লেখার শুরু করব দুটি বিশেষ ঘটনার উল্লেখের মধ্যে দিয়ে। (১) কর্ণাটকের বিদারে এক স্কুল ছাত্রকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করা। (২) ব্যাঙ্গালুরুতে বাংলাদেশী হুজুগ তুলে বস্তি উছেদ করা। আপাতভাবে দুটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা, কিন্তু সামগ্রিক রাজনৈতিক আর সামাজিক প্রেক্ষাপটে তারা বিচ্ছিন্ন নয়। গত ২১ জানুরায়ী কর্ণাটকের বিদারে সাহিন প্রাথমিক এবং উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্ররা এনআরসি, সিএএ-র বিরুদ্ধে একটি নাটক পরিবেশন করছিল। নাটকের অংশ হিসাবেই সরকার এবং প্রধানমন্ত্রীর সম্পর্কে ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য করা হয়েছিল, আর এই ছিল তাদের অপরাধ। কর্ণাটক পুলিশ এই ঘটণায় বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা, অধ্যক্ষর নামে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪এ, ৫০৪, ৫০৫ নং ধারা অনুযায়ী দেশদ্রোহের মামলা রুজু করে। বিদ্যালয়ের যে ছাত্ররা ঐ নাটকে অংশ নিয়েছিল তাদের সবাইকে ধারাবাহিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠানো হয়। শাসকদলের কণ্ঠরোধের চেষ্টার প্রচেষ্টার সাথে আমরা পরিচিত এবং তা যে কোনো সময়ের শাসকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, কিন্তু সাধারণ মানুষের সামান্য প্রতিবাদকে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করার প্রবণতা এমনকি জরুরি অবস্থাকেও ছাড়িয়ে যায়।
এটাই ভাজপা সরকারের প্রকৃত রূপ — উত্তরপ্রদেশে যোগীরাজ এক চূড়ান্ত দমনপীড়নকারী বিকৃত শাসনব্যবস্থা, কর্ণাটক খূব আলাদা কিছু নয়, আর পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্য — যেখানে তারা বিরোধী পক্ষে — সব জায়গায় তাদের অবস্থান মোদী–শাহ কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ–চূড়ান্ত সাম্প্রদায়িক–মুসলমান বিরোধী এবং এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে সামনে রেখে নয়া উদারনৈতিক অর্থনৈতিক আগ্রাসন চালানো যায় আর এনআরসি, সিএএ-এর মাধ্যমে জনগণের এক বড় অংশকে সস্তা শ্রমিকে পরিণত করে মূল সমস্যা থেকে নজর অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া। এর সাথে যুক্ত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিষয়টি। ‘গোলি মারো শালো কো’-র মতাদর্শই মোদি-শাহ দিকে দিকে ছড়িয়ে দিতে চায়। এনআরসি, সিএএ বিরোধি আন্দোলন যে সারা দেশে এইভাবে ছড়িয়ে পড়বে তা তাদের ধারণার বাইরে ছিল।
কর্ণাটকে — বিগত ১৯ ডিসেম্বর ১৪৪ ধারাকে উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষ এনআরসি, সিএএ এর বিরুদ্ধে জমায়তে সামিল হয় এবং বেঙ্গালুরুতে ২০০ জনেরও বেশি গ্রেপ্তারবরণ করে। সারা ভারতবর্ষব্যাপী এই আন্দোলন কর্ণাটকের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে আর ম্যাঙ্গালোরে পুলিশের গুলিচালনায় ২ জন আন্দোলনকারীর মৃত্যু হয়।
