২০ ও ২৪ ফেব্রুয়ারী মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারত ভ্রমণ সারলেন। গোদি মিডিয়া বা পেটোয়া সংবাদমাধ্যম ট্রাম্পের সফর সম্পর্কিত বহুবিধ সমারোহপূর্ণ দৃশ্য প্রচার করেছে যাতে করে শাসক বিজেপি ও তার মুখপাত্রেরা ভারতীয় অর্থনীতির বিপর্যস্ত অবস্থা, আকাশছোঁয়া বেকারত্ব ও দেশজোড়া সাম্প্রদায়িক বিভাজন থেকে জনগণের দৃষ্টিকে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার উপযোগী জুৎসই আরও একটা মওকা পেয়ে যায়। কিন্ত ট্রাম্পের সফরের জৌলুষের আড়ালে লুকিয়ে থাকা বাস্তবতাগুলিকে, আসুন, আমরা বোঝার চেষ্টা করি।
সংবাদমাধ্যমে মহাসমারোহর দৃশ্য প্রদর্শনের জন্য কোটি কোটি টাকার অপচয় – ডোনাল্ড ট্রাম্প বারম্বার সগর্বে ঘোষণা করেছেন যে তাঁর ভারত ভ্রমণের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, বিমানবন্দর থেকে সমাবেশস্থল পর্যন্ত পথে ৭০ লাখ থেকে ১ কোটি মানুষ তাঁকে স্বাগত জানাবে (ঘটনাক্রমে, আমেদাবাদের জনসংখ্যা হল ৫৫ লক্ষ)। এর জন্য করদাতাদের গুণে দিতে হবে পর্বতপ্রমাণ ৮০ থেকে ৮৫ কোটি টাকা। অন্যদিকে, আমেদাবাদের দরিদ্র বাসিন্দাদের একটা প্রাচীরের আড়ালে থেকে অবমাননা ও নির্মমতার শিকার হতে হবে। গরিবদের অদৃশ্য করে রাখার গুজরাট মডেল, শহরে ট্রাম্পের আগমনকালে পুরোপুরিভাবে প্রদর্শিত হল। ট্রাম্প যখন সোচ্চারে বলছেন, ‘‘সর্বাগ্রে আমেরিকা”, সেখানে মোদি সরকারের কাছে “সর্বাগ্রে ট্রাম্প, ভারত নয়।’’
ভারতকে মার্কিন অস্ত্র কিনতে বাধ্য করা হল, কিন্তু ভারতের রপ্তানি-পণ্যের ক্ষেত্রে সুবিধাজনক সংস্থান প্রত্যাহৃত হল ও রপ্তানি-সামগ্রীর মাশুল বৃদ্ধি পেল যা প্রায় প্রকাশ্যেই এল না অথচ ট্রাম্পের সফরের যেটা মুখ্য উদ্দেশ্য তা হল, ভারতকে ২.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অস্ত্র কিনতে বাধ্য করা হল। এভাবেই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন আমাদের কোষাগারে দাঁত বসাচ্ছে ও ভারতের বাজারে পথ করে নিচ্ছে এবং সাথে সাথে আমেরিকার বাজারে ভারতীয় পণ্যের প্রবেশ ও ভারতীয় রপ্তানিকে নিয়ন্ত্রিত করার পদক্ষেপ নিচ্ছে তখন মার্কিন পদক্ষেপের পালটা দিতে মোদির মেরুদন্ডের কোনো জোরই দেখা গেল না। ২০১৬-তে রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর ট্রাম্প ভারতীয় ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়াম জাত পণ্যের মাশুল বৃদ্ধি করেছে এবং এ যাবৎ আমেরিকার বাজারে ২৩টি ভারতীয় পণ্য নিঃশুল্ক রপ্তানির যে সুযোগ ছিল সেই সাধারণ সুবিধা ব্যবস্থা (জেনারেল সিস্টেম প্রেফারেন্স) প্রত্যাহার করা হয়েছে।
