নির্দিষ্ট একটা হেডিং-এর ওপর ক্লিক করুন
(তখন বাকিগুলো দেখাবে না)
মে দিবস আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। ঊনবিংশ শতাব্দীতে দৈনিক কাজের সময়কে বেঁধে আট ঘণ্টা করার বড় লড়াই থেকে আসে দিনটার অনুপ্রেরণা। সে দাবি আজও প্রাসঙ্গিক। বিশেষ করে আমাদের ভারতবর্ষে যখন করোনা ভাইরাস লকডাউনের মধ্যে সরকার দৈনিক কাজের সময়কে আবার বাড়িয়ে ১২ ঘণ্টা করার তোড়জোড় করছে। আট ঘণ্টা কাজের সাথেই যুক্ত নিয়মিত কাজ ও সবেতন ছুটির প্রশ্ন। অথচ আমাদের দেশে কোটি কোটি শ্রমজীবি মানুষ আজও শ্রমিক হিসেবেই স্বীকৃত নন।
এ বছরের মে দিবস নিশ্চিতভাবেই সেইসব অত্যাবশ্যকীয় ক্ষেত্রের কর্মচারিদের কথা বলছে যাঁদের এই মহামারীজনিত লকডাউনের মধ্যেও ফুরসত নেই। বরং বলা ভাল যে এই সংকটের জন্যই তাঁদের কাজের বিরতি নেই। ডাক্তার, নার্স, প্যারামেডিক্যাল কর্মী, জনস্বাস্থ্য কর্মী, সাফাই কর্মী, পরিবহণ শ্রমিক, পুরুষ ও মহিলা পুলিশকর্মী- এঁদের সকলের জন্য এই সময়টা মাত্রাতিরিক্ত কাজের চাপ ও ঝুঁকি নিয়ে হাজির হয়েছে। প্রায়শই তাঁদেরকে ন্যূনতম সুরক্ষার সরঞ্জাম ছাড়াই এই সংক্রমণ বিপদের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। যদি এখনও তাঁদের কাজের প্রাথমিক সমস্যাগুলোর দিকে নজর দিয়ে সেগুলোর সমাধান না করা হয় তাহলে কেবল তালি বাজালে তাঁদের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেওয়াই হবে।
মে দিবস শ্রমিকদের শ্রমের মর্যাদা ও কর্মস্থলে নিরাপত্তার কথা বলে। প্রতিদিন নর্দমা পরিষ্কার করতে গিয়ে মারা পড়ছেন যে সাফাই কর্মী তাঁর আজও সম্মান ও নিরাপত্তা কোনোটাই নেই! শ্রমশক্তির একটা বড় অংশ প্রতিদিন কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা ও জাতপাতের নিপীড়ন সহ বিবিধ হয়রানি ও লাঞ্ছনার শিকার হয়েই চলেছেন। মে দিবস তাই আমাদের কাজের স্বীকৃতি, নিরাপদ কর্মস্থল, কাজের গণতান্ত্রিক ও মর্যাদাপূর্ণ পরিবেশের দাবিতে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার শপথের দিন।
এবারের মে দিবস এলো এমন একটা সময়ে যখন দুনিয়া জুড়ে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ বা ‘বাড়ি থেকে কাজ’ নামক একটা নতুন আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। অনেকর জন্য সেটাই নতুন বাস্তব। আমাদের তখন সবার আগে সেই ভাইবোনদের কথা মনে রাখা দরকার যাঁদের না আছে বাড়ি না আছে কাজ। লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক রাস্তায় দিন কাটাচ্ছেন, তাঁদের কাজ নেই, মজুরি নেই, ছায়াসঙ্গী হয়ে আছে কেবল নিরাপত্তাহীনতা, অপমান, ক্ষুধা আর দুর্ভোগ। নির্মাণ শ্রমিকদের বানানো বাড়িতে মানুষকে নিরাপদ ও বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার পরামর্শ দিচ্ছে সরকার, অথচ সেই নির্মাণ শ্রমিকদের নিজেদেরই অনেকের মাথার উপর কোনো ছাদ নেই।
সেইসব মহিলা ও শিশুদের কথাও ভাবতে হবে আমাদের যাঁদের সারাদিনের কাজের জায়গাটাই হল বাড়িতে, কিন্তু সেইসব কাজ চোখের আড়ালেই থেকে গেছে, কাজের স্বীকৃতি পায়নি। তথ্যপ্রযুক্তি কর্মীদের কাছে বাড়ি আর কর্মস্থলের মধ্যে ফারাকটাই আজ অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে, শুধু বেড়ে চলেছে কাজের বোঝা ও মানসিক চাপ। চিরকাল যাঁরা ঘরের চার দেওয়ালে মধ্যে আবদ্ধ তাঁদের থেকে শুরু করে যাঁদের আজ ঘরে ঠেলে দিয়ে বাড়ি থেকে কাজ করার ‘সুবিধা’ টের পাইয়ে দেওয়া হচ্ছে তাঁদের সকলের জন্যই ভাবনার নতুন খোরাক আর সংগ্রামের নতুন বার্তা নিয়ে এসেছে এবারের মে দিবস।
এবারের মে দিবস আসন্ন অর্থনৈতিক মন্দার আভাস ছড়িয়ে দিচ্ছে মানুষের চোখে মুখে। এই বিধ্বংসী ধাক্কা ও ভাঙ্গাচোরা হাল সামলে অর্থনীতি কিভাবে আবার উঠে দাঁড়াবে? কে এই পাহাড়প্রমাণ ক্ষতির ব্যয়ভার বহন করবে? ইতিমধ্যেই কয়েক লাখ মানুষ জীবিকা ও অন্নসংস্থান হারিয়েছেন। মজুরি কাটা হচ্ছে, মহার্ঘ ভাতা ঠাণ্ডাঘরে, অধিকাংশ শিল্পক্ষেত্রে প্রচুর কর্মী ছাঁটাইয়ের কথা শোনা যাচ্ছে আর অত্যাবশ্যকীয় পণ্যদ্রব্যের দামও আকাশ ছুঁতে শুরু করেছে। এই মহামারী এবং মন্দার মিলিত বোঝা কখনোই অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল শ্রমজীবী জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া চলবে না। এই মে দিবস তাই অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে এবং জনগণকে ত্রাণ সরবরাহ করতে প্রয়োজনীয় তহবিল গড়ার জন্য ধনীদের উপর অবিলম্বে কোভিড সম্পত্তি কর বসানোর দাবি তোলার সময়।
উৎপাদন ব্যবস্থার কেন্দ্রে থাকা শ্রমিকরাই মানবিক শ্রমের মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদের রূপান্তর ঘটিয়ে আমাদের ক্রমবর্ধমান বস্তুগত চাহিদার যোগান দিয়ে চলেছেন। তাঁদের উৎপাদিত সামগ্রী মুষ্টিমেয় মানুষের মুঠোয় জমা হয়ে সম্পত্তির পাহাড় তৈরি করেছে। সেই সম্পত্তিই শ্রমজীবী উৎপাদক জনতার উপর আজ যুদ্ধের হাতিয়ার হিসাবে কাজে লাগানো হচ্ছে। এবারের মে দিবস তাই গোটা উৎপাদন ব্যবস্থা, সম্পত্তির মালিকানা ও বণ্টনের ধরন সম্পর্কে আবারো ভেবে দেখার সময়। জনগণের জন্য ক্রমাগত ব্যয় সংকোচন আর মুষ্টিমেয় লোকের প্রাচুর্য্য, মুনাফার বেসরকারীকরণ আর লোকসানের রাষ্ট্রায়ত্তকরণ, সামাজিক উৎপাদনের উপর সংকীর্ণ কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ অনেক দেখেছি। আর নয়! কর্পোরেটদের লোভ আর লুঠের হাত থেকে প্রকৃতি ও জনগণকে রক্ষা করার, একটা নতুন ও ন্যায়পূর্ণ পৃথিবী গড়ার সাইরেন বাজিয়ে দিয়েছে কোভিড-১৯।
আম্বেদকরের একটা বিখ্যাত কথা স্মরণ করা যেতে পারে – জাতব্যবস্থা শ্রমের বিভাজন নয়, শ্রমিকের বিভাজন। মে দিবস হল সেই বিভক্ত শ্রমিকের ঐক্যের দিন। বিশ্বব্যাপী শ্রমজীবী ও শোষিত মানুষের ঐক্য। জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার ধারাবাহিক ধ্বংসসাধন ও মহামারী মোকাবিলায় বেশিরভাগ দেশের সরকারেরই অপদার্থতা আর নিষ্ঠুর উদাসীনতার ফলে সারা বিশ্বে শ্রমজীবী মানুষকেই কোভিড-১৯ মহামারীর সবথেকে বেশি ধকল সইতে হচ্ছে। অথচ সরকারগুলো এখনও নিজেদের সব দায়িত্ব এড়িয়ে শ্রমিকদেরকেই দোষারোপ ও বিভাজন করতে ব্যস্ত! এই বিভাজনের ছককে রুখে দেওয়াটা আজ ভীষণ জরুরি। আজ যখন বিশ্ব পুঁজিবাদ আর মানুষের বেঁচে থাকার মধ্যে সংঘাত সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে তখন অন্যরকম বিশ্ব গড়ে তোলাটা আমাদের কাছে আশু তাগিদ। আজ সত্যিই ডাক পড়েছে গোটা পৃথিবীকে জয় করার, নতুন বিশ্ব গড়ে তোলার। জোট বাঁধো তেরি হও। এ লড়াই সবার লড়াই। এ লড়াই জিততে হবে।
ভারত আবার কবে গৃহবন্দী দশা থেকে মুক্ত হবে তা এক অনিশ্চিত আশা হয়েই থাকছে, কোনও রূপোলী রেখার দেখা এখনও মিলছে না। গোটা দেশকে এখন রোজ সরকার নির্দেশিত তিন রকমের ‘জোন’-রেখাচিত্রের ওঠানামার পাঠ বুঝে কোবিড আর লক ডাউনের বর্তমান-ভবিষ্যৎ আত্মস্থ করতে হচ্ছে।
বিপরীতে, যে বিপদ ভয়াবহ আকারে বাড়তে শুরু করেছে তা হল একদিকে কাজ উধাও ও ছিন্নমূল হয়ে যাওয়া অন্যদিকে কপর্দকশূন্য ও ক্ষুধা কবলিত জনতার ভিড়। এই বিপজ্জনক রেখচিত্রে কোনো ওঠানামা নেই। বরং তা তীব্র গতিতে কেবলই ঊর্ধ্বগামী, সর্বগ্রাসী হচ্ছে। সরকারী পরিভাষায় নাগরিক জনতার অনেক রকম বর্গ ভাগ রয়েছে, মাঝেমধ্যে তার যাচাই অভিযানে নামকরণে অদল-বদল হয়, সে যাইই হয় মোদ্দা প্রবণতা হল সরকারের খাতায় অভাবী জনতার কেবল সংখ্যাগত সংকোচনই হয়ে আসছে। বাস্তবে ক্ষুধার ভারতের দারিদ্রের ভারতের মাথা-মানচিত্র যে কেবলই বেড়ে চলেছে সেটা শাসকশ্রেণীর কোনও অংশই মানতে চায়না। বিগত একমাসের লক ডাউনের পরিস্থিতি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রকৃত দুর্বিষহ অবস্থাটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। এক ধাক্কায় কেন্দ্র-রাজ্যের নানারঙের সরকারগুলোর সমস্ত রকমের পরিসংখ্যানগত অর্ধসত্যের কারসাজি উন্মোচিত হয়ে গেল। গ্রামীণ দিনমজুর ও শিল্প শ্রমিকদের মধ্যে সামাজিক মাধ্যম নির্ভর এক সাম্প্রতিকতম নমুনা সমীক্ষায় খাদ্য-ত্রাণ না মেলার যে তথ্যচিত্র ধরা পড়েছে তা শিউড়ে ওঠার মতোই। তাতে এটাই নজরে এসেছে বিহার, ঝাড়খন্ড ও মধ্যপ্রদেশে গ্রামীণ মজুরদের যে অংশে সমীক্ষা চালানো হয় তাদের মধ্যে এই সময়ে সরকারী/বেসরকারী কোনোভাবেই খাদ্য সরবরাহের মুখ দেখেননি যথাক্রমে ৭৯, ৫৫ ও ৬৭ শতাংশ, আর বিনামূল্যে রেশন পাওয়া থেকে বঞ্চিত যথাক্রমে ৮৮, ৬৩ ও ৬৯ শতাংশ। তিরুপুর, গুরগাঁও, আমেদাবাদ, দিল্লীর মতো শিল্পশ্রমিকদের মধ্যে চালানো নমুনা সমীক্ষাও অনুরূপ তথ্যের জানান দিয়েছে। এ হল দৃশ্যমান বিভীষিকার শিলাখন্ড মাত্র। সারা দেশে সমীক্ষা চালালে গ্রাম-শহরে একই প্রবণতার ছবি প্রকাশ হয়ে যাবে। মোদী সরকার কেবল করোনার কামড় নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করছে, যদিও তা নিয়েও উঠছে অজস্র প্রশ্ন; পাশাপাশি অনাহার ও নগদ অর্থের হাহাকার অবস্থা সম্পর্কে কিন্তু কোনও তথ্য সংগ্রহের নাম নেই, হাজারো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে না চেয়েই সব এড়িয়ে যাচ্ছে। শাসকশ্রেণী কি দিয়ে আর কি ধামাচাপা দেবে! করোনার বিপদকে যেন ছাপিয়ে যেতে বাড়ছে অনাহারে অর্ধাহারে পাইকারীহারে শেষ হয়ে যাওয়ার বিপদ।
প্রধানমন্ত্রী নিরন্ন ও অভাবগ্রস্ত জনতার এই আপতকালীন সময়ে বিশেষ জরুরি যে দু’টি প্রয়োজন, খাদ্য ও নগদ অর্থ যোগানের দায় পালন না করে কথার ফুলঝুরিতে নাম ফাটাতে লিপ্ত। মোদী এই সেদিন ‘জাতীয় পঞ্চায়েত দিবসে’ পঞ্চায়েত প্রধানদের সঙ্গে মেতেছিলেন ভিডিও কথোপকথনে। তাতে পঞ্চায়েত প্রতিনিধিদের কোন কথা তিনি শুনলেন কিনা জানা গেল না, শুনতে চেয়েছিলেন কিনা সেটাও জানাননি। বরং জানা গেল তিনি শুনিয়েছেন করোনা থেকে মুক্ত হওয়ার অভিযানে দেশকে, বিশেষত গ্রাম ভারতকে পরদেশ নির্ভরতা থেকে মুক্ত থাকার তথা আত্মনির্ভর হওয়ার বাণী। এখন এসব প্রসঙ্গ উত্থাপন করাই অবান্তর, রাষ্ট্রীয় দায় এড়িয়ে থাকার জন্য কথার চালবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়। যখন গ্রাম ভারতের সামনে জ্বলন্ত সমস্যা খাদ্য-অর্থ-কাজ-মজুরি- চাষ-পুঁজি-ঋণমুক্তির, তখন মোদী শোনালেন স্বনির্ভর গ্রাম সমাজ তৈরির নজির হিসাবে গত পাঁচ বছরে সওয়া এক লক্ষ পঞ্চায়েতকে ব্রড ব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগের আওতায় নিয়ে আসা ও পরবর্তী লক্ষ্যমাত্রা পাঁচ লক্ষে নিয়ে যাওয়ার কথা। গ্রাম ভারতের দাবিগুচ্ছ একরকম, মোদীর নজর ঘোরানোর উদ্দেশ্য আরেকরকম। পরন্তু তিনি বলতে ছাড়েননি আত্মনির্ভরতাকে আঁকড়ে গ্রামসমাজে তৃণমূল স্তর থেকে গণতন্ত্র ও উন্নয়নকে শক্তিশালী করার কথা। কিন্তু এই কঠিন চরমতম দুঃসময়েও একেবারেই চুপ থাকলেন কৃষক সমাজকে ঋণ থেকে মুক্তি দেওয়ার প্রশ্নে। তাছাড়া এখন রবিশস্যের ফসল তোলার মরশুম। এখন তো মনরেগা প্রকল্পে গ্রামীণ মজুরদের আগাম দু-তিন মাসের মজুুুরি দিয়ে একশ দিনের কাজকে ফসল কাটার কাজে যুক্ত করা যায়, তাতে মজুরদেরও কাজ ও মজুরির নিশ্চয়তা মেলে, আর নিখরচায় মজুর পেয়ে প্রাধান্যমূলক অবস্থায় থাকা ক্ষুদ্র জোতের চাষিদেরও একটু আর্থিক সুরাহা হয়। কিন্তু না, সেকথা নেই। শস্যের ভান্ডার উপচে পড়ছে। সরকার নিজেই এই খাদ্য সংবাদ জানিয়েছে। তার ওপর সরকার জানাচ্ছে লক ডাউনের পরিস্থিতিতেও রবি ফসল তোলার প্রথম দশ দিনের মধ্যে নাকি উত্তর ও মধ্য ভারতের চার রাজ্য পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশে নব্বই শতাংশ গম সংগ্রহ ও গোলায় মজুত সারা। এফসিআই মান্ডিগুলো জমাকৃত গমে ভরা। আর দক্ষিণাঞ্চলের রাজ্যগুলোতেও নাকি চাষিরা দুশ্চিন্তায় নেই, কারণ সরকারী এজেন্সিগুলোর ধান সংগ্রহ অভিযান নাকি সারা! সরকারী গণ বন্টণ ব্যবস্থার জন্য মজুত খাদ্যশস্যের নাকি উদ্বৃত্তই থাকছে, গত ২০১৯-২০ আর্থিক বছরে সংগৃহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল যেখানে ৩৫ মিলিয়ন টন, সেখানে ২০২০-২১ বর্ষে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা হল ৪০ মিলিয়ন টন। সরকারপক্ষের নিজেকে জাহির করার সত্য-মিথ্যা নিয়ে তর্ক এযাত্রা না হয় তোলা থাক, তবু সরকারের দাবি মোতাবেক পাল্টা দাবি হল, তবে সরকার ভিক্ষা দেওয়ার মতো মাসে পাঁচ-দশ কেজি চাল-গম দিয়ে ক্ষান্ত থাকবে কেন? পরিবারপিছু ন্যূনতম পঞ্চাশ কেজি খাদ্যশস্য কেন দেবেনা? উত্তর মেলে না।
মোদী সরকার করোনা সংকটের পরিস্থিতিতে আর্থিক ত্রাণ প্যাকেজ যা ঘোষণা করেছে তা জিডিপি-র এক শতাংশেরও কম। বরাদ্দ করা উচিত ছিল অন্তত ছয় শতাংশ। সে কথা কানেই তুলছে না। অন্যদিকে অতিরিক্ত উপায়েও টাকা তুলছে বিস্তর। আর এস এস নির্দেশিত ‘স্বদেশী’ মডেলে স্বনির্ভর হওয়ার নামে হরেক জন অধিকার হরণের পদক্ষেপ করছে। ব্যাঙ্কে সমস্ত ধরনের আমানতের ১.১ সুদ হ্রাস, কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারিদের মহার্ঘভাতা কর্তন, পেনশন গ্রহীতাদের প্রাপ্যে থাবা বসানো, এমনকি প্রতিরক্ষা কর্মী এবং কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত সেনাদের টাকা কেটে নেওয়ার একতরফা পলিসি-পদক্ষেপ করা হচ্ছে। এছাড়া আসছে কমবেশি ‘কর্পোরেট অনুদানে’র অর্থ, যা অবশ্য না নিয়ে কর্পোরেট পুঁজির ওপর ন্যূনতম ১০-২০ শতাংশ ‘করোনা কর’ চাপানো উচিত ছিল। কিন্তু মোদী সরকার ওপথে চলার নয় শুধু নয়, ভীষণভাবেই অনিচ্ছুক বা বিরোধী। তার আঁচ পাওয়া গেল খোদ আয়কর অফিসারদের একাংশের তরফে সর্বোচ্চ ধনীদের ওপর ৪০ শতাংশ করোনা কর ও অন্যান্য সেস বসানোর সুপারিশের প্রতিক্রিয়ায় তুরন্ত সেন্ট্রাল বোর্ড অব ডাইরেক্ট ট্যাক্স কর্তৃপক্ষের দিক থেকে তদন্তের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পদক্ষেপে। সরকারের দিক থেকে বরং কর্পোরেট অনুদান নেওয়ার পিছনে উত্তরোত্তর কর্পোরেট লুন্ঠণ চালাতে দিতে আরও উদার হওয়ার বিপজ্জনক উদ্দেশ্যই থাকবে। যাই হোক, সরকারের হাতে যখন ঘোষিত করোনা প্যাকেজের টাকা আছে, তাছাড়া করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে নানা খাত থেকে নানা সূত্রে প্রচুর টাকা আসছে, তখন করোনা চিকিৎসা ক্ষেত্রে আরও ব্যয়বৃদ্ধি সহ অভাবী জনগণের বিভিন্ন অংশের দাবির যৌক্তিকতা বিবেচনা সাপেক্ষে গ্রহণযোগ্য মাথা পিছু খাদ্যশস্যের পরিমাণগত যোগান বৃদ্ধি এবং কয়েকমাসের জন্য আর্থিক অনুদান বাড়ানো হবে না কেন? সাংসদদের তহবিল থেকে উন্নয়নকাজে অর্থব্যয় স্থগিত রাখার নির্দেশ জারি হয়েছে, কিন্তু চূড়ান্ত অপ্রয়োজনীয় দিল্লীর সৌন্দর্যায়ন প্রকল্প ও বুলেট ট্রেন তৈরির সিদ্ধান্ত রদ হবে না কেন? তাহলেও তো আরও হাজার লক্ষ কোটি টাকা বেঁচে যায়। সেই টাকাও কাজে লাগানো হবে না কেন আজকের জনস্বার্থের প্রয়োজনে? মোদী সরকার একমুখে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই বলছে, অন্যমুখে রাজ্য সরকারগুলোকে – বিশেষত বিরোধী দলের সরকারকে প্রাপ্য অর্থ মেটাচ্ছে না, রাজ্য সরকারগুলোর জন্য শুধু নির্দেশিকা তৈরি করছে আর সিংহভাগ আর্থিক দায় চালান করে দিচ্ছে। কেন্দ্রের মোদী সরকার এভাবে অর্থনৈতিক ক্ষমতার চূড়ান্ত স্বেচ্ছাচারীতা, কেন্দ্রীকরণ, প্রবঞ্চনা, প্রতারণা ও পীড়ন চালাচ্ছে।
রাজ্য সরকারগুলোও, তা বিজেপি ও তার বন্ধু সরকার, কিংবা ভিন্ন ভিন্ন দল পরিচালিত কেরলের বিজয়ন সরকার বা বাংলার মমতা সরকার, কেউই সমালোচনা-কঠিন সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। কেরল সরকার করোনা মোকাবিলায় যেমন কিছু ভালো কাজ করেছে, কিন্তু রাজ্য সরকারী কর্মচারিদের বেতন থেকে একটা অংশ টাকা কেটে নেওয়ার পদক্ষেপও শুরু করেছে, যেটা নিন্দনীয়। আর, বাংলার তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে তো উঠছে ভুরি ভুরি অভিযোগ। বিশেষত করোনা মোকাবিলায় বিভিন্ন তথ্য গোপন এবং ঢালাও রেশন দুর্নীতি-দলতন্ত্র-স্বজনপোষণ ক্রমবর্দ্ধমান ধিক্কারের সম্মুখীন হলেও মমতা সরকার নিজেকে সংশোধনের কোনও সদিচ্ছা দেখাচ্ছে না। তাই লক ডাউনের পরিস্থিতিতে প্রতিবাদ লড়াই চালিয়ে যেতে হবে উভয় ফ্রন্টেই। লড়ে যেতে হবে করোনা থেকে মুক্তি পাওয়ার আর কেন্দ্র-রাজ্যের সরকারের জনস্বার্থবিমুখতা থেকে জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য।
বড় বড় সংকট, তা সে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রেই হোক, বা শিল্প, শিক্ষা ক্ষেত্র বা অর্থনীতির জগতেই হোক, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আমরা কোথায় আছি। যে নীতি ও তত্ত্বকথার দাঁড়িয়ে পদক্ষেপ ও কর্মসূচী নেওয়া হয়, হয়েছে এবং হয়ে চলেছে ,তা কত ভঙ্গুর, অকার্যকরী এবং বিপজ্জনকও হতে পারে।
সংকটের দিনগুলোতেই এটা ভাল করে বোঝা যায়, সংকট থেকে বেরিয়ে আসার রাস্তাও এর মধ্যে দিয়ে বের হয়। কোনো কোনো পন্ডিত মানুষ অবশ্য বলেন এবং পরামর্শও দেন, এই মহাসংকটে প্রশ্ন করা ঠিক নয়, বিতর্ক তো নৈব নৈব চ। বিজ্ঞান নাকি বলে, মহাসংকটে বিনা প্রশ্নে, বিনা বিতর্কে সরকার যা বলে ও করে তাকে মেনে চলা ও পালন করা উচিত। পন্ডিতজনেরা বলেন, মহাসংকট কেটে যাক্, তারপর কোমর বেঁধে বিতর্ক করা যাবে। তর্কপ্রিয় ভারতীয়রা এই সময় একটু চুপ থাকুন। আর রং বেরঙের রাজনীতিবিদরা যেহেতু বিতর্ক করতে ভালোবাসেন, তাই তাদের একদম চুপ থাকতে বলেছেন বিজ্ঞান মনস্ক বন্ধুরা। মজার হলো, যারা প্রশ্ন করতে, বিতর্ক করতে সকালে মানা করেছেন, তাঁরাই আবার সন্ধ্যায়ঘণ্টা খানেক সঙ্গে .... আসরে বিতর্ক করছেন। আমার এক পরিচিত স্বনামধন্য চিকিৎসক বন্ধু, যিনি ২৭ এপ্রিল আনন্দবাজার পত্রিকায় উত্তর সম্পাদকীয় নিবন্ধে আমাদের বিতর্ক থেকে সরে থাকার সুপরামর্শ দিয়েছেন, তিনিও থাকেন এবং যুক্তিসহ আলোচনা ও মত দেন। আমার বা আমাদের অনেকের খটকা এখানেই। একে তো বিতর্ক করায় মানা, তার উপর বিতর্ক করার একচেটিয়া অধিকার পন্ডিতদের জন্য সীমায়িত।খটকা তাই দ্বিগুণ বেড়ে গেল।
