প্রতিবেদন
চাকরিতে পদোন্নতির ক্ষেত্রে সংরক্ষণ সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের রায়

চাকরিতে পদোন্নতির ক্ষেত্রে সংরক্ষণ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায় সামাজিক ন্যায় প্রসঙ্গে শাসক শক্তিগুলো এবং বিচার বিভাগের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নতুন প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এসেছে। “পদোন্নতিতে সংরক্ষণ মৌলিক অধিকার নয়” — সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বহু চর্চিত এই কথাগুলো শিরোনামে উঠে আসছে। কিন্তু রায়টাকে খুঁটিয়ে পড়লে দেখা যাবে, মূল বিষয়টা এর থেকে অনেকটাই আলাদা। এই মামলায় কেন্দ্রীয় এবং উত্তরাখণ্ডের বিজেপি সরকার যে অবস্থান গ্ৰহণ করেছে তা মিথ্যা দিয়ে তাদের কার্যকলাপকে ঢাকার চেষ্টা। বিজেপিকে পরিষ্কার ভাবে ঘোষণা করতে হবে যে তারা সামাজিক ন্যায়-এর কোনো নীতিতে বিশ্বাস করে না; আর সুযোগ পেলেই তারা সামাজিক ন্যায়-এর ক্ষতি করবে আর না হয় ক্ষতি যাতে হয় সেই চেষ্টা করবে।

সুপ্রিম কোর্ট ২০২০-র ৭ ফেব্রুয়ারি মুকেশ কুমার ও অন্যান্য বনাম উত্তরাখণ্ড সরকার মামলার রায়ে পদোন্নতির ক্ষেত্রে সংরক্ষণের অবসান ঘটিয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট তাদের রায়ে বলেছে যে, পদোন্নতির ক্ষেত্রে সংরক্ষণের দাবি মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে না। এর আগের কয়েকটি মামলার দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে বিচারপতি এল নাগেশ্বর রাও এবং বিচারপতি হেমন্ত গুপ্তর ডিভিসন বেঞ্চ বলেছে যে, ধারা ১৬(৪) এবং ১৬(৪)এ-তে যে সংস্থান রয়েছে তা পদোন্নতির ক্ষেত্রে সংরক্ষণের প্রয়োজন আছে কি নেই তা ঠিক করার স্বাধীনতা রাজ্য সরকারকে দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট আরো বলেছে যে, প্রতিষ্ঠিত আইন হল, পদোন্নতি ঘটানোর নির্দেশ রাজ্য সরকারকে দেওয়া যাবে না। আদালতের সুনির্দিষ্ট অভিমত হল, পদোন্নতির ক্ষেত্রে তপশিল ভুক্ত জাতি ও উপজাতিদের জন্য সংরক্ষণের সংস্থান করতে রাজ্য সরকার বাধ্য নয়; তবে রাজ্য সরকার যদি তা করে তবে তার কাছে যথেষ্ট মাত্রায় পরিমাণগত তথ্য থাকতে হবে যা দিয়ে দেখানো যায় যে এই অংশগুলির পর্যাপ্ত প্রতিনিধিত্বের জন্য সংরক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট এইভাবে বলটা রাজ্য সরকারের কাছেই পাঠিয়ে দিয়েছে যাতে যা করার তা তাদেরই করতে হয়। সুপ্রিম কোর্ট এই বিষয়ে কোন হুকুমনামা নিম্ন আদালত বা সরকারি কর্তাদের কাছে পাঠাতে অস্বীকার করেছে।

সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের অদ্ভুত একটা বিষয় হল যে, সংরক্ষণ দেওয়ার জন্য পরিমাণগত তথ্য থাকতে হবে বলে তাতে বলা হয়েছে। কিন্তু, সরকার যদি পদোন্নতির ক্ষেত্রে সংরক্ষণ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তবে সরকারি চাকরিতে তপশিল ভুক্ত জাতি/উপজাতিদের পর্যাপ্ত প্রতিনিধিত্ব থাকার ব্যাপারটা তাকে যথেষ্ট তথ্য সহকারে প্রমাণ করতে হবে না। আদালত এমনকি এই কথাও বলেছে যে, সরকারি চাকরিতে তপশিল ভুক্ত জাতি/উপজাতিদের কম প্রতিনিধিত্ব থাকার ব্যাপারটা যদি তাদের নজরে আনাও হয় তবে তপশিল ভুক্ত জাতি/উপজাতিদের জন্য সংরক্ষণ দেওয়ার নির্দেশ তারা কোনো কতৃপক্ষকে দিতে পারবে না। এটা বলার কোনো প্রয়োজন ছিল না। নির্দিষ্ট কোনো জাতির একটা অংশ বা ব্যক্তিবর্গ সরকারি চাকরিতে যথাযথ প্রতিনিধিত্ব না পেলে তারা আদালতে যাবে আর আদালত তো আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছে যে তারা সংরক্ষণ দেওয়ার জন্য কাউকে কোনো নির্দেশ দিতে পারবে না, সে ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার পাওয়ার কোনো উপায় কি আর থাকছে? উত্তরাখণ্ডের সরকারি পরিসংখ্যান জানাচ্ছে যে, সরকারি চাকরিতে তপশিল ভুক্ত জাতি/উপজাতিদের পর্যাপ্ত প্রতিনিধিত্ব নেই। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট যদি এই ব্যাপারে কোনো নির্দেশ জারি না করার সিদ্ধান্ত আগে থেকেই নিয়ে রাখে, তবে তারা ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য কার দ্বারস্থ হবে?

