ক্যালকাটা আর কালিকট — শুনতে খানিকটা একই রকম না? ইংরাজি বানানটা পড়তে গেলে তো অনেক সময়ই গুলিয়ে যায়। আবার ধরুন আইআইটি শব্দটার পরে দিল্লী, কানপুর, বম্বে কিম্বা মাদ্রাজ এই জায়গাগুলোর নাম জোড়া না থাকলে আপনি আক্ষরিক অর্থেই ধরতে পারবেন না যে আইআইটি গুলোর মধ্যে ফারাক কী। শুনতে তো একই, দেখতেও প্রায় একই হয়ে দাঁড়িয়েছে এই মুহূর্তে ক্যাম্পাসগুলো। কোলাহল উঠছে — লাইব্রেরী থেকে, ল্যাবরেটরী থেকে, কমনরুম থেকে, ক্যান্টিন থেকে, লেকচার হল থেকে রাস্তায় — প্রেসিডেন্সী, পণ্ডিচেরী, পাঞ্জাব, পাটনা, আম্বেদকর, আলিগড় সর্বত্র। ক্যাম্পাস থেকে শুধুই ক্যাম্পাসিংয়ের দাবি ওঠেনা; ক্যাম্প গুঁড়িয়ে দেওয়ার দাবিও ওঠে — ডিটেনশন ক্যাম্প। তাই ১৯ ডিসেম্বর দুপুরে মহানগরীর মহামিছিলে স্কুলপড়ুয়ার হাতেও দেখা যায় পোস্টার, যাতে লেখা—“আমার বন্ধু নাদিয়াকে আমি ডিটেনশন ক্যাম্পে যেতে দেবো না”। নাও, ঠেলা সামলাও ... প্রমাদ গুনছে গেরুয়া শাসকেরা, সত্যিই যদি সব শিশু, কিশোরী, যুব এভাবে উলঙ্গ রাজাকে আঙুল তুলে প্রশ্ন করতে শুরু করে তাহলে তো নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহদেরই সব নতুন রকম চালাকি (এনআরসি) ফাঁস হয়ে বনবাসে কিম্বা ডিটেনশন ক্যাম্পে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।
বিদ্রোহ চারিদিকে, বিদ্রোহ আজ — এসব লাইন নাৎসী হিটলারের উত্তরসূরী আরএসএস, বিজেপির পড়ার বা শোনার কথা নয় তাই ওরা বেশিদূর দেখতে পায় না বা দেখতে চায় না। ভাবে ছাত্রীছাত্ররা হয়তো কেবলই নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত, মুখ খুললেও বড়জোর নিজেদের লাইব্রেরীর বই, হস্টেল ফি বৃদ্ধি, যাতায়াতের বাস/মেট্রোর ভাড়া কমানো, গবেষণার ভাতা বৃদ্ধি কিম্বা মিড-ডে-মিলে সরকারী বরাদ্দ বাড়ানোর দাবির কথা বলবে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা তো বোঝে যে, কাল মাথা গোঁজার ঠাঁই না থাকলে একাডেমিক্স, ইকোনমিক্স কোনোটাই হবে না। কাজেই এনআরসি দিয়ে দেশের মানুষকে দেশছাড়া করা আর সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) দিয়ে আবার ধর্মে ধর্মে মানুষ ও দেশটাকে ভাগ করার ফ্যাসিবাদী নীল নকশাকে জ্বালাতে তারা তো মাঠে নামবেই। শুরুতে মোদী সরকার ভাবলো যে, প্রতিবাদীদেরকে ফেজ টুপি কিম্বা লুঙ্গি জাতীয় পোষাকের ছবিতে বেঁধে ফেলতে পারলেই বুঝি বিশেষ একটা ধর্মীয় সম্প্রদায়কে ‘অপরাধী’ সাজানো যাবে। ফলত দিল্লীর জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের রাস্তায় শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকে কলঙ্কিত করতে ও থামাতে তারা দিল্লী পুলিশকে ব্যবহার করে নিজেরাই বাসে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগালো, বাইকের হেলমেট পরে হাতে পুলিশের লাঠি নিয়ে বিজেপির গুণ্ডারা এসে লাইব্রেরী, শৌচাগার, ক্লাসরুমে ঢুকে পেটালো পড়ুয়াদের, এলাকার দোকান ভাঙচুর করলো, দালাল কিছু মিডিয়া যথারীতি ‘প্রতিবাদের নামে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির ক্ষতি’ বুলি আউড়ে মিথ্যাচার শুরু করলো কিন্তু কত সত্যিকে আর এভাবে চাপা দেওয়া সম্ভব? একাধিক ছবি ও ভিডিওতে বেরিয়ে পড়লো, সম্পত্তি নষ্টের পিছনে, রাস্তায় ছিঁচড়াতে ছিঁচড়াতে নিয়ে গিয়ে ছাত্রীদের বর্বরভাবে মারধোরের পিছনে কারা? কফিনে শেষ পেরেকটা মারলেন খোদ দিল্লী রাজ্য সরকারের উপমুখ্যমন্ত্রী মণীশ শিসোদিয়া, বলে দিলেন যে পুলিশই জ্বালিয়েছে বাস।
মুখোশ খসে পড়ে পরপর — এই রাজ্যের মুর্শিদাবাদে ইসলামী সংস্কৃতির পোষাক পরে সেজেগুজে ট্রেনে পাথর ছুঁড়তে গিয়ে ধরা পড়লো ছয়জন বিজেপি সদস্য। ঝুলিতে বেড়াল লুকোতেও ঠিক করে শেখেনি দাঙ্গাবাজরা। শহীদ রামপ্রসাদ বিসমিল, আসফাকউল্লাদের দেশে যে শাসকের বেয়াদবির বিরুদ্ধে জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নামবে তাতে আর সন্দেহ কী? দিল্লী, হরিয়ানা, হায়দ্রাবাদ, লক্ষ্মৌ, তামিলনাড়ু, থেকে আইসা সহ একাধিক বাম ও গণতান্ত্রিক ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের লাগাতার রক্তাক্ত, গ্রেফতার করার পরেও বাংলার শিক্ষার্থীরা বিজেপির রাজ্য দফতর ঘেরাও করার দুঃসাহস দেখায়। কল্যাণীর আইআইএসইআর থেকে বেঙ্গালুরুর আইআইএসসি- সারা দেশে শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কলেজ ক্যাম্পাসে ছড়িয়েছে দল-মত-জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে শিক্ষার্থীদের প্রতিস্পর্ধার আগুন। “আঠারো বছর বয়স জানে না কাঁদা”
জেএনইউ থেকে যাদবপুর — উঠছে কেবল একটা সুর : এনআরসি মানছিনা, এনপিআর চলবে না, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) অবিলম্বে বাতিল করো