এক সময় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্রে প্রধান গৌরব তাঁহার অজেয় পৌরুষ, তাঁহার অক্ষয় মনুষ্যত্ব’। সেই বিদ্যাসাগর তাঁর জন্মের ২০০ বছর পরেও প্রাসঙ্গিক কিনা সেটাই আজকের আলোচ্য।
বিদ্যাসাগরের মানবতাবাদী চরিত্র সবার কাছেই পরিচিত। অসহায় মানুষকে শুধু যে তিনি আর্থিক সাহায্য করতেন তাই নয়, অসুস্থ মানুষকে নিজ হাতে সেবা করাটা ছিল তাঁর চরিত্রের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।
শিক্ষার সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কোনো ব্যক্তি বা কোনো পরিস্থিতির সঙ্গে কখনো আপস করেননি। অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যাসাগর ছিলেন নীতিনিষ্ঠ। তাই শিক্ষাক্ষেত্রে অবহেলার কারণে নরেন্দ্রনাথ দত্ত, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, এমনকি নিজের জামাইকেও ক্ষমা করেননি। সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ থাকাকালীন নিজের শিক্ষকদেরও কৌশলে তাঁদের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিতেন। শিক্ষাকে সর্বজনীন করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। তাই তিনি নারীশিক্ষার ওপর এত গুরুত্ব দিয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর পুঁথিগত বিদ্যার সমর্থক ছিলেন না। বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাই ছিল তাঁর কাম্য। সমাজকে যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক এবং কুসংস্কারমুক্ত করার জন্যে তিনি আমৃত্যু লড়াই করে গেছেন। তিনি ছিলেন সৃজনশীল প্রতিভার পৃষ্ঠপোষক। তাই বারবার মধুসূদন দত্তকে তিনি আর্থিক সাহায্য করেছেন। একারণে কেউ কেউ তাঁর কাছে পরোক্ষ প্রশ্ন রেখেছেন, কেন তিনি মদ্যপ মধুসূদনকে আর্থিক সাহায্য করেন। তারাও বিদ্যাসাগরের কাছে মদ খাওয়ার জন্যে অর্থ দাবি করেছিলেন। বিদ্যাসাগর জবাবে বলেছিলেন, তারা যদি মধুসূদনের মতো ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ লিখতে পারেন তাহলে তিনি তাদের অবশ্যই মদ খাওয়ার পয়সা দেবেন। বিদ্যাসাগর ব্যক্তি মধুসূদনকে অর্থদান করতেন না, তিনি বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন তাঁর সৃজনশীলতাকে। ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করলেও প্রকৃত অর্থে তিনি ঈশ্বর বিশ্বাসী ছিলেন না। ধর্ম নিয়েও তিনি সময় নষ্ট করতেন না। তাঁর নেতৃত্বে যতো আন্দোলন হয়েছিল তার সবকটিই ছিল ধর্মনিরপেক্ষ। তৎকালীন সময়ে রক্ষনশীল সমাজপতিরা ঈশ্বরচন্দ্রের কর্মযজ্ঞকে ভন্ডুল করে দেওয়ার জন্য সর্বশক্তি দিয়ে তাঁর বিরোধিতা করেছিলেন চিরকাল। কিন্তু সংস্কারমুক্ত এক সমাজ গড়ার লক্ষ্যে বিদ্যাসাগর ছিলেন অবিচল। তাঁর শক্ত মেরুদন্ড আর দায়বদ্ধতাকে সম্বল করে তিনি সামাজিক আন্দোলনের অগ্রদূত হিসাবে অবতীর্ণ হতেন।
