নাম তাঁর ডাঃ কৃষ্ণমূর্তি সুব্রাহ্মনিয়ম। তিনি ভারত সরকারের প্রধান আর্থিক উপদেষ্টা। এ বছর বাজেট পেশের আগে আর্থিক সমীক্ষা পেশ করার সময় তিনি সংসদে বলেছিলেন, “রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোতে এক টাকা বিনিয়োগ করলে সরকারের লোকসান হয় ২৩ পয়সা। আবার, সেই এক টাকাই যদি বেসরকারী ব্যাঙ্কগুলোতে ঢালা হয় তবে লাভ হবে ৯.৬ পয়সা!”
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোর বেসরকারীকরণের সপক্ষে এহেন নির্লজ্জ ওকালতির উপর সজোরে থাপ্পড় মারলো ইয়েস ব্যাঙ্কের চলমান ঘটনাক্রম।
একেই দেশের অর্থনীতি গভীর মন্দায় আক্রান্ত। তার উপর করোনা আতঙ্ক এবং ইয়েস ব্যাঙ্কের পতন মরার উপর মোক্ষম আঘাত হেনে বসল। সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর, এই তিন মাসে ভারতের উৎপাদন বৃদ্ধির হার নেমে গেছে ৪.৭ শতাংশে। আন্তর্জাতিক এক সংস্থা ব্লুমবার্গ ইন্টেলিজেন্সের সমীক্ষা জানাচ্ছে যে, শুধুমাত্র করোনার ছোবলে জানুয়ারী থেকে মার্চ, এই তিন মাসে ভারতের বৃদ্ধির হার কমতে পারে ০.৪ শতাংশে। শেয়ার বাজারে এক নাগাড়ে পতনের আঘাত বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে মিউচুয়াল ফান্ডের জগতে, বিশেষ করে ইক্যুইটি ফান্ডগুলোতে। মার্চের ২-৬ এর মধ্যে বিদেশি পোর্টফোলিও বিনিয়োগ ইক্যুইটি ফান্ডগুলো থেকে ৮,৯৯৭.৪৬ কোটি টাকা এবং ঋণের ফান্ড থেকে ৪,১৫৯.৬৬ কোটি টাকা, অর্থাৎ মোট ১৩, ১৫৭.১২ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে। আর, গ্লোবাল ট্রাস্ট ব্যাঙ্কের পর বেসরকারি সংস্থার পঞ্চম সর্ববৃহৎ ব্যাঙ্ক, ইয়েস ব্যাঙ্কের পতনের পর বিশেষ করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাঙ্কের শেয়ারে বড় ধরনের ধ্বস নেমে এসেছে।
ইয়েস ব্যাঙ্কের পতন নতুন ঘটনা নয়। মোদীর আমলে পতন প্রথমে শুরু হয় আইএল অ্যান্ড এফএস-কে ধরে। তারপর একে একে ডিএইচএফএল-এর মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠান, পরে পিএমসি ব্যাঙ্ক আর এখন ইয়েস ব্যাঙ্ক। অর্থনীতি যখন মজবুত থাকে তখন অনেক রোগ লুকিয়ে থাকে আড়ালে কিন্তু অর্থব্যবস্থায় যখন নানান ভঙ্গুরতা প্রকট হয়ে ওঠে, তখন লুকিয়ে থাকা রোগগুলো তার আসল চেহারা নিয়ে সামনে হাজির হয়। এ ক্ষেত্রে ও তাই হলো। তাই আমরা দেখলাম, প্রথমে আইএল অ্যান্ড এফএস ও পরে ডিএইচএফএল-র মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠান দিয়ে যা শুরু হয়, তা পরে আছড়ে পড়ে পিএমসি ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রে। এবার ইয়েস ব্যাঙ্কের পালা। ব্যাঙ্ক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো একের পর এক ভেঙে পড়ার এই প্রবণতাই দেখিয়ে দেয় যে মোদীর আমলে গোটা আর্থিক ব্যবস্থার ভিতটাই নড়বড়ে হয়ে গেছে। যে কোনো দেশে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাটা টিকে থাকে আমানতকারীদের বিশ্বাসের উপর। নোট বাতিলের সময় এই বিশ্বাসের ভিতের উপর প্রথম বড় সড় আঘাত নামে। নোবেল