জেএনইউ, দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, জামিয়া মিলিয়া এবং আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর সংঘের ঝটিকা বাহিনীর মারাত্মক আক্রমণ ফ্যাসিস্টদের মার্কামারা কার্যধারার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।মোদী সরকার ২০১৯ সালের মে মাসে পুনরায় নির্বাচিত হলে বিজেপির সাধারণ সম্পাদক রাম মাধব বিজয়দর্পে মণ্ডিত এক নিবন্ধ লেখেন যাতে তিনি বলেন, উদারবাদীরা ‘‘দেশের বিদ্যাচর্চা, সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক ক্ষেত্র থেকে প্রত্যাখ্যাত হবে।’’ সংঘ ও বিজেপি কেন উদারবাদী ক্যাম্পাসগুলোর ওপর আক্রমণ চালানো এবং সেগুলোকে ধ্বংস করার সাথে সাথে পাঠ্যক্রম এবং স্কুলগুলোর গৈরিকীকরণে সমানভাবে নিয়োজিত, স্ট্যানলি সে বিষয়ে দৃষ্টিপাত করেছেন, ‘‘শিক্ষা ... ফ্যাসিবাদের কাছে হয় বড় বিপদ হয়ে দেখা দেয় আর না হয় অতিকথামূলক রাষ্ট্রের পক্ষে সমর্থনের এক স্তম্ভ হয়ে ওঠে। এতে অতএব বিস্ময়ের কিছু নেই যে, ক্যাম্পাসগুলো প্রতিবাদ এবং সাংস্কৃতিক সংঘাতের যথার্থ রণাঙ্গনের পরিচায়ক হয়ে ওঠে এবং জাতির মনোযোগ আকর্ষণ করে। এতে বড় স্বার্থ জড়িয়ে রয়েছে—ফ্যাসিবাদী রাজনীতি সেই সময় পর্যন্ত বিরোধিতার স্বাধীন কন্ঠস্বরগুলোকে রক্ষা করে চলা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতার হানি ঘটাতে থাকে যতক্ষণ না সেই প্রতিষ্ঠানগুলোকে হঠিয়ে এমন সংবাদ মাধ্যম ও বিশ্ববিদ্যালয় উঠে আসে যারা এ কন্ঠস্বরগুলোকে প্রত্যাখ্যান করে।’’
স্ট্যানলি বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে ফ্যাসিবাদী বিদ্বেষের যে বর্ণনা দিয়েছেন তা জেএনইউ-র ওপর সংঘের আক্রমণ এবং বিদ্রুপ করে তারা আজ যাদের ‘পুরস্কার ফেরত দেওয়া জোট’, ‘খান মার্কেট চক্রী’ বা ‘শহুরে নকশাল’ বলে তার মতনই শোনায় :
‘‘ফ্যাসিবাদ যখনই হুমকি দেয়, তার প্রতিনিধি ও মদতকারীরা বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুলগুলোকে ‘‘মার্কসবাদে উদ্বুদ্ধ করার’’ উৎস হিসাবে ভর্ৎসনা করে, যা হল ফ্যাসিবাদী রাজনীতির চিরাচরিত জুজু। মার্কস বা মার্কসবাদের কোন ধরনের সংযোগ ছাড়াই উপরোক্ত ঐ অভিধাকে ফ্যাসিবাদী রাজনীতির বৈশিষ্ট্য হিসাবে প্রয়োগ করা হয় সমতাকে কলঙ্কিত করার পথ হিসাবে। আর সে কারণেই যে সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রান্তিক পরিপ্রেক্ষিতকে কিছুটা বৌদ্ধিক পরিসর যোগাতে চায়—তা যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন—সেগুলো ‘‘মার্কসবাদে’’র আখড়া হিসাবে ধিক্কৃত হয়। ... ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতিবাদ সংবাদপত্রে বিশৃঙ্খল জনতার হাঙ্গামা, আইনি ব্যবস্থার প্রতি বিপদ রূপে বিকৃতভাবে উপস্থাপিত হয়। ফ্যাসিবাদী রাজনীতিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সাধারণের চর্চায় হেয় করে তোলা হয় এবং জ্ঞান ও পারদর্শিতার বৈধ উৎস হিসাবে বিদ্বজ্জনদের খাটো করা হয়, তাদের তুলে ধরা হয় গবেষণার আড়ালে বামপন্থী মতাদর্শগত এজেণ্ডা সম্প্রচারের radical ‘‘মার্কসবাদী অথবা ‘‘নারীবাদী’’ রূপে। উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোকে হেয় করে তুলে এবং নীতিমালা নিয়ে আলোচনা করার আমাদের সম্মিলিত শব্দভাণ্ডারের শক্তিকে বিপর্যস্ত করে তুলে ফ্যাসিবাদী রাজনীতি বিতর্ককে মতাদর্শগত সংঘাতে পর্যবসিত করে। এই ধরনের কৌশলের মধ্যে দিয়ে ফ্যাসিবাদী রাজনীতি বাস্তবকে সামনে আসতে না দিয়ে তথ্যের পরিসরকে খাটো করে তোলে।’’
