লক ডাউন প্রথম দফা ২১ দিন চলার পর বাড়িয়ে দেওয়া হল আরও ১৯ দিন। সরকারি সূত্র বলছে, চলতি পর্ব চলবে ক্ষেত্রবিশেষে কিছু অতিরিক্ত কড়া ব্যবস্থা গ্রহণ ও কিছু ছাড় দেওয়ার ভিত্তিতে। সরকার যাই বলে চলুক, মানুষের মধ্যে পুঞ্জীভূত হচ্ছে ধন্দ-শংকা-অনিশ্চয়তা-অসহায়তা-অসন্তোষ-ক্ষোভ। তার কিছু কিছু বহিঃপ্রকাশও ঘটতে শুরু করেছে। সাধারণ মানুষের এই প্রতিক্রিয়ার প্রকাশগুলো ঘটছে করোনার সংক্রমণ জড়িত সবদিক নিয়েই। কোনও ক্ষেত্রেই যেন নিঃসংশয় হওয়া যাচ্ছে না। স্বাস্থ্য পরীক্ষার কথায় আসা যাক। বিগত তিন সপ্তাহে পরীক্ষা-পদ্ধতি-প্রকরণ প্রক্রিয়ায় কোনো গুণগত পরিবর্তন এসেছে কি? বলা হচ্ছে, কোনো এলাকা বিশেষে সর্বশেষ সংক্রমণের পর থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে যদি কোনো নতুন সংক্রমণের খবর না আসে তবে ধরে নেওয়া হবে এলাকাটি সংক্রমণ-মুক্ত। এই যদি মাপকাঠি হয় তাহলে বুঝে নিতে হচ্ছে বিপদাশংকা এতটুকু কমেনি। পাশাপাশি এমনও কিছু সংক্রমণের কেস মিলছে যার সাথে সাম্প্রতিক অতীতে বিদেশ ফেরত, বিশেষ অনুষ্ঠান বা জমায়েতে থাকার কোনো তথ্য নেই। এহেন নমুনার মধ্যে কি চাপা সামাজিক সংক্রমণের উৎস থেকে যাচ্ছে না? উদ্বেগ ও জিজ্ঞাসা থাকছেই। তাই পরীক্ষা অভিযানকে তীব্র ও ব্যাপক করে তোলার গুরুত্ব কোনোভাবেই হ্রাস করতে দেওয়া যেতে পারে না। অথচ কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের রিপোর্ট-কার্ডে তেমন আত্মানুসন্ধানী মনোভাব নেই, কোনও বিশ্বাসযোগ্য বিশ্লেষণ থাকছে না, বরং প্রকাশ পাচ্ছে যেন একরকম আত্মতুষ্টি। প্রধানমন্ত্রী যেদিন জাতির উদ্দেশ্যে তাঁর চতুর্থ ভাষণটি দিলেন তখনও পর্যন্ত দিনপ্রতি পরীক্ষাকরণের তৃতীয় পর্বের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়নি। আইসিএমআর সূত্রের রিপোর্ট অনুসারে দৈনিক পরীক্ষার সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছিল ২১ হাজারে। পরীক্ষা কেন্দ্রের সংখ্যা ২৪৪টি, সরকারি ল্যাব ১৭১টি, বেসরকারি ৭৩টি। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক ইতিমধ্যে বিবৃতি দিয়েছে এপ্রিলের শেষ নাগাদ পরীক্ষা-সংখ্যার লক্ষ্যমাত্রাকে দিনপ্রতি ৪০ হাজারে নিয়ে যাওয়া হবে। এছাড়া দাবি করা হচ্ছে যে, প্রচুর পরিমাণে কিট মজুত আছে, তাছাড়া আরও ৩৩ লক্ষ ‘আরটিপিসিআর’ কিট, ৩৭ লক্ষ ‘ৠাপিড অ্যান্টিবডি ডায়গনোস্টিক’ কিট আমদানির বরাত দেওয়া হয়েছে, যেকোনো দিন এসে যাবে। প্রশ্ন হল, রাজ্যে রাজ্যে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য প্রবণতার নিরীখে কিট মজুদের উপরোক্ত সংখ্যাচিত্রটা কত শতাংশ! আদৌ উল্লেখযোগ্য নয়। আরও প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে। পরীক্ষা পদ্ধতিতে বড় মাত্রায় পরিবর্তন না এনে ও পরীক্ষাকেন্দ্রের সংখ্যাগত উল্লম্ফন না ঘটিয়ে পরীক্ষার ঘোষিত বর্দ্ধিত লক্ষ্যমাত্রায় কি পৌঁছানো সম্ভব? সাদা মনে সহজ অংকে সেই হিসাব মেলার নয়। মোদী সরকার নিছক প্রতিশ্রুতির রাজনীতি ফেরী করে পার পেতে চাইছে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের আচরণ আরও গোলমেলে। সংক্রমণ ছড়ানোর গোড়ার পর্যায়ে ‘মাস্ক’ পরা নিয়ে কার্য়ত দেখানো হয় এক ধরনের ঢিলেঢালা ভাব। তারপরে সংক্রমণ বাড়তে দেখে যখন আকস্মিকভাবে লক ডাউন চাপিয়ে দেওয়া হয় তখন বাজারে মাস্কের যোগান ছিল খুবই কম, চাপ এড়াতে তখন বলা হতে থাকে সাধারণ সুস্থ মানুষের অতো মাস্ক পরার দরকার নেই, মাস্ক পরা দরকার স্বাস্থ্য কর্মী ও অসুস্থদের। মানুষ অভ্যস্ত হচ্ছিল সেভাবেই। তারপর অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে থাকলে তখন সরকারপক্ষ একদিকে মাস্ক সংগ্রহের দায়িত্ব চালান করে দিল জনতার ওপর, অন্যদিকে মাস্ক না পরে বের হলে শুরু করে দেওয়া হয় মানসিক-শারীরিক নির্যাতন। কেন্দ্রের স্বাস্থ্য মন্ত্রকের দ্বিতীয় বড় অপরাধ হল, করোনার প্রকোপ থেকে মুক্তি পাইয়ে দেওয়ার নামে সমাজের গভীরে গেড়ে থাকা অশিক্ষা ও কুসংস্কারকে পুঁজি করে অপবিজ্ঞানের হাওয়া তোলা হল, সে সম্পর্কে নিরুচ্চার থেকে যাওয়া। যেহেতু প্রকারান্তরে ঐ হাওয়া তোলার পেছনে ছিল মনুবাদী বিজেপি-আরএসএস-এর সুপরিকল্পিত যোগসাজশ। ঘর নিষ্প্রদীপ রেখে, দুয়ারে প্রদীপ আর রাস্তায় মশাল জ্বালিয়ে, বাজি পুড়িয়ে ‘গো ব্যাক করোনা’ কসরত প্রদর্শনের কর্মসূচী আচমকা ছিল না। মুখ বন্ধ করিয়ে রাখা হয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের।
কেন্দ্রের মোদী সরকার শুধু করোনা পরীক্ষায় মারছে না, মারছে অনাহারে-অর্দ্ধাহারে, মারছে লাঠিতে, ফাটকে পুরে দিয়ে। করোনার প্রতিক্রিয়ায় আরও একবার কল্পনাতীতভাবে প্রকাশ হয়ে গেল ভুখা ভারতের চেহারাটা। সরকারের গুদামে রয়েছে কোটি কোটি টন মজুদ খাদ্যশস্য, সরকার কবুল করছে এই বছরভর সবাইকে খাওয়ানোর মতো খাদ্য রসদ মজুদ রয়েছে, প্রধানমন্ত্রী গণবণ্টন ব্যবস্থায় মাথাপিছু বাড়তি পরিমাণ খাদ্যশস্য সরবরাহের ঘোষণাও শুনিয়েছেন, তবু নির্মম বাস্তব পরিণতি হল, মানুষ বিস্ফোরক হয়ে উঠছে না খেতে পেয়ে বা আধপেটা পরিত্যক্ত হয়ে থাকার কারণে। তথ্যের কারচুপি চলছে যেমন করোনার প্রকোপের মোকাবিলা করে উঠতে পারা না-পারা প্রসঙ্গে, একইভাবে পরিসংখ্যানগত জালিয়াতি চলছে প্রধানত কোটি কোটি গরিবের ঘরে অনাহার-অর্দ্ধাহার তথা সমস্ত দিক থেকে ঘোর অচলাবস্থা চলা নিয়ে। এবিষয়ে সরকারের দিক থেকে দৈনন্দিন তত্ত্বাবধান, পক্ষকালব্যাপী পর্যালোচনা এবং প্রতিনিয়ত জনদরদী পদক্ষেপ পুনর্বিন্যস্ত করে চলার রীতিনীতি প্রায় একেবারেই থাকছে না। উল্টে নেওয়া হচ্ছে অত্যন্ত বেদরদী অমানবিক অবস্থান। কপর্দকশূন্য হয়ে পড়া, খিদের জ্বালা সহ্য করতে না পারা, পরিবারের সমূহ বিপদ অনুভবে উতল হওয়া জনতার ওপর নামানো হচ্ছে পুলিশী উৎপীড়ন। মেগা-মিডিয়া চ্যানেলগুলোর দিনরাতের বিশেষজ্ঞ আলোচনায় যত স্থান পায় করোনার আক্রমণের ভয়াবহতা ও মুখোমুখি জনস্বাস্থ্যের বিষয়, সেই তুলনায় কণামাত্র স্থান পায় না খাদ্য ও পুষ্টির সুলভ সরবরাহ প্রসঙ্গ। এমনকি ঘিঞ্জি বসতি এলাকায় ‘শারীরিক দূরত্ব’ বজায় রাখা যে দুরূহ ভুলেও সেই সমস্যা ও তার সমাধানের আলোচনা সামনে আনা হয় না। পাছে দায়িত্ব নিতে হয় ভেবে পাশ কাটাচ্ছে শাসকপক্ষ। শুধু কি তাই! শ্রমিকদের ওপর একদিকে চলছে বকেয়া মজুরির অংশ কেটে নেওয়া, কোথাও আবার বকেয়া রেখে দেওয়া হচ্ছে পুরো মজুরি; অন্যদিকে ছুতোনাতায় চাপানো হচ্ছে ১২ ঘণ্টা কাজের নিয়ম। সবই চলছে করোনার নামে। এই সমস্ত কিছু চাপিয়ে দেওয়ার তথাকথিত বৈধতা আদায় করতে প্রধানমন্ত্রী একে জনগণের ‘ত্যাগের পরিচয়’ বলে প্রচারের হাতিয়ার করছেন। তাঁর বিগত ভাষণে প্রধানমন্ত্রী গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজোর মতো জনগণের জন্য জনগণকে সাত দফা কর্তব্য পালনে ‘সপ্তপদী’ হতে বললেন। কিন্তু রাষ্ট্রের করণীয় কর্তব্যগুলির বিষয়ে, কেন সেসব ক্ষেত্রে ব্যর্থতা থাকছে তার কোনও কৈফিয়ৎ দেওয়ার ধারকাছ মাড়ালেন না। উপরন্তু ত্রাতার নাম কেনার উদ্দেশ্য হাসিল করতে মোদী সরকার আত্মপ্রচারের স্বার্থে যা যা ধূর্তামি করে চলার সবই করে চলেছে। এই দেশ এই বিশ্ব দেখছে ভারতে করোনা আগ্রাসনের পরিস্থিতিতে এমনকি পাশবিক পুলিশীরাজ চালাচ্ছে মোদী জমানা।
তাই করোনার মোকাবিলায় অতন্দ্র সজাগতা-সতর্কতা রাখার পাশাপাশি মোদী সরকারের ওপর রেখে চলতে হবে অবিরাম চাপ। জারী থাকুক এই সংকল্প।
প্রতি
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী
বিষয়: কোভিড-১৯ মোকাবিলায় ভারতকে প্রয়োজনীয় শক্তি ও সামগ্রী জুগিয়ে প্রস্তুত করুন
প্রধানমন্ত্রী মহাশয়,
আপনার ঘোষিত ২৫ মার্চ শুরু হওয়া লকডাউনের সময়কাল শেষের পথে। ইতিমধ্যেই শোনা যাচ্ছে যে, কিছু কিছু রাজ্যে লকডাউনের সময়সীমা আবার বাড়তে চলেছে এবং করোনার তীব্র প্রকোপের চিহ্নিত এলাকাগুলিকে (হটস্পট) সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করা হবে। গত তিন সপ্তাহের অভিজ্ঞতা একদম সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করে দিয়েছে যে কোভিড-১৯ মহামারী ও লকডাউনের যৌথ প্রভাব বৃহত্তর সংকটের জন্ম দিয়েছে। গভীর হওয়া এই সংকটকে স্বীকার করা ও তাকে সামগ্রিকতায় মোকাবিলা করা এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ।
এই অভূতপূর্ব ও ব্যাপকবিস্তৃত বহুমুখী সংকটের পাঁচটি মূল বিন্দু নিম্নরূপ:
ক) একদিকে চূড়ান্ত অপ্রতুল চিকিৎসা সরঞ্জাম ও প্রায় বরাদ্দ-বিহীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা, আর অন্যদিকে জনগণের বিপুল অংশের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য-সতর্কতা গ্রহণের পক্ষে প্রতিকূল পরিবেশে কাজ ও জীবনযাত্রা – এই দুইয়ে মিলে জনস্বাস্থ্যের এক তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে, স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার মুখে; খ) কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষ আচমকা জীবিকা হারিয়েছেন। এদের অনেকেই বাড়ি থেকে অনেক দূরে কোনও কাজ ও উপার্জন ছাড়াই আটকে পড়েছেন। অনেকেই বাড়ি ফেরার জন্য মরিয়া হয়ে পড়েছেন; গ) দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে ক্ষুধা আর নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সংকট; ঘ) এই সংকট মোকাবিলায় যখন আমাদের আরও বেশি ঐক্য ও সংহতি প্রয়োজন, যখন যুক্তিবুদ্ধি, সচেতনতা ও সঠিক তথ্য সম্প্রচার দরকার তখন ঘৃণা, কালিমালেপন ও গুজব এবং তৎসহ কুসংস্কার ও মিথ্যা নিরাময় প্রচার এক অশুভ মাত্রা নিয়েছে; এবং ঙ) যখন এই সংকট মোকাবিলায় স্বচ্ছ ও দায়বদ্ধ কার্যনীতির মাধ্যমে আরও ব্যাপক জনতার সমর্থন দরকার, অর্থাৎ ব্যাপক সক্রিয় অংশগ্রহণ ও তৃণমূল স্তরের গণতন্ত্র দরকার, তখন দেখতে পাওয়া যাচ্ছে ক্ষমতার ক্রমবর্ধমান কেন্দ্রীকরণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহন ও তা কার্যকর করার ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচার আর নিপীড়ক পুলিশী কার্যকলাপ ও দমনমূলক প্রশাসন।
এই প্রেক্ষাপটে কিছু বিষয়ে জরুরি যৌথ হস্তক্ষেপ ও দৃঢ়সংকল্প উদ্যোগ নেওয়ার জন্য আমরা কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারগুলির এবং উদ্বিগ্ন গণমানসের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই ।
১। ট্রেড ইউনিয়ন ও সমস্ত নিপীড়িত অংশের প্রতিনিধি সহ সব সংশ্লিষ্ট পক্ষকে যুক্ত করে মতামত আদানপ্রদানের মাধ্যমে বিশ্বাস ও স্বচ্ছতা গড়ে তোল।
২। লকডাউনের নামে পুলিশ ও প্রশাসনের কোনরকম নিপীড়ন চলবে না: শারীরিক দূরত্ব বিধি ফলপ্রসূ করতে ধৈর্য সহকারে বোঝানো ও সহমর্মিতার হাত বাড়ানো দরকার, নিপীড়ন নয়।
৩) ডিটেনশন সেন্টারগুলি ফাঁকা করে দাও, কারাগারগুলির ঠাসাঠাসি ভিড় এড়াতে সমস্ত বিচারাধীন, দুর্বল ও অক্ষম বন্দীদের প্যারোলে মুক্তি দাও, কাশ্মীরের সকল বন্দী সহ সমস্ত রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দাও। সিএএ বা অন্যান্য জনস্বার্থে আন্দোলনকারী বিরোধী কন্ঠ স্তব্ধ করতে আর নতুন করে কাউকে কারাগারে নিক্ষিপ্ত করা চলবে না।
৪। পরিযায়ী শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও বেঁচে থাকার জন্য জরুরি অথচ অবহেলিত বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে দেখভাল করার জন্য একটি পরিযায়ী শ্রমিক অ্যাকশন প্ল্যান গড়ে তুলতে হবে: ক) গ্রাম ও পঞ্চায়েতের সাথে সমন্বয় গড়ে পরিযায়ী শ্রমিক ও তাদের পরিবারের তালিকা বানিয়ে ফেলতে হবে এবং তাদের সকলের একাউন্টে সরাসরি নগদ অর্থ প্রদান করতে হবে, খ) যে যেখানে আটকে আছে সেখানে তাদের সকলকে সাহায্য ও সুরক্ষা দিতে হবে; বিশেষত বিচ্ছিন্ন করে রাখা এলাকায় খাদ্য সরবরাহ সুনিশ্চিত করতে হবে, গ) স্বনিযুক্ত পরিযায়ী শ্রমিক সহ সমস্ত শ্রমিকের মজুরি ও জীবনধারণের ভাতা অবশ্যই অব্যাহত রাখতে হবে, ঘ) এই কর্মপ্রকল্পের সুচারু রূপায়নের জন্য স্থানীয় প্রশাসন ও নিয়োগকারীদের কঠোরভাবে দায়বদ্ধ করতে হবে।
৫। অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মী, যৌনকর্মী, রূপান্তরকামী, অক্ষম, বয়স্ক ও অন্যান্য যারা এই লকডাউনে চরম বিপর্যয়ে পড়েছেন তাদের জন্য নির্দিষ্ট ত্রাণ ও সাহায্যের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৬। দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে রান্না করা খাবার, রেশন, জ্বালানি ও অন্যান্য অপরিহার্য সামগ্রী ও পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া সুনিশ্চিত করতে হবে, তাদের রেশন কার্ড, ওয়েলফেয়ার বোর্ডের রেজিস্ট্রেশন, আধার বা অন্য কোনও কাগজপত্র থাকুক বা না থাকুক। সব অঞ্চলে কমিউনিটি (সামূহিক) রান্নাঘর গড়ে তুলতে হবে। শ্রমিক ও কৃষকদের বিভিন্ন সংগঠন, যুব সংগঠন ও বিভিন্ন সামাজিক ও গোষ্ঠিগত সংগঠন বা গ্রুপের ত্রাণ উদ্যোগকে সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্যই স্বাগত জানাতে হবে ও সহযোগিতা করতে হবে যাতে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় ত্রাণকার্য ফলপ্রসূ করে তুলতে এক দক্ষ ও প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী গড়ে উঠতে পারে।
৭। সমস্ত অব্যবহৃত বাড়ি, হোটেল, অনুষ্ঠান ভবন ইত্যাদিকে আশ্রয়হীনদের আশ্রয়ের জন্য ব্যবহার করতে হবে।
৮। ভাড়া ও ঋণ থেকে মুক্তি দিতে হবে, ইএমআই পরিশোধ স্থগিত রাখতে হবে, আর কাগজপত্রের বাছবিচার না করে সকলকে মহামারিতে টিকে থাকার ভাতা দিতে হবে।
৯। এই মহামারীর সময়ে রেশনে খাদ্য প্রদান ও এমএনআরইজিএ-কে অপরিহার্য পরিষেবা হিসেবে রূপান্তরিত করতে হবে এবং এই আপৎকালীন পরিস্থিতিতে অর্থ প্রদানের পরিমাণ বাড়াতে হবে।
১০। মজুরি কাটা, ছাঁটাই, কর্মচ্যুতি ও আশ্রয়ের সুরক্ষা হারানো রুখতে এবং গরিবদের জন্য জলের যোগান এবং ইন্টারনেট পরিষেবা অব্যাহত রাখতে ব্যবস্থা নিতে হবে। আইটি, আইটিনির্ভর ক্ষেত্র, ফিনটেক, পরিষেবা ক্ষেত্র, ট্যুরিজম ও এমএসএমই শিল্পে শ্রমিক ছাঁটাইএর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হবে।
১১। জমির পাকা ফসল তুলতে অবিলম্বে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ এবং লাভজনক মূল্যে কৃষকের কাছ থেকে সমস্ত ফসল কেনার ব্যবস্থা করে ঘনীভূত হতে থাকা কৃষি সংকটকে আরও গভীর হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে হবে।
১২। সমস্ত প্রাইভেট হাসপাতাল অধিগ্রহণ করে ও পরীক্ষাকেন্দ্র ও অন্যান্য সমস্ত চিকিৎসা সংক্রান্ত সুযোগ-সুবিধাগুলি ও ওষুধ উৎপাদক সংস্থার ওপর কঠোর সরকারী নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে গণস্বাস্থ্য পরিষেবা ব্যবস্থাকে জরুরি ভিত্তিতে শক্তিশালী করতে হবে যাতে সকলের জন্য বিনামূল্যে কোভিড-১৯ টেস্ট ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায়; পর্যাপ্ত ভেন্টিলেটর, পিপিই ও মাস্ক সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
১৩। কোভিড-১৯ টেস্টের হার ব্যাপকভাবে বাড়াতে হবে; পরীক্ষা কর, সংস্পর্শ চিহ্নিত কর, চিকিৎসা কর। মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত জরুরি পরামর্শ ব্যবস্থা সকলের জন্য বিনামূল্যে সরবরাহ করতে হবে।
১৪। এই মহামারীর সময়ে অন্যান্য রোগের জন্য নিয়মিত স্বাস্থ্য পরিষেবা যাতে অটুট থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে।
১৫। প্রত্যেক রাজ্যে জরুরি ভিত্তিতে মেডিক্যাল ও কোয়ারান্টাইন পরিকাঠামো গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করে তা দ্রুত বিনিয়োগ করতে হবে। কোভিড-১৯-এর ক্ষেত্রে যত্ন ও সচেতনতাকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে, নিপীড়ন চালানো ও অপরাধী বানানো নয়।
১৬। কাশ্মীরে অবিলম্বে ইন্টারনেট পরিষেবা পূর্ণরূপে পুনর্বহাল করতে হবে; প্রয়োজনীয় সংযোগ ব্যবস্থার অভাবে মহামারীর সময়ে অতীব জরুরি খবরাখবর আদানপ্রদান মারাত্মক রকম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
১৭। সমস্ত জরুরি পরিষেবা কর্মীরা (স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন, ডেলিভারি, এ্যম্বুলেন্স ড্রাইভার, সেবাযত্নে নিয়োজিত কর্মী (বিশেষত অক্ষম, রুগ্ন ও বৃদ্ধদের যাঁরা দেখভাল করছেন), পুলিশ কর্মী, ইস্পাত শিল্পের কর্মী, কৃষি ও অন্যান্য জরুরি পরিষেবা ক্ষেত্র) যাতে বিশেষ মহামারি কালীন মজুরি পায় (কমপক্ষে তিন মাসের মজুরির সমান) এবং কাজের স্থায়িকরণ হয় ও পিপিই সহ সমস্ত রকম সুরক্ষা ও সম্মান পায় তা নিশ্চিত করতে হবে।
১৮। গার্হস্থ্য নির্যাতন ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগ নেওয়ার জন্য প্রত্যেক জেলায় সপ্তাহে সাত দিন রাতদিন হটলাইন চালু করতে হবে, যেখানে অত্যাচারিতের অসুবিধে ও শঙ্কা শোনা উচিত ও ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অভিজ্ঞ দল থাকবে। ত্রাণ বণ্টনের সময় ঘরে ঘরে স্যানিটারি প্যাড পৌঁছে দিতে হবে। লকডাউনের সময়ে ভ্রুণের লিঙ্গ নির্ধারণের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হল তা অবিলম্বে পুনর্বহাল করতে হবে।
১৯। সংখ্যালঘুদের সাম্প্রদায়িক নিশানা বানানোকে ও কোভিড-১৯ রোগি ও সেবা প্রদানকারীদের অচ্ছুত বানাতে সামাজিক তকমা দেওয়াকে আটকাতে দ্রুত কার্যকরী ব্যবস্থা ও ব্যাপক সচেতনতা প্রচার দরকার। মুসলমানদের সামাজিক বয়কট, বহিস্কার ও হিংস্রতার শিকার হতে হচ্ছে, উত্তর পূর্বাঞ্চলের মানুষদের জাতিবিদ্বেষী আক্রমণের নিশানা হতে হচ্ছে, কোভিড-১৯ রোগি সন্দেহে বহিস্কার ও নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে – এরকম মারাত্মক প্রবণতার খবর আসছে। এসব ক্ষেত্রে তৎক্ষণাৎ দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নিলে তবেই এরকম অপরাধ আটকানো যাবে। এই ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংগঠনের নির্দেশিকা এবং অনেক দেরীতে হলেও শেষ পর্যন্ত যে সরকারী নির্দেশিকা জারি হয়েছে তা পূর্ণ মাত্রায় লাগু করতে হবে।
২০। স্থানীয় এলাকা উন্নয়ন তহবিল ও জনকল্যাণ প্রকল্পের রাজ্য তহবিল বন্ধ করে দেওয়ার বদলে এক্ষুনি বুলেট ট্রেন, সেন্ট্রাল ভিস্তা, সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়, সরকারী বিজ্ঞাপন ও প্রধানমন্ত্রী সহ সব সরকারি কর্তাব্যক্তিদের বিদেশ ভ্রমণের তহবিল বন্ধ করতে হবে। ধনকুবেরদের কাছ থেকে সমস্ত বকেয়া লোন ও ট্যাক্স আদায় করে তা কোভিড-১৯ ও লকডাউন তহবিলে জমা করতে হবে।
২১। ত্রাণ তহবিল থেকে দ্রুত বরাদ্দ সরবরাহ ও যথাযথ উপযোগ নিশ্চিত করতে হবে। ত্রাণ তহবিলগুলির, বিশেষত নতুন আনা পিএম-কেয়ার্স তহবিল যা কিনা কোভিড-১৯-এর জন্য বিশেষ তহবিল হিসেবে প্রচালিত হয়েছে, সেখানে জমার হিসেব ও তার ব্যবহারে পূর্ণ স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতার গ্যারান্টি চাই।
কোভিড-১৯ মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ লড়াইকে শক্তিশালী করতে সদর্থক মনোভাব ও পদক্ষেপের প্রত্যাশা রাখছি।
আন্তরিকতার সাথে
দীপঙ্কর ভট্টাচার্য
সাধারণ সম্পাদক
সিপিআই(এম এল) লিবারেশন
১১ এপ্রিল ২০২০
COVID-19 বিশ্বমহামারী আটকাতে WHO যে ক’জন বিজ্ঞানীর সঙ্গে কথা বলেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন এন্ড রিসার্চে (IISER, kolkata) কর্মরত এসোসিয়েট প্রফেসর ডক্টর পার্থসারথী রায়।
ডক্টর রায় IISC বেঙ্গালুরু থেকে মলিকিউলার ভাইরোলজির উপর তার PhD করেন এবং বর্তমানে তিনি ক্যান্সারের জিন নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কাজ করছেন। COVID-19 নিয়ে তার দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন ভারত এই ভাইরাসটির বৈশিষ্ট্য বুঝতেই পারেনি এবং সম্ভাব্য আক্রান্তদের পরীক্ষা করার দিক দিয়ে এখনও শতযোজন পিছিয়ে রয়েছে। দা উইক নামক অনলাইন পত্রিকায় দেওয়া তার সাক্ষাৎকারটি এখানে রইলো।
প্র: COVID-19 এলো কোথা থেকে? এব্যাপারে কিছু নিশ্চিত করে বলা যায় কি?