কোনো কূটনৈতিক সুবিধা নয়, মার্কিন নির্দেশের প্রতি নির্লজ্জ আত্মসমর্পণ : মোদি সরকার মার্কিন চাপের কাছে নতি স্বীকার করে ইরান থেকে তেল আমদানি বন্ধ করেছে। এই পদক্ষেপের ফলে শুধু যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আত্মসমর্পণ করা হল তাই নয়, এজন্য দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সুবিধাও আমাদের হাতছাড়া হল (১) আমরা ইরানকে ডলারের পরিবর্তে টাকার মাধ্যমে তেলের দাম মেটাতে শুরু করেছিলাম। (২) ইরান থেকে আমদানি করা অপরিশোধিত তেল শোধন করার খরচ কম হত কেন না আমাদের তৈল শোধনাগারগুলি ইরানের অপরিশোধিত তেল পরিশোধনের উপযোগী করেই নির্মিত হয়েছিল। মোদি, তার সাঙ্গপাঙ্গ ও পেটোয়া সংবাদমাধ্যমের তর্জন গর্জনের ঠিক বিপরীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সব সময়ই এই অঞ্চলে তার আপন স্বার্থসিদ্ধির উপায় হিসেবে ভারতকে ব্যবহার করেছে।
ভারতকে ‘উন্নত’ দেশের তকমা দেওয়া ও মোদিবাহিনীর মিথ্যা হর্ষধ্বনির নেপথ্যে নিহিত প্রকৃত সত্যঃ সম্প্রতি এক ‘উন্নয়নশীল’ দেশের অবস্থান থেকে ভারতকে উন্নত দেশের পর্যায়ভুক্ত করার মার্কিন সরকারের পদক্ষেপকে মোদি সরকারের এক মস্ত সাফল্য বলে তুলে ধরা হচ্ছে। বিজেপির বেশকিছু মন্ত্রী ও সমর্থক ইতিমধ্যেই এ বিষয়ে খুবগর্ব প্রকাশ করেছেন। কিন্ত বাস্তব সত্যটা কী? ভারতকে উন্নত জাতির শ্রেণীভুক্ত করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের দেশে ভারতীয় পণ্যের নিঃশুল্ক আমদানির পথটিকেই আসলে অস্বীকার করছে। এর ফলে, আমেরিকায় ভারতীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটবে ও আমাদের রপ্তানিতে তা ব্যাঘাত সৃষ্টি করবে। আমাদের এটা মনে রাখা দরকার, ভারতকে এক ‘উন্নত দেশ’ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে নতুন শ্রেণীবদ্ধকরণ করেছে তার ভিত্তি হল আমেরিকার মনগড়া নিজস্ব এক মানদন্ড যার নিরিখে বিশ্ব বাণিজ্যে ভারতের অংশ ০.৫%-এর সীমারেখারও বেশি। বিপরীতে রাষ্ট্রসঙ্ঘ অনুসৃত বিশ্বজনীন মানদন্ডে ‘উন্নত অর্থনীতি’র সংজ্ঞায় মাথাপিছু বার্ষিক আয় নির্ধারণ করা হয়েছে ১২,৩৭৫ মার্কিন ডলার। আর ভারতের মাথাপিছু বার্ষিক আয় হল ২০০০ মার্কিন ডলার যা উন্নত অর্থনীতি সম্পর্কিত বিশ্বজনীন মাপকাঠি থেকে অনেক দূরে। স্পষ্টতই, ভারতকে ‘উন্নত’ অর্থনীতির তকমা দেওয়ার মার্কিন পদক্ষেপের সঙ্গে ভারতের প্রকৃত অর্থনৈতিক সামর্থ্য ও জীবনযাত্রার মানের কোনো সম্পর্ক নেই। বরং আমেরিকা তার আপন স্বার্থে, ভারতীয় পণ্যকে আরও কম প্রতিযোগিতামুখী করে তোলা ও আমেরিকার অনুকুলে ভারতের বাণিজ্যিক সুবিধ সমূহকে ছিনিয়ে নেওয়ার জন্যই এমন পদক্ষেপ নিয়েছে।