তবে যে মার্কস বলেছিলেন, এভরি থিং পুট টু কোয়েশ্চেন (সব কিছুকেই প্রশ্নের মুখে ফেলতে হবে)। তা কি মহাসংকট, অতিমারি বা প্যান্ডেমিকের সময় প্রযোজ্য নয়?? আরও একটা গোবেচারা মানুষের প্রশ্ন তার কি হবে? তারস্বরে বলা হচ্ছে, যুদ্ধ বলুন, লড়াই বলুন, আন্দোলন জিতবার মূল চাবিকাঠি মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ। অংশগ্রহণকারী মানুষের কোনো প্রশ্ন থাকতে নেই? নির্জীব, জিজ্ঞাসাহীন মানুষের জীবন তো ক্রীতদাসের জীবন। আমরা কি করোনা মহামারি রোধে মানুষের অংশগ্রহণ ক্রীতদাসের স্তরেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাই।
আরও একটা মারাত্মক প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, বিজ্ঞানের চর্চা চলুক, রাজনীতির নয়। বিজ্ঞান ব্যাপারটা তবে ঠিক কি? এতদিন তো জানতাম, প্রামান্য তথ্যের ভিত্তিতে, তার বিশ্লেষণ, সংশ্লেষণ এর ভিত্তিতে অর্জিত বিশেষ জ্ঞান। চিকিৎসা বিজ্ঞানও এর ব্যতিক্রম নয়। তা সে ফিজিওলজি হোক বা প্যাথোলজি। নিরন্তর প্রশ্ন ওঠে এর কারণ কি। একটা স্বাভাবিক গঠন বৈচিত্রে হঠাৎ এই পরিবর্তন কেন? ধরুন মানুষের শরীরে হৃৎপিণ্ড বা হার্ট বুকের বাঁ দিকে থাকে। কেউ যদি এই জানা কথাটার পরেও জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা হার্ট কি বুকের ডানদিকে থাকতে পারে। আ্যনাটমি জানিয়ে দিল, হ্যাঁ, এত শতাংশ মানুষের শরীরে ডানদিকে থাকে। শুধু মুখে বললো না, বুক চিড়ে (ডিসেকশন করে) দেখিয়ে দিল, এই দেখুন, হার্ট বুকের ডানদিকে। প্রমাণ। এই যে ক্যান্সার নিয়ে এত গবেষণা, তার মূলেও তো এত প্রশ্ন। স্বাভাবিক কোষের যে জেনেটিক বিন্যাস (এমনকি অ্যামাইনো অ্যাসিডের সিকোয়েন্স) তা ক্যান্সার কোষের বদলে যায় কি বাইরের কোনো কারণে (কারসিনোজেনিক স্টিম্যুলেশনে), নাকি সব কোষই ক্যান্সার সেলের বদলে যাবার সম্ভাবনা নিয়ে সৃষ্টি হয়, কেউ বদলায়, কেউ বদলায় না। কেন এই কেন-র উত্তর খুঁজতে বিজ্ঞান নিরন্তর দৌড়ে বেড়ায়। এই কি ও কেনই বিজ্ঞানের আঁতুড়ঘর।
মার্কসবাদ এই বৈজ্ঞানিক নিয়ম নীতিকে অনুসরণ করেই সমাজের কাঠামো (স্ট্রাকচার) ও উপরিকাঠামো (সুপার স্ট্রাকচার)-র মধ্যেকার সম্পর্ক ও একে অন্যকে প্রভাবিত করার নিয়ম নীতি ও গতিসূত্রকে বোঝার চেষ্টা করে চলে (গো-মাতার অপবিজ্ঞান থেকে এখানেই এর পার্থক্য)। মার্কসবাদ তাই তথ্যকেই সত্য বলে মেনে নেয় না। তথ্যের মধ্যে সত্য লুকিয়ে থাকে বা থাকতে পারে।
করোনা মহামারি বা অতিমারী আমাদের দেশ ও রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে প্রায় উলঙ্গ করে দিয়েছে। বছরের শুরুতে যখন একের পর এক ইনফ্লুয়েঞ্জার জ্বর, সর্দিকাশি, শ্বাসকষ্ট নিয়ে রোগী আস্তে শুরু করল, প্রাথমিক যেটুকু শৈথিল্য ছিল, তাকে কাটিয়ে উঠে শুরু হল যুদ্ধকালীন তৎপরতা। কয়েকদিনের মধ্যে উহানে তৈরি হল ১০,০০০ শয্যা বিশিষ্ট করোনা হাসপাতাল। আমাদের রাজ্যের কথাই বলি। তিন মাসের বেশি সময় পাওয়া গেল, প্যান্ডেমিক নিয়ে সরকারী-বেসরকারী স্তরে প্রচুর চর্চা হল। বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে করোনা বেড মাত্র ৮২টি। ঘোষণা করা হল, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালকে করোনা চিকিৎসার জন্য; উৎসর্গ করা হলো। পরে জানা গেল, মেডিসিন বিভাগের দুটি তলা বা ফ্লোর করোনা চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত দৈনিক করোনা পরীক্ষার সংখ্যা মাত্র ৪০ । হ্যাঁ, মাত্র চল্লিশ। আজ ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত টেনেটুনে ৪০০০ থেকে ৪৫০০। আমি আছি ভয় পাবেন না ধরনের বিজ্ঞাপন এই মহাসংকটেও চলতে পারে, ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়। আজ ২৯ এপ্রিল, বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৩৪০+২৮ অর্থাৎ ৩৬৮। ধরে নেওয়া যাক, সংখ্যাটা আর একটু বেড়ে ৩৯০ পর্যন্ত পৌঁছেছে। সরকারী হাসপাতালে মোট করোনা চিকিৎসার বেড় বড়জোর ৫০০। কলকাতার বাইপাসের ধারে যে নামী দামী বেসরকারী হাসপাতাল রয়েছে, তার কোনটায় করোনা চিকিৎসার জন্য জেনারেল বেড ২/৩, আইসিইউ বেড ১-২ । সব মিলিয়ে ২৫/৩০/৩৫। এটা শুধু এরাজ্যের চিত্র এমন নয়। ভূ-ভারত ঘুরলে প্রায় সর্বত্র এই চিত্র (কেরল ব্যতিক্রম ধরেও)। মন কি বাতের আড়ালে রয়েছে সেই তত্ত্ব ।
১৯৯১-৯২ সালে নয়া অর্থনীতি চালু হওয়ার সাথে সাথে একটা দর্শনও ফেরি করা হয়। সরকারের ব্যয়ের অগ্রাধিকার কোথায় থাকবে? নীতিগতভাবে কেন্দ্রীয় সরকার জানাল, সেখানেই বেশি ব্যয় বরাদ্দ করা হবে যেখানে সমগ্রের স্বার্থ জড়িয়ে আছে (কালেকটিভ ইন্টারেস্ট)। যেমন, দেশের নিরাপত্তা, সামরিক বাহিনী ইত্যাদি, ইত্যাদি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ব্যক্তিগত স্বার্থ (ইন্ডিভিজুয়াল ইন্টারেস্ট)। কত ঘোষণা ২০০০ সালের মধ্যে সকলের স্বাস্থ্য, কত স্বাস্থ্য কমিশন/কমিটি। স্বাস্থ্য চলে গেল আপনার প্রয়োজন অনুসারে ক্রয় করার সামগ্রিতে। করোনা স্পষ্ট করলো এই নীতি দেউলিয়া। এ নীতি নিয়ে কর্পোরেটদের সেবা করা যায়, কোভিড-১৯ কে মোকাবিলা করা যায় না। মার্কসবাদে বিশ্বাসী মানুষ জন কেন্দ্র হোক, রাজ্য হোক, সব সরকারকে একথাই বলতে চায়, বলবে। ব্যবসার এই নীতি থেকেই ১৫০ টাকায় টেষ্ট কিট কিনে ৩৫০/৪০০ টাকায় বিক্রি করা যায়, তাও আবার বাতিল করতে হয় ফলস পজিটিভ/নেগেটিভ রিপোর্ট আসার পর। কফিন বিক্রির রাস্তা পরিস্কারের এই নীতির বিরুদ্ধে এইসময় কিছু বলা যাবে না? এই যে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে কারচুপি সেখানে তো চিকিৎসকদের একটা নৈতিকতা আদর্শ জড়িয়ে আছে। যে চিকিৎসক/চিকিৎসক টিম করোনা রোগীর চিকিৎসা করলেন, সহস্র প্রচেষ্টার পরেও রোগীকে বাঁচানো গেল না। তাঁর মৃত্যু সার্টিফিকেট লিখবে কোথাকার কোন অডিট কমিটি? আর তার ভিত্তিতে কোনটা কোভিড মৃত্যু, আর কোনটা কো-মরবিডিটি এটা ঘোষণা করবেন রাজ্য প্রশাসনের ১নং আমলা !! এই তথ্য গোপনের পেছনে একটা রাজনৈতিক প্রয়োজন ছিল, আমি আছি, ভয় নেই। বাস্তবে আমিও আছি, ভয়ও আছে। এটা যদি প্রমাণ হয়ে যায়! তাই সত্যিকারের তথ্য জানার আগ্রহ চিকিৎসা জগতের নৈতিক প্রশ্ন। করোনা মহামারীর বিরুদ্ধে ব্যুহ রচনার জন্য প্রকৃত তথ্য জানা অত্যন্ত প্রয়োজন। রাশিবিজ্ঞান শেখে মানুষ রাশিফল দেখার জন্য নয়, বিজ্ঞানকে, চিকিৎসা বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য। চিকিৎসা বিজ্ঞানের স্বার্থে এই জরুরি কথাগুলি বলতেই হবে। উত্তরও দিতে হবে আজ অথবা কাল। কেন্দ্রকে , রাজ্যকে।
করোনা ভাইরাসের কারণে সমস্ত দেশ আজ লকডাউনের কবলে। রোজই সংক্রমণের ঘটনা ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। দেশের শ্রমজীবী মানুষ এক কঠিন সংকটের আবর্তে। অসংগঠিত শ্রমিকদের চিত্রটা আরও ভয়াবহ। বিশেষ করে পরিযায়ী শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তাই আজ বিঘ্নিত।
আমরা এআইসিসিটিইউ-র পক্ষ থেকে গত ১৮-১৯ এপ্রিল পরিযায়ী শ্রমিকদের দাবি নিয়ে দেশব্যাপী কর্মসূচী পালন করেছি, যা বহু মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকার লকড ডাউনের নামে শ্রমজীবী মানুষের উপর ভয়ংকর আক্রমন নামিয়ে এনেছে। আমাদের রাজ্যেও সরকার বহু প্রতিশ্রুতি ঘোষনা করলেও কোথাও তা কার্যকরী হচ্ছে না। আগামী ১ মে ঐতিহাসিক মে দিবস। ৮ঘণ্টা কাজের দাবির ঐতিহাসিক লড়াই করে পাওয়া অধিকার আজ কর্পোরেটদের স্বার্থে কেন্দ্রীয় সরকার আইনিভাবে তুলে দিতে বদ্ধপরিকর। ইতিমধ্যেই তা বিভিন্ন রাজ্যে পরিবর্তন করে ৮ ঘণ্টার বদলে ১২ ঘণ্টা কাজ ও মজুরির নিয়ম বদল করা শুরু করে দিয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে এবারের মে দিবস পালন খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু লকডাউনের কারণে কেন্দ্রীয় বড় কোনো কর্মসূচী করা সম্ভব নয়। কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের প্রতিবারের মতো শহীদ মিনারে যুক্ত সমাবেশ সম্ভব নয়।
এআইসিসিটিইউ রাজ্য কমিটি আহ্বান করছে সমস্ত জেলায় যত সম্ভব বেশি জায়গায় মে দিবসের পতাকা উত্তোলন ও নিম্নে বর্ণিত শ্লোগানকে প্রচারের জন্য প্ল্যাকার্ড, পোস্টারে সুসজ্জিত করে কর্মসূচি পালন করুন।
শ্লোগান -
১। ৮ ঘণ্টার শ্রমদিবসকে ১২ ঘণ্টায় পরিণত করার চক্রান্ত বন্ধ কর।
২। সমস্ত পরিযায়ী ও অসংগঠিত শ্রমিকদের লকড ডাউন ভাতা বাবদ ১০০০০ টাকা দিতে হবে
৩। লকডাউন পর্যায়ে কোন শিল্পের কোনো শ্রমিকের মজুরি হ্রাস,ছাঁটাই করা চলবে না।
৪। সকল শ্রমিককে পর্যাপ্ত রেশন বিনামূল্যে দিতে হবে।
৫। পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য বিশেষ একশন প্ল্যান ঘোষনা করতে হবে।
এর সঙ্গে কমরেডরা নির্দিষ্ট সেক্টরের জন্য শ্লোগান ঠিক করে নিতে পারেন।
সংগ্রামী অভিনন্দন সহ
বাসুদেব বসু, সাধারণ সম্পাদক, এআইসিসিটিইউ, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি
করোনা পরিস্থিতিতে প্রকল্প কর্মীদের করোনা ভাইরাস জনিত দাবি নিয়ে ২৭ এপ্রিল থেকে ৩ মে দাবি সপ্তাহ পালন করা হবে। দাবি সপ্তাহে কর্মীরা মাথায় কালো ফেট্টি বেঁধে, বুকে দাবিপত্র ঝুলিয়ে পালন করবেন।
প্রকল্প কর্মীরা মাথায় লাল ফেট্টি ,লাল ব্যাজ,লাল ব্যান্ড ধারণ করবেন। স্থানীয় পরিস্থিতি অনুযায়ী পতাকা উত্তোলন করবেন,তবে ৫ জনের অধিক জড়ো হবেন না। যেখানে তা সম্ভব নয়,বাড়ির দরজায় বা বাড়ির উপরে লাল পতাকা তোলা হবে। উল্লেখ্য, লকডাউনের শারীরিক দূরত্ব ও অন্যান্য বিধি মেনেই পতাকা তোলা হবে।
১) কোভিড-১৯ কাজে যুক্ত সমস্ত স্কিম কর্মীদের পিপিই কিট দিতে হবে।
২) কোভিড-১৯ কাজে যুক্ত সকলের পূর্ণ নিরাপত্তা দিতে হবে।
৩) সমস্ত স্কিম কর্মীদের ৩ মাসের সাম্মানিক অগ্রিম দিতে হবে।
৪) কোভিড ১৯ কাজে সকল স্কিম কর্মীদের ৫০ লাখ টাকা জীবন বীমা, ১০ লক্ষ টাকা স্বাস্থ্যবীমা করতে হবে।
৫) প্রকল্প কর্মীদের সাধারণ স্বাস্থ্যবিমার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
৬) সমস্ত প্রকল্প কর্মীদের সরকারী কর্মীদের স্বীকৃতি ও সমান মজুরি দিতে হবে।
শশী যাদব (সংযোজক), এআইএসডব্লিউএফ
২৫ এপ্রিল, ২০২০
এআইসিসিটিইউ-র আহ্বানে সাড়া দিয়ে দার্জিলিং জেলায় তরাই সংগ্রামী চা শ্রমিক ইউনিয়নের ব্যানারে ফাঁসিদেওয়া ব্লকের ত্রিহানা চা বাগান (মোহনলাল ডিভিশন) এবং খড়িবাড়ি ব্লকের শচীন্দ্র চন্দ্র চা বাগানে (সোনা চাঁদি) লক ডাউন চলাকালীন পুরো মজুরি দেওয়ার দাবিতে, রেশন দেওয়ার দাবিতে, স্হায়ী অস্হায়ী শ্রমিকের মজুরি ভাগ না করা, চা শ্রমিকদের ঘর নিয়মিত স্যানিটাইজ করা, মাস্ক, স্যানিটাইজার প্রভৃতি নিয়মিত যোগান দেওয়ার দাবিতে বিক্ষোভ দেখান চা শ্রমিকেরা।
ত্রিহানা চা বাগান : কান্দরা মুর্মু, রমু সিং, বন্ধু বেক, দেওয়ান মার্ডির নেতৃত্বে বিভিন্ন দাবি সম্মিলিত প্ল্যাকার্ড নিয়ে বিক্ষোভে সামিল হন বাগানের শ্রমিকরা। শ্রমিকদের সোচ্চার শ্লোগান শেষে বক্তব্য রাখেন চা বাগান আন্দোলনের অনতম নেতৃত্ব কান্দরা মুর্মু।
শচীন্দ্র চন্দ্র চা বাগান খড়িবাড়ি : খড়িবাড়ি ব্লকের সোনা চাঁদি বাগানেও (শচীন্দ্র চন্দ্র) শ্রমিকদের পুরো মজুরি, রেশন সহ বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ দেখান বাগান শ্রমিকরা। নেতৃত্বে ছিলেন সুমন্তি এক্কা, জোসেফ ওঁরাও , তাসিলাল ওঁরাও, ফুলজেন এক্কা, রোজলিনা এক্কা প্রমুখ।
কত দিন এই লকডাউন চলতে পারে! দাবি আদায়ের জন্য এক দিন ধর্মঘট করলে দেশের কত ক্ষতি ও সেই ধর্মঘটে দিনমজুর, অসংগঠিত ক্ষেত্রের মানুষজনের কত ক্ষতি হয়, তা নিয়ে যারা শোরগোল তোলেন লকডাউনের ফলে তাঁদের ক্ষতি ও সেই ক্ষতিপূরণ নিয়ে তাদের কোনো হেলদোল দেখা যাচ্ছে না।
কেবল ভ্রমনের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ৯ কোটি জনতার কী হইবে? ২০১৫-১৬ সালে জিডিপিতে ভ্রমণ শিল্পের অংশ ছিল ৫.২%। ২০১৭-১৮ সালে ওই শিল্পে প্রত্যক্ষ ভাবে কর্মরত ছিল ৩.৫৪ কোটি মানুষ, পরোক্ষ ভাবে কাজ করতেন ৪.৫৬ কোটি কর্মচারি, মোট ৮.১১ কোটি ভ্রমণ শিল্পে জীবিকা নির্বাহ করতেন, যা ভারতবর্ষে মোট নিয়োগের ১২.৩৮% ছিল। অনুপাত যাই হোক না কেন, গত দুবছরে সংখ্যাটা বেড়েছে বই কমেনি। ফলে কোভিড ১৯ জনিত আতঙ্ক, যা লকডাউনের ফলে ব্যাপকতা লাভ করেছে, সরাসরি প্রায় ৯ কোটি কর্মচারির জীবন ও জীবিকাকে বিপন্ন করে তুলেছে।
অলস তালাবন্দী জীবন। ফ্রিজ থেকে ডিম ও মাছ বেরোচ্ছে। রান্না খাওয়া চলছে। রাঁধছে অবশ্য অন্যজন। ছাদের ওয়াটার রিজার্ভয়ের থেকে চাইলেই জল। দিনে বার আষ্টেক হ্যান্ড ওয়াশ দিয়ে হাত ধোয়া। ইলেক্ট্রিক কেটলিতে জল গরম করে বার সাত-আট চা-কফি ও সাথে গিন্নির গালমন্দ খাওয়া। রোজকার কাজ হিশেবে একবার ঘর ঝাড় দিয়ে মপার দিয়ে ঘর মোছা। সন্ধেবেলা ছাদে ঘণ্টা দেড়েক ফোন কানে নিয়ে পায়চারি। কাজের মেয়েটি (এই ডাকেই বোঝা যায় আমাদের মতো মধ্যবিত্তরা কতটাই অকাজের) ট্রেনে করে আসত, আসতে পারছে না; এলেও ঢুকতে দেওয়া হবে কিনা তাতে সন্দেহ আছে। তাঁদের নিষ্কর্মা বেতন দেওয়া নিয়ে ‘বামৈশ্লামিক’দের তেমন দ্বিধা না থাকলেও অনেক ‘দেশপ্রেমী’ বেতনভূক বা ব্যবসায়ীদের বেশ উষ্মা ক্রমশ বাড়ছে, কাজ যখন করছে না কেন তাঁরা বেতন পাবেন? পাড়ার অটোচালক বা ওলা-উবের চালক কিংবা সুইগি-জোম্যাটোর ডেলিভারি বয়রা সব্জির গাড়ি ঠেলতে ঠেলতে নুতন দাড়িপাল্লা নিয়ে হাজির হচ্ছে। ফলের গাড়ি বা মাছের ঝুড়ি নিয়েও আসছে নভিসরা, মাছ কাটতে গিয়ে হাতও কাটছে। সরকারী চাকুরে, কলেজ-বিদ্যালয় শিক্ষক, সংগঠিত সংস্থার কর্মচারীদের দিন খুব একটা খারাপ কাটছে না। যদিও দেশের চিন্তায় অস্থির হয়ে তবলিগিরা ও মেটিয়াবুরুজের বাসিন্দারা কোরোনার প্রকোপের জন্য কতটা দায়ী তা নিয়ে তাঁরা দ্বেষ ছড়াতে একটুও রেয়াত করছেন না, হোয়াটসএ্যাপে ও সব্জি বা ফলের ভ্যানের সামনে থলে নিয়ে বেরিয়ে। তবে পিএম কেয়ারে কত সোনা তাঁরা দিলেন সে খবর আমার কাছে নেই। একই সঙ্গে রাজাবাজার, পার্ক সার্কাস, মেটিয়াবুরুজে কীভাবে লোকে জটলা করছে সে বিষয়েও বাজারে গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়েই সবাইকে শুনিয়ে বিস্তারিত বিবরণ দিচ্ছেন, যেন এই লকডাউনের বাজারে ওনারা মেটিয়াবুরুজে পাইকারি কাপড়-চোপড় বা পার্ক সার্কাসে রেওযাজি খাসি কিনতে গিয়েছিলেন। তবে বিদায়ের সময়ে সকলকেই স্টে হোম স্টে সেফ বলে উইশ করতে ছাড়ছেন না।
ওদিকে ২৪ ঘণ্টা দুজনে বাড়িতে থাকলে যা হয়, বিবাদ বিসম্বাদ। সরকার যা বলে, লোকে যা বলে তোমরা সব সময় তার উল্টো বল – এই অভিযোগে তাঁরও ক্লান্তি নেই আমারও শ্রান্তি নেই। আমি লকডাউনের সার্বিক বিপক্ষে। বলি, এভাবে কীভাবে হবে? তাঁকে বোঝাতে চাই, কোরোনার সংক্রমণকে লক ডাউন করে তখনই বিলুপ্ত করা সম্ভব যখন কর্তৃপক্ষ নির্দিষ্ট কোনো এক সময়ে সকল করোনা আক্রান্তকে ও সেই সময়ে সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে এমন সকলকে চিহ্নিত করতে পারবেন, কোরোনা আক্রান্তদের চিকিৎসা করবেন ও সম্ভাব্যদের কোয়ারান্টাইন করতে পারবেন ও তার পরে লকডাউন তুলবেন। তেমনটা কী হওযা সম্ভব? যদি তা না হয়, তাহলে তো লকডাউন তোলার পরেই ভাইরাস আবার ছড়াতে শুরু করবে। অন্য দিকে কত দিন এই লকডাউন চলতে পারে! দাবি আদায়ের জন্য এক দিন ধর্মঘট করলে দেশের কত ক্ষতি ও সেই ধর্মঘটে দিনমজুর, অসংগঠিত ক্ষেত্রের মানুষজনের কত ক্ষতি হয়, তা নিয়ে যারা শোরগোল তোলেন লকডাউনের ফলে তাঁদের ক্ষতি ও তার পূরণ করা নিয়ে তাদের কোন হেলদোল দেখা যাচ্ছে না। অবসরপ্রাপ্ত জীবনে মাঝে মাঝে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াই বলে ভ্রমণের কথা ভাবছিলাম। এবছর বেশ কিছু টাকা জমে যাবে মনে হচ্ছে, অবশ্য যদি সরকার পেনশন দিতে থাকেন। কারণ, ভারতীয় জীবনে যে পরিমাণ ভয়ভীতি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে তাতে কোথাও গেলে সেখানকার মানুষ তাড়া লাগাতে পারে, তাছাড়া নন্দলালের নুতন সংস্করণ হিসেবে “হাঁটিতে সর্প কুক্কুর আর গাড়ি চাপা পড়া ভয়”-এর বদলে এখন ভ্রমনে যাহিলে ট্রেনে বা বিমানে কোরোনা জনিত ভয়। ফলে, ভ্রমণের অর্থ সঞ্চিত হবে, এবং উহা বিনি সুদের ব্যাঙ্ক এফডির বদলে মিউচুয়াল ফান্ডের মাধ্যমে শেয়ার বাজারেও যাইতে পারে।
কিন্তু ওই ভ্রমনের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ৯ কোটি জনতার কী হইবে? ২০১৫-১৬ সালে জিডিপিতে ভ্রমণ শিল্পের অংশ ছিল ৫.২%। ২০১৭-১৮ সালে ওই শিল্পে প্রত্যক্ষ ভাবে কর্মরত ছিল ৩.৫৪ কোটি মানুষ, পরোক্ষ ভাবে কাজ করতেন ৪.৫৬ কোটি কর্মচারী, মোট ৮.১১ কোটি ভ্রমণ শিল্পে জীবিকা নির্বাহ করতেন, যা ভারতবর্ষে মোট কর্মসংস্থানের ১২.৩৮% ছিল। অনুপাত যাই হোক না কেন, গত দুবছরে সংখ্যাটা বেড়েছে বই কমেনি। ফলে কোভিড ১৯ জনিত আতঙ্ক, যা লকডাউনের ফলে ব্যাপকতা লাভ করেছে, সরাসরি প্রায় ৯ কোটি কর্মচারীর জীবন ও জীবিকাকে বিপন্ন করে তুলেছে। ২০১৮ সালে ভ্রমণ শিল্পে বিদেশী মুদ্রার আয় ছিল ২৮৫৯ কোটি ডলার বা টাকার অঙ্কে ১.৯৪, ৮৯২ কোটি টাকা। অবশ্যম্ভাবীভাবে বিগত সময়ে তা বেড়ে ৩০০০ কোটি ডলারে পৌঁছেছে, কারণ ওই অঙ্ক ২০১৮ সালে ৪.৭% হারে বাড়ছে। (এসমস্ত তথ্যই ভ্রমণ মন্ত্রক কর্তৃক প্রকাশিত ২০১৮-১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে পাওয়া।)