২৩ ডিসেম্বর ফ্রেজারটাউন, নন্দিদুরগারোড সহ সংলগ্ন এলাকা জুড়ে প্রায় ৭০ হাজার মানুষ জড়ো হয়েছিল। তাদের দৃপ্ত কন্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল — এনআরসি, সিএএ নিপাত যাক, আজাদি, সংবিধান বাঁচাও। অধিকাংশ মানুষই মুসলিম, হাতে তাদের জাতীয় পতাকা।
বিভিন্ন সংগঠন, আর স্বতস্ফূর্ততার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে ‘হাম ভারতকে লোগ’, যা অন্য উদ্যোগগুলির পাশাপাশি বিভিন্ন আন্দোলন সংগঠিত করতে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছে।
আইআইএসসি, সেন্ট যোসেফ, ক্রাইস্টসহ বিভিন্ন কলেজের হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে ছাত্র-ছাত্রীদের এক অংশ ধারাবাহিকভাবে প্রচার আন্দোলন গড়ে তুলেছে জামিয়া মিলিয়া-জেএনইউ-তে পুলিশী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। প্রতিদিন সিলিকন ভ্যালি বেঙ্গালুরুতে বিভিন্ন জায়গায় একাধিক কর্মসূচী সংগঠিত হচ্ছে। সারা দেশ জোড়া আন্দোলন আর শাহিনবাগের লড়াই এ অনুপ্রাণিত হয়ে ফ্রেজারটাউন, আজকের বিলালবাগে ধারাবাহিকভাগে অবস্থান শুরু হয়েছে, যার সামনের সারিতে রয়েছে মুসলিম মহিলারা। উল্লেখযোগ্য বিষয় এই আন্দোলনে প্রাক্তন স্বাধীনতা সংগ্রামী, ১০১ বছর বয়সী দোরাইস্বামীর উপস্থিতি। আন্দোলন মুলত শহরকেন্দ্রিক হলেও, মাইসোর, বিদার কালবুর্গীর মতো জায়গাতে উদ্যোগ সংগঠিত হয়েছে। এই আন্দোলন, যা শান্তিপূর্ণ গণ আন্দোলন হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে, তা শাসকদলকে আতঙ্কিত করেছে, তাই দিল্লি কেন্দ্রীয় সরকার, উত্তরপ্রদেশের রাজ্য সরকারের কায়দায় বিদারে দেশদ্রোহিতার মিথ্যা মামলায় অভিযূক্ত করা হয়েছে। মিথ্যা অভিযোগ আর দেশদ্রোহিতার অভিযোগ বিজেপি সরকারের সময়ে খেলাধূলোর মত হয়ে গেছে। আসলে যারা সংবিধানের ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকারকে খর্ব করে সংবিধানকে বিকৃত ও পরির্বতন করার চেষ্টা করে, যাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভূমিকা হয় ব্রিটিশদের পক্ষে দাঁঁড়ানো অথবা নিষ্ক্রিয় থাকা, তারা আজ উঠে পড়ে লেগেছে দেশদ্রোহী প্রমাণ করা তাদেরকে, যারা সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়ে, জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে ফ্যাসিস্ত সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছে। ফুলওয়ামার ঘটনাকে পাথেয় করে, আম্বানি, আদানি, টাটাদের প্রদেয় অর্থকে ব্যবহার করে ব্যাপক প্রচার, কর্পোরেড মিডিয়ার তীব্র মেকি জাতীয়তাবাদী প্রচার ও সর্বোপরি অন্য শাসকদলগুলির ব্যর্থতার কারণে বিপুল ভোটে জিতে আসা বিজেপি এনআরসি, সিএএ নিয়ে এত প্রতিরোধের মুখে পড়বে তা ভেবে উঠতে পারেনি।
