ত্রাণবিলির কাজ শেষ হতে হতে বিকেল গড়িয়ে গেলো, এবার আমাদের ফেরার পালা, ইছামতীর ব্রিজে যখন আমাদের গাড়ি তখন আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ আস্তে আস্তে উঠছে।
ত্রাণের ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন হাসনাবাদের বর্ষীয়ান নেতা কমরেড মোকসেদ মিস্ত্রি ও মিড-ডে-মিল রন্ধন কর্মী ইউনিউনের দুই নেত্রী নন্দিতা ও শ্যামলী। কমরেড নাতাশা, পাভেল ও তপতি বিশ্বাসের টিম তথা ‘নির্মাণ সাংস্কৃতিক সংস্থা’ ও ‘চেতনায় বিজ্ঞান’ সংগঠনের কর্মীরা অসম্ভব পরিশ্রম করে বিভিন্ন কাজ করেছেন। সমগ্র টিমে যুক্ত ছিলেন আরও অনেক দায়িত্বশীল কর্মী ও নেতারা। এলাকায় ধারাবাহিক কাজ চলবে। সেই লক্ষ্যে এবং মানুষজনের সাথে কথাবার্তার ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি :
প্রথমত সুন্দরবনের এই অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব যেটা পড়েছে তা হল নদীবাঁধ ভাঙন, নদীর জল, সমুদ্রের নোনা জল গ্রামের ভেতর ঢুকে পড়া, ফলত আগামী দু-চার বছর চাষ আবাদ হবে না জমিগুলোতে, শুরু হবে খাদ্যের আকাল।
ঝড়ে সেই সব নদীবাঁধ মূলত কোথাও বেশি কোথাও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে কিছু কিছু অংশেও। এর পেছনেও উঠে আসছে বাঁধ নির্মাণে স্থানীয় নেতা ও সরকারী আধিকারিকদের অশুভ আঁতাত, দুর্নীতি, অবৈধ ভাবে বাঁধের গায়ের মাটি কেটে ইট ভাঁটা চালানো এবং মাছ চাষের জন্য প্রভাবশালীদের দ্বারা নদীর জল ঢোকানোর মতো অভিযোগ।
দ্বিতীয়ত, অনেক কাঁচা বাড়ি ভেঙেছে, বিশেষত খড়ের চাল, টিনের ও আ্যাসবেস্টসের চাল উড়ে গেছে। কিন্তু এই দুসপ্তাহেই গ্রামের মানুষ নিজেদের উদ্যোগে আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ বাড়িগুলোর মেরামতের কাজ কিছুটা এগিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে জলস্রোতের ফলে সব কাজ বন্ধ, সবাই কমবেশি জলবন্দী, এক অসহায় করুণ অবস্থা।
যে বিষয়গুলি নিয়ে চর্চা হতেই পারে, তা হলো এই সব অঞ্চলের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মোকাবিলার জন্য চাই এক দীর্ঘস্থায়ী সমাধান। কারণ বছর বছর নদিবাঁধ ভাঙবে আর কোনো রকমে জোড়াতালি দিয়ে কাজ চালানো গোছের কিছু করে দিয়ে উদ্ধার পাওয়া দীর্ঘদিন চলতে পারে না। তাই তৈরি করতে হবে সুন্দরবন ও সেখানকার মানুষদের বাঁচানোর জন্য কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের যৌথ উদ্যোগে একটি আদর্শ “মাস্টার প্ল্যান” (একদা যা বহু চর্চিত হয়েছিল, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি সে ভাবে)।
দাবি উঠুক, অবিলম্বে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করতে হবে রাজ্য সরকারের উদ্যোগে, যে দলে থাকবেন নদী বিশেষজ্ঞ, প্রযুক্তিবিদ, উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদ, আর স্থানীয় স্তরের বিভিন্ন পরিবেশবাদী আন্দোলনের নেতৃত্ব।
এই সব অঞ্চলে ৯০-এর দশকে চালু হওয়া ইডব্লিউ স্কিম (যা একদা উপকুলবর্তী এলাকার মানুষদের জন্য চালু হয়েছিল)-এর আওতায় কাঁচাবাড়ির পরিবর্তে পরিবার পিছু ছোট ছোট কটেজ টাইপের পাকা বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু করতে হবে সরকারী খরচে।
প্রতিটি পঞ্চায়েতে দোতলা বা তিন তলা ফ্লাড সেন্টার বা রেসকিউ সেন্টার তৈরি করতে হবে, যেখানে মজুত থাকবে আপৎকালীন অবস্থার জন্য একসাথে তিন চারশো লোকের থাকার ব্যবস্থা, থাকবে পর্যাপ্ত খাদ্য, ওষুধপত্র, পানীয় জল আর গবাদি পশুদের জন্য ভিন্নধর্মী পশু খামার।
সমগ্র সুন্দরবন এলাকা জুরে নানান তাৎক্ষণিক বিপর্যয়-প্রতিরোধী ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট গ্রুপ গঠন, যেখানে যুক্ত হবেন এই অঞ্চলের যুবশক্তি, তাঁদের পর্যাপ্ত ট্রেনিংয়ের আশু প্রয়োজন এবং যাতে তারাই প্রতিটি দুর্যোগের পর তার আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত অংশগুলোর দ্রুত মেরামত করতে পারেন।
এই প্লাবনের তাৎক্ষনিক ক্ষতির চেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি অনেক বেশি। যেসব অঞ্চলে নোনা জল ঢোকে সেখানে চাষাবাদ বন্ধ হয়ে যাবে কয়েক বছর। ফলে শুরু হবে গ্রাম ছেড়ে পরিবার ছেড়ে দূর শহরে লেবারের কাজ করতে যাওয়া মানুষের ঢল। স্থানীয় স্তরে কর্মদিবস সৃষ্টি করতে হবে। যাদের চাষের জমি ডুবে গেছে তাদের জন্য স্থানীয় স্তরে বিকল্প রোজগারের পথ, বিকল্প গ্রামীণ অর্থনীতির ভাবনার জন্য প্রশাসনিক উদ্যোগ দ্রুত নিতে হবে।
আজ তাই আশু প্রয়োজন হলো প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে সুন্দরবনকে রক্ষা করা, সুন্দরবন বাঁচলে বাঁচবে শহর, বাঁচবে মানব সম্পদ। কোর অঞ্চলের পরিধিকে আর ছোট না করা। কোর অঞ্চল বা তার সংলগ্ন অঞ্চলে কোনো ধরনের ব্যবসায়িক বৃহৎ নির্মাণ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা। পরিবেশ প্রকৃতি রক্ষায় জনউদ্যোগকে আরো বাড়াতে হবে, শুধুমাত্র সরকার মুখাপেক্ষিতা নয়, গড়ে উঠুক ওই অঞ্চলের মানুষের জীবন জীবিকা রক্ষা ও পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন।
রিপোর্ট: দেবল, বারাসাত
গত ৫ জুন একই দিনে রাষ্ট্রপতি তিন তিনটি অধ্যাদেশে স্বাক্ষর করেছেন।
অধ্যাদেশগুলির প্রথমটির নাম : দি ফার্মার্স প্রোডিউস ট্রেড এন্ড কমার্স (প্রোমোশন এন্ড ফেসিলিটেসন = উৎসাহ ও সহায়তা প্রদান) অর্ডিনান্স ২০২০। দ্বিতীয় অধ্যাদেশটির নাম : দি ফার্মার্স (এমপাওয়ারমেন্ট এন্ড প্রোটেকশন) এগ্রিমেন্ট অন প্রাইস অ্যাসিওরেন্স এন্ড ফার্ম সার্ভিসেস অর্ডিন্যান্স ২০২০। তৃতীয় অধ্যাদেশটির নাম : দি এসেনসিয়াল কমোডিটিস (অ্যামেন্ডমেন্ট অর্ডিন্যান্স ২০২০।
প্রথম অধ্যাদেশটির ঘোষিত উদ্দেশ্য : কৃষকের ফসলের ক্রয় বিক্রয়ের ক্ষেত্রে যাতে কৃষক পছন্দমতো লেনদেনের স্বাধীনতা পান – যার ফলে ব্যবসায় প্রতিযোগিতামূলক বিকল্প পথ খুলে গিয়ে লাভজনক দাম পাওয়ার সুবিধা বৃদ্ধি হয়। কৃষিপণ্যের আন্তঃরাজ্য ব্যবসা অবাধ হতে পারে, বিভিন্ন রাজ্য সরকারের নির্ধারিত কৃষিপণ্য বাজারের বাইরেও ক্রয় বিক্রয় সম্ভব হয় এবং অনলাইনে বাণিজ্যের কাঠামো গড়ে তোলা সহজতর হয়।
অধ্যাদেশটিতে ৪টি পরিচ্ছেদ (চ্যাপটার) আছে। প্রথম পরিচ্ছেদে (১) ‘কৃষকের উৎপাদিত ফসল’, (২) ‘বৈদ্যুতিন বাণিজ্য ও লেনদেনের মঞ্চ’, (৩) ‘কৃষক’, (৪) ‘কৃষক উৎপাদক সংগঠন’, (৪) ‘বাণিজ্যিক (ট্রেড) এলাকা’ ইত্যাদি শব্দ বা শব্দবন্ধের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।
কৃষকের উৎপাদিত ফসলের মধ্যে চাল, গম থেকে শুরু করেডাল, তৈলবীজ, তেল, সব্জি, ফল, বাদাম, মশলা, আখ এত্যাদি ছাড়াও হাঁস, মুরগী, শুয়োর, ছাগল, মাছ ও দুগ্ধজাত দ্রব্য ধরা হয়েছে। গো-খাদ্য, খোল, তুলোর বীজ, তুলো ও পাটকেও ধরা হয়েছে। ‘কৃষক (ফার্মার) উৎপাদক সংগঠন’ বলতে চাষিদের অ্যাসোশিয়েসন অথবা চাষিদের গোষ্ঠীকে (গ্রুপ) বোঝানো হয়েছে। ‘ব্যক্ত’ বলতে কোনো একজন, অংশীদারী প্রতিষ্ঠান, সমবায় সমিতি, সোসাইটি এবং কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের চালু কোনো প্রকল্পের আওতায় ‘গ্রুপ’ বলে স্বীকৃত যে কোনো সমিতি বা কিছু লোককে নিয়ে গঠিত সংস্থা (Body of persons)-কে বোঝানো হয়েছে। বাণিজ্যিক এলাকা বলতে, খামারের ফটক, কারখানা চত্বর, মাল গুদাম, গোলা তথা ভূগর্ভস্থ ভান্ডার, হিমঘর ও যে কোনো কাঠামো বা জায়গাকে বোঝানো হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রিত বাজারের (এগ্রিকালচারাল প্রোডিউস মার্কেট কমিটি = এপিএমসি) অভ্যন্তর, প্রাইভেট বাজার, রাজ্যগুলিতে এপিএমসির অধীন গুদাম, হিমঘর ইত্যাদিকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
দ্বিতীয় পরিচছেদের শিরোনাম হল : কৃষকের ফসলের ব্যবসা বাণিজ্যে উৎসাহ ও সহায়তা প্রদান। একরাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে চাষি ও ব্যবসাদারদের বাধাহীনভাবে ব্যবসার অধিকারের কথা এখানে ঘোষিত হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার মনে করলে ট্রেডারের নাম অনলাইনে নথিভুক্তকরণ, লেনদেনের পদ্ধতির স্বরূপ (মোডালিটি) ও ফসলের দাম মেটানোর পদ্ধতি সম্পর্কে নির্দেশিকা জারি করতে পারে। বৈদ্যুতিন পদ্ধতিতে আন্তঃরাজ্য ব্যবসা ও আর্থিক লেনদেন (ফসলের দাম মেটানো) বিষয়ে প্রযুক্তিগত ও বিধিনিয়মের বেশ কিছু কথা বলা হয়েছে।
একটি জায়গায় (ধারা ৬) বলা হয়েছে,রাজ্যের এপিএমসি আইন বা রাজ্যের কোনো আইনবলে কোনো কৃষক বা ব্যবসায়ীর থেকে (যারা অধ্যাদেশ অনুযায়ী ব্যবসা করার জন্য নাম নথিভুক্ত করিয়েছে) ফী, সেস বা লেভি আদায় করা যাবে না।
তৃতীয় পরিচ্ছেদে বিরোধ নিষ্পত্তির কথা বলা হয়েছে। কৃষক ও ব্যবসাদারের মধ্যে কোনো বিরোধ দেখা দিলে তারা সাব ডিভিসনাল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে সালিশী মীমাংসার জন্য আবেদন করতে পারবে। এসডিএম তাঁর দ্বারা নিযুক্ত সালিশী বোর্ডের কাছে বিষয়টি প্রেরণ করবেন।
চতুর্থ পরিচ্ছেদে জরিমানা সম্পর্কে আলোচনা রয়েছে। ধারা ১৪টি দুর্বোধ্য। এটি হুবহু উদ্ধৃত করা হল : The provisions of this Ordinance shall have effect, notwithstanding anything inconsistent therewith contained in any state APMC Act or any other law for time being in force or in any instrument having effect by virtue of any law for the time being in force. অধ্যাদেশে বিজ্ঞাপিত কর্তৃপক্ষের (সালিশী সংক্রান্ত) রায়কে কোনো দেওয়ানি আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না (ধারা ১৫)। অধ্যাদেশের কোনো কিছুই সিকিউরিটি কনট্রাক্টস (নিয়ন্ত্রণ) আইনস্থ স্টক এক্সচেঞ্জ ও ক্লিয়ারিং কর্পোরেশনের জন্য প্রযোজ্য হবে না (ধারা ১৬)। (এই ধারাটি দুরভিসন্ধিমূলক। বিদ্বজ্জনেরা এ বিষয়ে আলোকপাত করতে পারেন) বিরোধ মীমাংসার রায় দেওয়ার ক্ষেত্রে, চুক্তি লঙ্ঘনের আভিযোগ প্রমাণ হলে এসডিএম অর্থ আদায়ের আদেশ দেবেন। পেনাল্টি ধার্য করবেন। বিতর্কিত ব্যবসায়ীকে ব্যবসা বন্ধের নির্দেশ দিতে পারেন। এসডিএমএর রায় পছন্দ না হলে অ্যাপেলেট অথরিটির হিসেবে জেলা কালেক্টর বা অ্যাডিশনাল কালেক্টরের কাছে আবেদন করা যাবে। তাঁর রায়ও পছন্দ না হলে কেন্দ্রীয় সরকারের যুগ্ম সচিব পর্যায়ের আমলার (যাকে এই উদ্দেশ্যে কেন্দ্র ভার দেবে) দ্বারস্থ হওয়া যাবে।
