সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন ও এনআরসি-র বিরোধিতায় আসমুদ্র হিমাচল আলোড়িত। কিন্ত আন্দোলনের ব্যাপকতায় বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশ পৌঁছেছে এক নতুন উচ্চতায়। মিরাট থেকে মৈনপুরি, আলিগড় থেকে বেনারস-বিশাল বিশাল মিছিল ও প্রতিবাদী সমাবেশ মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। আতঙ্কে দিশাহারা মুখ্যমন্ত্রী সমগ্র উত্তরপ্রদেশে কায়েম করেছে এক ভয়াবহ পুলিশী রাজ। পুলিশের গুলি চালনায় কমপক্ষে ২১ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।এদের মধ্যে প্রায় সকলেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের যুবক এবং ছাত্র। নির্বিচারে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সমাজকর্মী, বুদ্ধিজীবী, গণনেতা সহ অসংখ্য মানুষকে। শুধুমাত্র বেনারসের বেনিয়াবাগেই সিপিআই(এমএল)-এর কেন্দ্রীয় কমিটি সদস্য মনীশ শর্মা সহ ৬৮ জনকে বন্দি করা হয়েছে।সিএএ ও এনআরসি মুসলিম সংখ্যালঘুদের যে বিপন্নতার মুখে ঠেলে দিয়েছে তার প্রতিক্রিয়ায় আন্দোলনের রাস্তায় সমগ্র মুসলিম সমাজের জোরদার উপস্থিতি ও জঙ্গী মেজাজ নিতান্ত স্বাভাবিক। অথচ যোগী আদিত্যনাথ ও তার পুলিশ বাহিনী নির্লজ্জভাবে আন্দোলনকারী মুসলিমদের পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে।সরকারী সম্পত্তির ক্ষতিপূরণ আদায়ের নামে সংখ্যালঘু মহল্লায় চলেছে অবাধ লুটপাট।
গণ আন্দোলনে বিশেষত সংখ্যালঘুদের ওপর উত্তরপ্রদেশ সরকারের এই হামলার প্রতিবাদে ধৃতদের অবিলম্বে মুক্তি এবং আদিত্যনাথের পদত্যাগের দাবিতে ৩০ ডিসেম্বর কলকাতার বিবাদী বাগে উত্তরপ্রদেশ সরকারের জনসংযোগ আধিকারিকের দপ্তরের সামনে বিক্ষোভ সংগঠিত হয়। হিমেল হাওয়াকে হার মানিয়ে বিক্ষোভের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক-ফেয়ারলি প্লেসের সমগ্র চত্বর জুড়ে। দৃপ্ত শ্লোগান-আবৃত্তি-গান ও বৈচিত্র্যময় বক্তৃতা শোনার জন্য অফিস পাড়ার মানুষেরা সারবন্দি দাঁড়িয়ে পড়েন বিক্ষোভ স্থলে। রুদ্র-সায়নী প্রমুখ ‘আইসা’র শিল্পীদল বাউল সুরে যখন গাইছে ‘মোদি ক্যাম্প করেছ — এবার তোমার বারোটা বাজাই’ তখন সত্যিই অফিস ফেরতা মানুষেরা মন্ত্রমুগ্ধ। তরতাজা যুবক সইফুল খালদের স্বরচিত কবিতা পাঠের পর ‘হাওডি মোডি’র অনুষঙ্গ জুড়ে যে প্রশ্নবাণ তা শুনে উল্লাসে ফেটে পড়েন জমায়েতের সমগ্র শ্রোতারা। সত্যিই এক অনন্য প্রতিবাদ সভা-যেখানে ছকে বাঁধা এক ঘেয়ে নীরস বক্তৃতা নয় — ছড়িয়ে পড়েছে ছক ভাঙ্গার সমস্ত উপকরণ। বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারী নেতা-কর্মীদের মধ্যে তারুণ্য ও