“এনপিআর করতে বাড়িতে লোক এলে চা বিস্কুট খাওয়ান, তারপর ওদের বিদায় করে দিন”, কানপুরের চমনগঞ্জে গড়ে ওঠা অবস্থানমঞ্চ থেকে একথা বলছেন রাফিয়া। ছয় সপ্তাহের বেশি হয়ে গেল কানপুরের মহিলারা ধর্ণায়। বলাই বাহুল্য শাহিনবাগের মহিলাদের অনুপ্রেরণায় দেশ জুড়ে গড়ে ওঠা অসংখ্য ধর্নামঞ্চগুলির মতোই একটি মঞ্চ এই চমনগঞ্জ। কিন্তু উত্তরপ্রদেশের যোগী সরকারের প্রশাসনের বিরুদ্ধে যেভাবে প্রতিরোধ গড়ে তাঁরা ধর্ণামঞ্চকে প্রতিষ্ঠা করেছেন ও টিঁকিয়ে রেখেছেন এবং এমনকি শেষ পর্যন্ত পিতৃতান্ত্রিক সমাজকর্তাদেরকেও অতিক্রম করে স্বমহিমায় মাথা উঁচু করেছেন তা বিশেষ চর্চার বিষয় হয়েছে।
একথা সকলের স্মরণে আছে যে গত ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাস জুড়ে উত্তরপ্রদেশে গণতান্ত্রিক প্রতিবাদের ওপর চরম নিপীড়ন চলছিল। তারই মাঝে জানুয়ারি মাসের শুরুতে মহম্মদ আলি পার্কে প্রতি সন্ধ্যায় বেশ কয়েকজন মহিলা এসে সমবেত হতে শুরু করেন এবং কিছু দিনের মধ্যেই তা দিনরাত অবস্থানের রূপ নেয়, “এনআরসি-সিএএ-এনপিআর-এর বিরুদ্ধে কানপুরের মহিলাদের অনির্দিষ্টকালীন সত্যাগ্রহ”। কানপুর পুলিশ ধর্ণা তুলে দেওয়ার জন্য বহুমুখী উদ্যোগ নেয়। সম্প্রদায়ের স্থানীয় নেতাদের সাথে বারবার বৈঠক করে চাপ তৈরি করে। জেলাস্তরের প্রশাসনিক কর্তারা দু’দুবার এসে মহিলাদের সাথে মিট করে স্মারকলিপি গ্রহণ করে। কিন্তু কানপুরের মহিলারা তাঁদের অবস্থানে অবিচল থাকেন। অবশেষে ৭ ফেব্রুয়ারী কানপুরের মুসলমান সমাজের দুই সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতাকে পাঠানো হয় অবস্থান তুলে নেওয়ার আবেদন জানাতে। ওই ধর্মীয় নেতাদের বক্তব্য, “আমরা এ কাজ করতে বাধ্য হয়েছিলাম কারণ প্রশাসনের তরফ থেকে অসহনীয় চাপ তৈরি করা হয়”। যাই হোক, মহিলারা কাজি সাহেবদের পাত্তাই দেননি। ওদের “প্রশাসনের কাছে বিক্রি হয়ে যাওয়া লোক” বলে অভিহিত করেন তাঁরা। হিন্দি দৈনিকপত্রে খবর হয় যে অবস্থান তুলে নিতে বলা নেতাদের “চপ্পল হাতে দৌড়ে পালাতে হয়”। এরপর শুরু হয় পুলিশের সর্বাত্মক অভিযান। ৯ ফেব্রুয়ারী ভোর রাতে বিশাল পুলিশ বাহিনী মেয়েদের ঘিরে ধরে মারতে শুরু করে। ব্যাপকভাবে মারতে মারতে মহম্মদ আলি পার্ক ফাঁকা করে দেয় পুলিশ।
একদিন পর কানপুর এক অভূতপূর্ব ঘটনার সাক্ষী হয়। অবস্থান তুলে নেওয়ার আবেদন জানাতে যাওয়া এক নেতার ভাষায়, “পর দিন ই-রিক্সায় চড়ে দলে দলে মহিলারা আসতে শুরু করেন। আর রাস্তার ওপর বসে পড়েন”। কানপুরের এক মহিলার ভাষায়, “আমরা ত শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করছিলাম। পুলিশ কেন ওভাবে মারল? তাই আমরা রাস্তায় বসে পড়ি”। পরবর্তী দুই দিন চমনগঞ্জের ব্যস্ততম রাস্তা দখল করে বসে থাকেন মেয়েরা। দুদিন ধরে তাঁরা নিজেদের অবস্থানে দৃঢ় থেকে সমানে স্থানীয় নেতা ও পুলিশ অফিসারদের সাথে বাদানুবাদ চালিয়ে যান। অবশেষে আবার মাহম্মদ আলি পার্কে অবস্থান মঞ্চ চালু করার রফা হয়। পুলিশ বলে, “রাস্তা আটকে রাখার চাইতে বরং পার্কই আটকে রাখুক। শহর কাজী বলে, “আগে ওরা আমাদের কথা শুনত। এখন ওরাই আমাদের দালাল আর টিকটিকি বলছে। বুঝতে পারছি না কেন এমন হচ্ছে!”
সমস্ত স্থানীয় নেতা ও শহরের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতাদের পিতৃতান্ত্রিক খবরদারি নস্যাৎ করে দিয়ে কানপুরের মেয়েদের এই উত্থান দেশজুড়ে চলা শাহিনবাগ আন্দোলনের মনের কথা, কোথাও তা সুস্পষ্ট চেহারা নিচ্ছে কোথাও প্রচ্ছন্ন।
(সূত্রঃ স্ক্রল.ইন)