ভ্রমণপ্রিয় জনতার বেড়ানো বন্ধ হয়ে গেলে কতটা ক্ষতি হবে ভারতীয় অর্থনীতির ও তার উপরে ভরসা করে বেঁচে থাকা কর্মীদের তা উপরের হিসেব থেকে বোঝা গেলেও তাই সম্পূর্ণ নয়। ভ্রমণের সঙ্গেঅঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে রয়েছে আরো কয়েকটি শিল্প। তার মধ্যে অন্যতম মোটরগাড়ি শিল্প। মোটরগাড়ি ও সহযোগী শিল্প ও সহযোগী কাজকর্মের উপরে প্রায় ৪ কোটি শ্রমিক কর্মচারি নির্ভরশীল ও দেশের মোট জিডিপির ৭.৫% ও ম্যানুফাকচারিং শিল্পের ৪৯% মোটরগাড়ি শিল্প থেকে আসে। এমনিতেই ভারতের মোটরগাড়ি শিল্পের অবস্থা খারাপ ছিল। এই কোভিড ১৯ উদ্ভুত আর্থিক ধাক্কা শিল্পের অবস্থাকে আরো খারাপ করবে। ফলে বহু মানুষের কাজ হারানোর সম্ভাবনা রয়েছে। এই সময়ে যে ক্ষেত্রটি চরম বিপদের মুখে পড়েছে সেটি হল পরিবহণ শিল্প। পথ ও জলপথ পরিবহণের অধিকাংশটাই বেসরকারী ক্ষেত্রে। ট্যাক্সি, অটো, বাস, টোটো, রিক্সা, জলপথ পরিবহণ এগুলি গত দেড় মাস চলছে না। এগুলির অধিকাংশই একত্রে অনেক মানুষকে নিয়ে চলে। পরিবহণ চালু হলেও সেভাবে চলার উপরে নিষেধ থাকবে বলে মনে হয়। ফলে সেই কাজেও একটি সঙ্কট থেকে যাবে। রেলওয়ে স্টেশনগুলিতে যে দোকান পসার থাকে সেগুলি এখন বন্ধ। সরকার কোভিড-১৯ এর সুযোগ নিয়ে সেগুলিকে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করবে। রেস্তোরা ও পথ পার্শ্বের ছোট খাবার দোকানগুলিও একই ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সেগুলির পুনর্জীবিত হওয়ার সম্ভাবনা কমছে। শপিং মলের কর্মচারি ও ফুটপাথে হকাররাও বিপুল সমস্যার সম্মুখীন। গত বৈশাখ বা বর্ষ শেষের সেলের বিক্রি বন্ধ হয়েছে। ঈদের বিক্রিও বন্ধের মুখে। পুজোয় যে বিক্রি বাটা হয় তাও কতটা হতে পারবে বলা দুস্কর। প্রায় দেড় মাসের টানা লকডাউন জনসাধারণের অনেক অভ্যেসকে পাল্টে দিয়েছে। যারা বইএর পাতা উল্টাতেন ও মোবাইল বা কম্প্যুটারে পড়ে আনন্দ পেতেন না, তাদের অনেকেই তাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। ফলে বইপাড়াতে ও ছাপাখানায় এর প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা প্রবল। সংবাদপত্র শিল্পের সঙ্গে যুক্ত সাংবাদিক, বণ্টনকারীদের উপরেও বড় ধাক্কা আসতে পারে। অর্থনৈতিক ডামাডোল বিজ্ঞাপন কমাবে, উপরন্তু কাগজের বদলে ইন্টারনেটে সংবাদ পাঠের প্রবণতা ও অভ্যেস তৈরি হয়েছে এই কদিনে। ফলে সংবাদপত্র জগতের সঙ্গে যুক্ত সর্বস্তরের কর্মীদের উপরে কর্মী সঙ্কোচনের খাড়া ঝুলছে। বিমান পরিবহণ শিল্প এমনিতেই দুরবস্থায় ছিল। কোভিড সেই খারাপ অবস্থাকে গভীর করছে। একদিকে ভ্রমণ শিল্পের অবনতি, অপরদিকে কোভিড-১৯ এর জন্য শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে গেলে বিমান শিল্পের ব্যয় প্রভূত বাড়বে। ফলে বিমান ভড়াও ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে। সম্প্রতি বিমান ভাড়া যে মধ্যবিত্তদের আয়ত্বে এসেছেল সেই পর্যায়কে অতিক্রম করে তা আবার উচ্চবিত্তের বিলাসে রূপান্তরিত হবে। ফলে বিমান শিল্পের সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের আয় কমবে ও কর্মী সঙ্কুচিত হবে। রেলপথ পরিবহণের ক্ষেত্রেও যৎপরোনাস্তি ক্ষয়ক্ষতি হয়েচে ও হবে। কিন্তু যেহেতু সেটি সরকারী বিভাগ তাই এই মুহূর্তে সেখানে কর্মী ছাটাই সহজ হবে না।
সব মিলিয়ে শ্রমিক কর্মচারিদের উপরে কোভিড এক দুর্যোগের আবহ তৈরি করেছে। যা কেবল অসংগঠিত ক্ষেত্রের ৪০ কোটি শ্রমিক কর্মচারিই নয়, সংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক কর্মচারিদের উপরেও আঘাত হানার বাতাবরণ তৈরি করছে। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কোথায়? যারা বেসরকারী উদ্যোগের জয়গান গেয়ে থাকেন, তাদের জ্ঞাতার্থে জানাই, এই যে প্রবল কর্মী সঙ্কোচনের সম্ভাবনা তা কিন্তু বেসরকারী ক্ষেত্রেই। সরকারী ক্ষেত্র সমস্ত ‘অদক্ষতা’র অভিযোগ সত্বেও টিকে থাকবে ও অর্থনীতিতে চাহিদার যোগান বজায় রেখে তাকে ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তা করবে। বেসরকারী ক্ষেত্র নিজের মুনাফার তাগিদে ঝাঁপ বন্ধ করে দিতে পারে ও অর্থনীতির দুরবস্থাকে ত্বরান্বিত করতে পারে নিজের সুবিধের জন্য।
শেষ করার আগে অবহেলিত কিছু মানুষজনের দিকে পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। যে সমস্ত মানুষদের আমরা অবমানব হিশেবে গণ্য করি বা ধর্তব্যে আনি না, সব ধরনের হিসেব নিকেশের সময়ে তাদের গুণতির বাইরে রাখি, সেই ট্রান্সজেনডার বা উভলিঙ্গ বা এলজিবিটিকিউ বা হিজরেদের আয় একদম বন্ধ, বন্ধ দেহব্যবসায়ীদের আয়। সমাজের অংশ হিশেবে তাদের বেঁচে থাকার দাবি কেউ কেউ তুললেও তা কোনো স্বর হয়ে উঠতে অপারগ।
অবশেষে, করোনা অতিমারী মোদীর কাছে আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়ালো। শুধু মোদী নয়, দেখা যাচ্ছে বিশ্ব জুড়েই মোদীর মতো অতি দক্ষিণপন্থী শাসকদের কাছে আজকের এই মারাত্বক সংকট তাদের ফ্যাসিবাদী, স্বৈরাচারী শাসনকে সংহত করতে যেন বাড়তি শক্তি যুগিয়েছে। প্রায় সব জায়গায় ক্ষমতাসীন শাসক এই অতিমারিকে মোকাবিলা করতে নিজেই চলে এসেছে কেন্দ্রবিন্দুতে, বিরোধীদের “কোয়ারান্টিনে” পাঠিয়ে। করোনার মোকাবিলায় সোশ্যাল ডিস্টান্সিং, লকডাউন প্রকাশ্যে জনপরিসরকে একেবারেই সংকুচিত করার এক দারুণ হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।
করোনাকে কাজে লাগিয়ে কেন্দ্র সর্বপ্রথম কারখানা আইন, ১৯৪৮-কে সংশোধিত করে বর্তমানে ৮ ঘণ্টার শ্রমদিবসকে ১২ ঘণ্টায় নিয়ে (৬ দিনের সপ্তাহে ৭২ ঘণ্টা) যাওয়ার প্রস্তাব হাজির করে। “খুবই ব্যতিক্রমী পরিস্থিতে ব্যতিক্রমী পদক্ষেপের” প্রয়োজনীয়তা থেকেই এই প্রস্তাব গ্রহণের কথা বলা হচ্ছে। ফ্যাক্টরিস্ অ্যাক্ট, ১৯৪৮-র ৫নং ধারায় বলা আছে যে “পাব্লিক এমারজেন্সি”র সময় সংশ্লিষ্ট সরকার এই ধারাটি সংশোধন করতে পারে। আর, “পাব্লিক এমারজেন্সির” সংজ্ঞায় বলা হয়েছে ‘গ্রেভ’ বা গুরুতর আপৎকালীন পরিস্থিতি, যেমন, ভারতের নিরাপত্তা অথবা তার সীমানার কোনো এক অংশ যখন বিরাট বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে, যুদ্ধ, বহিঃশত্রুর দ্বারা আগ্রাসন অথবা বড় ধরনের আভ্যন্তরীণ গোলযোগ দেখা দিলে সেটাকে পাব্লিক এমারজেন্সি হিসাবে গণ্য করা হবে। কিন্তু মহামারী বা অতিমারীকে এই সংজ্ঞার আওতায় রাখা হয়নি। তা সত্ত্বেও, কেন্দ্র এবং কিছু রাজ্য সরকার এই সুযোগে শ্রমিক বিরোধী কানুন আনার জন্য কোমর বেঁধেছে ।
মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও একই মর্মে আইন সংশোধন করেছে। বিধিবদ্ধ শ্রম সময়ের অতিরিক্ত শ্রম দিলে ওভারটাইম হিসাবে তা গণ্য হয়, আর সেক্ষেত্রে দ্বিগুণ মজুরি আইনগত ভাবে প্রাপ্ত। কিন্তু, গুজরাট সরকার এক্ষেত্রে সেটাও দেবে না। যেহেতু শ্রম ক্ষেত্রটি সংবিধানের যুগ্ম তালিকায়, তাই রাজ্য সরকারগুলোকে দিয়ে এইভাবে আইনটার সংশোধন করে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে বহু রক্তঝরা পথে আট ঘণ্টা শ্রম দিবসের অর্জিত অধিকার। আবার প্রভিডেন্ট ফান্ডের তহবিল থেকে ৪৮০০ কোটি টাকা প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ যোজনায় স্থানান্তরিত করার প্রস্তাব আসছে। একই ভাবে ইএসআই-এর তহবিল থেকে বেশ কিছু পরিমাণ টাকা এমন সব খাতে বিনিয়োগ করার কথা ভাবা হচ্ছে যার সাথে ইএসআই-এর সুযোগ সুবিধার কোনো সম্পর্ক নেই। সারা দুনিয়া জুড়ে করোনা অতিমারীর পরিস্থিতে বিভিন্ন দেশে দুর্বল হয়ে পড়া সামাজিক সুরক্ষার রক্ষাকবচগুলোকে যখন আবার মজবুত করার প্রবণতা শুরু হয়েছে, তখন মোদী সরকার নিজের পুরনো অ্যাজেন্ডাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। ইতিমধ্যে, গুজরাট চ্যাম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের তরফ থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রম দপ্তরের কাছে এক আবেদন জানানো হয়েছে। সেখানে বনিক সভা-টি বলেছে, ২০২০-২১-এর আর্থিক বছরে কর্মী ইউনিয়ন গঠন করার যে অধিকার শ্রম বিরোধ আইনে দেওয়া হয়েছে, তা প্রত্যাহার করা হোক। অর্থাৎ, ইউনিয়ন গঠন করার এই মৌলিক সাংবিধানিক অধিকারটিকে করোনার অজুহাতে হরণ করার দাবি সামনে এসেছে। ইতিমধ্যে, কর্মরত এবং অবসরপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারিদের মহার্ঘ ভাতা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত আগামী দেড় বছর স্থগিত রাখার কথা ঘোষণা করেছে কেন্দ্র। যেহেতু ডিএ মজুরির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, তাই ডিএ-তে হাত পড়ার অর্থ মজুরির উপর আক্রমণ। এর ফলে নিজ পাওনা থেকে বঞ্চিত হবেন প্রায় ৪৮.৩৪ লক্ষ কর্মচারি এবং ৬৫.২৬ লক্ষ পেনশনভোগী। এখন আবার কন্ট্রাক্ট শ্রমিকদের মজুরি নরেগার মজুরি অর্থাৎ ২০২ টাকায় বেঁধে দেওয়ার জোরালো প্রস্তাব সামনে আসতে শুরু করেছে।
করোনাকে মোকাবিলা করাটা মোদী এক যুদ্ধ হিসাবে ঘোষণা করেছেন। যুদ্ধে একজন প্রধান সেনাপতি থাকেন, আর বলাই বাহুল্য তিনিই সেই ভূমিকায় দেশকে সামনে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। যুদ্ধের সময় প্রশ্ন, বিতর্ক করা যায় না। তাই লকডাউনের যাবতীয় যন্ত্রণা যাদের উপর চেপে বসেছে সেই পরিযায়ী শ্রমিকদের ১৪ এপ্রিলের ভাষণে তিনি শৃঙ্খলাবদ্ধ সেনানীর মতো আচরণ করতে বলেছেন, ঠিক যেভাবে কালো টাকা উদ্ধারের যন্ত্রণাকে সইতে নোটবন্দীকে মেনে নিতে বলা হয়। স্বাস্থ্য কর্মীদের ও তিনি “জাতির প্রহরী” এবং “করোনা যোদ্ধা” হিসাবে বর্ণনা করেন। যুদ্ধে সকলকেই অসীম কষ্ট সহ্য করতে হয়, যা মেনে নিতে হয় মুখ বুজে। তাই, কর্মক্ষেত্রের বিপন্নতা বা ঝুঁকি যেমন বর্মবস্ত্র বা মাস্ক না থাকলেও ডাক্তার-নার্সদের তা নিয়ে হৈচৈ করা অনুচিত। বেশ কয়েকটি রাজ্যে স্বাস্থ্য কর্মী এমনকি ডাক্তারদের উপর ও হামলা এ কারণেই হয়েছে।
যুদ্ধ করতে হয় এক বাইরের শত্রুর সঙ্গে। আর এই যুদ্ধে তাই ট্রাম্প যেমন চীন দেশ, চিনা ও এশিয়ানদের দাগিয়েছেন, আমেরিকার এই বিধ্বস্ত অবস্থার পেছনে ‘চিনা ভাইরাস’ কে দায়ী করেছেন, মোদী ও তার দলবল এ প্রশ্নে চিহ্নিত করেছে সংখ্যালঘুদের। ভাইরাসের তল্পিতল্পা নিয়ে যারা দেশে করোনা জিহাদ ঘোষণা করে দেশময় ছড়িয়েছে। আর, যুদ্ধে বৈধ গণতান্ত্রিক অধিকারের সৌখিনতা চলে না। তাই, এই সংকটাপন্ন আবহে আবার ছাত্র নেতা নেত্রী, মানবাধিকার আন্দোলনের সাথে যুক্ত প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবীদের গ্রেপ্তার করা হয়। শীর্ষ আদালতও জানিয়ে দেয় যে এই সময়ে সরকারের সিদ্ধান্তকে আদালত বিরোধিতা করবে না।
দুনিয়া জুড়েই স্বৈরশাসকেরা এই অতিমারিকে কাজে লাগাচ্ছে নিজেদের শাসনকে সংহত করার জন্য। ইজ্রায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর হাজতে থাকার কথা ছিল, বিরাট মাপের এক দুর্নীতির কারণে। কিন্তু এই করোনাই তাকে উদ্ধার করলো। বিশেষ পরিস্থিতির দোহাই তুলে এই সময়ে সমস্ত আদালতকে তিনি বন্ধ করে দেন, নাগরিকদের উপর কড়া নজরদারি রাখার আদেশ দিয়েছেন আর কোয়ারান্টাইন ভাঙ্গার অপরাধে যে কোন নাগরিককে ছ’মাসের জন্য কারারুদ্ধ করা যাবে।
ইউরোপ, আমেরিকা সহ অনেক দেশেই প্রধান বিরোধী দলগুলো করোনার সংকটে সমস্ত রাজনৈতিক বিরোধকে পেছনে সরিয়ে শাসক দলকে সহযোগিতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
হাঙ্গেরির স্বৈরশাসক ভিক্টার ওরবানকে দেশের সংসদ অনির্দিষ্টকালের জন্য ডিক্রি জারি করে শাসন করার পূর্ণ অধিকার দিল। মিথ্যা সংবাদ বা বিকৃত খবর পরিবেশন করার অপরাধে যে কোনো সাংবাদিককে পাঁচ বছর জেলে পুরে রাখার অধিকার তাঁকে দেওয়া হলো। ফিলিপাইন্সের রাষ্ট্রপতি রড্রিগো দ্যুতার্তেকে তাঁর দেশের আইনসভা আপৎকালীন প্রচুর ক্ষমতা দিয়েছে, যে আইনসভায় তাঁর একচ্ছত্র প্রাধান্য রয়েছে। তিনি দেশের বামপন্থীদের সাথে সমস্ত দ্বৈরথের ‘অবসান’ ঘটিয়েছেন করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। একই সঙ্গে কোয়ারান্টাইন কারফিউ লঙ্ঘন করার অপরাধে দেখা মাত্র গুলি চালানোর অধিকার আদায় করে নিয়েছেন।
চিলিতে তো সেনাবাহিনী এখন রাস্তার দখল নিয়েছে। বেশ কিছুদিন আগে পর্যন্ত সরকারের বিরুদ্ধে যে আন্দোলনকারীরা লাগাতার সরকার বিরোধী বিক্ষোভে রাজপথ কাঁপিয়েছিল, তাঁদের আর কোনো ধরনের প্রকাশ্য বিক্ষোভের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না, করোনার কারণে। বলিভিয়াতে সেনাবাহিনীর মদতে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করার পর নির্বাচন করার প্রতিশ্রুতি দেয় শাসক বর্গ। এখন করোনার অজুহাতে অনির্দিষ্টকালের জন্য তা স্থগিত করা হয়েছে। ৩১ জানুয়ারী ইতালিতে প্রথম দু’জনের মধ্যে করোনার সংক্রমণ পাওয়া যায়। এই ঘটনার পরই দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এতো করেও ঠেকানো গেলনা ইতালিতে করোনার সর্বনাশা থাবা। দেখা গেল, জরুরি অবস্থা আটকাতে পারলো না ইতালির সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী অঞ্চল লোমবার্ডিতে ব্যাপক সংক্রমণ। ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রর হাতে এখন অধিকার রয়েছে নাগরিকদের আটক রাখা, সীমানাকে বন্ধ করার। করোনা অতিমারি আবির্ভাবের আগে দেশে দেশে ক্ষমতাসীন শাসকদের বিরুদ্ধে বড় বড় বিক্ষোভ, আন্দোলনের এক বহুবর্ণ সংগ্রামের চিত্রপট রচিত হয়েছিল। কিন্তু করোনার হামলা সব কিছুকে তছনছ করে দিল। নিভৃতবাস, লকডাউনের বাধ্যতামূলক পরিস্থিতি হরণ করেছে প্রকাশ্য আন্দোলনের সমস্ত পরিসর।
কিন্তু এর মধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে উঠে আসছে প্রতিবাদ জানানোর নতুন নতুন রূপ ও পদ্ধতি। লকডাউনের নিয়ম বিধিকে মেনে প্রকাশ্যে বা ঘরের অভ্যন্তরে আমাদের পার্টি ও বামপন্থীরা নিজেদের প্রাসঙ্গিকতাকে বজায় রাখতে বেশ কিছু কর্মসূচি নিচ্ছে। ওয়ার্ক ফ্রম হোমের মতো প্রোটেস্ট ফ্রম হোম এখনকার নতুন প্রতিবাদের ভাষা। দেখা যাচ্ছে, এটাকেও বরদাস্ত করা হচ্ছে না। তামিলনাড়ু, উত্তর প্রদেশের অযোধ্যায় ঘরের মধ্যে অনশন করার জন্য পুলিশী হেনস্থা, এমনকি গ্রেপ্তার ও করা হয়েছে।
করোনা ফ্যাসিস্ট শাসকদের কাছে আশীর্বাদ হয়ে উঠেছে। অতিমারীর বিরুদ্ধে লড়াই এবার ক্রমে ক্রমেই ক্ষুধার বিরুদ্ধে ব্যাপক মানুষকে নিয়ে আরও বড় এক গণজাগরণের অপেক্ষায় দিন গুনছে।
নোবেলজয়ী অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন যে দরিদ্রদের ত্রাণ সরবরাহের ক্ষেত্রে ভারত যা দরকার তার কাছাকাছিও কিছু করতে পারেনি। তিনি আরও বলেন যে পরবর্তী কালে সরকারের কী করা উচিত সে সম্পর্কে ভারত সরকারকে একটি “স্পষ্ট, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা” বানাতে হবে।
বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন যে সংকট মোকাবিলায় সরকার “সিস্টেমের মধ্যে একটি ধাক্কা দিয়ে ঠিক করেছে”, তবুও লোকদের ত্রাণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আরও উদার হওয়া দরকার। “এই রোগটি দীর্ঘদিন ধরে আমাদের সঙ্গে থাকবে যতক্ষণ না কোনও প্রতিষেধক আসে, যা খুব তাড়াতাড়ি হওয়ার সম্ভাবনা নেই ।”
ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ইতিমধ্যে অতিরিক্ত চাপের মধ্য দিয়ে চলেছ। এর ওপর করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের ফলে জীবিকা অর্জন করার সুযোগ হ্রাস পেয়েছে এবং এর জন্য বাজারে চাহিদা হ্রাস পেয়েছে, “আমি জানি যে একটি উদ্বেগ আছে যে ‘বাজারগুলি যদি বন্ধই থাকে তাহলে অর্থ প্রদান করে কি হবে?’ তবে, মানুষকে টাকা দিলে মানুষ আশ্বস্ত হবে এবং বাজারে চাহিদা বাড়বে। মানুষের আশ্বাস দরকার। এবং জনগণকে আশ্বাস দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারকে তৎপর হতে হবে।”
অভিজিৎ বাবু যোগ করেছেন যে, ভারতীয় প্রশাসনের উচিত আয়ের সুযোগ হারানোর কারণে দারিদ্র্যের মুখোমুখি হওয়া লোকদের আরও উদার হস্তে সাহায্য করা। “কোটি কোটি পরিবার যারা ইতিমধ্যে ভারতের বহু কল্যাণমূলক প্রকল্পের প্রাপক হিসাবে তালিকাভুক্ত আছেন তাদেরকে সরাসরি টাকা দেওয়া, বিপুল সংখ্যক লোক যারা এই জাতীয় প্রকল্পের সুবিধাভোগী নয় তাদের চিহ্নিত করে অর্থটি তাদের পকেটে পৌঁছেছে কি না তা নিশ্চিত করার জন্য স্থানীয় রিপোর্টিং-এর ব্যবস্থা করা দরকার”।
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ স্বীকার করেছেন যে এই সুবিধাগুলির প্রাপকদের চিহ্নিতকরণ প্রক্রিয়ায় ভুল থাকবে, “কিন্তু, নিখুঁত থাকাটা এই মুহুর্তের মূল কথা নয়, এটি জরুরি অবস্থা”। অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় আরও বলেছেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো ভারতেরও জনকল্যাণ স্কিমগুলোর প্রসার ঘটাতে অর্থ ছাপানো উচিত।
বন্দ্যোপাধ্যায় আরও বলেন, “সম্ভবত পণ্য ও পরিষেবার সরবরাহ না হলে মুদ্রাস্ফীতি হওয়ার আশঙ্কা আছে ভারত সরকারের। “তবে, ভারতে উপার্জনের যেরকম বৈষম্য তৈরি হয়েছে তা কমানোর জন্য কিছু করা দরকার। সরকারকে আরও আগ্রাসী ভাবে অর্থ ব্যয় করতে হবে”।
বাংলা রিপোর্ট- প্রত্যুষ নন্দী, সূত্র: দ্যা ওয়্যার।
লেখক কোষ ও আণবিক জীববিদ্যা গবেষক , ক্যালিফোর্ণিয়া, USA
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি COVID-19 র জন্য দায়ী SARS-COV-2 করোনা ভাইরাস প্রতিষেধক ভ্যাক্সিন বানাচ্ছে আমরা সবাই এতদিনে জেনে গেছি। এ সংক্রান্ত একটা Post খুব ভাইরাল হচ্ছে, করোনা ভাইরাসের মতই, যে এলিসা গ্রানাতে বলে একজনকে SARS-COV-2 করোনা ভাইরাসের ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়েছে। এবং এর পরে ওঁর শরীরে করোনা ভাইরাস ইঞ্জেক্ট করা হবে। যদি ভ্যাক্সিন কাজ না করে, ওঁর মৃত্যুও হতে পারে। মাত্র ৩২ বছর বয়েসে এলিসা মানবতার স্বার্থে এতবড় জীবনের ঝুঁকি নিলেন। ভ্যাক্সিন সফল হলে বিজ্ঞানীকে লোকে মনে রাখবে, এঁকে লোকে ভুলে যাবে। স্যালুট ইত্যাদি।
এতগুলো কথার মধ্যে এলিসাকে ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়েছে, এই কথাটাই খালি সত্যি। বাকি যা লেখা আছে, তা বাংলা সিরিয়ালের গ্যাদগ্যাদে সংলাপ মাত্র। খালি তাই না, তা চরম মিথ্যা, ভুল এবং মারাত্মক অপবিজ্ঞান। ভ্যাক্সিনের কার্য্যকারীতা এভাবে পরীক্ষা করা হয় না। হ্যাঁ, স্মল পক্স নিয়ে ডাক্তার এডোয়ার্ড জেনার এরকম পরীক্ষা করেছিলেন। কিন্তু তা ১৭৯৬ সালে। তারপর আর কেউ করেছেন বলে শুনিনি। সেই গপ্প ভাঙ্গিয়ে লোকে ২০২০-তে বসে এরকম গল্প সোশ্যাল মিডিয়ার বাজারে ছাড়ছে!