সংঘ এমনকি উদারবাদী ইতিহাসবিদদেরও সব সময় ‘বামপন্থী’ অথবা ‘মার্কসবাদী’ বলে উল্লেখ করে থাকে। আর এখন বিরোধী স্বরের সমস্ত ব্যক্তিদের, এমনকি গান্ধিবাদীদেরও ‘মাওবাদী’ অথবা ‘শহুরে নকশাল’ বলে বলা হচ্ছে।
আজকের ভারতে ‘মোদীতে ডুবে থাকা’ টেলিভিশনের নিখুঁত বর্ণনার মতো যা শোনায়, সেরকমভাবেই স্ট্যানলি লিখছেন, ‘‘ফ্যাসিবাদী রাজনীতি সংবাদকে তথ্য এবং যুক্তিনিষ্ঠ বিতর্কের মাধ্যম থেকে রূপান্তরিত করে এমন এক জমকালো দৃশ্যে যাতে এক ক্ষমতাবান ব্যক্তি নক্ষত্র হয়ে ওঠেন।’’
আমরা দেখেছি, প্রাধান্যকারী হিন্দু উচ্চবর্ণের পুরুষদের উদ্বেগ (তারা জাত-ভিত্তিক সংরক্ষণের শিকার এবং মুসলিমরা ‘ছাড়িয়ে যাচ্ছে’ এমন ধারণা এবং এমনকি পশ্চিমী ধ্যানধারণায় অভ্যস্ত মহিলাদের থেকে ‘পুরুষদের অধিকার’ এবং ‘পরিবারকে’ রক্ষা করতে হবে, এই ধারণা) কিভাবে আরএসএস-কে উর্বর জমি যুগিয়েছে। এটা কিভাবে কাজ করে, স্ট্যানলি তার ব্যাখ্যা দিচ্ছেন :
‘‘স্তর বিন্যাস ফ্যাসিস্ত রাজনীতিকে আর এক দিক থেকে সুবিধা দেয় : যারা এর থেকে সুবিধা লাভে অভ্যস্ত, সমতা সম্পর্কে উদারবাদী ভাবনা নিয়ে তাদের খুব সহজেই এই ধারণা গঠনের দিকে নিয়ে যাওয়া যে তা হল কাউকে অন্যায়ের শিকারে পরিণত করার উৎস। যারা স্তরীয় বিন্যাস থেকে সুবিধা লাভ করে তারা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে এক অতিকথা অবলম্বন করবে যা সামাজিক বাস্তবতা সম্পর্কে বুনিয়াদি তথ্যকে অবরুদ্ধ করে রাখবে। তারা এই দিক থেকে সহিষ্ণুতা এবং সর্বজনীনতার উদারবাদীদের নিবেদনকে অবিশ্বাস করবে যে ঐ নিবেদন আসলে হল অন্যান্য গোষ্ঠীগুলোর দ্বারা ক্ষমতা দখলের মুখোশ। স্তরীয় মর্যাদার হানি জনিত ক্ষতির শিকার হওয়ার বোধকে ফ্যাসিবাদী রাজনীতি পুষ্ট করে।’’
জাত ব্যবস্থা এবং বিশেষভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতন্ত্র ভারতীয় সমাজকে অনেক বেশি স্তরে ভাগ করে রাখে—এবং ফলে তা বিশেষভাবে ফ্যাসিবাদী রাজনীতির আক্রমণের কাছে অসহায় হয়ে ওঠে।
স্ট্যানলি এরপর যে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করেছেন তা হল, ‘‘কর্তৃত্বকারী গোষ্ঠীগুলো কিভাবে চিরাচরিত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোর আরো বেশি মাত্রায় প্রতিনিধিত্বকে বিভিন্ন দিক থেকে বিপদের সম্ভাবনাময় বলে অনুভব করে থাকে।’’
এখানে স্ট্যানলি উপনিবেশ-বিরোধী জাতীয়তাবাদ এবং উগ্র-জাতীয়তাবাদী জাতীয়তাবাদের মধ্যে তফাতকে সুস্পষ্ট করতে সাহায্য করেন। তিনি বলছেন, ‘‘উপনিবেশ-বিরোধী সংগ্রামগুলো সাধারণভাবে জাতীয়তাবাদের পতাকাতলেই সংঘটিত হয়; উদাহরণস্বরূপ, মহাত্মা গান্ধি ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এক হাতিয়ার হিসাবেই ব্যবহার করেছিলেন। এই ধরনের জাতীয়তাবাদের উৎস, যে জাতীয়তাবাদ উৎপীড়ন থেকে জন্ম নেয়, ফ্যাসিবাদ নয়। জাতীয়তাবাদের এই রূপগুলো তাদের মৌলিক রূপে সমতা-চালিত জাতীয়তাবাদী আন্দোলন।’’