উ: এটি একটি জুনোটিক ভাইরাস। মানে প্রাণীদেহের ভাইরাস। সংক্রমণের উৎপত্তি চীনের উহান প্রদেশের বন্যপ্রাণী শরীর। কোভিড ১৯ জেনেটিক মিউটেশন* করতে পারে। পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজেকে পালটে পালটে নেয়। তাই শুধুমাত্র একটি নয়, বিভিন্ন আলাদা আলাদা প্রজাতির প্রাণীদের সংক্রমণের ক্ষমতা রাখে। এক্ষেত্রে ভাইরাসটি এমনভাবে নিজেকে পালটেছে যে, মানবদেহের নির্দিষ্ট কোষের প্রোটিনের সাথে আবদ্ধ হতে পারে। ফলে মানুষকে সংক্রমিত করতে পারছে।
প্র: কোন কোন প্রাণীর COVID-19 সংক্রমন হতে পারে?
উ: গবেষণা বলছে মানবদেহে সংক্রমণকারী ভাইরাসের সঙ্গে বাদুড় সংক্রমণকারী ভাইরাসের জিনগত মিল ৯৬%, আর প্যাংগোলিন সঙ্গে মিল ৯৯%। বলা যায় এই ভাইরাস বাদুড় থেকে প্যাংগোলিন হয়ে মানুষের দেহে এসেছে। এরপর এই ভাইরাস আর কাকে কাকে আক্রমণ করবে সেটা জানতে আরও গবেষণা দরকার।
প্র: WHO কেনো এটাকে বিশ্বমহামারী বলছে?
উঃ কোনো একটি অসুখের মারণক্ষমতা এবং সংক্রামক ক্ষমতা দুটো আলাদা জিনিস। সাধারণত যে ভাইরাসের মারণক্ষমতা অত্যন্ত বেশি সেই ভাইরাস বিরাট একটা সংক্রামক হয় না, অপরপক্ষে যে ভাইরাস অতিরিক্ত সংক্রামক তাতে আবার খুব বেশি মানুষ মারা যায় না। যেমন ২০০৩-এর সার্স ভাইরাসে মৃত্যুর হার অনেক বেশি ছিল। বেশি মানুষ সংক্রামিত হননি। উল্টোদিকে এই ভাইরাস বিশ্বব্যাপী সকলকে সংক্রামিত করার ক্ষমতা রাখে।
প্র: তাহলে আপনি বলতে চাইছেন, করোনা (কোভিড ১৯) মারন ভাইরাস নয়?
উ: একদমই না। কেবলমাত্র বয়স্ক মানুষ এবং আগে থেকে অন্য গুরুতর অসুখে ভোগা মানুষের জন্যই মৃত্যু ডেকে আনতে পারে।
প্র: WHO তো বলেছে আমাদের এই ভাইরাসকে সঙ্গে নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে।
উ: একদমই তাই। আমরা কি আমাদের চারপাশে টিবি বা ইনফ্লুয়েঞ্জা নিয়ে বেঁচে নেই? এ হল Attenuation প্রসেস। হীনবল হতে হতে টিকে যাওয়া। যেসব মানুষ সংক্রামিত তাদের মারা যাবার সঙ্গে সঙ্গে ভাইরাসটাও মারা যায়। ফলে অন্যদের সংক্রামিত করার ক্ষমতাও আর থাকে না। তাই ভাইরাসও সময় ও পরিস্থিতির সঙ্গে নিজের পরিবর্তন (মিউটেশন) করে টিকে থাকে কিছু কেমন জায়গায়। একে Endemic* বলে। মাঝে মাঝে এটি আবার ফেটে পড়ার মতো বেশ খানিকটা ছড়ায়। তখন কম ইমিউন, খেতে না পাওয়া, অসুস্থ, অপুষ্টিতে ভোগা মানুষদেরই কেবল মারা পড়ার সম্ভাবনা থাকে। এই ভাইরাসগুলোর মারণক্ষমতা কম কিন্তু ফিরে আসার ক্ষমতা প্রবল। আমার প্রশ্ন হল, মানুষ কেন আজও না খেতে পেয়ে অপুষ্টির জন্য মরবে? সরকারগুলি অপুষ্টি আটকাতে কী ব্যবস্থা নিচ্ছে?
প্র: আচ্ছা আপনি কীভাবে WHO কে সাহায্য করেছেন?
উ: উহানে যখন ছড়াতে শুরু করল হু পৃথিবীজুড়ে বিজ্ঞানীদের সঙ্গে পরামর্শ করেছে।
প্র: কী বুঝতে চাইছিল হু?
উ: অসুখটার গতিপ্রকৃতি মূলত। কতগুলো রকমফেরে নিজেকে ছড়াতে পারে। যদি মিউটেট করে তাহলে কেমন আকার নেবে, একে বলে জিনোটাইপ সংক্রান্ত বোঝাপড়া।
প্র: জিনোটাইপ জানার দরকার পড়ে কেন?
উ: গোটা পৃথিবীতে COVID-19-এর টীকা আর ওষুধ তৈরি করার চেষ্টা চলছে। মুশকিল হল নির্দিষ্ট টীকা বা ওষুধ কেবল নির্দিষ্ট জিনোটাইপ* এর ওপরেই কাজ করতে পারে, অন্যান্যদের ক্ষেত্রে নয়।
প্র: কতগুলো COVID-19 জিনোটাইপ এখনো পাওয়া গেছে?
উ: গোটা পৃথিবীতে মোট ঊনত্রিশটা। দুর্ভাগ্যবশত ভারতে আমরা মাত্র দুটো পেয়েছি বাকি জিনোটাইপগুলো খোঁজার চেষ্টাও হচ্ছে না ঠিকমতো। এখানে শুধু মানুষের মুখে লকডাউনের মতো মুখরোচক কথার ফুলঝুরি ছুটছে।
প্র: এই দুটো জিনোটাইপ নিয়ে যদি একটু বলেন—
উ: আমরা অনেক পিছিয়ে আছি, যেখানে WHO সারা বিশ্বের একটা বড় অংশ থেকে নমুনা পরীক্ষা করে উনত্রিশটা করোনা ভাইরাস জিনোটাইপ খুঁজে পেয়েছে, ভারতে আমরা মাত্র দুটো নমুনা থেকে দুটোই মাত্র জিনোটাইপ পেয়েছি। ভারতে এই ভাইরাস সম্বন্ধে বোঝাপড়া এখনো সেভাবে কিছুই গড়ে ওঠেনি ফলে এই সংক্রমণকে আটকানোর ব্যাপারেও একেবারে বিশবাঁও জলে পড়ে আছি আমরা।
প্র: তাহলে কি মলিকিউলার বায়োলজিস্টরা এই লকডাউনকে সাপোর্ট করেন না?
উ: আমি শুধু আমার কথাটাই বলতে পারি। আমার মতে এই লকডাউন পিরিয়ডকে কাজে লাগিয়ে যদি সংক্রমণ খুঁজে পাওয়ার কোনো চেষ্টাই না করা হয়, যদি সম্ভাব্য আক্রান্তদের পরীক্ষাই না করা হয় তাহলে কোনো লাভ নেই। আমরা কি করছি? না, আক্রান্তদের বাড়িতেই আটকে রেখে দিচ্ছি, তাতে তাদের বাড়ির লোক আক্রান্ত হচ্ছেন। যদি অসুস্থতার লক্ষ্মণগুলো দেখা যায় তবেই হাসপাতালে যাচ্ছেন। কিন্তু ৬৫% লোকের তো কোনো রোগলক্ষণই দেখা দেবে না। লকডাউন শেষ হলে এই লোকগুলোই বয়স্ক এবং অন্যান্য রোগে ধুঁকতে থাকা মানুষদের সংক্রামিত করবে আর ভাইরাসটি আবার মাথা চাড়া দেবে।
১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লু মহামারিতে ঠিক এইভাবে দ্বিতীয় বারের সংক্রমণে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায়।
প্র: তাহলে সরকার কেন লকডাউন ঘোষণা করলো?
উ: সেটা তো সরকারই জানেন। হয়তো খানিকটা ভয় থেকে আর খানিকটা টেস্ট এড়াবার জন্য। WHO বারবার জোর দিয়েছে যত বেশি সম্ভব টেস্ট করা যায় তার ওপর। ভারতের উচিত ছিলো এই রোগের ফাউন্ডার পপুলেশন* ( যারা প্রথম এই রোগকে এদেশে নিয়ে আসে) কে আলাদা করে আইসোলেশনে রাখা।
প্র: তাহলে স্পেন, ইতালি আমেরিকা নিয়ে কী বলবেন?
উ: না না ইতালি, আমেরিকা বা অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলোর সাথে ভারতবর্ষকে এক করে ফেলবেন না। ওই দেশগুলোর বেশিরভাগই বয়স্ক মানুষ। ইতালির ৬৫% লোক ষাটোর্ধ্ব। তাই মৃতের সংখ্যাও ওই দেশগুলোতে বেশি। এছাড়াও ইতালির বর্ণাঢ্য টুরিসম ব্যবসার ক্ষতি হবার কথা ভেবে ওরা বিদেশি টুরিস্টদের আটকায়নি।
প্র: কিন্তু ওরাও তো এখন লকডাউন ঘোষনা করেছে—
উ: সেটা টেস্টিং এর জন্য। ওরা সাময়িক লকডাউন করেছে সন্দিগ্ধ আক্রান্তদের টেস্ট করার জন্য। আর হাসপাতাল, বেড ভেন্টিলেশন এই ব্যবস্থাগুলো ঠিকঠাক করে গড়ে তুলতে, স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য দরকারী সুযোগসুবিধা দিতে। লকডাউন আসলে সেই গুরুত্বপূর্ণ সময়টুকু দেয় যাতে ঠিকঠাক টেস্টিং আর এই স্বাস্থ্যসেবার পরিকাঠামো গড়ে তোলা যায়।
প্র: আপনার কি মনে হয় ভারত এগুলি কিছুই করেনি?
উ: একদমই করেনি। ইতালি প্রতি দশ লক্ষে পাঁচ হাজার জনের টেস্ট করিয়েছে ভারত মাত্র আঠারো। যদি আমি টেস্ট না করাই, ঠিকঠাক স্বাস্থ্য পরিকাঠামো, আইসিইউ-এর ব্যবস্থা না করি, স্বাস্থকর্মীদের বন্দোবস্ত না করি তাহলে লকডাউনের লাভটা কি?
প্র: কিন্তু আমাদের হাতে তো প্রয়োজনীয় সংখ্যায় টেস্ট কিট নেই?
উ: এটা কোনো অজুহাত হতে পারে না। আমাদের দেশে দশ হাজার এরকম ল্যাব আছে যেখানে টেস্টিং সম্ভব।
প্র: এটা কীভাবে সম্ভব?
উ: আক্রান্ত হয়েছে এমন একজনের রক্তের নমুনা লাগবে আমাদের আর যাদের সম্ভাবনা আছে হবার তাদের রক্ত লাগবে। আমরা জিন মিলিয়ে দেখে নিতে পারব। এটা হাজার টাকা বা তারও কমে হতে পারে। ঘটনাচক্রে দু’সপ্তাহ আগেই আমরা IISER-এ এই টেস্টটার খরচ হিসেব করছিলাম, যা দেখলাম তাতে মোটামুটি সাতশো টাকার কাছাকাছি লাগবে।
প্র: কিন্তু এই টেস্ট কতটা ভরসাযোগ্য?
উঃ মার্কেটে যে ভুলভাল অনিশ্চিত কিট চলছে তার থেকে অনেক বেশি। আমি শুনে অবাক হলাম সরকার টেস্টের প্রতি সাড়ে চার হাজার টাকা ঠিক করেছে। আর কিছু নির্দিষ্ট কোম্পানিকেই এর বরাত দেওয়া হয়েছে। ভেবে অবাক লাগে এই দুর্দিনেও কিছু কেমন লক্ষ-কোটিপতিদের পয়সা কামিয়ে নেবার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে।
প্র: আপনারা সরকারের দ্বারস্থ হয়েছেন?
উঃ সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় এটাই। আমাদের ল্যাবগুলো বিশ্বের অনেক দেশের ল্যাবের চেয়ে বেশি সমৃদ্ধ। এমনকি WHO আমাদের রিসার্চ-এর ওপর ভরসা করে। কিন্তু আজ পর্যন্ত না কেন্দ্র না কোনো রাজ্য সরকার, কেউ আমাদের সাথে আলোচনা করেনি।
প্র: কিন্তু ভারত তো WHO এর গাইডলাইনই ফলো করছে—
উ: WHO বলেছে আইসোলেটেড রাখো এবং টেস্ট করো। কোত্থাও বলেনি লকডাউন করতে। ভারত লকডাউন করেছে কিন্তু টেস্টিং করছে না। যদি টেস্ট না করা হয় আমরা ভাইরাসের আলাদা আলাদা ভ্যারাইটি আর আলাদা আলাদা মিউটেশনগুলোর কথা জানতেই পারব না।
দেশব্যাপী তিন সপ্তাহের লকডাউনের তৃতীয় সপ্তাহে আমরা এখন প্রবেশ করছি। কোভিড-১৯ অতিমারীর মোকাবিলায় মোদী সরকার লকডাউনকেই একমাত্র নির্ণায়ক ও নির্দিষ্ট উপায় করে তুলেছে এবং তাকে বলবৎ করতে সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করছে। ভারতে অতিমারীর বৃদ্ধি ও বিস্তারের দিকে তাকালে আমরা বুঝতে পারছি না যে, লকডাউনের কৌশল এখনও পর্যন্ত কতটা সফল হয়েছে। লকডাউনের এই দু-সপ্তাহে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৬০৬ থেকে বেড়ে ৪৪২১-এ পৌঁছেছে, আর মৃতের সংখ্যাও ১০ থেকে বেড়ে পৌঁছেছে ১১৪-তে (বিং ডট কম-এ দেওয়া ৭ এপ্রিল-এর তথ্য)। সংখ্যাগুলো অতি দ্রুত বেড়ে চলেছে, প্রায় প্রতি তিন দিনের ব্যবধানে দ্বিগুণ হচ্ছে এবং ভারতের সমস্ত জেলার ৪০ শতাংশই এখন সংক্রমণের কবলে।
দেশব্যাপী লকডাউন চালু না হলে ওই সংখ্যাগুলো খুব সম্ভবত আরও বিশ্রী দেখাত, তবে যে পরিসংখ্যান আমাদের দেওয়া হচ্ছে তা এখনও যে অনেক কম দেখাচ্ছে তা প্রধানত এই কারণে যে, ভারতে নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে প্রতি দশ লক্ষ লোকের মধ্যে মাত্র ৫০ জনের, পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশের তুলনায় যা অনেক কম। ব্যাপক সংখ্যক মানুষের নমুনা পরীক্ষা এমনই একটা কৌশল যা দক্ষিণ কোরিয়া ও জার্মানির মত দেশে যথেষ্ট ফলদায়ী রূপে দেখা দিয়েছে। এখানে আমরা শুধু সেই দেশগুলোর মধ্যে মাত্র দুটো দেশের কথাই উল্লেখ করলাম যেগুলোতে ব্যাপক সংখ্যক মানুষের মধ্যে করোনা সংক্রমণ ঘটলেও মৃতের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক কম। কার্যকরী চিকিৎসা পরিকল্পনার সঙ্গে একযোগেই লকডাউন ফলদায়ী হতে পারে। যথেষ্ট সংখ্যক মানুষের নমুনা পরীক্ষা না করে এবং যে সমস্ত চিকিৎসাকর্মী এই মারণ ভাইরাসের মোকাবিলায় সামনের সারিতে রয়েছেন তাদের সুরক্ষা ব্যবস্থায় গাফিলতি করে ভারতীয় রাষ্ট্র আশু চিকিৎসা ব্যবস্থার দিক থেকেও শোচনীয় অবহেলা দেখিয়েছে।
কোনো ধরনের পরিকল্পনা না করে এবং এবং ভুল পথে চালিত করে লকডাউনকে আরও দুর্বল করে তোলা হয়েছে। পরিযায়ী শ্রমিক এবং দিন আনা দিন খাওয়া গ্ৰাম ও শহরাঞ্চলের দরিদ্ররা কিভাবে বাঁচবে সরকার সেটা কিন্তু অনায়াসেই অনুমান করতে পারত। সরকার যদি গোড়ার ব্যাপারগুলো ঠিকভাবে করতে পারত, লকডাউনের ফলে যাদের সবচেয়ে অসহায় ও ক্ষতিগ্ৰস্ত হওয়ার সম্ভাবনা তাদের দুর্দশা লাঘবের পরিকল্পনা তৈরি করে সম্প্রচারিত করত, যদি খাদ্য এবং প্রতিদিনের অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যসমূহের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহকে সুনিশ্চিত করতে পারত, সে ক্ষেত্রে আজ যে দলে-দলে শ্রমজীবী জনগণের নিষ্ক্রমণ ঘটছে এবং যে তীব্র অনাহার মারণ করোনা ভাইরাসের চেয়ে আরও দ্রুত গতিতে ভারতকে তাড়া করছে, তা আমাদের দেখতে হত না। জনগণ যদি লকডাউনের জন্য প্রস্তুত হওয়ার কিছুটা সময় পেত, তবে যে ধরনের আতঙ্ক তাড়িত কেনাকাটার হুড়োহুড়ি আমরা দেখলাম, যা জনগণের অসুবিধা সৃষ্টি করা ছাড়াও ‘সামাজিক দূরত্ব’ বজায় রাখার সমস্ত বিধিকে প্রহসনে পরিণত করল, তা আমাদের দেখতে হত না।
সরকার তার সিদ্ধান্তগুলোর ক্ষেত্রে কোনো রাজ্য সরকার, রাজনৈতিক দল, স্বাধীন বিশেষজ্ঞ এবং নাগরিক স্বাধীনতার সংগঠনগুলোর সঙ্গে কোনো ধরনের পরামর্শ করাকে একেবারেই আমল না দিলেও নরেন্দ্র মোদী এবং সংঘ-বিজেপি বাহিনী মোদী ভজনা এবং বিজেপির স্বার্থকে এগিয়ে নিয়ে যেতে কোভিড-১৯ সংকটকে কাজে লাগাতে চেষ্টার কোনো কসুর করছে না। চীন এবং মুসলমানদের যথাক্রমে এই রোগটার “উৎপাদক” ও “পরিবেশক” বলে দাগানোর একটা বিদ্বেষমূলক প্রচারাভিযান চলছে। নিজামুদ্দিনে তবলিগি জামাতের জমায়েতকে বিশেষভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণার বিদ্বেষ ছড়াতে, আর এই প্রচারের ফলস্বরূপ সন্তান জন্ম দেওয়ার কালে এক মুসলিম মহিলাকে চিকিৎসা পরিষেবা থেকে বঞ্চিত করা হয় যার পরিণামে তাঁর সন্তান মারা যায়, এবং মুসলিমদের সামাজিকভাবে বয়কট করা এবং বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়াও হচ্ছে। এরই মধ্যে, ডাক্তার এবং অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা কর্মীদের প্রতি সংহতি জানাতে হাততালি দেওয়া ও থালাবাটি বাজাতে এবং প্রদীপ ও মোমবাতি জ্বালাতে বলা হয়। এই দুই উপলক্ষেই ‘সামাজিক দূরত্ব’ বিধির ব্যাপক লঙ্ঘন হয় এবং তার সাথেই এই রোগ মোকাবিলার নামে কুসংস্কারাচ্ছন্ন গুজবকে বিপজ্জনক মাত্রায় ছড়ানো হয়।
শ্রমিকদের ছাঁটাই না করা বা মজুরি হ্রাস না করা সম্পর্কে নিয়োগকর্তাদের কাছে সরকারের নির্দেশাবলী এবং আবেদনের বলতে গেলে কোনো ফলই দেখা যাচ্ছে না এবং এই নির্দেশনামাকে বলবৎ করতে রাষ্ট্রের তরফেও কোন আন্তরিক প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে না। এখন আবার কোভিড-১৯-এর মোকাবিলার লক্ষ্যে অর্থ জোগাড়ের নামে সরকার দু-বছরের জন্য সাংসদদের মাধ্যমে বিতড়ন করা স্থানীয় এলাকা উন্নয়ন তহবিলকে স্থগিত করে দিয়েছে। স্থানীয় এলাকা উন্নয়নকে স্থগিত করে দিয়ে সরকার যেখানে ৭৯০০ কোটি টাকা পাবে, সরকার সেখানে কেন্দ্রীয় ভিস্তা প্রকল্পের অধীনে রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে ইণ্ডিয়া গেট পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা লাটিয়েন দিল্লীর কেন্দ্রস্থলের সৌন্দার্যায়নের জন্য ২০০০০ কোটি টাকা ব্যয় করতে প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। এরই মধ্যে আবার ঘৃণা ও কুসংস্কারের লাগাতার প্রচারের ওপর সওয়ার হয়ে বিজেপি জনগণের মধ্যে ‘মোদী মিল’ বিতরণ করে জনগণের ক্ষুধাকে তাদের স্বার্থ সিদ্ধিতে কাজে লাগাচ্ছে।
কোভিড-১৯ সংকট এবং লকডাউন, এই দুই ধাক্কা আমাদের প্রতিদিনের অস্তিত্বের সামনে এক অভূতপূর্ব ধাক্কা হয়ে দেখা দিচ্ছে। সবকিছুই অচল হয়ে গেছে। তবে, এটাও ঠিক যে দুর্দশাগ্রস্ত জনগণ একে অপরকে সহায়তা দিয়ে এই সংকটকে প্রতিহত করার পথের সন্ধান পাচ্ছেন। জনগণের লড়াইয়ের এই অঙ্গীকার এবং দৃঢ়তাই অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মোকাবিলার চাবিকাঠি হয়ে দেখা দেয়। বিজেপি যেখানে চরম অবক্ষয়ী এবং পশ্চাৎমুখী ধ্যানধারণাগুলোয় সুড়সুড়ি দিয়ে আমাদের সমাজে বিদ্যমান অবিশ্বাস ও ঘৃণার উৎসগুলোকে গভীরতর করে তুলতে চাইছে, তার বিপরীতে আমরা সবসময়েই জনগণের নিজস্ব অভিজ্ঞতাগুলোর চমৎকার ঐতিহ্য এবং শক্তিশালী বৈশিষ্ট্যগুলোর ওপর আস্থা রাখি, তাদের উদ্যমগুলোর মধ্যে সমন্বয়সাধন করি এবং উদ্যোগের দ্বারকে উন্মুক্ত করে দিই। কোভিড-১৯ মহামারীর বিরুদ্ধে আমাদের প্রহরা ও লড়াইকে চালিয়ে যাওয়ার সাথে-সাথে আমাদের জনগণের জন্য আশু ত্রাণের ব্যবস্থার লক্ষ্যে সার্বিক চেষ্টা চালাতে হবে এবং সমস্ত কমরেডের সমবেত উদ্দীপনা ও উদ্যোগকে শক্তিশালী করে তুলতে হবে। আজকের এই ধরনের সন্ধিক্ষণে আমাদের এই নীতির প্রতি সুবিচার করতে হবে : “জনগণের স্বার্থই পার্টির স্বার্থ”, এবং আমাদের সমস্ত চিন্তাধারা, দৃষ্টিভঙ্গি ও কাজের মধ্যে দিয়ে কমিউনিস্ট হিসাবে নিজেদের প্রতিপন্ন করতে হবে।
(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ৭ এপ্রিল ২০২০)
এবছর আমরা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া এক ঘাতক মহামারী সৃষ্ট বিপন্নতা এবং দেশব্যাপী বলবৎ লকডাউনের চাপানো অসহনীয় ভারের পরিস্থিতির মধ্যে আমবেদকর জয়ন্তী উদযাপন করছি। সবাই সমবেত হয়ে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের মতো অবস্থা নেই, তবে সব সময়েই যা করেছি, এবারও সে রকম ভাবেই আমাদের তাঁর মুক্তিকামী সংগ্ৰাম, চিন্তাধারা ও উত্তরাধিকার থেকে অনুপ্রেরণা নিতে হবে। “শিক্ষিত কর, আন্দোলন কর, সংগঠিত কর” – তাঁর এই আদর্শমন্ত্র থেকে আজকের এই বিপুল সংকটের মোকাবিলায় আমাদের সঞ্জিবীত হতে হবে; করোনা ভাইরাসের সঙ্গেই সক্রিয় থাকা নিপীড়ন ও অবিচারের সামাজিক ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই এবং জাত প্রথাকে ধ্বংস করার তাঁর উদাত্ত আহ্বান থেকে আমাদের উজ্জীবিত হতে হবে; এবং তাঁর সভাপতিত্বে রচিত আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লিখিত ন্যায়, স্বাধীনতা, সমতা ও ভ্রাতৃত্বের লক্ষ্যগুলো অবশ্যই আমাদের উদ্যোগ ও লড়াইগুলোকে পথ দেখাতে থাকবে।
ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার জন্য আমেরিকা ও ইউরোপের বর্ণবাদী শক্তিগুলো চীনকে দোষারোপ করছে, এবং ভারতে সংঘবাহিনী ও গোডি মিডিয়া এরই সাথে মুসলিমদেরও দায়ী করছে। মনুবাদী সামাজিক ব্যবস্থা ঐতিহাসিক ভাবে দলিতদের বিরুদ্ধে যে অস্পৃশ্যতাকে চালিয়ে এসেছে, আজ তাকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে, অন্য রাজ্যে কর্মরত বা অধ্যয়ন রত উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষদের বিরুদ্ধে, ভাইরাসে আক্রান্ত বলে সন্দেহভাজনদের বিরুদ্ধে এবং এমনকি কোভিড আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা করা ডাক্তার ও পরিচর্যাকারীদের বিরুদ্ধেও সম্প্রসারিত করা হচ্ছে। কোভিড-১৯ অতিমারি এইভাবে নতুন রূপের অস্পৃশ্যতার অভিব্যক্তির মাধ্যম হয়ে উঠেছে; আমরা যারা সবসময়েই সামাজিক উৎপীড়ন ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে এসেছি, তাদের সর্বশক্তি দিয়ে এই সাম্প্রদায়িক ভাইরাস এবং বিদ্বেষ প্রসূত সামাজিক বর্জনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।
