বুঝতে হবে

যোগী-মোদী জমানার প্রতি অপ্রিয় আচরণ করলে মাসের পর মাস শায়েস্তার শিকার হওয়া অবধারিত, আর প্রয়োজন মেটালে তা আইনের চোখে যতই শাস্তির দাবিযোগ্য হোক দিব্যি দিনের পর দিন গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়ানোর মওকা মেলে।

স্বনামধন্য চিকিৎসক ডাঃ কাফিল খান আজও কারারুদ্ধ। প্রায় দেড় মাস অতিক্রান্ত। গোরক্ষপুরের এই চিকিৎসক বারেবারে গোটা দেশজুড়ে পরিচিত হয়েছেন। প্রথম খবর হন ২০১৭ সালে। যখন সেখানে সরকারি হাসপাতালে গণ শিশুমৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল অক্সিজেন সিলিন্ডারের প্রাদুর্ভাবের কারণে, কারণ পেমেন্ট বাকি থাকায় সরবরাহ সংস্থা সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল। তখন কাফিল খান ও তার চিকিৎসক সহকর্মীদের টিম সচেষ্ট হয়েছিলেন এক কল্পনাতীত ব্যতিক্রম হার না মানা উদ্যোগে। সরকারি নিয়মরীতি বা অনুমতির অপেক্ষায় না থেকে এখান-সেখান থেকে যেভাবে হোক সিলিন্ডার যোগাড় করে শিশুমৃত্যুর মিছিল রোধ করতে। কিন্তু ঘটনাবলীর ধাক্কায় যেহেতু যোগী জমানায় সরকারী হাসপাতালের জরুরি চিকিৎসা পরিকাঠামোর মহা বিপজ্জনক সংকটের চেহারাটা প্রকটভাবে চিহ্নিত হয়ে যায়, তাই জনমানসে কাফিল খানরা তারিফ পেলেও বিষনজরে পড়েন যোগী সরকারের। সরকার ‘বদলা’ নিতে গণশিশু মৃত্যুর দায়টা নিজের দিক থেকে চালান করে দেয় উদ্ধারকারী টিমের দিকে, শুধু তাই নয়, শিশু চিকিৎসায় অবহেলা দেখানোর অভিযোগে কাফিল খানদের অভিযুক্ত করে পাঠায় কারাবাসে। তার গ্রেপ্তারিকে ধিক্কার জানিয়ে মুক্তির দাবিতে দেশজুড়ে সোচ্চার হয় গণতান্ত্রিক বিবেকবান মহল। এক দীর্ঘ আদালতের লড়াইয়ের পর তাঁর জামিনে মুক্তি মেলে। কিন্তু আজও তিনি কর্মস্থল ফিরে পাননি, শিকার হয়ে রয়েছেন সাসপেনশনের, প্রবল আর্থিক অনটনের। প্রবল মানসিক কষ্ট পেয়েছেন সপরিবারে, তা সত্বেও তিনি কখনও ভেঙে পড়েননি, আর্ত মানুষের প্রতি জরুরি হাত বাড়িয়ে দিতে দ্বিধা রাখেননি। গত বছর বন্যাক্রান্ত মানুষের চিকিৎসার প্রয়োজনে ছুটে গিয়েছিলেন অসমে, ‘অসমিয়া, অ-অসমিয়া’ কোনওরকম ভেদাভেদ করেননি। কাজ করেছেন অকাতরে। একরকম একজন প্রকৃত মানবতাবাদীকে অথচ স্রেফ মুসলমান বলে এবং সরকারী চিকিৎসা ব্যবস্থার চরম অবহেলাজনিত সংকটের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করানোয় অনুঘটকের ভূমিকা থাকার কারণে উল্টে ‘অভিযুক্ত’ হতে হয়! তার খেসারত দিতে হচ্ছে আজও। এইসব নিয়ে ইতিমধ্যে দরদীদের উদ্যোগে তথ্যচিত্রও নির্মীত হয়েছে এবং তার প্রদর্শন হয়ে আসছে রাজ্যে রাজ্যে, সেই সুবাদে কাফিল খান এই বাংলায়ও আসা-যাওয়া করেছেন বারকয়েক। এই প্রক্রিয়ায় তাঁর চেতনায়ও এসেছে উন্নততর দেশপ্রেমের উত্তরণ। সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থায় গভীরে বাসা বাঁধা অবহেলা বা গাফিলতির মতো কঠিন রোগকে নির্মূল করার যুদ্ধ করতে করতে নাগরিকত্ব ব্যবস্থায় নয়া ‘সংশোধনী’র নামে যে নয়া আক্রমণ নামানো হচ্ছে তার বিরুদ্ধেও সক্রিয় সরব হয়েছেন ডাঃ খান। ছুটে গিয়েছিলেন আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে, সিএএ-র বিপদ সম্পর্কে ছাত্রছাত্রীদের সামনে বক্তব্য রাখতে। এহেন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সহ্য হয়নি যোগী সরকারের, বিশেষ টাস্ক ফোর্স লাগিয়ে ফের ডাক্তারকে গ্রেপ্তার করে। সেই থেকে তিনি কারাগারে। তাঁর অন্যায় গ্রেপ্তারিকে তীব্র নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে মুক্তির দাবিতে আবারও রাস্তায় নেমেছে সহমর্মী চিকিৎসক ও নাগরিক সমাজ। পথে নেমেছেন কলকাতার বান্ধবসমাজও।

