এ ভারতের দৃশ্য কেউ কোনোদিন দেখেনি। আক্ষরিক অর্থেই নির্লজ্জতায় নজীরবিহীন। বীভৎসতায় অন্তহীন। একদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে অভিজাত আপ্যায়ন। একইসময়ে অন্যদিকে সংখ্যালঘু অধ্যূষিত অঞ্চলে সুপরিকল্পিত আক্রমণ।
ট্রাম্পের দুদিনের ভারত সফরে খরচ করা হল কত! ১০০ কোটি টাকা! আমজনতার ন্যূনতম কল্যাণকর বাজেটের বালাই নেই, বরাদ্দ ছাঁটা হচ্ছে ক্রমাগত, অথচ মার্কিন রাষ্ট্রপতির জন্য রাজকীয় খরচ করতে বাধেনি। বিমানবন্দর থেকে সম্বর্ধনার আসরকেন্দ্র দেশের বৃহত্তম মোতেরা স্টেডিয়ামে নিয়ে আসা হয়েছে মাছি গলতে না পারার নিরাপত্তায় ঘিরে। পথে বহু ঢাক পেটানো ‘উম্নয়নের’ পরিণাম ঢাকতে আগের রাতের অন্ধকারে কোথাও সরিয়ে দেওয়া হয়েছে ঘিঞ্জি বস্তিবাসীদের, কোথাও বস্তির সামনে তুলে দেওয়া হয়েছে উঁচু পাঁচিল। নির্লজ্জ শাসকদের আবার লজ্জা কি! মোদী ভারতে বস্তি-ঝুগ্গি-ঝোপড়া বা খোলা আকাশের নীচে কত শতাংশ গরীবতমদের থাকতে হয় সে তো ইন্টারনেট দেখলেই জানা যায়। অন্যদিকে ‘উন্নয়নের’ অত্যাধুনিক রাষ্ট্র দাবি করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও সাদা-কালো কত শতাংশ গরিব মানুষ পথবাসী সেও তো বিশ্ব উন্নয়ন সমীক্ষায় অধরা নয়। তাহলে আবার ঘটা করে ‘উন্নয়নের’ লজ্জা ঢাকার ঢঙ দেখানো কেন? ভন্ডামির শেষ নেই। ট্রাম্পকে সম্বর্ধনার আসর জমাতে জমায়েতের জনতাকে নিয়ে আসা হয়েছিল বিভিন্ন রাজ্য থেকে এবং যথেষ্ট টাকা ছড়িয়ে। বিগত সবকটা বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির পরাজয় ঘটেছে। সদ্য হারতে হয়েছে দিল্লী বিধানসভা নির্বাচনে। প্রমাণ হয়ে চলেছে বিজেপির ভাগ্যরেখা নামছে ক্রমশ নীচের দিকে। গুজরাটে ক্ষমতায় থাকলেও সেখান থেকে এখন স্টেডিয়াম ভরানোর লোক জোগাড় করা মুশকিল, পরন্তু গুজরাটের বুকেও গড়ে উঠছে প্রতিবাদ। এই অবস্থায় ট্রাম্পের আগমন উপলক্ষে জমায়েত ক্ষমতা করে দেখানোর মওকা বিজেপি হাতছাড়া করতে চায়নি। কিন্তু এই দেখনদারী কোনো অভিনবত্ব কুড়োতে পারেনি, বরং সম্মুখীন হয়েছে বিদ্রূপের। মোদী সরকার যেখানে একশ দিনের কাজের মোট বরাদ্দ ছেঁটে দিচ্ছে, যার ফলে কাজ জুটছে না চাহিদা অনুপাতে, সেখানে প্রায় ‘এক লক্ষ’ মানুষকে একদিনের খাওয়া-পরার কাজের সংস্থান করে দিয়েছে! ট্রাম্প-মোদী একজন অন্যজনের পিঠ চাপড়েছেন। মোদী মার্কিন মুলুকে যখন যান তখন ট্রাম্পের গণতন্ত্র বিরোধী, বর্ণবিদ্বেষী, নারী বিরোধী, অভিবাসী বিরোধী, পরিযায় বিরোধী পলিসি নিয়ে কোন কথা বলেননি। তার বদলে ট্রাম্পকে একজন বলশালী মার্কিন নেতা হিসেবে তুলে ধরেছিলেন; ট্রাম্পও তেমনি