অভিজ্ঞতার মেলবন্ধনে বিক্ষোভের ভাষা ও মেজাজ থেকেছে টানটান — সকলের নজর কাড়ার মতো। পার্টির রাজ্য সম্পাদক পার্থ ঘোষ সহ বিভিন্ন নেতৃবর্গ বিক্ষোভ সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন। বক্তব্য রেখেছেন রাজ্য কমিটি সদস্য বাসুদেব বোস, মলয় তেওয়ারী, জয়তু দেশমুখ, অনিমেষ চক্রবর্তী ও অন্যান্যরা। সকলের বক্তব্যেরই সার নির্যাস ছিল — সহস্র দুর্বলতা সত্বেও স্বাধীনতা লাভের দিন থেকে আজ অবধি ভারতীয় সংবিধানে গৃহীত ধর্মনিরপেক্ষতার নিশানকে দেশবাসী ম্লান হতে দেননি। কিন্ত সেই ঐতিহ্যকে সঙ্ঘ পরিবারের ফ্যাসিবাদী শক্তি আজ নির্মূল করতে চাইছে।
১৯৯২-তে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মাধ্যমে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের হৃদয়ে যে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয় তা উপশমের পরিবর্তে মোদি সরকার ৩৭০ ধারা রদ করেছে, অবরুদ্ধ হয়েছে কাশ্মীর। তারপর এসেছে অযোধ্যা জমি মামলার রায় — যেখানে আইনি যুক্তি ছাপিয়ে তথাকথিত ‘বিশ্বাসের’ ভিত্তিতে ‘রামলালার’ হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে বিতর্কিত জমির মালিকানা। তখনও প্রায় নীরব থেকেছেন মুসলিম জন সমুদায়। হয়ত স্থানীয় বা বিশেষ সমস্যা বলে, যন্ত্রণা নিয়েও তাঁরা সহ্য করছিলেন সব। কিন্ত অবশেষে ধর্মীয় ভিত্তিতে নাগরিক আইন সংশোধন তাঁদের সকলেরই অস্তিত্বের শিকড় ধরে টান দিতে আর তাঁরা নিশ্চুপ থাকতে পারেননি। অগণতান্ত্রিক, ফ্যাসিবাদী আইনের বিরুদ্ধে সারা দেশ গর্জে উঠতেই কাতারে কাতারে হিন্দু-মুসলিম নর-নারী পথে নেমে এসেছেন। শত দমন পীড়নেও মোদি-অমিত শাহ ও তাদের তৃতীয় অবতার যোগী আদিত্যনাথ এই জনজোয়ার রোধ করতে পারবে না। আদিত্যনাথকে পদত্যাগ করতে হবে এবং কেন্দ্রকে সিএএ এবং এনআরসি প্রত্যাহার করতে হবে। আরও সাবলীল ও প্রাঞ্জল বক্তব্যে সভাস্থলকে মাতিয়ে দিয়েছিলেন দুই নতুন মুখ — আইসা নেত্রী সায়নী ও অন্বেষা। তারা বলেন, বিজেপি’র জন্ম ১৯৮০ সালে আর তারা কিনা আপনাকে আমাকে ১৯৪৭-এর নথি দেখাতে বলছে! তারা যখন বলেন, ‘‘হাম কাগজ নেহি দিখায়েঙ্গে’’ — তখন জমায়েতের সমস্ত মানুষ তুমুল হর্ষধ্বনিতে ফেটে পড়েন। তাঁরা আরো বলেন, মানুষের কর্ম সংস্থান, শ্রমিক-কৃষকের অধিকারই মূল বিষয় আর সেজন্য আগামী ৮ জানুয়ারী সাধারণ ধর্মঘট সর্বাত্মকভাবে সফল করে তুলে মোদি-শাহ-যোগীর জমানাকে শেষ হুঁশিয়ারী জানাতে হবে। বিক্ষোভ স্থল থেকে উত্তরপ্রদেশের এ রাজ্যস্থ ভারপ্রাপ্ত আধিকারিকের নিকট স্মারকলিপি প্রদান করার পর উদ্ধত, হিন্দুত্ববাদী জহ্লাদ আদিত্যনাথের কুশপুতুল দাহের মধ্য দিয়ে কর্মসূচীর পরিসমাপ্তি ঘটে।