প্রথমত, ভ্যাক্সিন কোনো একজনের ওপর পরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় না। বিরাট সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবীর ওপর পরীক্ষা করা হয়। সেরকম এই করোনা ভ্যাক্সিনও প্রথম ধাপে ১১০২ জন স্বেচ্ছাসেবীর ওপর প্রয়োগ করা হবে। এলিসা একা নন, ওঁর পরেও আরও ১১০০ জন আছেন। ১১০২-১=১১০১ আমি জানি। অঙ্কে কাঁচা হলেও, এতটাও না!! তাহলে ১১০০ কেন বললাম? কারণ, সেদিন মাইক্রোবায়োলিজিস্ট এলিসার সাথে এডোয়ার্ড ও’নীল বলেও একজন ক্যান্সার গবেষককেও করোনা ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়েছিল। এলিসাই কি করে বিখ্যাত হয়ে গেলেন জানি না !
দ্বিতীয়ত, এলিসাকে হয়তো করোনা ভ্যাক্সিন দেওয়াই হয়নি। অবাক হলেন? বিজ্ঞাপনী হিন্দিতে, চক গ্যায়ে? হবেন না!কারণ, যে কোনa ওষুধ বা ভ্যাক্সিন যখন পরীক্ষা করা হয়, তখন একদলকে ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়, আরেকদলকে নুনজল ইত্যাদি মিছিমিছি ওষুধ দিয়ে, ভ্যাক্সিন দেবার ভান করা হয়। আর কাকে আসল ভ্যাক্সিন দেওয়া হচ্ছে আর কে মিছিমিছি, সেটা একমাত্র গবেষক জানেন। যিনি ইঞ্জেক্ট করছেন, তিনিও হয়তো জানেননা, যে তাকে “দিদি, কি দিলে গো?’ ভ্যাক্সিন না নুনজল?” বলে জেনে নেবেন!
এবার দু’দলকে বেশ কয়েকমাস নজরে রেখে দেখা হয়, যাদের ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়েছিল, মিছিমিছি দলের সাথে রোগ প্রতিরোধে তাদের কোন পার্থক্য আছে কিনা! যদি থাকে তবে কত বেশি পার্থক্য!
সে জন্য ১১০২ জনকে দুভাগে ভাগ করে একদলকে করোনা ভ্যাক্সিন আর একদলকে মিছিমিছি হিসেবে মেনিনজাইটিসের ভ্যাক্সিন দেওয়া হবে। মেনিনজাইটিস ভ্যাক্সিনের সাথে করোনার কোনো সম্পর্ক নেই। এটা meningococcus ব্যাক্টিরিয়ার ভ্যাক্সিন। নুন জলের বদলে মিছিমিছি হিসেবে মেনিনজাইটিস ভ্যাক্সিন কেন দেওয়া হল? কারণ, করোনা ভ্যাক্সিন দিলে, সাময়িক ভাবে জ্বর আসতে পারে, ছুঁচ ফোটানোর বাহুতে ব্যাথা ইত্যাদি হতে পারে। নুন জল দিলে তা হবে না। তাই যাকে দেওয়া হল, তিনি বুঝে যাবেন তাঁকে করোনা ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়েছে। মেনিনজাইটিস ভ্যাক্সিনেও যেহেতু একই রকম জ্বর, ব্যাথা হতে পারে, তাই নুন জলের বদলে এই ভ্যাক্সিন। অবশ্যই জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যে “আপনাকে করোনা বা মেনিনজাইটিস, যে কোন একটা ভ্যাক্সিন দেওয়া হচ্ছে”! কিন্তু কোনটা সেটা বলা হয় না। তাই হতেই পারে এলিসাকে হয়তো মেনিনজাইটিস ভ্যাক্সিন, যা করোনার ক্ষেত্রে মিছিমিছি আর এডোয়ার্ডকে আসল করোনা ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়েছে। সেটা ওই ভ্যাক্সিন টিমের প্রথম সারির লোকজন ছাড়া কেউ জানেননা। এত লুকোছাপা কেন? কারণ বলে দিলে তো যাঁকে দেওয়া হয়েছে, তিনি ভাববেন আমি এখন করোনা প্রতিরোধ করতে পারব, বলে বেশি সাহসী হইয়ে উঠতে পারেন, কিন্তু ভ্যাক্সিন হয়তো কাজই করলনা, এদিকে তিনি আক্রান্ত হলেন। উল্টোদিকে যিনি জানেন, তিনি মিছিমিছি ভ্যাক্সিন পেয়েছেন, তিনি এত সাবধানী হয়ে গেলেন, করোনা সংক্রমণ তাঁর এমনিই হল না। দুক্ষেত্রেই প্রকৃত সমীক্ষা কখনোই হবে না। ভুলভাল ফল আসবে।এটাই কারণ। এছাড়া আরও না না কারণে, যে কোনো ওষুধ বা ভ্যাক্সিনের মানবদেহে পরীক্ষার ক্ষেত্রে এই গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়।
তৃতীয়ত, ৩২ বছর বয়সী এলিসা বা তরুণ এডোয়ার্ড এত বড় প্রাণের ঝুঁকি নিলেন কেন? এডোয়ার্ডের আবার ছোট বাচ্চাও আছে। এরপর তো ওঁদের দেহে করোনা পুরে দেওয়া হবে! যদি ভ্যাক্সিন কাজ করে, তাহলে একজন বাঁচবেন আর না কাজ করলে দুজনেই মরবেন! তাই তো? শুনুন মশাই, ওভাবে কোনো ভ্যাক্সিন পরীক্ষা হয় না। আর একটা কথা, করোনা মানেই মৃত্যু এটা বারবার বলছি, একেবারেই নয়। রোগলক্ষণহীন Asymptomatic-দের ধরলে মৃত্যুহার মাত্র ১%। যাই হোক, ১% হলেও কারো দেহে কোনো করোনা পুরে দেওয়া হবে না, meningococcus ও ভরে দেওয়া হবে না। ১১০২ জন যে যেখানে আছেন, তেমনই থাকবেন, যেমন জীবন যাপন করছেন, তাই করবেন। করোনা সংক্রমণ সারা পৃথিবীর লোকের যেমন করে হচ্ছে তেমনি হবে। কয়েকমাস বাদে দেখা হবে, করোনার এই প্রকোপের মধ্যেও ভ্যাক্সিন আর মিছিমিছি দু’দলের মধ্যে ভ্যক্সিন-দল কতটা সুরক্ষিত ছিলেন। তারপর Statistician বা রাশিবিজ্ঞানীরা চশমা এঁটে, নাকে নস্যি নিয়ে, অনেক জটিল অঙ্ক কষে জানাবেন ভ্যাক্সিন কতটা কার্য্যকারী বা সফল হল। যদি কাজ না করে, দু’দলই করোনা আক্রান্ত হতে পারেন। স্বেচ্ছাসেবীদের বয়েস সবার ১৮-৫৫। এবং সুস্বাস্থ্যের অধিকারী বা অধিকারিণীকেই এই পরীক্ষায় নেওয়া হচ্ছে, তাই ভ্যাক্সিনে কাজ না হলেও মরার কোনো সম্ভাবনাই প্রায় নেই। নেহাত মারা গেলেও অন্তত ভাক্সিনের কাজ করা বা না করায় তাতে কোনো ভূমিকা নেই। আর ভ্যাক্সিনের জন্য বড়জোর দুদিন জ্বর, গা ব্যাথা হতে পারে। মারা যাবার কোনো প্রশ্নই নেই! তাই দোহাই, গ্যাদগ্যাদে সংলাপের আড়ালে বিজ্ঞানটাকে হারিয়ে ফেলবেন না।
এখন ভ্যাক্সিনটি কতটা কার্যকরী হল, তার সম্পূর্ণ হিসেব পেতে আগামী কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হবে।
গত ২৩ এপ্রিল সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি শারীরিক দূরত্ব রেখে সামাজিক সংহতি ও ঐক্যের দাবিতে, লকডাউনে ক্ষুধার বিরুদ্ধে, করোনার নামে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রচারের প্রতিবাদে এবং মহিলা ও শিশুদের প্রতি ক্রমবর্ধমান হিংসার বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে অনশন অবস্থান কর্মসূচী পালন করে। লকডাউনের সময়কার নিয়মবিধি মেনে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাড়িই হয়েছে অনশন অবস্থানস্থল।
এরাজ্যের বিভিন্ন জেলায় এই কর্মসূচি পালিত হয। প্ল্যাকার্ড, পোস্টার নিয়ে মহিলারা করোনা লক-ডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত সমস্ত গরিব, প্রান্তিক, কাজ-হারা ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য খাদ্যের দাবি, রেশনে প্রত্যেক মানুষের প্রয়োজন অনুসারে খাদ্যদ্রব্য বণ্টনের দাবি করেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে করোনার নামে অস্পৃশ্যতা,ঘৃণা ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ প্রচারের বিরুদ্ধে ঐক্য ও সম্প্রীতির আওয়াজ তোলা হয়। ডাক্তার, নার্স, আশা, স্বাস্থ্যকর্মী ও করোনা আক্রান্তদের উপর যে সামাজিক অস্পৃশ্যতা দেখা যাচ্ছে তার বিরোধিতা করি।
অতিমারীর সময়ে নারী ও শিশুদের উপর ঘরোয়া হিংসা বৃদ্ধির বিরুদ্ধে হেল্প লাইনের ও নিরাপত্তার দাবি করা হয়। এছাড়া পরিযায়ী শ্রমিক পরিবার, অসংগঠিত ক্ষেত্রের মহিলা আশা, অঙ্গনওয়াড়ি, মিড ডে মিল, পরিচারিকাদের মহামারী ভাতার জন্য সরকারের কাছে দাবি করা হয়।
দার্জিলিং জেলার রিপোর্ট – কোভিড -১৯ এর সময় লকডাউন চলাকালীন ক্রমশ বেড়ে চলা সাম্প্রদায়িক হিংসা বুভুক্ষা ও অবহেলার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়া মানুষের সঙ্গে ঐক্য ও সংহতি জানাতে এবং পরিযায়ী ও অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের মজুরি হ্রাস না করে উপযুক্ত লকডাউন ভাতা দেওয়ার দাবি সহ বিভিন্ন দাবিতে শারীরিক দুরত্ব বজায় রেখে সকাল ১১ থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত সমস্ত রাজ্যের সঙ্গে দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি-ফাঁসিদেওয়া-কাওয়াখালি এবং খড়িবাড়িতে অনশন প্রতিবাদ পালন করলেন সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির কর্মী সমর্থকেরা।
ফকদই বাড়ি - শিলিগুড়ির ডাবগ্রাম ফুলবাড়ি সংলগ্ন ফকদই বাড়িতে প্রায় চল্লিশ জন শ্রমজীবী মহিলা সকাল ১১ থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত অনশন বসেন। বিভিন্ন দাবির সপক্ষে শ্লোগানে মুখরিত অনশন কর্মসূচির নেতৃত্বে ছিলেন মীরা চতুর্বদী, রীতা সরকার, ময়না সরকার প্রমুখ।
শক্তিগড় : শিলিগুড়ি শক্তিগড়ে সকাল ১১ থেকে প্রতিবাদী অনশন শুরু হয়। মুলত শ্রমজীবী পরিবার থেকে আসা ১৫ জন মহিলা অনশনে বসেন। নেতৃত্বে ছিলেন রুবী সেনগুপ্ত, মিলি ভট্টাচার্য, গঙ্গা রায়, ছবি দত্ত, কল্পনা সরকার, ভাগ্য মন্ডল, আরতি বর্মণ, সঙ্গীতা দাস প্রমুখ। শ্লোগানে মুখরিত অনশন কর্মসূচী চলাকালীন পথচলতি অনেক মানুষকেই দাঁড়িয়ে শুনতে দেখা যায়। এআইপিডব্লিউএ-র অনশন কর্মসূচীকে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন পার্টির জেলা নেতৃত্ব পুলক গাঙ্গুলী। যদিও স্থানাভাব এবং কমরেডদের স্বতস্ফূর্ততার কারণে চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত শারীরিক দুরত্ব বজায় রাখতে পারা যায়নি।
কাওয়াখালি : কাওয়াখালিতেও প্রতিবাদ অনশন কর্মসূচি পালিত হয় মামণি বর্মণ, প্রতিমা সরকার, শম্পা বর্মনের নেতৃত্বে।
ফাঁসিদেওয়া ভতন জোত : সফে সিংহ, শোভা বর্মণদের নেতৃত্বে ভতন জোতের তিনটি জায়গায় প্রতীকী অনশন বসেন প্রায় ২০ জন শ্রমজীবী মহিলা। বিকাল ৫টা পর্যন্ত অনশন চলেছে।
খড়িবাড়ি : খড়িবাড়ি সোনাচান্দি চাবাগান সংলগ্ন কদুভিটাত সুমন্তি এক্কার নেতৃত্বে চা বাগানের মহিলা শ্রমিকেরা উত্সাহের সাথে প্রতিবাদ অনশন কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করেন।
সমস্ত জায়গাতেই শ্রমজীবী মহিলাদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য।
সর্বভারতীয় স্তরে সারা ভারত কৃষি মজুর ও গ্রামীণ মজুর সমিতি এবং সারা ভারত কৃষক মহাসভা কৃষক ও গ্রামীণ মজুর এবং পরিযায়ী শ্রমিক জনগনের দাবি দাওয়া ও সমস্যা নিয়ে দেশব্যাপী উদ্যোগী হয়। লকডাউন-এর নিয়ম মেনে (মাস্ক পরা এবং শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা) এই ধরনের আন্দোলন বা কর্মসূচী করা নতুন নতুন অভিজ্ঞতাকে সামনে এনেছে। আমরা এই প্রোগ্রামে দেখলাম আসাম, এিপুরা, ছএিশগড়, অন্ধ্রপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, হরিয়ানা, ঝাড়খণ্ড, তামিলনাড়ু, বিহার, বাংলা প্রভৃতি রাজ্যে সক্রিয়ভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। পার্টির গড়ে তোলা দুটো কৃষক সংগঠনের নেতৃত্ব ও কর্মীবৃন্দ অল্প সময়ে পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন নতুন নতুন জায়গায় কর্মসূচী সংগঠিত করে। রিপোর্টগুলি বেশ উৎসাহ জনক।
আমরা দেখলাম আমাদের ঠিক করা দাবিগুলি ছাড়াও নতুন কিছু দাবি যুক্ত হয়। যেমন মধ্যপ্রদেশে বেশ কিছু জায়গায় আফিম চাষিদের, মালদা-মুর্শিদাবাদ পলুচাষির (রেশম) এবং চা পাতা চাষ করে তাদের দাবি-দাওয়াগুলি যুক্ত হয়ে পরে, তেমনি তার সাথে যুক্ত চাষিরাও এই আন্দোলনে সামিল হন। করোনাও লকডাউনের জন্য পরিযায়ি শ্রমিক, গ্রামীণ মজুর, কৃষক জনগন চরম দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে পড়েছে। পরিযায়ী শ্রমিকদের কাজ খাদ্য বাসস্থান নেই। তাদের অর্ধাহার অনাহারে দিন কাটাতে হচ্ছে। কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসলের নায্য মূল্য পাচ্ছে না। তারাও সংকটে পড়েছে। যারা দেশের জনগণের খাদ্য তৈরি করে তারা আজ খেতে পাচ্ছে না। কাজ খাদ্য বাসস্থান থেকে কোটি কোটি মানুষ বঞ্চিত। এই কঠিন অবস্থায় কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের ত্রান সামগ্রী খুব সীমিত। ক্ষোভ এর প্রকাশ ক্রমশ বাড়ছে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই কর্মসূচীতে আমরা দেখতে পেলাম, জনগণের দাবি দাওয়া অবিলম্বে আশু সমাধান জরুরি। আমরা দেখতে পেলাম বাকুড়া, বর্ধমান, হুগলি, নদিয়া, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, দক্ষিন ২৪ পরগনা, মালদহ, দাজ্জিলিং, জলপাইগুড়ি, উত্তর ২৪ পরগনা, হাওড়া প্রভৃতি জেলার গ্রামাঞ্চলে কমরেডরা সাহসিক ও সৃজনশীল ভাবে কর্মসূচী সফল করেছেন। জনগণের অংশ গ্রহণের মধ্যেও উৎসাহ ছিল। এতে আমরা দেখলাম বর্ধমান, বীরভূম, হুগলি এই কয়েকটি জেলায় কাজের পুরনো জায়গা যুক্ত হয়েছে।
আসুন আমরা জনগণের এই ক্ষোভকে ব্লক ও জেলাশাসক-এর অফিসে পৌছে দিই জনগনের নায্য অধিকার আদায় করতে জনগণকে সামিল করি। লকডাউন উঠে গেলেই এই কাজে নেমে পড়তে হবে। বিজেপির ফ্যাসিবাদী রাজনীতিকে মোকাবিলা করেও রাজ্য সরকারের কাছে আমাদের দাবিকে জোরদার করি।
-- কার্তিক পাল
মূল্যবৃদ্ধির এই বাজারে সব্জির দাম ৩ টাকা বা ৪ টাকা কেজি-ভাবা যায়? লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকে কমপক্ষে ১২-১৫ দিন ধরে গ্রাম বাংলার চাষিরা ফসলের এই নগন্য দাম পেয়েছে! শুনতে আশ্চর্য লাগলেও এটাই বাস্তব! বাঁকুড়ার ওন্দা কিংবা হুগলীর সিঙ্গুর, বর্ধমানের কালনা পূর্বস্থলী থেকে শুরু করে ২৪ পরগণার ভাঙড় - গ্রামের মাঠে মাঠে কৃষকের রক্ত ঘামে উৎপাদিত ফসল – পটল, উচ্ছে বেগুন, কুমড়ো হেলায় পড়ে আছে। গ্রাম বাংলার সর্বত্রই ছিলো এমন ছবি ! চাষিরা নিরুপায় হয়ে নামমাত্র দামে, বিপূল লোকসানে আনাজ বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়িতে তো হাটের রাস্তায় টমেটো, বেগুন ফেলে তুমুল বিক্ষোভ দেখিয়েছে কৃষকরা। লকডাউন শুরু হওয়ার পর সম্পূর্ণ অপরিকল্পিত ভাবে বিকল্প ব্যবস্থা না করে গ্রামীণ হাট ও কৃষি পণ্য পরিবহন ব্যবস্থাকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তৈরি করা হয়েছে চাষির সর্বনাশ! অথচ শহর গঞ্জে সেই ফসল বিক্রি হয়েছে ৪-৫ গুন বেশি দামে! এখন এই চাষিদের ন্যায়সঙ্গত ক্ষতিপূরণ কে দেবে? তাই আজ দাবি উঠেছে সরকারকে কৃষকদের একর পিছু ২৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। লাভজনক দামে সরকারী উদ্যোগে গ্রামস্তর থেকে সমস্ত ফসল কিনতে হবে।
লকডাউনে কাজ হারিয়ে ভিন রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া গ্রামীণ পরিযায়ী শ্রমজীবীরা অনেকেই এ সময়কালে ঘরে ফিরে এসেছে। শহর থেকে গ্রাম এই উল্টোযাত্রা – যা সবে মাত্র শুরু হয়েছে আগামীদিনে বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। এর ফলে গ্রামীণ মজুররা এখন সংখ্যায় বাড়ছে। কিন্তু রেশনের যৎসামান্য খাদ্যদ্রব্য –দৈনিক ১৬৬ গ্রাম চাল বা গম/আটা ছাড়া সরকার তাঁদের আর কিছুই দিলো না। কোনো রোজগার নেই, তারা খাবে কী? স্বাস্থ্যবিধি মেনে ১০০ দিনের কাজ চালু হবে এই ঘোষণা সরকার করেছে এপ্রিলের ১০ তারিখ। কিন্তু দুই সপ্তাহ হয়ে গেলো “কাজের দেখা নাই”। লকডাউনের এই আকালে অনাহার অর্ধাহারে থাকা সমগ্র গ্রামীণ মজুররা তাই দাবি তুলেছে ২০০ দিনের কাজ দাও, ৫০০ টাকা মজুরি দাও। কাজ না হওয়ার ক্ষতিপূরণ হিসাবে প্রতিটি জবকার্ড এ্যাকাউন্টে ১০ হাজার টাকা দাও।
অধিকার বুঝে নেওয়া এই সমস্ত দাবিগুলিতে লকডাউনের এক মাস কেটে যাওয়ার পর গত ২৭ এপ্রিল দেশব্যাপী সংগঠিত হলো প্রতিবাদ দিবস। সারা ভারত কিষাণ মহাসভা ও সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতির আহ্বানে যেন উঠে গেলো “আন্দোলনের লকডাউন”। প্রতিবাদী বিক্ষোভে সমবেত মেহনতি মানুষের শরীরী ভাষায় ফুটে উঠলো সংকটগ্রস্ত লক্ষ কোটি মানুষের মধ্যেকার জমে থাকা পুঞ্জিভূত ক্ষোভ – কাজ দাও, খাদ্য দাও, ক্ষতিপূরণ দাও। কারন লকডাউনে সবচেয়ে বেশী মূল্য দিতে হয়েছে তাঁদেরই! এই কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করেছিলো সিপিআই(এমএল) ও মনরেগা সংগ্রাম সমিতি। আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চ প্রধানত হুগলী জেলায় ছিলো একেবারে সামনের সারিতে। এখনও পর্যন্ত প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী
রাজ্যের বিভিন্ন গ্রামীণ জেলাগুলির প্রায় ৬৫-৭০ টি গ্রামে কয়েকশত গরিব মানুষ এই বিক্ষোভ কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করেছেন। লকডাউনের পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিজ নিজ গ্রামে-পাড়ায়-গঞ্জে-হাটে-বাজারে শারিরীক দূরত্ব বজায় রেখে, সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে স্লোগান প্ল্যাকার্ড নিয়ে তাঁরা নিজেদের বাঁচার দাবিগুলিকে তুলে ধরেছেন। সকলের মুখে ছিলো মাস্ক বা মুখোষ-না থাকলে গামছায় বা শাড়ির আঁচলে নাক মুখ ঢেকে- ঝুড়ি কোদাল নিয়ে, কোথাও বা কাস্তে হাতে তারা তুলে ধরলেন নিজেদের জীবনযন্ত্রণার কথা। কারও দয়া দাক্ষিন্য নয়, তারা সোচ্চার হয়ে উঠলেন নিজেদের অধিকারের দাবিতে, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের প্রতারণা ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে। বহু জায়গায় শাসক তৃণমূলের চোখরাঙ্গানি, কোথাও বা পুলিশের চক্রান্ত উপেক্ষা করে সংগ্রামী চেতনায় উদ্দীপ্ত ছিলো বঞ্চিত মানুষের এই প্রতিবাদী কর্মসূচী। বঞ্চনার তালিকা ক্রমশই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। যে ক্ষুদ্র কৃষক, ভাগ-চুক্তি চাষিরা ফসলের লাভজনক দাম পায়নি, যে গ্রামীণ মজুর- আদিবাসী-সংখ্যালঘু মানুষেরা রেশন কার্ড থেকে বঞ্চিত – ফলে বরাদ্দ সামান্য চাল গমটুকুও তাদের জোটেনি, দুর্নীতির কারনে বহু গরিব মানুষ প্রাপ্য মালপত্র পায়নি। যে চা বাগিচা শ্রমিকরা পায়নি ন্যায্য মজুরি, যে মহিলা বিড়ি শ্রমিক কর্মহীন হয়ে মজুরিহীন দিন কাটিয়েছে তারা সকলেই কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করেছেন। বারংবার ব্লক দপ্তরে অবস্থান করে, একরোখা লড়াই চালিয়ে যে সমস্ত গ্রামীণ আদিবাসী গরিব মানুষেরা ত্রাণ সাহায্য আদায় করেছেন তারাও ছিলেন প্রতিবাদের সামনের সারিতে। যে দৃঢ়চেতা মায়েরা দুরদেশে কাজ করতে যাওয়া সন্তানদের ফেরত আনার দাবিতে অনশন বিক্ষোভ করতে বাধ্য হয়েছিলেন তারাও সমাবেশিত হয়েছিলেন নিজ গ্রামের প্রাঙ্গনে – লাল পতাকা হাতে। করোনাকে কাজে লাগিয়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে প্রবল ঘৃণা প্রচার চলছে। গ্রামে গ্রামে উভয় সম্প্রদায়ের এই ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদী কর্মসূচী তুলে ধরেছে কৃষকের শ্রেণী ঐক্যের বার্তা।
বিক্ষোভ থেকে দাবি উঠলো পরিযায়ীদের ঘরে ফেরাও তাঁদের খাদ্য দাও, নগদ অর্থ দাও। এক মাস হয়ে গেলো কেন্দ্রীয় প্রতিশ্রুতি – পিএম যোজনায় কৃষকদের আর্থিক সাহায্য কেন আজও কাগজে কলমে রয়ে গেলো? ফসল কেনার সরকারী উদ্যোগ নেই, উল্টে কেন্দ্রীয় সরকার সারের উপর ভর্তুকি কমিয়ে চাষের খরচ বাড়িয়ে দিলো কেন? অথচ কর্পোরেটদের বিগত পাঁচ বছরে অনাদায়ী ঋণ মুকুব করা হলো ৭.৭ লক্ষ কোটি টাকা! রাজ্য সরকার মেলা খেলায় কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছে অথচ কৃষকদের বিদ্যুতের মাশুল কমাচ্ছে না কেন? কেন ডিজেলে সরকারী কর কমিয়ে চাষিদের ভর্তুকি দিয়ে তা সরবরাহ করা হবে না? সার বীজ কম দামে দেওয়া হবে না? কেন ফড়ে দালাল মহাজনেরা চাষির থেকে কম দরে ধান কিনে সেই ধান সরকারের ঘরে বিক্রি করে মুনাফা করে নিচ্ছে?