বিপরীতে, যারা দিল্লীতে প্রকাশ্য নির্বাচনী মঞ্চ থেকে শাহীনবাগের রাস্তার মহিলা জমায়েতের উদ্দেশ্যে বিদ্বেষ-ঘৃণা উগড়ে দিল, যার পরিণামে কেন্দ্র নিয়ন্ত্রিত পুলিশ থাকল নীরব-নিষ্ক্রিয়, আর তাদের সামনে বিজেপির বাহিনী সংঘটিত করল উত্তর-পূর্ব দিল্লীর সাম্প্রদায়িক গণহত্যা, সেই শয়তানদের বিরুদ্ধে আজ পর্যন্ত কোনও এফআইআর হল না, গ্রেপ্তারির দাবি কানে তোলা হচ্ছে না। মুখ খোলেননি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী! কারণ আর কিছুই নয়, হিন্দুত্ববাদী অপরাধের যাবতীয় ছাড় মেলার জমানাই চলছে।

kafil

 

কেবল কাফিল খান একা না, রাষ্ট্রীয় সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্বের বিষদৃষ্টি থেকে রেহাই পাননি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আরও অনেক প্রাক্তন ও বর্তমান বিভিন্ন পদাধিকারী নাগরিকরা। এদের মধ্যে আছেন অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস অফিসার, সমাজকর্মী, আইনজীবী, প্যাথলজিক্যাল ক্লিনিক মালিক, শিয়া চাঁদ কমিটির সভাপতি, অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের সহ সভাপতি প্রমুখ। গত ডিসেম্বরে সিএএ বিরোধী যে আন্দোলন ফেটে পড়ে তাতে বহুজনকে অভিযুক্ত করে রাস্তায় রাস্তায় লাগানো হয়েছে ছবি সহ হোর্ডিং, মাথা পিছু হিসাব ধরে নোটিশ জারি হয়েছে মোট দেড় কোটি টাকা জরিমানার। এইভাবে মেটানো হচ্ছে বিদ্বেষের আক্রোশ, বিষিয়ে তোলা হচ্ছে পরিবেশ। এলাহাবাদ হাই কোর্ট ঐসমস্ত হোর্ডিং সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছে।

এসব নিয়ে মোদী-শাহ-যোগী’র দল কখনও মুখ খুলবেন কি খুলবেন না, আদৌ দ্বিধায় নেই সেই স্বেচ্ছাচারিতায়। চর্চার সুযোগ বন্ধ উত্তরপ্রদেশ বিধানসভায়, সংসদেও তাই।

ক্ষোভের কারণ বাংলায়ও ঘটছে, বাংলার শাসকের আচরণের প্রতিক্রিয়ায়ও বাড়ছে। অমিত শাহ’র সভায় যোগ দিতে চলা মিছিল থেকে আওয়াজ ওঠে ‘.… গোলি মারো ...’! পরে পুলিশ হাতে গোনা কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করলেও তারা রাতারাতি গলায় মালা পরে বেরিয়ে এল! প্রকাশ্যে গুলি করে মারার হুমকি দিয়েও মমতা সরকারের হাজতে থাকতে হল না! মমতা সরকার এভাবে কার্যত এক দ্বিচারিতার আগুন নিয়ে খেলছে। প্রথমত, এটাই চাপিয়ে দিতে চায় এখানে তৃণমূলের বিরুদ্ধতার করলে দমননীতি চলবে। দ্বিতীয়ত এমনকি এনপিআর-সিএএ বিরোধী বা কেন্দ্র বিরোধী মোকাবিলার নিয়ন্ত্রণ কেবল রাজ্য সরকার বা তৃণমূল কংগ্রেসের হাতেই থাকবে, অন্য কোনও বাম গণতান্ত্রিক ধারাকে মাথা তুলতে দেওয়া হবে না। যে কারণে-অকারণে অনেক সময় অনুমোদন দেওয়া হয়না ছোট বড় সব ধরনের বাম ও গণতান্ত্রিক দলগুলোকে সভা-সমাবেশ করার। কার্যত এ হল রকমফের এক শাসকের বিদ্বেষপ্রসূত অগণতান্ত্রিক আচরণ। এই মনোভাব উপরন্তু নিজেকে আরও উন্মোচিত করছে এই অর্থে যে, কীভাবে ‘আইনের শাসনে’ বিজেপির গুন্ডামিকে ছাড় দিয়ে চলছে। তাই তৃণমূলী এই দ্বিচারিতার অবস্থানকেও একেবারেই বরদাস্ত করা যায় না।

খণ্ড-27
সংখ্যা-7