মোতেরায় মোদীকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিলেন। মোদী সম্পর্কে ট্রাম্প বললেন, ‘শান্ত, ধার্মিক’! যদিও মোদীর সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী, বর্ণবাদী, আদিবাসী বিরোধী নারী বিরোধী, গণতন্ত্র বিরোধী গুণপনা নিয়ে ট্রাম্পের কিছুই অজানা নেই। আর উভয়ের মধ্যে সবচেয়ে জঘন্য মিল রয়েছে ইসলাম-মুসলিম বিরোধিতায়। তাই দুই রাষ্ট্রীয় শিরোমণির পারস্পরিক আচরণে মিলিজুলি ভাবেরই গলাগলি প্রত্যক্ষ হল।
ট্রাম্পকে মোদী নিয়ে গেছেন সাবরমতী আশ্রমে। তার পিছনে কাজ করেছে সুচতুর ছক। এটা ট্রাম্পেরও বেশ মনে ধরে। দুটো আলাদা দেশে ঘৃণা-বিদ্বেষ-বিভাজন-হিংসার রাজনীতির দুই একচেটিয়া কারবারী অহিংসার প্রতীক গান্ধীর বসতবাটিতে গেলেন উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই। নিজেদের অপশাসনকে গণঅসন্তোষের হাত থেকে বাঁচাতে গান্ধী-স্মৃতিচারণের হাবভাব দেখাতে। গান্ধীর আশ্রমিক খাতায় ট্রাম্প গান্ধী প্রসঙ্গে লিখেছেন কেবল মোদীর প্রশস্তির কথা। যেসব ইস্যুতে আজ গোটা ভারত উথালপাথাল, যেমন সিএএ, এনআরসি, এনপিআর, কাশ্মীর ইত্যাদি; মোদীকে বিড়ম্বনায় না ফেলতে সেসব বিষয়ে ট্রাম্প ঢোকেননি। ট্রাম্প-মোদীর পৌরহিত্যে ভারত-মার্কিন চুক্তি হল প্রধানত অস্ত্রশস্ত্রের। ভারত হয়ে উঠুক মার্কিনের অন্যতম প্রতিরক্ষা সহযোগী, এটা কেবল ট্রাম্প নন, মোদীও চান, বিনিময়ে মোদী আরও প্রত্যাশা আমেরিকা ‘মোদী-ভারতে’র পাশে থাকুক। মার্কিনের অস্ত্রবেচার বিশ্ববাজারে ভারত এক বড় খরিদ্দার, রাফায়েল কেচ্চা নিয়ে বহু তোলপাড় হওয়ার পরে মোদী সরকার এখন অস্ত্র কিনতে মার্কিনমুখী। কথা দিয়ে দিল ৩৫০ কোটি ডলার মূল্যের সেনা হেলিকপ্টার কেনার। কোনও দেশের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার লক্ষণ নেই। কেবল বহু আভ্যন্তরীণ যুদ্ধ পরিস্থিতি চাপিয়ে দিচ্ছে মোদী সরকার, কিন্তু সেক্ষেত্রে তো সেনা হেলিকপ্টারের দরকার পড়ে না। দেশ ছেয়ে যাচ্ছে বিভীষিকার মতো গরিবী আর বেকারিতে। আর এই অবস্থাতেও সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পেল অত্যাধুনিক সেনা হেলিকপ্টার চুক্তি। ট্রাম্প-মোদী বোঝাবুঝি হল আরও কিছু বিষয়ে। যেমন, তেলসম্পদ আহরণ ও গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থা, ৫জি নেটওয়ার্ক ও আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংক্রান্ত ব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে। আর, ট্রাম্পের কাছে দ্বিতীয় গুরুত্ব পেলেন কর্পোরেট চাঁই মুকেশ আম্বানি। ট্রাম্প থাকতেই গেরুয়া ভৈরববাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছিল শাহীনবাগের ওপর। আর ট্রাম্প ভারত