দ্বিতীয় আধ্যাদেশটিতেও ৫টি পরিচ্ছেদ রয়েছে। অধ্যদেশটির ঘোষিত লক্ষ : কৃষি বাণিজ্য সংস্থা, প্রসেসর, হোলসেলার, এক্সপোর্টার, লার্জ রিটেলার ইত্যাদির সঙ্গে ফার্ম সারইসের জন্য ও উৎপন্ন ফসল পারস্পরিক চুক্তির ভিত্তিতে ন্যায্যমূল্য পাওয়ার স্বার্থে চাষিদের সুরক্ষা পাওয়া। সাথে সাথে চাষিদের ক্ষমতায়ন ঘটানোর জন্য একটা জাতীয় কাঠামো (ফ্রেমওয়ার্ক) গড়ে তোলা।
প্রথম অধ্যাদেশটির মতো এই অধ্যাদেশেও কৃষি ফসলের (ফার্মিং প্রোডিউস) একই রকম লম্বা ফিরিস্তি দেওয়া হয়েছে। ফার্ম সার্ভিসেস বলতে, বীজ, গো-খাদ্য, কৃষি রাসায়ণিক, যন্ত্রপাতিসহ সমস্ত ইনপুটকে বোঝানো হয়েছে। ফার্মিং এগ্রিমেন্ট বলতে, চাষি ও স্পনসরের মধ্যে; চাষি, স্পনসর ও তৃতীয় পক্ষের মধ্যে নির্ধারিত গুণমান সম্পন্ন ফসল নির্ধারিত দামে কেনার লিখিত চুক্তিকে বোঝানো হয়েছে। এরই সাথে যুক্ত হয়েছে ‘ট্রেড এন্ড কমার্স এগ্রিমেন্ট’ যেখানে বলা হয়েচে, উৎপাদনের সময়কালীন পণ্যের মালিক কৃষক এবং সে চুক্তি অনুযায়ী মাল ডেলিভারি দিলেই দাম পেয়ে যাবে। আরও রয়েছে ‘প্রোডাকসন এগ্রিমেন্ট’ – যেখানে বলা হয়েছে, স্পনসরকে পূর্ণ কিম্বা আংশিকাবে ফার্ম সারইস দিতে হবে এবং উৎপন্ন ফসলের (আউটপুট) ঝুঁকি নিতে হবে। কৃষক নিজেই যদি ফার্ম সার্ভিস দেয় তার দাম কিন্তু স্পনসরকে মেটাতে হবে। চুক্তিতে Force majeure বা বাধ্যতামূলক পরিস্থিতিগত কারণে (অভাবিত প্রাকৃতিক বা এক্সটার্নাল ঘটনা – যেমন যুদ্ধ) চিক্তি বাতিল হওয়ার সংস্থান আছে।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে যেখানে ফার্মিং এগ্রিমেন্ট সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা আছে সেখানে এক জায়গায় বলা হয়েছে, “এই দরনের পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে আইনগত প্রয়োজনের দায় মেটানোর ভার থাকবে স্পনসর বা সার্ভিস প্রোভাইডারের হাতে।” ভালমানুষির একটা ভানও একটি ধারায় আছে। যেমন বলা হয়েছে, “ভাগচাষির অধিকার ক্ষুন্ন করে কৃষক কোনো চুক্তি করতে পারবে না।” (২য় পরিচ্ছেদ, ধারা ২)
চুক্তির মেয়াদ সম্পর্কে বলা হয়েছে, একটা ফসল ওঠার মরশুম (ক্রপ সিজন)। যেখানে উৎপন্ন ফসল সংগ্রহের উপযোগী হতে সময় লাগে – এমন ক্ষেত্রে সর্বাধিক ৫ বছর পর্যন্ত চুক্তিটি বলবত থাকতে পারে। ফসলের গুণমানে নজরদারি ও সংশাপত্র দেওয়ার জন্য তৃতীয় পক্ষ হিসেবে যোগ্যতাসম্পন্ন পরীক্ষাকারী (assayer) নিযুক্ত হতে পারে। বীজ চাষ ছাড়া অন্য ফসলের ক্ষেত্রে, ফসল ডেলিভারি দেওয়ামাত্র (৪৮ ঘণ্টার মধ্যে) দাম মেটাতে হবে। বীজের ক্ষেত্রে, দিনের দিন দুই তৃতীয়াংশের দাম মেটাতে হবে, বাকিটা সংশাপত্র পাওয়ার পর (ডেলিভারির ৩০ দিনের মধ্যে) মেটাতে হবে।
তিনটি অধ্যাদেশের মধ্যে তৃতীয়টি অর্থাৎ দি এসেনসিয়াল কমোডিটিস (আ্যামেন্ডমমেন্ট) অর্ডিন্যান্সটি মনে হয় সবচেয়ে মারাত্মক।
অধ্যাদেশের ঘোষিত উদ্দেশ্য হল : কৃষিক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা এবং কৃষকদের আয় বৃদ্ধি করার স্বার্থে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উদারিকরণ ঘটানো – একই সাথে উপভোক্তাদের স্বার্থকে সুরক্ষিত রাখা।
১৯৫৫ সালের অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনের ধারা-৩ এর উপধারা ১(এ)-তে সংশোধনী এনে বলা হয়েছে, দানা শস্য, ডাল, আলু, পেঁয়াজ, ভোজ্য তৈলবীজ, তেল এর সরবরাহ – যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, অস্বাআবিক মূল্যবৃদ্ধি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। পণ্য মজুতের সীমা সম্পর্কে তখনই ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে যখন ফল-মূলের (হর্টিকালচার) দামের ১০০% বৃদ্ধি ঘটবে। খাদ্য শস্যের খুচরো দামের ৫০% বৃদ্ধি ঘটলে (এক বছর আগের তুলনায় অথবা গত ৫ বছরের গড় দামের তুলনায়) ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। সাথে সাথেই বলা হয়েছে, মজুতের সীমা নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত এইরূপ আদেশনামা কৃষিপণ্যের কোনো প্রসেসর বা ভ্যালু চেইন* পার্টিসিপান্টের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না – যদি না এই জাতীয় ব্যক্তির প্রসেসিং করার যে ধার্য ক্ষমতা (ইনস্টলড ক্যাপাসিটি) তার উর্ধসীমা লঙ্ঘিত হয় অথবা যদি তা কোনো রপ্তানিকারীর রপ্তানির প্রয়োজনে হয়ে থাকে। তবে এ কথাও বলা হয়েছে, উপধারা ১(এ)-র কোনো কিছু গণবণ্টন ব্যবস্থা সম্পর্কে সরকারী আদেশনামার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। তবে আমার মনে হয় এটি সান্তনা পুরস্কার মাত্র।
*ভ্যালু চেইন পার্টিসিপান্ট বলতে পণ্য তৈরির সমগ্র প্রক্রিয়ায় (চেইন) যারাই যুক্ত তা সে প্যাকেজিং-এর কাজ হোক, গুদামজাত করার কাজ, পরিবহনের কাজ যাবতীয় সবকিছুকেই বোঝায়)।
-- মুকুল কুমার
সব মনে রাখা হবে কর্মসূচী যাদবপুর ৮বি বাসষ্ট্যান্ডের পাশে। এই কর্মসূচী এক ঘণ্টার বেশি সময় নিয়ে চলে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা, আঞ্চলিক এনআরসি, সিএএ বিরোধী বেশ কিছু ব্যাক্তি ও সংগঠন-এর সাথে এআইপিডব্লিউএ-র কর্মী ও নেত্রীরা এই কর্মসূচীতে অংশ নেয়।রাস্তায় গোল হলে ঘিরে গানে, শ্লোগান, বক্তব্য চলে। অন্যান্যের সাথে বক্তব্য রাখে ছাত্রী সম্প্রীতি, এআইপিডব্লিউএ-র নেত্রী চান্দ্রস্মিতা, মলয় তেওয়ারি। এই কর্মসূচীতে এআইপিডব্লিউএ-র রাজ্য সম্পাদক ইন্দ্রাণী দত্ত ছাড়াও সিপিআই(এমএল) পার্টির রাজ্য নেতা জয়তু দেশমুখ ও বাসুদেব বসু অংশ নেন।
সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবিদ্বেষের শিকার হন জর্জ ফ্লয়েড। তাঁকে হত্যার প্রতিবাদে উত্তাল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ সমগ্র বিশ্ব। বিশ্বব্যাপী এই আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে এবং বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে ৮/৬/২০ তারিখে এয়ারভিউ মোড়ে এআইসিসিটিইউ, এআইপিডব্লিউএ, আইসা সহ সমস্ত বামপন্থী শ্রমিক সংগঠন ছাত্র, যুব, মহিলা, সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে প্রতিবাদী বিক্ষোভ কর্মসূচী পালন করা হয়।
৮ জুন ২০২০ বিকেল ৫টায় জলপাইগুড়ি শহরের বড় পোস্ট আফিস মোরে কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠনগুলি ও কর্মচারী সমিতি সহ ছাত্র-যুব সংগঠনগুলি পক্ষ থেকে আমেরিকায় বর্ণবৈষম্য বাদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী আন্দোলনকে সংহতি জানিয়ে বিক্ষোভ দেখানো হয়।
১৯৭৩ সালের ৪ জুন তিনজন তরতাজা যুবককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ ত্রিবেণী গঙ্গার ঘাটে নিয়ে গিয়ে গুলি হত্যা করে। হুগলির চকবাজারের গ্রিল কারখানার শ্রমিক জিতেন কুন্ডু, কাপাসডাঙা সতিন সেন স্কুলের শিক্ষক মনতোষ চক্রবর্তী এবং গুপ্তিপাড়ার ছাত্র রামশঙ্কর ব্যানার্জির শহিদ দিবস যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে হুগলিঘাট পার্টি অফিসে পালিত হয়। এই এলকার বিপ্লবী সাথী জিতেন কুন্ডু, মনতোষ চক্রবর্তী নামাঙ্কিত শহিদ বেদীতে মালা পুষ্প অর্পণ করেন উপস্থিত পার্টি সদস্যর ও পার্টি দরদী কমরেড তাপস ঘোষ, সুজন চ্যাটার্জি, ধনুয়া, সালাউদ্দিন, জয়দেব উপস্থিত ছিলেন। ফ্যাসিবাদ কে পরাস্ত করা, বর্তমান পর্যায়ে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষদের পাশে দাঁড়ানো এবং শহিদদের অসমাপ্ত কাজকে এগিয়ে নিয়ে চলার শপথ গ্রহণ করা হয়। কর্মসূচীতে পতাকা উত্তোলন করেন কমরেড কল্যাণ সেন।
গত একবছর ধরে হাওড়া জেলার সমস্ত সরকারী স্কুলে বিনা খরচে ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা দেওয়ার দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচী নিয়েছিল হাওড়া আইসা জেলা কমিটি এবং দেওয়া হয়েছিল ডিএম ডেপুটেশন। এছাড়াও এই করোনা বিপর্যয়ের সময় লকডাউন অবস্থায় সমস্ত স্কুল গুলিতে ফি মুকুম ও অন্যান্য দাবিতে আইসা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটিও প্রচার অভিযান চালিয়ে ছিল। সেই দাবিকেই আংশিক মান্যতা দিয়ে বালি বিধানসভা অঞ্চলের স্কুল গুলিতে এই নির্দেশটি জারি করে বালি বিধানসভার বিধায়িকা। এই নির্দেশ অনুসারে বালি বিধানসভার স্কুল গুলিতে লকডাউন পর্যায়ের তিন মাসের স্কুল ফি, অ্যাডমিশন ফি ও বাস ভাড়া মুকুব করা হয়েছে। এই নির্দেশিকাকে সামনে রেখে আবার আইসা হাওড়া জেলা কমিটির পক্ষ থেকে হাওড়ার জেলা শাসককে ডেপুটেশন দেওয়া হবে ও জেলার অন্য বিধায়ক দের সাথেও যোগাযোগ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
ভারতবর্ষ ছিল আমার কাছে একটা স্বপ্নের মতো। যখন প্লেন ভারতের মাটি ছুঁল, আমার শরীর রোমাঞ্চিত হয়েছিল। মনে হয়েছিল, মহাত্মা গান্ধীর পুণ্যভূমিতে পা রাখলাম।
একুশ বছরের আমি সুদূর নাইজিরিয়া থেকে দিল্লিতে মাইক্রোবায়োলজি পড়তে এসেছিলাম দুচোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে। তখন, ছোট একটা ছেলের মতো ভেবেছি ক্লাসে কত নতুন বন্ধু হবে! তাদের কাছ থকে আস্বাদ পাব ভারতভূমির সমৃদ্ধ ইতিহাসের, নানা ভাষার, বিভিন্ন খাবারের, অপার বৈচিত্রের, অপূর্ব সংস্কৃতির। কিন্তু এখানে আসার পর থেকে আমার জীবনের প্রতিটা দিন যে এভাবে বদলে যাবে ভাবিনি।
এসেই প্রথম যে হিন্দি কথাটা শিখে ফেললাম, সেটা হল ‘কাল্লু’। ক্লাসে, রাস্তায়, বাজারে, পাড়ায় একটাই পরিচয় আমার – ‘কাল্লু’। আমার দিকে প্রতিটা মুহূর্ত লোকে অন্যভাবে তাকিয়ে আছে, সর্বক্ষণ আমায় বিচার করছে, কারো চোখে ঘৃণা, কারো চোখে ভয়। কারণ একটাই – আমার গায়ের রং! আর আমি একা নই, প্রতিটি আফ্রিকানকে ভারতে এই একই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।
সর্বক্ষণ আমায় মনে রাখতে হয় আমি এখানে অপর, ভিন্ন। কেউ ডাকে ‘নরখাদক’ বলে, কেউ ভাবে বেশ্যার দালাল। পুলিশ প্রায়ই কড়া নাড়ে দরজায়, আমি ড্রাগ বেচি কিনা জানতে। আমি এতটাই ‘অপর’ এখানে, কোনো ভারতীয় মেয়ের দিকে তাকিয়ে সৌজন্যের হাসিটুকু হাসতেও আতঙ্কিত হই। হ্যাঁ, ঘর ভাড়া পেয়েছি, কিন্তু ভারতীয়দের তুলনায় অনেক বেশি ভাড়া দিয়ে। আমার বাড়িওলা দরজার বাইরে থেকে প্রতিমাসে কোনোক্রমে টাকাটা গুণে নিয়েই দরজা বন্ধ করে দেয়। আজ পর্যন্ত, কখনো একটিবারও বলেনি, ‘ভেতরে এস, একটু চা খেয়ে যাও’। এই কি তবে সেই ভারতের সুমহান আতিথ্যের নমুনা?