জয়ী অর্থশাস্ত্রী ডাঃ অমর্ত্য সেন সেই সময় এই কথা বার বার বলেছিলেন। পর পর আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে ভেঙে পড়তে শুরু করেছে, তাতে সাধারণ মানুষ ব্যাঙ্কগুলোর উপর তাদের বিশ্বাস ও আস্থা আর ধরে রাখতে পারবে কিনা তা নিয়ে ঘোরতর সন্দেহ দানা বেঁধে উঠছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আজ থেকে বেশ কয়েক মাস আগে শীর্ষ ব্যাঙ্ক সমস্ত ব্যাঙ্কগুলোর কাছে এক সার্কুলার দিয়েছিল এই মর্মে যে “সাধারণ মানুষের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দিতে হবে যে ভারতীয় ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা যথেষ্ট পোক্ত ভিত্তির উপরই দাঁড়িয়ে রয়েছে।” স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে শীর্ষ ব্যাঙ্কের তরফ থেকে এই ধরনের বিজ্ঞপ্তি নজিরবিহীন।
মাত্র তিনটি ক্ষেত্র, রিয়েল এস্টেট, এনবিএফসি, নির্মাণ, এখানেই মোট ঋণের ২৫ শতাংশ ঢেলেছিল ইয়েস ব্যাঙ্ক, মন্দায় আক্রান্ত ওই ক্ষেত্রগুলো যে ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়। এছাড়া অনিল আম্বানী, এসএল, ভোডাফোন, আইএল অ্যান্ড এফএস, ডিএইচএফএল, কক্স অ্যান্ড কিং, কাফে কফি ডে-র মতো সংস্থাগুলোর বিপুল অনাদায়ী ঋণের ভারে ঝুঁকে পড়ে ইয়েস ব্যাঙ্ক। বিগত ছ’মাসে আমানতকারীরা তাদের ১৮,০০০ কোটি টাকা তুলে নেয়। ইয়েস ব্যাঙ্কের শেয়ার ৮৫ শতাংশ ক্ষয় প্রাপ্ত হয়। ২০১৫ সাল থেকে ইয়েস ব্যাঙ্ক এমন সংস্থাগুলোকে আকছার ঋণ দিয়েছিল যাদের ঋণ পরিশোধযোগ্যতা নিয়েই বড় প্রশ্ন উঠে গেছিল। এমনকি দাউদ ইব্রাহিমের ঘনিষ্ট সংস্থাকেও ঋণ দিয়েছিল। ২০১৪-র মার্চ থেকে বকেয়া ঋণের পরিমাণ প্রতি বছর ৩৫ শতাংশ হারে বেড়েছে, যেখানে সামগ্রিকভাবে ব্যাঙ্ক ক্ষেত্রে ঋণের পরিমাণ বছরে ১০ শতাংশ কম হারে বেড়েছে। এক বছরে গ্রস এনপিএ ৮৭ শতাংশ বেড়ে যায়। আরবিআই-এর প্রাক্তণ ডেপুটি গভর্নর ইয়েস ব্যাঙ্কের বোর্ডে নিযুক্ত হওয়ার পরও পরিস্থিতি বিন্দুমাত্র বদলালো না। আর্থিক অনিয়ম, নানা সন্দেহজনক সংস্থাগুলোকে বিপুল পরিমাণে ঋণ, টাকা পাচার প্রভৃতি নানা আর্থিক অপরাধে এখন সিবিআই গ্রেপ্তার করেছে ব্যাঙ্কের কর্ণধার রাণা কপূরকে। আর দিনের পর দিন, বছরের পর বছর রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এই সমস্ত কিছুর দিকে চোখ বন্ধ করে থেকেছে। শেষে এমনই হাল হলো যে তার শেয়ার ৮৫ শতাংশ পতন হয়ে প্রতি শেয়ার ৫.৫৫ টাকায় এসে দাঁড়ালো। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলো হয়ে উঠেছে কর্পোরেট লুঠের অবাধ মৃগয়া ক্ষেত্র। বেসরকারী সংস্থার হাতে না তুলে দিয়েও এগুলো কর্পোরেটদের ঢালাও ঋণ জুগিয়ে গেছে সরকারী নির্দেশে। সেই পর্বতপ্রমাণ ঋণ পরিশোধ না হওয়ায় অনাদায়ী ঋণের ভারে আমাদের দেশের গোটা ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাটাই বড় ধরনের সংকটের মুখে। ২০১৪ সাল থেকে ব্যাঙ্কগুলো অনাদায়ী ঋণের ৭,৭৮০০০ কোটি টাকা তার হিসাবের খাতা থেকে মুছে দিয়েছে। শুধু মাত্র ২০১৮-১৯ এই ব্যাঙ্কগুলো মুছেছে ১.