এক অদ্ভুত সময় পার করেছে আজকের ভারতবর্ষ। গণতন্ত্র ও সংবিধান রক্ষার প্রাণপন লড়াই সারা ভারতবর্ষ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে দাবানলের মতো। ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংকল্পের দিনগুলোতে শিল্পমাধ্যমের একটি কাজ থাকে। এই তীব্র স্পন্দনকে সৎভাবে প্রতিফলিত করা। বিশ্বের সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিরোধের সঙ্গে ভারতের জনসাধারণের এই সংগ্রামের এক নিবিড় আত্মীয়তা আছে। সেই সূত্রগুলোকে গ্রন্থিত করা এই মুহূর্তে শিল্পমাধ্যমগুলির এক গুরুদায়িত্ব। সিনেমা এমনই একটি মাধ্যম যা এই কাজটিকে থেকে খুব দ্রুত সম্পন্ন করে, একটি স্থানে দাঁড়িয়ে নানা স্থান, নানা কালের, নানা বর্ণের জীবন যুদ্ধকে জুড়ে দিতে পারে। এক মুহূর্তে ছড়িয়ে দিতে পারে প্রতিরোধের জরুরী বার্তা।
প্রতিরোধের সিনেমা ‘সিনেমা অফ রেজিস্ট্যান্স’ এই কাজটি করতে চায়, বিশ্বের নানা কোণের জীবন ও প্রতিরোধের গল্প তার সামর্থ্য অনুযায়ী বয়ে নিয়েযেতে চায় আশেপাশের মানুষের মধ্যে, যা সংগ্রামরত মানুষকে আশা ও উদ্দীপনা যোগাবে।
গত ২৬ ডিসেম্বর সিনেমা রেজিস্ট্যান্স’ পৌঁছেছিল পূর্বস্থলী’র চন্ডীপুরে। সেখানে চড়কতলায় তিন দিন ধরে চলছিল গণ সংস্কৃতি পরিষদ আয়োজিত সৃজন উৎসব। এলাকার মানুষের তা নিয়ে ছিল সীমাহীন উৎসাহ, প্রচুর মানুষের অংশগ্রহনে যা চেহারা নিয়েছিল জন উৎসবের।
২৬ ডিসেম্বর সকালের দিকে বাচ্চাদের জন্য দেখানো হলো বার্ট হান্সট্রার পরিচালিত ‘জু’, আব্বাস কিয়ারোস্তামির ‘টু সলিউশান্স ফর ওয়ান প্রবলেম’ এবং নর্ম্যান ম্যাকলরেনের ‘নেইবার্স’। মহৎ সিনেমা উসকে দেয় বাচ্চাদের মনকেও। আলাদা করে কিছু বলতে হলো না কলকাতায় এসে চিড়িয়াখানা দেখেনি এমন বাচ্চাও খুব সহজেই বুঝিয়ে দিলো খাঁচার ভেতর ও বাইরের বিপরীত পরিপ্রেক্ষিতের কথা ওর মত করে।
‘টু সলিউশান্স ফর ওয়ান প্রবলেম’ নিয়ে বলতে গিয়ে ভাগ করে নিল ওদের শৈশব অভিজ্ঞতা, হঠাৎ এসে পড়া সমস্যাকে কেমন ভাবে মোকাবিলা করেছে। আর ‘নেইবার্স’ দেখে তো ওরা এক বাক্যে জানিয়ে দিল “প্রতিবেশির সঙ্গে মারামারি নয়”।
ওই দিন বিকেলে ঝমঝমে বৃষ্টি উপেক্ষা করে বহু দর্শক উপস্থিত হলেন উৎসব শামিয়ানার নীচে। প্রথমে দেখানো হলো “গাঁও ছোড়ব নেহি” গানটি দৃশ্যায়ন। এরপর গৌতম ঘোষের “দখল”। বহু কষ্টে অর্জিত নিজের বাসভূমির অধিকার রক্ষার জন্য এক নারীর একক লড়াইয়ের সাথে একাত্ম বোধ করলেন উপস্থিত মেয়েরা। কথোপকথন পর্বে একজন জানালেন এনআরসি’র জন্য তাদের ঘর, জমি থেকে উচ্ছেদ করলে তারাও এমন লড়াই করতে জানেন। আর দেখানো হলো একতারা কালেক্টিভ এর বানানো ‘চন্দা কি জুতে’। একটি গ্রামের দরিদ্র ছোট্ট মেয়ের নিজস্ব বস্তি ছেড়ে বড় স্কুলে পড়তে যাওয়া এবং সেই পরিবেশের সাথে তাঁর দ্বন্দ্বের গল্প।