সংবিধান আমাদের এই স্বীকৃতি দেয় যে – আমাদের বুনিয়াদি অধিকার আছে, আমরা সার্বভৌম ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষের নির্মাতা। মোদী সরকার কিন্তু ভারতবাসীদের তাদের হাতের পুতুল বলেই গণ্য করে যাদের প্রতারিত করার কায়দাবাজি এবং কুসংস্কার দিয়ে অদৃশ্য সুতোর টানে নাচানো যায়, এবং তাদের এমন দরিদ্র বলে মনে করে যারা শুধুই তুচ্ছ কিছু সংখ্যা, যাদের জন্য খাদ্য বা রেশনের ব্যবস্থা না করেই, কোনো ভাতা বা জীবনধারণের উপায় ছাড়াই লকডাউনের পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দেওয়া যায়। বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য লক্ষ-লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিককে পায়ে হেঁটে শত-শত কিমি পথ পেরোতে বাধ্য করা হয়েছে, এবং আরও লক্ষ-লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিককে খাদ্য বা টাকাপয়সা না থাকা অবস্থায় সহায়সম্বলহীনভাবে আটকে থাকতে হচ্ছে। গ্ৰাম ও শহরের দরিদ্রেরও একই রকম দুরবস্থা, সরকারের দাবির বিপরীতে তাদের কাছে কোনো রেশন বা ত্রাণ পৌঁছচ্ছে না। আমবেদকার থাকলে নাগরিক হিসাবে আত্মঘোষণা করার পরামর্শ আমাদের দিতেন, আমাদের অধিকার ও ন্যায্য অংশ দাবি করতে বলতেন, এবং বিজ্ঞান মনস্কতা ও মনুষ্যসুলভ বিচারবুদ্ধি দিয়ে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে বলতেন।
আমবেদকরের সারা জীবনটাই অধিকার ও স্বাধীনতার জন্য লড়াইতে ব্যয়িত হয়েছে – শ্রমিকদের অধিকার, নারীদের সমতা এবং নাগরিকদের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে। মোদী সরকার আজ কষ্টার্জিত আমাদের সমস্ত অধিকারের প্রতি চূড়ান্ত নির্মমতা দেখাচ্ছে। লকডাউন ঘোষণা করতে গিয়ে যে আইনটার আশ্রয় সরকার নিয়েছে সেটা ১২৩ বছর আগের ঔপনিবেশিক আমলের একটা আইন – ১৮৯৭ সালের দানবীয় মহামারী ব্যাধি আইন যা নাগরিকদের সমস্ত আইনি রক্ষাকবচ ও সুরক্ষা হরণে রাষ্ট্রকে যে কোন স্বৈরাচারী পদক্ষেপ ঘোষণার অনুমোদন দেয়। প্রতিদিনের কাজের শিফটকে আট ঘণ্টা থেকে বাড়িয়ে বারো ঘন্টা করার চেষ্টা হচ্ছে। ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ পরীক্ষাকে – যা কন্যা ভ্রূণ হত্যাকে সহজসাধ্য করে তোলে – নিষিদ্ধ করা সম্পর্কিত আইনকে অতিমারীর জন্য চিকিৎসার ওপর অত্যধিক চাপ পড়ার অছিলায় মুলতুবি করা হয়েছে। নিয়োগকর্তারা মজুরি হ্রাস এবং বিপুল আকারের কর্মী ছাঁটাইয়ের দাবি জানাচ্ছেন আর ভারতের প্রধান বিচারপতি বলছেন যে, লকডাউনের মধ্যে শ্রমিকদের যখন খাবার দেওয়া হচ্ছে তখন তাদের মজুরি দেওয়ার প্রয়োজনটা কোথায়।
মানবাধিকার, বিশেষভাবে নিপীড়িত অংশগুলির অধিকার এবং সরকার বিরোধী মতো প্রকাশকারী নাগরিকগণ এবং সরকারের সমালোচকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা ভারতবর্ষে কখনই সুরক্ষিত বলে দেখা যায়নি। আজ সেগুলো বিশেষ করে বিপন্ন হয়ে উঠেছে এই জন্য যে, মোদী সরকার সমালোচনামূলক প্রতিটি কণ্ঠকেই দমিয়ে দিতে চাইছে। অতিমারী চলা অবস্থায় সমস্ত রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি দেওয়া এবং সমস্ত বিচারাধীন বন্দী এবং বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী বন্দীদের জামিনে ও শর্তাধীনে মুক্তি দেওয়াটাই যখন সরকারের উচিত, ভারতীয় রাষ্ট্র তখন সমাজ আন্দোলনের আরও কর্মীদের গ্ৰেপ্তার ও নির্যাতন করার পথেই যাচ্ছে। আনন্দ তেলতুমদে ও গৌতম নঔলাখার মতো বিদ্বজ্জন ও লেখক থেকে সিদ্ধার্থ বরদরাজন ও সিএএ-র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো মানুষজন – এদের সবাইকেই নির্যাতিত হতে হচ্ছে; আর জিএন সাইবাবা, ভারভারা রাও, সুধা ভরদ্বাজ এবং কৃষি শ্রমিকদের বেশ কয়েকজন নেতা এবং ভারতের বিভিন্ন স্থানে দলিত ও আদিবাসীদের সুরক্ষা যোগানো ব্যক্তিদের এখনও জেলে পচতে হচ্ছে। আমরা যখন ডঃ ভীমরাও আম্বেদকরের মুক্তিকামী উত্তরাধিকারকে স্মরণ করব, আমাদের তখন অবশ্যই সমস্ত নাগরিকের মানবাধিকার ও সাংবিধানিক স্বাধীনতার পরিপূর্ণ সুরক্ষার দাবি জানাতে হবে।
( এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ১৪ এপ্রিল ২০২০)
• পরিযায়ী শ্রমিকদের ক্রোধ সঙ্গত ও ন্যায্য।
• বিক্ষুব্ধ পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর পুলিশী বর্বরতাকে এআইসিসিটিইউ তীব্র নিন্দা করছে।
• তাঁদের নিজ নিজ রাজ্যে ফিরিয়ে আনতে বিশেষ পরিবহন ব্যবস্থার দাবি জানাচ্ছে।
গোটা দেশজুড়ে পরিযায়ী শ্রমিকরা এক অন্তহীন দুর্দশার কবলে। আরও ১৯ দিন, অর্থাৎ, ৩রা মে পর্যন্ত মোদী সরকার এই দুর্দশাকে টেনে নিয়ে গেল। হতদরিদ্র ওই সমস্ত শ্রমিকেরা চরম দুরাবস্থার মধ্যে, পরিচ্ছন্ন- পাকাপোক্ত আশ্রয়স্থল ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশের বদলে অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলোর অপরাধসম নির্লিপ্ততার কারণে। এই সমস্ত পরিযায়ী শ্রমিকদের ক্রোধ স্বতস্ফূর্তভাবে ফেটে পড়ছে রাজপথে, আর তাঁদের ঠান্ডা করতে নেমে আসছে নির্মম পুলিশি দমন পীড়ন। করোনার এই ঘোর দুঃসময়ে তাঁদের এই সংকটকে অনেক বেশি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সংবেদনশীলতার সাথে দেখা উচিত ছিল। তাঁদের ছাঁটাই না করা, মজুরি না কেটে নেওয়া বা লকডাউনের পর্যায়টি সবেতন ছুটি হিসাবে গণ্য করার যে সরকারি বিজ্ঞপ্তি ছিল, তাকে কার্যকরী করতে জোর না দিয়ে রাষ্ট্রশক্তি স্বৈরাচারী মনোভাব নিয়ে তাঁদের ন্যায়সঙ্গত ক্ষোভকে দাবিয়ে রাখতে তৎপর হয়ে উঠেছে। উল্টে, অতিমারির এই সংকটের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সরকার শ্রমিকদের অধিকারগুলো হরণ করতে উদ্যত। সরকার এখন শ্রম দিবসকে ১২ ঘণ্টা বাড়ানোর কথা চিন্তাভাবনা করছে। আম্বেদকর দিবসে, ১৪ এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে শ্রমিকদের বিপন্নতাকে নিরসন করতে কোনো আমলই দেওয়া হলো না। বরং, তা ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যা ও বুলি সর্বস্বতায় পরিণত হল, আবার প্রমাণিত হল প্রধানমন্ত্রী কোনো কিছুই তোয়াক্কা করেন না।
গতকাল বিহার, উত্তর প্রদেশ, পশ্চিম বাংলা থেকে দু’হাজারের ও বেশি পরিযায়ী শ্রমিক একত্রিত হয়ে রেশনের ও নিজেদের রাজ্যে ফিরে আসার দাবিতে সোচ্চার হন। তাঁদের উপর নির্মমভাবে চলল লাঠি, যথেচ্ছ ধরপাকড় শুরু হয়, রেহাই পায়নি এমনকি নিরীহরাও। প্রায় ১০০০ র বেশি সংখ্যায় এফআইআর দায়ের হয়েছে বান্দ্রা স্টেশনের ঘটনায়, লকডাউন আরও বাড়ানোর ঘোষণার পর। এই বিক্ষোভ টাকে ষড়যন্ত্র ও গুজবের ফসল হিসাবে দেখানোর চেষ্টা চালানো হচ্ছে। দিনকয়েক আগে ক্ষুধার্ত পরিযায়ী শ্রমিকরা সুরাতের রাস্তায় নেমে পড়েন প্রতিবাদ জানাতে। তখন তাদের উপর নেমে আসে নির্মম লাঠির আঘাত, তাদের গ্রেপ্তারও করা হয়। সুরাতে শ্রমিকরা আবার রাস্তায় নেমেছেন প্রতিবাদ জানাতে। গোটা দেশ জুড়ে এই ক্রোধ ধিক ধিক করে জ্বলছে। অন্যদিকে, এই সমস্ত শ্রমিকেরা খেতে না পেয়ে, ঘরে ফিরতে না পারার চরম হতাশা থেকে আত্মঘাতী হচ্ছেন। আর, এটা এখন হয়ে উঠেছে এক সাধারণ ঘটনা। কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যাক। চেন্নাইয়ে রং এর কারখানায় কর্মরত বিহার থেকে আগত এক তরুণ শ্রমিক খিদের জ্বালায় আত্মহত্যা করেছেন। হায়দ্রাবাদে, বিহারের এক পরিযায়ী শ্রমিক ঘরে ফিরতে না পারায় হতাশায় আত্মঘাতী হন। সর্বত্র, এমনকি দেশের রাজধানীতেও এসব ঘটছে। কিছুদিন আগে, ২৪ মার্চ প্রথমবার দেশব্যাপী লকডাউন ঘোষিত হওয়ার পর আমরা দেখেছিলাম হাজারে হাজারে পরিযায়ী শ্রমিক মাইলের পর মাইল পথ ধরে নিজ নিজ রাজ্যের দিকে হাঁটতে শুরু করেন। লকডাউনের দুঃসহ ২১টা দিন কাটানোর পর এই সমস্ত পরিযায়ী শ্রমিকরা আবার রাস্তায় নেমে আসেন মরিয়া হয়ে ঘরে ফেরার জন্য, পর্যাপ্ত রেশনের দাবিতে।
পরিযায়ী শ্রমিকদের অবস্থা দিনের পর দিন খারাপ হচ্ছে। তাঁদের দুর্দশা থেকে রক্ষা করতে, অনাহার মৃত্যু ঠেকাতে, পর্যাপ্ত রেশন, পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যসম্মত আশ্রয়স্থল, মজুরি সংকোচন রুখতে জনধন অ্যাকাউন্টে এককালীন অনুদান পাঠাতে এ আই সি সি টি ইউ দাবি জানাচ্ছে --
কোটি কোটি পরিযায়ী শ্রমিক ও দেশের শ্রমিকশ্রেণির সঙ্গত ও ন্যায্য দাবিগুলোর প্রতি চোখ বন্ধ করে থাকলে কোভিড-১৯-র বিরুদ্ধে এই লড়াইটা লড়া যাবে না। ঔদ্ধত্যপূর্ণ মনোভাব নিয়ে সমস্ত প্রতিবাদকে দমন করাটা শুধু অযৌক্তিকই নয়, তাকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নিন্দা জানাতে হবে।
রাজিব ডিমরি,
সাধারণ সম্পাদক, এআইসিসিটিইউ।
৩০ এপ্রিল পর্যন্ত আবার বাড়ানো হলো দেশব্যাপী লকডাউন। প্রায় সমস্ত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সাথে প্রধানমন্ত্রীর ভিডিও কনফারেন্সে এই সিদ্ধান্ত আবার বিরাট অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগের মধ্যে ফেলে দিল কোটি কোটি শ্রমজীবী জনতাকে। উচ্চ পর্যায়ের এই বৈঠকে ও ঘোষিত হলো না কর্মচ্যুত এই সুবিপুল জনসংখ্যার জন্য ন্যুনতম কোনো আর্থিক প্যাকেজ। লকডাউন পর্যায়ে তাঁদের ছাঁটাই করা চলবে না, তাঁদের সমস্ত মজুরি দেওয়ার সরকারী বিজ্ঞপ্তি নিয়োগকর্তারা ছেঁড়া কাগজে পরিণত করেছে। কিভাবেই বা তাঁরা ফিরবেন নিজ নিজ রাজ্যে তা নিয়ে ও কোনো উচ্চবাচ্চ নেই প্রশাসনের তরফ থেকে।
এর বিরুদ্ধে এবার বিক্ষোভ-প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। সুরাট হচ্ছে গুজরাটের বয়নশিল্পের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। বিপুল সংখ্যক পরিযায়ী শ্রমিক সেখানে কর্মরত। লকডাউনকে ভেঙে বিশাল সংখ্যায় বয়ন শিল্পের সঙ্গে যুক্ত পরিযায়ী শ্রমিক ৩০ মার্চ দাবি তোলে তাঁদের অবিলম্বে ওড়িশায় ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিতে হবে। এরপর, এপ্রিল ১১ বেশ কিছু শ্রমিক ফের লকডাউন উপেক্ষা করে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন তাঁদের বকেয়া মজুরি, নিজভূমে ফেরার অনুমতি, এবং নিম্নমানের খাদ্য সরবরাহের বিরুদ্ধে। তাঁদের আন্দোলন হিংসাত্মক চেহারা নেয়। পুলিশ তাঁদের গ্রেপ্তার ও করে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কিছুদিন আগে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট বেশ কিছুটা বিস্ময় প্রকাশ করে বলে, পরিযায়ী শ্রমিকরা তো খেতে পারছে, তাঁদের টাকার কী প্রয়োজন। সেখানে খাদ্যের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও বিচারপতিরা তা পাত্তাই দেয় না।
এদিকে, এ রাজ্যেও চটকল শ্রমিকেরা লকডাউন পর্যায়ে তাঁদের মজুরির দাবিতে সোচ্চার হচ্ছেন। বালি জুটের মালিক শ্রমিকদের মজুরি না দিয়ে উৎপাদিত মাল বার করতে গেলে শ্রমিকরা বাধা দিয়ে তা আটকে দেয়। থানায় থানায় বিক্ষোভ শুরু হয়েছে মজুরি প্রদানে সরকার, প্রশাসনকে অবিলম্বে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার দাবিতে।
লকডাউন যত দীর্ঘতর হচ্ছে, অনাহার-দারিদ্রের করাল ছায়া ততই গ্রাস করতে শুরু করেছে। এরপর, স্বতস্ফূর্ত শ্রমিকদের বিক্ষোভ এখন শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা।
এপ্রিলের ৬ তারিখের ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস একটা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ২৪ মার্চ রাত থেকে দেশব্যাপী লকডাউন শুরু হওয়ার পর পরিযায়ী শ্রমিক, বিশেষ করে নির্মাণ শ্রমিকদের চরম দুর্দশা ও বিপন্নতা নিয়ে জন সাহাস নামক এক এনজিও এক সমীক্ষা চালায় ৩,১৯৬ জন পরিযায়ী নির্মাণ শ্রমিকদের মধ্যে, টেলিযোগাযোগের মাধ্যমে। ২৭-২৯ মার্চ এই সমীক্ষা চালানো হয়। লকডাউন শুরু হওয়ার পর উল্লিখিত সংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ শ্রমিক নিজ নিজ রাজ্যে ফিরে যেতে পারেননি। কর্পদকশূণ্য ওই সমস্ত শ্রমিকেরা পানীয় জল খাদ্য না পেয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছেন। ৪২ শতাংশ শ্রমিকরা জানায়, তাঁদের এক দিনের জন্য ও রেশন নেই। ২১ দিনের লকডাউন পর্যায়ে তাঁদের যে কী অবস্থা হবে তা ভেবে তাঁরা কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছেন না। ৬৬ শতাংশ শ্রমিক জানিয়েছেন, ২১ দিনের পর লকডাউন বজায় থাকলে, এক সপ্তাহের বেশি তারা তাদের প্রাত্যহিক জীবনের খরচ চালাতে পারবেন না।
যারা যারা নিজের নিজের এলাকায় ফিরে যেতে পেরেছেন, সেখানে রেশন বা আয় না থাকায় চরম অভাব অনটনে দিন গুজরান করতে হচ্ছে।
সমীক্ষা আরও জানাচ্ছে, ৯৪ শতাংশ নির্মাণ শ্রমিকরা কল্যাণ বোর্ডের সদস্য নন, নেই তাঁদের পরিচয় পত্র। তাই ওই তহবিল থেকে নির্মাণ শ্রমিকদের জন্য এককালীন যে আর্থিক অনুদান ঘোষণা করা হয়েছে সেখান থেকেও তাঁরা বঞ্চিত হবেন। ৩১ শতাংশ শ্রমিকরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ঋণ নিয়েছেন সুদখোরের কাছ থেকে, ব্যাঙ্ক থেকে যে সুদের হার তিন গুণ বেশি। এছাড়া, ৭৯ শতাংশ শ্রমিক, যারা ঋণ নিয়েছেন, তাঁরা অদূর ভবিষ্যতে তা পরিশোধ করতে পারবেন কিনা সে ব্যাপারে রীতিমতো সন্দিহান।
সমীক্ষায় সাক্ষাৎকার নেওয়া প্রায় সমস্ত নির্মাণ শ্রমিকরাই সংকট সামাল দিতে আশু রেশন সরবরাহ, মাসিক আর্থিক অনুদান চেয়েছেন। ৮৩ শতাংশ শ্রমিক জানেন না যে ২১ দিন লকডাউনের পর (এখন তো তা বেড়ে গোটা এপ্রিল মাস পর্যন্ত চলবে) তাঁরা আদৌ কাজ পাবেন কিনা। ৮০ শতাংশ শ্রমিক মনে করেন যে ২১ দিন লকডাউনের পর তাঁদের পরিবারকে অনাহারে দিন কাটাতে হবে।
দেখা যাচ্ছে, ৫৫ শতাংশ শ্রমিকেরা দৈনিক ২০০- ৪০০ টাকা আয় করে চারজনের পরিবারকে চালায়। আর, ৩৯ শতাংশ দৈনিক আয় করেন ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা। বিরাট সংখ্যক শ্রমিকেরা ন্যুনতম মজুরি আইন কর্তৃক নির্দ্ধারিত মজুরি থেকে বঞ্চিত। এদিকে সরকারী এক তথ্য জানাচ্ছে, নির্মাণ ক্ষেত্র জাতীয় আয়ে অবদান রাখে ৯ শতাংশ। কৃষিকাজের পর এখানেই দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ শ্রমশক্তি নিয়োজিত। ৫ কোটি ৫০ লক্ষ দৈনিক মজুরি প্রাপ্ত মজুর এখানে জীবন নির্বাহ করেন। ফি বছর ৯০ লক্ষ মানুষ গ্রামীণ ক্ষেত্র থেকে শহরাঞ্চলে কৃষি কাজের খোঁজে ছুটে যায়।
এই বিপুল জনসংখ্যা আমাদের দেশে নিরন্তর গড়ে তুলছেন একের পর এক পরিকাঠামো – ফ্লাইওভার, সেতু, মেট্রোর সুবিশাল কর্মকান্ড, গগনভেদী অট্টালিকা, প্রশস্থ হাইওয়ে, আরো কত কিছু। নিদারুণ বঞ্চনার মধ্যে, দিনের পর দিন, বছরের পর বছর এরা হাড় ভাঙা পরিশ্রম করে যে চোখ ধাঁধানো সভ্যতা নির্মাণ করে, তাঁদেরই সবচেয়ে নীচে, পশচাতে ঠেলে রেখেছে আমাদের সরকার, আইন আদালত, রাষ্ট্র।
লকডাউন আজ এদের বিরাট অনাহারের অন্ধকার জগতে নিক্ষিপ্ত করেছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুখর হওয়া আজ সময়ে দাবি।
আজ দেশে দ্বিতীয় পর্যায়ের লকডাউন শুরু হল। ২১ দিনের পরে, ১৯ দিন। অর্থাৎ ৪০ দিন লকডাউনের জেরে কেমন থাকবে দেশ? সবার জন্য যে একইরকম থাকবে না তার ইঙ্গিত ভারতের আর্থিক রাজধানীতে মুম্বাইতেই পাওযা যাচ্ছে। গতকাল খোয়ারে বন্দি কাজ হারানো ক্ষুধার্ত হাজারো শ্রমিক মুম্বাই-এর বান্দ্রায় হাজির হয়েছিলেন নিজেদের বাড়ি ফিরবেন বলে। তাঁরা বুঝেছিলেন বা কেউ তাদের বুঝিয়েছিল যে, ১৪ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ২১ দিনের লকডাউন শেষ হওয়ার পরে ট্রেন পাওযা যাবে বাড়ি ফেরার। তেমনটাইতো কথা ছিল। এমনিতেই ৪ ঘণ্টার নোটিশে পেটের দায়ে ঘর ছেড়ে বিভুঁয়ে কাজ করতে আসা মানুষগুলিকে মজুরিহীন অবস্থায় আধ পেটা খাইয়ে না খাইয়ে সম্পূর্ণ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খোয়ারবন্দি করে রাখা হয়েছে। তাঁরা দিন গুনছিলেন কবে বাড়ি ফিরতে পারবেন, পরিজনের কাছে গিয়ে দুঃখ ভাগ করতে পারবেন। সুখের চাইতে স্বস্তি ভালো। সেই তাঁরা যখন একত্র হয়ে বাড়ি ফিরতে জড় হলেন পুলিশ তাদের লাঠি পেটা করে খেদিয়ে দিল। আর শাসকের কোলে দোল খাওয়া প্রচার মাধ্যম চেচাতে শুরু করল, কে তাদের নিয়ে এসেছে, কেন বান্দ্রায় মসজিদে তাঁরা জড় হল? চারিদিকে বই সাজানো, এসি ঘরে থেকে রোগ ছড়ানোর জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হল তাদের যারা খেতে কাজ করে খাবার যোগান দেয় সকলকে, আবার তারাই শহরের উড়ালপুল, শপিং মল, বহুতল তৈরি করেন পরিবার ছেড়ে এসে। বহুতলের হাজার দু-হাজার বর্গফুটের এ্যাপার্টমেন্ট থাকে যারা তারাই ওইসব শ্রমিকদের একত্র হওয়াকে রোগ ছড়ানোর পক্ষে কত মারাত্মক তা নিয়ে টিভি পর্দার বিতর্ক দেখলেন।