এখন সামনেই গ্রামে গ্রামে বোরো ধান কাটার সময়। কৃষক ও মজুর উভয়ের স্বার্থে ১০০ দিনের কাজকে কৃষিকাজের সাথে যুক্ত করার দাবি বামপন্থীরা দীর্ঘ দিন ধরে তুলে আসছে। এই বিষয়টা সম্প্রতি এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তুলে ধরলেন এবং কেন্দ্রকে চিঠি দিয়ে নিজের দায় সারলেন। কিন্তু রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে তার কোনো সরকারী নির্দেশ আজও হলো না। গ্রামাঞ্চলে কৃষি পরিকাঠামো নির্মাণে, জলসম্পদ সৃষ্টি করতে কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্প কার্যকরী ভুমিকা নিতে পারে। কিন্তু কেন্দ্র মনরেগা খাতে বাজেটে বরাদ্দ অর্থের পরিমান ১০০০ কোটি টাকা কমিয়ে দিয়েছে। ১০০ দিনের প্রকল্পে সারা দেশে কেন্দ্রীয় সরকারের বরাদ্দ ৬১ হাজার কোটি টাকা। অপরদিকে দেশের ৫০ জন শিল্পপতির অনাদায়ী ব্যাংক ঋণ মুকুবের পরিমান ৬৫ হাজার কোটি টাকা! গরিব মানুষের প্রতি কেন্দ্রের মনোভাব এ থেকে স্পষ্ট হয়ে যায়। পাশাপাশি রাজ্য সরকার ১০০ দিনের কাজে ব্যপক দুর্নীতি করে গ্রামীণ মজুরদের লাগাতার বঞ্চিত করে চলেছে। দেখা যাচ্ছে ১০০ দিনের কাজ চালু করার জন্য পঞ্চায়েতের কোনো জরুরি নির্দেশ আজও জারি করা হলো না।
আজ লকডাউনের ফলশ্রুতিতে পরিযায়ীদের সংকট বা শিল্প-ব্যবসা ক্ষেত্রে যে সংকট দেখা দিয়েছে তার ফলে গ্রামাঞ্চলে যে বর্ধিত শ্রমশক্তি তারা তো আমাদের দেশেরই সম্পদ। অনেক বিশেষজ্ঞরা বলছেন এ সময়কালে শ্রম নিবিড় যে ক্ষেত্রগুলি গ্রামে প্রভূত সম্পদ সৃস্টি করতে পারে যেমন – বৈজ্ঞানিক পশুপালন, মৎসচাষ,খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ-যে গুলিকে বছরের পর বছর অবহেলিত করে রাখা হয়েছে, সেই ক্ষেত্রগুলিকে এখন নতুন করে ব্যবহার করা যেতে পারে। মনরেগার বিরাট গুরুত্ব এক্ষেত্রে রয়েছে। কিন্তু তা নিয়ে সরকারের কোনো পরিকল্পনাই নেই। বিক্ষোভ কর্মসূচী থেকে এ প্রশ্ন উঠে আসে। এছাড়া আজ খাদ্য নিরাপত্তাও একটা কঠিন সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে। এসময় রেশন ব্যাবস্থাকে ঢেলে সাজানো – প্রতিটি পরিবারকে মাসে ৫০ কেজি খাদ্যদ্রব্য এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে রেশনে ডাল, ভোজ্য তেল সরবরাহের দাবিটাও গুরুত্বের সাথে উঠে আসে। ফসলের সরকারী ক্রয় ও গণবণ্টন এই দুটি প্রশ্ন অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। তাই কৃষক ও কৃষিশ্রমিকের যুক্ত লড়াই আগামীদিনে শক্তিশালী করে তোলার অঙ্গীকার প্রতিবাদী কর্মসূচী থেকে তুলে ধরা হয়।
কর্মসূচী অনুষ্ঠিত হয় যেখানে – পুর্ব বর্ধমান জেলার ব্লক ভিত্তিক গ্রামের নাম – কালনা ২নং ব্লক – আগ্রাদহ, ঝিকড়া ও বাজিতপুর। পুর্বস্থলী ২নং ব্লকের – সিমলা, চণ্ডীপুর। কালনা ১নং ব্লকের – একচাকা।
রায়না ব্লকের – শ্যামসুন্দর। সদর ১নং ব্লকের – ভণ্ডুল। সদর ২নং ব্লক – শক্তিগড়। মেমারী ২নং ব্লক – রানীহাটি ও খালডাঙ্গা। মন্তেশ্বর ব্লকের – কুলুট। কাটোয়া থানার – সাহাপুর। মেমারী ১নং ব্লকের – কাকডাঙ্গা। জামালপুর ব্লকের – আজাপুর।
বীরভূমের – নানুর থানার - কালিকাপুর। লাভপুরের - বগদোড়।
মালদহের – কালিয়াচক ব্লকের - মডেল গ্রাম। মুর্শিদাবাদের – নতুনগ্রাম পঞ্চায়েত-এর পাঠানপাড়া ও খড়গ্রাম ব্লকের - কেলাই গ্রাম।
হুগলী জেলার ধনেখালির বোসো,বেলমুড়ি, কনুইবাঁকা, জয়হরিপুর; দাদপুরের শ্রীরামপুর; পোলবার বালিটানা, যাঁতা, পাউনান -১, পাউনান-২, সারাংপুর, দাঁতরা। পান্ডুয়ার সাঁচিতারা, আলিপুর। বলাগড়ের গুপ্তিপাড়া, বাকসাগড়, বড়াল, বাতনা,বেলেডাঙ্গা, ইটাগড় মোড়, সায়রা, করিন্যা
দক্ষিণ ২৪পরগনা- নিশ্চিন্তপুর, জামালপুর, উস্থি, বাখরাহাট ।
হাওড়া- বাগনান ।
দার্জিলিং - ফাঁসিদেওয়া - ছোট পথুজোত, খড়িবাড়ী - বিত্তানজোত, কদুভিটা।
উত্তর ২৪পরগনা – গাইঘাটার - ঢাকুরিয়া, নৈহাটি - শিবদাসপুর, হাবড়া-২ – চন্ডীগাছা, শ্রীকৃষ্ণ পুর, বসিরহাট - মাটানিয়া ।
জলপাইগুড়ি - উত্তর পুটিমারী, দক্ষিণ পুটিমারী, মল্লিকঘাট ।
বাঁকুড়া – নিকুঞ্জপুর, মালিয়ান, ঝাঁটিপাহাড়ী।
নদীয়া – ধুবুলিয়া, সোনাতলা, গাছাবাজার, বসতপুর, কালিনগর।
জয়তু দেশমুখ,রাজ্য সম্পাদক, এআইকেএম
সজল পাল, রাজ্য সভাপতি, আয়ারলা
মাঠের ফসল বৃষ্টিতে ভিজছে, গুদামের শস্য তালা বন্ধ পচছে! মানুষের অন্ন নেই, অন্নদাতাদের অর্থ নেই! হাটবাজার, গাড়িঘোড়া, কারখানা গেটে কুলুপ মারা যায় কিন্তু পেটে? খিদের বিরতি হয়? 'মানুষের সৎভাই চায় শুধু ফ্যান!' শূন্য থালা, ফাঁকা ঝুড়ি, শুকনো মাটির দাগ লেগে থাকা কোদাল, কাস্তে নিয়ে আলপথে, বেড়ে, ডোবার ধারে, মড়াইয়ের পাশ থেকে একে একে একে.... কিছু শীর্ণ শরীর, জীর্ণ কাপড়, ২৭ এপ্রিল দেখেছে গ্রাম বাংলা। সারা ভারত কিষাণ মহাসভা (AIKM) এবং সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতি (AIARLA)-র ডাকে আজ জেলায় জেলায় লোক ডাউন হয়েছে! মেটে পথে নেমেছেন গরিব চাষি, ক্ষেতমজুর, ১০০ দিনের কাজের মজুর, আদিবাসী, দলিত, সংখ্যালঘু গ্রামবাসীরা। ওঁরা সমবায় জীবনে পরস্পর বেঁধে বেঁধে থাকতেই অভ্যস্ত, স্বভাবপ্রকৃতিতেও মুখোশ পরার প্রচলন নেই; তবে কিনা মহামারী চলছে তায় আবার N95 তো মুড়ি মুড়কির মতো মেলে না অগত্যা পড়শিদের থেকে কয়েক হাত করে শরীরের দূরত্ব রেখেই কারোর মুখে গামছা, কারো মুখে শাড়ির আঁচল কিম্বা গঞ্জের দোকানে পাওয়া কাপড়খণ্ড, যারে বাবুরা বলে মাস্ক! ভাঙাচোরা গলাতেই স্লোগান উঠেছে --
রেশন চাই সবার, পরিবার পিছু ৫০ কেজি খাদ্যশস্য চাই, পর্যাপ্ত ত্রাণ চাই, ১০০ দিনের কাজ চাই, সেটা বাড়িয়ে ২০০ দিন আর মিনিমাম ৫০০ টাকা দৈনিক মজুরি চাই, লকডাউনে গ্রামীণ মজুরদের সংসার চালাতে এককালীন ১০০০০ টাকা ভাতা চাই, সব পরিযায়ী শ্রমিককে নিরাপদে ঘরে ফেরানো চাই! ... আরো নানারকম দাবি
হুগলী জেলার ধনেখালি ব্লকের বোসো চারাবাগানে পথে নামা মানুষদের উপর সকালেই নেমে এল তৃণমূলী হম্বিতম্বি! সেসব ঢাকা পড়ে গেল আদিবাসীদের স্লোগানে!! আওয়াজ ছড়ালো আরো এলাকায় – জয়হরিপুর, কনুইবাঁকা, বেলমুড়ির পথে আরো কিছু মানুষ ... ওদিকে পাণ্ডুয়া ব্লকের সাঁচিতাড়া গ্রামেও তখন ক্ষেতমজুরদের কোলাহল, পেটের জ্বালা একই তাই চাহিদাও এক, গলায় ঝোলানো প্ল্যাকার্ডে লেখা। বৈঁচির আলিপুরে আবার বিকালের দিকে মাঠে নামলেন আদিবাসী, সংখ্যালঘু জনতা। ওদিকে নেত্রী সরস্বতী বেসরার নেতৃত্বে পাণ্ডুয়া বিডিও অফিস থেকে ত্রাণ সংগ্রহ করতেও পেরেছে পাঁচটি পরিবার, কয়েকদিন ধরেই এমন দরিদ্র ও রেশন কার্ড না থাকা পরিবারগুলির জন্য চলছে তৎপরতা। মুখর বলাগড় ব্লকটাও সারাদিন – গুপ্তিপাড়া ২নং অঞ্চল, জিরাটের বাকসাগড় (খোদ তৃণমূল বিধায়কের গ্রাম), খামারগাছি অঞ্চলের বরাল, বাতনা একতারপুর, সায়রা বাকুলিয়া, মহিপালপুর অঞ্চলের ইটাগড়, কুলগাছি, ইছাপুর-বেলেডাঙ্গা ... বেলা বাড়তে বাড়তে সন্ধ্যার মুখে বাকুলিয়া-ধোবাপাড়ার সাঁওতাল গ্রাম করিন্যায় বদ্রীনাথ হেমব্রমের নেতৃত্বে লাল পতাকা, আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চের ব্যানার হাতে শিরা টানটান আওয়াজ! বাকসাগড়ে প্রতিবাদের মেজাজ দেখে ১৮টি আদিবাসী পরিবারকে মাথাপিছু ৩ কেজি করে চাল দিতে হয়েছে প্রশাসনকে। সংগঠনের উদ্যোগে ইতিমধ্যেই খাদ্য পেয়েছে আরো কিছু পরিবার। অন্যান্য ব্লক যখন এভাবে সক্রিয় থেকেছে তখন দীর্ঘ লড়াইয়ের এলাকা পোলবা-দাদপুর যে প্রতিবাদের মালা গাঁথবে তা বলাই বাহুল্য ... বালিটানা, জাঁতা, সারাংপুরে বেলা বাড়ার সাথে সাথে সোচ্চার কণ্ঠের পারদ চড়েছে; পাউনানের অলিগলিতে এভাবে স্বতস্ফূর্ত লাল পলাশের ছড়াছড়ি বেশ কিছু বছর পর অনভ্যস্ত চোখে দেখলো গেরুয়া, সবুজ মাতব্বরেরা! চমকে দিয়ে আবার অনেকদিন পরে নকশালদের ডাকে কলরব করলেন গোস্বামী-মালিপাড়ার দাঁতরার গ্রামবাসীরা! দাদপুরের শ্রীরামপুরে পুলিশ বাধা দেওয়ার চেষ্টায় ছিলো দুপুরের দিকে, কিন্তু ভুখমারি আর মহামারির ষাঁড়াশি আক্রমণের সাথে যুঝতে থাকা সিদহো-কানহু-বিরশা-তিলকা মাঝির সন্তানদের ভয় দেখিয়ে রুখবে এমন কোনো ধাতুর ব্যারিকেড আছে? ইস্পাতের থেকেও কঠিন ব্যারিকেডটা কমরেডদের কাঁধে কাঁধেই খাড়া হয়
রিপোর্ট - সৌরভ
সারা ভারত কৃষাণ মহাসভা (এআইকেএম) এবং আয়ারলার পক্ষ থেকে ১০০ দিনের কাজের সময়সীমা বাড়িয়ে ২০০ দিন করা, এনারজিএ প্রকল্প চালু করা, ৫০০ টাকা দৈনিক মজুরি ৫০ কেজি খাদ্যশস্য, জবকার্ড থাকা প্রত্যেক গ্রামীণ মজুরকে দশহাজার টাকা লকডাউন ভাতা এবং পরিযায়ী শ্রমিকদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার দাবি সহ বিভিন্ন দাবিতে দেশের অন্যান্য জায়গার সাথে দার্জিলিং জেলার ফাঁসিদেওয়ার ছোটপথুতে এবংখড়িবাড়ি ব্লকের বিত্তানজোতে ও কদুভিটা এবং জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ির বার্নিশ, উত্তর পুঁটিমারি - দক্ষিণ পুঁটিমারি - চাঁদের বাড়ি বেরুবাড়ি গ্রামে বিক্ষোভ দেখান এআইকেএম এবং আয়ারলার জেলা নেতৃত্ব ও কর্মীরা।
দার্জিলিং জেলা: ফাঁসিদেওয়া ব্লকের ছোটপথুতে এআইকেএম এবং আয়ারলা স্বাস্থ্য বিধি মেনে সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে দাবি সম্মিলত প্ল্যাকার্ড নিয়ে আইকেএম-এর জেলা সম্পাদক পবিত্র সিংহ ও আয়ারলার জেলা সম্পাদক শরত সিংহের নেতৃত্বে বিক্ষোভ সামিল হন নেমু সিংহ, পৈষানজু সিংহ, পঞ্চা বর্মণ প্রমুখ। বিক্ষোভ কর্মসূচীতে উপস্থিত ছিলেন এলাকার কিছু পার্টি দরদী কৃষি মজুর ও শ্রমজীবী মানুষ। কর্মসূচী শেষে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন পবিত্র সিংহ।
খড়িবাড়ি বিত্তান জোত : খড়িবাড়ি ব্লকের বিত্তান জোতে কমরেড কান্দরা মুর্মু, রমু সিং, দেওয়ান মার্ডির নেতৃত্বে বেশ কিছুক্ষণ ধরে চলে বিক্ষোভ অবস্থান। দাবি সম্মিলিত প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে কমরেডদের সোচ্চার শ্লোগানে মুখরিত আজকের কর্মসূচীকে সংহতি জানিয়ে চা শ্রমিকদের অংশগ্রহণ ছিল লক্ষ্যণীয়। কদুভিটা : খড়িবাড়ি কদুভিটাতে বর্ষীয়ান নেতৃত্ব সিরিল এক্কার নেতৃত্বে চলে বিক্ষোভ অবস্থান।
জলপাইগুড়ি ময়নাগুড়ি বার্নিশ : বার্নিশ অঞ্চলের উত্তর পুঁটিমারিতে উমেশ রায়ের নেতৃত্বে এআইকেএম এবং আয়ারলার স্হানীয় নেতৃত্ব এবং কর্মীরা উৎসাহের সঙ্গে বিক্ষোভ কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করেন। বেশ কিছু সময় ধরে চলে বিক্ষোভ ধর্না। যা এলাকার মানুষের নজর কারে।
দক্ষিণ পুঁটিমারি : কমরেড বৈশাখি, হরিনাথ এবং ব্রাঞ্চ সম্পাদক জিন্নাতুল ইসলামের নেতৃত্বে এআইকেএম এবং আয়ারলার কর্মীরা বিক্ষোভে সামিল হন।
চাঁদের বাড়ি : ভাস্কর দত্ত, মুকুল চক্রবর্তীর নেতৃত্বে কর্মীরা চাঁদেরবাড়ি গ্রামে বিক্ষোভে সামিল হন।
মূলত গ্রামীণ এলাকায় সংঘটিত এই বিক্ষোভ কর্মসূচীতে কমরেডদের সোচ্চার অংশগ্রহণ লকডাউন চলাকালীন গ্রামীন সংকট বিশেষত কৃষক ও কৃষিমজুরদের সংকটের ছবিকেই স্পষ্ট করে দেয়।
রিপোর্ট - শাশ্বতী
ফসলের দেড়গুণ দাম, মনরেগায় সমস্ত গ্রামীণ মজুরদের ২০০ দিনের কাজ ও দৈনিক ৫০০ টাকা মজুরি, করোনার সময় সমস্ত কৃষককে ১০০০০ টাকা ভাতা সহ বিভিন্ন দাবিতে সিপিআই(এম-এল) লিবারেশনের কৃষক সংগঠন সারা ভারত কিষাণ মহাসভা ও সারাভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতির ডাকে সারা ভারতে যে বিক্ষোভ কর্মসূচী চলছে তার অঙ্গ হিসাবে দক্ষিণ ২৪ পরগণার বাখরাহাটে সংগঠনের অবস্থান হয়। উপস্থিত ছিলেন সারাভারত কিষাণ মহাসভার রাজ্য সম্পাদক জয়তু দেশমুখ, দঃ ২৪ পরগণা জেলা সম্পাদক কমরেড দিলীপ পাল। দঃ ২৪ পরগণার বজবজের জামালপুর, নিশ্চিন্তপুর অঞ্চলে কর্মসূচী হয়। নিশ্চিন্তপুর অঞ্চলে গ্রামীণ শ্রমিকদের কর্মসূচীর নেতৃত্ব দেন সারাভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতির জাতীয় কাউন্সিলের সদস্যা কমরেড দেবযানী গোস্বামী। জামালপুর অঞ্চলে নেতৃত্ব দেন কমরেড শ্যামসুন্দর গোস্বামী। দঃ ২৪ পরগণার উস্থিতে বিক্ষোভ কর্মসূচী হয়।নেতৃত্ব দেন সারাভারত কিষাণ মহাসভার জেলা নেতা কমরেড জগদীশ মন্ডল। উপস্থিত ছিলেন পার্টির জেলা কমিটির সদস্য কমরেড জয়দেব নস্কর।
রিপোর্ট - শুভদীপ পাল
১) নৈহাটির শিবদাসপুর এআইএআরএলএ তরফ থেকে তাড়িখানা মোড়ে পালন করা হয় ।
২) আজ সারা গ্রামীণ ভারতের সাথে সাথে বসিরহাটের মাটনিয়াতে খাদ্য-কাজ-মজুরি-ফসলের ন্যায্য দাম-পরিযায়ী শ্রমিকদের সরকারের দায়িত্বে ঘরে ফেরানো-মনরেগায় অর্থাৎ ১০০ দিনের কাজে যুক্ত সহ সমস্ত গ্রামীণ শ্রমিকেদের অবিলম্বে ১০ হাজার টাকা ভাতার দাবি সহ একাধিক দাবিতে সারা ভারত কৃষাণ মহাসভা ও সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতির দাবি দিবস-এর প্রোগ্রাম করা হয়।
৩) হালিসহর সাংস্কৃতিক সংস্থা আজ ২৭ এপ্রিল তারিখে, সোমবার সকাল ৯টা ৩০ মিনিট থেকে আরো একবার আটত্রিশ জন দুস্থ অসংগঠিত নির্মাণ ও অন্যান্য অসহায় সাধারণ মানুষকে ৩ কেজি চাল, ৩ কেজি আলু, ৫০০ গ্রাম পেয়াজ, ৩০০ গ্রাম মুসুর ডাল, ৩০০ গ্রাম সোয়াবিন, ২০০ গ্রাম সরষের তেল, একটা সাবান ও একটি মাস্ক ত্রাণ উপলক্ষে স্বাস্থ্য বিধি মেনে বিলি বন্টন করা হয়। এই কর্মসূচিতে নারায়ণ রায় (খোকা), বিশ্বজিত পান (বাপি), স্বাগতা মল্লিক, জিতেন্দ্র পান (ডিস্ক), আকাশ চট্টোপাধ্যায় (পাপাই), অতনু মজুমদার (বুলু), সাগর কুমার চ্যাটার্জি, রবি সেন ও সুবিকাশ মিস্ত্রি উপস্থিত ছিলেন । বেলা ঠিক ১১টায় পৃথিবীতে যে সমস্ত মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন, চিকিত্সা ও সেবার কারণে যারা করোনা রোগীদের সাথে সরাসরি যুক্ত, অন্যান্য জরুরি পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়ে শহীদ হয়েছেন, বিশেষ করে এ রাজ্যের ডাক্তার বিপ্লব দাশগুপ্তর শহীদ হওয়ার কারণে দু মিনিট তাঁদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে নীরবতা পালন করা হয় এবং তাঁদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানানো হয়। দুঃস্থ মানুষকে পরবর্তীতে ধারাবাহিক ভাবে ত্রাণ দেওয়া হবে – এই প্রতিশ্রুতিতে সকলেই অঙ্গীকারবদ্ধ হই। আমাদের এই ত্রাণ কর্মসূচীতে যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করছে, তাদের প্রত্যেককে হার্দিক অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানাই। আমাদের সহযোগী সংগঠন হালিসহর বিজ্ঞান পরিষদ ও মুক্তমনা সৈকত অসংখ্য মাস্ক নিয়ে এসে দুঃস্থদের মধ্যে বণ্টন করে। তাদেরকে আমরা সংগঠনের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাই ।
রিপোর্ট - অজয় বসাক
দক্ষিণ ২৪ পরগণা - সিপিআই(এম-এল) লিবারেশন দঃ ২৪ পরগণা জেলা অফিসে লেনিনের ১৫০তম জন্মদিবস ও সিপিআই(এমএল)-এর ৫১ তম প্রতিষ্ঠা দিবস উদযাপন। পার্টির আহ্বান ৫টি শপথ নিয়ে বক্তব্য রাখেন জেলা সম্পাদক কিশোর সরকার, রক্ত পতাকা তোলেন কম: লক্ষিকান্ত অধিকার, মাল্যদান করেন অঞ্জন ঘোষ, দেবাশিস মিত্র, পঞ্চু ঘোষ, সেখ সাবির, নন্দন মন্ডল, শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত হয়ে শহীদ স্মরণ করে সভা শেষ করা হয়।
কমরেড লেনিনের ১৫০ তম জন্মজয়ন্তী ও সিপিআই(এম-এল)এর ৫১ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালিত হল বাখরাহাট স্কুল মোড়ে। উপস্থিত ছিলেন পার্টির দঃ ২৪ পরগণা জেলা কমিটির অন্যতম সদস্য কমরেড দিলীপ পাল,কমরেড শুভদীপ পাল, লোকাল সম্পাদক কমরেড নিখিলেশ পাল,লোকাল কমিটির সদস্য কমরেড সুনীত ধাড়া, কমরেড সন্দীপ ধাড়া, কমরেড পূর্ণিমা হালদার ও শ্রমজীবী সাথীরা।পার্টির আহ্বান ৫টি শপথ পাঠ ও সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রেখে সভা পরিচালনা করেন কমরেড শুভদীপ পাল। রক্তপতাকা উত্তোলন করেন কমরেড দিলীপ পাল, শহীদ বেদীতে মাল্যদান করেন লোকাল কমিটির সম্পাদক কমরেড নিখিলেশ পাল।
বজবজ গ্রাম লোকাল কমিটির নেতৃত্বে বজবজের গ্রামে কমরেড লেনিনের ১৫০তম ও পার্টির ৫১তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালিত হল। উপস্থিত ছিলেন জেলা কমিটির অন্যতম সদস্যা কমরেড দেবযানী গোস্বামী,কমরেড অঞ্জনা মাল,লোকাল কমিটির অন্যতম সদস্য কমরেড শ্যামসুন্দর গোস্বামী, যুব নেতা কমরেড আশুতোষ মালিক ও আইসার কমরেডরা।
