উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে মুসলিম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণকারী ভীড় হিংসায় দিল্লি পুলিশের যোগসাজশের ভূরি ভূরি প্রমাণ উপচে পড়ছে।
কল-লগগুলি থেকে দেখা যাচ্ছে উত্তর-পূর্ব দিল্লির থানাগুলিতে সাহায্যের আর্তি জানিয়ে হিংসার শিকার অসহায় মানুষের হাজার হাজার ফোন আছড়ে পড়েছে, কিন্তু কোনো সাড়া মেলেনি। অনেক ছক কষেই পুলিশের এই উধাও হয়ে যাওয়া শুধু যে পরিকল্পিত মুসলিম-বিরোধী সন্ত্রাসের জন্য যথেষ্ট দায়ী তা-ই নয়, মুসলিমদের দ্বারা হিন্দুদের আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রেও এমন ঘটনা হয়েছে। হিংস্র জনতার সঙ্গে পুলিশেরও শ্লোগান তোলার প্রমাণ রয়েছে। এক ন্যক্কারজনক ঘটনায়, পুলিশ আহত মুসলিমদের পিটিয়ে, লাথি মেরে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে বাধ্য করেছে, চিকিৎসাতেও বাধা দিয়েছে। এইভাবে প্রহৃত ও প্রকাশ্যে নিগৃহীত একজন পরে মারা যায়। আহতদের কাছে অ্যাম্বুল্যান্স যাতে নিরাপদে পৌঁছাতে পারে সেজন্য মাঝরাতে হাইকোর্ট থেকে পুলিশকে নির্দেশ দিতে হয়েছে! এবং অবশ্যই, সেই বিজেপি নেতা, যারা হিংসায় উস্কানি দিতে প্রকাশ্যে ঘৃণাবর্ষী ভাষণ দিয়েছিল, পুলিশ তাদের গ্রেফতার করতে অস্বীকার করেছে।
অতি সম্প্রতি মধ্য দিল্লি এবং দিল্লি মেট্রোতে, এক দল লোককে “গোলি মারো গদ্দারোঁ কো” শ্লোগান দিতে দেখা গিয়েছিল – দিল্লি পুলিশ এদের কোনো একজনকেও গ্রেফতার বা অভিযুক্ত করেনি। বিজেপি’র কাছে, যে কেউ এনপিআর-এনআরসি-সিএএ আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালেই বা মোদী সরকার নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুললেই ‘বিশ্বাসঘাতক’। তাছাড়া বিজেপি এবং আরএসএস, ভারত সম্পর্কে তাদের হিন্দু রাষ্ট্রের ধারণা থেকে সব মুসলমানকেই ‘বিশ্বাসঘাতক’ মনে করে। দিল্লি পুলিশের, বিজেপি ও আরএসএস-এর মতাদর্শে অনুগত সশস্ত্র হিংস্র জনতা বা ব্যক্তিকে ছাড় দেওয়ার বেশ দীর্ঘ রেকর্ড আছে। তারা জেএনইউ-তে ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের মধ্যে সন্ত্রাস সৃষ্টিকারী সশস্ত্র এবিভিপি-সদস্যদের গ্রেফতার করতে অস্বীকার করে এবং একটি সিএএ আইন-সমর্থক মিছিলের সদস্যরা যখন গার্গী কলেজের ছাত্রীদের যৌন নিগ্রহ করে,তারা নিষ্ক্রিয় দর্শক হয়ে ছিল। এক সশস্ত্র ব্যক্তি যখন জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া-র ছাত্রছাত্রীদের দিকে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে এক ছাত্রকে ঘায়েল করে ফেলে, তারা কোনো গুরুত্ব না দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছিল। বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র যখন দিল্লিতে মুসলিম- বিরোধী হিংসাকে উস্কানি দেওয়ার অভিপ্রায় ঘোষণা করছিল, তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন দিল্লি পুলিশের এক পদস্থ কর্তা। মুসলিম-বিরোধী হিংসায় যারা তাণ্ডব চালিয়েছিল, হাত রাঙিয়েছিল, তাদের পরিচয় সুরক্ষিত রাখার জন্য দিল্লি পুলিশ সিসি টিভি-ক্যামেরাগুলো ধ্বংস করে ফেলেছে।