খালি এতেই শেষ ভাবলে ভুল। প্রতি মুহূর্তে রাস্তায় বেরোলে ভাবি, আজ আমার ওপর নিশ্চয়ই কেউ হামলা করবে, এমন কী মেরেও ফেলতে পারে! যেমন মেরে ফেলা হয়েছিল কঙ্গোর একজনকে গত বছর। ক্রমাগত নিজেকে প্রশ্ন করি, আমি কেন একজন সাধারণ মানুষের মতো ভারতে বাঁচতে পারি না? একই জানা আর বীভৎস উত্তর প্রতিধ্বনিত হয় আমার ছোট্ট ঘরটায়, তুমি কালো বলে।
এখানকার সরকার আমাদের নিরাশ করেছে। কঙ্গোর ছাত্রটির হত্যার প্রতিবাদে আমরা আফ্রিকান ছাত্রছাত্রীরা ভেবেছিলাম যন্তর-মন্তরে ধর্ণা দেব। কিন্তু ভারতের বিদেশমন্ত্রক থেকে আমাদের আবেদন করা হল, ধর্ণার বদলে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা মিটিয়ে নিতে। আমরা রাজি হলাম। অনুরোধ করলাম, আমাদের নিয়ে যেসব ভ্রান্ত ধারণা, তার বিরুদ্ধে সরকারকে প্রচার চালাতে। কিন্তু আজ পর্যন্ত একটা বিলবোর্ডও দেখলাম না, যেখানে লেখা ‘আফ্রিকানরা আমাদের ভাই’, টিভিতে কোনো বিজ্ঞাপন দেখলাম না, যেখানে বলা হচ্ছে, আফ্রিকানরা নরখাদক নয়। বহু শিক্ষিত অভিজাত ভারতীয় জানেই না, যে আফ্রিকা একটা মহাদেশ।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের ভারতীয়দের সাথে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে বারণ করা হয়। অন্য ভারতীয় ছাত্ররা আমাদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসে, নিজেদের মধ্যে গুজগুজ করে, কাল্লু বলে উত্যক্ত করে, আফ্রিকান মেয়েদের উদ্দেশ্যে তাদের ‘রেট’ কত জানতে চায়। আমাদের কান্না উঠে আসে, ক্রোধ-ক্ষোভ দলা পাকায়, কিন্তু আমরা নীরবে সহ্য করি।আজ পর্যন্ত কোনো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ভারতীয় ছাত্রেদের বলল না, যে ‘কাল্লু’ বলা উচিত নয়।
ভারতের আফ্রিকান ছাত্র সমিতির আহ্বায়ক হিসেবে, সারাদিনই ফোন আসতে থাকে বিভিন্ন রাজ্য থেকে আফ্রিকান ছাত্রছাত্রীদের। তাদের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা শুনে শুনে বুঝি, কালোকে ঘেন্না করার সংস্কৃতির শেকড় ভারতে অনেক গভীরে প্রোথিত। আমি নিজেকে বোঝাই, কয়েকটা ঘটনা দিয়ে পুরো ভারতকে বিচার করা উচিত নয়। কিন্তু দিনের শেষে আমি দেখতে পাই, আমার কোনো বন্ধু নেই। ছেলেরা আমায় টিটকিরি দেয়, মেয়েরা ভয় পায়। আমি সন্ন্যাসীর মতন নিভৃতে জীবন কাটাই। বাইরে যাই না, যাতে লোকে আমায় দেখে বিরক্ত না হয়। তাদের বিরক্ত না হওয়াই আমার সুরক্ষার একমাত্র উপায়। যখনই শুনি, কোথাও কোনো আফ্রিকানের ওপর হামলা হয়েছে, ভাবি ‘কাল বোধহয় আমার পালা’। আমি ভারতীয় পোশাক পরে ঘুরি, সবাইকে বোঝাতে যে আমি ভারতীয় সংস্কৃতিকে আপন করে নিয়েছি। কিন্তু সে পোশাকের বাইরেও আমার গায়ের কালো রঙটাই তাদের চোখে ফুটে ওঠে। আমার কাল্লুর বেশি আর কিছু হয়ে ওঠা হয়না।
দাঁতে দাঁত চেপে কোনক্রমে কোর্সটা শেষটা করে দেশে ফিরতে চাই। না হলে রোজকার এই নারকীয় যন্ত্রণার থেকে মুক্তি নেই! ভারত বলতে আমার স্মৃতিতে এটুকুই থাকবে আর যে স্মৃতি আমি আপ্রাণ চেষ্টা করব ভবিষ্যতে মুছে ফেলতে।
– ভারতীয় সমাজের গভীরে প্রোথিত বৈষ্যম্য ও বিদ্বেষের বিষয়টিতে আলোকপাত করতে হিন্দুস্থান টাইমসের #LetsTalkAboutRacism-র প্রচারের অঙ্গ হিসেবে Ezeugo Nnamdi Lawrence-র লেখা। লেখক অ্যাসোসিয়েশান অফ আফ্রিকান স্টুডেন্টস ইন ইন্ডিয়ার আহ্বায়ক।
সংক্ষিপ্ত ভাবানুবাদ - নির্মাল্য দাশগুপ্ত
[ স্ট্র্যান্ডেড ওয়ার্কার্স অ্যাকশন নেটওয়ার্ক (সোয়ান) পরিযায়ী শ্রমিকদের স্বার্থে গড়ে তোলা এক নেটওয়ার্ক, যেটা ২৭ মার্চ থেকে পরিযায়ীদের সাথে সক্রিয়ভাবে বিরাট পরিধি জুড়ে যোগাযোগ রেখে আসছে। রিলিফ, খাদ্য সরবরাহ, নিঃস্ব রিক্ত শ্রমিকদের আর্থিক সাহায্য দিয়ে বিপন্ন সময়ে তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছে। এই মঞ্চের তরফ থেকে ১৪ই এপ্রিল, তারপর ১ মে আর শেষে ৫ জুন একটা রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। সর্বশেষ রিপোর্টের একটা অংশের অনুবাদ এখানে দেওয়া হলো। শিরোনাম আমাদের – সম্পাদকমণ্ডলী]
চতুর্থ দফার লকডাউন শেষ হয় ৩১ মে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ৩০ মে এক বিজ্ঞপ্তি জারি করে ‘ধাপে ধাপে সচল করার’ ( আনলক – ১.০) এক রূপরেখা প্রকাশ করে। লকডাউনের প্রতিটি পর্যায়ে পরিযায়ী শ্রমিকরা নানান যন্ত্রণা ও হয়রানির শিকার হন। লকডাউনের প্রথম দু’টি পর্যায়ে বিভিন্ন রাজ্যে আটকে থাকা পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রধান সমস্যা ছিল খাদ্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষ পত্র ক্রয় করার মতো হাতে কোনো টাকা পয়সা না থাকা। এই যন্ত্রণা বহুগুণ বেড়ে যায় পরিযায়ী শ্রমিকদের নিজ নিজ ঘরে ফিরে আসাকে কেন্দ্র করে সরকার সৃষ্ঠ হরেক ধরনের বিশৃঙ্খলা। পথ দুর্ঘটনায়, দীর্ঘ পথ হাঁটার ফলে পরিশ্রান্ত, ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর একের পর এক পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু হয়। তার উপর পুলিশী বর্বরতা তো আছেই। এর পরিপ্রেক্ষিতে, কেন্দ্রীয় সরকার, দেশের বিচার বিভাগ কী ধরনের ভূমিকা নেয়, তা দেখে নেওয়া যাক।
প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ যোজনা ছিল অর্থমন্ত্রীর তরফ থেকে ঘোষিত প্রথম আর্থিক প্যাকেজ। কিন্তু তাতে পরিযায়ী শ্রমিকরা পেলেন না এক কানাকড়িও। উপরন্তু, এই প্রকল্প সম্পর্কে বেশ কিছু বিভ্রান্তিকর প্রচার চালানো হয়। অনেক অর্থশাস্ত্রী, এমনকি আইএমএফ-এর হিসাব অনুযায়ী এখন পর্যন্ত কেন্দ্র ও রাজ্যগুলোর সম্মিলিত ব্যয় বরাদ্দ হল ১.৪২ লক্ষ কোটি টাকা – কেন্দ্রের ঘোষিত ১.৭ লক্ষ কোটি টাকা নয়। কেন্দ্রীয় সরকার পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য যে ত্রাণ সাহায্য করছে তাতে সন্তুষ্ট হয়ে শীর্ষ আদালত ২১ এপ্রিলের মামলাটার নিষ্পত্তি করে, যা লকডাউনের প্রথম পর্যায়ে দায়ের করা হয় পরিযায়ী শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি প্রদানকে কেন্দ্র করে। কিন্তু পরিযায়ী শ্রমিকদের রিলিফ দেওয়ার যে দাবি কেন্দ্রীয় সরকার করেছে তা নেহাতই অসাড়। সোয়ানের সংস্পর্শে আসা ৮২ শতাংশ পরিযায়ী শ্রমিক জানায় তাঁরা কোনো ধরনের সরকারী রেশন পাননি। ৭০ শতাংশ পায়নি রান্না করা খাবারের একটিও দানা। লকডাউনের দ্বিতীয় পর্যায়ে যে দুই তৃতীয়াংশের সাথে যোগাযোগ হয়, তাঁদের পকেটে ১০০ টাকাও ছিল না।
দ্বিতীয় পর্যায়ের লকডাউন শেষ হওয়ার মুখে, ২৯ এপ্রিল, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক প্রথম বিজ্ঞপ্তি জারি করে পরিযায়ী শ্রমিকদের ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেয়। ১ মে বিশেষ শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন মারফত তাঁদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। ২৯ এপ্রিল থেকে ১ মে পর্যন্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক অন্তত আটখানা পরস্পর বিরোধী বিজ্ঞপ্তি জারি করে। এর ফলে তৈরি হয় বিরাট মাত্রায় বিভ্রান্তি, বিশৃঙ্খলা, মৃত্যু ও বিপর্যয়। অপর্যাপ্ত যানবাহন ও চূড়ান্ত পরিকল্পনাহীনতার জন্য অসংখ্য পরিযায়ী শ্রমিক দুঃসহ যন্ত্রণার থেকে মুক্তি পেতে সাইকেল, বা ভাঙ্গাচোরা ট্রাকে করে ফিরে আসার চেষ্টা করে। বহু শ্রমিক হাজার হাজার কিলোমিটার হেঁটে পাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯ মে মহারাষ্ট্রের ঔরাঙ্গাবাদে ১৬ জন শ্রমিক ট্রেনের তলায় কাটা পড়লেন ঘরে ফেরার পথে। দীর্ঘ পথ হাঁটার পর ক্লান্ত অবসন্ন শরীরগুলো এলিয়ে পড়ে রেল লাইনে। ঘুমন্ত অবস্থায় তাঁরা চিরনিদ্রায় শায়িত হয়।
৪৫ দিন ধরে তৈরি করা এই সংকটের পর অর্থমন্ত্রী হাজির হন আত্মনির্ভর ভারত নামাঙ্কিত এক ত্রাণ প্যাকেজ নিয়ে। এর মধ্যে একটা অংশ রয়েছে ‘গরিব’, পরিযায়ী ও চাষিদের উন্নতিকল্পে। অর্থমন্ত্রীর আত্মনির্ভর প্রকল্পের মধ্যে দুটো আশু দিক বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। এই প্রথমবার স্বীকার করা হল, বিভিন্ন রাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিকদের খাদ্যশস্য বিলিবণ্টন করা দরকার। আর, অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্যটাই খারিজ করে দেয় সলিসিটার জেনেরাল তুষার মেহতার তাড়াহুড়ো করে শীর্ষ আদালতের কাছে দেওয়া কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে সেই ঘোষণা যে প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ যোজনার ত্রাণ প্রকল্প পরিযায়ী সহ সমস্ত গরিব মানুষের সমস্ত দৈনন্দিন প্রয়োজনের স্বার্থেই পরিচালিত হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ভারত সরকার শীর্ষ আদালতকে জানায়, গোটা দেশজুড়ে সরকার ১৫ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেছে। যদিও, নতুন প্যাকেজে তারা ঘোষণা করে, কেন্দ্রীয় সরকার এটা সুনিশ্চিত করছে ৮ কোটি পরিযায়ী শ্রমিক মাথাপিছু ৫ কেজি খাদ্য শস্য, এবং পরিবার পিছু দু’মাস ধরে এক কেজি ছোলা পাবেন। তবে সেই সমস্ত পরিযায়ীরাই এই সুবিধা পাবেন, যাদের নাম জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইন বা রাজ্যস্তরে নথিভুক্ত নেই। এটা আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নকে সামনে আনলো। কেন্দ্রীয় সরকার যদি আন্তঃরাজ্য পরিযায়ীদের একটা আনুমানিক সংখ্যা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েই থাকে তবে কী করেই বা তারা এপ্রিলে ঘোষণা করলেন যে ১৫ লক্ষ পরিযায়ীদের আশ্রয়স্থলগুলোতে তারা খাবার বিতরণ করেছে? যারা যারা আশ্রয় শিবিরে নেই, চাল-চুলো-রুটি-রুজি হারিয়ে নানা জায়গায় আটকে পড়েছেন, তাদের কেন ধর্তব্যের মধ্যে আনা হচ্ছে না? আরও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল, আদালত কোন বিবেচনার উপর দাঁড়িয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের যাবতীয় বক্তব্যকে চোখ-কান বন্ধ করে অনুমোদন দিয়ে বসলো?
মে মাসের মাঝামাঝি কেন্দ্রীয় সরকার যে আত্মনির্ভর প্রকল্প ঘোষণা করলো তাতে বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকার ৩,৫০০ কোটি টাকা মূল্যের রেশন বিতরণ করবে। এমন সময়ে এই ঘোষণাটা এলো যখন পরিযায়ীরা নিজ নিজ ঘরের দিকে পাড়ি দিতে শুরু করেছে। পরিযায়ীদের চিহ্নিত করে রেশন বিতরণের কাজটা ছেড়ে দেওয়া হলো রাজ্য সরকারগুলোর উপর। এখন, বেশিরভাগ পরিযায়ীরা সরকারের আশ্রয়স্থলে থাকেন না। তাঁরা থাকেন তাঁদেরই কর্মস্থলের কাছাকাছি কোনো আস্তানায়। রাজ্য সরকারগুলোর তরফ থেকে তাঁদের নাম নথিভুক্ত করার ঘটনাটাও রীতিমতো বিরল। কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রকের হাতে আটকে থাকা পরিযায়ীদের কোনো রেকর্ড নেই। তা সত্ত্বেও, মূখ্য শ্রম কমিশনার সমস্ত রাজ্যের শ্রম-কমিশনারকে জানিয়েছেন, এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে সেই তালিকা জমা দিতে। রাজ্য সরকারগুলো বাড়ি বাড়ি সমীক্ষা চালিয়ে পরিযায়ীদের সনাক্ত করতেই হিমশিম খাচ্ছে, আর উক্ত ঘোষণার দুই সপ্তাহ পরে ও আমাদের সামনে আটকে পড়া পরিযায়ীদের সংখ্যাকে নির্দিষ্ট করা যায়নি। এখনো গণনা করে বলা যাচ্ছেনা কতজনই বা প্রতিশ্রুতি মতো খাদ্যশস্য পেয়েছেন। হরিয়ানার উদাহরণটাই সামনে আনা যাক। বিপুল সংখ্যক শ্রমিক কাজের সন্ধানে এই রাজ্যে আসেন। যাদের রেশন কার্ড নেই, তাঁদের রেশন দেওয়ার ঘোষণা ১৪ এপ্রিল করা হলেও রাজ্য সরকার এখনো বাড়ি বাড়ি সমীক্ষার কাজে আটকে রয়েছে, এখনো তালিকা মেলানো, কুপন ছাপানোর মধ্যেই আটকে আছে। বাস্তব জমিতে নেমে রেশন বিতরণ এখনও দূর অস্ত।
আত্মনির্ভর প্যাকেজ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, লকডাউনের পর, ২৮ মার্চ থেকে যে সমস্ত শহুরে গৃহহীনরা আশ্রয়স্থলে থাকবেন (শেল্টারস ফর আরবান হোমলেস) তাঁদের দিনে তিনবার স্বাস্থ্য সম্মত ভাবে রান্না করা খাবার দেওয়া হবে। যদিও, সিংহভাগ পরিযায়ী শ্রমিকরা কোনো সরকারী আশ্রয়স্থলে থাকেন না, আর আটকে পড়া পরিযায়ীদের সরকারী আশ্রয়স্থলে সম্মানজনক ভাবে স্থানান্তরিত করার বিন্দুমাত্র কোনো প্রচেষ্টা আজ পর্যন্ত নেওয়া হয়নি।