রিপোর্ট – সজল পাল
নদীয়া - নদীয়া জেলার বিভিন্ন এলাকায় আজ পার্টির ৫১তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উদযাপন করা হয়। একইসাথে কমরেড লেনিনের ১৫০তম জন্মবার্ষিকীও মর্যাদার সাথে স্মরণ করা হয়। কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বান অনুযায়ী শপথ গ্রহণ করা, লাল পতাকা উত্তোলন, শহীদ বেদীতে মাল্যদান, নীরবতা পালন প্রভৃতির মধ্য দিয়ে দিবসটি মর্যাদার সাথে পালন করা হয়। লকডাউনের কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও স্থানীয় কমরেডরা শারীরীক দূরত্ব বজায় রেখে কর্মসূচী পালন করেন।
জেলা সদর কৃষ্ণনগরে পার্টি অফিসে পতাকা উত্তোলন করে শপথ গ্রহণ করা হয়। ধুবুলিয়াতে পার্টি অফিসের সামনে শহীদ বেদীতে মাল্যদান ও শপথ অনুষ্ঠান সংগঠিত হয়। অনুরূপ কর্মসূচী অনুষ্ঠিত হয় গাছাবাজার, বেথুয়াডহরী ও চাপড়ায়। ধুবুলিয়ার গ্রামাঞ্চল নপাড়া অঞ্চলের স্থানীয় কর্মীরা কালীনগর গ্রামে সমবেত হয়ে এই কর্মসূচী পালন করেন। চাকদা শহর ও তাহেরপুরেও পার্টি প্রতিষ্ঠা দিবস গুরুত্বের সাথে কমরেডরা পালন করেন। নবদ্বীপে কেন্দ্রীয় কমিটির ৫ পয়েন্টের আহ্বানকে নিয়ে রাজনৈতিক অধ্যয়ন সংগঠিত হয়। আগামী দিনগুলিতে গরিব মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের দাবিগুলি লকডাউনের পরিস্থিতি উপযোগী করে প্রচার করার অঙ্গীকার কমরেডরা গ্রহণ করেন।
রিপোর্ট – জয়তু দেশমুখ
আজ ২২ এপ্রিল সকাল ১১টার সময় বহরমপুর শহরের সিপিআই(এম-এল) লিবারেশন এর মুর্শিদাবাদ জেলা অফিসের সামনে সিপিআই(এম-এল) লিবারেশন-এর ৫১তম প্রতিষ্ঠাদিবস এবং কমরেড লেনিনের ১৫০তম জন্মদিবস অনুষ্ঠিত হয়।পতাকা উত্তোলন, শহীদ বেদীতে মাল্যদান এবং কমরেড লেনিনের ফটোতে মাল্যদান করা হয়। শ্লোগান তোলা হয় সিপিআই(এম-এল) ৫১তম প্রতিষ্ঠাদিবস পালন করুন, কমরেড লেনিনের ১৫০তম জন্মদিবস পালন করুন। ভুখা জনতার পাশে দাঁড়ান, করোনার মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ হোন। তারপর শহীদের স্মরণে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন জেলা সম্পাদক কমরেড রাজীব রায়।
এরপর অফিসে বসে সাধারণ সম্পাদক কমরেড দীপঙ্কর ভট্টাচার্য এর ভিডিও ভাষণ ছোট সাউন্ড বক্স চালিয়ে শোনা হল । এবং কেন্দ্রীয় কমিটির পাঠানো শপথ বাণী মোবাইল থেকে পাঠ করেন কমরেড রাজীব রায়। লেখার উপর সংক্ষিপ্ত ব্যাখা রাখেন রাজ্য কমিটির সদস্য কমরেড সজল পাল । আলোচনা করেন কমরেড অপুর্ব লাহিড়ী। রাজীব রায় করোনা পরিস্থিতির মধ্যে জেলার পরিস্থিতি ও পার্টির ভুমিকা নিয়ে আলোচনা করেন। জেলার বিভিন্ন ব্লকের পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য বিভিন্ন রাজ্যে পার্টির সহযোগিতার ফলে গরিব মানুষের মধ্যে ভাল প্রভাব পড়েছে। ত্রাণ সংগ্রহ করে এলাকার গরিব মানুষের মধ্যে বন্টনের পরিকল্পনা করা হয়। উপস্থিত ছিলেন বহরমপুর লোকাল কমিটির সম্পাদক কমরেড রবি মন্ডল এবং কমরেড নান্টু, অনুপ দা তাপস দা ও গোপাল হালদার ।
গত ১২ এপ্রিল কেন্দ্রীয় কমিটির ডাকা বিক্ষোভ কর্মসূচীর অংশ হিসেবে বহরমপুর অফিস থেকে ব্যনার প্লাকার্ড নিয়ে লকডাউন নিয়ম মেনেই কুঞ্জঘাটা বাজার পর্যন্ত মিছিল করা হয়। মিছিলে সামিল হয়েছেন জেলা সম্পাদক রাজীব রায়, জেলা কমিটির সদস্য অপুর্ব লাহিড়ী, লোকাল কমিটির সম্পাদক কমরেড রবি মন্ডল ও কমরেড নান্টু, নকুল সহ আট জন।
করোনা লকডাউনের পরিস্থিতিতে সংকটগ্রস্ত মানুষের কয়েকটি জরুরি দাবিকে তুলে ধরে তাহেরপুর নোটিফায়েড এরিয়া কর্তৃপক্ষের কাছে পার্টির পক্ষ থেকে এক ডেপুটেশন সংগঠিত হয়। গত ২০ এপ্রিল স্থানীয় পার্টির ৫ জনের এক প্রতিনিধিদল ডেপুটেশনে যায়। বর্তমান রেশন নিয়ে যে নানারকম অনিয়ম চলছে এবং গরিবমানুষ সঠিক পরিমানে খাদ্য দ্রব্য পাচ্ছেন না। এই পরিপ্রেক্ষিতে দাবী তোলা হয় যে প্রতিটি রেশন দোকানে বন্টিত খাদ্যদ্রব্যের পরিমান লিখিত ভাবে বোর্ডে টাঙ্গিয়ে দিতে হবে- পৌরসভাকে এই নির্দেশ জারি করতে হবে। বিষয়টি পৌর কর্তৃপক্ষ মেনে নেয়। দাবী জানানো হয় সকল গরিব মানুষ - কার্ড থাকুক বা না থাকুক রেশন দিতে হবে। যারা নানাবিধ কারনে রেশনে মাল পাচ্ছেন না তাঁদের রেশন দেওয়ার দায়িত্ব পৌরসভাকে নিতে হবে। কর্তৃপক্ষ জানায় এ ধরনের বঞ্চিত গরীবদের নাম পাঠালে তাঁরা মানবিক জায়গা থেকে অবশ্যই বিবেচনা করবেন। এছাড়া ১ হাজার টাকা আর্থিক সাহায্যের প্রকল্প “প্রচেষ্টা” সরকারী ভাবে ঘোষিত হলে তারা এ বিষয়ে সবরকম সহযোগিতা করবেন। পুরসভা এলাকা জীবানুমুক্ত করার ব্যবস্থাবলী পরিচালনা করবেন। দাবী জানানো হয় এই সমস্ত প্রশ্নে সার্বিক ভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। আরেকটি জরুরি বিষয় তুলে ধরা হয় যে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নির্মাণ কর্মীদের এলাকায় ঢুকতে দেওয়া হবে না - এই ধরনের একটা সাম্প্রদায়িক ঘৃণাপ্রচার তাহেরপুরে কোনো কোনো মহল থেকে করা হচ্ছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, পার্শ্ববর্তী মুর্শিদাবাদ জেলার নির্মাণকর্মীরা নিয়মিত ভাবে তাহেরপুরে নির্মাণকাজ করে থাকেন। লকডাউনের পরিস্থিতিতে তাঁদের অনেক কাজ বকেয়াও পড়ে আছে। পৌরসভার কাছে দাবি জানানো হয় আগামীতে ঐ নির্মাণকমীরা যাতে নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। করোনাকে কাজে লাগিয়ে সাম্প্রদায়িক প্রচার বন্ধ করতে পৌরসভাকে পাল্টা প্রচার করতে হবে। প্রতিনিধি দলে ছিলেন নদীয়া জেলা সদস্য জীবন কবিরাজ, তাহেরপুর ব্রাঞ্চ সম্পাদক যোগেশ শিকদার, স্থানীয় পার্টি কর্মী শিবশংকর দাস, আশীষ দত্ত,অমিয় দাস।
রিপোর্ট – জয়তু দেশমুখ
পশ্চিমবঙ্গে ছোট বড় মিলিয়ে মোট ৭৫-৮০ টি চটকল বর্তমানে আছে। প্রায় ২.৫ লক্ষ শ্রমিক কর্মচারিরা এই মিলগুলোতে শ্রমশক্তি বিক্রি করে তাঁদের রুটি রুজি চালান। কোভিড-১৯ সংক্রমণ ছড়াবার পর অন্যান্যদের মতো চটকল শ্রমিকদেরও শ্রমশক্তি বেঁচার বাজার বন্ধ হয়ে গেছে, কারণ মিল বন্ধ। করোনা ভাইরাস রোধে সরকারী নিদান ২২ মার্চ থেকে ‘লকডাউন’ সবাই গৃহবন্দী থাকুন। আচমকা সরকারী ফরমানে সমস্যায় পড়লেন চটকল শ্রমিকরা। চটকলের সিংহভাগ শ্রমিক রোজগারের জন্য আসেন পাশের রাজ্য উত্তরপ্রদেশ ও বিহার থেকে। কারখানা বন্ধ থাকায় তাদের হাতে অর্থ নেই, কাজ নেই, আবার নিজেদের রাজ্যে ফিরে যাওয়ারও ব্যবস্থা নেই। এক অসহনীয় অবস্থার মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছেন চটকলের শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যরা। সঙ্কটকালীন অবস্থায় সামান্য একটু আলো দেখলেই মানুষ কিছুটা স্বস্তি পায়, এই ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। কেন্দ্রীয় বস্ত্রমন্ত্রী ১৩ এপ্রিল জানালেন লকডাউন শিথিল করা হয়েছে ২৫% শ্রমিক নিয়ে ১৮টা চটকলে উৎপাদন চালু হবে। এরপর ১৫ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করলেন শুধুমাত্র ১৮টা মিল না, সব মিলে খুলবে ১৫% শ্রমিক নিয়ে। শ্রমিকরা আশায় বুক বাধলেন, যাই হোক সঙ্কট কালে ঘুরিয়ে ফিরিয়েও যদি মাসে কয়েকদিন কাজ পাওয়া যায়, আপাতত মন্দের ভালো। দ্বিতীয় দফার লকডাউনের মেয়াদ ছিল ২০ এপ্রিল পর্যন্ত, শ্রমিকদের আশা ছিল মিল খুলবে, না মিল বন্ধই থাকল। উল্টে লকডাউনের মেয়াদ ৩ মে পর্যন্ত বর্দ্ধিত হল।
২১টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিনের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের দুরবস্থার কথা কেন্দ্রের শ্রমমন্ত্রী, বস্ত্রমন্ত্রী, রাজ্যের মুখমন্ত্রী, মুখ্যসচীব, শ্রমমন্ত্রী সহ সব জেলাশাসক, মহকুমাশাসক এবং প্রতিটি মিল কর্তৃপক্ষ এবং মালিকদের প্রতিষ্ঠান ‘ইন্ডিয়ান জুট মিল অ্যাসোসিয়েশন’ কে জানানো হয়েছে। আবার বিসিএমএফ সহ অন্যান্য ইউনিয়নগুলো সতন্ত্রভাবে প্রশাসনের সবস্তরে শ্রমিকদের দুর্দশা ও লকডাউনের সময়ে পূর্ণ মজুরির জন্যে স্মারক লিপি দিয়েছেন। কিন্তু কোনো সরকারের কাছ থেকে সুরাহার কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তারা মুক ও বধির হয়ে বসে আছেন।
বিসিএমএফ লকডাউনের সময় পূর্ণ মজুরির দাবিতে কাঁকিনাড়া, জগদ্দল, নৈহাটি, আগরপাড়া, বালি, মহাদেও, বাউরিয়া, নর্থশ্যাম নগর, এঙ্গাস, এবং অন্যান্য মিলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। আন্দোলনের চাপে বেশ কিছু মিল শ্রমিকদের ২০০০ – ৪০০০ টাকা অগ্রিম দিয়েছে, মিল খুললে জুন/জুলাই মাস থেকে কয়েক কিস্তিতে শ্রমিকদের এই ধারের টাকা পরিশোধ করতে হবে।
এদিকে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে চলছে। মৃত্যু প্রতিদিন বাড়ছে। সংক্রমণ রোধে সরকার – ‘লকডাউন’ ‘ঘরবন্দি’ ‘দৈহিক দূরত্ব রক্ষা’ ‘মাস্ক ব্যবহার’ সহ ব্যবস্থাদি মেনে চলার নির্দেশ জারি করেছে। ‘লকডাউন’ আপাতত ৩ মে ২০২০ পর্যন্ত ঘোষণা করা হয়েছে। একই সঙ্গে সংগঠিত অসংগঠিত সমস্ত ক্ষেত্রে সকল শ্রমিককে ‘লকডাউন’ সময়ের জন্য পুরো মজুরি/বেতন দেবার নির্দেশ সরকার জারি করেছে যাতে ভুখমারী দেখা না দেয় এবং অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে না পড়ে।
চটশিল্পের মালিকরা সরকারের নির্দেশ পাবার পরেও তাকে কোনোরকম আমলই দিচ্ছে না। মিল কর্তৃপক্ষ ৩১ মার্চ ২০২০ পক্ষকালের মধ্যে শ্রমিকরা যতটুকু কাজ করেছে সেই সময়কার বেতন (earned wages) দিয়েছে, লকডাউনের বাকি সময়ের বেতন দেয়নি। শুধু তাই নয় মালিকরা বেতন না দিয়ে তারা ‘লকডাউন’ ভেঙ্গে কাজ করানো এবং তৈরি পণ্য বের করার জন্য দালাল নিয়োগ করেছে। এই দালালরা ইতিমধ্যেই বিভিন্ন জায়গায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এই অবস্থায় শ্রমিকরা ক্ষুব্ধ। কয়েকটি কারখানা বেশ কিছুকাল ধরে বন্ধ। তারা দুঃসহ অবস্থার মধ্যে দিনাতিপাত করছে। শ্রমিকরা বেতন না পেলে ‘ভুখমারী’ দেখা দিতে পারে এমন আশঙ্কা আছে। আবার দালাল লাগিয়ে মাল বের করার চেষ্টা হলে নৈরাজ্য সৃষ্টির আশঙ্কা থাকছে। শ্রমিকরা সরকারের সমস্ত বিধি নির্দেশ মেনে চলছে। মেনে চলবে। এর অর্থ এই নয় শ্রমিকরা ‘ঘরবন্দী’ থাকবে আর মালিকরা সেই সুযোগে সরকারের নির্দেশ ভেঙ্গে তাদের জুলুম ও অপকীর্তি চালিয়ে যাবে। এই অবস্থা চললে শ্রমিকরা আইন মেনে আন্দোলনের পথে নামতে বাধ্য হবে। অত্যাবশ্যক পণ্য আইন দেখিয়ে তৈরি মাল বার করার অপচেষ্টায় প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদত আছে। মালিকরা যখন বে-আইনিভাবে জুটমিল লক-আউট করে তখন অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনের কথা সরকারের মনে পড়ে না। লকডাউনের সময় সে কথা মনে পড়েছে।
লকডাউনের দিন যত বাড়ছে শ্রমিকদের মধ্যে হতাশা, ক্রোধ বাড়ছে। হাতের সামনে মিল কর্তৃপক্ষকে শ্রমিকরা পাচ্ছেন না, অনেক ক্ষেত্রে তাদের রাগের প্রকাশ ঘটে মিলের নেতৃত্বের উপর। এআইসিসিটিইউ সহ কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন চটকল শ্রমিকদের মজুরির জন্য কলকাতা উচ্চ আদালতে মামলা দায়ের করা হবে। তার প্রস্তুতিতে চটকলের ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ একসাথে ২৭ ও ২৮ এপ্রিল যে যে থানায় জুটমিল আছে সেখানে মিল কর্তৃপক্ষ বিরুদ্ধে এফআইআর করা হয়েছে। দায়ের করা প্রথম অভিযোগে আছে সরকারী আদেশ অমান্য করে মিল কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের লকডাউনের সময়ের পূর্ণ মজুরি থেকে বঞ্চিত করেছে। এখন দেখা যাক এতেও মালিকদের চৈতন্যের উদয় হয় কিনা। না হলে? ইউনিয়নকে এক রকম বাধ্য হয়েই আইনের দীর্ঘ পথে ঢুকতে হবে। তাই এই আপৎকালীন অবস্থায় অর্ধাহারে থাকা শ্রমিক ও তাদের পরিবারের পাশে থাকার অঙ্গীকারের হাত বড়িয়ে দিন। ‘বেঙ্গল চটকল মজদুর ফোরাম’ শ্রমিকদের কাছে আপনাদের সহযোগিতার বার্তা পৌঁছে দেবে।
পুর্ব বর্ধমান জেলার কালনা- পুর্বস্থলী- মন্তেশ্বর- কাটোয়ার বিভিন্ন এলাকার প্রচুর গ্রামীণ মেহনতি মানুষ বিভিন্ন প্রদেশে বিভিন্ন ধরনের মজুরের কাজ করে থাকেন । করোনা সংক্রমণের পরিস্থিতির জন্য হঠাৎ অপরিকল্পিত লকডাউন-এর ব্যাপক শ্রমিক বিভিন্ন প্রদেশের বিভিন্ন এলাকায় আটকে পড়ে। কাজ বন্ধ, মজুরি নাই, থাকার জায়গার সমস্যা, মালিকরা ভাড়া টাকার জন্য চাপ দিচ্ছেন, অনেক ক্ষেত্রেই ঘর ছেড়ে দেওয়ার জন্য ছাপ দিচ্ছেন। আবার তাদের পরিবারের লোকজন ঘরে থেকে খাবার ও অর্থের অভাবে চরম কষ্ট ভোগ করছেন । এই অবস্থার মধ্যে বিভিন্ন গ্রামের শ্রমিকদের পরিবারের লোকজন পার্টির এলাকার কমরেডদের কাছে জানাতে থাকেন এবং কান্না কাটি করতে থাকেন। পার্টির পক্ষ থেকে বিভিন্ন প্রদেশের যেমন কেরল, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা, দিল্লী ও গুজরাট প্রদেশের কয়েক হাজার পরিযায়ী শ্রমিককে বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। অন্য দিকে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের অনেক বড় বড় ভাষণ ও ঘোষণা এই সমস্ত শ্রমিক ও তাদের পরিবারের অসহায়ত্ব মোচনের ব্যবস্থা হল না। তাই গ্রামের গরিব মানুষের মধ্যেক্ষোভ বেড়ে চলেছে ।এই অবস্থায় পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরানোর দাবি এবং খাওয়া-থাকার ব্যবস্থা ও পরিবার পিছু অর্থ বরাদ্দ করার দাবি মানুষের মধ্যে কিছুটা হলেও আশা জাগিয়েছে। তাই সমস্ত লকডাউন প্রতিকুলতার মধ্যেও ১৮ এপ্রিল সকাল ৮টা থেকেই কালনা থানার আগ্রাদহ, ঝিকড়া, বাজিতপুর ও ওমরপুর গ্রামের ২০টি পরিবার বাড়ির মধ্যে বসেই অনশনে অংশগ্রহণ করেন। এই চারটি গ্রামের ২৫০ লোক বিভিন্ন রাজ্যে আছেন। আবার নাদনঘাট থানার ইসলাম পুর, শাঁকড়া গ্রামের ১০টি পরিবার অনশনে বসেছেন। এই দুটি গ্রামের ৩০০ লোক বিভিন্ন রাজ্যে আটকে আছেন ।
ঐ দিনই বিভিন্ন রাজ্যে থাকা শ্রমিকরা অনশন করেন। রাজস্থান, কেরল, হরিয়ানার শ্রমিকদের সামিল হওয়া উল্লেখযোগ্য ।
১৯ এপ্রিল এই আন্দোলনের সংহতিতে বর্ধমান শহরের সিপিআই(এম-এল) লিবারেশন-এর জেলা কমিটির সদস্য কমরেড শ্রীকান্ত রানা ও কমরেড কুনাল বক্সীর নেতৃত্বে যুব ও শ্রমিক কমরেডদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিক্ষোভ প্রদর্শন সংগঠিত হয়।
কালনা লোকাল কমিটির সম্পাদক কমরেড রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে ভালোসংখ্যক কমরেডের অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে দূরত্ব বজায় রেখেই সংহতিমুলক বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন । বৈদ্যিপুর গ্রামের সিপিআই (এম-এল) লিবারেশন জেলা কমিটির সদস্য কমরেড প্রদ্যুত ঘোষ ও কমরেড সুমি মজুমদার (ঘোষ) অনশনে বসেন ।
কাটোয়া থানার সাহাপুর গ্রামের কয়েকটি শ্রমিক পরিবারের লোকজন অনশন করেন ।
২১ এপ্রিল বর্ধমান শহরে সিপিআই (এম-এল) লিবারেশন ও সিপিএমের পক্ষ থেকে যৌথ বিক্ষোভ কর্মসূচী সংগঠিত করাহয়। বিক্ষোভ অবস্থানে সিপিআই(এম-এল)-এর পক্ষ থেকে কমরেড শ্রীকান্ত রানা, কমরেড কুনাল বক্সী কমরেড তৃনাঞ্জন বক্সী ও অন্যান্য কয়েক জন ছিলেন । এবং মেমারী শহরে ও যৌথ কর্মসূচী সংগঠিত করা হয়। সিপিআই (এম-এল) লিবারেশন-এর পক্ষ থেকে জেলা কমিটির সদস্য কমরেড সাধন কর্মকারের নেতৃত্বে ৪ জন উপস্থিত ছিলেন । দাবি ছিল পরিযায়ী শ্রমিকদের সরকারী খরচে ঘরে ফেরানোর ব্যবস্থা করা, পরিবার পিছু ১০ হাজার টাকার করোনা ভাতা, পর্যাপ্ত রেশন দেওয়া ও রেশন নিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে।