যেদিন মুম্বাই-এ শ্রমিকরা জড় হলেন, সুরাটেও হলেন, বাড়ি ফেরার জন্য, তার পরের দিনই ওই মুম্বাই-এ কয়েক কিলোমিটার দূরে শেয়ার বাজার খুলল সকালবেলায় শেয়ারের দাম চড়ল, মুম্বাই স্টক এক্সচেঞ্জের সূচক চড়ল ৭০০ পয়েন্ট। কোনো অভিঘাতই পড়ল না শেয়ার বাজারে। বিকেল বেলায় শেয়ার সূচক নেমেছে কিন্তু তাতো বান্দ্রার ঘটনার জন্য নয়, অন্য কোনো কারণে হবে। শেয়ার বাজার নাকি অর্থনীতির কাজকর্মের সূচক। তা যদি হয় তাহলে শ্রমিকদের দুঃখ কষ্ট বাড়ি ফেরার আকুতি কোনো ভাবেই দেশের অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত নয়। যদি হত, তাহলে গতকাল ও তার আগে মার্চের শেষে পরিযায়ী শ্রমিকদের অসহায়তা, মৃত্যু মাইলের পর মাইল হাঁটা জানিয়ে দিত এই দেশের অর্থনীতি কতটাই দুর্বল, কতটাই ছেঁদো অর্থনৈতিক বৃদ্ধির ফানুস। পৃথিবীর বহুদেশে লকডাউন হয়েছে, কিন্তু কোনো দেশে শ্রমিকদের এই অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্ট হতাশার সম্মুখীন হতে হয়েছে বলে শোনা যায়নি।
বিশ্বমহামারীর এই কালবেলায় ভীত সন্ত্রস্ত বিত্তবান মধ্যবিত্ত বিদ্যাজীবী, বুদ্ধিজীবী বিদ্বজ্জন, প্রচার মাধ্যম, মন্ত্রী শান্ত্রী, পুলিশ, চিকিৎসক, আইনজীবী, শিক্ষক সকলের সকলের প্রতি ঘরে থাকার আর্তি শুনতে শুনতে মনে হচ্ছে, সকলেই ভয় পেয়েছে, ভয় পেয়েছে কোরোনা আক্রান্ত হলে মৃত্যুর, প্রিয়জনের, নিজের; ভয় পেয়েছে নিজ বাসে একঘরে হওয়ার, সেরে ওঠার পরে বাড়ি ফিরলে প্রতিবেশীর দাপটে ঘরছাড়া হওয়ার। তাই, আবেদন করছে, নিবেদন করছে, ধমকাচ্ছে চমকাচ্ছে একে অপরকে। যে একটু আগে বাজার থেকে ঘুরে এল সে টিভিতে বাজারের ভিড়ের ছবি দেখে ঘরে বসে চেচাচ্ছে ওইসব বেআক্কেলেদের গুলি করে মারতে হয়। গত পরশু যে রামনবমী উদযাপনে ভিড় জমিয়েছিল সে অর্নব গোস্বামীর টেবিল বিদারক চিৎকারে উৎসাহিত হয়ে ঘুসি মেরে সামনে রাখা চায়ের কাপকে উল্টে দিয়ে বলছে ওই ‘মোল্লা’রাই দেশের করোনার জন্য দায়ী। সেলিমপুরের রেললাইনের ধারের ঝুপড়িতে থাকা, দিনভর পাশের ফাঁকা জায়গায় দল বেধে ক্যারম খেলা ছেলেগুলো, যারা জীবনেও রাজাবাজার যায়নি, তারা রাজাবাজারে কেউ লকডাউন মানছে না বলে খোস গল্প করছে। মাসের শেষে ব্যাঙ্কে বেতনের টাকা জমা পড়ে গেছে যার, অনলাইনে তিনমাসের রসদ জমা করে দেশব্যাপী করোনা-বিরোধী ঐক্যের প্রদর্শনীতে আলো নেভানো জ্বালানোর চমৎকার দেখাচ্ছেন বা হাউই তুবড়ি পটকা সহযোগে উৎসব পালনেও মগ্ন কেউ কেউ। যারা তবলিগির অবৈজ্ঞানিক অবিবেচক কোরোনা-প্রসারী আচরণে সমস্ত মুসলিমদের উপরে ক্ষিপ্ত তারাই নিজের বাড়ির ভাড়াটিয়া কোরোনার সঙ্গে লড়াই করা ডাক্তার-নার্সকে বাড়িতে ঢুকতে না দিয়ে বা কোরোনায় মৃত রোগীর শবদেহ পোড়াতে না দিয়ে নিজেদেরকে সুরক্ষিত রাখছে। অন্যদিকে ধর্ম না দেখেই চিকিৎসা করার ঘোষণাকারী ডাক্তারবাবু ভিনধর্মের তবলিগিদের বিরুদ্ধে জিঘাংসা উগরে দিচ্ছে। এভাবেই কোরোনা বিরোধী লড়াই জারি আছে।
সকলেই বলছেন, দেশের এই দুর্দিনে, মানবজাতির এই সঙ্কটকালে সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। ঠিক কথা। কিন্তু ঐক্যবদ্ধ থাকা মানে কী? কারুর ব্যাঙ্কে জমা টাকা ও প্রতি মাসে নির্দিষ্ট সময়ে ব্যাঙ্ক এ্যাকাউন্টে বেতন বা পেনশনের টাকা জমা পড়তে থাকা, যা ব্যবহার করে অনলাইনে ছোঁয়া বাঁচিয়ে রোগ বীজাণু মুক্ত করে যথা বিহিত খাওয়া দাওয়া করতে করতে উদগার তোলা; আবার কোনো পাটকলের শ্রমিক বা পরিযায়ী শ্রমিকের পেটের খিদে সহ্য করে ঘরবন্দি থাকা। ঐক্য কেবল ওই লকডাউনে ঘরবন্দি থাকাতেই সীমাবদ্ধ। নিজের খাবার ভাগ করে খাওয়াতে নয়, কেন ঐ ২২ জন পরিযায়ী শ্রমিককে রাস্তায় মরে যেতে হল, কেন সুপ্রিম কোর্টের ঘি-মাখনে বেঁচে থাকা বিচারপতিদের ওই ঘরছাড়া শ্রমিকদের কেবল খাবার দিলেই হবে, মজুরির কী দরকার এই নির্দেশের সে সমস্ত বিষয়ে প্রশ্ন তোলাতে, সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ প্রতিরোধে গলা মেলানোতে নয়, কেবল ওই নিজেকে ও পরিজনকে বাঁচানোর লকডাউন যথাযথ রূপায়নেই সেই ঐক্যের পরিসমাপ্তি। লকডাউন উঠে গেলে, পৃথিবী আবার শান্ত হলে যে যার কক্ষপথে আবর্তিত হবে। রোজগার চলে যাওয়া অস্থায়ী শ্রমিকটি বা কাজ খোয়ানো বেসরকারী সংস্থার কর্মচারিটি কিংবা ভুখা থাকা পরিযায়ী শ্রমিকটির পরিবারের সঙ্গে ঐক্যের কোনো চিহ্নই অবশিষ্ট থাকবে না নিরাপদ সরকারি চাকুরে , কর্পোরেট আমলা, কোটিপতি ব্যবসায়ীদের। ঐক্যের স্থায়িত্ব কোভিড ১৯-এর ভয়ের সঙ্গেই সংযুক্ত।
তবুও, ভয় কাটছে না উত্তমর্ণদের। কবে আবার দেশ, পৃথিবী পুরোনো ধারায় ফিরবে, আদৌ তা পূর্ব নির্দিষ্ট ছন্দে ফিরবে কিনা তা নিয়ে ধন্ধে রয়েছে অর্থনীতির আপাত চালিকা শক্তিরা। প্রকৃত চালক-শ্রমিক কৃষক মেহনতি জনতা যখন কী করে এই লক ডাউনে দুমুঠো খাবার যোগাড় করা যাবে সেই দুশ্চিন্তায় নিমজ্জিত, তখন চা বাগান মালিক, চটকল মালিক, কীভাবে ফার্স্ট ফ্লাশের চা পাতা তোলানো যায় বা কীভাবে কল খুলিয়ে মুনাফা করা যায় সেই পরিকল্পনা চালাচ্ছে। সরকারও সঙ্গত করছে। একদিকে দেশ জোড়া লকডাউন, অন্যদিকে চাবাগান খোলার অনুমতি দিয়ে বাগান শ্রমিকদের কোরোনার মুখে দাঁড় করানো হচ্ছে।
পুরোপুরি অপরিকল্পিত লকডাউনের ফলে ৪০ কোটির বেশি শ্রমিক করোনার থেকেও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দারিদ্র ও ক্ষুধার আঘাতে। সরকারী নির্দেশ সত্বেও তথ্যপ্রযুক্তি ও তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর পরিষেবা ক্ষেত্র সমেত অন্যান্য সংস্থাতে শ্রমিক ছাঁটাই চলছে। অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগে কর্মরত শ্রমিকেরা কোনো মজুরিই পাচ্ছে না। বহু ক্ষেত্রে তারা আগের কাজের মজুরিও পাননি। সরকার শ্রমিক কর্মচারীদের মজুরি নিশ্চিত করার জন্য কোনো পদক্ষেপই নেয়নি।
কোরোনা ভাইরাসের সঙ্গে লড়াইএর জন্য কেন্দ্রীয় সরকার এপর্যন্ত যে অর্থ বরাদ্দ করেছে তা অতি সামান্য। আমেরিকা যেখানে মোট জাতীয় উৎপাদনের ১০% এর বেশি অর্থ সরকারী তরফে অতিরিক্ত ব্যয় করার কথা ঘোষণা করেছে, ভারতে তার পরিমাণ তদর্থে ০.৫% ও নয়। যে অর্থনৈতিক প্যাকেজ নির্মলা সিতারামন ঘোষণা করেছিলেন, তার মধ্যে অতিরিক্ত চাল-ডাল, মহিলাদের জনধন এ্যাকাউন্টে সামান্য টাকা ও বয়স্কদের সামান্য পেনশন ব্যতিরেকে তেমন কোনো বাজেট বহির্ভুত অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের কথা বলা হয়নি। সেই ঘোষিত প্রকল্পগুলিও সর্বাংশে কার্যকর হয়নি। গরিব জনতার জন্য যখন ছিটেফোটা বরাদ্দ করা হয়েছে, ঠিক তখনই ১৫ লক্ষ কোটি টাকার অর্থনৈতিক উদ্দীপনা সৃষ্টির প্যাকেজের দাবি করেছে শিল্পপতিদের গোষ্ঠি এ্যাসোচ্যাম। যার মধ্যে কর ছাড় থেকে শুরু করে বিবিধ দাবি করা হয়েছে। জানি না কর্পোরেটপন্থী এই সরকার এ্যাসোচ্যামের দাবি মেনে গরিব ভুখা মানুষের খাবার ও অত্যাবশ্যক প্রয়োজন মেটাতে অর্থ বরাদ্দ না করে শেয়ার বাজারের দিকে তাকিয়ে অর্থ খরচ করবে?
এননএসএসও-র ৭৫তম দফার তথ্য অনুযায়ী ভারতে গ্রাম-শহরের তফাৎ বেড়েই চলেছে। ২০১১-১২-তে গ্রামীণ মাথাপিছু আয় ছিল মাসিক ১৪৩০ টাকা, যেটা ২০১৭-১৮তে কমে দাঁড়িয়েছিল ১৩০৪ টাকায়; অন্যদিকে শহুরে আয় বেড়ে ২৬৩০ টাকা থেকে ৩১৫৫ টাকা হয়েছে। ২০১৩ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত কৃষিতে গড় বৃদ্ধির হার ছিল বার্ষিক ৩.১% যা সামগ্রিক বৃদ্ধির গড় হার বার্ষিক ৬.৭% থেকে অর্ধেকেরও কম। এমনকি সেক্ষেত্রেও শস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে বৃদ্ধির গড় হার ছিল মাত্র ০.৩%। ফলে অত্যন্ত কম জমির মালিক বা বহু ভূমিহীন কৃষক গ্রাম ছেড়ে শহরে কাজ খুঁজতে চলে যায়। ২০১১র জনগণনা অনুযায়ী ভারতে আন্তঃরাজ্য বা আন্তঃশহর অভিবাসীর সংখ্যা ৪৫ কোটি। বছরে ৯০ লক্ষ করে অন্তর্দেশীয় অভিবাসন হতেই থাকছে। এই অভিবাসনের একটা বড় অংশ পরিযায়ী শ্রমিক, যারা কোন স্থায়ী চাকুরি করে না, দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে শহরাঞ্চলে কাজ করে। ভারতের অর্থনীতির একটা বড় অংশ তাদের কাজের উপর টিকে আছে। কেবল তাই নয় গ্রামীণ অর্থনীতিও ওই শ্রমিকদের উপর বিপুল ভাবে নির্ভর করে। পরিযায়ী শ্রমিকদের পাঠানো টাকার উপর ভর করে বহু রাজ্যের অর্থনীতির চাকা গড়াচ্ছে। একদিকে দিল্লি, কেরালা, মহারাষ্ট্র, তামিনাড়ু, কর্ণাটক, হরিয়ানা গুজরাটের মতো তুলনামূলক ধনী রাজ্যগুলিতে সস্তা শ্রমের যোগান দিয়েছে পরিযায়ী শ্রমিক, যার ফলে সেখানকার অর্থনীতিতে উৎপাদনের পরিমাণ বেড়েছে, মুনাফা বেড়েছে, পুঁজিও বেড়েছে। অন্যদিকে বিহার, ওড়িশা, উত্তর প্রদেশ, আসামের মতো গরিব রাজ্যগুলিতে তাদের পাঠানো অর্থ চাহিদা সৃষ্টি করে কিছুটা হলেও সামাল দিয়েছে। করোনা এই পুরো অর্থনৈতিক বন্দোবস্তকে আঘাত করেছে।
কবে এই ভাইরাসের আক্রমণ থেকে আমরা মুক্তি পেয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরব তা বলা দুষ্কর। কিন্তু এটা বলাই যায় যে, অর্থনীতির উপরে দুঃসহ আঘাত আসতে চলেছে। পুঁজির বিশ্বায়ন পরবর্তিতে এত বড় ঘটনা ঘটেনি। তাই অর্থনীতিতে এর কী প্রভাব পড়বে তা বলা অসম্ভব। কোরোনার প্রভাব যোগান ও চাহিদা দুদিকেই পড়বে। আগে অর্থনৈতিক মন্দা এসেছে, উৎপাদনে মন্থরতা এসেছে কিন্তু এভাবে আক্ষরিক অর্থেই উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়া ভাবাই যায়নি। এমন একটা পরিস্থিতি যে বিষয়ে কোনো অভিজ্ঞতা না থাকায় বলাই যাচ্ছে না যে অর্থনীতির বিভিন্ন অংশগুলি কীভাবে প্রভাবিত হবে ও কী প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে? চাহিদা ও যাোগান উভয় তরফে এমন আঘাত অন্য কোনো ধরনের আক্রমণে ঘটে না। কোথাও আঘাতটা আসে চাহিদার দিক থেকে যা যোগানের দিককে পরবর্তিতে আঘাত করে, যেমনটা ঘটেছিল বিমুদ্রাকরণে, আবার কখনো তার সূত্রপাত ঘটে যোগানের অভাবে।
এই সামগ্রিক সামাজিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষিতে রাষ্ট্র ও সমাজের উপর প্রভাব বিস্তারকারী সকল পক্ষই কীভাবে এই সংকটকে মোকাবিলা করা যায় তার উপায় বাতলাচ্ছে। মনে রাখা দরকার বিভিন্ন জন ও ক্ষেত্র করোনার ফলে বিভিন্ন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কেউ কেউ লাভবানও হবে। প্রত্যেক গোষ্ঠিই সরকারের নীতি ও কার্যক্রমকে প্রভাবিত করে নিজেদের পক্ষে আনতে চাইবে। কিন্তু সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত ওই কোটি কোটি অসংগঠিত ক্ষেত্র ও পরিযায়ী শ্রমিকদের পক্ষে কথা বলবার জন্য যদি কেউ থাকে তো রয়েছেন বামপন্থীরা। কী করলে হত-দরিদ্র সেই মানুষগুলি এই দুঃসহ পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারে তার উপায় বামপন্থীদেরই খুঁজতে হবে।
চেম্বার অফ কমার্সগুলি নিজেদের দিকে ঝোল টানার চেষ্টা করছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সুদের হার কমিয়েছে অনেক আগেই। সুদের হার আরো কমানোর দাবি রয়েছে। সুদের হার কমানোর সাথে সাথেই ব্যাঙ্কগুলি আমানতের উপর সুদের হার কমাচ্ছে, একই সাথে স্বল্প সঞ্চয়ে সুদের হার চূড়ান্ত মাত্রায় কমানো হচ্ছে। আমানতের উপরে সুদ কমার ফলে বয়স্ক নাগরিকদের আয় কমছে। লকডাউনের ফলে যখন নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম কমছে তখন আয়ের হ্রাসের ফলে তাদের জীবন যাপন দুর্বিসহ হয়ে উঠছে। এ্যাসোচ্যাম বা ফিকি (ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান চেম্বার অফ কমার্স) যে দাবিগুলি করছে সেগুলো মূলত ব্যবসায়ীদের কর ছাড়, জিএসটি ছাড়, কর্মচারী ভবিষ্যনিধি তহবিলে নিয়োগকর্তার দেয় অংশ দিয়ে দেওয়ার দাবি, ব্যাঙ্ক ঋণে ছাড় ইত্যাদি। সঙ্গে অবশ্য অতি ক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র শিল্পে সুবিধে দেওয়া এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের অর্থ প্রদানের দাবিও রয়েছে। কিন্তু তা মূলত ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য রাখা। চেম্বার অফ কমার্সের দাবিগুলি দেখলে খেয়াল করা যাবে যে ১১ লক্ষ কোটি টাকা থেকে ২২.৫ লক্ষ কোটি টাকার মতো আর্থিক সহায়তার দাবি জানানো হয়েছে। অর্থাৎ দেশে জিডিপির ৫ থেকে ১০ শতাংশ। কিন্তু তার মধ্যে মাত্র ২ লক্ষ কোটি টাকার বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে গরিব নিরন্ন মানুষ ও পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য। যদিও তারা উদ্বিগ্ন পরিযায়ী শ্রমিকদের গ্রামে ফিরে যাওয়ায়। শ্রমিকদের ফিরে যাওয়ার ফলে কারখানাগুলি যথাযথ ভাবে চলতে পারবে না। ফলে সস্তা শ্রম থেকে তারা বঞ্চিত হবে। তাই সরকারের কাছে পরিযায়ী শ্রমিকদের ফেরত আনার জন্য পরিবহনেরও দাবি করা হয়েছে। চেম্বারগুলি মূলত তাদের জন্য সহজ শর্তে ধার, ঋণ-খেলাপির শর্ত শিথিল, জিএসটিতে ছাড় চাইছে।
অন্যদিকে দরিদ্র মানুষ কাজ হারিয়েছেন, তাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। কোভিড-১৯ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে শহরের অর্থনীতির চালিকা শক্তি আসলে ওই পরিযায়ী শ্রমিকেরা, যাদের এই শহর মনুষ্যেতর করে রাখে, যখন তখন উচ্ছেদের হুমকির সামনে। ওই শ্রমিকদের কেবল পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে গেলেই হবে না তাঁরা যেখানে থাকবেন সেখানে তাদের অধিকার দিতে হবে, থাকার সুবন্দোবস্ত করতে হবে। সরকারকেই তার জন্য অর্থ ব্যয় করতে হবে। করোনার সময়ে, প্রয়োজনে তারপরেও দরিদ্রজনের হাতে পরিবার পিছু প্রতি মাসে অন্তত ৬ হাজার টাকা দিতে হবে। যেহেতু, করোনার ফলে অন্তত আগামী ৬ মাস কাজে ভাটা পড়বে বলে মনে হচ্ছে তাই ৬ মাসের জন্য ওই অর্থ দেওয়া শুরু করতে হবে। অবস্থার উন্নতি ঘটলে সে বিষয়ে পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে। এমএসএমই, অর্থাৎ ক্ষুদ্র শিল্র যে ব্যাঙ্ক বা অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়েছে, তার জন্য মরেটোরিয়ামের পাশাপাশি ঋণ মকুবের বন্দোবস্ত করতে হবে। তা না হলে দেশ জুড়ে অসংগঠিত ক্ষুদ্র শিল্প বন্ধ হয়ে যাবে।
দেশের কৃষি অর্থনীতি এমনিতেই খারাপ অবস্থায় ছিল। কোরোনার ফলে নগদ শস্য বা ক্যাশ-ক্রপের দাম পাওয়া মুশকিল হবে। সরকারকে খালি ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ করে দিলেই হবে না, কৃষকের কাছ থেকে ফসল কিনতে হবে তাঁর দোড়গোড়ায় গিয়ে। বহুক্ষেত্রেই ঋণ যেহেতু প্রতিষ্ঠানের বাইরে মহাজনের কাছ থেকে নেওয়া হয়, সেই অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণের ক্ষেত্রেও সরকারকে শোধের জন্য দায় নেওয়ার কার্যকরী ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। শিল্পোৎপাদন ও ব্যবসায় ও যথেষ্ট সমস্যায় পড়েছে, তাই ওই সমস্ত ক্ষেত্রকে চাঙা করার জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় অর্থ ব্যয় করতে হবে; কিন্তু শর্ত হিসেবে ওই প্রতিষ্ঠানগুলি কোন কর্মচারিকে ছাটাই করতে পারবে না, এবং তাদের বেতন কাটতে পারবে না। শহরাঞ্চলে বহু মানুষ ফ্রি ল্যান্স কাজ করেন, গিগ অর্থনীতিতে কর্মরত অর্থাৎ ওলা-উবের চালান, জোম্যাটো-সুইগির ডেলিভারি দেন, ফিল্মে নাটকে কাজ করেন, তাদের রুজি বন্ধ হয়েছে; তাদের জন্যও পরিবার পিছু মাসিক ৬ হাজার টাকা দেওয়ার বন্দোবস্ত করতে হবে।
রাজ্য সরকারগুলিই কোরোনা মোকাবিলায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। তাদের নোট ছাপিয়ে সামাল দেওয়ার উপায় নেই। ওদিকে অতিরিক্ত সম্পদ সংগ্রহের কোনো রাস্তাই রাজ্য সরকারগুলির কাছে নেই পণ্য ও সেবা কর চালু হওযার পর। যেহেতু অর্থনৈতিক কাজকর্ম শিকেয় উঠেছে তাই পণ্য ও সেবা কর থেকে আদায়ও কম, তার ভাগও কম। তাই, কেন্দ্রীয় সরকারকে রাজ্য সরকারের দায় গ্রহণ করতে হবে। এমন এক ভয়ংকর দুর্যোগে রাজ্য সরকারগুলিকে সব মিলিয়ে ৩-৪ লক্ষ টাকা অনুদান দেওয়া দরকার।
সব মিলিয়ে সরকারকে অর্থনীতিকে উজ্জীবিত করার জন্য ভূমিকা গ্রহণ করে প্রভূত পরিমাণ টাকা ব্যয় করতে হবে। আনুমানিক ১৫ লক্ষ কোটি থেকে ২০ লক্ষ কোটি টাকা এই কাজে প্রয়োজন হতে পারে। সম্পদ সংগ্রহের জন্য সরকার শিল্পপতি ও ধনীদের উপরে কর বসাক। মনে রাখা দরকার শিল্প প্রতিষ্ঠান ও শিল্পপতি এক নয়। ব্যক্তিগত করকে বাড়ানো হোক। সম্পত্তির উপর কর বসানো হোক। যারা সর্বক্ষেত্রে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ও প্রতিযোগিতার গল্প ফাঁদেন তাদের অধিকাংশই উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি ও মূলধনের উপরে ভরসা করেই ধনী ছিলেন ও আরো ধনী হয়েছেন। দেশের এই সঙ্কটকালে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদের উপরে কর বসানো হোক, এবং তা ধার্য হোক পূর্ববর্তীকাল থেকে। অপ্রয়োজনীয় সরকারি ব্যয় কাটছাট করে অর্থ বাঁচানো যেতে পারে, তবে জনপ্রতিনিধিদের উন্নয়ন তহবিলকে বন্ধ করে নয়। অতিরিক্ত সম্পদ সংগ্রহ ও ব্যয় কমানোর পরেও যে ঘাটতি থাকবে তাকে মেটানো হোক নোট ছাপিয়ে। আমাদের যে এফআরবিএম (রাজস্ব দাযিত্ব ও বাজেট পরিচালন) আইন আছে তা বারবারই ভাঙা হয়েছে। এমন দুরূহ পরিস্থিতিতে রাজস্ব ঘাটতি ও তার থেকে উদ্ভুত মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে চিন্তা না করে দেশের সকল মানুষের কথা চিন্তা করাই সরকারের কাজ।
জরুরি বিভাগ খোলা। ওপিডি খোলা। ডাক্তাররা রুগিও দেখছেন। কিন্তু ইন্ডোর ফাঁকা। কিন্তু কেন?
ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মীরা পিপিই-র অভাবে নিঃসন্দেহে ভীত। রোগিদেরও পিপিইর সরবরাহ করা প্রয়োজন। “কোভিড ১৯” বলে কয়েকটি হাসপাতাল চিহ্নিত হয়েছে। তেমনি “শুধুমাত্র এমার্জেন্সি রোগের জন্য” বলে ঘোষণা করা উচিৎ নয় কি!
অজস্র অসহায় মানুষ গাড়ি বা অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে হাসপাতালে হাসপাতালে ছুটে বেড়াচ্ছেন। হার্ট অ্যাটাক, হার্টব্লক, তীব্র শ্বাসকষ্ট, সুগার ফল করা, লাগাতার খিঁচুনি, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, ডায়ারিয়া থেকে ডিহাইড্রেশন, রক্তবমি বা রক্ত কাশি, ক্যান্সারের জরুরি অপরেশন বা কেমো বা রেডিয়েশন , হাড় ভাঙা, হেডইনজুরি, নানারকম অ্যাক্সিডেন্ট, আত্মহত্যার চেষ্টা,জলে ডুবে যাওয়া, সাপের কামড়, থ্যালাসেমিয়ায় রক্ত দেওয়া, হিমোফিলিয়ায় ফ্যাটর দেওয়া, এমারজেন্সি অপরেশন .... এসব রোগিদের কোনো চিকিৎসা হবে না!
বেসরকারি হাসপাতালেরও একই অবস্থা। তারা আবার গেটের মুখেই জ্বর আক্রান্তদের ভাগিয়ে দিচ্ছে। অথচ অফিসিয়ালি সব খোলা রেখেছে।
এই অবস্থায় আমাদের কী করণীয় ?
- ডাঃ বর্ণালী রায়
আজ (৯ এপ্রিল) পোলবা বিডিও অফিস গিয়েছিলেন রাজিয়া বিবি। স্বামী রিকশা চালক জাকির আলীর আয় বন্ধ লকডাউনে। ৫ জনের সংসার। সরকার রেশন দিয়েছে মোট ৮ কেজি চাল, ৬ কেজি আটা। ৪ জনের। কারণ ছোট মেয়ে বছর পনেরোর নাজিমার রেশন কার্ড বার বার দরখাস্ত করেও এখনো মেলেনি। নাজিমা তবে কার ভাগ থেকে খাবে!!!
রাজিয়ার ভয়ার্ত জিজ্ঞাসা, ওইটুকু রেশন তো প্রায় শেষ হয়ে এল। বাকি মাসটা খাবে কী? আর সরকার তবে মাথাপিছু ৫ কেজির কথাই বা কেন বললো! এরপর লকডাউন যদি আরো বাড়ে, তবে তো আরো বিপদ রাজিয়াদের!
বছর বাষট্টির হাসিনা বিবির বিপদও একই। ২ কেজি চাল, দেড় কেজি আটায় কিভাবে চালাবেন তিনি!
বিডিও সন্তু দাসের কাছে কোনো সদুত্তর নেই। কারণ যারা রেশন পেয়েছে, তাদের জন্য তিনি কিছুই করতে পারবেন না!
রীতা মাজি, ঝন্টু মাজিদের আবার সমস্যার চরিত্র অন্যরকম। এদের পরিবারে একটাই কার্ড – অন্ত্যোদ্যয়। হিসাব মতো পরিবার পিছু ৩৫ কেজি খাদ্য। কিন্তু এই রেশন বরাবর বৃদ্ধা শ্বাশুড়ি হরিদাসী মাজি একাই নেন। তাঁর নামেই কার্ড। এই রেশনে মাস চালান তিনি। ভিন্ন থাকেন। ছেলেদের সাথে খান না, দেন ও না। যেহেতু অন্তোদ্যয় কার্ড পরিবার ভিত্তিক, সেকারণে ছেলের পরিবার এখনো কার্ড পায়নি। এমন অসংখ্য পরিবারে এমনই ‘অন্তোদ্যয়’ সমস্যা।
এতদিন কাজ ছিল। ছেলে-বৌ দুই বাচ্চা নিয়ে যাহোক করে সামলে নিয়েছে।
এখন রেশন ছাড়া চলবে কিভাবে, ছুটোছুটি করছেন রীতা!
পোলবা- দাদপুরের ৪/৫টা মাত্র গরিব পাড়ায় কৃষি ও গ্রামীন মজুর সমিতি (আয়ারলা) এবং আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চের কমরেডরা কদিন ঘুরেই চিহ্নিত করলেন এমন তিন শতাধিক মানুষকে (ছোট-বড় মিলিয়ে) যাদের রেশনকার্ড নেই। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা, যাদের কার্ড নেই, তারাও বিশেষ টোকেনে রেশন পাবে।
আমাদের কমরেডরা এদের নাম জমা দিলেন। আজ বিডিও বলছেন, যারা রেশন কার্ডের পূর্ববর্তী দুটি শিবিরে নাম জমা দিয়েছেন, তারাই কেবল বিশেষ টোকেন পাবেন কয়েক দিনের মধ্যে।
বাকিদের কী হবে?
পোলবার দনারপাড়া থেকে চাষে জল ধরানোর কাজ কোনোমতে সেরে আজ বিডিও অফিসে ছুটে এসেছিলেন কার্তিক মান্ডি। ওঁর পাড়ায় ৪/৫টি গোটা পরিবার সহ জনা ৫০-এর কোনো রেশনকার্ড নেই।
বলছিলেন, ‘সমাধান না হলে, সবাই মিলে পাড়াতেই ধর্ণায় বসবো’।
সবমিলিয়ে, অবস্থা ভালো নয়। যা রেশন মিলেছে, ২/৪ দিন পরই শেষ হবে। মুখ্যমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী কেউই কথা রাখেননি। লকডাউনকে মাথায় রেখেই ক্ষুধার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। সময়োচিত উদ্যোগে এগিয়ে যেতে হবে আমাদের।
এই সর্বব্যাপী খাদ্য সংকটে আমাদের নিজেদের উদ্যোগে রিলিফের যে কাজ আমরা করে চলেছি সেই কাজ বজায় রেখেই গ্রামীণ গরিব ও মেহনতি মানুষের উঠে দাঁড়ানোর আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
- সজল অধিকারী, হুগলি
নতুন করোনাভাইরাস বিশ্বকে এক প্রচন্ড ধাক্কার মুখোমুখি করিয়েছে। অতিমারীটি কেউ সংক্রমিত এটা জানার আগেই তা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে এবং এভাবে খুব কম জায়গাই সম্ভবত সংক্রমণমুক্ত থাকতে পারে। কোভিড-১৯ চারশো কোটি লোককে সংক্রামিত করলে ১% প্রাণহানি নথিভুক্ত হতে পারে অর্থাৎ সংখ্যাটা ৪ কোটি! একটি বৃহৎ সংখ্যার একটি ছোট অনুপাতও একটি বড় সংখ্যা। অবশ্যই আমরা প্রাদুর্ভাবের শুরুতেই আছি। এটি বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে মহামারীর সময় নতুন সংক্রমণ তার অবস্থার পরিবর্তন ঘটায়। প্রাথমিক পর্যায়ে সংক্রমণ অপেক্ষাকৃত কমে যেতে পারে। অন্যদিকে, অজান্তেই প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ১৯১৮ এর বসন্তে ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারীর প্রথম তরঙ্গ ছিল অপেক্ষাকৃত হালকা সংক্রমণ। শীতকালে এর দ্বিতীয় এবং তৃতীয় তরঙ্গ আসে যা ১৯১৯ সালে লক্ষ লক্ষ লোককে হত্যা করেছিল।
প্রতিটি নতুন প্রাদুর্ভাবের আসল বিপদটি হলো একে আটকাতে না পারার ব্যর্থতা। কোভিড-১৯ এর মতো প্রতিটি প্রাদুর্ভাবের কোনোটাই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। নতুন প্রাদুর্ভাব যখন বেড়ে ওঠে, তখন সরকার, মিডিয়া এবং এমনকি বেশিরভাগ চিকিত্সা সংস্থা প্রতিটি পৃথক প্রাদুর্ভাবের জরুরি অবস্থার প্রতি এতটাই মনোনিবেশ করে যে একাধিক প্রান্তিক রোগজীবাণুগুলি হঠাৎ কেন একের পর এক বিশ্বব্যাপী এমন প্রাদুর্ভাব সৃষ্টি করছে, তার কাঠামোগত কারণগুলি তারা এড়িয়ে যায়। ভাইরাস ঘটিত প্রাদুর্ভাবের ক্রমবর্ধমান ঘটনাগুলি খাদ্য উত্পাদন এবং বহুজাতিক কর্পোরেশনের মুনাফার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। ভাইরাসগুলি কেন আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠছে তা বোঝার জন্যে অবশ্যই কৃষি উৎপাদনের শিল্প মডেল এবং আরও নির্দিষ্ট করে বললে প্রাণীসম্পদ উত্পাদন পদ্ধতির তদন্ত করা দরকার।
মূলত শিল্পজাত-কৃষি এর জন্যে দায়ী, তবে আরো অনেক কারণ হতে পারে। বিশ্বব্যাপী প্রাইমারি ফরেস্ট বা জনগণের ছোঁয়ার বাইরে থাকা গভীর বন থেকে প্রান্তিক কৃষকদের ক্ষুদ্র কৃষি জমি সমস্ত দখলে নেতৃত্ব দিচ্ছে পুঁজি। এই পুঁজি বিনিয়োগগুলির বনভূমি উজাড় করে দেয়া এবং তথাকথিত উন্নয়ন বিভিন্ন রোগের আবির্ভাব ঘটাচ্ছে। ভূমির এইসব বিশাল এলাকার কার্যকরী বৈচিত্র্য এবং জটিলতার পরিবর্তন বনভূমিতে আটকে থাকা জীবাণুগুলির স্থানীয় প্রাণিসম্পদ এবং মানব সম্প্রদায়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার পথ মসৃন করে তুলেছে। সংক্ষেপে, পুঁজির কেন্দ্রগুলি আমাদের প্রাথমিক ভাবে রোগের লক্ষণ দেখা দেয়ার কেন্দ্র হিসাবে বিবেচনা করা উচিত।
এই প্রক্রিয়াটিতে বহুজাতিক সংস্থাগুলির ভূমিকা কী? বায়োমাস অর্থাৎ যেসব জৈব পদার্থকে শক্তিতে রূপান্তরিত করা যায় এবং জমি, এই উভয় ক্ষেত্রে এই পৃথিবী হলো মূলত প্ল্যানেট ফার্ম বা খামারে প্রযুক্তি প্রয়োগে কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় পরিণত স্থান। কৃষি উৎপাদন ব্যবসার লক্ষ্য হলো খাদ্যপণ্যের বাজারকে পুরোপুরি কব্জায় নিয়ে আসা। অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলির জমি ও সম্পদের উৎসকে হাতিয়ে নিতে শিল্পোন্নত দেশগুলির বিভিন্ন সংস্থা নয়া-উদারনৈতিক প্রকল্পকে কেন্দ্র করে সংগঠিত হয়েছে, যা প্রায় সম্পূর্ণ। এর ফলস্বরূপ, দীর্ঘকালের বিবর্তনে জঙ্গলের বাস্তুতন্ত্র যেসব জীবাণুগুলিকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলো তারা অবাধে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, পুরো বিশ্বকে হুমকির মধ্যে ফেলেছে। ভারতবর্ষেও সাম্প্রতিক কালে স্যাঙাত পুঁজিপতিদের হাতে আমাদের গভীর বন তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। কৃষির ব্যবসায়িক উত্পাদন পদ্ধতির ফলে এই জীবাণুগুলির ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়ে। পুঁজি-নিয়ন্ত্রিত কৃষি প্রাকৃতিক বাস্ততন্ত্রকে ঠিক এমনভাবে বদলে দেয় যার ফলে রোগ জীবাণুগুলি নিজেদেরকে আরো তীব্র ক্ষতিকর ও সংক্রামক গঠনে বদলে ফেলে। কোনো মারাত্মক রোগের চাষ করার জন্যে এর থেকে আর ভালো পরিকল্পনা আর হয় না। গৃহপালিত পশুদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান genetic monoculture, বা একই ধরনের পশুপালের মড়ক তাদের মধ্যে সংক্রমণকে মন্থর করার জন্যে যে স্বাভাবিক প্রতিরোধী দেয়াল থাকে তাকে সম্পূর্ণ ভেঙে দেয়। বৃহৎ সংখ্যক পশু এবং ঘনত্ব, সংক্রমণের হার বৃদ্ধিকে সহজতর করে। এইরকম ঘনবসতিপূর্ণ পরিবেশ অনাক্রম্য বা প্রতিরোধী প্রতিক্রিয়াকে মন্দীভূত করে দেয়। উচ্চ উৎপাদন হার, যা যে কোনও শিল্প উত্পাদনের অংশ, কার্যকরী অংশগুলোকে বারবার পুনর্নবীকরণ করে উৎপাদন চালাতে থাকে যা রোগজীবাণুর ক্রমবিবর্তনে ইন্ধন দেয়। অন্য কথায়, কৃষির শিল্পোদ্পাদন পদ্ধতিতে মুনাফার প্রতি এতটা মনোনিবেশ করা হয়েছে যে এর ফলে একশো কোটি মানুষকে হত্যা করতে পারে এমন ভাইরাস যদি উন্মুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তাহলেও সেই উৎপাদন পদ্ধতি একটি গ্রহণযোগ্য ঝুঁকি হিসাবে বিবেচিত হয়।
এই সংস্থাগুলি তাদের মহামারীর সম্ভাবনাপূর্ণ বিপজ্জনক অপারেশনের পরিনাম অন্য সকলের বিপদে পরিণত করে দিতে পারে। পশু থেকে শুরু করে, খামারি শ্রমিক, স্থানীয় পরিবেশ তথা বিচার ব্যবস্থার এক্তিয়ার পর্যন্ত সরকার, এই সকলকেই। ক্ষয়ক্ষতিগুলি এতটাই বিস্তৃত যে তাদের এই চাপিয়ে দেয়া ক্ষতির মূল্য চোকানোর সামর্থ্য কোনো সংস্থার নেই।
উহানের হুনান হোলসেল সি ফুড মার্কেট যেখানে বন্য প্রাণী বিক্রি হতো সেই পর্যন্ত সংক্রমণের সংযোগ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। পরিবেশগত তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে বাজারের পশ্চিম প্রান্তের যেখানে বন্যপ্রাণী ছিল সেই অঞ্চলটিকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
তবে আমাদের কতদূর পিছনে এবং কতটা ব্যাপকভাবে তদন্ত করা উচিত? বাজারটির ওপর সমস্ত দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল, ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে ওয়াইল্ড ফুড বা বন্য কৃষির উত্স এবং তার ক্রমবর্ধমান প্রভাব সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। বিশ্বব্যাপী এবং চীনে ওয়াইল্ড ফুড অর্থনৈতিক ক্ষেত্র হিসাবে আরও বৈধ হয়ে উঠছে। তবে শিল্পজাত কৃষির সাথে এর সম্পর্ক একই বাজার ভাগ করে নেওয়ার বাইরেও প্রসারিত। শূকর, হাঁস-মুরগি এবং এগুলির মতো প্রাণীর শিল্প উৎপাদন গভীরতর বনাঞ্চলে প্রসারিত হতে থাকে, এটি বন্য খাদ্য সংগ্রাহকদের জঙ্গলের আরো গভীরে গিয়ে বন্য খাদ্য তুলে আনতে বাধ্য করে, যা কোভিড-১৯ সহ নতুন রোগজীবাণুগুলিকে পৃষ্ঠতল থেকে উঠে আসতে এবং ব্যাপক হারে বৃদ্ধি ঘটাতে সাহায্য করে। এই মুহূর্তে কোনো রোগ জীবাণুই নেই যা পুঁজির প্রভাব মুক্ত। এমনকি সর্বাধিক দূরবর্তী স্থানগুলিও প্রভাবিত, সে যত দুরেরই হোক। ইবোলা, জিকা, করণা ভাইরাস, পুনরায় হলুদ জ্বরের প্রত্যাবর্তন এবং শূকরদের মধ্যে আফ্রিকান সোয়াইন ফ্লু – অনেক ভাইরাসের মধ্যে থেকে এরা বেরিয়ে আসার পথ তৈরি করে নিচ্ছে, দূরবর্তী উপকূল ভাগ থেকে শহর সংলগ্ন এলাকা, সেখান থেকে আঞ্চলিক রাজধানী এবং তারপর গ্লোবাল ট্রাভেল নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত সমস্ত স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে, মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে কঙ্গোর ফ্রুট ব্যাট নামক বাদুড় থেকে মিয়ামি সানবাথারদের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে।
কোভিড-১৯ ই চীনে প্রথম ভাইরাসের বিকাশ নয় যাকে সরকার আড়াল করার চেষ্টা করেছিল। তবে হ্যাঁ, এটি কোনো চীনা ব্যতিক্রমও নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ নতুন ইনফ্লুয়েঞ্জার জন্য গ্রাউন্ড জিরো হিসাবে কাজ করেছে, সাম্প্রতিককালের H5N2 এবং H5Nx ভাইরাসের কথা মনে করুন। তাদের বহুজাতিক এবং নয়া-ঔপনিবেশিক প্রতিনিধিরা পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলা এবং ব্রাজিলে জিকা ভাইরাসের উত্থান ঘটিয়েছে। কৃষিজাত শিল্প ব্যবসার স্বার্থে ২০০৯ এর H1N1 এবং H5N2 প্রাদুর্ভাবকে মার্কিন জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তারা আড়াল করেছিলেন।
এর হাত থেকে বাঁচতে আমাদের আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। নতুন ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব হ্রাস করতে, খাদ্য উৎপাদন পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। কৃষকের কর্ম স্বাধীনতা এবং শক্তিশালী রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্র পরিবেশের ক্রমাগত ক্ষয় এবং অনিয়ন্ত্রিত সংক্রমণকে রোধ করতে পারে। খামার এবং আঞ্চলিক উভয় স্তরেই বিভিন্ন ধরনের গৃহপালিত পশু এবং ফসল উৎপাদনের পুরোনো কৌশল ফিরিয়ে আনতে হবে। খাদ্য প্রাণীদের শারীরিক অনাক্রম্যতা নিশ্চিত হতে একমাত্র নির্দিষ্ট জায়গাতেই পুনরুৎপাদনের অনুমতি দিতে হবে। সরবরাহের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে উৎপাদন হার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কৃষি সহায়ক মূল্যে এবং বাস্তুতন্ত্রের নিয়ম মেনে যে কৃষি উৎপাদন পদ্ধতি তাতে ভর্তুকি দিতে হবে। যে পরীক্ষাগুলি নয়া-উদারনৈতিক অর্থনীতি সমভাবে ব্যক্তি ও সম্প্রদায়ের উপর চাপিয়ে দিয়েছে এবং পুঁজি-নেতৃত্বাধীন রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন ও হুমকির মুখোমুখি করেছে এই উভয় ক্ষেত্রেরই জোর-জবরদস্তির মোকাবিলা করতে হবে। সামগ্রিকভাবে, অবশ্যই আমাদের অর্থনীতি ও বাস্তুশাস্ত্রের সমন্বয়কে ধ্বংসকারী মেটাবলিক রিফ্ট অর্থাৎ সমাজিক ব্যবস্থা ও পরিবেশের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে সৃষ্ট বাস্তুতন্ত্রের গভীর ক্ষতকে নিরাময় করতে হবে। মোটের ওপর, আমাদের এই প্রানপ্রিয় গ্রহে মানবতার জয়ধ্বজা ওড়াতেই হবে।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার : মার্কস ২১ পত্রিকা, বিজ্ঞানী ড. রব ওয়ালেস
১) গত ৯ এপ্রিল রাতে প্রয়াত হয়েছেন বালির দীর্ঘদিনের পার্টি সমর্থক, আমাদের অভিভাবক কমরেড জহর মুখার্জি। তিনি উত্তরপাড়ার উই কেয়ার নার্সিংহোমে ভর্তি ছিলেন। সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়েছিলো। কমরেড জহর মুখার্জি লাল সেলাম।
২) পুর্ব বর্ধমান জেলা কমিটির সদস্য কমরেড সমীর বসাকের বাবা কমরেড আশিষ বসাক ১১ এপ্রিল সকাল সাড়ে এগারোটার সময় ৭৮ বছর বয়সে পুর্বস্থলী ব্লকের সিমলা গ্রামের নিজের বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন । কয়েক মাস ধরেই তিনি গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় ছিলেন। কিছুদিন আগে নবদ্বীপের প্রতাপ নগর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তিনি পার্টির দৃঢ় সমর্থক ছিলেন। আগে নদীয়ার ফুলিয়াতে বসবাস করতেন। সত্তরের দশকের নকশাল আন্দোলনে ওনার বাড়িতে কমরেডদের আসা যাওয়া ও সেন্টার ছিল। ২০০৯ সাল নাগাদ পুর্বস্থলীর গ্রামে চলে আসেন। এখানেও ওনার পরিবারটি পার্টির পরিবার হিসাবে পরিচিত। মৃত্যুকালে তিন মেয়ে ও একমাত্র ছেলে সমীর বসাককে রেখে গেলেন। এই কমরেডের মৃত্যুতে তাঁর পরিবারের শোকের অংশীদার হয়ে জেলা কমিটির পক্ষ থেকে তাঁর পরিবার, পাড়াপড়শি ও আত্মীয়দের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেছেন। কমরেড আশিষ বসাক লাল সেলাম।
৩) প্রয়াত হলেন কমরেড বিষ্ণু প্রামাণিক। রেলওয়ে-তে বামপন্থী শ্রমিক আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন কমরেড। বিষ্ণু প্রামাণিকের অকাল প্রয়াণ অত্যন্ত দুঃখজনক। সাথীকে জানাই লাল সেলাম।