এই আচরণ, শান্তিপূর্ণ সাংবিধানিক প্রতিবাদের প্রতি দিল্লি পুলিশ যে আচরণ করেছে, ঠিক তার উল্টো। দিল্লি পুলিশ জেএনইউ-এর ছাত্র-ছাত্রীদের গ্রেফতার করেছে, দেশদ্রোহিতায় অভিযুক্ত করেছে – শুধুমাত্র শ্লোগান দেওয়ার অভিযোগে যা প্রমাণিত হয়নি, এবং শুধুমাত্র ভাষণ দেওয়ার অভিযোগে যাতে হিংসার কোনো উস্কানিই ছিল না। এই বাহিনী বারংবার ছাত্রছাত্রীদের উপর লাগামছাড়া বর্বর আক্রমণ নামিয়েছে – জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া ক্যাম্পাসের ভিতরে, লাইব্রেরীতে যেমন, তেমনই জেএনইউ-ছাত্রছাত্রীদের নিরস্ত্র শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে। আরও সম্প্রতি, এই বাহিনী পূর্ব দিল্লির খুরেজি-তে সিএএ-বিরোধী সংগঠক ও প্রতিবাদকারীদের নৃশংসভাবে মেরেছে, একজনকে “হত্যার চেষ্টার” অভিযোগে জেলেও পাঠিয়েছে। আর ৩ মার্চ যখন সারা ভারত থেকে ছাত্র-যুবরা হাজারে হাজারে শান্তি, ন্যায় ও গণতন্ত্রের জন্য ‘ইয়ং ইন্ডিয়া মার্চ’-এ অংশ নিতে এসেছিল, দিল্লি পুলিশ তাদের শয়ে শয়ে আটক করে, এমনকি বাস চালকদেরও আটকে রাখে যাতে তারা প্রতিবাদকারীদের মার্চে সামিল হওয়ার জন্য পৌঁছে দিতে না পারে।
দিল্লি পুলিশ সরাসরি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নিয়ন্ত্রণাধীন। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো থেকে এটা একেবারে পরিষ্কার যে, এই বাহিনী এখন কার্যত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের কট্টর অনুগামী, একটি রাজনৈতিক বাহিনী হিসেবেই কাজ করছে। তাই দিল্লি পুলিশের ভারতীয় সংবিধানের প্রতি নৈতিক বা আইনগত, কোনো দায়বদ্ধতা নেই। দিল্লির পরিকল্পিত হত্যাভিযান, ভারতের বাকি অংশে সুসংগঠিত হত্যালীলা চালানোর শাহ-মোদীর অভিসন্ধির এক আগাম সংকেত। অমিত শাহের কলকাতা সফরের সময় তার শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীরা শ্লোগান তুলেছে,” গোলি মারো গদ্দারোঁ কো” — এটা এক অশুভ তাৎপর্য বহন করছে।
শাহের কলকাতা শোভাযাত্রা তেমন বড় কিছু ছিল না; আর এটাও তাৎপর্যপূর্ণ যে, পশ্চিমবঙ্গে তার আগেকার ভাষণগুলির বিপরীতে, এবার এনআরসি নিয়ে তার নীরবতা চোখে পড়ার মতো। বরং তিনি আশ্বস্ত করতে চেয়েছেন যে সিএএ থেকে ভয়ের কিছু নেই। একই সাথে, বিহার বিধানসভায় এনআরসি, ২০২০ এনপিআর-এর বিরুদ্ধে গৃহীত সর্বসম্মত সিদ্ধান্তটিও লক্ষণীয় — এসবই দেখিয়ে দেয় যে ভারত-জোড়া প্রতিবাদ আন্দোলন বিজেপি-কে এনপিআর-এনআরসি নিয়ে পিছু হটতে বাধ্য করেছে। এখন বিজেপি সিএএ বাঁচাতে মরিয়া, এমনকি তা এনআরসি নিয়ে সাময়িক ও রণকৌশলগত পরিকল্পিত পশ্চাদপসরণ এবং হয়তো এনপিআর নিয়ে আংশিক পিছু হটার মূল্যেও। বিজেপি’র আশা, এটা করার মধ্য দিয়ে, তার মুসলিম-বিরোধী ঘৃণা ও হিংসার আখ্যানকে প্রতিষ্ঠিত করার ও ভারতব্যাপী এনপিআর ও এনআরসি-কে ছড়িয়ে দেওয়ার মতো অনুকূল একটি আবহাওয়া গড়ে তোলার যথেষ্ট সময় পাবে।
আমাদের, ভারতবর্ষের জনসাধারণের, এনপিআর-এনআরসি-সিএএ-এর গরিব-বিরোধী গণতন্ত্র-বিরোধী অ্যাজেন্ডাকে উন্মোচিত করার এবং এইসব ফ্যাসিস্ট নাগরিকত্ব আইন পুরোপুরি ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করার চেষ্টাকে এতটুকু শিথিল করা চলবে না। তার সঙ্গে, দিল্লির অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে এবং ভারতবর্ষের কোথাও সাম্প্রদায়িক হিংসার আগুন উস্কে তোলার যে কোনো চেষ্টাকে রূঢ় প্রত্যাখ্যানের জন্য সতর্ক থাকতে হবে। দিল্লির পরিকল্পিত হত্যাভিযানের সংঘটকদের বিচারের আওতায় আনার জন্য আমাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।
(এমএল আপডেট সম্পাদকীয় ৩ মার্চ, ২০২০)