বিশ্বত্রাস করোনাভাইরাস। জাতি-ধর্ম ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে প্রথম বিশ্ব তৃতীয় বিশ্বের মানুষকে একসারে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। হ্যাঁ, আক্রান্ত হওয়ার প্রশ্নে। কিন্তু প্রতিরোধ? সেখানেও কি এই ‘সাম্য’?
এইটাই গণ্ডগোলের প্রশ্ন। ‘হু’-এর নির্দেশিকা থেকে শুরু করে কেন্দ্র-রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্য দপ্তর, ডাক্তারবাবু – সবার সতর্কীকরণ ও আলোচনা একটি নির্দিষ্ট স্তরের জনসাধারণের জন্য – যারা মোটামুটিভাবে শিক্ষিত, অন্তত সাক্ষর, স্বাস্থ্য সচেতন, (সামান্য হলেও) সঙ্গতিসম্পন্ন নাগরিক মানুষ, একটি মোটামুটিভাবে সুস্থ আবহে সুশৃঙ্খল জীবনধারার মধ্যে আছেন। সেটাই তো স্বাভাবিক, সেটাই তো সঙ্গত!
স্বাধীনতার বাহাত্তর বছর পরে মানুষের এই ন্যূনতম উন্নতিটুকু তো একান্ত প্রত্যাশিত! নাহ্, এই সব স্বাস্থ্যবিধি, নির্দেশিকার ব্যাপারে কিছু বলার নেই।
ভাবছিলাম সেই মানুষদের কথা যারা ‘নেই’ রাজ্যের বাসিন্দা। যাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, পায়ের তলার মাটি, মাথার উপর ছাদ, সম্ভ্রম রক্ষার আব্রু, মর্যাদাপূর্ণ কর্মসংস্থান – কিচ্ছু নেই। নেই নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো একটু তাজা বাতাস, সুস্থ গার্হস্থ্যযাপনের মতো কোনো পরিবেশ। অনেকেরই নেই নাগরিকত্ব প্রমাণের ‘কাগজ’। আর তাই নেই ভোটাধিকার। স্রোতের শ্যাওলার মতো পেটের তাগিদে ভেসে বেড়ানো জীবন। অভাবের তাড়নায় তাড়া খাওয়া জীবন।
গাঁ-গঞ্জ থেকে দু’মুঠো ভাতের নিশ্চিত সংস্থানের আশায় শহরের বা শহরতলির কোনো ঘিঞ্জি বস্তি, রেললাইনের ধারে কোনো ঝুপড়িতে দিন গুজরান। কোথাও রেলের জমিতে অদৃশ্য মালিকের বানানো ঘরে উপার্জনের সিংহভাগটুকু ভাড়া হিসেবে গুনে দিয়ে একটু মাথা গোঁজার চেষ্টা। না আছে নিকাশি ব্যবস্থা, না আছে জল। হুকিং করে টেনে আনা লাইনে ঘরে আলো জ্বলে পাখাও হয়তো চলে। তার জন্যে আলাদা পয়সা। কোনো অভিযোগ জানানো যাবে না – ‘না পোষায় চলে যাও’। দূরের কল থেকে, কখনও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রেললাইন পেরিয়ে, কখনও চওড়া যানবহুল রাস্তা পার হয়ে পানীয় জলটুকু সংগ্রহ করে আনা। (এবং সেটা অবধারিতভাবেই মেয়েদের দায়। কর্মক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরে পুরুষদের আর এই বিরক্তিকর কাজটা পোষায় না। যদিও তিন-চার সন্তানের মা মহিলাটিও পাঁচ-ছ’বাড়ি কাজ সেরে ফেরে) স্নান, কাপড় কাচা বাসন মাজা? এককালের টলটলে দিঘী এখন মিউনিসিপ্যালিটির লাগাতার ময়লা ফেলার সৌজন্যে নোংরা ডোবা হয়ে গেছে। (ওটা সরকারী জমিতে। ভরাট করে অন্য কাজে লাগানো হবে) যার জল ব্যবহার করে চর্মরোগ দেখা দিয়েছে। আর শৌচাগার? কেন, রেল লাইন তো আছে! অথবা ‘কাজের বাড়ি’ – হাউজিং কমপ্লেক্সের বারোয়ারি টয়লেট। ঘর থেকে বেরিয়ে দীর্ঘ পথ হেঁটে সেখানে লাইন দেওয়া। মাঝেমধ্যে বচসা হাতাহাতিও হয়ে যায়। প্রাকৃতিক প্রয়োজন তো সৌজন্য মানে না। বেলাইনে কেউ ঢুকতে চাইলেই ঝামেলা। – হ্যাঁ, অত্যন্ত দুঃখের, অত্যন্ত লজ্জার হলেও ‘স্বচ্ছ ভারত’-এর বিজ্ঞাপন-মোড়া শহরে এমনিভাবেই বহু মানুষ বেঁচে আছে, বেঁচে থাকবে। এদের হয়ে বলার, এদের ন্যূনতম পরিচ্ছন্ন পরিবেশের ব্যবস্থা করার কেউ নেই – কারণ এদের কোনো ‘ভোট’ নেই, থাকলেও তা ‘দেশে’ – প্রত্যন্ত কোনো গ্রামে। এদের হয়ে লড়ার কেউ নেই, কারণ এরা ‘জবরদখল’ করে থাকা এক উপদ্রব বিশেষ – স্থানীয় প্রশাসনের কপালে বিরক্তির কুঞ্চন হয়ে টিঁকে রয়েছে যতক্ষণ না বুলডোজার এদের মাটির উপর হুমড়ি খেয়ে থাকা চট প্লাস্টিক দরমার অকিঞ্চিত্কর গেরস্থালি ধুলোয় মিশিয়ে দিচ্ছে।