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী), ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী- লেনিনবাদী) লিবারেশন, সারা ভারত ফরোয়ার্ড ব্লক ও রেভল্যুশনারি সোশালিস্ট পার্টি যৌথভাবে নিম্নলিখিত বক্তব্য পেশ করছে
বামপন্থী দলগুলি ১৪ এপ্রিল বিকেল ৫টায় নিম্নলিখিত বিষয়গুলিতে সংকল্প গ্রহণের মধ্য দিয়ে আম্বেদকর জয়ন্তী পালনের (লকডাউনের স্বাস্থ্য বিধি অনুসরণ করে) জন্য ভারতের জনগণের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে।
১) আমাদের সংবিধানকে রক্ষা করা,
২) সমস্ত দরিদ্র ও লকডাউনে বিপদাপন্ন সকল অভাবীদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে নগদ প্রদান ও খাদ্য বন্টন,
৩) ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ ও প্রতিবন্ধকতা নিরপেক্ষভাবে সামাজিক ঐক্যের বন্ধনকে দৃঢ় করার লক্ষ্যে। লকডাউনের বিধিনিষেধের মধ্য অতিমারির বিরুদ্ধে লড়াই-এর নামে জীবন, স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক অধিকারের উপর আক্রমণ বা অস্পৃশ্যতার প্রকাশ রুখে দেওয়া --
“সামাজিক দূরত্ব” নয়, আমাদের আহ্বান হল “সামাজিক ঐক্য সহযোগে শারীরিক দূরত্ব” মেনে চলা।
৪) অজ্ঞানতা, কুসংস্কার ও মতান্ধতার বিরুদ্ধে জনগণকে শিক্ষিত করে তোলার আম্বেদকারের আদর্শের ভিত্তিতে আমরা এই সংকল্প নিচ্ছি। লকডাউনের সময়ে মানুষের প্রয়োজনে জীবন ও জীবনধারণের জন্য সাহায্য ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে আমরা সংকল্প নিচ্ছি।
যেহেতু, জন সমাবেশ ও আম্বেদকারের মূর্তিতে মাল্যদান করা সম্ভব হবে না, তাই জনসাধারণ ১৪ তারিখ বিকেল ৫ টার সময় নিরাপদ ও সুবিধেজনক স্থানে এই সংকল্প গ্রহণ করবেন।
গত ৫ এপ্রিল রাত প্রায় ৯টার সময় কিছু সামন্ততান্ত্রিক দুর্বৃত্ত ভোজপুর জেলার তারারি ব্লকের সারা মুসাহার টোলার কৃষ্ণ মুসাহারের বাড়িতে ঢুকে আক্রমণ চালায়। বাড়ির মেয়েদের ধর্ষণ করার উদ্দেশ্যেই ওই দুর্বৃত্তরা বাড়ির ওপর চড়াও হয়, কিন্তু বাড়ির মেয়েরা রুখে দাঁড়ালে ওরা গুলি চালাতে শুরু করে। তাদের চালানো গুলিতে ছ-জন আহত হয়। সিপিআই(এম-এল)-এর বিহার রাজ্য সম্পাদক কমরেড কুনাল এই ঘটনায় তীব্র ধিক্কার জানিয়ে বলেন, করোনা সৃষ্ট সংকটের সময়ও এই দুর্বৃত্তরা জঘন্যতম অপরাধ সংঘটিত করতেও পিছপা হয় না। এই ধরনের অপরাধের সংঘটনকে রুখতে সরকারকেই ব্যবস্থা নিতে হবে।
কমরেড কুনাল পাটনা জেলায় সংঘটিত আর একটি অপরাধের উল্লেখ করে বলেন, এই সব ঘটনা দেখিয়ে দিচ্ছে যে দুর্বৃত্তরা কতটা স্পর্ধিত হয়ে উঠেছে। বিজেপি মদতপুষ্ট সমাজবিরোধী লোকজন পাটনা জেলার পালিগঞ্জ ব্লকের জারখা গ্ৰামের বাসিন্দা সিপিআই(এম-এল) ব্লক কমিটির সদস্য রাজেশ কুমারের লাগাতার হেনস্থা ঘটিয়ে চলেছে। এই দুর্বৃত্তরা গ্ৰামের সামাজিক এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে বিষিয়ে তোলার যে লাগাতার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, কমরেড রাজেশ তার ধারাবাহিক বিরোধিতা করে আসছেন। আর সেই কারণেই বিজেপি মদতপুষ্ট এই দুর্বৃত্তরা তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে ৪ এপ্রিল তাঁর বাড়িতে আক্রমণ চালায়। লকডাউনের ফলে ক্ষতিগ্ৰস্ত পরিযায়ী শ্রমিক ও দরিদ্রদের অবস্থার খোঁজখবর নেওয়ার পর পাটনা জেলারই বিহটা ব্লকের বিষ্ণুপুরা গ্ৰামে ফিরছিলেন সিপিআই(এম-এল)-এর জেলা কমিটি সদস্য গোপাল সিং, কিন্তু এখানেও তাঁর গ্ৰামে ঢোকাকে আটকায় সামন্ততান্ত্রিক শক্তিগুলো। সমাজে বিদ্যমান অস্পৃশ্যতা এবং দলিত ও মুসলিমদের এবং তার সাথে কোভিড-১৯ সংক্রমিত মানুষদের বিরুদ্ধে চালিত বৈষম্যের অভিশাপগুলোকে আরও শক্তিশালী করে তুলছে লকডাউন এবং দক্ষিণপন্থী ঘৃণার প্রচার।
সিপিআই(এম-এল) আরও একবার এই দাবিগুলোকে তুলে ধরছে : অপরাধের ক্রমবর্ধমান ঘটনায় রাশ টানতে হবে; সবাইকেই রেশন দিতে হবে এবং কারো বিরুদ্ধে কোনো রকম বৈষম্য করা চলবে না; স্বাস্থ্যকর্মী এবং ত্রাণ বণ্টনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিগণ এবং তার সাথে কোভিড-১৯ সংক্রমিত রোগীদের ওপর কালিমা লেপনের প্রচেষ্টাগুলোকে খর্ব করার ব্যবস্থা নিতে হবে, এবং এই সব প্রশ্নে গৃহীত উদ্যোগে বিরোধী দলগুলোকেও শামিল করতে হবে।
সারা মুসাহার টোলায় গুলি চালনার খবর পেয়ে তারারির সিপিআই(এম-এল) বিধায়ক কমরেড সুদামা প্রসাদ এবং ব্লক সম্পাদক রমেশ সিং ওই গ্ৰাম পরিদর্শন করে সরেজমিনে ঘটনাটির খবর নেন। যাঁরা সেদিনের গুলিচালনায় আহত হয়েছিলেন তাঁরা হলেন:
১। কৃষ্ণ মুসাহার(২৬) – ৭টা গুলি লাগে; ২। রামনাথ মুসাহার(৫০) – ৬টা গুলি লাগে; ৩। অজয় মুসাহার (২৫) – ২টো গুলি লাগে; ৪। বিদেব মুসাহার(২২) – ২টো গুলি লাগে; ৫। ভিকান মুসাহার(১৫) – ??? ৬। আনুসি কুমারি(৬ মাস) – হাতে গুলি লাগে (অজয় মুসাহারের মেয়ে)।
বিদেব মুসাহার ছাড়া অন্য সব আহতদের আক্রমণের দিন রাতে আরা সদর হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। তারারির সিপিআই(এম-এল) বিধায়ক সুদামা প্রসাদ, সিপিআই(এম-এল)-এর শহর সম্পাদক দিলরাজ প্রীতম এবং চিকিৎসা ব্যাপারে দায়িত্বশীল দীননাথ সিং আরা সদর হাসপাতালে গিয়ে আহতদের সঙ্গে দেখা করেন, এবং ঘটনাটি সম্পর্কে বিশদ খবরাখবর নেন। তার পরই জেলা শাসককে ঘটনাটি সম্পর্কে অবহিত করা হয়। সিপিআই(এম-এল) এই উদ্যোগ নেওয়ায় আহতদের প্রত্যেকে এক লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ পান।
সুদামা প্রসাদ দাবি জানিয়েছেন, সমস্ত অপরাধীদের অবিলম্বে গ্ৰেপ্তার করতে হবে এবং দ্রুত বিচার সম্পন্ন করে তাদের যথাযথ শাস্তি দিতে হবে; আহতদের পর্যাপ্ত ও যথার্থ চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে; লকডাউনের জন্য রেশন পাওয়ার সমস্যা হওয়ায় সমস্ত আহতদের পরিবারগুলো যাতে যথাযথ পুষ্টি ও খাদ্য পায় তার ব্যবস্থা করতে হবে; সমগ্ৰ মুসাহার টোলার জন্য রেশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
করোনা সংক্রমণ ও তার পরবর্তীতে নামানো লকডাউন দেশে ব্যাপক বিপর্যয় নিয়ে এসেছে। অনাহারের মুখোমুখি হয়ে হাজার-হাজার পরিযায়ী শ্রমিক শতশত মাইল পারি দিচ্ছেন বাড়ির উদ্দেশ্যে, এ দৃশ্য আমাদের দেশের সঙ্গে সারা দুনিয়াও দেখেছে। প্রায় দু-লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক বিহারে ফিরে এসেছেন, কিন্তু সরকার এবং প্রশাসন তাদের প্রতি কোনো আন্তরিকতা না দেখিয়ে নিষ্ঠুর মনোভঙ্গিই প্রদর্শন করেছে। নীতীশ কুমার এমনকি এই কথাও বলেছেন যে, তাদের বিহারের সীমানা পেরিয়ে রাজ্যের ভেতর ঢুকতে দেওয়া হবে না। কিছু জায়গায় সিপিআই(এম-এল) উদ্যোগ নেওয়ায় পরিযায়ী শ্রমিকরা বাড়ি ফিরতে পেরেছেন। অনাহার, জীবিকা হারানো এবং করোনা সংক্রমণের আতঙ্ক বিহারের এক বড় অংশের মানুষকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। বিহার সরকার কিন্তু গা-ছাড়া মনোভাব দেখাচ্ছে, সংকটের একটা কার্যকরী সমাধানে পৌঁছতে অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের সাহায্য ও সহযোগিতাকে প্রত্যাখ্যান করছে। এই পরিস্থিতিতে সামন্ততান্ত্রিক শক্তিগুলোর আক্রমণ এবং তাদের দ্বারা দরিদ্র ও দলিতদের সামাজিক বয়কটও অনেক গুণ বেড়ে গেছে। দিল্লীর তবলিগি জামাত জমায়েতের ঘটনাকে অছিলা করে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়ানোর পরিঘটনাও ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ভারত এমন একটা দেশ যেখানে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কিছু জাত ও সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাটা এক নির্মম বাস্তবতা হয়েই বিরাজ করছে। এখানেই আবার সামাজিক দূরত্ব চালিয়ে যাওয়ার ব্রাহ্মণ্যবাদী ব্যবস্থাকে অব্যাহত রাখতে করোনাকে অস্ত্র হিসাবে কাজে লাগানো হচ্ছে। 'লকডাউন'কে সামনে রেখে সমস্ত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে চূর্ণ করা হচ্ছে এবং স্বৈরতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চলছে।
করোনাভাইরাস-লকডাউন-মদ নিষেধের নামে বিজেপি-জেডিইউ গুণ্ডা ও পুলিশের গাঁটছড়া বিহারের অনেক স্থানেই মারধর, লুট, হত্যা, ইত্যাদি যে নিপীড়নগুলো চালিয়েছে, সিপিআই(এম-এল)-এর কয়েকটি দল সেই সমস্ত ঘটনার তদন্ত করে দেখেছে। পাটনা, মাসাউরি, পুনপুন, ধনরুয়া ইত্যাদি স্থানে সংঘটিত কিছু ঘটনার বিবরণ নীচে দেওয়া হল।
ঘটনা : এখানে বেশ কয়েকদিন ধরেই পুলিশের হানাদারি ও তল্লাশি চলছিল এবং ২৭ মার্চ বিজেপি-জেডিইউ মদতপুষ্ট সামন্ততান্ত্রিক দুর্বৃত্তরা গ্রামে ঢুকে পুরুষ, মহিলা এবং এমনকি শিশুদেরও মারধর করে, কিছু জিনিসপত্র ধ্বংস এবং কিছু লুটও করে; এসবই তারা করে আঞ্চলিক ডিএসপি-র যোগসাজশে এবং ঐ সমস্ত হানাদারিতে নেতৃত্ব দেন জেডিইউ ব্লক সভাপতি বেদ প্রকাশ ও ভোলা সিং। অসুস্থ ৫০ বছর বয়স্ক বোথা মানঝিকে এমন ভয়ঙ্করভাবে মারা হয় যে তিনি ২ এপ্রিল মারা যান। সিপিআই(এম-এল) আঞ্চলিক অফিসারের কাছে এই বিষয়ে লিখিত অভিযোগ জানালেও কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
বলবৎ করার নামে এক বিরাট পুলিশ বাহিনী বিজেপি-আরএসএস গুণ্ডা নরেন্দ্র সিংকে সঙ্গে নিয়ে এই গ্ৰাম এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে হানাদারি চালিয়ে সন্ত্রাসের আবহাওয়া সৃষ্টি করে। ওরা ২৮ মার্চ আবার আসে এবং গ্রামের লোকজনকে প্রচণ্ড প্রহার করতে থাকে। লকডাউন চলতে থাকায় নগেন্দ্র মানঝির ছেলে আহত রোহিত কুমারকে সময়মতো পাটনা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া যায়নি, ফলে সে মারা যায়। নরেন্দ্র সিং ও তার গুণ্ডাবাহিনী তার শেষ কৃত্যেও বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু জনগণ সেটা ব্যর্থ করে দেয়। ওই গুণ্ডারা ২৯ মার্চ আবার গ্রামে ঢোকে, জনগণকে মারধর করে এবং ১৫ বছরের কিশোরী মহাদলিত সম্প্রদায়ের সরস্বতী কুমারীকে টেনে নিয়ে যায় যার উদ্দেশ্য ছিল তাকে ধর্ষণ করা। গ্রামবাসীরা প্রতিবাদ জানালে রড দিয়ে তাদের মারা হয়। শিবরাম মানঝির বাড়িতে লুটপাট চালানো হয় এবং তার মেয়ের বিয়ের জন্য রাখা গয়নাও ছিনিয়ে নেওয়া হয়। অরুণ সাহু, নান্দু মানঝি ও আরো কিছু মানুষকে মারধর করে তাদের বাড়িতে লুটপাট চালানো হয়।
৩। বিক্রম ব্লকের চিকোডার ঘটনা : মদের ওপর নিষেধাজ্ঞাকে বলবৎ করার নামে পালিগঞ্জের ডিএসপি-র নেতৃত্বে বিজেপি সমর্থিত সামন্ততান্ত্রিক গুণ্ডারা গ্রামের ওপর আক্রমণ চালিয়ে গ্রামবাসীদের মারধর করে। তলোয়ার ও লাঠি নিয়ে যে গুণ্ডারা গ্রামে ঢোকে তাদের মধ্যে ছিল পুটু সিং, বীরেন্দ্র সিং, টুটু সিং, হরিরাম সিং, অমরনাথ সিং, রাজকমল সিং, সুধীর সিং ও অন্যান্যরা। যাবার সময় ওরা গ্রামবাসীদের এই হুমকি দিয়ে যায় যে, ওরা যদি এক সপ্তাহর মধ্যে গ্রাম না ছাড়ে তবে করোনা ভাইরাসের নামে ওদের জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হবে।
৪। ফুল ওয়ারির উড়ান টোলার ঘটনা : ৪ এপ্রিল গ্রামে ঢুকে পুলিশ গ্রামবাসীদের কাছ থেকে তোলা আদায় করতে শুরু করে। গ্রামবাসীরা যখন বলল যে ওদের টাকা নেই এবং ওরা অনাহারে রয়েছে, পুলিশ তখন মদের ওপর নিষেধাজ্ঞার নামে ওদের মারতে শুরু করে।
৫। পালিগঞ্জের জারখার ঘটনা : সিপিআই(এম-এল) ব্লক কমিটির সদস্য রাজেশ কুমারকে ফোনে হুমকি দেওয়া হয় এবং তারপর গুণ্ডারা তার বাড়িতে ঢুকে ইট-পাথর ছুড়তে এবং গুলি চালাতে শুরু করে। উল্লেখ্য যে, রাজেশ কুমার দীর্ঘদিন ধরেই বিজেপি গুণ্ডাদের অপকীর্তিগুলোকে ফাঁস করে আসছেন। এই গুণ্ডারাই এর আগে গ্রামের দরিদ্রদের ওপর আক্রমণ চালায় এবং শিব মন্দিরে মুসলিম-বিরোধী পোস্টার সাঁটায়।
৬। রামপুর নিগওয়ার ঘটনা : রামানি (কাহার) জাতের যে তিনজন পরিযায়ী শ্রমিক গ্রামে ফিরেছিল বিজেপি-আরএসএস গুণ্ডারা ওদের হুমকি দিয়ে বলে যে তাদের গ্রামে থাকা হবে না এবং গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয় যে ওদের দেখে অসুস্থ মনে হচ্ছে না, আর তাই ওরা থাকতে পারে। কিন্তু ওই গুণ্ডাদের সেটা পছন্দ হয়নি এবং তিন দফায় ওদের মারধর করে গুরুতর রূপে আহত করা হয়।
৭। বিহটার ঘটনা : সামন্ততান্ত্রিক শক্তিগুলো এই ব্লকের গ্রামগুলোর ওপর আক্রমণ চালিয়ে সন্ত্রাসের আবহাওয়া সৃষ্টি করে। সিপিআই(এম-এল) জেলা কমিটি সদস্য গোপাল সিংকে গ্রামে ঢুকতে দেওয়া হয় না এবং আধিপত্য চালানো সামন্ততান্ত্রিক অংশ এই মিথ্যা প্রচার ছড়ায় যে, তাঁর করোনা সংক্রমণ হয়েছে এবং তাঁর থেকে সংক্রমণ ছড়াবে।
৮। দানিয়াওয়ার ঘটনা : গ্রামবাসীরা লকডাউনের সময় ফসল কাটার কাজ করতে অস্বীকার করলে সামন্ততান্ত্রিক শক্তিগুলো সাহজাপুর এলাকার কেওয়াই গ্রামে আক্রমণ চালিয়ে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে। মহাদলিত সম্প্রদায়ের শ্রমিক ৪০ বছর বয়স্ক হরদয়াল মানঝিকে প্রচণ্ড মারধর করে তার হাত ভেঙ্গে দেওয়া হয়।
৯। ভোজপুরের সারা মুসাহার টোলার ঘটনা : সামন্ততান্ত্রিক গুণ্ডারা ৫ এপ্রিল টোলায় আক্রমণ চালালে ছয় ব্যক্তি গুরুতর রূপে আহত হয়। যারা আহত হয়েছে তাদের বয়স ছয় মাস থেকে ৫০ বছর। প্রাপ্ত সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে, রবি যাদব এবং শিবলগন যাদবকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, কিন্তু অন্য অভিযুক্তরা এখনও অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
ভোজপুরের বিভিন্ন স্থান থেকে করোনার নাম নিয়ে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ভুয়ো খবর ছড়ানোর খবর পাওয়া গেছে। হাঁপানি রোগে ভোগা আরা সদর হাসপাতালে ভর্তি ৩০ বছর বয়সী এক মুসলিম যুবক অবহেলা এবং ভুল ইঞ্জেকশন দেওয়ার ফলে মারা যায়। রুষ্ট আত্মীয়রা প্রতিবাদ জানালে ওই ডাক্তার পুলিশ ডাকেন এবং এই মিথ্যা আখ্যান হাজির করেন যে, যুবকটির মৃত্যুর কারণ করোনা সংক্রমণ। পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে অবশ্য করোনা ছিল না বলে বলা হয়। কিন্তু লাগামছাড়াভাবে এই মিথ্যা প্রচার চলতে থাকে যে, মুসলিমরা করোনা ছড়াচ্ছে। নওয়াদা, সাহার এবং অন্যান্য স্থান থেকেও একই ধরনের সংখ্যালঘু-বিরোধী গুজব ছড়ানোর, করোনা সংক্রমণের জন্য মুসলিমরাই দায়ী বলে মিথ্যা প্রচারের খবর আসে।
জাহানাবাদের মোদানাগঞ্জের দয়ালি বিগাহা থেকে গ্রামে ফেরা পরিযায়ী শ্রমিকদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার, মারধর এবং নির্মম আচরণের সংবাদ পাওয়া যায়। জাহানাবাদ জেলার সুরদাসপুর, মুডগাঁও, কল্পা ওলি এবং ঘোষির লাখাওয়ার থেকেও কৃষক ও মাছ চাষিদের মারধর করা এবং হুমকি দেওয়ার খবর আসে।
গোপালগঞ্জ (ভোরে ব্লক এবং কুছায়াকোট থানার বেদুয়া টোলা), দ্বারভাঙ্গা (মনিগাছি) এবং সিওয়ান থেকেও পুলিশি নিপীড়ন এবং সামন্ততান্ত্রিক শক্তি-দুর্বৃত্তদের অত্যাচারের খবর পাওয়া গেছে। সিওয়ান শহরে ৪ মার্চ অশোক রামের ওপর গুলি চালানো হয়। ৭ মার্চ পার্শ্ব শিক্ষক রিঙ্কু দুবের ওপর গুলি চালানো হয় যার ফলে তিনি মারা যান। সদর মনিগাছিতে বিজেপি সদস্যদের প্ররোচনায় প্রতিবেশীরা সিপিআই(এম-এল) নেত্রী রসিদা খাতুনের ওপর আক্রমণ চালায়। ঘটনার পরপরই দল উদ্যোগ নেয় এবং পুলিশ আক্রমণকারীদের গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হয়।
জম্মু ও কাশ্মীরে চালু হল রাষ্ট্রপতি শাসন। ভূস্বর্গ মুহূর্তে ভরে গেল ভারী বুট, বুলেটের আতঙ্কে। ৩৫(ক) বিলুপ্তির মাধ্যমে প্রশ্ন চিহ্নের মুখে ফেলা হল কাশ্মীরের ভূমিসন্তানদের বিশেষ অধিকারগুলিকে। ৩৭০ ধারা অবলুপ্তির মাধ্যমে সাংবিধানিকভাবে কেড়ে নেওয়া হল কাশ্মীরের স্বশাসনের অধিকার। ভেঙ্গে দেওয়া হল জম্মু ও কাশ্মীরকে। তৈরি হল দুটি পৃথক কেন্দ্রশাসিত রাজ্য।
বৃহত্তম গণতন্ত্র বোধহয় একেই বলে। এই কি শেষ তবে? কাশ্মীরের স্বতন্ত্রতা ও স্বাধীনতার উপর শেষ পেরেকটা বোধহয় বাকি ছিল। ৩১ মার্চ, ২০২০ জারি হল কাশ্মীরে স্থায়ি বাসিন্দা হিসাবে স্বীকৃতির শংসাপত্র পাওয়ার অধিকারের নতুন আইন। কাশ্মীরে এই নতুন ডোমিসাইল নীতি কাশ্মীরীদের অধিকার হরণের বৃত্তকে সম্পূর্ণ করল। শুরু হল কাশ্মীরের জনমানচিত্র বদলে ফেলার পদক্ষেপ।