১৬ মে, রেলমন্ত্রী পীযুষ গোয়েল বেনেট বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা ভাষণে বলেন, “বিগত তিন মাস যাবত, আমরা একজনকেও অভুক্ত অবস্থায় থাকতে দিইনি। এটা শুধুমাত্র কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যে সম্ভবপর হয়েছে, তা নয়, এটা করা গেছে ১৩০ কোটি ভারতবাসীর প্রচেষ্টায়।” অর্থমন্ত্রীর ঘোষণার দু’দিন পর তিনি ওই কথা বলেন, যে ঘোষণায় শেষ পর্যন্ত পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশার কথা পরোক্ষে স্বীকার করে নেওয়া হয়। এই নিদারুণ অসংবেদনশীল মন্তব্যের সময়ে একবারও নজরে আসলো না সমকালীন নানা সমীক্ষা ও প্রামান্য নথি কী কী তথ্য সামনে তুলে ধরলো। উদাহরণ স্বরূপ, আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে দশটি রাজ্যে ৫,০০০ পরিবারের মধ্যে এক সমীক্ষা চালানো হয়। সেই সমীক্ষা করুণ এক ছবি ফুটিয়ে তুলেছে। সেই সমীক্ষার মতে, ৭৭ শতাংশ পরিবার আগের তুলনায় কম পরিমাণে খাবার খেতে বাধ্য হচ্ছে, আর, ৪৭ শতাংশের হাতে এক সপ্তাহের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার কোনো টাকা পয়সা নেই। চারটের মধ্যে একটা পরিবার রেশন পাচ্ছে না। ৩৪৭টি পরিবারের মধ্যে ৩১ শতাংশ পরিবার জানিয়েছে যে রেশন দোকান গুলো আগে যেমন খুলতো, এখনো তেমনভাবেই চলছে। ইন্ডাস অ্যাকশনের তরফ থেকে ১৫ রাজ্যে ৫,০৪৬টি পরিবারের মধ্যে সমীক্ষা চালানো হয়। দেখা গেছে, ৬টি পরিবারের মধ্যে অন্তত একটি পরিবার তীব্র খাদ্য সংকটের সম্মুখীন। এই সময়ে সমস্ত সমীক্ষাগুলোতে ফুটে উঠেছে চরম বুবুক্ষা, অনাহার, অর্থাভাবের নিদারুণ ছবি। তা সত্ত্বেও, শাসক দল চোখ বন্ধ করে ক্ষমাহীন এক পরিতৃপ্তি ও নির্লিপ্ততার মধ্যে দিনযাপন করছে।
সংযোজন -
আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে চালানো সমীক্ষায় যে তথ্যগুলো উঠে এসেছে তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। এই সমীক্ষা দেখিয়েছে, সাধারণ মানুষের রুটিরুজির উপর নেমে এসেছে লকডাউনের মারাত্বক ধ্বংসাত্মক প্রভাব। আর, এর দরুণ মহিলারাই সবচেয়ে আক্রান্ত, বিপন্ন।
শহরের শ্রমজীবীদের মধ্যে সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে ৮২ শতাংশ ক্যাজুয়াল মহিলা শ্রমিক ও ৮০ শতাংশ ক্যাজুয়াল পুরুষ শ্রমিক কাজ হারিয়েছে। ৮৯ শতাংশ স্বনিযুক্ত মহিলা কর্মী এবং ৭৭ শতাংশ স্বনিযুক্ত পুরুষ কর্মী কাজ হারিয়েছে। সবচেয়ে চিন্তার বিষয় হলো, লকডাউনের ফলে নিয়মিত চরিত্রের বেতনভুক কর্মীরাও চাকরি চ্যুত হয়েছেন।
চারজন শহুরে বেতনভুক কর্মীদের মধ্যে তিনজনের ও বেশি মহিলা ও পুরুষ তাদের চাকরি খুইয়েছেন। ৮৯ শতাংশ শহরে বসবাসকারী পরিবার জানিয়েছে তারা পরের মাসে ঘর ভাড়া দিতে অক্ষম। ৪১ শতাংশ শহুরে পরিবারগুলো জানিয়েছে যে তারা খরচ চালাতে ঋণ নিয়েছেন। গ্রামাঞ্চলে এই ধরনের পরিবারের সংখ্যা যথাক্রমে ৬৫ ও ৩৩ শতাংশ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নেওয়া হয়েছে।
ভাষান্তর ও সংযোজন – অতনু চক্রবর্তী
কোভিড-১৯ গোটা পৃথিবী জুড়ে অনেক কিছুকেই বেআব্রু করে দিয়েছে। নগ্ন করে দিয়েছে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে। শাসকের নির্দায় নির্দয় চেহারাটাকে, নৃশংস স্বার্থপরতাকে উন্মোচিত করেছে।
ভারতবর্ষে লকডাউন পর্ব শাসকশ্রেণিকে অনেক সুযোগ করে দিয়েছে, আড়াল তৈরি করে। নির্বিচারে চলছে কর্পোরেট তোষণের জন্য যথেচ্ছ লুঠ তরাজ। বন জঙ্গল হু হু করে সাফ হয়ে যাচ্ছে। চলছে ভূমিপুত্র আদিবাসীদের ঘর-বসতি জ্বালিয়ে দেওয়া। সাধারণ মানুষের অধিকার হরণ। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মীদের উপর নগ্ন আক্রমণ। কিন্তু সব কিছুকে ছাপিয়ে গেছে পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রতি রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি, অবস্থান, মনোভাব। সরকারের মিথ্যাচার। সরকার যেমন আড়ালের সুযোগ নিয়েছে, সেই আড়ালকে ছিন্ন করে সত্যিটাকে সামনে আনার জন্যও একদল অসমসাহসী মানুষ নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সত্যান্বেষণের দুরূহ দুর্গম উপত্যকায়, দুরারোহ শৃঙ্গচূড়ায় তারা অনুসন্ধানী আলো ফেলে ঘুরে বেড়ান প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে। গদি মিডিয়ার বিপরীতে, শাসকের রক্তচক্ষু তথা ইউএপিএ-এর ‘আপ্যায়ন’কে তুচ্ছ করে। তেমনই এক বলিষ্ঠ কলমের প্রথিতযশা সাংবাদিক বরখা দত্ত ‘হিন্দুস্তান টাইমস'-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে সম্প্রতি জানিয়েছেন, পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টে ভারত সরকারের সলিসিটর জেনারেলের অবস্থান ছিল ন্যায়বিরুদ্ধ। সত্য উদ্ঘাটনের সেই কাহিনি তাঁর মরমী কলমেই পড়ুন :
“লকডাউন উচ্চ-মধ্যবিত্তদের সুরক্ষা দিয়েছে। হতদরিদ্র নাগরিকদের ঠেলে দিয়েছে প্রান্তসীমায়।
আমার মনে হয়, সলিসিটর জেনারেলের সংজ্ঞা অনুযায়ী, আমি এক ‘সর্বনাশের দূত’-এক কুনজরের মানুষ। সুপ্রিম কোর্টে তিনি যা বলেছেন, তার কয়েকটি শব্দে আমি হতবাক। বিষণ্ণ। অবশ্য সামলে নিয়েছি-অনেক পরে হলেও শীর্ষ আদালত পরিযায়ী শ্রমিকদের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেছে।
আমার ৭০ দিনেরও বেশি সময় কেটে গেছে, ১২টা রাজ্যে ঘড়ি ধরে ১৫০০০ কিলোমিটার চষে বেড়িয়ে – সেই সব কর্মীবাহিনীর নৈরাশ্যের দিনপঞ্জি লিখে – যারা আমাদের শহরগুলো গড়ে তুলেছে, কারখানাকে মজবুত করেছে, আমাদের রান্নাঘরগুলো চালু রেখেছে, বাচ্চাদের দেখভাল করেছে – আর অভিজাত শ্রেণির নির্মম ঔদাসীন্য আর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাব যে শক্তিকে কার্যত অনাথ করেছে। মাননীয় এস জি হয়তো আমাকে একটা “শকুন” বলে নস্যাৎ করে দেবেন।
কিন্তু লক্ষ লক্ষ ভারতীয় অদৃশ্য থেকে যেত যদি না কয়েকটি মানুষ, তাদের গল্প বলার অদম্য জেদ নিয়ে তাদের পিছু নিত। আমরা সবাই মানছি যে ভারতের মতো এত বিশাল, এত জটিল একটা দেশকে আমরা পরিচালনা করছি না। আমরা এটাও বুঝি যে চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। আর এটাও বুঝি, পৃথিবীর বৃহত্তম লকডাউন কার্যকর করতে গিয়ে কিছু ভুলভ্রান্তি ত্রুটি বিচ্যুতি হতেই পারে।
কিন্তু যারা গরিবদের জন্য মুখ খুলেছে, অনেক সময় নিজেদের প্রাণ বিপন্ন করেও, লক্ষ লক্ষ মানুষের স্থানান্তর গমনের জন্য পথে নামাকে তথ্যায়িত করেছে, তাদের আক্রমণ করাটা অদ্ভুত। হৃদয়হীনতার পরিচয়ও বটে।
প্রথম লকডাউন ঘোষণার ঠিক পরেই, এক পরিযায়ী শ্রমিক – কোনো অটোমোবাইল কারখানার ঠিকে শ্রমিকের সঙ্গে পথ হাঁটার কথা মনে পড়ছে। গন্তব্য উত্তর প্রদেশের পথে তাকে কয়েক শো মাইল হাঁটতে হবে। রাগে ফুটতে ফুটতে বলেছিল, “ওরা কি আমাদের জন্যে বাসের ব্যবস্থাটুকুও করতে পারে না? না কি, আমরা গরিব বলে করছে না?” ক্রোধে ফেটে পড়ে বলেছিল “শুধু গরিব মানুষই মরবে! একটা নেতার একটা বাচ্চাও মরবে না”।
করোনা ভাইরাস নিয়ে প্রচলিত ধারণা – তার নিক্তিতে নাকি সবাই সমান – গরিব বড়লোক বাছবিচার নেই; এটা আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় ধোঁকা। মুম্বাই থেকে দিল্লি, তেলেঙ্গানা থেকে কেরালা – ভারতবর্ষের গরিব মানুষেরাই আমাদের শ্রেণিকে নিরাপদে রাখার মূল্য চুকিয়েছে। লকডাউন ধনী এবং উচ্চবিত্তদের সুরক্ষিত করেছে। দরিদ্রতম নাগরিকদের ঠেলে দেওয়া হয়েছে একেবারে প্রান্তসীমায়।
গত দু’মাস বাস্তবের মাটিতে থেকে, দলীয় রাজনীতির কোন্দলে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেছি। কংগ্রেস উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্য নাথের সঙ্গে বাস নিয়ে সংঘাতে তো ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি)-র আক্রমণের লক্ষ্য আবার মহারাষ্ট্রের শিবসেনা। আমি দূরদর্শনের হাই-তোলা, অসম্ভব ক্লান্তিকর বিতর্কগুলো দেখি না। ওখানে মূল সমস্যার বাইরের বিষয় নিয়েই চর্চা হয়। ঐ চৌহদ্দির বাইরে, আমাদের দেশের বস্তি-মহল্লায় বা উপচানো-ভীড় ট্রাকের পিঠে যেখানে এক চিলতে জায়গার জন্যে শ্রমিকদের ৩০০০ টাকা করে দিতে হয়, সেখানে বড্ড বেমানান এসব। আর ‘সামাজিক দূরত্বের’ মতো কথাগুলো বিদ্রূপের মতো শোনায়।
অন্তত ৯ কোটি ২০ লক্ষ ভারতীয় পরিবারের সংসার একটা ঘরের মধ্যে, কোথাও কোথাও ছয় থেকে আট জন মানুষ থাকে এক চিলতে জায়গায় যার আয়তন একটা বাসনের আলমারির থেকে বেশি নয়। ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’-এমন একটা ধারণা যা অর্থহীন। যেহেতু সব কিছুই চলমান এবং দেশে আজ, দেশভাগের পর বৃহত্তম স্থানান্তরগমনের ঘটনা ঘটছে, স্বাস্থ্য আর ভীড় না করা নিয়ে আমাদের শহর-উজ্জ্বল করা শ্লোগানগুলো শুধু খোওয়া যাওয়া সুযোগগুলোর একটা রকম ফের মাত্র। মুম্বইয়ের ধারাবি, যেখানে খবর করার জন্যে আমি অনেক দিন কাটিয়েছি, সেখানে ৮ লক্ষ লোকের জন্য মাত্র ৮ হাজার সাধারণ শৌচাগার আছে। এখানে ভাইরাসের সংক্রমণ রোখা তো এক বিরাট চ্যালেঞ্জ!
এই অতিমারী আমাদের স্তরবিন্যস্ত বৈষম্যের সমাজকে ঠিক তার আসল চেহারায় উন্মোচিত করেছে, এই বৈষম্যগুলো আমাদের যুগ-পরম্পরাগত উত্তরাধিকার। এবং প্রত্যেকটি সরকারের তাতে দায়ভাগ আছে।
কিন্তু পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর আচমকা এক বিপর্যয়কর পরিবর্তনের নীতি চাপিয়ে দেওয়াটার কোন ব্যাখ্যা হয় না। ৩০ মার্চ মেহতা কোর্টকে জানালেন “রাস্তায় কোনো পরিযায়ী শ্রমিক নেই”। কিন্তু সত্যটা (পরিষ্কার দ্ব্যর্থহীনভাবে ক্যামেরায় ধরা আছে) হল, এর পর প্রায় দু’মাস ধরে আমাদের শ্রমিকরা রাস্তায় ছিলেন। এমনকি এক সপ্তাহ আগেও, ট্রেন আর বাসের জন্য আর অপেক্ষা করতে নারাজ অথবা অপারগ হয়ে, হাইওয়ের পর হাইওয়ে ধরে হেঁটে চলা নারী, পুরুষ, শিশুদের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। হাত জোড় করে, ড্রাইভার বিনিময়ে যা চাইছে তাই দিতে রাজি হয়ে, গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার কাতর আকুতি নিয়ে ট্রাকের পিছনে দৌড়াতেও দেখেছি কতজনকে।
প্রথম যখন ট্রেনের ঘোষণা হল, আমি সুরাত থেকে বিহারগামী ট্রেনটায় শ্রমিকদের হাত নেড়ে বিদায় জানাতে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু সেখানেও পরিচালনায় ছিল অহেতুক স্বচ্ছতার অভাব আর ভুল তথ্য। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার জোর দিয়ে বলল, শ্রমিকদের ট্রেনের টিকিটের দাম দিতে হচ্ছে না।কিন্তু তাদের দিতে হচ্ছে। আমি কর্ণাটক থেকে উত্তর প্রদেশগামী একটা ট্রেনে উঠেছিলাম। সেখানে যত জন শ্রমিকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, প্রত্যেককে হয় ঋণ নিয়ে, ফোন বেচে বা অন্য কোনোভাবে টাকা যোগাড় করে টিকিটের দাম মেটাতে হয়েছিল। বাড়ি ফেরার পথে ট্রেনেই মৃত কাজী আনোয়ারের স্ত্রীর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। তাদেরও নিজের পয়সায় টিকিট কাটতে হয়েছিল, উপরন্তু টিকিট পেতে দালালকে অতিরিক্ত ৭০০ টাকা দিতে হয়েছিল। এসজি’র জানা উচিত, আমরা সবাই ভালো খবর পেতেই চাই। কিন্তু আশা কখনও বাস্তবকে ছাপিয়ে যেতে পারে না, যেমন মধুর প্রলেপে বিষাদকে ঢাকা যায় না। আমি বলব-সেটা করাটা-কর্তব্যকে অস্বীকার করা-নীতিগত এবং পেশাগত উভয় দিক থেকেই।”
(The Solicitor General is wrong on migrant workers :
Barkha Dutt; Hindustan Times)
সত্যের প্রতি দায়বদ্ধ, নির্ভীক সাংবাদিকতাকে আমরা কুর্নিশ জানাই।
– জয়ন্তী দাশগুপ্ত
-- আয়িশা নাতাশা শফিক
রাস্তায় ওরা চেপে ধরেছে আমাকে
নড়তে চড়তে পারছি না
আমি শুধু বলতে পারছি
ফিস ফিস করে
“দমবন্ধ হয়ে আসছে আমার”।
বহু লোক আমাকে দেখছিল
ছবি তুলছিল ক্লিক ক্লিক
আমি শুধু বলতে পারছিলাম
ফিস ফিস করে
“দমবন্ধ হয়ে আসছে আমার”।
তবু অফিসার আমার ঘাড়ের ওপর থেকে
তার হাঁটু সরিয়ে নিল না
মাটিতে চেপে ধরা ছিল আমার মুখ,
নাক দিয়ে অঝোরে রক্ত,
আমি শুধু বলতে পারছিলাম
ফিস ফিস করে
“দমবন্ধ হয়ে আসছে আমার”।
কারণ কী ছিল এর?
আমি একটা বাজে চেক জমা দিয়েছিলাম
না আমার জাতির কারণে?
আমি কি বন্ধুতায় বাঁধিনি তোমাদের?
এখন এই শেষ মুহূর্তগুলোয়
অন্য আর কীইবা করতে পারতাম আমি
ফিস ফিস করে বলা ছাড়া
“দমবন্ধ হয়ে আসছে আমার”।
মনে আছে ছ’বছর আগে ভাই এরিক
গলা টিপে মারার মুহূর্তে
তুমি শুধু বলতে পেরেছিলে
“দমবন্ধ হয়ে আসছে আমার”।
আমার গোটা জীবনের জলছবিগুলো
ঝলকে যাচ্ছিল চোখের ওপর দিয়ে
আমার বউ ও মেয়ের কথা মনে পড়ছিল
আর আমি শুধু যা পারছিলাম
ফিস ফিস করে বলতে
“দমবন্ধ হয়ে আসছে আমার”।
স্যার, আমি শুধু একটা বাজে চেক লিখেছি
শুধু সে জন্যই কি? অথবা কালো চামড়া বলে আমার?