৮৩ লক্ষ কোটি টাকা। একদিকে, কর্পোরেট ঘরানাগুলোকে বিপুল ঋণছাড় দিয়ে, আর অন্যদিকে, ডুবতে থাকা বেসরকারী ব্যাঙ্কগুলোকে বাঁচাতে পরিত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোকেই বার বার আসরে নামিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। ইয়েস ব্যাঙ্কে বাঁচাতে এসবিআই-এর ভূমিকা হচ্ছে লোকসানের জাতীয়করণ ও মুনাফার বেসরকারীকরণের সবচেয়ে চমৎকার উদাহরণ। ইয়েস ব্যাঙ্কের এখনকার দু’ টাকা দামের প্রতিটা শেয়ার এসবিআই কিনে নিচ্ছে দশ টাকা দামে, আর এই ভাবে ২৫৫ কোটি শেয়ার কিনে (যা তার মোট শেয়ারের ৪৯ শতাংশ) ইয়েস ব্যাঙ্কের সংকটদীর্ণ ঝুলিতে এসবিআই দেবে ২,৪৫০ কোটি টাকা। এসবিআই, এলআইসি, এবং আরও কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ককে নিয়ে একটা কনসোর্টিয়াম মারফত ইয়েস ব্যাঙ্কে বাঁচাবার চেষ্টা চলছে।
নোট বাতিলের ঠিক আগে বিজেপি, বা মোদীর ঘনিষ্ঠ স্যাঙাতেরা খবর পেয়ে গেছিল। তাই, আগেভাগে টাকা সরাতে তাদের বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হয়নি। ইয়েস ব্যাঙ্কের সংকটে আরবিআই-এর হস্তক্ষেপ ঘটানো এবং টাকা তোলার উপর গ্রাহকদের নিষেধাজ্ঞা জারির ঠিক আগের দিন ভাদোদরা স্মার্ট সিটি কোম্পানি তুলে নেয় ২৬৫ কোটি টাকা। আর, আদানি গ্যাস ফেব্রুয়ারী ২৫-এর পর থেকে ইয়েস ব্যাঙ্ক মারফত তার খরিদ্দারদের সঙ্গে বন্ধ করে দেয় সমস্ত লেনদেন। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক মাঠে নামার ঠিক আগের দিন ইয়েস ব্যাঙ্কের শেয়ার দর কোন ছুঁ মন্ত্রে ২৭ শতাংশ বাড়ল তা নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে সেবি। মোদী সরকার এখন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোকে ঢালাও বেসরকারীকরণ করার রাস্তা নিয়েছে। অকর্মণ্য, অকার্যকর লোকসানে চলা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে বাঁচানোর একমাত্র দাওয়াই নাকি বেসরকারীকরণ। বাস্তবে, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা — জাতীয় পুঁজিকেই ব্যবহার করা হচ্ছে লোকসানে চলা বেসরকারি কর্পোরেট সংস্থাগুলোকে পুনরুদ্ধার করতে। নরসিমহা রাও-এর প্রধানমন্ত্রীত্বের আমলে অর্থমন্ত্রী ছিলেন মনমোহন সিং। তিনি তখন বিরাট ঢাক-ঢোল পিটিয়ে উদ্বোধন করেছিলেন রমেশ গেল্লির গ্লোবাল ট্রাস্ট ব্যাঙ্ক। চূড়ান্ত অদক্ষ পরিচালনা, অন্য খাতে বিপুল মূলধন সরিয়ে নেওয়ায় তা মুখ থুবড়ে পড়ে। তখন অত্যন্ত লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক ওরিয়েন্টাল ব্যাঙ্ক অফ কমার্সকে মাঠে নামানো হয়। ওরিয়েন্টাল ব্যাঙ্ক তুলে নেয় বেসরকারী কর্পোরেট গ্লোবাল ট্রাস্ট ব্যাঙ্কের সমস্ত আর্থিক লোকসানের দায়ভার।
এটাই হচ্ছে নয়া উদারবাদী অর্থনীতির এক চমৎকার বৈশিষ্ট্য! সে যত বেশি মুখ থুবড়ে পড়বে, তত বেশি সে শুষে নিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করবে সেই ব্যবস্থার যারা বলি হচ্ছে, তাদের কাছ থেকে।