সালটা ২০১৯, ইলেকশনের প্রচারেও কাশ্মীরের গলায় ছুরি বসানোর কসুর করেননি মোদীজি। এবং সেই প্রচারের সময় দেওয়া কথা অনুযায়ীই আগস্টে তুলে দিয়েছিলেন ৩৭০ ধারা। কিন্তু তবু গলার কাঁটা থেকেই যাচ্ছিল, করণ কাশ্মীর মুসলিম প্রধান রাজ্যই থেকে যাচ্ছে। ৩৭০ এবং ৩৫(ক)-এর বিলুপ্তির পরও কাশ্মীরির সংখ্যাগুরু তো মুসলমানই থেকৃ যাচ্ছে! কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছিল সাম্প্রদায়িক মোদী সরকার এবং তার পৃষ্ঠপোষক আরএসএস-এর। এতটা সময় হয়ত লাগতও না এই অর্ডার আনতে। কিন্তু দেশজোড়া শয়ে শয়ে শাহিনবাগ; এনআরসি, এনপিআর, সিএএ-এর বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন রাজপথের জনপ্লাবন – বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেই পথে। আশীর্বাদস্বরূপ এল করোনা ভাইরাস। সবার গৃহবন্দি হওয়ার সুযোগ নিয়ে চুপিসাড়ে ৩১ মার্চ কাশ্মীরের কফিনে শেষ পেরেক পোঁতার কাজটা শেষ হল, যে অর্ডার কাশ্মীরের উপর চাপিয়ে দেবে কেন্দ্রীয় নিয়মনীতি। কারণ করোনার সুবাদে প্রতিবাদ তো দূর কেউ বাইরে বেরোলেও তাঁকে সামলানোর জন্যে সরকারি লেঠেল বাহিনী তো আছে।
কী আছে এই অর্ডারে? এই অর্ডার অনুযায়ী শুধুমাত্র জম্মু ও কাশ্মীরের স্থায়ী বাসিন্দারাই নয়, এখন থেকে যারা ১৫ বছর কাশ্মীরে থেকেছেন বা ৭বছর বা তার বেশি সময় ধরে কাশ্মীরে থেকে পড়াশোনা করেছেন বা দশম বা দ্বাদশ শ্রেণী পাশ করেছেন বা কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্ত রকম কর্মচারি যারা ১০ বছরের বেশি সময় ধরে জম্মু ও কাশ্মীরে সার্ভিস দিচ্ছেন, এমনকি তাদের সমস্ত সন্তানসন্ততিরাও বা যে সমস্ত অভিবাসীদের নাম জম্মু ও কাশ্মীরের কমিশনারের কাছে রিলিফ ও পুনর্বাসনের জন্যে নথিভুক্ত আছেন – এরা সবাই কাশ্মীরের বাসিন্দা শংসাপত্র পেতে পারেন।
আপাতভাবে দেখতে গেলে একটু দেশপ্রেম দেশপ্রেম ভাব জাগতে পারে কিন্তু এই অর্ডারের ফল হবে বিধ্বংসী। কারণ এই অর্ডারের ফলে বাইরের বহু ব্যক্তি এখন জম্মু কাশ্মীরের জমির মালিক হতে পারেন এবং স্থায়ী বাসিন্দার মতো থাকতে ও সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে পারবেন। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকবে কাশ্মীরের জনসংখ্যা। এবং ধীরে ধীরে সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে কাশ্মীরিরা তথা কাশ্মীরের ভূমিসন্তানেরা। ফলত কাশ্মীরীদের মতামতও হয়ে পড়বে সংখ্যালঘুর মতো যা বাধ্য করবে গণভোটের ফলকে কাশ্মীরের বাইরের ভারতেরই পক্ষে যেতে। কাশ্মীর আর কাশ্মীরীদের থাকবে না। সমস্ত কর্পোরেট তথা ইন্ডিয়ান কোম্পানিগুলি লোলুপের মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে ভূস্বর্গের জল জঙ্গল জমিনকে কব্জা করতে। নাহ এখানেই শেষ নয়। কাশ্মীরের ক্ষেত্রে ন্যুনতম গ্রেড ফোর অব্দি সরকারি চাকরি সংরক্ষিত ছিল কাশ্মীরীদের জন্যে। সেটুকুও ছিনিয়ে নেবে এই অর্ডার। এবং মজার বিষয় হল এতকিছু সত্ত্বেও টুঁ-শব্দটি করতে পারবেন না কাশ্মীরীরা। কারণ সরকারিভাবেই দেওয়া হয়েছে হুমকি যে এই অর্ডারের বিরোধিতা করার ফল ভালো হবে না।
আশ্চর্যজনকভাবে হিমাচল প্রদেশ বা নাগাল্যান্ডেও কিন্তু জমি কেনার অধিকারে আরোপ রয়েছে ঠিক যেমনটা কাশ্মীরে ছিল। ওই রাজ্যগুলিতে কিন্তু রক্তচক্ষুর প্রশ্ন আসে না কখনই। হিমাচলপ্রদেশে রয়েছে বিজেপি সরকার আর নাগাল্যান্ডের সরকার বিজেপি সমর্থিত। সুতরাং কাশ্মীরের ক্ষেত্রে মুসলিম-বিদ্বেষজনিত বর্বরতাই চক্ষুশূলের কারণ নয় কি?
এই অর্ডার কাশ্মীরের পক্ষে এতটাই অবমাননাকর যে খোদ বিজেপিধন্য ‘জম্মু ও কাশ্মীর আপনি পার্টির’ সভাপতি আলতাফ বুখারিও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে ৩১ অক্টোবর ২০১৯-এর পর কাশ্মীরীরা স্বাধিকার ও চাকরি সংক্রান্ত প্রশ্নে যেটুকু আশ্বাস মোদি সরকারের উপর রেখেছিল তাও গলা টিপে হত্যা করা হল এই ডোমিসাইল অর্ডারের মাধ্যমে। গত ১৫ই মার্চ কাশ্মীরের সমস্ত রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহের সঙ্গে দেখা করতে যান। কিন্তু তাঁদের জানানো হয় যে, জম্মু ও কাশ্মীরের বাসিন্দাদের অধিকার রক্ষার্থেই নাকি এই সব করা হয়েছে। সুতরাং, জোর করে কাশ্মীরের জনমানচিত্র বদলে দিয়ে সেটেলার কলোনি বানানো এবং আত্মনির্ধারণের অধিকার কেড়ে নিয়ে একপ্রকার ডিটেনশনে পাঠানো – সবটাই করা হচ্ছে ভীষণ পরিকল্পিতভাবে যা সরাসরি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের বিরোধী। সমস্ত আন্তর্জাতিক স্তরে এ নিয়ে এখনই আওয়াজ ওঠা জরুরি। আওয়াজ উঠুক মানবতার পক্ষে, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের পক্ষে।
দেশব্যাপী নিরন্ন অসহায় মানুষের সঙ্কটের মুখে সরকারের ইচ্ছাকৃত মৌনতা, নিশ্চেষ্টতার বিরুদ্ধে দেশব্যাপী প্রতিবাদের ডাক দেওয়া হয় সিপিআই(এম এল) এর পক্ষ থেকে। একটি খোলা আহ্বানে জানানো হয় –
“প্রায় তিন সপ্তাহ হয়ে গেল সারা দেশ সম্পূর্ণ লকডাউনে আছে। বেঁচে থাকার জন্য আমরা যারা দিনমজুরি করি, লকডাউনে তাদের উপার্জনও লকড হয়ে গেছে। দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে খাবার বা অন্যান্য অপরিহার্য্য দ্রব্য খরিদ করার সামর্থ্য আর নাই আমাদের।
সঞ্চয় যা ছিল তা শেষ। আমাদের খাবার থালা শূন্য এবার। কে তা পূর্ণ করবে? আমাদের ছেলেমেয়েরা না খেয়ে ঘুমোতে যাচ্ছে, কে তাদের খাওয়াবে?
লকডাউনের নামে এই ক্ষুধার সাম্রাজ্য আমরা মেনে নেব না। ঘাম ঝড়িয়ে আমরাই যে খাদ্য শস্য উৎপন্ন করেছিলাম তা দেশের খাদ্য ভাণ্ডারগুলিতে মজুদ আছে। এখন সেই খাদ্য দেশের মানুষের মাঝে বিতরণ কর।
ট্যাক্স আর ফি হিসেবে আমরা যে অর্থ দিই তা দিয়েই তো তোমরা ভর্তি কর রাজকোষ। আর তোমরা রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে টাকা সরাও। এখন আমাদের মজুরি আর ভাতা মেটাতে রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে খরচ কর। সবার জন্য খাবার, সবার জন্য রেশন, সবার মজুরি আর সবার সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত কর।
আমাদের বললে থালা ঘটি বাটি বাজাতে, আমাদের ঘটিবাটি তো এখন চাটি হয়ে গেল। তুমি খুব মন-কি বাত শোনালে, এখন একটু আমাদের ক্ষুধা কাতরতা শোনো। আমাদের খালি ঘটিবাটি, খালি পেট ভরে দাও। আমাদের ভুখা পেটে অন্ন দাও। আমাদের রেশন দাও। আমাদের মজুরি আর ভাতা দাও।
ক্ষুধার্ত ভারত কোভিড-১৯ মোকাবিলা করবে কীভাবে? বুভুক্ষু মানুষের মুখে অন্ন তুলে দাও, অনাহার আটকাও, তবে না হবে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই !
আসুন, ১২ এপ্রিল আমরা আমাদের শূন্য থালাবাটি বাজাই যাতে এই বধির মোদী সরকারের কানে কথাগুলি পৌঁছায়। আমরা লড়ব, আমরা জিতব।”
বিভিন্ন জায়গায় এই বিক্ষোভ কর্মসূচী পালনের যে রিপোর্ট ও ছবি এসে পৌঁছেছে তার কয়েকটি এখানে রইলো –
১) দার্জিলিং জেলার রিপোর্ট – খালি পেটে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করা যায় না, যাবে না। খালি পেটে ভাতের দাবিতে, সকলের জন্য রেশন এবং মজুরির দাবিতে বধির সরকারের কানে সম্মিলিত আওয়াজ পৌঁছে দিতে দেশের অন্যান্য জায়গার সাথে সাথে দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ির শক্তিগড় সন্নিহত জলপাইমোড়, রাঙাপাণির বরপথু এবং ডাবগ্রাম ফুলবাড়ির অন্তর্গত ফকদই বাড়ির নীচপাড়া অঞ্চলে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক, পরিচারিকা, ক্ষেতমজুর সহ দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষেরা কোথাও খালি থালা বাজিয়ে, কোথাও শ্লোগান দিয়ে, বক্তব্যের মাধ্যমে নিজেদের অধিকারের পক্ষে সরব হয়েছেন। মানুষের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণে কমরেডরা চেষ্টা করলেও কোথাও কোথাও সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখা সম্ভব হয়নি। কিন্তু এই স্বতস্ফূর্ততা মানুষের বিপন্নতাকেই প্রকট করেছে। তাদের সোচ্চর দাবি শুনে প্রয়োজনে রাস্তায় বেরোনো মানুষদের দাঁড়িয়ে থাকতেও দেখা যায়।
জেলার তিন জায়গার কর্মসূচীতে নেতৃত্ব দেন পুলক গাঙ্গুলী, অপু চতুর্বদী, পবিত্র সিংহ, মীরা চতুর্বদী, শাশ্বতী সেনগুপ্ত, রুবী সেনগুপ্ত, রজত বর্মণ, শরত সিংহ, নেমু সিংহ, শিখা সিংহ, কৃষ্ণপদ সিংহ, দীনবন্ধু, গোপাল সরকার, গঙ্গা রায়, নীলিমা সরকার, কল্পনা সরকার, সুভাষ মন্ডল পঞ্চা বর্মণ, রেনু দাস, ভাগ্য মন্ডল প্রমুখ।
- শাশ্বতী সেনগুপ্ত
২) উত্তর ২৪ পরগণার রিপোর্ট - ক্ষুধার বিরুদ্ধে, খাদ্য-মজুরি-ভাতার দাবিতে বিক্ষোভ আন্দোলনে উঃ ২৪ পরগণা জেলার বিভিন্ন প্রান্তে আদিবাসী, ক্ষেতমজুর, অসংগঠিত ও সংগঠিত শ্রমিক, শহুরে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষ রাস্তায় নামেন।
অশোকনগরে জনবহুল গোলবাজের সুসজ্জিত দাবি সনদ নিয়ে কর্মীরা উপস্থিত মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন । পার্টি নেতা কম, অজয় বসাক সংক্ষিপ্ত ভাষণে দাবিগুলো তুলে ধরে বলেন – দেশজুড়ে দ্বিতীয় পর্যায় লকডাউন হতে চলেছে। ৯০ কোটি শ্রমজীবী মানুষ বিপন্ন। অনাহারের পথে। কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষিত বিশেষ রেশন ২০ দিন অতিক্রান্ত। আজও এল না । সরকারি শস্যভান্ডার প্রয়োজনের অতিরিক্ত সাড়ে ৩ গুণ খাদ্য মজুত। অথচ যে কৃষক-ক্ষেতমজুর এই ফসল তুলে গুদামে ভরেছে তারাই অনাহারে। তাই ভুখা পেটে লকডাউন হতে পারে না। হয় করোনা নয় অনাহার, মানুষের মৃত্যু অনিবার্য। এর বিরুদ্ধে সকলে সোচ্চার হোন ।
বিকাল ৫টায় অশোকনগর শ্রীকৃষ্ণপুর অঞ্চলের আদিবাসী, ক্ষেত মজুররা থালা বাজিয়ে ঐ দাবিতে সোচ্চার হন।
গণশিল্পী অনুপ মজুমদার ও মেঘনা মজুমদার এই সময়ের অনবদ্য সঙ্গীত গেয়ে সংহতি জানান।
জেলার নৈহাটি থানার শিবদাসপুর অঞ্চলের আদিবাসী ক্ষেতমজুররা তাড়িখানা মোড়ে জমায়েত হয়ে খাদ্য, ভাতার দাবিতে থালা বাজিয়ে সোচ্চার হন। নৈহাটি শহরের নৈহাটি জুট মিলের শ্রমিকরাও একই দাবিতে থালা বাজিয়ে পোস্টার-পতাকা সহ শ্রমিক মহল্লায় প্রতিবাদী কর্মসূচী পালন করেন। বারাসাতের কর্মীরা জেলাপরিষদ ভবনের সামনে খাদ্য, ভাতা, মজুরির দাবিতে পোস্টারে শ্লোগানে সোচ্চার হন। হালিশহর সাংস্কৃতিক সংস্থা, নির্মাণ ও রেল শ্রমিক সংগঠকরা আজ সকালে ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে খাবার পৌঁছিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি এই প্রতিবাদী কর্মসূচী পালন করেন। নৈহাটি অগ্নিবীণার সাংস্কৃতিক সংস্থা আইসার ছাত্র বন্ধুদের সহযোগিতায় ক্ষুধার বিরুদ্ধে আজকের এই কর্মসূচিকে সফল করার আহ্বান জানিয়ে এক আকর্ষনীয় গানের ভিডিও প্রকাশ করে।
◾ ধনিয়াখালি ব্লকের কনুইবাঁকা ও জয়হরিপুর পার্টি, সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতি ও আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত রেশনের দাবিতে ভুখা পেটে গ্রামের মেহনতি মানুষদের থালা বাজানো কর্মসূচি সংগঠিত হয়।
◾ পোলবা-দাদপুর ব্লকের বরুনানপাড়া গ্রাম, বিডিও অফিস মোড় ও রামনগর মোড়ে ভুখা পেটে খাদ্য, আর্থিক সহায়তা ও রেশনের দাবিতে পার্টি, আদিবাসী মঞ্চ ও আয়ারলার নেতৃত্বে আদিবাসী সমাজ ও ক্ষেতমজুর জনতার শূণ্য থালা ও প্ল্যাকার্ড, লাল ঝাণ্ডা সহ বিক্ষোভ দেখান।
◾ বলাগড় ব্লকের ইছাপুর বেলেডাঙ্গা মোড়ে সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতির পক্ষ থেকে খাদ্যের দাবিতে ক্ষেতখামারে প্রতিবাদে নামেন আদিবাসী জনতা।
শহরাঞ্চল
◾ চুঁচুড়ায় রেশন অফিসের সামনে শ্রমিক সহ সমস্ত গরিব মানুষদের ভুখা পেটে খাদ্য, রেশন, ভাতা ও মজুরির দাবিতে অবস্থান কর্মসূচী হয়।
◾ লকডাউনে নির্মাণ সহ অসংগঠিত শ্রমিকদের মজুরি, খাদ্য, রেশনের দাবিতে কোন্নগর ও উত্তরপাড়া-কোতরং পৌর এলাকার সংযোগস্থলে অরবিন্দ পল্লীতে পার্টির উত্তরপাড়া-রিষড়া এরিয়া কমিটি ও AICCTU উত্তরপাড়া থানা এলাকা কমিটির উদ্যোগে অবস্থান কর্মসূচী হয়।
গোটা জেলা জুড়েই সবকটি কর্মসূচী লকডাউনের শারীরিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি বজায় রেখেই সংগঠিত হয়।
৪) পূর্ব বর্ধমান জেলার রিপোর্ট –
কালনা ২নং ব্লক এর অকালপোষ অঞ্চলের আগ্রাদহে সিপিআই(এম-এল)লিবারেশন-এর কালনা লোকাল কমিটির পক্ষ থেকে ৫০-৬০ জনের বেশি গরিব আদিবাসীদের মহিলা পুরুষ ও অন্যান্য গ্রামীণ মেহনতি মানুষকে নিয়ে লকডাউন-এর নিয়ম মেনেই মিছিল অবস্থান সংগঠিত করা হয়। অবস্থান কর্মসূচীতে থালা বাসন বাজিয়ে খাদ্য রেশন ভাতা ৫০ কেজি খাদ্য শস্য তেল ডাল আলু অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ও ১০ হাজার টাকা অনুদান মাসিক প্রতিটি গরিব পরিবারের জন্য সরবরাহের দাবিতে বিক্ষোভ দেখান হয়। এই বিক্ষোভ কর্মসূচীর আগ এলাকায় পোষ্টার লাগানো হয়। খবর পেয়ে প্রশাসন কালনা থানার অফিসার ইনচার্জ বারবার সিপিআই(এম-এল) নেতাদের ফোন করে কর্মসূচীর রুপায়নে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। সিপিআই(এম-এল) নেতৃত্ব নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই কর্মসূচী সফল করেন। ঐদিনই চাল ডাল কালেকশন করে ২৫০-র মতো গরিব মানুষের মধ্যে রান্না খাবার বিতরণ করা হয় । সমস্ত কর্মসূচীর নেতৃত্বে ছিলেন লোকাল কমিটির সম্পাদক কমরেড রফিকুল ইসলাম ও জেলা কমিটির সদস্য কমরেড প্রদ্যুত ঘোষ। এলাকার মানুষের মধ্যে এই কর্মসূচীর ভালো প্রভাব পড়ে। বাকি কালেকশন করা চাল ডাল গরিব মানুষের মধ্যে ঘরে ঘরে বণ্টন করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
পুর্বস্থলী ২নং ব্লকের সিমলা গ্রামের গরিব কৃষিমজুরদের সংগঠিত করে অবস্থান বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়।বিক্ষোভ অবস্থানে বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এম-এল) লিবারেশন-এর পুর্বস্থলী-কাটোয়া এরিয়া কমিটির সম্পাদক কমরেড শিবু সাঁতরা। উপস্থিত থাকেন জেলা কমিটির সদস্য কমরেড সমীর বসাক ও লোকাল কমিটির সদস্য এবং ব্রাঞ্চ সম্পাদক কমরেড পার্থ মন্ডল ।
পুর্বস্থলী ১নং ব্লকের ইসলামপুর গ্রামে সিপিআই(এম-এল) লিবারেশন-এর জেলা কমিটির সদস্য কমরেড জিয়াদুল সেখের নেতৃত্বে বিক্ষোভ অবস্থান সংগঠিত করা হয়। থালা বাজিয়ে শ্লোগানের মাধ্যমে বিক্ষোভ প্রদর্শন সম্পন্ন করা হয় ।
মেমারী ২নং ব্লকে লোকাল কমিটির সম্পাদক মনসুর মন্ডলের নেতৃত্বে তিনটি গ্রামে পোস্টার লাগানো হয়।
মন্তেশ্বর ব্লকের কুলুট গ্রামে সিপিআই(এম-এল) লিবারেশন-এর রাজ্য কমিটির সদস্য কমরেড আনসারুল আমান মন্ডলের নেতৃত্বে থালা বাজিয়ে ও শ্লোগান-এর মাধ্যমে গরিব মজুরদের উপস্থিতিতে বিক্ষোভ সংগঠিত হয়। পরে এলাকার গরিব মানুষের মধ্যে চাল ডাল আলু সংগ্রহ করে বিলি করা হয়।
(সজল পাল)
৫) নদীয়া জেলার রিপোর্ট –
নদীয়া জেলার কালীগঞ্জে গহরাপোতা গ্রামের গরিব মানুষরা গ্রামের মধ্যে একটা যায়গায় জড়ো হন এবং থালা হাতে নিয়ে প্রতিবাদ সংগঠিত করেন। সমস্ত গরিব মানুষকে রেশন দিতে হবে, মাসিক ৫০ কেজি খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ করতে হবে -- প্রভৃতি স্লোগান তোলা হয়। পার্টি কর্মীরা আওয়াজ তোলেন, লকডাউনে গরিব মানুষের যখন কাজ নেই তখন প্রতিটি জবকার্ডে ১০ হাজার টাকা করে দিতে হবে। আমাদের পার্টি যে এই সমস্ত দাবিগুলিকে তুলে ধরে সারা দেশ জুড়ে প্রতিবাদ সংগঠিত করছে এই বার্তা গোটা গ্রামে প্রচারিত হয় এবং তা ব্যাপক মানুষের সমর্থন পায়।
১২ এপ্রিল ছিলো কমরেড জালালের শহীদ দিবস। তাই ঐ দিন খাদ্যের দাবিতে প্রতিবাদ দিবস উদযাপন একটা ভিন্ন মাত্রা এনে দেয়। ঐদিন বিকাল ৪টায় নাকাশীপাড়া ব্লকের গাছা বাজারে অবস্থিত কমরেড জালালের শহীদবেদীর সামনে গাছা গ্রামের পার্টি কর্মীরা সমাবেশিত হন। উপস্থিত ছিলেন জেলা সম্পাদক সুবিমল সেনগুপ্ত, জেলা সদস্য কাজল দত্তগুপ্ত, যুব সংগঠক অমিত মন্ডল, মুড়াগাছা লোকাল কমিটির সম্পাদক হবিবুর রহমান প্রমুখ। কমরেড জালাল সহ কৃষক প্রতিরোধ সংগ্রামের সমস্ত শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়, তারপর শহীদ বেদীতে মাল্যদান করে নীরবতা পালন করা হয়। স্লোগান ওঠে সমস্ত গরিব মানুষকে রেশন দাও,খাদ্য দাও। দেশজুড়ে খাদ্যের দাবিতে সিপিআই(এমএল) লড়ছে লড়বে ইত্যাদি। গাছা বাজারে জাতীয় সড়কের পার্শ্ববর্তী স্হানে অনুষ্ঠিত এই কর্মসূচী এলাকার ব্যপক মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আজকের লকডাউনের সময়কালে গরীব মানুষের রুজি রুটির লড়াইকে সংগঠিত করার মধ্য দিয়ে শহীদ কমরেড জালালের স্বপ্নকে সফল করার পথে এগিয়ে যাওয়ার শপথ উপস্থিত পার্টি কর্মীরা গ্রহণ করেন।