আপনাদের এই আধুনিক জগতে স্যার
আমি কখনো ভাবিনি আমার মৃত্যু হবে
কারণ আমার চামড়ার রঙ ছিল কালো
“স্যার, দমবন্ধ হয়ে আসছে আমার”।
মধুরিমা কন্যা আমার,
কী ভীষণ ইচ্ছে করছে তোমাকে দেখার,
দেখতেও পাচ্ছি তোমাকে
কিন্তু দুঃখিত প্রিয় কন্যা আমার
বাবার দম ফুরিয়ে আসছে এ মুহূর্তে।
আমার জীবন নিভে আসছে
ধীরে, অতি ধীরে, কিন্তু নিশ্চিতভাবে,
আর শেষে আমি যা করতে পারতাম
ফিস ফিস করে বলেছি বারবার
“দমবন্ধ হয়ে আসছে আমার”।
দয়া করো, দম নিতে পারছি না আমি
যন্ত্রণা হচ্ছে আমার পেটে
যন্ত্রণা হচ্ছে আমার ঘাড়ে
যন্ত্রণা হচ্ছে সর্বশরীরে
“ওরা আমায় মেরে ফেলছে”।
“স্যার একটু অনুগ্রহ
দমবন্ধ হয়ে আসছে আমার”।
অনুবাদ - তাপস গঙ্গোপাধ্যায়
বর্তমানে প্রথম বিশ্ব ও তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশে রাজনৈতিক ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থান করেছে ফ্যাসিস্ট শক্তিগুলি। সমান্তরাল ভাবে ফ্যাসিবাদ ও পুঁজিবাদে নিষ্পেষিত মানুষের প্রতিরোধ ক্ষমতার নিদর্শন থেকেছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে শাসক শ্রেণীর মানুষের বিরুদ্ধে সংগঠিত লড়াইয়ে। আমেরিকার শাসকপুষ্ট সাদা পুলিশের হাঁটুর চাপে দমবন্ধ হতে হতে শেষ নিশ্বাসের আগে অব্দি পৃথিবীর অবদমিত মানুষের প্রতিনিধি জর্জ ফ্লয়েড বলেছেন, “আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না”। বিশ্বজোড়া পুঁজিবাদের প্রকোপ, মূল্যবৃদ্ধি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রোজগারের বেসরকারীকরণের বিরুদ্ধে আমেরিকার মানুষকে এক করে দিয়েছে জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু। খোদ আমেরিকার বুকে, পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ও রাষ্টযন্ত্রের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান #blacklivesmatter উচ্চারিত হচ্ছে সমস্বরে। সেই মুহুর্তে আমাদের দেশ ভারতবর্ষে, সাধারণ মানুষের উপর ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও তার পুলিশি যন্ত্রের আগ্রাসন পৌছেছে চরম সীমায়। করোনা মহামারীর সময়, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন-বিরোধী আন্দোলনে রযারা আগে অংশ নিয়েছিল তাদের, দেশ-দ্রোহিতার অপরাধে অভিযুক্ত করে একের পর এক গ্রেপ্তার ও নির্যাতন শুরু করেছে। দেশের মুসলমান মানুষদের ঘরছাড়া করার নীল-নকশা, অর্থাৎ বিজেপি সরকার প্রস্তাবিত নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল লোকসভায় আইন আকারে পাশ হওয়ার পর থেকে দেশজুড়ে শুরু হয় নারী ও ছাত্র-যুবর নেতৃত্বে গণ-আন্দোলন। শাহ-মোদীর কেন্দ্রীয় সরকার, ধর্ম নিয়ে বিদ্বেষের আবহ বলবত করার আড়ালে ভারতবর্ষের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে মুছে ফেলতে চাইছে।
ফ্যাসিবাদ ও পুঁজি নিয়ন্ত্রিত নয়া ভারত গড়ার এজেণ্ডা নিয়ে দ্বিতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় এসেছে শাহ-মোদী জুটি। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির বলপুর্বক বিলোপ, শিক্ষা-স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অবাধ বেসরকারীকরণ করেছে। বেকারত্বের চরমতম সূচকে থাকা ভারতবাসীর উপর নামিয়ে এনেছে একের পর এক জনবিরোধী আইনের প্রকোপ। শ্রম-আইন, গৃহ-হিংসা বিরোধী আইন শিথিল করার সাথে সাথে ট্রান্স-জেন্ডার অ্যাক্ট, ২০১৬ আইনে নতুন বৈষম্য লাগু করা বা জল-জঙ্গল-জমিনের অধিকার সংক্রান্ত আইনের ওপর আঘাত হেনে কেন্দ্রীয় সরকার দেশের বৈষম্য-জনিত আর্থ-সামাজিক বাস্তবতাকে গভীরতর নিত্যনতুন সংকটের মুখে ফেলেছে। বৈষম্যতাড়িত ভারত, ক্ষমতার অসামঞ্জস্যের বিরুদ্ধে ফুঁসতে থাকা ভারতের মেহনতি জনতা, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন লাগু হওয়ায় বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। এই আইন পাশ হওয়ার অব্যবহিত পরেই দেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত ছাত্র-যুব সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়ে শুরু করে সিএএ-বিরোধী আন্দোলন। দিল্লীর জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, উত্তর-প্রদেশের আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত ছাত্রীদের দমন করতে নির্বিচারে পড়ুয়াদের উপর আক্রমন হানে শাহ-যোগী পরিচালিত পুলিশ। পুলিশি পাহারায় জেএনইউ বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট বন্ধ রেখে ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের উপর হামলা চালায় ফ্যাসিস্ট গুন্ডাবাহিনী। ভারতের নব্য ঔপনিবেশিক ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে দিল্লীর শাহিনবাগে মুসলিম মহিলারা অবস্থানে বসেন। দেশের নারী ও ছাত্র-যুবর নেতৃত্বে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভ। কলকাতা থেকে মুম্বাই, বিহার থেকে কর্ণাটক গড়ে ওঠে সিএএ-বিরোধী অবস্থান মঞ্চ। দেশের ভিতরে ও বাইরে বসবাসকারী নাগরিকরা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংবিধান রক্ষার শপথে সংগঠিত হতে থাকে। সাথে চলে আন্দলোন দমনের বিভিন্ন প্রচেষ্টা।
গত ২২ ফেব্রুয়ারী দিল্লীর জাফরাবাদ অঞ্চলে নারী আধিকার কর্মীরা চাকা-বন্ধের কর্মসূচীর ডাক দেয়। বিজেপির অভিজাত পরিবারের উচ্চবর্ণীয় নেতা কপিল মিশ্র তার অনুগামীদের নিয়ে অবস্থানের অদুরবর্তী এলাকায় এসে ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক বক্তব্য রাখে। দাঙ্গায় উস্কানি দেওয়া এই বক্তব্য থেকে নৃশংস বিদ্বেষবিষ ছড়ায় দিল্লীর উত্তর-পুর্বের শ্রমিক মহল্লাগুলিতে। গুজরাট মডেলের আতঙ্কজনক স্মৃতি উসকে দিয়ে সংখ্যালঘু নিধনযজ্ঞ চালায় দিল্লী পুলিশের সহযোগিতিয় ফ্যাসিস্ট বাহিনী। মারা যান ৬০ জন গরিব খেটে খাওয়া মানুষ। সরকারী তথ্যে আহত, ধর্ষিত, বেঘর মানুষদের হদিশ মেলে না। এই আন্দোলনেও থামেনি শাহিনবাগের অঙ্গীকার। এই মহল্লাগুলিতে পুনরায় অবস্থানে বসেন মানুষ। শাসকের চোখে চোখ রেখে মানুষ বলেন, “সব ইয়াদ রাখ্খা যায়েগা। তুম যমিন পে জুল্ম লিখদো, আসমান পে ইনকিলাব লিখ্খা যায়েগা।”
দেশের নাগরিকদের উপর দেশের সরকারে ক্ষমতাসীন দলের মদতে চলা এই হত্যালীলায় ভারত সরকারের ভূমিকার চরম নিন্দা হয় দেশবিদেশের গণতান্ত্রিক মহলে। শাহ-মোদির দামি পোষাকে লেগে থাকা রক্তের দাগ লুকাতে ঢাল হিসাবে ব্যবহৃত হয় করোনা পরিস্থিতি। জানুয়ারী মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে জারি হওয়া করোনা নিয়ে সতর্ক বার্তা উড়িয়ে দিয়ে চলেছে বিশ্বের পুজিবাদ, পিতৃতন্ত্র, বর্ণবাদের পরাকাষ্ঠায় বসে থাকা শাসক আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বা ব্রাজিলের প্রধানমন্ত্রী বলসোনারোকে নিয়ে ভারত সরকারের মোচ্ছোব। এসবের পর ২২ মার্চ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মাত্র চার ঘণ্টার নোটিশে জারি করলেন দেশজোড়া পরিকল্পনাহীন লকডাউন। পরবর্তীতে গরিব বিরোধী, শ্রমিক বিরোধী বিজেপি সরকারের মন্ত্রকগুলির চরম ব্যর্থতা পরিলক্ষিত হয়েছে শয়ে শয়ে শ্রমিক মানুষের অনাহার, দারিদ্রের কোপ ও পথ দুর্ঘটনার মৃত্যুতে। অন্যদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের নির্দেশে সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা ছাত্রছাত্রী, যুব, মহিলা, দলিত প্রতিনিধিরা অভিযুক্ত হচ্ছেন দেশ-দ্রোহিতার কালা-কানুন ইউএপিএ-র কোপে। হিংসার বিরুদ্ধে, দেশের সংবিধান বাঁচাতে যারা শান্তিপুর্ণ আন্দোলনের পথ বেছে নিয়েছিলেন তাদের ঠাঅঁই হচ্ছে কারাগারের অন্ধকারে।
বিগত দুই মাস ধরে দিল্লী পুলিশ জামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া সাফুরা জারগার, মিরান হায়দার, আসিফ ইকবাল তান্হা, জেএনইউ এ শিক্ষারত নাতাশা নারওয়াল, দেবাঙ্গনা কাটিলা, রাজনৈতিক কর্মী ইশরাত জাহান, খালিদ সাইফি, গুলফিশা ফতিমা, সারজিল ইমাম সহ শ-খানেক মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত যুবকে গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তার হওয়া সাথীদের মধ্যে অনেককে কালা-আইন ইউএপিএ দ্বারা অভিযুক্ত করার মাধ্যমে গত ডিসেম্বর থেকে দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়া সিএএ-এনআরসি-বিরোধী গণ-আন্দোলনের জোয়ারকে দমন করার চেষ্টা চালাচ্ছে ফ্যাসিবাদী কেন্দ্রীয় সরকার। শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, এএমইউ-এর ছাত্র ফারহান যুবেরি এবং রাভিশ আলি খানকে সিএএ বিরোধী প্রতিবাদে অংশ নেওয়ার জন্য গ্রেপ্তার করেছে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ। নিঃসন্দেহে আগামীতে দমনের মাত্রা তীব্রতর হবে এবং রাজনৈতিক বন্দীদের তালিকায় নিত্যনতুন নাম যোগ হতে থাকবে। অথচ, প্রকাশ্যে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের উপর সংগঠিত হিংসায় ইন্ধন দেওয়া কপিল মিশ্র, পারভেশ বর্মা, অনুরাগ ঠাকুররা বুক চিতিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে খোলা হাওয়ায়।
একথা স্পষ্ট যে শাসক দল, সামাজিক আন্দোলনগুলির দাবি চিহ্নিত করার বদলে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ও দমন মূলক আইনের ব্যবহারে দমিয়ে দিতে চায় আন্দোলনের প্রতিবাদী স্বর। ভীমা-কোরেগাও প্রতিবাদের পটভূমিকায় কেন্দ্রীয় সরকার একইভাবে বিভিন্ন গণ-আন্দোলনের কর্মীদের মিথ্যা অভিযোগে বন্দী করেছে। সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের সময় থেকে রাষ্ট্রের কারাগারে বন্দী বিট্টু সোনোয়াল, মানস কোনওয়ার, ধৈর্য কোনওয়ার সহ অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মীরা। অখিল গোগোই এর নামে লাগু হয়েছে রাষ্ট্র-দ্রোহিতার মামলা। করোনা মহামারীতে দেশের বেহাল স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা, নিম্নগামী অর্থনীতির বিপর্যয়ের ধাক্কায় হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, লক্ষ কোটি মানুষের জীবন-যাত্রা বিপন্ন। এই মহামারীর মোকাবিলায় সরকারী ক্ষমতা ও সম্পদের পূর্ণ-ব্যবহার করার পরিবর্তে ছাত্র ও রাজনৈতিক কর্মীদের গ্রেপ্তার, আদপেই শাসকের অত্যাচারী চেহারার নির্লজ্জ, নির্লিপ্ত প্রদর্শন।
দেশের মুসলিম, দলিত, আদিবাসী, শ্রমিক, ট্রান্সজেন্ডার, মহিলা সহ সমস্ত প্রান্তিক মানুষের অধিকারের দাবিতে গণ-আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন যারা, তাদের উপর এই আক্রমণ মেনে নিচ্ছে না তরুণ প্রজন্ম। গণতান্ত্রিক স্বর দমনের বিরুদ্ধে গত ৩ মার্চ সিএএ-বিরোধী গণতান্ত্রিক ঐক্যবদ্ধ মঞ্চগুলির পক্ষ থেকে দেশ জুড়ে ‘সব ইয়াদ রাখ্খা জায়েগা’ নামে প্রতিবাদ দিবস পালিত হয়। অন্যান্য শহরের মতো কোলকাতায় যাদবপুর, গড়িয়াহাট, দমদম, বাঘা-যতীন অঞ্চলে সামাজিক সংহতির বার্তা নিয়ে, শারীরিক দুরত্ব বজায় রেখে জমায়েত হন মানুষ। সাম্প্রতিক সময় চলা, #ব্ল্যাকলাইভসম্যাটার আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে, ভারতের ফ্যাসিস্টদের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই তীব্র করার শপথ নেওয়া হয়। দিল্লী গণহত্যার আসল অপরাধী কপিল মিশ্র ও অনুভব ঠাকুরদের অবিলম্বে গ্রেপ্তারের দাবি জানানো হয়। সিএএ-বিরোধী ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কর্মীদের অবিলম্বে মুক্তির দাবি জানিয়ে এই কর্মসূচী চলে। এই কর্মসূচীতে অংশ নিয়েছিলেন, কলকাতার বিভিন্ন মহিলা সংগঠন যেমন ফেমিনিস্টস ইন রেজিস্ট্যান্স, সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি, ‘তুমি ধর্ষক’ প্রভৃতি নারীবাদী সংগঠন ও আইসা সহ বিভিন্ন ছাত্র যুব ও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতির কর্মীরা।
– সম্প্রীতি মুখার্জী
প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট। অথচ হাসপাতালে ভেন্টিলেটর ফাঁকা নেই। ঘন্টার পর ঘন্টা অক্সিজেনের অভাবে চরম কষ্ট পেয়ে অবশেষে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন কবিতা। আমরা হারালাম করোনা বিরোধী লড়াইয়ের একজন প্রথম সারির যোদ্ধাকে। আবারো প্রমান হলো কোভিড চিকিৎসায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বেহাল দশা কি ভয়ঙ্কর! লকডাউন – নাইট কার্ফু নামে সারা দেশকে ঘরবন্দী করার উদ্দেশ্য ছিলো তো সংক্রমণের গতি কমিয়ে প্রস্তুতির জন্য সময় কেনা। অথচ দু মাসাধিক সময় অতিক্রান্ত করে ভগ্ন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আজ যেন অন্তর্জলি যাত্রা শুরু হয়েছে!
নৈহাটির বাসিন্দা কবিতা দত্ত মজুমদার বারাসাত হাসপাতালের সিস্টার-ইন-চার্জ ছিলেন। করোনা আবহে গত মার্চ মাস থেকে হাসপাতালে প্রচন্ড কাজের চাপ। এই চাপ তিনি আর নিতে পারছিলেন না। শরীর ক্রমশ খারাপ হতে থাকে। অথচ ছুটি নেই। তাঁর মেয়ে গার্গী জানালেন “হাসপাতালে স্টাফ কম থাকায় মা টানা ৩৬ ঘণ্টা ডিউটি করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৫ মে মা হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরেন ১০৭ ডিগ্রি জ্বর ও প্রচন্ড পেটের যন্ত্রনা নিয়ে। সঙ্গে উচ্চ রক্ত চাপ ও সারা দেহে অসহ্য ব্যাথা।” বাড়ির লোক সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর চেষ্টা করে। কিন্তু করোনা আতঙ্কে ( যেহেতু উচ্চ জ্বর) নৈহাটি ও কল্যাণী হাসপাতাল এমনকি রোগীকে দেখতেও অস্বীকার করে। বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে শেষ পর্যন্ত বারাকপুর অঞ্চলের একমাত্র কোভিড হাসপাতাল টেকনোগ্লোবে ভর্তি করা হয়। তাঁর প্রথম রিপোর্ট কোভিড নেগেটিভ আসে। প্রায় ১০ দিন এই হাসপাতালে চিকিৎসা চলে। ডাক্তারদের মতে রোগীর অন্ত্রে সংক্রমণ। খুব দ্রুত নিম্নাঙ্গ অবশ হয়ে যায় ও অবস্থাও ক্রমশ খারাপ হতে থাকে। এর মধ্যেই দ্বিতীয়বার কোভিড রিপোর্ট নেগেটিভ আসায় তাঁকে ঐ কোভিড হাসপাতাল থেকে ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়।
আবার অনেক চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত ২৫ মে আরজিকরে মেডিসিন বিভাগে ভর্তি করা হয়। এখানকার ডাক্তাররা বিভিন্ন পরীক্ষা চালিয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে অন্ত্রে নয়, কবিতার স্পাইনাল কর্ডে ইনফেকশন। তাঁর অসার নিম্নাঙ্গে সংক্রমণ তখন ভালোমাত্রায় ছড়িয়ে পড়েছে। ডাক্তাররা আশঙ্কা প্রকাশ করে জানায় এবার ঊর্ধাঙ্গে যদি ছড়িয়ে পড়ে তবে তার শ্বাসকষ্ট সহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেবে। কয়েকদিন রোগী স্থিতিশীল থাকার পর ৩১ মে অবস্থা ক্রমশ অবনতি হতে থাকে, শুরু হয় প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট। রোগীর প্রয়োজন ভেন্টিলেটর। কিন্তু যেহেতু কোভিড হাসপাতাল থেকে রোগী এসেছে, তাই ভেন্টিলেটর দিতে রাজি নয় মেডিসিন বিভাগ। তাই বাড়ির লোক তাঁকে কোভিড চিকিৎসা বিভাগে ভর্তি করান।
কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হলো না। সেখানেও ভেন্টিলেটর ফাঁকা নেই। চরম কষ্ট ভোগ করতে করতে প্রায় বিনা চিকিৎসায় ১ জুন মারা গেলেন কবিতা। দীর্ঘদিনের নার্স, কত রোগীকে সেবার মাধ্যমে সুস্থ করে ঘরে ফিরিয়ে দিয়ে আজ নিজে চলে গেলেন চিকিৎসা সেবা না পেয়ে!
এখন তো মরেও শান্তি নেই! হাসপাতাল থেকে বাড়ির লোককে জানিয়ে দেওয়া হলো ৩১ মে কবিতার নমুনা সংগ্রহ করে কোভিড টেস্টে পাঠানো হয়েছে। রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত মরদেহ বাড়ির হাতে তুলে দেওয়া যাবে না। দু-দুবার কোভিড নেগেটিভ রোগী কবিতার মৃত্যুর পরের দিন রিপোর্ট আসলো কোভিড পজিটিভ। তাই মৃতদেহ বাড়ির লোকের হাতে তুলে দেওয়া যাবে না। মর্গেই থাকবে। প্রশাসন তার সুবিধা মতো কোনো একদিন কোনো এক জায়গায় দাহ করবে। পরিবারের লোক তাদের প্রিয়জনকে শেষ বিদায় পর্যন্ত জানাতে পারলো না।
বারাসাত হাসপাতালের সুপারের বক্তব্য তার হাসপাতালে এখনো কোনো করোনা কেস নেই। তাই হয়তো করোনা আক্রান্ত হয়েছে বারাকপুর শিল্পাঞ্চলের একমাত্র কোভিড হাসপাতাল টেকনোগ্লোব থেকেই। ঐ হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরই তাই তাঁর রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে। স্বাস্থ্য দপ্তর পরিবারকে জানিয়েছে যে তারা এই মৃত্যুর তদন্ত করে দেখবে। জানিনা বাড়ির লোক সেই রিপোর্ট দেখতে পাবে কি না?