যাই হোক এনআরসি, সিএএ বিরোধী আন্দোলনের পাশাপাশি গত ৮ জানুয়ারী বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের ডাকা ও বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন এবং কৃষক সংগঠন সমর্থিত সর্বভারতীয় ধর্মঘট এক অর্থে সফল। কর্ণাটকেও হাজার হাজার শ্রমিক কর্মচারিরা ধর্মঘটকে সমর্থন করে, যে ধর্মঘটের অন্যতম দাবি ছিল এনআরসি, সিএএ-কে নাকচ করা। আন্দোলনের আর একটি বৈশিষ্ট হল দলিত সংগঠনগুলির আন্দোলনে সামিল হওয়া। মোদী সরকারের উদ্যোগে এবং আদালতের সাম্প্রতিক রায়ে এটা পরিষ্কার সংরক্ষণ প্রথা, দলিতদের উপর সন্ত্রাস বিরোধী আইনকে লঘু করার প্রচেষ্টা চলছে। কর্ণাটকেও দলিত সংঘর্ষ সমিতি এনআরসি, সিএএ বিরোধী বিভিন্ন সমাবেশে অংশগ্রহণ করেছে। তবে বিজেপি সরকার চাপে পড়লেও তারা তাদের জনবিরোধী কর্মসূচী চালিয়ে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। বাংলাদেশী হুজুগ তুলে অভিবাসী শ্রমিকদের উপর হামলা এটা দেখিয়ে দেয় যে এনআরসি আসলে গরিব বিরোধী একটি আইন।
এনআরসি, সিএএ আইনের পর্যালোচনা করার অবকাশ এখানে নেই। তবে এনপিআর-এ যেমন বাবা, মা-র জন্ম তারিখ, স্থান জিজ্ঞেস করবে, তেমনি এনআরসি-তে সন্দেহজনক নাগরিক হিসাবে চিহ্নিত হলে ভোটার কার্ড, আধার কার্ড দেখানোই যথেষ্ট নয়। আর সিএএ-তে ধর্মীয় নিপীড়নের প্রমাণ দেখাব কিভাবে? যাই হোক গত জানুয়ারী মাসে কর্ণাটক পুরসভা মারাথালির কাছে একটি বস্তি উচ্ছেদ করে, যেখানে উত্তর কর্ণাটকের, পশ্চিমবঙ্গের শ্রমিকরাই থাকতেন। আসলে বাঙালী এবং বাংলাদেশীকে সমার্থক করে দিয়ে অভিবাসী শ্রমিকদের মধ্যে আতঙ্ক করাই উদ্দেশ্য। শোনা যায় বিজেপির এক এমএলএ-র উদ্যোগে এই কার্য সংগঠিত হয়। বিভিন্ন সংগঠন উচ্ছেদ হওয়া শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ান আরপিইউএল-এর উদ্যোগে হাইকোর্টে পিটিশন দাখিল হয়, আর হাইকোর্ট এই উচ্ছেদের বিরুদ্ধে রায় শোনায়। জয় সামান্য হলেও। কিন্তু বিজেপির আগ্রাসী আচরণ কোর্টকেও পরোয়া করে না, যার প্রমাণ এই ধরনের ঘটনা আবার ঘটান।
গত ১৩ ফেব্রুয়ারী পূর্ব ব্যাঙ্গালোরের মুন্নিখোলালা অঞ্চলে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলা থেকে কাজের খোঁজে আসা বাঙালি মাইগ্রেন্ট শ্রমিকদের বস্তিতে ৫০-৬০ জন স্থানীয় গুন্ডা অতর্কিতে আক্রমণ করে ওই অঞ্চলের প্রায় ২৫টা বাড়ি ভেঙে দেয়। একজন মহিলা গুন্ডাদের বাধা দিলে তারা মহিলাটির ৬ মাসের বাচ্চাকে মাটিতে আছড়ে ফেলে। বাচ্চাটির মাথায় চোট লেগেছে। পুলিশ ১০-১২ জন গুন্ডাকে গ্রেপ্তার করেছে। স্থানীয় মানুষের অনুমান স্থানীয় বিজেপি এমএলএ অরবিন্দ নিম্ববলির প্রভাবেই এই আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। তবে আন্দোলনকারীদের দমানো যায়নি—তারা শ্রমিকদের পাশে থেকে প্রশাসনের উপর চাপ তৈরি করেছে সমাজবিরোধীদের বিরূদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য এবং এফআইআর গৃহীত হয়েছে।
‘‘কে আছো জোয়ান হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যত ...’’ ছাত্র–যুব, শ্রমিক-কৃষক-দলিত-আদিবাসীদের বেশি বেশি করে সংগঠিত করা — এটাই কাজ। কান্নন গোপীনাথন, জিগনেশ মেভানি, কবিতা কৃষ্ণান সহ প্রমুখ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা ডাক দিয়েছেন — ‘‘কাগজ নেহি দিখায়েঙ্গে’’ — যার অর্থ সমবেতভাবে এনআরসি, সিএএ বয়কট। আর এর সাথে চাপ বাড়াতে হবে রাজ্য সরকারের উপর যাতে তারা সাংবিধানিকভাবে কেন্দ্রের এই কালা ফরমানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়।