স্ট্যানলি অবশ্য সতর্ক করে বলছেন, ‘‘সমতা-চালিত জাতীয়তাবাদ নিজেই দ্রুত উৎপীড়ক চরিত্রের হয়ে উঠতে পারে, যদি ক্ষমতার পরিবর্তনে যথেষ্ট মনোযোগ না দেওয়া হয়। উৎপীড়নের যথার্থই প্রশ্নাতীত ইতিহাস থেকে কিছু সংশয়াত্মক জাতীয়তাবাদী ভাবাবেগের আবির্ভাব ঘটে।’’ ভারতীয় এবং চীনা রাষ্ট্র তাদের গোড়ার দিকের উপনিবেশ-বিরোধী এবং সমতাবাদী লক্ষ্য থেকে সরে এসে বৈষম্য এবং দমনকে যুক্তিযুক্ত করে তুলতে যেভাবে ‘‘জাতীয়তাবাদে’’-র প্রয়োগ ঘটিয়েছে, এবং তাতে এই বক্তব্য ঐ দুই রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে অবশ্যই খাটে। ভারত যে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা পেয়েছে তার অর্থ এই নয় যে তারা কাশ্মীরে ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গির পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে না।
জাত-ভিত্তিক যে সংরক্ষণকে ‘‘উৎকর্ষ’’র জাতপাতবাদী যুক্তি দিয়ে আক্রমণ করা হয়, স্ট্যানলি সম্ভবত সে সম্পর্কেই বলেন যখন তিনি লেখেন :
‘‘দীর্ঘ, কষ্টকর উদ্যমের মাধ্যমে কাঠামোগত অসমতার মোকাবিলার যে উপায়ের কথা বলা হয়, তার উল্টো ব্যাখ্যা করে, তাকে ভুলভাবে উপস্থাপিত করে এবং তার বিপর্যয় ঘটিয়ে ফ্যাসিবাদী রাজনীতি কাঠামোগত অসমতাকে আড়াল করে থাকে। দুর্বলদের আরো বেশি প্রতিনিধিত্বের বিষয়টার উদ্দেশ্য খুব বেশি হলে ছিল কাঠামোগত অসমতাকে স্বীকার করে তার সমাধান করা। কিন্তু দুর্বলদের প্রতিনিধিত্বের বিষয়টাকে ব্যক্তির উৎকর্ষের থেকে বিযুক্ত বলে ভুলভাবে উপস্থাপিত করে এবং কিছু সমালোচক দুর্বলদের প্রতিনিধিত্বের প্রবক্তাদের এই বলে চিত্রিত করে যে তারা কঠোর পরিশ্রমী শ্বেত আমেরিকানদের ক্ষতির বিনিময়ে নিজেদের বর্ণ বা লিঙ্গ-ভিত্তিক ‘‘জাতীয়তাবাদ’’-কে চালিয়ে যাচ্ছে, বাস্তব নিদর্শন যাই হোক না কেন।’’
অতএব, ভারতে আমাদের সমতা-ভিত্তিক জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সেই জাতীয়তাবাদের ফারাক করতে হবে যা অসহায় সংখ্যালঘুদের ‘‘বিপজ্জনক অপর’’-এর ভূমিকার ছাঁচে ফেলে তার বৈপরীত্যে নিজেকে সংজ্ঞায়িত করে। বৈষম্য-চালিত এবং অত্যাচারী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আত্মঘোষণা করা যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের রূপ প্রগতিশীল হয়, সেই জাতীয়তাবাদই আবার সাম্প্রদায়িক ও বিদেশাতঙ্কের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হয়ে ওঠা যখন তা ভাষাভিত্তিক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের থেকে আসা পরিযায়ী শ্রমিকদের শত্রু রূপে গণ্য করে। স্ট্যানলি যেমন বলছেন,
“ফ্যাসিবাদের কেন্দ্রে রয়েছে জাতীয়তাবাদ। ফ্যাসিবাদী নেতা সমষ্টির বঞ্চনার কথা বলে গোষ্ঠী পরিচিতির এক বোধের সৃষ্টি করেন যা প্রকৃতিগতভাবে বিশ্বজনীন ভাবসত্তা এবং উদার গণতন্ত্রের ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের বিরোধী। গোষ্ঠী পরিচিতির বিভিন্ন ভিত্তি হতে পারে—চামড়ার রং, ধর্ম, ঐতিহ্য, জনজাতি উৎস। তবে এটাকে সর্বদাই অনুমিত অপরের ধারণার সঙ্গে তুলনা করা হয় যে অপরের বিরুদ্ধে জাতিকে সংজ্ঞায়িত করা হবে। ফ্যাসিবাদী জাতীয়তাবাদ একটা বিপজ্জনক ‘‘ওরা’’ সৃষ্টি করে যাদের বিরুদ্ধে সাবধান হতে হবে, কখনও কখনও আবার গোষ্ঠীর মর্যাদার পুনরুদ্ধারে লড়াই করতে, নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।’’
(ক্রমশ:)
- ভাষান্তর : জয়ন্ত মিত্র