এখন কবিতার একমাত্র মেয়ে সদ্য গ্র্যাজুয়েট গার্গী করোনা আক্রান্ত হয়ে বেলাঘাটা আইডি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এই রিপোর্ট লেখার সময় জানতে পারলাম গার্গীর অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল হওয়ায় তাকে আইসিইউ থেকে জেনারেল বেডে দেওয়া হয়েছে। ওর বাবা আছেন সরকারী কোয়ারিন্টাইন সেন্টারে। কবিতার ভাই বোন সহ ৫টি পরিবার হোম কোয়ারিন্টাইনে। কবিতার বারবার কোভিড নেগেটিভ রিপোর্ট আসায় এই পরিবারগুলি মিসগাইড হওয়ার ফল ভোগ করছে।
কবিতার ভাই কমরেড বরুনাভ দত্ত হোম কোয়ারিন্টাইন থেকে ফোনে জানালেন যে “করোনা মোকাবিলায় রাজ্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থার করুন কঙ্কাল দশা আবার বে-আব্রু হলো আমার দিদির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। এই অবস্থা বদলাতে সোচ্চার হতে হবে আমাদের সবাইকে। সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে ভেন্টিলেটরের সংখ্যা বাড়ানোর। না হলে দেখতে হবে এই ভাবে বিনা চিকিৎসায় কষ্ট পেয়ে চলে যেতে আমাদের অনেক প্রিয়জনদের। সে বড় বেদনাদায়ক !”
আমরা কবিতা দত্ত মজুমদারের অকাল প্রয়াণে গভীর শোক জ্ঞাপন করছি। তাঁর পরিবারের প্রতি সহমর্মিতা জানাচ্ছি। দাবি করছি তার মেয়ে গার্গীর চিকিৎসা যেন সরকার উপযুক্ত দায়িত্ব নিয়ে তত্ত্বাবধান করে। আমরা গার্গীর দ্রুত আরোগ্য লাভ কামনা করি। রাজ্যে প্রথম সিস্টার কোভিড শহীদ কবিতা দত্ত মজুমদারকে প্রকৃত শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে আসুন আমরা সকলে মিলে এই স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পরিবর্তনের লক্ষ্যে সোচ্চার হই।
– সুব্রত সেনগুপ্ত
করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একজন সামনের সারির যোদ্ধা সিনিয়ার নার্স কবিতা দত্ত মজুমদারের মৃত্যু আমাদের বিচলিত করেছে। বিনা চিকিৎসায় একজন সিনিয়ার নার্সের মৃত্যু হল। এরকম আরও কত অজানা ঘটনা আছে যা হয়তো কোনদিন প্রকাশ্যে আসবে না। তাঁদের স্বজন হারানোর কষ্ট কেউ জানতেও পারবে না।
কোভিড-১৯ আমাদের সমগ্র সমাজ ব্যবস্থা সহ চিকিৎসা জগতকে পুরোপুরি উন্মোচিত করে দিয়েছে। মানুষ অতিমারীতে আক্রান্ত হচ্ছেন। সুস্থরা গৃহবন্দি। সবার কপালে ভাঁজ পড়েছে। তাঁদের প্রিয় জনের কিছু হলে কোথায় চিকিৎসার জন্যে নিয়ে যাবেন? রাজ্যে প্রায় ২০০০ ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান। এরমধ্যে আছে কর্পোরেট হাসপাতাল ও কিছু নার্সিংহোম কাম হাসপাতাল। অতিমারির সময় বেশিরভাগ বেসরকারী স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান আংশিক চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু রেখেছে।
২০১৭ সালে বেসরকারী স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ, ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের বিরুদ্ধে ভূরিভূরি অভিযোগ আসতে থাকল। রোগীর পরিজনদের সাথে বেসরকারী হাসপাতলের সঙ্গে ঝামেলা নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। হাসপাতাল গুলিতে মারপিট, দাঙ্গা হাঙ্গামা বাড়তে থাকে। রাজ্য সরকার বাধ্য হয়ে নয়া হাসপাতাল বিল ২০১৭ বিধানসভায় পেশ করে।
বামফ্রন্ট সরকার ২০১০ সালে অনুরূপ বিল পেশ করেছিল। যদিও সেই সময় বিরোধী দল তৃণমূল কংগ্রেস আইনটির বিরোধিতা করেছিল৷ বিধানসভার সিলেক্ট কমিটির কাছে ‘নোট অফ ডিসেন্ট’ দিয়ে, এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় আইনের দাবি করেছিল৷ প্রায় অনুরূপ একটা বিল ২০১৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বিধানসভায় আনলো।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি নিজেই পেশ করলেন ‘দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল ক্লিনিক্যাল এস্টাবলিশমেন্টস (রেজিস্ট্রেশন, রেগুলেশন অ্যান্ড ট্রান্সপারেন্সি) বিল, ২০১৭’৷ এই বিলে চিকিৎসার গাফিলতির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক জরিমানার ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রাখা হলো৷ এক নজরে নিয়মগুলি যা দাঁড়ালো — চরম গাফিলতির ক্ষেত্রে ন্যূনতম জরিমানা ১০ লক্ষ টাকা৷ বড় ক্ষতির ক্ষেত্রে ৫ লক্ষ এবং তুলনায় কম ক্ষতির ক্ষেত্রে ৩ লক্ষ টাকা জরিমানা৷ এই ক্ষতিপূরণ বিপত্তি ঘটার এক মাসের মধ্যে আংশিক এবং ছয় মাসের মধ্যে পুরোপুরি মিটিয়ে দিতে হবে৷ এছাড়া বলা হলো, দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে আর্থিক সঙ্গতি না দেখে, সবার আগে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে৷ অ্যাসিড হামলা এবং ধর্ষণের শিকার হবেন যাঁরা, তাঁদের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম৷ বলা হয়েছে, এমার্জেন্সি বিভাগ থেকে রোগী প্রত্যাখ্যান করা যাবে না৷ বিল মেটাতে না পারলে মৃতদেহ আটকে রাখাও যাবে না৷ নতুন বিলে খুব স্পষ্ট করে দেওয়া আছে যে, যে চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান এইসব নিয়ম মানবে না, তাদের লাইসেন্স বাতিল হবে৷ এবং সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের ৩ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান দেওয়া আছে বিলে৷
কিন্তু বাস্তবটা বড় কঠিন। করোনা অতিমারী শুরু হতেই, বেসরকারী চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রায় উঠেই গেল। বেসরকারী হাসপাতালগুলো করোনার জন্য কয়েকটি বেডের ব্যবস্থা করে নিজেদের দায় মুক্ত করে নিল। করোনা ছাড়া অন্য কোনো রোগ নিয়ে বেসরকারী হাসপাতালে গেলে, আগে করোনার নেগেটিভ রিপোর্ট দেখাতে হবে। তারপর চিকিৎসা পাবেন। এমন কি যে সব ডাক্তারবাবুরা ব্যাক্তিগত চেম্বার করতেন তারাও উধাও হয়ে গেলেন। করোনা ছাড়াও হাজারো রোগ আছে, কেউ কেউ দীর্ঘদিন কোনো জটিল বা মারণ রোগে আক্রান্ত, কেউবা বিভিন্ন উপসর্গ নিয়ে আছেন চিকিৎসক খুঁজে পাচ্ছেন না। এ এক করুণ দুর্বিষহ পরিস্থিতির মুখোমুখি আম জনতা। আর বেসরকারী হাসপাতাল, নার্সিংহোম, চিকিৎসক সবাই করোনা দেখিয়ে আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেলেন। অসহায় মানুষ চিকিৎসার জন্য ছটফট করছেন। এখন মেডিক্লেমের গল্পগাছা শুনতে পাবেন না। বীমা কোম্পানিগুলোর গল্পও শেষ। মানুষ রোগমুক্তির জন্যে ছুটছেন ভেঙে পড়া সরকারী হাসপাতালে।
যখন ‘চাচা নিজের প্রাণ বাঁচা’ বলে বেশিরভাগ বেসরকারী হাসপাতাল, নার্সিংহোম, চিকিৎসা কেন্দ্র বা চেম্বারে বসা মোটা ভিজিটের ডাক্তারবাবুরা সবাই হাত তুলে দিয়েছেন, তখন অগতির গতি সরকারী হাসপাতাল। রোগী উপচে পড়ছে। সামাজিক, অসামাজিক কোন দূরত্বের বালাই নেই। হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স এবং অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদেরও করোনার সংক্রমণে মৃত্যু হচ্ছে। তারাও অবহেলার শিকার হচ্ছেন। সিনিয়ার নার্স কবিতা দত্ত মজুমদার এই অব্যবস্থার শিকার হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। মৃতা কবিতা দত্ত মজুমদারের মেয়ে করোনায় সংক্রমিত হয়ে বেলেঘাটা আইডি-তে ভর্তি আছেন।
এরকমই এক হতভম্ব হয়ে যাওয়া মর্মন্তুদ কাহিনী সাগরদত্ত হাসপাতালের। ২১ মে সালাউদ্দিন সাগর দত্ত হাসপাতালে বুকে ব্যথা নিয়ে ভর্তী হন। ২২ মে মারা যান। মৃত্যুর ১২ দিন পর মৃত সালাউদ্দিনের দেহ ও ডেথ সার্টিফিকেট পরিজনরা পেলেন। এই বারোদিন পরিজনেরা একরাশ উৎকন্ঠা নিয়ে প্রতিদিন হাসপাতালে গেছেন, ফিরে এসেছেন। বাড়ির লোকেরা অসহায়ভাবে ঘুরে বেরিয়েছেন, এক সময় আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। এরপর সুপারের সাথে যোগাযোগ হয়, তিনি আবার নতুন করে উদ্যোগী হলেন।
২ জুন সুপারের সাথে যোগাযোগ করে জানা গেল তিনি এই ঘটনায় ওয়াকিবহাল আছেন। তিনি জানান সালাউদ্দিন ২১ মে ভর্তি হয়েছন এবং ২২ মে মারা যান। তিনি আরও বলেন খুব দুঃখের ঘটনা, আমার পরিবারের এরকম হলে, আমিও খুব কষ্ট পেতাম। অভিযোগ করা হল পরের রিপোর্ট আগে আসছে এবং আগের রিপোর্ট পরে আসার জন্য, ক্রমানুসার ঠিক থাকছে না। সুপার জানান এই তথ্য ঠিক না। আসল কারণ নাইসেড এতো চাপ সামলাতে পারছে না। মৃতের পরিবার ১২ দিন সাধারণ জীবন যাপন করছেন। যদি মৃতের রিপোর্ট পজিটিভ হয়? তাহলে মৃতের পরিবারের মাধ্যমে সমাজে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকছে। হ্যাঁ। দুশ্চিন্তা থাকছে। চেষ্টা করছি যাতে রিপোর্ট তাড়াতাড়ি আসে।
৩ জুন সকালে হাসপাতাল থেকে মৃতের বাড়িতে ফোন যায়, ‘মৃতদেহ নিয়ে যান’। মৃতের পরিবার উৎকন্ঠা মুক্ত হলেন। সৌভাগ্যবশত মৃতের কোভিড রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। সমাজও সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পায়। রিপোর্ট যদি পজিটিভ হোত তাহলে মৃতের পরিবার ও সমাজ দিনের পর দিন উৎকন্ঠায় থাকতো। আর এই পরিবারটিও অসংবেদনশীলতার শিকার হতেন। সাম্প্রদায়িক দলের প্রতিনিধিরা, ঘৃণা ও বিভজনের জন্যে সলতে পাকানো শুরু করে দিত। আমাদের চোখের আড়ালে এরকম আরও কত যে অমানবিক কাহিনী ছড়িয়ে আছে? তা হয়তো জানাও যাবে না।
কোভিড-১৯ আমাদের জীবন ও সরকারী প্রতিষ্ঠানে বহু পরিবর্তন হয়ে চলেছে। খবরে প্রকাশিত রাজ্য সরকার ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি সরকারী ও বেসরকারী হাসপাতাল, নার্সিংহোম এবং হোটেলকে করোনা হাসপাতাল বানিয়েছে। রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তর কামারহাটি কলেজ অব মেডিসিন এন্ড সাগরদত্ত হাসপাতালকে করোনা হাসপাতালে পরিণত করার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে। যখন করোনার প্রাদুর্ভাব হচ্ছে তখন বেশ কিছু করোনা হাসপাতাল গড়ে তুলতে হবে, এতে নীতিগত কোনো আপত্তি থাকতে পারে না। কিন্তু সরকারের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি না থাকলে চট জলদি যে কোনো সিদ্ধান্ত ‘হিতে বিপরীত’ ফল দিতে পারে। আগেই আলোচনা করেছি, অতিমারীর সময় প্রায় সব বেসরকারী চিকিৎসা বন্ধ। বর্তমানে নৈহাটি থেকে বেলঘরিয়া, মধ্যমগ্রাম, দমদম, নিমতা, বরানগর এমন কী গঙ্গার ওপারে বালি, উত্তরপড়া, হিন্দ মোটর, কোন্নগর থেকেও বহু রোগী চিকিৎসার জন্য সাগর দত্ত হাসপাতালে আসছেন। এখন সব চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রায় বন্ধ, তখন সরকার বাহাদুর কী ভাবছেন? এই অঞ্চলের লক্ষ লক্ষ রোগীরা কোথায় যাবেন চিকিৎসা করাতে!?