ছাড়তেই সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা প্রবল আকার নিল, চলল ব্যাপক লুঠ-মার-খুনখারাবি। তিনদিন একটানা হামলায় সংখ্যালঘু জনজীবন হল জেরবার। বিজেপির চার-পাঁচজন মাফিয়া নেতার লাগাতার উস্কানিমূলক উক্তিবর্ষণ পরিবেশকে রক্তক্ষয়ী প্রাণঘাতী সংঘর্ষের আবর্তে ফেলে দেয়। শুধু তাই নয়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীও যথেষ্ট দায়ী, দিল্লী নির্বাচনী প্রচারপর্বের সময় থেকে সমানে তাতিয়ে এসেছেন।
দিল্লীতে যা ঘটছে তা মোটেই হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের দাঙ্গায় লিপ্ত হওয়া নয়, এ হল এনআরসি-এনপিআর-সিএএ-বিরোধী আন্দোলনকে দমন করতে হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রায়িক আক্রমণ। দিল্লী পুলিশকে সুপরিকল্পিতভাবে নিস্ক্রীয় করে রেখেই মারমুখী অভিযান সংগঠিত করা হল। ধরনটা বাবরি মসজিদ ধ্বংস বা গুজরাট গণহত্যার নজির স্মরণ করিয়ে দিল। দিল্লী হাইকোর্ট দিল্লী পুলিশের নিস্ক্রীয়তা নিয়ে ভর্ৎসনা করেছে, কৈফিয়ৎ তলব করেছে, হুঁশিয়ার করেছে, দাঙ্গাবাজ বিজেপি নেতা ও গুন্ডাবাহিনী কি করে অপারেশান চালাতে পারল? এখনও অপরাধীদের পান্ডাদের সমেত গ্রেপ্তার করা হল না কেন? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নির্বিকার। প্রধানমন্ত্রী তিনদিন বাদে কিঞ্চিৎ ‘শান্তি-সম্প্রীতি’র বাণী দিলেন মাত্র। হ্যাঁ, অবশেষে শ্মশানের শাম্তি ফিরিয়ে আনতে নামানো হয়েছে আধা সেনা, পক্ষান্তরে নিরাপত্তাহীনতায় প্রচণ্ড উদভ্রান্ত সংখ্যালঘু জনতা মায় সাংবাদিক মানুষজন পর্যন্ত। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের নামে উপদ্রুত মহল্লায় নামিয়েছে এমন এক ক্রুর প্রকৃতির ‘জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা’কে যিনি চরম মুসলিম-বিরোধী, কাশ্মীরী জাতিসত্ত্বার স্বাধিকার বিরোধী, পাক বিরোধী; আর প্রচুর সংখ্যায় সেনাজীবন শেষ হয়ে যাওয়ার যে বেদনাদায়ক পুলুওয়ামাকাণ্ড ঘটেছিল, তার পিছনে চরম গাফিলতির দায় ছিল উপরোক্ত উপদেষ্টা আমলার। তিনি দিল্লীকাণ্ডে পথে নামা শুরু করলেন সরকার আর পুলিশের সাফাই গেয়ে। পদত্যাগের দাবি উঠেছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর। কিন্তু কর্ণপাত করছেন না।
দিল্লীকাণ্ড ঘটানোর মাথারা শুনিয়েছিলেন গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সবক শেখানোর কথা। এখন শাহীনবাগ, জাফরাবাদ থেকে শুরু করে সারা দেশজুড়ে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে নতুন করে শপথ নিতে হবে, ঘাতক হিন্দুত্ব যে প্রতিরোধের ভাষা বোঝে সেই ভাষাতেই দিতে হবে প্রত্যুত্তর।