দশ ফুট বাই দশ ফুট ঘরে, গাদাগাদি করে থাকা আধ ডজন মানুষের সংসারে – কোথায় ঘন্টায় ঘন্টায় হাত ধোওয়ার সাবান, জল, সময় কোথায় হ্যান্ড স্যানিটাইজার, সেল্ফ কোয়ারান্টাইন! অগত্যা ‘মারী নিয়ে ঘর করা’ মানুষগুলোর ভরসা সেই ‘আল্লা-ভগবান’।
আর সসঙ্কোচে সভয়ে উল্লেখ করতেই হচ্ছে – বিজেপি কর্মীদের ‘মানুষকে ভালোবেসে’ গোমূত্র পান করানোর কথা। বিজেপি’র রাজ্যনেতা সদম্ভে এইসব কর্মকাণ্ডকে সাফাই দিয়ে ঘোষণা করলেন – গোমূত্র তিনিও খান, ভবিষ্যতেও খাবেন। তবে পশ্চিমবঙ্গের বুকে দাঁড়িয়ে এইভাবে কুসংস্কারের মদত দেওয়ায় বিজেপি-আরএসএস-এর যত না কৃতিত্ব আছে, তার থেকে ঢের বেশি দায় আছে আমাদের। সাড়ে তিন দশকের বাম জমানা এবং তার পরেও বামপন্থীদের লাগাতার মিছিল মিটিং অবস্থান থেকে বক্তব্য – সব মাঝপথে রাজপথেই হারিয়ে গেল! আমরা কি মানুষের মনের অন্দরমহলে যাওয়ার পথটা হারিয়ে ফেললাম! আমরা কি শ্রমিক মহল্লার বারোয়ারি একচিলতে উঠোনের চারপাই-টায় অনেক দিন গিয়ে বসিনি! শ্রমিক কমরেডের বৃদ্ধ বাবা কিশোরী মেয়েটির খোঁজখবর রাখিনি! সদ্য তরুণ ছেলেটির মনের তালাশ করিনি! পড়াশুনোর খোঁজখবর রাখিনি! যাক, সে প্রসঙ্গ তো আপাতত আলোচ্য নয়। মোদ্দা কথা হল, বহু মানুষের পক্ষে এই সুরক্ষা বিধি বাস্তবেই মানার উপায় নেই। তাদের কী হবে?
দিল্লীর ধ্বংসস্তূপের বিপন্ন মানুষ আজ যেখানে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন সেই ঈদগাহ ত্রাণশিবিরে সুরক্ষা বলয় কতটা কার্যকরী?
কুড়ি লক্ষ মানুষের দৈনিক আনাগোনা যেখানে সেই শিয়ালদহ -হাওড়া স্টেশনের জমাট ভীড় এখন নিশ্চয়ই অনেক কম। কিন্তু তাতেও তো সেখানে সুরক্ষা নিয়ে উৎকণ্ঠা থেকেই যায়।
স্কুল কলেজ বন্ধ থাকলেও অভিজাত স্কুলগুলিতে পঠন পাঠন অব্যাহত রাখার চেষ্টা চলছে আধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে। কিন্তু প্রান্তিক পরিবারের যে শিশুরা মিড ডে মিল-এর জন্যেই স্কুলমুখী হয়েছে তাদের ক্ষুন্নিবৃত্তি কীভাবে হবে?
করোনা ভাইরাসের উৎস নিয়ে বড় বড় দেশ তথা রাষ্ট্রপ্রধানদের মধ্যে অনেক চাপান-উতোর চলছে। কোনো দাবিই এখনও পর্যন্ত প্রমাণিত হয়নি। কিন্তু সেই সব মন্তব্যকে আশ্রয় করে জাতিবিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ছে করোনাভাইরাস-এর থেকেও দ্রুতগতিতে! এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামের সাধারণ মানুষের মধ্যেও!
এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে এক ভারতপ্রেমী ইতালীয় লেখিকার লেখায় ব্যবহৃত উদ্ধৃতিটি ধার নিয়ে শুধু বলি, “অল উই নিড ইজ লাভ/লাভ ইজ অল উই নিড”। মন্ত্রোচ্চারণের মতো বুকের ভিতরে শুধু প্রতিধ্বনিত হোক এই ভালোবাসা দরদ সহমর্মিতার কথা। আন্তর্জাতিক স্তরে চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীরা সম্ভবত এই মন্ত্রে ভর করেই হাতে হাত মিলিয়ে প্রাণপাত করে চলেছেন সভ্যতার এই সংকট অতিক্রমণের। আসুন আমরাও সামিল হই!