এনআরসি-সিএএ অভিযান আদিবাসী জনজীবনে ব্যাপক বিপর্যয় আনতে চলেছে

আসামে এনআরসির তালিকা প্রকাশ হওয়ার পর দেখা গেছে বাদ পড়াদের মধ্যে এক লক্ষের কিছু বেশি মানুষ আদিবাসী সমাজের। সারা দেশে এনআরসি হলে আদিবাসীদের বৃহৎ অংশই যে বাদ পড়বে তা আলোচিত হতে শুরু করেছে। অন্যদিকে নাগরিকত্ব আইনের নয়া সংশোধনীর ফলে আদিবাসীদের জমি, সাংবিধানিক রক্ষাকবচ, জনবিন্যাস ও ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক পরিচিতি বিপন্ন হয়ে পড়ার সম্ভাবনা স্পষ্ট হতে শুরু করেছে।

বে-নাগরিক হয়ে যাওয়া

সারা দেশে এনআরসি হলে বে-নাগরিক হয়ে যাওয়া আদিবাসী মানুষের সংখ্যা কোটির ঘরে চলে যেতে পারে। বিভিন্ন কারণে এরকম আশঙ্কা করা হচ্ছে। কোনোরকম সরকারী কাগজপত্র নাই এরকম প্রথাগত যাযাবর আদিবাসীরা ছাড়াও গোটা দেশে উন্নয়নুদ্বাস্তুদের বিপুল অংশই আদিবাসী। বনাঞ্চলে বসবাসকারীরা বনাধিকার আইনে আবেদন করেও জমির পাট্টা পাননি এরকম সংখ্যাও বেশ কয়েক লক্ষ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ঝাড়খণ্ডের সারাণ্ডা অরণ্যাঞ্চলে ১৭টি আদিবাসী গ্রামের একজনের কাছেও কোনও কাগজ নাই সরকারের কাছে নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করার মতো। তাছাড়া ঝাড়খণ্ডে পাথালগাঢ়ি আন্দোলনে রাষ্ট্রব্যবস্থা অস্বীকার করে হাজার হাজার আদিবাসী মানুষ নিজেদের সমস্ত কাগজপত্র নিজেরাই পুড়িয়ে দিয়েছেন। সব মিলিয়ে এনআরসিতে প্রমাণ দিতে না পারা আদিবাসী মানুষের সংখ্যা এক কোটি ছাপিয়ে যাবে। আর কাগজ থাকলেও নাম না ওঠার সম্ভাবনা তো আছেই।

জমির অধিকার হারানো

নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনীতে (সিএএ, ২০১৯) স্পষ্টভাবে বলা আছে যে ষষ্ঠ তপশীলভূক্ত এলাকায় এই আইন কার্যকর হবে না। সিএএ-এর বিরুদ্ধে আসামে ব্যাপক আন্দোলন শুরু হওয়ায় এই অংশটি যুক্ত হয়। এর অর্থ হল উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির আদিবাসীদের জমি ষষ্ঠ তপশীল দ্বারা যেমন ছিল তেমনই সুরক্ষিত থাকবে, সিএএ-র মাধ্যমে ঘোষিত হওয়া শরণার্থীদের ষষ্ঠ তপশীলভূক্ত এলাকায় পুনর্বাসন দেওয়া হবে না। তাহলে কোথায় দেওয়া হবে? উত্তরটা অনেকের কাছেই পরিস্কার: পঞ্চম তপশীলভূক্ত এলাকায় শরণার্থীদের বসানো হবে। সমতলের দশটি রাজ্যে আদিবাসীদের জন্য যে এলাকাগুলি পঞ্চম তপশীল দ্বারা সংরক্ষিত থাকার কথা সেই এলাকাগুলিতে নতুন সেটেলমেন্ট হবে। এমনিতেই পরিসংখ্যান বলছে হাজার হাজার একর জমি বেআইনিভাবে আদিবাসীদের হাত থেকে প্রতি বছর হস্তান্তরিত হয়ে যাচ্ছে। বনাধিকার আইনও বাস্তবে আমলাতন্ত্রের দ্বারা প্রায় অকেজো। সিএএ, ২০১৯ পঞ্চম তপশীলের অধিকারে অনুপ্রবেশ করে আদিবাসীদের জমি গ্রাস করবে।

সাংষ্কৃতিক ধারাবাহিকতা ধ্বংস

নতুন শরণার্থী সেটেলমেন্ট আদিবাসী বসতি এলাকাগুলির জনবিন্যাস বদলে দেবে। ঝাড়খণ্ডে কলকারখানা স্থাপনের মাধ্যমে ইতিমধ্যেই এরকম বদল ঘটেছে। ১৯৫০ সালে এই অঞ্চলে মোট জনসংখ্যার ৩৬% ছিল আদিবাসী। ২০১১ সালে এই অনুপাত নেমে এসেছে ২৬.২%। ১৯০৭ সালে পূর্ব সিংভূম জেলায় টাটাদের ইস্পাত কারখানা স্থাপনের সময় সেখানকার ৯৫% ছিল আদিবাসী, যা ২০১১ সালে মাত্র ৫% হয়ে গেছে। নতুন শরণার্থী পুনর্বাসন পঞ্চম তপশীল এলাকাগুলিতে আদিবাসীদের সংখ্যালঘু করে দিতে পারে এবং সেক্ষেত্রে বিধানসভা লোকসভায় আসন সংরক্ষণ সহ অন্যান্য সাংবিধানিক রক্ষাকবচ হারাবে আদিবাসীরা। আদিবাসীদের ভাষা সংস্কৃতির ধারাবাহিকতাও ধ্বংস হয়ে যাবে। নিজস্ব ধর্মের স্বীকৃতির জন্য যে আন্দোলন আদিবাসীরা চালাচ্ছেন তাও স্তব্ধ করে দেবে সিএএ।সব মিলিয়ে এনআরসি-সিএএ আদিবাসী সমাজে ব্যাপক বিপর্যয় আনতে চলেছে। ঝাড়খণ্ডের বাসিন্দা, খেড়িয়া আদিবাসী সমাজের সন্তান ও গবেষক গ্ল্যাডসন ডুংডুং- এর লেখা একটি নিবন্ধে উপরের বিষয়গুলি ব্যক্ত হয়েছে।

খণ্ড-27
সংখ্যা-5