সমাজে আধিপত্যকারী শ্রেণী যেমন কখনও সম্পদ-অর্থনীতি-সংস্কৃতির ওপর তাদের কবজাকে আলগা করার কথায় আমল দিতে পারে না, ফ্যাসিস্তরাও একইভাবে কোনো পরিস্থিতিতেই তাদের কেন্দ্রীয় এজেণ্ডা থেকে বিরত থাকার কথা ভাবতে পারে না। নরেন্দ্র মোদী কোভিড-১৯ সংক্রমণের মোকাবিলায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ার, জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দুঃসময়ের মোকাবিলার আহ্বান জানালেন। কিন্তু মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ উসকিয়ে তোলা, সরকারের সমালোচক মানবাধিকার কর্মীদের বিরুদ্ধে নিগ্ৰহ ও গ্ৰেপ্তারি, অ-বশ্য সাংবাদিকদের দানবীয় আইনে অভিযুক্ত করা, সিএএ-এনআরসি-এনপিআর বিরোধী আন্দোলনের কর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশ লেলিয়ে দিয়ে তাদের গ্ৰেপ্তার করা – এই সমস্ত মার্কামারা ফ্যাসিবাদী পদক্ষেপকেও মোদী সরকার লকডাউন পর্বে অবাধে চালিয়ে গেল। বিভিন্ন রাজ্যে কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক দল পাঠিয়ে করোনা মোকাবিলা ব্যবস্থার সরজমিন অনুসন্ধানের নামে কেন্দ্রের দাদাগিরি তীব্র মাত্রা অর্জন করল। কোথাও-কোথাও বিজেপি অনুগামী রাজ্যপালরাও তাঁদের গূঢ় এজেণ্ডার প্রয়োগে অতীব সক্রিয়তা দেখাতে উঠেপড়ে লাগলেন। পশ্চিম বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বিরুদ্ধে করোনা সন্দেহভাজনদের নমুনা পরীক্ষার অপ্রতুলতা, করোনায় মৃত্যূ সংখ্যা নিয়ে কারচুপি, চিকিৎসা ব্যবস্থার বেহাল দশার অভিযোগের কিছু যথার্থতা অবশ্যই রয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারেও প্রশ্নের কোনো অবকাশ নেই যে, এ রাজ্যের রাজ্যপাল রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে যে রণংদেহি মূর্তি ধারণ করেছেন তা কখনই পশ্চিমবঙ্গবাসীর হিতাকাঙ্খা প্রসূত নয়। জগদীপ ধনখড় এই রাজ্যে বিজেপিকে রাজনৈতিক সুবিধা জোগানো, নাগপুরের খিদমতগিরি করার এজেণ্ডাকে নির্লজ্জভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন। ঐক্যের সংঘটন নয়, বিভেদ সৃষ্টিই মোদী ও তাঁর নিয়োজিত এজেন্টদের আরাধ্য হয়ে উঠছে। লকডাউন পর্বেও মোদী সরকার তার নিপীড়নমূলক এজেণ্ডাকে – বিরোধী স্বরের দমন, গণতন্ত্রের বিপর্যয় ঘটানোর যে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, তার কিছু নিদর্শনের দিকে তাকানো যাক।
লকডাউনের প্রথম দিকে নিজামুদ্দিনে তবলিগি জামাতের জমায়েতকে ধরে মুসলিম-বিরোধী বিদ্বেষ উসকিয়ে তোলার প্রচেষ্টা সক্রিয় হয়ে উঠল। বিজেপি নেতৃবৃন্দ এবং তাদের বশংবদ মিডিয়া প্রচার করতে লাগল যে, ভারতে করোনা সংক্রমণের বৃদ্ধির জন্য জামাতের ওই জমায়েতই অনেকাংশে দায়ী। সরকারী কর্তাব্যক্তিরাও এই সুরে কথা বলতে লাগলেন। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক থেকে ইঙ্গিত করা হল যে, ভারতে করোনা সংক্রমণের এক তৃতীয়াংশের উৎস হল নিজাম্মুদিনের জমায়েত। নিজামুদ্দিনের জমায়েতে যোগ দেওয়া মুসলিমদের কেউ-কেউ করোনা আক্রান্ত হলেও তাদের থেকেই সংক্রমণ অনেক ছড়িয়েছে এমন ধারণার কি সত্যিই ভিত্তি রয়েছে? ভারতের বেশ কিছু বিজ্ঞানী এই বক্তব্যকে খণ্ডন করে বললেন-- জামাতের জমায়েতের কারণে সংক্রমণ অনেক ছড়িয়েছে এমন কোনো প্রমাণ নেই। এই বক্তব্যের সমর্থনে তাঁরা সরকারের কাছ থেকে তথ্যের দাবিও করলেন। করোনা নিয়ে ভারতে মুসলিমদের অসম্মান ও হয়রানি ঘটানো হচ্ছে, কয়েকটি আরব দেশের নেতারা এই মর্মে উদ্বেগ প্রকাশ করলে প্রধানমন্ত্রী মোদীও অবশেষে বলতে বাধ্য হলেন যে-- মহামারী ধর্ম-জাতি-বর্ণ ভেদাভেদ মানে না। কিন্তু ততদিনে হিন্দুত্ববাদীদের উদ্দেশ্য অনেকটাই সফল হয়েছে -- জামাতের জমায়েতকে ‘করোনা বোমা’ আখ্যা দিয়ে বেশ কিছু মানুষের মধ্যে মুসলিম-বিরোধী ঘৃণা ছড়ানোর তাদের উদ্দেশ্য অনেকটাই হাসিল হয়েছে। গোটা মুসলিম সমাজকেই কালিমালিপ্ত করার প্রকল্প সচল হয়েছে।
দিল্লী পুলিশ জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত ছাত্র মীরন হায়দারকে ২ এপ্রিল এবং ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া সাফুরা জারগরকে ১০ এপ্রিল ইউএপিএ ধারায় অভিযুক্ত করে গ্ৰেপ্তার করল। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ -- ফেব্রুয়ারীর শেষের দিকে সংঘটিত দিল্লী দাঙ্গায় তারা ইন্ধন যুগিয়েছে।এই দুজন ছাড়াও জেএনইউ-র প্রাক্তনী উমর খলিদও ইউএপিএ-র ধারায় দিল্লী পুলিশের হাতে অভিযুক্ত হল। সে নাকি ফেব্রুয়ারির শেষে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পের ভারত সফরের সময় ট্রাম্প-বিরোধী বিক্ষোভে শামিল হতে মুসলিমদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে পরিস্থিতিকে বিশৃঙ্খল করে তোলার চেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন – প্রথম দু-জন পড়ুয়ার গ্ৰেপ্তারি এবং আর একজনের বিরুদ্ধে ইউএপিএ-তে অভিযোগের জন্য এগুলো আদৌ কারণ নয়। এই তিন জনই সিএএ-এনআরসি-এনপিআর বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল এবং শাহিনবাগ আন্দোলনেও প্রেরণা যুগিয়েছিল। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সর্বোচ্চ স্তরের নির্দেশেই দিল্লী পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসামূলক পদক্ষেপ নিয়েছে। দিল্লী পুলিশের এই তৎপরতার পিছনে দিল্লী দাঙ্গার তদন্তকে বিপথে চালিত করার, হিন্দুত্ববাদীদের চক্রান্তকে ধামাচাপা দেওয়ার অভিসন্ধিকেও অনেকে দেখতে পাচ্ছেন।
এরপর ১০ এপ্রিল উত্তরপ্রদেশের পুলিশ অযোধ্যা থানায় সকাল ১০টার মধ্যে হাজিরা দেওয়ার জন্য নোটিশ ধরাল ওয়েব পত্রিকা দ্য ওয়্যার-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক সিদ্ধার্থ ভরদরাজনকে। এবং এই নোটিশ ধরানোর জন্য উত্তরপ্রদেশের পুলিশ লকডাউনের মধ্যে গাড়ি চালিয়ে অযোধ্যা থেকে ৭০০ কিমি পথ পেরিয়ে দিল্লীতে ভরদরাজনের বাড়িতে হাজির হয়। ভরদরাজনের অপরাধ কি? তাঁর একটি লেখায় ভরদরাজন একটি উদ্ধৃতিকে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের বলে উল্লেখ করেন যেটি আসলে আদিত্যনাথের নয়। ভগবান রাম তাঁর ভক্তদের করোনা ভাইরাসের আক্রমণ থেকে রক্ষা করবেন – ভরদরাজনের লেখায় উল্লেখ করা এই উক্তিটি অযোধ্যা রাম মন্দির ট্রাস্টের প্রধান স্বামী পরমহনসের, যোগী আদিত্যনাথের নয়। এই ভুল জানতে পেরে ভরদরাজন পরে তাঁর লেখায় সেটি সংশোধনও করে নেন। কিন্তু হিন্দুত্ববাদের মার্কামারা এক শাসকের পুলিশ তাতে সন্তুষ্ট হতে পারবে কেন? যিনি মোদী সরকারের সমালোচনা করে থাকেন, হিন্দুত্ববাদীদের দুষ্কর্মের স্বরূপ উদঘাটন করেন, মানবাধিকার রক্ষার প্রবক্তা হয়ে উঠে রাষ্ট্রের মানবাধিকার লঙ্ঘনকে ধিক্কার জানান – সামান্য সুযোগ পেলেও কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা হেনস্থার মুখোমুখি হওয়া থেকে তাঁকে রেহাই দেবে কেন? কতটা প্রতিহিংসা প্রবণ হলে তবে অনবধনতাবশত এক তুচ্ছ ভুলের জন্য নোটিশ ধরাতে পুলিশকে ৭০০ কিমি পথ পারি দিতেও নির্দেশ দেওয়া যায়!
দলিত অধ্যাপক আনন্দ তেলতুম্বডে এবং সমাজ আন্দোলনের কর্মী ও লেখক গৌতম নওলখা অনেক দিন ধরেই মোদী সরকারের বিষনজরে – সরকার এদের 'শহুরে নকশাল' বর্গের অন্তর্ভুক্ত বলেই মনে করে, রাষ্ট্রের হাতে দমনের ভবিতব্যই যাদের জন্য অপেক্ষা করছে। এদের বিরুদ্ধে আপাত অভিযোগ – ২০১৮-র ১ জানুয়ারীর ভীমা কোরেগাঁওয়ের সহিংস ঘটনায় এদের প্ররোচনা ছিল, মাওবাদীদের সঙ্গে এদের যোগ খুঁজে পাওয়া গেছে, এরা নাকি মোদীকে হত্যার ষড়যন্ত্রেও যুক্ত ছিল। তবে আইন-শৃঙ্খলার ইস্যুর চেয়ে কারণ যে আরও গভীরে, রাষ্ট্রের অনুসৃত নীতির বিরোধিতা করে শাষকদের রোষ আকর্ষণই যে তাদের হেনস্থার পিছনে আসল কারণ তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার নয়। দুজনেই মোদী সরকার ও হিন্দুত্ববাদকে ধিক্কার জানান এবং রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন বিরোধী ধারাবাহিক কন্ঠস্বর। অধ্যাপক তেলতুম্বডে আম্বেদকরের ঐতিহ্যকে তুলে ধরে হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে, জাত প্রথার ধ্বংসে একনিষ্ঠ লড়াইয়ের কথা বলেন। মোদী হিটলারের চেয়েও বিপদজনক বলেও তিনি মন্তব্য করেছিলেন। গৌতম নওলখা কাশ্মীরে ভারতীয় রাষ্ট্রের নীতির, সেখানে সেনা অত্যাচারের তীব্র সমালোচক। এই ধরনের বিরোধী স্বরদের সহ্য করাটা মোদী-শাহদের ধাতে একেবারেই নেই। আর তাই ২০১৯-এর নভেম্বরে মহারাষ্ট্রে নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পর এদের বিরুদ্ধে তদন্তের ভার রাজ্যের হাত থেকে নিয়ে এনআইএ-র হাতে দেওয়া হয়। সুপ্রিম কোর্ট এদের আগাম জামিনের আবেদন খারিজ করে এনআইএ-র কাছে আত্মসমর্পণ করতে বলে। দুজনেই এনআইএ-র কাছে আত্মসমর্পণ করলে এনআইএ-র পুলিশ ১৪ এপ্রিল তাঁদের গ্ৰেপ্তার করে।
কাশ্মীরের কোন সাংবাদিক মোদীকে সমালোচনা করার স্পর্ধ দেখাবে, সেটা মোদী সরকার হজম করবে কি করে। মাসরত জাহরার চিত্র সাংবাদিক – ওয়াশিংটন পোস্ট, আল জাজিরা, দ্য ক্যারাভ্যান-এর মতো পত্রিকায় তাঁর ছবি ছাপা হয়েছে। এই সাংবাদিক যখন কাশ্মীরের অশান্ত পরিস্থিতিতে নারী ও শিশুদের অসহায়তাকে তুলে ধরেন, মোদীর মোমবাতি ও প্রদীপ জ্বালানোর আহ্বানের সমালোচনা করে বলেন, “আমি হলফ করে বলতে পারি যে, আমরা দুটো অতিমারির বিরুদ্ধে লড়াই করছি – একটা কোভিড-১৯ আর একটা মোদীর মূঢ়তার বিরুদ্ধে”, সরকারকে ফোটানো এই হুল সহ্য করা মোদীর পক্ষে সম্ভব হয় না। ইউএপিএ ধারায় অভিযুক্ত করে ১৮ এপ্রিল তাঁর বিরুদ্ধে এফআইআর করা হয়। কাশ্মীরে দ্য হিন্দু পত্রিকার সাংবাদিক পীরজাদা আশিকও এফআইআর-এর লাঞ্ছনা থেকে রেহাই পেলেন না। অভিযোগ – তাঁর প্রতিবেদনে বিবৃত শোপিয়ানের একটা সংঘর্ষের ঘটনায় তিনি ভুয়ো তথ্য দিয়েছেন। তাঁর প্রকাশিত তথ্য সঠিক কিনা সেটা তিনি প্রশাসনের কাছ থেকে যাচাই করেন নি। কিন্তু আশিক জানিয়েছেন, তাঁর প্রতিবেদনে ‘তথ্যগত ভ্রান্তির’ অভিযোগ ঠিক নয় – তাঁর দেওয়া তথ্য যে সঠিক তা প্রতিষ্ঠিত করার মতো প্রমাণ তাঁর কাছে আছে। কিন্তু জোহুজুর নয়, এমন সাংবাদিকদের শাস্তি দিতে অতীব ব্যগ্ৰ সরকার যুক্তির পথে হাঁটবে কেন! অতএব ২০ এপ্রিল তাঁর বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের হল। কাশ্মীরের আর এক সাংবাদিক ও লেখক গৌহর গিলানি এই অভিযোগে অভিযুক্ত হলেন যে, সামাজিক মাধ্যমে তাঁর করা পোস্টগুলো “জাতীয় সংহতি, সার্বভৌমত্ব এবং ভারতের নিরাপত্তার পক্ষে ক্ষতিকর।” তিনিও তাই এফ আই আর-এর অস্ত্রে সরকারের হাতে বিদ্ধ হলেন।
কোভিড ১৯-এর মোকাবিলায় পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই যখন লকডাউন চলছে, তখন দেশে-দেশে স্বৈরাচারী শাসকদের নিজেদের হাতে আরও ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার প্রবণতা অত্যন্ত স্পষ্টরূপে সামনে আসছে। অনেক দেশেই জারি হয়েছে জরুরি অবস্থার আইন – অবাধ চলাফেরা ও জমায়েতের উপর নিয়ন্ত্রণ, প্রতিবাদ-বিক্ষোভে নিষেধাজ্ঞা, আর্থিক বঞ্চনা, সেলফোন সংযোগ ও নানান অ্যাপকে কাজে লাগিয়ে জনগণের ওপর নজরদারি, এবং এই ধরনের গণতন্ত্র সংকোচনের আরও পদক্ষেপের ক্লেশ জনগণকে স্বীকার করতে হচ্ছে। ভাইরাস ছড়িয়ে পড়াকে নিয়ন্ত্রিত করতে এগুলো তাৎক্ষণিক ভাবে কার্যকর হলেও দীর্ঘস্থায়ী ব্যবস্থা হতে পারে না। কিন্তু স্বৈরাচারী নেতারা এই সমস্ত পদক্ষেপকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতাকে নিজেদের হাতে কুক্ষিগত করছেন। রাজনৈতিক ভাষ্যকার জসুয়া কার্লনাতজিক তাঁর সাম্প্রতিক এক নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন – “আলিয়েভ (আজারবাইজানের স্বৈর নেতা) কখনই একা নন। ফিলিপাইনস থেকে হাঙ্গেরি পর্যন্ত বিস্তৃত ক্ষেত্রে অনেক দেশেই স্বৈরাচারী নেতারা ভাইরাসকে ধরে তাঁদের হাতে ক্ষমতাকে বাড়িয়ে নিচ্ছেন--নতুন-নতুন বিধি চালু করছেন যেগুলো করোনাভাইরাস পরাস্ত হলেও পাল্টানো দুরূহ হবে। …” আমেরিকার ট্রাম্প থেকে ব্রাজিলের বোলসোনারো থেকে হাঙ্গেরির ভিক্টর অরবান, করোনা অধ্যায়ে এই দক্ষিণপন্থী নেতাদের স্বৈর দাপট বেড়েই চলেছে। ভারতেও এই প্রবণতার, গণতন্ত্রের ভিত্তি আরও দুর্বল হয়ে পড়ার আশঙ্কা প্রবল হয়েই দেখা দিচ্ছে। যে কোনো বিরোধী স্বরকেই ‘জাতীয়তা বিরোধী’ বলে ছাপ মেরে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পুলিশি জেরা ও তদন্তের মুখে ফেলার রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের পরিঘটনা সম্ভবত বেড়ে চলবে। ইউএপি-এর নির্বিচার প্রয়োগ এবং নাগরিক অধিকারের দমনও সম্ভবত অবাধ হয়ে উঠবে। অর্থনৈতিক সংকট দীর্ঘস্থায়ী হবে বলেই বিশেষজ্ঞ মহলের অনুমান (অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা জারি হতে পারে বলেও অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন) এবং এর বোঝা জনগণের ঘাড়ে পাচার করতে মোদী সরকার বোধকরি নিজদের হাতে ক্ষমতার আরও কেন্দ্রীভবন ঘটাবে। এই প্রবণতাকে রুখতে সক্রিয় না হলে মোদী স্বৈরাচারের দানবীয় আকার নেওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। গণতন্ত্র ও বহুত্ববাদের রক্ষার লড়াই সামনের দিনগুলোতে অনেক বেশি জরুরি মাত্রা অর্জন করতে চলেছে।
কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রক তাদের জারি করা ২৩ এপ্রিলের নির্দেশিকায় কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারীদের এবং পেনশন ভোগীদের ২০২০ সালের জানুয়ারী থেকে প্রদেয় ৪ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা ও মহার্ঘ খয়রাতি সহায্য ২০২১ - এর জুলাই পর্যন্ত বন্ধ রাখার কথা বলেছে। কর্মচারিদের যে মহার্ঘ ভাতা এবং পেনশন ভোগীদের যে মহার্ঘ খয়রাতি সাহায্য ২০২০ সালের ১ জানুয়ারী থেকে প্রাপ্য সেটাকেই শুধু আটকে রাখা হচ্ছে না, ২০২০ সালের ১ জুলাই এবং ২০২১ সালের ১ জানুয়ারী থেকে প্রাপ্য মহার্ঘ ভাতা ও মহার্ঘ খয়রাতি সাহায্যও দেওয়া হবে না। ২০২০ সালের ১ জানুয়ারী থেকে ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সময়কালের জন্য কোনো বকেয়াও দেওয়া হবে না। “পি এম কেয়ারস” তহবিলের জন্য এক দিনের বেতন কেটে নেওয়া এবং
ডিএ না পাওয়ার ফলে কর্মচারিদের সম্মিলিত ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৭ শতাংশ। এই নির্দেশিকা সামনের সারিতে থেকে কাজ করা কর্মীদেরও রেহাই দেবে না।
শ্রমজীবী জনগণের ওপর একাদিক্রমে নামানো বেশ কয়েকটি আক্রমণের সাথেই এল সাম্প্রতিকতম এই আক্রমণ। এটা দেখিয়ে দিচ্ছে যে, করোনা মহামারী এবং তারপর আচমকা নামানো লকডাউনের পরিণামে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটের গোটা বোঝাটাই শ্রমিক ও কর্মচারীদের ঘাড়ে চালান করার নীতিই সরকার নিয়েছে। দেশে অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা জারি হওয়ার আশঙ্কা জোরালো হয়ে দেখা দিচ্ছে। গুজরাট ও রাজস্থানের মতো কয়েকটি রাজ্য সরকার ইতিমধ্যেই ১২ ঘণ্টার শ্রম দিবসে বৈধতা দিয়েছে। মোদী সরকার একদিকে লক্ষ-লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিককে খাদ্য ও আশ্রয় ছাড়াই সহায়সম্বলহীন অবস্থায় আটকে থাকতে বাধ্য করছে, লকডাউন পর্বে অসংগঠিত শ্রমিকদের মজুরি দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে তার নিজের নির্দেশিকা থাকলেও ব্যাপক সংখ্যাধিক শ্রমিকদের ওই মজুরি থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। অন্য দিকে, কর্পোরেট কোম্পানিগুলোকে লক্ষ-লক্ষ কোটি টাকার বিপুল পরিমাণ কর ছাড় দেওয়া ও সুরাহা করা হচ্ছে আর কোভিড-১৯ অতিমারির মোকাবিলায় জিডিপি-র ১ শতাংশেরও কম পরিমাণের আর্থিক প্যাকেজ বরাদ্দ করেছে। দুর্নীতিপরায়ণ অতি ধনী সম্প্রদায় ও ধনকুবের ব্যবসায়ীদের থেকে কর আদায় না করে সরকার সাধারণ, শ্রমজীবী জনগণকে বঞ্চিত করে শুধু রাজকোষই ভরাচ্ছে না, কর্পোরেটদের ভাঁড়ারও পূর্ণ করছে।
ডিএ আটকে রাখাটা শুধু দুর্দশা সৃষ্টিকারী বড়সড় আর্থিক আক্রমণই নয়, বিশেষভাবে লকডাউন পরবর্তী পর্যায়ে মূল্যস্ফীতির প্রত্যাশিত সম্ভাবনার প্রেক্ষাপটে, তা একই সাথে কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারি ও পেনশন ভোগীদের কষ্টার্জিত অধিকার কেড়ে নেওয়াকেও দেখিয়ে দেয়। এ ছাড়াও লকডাউনের সময় কর্মচারিরা যেহেতু অফিস যাচ্ছেন না, তাদের তাই পরিবহন ভাতা দেওয়া হবে না বলেও সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই আশঙ্কাও দেখা দিচ্ছে যে, “পি এম কেয়ারস” তহবিলের জন্য এক দিনের বেতন কাটা এক বছর ধরে চলবে। ডিএ আটকে রাখার কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশিকা রাজ্য সরকারগুলোর, সরকার গৃহীত সংস্থাসমূহর কর্মচারীদের ও শিল্প ক্ষেত্রের শ্রমিকদের থেকেও একই ধরনের ডিএ ও মজুরি কাটার সংকেত বা সূচনা হয়ে উঠতে পারে।