ঈশ্বরচন্দ্র ছিলেন একজন শক্ত মেরুদন্ডের ব্যক্তিত্বসম্পন্ন প্রতিবাদী মানুষ। বাইরে যতটা কঠোর, ভিতরে বাঙালি মায়ের মতো ততোটাই কোমল। তাই তিনি অত্যাচারিত, নিপীড়িত হিন্দু নারীসমাজের দুঃখ-দুর্দশা দূর করে তাঁদের মৌলিক অধিকার পাইয়ে দিয়ে তিনি এক নতুন দেশ গড়তে চেয়েছিলেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, নারীসমাজ যদি কুসংস্কারমুক্ত না হতে পারে, নারীজাতি যদি নিরক্ষর থাকে তাহলে তাদের সন্তানরাও সমাজসচেতন হয়ে উঠতে পারে না। সেজন্যে নারীশিক্ষা প্রসারে এতো গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু আফশোষের বিষয়, ২০০ বছর আগে বিদ্যাসাগর যে চারিত্রিক তেজ এবং প্রতিবাদী চেতনা নিয়ে মানুষকে যুক্তিবাদী করে গড়ে তুলতে মরীয়া ছিলেন, যে মনুষ্যত্ব নিয়ে তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছিলেন, সেই তেজ, সেই মনুষ্যত্ব, সেই প্রতিবাদের ভাষা আমাদের যুবসমাজে বিরল। তথাকথিত প্রগতিশীল লেখকরাও তাবিজ-কবচে বাহুভারী করতে দ্বিধাবোধ করেন না। তথাকথিত কম্যুনিস্টরাও বৈজ্ঞানিক সত্যকে মেনে নিতে পারেন না। দলিতদের ওপর অমানুষিক অত্যাচারের আবহেও নিরাপদ দূরত্বে থেকে ‘নন্দলাল’-ই থেকে যান।
শিক্ষা অর্জনে বিদ্যাসাগর কোনো সংকীর্ণতার পরিচয় দেননি। তাই তিনি সংস্কৃতে পারদর্শী হয়েও নিজে যেমন ইংরেজি শিক্ষায় পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন তেমনি অন্যান্যদেরও ইংরেজি শিক্ষাতে এবং শেখাতেও উৎসাহিত করতেন। কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বা কোনো প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানের আশ্রয়ে না থেকেও শুধু নিজের বিদ্যা ও বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন বিদ্যাসাগর, বিশেষ করে সময়টা যখন ছিল ব্রিটিশ শাসনে। বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কার ও বেথুন সাহেব ছাড়া বিশেষ কেউ সক্রিয়ভাবে বিদ্যাসাগরের পাশে কখনোই ছিলেন না, এমনকি তাঁর পরিবারও নয়।
রামমোহন থেকে শুরু করে বিদ্যাসাগরের আগে পর্যন্ত সমাজ সংস্কারের জন্যে কিছু আন্দোলন হয়েছিল, কিন্তু সেসব আন্দোলন সম্পূর্ণরূপে ধর্ম এবং ধর্মীয় মানসিকতার ঊর্দ্ধে উঠতে পারেনি। বিদ্যাসাগর এসে সেই ধারায় একটা পরিবর্তন এনেছিলেন। বিদ্যাসাগরের সময়ে হিন্দু ব্রাহ্মণ সমাজপতিদের দৌরাত্ব্যে সমাজ ছিল কুসংস্কারের অন্ধকারে নিমজ্জিত, তাই তিনি শিক্ষক হিসাবে শিক্ষার্থীদের এমন শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চেয়েছিলেন, যে শিক্ষা হবে বিজ্ঞানভিত্তিক, যে শিক্ষা মানুষকে যুক্তিবাদী করে তুলতে পারে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াতে শেখায়, যে শিক্ষা চরিত্রের সার্বিক বিকাশ ঘটায়। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষকে বিজ্ঞানমনস্ক ও যুক্তিবাদী করে না তুলতে পারলে কোনো আন্দোলনই ফলপ্রসূ হতে পারেনা। তাই তিনি একদিকে যেমন বিধবা বিবাহ চালু করা, বাল্য বিবাহ বন্ধ করা, বহুবিবাহ বন্ধ করাার মতো কাজে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন তেমনি আবার প্রকৃত শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতির জন্যেও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। আর এটা করতে গিয়ে সেই সময়কার গোঁড়া হিন্দু সমাজের বিরুদ্ধে সারাজীবন তাঁকে লড়তে হয়েছিল। একবার বিদ্যাসাগর যখন একটি বিধবা মেয়ের বিয়ে দিয়ে ফিরছিলেন তখন সমাজপতিরা লোক লাগিয়ে তাঁকে আক্রমণ করেছিলেন। তাঁকে মেরে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ভয় পাননি বিদ্যাসাগর, নিজের ছেলের সঙ্গেও তিনি বিধবার বিয়ে দিয়েছিলেন। যদিও সেই বিয়ের পরিণতি সুখকর হয়নি।
