দেশের রাজধানী দিল্লীতে হত্যা অভিযান সংগঠিত হওয়ার দায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ওপরই বর্তায়। দিল্লীর পুলিশ তাঁর দপ্তরের অধীন। চার দিন ধরে চলা হত্যা ও ধ্বংসলীলায় দিল্লী পুলিশের ভূমিকা নিয়ে দেশ জুড়ে তো বটেই এমনকি আন্তর্জাতিক স্তরে প্রশ্ন উঠেছে। নির্দিষ্ট একটি সম্প্রদায়কে নিশানা বানিয়ে সুপরিকল্পিতভাবে এই অভিযান চলে এবং সমগ্র পর্ব জুড়ে হত্যা, লুন্ঠন ও শত শত বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা পুলিশের সামনে ঘটে। হামলাকারীদের প্রতিরোধ করা তো দূরের কথা, কিছু কিছু ক্ষেত্রে পেছন থেকে সহযোগিতা করার ভূমিকাতেও দেখা যায় দিল্লী পুলিশকে। রাজধানী শহরে যখন এই প্রলম্বিত বিধ্বংসী অভিযান চলছিল, যখন আগুন জ্বলছিল একের পর এক সংখ্যালঘু বসতিতে, যখন হত্যা করে লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছিল নর্দমায়, তখন সমগ্র সময়টা জুড়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ছিলেন সম্পূর্ণ নীরব। গণহত্যায় সম্মতি জ্ঞাপন ছাড়া এই নীরবতার আর কোন অর্থ থাকতে পারে? জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর থেকেও পুলিশের এই নিষ্ক্রিয়তাকে চিহ্নিত করে ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন শহরে তো বটেই, ইউরোপ ও আমেরিকার শতাধিক শহরের প্রতিবাদী সভা থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়বদ্ধতা দাবি করে পদত্যাগ চাওয়া হয়। এরকম পরিস্থিতিতে কলকাতায় পূর্ব নির্ধারিত দলীয় জনসভায় বক্তব্য রাখতে আসেন অমিত শাহ।
১ মার্চ কলকাতায় অমিত শাহের জনসভাকে কেন্দ্র করে যুগপৎ ক্রোধ ও ভীতির সঞ্চার হয়েছিল। দিল্লীর হত্যা অভিযানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের ভূমিকার বিরুদ্ধে বেদনাবিধুর ক্ষোভ যেমন আচ্ছন্ন করেছিল শান্তিকামী মানুষকে, তেমনি অন্যদিকে এক আশঙ্কাও গ্রাস করছিল। কলকাতাতেও কি দিল্লীর মতোই কিছু ঘটাতে চলেছে বিজেপি-আরএসএস? দিল্লীর অভিযান ছিল সম্পূর্ণ একতরফা। কলকাতাতেও ভিন্ন মাত্রায় সেরকমই একটা দাঙ্গাহাঙ্গামা বাধাতে কি কাজে লাগানো হবে অমিত শাহের জনসভাকে? এই আশঙ্কা কেউই মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছিল না। বিশেষত খবর ছড়িয়ে পড়ে যে পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলি থেকে বাহিনী সংগঠিত করে আনছে বিজেপি, যারা সুযোগ পেলে তাণ্ডব চালাবে। এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের কয়েকটি গণমঞ্চ এই আশঙ্কায় ১ মার্চে রাস্তায় নেমে প্রত্যক্ষ বিরোধিতার কর্মসূচী থেকে সরে আসে। বামপন্থী ছাত্র-যুব সংগঠনগুলি সতর্কতার সাথেই শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ কর্মসূচীতে অটল থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। বামপন্থী দলগুলিও শহরের বিভিন্ন জনবহুল স্থানে স্থানীয় স্তরের বিক্ষোভ কর্মসূচী ও একটি কেন্দ্রীয় মিছিল সংগঠিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। এছাড়াও বিভিন্ন স্বতস্ফুর্ত ও শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদী কর্মসূচী সংগঠিত হয়। কার্যত, এয়ারপোর্ট থেকে শুরু করে যাদবপুর, মৌলালী থেকে শুরু করে ধর্মতলা, কলকাতার বিভিন্ন স্থানেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ চেয়ে “গো ব্যাক অমিত শাহ” আওয়াজ ওঠে, অমিত শাহের কুশপুতুল পোড়ে। মৌলালী রামলীলা ময়দানে কয়েক শত যুব অবশ্য বিজেপির রাজ্য অফিস অভিমুখে রওনা হয় ফুলের তোড়া, মিস্টি, ‘লাভ লেটার’ ও এক কপি সংবিধান হাতে নিয়ে; তাদের ব্যানারে লেখা ছিল “অমিত শাহ, তোমরা ঘৃণা ছড়াচ্ছ, আমরা ভালোবাসা ছড়িয়ে দেব”। কলকাতার বিভিন্ন স্থানে যে “শাহিনবাগ” গড়ে তুলেছেন মহিলারা, সেখান থেকেও ধিক্কার জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করা হয়। পরদিন ১৭টি বাম ও গণতান্ত্রিক দলের যৌথ মিছিল সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার থেকে ধর্মতলা যায়, যেখানে উপস্থিত ছিলেন সিপিআই(এমএল)-এর রাজ্য সম্পাদক পার্থ ঘোষ সহ আরও অনেকে।
একদিকে এইসব বিক্ষোভ ও পদত্যাগের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে কলকাতা, অন্যদিকে ১ মার্চ কলকাতায় অমিত শাহের জনসভা ছিল এক কথায় ফ্লপ। জমায়েতের আকার দেখে যেমন একথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে দিল্লীর গণহত্যা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভূমিকাকে মন থেকে মেনে নেয়নি বিজেপি প্রভাবিত জনতাও, তেমনি এদিন অমিত শাহের বক্তব্যও ছিল অন্তসারশূণ্য। রাজধানীতে এত বড় ধ্বংসলীলা সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একটি কথাও বলেননি জনসভায়। অন্যদিকে — প্রচার ছিল যে তিনি নাগরিকত্ব আইন নিয়ে বোঝাতে আসছেন — সে প্রসঙ্গেও তিনি তেমন কিছুই বলে উঠতে পারেননি। কেন এতদিন পর নমশূদ্র সমাজের মানুষকে সিএএ-র মাধ্যমে নতুন করে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে হবে সে বিষয়ে কিছুই বোঝাতে পারলেন না তিনি। অন্য দেশ থেকে নতুন আসা ব্যক্তিদের নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য ১৯৫৫-র আইনই তো যথেষ্ট ছিল, তাও কেন এমন একটা সংকীর্ণ আইন আনা হল; অথবা সিএএ-র মাধ্যমে পঞ্চম তপশীলভূক্ত জমিতে অনুপ্রবেশ ও নিজস্ব ধর্মীয় স্বীকৃতির আন্দোলনকে স্তব্ধ করার অপচেষ্টা সম্পর্কে আদিবাসীদের আশঙ্কা নিয়েও কোনও কথা বলেননি তিনি। কার্যত অমিত শাহের জনসভা বাংলাতে আমদানি করে গেল “গোলি মারো” শ্লোগানটি কেবল আতঙ্ক বিভাজন হত্যা নৈরাজ্যই নিয়ে আসবে। বাংলার মানুষ তা মেনে নেবে বলে মনে হয় না।