এনআরসি, এনপিআর, সিএএ বিরোধী লড়াইয়ে কলকাতার শাহীনবাগ হয়ে ওঠা পার্কসার্কাস মেয়েদের অবস্থান প্রতিবাদে ৪০ দিন পেরিয়ে গিয়েছে অনেক প্রতিবন্ধকতা পার করে তাদের অদম্য লড়াইকে সম্মান জানাতে’ সিনেমা রেজিস্ট্যান্স’ সেখানে সিনেমা দেখানোর আয়োজন করে গত ১৫ জানুয়ারি। প্রথমে দেখানো হয় পার্ক সার্কাস মেয়েদের নিয়ে বানানো একটা ছোট্ট ভিডিও পরিচালনায় মিতালী। সকলের প্রবল হর্ষধ্বনিতেই বোঝা গেল এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা তাদের কতটা আনন্দ দিয়েছে। এরপরে দেখানো হল নকুল সিং সাহানি’র চলচ্চিত্র অভিযান নির্মিত ছবি ‘সাবিত্রি’স সিস্টার্স অব আজাদি কোচ’। গুজরাটের উনাতে দলিতদের প্রকাশ্যে অত্যাচারের এক বছর পরে, ‘আজাদি কোচ’ যাত্রা (মার্চ) করার জন্য একটি আহ্বান জানানো হয়েছিল। এই যাত্রাটি গুজরাটের বেশ কয়েকটি শহর ও গ্রাম ভ্রমণ করেছিল। প্রধান দাবি ছিল দলিতদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া জমি হস্তান্তর। যা প্রভাবশালী উচ্চ বর্ণের হিন্দু শ্রেণীর মানুষেরা অবৈধভাবে দখল করে আসছে। এই ছবিটিতে দেখানো হয়েছে কিভাবে ‘আজাদি কোচ’ যাত্রায় আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে উঠে আসা দুই দলিত মহিলা নেতা লক্ষ্মীবেন ও মধুবেনও বর্ণ ও পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে গ্রাম গ্রাম ঘুরে দলিতদের ভুমি অধিকারের দাবির লড়াইকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য এবং মহিলাদের তাদের অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে এগিয়ে আসার জন্য সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করছে। আত্মশক্তি এবং হক বুঝে নেওয়ার এই সিনেমাটি জুড়ে দিল গুজরাট ও পার্ক সার্কাসকে। এখানেও দেখানো হল গাঁও ছোড়ব নেহি গানটির দৃশ্যায়ন। জল জঙ্গল জমি না ছাড়ার ঘোষণা তো সমস্ত লড়াইরত মানুষের ঘোষণা এখন। দেখানো হলো “ওয়ান প্রবলেম টু সলিউশনস” আর “নেইবারস’’।
প্রতিটি ছবি খুব আগ্রহের সঙ্গে দেখছিলেন আন্দোলনরত মহিলারা এবং উপস্থিত অসংখ্য দর্শক। নিজের পরিচয় ও অধিকার রক্ষার আন্দোলনের যে সুর অন্যায়কে প্রতিহত করার যে ডাক তা সর্বজনীন। পার্কসার্কাসের বয়ানে সেই ভাষ্যই উঠে এল। নেইবার্স ছবিটি নির্বাক। ছবির শেষে খুব স্বতঃস্ফূর্তভাবে একজন জানান দিলেন এত কাশ্মীর নিয়ে ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধ। সম্পূর্ণ প্রতিকী এই ছবি দেখে কারোর কোথাও বুঝতে অসুবিধা হলো না। সিনেমার এই সর্বজনীন ভাষাটিকে আগামী দিনেও ‘সিনেমা অফ রেজিস্ট্যান্স’ সমস্ত প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ উন্মুখ মানুষের কাছে পৌছে দিতে চায়।