শতাব্দী প্রাচীন সাগর দত্ত চেরিটেবল ডিসপেনসারিকে ১৯৩৭ সালে রেকগনাইজড মেডিকেল সেক্রেটারি ডাঃ অ্যান্ডারসন মান্যতা দেন। ২০০৭ সালে প্রস্তাব আসে বেসরকারী স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান অ্যাপোলো গ্লেনিগেলসের সাথে পিপিপি (পাবলিক, প্রাইভাট, পার্টনারশিপ) মডেলে সুপার স্পেশালিষ্ট হাসপাতাল তৈরি করা হবে। বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষ ‘সাগর দত্ত হাসপাতাল বাঁচাও মঞ্চ’ গড়ে তুলে প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু করেন। অ্যাপোলো ও রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তর পিছু হটে। স্বাস্থ্য দপ্তর ২০১০ সরকারী মেডিকেল কলেজ করার সিদ্ধান্ত নেয়। ৩০ জুন ২০১১ সালে ‘কলেজ অব মেডিসিন অ্যান্ড সাগরদত্ত হাসপাতাল’ গড়ে ওঠে। তারপর খুব ভালো না হলেও যে ভাবে সব কিছু আমাদের দেশে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে সাগর দত্ত হাসপাতালও চলছিল। এখন সব বন্ধ। আউট ডোর, জরুরি পরিষেবা, অন্য রোগের চিকিৎসা সব বন্ধ। সবাই হতাশ, আতঙ্কগ্রস্ত অসুস্থ হলে তারা কোথায় যাবেন, ন্যূনতম চিকিৎসার জন্যে? আশার কোনো আলো নেই, চারিদিকে শুধু অন্ধকার, আর অন্ধকার।
-- নবেন্দু দাশগুপ্ত
গ্রামীণ এলাকায় নিশ্চিন্তপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের আটটি বুথেই আমাদের সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির সক্রিয়তা রয়েছে। এখানে আমাদের সদস্যরা কেউ নির্মাণ শ্রমিক, কেউ স্বনির্ভর গোষ্ঠীর কর্মী। এরা ঋণ নিয়ে মাছ চাষ, সবজি চাষ, সেলাই ইত্যাদি করেন। অসংগঠিত শ্রমিকও আছেন। এরা মাছ, সবজি বিক্রি করেন। রাখী বাঁধেন, ঝুড়ি বাঁধেন, জরির কাজ করেন। স্বামীরা কেউ ভ্যান বা চালান। রাজমিস্ত্রি, রং মিস্ত্রির বা ছোটখাটো কাজ করেন। শহরাঞ্চলে বজবজ ও পূজালি পৌরসভা অঞ্চলে মহিলা সমিতি কাজ করছে। এখানে মিড ডে মিল কর্মীরা আমাদের সদস্য। তারা স্থানীয় প্রোগ্রামে অংশ নিলেও তৃণমূলী সন্ত্রাসে বাইরের বড় কর্মসূচীতে ইদানিং থাকতে পারেন না।
কেন্দ্রীয় সরকারের বিনা নোটিশের লক ডাউনে ব্যাপক শ্রমজীবী মহিলা চূড়ান্ত অসহায় অবস্থায় পড়েছেন। একশো দিনের কাজ বন্ধ। হাতে পয়সা নেই। খালে বিলে মাছ ধরে, পুকুরের শাক তুলে পাড়ায় পাড়ায় বিক্রি করে কোনো রকমে চলছে। স্বাস্থ্য সচেতনতা এদের কাছে আশা করা যায় না। বজবজ এলাকায় জনা কুড়ি শ্রমিক ভিন রাজ্য থেকে গ্রামে ফিরেছে। বৈষ্ণবপাড়া ও জামালপুর অঞ্চলে প্রথম যখন শ্রমিকরা বাড়িতে ফিরল, পঞ্চায়েত থেকে রুটিন মাফিক একবার শুধু স্বাস্থ্যবিধি মানার কথা বলে গিয়েছিল। কিন্তু কতটা বাস্তবে মানা হচ্ছে, তা নিয়ে নজরদারি ছিল না। আমাদের মহিলা সমিতির নেত্রী দেবযানী বিষয়টি নিয়ে গ্রামবাসী, আশাকর্মী, পঞ্চায়েত সদস্য সবার সঙ্গে বারবার কথা বলে গুরুত্বটা বোঝাতে পারেন। এমনকি থানাতেও গিয়েছিলেন। তবে আলাদা কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করা যায়নি। হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বলা হয়েছে। পরে শ্রমিক স্পেশালে যারা ফিরেছেন তাদেরও একই কথা বলা হয়েছে। একটা মাত্র ঘর, তাও আবার আমফানে চালের টিন উড়ে গেছে।
বজবজ গ্রামাঞ্চলে, নিশ্চিন্তপুর গ্রাম পঞ্চায়েতে আমফানের ঝড়ে খুব ক্ষতি হয়েছে। আমাদের কাজের এলাকায় ২২টি পরিবারের ঘর ভেঙে গেছে। দেওয়াল পড়ে গেছে, চাল উড়ে গেছে। সবজি ও বোরো ধানের চাষে খুব ক্ষতি হয়েছে। পঞ্চায়েত সদস্য রুটিন বলে দিয়েছে। কিন্তু করণীয় কিছুই নেই। বিডিও বা পঞ্চায়েত থেকে এখনও ক্ষয় ক্ষতি দেখতে কেউ আসেনি। দেবযানীর নেতৃত্বে মহিলারা পাড়ায় গিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে একটা লিস্ট বানিয়েছে – কার কত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ফর্ম ফিল আপ করছে। এতে এলাকায় আমাদের সমিতি ও পার্টি সম্পর্কে মানুষের মধ্যে ভালো প্রভাব পড়েছে। দেবযানী ও অঞ্জনার নেতৃত্বের এটা কেন্দ্র করে প্রচার চলছে। বাখরাহাটে পূর্ণিমার নেতৃত্বে প্রচার চলছে। ওখানে সম্প্রতি মহিলা সমিতি মহীয়সী নারী ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের দু’শো বছরের জন্মজয়ন্তী পালন করে পার্টির সহযোগিতায়। প্রায় ১৫ জন সমিতি সদস্য, স্বাস্থ্যকর্মী, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও অন্যান্যদের উপস্থিতিতে তাঁর সেবাপরায়ণতার আদর্শ নিয়ে বক্তব্যও রাখে মহিলারা।
১০০ দিনের কাজ কিছু মহিলা পেয়েছে। সব জায়গায় শুরু হয়নি। লকডাউনে সরকার শুধু চাল দিয়েছে। আর কিছু না দেওয়ার ফলে আমরা গত ১৮ মে বিডিও-তে গেছিলাম। সবাই সরব হয়েছে – শুধু চাল কি চিবিয়ে খাব। আয়ারলা-র সঙ্গে মহিলা সমিতির প্রায় ৫০ জন বিক্ষোভে ছিল। আমাদের দাবি ছিল-পরিবার পিছু মাসে ৫০ কেজি খাদ্যশস্য, ভোজ্য তেল, ২০০ ইউনিট ফ্রি বিদ্যুৎ, ২০০ দিনের কাজ, দিন ৫০০ টাকা মজুরি।
মহিলা সমিতি ও পার্টির উদ্যোগে তিনবারে ৮টি বুথের ২০৫টি পরিবারকে সাহায্য দেওয়া হয়েছে। ঝড়ের এই ক্ষতির উপর মদের দোকানে ভিড়। এর ফলে গার্হস্থ্য হিংসা বাড়তে শুরু করছে। লকডাউনে আমার উপলব্ধি-সংগঠনকে বাঁচিয়ে রাখতে ও কর্মীদের উদ্যোগ বাড়াতে কর্মীদের সঙ্গে রোজকার যোগাযোগ রাখাটা খুব দরকার। আমি কাজের এলাকায় যেতে না পারলেও ফোনে অনবরত খোঁজখবর নিয়েছি, কথা বলেছি। দেখেছি বিভিন্ন ব্যাপারে ওরা আগের থেকেও বেশি উদ্যোগ নিয়েছে সাহসের সঙ্গে। যেমন কোয়ারেন্টাইন নিয়ে। যেমন ডেপুটেশন বিক্ষোভে প্রথম শ্লোগান দিয়েছে। অ্যাপোয়ার কর্মসূচী নিজেরাই সংগঠিত করেছে। ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে থেকে প্রশাসনকে চাপ দেওয়া, লকডাউনে কাজ হারানো মানুষকে সাহায্য পৌঁছে দেওয়া – এসব ব্যাপারে যে উদ্যোগ নিয়েছে তা আমাকে উৎসাহিত করেছে। এখন আমাকে ভাবতে হবে কীভাবে ওদের আরও রাজনীতি সচেতন করা যায়।
-- কাজল দত্ত
সম্পাদিকা
সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি
দক্ষিণ ২৪ পরগণা
সে এক দিন ছিলো – যখন সেমিনার মানে সংশ্লিষ্ট কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় প্রধান বা অধ্যক্ষ মশাইয়ের মেয়ের বিয়ে, হইচই হাঁকডাকে তার একমাস আগে থেকেই কাজকর্মের দফারফা। দুপুরের ভূরিভোজ (“ওয়ার্কিং লাঞ্চ”) থেকে আরম্ভ করে বহিরাগত অতিথিদের (“রিসোর্স পার্সন”) যাতায়াতের গাড়ি-দুই বা একদিনের মধ্যে সবটা বেঁধে ফেলা ছিলো অনেকটা ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীতের গৌড়সারঙ্গ রাগিনী গায়নের মতো … সীমিত সময়ে আরোহ অবরোহসহ শেষ করে ওঠাই মুশকিল। মুশকিল আসানের জন্যও থাকতেন কিছু শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মী-অধ্যক্ষ বা বিভাগীয় প্রধান জানতেন, তাঁর স্যুটের ক্রিজ বা পাঞ্জাবির ভাঁজ নষ্ট হবে না, সব ঠিক ‘ম্যানেজ’ হয়ে যাবে। লকডাউন সেই মুশকিল আসানদের একঝটকায় মূল্যহীন করে দিলো – সেমিনারের জায়গা পাকাপাকিভাবে দখল করলো ওয়েবিনার।
এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, অনলাইন সেমিনার বা ওয়েবিনার বা স্কাইপ প্রেজেন্টেশন এর আগেও ছিলো – কিন্তু এমন সর্বজনীন স্তরে তা নেমে আসেনি। অনলাইন প্রেজেন্টেশন ছিলো একটা সমান্তরাল মাধ্যমের মতো, কিছুটা বিকল্পের ধারণাও নিহিত থাকতো তার মধ্যে … কিছুটা ‘আদারনেস’-এর ধারণাও কি ছিলো না? অনেক সেমিনারে সার্টিফিকেটে লিখেও দিতো – “পেপার প্রেজেন্টেড থ্রু স্কাইপ/অনলাইন মোড” … লকডাউন এসে ‘সেন্টার’ আর ‘মার্জিন’-এর সেই ধারণাকে একেবারে ঘুরিয়ে দিলো! গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে … ওয়েবিনার হয়ে উঠলো লকডাউনকালীন বিদ্যাচর্চার স্টাইল আইকন। ফল? লকডাউনে গৃহবন্দী পুরাতত্ত্বের গবেষককেও টিটকিরি খেতে হলো – “ওয়েবিনারে একটাও প্রেজেন্টেশন দাওনি? লকডাউন কি খেয়ে-ঘুমিয়ে কাটালে?” কে বোঝাবে – তার সাবজেক্টে ঘুরে বেড়ানোটাই একটা কাজ, ঘরে বসে অনলাইনে আর্কিওলজির গবেষণা হয় না! কোথাও বা আবার ছাত্রছাত্রীরা ব্যস্ত হয়ে পড়লো কে কটা ওয়েবিনার অ্যাটেন্ড করেছে, প্রমাণসহ তার সংখ্যা ফেসবুকে পোস্টাতে … শিয়ালদা শাখার বনগাঁ লোকালে একই কামরায় দুজন হকার দুদিক থেকে উঠে এলে নিত্যযাত্রীরা জানেন, দুজনের হাঁকাহাঁকিতে দাম কমতে বাধ্য – এ দশ টাকায় আটটা দিতে চায় তো ও ওদিক থেকে হেঁকে ওঠে, “দশে দশ, দশে দশ-শুধু নিয়ে যান” – তেমনি এই কলেজ বলে, আমরা আটটা ওয়েবিনার করেছি, তো পাশের কলেজ আস্তিন গুটিয়ে তেড়ে আসে : আমরা যে দশটা করলাম, তার বেলা?
২০১৫-র ১২ মার্চ আর্জেন্তিনার রাজধানী বুয়েনস আয়ার্সে একটি বক্তৃতা দেন এই সময়ের এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তক নোয়াম চমস্কি। তাতে তিনি স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, পুঁজিবাদী আধুনিকতার স্বার্থে মানুষের প্রযুক্তিনির্ভরতা যদি মাত্রাতিরিক্ত হারে বাড়ে, তাহলে নাগরিকরা খুব সহজে তাদের অজান্তেই চলে আসবে রাষ্ট্রীয় নজরদারির আওতায়, যেমনটা হচ্ছে চিনে। করোনা পরবর্তী সময়ে ২০২০-র এপ্রিল-মে মাসের বক্তৃতা বা সাক্ষাৎকারে তিনি নিও লিবারেলিজমের আড়ালে পুঁজিবাদের আকাশচুম্বী অহংকারের পতনের কারণ অনুসন্ধানের মধ্যেও প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন এই দেশগুলির প্রযুক্তিনির্ভরতার ‘মাত্রা’র দিকে। প্রযুক্তিকে আমি আমার স্বার্থে ব্যবহার করবো, কিন্তু প্রযুক্তি যদি সিন্দবাদের বৃদ্ধের মতো আমার ঘাড় থেকে না নামতে চায়, তখন?
আপাত মজাটুকু বাদ দিয়ে এই সেমিনারগুলির কিছু ভালো দিকও ছিলো – ছাত্রছাত্রীরা প্রশ্ন করতে শিখতো, তরুণ গবেষকরা নিজেদেরকে আরো অনেক ধারালো করে তোলার সুযোগ পেতেন, বিভিন্ন চিন্তাধারার ধাক্কায় যে আগুনের ফুলকি উঠে আসতো, উত্তাপের সঙ্গে তা আলোও যোগাতো। অল্প হলেও উদ্ভাসিত হয়ে উঠতো জ্ঞানচর্চার জগৎ। সবথেকে মলিন সালোয়ার-কামিজ পরা মেয়েটি বা সবচেয়ে সাধারণ চেহারার ছেলেটি প্রশ্নোত্তর পর্বে আমন্ত্রিত বক্তার চোখে চোখ রেখে অনেক সময় এমন সব প্রশ্ন ছুঁড়ে দিত, সেই সারল্যভরা বিশুদ্ধ জিজ্ঞাসার সামনে অনেক তাবড় তাবড় বক্তা থমকে যেতেন !
তরুণ গবেষকের প্রশ্নে নাস্তানাবুদ হয়ে কখনো রেগে গিয়ে, কখনো সস্নেহ হেসে,আবার কখনো বা নিজের বক্তব্যকে প্রত্যাহারও করে নিতে দেখেছি অনেকবার। মধ্যভারতের একটি জাতীয় নাট্য কর্মশালায় আদিবাসী লোকনাট্য আর থার্ড থিয়েটারের তুলনামূলক আলোচনায় এক আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞকে প্রায়োগিক প্রশ্নে নাকানিচোবানি খাইয়ে দিয়েছিলেন ঝাড়খণ্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাইবাল ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড লিটারেচারের একদল তরুণ গবেষক … অসম্ভব বুদ্ধিদীপ্ত সেই প্রশ্নোত্তর পর্বের শেষে অভিনন্দনের উত্তরে উত্তেজনায় চকচকে মুখে তাঁদেরই একজন বলেছিলেন, “স্যর, অগর আপনে বিসওয়াস মে দম হ্যায়, তো ঠোককে বোলনা চাহিয়ে।” ওয়েবিনারের প্ল্যাটফর্ম সেই ‘ঠোককে বোলনা চাহিয়ে’র গণতান্ত্রিক পরিসরকে কোথাও যেন নষ্ট করে দিলো … ইন্টারনেটের পাসপোর্ট ছাড়া সেখানে ঢোকা বারণ যে! ইন্টারনেটের থেকে যারা দূরে, এ জগতে তাদের কোনো প্রবেশাধিকার নেই। এ ওয়েবিনার তাদের জন্য নয়, যাদের জামা কোঁচকানো, চোখের কোনে কালি, গায়ে ঘামের গন্ধ, পেটে খিদে-অথচ থাকার মধ্যে আছে হায়ার সেকেন্ডারির একটা চোখধাঁধানো মার্কশিট আর দুচোখে জ্বলজ্বলে স্বপ্ন। যে ছেলে সকালে পান্তা খেয়ে মাঠে হাল দিয়ে এসে সকালের ক্লাসে বসে ঘুমে ঢুলতে থাকে, এ ওয়েবিনার তার জন্য নয়; যে মেয়ে বাড়ি বাড়ি বাসন মেজে কলেজে ঢুকে গার্লস কমন রুমে পোষাক বদলে প্র্যাক্টিকাল করতে দৌড়োয়, এ ওয়েবিনার তার জন্য নয়; যে গবেষক পয়সার অভাবে রোজ সকালে স্টেশনে গিয়ে খবরের কাগজ পড়ে আসে, আর তড়িঘড়ি বাড়িতে ফিরে গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় অংশ খাতায় টুকে রাখে-এ ওয়েবিনার তার জন্য নয়। তাই এখানে কোনো ঠোকাঠুকি লাগে না, কোনো অস্বস্তিকর প্রশ্ন নেই, কোনো হঠাৎ চেয়ার ঠেলে বেরিয়ে যাওয়া নেই – আবার কোনো পায়রা ওড়ানো হাততালিও নেই। নোয়াম চমস্কির বক্তৃতার চিনের মতো অনলাইনে ভার্চুয়ালি নিজের অস্তিত্বের জানান দিতে পারলেই … কেল্লাফতে!
আমরা, যারা প্রতি মুহূর্তে “শিক্ষা বেসরকারী হাতে চলে যাচ্ছে” বলে গলা ফাটাই, তারা বুঝিও না বা বুঝেও বুঝতে চাই না এভাবেই ‘ডিজিটাল’ আর ‘নন ডিজিটাল’ দুটি শ্রেণি তৈরি করে ফেলছি আমরা। আর এভাবেই, কেন্দ্র ও রাজ্যের যৌথ তালিকাভুক্ত শিক্ষা ও গবেষণার দম বন্ধ হয়ে আসছে … উচ্চশিক্ষার ডিজিটাল ইন্ডিয়ায় বেমানান অনেক প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীর মতো সে হয়তো গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে না, গায়ে কেরোসিন ঢেলে পুড়ছে না, মায়ের প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে লুকিয়ে আলজোলাম কিনছে না … সে নিঃশব্দে, নীরবে তার প্রতি মুহূর্তের বাঁচা বন্ধ করে বসে আছে!
-- ঋষি ঘোষ
গৌড় মহাবিদ্যালয়ের অধ্যাপক (বাংলা বিভাগ)
এই মুহূর্তে ভারতীয় রেলে চাকরি করা মোট কর্মীর সংখ্যা ১৪ লক্ষ। কর্মরত এই ১৪ লক্ষ কর্মীর মধ্যে ১৩ লক্ষ কর্মীকেই ছাঁটাইয়ের পথে চলেছে রেল।
রেলমন্ত্রী পীযুষ গয়ালের নেতৃত্বে সম্প্রতি একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হয়। তাতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে রেলে কর্মরত ১৪ লক্ষ কর্মীর মধ্যে ১৩ লক্ষ কর্মীকে আকর্ষণীয় ভিআরএস প্যাকেজের মাধ্যমে স্বেচ্ছাবসর প্রকল্পের মধ্যে আনা হবে। এবং এ সবকিছুই আগামী আর্থিক বছরের মধ্যে করে ফেলা হবে বলে দিল্লী রেল মন্ত্রক সূত্রে জানা গেছে।
এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে সরকার সূত্রে রেলের কিছু উচ্চ পদস্থ অফিসার জানিয়েছেন নিজেদের স্থায়ী কর্মীদের বদলে বেসরকারী আউটসোর্সিং কোম্পানিদের থেকে কর্মী নিয়োগ করলে রেলের পারফরমেন্স আরো ভালো হবে।
এই পর্যন্ত পড়ে যে সমস্ত ভক্তরা আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে চিৎকার করে বলছেন আবার মোদীজির একটি খুব বড় ‘মাস্টারস্ট্রোক’ তাদের সকলের উদ্দেশ্যে বলছি - জাস্ট রিলাক্স লেডিজ এন্ড জেন্টেলম্যান ! জাস্ট রিলাক্স !