- জয়তু দেশমুখ।
৬) কোলকাতা জেলার রিপোর্ট -- সমস্ত ভুখা পেটে খাদ্য, সব হাতে বেতন, মজুরি, ভাতা, নিত্যপ্রয়োজনীয় রেশনের দাবিতে ১২ এপ্রিল সারা দেশের মতো কলকাতাতেও বিক্ষোভ কর্মসূচী নেওয়া হয়। যাদবপুরের পালবাজারে এবং যাদবপুর ঢাকুরিয়া আঞ্চলিক পার্টি অফিসে পোস্টার প্ল্যাকার্ড নিয়ে স্বাস্থ্য বিধি বজায় রেখে প্রতিবাদ সংগঠিত হয়।
বেহালার কালিতলায় সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের উদ্যোগে রাস্তায় গ্রাফিতি ও শ্লোগানের মাধ্যমে পরিযায়ী শ্রমিকদের খাদ্য সংকটের সমস্যা সমাধানের দাবি ও করোনার বিরুদ্ধে সচেনতা তুলে ধরা হয়। ১২ তারিখ সেইখানেই খাবার, রেশনের দাবিতে বিক্ষোভ কর্মসূচীতে সামিল হন স্থানীয় কমরেডরা।
-- মধুরিমা বক্সী
পাঠ্য বইয়ের বাইরে তেমন পড়িনি কিছুই দেখতে দেখতে এসে গেল ৬৬’র খাদ্য আন্দোলন। বামপন্থী আন্দোলনে বিশ্বাস তৈরি হল। সুকান্তের কবিতা পড়ি। পথের দাবি পড়া হয়েছে। ওই পর্যন্ত। তাতেই ‘যাহা আসে কই মুখে’। বাবা বললেন, “খুব তো বড় বড় কথা বল আর বিদ্যে ফলাও। হাসুবানু পড়েছ?” কথাটা মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল। কিন্ত এসে গেল নকশালবাড়ি। সামান্য যা পড়াশুনো তার পাট চুকিয়ে উত্তাল মহাজীবনের স্রোতে ভেসে গেলাম।
অনেক কাল কেটে গেছে। ইট পূজো-বাবরি মসজিদ পেরিয়ে ফ্যাসিবাদ এখন পূর্ণ রাজ্য পাটে। দেশ বিভাগের ক্ষতচিহ্ন উসকে সঙ্ঘ পরিবার প্রতিটি প্রশ্নের সঙ্গে জুড়ে দিচ্ছে মুসলিম বিদ্বেষ। এমনকি করোনা ভাইরাসের জন্যও কিনা মুসলমানরাই দায়ী! লকডাউনের সময় মনে পড়ে গেল হাসুবানুর কথা। প্রবোধ কুমার সান্যালের এই উপন্যাস তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার সে দেশে নিষিদ্ধ করে দেয়। পড়তেই হবে বইটি। কিন্ত পাব কোথায়? আমার ‘মুশকিল আসান’ নীলাশিস বইটির পিডিএফ ভার্সন পাঠিয়ে দিল। ৩৫০ পৃষ্ঠার বই, ২৫ বৈশাখ, ১৩৫৯ প্রথম প্রকাশ।
বইয়ের গল্পে কী এমন আছে যে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের শাসকদের তা মোটেই মনপসন্দ হয়নি? পড়ে দেখলাম, আগাগোড়া উপন্যাসটিতে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির জন্য লেখকের আর্তি। হাসুবানু (বলা বাহুল্য উপন্যাসের মূল চরিত্র) শৈশবেই মা-বাবাকে হারায় ও এক হিন্দু জমিদারের আশ্রয়ে বেড়ে ওঠে। হাসনুর বাবা জমিদারের বিশ্বস্ত কর্মচারি ছিলেন আর সে বিশ্বাসের দাম চোকাতে জমিদার কোনো কার্পণ্য করেননি। নিজের বাড়িতে হাসনুকে রেখেছেন, নিজের মেয়ের সঙ্গেই সমান আদর ও যত্নে তার লেখা-পড়ার ব্যবস্থা করেছেন। ইংরেজি, উর্দু, সংস্কৃত-এ সবকটি ভাষাই হাসনুর আয়ত্তে। মনে প্রাণে সে ধর্মনিরপেক্ষ। ইসলাম ধর্মের রীতি মেনে তার দু-দু’বার বিয়ে হয়।কিন্ত কোনো বারই তার ‘ঘর বাঁধা’ হয়ে ওঠেনি। মুসলিম সমাজে পুরুষদের আধিপত্য ও নারীদের অবমাননা হাসুবানু মানতে চায়নি। কিন্ত সে শুধু মুসলিমদের পুরুষতান্ত্রিকতার বিরোধী এমন নয়, সে সামগ্রিকভাবেই পুরুষতন্ত্রের বিরোধী। দাঙ্গা, গৃহদাহের মধ্যদিয়ে দেশ ভাগ হয়ে গেল। বহু পথ পেরিয়ে হাসুবানু ভারতেও এসেছে। ছোটবেলার এক হিন্দু বন্ধুর সঙ্গে তার আবার দেখা হয়েছে। দুজনে একত্রে বেরিয়েছে – একে অপরের কমরেড হয়ে। কিন্ত ভারত (অর্থাৎ বৃহত্তর হিন্দু সমাজ) তাকে সন্দেহের চোখে দেখেছে। সে তার কমরেডকে নিয়ে ফিরে গেছে পূর্ব পাকিস্তানে। কিন্তু পাকিস্তান তাকে ভারতের গুপ্তচর সন্দেহে বন্দি (অন্তরীণ) করেছে এবং অত্যাচারে উন্মাদ হয়ে তার মৃত্যু ঘটেছে। এই কাহিনী থেকে তদানীন্তন পাকিস্তানের শাসকদের উষ্মার কারণ বোঝা যায়। কিন্ত এখন বিজেপি যদি পশ্চিমবাংলায় ক্ষমতায় আসে তাহলে এবার হয়ত হাসুবানু এপাড় বাংলাতেই নিষিদ্ধ হবে। কেন না প্রবোধবাবু বইটি উৎসর্গ করেছেন জনাব লিয়াকৎ হোসেন ও জনাব সোফিয়ার রহমানকে – প্রথমজন এক ধর্মনিরপেক্ষ, দেশবৎসল ব্যক্তি, দ্বিতীয়জন এক তরুণ আইনজীবী।
বইটি দেশভাগের কোনো ঐতিহাসিক দলিল নয়। অমিতাভ ঘোষের ‘হাঙ্গরি টাইডের’ মতো গল্পের ভাঁজে ভাঁজে তথ্য ও ইতিহাসের বিশেষ বিশেষ দলিলও যুক্ত হয়নি। কিন্ত হাসুবানুর জবানিতে দেশভাগের বিয়োগব্যথা বড় আবেগের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে – যেখানে দুই বাংলার সাধারণ জনগণের দুর্দশার ছবি চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঝরে পড়েছে। হাসনু অবিভক্ত বৃহত্তর ভারতের মানচিত্র আঁকেনি। সে চেয়েছে দুই বাংলার পুনর্মিলন – যেখানে ‘আমিনা, ফকিরুদ্দিন, ওই হাবু মোড়ল আর দাশু সেখদের’ মানুষের মতো মানুষ করে তোলা হবে। সে স্বপ্ন দেখেছে : বিরাট পুরুষকে চাই, পার সঙ্গে চাই বিরাটতর আইডিয়া। জীবনমৃত্যুর বিভীষিকার ভিতর দিয়ে আসবে সংহতি, যাকে বলে সিন্থেসিস। হাসুবানু ভাবালুতাকে পেরিয়ে শক্ত জমিতে পা রাখতে পারেনি। কী জানি, আজকের হাসনু ও হিরণরা (হাসনুর কমরেড) তা পারবে কিনা!
মিতালী বিশ্বাস
রাজা তোমার কথায়
করোনা তাড়াতে
যে থালা বাজিয়েছি
সেই থালা আজ ভাত চায়
ভাইরাস পোড়াতে যে মোমবাতি জ্বালিয়েছি
সেই আগুন আজ পেটের ভিতর জ্বলে।
কাজ নেই, মজুরি নেই, রেশন নেই
খাবো কি, মোমবাতি আর থালা?
হে মহামান্য রাজা!
আমরা সেই প্রান্তজন,
পাথরচাপা কপালের দল
দেশের উন্নতি হয় আমাদেরই পরিশ্রমে
আর আমরাই হাঁটি ভুখাপেটে
আমাদের সন্তানেরা-
খিদেয় খায় ঘাস
আমাদের মৃত শরীর ছোঁয়াও পাপ
তাই অ্যাম্বুলেন্সের অভাবে চড়া রোদে
মৃত সন্তান কোলে হেঁটে যায় মা
যক্ষায় মৃত পিতার লাশ কাঁধে ছোটে
তাঁর চার কিশোরী মেয়ে
তুমি রাজা ঠান্ডা ঘরে শুধু বলো
লকডাউন লকডাউন লকডাউন
আমাদের জীবনটাই যে লকড
তার হিসেব রাখো কি?
জাপানের বিখ্যাত কথাকার হারুকি মুরাকামির উপন্যাস লেখার শুরুটা খানিকটা আকস্মিকভাবেই হয়েছিল। মুরাকামি নিজেই জানিয়েছেন তাঁর প্রথম উপন্যাস হিয়ার দ্য উইন্ড সিং (শোনো বাতাসের সুর) লিখতে শুরু করার আগে অবধি তিনি সেভাবে লেখালেখি করেনইনি। তখন তিনি জাপানে একটি জ্যাজ ক্যাফে চালিয়ে দিন গুজরান করেন। ১৯৭৮ সালের ১ এপ্রিল একটি বেসবল খেলা দেখতে দেখতে এই উপন্যাসটির ভাবনা হঠাৎ করেই তাঁর মাথায় আসে। কাজ সেরে বাড়ি ফিরে তিনি রোজ একঘণ্টা করে লিখতে থাকেন এবং চারমাস ধরে একটানা লিখে এই উপন্যাসটি শেষ করেন। উপন্যাসটি আকারে তেমন বড় নয়। চল্লিশটা ছোট ছোট অনুচ্ছেদ মিলিয়ে ১৩০ পাতার একটা পকেট বই। ১৯৭৯ সালের জুন মাসে জাপানের বিখ্যাত সাহিত্য পত্রিকা গুনজোতে এটি প্রথম প্রকাশিত হয়। পরের মাসেই এটি বই হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
১৯৭০ সালের অগস্ট মাসের কয়েকটা দিনের কাহিনী রয়েছে এই উপন্যাসটিতে। কাহিনীর শুরু ১৯৭০ সালের ৮ অগস্ট, যখন অনামা কথক গ্রীষ্মাবকাশে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাড়ি ফিরেছে। উপন্যাসের সময়কাল আঠারো দিন। ২৯ অগস্টে গিয়ে কাহিনী শেষ হয়, যখন অনামা কথক গ্রীষ্মাবকাশ শেষে আবার ফিরে যাচ্ছে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে। কাহিনী বলতে অবশ্য একটানা কোনও আখ্যান নয়। ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু স্মৃতিকথা, কিছু অনুভূতি, কিছু পর্যবেক্ষণ। উপন্যাসের কথকের কোনও নাম নেই এখানে। তার সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানাও যায় না। গরমের ছুটির অবকাশে সে কয়েকদিনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরেছে তার বাড়িতে। সেখানে ফিরে এক স্থানীয় পাবে যায় সে, মদ খেয়েই কাটিয়ে দেয় বেশিরভাগ সময়টা। অনামা কথকের বয়স মুরাকামির নিজের বয়সের সমান। ১৯৪৮ এর ২৪ ডিসেম্বর এই অনামা কথকের জন্ম আর মুরাকামির নিজের জন্মদিন ১২ জানুয়ারী ১৯৪৯ এ। উপন্যাসটিতে একটি বারে বসে এই অনামা নায়ক কেন অঢেল মদ্যপান করে, তার কোনও স্পষ্ট কারণ জানা যায় না। কদিন আগেই যার তৃতীয় প্রেমিকা হঠাৎই গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু এজন্যই তার পানাসক্ত হয়ে পড়া না এ তার বহুদিনের স্বাভাবিক অভ্যাস, এর কোনও ইঙ্গিত উপন্যাসে নেই। কথক যদিও জানিয়েছে গরমের হাত থেকে বাঁচার জন্যই তাদের এই মাত্রাতিরিক্ত বিয়ার পান – “গ্রীষ্মের এই গরমে আমরা যেন পাল্লা দিয়ে বিয়ার টানি। আমাদের খাওয়া বিয়ার দিয়ে ২৫ মিটারের সুইমিংপুল অনায়াসে ভরে ফেলা যায়। আর বাদামের খোসায় জে-এর বারের মেঝে পাঁচ সেন্টিমিটার পর্যন্ত পুরো হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু এটা যদি না করি, তাহলে গরমের অসহ্য যাতনা থেকে রেহাই পাওয়ার আর কোনো উপায় থাকে না”। তবে এ নিজের রক্তাক্ত হৃদয়কে নিরাসক্তি দিয়ে ঢেকে রাখার চেষ্টাও হতে পারে। আমরা জানতে পারি কথকের শুধু এই তৃতীয় প্রেমটিই নয়, অনামা কথকের আগের দুটি প্রেমও হঠাৎ করেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। প্রথম প্রেম ছিল হাইস্কুলের এক সহপাঠিনীর সাথে। স্কুল শেষ হবার কয়েক মাসের মধ্যেই তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। মেয়েটি কোথায় হারিয়ে যায়, তার আর সন্ধান পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয় প্রেম স্টেশনে হঠাৎ আলাপ হওয়া একটি মেয়ের সাথে। ছাত্র আন্দোলনে ফেরার পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সে কথকের ঘরে চলে আসে ও সেখানেই হপ্তাখানেক থেকে যায়। তারপর সেখান থেকে সে চলে যায় ও তাদের সম্পর্কের সেখানেই ইতি। তারপর এই তৃতীয় প্রেম, যার শুরুটা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে তাদের পরিচয়ের মধ্যে দিয়ে। মেয়েটি ফরাসী ভাষা নিয়ে তখন পড়াশুনো করছে। পরের বসন্তেই হঠাৎ এই শোচনীয় পরিণতি, যে আত্মহত্যার কারণ কথক শুধু জানে না তাই নয়, অনুমানও করতে পারে না। কথক বাইরে থেকে নিজেকে নিরাসক্ত দেখানোর চেষ্টা করে, না সে সত্যিই নিরাসক্ত সে ধাঁধার উন্মোচন মুরাকামি এখানে করেননি। পাঠক নিজের মতো করে এই নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী।
কথকের মদ্যপানের সঙ্গী র্যাট বলে একজন। সে তিনতলা এক বাড়িতে থাকে, বেশ বড়লোক বাবার ছেলে। তা সত্ত্বেও সে বড়লোকদের কোনও এক কারণে তীব্র অপছন্দ করে, তাদের নিয়মিত গালাগালি করে থাকে। – “বড়লোকদের প্রতি র্যাটের মুখ খারাপ করা এটাই প্রথম নয়। আগেও বহুবার করেছে। তাতেই বোঝা যায়, আসলেই সে বড়লোকদের ঘৃণা করে। অথচ তার নিজের পরিবার মোটামুটি বড়লোকই। আমি তাকে তা স্মরণ করিয়ে দিলে জবাবও তার, ‘এ জন্য তো আমি দায়ী নই।” র্যাট ছাড়াও বারটেন্ডার জে’র সাথে অনামা কথকের মাঝেমাঝে কিছু কথাবার্তা হয় ও ক্রেতা খরিদ্দার সম্পর্কের বাইরে একটা হালকা বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। সে নিজে চিনা, কিন্তু তাদের থেকেও ভালো জাপানিজ বলে।
এই বারেই একদিন বাথরুমের কাছে একটি মেয়েকে অচেতন হয়ে পড়ে থাকতে দেখে কথক। বারের সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করেও তার কোনও পরিচয় পাওয়া যায় না। ব্যাগ থেকে পাওয়া ঠিকানার ভিত্তিতে তাকে তার ঘরে পৌঁছে দেয় কথক ও সেখানেই রাতটা থেকে যায়, যতক্ষণ না মেয়েটি সুস্থ হয়ে ওঠে। এই মেয়েটিরও কোনও নাম নেই আখ্যানে, তাকে আমরা চিনি বাঁ হাতের কড়ে আঙুলটি নেই যার, এমন এক পরিচয়ে। এই মেয়েটির সাথে পরে কথকের আবার দেখা হয় তার কাজের জায়গায়, একটি রেকর্ডের দোকানে। এরপর আবার যখন মেয়েটি তার ঘরে আসে তখন সে জানায় সে এখন যৌন সংগমে অক্ষম, কারণ সদ্য তাকে গর্ভপাত করাতে হয়েছে।
লেখালেখি সম্পর্কে এই অনামা কথক উপন্যাসের এখানে সেখানে তার বেশ কিছু ভাবনা চিন্তার কথা জানিয়েছে। “গল্প লেখা স্বচিকিৎসার কোনো ব্যাপার না। বরং বলা ভালো, তা স্বচিকিৎসার হীন চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে স্বীকার করতেই হবে যে, সততার সঙ্গে কোনো কাহিনী বলা খুবই কষ্টকর। কেননা আমি যেসব শব্দ খুঁজে বেড়াই, তা মনে হয় গহীন গভীরে গিয়ে লুকায়। এটা একেবারেই সত্যনিষ্ঠ স্বীকারোক্তি, কোনো কৈফিয়ত নয়। তবে শেষ পর্যন্ত আমি যা লিখেছি, তা-ই সেরা, এর চেয়ে ভালো লেখা আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়। এছাড়া এব্যাপারে আমার আর কিছু বলার নেই। এখনো আমি ভাবছি, যেভাবে তুমি এখন দক্ষ, বছরের পর বছর, কিংবা দশকের পর দশক আগে তুমি তা ছিলে। এভাবে চিন্তা করলেই তুমি তোমাকে বাঁচাতে পারো বলে আমার ধারণা। তবে তার পরও যখন তোমার কাজ হয়ে যাবে, তখন হাতি সমতলে ফিরে এসে তোমার চেয়ে আরো সুন্দর শব্দে তার নিজের কাহিনী বয়ান করতে সক্ষম হবে”। ... “লেখালেখি নিয়ে আরো কিছু লিখছি। তবে এটাই হবে আমার শেষ কথা। আমার কাছে লেখালেখি খুবই কষ্টকর একটা ব্যাপার। কখনো কখনো মাস কেটে যায়, একটা লাইনও লিখতে পারি না। আবার কখনো কখনো একটানা তিন দিন তিন রাত ধরে লেখার পর একসময় বুঝতে পারি, যা কিছু লিখছি তা কিছু হয়নি। এই সব কিছু সত্ত্বেও লেখালেখির মধ্যে আনন্দ আছে। জীবনযাপনের সমস্যাদির সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, লেখালেখির মধ্যে অর্থবহ কিছু খুঁজে পাওয়া খুবই সহজ। এটা যখন আমি বুঝতে পারি, তখন আমার বয়স খুব কম। তাই বিস্ময়ে সপ্তাহখানেক ধরে হতভম্ব হয়ে থাকি।”
কথকের বাবা মার কথা এখানে কিছু নেই। তবে তার তিন কাকার উল্লেখ আছে। একজন জাপান জুড়ে বিভিন্ন উষ্ণ প্রস্রবনে ঘুরে ঘুরে বেড়ান। একজন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার ঠিক দুদিন পরে নিজের পাতা মাইন বিস্ফোরণেই মারা যান। আর এক কাকা মারা যান ক্ষুদ্রান্তের ক্যান্সারে। এই কাকাই তাকে ডেরেক হার্টফিল্ড-এর উপন্যাসের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। এই কাল্পনিক ঔপন্যাসিককে একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে এই আখ্যানে নিয়ে আসেন মুরাকামি। এই কল্পিত লেখক চরিত্রটি অনেক জনপ্রিয় উপন্যাসের রচয়িতা। দৈত্য, দানো, ভিনগ্রহের প্রাণীদের নিয়ে কাহিনী ফাঁদতে তিনি ছিলেন ওস্তাদ। কথক জানিয়েছেন তিনি এনার থেকেই লেখার অনেক কলাকৌশল শিখেছিলেন। – “লেখালেখির ব্যাপারে ডেরেক হার্টফিল্ডের কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। অবশ্য বলা উচিত, পুরোটাই তাঁর কাছ থেকে শেখা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে হার্টফিল্ড নিজে একজন সাধারণ মানের লেখক ছিলেন। আপনি যদি তাঁর বই পড়ে থাকেন, তাহলে সহজেই বুঝতে পারবেন আমি কী বলতে চাচ্ছি। তাঁর লেখা পড়া খুব কষ্টসাধ্য। আর লেখার প্লট এলোমেলো, থিম একেবারেই শিশুসুলভ। এসব সত্ত্বেও যে কজন অসাধারণ লেখক তাঁদের লেখাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছেন, তাদের মধ্যে তিনি অনন্য। হেমিংওয়ে, ফিৎজারেন্ডের মতো তাঁর সময়কার অন্যান্য লেখকের সঙ্গে তুলনা করে দেখেছি যে তাঁর লেখালেখি তেমন সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়নি বলে আমার মনে হয়েছে”। ... “ভালো লেখালেখির ব্যাপারে হার্টফিল্ড যা বলেছেন, তা জড়ো করলে দাঁড়ায় এ রকম — ‘তিনি লেখক, যিনি সাহিত্য লেখেন। তাই বলা যায়, লেখকের লেখাই হবে মূলকথা। তিনি সব সময় দূরত্ব বজায় রাখবেন। আর তিনি কী বুঝলেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং তিনি কী মাপকাঠি ব্যবহার করেছেন, সেটাই বিবেচনার বিষয়”।
মজার ব্যাপার হল মুরাকামির উপন্যাসটি প্রকাশিত ও জনপ্রিয় হলে অনেক পাঠকই ডেরেক হার্টফিল্ডকে একজন বাস্তব লেখক হিসেবে ধরে নিয়ে বিভিন্ন গ্রন্থাগারে তাঁর বই এর খোঁজ করতে থাকেন ও গ্রন্থাগারিকেরা এই নিয়ে বেশ বিড়ম্বনায় পড়েন।