জাতীয় স্তরে এই ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে বিজেপির কেন্দ্রের এবং উত্তরাখণ্ডের সরকার আধা-সত্যি এবং মিথ্যা মিশিয়ে এর উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছে। সামাজিক ন্যায় ও ক্ষমতায়ন মন্ত্রী সংসদে এবং উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী ত্রিবেন্দ্র সিং রাওয়াত দেরাদুনে বলেন যে, কংগ্রেস সরকারই ২০১২ সালে পদোন্নতির ক্ষেত্রে সংরক্ষণের অবসান ঘটানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এখন প্রশ্ন হল: বিজেপি যদি এই সিদ্ধান্তকে সঠিক বলে মনে না করে তবে তারা তাকে বাতিল করল না কেন? কংগ্রেস সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্ত যদি এসসি/এসটি কর্মচারীদের স্বার্থের বিরুদ্ধে চালিত হয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে ঐ সিদ্ধান্তকে পাল্টাতে বিজেপির আটকালো কোথায়?

ঘটনা হল, যে বিজয় বহুগুণা ২০১২ সালে উত্তরাখণ্ডের কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে ঐ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তিনি এখন বিজেপিতে এবং তাঁর সেই সময়ের অধিকাংশ মন্ত্রীই এখন আবার উত্তরাখণ্ডের বর্তমান বিজেপি সরকারের মন্ত্রী। একই কথা প্রযোজ্য বহুগুণার পরে উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী কংগ্রেস নেতা হরিশ রাওয়াতের ক্ষেত্রেও : তিনি যদি ঐ সিদ্ধান্তকে ভুল বলে মনে করতেন তাহলে সেটাকে পাল্টালেন না কেন? ঐ সিদ্ধান্ত কংগ্রেস সরকারই নিয়েছিল, এই কথা বলে মুখ্যমন্ত্রী ত্রিবেন্দ্র রাওয়াত এবং বিজেপি পার পেয়ে যেতে পারে না। সুপ্রিম কোর্টে উত্তরাখণ্ড সরকারের হয়ে সওয়াল করে আইনজীবী পি এস নরসিমা এবং মুকুল রোহত্যাগি জোরের সাথে বলেন, রাজ্য সরকার সংরক্ষণ না দেওয়ার সিদ্ধান্তই নিয়েছে। এটা দু-মুখো কথা এবং কপট চরিত্রেরই পরিচায়ক : আদালতে বলা হচ্ছে, সরকার সংরক্ষণ দেবে না; আর সর্ব সমক্ষে বলা হচ্ছে যে সংরক্ষণ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত আমাদের সরকারের নয়, তা আগের সরকারের!

সরকারগুলো শুধু সংরক্ষণকেই শেষ করছে না, তারা সরকারি কাজেরই বিলোপ ঘটাচ্ছে। সাধারণ বর্গ এবং তার সাথে সংরক্ষিত বর্গের জন্য কাজ ততক্ষণই পাওয়া যাবে যতক্ষণ সরকারি চাকুরি বেঁচে থাকবে। উত্তরাখণ্ডে প্রায় ৫৬০০০ পদ খালি পড়ে রয়েছে। লড়াই যদি করতে হয়, তবে যোগ্যতার ভিত্তিতে এবং স্বচ্ছতা বজায় রেখে এই পদগুলি পূরণ করার জন্য লড়াই করা দরকার। অন্যথায় সরকার এই পদগুলিকে কালক্রমে “বাতিল” বলে ঘোষণা করবে এবং জনগণের দৃষ্টিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হবে জাতের শ্রেষ্ঠত্ব বোধ এবং সংরক্ষণের বিরুদ্ধে বিদ্বেষপূর্ণ লড়াইয়ের দিকে।

পদোন্নতির ক্ষেত্রে সংরক্ষণ সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের রায় সরকার এবং বিজেপির সংরক্ষণ-বিরোধী মুখকেই উন্মোচিত করে। চাকরিতে পদোন্নতির ক্ষেত্রে সংরক্ষণ দেওয়ার পক্ষে না থাকার যে কথা উত্তরাখণ্ডের বিজেপি সরকার সুপ্রিম কোর্টে বলল তা চূড়ান্ত ধিক্কার যোগ্য। সংরক্ষণ মৌলিক অধিকার নয় বলে সুপ্রিম কোর্ট আবার যা বলল তা সংবিধানে প্রতিশ্রুত  সামাজিক ন্যায় এবং সমতার বুনিয়াদি ভিত্তিটাকেই দুর্বল করে তুলবে।

আমরা সমস্ত স্তরেই পদোন্নতির ক্ষেত্রে সংরক্ষণের পক্ষে এবং সংসদের বর্তমান অধিবেশনে একটি আইন পাশ করানোর জন্য মোদী সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি যাতে বিষয়টিকে সুনিশ্চিত করা যায়।

খণ্ড-27
সংখ্যা-4