ভারতীয়দের বিরুদ্ধে এবং এইচ-১ বি ভিসা হ্রাস করার উদ্দেশ্যে ট্রাম্প প্রশাসনের লাগাতার পদক্ষেপ : আমেরিকায় ভারতীয় পেশাজীবীদের কাজ করাকে ট্রাম্প প্রশাসন ক্রমাগত কঠিন করে তুলছে। অতি দক্ষ ভারতীয় নাগরিকদের জন্য যে এইচ-১ বি ভিসা মঞ্জুর করা হয় তাতে নিয়মবিধির পরিবর্তন আনার মধ্যেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। ২০১৭-তে ট্রাম্প ‘আমেরিকানদের থেকে কেনো। আমেরিকানদের ভাড়া কর’ নীতি গ্রহণ করেছে — যার দ্বারা ভারতীয় পেশাজীবীদের ভারা করা কঠিন হয়ে পড়ছে। ফলস্বরূপ, এইচ-১ বি ভিসা নাকচের পরিমাণ ২০১৫-র ৪% থেকে বেরে ২০১৮-তে দাঁড়িয়েছে ১৫%-এ। ভারতীয় তথ্য প্রযুক্তি (আই টি) কোম্পানিগুলির প্রাপ্ত এইচ-১ বি’র অংশ ২০১৬তে ৫১%-এর তুলনায় হ্রাস পেয়ে ২০১৯-এ নেমে এসেছে ২৪%-এ। যারা ইতিমধ্যে আমেরিকায় থেকে কাজ করছেন এমন ব্যক্তিদের এইচ-১ বি ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন খারিজ করার হার ২০১৬-র ৪% থেকে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১৮%-এ। এই সমস্ত তথ্য থেকে যে বাস্তব সত্যটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে তা হল, ট্রাম্প আমেরিকায় ভারতীয় নাগরিকদের কাজ করা কটিন করে তুলেছেন। আমেরিকায় ট্রাম্প যে ভাবে ঘৃণা ও বিদেশী-বিদ্বেষের আবহ সৃষ্টি করেছেন তার শিকার হচ্ছেন ভারতীয়রা অথচ মোদি সরকার ও তার সমর্থকেরা এ ব্যাপারে নিশ্চুপ থেকে গেছে। ট্রাম্প বার বার বলছেন, ভারতকে নিয়ে তিনি সুখী নন কিন্ত মোদি তাঁর মিত্র। ভারত এবং সাধারণ ভারতবাসীর কাছে এর অর্থ কী দাঁড়ায়? শেষ বিচারে, নিজ নিজ দেশে তাঁদের দ্বারা উসকে দেওয়া ঘৃণা, বিভাজন ও বিদেশী-বিদ্বেষ দুই নেতাকে এক সূত্রে গ্রথিত করে। আর নিয়তির কী পরিহাস! নিজেদের অতীব জাতীয়তাবাদী বলে ঘোষণা করায় যাদের ক্লান্তি নেই এবং অন্য যে কোনো স্বরকে যারা ‘জাতীয়তা বিরোধী’ বলে কাঠগড়ায় তোলে তারাই নতজানু হয়ে ট্রাম্পের নির্দেশের সামনে অসহায় আত্মসমর্পণ করছে। ট্রাম্পের সফরের সময় সংবাদমাধ্যমে সমারোহের দৃশ্য ফুটিয়ে তোলার জন্য করদাতাদের অর্থের জঘন্য অপব্যবহারকে আমাদের অবশ্যই উন্মোচিত করতে হবে। ট্রাম্প প্রশাসনের মর্জি ও আবদারের সামনে মোদি সরকারের নির্লজ্জ আত্মসমর্পণকেও আমাদের প্রত্যাখ্যান ও প্রতিরোধ করতে হবে।