বর্তমানের এই সংকট মুহূর্তে কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারি ও পেনশন ভোগীদের এবং সাধারণভাবে শ্রমজীবী জনগণকে নিশানা না বানিয়ে সরকারের উচিৎ কর্পোরেটদের ওপর ১০ শতাংশ কোভিড-১৯ কর চাপানোর কথা বিবেচনা করা।
এআইসিসিটিইউ অর্থ মন্ত্রকের জারি করা নির্দেশিকা অবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছে।
এআইসিসিটিইউ আরও দাবি জানাচ্ছে, মহামারীর নাম নিয়ে কর্মচারীদের এবং সাধারণভাবে শ্রমিকদের কোনো ধরনের ডিএ আটকে রাখা অথবা যেকোনো ধরনের মজুরি কেটে নেওয়া বা হ্রাস করা বন্ধ রাখতে হবে।
(এমএল আপডেট থেকে গৃহীত রিপোর্ট)
বিহার সিপিআই(এম-এল) রাজ্য সম্পাদক কমরেড কুনাল ১৯ এপ্রিলের তাঁর এক বিবৃতিতে বেগুসরাইয়ে সন্তোষ কুমার শর্মার হত্যাকে ধিক্কার জানিয়ে ওই ঘটনায় এক উচ্চ পর্যায়ের তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। প্রাথমিক ভাবে পাওয়া খবর থেকে জানা গেছে সামন্ততান্ত্রিক-সমাজবিরোধী শক্তিগুলোর চাপে ওই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে নভাকোটি থানা। জেলার বড়-বড় রাজনৈতিক নেতাদের নামও ওই ঘটনায় জড়িয়ে রয়েছে বলে দেখা যাচ্ছে।
ওই জেলার সিপিআই(এম-এল) সম্পাদক দিবাকর বলেন, বৈশ্য জাতের বিক্রম পোদ্দারকে বীরপুর থানা হাজতে ২৩ মার্চ হত্যা করা হয়। বিক্রমের সাথে উচ্চ জাতের একটি মেয়ের প্রেমই এই হত্যার পিছনে রয়েছে। তাঁর মেয়েকে অপহরণ করা হয়েছে বলে মেয়েটির বাবা বিক্রমের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। বিক্রমকে বীরপুর থানায় তিনদিন রাখা হয়, তারপর খবর আসে যে সে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। এটা স্পষ্টতই থানা হেফাজতে এক হত্যা বলেই মনে হয়।
সন্তোষ কুমার শর্মা এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে লাগাতার প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিলেন। এতে সামন্ততান্ত্রিক শক্তিগুলো ক্রুদ্ধ হয়ে পড়ে। তাদের চাপে নভাকোটি থানার প্রধান ৬ এপ্রিল তাকে লকডাউন না মানার অভিযোগে থানায় নিয়ে আসে। সমাজ আন্দোলনের কর্মীরা প্রতিবাদ জানালে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়, কিন্তু পরবর্তীতে তাকে ধরে অন্য আর এক জায়গায় নিয়ে গিয়ে এমন প্রহার করা হয় যে সে ১৭ এপ্রিল মারা যায়।
কুনাল বলেছেন, পুলিশ ও প্রশাসনের সাথে যোগসাজশে সামন্ততান্ত্রিক শক্তিগুলোর এই ধরনের অপরাধ বেগুসরাইয়ে এক সাধারণ ঘটনা। আমাদের অনেক নেতাকেও এইভাবে হত্যা করা হয়েছে। গিরিরাজ সিং সাংসদ হওয়ার পর সামন্ততান্ত্রিক দুর্বৃত্তদের স্পর্ধা অনেক বেড়ে গেছে এবং তারা বেপরোয়া হয়ে পড়েছে। বিক্রম পোদ্দার ও সন্তোষ কুমার শর্মার হত্যায় আমাদের সংগঠন এক উচ্চ পর্যায়ের তদন্তের দাবি জানাচ্ছে। অপরাধী পুলিশ কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং নিহতদের পরিবারগুলিকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবিও দল জানিয়েছে।
(এমএল আপডেট থেকে গৃহীত রিপোর্ট)
বিহার সিপিআই(এম-এল)-এর রাজ্য সম্পাদক কমরেড কুনাল ১৭ এপ্রিলের এক বিবৃতিতে বলেছেন, দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ, শ্রমিক এবং দুর্বল অংশের জনগণ পুলিশের পাশবিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। দোকানদার, সাফাই কর্মী এবং অন্যান্য শ্রমজীবী জনগণও পুলিশি নিপীড়ন থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। এদের অপরাধ, লকডাউন চলার সময় তাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়েও সাধারণ মানুষের কাছে অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্য ও পরিষেবা পৌঁছে দিচ্ছেন। এটা অত্যন্ত ধিক্কারজনক বিষয়। প্রশাসন যেন মনে না করে যে লকডাউন হল নিপীড়ন চালানোর লাইসেন্স। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী ও ডিজিপিকে অবিলম্বে এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে নিপীড়ন বন্ধের ব্যবস্থা নিতে হবে। পুলিশকেও বুঝতে হবে যে, একেবারে জরুরি প্রয়োজনেই জনগণ বাড়ির বাইরে বেরোচ্ছেন। কমরেড কুনাল পাটনা জেলার মাসৌরির দৃষ্টান্তের উল্লেখ করেন যেখানে সম্প্রতি ওষুধের দোকানের মালিকদের পাশবিকভাবে লাঠিচার্জ করা হয়।
আয়ারলার বিহার রাজ্য সম্পাদক গোপাল রবিদাস জানালেন পুলিশ কিভাবে ওষুধের দোকানদারদের মেরেছে। সরস্বতী ফার্মার মালিক রাহুল কুমার ১৪ এপ্রিল দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরছিলেন। হঠাৎই ডিএসপি নিজে তাকে মারতে শুরু করেন। এতে ওষুধের অন্যান্য দোকানদাররা রুষ্ট হয়ে ধর্মঘট করার সিদ্ধান্ত নেন। পুলিশ এরপর প্রভীন ফার্মা নামক দোকানে গিয়ে দোকানের কর্মচারীদের মারতে শুরু করে এবং দোকানের মালিক প্রভীন কুমারকে গ্ৰেপ্তার করে। ওষুধের দোকানদাররা এরপর বিক্ষোভ মিছিল সংগঠিত করে থানা ঘেরাও করে। পরে এসডিও-র হস্তক্ষেপেই কেবল পরিস্থিতি শান্ত হয়।
একইভাবে মাসাউরিতেও সাফাই কর্মীদের মারধর করা হলে ৬০-৭০ জন সাফাই কর্মী ধর্মঘট করেন। অন্য যাঁরা পুলিশের হাতে প্রহৃত হয়েছেন তাঁরা হলেন আকুপ্রেসার ডাক্তার পাপ্পু ঠাকুর, দরজি রহমত মিঁয়া, এবং সিগোডিতে সব্জি কিনতে যাওয়া এক ব্যক্তি।
আমবেদকর জয়ন্তি পালন করার পর সিপিআই(এম-এল) কর্মীরা ১০০০ জনকে খাবার বিতরণের ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু পুলিশ তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, লাঠিচার্জ করে, সমস্ত খাবার ফেলে দেয় এবং সবাইকে জেলে পোরার হুমকি দেয়। পুলিশ পিরহি দুলহিন বাজারে চিকিৎসা করাতে যাওয়া ৭০ বছর বয়স্ক রানাথ যাদবকেও মারধর করে।
যে সমস্ত পুলিশ কর্মী জনগণের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি সিপিআই(এম-এল) জানিয়েছে। সিপিআই(এম-এল)-এর আরও দাবি, মাসাউরির ডিএসপি-কে অবিলম্বে বরখাস্ত করতে হবে এবং জনগণকে সন্ত্রস্ত করার কাণ্ডকারখানা বন্ধ করতে হবে।
গত ১৬ এপ্রিল কাজ থেকে পাটনায় ফেরার সময় যে সমস্ত শ্রমিক দুর্ঘটনায় পড়েছেন, সিপিআই(এম-এল) তাদের জন্য ক্ষতিপূরণের দাবি জানাচ্ছে। উল্লেখ্য যে, করোনা সম্পর্কিত ত্রাণ বিলির জন্য গোলাঘরের কাছে সরকারের প্যাণ্ডেল তৈরির কাজ সেরে ফেরার সময় রামকৃষ্ণ বাইপাসের কাছে একটা ট্রাক শ্রমিকদের ধাক্কা মারে যাতে সঞ্জু দাস ঘটনাস্থলেই মারা যান, আর গুরুতর রূপে আহত হন ঊমেশ মোচি, ওম প্রকাশ পাশোয়ান, অরুণ দাস, শ্যাম দাস, রামসেবক দাস ও ছোটে দাস। এদের মধ্যে ওম প্রকাশ পাশোয়ান ও ঊমেশ কুমারের অবস্থা সঙ্কটজনক। সিপিআই(এম-এল) দাবি জানাচ্ছে, মৃতের পরিবারকে ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং আহতদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ, বিনমূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা ও ত্রাণ দিতে হবে। সিপিআই(এম-এল)-এর সম্পতচক ব্লকের সম্পাদক সত্যানন্দ কুমার আহতদের সঙ্গে সর্বদা যোগাযোগ রেখে চলেছেন।
(এমএল আপডেট থেকে গৃহীত রিপোর্ট)
বিহার : বামদলগুলো দেশব্যাপী আমবেদকর জয়ন্তী উদযাপনের যে ডাক দেয় তার প্রতি সাড়া দিয়ে ১৪ এপ্রিল তাঁর জন্ম বার্ষিকীতে বিহারের সিপিআই(এম-এল) কর্মীরা তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করে ও সংবিধান রক্ষার শপথ নেয়। তাঁরা সরকারের কাছে এই দাবিগুলোও রাখেন : লকডাউন চলার সময় দরিদ্র ও অভাবীদের নগদ টাকা এবং খাদ্য ও রেশন দিতে হবে; ধর্ম, জাত, লিঙ্গর ভিত্তিতে বৈষম্য না করে সামাজিক ঐক্যের বন্ধনকে শক্তিশালী করে তুলতে হবে; মহামারীর মোকাবিলার নামে জনগণের জীবন, স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর আক্রমণ নামানো চলবে না; অস্পৃশ্যতা অথবা বৈষম্যের যে কোন প্রকাশকেই নিয়ন্ত্রিত করতে হবে।
পাটনায় রাজ্য সদর দপ্তরে রাজ্য সম্পাদক কুনাল, সরোজ চৌবে, সন্তোষ সাহার, ব্রিজ বিহারী পাণ্ডে, প্রদীপ ঝা এবং অন্যান্যরা সংবিধান রক্ষার শপথ পাঠ করেন। কমরেড কুনাল বলেন, অন্ধবিশ্বাস এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে জনগণকে শিক্ষিত করার যে প্রচেষ্টা আমবেদকর চালিয়েছিলেন তার তাৎপর্যের অনুসরণেই আমাদের এই শপথ নিতে হবে। লকডাউন পর্বে দুস্থ ও দুর্দশাগ্ৰস্তদের ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার কাজে নিজেদের স্বেচ্ছাসেবক করে তোলার শপথ আমরা নিচ্ছি।
ছিটকোহরাতে বাবাসাহেবের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেন ধীরেন্দ্র ঝা, শশী যাদব, মুর্তজা আলি, আবিদা খাতুন ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। ধীরেন্দ্র ঝা বলেন, লকডাউনের সময়সীমাকে বাড়ানো হয়েছে, কিন্তু দরিদ্রদের কাছে রেশন পৌঁছানোর সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি।
বিহারের অন্যান্য জেলাতেও আমবেদকর জয়ন্তী উদযাপন এবং সংবিধান রক্ষার শপথ নেওয়া হয়। মধুবনীতে সিপিআই(এম-এল), আয়ারলা, কিসান মহাসভা ও আরওয়াইএ-র কর্মীরা বাবাসাহেবের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেন, তাঁর প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করেন এবং সংবিধান রক্ষার শপথ নেন। অন্যান্য যে সমস্ত স্থানে আমবেদকরের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন ও সংবিধান রক্ষার শপথ নেওয়া হয় সেগুলি হল – সহর্ষর আমবেদকর চক, দাউদনগর, চইন সিং পট্টির ভগৎ সিং আমবেদকর পাঠাগারে, বেগুসরাই, আরওয়াল, দ্বারভাঙ্গা ও জাহানাবাদে। ভোজপুর, রোহতাস, সিওয়ান, মুজাফফরপুর, নওয়াদা, নালন্দা এবং অন্যান্য জেলাতেও কমরেডরা যথাযথ নিষ্ঠার সঙ্গে আমবেদকর জয়ন্তী পালন করেন ও সংবিধান রক্ষার শপথ নেন।
উত্তরপ্রদেশ : করোনাকে প্রতিহত করার বিধি মেনে এবং শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে উত্তরপ্রদেশে সিপিআই(এম-এল) কর্মীরা আমবেদকর জয়ন্তী উদযাপন করেন। এই জয়ন্তী উদযাপনের সাথে সাথে অধ্যাপক তেলতুম্বডে, লেখক ও সাংবাদিক গৌতম নওলখা এবং ‘শহুরে নকশাল’ বলে যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের মুক্তির দাবি করা হয়।
বেনারসে আমবেদকর জয়ন্তী উদযাপনের সময় নাখি ঘাটে সাফাই কর্মীদের মহল্লায় সাবান, মাস্ক ও গ্লাভসের মতো জিনিসপত্র বিলি করা হয়। সাফাই কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরকারের পক্ষ থেকে তাদের কোন সুরক্ষাদায়ী সরঞ্জাম দেওয়া হচ্ছে না। এটা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় এবং তাদের জীবনে বিপন্নতার ঝুঁকিকে বাড়িয়ে তুলছে।
চান্দৌলি, শাকলডিহা, ছাহানিয়া, নৌগড়, সীতাপুর, ফৈজাবাদ, এলাহাবাদ এবং অন্যান্য স্থানেও যথাযথ মর্যাদা সহকারে আমবেদকর জয়ন্তী উদযাপিত হয়।
মারণ রোগ ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার খবর এসেছিল ২০১৮ সালেই। একটানা চিকিৎসা চলেছিল লন্ডনে। তারপর আবার ফেরেন অভিনয় জগতে। করোনা সংক্রমণে গোটা দেশে লকডাউন ঘোষণার সময় সিনেমা হলে চলছিল তাঁর অভিনীত কামব্যাক ফিল্ম আংরেজি মিডিয়াম। কিন্তু লকডাউন চলতে চলতেই আবারো অসুস্থ হয়ে পড়লেন তিনি। ভর্তি হলেন হাসপাতালে। আর কামব্যাক করা সম্ভব হল না। ২৯ এপ্রিল সকালেই চলে গেলেন নিতান্ত অল্পবয়সে। তাঁর প্রয়াণে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে যে হাহাকার ও শোকের ছাপ, সেটাই বলে দেয় অভিনয় দিয়ে কীভাবে মানুষের মন জিতে নিয়েছিলেন তিনি।
মনে করা যাক ইরফান অভিনীত পিকু ছবির রানা চরিত্রটিকে। অমিতাভ বচ্চন বা দীপিকা পাডুকনের মতো স্টার কাস্টদের পাশেও কি অসম্ভব উজ্জ্বল ইরফান। কথা রাখতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন, কিন্তু তার মধ্যেই হাল্কা আড়চোখে মজার চোখে দেখতে চাইছেন পরিস্থিতিটা। ছোট্ট ছোট্ট মোচড়ে, অল্প কথায় বা নীরব চাহনিতে, মুখভঙ্গীতে অভিনয়কে কোন উচ্চতায় তুলে নিয়ে যাওয়া যায় – ইরফান ছিলেন তার আদর্শ উদাহরণ। ইরফান খান এর অভিনয়ের মধ্যে আদ্যন্ত পাওয়া যায় একটা অসামান্য সেন্স অফ হিউমার, পিকু সিনেমার রানা চরিত্রটির রূপদানে এর প্রমাণ দর্শক পাবেন।
ইরফান খানের অসামান্য অভিনয়ের কথা বলতে শুরু করলেই চলে আসে লাঞ্চ বক্স সিনেমাটির কথা। ঘটনার জাল এড়িয়ে সামান্য উপাদান দিয়ে টানটান সিনেমটিক এক্সপেরিয়েন্স কীভাবে তৈরি করতে হয়, এটি তার একটি দৃষ্টান্ত। মুম্বাইয়ের এক সরকারী অফিসে মধ্যবয়সী বিপত্নীক ইরফান কাজ করেন। ভুলক্রমে তার নিজের লাঞ্চবক্সের বদলে অন্য একটি লাঞ্চবক্স তাকে দিয়ে যায় ডাব্বাওয়ালা। তারপর রোজই চলতে থাকে এই ভুল। কোথা থেকে আসছে লাঞ্চবক্স একটি চিরকুট পাঠিয়ে তাও জানা হয়ে যায়। যে গৃহিণীর তৈরি খাবার এসে পৌঁছতে থাকে তার সাথে চিরকূট বিনিময় চলতে থাকে। ছোট ছোট চিরকুট আর খাবারের সুঘ্রাণ মিলেমিশে তৈরি হয় এক অস্পষ্ট সম্পর্করেখা। তা ভালোবাসা নাকি চল্লিশোর্ধ বিপত্নীক আর ত্রিশের কোঠার একলা গৃহবধূর একাকিত্ব কাটানোর মরীয়া চেষ্টা – আমরা তা জানতে পারি না। তবে এটা জেনে যাই ইরফানের অভিনয় দক্ষতা কোন তুঙ্গ শিখর স্পর্শ করতে সক্ষম।
নেগেটিভ চরিত্রে অভিনয়ের সময়েও ইরফান ছিলেন অসামান্য। মকবুল সিনেমাটির কথা এই প্রসঙ্গে মনে করা যায়। অথবা দ্য গ্রেট মারাঠায় নাজিবউদ্দৌল্লার চরিত্রে ইরফানের অভিনয়। ক্রুর বাচনভঙ্গী কোথায় নিয়ে যেতে পারে অভিনয়কে, ইরফান এখানে তার প্রমাণ রেখেছেন।
চরিত্রকে বুঝে ফেলা ও তার মর্মস্থলটিকে অভিনয়ে নিয়ে আসার দক্ষতা ইরফান দেখিয়েছিলেন একেবারে অভিনয় জীবনের প্রথম পর্ব ভারত এক খোঁজ-এ অভিনয়ের সময়েই। চাণক্য চরিত্রের রূপায়ণে বা চন্দ্রকান্ত সিরিয়ালে তাঁর অসামান্য অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়েছিল দর্শক। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ইরফান দূরদর্শনের জন্য তোলা বেশ কিছু নাটকেও অভিনয় করেছিলেন। ন্যাশানাল স্কুল অব ড্রামাতে অভিনয় শিখে আসা ইরফানের এই ধরনের অভিনয়ে দক্ষতা স্বাভাবিকভাবেই ছিল অনায়াস। এখানে যেগুলিতে তিনি অভিনয় করেন তার মধ্যে একটি ছিল ‘লাল ঘাস পর নীল ঘোড়ে’। এখানে ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের ভূমিকায় অভিনয় করে ছিলেন ইরফান।
সালাম বোম্বেতে একটি ছোট ভূমিকায় অভিনয় করলেও সেটি পরে আর সিনেমায় ব্যবহার করেন নি পরিচালক। তাই বিশ শতকের গোড়ায়, ২০০১ সালে রাজস্থান আর হিমালয়ের প্রেক্ষাপটে নির্মিত ব্রিটেন প্রবাসী ভারতীয় পরিচালক আসিফ কাপাডিয়ার The Warrior ছবিটি দিয়েই সিনেমা জগতে ইরফানের পথ চলার সূত্রপাত বলা যায়। তবে ২০০৪ সালে শেক্সপীয়রের ম্যাকবেথ অবলম্বনে নির্মিত মকবুল চরিত্রের নাম ভূমিকায় অসামান্য অভিনয় থেকেই ভিন্ন ঘরানার অভিনেতা হিসেবে তিনি সাধারণ দর্শক ও ফিল্ম ক্রিটিক – উভয় গোত্রের মন একসাথে জয় করে নেন। ২০০৮ এ আলোড়ন তোলা স্লামডগ মিলিওনেয়ার ছবিতে পুলিশ ইনসপেক্টর চরিত্রে তাঁর অসামান্য অভিনয় দর্শক ভুলবেন না।
একইসঙ্গে শিল্প সম্মত ছবির স্বীকৃতি ও বাণিজ্যিক সাফল্য পেয়েছে ইরফানের ছবিগুলি – এটা একটা বিশেষ উল্লেখযোগ্য ব্যাপার।
বলিউডের পাশাপাশি ইংরাজি ছবির ভিন্ন ঘরানাতে অভিনয় করেও তিনি অত্যন্ত সফল হয়েছেন। এই প্রসঙ্গে মনে করা যায় তাঁর টোকিও ট্রায়াল ছবিটির কথা। বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল চরিত্রে এখানে অসামান্য অভিনয় করেন ইরফান। এখানে তাঁর অসামান্য অভিনয় দক্ষতা এখনো আন্তর্জাতিক স্তরে চর্চিত হয়।
অনেক সিনেমাতেই তিনি মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন, কোথাও বা পার্শ্ব চরিত্রে। প্রথাগত নায়কের ভূমিকায় সেভাবে নামেননি। মূলত চরিত্রাভিনেতা হিসেবেই খ্যাত ছিলেন। এই সময়ের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য চরিত্র অভিনেতাদের মধ্যে নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি, রণদীপ হুদা বা মনোজ বাজপাই-এর নামও উল্লেখযোগ্য। কিন্তু ইরফান খান ছিলেন এই অসামান্যদের মধ্যেও অতি বিশেষ।
অকালে চলে যাওয়াটা খুব খুব বড় একটা ক্ষতি। এ শোকের সান্ত্বনা হয় না। আপনার অভিনয় মনে থেকে যাবে ইরফান। বিদায় ...