ভক্তরা মনে হয় জানেন না যে ভারতীয় রেল বিশ্বের বৃহত্তম ও ব্যস্ততম রেল পরিবহন ব্যবস্থাগুলির অন্যতম। প্রতিদিন ১ কোটি ৮০ লক্ষেরও বেশি যাত্রী এবং ২০ লক্ষ টনেরও বেশি পণ্য ভারতীয় রেলপথে চলাচল করে। তাই রেলে চাকরি করা ১৪ লক্ষ মানুষের মধ্যে ওই ১৩ লক্ষ মানুষেরই শুধু চাকরি চলে যাবে না, এর সরাসরি প্রভাবও আমাদের সাধারণ মানুষের জীবনে পড়বে। এটুকু তো দিনের আলোর মতো পরিষ্কার রেলের ওই ১৩ লক্ষ কর্মী ছাঁটাই করে সেই কর্মী নিয়োগের দায়িত্ব সহ রেলের সবকিছুই আস্তে আস্তে আম্বানি আদানীদের হাতে বিক্রি করে দেবে মোদী-শাহ।
আপনি হয়তো ভাবছেন আমার পরিবারের তো কেউ রেলে চাকরি করেনা,তাই আমার কিছু এসে যায়না। তাদের সকলের উদ্দেশ্যে আবার বলছি - জাস্ট রিলাক্স লেডিজ এন্ড জেন্টেলম্যান ! জাস্ট রিলাক্স !
একটু জেনে রাখুন। আপনি যে ৫ টাকা দিয়ে টিকিট কাটতেন সেটা বেড়ে দাঁড়াবে ২০ টাকা, ১০০ টাকা দিয়ে যে মান্থলি কাটতেন সেটা বেড়ে হবে ৪০০ টাকা, প্রতিটি বড় স্টেশন থেকে বিনামূল্যে ওয়েটিং রুমে থাকার সুবিধে ও আর থাকবে না। শিয়ালদা স্টেশনে দ্বিতীয় শ্রেণীর যাত্রীদের ওয়েটিং রুম অলরেডি ভেঙে ফেলা হয়েছে। তার বদলে শিয়ালদা স্টেশনের দোতলায় এক ঝাঁ চকচকে ওয়েটিং রুম বানিয়েছে কলকাতার একটি বেসরকারী কোম্পানি। ওই ওয়েটিং রুমে ট্রেন ধরার জন্য অপেক্ষা করতে হলে গুনে গুনে দিতে হবে প্রতি ঘণ্টাতে ৪০০ টাকা।
নীতি আয়োগের মাধ্যমে ইতিমধ্যেই ১৫০টি ট্রেন ও ৫০টি স্টেশনকে বেসরকারী মালিকানার হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এখন এইসব ট্রেন আর স্টেশন বেসরকারী কোম্পানিদের হাতে চলে গেলে ইআরএমইউ-র হিসাব অনুযায়ী রেল স্টেশনকে কেন্দ্র করে যে কোটি কোটি মানুষ জীবিকা নির্বাহ করেন তাদের রুটি রোজগার সরাসরি বন্ধ হয়ে যাবে। রেল স্টেশন থেকে বেরিয়ে রেলের জমিতে অটো, টোটো, বাস, ট্রেকার, কুলি, হকার কিছুই আর থাকবে না। সবটাই তুলে দেওয়া হবে আম্বানি-আদানিদের মতো বেসরকারী কোম্পানি দের হাতে।
বেসরকারী কোম্পনির হাতে গেলে ভাড়া কিভাবে বৃদ্ধি পাবে তার জ্বলন্ত ২টি উদাহরণ হলো তেজ এক্সপ্রেস ও হাওড়া স্টেশন-এর বাইরে ক্যাব।
লক্ষ্নৌ থেকে দিল্লী পর্যন্ত গোমতি এক্সপ্রেসের এসি চেয়ারকারের আগে ভাড়া ছিল ৬৪০ টাকা, সেই ট্রেন বেসরকারী হয়ে এখন নাম হয়েছে তেজ এক্সপ্রেস, যার ভাড়া এখন ৬৪০ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৭০০ টাকা ! আর হাওড়া স্টেশনের বাইরে ক্যাব রোড রেলের হাতে থাকার সময়ে ভাড়া ছিল ৪০ টাকা, যা এখন বেসরকারী হওয়ার পর বেড়ে হয়েছে ২৫০ টাকা।
সুতরাং রেলের বেসরকারীকরণ হলে যে দেশের সাধরণ মানুষের চরম ক্ষতি হয়ে যাবে সেটুকু বোঝার জন্য বিরাট কোনো পড়াশোনার দরকার হয় না, যেটা দরকার হয় সেটি হলো চোখ থেকে ভক্তের ওই চশমাটা খুলে ফেলা।
আপনি অন্ধ মোদি ভক্ত হতেই পারেন, জী নিউজ-অর্ণব গোস্বামীদের মুখ নিঃসৃত বাণী আপনার সবই সত্য বলে মনে হতেই পারে, সারাদিনে কয়েকশো বার হিন্দু-মুসলিম না করলে রাতে আপনার ঘুম নাই ধরতে পারে, ফেইসবুক-হোয়াটস অ্যাপে ফেক নিউজ শেয়ার না করলে আপনার ভাত হজম নাই হতে পারে কিন্তু জেনে রাখুন মশাই আপনার বাড়ির যে ছেলেটি রাতদিন পড়াশোনা করে রেলে চাকরি করার স্বপ্ন দেখছে তাদের স্বপ্ন গুলো শেষ হয়ে যেতে চলেছে।
এই বছর ২৮ ফেব্রুয়ারী রেল ‘এনটিপিসি’ বলে একটি নোটিফিকেশন বের করে যাতে করে ৩৫,২০৮টি ভ্যাকেন্সি আছে। কিন্তু প্রায় ১০ মাস হয়ে গেলেও সেই পরীক্ষা কবে হবে বা আদৌও হবে কিনা সেই নিয়ে রেল মুখে কুলুপ এঁটেছে।
এছাড়া রেল ১২ মার্চ ‘লেভেল ওয়ান’ বলে আরো একটি নোটিফিকেশন বের করেছিল যাতে করে ১,০৩৭,৬৯টি ভ্যাকেন্সি আছে বলে জানায়। কিন্তু প্রায় ৯মাস হয়ে গেলেও সেই পরীক্ষা কবে হবে বা আদেও হবে কিনা সেই নিয়ে রেল মুখে কুলুপ এঁটেছে।
পুরো দেশ জুড়ে প্রায় ২কোটির উপরে ছেলে মেয়ে এই ২টি পরীক্ষার ফর্ম এক একটা ৫০০ টাকা করে ফিলাপ করেছিল। কিন্তু আচ্ছে দিনের সরকার তাদের সব স্বপ্ন গুলো গলা টিপে খুন করে দিচ্ছে দিনের পর দিন।
তাই এখনো সময় আছে, অন্ধ ভক্তি ছাড়ুন, কোনো বিষয়ে ভালো করে জানুন পড়ুন আর তারপর পক্ষ নিন। আজ না হয় কাল অথবা পরশু পক্ষ আপনাকে নিতেই হবে। কারণ নিরপেক্ষতা বলে কিছু হয় না।
আমরা এই ফ্যাসিবাদ সরকারের যা কিছু অন্যায়, যা কিছু ভুল তার বিরুদ্ধে আমাদের সীমিত ক্ষমতা অনুযায়ী লিখে যাবো, বলে যাবো, প্রতিবাদ করে যাবো।
কারণ আমরা জানি অধিকার কখনো কেউ কাউকে দেয়না, অধিকার ছিনিয়ে নিতে হয়। বাঁচতে গেলে লড়াই করতে হবে কারণ লড়াই করেই বাঁচতে হবে।
-- শুভ্রেন্দু সমাজদার
প্রয়াত হলেন কোচবিহার শহরের বিশিষ্ঠ পার্টি দরদী মাসীমা বিথিকা দেব। গত ১১ মে বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার কারণে তিনি নিজের বাসভবনে চির বিদায় নিলেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ৮৬ বৎসর। ১৯৮০-র দশক থেকে কোচবিহার-আলিপুরদুয়ারে পার্টি কাজের অন্যতম কেন্দ্র হিসাবে তাঁর পরিবারটির একটা বিশেষ অবদান রয়েছে। গোপন অবস্থা থেকে শুরু করে পরবর্তীতে দীর্ঘ সময় ধরে পার্টি কমরেডদের নিরাপদ ও নিশ্চিত আশ্রয় দিয়ে পার্টিকে রক্ষা করার কাজ নীরবে-অন্তরালে থেকে যারা করে গেছেন কমরেড বিথিকা দেব ছিলেন তাঁদের অন্যতম। পার্টির রাজ্য কমিটি তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। কমরেড বিথিকা দেব লাল সেলাম।
উল্লেখ্য প্রয়াত বিথিকা দেব হলেন কোচবিহার শহরের পার্টি কমরেড ভাস্কর দেবের মা।
১৯৭০ দশকে সমাজ বদলের স্বপ্ন বুকে ঘর-বাড়ি, ক্যারিয়ার বিসর্জন দিয়ে যে যুব প্রজন্ম বিপ্লবী যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো তাঁদেরই একজন কমরেড আশীষ রায় (ঝুনু) গত ৮ জুন প্রয়াত হলেন। উঃ ২৪ পরগণার অশোকনগরে নিজ বাসগৃহে। মৃত্যুর সময়কালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ৬৫ বৎসর। ১৯৭২ সাল – নকশালবাড়ি আন্দোলনে ধাক্কার সময়কালে অশোকনগরের বুকে নেমে এসেছিলো প্রবল রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। বিপরীতে উদ্বাস্তু জনবসতির এই শহরতলীর বুকে মুক্তি শপথ নেওয়া যুব শক্তি গড়ে তুলছিলো হার না মানা পাল্টা প্রতিরোধ। সে সময় কুম্বিং অপারেশনরত সামরিক বাহিনীর উপর দুঃসাহসী পাল্টা প্রত্যাঘাতের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। তারপর গ্রেপ্তার হয়ে দীর্ঘদিন দমদম জেলে কারাবাসে থেকেছেন। ১৯৭৭ সালের পর মুক্তি পান। সেই সময়ে অশোকনগরে নবপর্যায়ে পার্টি কাজের শুরু থেকেই নানাবিধ গণআন্দোলনে, সংগঠনের উপর নেমে আসা বিভিন্ন হামলা ও ঝড় ঝাপটার সময়ে দৃঢ়চেতা প্রকৃত এক ঘনিষ্ঠজন হিসাবে পার্টির পাশে থাকার ভূমিকা নিয়ে গেছেন আজীবন। ব্যাপক মানুষের সাথে মিশতেন, মানবিক মূল্যবোধ ও বলিষ্ঠতা ছিলো তাঁর বিশেষ গুণ। এলাকায় উদ্বাস্তু মানুষের বসতি স্থাপনের লড়াইয়ে নিয়েছিলেন অগ্রণী ভূমিকা। ১৯৭০ দশকে কারাবাসে থাকা নকশালপন্থী ও বামপন্থীদের রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে স্বীকৃতি ও পেনশনের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে ও সংগঠনের সামনের সারিতে থেকেছেন। এই সংগঠনের উঃ ২৪ পরগণা জেলার সম্পাদক ছিলেন। গলার ক্যানসার রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন, কলকাতা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাও হয়েছিলো। দীর্ঘ রোগভোগের পর অবশেষে তিনি চিরবিদায় নিলেন। কমরেড আশীষ রায় (ঝুনু) লাল সেলাম।
পরিবহন শ্রমিক আন্দোলনের অন্যতম বিশিষ্ট নেতা কমরেড বাণী দত্তগুপ্তের জীবনাবসান হয়েছে কলকাতার আরজিকর হাসপাতালে। বুধবার সকাল দশটায়। ভারতের অন্যতম কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন সিআইটিইউ-র প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের মধ্যে অন্যতম কমরেড বাণী দত্তগুপ্তের জন্ম বাংলাদেশের হাবলা উচ্চ গ্রামে তৎকালীন কুমিল্লা ও বর্তমানে ব্রাহ্মণবেড়িয়া জেলায়, যেখানে তার পরিবার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত স্কুল ও মন্দির আজও বর্তমান। দেশ বিভাজনের পর ছাত্রাবস্থাতেই তিনি কোলকাতায় আসেন এবং নিদারুন জীবনসংগ্রামের সম্মুখীন হন। আর্থিক উপার্জনের জন্য কারখানায় কাজকরবার সাথে সাথে নিজের শিক্ষা অর্জনের কাজ চালিয়ে যান এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রীশ চন্দ্র কলেজে থেকে বাণিজ্য বিভাগে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ছাত্রাবস্থাতে শ্রমিক রূপে কাজ করবার সময় তিনি ট্রেডইউনিয়ন আন্দোলনের সংস্পর্শে আসেন এবং কিছু কিছু আন্দোলনের শরিক হন। স্নাতক ডিগ্রী অর্জনকরবার পর তিনি সরকারী চাকরিতে যোগদান করেন এবং জরুরি অবস্থা চলাকালীন সময় কর্মক্ষেত্রে ট্রেডইউনিয়ন সংগঠন গড়ে তুলবার প্ৰচেষ্টা করবার অপরাধে কতৃপক্ষ তাকে সাসপেন্ড করেন একই সময় কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত থাকার কারণে তিনি তৎকালীন কংগ্রেস কর্মী দের হাতে আক্রান্ত হয়ে প্রায় দুবছর ঘর ছাড়া হয়ে থাকেন। এই সময়কালে তিনি শ্রমিক আন্দোলনের নেতা মহম্মদ ইসমাইল এর সংস্পর্শে আসেন এবং সম্পূর্ণ রূপে পরিবহন শ্রমিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন এবং তৎকালীন এআইটিইউসি-র নেতৃত্বাধীন বাস শ্রমিক সংগঠন বাস ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন-এর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন মৃত্যুর সময় অবধি তিনি এই সংগঠনের নেতৃত্বদান করে গেছেন। পরবর্তী কালে এআইটিইউসি বিভাজিত হয়ে সিআইটিইউ গঠিত হলে কমরেড বাণী দত্তগুপ্তের নেতৃত্বে বাস ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন সিআইটিইউ-র সাথে সংযুক্ত হয় এর পরবর্তী দীর্ঘ বছর সিআইটিইউ-র রাজ্য নেতৃত্বে থেকে বাস শ্রমিকদের জন্য কাজ করে গেছেন। আশির দশকের শেষদিকে রাজ্য ব্যাপী বিস্তৃত বাস ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন বিভাজিত হয়ে জেলা ভিত্তিক বাস শ্রমিক সংগঠন তৈরি হলে বাস ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন কলকাতা জেলার সম্পাদক হিসাবে হিসাবে তিনি নিজের দায়িত্বপালন করেন। অল ইন্ডিয়া রোড ট্রান্সপোর্ট ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের ও তিনি ছিলেন অন্যতম কারিগর ও নেতৃত্ব। প্রয়াত কমরেডের স্ত্রী ছন্দা দত্তগুপ্ত ও একমাত্র পুত্র বর্তমান। তার পুত্র শুভজিৎ দত্তগুপ্ত অন্যতম কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ন্যাশনাল ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়ান ট্রেড ইউনিয়ন উত্তর কলকাতা জেলা সভাপতি।
কমরেড বাণী দত্তগুপ্তের প্রয়াণে গভীর শোকপ্রকাশ করেছেন সিআইটিইউ-র রাজ্য সভাপতি সুভাষ মুখার্জী ও সাধারণ সম্পাদক অনাদি সাহু, আইএনটিইউসি-র রাজ্য সভাপতি দেবাশীষ দত্ত, টিইউসিসি-র সর্ব ভারতীয় সাধারণ সম্পাদক এস পি তিওয়ারি ও রাজ্য সভাপতি রবীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, এআইসিসিটিইউ-র রাজ্য সম্পাদক দিবাকর ভট্টাচার্য, সারা ভারত ফরোয়ার্ড ব্লকের কলকাতা জেলার সম্পাদক জীবন প্রকাশ সাহা, ন্যাশনাল ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়ান ট্রেড ইউনিয়ন এর রাজ্য সভাপতি তথা কেন্দ্রীয় সহসভাপতি অমিয় সরকার, বাস মালিক সংগঠনের নেতা আলোক দাস, ওয়েস্ট বেঙ্গল রোড ট্রান্সপোর্ট ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের এর সম্পাদক নেপাল দেব ভট্টাচার্য, উত্তর চব্বিশ পরগনার শ্রমিক নেতা জহর ঘোষাল, এনটিইউআই-এর নেতা সোমনাথ ঘোষ, হকার সংগ্রাম কমিটির নেতা মুরাদ হোসেন প্রমুখ।