বিদ্যাসাগর ধর্ম নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কখনো সময় নষ্ট করতেন না। তাঁর একমাত্র ধর্ম ছিল মানবতা, তিনি চিরকাল জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে মানুষের সেবা করেছেন। কিন্তু আজ বিজ্ঞান শিক্ষায় সমৃদ্ধ মানুষরাও ধর্মকে সামনে রেখে মানুষের বিরুদ্ধে মানুষকে লড়িয়ে দিয়ে নিজের মনুষ্যধর্মকে অপমান করেই চলেছে। বিজ্ঞান যতই এগিয়ে চলেছে, বহুক্ষেত্রে মানুষ ততটাই নিজেদের পিছিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞান পড়া মানুষরাও কুসংস্কারাছন্ন হয়ে পড়ছে দিনের পর দিন। পরবর্তী প্রজন্মকেও দিয়ে যাচ্ছে ভোগসর্বস্ব জীবনের সুবিধাবাদী উত্তরাধিকার। তারা মনুর দর্শনে বিশ্বাসী হয়ে উঠছে ক্রমাগত।
বিদ্যাসাগরের জন্মের ২০০ বছর পরে এসে সমাজে নারীর গুরুত্ব বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে দেখা যাবে আমাদের প্রাপ্য শুধু একটি দীর্ঘশ্বাস। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় নারীশিক্ষার প্রসার ঘটেছে। হ্যাঁ, শিক্ষার হার অবশ্যই বেড়েছে, কিন্তু যে শিক্ষা মেয়েদের হাত-পায়ের আর মনের শিকল ভাঙে সে শিক্ষা এখনো বহু দূরে। তাই আমাদের সমাজে এখনো অবাধে ঘটে চলছে ভ্রুণহত্যা, নারী পাচার আর ধর্ষণ।
সব কথার শেষ কথা, সমাজকে বদলাতে হলে এক ভাবনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। যাদের জন্যে লড়াই তাদের সঙ্গে নিয়েই পথে নামতে হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, বিদ্যাসাগর যাদের মঙ্গলের জন্যে লড়াই করেছেন তারা তাঁর আন্দোলনের অংশীদার হননি। সুতরাং বিদ্যাসাগর যে কারণে বিজয়ী হতে পারেননি সেই চেতনাহীন জনগণকে প্রকৃত অর্থে শিক্ষিত করে আন্দোলনের উপযোগী করে তোলাই বর্তমান সময়ের কাজ। নাহলে বিদ্যাসাগরের মতো আমরাও বারবার হেরে যাব। আজকের যুবসমাজ-ছাত্রসমাজকে উত্তরাধিকার হিসাবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে অবশ্যই মূল্যবোধের শিক্ষা নিতে হবে। মানুষের প্রতি, সমাজের প্রতি, দেশের প্রতি দায়বদ্ধ হয়ে না উঠতে পারলে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বিদ্যাসাগরকে স্মরণ করা একেবারেই অর্থহীন। তাঁর অসামান্য আত্মসম্মানবোধ, মানুষের প্রতি, দেশের প্রতি ভালোবাসা ও দায়বদ্ধতা তাঁকে এক ব্যতিক্রমী মানবতাবাদী চরিত্র হিসাবে চিহ্নিত করে রেখেছে। আজকের জটিল ও কঠিন পরিস্থিতিতে তাই ঈশ্বরচন্দ্রের জীবন ইতিহাস থেকে নতুন করে পাঠ নিয়ে চলতে হবে। আর সেটাই হবে তাঁর প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা জানানো, তাকে সঙ্গে নিয়ে চলা।